বহ্ম জানাতি স ব্রাহ্মণঃ |
ঊ॒রূ তদ॑স্য॒ য়দ্বৈশ্যঃ॑ প॒দ্ভ্যাᳬশূ॒দ্রোऽঅ॑জায়ত ॥ যজু০ ৩১।১১ ॥
অ॒স্মদ্রা॑তা দেব॒ত্রা গ॑চ্ছত প্রদা॒তার॒মাবি॑শত ॥ যজু ০ ৭।৪৬ ॥
(মহাভারত শান্তিপর্ব ১৮৮-১০) অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণের মধ্যে কোনই প্রভেদ নাই । কেন না পূর্বে এই পৃথিবীতে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পুর্ণ ছিল । তাঁহারাই পৃথক পৃথক কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র নামে অভিহিত হইয়াছেন ।” মহামতি ভীষ্ম বলিতেছেন “তস্মাদ্বর্ণা ঋজবো জ্ঞাতির্বণাঃ” অর্থাৎ “ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র সকলেই সাধু এবং একে অন্যের জ্ঞাতি ।” ব্রাহ্মণই পরবর্তী যুগে বিভিন্ন গুণ কর্ম্ম স্বভাব অনুসারে ঋষি মুনি ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ,রাক্ষস দৈত্য দানব , নাগ ঋক্ষ কপি , হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান , নিগ্রো কার্ফি ইহুদি , আর্য্য অনার্য্য নামে পৃথক ও বিভক্ত হইয়াছে । শাস্ত্র কার ব্রাহ্মণ কে দশ ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন । অত্রি সংহিতা বলিতেছেঃ দেবো মুনির্দ্বিজো রাজা বৈশ্য শূদ্রো নিষাদকঃ । পশু ম্লের্চ্চোহপি চন্ডালো দশবিধাঃ স্মৃতাঃ । (৩৬৪) ব্রাহ্মণ দশ প্রকারের যথা— দেব ,মুনি , দ্বিজ , ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র , নিষাদ , পশু ও চন্ডাল । মহর্ষি অত্রির মতে ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শূদ্র , নিষাদ , পশু , ম্লেচ্ছ ও চণ্ডাল ইহারা সকলেই ব্রাহ্মণ । পশু ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে ইনি বলিতেছেনঃ — “ব্রহ্মতত্ত্বং না জানাতি ব্রহ্মসূত্রেণ গর্ব্বীতঃ । তেনৈব স চ পাপেন বিপ্রঃ । পশুরুদাহৃতঃ । (৩৭২) ।
অর্থাৎ গলায় মাত্র পৈতা করিয়া যে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণত্বের গর্ব্ব করে অথচ ব্রহ্মতত্ত্ব জানে না এই পাপে তাহাকে পশু ব্রাহ্মণ বলা হয় ।” তাহার গলায় পৈতা আর গো মহিষ ছাগলের স্কন্ধে রজ্জু একই প্রকারের । এই শ্রেণীর ব্রাহ্মণের প্রাচুর্য্যেই ত দেশ ও সমাজ রসাতলে যাইতে বসিয়াছে ।
পূর্বকালে ব্রাহ্মণ বা নরগণ যখন শত্রুর হাত হইতে দেশকে রক্ষা করতেন তখন তাঁহাদিগকে ক্ষত্রিয় (military power) বলা হইত , কৃষি বাণিজ্য করিলে বৈশ্য (Trading class) , সমাজ সেবা (social service) করিলে শূদ্র এবং শারীরিক পরিশ্রম না করিয়া চিন্তা শক্তির দ্বারা সমাজসেবা করিলে তাহাদিগকে নতুন সংজ্ঞা বা উপাধি না দিয়া শুধু ব্রাহ্মণই বলা হইত । একই ব্যক্তি একই জীবনে বৃত্তি অনুসারে কখনো ব্রাহ্মণ কখনো ক্ষত্রিয় , কখনো বৈশ্য বা কখনো শূদ্র সংজ্ঞা পাইত । চারি বর্ণের মধ্যে তখন অবাধে বৈবাহিক আদান-প্রদান ও পান ভোজন চলিত , সকলেই বেদ পাঠ ও ভগবত উপাসনা করিতে পারিত । আর্য জাতি তখন সব একাকার ভারতের তখন স্বর্ণ যুগ ।
তখন বিবাহে জাতিভেদ ছিল না । “অক্ষমালা বৈশিষ্টেন সংযুক্তা ধর্মযোনিজা । সারঙ্গী মন্দপালনে জগামোভা হর্ণীয়তাম্ ।। (মনুসংহিতা ৯২৩) অর্থাৎ বশিষ্ট নিকৃষ্ট কুলোৎপন্ন অক্ষ মালাকে এবং মন্দপাল অধম কুল হইতে উৎপন্ন সারঙ্গীকে বিবাহ করিয়াছিলেন ।” ইহাদের পুত্রেরা সকলেই পিতৃবর্ণ ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন ; কোন নুতন জাতির সৃষ্টি হয় নাই । মহর্ষি উৎস বিবাহ করিলেন ক্ষত্রিয় রাজা ভগিরথের কন্যাকে । এইরূপে মহর্ষি অঙ্গিরা ক্ষত্রিয় মরুত্তের কন্যাকে , মহর্ষি হিরণ্যহস্ত ক্ষত্রিয় মাদিরাশ্বের কন্যাকে , ব্রাহ্মণ ঋষ্যশৃঙ্গ ক্ষত্রিয় দশরথের কন্যা শান্তাকে , জমদগ্নি ক্ষত্রিয় প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকাকে , মহর্ষি ভৃগু ব্রাম্মন পুত্র এবং ক্ষত্রিয় শর্য্যাতির কন্যাকে , মহর্ষি রিতিক ক্ষত্রিয় গাধীর কন্যা বা বিশ্বামিত্রের ভগ্নী সত্যবতীকে অবাধে বিবাহ করিয়াছিলেন । তখন ব্রাহ্মণ বংশ অব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণ বংশে ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করিতেন । মনুর পুত্র ধৃষ্ট হইতে ধার্ষ্ট নামক ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তি । ধার্ষ্টগণ ক্ষত্রিয় হইতে ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন । (শ্রীমদ্ভগবদ -শ্রীধর টিকা ৯।২।১৭৬) । দিষ্ট ছিলেন ক্ষত্রিয় কিন্তু তাঁহার পুত্র নাভাগ বৈশ্য ; ইনি বৈশ্য কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন (মার্কণ্ডেয় পুরাণ) নাভাগারিষ্টের দুই বৈশ্য পুত্র ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (হরিবংশ ১১।৬৫৮) । মনুর দৌহিত্র পুরুরবার বংশে জন্মিয়াছিল ক্ষত্রিয় শুনুক । এই শুনুকের বংশে চারি বর্ণই জন্মিয়াছে (বিষ্ণুপুরাণ ৩।১৮) । ক্ষত্রিয় বিজয়ের পুত্রই মহাত্মা কপিল । বিজয়ের অন্য পুত্র সুহোত্রের গৃৎসমতি নামক পুত্রের বংশে ও চারিবর্ণের উৎপত্তি হয় (হরিবংশ ৩২) । পুরূরবার বংশে ক্ষত্রিয় রভস জন্মগ্রহণ করেন , তাঁহার গোত্র হইতে বহু ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন (ভাগবত ৯/১৭/১০) । পুরুর বংশে ক্ষত্রিয় মেধা তিথি জন্মগ্রহণ করেন , এই মেধাতিথি হইতেই কাম্বায়ন গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণ জন্মগ্রহণ করেন (বিষ্ণুপুরাণ ৪/১৯/২) । ক্ষত্রিয় রাজ অজমিঢ়ের বংশে প্রিয়মেধাদি ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন (ভগবত ৯/২১/২১) । অজমীঢ়ের বংশে মুদ্গলের জন্ম , এই মুদ্গল হইতেই মৌদ্গল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণের উৎপত্তি (মৎস্য পুরাণ) । গর্গ , সংস্কৃতি ও কাব্য নামক তিনজন মহর্ষি ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন (মৎস্য পুরাণ) । গর্গ হইতে শিনি এবং তাঁহা হইতে ক্ষত্রিয়-গার্গগণ ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন । গর্গের ভ্রাতা মহাবীর্য্যের পুত্র ক্ষত্রিয় অরুক্ষয়ের তিন পুত্র ত্রর্য্যরুণ , পুষ্করী ও কপি ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (মৎস পুরাণ) । পুরো বংশীয় ক্ষত্রিয় ঋষ্টি সেনের পুত্র দেবাপি স্বীয় ভ্রাতা শান্তনুর পৌরহিত্য করিয়াছিলেন (নিরুক্ত ২।১০) । সিন্ধুদিপ , দেবাপি ও বিশ্বমিত্র ক্ষত্রিয় হইয়াও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন (মহাভারত শল্য ৪০ ) । ক্ষত্রিয় জনক ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন (শতপথ ব্রাহ্মণ ) । শুধু তাহাই নয়— জাতো ব্যাসস্তু কৈবর্ত্ত্যাঃ শ্বপাক্যাশ্চ পরাশরঃ । শুক্যাঃ শুকঃ কণাদাখ্যঃ ততোলুক্যাঃ সূতোহ ভবৎ ।। মৃগীজঋষ্যশৃঙ্গোহপি বশিষ্ঠো গণিকান্তজঃ । মন্দপালো মুনিশ্রেষ্ঠো নাবিকাপত্য উচ্যতে ।। মান্ডব্যো মুনিরাজস্তু মন্ডুকী গর্ভসম্ভবঃ বহবোহন্যোহপি বিপ্রত্বং প্রাপ্তা যে শূদ্রযোনয়ঃ ।। ( ভবিষ্য পুরাণ ব্রাহ্ম পর্ব্ব ৪২ অধ্যায় — বজ্রসূচী দ্রষ্টব্য অর্থাৎ কৈবর্ত কন্যার গর্ভজাত মহর্ষি কৃষ্ণ দৈপায়ণ বেদব্যাস , শ্বপাক অনার্য্য কন্যার গর্ভজাত শাস্ত্র কর্তা পরাশর (ব্যাসের পিতা) , ম্লেচ্ছ কন্যা শুকীর গর্ভজাত শুকদেব (ব্যাসের পুত্র ; অনার্য্য কন্যা উলুকীর গর্ভজাত বৈশেষিক দর্শনাকার কণাদ ; শূদ্র কন্যা মৃগী’র গর্ভজাত ঋষ্যশৃঙ্গ ; বেশ্যার গর্ভজাত মহর্ষি মন্দপাল ; ব্যাধ জাতীয় কন্যা মুন্ডুকীর গর্ভজাত ঋষি মান্ডব্য ; তারা সকলেই ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন । বারবিলাসিনী যাবালার পুত্র সত্যকাম ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (ছান্দোগ্যোপনিষৎ) । শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বংশে জন্মিয়াও অভিমুন্যুর জাতকর্ম প্রভৃত্তি শুভকর্ম্মে পৌরহিত্য করিয়াছিলেন (মহাভারত আদি পর্ব্ব ২২১ বর্দ্ধমান রাজবাটীর ) । ক্ষত্রিয়া রেনুকার গর্ভে জন্মিয়া পরশুরাম ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (মহাভারত -বন পর্ব্ব ১১৫।১৬) । অন্ধ মুনি বৈশ্য ছিলেন । শূদ্রাণী স্ত্রীর গর্ভে জন্মিয়াছিলেন ব্রাহ্মণ সিন্ধু মুনি । ইঁহাকে বধ করিয়া দশরথ ব্রহ্ম হত্যার পাপে লিপ্ত হইয়াছিলেন (রামায়ণ , অযোধ্যা কান্ড ৬৩।৫১) । দাসী পুত্র কক্ষীবাপ পূজনীয় ঋষি এবং দাসী পুত্র নারদ দেবর্ষি হইয়াছিলেন । ব্রাহ্মণ জরৎকারু অনার্য্য নাগ কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন , ইঁহারই গর্ভে ব্রাহ্মণ আস্তিক মুনি জন্মগ্রহণ করেন । ইহাই হইল ভারতের স্বর্ণযুগ । এই জন্যই ভারত ছিল স্বাধীন ও পরাক্রমশালী ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ