আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

17 July, 2021

আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ

আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ
বহ্ম জানাতি স ব্রাহ্মণঃ

জাতিভেদ ঈশ্বরকৃত ও মনুষ্যকৃত দুই ।
যেমন ধরুন - মানুষের মধ্যে যে চারটি বর্ণ (যথা - ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শূদ্র ) তা ঈশ্বরকৃত , কিন্তু এই চার বর্ণের মধ্যে কোন মনুষ্য কোন বর্ণের তা নির্দিষ্ট করে রাজা বা বিদ্বানরা তাই ইহা মনুষ্যকৃত ।
মনুষ্য , পশু-পক্ষী , বৃক্ষ , জলচর জাতি ঈশ্বরকৃত । যেরূপ গরু , ঘোরা , হাতি প্রভৃতি মধ্যে ; অশ্বথ বট এবং আম প্রভৃতি বৃক্ষের মধ্যে ; হাঁস , কাক এবং বক প্রভৃতি পক্ষীর মধ্যে , এবং মাছ , কুমির প্রভৃতি জলজন্তুর মধ্যে জাতিভেদ সেইরূপ ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শূদ্র এবং অন্ত্যজ প্রভৃতি মানুষের মধ্যে জাতিভেদ ঈশ্বরকৃত আছে । তবুও মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সামান্য জাতি নয় , কিন্তু সামান্য বিশেষাত্মক জাতিতে পরিগণিত ।
ভোজন ভেদেও জাতিভেদ ঈশ্বরকৃত ও মনুষ্যকৃত হয়ে থাকে । যেমন ধরুন - সিংহ মাংসাহারী , গরু তৃণ ভোজী এই ব্যবস্থা ঈশ্বরকৃত কিন্তু দেশ-কাল-বস্তু ভেদে ভোজন মনুষ্যকৃত ।
বর্ণ ব্যবস্থা গুণ ও কর্ম অনুসারে স্বীকার করতে হবে । গুণ কর্ম স্বভাব অনুসারে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্রাদি বর্ণের পরীক্ষা করেই তবে রাজা বা বিদ্বানরা বর্ণ ব্যবস্থা করে ।

রু॒চং ব্রা॒হ্মং জ॒নয়॑ন্তো দে॒বাऽঅগ্রে॒ তদ॑ব্রুবন্ । য়স্ত্বৈ॒বং ব্রা॑হ্ম॒ণো বি॒দ্যাৎ তস্য॑ দে॒বাऽঅ॑স॒ন্ বশে॑ ॥  যজু০ ৩১। ২১ ॥

পদার্থঃ- হে ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষ ! যিনি (রুচম্) রুচিকারক (ব্রাহ্মম্) ব্রহ্মের উপাসক (ত্বা) আপনাকে (জনয়ন্তঃ) সম্পাদন করিয়া (দেবাঃ) বিদ্বান্গণ (অগ্রে) প্রথমে (তৎ) ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতির স্বরূপকে (অব্রুবন্) বলিবেন (য়ঃ) যে (ব্রাহ্মণঃ) ব্রাহ্মণ (এবম্) এইরকম (বিদ্যাৎ) জানিবেন (তস্য) তাহার সেই সব (দেবাঃ) বিদ্বান্ সকল (বশে) বশে (অসন্) হইবেন ॥ ২১ ॥

ভাবার্থঃ- এই বিদ্বান্দিগের প্রথম কর্ত্তব্য, বেদ, ঈশ্বর ও ধর্মাদিতে রুচি, উপদেশ, অধ্যাপন, ধর্মাত্মতা, জিতেন্দ্রিয়তা, শরীর ও আত্মার বল বৃদ্ধি করা । এমন করিলেই সকল উত্তম গুণ ও ভোগ প্রাপ্ত হইতে পারে ॥ ২১ ॥

ব্রাহ্মণ কারা তা নিয়ে যজুর্বেদের ৩১ অধ্যায়ের ১১ নং মন্ত্রে বলা হয়েছেঃ

ব্রা॒হ্ম॒ণো᳖ऽস্য॒ মুখ॑মাসীদ্ বা॒হূ রা॑জ॒ন্যঃ᳖ কৃ॒তঃ ।
ঊ॒রূ তদ॑স্য॒ য়দ্বৈশ্যঃ॑ প॒দ্ভ্যাᳬশূ॒দ্রোऽঅ॑জায়ত ॥ যজু০ ৩১।১১ ॥

পদার্থঃ- হে জিজ্ঞাসুগণ ! তোমরা (অস্য) এই ঈশ্বরের সৃষ্টিতে (ব্রাহ্মণঃ) বেদ ঈশ্বরের জ্ঞাতা, তাহার সেবক বা উপাসক (মুখম্) মুখতুল্য উত্তম ব্রাহ্মণ (আসীৎ) আছে (বাহূ) ভুজ তুল্য বল পরাক্রমযুক্ত (রাজন্যঃ) রাজন্য (কৃত) করিয়াছে (য়ৎ) যে (ঊরূ) ঊরূতুল্য বেগাদি কর্ম্ম করে, (তৎ) সে (অস্য) ইহার (বৈশ্যঃ) সর্বত্র প্রবেশকারী বৈশ্য (পদ্ভ্যাম্) সেবাযুক্ত এবং অভিমান রহিত হওয়ার ফলে (শূদ্রঃ) মূর্খতাদি গুণযুক্ত শূদ্র (অজায়ত) উৎপন্ন হইয়াছে, এই উত্তরগুলি ক্রমপূর্বক জানিবে ॥ ১১ ॥

ভাবার্থঃ- যে সব মনুষ্য বিদ্যা ও শমদমাদি উত্তম গুণে মুখের তুল্য উত্তম হয়, তাহারা ব্রাহ্মণ, যাহারা অধিক পরাক্রমযুক্ত ভুজ তুল্য কার্য্যগুলিকে প্রতিপন্ন করে, তাহারা ক্ষত্রিয়, যাহারা ব্যবহারবিদ্যায় প্রবীণ তাহারা বৈশ্য এবং যাহারা সেবায় প্রবীণ, বিদ্যাহীন, পায়ের সমান মূর্খতা আদি নীচগুণযুক্ত তাহারা শূদ্র হইবে এবং মান্যতা লাভ করিবে ॥ ১১ ॥

শতপথ ব্রাহ্মণেও একি কথা বলাহয়েছে
 
যস্মাদেতে মুখ্যাস্তস্মানমুখতোহ্যসৃজ্যন্ত ইত্যাদি [শত০ ব্রা০ ৬।১।১।১০ ]

জন্মনা ব্রাহ্মণো জ্ঞেয়ঃ সংস্কায়ৈদ্বিজ উচ্চ্যতে।
বিদ্যয়া যাতি বিপ্রত্বং শ্রোত্রিয়স্ত্রিভিরেব চ॥ [অত্রি সংহিতা ১৪০] এখানে জন্মগত ব্রাহ্মণ বলার কারণ মানব সৃষ্টির প্রারম্ভে বিদ্যান ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হয়।

যে ব্রাহ্মণ বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন ও তার উপদেশমত কার্য্য করেন, তাঁকে 'বেদবিৎ" বলা যায় [অত্রিসংহিতা ১৪১]
 
ব্রা॒হ্ম॒ণম্য॒ বি॑দেয়ং পিতৃ॒মন্তং॑ পৈতৃম॒ত্যমৃষি॑মার্ষে॒য়ꣳ সু॒ধাতু॑দক্ষিণম্ ।
অ॒স্মদ্রা॑তা দেব॒ত্রা গ॑চ্ছত প্রদা॒তার॒মাবি॑শত ॥ যজু ০ ৭।৪৬ ॥

যজুর্বেদ অধ্যায় ৭ এর ৪৬ নং মন্ত্রে ব্রাহ্মণ বলতে বেদও ব্রহ্মের জ্ঞাতা কে বলা হয়েছে.. এই বিষয়ে পুরানে শ্লোক রেয়েছঃ

‘জন্মানা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাৎ দ্বিজ উচ্যতে।
বেদ পাঠাৎ ভবেদ্ বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি স ব্রাহ্মণঃ।’
(পদ্মপুরাণ / স্কন্দ পুরান অনুযায়ী)

অর্থাৎ, মানুষ শূদ্র হয়ে জন্মে। সংস্কার (উপনয়ন) করে হয় দ্বিজ। দ্বিজ হলে বেদ পাঠ করে হয় বিপ্র। বেদ পাঠ করে জ্ঞান অর্জন ও সাধনা করে সাধনালব্ধ ফলের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে ব্রহ্মকে জেনে ব্রাহ্মণ হয়।
বেদ পাঠাৎ ভবেদ্ বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি স ব্রাহ্মণঃ- বেদ পাঠ করে জ্ঞান অর্জন ও সাধনা করে সাধনালব্ধ ফলের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে ব্রহ্মকে যে জানে তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়। তাঁর কাজই বেদ পড়া এবং বেদ পড়ানো বা বেদ জ্ঞান দান করা..

অথর্ববেদ ১০।৮।৩৭ নং মন্ত্রে বাহ্মণই ব্রহ্মকে জানতে পারেন বলা হয়েছেঃ
য়ো বিদ্যাৎসূত্রং বিততং য়স্মিন্নোতাঃ প্রজা ইমাঃ।
সূত্রং সূত্রস্য য়ো বিদ্যাৎস বিদ্যাদ্ ব্রাহ্মণং মহৎ॥-অর্থাৎ সেই মানব (মহৎ ব্রাহ্মণ) মহান ব্রহ্মকে জানতে পারেন।

(মহাভারত শান্তিপর্ব ১৮৮-১০) অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণের মধ্যে কোনই প্রভেদ নাই । কেন না পূর্বে এই পৃথিবীতে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পুর্ণ ছিল । তাঁহারাই পৃথক পৃথক কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র নামে অভিহিত হইয়াছেন ।” মহামতি ভীষ্ম বলিতেছেন “তস্মাদ্বর্ণা ঋজবো জ্ঞাতির্বণাঃ” অর্থাৎ “ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র সকলেই সাধু এবং একে অন্যের জ্ঞাতি ।” ব্রাহ্মণই পরবর্তী যুগে বিভিন্ন গুণ কর্ম্ম স্বভাব অনুসারে ঋষি মুনি ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ,রাক্ষস দৈত্য দানব , নাগ ঋক্ষ কপি , হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান , নিগ্রো কার্ফি ইহুদি , আর্য্য অনার্য্য  নামে পৃথক ও বিভক্ত  হইয়াছে । শাস্ত্র কার ব্রাহ্মণ কে দশ ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন । অত্রি সংহিতা বলিতেছেঃ দেবো মুনির্দ্বিজো রাজা বৈশ্য শূদ্রো নিষাদকঃ । পশু ম্লের্চ্চোহপি চন্ডালো দশবিধাঃ স্মৃতাঃ ।  (৩৬৪) ব্রাহ্মণ দশ প্রকারের যথা— দেব ,মুনি , দ্বিজ , ক্ষত্রিয় ,বৈশ্য ,শূদ্র , নিষাদ , পশু ও চন্ডাল । মহর্ষি অত্রির মতে ক্ষত্রিয় , বৈশ্য‌ , শূদ্র , নিষাদ , পশু , ম্লেচ্ছ ও চণ্ডাল ইহারা সকলেই ব্রাহ্মণ ।  পশু ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে ইনি বলিতেছেনঃ — “ব্রহ্মতত্ত্বং না জানাতি ব্রহ্মসূত্রেণ গর্ব্বীতঃ । তেনৈব স চ পাপেন বিপ্রঃ । পশুরুদাহৃতঃ । (৩৭২) । 

অর্থাৎ গলায় মাত্র পৈতা করিয়া যে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণত্বের গর্ব্ব করে অথচ ব্রহ্মতত্ত্ব জানে না এই পাপে তাহাকে পশু ব্রাহ্মণ বলা হয় ।”  তাহার গলায় পৈতা আর গো মহিষ ছাগলের স্কন্ধে রজ্জু একই প্রকারের । এই শ্রেণীর ব্রাহ্মণের প্রাচুর্য্যেই ত দেশ ও সমাজ রসাতলে যাইতে বসিয়াছে ।  

 পূর্বকালে ব্রাহ্মণ বা নরগণ যখন শত্রুর হাত হইতে দেশকে রক্ষা করতেন তখন তাঁহাদিগকে ক্ষত্রিয় (military power) বলা হইত , কৃষি বাণিজ্য করিলে বৈশ্য (Trading class) , সমাজ সেবা (social service) করিলে শূদ্র এবং শারীরিক পরিশ্রম না করিয়া চিন্তা শক্তির দ্বারা সমাজসেবা করিলে তাহাদিগকে নতুন সংজ্ঞা বা উপাধি না দিয়া শুধু ব্রাহ্মণই বলা হইত । একই ব্যক্তি একই জীবনে বৃত্তি অনুসারে কখনো ব্রাহ্মণ কখনো ক্ষত্রিয় , কখনো বৈশ্য বা কখনো শূদ্র সংজ্ঞা পাইত । চারি বর্ণের মধ্যে তখন অবাধে বৈবাহিক আদান-প্রদান ও পান ভোজন চলিত , সকলেই বেদ পাঠ ও ভগবত উপাসনা করিতে পারিত । আর্য জাতি তখন সব একাকার ভারতের তখন স্বর্ণ যুগ । 

   তখন বিবাহে জাতিভেদ ছিল না । “অক্ষমালা বৈশিষ্টেন সংযুক্তা ধর্মযোনিজা । সারঙ্গী মন্দপালনে জগামোভা হর্ণীয়তাম্  ।। (মনুসংহিতা ৯২৩) অর্থাৎ বশিষ্ট নিকৃষ্ট কুলোৎপন্ন অক্ষ মালাকে এবং মন্দপাল অধম কুল হইতে উৎপন্ন সারঙ্গীকে বিবাহ করিয়াছিলেন ।” ইহাদের পুত্রেরা সকলেই পিতৃবর্ণ ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন ; কোন নুতন জাতির সৃষ্টি হয় নাই । মহর্ষি উৎস বিবাহ করিলেন ক্ষত্রিয় রাজা ভগিরথের কন্যাকে । এইরূপে মহর্ষি অঙ্গিরা ক্ষত্রিয় মরুত্তের কন্যাকে , মহর্ষি হিরণ্যহস্ত ক্ষত্রিয় মাদিরাশ্বের কন্যাকে , ব্রাহ্মণ ঋষ্যশৃঙ্গ ক্ষত্রিয় দশরথের কন্যা শান্তাকে , জমদগ্নি ক্ষত্রিয় প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকাকে , মহর্ষি ভৃগু ব্রাম্মন পুত্র এবং ক্ষত্রিয় শর্য্যাতির কন্যাকে , মহর্ষি রিতিক ক্ষত্রিয় গাধীর কন্যা বা বিশ্বামিত্রের ভগ্নী সত্যবতীকে অবাধে বিবাহ করিয়াছিলেন ।  তখন ব্রাহ্মণ বংশ অব্রাহ্মণ এবং  অব্রাহ্মণ বংশে ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করিতেন । মনুর পুত্র ধৃষ্ট হইতে ধার্ষ্ট নামক ক্ষত্রিয় বংশের উৎপত্তি । ধার্ষ্টগণ ক্ষত্রিয় হইতে ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন । (শ্রীমদ্ভগবদ -শ্রীধর টিকা ৯।২।১৭৬) । দিষ্ট ছিলেন ক্ষত্রিয় কিন্তু তাঁহার পুত্র নাভাগ বৈশ‌্য ; ইনি বৈশ্য কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন (মার্কণ্ডেয় পুরাণ) নাভাগারিষ্টের দুই বৈশ্য পুত্র ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (হরিবংশ ১১।৬৫৮) । মনুর দৌহিত্র পুরুরবার বংশে জন্মিয়াছিল ক্ষত্রিয় শুনুক । এই শুনুকের বংশে চারি বর্ণই জন্মিয়াছে (বিষ্ণুপুরাণ ৩।১৮) । ক্ষত্রিয় বিজয়ের পুত্রই মহাত্মা কপিল । বিজয়ের অন্য পুত্র সুহোত্রের গৃৎসমতি নামক পুত্রের বংশে ও চারিবর্ণের উৎপত্তি হয় (হরিবংশ ৩২) । পুরূরবার বংশে ক্ষত্রিয় রভস জন্মগ্রহণ করেন , তাঁহার গোত্র হইতে বহু ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন (ভাগবত ৯/১৭/১০) । পুরুর বংশে ক্ষত্রিয় মেধা তিথি জন্মগ্রহণ করেন , এই মেধাতিথি হইতেই কাম্বায়ন গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণ জন্মগ্রহণ করেন (বিষ্ণুপুরাণ ৪/১৯/২) । ক্ষত্রিয় রাজ অজমিঢ়ের বংশে প্রিয়মেধাদি ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন (ভগবত ৯/২১/২১) । অজমীঢ়ের বংশে মুদ্গলের জন্ম , এই মুদ্গল হইতেই মৌদ্গল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণের উৎপত্তি (মৎস্য পুরাণ) । গর্গ , সংস্কৃতি ও কাব্য নামক তিনজন মহর্ষি ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন (মৎস্য পুরাণ) ।   গর্গ হইতে শিনি এবং তাঁহা হইতে ক্ষত্রিয়-গার্গগণ ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন ।  গর্গের ভ্রাতা মহাবীর্য্যের পুত্র ক্ষত্রিয় অরুক্ষয়ের তিন পুত্র ত্রর্য্যরুণ , পুষ্করী ও কপি ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (মৎস পুরাণ) । পুরো বংশীয় ক্ষত্রিয় ঋষ্টি সেনের পুত্র  দেবাপি স্বীয় ভ্রাতা শান্তনুর পৌরহিত্য করিয়াছিলেন (নিরুক্ত ২।১০) । সিন্ধুদিপ , দেবাপি ও বিশ্বমিত্র ক্ষত্রিয় হইয়াও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন (মহাভারত শল্য ৪০ ) । ক্ষত্রিয় জনক ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন (শতপথ ব্রাহ্মণ ) । শুধু তাহাই নয়— জাতো ব্যাসস্তু কৈবর্ত্ত্যাঃ শ্বপাক্যাশ্চ পরাশরঃ । শুক্যাঃ শুকঃ কণাদাখ্যঃ ততোলুক্যাঃ সূতোহ ভবৎ ।। মৃগীজঋষ্যশৃঙ্গোহপি বশিষ্ঠো গণিকান্তজঃ । মন্দপালো মুনিশ্রেষ্ঠো নাবিকাপত্য উচ্যতে ।। মান্ডব্যো মুনিরাজস্তু মন্ডুকী গর্ভসম্ভবঃ বহবোহন্যোহপি বিপ্রত্বং প্রাপ্তা যে শূদ্রযোনয়ঃ ।। ( ভবিষ্য পুরাণ ব্রাহ্ম পর্ব্ব ৪২ অধ্যায় — বজ্রসূচী দ্রষ্টব্য অর্থাৎ কৈবর্ত কন্যার গর্ভজাত মহর্ষি কৃষ্ণ দৈপায়ণ বেদব্যাস , শ্বপাক অনার্য্য কন্যার গর্ভজাত শাস্ত্র কর্তা পরাশর (ব্যাসের পিতা) , ম্লেচ্ছ কন্যা শুকীর গর্ভজাত শুকদেব (ব্যাসের পুত্র ; অনার্য্য কন্যা উলুকীর গর্ভজাত বৈশেষিক দর্শনাকার কণাদ ; শূদ্র কন্যা মৃগী’র গর্ভজাত ঋষ্যশৃঙ্গ ; বেশ্যার গর্ভজাত মহর্ষি মন্দপাল ; ব্যাধ জাতীয় কন্যা মুন্ডুকীর গর্ভজাত ঋষি মান্ডব্য ; তারা সকলেই ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন । বারবিলাসিনী যাবালার পুত্র সত্যকাম ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (ছান্দোগ্যোপনিষৎ)  । শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বংশে জন্মিয়াও  অভিমুন্যুর জাতকর্ম  প্রভৃত্তি শুভকর্ম্মে পৌরহিত্য করিয়াছিলেন (মহাভারত আদি পর্ব্ব ২২১ বর্দ্ধমান রাজবাটীর ) । ক্ষত্রিয়া রেনুকার গর্ভে জন্মিয়া পরশুরাম ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (মহাভারত -বন পর্ব্ব ১১৫।১৬) । অন্ধ মুনি বৈশ্য ছিলেন । শূদ্রাণী স্ত্রীর গর্ভে জন্মিয়াছিলেন ব্রাহ্মণ সিন্ধু মুনি  । ইঁহাকে বধ করিয়া দশরথ ব্রহ্ম হত্যার পাপে লিপ্ত হইয়াছিলেন (রামায়ণ , অযোধ্যা কান্ড ৬৩।৫১) ।   দাসী পুত্র কক্ষীবাপ পূজনীয় ঋষি এবং দাসী পুত্র নারদ দেবর্ষি হইয়াছিলেন । ব্রাহ্মণ জরৎকারু অনার্য্য নাগ কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন , ইঁহারই গর্ভে ব্রাহ্মণ আস্তিক মুনি জন্মগ্রহণ করেন । ইহাই হইল ভারতের স্বর্ণযুগ । এই জন্যই ভারত ছিল স্বাধীন ও পরাক্রমশালী ।

ব্রাহ্মণ শব্দটি নিয়ে ভ্রান্তি এবং তার নিবারণ

উত্তর-ব্রাহ্মণ শব্দটি নিয়ে অনেক ভ্রান্তি। তার সমাধান করা অত্যন্ত আবশ্যক কারণ হিন্দু সমাজের সব থেকে বড় দুর্বলতা জাতপাত। ব্রাহ্মণ শব্দের সত্য অর্থ না বোঝার কারণে জাতপাত কে উৎসাহিত করা হয়েছে।

শঙ্কা-১- ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা দাও?

সমাধান-পঠন-পাঠন দ্বারা,চিন্তন-মনন করা থেকে ব্রহ্মচর্য,অনুশাসন,সত্য-ভাষণাদি ব্রতের পালন করা থেকে,পরোপকার সৎ কর্ম করা দ্বারা,বেদ-বিজ্ঞান আদি পাঠন দ্বারা, কর্তব্যের পালন করা থেকে,দান করা থেকে এবং আদর্শের প্রতি সমর্পিত হয়ে মানুষের এই শরীর ব্রাহ্মন করা হয়।। মনুস্মৃতি-২/২৮।।

শঙ্কা-২-ব্রাহ্মণ কি জাতি,নাকি বর্ণ হয়?

সমাধান-ব্রাহ্মণ বর্ণ,জাতি নয়। বর্ণের অর্থ চয়ন যা নির্বাচন করা এবং সাধারণত-শব্দ বরণও একই অর্থ বহন করে। ব্যক্তি নিজেই রুচি,যোগ্যতা এবং কর্মের অনুসারে এর স্বয়ং বহন করা হয়,এই কালণে এর নাম বর্ণ। বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থাতে চার বর্ণ রয়েছে। ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য এবং শূদ্র।
ব্রাহ্মণের কর্ম বিধিবত পঠন ও পাঠন,যজ্ঞ করা এবং করানো, দান প্রাপ্ত করা এবং সুপাত্রে দান দেওয়া।
ক্ষত্রিয়ের কর্ম বিধিবত পঠন,যজ্ঞ করা,প্রজাদের পালন-পোষণ এবং রক্ষা করা,সুপাত্রে দান দেওয়া,ধন ঐশ্বর্যে লিপ্ত না হয়ে জিতেন্দ্রিয় থাকা।
বৈশ্যের কর্ম পশুদের লালন-পালন করা,সুপাত্রে দান দেওয়া,যজ্ঞ করা বিধিবত অধ্যায়ন করা,ব্যবসা করা,ধন কামনা,কৃষি করা।
শূদ্রের কর্ম সকল চার বর্ণের ব্যক্তিদের সেবা বা শ্রম করা। শূদ্র শব্দকে মনু অথবা বেদ কোথাও অপমানজনক,নিচ অথবা নিকৃষ্ট মনে করেনি। মনুর অনুসারে চার বর্ণ ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য এবং আর্য।
মনুস্মৃতি-১০/৪।

শঙ্কা-৩-মানুষের মধ্যে কয় জাতি আছে?

সমাধান-মানুষের মধ্যে কেবল একই জাতি আছে। তিনি "মানুষ" অন্য কোন জাত নেই।

শঙ্কা-৪-চার বর্ণের বিভাজনের আধার কি?

সমাধান-বর্ণ তৈরীর মূখ্য প্রয়োজন কর্ম বিভাজন। বর্ণ বিভাজনের আধার ব্যক্তির যোগ্যতা। আজএ শিক্ষা প্রাপ্তির পর ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,উকিল আদি তৈরী হয়। জন্ম থেকে কেউ ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,উকিল হয় না। একেই বর্ণ ব্যবস্থা বলা হয়েছে।

শঙ্কা-৫-কোনও ব্রাহ্মণ জন্ম থেকে হয়,অথবা গুণ,কর্ম এবং স্বভাব দ্বারা হয়?

সমাধান-ব্যক্তির যোগ্যতার নির্ধারণ শিক্ষা প্রাপ্তির পশ্চাতই হয়। যে কোনও ব্যক্তির গুণ,কর্ম এবং স্বভাবের ভিত্তিতে তার বর্ণের অনুসন্ধান হয়। কোন ব্যক্তি নিরক্ষর হয় এবং নিজেকে নিজে ব্রাহ্মণ বলে তবে সে ভুল।
মনুর উপদেশ পড়ুন-
যেমন কাঠ দ্বারা তৈরী হাতি এবং চামড়ার তৈরী হরিণ শুধু নামের জন্যই হাতি এবং হরিণ বলা যায় তেমনই অপাঠিত ব্রাহ্মণ মাত্র নামেরই ব্রাহ্মণ হয়। মনুস্মৃতি-২/১৫৭।

শঙ্কা-৬-একজন ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান কেবল এইজন্য ব্রাহ্মণ বলা হয় যে তার পিতা ব্রাহ্মণ?

সমাধান-এসব ভ্রান্তি যে ব্রাহ্মণের পিতার সন্তান এইজন্য ব্রাহ্মণ বলা হবে কারণ তার পিতা ব্রাহ্মণ। যেমন এক ডাক্তারের সন্তান তখনই ডাক্তার বলা হবে যখন MBBS উত্তীর্ণ হবে। যেমন এক ইঞ্জিনিয়ারের সন্তান তখনই ইঞ্জিনিয়ার বলা হবে যখন সে BTech উত্তীর্ণ হবে। না পড়লে বলা যাবে না। তেমনই ব্রাহ্মণ এক অর্জিত জানার পুরানো উপাধি।
মনুর উপদেশ পড়ুন-
মাতা-পিতা থেকে উৎপন্ন সন্তানের মায়ের গর্ভ দ্বারা প্রা্প্ত জন্ম সাধারণ জন্ম। বাস্তবিক জন্ম তখনই হয় শিক্ষাজীবন পূর্ণ করার পরেই হয়। মনুস্মৃতি-২/১৪৭।

শঙ্কা-৭-প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য কি করতে হতো?

সমাধান-প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ তৈরীর জন্য শিক্ষিত এবং গুণবান উভয়ই হতে হতো।
মনুর উপদেশ দেখুন-
বেদে পারদর্শী আচার্য দ্বারা শষ্যকে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার পরেই তার বাস্তবিক মনুষ্য জন্ম হয়। মনুস্মৃতি-২/১৪৮।
ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য,এই তিন বর্ণ বিদ্যাধ্যয়ন দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্ত করে। বিদ্যাধ্যয়নে অক্ষম শূদ্র,চার বর্ণ। মনুস্মৃতি-১০/৪।
আজকাল কিছু লোক কেবল এইজন্যনিজে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে জাতের অভিমান দেখায় কারণ তার পূর্বজ ব্রাহ্মণ ছিলেন। এটা একেবারেই ভুল। যোগ্যতা অর্জন না করে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না।আমাদের প্রাচীন ব্রাহ্মণ নিজ তপস্যা দ্বারা নিজ বিদ্যা দ্বারা নিজ জ্ঞান দ্বারা সম্পূর্ণ সংসারের মার্গদর্শন করেছেন। এইজন্য আমাদের আর্যবর্ত দেশ বিশ্ব গুরু ছিলো।

শঙ্কা-৮-ব্রাহ্মণকে শ্রেষ্ঠ কেন মানে?

সমাধান-ব্রাহ্মণ এক গুণবাচক বর্ণ। সমাজের সব থেকে জ্ঞানী,বুদ্ধিমান,শিক্ষিত,সমাজের মার্গদর্শনকারী, ত্যাগী,তপস্বী ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ বলার অধিকারী হয়। এইজন্য ব্রাহ্মণ বর্ণ শ্রেষ্ঠ। বৈদিক বিচার ধারায় ব্রাহ্মণকে যদি সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়, তবে ব্রাহ্মণকেও সবচেয়ে বেশি ভুল করার জন্য দন্ড্ও দেওয়া হয়েছে।
মনুর উপদেশ দেখুন-
একই অপরাধের জন্য শূদ্রকে সব থেকে কম দন্ড,বৈশ্যকে দুইগুণ,ক্ষত্রিয়কে তিনগুণ এবং ব্রাহ্মণকে ষোল গুণ বা ১২৮ গুণ দন্ড পেয়েছে। মনুস্মৃতি-৮/৩৩৭-৩৩৮। এই শ্লোকের ভিত্তিতে কেউ মনু মহারাজকে পক্ষপাতদুষ্ট বলতে পারবে না।

শঙ্কা-৯-একজন শূদ্র কি ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মন কি শূদ্র হতে পারে?

সমাধান-ব্রাহ্মণ,শূদ্রাদি বর্ণ ব্যক্তি গুণ,কর্ম এবং স্বভাবের ভিত্তিতে বিভাজিত।এইজন্য কাতে পরিবর্তন সম্ভব। কোনও ব্যক্তি জন্ম থেকে ব্রাহ্মণ না। কিন্তু শিক্ষা প্রাপ্তির পর তার বর্ণের নির্ধারণ হয়।
মনুর উপদেশ দেখুন-ব্রাহ্মণ শূদ্র হতে পারে এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারে। একই প্রকার ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যও নিজ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে। মনুস্মৃতি-১০/৬৪।।

ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

www.ধর্ম্মতত্ত্ব.com

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ