পূজা-উপাসনার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইল পঞ্চদেবতা পূজা। কথিত আছে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে বৈদান্তিক ধর্মসংস্কারক আদি শঙ্কর এই বিশেষ পূজার প্রবর্তন করিয়াছিলেন। গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দুর্গা – এই পঞ্চ দেবদেবীর পূজাকেই বলা হয় পঞ্চদেবতা পূজা বা পঞ্চায়তন পূজা। এই পঞ্চদেবদেবী হিন্দুদের পঞ্চ সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা। বৈদিক দার্শনিক তত্ত্বের বিচারে, ইঁহারা কেহই পৃথক দেবতা নহেন, বরং একই সগুণ ব্রহ্মের পাঁচটি পৃথক রূপমাত্র।
বৈদিক মতে পঞ্চায়তন পূজা বলতে কোন প্রকার মূর্তি পূজা না।
কিন্তু নিম্নে যে " মূর্ত্তিমান্" সম্বন্ধে বলা হইবে, তাহার পূজা অর্থাৎ সম্মান করা উচিত। সেই পঞ্চদেব পূজা এবং পঞ্চায়তন পূজা শব্দের অর্থ অতি উত্তম। কিন্তু বিদ্যাহীন মূঢ়গণ তাহার সদর্খ পরিত্যাগ করিয়া কদর্থ গ্রহন করিয়াছে। আজকাল যে শিবাদি পঞ্চমূর্ত্তি নির্মাণ করিয়া পূজা করা হয়, তাহার ত খণ্ডন এখনেই করা হইয়াছে। এখন সত্য, বেদোক্ত এবং বেদানুকূল পঞ্চায়তন,দেবপূজা ও মূত্তিপূজা বিষয় শ্রবণ কর-
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসংভূতিমুপাসতে।
ততো ভুয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যা রতাঃ।।১
যজুর্বেদ ৪০অধ্যায় ৯মন্ত্র
ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ।
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা যস্মান্ন জাত ইত্যেষঃ।।২
যজুর্বেদ ৩২অধ্যায় ৩মন্ত্র
অনুবাদঃ যাহারা ব্রহ্মের স্থানে "অসম্ভূতি" অর্থাৎ অনুৎপন্ন অনাদি প্রকৃতি কারণের উপাসনা করে, তাহারা অন্ধকার অর্থাৎ অজ্ঞানতা এবং দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়। আর যাহারা ব্রহ্মের স্থানে "সম্ভূতি" অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত, পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে, তাহারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামূর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করে।।১।।
যিনি সমস্ত জগতে ব্যাপক, সেই নিরাকার, পরমাত্মা প্রতিমা, পরিমাণ, সাদৃশ্য অথবা মূর্তি নাই।।২।।
দেখুন জীবন্ত মূর্তির পূজা বিষয়ে কি বলেঃ-
দেবপিতৃকার্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্।
মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।
আচার্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব। যান্যনবদ্যানি কর্মাণি।
তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি। যান্যস্মাকং সুচরিতানি।
তানি ত্বয়োপাস্যানি। নো ইতরাণি।। [তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১অধ্যায় ১১অনুবাক ২মন্ত্র]
অনুবাদঃ দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে অমনোযোগী হইবে না; প্রথম দেবতাঃ মাতা, দ্বিতীয় দেবতাঃ পিতা, তৃতীয় দেবতাঃ অতিথি এবং চতুর্থ দেবতাঃ আচার্য যেন তোমার দেবতা হন অর্থাৎ দেবতাজ্ঞানে তাহাদের পূজা করিবে। যেসকল কর্ম অনিন্দিত তাহাদের অনুষ্ঠানই তোমার কর্তব্য, নিন্দিত কর্মের অনুষ্ঠান করিবে না। আমাদের সদাচারসমূহের অনুষ্ঠানই তোমার কর্তব্য, যাহা সদাচার নহে তাহার অনুষ্ঠান করিবে না।
ব্যাখ্যাঃ দেবতার কার্য (যজ্ঞাদি) এবং পিতৃকার্য (তর্পনাদি কর্ম) অবহিত হইয়া নিয়মমত সম্পাদন করিবে। মাতা, পিতা, আচার্য এবং অতিথিকে দেবতাজ্ঞানে সেবা করিবে। লোকসমাজে যে সকল কর্ম নিন্দনীয় বলিয়া বিবেচিত হয় কখনও তাহা করিবে না। আচার্যগণের যে শোভন আচারণ তাহারই অনুসরণ করিবে।
পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপসুভিঃ।।- [মনুস্মৃতিঃ৩/৫৫]
পূজ্যো (হি) দেববৎ পতিঃ।। মনুস্মৃতিঃ৫/১৫৪
পঞ্চম দেবতাঃ স্ত্রীর পক্ষে পতি এবং পতির পক্ষে স্বপত্নী দেবতা জ্ঞানে পূজা করিবে।
ভাবার্থঃ এই পাচ মূর্ত্তিমান দেব। ইহাদিগের সংসর্গে মনুষ্যদেহের উৎপত্তি, পালন, সত্যশিক্ষা, বিদ্যা ও সত্যোপদেশ লাভ হইয়া থাকে! ইহারাই পরমেশ্বরের প্রাপ্তির সোপান - পরম্পরা। যাহারা ইহাদিগের সেবা না করিয়া পাষাণাদি মূর্ত্তির পূজা করে, তাহারা অতীব পরম নরকগামী।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ