সিজোফ্রেনিয়া - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 July, 2018

সিজোফ্রেনিয়া

রামকৃষ্ণের কালী দর্শন

সিজোফ্রেনিয়া তীব্র একটি মানসিক রোগ যার ফলে রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলেন। প্রায়ই তার হেলুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ) হয়। অর্থাৎ বাস্তবে নেই বা ঘটছে না এমন কিছু ঘটতে দেখা বা শোনা। এবং ডিলিউশন হয় অর্থাৎ মনে এমন বিশ্বাস বা মনোবিকার থাকে যে, কেউ বুঝি তাকে গায়েব বা অদৃশ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা তাকে হত্যা করার চেষ্ট করছে। এছাড়াও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন, যেমন, হুট করেই একটি বিষয় থেকে এমন আরেকটি বিষয়ে কথা বলা শুরু করেন যার সঙ্গে আগেরটির কোনো সম্পর্ক নেই। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নেন। সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয় একটি জীবন্তু দুঃস্বপ্ন।মনোবিশেষজ্ঞ তুষার জানান, ভ্রান্ত বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা (ডিল্যুশন), অবাস্তব চিন্তাভাবনা, হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ), অসংলগ্ন কথাবার্তা ইত্যাদি সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষণ হচ্ছে অনাগ্রহ, চিন্তার অক্ষমতা, আবেগহীনতা, বিচ্ছিন্নতা।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এমন ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যার কোনো ভিত্তি নেই। যেমন, অনেকে বিশ্বাস করেন তিনি মহাপুরুষ। তাঁর অনেক ক্ষমতা আছে যা দিয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। কোনো কারণ ছাড়াই কেউ বিশ্বাস করে তাঁর নিজের বাবা-মা, স্বামী স্ত্রী বা কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর ক্ষতির চেষ্টা করছে। তাঁকে পাগল বানাতে চেষ্টা করছে বা হত্যা করতে চাইছে। রোগী নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারেন। রোগীর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসসংক্রান্ত কতগুলো ভুল ধারণার জন্ম নেয়। তিনি নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। কেউ স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি তীব্র সন্দেহে ভুগতে পারেন। 

রোগী কতগুলো অবাস্তব দৃশ্য দেখে, এগুলোকে বাস্তব মনে করেন। কোনো বাস্তব স্পর্শ ছাড়াই অনুভব করতে পারেন, কেউ তাকে স্পর্শ করছে। শরীরে খোঁচা লাগার অনুভূতিও হতে পারে। তাঁরা অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলেন বা কথা ঠিকমতো বোঝা যায় না। এই রোগীদের আচরণ স্বাভাবিক থাকে না।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অন্যের ওপর সহিংসতা না করে বরং নিজেই সহিংসতার শিকার হন। এই রোগ পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা লজ্জার কারণে কারো সাহাজ্য চাইতে আসে না। আবার অনেক সময় লোকে তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়, কেননা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অযথাই লোককে ভয় পায় যে তারা হয়তো তার ক্ষতি করবে। এ কারণে লোকে অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে পাগল মনে করেন।

সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তদের সম্পর্কে রইল এমন ৭টি বিষয় যা সকলেরই জানা দরকার।

১. সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা সহিংস নন

এরবরং নিজেদের সঙ্গেই সহিংসতা করেন অনেক সময়। তাদের ডিলিউশন এবং হেলুসিনেশন বা উৎকল্পনাগুলো যখন চরম মাত্রায় পৌঁছে যায় তখন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী অন্যদের ক্ষতি না করে বরং নিজের ক্ষতি করেন। তবে সেসময় তারা জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলতে পারেন এবং দেয়ালে কিল-ঘুষি মেরে নিজেকেই আহত করতে পরেন। এসময় অন্য কেউ এসে তাদের পাশে দাঁড়ালে তারা বরং শান্ত হয়ে আসেন এবং বাস্তবতার বোধ ফিরে পান।

এই রোগ জীবনভরই থাকে। ভালোবাসা এবং মানসিক সহায়তার মাধ্যমেই শুধু একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়। সুতরাং আপনার কাছের কারো যদি এই রোগ থাকে তাহলে তাদেরকে মানসিকভাবে সহায়তা করুন। তাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিন তাদের উৎকল্পনাগুলো বাস্তব নয়। এবং সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসলেই তারা সুস্থ থাকতে পারবেন।

২. এরা প্রতিদিনের স্বভাবিক কাজকর্ম করতে অক্ষম নন

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম নয় বলে মনে করা হয়। এবং তাদেরকে কোনো মানসিক চিকিৎসালয়ে নজরদারির মধ্যে রাখা উচিত বলেও বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল। বরং সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধ দিলে তারা বরং কাজেকর্মে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

৩. সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তরা খুবই সৃজনশীল হয়ে থাকেন

প্রফেসর জন ন্যাশ একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত গণিতবিদ। যার সিজোফ্রেনিয়া ছিল। তাকে নিয়ে হলিউডে একটি বিখ্যাত সিনেমা বানানো হয়। সিনেমাটির নাম ‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’। সিনেমাটিতে দেখানো হয় কী করে স্ত্রীর সহযোগিতায় জন ন্যাশ সিজোফ্রেনিয়া থেকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গণিতবিদ হয়ে উঠেছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রায় সৃষ্টিশীল লোকদের চিন্তার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মিল রয়েছে। সৃজনশীলতার নানা পরীক্ষায়-নিরীক্ষায় সাধারণের চেয়ে তাদের চিন্তা আনেক বেশি সৃষ্টিশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোরিওগ্রাফির জগতে কিংবদন্তী শিল্পী নিজনস্কি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

৪. সিজোফ্রেনিয়া শুধু বংশগত রোগ নয়

পূর্বপুরুষদের কারো মধ্যে এই রোগ থাকলে কারো সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। আর জমযদের কারো একজনের সিজোফ্রেনিয়া হলে অপরজনের তাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৬৫%। কিন্তু এটি শুধু বংশগত রোগ নয়। পারিপার্শ্বিক নানা কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো মাদক সেবন। এমনকি সৃজনশীল বা দার্শনিক চিন্তা করতে গিয়েও অনেকের সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে।

৫. সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা আছে

এই রোগ হয়তো পুরোপুরি ভালো হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা সম্ভব। তবে এই রোগ অন্যান্য মানসিক রোগের মতোই আজীবন মাথার মধ্যে থেকে যায়। ফলে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করার জন্য সবসময়ই চিকিৎসা নিতে হয়।

৬. সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা ‘পাগল’ নন

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রায়ই এই উৎকল্পনায় ভোগেন যে লোকে বুঝি তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বা তাদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে বা কেউ তাকে গোপনে নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব দেখে লোকে হয়তো তাদেরকে পাগল ভাবতে পারেন। তারা এমনকি অনেক সময় এও ভাবতে পারেন যে তাদের কল্পনার বাইরে বাস্তবে আর কিছুই ঘটছে না। তারা অনেক সময় এমন কিছু শুনতে পান যা অন্যরা শুনতে পায় না। অদৃশ্য সেই স্বর হয়তো তাদেরকে নিজের ক্ষতি করতে বলছে। তারা এমন কিছু দেখছে যা অন্যরা দেখছে না। যা হয়তো তাদের ক্ষতি করতে আসছে।

এজন্য তাদেরকে ঠিক পাগল বলা উচিত নয়। এরা অনেক সময় জনসম্মুখে থাকলে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থেকে বুঝা যায়না কেউ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত কিনা। কেননা তারা তাদের উৎকল্পনাগুলো কারো কাছে প্রকাশ করে না।

৭. সিজোফ্রেনিয়া সহজে শনাক্ত করনা যায় না

আপনার বন্ধুও যদি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিজে না বললে আপনি বাইরে থেকে দেখে তার রোগ ধরতে পারবেন না। জনসম্মুখে থাকার সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা তাদের উৎকল্পনাগুলোর প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না বা খুবই দক্ষতা ও সক্রিয়ার সঙ্গে তা অগ্রাহ্য করেন। যদিও অন্য কিছু আচরণ দেখে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব। যেমন, এরা অনেক সময় খুবই ধীরে এবং টেনে-হিচঁড়ে কথা বলেন। এরা অনেক সময় একই বাক্য বা শব্দ বারবার বলতে থাকেন। এবং হুট করেই একটি বিষয় থেকে আরেকটি বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। যে দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই রোগ যখন তুঙ্গে থাকে তখন তারা সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারেন। কারণ তখন তাদের মনে এই উৎকল্পনা কাজ করে যে লোকে বুঝি তাদেরকে বিষ খাইয়ে হত্যা করবে।

মনোবিজ্ঞানী তুষার বলেন, সিজোফ্রেনিয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন কারণে সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক কারণ বেশি কাজ করতে পারে। আবার কতগুলো কারণ একসাথেও কাজ করতে পারে। বংশে কারো থাকলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বাবা মা দুজনের মধ্যে একজনের থাকলে সন্তানের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা ১৭ শতাংশ। যদি উভয়েরই থাকে তবে সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৪৬ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণে ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদান ভারসাম্যহীন হলে এ রোগ হয়। জন্মকালীন কোনো জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 
বঞ্চিত পরিবারে সিজোফ্রেনিয়া বেশি দেখা যায়। গর্ভকালীন মা ইনফ্লুয়েঞ্জা বা রুবেলা আক্রান্ত হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করার প্রবণতা তৈরি হয়।

যুক্তরাষ্ট্র্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, সিজোফ্রেনিয়া রোগটি একক কোনো রোগ নয়। বরং আটটি ভিন্ন ধরনের সমস্যার সমন্বিত রূপ। তাঁদের মতে, এই নতুন ধরনের ব্যাখ্যায় রোগটি ব্যাখ্যার নতুন দুয়ার খুলে গেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড্রাগান সভ্রাকিক বলেন, জিনগুলো আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। বরং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে সিজোফ্রেনিয়া হয়। 

এ রোগ কীভাবে নির্ণয় করা হয় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ ও অতীত কর্মকাণ্ড পযর্বেক্ষণের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। 

তবে একটু যত্ন করলে এবং ভালোবাসা দিলেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত লোকরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। এমনকি তারা সৃজনশীলতার অসামান্য নজির স্থাপন করতে পারেন।বর্তমানে সারা বিশ্বে কমপক্ষে দুই কোটি ৬০ লাখ লোক সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীরা ১৫-২০ বছর আগে মারা যান। অন্যদের তুলনায় তাঁরা ছয়–সাত গুণ বেশি বেকার জীবন যাপন করেন, তাঁরা প্রায়ই গৃহহীন থাকেন (রাস্তায় ভবঘুরে জীবন যাপন করেন), সর্বোপরি তাঁদের ৫-১০ শতাংশ আত্মহত্যা করে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। তাঁরা সম্মানহীন এবং বন্ধুহীন ও আত্মীয়হীন জীবন যাপন করেন। শিক্ষার সুযোগ হারান, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, শারীরিক সুস্থতা নষ্ট হয়, চেহারা বিনষ্ট হয়। সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে যায়, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ জীবন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে ধূমপানের হার দুই থেকে ছয় গুণ বেশি। তাঁদের মধ্যে ৪৫-৫৫ শতাংশ মোটা বা স্থূলতায় ভোগেন, তাঁদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের হারও অধিক থাকে। অথচ অন্যদের তুলনায় তাঁদের শারীরিক রোগের চিকিৎসায়ও অবহেলা করা হয়।

এবারের প্রতিপাদ্য ‘সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস’। কারা সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস করেন? তাঁদের সমস্যা ও যন্ত্রণা কী? সেই সমস্যা ও যন্ত্রণা লাঘবে আমরা কী করতে পারি—এসবই হচ্ছে এই প্রতিপাদ্যের মূল ভাবনা। সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস যাঁরা করেন তাঁরা হচ্ছেন: রোগী নিজে, পরিবারের লোকসহ অন্য যাঁরা তাঁদের যত্ন নেন, মনোরোগ চিকিৎসক যাঁরা তাঁদের চিকিৎসা দেন, যাঁরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেন এবং অবশ্যই বৃহত্তর সমাজ। এই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কোলাবরেশন তৈরি করতে পারলে সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস ও স্বস্তিদায়ক হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা যেন ইতিবাচক ও অর্থপূর্ণ হয়, সে রকম চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের তৈরি করতে হবে।
মি. জেনেট পেলিও, যিনি বর্তমানে রিকভারি বেসড সার্ভিস টেক্সাস কাউন্সিলের পরিচালক এবং ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ফর মেন্টাল হেলথের বোর্ড মেম্বার, একসময় সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার নয়টি বিভিন্ন রোগ ছিল; এর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার জন্য আমি সবচেয়ে বেশি ভীত ছিলাম, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার কোনো আশা ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল না, আমি অবাক হতাম যে স্রষ্টা আমাকে কেন এত ঘৃণা করত। আমি জীবনকে ঘৃণা করতাম, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতাম নিজেকে। আমার মন-যন্ত্রণা আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না। এখান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু অবশেষে আমি আরোগ্য লাভের সুযোগ পাই। বর্তমানে আমার জীবন পূর্ণতা পেয়েছে, নতুন আশাবাদ ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রত্যেকের জন্য আরোগ্য লাভের সুযোগ তৈরি করা এবং প্রত্যেকে তেমন সুযোগ পাওয়ার উপযুক্ত।’
আমরা মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে যে মি. জেনেট পেলিওর মতো অনেক সিজোফ্রেনিয়ার রোগী আরোগ্য লাভ করেছেন এবং উঁচু পদে কর্মরত রয়েছেন। একসময়ের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে যে এই রোগের ক্রমাবনতি হয়। বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা আরোগ্য লাভকে সহজতর করেছে, এমনকি অনেকে উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। ২৫ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন, আরও ৩৫ শতাংশ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারেন, আরও ২০ শতাংশ সহায়তা সাপেক্ষে উন্নতি লাভ করেন। মাত্র ১৫ শতাংশ তেমন উন্নতি লাভ না-ও করতে পারেন। অথচ এই ১৫ শতাংশকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এ রোগ আরোগ্য লাভ হয় না। এ বিউটিফুল মাইন্ড চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, এ ধরনের রোগীরা অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অবশেষে কীভাবে আশাবাদী। জীবন অর্জন করতে পারেন।
বলা হয়, ‘মানসিক স্বাস্থ্য ব্যতিরেকে কোনো স্বাস্থ্য নেই’। আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য যত ভালোই হোক, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সে স্বাস্থ্য-সুখ উপভোগ করতে পারবেন না। তাই আমাদের সবারই মানসিক স্বাস্থ্যর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সিজোফ্রেনিয়া রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয় (ক্রনিসিটি) ওই রোগের জন্য নয় বরং সমাজ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ওই রোগকে যে প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা দিয়ে থাকে তার জন্য। ওই রোগীরা সঠিক চিকিৎসায় শুধু আরোগ্য লাভ করেন না, তাঁরা গড়ে উঠতে, বেড়ে উঠতেও পারেন (থ্রাইভ)। এর জন্য ওষুধ ও চিকিৎসার পাশাপাশি কমিউনিটি বেসড রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হবে। যত আগে থেকে চিকিৎসা শুরু হবে, ফল তত ভালো হবে। চাকরির সংস্থান, বাসস্থানের ব্যবস্থা, যথাযথ শিক্ষার সুযোগ, উপযুক্ত বিনোদন এবং উষ্ণ ও ভালোবাসাপূর্ণ পারিবারিক জীবন এঁদের আরোগ্য লাভকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এককথায়, আমরা একটি ভালো জীবনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকি, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য সেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসা

গবেষণায় দেখা গেছে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, ৫০ ভাগ ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। বাকি ২৫ ভাগ কখনোই ভালো হয় না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হচ্ছে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। কারণ নিয়মিত ওষুধ ও কতগুলো মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ এবং উপদেশ মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

সিজোফ্রেনিয়ায় দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে : ওষুধ প্রয়োগ ও সাইকোথেরাপি। এক্ষেত্রে ইনডিভিজুয়াল সাইকোথেরাপির মধ্যে রয়েছে হ্যালুসিনেশন নিয়ন্ত্রণ, ফ্যামিলি থেরাপি, যোগাযোগের প্রশিক্ষণ, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ইত্যাদি। অনেক সময় ভালো হয়ে যাওয়ার পর ওষুধ বন্ধ করে দিলে পুনরায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি।  

সিজোফ্রেনিয়া নিয়েও একজন রোগী ভালোভাবে বাঁচতে পারে, যদি ঠিকমতো চিকিৎসা করা যায়। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

মনোবিজ্ঞানী তুষার বলেন, যেসব পরিবার তীব্র আবেগ প্রকাশ করে, তাদের সদস্যদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। রোগীকে মানসিক চাপ না দেওয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা ও চিন্তামুক্ত রাখা খুব জরুরি। যদি তিনি ওষুধ সেবনের মধ্যে থাকেন তবে ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিকভাবে রোগীর ক্ষেত্রে সহেযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাকে পাগল বিবেচনা করা ঠিক নয়। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। 

বিঃদ্রঃ চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ সেবন করুন


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

মনুস্মৃতি প্রথম অধ্যায়

স্মৃতি শাস্ত্রের মধ্যে মনুস্মৃতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন বৃ্হস্পতিস্মৃতিতে বলা হয়েছে- বেদার্থপ্রতিবদ্ধত্বাত্ প্রাধাণ্যং তু মনো: স্মৃত...

Post Top Ad

ধন্যবাদ