রামকৃষ্ণের লীলা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

03 March, 2021

রামকৃষ্ণের লীলা

সেকুলার রামকৃষ্ণ
রামকৃষ্ণ পুঁথি
রামকৃষ্ণ পরমহংস পূর্বাশ্রমের নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়

১৮৩৫ খ্রী: রামকৃষ্ণের বাবা ক্ষুদিরাম তীর্থ ভ্রমণে যান। স্বামীর অবর্তমানে রামকৃষ্ণের মা চন্দ্রাদেবী স্বপ্ন দেখলেন একটি জ্যোতির্ময় মূর্তি তার শয্যায় রয়েছেন! তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তখনও তিনি যেন ঐ জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখতে পেলেন। মনে হল কে যেন দরজা ভেঙ্গে তার শয়ন কক্ষে ঢুকছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালেন। কিন্তু দেখলেন, দরজায় খিল দেওয়া আছে, ঘরে কেউ নেই।

এরপর একদিন তিনি প্রতিবেশী ধ্বনি কামরানী সঙ্গে শিব মন্দিরে শিব বিগ্রহের সম্মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব বিগ্রহ থেকে একটি জ্যোতির্ময় শিখা বিচ্ছুরিত হয়ে তীর-বেগে তার দিকে ছুটে আসলো। এ সম্পর্কে ধ্বনীকে তিনি কিছু বলার আগেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ধ্বনি তার চোখে মুখে জল দিয়ে তার মূর্ছা ভাঙ্গিয়ে তাকে ঘরে আনলো। সে তার কাছে আনুপূর্বক ঘটনা শুনে ভাবলো চন্দ্রার মাথায় অসুখ হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রাদেবী ভাবলেন তিনি সন্তান সম্ভব্য হয়েছেন।
এইভাবে অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে ১৮৩৬ খ্রী: ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে জন্ম হয় গদাধরের (রামকৃষ্ণের) (ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী – স্বরূপানন্দ – পৃ: ৮)

এইবার বুঝুন ঠেলা, গর্ভসঞ্চারের কি সুন্দর ব্যাখ্যা! এইভাবে যদি ভগবানের গর্ভসঞ্চারের ক্ষমতা থাকতো তাহলে পৃথিবীতে পুরুষ প্রাণীর কোন প্রয়োজন থাকত না। সব পুরুষ প্রাণীগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হত।
আমার মনে হয় এইসব ধর্ম-পুরুষদের পাশে এইসব কাহিনী জুড়ে তাদের অপমানিত করেছে তাদের শিষ্যরা।
উপরিউক্ত ঘটনা হাস্যকর তো বটেই। আর যদি তা বিন্দুমাত্র সত্যি হয় তা হলে নারীর কোকিলা-চরণের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
যীশু বা রামকৃষ্ণের জন্মের অলৌকিকতা দান করতে গিয়ে রীতিমত তাদের অবৈধ সন্তানের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন তাদের শিষ্যরা।

রামকৃষ্ণকে যেভাবে দয়ালু সবধর্মে বিশ্বাসী বলে সর্বস্তরে প্রচার করা হয়। আসলে তিনি কতটুকু দয়ালু ছিলেন যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে।

১৮৪৩ সালে পিতৃবিয়োগের পর পরিবারের ভার গ্রহণ করেন তার অগ্রজ রামকুমার। গদাধর যখন কিশোর, তখন তার পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়। রামকুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন। 

১৮৫৫ সালে কলকাতার অস্পৃশ্য কৈবর্ত সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন। নিম্নবর্ণীয়া এক নারীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির হওয়া সত্ত্বেও সামান্য অনুরোধেই গদাধর সেই মন্দিরে চলে আসেন। তিনি ও তার ভাগনে হৃদয়রাম রামকুমারের সহকারী হিসাবে প্রতিমার সাজসজ্জার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তার স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তার অবশিষ্ট জীবন। অনুমিত হয়, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন।( Life of Sri Ramakrishna, Advaita Ashrama, Ninth Impression, December 1971, p. 44) অন্য মতে, এই নামটি তার অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া। রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়।

 ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তার শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বয়সের এই পার্থক্য উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজে কোনও অপ্রচলিত দৃষ্টান্ত ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের মে মাসের আগে তাদের আর সাক্ষাৎ হয়নি। বিবাহের পর শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে পুণরায় মন্দিরের কাজ গ্রহণ করেন।

১৮৬১ সালে ভৈরবী ব্রাহ্মণী নামে গৈরিক বস্ত্র পরিহিতা এক যোগিনী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন । তার প্রকৃত নাম ছিল যোগেশ্বরী এবং বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। দক্ষিণেশ্বরে আগমনের পূর্বে তার জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না।তবে তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞা ও তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধনে সিদ্ধা। ভৈরবী শ্রীরামকৃষ্ণকে কুমারী পূজা শিক্ষা দেন। এই পূজায় কোনও কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। এছাড়াও ভৈরবীর নির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ কুণ্ডলিনী যোগেও সিদ্ধ হন। ভৈরবীর পথনির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করেন। ১৮৬৩ সাল নাগাদ তার তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হয়।ভৈরবী তাকে মনে করতেন ঈশ্বরের অবতার। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করেন। 

কালীদর্শন ও বিবাহে মধ্যবর্তী সময়ে কিছুকালের জন্য তিনি দাস্যভাবে সাধনা করেছিলেন। এই সময় তিনি হনুমানভাবে ভাবিত হয়ে রামচন্দ্রের আরাধনা করেন। এইসময় তার হাবভাব সকলই হনুমানের মতো হয়েছিল। তিনি কদলীভক্ষণ করতেন, অধিকাংশ সময় বৃক্ষশাখায় কাটাতেন, এমনকি বানরের মতো অস্থির চোখের দৃষ্টিও লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তার মেরুদণ্ডের নিচে সামান্য অংশও এই সময় লেজের মতো প্রসারিত হয়েছিল। দাস্যভাবে সাধনার সময় তিনি রামের পত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান এবং সীতার সেই মূর্তি তার নিজদেহে অন্তর্হিত হতে দেখেন।

১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী তোতাপুরী ছিলেন জটাজুটধারী এক বিশালবপু উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসী।

উনার জীবনী পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি ছিলেন চরম বর্ণ বিদ্বেষী, ব্রাহ্মণ্যবাদী। দু একটা ঘটনা দিয়ে উদাহরণ দেই –

রামকৃষ্ণ ছিলেন দারিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। চরম দারিদ্র্যের কারণে তার ভাই রামকুমার দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাণী রাসমণি ছিলেন তথাকথিত শূদ্র বংশের। ভাইয়ের শূদ্রের মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার তীব্র বিরুধী ছিলেন রামকৃষ্ণ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি রামকুমারকে বলেছিলেন – “আমার পিতা ও পূর্বপুরুষরা কেউ শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করেনি, এই মন্দিরে পৌরহিত্য গ্রহণ করে তিনি সর্বপ্রথম একাজ করবেন এবং তাতে চাটুজ্জে পরিবারের কলঙ্ক হবে।“

তারপরও রামকুমার ঐ মন্দিরের পুরোহিত হয়েছিলেন এবং রামকৃষ্ণকে সেখানে নিয়ে যান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ ভাইয়ের মনযোগাতে সেখানে যান ঠিকই কিন্তু রীতিমত বেঁকে বসেন। তিনি মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং স্বহস্তে রান্না করে খেতেন। শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করেন এবং কালী সাধক হয়ে উঠেন।

আরেকটা ঘটনাবলি – একদিন তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় একগাছের তলায় বসে সাধনা করতে বসেছেন। সেই সময় উনার ভাগ্নে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল – “মামা তুমি পৈতে খুলে রেখেছে? অথচ ব্রাহ্মণদের পৈতে খুলে রাখা অনুচিত। “

এর উত্তরে রামকৃষ্ণ ভাগ্নেকে বললেন – “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়’ – এই অভিমানের চিহ্ন এবং একটা পাশ, মাকে ডাকতে হলে ঐ সব ফেলে রেখে একমনে ডাকতে হয়। তাই পৈতে খুলে রেখেছি। ধ্যান করা শেষ হলে ফিরবার পথে আবার পরব।“
এখানে প্রশ্ন থাকে ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড় এটা যদি অভিমানের চিহ্ন এবং পাশ হয় তবে ধ্যান শেষে পৈতে পরবার প্রয়োজন কি? না কি অদৃশ্য ভগবানের কল্পনা করার সময় আমি ব্রাহ্মণ নই সাধারণ মানুষ আর মানব সমাজে ফিরে আসলে “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়” ? তাই মনে হয় আসল কথা।

ছোটবেলা থেকেই রামকৃষ্ণ ছিলেন হিষ্টিরিয়ার রোগী। হঠাৎ হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। আর এই রোগকে পল্লবিত করতে গিয়ে তার শিষ্যরা বলেন তিনি নাকি মাঝে মধ্যে ভাব সমাধিতে চলে যেতেন।

তাছাড়া ছিল উনার হরমোনের সমস্যা যার জন্য উনার মধ্যে পুরুষালি ভাবগুলি কম ছিল।
এই কারণই হয়তো উনাকে বিবাহিত জীবন থেকে ব্যর করেছিল।
এই প্রসঙ্গে স্বরূপানন্দ তার ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী বইতে বলেছেন –
“সাধন-কালে রামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে মথুরবাবুর(রাণী রাসমণির জামাতা) বাড়ীতে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। মেয়েরা রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে কোনরূপ সংকোচ করত না। রামকৃষ্ণ তাদেরই একজন এই বোধ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। বাল্যকাল থেকে যখন কলসি কাঁধে জল নিয়ে বাড়ী ফিরতেন তখন কেউ তাকে পুরুষ বলে বুঝতেই পারতো না।“
এখানেও অন্ধবিশ্বাসী শিষ্যরা উনার মহত্ব বাড়াতে এই হরমোনের সমস্যাকে কালীর ভর বলে এখনও চালায়।

যাইহোক রামকৃষ্ণের লোক দেখানো গরীব দরদ সম্পর্কে একটু দৃষ্টিপাত করি –
তিনি একবার দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ একদিন পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র করুন অবস্থা দেখে কাতর হলেন এবং জমিদার মথুর বাবুকে এই সব দারিদ্র লোকদের অন্ন বস্ত্র দিতে বললেন। মথুর বাবু ইতস্তত করে বললেন।
“এই তীর্থ যাত্রায় অনেক টাকা লাগবে। তাই এদের সাহায্যে করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।“
কিন্তু রামকৃষ্ণ এদের শোচনীয় দু:খ দারিদ্র দেখে কাঁদতে লাগলেন “ছি: ছি:! তুমি কি বলছো? আমি এদের ছেড়ে বারানসিও যেতে চাই না।“ তিনি অবশেষে মথুরবাবুর সঙ্গ ছেড়ে দরিদ্র গ্রামবাসীর সঙ্গে বসলেন। মথুরবাবু শেষে বাধ্য হয়ে কলকাতা থেকে কয়েক গাঁট কাপড় এনে এদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং এদের সকলকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন।

ভেবে দেখুন মায়া কান্না আর কাকে বলে? একবেলা খাওয়ালে আর একবার বস্ত্র বিতরণ করলে যে দরিদ্রের দারিদ্র দূর হয় তাই আশ্চর্যের। বরং তিনি পুরো ভারতের প্রয়োজন নেই এই এলাকার স্থায়ী দারিদ্র দূরীকরণে একটা ব্যবস্থা নিতেন তাহলে উনাকে প্রকৃত গরীব দরদী বলতাম।
আর কাপড় ও খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মথুরবাবুর দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কি? মা কালী যেহেতু উনার সব কথা শুনেন। সেহেতু মা কালীর কাছে দরিদ্র গ্রামবাসীর সমস্যা কথা বললেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
অবশ্য মা-কালির প্রতি তিনি কতটুকু আস্থাশীল ছিলেন তাও সন্দেহ হয়। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন- “সত্যি কি তুই আছিস মা? না, এসবই মনের কল্পনা? তুই আছিস তবে আমি তোকে দেখতে পাই না কেন? তবে এসব কি আকাশ কুসুম? (ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী – স্বরূপানন্দ- পৃ: ৮)

এইবার একবার ভাবুন তো পৃথিবীর সব মানুষ যদি তার কাজ কর্ম ছেড়ে ঈশ্বর সাধনায়
মগ্ন হয়ে যায় তবে সমস্ত পৃথিবীর কি অবস্থা হবে? না থাকবে মানব সমাজ, না থাকবে ঈশ্বর কল্পনা করার কেউ।
কিন্তু রামকৃষ্ণ তো এই আদর্শই প্রচার করতে চেয়েছিলেন। শুধু সংসার ত্যাগ নয় মানুষের সেবামূলক পেশার উপর আঘাত করতে দ্বিধা-বোধ করেন নি।
একটা উদাহরণ দেই – একদিন ঠাকুর তাঁর ভক্তদের কাছে বলছিলেন,”ডাক্তার উকিল ও দালাল এদের ঈশ্বর লাভের পথে এগোন কঠিন।“
বিশেষ করে ডাক্তারদের প্রতি বললেন, “মনটা যদি ঔষধের ফোটায় পড়ে থাকে, তবে কি করে সে অসীম অনন্তকে চিন্তা করবে?“
এটা শুনে রামকৃষ্ণের শিষ্য জনৈক নাগ মহাশয় ডাক্তারি ছাড়তে দৃঢ় সংকল্প হলেন এবং ঔষধের বাক্স বই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন।
বাহ! আদর্শের প্রশংসা না করে পারা যায় না। ডাক্তারির মতো একটা বাস্তব মহত সমাজ সেবামূলক কাজ ছেড়ে যার অস্তিত্ব নেই তাকে খোজার মধ্যেই মহত্ব বেশী তাই না?

আমি প্রথমই বলেছিলাম রামকৃষ্ণ যখন ধর্মীয় ভাবধারা প্রচার শুরু করেন তখন ধর্মবিপ্লব চলছে।
তিনি ব্রাহ্মসমাজের তীব্র বিরুদ্ধি ছিলেন। অথচ ব্রাহ্ম সমাজকে তিনি অতি কৌশলে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে দ্বিধা-বোধ করেন নি।
১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে তার শিশু কন্যার বিয়ে দিলে বাল্যবিবাহ বিরুধী ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেশব চন্দ্রের অনুরাগী তাকে ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে ব্রাহ্মসমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
ব্রাহ্মসমাজ বিরোধী রামকৃষ্ণ সুযোগ বোঝে কেশবচন্দ্রের কার্যের সমর্থনে বললেন –
“জন্ম,মৃত্যু,বিবাহ ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে তাই এতে দোষ কি আছে? কেশব গৃহী, সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে পিতার কর্তব্য পালন করেছে, এতে ধর্মের কোন হানি হয় নি।“
বাহ! কি সুন্দর কথা। বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু সব ভগবানের ইচ্ছা। অথচ উন্নত বিশ্বে আজ বাল্য বিবাহ নাই বলেই চলে, আর জন্ম যদি ভগবানের হাতেই থাকতো তবে আমরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কিভাবে গ্রহণ করছি? নাকি উন্নত বিশ্বের দেশ থেকে ভগবান সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছেন? যাদের ধর্ম-পুরুষ ভেবে জনসাধারণ পূজা করে এরাই প্রগতি বিরুধী সমাজের বড় শত্রু।
ব্রাহ্ম সমাজের বিরুধীতা করতে গিয়ে নারীকে গরু ছাগলের সাথে তুলনা করতে কার্পণ্য করেননি রামকৃষ্ণ।
শিবনাথ শাস্ত্রী রামকৃষ্ণের কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের আদর্শ সম্পর্কে তিনি রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “
স্ত্রী লোকেরা ব্রাহ্মসমাজের সদস্যা ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সামাজিক ও গাহস্থ্য ধর্ম, ব্রাহ্মসমাজ নারীজাতিকে শিক্ষা ও স্বাধীনতা দিতে চায়। সুতরাং কামিনী ত্যাগের কঠোর আদর্শ আমরা বিশ্বাস করি না।“
এর পরিপ্রেক্ষিতে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন – “চারাগাছ নিয়ে মালী কি করে? ছাগল গরু থেকে বাঁচাবার জন্য বেড়া দেই। পরে চারাগাছ যখন বেড়ে ওঠে তখন আর বেড়া দেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনেও আমরা তাই করি।“
শিবনাথ তাতে বলেছিলেন – “আমি আপনার মতো নারী জাতির কাজকে গরু ছাগলের মতো ধ্বংসাত্মক মনে করি না। আমাদের সংগ্রাম ও সামাজিক অগ্রগতিতে তারা সহায় হতে পারে।
রামকৃষ্ণের এক শিষ্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ শ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রী শ্রী মা ও বিবেকানন্দ বইতে তখনকার ধর্ম বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন –
“পরমহংসদেব যখন জগৎ সমক্ষে উদয় হন, তখন ঘোরতর ধর্মবিপ্লব।“
জড়বাদী মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন – “জড় হইতেই সমস্ত,জড়ের সংযোগেই আত্মা, জড় ব্যতীত আর কিছু নাই।“ ব্রাহ্ম সমাজ বলেন – “বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি কিছুই মানিবার আবশ্যক নাই, কোনটিই অভ্রান্ত নয়, কোনটিই ঈশ্বর বাক্য নয়। এমন সময় পরমহংসদেব প্রচার করলেন “কোন ধর্ম কোন ধর্মের বিরোধী নয়। বাহ্য দৃষ্টিতেই বিরোধ কিন্তু সকল।
ধর্মে ধর্মে বিরোধ আছে কি নেই? তা অন্তর্দৃষ্টি বাহ্য দৃষ্টি দুভাবে দেখলেই বোঝা যায়।
যাক এখন প্রশ্ন উঠতে পারে প্রাচীন ভারত থেকে দেখে আসছি নানা সময় নানা যুক্তিবাদী মতবাদ আন্দোলনের আকার নিলেও তা পুরো সফল হতে পারে না। কোন না কোন ঈশ্বর সন্তান নামধারী ব্যক্তি এসে একে প্রতিহত করে দেয়। যেমন প্রাচীন ভারতে শঙ্কর বেদান্তের ভাব জোয়ারে বস্তুবাদ ধ্বংস হয় আর উনবিংশ শতকে ধর্ম-বিদ্রোহ প্রতিহত করে রামকৃষ্ণের ভাব জোয়ারে।
কিন্তু এর কারণ কি? প্রথমত আমার মনে হয় বিভিন্ন সময়ের যুক্তিবাদী আন্দোলনগুলি একটি নির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কাছে রয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে এর সারমর্ম সঠিকভাবে পৌঁছায়নি।

দ্বিতীয়ত আদিযুগ থেকে চলে আসা অলৌকিক চিন্তাধারাগুলি বংশ পরম্পরায় আমাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে রয়ে গেছে তাই একটু অলৌকিকতার সুড়সুড়ি পেলেই যুক্তির ধার না ধরেই জনশ্রুত সেই অলৌকিকতার নামধারী ব্যক্তিদের দিকেই ছুটতে থাকে। তবে আজ সময় এসেছে এটা ভেবে দেখার আমরা একটা সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিয়ে নিজের যুক্তি বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাব নাকি অলৌকিকতার ধ্বজাধারীদের আদর্শ মেনে অন্ধ থেকে যাব। 

১৮৮৫ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতার সেরা চিকিত্সকের পরামর্শের জন্য তার শিষ্যগণ রামকৃষ্ণকে শ্যামপুকুরে এক ভক্তের বাড়িতে স্থানান্তরিত করেছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে এবং কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। তার অবস্থা দিনের পর দিন আরও অবনতি ঘটে এবং অবশেষে ১৮৮৬ সালে ১৬ আগস্ট কাশীপুরে বাগান বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সেকুলার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের যুক্তি খন্ডন।

আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল – এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক, দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে, একঘাটের লোক বলছে জল, আর একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর একঘাটের লোক বলছে পানি, হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক। মত-পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।।।
রামকৃষ্ণ দেব এই অধমকে ক্ষমা করবেন, আমি আপনার কথার সাথে একমত হতে পারলাম না। কারণ কারো ধর্ম যদি হয় অংশীবাদীদের হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুট করা, অন্য সম্প্রদায়ের নারী দের যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহার করা; অন্য সম্প্রদায়ের আবাসভূমি এবং উপাসনালয় ধ্বংস করা। তবে সেই ধর্ম কে ঠিক, যাথার্থ্য মনে করার জন্য; আপনার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন দিব্যজ্ঞান আমার নাই।
আপনি বলেছেনঃ আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল – এ মত ভাল না। তাহলে তো আল্লাহ নিজে বলেছেনঃ আল্লাহ্ নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযোগ্য হবে না।(৩:১৯, ৩:৮৫) তবে আপনি কেন আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল- এ মত ভাল না বলে ভাঁওতাবাজি করছেন? এটাকে আপনি বা আপনার অন্ধ ভক্তরা কি বলবে?
আরো বলেছেনঃ ঈশ্বর এক, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে শিব। যদি তাই হয় তবে আল্লাহ নিজে বলেছেনঃ আল্লাহ্ সাথে কাউকে শরীক না করার জন্য, অংশীদার না করার জন্য।(৪:৩৬) যদি কেউ আল্লার সাথে অংশীদারি করে তবে সে জাহান্নামে যাবে।(৫:৭২) তবে আপনি কেন আল্লাহ্ সাথে শরীক করছেন? অংশীস্থাপন করছেন?
রামকৃষ্ণদেব আপনি যথার্থ বলেছেন "ঈশ্বর এক, দুই নাই" পবিত্র বেদ আমাদের কে সেটাই বলে- এক সত্তা পরব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎমান, যম, মাতরিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন।(ঋগ্বেদ. ১/১৬৪/৪৬।) কিন্তু বেদ এবং আমাদের ঋষি প্রদত্ত কোন বৈদিক গ্রন্থে আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই।
আবার বলেছেনঃ তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। দেখুন! সূর্য কে ভিন্ন ভিন্ন লোক ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকতে পারে যেমন রবি, সবিতা, দিবাকর, আদিত্য, প্রভাকর ইত্যাদি কারণ এগুলো সূর্যের বিভিন্ন নাম। কিন্তু কোন বিজ্ঞ লোক সূর্য কে কখনো জল, বারি, অশ্ব, ঘোটক নামে ডাকবে না; কারণ জল, বারি, অশ্ব আর সূর্য একই বস্তু নয়। একি ভাবে বেদে ঈশ্বরের অনেক নাম আছে কিন্তু আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই, কোথাও বলা হয়নি ঈশ্বরের আর এক নাম আল্লাহ, গড। তাই যিনি যথার্থ জ্ঞানী তিনি কখনো পরমাত্মাকে আল্লাহ, গড, নামে কখনো ডাকবেন না। কারণ আবার বলছি পরমাত্মার অনেক নামের মধ্যে আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই।
আপনি আমার মত অধম কে বুঝানোর জন্য, উদাহারণ দিয়ে বলেছেন “হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক”। হ্যাঁ! জল, পানি, ওয়াটার এর বৈশিষ্ট্য এক, কোন পার্থক্য নাই তাই একই বস্তু; কিন্তু আল্লাহ, গড, ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য তো এক নয়! পার্থক্য বিদ্যমান। তাহলে আল্লাহ, গড, ঈশ্বর একই সত্তা হয় কিভাবে??? এক জন হয় কিভাবে??? সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে পানি এবং এসিড কে একই বস্তু বলে মনে হতে পারে কারণ পানিও তরল এসিডও তরল অবস্থায় থাকে। কিন্তু এসিড আর পানির পার্থক্য না বুঝে এসিড কে পানি মনে করে পান করলে মৃত্যু নিশ্চিত।
নদী নানাদিক ধরে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয় কিন্তু নদী পথ ধরে যেমন কখনো চন্দ্রে পৌছাতে পারে না। নদী পথ ধরে সাগরে পৌছানো যায় আর চন্দ্রে পৌছাতে হলে আকাশ পথে যেতে হয়। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথের অনুসরণ করতে হয়। সেরকম অংশীবাদীদের হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুট করা; অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী দের যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহার করা; অন্য সম্প্রদায়ের আবাসভূমি এবং উপাসনালয় ধ্বংস করার জন্য যে মতবাদ নির্দেশ দেয় এরুপ ঘৃণ্য মতবাদ বা পথ অনুসরন করে কখনো পরমাত্মার সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। সকল মত পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায় এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।।

তন্ত্র সাধনা যা অত্যন্ত অশ্লীল এখানে সাধনার নামে "ভৈরবোহহম্ শিবোহম্' ইত্যাদি বলে নরকপালে মদ্যপান করে তান্ত্রিকদের রচিত সংস্কৃত মন্ত্র(শ্লোক) যা কতটা অশ্লীলতায় ভরা নিজেরা দেখুন-" অহং ভৈরবত্বং ভৈরবীহ্যাবরোরম্ভ সঙ্গম"। অন্য কেই যাতে না বুঃতে পারে এ জন্য এরা মদের নাম দেয় "তীর্থ", মাংসের নাম "শুদ্ধি", মৎসের নাম " জল তুম্বিকা", মৈথুনের নাম "পঞ্চমী", অঘোরীরা মূত্রবিষ্ঠাও ভক্ষণ করে নাম দেয় "অজরী বজরী ক্রিয়া"। এভাবে এদের সিদ্ধিলাভ হয়। গদাধর এই তন্ত্রসাধনা করেছিলেন[শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ]। তিনি এই সাধনা কে একটি জ্ঞানমার্গ বলে উল্লেখ করেন। আরো কত কিছু ওনার টাইম লাইন থেকে পডুন, সেখানে দেখবেন তিনি বজরংবলী, ভগবান পুরুষোত্তম রামচন্দ্র, সীতা দেবী সবাইকে দেখেছেন, যীশু কে দেখেছন।
দূর্জন তোষণের জন্য যদি সব কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া হয় তাহলেও প্রশ্ন ওঠে ১৮৫৬ সালে তিনি যদি ব্রহ্মরুপী পরমেশ্বর কালীর দর্শন করেন মানবী রূপে, তার পরেও তিনি কার সাধনা করছিলেন..??
time line:-
১৮৫৫ সালে কলকাতায় রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।(Amiya P. Sen, "Sri Ramakrishna, the Kathamrita and the Calcutta middle Classes: an old problematic revisited" Postcolonial Studies, 9: 2 p 176) ১৮৫৬ সালে গদাধর পাকাপক্ত ভাবে পৌরহিত্য করেন।(Isherwood, Christopher (১৯৭৪)। Ramakrishna and his Disciples। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা pp. 55–57) ১৮৫৬ সালে তিনি দাবী করেন পাষাণপ্রতিমা জীবন্ত হয়ে অন্নগ্রহণ করে, কালীর দর্শন করেন।(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম ভাগ, পূর্বকথা ও বাল্যজীবন, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৬৫) ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ।(Sil, Divine Dowager, p. 42) ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। *কালীদর্শন ও বিবাহে মধ্যবর্তী সময়ে কিছুকালের জন্য তিনি হনুমানভাবে ভাবিত হয়ে রামচন্দ্রের আরাধনা করেন। এই সময় তিনি রামের পত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান এবং সীতার সেই মূর্তি তার নিজদেহে অন্তর্হিত হতে দেখেন।( Isherwood, p. 70–73) ১৮৬৭ সালের মে মাসে পুনরায় সারদা দেবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। ১৮৬১ সালে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর (যোগেশ্বরী) পথনির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করেন। ভৈরবীর সহায়তায় তিনি তন্ত্রোল্লেখিত ৬৪ প্রকার প্রধান সাধন অভ্যাস করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বামাচারকে একটি জ্ঞানমার্গ বলে উল্লেখ করেন।( Isherwood, p. 76) ১৮৬৩ সাল নাগাদ তার তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হয়। যোগেশ্বরী প্রথম সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করেন।( The Life of Ramakrishna। পৃষ্ঠা pp.22–37) ১৮৬৪ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন তিনি ধাতুমূর্তিতেই জীবন্ত বালক রামচন্দ্রকে চাক্ষুষ করতেন।(Isherwood, p. 197–198.) ১৮৬৪ সালেই তিনি চৈতন্য ও নিত্যানন্দের নৃত্যরত বালককে তার দেহে অন্তলীন হতে দেখেছিলেন। ১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর / উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।(The Gospel of Ramakrishna, capter-1) শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী, এরপর তিনি দেবী কালীর নিকট থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন - “তুই ভাবমুখে থাক” (অর্থাৎ, সমাধি ও সাধারণ অবস্থার মুখে অবস্থান করে লোকশিক্ষা দান কর।)-(Isherwood, Christopher। "Tota Puri"। Ramakrishna and his Disciples। পৃষ্ঠা p.123) ১৮৭৩ সালের শেষভাগ যিশু খ্রিস্টের চিত্রে তিনি জীবন্ত যিশুর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। যিশুর চিত্রে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।("Lay Disciples of Ramakrishna") ১৮৭৬ সাল নাগাদ সারদা দেবী স্বামীগৃহে ফিরে আসেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সময় ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। এই পূজায় তিনি সারদা দেবীকে দিব্য মাতৃকাজ্ঞানে পূজা নিবেদন করেছিলেন।( "The Return to Man"। The Life of Ramakrishna। পৃষ্ঠা p.59)

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী ১৮৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কোলকাতায় আসেন এবং ১৮৭৩ সালের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি কোলকাতায় ছিলেন।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত অনুযায়ী ১৮৮৪ সালের ২৬শে অক্টোবর গদাধর ওরফে রামকৃষ্ণ জীর সাথে মহর্ষি দয়ানন্দ জী দেখা করেছিলেন!
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামী ১৮৮৩ সালের অক্টোবর মাসে মৃত্যুবরণ করেন !

সাম্প্রদায়িক প্রচার-বিভ্রাটের মধ্য থেকে বিচার করে, রামকৃষ্ণের জীবনী পড়লে জানা যায়, বাল্যকাল হতেই তাঁর পূর্ব পূর্ব জন্মাচ্ছিত তপস্যার ফলে তাঁর মধ্যে চৈতন্য শক্তির স্ফূরণ হ’তো, তাঁর ভাব সমাধির মত একটা কিছু হ'ত। তারপর তার দাদা যখন রাসমণির পুরোহিতরূপে দক্ষিণেশ্বরে এলেন, তিনিও এলেন তাঁর সঙ্গে; এখানে গঙ্গার তীরে, স্নিগ্ধশান্ত অনুকূল পরিবেশে তাঁর মধ্যে যে লুপ্ত ভাবধারাগুলি ছিলো, তার উদ্দীপন হ'ল। এ তিনি দক্ষিণেশ্বরে না এসে কামারপুকুরে বসে থাকলেও হ'ত, কালীমূর্তির বদলে বর্তী দেবীর মূর্ত্তি হলেও হ'ত, না হলেও হ'ত। মুর্ত্তির ওখানে কোন Speciality নেই! তবে জন্মার্জিত সংস্কারানুযায়ী ঈশ্বরকে তিমি রামপ্রসাদের মতই মা বলে ডাকতে ভালবাসতেন। তিনি গঙ্গার তীরে, কখনও বা পঞ্চবটিতে ‘মা মা বলে উতলা হ'য়ে পড়তেন, এবং তাঁর মাকে পাওয়ার জন্য যে যেমন বলেছে সিদ্ধিলাভের উপায় হিসাবে কুসংস্কার বশে পূর্বোল্লিখিত ‘ছেলেমানুষি' করে সময় কাটিয়েছেন! একটার পর একটা গুরুবরনেও তাঁর বিরাম ছিল না, একটার পর একটা অভিনব কিভূত কিমাকার সাধন পদ্ধতি Practice করতেও তাঁর ক্লান্তি ছিলো না !! এ সবের মধ্যে তার যে Sincerity এবং urge প্রকাশ পেত পরমার্থ লাভের জন্য তা appreciate করি। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার কোন তত্ত্বজ্ঞ গুরু লাভ না হওয়ায়, সচ্চিদানন্দ পরমেশ্বর কি বঙ কি ভাবে তাকে পাওয়া যায়, বেদ বেদান্তে সত্যলাভের কিরূপ পথ নির্দেশ আছে, সে সব

নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুই জানতে পারেন নি। শিশুকাল হ'তেই হিন্দু ঘরের ছেলে মেয়েরা লক্ষ্মীমূর্তি, কৃষ্ণমূর্তি, কালীমূর্ত্তির চরণতলে ফুল দেওয়া, প্রণাম করা শেখে, ঐ মূৰ্ত্তিকে ভগবান বলে ভারতে অভ্যস্ত হয়; পরে বড় হয়েও Subliminal Conscious imprinted সংস্কারাহযায়ী, যেমন আজকাল জ্ঞানীগুণী বুড়োরাও করে, তেমনি যে যার মনোমত রুচিমত, কালী কৃষ্ণ শিব দুর্গ। যাই হোক একটা মূর্তিকেই ঈশ্বর বলে ভেবে অন্ধ সংস্কার বশে পূজা করে চলে। একটি নক্‌সার মধ্যে যেমন কোন স্থানের কোন গুপ্তধন পাওয়ার ইঙ্গিত থাকে, সংকেত থাকে, তেমনি একটি মূর্ত্তির রং, বেশভূষা বিচিত্র্য আকৃতির মধ্যে, ঋষিরা যে কোন নিগূঢ় তত্ত্বের কী নিগুঢ় সংকেত রেখে গেছেন, তা না জেনে অধ্যাত্মরাজ্যের শিশুরা বুখাই একটা হুড়মুর্তির চরণতলে ফুল চ চড়িয়ে কেঁদে আকুল হয় আর ভাবে অধ্যাম্ব পথে সে এগুচ্ছে।

রামকৃষ্ণও ঐ রকম এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মে শিশুকাল হ'তেই ঐ কালী শিবমুর্তিকে পরমেশ্বর জ্ঞান করতে শিখেছিলেন। একদিকে জন্মান্তরীন সাধন সংস্কার আর অন্যদিকে নিজের মূর্ধতাসহ একটি গোঁড়া হিন্দু পরিবারের শিক্ষানুযায়ী কুসংস্কার—এই উভয়ের সংঘাত তাঁর প্রাণে খুব অন্তদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল; একদিকে ঈশ্বরবিরহ, পরমার্থ লাভের আকুলতা, অন্যদিকে শুড়মুর্তির কাছে কেঁধে কেঁদেও কোন সাড়া না পাওয়া—এই সংঘাতমুখর যন্ত্রণা তাকে খুব ব্যথা দিত। গঙ্গার তীরে, কখনও বা পঞ্চবটিতে তিনি 'মা মা' রবে কেঁদে কেঁদে আকুল হতেন। দুই হাত দিয়ে বুকট। চেপে ধরে অনেক সময় মাটিতে গোড়ালুট দিতে দিতে তিনি বলতেন, 'ওরে জ্বধে, বুকের ভিতরটা আমার গামছা নিংড়ানোর মত যন্ত্রণা হচ্ছে। যখন যেমন ধরণের সাধু পেয়েছেন, তাঁরই কাছে দীক্ষা নিয়ে, প্রয়োবর্ষপাতের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছেন। এই সময় এলেন তান্ত্রিক সাধিকা ভৈরবী ব্রাহ্মণা। তিনি তাঁকে তন্ত্র সাধনার নামে অনেক অন্য ক্রিয়াকলাপ করালেন। তাঁর ঐ সব সাধন-পৰ্ব্বও সমাধা হয়েছিল পঞ্চবটির ধ্যানগম্ভীর পরিবেশে-ভবতারিণী কালীমুদ্ধির চরণতলে বিশ্ববাদল চড়িয়ে বা কাংলঘণ্টা আরতি বাজনার মধ্য দিয়ে নয়। ঐ সকলের ভিতর দিয়ে যতই সময় অতিবাহিত হতে লাগলো, তাঁর আকুলতা, অন্তরের আবেগও দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হতে হতে, গভীরতর ধামের তার অবস্থায় অনাহত চক্রের Presiding Diety কালীদর্শন তার হয়েছিলো। সূক্ষ্ম জগতের ঐ কালীদর্শনও তার হয়েছিলো, পঞ্চবটির ‘বুনো গাছ গাছড়াময়' নির্জন নিঃস্তব্ধ অন্ধকারময় পঞ্চবটিতে ধ্যান করে করে, তোমাদের ঐ প্রস্তরমরী কালীমূর্ত্তি পুজা করে নয়। স্বামী সারদানন্দ ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে' পঞ্চবটিতে তাঁর ধ্যান সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছেন, নিত্য নিয়মিত ভাবে গভীর রাত্রে ঐ পঞ্চবটিতে রামকৃষ্ণ ধ্যান করতে যেতেন বলে, পেছনে অনুসরণ করে হৃদয় ‘ঢিল ছুঁড়ে নানা ভাবে তাঁকে ভয় দেখিয়েও প্রতিনিবৃত্ত করতে পারতেন না- “একদিন ঠাকুর বৃক্ষতলে যাইবার কিছুক্ষণ পরে নিঃশব্দে জঙ্গল মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া (হৃদয়) দেখিল, তিনি পরিধেয় বজ্র ও যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করিয়া সুখাসীন হইয়া ধ্যানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। দেখিয়া ভাবিল 'মামা কি পাগল হইল নাকি ? ..... সম্বোধ করিয়া বলিতে লাগিল, ‘একি হচ্ছে? পৈতে, কাপড় ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে বসেছ যে?' কয়েকবার ডাকাডাবির পরে ঠাকুরের চৈতন্য হইল এবং বলিলেন, 'তুই কি জানিস ? এইরূপে পাশযুক্ত হয়ে ধ্যান করতে হয় ; জন্মাবধি মানুষ ঘৃণা, লজ্জা কুলশীল, ভয়, মান, জাতি ও অভিমান এই অষ্টপাশে বন্ধ হয়ে রয়েছে, পৈতে গাছটাও 'আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড় এই অভিমানের চিহ্ণ এবং একটা পাশ; মাকে ডাকতে হ'লে ঐ পাশ ফেলে দিয়ে এক মনে ডাকতে হয়, তাই ঐ সব খুলে রেখেছি; ধ্যান করা শেষ হলে ফিরবার সময় আবার পর্ষ” [ ঐ সাধকভাব ২য় খণ্ড, ১০৩-১০৪ পৃঃ ]

রামকৃষ্ণের লীলা
                                                   
 কালী দর্শনের পর ব্রহ্মদীক্ষা লাভ





রামকৃষ্ণের জীবন বৃত্তান্ত


কাল্পনিক ছায়ার পেছনে ছুটছ ! তাঁর সেই প্রত্যক্ষ দেবতারই উপাসনা কর এবং আর সব প্রতিমা ভেঙ্গে ফেল।[ঐ, ২৪৭ পৃষ্ঠা]


গদাধরের লীলা

পারে এ অস্বীকার করার জো নেই।
ধরুন আপনার পাড়ার রামবাবু একজন অতি সাধারণ লোক। আর পাঁচজন অতি সাধারণ লোকের মতই খাচ্ছেন, ঘুরছেন, অফিস করছেন, সংসার করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এতক্ষেণ আলোচনায় যা নিয়ে একটিও কথা বলা হয়নি তা হল রাণীর "জাত"। এই ব্যাপারটিকে খুব গভীর ভাবে বুঝতে হবে, করাণ এই জাতপাত ব্যবস্থার মধ্যেই লুকিয় আছে রামকৃষ্ণায়ণের মূল গোপন সূত্রটি।
রামকৃষ্ণের লীলা
দাস-দাসীর সংখ্যা কম নয়, তারা যখন রাণীর শ্বপ্নাদেশের কথা জেনেছে রাষ্ট্র হতে খুব বেশী সময় লাগবে না। প্রশ্ন হতে পারে রাণী দাস-দাসীদের দিয়ে তার স্বপ্নের কথা
রাজী হবে।

গদাধরের লীলা
রামকৃষ্ণের জীবন বৃত্তান্ত

শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
রামকৃষ্ণের লীলা
রামকৃষ্ণের লীলা
গদাধরের লীলা
সেকুলার রামকৃষ্ণ
আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল – এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক, দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে, একঘাটের লোক বলছে জল, আর একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর একঘাটের লোক বলছে পানি, হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক। মত-পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।-রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব!!!
রামকৃষ্ণ দেব এই অধমকে ক্ষমা করবেন, আমি আপনার কথার সাথে একমত হতে পারলাম না। কারণ কারো ধর্ম যদি হয় অংশীবাদীদের হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুট করা, অন্য সম্প্রদায়ের নারী দের যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহার করা; অন্য সম্প্রদায়ের আবাসভূমি এবং উপাসনালয় ধ্বংস করা। তবে সেই ধর্ম কে ঠিক, যাথার্থ্য মনে করার জন্য; আপনার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন দিব্যজ্ঞান আমার নাই।
আপনি বলেছেনঃ আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল – এ মত ভাল না। তাহলে তো আল্লাহ নিজে বলেছেনঃ আল্লাহ্ নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযোগ্য হবে না।(৩:১৯, ৩:৮৫) তবে আপনি কেন আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল- এ মত ভাল না বলে ভাঁওতাবাজি করছেন? এটাকে আপনি বা আপনার অন্ধ ভক্তরা কি বলবে?
আরো বলেছেনঃ ঈশ্বর এক, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে শিব। যদি তাই হয় তবে আল্লাহ নিজে বলেছেনঃ আল্লাহ্ সাথে কাউকে শরীক না করার জন্য, অংশীদার না করার জন্য।(৪:৩৬) যদি কেউ আল্লার সাথে অংশীদারি করে তবে সে জাহান্নামে যাবে।(৫:৭২) তবে আপনি কেন আল্লাহ্ সাথে শরীক করছেন? অংশীস্থাপন করছেন?
রামকৃষ্ণদেব আপনি যথার্থ বলেছেন "ঈশ্বর এক, দুই নাই" পবিত্র বেদ আমাদের কে সেটাই বলে- এক সত্তা পরব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎমান, যম, মাতরিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন।(ঋগ্বেদ. ১/১৬৪/৪৬।) কিন্তু বেদ এবং আমাদের ঋষি প্রদত্ত কোন বৈদিক গ্রন্থে আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই।
আবার বলেছেনঃ তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। দেখুন! সূর্য কে ভিন্ন ভিন্ন লোক ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকতে পারে যেমন রবি, সবিতা, দিবাকর, আদিত্য, প্রভাকর ইত্যাদি কারণ এগুলো সূর্যের বিভিন্ন নাম। কিন্তু কোন বিজ্ঞ লোক সূর্য কে কখনো জল, বারি, অশ্ব, ঘোটক নামে ডাকবে না; কারণ জল, বারি, অশ্ব আর সূর্য একই বস্তু নয়। একি ভাবে বেদে ঈশ্বরের অনেক নাম আছে কিন্তু আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই, কোথাও বলা হয়নি ঈশ্বরের আর এক নাম আল্লাহ, গড। তাই যিনি যথার্থ জ্ঞানী তিনি কখনো পরমাত্মাকে আল্লাহ, গড, নামে কখনো ডাকবেন না। কারণ আবার বলছি পরমাত্মার অনেক নামের মধ্যে আল্লাহ, গড নাম কোথাও নাই।
আপনি আমার মত অধম কে বুঝানোর জন্য, উদাহারণ দিয়ে বলেছেন “হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক”। হ্যাঁ! জল, পানি, ওয়াটার এর বৈশিষ্ট্য এক, কোন পার্থক্য নাই তাই একই বস্তু; কিন্তু আল্লাহ, গড, ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য তো এক নয়! পার্থক্য বিদ্যমান। তাহলে আল্লাহ, গড, ঈশ্বর একই সত্তা হয় কিভাবে??? এক জন হয় কিভাবে??? সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে পানি এবং এসিড কে একই বস্তু বলে মনে হতে পারে কারণ পানিও তরল এসিডও তরল অবস্থায় থাকে। কিন্তু এসিড আর পানির পার্থক্য না বুঝে এসিড কে পানি মনে করে পান করলে মৃত্যু নিশ্চিত।
নদী নানাদিক ধরে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয় কিন্তু নদী পথ ধরে যেমন কখনো চন্দ্রে পৌছাতে পারে না। নদী পথ ধরে সাগরে পৌছানো যায় আর চন্দ্রে পৌছাতে হলে আকাশ পথে যেতে হয়। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে পৌছানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথের অনুসরণ করতে হয়। সেরকম অংশীবাদীদের হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুট করা; অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী দের যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহার করা; অন্য সম্প্রদায়ের আবাসভূমি এবং উপাসনালয় ধ্বংস করার জন্য যে মতবাদ নির্দেশ দেয় এরুপ ঘৃণ্য মতবাদ বা পথ অনুসরন করে কখনো পরমাত্মার সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। সকল মত পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায় এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।।
রামকৃষ্ণদেব বলিতেন ," জন্মগত দ্বিজাতি (উঁচু জাত) নহে , এমন ভক্ত মুখে পরব্রহ্ম বাচক প্রণব উচ্চারণ শুনিলেই কে যেন কানে ছুঁচ ফুটিয়ে দেয়।" তাই কোন কায়স্থ ভক্তকে কহেন, " নামী কিনা ভগবান সঙ্গে অভেদ এমন যে, তার নাম জপ করলে সর্বার্থ সিদ্ধ হয় , তখন প্রণবটা না বল্লে আর তোমার ধর্ম হবে না "?' (শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত, পৃষ্ঠা - ১৩৭)।
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল ঐ গ্রন্থের অন্যত্র বলছেন ,' আর একদিন ঠাকুর কহেন ," শূদ্র মুখে প্রণব উচ্চারণ শুনলে কানে যেন ছুঁচ ফুটিয়ে দেয় ; ভগবানের অসংখ্য নামের একটিতে রতি হলে সর্বার্থ সিদ্ধি হয়। তখন প্রণব উচ্চারণের কি আবশ্যিক" ?' (ঐ, পৃ - ৩৩৪)। দেখুন ঠাকুর কি বলছেন , জন্মসূত্রে যে উচ্চবর্ণ নয় তার মুখে প্রণব মন্ত্র তিনি শুনতে চান না।
একটি পুরনো দিনের ঘটনা -- বৃন্দাবন ভ্ৰমন প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, " বৃন্দাবনে গিয়ে আর আমার ফিরে আসতে ইচ্ছে হল না। গঙ্গামার কাছে থাকবার কথা হলো। সব ঠিকঠাক। এদিকে আমার বিছানা হবে, ওদিকে গঙ্গামার বিছানা হবে, আর কলকাতায় যাব না, কৈবর্তের ভাত কতদিন খাব ?"( কথামৃত , রিফ্লেক্ট , অখন্ড সং . পৃ - ৩৩৬)। এরপর আছে মাতৃভক্তি , মায়ের টানে কলকাতায় ফিরে আসা।
কিন্তু ফিরলেই তো হবে না, আমরা তার মনের কথাটা শুনে নিয়েছি। কে এক গঙ্গামা, যাকে তিনি চিনেছেন দু দিন আগে, মথুরবাবুর এত দিনের আতিথেয়তা জাতপাতের জোয়ারে মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি বৃন্দাবনেই থেকে যাবেন।
নীচু জাত উদ্ধার তো হলো না।
(গ্রন্থসূত্র : শ্রীরামকৃষ্ণ-কিছু অজানা প্রসঙ্গ।লেখক-সুনীত দে)
তথ্যসূত্র:-
রামকৃষ্ণের জীবন বৃত্তান্ত
শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
রামকৃষ্ণ চরিত- গুরুদাস বর্মণ
রামকৃষ্ণ পুঁথি
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম খণ্ড, সাধকভাব, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৬৭-৬৮
 "Tota Puri"। Ramakrishna and His Disciples। পৃষ্ঠা p.116।
Râmakrishna his Life and Sayings। পৃষ্ঠা pp.52–53।
A Comparative Study of Religions। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা pp.198–199।
 Isherwood, Christopher (১৯৭৪)। Ramakrishna and his Disciples। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা p. 66–70।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ, ১৯৮৬-৮৭, পৃষ্ঠা ১০৮৫
Râmakrishna his Life and Sayings। পৃষ্ঠা pp.43–44।

শ্রীরামকৃষ্ণের চরিত্র বিশ্লেষণ:
শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক অশিক্ষিত, মূলতঃ মানসিক বিকারগ্রস্ত এক সাধক, যাকে নিয়ে ভারতবাসীরা এখনো যার পর নাই গর্বিত। এই প্রায়-অর্ধোন্মাদ সাধক বলতেন তিনি সাধনায় মা কালীর সাথে এক্কা দোক্কা খেলেন; সাধনা করতে করতে প্রায়ই মূর্ছা যেতেন তিনি। আজকের দিন হলে তাকে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে হিস্টিরিয়ার চিকিৎসা করা হত নিঃসন্দেহে। তার আধ্যাত্মিকতা কিংবা অসুস্থতা – কোনটা নিয়েই আমার অবশ্য কোন আগ্রহ নেই।
তিনি হ্যালুসিনেশনে ভুগতেন।হ্যালোসিনেশন হল, বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়াই মস্তিস্কে বাস্তবের মত অনুভূতি প্রত্যক্ষণের প্রক্রিয়া। হ্যালোসিনেশন একদম স্পষ্ট ও বাস্তবসদৃশ স্থায়ী হয়ে থাকে। তাছাড়া হ্যালোসিনেশন বাস্তব জগতের স্থানও দখল করে। তবে হ্যালোসিনেশনকে বাস্তব জীবনে আমাদের পরিচিত ঘটনাগুলো থেকে আলাদা করা হয়ে থাকে। যেমন, ঘুম আর হ্যালোসিনেশন এক নয়। কারণ ঘুমের সাথে জেগে থাকার সম্পর্ক নেই। আবার সিউডো হ্যালেসিনেশন আর আমাদের আলোচ্য হ্যালেসিনেশনও এক নয়। কেননা, সিউডো হ্যালেসিনেশন বাস্তব অনুভূতির হুবুহু প্রতিচ্ছবি তৈরি করে না এবং এটি অবাস্তব কল্পনা হিসেবে গৃহীত হয়। অনুরূপ, ইলিউশন(মায়াচ্ছন্নতা) আর হ্যালেসিনেশনও এক নয়। যেহেতু ইলিউশনের ক্ষেত্রে বাস্তব জগত অনেকটা বিকৃত দেখা যায়। ইমেজারিও(কল্পনা) হ্যালেসিনেশন থেকে আলাদা। কারণ ইমেজারিও বাস্তব অনুভূতির হুবুহু অনুকরণ করে না এবং এটি ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়।তাছাড়া হ্যালোসিনেশন ডিলিউশন(অলীক বিশ্বাস) থেকেও ভিন্ন। ডিলিউশনে বাস্তব জগতের উদ্দীপক থাকে এবং অনুভূতিও একদম বাস্তব হয়। বাস্তব উদ্দীপক ও এর থেকে প্রাপ্ত অনুভূতি থেকেই বাড়তি (সাধারণত উদ্ভট) কিছু ব্যক্তির মাথায় ঢুকে যায়।হ্যালোসিনেশন বিভিন্নরূপে প্রকাশ পেতে পারে।ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন তথা দৃষ্টির হ্যালোসিশেন হল, "বাইরের কোনো উদ্দীপক ছাড়াই দর্শন অনুভূতি প্রত্যক্ষণ করার প্রক্রিয়া"।হ্যালোসিনেশনে বিভিন্ন ধরণের।তার মধ্যে ভিজুয়াল ইলিউশন হল, বাহ্যিক উদ্দীপক হতে প্রাপ্ত বাস্তব অনুভূতির বিকৃতরূপ ধারণ। সুতরাং, এদুটোকে এক মনে করা যাবে না।ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন সাধারণ ও জটিল এই দুভাগে বিভক্ত।সাধারণ ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন(SVH)-কে প্রাথমিক বা অগঠিত ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশনও বলা হয়। এ ধরনের হ্যালোসিনেশন আলো, রং, জ্যামিতিক আকৃতি এবং অবিভক্ত বস্তু প্রভৃতির ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। একেও দুভাগে ভাগ করা যায়- ১. ফসফেন (কাঠামোবিহীন SVH) ২. ফটোপসেইস(জ্যামিতিক কাঠামোসহ SVH)কম্পেক্স বা জটিল ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন(CVH)-কে সুগঠিত ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশনও বলা হয়। এ ধরনের হ্যালোসিশেন পরিষ্কার এবং মানুষ, প্রাণী, বস্তু, স্থান প্রভৃতির প্রাণবন্ত দৃশ্য বা ছবির মত হয়।উদাহরণস্বরূপ, কারো যদি হ্যালোসিনেশনের মাধ্যমে একটা জিরাফ দেখার ঘটনা ঘটে। তাহলে সাধারণ ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন হলে সে কেবল এমন একট আকৃতি দেখবে যেটা অনেকটা জিরাফের মত দেখতে। আর জটিল ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন হলে সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে যে, ওটা একদম বাস্তব জীবন্ত একটা জিরাফ ছিল।শ্রীরামকৃষ্ণের ভিজুয়াল হ্যালোসিনেশন হত। শ্রীরামকৃষ্ণেরও মনে হত, তিনি মা কালীর দর্শন লাভ করতেন।আসলে এটার কারণ ছিল তার মানসিক অসুস্থতা ।
রামকৃষ্ণকে যেভাবে দয়ালু সবধর্মে বিশ্বাসী বলে সর্বস্তরে প্রচার করা হয়। আসলে তিনি কতটুকু দয়ালু ছিলেন যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে।
উনার জীবনী পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি ছিলেন চরম বর্ণ বিদ্বেষী, ব্রাহ্মণ্যবাদী। দু একটা ঘটনা দিয়ে উদাহরণ দেই –
শ্রীরামকৃষ্ণ জাতিভেদ মানতেন না এমন গল্প শোনা যায়।কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে।জাতিভেদ না মানার প্রমাণ হিসাবে নীচ জাতি কামার বউকে ভিক্ষেমা হিসাবে দেখানো হয়।প্রতিবেশী নিঃসন্তান ধনী কামার বউ গদাধরকে ছোট থেকে স্নেহ করতেন ও কোলে পিঠে মানুষ করেছেন।তাই বালক গদাধর কামার বউয়ের স্নেহের টানে বাধা পড়েছিলেন।বালক গদাধরের জেদের জন্য বাধ্য হয়ে ক্ষুদিরাম ধনী কামার বউকে গদাধরের ভিক্ষে মা করেন।(শ্রীরামকৃষ্ণঃকিছু অজানা প্রসঙ্গ-সুনীত দে-পৃঃ৪৫)
বালক গদাধরের তখন কিন্তু জাতপাতের কোন জ্ঞান হয় নি।অর্থাৎ ধনী কামার বউকে ভিক্ষে মা প্রমাণ করে না যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব জাতপাত মানতেন না।
বাল্যাবস্থায় কামার বউকে মা বললেও পরে কিন্তু কামারের গন্ধ পেয়েছেন।
তাঁর কথায়-“আমার কামার বাড়ীর দাল খেতে ইচ্ছেছিলো;ছোট বেলা থেকে কামাররা বলতো বামুনেরা কি রাঁধতে জানে ? তাই(ধনীর বাড়ী) খেলুম,কিন্তু কামার কামার গন্ধ।”
(পৃষ্ঠা ১৩২, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত দ্বিতীয় খণ্ড, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়)।
আগে গন্ধ পান নি বয়স কম থাকায়।এখন জাতের গন্ধ পাচ্ছেন।
জমিদার মনি মল্লিকের বাড়ীতে খেয়ে বলেন-“মনি মল্লিকের বরানগর বাগানে ব্যঞ্জন রান্না খেলুম কিন্তু কেমন একটা ঘেন্না হল”।(ঐ পৃঃ-১৩২)
ব্রাহ্মণের বাড়িতে অন্ন গ্রহণে তাঁর কোন দ্বিধা ছিলো না।কোন গন্ধ লাগতো না বা ঘেন্না করতেন না।
রামকৃষ্ণ ছিলেন দারিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। চরম দারিদ্র্যের কারণে তার ভাই রামকুমার দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাণী রাসমণি ছিলেন তথাকথিত শূদ্র বংশের। ভাইয়ের শূদ্রের মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার তীব্র বিরুধী ছিলেন রামকৃষ্ণ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি রামকুমারকে বলেছিলেন – “আমার পিতা ও পূর্বপুরুষরা কেউ শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করেনি, এই মন্দিরে পৌরহিত্য গ্রহণ করে তিনি সর্বপ্রথম একাজ করবেন এবং তাতে চাটুজ্জে পরিবারের কলঙ্ক হবে।“
তারপরও রামকুমার ঐ মন্দিরের পুরোহিত হয়েছিলেন এবং রামকৃষ্ণকে সেখানে নিয়ে যান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ ভাইয়ের মনযোগাতে সেখানে যান।
শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করেন এবং কালী সাধক হয়ে উঠেন।
তথ্যসূত্র:ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী, স্বামী স্বরূপানন্দ।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠায় লক্ষ লক্ষ পুরোহিত ভোজন করলেও শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু শূদ্রের অন্ন বলে তা স্পর্শ করেন নি।চিড়ে মুড়ি কিনে খেয়ে দাদার ঝামাপুকুরের টোলে গিয়ে শুয়ে পড়েন।রাসমনি কথিত ছোটজাত বলে তার কি ঘৃণা ছিলো সেরকম একটি প্রমাণ আছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ বইতে-
“ঠাকুর কিন্তু ঐ আনন্দোৎসবে সম্পূর্ণহৃদয়ে যোগদান করিলেও আহারের বিষয়ে নিজ নিষ্ঠা রক্ষাপূর্বক সন্ধ্যাগমে নিকটবর্তী বাজার হইতে এক পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনিয়া খাইয়া পদব্রজে ঝামাপুকুরের চতুষ্পাঠীতে আসিয়া সে রাত্রি বিশ্রাম করিয়াছিলেন।”
[পৃষ্ঠা ৮৪, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খণ্ড, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়]
রাসমনির মন্দিরের প্রসাদ রামকৃষ্ণ খাবেন না!
“ভোজ্য পদার্থ অপরিমিত পরিমাণে প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু পরমহংসদেব তাহা কিছুই স্পর্শ করেন নাই। তিনি সমস্ত দিবস অনাহারে থাকিয়া রাত্রিকালে নিকটস্থ এক মুদির দোকান হইতে এক পয়সার মুড়কি ক্রয় করিয়া ভক্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি কি জন্য যে মন্দিরের সামগ্রী স্পর্শ করেন নাই, আমরা তাহার কোনো কারন প্রদর্শন করিতে পারিলাম না।”
[পৃষ্ঠা ৫, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনবৃত্তান্ত, রামচন্দ্র দত্ত, উদ্বোধন কার্যালয়]
দাদা না ফেরায় তিনি আবার দক্ষিণেশ্বরে আসেন ও দাদার সাথে ঝগড়া করেন কেন দাদা শূদ্রের আশ্রয় ও অন্ন গ্রহণ করছেন তাই নিয়ে।
দাদা রামকুমারের কাছ থেকে চাল ডাল নিয়ে গঙ্গাজলে ফুটিয়ে শুদ্ধ করে খেতে থাকেন কিন্তু শূদ্রের মন্দির ও অন্ন কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নন।দাদার চাল,ডাল কিন্তু শূদ্রের ছিলো কারণ তা রানী রাসমনির দেওয়া।
রামদত্তের বাড়ীতে অন্নগ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন কারন রামদত্ত ব্রাহ্মণ নয়।
(৪-৭- লীলা প্রসঙ্গ পৃঃ ১৯০-৯১-৯২)
ভাগ্নে হৃদয়রাম বলছেন-“যতদিন দেখিয়াছি লুচি খাইতে খাইতে তাহার চক্ষে জল আসিয়াছে এবং আক্ষেপ করিয়া শ্রী শ্রী জগন্মাতাকে বলিয়াছেন “মা” আমাকে কৈবর্ত্যের অন্ন খাওয়ালি”।
(লীলা প্রসঙ্গ-পৃঃ-১৯৫)
বিবেকানন্দের আইরিশ শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতার স্মৃতিচারণ থেকেও জানা যায় – “তথাপি শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কামারপুকুরের ব্রাহ্মণযুবকরূপে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমন করেন, তখন তিনি এত আচারনিষ্ঠ ছিলেন যে, এক নিম্নশ্রেণীর নারীকর্তৃক মন্দির নির্মাণ এবং ঐ উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দান তাঁহার অত্যন্ত বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল। তিনি ছিলেন প্রধান পুরোহিতের কনিষ্ঠভ্রাতা এবং সেজন্য প্রতিষ্ঠাদিবসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁহাকে পূজানুষ্ঠান কার্যে সহয়তা করিতে হয়। কিন্তু কিছুতেই তিনি প্রসাদ গ্রহনে সম্মত হন নাই। শোনা যায়, সব শেষ হইয়া গেলে, এবং সমাগত লোকজন চলিয়া গেলে গভীর রাতে তিনি বাজার হইতে একমুঠা ছোলাভাজা কিনিয়া আনেন এবং উহা খাইয়া সারাদিন উপবাসের পর ক্ষুধা নিবৃত্ত করেন।” (পৃষ্ঠা ১৭০, স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, ভগিনী নিবেদিতা, উদ্বোধন কার্যালয়)।
এই কথিত নিম্নশ্রেণীর নারীটি হচ্ছেন রানী রাসমনি। কথিত শূদ্র হওয়ায় তার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়ির প্রসাদ তিনি মুখে দেননি। রামকৃষ্ণ বালক বয়েসে এক কামার স্ত্রীর হাতে অন্ন খেয়েছিলেন দেখিয়ে তাকে ভক্তরা জাতপাতহীন সাজাতে চাইলে কি হবে, পরিণত বয়সে গদাধর থেকে রামকৃষ্ণ হয়ে তিনি কি বলেছিলেন দেখুন –
“কৈবর্তের অন্ন খেতে পারি না দাদা।আমার এখনকার অবস্থা, – বামুনের দেওয়া ভোগ না হলে খেতে পারি না !” (পৃষ্ঠা ৩২, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম খণ্ড, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সিগনেট প্রেস)।
আরেকটা ঘটনাবলি – একদিন তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় একগাছের তলায় বসে সাধনা করতে বসেছেন। সেই সময় উনার ভাগ্নে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল – “মামা তুমি পৈতে খুলে রেখেছে? অথচ ব্রাহ্মণদের পৈতে খুলে রাখা অনুচিত। “
এর উত্তরে রামকৃষ্ণ ভাগ্নেকে বললেন – “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়’ – এই অভিমানের চিহ্ন এবং একটা পাশ, মাকে ডাকতে হলে ঐ সব ফেলে রেখে একমনে ডাকতে হয়। তাই পৈতে খুলে রেখেছি। ধ্যান করা শেষ হলে ফিরবার পথে আবার পরব।“
এখানে প্রশ্ন থাকে ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড় এটা যদি অভিমানের চিহ্ন এবং পাশ হয় তবে ধ্যান শেষে পৈতে পরবার প্রয়োজন কি? না কি অদৃশ্য ভগবানের কল্পনা করার সময় আমি ব্রাহ্মণ নই সাধারণ মানুষ আর মানব সমাজে ফিরে আসলে “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়” ? তাই মনে হয় আসল কথা।
ছোটবেলা থেকেই রামকৃষ্ণ ছিলেন হিষ্টিরিয়ার রোগী। হঠাৎ হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। আর এই রোগকে পল্লবিত করতে গিয়ে তার শিষ্যরা বলেন তিনি নাকি মাঝে মধ্যে ভাব সমাধিতে চলে যেতেন।
তাছাড়া ছিল উনার হরমোনের সমস্যা যার জন্য উনার মধ্যে পুরুষালি ভাবগুলি কম ছিল।
এই কারণই হয়তো উনাকে বিবাহিত জীবন থেকে ব্যর করেছিল।
এই প্রসঙ্গে স্বরূপানন্দ তার ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী বইতে বলেছেন –
“সাধন-কালে রামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে মথুরবাবুর(রাণী রাসমণির জামাতা) বাড়ীতে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। মেয়েরা রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে কোনরূপ সংকোচ করত না। রামকৃষ্ণ তাদেরই একজন এই বোধ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। বাল্যকাল থেকে যখন কলসি কাঁধে জল নিয়ে বাড়ী ফিরতেন তখন কেউ তাকে পুরুষ বলে বুঝতেই পারতো না।“
এখানেও অন্ধবিশ্বাসী শিষ্যরা উনার মহত্ব বাড়াতে এই হরমোনের সমস্যাকে কালীর ভর বলে এখনও চালায়।
নারী সম্পর্কে তার মনোভাব ছিলো খুবই সনাতন। নারীকে তিনি মনে করতেন ‘নরকের দ্বার’–
‘কামিনী নরকস্য দ্বারম্‌। যত লোক স্ত্রী লোকের বশ’।
নারী সম্বন্ধে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের আরো কিছু ‘কথামৃত’ শ্রবণ করা যাক–
মেয়ে মানুষের কাছে খুব সাবধান হ’তে হয়। মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে।
আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে। আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি! সব রাক্ষসীর মত দেখি।
মেয়ে মানুষের শরীরে কি আছে – রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মূত্র, বিষ্ঠা এই সব। সেই শরীরের উপর ভালবাসা কেন?
দেখ না, মেয়ে মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিনী মেয়েদের! পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ এক সঙ্গে ব’সে আছে, তখন বলি, আহা! এরা গেছে।
হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশীক্ষণ কাছে বসতে দেই না। একটু পরে হয় বলি – ‘ঠাকুর দেখো গে যাও’; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
যদি স্ত্রীলোক ভক্তিতে গড়াগড়ি যায়, তবুও তার কাছে যাতায়াত করবে না।
মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকলেই তাঁদের বশ হয়ে যেতে হয়।
মেয়ে ভক্তদের গোপাল ভাব- ‘বাৎসল্য ভাব’ বেশি ভাল নয়। ঐ ‘বাৎসল্য’ থেকেই আবার একদিন ‘তাচ্ছল্য’ হয়।
মেয়ে মানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাঁদের হাওয়া গায় লাগে।
রামকৃষ্ণ মনেই করতেন, মেয়েদের লজ্জাই হওয়া উচিৎ একমাত্র ভূষণ। আরো বলতেন, ভাল মেয়ে সেই, যার কাম ক্রোধ ঘুম এসব কম, আর স্নেহ, মায়া লজ্জা এসব বেশি থাকে। একবার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গৃহীভক্ত শ্রী মহেন্দ্র গুপ্তের বাড়ির নয়-দশ বছরের দুটি মেয়ে এসে একবার রামকৃষ্ণকে দুটো ভক্তি-গীতি শুনিয়েছিলেন। সেই গান শুনে ঠাকুর বড়ই আনন্দিত হন। তারপর আরেকদিন সেই মেয়ে দুটো কাশীপুর বাগানে ঠাকুরকে গান শোনানোর সময় ভক্তরাও সেটা শুনে ফেলে, আর তাঁদের ডেকে নিয়ে তারাও গান শোনে। তখন শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার মেয়েদের আর গান শিখিও না। যার তার কাছে গাইলে লজ্জা ভেঙ্গে যায়। লজ্জা মেয়েদের বড় দরকার’।
লজ্জা যে মেয়েদের খুবই দরকার, আর গান গাওয়া কিংবা মঞ্চে ওঠা মেয়েদের যে লজ্জা ফজ্জা থাকে না, তারা যে খারাপ মেয়ে – এই মানসিকতা শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্তরা আজো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন তাঁদের মননে এবং আচরণে। একটা উদাহরণ দেই। ১৯৯৪ সালের দৈনিক আজকালের একটা খবর থেকে জানা যায়, বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ‘লোককৃষ্টি’ নামের একটি নাটকের দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি। কারণ – ঐ দলে কিছু নারী শিল্পী ছিলেন। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিতর্ক শুরু হলে মিশনের প্রধান জানান,
‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কোন অনুষ্ঠানে মহিলারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেন না। ১৮৯৭ সালে স্বামীজি যখন বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখন থেকেই এই ঐতিহ্য এবং ভাবধারা বহমান। বেলুড় মঠের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ভাবধারা মেনেই ঐ অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি’।
মিশনের প্রধান ভুল কিছু বলেননি। তিনি নিয়মনিষ্ঠ ভাবে রামকৃষ্ণের সেই ‘নারীরা নরকের দ্বার’ নামক ঐতিহ্যই অনুসরণ করেছেন। আসলে নারীদের নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা আর যৌন-ভীতি ছিলো। তিনি সকল স্ত্রী লোককে নাকি ‘মা হিসেবে’ দেখতেন- এমনকি তার নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকেও। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীকে একটা সময় পরে তিনি ‘ভাই বোনের’ মত থাকার পরামর্শ দিতেন –
‘স্ত্রী লোক কিরূপ জান? যেমন, আচার তেঁতুল। মনে করলে মুখে জল সরে। আচার তেঁতুল সম্মুখে আনতে হয় না। … আপনারা যতদূর পার স্ত্রীলোকের সাথে অনাসক্ত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে নির্জন স্থানে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করবে। সেখানে যেন ওরা কেউ না থাকে। ঈশ্বরেতে বিশ্বাস ভক্তি এলে অনেকটা অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারবে। দু-একটি ছেলে হলে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনে ভাইবোনের মত থাকবে। আর ঈশ্বরকে সর্বদা প্রার্থনা করবে, যাতে ইন্দ্রিয় সুখেতে মন না যায়, ছেলেপুলে আর না হয়’।
নারীদের নিয়ে নিজের মনেই এক ধরণের যৌন-ভীতি তৈরি করে অস্বাভাবিক উপায়ে কাম জয়ের চেষ্টা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ যে সফল হননি, তা বলাই বাহুল্য। তার স্বীকৃতি মেলে তার নিজের করা উক্তিতেই –
‘ওরে ভগবদ্দর্শন না হলে কাম একেবারে যায় না। তা (ভগবানের দর্শন) হলেও শরীর যতদিন থাকে ততদিন একটু-আধটু থাকে, তবে মাথা তুলতে পারে না। তুই কি মনে করিস, আমারই একেবারে গেছে? একসময় মনে হয়েছিল কামটাকে জয় করেছি। তারপর পঞ্চবটিতে বসে আছি।, আর ওমনি কামের এমন তোড় এলো যে আর যেন সামলাতে পারিনি! তারপর ধুলোয় মুখ ঘষড়ে কাঁদি আর মাকে বলি – মা , বড় অন্যায় করেছি আর কখনো ভাবব না যে কাম জয় করেছি-’
রামকৃষ্ণের ভণ্ডামির প্রমাণ:
কোনো দিন বা মন্দিরে মাকে শয়ন দিচ্ছে, হঠাৎ শূন্যরূপকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল গদাধর: আমাকে তোর কাছে শুতে বলছিস? আচ্ছা, শুচ্ছি তোর বুকের কাছে। মার সর্ব অঙ্গে বাতসল্য, দু চোখে স্নেহসিঞ্চিত লাবনী। হাত-পা গুটিয়ে ছোট্টটি হয়ে মার রূপোর খাটে শুয়ে পরল গদাধর। নীল নিবিড় মেঘমণ্ডলের কোলে ক্ষীণ শশিকলা।
(পরমপুরুষ শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)
রামকৃষ্ণের অনেক কিছুই যে ছোটবেলা থেকেই স্বাভাবিক ছিল না, সেটা তার অনেক উক্তিতেই মেলে। বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন ঘটনায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। সে সময় তিনি গ্রামের পুকুরে মেয়েদের ঘাটে নেমে স্নান করতে চাইতেন। গ্রামের মেয়েরা তার মার কাছে নালিশ জানালে মা তাকে বকাবকিও করেন। মেয়েদের ঘাটে নামা ছাড়াও তিনি আড়াল থেকে স্নানরতা নগ্ন মেয়েদের দিকে আড়ালে আবডালে উঁকি দিতে শুরু করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। যৌন-সুড়সুড়ি পাওয়ার আশায় গোপনে যৌনাঙ্গ দেখার অভিলাষ এবং অভ্যাসকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ভোয়ুরিজম বা স্কোপোফিলিয়া’। এটা এক ধরণের মানসিকবিকারগ্রস্ততাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ একসময় মহবীর
হনুমানজীর ধ্যান করতেন, তিনি বলেছেন......
“ঐ সময়ে আহার বিহারাদি সকল কার্য্য
হনুমানের ন্যায় করিতে হইত ইচ্ছা করিয়াই যে
করিতাম তাহা নহে, আপনা আপনিই হইয়া
পড়িত। পরিবার কাপড়খানােকে লেজের মত
করিয়া কোমরে জড়াইয়া বাঁধিতাম, উল্লঙ্ঘনে।
(লাফ দিয়ে) চলিতাম, ফলমূলাদি ভিন্ন অপর
কিছুই খাইতাম না- তাহাও আবার খােসা
ফেলিয়া খাইতে প্রবৃত্তি হইত না, বৃক্ষের উপরেই
অনেক সময় অতিবাহিত করিতাম এবং নিরন্তর
“রঘুবীর, রঘুবীর' বলিয়া গম্ভীর স্বরে চীৎকার
করিতাম। চক্ষুদ্বয় তখন সৰ্ব্বদা চঞ্চল ভাব
ধারণ করিয়া ছিল এবং আশ্চর্যের বিষয়
মেরুদণ্ডের শেষ ভাগটা ঐ সময়ে প্রায় এক ইঞ্চি
বাড়িয়া গিয়াছিল।"
[শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা]
(এই মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষটা নাকি
আবেশাবতার)
এ ধরণের আরো উদাহরণই দেয়া যায়। মেয়েদের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ঢাকতে তিনি একসময় মেয়েদের কাপড় গয়না পরা শুরু করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে জিতেন্দ্রিয় হওয়া যাবে। দেখুন তার কথাতেই – ‘জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় কেমন করে? আপনাতে মেয়ের ভাব আরোপ করতে হয়। আমি অনেকদিন সখীভাবে ছিলাম। মেয়েমানুষের কাপড়, গয়না পরতুম, ওড়না গায়ে দিতুম’ (শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ১৫০)। এগুলো কি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পরিচয়?
এ লোকটা সবসময় বিবস্ত্র হয়ে থাকত। প্রায় সময়ই পোশাক না পরে ঘোরাফেরা করতো। তার এই উলঙ্গ হয়ে থাকা নিয়ে বেশ মজার একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন স্বামী সারদানন্দ।
একবার পুজোর সময় পরমহংসদেব ডস্ট কোম্পানির মুচ্ছুদী গৃহীভক্ত সুরেশ মিত্তিরের (১৮৫০-৯০) বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদালানে মারবেল পাথরের মেঝের উপর তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছিল।
মেয়েরা ঘরে জানালা হইতে পরমহংস মশাইকে দেখিতেছিলেন। পরমহংস মশাই- এর সম্মুখে অনেক লোক দাঁড়াইয়া তাঁহাকে আহার করাইতেছিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেছিলেন। এইরূপ বসিয়া আহার করাই তাঁহার দেশের প্রথা। আমরাও দেখিয়াছি যে, পরমহংস মশাই আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া আহার করিতেন না, হাঁটু দুইটি উঁচু করিয়া উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেন।
তিনি আহার করিতেছেন ও বলিতেছেন যে, পূর্বে তিনি বড় বিভোর থাকিতেন, বাহ্যজ্ঞান কিছুই থাকিত না, কাপড় পরার কথা মনে থাকিত না, একেবারেই বে-ভুল, বে-এক্তিয়ার হইয়া থাকিতেন, কিন্তু এখন তাঁহার সে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে, এখন তিনি কাপড় পরিয়া থাকেন এবং লোকজনের সম্মুখে বেশ সভ্যভব্য হইয়া বসিয়া থাকেন। এই কথা শুনিয়া উপস্থিত লোকসকল ও যে সকল মেয়েরা জানালা হইতে দেখিতেছিলেন, একটু হাসিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ হাসিয়া বলিলেন, ‘আজ্ঞে ও-কথা ঠিক তো বটেই।‘ সকলে এই বলিয়া আমোদ করিয়া তাঁহাকে উপহাস করিতে লাগিলেন।
পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া একটু একটু খাইতেছেন আর এইরূপ কথা চলিতেছে। সকলেই মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বাঁদিকের বগলের প্রতি হঠাৎ পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি পড়িল। তিনি দেখেন যে, কাপড়খানি বাঁ-বগলের ভেতর জড়ানো রহিয়াছে আর তিনি দিগবসন হইয়া বসিয়া আছেন।
এইরূপ দেখিয়া তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, ‘আরে ছ্যা! আমার ওটা গেল না; কাপড় পরাটা আর মনে থাকে না।‘ এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি কাপড়খানি লইয়া কোমরে জড়াইতে লাগিলেন। যে সকল পুরুষ দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার সকলে উচ্চরোলে হাসিয়া উঠিলেন, মেয়েরাও জানালা হইতে হাসিয়া উঠিলেন।
কিন্তু পরমহংস মশাই-এর ভাব এত সরল, স্নিগ্ধ ও উচ্চ ছিল যে, কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ না আসিয়া এক অতীন্দ্রিয় ভাব আসিল। কেহ কেহ বলিলেন মশাই, আপনার কাপড় পরবার দরকার নেই। আপনি যেমন আছেন, তেমনি থাকুন। আপনার কোন দোষ হয় না। (অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ, লেখক শংকর)
যাইহোক রামকৃষ্ণের লোক দেখানো গরীব দরদ সম্পর্কে একটু দৃষ্টিপাত করি –
তিনি একবার দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ একদিন পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র করুন অবস্থা দেখে কাতর হলেন এবং জমিদার মথুর বাবুকে এই সব দারিদ্র লোকদের অন্ন বস্ত্র দিতে বললেন। মথুর বাবু ইতস্তত করে বললেন।
“এই তীর্থ যাত্রায় অনেক টাকা লাগবে। তাই এদের সাহায্যে করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।“
কিন্তু রামকৃষ্ণ এদের শোচনীয় দু:খ দারিদ্র দেখে কাঁদতে লাগলেন “ছি: ছি:! তুমি কি বলছো? আমি এদের ছেড়ে বারানসিও যেতে চাই না।“ তিনি অবশেষে মথুরবাবুর সঙ্গ ছেড়ে দরিদ্র গ্রামবাসীর সঙ্গে বসলেন। মথুরবাবু শেষে বাধ্য হয়ে কলকাতা থেকে কয়েক গাঁট কাপড় এনে এদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং এদের সকলকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন।
ভেবে দেখুন মায়া কান্না আর কাকে বলে? একবেলা খাওয়ালে আর একবার বস্ত্র বিতরণ করলে যে দরিদ্রের দারিদ্র দূর হয় তাই আশ্চর্যের। বরং তিনি পুরো ভারতের প্রয়োজন নেই এই এলাকার স্থায়ী দারিদ্র দূরীকরণে একটা ব্যবস্থা নিতেন তাহলে উনাকে প্রকৃত গরীব দরদী বলতাম।
আর কাপড় ও খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মথুরবাবুর দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কি? মা কালী যেহেতু উনার সব কথা শুনেন। সেহেতু মা কালীর কাছে দরিদ্র গ্রামবাসীর সমস্যা কথা বললেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
অবশ্য মা-কালির প্রতি তিনি কতটুকু আস্থাশীল ছিলেন তাও সন্দেহ হয়। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন- “সত্যি কি তুই আছিস মা? না, এসবই মনের কল্পনা? তুই আছিস তবে আমি তোকে দেখতে পাই না কেন? তবে এসব কি আকাশ কুসুম?
(ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী – স্বরূপানন্দ- পৃ: ৮)
রামকৃষ্ণ যখন ধর্মীয় ভাবধারা প্রচার শুরু করেন তখন ধর্মবিপ্লব চলছে।
তিনি ব্রাহ্মসমাজের তীব্র বিরুদ্ধি ছিলেন। অথচ ব্রাহ্ম সমাজকে তিনি অতি কৌশলে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে দ্বিধা-বোধ করেন নি।
১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে তার শিশু কন্যার বিয়ে দিলে বাল্যবিবাহ বিরুধী ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেশব চন্দ্রের অনুরাগী তাকে ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে ব্রাহ্মসমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
ব্রাহ্মসমাজ বিরোধী রামকৃষ্ণ সুযোগ বোঝে কেশবচন্দ্রের কার্যের সমর্থনে বললেন –
“জন্ম,মৃত্যু,বিবাহ ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে তাই এতে দোষ কি আছে? কেশব গৃহী, সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে পিতার কর্তব্য পালন করেছে, এতে ধর্মের কোন হানি হয় নি।“
ব্রাহ্ম সমাজের বিরুধীতা করতে গিয়ে নারীকে গরু ছাগলের সাথে তুলনা করতে কার্পণ্য করেননি রামকৃষ্ণ।
শিবনাথ শাস্ত্রী রামকৃষ্ণের কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের আদর্শ সম্পর্কে তিনি রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “
স্ত্রী লোকেরা ব্রাহ্মসমাজের সদস্যা ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সামাজিক ও গাহস্থ্য ধর্ম, ব্রাহ্মসমাজ নারীজাতিকে শিক্ষা ও স্বাধীনতা দিতে চায়। সুতরাং কামিনী ত্যাগের কঠোর আদর্শ আমরা বিশ্বাস করি না।“
এর পরিপ্রেক্ষিতে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন – “চারাগাছ নিয়ে মালী কি করে? ছাগল গরু থেকে বাঁচাবার জন্য বেড়া দেই। পরে চারাগাছ যখন বেড়ে ওঠে তখন আর বেড়া দেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনেও আমরা তাই করি।“
শিবনাথ তাতে বলেছিলেন – “আমি আপনার মতো নারী জাতির কাজকে গরু ছাগলের মতো ধ্বংসাত্মক মনে করি না। আমাদের সংগ্রাম ও সামাজিক অগ্রগতিতে তারা সহায় হতে পারে।"

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ