জল আর পানি একই পদার্থ। পদার্থ হিসেবে ওটার নাম জল। কিন্তু জল পান করা হয় তাই এটা পানীয়। তাই এটা’র আর একটা নাম পানী। দুটো শব্দই সংস্কৃত থেকে এসেছে। বাংলা অনেক শব্দে ‘জল’ আর পানি একসঙ্গে লেখা হয়। যেমন : ‘জলপানি। শব্দটির অর্থ: ছাত্রবৃত্তি, স্কলারশিপ, জলযোগের পয়সা প্রভৃতি। আর, যে ছাত্র ‘জলপানি’ পায় সে যে মেধাবী, তা কে না জানে? সুতরাং, যারা মেধাবী তাদের কাছে জলপানি, বা জল ও পানি অভিন্ন জিনিস। শব্দকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে টেনে আনা সমীচীন বলে মনে হয় না।
সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দটি একটু পরিবর্তন হয়ে ‘পানি’ হয়েছে বলে হয়তো মুসলিমরা সরাসরি সংস্কৃত ‘জল’ না-বলে ‘পানি’ বলে থাকেন। হিন্দিভাষীগণ ‘পানি’ বলেন। বেশির ভাগ হিন্দিভাষী অমুসলিম। মুসলিমরাও বলে থাকেন পানি। সুতরাং উপমহাদেশে, ‘জল’ এর চেয়ে ‘পানি’ বলা লোকের সংখ্যা অধিক। তবে বাংলায় বিভিন্ন শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচনে পানির চেয়ে জলের আধিক্য বেশি। ‘পানি’ দিয়ে গঠিত এবং বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে অন্তর্ভূক্ত শব্দের সংখ্যা মাত্র পাঁচ, কিন্তু ‘জল’ দিয়ে গঠিত শব্দের সংখ্যা একশ একচল্লিশ।এটিও বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের একছত্র প্রভাবের কারণে ঘটেছে।
বাংলায় ব্যবহৃত আরবি শব্দ যে, হিন্দুরা ব্যবহার করেন না তা নয়। হিন্দুরা ‘আইন’, ‘কাগজ’, ‘কলম’ প্রভৃতির মতো আরও অনেক আরবি বা ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন, কিন্তু জল ও পানি কীভাবে হিন্দু মুসলিম হয়ে গেল- তা যথার্থভাবে বলা কষ্টসাধ্য।
অনেক হিন্দু এবং একই সঙ্গে বহু মুসলিম মনে করেন, ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি-জাত শব্দ। আবার অনেকে বলেন, এটি উর্দু। গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাবহারিক প্রাচীনত্বের কারণে ‘পানি’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরিব এবং অশিক্ষিত বাঙালি মুসলিম শ্রমজীবীগণ অধিক হারে ব্যবহার করায় এবং তার বিপরীতে আর একটি সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ (জল) থাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতবর্গ ‘পানি’ শব্দটিকে ইসলামি শব্দ এবং অস্পৃশ্যদের ব্যবহার্য শব্দ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের কাছে প্রাচীন কাল হতে ব্যবহৃত হয়ে আসা ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত হতে আগত হয়েও হিন্দুত্ব হারিয়ে ফেলে। এজন্য হিন্দুরা ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। ফলে ‘জল’ হয়ে যায় হিন্দুয়ানি শব্দ। প্রকৃতপক্ষে, ‘পানি’ শব্দের সঙ্গে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। আরবি ভাষায় ‘পানি’ অর্থ ‘মাউন’(যাকাত না দেয়া, আনুগত্য না করা)। অন্যদিকে, ফারসি ভাষায় পানিকে বলা হয় ‘আব’। সুতরাং ‘পানি’ শব্দকে ইসলামি শব্দ বলে বাঙালি হিন্দুদের তা ব্যবহার না-করার কথাটি সত্য হলেও ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি শব্দ- এটি ঠিক নয়। যদিও উভয় পক্ষের অনেকে এমন দাবি করে থাকেন। অধিকন্তু, হিন্দুরা ছাড়াও অধিকাংশ বাঙালি অমুসলিম সাধারণত ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করে থাকেন।
‘জল’ ও ‘পানি’ দুটোই সংস্কৃতজাত শব্দ– প্রথমটি তৎসম এবং দ্বিতীয়টি তদ্ভব। সংস্কৃত ‘জল (=√জল্+অ)’ শব্দের বহুল প্রচলিত অর্থ পানি, বারি, সলিল প্রভৃতি। অন্যদিকে, সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দ থেকে উদ্ভূত তদ্ভব ‘পানি’ শব্দের অর্থ জল, বারি, সলিল প্রভৃতি। বাংলায় ব্যবহৃত ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। এবার পরিবর্তনটি কীভাবে হয়েছে দেখা যাক : (সংস্কৃত) পানীয়> (পালি) পানীয়> (প্রাকৃত) পাণিঅ> (বাংলা) পাণি/পাণী> পানি। প্রাকৃত শব্দ “পাণিঅ” থেকে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাও ‘বারি’ অর্থ প্রকাশে পানি শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে।
এবার পর্যালোচনা করে দেখি, বাংলা সাহিত্যে প্রথমে ‘পানি’ না কি ‘জল’ শব্দটির ব্যবহার চালু হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার সুপ্রাচীন, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রচলন হয়েছে পরে । বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে ‘পানি’ শব্দটির প্রয়োগ পাওয়া যায়, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় না। চর্যাপদে ভুসুক পা লিখেছেন :
“তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী ।
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ।।”
অর্থাৎ ‘ধৃত হরিণ প্রাণভয়ের হতভম্বতায় ঘাসও খায় না, ‘পাণী (পানি)’ পানও করে না।” অতএব, বলা যায় – বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দটি ‘জল’ শব্দের আগে এসেছে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর অভিমত, চর্যার পদগুলো খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয়েছে।ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে চর্যাপদ লিখিত হয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, চর্যা এরও আগে রচিত হয়েছে। সে হিসেবে এখন থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার বছর বা তারও পূর্বে বাংলায় ‘পানি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়েছিল; তখন জল শব্দের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে ছিল না।সংগতকারণে, বাঙালির মুখেও ‘জল’ ছিল না, ‘পানি’ ছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয়ে যে, ‘পানি’ ‘জল’-এর আগে; যদিও ‘প’ বর্ণটি বর্গীয়-জ বর্ণের পরে।
বাংলা ভাষার আদি কালে জল এবং পানী দুটোই সমান ভাবে ব্যবহার করা হত। হিন্দুরা কোনোদিনি বিস্বাস করেনা বা মনে করেনা যে পানি বললে মুসলমান হয়ে যাব কারন অসংখ্য হিন্দীভাষী পানী বলছে। কিন্তু বাংলা ভাষার মান্যরূপ স্থির করার সময় কলকাতা তথা পূর্ববঙ্গের পন্ডিত গন জল টাকে গ্রহন করেছিলেন তবে সেটা হিন্দু মুসলমানের কারনে নয়। নিজেদের মুৃখের ভাষা টাকা মান্যরূপ বলে চালানোর গর্ব থেকে। কিন্তু এতেই মুসলিম পন্ডিতেরা মানসিক ভাবে আহত হলেন। তাছাড়া মুসলমান রা সবমসয় চায়ত হিন্দুদের থেকে আলাদা হতে। মুসলিম শাষন কালে যখন মানুষ দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়েছে তখন তারা প্রানপণ চেষ্টা করত কিভাবে নিজেদের হিন্দু নয় তা প্রমান করা যায়। এই মানসিকতা সেই সময় থেকেই চলে আসছে। তাই তারা সচেতন ভাবেই সেইসব শব্দ বেশি ব্যাবহার করতে লাগল যা হিন্দুরা ব্যবহার করেনা বেশি। পানীর উপর জোর দেওয়া উপর এই দুটোই কারন, এক হিন্দুদের থেকে আলাদা হওয়া দুই ইগো। ভারতে গোমাংস খাওয়া প্রচলন ও কিন্তু হিন্দু নই তা প্রমান করার জন্যই চালু হয়েছিল। তার প্রমান আজ ও পাওয়া যায় সর্বত্র। আসলে জল আর পানী দুটোই হিন্দু শব্দ (যদি শব্দের ধর্ম খুজতে চান তো)। কিন্তু মুসমানেরা পানী কে আপন করেনিয়েছিল কারন পুর্ববাংলার পন্ডিতেরা জল টাকে মান্যরূপ বলে ঠিক করেছিল তাই। তার পর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালী মুসলমানেরা ভাবল এবার আমরাও সুযোগ পেয়েছি। বাংলা ভাষার মুসলমানি করেই ছাড়ব। যার ফল বাংলাভাষার মুসলিম সংস্করন তৈরি করেছেন। সত্যি হাস্যকর ব্যাপর। কিন্তু ক্ষমতা থাকলে কেন করবেনা। যাই হোক এই ইগোর দ্বন্দ্ব থেকেই মুসলমান পন্ডিতেরা জল কেটে করলেন পানী, স্নান কেটে করলেন গোসল, মাংস কেটে করলেন গোস্ত, নিমন্ত্রন কেটে করলেন দাওয়াত, প্রাতঃরাস কেটে করলেন নাস্তা, বাড়ি কেটে করলেন বাসা, আরো কতকিছু। তবে জল, পানী, নীর, ওয়াটার সব একই বস্তু। শব্দের কোনো ধর্ম হয়না। এটা মানুষের সংকীর্ণতা ছাড়া কিছুই নয়। বাংলা ভাষায় আগত হিন্দি শব্দ যেমনঃ চিঠি,ঠিকানা,পানি ইত্যাদি। "পানি"-এর সংস্কৃত শব্দ হলো জল অপরদিকে পানি শব্দটি হিন্দি ভাষা থেকে আগত।
জল-পানি নিয়ে উইকিপিডিয়ার কথোপকথনের শেষাংশ, (কপি-পেষ্ট)
জল ও পানি শব্দদুটো দুপারের লোকেরাই জানেন। ওপারে জল বেশি চলে, এপারে বেশি চলে পানি। পশ্চিমবঙ্গীয়রা পানি চেনেন কিন্তু ব্যবহার করেন না; বাংলাদেশীরা জল চিনি কিন্তু ব্যবহার করি না। সুতরাং শব্দদুটো সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত হলেও সার্বজনীন প্রচলিত নয়। তাই প্রস্তাবটা চলবে না।
পানি শব্দটার মূল উৎস সংস্কৃত পানীয় (√পা+অনীয়=পানীয়)[বাংলা একাডেমী, সংসদ বাংলা অভিধান]। হিন্দুস্তানি (হিন্দি ও উর্দু) ভাষায়ও পানি শব্দটা সংস্কৃত থেকেই গিয়েছে। পান, পানাহার, পানাসক্ত শব্দগুলোও একইভাবে উদ্ভূত। সুতরাং আপনি পানীয় জল বা কোমল পানীয় যা-ই পান করুন না কেন, পানির ছোঁয়া এড়াতে পারবেন না। সুকুমারের অবাক জলপান, সত্যেন্দ্রের পানকৌড়ি/পানিকৌড়, চণ্ডীচরণের পানিফল, মুজতবার পানতোয়া/পান্তুয়া আর বাঙালির চিরকেলে পান্তাভাত (পানি+তা=পানিতা> পান্তা)- পানি বইছেই।
"জল পড়ে পাতা নড়ে" ছড়াটা কবিগুরুর নয় বলেই জানি। জলপানি (জল+পানি; ছাত্রবৃত্তি) শব্দটা তাঁর লেখাতেই পাচ্ছি- "এবার সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া জলপানি পাচ্ছে" (বাএ)। তিনি শব্দের উপযোগিতা দেখতেন, জাতপাত নয়। তবে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের অপপ্রভাব নিয়ে কিন্তু তিনি যথেষ্টই সোচ্চার ছিলেন।
জল শব্দটা সংস্কৃত ভাষার শব্দ; বাংলাতে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, অর্থাৎ তৎসম। আর সংস্কৃত পানীয় প্রাকৃতে চেহারা বদলে পানি হয়েছে, যাকে বলি তদ্ভব। এই তদ্ভব শব্দগুলোই "খাঁটি বাংলা", এবং এদের অস্বীকার করা কোনো কাজের কথা নয়।
বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে দেখলাম, বাংলা ভাষায় পানি-জল দুটো শব্দেরই প্রথম লিখিত ব্যবহার করেছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস, সে-ই ১৪৫০ সালে।
পার্সি ভাষায় জল কে বলা হয় " আব " আর আরবি ভাষায় " মা'উন " । জল হচ্ছে একটি তরল পদার্থ যার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Dihydrogen Oxide । পানি হচ্ছে এমন জল যা পানের যোগ্য । তাহলে পশ্চিমবঙ্গে জল আর বাংলাদেশে পানি বলা হয়ে কেন ? : সহজ উত্তর উপভাষা । পশ্চিম দিকের বাংলা উপভাষাগুলোতে জল আর পূর্ব দিকের বাংলা উপভাষাগুলোতে পানি বলা হয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এখনো অনেক পুরনোদিনের পূর্ববঙ্গবাসী আছে যারা জলের বদলে পানি বলে এবং তারা অধিকাংশই হিন্দু । তেমনি যে সব বাঙালী মুসলিম কোলকাতা বা তার আসে পাশে থাকে তারা জল বলে পানি নয় ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ