অপরা বিদ্যা অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে সকল পদার্থ এর কার্য এর জ্ঞান । যেখানে অপরা বিদ্যা শেষ হচ্ছে সেখান থেকে পরা বা আধ্যাত্মিক বিদ্যা শুরু হচ্ছে । মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৫ শ্লোকে বলা হয়েছে ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ অথর্ববেদ এবং শিক্ষা ৬ বেদাঙ্গকে #অপরাবিদ্যা (জড় পদার্থ বিষয়ক যে বিদ্যা) বলা হয়েছে আর যে বিদ্যা দ্বারা অক্ষর ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায় তা হলো পরাবিদ্যা। #পরাবিদ্যা, যে বিদ্যার সাহায্যে সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মকে জানা যায় তাকেই বলে পরাবিদ্যা।পৃথিবী ও তৃণাদি থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত সব জড় পদার্থের গুণ জেনে তার সাহায্যে কাজে সিদ্ধ হওয়া যায় যে বিদ্যার সাহায্যে তাকেই বলা হয় অপরাবিদ্যা। এই শ্লোকের অর্থ অনেকেই ভিন্ন ভাবে বোঝে, কেউ বলে বেদে কোনো পরাবিদ্যা নেই বরং উপনিষদে পরা বিদ্যা আছে, আবার কিছু বৈষ্ণব বলে বেদে শুধুই অপরা বিদ্যা আর গীতাতে শুধুই পরা বিদ্যা।
এইবার দেখে নেওয়া যাক বেদে পরাবিদ্যা অর্থাৎ আধ্যাত্মিকবিদ্যা আছে কি নেই। ঋষি মনু বলেছেন -সম্পূর্ণ বেদ হলো ধর্মের মূল (মনুস্মৃতি ২/৬)। নিরুক্ত ৭/১-২ অনুযায়ী বেদ মন্ত্রের ৩ প্রকার অর্থ হয় যেমন- আধিভৌদিক যা মনুষ্যের ব্যাবহারিক বিদ্যা, আধিদৈবিক যা পদার্থ বিদ্যা বিষয়ক ও আধ্যাত্মিক যা আত্মা বিষয়ক বিদ্যা। ঋষি মনু বলছে বেদই হলো ধর্মের মূল, ঋষি য়াস্কও বলছে বেদে সকল বিদ্যা আছে আর এইদিকে কিছু বালবুদ্ধির ব্যক্তিরা প্রচার করছে বেদে পরা বিদ্যা নেই! ঋষিদের কথন অনুযায়ী প্রমাণ হয় যে বেদে উভয় প্রকার বিদ্যা রয়েছে। সকলের এই বিষয়ে জেনে রাখা উচিত যে অপরা বিদ্যা অর্থাৎ পদার্থের সৃষ্টি বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়ে পরা বিদ্যা দ্বারা কখনোই মোক্ষ প্রাপ্তি সম্ভব নয়, আবার আধ্যাত্মিক অর্থাৎ পরা বিদ্যাকে না জেনে শুধুমাত্র অপরা বিদ্যা দিয়ে কখনোই মোক্ষ প্রাপ্তি সম্ভব নয়। ঈশ্বর কে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য ঈশ্বরের সৃষ্টি করা পদার্থের বিদ্যা এবং আধ্যাত্মিক বিদ্যা উভয় প্রয়োজন।
ঋষি দয়ানন্দ আর্য় সমাজের প্রথম নিয়মেই বলেছেন 'যে পদার্থ বিদ্যার দ্বারা জানা যায়, সে সকলের মূল পরমেশ্বর'। পদার্থ বিদ্যা ছাড়া মোক্ষ প্রাপ্তি তো দূরের কথা পরমেশ্বরকে জানা পর্যন্ত যাবে না। এই বিষয়ে একটি সাধারণ উদাহরণ দিচ্ছি - আপনি যদি কোনো ব্যক্তিকে স্রষ্টা বিষয়ে বোঝাতে যান, তাহলে আপনাকে নিশ্চয় এই ভাবে বোঝাতে হবে যে, স্রষ্টা বা পরমেশ্বর তিনিই যিনি সকল প্রাণী, উদ্ভিদ আদি এবং চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী আদি সকল জড় পদার্থ নির্মাণ করেছে তিনিই আমাদের স্রষ্টা। একটু ভেবে দেখুন এই উদাহরণটি কিন্তু পদার্থ বিদ্যার ওপরই তৈরি, স্রষ্টাকে জানার প্রথম উপায় কিন্তু সৃষ্টি বিদ্যাই। যদিও পদার্থ বিদ্যার চেয়ে আধ্যাত্মিক বিদ্যা কিন্তু শ্রেষ্ঠ। ঋষি দয়ানন্দ বলেছেন অপরাবিদ্যার (পদার্থবিদ্যা) শ্রেষ্ঠ ফল হলো পরাবিদ্যা(আধ্যাত্মিক বিদ্যা)। ঋষি দয়ানন্দ তার য়জুর্বেদ ভাষ্যের ৪০/১১ মন্ত্রে লিখেছেন -হে মনুষ্য! যে বিদ্বান, যেখানে সমস্ত পদার্থ উৎপন্ন হয় ওই কার্য়রূপ সৃষ্টি ও তার গুণ, কর্ম, স্বভাবকে তথা যেখানে সমস্ত পদার্থ নষ্ট হয় ওই কারণ রূপ জগত ও তার গুণ,কর্ম, স্বভাব কে জানে তিনি মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। এই মন্ত্র বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যে মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত অবশ্যই হতে হবে। একটু লক্ষ্য করে দেখুন যে সকল প্রযুক্তি বিদ্যা পূর্বে ছিল বা আছে সবই কিন্তু পদার্থ বিদ্যারই ফসল যেমন শ্ৰীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র, আকাশে ভ্রমণ করার যান বিমানও কিন্তু পদার্থ বিদ্যা দ্বারাই তৈরি, ঋষি দয়ানন্দই আধুনিক সময়ে সর্বপ্রথম বলেছিল বিমানের কথা। ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশে রামায়ণের তথ্য দিয়ে লিখেছেন শ্রীরাম লঙ্কা জয় করে অযোধ্যায় এসেছিল পুষ্পক বিমানে করে। এখানেই শেষ নয় তিনি ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকায় বিমান বানানোর কিছু সূত্রও বলে গেছে। আমরা জ্যোতিষ শাস্ত্রের কথা সকলেই জানি, যেমন সূর্যসিদ্ধান্ত যা বরাহমিহিরের লেখা, এই জ্যোতিষ শাস্ত্রের সাহায্যে সূর্য্য-চন্দ্রের আবর্তন ও ঋতুপরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় জানা যায়, এই জ্যোতিষ বিদ্যাও পদার্থ বিদ্যারই ফসল। অর্থাৎ দৃঢ় ভাবে বলা যায় যে পদার্থ বিদ্যা ছাড়া সমাজ উন্নতি পর্যন্ত সম্ভব নয়, ঈশ্বর প্রাপ্তি তো দূর।
উক্ত প্রকার যুক্তি তর্ক ও শাস্ত্রীয় প্রমাণ সম্পর্কে জানার পরেও এখনো যদি বলে যে, বেদে নয় বরং উপনিষদে পরাবিদ্যা আছে এবং শুধু পরাবিদ্যা দিয়েই মোক্ষ প্রাপ্তি হওয়া, তারা নিশ্চয় উপনিষদ পড়ে মোক্ষ লাভ করতে পারবে ? আর যারা মনে করে যে, বেদে নয় বরং গীতাই পরাবিদ্যা আছে এবং শুধুমাত্র পরা বিদ্যা দিয়েই মোক্ষ লাভ করা যায়। তারা নিশ্চয় গীতা পড়ে মোক্ষ লাভ করতে পারবে ? আমি এমন ব্যক্তির খোঁজে আছি, যারা গীতা ও উপনিষদ পড়ে মোক্ষ লাভ করেছে! কারোর জানা থাকলে বলবেন যারা মোক্ষ প্রাপ্ত হয় সে তো বিজ্ঞানী কারণ যিনি ঈশ্বর পেয়ে যান তিনি ঈশ্বরের সকল তৈরি সকল পদার্থের জ্ঞান বিজ্ঞান জানতে সক্ষম। যেমন- কিভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হলো, কীভাবে জলের অনু-পরমাণু তৈরি হলো, সূর্য কোথায় থেকে এতো জ্বালানি পাচ্ছে, কিভাবে মন আদি সূক্ষ্ম পদার্থ সৃষ্টি হয় আদি আদি। গীতা বা উপনিষদ পড়ে যারা যারা মোক্ষ লাভ করেছে তারা এদিক ওদিক ফালতু সময় নষ্ট না করে তাদের উচিত নাসা বা ইসরোতে যোগ দেওয়া।
মুণ্ডকোপনিষৎ ১।১।৫
তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ
শিক্ষা কল্পো ব্যকরণং নিরুক্তং ছন্দ জ্যোতিষমমিতি।
অথ পরা যয়া তদক্ষরসমধিগম্যতে।।
অর্থাৎঃ বিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ ইহা অপরা বিদ্যা এবং যাহা দ্বারা সেই অবিনাশী পরমাত্মা প্রাপ্ত হয়, তাহা পরা বিদ্যা।
গীতার ১৫ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো"
অর্থাৎ সমস্ত বেদ দ্বারা আমি (পরমাত্মাই) জানার যোগ্য।
অংতি সম্ভং ন জহাত্যস্তি সম্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি ॥
অথর্ববেদ ১০/৮/৩২।
বঙ্গানুবাদ *- মনুষ্য সমীপবর্তী পরমাত্বাকে দেখেও না,তাহাকে ছাড়িতেও পারে
না। পরমাত্মার কাব্য বেদকে দেখ; তাহা মরেও না, জীর্ণও হয় না।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ