ঈশ্বর সিদ্ধি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 July, 2021

ঈশ্বর সিদ্ধি

মানুষ অজানাকে জানতে চায় এবং যা রহস্যাবঁত তার রহস্য উন্মোচন করতে চায় তার বুদ্ধি নামক বৈশিষ্ট্যের কারণে।  বুদ্ধিবৃত্তির উপস্থিতির কারণে কেবল বর্ত্তমানই নয় বরং অতীত ও ভবিষৎ সম্পর্কেও চিন্তা করতে সক্ষম হয় মানুষ। তবে এটাও সত্য যে অতীত ও ভবিষ্য়তের কোন বিষয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় নয়, পরোক্ষ জ্ঞানের বিষয়। আর সে কারণেই অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে হয় অনুমানের (inference) মাধ্যমে। 

কোনো পূর্ব দৃষ্ট পদার্থের এক অঙ্গকে প্রত্যক্ষ দেখিয়া পরে যদ্দ্বারা পূর্ব দৃষ্ট পদার্থের অদৃষ্ট অঙ্গের যথাবৎ জ্ঞান হইয়া থাকে উহাকে অনুমান বলে।(ন্যায় দর্শন ১।১।৫)

সাংখ্যমতে প্রকৃতির বিবর্ত্তনের ফলে বস্তু উৎপন্ন হয়। আত্মা দোষগুণ অনুসারে কর্মফল ভোগ করে। প্রকৃতির বিবর্ত্তনের মধ্য দিয়েই আত্মার মুক্তিলাভ হয়। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলেই আত্মা মুক্ত হয়। সাংখ্য মতে সব প্রমার (সত্যজ্ঞান) তিনটি উপাদান আবশ্যিক অঙ্গ- একটি হ'ল প্রমাতা (যে জান্ছে), দ্বিতীয়টি হ'ল প্রমেয়, অর্থাৎ যা জানা যাচ্ছে, আর জানার উৎস হ'ল প্রমাণ। বুদ্ধির আত্মাতে বিষয়াকারে যে প্রতিফলন হয়, তাই প্রমাণ। সাংখ্যদর্শনে বুদ্ধি অচেতন (জড়)। সেই বুদ্ধি যখন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন বিষয়ের আকার ধারণ করে এবং ঐ আকারে রূপায়িত বুদ্ধি চৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে প্রতিফলিত হয়, তখনই প্রমা বা সত্যজ্ঞান সম্ভব। কোন বিষয় প্রমানের জন্য প্রমান কি ও কিভাবে তার আলোচনা প্রয়োজন।

সাংখ্য মতে এই জানা কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সব্ভব হয়- প্রথমত, ইন্দ্রিয়গুলিতে একটি ছাপ (impression) পড়ে। তৃতীয়ত, মন, বুদ্ধিএকে বিশ্লেষণ করে। চতুর্থত, বুদ্ধি যে স্বরূপত অচেতন, তাই বিষয়টিকে সরাসরি জানতে পারে না, কিন্তু বিষয়ের আকারে আকারিত হয়। বুদ্ধিতে সত্ত্বিক গুণ থাকার ফলে তা আত্মার চেতন অংশে প্রতিফলিত হয়, ও শেষে বুদ্ধির প্রতিফলনের সাহায্যে আত্মা বস্তুটিকে জানে। প্রত্যক্ষ দুধরনের-- নির্বিকল্প ও সবিকল্প। নির্বিকল্প প্রত্য়ক্ষ ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সলযোগ থেকে উৎপন্ন হয়। এই প্রত্যক্ষ একেবারেই সংবেদন (sensation), বাক্যে একে প্রয়োগ করা যায় না। এই অবস্থাকে আলোচনা বহা হয়। শিশুর যেমন বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে সংবেদন হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনা বিষয়টির নির্দিষ্ট স্বরূপ, তেমনি নির্বিকল্প প্রত্যক্ষেও শুধু সংবেদন হয়। দ্বিতীয় অবস্থা হ'ল সবিকল্প প্রত্যক্ষ। টই প্রত্যক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাতার পূর্ণ জ্ঞান হয়, তখন সে বলতে পারে-" এটি একটি টেবিল", "এটি বই" ইত্যাদি। 

জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস হল অনুমান। সাংখ্যদর্শন মতে কার্যকারণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্র ধরে আমরা প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে পৌঁছাই। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আগুন ও ধোঁয়ার একটি অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক সব সময় দেখেছি। তাই যখনই ধোঁয়া দেখছি তখনই আগুনের অস্তিত্ত্ব অনুমান করছি। এই অনুমান সদর্তক ও নেতিবাচক হ'তে পারে। কোন জানা বিষয়ের ভিত্তি থেকে কোন আজানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা করার প্রক্রিয়া হলো অনুমান। আর এ অনুমান যখন ভাষায় প্রকাশিত হয় তখন তাকে বলে যুক্তি। অনুমান নির্বর জ্ঞান যথার্থ হতে পারে যদি তা সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের চিন্তা সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে কি-না তা বুঝার জন্যই যুক্তিবিদ্যা (logic) মানুষের বিশেষ জ্ঞানের শাখা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, যথার্থভাবে যুক্তি প্রদানের জন্যই যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজন। ঈশ্বরের সর্ববিষয়েই প্রত্যক্ষজ্ঞান নিত্য , তিনি প্রমার (যথার্থ জ্ঞানের) আশ্রয়। তাঁহার প্রত্যক্ষে বাহ্নিক ইন্দ্রিয়াদির প্রয়োজন হয় না।

"অনু" শব্দের অর্থ পশ্চাৎ, আর "মান" শব্দের অর্থ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ বিশেষের পরে প্রতক্ষ্যজনিত যে যথার্থ জ্ঞান, তাহাই "অনুমান" নামক প্রমাণ। যে বস্তুকে সাধন করিতে যাইতেছি, হেতুর সাহায্যে যাহাকে পাইতে চাই, তাহার নাম "সাধ্য"। ধূম দেখিয়া মনে করা আগুনের অস্তিত্ব। ধূপরূপ হেতুর সহায়তায় যে আগুনের অস্তিত্ব স্থির হয় সেই আগুনই "সাধ্য"। যে স্থানে বা অধিকরণে সাধ্যের অস্তিত্ব স্থির করা হয়, তাহার নাম "পক্ষ"। অনুমানের বেলায় হেতু অপেক্ষা সাধ্য বস্তুটি বেশী জায়গা জুড়িয়া থাকে, অন্তত সমান জায়গায় তো থাকবেই, হেতু সকল সময় সাধ্য অপেক্ষা অল্প স্থান জুড়িয়া থাকে, যদি কোথাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়, অর্থাৎ সাধ্য অপেক্ষা হেতু বেশী জায়গায় থাকে, তখন সেই হেতুর সাহায্যে যে অনুমান করা হয় তাহা ভুল। 

সাংখ্যসৃষ্টি তত্ত্বে প্রথম উৎপন্ন যেটি সেটি হ'ল বুদ্ধি। এই বুদ্ধি মননশীল মানুষের প্রধান সম্পদ। তাই এটির গুরুত্ব অসীম। এই বুদ্ধি, মন ও অহলকার এদের কাজ ব্যক্তির অন্তরে। বইরের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্বস্তুর জ্ঞান আহরণে মন, বুদ্ধি ব্যক্তি কে সহায়তা করে। সাংখ্যমতে কতগুলি গুণের সমষ্টি বুদ্ধি, যেমন জ্ঞান, ধর্ম্ম, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্য। কিন্তু এই বুদ্ধি যখন তমোগুণের দ্বারা দূষিত হয়, তখন সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়, ফলে কতগুলি অসৎগুণ যেমন, অজ্ঞান,অধর্ম্ম, অশক্তি ও আসক্তি বুদ্ধিকে আবৃত করে। এই বুদ্ধি মানুষের সমস্ত বৌদ্ধিক কাজকর্মের উৎস স্বরূপ।

সাংখ্যে কোন বস্তু বা বিষয় জানার প্রক্তিয়া যে কতগুলি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ উল্লিখিত হয়েছে, সেগুলি আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে ও মনোবিজ্ঞানে খুবই মূল্যবান। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে জানার উৎস হিসাবে "প্রত্যক্ষ" প্রমান একটি বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে। ইন্দ্রিয় তো জ্ঞান আহরণের দ্বার স্বরূপ।

সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয় বস্তুর সংযোগে যে ছাপ তৈরি হয় সেটিকে মন বুদ্ধি পর্যালোচনা করে-এবং নির্বাচন ও বর্জন (selection and elimination) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্টতায় উন্নীত হয় ও তখন বস্তু বা বিষয়টির সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানলাভ সম্ভব হয়। এই যে সরল থেকে জটিলে, মূর্ত (concrete) থেকে অমূর্তে (abstact) জ্ঞান আহরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরবিন্যাস, তা আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানসন্মত। তাই জন্য শিক্ষাবিজ্ঞানে শিসুদের ইন্দ্রিয় সঞ্চালন, ইন্দ্রিয় পরিমার্জনা আবশ্যিক অঙ্গ। ইন্দ্রিয় অনুশীলিত হলে তবেই মনের দরজায় বুদ্ধির আয়নায় তাদের তথ্যমাগ্রীর জ্ঞান সৌধ হয়ে গড়ে ওঠে। সাংখ্যমতে প্রত্যক্ষের দুটি ধরন একটি নির্বিকল্প, আর একটি সবিকল্প। নির্বিকল্প মনের প্রাক্চেতন (preconscious layer of mind) স্তরে স্থান পেয়েছে।

বিঃদ্রঃ সাংখ্য দর্শনশাত্রের মূল প্রবক্তা হ'লেন কপিলমুনি। পরবর্তীকালে এই দর্শনশাকার বিস্তৃতি ঘটেকপিলমুনির শিষ্য-প্রশিষ্দের বৌদ্ধিক প্রচেষ্টার দ্বারা।

সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা হয় ৫টি উপায়ে , যথা -
১ ) ঈশ্বর তার গুণ , কর্ম , স্বভাব ও বেদ বিদ্যা ।
২ ) সৃষ্টিক্রম
৩ ) প্রত্যক্ষাদি অষ্ট প্রমাণ
৪ ) আপ্ত পুরুষদের আচার , উপদেশ গ্রন্থ ও সিদ্ধান্ত ।
৫ ) স্বীয় আত্মার সাক্ষ্য , অনুকূলতা , জিজ্ঞাসুতা ,
পবিত্রতা ও বিজ্ঞান ।
১ ) ঈশ্বরাদি দ্বারা পরীক্ষা করা -
অর্থাৎ , যা ঈশ্বরের ন্যায়াদি গুণ যা পক্ষপাতরহিত সৃষ্টি রচনা করার কর্ম ও সত্য , ন্যায় , দয়ালুতা , পরোপকারীতাদি স্বভাব ও বেদের উপদেশ দ্বারা সত্য ও ধর্ম স্থির হয় তাই সত্য ও ধর্ম এবং যা অসত্য ও অধর্ম স্থির হয় , তাই অসত্য ও অধর্ম ।
যেমন - কেউ যদি বলেন যে - বিনা কারণ ও কর্তা দ্বারা কার্য্য হয় সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা জানবে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে - যা সৃষ্টি রচনা কারী বস্তু সেটা ঈশ্বর ও তার গুণ , কর্ম , স্বভাব , বেদ ও সৃষ্টিক্রম দ্বারাই নিশ্চিত জানা যায় ।
২ ) সৃষ্টিক্রম -
সৃষ্টিক্রম তাকে বলে যে সৃষ্টিক্রম অর্থাৎ সৃষ্টির গুণ , কর্ম ,স্বভাবের বিরুদ্ধে তা মিথ্যা এবং যা অনুকূলে তা সত্য ।
যেমন - কেউ যদি বলে যে - "বিনা মাতা পিতার সন্তান" , "কান দিয়ে দেখা" , "চোখ দিয়ে বলা" ইত্যাদি হয়েছে সৃষ্টিক্রমের বিরুদ্ধে হওয়ায় তা মিথ্যা এবং মাতা পিতা থেকে সন্তান , কান দিয়ে শোনা, চোখ দিয়ে দেখা ইত্যাদি সৃষ্টির অনুকূল হওয়ায় সত্য।
৩ ) প্রত্যক্ষাদি অষ্ট প্রমাণ দিয়ে পরীক্ষা -
( যদিও আগের পোস্টে একবার আলোচনা করেছি ) যা প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা ঠিক নির্ধারিত হয় তাই সত্য এবং যা বিরুদ্ধ তাকে মিথ্যা বুঝতে হবে।
যেমন - কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করলো - "এটা কি ?" দ্বিতীয়জন উত্তর দিলো - "পৃথিবী"। এটা প্রত্যক্ষ। একে দেখে এর কারণের নিশ্চয় করা অনুমান। যেমন - বিনা নির্মাণকারীর গৃহ তৈরী হতে পারে না সেইরূপ সৃষ্টির নির্মাণকর্তা ঈশ্বরও বিরাট কারিগর । এই দৃষ্টান্ত উপমান এবং সত্যোপদেষ্টাদের উপদেশ তা শব্দ । ভূতকালস্থ পুরুষদের চেষ্টা , সৃষ্টি ইত্যাদি পদার্থের বৃত্তান্ত এই গুলি ঐতিহ্য । একটা কথা শুনে অন্য কথা না শুনে , প্রসঙ্গমাত্র জেনে অন্য কথা জেনে যাওয়া এ অর্থাপত্তি। কারণ থেকে কার্য হওয়া ইত্যাদিকে সম্ভব , আর কেউ কাউকে বললো জল নিয়ে এসো। সে স্থানে জলের অভাব দেখে তর্কের মাধ্যমে জানতে পারে জল কোথায় এবং সেখান থেকে জল নিয়ে এসে দেয়। একেই অভাব প্রমাণ বলে। এই অষ্ট প্রমাণ থেকে যা বিপরীত না হয় তাকে সত্য এবং যা বিরুদ্ধ তাকে মিথ্যা জানবে।
৪ ) আপ্ত পুরুষদের আচরণ ও সিদ্ধান্ত -
যারা সত্যবাদী , সত্যকারী , সত্যমানী , পক্ষপাত শূন্য , সকলের হিতাকাঙ্খি বিদ্বান সকলের জন্য চেষ্টা করেন , তাদের ধার্মিক ব্যক্তিরা আপ্ত পুরুষ বলে । তাদের উপদেশ , আচরণ , গ্রন্থ ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে যা যুক্ত তাই সত্য এবং যা বিপরীত তাই মিথ্যা ।
৫ ) আত্মা দিয়ে পরীক্ষা -
যা আত্মা নিজের জন্য চায় , তাই সকলের জন্য চাওয়া , আর যা না চায় , তার কারো জন্য না চাওয়া , যেমন আত্মায় তেমন মনে , যেমন মনে সেইরূপ প্রক্রিয়ায় পরিণত করার ইচ্ছা , শুদ্ধ ভাবও বিদ্যার নেত্র দিয়ে দেখে সত্য ও অসত্যের নিশ্চয় করা দরকার ।

এই পাঁচ প্রকার পরীক্ষা দ্বারা সত্য ও অসত্যের নিশ্চয় হয় ।অধ্যাপন অধ্যয়নকারী এবং সব মনুষ্য সত্যাসত্যের নির্ণয় করে ধর্ম গ্রহণ এবং অধর্মের পরিত্যাগ করবেন ।

 যোগসূত্রকার পতঞ্জলির মতে যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ (যোগসূত্র )

সন্ধি ভাঙলে , যোগঃ + চিত্তবৃত্তি,  নিরোধঃ।  অর্থাৎ যোগ হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ।  

 -- সাংখ্য দর্শনে যে অন্তঃকরণ কে মহত্তত্ব বা বুদ্ধিত্তত্ব বলা হয়েছে, সেটি ই এখানে যোগ দর্শনে চিত্ত বা মন ।

 -- চিত্ত জ্ঞান অর্জন ও নিশ্চিত করণে সাহায্য করে , এছাড়া,  সবকিছুর অর্থ চিন্তন করে । চিন্তন চিত্তে র একটি প্রধান কাজ , যা চিতি (চেতন তত্ত্ব) র সাহায্য নিয়ে করে । তাই চিতি ধাতু থেকে চিত্ত শব্দ সিদ্ধ হয় ক্ত প্রত্যয় যোগে।  চিতি সংজ্ঞানে (ভ্বাদী)  ও চিতি স্মৃত্যাম্  (চুরাদি) , অর্থাৎ অর্থ চিন্তন ও স্মরণ , দুটি কাজ ই চিত্ত করে ।  

যার যা কার্য , তাকেই মূলত বৃত্তি বলে । যেমন আমরা কিন্তু চোখ দিয়ে দেখিনা । দেখা চোখের কাজ নয় । আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও তাই বলে , চোখ ক্যামেরা,  শুধু বস্তুর ছবি তোলে , তুলে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে সেই ছবি টাকে ব্রেণে পাঠায় , চোখের কাজ এটুকুই , তাই চোখের কাজ দেখা নয় । তাই মৃত্যুর পরেও এক ঘন্টা চোখ সচল থাকে , প্রতিস্থাপন করা যায়,  কিন্তু চোখ সচল থাকা সত্তেও মৃত ব্যক্তি দেখতে পায় না । এ থেকে আরো স্পষ্ট হয় , দেখা চোখের কাজ নয় । ঠিক তেমনি মনের কাজ অর্থ চিন্তন ও স্মরণ । আমাদের চিত্ত পাঁচটি দশায় কাজ করে , ক্ষিপ্ত,  মূঢ় , বিক্ষিপ্ত এবং একাগ্র ও নিরুদ্ধ।  এই পাঁচ দশাতে উক্ত কর্ম ই চিত্তের বৃত্তি।  এই পাঁচ অবস্থায় আত্ম জ্ঞান সম্ভব নয় , তাই এই পাঁচ দশাথেকে চিত্তকে মুক্ত করলে , চিত্ত তার বৃত্তির দ্বারা আর প্রভাবিত থাকবে না , এটাই চিত্তবৃত্তি নিরোধ।  যোগের মূল উদ্দেশ্য ই এটি।

কার্য মাত্রেই কর্ত্তা ও করণকে অপেক্ষা করে, কর্ত্তা ও করণ না থাকিলে কার্য্য জন্মে না। বস্ত্র প্রভৃতি কার্য্যের কর্ত্তা তন্তুবায় প্রভৃতি করণ তুরী (মাকু) প্রভৃতি ও তুরীর সহিত তন্তুর সংযোগ ব্যাপার। তাহার ন্যায় জ্ঞানও একটি কার্য্য বলিয়া, তাহার কর্ত্তা ও করণ অবশ্যই আছে। তাই বলা হয় সমস্ত বিষয়ে তিনটি বস্তু আবশ্যক। যাহার যত্নে কার্য্য জন্মায় সেই কর্ত্তা। যাহার ব্যাপারের অনন্তরই কার্য্য উৎপন্ন হয় তাহার নাম করণ। আত্মার যত্নে জ্ঞান জন্মাতেছে, এজন্য জ্ঞানের কর্ত্তা আত্মা। ইন্দ্রিয় ও ব্যাপ্তি জ্ঞানাদি প্রভৃতির ব্যাপারের অনন্তর জ্ঞান উৎপন্ন হয় এজন্য ইন্দ্রিয় ও ব্যপ্তিজ্ঞানাদি জ্ঞানের করণ; ঐ যথার্ত জ্ঞানের করণই প্রমান। 

‘অবিজ্ঞাত-তত্ত্বেহর্থে কারণোপপত্তিতস্তত্ত্বজ্ঞানার্থম্ ঊহঃ তর্কঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪০)

অর্থাৎ : ‘অবিজ্ঞাততত্ত্ব’ পদার্থে অর্থাৎ সামান্যতঃ জ্ঞাত যে পদার্থের তত্ত্ব অবিজ্ঞাত, এমন পদার্থ বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞানের নিমিত্ত, কারণের উপপত্তি অর্থাৎ প্রমাণের সম্ভবপ্রযুক্ত ‘ঊহ’ (জ্ঞানবিশেষ) হচ্ছে তর্ক।  তর্ক হলো এমন এক প্রাকল্পিক যুক্তি (a hypothetical argument) যা কোনো স্বীকৃত সিদ্ধান্তের বিপরীত বক্তব্যকে অসম্ভব প্রমাণ করার জন্য প্রদর্শন করা হয় এবং তার দ্বারা পরোক্ষভাবে মূল সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণ করা হয়। যেমন- পর্বতে ধূম থাকলেও কেউ যদি পর্বতে অগ্নির অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা এরূপ তর্ক প্রয়োগ করেন যে ‘যদি অগ্নি না থাকে তাহলে ধূম অগ্নিজন্য না হোক্’। 

প্রমান বহুবিধ-প্রত্যক্ষ,অনুমান,উপমান ও শব্দ ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্রকারগন প্রমানের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা স্বীকার করেন। মীমাংসা-শাস্ত্রকার জৈমিনি দুইটি প্রমাণ স্বীকার করেন। গৌতম ন্যায় শাস্ত্রকার আটটি প্রমাণ স্বীকার করেন। কেহ অর্থাৎ অন্য ন্যায়-শাস্ত্রকার চারটি স্বীকার করেন। পতঞ্জলি যোগ শাস্ত্রকার তিনটি স্বীকার করেন। বেদান্তে ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করা হইয়াছে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা স্বীকার করা ইহা সেই সমস্ত শাস্ত্রকারদের বিষয়ানুরূপে করা হইয়াছে।

"ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ। মুক্তবদ্ধযোরন্যতরাভবাবান্ন তসিদ্ধিঃ।

উভযথাপ্যসৎকরত্ম। মুক্তাত্মনঃ প্রশংসা উপাসাসিদ্ধস্য বা।"

                                                      [সাংখ্য ১।৯২-৯৩-৯৪-৯৫]

ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ-সাং অঃ সূঃ ১২

প্রমাণাভাবান্ন তৎসিদ্ধিঃ- সাং অঃ৫ সূঃ১০

সন্বন্ধভাবান্নানুমানম্- সাং অঃ সূঃ ১১

সমস্ত প্রমাণ সমূহের (একটি অপরটিতে) অন্তর্ভাব করিয়া তিনটি প্রমাণ অবশিষ্ট থাকিয়া যাইতেছে- প্রত্যক্ষ,আনুমান ও শব্দ। 

সাংখ্যমতে ঐ প্রমাণ চারি প্রকারে বিভক্ত হইয়াছে যথা প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান ও শব্দ। প্রত্যক্ষ শব্দটি জ্ঞানবিশেষকে বুঝায় ও জ্ঞান বিশেষের করণকেও বুঝায়। 

বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ ৮ প্রকার (১) প্রত্যক্ষ (২) অনুমান (৩) উপমান (৪) শব্দ (৫)ঐতিহ্য (৬) অর্থাপত্তি (৭)সম্ভব এবং (৮) অভাব  

১) প্রত্যক্ষানুমানোপমানশব্দাঃ (প্রমাণানি ন্যায়0 অঃ১ আহ্নিকঃ ১সূত্রঃ ৩)

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ নামে প্রমাণপদার্থ চতুর্বিধ।

যাহা প্রসিদ্ধ শব্দাদি পদার্থের সহিত শ্রোত্রাদী ইন্দ্রিয় ও মনের নিকট সম্বন্ধ হইতে জ্ঞান জন্মে উহাকে প্রত্যক্ষ বলে 

ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষোৎপন্নং জ্ঞানমব্যপদেশ্য

মব্যভিচারি ব্যবসায়ত্মকং প্রত্যক্ষম্ ইতি।।(প্রমাণানি ন্যায়0 অঃ১ আহ্নিকঃ ১সূত্রঃ ৪)

চক্ষু,ত্বক ও নাসিকা প্রভিতি বাহ্য ইন্দ্রিয়, কিলবা আভ্যন্তরিক ইন্দ্রিয় মনঃ, বিষয়কে প্রাপ্ত হইয়া, যে অব্যভিচারি, অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানের জনক হয়, সেই জ্ঞানের নাম প্রত্যক্ষ প্রমিতি। চক্ষু ও জ্বিহ্বাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা রূপ রসাদির

যাহা সাক্ষাৎকার হয় উক্ত সাক্ষাৎকারই প্রত্যক্ষ প্রমিতি। এস্থানে এই আশঙ্কার হইতে পারে, চক্ষু যখন বাহ্য বস্তুর প্রত্যক্ষ উৎপাদন করে, তৎকালে চক্ষু শরীরেই থাকে শরীর হইতে নির্গত হয় না।  কিরূপে ঘটাদিতে সংযুক্ত হইয়া,

তাহার প্রত্যক্ষ সম্পাদন করে, এই সঙ্কা বিশেষ বিবেচনা করিলে, দূরীকৃত অবশ্যই হইবে। করাণ দীপ, গৃহাদির একদেশে থাকিলেও তাহার প্রভা সমস্ত গৃহকে ব্যপিয়া উদ্ভাসিত করে, সেরূপ চক্ষু পদার্থ তেজস "অর্থাৎ তেজঃ স্বরূপ" তৎপ্রযুক্ত তাহার সূক্ষ্ম প্রভা নির্গত হয়।

উক্ত সূক্ষ্ম প্রভা অগ্রবর্ত্তী পদার্থকে প্রাপ্ত হইয়া এই মনুষ্য এইটী গো ইত্যাদি জ্ঞান সম্পাদন করিয়া দেয়। যদিও মতান্তরে আলোক সহযোগ বস্তু সকল চক্ষুতে প্রতিবিম্বিত হিলে সেই বস্তুর প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। কিন্তু ঐ মতটী যুক্তিসিদ্ধ বলা যায় না কারণ চন্দ্র ও নক্ষত্রগণ দূরে আছে এইরূপ প্রত্যক্ষ হয় প্রতিবিম্ব হইলে দূর কদাচ বোধ হইতে পারে না কারণ মধ্যে আকাশমাত্র আছে আকাশ নিরাকার তাহার প্রতিবিম্ব সম্ভব নহে। ত্বগিন্দ্রিয় প্রায় সমস্ত শরীর ব্যাপ্ত হইয়া থাকে অতএব হস্তপদাদি অবয়বেব সহিত শীত উষ্ণাদি কোন বস্তু সংযুক্ত হইলেই তারা প্রত্যক্ষ হয়। রসনেন্দ্রিয় রসযুক্ত পদার্থকে প্রাপ্ত হইয়া তাহার মাধুর্য্যাদি গুণকে সাক্ষাৎকার করায়, এবং নাসিকাও ঐরূপে গন্ধকে গ্রহণ করায়, তদ্রুপ কর্ণেন্দ্রিয় শব্দকে প্রত্যক্ষ করায়। কোন রক্তবস্তু-সমীপস্থিত স্ফটিকাদিতে যে রক্ততা প্রত্যক্ষ হয়, ঐ প্রতক্ষটী ভ্রমাত্মক। কারণ স্ফটিক শুক্লবর্ণ তাহাতে রক্তবর্ণ জ্ঞানটী অযথার্থ, এজন্য তদ্বারণের নিমিত্ত, সূত্রে অব্যভিচারি অর্থাৎ ভ্রমভিন্ন বিশেষণ দিয়াছেন। ইন্দ্রিয় ও বিষয় এই উভয়ের, যে সম্বন্ধ থাকিলে প্রত্যক্ষ হয়, ঐ সম্বন্ধকে সন্নিকর্ষ বলে। উক্ত সন্নিকর্ষ ছয় প্রকার। যথা সংযোগ, সংযুক্তসমবায়, সংযুক্তসমবেতসমবায়, সমবায়, সমবেতসমবায়, বিশেষণতা। 

তাহার মধ্যে প্রথমতঃ ইন্দ্রিয় দ্রব্যে যুক্ত হয়, এজন্য দ্রব্য প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ সংযোগ। গুণ ও ক্রিয়া এবং দ্রব্যেতে যে জাতি থাকে, তাহার প্রত্যক্ষে সংযুক্তসমবায় সন্নিকর্ষ। তাহার কারণ, প্রথমতঃ ইন্দ্রিয়ের দ্রব্যেতে সংযোগ সম্বন্ধ হয়, পরে ঐ দ্রব্যের সমবায়-রূপ-সম্বন্ধ গুণাদিতে আছে এজন্য সংযুক্ত দ্রব্য সমবায় সন্নিকর্ষ। সর্ব্বত্রেই এই রূপ প্রণালী। গুণ এবং ক্রিয়াতে যে জাতি থাকে, তাহার প্রত্যক্ষে সংযুক্তসমবেত সমবায়। অভাব প্রত্যক্ষে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ। ঐ প্রত্যক্ষ দুই প্রকারে বিভক্ত। তন্মধ্যে প্রথম অব্যপদেশ বা নির্ব্বিকল্প বলে। ঐ জ্ঞানটী ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রথম জন্মায়, ইহা গোত্বধর্ম্ম ও গো-ধর্ম্মি প্রভৃতিকে পৃথক রূপে বিষয় করে অর্থাৎ গোত্বাদির গবাদিতে সম্বন্ধকে বিষয় করে না। দ্বিতীয় ব্যবসায়ত্মক ইহাকে সবিকল্প কহে। এই প্রত্যক্ষ গবাদিতে গোত্বাদির সম্বন্ধকে বিষয় করে। এজন্য গোত্ববিশিষ্ট গো এইরূপ প্রত্যক্ষের আকার হইয়া থাকে।।

কোন ব্যাপ্য পদার্থকে দর্শন করিয়া, অন্য কোন ব্যাপকের যে নিশ্চয় হয়, সেই অনুমিতি। যে কোন পদার্থ দেখিলেই অন্যের নিশ্চয় হয় এরূপ নহে, তাহা হইলে, গো দেখিলে ঘোটকের নিশ্চয় হিত ও ঘট দেখিলে পটের নিশ্চয় হইত, এজন্য ব্যাপ্য দেখিলেই ব্যাপকের নিশ্চয় হয় ইহাই অবধারণ করিতে হইবে। যথা ধূম দর্শন করিয়া পর্ব্বত ও গৃহাদিতে অগ্নির, ও নদীবৃদ্ধি দেখিলে বৃষ্টির, পত্র দর্শন দ্বারা লেখকের জীবিত্বের নির্নয় প্রায় সকলেরই হইয়া থাকে। এস্থলে ধূমটী বহ্নির ব্যাপ্য, কারন ব্যাপ্তিবিশিষ্ট যে হয় তাহার নাম ব্যাপ্য, সাধ্যশূন্য দেশে অর্থাৎ সাধ্যটি যে স্থানে না থাকে সেই দেশে অসম্ভাব অর্থাৎ তদ্দেশে না থাকা তাহাকে সাধ্যের ব্যাপ্তি কহে। সাধ্যশব্দটী যাহার অনুমিতি হয় তাহার নাম। এ স্তলে বহ্নির ও বৃষ্টি প্রভৃতির অনুমিতি হইতেছে, এজন্য বহ্নি ও বৃষ্ট্যাদি সাধ্য। বহ্নিশূন্য দেশে কদাচ ধূম তাকে না অর্থাৎ বহ্নি যে দেশে নাই, সে স্তলে ধূমের অসদ্বাব আছে, একারণে ধূম বহ্নির ব্যাপ্য। বৃষ্টি না হইলে কোন রূপেই নদীবৃদ্ধি হয় না। যে স্থানে অধিক বৃষ্টি হয় সেই স্থানেই নদীর বৃদ্ধি হয়। একারণ বৃষ্টির ব্যপ্য নদীবৃদ্ধিকে বলিতে হইবে, ও জীবন না তাকিলে লেখা কদাচ ঘটিতে পারে না, এজন্য লেখনটীও জীবনের ব্যপ্য ইহাতে সন্দেহ নাই। পর্ব্বতাদিতে বহ্নিব্যাপ্য ধূমাদির দর্শন হইয়া তৎপরে বহ্নিব্যপ্য ধূমবিশিষ্ট পর্ব্বাতাদি, এবং বৃষ্টিব্যাপ্য নদীবৃদ্ধিবিশিষ্ট দেশাদি নিশ্চয় হয় তদনন্তর বহ্নিমান্ পর্ব্বতাদি এবং নদীবৃদ্ধিবিশিষ্ট দেশাদিরূপ অনুমিতি জন্মে। ঐ বহ্ন্যাদির নির্ণয়কে প্রত্যক্ষ বলা যায় না, কারণ, যে যে পদার্থের প্রত্যক্ষ হয়, তাহার সহিত ইন্দ্রিয়ের সংযোগ না হইয়া জন্মে না। এস্তলে পর্ব্বতাদিতে যে বহ্নির নির্ণয় কিলবা দেশাদিতে বৃষ্টির নির্ণয় তাহাতে কোন ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ নাই, এবং কোন বাক্য দ্বারা ঐ জ্ঞানটী জন্মাইতেছে না বিধায ঐটী শাব্দবোধও কোন রূপে হইতে পারে না। এজন্য সাধ্যব্যাপ্য হেতুবিশিষ্ট পক্ষ পর্ব্বতাদি রূপ জ্ঞান হইয়া যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাহারই নাম অনুমিতি। ঐ অনুমিতির করণ যে হইবে সেই অনুমান। সাধ্যব্যাপ্য হেতুবিশিষ্ট পক্ষজ্ঞানজন্য জ্ঞানত্ব অনুমিতির লক্ষণ, বহ্নিব্যাপ্তি বিশিষ্ট ধূম এইরূপ যে জ্ঞান প্রথম জন্মায় সেই করণ। 

২) কোনো পূর্ব দৃষ্ট পদার্থের এক অঙ্গকে প্রত্যক্ষ দেখিয়া পরে যদ্দ্বারা পূর্ব দৃষ্ট পদার্থের অদৃষ্ট অঙ্গের যথাবৎ জ্ঞান হইয়া থাকে উহাকে অনুমান বলে ।

৩) কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে বলিল নীল গাভী (গবয়) দেখিতে গাভীর ন্যায় । এইরুপ উপমা দ্বারা যে সাদৃশ্য-জ্ঞান জন্মায় তাহাকে উপমান বলে ।

৪) যাহা পূর্ণ আপ্ত পরমেশ্বর এবং আপ্ত পুরুষের উপদেশ তাহাকে শব্দ বলে । (সাংখ্য দার্শনিকেরা বেদ ভিত্তিক শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না।)

৫) যাহা শব্দ প্রমানের অনুকূল এবং যাহা অসম্ভব তথা মিথ্যা লিখিত নহে ,উহাকে ইতিহ্য (ইতিহাস) বলে ।

৬) একটি কথা বলিবার পর অপরটি না বলিলেও যাহার পরিচয় পাওয়া যায় , উহাকে অর্থাপত্তি বলে ।

৭) যে বাক্যটি প্রমাণ যুক্তি এবং সৃষ্টি ক্রমানুমোদিত উহাকে সম্ভব বলে ।

৮) এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বললো - "তুমি জল আনো" আদিষ্ট ব্যক্তি দেখিলো যে , সেখানে জল নাই কিন্তু যেখানে জল আছে সেখানে থেকে জল আনা প্রয়োজন বোধ করিল । এই অভাব নিমিত্ত যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় উহাকে অভাব বলে ।

প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান ও শব্দ তিনটি প্রমাণের লাপিকা করিয়া ঈশ্বর বিষয়ক প্রযত্ন করিবার সময় প্রত্যক্ষের লাপিকা করিয়া পূর্ব অনুমানের লাপিকা করা উচিত। কারন, প্রত্যক্ষের জ্ঞান অতীব সংকুচিত এবং ক্ষুদ্র (অল্প)। লাপিকা শব্দ আ-লাপিকার এক অংশ, উদাঃ সত্যভামা-ভামা। আলাপ অর্থাৎ বিচার-বিবেচনা। একক ব্যক্তির পক্ষে ইন্দ্রিয় দ্বারা কতটুকু জ্ঞান সম্ভব..? 

এ কারণ প্রত্যক্ষকে একদিকে রাখিয়া শাস্ত্রীয় বিষয়ে অনুমানকেই বিশেষ রূপে গণ্য করা হইয়াছে। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে [ও] অনুমান আবশ্যক। অনুমান ব্যতীত ভবিষ্য়তের ব্যবহারিক বিষয়ে আমাদের যে স্থির নিশ্চয়, উহা নিরর্থক হইবে। আগামী কাল সূর্য উদয় হইবে, ইহা প্রত্যক্ষ নহে, ততাপি এ বিষয়ে কাহারও মনে তিল মাত্রও সন্দেহ হয়না। এবার এই অনুমানের তিনটি প্রকার ভেদ দেখা যায় -পূর্ব্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট, তন্মধ্যে কারণহেতুক (অর্থাৎ কারণ দ্বারা কার্য্যের অনুমান) অনুমানের নাম পূর্ব্ববৎ যথা উন্নতমেঘবিশেষ দর্শন করিয়া শীঘ্র বৃষ্টি হিবে এইরূপ অনুমিতি। এবং রোগ বিশেষ দেখিয়া, মৃত্যু হইবে এইরূপও অনুমিতি জন্মে, এস্থলে বৃষ্টির কারণ উন্নত মেঘ ও মৃত্যুর কারণ রোগ বিশেষ। ইহারা হেতু জ্ঞাপক হওয়ায় ঐ অনুমিতি সকল কারণ লিঙ্গক অনুমিতি হইতেছে।

কার্য্যহেতুক অনুমান ( কার্য্য দ্বারা কারণের অনুমান) অর্থাৎ কার্য্যকে হেতু করিয়া কারণের যে অনুমিতি হয় তাহার করণকে শেষবৎ কহে। যথা ধূমাদি দর্শন করিয়া, বহ্ন্যাদির অনুমিতি, এবং নদীবৃদ্ধি দেখিয়া অতীত বৃষ্টির অনুমিতি হয়। এবং কার্য্য ও কারণ ভিন্ন হেতুক যে অনুমান (অর্থাৎ সংসারে যেরূপ ব্যবস্থা দৃষ্ট হয় উহা দ্বারা যে অনুমান হইয়া তাকে, উহা) সেই সামান্যতো দৃষ্ট যথা, জন্যত্ব দেখিয়া বিনাশিত্নের অনুমিতি এবং শৃঙ্গ দেখিয়া পশুতে পুচ্ছের অনুমিতি উৎপন্ন হয়, তাহার করণ ইত্যাদি।

পূর্ববৎ, শেষবৎ, সামান্যতো দৃষ্ট -এই তিন প্রকার অনুমানের লাপিকা [বিচার বিবেচনা] করিলে ঈশ্বর পরমপুরুষ সনাতন ব্রহ্ম সর্ব পদার্থের বীজ, ইহা সিদ্ধ হইয়া যায়। রচনারূপী কার্য দৃষ্ট হয়। 

ঈশ্বর বিষয়ক
য এতং দেবমেকমৃতং বেদ।।
ন দ্বিতীয় ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।।
ন অষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।।
-[অথর্ববেদ ১৩/৪/১৫]
পদার্থ - (যে) যিনি (এতং দেবম্) এই প্রকাশস্বরূপ পরেমেশ্বরকে (একবৃতং বেদ) একক বর্তমান বলে জানেন, তিনি জানেন যে সেই পরেমেশ্বর (না দ্বিতীয়) না দ্বিতীয় (ন তৃতীয়) না তৃতীয় (ন চতুর্থ) না চতুর্থ (অপি উচ্যতে) বলেও অভিহিত হন। (ন পঞ্চম) না পঞ্চম (ন ষষ্ঠ) না ষষ্ঠ (না সপ্তম) না সপ্তম (অপি উচ্যতে) বলেও অভিহিত হন। (ন অষ্টম)না অষ্টম (ন নবম) না নবম (ন দশম) না দশম (অপি উচ্যত) বলেও অভিহিত হন। তিনি কেবল এক।

অহমস্মি প্রথমজা ঋতস্য পূর্বং দেবেভ্যো অমৃতস্য নাম যো মা দদাতি স ইদেবমাবদহমন্নমন্নমদন্তমদ্মি।।
-[ সামবেদ ৫৯৪]
পদার্থ - (অহম্) আমি পরমেশ্বর (ঋতস্য) সর্বত্র দৃশ্যমান সত্য নিয়মের (প্রথমজা অস্মি) প্রথম উৎপন্নকারী। (দেবেভ্য) সূর্য, চন্দ্রাদি দেবতাসকলের (পূর্বম্) পূর্বেও বিদ্যমান ছিলাম। (অমৃতস্য নাম) আমি মোক্ষসুখের কেন্দ্র। (যঃ) যে (মা) আমাতে (দদাতি) নীজের আত্মাকে সমর্পণ করে (সঃ ইৎ এব) নিশ্চিতরূপে সেই (মা) আমাকে (অবৎ) প্রাপ্ত হয়। (অহম্) আমি (অন্নম্) অন্ন এবং আমিই (অন্নম্ অদন্তম্) অন্ন ভক্ষণকারী প্রত্যেক প্রাণিকে (অদ্মি) ভক্ষণ করি,অর্থ্যাৎ প্রলয়কালে গ্রাস করি।

য এক ইৎ তমু ষ্টুহি কৃষ্টীনাং বিচর্ষণিঃ।
পতির্জজ্ঞে বৃষক্রতুঃ।।
-[ঋগ্বেদ ৬/৪৫/১৬]
পদার্থ - হে মানব! (যঃ) যিনি (এক ইত্) এক ও অদ্বিতীয় (কৃষ্টিনাম) মনুষ্যদের (পতি) পালক (বিচর্ষণিঃ) সর্বদ্রষ্টা (বৃষক্রতু জজ্ঞে) ও সর্বশক্তিমান (তম্ উ) কেবল সেই পরমেশ্বরেরই (স্তুহি) স্তুতি কর।

হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ত্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীত্।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।
-[ঋগ্বেদ ১০/১২১/১, যজুর্বেদ ১৩/৪]
পদার্থ - (হিরণ্যগর্ভ) যার গর্ভে সূর্যাদি জ্যোতিষ্কমণ্ডলী স্থান পেয়েছে। (ভূতস্য) উৎপন্ন জগতের যিনি (একঃ) একক (জাতঃ) রচনা ও (পতি) পালনকারী (অগ্রে) জগত রচনার পূর্বেও (সমবর্ত্তত অাসীত্) যিনি বিদ্যমান ছিলেন (ইমাম পৃথিবীম্) এই পৃথিবী (উত্) ও (দ্যাম্) অাকাশকে (দাধার) যিনি ধারণকারী (সঃ) সেই (কস্মৈ) সুখস্বরূপ (দেবায়) প্রকাশস্বরূপ পরমেশ্বরকে (হবিষা)প্রেম, ভক্তি ও নানা সামগ্রী দ্বারা (বিধেম) পূজা করি।


বিজ্ঞানের বিষয়ে আমরা এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের সাথে যা আলোচনা করেছি, সে থেকে একটি ধারণা আসে যে বিজ্ঞানীরা 'কেন' প্রশ্নের উত্তর দেন না কারণ তাদের দৃষ্টিতে এটি বিজ্ঞানের বিষয় নয়। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্তরে নিম্নলিখিত প্রশ্নোত্তর শব্দগুলির মুখোমুখি হই 1. কেন 2. কে 3. কার জন্য 4 কি ৫. কীভাবে ইত্যাদি এই প্রশ্নগুলির মধ্যে, বর্তমান বিজ্ঞান 'কী', 'কীভাবে' এর উত্তর সম্পর্কে চিন্তা করার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও এই দুটি প্রশ্নের সম্পূর্ণ সমাধান বিজ্ঞানের সাথে নয়, তবে চেষ্টা অবশ্যই সততার সাথে করা হচ্ছে। এই তিনটি প্রশ্ন সম্পর্কে 'কী', 'কারা' এবং 'কার জন্য' চিন্তা করা অন্যান্য প্রশ্নগুলিও আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষে আগ্রহের বিষয় নয়। আমরা যথাক্রমে এই প্রশ্নের অর্থ বিবেচনা করি- 1. কেন- এই প্রশ্নটি উদ্দেশ্যটির জন্য অনুসন্ধানের অনুরোধ জানায়। আমরা অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের ক্রিয়াকলাপ করি এবং অনেক তরল সংগ্রহ করি। তাদের সবারই কিছু উদ্দেশ্য আছে। যে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর কোনও না কোনও উদ্দেশ্য বা প্রবণতার প্রবণতা থাকে। বোকা মানুষ উদ্দেশ্যহীন কাজে নিযুক্ত হলেও জ্ঞানী মানুষ কখনই তা করতে পারে না। এটি কেন নির্মিত এবং পরিচালিত হচ্ছে তা বিশ্বকে বিবেচনা করুন। এর প্রতিটি ক্রিয়াকলাপের কোনও না কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে। 'কেন' প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে কোনও বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে পুরো মহাবিশ্ব একটি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি? আমাদের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষের প্রথমে 'কেন' প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করা উচিত। যে কোনও কর্ম সম্পাদনের আগে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য জানেন, তেমনিভাবে এই জগতের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং শারীরিক সত্তার জন্ম সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করা উচিত। আজ, অনেক গবেষণা করার পরেও তিনি বর্তমান বিজ্ঞানের এই প্রশ্ন থেকে দূরে থাকার কারণে তাদের উদ্দেশ্যমূলক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলি বিবেচনা করেন না। এই কারণে আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এমনকি জীবন যাপনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে মানুষ অশান্তি ও দুঃখের জালে জড়িয়ে পড়ছে, উপভোগের চরম আকাঙ্ক্ষায় ভ্রষ্ট হচ্ছে। ২. কে - এই প্রশ্নটি 'কেন' সম্পর্কিত। কোন উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা হচ্ছে, এগুলি ছাড়াও এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রশ্নগুলিও বিদ্যমান, কে এই কাজটি সম্পন্ন করেছে বা কে এটি সম্পন্ন করেছে অর্থাৎ এর পৃষ্ঠপোষক কে? এই সৃষ্টির প্রতিটি ক্রয়ের একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে, এর স্পনসর একটি সচেতন উপাদান। কোনও মূল পদার্থের স্পনসর নেই। মূল উপাদানটি উদ্দেশ্যটির জন্য উপাদান হয়ে উঠতে পারে তবে এর স্পনসর অর্থাৎ স্পনসর নয়। সচেতন উপাদান সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং মূল উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করে। সচেতন হওয়া স্বাধীন, চেতনার কর্তব্য ধারণ করে, মূল বিষয়টি নিখরচায় নয়, এটি কৌতূহল জাগাতে পারে না। ৩. কাদের জন্য - এই প্রশ্নটি বিবেচনা করে যে কোনও কাজকারী যদি কিছু করে বা করণীয় করে থাকে তবে সে নিজেই এটি করছে বা অন্য কোনও সচেতন উপাদানটির জন্য করছে? এখানে একজন গ্রাহক থাকবেন এবং ভোক্তা সচেতনও হন। মূল উপাদানটি নিজেই গ্রাস করতে পারে না বা এটি অন্যান্য মূল উপাদান ব্যবহার করতে পারে না। ৪. কী- এই প্রশ্নটি পদার্থের প্রকৃতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে। পৃথিবী কী? এর প্রকৃতি কী? মৌলিক কণা কী? শক্তি এবং অর্থ কী? শক্তি কী? এই সমস্ত প্রশ্নের সমাধান এই ক্ষেত্রের বিষয়। বর্তমান বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করে। এর অঞ্চলটি খুব প্রশস্ত। বর্তমান বিজ্ঞান এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে সক্ষম নয়। বিজ্ঞান যেখানে অক্ষম হয়ে ওঠে, বৈদিক বিজ্ঞান, কিন্নব দর্শন তার উত্তর দেয়। ৫. কীভাবে- কীভাবে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়? পৃথিবী কীভাবে তৈরি হয়? পদার্থ এবং শক্তি কীভাবে আচরণ করে? কিভাবে জোর কাজ করে? এই সমস্ত প্রশ্নের সমাধান এই ক্ষেত্রের বিষয়। বর্তমান বিজ্ঞান এই ক্ষেত্রে কাজ করে তবে এর সম্পূর্ণ সন্তোষজনক উত্তর নেই। অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর না জেনে সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই পাঁচটি প্রশ্ন ছাড়াও আরও কিছু প্রশ্ন রয়েছে, যা কেবল এই পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে থাকতে পারে।

‘তন্ত্রাধিকরণাভ্যূপগমসং স্থিতিঃ সিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৬)
অর্থাৎ : তন্ত্রাধিকরণের অর্থাৎ প্রমাণবোধিত পদার্থসমূহের স্বীকার-সংস্থিতি হচ্ছে সিদ্ধান্ত
এই সিদ্ধান্ত পদার্থ চারপ্রকার। ন্যায়সূত্রে এ সম্বন্ধে মহর্ষি বলেছেন-
‘স চতুর্ব্বিধঃ সর্ব্বতন্ত্র-প্রতিতন্ত্রাদিকরণাভ্যুপগমসং স্থিত্যর্থান্তরভাবাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৭)
অর্থাৎ : কিন্তু তন্ত্রের ভেদপ্রযুক্ত সেই সিদ্ধান্ত পদার্থ চতুর্বিধ, যেহেতু- সর্বতন্ত্রসংস্থিতি, প্রতিতন্ত্রসংস্ kথিতি, অধিকরণসংস্থিতি ও অভ্যুপগমসংস্থিতির ‘অর্থান্তভাব’ (পরস্পর ভেদ) আছে।
তার মানে সিদ্ধান্ত চার প্রকার, যথা- সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত, প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত, অধিকরণসিদ্ধান্ত ও অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘সর্ব্বতন্ত্রাবিরুদ্ধস্তন্ত্রেঃ অধিকৃতোহর্থঃ সর্ব্বতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৮)
অর্থাৎ : তারমধ্যে সর্বশাস্ত্রে অবিরুদ্ধ, শাস্ত্রে কথিত পদার্থ হলো সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত বুঝাতে ‘ন্যায়ভাষ্যে’ উদাহরণ দিয়ে বলেছেন- ‘যেমন ঘ্রাণাদি ইন্দ্রিয়, গন্ধ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ার্থ, ক্ষিতি প্রভৃতি ভূত, প্রমাণের দ্বারা পদার্থের যথার্থ জ্ঞান হয়, ইত্যাদি সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত’ (যথা ঘ্রাণাদীনীন্দ্রিয়াণি, গন্ধাদয় ইন্দ্রিয়ার্থাঃ, পৃথিব্যাদীনি ভূতানি, প্রমাণৈরর্থস্য গ্রহণমিতি)।
প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘সমানতন্ত্রসিদ্ধঃ পরতন্ত্রাসিদ্ধঃ প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৯)
অর্থাৎ : সমানতন্ত্রসিদ্ধ অর্থাৎ একশাস্ত্র বা স্বশাস্ত্রসিদ্ধ, (কিন্তু) পরতন্ত্রে (অন্য শাস্ত্রে) অসিদ্ধ (পদার্থ) হচ্ছে প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
যেমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যা সমানতন্ত্র হিসেবে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে সিদ্ধান্ত করা হয় যা অন্য দর্শনে অস্বীকৃত। একইভাবে সাংখ্য ও যোগ সমানতন্ত্র শাস্ত্র, মীমাংসা ও বেদান্ত সমানতন্ত্র শাস্ত্র, ফলে এগুলির মধ্যে মৌলিক কিছু সিদ্ধান্তে মতপার্থক্য থাকলেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সমানতান্ত্রিক।
এরপর অধিকরণসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-
‘যৎসিদ্ধাবন্যপ্রকরণসিদ্ধঃ সোহধিকরণসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩০)
অর্থাৎ : যে পদার্থের সিদ্ধিবিষয়ে অন্য ‘প্রকরণে’র অর্থাৎ অন্য আনুষঙ্গিক পদার্থের সিদ্ধি হয়, সেই পদার্থ হলো অধিকরণসিদ্ধান্ত।
যেমন বৃত্তিকার বিশ্বনাথ জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্বকে অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন। কারণ, জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্ব ছাড়া সৃষ্টির প্রথমে উৎপদ দ্ব্যণুকাদির সকর্তৃকত্ব সিদ্ধ হয় না। যে পদার্থ ব্যতীত যা সিদ্ধ হয় না, সেই পদার্থই তার সিদ্ধিতে ‘অনুষঙ্গী’ পদার্থ। নৈয়ায়িক উদ্দ্যোতকর প্রভৃতি সেই অনুষঙ্গী পদার্থকেই অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন।
অতঃপর অভ্যুপগমসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-
‘অপরীক্ষিতাভ্যূপগমাৎ তদ্বিশেষপরীক্ষণম্ অভ্যুপগমসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩১)
অর্থাৎ : (যে স্থলে) অপরীক্ষিত পদার্থের স্বীকারপ্রযুক্ত অর্থাৎ প্রমাণাদির দ্বারা বিচারপূর্বক অনির্ণীত কোন পরসিদ্ধান্তের (আপাত) স্বীকার করে যখন সেই ধর্মীর বিশেষধর্মের পরীক্ষা অর্থাৎ বিচার করা হয়, (সেই স্থলে সেই স্বীকৃত পরসিদ্ধান্ত) হচ্ছে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত বুঝাতে গিয়ে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ব্যাখ্যানুসারে, যে স্থলে প্রতিবাদী নিজের অসম্মত কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই কোন পদার্থের বিশেষ ধর্মের পরীক্ষা বা বিচার করেন, সেই স্থলে তাঁর আপাত স্বীকৃত সেই পরসিদ্ধান্তই তাঁর পক্ষে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত। যেমন, কোন বাদী শব্দকে নিত্য ও দ্রব্যপদার্থ বললে, তখন প্রতিবাদী নৈয়ায়িক যদি বলেন যে, আচ্ছা, শব্দ দ্রব্যপদার্থই হোক, কিন্তু তা নিত্য অথবা অনিত্য, সেটি পরীক্ষণীয়। এভাবে নৈয়ায়িক শব্দের দ্রব্যত্ব মেনে নিয়েই তার বিশেষ ধর্ম নিত্যত্ব ও অনিত্যত্ব বিষয় বিচার করলে সেই স্থলে তাঁর স্বীকৃত ঐ পরসিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে ‘অভ্যুপগম-সিদ্ধান্ত’।
নির্ণয় : নির্ণয় হলো এমন এক যুক্তি যার সাহায্যে এক পক্ষের মতকে বর্জন করে অপর পক্ষের মতকে গ্রহণ করা হয়। পরস্পরবিরোধী মতবাদ বিচার করে একটিকে বর্জন করে অপরটিকে গ্রহণ করার নাম নির্ণয়। সোজা কথায়, নির্ণয় হলো স্বীকৃত প্রমাণের দ্বারা একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিমৃশ্য পক্ষপ্রতিপক্ষাভ্যামর্থ অবধারণং নির্ণয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪১)
অর্থাৎ : তর্কবিষয়ে অর্থাৎ পূর্বোক্ত তর্কস্থলে- সংশয় করে পক্ষ ও প্রতিপক্ষের দ্বারা অর্থাৎ স্বপক্ষের সংস্থাপন এবং পরপক্ষের সাধনের খন্ডনের দ্বারা পদার্থের অবধারণ হচ্ছে নির্ণয়।

"প্রমাণৈরর্থ-পতিপত্তৌ প্রবৃত্তিসামর্থ্যাদর্থবৎ প্রমাণং"।-ন্যায়ভাষ্য় ১।১।। এই ন্যায় অনুসার যে বস্তুটি হইবে,উহাই সত্য।
ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থ
ন্যায় দর্শনের উদ্দেশ্য হলো ষোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করা। এই ষোলটি পদার্থ হলো- (১) প্রমাণ, (২) প্রমেয়, (৩) সংশয়, (৪) প্রয়োজন, (৫) দৃষ্টান্ত, (৬) সিদ্ধান্ত, (৭) অবয়ব, (৮) তর্ক, (৯) নির্ণয়, (১০) বাদ, (১১) জল্প, (১২) বিতণ্ডা, (১৩) হেত্বাভাস(কুযুক্তি / ফ্যালাসি), (১৪) ছল, (১৫) জাতি, (১৬) নিগ্রহস্থান ।
ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতম তাঁর ‘ন্যায়সূত্রে’র প্রথম সূত্রেই বলেছেন-
‘প্রমাণ-প্রমেয়-সংশয়-প্রয়োজন-
দৃষ্টান্ত-সিদ্ধান্তাবয়ব-তর্ক-নির্ণয়-বাদ-জল্প-
বিতন্ডা-হেত্বাভাসচ্ছল-জাতি-নিগ্রহস্থানানাং
তত্ত্বজ্ঞানান্নিঃশ্রেয়সাধিগমঃ।। (ন্যায়সূত্র-১/১/১) ।
অর্থাৎ : সেই অর্থাৎ মোক্ষোপযোগী এই ভাব পদার্থেরই প্রকার- প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতন্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি ও নিগ্রহস্থানের অর্থাৎ এই ষোল প্রকার পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানপ্রযুক্ত নিঃশ্রেয়স লাভ হয় ।
সাধারণত আমরা পদার্থ বলতে যা বুঝি এখানে পদার্থ অর্থ তা নয়। ন্যায় মতে পদার্থের অর্থ হচ্ছে- ‘পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ’ । পদের অর্থই হলো পদার্থ। অর্থাৎ, কোন পদ দ্বারা যে অর্থ বা বিষয় নির্দেশিত হয়, তাই পদার্থ । প্রতিটি পদার্থই জ্ঞেয়, প্রমেয় এবং অভিধেয় । অর্থাৎ যাকে জানা যায়, যার সত্তা আছে এবং যার নামকরণ করা যায়, তাই পদার্থ । ন্যায়দর্শন অনুযায়ী পদার্থগুলির তত্ত্বজ্ঞান জীবের মোক্ষ লাভের জন্য একান্ত প্রয়েজন ।
উল্লেখ্য, ন্যায়দর্শন হলো অনিয়ত পদার্থবাদী দর্শন । যে দর্শনে পদার্থের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, সেটিই হলো অনিয়তপদার্থবাদী দর্শন । যদিও ন্যায়দর্শনে ষোলটি পদার্থের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পদার্থ ষোলটি একথা বলা হয়নি । মুক্তির উপায় হিসাবে ষোলটি পদার্থের জ্ঞান উপযোগী একথাই কেবল বলা হয়েছে। একারণে ন্যায়দর্শন হলো অনিয়ত পদার্থবাদী দর্শন ।
(১) প্রমাণ : ‘প্র’ পূর্বক ‘মা’ ধাতুর উত্তর করণবাচ্যে অনট্ প্রত্যয় দ্বারা প্রমাণ শব্দ নিষ্পন্ন হয়। ‘মা’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান। ‘প্র’ উপসর্গের অর্থ প্রকৃষ্ট বা উৎকৃষ্ট। জ্ঞানের পক্ষে উৎকৃষ্টতা হলো ভ্রান্তিশূন্যতা। ‘অনট্’-প্রত্যয়ের অর্থ করণ অর্থাৎ কারণ বিশেষ। যাহার ব্যাপার বা কার্য হলে কর্তা ক্রিয়া নিষ্পন্ন করেন সেই কারণকেই করণ বলা হয়। অর্থাৎ, যে প্রণালী দ্বারা প্রমা বা যথার্থজ্ঞান লাভ করা যায় তাকেই প্রমাণ বলা হয়। ন্যায়মতে যথার্থজ্ঞান চারপ্রকার- প্রত্যক্ষণ, অনুমিতি, উপমিতি এবং শাব্দবোধ। ফলে এই চারপ্রকার যথার্থজ্ঞানের করণ বা প্রমাণও যথাক্রমে চারপ্রকার- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘প্রত্যক্ষানুমানোপমানশব্দাঃ প্রমাণানি’।। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ নামে প্রমাণপদার্থ চতুর্বিধ।
কোনো কিছুর প্রকৃত জ্ঞান লাভ করার পদ্ধতিকে প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণের মধ্যে আমরা জ্ঞানের সব উৎস পাই। দর্শনের বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রমাণের এক বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। তা নিয়ে পরে বিস্তৃত আলোচনা হবে।
(২) প্রমেয় : প্রমেয় হলো যথার্থ অনুভব বা জ্ঞানের বিষয়। ন্যায়মতে প্রমেয়ের জ্ঞান মোক্ষলাভের সহায়ক। প্রমেয় বা জ্ঞানের বিষয় বারোটি- আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়ের বিষয় বা অর্থ, বুদ্ধি অর্থাৎ জ্ঞান বা উপলব্ধি, মন, প্রবৃত্তি বা ধর্ম ও অধর্ম, দোষ অর্থাৎ রাগ, প্রেত্যভাব অর্থাৎ পুনর্জন্ম, মোহ বা মৃত্যু, ফল অর্থাৎ কর্মজন্য সুখ-দুঃখের অনুভূতি, দুঃখ এবং অপবর্গ বা মোক্ষ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘আত্ম-শরীরেন্দ্রিয়ার্থ-বুদ্ধি-মনঃ-প্রবৃত্তি-
দোষ-প্রেত্যভাব-ফল-দুঃখাপবর্গাস্তু প্রমেয়ম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৯)
অর্থাৎ : আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ অর্থাৎ এই দ্বাদশ প্রকার পদার্থই প্রমেয় পদার্থ।
এই প্রমেয় পদার্থগুলির প্রত্যেকটির লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে সূত্রকার ‘ন্যায়সূত্রে’ বলেছেন-
‘ইচ্ছা-দ্বেষ-প্রযত্ন-সুখ-দুঃখ-জ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১০)
‘চেষ্টেন্দ্রিয়ার্থাশ্রয়ঃ শরীরম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১১)
‘ঘ্রাণরসনচক্ষুস্ত্বক্-শ্রোত্রাণীন্দ্রিয়াণি ভূতেভ্যঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১২)
‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
‘গন্ধরসরূপস্পর্শশব্দাঃ পৃথিব্যাদিগুণাস্তদর্থাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৪)
‘বুদ্ধিরুপলব্ধির্জ্ঞানমিত্যনর্থান্তরম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৫)
‘যুগপজ্-জ্ঞানানুৎপত্তির্স্মনসো লিঙ্গম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৬)
‘প্রবৃত্তির্ব্বাগ্ বুদ্ধিশরীরারম্ভঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৭)
‘প্রবর্ত্তনালক্ষণা দোষাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)
‘পুনরুৎপত্তিঃ প্রেত্যভাবঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৯)
‘প্রবৃত্তিদোষজনিতোহর্থঃ ফলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২০)
‘বাধনালক্ষণং দুঃখম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২১)
‘তদত্যন্তবিমোক্ষোহপবর্গঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২২)
অর্থাৎ :
ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ ও জ্ঞান আত্মার লিঙ্গ অর্থাৎ দেহাদিভিন্ন চিরস্থায়ী জীবাত্মার অনুমাপক (ন্যায়সূত্র-১/১/১০)। চেষ্টার আশ্রয়, ইন্দ্রিয়ের আশ্রয় এবং অর্থের (সুখ-দুঃখের) আশ্রয় শরীর (ন্যায়সূত্র-১/১/১১)। ভূতবর্গজন্য অর্থাৎ যথাক্রমে পৃথিব্যাদি পঞ্চভূতমুলক ঘ্রাণ, রসন, চক্ষুঃ, ত্বক ও শ্রোত্র হলো ইন্দ্রিয় (ন্যায়সূত্র-১/১/১২)। ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)। পৃথিব্যাদির গুণ (পূর্বোক্ত পঞ্চভূতের গুণ) গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ হলো ‘তদর্থ’ বা ইন্দ্রিয়ার্থ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৪)। বুদ্ধি, উপলব্ধি, জ্ঞান এগুলি অর্থান্তর নয়, অর্থাৎ একই পদার্থ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৫)। একই সময়ে জ্ঞানের অর্থাৎ বিজাতীয় নানা প্রত্যক্ষের অনুৎপত্তি বা উৎপত্তি না হওয়াই মনের লিঙ্গ বা অনুমাপক। যার সংযোগের অভাবে অন্য ইন্দ্রিয়জন্য প্রত্যক্ষ জন্মে না তাই হলো মন (ন্যায়সূত্র-১/১/১৬)। বাচিক, মানসিক ও শারীরিক শুভাশুভ কর্মই প্রবৃত্তি (ন্যায়সূত্র-১/১/১৭)। প্রবৃত্তিজনকত্ব যাদের লক্ষণ এবং অনুমাপক, সেই সমস্ত হলো দোষ অর্থাৎ রাগ, দ্বেষ ও মোহ (ন্যায়সূত্র-১/১/১৮)। পুনরুৎপত্তি অর্থাৎ মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হচ্ছে প্রেত্যভাব (ন্যায়সূত্র-১/১/১৯)। প্রবৃত্তি এবং দোষ-জনিত পদার্থ (সুখ-দুঃখের অনুভব) হচ্ছে ফল (ন্যায়সূত্র-১/১/২০)। এই সমস্তই অর্থাৎ পূর্বোক্ত শরীর থেকে ফল পর্যন্ত সমস্ত প্রমেয়ই বাধনালক্ষণ অর্থাৎ দুঃখানুষক্ত দুঃখ (ন্যায়সূত্র-১/১/২১)। তার সাথে (পূর্বোক্ত মুখ্য গৌণ সবধরনের দুঃখের সাথে) অত্যন্ত মুক্তি হচ্ছে মোক্ষ বা অপবর্গ (ন্যায়সূত্র-১/১/২২)।
(৩) সংশয় বা সন্দেহ : সংশয় হলো একপ্রকার অনিশ্চিত জ্ঞান। কোনো বস্তু ঠিক কী হবে নির্ণয় করতে না পেরে বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে মনে যে সন্দেহ হয় তাকে সংশয় বলে। একই সময়ে একই বস্তুতে পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম বা গুণের উপস্থিতির জ্ঞান বা চিন্তা করা হলে তখনই সংশয় দেখা দেয়। যেমন- ‘এটি স্থানু অথবা পুরুষ’ এরূপ জ্ঞান। তাই অনিশ্চিত জ্ঞানই হলো সংশয়। এই সংশয় বা সন্দেহ প্রসঙ্গে ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে-
‘সমানানেক ধর্ম্মোপপত্তেঃ র্ব্বিপ্রতিপত্তেঃ উপলব্ধ্যনুপলব্ধঃ অব্যবস্থাতশ্চ বিশেষাপেক্ষো বিমর্শঃ সংশয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৩)
অর্থাৎ : সাধারণ ধর্মবিশিষ্ট ধর্মীর জ্ঞানজন্য, অসাধারণ ধর্মবিশিষ্ট ধর্মীর জ্ঞানজন্য, বিপ্রতিপত্তিজন্য অর্থাৎ এক পদার্থে বিরুদ্ধার্থ-প্রতিপাদক বাক্যজন্য, উপলব্ধির অব্যবস্থাজন্য, এবং অনুপলব্ধির অব্যবস্থাজন্য ‘বিশেষাপেক্ষ’ অর্থাৎ যাতে পূর্বে বিশেষ ধর্মের উপলব্ধি হয় না, কিন্তু বিশেষ ধর্মের স্মৃতি আবশ্যক, এমন ‘বিমর্শ’ অর্থাৎ একই পদার্থে নানা বিরুদ্ধ পদার্থের জ্ঞান হচ্ছে সংশয়।
(৪) প্রয়োজন : মানুষ যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মে প্রবৃত্ত হয় তাকেই প্রয়োজন বলা হয়। প্রয়োজন হলো সেই উদ্দেশ্য যা লাভ বা পরিহারের জন্য মানুষকে প্রবৃত্ত করায়। আমরা কোনো বাঞ্ছনীয় বিষয়কে পাওয়ার জন্য কাজ করি অথবা অবাঞ্ছনীয় জিনিস থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কাজ করি। এই দুটোই হলো আমাদের কর্মের উদ্দেশ্য। এই দুই ধরনের কর্মে প্রবৃত্ত হওয়াকে প্রয়োজন বলা হয়। এককথায়, প্রয়োজন হলো সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখের বিনাশ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘যমর্থমধিকৃত্য প্রবর্ত্ততে তৎ প্রয়োজনম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৪)
অর্থাৎ : যে পদার্থকে অধিকার করে অর্থাৎ গ্রাহ্য বা ত্যাজ্যরূপে নিশ্চয় করে (জীব) প্রবৃত্ত হয়, তা-ই প্রয়োজন।
(৫) দৃষ্টান্ত : দৃষ্টান্ত হলো প্রমাণসিদ্ধ উদাহরণ। যার সম্বন্ধে কোনো মতভেদ থাকে না, বাদী ও প্রতিবাদী উভয়ই যা স্বীকার করে নেয় তাকে দৃষ্টান্ত বলে। যেমন, কোনো জায়গায় ধূম দেখে যদি সিদ্ধান্তে আসে যে ‘সেখানে আগুন আছে’, তখন দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বলন্ত চুল্লির উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে; কারণ জ্বলন্ত চুল্লিতে ধূম ও অগ্নির সহাবস্থান সকলেই জানেন। অর্থাৎ, দৃষ্টান্ত হলো অনুমানের সহায়ক ব্যাপ্তি সম্বন্ধের সমর্থসূচক বস্তু, যেমন পাকশালা। এ সম্বন্ধে সূত্রকার বলেছেন-
‘লৌকিকপরীক্ষকাণাং যস্মিন্নর্থে বুদ্ধিসাম্যং স দৃষ্টান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৫)
অর্থাৎ : লৌকিকদের এবং পরীক্ষকদের যে পদার্থে বুদ্ধির সাম্য (অবিরোধ) হয়, তা দৃষ্টান্ত।
(৬) সিদ্ধান্ত : সিদ্ধান্ত হলো কোনো বিষয় সম্পর্কে শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। যেমন ন্যায়দর্শনের একটি সিদ্ধান্ত হলো- আত্মা এক প্রকার দ্রব্য যেখান থেকে চেতনাগুণকে আলাদা করা যায় অর্থাৎ চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ। সহজ কথায়, সিদ্ধান্ত হলো কোন কিছু যা প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘তন্ত্রাধিকরণাভ্যূপগমসং স্থিতিঃ সিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৬)
অর্থাৎ : তন্ত্রাধিকরণের অর্থাৎ প্রমাণবোধিত পদার্থসমূহের স্বীকার-সংস্থিতি হচ্ছে সিদ্ধান্ত।
এই সিদ্ধান্ত পদার্থ চারপ্রকার। ন্যায়সূত্রে এ সম্বন্ধে মহর্ষি বলেছেন-
‘স চতুর্ব্বিধঃ সর্ব্বতন্ত্র-প্রতিতন্ত্রাদিকরণাভ্যুপগমসং স্থিত্যর্থান্তরভাবাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৭)
অর্থাৎ : কিন্তু তন্ত্রের ভেদপ্রযুক্ত সেই সিদ্ধান্ত পদার্থ চতুর্বিধ, যেহেতু- সর্বতন্ত্রসংস্থিতি, প্রতিতন্ত্রসংস্থিতি, অধিকরণসংস্থিতি ও অভ্যুপগমসংস্থিতির ‘অর্থান্তভাব’ (পরস্পর ভেদ) আছে।
তার মানে সিদ্ধান্ত চার প্রকার, যথা- সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত, প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত, অধিকরণসিদ্ধান্ত ও অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘সর্ব্বতন্ত্রাবিরুদ্ধস্তন্ত্রেঃ অধিকৃতোহর্থঃ সর্ব্বতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৮)
অর্থাৎ : তারমধ্যে সর্বশাস্ত্রে অবিরুদ্ধ, শাস্ত্রে কথিত পদার্থ হলো সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত বুঝাতে ‘ন্যায়ভাষ্যে’ উদাহরণ দিয়ে বলেছেন- ‘যেমন ঘ্রাণাদি ইন্দ্রিয়, গন্ধ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ার্থ, ক্ষিতি প্রভৃতি ভূত, প্রমাণের দ্বারা পদার্থের যথার্থ জ্ঞান হয়, ইত্যাদি সর্বতন্ত্রসিদ্ধান্ত’ (যথা ঘ্রাণাদীনীন্দ্রিয়াণি, গন্ধাদয় ইন্দ্রিয়ার্থাঃ, পৃথিব্যাদীনি ভূতানি, প্রমাণৈরর্থস্য গ্রহণমিতি)।
প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তের লক্ষণে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘সমানতন্ত্রসিদ্ধঃ পরতন্ত্রাসিদ্ধঃ প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/২৯)
অর্থাৎ : সমানতন্ত্রসিদ্ধ অর্থাৎ একশাস্ত্র বা স্বশাস্ত্রসিদ্ধ, (কিন্তু) পরতন্ত্রে (অন্য শাস্ত্রে) অসিদ্ধ (পদার্থ) হচ্ছে প্রতিতন্ত্রসিদ্ধান্ত।
যেমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যা সমানতন্ত্র হিসেবে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে সিদ্ধান্ত করা হয় যা অন্য দর্শনে অস্বীকৃত। একইভাবে সাংখ্য ও যোগ সমানতন্ত্র শাস্ত্র, মীমাংসা ও বেদান্ত সমানতন্ত্র শাস্ত্র, ফলে এগুলির মধ্যে মৌলিক কিছু সিদ্ধান্তে মতপার্থক্য থাকলেও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সমানতান্ত্রিক।
এরপর অধিকরণসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-
‘যৎসিদ্ধাবন্যপ্রকরণসিদ্ধঃ সোহধিকরণসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩০)
অর্থাৎ : যে পদার্থের সিদ্ধিবিষয়ে অন্য ‘প্রকরণে’র অর্থাৎ অন্য আনুষঙ্গিক পদার্থের সিদ্ধি হয়, সেই পদার্থ হলো অধিকরণসিদ্ধান্ত।
যেমন বৃত্তিকার বিশ্বনাথ জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্বকে অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন। কারণ, জগৎকর্তার সর্বজ্ঞত্ব ছাড়া সৃষ্টির প্রথমে উৎপদ দ্ব্যণুকাদির সকর্তৃকত্ব সিদ্ধ হয় না। যে পদার্থ ব্যতীত যা সিদ্ধ হয় না, সেই পদার্থই তার সিদ্ধিতে ‘অনুষঙ্গী’ পদার্থ। নৈয়ায়িক উদ্দ্যোতকর প্রভৃতি সেই অনুষঙ্গী পদার্থকেই অধিকরণসিদ্ধান্ত বলেছেন।
অতঃপর অভ্যুপগমসিদ্ধান্তের লক্ষণে সূত্রকার বলেছেন-
‘অপরীক্ষিতাভ্যূপগমাৎ তদ্বিশেষপরীক্ষণম্ অভ্যুপগমসিদ্ধান্তঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩১)
অর্থাৎ : (যে স্থলে) অপরীক্ষিত পদার্থের স্বীকারপ্রযুক্ত অর্থাৎ প্রমাণাদির দ্বারা বিচারপূর্বক অনির্ণীত কোন পরসিদ্ধান্তের (আপাত) স্বীকার করে যখন সেই ধর্মীর বিশেষধর্মের পরীক্ষা অর্থাৎ বিচার করা হয়, (সেই স্থলে সেই স্বীকৃত পরসিদ্ধান্ত) হচ্ছে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত।
অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত বুঝাতে গিয়ে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ব্যাখ্যানুসারে, যে স্থলে প্রতিবাদী নিজের অসম্মত কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই কোন পদার্থের বিশেষ ধর্মের পরীক্ষা বা বিচার করেন, সেই স্থলে তাঁর আপাত স্বীকৃত সেই পরসিদ্ধান্তই তাঁর পক্ষে অভ্যুপগমসিদ্ধান্ত। যেমন, কোন বাদী শব্দকে নিত্য ও দ্রব্যপদার্থ বললে, তখন প্রতিবাদী নৈয়ায়িক যদি বলেন যে, আচ্ছা, শব্দ দ্রব্যপদার্থই হোক, কিন্তু তা নিত্য অথবা অনিত্য, সেটি পরীক্ষণীয়। এভাবে নৈয়ায়িক শব্দের দ্রব্যত্ব মেনে নিয়েই তার বিশেষ ধর্ম নিত্যত্ব ও অনিত্যত্ব বিষয় বিচার করলে সেই স্থলে তাঁর স্বীকৃত ঐ পরসিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে ‘অভ্যুপগম-সিদ্ধান্ত’।
(৭) অবয়ব : অবয়ব হলো ন্যায়দর্শন স্বীকৃত পরার্থানুমান বা অনুমানের অন্তর্গত যে-কোনো একটি অঙ্গ। পরার্থানুমানের পাঁচটি অবয়ব। অবয়ব প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্ অবয়বাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩২)
অর্থাৎ : প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পঞ্চবাক্য অবয়ব।
প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পাঁচটি বাক্যকে ন্যায়ের অবয়ব বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ-
১. পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)
২. কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)
৩. যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি (উদাহরণ)
৪. পর্বত ধূমায়মান (উপনয়)
৫. সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন)
অবয়ব নিয়ে পরে ভিন্নভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
(৮) তর্ক : তর্ক হলো এমন এক প্রাকল্পিক যুক্তি (a hypothetical argument) যা কোনো স্বীকৃত সিদ্ধান্তের বিপরীত বক্তব্যকে অসম্ভব প্রমাণ করার জন্য প্রদর্শন করা হয় এবং তার দ্বারা পরোক্ষভাবে মূল সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণ করা হয়। যেমন- পর্বতে ধূম থাকলেও কেউ যদি পর্বতে অগ্নির অস্তিত্ব অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা এরূপ তর্ক প্রয়োগ করেন যে ‘যদি অগ্নি না থাকে তাহলে ধূম অগ্নিজন্য না হোক্’। তর্কের সংজ্ঞায় ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘অবিজ্ঞাত-তত্ত্বেহর্থে কারণোপপত্তিতস্তত্ত্বজ্ঞানার্থম্ ঊহঃ তর্কঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪০)
অর্থাৎ : ‘অবিজ্ঞাততত্ত্ব’ পদার্থে অর্থাৎ সামান্যতঃ জ্ঞাত যে পদার্থের তত্ত্ব অবিজ্ঞাত, এমন পদার্থ বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞানের নিমিত্ত, কারণের উপপত্তি অর্থাৎ প্রমাণের সম্ভবপ্রযুক্ত ‘ঊহ’ (জ্ঞানবিশেষ) হচ্ছে তর্ক।
.
তর্ক প্রসঙ্গে উদয়নাচার্য্যরে মতানুসারেই বরদরাজ তাঁর ‘তার্কিকরক্ষা’য় বলেছেন-
‘তর্কোহনিষ্টপ্রসঙ্গঃ স্যাদনিষ্টং দ্বিবিধং স্মৃতং।
প্রামাণিকপরিত্যাগস্তথেতরপরিগ্রহঃ।।’- (তার্কিকরক্ষা)
অর্থাৎ : অনিষ্টের প্রসঙ্গ বা আপত্তিই তর্ক। সেই অনিষ্ট প্রামাণিক পদার্থের পরিত্যাগ এবং অপ্রামাণিক পদার্থের স্বীকার।
.
যেমন ‘জলপান পিপাসার নিবর্তক নয়’ একথা বললে আপত্তি হয় যে, তাহলে পিপাসু ব্যক্তিরা জল পান না করুক? মহানৈয়ায়িক উদয়নাচার্য্যরে মতে ‘তর্ক’পদার্থ পঞ্চবিধ- আত্মাশ্রয়, ইতরেতরাশ্রয়, চক্রকাশ্রয়, অনবস্থা ও অনিষ্টপ্রসঙ্গ তর্ক।
কোন পদার্থ নিজের উৎপত্তি অথবা স্থিতি অথবা জ্ঞানে অব্যবধানে নিজেকে অপেক্ষা করলে একারণে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘আত্মাশ্রয়’। আর সেই পদার্থ অপর একটি পদার্থকে অপেক্ষা করে আবার নিজেকেই অপেক্ষা করলে সেকারণে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘ইতরেতরাশ্রয়’ বা ‘অন্যোন্যাশ্রয়’। এইরূপ অপর দুটি পদার্থ বা ততোধিক পদার্থকে অপেক্ষা করে আবার নিজেকেই অপেক্ষা করলে তার ফলে যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাকে বলে ‘চক্রকাশ্রয়’। আর যে আপত্তির কোথাও বিশ্রাম বা শেষ নেই, এমন যে ধারাবাহিক আপত্তি, তাকে বলে ‘অনবস্থা’। এভাবে অনন্ত আপত্তিমূলক যে অনিষ্টাপত্তি হয়, তাও ‘অনবস্থা’ নামে কথিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্থলে ঐরূপ আপত্তি সর্বমতে প্রমাণসিদ্ধ হলে তা ‘অনবস্থা’রূপ তর্ক হবে না। কারণ, সেরূপ স্থলে সেটি সকল মতেই ইষ্টাপত্তি। এই চারপ্রকার তর্ক ছাড়া বাকি সমস্ত তর্কই ‘অনিষ্টপ্রসঙ্গ’ নামে পঞ্চম প্রকার তর্ক।
.
(৯) নির্ণয় : নির্ণয় হলো এমন এক যুক্তি যার সাহায্যে এক পক্ষের মতকে বর্জন করে অপর পক্ষের মতকে গ্রহণ করা হয়। পরস্পরবিরোধী মতবাদ বিচার করে একটিকে বর্জন করে অপরটিকে গ্রহণ করার নাম নির্ণয়। সোজা কথায়, নির্ণয় হলো স্বীকৃত প্রমাণের দ্বারা একটি বিষয়ের নিশ্চয়তা। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিমৃশ্য পক্ষপ্রতিপক্ষাভ্যামর্থ অবধারণং নির্ণয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪১)
অর্থাৎ : তর্কবিষয়ে অর্থাৎ পূর্বোক্ত তর্কস্থলে- সংশয় করে পক্ষ ও প্রতিপক্ষের দ্বারা অর্থাৎ স্বপক্ষের সংস্থাপন এবং পরপক্ষের সাধনের খন্ডনের দ্বারা পদার্থের অবধারণ হচ্ছে নির্ণয়।
.
(১০) বাদ : বাদ হলো তত্ত্বকে জানার জন্য একপ্রকার কথা বা আলোচনা। প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা তত্ত্বনির্ণয়ের উদ্দেশ্যে আলোচনাকেই বাদ বলা হয়। যেমন আত্মার অস্তিত্ব আছে আবার নেই, দুটো সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরূপ ক্ষেত্রে আত্মার যথার্থ স্বরূপ নির্ণয় করার জন্য যে আলোচনা তাই হলো বাদ। গুরু-শিষ্যের দার্শনিক আলোচনা বাদ-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাদ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘প্রমাণ-তর্ক-সাধনোপালম্ভঃ সিদ্ধাস্তাবিরুদ্ধঃ পঞ্চাবয়বোপপন্নঃ পক্ষপ্রতিপক্ষপরিগ্রহো বাদঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪২)
অর্থাৎ : যাতে প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা ‘সাধন’ (স্বপক্ষস্থাপন) এবং ‘উপালম্ভ’ (পরপক্ষখণ্ডন) হয়, এমন ‘সিদ্ধান্তবিরুদ্ধ’ ও পঞ্চাবয়বযুক্ত ‘পক্ষপ্রতিপক্ষ-পরিগ্রহ’ অর্থাৎ যাতে বাদী ও প্রতিবাদীর স্বীকৃত বিরুদ্ধ-ধর্মদ্বয়রূপ পক্ষ ও প্রতিপক্ষের পরিগ্রহ হয়, এমন বাক্যসমূহ হচ্ছে ‘বাদ’।
.
(১১) জল্প : কোন তত্ত্বনির্ণয়ের প্রতি লক্ষ্য না রেখে কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য যে নিছক বাক্-যুদ্ধ চলে, তাকেই বলা হয় জল্প। জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মপক্ষ সমর্থন। এখানে শাস্ত্রনীতি লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে। সোজা কথায়, জল্প সেই আলোচনা যার লক্ষ্য তত্ত্বজ্ঞান নয়, যার একমাত্র লক্ষ্য জয়লাভ করা। ন্যায়সূত্রে জল্প প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘যথোক্তোপপন্নশ্ছল-জাতি-নিগ্রহস্থান-সাধনোপালম্ভো জল্পঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৩)
অর্থাৎ : পূর্বসূত্রে বাদের লক্ষণে কথিত সমস্ত বিশেষণবিশিষ্ট হয়ে ‘ছল’, ‘জাতি’ ও সমস্ত ‘নিগ্রহস্থানে’র দ্বারা যাতে সাধন ও উপালম্ভ (পরপক্ষখণ্ডন) করা যায়, তা হচ্ছে জল্প।
(১২) বিতণ্ডা : বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক। এক্ষেত্রে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে অপরের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার আলোচনা যার লক্ষ্য তত্ত্বজ্ঞান নয়, জয়লাভ করাও নয়, যার একমাত্র লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে খণ্ডন করা। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘স প্রতিপক্ষস্থাপনাহীনো বিতণ্ডা’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৪)
অর্থাৎ : সেই জল্প, প্রতিপক্ষের স্থাপনাশূন্য হলে বিতণ্ডা হয়।
.
(১৩) হেত্বাভাস : হেত্বাভাস অনুমান সংক্রান্ত অনুপপত্তি বা অনুমানের হেতু সংক্রান্ত দোষ। যে হেতুতে সৎ হেতুর লক্ষণের কোন একটির অভাব থাকে সেটিই অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস দোষদুষ্ট হেতু। আসলে হেতু নয় অথচ হেতুর আভাস বা হেতুর মতো দেখায় তাকে হেত্বাভাস বলে। হেত্বাভাসের লক্ষণে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেছেন-
‘হেতুলক্ষণাভাবাদহেতবো হেতুসামান্যাৎ হেতুবদাভাসমানাঃ’। (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : হেতুর সমস্ত লক্ষণ না থাকায় অহেতু অর্থাৎ প্রকৃত হেতু নয়, এবং হেতুর সামান্য বা সাদৃশ্য থাকায় হেতুর ন্যায় প্রকাশমান, এটাই ‘হেত্বাভাস’ শব্দের অর্থ।
.
হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার। এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-প্রকরণসম-সাধ্যসম-কালাতীতা হেত্বাভাসাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৪৫)
অর্থাৎ : এসব লক্ষণাক্রান্ত হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, প্রকরণসম, সাধ্যসম ও কালাতীত।
.
গুরুত্ব বিবেচনায় হেত্বাভাস নিয়ে ভিন্নভাবে আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
.
(১৪) ছল : বক্তা যে অর্থে একটি শব্দ বা বাক্য প্রয়োগ করেন, প্রতিপক্ষ যদি সেই শব্দ বা বাক্যের অন্য অর্থ কল্পনা করে বক্তার বক্তব্যের দোষ দেখান, তাহলে তাকে বলা হয় ছল। ছলে দেখা যায় যে, বাদী বা বক্তা এক অর্থে একটি শব্দ ব্যবহার করে কিন্তু প্রতিপক্ষ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক হওয়ার জন্য শব্দটিকে অন্য অর্থে গ্রহণ করে। বাক চাতুরী দ্বারা প্রতিপক্ষের বাক্যের দোষ দেখানো হলো ছল। যেমন ‘দণ্ড’ কথাটি সময়ের অংশ এই অর্থে বাদী বললো যে- ‘দণ্ড’ হলো ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ‘দণ্ড’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো ‘শাস্তি’। প্রতিপক্ষ বিপরীত অর্থ কল্পনা করে ছল করলেন। সোজা কথায়, ছল হলো একটি বাক্যের অভিপ্রেত অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করে ঐ বাক্যের খণ্ডন (দূষণ)। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-
‘বচনবিঘাতোহর্থাবকল্পোপপত্ত্যা ছলং’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫১)
অর্থাৎ : ‘অর্থবিকল্প’- অর্থাৎ বাদীর অভিমত অর্থের বিরুদ্ধার্থ-কল্পনারূপ উপপত্তির দ্বারা (বাদীর) বচনের বিঘাত হচ্ছে ছল।
.
ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে, ছল তিনপ্রকার- বাক্-ছল, সামান্য ছল এবং উপচার ছল।
‘তৎ ত্রিবিধং–বাক্ছলং সামান্যচ্ছলম্ উপাচারচ্ছলঞ্চ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫২)
অর্থাৎ : ছল ত্রিবিধ- বাক্-ছল, সামান্যছল ও উপচারছল।
.
এই তিনপ্রকার ছলের লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘অবিশেষাহিতেহর্থে বক্তুরভিপ্রায়াৎ অর্থান্তরকল্পনা বাক্চ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৩)
‘সম্ভবতোহর্থস্য অতিসামান্যযোগাৎ অসম্ভূতার্থকল্পনা সামান্যচ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৪)
‘ধর্ম্মবিকল্প-নির্দ্দেশেহর্থ-সদ্ভাব-প্রতিষেধ উপচারচ্ছলম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৫)
অর্থাৎ :
সেই ত্রিবিধ ছলের মধ্যে অবিশেষে উক্ত হলে অর্থাৎ দ্ব্যর্থ বোধক সমান শব্দ প্রয়োগ করলে অর্থ বিষয়ে বক্তার অভিপ্রেত অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থের কল্পনা বা ঐরূপ অর্থান্তরকল্পনার দ্বারা যে দোষপ্রদর্শন, তা বাক্ছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৩)। সম্ভাব্যমান পদার্থের সম্বন্ধে অতি সামান্য ধর্মের যোগবশত অর্থাৎ যে সামান্য ধর্মটি বক্তার উদ্দিষ্ট পদার্থকে অতিক্রম করে অন্যত্রও থাকে, সেরূপ সামান্য ধর্মের সম্বন্ধবশত অসম্ভব অর্থের যে কল্পনা বা সেই কল্পনার দ্বারা যে প্রতিষেধ, তা সামান্যছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৪)। ধর্মবিকল্পের নির্দেশ হলে অর্থাৎ কোন শব্দের লাক্ষণিক বা গৌণ অর্থে প্রয়োগ হলে অর্থসদ্ভাবের দ্বারা যে প্রতিষেধ, অর্থাৎ মুখ্যার্থ অবলম্বন করে যে দোষ প্রদর্শন, তা উপচারছল (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৫)।
.
(১৫) জাতি : ব্যাপ্তির উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র সাদৃশ্য (similarity) বা বৈসাদৃশ্যের (dissimilarity) উপর ভিত্তি করে যখন কোনো অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি উপস্থাপন করা হয় তখন তাকে জাতি বলে। যদি কেউ যুক্তি দেখায় যে ‘শব্দ অনিত্য’ কারণ ঘট-পটাদির মতো উৎপত্তিশীল। বক্তার এই সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করার জন্য প্রতিপক্ষ বলেন ‘শব্দ নিত্য’ কারণ এ আকাশের মতো অমূর্ত। এখানে নিত্যত্ব এবং অমূর্তত্বের মধ্যে কোনো ব্যাপ্তি সম্পর্ক নেই। প্রতিপক্ষের এ যুক্তির নাম জাতি। অর্থাৎ, জাতি হলো মিথ্যা সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে অযথার্থ উত্তর প্রদান। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছ-
‘সাধর্ম্ম্য-বৈধর্ম্ম্যাভ্যাং প্রত্যবস্থানং জাতিঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৫৯)
অর্থাৎ : সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যরে দ্বারা অর্থাৎ কেবল কোন সাধর্ম্য অথবা কোন বৈধর্ম্য গ্রহণ করে তার দ্বারা ‘প্রত্যবস্থান’ (প্রতিষেধ) হলো জাতি।
জাতি অষ্টাদশ (মতান্তরে চব্বিশ) রকমের, যথা- সাধর্ম্যসমা, বৈধর্ম্যসমা, উৎকর্ষসমা, অপকর্ষসমা, বর্ণ্যসমা, অবর্ণ্যসমা, বিকল্পসমা, সাধ্যসমা, প্রাপ্তিসমা, অপ্রাপ্তিসমা, প্রসঙ্গসমা, প্রতিদৃষ্টান্তসমা, অনুৎপত্তিসমা, উৎপত্তিসমা, উপলব্ধিসমা, নিত্যসমা, অনিত্যসমা এবং কার্যসমা।
.
(১৬) নিগ্রহস্থান : নিগ্রহের অর্থ বিতর্কে পরাজয়ের হেতু বা কারণ। যদি যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করতে না পারে বা প্রতিপক্ষের নিজ মত খণ্ডিত হওয়ার ফলে তাকে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে তবে সে কারণ হবে নিগ্রহস্থান। ন্যায়সূত্রকার বলেছেন-
‘বিপ্রতিপত্তিরপ্রতিপত্তিশ্চ নিগ্রহস্থানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/২/৬০)
অর্থাৎ : বিপ্রতিপত্তি অর্থাৎ বিপরীত জ্ঞান এবং কুৎসিত জ্ঞান; আর অপ্রতিপত্তি অর্থাৎ অজ্ঞতাবিশেষ নিগ্রহস্থান। অর্থাৎ যার দ্বারা বাদী বা প্রতিবাদীর বিপ্রতিপত্তি অথবা অপ্রতিপত্তি বুঝা যায়, তাকে নিগ্রহস্থান বলে।
নিগ্রহস্থান বাইশ (মতান্তরে চব্বিশ) প্রকারের। যেমন- প্রতিজ্ঞাহানি, প্রতিজ্ঞান্তর, প্রতিজ্ঞাবিরোধ, প্রতিজ্ঞাসন্ন্যাস, হেত্বান্তর, অর্থান্তর, নিরর্থক, অবিজ্ঞাতার্থক, অপার্থক, অপ্রাপ্তকাল, ন্যূন, অধিক, পুনরুক্ত, অননুভাষণ, অজ্ঞান, অপ্রতিভা, বিক্ষেপ, মতানুজ্ঞা, পর্যনুযোজ্যোপেক্ষণ, নিরনুযোজ্যোনুযোগ, অপসিদ্ধান্ত এবং হেত্বাভাস।
বিচারে পরাজয়ের কারণ নানাভাবে হতে পারে। ভ্রমাত্মক জ্ঞান অথবা অজ্ঞানতাই পরাজয়ের কারণ ।

ঈশ্বর কে অখণ্ডনীয় যুক্তি-তর্ক, শব্দ প্রমান সহ প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারাও প্রমাণ করা সম্ভব। 'ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্যং প্রমাণং প্রত্যক্ষম্’। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষজনিত প্রমাণ প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং তজ্জনিত জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞান। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে গ্রাহ্য-বিষয়ের সন্নিকর্ষ ঘটলে যে অপরোক্ষ বা সাক্ষাৎজ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ। 

চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক—এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে নিজ নিজ বিষয়ের সন্নিকর্ষ (বা সংযোগ) হলে যে প্রত্যক্ষ হয় তা বাহ্যপ্রত্যক্ষ। এই পাঁচটি বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্য জগতের যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ সম্বন্ধে সাক্ষাৎ জ্ঞানলাভ হয়। কাজেই বাহ্য প্রত্যক্ষ পাঁচ প্রকার—দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শ।  যে- কোন ইন্দ্রিয় যে-কোন বিষয়কে গ্রহণ করতে পারে না; প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের স্ব স্ব গ্রাহ্যবিষয় থাকে। চোখ কেবল রূপকেই (রঙকেই) গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ চোখের দ্বারা কেবল রূপ-প্রত্যক্ষেই সম্ভব। এর কারণ হল, চোখ তেজঃ কণিকার দ্বারা গঠিত এবং তেজের বিশেষ ধর্ম হল রূপ। কান কেবল শব্দকেই  গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ কান দিয়ে কেবল শব্দ প্রত্যক্ষই সম্ভব। এর কারণ হল কর্ণেন্দ্রিয় আকাশ ভিন্ন অন্য কিছু নয় এবং আকাশের বিশেষ ধর্ম হল শব্দ। নাক কেবল গন্ধকেই গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ নাক দিয়ে কেবল গন্ধ প্রত্যক্ষই সম্ভব। এর কারণ হল, এই ইন্দ্রিয় পৃথিবী কণিকা দ্বারা গঠিত এবং পৃথিবীর বিশেষ ধর্ম গন্ধ। জিভ কেবল রস বা স্বাদকেই গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ জিভ দিয়ে কেবল রস-প্রত্যক্ষই সম্ভব। এর কারণ হল, জিভ জল-কণা দ্বারা উৎপন্ন এবং জলের বিশেষ ধর্ম স্বাদ। ত্বক কেবল স্পর্শকেই গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ ত্বক দিয়ে কেবল স্পর্শ-প্রত্যক্ষই সম্ভব। এর কারণ হল, ত্বগেন্দ্রিয় বায়ুকণিকা দ্বারা উৎপন্ন এবং বায়ুর বিশেষ ধর্ম ত্বাচ্ বা স্পার্শন। সংক্ষেপে যে ইন্দ্রিয় যে ভৌত পদার্থ দ্বারা গঠিত সেই ইন্দ্রিয় কেবল সেই পদার্থের বিশেষ ধর্মই গ্রহণ করতে সমর্থ।

যখন (১) আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ হয়, (২) মনের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয় এবং (৩) ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে গ্রাহ্যবিষয়ের সন্নিকর্ষ হয় কেবল তখনই প্রত্যক্ষজ্ঞান জন্মায় ৷ মন হল অন্তরিন্দ্রিয়। মন দ্বারা মানসিক অবস্থার, যথা—সুখ, দুঃখ, দ্বেষ, ইচ্ছা ইত্যাদির যে সাক্ষাজ্ঞান হয় তা মানস প্রত্যক্ষজনিত। অবশ্য এর অর্থ এমন নয় যে, কেবলমাত্র সুখদুঃখাদির মানস প্রত্যক্ষেই মন-রূপ অত্বরিন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয়। বাহ্য প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রেও, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ না হলে প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় না। সকল প্রকার বিষয়জ্ঞানের ক্ষেত্রেই বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ অপরিহার্য।

চলবে

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

  সম্পাদকীয় বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ