গীতা রহস্য - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

05 June, 2016

গীতা রহস্য

গীতাধ্যায়সঙ্গতি

প্ৰবৃত্তিলক্ষণং ধৰ্ম্মং ঋষির্নারায়ণোহব্ৰবীৎ ৷ 
[মভা|শান্তি|২১৭|২
(“নারায়ণ ঋষি, ধর্মকে প্রবৃত্তিমূলক বলিয়াছেন ।” নর ও নারায়ণ এই দুই ঋষিদের মধ্যেই এই নারায়ণ ঋষি ছিলেন; এবং এই দুয়েরই অনুক্ৰমে অর্জুন ও শ্ৰীকৃষ্ণ অবতার ছিলেন, ইহা পূর্বে বলা হইয়াছে । সেইরূপ আবার, নারায়ণীর ধর্মই গীতার প্রতিপাদ্য – এই সম্বন্ধে মহাভারতের বচনও পূর্বে দেওয়া হইয়াছে ।)

1) বিষয়-প্রতিপাদনের দুই নীতি - শাস্ত্রীয় ও সম্বাদাত্মক


কর্ম করিবার সময়েই অধ্যাত্ম বিচারের দ্বারা কিংবা ভক্তির দ্বারা সর্বাত্মৈক্যরূপ সাম্যবুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করা এবং তাহা প্ৰাপ্ত হইলেও সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা না করিয়া সংসারে শাস্ত্রতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম কেবল কর্তব্য বলিয়া সর্বদা করিতে থাকা, ইহাই এই জগতে মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ কিংবা জীবনযাপনের উত্তম মাৰ্গ, ইহাই ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদ ভগবদ্‌গীতায় প্ৰতিপাদিত হইয়াছে - এ পৰ্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে ইহা উপলব্ধ হইবে । কিন্তু যে ক্রম অনুসারে আমি এই গ্রন্থে এই অর্থ বিবৃত করিয়াছি তাহা হইতে গীতা গ্রন্থের ক্রম ভিন্ন হওয়ায়, ভগবদ্‌গীতায় ইহার কিরূপ বিন্যাস করা হইয়াছে, এখানে তাহারও একটু আলোচনা করা আবশ্যক । কোনও বিষয়ের নিরূপণ দুই পদ্ধতি অনুসারে করা যাইতে পারে; এক শাস্ত্রীয়, আর-এক পৌরাণিক; তন্মধ্যে সমস্ত লোকের সহজবোধ্য বিষয় হইতে প্ৰতিপাদ্য বিষয়ের মূলতত্ত্ব কিরূপে নিষ্পন্ন হয় তর্কশাস্ত্রানুসারে সাধক-বাধক প্ৰমাণ যথাক্রমে উপস্থিত করিয়া তাহা দেখানো হইল শাস্ত্রীয় পদ্ধতি । ভূমিতিশাস্ত্র এই পদ্ধতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ; ন্যায়সূত্র কিংবা বেদান্তসূত্ৰ - ইহাদের উপপাদনও এই বর্গের মধ্যে আসে । তাই ভগবদ্‌গীতায় ব্ৰহ্মসূত্রের বা বেদান্তসূত্রের যেখানে উল্লেখ আছে সেখানে উহার বিষয়টি হেতু যুক্ত ও নিশ্চয়াত্মক প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ হইয়াছে এইরূপ বর্ণনাও দেখিতে পাওয়া যায় – “ব্রহ্মসূত্ৰপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভিৰ্বিনিশ্চিতৈঃ” [গী|১৩|৪] । কিন্তু ভগবদ্‌গীতার নিরূপণ সশাস্ত্ৰ হইলেও উহা এই শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে করা হয় নাই । ভগবদ্‌গীতার বিষয় শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনরূপে সহজ ও মনোরঞ্জক রীতিতে বর্ণিত হইয়াছে । সেইজন্য প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে “ভগবদ্‌গীতাসূপনিষৎসু ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং ষোগশাস্ত্ৰে” এইরূপ উল্লেখ করিয়া তাহার পর “শ্ৰীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে” এইরূপ গীতানিরূপণের স্বরূপ দ্যোতক শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে । এই নিরূপণ ও শাস্ত্রীয় নিরূপণের প্রভেদ স্পষ্টরূপে দেখাইবার জন্য আমি সম্বাদাত্মক নিরূপণকেই ‘পৌরাণিক’ নাম দিয়াছি । সাত শত শ্লোকের এই সম্বাদাত্মক বা পৌরাণিক নিরূপণে “ধর্ম” এই ব্যাপক শব্দের মধ্যে যে সকল বিষয়ের সমাবেশ হয়, তাহাদের সকলগুলির সবিস্তর বিচার আলোচনা করা কখনই সম্ভব নহে । কিন্তু (যত সংক্ষেপেই হউক না কেন) গীতায় অনেক বিষয় যাহা পাওয়া যায়, তাহাদেরই সংগ্ৰহ অবিরোধে কেমন করিয়া হইল ইহাই আশ্চৰ্য ! ইহা দ্বারাই গীতাকারের অলৌকিক শক্তি ব্যক্ত হইতেছে; এবং অনুগীতার আরম্ভে যে বলা হইয়াছে যে, গীতার উপদেশ “অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তে কথিত হইয়াছে” তাহারও সত্যতায় বিশ্বাস হয় । 


2) সম্বাদাত্মক পদ্ধতির গুণ-দোষ


অর্জুন যাহা পূর্বেই অবগত ছিলেন তাহা পুনর্বার সবিস্তর বলিবার কোন প্রয়োজন ছিল না । আমি যুদ্ধের নিষ্ঠুর কর্ম করিব কি না, এবং করিলেও কিরূপে করিব ইহাই তাঁহার মুখ্য প্রশ্ন ছিল । শ্ৰীকৃষ্ণ নিজের উত্তরে দুএকটি যুক্তি দেখাইতে থাকিলে, অর্জুন সেই সম্বন্ধে কোন-না-কোন আপত্তি উত্থাপন করিতেছিলেন । এই প্রকার প্রশ্নোত্তররূপ সংবাদে গীতার বিচার-আলোচনা স্বভাবতই কখন ভাঙ্গাভর্তি কিংবা সংক্ষিপ্ত আর কখন বা পুনরুক্ত হইয়াছে । উদাহরণ যথা, - ত্রিগুণাত্মক প্ৰকৃতির বিস্তারের বর্ণনা স্বল্পভেদে দুইস্থানে [গী|অ|৭ ও ১৪] করা হইয়াছে; আবার স্থিতপ্রজ্ঞ,  ভগবদ্‌ভক্তত্ৰিগুণাতীত ও ব্ৰহ্মভূত - ইহাদের অবস্থার বর্ণনা এক হইলেও, বিভিন্ন দৃষ্টিতে প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে অনেকবার করা হইয়াছে । উল্টাপক্ষে, ‘অর্থ ও কাম যদি ধর্মকে না ছাড়ে তবেই তাহা গ্ৰাহ্য হয়’, এই তত্ত্বের - “ধর্মাবিরুদ্ধঃ কামোহস্মি” [৭|১১] এই একটি বচনেই গীতা ইঙ্গিত করিয়াছেন । ইহার পরিণাম এই হয় যে, গীতার মধ্যে সমস্ত বিষয় সমাবেশ করা হইলেও শ্ৰৌতধর্ম, স্মার্তধর্ম, ভাগবতধর্ম, সাংখ্যশাস্ত্র, পূর্বমীমাংসা, বেদান্ত, কর্মবিপাক, ইত্যাদির যে সকল প্রাচীন সিদ্ধান্তসমূহের আধারের উপর গীতার জ্ঞানের নিরূপণ করা হইয়াছে, তাহাদের পরম্পরা যে ব্যক্তি অবগত নহে, গীতা পাঠ করিবার সময় তাহার মন ঘুলাইয়া যায় । এবং গীতার প্রতিপাদনের রীতি ঠিক্‌ ঠিক্‌ উপলব্ধি করিতে না পারায় এই লোকদিগের এইরূপ ধারণা হইয়া থাকে যে, গীতা একপ্রকার ভেল্কীবাজি, অথবা শাস্ত্রীয় পদ্ধতি প্ৰচলিত হইবার পূর্বে গীতা রচিত হইয়া থাকিবে, সেইজন্য গীতার স্থানে স্থানে অপূর্ণতা ও বিরোধ দেখিতে পাওয়া যায়, কিংবা নিদানপক্ষে গীতোক্ত জ্ঞানই আমাদের বুদ্ধির অগম্য । সংশয়নিবৃত্তির জন্য টীকা দেখিলেও বিশেষ লাভ হয় না; কারণ, তাহা অনেক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতে রচিত হওয়ায়, টীকাকারদিগের মতসম্বন্ধীয় পরস্পর-বিরোধের সমন্বয় করা দুর্ঘট হয় এবং পাঠকদের মন অধিকাধিক বিভ্ৰান্ত হইয়া পড়ে । কোন কোন সুপ্রবুদ্ধ পাঠকও এইরূপ ভ্ৰান্তিতে পতিত হইয়াছেন আমি জানি । এই বাধা যাহাতে না থাকে সেইজন্য আমার নিজের ধারণা অনুসারে গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহের শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে বিন্যাস করিয়া এ পর্যন্ত বিচার করিয়া আসিয়াছি । এখন এস্থলে আর একটু এই বলিতে চাহি যে, এই বিষয়ই শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনে অর্জুনের প্রশ্ন কিংবা সংশয়ের প্রসঙ্গক্রমে ন্যূনাধি্ক পরিমাণে কি প্রকারে আসিয়া পড়িয়াছে তাহা বলিলে এই বিচার আলোচনা পূর্ণতা প্ৰাপ্ত হইবে এবং পরবর্তী প্রকরণে সমস্ত বিষয়ের উপসংহার করা সহজ হইবে ।


3) গীতার প্রারম্ভ


আমাদের ভারতবর্ষ যখন জ্ঞান, বৈভব, যশ ও পূর্ণস্বরাজ্যের সুখসম্ভোগ করিতেছিল, তখন এক সর্বজ্ঞ, মহাপরাক্রমী যশস্বী ও পরমপূজ্য ক্ষত্ৰিয় আর একজন মহাধনুর্ধর ক্ষত্রিয়কে ক্ষাত্ৰধর্মানুযায়ী স্বকর্তব্যে প্ৰবৃত্ত করাইবার জন্য গীতার উপদেশ করিয়াছিলেন, ইহার প্রতি পাঠকের প্রথমে লক্ষ্য করা আবশ্যক । জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্ৰবর্তক মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ, এই দুইজনও ক্ষত্ৰিয় ছিলেন । তথাপি ইহাঁরা উভয়েই বৈদিক ধর্মের কেবল সন্ন্যাসমাৰ্গকে স্বীকার করিয়া ক্ষত্ৰিয়াদি সমস্ত বর্ণের জন্য - সন্ন্যাসধর্মের দ্বার উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছিলেন । শ্ৰীকৃষ্ণ সেরূপ করেন নাই; কারণ, ভাগবতধর্মের উপদেশ এই যে, শুধু ক্ষত্ৰিয় কেন, ব্ৰাহ্মণদিগকেও নিবৃত্তিমার্গের শান্তির সঙ্গেসঙ্গেই নিষ্কামবুদ্ধিতে আমরণ সমস্ত কর্ম করিবার প্রযত্ন করিতে হইবে । যে কোন উপদেশই হউক না কেন, তাহার কোন-না-কোন কারণ অবশ্যই থাকে; এবং সেই উপদেশের সফলতা চাহিলে, শিষ্যের মনে উক্ত উপদেশের জ্ঞান অর্জন করিবার ইচ্ছাও প্ৰথম হইতেই জাগ্ৰত থাকা আবশ্যক । 


4) গীতার প্রথমাধ্যায়


তাই, এই দুই বিষয় স্পষ্ট করিবার জন্যই ব্যাসদেব গীতার প্ৰথম অধ্যায়ে শ্ৰীকৃষ্ণের অর্জুনকে এই উপদেশ দিবার কি কারণ হইয়াছিল, তাহা সবিস্তার বর্ণনা করিয়াছেন । কৌরব ও পাণ্ডবদিগের সৈন্য যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হইয়া কুরুক্ষেত্ৰে দণ্ডায়মান; এক্ষণে যুদ্ধ আরম্ভ হইবার অল্পই বিলম্ব আছে; ইতিমধ্যে অর্জুনের কথা অনুসারে শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহার রথ উভয় সৈন্যের মাঝখানে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইলেন এবং অর্জুনকে বলিলেন, “যাঁহাদের সহিত তোমার যুদ্ধ করিতে হইবে সেই ভীষ্ম-দ্ৰোণাদিকে দেখ” । তখন অর্জুন উভয় সৈন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, আপনারই বাপ, কাকা, পিতামহ, মাতামহ, মামা, ভাই, পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, আত্মীয়, গুরু, গুরুভাই প্ৰভৃতি দুইদিকে ভরিয়া আছে, এবং এই যুদ্ধে সকলেই বিনাশ প্ৰাপ্ত হইবে । যুদ্ধ করা পূর্ব হইতেই স্থির হইয়া গিয়াছিল এবং উভয় পক্ষেরই সৈন্যসংগ্ৰহ অনেক দিন হইতেই চলিতেছিল । তথাপি পরস্পরের মধ্যে এই যুদ্ধের ফলে কুলক্ষয়ের প্রত্যক্ষ স্বরূপ যখন সর্বপ্ৰথম অর্জুনের দৃষ্টিতে উপস্থিত হইল, তখন তাঁহার ন্যায় মহাযোদ্ধারও মনে বিষাদ আসিল এবং তাঁহার মুখ হইতে এই কথা বাহির হইল “রাজ্যলাভের জন্য এই ভয়ঙ্কর কুলক্ষয় আমরা করিতে বসিয়াছি; ইহা অপেক্ষা ভিক্ষা করাও কি শ্রেয়স্কর নহে ?” এবং পরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে বলিলেন যে “শত্রুরা আমার প্রাণবধ করিলেও আমার কিছুই আসে যায় না, কিন্তু ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যের জন্যও পিতৃহত্যা গুরুহত্যা ভ্ৰাতৃহত্যা বা কুলক্ষয়ের ন্যায় মহাপাপ করিতে আমি ইচ্ছা করি না ।” অর্জুনের সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল, হাত-পা শিথিল হইয়া গেল, মুখ শুকাইয়া গেল, এবং বিষন্ন বদনে হস্ত হইতে ধনুর্বাণ নিঃক্ষেপ করিয়া বেচারা রথে চুপচাপ বসিয়া পড়িলেন - এই কথা প্ৰথম অধ্যায়ে আছে । এই অধ্যায়কে “অর্জুনবিষাদ-যোগ” বলে । কারণ, সমস্ত গীতায় ব্রহ্মবিদ্যান্তৰ্গত (কর্ম-)যোগশাস্ত্ৰ নামক একই বিষয় প্ৰতিপাদ্য হইলেও, প্ৰত্যেক অধ্যায়ে যে বিষয় মুখ্যরূপে বিবৃত হইয়াছে তাহাকে এই কর্মযোগশাস্ত্রেরই এক অংশ মনে করিয়াই প্ৰত্যেক অধ্যায়কে তাহার বিষয়ানুসারে বিষাদযোগ, সাংখ্যযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দেওয়া হইয়াছে । এই সমস্ত ‘যোগ’ একত্র হইলে পর তাহাই “ব্রহ্মবিদ্যার অন্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্ৰ” হইয়া দাঁড়ায় । প্ৰথম অধ্যায়ের অন্তৰ্গত কথার মহত্ত্ব কি, তাহা আমি এই গ্রন্থের আরম্ভে বলিয়াছি । কারণ, আমার সম্মুখে কি প্রশ্ন উপস্থিত তাহা ঠিক না জানিলে সেই প্রশ্নের উত্তরও সম্যক্‌রূপে আমার মনে আসে না । “সাংসারিক কর্ম হইতে নিবৃত্ত হইয়া ভগবদ্‌ভজনেই প্ৰবৃত্ত হওয়া কিংবা সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা”, - ইহাই যদি গীতার তাৎপৰ্য বলিতে হয়, তাহা হইলে অর্জুন যুদ্ধের নিষ্ঠুর কর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষা মাগিতে তখনই প্ৰস্তুত থাকায় তাহাকে এই উপদেশ দিবার কোন আবশ্যকতা ছিল না । প্ৰথম অধ্যায়েরই শেষে “বাঃ ! বড় উত্তম কথা বলিয়াছ; তোমার এই উপরতি দেখিয়া আমার অত্যন্ত আনন্দ হইতেছে ! চল, আমরা দুজনেই এই কর্মময় সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসাশ্রম কিংবা ভক্তিযোগ অবলম্বন করিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণ সাধন করি !” এইরূপ অর্থের দুই একটা শ্লোক শ্ৰীকৃষ্ণের মুখে পুরিয়া দিয়া সেইখানেই গীতা সমাপ্ত করা উচিত ছিল । আবার এদিকে যুদ্ধ হইয়া গেলে ব্যাস তাহার বর্ণনায় তিন বৎসর কাল [মভা|আ|৬২|৫২] যদি আপন বাণীর দুর্ব্যবহার করিতেন তাহা হইলে তাহার দোষ বেচারী অর্জুন ও শ্ৰীকৃষ্ণকে স্পর্শ করিত না । তাহা হইলে কুরুক্ষেত্রে সমবেত শত শত মহারথী অর্জুনকে ও শ্ৰীকৃষ্ণকে উপহাস করিতেন সত্য, কিন্তু যে আপনার আত্মার কল্যাণ সাধন করিবে সে এইরূপ উপহাসকে অল্পই ভয় করিবে । জগতের লোক যাহাই বলুক না; “যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্ৰব্ৰজেৎ” [জা|৪] - যখনই উপরতি হইবে, তখনই সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে, বিলম্ব করিবে না - উপনিষদে তো ইহাই উক্ত হইয়াছে । অর্জুনের উপরতি জ্ঞানমূলক ছিল না মোহমূলক ছিল, এইরূপ বলিলেও উপরতিই তো হইয়াছিল; তাহা হইলেই অর্ধেক কাজ হইল, এখন মোহকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া সেই উপরতিকেই পূর্ণ জ্ঞানমূলক করা ভগবানের পক্ষে কিছুমাত্র অসাধ্য ছিল না । কোন কারণে সংসারের উপর বিতৃষ্ণা জন্মিলে সেই বিতৃষ্ণার দরুণ প্ৰথমে সংসার ত্যাগ করিয়া পরে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করিবার অনেক উদাহরণ ভক্তিমার্গে বা সন্ন্যাসমার্গেও আছে । অর্জুনেরও এই প্রকার দশা হইত । সন্ন্যাস গ্রহণের সময় বস্ত্ৰ গেরুয়া করিবার জন্য এক মুঠ গেরুয়া মাটি কিংবা ভক্তিপূর্বক ভগবানের নাম সংকীর্তন করিবার জন্য তাল মৃদঙ্গাদি সরঞ্জামও সমস্ত কুরুক্ষেত্রে না মিলিত এমন নহে ।


5) গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়


কিন্তু সেরূপ কিছুই না করিয়া বরং দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভেই শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিতেছেন — “অর্জুন, তোমার এই দুর্বুদ্ধি কি করিয়া আসিল ? এই ক্লৈব্য তোমার শোভা পায় না ! ইহা তোমার কীর্তিনাশ করিবে ! অতএব এই দৌর্বল্য ত্যাগ করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও !” তথাপি অর্জুন কাপুরুষের ন্যায় পুনর্বার প্রথমেই কান্নার সুর ধরিয়া অত্যন্ত দীনভাবে বলিলেন - “আমি ভীষ্ম-দ্রোণাদি মহাত্মাদিগকে কি করিয়া বধ করিব ? মরা ভাল কি মারা ভাল, এই সংশয়ে আমার মন বিভ্ৰান্ত হইতেছে; অতএব ইহাদের মধ্যে কোন ধর্ম শ্ৰেয়স্কর তাহা আমাকে বল; আমি তোমার শরণাপন্ন হইতেছি” । শ্ৰীকৃষ্ণ দেখিলেন, অর্জুন মায়ার বশীভূত হইয়াছেন এবং একটু হাসিয়া “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং” ইত্যাদি জ্ঞানের কথা ভগবান তাঁহার নিকট বলিতে আরম্ভ করিলেন । অর্জুন জ্ঞানী পুরুষের ন্যায় ভড়ং দেখাইতে গিয়াছিলেন এবং কর্মসন্ন্যাসের কথাও পাড়িয়াছিলেন । তাই, জগতে ‘কর্মত্যাগ’ ও ‘কর্মসাধন’ - জ্ঞানীপুরুষদিগের এই যে দুই আচরণ-পন্থা অর্থাৎ নিষ্ঠা দেখিতে পাওয়া যায়, - তাহা হইতেই ভগবান নিজের উপদেশ শুরু করিলেন; এবং এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে কোন একটী নিষ্ঠা গ্ৰহণ করিলেও তুমি ভুল করিতেছ ইহাই অর্জুনের প্রতি ভগবানের প্ৰথম উক্তি । তাহার পর, যে জ্ঞাননিষ্ঠা বা সাংখ্যনিষ্ঠার উপরে অর্জুন কর্মসন্ন্যাসের কথা বলিতেছিলেন সেই সাংখ্যনিষ্ঠার ভিত্তির উপরেই শ্ৰীকৃষ্ণ প্রথমে “এষা তেহভিহিতা বুদ্ধিঃ” [গী|২|১১-৩৯] পৰ্যন্ত উপদেশ করিলেন; এবং আবার অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত, কর্মযোগমার্গ অবলম্বন করিয়া যুদ্ধই তোমার প্রকৃত কর্তব্য এইরূপ অর্জুনকে বলিয়াছেন । “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে” এইরূপ শ্লোক “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং” এই শ্লোকের পূর্বে যদি আসিত তাহা হইলে এই অর্থই অধিকতর ব্যক্ত হইত । কিন্তু সম্ভাষণের প্রসঙ্গক্রমে সাংখ্যমার্গের প্ৰতিপাদন হইলে পর উহা এইরূপে আসিয়াছে – “ইহা তো সাংখ্যমাৰ্গ অনুসারে প্ৰতিপাদিত হইল; এক্ষণে যোগমার্গ অনুসারে প্রতিপাদন করিতেছি ।” যাহাই হউক না কেন, কিন্তু অর্থ একই । সাংখ্য (বা সন্ন্যাস) এবং যোগ (বা কর্মযোগ) ইহাদের মধ্যে যে প্ৰভেদ তাহা ১১শ প্রকরণে প্ৰথমেই আমি স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছি । অতএব তাহার পুনরুক্তি না করিয়া ইহাই বলিতেছি যে, চিত্তশুদ্ধির জন্য স্বধর্মানুসারে বর্ণাশ্রমবিহিত কর্ম করিয়া জ্ঞানলাভ হইলে পর মোক্ষের জন্য শেষে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করাকেই “সাংখ্য” মাৰ্গ বলে; এবং কর্ম কদাপি ত্যাগ না করিয়া শেষ পৰ্যন্ত উহা নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে থাকাকেই যোগ কিংবা কর্মযোগ বলে ।

ভগবান অর্জুনকে প্ৰথমে এইরূপ বলিয়াছেন যে, সাংখ্যমার্গের অধ্যাত্মজ্ঞানানুসারে আত্মা অমর ও অবিনাশী হওয়ায় “ভীষ্মদ্ৰোণাদিকে আমি বধ করিব” তোমার এই ধারণাটাই মিথ্যা; কারণ, আত্মা মরেও না, মারেও না । মনুষ্য যেরূপ আপনার বস্ত্র বদলায় সেইরূপই আত্মা এক দেহ ছাড়িয়া দেহান্তরে যায় এইমাত্র; কিন্তু সেইজন্য সে মরিয়াছে মনে করিয়া শোক করা উচিত নহে । ভাল; “আমি বধ করিব” এই ভ্ৰম স্বীকার করিলেও যুদ্ধই কেন করিব এইরূপ যদি বল, তাহার উত্তর এই যে, শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত যুদ্ধ হইতে পরাবৃত্ত না হওয়াই ক্ষাত্ৰধর্ম; এবং যখন এই সাংখ্যমার্গে প্রথমতঃ বৰ্ণাশ্রমবিহিত কর্ম করাই শ্ৰেয়স্কর বলিয়া বিবেচিত হয়, তখন তুমি যদি তাহা না কর তাহা হইলে লোকে তোমার নিন্দা করিবে; অধিক কি, যুদ্ধে মরাই ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম । অতএব কেন বৃথা শোক করিতেছ ? ‘আমি মারিব’, ‘সে মরিবে’ এই নিছক কর্মদৃষ্টি ছাড়িয়া দিয়া, আমি কেবল আপনার স্বধর্ম করিতেছি এই বুদ্ধিতে তুমি আপন প্রবাহপতিত কাৰ্য কর, তাহা হইলে কোন পাপই তোমাকে স্পর্শ করিবে না । সাংখ্যমাৰ্গানুসারে এই উপদেশ হইল । কিন্তু চিত্তশুদ্ধির জন্য প্রথমতঃ কর্ম করিয়া চিত্তশুদ্ধি হইলে পর শেষে সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করাই যদি এই মার্গ অনুসারে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়, তবে এই সংশয় থাকিয়া যায় যে, উপরতি হইবার সঙ্গে সঙ্গেই, যুদ্ধ ছাড়িয়া (সম্ভব হইলে) তখনই সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা কি ভাল নয় ? পুরাপুরি গৃহস্থাশ্ৰম করিয়া তাহার পর বার্ধক্যে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে; যৌবনে গৃহস্থাশ্রমই করিতে হইবে এইরূপ মন্বাদি স্মৃতিকারদিগের আদেশ, এ কথা বলিলে চলিবে না । কারণ, যখনই হউক সন্ন্যাসগ্রহণই যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তাহা হইলে যখনই সংসারে বিতৃষ্ণা হইবে তখনই বিলম্ব না করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করাই উচিত; এবং এই কারণেই উপনিষদেও “ব্রহ্মচৰ্য্যাদেব প্ৰব্ৰজেৎ গৃহাদ্বা বনাদ্ধা” [জা|৪] এইরূপ বচন পাওয়া যায় । সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিলে যে গতি হয়, রণক্ষেত্রে মৃত্যু হইলে ক্ষত্ৰিয় সেই গতিই প্ৰাপ্ত হয় ।
দ্বাবিমৌ পুরুষব্যাঘ্র সূৰ্যমণ্ডলভেদিনৌ ৷
পরিব্রাড্‌যোগযুক্তশ্চ রণে চাভিমুখো হতঃ ॥
“হে পুরুষব্যাঘ্র ! সূৰ্যমণ্ডলকে ভেদ করিয়া ব্ৰহ্মলোকে দুইজন গমন করেন; এক যোগযুক্ত সন্ন্যাসী, আর এক, যে ব্যক্তি রণে অভিমুখ হইয়া মরে”, এইরূপ মহাভারতে [উদ্যো|৩২|৬৫] উক্ত হইয়াছে । কৌটিল্যের অর্থাৎ চাণক্যের অর্থশাস্ত্ৰেও এই অর্থের এক শ্লোক আছে -
যান্‌ যজ্ঞসংঘৈস্তুপসা চ বিপ্রাঃ স্বর্গৈষিণঃ পাত্ৰচয়ৈশ্চ যান্তি ৷
ক্ষণেন তানপ্যতিযান্তি শুরাঃ প্ৰাণান্‌ সুযুদ্ধেষু পরিত্যজন্তঃ ॥
“স্বৰ্গেচ্ছু, ব্ৰাহ্মণ অনেক যজ্ঞের দ্বারা, নানা সরঞ্জামের দ্বারা ও তপস্যার দ্বারা যে লোকে গমন করে, যে ব্যক্তি যুদ্ধে প্ৰাণ দেয় সে তৎক্ষণাৎ সেই লোককেও ছাড়াইয়া যায়”; - অর্থাৎ শুধু তপস্বী বা সন্ন্যাসী এবং নানা যাগযজ্ঞদীক্ষিতেরাও যে গতি প্ৰাপ্ত হয়, রণক্ষেত্রে নিহত ক্ষত্ৰিয়ও সেই গতিই লাভ করে, [কৌটি|১০|৩|১৫০-১৫২ এবং নভা|শাং|৯৮-১০০ দেখ] । যুদ্ধরূপ স্বর্গের দ্বার ক্ষত্ৰিয়ের নিকট ক্কচিৎ উদ্‌ঘাটিত হয়; যুদ্ধে মরিলে স্বৰ্গ ও জয়লাভ করিলে পৃথিবীর রাজ্য পাওয়া যায়” [২|৩২,৩৭] গীতার এই উপদেশের তাৎপৰ্যও ইহাই । অতএব, ইহাও সাংখ্যমাৰ্গ অনুসারে প্রতিপাদন করা যাইতে পারে যে, সন্ন্যাস গ্ৰহণ কর কিংবা যুদ্ধ কর, ফল একই । কিন্তু ‘যাই বল না কেন, যুদ্ধ করিতেই হইবে’ এইরূপ নিশ্চিতাৰ্থ এই মার্গের যুক্তিবাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় না । সাংখ্যমার্গের এই বাধার প্রতি লক্ষ্য করিয়া পরে ভগবান্‌ কর্মযোগমার্গের প্রতিপাদন করিতে আরম্ভ করিলেন; এবং গীতার শেষ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত এই কর্মযোগেরই - অর্থাৎ কর্ম করিতেই হইবে এবং তাহা মোক্ষের অন্তরায় না হইয়া বরং কর্ম করিলেই মোক্ষলাভ হয়, তাহার বিভিন্ন প্ৰমাণ দিয়া সংশয়নিবৃত্তিপূর্বক সমর্থন করিয়াছেন । কোনও কর্মই ভাল কি মন্দ ইহা স্থির করিবার জন্য সেই কর্মের বাহ্য পরিণাম অপেক্ষা কর্তার বাসনাত্মক বুদ্ধি শুদ্ধ কি অশুদ্ধ, ইহা প্ৰথমে দেখিতে হইবে, - ইহাই কর্মযোগতত্ত্বের প্রধান তত্ত্ব [গী|২|৪৯] । কিন্তু বাসনা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ ইহা স্থির করাও শেষে ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধিরই কাজ হওয়ায়, নিৰ্বাচনকারী বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয়কে স্থির করিতে না পারিলে বাসনাও শুদ্ধ ও সম হয় না । এই জন্য সেই সঙ্গেই ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, বাসনাত্মক বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিতে হইলে, সমাধির দ্বারা প্ৰথমে ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয়কেও স্থির করা আবশ্যক, [গী|২|৪১] । জগতের সাধারণ ব্যবহার দেখিলে প্ৰতীত হয় যে, অনেক লোক স্বৰ্গাদি বিভিন্ন কাম্য সুখ লাভ করিবার জন্যই যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কাম্য কর্মের বৃথা উদ্যোগে প্ৰবৃত্ত হয়, এবং সেই জন্য তাহাদের বুদ্ধি - আজ এই ফল প্ৰাপ্তি হইবে, কাল আবার আর এক ফল পাওয়া যাইবে - এইরূপ চিন্তাতেই অর্থাৎ স্বার্থেতেই নিমগ্ন এবং সর্বদাই পরিবর্তনশীল ও চঞ্চল হইয়া থাকে । এই সব লোকেরা স্বৰ্গসুখাদি অনিত্য ফল অপেক্ষা বড় অর্থাৎ মোক্ষরূপ নিত্য সুখ কখনও লাভ করিতে পারে না । তাই, কর্মযোগমার্গের রহস্য অর্জুনকে এই বলা হইয়াছে যে, বৈদিক কর্মের কাম্য উদ্যোগ ছাড়িয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিতে শিখ; কর্ম করিবার অধিকার তোমার আছে; কর্মের ফল পাওয়া কি না পাওয়ার - ইহা কখনই তোমার আয়ত্তাধীন নহে [২|৪৭]; ফলদাতা পরমেশ্বর, ইহা মনে করিয়া, কর্মের ফল পাওয়া যাক্‌ বা নাই যাক্‌ দুই সমান, এইরূপ সমবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়াই যাহারা কর্ম করে তাহাদের পাপপুণ্য কর্তাকে স্পর্শ করে না; অতএব এই সমবুদ্ধিকেই তুমি আশ্ৰয় কর; এই সমবুদ্ধিকেই অর্থাৎ পাপস্পর্শ না লাগে এইরূপ কর্মের যুক্তি বা কৌশলকেই যোগ বলে; এই যোগ সাধন করিলে, কর্ম করিলেও তোমার মোক্ষ লাভ হইবে; মোক্ষের জন্য কর্মসন্ন্যাসই করিতে হইবে এরূপ নহে [২|৪৭-৫৩] । ভগবান যখন অর্জুনকে বলিলেন যে, যে ব্যক্তির বুদ্ধি এইরূপ সম হইয়াছে তাহাকে স্থিতপ্ৰজ্ঞ বলা যায় [২|৫৩], তখন অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, “স্থিতপ্রজ্ঞের আচরণ কিরূপ হইবে তাহা আমাকে বল” । তাই, দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা করা হইয়াছে এবং শেষে স্থিতপ্রজ্ঞের অবস্থাকেই ব্ৰাহ্মী স্থিতি বলে এইরূপ বলা হইয়াছে । সারকথা, অর্জুনকে যুদ্ধে  প্রবৃত্ত করিবার জন্য গীতায় যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা এই জগতে জ্ঞানীপুরুষের গ্রাহ্য “কর্মত্যাগ” (সাংখ্য) ও “কর্মসাধন” (যোগ) এই দুই নিষ্ঠা হইতেই আরম্ভ করা হইয়াছেঃ; এবং যুদ্ধ কেন করিতে হইবে তাহার উপপত্তি প্ৰথমে সাংখ্যনিষ্ঠা অনুসারে কথিত হইয়াছে । কিন্তু এই উপপত্তি অসম্পূৰ্ণ হয় দেখিয়া, পরে তখনই যোগ কিংবা কর্মযোগমার্গানুসারে জ্ঞানের কথা বলিতে আরম্ভ করা হইয়াছে; এবং এই কর্মযোগের স্বল্পাচরণও কিরূপ শ্ৰেয়স্কর ইহা বলিয়া তাহার পর, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান স্বীয় উপদেশকে এই পৰ্যন্ত লইয়া চলিলেন যে, কর্মযোগমার্গে কর্মাপেক্ষা কর্মের প্রেরক বুদ্ধিকেই যখন শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানা হয়, তখন স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় তুমি নিজ বুদ্ধিকে সম করিয়া কর্ম কর, তাহা হইলে কোন পাপই তোমাকে স্পর্শ করিবে না । এক্ষণে দেখা যাক্‌ যে, পরে আরও কি কি প্রশ্ন বাহির হয় । দ্বিতীয় অধ্যায়েই গীতার সমস্ত উপপাদনের মূল থাকায় তৎসম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি ।


6) গীতার তৃতীয় অধ্যায়


তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন প্রশ্ন করিয়াছেন যে, “কর্মযোগমার্গেও কর্মাপেক্ষা বুদ্ধিই যদি শ্রেষ্ঠ হয় তবে আমি এক্ষণে আমার বুদ্ধিকে স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় সম করিলেই হইল; আমাকে যুদ্ধের ন্যায় নিষ্ঠুর কর্ম করিতে কেন তবে বলিতেছ ?” ইহার কারণ এই যে, কর্মাপেক্ষা বুদ্ধিকে শ্রেষ্ঠ বলিলেই, “যুদ্ধ কেন করিবে ? বুদ্ধিকে সম রাখিয়া উদাসীন হইয়া কেন বসিয়া থাকিবে না,’’ এই প্রশ্নের নির্ণয় হয় না । বুদ্ধিকে সম রাখিয়াও কর্মসন্ন্যাস করিতে পারা যায় না এরূপ নহে । তারপর, সমবুদ্ধি পুরুষের সাংখ্যমাৰ্গানুসারে কর্ম ত্যাগ করিতে বাধা কি ? এই প্রশ্নের উত্তর ভগবান এইরূপ দিতেছেন যে, পুর্বে তোমাকে সাংখ্য ও যোগ এই দুই নিষ্ঠার কথা বলিয়াছি সত্য; কিন্তু ইহাও মনে রেখো যে, কোন মনুষ্যের পক্ষে কর্ম একেবারে ত্যাগ করা অসম্ভব । যে পৰ্যন্ত মনুষ্য দেহধারী হইয়া আছে সে পৰ্যন্ত প্ৰকৃতি স্বভাবতই তাহাকে কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত করিবেই; এবং প্রকৃতি যখন এই কর্ম ছাড়িতেই পারে না, তখন ইন্দ্ৰিয়সংযমের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির ও সম করিয়া কেবল কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারাই আপন কর্তব্য কর্ম করিতে থাকা অধিক শ্ৰেয়স্কর । এইজন্য তুমি কর্ম কর; কর্ম না করিলে তোমার খাওয়া পৰ্যন্ত চলিবে না [৩|৩-৮] ৷ পরমেশ্বরই কর্মের সৃষ্টি করিয়াছেন; মনুষ্য নহে । ব্ৰহ্মদেব যখন জগৎ ও প্ৰজা সৃষ্টি করিলেন সেই সময়েই তিনি ‘যজ্ঞে’রও সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং তিনি প্ৰজাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, যজ্ঞের দ্বারা তুমি আপনার সমৃদ্ধি করিয়া লও । এই যজ্ঞ যখন কর্ম ব্যতীত সিদ্ধ হয় না, তখন যজ্ঞ অর্থে কর্মই বলিতে হয় । অতএব, মনুষ্য ও কর্ম দুই-ই এক সঙ্গে উৎপন্ন হইয়াছে, এইরূপ বলিতে হয় । কিন্তু এই কর্ম কেবল যজ্ঞেরই জন্য এবং যজ্ঞ করা মনুষ্যের কর্তব্য, এই কারণে এই কর্মের ফলে মনুষ্যের বন্ধন হয় না । এখন ইহা সত্য যে, যে ব্যক্তি পুর্ণ জ্ঞানী হইয়াছেন তাঁহার নিজের কোন কর্তব্য অবশিষ্ট থাকে না; এবং লোকদিগের নিকটেও তিনি কোন বাধা পান না । কিন্তু ইহা দ্বারা সিদ্ধ হয় না যে, কর্ম করিবে না; কারণ, কর্ম হইতে কেহ নিষ্কৃতি পায় না বলিয়া ইহাই অনুমান করিতে হয় যে, স্বার্থের জন্য না করিলেও সেই কর্ম লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কামবুদ্ধিতে করা আবশ্যক [গী|৩|১৭-১৯] । এই কথার প্রতি লক্ষ্য করিয়াই জনকাদি জ্ঞানীপুরুষ পূর্বে কর্ম করিয়াছিলেন এবং আমিও করিতেছি । তাছাড়া ইহাও মনে রেখো যে, ‘লোকসংগ্রহ’ করা অর্থাৎ নিজের আচরণের দ্বারা লোকদিগকে ভাল দৃষ্টান্ত দেখাইয়া তাহাদিগকে উন্নতির পথে লইয়া যাওয়া জ্ঞানী পুরুষদিগের অন্যতর মুখ্য কর্তব্য । মনুষ্য যতই জ্ঞানবান হউন না কেন, প্ৰকৃতির ব্যবহার হইতে তাঁহার মুক্তি হয় না; অতএব কর্মত্যাগ করা ত দুরের কথা, কর্তব্য বলিয়া স্বধর্মানুসারে কর্ম করিতে থাকা এবং আবশ্যক হইলে যদি তাহাতে মৃত্যুও হয় তাহাও শ্রেয়স্কর [৩|৩০-৩৫]; তৃতীয় অধ্যায়ে ভগবান এই প্রকার উপদেশ করিয়াছেন । ভগবান এইরূপ প্ৰকৃতিকে সমস্ত কর্মের কর্তৃত্ব দিয়াছেন দেখিয়া মনুষ্যের ইচ্ছা না থাকিলেও মনুষ্য পাপ কেন করে, অর্জুন এইরূপ প্রশ্ন করিলেন; তখন ভগবান এইরূপ উত্তর দিয়া অধ্যায় সমাপ্ত করিয়াছেন যে, কামক্রোধাদি বিকার বলপূর্বক মনকে ভ্ৰষ্ট করে; অতএব ইন্দ্ৰিয়সংযম করিয়া প্রত্যেক মনুষ্যের আপন মনকে বশে রাখিতে হইবে । সারকথা, স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় বুদ্ধি সমতাপ্ৰাপ্ত হইলেও কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না; অতএব স্বার্থের জন্য না হউক, অন্তত লোকসংগ্রহের জন্যও নিষ্কাম-বুদ্ধিতে কর্ম করিতেই হইবে - এইরূপে কর্মযোগের আবশ্যকতা সিদ্ধ করা হইয়াছে; এবং ভক্তিমার্গের “আমাতে সমস্ত কর্ম অৰ্পণ কর” [৩|৩০-৩১] এইরূপ পরমেশ্বরার্পণ পূর্বক কর্ম করিবার তত্ত্বেরও এই অধ্যায়ে প্রথম উল্লেখ হইয়াছে ।


7) গীতার চতুর্থ অধ্যায়


কিন্তু এই বিচার-আলোচনা তৃতীয় অধ্যায়ে সম্পূর্ণ না হওয়ায় চতুর্থ অধ্যায়ও তাহারই আলোচনার জন্য আরম্ভ করা হইয়াছে । এখন পৰ্যন্ত যাহা প্ৰতিপাদন করা হইয়াছে তাহা কেবল অর্জুনকে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার নিমিত্তই নূতন রচিত এইরূপ সন্দেহ যেন কাহারও মনে না হয়; এইজন্য চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভে এই কর্মযোগের অর্থাৎ ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মের ত্রেতাযুগবাহী পরম্পরা প্রদত্ত হইয়াছে । শ্ৰীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলিলেন যে, আদিতে কিংবা যুগারম্ভে আমিই এই কর্মযোগমার্গ বিবস্বানকে, বিবস্বান মনুকে এবং মনু ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন, কিন্তু মধ্যে ইহা নষ্ট হইয়া যাওয়ায় ঐ যোগই (কর্মযোগমাৰ্গ) আমি এক্ষণে তোমাকে পুনর্বার বলিলাম; তখন অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, বিবস্বানের আগে তুমি কি করিয়া আসিবে ? সেই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় ভগবান বলিলেন যে, সাধুদিগের সংরক্ষণ, দুষ্টদিগের নাশ এবং ধর্মের স্থাপনা করাই আমার অনেক অবতারের প্রয়োজন; এবং এইরূপ লোকসংগ্ৰহকারক কর্ম আমি করিলেও আমার তাহাতে আসক্তি না থাকায় তাহার পাপপুণ্যাদি ফল আমাকে স্পর্শ করে না । এই প্রকারে কর্মযোগের সমর্থন করিয়া, এবং এই তত্ত্ব জানিয়াই জনকাদিও পুর্বে কর্মাচরণ করিয়াছিলেন এই উদাহরণ দিয়া তুমিও সেইরূপই কর্ম কর, ভগবান অর্জুনকে পুনর্বার এইরূপ উপদেশ করিলেন । তৃতীয় অধ্যায়ে মীমাংসকদিগের এই যে সিদ্ধান্ত বলা হইয়াছে যে, “যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধন হয় না” তাহাই পুনৰ্বার বলিয়া ‘যজ্ঞের’ বিস্তৃত ও ব্যাপক ব্যাখ্যা এইভাবে করা হইয়াছে যে, কেবল তিল-তণ্ডুল দগ্ধ করা কিংবা পশু বধ করা একপ্রকার যজ্ঞ সত্য, কিন্তু এই দ্রব্যময় যজ্ঞ হাল্‌কা-রকমের এবং সংযমাগ্নিতে কামক্রোধাদি ইন্দ্ৰিয়বৃত্তিকে দগ্ধ করা কিংবা ‘ন মম’ বলিয়া, ব্ৰহ্মেতে সমস্ত কর্ম আহুতি দেওয়া উচ্চ পৈঠার যজ্ঞ । তাই সেই উচ্চদরের যজ্ঞের জন্য ফলাশা ছাড়িয়া কর্ম কর অর্জুনকে এক্ষণে এইরূপ উপদেশ করিলেন । মীমাংসকদিগের ন্যায়ানুসারে যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম স্বতন্ত্ররূপে বন্ধন না হইলেও, যজ্ঞের কোন না কোন ফল পাইতেই হইবে । তাই, যজ্ঞও নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিলেও তাহার জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম এবং স্বয়ং যজ্ঞ এই দুইই বন্ধন হয় না । শেষে বলা হইয়াছে যে, সর্বভূত আপনাতে বা ভগবানে আছে এই জ্ঞান যে বুদ্ধি হইতে হয়, তাহারই নাম সাম্যবুদ্ধি । এবং এই জ্ঞান উৎপন্ন হইলেই সমস্ত কর্ম ভস্ম হইয়া তাহাদের কোন বাধা কর্তায় অর্শে না । “সৰ্ব্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে” - জ্ঞানে সমস্ত কর্মের লয় হয়; কর্ম স্বয়ং বন্ধন হয় না, অজ্ঞান হইতেই বন্ধনের উৎপত্তি । এইজন্য অজ্ঞান ত্যাগ কর এবং কর্মযোগকে আশ্ৰয় করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও, অর্জুনকে এইরূপ উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । সারকথা, কর্মযোগমার্গের সিদ্ধির জন্যই সাম্যবুদ্ধিরূপ জ্ঞান আবশ্যক, এই অধ্যায়ে জ্ঞানের এই প্রকার প্রস্তাবনা করা হইয়াছে ।


8) গীতার পঞ্চম অধ্যায়


কর্মযোগের আবশ্যকতা কি অর্থাৎ কর্ম কেন করিতে হইবে, তাহার কারণসমূহের বিচার তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে করা হইয়াছে সত্য; কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাংখ্যজ্ঞানের কথা বলিয়া কর্মযোগের বিচার-আলোচনাতেও কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধিই শ্ৰেষ্ঠ বারংবার বলা হইয়াছে, তাই এই দুই মার্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোনটি তাহা বলা এক্ষণে আবশ্যক । কারণ, দুই মার্গের যোগ্যতা সমান বলিলেও পরিণাম হইবে এই যে, যাহার যে মার্গ ভাল মনে হইবে সে তাহাই স্বীকার করিবে, কেবল কর্মযোগকে স্বীকার করিবার কোন কারণ থাকিবে না । অর্জুনের মনে এই সংশয় উৎপন্ন হওয়ায় পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন ভগবানকে এই প্রশ্ন করিলেন যে, “সাংখ্য ও যোগ এই দুই নিষ্ঠা সম্বন্ধে মিশ্ৰিতভাবে আমাকে না বলিয়া এই দুয়ের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ মাৰ্গ কোনটী তাহা নিশ্চয় করিয়া আমাকে যদি বল, তাহা হইলে সেই অনুসারে চলিবার সুবিধা হয়” । ইহার উত্তরে ভগবান স্পষ্টরূপে ইহা বলিয়া অর্জুনের সন্দেহ দূর করিলেন যে, দুই মাৰ্গই নিঃশ্রেয়স্কর অর্থাৎ সমান মোক্ষ প্ৰদ হইলেও, তন্মধ্যে কর্মযোগেরই মহত্ব অধিক - “কর্মযোগো বিশিষ্যতে” - [৫|২] । এই সিদ্ধান্তেরই দ্রঢ়ীকরণার্থ ভগবান্‌ আরও বলিলেন যে, সন্ন্যাস বা সাংখ্যনিষ্ঠার দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তাহাই কর্মযোগের দ্বারাও লাভ হয়ই; শুধু তাহাই নহে; কর্মযোগে যে নিষ্কাম বুদ্ধির কথা বলা হইয়াছে তাহা প্রাপ্ত না হইলে সন্ন্যাস সিদ্ধ হয় না; এবং তাহা প্ৰাপ্ত হইলে পর, যোগমার্গে কর্ম করিলেও ব্রহ্মলাভ না হইয়া যায় না । ইহার পর, এ বিবাদে লাভ কি - যে, সাংখ্য ও যোগ ইহারা ভিন্ন ? চলা, বলা, দেখা, শোনা, আঘ্রাণ করা ইত্যাদি শত শত কর্ম ছাড়িব বলিলেও যদি তাহা ছাড়া না যায়, তবে কর্মত্যাগের সঙ্কল্প না করিয়া, তাহা ব্ৰহ্মাৰ্পণবুদ্ধিতে করাই বুদ্ধিমানের মাৰ্গ । তাই, তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিতে থাকিয়া শেষে উহা দ্বারাই শান্তি ও মোক্ষ লাভ করেন । ঈশ্বর তোমাকে কর্ম কর এইরূপও বলেন না, আর কর্ম ত্যাগ কর এ কথাও বলেন না । এই সমস্ত প্রকৃতিরই খেলা; এবং বন্ধন মনের ধর্ম; এই কারণে সমবুদ্ধি কিংবা ‘সর্বভূতাত্মভুতাত্মা’ হইয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে, সেই কর্ম তাহার বাধা হয় না । অধিক কি, এই অধ্যায়ের শেষে ইহাও বলা হইয়াছে যে, কুকুর, চণ্ডাল, ব্ৰাহ্মণ, গরু, হাতী-ইহাদের সম্বন্ধে যাহার বুদ্ধি সম হইয়াছে এবং যে সর্বভূতান্তৰ্গত আত্মৈক্য উপলব্ধি করিয়া আপনার ব্যবহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে, তাহার যেখানে বসিয়া আছে সেইখানেই ব্ৰহ্মনিৰ্বাণরূপ মোক্ষলাভ হয়, মোক্ষলাভের জন্য তাহাকে আর কোথাও যাইতে হয় না, অথবা সাধন করিতেও হয় না, সে মুক্ত হইয়াই আছে ।


9) গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও আগাইয়া চলিয়াছে; এবং এই অধ্যায়ে কর্মযোগে সিদ্ধির জন্য আবশ্যক সমবুদ্ধিপ্ৰাপ্তির উপায় কথিত হইয়াছে । প্ৰথম শ্লোকেই, ভগবান আপনার মত স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে, যে ব্যক্তি কর্মফলের আশা না রাখিয়া কর্তব্য বলিয়া সংসায়ের প্রাপ্ত কর্ম করে সেই প্ৰকৃত যোগী ও প্রকৃত সন্ন্যাসী; অগ্নিহোত্ৰাদি কর্ম ছাড়িয়া যে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে সে প্ৰকৃত সন্ন্যাসী নহে । তাহার পর, ভগবান আত্মস্বাতন্ত্র্যের এই প্ৰকার বর্ণনা করিয়াছেন যে, কর্মযোগমার্গে বুদ্ধিকে স্থির করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ যে কর্ম করিতে হয়, তাহা সে আপনা হইতেই করিবে; তাহা না করিলে তাহার দোষ অন্যের উপর দেওয়া যাইতে পারে না । ইহার পরে, এই অধ্যায়ে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ যোগ কিরূপে সাধন করিবে, পাতঞ্জল দৃষ্টিতে, মুখ্যরূপে তাহার বর্ণনা আছে । কিন্তু যম-নিয়ম-আসনপ্রাণায়ামাদি সাধনের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিলেও তাহাতেই কাৰ্যনিৰ্বাহ হয় না; সেই কারণে আত্মৈক্যজ্ঞানেরও আবশ্যকতা এই অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে যে, পরে সেই ব্যক্তির বৃত্তি “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” কিংবা “যো মাং পশ্যতি সর্বত্ৰ সৰ্ব্বং চ ময়ি পশ্যতি” [৬|২৯,৩০] এই প্রকার সর্বভূতে সম হওয়া চাই । ইতিমধ্যে অর্জুনের এই সংশয় উপস্থিত হইল যে, এই সাম্যবুদ্ধিরূপ যোগ এক জন্মে সিদ্ধ না হইলে আবার অন্য জন্মেও আরম্ভ হইতেই অভ্যাস করিতে হইবে - এবং পুনর্বার সেই দশাই হইবে - এবং এই প্ৰকার যদি এই চক্ৰ ক্ৰমাগতই চলিতেই থাকে, তবে এই মার্গের দ্বারা মনুষ্য কখনই সদ্‌গতি লাভ করিতে পারিবে না । এই সংশয় দূর করিবার জন্য ভগবান প্ৰথমে বলিলেন যে, যোগমার্গে কিছুই ব্যর্থ যায় না, প্রথম জন্মের সংস্কার থাকিয়া যায় এবং তাহার সহায়তায় অন্য জন্মে অধিক অভ্যাস হইয়া থাকে এবং ক্রমে ক্ৰমে শেষ সিদ্ধি লাভ হয় । এইরূপ বলিয়া ভগবান এই অধ্যায়ের শেষে অর্জুনকে পুনরায় এই নিশ্চিত ও স্পষ্ট উপদেশ দিলেন যে, কর্মযোগমার্গই শ্রেষ্ঠ ও ক্রমশঃ সুসাধ্য হওয়ায়, কেবল (অর্থাৎ ফলাশা না ছাড়িয়া) কর্ম করা, তপশ্চৰ্য্যা করা এবং জ্ঞানের দ্বারা কর্ম-সন্ন্যাস করা - এই সমস্ত মাৰ্গ ত্যাগ করিয়া তুমি যোগী হও, অৰ্থাৎ নিষ্কাম কর্মযোগমার্গের আচরণ কর ।


10) কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, এই প্রকার গীতার তিন স্বতন্ত্র বিভাগ করা উচিত নহে


কাহারো কাহারো মত এই যে, এইস্থলে অর্থাৎ প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে কর্মযোগের বিচার সম্পূর্ণ হইয়াছে; ইহার পর জ্ঞান ও ভক্তিকে ‘স্বতন্ত্ৰ’ নিষ্ঠা মানিয়া ভগবান উহার বর্ণনা করিয়াছেন - অর্থাৎ এই দুই নিষ্ঠা পরস্পর নিরপেক্ষ বা কর্মযোগেরই তু্ল্যমূল্য, কিন্তু উহা হইতে পৃথক এবং উহার পরিবর্তে বিকল্পস্বরূপে আচরণীয়; সপ্তম অধ্যায় হইতে দ্বাদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত ভক্তি এবং পরে শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানের কথা বলিয়াছেন; এবং এই প্রকারে আঠারো অধ্যায়ের বিভাগ করিলে কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান ইহাদের মধ্যে প্ৰত্যেকের অংশে ছয় ছয় অধ্যায় হইয়া গীতার সমান ভাগ হয় । কিন্তু এই মত ঠিক্‌ নহে । পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভের শ্লোক হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, “সাংখ্যনিষ্ঠা অনুসারে যুদ্ধ ছাড়িয়া দিব কিংবা যুদ্ধের ঘোরতর পরিণাম চক্ষের সম্মুখে দেখিয়াও যুদ্ধই করিব, এবং যুদ্ধই করিতে হইলে তাহার পাপ কি করিয়া এড়াইব”, যখন অর্জুনের এই মুখ্য সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, তখন “জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় এবং তাহা কর্মের দ্বারাও প্রাপ্ত হওয়া যায়; এবং তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে ভক্তি নামে এক তৃতীয় নিষ্ঠাও আছে” এইরূপ ‘ধরাছাড়া’ ও নিষ্ফল উত্তরে সেই সংশয়ের সমাধান হইতেই পারিত না । তাহা ছাড়া, অর্জুন যখন একমাত্ৰ নিশ্চয়াত্মক মার্গের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন সর্বজ্ঞ ও চতুর শ্ৰীকৃষ্ণ আসল কথা ছাড়িয়া তাঁহাকে তিন স্বতন্ত্র ও বিকল্পাত্মক মাৰ্গ দেখাইলেন, এ কথাও অসঙ্গত । ইহাই সত্য যে, গীতায় ‘সন্ন্যাস’ ও ‘কর্মযোগ’ এই দুই নিষ্ঠারই বিচার আছে [গী|৫|১]; তন্মধ্যে ‘কর্মযোগ’ যে অধিক শ্রেয়স্কর তাহাও স্পষ্ট বলা হইয়াছে [গী|৫|২] । ভক্তির তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা তো কোথাও বলাই হয় নাই । সুতরাং জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিন স্বতন্ত্র নিষ্ঠার কল্পনা সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের নিজের মনগড়া; এবং গীতায় কেবল মোক্ষোপায়েরই বিচার করা হইয়াছে তাঁহাদিগের এইরূপ ধারণা থাকায় এই তিন নিষ্ঠার কথা কদাচিৎ ভাগবত হইতেই তাঁহাদের মনে আসিয়াছে [ভাগ|১১|২০, ৬] । কিন্তু ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্‌গীতার তাৎপৰ্য যে এক নহে, সে কথা টীকাকারদিগের মনে হয় নাই । শুধু কর্মের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় না, মোক্ষের জন্য জ্ঞান চাই, এই সিদ্ধান্ত ভাগবতকারেরও মান্য । কিন্তু ইহার অতিরিক্ত, ভাগবতকার এ কথা ও বলেন যে, জ্ঞান ও নৈষ্কর্ম্য মোক্ষপ্ৰদ হইলেও ঐ দুই-ই (অর্থাৎ গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ) ভক্তি ব্যতীত শোভা পায় না - ‘নৈষ্কৰ্ম্ম্যমপ্যচুতভাববর্জিতং ন শোভতে জ্ঞানমলং নিরঞ্জনম্‌’ [ভাগ|১২|১২|৫২ এবং ১|২|১২] । এইরূপে স্পষ্ট দেখা যায় যে, ভাগবতকার কেবল ভক্তিকেই প্ৰকৃত নিষ্ঠা অর্থাৎ চরম মোক্ষপ্ৰদ অবস্থা মনে করেন । ভগবদ্‌ভক্তেরা ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে কর্ম করিবেনই না, ভাগবত এরূপও বলেন না এবং করিতেই হইবে, এ কথাও বলেন না । নিষ্কাম কর্ম কর বা না কর, এ সমস্ত ভক্তিযোগেরই বিভিন্ন প্রকার মাত্র [ভাগ|৩|২৯|৭-১৯], ভক্তি না থাকিলে সমস্ত কর্মযোগ পুনর্বার সংসারে অর্থাৎ জন্মমরণের ফেরে আনিয়া ফেলে [ভাগ|১|৫|৩৪,৩৫], ভাগবত কেবল এই কথাই বলেন । সারকথা, ভাগবতকারের সমস্ত কটাক্ষ ভক্তির উপরেই থাকায়, তিনি নিষ্কাম কর্মযোগকেও ভক্তিযোগেই ঠেলিয়া দিয়া এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, ভক্তিই প্রকৃত নিষ্ঠা । কিন্তু ভক্তিই গীতার কিছু মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় নহে । তাই, ভাগবতের উপরি-উক্ত সিদ্ধান্ত বা পরিভাষা গীতার মধ্যে ঢুকাইয়া দেওয়া আতার গাছে আমের কলম লাগাইবার মত অনুচিত । 


10.1) জ্ঞান ও কর্মের সমান ভক্তি কোন তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা নহে


পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষপ্ৰাপ্তি আর কিছুতেই হয় না, এবং এই জ্ঞান সম্পাদনে ভক্তি এক, সহজ মাৰ্গ - এ কথা গীতার সম্পূর্ণ মান্য । কিন্তু এই মার্গের সম্বন্ধে আগ্ৰহ না রাখিয়া, মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য যে জ্ঞান নিতান্ত আবশ্যক তাহার প্রাপ্তি যাহার যে মার্গ সহজ হইবে সেই মার্গের দ্বারা সে করিয়া লইবে, গীতা একথাও বলিয়াছেন । শেষে অর্থাৎ জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর মনুষ্য কর্ম করিবে কি করিবে না - ইহাই তো গীতার মুখ্য বিষয় । তাই, সংসারে কর্ম করা ও কর্ম ত্যাগ করা - জীবন্মুক্ত পুরুষদিগের জীবনে এই যে দুই মার্গ দেখিতে পাওয়া যায়, ঐ দুই মাৰ্গ হইতেই গীতার আরম্ভ হইয়াছে । তন্মধ্যে, ভাগবতকারের মত গীতা প্রথম মার্গের ‘ভক্তিযোগ’ এই নূতন নাম না দিয়া, নারায়ণীয় ধর্মে প্ৰচলিত প্ৰাচীন নামই অর্থাৎ ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে কর্ম করাকে ‘কর্মযোগ’ বা ‘কর্মনিষ্ঠা’ এবং জ্ঞানোত্তর কর্মত্যাগকে ‘সাংখ্য’ বা ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’, এই নামই গীতাতে স্থির রাখা হইয়াছে । গীতার এই পরিভাষা স্বীকার করিয়া বিচার করিলে উপলব্ধি হইবে যে, জ্ঞান ও কর্মের সমান ভক্তি নামক কোন তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা কখনই হইতে পারে না । কারণ, ‘কর্ম করা’ ও ‘না করা অর্থাৎ ছাড়া’ (যোগ ও সাংখ্য) এই অস্তিনাস্তিরূপ দুই পক্ষের অতিরিক্ত কর্মসম্বন্ধে তৃতীয় পক্ষই এক্ষণে অবশিষ্ট থাকে না । তাই, ভক্তিমান পুরুষের নিষ্ঠাটি কি, তাহা গীতা অনুসারে স্থির করিতে হইলে, উক্ত ব্যক্তি ভক্তিভাবে লাগিয়াছে, কেবল ইহা ধরিয়াই তাহার নির্ণয় না করিয়া, সেই ব্যক্তি কর্ম করে কি করে না তাহারই বিচার করা আবশ্যক । ভক্তি পরমেশ্বরপ্রাপ্তির এক সুগম সাধন; এবং সাধন অর্থে যদি ভক্তিকেই ‘যোগ’ বলা যায় [গী|১৪|২৬] তথাপি তাহা চরম ‘নিষ্ঠা’ হইতে পারে না । ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান উৎপন্ন হইলে পর কেহ কর্ম করিলে তাহাকে কর্মনিষ্ঠ এবং না করিলে তাহাকে সাংখ্যনিষ্ঠ বলিতে হয় । তন্মধ্যে কর্ম করিবার নিষ্ঠা অধিক শ্ৰেয়স্কর, ভগবান আপনার এই অভিপ্ৰায় পঞ্চম অধ্যায়ে স্পষ্টরূপে বলিয়াছেন । 


10.2) কর্ম ত্যাগ করিতেই হইবে – সন্ন্যাসমাৰ্গীর এই আপত্তি সত্য নহে


কিন্তু কর্ম পরমেশ্বরের জ্ঞান হইবার পক্ষে প্ৰতিবন্ধক হয়, এবং পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয়ই না, তাই কর্ম ত্যাগ করিতেই হইবে; - সন্ন্যাসমাৰ্গীর কর্মসম্বন্ধে এই একটা বড় আপত্তি আছে । এই আপত্তি যে সত্য নহে এবং সন্ন্যাস মার্গের দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তাহাই কর্মযোগের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় [গী|৫|৫], তাহা পঞ্চম অধ্যায়ে সাধারণভাবে বলা হইয়াছে । কিন্তু এখানে এই সাধারণ সিদ্ধান্তের কোনও খোলসা ব্যাখ্যা করা হয় নাই । তাই কর্ম করিতে করিতেই শেষে পরমেশ্বরের জ্ঞান লাভ হইয়া কিরূপে মোক্ষলাভ হয় এক্ষণে ভগবান সেই অবশিষ্ট ও মহত্বপূর্ণ বিষয়ের সবিস্তার নিরূপণ করিতেছেন । এই কারণেই সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভে ভক্তি নামক এক স্বতন্ত্র তৃতীয় নিষ্ঠা তোমাকে বলিতেছি এরূপ না বলিয়া ভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন যে -
ময্যাসক্তমনাঃ পাৰ্থ যোগং যুঞ্জন্‌ মদাশ্রয়ঃ ৷
অসংশয়ং সমগ্ৰং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ॥
“হে পাৰ্থ, আমাতে চিত্ত সংস্থাপন করিয়া এবং আমাকে আশ্রয় করিয়া যোগ অর্থাৎ কর্মযোগ সাধন করিবার সময় ‘যথা’ অর্থাৎ যে প্রকারে আমার সম্বন্ধে নিঃসংশয় পূর্ণ জ্ঞান হইবে তাহা (সেই প্ৰণালী তোমাকে বলিতেছি) তুমি শোন” [গী|৭|১]; এবং ইহাকেই পরের শ্লোকে ‘জ্ঞানবিজ্ঞান’ বলা হইয়াছে [গী|৭|২] । তন্মধ্যে প্ৰথম অর্থাৎ উপরি প্রদত্ত ‘ময্যাসক্তমনাঃ’ ইত্যাদি শ্লোকে ‘যোগং যুঞ্জন্‌’ অর্থাৎ “কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে” এই পদের খুবই গুরুত্ব আছে । কিন্তু উহার প্রতি কোন টীকাকারই ভাল করিয়া মনোযোগ দেন নাই । ‘যোগং’ অর্থাৎ সেই কর্মযোগ, যাহা প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে; এবং এই কর্মযোগ সাধন করিতে থাকিলে যে প্রকার বিধি বা রীতিতে ভগবানসম্বন্ধীয় পুর্ণ জ্ঞান হইতে পারে, সেই রীতি বা বিধির কথা এক্ষণে অর্থাৎ সপ্তম অধ্যায় হইতে আরম্ভ করিতেছি, ইহাই এই শ্লোকের অর্থ । অর্থাৎ প্ৰথম ছয় অধ্যায়ের পরবর্তী অধ্যায়ের সহিত সম্বন্ধ কি, তাহা দেখাইবার জন্য এই শ্লোক সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভে ইচ্ছাপূর্বকই দেওয়া হইয়াছে । তাই এই শ্লোকের অর্থের প্রতি উপেক্ষা করিয়া ‘প্ৰথম ছয় অধ্যায়ের পরে ভক্তিনিষ্ঠা স্বতন্ত্ররূপে বৰ্ণিত হইয়াছে’ এ কথা বলা নিতান্তই অসঙ্গত । অধিক কি, এইরূপ বলিলেও চলে যে, এইরূপ বিপরীত অর্থ যাহাতে কেহ না করে এইজন্যই এই শ্লোকে “যোগং যুঞ্জন্‌” পদ ইচ্ছা করিয়াই দেওয়া হইয়াছে । গীতার প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে কর্মের আবশ্যকতা দেখাইয়া সাংখ্যমাৰ্গ অপেক্ষা কর্মযোগ শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে; এবং তাহার পরে ষষ্ঠ অধ্যায়ে কর্মযোগে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিবার জন্য যাহা আবশ্যক সেই পাতঞ্জল যোগের সাধন বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু ইহাতেই কর্মযোগের বর্ণনা সম্পূর্ণ হয় না । ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ অর্থে কর্মেন্দ্ৰিয়দিগের একপ্রকার কস্‌রত করানো । এই অভ্যাসের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়দিগকে আপনার অধীনে রাখা যায় সত্য; কিন্তু মনুষ্যের বাসনাই যদি মন্দ হয় তবে ইন্দ্ৰিয়গণ অধীনে থাকিলেও কোনও লাভ হয় না । কারণ দেখা যায় যে, বাসনা দুষ্ট হইলে কোন কোন লোক জারণ-মারণরূপ দুষ্কর্মে এই ইন্দ্রিয়নিগ্রহরূপ সিদ্ধিরই উপযোগ করিয়া থাকে । তাই ষষ্ঠ অধ্যায়েই উক্ত হইয়াছে যে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই বাসনাও “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” এইভাবে পরিশুদ্ধ হওয়া চাই [গী|৬|২৯]; এবং বাসনার এই শুদ্ধি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ পরমেশ্বরের শুদ্ধস্বরূপ উপলব্ধি ব্যতীত হইতে পারে না । তাৎপৰ্য এই যে, কর্মযোগে যে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ আবশ্যক তাহা সম্পাদন করিলেও ‘রস’ অর্থাৎ বিষয়ের অভিরুচি মন হইতে বিলুপ্ত হয় না । এই রস কিংবা বিষয়বাসনার উচ্ছেদ করিতে হইলে পরমেশ্বর সম্বন্ধে পুর্ণ জ্ঞান হওয়া চাই । এই কথা গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হইয়াছে [গী|২|৫৯] । তাই, কর্মযোগ সাধন করিতে করিতেই পরমেশ্বরের এই জ্ঞান যে রীতি অথবা বিধির দ্বারা হইতে পারে এক্ষণে ভগবান সপ্তম অধ্যায় হইতে সেই বিধি বিবৃত করিতেছেন । ‘কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে’ এই পদ হইতে ইহাও সিদ্ধ হয় যে, কর্মযোগ যখন চলিতে থাকে তখনই এই জ্ঞান সম্পাদনা করিতে হইবে; ইহার জন্য কর্ম ছাড়িয়া দিতে হয় না; এবং সেইজন্য ভক্তি ও জ্ঞানকে কর্মযোগের পরিবর্তে বিকল্প হিসাবে মানিয়া এই দুই স্বতন্ত্র মাৰ্গ সপ্তম অধ্যায় হইতে পরে বলা হইয়াছে, এ কথাও নির্মূল হইয়া পড়ে । গীতার কর্মযোগ ভাগবতধর্ম হইতেই গৃহীত হওয়ায়, কর্মযোগে জ্ঞানলাভবিধির যে বৰ্ণনা আছে তাহা ভাগবত ধর্ম কিংবা নারায়ণীয় ধর্মে কথিত বিধিরই বৰ্ণনা; এবং এই অভিপ্ৰায়েই শান্তিপর্বের শেষে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বলিয়াছেন যে, “প্রবৃত্তিমূলক নারায়ণীয় ধর্ম এবং তাহার বিধি ভগবদ্‌গীতায় বর্ণিত হইয়াছে” (প্ৰথম প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত শ্লোক দেখ) । বৈশম্পায়নের উক্তি অনুসারে সন্ন্যাসমার্গের বিধিও ইহারই অন্তর্ভূত । কারণ, ‘কর্ম করা ও কর্ম ত্যাগ করা’ - এই ভেদই এই দুই মার্গের মধ্যে থাকিলেও উভয়েরই একই জ্ঞানবিজ্ঞান আবশ্যক; সেইজন্য দুই মার্গেরই জ্ঞানপ্রাপ্তির বিধি একই হইয়া থাকে । কিন্তু ‘কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে’ এইরূপ প্ৰত্যক্ষপদ যখন উপরি-উক্ত শ্লোকে প্ৰদত্ত হইয়াছে, তখন ইহাই স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, গীতার সপ্তম ও তাহার পরবর্তী অধ্যায়সমূহে জ্ঞানবিজ্ঞানের নিরূপণ মুখ্যতঃ কর্মযোগেরই পরিপূর্তির জন্য করা হইয়াছে, উহার ব্যাপকতার কারণে উহাতে সন্ন্যাসমার্গেরও বিধিসমূহের সমাবেশ হয়, কর্মযোগ ছাড়িয়া কেবল সাংখ্যনিষ্ঠার সমর্থনের জন্য এই জ্ঞানবিজ্ঞান বলা হয় নাই । ইহাও বিবেচনার যোগ্য যে, সাংখ্যমার্গী জ্ঞানের গুরুত্ব স্বীকার করিলেও কর্ম বা ভক্তির কোনই গুরুত্ব দেন না; এবং গীতাতে তো ভক্তিকে সুগম ও প্রধান বলা হইয়াছে - ইহাই বা কেন; বরঞ্চ অধ্যাত্মজ্ঞান ও ভক্তির বর্ণন করিবার সময় শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্থানে স্থানে এই উপদেশ দিয়াছেন, যে, “তুমি কর্ম অর্থাৎ যুদ্ধ কর” [গী|৮|৭; ১১|৩৩; ১৬|২৪; ১৮|৬] । কাজেই সিদ্ধান্ত করিতেই হয় যে, গীতার সপ্তম ও পরবর্তী অধ্যায়সমূহে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে নিরূপণ হইয়াছে, উহা পুর্ববর্তী ছয় অধ্যায়ে কথিত কর্মযোগেরই পরিপূর্তি ও সমর্থনের জন্যই বলা হইয়াছে; এখানে কেবল সাংখ্যনিষ্ঠ বা ভক্তির স্বতন্ত্র সমর্থন বিবক্ষিত নহে । এইরূপ সিদ্ধান্ত করিলে পর, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান গীতার তিন পরস্পর-স্বতন্ত্র বিভাগ হইতে পারে না । শুধু ইহাই নহে; কিন্তু এখন বুঝা যাইবে যে, এই মতও (যাহা কোন কোন লোক প্রচার করেন) শুধু কাল্পনিক ও সুতরাং মিথ্যা । তাহারা বলেন যে, ‘তত্ত্বমসি’ এই মহাবাক্যে তিনটিই পদ আছে এবং গীতার অধ্যায়ও আঠারো; তাই, “তিন-ছয় আঠারো” এই হিসাবে গীতার ছয় ছয় অধ্যায়ের তিন সমান বিভাগ করিয়া প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে ‘ত্বম’ পদের, দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ‘তৎ’ পদের এবং তৃতীয় ছয় অধ্যায়ে ‘মসি’ পদের বিচার করা হইয়াছে । এই মতকে কাল্পনিক বা মিথ্যা বলিবার কারণ এই যে, গীতায় কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞানই প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে এবং ‘তত্ত্বমসি’ এই মহাবাক্যের বিবৃতির বাহিরে গীতায় আর বেশী কিছু নাই, এই একদেশদর্শী পক্ষই এক্ষণে আর দাঁড়াইতে পারে না ।


10.3) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত একাদশ অধ্যায়ের সঙ্গতি


ভগবদ্‌গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানের বিচার কেন আসিল তাহার এইরূপ একবার মীমাংসা হইলে পর, সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত একাদশ অধ্যায়ের সঙ্গতি সহজে অবগত হইতে পারা যায় । পূর্বে ষষ্ঠ প্রকরণে কথিত হইয়াছে যে, যে পরমেশ্বরের জ্ঞান হইতে বুদ্ধি বাসনাবর্জিত ও সম হয়, সেই পরমেশ্বর-স্বরূপের বিচার একবার ক্ষরাক্ষর-দৃষ্টিতে এবং একবার ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞদৃষ্টিতে করা আবশ্যক, এবং তাহা হইতে শেষে এই চরম সিদ্ধান্ত করা হইয়া থাকে যে, যে তত্ত্ব পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে । এই বিষয়ই গীতাতে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু পরমেশ্বর-স্বরূপের এইরূপ বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে দেখা যায় যে, পরমেশ্বরের স্বরূপ কখনও ব্যক্ত (ইন্দ্ৰিয়গোচর) হয়, আর কখন বা অব্যক্ত হইয়া থাকে । এবং তাহার পর, এই দুই স্বরূপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোন্‌টি, এবং এই শ্রেষ্ঠ স্বরূপ হইতে কনিষ্ঠ স্বরূপ কিরূপে উৎপন্ন হয় ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেরও বিচার এই নিরূপণে করা আবশ্যক হয় । সেইরূপ আবার, পরমেশ্বরের পূর্ণ জ্ঞান হইতে বুদ্ধিকে স্থির, সম ও আত্মনিষ্ঠ করিবার জন্য পরমেশ্বরের যে উপাসনা করিতে হয় তাহার মধ্যে ব্যক্তের উপাসনা ভাল কি অব্যক্তের উপাসনা ভাল, তাহারও নির্ণয় করা অতি আবশ্যক হয় । এবং সেই সঙ্গে, পরমেশ্বর যখন একমাত্র, তখন ব্যক্ত জগতের মধ্যে নানাত্ব কেন দেখিতে পাওয়া যায় তাহারও উপপত্তি বোঝানো আবশ্যক । এই সমস্ত বিষয় সুব্যবস্থিতভাবে বুঝাইবার জন্য এগারো অধ্যায়ের যে প্রয়োজন হইয়াছে, ইহা আশ্চৰ্য নহে । গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানের বিচার মোটেই করা হয় নাই এ কথা আমি বলি না । আমার শুধু বক্তব্য এই যে, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, এই তিন বিষয় কিংবা নিষ্ঠা স্বতন্ত্র অর্থাৎ তুল্যবল বুঝিয়া গীতার আঠারো অধ্যায়ের ভাইদের ভাগবণ্টনের মতো এই তিনের মধ্যে যে সমান ভাগবণ্টন করা হইয়া থাকে তাহা উচিত নহে; কিন্তু জ্ঞানমূলক ও ভক্তিপ্রধান কর্মযোগরূপ একই নিষ্ঠা গীতার প্রতিপাদ্য; এবং সাংখ্যনিষ্ঠা, জ্ঞানবিজ্ঞান বা ভক্তি, ইহাদের যে নিরূপণ ভগবদ্‌গীতায় আছে তাহা কেবল কর্মযোগনিষ্ঠার পূর্তি ও সমর্থনাৰ্থ আনুষঙ্গিকভাবে প্রদত্ত হইয়াছে, স্বতন্ত্র বিষয় প্রতিপাদন করিবার জন্য নহে । এক্ষণে এই সিদ্ধান্তানুসারে কর্মযোগের পরিপূর্তি ও সমর্থনের জন্য কথিত জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভাগ গীতার অধ্যায়সমূহের ক্রমানুসারে কিরূপ করা হইয়াছে তাহা দেখা যাক ।


11) গীতার সপ্তম অধ্যায় হইতে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ


11.1) গীতার সপ্তম অধ্যায়


সপ্তম অধ্যায়ে ক্ষরাক্ষর জগতের অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের বিচার আরম্ভ করিয়া ভগবান প্ৰথমে অব্যক্ত ও অক্ষর পরব্রহ্মের জ্ঞানের বিষয়ে বলিয়াছেন যে, যে এই সমস্ত সৃষ্টিকে - পুরুষ ও প্ৰকৃতিকে - আমারই পর ও অপর স্বরূপ জানে, এবং যে এই মায়ার বাহিরে অব্যক্ত রূপ উপলব্ধি করিয়া আমাকে ভজনা করে, তাহার বুদ্ধি সম হওয়ায় তাহাকে আমি সদ্‌গতি দিই; এবং পুনরায় তিনি আপন স্বরূপের এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন যে, সমস্ত দেবতা, সমস্ত ভূত, সমস্ত যজ্ঞ, সমস্ত কর্ম, এবং সমস্ত অধ্যাত্ম আমিই, আমা ছাড়া এই জগতে আর কিছুই নাই । 


11.2) গীতার অষ্টম অধ্যায়


তাহার পর, অষ্টম অধ্যায়ের আরম্ভে, অধ্যাত্ম, অধিযজ্ঞ, অধিদৈব ও অধিভূত কি, তাহার অর্থ আমাকে বল, অর্জুন এইরূপ প্রশ্ন করায়, এই সকল শব্দের অর্থ বলিয়া ভগবান বলিয়াছেন যে, এইরূপ আমার স্বরূপ যে ব্যক্তি উপলব্ধি করিয়াছে তাহাকে আমি কখনও বিস্মৃত হই না । এইরূপ বর্ণনার পর, সমস্ত জগতে অবিনাশী বা অক্ষর তত্ত্ব কি; সমস্ত জগতের সংহার কখন্‌ ও কিরূপে হয়; এবং পরমেশ্বরস্বরূপের জ্ঞান যাহার হইয়াছে সেই ব্যক্তি কোন গতি প্ৰাপ্ত হয়; এবং জ্ঞান ব্যতীত শুধু কাম্য কর্ম যে ব্যক্তি করে তাহার কোন গতি হয়, এই সকল বিষয়ের সংক্ষেপে বিচার আছে । 


11.3) গীতার নবম অধ্যায়


নবম অধ্যায়েও ঐ বিষয়ই চলিয়াছে । এই অধ্যায়ে ভগবান উপদেশ দিয়াছেন যে, চারিদিকে পূর্ণরূপে ব্যাপ্ত অব্যক্ত পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপকে ভক্তির দ্বারা উপলব্ধি করিয়া অনন্যভাবে তাহার শরণাপন্ন হওয়াই ব্ৰহ্মপ্ৰাপ্তির প্রত্যক্ষগম্য ও সুলভ মাৰ্গ বা রাজমাৰ্গ, এবং ইহাকেই রাজবিদ্যা বা রাজগুহ্য বলে । তথাপি এই তিন অধ্যায়ে মধ্যে মধ্যে, জ্ঞানবান বা ভক্তিমান ব্যক্তিকে কর্ম করিতেই হইবে, কর্মমার্গের এই প্ৰধান তত্ত্ব ভগবান বলিতে বিস্মৃত হন নাই । উদাহরণ যথা – “তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুদ্ধ্য চ” এই জন্য সর্বদা নিজের মনে আমাকে স্মরণ রেখো এবং যুদ্ধ কর, এইরূপ অষ্টম অধ্যায়ে বলিয়াছেন [৮|৭]; আবার “সমস্ত কর্ম আমাকে অৰ্পণ করিলে কর্মের শুভাশুভ ফল হইতে তুমি মুক্ত হইবে” এইরূপ নবম অধ্যায়ে বলিয়াছেন [৯|২৭,২৮] । 


11.4) গীতার দশম অধ্যায়


সমস্ত জগৎ আমা হইতে উৎপন্ন এবং উহা আমারই রূপ, উপরে এইরূপ যাহা বলা হইয়াছে তাহাই দশম অধ্যায়ে এইরূপ অনেক উদাহরণ দিয়া অর্জুনকে ভালরূপেই বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, ‘জগতের প্রত্যেক শ্রেষ্ঠ বস্তু আমারই বিভূতি’ । 


11.5) গীতার একাদশ অধ্যায়


অর্জুনের প্রার্থনা অনুসারে একাদশ অধ্যায়ে ভগবান তাঁহাকে নিজের বিশ্বরূপ প্ৰত্যক্ষ দেখাইয়া (আমিই) পরমেশ্বরই চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন এই কথার সত্যতা অর্জুনের চক্ষের সম্মুখে বিন্যাসপূর্বক তাহার সত্যতা উপলব্ধি করাইয়া  দিলেন । কিন্তু এই প্রকার বিশ্বরূপ দেখাইয়া এবং ‘সমস্ত কর্ম আমিই করাইতেছি’ অর্জুনের মধ্যে এইরূপ বিশ্বাস জন্মাইয়া, ভগবান তখনই বলিলেন যে, “প্রকৃত কর্তা তো আমিই, তুমি উপলক্ষ্য মাত্র, অতএব নিঃশঙ্ক হইয়া যুদ্ধ কর” [গী|১১|৩৩] । জগতে একই পরমেশ্বর আছেন, ইহা এই প্রকারে সিদ্ধ হইলেও অনেক স্থানে পরমেশ্বরের অব্যক্ত স্বরূপকেই মুখ্য মানিয়া বর্ণন করা হইয়াছে যে, “আমি অব্যক্ত, মূর্খ লোকেরা আমাকে ব্যক্ত মনে করে” [৭|২৪]“যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি” [৮|১১] বেদবেত্তারা যাঁহাকে অক্ষর বলে; “অব্যক্তকেই অক্ষর বলে” [৮|২১]; “আমার প্রকৃত স্বরূপ না জানিয়া আমি মনুষ্যদেহধারী এইরূপ মূঢ় লোকেরা মনে করে” [৯|১১]; “বিদ্যার মধ্যে অধ্যাত্মবিদ্যা শ্রেষ্ঠ” [১০|৩২]; এবং অর্জুনের কথন অনুসারে “ত্বমক্ষরং সদসত্তৎপরং যৎ” [১১|৩৭] । 


11.6) গীতার দ্বাদশ অধ্যায়


এইজন্য দ্বাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন প্রশ্ন করিয়াছেন যে, “পরমেশ্বরের উপাসনা করিতে হইলে ব্যক্তের অথবা অব্যক্তের উপাসনা করিতে হইবে ?” তখন ভগবান নবম অধ্যায়ে বৰ্ণিত ব্যক্ত স্বরূপের উপাসনা সুগম, এইরূপ আপন মত বলিয়া, দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের যেরূপ বর্ণনা আছে সেইরূপই পরম ভগবদভক্তের অবস্থার বর্ণনা করিয়া এই অধ্যায় সমাপ্ত করিয়াছেন ।


12) ভক্তি ও জ্ঞান পৃথক পৃথক বর্ণিত নাই, অতএব ষড়ধ্যায়ী মত অসত্য


কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, গীতার এই তিন স্বতন্ত্র বিভাগ না করা হইলেও, সপ্তম অধ্যায় হইতে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে বিষয় আরম্ভ হইয়াছে, তাহার ভক্তি ও জ্ঞান এই দুই পৃথক্ বিভাগ সহজেই হয়, এইরূপ কাহারও কাহারও মত । দ্বিতীয় ষড়ধ্যায়ী ভক্তিমূলক, এইরূপ তাহারা বলিয়া থাকেন । কিন্তু এই মতও যে সত্য নহে, একটু বিচার করিয়া দেখিলেই তাহা উপলব্ধি হইবে । কারণ, সপ্তম অধ্যায় ক্ষরাক্ষর জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান হইতে আরম্ভ করা হইয়াছে, ভক্তি হইতে নহে । এবং যদি বলা যায় যে, দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তির বর্ণনা সম্পূর্ণ হইয়াছে, তবে আমি দেখি যে, পরবর্তী অধ্যায়গুলির স্থানে স্থানে পুনঃ পুনঃ ভক্তির বিষয়ে উপদেশ করিয়াছেন যে, যে বুদ্ধির দ্বারা আমার স্বরূপ অবগত হয় নাই সে শ্রদ্ধাপূর্বক “অন্যের বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করিয়া আমার ধ্যান করিবে” [গী|১৩|২৫], “যে আমাকে অব্যভিচারিণী ভক্তি করে সে-ই ব্ৰহ্ম-ভূত হয়” [১৪|২৬], “যে আমাকেই পুরুষোত্তমরূপে জানে সে আমাকেই ভক্তি করে” [গী|১৫|১৯]; এবং শেষে অষ্টাদশ অধ্যায়ে পুনরায় ভক্তিরই এই প্ৰকার উপদেশ করিয়াছেন যে, “সর্বধর্ম ছাড়িয়া তুমি আমার ভজনা কর” [গী|১৮|৬৬] । তাই, দ্বিতীয় ষড়ধ্যায়ীতেই ভক্তির উপদেশ আছে এরূপ বলিতে পারা যায় না । সেইরূপ আবার, জ্ঞান হইতে ভক্তি স্বতন্ত্র, ভগবানের যদি এইরূপ অভিপ্ৰায় হইত, তাহা হইলে চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানের প্রস্তাবনা করিয়া [৪|৩৪-৩৭], সপ্তম অধ্যায়ের অর্থাৎ উপরি-উক্ত আপত্তিকারীদিগের মতে ভক্তিমূলক ষড়ধ্যায়ীর আরম্ভে ভগবান বলিতেন না যে, সেই ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানই’ তোমাকে এখন বলিতেছি [৭|২] । ইহার পরে নবম অধ্যায়ে রাজবিদ্যা ও রাজগুহ্য অর্থাৎ প্রত্যক্ষাবগম্য ভক্তিমার্গের কথা বলিয়াছেন সত্য; কিন্তু অধ্যায়ের আরম্ভেই “বিজ্ঞানের সহিত জ্ঞান তোমাকে বলিতেছি” [৯|১] এইরূপ বলিয়া দিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, গীতাতে জ্ঞানের মধ্যেই ভক্তির সমাবেশ করা হইয়াছে । দশম অধ্যায়ে ভগবান্‌ স্বকীয় বিভূতির বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্ত একাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন উহাকেই ‘অধ্যাত্ম’ বলিয়াছেন [১১|১]; এবং পরমেশ্বরের ব্যাক্ত স্বরূপের বর্ণনা করিতে করিতে মধ্যে মধ্যে ব্যক্ত স্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্তস্বরূপের শ্রেষ্ঠতাও আসিয়াছে, ইহাও উপরে বলা হইয়াছে । এই সকল বিষয় হইতেই দ্বাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন এই প্রশ্ন করিলেন যে, উপাসনা ব্যক্ত অথবা অব্যক্ত পরমেশ্বরের করিতে হইবে ? তখন অব্যক্ত অপেক্ষা ব্যক্তের উপাসনা অর্থাৎ ভক্তি সুগম এইরূপ উত্তর দিয়া ভগবান ত্ৰয়োদশ অধ্যায়ে ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞের ‘জ্ঞানের’ কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভের ন্যায়, চতুৰ্দশতম অধ্যায়ের আরম্ভেও বলিলেন যে, “পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্‌” [১৪|৪] – পুনর্বার তোমাকে সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানই সম্পূর্ণ করিয়া বলিতেছি । এই জ্ঞানের কথা বলিবার সময়, ভক্তির সূত্র বা সম্বন্ধও বজায় রাখিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, জ্ঞান ও ভক্তির কথা পৃথকভাবে অর্থাৎ আলাদা আলাদা করিয়া বলা ভগবানের উদ্দেশ্য ছিল না; কিন্তু সপ্তম অধ্যায় হইতে আরব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যেই দুইটীকে একত্ৰ গাঁথা হইয়াছে । ভক্তি ভিন্ন এবং জ্ঞান ভিন্ন, ইহা বলা সেই সেই সম্প্রদায়ের অভিমানমত্ততার ভ্ৰান্ত উক্তি; গীতার অভিপ্ৰায় সেরূপ নহে । অব্যক্ত-উপাসনাতে (জ্ঞানমার্গে) অধ্যাত্মবিচারের দ্বারা পরমেশ্বর-স্বরূপের যে জ্ঞান অর্জন করিতে হয়, তাহাই ভক্তিমার্গেও আবশ্যক হয়; কিন্তু ব্যক্ত-উপাসনাতে (ভক্তিমাৰ্গে) আরম্ভে ঐ জ্ঞান অন্যের নিকট হইতে শ্ৰদ্ধার সহিত গ্ৰহণ করা যাইতে পারে [১৩|২৫], তাই ভক্তিমাৰ্গ প্ৰত্যক্ষাবগম্য এবং সাধারণতঃ সকল লোকেরই পক্ষে অনায়াসসাধ্য [৯|২], এবং জ্ঞানমাৰ্গ (বা অব্যক্ত-উপাসনা) কষ্টকর [১২|৫] - ইহা ছাড়া এই দুই সাধনের মধ্যে গীতা আর কোন ভেদ করেন নাই । পরমেশ্বর-স্বরূপের জ্ঞান লাভ করিয়া বুদ্ধিকে সম করা - কর্মযোগের এই যে সাধ্য বিষয়, তাহা এই দুই সাধনের দ্বারা সমানই প্রাপ্ত হওয়া যায় । তাই ব্যক্তোপাসনাই কর আর অব্যক্তোপাসনাই করা, দুই-ই ভগবানের সমান গ্ৰাহ্য । তথাপি জ্ঞানী ব্যক্তিরও উপাসনার ন্যূনাধিক আবশ্যকতা থাকায়, চতুর্বিধ ভক্তের মধ্যে ভক্তিমান জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ এইরূপ বলিয়া [গী|৭|১৭], ভগবান জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ অপসারিত করিয়া দিয়াছেন । যাই হোক, জ্ঞানবিজ্ঞানের বর্ণনা যখন চলিতে থাকে তখন প্ৰসঙ্গক্রমে এক-আধ অধ্যায়ে ব্যক্তোপাসনার আর অপর কোন অধ্যায়ে অব্যক্তোপাসনার বিশেষ বর্ণনা অপরিহাৰ্য । কিন্তু তাই বলিয়া এরূপ সন্দেহ যেন না হয় যে, এই দুইটী পৃথক পৃথক, এই কারণে পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপের বর্ণনা যখন চলিতেছিল সেই সময়ে ব্যক্তস্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্তের শ্রেষ্ঠতা, এবং অব্যক্তের বর্ণনা যখন চলিতেছিল সেই সময়ে ভক্তির আবশ্যকতা বলিতে ভগবান ভূলেন নাই । এখন বিশ্বরূপের ও বিভূতির বর্ণনাতেই তিন চার অধ্যায় লাগিয়া যাওয়ায় এই তিন চার অধ্যায়কে (যড়ধ্যায়ীকে নহে) মোটামুটিভাবে ‘ভক্তিমাৰ্গ’ নাম দেওয়া যদি কাহারও ভাল লাগে, তবে সেরূপ করিতে কোন বাধা নাই । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ইহা নিশ্চিত স্বীকার করিতেই হইবে যে, গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানকে না পৃথক করা হইয়াছে, না এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলা হইয়াছে । সংক্ষেপে উক্ত নিরূপণের এই ভাবার্থই মনে রাখিতে হইবে যে, কর্মযোগে যাহা প্ৰধান সেই সাম্যবুদ্ধি লাভ করিতে হইলে, পরমেশ্বরের সর্বব্যাপী স্বরূপের জ্ঞান হওয়া চাই; তারপর এই জ্ঞান ব্যক্তের উপাসনা দ্বারাই হউক বা অব্যক্তের উপাসনা দ্বারাই হউক, সুগমতা ছাড়া ইহার মধ্যে আর কোন ভেদ নাই; এবং গীতাতে সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত, সমস্ত বিষয়েরই ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ বা ‘অধ্যাত্ম’ এই একই নাম প্ৰদত্ত হইয়াছে ।


13) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ


13.1) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়


যাক; পরমেশ্বরই সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ডে বা ক্ষরাক্ষর জগতে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, ভগবান তাহা বিশ্বরূপ প্রদর্শনের দ্বারা অর্জুনের ‘চর্মচক্ষুর’ প্ৰত্যক্ষ অনুভব করাইবার পর, এই পরমেশ্বরই পিণ্ডে অর্থাৎ মনুষ্যের শরীরে বা ক্ষেত্রে আত্মারূপে যে অবস্থিত এবং এই আত্মার অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞানই যে পরমেশ্বরেরও (পরমাত্মারও) জ্ঞান, এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিবৃত করিয়াছেন । প্ৰথমে পরমাত্মার অর্থাৎ পরব্রহ্মের “অনাদিমৎ পরং ব্ৰহ্ম” ইত্যাদি উপনিষদের ভিত্তিতে বর্ণনা করিয়া পরে বলা হইয়াছে যে, এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারই ‘প্রকৃতি’ ও ‘পুরুষ’ নামক সাংখ্যবিচারে অন্তর্ভূত হইয়াছে; এবং শেষে ইহা বলা হইয়াছে যে, ‘প্ৰকৃতি’ ও ‘পুরুষের’ ভেদ উপলব্ধি করিয়া সর্বগত নির্গুণ পরমাত্মাকে যিনি ‘জ্ঞানচক্ষু’র দ্বারা দেখিয়াছেন তিনি মুক্ত হন । কিন্তু তাহার মধ্যেও কর্মযোগের এই সূত্ৰ স্থির রাখা হইয়াছে যে, “সমস্ত কর্ম প্রকৃতি করে, আত্মা কর্তা নহে - ইহা জানিলে কর্ম বন্ধন হয় না” [১৩|২৯]; এবং “ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি” [১৩|২৪] ভক্তির এই সূত্ৰও বজায় রহিয়াছে । 


13.2) গীতার চতুৰ্দশ অধ্যায়


চতুৰ্দশ অধ্যায়ে এই জ্ঞানেরই কথা সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে বর্ণন করা হইয়াছে যে, একই আত্মা বা পরমেশ্বর সর্বত্র থাকিলেও সত্ত্ব, রজ ও তম প্ৰকৃতির গুণসমূহের ভেদ প্ৰযুক্ত জগতে বৈচিত্ৰ্য উৎপন্ন হয় । পরে বলা হইয়াছে যে, প্ৰকৃতির এই খেলা জানিয়া এবং নিজেকে কর্তা নহে উপলব্ধি করিয়া ভক্তিযোগে যে পরমেশ্বরের সেবা করে সেই ব্যক্তিই প্ৰকৃত ত্ৰিগুণাতীত কিংবা মুক্ত । শেষে অর্জুনের প্রশ্নের উপর স্থিতপ্ৰজ্ঞ ও ভক্তিমান পুরুষের অবস্থার সমানই ত্ৰিগুণাতীতের অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে । 


13.3) গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়


শ্রুতিগ্ৰন্থসমূহে পরমেশ্বরের কখন কখন বৃক্ষরূপে যে বৰ্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, পঞ্চদশ অধ্যায়ের আরম্ভে তাহারই বর্ণনা করিয়া ভগবান বলিয়াছেন যে, সাংখ্য যাহাকে, ‘প্ৰকৃতির বিস্তার’ বলে, এই অশ্বত্থ বৃক্ষ সেই বিস্তারকেই বুঝায়; এবং শেষে ভগবান অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, ক্ষর ও অক্ষর এই দুয়ের অতীত যে পুরুষোত্তম তাঁহাকে জানিয়া তাঁহাকেই ‘ভক্তি’ করিলে মনুষ্য কৃতকৃত্য হয় এবং তুমিও তাহাই কর । 


13.4) গীতার ষোড়শ অধ্যায়


ষোড়শ অধ্যায়ে বলা হইয়াছে যে, প্রকৃতিভেদ প্ৰযুক্ত জগতে যেরূপ বৈচিত্ৰ্য উৎপন্ন হয় সেইরূপই মনুষ্যের মধ্যেও দৈবী সম্পত্তিবিশিষ্ট ও আসুরী সম্পত্তিবিশিষ্ট, এই দুই ভেদ হয়; এইরূপ বলিয়া, তাহাদের কর্মের বর্ণনা এবং তাহারা কোন গতি প্ৰাপ্ত হয় তাহার বর্ণনা করা হইয়াছে । 


13.5) গীতার সপ্তদশ অধ্যায়


অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলে পর সপ্তদশ অধ্যায়ে বিচার করা হইয়াছে যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতির গুণবৈষম্য প্ৰযুক্ত যে বৈচিত্র হয় তাহা শ্ৰদ্ধা, দান, যজ্ঞ, তপ ইত্যাদি কর্মের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হয় । ইহার পর বলা হইয়াছে যে, ‘ওঁতৎসৎ’ এই ব্ৰহ্মনির্দেশের ‘তৎ’ পদের অর্থ ‘নিষ্কামবুদ্ধিতে কৃত কর্ম’, এবং ‘সৎ’ পদের অর্থ ‘ভাল, কিন্তু কাম্যবুদ্ধিতে কৃত কর্ম’, এবং এই অর্থ অনুসারে ঐ সাধারণ ব্ৰহ্মনির্দেশও কর্মযোগেরই অনুকুল । 


14) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত এগারো অধ্যায়ের তাৎপৰ্য


সারকথা, সপ্তম অধ্যায় হইতে আরম্ভ করিয়া সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত এগারো অধ্যায়ের তাৎপৰ্য এই যে, জগতে চতুর্দিকে একই পরমেশ্বর ব্যাপ্ত আছেন — তুমি তাঁহাকে বিশ্বরূপদর্শনেই উপলব্ধি কর কিংবা জ্ঞানচক্ষুর দ্বারাই উপলব্ধি কর; শরীরের মধ্যে ক্ষেত্ৰজ্ঞও তিনিই এবং ক্ষর-জগতে অক্ষরও তিনিই; তিনিই দৃশ্যজগৎ ভরিয়া আছেন এবং তাহার বাহিরেও কিংবা অতীতও তিনি;  তিনি এক হইলেও প্ৰকৃতির গুণভেদ প্ৰযুক্ত ব্যক্ত জগতে নানাত্ব বা বৈচিত্র্য দেখিতে পাওয়া যায়; এবং এই মায়া হইতে কিংবা প্ৰকৃতির গুণভেদের কারণেই জ্ঞান, শ্ৰদ্ধা, তপ, যজ্ঞ, ধৃতি, দান ইত্যাদি এবং মনুষ্যের মধ্যেও অনেক ভেদ হইয়া থাকে; কিন্তু এই সমস্ত ভেদের মধ্যে যে ঐক্য আছে তাহা উপলব্ধি করিয়া সেই এক ও নিত্য তত্ত্বের উপাসনার দ্বারা - আবার সেই উপাসনা ব্যক্তেরই হউক বা অব্যক্তেরই হউক - প্ৰত্যেকের আপন বুদ্ধিকে স্থির ও সম করিয়া সেই নিষ্কাম, সাত্বিক কিংবা সাম্যবুদ্ধি হইতেই সংসারে স্বধর্মানুসারে প্ৰাপ্ত সমস্ত ব্যবহার জগতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিতে হইবে । এই জ্ঞানবিজ্ঞান এই গ্রন্থের অর্থাৎ গীতারহস্যের পূর্ব পূর্ব প্রকরণে আমি সবিস্তর প্ৰতিপাদিত করিয়াছি বলিয়া, সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসারই এই প্ৰকরণে দিয়াছি - অধিক বিস্তৃতরূপে দিই নাই । গীতার অধ্যায়সঙ্গতি দেখানই উপস্থিত ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য হওয়ায়, তাহারই জন্য যেটুকু আবশ্যক সেইটুকুই এখানে প্রদত্ত হইয়াছে ।


15) অষ্টাদশের উপসংহার কর্মযোগপ্রধানই


কর্মযোগমার্গে কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধিই শ্ৰেষ্ঠ হওয়ায়, এই বুদ্ধিকে শুদ্ধ ও সম করিবার জন্য পরমেশ্বরের সর্বব্যাপিত্বের অর্থাৎ সর্বভূতান্তৰ্গত আত্মৈক্যের যে ‘জ্ঞানবিজ্ঞান’ আবশ্যক, তাহারই বিষয় বলিতে আরম্ভ করিয়া এ পর্যন্ত এই বিষয়ের নিরূপণ করা হইল যে অধিকার-ভেদানুসারে ব্যক্তের কিংবা অব্যক্তের উপাসনা দ্বারা এই জ্ঞান হৃদয়ে প্ৰতিভাত হইলে পর, বুদ্ধি স্থৈৰ্য ও সমতা প্ৰাপ্ত হয়, এবং কর্ম ত্যাগ না করিলেও শেষে মোক্ষ লাভ হয় । ইহারই সঙ্গে ক্ষরাক্ষর ও ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞেরও বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু বুদ্ধি এইরূপ সম হইবার পরেও কর্ম ত্যাগ করা অপেক্ষা ফলাশা ছাড়িয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ কর্ম করিতে থাকাই অধিক শ্ৰেয়স্কর, ইহা ভগবান নিশ্চিতরূপে বলিয়াছেন [গী|৫|২] । তাই স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে বৰ্ণিত ‘সন্ন্যাসাশ্রম’ এই কর্মযোগে নাই এবং সেইজন্য মন্বাদি স্মৃতিগ্ৰন্থ ও কর্মযোগের বিরোধ হওয়া সম্ভব । এই সংশয় মনে উপস্থিত করিয়া  ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ - এই দুয়ের রহস্য কি, অর্জুন অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে সেই প্রশ্ন করিয়াছেন । ভগবান ইহার এই উত্তর দিতেছেন যে, সন্ন্যাসের মূল অর্থ ‘ত্যাগ করা’ হওয়ায় এবং কর্মযোগমার্গে কর্ম ত্যাগ না করিলেও ফলাশা ত্যাগ করা হইয়া থাকে বলিয়া কর্মযোগ তত্ত্বতঃ সন্ন্যাসই; কারণ সন্ন্যাসীর ভেক ধারণ করিয়া ভিক্ষা না করিলেও বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসের স্মৃত্যুক্ত তত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধিকে নিষ্কাম রাখা - কর্মযোগেও বজায় থাকে । কিন্তু ফলাশা চলিয়া গেলে স্বৰ্গলাভেরও আশা না থাকায় আর এক সংশয় এখানে উপস্থিত হয় যে, এই অবস্থায় যাগযজ্ঞাদি শ্রোত কর্ম করিবার আবশ্যকতা কি ? ইহার উত্তরে ভগবান আপন নিশ্চিত মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে, উক্ত কর্ম চিত্তশুদ্ধিকারক হওয়ায় তাহাও অন্য কর্মের সঙ্গেই নিষ্কামবুদ্ধিতে করিয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যজ্ঞচক্ৰ সর্বদা বজায় রাখা আবশ্যক । অর্জুনের প্রশ্নের এই প্রকার উত্তর দেওয়া হইলে পর, প্ৰকৃতি-স্বভাবানুরূপ জ্ঞান, কর্ম, কর্তা, বুদ্ধি, ধৃতি ও সুখ, ইহাদের যে সাত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদ হইয়া থাকে তাহা নিরূপণ করিয়া গুণবৈচিত্র্যের বিষয়টি সম্পূৰ্ণ করিয়াছেন । তাহার পর স্থির করা হইয়াছে যে, নিষ্কাম কর্ম, নিষ্কাম কর্তা, আসক্তিরহিত বুদ্ধি, অনাসক্তিসম্ভূত সুখ এবং “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই নীতি অনুসারে উৎপন্ন আত্মৈক্যজ্ঞানই সাত্বিক বা শ্ৰেষ্ঠ । এই তত্ত্ব অনুসারেই চাতুর্বর্ণেরও উপপত্তি বিবৃত হইয়াছে এবং বলা হইয়াছে যে, চতুর্বৰ্ণ-ধর্ম হইতে প্ৰাপ্ত কর্ম সাত্বিক অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিলেই মনুষ্য এই জগতে কৃতকৃত্য হইয়া শেষে শান্তি ও মোক্ষ লাভ করে । শেষে ভগবান অর্জুনকে ভক্তিমার্গের এই নিশ্চিত উপদেশ দিয়াছেন যে, কর্ম প্ৰকৃতির ধর্ম হওয়ায় তাহা ছাড়িব মনে করিলেও ছাড়া যায় না; তাই, পরমেশ্বরই সর্বকর্তা ও কারয়িতা ইহা বুঝিয়া তাঁহারই শরণাপন্ন হইয়া, সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাক; আমিই, সেই পরমেশ্বর, আমার উপর বিশ্বাস রাখিয়া আমাকে ভজনা কর, আমি সমস্ত পাপ হইতে তোমাকে মুক্ত করিব । এইরূপ উপদেশ করিয়া ভগবান গীতার প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের নিরূপণ সম্পূর্ণ করিয়াছেন । সারকথা, ইহলোক ও পরলোক এই দুয়েরই বিচার করিয়া জ্ঞানবান ও শিষ্ট ব্যক্তির প্রচারিত ‘সাংখ্য’ ও ‘কর্মযোগ’, এই দুই নিষ্ঠা হইতেই গীতার উপদেশ শুরু হইয়াছে; তন্মধ্যে পঞ্চম অধ্যায়ের নির্ণয় অনুসারে যে কর্মযোগের মহত্ত্ব অধিক, যে কর্মযোগের সিদ্ধির নিমিত্ত ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাতঞ্জল যোগের বর্ণনা করা হইয়াছে, যে কর্মযোগের আচরণবিধির বর্ণন পরবর্তী এগারো অধ্যায়ে [৭ম হইতে ১৭ তম পৰ্যন্ত] পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞানপূর্বক সবিস্তর করা হইয়াছে, এবং ইহা বলা হইয়াছে যে ঐ বিধি আচরণ করিলে পর পরমেশ্বরের পুর্ণ জ্ঞান হয় এবং শেষে মোক্ষলাভ হয়, সেই কর্মযোগেরই সমর্থন অষ্টাদশ অধ্যায়ে অর্থাৎ শেষেও আছে; এবং মোক্ষরূপ আত্মকল্যাণের বাধা না হইয়া পরমেশ্বরার্পণপূর্বক কেবল কর্তব্যবুদ্ধিতে স্বধর্মানুসারে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সমস্ত কর্ম করিবার যে এই যোগ বা যুক্তি, তাহার শ্রেষ্ঠত্বের এই ভগবৎপ্রণীত উপপাদন অর্জুন যখন শুনিলেন, তখনই তিনি সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া ভিক্ষা করিবার স্বীয় প্ৰথম সঙ্কল্প ত্যাগ করিয়া এক্ষণে - কেবল ভগবান বলিতেছেন বলিয়া নহে, কিন্তু - কর্মাকর্মশাস্ত্রের পূর্ণ জ্ঞান হওয়ায় স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন । অর্জুনকে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্যই গীতার আরম্ভ হইয়াছিল এবং গীতার শেষও সেইরূপই হইয়াছে [গী|১৮|৭৩] ।


16) মীমাংসকদের দৃষ্টিতেও গীতাতে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য হইয়াছে


গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের যে সঙ্গতি উপরে বলা হইয়াছে তাহা হইতে বুঝা যাইবে যে, গীতা কিছু কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান এই তিন স্বতন্ত্র নিষ্ঠার খিচুড়ী নহে; কিংবা উহা তুলা রেশম ও জরির সেলাই করা কাঁথা নহে; বরং দেখা যাইবে যে, তুলা, রেশম ও জরির বিভিন্ন সূত্র যথাস্থানে যোগ্যরূপে বসাইয়া কর্মযোগ নামক মূল্যবান ও মনোহর গীতারূপ বস্ত্ৰখণ্ড প্রথম হইতে শেষ পৰ্যন্ত ‘অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তের দ্বারা’ ঠাসবুনানি হইয়াছে । নিরূপণের পদ্ধতি কথোপকথনমূলক হওয়ায় শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অপেক্ষা উহা একটু শিথিল হইয়াছে সত্য । কিন্তু কথোপকথনমূলক নিরূপণের দ্বারা শাস্ত্রীয় পদ্ধতির রুক্ষ্মতার পরিবর্তে গীতা সুলভতা ও প্রেমিকতায় পূর্ণ হইয়াছে, তাহা মনে করিলে শাস্ত্রীয় পদ্ধতির হেতু-অনুমানের কেবল বুদ্ধিগ্ৰাহ্য ও নীরস কথার অনস্তিত্ব কাহারও তিলমাত্র খারাপ লাগিবে না । সেইরূপ আবার, গীতানিরূপণের পদ্ধতি পৌরাণিক কিংবা সংবাদাত্মক হইলেও মীমাংসকদিগের গ্রন্থবিচারের সমস্ত কষ্টিপাথর অনুসারে গীতার তাৎপৰ্য নির্ধারণ করিতে কোনও বাধা হয় না । ইহা এই গ্রন্থের সমস্ত বিচার আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । গীতার প্রারম্ভ দেখিলে, ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে যুদ্ধ করিবার জন্য নির্গত অর্জুন যখন ধর্মাধর্মবিচিকিৎসার চক্রের মধ্যে পড়িলেন, তখন বেদান্তশাস্ত্ৰ অনুসারে তাহাকে প্ৰবৃত্তিমূলক কর্মযোগধর্মের উপদেশ দিবার জন্য গীতা প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন এইরূপ স্পষ্ট দেখা যায়; এবং গীতায় উপসংহার ও ফল উভয়ই এই প্রকারের অর্থাৎ প্ৰবৃত্তিমূলকই ইহা প্ৰথম প্ৰকরণেই আমি দেখাইয়াছি । ইহার পর আমি বলিয়াছি যে, গীতায় অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহাতে “তুমি যুদ্ধ অর্থাৎ কর্মই কর” এইরূপ স্পষ্টরূপে দশবারোবার ও পর্যায়ক্রমে অনেকবার (অভ্যাস) বলা হইয়াছে; এবং আমি ইহাও বলিয়াছি যে, সংস্কৃতসাহিত্যে কর্মযোগের উপপত্তি গীতা ছাড়া অপর কোন গ্রন্থে না থাকায় অভ্যাস ও অপূর্বতা এই দুই প্ৰমাণের দ্বারা গীতায় কর্মযোগের প্রাধান্যই অধিক ব্যক্ত হয় । মীমাংসকগণ গ্ৰন্থতাৎপৰ্য নির্ণয়ার্থ যে সকল কষ্টিপাথরের কথা বলিয়াছেন তন্মধ্যে অর্থবাদ ও উপপত্তি এই দুই অবশিষ্ট থাকিয়া গিয়াছিল । ইহাদের সম্বন্ধে প্ৰথমে পৃথক পৃথক প্রকরণে এবং এক্ষণে গীতার অধ্যায়ক্রম অনুসারে এই প্ৰকরণে যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে ‘কর্মযোগ’ই গীতার একমাত্ৰ প্ৰতিপাদ্য বিষয়, ইহাই নিষ্পন্ন হইয়াছে । এই প্রকারে মীমাংসকদিগের গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের সমস্ত নিয়ম প্রয়োগ করিলে গীতাগ্রন্থে জ্ঞানমূলক ও ভক্তি প্ৰধান কর্মযোগই যে প্রতিপাদিত হইয়াছে, তাহাই নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় ৷ এখন সন্দেহ নাই যে, ইহার অতিরিক্ত বাকী সমস্ত গীতা-তাৎপৰ্য কেবল সাম্প্রদায়িক । এই সকল তাৎপৰ্য সাম্প্রদায়িক হইলেও এই প্রশ্ন করা যায় যে, গীতার এই সাম্প্রদায়িক অর্থ - বিশেষতঃ সন্ন্যাসমূলক অর্থ - সন্ধান করিবার কৌশল কেমন করিয়া কতক লোক পাইল ? এই প্রশ্নেরও বিচার না হওয়া পৰ্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক অর্থের আলোচনা সম্পূর্ণ হইল, বলা যায় না । তাই এই সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা গীতার সন্ন্যাসমূলক অর্থ কিরূপে করেন, এক্ষণে তাহার একটু বিচার করিয়া এই প্রকরণ শেষ করিব ।


17) চতুর্বিধ পুরুষার্থ


মনুষ্য বুদ্ধিমান প্ৰাণী হওয়ায় পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডের তত্ত্ব উপলব্ধি করাই তাহার মুখ্য কাৰ্য কিংবা পুরুষাৰ্থ, ইহা আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সিদ্ধান্ত; এবং ধর্মশাস্ত্রে ইহাকেই ‘মোক্ষ’ বলে । কিন্তু দৃশ্যজগতের ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি করিয়া শাস্ত্ৰে ইহাই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, পুরুষাৰ্থ চারি প্রকার - ধর্মঅর্থকাম ও মোক্ষ । এইস্থলে ‘ধর্ম’ শব্দে ব্যবহারিক সামাজিক ও নৈতিক ধর্ম বুঝিতে হইবে, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । এখন পুরুষাৰ্থ এইরূপ চতুর্বিধ স্বীকার করিলে পর তাহার চারি অঙ্গ বা ভাগ পরস্পরের পোষক কিংবা পোষক নহে এই প্রশ্ন স্বতই উৎপন্ন হয় । এই জন্য যেন মনে থাকে যে, পিণ্ডে ও ব্ৰহ্মাণ্ডে যে তত্ত্ব আছে তাহার জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয় না; ফের সেই জ্ঞান যে-কোন মার্গের দ্বারাই পাওয়া যাক না কেন । এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে শাব্দিক মতভেদ থাকিলেও তত্ত্বতঃ মতভেদ নাই । অন্ততঃ গীতাশাস্ত্রে এই সিদ্ধান্ত সৰ্বথাই গ্ৰাহ্য । সেইরূপ আবার, অর্থ ও কাম এই দুই পুরুষাৰ্থ সম্পাদন করিতে হইলে উহাও নাতিধর্মের দ্বারাই করিতে হইবে গীতার এই তত্ত্বও সম্পূর্ণ মান্য । এক্ষণে কেবল ধর্ম (অর্থাৎ ব্যবহারিক চাতুর্বৰ্ণধর্ম) ও মোক্ষের পরস্পর-সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে বাকী আছে । তন্মধ্যে, ধর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি না হইলে মোক্ষের কথা বলাই ব্যর্থ, ধর্মবিষয়ে এই সিদ্ধান্ত সৰ্ববাদসম্মত । কিন্তু এই চিত্তশুদ্ধি করিতে অনেক সময় লাগে; তাই, মোক্ষদৃষ্টিতে বিচার করিলেও ইহাই সিদ্ধ হয় যে, তৎপূর্বে সর্বপ্রথম ‘ধর্মের দ্বারা’ সংসারের সমস্ত কর্তব্য সম্পূর্ণ করিয়া লইতে হইবে [মনু|৬|৩৫-৩৭] । 


18) গীতার সন্ন্যাসপ্রধান অর্থ কি প্রকারে করা গিয়াছে ?


সন্ন্যাস অর্থে ‘ত্যাগ করা’; এবং ধর্মের দ্বারা যাহার এই সংসারে কিছুই সিদ্ধ হয় নাই, সে ত্যাগ করিবেই বা কি ?  অথবা যে ব্যক্তি ‘প্ৰপঞ্চ’ই (সাংসারিক কর্ম) ঠিক ঠিক সাধন করিতে পারে না, সেই “হতভাগ্য” পরমার্থও কি প্রকারে ঠিক সাধন করিবে [দাস|১২|১|১-১০ এবং ১২|৮|২১-৩১] ? কাহারও চরম উদ্দেশ্য বা সাধ্য সাংসারিকই হউক বা পারমার্থিকই হউক, ইহা সুস্পষ্ট যে, তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য দীর্ঘ প্ৰযত্ন, মনোনিগ্রহ ও সামর্থ্য ইত্যাদি গুণের সমানই প্ৰয়োজন থাকে; এবং এই সকল গুণ যাহার নাই, সে কোন সাধ্যই প্ৰাপ্ত হইতে পারে না । ইহা স্বীকার করিলেও কেহ কেহ ইহা হইতে সম্মুখে চলিয়া বলেন যে, যখন দীর্ঘ প্ৰযত্ন ও মনোনিগ্রহের দ্বারা আত্মজ্ঞান হয়, তখন শেষে জগতের বিষয়োপভোগরূপ সমস্ত ব্যবহার অসার বলিয়া মনে হয়; এবং সৰ্প যেরূপ আপনি অব্যবহাৰ্য চর্ম ফেলিয়া দেয় সেইরূপ জ্ঞানীপুরুষও সমস্ত ঐহিক বিষয় ত্যাগ করিয়া কেবল পরমেশ্বর স্বরূপেই লীন হইয়া থাকেন [বৃ|৪|৪|৭] । জীবনযাত্রার এই মার্গে সমস্ত ব্যবহার ত্যাগ করিয়া শেষে কেবল জ্ঞানকেই প্রাধান্য দেওয়ায়, ইহাকে জ্ঞাননিষ্ঠা, সাংখ্যনিষ্ঠা কিংবা সমস্ত ব্যবহার ত্যাগ করিলে সন্ন্যাসনিষ্ঠাও বলা হয় । কিন্তু ইহার উল্টা গীতাশাস্ত্র বলেন যে, প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য ‘ধর্ম’ আবশ্যক তো বটেই, কিন্তু পরে চিত্তশুদ্ধি হইলে পরও - নিজের জন্য বিষয়োপভোগরূপ ব্যবহার তুচ্ছ হইলেও - ঐ সমস্ত ব্যবহারই কেবল স্বধর্ম ও কর্তব্য বলিয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করা আবশ্যক । জ্ঞানীপুরুষ এইরূপ না করিলে, দৃষ্টান্ত দেখাইবার কেহই থাকিবে না, এবং সংসার বিনষ্ট হইবে । এই কর্মভূমিতে কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না; এবং বুদ্ধি নিষ্কাম হইলে কোন কর্মই মোক্ষের অন্তরায় হইতে পারে না । তাই সংসারের কর্ম ত্যাগ না করিয়া অন্য লোকের ন্যায় জগতের সমস্ত ব্যবহার বিরক্তবুদ্ধিতে আমরণ করাই জ্ঞানীপুরুষেরও কর্তব্য হইয়া পড়ে । জীবনযাত্রার গীতোপদিষ্ট এই মাৰ্গকেই কর্মনিষ্ঠা কিংবা কর্মযোগ বলে । কিন্তু কর্মযোগ এইরূপ শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হইলেও উহার জন্য গীতাতে কোথাও সন্ন্যাসমার্গের নিন্দা করা হয় নাই । বরং উহাও মোক্ষ প্ৰদ বলা হইয়াছে । স্পষ্টই দেখা যায় যে, জগতের আরম্ভে সনৎকুমারাদি এবং পরে শুকযাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষি যে মার্গ স্বীকার করিয়াছেন তাহাকে ভগবানও সর্বথৈব ত্যাজ্য কিরূপে বলিবেন ? সাংসারিক ব্যবহার কাহারও নিকট নীরস বা মিষ্ট লাগা অংশত উহার প্রারব্ধ কর্মানুসারে প্রাপ্ত জন্মস্বভাবের উপর নির্ভর করে । এবং জ্ঞান হইলেও প্রারব্ধ কর্মের ভোগ না হইলে নিষ্কৃতি নাই ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । তাই এই প্রারব্ধকর্মানুসারে প্ৰাপ্ত জন্মস্বভাব হেতু কোন জ্ঞানী পুরুষের মনে সংসারে বিরক্তি উৎপন্ন হওয়ায় তিনি যদি সংসার ত্যাগ করেন তাহা হইলে তাঁহাকে নিন্দা করিয়া কোন ফল নাই । আত্মজ্ঞানের দ্বারা যে সিদ্ধপুরুষের বুদ্ধি নিঃসঙ্গ ও পবিত্র হইয়াছে তিনি অন্য কিছু করুন, বা না করুন; কিন্তু ইহা ভুলিলে চলিবে না যে তিনি মানববুদ্ধির শুদ্ধতার পরম সীমা, এবং স্বভাবতই বিষয়লুব্ধ দুর্ধর মনোবৃত্তিকে আপনার অধীনে রাখিবার সামর্থ্যের পরাকাষ্ঠা সকল লোকের প্ৰত্যক্ষ দৃষ্টির সম্মুখে আনিয়া দেন । তাঁহার এই কাজ লোকসংগ্রহের দৃষ্টিতেও ছোট নহে । সন্ন্যাসধর্ম সম্বন্ধে লোকের মধ্যে যে আদরবুদ্ধি আছে, ইহাই তাহার প্রকৃত কারণ; এবং মোক্ষ দৃষ্টিতে গীতারও ইহাই অভিমত । কিন্তু শুধু জন্মস্বভাবের প্রতি অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্মেরই প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া, যিনি পূর্ণ আত্মস্বাতন্ত্র্য প্রাপ্ত হইয়াছেন সেই জ্ঞানীপুরুষ এই কর্মভূমিতে কিরূপ ব্যবহার করিবেন এই বিষয়ের শাস্ত্রীয় পদ্ধতিক্ৰমে বিচার করিলে, কর্মত্যাগ পক্ষ গৌণ এবং জগতের আরম্ভে মরীচি প্ৰভৃতি এবং পরে জনকাদির আচরিত কর্মযোগই জ্ঞানীপুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ স্বীকার করেন, গীতার অনুসরণে এই সিদ্ধান্তই করিতে হয় । কারণ, এক্ষণে ন্যায়ত ইহাই বলিতে হয় যে, পরমেশ্বরের সৃষ্ট জগতের পরিচালন কাৰ্যও জ্ঞানীপুরুষেরই করিতে হইবে, এবং এই মাৰ্গে জ্ঞানসামর্থ্যের সঙ্গেই কর্মসামর্থ্যও অবিরোধে মিলিত থাকিবার কারণে, এই কর্মযোগ শুধু সাংখ্যমাৰ্গ অপেক্ষা কোথাও অধিক যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় ।


19) সাংখ্য + নিষ্কাম কর্ম = কর্মযোগ


সাংখ্য ও কর্মযোগ এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে যে মুখ্য ভেদ আছে তাহার উক্ত রীতি অনুসারে বিচার করিলে সাংখ্য + নিষ্কামকর্ম = কর্মযোগ, এই সমীকরণ নিষ্পন্ন হয়; এবং বৈশম্পায়নের উক্তি অনুসারে গীতার প্রবৃত্তিমূলক কর্মযোগের প্রতিপাদনে সাংখ্যনিষ্ঠার নিরূপণেরও সমাবেশ স্বাভাবিকভাবে হইয়া যায় [মভা|শাং|৩৪৮|৫৩] । এবং সেইজন্যই গীতার সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকারদিগের ইহা দেখাইবার বেশ সুবিধা হইয়াছে যে, তাঁহাদের সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমাৰ্গই গীতার প্রতিপাদ্য । গীতার যে শ্লোকগুলিতে কর্ম শ্ৰেয়স্কর নির্ধারণ করিয়া কর্ম করিতে বলা হইয়াছে, সেই শ্লোকগুলির প্রতি উপেক্ষা করিলে, অথবা সে সমস্ত অর্থবাদাত্মক অর্থাৎ আনুষঙ্গিক ও প্ৰশংসাত্মক এইরূপ নিজের ইচ্ছামত টিপ্পনী কাটিলে কিংবা অন্য কোন যুক্তি অবলম্বন করিয়া উক্ত সমীকরণের ‘নিষ্কাম কর্ম’কে উৎপাটিত করিয়া ফেলিলে ঐ সমীকরণের সাংখ্য = কর্মযোগ এই রূপান্তর হইয়া যায়; এবং গীতায় সাংখ্যমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত, এইরূপ বলিবার সুযোগ হয় । কিন্তু এই রীতিতে গীতার যে অর্থ করা হয় তাহা গীতার উপক্ৰমোপসংহারের অত্যন্ত বিরুদ্ধ; এবং আমি এই গ্রন্থের স্থানে স্থানে স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছি যে, গীতায় কর্মযোগকে গৌণ এবং সন্ন্যাসকে মুখ্য মনে করা, গৃহকর্তার গৃহে গৃহকর্তাকে অতিথি এবং অতিথিকে গৃহকর্তা মনে করা যেরূপ অসঙ্গত, সেইরূপ অসঙ্গত । যাঁহাদের মত এই যে, গীতাতে নিছক বেদান্ত, কেবল ভক্তি কিংবা শুধু পাতঞ্জল-যোগই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে তাঁহাদের এই মতের খণ্ডন আমি করিয়াই আসিয়াছি । 


20) গীতাতে কি নাই ? তথাপি শেষে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য


গীতায় কোন্‌ বিষয় নাই ? বৈদিক ধর্মে মোক্ষ প্ৰাপ্তির যতগুলি সাধন বা মাৰ্গ আছে তন্মধ্যে প্রত্যেক মার্গের কোন-না-কোন অংশ গীতায় গৃহীত হইয়াছে; এবং ইহার পরেও “ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থঃ” [গী|৯|৫] এই নীতি অনুসারে গীতার প্রকৃত রহস্য এই সমস্ত মাৰ্গ হইতে ভিন্নই হইয়াছে । জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয় না সন্ন্যাসমার্গের অর্থাৎ উপনিষদের এই তত্ত্ব গীতার গ্রাহ্য; কিন্তু নিষ্কাম কর্মের সহিত তাহা জুড়িয়া দেওয়ায় গীতার ভাগবত ধর্মেই যতিধর্মেরও সমাবেশ সহজেই হইয়াছে । তথাপি গীতায় সন্ন্যাস ও বৈরাগ্যের অর্থ কর্মত্যাগ না করিয়া, ফলাশা ত্যাগ করাই প্ৰকৃত বৈরাগ্য বা সন্ন্যাস এইরূপ বলিয়া শেষে উপনিষৎকারদিগের কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মযোগ অধিক শ্ৰেয়স্কর এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে । বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্ম কেবল যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠান করিলে বন্ধন হয় না, কর্মকাণ্ডী মীমাংসকদিগের এই মতও গীতার মান্য । কিন্তু গীতা ‘যজ্ঞ’ শব্দের অর্থ বিস্তৃত করিয়া উক্ত মতে এই এক সিদ্ধান্ত জুড়িয়া দিয়াছেন যে, ফলাশা ত্যাগ করিয়া সম্পাদিত সমস্ত কর্মই এক বৃহৎ যজ্ঞ হওয়ায় বর্ণাশ্রমবিহিত সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে সতত করাই মনুষ্যমাত্রের কর্তব্য । জগদুৎপত্তিক্ৰমবিষয়ে উপনিষৎকারদিগের অপেক্ষা সাংখ্যদিগের মতকে গীতা প্ৰাধান্য দিয়াছেন; তথাপি প্ৰকৃতি ও পুরুষেতেই না থামিয়া জগদুৎপত্তিক্রমের পরম্পরাকে উপনিষদের নিত্য পরমাত্মা পৰ্যন্ত আনিয়া পৌঁছাইয়া দিয়াছেন । অধ্যাত্ম জ্ঞান কেবল বুদ্ধির দ্বারা অর্জন করা ক্লেশকর হওয়ায় ভক্তি ও শ্রদ্ধা দ্বারা উহা অর্জন করিবার বিধি ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মে উক্ত হইয়াছে । বাসুদেবভক্তির সেই বিধি গীতাতেও বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই বিষয়েও ভাগবতধর্মের সর্বাংশে নকল না করিয়া, বরঞ্চ বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ বা জীব উৎপন্ন হইয়াছে, ভাগবতধর্মোক্ত জীবের উৎপত্তিসম্বন্ধীয় এই মত বেদান্তসূত্রের ন্যায় গীতাও ত্যাজ্য স্থির করিয়া ভাগবতধর্মোক্ত ভক্তির এবং উপনিষদের ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞসম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ মিল স্থাপন করিয়াছেন । ইহা ব্যতীত মোক্ষপ্ৰাপ্তির অন্য সাধন পাতঞ্জল যোগ । কিন্তু পাতঞ্জল যোগই জীবনের মুখ্য কর্তব্য ইহা গীতার বক্তব্য না হইলেও, বুদ্ধিকে সম করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ আবশ্যক হওয়ায় সেইটুকুরই জন্য পাতঞ্জল যোগের যমনিয়মসনাদির উপযোগ করিয়া লও এইরূপ গীতা বলিয়াছেন । সারকথা, বৈদিক ধর্মে মোক্ষ প্ৰাপ্তির যে যে সাধন কথিত হইয়াছে সে সমস্তই কর্মযোগের সাঙ্গোপাঙ্গ আলোচনা করিবার সময় প্রসঙ্গানুসারে ন্যূনাধিক অংশে গীতায় বর্ণিত হইয়াছে । এই সমস্ত বর্ণনাকে স্বতন্ত্র বলিলে অসঙ্গতি উৎপন্ন হইয়া গীতার সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী এইরূপ প্ৰতীয়মান হয়; এবং এই বিশ্বাস বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক টীকা হইতে আরও দৃঢ় হইয়া যায় । কিন্তু আমার উপরি-কথিত অনুসারে যদি এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ব্ৰহ্মজ্ঞান ও ভক্তির মিলন করাইয়া শেষে তদ্বারা কর্মযোগের সমর্থন করাই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয়, তাহা হইলে এই সমস্ত বিরোধ বিলুপ্ত হয়; এবং গীতাতে যে অলৌকিক কৌশলে পূর্ণ ব্যাপক দৃষ্টিতে তত্ত্বজ্ঞানের সহিত ভক্তি ও কর্মযোগের যথোচিত মিল করা হইয়াছে, তাহা দেখিয়া অবাক না হইয়া থাকা যায় না । গঙ্গায় গিয়া অন্য যত নদী মিলুক না কেন, তথাপি গঙ্গার স্বরূপের যেরূপ বদল হয় না, সেই প্ৰকার গীতারও কথা । তাহাতে যাহা কিছু সমস্ত থাকিলেও কর্মযোগই তাহার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । কর্মযোগই এইরূপ মুখ্য বিষয় হইলেও কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই মোক্ষধর্মের মর্মও উহাতে সুন্দর রূপে নিরূপিত হওয়ায় কাৰ্য্যাকাৰ্য নির্ণয়াৰ্থ কথিত এই গীতাধর্মই - “স হি ধৰ্ম্মঃ সুপৰ্যাপ্তো ব্ৰহ্মণঃ পদবেদনে” [মভা|অশ্ব|১৬|১২] - ব্রহ্ম প্ৰাপ্তি করাইয়া দিতেও পূর্ণ সমর্থ; এবং অনুগীতার আরম্ভে ভগবান অর্জুনকে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, এই মার্গের অনুসরণকারীর মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য অন্য কোন অনুষ্ঠানেরই আবশ্যকতা নাই । 


21) সন্ন্যাসমার্গীদের নিকটে প্রার্থনা



ব্যবহারিক সমস্ত কর্মের তাগ না করিলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ প্ৰতিপাদন যাহারা করে সেই সন্ন্যাসমার্গের লোকদিগের আমার এই উক্তি ভাল লাগিবে না, তাহা আমি জানি; কিন্তু তাহার উপায় নাই । গীতা গ্ৰন্থ সন্ন্যাসমার্গেরও নহে কিংবা অন্য কোন নিবৃত্তিমূলক পন্থারও নহে । জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পরেও কর্মসন্ন্যাস কেন করিবে না তাহার ব্ৰহ্মজ্ঞানদৃষ্টিতে সযুক্তিক উত্তর দিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের প্ৰবৃত্তি । তাই, সন্ন্যাসমাৰ্গাবলম্বীদিগের উচিত যে, তাহারা গীতাকেও ‘সন্ন্যাস দিবার’ গোলযোগে না ফেলিয়া ‘সন্ন্যাস প্ৰতিপাদক’ অন্য যে সব বৈদিক গ্ৰন্থ আছে, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুক । অথবা গীতায় সন্ন্যাসমার্গকেও ভগবান্‌ যে নিরাভিমান বুদ্ধিতে নিঃশ্ৰেয়স্কর বলিয়াছেন সেই সমবুদ্ধিতেই সাংখ্যমার্গীদিগেরও ইহাই বলা উচিত যে, “শুধু যাহাতে জগতের কাজ চলে এইজন্যই পরমেশ্বর; এবং যখন তিনি সময়ে সময়ে এই জন্যই অবতার ধারণ করেন, তখন জ্ঞানোত্তর নিষ্কামবুদ্ধিতে ব্যবহারিক কর্ম করিতে থাকিবার যে মার্গের উপদেশ ভগবান গীতায় করিয়াছেন সেই মাৰ্গই কলিকালে যুক্তিসঙ্গত” এবং এইরূপ বলাই উহাদিগের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উত্তম ।

গীতার বহিরঙ্গপরীক্ষা

অবিদিত্বা ঋষিং ছন্দো দৈবতং যোগমেব চ
যোহধ্যাপয়োজ্জপেদ্বাহপি পাপীয়ান্‌ জায়তে তু সঃ ॥ - [স্মৃতি]

(“কোন মন্ত্রের ঋষি, ছন্দ, দৈবত ও বিনিয়োগ না জানিয়া (উক্ত মন্ত্র) যে শিক্ষা দেয় কিংবা তাহার জপ করে সে পাপী হয় ।” ইহা কোন এক স্মৃতিগ্রন্থের বচন, কিন্তু কোন গ্রন্থের তাহা জানি না । হাঁ, তাহার মূল আর্ষেয়ব্রাহ্মণ [আর্ষেয় |১] শ্রুতিগ্রন্থে আছে; তাহা এই – “যো হ বা অবিদিতার্যেয়চ্ছন্দোদৈবতব্রাহ্মণেন মন্ত্রেণ যাজয়তি বাহধ্যাপয়তি বা স্থাণুং বর্চ্ছতি গৰ্ত্তং বা প্ৰতিপদ্যতে ॥” কোন মন্ত্রের ঋষি, ছন্দ প্রভৃতি বহিরঙ্গ; উহা না জানিয়া মন্ত্র বলিবেক না । এই নীতিই গীতার ন্যায় গ্রন্থ সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যায় ।)

পূর্ব পূর্ব প্ৰকারণে ইহা সবিস্তার বলিয়াছি যে, যখন ভারতীয় যুদ্ধে কুলক্ষয় ও জ্ঞাতিক্ষয়ের প্রত্যক্ষ স্বরূপ সর্বপ্রথম নেত্ৰসমক্ষে আসিল, তখন অর্জুন স্বকীয় ক্ষাত্ৰধর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসগ্রহণে উদ্যত হইলেন এবং সেই সময়ে তাঁহাকে ঠিক পথে ফিরাইয়া আনিবার জন্য বেদান্তশাস্ত্রের ভিত্তির উপর শ্ৰীকৃষ্ণ প্ৰতিপাদন করিলেন যে, কর্মযোগই অধিক শ্ৰেয়স্কর, কর্মযোগে বুদ্ধিরই প্ৰাধান্য, এইজন্য ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান কিংবা পরমেশ্বরভক্তির দ্বারা নিজের বুদ্ধিকে সাম্যাবস্থায় রাখিয়া সেই বুদ্ধি দ্বারা স্বধর্মানুসারে সকল কর্ম করিতে থাকিলেই মোক্ষলাভ হয়, ইহা ব্যতীত মোক্ষলাভের জন্য আর কিছুরই আবশ্যকতা নাই; এবং এইরূপ উপদেশ করিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করিতে প্ৰবৃত্ত করিলেন । গীতার ইহাই প্ৰকৃত তাৎপৰ্য । গীতাগ্রন্থ কেবল বেদান্তবিষয়ক ও নিবৃত্তিমূলক, এইরূপ ভ্ৰান্ত সংস্কারের দরুণ “মহাভারতের ভিতর গীতাকে সন্নিবিষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই” ইত্যাদি যে সন্দেহ উৎপন্ন হইয়াছে তাহাও এক্ষণে সহজে নিরাকৃত হয় । কারণ কর্ণপর্বে সত্যানুত্যের আলোচনা করিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ যেরূপ অর্জুনকে যুধিষ্ঠির-বধ হইতে নিবৃত্ত করিয়াছিলেন, সেইরূপ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য গীতার উপদেশও আবশ্যক হইয়াছিল । এবং কাব্যদৃষ্টিতে দেখিলেও, ইহাই সিদ্ধ হয় যে, মহাভারতে অনেক স্থলে এই প্ৰকারই অন্য যে সকল প্ৰসঙ্গ আসিয়াছে সেই সমস্তের মূলতত্ত্ব কোথাও-না-কোথাও বলা আবশ্যক ছিল, তাই উহা ভগবদ্‌গীতাতে বলিয়া ব্যবহারিক ধর্মাধর্মের কিংবা কার্যাকাৰ্যব্যবস্থিতির নিরূপণের পুর্ণতা গীতাতেই করা হইয়াছে । বনপর্বের ব্ৰাহ্মণব্যাধ-সংবাদে ব্যাধ বেদান্তের ভিত্তিতে “আমি মাংসবিক্রয়ের ব্যবসায় কেন করিতেছি ।” তাহার বিচার করিয়াছে; এবং শান্তিপর্বের তুলাধার-জাজলি-সংবাদেও ঐ প্রকারেই তুলাধার স্বকীয় বাণিজ্যব্যবসায়ের সমর্থন করিয়াছে [বন |২০৬-২১৫ ও শাং |২৬০-২৬৩] । কিন্তু এই উপপত্তি সেই সেই বিশিষ্ট ব্যবসায়েরই করা হইয়াছিল । এই প্ৰকার অহিংসা, সত্য প্ৰভৃতি বিষয়ের আলোচনা মহাভারতে কয়েকস্থানে আসিলেও তাহাও একদেশদর্শী অর্থাৎ সেই সেই বিশিষ্ট বিষয়ের জন্যই হইয়াছিল, তাই উহাকে মহাভারতের প্রধান ভাগ ধরা যাইতে পারে না । এইরূপ একদেশদর্শী আলোচনা দ্বারা ইহাও নির্ণয় করা যায় না যে, যে শ্ৰীকৃষ্ণের এবং পাণ্ডবদিগের মহৎ কাৰ্যসমূহের বর্ণনা করিবার জন্য ব্যাস মহাভারত লিখিয়াছিলেন, সেই মহাত্মা ব্যক্তিদের চরিত্রকে আদর্শ ধরিয়া মনুষ্য সেই প্ৰকার আচরণ করিবে কি না । সংসার অসার এবং কোন-এক সময়ে সন্ন্যাসগ্রহণই শ্রেষ্ঠ যদি ধরা হয় তবে স্বভাবত এই প্রশ্ন আসে যে, শ্ৰীকৃষ্ণ এবং পাণ্ডবদিগের এত ঝঞ্ঝাটে পড়িবার কারণ কি ছিল ? এবং যদি তাহাদের প্রযত্নের কোন কারণ স্বীকারও করা যায়, তবে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ তাহাদের গৌরবকীর্তন করিয়া ব্যাসের তিন বৎসরকাল সমান পরিশ্রম করিয়া [মভা |আ|৬২|৫২] এক লাখ শ্লোকের বৃহৎ গ্ৰন্থ লিখিবার প্রয়োজনই বা কি ছিল ? বৰ্ণাশ্ৰমকর্ম চিত্তশুদ্ধির জন্য করা হয়, কেবল এইটুকু বলিলেই এই প্রশ্নের ঠিক মীমাংসা হয় না; কারণ, যাহাই বল না কেন, স্বধর্মাচরণ কিংবা জগতের অন্য সমস্ত ব্যবহার তো সন্ন্যাসদৃষ্টিতে গৌণ বলিয়াই মানা হয় । এই জন্য মহাভারতে যে মহাপুরুষদিগের চরিত্র বর্ণিত হইয়াছে, সেই মহাপুরুষদিগের আচরণের উপর “মূলে কুঠার” নীতি-অনুযায়ী আপত্তির নিরসন করিয়া উক্ত গ্রন্থে কোন-না-কোন স্থানে সবিস্তার ইহা বলা আবশ্যক ছিল যে, সংসারের সমস্ত কাজ করিতে হইবে কি না; এবং করিতে হইবে বলিলেও প্ৰত্যেক মনুষ্য কিরূপে সংসারে নিজ নিজ কর্ম চালাইলে সেই সব কর্ম মোক্ষলাভের অন্তরায় হইবে না। নলোপাখ্যান, রামোপাখ্যান প্ৰভৃতি যে সব উপাখ্যান মহাভারতে আছে তাহাতে এই সকল বিষয়ের আলোচনা উচিত বলিয়া বিবেচিত হয় নাই; কারণ, এইরূপ করিলে সেই উপাঙ্গগুলির ন্যায় এই আলোচনাও গৌণ বলিয়াই বিবেচিত হইত । সেইরূপ বনপর্ব কিংবা শান্তিপর্বের অনেক বিষয়ের খিচুড়ীর মধ্যে গীতাকেও সন্নিবিষ্ট করিলে উহার মহত্বের লাঘব না হইয়া যাইত না । তাই, উদ্যোগপর্ব শেষ করিয়া মহাভারতের প্রধান কাৰ্য - ভারতীয় যুদ্ধ - আরম্ভ হইবার ঠিক প্রসঙ্গেই, সেই সম্বন্ধে এরূপ আপত্তি করা হইয়াছে, যাহা নীতিধর্মদৃষ্টিতে অপরিহাৰ্য দেখায়, এবং সেইখানেই এই কর্মাকর্মবিচারের স্বতন্ত্র শাস্ত্ৰ উপপত্তির সহিত কথিত হইয়াছে । সার কথা, পাঠক কিছু বিলম্বের কারণে যদি এই পরম্পরাগত কথা ভুলিয়া যান যে, শ্ৰীকৃষ্ণ যুদ্ধারম্ভেই অর্জুনকে গীতা শুনাইয়াছিলেন, এবং যদি তিনি এই বুদ্ধিতেই বিচার করেন যে, মহাভারতে ধর্মাধর্মনিরূপণার্থ বিরচিত ইহা এক আর্ষ মহাকাব্য, তথাপি ইহাই উপলব্ধি হইবে যে, গীতার জন্য মহাভারতে যে স্থান নিযুক্ত করা হইয়াছে তাহাই গীতার মহত্ব প্ৰকাশ করিবার জন্য কাব্যদৃষ্টিতেও সঙ্গত হইয়াছে । গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় কি এবং মহাভারতে কোন স্থানে গীতা বিবৃত হইয়াছে, এই সকল বিষয়ের ঠিক ঠিক উপপত্তি যখন বুঝা গেল. তখন এই সকল প্রশ্নের কোনই গুরুত্ব দেখা যায় না যে “গীতোক্ত জ্ঞান রণভূমিতে বিবৃত করিবার কি প্রয়োজন ছিল ? কোন সময়ে কেহ এই গ্ৰন্থ পরে মহাভারতে ঢুকাইয়া দিয়া থাকিবে অথবা ভগবদ্‌গীতার দশ শ্লোকই মুখ্য কিংবা শত শ্লোকই মুখ্য ?” কারণ অন্য প্রকরণসমূহ হইতেও উপলব্ধি হইবে যে, যখন একবার ইহা স্থির হইল যে ধর্মনিরূপণার্থ ‘ভারত’কে ‘মহাভারত’ করিবার জন্য অমুক বিষয় মহাভারতে অমুক কারণে অমুক স্থানে সন্নিবেশ করা আবশ্যক, তখন মহাভারতকার সেই বিষয়ের নিরূপণে কত স্থান লাগিবে তাহার জন্য কোন চিন্তা করেন না । তথাপি গীতার বহিরঙ্গপরীক্ষা সম্বন্ধে অন্য যে সকল তর্ক উপস্থিত করা হয় তাহার উপরেও এক্ষণে প্ৰসঙ্গানুসারে বিচার করিয়া তাহার মধ্যে কতটা তথ্য আছে তাহা দেখা আবশ্যক, তাই তন্মধ্যে 
(১) গীতা ও মহাভারত
(২) গীতা ও উপনিষৎ, 
(৩) গীতা ও ব্ৰহ্মসূত্র
(৪) ভাগবত ধর্মের উদয় ও গীতা, 
(৫) বর্তমান গীতার কাল
(৬) গীতা ও বৌদ্ধ গ্ৰন্থ, এবং (শেষ অংশ দেখুন)
(৭) গীতা ও খৃষ্টানদিগের বাইবেল,(শেষ অংশ দেখুন)
-“এই সাত বিষয়ের আলোচনা এই প্ৰকারণের সাত ভাগে যথাক্রমে করা হইয়াছে । স্মরণ থাকে যেন, এই বিচার করিবার সময় কেবল কাব্যের হিসাবে অর্থাৎ ব্যবহারিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেই মহাভারত, গীতা, ব্ৰহ্মসূত্র, উপনিষৎ প্রভৃতি গ্রন্থের আলোচনা বহিরঙ্গসমালোচক করিয়া থাকেন, অতএব আমিও সেই দৃষ্টিতেই এক্ষণে উক্ত প্রশ্ন সমূহের বিচার করিব ।

কর্মযোগশাস্ত্র (Science of Right Action)


তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম্‌ ৷ [গীতা|২|৫০]

(“অতএব তুমি যোগ অবলম্বন কর । কর্ম করিবার যে শৈলী, চাতুর্য, কিংবা কুশলতা তাহাকেই যোগ বলে ।”)

কর্মজিজ্ঞাসার মহত্ব


কোন শাস্ত্রের জ্ঞানলাভার্থ যদি কোন ব্যক্তির পূর্ব হইতে ইচ্ছা না থাকে, তবে সে ব্যক্তি সে শাস্ত্রের জ্ঞানলাভের অনধিকারী হয় । এইরূপ অনধিকারী ব্যক্তিকে ঐ শাস্ত্ৰ শিক্ষা দেওয়া আর উল্টানো কলসে জল ভরা - একই কথা । শিষ্যের তাহা হইতে কোন ফল হয় না, - শুধু তাহা নহে, গুরুরও অকারণ শ্রম হয়; উভয়েরই সময় ব্যর্থ হইয়া যায় । জৈমিনি এবং বাদরায়ণের সূত্রের আরম্ভে “অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা” ও “অথাতো ব্ৰহ্মজিজ্ঞাসা” এইরূপ সূত্র এই কারণেই স্থাপিত হইয়াছে । ব্ৰহ্মোপদেশ যেরূপ মুমুক্ষুকে, ধর্মোপদেশ যেরূপ ধর্মজিজ্ঞাসুকে দেওয়া উচিত, সেইরূপ, সংসারে কর্ম কিরূপে করিতে হইবে, ইহার তত্ত্ব জানিবার ইচ্ছা কিংবা জিজ্ঞাসা যাহার হইয়াছে, তাহাকেই কর্মশাস্ত্ৰোপদেশ দেওয়া উচিত; এবং এই জন্যই প্ৰথম প্ৰকরণে ‘অথাতো’ করিয়া, দ্বিতীয় প্রকরণে কর্মজিজ্ঞাসার স্বরূপ ও কর্মযোগশাস্ত্রের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমি একটা মোটামুটি আলোচনা করিয়াছি । অমুক স্থানে আমার আটকাইতেছে এইরূপ প্ৰথমেই অনুভবে আসা ব্যতীত, আটক বাধা হইতে মুক্তিলাভের পক্ষে শাস্ত্রের যে কতটা গুরুত্ব তাহা আমাদের উপলব্ধি হয় না এবং উহার গুরুত্ব উপলব্ধি না হওয়ায়, কেবল মুখে আওড়ানো শাস্ত্ৰ পরে মনে রাখাও কঠিন হইয়া পড়ে । এই জন্য সদগুরু শিষ্যের জিজ্ঞাসা অর্থাৎ জানিবার ইচ্ছা আছে কিনা তাহাই দেখেন, যদি না থাকে তবে তাহাকে জাগ্ৰত করিবার জন্য প্ৰযত্ন করিয়া থাকেন । 

 গীতার প্রথম অধ্যায় ও কর্মযোগশাস্ত্রের প্রয়োজন


গীতার কর্মযোগশাস্ত্রের বিচার-আলোচনা এই পদ্ধতি অনুসারেই করা হইয়াছে । যে যুদ্ধে নিজের হাতে পিতৃবধ ও গুরুবধ হইয়া সকল রাজাদিগের ও ভ্রাতাদিগেরও ক্ষয় হইবার কথা, সেই ঘোরতর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হওয়া উচিত কি অনুচিত, এই সংশয় অর্জুনের মনে উদয় হওয়ায় অর্জুন যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস অবলম্বন করিতে যখন প্ৰস্তুত হইলেন, এবং প্ৰাপ্ত কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া পাগলামি ও দুর্বলতার লক্ষণ হওয়ায় তাহাতে স্বৰ্গপ্রাপ্তি হওয়া দূরে থাকুক, উল্টা শুধু দুষ্কীর্তিই লাভ হইবে; এইরূপ সাধারণ ধরণের যুক্তিবাদেও যখন তাহার সমাধান হইল না, তখন “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে” - তুমি অশোচ্যের জন্য শোক করিতেছ এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানের বড় বড় কথা আমাকে বলিতেছ - শ্ৰীকৃষ্ণ একটু উপহাসের ভাবে ইহা বলিয়া অর্জুনকে কর্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন । অর্জুনের সংশয় ভিত্তিহীন না হওয়ায়, বড় বড় পণ্ডিতেরাও প্ৰসঙ্গবিশেষে “কি করিবে কি করিবে না” এই বিষয়ে যেরূপ হতবুদ্ধি হইয়া পড়েন তাহা আমি পূর্ব প্রকরণে দেখাইয়াছি । কিন্তু কর্মাকর্মের বিচারে অনেক কঠিন সমস্যার উদ্ভব হয় বলিয়া কর্ম ত্যাগ করা যুক্তিসিদ্ধ নহে; যাহাতে জাগতিক কর্মের লোপ না হইয়া, কেবলমাত্ৰ কর্মজনিত পাপ বা বন্ধন আমাতে না লাগে, এই প্রকারের ‘যোগ’ অর্থাৎ যুক্তি বুদ্ধিমান ব্যক্তির মানিয়া লণ্ডয়া আবশ্যক । অতএব “হে অর্জুন তুমিও এই যুক্তি স্বীকার কর” – তস্মাদ্‌যোগায় যুজ্যস্ব - ইহা অর্জুনের প্রতি শ্ৰীকৃষ্ণের প্রথম বক্তব্য । এই ‘যোগ’ই “কর্মযোগশাস্ত্ৰ” । অর্জুন যে সমস্যায় পড়িয়াছিলেন, সেই সমস্যা-প্ৰসঙ্গ কিছু অলৌকিক ছিল না - সংসারে এই প্রকারের ছোট বড় অনেক সংকট সকলের নিকটেই উপস্থিত হয় । তাই ভগবদ্গীতায় কর্মযোগশাস্ত্রের যে বিচার করা হইয়াছে তাহা আমাদের সকলেরই শিক্ষণ করা অবশ্য কর্তব্য ।

গুঢ়াৰ্থ শব্দের অর্থনির্ণয়


কিন্তু যে কোন শাস্ত্ৰ হউক না, তাহার প্রতিপাদন কল্পে কতকগুলি মুখ্য এবং কতকগুলি গুঢ়াৰ্থ শব্দ প্ৰযুক্ত হয় । ঐ শাস্ত্রের অর্থ ঠিক বুঝিবার জন্য, সেই সকল শব্দের সরল অর্থ এবং সেই শাস্ত্ৰ প্ৰতিপাদনের মূল পন্থাটাও প্রথমে জানা আবশ্যক । নচেৎ পরে উহা বুঝিবার পক্ষে অনেক প্রকার ভুল ও গণ্ডগোল উৎপন্ন হইতে পারে । এই জন্য এই সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া প্ৰথমে এই শাস্ত্ৰে ব্যবহৃত কতকগুলি শব্দের অর্থ-পরীক্ষা অগত্যা করিতে হইতেছে ।


 কর্ম শব্দের অর্থনির্ণয়


তন্মধ্যে সর্বপ্রথম শব্দ ‘কর্ম’। ‘কর্ম’ শব্দ কৃ-ধাতু হইতে বাহির হওয়ায় তাহার অর্থ ‘করা’, ‘ব্যাপার’, ‘আচরণ’ - এইরূপ; এবং এই সাধারণ অর্থে ঐ শব্দ ভগবদ্গীতায় ব্যবহৃত হইয়াছে । ইহা বলিবার কারণ এই যে, মীমাংসা-শাস্ত্ৰে কিংবা অন্যত্র এই শব্দের যে সংকুচিত অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহা মনে আনিয়া পাঠক যেন ভ্ৰমে পতিত না হন । 


 শ্রৌত কর্ম


যে কোন ধর্মই ধর না কেন, তাহাতে ঈশ্বরকে লাভ করিবার জন্য কোন না কোন কর্ম করিতে বলা হইয়াছে । প্রাচীন বৈদিক ধর্ম অনুসারে বলিতে হইলে, যজ্ঞযাগই সেই কর্ম । বৈদিকগ্রন্থে এই যজ্ঞযাগেরই (অর্থাৎ শ্রৌত কর্ম) বিধি বৰ্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধে বৈদিক গ্ৰন্থাদির স্থানে স্থানে কখন কখন বিরোধী বচনও পাওয়া যায়; তাহাদিগের সঙ্গত সমন্বয় কিরূপে হইতে পারে তাহা জৈমিনীয় পূর্বমীমাংসা-শাস্ত্ৰ দেখাইতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন । জৈমিনীয় মতানুসারে, এই বৈদিক ও শ্রৌত যজ্ঞযাগের অনুষ্ঠান করাই মুখ্য প্রাচীন ধর্ম । মানুষ যাহা কিছু করে সবই যজ্ঞের জন্য করে । মানুষের ধন পাইতে হইলে, যজ্ঞের জন্যই পাওয়া চাই; এবং ধান্য সংগ্ৰহ করিলেও তাহা যজ্ঞেরই জন্য বুঝিতে হইবে [মভা|শাং|২৬|২৫] । যখন, যজ্ঞ করিবে – ইহাই বেদের দেবতাদিগের আদেশ, তখন যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কোন কর্ম স্বতন্ত্ররূপে কোন মনুষ্যের বন্ধক ফলদায়ক হয় না । তাহা যজ্ঞের সাধন, স্বতন্ত্ৰ সাধ্য নহে । তাই, যজ্ঞ হইতে যে ফল পাওয়া যায় তাহা যজ্ঞেরই অন্তর্ভূত; উহার অন্য পৃথক্‌ ফল নাই । কিন্তু যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত এই সকল কর্ম স্বতন্ত্র ফলদায়ক না হইলেও শুধু যজ্ঞের দ্বারাই স্বৰ্গ প্ৰাপ্তি (অর্থাৎ মীমাংসকের মতে একপ্রকারের সুখ প্ৰাপ্তি) হয় এবং সেই স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির জন্যই যজ্ঞকর্তা পুরুষ অনুরাগের সহিত যজ্ঞ করিয়া থাকে । সুতরাং স্বয়ং যজ্ঞকর্মই পুরুষাৰ্থ ইহা স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । যে বস্তু সম্বন্ধে মনুষ্যের প্রীতি থাকে ও পাইবার ইচ্ছা হয় তাহাকেই পুরুষাৰ্থ বলে [জৈ|সূ|৪|১|১ ও ২] । যজ্ঞের এক পর্যায় শব্দ ‘ক্রতু’; তাই যজ্ঞার্থের বদলে “ক্রত্বর্থ” এই শব্দও ব্যবহৃত হয় । এইরূপ সর্বকর্ম দুই বর্গে বিভক্ত হইয়া থাকে – 
(i) ‘যজ্ঞার্থ’ (ক্ৰত্বৰ্থ) কর্ম অর্থাৎ যাহা স্বতন্ত্ররূপে ফলদায়ক নহে বলিয়া অবন্ধক; এবং 
(ii) ‘পুরুষাৰ্থ’ কর্ম অর্থাৎ যাহা পুরুষের ফলদায়ক বলিয়া বন্ধক । 
সংহিতা ও ব্রাহ্মণগ্রন্থে যাগযজ্ঞাদিরই বর্ণনা আছে । ঋগ্‌বেদ-সংহিতায় ইন্দ্ৰাদি দেবতাদিগের স্তুতিপর সূক্ত আছে সত্য, কিন্তু মীমাংসক বলেন যে তাহাদের বিনিয়োগ যজ্ঞের সময়েই কর্তব্য হওয়ায় সমস্ত শ্রুতিগ্ৰন্থ যজ্ঞাদি কর্মেরই প্ৰতিপাদক । বেদের অন্তর্ভূত যাগযজ্ঞাদি কর্মের অনুষ্ঠান করিলে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হয়, নতুবা হয় না; অতএব ঐ যাগযজ্ঞ তুমি অজ্ঞানে কর কিংবা ব্রহ্মজ্ঞানপূর্বক কর, একই ফল - এইরূপ এই কর্মনিষ্ঠ, যাজ্ঞিক ও নিছক্‌ কর্মবাদীরা বলিয়া থাকেন । উপনিষদে এই যজ্ঞ গ্ৰাহ্য বলিয়া ধৃত হইলেও, উহার যোগ্যতা ব্ৰহ্মজ্ঞান অপেক্ষা কম বলিয়া যজ্ঞের দ্বারা স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হইলেও প্ৰকৃত মোক্ষলাভের পক্ষে ব্ৰহ্মজ্ঞানও আবশ্যক আছে এইরূপ প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে “বেদবাদরতাঃ পাৰ্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ” [গী|২|৪২] প্ৰভৃতি বাক্যে যে যাগযজ্ঞাদি কাম্যকর্ম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে তাহা বিনা ব্ৰহ্মজ্ঞানে অনুষ্ঠিত উপরিউক্ত যাগযজ্ঞাদি কর্ম । সেইরূপ “যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্ৰ লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ” - যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধন হয় না, বাকী সব কর্ম বন্ধন হইয়া থাকে [গী|৩|৯], ইহাই মীমাংসকদিগের মতের অনুবাদ । 


স্মার্ত কর্ম (চাতুর্বর্ণ্য)


এই যাগযজ্ঞাদি বৈদিক অর্থাৎ শ্রৌত কর্ম ব্যতীত, ধর্মদৃষ্টিতে অন্য আবশ্যক কর্মও চাতুর্বর্ণ্যভেদে মনুস্মৃত্যাদি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, যথা - ক্ষত্ৰিয়ের যুদ্ধ, বৈশ্যের বাণিজ্য প্রভৃতি । এই সকল কর্ম প্রথমতঃ স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতেই পদ্ধতিপূর্বক প্রতিপাদিত হওয়ায়, ইহাদিগকে ‘স্মার্ত কর্ম’ কিংবা ‘স্মার্ত যজ্ঞ’ এমনও বলা হইয়া থাকে । 


পৌরাণিক কর্ম


এই শ্রৌত ও স্মার্ত কর্ম ব্যতীত অপর কতকগুলি ধর্মকর্ম - যথা, ব্ৰত উপবাস প্রভৃতি - কেবল পুরাণ গ্ৰন্থাদিতেই প্ৰথমে সবিস্তার প্রতিপাদিত হওয়ায় উহাদিগকে ‘পৌরাণিক কর্ম’ বলিতে পারিব । এই সমস্ত কর্মের আবার নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য, এই তিন ভেদ নিরূপিত হইয়াছে । 
(i) নিত্য কর্ম - আবশ্যক স্নান-সন্ধ্যাদি কর্মই নিত্য কর্ম । ইহা করিলে কোন বিশেষ ফল কিংবা অর্থসিদ্ধি হয় না; কিন্তু না করিলেই দোষ হয় । 
(ii) নৈমিত্তিক কর্ম - কোন কারণ উপস্থিত হওয়ায় যাহা করা আবশ্যক হয় সেই নৈমিত্তিক কর্ম, যথা – অনিষ্ট-গ্রহ-শান্তি, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি । যে নিমিত্ত আমরা শান্তিশ্বস্ত্যয়ন করি, কিংবা প্রায়শ্চিত্ত করি, সেই ঘটনা পূর্বে না ঘটিলে এই সকল নৈমিত্তিক কর্ম করিবার প্রয়োজন নাই । 
(iii) কাম্য কর্ম - ইহা ব্যতীত, কোন বিশেষ বিষয়ের ইচ্ছা হইলে তাহার প্রাপ্তির নিমিত্ত আমরা অনেক সময় শাস্ত্রানুসারে যে সকল কাজ করি, তাহাই কাম্য কর্ম, যথা – বৃষ্টির জন্য কিংবা পুত্রলাভের জন্য যজ্ঞ করা । 
(iv) নিষিদ্ধ কর্ম - নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য - ইহা ব্যতীত অন্য কর্মকে নিষিদ্ধ কর্ম বলে, যথা - সুরাপান শাস্ত্ৰে একেবারেই ত্যাজ্য বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে । 


গীতায় কর্মের ব্যাপক অর্থ


কোনটা নিত্যকর্ম, কোনটা নৈমিত্তিক, কোনটা কাম্য এবং কোনটাই বা নিষিদ্ধ, তাহা ধর্মশাস্ত্ৰ নির্ধারিত করিয়া দিয়াছে । অমুক ব্যক্তির কৃত অমুক কর্ম পাপজনক না পুণ্যপ্ৰদ, কোন ধর্মশাস্ত্রীকে যদি এইরূপ প্রশ্ন করা যায়, তবে তিনি সেই শাস্ত্ৰ অনুসারে উক্ত কর্ম যজ্ঞার্থ বা পুরুষার্থ, নিত্য কি নৈমিত্তিক, কাম্য কি নিষিদ্ধ, ইত্যাদি বিচার করিয়া পরে তাঁহার নিজের নির্ণয়টা বলিবেন । কিন্তু ভগবদ্গীতার দৃষ্টি ইহা অপেক্ষাও ব্যাপক - অধিক কি, উহাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে বলিলেও হয় । মনে কর, শাস্ত্ৰে কোন-এক কর্ম নিষিদ্ধ বলিয়া স্বীকৃত হয় নাই, অধিক কি, উহা বিহিত বলিয়া আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পরিগণিত হইয়াছে; উদাহরণ যথা - উপস্থিত প্রসঙ্গে ক্ষাত্ৰধর্ম অর্জুনের পক্ষে বিহিত ছিল । কিন্তু ইহা হইতে এটুকু সিদ্ধ হইতেছে না যে ঐ সকল কর্ম আমরা সর্বদা করিব, অথবা ঐরূপ কর্ম করিলে তাহা সর্বদাই শ্ৰেয়স্কর হইবে । তাছাড়া, শাস্ত্রের আদেশও যে কোন কোন প্রসঙ্গে পরস্পরবিরুদ্ধ হইয়া থাকে তাহা পূর্বপ্ৰকরণে দেখাইয়াছি । এরূপ অবস্থায়, মানুষ কোন মাৰ্গ স্বীকার করিবে, তাহা স্থির করিবার কোন যুক্তি আছে কি না এবং যদি থাকে তো সে যুক্তিটি কি, - ইহাই গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় । এই বিষয়ে কর্মের যে নানা ভেদ উপরে বলা হইয়াছে, তৎপ্ৰতি বিশেষ লক্ষ্য করিবার প্রয়োজন নাই । যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কর্ম সম্বন্ধে কিংবা চাতুৰ্বর্ণ্যের অন্য কর্ম সম্বন্ধে মীমাংসকগণ যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাহা গীতা-প্রতিপাদিত কর্মযোগ সম্বন্ধে কতটা প্ৰযুক্ত হইতে পারে তাহা দেখাইবার জন্য, মীমাংসকের উক্তিসকলও গীতায় প্রসঙ্গক্রমে বিচার করা হইয়াছে এবং শেষ অধ্যায়ে যাগযজ্ঞাদি কর্ম জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য কি কর্তব্য নহে, এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৮|৬] । কিন্তু গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইহা অপেক্ষা বেশী ব্যাপক হওয়ায়, গীতাতে ‘কর্ম’ শব্দের অর্থ কেবল শ্রৌত বা স্মার্ত কর্ম, এইরূপ সঙ্কুচিত অর্থে না বুঝিয়া তাহা অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক অর্থে গ্ৰহণ করিতে হইবে । সার কথা, মানুষ যে-যে কাজ করে - খাওয়া, পরা, খেলা, বসা, ওঠা, থাকা, নিঃশ্বাস গ্রহণ করা, হাসা, কাঁদা, আঘ্রাণ করা, দেখা, বলা, শোনা, চলা, দেওয়া, লওয়া, ঘুমান, জাগিয়া থাকা, মারা, লড়াই করা, মনন বা ধ্যান করা, আজ্ঞা বা নিষেধ করা, দান করা, যাগযজ্ঞ করা, চাষ কিংবা বাণিজ্য ব্যবসায় করা, ইচ্ছা করা, নিশ্চয় করা, গল্প করা ইত্যাদি ইত্যাদি কর্ম কায়িকই হউক, বাচনিকই হউক, বা মানসিকই হউক সকল কর্মই এই শব্দের অন্তর্ভুক্ত [গীতা|৫|৮,৯] । অধিক কি, বাঁচা, মরা পৰ্যন্ত সমস্তই কর্মের অন্তর্ভূত; এবং প্রসঙ্গ অনুসারে “বাঁচা কিংবা মরা” এই দুয়ের মধ্যে কোন কর্মে প্ৰবৃত্ত হইবে ইহারও বিচার করা আবশ্যক হয় । এই বিচার উপস্থিত হইলে পর, ‘কর্ম’ শব্দের ‘কর্তব্য কর্ম’ অথবা ‘বিহিত কর্ম’ এই অর্থ হইয়া থাকে [গী|৪|১৬] । মনুষ্যের কর্মসম্বন্ধে এইরূপ বিচার হইল । ইহারও পরে, সমস্ত চরাচর সৃষ্টির, অর্থাৎ অচেতন পদার্থাদির ব্যাপার সম্বন্ধেও এই শব্দের প্রয়োগ হইয়া থাকে । কিন্তু তাহার বিচার পরে কর্মবিপাক প্ৰকরণে করা যাইবে ।


যোগ শব্দের অর্থনির্ণয়


কর্মাপেক্ষাও অধিক ‘গোলমেলে’ শব্দ হইতেছে – ‘যোগ’ । এই শব্দের বর্তমান প্ৰচলিত অর্থ “প্ৰাণায়ামাদির সাধনের দ্বারা চিত্তবৃত্তি কিংবা ইন্দ্ৰিয়াদির নিরোধ করা” অথবা “পাতঞ্জল সূত্ৰোক্ত সমাধি কিংবা ধ্যানযোগ” । এই অর্থে এই শব্দ উপনিষদেও প্ৰযুক্ত হইয়াছে [কঠ|৬|১১] । কিন্তু এই সঙ্কুচিত অর্থ ভগবদ্গীতাতে সাধারণভাবে বিবক্ষিত হয় নাই ইহা মনে রাখা আবশ্যক, ‘যোগ’ এই শব্দ ‘যুজ্‌’ অর্থাৎ যুড়িয়া দেওয়া এই ধাতু হইতে বাহির হইয়াছে, সুতরাং - উহার ধাত্বর্থ ‘যোড়’ যোড়া, মিলন, সঙ্গতি, একত্রাবস্থিতি ইত্যাদি; এবং ঐরূপ অবস্থা প্ৰাপ্ত হইবার ‘উপায়, সাধন, যুক্তি কিংবা কৌশল’-রূপ যে কর্ম তাহাকেও যোগ বলা হয় । এই সকল অর্থ অমরকোষেও প্রদত্ত হইয়াছে, “যোগঃ সংহননোপায়ধ্যানসঙ্গতিযুক্তিষু” [৩|৩|২২] । ফলিত জ্যোতিষে কোন গ্ৰহ ইষ্ট বা অনিষ্টজনক হইলে সেই গ্রহের ‘যোগ’ ইষ্ট বা অনিষ্টজনক এইরূপ আমরা বলিয়া থাকি; এবং ‘যোগক্ষেম’ এই পদে ‘যোগ’ শব্দের অর্থে অপ্রাপ্ত বস্তু প্ৰাপ্ত হওয়া ধরা গিয়াছে [গী|৯|২২] । মহাভারতীয় যুদ্ধে দ্ৰোণাচার্যকে পরাজয় করিতে পারা যাইতেছে না দেখিয়া তাহাকে পরাভূত করিবার জন্য একই ‘যোগ’ (সাধন বা যুক্তি) - একোহি যোগোহস্য ভবেদ্‌বধায় - এইরূপ শ্ৰীকৃষ্ণ বলিয়াছেন [মভা|দ্রো|১৮১|৩১]; এবং পরে তিনি ইহাও বলিয়াছেন, “আমি জরাসন্ধাদি রাজাদিগকে পূর্বকালে ধর্মরক্ষণার্থ ‘যোগের দ্বারাই’ কি করিয়া বধ করিয়াছিলাম” । ভীষ্ম অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করিলে পর অন্য রাজগণ ‘যোগ, যোগ’ বলিয়া তাহাদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এইরূপ উদ্যোগ পর্বে [অ|১৭২] উক্ত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত মহাভারতের অনেক স্থানে এই অর্থেই ‘যোগ’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় । গীতাতে ‘যোগ’, ‘যোগী’ কিংবা যোগ শব্দ হইতে নিষ্পন্ন সামাসিক শব্দ প্ৰায় ৮০ বার প্রযুক্ত হইয়াছে । কিন্তু, খুব যদি বেশী হয়, চারি পাঁচ [গী|৬|১২,২৩] স্থল ছাড়া ‘যোগ’ শব্দের ‘পাতঞ্জল যোগ’ এই অৰ্থ কোথাও অভিপ্রেত হয় নাই । ‘যুক্তি, কৌশল, সাধন, উপায়, যোড়া, মেলা’ এই অর্থই স্বল্পাধিক ভেদে গীতায় সর্বত্ৰ দেখিতে পাওয়া যায় । সুতরাং গীতাশাস্ত্রান্তর্ভূত ব্যাপক শব্দগুলির মধ্যে ইহাও একটি, ইহা বলিতে কোন বাধা নাই । তথাপি যোগ অর্থে সাধন, কৌশল বা যুক্তি, এইরূপ সাধারণভাবে বলিলেও চলে না । কারণ, বক্তার ইচ্ছানুসারে এই সাধন সন্ন্যাসের, কর্মের, চিত্তনিরোধের, মোক্ষের, কিংবা আর কোন কিছুরও হইতে পারে । দৃষ্টান্ত যথা - গীতাতেই দুই চারি স্থানে ভগবানের নানাবিধ ব্যক্ত সৃষ্টি নির্মাণ করিবার ঐশ্বরিক কৌশল বা অদ্ভুত সামর্থ্যের সম্বন্ধে যোগ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে [গী|৭|২৫; ৯|৫; ১০|৭; ১১|৮] । এই অর্থেই ভগবানকে “যোগেশ্বর” বলা হইয়াছে [গী|১৮|৭৫] । কিন্তু গীতান্তর্ভূত যোগশব্দের ইহা কিছু মুখ্যার্থ নহে । তাই গীতায় ‘যোগ’ শব্দের মুখ্য অর্থ কোন বিশেষ প্রকারের কৌশল, সাধন, যুক্তি বা উপায়, ইহা বলিবার জন্য “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” [গী|২|৫০] অর্থাৎ কর্ম করিবার কোন বিশেষ প্রকারের কুশলতা, যুক্তি, চাতুর্য বা শৈলী - এইরূপ এই শব্দের ব্যাখ্যা স্পষ্টরূপে করা হইয়াছে । শাঙ্করভাষ্যেও “কর্মসু কৌশলম্‌” এই পদের “কর্মের যে স্বাভাবিক বন্ধকত্ব তাহা বিনষ্ট করিবার যুক্তি” এইরূপ অর্থই করা হইয়াছে । সাধারণভাবে দেখিতে গেলে, একই কর্মের অনেক ‘যোগ’ বা ‘উপায়’ হইয়া থাকে । কিন্তু তাহার মধ্যে, উত্তম সাধনের সম্বন্ধেই ‘যোগ’ শব্দ বিশেষরূপে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - ধনলাভ করিতে হইলে তাহা চুরি করিয়া, ঠকাইয়া, ভিক্ষা করিয়া, সেবা করিয়া, কর্জ করিয়া, মেহনৎ করিয়া ইত্যাদি নানাবিধ সাধনের দ্বারা করা যাইতে পারে; এবং ইহার মধ্যে প্ৰত্যেক সাধনসম্বন্ধে ‘যোগ’ শব্দ ধাত্বর্থ অনুসারে প্রযুক্ত হইতে পারিলেও “আপনার স্বাতন্ত্র্য না হারাইয়া, মেহনৎ করিয়া পয়সা রোজগার করা” এই উপায়ই মুখ্যরূপে ‘ধনপ্রাপ্তি যোগ’ এইরূপ বলা প্রচলিত আছে ।


 গীতায় যোগ = কর্মযোগ, এবং তাহাই প্রতিপাদ্য


“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” - কর্ম করিবার একপ্রকার বিশেষ যুক্তি অর্থাৎ যোগ, যখন স্বয়ং ভগবান গীতায় যোগ শব্দের এইপ্ৰকার বিশেষ ব্যাখ্যা করিয়া দিয়াছেন, তখন বস্তুত গীতায় এই শব্দের মুখ্য অর্থ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না । কিন্তু ভগবানকৃত এই ব্যাখ্যার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া গীতার অনেক টীকাকার এই শব্দকে টানিয়া বুনিয়া নানাপ্রকারে গীতার মথিতার্থ বাহির করিয়াছেন; তাই, ভুল-বুঝা দূর করিবার জন্য এইখানে ‘যোগ’ শব্দের আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । সর্বপ্রথমে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে যোগশব্দের প্রয়োগ হইয়াছে এবং সেই স্থানেই উহার অর্থ কি তাহাও স্পষ্টরূপে উক্ত হইয়াছে । যুদ্ধ করা কেন কর্তব্য, সাংখ্যমাৰ্গানুসারে ইহার যুক্তি বিবৃত করিবার পর, “এক্ষণে তোমাকে যোগশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বলিতেছি” [গী|২|৩৯] এইরূপ ভগবান, বলিয়াছেন । আবার, যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্মেতে নিমগ্ন লোকদিগের বুদ্ধি , ফল-প্ৰত্যাশার দরুণ কিরূপ ব্যগ্ৰ হইয়া থাকে তাহারও বর্ণনা করিয়াছেন [গী|২|৪১-৪৬] । তাহার পর, তিনি উপদেশ দিয়াছেন যে, বুদ্ধিকে এরূপ ব্যগ্ৰ হইতে না দিয়া “আসক্তি ছাড়, কিন্তু কর্ম ছাড়িয়া দিতে ব্যগ্ৰ হইও না” এবং “যোগস্থ হইয়া কর্ম কর” [গী|২|৪৮] । এইখানেই “সিদ্ধি বা অসিদ্ধি উভয়ে সমত্ববুদ্ধি” ‘যোগ’ শব্দের এই অর্থ স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে । তাহার পর, “ফলপ্ৰত্যাশায় কর্ম করা অপেক্ষা সমত্ববুদ্ধির যোগই শ্রেষ্ঠ” [গী|২|৪৮], “বুদ্ধি সমতা প্ৰাপ্ত হইলে কর্মের পাপ-পুণ্য-বাধা কর্তাকে স্পর্শ করে না অতএব তুমি এই ‘যোগ’ সম্পাদন কর”, এইরূপ বলিয়া তখনই আবার “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” [গী|২|৫০] যোগের এই লক্ষণ বলিয়াছেন । ইহাতে স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে, কর্মের পাপপুণ্যে লিপ্ত না থাকিয়া কর্ম করিবার সমত্ব-বুদ্ধিরূপ যে বিশেষ যুক্তি প্ৰথমে উক্ত হইয়াছে তাহারই নাম ‘কৌশল’, এবং এই কৌশলের দ্বারা অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা কর্ম করা, ইহাকেই গীতাতে ‘যোগ’ বলা হইয়াছে । এই অর্থই পরে “যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন” [গী|৬|৩৩] “সমতার অর্থাৎ সমত্ববুদ্ধির এই যে যোগ তুমি আমাকে বলিয়াছ”, - এই শ্লোকে অর্জুন আবার স্পষ্ট করিয়াছেন । 

জ্ঞানী মনুষ্য এই জগতে কিরূপভাবে চলিবেন তাহার সম্বন্ধে শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পূর্ব অবধি প্ৰচলিত বৈদিক ধর্ম অনুসরণ করিয়া দুই মাৰ্গ আছে । তন্মধ্যে, জ্ঞানী ব্যক্তির সম্বন্ধে সর্ব কর্মের স্বরূপতঃ সন্ন্যাস অর্থাৎ ত্যাগ করা - এই এক মাৰ্গ; এবং জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পরেও কর্মত্যাগ না করিয়া, কর্মের পাপপুণ্য-বাধা না স্পর্শ করে সেইরূপ যুক্তি অনুসারে আমরণ কর্ম করিতে থাকা - এই দ্বিতীয় মার্গ । এই দুই মাৰ্গ গীতাতে [গী|৫|২] সন্ন্যাস ও কর্মযোগ বলিয়া উক্ত হইয়াছে । সন্ন্যাস অর্থাৎ ছাড়া এবং যোগ অর্থাৎ জোড়া; সুতরাং কর্মের ছাড়া ও জোড়াই এই দুই ভিন্ন ভিন্ন মার্গ । এই দুই ভিন্ন মাৰ্গ লক্ষ্য করিয়াই পরে “সাংখ্য ও যোগ” (সাংখ্যযোগৌ) এই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাও [গী|৫|১৪] প্রদত্ত হইয়াছে । 

বুদ্ধি স্থির করিবার জন্য পাতঞ্জল যোগান্তর্ভূত আসনাদির বর্ণনা ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে সত্য; কিন্তু তাহা কাহার জন্য ? তপস্বীর জন্য নহে, পরন্তু কর্মযোগীর অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা কর্মশীল মনুষ্যের এই সমতারূপ যুক্তি সিদ্ধ করিবার জন্য বলা হইয়াছে । নচেৎ “তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী” এই বাক্যের কোনই অর্থ হয় না । সেইরূপ আবার “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” [৬|৪৬] বলিয়া যে উপদেশ অধ্যায়ের শেষে আছে, তাহার অর্থ “পাতঞ্জল যোগের অভ্যাস করিতে থাক” এইরূপ হইতে পারে না । এই কারণে উক্ত উপদেশের অর্থ “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি” [২|৪৮], অথবা, পরে “তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” [গী|২|৫০] কিংবা চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে “যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত” [৪|৪২] ইত্যাদি বাক্যের সমানার্থক হওয়া উচিত; অর্থাৎ “যুক্তির দ্বারা কর্মকারী যোগী অর্থাৎ কর্মযোগী হও” – এইরূপ অর্থই গ্ৰহণ করা সঙ্গত । কারণ, “পাতঞ্জল যোগের আশ্রয় করিয়া তুমি যুদ্ধে দাঁড়াও” এ কথা বলা কখনই সম্ভব হইতে পারে না । 

ইতিপূর্বে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, “কর্মযোগেন যোগিনাম্‌” [গী|৩|৩] অর্থাৎ যোগী পুরুষ কর্ম করিয়া থাকেন । মহাভারতে নারায়ণীয় ধর্ম কিংবা ভাগবতধর্মের বিচার-আলোচনাতেও উক্ত হইয়াছে যে, এই ধর্মাবলম্বী লোক আপনার কর্ম না ছাড়িয়াই যুক্তিপূর্বক কর্মসাধনের দ্বারা (সুপ্রযুক্তেন কর্মণা) পরমেশ্বরকে লাভ করে [মভা|শাং|৩৪৮|৫৬] । ইহাতে, যোগী ও কর্মযোগী এই দুই শব্দ গীতাতে সমানার্থক হওয়ায়, উহাদের “যুক্তিপূর্বক কর্মকারী” এইরূপ অর্থই সস্পষ্ট উপলব্ধ হয় । তথাপি ‘কর্মযোগ’ এই ঈষৎ দীর্ঘ শব্দের পরিবর্তে ‘যোগ’ এই সংক্ষিপ্ত শব্দই গীতাতে ও মহাভারতে অধিক ব্যবহৃত হইয়াছে । “আমি তোমাকে এই যে যোগের কথা বলিলাম তাহা পূর্বে বিবস্বানকে বলিয়াছিলাম [গী|৪|১]; বিবস্বান মনুকে বলিয়াছিলেন; কিন্তু ঐ যোগ ইতিপূর্বে নষ্ট হওয়ায় আজ নূতন করিয়া ঐ যোগের কথা তোমাকে বলিতে হইল”, ভগবান ‘যোগ’ শব্দের এই যে তিনবার উল্লেখ করিয়াছেন, এখানে পাতঞ্জল যোগ বিবক্ষিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না, - “কর্ম করিবার কোন এক প্রকারের বিশিষ্ট যুক্তি, সাধন বা মাৰ্গ” এই অর্থই সঙ্গত হয় । সেইরূপ আবার, গীতা-অন্তৰ্গত কৃষ্ণার্জুনসংবাদে সঞ্জয় যখন ‘যোগ’ শব্দ প্রয়োগ করিতেছেন [গী|১৮|৩৫], তখনও ঐ অর্থই অভিপ্ৰেত বলিয়া বুঝা যাইতেছে । 

শ্ৰীশঙ্করাচার্য নিজে সন্ন্যাসপন্থী হইলেও আপন গীতা-ভাষ্যের আরম্ভে বৈদিক ধর্মের নিবৃত্তি ও প্ৰবৃত্তি এইরূপ দুই ভেদ বলিয়া, ‘যোগ’ শব্দের অর্থ, ভগবান-প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসারে কখন ‘সম্যগ্‌দর্শনোপায়কর্মানুষ্ঠানম্‌’ [গী|৪|৪২], আবার কখন ‘যোগ যুক্তিঃ’ [গী|১০|৭] এইরূপ করিয়াছেন । সেইপ্ৰকার মহাভারতেও যোগ ও জ্ঞান, এই দুই শব্দের অর্থ অনুগীতায় স্পষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, “প্ৰবৃত্তিলক্ষণো যোগঃ জ্ঞানং সন্ন্যাস লক্ষণম্‌” - যোগ প্ৰবৃত্তিলক্ষণ এবং জ্ঞান সন্ন্যাস বা নিবৃত্তিলক্ষণ [মভা|অশ্ব|৪৩|২৫] । শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় উপখ্যানে সাংখ্য ও যোগ শব্দ এই অর্থেই অনেকবার প্রযুক্ত হইয়াছে এবং এই দুই শব্দ সৃষ্টির আরম্ভেই ভগবান কিরূপে ও কি-কারণে স্থাপন করিলেন তাহা বর্ণন করা হইয়াছে [মভা|শাং|২৪০ ও ৩৪৮ দেখ] । এই নারায়ণী কিংবা ভাগবত ধর্ম ভগবদ্গীতার প্রতিপাদ্য, তাহা প্ৰথম প্রকরণে প্রদত্ত মহাভারতের বচনাদি হইতে স্পষ্টরূপেই প্ৰকাশ পাইয়াছে । তাই, সাংখ্য অর্থাৎ নিবৃত্তি এবং যোগ অর্থাৎ প্ৰবৃত্তি, এই দুই শব্দের যে প্রাচীন ও পারিভাষিক অর্থ নারায়ণী ধর্মে আছে, তাহাই গীতাতেও বিবক্ষিত এরূপ বলা যাইতে পারে । এই সম্বন্ধে কাহারও কোন সংশয় থাকিলে “সমত্বং যোগ উচ্যতে” বা “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” গীতোক্ত এই ব্যাখ্যা দ্বারা এবং “কর্মযোগেন যোগিনাম্‌” ইত্যাদি উপরিউক্ত গীতোক্ত বচনাদি দ্বারা ঐ সংশয়ের সমাধান হইতে পারে । এই সকল হইতে ইহাই নির্বিবাদে সিদ্ধ হইবে যে, গীতাতে যোগশব্দ প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ অর্থাৎ, ‘কর্মযোগ’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে । শুধু বৈদিক ধর্মগ্রন্থে নহে, পালি ও সংস্কৃত বৌদ্ধধর্মগ্রন্থেও এইরূপ অর্থেই যোগশব্দের প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - প্ৰায় ২০০ শকে (৩৩৫ সংবৎ) লিখিত মিলিন্দপ্রশ্ন নামক পালিগ্রন্থে “পূর্ব্বযোগো” (পূর্বযোগ) এইরূপ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে এবং সেইখানেই তাহার অর্থ ‘পূর্ব্বকর্ম’ (পূর্বকর্ম) এইরূপ প্রদত্ত হইয়াছে [মি|প্র|১|৪] সেইরূপ শালিবাহন শকের আরম্ভে আবির্ভূত অশ্বঘোষ কবির ‘বুদ্ধ চরিত’ নামক সংস্কৃত, কাব্যের প্রথম সর্গের ৫০ শ্লোকে বর্ণিত হইয়াছে
“আচাৰ্যকং যোগবিধৌ দ্বিজানামপ্ৰাপ্তমনৈর্জনকো জগাম ৷”
“ব্ৰাহ্মণদিগকে যোগবিধি শিক্ষাদানে জনকরাজা আচার্যা (উপদেষ্টা) হইয়াছিলেন, জনকের পূর্বে কেহই আচার্য পদ প্ৰাপ্ত হন নাই” । এইস্থানে যোগবিধির অর্থ নিষ্কাম কর্মযোগের বিধি করিতে হয় । কারণ, জনকের আচরণের ইহাই রহস্য এইরূপ গীতাদি গ্ৰন্থ উচ্চকণ্ঠে বলিয়াছেন; এবং অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতেও [৯|১৯ ও ২০] “গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়াও মোক্ষসাধন কিরূপে করা যাইতে পারে” ইহা দেখাইবার জন্যই জনকের দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইয়াছে । জনকপ্ৰদৰ্শিত মার্গের নামও ‘যোগ’ ছিল । এইরূপ যোগ বৌদ্ধগ্রন্থাদিতেও যখন সিদ্ধ হইয়াছে তখন গীতার যোগ শব্দেরও এই অর্থ গ্ৰহণ করিতে হয়; কারণ, জনকের মাৰ্গ গীতারও প্ৰতিপাদ্য এইরূপ গীতাই বলিতেছেন [গী|৩|২০] । সাংখ্য ও যোগ এই দুই মার্গ সম্বন্ধে বেশী বিচার আলোচনা পরে করা যাইবে । কোন অর্থে গীতায় যোগশব্দের প্রয়োগ হইয়াছে ইহাই এখনকার উপস্থিত প্রশ্ন ।

যোগ অর্থে কর্মযোগ এবং যোগী অর্থে কর্মযোগী, গীতার এই দুই শব্দের মুখ্য অর্থ এই অনুসারে একবার নির্ণয় হইলে পর, ভগবদ্গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় কোনটি ইহা আর স্বতন্ত্ররূপে বলিতে হইবে না । ভগবান নিজেই আপন উপদেশকে ‘যোগ’ নামে অভিহিত করিয়াছেন [গী|৪|১-৩], শুধু তাহা নহে, ষষ্ঠ অধ্যায়ে অর্জুন [গী|৬|৩৩] এবং গীতার শেষের উপসংহারে [গী|১৮|৭৫] সঞ্জয়ও গীতোক্ত উপদেশেওর নাম ‘যোগ’ দিয়াছেন । এইরূপে গীতার প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে অধ্যায়সমাপ্তিপ্রদর্শক যে সঙ্কল্প থাকে তাহাতেও স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে ‘যোগশাস্ত্ৰ’ই গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় । কিন্তু এই সঙ্কল্পের অন্তর্গত শব্দের অর্থের প্রতি বর্তমানের টীকাকারদিগের মধ্যে কেহই মনোযোগ দিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না । আরম্ভের “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু” এই দুই পদের পর, সঙ্কল্পে “ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই দুই শব্দ সংযুক্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে প্রথম দুই পদের অর্থ হইতেছে “ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদে”; এবং পরবর্তী দুই শব্দের অর্থ হইতেছে “ব্রহ্মবিদ্যান্তর্গত যোগশাস্ত্রে” অর্থাৎ “কর্মযোগশাস্ত্ৰে”, যাহা এই গীতার বিষয় ।

ব্ৰহ্মবিদ্যার অর্থে ব্ৰহ্মজ্ঞান; ঐ জ্ঞান লাভ হইলে, জ্ঞানী পুরুষের নিকট দুই মার্গ উন্মুক্ত হয় [গী|৩|৩] — এক, সাংখ্য অথবা সন্ন্যাসমার্গ - যে মার্গে জ্ঞানলাভের পর, জাগতিক সর্বকর্ম ত্যাগ করিয়া বিরাগীর মত থাকিতে হয় । দ্বিতীয় যোগ কিংবা কর্মমার্গ - যে মার্গে কর্ম না ছাড়িয়া এরূপ যুক্তিপূর্বক নিত্য কর্ম করিতে হয় যাহার ফলে মোক্ষপ্ৰাপ্তির কোন বাধা না হয় । এই দুই মার্গের মধ্যে - প্রথমটির ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’ এইরূপ অন্য নামও থাকায়, উপনিষদের অনেক ঋষি ও অপর গ্রন্থকারেরাও উহার আলোচনা করিয়াছেন । কিন্তু ব্ৰহ্মবিদ্যার অন্তৰ্গত কর্মযোগের বা যোগশাস্ত্রের তাত্ত্বিক আলোচনা ভগবদ্গীতা ব্যতীত অন্য কোথাও নাই । প্রথমেই ইহা বলা যাইতেছে যে, অধ্যায় সমাপ্তিদর্শক সংকল্প গীতার সকল সংস্করণেই দেখিতে পাওয়া যায় বলিয়া গীতার সকল টীকা লিখিত হইবার পূর্বেই উহা রচিত হইয়া থাকিবে এইরূপ অনুমান হয় । এই সংকল্পের রচয়িতা এই সংকল্পে “ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই দুই পদ বৃথা জুড়িয়া দেন নাই; কিন্তু তিনি গীতাশাস্ত্ৰান্তর্গত বিষয়ের অপূর্বত দেখাইবার জন্যই ঐ পদগুলি সেই সঙ্কল্পের মধ্যে ভিত্তির উপরে যুক্তিপূর্বক স্থাপন করিয়াছেন । এখন ইহাও সহজে উপলব্ধি হইবে যে, গীতাসম্বন্ধে বিস্তর সাম্প্রদায়িক টীকা হইবার পূর্বে গীতার তাৎপৰ্য লোকে কি উপায়ে ও কি ভাবে বুঝিত । সৌভাগ্য আমাদের, এই যোগমার্গের প্ৰবর্তক এবং সমস্ত যোগের সাক্ষাৎ ঈশ্বর (যোগেশ্বর = যোগ+ঈশ্বর) স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণ ভগবান এই কর্মযোগ প্ৰতিপাদন কাৰ্যের ভার গ্ৰহণ করিয়া, সর্বলোকের হিতার্থ অর্জুনকে তাহার রহস্য বুঝাইয়া দিয়াছেন । ‘যোগ’ ও ‘যোগশাস্ত্ৰ’ - গীতার এই দুইটি শব্দ অপেক্ষা ‘কর্মযোগ’ ও ‘কর্মযোগশাস্ত্ৰ’ এই দুই শব্দ একটু দীর্ঘ সত্য, কিন্তু গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ না থাকে, এইজন্য এই গ্রন্থে ও প্রকরণে এই ঈষৎ দীর্ঘধরণের নাম দেওয়া আমি পছন্দ করিয়াছি ।


 কর্ম-অকর্মের পর্যায় শব্দ


একই কর্ম করিবার যে অনেক যোগ, সাধন কিংবা মাৰ্গ আছে তন্মধ্যে সৰ্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর ও শুদ্ধমার্গ কোন্‌টি; তাহা সর্বদা আচরিত হইতে পারে কি না; না পারিলে তাহার অপবাদ বা ব্যতিক্রম স্থলটি কি, এবং সেই ব্যতিক্রম কেন উৎপন্ন হয়; যে মাৰ্গ আমরা ভাল মনে করি, তাহা কেন ভাল, কিংবা যাহাকে মন্দ বলি তাহা কেন মন্দ এবং এই ভালমন্দ কি উপায়ে কেমন করিয়া স্থির করিবে, কিংবা তাহার বীজটি কি, ইত্যাদি বিষয়, যে শাস্ত্রের বনিয়াদে নিশ্চিত করা যাইতে পারে তাহাকে ‘কর্মযোগশাস্ত্ৰ’ কিংবা গীতান্তৰ্গত সংক্ষিপ্ত রূপ অনুসারে, ‘যোগশাস্ত্ৰ’ বলা হইয়া থাকে । ভাল ও মন্দ এই দুই শব্দ “সামান্য” শব্দ; এই দুই শব্দেরই সদৃশ অর্থে কখন শুভ ও অশুভ, কখন হিতকর ও অহিতকর, কখন শ্ৰেয়স্কর ও অশ্রেয়স্কর, কখন পাপ ও পুণ্য, কখন বা ধর্ম ও অধর্ম, ঐ সকল শব্দও ব্যবহৃত হইয়া থাকে । কাৰ্য-অকাৰ্য, কর্তব্য-অকর্তব্য, ন্যায্য-অন্যায্য ইত্যাদি শব্দগুলিরও অর্থ ঐ প্রকার । তথাপি এই শব্দব্যবহারকারীদিগের সৃষ্টি-রচনা সম্বন্ধীয় মত বিভিন্ন হওয়ায় ‘কর্মযোগ’ শাস্ত্রের নিরূপণ-পন্থাও বিভিন্ন হইয়াছে ।


শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের তিন পন্থা -


যে কোন শাস্ত্ৰই ধর না কেন, তদন্তর্ভূত বিষয়ের চর্চা সাধারণতঃ তিন প্রকারে করা যাইতে পারে – 


 আধিভৌতিক পন্থা


জড়সৃষ্টির অন্তৰ্গত পদাৰ্থ আমাদের ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে যেমনটি প্রকাশ পাইয়া থাকে, সেইরূপই তাহারা, তাহার ওদিকে আর কিছুই নাই, - এই দৃষ্টিতে তাহাদের সম্বন্ধে বিচার করা, ইহাই প্রথম পদ্ধতি, ইহাকে আধিভৌতিক বিচার বলা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - সূর্যকে দেবতা বলিয়া না মানিয়া, কেবল পাঞ্চভৌতিক জড় পদার্থের এক গোলা বলিয়া মানিয়া উহার উষ্ণতা, প্ৰকাশ, ওজন, দূরত্ব, আকর্ষণ প্ৰভৃতি তাহার গুণধর্মেরই যখন পরীক্ষা করা হয় তখন সূর্যসম্বন্ধে আধিভৌতিক আলোচনা করা হইতেছে বলিব । আর একটা গাছের উদাহরণ ধর । গাছের ডালপালা গজাইয়া উঠা প্রভৃতি ক্রিয়া কোন অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা হইয়া থাকে । ইহার বিচার না করিয়া, জমিতে বীজ লাগাইলে অন্ধুর জন্মায় ও পরে তাহারই বৃদ্ধি হইয়া শাখা, পত্র, ফুল, ফল প্রভৃতি তাহার দৃশ্যমান বিকার উৎপন্ন হয়, ইত্যাদি বিষয় কেবল বাহ্যদৃষ্টিতে বিচার করিলে, ঐ গাছের আধিভৌতিক আলোচনা করা হয় বলিতে পারি । রসায়নশাস্ত্ৰ, পদার্থবিদ্যা, তড়িৎশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি আধুনিক শাস্ত্ৰসম্বন্ধে আলোচনা এই ঢঙ্গেরই হইয়া থাকে । অধিক কি, এই প্রকারে কোন বস্তুর পরিদৃশ্যমান গুণের বিচার করিলেই আমাদের কাজ শেষ হইল, ইহা অপেক্ষা সৃষ্টির পদার্থের বেশী বিচার আলোচনা করা নিষ্ফল, ইহাই আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মত ।


আধিদৈবিক পন্থা


উক্ত দৃষ্টি ছাড়িয়া, জড়পদার্থগুলি মূলতঃ কি, এই সকল পদার্থের ব্যবহার কেবল তাহাদের গুণধর্মের দ্বারাই হইয়া থাকে কিংবা তাহাদের পশ্চাতে অন্য কোন তত্ত্ব ভিত্তিস্বরূপে আছে, ইহা বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেই আধিভৌতিক বিচারকে ছাড়াইয়া সম্মুখে পা বাড়াইতে হয় । উদাহরণ যথা - এই পাঞ্চভৌতিক সূর্যের জড় কিংবা অচেতন গোলকের মধ্যে তদধিষ্ঠাত্রী সূর্য নামে এক দেবতা আছেন এবং তাঁহা দ্বারাই জড় সূর্যের ব্যাপার বা ব্যবহার চলিতেছে এইরূপ যখন মানি তখন তাহাকে আধিদৈবিক বিচার বলা যায় । এই মতানুসারে মানিতে হয় যে, বৃক্ষ, পত্র, বায়ু প্ৰভৃতি সর্বত্র সেই সেই জড়পদার্থ হইতে স্বতন্ত্র বিভিন্ন দেবতা আছেন এবং তাঁহারা উক্ত জড়পদার্থ সকলের কাজ চালাইয়া থাকেন ।


 আধ্যাত্মিক পন্থা


কিন্তু যখন ইহা মানা যায় যে, জড় সৃষ্টির অন্তৰ্গত সহস্ৰ সহস্ৰ জড়পদার্থের মধ্যে এইরূপ সহস্ৰ সহস্ৰ স্বতন্ত্র, দেবতা নাই, কিন্তু বাহ্যসৃষ্টির সর্বকাৰ্যপরিচালক, মনুষ্যের শরীরে আত্মস্বরূপে অবস্থিত এবং মনুষ্যের সকল সৃষ্টিসম্বন্ধীয় জ্ঞানবিধায়ক, ইন্দ্রিয়াতীত একমাত্র চিৎশক্তি এই জগতে অধিষ্ঠিত আছেন, যে শক্তির দ্বারাই এই জগৎ চলিতেছে, তখন তাহাকে আধ্যাত্মিক বিচার বলা যায় । উদাহরণ যথা - সূর্যচন্দ্রাদির ক্রিয়া, অধিক কি, গাছের পাতাটি নড়া পৰ্যন্ত এই অচিন্ত্য শক্তিরই প্রেরণায় হইয়া থাকে, সুৰ্যচন্দ্ৰ প্ৰভৃতিতে বা অন্যস্থানে বিভিন্ন ও স্বতন্ত্র দেবতা নাই । 


শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের এই পন্থাভেদের কারণ


যে কোন বিষয়েরই বিচার করা হউক না কেন, এই তিন মার্গ প্রাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, এবং উপনিষদ্‌গ্রন্থাদিতেও তাহা অনুসৃত হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - বৃহদারণ্যকাদি উপনিষদে জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল ও প্রাণ ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, ইহার বিচারকালে একবার ইন্দ্ৰিয়সমূহের অগ্নি-আদি দেবতাগণকে, আর একবার তাঁহাদের সূক্ষ্মস্বরূপ (অধ্যাত্ম) লইয়া উহাদের বলাবল সম্বন্ধে বিচার করা হইয়াছে [বৃ|১|৫|২১ ও ২২; ছাং|১|২ ও ৩; কৌষী|২|৮] । গীতার সপ্তম অধ্যায়ের শেষে ও অষ্টম অধ্যায়ের আরম্ভে ঈশ্বর-স্বরূপের যে বিচার আলোচনা করা হইয়াছে তাহাও এই দৃষ্টিতে করা হইয়াছে । তন্মধ্যে “অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাম্‌” [গী|১০|৩২] এই বাক্য অনুসারে আমাদের শাস্ত্রকারগণ আধ্যাত্মিক আলোচনাকেই উপরি-উক্ত তিন মার্গের মধ্যে অধিক গুরুত্ব দিয়া থাকেন । 


 কোঁতের মত


কিন্তু আধুনিক কালে, উপরি-উক্ত তিন শব্দের অর্থ একটু বদলাইয়া প্ৰসিদ্ধ আধিভৌতিক ফরাসী পণ্ডিত “কোঁৎ” আধিভৌতিক প্ৰতিপাদনকেই সর্বত্র অধিক গুরুত্ব প্ৰদান করিয়াছেন । তিনি বলেন যে, সৃষ্টির মূলে কি তত্ত্ব আছে তাহার অনুসন্ধান করিতে যাওয়ায় কোন লাভ নাই; এই তত্ত্ব অনধিগম্য হওয়ায় কখনই আমাদের জানা সম্ভব নহে, সুতরাং সেই ভিত্তির উপর কোন শাস্ত্রের ইমারৎ খাড়া করা উচিত বা সাধ্যায়ত্ত নহে । বুনো লোকেরা গাছ, পাথর, জ্বালামুখী প্রভৃতি নড়াচড়া পদার্থ যখন প্ৰথম দেখিল তখন তাহারা ধর্মান্ধতাবশত এই সমস্তই দেবতা বলিয়া মনে করিতে লাগিল । কোঁতের মতে ইহাই আধিদৈবিক বিচার । কিন্তু মানুষ শীঘ্রই এই কল্পনাটি ছাড়িয়া দিয়া সকল পদার্থের মধ্যে কোন-না-কোন প্রকার আত্মতত্ত্ব নিশ্চয় পূর্ণ হইয়া আছে এইরূপ মনে করিতে লাগিল । কোঁতের মতে মানবীয় জ্ঞানের উন্নতির ইহাই দ্বিতীয় সোপান । এই ভিত্তিকে তিনি “আধ্যাত্মিক” এই নাম দিয়াছেন । কিন্তু এই মাৰ্গ ধরিয়া সৃষ্টির বিচার করিয়াও প্ৰত্যক্ষ-উপযোগী শাস্ত্রীয় জ্ঞানের যখন কোন বৃদ্ধি হয় না, তখন মানুষ শেষে সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থসমূহের দৃশ্য গুণধর্মেরই আরও বেশী অনুসন্ধান করিতে প্ৰবৃত্ত হইল; এবং তাহার ফলেই এক্ষণে আগগাড়ী, তার প্রভৃতির ন্যায় যন্ত্র আবিষ্কার করিয়া বাহ্য সৃষ্টির উপর মানুষ স্বীয় আধিপত্য অধিকতর স্থাপিত করিল । কোঁৎ ইহার আধিভৌতিক মার্গ নাম দিয়াছেন । তিনি স্থির করিয়াছেন যে, যে-কোন শাস্ত্রের কিংবা বিষয়ের বিচার আলোচনা করিবার সময় এই মাৰ্গই অন্যান্য মাৰ্গ অপেক্ষা অধিকতর লাভজনক ও শ্রেষ্ঠ । কোঁতের মতে, সমাজশাস্ত্ৰসম্বন্ধে কিংবা কর্মযোগশাস্ত্ৰসম্বন্ধে তাত্ত্বিক বিচারের এই দৃষ্টিভূমিকেই স্বীকার কৱিতে হইবে । এই মার্গ স্বীকার করিয়া এই পণ্ডিত ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন এবং সকল ব্যবহারশাস্ত্রের এই মথিতাৰ্থ বাহির করিয়াছেন যে, এই সংসারে প্রত্যেক মনুষ্য সমস্ত মানবজাতির উপর প্ৰেম স্থাপন করিয়া সতত সর্বলোকের কল্যাণ চেষ্টা করিবে, ইহাই তাহার পরমধর্ম । মিলস্পেনসর, প্রভৃতি ইংরেজ পণ্ডিত এই মতের অগ্ৰণী বলিলেও চলে । উল্টাপক্ষে, কাণ্টহেগেলশোপেন্‌হোর প্রভৃতি জর্মান তত্ত্বজ্ঞানী এই আধিভৌতিক পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের বিচারপক্ষে অপূর্ণ স্থির করিয়া আজকাল ইউরোপে আমাদের বেদান্তীদিগের ন্যায় অধ্যাত্মদৃষ্টির দ্বারাই নীতিসমর্থক মার্গ পুনরায় স্থাপন করিয়াছেন । তৎসম্বন্ধে আরও অনেক জ্ঞাতব্য কথা পরে বলা যাইবে ।
(ফান্সদেশে, গত শতাব্দীতে অগস্ত কোঁৎ এক বড় পণ্ডিত ছিলেন । ইনি সমাজশাস্ত্রের উপর এক বড় গ্ৰন্থ লিখিয়া, শাস্ত্রীয় রীতিতে সমাজ রচনায় কিরূপ বিচায় করিবে ইহাই প্ৰথম দেখাইয়াছেন । যে কোন শাস্ত্র ধর না কেন, তাহার আলোচনা প্রথম theological, তাহার পর metaphysical পদ্ধতিতে হইয়া থাকে এবং শেষে তাহার positive স্বরূপ প্রাপ্ত হওয়া যায় - অনেক শাস্ত্রের পৰ্যালোচনা করিয়া তিনি ইহা স্থির করিয়াছেন । এই তিন পদ্ধতির অনুক্ৰমে আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক এই প্রাচীন নাম আমি এই গ্রন্থে দিয়াছি; কোঁৎ এই পদ্ধতি নূতন বাহির করেন নাই, উহা পুরাতনই । কিন্তু ঊহাদিগের ঐতিহাসিক ক্রমটি তাঁহার নূতন রচনা । সর্বাপেক্ষা positive (আধিভৌতিক) পদ্ধতিই শ্ৰেষ্ঠ ইহাই তাঁহার নূতন কথা । ইংরাজী ভাষায় ইঁহার প্রধান গ্রন্থের ভাশান্তর হইয়াছে ।)


 গীতা অনুসারে অধ্যাত্মদৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা


একই অর্থ বিবক্ষিত হইলেও ‘ভাল ও মন্দের’ পর্যায়বাচী ‘কাৰ্য ও অকাৰ্য’, ‘ধর্ম ও অধর্ম’, প্ৰভৃতি বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার কেন প্ৰচলিত হইল ? ইহার কারণ এই যে, বিষয়প্ৰতিপাদনবিষয়ে প্রত্যেকের মার্গ বা দৃষ্টি ভিন্ন ভিন্ন । যে যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্ৰোণাদিকে বধ করিতে হইবে সেই যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হওয়া আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর কিংবা শ্ৰেয়স্কর নহে, অর্জুনের এইরূপ প্রশ্ন ছিল [গী|২|৭] । কোন আধিভৌতিক পণ্ডিতের উপর যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিবার ভার পড়িত, তবে মহাভারতীয় যুদ্ধ হইতে অর্জুনের নিজের লাভালাভ কতটুকু এবং সমস্ত সমাজের উপর তাহার পরিণামই বা কি ঘটতে পারে, তাহার সারাসার বিচার করিয়া, যুদ্ধ করা ‘ন্যায্য’ কি ‘অন্যায্য’ এই বিষয়ে তিনি নিষ্পত্তি করিতেন । ইহার কারণ এই যে, কোন কর্মের ভালমন্দ নির্ণয় করিবার সময় আধিভৌতিক পণ্ডিত চিন্তা করেন যে, এই সংসারে ঐ কর্মের আধিভৌতিক অর্থাৎ প্ৰত্যক্ষ বাহ্য পরিণাম কি ঘটিয়াছে বা ঘটতে পারে । উহা ব্যতীত উক্ত কর্মের ভালমন্দ নির্ণয় করিবার দ্বিতীয় সাধন বা কষ্টিপাথর এই সরল আধিভৌতিক পণ্ডিতের অভিমত নহে । কিন্তু এইরূপ উত্তরে অর্জুনের সমস্যার সমাধান হয় না । তাঁহার দৃষ্টি ইহা অপেক্ষা ব্যাপক ছিল । শুধু এই জগতের নহে, কিন্তু পারলৌকিক দৃষ্টিতেও এই যুদ্ধের পরিণামে আপনি আত্মার শ্ৰেয় হইবে কি হইবে না, তাঁহার নিকট ইহার নিষ্পত্তি হওয়া আবশ্যক ছিল । যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্ৰোণাদি নিহত হইলে, আমাদের রাজ্যপ্রাপ্তি হইয়া সুখ লাভ হইবে কি না, কিংবা যুধিষ্ঠিরাদির শাসনকাল, দুর্যোধনের রাজত্ব অপেক্ষা লোকের পক্ষে অধিকতর সুখজনক হইবে কি না, সে সম্বন্ধে তাহার কোন সংশয় উপস্থিত হয় নাই । সুতরাং আমি যাহা করিতেছি তাহা ‘ধর্ম’ বা ‘অধর্ম’, ‘পুণ্য’ কি ‘পাপ’, ইহাই তাহার দেখিবার বিষয় ছিল । গীতার বিচার-আলোচনাও সেই দৃষ্টিতেই করা হইয়াছে । শুধু গীতায় নহে, মহাভারতের অন্যান্য কয়েক স্থানেও যে বিচার-আলোচনা আছে তাহাও এই পারলৌকিক ও অধ্যাত্মদৃষ্টিতে করা হইয়াছে । সেই সকল স্থলে কোন কর্মের ‘ভাল মন্দ’ দেখাইবার সময়, ‘ধর্ম’ ও ‘অধর্ম’ এই দুই শব্দই প্ৰায় ব্যবহৃত হইয়াছে । কিন্তু ‘ধর্ম’ ও তাহার প্রতিযোগী অর্থাৎ উল্টা ‘অধর্ম’ এই দুই শব্দ ব্যাপক অর্থে কখন কখন ভ্ৰম উৎপাদন করায়, কর্মযোগশাস্ত্ৰে মুখ্যরূপে কোন অর্থে উহাদের ব্যবহার হইতেছে তৎসম্বন্ধে এইখানে কিছু বিস্তৃতভাবে মীমাংসা করা আবশ্যক ।


ধর্ম শব্দের দুই অর্থ, পারলৌকিক ও ব্যবহারিক


নিত্যব্যবহারে, অনেক সময় ‘ধর্ম’ শব্দ নিছক ‘পারলৌকিক সুখের মাৰ্গ’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে । আমরা যখন কাহাকেও প্রশ্ন করি যে “তোমার কোন্‌ ধর্ম”, তখন কেবল পারলৌকিক কল্যাণার্থ, তুমি কোন মার্গ অনুসরণ করিতেছ - বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন, খৃষ্টীয়, মহম্মদীয় বা পার্সী - ইহাই আমাদের প্রশ্নের হেতু; এবং উত্তরদাতাও তদনুসারে তাহার উত্তর দিয়া থাকে । সেই প্রকার স্বৰ্গপ্রাপ্তির সাধনভূত যাগযজ্ঞাদি বৈদিক বিষয়ের মীমাংসা করিবার সময়, “অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা” প্রভৃতি সূত্ৰেতেও ধর্মশব্দের এই অর্থই অভিপ্রেত হইয়াছে । কিন্তু ‘ধর্ম’ শব্দের এইমাত্র সঙ্কুচিত অর্থ নহে; ইহা ব্যতীত রাজধর্ম, প্রজাধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম, কুলধর্ম, মিত্ৰধর্ম প্রভৃতি সাংসারিক নীতিবন্ধনেও ধর্মশব্দ প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । ধর্মশব্দের এই দুই অর্থ পৃথক করিয়া দেখাইতে হইলে পারলৌকিক ধর্মকে ‘মোক্ষধর্ম’ বা কেবল ‘মোক্ষ’, ব্যবহারিক ধর্ম বা নীতিকে ধর্ম বলা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - চতুর্বিধ পুরুষার্থের গণনা করিবার সময় আমরা ‘ধর্ম অৰ্থ কাম মোক্ষ’ বলি । ইহাদের প্রথম শব্দ ধর্মের ভিতর মোক্ষের সমাবেশ হইলে, শেষে মোক্ষকে পৃথক পুরুষাৰ্থ বলিবার প্রয়োজন ছিল না । সুতরাং এইস্থানে ধর্মশব্দে জগতের বা সংসারের শত শত নীতিধর্মই শাস্ত্ৰকারদিগের অভিপ্ৰেত এইরূপ বলিতে হয় । ইহাকেই আমরা আজকাল কর্তব্য কর্ম, নীতি, নীতিধর্ম কিংবা সদাচরণ বলিয়া থাকি । কিন্তু প্ৰাচীন সংস্কৃত গ্ৰন্থসমূহে ‘নীতি’ কিংবা ‘নীতিশাস্ত্ৰ’ শব্দ বিশেষরূপে রাজনীতির উদ্দেশেই প্ৰযুক্ত হইত বলিয়া কর্তব্য কর্ম কিংবা সদাচার সম্বন্ধীয় সাধারণ আলোচনাকে ‘নীতিপ্ৰবচন’ না বলিয়া ‘ধর্মপ্রবচন’ নাম দেওয়া হইত । কিন্তু নীতি ও ধর্ম এই দুই শব্দের এই পারিভাষিক ভেদ সকল সংস্কৃত গ্রন্থেই যে স্বীকৃত হইয়াছে তাহা নহে । তাই আমিও এই গ্রন্থে ‘নীতি’, ‘কর্তব্য’ ও ‘ধর্ম’ এই সকল শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি; এবং মোক্ষের বিচার যেখানে করা হইয়াছে, সেই প্রকরণকে আমি ‘অধ্যাত্ম’ ও ‘ভক্তিমার্গ’ এইরূপ স্বতন্ত্র নাম দিয়াছি । মহাভারতে ধর্ম শব্দ অনেক স্থানেই পাওয়া যায়; এবং যে স্থানে বলা হইয়াছে যে, “কাহারও কোন কাৰ্য ধর্মসংগত হইয়াছে,” সেই স্থানে ধর্ম শব্দে কর্তব্য শাস্ত্ৰ কিংবা তৎকালীন সমাজব্যবস্থাশাস্ত্ৰ অৰ্থই অভিপ্রেত বুঝিতে হইবে; এবং যে স্থানে পারলৌকিক কল্যাণের মার্গ বিবৃত করিবার প্রসঙ্গ আসিয়াছে, সেই স্থানে অর্থাৎ শান্তিপর্বের উত্তরার্ধে “মোক্ষধর্ম” এই বিশিষ্ট শব্দের যোজনা করা হইয়াছে ।


 চাতুর্বর্ণ্য আদি ধর্ম


সেইরূপ আবার মন্বাদি স্মৃতিশাস্ত্ৰে ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য ও শূদ্র ইহাদের বিশিষ্ট কর্ম অৰ্থাৎ চাতুৰ্বর্ণ্যের কর্ম বিবৃত করিবার সময়ে অনেকবার অনেক স্থানে কেবল ধর্মশব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে; ভগবদ্গীতাতেও যখন অর্জুনকে ভগবান “স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য” [গী|২|৩১] অর্থাৎ স্বধর্ম কি তাহা দেখিয়া যুদ্ধ করিতে বলিয়াছেন, তখন এবং তৎপূর্বে “স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ” [গী|৩|৩৫], সেই স্থানেও ‘ধর্ম’ শব্দ “ইহলৌকিক চাতুর্বর্ণ্যের ধর্ম” এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হইয়াছে । সমাজের সমস্ত ব্যবহার যাহাতে সুচারুরূপে পরিচালিত হয়, কোন এক বিশিষ্ট ব্যক্তির উপরে কিংবা মণ্ডলীর উপরেও সমস্ত ভার না পড়ে এবং সমাজের সকল পক্ষেরই ভালরূপে সংরক্ষণ ও পোষণ হয়, এই নিমিত্ত শ্রমবিভাগরূপ চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা পুরাকালীন ঋষিগণ কর্তৃক সংস্থাপিত হয় । ইহা পৃথক কথা যে, কিছুকাল পরে চতুর্বর্ণের লোক কেবল জাতিমাত্ৰোপজীবী অর্থাৎ প্রকৃত স্বকর্ম বিস্মৃত হইয়া কেবল নামধারী ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য ও শূদ্র হইয়া পড়িল । ইহা নিঃসন্দেহ যে, গোড়ায় এই ব্যবস্থা সমাজধারণার্থ করা হইয়াছিল; এবং চতুর্বর্ণের মধ্যে যদি কোন বর্ণ আপনি ধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য পরিাত্যাগ করে, কিংবা যদি কোন বর্ণ সমূলে বিনষ্ট হয়, ও তাহার স্থান অন্য লোক আসিয়া পূর্ণ না করে, তাহা হইলে সমস্ত সমাজ সেই পরিমাণেই পঙ্গু হইয়া ধীরে ধীরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়, কিংবা উহা নিকৃষ্ট অবস্থাতে তো নিশ্চয়ই আসিয়া পৌঁছে । যদিও এ কথা সত্য যে, পাশ্চাত্য খণ্ডে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা ব্যতীত অনেক সমাজের অভ্যুদয় হইয়াছে, তথাপি ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, সে দেশে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা না থাকিলেও চারিবর্ণের সমস্ত ধর্ম, জাতিরূপে না হউক, গুণবিভাগরূপে জাগ্ৰত রহিয়াছে । সারকথা, যখন আমরা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ধর্মশব্দ ব্যবহার করি তখন সর্বসমাজের ধারণ ও পোষণ কিরূপে হইতে পারে, তাহাই আমরা দেখি । মনু বলিয়াছেন - “অসুখোদর্ক” অর্থাৎ যাহার পরিণামে দুঃখ হয় সেরূপ ধর্ম পরিত্যাগ করিবে [মনু|৪|১৩৬]; এবং শান্তিপর্বের সত্যানৃতাধ্যায়ে [শাং|১০৯|১২] ধর্মাধর্মের বিচারকালে ভীষ্ম ও তৎপূর্বে কৰ্ণপর্বে শ্ৰীকৃষ্ণ এইরূপ বলিতেছেন যে -
ধারণাদ্ধৰ্মমিত্যাহুঃ ধর্মো ধারয়তে প্ৰজাঃ ৷
যৎ স্যাদ্ধারণসংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ ॥
অর্থাৎ “ধর্ম শব্দ ধৃধাতু (= ধারণ করা) হইতে বাহির হইয়াছে । ধর্মের দ্বারাই সমস্ত প্ৰজা বাঁধা রহিয়াছে । ইহাই স্থির হইয়াছে যে, যাহার দ্বারা (সকল প্ৰজার) ধারণ হয় তাহাই ধর্ম” [মভা|কৰ্ণ|৬৯|৫৯] । অতএব, এই ধর্ম চলিয়া গেলে সমাজের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয় এইরূপ বুঝিতে হইবে; এবং সমাজের বন্ধন ছিন্ন হইলে আকর্ষণ শক্তি ব্যতীত আকাশস্থ সূর্যাদি গ্ৰহমালার কিংবা কর্ণধার ব্যতীত সমুদ্রের উপর জাহাজের যে অবস্থা হয়, সমাজেরও সেই অবস্থা হইয়া থাকে । এই শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হইয়া যাহাতে সমাজের বিনাশ না হয়, সেই কারণে ব্যাসদেব কয়েক স্থানে বলিয়াছেন যে, যদি অর্থ বা দ্রব্য লাভ করিতে ইচ্ছা হয়, তবে তাহা ধর্মতঃ অর্থাৎ যাহাতে সমাজের গঠন বিগড়াইয়া না যায়, এইরূপ ভাবে করিবে, এবং কামাদি বাসনা তৃপ্ত করিতে হইলে তাহাও ধর্মতই করিবে । মহাভারতের শেষে ব্যাস বলিতেছেন যে -
উৰ্দ্ধবাহুর্বিরৌম্যেষঃ ন চ কশ্চিচ্ছৃণোতি মাম্‌ ৷
ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ স ধৰ্ম্মঃ কিং ন সেব্যতে ॥
“ওরে ! বাহু তুলিয়া আমি চীৎকার করিতেছি, (কিন্তু) আমার কথা কেহই শুনে না ! ধর্ম হইতে অর্থ ও কাম উভয়ই প্ৰাপ্ত হওয়া যায়; (তথাপি) এইরূপ ধর্ম তুমি কেন আচরণ করিতেছ না ?” ইহা হইতে পাঠকের স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হইবে যে, মহাভারতকে যে ধর্মদৃষ্টিতে পঞ্চম বেদ কিংবা ধর্মসংহিতা বলিয়া স্বীকার করা হয়, সেই ‘ধর্মসংহিতা’ শব্দের মধ্যে ‘ধর্ম’ এই শব্দের মুখ্য অর্থ কি । ইহাই কারণ যে, “নারায়ণং নমস্কৃত্য” এই প্ৰতীক শব্দগুলির দ্বারা ব্ৰহ্মযজ্ঞের নিত্যপাঠের মধ্যে পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা এই দুই পারলৌকিক অর্থপ্ৰতিপাদক গ্রন্থের ন্যায় ধর্মগ্ৰন্থরূপে মহাভারতেরও সমাবেশ করা হইয়াছে ।


জগতের ধারণ করে এই জন্য ধর্ম


ধর্মাধর্ম সম্বন্ধে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত শুনিয়া কেহ এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, যদি ‘সমাজধারণ’, এবং দ্বিতীয় প্রকরণের সত্যানৃতবিবেক প্রসঙ্গে কথিত ‘সর্বভূতহিত’, এই দুই তত্ত্ব যদি তুমি স্বীকার কর, তবে তোমার দৃষ্টিতে ও আধিভৌতিক দৃষ্টিতে প্ৰভেদ কি ? কারণ, এই দুই তত্ত্বই বাহ্যতঃ প্ৰত্যক্ষজ্ঞানমূলক ও আধিভৌতিক । এই প্রশ্নের সবিস্তার বিচার পরবর্তী প্ৰকরণে করা হইয়াছে । আপাতত এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, সমাজধারণই ধর্মের প্ৰধান বাহ্য উপযোগ; এই তত্ত্ব স্বীকার করিলেও, আমার মতের বিশেষত্ব এই যে, বৈদিক কিংবা অন্য সমস্ত ধর্মের পরম সাধ্য যে আত্মকল্যাণ কিংবা মোক্ষ তাহা হইতেও আমার দৃষ্টিকে কখনই বিচলিত হইতে দিই নাই । ‘সমাজধারণ’ই বল আর ‘সর্বভূতহিত’ই বল, এই দুই বাহ্যোপযোগী তত্ত্ব যদি আমাদের আত্মাকল্যাণের পথের অন্তরায় হয়, তবে তাহা আমরা চাহি না । আমাদের আয়ুৰ্বেদ যদি ইহাই প্ৰতিপাদন করে যে, বৈদ্যকশাস্ত্ৰও শরীররক্ষণ দ্বারা মোক্ষপ্ৰাপ্তির সাধন বলিয়াই সংগ্ৰহণীয়, তবে, ইহা কখনই সম্ভব নহে যে, এই জগতে কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, এই গুরুতর বিষয়ের যে শাস্ত্ৰ বিচার-আলোচনা করে, সেই কর্মযোগশাস্ত্ৰকে আমাদের শাস্ত্রকার আধ্যাত্মিক মোক্ষজ্ঞান হইতে পৃথকরূপে ব্যাখ্যা করিবেন । অতএব আমি মনে করি যে, মোক্ষের অর্থাৎ আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির অনুকুল যে কর্ম তাহাই পুণ্য, ধর্ম, কিংবা শুভকর্ম এবং তাহার প্রতিকুল যে কর্ম তাহাই পাপ, অধর্ম কিংবা অশুভ । কর্তব্য ও কাৰ্য এবং অকর্তব্য ও অকাৰ্য এই সকল শব্দের পরিবর্তে একই অর্থে, (একটু সন্দিন্ধ হইলেও) আমরা ধর্ম ও অধর্ম এই দুই শব্দের ব্যবহার যে অধিক পছন্দ করি, তাহারও মর্ম ইহাই । বাহ্যসৃষ্টির অন্তর্ভূত ব্যবহারিক কর্ম ব্যাপার, মুখ্যরূপে আমাদের বিচারের বিষয় হইলেও, উক্ত কর্মসমূহের বাহ্য পরিণামের বিচারেরই ন্যায় এই সকল ব্যাপার আমাদের আত্মারও কল্যাণের অনুকুল কি প্ৰতিকুল, সে বিচারও আমরা সর্বদা করিয়া থাকি । আমি নিজের হিত ছাড়িয়া লোকের হিত কেন করিব, আধিভৌতিকবাদীকে এইরূপ কোন প্রশ্ন করিলে, “সাধারণতঃ ইহাই মানব-স্বভাব” - ইহা ব্যতীত আর কি উত্তর তিনি দিতে পারেন ? আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের দৃষ্টি ইহার অগ্ৰে পৌছিয়াছে; এবং সেই ব্যাপক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেই মহাভারতে কর্মযোগশাস্ত্রের বিচার করিয়াছেন; এইজন্য ভগবদ্গীতাতেও বেদান্তের নিরূপণও করা হইয়াছে । প্ৰাচীন গ্ৰীক পণ্ডিতদিগেরও এই মত যে মনুষ্যের ‘অত্যন্ত হিত’ কিংবা ‘সদগুণের পরাকাষ্ঠা’ এইরূপ কোন কিছু পরম সাধ্য কল্পনা করিয়া পরে সেই অনুসারে কর্মাকর্মের বিচার আলোচনা করিতে হইবে; এবং আরিষ্টটল স্বরচিত নীতিশাস্ত্ৰসংক্রান্ত গ্রন্থে বলিয়াছেন [১|৭|৮] যে, আত্মার কল্যাণের মধ্যেই এই সমস্ত বিষয়ের সমাবেশ হইয়া থাকে । তথাপি আত্মার হিত সম্বন্ধে যতটা প্ৰাধান্য দেওয়া আবশ্যক, আরিষ্টটল ততটা প্ৰাধান্য দেন নাই । 

আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সম্বন্ধে এ কথা খাটে না । তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, আত্মার কল্যাণ কিংবা আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থাই প্ৰত্যেক মনুষ্যের প্রথম ও পরম সাধনার বিষয়; অন্য প্রকারের হিত অপেক্ষা উহাকেই প্ৰধান স্বীকার করিয়া তদনুসারে কর্মাকর্মের বিচার করা আবশ্যক; অধ্যাত্মবিদ্যাকে ছাড়িয়া কর্মাকর্মের বিচার করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । বর্তমানকালে পাশ্চাত্যদেশের কোন কোন পণ্ডিতও কর্মাকর্ম বিচারের এই পদ্ধতিই স্বীকার করিয়াছেন দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - জার্মান তত্ত্বজ্ঞানী কাণ্ট প্ৰথমে “শুদ্ধ (ব্যবসায়াত্মিক) বুদ্ধির মীমাংসা” নামক আধ্যাত্মিক গ্ৰন্থ লিখিয়া পরে তাহার পূরণস্বরূপে “ব্যবহারিক (বাসনাত্মক) বুদ্ধির মীমাংসা” নামক নীতিশাস্ত্ৰবিষয়ক গ্ৰন্থ লিখিয়াছেন [কাণ্ট জর্মন তত্ত্বজ্ঞানী; ইনি অর্বাচীন তত্ত্বজ্ঞানশাস্ত্রের জনক বলিয়া খ্যাত । ইহার “Critique of Pure Reason” (শুদ্ধ বুদ্ধির মীমাংসা) এবং “Critique of Practical Reason” (বাসনাত্মক বুদ্ধির মীমাংসা) এই দুই গ্ৰন্থ প্রসিদ্ধ ।];
এবং ইংলেণ্ডেও গ্রীন আপন “নীতিশাস্ত্রের উপোদ্‌ঘাত” স্থষ্টির মূলে অবস্থিত আত্মতত্ত্ব হইতেই আরম্ভ করিয়াছেন (গ্রীন এই গ্রন্থের নাম “Prolegomena to Ethics” এই নাম দিয়াছেন) । কিন্তু এই গ্ৰন্থসমূহের পরিবর্তে কেবল আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগেরই নীতিগ্ৰন্থ আজকাল আমাদের দেশে ইংরেজি পাঠশালায় পড়ান হয়; তাহারই পরিণামে দেখা যায় যে, গীতোক্ত কর্মযোগশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব আমাদের মধ্যে অনেক ইংরেজিশিক্ষিত পণ্ডিতেরাও ভাল বুঝিতে পারেন না ।

‘ধর্ম’ এই সাধারণ শব্দ ব্যবহারিক নীতিবন্ধন সম্বন্ধে কিংবা সমাজধারণ ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমি কেন প্রয়োগ করিয়াছি, তাহা উপরি-উক্ত বিচার আলোচনা হইতে জানিতে পারা যাইবে । মহাভারত, ভগবদ্গীতা প্ৰভৃতি সংস্কৃত গ্ৰন্থসমূহে এবং ভাষাগ্রন্থেও ব্যবহারিক কর্তব্য কিংবা নিয়ম অর্থে ধর্মশব্দ সর্বদাই ব্যবহৃত হয় । কুলধর্ম ও কুলাচার এই দুই শব্দ আমরা সমানার্থক বলিয়া বুঝি । মহাভারতীয় যুদ্ধে একবার কর্ণের রথের চাকা পৃথিবী গ্ৰাস করিয়াছিলেন; সেই চাকা উঠাইয়া উপরে আনিবার জন্য কৰ্ণ আপন রথ হইতে নীচে নামিলে পর, অর্জুন তাঁহাকে বধ করিতে উদ্যত হইলেন । তাহা দেখিয়া কৰ্ণ বলিলেন - “শত্রু নিঃশস্ত্ৰ হইলে তাহাকে মারা ধর্মযুদ্ধ নহে” । তাহ শুনিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ দ্ৰৌপদীর বস্ত্রহরণ, সকলে মিলিয়া একাকী অভিমন্যুর বধসাধন প্ৰভৃতি পূর্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে কর্ণকে এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন যে “হে কৰ্ণ তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল ?” মহারাষ্ট্রকবি মোরোপন্ত এই সকল বিষয়ের বর্ণনা করিয়াছেন । এবং মহাভারতেও এই প্রসঙ্গে “ক্ব তে ধর্মস্তদা গতঃ” এই প্রশ্নে ধর্ম শব্দেরই প্রয়োগ করা হইয়াছে । সেইরূপে শেষে বলা হইয়াছে যে, যে এই প্ৰকার অধর্ম করে তাহার সহিত ঐ প্রকারের ব্যবহার করাই তাহার উচিত দণ্ড । সার কথা, কি সংস্কৃত, কি ভাষাগ্ৰন্থ, সকল গ্রন্থেই, শিষ্টের নানা বিষয়সম্বন্ধে অধ্যাত্মদৃষ্টিতে সমাজ-বিধরণের জন্য যে নীতি-নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন, সেই সকলেতেই ধর্মশব্দের প্রয়োগ আছে । এই কারণে ঐ শব্দ আমিও এই গ্রন্থে বজায় রাখিয়াছি । এই দৃষ্টিতে বিচার করিয়া সমাজবিধরণার্থ শিষ্টগণস্থাপিত ও সর্ববাদসম্মত নীতির ঐ সকল নিয়ম বা ‘শিষ্টাচার’কে ধর্মের মূলভিত্তি বলা যাইতে পারে । এবং সেই কারণে, মহাভারতে [অনু|১৫৪|১৫৭] ও স্মৃতিগ্রন্থে “আচারপ্রভবো ধৰ্ম্মঃ” অথবা “আচারঃ পরমো ধৰ্ম্মঃ” [মনু|১|১০৮], কিংবা ধর্মের মূল বুঝাইবার সময় “বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ” [মনু|২|১২], এই সকল বচন উক্ত হইয়াছে । কিন্তু কর্মযোগশাস্ত্রে এইটুকুতে কাজ চলে না; এই আচার প্রবর্তিত হইবার কারণ কি, তাহার পূর্ণ ও মার্মিক বিচার করা আবশ্যক । 


 চোদনালক্ষণ-ধর্ম


ধর্মশব্দের আর এক যে ব্যাখ্যা প্রাচীন গ্ৰন্থাদিতে প্রদত্ত হয়, তাহারও কিছু বিচার করা এইখানে আবশ্যক । মীমাংসকেরা “চোদনালক্ষণোহর্থো ধৰ্ম্মঃ” এইরূপ বলিয়া থাকেন [জৈ|সূ|১|১|২] । কোন অধিকারী ব্যক্তি কর্তৃক “তুমি অমুক কাজ কর” বা “করিও না” এইরূপ বলা কিংবা আদেশ করার নাম চোদনা বা প্রেরণা । যে পর্যন্ত এই রকমের বিধান স্থাপিত না হয়, সে পর্যন্ত, যে কোন বিষয় যে কোন ব্যক্তির করিবার অধিকার আছে । ইহার ভাব এই যে, ধর্ম প্রথমতঃ নিয়মবিধানের হিসাবে প্ৰবর্তিত হইয়াছে; প্ৰসিদ্ধ ইংরেজ গ্ৰন্থকার হব্‌স’এর মতের সঙ্গে, ধর্মের এই ব্যাখ্যার কিয়দংশে মিল আছে । অসভ্য ও বন্য অবস্থায় প্ৰত্যেক মনুষ্য, যখন যে মনোবৃত্তি প্ৰবল হয়, তদনুসারে কাজ করে । কিন্তু পরে, ধীরে ধীরে এই প্রকারের স্বৈরাচার শ্রেয়স্কর নহে এইরূপ বুঝা যায়; এবং ইহা বিশ্বাস হয় যে, ইন্দ্ৰিয়গণের স্বাভাবিক ব্যাপারের একটা সীমা নির্দেশ করিয়া তাহারই পালনে সকলের কল্যাণ হয়; তখন শিষ্টাচার কিংবা অন্য কোন রীতির উপর দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠ এই সীমা-মর্যাদা প্ৰত্যেক মনুষ্য আইনের ন্যায় পালন করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । এবং এই প্রকারের সীমামৰ্যাদার সংখ্যা বেশী হইলে সেই সমস্ত লইয়াই এক শাস্ত্র রচিত হইয়া থাকে । বিবাহব্যবস্থা পূর্বে প্রচলিত ছিল না, শ্বেতকেতুই বিবাহব্যবস্থা সর্বপ্রথম আমলে আনিয়াছিলেন । সুরাপান শুক্রাচার্য নিষিদ্ধ বলিয়া স্থির করেন - ইহা আমি পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । শ্বেতকেতুর কিংবা শুক্রাচার্যের এই সীমামর্যাদা স্থাপনে হেতু কি ছিল তাহা না দেখিয়া, এই প্রকার সীমা মর্যাদা স্থাপনের পক্ষে কেবল তাঁহাদের কর্তব্যকেই লক্ষ্যের মধ্যে আনিয়া ধর্মশব্দের “চোদনালক্ষণোহর্থো ধৰ্ম্মঃ” এইরূপ ব্যাখ্যা নিষ্পন্ন হইয়াছে । ধর্ম হইলেও প্রথমতঃ তাহার মহত্ব কাহারও লক্ষ্যের মধ্যে আসে এবং তখনই তাহাতে উহার প্রবৃত্তি হইয়া থাকে । ‘খাও, পিয়ো, মজা লোটো’ একথা কাহাকেও শিখাইতে হয় না; কারণ, উহা ইন্দ্ৰিয়সমূহের স্বাভাবিক ধর্ম । মনু বলিয়াছেন - “ন মাংসভক্ষণে দোষো ন মদ্যে ন চ মৈথুনে” [মনু|৫|৫৬] মাংসভক্ষণ, মদ্যপান ও মৈথুনে কোন দোষ নাই অর্থাৎ ঐ সকল কাৰ্যে সৃষ্টিকর্মের বিরুদ্ধ কোন দোষ নাই, ইহাই উহার তাৎপৰ্য । এই সব বিষয় শুধু মনুষ্যের নহে, কিন্তু প্রাণীমাত্রেরই স্বাভাবিক - “প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাম্‌” । সমাজধারণের জন্য অর্থাৎ সকল লোকের সুখের জন্য প্ৰবৃত্তি-সূত্রে প্রাপ্ত এই স্বৈরাচারকে যথোচিত সংযত করাই ধর্ম । মহাভারতেও উক্ত হইয়াছে [শান্তি|২৯৪|২৯] -
আহারনিদ্রাভিয়মৈথুনং চ সামান্যমেতৎ পশুভির্নরাণাম্‌ ৷
ধর্মো হি তেষামধিকো বিশেষো ধর্মেন হীনাঃ পশুভিঃ সমানঃ ॥
অর্থাৎ আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন মনুষ্য ও পশু উভয়েরই সমান স্বাভাবিক । ধর্মেই (“অর্থাৎ এই সকল বিষয়ে নীতির সীমা স্থাপনে”) মনুষ্য ও পণ্ডতে ভেদ বুঝিতে হইবে । আহারবিহারের সংযম সম্বন্ধে ভাগবতের শ্লোক পূৰ্বপ্রকরণে প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ ভগবদ্গীতাতেও যখন অর্জুনকে ভগবান বলিতেছেন [গী|৩|৩৪] -
ইন্দ্ৰিয়স্যেন্দ্ৰিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ৷
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ॥
অর্থাৎ “প্ৰত্যেক ইন্দ্ৰিয়ে আপনাপন উপভোগ্য বা ত্যাজ্য পদার্থে প্রীতি ও দ্বেষ স্বভাবিসিদ্ধ । ইহাদের অধীন হওয়া আমাদের উচিত নহে; কারণ, রাগ ও দ্বেষ উভয়ই আমাদের শক্ৰ”, তখন ভগবান স্বাভাবিক মনোবৃত্তিকে সংযত করা যে ধর্মের লক্ষণ, তাহাই স্বীকার করিয়াছেন । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়াদি তাহাকে পশুর ন্যায় আচরণ করিতে বলে এবং তাহার বুদ্ধি তাহাকে উল্টাদিকে আকর্ষণ করে । কলহানলে যে ব্যক্তি দেহের মধ্যে বিচরণকারী এই পশুত্বকে আহুতি দিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করে, সেই প্ৰকৃত যাজ্ঞিক ও সেই ধন্য হয় ।


ধর্ম-অধর্মের নির্ণয় করিবার সাধারণ নিয়ম


ধর্ম ‘আচার-মূলকই’ বল, ‘ধারণাৎ’ ধর্মই বল, বা ‘চোদনালক্ষণ’ ধর্মই বল, ধর্মের বা ব্যবহারিক নীতিবন্ধনের যে কোন ব্যাখ্যাই গ্ৰহণ কর না কেন, ধর্মাধর্মসম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হইলে তাহা নির্ণয় করিবার জন্য উপরি-উক্ত তিন লক্ষণের কোন উপযোগ হয় না । ধর্মের মূল স্বরূপ কি তাহাই শুধু প্ৰথম ব্যাখ্যাটিতে বুঝা যায়; উহার বাহ্য উপযোগ কি, তাহা দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটির দ্বারা জানা যায়; এবং ধর্মের সীমামর্যাদা প্ৰথমে কোন এক ব্যক্তি স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তৃতীয় ব্যাখ্যার দ্বারা উপলব্ধি হইয়া থাকে । কিন্তু আচারে আচারে ভেদ দেখা যায়; একই কর্মের অনেক পরিণাম হয়; এবং অনেক ঋষির আদেশ অর্থাৎ ‘চোদনা’ও ভিন্ন ভিন্ন হয় । এই সকল কারণে সংশয়স্থলে ধর্মনির্ণয়ের অন্য মার্গ দেখা আবশ্যক । 


 ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ’


এই মার্গটা কি, যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির তাঁহাকে উত্তর দিয়াছিলেন -
তর্কোহপ্ৰতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো বিভিন্নাঃ নৈকো ঋষিৰ্যস্ত বচঃ প্রমাণম্‌ ৷
ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো যেন গতঃ সা পন্থা ॥
অর্থাৎ - “তর্ক অপ্রতিষ্ঠ, যাহার বুদ্ধি যেরূপ তীক্ষ্ণ তদনুসারে অনেক প্রকারের অনেক অনুমান তর্কের দ্বারা স্থাপিত হইতে পারে; শ্রুতি অর্থাৎ বেদেরও আদেশ ভিন্ন ভিন্ন; এবং স্মৃতিশাস্ত্রের কথা যদি বল, এমন এক ঋষিও নাই যাঁহার বচন আমরা অন্য অপেক্ষা অধিক প্রামাণ্য বলিয়া মনে করিতে পারি । ভাল, (এই ব্যবহারিক) ধর্মের মূলতত্ত্ব যদি দেখা যায় তবে তাহাও অন্ধকারের মধ্যে প্রচ্ছন্ন, অর্থাৎ সাধারণ লোকের বুদ্ধির অগম্য । এই জন্য মহাজন যে পথ দিয়া গিয়াছেন, সেই পথই পথ” [মভা|বন|৩১২|১১৫] । ঠিক কথা ! 


এই পন্থার দোষ


কিন্তু ‘মহাজন’ কাহাকে বলে ? উহার অর্থ “অধিক কিংবা বহু জনসমূহ” হইতে পারে না । কারণ, যে সাধারণ লোকের মনে ধর্মাধর্মের সংশয়ও কখন উৎপন্ন হয় না, তাহাদের প্রদর্শিত পথে চলা কি রকম ? - না যেমন, কঠোপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, অন্ধ কেশিন্বিরের ন্যায় (“অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ”) অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধ ! মহাজনের অর্থ যদি “বড় বড় শিষ্ট ব্যক্তি” ধরা যায় এবং এই অর্থই যদি উপরি-উক্ত শ্লোকের অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলেও ঐ সকল ব্যক্তির আচরণে মিল কোথায় ? নিষ্পাপ রামচন্দ্র আপন পত্নীকে অগ্নি হইতে শুদ্ধ হইয়া নিৰ্গত হইবার পরেও কেবল লোকাপবাদের জন্যই ত্যাগ করিলেন; এবং সুগ্ৰীবকে পাইবার জন্য, তাহার সহিত ‘তুল্যারিমিত্র’ অর্থাৎ তোমার শত্ৰু আমার শত্রু এবং তোমার মিত্র আমার মিত্র এই প্রকার অঙ্গীকারে বদ্ধ হইয়া রামচন্দ্ৰ বিনা অপরাধে বালিকে বধ করিলেন ! পরশুরাম পিতার আজ্ঞাক্ৰমে আপন মাতার শিরশেছদ করিলেন ! পাণ্ডবদিগের আচরণ দেখ - পাঁচজনের এক স্ত্রী ! স্বর্গের দেবতাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে - কেহবা অহল্যার সতীত্ব নাশ করিয়াছেন, আর কেহ বা মৃগরূপ ধরিয়া আপন কন্যার প্ৰতি অভিলাষ করায় রুদ্রের বাণে বিদ্ধশরীর হইয়া আকাশে পড়িয়া আছেন [ঐ|ব্রা|৩|৩৩] । এই কথা মনে করিয়াই ‘উত্তররামচরিত’ নাটকে ভবভূতি লবের মুখ দিয়া “বৃদ্ধাস্তে ন বিচারণীয়চরিতাঃ” - অৰ্থাৎ এই বৃদ্ধদের চরিত্র বেশী বিচার করিয়া কাজ নাই - এই কথা বলাইয়াছেন । ইংরাজীতে শয়তানের ইতিহাসলেখক এক গ্ৰন্থকার বলিয়াছেন যে, শয়তানের অনুচর ও দেবদূত ইহাঁদের যুদ্ধবৃত্তান্তে দেখা যায় যে, অনেকবার দেবতারাই দৈত্যদিগকে কপটতা দ্বারা ঠকাইয়াছেন । সেইপ্ৰকার কৌষীতকী ব্ৰাহ্মণোপনিষদে [কোষী|৩|১ ও ঐ|ব্ৰা|৭|২৮ দেখ] ইন্দ্ৰ প্ৰতৰ্দনকে বলিতেছেন যে, “আমি বৃত্ৰকে (যদিও সে ব্ৰাহ্মণ ছিল) বধ করিয়াছি । অরুন্মুখ সন্ন্যাসীদিগকে আমি টুক্‌রা টুক্‌রা করিয়া বৃকদিগের নিকট ফেলিয়া দিয়াছি এবং আমার অনেক অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া প্ৰহ্লাদের আত্মীয় ও গোত্রজদিগকে এবং পৌলোম ও কালখঞ্জ নামক দৈত্যদিগকে বধ করিয়াছি, তথাপি আমার এক গাছা চুলও বাঁকে নাই, - “তস্য মে তত্ৰ ন লোম চ মা মীয়াতে” ! যদি কেহ বলেন “তোমাদের এই মহাপুরুষদিগের মন্দ কর্মের প্রতি লক্ষ্য করিবার কোনই কারণ নাই; তৈত্তিরীয়োপনিষদের উক্তি অনুসারে [তৈত্তি|১|১১|২] তাঁহাদের যে সকল কর্ম ভাল, তোমরা তাহারই অনুকরণ কর, বাকী ছাড়িয়া দেও; উদাহরণ যথা - “পরশুরামের মতোই পিতার আজ্ঞা পালন কর, কিন্তু মাতাকে বধ করিও না”, তাহা হইলে ঐ প্রথম প্রশ্ন পুনরায়, উঠে যে ভালমন্দ কর্ম, বুঝিবার উপায় কি ? তাই, উপরি-উক্ত আপন কৃত্যাদি বর্ণনা করিয়া ইন্দ্ৰ প্ৰতৰ্দনকে পুনরায় বলিতেছেন যে, “যে পূর্ণ আত্মজ্ঞানী হইয়াছে, তাহাকে মাতৃবধ, পিতৃবধ, ভ্রূণহত্যা বা স্তেয় (চৌর্য) ইত্যাদি কোন কর্মেরই দোষ স্পর্শ করে না - এই কথাটী ভালরূপে বুঝিয়া লও এবং আত্মা কাহাকে বলে তাহাও তুমি বুঝিয়া লও; তাহা হইলেই তোমার সকল সংশয়ের নিবৃত্তি হইবে” । তাহার পর, ইন্দ্ৰ প্ৰতর্দনকে আত্মবিদ্যার উপদেশ দিয়াছেন ।

সারকথা এই যে, “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা”, এই যুক্তি সাধারণ লোকদিগের পক্ষে সহজ হইলেও সকল কথার ইহা দ্বারা সমাধান হয় না; এবং শেষে মহাজনদিগের আচরণের প্রকৃত তত্ত্ব যতই গূঢ় হউক না কেন, বিচারক ব্যক্তিগণ আত্মজ্ঞানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে বাধ্য হন । “ন দেবচরিতং চরেৎ” অর্থাৎ, দেবতাদের কেবল বাহ্য চরিত্র অনুসারে কাজ করিবে না - এই উপদেশের ও ইহাই রহস্য । 


‘অতি সর্বত্র’ এবং উহার অপূর্ণতা


কর্মাকর্ম নির্ণয়ার্থ ইহা ব্যতীত আর এক সরল যুক্তি কেহ কেহ বাহির করিয়াছেন । তাহারা বলেন যে, যে কোন সদ্‌গুণ হউক না কেন, তাহার আধিক্য যাহাতে না হয় তাহার জন্য সর্বদা চেষ্টা করা আবশ্যক; কারণ, এইরূপ আধিক্যের কারণেই সদ্‌গুণও শেষে দুর্গুণ হইয়া পড়ে । দান করা একটা সদ্‌গুণ সত্য, কিন্তু “অতি দানাদ্‌ বলির্বদ্ধঃ” - অৰ্থাৎ অতিদানে বলি রাজা বাঁধা পড়িয়াছিলেন । প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক পণ্ডিত আরিষ্টটল আপন নীতিশাস্ত্রসংক্রান্ত গ্রন্থে কর্মাকর্মনির্ণয়ের এই যুক্তি ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন যে প্রত্যেক সদ্‌গুণ ‘অতি’ হইলে কিরূপে ‘মাটি’ হয় । কালিদাসও রঘুবংশে বর্ণনা করিয়াছেন যে নিছক শৌৰ্য ব্যাঘ্রের ন্যায় হিংস্ৰ জন্তুদিগের ক্রুর কর্ম, এবং নিছক্‌ নীতি ভীরুতা, ইহা স্থির করিয়া অতিথি রাজা, তরবারি ও রাজনীতি এই উভয়ের যোগ্য মিশ্রণে আপন রাজ্য চালাইয়াছিলেন [রঘু|১৭|৪৭] । ভর্তৃহরিও কতকগুলি গুণদোষের বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন যে, বেশী কথা বলা ‘বাচালতার’ লক্ষণ এবং অল্প কথা বলা মুকের লক্ষণ; বেশী খরচ করা ‘উড়োনচণ্ডীর’ লক্ষণ এবং কম খরচ করা কঞ্জুষের লক্ষণ, সম্মুখে অগ্রসর হইলে ‘প্ৰগল্‌ভতা’ এবং পিছাইয়া পড়িলে শিথিলতা; অতিশয় আগ্ৰহ করিলে জেদী এবং না করিলে চঞ্চল, বেশী তোষামোদ করিলে নীচ এবং চুপ করিয়া থাকিলে গর্বিত; কিন্তু এইরূপ স্থূলরকমের কষ্টিপাথরে শেষ পর্যন্ত কাজ হয় না । কারণ, ‘অতি’ই বা কি, আর ‘নিয়মিত’ই বা কি - ইহার তো কোন প্রকার নির্ণয় হওয়া আবশ্যক; আর সেই নির্ণয় কে করিবে, এবং কেমন করিয়াই বা করিবে ? এক জনের নিকট কিংবা এক প্রসঙ্গে যাহা ‘অতি’, তাহাই আর একজনের নিকট কিংবা আর এক প্রসঙ্গে ‘অনতি’ বা ন্যূন হইতে পারে । হনুমানজী জন্মগ্রহণ করিতেই সূর্যকে ধরিবার জন্য লম্ফ প্ৰদান করা কঠিন কার্য মনে করেন নাই [বা|রামা|৭|৩৫]; কিন্তু ইহা অন্যের পক্ষে কঠিন, এমন কি অসম্ভব । 


 অবিরোধের দ্বারা ধর্ম-নির্ণয়


এইজন্য ধর্মাধর্মের সংশয় উপস্থিত হইলে প্রত্যেক মনুষ্যের শিবি রাজার প্রতি শ্যেনের উপদেশমত নির্ণয় করা উচিত -
অবিরোধাত্তু যো ধর্মঃ স ধৰ্ম্মঃ সত্যবিক্রম ৷
বিরোধিষু মহীপাল নিশ্চিত্য গুরুলাঘবম্‌ ৷
ন বাধা বিদ্যতে যত্ৰ তং ধৰ্ম্মং সমুপাচরেৎ ॥
পরস্পরবিরুদ্ধ ধর্মসকলের তারতম্য কিংবা, লাঘব-গৌরব দেখিয়াই প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে আপন বুদ্ধি অনুসারে প্রকৃত ধর্মের কিংবা কর্মের নির্ণয় করা উচিত [মভা|বন|১৩১|১১, ১২ ও মনু|৯|২৯৯ দেখ] । কিন্তু এরূপও বলা যাইতে পারে না যে, ইহা দ্বারাই ধর্মাধর্মের সারাসার বিচার করাই সংশয়স্থলে ধর্মনির্ণয়ের এক প্রকৃত কষ্টিপাথর । কারণ, ব্যবহারে অনেকবার দেখা যায় যে, অনেক পণ্ডিত লোক আপনাপন বুদ্ধি অনুসারে সারাসারের বিচারও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে করিয়া, একই বিষয়ের নীতিমত্তার নির্ণয়ও ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে করিয়া থাকেন । এই অর্থই উপরি-উক্ত “তর্কোহপ্ৰতিষ্ঠঃ” বচনে বলা হইয়াছে । 


 কর্মযোগশাস্ত্রের কার্য


তাই, এক্ষণে আমাদের দেখিতে হইবে যে, ধর্মাধর্মসংশয়ের এই প্রশ্নের নির্ভুল মীমাংসা করিবার অন্য কোন উপায় আছে কি নাই; যদি থাকে, ত সেটা কি; আর যদি অনেক উপায় থাকে তবে তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় কোনটি । এই বিষয়ের নির্ধারণ করাই হইল শাস্ত্রের কাৰ্য । শাস্ত্রের লক্ষণও এই যে, “অনেকসংশয়োচ্ছেদি পরোক্ষার্থস্য দর্শকম্‌” - অৰ্থাৎ অনেক সংশয় উৎপন্ন হইলে পর, সর্বপ্রথম ঐ সকল বিষয়ের পাকগুলি পৃথক পৃথক করিয়া দেয়; যে সকল বিষয় বুঝা যায় না, সেই সকল বিষয়ের অর্থ স্পষ্ট ও সুগম করিয়া দেয় এবং যে বিষয় প্রত্যক্ষ নহে কিংবা পরে প্রত্যক্ষ হইবে এরূপ বিষয়সমূহেরও যথার্থ জ্ঞান সম্পাদন করে । জ্যোতিষশাস্ত্ৰবেত্তা ভাবী গ্ৰহণও গণনা করিতে পারেন আলোচনা করিলে, উক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে “পরোক্ষার্থস্য দর্শকং” এই অংশটির সার্থকতা উপলব্ধি হইবে । কিন্তু অনেক সংশয়ের সমাধান করিতে হইলে প্রথমে জানা আবশ্যক যে উহা কোন প্রকারের সংশয় । তাই, প্রাচীন ও অর্বাচীন গ্ৰন্থকারদিগের এই পদ্ধতি প্রচলিত যে, কোন শাস্ত্রান্তর্গত সিদ্ধান্তপক্ষ বিবৃত করিবার পূর্বে, সেই বিষয়ে যতগুলি পক্ষ বাহির হইয়াছে সেগুলির বিচার করিয়া, তাহাদের দোষ ও ন্যূনতা প্ৰদৰ্শন করা হয় । এই পদ্ধতিই স্বীকার করিয়া লইয়া গীতাতে কর্মাকর্মনিৰ্ণয়াৰ্থ প্ৰতিপাদিত সিদ্ধান্তপক্ষীয় যোগ অর্থাৎ যুক্তি বিবৃত কবিবার পূর্বে, এই কাজের জন্যই অন্য যে কিছু যুক্তি পণ্ডিতলোকেরা ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন, এক্ষণে আমি সেগুলিরও বিচার করিব । এ কথা সত্য যে, এই সকল যুক্তি আমাদের মধ্যে পূর্বে বিশেষরূপে প্রচলিত ছিল না; বিশেষভাবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই বর্তমান সময়ে ঐ সকল যুক্তি প্ৰবর্তিত করিয়াছেন; কিন্তু তাহার দরুণ উহার বিচার এই গ্রন্থে করা উচিত নহে, একথা বলা যাইতে পারে না । কারণ, কেবল তুলনার জন্য নহে, কিন্তু গীতার অন্তর্গত আধ্যাত্মিক কর্মযোগের মহত্ব উপলব্ধি করিবার জন্যও এই সকল যুক্তি - যতই সংক্ষেপ হউক না কেন - অবগত হওয়া আবশ্যক ।

আধিভৌতিক সুখবাদ (Materialistic Theory of Happiness)


দুঃখাদুদ্বিজতে সৰ্ব্বঃ সর্ব্বস্য সুখমীপ্সিতম্‌ ৷ [মভা|শান্তি|১৩৯|৬১]

(দুঃখ সকলকেই উদ্বেজিত করে, সুখ সকলেরই অভীপ্সিত ।)

1) ভূমিকা - কর্মাকর্মের বিচার


মনুপ্ৰভৃতি শাস্ত্রকারদিগের “অহিংসাসত্যমস্তেয়ং” ইত্যাদি নিয়ম স্থাপন করিবার কারণ কি, উহা নিত্য কি অনিত্য, উহাদের ব্যাপ্তি কিরূপ, উহাদের মূলতত্ত্বটি কি, এবং উহাদের মধ্যে কোন দুইটী পরস্পরবিরোধী ধর্ম একই সময়ে আসিয়া পড়িলে, কোন মাৰ্গ স্বীকার করা যাইবে, ইত্যাদি প্রশ্নের “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ”, কিংবা “অতি সর্বত্ৰ বৰ্জয়েৎ” এইরূপ সাধারণ যুক্তির দ্বারা নিষ্পত্তি হইতে পারে না । এই সকল প্রশ্নের উচিত নির্ণয় কি প্রকারে হয় এবং শ্রেয়স্কর মার্গ কোনটি তাহা স্থির করিবার জন্য নির্ভুল যুক্তি কি, তাহা এক্ষণে দেখিতে হইবে; অর্থাৎ জানা চাই যে, পরস্পরবিরুদ্ধ ধর্মসমূহের লাঘব ও গৌরব, ন্যূনাধিক মহত্ব কোন দৃষ্টিতে নির্ধারণ করা যাইতে পারে । অন্য শাস্ত্রীয় প্ৰতিপাদন অনুসারে কর্মাকর্মবিচার সম্বন্ধীয় প্ৰশ্নসমূহের মীমাংসা করিবার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই তিন মাৰ্গ আছে । এই মাৰ্গত্ৰয়ের ভেদ কি, তাহা পূর্বপ্রকরণে বলিয়াছি । আমাদের শাস্ত্ৰকর্তাদিগের মতে, এই সকলের মধ্যে আধ্যাত্মিক মাৰ্গই শ্রেষ্ঠ । কিন্তু অধ্যাত্মমার্গের মহত্ত্ব পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে অন্য দুই মার্গেরও বিচার করা আবশ্যক, তাই প্ৰথমে এই প্রকরণে কর্মাকর্ম পরীক্ষণের আধিভৌতিক মূলতত্ত্বের চর্চা করা হইয়াছে । 


2) আধিভৌতিক মার্গ


যে আধিভৌতিক শাস্ত্রের আজকাল অনেক উন্নতি হইয়াছে তাহাতে ব্যক্ত পদার্থসমূহের বাহ্য ও দৃশ্য গুণেরই বিচার বিশেষভাবে করা হয় । এইজন্য আধিভৌতিক শাস্ত্ৰাদির অধ্যয়নে যাহার জীবন কাটিয়া গিয়াছে, এবং এই সকল শ্বাস্ত্রের বিচারপদ্ধতি সম্বন্ধে যাহাদের অভিমান আছে, তাহারা বাহ্য পরিণামের বিচারেই অভ্যস্ত হইয়া পড়েন । তাহার পরিণামে তাহাদের তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিও অল্পবিস্তর সঙ্কুচিত হয় এবং তাহারা কোন বিষয়ের বিচার করিবার সময় আধ্যাত্মিক, পারলৌকিক, অব্যক্ত বা অদৃশ্য কারণসমূহের বিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না । কিন্তু যদিও তাহারা এইরূপ কারণে আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক দৃষ্টি পরিহার করেন, তথাপি তাহাদের ইহা মানিতে হয় যে, মনুষ্যদিগের সাংসারিক ব্যবহার সুচারুরূপে পরিচালিত করিবার এবং লোকসংগ্ৰহ করিবার জন্য নীতিনিয়মের অত্যন্ত প্রয়োজন আছে । আমি দেখিতেছি যে, পরলোক সম্বন্ধে যাহাদিগের অনাস্থা আছে কিংবা অব্যক্ত অধ্যাত্মজ্ঞানের উপর (অর্থাৎ পরমেশ্বরেতেও) যাহাদের বিশ্বাস নাই, এইরূপ পাশ্চাত্যদেশের পণ্ডিতেরাও কর্মযোগশাস্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্ব উপলব্ধি করেন । এই সকল পণ্ডিত পাশ্চাত্যদেশে এই সম্বন্ধে অনেক তর্কবিতর্ক করিয়াছেন এবং এখনও এই তর্কবিতর্ক চলিতেছে যে, কেবল আধিভৌতিক শাস্ত্ররীতি অনুসারে অর্থাৎ নিছক ঐহিক প্রত্যক্ষ যুক্তিবাদ অনুসারেই কর্মাকর্মশাস্ত্রের উপপত্তি দেখানো যাইতে পারে কি না । এই তর্কবিতর্কের ফলে ঐ সকল পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন যে, নীতিশাস্ত্রের বিচার করিবার জন্য আধ্যাত্মশাস্ত্রের কোনই প্ৰয়োজন নাই । 

কোন কর্মের ভালমন্দ উক্ত কর্মের আমাদের প্রত্যক্ষ বাহ্য পরিণাম হইতেই করা আবশ্যক; এবং এইভাবে করাও হয় । কারণ, মনুষ্য, যে যে কর্ম করে তাহা সমস্তই সুখের জন্য কিংবা দুঃখ নিবারণার্থই করিয়া থাকে । অধিক কি, ‘সকল মনুষ্যের সুখ’ই ঐহিক পরমসাধ্য বিষয়; এবং যদি সকল কর্মের শেষ দৃশ্যফল এই প্রকার নিশ্চিত হয়, তবে সুখপ্ৰাপ্তির কিংবা দুঃখনিবারণের তারতম্য অর্থাৎ লাঘবগৌরব দেখিয়া সকল কর্মের নীতিমত্ত নির্ধারণ করা নীতিনির্ণয়ের প্রকৃত মার্গ । যে গরু ক্ষুদ্ৰশৃঙ্গী ও শান্ত কিন্তু অধিক পরিমাণে দুধ দেয় সেই গরু যেমন ভাল বলা যায়, সেইরূপ যদি ব্যবহারে কোন বিষয়ের ভালমন্দ বাহ্য উপযোগের হিসাবেই স্থির করা যায়, তবে ঐ নীতি অনুসারেই যে কর্ম হইতে সুখপ্ৰাপ্তি দুঃখনিবারণাত্মক বাহ্য ফল অধিক, তাহাই নীতিদৃষ্টিতেও শ্ৰেয়স্কর বুঝিতে হইবে । আমরা যখন কেবল বাহ্য ও দৃশ্য পরিণামসমূহের লাঘবগৌরব দেখিয়া নীতিমত্তার নির্ণয় করিবার এই সরল ও শাস্ত্রীয় কষ্টিপাথর পাইলাম, তখন তাহার জন্য আত্ম-অনাত্ম বিচারের গভীর সাগরে প্রবেশ করিয়া “দ্রাবিড়ী প্ৰাণায়াম” করা উচিত নহে । “অর্কে চেন্মধু বিন্দেত কিমৰ্থং পর্বতং ব্ৰজেৎ” অর্থাৎ হাতের কাছে যদি মধু পাওয়া যায় তবে মধুর জন্য কিজন্য পর্বতে যাইবে ? (এই শ্লোকে ‘অর্ক’ শব্দের অর্থ তুলার বৃক্ষ এইরূপ কেহ কেহ করিয়া থাকেন । কিন্তু ব্রহ্মসূত্র ৩|৪|৩, উপরি-উক্ত শাঙ্কর ভাষ্যের টীকায় আনন্দগিরি ‘অর্ক’ এই শব্দের অর্থ ‘সমীপ’ এইরূপ করিয়াছেন । এই শ্লোকের দ্বিতীয় চরণ এই – “সিদ্ধস্যার্থস্য সংপ্রাপ্তৌ কে বিদ্বান্‌ যত্নমাচরেৎ” ।) কোন কর্মের কেবল বাহ্যফল দেখিয়া নীতি ও অনীতির নির্ণয়কারীর পক্ষকে আমি “আধিভৌতিক সুখবাদ” এই নাম দিয়াছি । কারণ, নীতিমত্তার নির্ণয়াৰ্থ এই মত অনুসারে যে সুখদুঃখের বিচার করা হয়, সে সমস্ত প্রত্যক্ষদৃষ্ট এবং কেবল বাহ্য অর্থাৎ বাহ্য পদার্থের ইন্দ্ৰিয়ের সহিত সংযোগ হইবার পর উৎপন্ন বা আধিভৌতিক । এবং এই পন্থাও সর্বজগতের কেবল আধিভৌতিক দৃষ্টিতে বিচারকারী পণ্ডিতেরাই প্রচার করিয়াছেন । 

এই মতবাদের সবিস্তার বিবরণ এই গ্রন্থে বলা অসম্ভব । ভিন্ন ভিন্ন গ্ৰন্থকারদিগের মতের সংক্ষিপ্তসার দিতে গেলেও একটা স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ লিখিতে হয় । তাই, ভগবদ্গীতান্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্রের স্বরূপ ও গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিবার নিমিত্ত নীতিশাস্ত্রের এই আধিভৌতিক মার্গের যতটা বিবরণ দেওয়া নিতান্ত আবশ্যক সেইটুকু স্থুল বিবরণই এই প্রকরণে সংক্ষেপে একত্র করিয়া আমি দিয়াছি । ইহা অপেক্ষা অধিক বিবরণ কাহারও জানিতে হইলে পাশ্চাত্য বিদ্বানদিগের মূল গ্ৰন্থ তাহার দেখা আবশ্যক ।

উপরে বলা হইয়াছে যে, আধিভৌতিকবাদী পরলোক সম্বন্ধে কিংবা আত্মবিদ্যা সম্বন্ধে উদাসীন; একথার ইহা তাৎপৰ্য নহে যে, এই মার্গের সকল বিদ্বানই স্বার্থসাধক আত্মম্ভরী কিংবা অনীতিমান্‌ । এই সকল লোকের পারলৌকিক দৃষ্টি যদি না থাকে তো নাই রহিল । ইহারা মনুষ্যের কর্তব্য বিষয়ে ইহাই বলেন যে প্রত্যেক মনুষ্যের স্বীয় ঐহিক দৃষ্টিকেই, যতদূর সন্তব, ব্যাপক করিয়া সমস্ত জগতের কল্যাণের নিমিত্ত চেষ্টা করাই কর্তব্য । আন্তরিক পূর্ণ উৎসাহের সহিত যাহারা এই ভাবের উপদেশ করিয়াছেন, সেই কোঁৎমিলস্পেন্‌সর প্রভৃতি সাত্ত্বিকবৃত্তির অনেক পণ্ডিতও এই মার্গে আছেন; এবং উহাদের গ্ৰন্থ অনেক প্রকারের উদাত্ত ও প্ৰগল্‌ভ বিচারের দ্বারা পূৰ্ণ হওয়ায় উহাদের গ্ৰন্থ সকলেরই পঠনীয় । যদিও কর্মযোগশাস্ত্রের পন্থা ভিন্ন, তথাপি যে পৰ্যন্ত জগতের কল্যাণ, এই বাহ্য সাধ্য উহা হইতে বাদ না পড়ে সে পৰ্যন্ত ভিন্ন রীতিতে নীতিশাস্ত্রের প্রতিপাদক কোনও মার্গ বা পন্থাকে উপহাস করা উচিত নহে । সে যাই হোক্‌; নৈতিক কর্মাকর্মের নির্ণয়াৰ্থ যে আধিভৌতিক বাহ্য সুখের বিচার করিতে হইবে, সে কাহার সুখ ? নিজের, না, পরের; একজনের, না, বহুলোকের ? এই সম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদীদিগের মধ্যে মতভেদ আছে । এক্ষণে সংক্ষেপে বিচার করিব যে নব্য ও প্রাচীন সমস্ত আধিভৗতিকীবাদীদিগকে মুখ্যত কতগুলি বর্গের অন্তৰ্ভুক্ত করা যাইতে পারে, এবং তাহাদের এই মার্গ কতদূর উচিত বা নির্দোষ ।


3) আধিভৌতিক সুখবাদের শ্রেণীবিভাগ



3.1) কেবল স্বার্থ (চার্বাক/জাবালি/কণিক)


তন্মধ্যে প্ৰথম বর্গটি নিছক স্বাৰ্থসুখবাদীদিগের । এই মার্গের বক্তব্য এই যে, পরলোক ও পরোপকার সমস্তই মিথ্যা, দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা শুধু নিজের উদর পূর্ণ করিবার জন্য আধ্যাত্মিক ধর্মশাস্ত্ৰ লিখিয়াছে, এই জগতে স্বার্থই একমাত্র সত্য, এবং, যে উপায়ে স্বার্থসিদ্ধি হইতে পারে অথবা যাহার দ্বারা নিজের আধিভৌতিক সুখের বৃদ্ধি হয়, তাহাই ন্যায্য, প্রশস্ত বা শ্রেয়স্কর বলিয়া বুঝিতে হইবে । আমাদের ভারতবর্ষে অতি প্ৰাচীনকালে চার্বাক উৎসাহ সহকারে এই মত প্রতিপাদন করিয়াছিলেন; এবং রামায়ণে অযোধ্যাকাণ্ডের শেষে, জাবালি রামকে যে কুটিল উপদেশ করিয়াছেন তাহা এবং মহাভারতে বর্ণিত কণিক নীতিও [মভা|আ|১৪২] এই মার্গেরই অন্তৰ্ভুত । চাৰ্বাকের মত এই যে, পঞ্চমহাভূত একত্র হইয়া তাহার মিশ্রণ হইতে আত্মারূপ এক গুণ উৎপন্ন হয় এবং দেহ দগ্ধ হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও দগ্ধ হইয়া যায়; তাই পণ্ডিতদিগের কর্তব্য এই যে, আত্ম-বিচারের গণ্ডগোলের মধ্যে না পড়িয়া শরীর যতদিন বাঁচিয়া থাকিবে ততদিন “ঋণ করিয়াও উৎসব করিবে” - ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ - কারণ মরিবার পর আর কিছুই থাকে না । চাৰ্বাক ভারতবর্ষে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া ঘৃতের উপরে তাঁহার লোভটি বেশি ছিল । নতুবা “খণং কৃত্বা সুরাং পিবেৎ” এইরূপ সূত্রটির রূপান্তর দেখা যাইত । কোথায় বা ধর্ম, কোথায় বা পরোপকার ! এজগতে যত পদার্থ পরমেশ্বর - শিব শিব ! ভুল হইয়াছে ! পরমেশ্বর আসিল কোথা হইতে ? - এই জগতে যে কিছু বস্তু আমি দেখিতেছি সে সমস্তই আমারই উপভোগের জন্য । সে সকলের অন্য কোন ব্যবহার দেখা যায় না, - নাই ই ! আমি মরিলেই জগৎ অন্তৰ্হিত হইল । তাই, যতদিন বাঁচি তত দিন আজ এটা, কাল ওটা, এইরূপ যাহা কিছু সমস্ত আমার আয়ত্ত করিয়া লইয়া আমার সমস্ত বাসনা কামনা আদি পরিতৃপ্ত করিব । আমি যদি তপস্যা করি কিংবা দান করি, সে সমস্তই আমার মহত্ব বৃদ্ধির জন্যই করিব । এবং আমি যদি রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করি, তা কেবল আমার অধিকাব সর্বত্র অবাধিত প্ৰদৰ্শন করিবার জন্যই করি । সারাংশ, — এই জগতের ‘আমি’ই একমাত্র কেন্দ্ৰ; ইহাই সমস্ত নীতিশাস্ত্ৰের রহস্য, বাকী সব মিথ্যা । “ঈশ্বরোহহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্‌ সুখী” [গী|১৬|১৪] আমিই ঈশ্বর, আমিই ভোগী, আর আমিই সিদ্ধ, আমিই বলবান্‌ ও সুখী - এই প্রকারের আসুরী মতাভিমানীদিগের বিষয় গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে । শ্ৰীকৃষ্ণের পরিবৰ্তে জাবালির ন্যায় এই মার্গের কোন ব্যক্তি অর্জুনের পাশে বসিয়া অর্জুনকে যদি উপদেশ দিতেন তাহা হইলে তিনি প্রথমেই অর্জুনকে মুখথাব্‌ড়া দিয়া বলিতেন — “ওরে তুই কি মুর্খ ! যুদ্ধে সকলকে জিতিয়া অনেক প্রকারের রাজভোগ ও বিলাস উপভোগের এই উত্তম সুযোগ পাইয়াও ইহা করিব কি উহা করিব” এইরূপ ব্যর্থ প্ৰলাপ কেন করিতেছিস্‌ ? এরূপ সুযোগ আর আসিবে না । কোথাকার আত্মা, আর কোথাকার আত্মকুটুম্বের জন্য বসে আছিস্‌ ! ভারী ভুল ! তুই হস্তিনাপুরের সাম্রাজ্য সুখে ও নিষ্কণ্টকে ভোগ কর্‌ ! ইহাতেই তোর পরম কল্যাণ । নিজের প্রত্যক্ষ ঐহিক সুখ ব্যতীত এই জগতে আর আছে কি ? কিন্তু অর্জুন এই জঘন্য স্বার্থসাধক ও নিছক্‌ আত্মম্ভৱী রাক্ষসী উপদেশ অপেক্ষা না করিয়া প্রথমেই শ্ৰীকৃষ্ণকে বলিয়া রাখিয়াছেন যে -
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন ৷অপি ত্ৰৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে ॥
“শুধু পৃথিবী কেন, সমস্ত ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যও (এ বড় বিষয়সুখ) যদি (এই যুদ্ধে) আমি পাই, তবু আমি কৌরবদিগকে বধ করিতে ইচ্ছা করি না । আমার যদি গল৷ কাটা যায় তাহাও স্বীকার ।” [গী|১|৩৪] । অর্জুন প্রথমেই যে আত্মমৎলবী নিছক্‌ স্বার্থপরায়ণ ও আধিভৌতিক সুখবাদের এই প্রকারে নিষেধ করিলেন, সেই আসুরী মতের কেবল উল্লেখ মাত্রেই তাহার খণ্ডন হয় বলা যাইতে পারে । লোকের যাই হৌক না কেন, কেবল আমার নিজের বিষয়েীপভোগসুখকেই পরম পুরুষাৰ্থ মনে করিয়া নীতি ও ধর্মবিসর্জনকারী আধিভৌতিকবাদীদিগের এই অত্যন্ত কনিষ্ঠ শ্রেণী, কর্মযোগশাস্ত্রসংক্রান্ত সমস্ত গ্ৰন্থকার এবং সাধারণ লোকেরও নিকটে এক্ষণে অত্যন্ত অনীতিমূলক, ত্যাজ্য ও গৰ্হিত বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে । অধিক কি, এই পন্থাটি নীতিশাস্ত্র কিংবা নীতিবিচার নামেরও যোগ্য নহে । তাই, এই সম্বন্ধে বেশী আলোচনা না করিয়া আধিভৌতিক সুখবাদীদিগের দ্বিতীয় বর্গের দিকে ফেরা যাক ।


3.2) দূরদর্শী স্বার্থ (হব্‌স/হেল্‌বেশিয়াস্‌)


সুস্পষ্ট নগ্ন স্বাৰ্থ বা আত্মোদর ভরণসর্বস্বতা জগতে চলে না । কারণ, আধিভৌতিক-বিষয়সুখ প্ৰত্যেকের অভীষ্ট হইলেও, নিজের সুখ অন্য লোকের সুখভোগের যখন অন্তরায় হয়, তখন অন্য লোকেরা আমার নিজের সুখের বিঘ্ন না জন্মাইয়া নিরস্ত হয় না, ইহা প্ৰত্যেক লোকই নিজের অভিজ্ঞতায় জানে । তাই, আর কতকগুলি আধিভৌতিক পণ্ডিত এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন যে, নিজের সুখ বা স্বার্থসাধন আমার সাধ্য হইলেও, অন্য লোকদিগকে নিজের মতো সাহায্য করা ব্যতীত নিজেরও সুখলাভ হইতে পারে না, তাই নিজের সুখের জন্য, দুরদৰ্শিতাসহকারে অন্যেরও সুখের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । এই আধিভৌতিকবাদীদিগকে আমি অন্য বর্গের অন্তভুর্ক্ত বলিয়া গণনা করি । কিন্তু নীতির আধিভৌতিক উপপত্তির প্রকৃত আরম্ভ এইখান হইতেই হয় বলিলেও চলে । কারণ ইহারা চার্বাকের ন্যায় সমাজ-বিধরণের জন্য নীতির বন্ধন নিষ্প্রয়োজন, সে কথা বলেন না; কিন্তু ঐ সমস্ত নীতি কেন পালন করা আবশ্যক, ইহারা স্বীয় বিচারদৃষ্টিতে তাহার কারণ উল্লেখ করিয়াছেন । ইহারা বলেন যে, জগতে অহিংসাধর্ম কিরূপে উৎপন্ন হইল কিংবা লোকেরা তাহা কেন পালন করে তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিলে, “আমি অন্যকে মারিলে অন্যেরাও আমাকে মারিবে ও পরে আমার সুখ চলিয়া যাইবে ।” এই স্বাৰ্থমূলক ভয় ব্যতীত তাহার অন্য কোন গভীর কারণ নাই, এইরূপ দেখা যায় । অহিংসাধর্মের ন্যায় অন্য সমস্ত ধর্মই এই প্রকার স্বাৰ্থমূলক কারণেই প্রচলিত হইয়াছে । আমার দুঃখ হইলে আমি কাঁদি এবং অন্যের দুঃখে আমাদের দয়া হয় কেন ? আমারও কখনো ঐরূপ অবস্থা হইতে পারে এই ভীতি, সুতরাং নিজের ভাবী দুঃখ, মনে আইসে - এই কারণেই কি নহে ? পরোপকার, ঔদার্য, দয়া, মায়া, কৃতজ্ঞতা, নম্রতা, মৈত্রী প্রভৃতি যে সকল গুণ প্ৰথম দৃষ্টিতেই লোকের সুখের নিমিত্ত আবশ্যক বলিয়া মনে হয়, সে সমস্তই মূলত দেখিতে গেলে, আমার নিজেরই সুখের জন্য কিংবা নিজেরই দুঃখনিবারণের জন্য । কেহ কাহাকে সাহায্য করে বা দান করে - কেন ? ইহাই, কি তাহার কারণ নহে যে, আমার নিজের সঙ্কট উপস্থিত হইলে অন্য লোকেও আমাকে সাহায্য করিবে ? আমার উপর লোকেরা দয়া করিবে বলিয়া আমিও তাহাদের উপর দয়া করি । নিদানপক্ষে, লোকেরা ভাল বলিবে, অন্তত এই স্বাৰ্থমূলক হেতুটিও আমাদের মনের মধ্যে নিহিত থাকে । পরোপকার ও পরার্থ এই দুই শব্দ নিছক ভ্ৰান্তিমূলক । একমাত্র স্বার্থই সত্য; এবং স্বাৰ্থ অর্থে নিজের সুখলাভ কিংবা দুঃখনিবারণ । মাতা সন্তানকে স্তন্য দেন, তাহার কারণ মাতার প্রেম নহে; ইহার প্রকৃত কারণ এই মে, মাতার স্তনের স্ফীতি তাহাকে কষ্ট দেয়া বলিয়া সেই কষ্ট নিবারণের জন্য, কিংবা পরে সন্তানেরা তাহার প্রতি মমতা করিয়া তাহাকে সুখ দিবে এই স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্যই সে এই স্বার্থসাধক উপায় অবলম্বন করিয়া থাকে, - প্রেম বাৎসল্যাদির ইহাই মূল কারণ ! দ্বিতীয় বর্গের আধিভৌতিকবাদী স্বীকার করেন যে, আমার নিজের সুখের জন্য যাহাই হউক না, কিন্তু ভবিষ্যতের উপর দৃষ্টি রাখিয়া এমন নীতিধর্ম পালন করা উচিত, যাহাতে অন্যেরও সুখ হইতে পারে - বস্, এইখানেই এই মতের সহিত চার্বাকমতের প্ৰভেদ । তথাপি চার্বাকমত-অনুসারে এই মতেও স্বীকার করা হয় যে, মনুষ্য নিছক বিষয়সুখরূপ স্বার্থের ছাঁচে ঢালা এক পুতুল । ইংলণ্ডে হব্‌স্‌ এবং ফ্রান্সে হেল্‌বেশিয়াস্‌ এই মত প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । কিন্তু এই মতের অনুগামী এক্ষণে না ইংলণ্ডে না অন্যত্র বেশী পাওয়া যায় । হব্‌সের নীতিধর্মের এই উপপত্তি বহুলপ্রচার হইলে পর বট্‌লরের ন্যায় বিদ্বানেরা উহার খণ্ডন করিয়া সপ্রমাণ করিলেন যে, মানবস্বভাব নিছক স্বার্থপর নহে; স্বার্থের ন্যায় ভূতদয়া, প্ৰেম, কৃতজ্ঞতা প্রভৃতি সদ্‌গুণও ন্যূনাধিক পরিমাণে মনুষ্যের মধ্যে জন্ম হইতেই নিহিত থাকে । (হব্‌সের মত তাহার Leviathan গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে; এবং বট্‌লরের মত তাহার Sermons on Human nature এই প্রবন্ধে বিবৃত হইয়াছে । হেল্‌বেশিয়সের পুস্তকের সারাংশ, মর্‌লি স্বীয় Diderot বিষয়ক গ্রন্থে দিয়াছেন, Vol II, Chap. V.)


3.2.1) স্বার্থ-বুদ্ধির ন্যায়ই পরোপকারবুদ্ধিও স্বাভাবিক


এই নিমিত্ত, কোন ব্যবহার বা কর্মের নৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করিবার সময়, কেবল স্বার্থের দিকে কিংবা দূরদর্শী স্বার্থের দিকেই না দেখিয়া, স্বার্থ ও পরার্থ মানবস্বভাবের এই দুই নৈসর্গিক প্রবৃত্তির দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা অবশ্যক । বাঘিনীর ন্যায় ক্রূর জানোয়ার পর্যন্ত আপন বাচ্ছাদের রক্ষণার্থ যখন প্ৰাণ দিতে প্ৰস্তুত থাকে, তখন সকল মনুষ্যের মধ্যে প্রেম ও পরোপকারবুদ্ধি নিছক স্বাৰ্থ হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে এরূপ বলিতে পারি না । ইহা হইতে  সিদ্ধ হইতেছে যে, কেবল দূরদর্শী স্বাৰ্থ বুদ্ধিতেই ধর্মাধর্মের পরীক্ষা করা শাস্ত্ৰদৃষ্টিতেও উচিত নহে । কেবল সংসারেতেই আসক্ত থাকায় যাহাদের বুদ্ধি পরিশুদ্ধ হয় নাই এইরূপ মনুষ্য এ জগতে অন্যের জন্য যাহা কিছু করে তাহা অনেক সময় নিজের হিতের জন্যই করিয়া থাকে, এই কথা আমাদের প্রাচীন পণ্ডিতদিগেরও মনে আসিয়াছিল । মহারাষ্ট্রে তুকারাম বড় ভগবদ্ভক্ত ছিলেন । “শাশুড়ীর তরে কাঁদে বৌ, কিন্তু মনের ভাব ভিন্ন রূপ” [গা|২৫৮|৩|২] এইরূপ তুকারাম বলিয়াছেন । অনেক পণ্ডিত হেল্‌বেশিয়স্‌কেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন । উদাহরণ যথা -

মনুষ্যের সমস্ত স্বার্থ ও পরার্থপ্রবৃত্তিই দোষময় হইয়া থাকে - প্ৰবর্তনালক্ষণা দোষাঃ - এই গৌতম-ন্যায়সূত্রের [১০|১|১৮] বনিয়াদে ব্ৰহ্মসূত্ৰভাষ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্য যাহা কিছু বলিয়াছেন [বে|সূ|শাং-ভা|২|২|৩], তাহার উপর টীকা করিবার সময় আনন্দগিরি লিখিয়াছেন যে, “আমার হৃদয়ে কারুণ্যবৃত্তি জাগ্ৰত হইলে, তাহা হইতে আমাদের যে দুঃখ হয় তাহা দূর করিবার জন্য আমরা লোকের উপর দয়া কিংবা পরোপকার করিয়া থাকি ।” আনন্দগিরির এই যুক্তি প্রায় সমস্ত সন্ন্যাসমার্গীর গ্রন্থে প্রাপ্ত হওয়া যায় । উহার দ্বারা মুখ্যরূপে ইহাই সিদ্ধ করিবার চেষ্টা দেখা যায় যে, সব কর্মই স্বার্থপর অতএব ত্যাজ্য । 


3.2.2) যাজ্ঞবল্ক্যের আত্মার্থ


কিন্তু বৃহদারণ্যক উপনিষদে, যাজ্ঞবল্ক্য ও তাঁহার স্ত্রী মৈত্ৰেয়ী ইঁহাদের যে কথোপকথন দুই স্থানে আছে [বৃ|২|৪; ৪|৫], তাহাতে আর এক চমৎকার রীতিতে এই যুক্তিবাদের উপযোগ করা হইয়াছে । “আমার অমৃতত্ত্ব কিসে লাভ হইবে ?” মৈত্রেয়ীর এই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহাকে বলিলেন যে, “মৈত্ৰেীয়ী ! স্ত্রী স্বামীকে যে ভালবাসে তাহা স্বামীর জন্য নহে; - আত্মপ্ৰীত্যৰ্থই ভালবাসে । সেইরূপ পুত্ৰকে পুত্ৰ বলিয়া আমরা ভালবাসি না, আমার নিজের জন্য পুত্রকে ভালবাসি । ধনসম্পত্তি, পশু ও অন্য সমস্ত পদার্থেই এই নীতি প্ৰযুক্ত হইতে পারে । ‘আত্মনস্তু কামায় সৰ্ব্বং প্ৰিয়ং ভবতি’ - আত্মপ্রীত্যৰ্থ সমস্ত পদার্থ আমাদের প্রিয় হইয়া থাকে । এবং সমস্ত প্ৰেমই যদি এইরূপ আত্মমূলক হয়, তবে আত্মাকে (আমি) প্ৰথমে চেনা আবশ্যক নহে কি ?” এইরূপ বলিয়া শেষে যাজ্ঞবল্ক্য উপদেশ দিলেন – ‘আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ’ - “আত্মা কে (প্ৰথমে) তাহা দেখ, শোনো, এবং তাঁহার মনন ও ধ্যান কর” । এই উপদেশ অনুসারে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ একবার জানিতে পারিলে তাহার পর সমস্ত জগতই আত্মময় দৃষ্ট হয়, এবং স্বার্থ ও পরার্থের ভেদও মন হইতে বিলুপ্ত হয় । যাজ্ঞবল্কোর এই যুক্তিবাদ আপাতত হব্‌সের অনুরূপ বলিয়া মনে হয়; কিন্তু ইহা জানা কথা যে, এই উভয় হইতে উপপন্ন সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরুদ্ধ । 
(“What say you of natural affection ? Is that also a species of self-love ? Yes; All is self-love. Your children are loved only because they are yours. Your friend for a like reason. And Your country engages you only so far as it has a connection with Your-self.” হিউমও স্বকীয় “of the Dignity or Meannness of Human nature” নামক প্রবন্ধে এই যুক্তির উল্লেখ করিয়াছেন । হিউমের নিজের মত ইহা হইতে ভিন্ন ।)

হব্‌স্‌ স্বার্থকেই প্ৰাধান্য দেন এবং সমস্ত পরার্থকে দূরদর্শী স্বার্থেরই এক আকার ভাবিয়া বলেন যে, স্বাৰ্থ ব্যতীত এই জগতে আর কিছু নাই । যাজ্ঞবল্ক্য ‘স্বাৰ্থ’ এই শব্দান্তর্ভূত ‘স্ব’ (আপনি) এই পদের বনিয়াদে দেখাইয়াছেন যে, অধ্যাত্মদৃষ্টিতে আমার এক আত্মাতেই সমস্ত ভূতের ও সমস্ত ভূতেতেই আমার আত্মার অবিরোধে কিরূপে সমাবেশ হয় । ইহা দেখাইয়া স্বার্থ ও পরার্থ এই উভরের মধ্যে অবভাসমান দ্বৈতের বিরোধও ভাঙ্গিয়া দিলেন । যাজ্ঞবল্ক্যের উক্ত মত এবং সন্ন্যাসমাৰ্গ সম্বন্ধে পরে আরও বিচার করা যাইবে । “সাধারণ মনুষ্যের প্রবৃত্তি স্বার্থপর অর্থাৎ আত্মসুখপর হইয়া থাকে ।” এই একই বিষয়ের ন্যূনাধিক গৌরব প্ৰদান করিয়া কিংবা উহাকে সর্বথা অপবাদরহিত বা অব্যভিচারী স্বীকার করিয়া আমাদের প্রাচীন গ্ৰন্থকারেরা উহা হইতেই হব্‌সের বিপরীত অন্য সিদ্ধান্ত কিরূপে বাহির করিয়াছেন তাহা দেখাইবার জন্যই এইস্থানে যাজ্ঞবল্ক্যাদির উল্লেখ করিয়াছি ।


3.3) উদাত্ত / জ্ঞানদীপ্ত / উচ্চ স্বার্থ (স্বার্থ-পরার্থ-উভয় বাদ)


একথা যখন সিদ্ধ হইল যে, ইংরেজ গ্ৰন্থকার হব্‌স্‌, ও ফরাসী পণ্ডিত হেল্‌ভেশিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুসারে মনুষ্যস্বভাব নিছক স্বার্থপর অর্থাৎ তমোগুণী রাক্ষসী নহে; কিন্তু স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে পরোপকার-বুদ্ধিরূপ সাত্ত্বিক মনোবৃত্তিও মনুষ্যের অন্তরে জন্ম হইতেই নিহিত থাকে; অর্থাৎ যখন ইহা স্থির হইল যে, পরোপকার শুধু দূরদর্শী স্বাৰ্থ নহে, তখন স্বাৰ্থ অর্থাৎ স্ব-সুখ এবং পরার্থ অর্থাৎ অন্যের সুখ এই দুই তত্ত্বের উপরে সমান দৃষ্টি রাখিয়া কার্যাকাৰ্যব্যবস্থিতিশাস্ত্রের রচনা করিবার প্রয়োজন প্ৰতীত হইতেছে । ইহাই আধিভৌতিকবাদীদিগের তৃতীয় বর্গ । তথাপি কি স্বাৰ্থ কি পরার্থ, উভয়ই ঐহিক সুখবাচক, ঐহিক সুখের ওদিকে আর কিছুই নাই, এই আধিভৌতিক মত এই পক্ষেও অক্ষুন্ন রহিয়াছে । এইটুকু প্ৰভেদ যে, এই পন্থার লোকেরা স্বাৰ্থ বুদ্ধির ন্যায় পরার্থ বুদ্ধিকেও নৈসৰ্গিক স্বীকার করিয়া বলেন যে, নীতির বিচার করিবার সমস্ত স্বার্থের ন্যায় পরার্থকেও আমাদের দেখা কর্তব্য । সাধারণতঃ স্বার্থ ও পরার্থ ইহাদের মধ্যে বিরোধ উৎপন্ন হয় না, তাই মনুষ্য যে কোন কর্ম করে তাহা প্রায়ই সমাজের হিতকর হয় । একজন ধন সঞ্চয় করিলে তাহাতে সমস্ত সমাজেরও হিত সাধিত হয়; কারণ সমাজ অর্থে অনেক ব্যক্তির সমূহ এবং যদি ঐ সমাজের প্ৰত্যেক ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি না করিয়া আপনাপন লাভ করে, তাহাতে সমাজের কল্যাণই হয় । এইজন্য এই মার্গের লোকেরা স্থির করিয়াছেন যে নিজের সুখের প্রতি দুৰ্লক্ষ্য না করিয়া যদি কেহ লোকের হিতসাধন করিতে পারে তাহাই তাহার কর্তব্য । কিন্তু এই পক্ষের লোক পরার্থের শ্ৰেষ্ঠত্ব স্বীকার করেন না, এবং বলেন যে, সকল সময়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে, স্বার্থ শ্রেষ্ঠ কি পরার্থ শ্রেষ্ঠ ইহার বিচার করিবে । ইহার পরিণাম এই হয় যে, যখন স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন অনেকে লোকের সুখের জন্য নিজের সুখ কতটা বিসর্জন করিবে ইহার নির্ণয়ে গোলযোগ পড়িয়া অনেক সময় স্বার্থেরই দিকে বেশী ঝুঁকীয়া পড়ে । উদাহরণ যথা, - স্বার্থ ও পরার্থ দুই-ই সমান প্ৰবল বলিয়া মানিলে সত্যের জন্য প্ৰাণ দেওয়া কিংবা রাজ্য হারানো দুরের কথা, ধনের ক্ষতি অধিক হইলেও উহা সহ্য করিবে কিনা, ইহা এই মার্গের মতানুসারে নির্ণয় হয় না । কোন উদারচিত্ত ব্যক্তি পরার্থের জন্য নিজের প্রাণ দিলে, এই মাৰ্গাবলম্বী লোক কদাচিৎ তাহার প্রশংসা করিবে । কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ঐরূপ প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইলে, স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই নৌকায় যে সকল পণ্ডিত সর্বদাই পা দেন তাহারা স্বার্থের দিকেই যে অধিক ঝুঁকিবেন তাহা আর বলিতে হইবে না । হব্‌সের ন্যায় ইহারা পরার্থকে স্বার্থেরই দূরদর্শী প্ৰকারভেদ বলিয়া মানেন না; কিন্তু ইহা মনে করেন যে, স্বার্থ ও পরার্থ উভয়কে তৌলে স্থাপন পূর্বক উহাদের তারতম্য অর্থাৎ ন্যূনাধিক্য বিচার করিয়া খুব চতুরতার সহিত তাহারা নিজের নিজের স্বার্থের নির্ণয় করিয়া থাকেন; এইজন্য এই পন্থার লোকেরা আপন মাৰ্গকে “উদাত্ত” বা “উচ্চ” বা “জ্ঞানদীপ্ত স্বাৰ্থ” (কিন্তু স্বাৰ্থ বটে) নাম দিয়া তাহারই মাহাত্ম্য কীর্তন করিয়া থাকেন । (ইংরাজীতে ইহাকে Enlightened self-interest বলে ।) কিন্তু ভর্তৃহরি কি বলিতেছেন দেখ -
একে সৎপুরুষাঃ পরার্থঘটকাঃ স্বাৰ্থান্‌ পরিত্যজ্য যে
সামান্যাস্তু পরার্থমুদ্যমবতঃ স্বাৰ্থাহবিরোধেন যে ৷
তেহমী মানবরাক্ষসাঃ পরহিতং স্বার্থায় নিঘ্নন্তি যে
যে তু ঘ্নন্তি নিরর্থকং পরহিতং তে কে ন জানমহে ॥
“নিজের লাভ ছাড়িয়া দিয়া যাঁহারা লোকের কল্যাণ করিয়া থাকেন তাঁহারাই প্ৰকৃত সৎপুরুষ; স্বাৰ্থ না ছাড়িয়া লোকের হিতের জন্য যাহার চেষ্টা করিয়া থাকেন তাহারা সাধারণ পুরুষ; এবং নিজের লাভের জন্য লোকের ক্ষতি যাহারা করে তাহারা মনুষ্য নহে, তাহারা রাক্ষস; কিন্তু ইহাদের পরেও, যাহারা নিরর্থক লোকহিত নষ্ট করে, তাহাদের কি নাম দিব তাহা জানি না” [নী|শ|৭৪] । রাজধর্মের উত্তম অবস্থা বৰ্ণনা করিতে গিয়া কালিদাসও বলিয়াছেন -
স্বসুখনির ভিলাষীঃ খিাদ্যসে লোকহেতোঃ ৷
প্রতিদিনমথবা তে বৃত্তিরে বন্বিধৈব ॥
“নিজ সুখের অভিলাষ না করিয়া তুমি প্ৰতিদিন লোকহিতের জন্য কষ্ট করিয়া থাক । অথবা তোমার বৃত্তি বা ব্যবসায়ই এইরূপ” [শকুং|৫|৭] । ভর্তৃহরি কিংবা কালিদাস দেখেন নাই যে, কর্মযোগশাস্ত্ৰে স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই তত্ত্বই স্বীকার করিয়া উহাদের তারতম্যের দ্বারা ধর্মাধর্মের বা কর্মাকর্মের নিৰ্ণয় কেমন করিয়া করিতে হইবে, তথাপি পরার্থের জন্য যাহারা স্বাৰ্থ ত্যাগ করেন সেই সব পুরুষকে তাঁহারা যে প্রথম স্থান দিয়াছেন, তাহা নীতিদৃষ্টিতেও ন্যায্য । এই মার্গের লোকেরা এই সম্বন্ধে বলেন যে, “তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে পরার্থ শ্রেষ্ঠ হইলেও সনাতন বিশুদ্ধ নীতি কি, তাহা না দেখিয়া, সাধারণ ব্যবহারে ‘সামান্য’ মনুষ্য কি ভাবে কাজ করিবে তাহাই স্থির করিতে হইবে; এবং সেই কারণে জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থকে আমরা যে অগ্ৰস্থান দিই তাহাই ব্যবহারদৃষ্টিতে সমুচিত ।” (Sidgwick's Methods of Ethics, Book I. Chap. II. $ 2, pp 18-29; also Book IV. Chap. IV, $ 3, p 474. এই তৃতীয় পন্থা Sidgwick বাহির করিয়াছেন এরূপ নহে; কিন্তু সাধারণ সুশিক্ষিত ইংরেজ লোক প্রায় এই পন্থারই অনুগামী; ইহার Common sense morality এইরূপ নামও আছে ।)


আপত্তি

কিন্তু আমাদের মতে এই যুক্তিবাদে কোন লাভ নাই । বাজারে ব্যবহৃত ওজন মাপে সর্বদাই কিছু কমি বেশী হইয়া থাকে; বস্‌ - এই কারণে যদি রাজদরবারে সকলের প্রমাণভূত বলিয়া নির্ধারিত ওজনমাপেও ন্যূনাধিক্য রাখা হয়, তবে কি আমরা সেই সম্বন্ধে অধিকারীদিগের উপর দোষারোপ করি না ? কর্মযোগশাস্ত্ৰেও এই নীতি প্ৰযুক্ত হইতে পারে । নীতিধর্মের পূর্ণ, শুদ্ধ ও, নিত্য স্বরূপ কি, - ইহার শাস্ত্রীয় নির্ণয় সম্পাদনার্থই নীতিশাস্ত্ৰ প্ৰবর্তিত হইয়াছে; এবং এই কাজ নীতিশাস্ত্ৰ যদি না করে তবে নীতিশাস্ত্ৰ নিষ্ফল বলিতে হইবে । ‘জ্ঞানালোকিত স্বাৰ্থ’ সাধারণ মনুষ্যের মার্গ – সিজ্‌বিক্‌ যে ইহা বলেন, তাহা কিছু মিথ্যা নহে । ভর্তৃহরিও তাহাই বলেন । কিন্তু এই সাধারণ লোকদিগেরই পরাকাষ্ঠা-নীতিমত্তা সম্বন্ধে কিরূপ মত তাহা যদি অনুসন্ধান করা যায়, তাহা হইলে দেখা যাইবে যে, সিজ্‌বিক্‌ “জ্ঞানদীপ্ত উচ্চ স্বাৰ্থে” যে মহত্ত্ব আরোপ করিয়াছেন তাহা ভ্ৰান্তিমূলক; কারণ সাধারণ লোকেরও ধারণা এই যে, নিষ্কলঙ্ক নীতির মাৰ্গ কিংবা সৎপুরুষদিগের অনুসৃত আচরণের মাৰ্গ - ইহা সাধারণ স্বোদর-পূরণ মার্গ হইতে শ্রেয়স্কর । উপরি-উক্ত শ্লোকে ভর্তৃহরি ইহাই বিবৃত করিয়াছেন ।


3.4) অধিক লোকের অধিক সুখ - পরার্থপ্রধান মাৰ্গ


আধিভৌতিক সুখবাদের নিছক স্বাৰ্থী, দূরদর্শী স্বার্থী ও উভয়বাদী বা জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থী, - এই যে তিন মাৰ্গ আছে, সেই তিন মাৰ্গ সম্বন্ধে এতক্ষণ পৰ্যন্ত বিচার করিয়া তাহাদের মুখ্য দোষগুলি কি তাহা বলিয়াছি । কিন্তু ইহাতেও সমস্ত আধিভৌতিক মাৰ্গ শেষ হয় নাই । সাত্ত্বিক আধিভৌতিক পণ্ডিতৈরা প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, সমস্ত আধিভৌতিক মার্গের মধ্যে “একই মনুষ্যের সুখের দিকে লক্ষ্য না করিয়া, সমস্ত মনুষ্যেরই আধিভৌতিক সুখদুঃখের তারতম্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়া নৈতিক কার্যাকাৰ্যের নির্ণয় করা অবশ্যক” । এইরূপ মাৰ্গই শ্রেষ্ঠতম মাৰ্গ । (বেন্থামমিল প্রভৃতি পণ্ডিত এই মার্গের অগ্রণী । Greatest good of the greatest number, ইহার অনুবাদ করিয়াছি – “অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ” ।) একই কাৰ্যে একই সময়ে সমাজের কিংবা জগতের অন্তৰ্গত সমস্ত ব্যক্তির সুখ হইতে পারে না । একজন যাহা সুখ বলিয়া মনে করে, অন্যের নিকট তাহাই দুঃখজনক । কিন্তু পেচকের আলোক ভাল লাগে না বলিয়া আলোক ত্যাজ্য এরূপ কেহ বলে না, সেইরূপ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের কোন কথা লাভজনক মনে না হইলেও তাহা যে সকলের পক্ষেই হিতাবহ নহে - একথা কর্মযোগশাস্ত্ৰও বলিতে পারে না ! এবং এই কারণেই “সকল লোকের সুখ” এই শব্দগুলির “অধিক লোকের অধিক সুখ” - এই অৰ্থও করিতে হয় । সারকথা, - “যাহাতে অধিক লোকের অধিক সুখ হয় – তাহাই নীতিদৃষ্টিতে ন্যায্য ও গ্রাহ্য বলিয়া বুঝিতে হইবে” - এই মার্গের এইরূপ  মত । 

আধিভৌতিক সুখবাদের এই তত্ত্ব আধ্যাত্মিক মাৰ্গও স্বীকার করিয়া থাকে । অধিক কি, এই তত্ত্ব আধ্যাত্মিকবাদীরা অতি প্ৰাচীনকালে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন; প্ৰভেদ এইটুকু যে, আধিভৌতিকবাদীরা এক্ষণে একটা বিশেষ রীতিতে উহার উপযোগ করিয়াছে মাত্র । তুকারামের কথা অনুসারে “জগতের কল্যাণেরই জন্য সাধুদিগের বিভূতি । পরোপকারের জন্য তাঁহারা দেহকে কষ্ট দেন ।” ইহা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হয় না । সুতরাং এই তত্ত্বের সত্যতা সম্বন্ধে কিংবা ঔচিত্য সম্বন্ধে কোন বিরোধই নাই । স্বয়ং ভগবদ্গীতাতেও পূর্ণ যোগযুক্ত অর্থাৎ কর্মযোগযুক্ত জ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ বলিবার সময় “সর্বভূতহিতে রূতাঃ” অর্থাৎ সর্বভূতের কল্যাণ সাধনেই তাঁহারা নিমগ্ন, এইরূপ দুইবার স্পষ্টরূপে কথিত হইয়াছে [গী|৫|২৫; ১২|৪] । ধর্মাধর্মের নির্ণয়ার্থেও আমাদিগের শাস্ত্রকার যে এই তত্ত্বের প্রতি সর্বদাই লক্ষ্য রাখেন তাহা দ্বিতীয় প্রকরণে প্রদত্ত “যদ্‌ভূতহিত্যমত্যন্তং তৎ সত্যমিতি ধারণা” এই মহাভারতের বচনে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের উক্তি অনুসারে, “সর্বভূতহিত”কে জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের আচরণের বাহ্য লক্ষণ স্থির করিয়া ধর্মাধর্ম নির্ণয়াৰ্থ প্ৰসঙ্গ বিশেষে স্থুলভাবে উহার উপযোগ করা এক কথা; এবং উহাকে নীতিমত্তার সর্বস্ব মনে করিয়া অন্য কোন বিষয়ের বিচার না করিয়া, কেবল এই ভিত্তির উপরেই নীতিশাস্ত্রের সমস্ত ইমারত খাড়া করা পৃথক কথা । এই উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য । আধিভৌতিক পণ্ডিত অন্য মার্গ স্বীকার করিয়া প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন যে, অধ্যাত্মবিদ্যার সহিত নীতিশাস্ত্রের কোন সম্বন্ধ নাই । তাই, তাহার এই কথা কতটা যুক্তিসংগত তাহা আমাদিগের এখন দেখিতে হইবে । ‘সুখ’ ও ‘হিত’ এই দুই শব্দের অর্থে খুবই ভেদ আছে; কিন্তু আপাতত ঐ ভেদ যদি একপাশে সরাইয়া রাখা হয় এবং ‘সর্বভূতহিত’ অর্থে “অধিক লোকের অধিক সুখ” ধরিয়াই কাজ চালানো হয়, তথাপি, কার্যাকাৰ্যনির্ণয়ের কাজে কেবল এই তত্ত্বেরই উপযোগ করিলে দেখা যায় যে, অনেক,গুরুতর বাধাবিঘ্ন উৎপন্ন হইয়া থাকে । মনে কর, এই তত্ত্বের কোন অধিভৌতিক উপদেষ্টা অর্জুনকে উপদেশ দিতে গেছেন; তিনি তাঁহাকে কি উপদেশ দিতেন ? ইহাই না কি যে, ভারতীয় যুদ্ধে তোমাদেয় জয়লাভ হইলে, যদি অধিক লোকের অধিক সুখ হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবেই ভীষ্মকে বধ করিয়াও যুদ্ধ করা তোমার কর্তব্য” ? 


আপত্তি-১ : কেবল সংখ্যাধিক্য দ্বারা নীতি নির্ধারণ

বাহ্যদৃষ্টিতে এই উপদেশ অত্যন্ত সহজ ও সরল বলিয়া মনে হয়; কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলে, উহার অপূর্ণতা ও বাধা বুঝা যায় । অধিক অর্থে কত লোক ? পাণ্ডবদিগের সাত, আর কৌরবদিগের এগারো অক্ষৌহিণী লোক; পাণ্ডবদিগের পরাজয় হইলে এই এগারো অক্ষৌহিণীর সুখ হইত, - এই যুক্তিবাদে, পাণ্ডবদিগের পক্ষ ন্যায়ের বিরোধী পক্ষ ছিল, একথা বলা যাইতে পারে কি ? শুধু ভারতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধে কেন, অন্য অনেক প্রসঙ্গেও কেবল সংখ্যা ধরিয়া নীতিমত্তার নির্ণয় করা ভুল । লক্ষ দুৰ্জ্জনের সুখ হওয়া অপেক্ষা যাহাতে একজন সজ্জনেরও সন্তোষ হয় তাহাই প্ৰকৃত সৎকাৰ্য, - ব্যবহার ক্ষেত্রে সকল লোকই এইরূপ বুঝিরা থাকে । এই ধারণা সত্য হইলে, এক সজ্জনের সুখকে লক্ষ দুৰ্জ্জনের সুখাপেক্ষা অধিক মূল্য দিতে হয়; এবং ঐরূপ করিলে, “অধিক লোকের অধিক সুখই” নীতিমত্তার পরীক্ষার একমাত্ৰ সাধন, এই প্ৰথম সিদ্ধান্তটি ঐ পরিমাণে পঙ্গু হইয়া পড়ে । তাই, লোকের সংখ্যা কম কিংবা বেশী হওয়ার সহিত নীতিমত্তার নিত্য সম্বন্ধ হইতে পারে না, একথা স্বীকার করিতেই হয় । 


আপত্তি-২ : কে নিশ্চিত করিবে যে, অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ কি ?

আর একটা কথা মনে করা উচিত যে, সাধারণতঃ সকল লোকে যে বিষয়কে কখন কখন সুখাবহ বলিয়া মনে করে, তাহাই দূরদর্শী ব্যক্তি পরিণামে সকলের পক্ষেই অনিষ্টজনক মনে করেন দেখা যায় । উদাহরণ যথা – সক্রেটিস্‌ ও যিশুখৃষ্ট । দুজনেই দেশভাইদিগকে আপনি আপন মত কল্যাণজনক জানিয়া তদনুসারে উপদেশ দিতেন । কিন্তু তাঁহাদের দেশভাইরা তাঁহাদিগকে “সমাজের শত্রু” মনে করিয়া তাঁহাদিগের জন্য “দেহান্ত প্ৰায়শ্চিত্ত” ব্যবস্থা করিলেন । সেই সময়ের জনসাধারণ ও জন-নায়ক উভয়েই মিলিতভাবে “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই তত্ত্ব ধরিয়াই কাজ করিয়ছিল; কিন্তু এখন আমরা বলিতে পারি না যে, সাধারণ লোকের আচরণ ন্যায্য হইয়াছিল । সারকথা, “অধিক লোকের অধিক সুখ”ই নীতির মূলতত্ত্ব - ইহা যদি মুহুর্তের জন্যও স্বীকার করা যায় তথাপি, তাহা দ্বারা লক্ষকোটী লোকের সুখ কিসে হয় এবং কি করিয়া তাহা স্থির হইবে এবং কে স্থির করিবে, এ সকল প্রশ্নের কোন মীমাংসা হয় না । সাধারণত, যে সকল লোকের সুখদুঃসম্বন্ধে প্রশ্ন উপস্থিত হয়, সেই সকল হস্তেই ইহার মীমাংসার ভার দেওয়া যাইতে পারে । কিন্তু সাধারণ প্রসঙ্গে, এতটা হ্যাঙ্গাম হুজ্জৎ করিবার কোন প্রয়োজন হয় না; এবং যখন কোন গোলমেলে বিশেষ প্রসঙ্গ উপস্থিত হয় তখন নিজের সুখ কিসে হয় ইহার নির্ভুল বিচার করা সাধারণ লোকের সাধ্যায়ত্ত হয় না । এই অবস্থায় ভূতের হাতে জ্বলন্ত কাঠ দিলে যে পরিণাম হয়, “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই নীতিতত্ত্ব অনধিকারী লোকের হাতে পড়িলে ঐরূপ পরিণামই হইয়া থাকে । ইহা উপরি-উক্ত দুই উদাহরণে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । “আমাদের এই নীতিধর্মের তত্ত্বটি আসলে সত্য, কিন্তু অজ্ঞান লোকেরা যদি তাহার অপব্যবহার করে, আমরা তাহার কি করিব ?” এই উত্তরের কোন অর্থ নাই । কারণ, কোন তত্ত্ব সত্য হইলেও তাহার উপযোগ করিবার অধিকারী কে এবং সেই অধিকারী ইহার উপযোগ কখনও কিরূপে করিবে, - ইত্যাদি বিষয়ের নিয়মও ঐ তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া দেওয়া উচিত । নচেৎ, সক্রেটিসেরই ন্যায় নীতিমত্তা নির্ণয় করিতে আমরা সমর্থ মনে করিয়া আমাদের অর্থকে অনর্থে পরিণত করাই সম্ভব ।


আপত্তি-৩ : কর্ম অপেক্ষা কর্তার বুদ্ধির মহত্ব

কেবল সংখ্যা ধরিয়া নীতির সমুচিত নির্ণয় হয় না, এবং অধিক লোকের অধিক সুখ কিসে হয় ইহা তর্কের দ্বারা নির্ধারণ করিবার কোনো বাহ্য সাধন নাই । এই দুই আপত্তি ছাড়া, এই মার্গ সম্বন্ধে আরও গুরুতর আপত্তি আনা যাইতে পারে । উদাহরণ যথা, বিচার করিয়া দেখিলেই সহজে উপলব্ধি হইবে যে, কোন কাৰ্যের শুধু বাহ্য পরিণাম ধরিয়াই সেই কাৰ্য ন্যায্য কিংবা অন্যায্য ইহার পূর্ণ ও সন্তোষজনক মীমাংসা অনেক সময় করিতে পারা যায় না । কোন ঘড়ি ঠিক্‌ সময় রাখে কি না, তাহা ধরিয়াই ঐ ঘড়ি ভাল কি মন্দ নির্ণয় করি সত্য; কিন্তু মনুষ্যের কাৰ্যে এই ন্যায় প্রয়োগ করিবার পূর্বে, মনুষ্য শুধু একটা ঘড়ির মত যন্ত্র নহে, ইহা মনে রাখা আবশ্যক । সজ্জনমাত্রেই জগতের কল্যাণার্থে চেষ্টা করিয়া থাকেন সত্য; কিন্তু উল্টাপক্ষে, যে কোন লোক লোকহিতের চেষ্টা করিবে সে-ই যে সাধু হইবে এরূপ নিশ্চয় করা যাইতে পারে না । মনুষ্যের অন্তঃকরণ কিরূপ তাহাও দেখা আবশ্যক । যন্ত্র ও মনুষ্যের মধ্যে যদি কোন ভেদ থাকে, তাহা এই যে, যন্ত্র হৃদয়হীন আর মনুষ্য হৃদয়যুক্ত; এবং সেই জনাই, অজ্ঞান কিংবা ভুলক্রমে যদি কাহারো অপরাধ হয় আইনে তাহা মাৰ্জনীয় বলিয়া স্বীকৃত হয় । তাৎপৰ্য, - কোন কর্ম ভাল কি মন্দ, ধর্ম কি অধর্ম, নীতিমূলক কি অনীতিমূলক, শুধু বাহ্য ফল বা পরিণাম দেখিয়া, অর্থাৎ ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ হইবে কি না এই মাত্র দেখিয়া তাহা নিৰ্ণয় করা যাইতে পারে না । উক্ত কর্ম করিবার বুদ্ধি, বাসনা, বা হেতু কিরূপ সে সম্বন্ধেও দেখিতে হইবে । একবার আমেরিকার কোন বড় শহরে সকল লোকের সুখ ও সুবিধার জন্য ট্রামওয়ে করা আবশ্যক হইয়াছিল; কিন্তু অধিকারীদিগের বিনা আদেশে ট্রামওয়ে করা সম্ভব ছিল না । সরকারী মঞ্জুরী পাইতে বিলম্ব হইতেছিল । তখন ট্রামওয়ের ব্যবস্থাপক, অধিকারীদিগকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়া শীঘ্র শীঘ্ৰ মঞ্জুরী বাহির করিয়া লইলেন । ট্রামওয়ে হইয়া গেল এবং তাহার দরূণ শহরের সকল লোকের সুবিধা ও উপকার হইল । কিছু দিন পরে ঘুষ দিবার কথা প্ৰকাশ হওয়ায় ব্যবস্থাপকের উপর ফৌজদারী মোকদ্দমা রুজু হইল । প্ৰথম “জুরি” একমত না হওয়ায়, অন্য “জুরি” নির্বাচিত হইল, এবং সেই জুরি দোষী বলিয়া সা্ব্যস্ত করায় ট্রামওয়ে ব্যবস্থাপকের দণ্ড হইল । এই স্থলে, ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ এই নীতিতত্ত্ব ধরিয়া নিষ্পত্তি হইতে পারে না । ঘুষ দিবার দরুণ ট্রামওয়ে হইল - এই বাহ্য পরিণামে অধিক লোকের অধিক সুখ হইবার কথা; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এইরূপ ঘুষ দিয়া কার্য উদ্ধার করাটা ন্যায়সঙ্গত হয় নাই । (পল্‌ কেরসের “The Ethical Problem” গ্ৰন্থ হইতে এই উদাহরণ গৃহীত হইয়াছে ।)

আমাদের কর্তব্য মনে করিয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে দান করা, এবং কীর্তির জন্য বা অন্য কোন ফলকামনায় দান করা - এই দুই প্ৰকার দানের বাহ্য পরিণাম একই রকম হইলেও প্রথম প্রকারের দান সাত্ত্বিক ও দ্বিতীয় প্রকারের দান রাজসিক - ভগবদ্গীতায় এইরূপ ভেদ করা হইয়াছে [গী|১৭|২০, ২১] । এবং ঐ দান কুপাত্রে প্রদত্ত হইলে তাহা তামসিক বা গর্হিত বলিয়াও উক্ত হইয়াছে । কোন গরীব লোক কোন ধর্মকাৰ্যে চারি পয়সা দিলে এবং সেই একই কাৰ্যে কোন ধনবান ব্যক্তি একশো টাকা দিলে, উভয়েরই নৈতিক যোগ্যতা জনসাধারণের নিকট সমান বলিয়াই বিবেচিত হয় । কিন্তু কেবল “অধিক লোকের অধিক হিত” এই বাহ্য সাধনের দ্বারা যদি বিচার করা যায় তাহা হইলে এই দুই দান নৈতিক দৃষ্টিতে সমান যোগ্য নহে এইরূপ বলিতে হয় । “অধিক লোকের অধিক হিত” এই আধিভৌতিক নীতিতত্ত্বের একটা মস্ত দোষ এই যে, কর্তার মনোগত অভিপ্ৰায় বা ভাবের কোন বিচার উহাতে হয় না; এবং মনোগত অভিপ্ৰায়ের প্রতি লক্ষ্য করিতে হইলে, অধিক লোকের অধিক বাহ্য সুখই নীতিমত্তার কষ্টিপাথর এই যে প্ৰথম প্ৰতিজ্ঞা, তাহার সহিত বিরোধ উপস্থিত হয় । ব্যবস্থাপক সভা কিংবা মণ্ডলী অনেক ব্যক্তির সমষ্টি হওয়ায়, তৎকর্তৃক প্ৰণীত আইন বা নিয়ম উচিত কি অনুচিত বিচার করিবার সময় সভাসদ্‌দিগের অন্তঃকরণ কিরূপ ছিল তাহা দেখিবার কোন হেতু থাকে না; তাহাদের কৃত আইন হইতে, অধিক লোকের অধিক সুখ হইবে কি না, এই বাহ্য বিচার করিলেই যথেষ্ট হয় । কিন্তু অন্য স্থলে ঐ ন্যায় খাটে না, তাহা পুর্বোক্ত উদাহরণ হইতে সহজেই উপলব্ধি হইবে । “অধিক লোকের অধিক হিত বা সুখ” একেবারেই অনুপযোগী এরূপ আমি বলি না । কেবল বাহ্য পরিণামের বিচার করিতে হইলে উহ্য অপেক্ষা অন্য উৎকৃষ্ট তত্ত্ব কোথাও পাওয়া যাইরে না । কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, কোন বিষয় নীতিদৃষ্টিতে ন্যায্য বা অন্যায্য নির্ণয় করিতে হইলে, এই বাহ্য তত্ত্বের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করিয়া অনেক প্রসঙ্গে অন্য বিষয়েরও বিচার করা আবশ্যক হয় । 

সুতরাং নীতিতত্ত্বনির্ণয় শুধু এই তত্ত্বের উপরেই সম্পূর্ণরূপ নির্ভর করিয়া থাকিতে পারে না, ইহা অপেক্ষা অধিকতর নিশ্চিত ও নির্দোষ তত্ত্ব খুঁজিয়া বাহির করা আবশ্যক । “কর্মাপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ” [গী|২|৪৯] এই যে কথা গীতার আরম্ভেই উক্ত হইয়াছে, তাহারও ইহাই অভিপ্ৰায় । শুধু বাহ্য কর্মের উপর দৃষ্টি রাখিলে অনেক সময় ভ্ৰমে পড়িতে হয় । “স্নান, সন্ধ্যা, তিলক, মালা” ইত্যাদি বাহ্য কর্ম স্থির রাখিলেও “অন্তরে ক্ৰোধের জ্বালা” জলিতে থাকা অসম্ভব নহে । কিন্তু উল্টাপক্ষে অন্তরের ভাব শুদ্ধ থাকিলে, বাহ্য কর্মের কোন গুরুত্বই থাকে না; সাধারণ লোকের নিকট সুদামের প্রদত্ত একমুষ্টি চাউল দানের ন্যায় অত্যন্ত অল্প বাহ্য কর্মের ধর্মসংগত ও নীতিসংগত যোগ্যতা, অধিক লোকের অধিক সুখদায়ী বিশ মণ অন্নের সমান । তাই, জর্মান তত্ত্বজ্ঞানী কাণ্ট, কর্মের বাহ্য ও প্ৰত্যক্ষ পরিণামের তারতম্যবিচার গৌণ স্থির করিয়া কর্তার শুদ্ধ বুদ্ধি হইতেই নীতিশাস্ত্ৰ বিষয়ে স্বীয় বিচার আরম্ভ করিয়াছেন । (Kants’ “Theory of Ethics”, translated by Abbott, 6th Ed, P.6).

আধিভৌতিক সুখবাদের এই প্রধান ত্রুটি আধিভৌতিকবাদীদিগের যে নজরে পড়ে নাই তাহা নহে । হিউম স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, যখন মনুষ্যের কর্ম তাহার স্বভাবের দ্যোতক হয়, এবং সেই কারণে যখন লোকেরা উহাই নীতিমত্তার প্রদর্শক বলিয়া স্বীকার করে, তখন কেবল বাহ্য পরিণাম ধরিয়া ঐ কর্ম স্তুত্য বা নিন্দনীয় তাহা স্থির করা অসম্ভব । (“For as actions are objects of our moral sentiment, so far only as they are indications of the internal character, passions and affections, it is impossible that they can give rise either to praise or blame, where they proceed not from these principles, but are derived altogether from external objects." – Hume’s “Inquiry concerning Human Understanding”, Section VIII. Part II., P.368 of Hume’s “Essays”, the World Library Edition.)

“কর্তা যে বুদ্ধিতে বা হেতুতে কোন কর্ম করে, সেই কর্মের নীতিমত্তা সম্পূর্ণরূপে তাহারই উপর নির্ভর করে” এই কথা মিল সাহেবেরও অভিমত । কিন্তু স্বপক্ষ সমর্থনাৰ্থ মিল এই সম্বন্ধে এইরূপ কুটতর্ক করেন যে, “যে পর্যন্ত বাহ্য কর্মের মধ্যে কোন ভেদ না হয় সে পর্যন্ত কর্তার উহা করিবার যে কোন বাসনা হউক না কেন তাহার দ্বারা কর্মের নীতিমত্তার কোন ইতরবিশেষ হয় না ।” (“Morality of the action depends entirely upon the intention, that is, upon what the agent wills to do. But the motive, that is, the feeling which makes him will so to do, when it makes no difference in the act, makes none in the morality.” Mill’s “Utilitarianism” P.27.)

মিলের এই তর্কে সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহ দেখা যায়; কারণ, বুদ্ধি পৃথক হওয়া প্ৰযুক্ত, দুই কর্ম দেখিতে এক হইলেও, তত্ত্বতঃ উহা একই মূল্যের কখনই হইতে পারে না । তাই “যে পৰ্যন্ত (বাহ্য) কর্মের মধ্যে ভেদ না হয়” ইত্যাদি মিলের নিয়মটিও নির্মূল হইয়া পড়ে, ইহা গ্রীনসাহেব উত্তরে বলিয়াছেন (Green’s “Prolegomena to Ethics” $202 note, Р.348. 5th Cheaper Edition.) । গীতার অভিপ্ৰায়ও তাহাই । কারণ, দুই ব্যক্তি একই ধর্মকাৰ্যের জন্য একই রকমের দান করিলেও, উভয়ের বুদ্ধিভেদমূলে এক দান সাত্ত্বিক, অন্য দান রাজসিক বা তামসিকও হইতে পারে, ইহা গীতাতে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধে বেশী বিচার, প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য মতের তুলনা করিবার সময় পরে করিব । এক্ষণে এইটুকু দেখিতে হইবে যে, কর্মের নিছক্‌ বাহ্য পরিণামের উপর নির্ভরকারী আধিভৌতিক সুখবাদের শ্রেষ্ঠ শ্রেণীও নীতিনির্ণয়কাৰ্যে কিরূপ অসম্পূর্ণ হইতেছে; এবং ইহা সিদ্ধ করিবার জন্য মিলের উপরি-উক্ত স্বীকৃতিই আমাদের মতে যথেষ্ট ।


আপত্তি-৪ : পরোপকার কেন করা চাই ?

“অধিক লোকের অধিক সুখ” এই আধিভৌতিক মার্গে, কর্তার বুদ্ধির বা ভাবের কোন বিচারই হয় না, ইহাই সব চেয়ে বড় দোষ । মিলের উক্তি হইতে ইহা স্পষ্টই সিদ্ধ হইতেছে যে, তাহার যুক্তিকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইলেও সব সময়ে তাহার একই প্ৰকার উপযোগ করা যাইতে পারে না; কারণ উহা কেবল বাহ্য ফল ধরিয়া নীতিনির্ণয় করে, অর্থাৎ তাহার উপযোগ একটা সীমার মধ্যে বদ্ধ সুতরাং একদেশদর্শী । কিন্তু ইহা ছাড়া এই মত সম্বন্ধে আরও একটা আপত্তি আছে যে, ‘স্বাৰ্থ অপেক্ষা পরার্থ কেন এবং কিসে শ্রেষ্ঠ’ তাহার কোন যুক্তি না বলিয়া ইহারা এই তত্ত্বকে সত্য বলিয়া মানিয়া লয়েন । ফলে দাড়ায় এই যে, জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থের অপ্রতিহত বৃদ্ধি হইতে থাকে । স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই তত্ত্বই মনুষ্যের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যদি উৎপন্ন হইয়া থাকে অর্থাৎ স্বাভাবিক হয়, তবে স্বাৰ্থ অপেক্ষা “অধিক লোকের সুখ” এই তত্ত্বের অধিকতর গুরুত্ব আমি কেন মানিব ? তুমি অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ দেখিয়া এইরূপ কর, ঐ প্রশ্নের ইহা সন্তোষজনক উত্তর হইতেই পারে না; কারণ, “অধিক লোকের অধিক সুখ” আমরা কেন করিব, ইহাই হইল মূল প্রশ্ন । লোকের হিত করিলে প্ৰায় আপনারও হিত হয় বলিয়া এই প্রশ্ন সর্বদা উপস্থিত হয় না, এ কথা সত্য । কিন্তু আধিভৌতিক মার্গের উপরি-উক্ত তৃতীয় বৰ্গ হইতে এই শেষের অর্থাৎ চতুর্থ বর্গের বিশেষত্ব এই যে, এই আধিভৌতিক মার্গের লোকেরা মনে করে যে, স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইলে, জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থের মার্গ অনুসরণ না করিয়া, উচ্চ স্বাৰ্থ ছাড়িয়া পরার্থ সাধনেরই চেষ্টা করা কর্তব্য । এই আধিভৌতিক মার্গের বিশেষত্বসম্বন্ধে কোন যুক্তি দেখানো হয় নাই । 


3.4.1) মনুষ্যজাতির পূর্ণ অবস্থা


এই অভাব এই মার্গের এক আধিভৌতিক পণ্ডিতের নজরে পড়ে । তিনি ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত সমস্ত সজীব প্ৰাণীদিগের ব্যবহার বিশেষরূপ নিরীক্ষণ করেন । শেষে তিনি এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, যখন আপনার মতোই আপনার সন্তানসন্ততি ও জাতিকে পরিপোষণ করা এবং কাহাকে কষ্ট না দিয়া আপন বন্ধুদিগকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করা - এই গুণটি ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পর্যন্ত উত্তরোত্তর বর্ধিত আকারে ব্যক্ত হইয়া আসিতেছে দেখিতে পাওয়া যায়, তখন বলা যাইতে পারে যে, সজীব সৃষ্টির আচরণের এই পরস্পরকে সাহায্য করা একটী মুখ্য ভাব । সজীব সৃষ্টির এই ভাবটী প্রথমতঃ সন্তানোৎপাদন এবং পরে তাহার রক্ষণ-পোষণ ব্যাপারেই দেখা যায় । স্ত্রী-পুরুষ ভেদ যাহাদের মধ্যে হয় নাই এইরূপ অতিসূক্ষ্ম কীটজগতের মধ্যেও দেখা যায় যে, কীটের দেহ বাড়িতে বাড়িতে ফাটিয়া গিয়া উহা দুই কীটে পরিণত হয় । সন্ততির জন্য অর্থাৎ পরের জন্য এই ক্ষুদ্র কীট আপন দেহ বিসর্জন করে বলিলেও চলে । সেইরূপ আবার, সজীব সৃষ্টির মধ্যে এই কীটের উপরউপরকার পদবীর স্ত্রীপুরুষাত্মক প্ৰাণীও আপনি সন্ততি রক্ষণার্থ স্বাৰ্থত্যাগে আনন্দ অনুভব করিয়া থাকে; এবং এই গুণ পরে উত্তরোত্তর বাড়িয়া গিয়া মনুষ্যজাতির নিতান্ত বন্য অসভ্য সমাজের মধ্যেও দেখা যায় যে, শুধু আপনি সন্ততিকে নহে, আপন জাতভাইদিগকেও আনন্দের সহিত সাহায্য করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । তাই, পরার্থের কাজে ও স্বার্থের মতোই সুখ অনুভব করা, সমস্ত সৃষ্টি্র এই যে মুখ্য ভাব, এই ভাবটিকে আরও সন্মুখে অগ্রসর করিয়া দিয়া স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে প্ৰতীয়মান বিরোধটি একেবারে বহিষ্কৃত করিবার প্রযত্ন সজীব সৃষ্টির শিরোমণি মনুষ্যের কর্তব্য । বস্, ইহাতেই উহার কর্তব্যের শেষ । (এই মতবাদ স্পেনসারের “Data of Ethics” গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে । তাঁহার নিজের মত ও মিলের মতের মধ্যে কি প্রভেদ, তাহা মিলের নিকট প্রেরিত পত্রের মধ্যে বিবৃত হওয়ায়, ঐ পত্র হইতে, উহা উদ্ধৃত করিয়া উক্ত গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে । PP. 57, 123. Also, see Bain's “Mental and Moral Science”, PP.721, 722, (1875).

এই যুক্তিবাদ খুবই ঠিক । পরোপকার করিবার সদ্‌গুণ, মুক-সৃষ্টির মধ্যেও সন্ততিরক্ষণব্যাপারে পাওয়া যায়, অতএব উহার পরমোৎকর্ষ সাধন করাই জ্ঞানবান মনুষ্যের পুরুষাৰ্থ, এই তত্ত্ব কিছু নূতন নহে । এই তত্ত্বের বিশেষত্ব কেবল এইটুকু যে, আধিভৌতিক শাস্ত্রের জ্ঞান অধুনা অনেক বাড়িয়া যাওয়ায় এই তত্ত্বের আধিভৌতিক উপপত্তি ভাল করিয়া বিবৃত করা হইয়াছে । আমাদের শাস্ত্রকারদিগের দৃষ্টি আধ্যাত্মিক হইলেও প্রাচীন গ্ৰন্থাদিতে কথিত হইয়াছে যে, -
অষ্টাদশপুরাণানাং সারং সারং সমুদ্‌ধৃতম্‌ ৷
পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্‌ ॥
“পরোপকারই পুণ্য এবং পরপীড়নই পাপ - ইহাই অষ্টাদশ পুরাণের সার কথা” । ভর্তৃহরিও বলিয়াছেন যে, “স্বাথো যস্য পরার্থ এবং স পুমান্‌ একঃ সতাং অগ্ৰণীঃ” পরার্থই যাহার স্বাৰ্থ হইয়াছে সে-ই সমস্ত সজ্জনের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ । ভাল; এখন ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত সৃষ্টির উত্তরোত্তর উন্নত শ্রেণীদিগকে লক্ষ্যের মধ্যে আনিলে আর একটী প্রশ্ন বাহির হয় যে, মনুষ্যে কেবল পরোপকারবুদ্ধিরই কি উৎকর্ষ হইয়াছে, অথবা তাহার সঙ্গে ন্যায়বুদ্ধি, দয়া, উদারতা, দূরদৃষ্টি, তর্ক, শৌর্য, ধৃতি, ক্ষমা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ইত্যাদি অন্য সাত্ত্বিক গুণেরও বৃদ্ধি হইয়াছে ? এই বিষয়ে বিচার করিলে পর বলিতে হয় যে, অন্য সমস্ত সজীব প্ৰাণী অপেক্ষা, মানুষ্যের মধ্যেই সমস্ত সদ্‌গুণের উৎকর্ষ হইয়াছে । এই সমস্ত সাত্ত্বিক গুণসমূহের সমুচ্চয়কে আমরা মনুষ্যত্ব নামে অভিহিত করি । এক্ষণে ইহা সিদ্ধ হইল যে, পরোপকার অপেক্ষা “মনুষ্যত্ব”কে আমি শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া মানি; এ অবস্থাতে কোন কর্মের ঔচিত্য অনৌচিত্য বা নীতিমত্তার নির্ণয়ে, সেই কর্মের পরীক্ষা কেবল পরোপকারের দিক দিয়া করা যায় না - “মনুষ্যত্বের” দৃষ্টিতে, অর্থাৎ মানবজাতির মধ্যে অন্য প্ৰাণী অপেক্ষা যে সকল গুণ উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে দেখা যায়, সেই সমস্ত গুণের দৃষ্টিতে উক্ত কর্মের পরীক্ষা করা একান্ত আবশ্যক । কেবল এক পরোপকারবুদ্ধির উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া কোন প্রকার সিদ্ধান্ত করিবার পরিবর্তে ইহাই স্বীকার করিতে হয় যে, সমস্ত মনুষ্যের “মনুষ্যপণা” বা “মনুষ্যত্ব” যে কর্মের দ্বারা বৃদ্ধি পাইতে পারে কিংবা “মনুষ্যত্ব” যে কর্মের দ্বারা বিভূষিত হয় তাহাই সৎকাৰ্য, তাহাই নীতিধর্ম । এই ব্যাপক দৃষ্টিকে একবার অনুসরণ করিলে, “অধিক লোকের অধিক সুখ” উক্ত দৃষ্টির একটা স্বল্প অংশ হইয়া যাইবে -  কেবল এই শেষোক্ত দৃষ্টিতেই সমস্ত কাৰ্যের ধর্মাধর্ম বা নীতিমত্তার বিচার করিতে হইবে, এই মতের উপর আর নির্ভর করা যায় না; সুতরাং ধর্মাধর্মের নির্ণয়ের জন্য মনুষ্যত্বেরই বিচার করা আবশ্যক হইবে । “মনুষ্যত্ব বা মনুষ্যপণা”র যথার্থ স্বরূপ কি, তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে, আমার মনে যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তি অনুসারে “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ” এই বিষয় স্বভাবতই উপস্থিত হয় । নীতিশাস্ত্রের বিচারক এক মার্কিন গ্ৰন্থকার এই সমুচ্চয়াত্মক মনুষ্যধর্মকেই ‘আত্মা’ সংজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন ।

নিছক স্বাৰ্থ বা নিজের বিষয়-সুখের কনিষ্ঠ শ্রেণী হইতে উচ্চে উঠিতে উঠিতে আধিভৌতিক সুখবাদীরাও কেমন করিয়া পরোপকার ও শেষে মনুষ্যত্বের শ্রেণী পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছেন তাহা উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । কিন্তু মনুষ্যত্ববিষয়েও আধিভৌতিকবাদীদিগের মনে প্রায় সমস্ত লোকের বাহ্য বিষয়সুখেরই কল্পনা মুখ্য হয়; অতএব যাহাতে অন্তঃশুদ্ধি ও অন্তঃসুখের বিচার আমলে না আসে, আধিভৌতিকবাদীদিগের সেই শেষের শ্রেণীও আমাদিগের, অধ্যাত্মবাদী শাস্ত্রকারের মতে নির্দোষ বলিয়া নির্ধারিত হয় নাই । মনুষ্যের সমস্ত চেষ্টা-প্ৰযত্ন, সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখনিবারণার্থ হইয়া থাকে, ইহা সাধারণত স্বীকার করিলেও, প্ৰকৃত ও নিত্যসুখ আধিভৌতিক অর্থাৎ ঐহিক বিষয়োপভোগের মধ্যেই আছে কিংবা অন্য কিছুতে আছে প্ৰথমে এই প্রশ্নের নির্ণয় ব্যতীত, কোন আধিভৌতিক পক্ষই গ্ৰাহ্য বলিয়া ধরা যাইতে পারে না । শারীরিক সুখাপেক্ষা মানসিক সুখের যোগ্যতা অধিক, ইহা আধিভৌতিকবাদীও স্বীকার করেন । পশুর যে-যে সুখ উপভোগ করিতে সমর্থ, সেই সমস্ত সুখ কোন মনুষ্যকে দিয়া, তাহাকে যদি প্রশ্ন করা যায় “তুই পশু হইতে রাজি আছিস কি ?” - একজন মনুষ্যও পশু হইতে স্বীকার করিবে না । সেইরূপ, তত্ত্বজ্ঞানের গভীর বিচার নিবন্ধন বুদ্ধি যে এক প্রকার শান্তি লাভ করে তাহার যোগ্যতা, ঐহিক সম্পত্তি কিংবা বাহ্য উপভোগ অপেক্ষা শতগুণ অধিক, একথা জ্ঞানী ব্যক্তিকে বলিতে হইবে না । ভাল; লোকমতের প্রতি লক্ষ্য করিলেও দেখিতে পাওয়া যায় যে, নীতিমত্তা-নির্ণয় শুধু সংখ্যার উপর নির্ভর করে না; মনুষ্য যাহা কিছু করে তাহা কেবল আধিভৌতিক সুখের জন্যই করে না, আধিভৌতিক সুখকেই পরম সাধ্য বলিয়া মানে না । আমাদের বক্তব্য এই যে, শুধু বাহ্য সুখ কেন, প্ৰসঙ্গবিশেষ আসিলে জীবনেরও পরোয়া রাখা কর্তব্য নহে । কারণ, সেই সময়ে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সত্যাদি যে সকল নীতিধর্মের যোগ্যতা নিজের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক, সেই সকল পালন করিবার জন্য মনোনিগ্ৰহেতেই মনুষ্যের মনুষ্যত্ব । অর্জুনের এইরূপ অবস্থা হইয়াছিল । অর্জুনেরও প্রশ্ন ইহা ছিল না যে, যুদ্ধ করিলে কাহার কতটা সুখ হইবে । শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট তাঁহার এই প্রশ্ন ছিল যে, “আমার অর্থাৎ আমার আত্মার শ্রেয় কিসে হইবে তাহা আমাকে বল” [গী|২|৭; ৩|২] । আত্মার এই নিত্যকালের শ্ৰেয় ও সুখ, আত্মার শান্তিতে আছে । তাই ঐহিক সুখ কিংবা সম্পত্তি যতই পাওয়া যাক না কেন, শুধু তাহাতে এই আত্মসুখ কিংবা শান্তিলাভের আশা নাই - “অমৃতত্বস্য তু নাশাস্তি বিত্তেন” - ইহা বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হইয়াছে [বৃ|২|৪|২] । এই প্রকারে কঠোপনিষদে লিখিত আছে যে, মৃত্যু নচিকেতাকে পুত্র পৌত্র পণ্ড ধান্য দ্রব্য প্রভৃতি বহু প্রকার ঐহিক সম্পত্তি দিবার জন্য প্ৰস্তুত থাকিলেও, নচিকেতা মৃত্যুকে স্পষ্ট জবাব দিলেন – “আমি আত্মবিদ্যা চাই, আমি সম্পত্তি চাই না;” এবং প্রেয় অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের প্রীতিজনক ঐহিক সুখ এবং শ্ৰেয় অর্থাৎ আত্মার প্রকৃত কল্যাণ এই দুয়ের মধ্যে ভেদ দেখাইয়া বলিলেন -
শ্ৰেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ সংপরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ ৷
শ্ৰেয়ো হি ধীরোহৰ্ভিপ্রেয়সো বৃণীতে প্রেয়ো মন্দো যোগক্ষেমাদ্‌বৃণীতে ৷৷
প্রেয় (ক্ষণিক বাহ্য ইন্দ্ৰিয় সুখ) এবং শ্ৰেয় (প্রকৃত চিরন্তন কল্যাণ) এই দুই মনুষ্যের সম্মুখে আসিলে, বিজ্ঞ মনুষ্য ঐ দুয়ের মধ্যে একটীকে বাছাই করিয়া লয়েন । সুবুদ্ধি যিনি, তিনি প্ৰেয় অপেক্ষা শ্রেয়কে অধিক পছন্দ করেন; কিন্তু মন্দবুদ্ধি মনুষ্যের নিকট আত্মকল্যাণ অপেক্ষা প্ৰেয় অর্থাৎ বাহ্য সুখই অধিক প্রিয়,” [কঠ|১|২|২] । তাই, সংসারের ইন্দ্ৰিয়গম্য বিষয়সুখই এই জগতে মনুষ্যের পরম সাধ্য, এবং মনুষ্য যাহা কিছু করে সে সকলই কেবল বাহ্য অর্থাৎ আধিভৌতিক সুখের জন্য অথবা নিজের দুঃখনিবারণার্থই করিয়া থাকে এরূপ মনে করা ঠিক নহে ।


4) সুখদুঃখের অনিত্যতা এবং নীতিধর্মের নিত্যতা


ইন্দ্রিয়গম্য বাহ্য সুখ অপেক্ষা বুদ্ধিগম্য অন্তঃসুখের যোগ্যতা অধিক তো আছেই; কিন্তু তাহার সঙ্গে একটী কথা এই যে, বিষয়সুখ আজ আছে, কাল নাই, অর্থাৎ বিষয়সুখ অনিত্য । নীতিধর্মে একথা খাটে না । সকল লোকেই মানিয়া থাকে যে, অহিংসা, সত্য প্রভৃতি ধর্ম কোন বাহ্য উপাধির উপর নির্ভর করে না । অর্থাৎ বাহ্য সুখদুঃখকে অবলম্বন করিয়া নাই; সর্বকালে ও সর্বপ্রসঙ্গে তাহা একইপ্রকার, সুতরাং নিত্য । বাহ্য বিষয়ের উপর যাহা নির্ভর করে না সেই  নীতিধর্মের নিত্যত্ব কোথা হইতে আসিল, তাহার কারণ কি ? আধিভৌতিকবাদে ইহার কোন উপপত্তি পাওয়া যায় না । কারণ, বাহ্য সৃষ্টির সুখদুঃখ অবলোকন করিয়া কোন একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত করিলেও সমস্ত সুখদুঃখ স্বভাবতই অনিত্য হওয়ায়, উহাদের অসম্পূর্ণ ভিত্তির উপর নির্মিত নীতিসিদ্ধান্তও ঐরূপ কাঁচা অৰ্থাৎ অনিত্য হইবে । এবং এই অবস্থাতে সুখদুঃখের কোনও পরোয়া না করিয়া, সত্যের খাতিরে প্রাণ গেলেও ভাল - ত্রিকালে অবাধিত এই সত্যধর্মের যে নিত্যতা তাহা “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই তত্ত্বের দ্বারা সিদ্ধ হয় না । এ বিষয়ে এই আপত্তি করা যায় যে, যখন সাধারণ ব্যবহারে সত্যের জন্য প্ৰাণ দিবার সময় উপস্থিত হইলে ভাল ভাল লোকও অসত্যের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে সংকোচ করেন না, এবং শাস্ত্রকারেরাও এরূপ সময়ে খুব টানিয়া ধরেন না, তখন সত্যাদি ধর্মের নিত্যতা কেন স্বীকার করি ? কিন্তু এই আপত্তি ঠিক নহে । কারণ, সত্যের জন্য প্ৰাণ দিতে যাহার সাহস হয় না সেও এই নীতিধর্মের নিত্যত্ব নিজ মুখে স্বীকার করিয়াই থাকে । এইজন্য মহাভারতে, অৰ্থকামাদি পুরুষাৰ্থ যাহা দ্বারা সিদ্ধ হয় সেই সকল ব্যবহারিক ধর্মের বিচার আলোচনা করিয়া শেষে ভারতসাবিত্রীতে (এবং বিদুরনীতিতেও) ব্যাসদেব সকল লোককে এই উপদেশ দিয়াছেন -
ন জাতু কামান্ন ভয়ান্ন লোভাদ্ধর্মং ত্যজেজ্জীবিতস্যাপি হেতোঃ ৷
ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে জীবো নিত্যঃ হেতুরস্য ত্বনিত্যঃ ॥
“সুখদুঃখ অনিত্য, কিন্তু (নীতি-) ধর্ম নিত্য; অতএব, সুখেচ্ছায়,  ভয়ে, লোভে, অথবা প্ৰাণসঙ্কট উপস্থিত হইলেও, ধর্মকে কখনই ছাড়িবে না । জীব নিত্য, তাহার হেতু অৰ্থাৎ সুখদুঃখাদি বিষয় অনিত্য” । অতএব; ব্যাসদেব উপদেশ দিতেছেন যে, অনিত্য সুখদুঃখের বিচার করিতে না বসিয়া, নিত্য ধর্মের সঙ্গেই নিত্য জীবকে সংযুক্ত করিয়া দেওয়া কর্তব্য [মভা|স্ব|৫|৬০; উ|৩৯|১২, ১৩] । ব্যাসের এই উপদেশ কতটা যোগ্য ইহা দেখিবার জন্য, সুখদুঃখের প্রকৃত স্বরূপ কি, এবং নিত্য সুখ কাহাকে বলে, - এক্ষেণে তাহার বিচার করা আবশ্যক ।

সুখদুঃখবিবেক (Consideration of Happiness & Unhappiness)

সুখমাত্যন্তিকং যত্তৎ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্ৰিয়ম্‌ ৷ [গীতা |৬|২১]

(“যাহা কেবল বুদ্ধির দ্বারা গ্রাহ্য ও অতীন্দ্রিয় তাহাই আত্যন্তিক সুখ” ।)

1) সুখের জন্য প্রত্যেকের প্রবৃত্তি



সুখ পাইবার জন্য কিংবা প্রাপ্ত সুখের বৃদ্ধির জন্য, দুঃখ নিবারণ বা লাঘব করিবার জন্য প্রত্যেক মনুষ্য এই জগতে সর্বদাই চেষ্টা করিয়া থাকে; এই সিদ্ধান্ত আমাদের শাস্ত্রকারদিগের অভিমত । “ইহ খলু অমৃষ্মিংশ্চ লোকে বস্তুপ্ৰবৃত্তয়ঃ সুখাৰ্থমভিধীয়ন্তে ৷ ন হ্যতঃপরং ত্ৰিবৰ্গফলং বিশিষ্টতর মস্তি ৷” [মভা|শা|১৯৯০|৯] । ইহলোকে কিংবা পরলোকে সমস্ত প্ৰবৃত্তি সুখের নিমিত্ত; ইহার অতিরিক্ত ধর্মার্থকামের আর কোন ফল নাই, ইহা শান্তিপর্বে ভৃগু ভরদ্বাজকে বলিয়াছেন । কিন্তু শাস্ত্রকারগণ বলিয়াছেন যে, মনুষ্য প্ৰকৃত সুখ কিসে হয় ইহা না বুঝিবার দরুন, মেকি মুদ্ৰা আঁচলে বাঁধিয়া তাহাই খাঁটি মনে করিয়া মিথ্যা সুখকেই সত্য সুখ মনে করে; এবং আজ না হয় কাল সুখ নিশ্চয়ই মিলিবে এই আশায় ভর করিয়া, জীবন কাটাইতে থাকে । ইহাতেই তাহাকে একদিন মৃত্যুর কবলে পড়িয়া সংসার ছাড়িয়া যাইতে হয় । তথাপি সে সাবধান না হইয়া পুনর্বার তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকে । এই ভাবে এই ভাবচক্র চলিতেছে, কেহই প্রকৃত ও নিত্য সুখ কি, তাহার বিচার করে না । সংসার কেবল দুঃখময়, কিংবা সুখপ্রধান বা দুঃখপ্রধান, এই সম্বন্ধে প্রাচ্য ও পশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞানীদিগের মধ্যে খুবই মতভেদ আছে । কিন্তু এই সকল মতবাদীদিগের সকলেরই ইহা স্বীকৃত যে, দুঃখের অত্যন্ত নিবারণ পূর্বক অত্যন্ত সুখ প্ৰাপ্তির কার্যেই মনুষ্যের কল্যাণ ।


2) সুখদুঃখের লক্ষণ ও ভেদ



সুখ’ শব্দের পরিবর্তে প্ৰায় ‘হিত’, ‘শ্ৰেয়’, ‘কল্যাণ’ এই সকল শব্দ বেশী ব্যবহৃত হইয়া থাকে । উহাদের মধ্যে ভেদ কি, তাহা পরে বলা যাইবে । ‘সুখ’ শব্দের ভিতর সর্বপ্রকারের সুখ বা কল্যাণের সমাবেশ হয়, এ কথা মানিলে, সুখের নিমিত্ত প্রত্যেকের প্রযত্ন হইয়া থাকে, এ কথা সাধারণত বলা যাইতে পারে । কিন্তু ইহার মূলে “যদিষ্টং তৎসুখং প্রাহুঃ দ্বেষ্যং দুঃখমিহেষ্যতে” - আপনার যাহা কিছু ইষ্ট তাহাই সুখ এবং আমরা যাহার দ্বেষ করি অর্থাৎ যাহা কিছু আমরা চাহি না তাহাই দুঃখ - এইরূপ সুখদুঃখের যে লক্ষণ মহাভারতের অন্তর্গত পরাশরগীতায় বিবৃত হইয়াছে [মভা|শাং|২৯৫|২৭], শাস্ত্রদৃষ্টিতে তাহা সম্পূর্ণ নিৰ্দোষ নহে । কারণ এই ব্যাখ্যায় ‘ইষ্ট’ শব্দের অর্থ ইষ্ট বস্তু বা পদার্থ হইলেও হইতে পারে; এবং এইরূপ অর্থ ধরিলে, ইষ্ট পদার্থকেও সুখ বলিতে হয় । উদাহরণ যথা, তৃষ্ণার সময় জল ইষ্ট হইলেও, ‘জল’ এই বাহ্য পদার্থকে ‘সুখ’ নাম দেওয়া যাইতে পারে না । ওরূপ হইলে, নদীর জলে-ডোবা মানুষের বলিতে হয় যে, সে সুখেতে ডুবিতেছে । ইহাই সত্য যে, জলপানে যে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি হয় তাহাই সুখ । ইহাতে সন্দেহ নাই যে, মনুষ্য এই ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তিকে বা সুখকেই চাহে; কিন্তু তাই বলিয়া মানুষ যাহা চাহিবে তাহাই যে সমস্ত সুখ হইবে, এরূপ ব্যাপক সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না । এই কারণে নৈয়ায়িকেরা অনুকুল-বেদনীয়ং সুখং, যে বেদনা আমাদের অনুকূল তাহাই সুখ এবং প্ৰতিকুল-বেদনীয়ং দুঃখং - যে বেদনা আমাদের প্রতিকূল তাহাই দুঃখ, এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়া সুখ ও দুঃখ উভয়ই একপ্রকার বেদনা বলিয়া স্থির করিয়াছেন । এই বেদনা মূলতঃ অর্থাৎ জন্ম হইতেই সিদ্ধ এবং অনুভবগম্য হওয়া প্ৰযুক্ত, নৈয়ায়িকদিগের এই ব্যাখ্যা অপেক্ষা সুখদুঃখের কোন সুন্দরতর লক্ষণ বলা যাইতে পারে না । এই বেদনারূপ সুখদুঃখ, কেবল মনুষ্যের ব্যাপারাদিতেই সমুদ্ভূত হয়, ইহা বলা ঠিক নহে; কারণ, কখন কখন দেবতাদের কোপ-প্ৰযুক্তও কঠিন রোগ উৎপন্ন হইবার ফলে মনুষ্যকে দুঃখ ভোগ করিতে হয় । 


2.1) বেদান্তে সুখদুঃখের ভেদ



তাই, বেদান্তগ্ৰন্থাদিতে সাধারণত, (i)আধিদৈবিক, (ii)আধিভৌতিক ও (iii)আধ্যাত্মিক - সুখদুঃখের এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । 
(i)আধিদৈবিক : দেবতার প্রসাদে বা কোপে যে সুখদুঃখ অনুভূত হয় তাহাকে “আধিদৈবিক” এই সংজ্ঞা দেওয়া হয়; 
(ii)আধিভৌতিক : বাহ্য জগতের পৃথিবী প্রভৃতি পঞ্চ মহাভূতাত্মক পদার্থ মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের সহিত সংযুক্ত হইলে শীতোষ্ণাদিমূলক যে সুখদুঃখ হয় তাহাকে “আধিভৌতিক” নাম দেওয়া হয়; 
(iii)আধ্যাত্মিক : এবং এই প্রকারের বাহ্য সংযোগ ব্যতীত উৎপন্ন অন্য সমস্ত সুখদুঃখ “আধ্যাত্মিক” নামে অভিহিত হয় । 
এ সুখদুঃখের এই বৰ্গীকরণ স্বীকার করিলে শরীরান্তর্ভূত বাতপিত্তাদি দোষের পরিণাম বিকৃত হইয়া যে জরাদি দুঃখ উৎপন্ন হয়, এবং উহাদের পরিণাম ঠিক থাকিলে শরীরপ্ৰকৃতির যে স্বাস্থ্য উৎপন্ন হয়, তাহা আধ্যাত্মিক সুখদুঃখের মধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে । কারণ, এই সুখদুঃখ পঞ্চভূতাত্মা শরীরান্তর্ভূত হইলেও অর্থাৎ শারীরিক হইলেও, শরীরের বাহিরের পদার্থসংযোগে উহা উৎপন্ন হইয়াছে, এ কথা সব সময়ে বলা যাইতে পারে না; এবং সেই জন্য, বেদান্তদৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক সুখদুঃখেরও পুনরায় কামিক ও মানসিক, এইরূপ ভেদ নির্ণয় করা আবশ্যক হয় । কিন্তু এইপ্ৰকার সুখদুঃখের কায়িক ও মানসিক এই দুই ভেদ করিলে, আবার আধিদৈবিক সুখদুঃখকে স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার করিবার প্রয়োজন থাকে না । কারণ, দেবতার প্ৰসাদে কিংবা কোপে সমূৎপন্ন সুখদুঃখকেও, মনুষ্যের নিজের শরীরে কিংবা মনে ভোগ করিতে হয়, ইহা ত স্পষ্টই দেখা যায় । তাই আমি এই গ্রন্থে বেদান্তগ্রন্থের পরিভাষা অনুসারে সুখদুঃখের ত্ৰিবিধ বৰ্গীকরণ না করিয়া উহাদের বাহ্য বা কায়িক এবং আভ্যন্তর বা মানসিক এই দুই বৰ্গই কল্পনা করিয়া, প্ৰথম অর্থাৎ সর্বপ্রকার কায়িক সুখদুঃখকে “আধিভৌতিক” এবং সমস্ত মানসিক সুখদুঃখকে “আধ্যাত্মিক” এই নামে অভিহিত করিয়াছি । বেদান্তগ্রন্থের “আধিদৈবিক” বলিয়া স্বতন্ত্র তৃতীয় বর্গ আমি স্থাপন করি নাই । কারণ, আমার মতে সুখদুঃখের শাস্ত্রীয় বিচার করিবার পক্ষে এই দ্বিবিধ বৰ্গীকরণই অপেক্ষাকৃত অধিক সহজ । সুখদুঃখের পরবর্তী বিচার পড়িবার সময়, বেদান্তগ্রন্থের ও আমার পরিভাষার ভেদ সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক ।


3) সুখ স্বতন্ত্র বা দুঃখাভাবরূপ ? সন্ন্যাসমার্গের মত



সুখদুঃখ দ্বিবিধই স্বীকার কর, বা ত্ৰিবিধই স্বীকার কর, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, দুঃখ কেহই চাহে না । তাই সর্বপ্রকার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি করা এবং আত্যন্তিক ও নিত্য সুখ অর্জন করাই মনুষ্যের পুরুষাৰ্থ, এইরূপ বেদান্ত ও সাংখ্য এই দুই শাস্ত্রেই উক্ত হইয়াছে [সাং|কা|১; গী|৬|২১,২২] । এইরূপ আত্যন্তিক সুখই মনুষ্যের পরম সাধ্য স্থির হইলে পর, এই প্রশ্ন সহজেই মনে আসে যে, অত্যন্ত সত্য ও নিত্য সুখ কাহাকে বলে, তাহা লাভ করা সাধ্যায়ত্ত কি না, সাধ্যায়ত্ত হইলে কিরূপে ও কখন লাভ হইতে পারে ইত্যাদি । এবং এই সকল বিষয়ের বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে প্ৰথমেই এই প্রশ্ন উঠে যে, নৈয়ায়িকদের প্রদত্ত লক্ষণ অনুসারে সুখ ও দুঃখ কি দুই প্রকার স্বতন্ত্র বেদনা, অনুভূতি বা বস্তু, অথবা “আলোক না হইলেই অন্ধকার” এই ন্যায় অনুসারে এই দুই বেদনার মধ্যে একের অভাব হইলেই কি দ্বিতীয় সংজ্ঞার উপযোগ করা হয় ? ভর্তৃহরি বলিয়াছেন -“তৃষ্ণায় ঠোঁট শুকাইয়া গেলে সেই দুঃখ নিবারণার্থ আমরা মিষ্ট জল পান করি, ক্ষুধায় পীড়িত হইলে সুগ্ৰাস অন্ন খাইয়া সেই ক্লেশ দূর করি, এবং কামবাসনা প্ৰদীপ্ত হইয়া দুঃসহ হইলে স্ত্রীসঙ্গের দ্বারা তাহা তৃপ্ত করি”; এই কথা বলিয়া শেষে বলিয়াছেন -
“প্ৰতীকারো ব্যাধেঃ সুখমিতি বিপর্যস্যতি জনঃ ৷”
কোন ব্যাধি বা দুঃখ হইলে, তাহার নিবারণ বা প্ৰতীকারকেই লোকে ভ্ৰম-ক্ৰমে সুখ বলে । দুঃখনিবারণের অতিরিক্ত সুখ বলিয়া কোন স্বতন্ত্র পদার্থ নাই । উক্ত সিদ্ধান্ত মনুষ্যের স্বার্থমূলক ব্যবহারসমূহের বিষয়েই যে কেবল খাটে, তাহা নহে । অন্যের উপকার করিবার সময়েও তাহার দুঃখ দেখিয়া আমাদের অন্তরে জাগ্ৰত কারুণ্যবৃত্তি আমাদের দুঃসহ হইয়া থাকে, এবং সেই দুঃসহত্বের ক্লেশ দূর করিবার জন্যই আমরা পরোপকার করি, - ইহা যে আনন্দগিরির মত, তাহা পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । এই পক্ষ স্বীকার করিলে মহাভারতের অনুসরণে মানিতে হয় যে, 
“তৃষ্ণাৰ্ত্তিপ্ৰভবং দুঃখং দুঃখাৰ্ত্তিপ্রভবং সুখং ৷”
প্ৰথমে কোন বিষয়ের তৃষ্ণা উৎপন্ন হইলে, সেই তৃষ্ণার পীড়া হইতে দুঃখ হয় এবং সেই দুঃখের পীড়া হইতে পুনরায় সুখ উদ্ভূত হয় [শাং|২৫|২২; ১৭৪,১৯] । সংক্ষেপে এই মার্গের উক্তি এই যে, মনুষ্যের মনে প্ৰথমত কোন আশা, বাসনা বা তৃষ্ণা উৎপন্ন হইয়া তাহা হইতে দুঃখ উৎপন্ন হইলে পর, উক্ত দুঃখের নিবারণত সুখ; সুখ বলিয়া স্বতন্ত্র পৃথক কোন বস্তু নাই । অধিক কি, এই মার্গের লোকেরা এই অনুমানও বাহির করিয়াছেন যে, মনুষ্যের সাংসারিক সমস্ত প্ৰবৃত্তি বাসনাত্মক ও তৃষ্ণাত্মক; যে পৰ্যন্ত সমস্ত সাংসারিক কর্মের ত্যাগ করা না যায়, সে পৰ্যন্ত বাসনা বা তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয় না; তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি ব্যতীত, সত্য ও নিত্য সুখ লাভ হইতে পারে না । বৃহদারণ্যকে [বৃ|৪|৪|২২; বেসু|৩|৪|১৫] বিকল্পভাবে এবং জাবালসন্ন্যাসাদি উপনিষদে মুখ্যভাবে এই মাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে; সেইরূপ অষ্টাবক্ৰগীতাতে [৯|৮; ১০|৩,৮] এবং অবধূতগীতাতে [৩|৪৬] ইহারই অনুবাদ করা হইয়াছে । এই মার্গের চরম সিদ্ধান্ত এই যে, যে ব্যক্তি আত্যন্তিক সুখ বা মোক্ষ লাভ করিতে চাহে, তাহার পক্ষে যত শীঘ্ৰ সম্ভব সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস অবলম্বন করা আবশ্যক । স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে বর্ণিত এবং শ্ৰীশঙ্করাচার্য কর্তৃক কলিযুগে স্থাপিত শ্ৰৌত-স্মার্ত কর্ম-সন্ন্যাসমার্গ এই তত্ত্বের উপরেই দাঁড়াইয়া আছে । সত্য; সুখ বলিয়া যদি কোন স্বতন্ত্র পদাৰ্থ না থাকে, যাহা কিছু আছে তাহা যদি শুধু দুঃখই হয় এবং তাহাও তৃষ্ণামূলক হয়, তাহা হইলে এই তৃষ্ণাদিরই বিকার প্রথমত সমুলে উৎপাটিত করিয়া ফেলিলে স্বার্থের ও পরার্থের সমস্ত কচ্‌কচি আপনিই বিলুপ্ত হইবে, এবং মনের মূল সান্যাবস্থা ও শান্তি থাকিয়া যাইবে । এই অভিপ্ৰায়েই মহাভারতে শান্তিপর্বের অন্তৰ্গত পিঙ্গলগীতায় এবং মঙ্কিগীতাতেও উক্ত হইয়াছে যে, -
যচ্চ কামসুখং লোকে যচ্চ দিব্যং মহৎ সুখম্‌ ৷
তৃষ্ণাক্ষয়সুখস্যৈতে নাৰ্হতঃ ষোড়শীং কলাম্‌ ॥
“ইহলোকে কাম অর্থাৎ বাসনার তৃপ্তিতে যে সুখ হয় এবং স্বর্গের যে মহৎ সুখ - এই দুই সুখের যোগ্যতা, তৃষ্ণাক্ষয়জনিত সুখের ষোল কলারও সমান নহে” [শাং|১৭৪|৪৮; ১৭৭|৪৯] । পরে জৈন ও বৌদ্ধধর্মে বৈদিক সন্ন্যাসমার্গেরই অনুকরণ করা হইয়াছে । তাই, এই দুই ধর্মের গ্ৰন্থসমূহে তৃষ্ণার দুষ্পরিণাম ও ত্যাজ্যতা উপরি-উক্ত বচনের অনুরূপ এবং স্থানে স্থানে একটু বেশী করিয়া বর্ণিত হইয়াছে (উদাহরণার্থ, ধর্মপদের অন্তভূর্ত তৃষ্ণাবর্গ দেখ) । তিব্বতদেশস্থ বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থাদিতে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, মহাভারতের উক্ত শ্লোক, বুদ্ধত্ব প্ৰাপ্ত হইবার পর গৌতম বুদ্ধের মুখ হইতে বাহির হইয়াছে । [Rockhill’s “Life of Budha”, P. 33, উদান নামক পালি গ্রন্থে [২|২] এই শ্লোকটি আছে । কিন্তু উহাতে এরূপ বলা হয় নাই যে, বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইবার সময়, বুদ্ধের মুখ হইতে এই শ্লোক বাহির হইয়াছে । ইহা হইতে এই শ্লোক সর্বপ্রথম যে বুদ্ধের মুখ হইতে বাহির হয় নাই তা স্পষ্ট উপলব্ধি হয় ।]


4) সন্ন্যাসমার্গের মতের খণ্ডন : গীতার সিদ্ধান্ত



উপরি-উক্ত তৃষ্ণার দুষ্পরিণাম ভগবদ্‌গীতায় স্বীকৃত হয় নাই এরূপ নহে । তথাপি উহার নিবারণার্থ সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা উচিত নহে, গীতার এইরূপ সিদ্ধান্ত হওয়ায়, সুখদুঃখের উক্ত উপপত্তি সম্বন্ধে একটু সূক্ষ্ম বিচার করা আবশ্যক । তৃষ্ণাদি দুঃখের নিবারণ হইতেই সমস্ত সুখ উৎপন্ন হয়, সন্ন্যাসমার্গের এই উক্তি সম্পূর্ণরূপে সত্য বলিয়া মানা যাইতে পারে না । একবার অনুভূত (দৃষ্ট শ্রুত প্রভৃতি) কোন বস্তু পুনৰ্বার চাহিলেই তাহাকে ‘কাম’, ‘বাসনা’ বা ‘ইচ্ছা’ বলা হইয়া থাকে । ঈপ্সিত বস্তু শীঘ্ৰ না পাইলে দুঃখ হয়; এবং এই ইচ্ছা আরও তীব্ৰ হইতে থাকিলে, কিংবা প্ৰাপ্ত সুখ পূর্ণ মাত্রায় না হওয়ায় উহার আকাঙ্ক্ষা ক্ৰমেই বাড়িতে থাকিলে সেই ইচ্ছাকে, তৃষ্ণা নাম দেওয়া হয় । কিন্তু কেবল ইচ্ছা এইরূপে তৃষ্ণার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হইবার পূর্বে যদি সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়, তবে তজ্জনিত সুখ তৃষ্ণাদুঃখের ক্ষয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, একথা আমি বলিতে পারি না । উদাহরণ যথা – প্রতিদিন আহার যথা সময়ে প্রাপ্ত হইলে, আহারের পূর্বে দুঃখই হইয়া থাকে এরূপ আমাদের অনুভব হয় না । সময়মত আহার না মিলিলে প্ৰাণ ক্ষুধায় ব্যাকুল হইবে, নচেৎ হইবে না । ভাল; যদি স্বীকার করা যায় যে, তৃষ্ণা ও ইচ্ছা একই অর্থবাচক শব্দ, তাহা হইলেও সমস্ত সুখই তৃষ্ণামূলক, এ সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানা যাইতে পারে না । উদাহরণ যথা - এক ছোট ছেলের মুখে অকস্মাৎ মিছ্‌রীর এক টুকরো দিলে তাহার যে সুখ হয়, সে সুখ তাহার পূর্ব তৃষ্ণার ক্ষয়প্রযুক্ত হইয়াছে, এরূপ বলা যায় না । সেইরূপ, রাস্তায় চলিতে চলিতে কোন রমণীয় উদ্যান হইতে কোকিলের মধুর ডাক কানে আসিলে এ কথা বলা যায়ী না যে, সেই মধুর ধ্বনি শোনা প্ৰযুক্ত যে সুখ, সেই সুখ আমি পূৰ্বেই ইচ্ছা করিয়া বসিয়াছিলাম । এই কথাই ঠিক যে, সুঃখর ইচ্ছা না করিলেও ঐ সময়ে আমি সুখ পাইয়াছিলাম । এই উদাহরণের প্রতি লক্ষ্য করিলে এইরূপ বলিতে হয় যে, সন্ন্যাসমার্গের অবলম্বিত সুখের উপরি-উক্ত ব্যাখ্যা ঠিক নহে । 


5) সুখ ও দুঃখ, দুই স্বতন্ত্র ভাব



এবং ইহাও বলিতে হয় যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের ভাল-মন্দ পদার্থের উপভোগ করিবার স্বাভাবিক শক্তি থাকাতে ইন্দ্ৰিয়গণ যখন আপনাপন ব্যাপার সম্পাদন করে, এবং যদি কোন সময়ে তাহাদের অনুকূল বা প্ৰতিকূল বিষয় প্ৰাপ্তি হয়, তখন গোড়ায় তৃষ্ণা বা ইচ্ছা না থাকিলেও, আমাদের সুখদুঃখের অনুভব হইয়া থাকে । এই অভিপ্ৰায়েই, “মাত্রাস্পর্শের” দ্বারা শীতোষ্ণাদির অনুভব ঘটলে সুখদুঃখ হয়, গীতাতে এইরূপ কথিত হইয়াছে [গী|২|১৪] । সৃষ্টির অন্তৰ্গত বাহ্য পদার্থের সংজ্ঞা হইতেছে ‘মাত্ৰা’ গীতার উক্ত পদের অর্থ এই যে, যখন ইন্দ্ৰিয়াদির সহিত বাহ্য পদার্থের স্পর্শ অর্থাৎ সংযোগ হয় তখন সুখদুঃখের বেদনা উৎপন্ন হয় । কর্মযোগশাস্ত্রেরও ইহাই সিদ্ধান্ত । কৰ্কশ আওয়াজ কানের কেন অপ্রিয় এবং জিহ্বার মধুর রস কেন প্রিয়, কিংবা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না নয়নের কেন আনন্দদায়ক মনে হয়, এ সকলের কারণ কেহই বলিতে পারে না । মধুর রস পাইলে জিহ্বা পরিতুষ্ট হয়, এইটুকুই আমরা জানি । ইহা হইতে উপলব্ধি হইতেছে যে, আধিভৌতিক সুখের স্বরূপ কেবল ইন্দ্ৰিয়াধীন হওয়ায় অনেক সময় এই ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার চালাইতে থাকিলেই সুখ অনুভূত হয়, পরে তাহার পরিণাম যাহাই হোক্‌ না কেন । উদাহরণ যথা - কখনো কখনো এমন হয় যে, কোন চিন্তা মনে আসিলে ঐ বিচারসূচক শব্দ আপনিই মুখ দিয়া বাহির হয় । এই শব্দ কাহাকে জানাইবার জন্য বাহির হয় না; উল্টা, কত সময় এই সকল স্বাভাবিক ব্যাপারে মনের গুপ্ত অভিপ্ৰায় বা মৎলব বাহিরে প্রকাশ হইয়া পড়ায় ক্ষতি হইবারও সম্ভাবনা হয় । ছোট ছেলেরা প্ৰথম চলিতে শিখিলে, সমস্ত দিন অকারণ যে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহার কারণ এই যে, চলন ক্রিয়াতেই সেই সময় তাহাদের আনন্দ বোধ হয় । তাই, দুঃখের অভাবই সমস্ত সুখ এইরূপ না বলিয়া“ইন্দ্ৰিয়স্যেন্দ্ৰিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ” [গী|৩|৩৪] ইন্দ্ৰিয়সমূহে ও তাহাদের শব্দস্পর্শদি বিষয়সমূহে যে রাগ (প্রেম) ও দ্বেষ থাকে, এই দুই প্ৰথম হইতেই ‘ব্যবস্থিত’ অর্থাৎ স্বতন্ত্রসিদ্ধ বলা হইয়াছে । এবং এখন আমাদের দেখিতে হইবে যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের এই ব্যাপার কিরূপে আত্মার কল্যাণদায়ক হয় কিংবা সেগুলিকে আত্মার কল্যাণদায়ক করা যাইতে পারে । এই কারণে ভগবানের এই উপদেশ যে, ইন্দ্ৰিয় ও মনের বৃত্তিসমূহকে একেবারে বিনাশ করিবার চেষ্টা না করিয়া তাহাদিগকে আমাদের আত্মার উপকারে আনিবার জন্য আপনার অধীনে রাখিবে, স্বেচ্ছাচারী হইতে দিবে না । ভগবানের এই উপদেশ এবং তৃষ্ণা কিংবা তৃষ্ণারই ন্যায় অন্য সমস্ত মনোবৃত্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করা, এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ । জগতের সমস্ত কর্তৃত্ব ও পরাক্রম একেবারে উচ্ছিন্ন করিবে, গীতার তাহা তাৎপর্য নহে; বরং উহার অষ্টাদশ অধ্যায়ে [১৮|২৬] বলা হইয়াছে যে, কাৰ্যকর্তাতে সমবুদ্ধির সহিত ধৃতি ও উৎসাহ গুণও থাকা আবশ্যক । এই বিষয়ে অধিক বিচার আলোচনা পরে করিব । এখানে কেবল ইহাই আমাদের বিবেচ্য যে, ‘সুখ’ ও ‘দুঃখ’ দুই ভিন্ন বৃত্তি, কিংবা তন্মধ্যে একটি দ্বিতীয়টির অভাবমাত্র । এই বিষয়ে ভগবদ্‌গীতার অভিপ্রায় কি, তাহা উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইয়াছে । ‘ক্ষেত্র’ বস্তুটি কি তাহা বলিবার সময় সুখ ও দুঃখের পৃথক পৃথক গণনা করা হইয়াছে [গী|১৩|৬] । শুধু তাহা নহে, সুখ’ সত্ত্বগুণের লক্ষণ এবং ‘তৃষ্ণা’ রজোগুণের লক্ষণ [গী|১৪|৬,৭], ইহাও উক্ত হইয়াছে; এবং সত্ত্বগুণ ও রজোগুণ দুই পৃথক্‌ পৃথক্‌ । এই অনুসারেও, ভগবদ্‌গীতার এইমত স্পষ্ট জানা যাইতেছে যে, সুখ ও দুঃখ উভয়ে পরস্পরের প্রতিযোগী এবং দুই পৃথক্‌ পৃথক্‌ বৃত্তি । অষ্টাদশ অধ্যায়ে “কোন কর্ম দুঃখজনক বলিয়া ত্যাগ করিলে ত্যাগের ফল লাভ হয় না, কিন্তু এই প্ৰকার ত্যাগ রাজসিক উক্ত হয়” [গী|১৮|৮] এইরূপে যে রাজসিক ত্যাগের ন্যূনতা প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে, তাহাও “সমস্ত সুখই তৃষ্ণাক্ষয়মূলক”, এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধ ।


6) ইহলোক প্রাপ্ত সুখ-দুঃখবিপর্যয়



সমস্ত-সুখ তৃষ্ণাক্ষয়রূপ কিংবা দুঃখ-অভাবরূপ নহে এবং সুখ ও দুঃখ দুই স্বতন্ত্র বস্তু স্বীকার করিলেও এই দুই বেদনা পরম্পরবিরুদ্ধ বা প্ৰতিযোগী হওয়া প্ৰযুক্ত আর একটি প্রশ্ন এই উঠে যে, যাহার দুঃখের একটুও অনুভব নাই, সে সুখের মধুরতা উপলব্ধি করিতে পারে কি না ? কেহ কেহ বলেন যে, দুঃখানুভব না হইলে সুখের মধুরতা উপলব্ধি করা যায় না । উল্টাপক্ষে, স্বৰ্গস্থ দেবতাদিগের নিত্য সুখের দৃষ্টান্ত দিয়া অন্য পণ্ডিতেরা এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন যে, সুখের মধুরতা উপলব্ধি করিবার জন্য দুঃখের পূর্বানুভব অত্যাবশ্যক নহে । লবণাক্ত পদার্থের আস্বাদন না হইলেও যেমন মধু, গুড়, চিনি, আম, কলা ইত্যাদি পদার্থের পৃথক্‌ পৃথক্‌ মিষ্টত্ব অনুভব করা যায়, সেইরূপ সুখেরও অনেক প্রকার ভেদ থাকার কারণে পূর্বদুঃখানুভব ব্যতীতও সব সময়েই ভিন্ন ভিন্ন সুখের - যথা তুলার গদির পর পালকের গদিতে বসা বা পাল্‌কীর পর তাঞ্জামে চড়া ইত্যাদি সুখের পর্যায়ে বিরক্তি না জন্মিয়া - অনুভব হওয়া অসম্ভব নহে । কিন্তু এই জগতের ব্যবহার দেখিলে এই তর্ক নিরর্থক বলিয়া বুঝা যাইবে । পুরাণে দেবতাদিগেরও সঙ্কটে পতিত হইবার অনেক উদাহরণ আছে; এবং পুণ্যাংশ চলিয়া গেলে স্বৰ্গসুখও কালান্তরে বিলুপ্ত হয় । অতএব স্বৰ্গসুখের দৃষ্টান্ত উপযোগী নহে; এবং উপযোগী হইলেও স্বর্গের দৃষ্টান্ত আমাদের কি উপযোগী ? “নিত্যমেব সুখং স্বৰ্গে” এই কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিলেও ইহার পরেই “সুখং দুঃখমিহোভয়ম্‌” [মভা|শা|১৯০|১৪] - এই সংসারে সুখ ও দুঃখ দুই মিশ্রিত হইয়া থাকে - ইহাও কথিত আছে । এই কথা অনুসরণ করিয়াই সমর্থ শ্রীরামদাস স্বামী বলিয়াছেন যে, “জগতে সৰ্বসুখী কোন্‌ জন, বিচারিয়া দেখরে মন” । তা ছাড়া দ্রৌপদী সত্যভামাকে উপদেশ দিয়াছেন যে, -
“সুখং সুখেনেহ ন জাতু লভ্যং
দুঃখেন সাধ্বী লভতে সুখানি ৷”
অর্থাৎ সুখের দ্বারা সুখ কখন মেলে না; সুখ পাইতে হইলে সাধ্বীকে কষ্ট সহ্য করিতে হয়” [মভা|বন|২৩৩|৪] । ইহা লোকের অনুভূতি অনুসারে সত্য, এইরূপ বলিতে হয় । কারণ, জাম ঠোঁটেতে পড়িলেও মুখের ভিতর দিতে হয়, এবং মুখের ভিতর গেলেও তাহা কষ্ট করিয়া চিবাইতে হয় । অন্ততঃ এইটুকু নির্বিবাদ যে, দুঃখের পর প্ৰাপ্ত সুখের মিষ্টতা এবং সকল সময়ে বিষয়ভোগে নিমগ্ন ব্যক্তির সুখের মিষ্টতা, এই দুয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে । কারণ, নিত্য সুখভোগে সুখানুভব করিবার ইন্দ্রিয়শক্তি মন্দীভূত হয় । কথিত আছে যে, -
“প্ৰায়েন শ্ৰীমতাং লোকে ভোক্তুং শক্তির্ন বিদ্যতে ৷
কাষ্ঠান্যপি হি জীর্যন্তে দরিদ্রাণাং চ সর্বশঃ ॥”
অর্থাৎ - শ্ৰীমন্তদিগের সুস্বাদু অন্ন সেবনেরও প্রায় শক্তি থাকে না এবং দরিদ্রের কাষ্ঠও জীর্ণ হইয়া যায় [মভা|শা|২৮|২৯] । তাই, ইহলোকের ব্যবহারের বিচার করিতে হইলে বলিতে হয় যে, দুঃখ ব্যতীত সুখ সব সময়ে অনুভূত হয়, কি হয় না, এই প্ৰশ্নকে লইয়া বেশী রগড়ারগড়ি করায় কোন ফল নাই । “সুখস্যানন্তরং দুঃখং দুঃখস্যানন্তরাং সুখম্‌” [বন|২৬০|৪৯; শা|২৫|২৩] সুখের পরে দুঃখ এবং দুঃখের পরে সুখ লাগিয়াই আছে । মহাকবি কালিদাসও মেঘদূতে [মে|১১৪] বৰ্ণনা করিয়াছেন -
“কস্যৈকান্তং সুখমুপনতং দুঃখমেকান্ততো বা ৷
নীচৈর্গচ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রনেমিক্রমেণ ॥”
“কাহারই নিয়ত সুখের কিংবা নিয়ত দুঃখের অবস্থা হয় না । সুখদুঃখের দশা চক্রগতির ন্যায় একবার নীচের দিকে, একবার উপর দিকে হইয়া থাকে ।” এই ক্ৰম সর্বদাই চলিতে থাকে । এখন এই দুঃখ আমাদের সুখের মিষ্টতা বাড়াইবার জন্য উৎপন্ন হউক কিংবা প্ৰকৃতিজগতে তাহার হয়ত অন্য কোন উপযোগ থাকুক, উক্ত অনুভবসিদ্ধ ক্ৰমবিষয়ে মতভেদ হইতে পারে না । হাঁ, একথা কখনো অসম্ভব নহে যে, কেহ সর্বদাই বিষয়সুখ উপভোগ করিবে, আর উহার ফলে তাহার প্রাণে বিরক্তি আসিবে না; কিন্তু এই কর্মভূমিতে (মৃত্যুলোক বা সংসারে) এ কথা অবশ্য অসম্ভব যে, দুঃখ সম্পূর্ণ নষ্ট হইবে এবং সর্বদা সুখেরই অনুভব হইবে ।


7) সংসারে সুখ অধিক বা দুঃখ ?



যদি এ কথা সিদ্ধ হয় যে, সংসার নিছক সুখময় নহে, কিন্তু সুখদুঃখাত্মক, তবে এক্ষণে তৃতীয় প্রশ্ন স্বতই মনে উদয় হয় যে, সংসারে সুখ অধিক বা দুঃখ অধিক ?


7.1) পাশ্চাত্য সুখাধিক্যবাদ



আধিভৌতিক সুখকেই যাহারা পরম সাধ্য বলিয়া মানেন সেই সকল পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের মধ্যে অনেকে এই কথা বলেন, যে, সংসারে সুখাপেক্ষা যদি দুঃখই অধিক হইত, তবে সংসারের গোলযোগের মধ্যে না থাকিয়া, সকলে না হৌক অধিকাংশ লোকই আত্মহত্যা করিত । কিন্তু যখন মনুষ্য নিজের জীবনে বিরক্ত হইয়াছে দেখা যায় না, তখন এই অনুমান ঠিক বলিয়া ধরা যাইতে পারে যে, সংসারে দুঃখাপেক্ষা সুখভোগই অধিক হয়; এবং মানুষ সুখকেই পরম সাধ্য মনে করিয়া ধর্মাধর্মের নির্ণয়ও সেই মাপকাঠীতে করিয়া থাকে । 


7.2) পাশ্চাত্য মতের খণ্ডন : আত্মহত্যার সাথে সুখের সম্বন্ধ নাই



এখন উপরি-উক্ত মতকে ভালরূপে পরীক্ষা করিলে বুঝা যাইবে যে, এখানে সংসারসুখের সহিত আত্মহত্যার যে সম্বন্ধ জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহা প্রকৃতপক্ষে দেখিতে গেলে সত্য-নহে । এ কথা সত্য যে, কোন কোন প্রসঙ্গে কোন মনুষ্য সংসারে ক্লান্ত হইয়া আত্মহত্যা করে; কিন্তু লোকে তাহা অপবাদ বা পাগলামির মধ্যে গণনা করে । ইহা হইতে বুঝা যায় যে, সর্বসাধারণ লোকও আত্মহত্যা করা বা না করার সহিত সংসার-সুখের কোন সম্বন্ধ রাখে না, উহাকে এক স্বতন্ত্র বিষয় বলিয়া মনে করে । সুসভ্য মনুষ্য যে অসভ্য সমাজকে অত্যন্ত কষ্টময় বলিয়া মনে করে, সেই অসভ্য মনুষ্যসমাজের বিষয় বিচার করিয়া দেখিলেও এই অনুমানই নিষ্পন্ন হয় । প্ৰসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞ চার্লস ডার্বিন আপন প্ৰবাস-গ্রন্থে, দক্ষিণ আমেরিকার অত্যন্ত দক্ষিণ প্ৰান্তে যে সব অসভ্য লোক দেখিয়া আসিয়াছিলেন সেই অসভ্য লোকদিগের বর্ণনা করিবার সময় এইরূপ লিখিতেছেন যে, এই অসভ্য লোক-পুরুষ ও স্ত্রী সকলেই অত্যন্ত শীতের সময়েও বিনা বস্ত্ৰে উলঙ্গ অবস্থাতেই বেড়ায়; এবং ইহাদের নিকটে অন্নের সংগ্ৰহ না থাকিলে, কখনো কখনো তাহাদিগকে বিনা অন্নেই ক্ষুধার্ত হইয়া মরিতে হয়; তথাপি তাহাদিগের সন্তান-সন্ততি বাড়িয়াই চলিয়াছে ! (Darwin’s Naturalist’s Voyage Round the World, Chap X). এই অসভ্য মনুষ্যও নিজের প্রাণ বিসর্জন করে না, কিন্তু ইহা হইতে এরূপ অনুমান করা কি ঠিক্‌ যে, তাহাদের সংসার বা জীবন সুখময় ? তাহারা আত্মহত্যা করে না, একথা ঠিক; কিন্তু তাহার কারণের বিষয়ে সূক্ষ্মবিচার করিলে দেখা যাইবে সভ্য বা অসভ্য প্রত্যেক মনুষ্যই “আমি পশু নহি, আমি মনুষ্য” এই কথাতেই অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করে; এবং অন্য সমস্ত সুখ অপেক্ষা মনুষ্য হওয়ারূপ সুখকে এত বেশী মহত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করে যে, এই সংসার যতই কষ্টময় হোক না কেন, সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া মনুষ্যত্বের এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ হারাইতে সে কখনই প্ৰস্তুত থাকে না । মনুষ্য কেন, পশুপক্ষীও -আত্মহত্যা করে না । তাই, তাহাদের সংসারও সুখময় তাহা কি বলিতে পারি ? তাৎপর্য এই যে, মনুষ্য কিংবা পশুপক্ষী আত্মহত্যা করে না, তাই বলিয়া তাহাদের সংসার সুখময় এইরূপ ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত না করিয়া, সংসার যাহাই হউক, তাহার কোন অপেক্ষা না রাখিয়া নিছক্‌ অচেতনের সচেতন পরিণত হওয়াতেই অনুপম আনন্দ আছে, এবং তাহার মধ্যে মনুষ্যত্বের আনন্দ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এই সিদ্ধান্ত করা ঠিক্‌ । 

আমাদের শাস্ত্রকারেরাও বলিয়াছেন -
ভূতানাং প্ৰাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্ৰাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ ৷
বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্ৰাহ্মণাঃ স্বতাঃ ॥
ব্ৰাহ্মণেষু চ বিদ্বাংসঃ বিদ্ধৎসু কৃতবুদ্ধয়ঃ ৷
কৃতবুদ্ধিষু কর্তারঃ কর্তৃষু ব্ৰহ্মবাদিনঃ ॥
অর্থাৎ অচেতনদিগের মধ্যে সচেতন, সচেতনের মধ্যে বুদ্ধিসম্পন্ন জীব, বুদ্ধিসম্পন্ন জীবদিগের মধ্যে মনুষ্য, মনুষ্যের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, ব্ৰাহ্মণের মধ্যে বিদ্বান, বিদ্বানের মধ্যে কৃতবুদ্ধি (যাহার সুসংস্কৃত বুদ্ধি), কৃতবুদ্ধির মধ্যে কর্তা এবং কর্তাদিগের মধ্যে ব্ৰহ্মবাদী শ্ৰেষ্ঠ । এইরূপ, শাস্ত্ৰে যে ক্ৰমোচ্চপদবীর বর্ণনা আছে তাহা এইভাবেই প্রযুক্ত হইয়াছে [মনু|১|৯৬,৯৭; মভা|উদ্যো|৫|১,২]; এবং এই নীতি অনুসারে ৮৪ লক্ষ যোনির মধ্যে নরদেহ শ্রেষ্ঠ, নরের মধ্যে মুমুক্ষু, মুমুক্ষুর মধ্যে সিদ্ধ শ্রেষ্ঠ – প্রাকৃত গ্রন্থাদিতেও এইরূপ কথিত হইয়াছে । “সবসেজীব্‌প্যারা” এই যে চলিত কথা আছে তাহারও তাৎপর্য এই; এবং এই কারণেই সংসার দুঃখময় হইলেও, কেহ আত্মহত্যা করিলে, লোকে তাহাকে পাগল বলে এবং ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তাহাকে পাপী বলা হয় [মভা|কর্ণ|৭০|১৮]; এবং আত্মহত্যার চেষ্টাও আইনে অপরাধ বলিয়া ধরা হইয়া থাকে । সংক্ষেপে ইহা সিদ্ধ হইল যে, মনুষ্য আত্মহত্যা করে না, এই কথা ধরিয়া সংসারের সুখময়ত্বের সিদ্ধান্ত করা ঠিক নহে । এই অবস্থাতে ‘এই সংসার সুখময় বা দুঃখময়’, আমার এই প্রশ্নের নির্ণয়ের জন্য পূর্বকর্মানুসারে কোন বিশেষ পদবীতে-পতিত নরদেহ প্রাপ্তিরূপ নিজের নৈসর্গিক ভাগ্যের কথা একপাশে সরাইয়া রাখিয়া, তদুত্তরকালীন অর্থাৎ সংসার-ঘটিত বিষয়েরই আমাদের বিচার করা আবশ্যক । ‘মনুষ্য আত্মহত্যা করে না, বরঞ্চ বাঁচিবার ইচ্ছা করে’ ইহাই তো কেবল-সংসার-প্রবৃত্তির কারণ; আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মতানুসারে সংসারের সুখময় হইবার পক্ষে ইহা কোন প্রমাণ নহে । এই কথা অন্যপ্রকারে ব্যক্ত করিতে চাহিলে বলিতে হয় যে, আত্মহত্যা না করিবার বুদ্ধি স্বাভাবিক, তাহা সাংসারিক সুখদুঃখের কোন প্রকার তারতম্য হইতে উৎপন্ন নহে, এবং সেই জন্যই ইহা হইতে এই কথা সিদ্ধ হইতে পারে না যে, সংসার সুখময় ।


7.3) সুখের ইচ্ছার অপার বৃদ্ধি



কেবলমাত্র মনুষ্যজন্ম পাইবার মহদ্‌ভাগ্য এবং তৎপরে মনুষ্যের সংসার এই উভয়কে ভ্রমবশত অভিন্ন মনে করিবে না; মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যের সংসার অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার, এই উভয় পৃথক, এই পার্থক্যের উপর লক্ষ্য রাখিয়া ইহা নিশ্চয় করিতে হইবে যে, এই সংসারে শ্রেষ্ঠ নরদেহধারী প্রাণির সুখ অধিক, কি দুঃখ অধিক ? এই প্রশ্নের যথার্থ সমাধান করিতে হইলে, প্রত্যেক মনুষ্যের ‘উপস্থিত’ বাসনার মধ্যে কত বাসনা সফল ও কত বাসনা নিষ্ফল হয়, ইহা দেখা ভিন্ন অন্য উপায় নাই । ‘উপস্থিত’ বলিবার কারণ এই যে, যে সব জিনিষ সভ্য অবস্থায় সকলেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তাহা নিত্য ব্যবহারে আসায় তদুৎপন্ন সুখ আমরা ভুলিয়া যাই, এবং যে বস্তুর গরজ নূতন উৎপন্ন হয়, তাহার মধ্যে কোন্‌টা পাওয়া গেল তাহা দেখিয়া এবং কেবল তাহা ধরিয়াই আমরা সংসারের সুখদুঃখের নির্ণয় করিয়া থাকি । বর্তমানকালে আমরা কত সুখসাধন প্রাপ্ত হইয়াছি তাহার তুলনা করা এবং শতবর্ষ পূর্বে এই সকলের মধ্যে কতকগুলি সুখসাধন পাওয়া গিয়াছিল; এবং আজিকার মুহূর্তে আমি সুখী কি সুখী নই তাহার বিচার করা – এই দুই বিষয় অত্যন্ত ভিন্ন । উদাহরণ যথা – শত বৎসর পূর্বের গরুর গাড়ীতে ভ্রমণ করা অপেক্ষা এখনকার আগ্‌গাড়ীতে ভ্রমণ করা অধিকতর সুখদায়ক, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবে । কিন্তু এখন ‘আগ্‌গাড়ী’তে ভ্রমণ সুখের এই সুখত্ব আমরা ভুলিয়া গিয়া কোনদিন গাড়ী আসিতে বিলম্ব হওয়ায় ডাকে চিঠি পাইতে বিলম্ব হইলে আমাদের বড় খারাপ লাগে । তাই, মনুষ্যের উপস্থিত সুখদুঃখের বিচারে উপলব্ধ সুখসাধন ধর্তব্যের মধ্যে না আনিয়া, মনুষ্য উপস্থিত ‘গরজ’ অনুসারে সুখদুঃখের বিচার করিয়া থাকে । এবং, এই গরজ সম্বন্ধে বিচার করিলে, তাহার আর শেষ দেখা যায় না, - উহা অনন্ত ও সীমাহীন দেখিতে পাওয়া যায় । আজ এক ইচ্ছা সফল হইলে কাল আর এক নূতন ইচ্ছা উৎপন্ন হয় এবং এই নূতন ইচ্ছা সফল করিতেই হইবে, এইরূপ মনে হইতে থাকে । যখন যখন মনুষ্যের ইচ্ছা বা বাসনা সফল হইতে থাকে, তখন তখনই তাহার দৌড় এক পা সম্মুখে বাড়িয়া চলে, এবং যখন ইহা অনুভবসিদ্ধ হয় যে, সকল ইচ্ছা বা বাসনা সফল হওয়া সম্ভব নহে, তখন আর সন্দেহ থাকে না যে, মনুষ্যের অদৃষ্টে দুঃখ ছাড়িতে চাহে না । সমস্ত সুখই কেবল তৃষ্ণাক্ষয়রূপ এবং যতই সুখলাভ হোক না কেন, মনুষ্য অসন্তুষ্ট থাকে, এই দুই বিষয়ের ভেদের প্রতি এই স্থানে বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । প্রত্যেক সুখ দুঃখাভাবরূপ নহে, কিন্তু সুখ ও দুঃখ ইন্দ্রিয়সমূহের দুই স্বতন্ত্র বেদনা, ইহা এক কথা, এবং মনুষ্য কোন এক সময়ে প্রাপ্ত সুখকে ভুল করিয়া ধর্তব্যের মধ্যে না আনিয়া এবং অধিকাধিক সুখলাভের উদ্দেশ্যে অসন্তুষ্ট থাকে, ইহা পূর্বোক্ত হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা । ইহাদের মধ্যে প্রথম তর্ক সুখের প্রকৃত স্বরূপ লইয়া; এবং দ্বিতীয় তর্ক এই যে, প্রাপ্ত সুখে মনুষ্যের পূর্ণ তৃপ্তি হয়, কি হয় না ।


7.4) সুখের ইচ্ছা সুখোপভোগে তৃপ্ত হয় না ⇒ সংসারে দুঃখের আধিক্য



বিষয়বাসনা সর্বদাই সমান বাড়িয়া যায় বলিয়া প্রতিদিন নূতন নূতন সুখ লাভ না হইলেও পূর্ব সুখ পুনঃ পুনঃ ভোগ করিব এইরূপ মনে করিয়া মনের আকাঙ্ক্ষার কিছুমাত্র হ্রাস হয় না । বিটেলিয়স্‌ নামে এক রোমক সম্রাটের সম্বন্ধে এইরূপ কথিত আছে যে, জিহ্বার সুখ পুনঃ পুনঃ পাইবার উদ্দেশ্যে ঔষধ সেবন করিয়া উদরস্থ অন্ন বাহির করিয়া ফেলিতেন এবং প্রতিদিন তিনি অনেকবার ভোজন করিতেন । কিন্তু এই প্রসঙ্গে যযাতি রাজার কথা ইহা অপেক্ষা আরও জ্ঞানপ্রদ । যযাতি রাজা শুক্রাচার্যের শাপে জরাগ্রস্ত হইলে, সেই জরা অন্যকে দিয়া তৎপরিবর্তে সেই ব্যক্তির তারুণ্য গ্রহণ করিতে পারিবেন বলিয়া শুক্রাচার্য কৃপা করিয়া তাঁহার সুবিধা করিয়া দিয়াছিলেন । তখন পুরু নামক নিজ পুত্রের যৌবন লইয়া, যযাতি এক হাজার বৎসর সমান বিষয়সুখ উপভোগ করিলেও পরিণামে তাঁহার উপলব্ধি হইল যে, পৃথিবীর সমস্ত পদার্থ একজন মনুষ্যেরও সুখবাসনা তৃপ্ত করিতে অসমর্থ । তখন তাঁহার মুখ হইতে এই কথা বাহির হইল –
ন জাতু কামঃ কামানাম্‌ উপভোগেন শাম্যতি ৷
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্নেব ভুয় এবাভিবর্ধতে ॥
অর্থাৎ “সুখের উপভোগে বিষয়বাসনার তৃপ্তি না হইয়া হবন দ্রব্যের দ্বারা অগ্নির ন্যায় বিষয়ের উপভোগ বিষয়বাসনা আরও বৃদ্ধি পায়” [মভা|আ|৭৫|৪৯] । 


7.5) আমাদের শাস্ত্রকারদের তদনুকুল সিদ্ধান্ত



এই শ্লোকই মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|২|৯৪] । সুখসাধন যতই উপলব্ধি হউক না কেন, ইন্দ্ৰিয়ের লালসা সতত বর্ধিতই হইতে থাকে; তাই কেবল সুখভোগের দ্বারা সুখেচ্ছা কখনই তৃপ্ত হয় না, উহাকে প্রতিরুদ্ধ করিবার জন্য অন্য কোন উপায় অবলম্বন আবশ্যক হয়, ইহাই হইল তাৎপর্য । এই তত্ত্ব আমাদিগের ধর্মশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় সকল গ্ৰন্থকারদিগের অভিমত হওয়ায়, তাঁহাদের প্রথম বক্তব্য এই যে, প্ৰত্যেক ব্যক্তির নিজের কামোপভোগে সংযম অবলম্বন করা আবশ্যক । বিষয়োপভোগই এই সংসারের পরম সাধ্য, এইরূপ যাহারা বলেন তাহার এই অনুভূত সিদ্ধান্তের প্রতি একটুও লক্ষ্য করিলেই তাঁহাদের মতের অসারতা সহজেই উপলব্ধি করিবেন । বৈদিক ধর্মের, এই সিদ্ধান্ত বৌদ্ধধর্মেও স্বীকৃত; এবং যযাতির পরিবর্তে মান্ধাতা নামক পৌরাণিক রাজা মৃত্যুকালে বলিয়াছেন :- 
ন কহাপণবস্‌সেন তিত্তি কামেসু বিজতি ৷
অপি দিব্বেসু কামেসু রতিং সো নাধিগচ্ছতি ॥
“কার্ষাপণ নামক মোহরের বৃষ্টি হইলেও কামের তৃপ্তি হয় না, এবং স্বৰ্গসুখ মিলিলেও কামী পুরুষের কামের নিবৃত্তি হয় না” ইহা ধর্মপদ নামক বৌদ্ধগ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে [১৮৬, ১৮৭] । ইহা হইতে বলা যায় যে, বিষয়োপভোগসুখের পূর্ণতা কখনই হয় না, তাই প্ৰত্যেক মনুষ্য মনে করে - “আমি দুঃখী । মনুষ্যমাত্রের এই অবস্থা লক্ষ্য করিলে মহাভারতে কথিত সিদ্ধান্তই ঠিক মনে হয় যে -
সুখাদ্ বহুতরং দুঃখং জীবিতে নাস্তি সংশয়ঃ ॥
অর্থাৎ “এই জীবনে অর্থাৎ এই সংসারে সুখ অপেক্ষা দুঃখই অধিক” [শা|২০৫|৬ ; ৩৩০|১৬] । এই সিদ্ধান্ত সাধু তুকারাম এই প্রকারে বলিয়াছেন -
“সুখপাহতা জবাপাতেঁ ৷ দুঃখ পর্বতাএবঢেঁ ॥”
“সুখ যব প্রমাণ, দুঃখ পর্বত প্ৰমাণ” [তুকা|গা|২৯৮৮]
উপনিষৎকারদিগেরও ইহাই সিদ্ধান্ত [মৈত্র্যু|১|২|৪] । গীতাতেও মনুষ্যের জন্ম অ-শাশ্বত ও ‘দুঃখের ঘর’ এবং এই সংসার অনিত্য ও “সুখহীন” [গী|৮|১৫; ৯|৩৩] কথিত হইয়াছে । 


7.6) শোপেনহরের মত



জর্মন পণ্ডিত শোপেন্‌হৌয়েরেরও এই মত, এবং তাহা সপ্রমাণ করিবার জন্য তিনি এক বিচিত্র দৃষ্টান্ত যোজনা করিয়াছেন । তিনি বলেন যে, মনুষ্যের সমস্ত সুখেচ্ছার মধ্যে যত সুখের ইচ্ছা সফল হয় সেই পরিমাণে আমরা তাহাকে সুখী মনে করি; এবং সুখোপভোগ সুখেচ্ছা অপেক্ষা কম হইলে সেই মনুষ্যকে সেই পরিমাণে দুঃখী বলি । ইহা গণিতের রীতিতে দেখাইতে হইলে, সুখোপভোগকে সুখেচ্ছার দ্বারা ভাগ করিয়া ভগ্নাংশরূপে এইরূপ লিখিতে হয় যথা -
সুখোপভোগ (বিভাজ্য) / সুখেচ্ছা (বিভাজক)
কিন্তু এই ভগ্নাংশের এই একটু বিশেষত্ব যে, তাহার বিভাজক অর্থাৎ সুখেচ্ছা তাহার বিভাজ্য অপেক্ষা অর্থাৎ সুখোপভোগ অপেক্ষা বরাবরই অধিক পরিমাণে বাড়িতে থাকে । যদি এই ভগ্নাংশ প্রথমে ½ হয়, এবং পরে উহার বিভাজ্য 1 হইতে 3 হয়, তবে উহার বিভাজক 2 হইতে 10 হইবে - অর্থাৎ ঐ ভগ্নাংশ 3 হইয়া যায় । তাৎপর্য এই যে, যদি বিভাজ্য তিন গুণ বৃদ্ধি হয়, তবে বিভাজক পাঁচগুণ বাড়িয়া যায় । তাহার ফল এই যে, ঐ ভগ্নাংশ পূর্ণতার দিকে না যাইয়া অধিকাধিক অপূর্ণতার দিকেই চলিয়া যায় । অতএব মনুষ্যের পূর্ণ সুখ আশা করা বৃথা । প্রাচীনকালে সুখ কি পরিমাণ ছিল তাহার বিচার করিবার সময় এই ভগ্নাংশের বিভাজ্যের প্রতি আমরা পুর্ণ লক্ষ্য রাখি, কিন্তু বিভাজ্য অংশ অপেক্ষা বিভাজক যে বেশী বাড়িয়া গিয়াছে সেদিকে আমরা লক্ষ্য করি না । কিন্তু যখন সুখদুঃখের মাত্রারই নির্ণয় করিতে হইবে, তখন কোন কালের অপেক্ষা না করিয়া কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, উক্ত ভগ্নাংশের বিভাজ্য ও বিভাজক এই উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধ কিরূপ । আবার ইহা স্পষ্টই উপলব্ধ হইবে যে, এই অপূর্ণাঙ্ক কখনই পূর্ণ হইতে পারে না । “ন জাতু কামঃ কামানাং” এই মনুবচনের [২|৯৪] অর্থই এই ।

সুখদুঃখ মাপিবার উষ্ণতামাপক যন্ত্রের মত কোন নিশ্চিত সাধন না থাকায়, গণিতের পদ্ধতি অনুসারে এইরূপ সুখদুঃখের তারতম্য-বিন্যাস অনেকের পছন্দ না হওয়া সম্ভব । কিন্তু এই যুক্তিবাদ হইতে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, সংসারে মনুষ্যের সুখ অধিক ইহা প্ৰমাণ করিবারও কোন নিশ্চিত উপায় নাই । এই আপত্তি উভয়পক্ষের নিকটেই সমান, তাই উক্ত সাধারণ সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অর্থাৎ সুখোপভোগ অপেক্ষা সুখেচ্ছার অসংযত বৃদ্ধি হয় এই যে সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে উহা কোনও বাধা আনিতে পারে না । ধর্মগ্রন্থসমূহে এবং জগতের ইতিহাসে এই ইতিহাসের পোষক অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় । স্পেন দেশে যখন মুসলমান রাজ্য ছিল সেই সময় তৃতীয় আবদুল রহমান নামক তত্রস্থ এক ন্যায়পরায়ণ ও পরাক্রমী সম্রাট নিজের দিনগুলি কেমন কাটিতেছে তাহার রোজনাম্‌চা রাখিতেন এবং সেই রোজনাম্‌চা অনুসারে, তাহার রাজত্বের ৫০ বৎসরের মধ্যে ১৪ দিন মাত্র পুর্ণ সুখে কাটিয়াছে তিনি দেখিতে পাইলেন, এইরূপ মুসলমান ইতিহাসে কথিত হইয়াছে । [Moors in Spain, P.128, “Story of the Nations Series”]. একজন হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, জগতে, বিশেষতঃ য়ুরোপখণ্ডে, প্রাচীন ও অর্বাচীন তত্ত্বজ্ঞানীদের মত আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, তাঁহাদের প্রায় অর্ধেক “সংসার সুখময়” প্ৰতিপাদন করিয়াছেন এবং অপর অর্ধেক “সংসার দুঃখময়” প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । অর্থাৎ সংসারকে সুখময় ও দুঃখময় প্রতিপাদনকারীর সংখ্যা প্ৰায় সমান । [Macmillan’s Promotion of Happiness, P.26.]. এই সংখ্যার উপর হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মতের ভার চাপাইলে, তৌল কোনদিকে ঝুঁকিবে তাহা আর বলিতে হইবে না ।


8) অসন্তোষের উপযোগ


সাংসারিক সুখদুঃখের উপরি-উক্ত বিচার শুনিয়া কোন সন্ন্যাসমার্গী ব্যক্তি এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, “সুখ বাস্তবিক পদাৰ্থ না হওয়ায় তৃষ্ণাত্মক সমস্ত কর্ম না ছাড়িলে শান্তি নাই, এই কথা তুমি স্বীকার না করিলেও, তোমার কথা অনুসারেই তৃষ্ণা হইতে অসন্তোষ এবং অসন্তোষ হইতে পরে দুঃখ হয়; তাহা হইলে নিদেন এই অসন্তোষ দূর করিবার জন্য মনুষ্য, নিজের সমস্ত তৃষ্ণা এবং তৃষ্ণার সহিত সাংসারিক সমস্ত কর্ম - তাহা পরোপকারের জন্যই হৌক বা স্বার্থের জন্যই হৌক - ত্যাগ করিয়া সর্বদাই সন্তুষ্ট থাকিবে এইরূপ বলিতে বাধা কি ?” মহাভারতেও আছে - “অসন্তোষস্য নাস্ত্যন্তস্তুষ্টিন্তু পরমং সুখম্‌” অসন্তোষের অন্ত নাই, সন্তোষই পরম সুখ [মভা|বন|২১৫|২২] । জৈন ও বৌদ্ধধর্মের ভিত্ত্বিও এই তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত; এবং পাশ্চাত্য দেশে শোপেনহৌর অর্বাচীনকালে এই মত প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । [Schopenhauer’s World as will and Representation, Vol II. Chap.46. শোপেনহৌর কৃত সংসারের দুঃখময়ত্ব বর্ণনা অত্যন্ত সরস । মুলগ্রন্থ জর্মন ভাষায় লিখিত এবং ইংরাজীতে উহার অনুবাদ আছে ।] 

কিন্তু ইহার বিপরীতে এইরূপ প্রশ্নও করা যাইতে পারে যে, জিহ্বা দ্বারা কখন কখন অপশব্দ উচ্চারিত হয় বলিয়া জিহ্বার সহিত সমস্ত সম্বন্ধ উচ্ছেদ করিতে হইবে কি ? অগ্নির দ্বারা কখন কখন গৃহদাহ হয় বলিয়া কি সমস্ত অগ্নিকে বিসর্জন দিয়া লোকে রাঁধাবাড়াও ছাড়িয়া দিয়াছে ? অগ্নির কথা কি, বিদ্যুৎশক্তিকেও যোগ্য সীমার মধ্যে রাখিয়া আমরা যেমন তাহাকে নিত্য কাজে খাটাইয়া লই, সেইরূপ তৃষ্ণা কিংবা অসন্তোষেরও সুব্যবস্থিত কোন সীমা বাঁধিয়া দেওয়া অসম্ভব নহে । হাঁ, অসন্তোষ যদি সর্বাংশে ও সর্বপ্রসঙ্গে হানিজনক হয় তবে সে স্বতন্ত্র কথা । কিন্তু বিচারান্তে তাহা দেখা যায় না । অসন্তোষ অর্থে নিছক আকাঙ্ক্ষা বা হাহুতাশ নহে । এই অসন্তোষ শাস্ত্রকারেরাও গর্হিত বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন । কিন্তু অমোদের বর্তমান অবস্থাতে কেবলই আক্ষেপ করিতে না থাকিয়া শান্ত ও সমচিত্ততার সহিত যথাশক্তি ঐ অবস্থার উত্তরোত্তর সংশোধন করিয়া যথাসাধ্য উহাকে উত্তম অবস্থায় পরিণত করিবার যে ইচ্ছা সেই ইচ্ছার মূলভূত যে অসন্তোষ তাহা গৰ্হিত বলিয়া কখন স্বীকার করা বাইতে পারে না । চাতুর্বর্ণ্যের বন্ধনে আবদ্ধ সমাজে ব্ৰাহ্মণ যদি জ্ঞানের, ক্ষত্ৰিয় যদি ঐশ্বর্যের এবং বৈশ্য যদি ধনধান্যের এই প্ৰকার ইচ্ছা বা বাসনা ছাড়িয়া দেয় তাহা হইলে সমাজ যে শীঘ্রই অধোগতি প্ৰাপ্ত হয়, এ কথা আর বলিতে হইবে না । এই অভিপ্ৰায় মনেতে আনিয়া ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছেন যে, “যজ্ঞ-বিদ্যা-সমুখানমসন্তোষঃ শ্ৰিয়ং প্ৰতি” [শাং|২৩|৯] অর্থাৎ “যজ্ঞ, বিদ্যা, উদ্যোগ ও ঐশ্বর্য বিষয়ে অসন্তোষই ক্ষত্রিয়েয় গুণ” । সেইরূপ বিদুলও আপন পুত্রকে উপদেশ করিবার সময় বলিয়াছিলেন যে, “সন্তোষো বৈ শ্ৰিয়ং হন্তি” [মভা|উ|১৩২|৩৩] অৰ্থাৎ সন্তোষে ঐশ্বর্য নাশ হয় । অন্য এক প্রসঙ্গে ইহাও বলা হইয়াছে যে, “অসন্তোষঃ প্রিয়ো মূলং” [মভা|সভা|৫৫|১১] । ব্ৰাহ্মণধর্মে সন্তোষকে গুণ বলা হইয়াছে; তথাপি তাহার অর্থ চাতুর্বর্ণ্যধর্মানুসারে দ্রব্যবিষয়ে কিংবা ঐহিক ঐশ্বর্যসম্বন্ধে সন্তোষ ইহাই অভিপ্ৰেত । আমি যেটুকু জ্ঞানলাভ করিয়াছি তাহাতেই আমি সন্তুষ্ট এইরূপ যদি কোন ব্ৰাহ্মণ বলে, তাহা হইলে সে নিজেরই সর্বনাশ করিবে । সেইরূপ বৈশ্য কিংবা শূদ্র আপনি আপনি ধর্মানুসারে যাহা পাইয়াছে তাহাতেই যদি সন্তুষ্ট থাকে, তাহারও ঐরূপ দশা হইবে । সারাংশ, অসন্তোষই সকল ভাবী উৎকর্ষ, প্রযত্ন, ঐশ্বর্য এবং মোক্ষেরও বীজ । এই অসন্তোষ যদি আমরা সমূলে বিনষ্ট করি, তাহা হইলে ইহলোকে ও পরলোকে আমাদের দুৰ্গতি হইবে, ইহা আমাদের প্রত্যেকের সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক । [Cf. “Unhappiness is the cause of progress” Dr. Paul Carus’ “The Ethical Problem”, P.251, 2nd Ed.]

ভগবদ্‌গীতাতেও শ্ৰীকৃষ্ণের উপদেশ শুনিবার সময় অর্জুন বলিয়াছেন যে, “ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্‌” [গী|১০|১৮], অর্থাৎ “তোমার অমৃতবাণী শুনিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না, অতএব তোমার বিভূতির কথা পুনঃ পুনঃ আমাকে বল” । এই কথা অর্জুন বলিলে পর ভগবান আবার স্বীয় বিভূতির কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন; তিনি এরূপ উপদেশ করেন নাই যে, “তুমি আপন ইচ্ছা সম্বরণ কর, অতৃপ্তি বা অসন্তোষ ভাল নহে” । ইহা হইতে সিদ্ধ হইতেছে, ভাল কিংবা কল্যাণকর বিষয় সম্বন্ধে উচিত অসন্তোষ হওয়া ভগবানেরও অভীষ্ট । “যশসি চাভিরুচিৰ্ব্যসনং শ্রুতৌ” অর্থাৎ অভিরুচি হওয়া চাই - যশের অভিরুচি, ব্যসন হওয়া চাই - বিদ্যার ব্যসন; তাহা গৰ্হিত নহে । ভর্তৃহরিও এক শ্লোকে এইরূপ বলিয়াছেন । 


9) উহার দুষ্পরিণাম হটাইবার উপায়



কামক্রোধাদি বিকারের মত অসন্তোষকেও অসংযত হইতে দেওয়া ঠিক নহে । অসংযত হইলে তাহা সর্বস্ব নাশ করিবে নিঃসন্দেহ । এই হেতু কেবল বিষয়ভোগের জন্য তৃষ্ণার উপর তৃষ্ণা কিংবা আশার উপর আশা চাপাইয়া ঐহিক সুখের পশ্চাতে সর্বদা ছুটিয়া চলে যে ব্যক্তি তাহার সম্পদকে গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে “আসুরী সম্পদ্‌” বলা হইয়াছে । এইরূপ অসংযত লালসার দরুণ মানবমনের সাত্ত্বিক বৃত্তির উচ্ছেদ হইয়া মনুষ্য শুধু যে অধোগতি প্ৰাপ্ত হয় তাহা নহে, তৃষ্ণারও পুর্ণ তৃপ্তি অসম্ভব হওয়ায় কামোপভোগ-বাসনা অধিকাধিক বাড়িয়া গিয়া তাহাতেই শেষে মনুষ্যের বিনাশ হয় । কিন্তু উল্টা পক্ষে, তৃষ্ণা ও অসন্তোষের এই দুষ্পরিণাম পরিহার করিবার জন্য সর্বপ্রকার তৃষ্ণার সঙ্গে সমস্ত কর্ম একেবারে ত্যাগ করাও সাত্ত্বিক মার্গ নহে । উপরি-উক্ত কথা অনুসারে, তৃষ্ণা বা অসন্তোষই ভাবী উৎকর্ষের বীজ; তাই চোরের ভয়ে নিৰ্দোষকে মারিবার প্রযত্ন না করিয়া কোন্‌ তৃষ্ণা হইতে বা অসন্তোষ হইতে দুঃখ হয়, তাহার ঠিক বিচার করিয়া সেই দুঃখজনক আশা, তৃষ্ণা বা অসন্তোষ ত্যাগ করাই উচিত মার্গ স্বীকার করিতে হইবে । তাহার জন্য সমস্ত কর্মত্যাগ করিবার কোন কারণ নাই । দুঃখজনক আশা ছাড়িয়া দিয়া স্বধর্মানুসারে কর্ম করিবার এই যে যুক্তি বা কৌশল, তাহাকেই ‘যোগ’ বা ‘কর্মযোগ’ বলে [গী|২|৫০]; এবং তাহাই গীতার মুখ্যরূপে প্ৰতিপাদ্য হওয়ায় গীতাতে কোন্‌ প্রকারের আশা দুঃখজনক বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে, সেই সম্বন্ধে এইখানে আরও কিছু বিচার-আলোচনা করিব ।



10) সুখদুঃখ অনুভবের আত্মবশ্যতা, এবং ফলাশার লক্ষণ



মনুষ্য কানে শোনে, ত্বকের দ্বারা স্পর্শ করে, চোখে দেখে, জিহ্বার দ্বারা আস্বাদন করে ও নাকের দ্বারা আঘ্রাণ করে । ইন্দ্ৰিয়সমূহের এই ব্যাপার স্বাভাবিক বৃত্তির যেরূপ অনুকুল বা প্ৰতিকুল হয়, সেই অনুসারে মনুষ্যের সুখ বা দুঃখ হইয়া থাকে । সুখদুঃখের বস্তু-স্বরূপের এই লক্ষণ উপরে প্রদত্ত হইয়াছে । কিন্তু সুখদুঃখের বিচার কেবল এই ব্যাখ্যাতেই সম্পূর্ণ হয় না । আধিভৌতিক সুখদুঃখ উৎপন্ন হইবার পক্ষে ইন্দ্ৰিয়গণের সহিত বাহ্য পদার্থের সংযোগ প্ৰথমে নিতান্ত আবশ্যক হইলেও, সুখদুঃখের অনুভব মনুষ্যের নিকট পরে কি প্রকারে আসিয়া থাকে, তাহার বিচার করিলে উপলব্ধি হইবে যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের স্বাভাবিক-ব্যাপার-নিষ্পন্ন এই সুখদুঃখ জানিবার কাজ অর্থাৎ নিজের জন্য তাহা স্বীকার বা অস্বীকার করিবার কাজ পরিশেষে প্ৰত্যেক মনুষ্যকে নিজের মনের দ্বারাই করিতে হয় । মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, “চক্ষুঃ পশ্যতি রূপাণি মনসা ন তু চক্ষুষা” -  দেখিবার কাজ কেবল চোখের দ্বারা হয় না, তাহাতে মনের সাহায্য নিতান্তই আবশ্যক হয় [মভা|শা|৩১১|১৭], এবং সেই মন যদি ব্যাকুল থাকে, তবে চোখে দেখিলেও, না দেখিবার মতো হইয়া থাকে । বৃহদারণ্যক-উপনিষদেও [১|৫|৩] উক্ত দেখা যায় যে, “আমার মন অন্যদিকে থাকার দরুণ আমি দেখিতে পাই নাই (অন্যত্রমনা অভুবং নাদর্শম্‌) আমার মন অন্যত্র আছে বলিয়া আমি শুনিতে পাই নাই (অন্যত্রমনা অভুবং নাশ্রৌষম্‌)” । ইহা হইতে আধিভৌতিক সুখদুঃখের অনুভব ঘটিবার পক্ষে কেবল ইন্দ্ৰিয়গণই কারণ নহে, তাহার সঙ্গে মনেরও সাহায্য দরকার হয় - ইহা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে; এবং আধ্যাত্মিক সুখদুঃখ তো মানসিক হইয়াই থাকে । এই সমস্ত হইতে দেখা যায়, - সর্বপ্রকার সুখদুঃখানুভূতি শেষে মনকেই অবলম্বন করিয়া থাকে । এবং ইহা যদি সত্য হয়, তবে মনোনিগ্রহের দ্বারা সুখদুঃখানুভূতিরও নিগ্ৰহ অসাধ্য নহে, ইহা স্বতই উপলব্ধি হইবে । ইহারই প্ৰতি লক্ষ্য রাখিয়া মনু সুখদুঃখের লক্ষণ, নৈয়ায়িকদিগের লক্ষণ হইতে ভিন্নরূপে বলিয়াছেন । তিনি বলেন -
সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বমাত্মবশং সুখম্ ৷
এতদ্‌ বিদ্যাৎ সমাসেন লক্ষণং সুখদুঃখয়োঃ ॥
অর্থাৎ “যাহা কিছু পরবশ তাহাই দুঃখ, যাহা কিছু আপনার আয়ত্ত তাহাই সুখ - ইহাই সুখদুঃখের সংক্ষিপ্ত লক্ষণ” [মনু|৪|১৬০] । নৈয়ায়িকদিগের লক্ষণের অন্তর্ভূত ‘বেদনা’ শব্দে শারীরিক ও মানসিক উভয় বেদনারই সমাবেশ হয় এবং তাহা দ্বারা সুখদুঃখের বাহ্যবস্তুস্বরূপও দেখান হয়; মনু সুখদুঃখের কেবল আভ্যন্তরিক অনুভূতির উপরেই বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছেন । এইটুকুর প্রতি লক্ষ্য রাখিলে, সুখদুঃখের উক্ত দুই লক্ষণের মধ্যে কোনই বিরোধ থাকে না । সুখদুঃখানুভূতির ইন্দ্রিয়াবলম্বিতা এইরূপে বিলুপ্ত হইলে বলিতে হয় যে -
“ভৈষজ্যমেতদ্‌ দুঃখস্য যদেতন্নানুচিস্তয়েৎ ৷”
অর্থাৎ - “দুঃখের চিন্তা না করাই দুঃখনিবারণের মহৌষধ” [মভা|শা|২০৫|২]; এবং এই নীতি অনুসারে মনকে দৃঢ় করিয়া সত্যের জন্য ও ধর্মের জন্য আহ্লাদের সহিত অগ্নিকাষ্ঠভক্ষণের অনেক উদাহরণ ইতিহাসেও আছে । 


11) ফলাশা ত্যাগ করিলেই দুঃখনিবারণ হয়, অতএব কর্মত্যাগের নিষেধ



অতএব গীতায় উক্ত হইয়াছে যে, যাহা কিছু করিবে, তাহা মনোনিগ্রহপূর্বক এবং তাহার ফলাশা ছাড়িয়া ও সুখদুঃখ সম্বন্ধে সমবুদ্ধি রাখিয়া করিবে; এই ভাবে কর্ম করিতে থাকিলে আমাদের কর্ম ছাড়িতেও হইবে না কিম্বা সেই কর্ম হইতে আমাদের দুঃখরূপ বাধাপ্ৰাপ্তির ভীতি বা সম্ভাবনা থাকিবে না । ফলাশাত্যাগের অর্থ ইহা নহে যে, ফল লাভ হইলে তাহা ত্যাগ করিতে হইবে, কিংবা সেই ফল কেহ কখনও না পায় এইরূপ ইচ্ছা করিবে । সেইপ্ৰকার ফলাশা এবং কর্ম করিবার নিছক ইচ্ছা, আশা, হেতু, কিংবা ফলে অন্য কোন বিষয়ের যোজনা করা, উভয়ের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ । কেবল হাত পা নাড়ানোর ইচ্ছা হওয়া, আর অমুককে ধরিবার জন্য কিংবা অমুককে লাথি মারিবার জন্য হাত পা নাড়াইবার ইচ্ছা হওয়া, উভয়ের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ । প্ৰথম ইচ্ছাটি কেবল কর্ম করিবারই ইচ্ছা, উহাতে অন্য কোন হেতু থাকে না; এবং এই ইচ্ছা চলিয়া গেলে সমস্ত কর্মই বন্ধ হয় । এই ইচ্ছার অতিরিক্ত প্রত্যেক মনুষ্যের এই জ্ঞানটি হওয়া চাই যে, প্রত্যেক কর্মের কোন-না-কোন পরিণাম বা ফল অবশ্যই হইবে । জ্ঞান হওয়া চাই শুধু নহে, এই প্রকার ইচ্ছাও হওয়া চাই যে, অমুক ফলের জন্য অমুক প্রকার যোজনা করিয়া অমুক কর্ম করিতে হইবে; নতুবা তাহার সমস্ত ক্রিয়া পাগলের মতো নিরর্থক হইবে । এই সমস্ত ইচ্ছা, হেতু বা যোজনা পরিণামে দুঃখজনক হয় না; এবং তাহা যে ছাড়িতে হইবে সে কথা গীতাও বলেন নাই । কিন্তু মনে রেখো যে, ইহাকে ছাড়াইয়া অনেক দূর অগ্রসর হইয়া যখন মনুষ্যের মনে এই ভাব হয় যে, “আমি যে কর্ম করিতেছি আমার সেই কর্মের অমুক ফল অবশ্যই আমার পাওয়া উচিত ।” অর্থাৎ যখন কর্মফলের প্রতি কর্তার বুদ্ধিতে মমত্বের এই আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, অভিমান, অভিনিবেশ বা আগ্রহ উৎপন্ন হয় এবং তাহা দ্বারা মন অধিকৃত হয়, এবং যখন বাঞ্ছিত ফল মিলিবার পক্ষে বাধা উপস্থিত হয়, তখনই দুঃখপরম্পরার সুত্রপাত হয় । এই বাধা অনিবার্য বা দৈবকৃত হইলে শুধু নৈরাশ্য উপস্থিত হয়; কিন্তু উহা মনুষ্যকৃত হইলে ক্রোধ ও দ্বেষ উৎপন্ন হইয়া তাহার ফলে কুকর্ম ঘটে এবং কুকর্মের দ্বারা বিনাশ উপস্থিত হয় । কর্মপরিণামের প্রতি যে মমত্বযুক্ত আসক্তি, উহার ‘ফলাশা’, ‘সঙ্গ’, ‘অহঙ্কার বুদ্ধি’ ও ‘কাম’, এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে; এবং এখান হইতেই সাংসারিক দুঃখপরম্পরার আরম্ভ, ইহা ব্যক্ত করিবার জন্য গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, বিষয়সঙ্গ হইতে কাম, কাম হইতে ক্ৰোধ, ক্রোধ হইতে মোহ এবং শেষে মনুষ্যের বিনাশও হইয়া থাকে [গী|২|৬২,৬৩] । এক্ষণে ইহা সিদ্ধ হইল যে, জড় জগতের অচেতন কর্ম স্বয়ং দুঃখের মূল কারণ নহে, কিন্তু মনুষ্য তাহাতে যে ফলাশা, কাম বা আসক্তি বা ইচ্ছা স্থাপন করে, তাহাই প্ৰকৃত দুঃখের মুল । এই দুঃখ হইতে পরিত্রাণ পাইবার সহজ উপায় এই যে, বিষয়ের ফলাশা, আসক্তি বা কাম মনোনিগ্রহের দ্বারা ত্যাগ করিতে হইবে; সন্ন্যাসমাৰ্গে যাহা বলা হয়, তদনুসারে সমস্ত বিষয় ও কর্ম অথবা সর্বপ্রকারের ইচ্ছাই ত্যাগ করিবার প্রয়োজন নাই । অতএব ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কাম ও নিঃসঙ্গ বুদ্ধিতে যে ব্যক্তি যথাপ্ৰাপ্ত বিষয়ের সেবা করে, সেই ব্যক্তিই প্ৰকৃত স্থিতপ্ৰজ্ঞ; ইহা পরে গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|২|৬৪] । জগতের কর্মব্যবহার কখনই বন্ধ হইতে পারে না । মনুষ্য এই জগতে থাকুক আর নাই থাকুক, প্ৰকৃতি নিজ গুণধর্মানুসারে সততই নিজের কার্য করিতে থাকিবে । জড় প্ৰকৃতির ইহাতে সুখও নাই দুঃখও নাই । মনুষ্য নিজের মহত্ত্বকে ব্যর্থ জানিয়া প্ৰকৃতির ব্যাপারে আসক্ত হওয়া প্ৰযুক্ত সুখদুঃখভাগী হইয়া পড়ে । যদি সে এই আসক্তিবুদ্ধি দূরে নিক্ষেপ করিয়া “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” - প্রকৃতির গুণধর্মানুসারে সমস্ত ব্যাপার চলিতেছে [গী|৩|২৮] এইরূপ ভাবিয়া সমস্ত ব্যবহার করে, তাহা হইলে অসন্তোষ জন্য তাহার কোন দুঃখই হইতে পারে না । তাই প্ৰকৃতির ব্যাপার প্রকৃতি করিতেছেই ইহা বুঝিয়া তাহার জন্য সংসারকে দুঃখপ্রধান বলিয়া কাঁদিতে বসা কিংবা তাহা ত্যাগ করিবারও ইচ্ছা করা উচিত নয় । মহাভারতে [শান্তি|২৫|২৬] ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, -
সুখং বা যদি বা দুঃখং প্ৰিয়ং বা যদি বাহপ্ৰিয়ম্‌ ৷
প্ৰাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা ॥
অর্থাৎ - সুখই হউক বা দুঃখই হউক, প্ৰিয়ই হউক, বা অপ্ৰিয়ই হউক, যখন যাহা প্ৰাপ্ত হইবে, অপরাজিতচিত্তে তাহার সেবা করিবে । সংসারে অনেক কর্তব্য দুঃখ সহিয়াও করিতে হয় - এই তত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখিলে এই উপদেশের মহত্ব পূর্ণরূপে উপলদ্ধ হইবে । ভগবদ্‌গীতাতে স্থিতপ্রজ্ঞের এই লক্ষণ উক্ত হইয়াছে যে, “যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্ ৷” [২|৫৭] । অর্থাৎ শুভ অথবা অশুভ প্ৰাপ্ত হইয়া যে ব্যক্তি সর্বদা অনাসক্ত থাকিয়া তাহার অভিনন্দন বা দ্বেষ করে না সে-ই স্থিতপ্ৰজ্ঞ । আবার পঞ্চম অধ্যায়ে উক্ত হইয়াছে যে, “ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্” [৫|২০] সুখ পাইয়া উল্লসিত হইবে না, এবং দুঃখে মুহ্যমানও হইবে না; এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই সুখদুঃখ নিষ্কাম বুদ্ধিতে ভোগ করিবার উপদেশ দেওয়া হইয়াছে [২|১৪,১৫] । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এই উপদেশই বারম্বার পুনরুক্ত করিয়াছেন [গী|৫|৯; ১৩|৯] । বেদান্তশাস্ত্রের পরিভাষায় ইহাকে “সকল কর্মের ব্ৰহ্মাৰ্পণ করা” এই নাম প্রদত্ত হইয়াছে; এবং ভক্তিমার্গে ‘ব্ৰহ্মাৰ্পণের’ স্থলে ‘শ্ৰীকৃষ্ণাৰ্পণ’ এই শব্দ সংযোজিত হইয়া থাকে; ইহাই সমস্ত গীতার সারতত্ত্ব ।


12) ইন্দ্রিয়নিগ্রহের মর্যাদা



কর্ম যে প্রকারেরই হউক না, উহা করিবার ইচ্ছা ও উদ্যোগ না ছাড়িয়া এবং ফলপ্ৰাপ্তির আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া (অর্থাৎ নিঃশঙ্গবুদ্ধিতে) উহা করিতে হইবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ভবিষ্যতে পরিণামপ্রাপ্ত সুখ-দুঃখকে একই সমানভাবে ভোগ করিবার জন্য প্ৰস্তুত থাকিতে হইবে । এইভাবে কর্ম করিয়া গেলে অমর্যাদিত তৃষ্ণা ও অসন্তোষজনিত দুষ্পরিণাম শুধু যে নিবারিত হয় তাহা নহে, কিন্তু তৃষ্ণা বা অসন্তোষের সঙ্গে সঙ্গে কর্মেরও নাশ করিলে জীবন ধ্বংস হইবার যে প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইতে পারিত তাহাও অসিতে পরিবে না; এবং আমার মনোবৃত্তি শুদ্ধ হইয়া সর্বভূতহিতপ্ৰদ হইয়া যাইবে । ইহা নির্বিবাদ যে, এইরূপে ফলাশা ছাড়িতে হইলেও বৈরাগ্যের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়সমূহের ও মনের পূর্ণ নিরোধ করিতে হয় । কিন্তু মনে রেখো যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহকে বশে রাখিয়া, স্বার্থের বদলে বৈরাগ্য ও নিষ্কাম বুদ্ধি হইতেই লোকসংগ্ৰহাৰ্থ তাহাদিগকে আপন আপন কর্ম করিতে দেওয়া এক কথা; এবং সন্ন্যাসমার্গ অনুসারে তৃষ্ণাকে উচ্ছেদ করিবার জন্য সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারকে অর্থাৎ সমস্ত কর্মকে আগ্রহের সহিত সমূলে নাশ করা পৃথক কথা - এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ । গীতায় যে বৈরাগ্য ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের উপদেশ করা হইয়াছে তাহা প্রথম প্রকারের, দ্বিতীয় প্রকারের নহে; এবং সেই অনুসারেই অনুগীতাতে জনক-ব্ৰাহ্মণ সংবাদে [মভা|অশ্ব|৩২|১৭-২৩] জনক রাজা ব্ৰাহ্মণের রূপধারী ধর্মকে এইরূপ বলিতেছেন যে -
শৃণু বুদ্ধিং যাং জ্ঞাত্বা সর্বত্র বিষয়ে মম ৷
নাহমাত্মার্থমিচ্ছামি গন্ধান্‌ ঘ্রাণগতানপি ॥
               ***
নাহমাত্মার্থমিচ্ছামি মনো নিত্যং মনোহন্তরে ৷
মনো মে নির্জিতং তস্মাৎ বশে তিষ্ঠতি সর্বদা ॥
অর্থাৎ - “যে (বৈরাগ্য) বুদ্ধি মনে রাখিয়া সমস্ত বিষয়ের আমি সেবন কারিয়া থাকি তাহা তোমাকে বলিতেছি, শোন । আমি নিজের জন্য গন্ধ আঘ্রাণ করি না (চোখে আপনার জন্য দেখি না ইত্যাদি) এবং মনকেও আত্মাৰ্থ অর্থাৎ, আপন লাভের জন্য ব্যবহার করি না; অতএব আমার নাক (চোখ ইত্যাদি) ও মনকে আমি জয় করিয়াছি, তাহারা আমার বশে আছে” । গীতারও বচনের [গী|৩|৬,৭] । ইহাই তাৎপর্য যে, যে মনুষ্য কেবল ইন্দ্ৰিয়সমূহের বৃত্তিকে দমন করিয়া মনের দ্বারা বিষয়সমূহের চিন্তা করিতে থাকে সে পুরো ভণ্ড, এবং যে ব্যক্তি মনোনিগ্রহের দ্বারা কাম্য বুদ্ধিকে জয় করিয়া সমস্ত মনোবৃত্তিকে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আপনি আপনি কাজ করিতে দেয় সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ । বাহ্যজগত কিংবা ইন্দ্ৰিয়ব্যাপার আমরা উৎপন্ন করি নাই, তাহারা স্বভাবসিদ্ধ; আমি দেখি যে, কোন সন্ন্যাসী যতই নিগ্ৰহী হউক না কেন, ক্ষুধা জলিয়া উঠিলে ভিক্ষা করিতে বাহির হইবেই [গী|৩|৩৩]; কিংবা অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসিইয়া থাকিলে, কখন বা দাঁড়াইয়া উঠে । তাৎপর্য এই যে, নিগ্ৰহ যতই হউক না কেন, ইন্দ্ৰিয়ের এই স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার কখনো রহিত হইতে পারে না; আর যদি একথা সত্য হয়, তবে ইন্দ্ৰিয়বৃত্তি ও সেই সঙ্গে সমস্ত কর্ম এবং সর্ব প্রকারের ইচ্ছা বা অসন্তোষ নষ্ট করিবার দুরাগ্রহে না পড়িয়া [গী|২|৪৭; ১৮|৫৯], মনোনিগ্রহের দ্বারা ফলাশা পরিত্যাগ পূর্বক এবং সুখদুঃখকে সমান জ্ঞানপূর্বক [গী|২|৩৮] নিষ্কাম বুদ্ধিতে লোকহিতার্থ সকল-কর্ম শাস্ত্রোক্ত রীতিতে করিতে থাকাই হইল শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মার্গ । তাই -


13) কর্মযোগের চতুঃসূত্র


কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ৷
মা কর্মফলহেতুর্ভূঃমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥
এই শ্লোকে [গী|২|৪৭] ভগবান অর্জুনকে প্রথমে এইরূপ বলিতেছেন যে, তুমি এই কর্মভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব “তোমার কর্ম করিবার অধিকার আছে”; কিন্তু তোমার এই অধিকার কেবল (কর্তব্য) কর্ম করিবারই অধিকার, ইহা মনে রেখো । ‘এব’ পদের অর্থ ‘কেবল’; এই পদটির দ্বারা সহজেই জানা যাইতেছে যে, কর্ম ব্যতীত অন্য বিষয়ে - অর্থাৎ কর্মফলে - মনুষ্যের অধিকার নাই । এই গুরুতর বিষয় কেবল অনুমানের উপর অবলম্বিত না রাখিয়া দ্বিতীয় চরণে ভগবান স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন যে, “কর্মফলে তোমার কোনই অধিকার নাই”, অর্থাৎ কোন কর্মের ফল পাওয়া, কি না পাওয়া, তোমার অধিকারের কথা নহে, উহা পরমেশ্বরের উপর কিংবা সৃষ্টির কর্মবিপাকের উপর অবলম্বিত আছে । যে বিষয়ে আমার অধিকার নাই, তাহার সম্বন্ধে আশা করা যে, উহা অমুক প্রকারে হউক, মূঢ়তার লক্ষণ । কিন্তু এই তৃতীয় বিষয়টিও অনুমানের উপর অবলম্বিত নহে । তৃতীয় চরণে উক্ত হইয়াছে যে, “অতএব তুমি কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা মনেতে রাখিয়া কোন কর্মই করিবে না” ; কর্মবিপাক অনুসারে তোমার কর্মের যে ফল হইবার তাহা হইবেই, তোমার ইচ্ছায় তাহা ন্যূনাধিক হওয়া অথবা শীঘ্ৰ বা বিলম্বে হওয়া অসম্ভব; কিন্তু যদি তুমি এইরূপ আশা রাখো বা আগ্ৰহ কর, তাহা হইলে তোমার কেবল ব্যৰ্থ দুঃখ ও কষ্ট হইবে মাত্র । এই স্থলে কোন কোন ব্যক্তি - বিশেষতঃ সন্ন্যাসমাৰ্গী - প্রশ্ন করিতে পারেন যে, কর্ম করিয়া ফলের আশা ছাড়িবার বৃথা চেষ্টা অপেক্ষা একেবারেই কর্ম ত্যাগ করা ভাল নহে কি ? এইজন্য ভগবান শেষে নিজের নিশ্চিত মতও বলিয়া দিয়াছেন যে, “কর্ম না করিবার (অকর্মের) আগ্রহ রাখিবে না”, তোমার যে অধিকার আছে তদনুসারে - কিন্তু ফলাশা ছাড়িয়া - কর্মই করিতে থাক । কর্মযোগদৃষ্টিতে এই সমস্ত সিদ্ধান্ত এত গুরুতর যে উপরি-উক্ত শ্লোকের চারি চরণ কর্মযোগশাস্ত্রের বা গীতাধর্মের চতুঃসূত্র বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না ।


14) আত্মপ্রসাদজ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সুখের শ্রেষ্ঠতা ও নিত্যতা



ইহা বোঝা গিয়াছে যে, সংসারে সুখ দুঃখ সর্বদাই পৰ্যায়ক্রমে প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, এবং এখানে সুখ অপেক্ষা দুঃখেরই পরিমাণ অধিক । ইহা সিদ্ধ হইলেও যদি সাংসারিক কর্ম অপরিত্যাজ্য হয়, তবে দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তির এবং অত্যন্ত সুখপ্ৰাপ্তির জন্য মনুষ্যের সমস্ত প্ৰযত্ন ব্যর্থ, ইহা কাহারও কাহারও মনে হওয়া সম্ভব; এবং কেবল আধিভৌতিক অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়গম্য বাহ্য বিষয়োপভোগরূপ সুখেরই দিকে দৃষ্টি করিলে তাহাদের ধারণা অসঙ্গত বলা যায় না । সত্য, চাঁদকে ধরিবার জন্য ছোট ছেলে আকাশে হাত বাড়াইলেও সে যেরূপ চাঁদকে মুঠির ভিতর আনিতে পারে না, সেইরূপ আত্যন্তিক সুখের আশায় কেবল আধিভৌতিক সুখের অনুসরণ করিলেও অত্যন্ত সুখপ্ৰাপ্তি দুর্ঘট হয় । কিন্তু মনে রেখো, আধিভৌতিক সুখই সর্বপ্রকার সুখের ভাণ্ডার নহে, সেই কারণ উপরি-উক্ত বাধার ভিতরেও অত্যন্ত ও নিত্য সুখপ্রাপ্তির একটা পথ বাহির করা যাইতে পারে । উপরে বলা হইয়াছে যে, শারীরিক ও মানসিক - সুখের এই দুই ভেদ । শরীরের কিংবা ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার অপেক্ষা শেষে মনেরই অধিক গুরুত্ব স্বীকার করিতে হয় । শারীরিক (অর্থাৎ আধিভৌতিক) সুখাপেক্ষা মানসিক সুখের যোগ্যতা অধিক, এই যে সিদ্ধান্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা করিয়া থাকেন, তাহা আপন জ্ঞানের অহঙ্কার বশতঃ তাঁহারা করেন না । এই সিদ্ধান্তেই শ্রেষ্ঠ মনুষ্যজন্মের যে প্রকৃত মহত্ব ও সার্থকতা, তাহা আধিভৌতিকবাদী “মিল” আপন উপযোগবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থে স্পষ্টরূপে স্বীকার করিয়াছেন । (“It is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied; better to be Socrates dissatisfied than a fool satisfied. And if the fool or the pig, is of a different opinion, it is because they only know their own side of the question.” - Utilitarianism, P.14, Longmans 1907).

কুকুর, শূকর, বলদ প্রভৃতিরও ইন্দ্ৰিয়সুখের আনন্দ যদি মনুষ্যেরই সমানই হইত; এবং বিষয়োপভোগই এই জগতে প্রকৃত সুখ, মনুষ্যের যদি ইহাই ধারণা হইত, তাহা হইলে মনুষ্য পশু হইতেও রাজি হইত । কিন্তু পশুর সমস্ত বিষয়মুখ নিত্য পাইবার অবসর আসিলেও কোন মনুষ্য পশু হইতে রাজি হয় না; ইহাতেই জানা যাইতেছে যে, পশু ও মনুষ্যের মধ্যে একটা কিছু বিশেষত্ব আছে । এই বিশেষত্বটি কি, তাহা বুঝিতে গেলে মন ও বুদ্ধির দ্বারা আপনার ও বাহ্যজগতের জ্ঞান যাহার দ্বারা হয়, সেই আত্মার স্বরূপের বিচার করা আবশ্যক; এবং একবার এই বিচার শুরু হইলে স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, পশু ও মনুষ্য এই উভয়ের বিষয়োপভোগজনিত সুখ একই কিন্তু তাহা অপেক্ষা মনের ও বুদ্ধির অত্যন্ত উদাত্ত ব্যাপারে ও শুদ্ধাবস্থাতে যে সুখ, তাহাই মনুষ্যের শ্রেষ্ঠ ও আত্যন্তিক সুখ । এই সুখ আত্মবশ; ইহার প্রাপ্তি কোন বাহ্য বস্তুর অপেক্ষা করে না; ইহার প্রাপ্তির জন্য অন্যের সুখ হ্রাস করিবার প্রয়োজন হয় না; এই সুখ, আপনারই প্রযত্নে প্ৰাপ্ত হওয়া যায় এবং যেমন যেমন আমার উন্নতি হইতে থাকে, তেমনি তেমনি এই সুখের স্বরূপও অধিকাধিক শুদ্ধ ও নির্মল হইতে থাকে । ভর্তৃহরি সত্যই বলিয়াছেন যে, “মনসি চ পরিতুষ্টে কোহর্থবান্‌ কো দরিদ্রঃ” — মন প্রসন্ন হইলে দরিদ্রই বা কে, ধনবানই বা কে, দুই-ই সমান । প্লেটো নামক প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক তত্ত্ববেত্তাও প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, শারীরিক (অর্থাৎ বাহ্য বা আধিভৌতিক) সুখাপেক্ষা মনের সুখ শ্ৰেষ্ঠ, এবং মনের সুখাপেক্ষাও বুদ্ধিগ্ৰাহ্য (অর্থাৎ পরম আধ্যাত্মিক) সুখ শ্রেষ্ঠ [Republic Book IX] । তাই যদি আমি এখন মোক্ষের বিচার ছাড়িয়া দিই, তথাপি ইহাই সিদ্ধ হয় যে, আত্মবিচার নিমগ্ন বুদ্ধি হইতেই পরম সুখ লাভ হইতে পারে । 

সেই কারণে ভগবদ্‌গীতাতে সুখের (i)সাত্ত্বিক, (ii)রাজসিক ও (iii)তামসিক এই তিন ভেদ করা হইয়াছে, এবং ইহাদের লক্ষণও বলা হইয়াছে, যথা – 
(i)সাত্ত্বিক : আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির (অর্থাৎ সর্বভুতে একই আত্মাকে জানিয়া আত্মার ঐ প্রকৃত স্বরূপে রত বুদ্ধির) প্ৰসন্নতা হইতে যে আধ্যাত্মিক সুখ পাওয়া যায় তাহাই সাত্ত্বিক ও শ্রেষ্ঠ সুখ, “তৎসুখং সাত্ত্বিকং প্রোক্তং আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদজম্‌” [গী|১৮|৩৭]
(ii)রাজসিক : যে আধিভৌতিক সুখ ইন্দ্ৰিয় ও ইন্দ্ৰিয়ের বিষয়প্ৰসূত, তাহা সাত্ত্বিক সুখের নিম্ন পদবীস্থ এবং তাহাকে রাজসিক বলা যায় [গী|১৮|৩৮]
(iii)তামসিক : এবং যে সুখ হইতে চিত্তমোহ হয় এবং যে সুখ নিদ্রা বা আলস্য হইতে উৎপন্ন হয়, তাহার যোগ্যতা তামসিক অর্থাৎ কনিষ্ঠ শ্রেণীর । 
এই প্রকরণের আরম্ভে গীতার যে শ্লোক প্রদত্ত হইয়াছে, তাহার ইহাই তাৎপর্য; এবং গীতাও বলিয়াছেন [গী|৬|২২] যে, এই পরম সুখের উপলব্ধি একবার হইলে পরে যত বড় দুঃখ আসুক না কেন, তাহাতেও মনুষ্যের সুখময় স্থৈর্য কখনই বিচলিত হয় না । 

এই আত্যন্তিক সুখ স্বর্গেরও বিষয়োপভোগজনিত সুখে পাওয়া যায় না; ইহা লাভ করিবার জন্য নিজের বুদ্ধি প্ৰথমে প্ৰসন্ন হওয়া চাই । বুদ্ধিকে কেমন করিয়া প্ৰসন্ন রাখিবে তাহা না দেখিয়া, যে ব্যক্তি কেবল বিষয়োপভোগেই নিমগ্ন হয় তাহার সুখ ক্ষণিক ও অনিত্য । .কেবল ইহাই নহে; কিন্তু যাহা আজ ইন্দ্ৰিয়ের সুখজনক প্রতীত হইতেছে, তাহাই কোন কারণপ্রযুক্ত কল্য দুঃখজনক হইতে পারে । উদাহরণ যথা - গ্ৰীষ্মকালে যে ঠাণ্ডা জল মিষ্ট লাগে তাহাই শীতকালে আর পান করা যায় না । ভাল; এত করিয়াও তাহা হইতে সুখেচ্ছার পুর্ণ তৃপ্তি হইতেই পারে না । তাই, ‘সুখ’ শব্দের ব্যাপক অর্থ লইয়া যদি আমি ঐ শব্দের উপযোগ সর্বপ্রকার সুখ সম্বন্ধেই করি, তাহা হইলে সুখের মধ্যেও ভেদ করা আবশ্যক হয় । নিত্য ব্যবহারে সুখের অর্থে মুখ্যত ইন্দ্ৰিয়সুখই বুঝায় । কিন্তু যখন ইন্দ্ৰিয়াতীত ও নিছক আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির উপলব্ধ সুখ হইতে বিষয়োপভোগরূপ সুখের ভেদ প্ৰদৰ্শন করিতে হইবে, তখন বিষয়োপভোগের আধিভৌতিক সুখকে কেবলমাত্ৰ সুখ বা প্রেয় এবং আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদ হইতে উৎপন্ন অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সুখকে শ্রেয়কল্যাণহিতআনন্দ অথবা শান্তি, এইরূপ বলিবার রীতি আছে । পূর্ব প্রকরণের শেষে প্রদত্ত কঠোপনিষদের বাক্যে প্রেয় ও শ্রেয় এই দুয়ের মধ্যে নচিকেতা যে ভেদ করিয়াছেন তাহাও এই মর্মেই করা হইয়াছে । মৃত্যু তাঁহাকে অগ্নির রহস্য প্রথমেই বলিয়াছিলেন । কিন্তু এই সুখ প্ৰাপ্ত হইবার পরেই যখন নচিকেতা, আত্মজ্ঞানপ্ৰাপ্তির বর চাহিলেন, তখন তাহার বদলে মৃত্যু তাঁহাকে অন্য অনেক ঐহিক সুখের লোভ দেখাইলেন । কিন্তু নচিকেতা অনিত্য আধিভৌতিক সুখে কিংবা আপাতদৃষ্ট মধুর (প্রেয়) বস্তুতে না ভুলিয়া, দূরদৃষ্টিপূর্বক, যাহাতে আত্মার শ্ৰেয় অর্থাৎ পরিণামে কল্যাণ হয়, সেই আত্মবিদ্যাকেই আগ্রহের সহিত ধরিয়া শেষে তাহাই সম্পাদনা করিলেন । সারকথা - আত্মবুদ্ধিপ্রসাদ হইতে উৎপন্ন নিছক বুদ্ধিগম্য সুখকেই অর্থাৎ আধ্যাত্মিক আনন্দকেই আমাদের শাস্ত্রকার শ্রেষ্ঠ সুখ বলিয়া মানেন; এই নিত্য সুখ আত্মবশ হওয়া প্ৰযুক্ত সকলেই পাইতে পারে এবং সকলেরই তাহা পাইবার জন্য প্ৰযত্ন করা কর্তব্য, ইহাই আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের অভিপ্ৰায় । পশুধর্ম হইতে প্ৰাপ্ত সুখ এবং মানবীয় সুখের মধ্যে যে কিছু বিশেষত্ব আছে তাহা ইহাই; এবং এই আত্মানন্দ কেবল বাহ্য উপাধিসমূহের উপর কখন নির্ভর না করিবার কারণে সমস্ত সুখের মধ্যে উহাই নিত্য, স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ । গীতাতে ইহারই নাম দেওয়া হইয়াছে – “নির্বাণের শান্তি” [গী|২|৭১; ৬|২৮; ১২|১২; ১৮|৬২ দেখ] ।


15) এই দুই সুখের প্রাপ্তিই কর্মযোগদৃষ্টিতে পরম সাধ্য



এখন স্থির হইল যে, আত্মার শান্তি বা সুখই অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ সুখ, উহা আত্মবশ হওয়া প্রযুক্ত উহা লাভ করাও সকলের সাধ্যায়ত্ত । কিন্তু ইহা সুস্পষ্ট যে, সকল ধাতুর মধ্যে স্বর্ণ অত্যন্ত মূল্যবান হইলেও কেবল সুবৰ্ণ হইতেই লৌহ প্ৰভৃতি অন্য ধাতু বিনা যেমন সংসারের কাজ চলে না, কিংবা চিনি অত্যন্ত মিষ্ট হইলেও, লবণ বিনা যেমন কাজ চলে না; সেইরূপ আত্মসুখ বা শান্তির বিষয়েও বুঝতে হইবে । ইহা নিঃসন্দেহ যে, এই শান্তির সহিত অন্তত শরীরধারণার্থও কোন কোন ঐহিক পদার্থের প্রয়োজন আছে; এবং এই অভিপ্ৰায়েই আশীর্বাদের সঙ্কল্পে কেবল ‘শান্তিরস্তু’ বলিয়া “শান্তিঃ পুষ্টিস্তুষ্টিশ্চাস্তু” অর্থাৎ শান্তির সঙ্গে পুষ্টি ও তুষ্টিও চাই - এইরূপ বলিবার রীতি আছে । কেবল শান্তির দ্বারাই তুষ্টি পাওয়া যায়, ইহা যদি শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্ৰায় হইত, তাহা হইলে এই সঙ্কল্পের মধ্যে ‘পুষ্টি’ শব্দের বৃথা সন্নিবেশ করিবার কোন হেতু থাকিত না । ইহার অভিপ্রার এরূপ নহে যে, পুষ্টির অর্থাৎ ঐহিক সুখবৃদ্ধির জন্য দিনরাত হায় হায় করিতে হইবে । উক্ত সঙ্কল্পের ভাবার্থ এই যে, শান্তি, পুষ্টি ও তুষ্টি (সন্তোষ) এই তিনই যোগ্য পরিমাণে তুমি প্রাপ্ত হও, এবং এই তিনিই পাইবার জন্য তোমায় যত্ন করা কর্তব্য । কঠোপনিষদেরও ইহাই তাৎপর্য । নচিকেতা যমলোকে গমন করিলে পর যম তাহাকে কোন তিনটী বর চাহিতে বলিলেন । তদনুসারে প্রার্থিত বর তাঁহাকে দিলেন, এই কথাই এই উপনিষদে সবিস্তার বৰ্ণিত হইয়াছে । সেই সময় নচিকেতা একেবারে প্রথম হইতে আমাকে “ব্ৰহ্মজ্ঞান দান কর” এইরূপ বর না চাহিয়া “আমার পিতা আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, তিনি যেন আমার উপর প্রসন্ন হন”, এই বর চাহিলেন । পরে তিনি দ্বিতীয় বর চাহিলেন যে, “অগ্নি অর্থাৎ ঐহিক সমৃদ্ধিউৎপাদক যজ্ঞাদি কর্মের জ্ঞান আমাকে প্ৰদান কর” । এই দুই বর প্রাপ্ত হইলে পর, শেষে তিনি যমের নিকট তৃতীয় বর চাহিলেন যে, “আমাকে আত্মবিদ্যার উপদেশ দেও” । কিন্তু এই তৃতীয় বরের বদলে আরও অনেক সম্পদ দিতেছি - এই কথা যম যখন বলিলেন, তখন - অৰ্থাৎ প্ৰেয় (সুখ) প্ৰাপ্তির পক্ষে আবশ্যক যজ্ঞাদি কর্মের জ্ঞান লাভ হইলে পর, তাহার সম্বন্ধে অধিক আশা না করিয়া নচিকেতা এই বিষয়েই আগ্ৰহ প্ৰকাশ করিলেন যে, “এক্ষণে, যাহাতে শ্ৰেয় (আত্যন্তিক সুখ) লাভ হয় সেই ব্ৰহ্মজ্ঞানের কথা আমাকে বল” । সারকথা এই যে, এই উপনিষদের শেষভাগের মন্ত্রে যাহা বর্ণিত হইয়াছে তদনুসারে ‘ব্রহ্মবিদ্যা’ এবং ‘যোগবিধি’ অর্থাৎ যজ্ঞযাগাদি - এই দুই-ই লাভ করিয়া নচিকেতা মুক্ত হইয়াছিলেন [কঠ|৬|১৮] । ইহা হইতে জ্ঞান ও কর্ম এই দুয়ের সমুচ্চয়ই উপনিষদের তাৎপর্য, ইহাই সিদ্ধ হয় । এই বিষয়ে ইন্দ্রেরও এই প্রকারের একটা কথা আছে । ইন্দ্ৰ তো স্বয়ং ব্ৰহ্মজ্ঞানী ছিলেনই, কিন্তু আবার তিনি প্রতর্দ্দনকেও ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছিলেন, কৌষীতকী উপনিষদে এইরূপ বৰ্ণিত আছে । তথাপি ইন্দ্রের রাজ্য গিয়া প্ৰহ্লাদ ত্ৰৈলোক্যাধিপতি হইলে পর, ইন্দ্র, দেবগুরু বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, “শ্রেয় কিসে হয় তাহা আমাকে বল” । তখন বৃহস্পতি রাজ্যভ্ৰষ্ট ইন্দ্রকে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়া বলিলেন যে, “ইহাই শ্ৰেয়” (এতাবচ্ছ্রেয় ইতি) । কিন্তু ইন্দ্র তাহাতে আশ্বস্ত না হইয়া “আরও বেশী কিছু আছে কি ?” (কো বিশেষো ভবেৎ ?) পুনরায় এইরূপ প্রশ্ন করিলে পর, বৃহস্পতি তাহাকে শুক্রাচার্যের নিকট পাঠাইলেন । সেখানেও ঐরূপ ঘটিলে পর, শুক্রাচার্য বলিলেন যে, “উহা প্ৰহ্লাদের ভাল জানা আছে” । তখন শেষে ব্ৰাহ্মণবেশে প্ৰহ্লাদের নিকট গিয়া ইন্দ্ৰ প্ৰহ্লাদের শিষ্য হইলেন এবং কিছুকাল তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন । একদিন প্ৰহ্লাদ তাঁহাকে বলিলেন যে, শীলই (সত্য ও ধর্মানুসারে আচরণ করিবার স্বভাব) ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যলাভের নিগুঢ় তত্ত্ব এবং তাহাই শ্রেয় । তাহার পর, প্ৰহ্লাদ যখন বলিলেন যে, তোমার সেবায় আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি ভাগ্যবান, তোমাকে বর দান করিব, তখনী ব্রাহ্মণবেশধারী ইন্দ্র এই বর চাহিলেন যে, “তোমার ‘শীল’ আমাকে দেও” । প্ৰহলাদ ‘তথাস্তু’ বলিতেই তাহার ‘শীল’ ও তাহার সঙ্গে ধর্ম, সত্য, বৃত্ত, শ্ৰী অথবা ঐশ্বর্য প্ৰভৃতি সমস্ত দেবতা প্ৰহ্লাদের শরীর হইতে নিৰ্গত হইয়া ইন্দ্রের শরীরে প্রবেশ করিলেন । তাহার ফলে ইন্দ্র আপন রাজ্য প্রাপ্ত হইলেন । মহাভারতের শান্তিপর্বে [শা|১২৪] ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে এই প্ৰাচীন কথা বলিয়াছিলেন । এই সুন্দর ইন্দ্ৰ-প্ৰহ্লাদের কথা হইতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, নিছক ঐশ্বর্য অপেক্ষা নিছক্ আত্মজ্ঞান যদি যোগ্যতরও হয়, তথাপি এ জগতে যাহার থাকিতে হইবে তাহার অন্য লোকেরই মতো আপনার জন্য এবং আপনার দেশের জন্য ঐহিক সমৃদ্ধি অর্জন করিবার আবশ্যকতা ও নৈতিক অধিকারও আছে; সেই কারণে যখন এই প্রশ্ন উঠে যে, এই জগতে মনুষ্যের পরম সাধ্য কি, তখন আমাদের কর্মযোগশাস্ত্ৰে শেষ উত্তর এই পাওয়া যায় যে, শান্তি ও পুষ্টি, শ্রেয় ও প্ৰেয় কিংবা জ্ঞান ও ঐশ্বর্য - দুই-ই এক সঙ্গে অর্জন কর । যে ভগবান অপেক্ষা এই জগতে, আর কেহই শ্রেষ্ঠ নাই এবং যাহার পথ ধরিয়া অন্য সকল লোকই চলিতেছে, [গী|৩|২৩] সেই ভগবানই কি ঐশ্বর্য ও সম্পদ, ত্যাগ করিয়াছেন ? -
ঐশ্বর্যস্য সমগ্ৰস্য ধর্মস্য যশস্যঃ শ্রিয়ঃ ৷
জ্ঞানবৈরাগ্যায়োশ্চৈব ষণ্ণাং ভগ ইতীরণা ॥
অর্থাৎ সমগ্ৰ ঐশ্বর্যধর্মযশসম্পদজ্ঞান ও বৈরাগ্য, এই ছয় বিষয়কে ‘ভগ’ বলে - ভগ শব্দের এই ব্যাখ্যা পুরাণাদিতে প্ৰদত্ত হইয়াছে [বিষ্ণু|৬|৫|৭৪ দেখ] । কেহ কেহ এই শ্লোকের ঐশ্বৰ্য শব্দের অর্থ ‘যোগৈশ্বৰ্য’ করেন; কারণ, শ্রী অর্থাৎ সম্পদসূচক শব্দ পরে আসিয়াছে । কিন্তু ব্যবহারে, ঐশ্বর্যশব্দে সত্তা, যশ ও সম্পদ, এবং জ্ঞানে বৈরাগ্য ও ধর্মে্র সমাবেশ হয়, তাই অনায়াসে বলিতে পারি যে, লৌকিক দৃষ্টিতে উক্ত শ্লোকের সমস্ত অর্থ, জ্ঞান ও ঐশ্বর্য এই দুই পদেই ব্যক্ত হয় । আর যখন স্বয়ং ভগবানই জ্ঞান ও ঐশ্বর্য স্বীকার করিয়াছেন, তখন উহাই প্ৰমাণ মনে করিয়া লোকের কাজ করা আবশ্যক [গী|৩|২১; মভা|শাং|৩৪১|২৫] । নিছক আত্মজ্ঞানই এই সংসারে পরম সাধ্য বস্তু, ইহা কর্মযোগমার্গের সিদ্ধান্ত কখনই নহে; সংসার দুঃখময় বলিয়া উহা একেবারে ছাড়িয়া দিতে হইবে, ইহা সন্ন্যাসমার্গের সিদ্ধান্ত । ভিন্ন ভিন্ন মার্গের এই সিদ্ধান্তগুলি একত্ৰ করিয়া গীতার অর্থের বিপর্যয় করা উচিত নহে । তথাপি মনে রেখো, গীতাই বলিয়াছেন যে, জ্ঞান বিনা কেবল ঐশ্বর্য, আসুরী সম্পদ । তাই ঐশ্বর্যের সহিত জ্ঞান এবং জ্ঞানের সহিত ঐশ্বর্য কিংবা শান্তি ও পুষ্টি এই দুয়ের সংযোগ নিত্য স্থির রাখা আবশ্যক এইরূপ সিদ্ধ হইতেছে । জ্ঞানের সহিত ঐশ্বর্য হওয়া অত্যাবশ্যক বলাতেই, কর্ম করিবার আবশ্যকতা স্বতই আসিয়া পড়ে । কারণ মনু বলিয়াছেন, “কর্মাণ্যারভমাণং হি পুরুষং শ্ৰীর্নিষেবতে” [মনু|৯|৩০০] কর্মকারী ব্যক্তিই এই জগতে শ্ৰী অর্থাৎ ঐশ্বর্য লাভ করে । প্ৰত্যক্ষ অনুভূতিতেও এই বিষয় সিদ্ধ হয়; এবং গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে সে উপদেশেও তাহাই উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৮] । মোক্ষদৃষ্টিতে কর্মের আবশ্যকতা না থাকায় শেষে অর্থাৎ জ্ঞানলাভের পর সমস্ত কর্ম ত্যাগ করাই আবশ্যক, এইরূপ কেহ কেহ বলেন । কিন্তু আপাতত কেবল সুখদুঃখেরই বিচার করা কর্তব্য; এবং এ পর্যন্ত মোক্ষ ও কর্মের স্বরূপ পরীক্ষা করা হয় নাই, তাই এই আপত্তির উত্তর এখানে দেওয়া যাইতে পারে না । পরে নবম ও দশম প্রকরণে অধ্যাত্ম ও কর্মবিপাক সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বিচার আলোচনা করিয়া পরে একাদশ প্রকরণে, এই আপত্তিও যে শূন্যগর্ভ তাহা দেখান যাইবে ।


16) বিষয়োপভোগসুখ অনিত্য এবং পরমধ্যেয় হইবার অযোগ্য



সুখ ও দুঃখ দুই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র অনুভূতি বা বেদনা; সুখেচ্ছা কেবল সুখোপভোগের দ্বারা তৃপ্ত হইতে পারে না, এই জন্য সংসারে মোটের হিসাবে দুঃখই অধিক অনুভূত হইয়া থাকে; কিন্তু এই দুঃখ এড়াইবার জন্য তৃষ্ণা বা অসন্তোষকে এবং তাহার সহিত সমস্ত কর্মকে সমূলে উচ্ছেদ করা উচিত নহে; কেবল ফলাশা ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম করিতে থাকাই শ্ৰেয়স্কর । কেবল বিষয়োপভোগ সুখ কখনই পুর্ণ হয় না, উহা অনিত্য ও পশুধর্ম; অতএব এই সংসারে বুদ্ধীন্দ্ৰিয়বিশিষ্ট মনুষ্যের যাহা প্ৰকৃত ধ্যেয় তাহা উহা অপেক্ষা উচ্চ আদর্শের হওয়া চাই; আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদ হইতে যে শান্তিসুখ পাওয়া যায় সেই শান্তিসুখই মনুষ্যের প্রকৃত ধ্যেয়; কিন্তু আধ্যাত্মিক সুখই এই প্রকার শ্রেষ্ঠ হইলেও উহার সঙ্গে এই সাংসারিক জীবনে ঐহিক বস্তুসমূহেরও যথোচিত আবশ্যকতা আছে; এবং এই কারণে নিষ্কাম বুদ্ধিতে প্ৰযত্ন অর্থাৎ কর্ম করাও আবশ্যক; - এই কথাগুলি কর্মযোগশাস্ত্ৰানুসারে সিদ্ধ হইলে পর, সুখদৃষ্টিতে বিচার করিলেও ইহা বুঝাইবার প্রয়োজন হয় না যে, কেবল আধিভৌতিক সুখকেই পরম সাধ্য মনে করিয়া কর্মের কেবল সুখদুঃখাত্মক বাহ্য পরিণামের তারতম্য হইতেই নীতিমত্তার নির্ণয় করা উচিত নহে । কারণ, যে বস্তু পরিপূর্ণাবস্থায় কখনও স্বতঃ আসিতে পারে না, তাহাকে পরম সাধ্য মনে করা অর্থাৎ ‘পরম’ শব্দের অপব্যবহার করিয়া মৃগজলের স্থানে জলের ভাবনা করাটাই অসঙ্গত । পরম সাধ্যই যখন অনিত্য ও অপূর্ণ হইল, তখন তাহার আশায় থাকিলে অনিত্য বস্তু ছাড়া আর কি পাইবো ? “ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে” এই বচনের মর্মও ইহাই । 

অধিক লোকের অধিক সুখ” এই বাক্যের মধ্যে সুখশব্দের অর্থ কি বুঝিতে হইবে, তৎসম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদীদিগের মধ্যেও অনেক মতভেদ আছে । তাঁহাদের মধ্যে অনেকে বলেন যে, অনেক সময় মনুষ্য সমস্ত বিষয়সুখকে পদাঘাত করিয়া কেবল সত্যের জন্য বা ধর্মের জন্য প্ৰাণ দিতেও প্ৰস্তুত হয়; কাজেই ইহা মনে করা অনুচিত যে, আধিভৌতিক সুখপ্ৰাপ্তির জন্যই মনুষ্যের সর্বদাই ইচ্ছা হয় । তাই, তাঁহারা সুচনা করিয়াছেন যে, সুখশব্দের বদলে হিত কিংবা কল্যাণ শব্দ জুড়িয়া দিয়া “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই সূত্রের “অধিক লোকের অধিক হিত বা কল্যাণ” এইরূপ রূপান্তর করিতে হইবে । কিন্তু এত করিয়াও এ মতে এই দোষ থাকিয়া যায় যে, কর্তার বুদ্ধির কোনই বিচার হয় না, এবং এই প্রকার অন্য দোষও এই মতে থাকিয়া যায় । ভাল, বিষয়সুখের সহিত মানসিক সুখেরও বিচার করিতে হইবে যদি বলা যায়, তাহা হইলে উহার আধিভৌতিক পক্ষের এই প্ৰথম প্ৰতিজ্ঞারই বিরোধ হয় যে, সকল কর্মেরই নীতিমত্তা কেবল তাহার বাহ্য পরিণাম ধরিয়াই স্থির করা আবশ্যক - এবং তখন তো কোন-না-কোন অংশে অধ্যাত্মপক্ষ একরকম স্বীকার করিতেই হয় । যখন এই প্রকারে শেষে অধ্যাত্মপক্ষ স্বীকার করিতেই হয়, তখন আধাআধি স্বীকার করিয়া লাভ কি ? অতএব আমাদের কর্মযোগশাস্ত্ৰে এই শেষ সিদ্ধান্ত স্থির করা হইয়াছে যে, সর্বভূতহিত, অধিক লোকের অধিক সুখ, এবং মনুষ্যত্বের পরম উৎকর্ষ প্রভৃতি নীতিনির্ণয়ের সমস্ত বাহ্য সাধন কিংবা আধিভৌতিক মাৰ্গ গৌণ জানিয়া এবং আত্মপ্ৰসাদরূপ আত্যন্তিক সুখ ও তাহার সহস্থায়ী কর্তার শুদ্ধ বুদ্ধিকেই আধ্যাত্মিক কষ্টিপাথর জানিয়া তাহা দ্বারাই কর্ম-অকর্মের পরীক্ষা করা আবশ্যক । 

দৃশ্য জগতের অতীত তত্ত্বজ্ঞানে প্রবেশ করিব না বলিয়া যাহারা শপথ গ্ৰহণ করিয়াছেন তাঁহাদের কথা ছাড়িয়া দাও । যাঁহারা এ প্রকার শপথ গ্ৰহণ করেন নাই, তাঁহাদের যুক্তি হইতে বুঝা যাইবে যে, মন ও বুদ্ধিরও অতীত নিত্য আত্মার নিত্য কল্যাণই কর্মযোগশাস্ত্ৰে মুখ্য বলিয়া স্বীকার করতে হয় । বেদান্তে একবার প্রবেশ করিলেই যাহা কিছু সমস্তই ব্ৰহ্মময় হইয়া যায়, সেখানে আর ব্যবহারের যুক্তি খাটে না, এইরূপ কাহারও কাহারও যে ধারণা, তাহা ভ্রান্ত ধারণা । আজকাল সাধারণতঃ বেদান্তবিষয়ক যে সকল গ্রন্থ পড়িতে পাওয়া যায়, সেগুলি সন্ন্যাসমাৰ্গ অনুযায়ী লিখিত হয় বলিয়া এবং সন্ন্যাসমার্গে তুষ্ণা-রূপী সংসারের সমস্ত ব্যবস্থারই অসার মনে করা হয় বলিয়া তাঁহাদের গ্রন্থাদিতে কর্মযোগের যথার্থ উপপত্তি ঠিক ঠিক পাওয়া যায় না । অধিক কি, এই পরসম্প্রদায়-অসহিষ্ণু গ্ৰন্থকারেরা সন্ন্যাসমার্গের যুক্তিক্ৰম কর্মযোগের মধ্যে গুঁজিয়া দিয়া যাহাতে সাধারণ লোকের ধারণা হয় যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই স্বতন্ত্র মার্গ নহে, সন্ন্যাসই একমাত্র শাস্ত্রোক্ত মোক্ষমাৰ্গ, তাহার জন্য প্ৰযত্ন করিয়াছেন । কিন্তু এরূপ ধারণা ঠিক নহে । সন্ন্যাসমার্গের ন্যায় কর্মযোগমাৰ্গও বৈদিক ধর্মে অনাদি কাল হইতে স্বতন্ত্ররূপে চলিয়া আসিতেছে; এবং এই মার্গের প্রচারকেরা বেদান্ততত্ত্ব না ছাড়িয়া দিয়াও কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি ঠিক ঠিক প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতা গ্ৰন্থ এই পন্থারই গ্ৰন্থ । গীতাকে ছাড়িয়া দিলেও জানা যাইবে যে, অধ্যাত্মদৃষ্টিতে কার্যাকার্যশাস্ত্রের বিচার আলোচনা করিবার পদ্ধতি স্বয়ং ইংলেণ্ডেই গ্রীণের ন্যায় গ্ৰন্থকারেরা শুরু করিয়াছেন; [Prolegomena to Ethics, Book I; Kant’s Metaphysics of Morals, translated by Abbot in Kant’s theory of Ethics.] এবং জর্মনীতে তো গ্রীণের পূর্বেই এই পদ্ধতি প্ৰচলিত ছিল । 


17) আধিভৌতিক সুখবাদের অপূর্ণতা



দৃশ্য জগতের যতই বিচার আলোচনা করা হোক না কেন, কিন্তু এই জগতের সাক্ষী ও কর্মকর্তা কে, ইহা যে পর্যন্ত ঠিক ঠিক অবগত হওয়া না যায়, সে পৰ্যন্ত তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এই জগতের মনুষ্যের পরম সাধ্য, শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বা অন্তিম ধ্যেয় কি, তাহারও বিচার অপূর্ণই থাকিবে । তাই, “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্ৰোতব্যে মন্তব্যো, নিদিধ্যাসিতব্যঃ” - যাজ্ঞবল্ক্যের এই উপদেশ উপস্থিত প্রকরণেও অক্ষরশঃ প্ৰযুক্ত হইতে পারে । দৃশ্য জগতের পরীক্ষা করিয়া যদি পরোপকাররূপ তত্ত্বই পরিশেষে নিষ্পন্ন হয়, তবে ইহা দ্বারা অধ্যাত্মবিদ্যার মাহাত্ম্য হ্রাস না হইয়া উল্টা উহা দ্বারা সর্বভুতে একই আত্মা থাকিবার আর এক প্ৰমাণ পাওয়া যায় । অ্যাধিভৌতিকবাদী যে স্বরচিত সীমার বাহিরে যাইতে পারেন না, তাহার কোন উপায় নাই । কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰকারদের দৃষ্টি এই সঙ্কীর্ণ সীমাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে, এবং এই কারণে তাঁহারা অধ্যাত্মদৃষ্টিতেই কর্মযোগশাস্ত্রের সম্পূর্ণ উপপত্তি দিয়াছেন । এই উপপত্তির কথা বলিবার পূর্বে, কর্মাকর্মপরীক্ষা সম্বন্ধে আর এক পূর্বপক্ষেরও কিছু আলোচনা করা আবশ্যক, তাই এক্ষণে সেই পন্থা সম্বন্ধে বিচার আলোচনা করিতে প্ৰবৃত্ত হইব ।

আধিদৈবতপক্ষ ও ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিচার (Intuitionist School - Body & Atman)

সত্যপূতাং বদেদ্‌ বাচম্‌ মনঃপুতং সমাচারেৎ ৷ [মনু|৬|৪৬]

(“সত্যের দ্বারা যাহা পূত অর্থাৎ শুদ্ধ হইয়াছে এইরূপ বাক্য বলিবেক এবং মন যাহা শুদ্ধ মনে করিবে তাহাই আচরণ করিবেক ।”

1) পাশ্চাত্য সদসদ্বিবেকদেবতাপক্ষ


আধিভৌতিক মাৰ্গ ব্যতীত কর্মাকর্ম পরীক্ষণের আর এক মাৰ্গ আছে, তাহা আধিদৈবতবাদীদিগের মাৰ্গ । এই মার্গের লোকেরা বলেন যে, যে সময়ে মনুষ্য কর্মাকর্মের বা কার্যাকার্যের নির্ণয় করে সেই সময়ে কোন কর্ম হইতে, কাহার কত সুখ বা দুঃখ হইবে, অথবা সেগুলি হইতে সুখের মোট সংখ্যা বা দুঃখের মোট সংখ্যা অধিক হইবে, মনুষ্য এইরূপ গোলযোগের মধ্যে কিংবা আত্মানাত্মবিচারের মধ্যে কখনই পড়ে না । অনেকে, এইরূপ গোলযোগ আছে বলিয়াই জানে না । অধিকন্তু, প্ৰত্যেক প্ৰাণী প্ৰত্যেক কর্ম যে কেবল নিজের সুখেরই জন্য করে এরূপ নহে । আধিভৌতিকবাদী যাহাই বলুন না কেন । কিন্তু ধর্মাধর্মনিৰ্ণয় করিবার সময় মানব-মনের অবস্থা কিরূপ হয়, একটু বিচার করিলেই দেখা যায় যে, কারুণ্য, দয়া, পরোপকার ইত্যাদি মানব-মনের স্বাভাবিক ও উচ্চ মনোবৃত্তিসকলই কোন কার্য সম্পাদন করিবার জন্য মনুষ্যকে একেবারেই প্ৰবৃত্ত করায় । উদাহরণ যথা - কোন ভিখারীকে দেখিয়া তাহাকে কিছু ভিক্ষা দিলে জগতের কিংবা নিজের আত্মার কতটা কল্যাণ হইবে ইহার বিচার মনুষ্যের মনে আসিবায় পুর্বেই মনুষ্যহৃদয়ে কারুণ্যবৃত্তি জাগ্ৰত হয় এবং সে আপন শক্তি অনুসারে ভিখারীকে ভিক্ষা দিয়াই খালাস হয় । সেইরূপ ছেলে কাঁদিতে আরম্ভ করিলে তাহাকে দুধ দিবার সময়, কত, লোকের কতটা হিত হইবে ইহার কিছুমাত্ৰ বিচার না করিয়া, তাহার মা আহাকে দুধ দেয় । সুতরাং এই উচ্চ মনোবৃত্তিসমুহই কর্মযোগশাস্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি । এই মনোবৃত্তিসকল আমাদিগকে কেহ দেয় নাই; কিন্তু এগুলি নিসর্গসিদ্ধ অর্থাৎ স্বাভাবিক, কিংবা এক ভাবে স্বয়ংভু দেবতা । বিচারপতি আপন বিচারআসনে বসিলে, তাঁহার বুদ্ধিতে ন্যায়দেবতার প্রেরণা হয় এবং তিনি সেই প্রেরণা অনুসারে ন্যায়-বিচার করেন; কিন্তু যখন কোন বিচারপতি এই প্রেরণাকে গ্রাহ্য না করেন, তখনই তাঁহার হাত দিয়া অন্যায়-বিচার বাহির হয় । ন্যায়-দেবতার মতোই কারুণ্য, দয়া, পরোপকার, কৃতজ্ঞতা, কৰ্তব্যানুরাগ, ধৈর্য ইত্যাদি সদ্‌গুণসমূহের যে সকল স্বাভাবিক মনোবৃত্তি তাহারাও দেবতা । এই দেবতাদিগের শুদ্ধস্বরূপ প্রত্যেকেরই স্বভাবত জানা আছে । কিন্তু লোভ, দ্বেষ, মাৎসৰ্য প্রভৃতি কোন কারণবশত যদি সে দেবতাদিগের প্রেরণা গ্ৰাহ্য না করে, তবে দেবতারা কি করিবেন ? ইহা সত্য যে, কখন কখন এই দেবতাদিগেরও মধ্যে লড়াই বাধিয়া যাওয়ায় কোন কার্য করিবার সময় কোন্‌ দেবতার প্রেরণা বলবত্তর বলিয়া স্বীকার করিব, সে বিষয়ে আমাদের সংশয় হয় । এই সংশয়ের নির্ণয়াৰ্থ ন্যায় কারুণ্যাদি দেবতাগণের অতিরিক্ত অপর কাহারো পরামর্শ গ্ৰহণ করা আবশ্যক বলিয়া মনে হয় । কিন্তু এই অবসরে অধ্যাত্মবিচারের কিংবা সুখদুঃখের তারতম্যের গোলযোগের মধ্যে না পড়িয়া আমরা আমাদের মনোদেবতার সাক্ষ্য গ্ৰহণ করিলে, সে-ই এই দুয়ের মধ্যে কোন মার্গ শ্রেয়স্কর, শীঘ্রই তাহার একটা নিষ্পত্তি করিয়া দেয় । তাহার কারণ এই যে, উপরি-উক্ত সমস্ত দেবতাদিগের মধ্যে মনোদেবতা শ্রেষ্ঠ । ‘মনোদেবতা’ শব্দে ইচ্ছা, ক্ৰোধ, লোভ প্রভৃতি সমস্ত মনোবিকারের সমাবেশ করা ঠিক নহে; কিন্তু এই শব্দের দ্বারা ভালমন্দ বাছাই করিবার যে ঈশ্বরদত্ত বা স্বাভাবিক শক্তি মনের মধ্যে আছে তাহাই ধরিতে হইবে । এই শক্তির ‘সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি’ (conscience, আধিদৈবতবাদ অর্থে Intuitionist School) এই এক বড় নাম আছে । কোন সংশয়প্রসঙ্গে মনুষ্য সুস্থ অন্তঃকরণে ও শান্তভাবে যদি ক্ষণমাত্র বিচার করিয়া দেখে তাহা হইলে এই সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি কখনই তাহাকে ধোখা লাগাইবে না বা পরিত্যাগ করিবে না । অধিক কি, এইরূপ প্রসঙ্গে “তুই আপনার মনকে জিজ্ঞাসা কর্‌” এইরূপই আমরা অন্যকে বলিয়া থাকি । কোন্‌ সদ্‌গুণের কোন্‌ সময়ে কতটা গুরুত্ব দিতে হইবে, এই বড় দেবতার নিকট সেই বিষয়ের একটা সুচী বা স্মারক লিপি সর্বদাই প্ৰস্তুত থাকে । সেই লিপি অনুসারে যথাসময়ে এই মনোদেবতা আপন নিষ্পত্তি ব্যক্ত করেন । মনে করা যে, কোন সময়ে আত্মসংরক্ষণ ও অহিংসার মধ্যে বিরোধ ঘটিল এবং দুর্ভিক্ষের সময়ে অভক্ষ্য ভক্ষণ করিবে কি না, এইরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইল; তখন এই সংশয় নিবারণের জন্য শান্তচিত্তে এই মনোদেবতার পুজা অৰ্চনা করিলে তখনি “অভক্ষ্য ভক্ষণ কর” এই নিষ্পত্তি বাহির হইয়া পড়ে । সেইরূপ স্বার্থ ও পরার্থ বা পরেপকার ইহাদের মধ্যে বিরোধ হইলে তাহারও নির্ণয় এই মনোদেবতার অর্চনার দ্বারা করিতে হইবে । মনোদেবতার আপন ঘরের, ধর্মাধর্মের তারতম্যের এই সুচী বা স্মারকলিপি এক গ্ৰন্থকার শান্তভাবে বিচার করিয়া উপলব্ধি করিয়াছেন; এবং তাঁহার নিজ গ্রন্থে উহা প্ৰকাশ করিয়াছেন । (এই গ্ৰন্থকারের নাম James Martineau (জেমস্‌ মার্টিনো) । ইনি এই স্মারকলিপি নিজের Types of Ethical Theory (Vol II. P. 266. 3d Ed.) নামক গ্রন্থে দিয়াছেন । মার্টিনো আপন পন্থাকে Idiopsychological এই নাম দিয়াছেন কিন্তু আমি উহা আধিদৈবতবাদেরই সামিল করিতেছি ।) এই স্মারকলিপিতে, ভক্তিভাবকে প্রথম আসন অর্থাৎ অত্যুচ্চ স্থান দেওয়া হইয়াছে; এবং তাহার নীচে কারুণ্য, কৃতজ্ঞতা, ঔদার্য, বাৎসল্য প্রভৃতি ভাবসমূহকে ক্ৰমশঃ নীচের শ্রেণীতে ধরা হইয়াছে । নীচের ও উপরের ধাপের সদ্‌গুণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইবামাত্ৰ অপেক্ষাকৃত উপরি-উপর ধাপের সদগুণগুলিকেই অধিকাধিক মান দেওয়া আবশ্যক, ইহাই এই গ্ৰন্থকারের অভিপ্ৰায় । কার্যাকার্যের বা ধর্মাধর্মের নির্ণয় করিতে হইলে, তাঁহার মতে, ইহা অপেক্ষা যোগ্য মাৰ্গ আর নাই । কারণ আমাদের দৃষ্টি খুব প্রসারিত করিয়া “অধিক লোকের অধিক সুখ” কিসে হয় তাহা সুনিশ্চিতরূপে নির্ধারিত করিলেও, এই তারতম্য বুদ্ধিতে ইহা বলিবার অধিকার নাই যে, অধিক লোকের যাহাতে সুখ হয় তুমি তাহা কর; তাই শেষে “অধিক লোকের অধিক হিত” আমি কেন করিব এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয় না । সুতরাং সমস্ত ঝগড়া যেখানে ছিল সেইখানেই থাকিয়া যায় । কোন বিচারপতি রাজার নিকট অধিকার না পাইয়া কোন বিচার নিষ্পত্তি করিলে সেই নিষ্পত্তির যেরূপ পরিণাম হয়, দূরদৃষ্টিতে সুখদুঃখের বিচার করিয়া যে কার্যাকার্য নির্ণয় হয়, তাহারও সেইরূপ পরিণাম হইয়া থাকে । তুমি এইরূপ কর, এই কাজটা তোমায় করিতেই হইবে, একথা কেবল দূরদৃষ্টি কাহাকেও বলিয়া দিতে পারে না । কারণ, দূরদৃষ্টি যতই কেন হৌক না, তাহা মনুষ্যকৃত বলিয়া মনুষ্যের উপরে নিজের শাসনাধিকার বিস্তার করিতে পারে না । এইরূপ প্রসঙ্গে, আমি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অধিকারবিশিষ্ট কাহারো নিকট হইতে আদেশ পাওয়া আবশ্যক । এবং ঐ কার্য ঈশ্বরদত্ত সদসদ্‌বিবেক-বুদ্ধিই করিতে পারে, কারণ উহা মনুষ্য অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ সুতরাং মনুষ্যের উপর নিজের অধিকার স্থাপনে সমর্থ । এই সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি বা ‘দেবতা’ স্বয়ম্ভূ হওয়াপ্রযুক্ত প্ৰচলিত ব্যবহারে এইরূপ বলিবার রীতি হইয়া গিয়াছে যে, আমার ‘মনোদেবতা’ আমাকে অমুক প্রকারের সাক্ষ্য দিতেছেন না । কেহ কোন দুষ্কর্ম করিলে পশ্চাত্তাপ বশত সে নিজেই লজ্জিত হয় এবং তাহার মনে সর্বদাই একটা যন্ত্রণা উপস্থিত হয় । ইহাও এই মনোদেবতার শাসনের ফল । ইহা দ্বারাও স্বতন্ত্ৰ মনোদেবতার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় । কারণ, আমার মন আমাকে কেন কষ্ট দেয়, আধিভৌতিক মতে উপরি-উক্ত সিদ্ধান্ত ব্যতীত এই প্রশ্নের আর কোন যুক্তি পাওয়া যায় না ।


2) মনোদেবতা সম্বন্ধে আমাদের গ্রন্থসমূহের বচন


পাশ্চাত্য আধিদৈবতবাদের সংক্ষিপ্ত সার উপরে প্রদত্ত হইল । পাশ্চাত্য দেশের এই মতবাদ প্ৰায় খৃষ্টধর্মের উপদেশকেরাই প্ৰবর্তিত করিয়াছেন । তাঁহাদের মতে ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে কেবল আধিভৌতিক সাধন অপেক্ষা এই ঈশ্বরদত্ত সাধন সুলভ ও শ্ৰেষ্ঠ অতএব গ্ৰাহ্য । আমাদের দেশে প্ৰাচীন কালে কর্মযোগশাস্ত্রের এইরূপ স্বতন্ত্র কোন পন্থা না থাকিলেও উক্ত প্রকারের মত প্রাচীন গ্ৰন্থসমূহের অনেক স্থানেই পাওয়া যায় । মনের বিভিন্ন বৃত্তিকে মহাভারতের অনেক স্থানে দেবতার স্বরূপ প্রদত্ত হইয়াছে দেখা যায় । পূর্ব প্রকরণে বলাও হইয়াছে যে, ধর্ম, সত্য, বৃত্ত, শীল, শ্রী প্রভৃতি দেবতা প্রহ্লাদের শরীর হইতে নিঃসৃত হইয়া ইন্দ্রের শরীরে কিরূপে প্রবেশ করিয়াছিল । কার্যাকার্য বা ধর্মাধর্মের নির্ণয়কারী দেবতার নামও ‘ধর্ম’ই দেওয়া হইয়াছে । শিবি রাজার আত্মবলের পরীক্ষা করিবার জন্য শ্যেনের রূপ ধরিয়া এবং যুধিষ্ঠিরের পরীক্ষা করিবার জন্য প্রথমে যক্ষের রূপ ধরিয়া ও শেষে কুকুরের রূপ ধরিয়া ধর্ম প্রকট হইয়াছিলেন এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে । এমন কি ভগবদ্‌গীতাতেও [১০|৩৪] কীর্তি, শ্রী, বাক্‌, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা ইহারা দেবতা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে । তন্মধ্যে স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা ইহারা মনের ধর্ম । মনও এক দেবতা এবং পরব্রহ্মের প্রতীক মানিয়া তাহার উপাসনাও উপনিষদে কথিত হইয়াছে [তৈ|৩|৪; ছা|৩|১৮] । “মনঃপূতং সমাচরেৎ”, - মনে যাহা শুদ্ধ বলিয়া বুঝিবে তাহাই করিবে – মনু যখন ইহা বলিতেছেন [৬|৪৬], তখন ইহাই মনে হয় যে, ‘মন’ শব্দে মনোদেবতাই মনুর অভিপ্রেত । প্রচলিত ব্যবহারে আমি বলি যে, “যাহা ভাল লাগে তাহাই করিবে” ।

‘মনঃপূত’ এই শব্দের অর্থ মারাঠীতে উল্টা হইয়া গিয়াছে, এবং অনেক সময় যাহা মনে হয় তাহাই যদৃচ্ছাক্রমে করিতে প্রবৃত্ত হইলে তাহা ‘মনঃপূত’ আচরণ এইরূপ আমরা বলিয়া থাকি । কিন্তু এই শব্দের প্রকৃত অর্থ “মনেতে যাহা পবিত্র কিংবা শুদ্ধ বলিয়া উপলব্ধি হইবে তাহাই করিবে” – এইরূপ । মনুসংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ে মনু এই বিষয় আরো স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন [মনু|৪|১৬১] –
যৎকর্ম কুর্বতোহস্য স্যাৎ পরিতোষোহন্তরাত্মনঃ ৷
তৎ প্রযত্নেন কুবীর্ত বিপরীতং তু বর্জয়েৎ ॥
অর্থাৎ - “যে কর্ম করিলে আমার অন্তরাত্মা সন্তুষ্ট হয় তাহা সযত্নে করিবেক, এবং তাহার বিপরীত কর্ম পরিত্যাগ করিবেক” । সেইরূপ আবার চাতুর্বর্ণ্যধর্মাদির ব্যবহারিক নীতির মূলতত্ত্ব বলিবার সময় মনুযাজ্ঞবল্ক্যাদি স্মৃতিগ্রন্থকারও বলিতেছেন :-
বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ ৷
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুসক্ষাদ্ধর্মস্য লক্ষণম্‌ ॥
অর্থাৎ - “বেদ, স্মৃতি, শিষ্টাচার এবং আপনার আত্মার ভাল লাগা, ধর্মের এই চারি মূলতত্ত্ব” [মনু|২|১২] । “আপনার আত্মার যাহা ভাল লাগে” ইহার অর্থ – মনে যাহা শুদ্ধ বলিয়া উপলব্ধি হয় । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে শ্রুতি, স্মৃতি ও সদাচার হইতে কোন কার্যের ধর্মাধর্মত্ব নির্ণয় হইতে না পারিলে তখন উহা নির্ণয় করিবার চতুর্থ সাধন হইতেছে ‘মনঃপূততা’ এইরূপ বুঝিতে হইবে । মহাভারতে প্রহ্লাদ ও ইন্দ্রের কথা বিবৃত করিবার পর “শীলের” লক্ষণ দিবার সময় ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ বলিয়াছেন –
যদন্যেষাং হিতং ন স্যাৎ আত্মনঃ কর্ম পৌরুষম্‌ ৷
অপত্রপেত বা যেন ন তৎ কুর্য্যাৎ কথঞ্চন ॥
অর্থাৎ - আমার যে কর্ম লোকের হিতকর নহে কিংবা যাহার জন্য নিজেরই লজ্জা হয়, সে কর্ম কখনই করা উচিত নহে [মভা|শাং|১২৪|৬৬] । “লোকের হিতকর নহে” ও “লজ্জা হয়” এই দুই পদে, ‘অধিক লোকের অধিক হিত’ ও ‘মনোদেবতা’ এই দুই পক্ষেরই উল্লেখ এই শ্লোকে একত্র কিরূপ উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার প্রতি পাঠক লক্ষ্য করিবেন । মনুস্মৃতিতেও [১২|৩৫|৩৭] উক্ত হইয়াছে যে, যে কর্ম করিলে লজ্জা বোধ হয় তাহা তামসিক এবং যে কর্ম করিলে লজ্জা বোধ হয় না ও অন্তরাত্মা সন্তুষ্ট থাকে তাহা সাত্ত্বিক । ধম্মপদ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থেরও এই প্রকার বিচার দৃষ্ট হয় [ধম্মপদ ৬৭ ও ৬৮ দেখ] । কর্মাকর্মের নির্ণয়ে কোন সংশয় উপস্থিত হইলে –
সতাং হি সান্দহপদেষু বস্তুষু প্রমাণমন্তঃকরণপ্রবৃত্তয়ঃ ॥
অর্থাৎ - “সৎব্যক্তি নিজের অন্তঃকরণের সাক্ষ্যই প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করেন” – কালিদাসও তাহা বলিয়াছেন [শকুং|১|২০] । পাতঞ্জলযোগ শিক্ষা দেয় যে, চিত্তবৃত্তির নিরোধ করিয়া একই বিষয়ের উপর মনকে স্থির রাখিতে হইবে । এই যোগশাস্ত্র আমাদের এখানে বহু প্রাচীন কাল হইতে প্রচলিত; তাই কর্মাকর্ম সম্বন্ধে কোন সন্দেহ উপস্থিত হইলে অন্তঃকরণকে স্বস্থ ও শান্ত করিয়া যাহা উচিত মনে হয় তাহাই করিবে – এ কথা আমাদের দেশের কাহাকেও শিখাইবার আবশ্যকতা নাই । সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রের আরম্ভে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, স্মৃতিকার ঋষি নিজের মনকে একাগ্র করিয়াই ধর্মাধর্ম বিবৃত করিতেন [মনু|১|১] । ‘যে কোন কর্মে মনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা উচিত’ – এই মার্গ প্রথম দৃষ্টিতে অত্যন্ত সুলভ বলিয়া মনে হয়, কিন্তু যখন তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ‘শুদ্ধ মন’ কাহাকে বলে এ বিষয়ে সূক্ষ্ম বিচার করিতে থাকি; তখন এই সহজ মতটি শেষ পর্যন্ত কাজ দিতে পারে না; কারণ আমাদের শাস্ত্রকারেরা কর্মযোগশাস্ত্রের ইমারত এই কাঁচা ভিত্তির উপর দাঁড় করান নাই । এই তত্ত্বজ্ঞানটি কি, এক্ষণে তাহার বিচার করিতে হইবে । কিন্তু তৎপূর্বে পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীরা এই আধিদৈবত মতবাদের খণ্ডন কিরূপ করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করা আবশ্যক । কারণ, এই বিষয়ে আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক এই দুই পন্থার যুক্তিগুলি ভিন্ন হইলেও এই উভয়ের শেষ সিদ্ধান্ত একই প্রকার । অতএব প্রথমে আধিভৌতিক যুক্তিগুলি বলিলে আধ্যাত্মিক যুক্তিসমূহের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা পাঠকদিগের শীঘ্র উপলব্ধি হইবে ।

উপরে বলা হইয়াছে যে, আধিদৈবিক পন্থায় শুদ্ধ মনকেই অগ্রস্থান দেওয়া হইয়াছে । ইহা হইতে প্রকট হইতেছে যে, ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ এই আধিভৌতিক নীতিপন্থায় কর্তার বুদ্ধি বা হেতুর কোন বিচার না করিবার যে দোষ পূর্বে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে তাহা এই আধিদৈবত মতে প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । কিন্তু সদসদ্‌বিবেকরূপী শুদ্ধ মনোদেবতা কাহাকে বলা হইবে তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে, এই পন্থাতেও অন্যান্য অনেক অপরিহার্য বাধা আসিয়া উপস্থিত হয় । যে কোন বিষয় ধর না কেন, তাহার সমস্ত দিক বিচার করিয়া তাহা গ্ৰাহ্য কি অগ্ৰাহ্য, করিবার যোগ্য কি অযোগ্য, অথবা তাহা লাভজনক বা সুখজনক কি না, তাহা নির্ধারণ করা, নাক কিংবা চোখের কাজ নহে; কিন্তু এই কাজ এক স্বতন্ত্র ইন্দ্ৰিয়ের, যাহাকে মন বলা যায় । অর্থাৎ কার্যাকার্যের কিংবা ধর্মাধর্মের নির্ণয় মনই করিয়া থাকে; - তাকে তুমি ইন্দ্ৰিয়ই বল আর দেবতাই বল । আধিদৈবতবাদের মত যদি এইমাত্র হয় তাহা হইলে কোনই আপত্তি নাই । কিন্তু পাশ্চাত্য আধিদৈবত পক্ষ ইহা অপেক্ষা আরও একপদ অগ্রসর হইয়াছেন । তাঁহারা বলেন যে, ভাল বা মন্দ (সৎ বা অসৎ) ন্যায্য বা অনায্য, ধর্ম বা অধর্মের নির্ণয় করা এক; আর কোন পদার্থ ভারী বা হাল্কা, সাদা বা কালো, কিংবা গণিতের কোন উদাহরণ ঠিক কি ভুল, তাহা নির্ণয় করা আর এক কথা । এই দুই বিষয় অত্যন্ত ভিন্ন । ইহার মধ্যে দ্বিতীয় প্রকার বিষয়ের নির্ণয় মন ন্যায়শাস্ত্রের পদ্ধতিক্রমে করিতে পারে; কিন্তু প্ৰথম প্রকার বিষয়ের নিষ্পত্তি কেবলমাত্ৰ মন করিতে অসমৰ্থ, অতএব সেই কার্য সদসদ্‌বিবেচনারূপ যে দেবতা মনেতে আছেন কেবল তিনিই করিয়া থাকেন । ইহার কারণ তাঁহারা এইরূপ বলেন যে, কোনও হিসাব ঠিক কি ভুল স্থির করিবার সময় আমরা সেই হিসাবের তেরিজ, গুণফল প্ৰভৃতি পরীক্ষা করিয়া তাহার পর আমাদের মত স্থির করি; অর্থাৎ এই বিষয়ের নির্ণয় করিবার পূর্বে মনের অন্য কোন ক্রিয়া বা ব্যাপার করা দরকার । কিন্তু ভাল মন্দের নির্ণয় সেরূপ নহে । কোন মনুষ্য কাহাকে খুন করিয়াছে শুনিবা মাত্র “ছি ! সে বড়ই মন্দ কাজ করিয়াছে” এই রূপ উচ্ছ্বাসোক্তি আমাদের মুখ দিয়া একেবারেই বাহির হইয়া পড়ে; সে সম্বন্ধে আমাদের কোন বিচার করিতে হয় না । সুতরাং কোনই বিচার না করিয়া আপনাপনি যে নির্ণয় করা যায়, এবং বিচার করিয়া যে নির্ণয় করা যায়, এই দুইই একই মনোবৃত্তির ব্যাপার, তাহা বলিতে পারা যায় না । সেই জন্য সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিকেও এক স্বতন্ত্র মানসিক দেবতা মানিতে হয় । সকল মনুষ্যের অন্তঃকরণে এই শক্তি বা দেবতা সমানরূপে জাগ্ৰত থাকায় সকলেই হত্যাকাণ্ডকে অপরাধ মনে করে; এবং সে সম্বন্ধে কাহাকে কিছু শিখাইতেও হয় না । 


3) আধিদৈবত পক্ষের উপর আধিভৌতিক পক্ষের আপত্তি


আধিভৌতিক পন্থার লোকেরা এই আধিদৈবিক যুক্তিবাদের এই উত্তর দেন যে, কেবল “আমি দুএকটা বিষয়ের নির্ণয় একেবারেই করিতে পারি” এইটুকু হইতে স্বীকার করিতে পারা যায় না যে, যে বিষয়ের নির্ণয় আমাদের বিচার করিয়া করা হয়, তাহা উহা হইতে ভিন্ন । কোন কাজ দ্রুত বা রহিয়া বসিয়া করা অভ্যাসের কাজ । ধর, হিসাবের কথা । ব্যাপারী লোক মন থেকেই সেরছটাকের দর চট্‌ করিয়া মুখে মুখে গণিতের প্রণালীতে হিসাব করিয়া বলিতে পারে; তাই বলিয়া বলা যায় না যে, উত্তম গণিতবেত্তা হইতে তাহার গুণন করিবার শক্তি বা দেবতা ভিন্ন । সাধনায় দ্বারা কোন বিষয় এমনি অভ্যাস হইয়া যায় যে কিছু বিচার না করিয়াও মনুষ্য তাহা শীঘ্র ও সহজে করিয়া যায় । উত্তম লক্ষ্যভেদী মনুষ্য উড়োপাখী বন্দুকে সহজে মারিয়া থাকে, তাই বলিয়া লক্ষ্যভেদের এক স্বতন্ত্র দেবতা আছে এরূপ কেহ বলিতে পারে না । শুধু তাহাই নহে, কিরূপে ‘তাক’ করিতে হইবে, উড়োপাখীর বেগ কিরূপে গণনা করিতে হইবে ইত্যাদি শাস্ত্রীয় উপপত্তিও কেহ নিরর্থক ও ত্যাজ্য বলিতে পারে না । নেপোলিয়ন সম্বন্ধে এই কথা প্ৰসিদ্ধ আছে যে, রণক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া একবার চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলেই শত্রুর ছিদ্র কোথায়, তাহা তৎক্ষণাৎ তাহার নজরে পড়িত । কিন্তু তাই বলিয়া যুদ্ধকলা এক স্বতন্ত্র দেবতা এবং অন্য মানসিক শক্তির সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই, এরূপ কেহ বলে না । কোন কাজে কাহারও বুদ্ধি স্বভাবত বেশী, আর কাহারও বা কম, ইহা সত্য । কিন্তু কেবল সেই কারণেই উভয়ের বুদ্ধি বস্তুত ভিন্ন, তাহা আমি বলিতে পারি না । তাছাড়া এ কথাও সত্য নহে যে, কার্যাকার্যের কিংবা ধর্মাধর্মের নির্ণয় একাএক হইয়া যায় । যদি তাহাই হইত, তবে এই প্ৰশ্নই কখনও উপস্থিত হইত না যে, “অমুক কাজ করা উচিত অথবা করা অনুচিত” । ইহা সুস্পষ্ট যে, এই প্রকার প্রশ্ন প্ৰসঙ্গ অনুসারে অর্জুনের ন্যায় সকলেরই সম্মুখে উপস্থিত হইয়া থাকে; এবং কার্যাকার্যনির্ণয়ের কোন বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির অভিপ্রায়ও ভিন ভিন্ন হইয়া থাকে; সদসদ্‌বিবেচনশক্তিরূপ স্বয়ম্ভূ দেবতা যদি একই হন তবে এই ভেদ কেন ? কাজেই বলিতে হয় যে, মনুষ্যের বুদ্ধি যে পরিমাণে সুশিক্ষিত বা সুসংস্কৃত হইবে, সেই পরিমাণেই যোগ্যতার সহিত সে কোন বিষয়ের, নির্ণয় করিবে । এমন অনেক অসভ্য লোক আছে যাহারা মনুষ্যহত্যাকে অপরাধ মনে না করিয়া হত মনুষ্যের মাংসও আনন্দে আহার করে ! অসভ্য লোকের কথা ছাড়িয়া দাও । সভ্য দেশেও দেখা যায় যে, দেশাচার অনুসারে কোন এক দেশে যাহা গর্হিত বলিয়া মনে করে, অন্য এক দেশে তাহাই সর্বমান্য হইয়া থাকে । উদাহরণ - এক স্ত্রী থাকিতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্ৰহণ করা বিলাতে অপরাধ বলিয়া গণ্য; কিন্তু হিন্দুস্থানে তাহা বিশেষ দুষণীয় বলিয়া বিবেচিত হয় না । ভরপুরসভার মধ্যে মাথা হইতে পাগড়ী খুলিয়া বসা হিন্দুলোকের নিকট লজ্জা ও অমৰ্যাদার কথা কিন্তু ইংরেজ লোক মাথা হইতে টুপি খোলাই সভ্যতার লক্ষণ মনে করে । যদি ঈশ্বরদত্ত বা স্বাভাবিক সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি প্ৰযুক্তই মন্দ কর্ম করিতে লজ্জাবোধ করা সত্য হয়, তাহা হইলে সকলেই একই কার্যে একই রকম লজ্জা বোধ করে না কেন ? বড় বড় দস্যুও যাহার অন্ন একবার গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা নিন্দনীয় মনে করে; কিন্তু বড় বড় সুসভ্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্রেও, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লোকদিগকে যুদ্ধে বধ করা স্বদেশভক্তির লক্ষণ মনে করে । সদসদ্‌বিবেচনশক্তিরূপ দেবতা যদি একই হয় তাহা হইলে এই পার্থক্য কেন মানা যায় ? এবং যদি বলা যায় যে, সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিরও শিক্ষা অনুসারে কিংবা দেশাচার অনুসারে ভেদ হয়, তাহা হইলে স্বয়ম্ভূ নিত্যত্ববিষয়ে বাধা আসে । অসভ্য অবস্থা ছাড়িয়া মনুষ্য যেমন-যেমন সভ্য হইতে থাকে সেই অনুসারে তাহার মন ও বুদ্ধি বিকশিত হইতে থাকে; এবং এই প্রকারে বুদ্ধির বিকাশ হইলে পর পূর্বে অসত্য অবস্থায় থাকিতে যে সকল বিষয়ে বিচার সে করিতে পারিত না, এক্ষণে সত্য অবস্থায় সেই সকল বিষয়েরই বিচার সে সত্বর করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । অথবা বলিতে হয় যে, এই প্রকার বুদ্ধির বিকাশ হওয়াই সভ্যতার লক্ষণ । সুসভ্য কিংবা সুশিক্ষিত মনুষ্য যে অপরের কোন বস্তু দেখিবামাত্র চাহিয়া বসে না বা লইতে ইচ্ছা করে না, ইহা তাহার ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের পরিণাম । সেইরূপ ভালমন্দ নির্ণয় করিবার মনের শক্তিও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়, এবং এখন তো কোন কোন বিষয়ে উহা এতটা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে যে, কোন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র বিচার করিবার অপেক্ষা না করিয়াই আমরা নিজের নৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করি । চক্ষু দ্বারা নিকটের কিংবা দূরের বস্তু দেখিতে হইলে চক্ষু, শিরা ও স্নায়ু ন্যুনাধিক পরিমাণে সঙ্কুচিত করিতে হয়; এবং এই সব ক্রিয়া এত দ্রুত হইয়া থাকে যে আমরা তাহা জানিতেও পারি না । কিন্তু তাহার দরুণ এই বিষয়ের উপপত্তি কেহ কি অনুপযোগী মনে করিয়াছে ? 


4) সদসদ্বিবেক কোন নিছক শক্তি নহে


সার কথা, মনুষ্যের মন বা বুদ্ধি সর্বকালে ও সর্বকাজে একই । কালো ও সাদার নির্ণয় এক প্রকারের বুদ্ধি করে এবং ভালমন্দের নির্ণয় অন্য প্রকারের বুদ্ধি করে, এ কথা ঠিক নহে । কাহার বুদ্ধি কম থাকে, আর কাহারও বুদ্ধি অশিক্ষিত বা অপরিণত থাকে, এইটুকুই যা প্ৰভেদ । এই ভেদের প্রতি, এবং কোন কার্য দ্রুত করিতে পারা যে অভ্যাস ও সাধনার ফল, এই উপলব্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীরা স্থির করিয়াছেন যে, মনের যে স্বাভাবিক শক্তিসমূহ আছে তাহার ওদিকে সদসদ্‌বিচারশক্তি বলিয়া কোন আলাদা স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট শক্তি স্বীকার করিবার প্রয়োজন নাই ।


5) অধ্যাত্ম পক্ষের আপত্তি - ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার


আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারদিগের এই সম্বন্ধীয় চরম সিদ্ধান্তও পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীদিগেরই ন্যায় । স্বস্থ ও শান্ত চিত্তে সকল বিষয়ের বিচার করা আবশ্যক, ইহা তাহারা স্বীকার করেন । কিন্তু ধর্মাধর্মনির্ণয়ের বুদ্ধি এক, এবং কালোসাদা বুঝিবার বুদ্ধি আর-এক, এ মত তাঁহারা স্বীকার করেন না । তাঁহারা, ইহাও প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, মন যে পরিমাণে সুশিক্ষিত হইবে সেই পরিমাণে সে ভালমন্দ নির্ণয় করিতে পারিবে, তাই মনের উন্নতিসাধনের জন্য প্ৰত্যেকের যত্ন করা আবশ্যক; এবং এই উৎকর্ষ কিরূপে সাধন করিতে হইবে তাহার নিয়মও উহারা বলিয়া দিয়াছেন । কিন্তু সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি সাধারণ বুদ্ধি হইতে কোন ভিন্ন বস্তু বা ঈশ্বরের দান, এ মত তাঁহারা মানেন না । মনুষ্য কিরূপে জ্ঞান লাভ করে এবং তাহার মন বা বুদ্ধির ব্যাপার কেমন করিয়া চলে, প্ৰাচীন কালে তাহার সূক্ষ আলোচনা হইয়া গিয়াছে । এই আলোচনা ‘ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে । ক্ষেত্র অর্থে শরীর এৰং ক্ষেত্ৰজ্ঞ অর্থে আত্মা । এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার আধ্যাত্মবিদ্যার মূল । এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞ বিদ্যার ঠিক্‌ জ্ঞান হইলে পর, শুধু সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি কেন, কোন মনোদেবতারই অস্তিত্ব আত্মা হইতে উৎকৃষ্ট বা স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না । এই অবস্থাতে আধিদৈবতপক্ষ স্বতই দুৰ্বল হইয়া পড়ে । তাই এক্ষণে এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিদ্যারই সংক্ষেপে বিচার করা হইবে । ভগবদগীতার অনেক সিদ্ধান্তেরই প্রকৃত অৰ্থও এই বিচারসূত্রে পাঠকের ঠিক উপলব্ধি হইবে । 


6) মনুষ্যদেহরূপ বৃহৎকারখানা - কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়


মনুষ্যের দেহ (পিণ্ড, ক্ষেত্র, বা শরীর) একটা মস্ত বড় কারখানা বলিলেও চলে । কোন কারখানায় যেরূপ বাহিরের পণ্যদ্রব্য প্রথমে ভিতরে লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাহার পর সেই মালের বাছাই বা ব্যবস্থা করিয়া পরে কারখানার উপযোগী পদার্থ কোনগুলি এবং অনুপযোগী কোনগুলি তাহা স্থির করিয়া বাহির হইতে ভিতরে-আনা কাঁচা মাল হইতে নূতন পদার্থ প্রস্তুত করিয়া তাহা বাহিরে পাঠান হয়; সেইরূপ মনুষ্যের দেহের মধ্যেও প্রতিক্ষণে অনেক ব্যাপার চলিতে থাকে । এই জগতের পাঞ্চভৌতিক পদার্থসম্বন্ধে মনুষ্যের জ্ঞানপ্ৰাপ্তির জন্য মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহই প্ৰথম সাধন । এই ইন্দ্ৰিয়সমূহের দ্বারা জাগতিক পদার্থের প্রকৃত বা মূল স্বরূপ জানা যায় না । আধিভৌতিকবাদীগণের মত এই যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সমক্ষে পদার্থসমূহ যেরূপ প্ৰতিভাত হয়, তাহাদের যথার্থ স্বরূপ তাহাই । কিন্তু কাল যদি আমরা কোন নব ইন্দ্রিয় প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে তাহার, দৃষ্টিতে জাগতিক পদার্থের গুণধর্ম বর্তমান হইতে যে ভিন্ন হইবে, তাহা আর বলিতে হইবে না । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহের মধ্যেও দুই ভেদ আছে - এক কর্মেন্দ্ৰিয়, দ্বিতীয় জ্ঞানেন্দ্ৰিয় । হাত, পা, বাক-যন্ত্র, গুদ (পায়ু/মলদ্বার অর্থে ব্যবহৃত, স্ত্রী-যোনি অর্থে নয়) ও উপস্থ (জননেন্দ্ৰিয়) এই পাঁচটী কর্মেন্দ্ৰিয় । আমরা আমাদের শরীরের দ্বারা যে কোন ব্যবহার করি সে সমস্তই এই কর্মেন্দ্ৰিয়ের দ্বারাই করিয়া থাকি । নাক, চোখ, কান, জিভ ও ত্বক, এই পাঁচটী জ্ঞানেন্দ্রিয় । চক্ষু দ্বারা রূপ, জিহ্বা দ্বারা রস, কৰ্ণ দ্বারা শব্দ, নাসিকা দ্বারা গন্ধ ও ত্বক দ্বারা স্পর্শ উপলব্ধি করি । যে কোন বাহ্য পদার্থই ধর না কেন, তৎসম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান হয়, তাহা উক্ত পদার্থের রূপ-রস শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের বাহিরে আর কিছুই নহে । উদাহরণ যথা - ধর, এক টুকরা সোনা ? উহা চোখের দৃষ্টিতে পীতবর্ণ, ত্বকের নিকট কঠিন বলিয়া প্ৰতিভাত হয়, পিটিলে লম্বা হয়, ইত্যাদি তাহার যে গুণ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় তাহাকেই আমরা সোনা বলি এবং এই গুণসকল বারংবার এক পদার্থের মধ্যে একই রকমে দেখিতে পাওয়া গেলে, আমাদের দৃষ্টিতে সোনা এক স্বতন্ত্র পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় । বাহিরের মাল ভিতরে নেওয়া এবং ভিতরের মাল বাহিরে পাঠিয়ে দিবার জন্য যেরূপ কোন কারখানার দরোজা থাকে, সেইরূপ মানবদেহে বাহিরের মাল ভিতরে আনিবার জন্য জ্ঞানেন্দ্ৰিয়রূপী দ্বার আছে এবং ভিতরের মাল বাহিরে পাঠাইবার জন্য কর্মেন্দ্ৰিয়রূপ দ্বার আছে । সূর্যের কিরণ কোন পদার্থের উপর পড়িয়া তথা হইতে আবার ফিরিয়া আমাদের চোখের মধ্যে প্ৰবেশ করিলে আমাদের আত্মায় সেই পদার্থের রূপসম্বন্ধে জ্ঞান হইয়া থাকে । কোন পদার্থ হইতে নিঃসৃত গন্ধের সূক্ষ্ম পরমাণু আমাদের নাকের মজ্জাতন্তুর উপর আসিয়া পড়িলে আমাদের নিকট তাহার গন্ধ আসে । অন্য জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ব্যাপারও এইরূপেই চলিয়া থাকে । জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল এইরূপে ব্যাপার করিতে থাকিলে তাহাদের দ্বারা বাহ্য জগতের পদার্থের জ্ঞান হইতে থাকে । কিন্তু জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল যে কোন ব্যাপার করে তাহাদের জ্ঞান স্বতঃ তাহাদের হয় না, তাই জ্ঞানেন্দ্ৰিয়দিগকে ‘জ্ঞাতা’ না বলিয়া শুধু বাহিরের মাল ভিতরে আনিবার ‘দরোজা’ বলা হইয়াছে । এই দরোজা দিয়া মাল ভিতরে আসিয়া পড়িলে পর, তাহার পরবর্তী ব্যবস্থা করা মনের কাজ । উদাহরণ যথা – দ্বিপ্রহর হইলে ঘড়িতে ঘণ্টা বাজিতে থাকিলে তখনই আমাদের মন বুঝিতে পারে না যে কয়টা বাজিয়াছে । কিন্তু যেমন যেমন ঘড়িতে ‘ঠনঠন’ করিয়া এক একটী আওয়াজ হইতে থাকে, তেমনি তেমনি বায়ুতরঙ্গ আমাদের কানে আসিয়া আঘাত করে, এবং মজ্জাতন্তুর দ্বারা প্ৰত্যেক আওয়াজের পৃথক পৃথক সংস্কার প্রথমে আমাদের মনের উপর হয় এবং শেষে এই সকল মিলিত করিয়া কয়টা বাজিল তাহা আমরা স্থির করি । জ্ঞানেন্দ্ৰিয় পশুদিগেরও আছে; ঘড়ির এক এক ঠোকা যেমন যেমন পড়িতে থাকে, তেমনি তেমনি প্ৰত্যেক ধ্বনির সংস্কার তাহার কান দিয়া মন পর্যন্ত পৌঁছায়; কিন্তু তাহারা ঐ সমস্ত সংস্কারকে একত্র করিয়া বারোটা বাজিল বলিয়া স্থির যে করিতে পরিবে, তাহাদেৱ মন এতটা বিকশিত হয় নাই । এই শব্দ শাস্ত্রীয় পরিভাষায় বলিতে হইলে এইরূপ বলা হইয়া থাকে যে, পশুর একাধিক সংস্কারের পৃথক পৃথক জ্ঞান হইলেও তাহার সেই অনেকতার মধ্যে একত্বের বোধ হয় না । ভগবদ্‌গীতাতে আছে - “ইন্দ্ৰিয়াণি পরাণ্যাহুঃ ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ” - অৰ্থাৎ ইন্দ্ৰিয়সকল (বাহ্য) পদাৰ্থ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ এবং ইন্দ্ৰিয় অপেক্ষাও মন শ্রেষ্ঠ [গীতা|৩|৪২] । উপরে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহাই ইহারও ভাবার্থ । পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি যে, মন স্থির না হইলে চোখ খোলা থাকিলেও কিছুই দেখা যায় না এবং কান খোলা থাকিলেও কিছুই শোনা যায় না । তাৎপর্য এই যৈ, এই দেহরূপী কারখানায় ‘মন’ একটী মুন্সী (কেরাণী), যাহার নিকট জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা বাহিরের সমস্ত মাল প্রেরিত হয়; এবং এই মুন্সী (মন) ঐ মালের যাচাই করে । এখন বিচার করিতে হইবে যে, এই যাচাই কিরূপে করা হয়, এবং এ পর্যন্ত আমরা যাহাকে সাধারণত ‘মন’ বলিয়া আসিয়াছি, তাহারও আর কত প্ৰকার ভেদ করা যাইতে পারে, কিংবা একই মন অধিকারভেদে কি-কি পৃথক নাম প্রাপ্ত হয় ।


7) মন ও বুদ্ধির পৃথক্‌ পৃথক্‌ কাজ


জ্ঞানেন্দ্ৰিয়যোগে মনের উপর যে সকল সংস্কার ঘটে সেগুলি প্ৰথমে একত্র করিয়া এবং তাহাদের পরস্পর তুলনা করিয়া নির্ণয় করিতে হয় যে, তাহাদের মধ্যে ভাল, আর কোন্‌টি মন্দ, কোন্‌টি গ্ৰাহ্য আর কোন্‌টি ত্যাজ্য, এবং কোন্‌টি লাভজনক ও কোন্‌টি ক্ষতিজনক । ইহা নিৰ্ণয় হইলে পর, তাহাদের মধ্যে যেটি ভাল, গ্ৰাহ্য, লাভজনক, উচিত বা করিবার যোগ্য তাহাই করিতে আমরা প্ৰবৃত্ত হই । ইহাই সাধারণ মানসিক ব্যবহার । উদাহরণ যথা - আমরা কোন বাগানে গমন করিলে, চক্ষু ও নাসিকা এই দুই ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা আমাদের মনের উপর বাগানের গাছ ও ফুলগুলির সংস্কার ঘটিয়া থাকে । কিন্তু এই ফুলগুলির মধ্যে কোন ফুলের গন্ধ ভাল ও কোন্‌টির গন্ধ খারাপ, এই জ্ঞান আমাদের আত্মাতে না হইলে, কোনও ফুল হস্তগত করিবার ইচ্ছা মনে উৎপন্ন হয় না এবং তাহা তুলিবার উদ্যোগও আমরা করি না । অতএব সমস্ত মনোব্যাপারকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে - (১) জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা বাহ্য পদার্থের জ্ঞান পাইয়া সেই সকল সংস্কারের তুলনার জন্য ব্যবস্থাপূর্বক সাজাইয়া রাখা; (২) এইরূপ ব্যবস্থার পর তাহাদের ভালমন্দের সারাসার বিচার করিয়া কোনটি গ্রাহ্য ও কোনটি ত্যাজ্য তাহা স্থির করা; এবং (৩) এই নিশ্চয় হইলে পর, গ্ৰাহ্য বস্তু গ্ৰহণ করিবার ও অগ্ৰাহ্য বস্তু ফেলিয়া দিবার ইচ্ছা উৎপন্ন হইয়া আবার সেই অনুসারে প্রবৃত্তি হওয়া । কিন্তু ইহা আবশ্যক নহে যে, এই তিন ক্রিয়া ব্যবধান বিনা সঙ্গে সঙ্গে একের পিছনে আর একটি হইতে থাকিবে । ইহা সম্ভব যে, পূর্বদৃষ্ট কোন বস্তুর ইচ্ছা আজ হইল; কিন্তু - ইহাতেই বলা যাইতে পারে না যে, উক্ত তিন ক্রিয়ার মধ্যে কোন একটি ক্রিয়ার প্ৰয়োজন নাই । বিচারের কাছারী এক হইলেও সেখানে যেমন কাজের এইরূপ বিভাগ আছে - প্ৰথমে বাদী ও প্ৰতিবাদী কিংবা তাহাদের উকিল আপন আপন সাক্ষ্য ও প্ৰমাণ বিচারপতির সমক্ষে উপস্থিত করে, তাহার পর উভয়পক্ষের সাক্ষীসাবুদ, দেখিয়া তাহার উপর বিচারপতি আপন বিচার নিষ্পত্তি করেন, এবং বিচারপতি-কৃত নিষ্পত্তি শেষে নাজির আমলে আনে; ঠিক সেইরূপ এ পৰ্যন্ত যে মুন্সীকে আমরা সাধারণত ‘মন’ বলিয়া আসিয়াছি, তাহার ব্যাপারসমূহেরও বিভাগ হইয়া থাকে । তন্মধ্যে সম্মুখে উপস্থিত বিষয়সমূহের সারাসার বিচার করিয়া কোন এক বিষয় অমুক প্রকারেরই (এবমেব) অন্য প্রকারের নহে (নাহন্যথা), এইরূপ নিশ্চয় করিবার কাজ (অর্থাৎ কেবল বিচারপতির কাজ) বুদ্ধি নামক ইন্দ্রিয়ের । উপরে কথিত সমস্ত মনোব্যাপার হইতে এই সারাসার বিবেকশক্তিকে পৃথক করিলে পর, কেবল বাকী সমস্ত ব্যাপারই যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হইয়া থাকে, তাহাকেই সাংখ্য ও বেদান্তশাস্ত্ৰে মন বলে [সাং|ক|২৩ ও ২৭ দেখ] । এই মন উকিলের মতো কোন বিষয় এইপ্রকার (সঙ্কল্প), কিংবা ইহার বিপরীতে ঐ প্রকার (বিকল্প), ইত্যাদি কল্পনাসমূহকে বুদ্ধির সমক্ষে নির্ণয়ের জন্য উপস্থিত করে । তাই ইহাকে ‘সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক’ অৰ্থাৎ নিশ্চয়কারী না বলিয়া শুধু কল্পনাকারী ইন্দ্রিয় বলা হইয়াছে । ‘সঙ্কল্প’ শব্দে কখন কখন ‘নিশ্চর্যের’ও অর্থ সমাবেশ করা যায় [ছন্দোগ্য|৭|৪|১ দেখ] । কিন্তু এখানে নিশ্চয়ের অপেক্ষা না রাখিয়া অমুক বিষয় অমুক প্রকারের মনে করা, মানা, কল্পনা করা, বুঝা কিংবা কিছু যোজনা করা, ইচ্ছা করা, চিন্তা করা, মনে আনা ইত্যাদি ব্যাপারের উদ্দেশ্যেই ‘সঙ্কল্প’ শব্দের উপযোগ করা হইয়াছে । কিন্তু উকিলের মতো এই প্রকার নিজ কল্পনাসমূহকে বুদ্ধিসমক্ষে নিষ্পত্তির জন্য কেবল উপস্থিত করাতেই মনের কাজ শেষ হয় না । বুদ্ধি দ্বারা ভালমন্দের নির্ণয় হইলে পর, যে বিষয় বুদ্ধি গ্রাহ্য মানিয়াছে, কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা তাহারই আবরণ করা অর্থাৎ বুদ্ধির আজ্ঞাকে কার্যে পরিণত করা - এই নাজিরের কাজও মনেরই করিতে হয় । তাহার দরুণ মনের ব্যাখ্যা অন্য প্রকারেও করিতে পারা যায় । ইহা বলিতে কোনই আপত্তি নাই যে, বুদ্ধিকৃত নিৰ্ণয়কে কিরূপে আমলে আনিতে হইবে তাহার যে বিচার করিতে হয়, তাহাও একপ্রকার সঙ্কল্পবিকল্পাত্মকই । কিন্তু ইহার জন্য সংস্কৃতভাষায় ‘ব্যাকরণ-বিস্তার করা’ এই স্বতন্ত্র নাম দেওয়া হইয়াছে । ইহার অতিরিক্ত বাকী সমস্ত কাজ বুদ্ধিরই । এ পর্যন্ত মন নিজেই কল্পনাসমূহের সারাসার বিচার করে না । সারাসার বিচার করিয়া অমুক বস্তু অমুক প্রকারের তাহা নিশ্চয় করা বা তর্কের দ্বারা কার্যকারণসম্বন্ধ দেখিয়া নিশ্চিত অনুমান করা, অথবা কার্যাকার্য নির্ণয় করা, এই সমস্ত ব্যাপার বুদ্ধির । সংস্কৃত ভাষায় এই ব্যাপারসমূহকে ‘ব্যবসায়’ বা ‘অধ্যবসায়’ বলে । তাই, এই দুই শব্দের উপযোগ করিয়া ‘বুদ্ধি’ ও ‘মন’ ইহাদের ভেদ দেখাইবার জন্য মহাভারতে [শাং|২৫১|১১] এই ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে –
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ মনো ব্যাকরণাত্মকম্‌ ॥
“বুদ্ধি (ইন্দ্রিয়) ব্যবসায়কারী অর্থাৎ সারাসারবিচারপূর্বক নিশ্চয়কারী; এবং মন ব্যাকরণ অর্থাৎ বিস্তারকারী – সে পরবর্তী ব্যবস্থাকারী প্রবর্তক ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ বুদ্ধি ব্যবসায়াত্মিকা এবং মন ব্যাকরণাত্মক” । ভগবদ্গীতাতে “ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ” এই শব্দের উল্লেখ আছে [গী|২|৪৪]; এবং সেই স্থানেও বুদ্ধির অর্থ ‘সারাসারবিচারপূর্বক নিশ্চয়কারী ইন্দ্রিয়ই ।  প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধি কেবল এক তলোয়ার মাত্র । যাহা কিছু তাহার সম্মুখে আসে বা আনীত হয়, তাহার কাটছাঁট করাই তাহার কাজ; তাহার অন্য কোনও গুণ বা ধর্ম নাই [মভা|বন|১৮১|২৬] । সঙ্কল্প, বাসনা, ইচ্ছা, স্মৃতি, ধৃতি, শ্ৰদ্ধা, উৎসাহ, কারুণ্য, উৎকণ্ঠা, প্ৰেম, দয়া, সহানুভূতি, কৃতজ্ঞতা, কাম, লজ্জা, আনন্দ, ভীতি, রাগ, সঙ্গ, দ্বেষ, লোভ, মদ, মাৎসর্য, ক্ৰোধ ইত্যাদি সমস্ত মনেরই গুণ বা ধর্ম [বৃ|৯|৫|২; মৈক্র্য|৬|৩০] । এই সকল মনোবৃত্তি যেমন যেমন জাগ্রত হয় তেমনি তেমনি কর্ম করিবার দিকে মনুষ্যের প্রবৃত্তি হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা — মনুষ্য যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন এবং যতই কেন ভালরূপ গরীব লোকদের অবস্থা জানুক না, তাহার মনে যদি করুণাবৃত্তি জাগ্ৰত না হয় তাহা হইলে তাহার গরীবদের সাহায্য করিবার ইচ্ছা কখনই হইবে না । অথবা, যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা থাকিলেও ধৈর্য না থাকিলে সে যুদ্ধ করিবে না । তাৎপর্য এই যে, যে বিষয় আমরা করিতে ইচ্ছা করি তাহার পরিণাম কি হইবে বুদ্ধি কেবল তাহাই বলিয়া দেয় । ইচ্ছা কিংবা ধৈর্য প্ৰভৃতি গুণ বুদ্ধির ধর্ম না হওয়ায় বুদ্ধি আপনা হইতে অর্থাৎ মনের সাহায্য ব্যতীত কখনই ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরণা দিতে পারে না । উল্টাপক্ষে ক্রোধাদির বশীভুত হইয়া স্বয়ং মন ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরণা দিতে পারিলেও বুদ্ধির সারাসার বিচার ব্যতীত শুধু মনোবৃত্তিসমূহের প্রেরণার দ্বারা সংঘটিত কর্ম নীতিদৃষ্টিতে শুদ্ধ হইবেই, তাহা বলা যায় না । উদাহরণ যথা - বুদ্ধির উপযোগ না করিয়া শুধু করুণাবৃত্তি হইতে কোন দান করিলে তাহা কোন অপাত্রে পড়িয়া তাহার মন্দ পরিণাম হইবার সম্ভাবনা আছে । সার কথা - বুদ্ধির সাহায্যব্যতীত মনোবৃত্তি সকল অন্ধ । তাই মনুষ্যের কোন কাজ তখনই শুদ্ধ হইতে পারে, যখন বুদ্ধি শুদ্ধ থাকে, অর্থাৎ ভালমন্দের অভ্রান্ত নির্ণয় করিতে পারে; মন, বুদ্ধির অনুরোধে কার্য করে; এবং ইন্দ্ৰিয়গণ মনের অধীনে অবস্থিত । 

বুদ্ধি ও মন এই দুই শব্দ ব্যতীত ‘অন্তঃকরণ’ ও ‘চিত্ত’ এই দুই শব্দও প্রচলিত আছে । তন্মধ্যে ‘অন্তঃকরণ’ শব্দের ধাত্বর্থ “অন্তরস্থ করণ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়”, এই জন্য তাহার মধ্যে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার প্রভৃতি সমস্তেরই সাধারণত সমাবেশ করা হয়; এবং মন সর্বপ্রথম বাহ্যবিষয়ের গ্ৰহণ অর্থাৎ চিন্তন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে তাহাই চিত্ত হয় [মভা|শা|২৭৪|১৭] । কিন্তু সাধারণ ব্যবহারে এই সমস্ত শব্দ প্ৰায় একই অর্থে প্ৰযুক্ত হওয়ায় অনেকসময় কোন অর্থ কোথায় বিবক্ষিত সে সম্বন্ধে গোলযোগ উপস্থিত হয় । এই গোলযোগ যাহাতে না হয়, তাই উক্ত অনেক শব্দের মধ্যে শাস্ত্রীয় পরিভাষায় মন ও বুদ্ধি এই দুই শব্দই উপরি-প্রদত্ত নিশ্চিত অর্থে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । এই প্রকারে মন ও বুদ্ধির ভেদ স্থাপন করিলে, বিচারপতির অধিকারসূত্ৰে বুদ্ধিকেই মন অপেক্ষা কাজেকাজেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিতে হয়; এবং মন ঐ বিচারপতি বুদ্ধির মুন্সী বা কেরাণী হইয়া দাঁড়ায় । “মনসস্তু পাৱা বুদ্ধিঃ” - মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্ৰেষ্ঠ বা অতীত [গী|৩|৪২] — গীতাবাক্যের ভাবাৰ্থও এই । তথাপি উপরি-উক্ত অনুসারে ঐ কেরাণীকেও দুই প্রকারের কাজ করিতে হয় - এক, জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা অথবা বাহির হইতে ভিতরে আনীত সংস্কারসমূহের ব্যবস্থা করিয়া, উহাদিগকে নিষ্পত্তির জন্য বুদ্ধির সমক্ষে স্থাপন করা; এবং দ্বিতীয়, বুদ্ধির দ্বারা নিষ্পত্তি হইলে পর, বুদ্ধির হুকুম বা আদেশ কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া, বুদ্ধির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য আবশ্যক বাহ্যক্রিয়া করাইয়া লওয়া । দোকানের জন্য জিনিস খরিদ করা ও দোকানে বসিয়া বিক্ৰী করা, এই দুই কাজই অনেক সময় যেমন দোকানের একই কর্মচারীকে করিতে হয়, সেইরূপ মনেরও দুই কাজ করিতে হয় । আমাদের কোন স্নেহপাত্র আমাদের নজরে পড়িলে এবং তাহাকে ডাকিবার ইচ্ছা হইলে আমরা তাকে ‘ওরে’ বলিয়া ডাকি । এই ব্যাপারটিতে অন্তঃকরণের মধ্যে কত ব্যাপার হয় দেখ । প্ৰথমে চোখ অথবা জ্ঞানেন্দ্ৰিয় এই সংস্কার মনের মারফত বুদ্ধির নিকট পাঠাইল যে, আমাদের স্নেহপাত্র নিকটে আছে; আবার বুদ্ধির মারফত সেই জ্ঞান আত্মাতে উৎপন্ন হয় । ইহা হইল জ্ঞান হইবার ক্রিয়া । তাহার পর, সেই স্নেহপাত্রকে হাক দিয়া ডাকিতে হইবে, আত্মা বুদ্ধির দ্বারা ইহা স্থির করে; এবং বুদ্ধির এই অভিপ্ৰায় আমলে আনিবার জন্য মনের মধ্যে বলিবার ইচ্ছা হয় এবং মন আমার জিহ্বা (কর্মেন্দ্রিয়ের) দ্বারা ‘ওরে’ শব্দ বলাইয়া থাকে । পাণিনির শিক্ষাগ্রন্থে শব্দোচ্চারণক্রিয়ার বর্ণনা এই ভাবেই করা হইয়াছে ।
আত্মা বুদ্ধ্যা সমেত্যাহাৰ্থান্‌ মনো যুংক্তে বিবক্ষয়া
মনঃ কায়াগ্নিমাহন্তি সঃ প্রেরয়তি মারুতম্‌ ৷
মারুতন্তূরসি চরন্‌ মন্ত্ৰং জনয়তি স্বরম্‌ ॥
অর্থাৎ - “আত্মা প্ৰথমে বুদ্ধি দ্বারা সমস্ত বিষয় আত্মগত করিয়া মনোমধ্যে বলিবার ইচ্ছা উৎপন্ন করে; এবং মন কায়াগ্নিকে চালিত করিবার পর কায়াগ্নি বায়ুকে প্রেরিত করে । তদনন্তর, এই বায়ু বক্ষের মধ্যে প্ৰবেশ করিয়া মন্ত্রস্বর উৎপন্ন করে” । এই স্বর পরে কণ্ঠতালব্যাদিবৰ্ণভেদে মুখ হইতে নিঃসৃত হয় । উপরিউক্ত শ্লোকের শেষ দুই চরণ মৈত্র্যুপনিষদেও প্রদত্ত হইয়াছে [মৈত্রু|৭|১১]; এবং ইহা হইতে উপলব্ধি হয় যে, এই শ্লোক পাণিনি হইতেও প্রাচীন । (মৈত্র্যুপনিষৎ পানিনি হইতে প্রাচীন, এইরূপ মোক্ষমূলর সাহেব লিখিয়াছেন । “Sacred Books of the East series”, Vol. XV, PP.XL. V. II-LI, ইহার বিস্তৃত বিচার আমি পরে পরিশিষ্টপ্রকরণে করিয়াছি, তাহা দেখ ।) আধুনিক শারীরশাস্ত্ৰে কায়াগ্নিরই নাম ‘মজ্জাতন্তু’ । কিন্তু বহিঃপদার্থের জ্ঞান অন্তরে আনিবার জন্য যে মজ্জাতন্তু এবং বুদ্ধির আদেশ কর্মেন্দ্ৰিয়যোগে মনের দ্বারা সম্পাদন করিবার জন্য যে মজ্জাতন্তু, এই দুই মজ্জাতন্তু বিভিন্ন; তাই তদনুসারে মনও দুই বলিয়া মানিতে হইবে, এইরূপ পাশ্চাত্য শারীরশাস্ত্ৰজ্ঞদিগের উক্তি । আমাদের শাস্ত্রকারেরা দুই মন না মানিয়া, বুদ্ধি ও মনকে পৃথক করিয়া এইমাত্র বলিয়াছেন যে, মন উভয়াত্মক অর্থাৎ তাহা কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট কর্মেন্দ্ৰিয়ের অনুরূপ ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নিকট জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অনুরূপ কার্য করিয়া থাকে । উভয়ের তাৎপর্য একই । উভয়েরই দৃষ্টিতে বুদ্ধি নিশ্চয়কারী বিচারপতি এবং মন প্ৰথমে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নিকট সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক হইয়া যায় এবং কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট ব্যাকরণাত্মক বা কার্যসম্পাদক অর্থাৎ কর্মেন্দ্ৰিয়ের সাক্ষাৎ প্ৰবর্তক হইয়া থাকে । কোন বিষয়ের ‘ব্যাকরণ’ অর্থাৎ কার্য সম্পাদনা করিবার সময়, বুদ্ধির হুকুম কি প্রকারে পালন করা যাইবে, সে সম্বন্ধে কখন কখন সঙ্কল্প-বিকল্প করাও মনের আবশ্যক হয় । তাই, মনের ব্যাখ্যা করিবার সময়, সাধারণত ‘সঙ্কল্পবিকল্পত্মিকং মনঃ’, এইরূপ বলিবারই রীতি আছে । কিন্তু মনে রেখো যে, সে সময়েও উহার মধ্যে মনের দুই ব্যাপারেরই সমাবেশ হইয়া থাকে ।


8) ব্যবসায়াত্মিকা ও বাসনাত্মক বুদ্ধির ভেদ ও সম্বন্ধ


‘বুদ্ধি কিনা নির্ণয়কারী ইন্দ্ৰিয়, এই যে অর্থ উপরে বলা হইয়াছে তাহা কেবল শাস্ত্রীয় ও সূক্ষ্ম বিচারের জন্য উপযোগী । কিন্তু এই শাস্ত্রীয় অর্থের নির্ণয় প্রায়ই পরে করা হয় । তাই, এখানে এই শাস্ত্রীয় অর্থ নিশ্চিত হইবার পুৰ্বেই ‘বুদ্ধি’ শব্দের যে ব্যবহারিক অর্থ প্রচলিত হইয়া গিয়াছে তাহাও এখানে বিচার করা আবশ্যক । ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি কোনও বিষয়ের প্রথম নির্ণয় না করিলে, সেই বস্তুর জ্ঞান আমাদের হয় না; এবং জ্ঞান না হইলে সেই বস্তু লাভ করিবার ইচ্ছা কিংবা বাসনাও হয় না । তাই ব্যবহারে, আম গাছ ও ফল উভয়েতেই যেরূপ ‘আম’ এই একই শব্দ প্ৰযুক্ত হয়, সেইরূপ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি ও সেই বুদ্ধির বাসনাদি ফল, উভয়েতেই ব্যবহারে সাধারণ লোকে অনেক সময় এই একই বুদ্ধিশব্দ প্রয়োগ করিয়া থাকে । উদাহরণ যথা – অমুকের বুদ্ধি দুষ্ট এইরূপ যখন আমরা বলি তখন তাহার বাসনা দুষ্ট এইরূপ অৰ্থে বলিয়া থাকি । শাস্ত্রদৃষ্টিতে ইচ্ছা বা বাসনা মনের ধর্ম হওয়ায় তাহার নাম বুদ্ধি নাম দেওয়া সঙ্গত নহে । কিন্তু বুদ্ধি শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ নিষ্কর্ষিত হইবার পূর্ব হইতেই সাধারণ ব্যবহারে লোকেরা এই দুই অর্থে বুদ্ধি শব্দের প্রয়োগ করিয়া আসিয়াছে - (১) নির্ণয়কারী ইন্দ্ৰিয় এবং (২) সেই ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার হইতে পরে মনুষ্যের মনে উৎপন্ন বাসনা বা ইচ্ছা । তাই আমের ভেদ দেখাইতে হইলে যেমন ‘গাছ’ ও ‘ফল’ এই শব্দগুলির প্রয়োগ করা হয়, সেইরূপ বুদ্ধির দুই অর্থের প্রভেদ দেখান যখন আবশ্যক হয় তখন নির্ণয়কারী অর্থাৎ শাস্ত্রীয় বুদ্ধির সহিত ‘ব্যবসায়াত্মিকা’ এই বিশেষণ সংযোজিত করা হয়, এবং বাসনাকে শুধু ‘বুদ্ধি’ বা বড় জোর ‘বাসনাত্মক’ বুদ্ধি বলা হইয়া থাকে । গীতাতে উপরি-উক্ত দুই অর্থেই ‘বুদ্ধি’ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে [গী|২|৪১,৪৪,৪৯; ৩|৪২] । কর্মযোগের বিচার ঠিক বুঝিতে হইলে ‘বুদ্ধি’ শব্দের উপরি-উক্ত দুই অর্থই সৰ্বদা মনে রাখা আবশ্যক । মনুষ্য যে-কোন কর্ম করুক না কেন, তাহার মনোব্যাপারের ফ্ৰেম এইরূপ - সেই কর্ম ভাল কি মন্দ, করণীয় কি করণীয় নহে ইত্যাদি বিষয়ের বিচার সে প্রথমে ‘ব্যবসায়াত্মিকা’ বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই করিয়া থাকে, এবং পরে সেই কর্ম করিবার ইচ্ছা বা বাসনা (অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধি) তাহার মনে উৎপন্ন হইয়া তাহাকে উক্ত কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত করে। কার্যাকার্যের নিষ্পত্তি করা, যাহা (ব্যবসায়াত্মিকা) বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার, উহা স্বস্থ ও শান্ত থাকিলে, নিরর্থক অন্য বাসনা (বুদ্ধি) মনেতে উৎপন্ন হইয়া মনকে বিগড়াইতে পারে না । তাই প্ৰথমে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে শুদ্ধ ও স্থির করা গীতান্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্রের প্রথম সিদ্ধান্ত [গী|২|৪১] । শুধু গীতায় নহে, ক্যান্টও বুদ্ধির এইরূপ দুই ভেদ করিয়া শুদ্ধ অর্থাৎ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির (Pure Reason) ও ব্যবহারিক অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধির (Practical Reason) ব্যাপারাদি দুই স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিচার করিয়াছেন । বস্তুত দেখিলে প্ৰতীতি হয় যে, ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে সুস্থির করা পাতঞ্জলযোগশাস্ত্রের বিষয়, কর্মযোগশাস্ত্রের নহে । কিন্তু কর্মের বিচার করিবার সময় কর্মের পরিণামের দিকে দৃষ্টি না করিয়া কর্মকর্তার বাসনা অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধি কিরূপ তাহাই প্ৰথমে দেখিতে হইবে, ইহাই হইল গীতার সিদ্ধান্ত [গী|২|৪৯] । এবং এই প্রকারে বাসনার বিচার করিলে দেখা যায় যে, যাহার ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি সুস্থির ও শুদ্ধ হয় নাই, তাহার মনে বাসনার বিভিন্ন তরঙ্গ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এবং সেইজন্য বলা যায় না যে, সেই বাসনা সর্বদা শুদ্ধ ও পবিত্র হইবেই [গী|২|৪১] । বাসনা শুদ্ধ না হইলে পরবর্তী কর্ম কি করিয়া শুদ্ধ হইবে ? তাই কর্মযোগশাস্ত্ৰেও ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি শুদ্ধ রাখিবার সাধনা অথবা উপায়সমূহের সবিস্তার বিচার করা আবশ্যক হয়; এবং এই জন্যই ভগবদ্‌গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে, বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিবার এক সাধন, এই দৃষ্টিতে পাতঞ্জল যোগের বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কোন কোন সাম্প্রদায়িক টীকাকার গীতার তাৎপর্য বাহির করিয়াছেন যে পাতঞ্জল যোগই গীতার প্রতিপাদ্য । এক্ষণে গীতাশাস্ত্রে ‘বুদ্ধি’ শব্দের উপরি-প্রদত্ত দুই অর্থ ও সেই দুই অর্থের পরস্পর সম্বন্ধ মনে রাখা আবশ্যক, তাহা পাঠকের উপলব্ধি হইবে ।


9) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি একই, কিন্তু সাত্ত্বিক আদি ভেদে তিন প্রকারের


সে যাক; মানব অন্তঃকরণের ব্যাপার কি প্রকারে চলে, তাহা লক্ষ্য করিয়া মন ও বুদ্ধির কাজ কি, এবং ‘বুদ্ধি’ শব্দের অন্য অর্থ কি, তাহা বলা হইয়াছে । এক্ষণে মন ও ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে এইরূপ পৃথক করিবার পর, সদসদ্‌বিবেকদেবতার কাজটা কি, তাহা দেখা যাক । ভালমন্দ নিৰ্বাচন করাই এই দেবতার কাজ হওয়ায় মনের মধ্যে তাহার সমাবেশ হইতে পারে না । এবং একমাত্র ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিই যে কোন বিষয়ের বিচার করিয়া নির্ণয় করে বলিয়া সদসদ্‌বিবেকরূপ দেবতার জন্য কোন স্বতন্ত্র স্থান থাকে না । ইহা নিঃসন্দেহ যে, যে কথার বা বিষয়ের সারাসার বিচার করিয়া নির্ণয় করিতে হইবে, সেই সমস্ত বিষয় অনেক হইতে পারে । যেমন বাণিজ্য, যুদ্ধ, ফৌজদারী বা দেওয়ানী মোকদ্দমা, মহাজনী, কৃষিকার্য ইত্যাদি অনেক ব্যবসায়ে বিবিধ প্রসঙ্গে সারাসার বিচার করা আবশ্যক হয় । কিন্তু তাহার দরূণ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি বিভিন্ন হয় না । সারাসার বিবেক বলিয়া যে ক্রিয়া, তাহা সর্বত্র একই প্রকার; এবং সেই জন্য বিবেক অথবা নির্ণয়কারী বুদ্ধিও একই হওয়া চাই । কিন্তু মনের ন্যায় বুদ্ধিও শারীরধর্ম হওয়া প্ৰযুক্ত পূর্বকর্মের অনুসারে, বংশানুক্রমিক বা আনুসঙ্গিক সংস্কারবশতঃ বা শিক্ষাদি, অন্য কারণে, এই বুদ্ধি ন্যূনাধিক পরিমাণে সাত্ত্বিক, রাজসিক কিংবা তামসিক হইতে পারে । কারণ, একের বুদ্ধিতে যে বিষয় গ্ৰাহ্য প্রতীত হয়, তাহাই অন্যের বুদ্ধিতে অগ্ৰাহ্য বলিয়া মনে হয় । কিন্তু তাই বলিয়া বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয় প্রত্যেক সময়েই ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে, এরূপ বলা যায় না । উদাহরণ স্বরূপ, মনে কর চোখ । কাহারও চোখ ট্যারা, কাহারও বোজা, আর কাহারও বা কাণা; আবার কাহারও দৃষ্টি ঘোলাটে, আর কাহারও বা স্বচ্ছ হইয়া থাকে । তাই বলিয়া চোখের ইন্দ্ৰিয় এক নহে, বহু-তাহা আমরা বালতে পারি না । বুদ্ধি সম্বন্ধেও এই ন্যায় প্রয়োগ করা বাইতে পারে । যে বুদ্ধির দ্বারা চাউল কিংবা গম জানা যায়; যে বুদ্ধির দ্বারা পাথর ও হীরার প্রভেদ জানা যায়; যে বুদ্ধির দ্বারা কালো, সাদা বা মিষ্ট-কটুর জ্ঞান হয়, সেই বুদ্ধিই কাহাকে ভয় করিবে, কাহাকে ভয় করিবে না, কিংবা সৎ কি আর অসৎ কি, লাভ ও ক্ষতি কাহাকে বলে, ধর্ম ও অধর্ম এবং কার্য ও অকার্যের ভেদ কি, এই সমস্ত বিষয়ের তারতম্য বিচার করিয়া শেষ নির্ণয়ও করিয়া থাকে । সাধারণ ব্যবহারে ‘মনোদেবতা’ বলিয়া উহার যতই গৌরব করা হউক না কেন, তথাপি তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে উহা একই ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি । এই অভিপ্ৰায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে একই বুদ্ধির সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিন ভেদ করিয়া ভগবান অর্জুনকে প্ৰথমে বলিয়াছেন -
প্ৰবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ কার্যাকার্যে ভয়াভয়ে ৷
বন্ধং মোক্ষং চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পাৰ্থ সাত্ত্বিকী ॥
অর্থাৎ “কোন্‌ কর্ম করিবে, কোন্‌ কর্ম করিবে না, কোন্‌ কর্ম করা উচিত, কোন্‌ কর্ম করা অনুচিত, কোন্‌ বিষয়ে ভয় করিযে, কোন্‌ বিষয়ে ভয় করিবে না, বন্ধন কিসে হয় আর মোক্ষ কিসে হয়, যে বুদ্ধি দ্বারা এই সকল বিষয়ের (যথাৰ্থ) জ্ঞান হয়, তাহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি” [গী|১৮|৩০] । এইরূপ বলিবার পর বলিয়াছেন যে -
যয়া ধর্মমধৰ্ম্মং চ কাৰ্য্যং চাকার্যমেব চ ৷
অযথাবৎ প্ৰজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী ॥
অর্থাৎ - “ধর্ম ও অধর্ম, কিংবা কার্য ও অকার্যের যথার্থ নির্ণয় যে বুদ্ধি করিতে পারে না, অর্থাৎ যে বুদ্ধি সর্বদা ভুল করিতে থাকে, সেই বুদ্ধিই রাজসিক” [১৮|৩১] । এবং শেষে বলিয়াছেন -
অধৰ্ম্মং ধর্মমিতি যা মন্যতে তমসাবৃতা ৷
সর্বাৰ্থান্বিপরীতাংশ্চ বুদ্ধিঃ সা পার্থ তামসী ॥
অর্থাৎ -“যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম বলে কিংবা সকল বিষয়ে বিপরীত বা উল্টা নির্ণয় করে সেই বুদ্ধি তামসী” [গী|১৮|৩২] । এই বিচার হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, কেবল ভালমন্দনির্ণয়কারী অর্থাৎ সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধিরূপ স্বতন্ত্র ও পৃথক দেবতা গীতার অভিমত নহে । বুদ্ধি নিয়ত ভালোর নির্ণয়কারী কখনই হইতে পারে না - এইরূপ ইহার অর্থ নহে । উপযুক্ত শ্লোকগুলির ভাবাৰ্থ এই যে, বুদ্ধি একই; এবং ঠিক ঠিক নির্ণয় করিবার সাত্ত্বিক ধর্ম ঐ এক বুদ্ধিতেই পূৰ্বসংস্কার, শিক্ষা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ কিংবা আহারাদির কারণে উৎপন্ন হইয়া থাকে; এবং এই পূর্বসংস্কারাদি কারণের অভাবেই ঐ বুদ্ধি কার্যাকাৰ্যনির্ণয়ের ন্যায় অন্যান্য বিষয়েও রাজসিক কিংবা তামসিক হইতে পারে । চোর ও সাধুদের অথবা বিভিন্নদেশীয় মনুষ্যদিগের বুদ্ধির মধ্যে পার্থক্য কেন হয়, এই সিদ্ধান্তের দ্বারা তাহার যেরূপ উপপত্তি হয়, সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিকে স্বতন্ত্র দেবতা বলিয়া মানিলে সেরূপ হয় না । আপনার বুদ্ধিকে সাত্ত্বিক করা প্ৰত্যেক মানুষ্যের কর্তব্য । ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ব্যতীত এ কাজ হইতে পারে না । যে পৰ্যন্ত ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি, মনুষ্যের প্রকৃত হিত কিসে হয় জানিতে পারে না, এবং তাহার নির্ণয় বা পরীক্ষা না করিয়া কেবল ইন্দ্রিয়দের মর্জি অনুসারে চলে, সে পৰ্যন্ত সেই বুদ্ধিকে ‘শুদ্ধ’ বলা যাইতে পারে না । এইজন্য বুদ্ধিকে মন ও ইন্দ্ৰিয়ের অধীন হইতে না দিয়া, আমাদের এমন ব্যবস্থা করা উচিত, যাহাতে মন ও ইন্দ্রিয় বুদ্ধির অধীনে আসে । ভগবদ্‌গীতাতে অনেক স্থানে এই তত্ত্বই কথিত হইয়াছে [গী|২|৬৭,৬৮; ৩|৭,৪১; ৬|২৪,২৬]; এবং কারণ এই যে, কঠোপনিষদে শরীরের সহিত রথের উপমা দিয়া এই রূপক বাঁধা হইয়াছে যে, ঐ শরীররূপী রথে যোজিত ইন্দ্ৰিয়রূপ অশ্বকে বিষয়োপভোগমার্গে সুনিয়মে চালাইবার জন্য (ব্যবসায়াত্মক) বুদ্ধিরূপ সারথীকে মনোময় লাগাম ধৈর্য সহকারে খুব টানিয়া ধরিতে হইবে [কঠ|৩|৩|৯] । মহাভারতেও দুই তিন স্থানে এই রূপকই কিছু ন্যূনাধিক পরিবর্তনের সহিত গৃহীত হইয়াছে [মভা|বন|২১০,|২৫; স্ত্রী|৭|১৩; অশ্ব|৫১|৫] । ইন্দ্রিয়নিগ্ৰহ বৰ্ণনা করিবার পক্ষে এই দৃষ্টান্ত এরূপ উপযোগী যে, গ্রীসদেশীয় প্ৰসিদ্ধ তত্ত্ববেত্তা প্লেটোও আপন গ্রন্থে [ফীড়ুস|২৪৬] ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের বর্ণনা করিবার সময় এই দৃষ্টান্তই প্রয়োগ করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতাতে এই দৃষ্টান্তের প্রত্যক্ষ উল্লেখ নাই বটে; তথাপি উপরে নির্দেশিত গীতার শ্লোকে, ইন্দ্রিয়নিগ্রহের বর্ণনা যে এই দৃষ্টান্তটি মনে রাখিয়াই করা হইয়াছে, তাহা এই বিষয়ের পূর্বাপর ধারা যাহারা অবগত আছেন, তাহাদের চোখে ইহা না পড়িয়া থাকিতে পারে না । সাধারণতঃ অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সূক্ষ্মভেদ করিবার আবশ্যকতা যখন হয়, তখন উহাকেই মনোনিগ্রহ বলা হইয়া থাকে । কিন্তু উপরি-উক্ত অনুসারে মন ও বুদ্ধির যখন ভেদ করা হয়, তখন নিগ্রহের কর্তৃত্ব মনের হাতে না থাকিয়া ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির হাতে চলিয়া যায় । এই ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিতে হইলে, পাতঞ্জলযোগের সমাধির দ্বারা, ভক্তির দ্বারা, জ্ঞানের দ্বারা কিংবা ধ্যানের দ্বারা পরমেশ্বরের স্বরূপ অবগত হইয়া, সমস্ত মনুষ্যের মধ্যে একই আত্মা আছে এই তত্ত্ব বুদ্ধির মধ্যে বদ্ধমূল হওয়া আবশ্যক । ইহাকেই আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধি বলে । ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি এইরূপ আত্মনিষ্ঠ হইলে এবং মনোনিগ্রহের দ্বারা মন ও ইন্দ্ৰিয় তাহার অধীনে কাজ করিতে শিখিলে ইচ্ছা, বাসনা ইত্যাদি মনোধর্ম (কিংবা বাসনাত্মক বুদ্ধি) স্বতই শুদ্ধ ও পবিত্র হয়, এবং শুদ্ধ সাত্ত্বিক কর্মের দিকে ইন্দ্ৰিয়দিগের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হইয়া থাকে । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে ইহাই সমস্ত সদাচরণের মূল অর্থাৎ কর্মযোগশাস্ত্রের রহস্য ।


10) সদসদ্বিবেক বুদ্ধি ইহাতেই আছে, পৃথক নাই


মন ও বুদ্ধির স্বাভাবিক বৃত্তিসমূহের অতিরিক্ত সদসদ্‌বিবেকাশক্তিরূপ স্বতন্ত্র দেবতার অস্তিত্ব আমাদের শাস্ত্রকারেরা কেন মানেন নাই তাহার কারণ উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । তাঁহাদের মতেও মনকে বা বুদ্ধিকে গৌরবার্থে দেবতা বলিতে কোন বাধা নাই; কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার করিয়া তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, আমরা যাহাকে মন বা বুদ্ধি বলি, তাহা হইতে ভিন্ন ও স্বয়ম্ভূ সদসদ্‌বিবেক নামক কোন তৃতীয় দেবতার অস্তিত্ব থাকিতেই পারে না । ‘সতাং হি সন্দেহপদেষু’ এই বাক্যে ‘সতাং’ পদের উপযোগিতা ও গুরুত্ব এক্ষণে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে । যাঁহাদের মন শুদ্ধ ও আত্মনিষ্ঠ, তাঁহাদের পক্ষে অন্তঃকরণের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করা কিছুই অসঙ্গত নহে; অধিক কি, অথবা ইহাও বলা যাইতে পারে যে, কোন কর্ম করিবার পূর্বে আপনার মনকে শুদ্ধ করিয়া তাহার সাক্ষ্য গ্ৰহণ করা উচিত । কিন্তু উচ্ছ্‌ঙ্খল চরিত্রের লোকের ‘আমরাও এই রকম করেই চলি’ বলিলে কখনই উচিত কথা হইবে না । কারণ, দুইজনের সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি এক হয় না, - সাধু লোকদিগের সাত্ত্বিক এবং চোরদিগের তামসিক হইয়া থাকে । সার কথা - যাহাকে, আধিদৈবতপক্ষের লোক সদসদ্‌বিবেকদেবতা বলেন, তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে তাহার বিচার করিলে উহাকে স্বতন্ত্র দেবতা বলিয়া মনে হয় না; কিন্তু ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির স্বরূপসমূহেরই মধ্যে উহা এক আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ, স্বাত্বিক স্বরূপ, ইহাই আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সিদ্ধান্ত । এবং এই সিদ্ধান্ত স্থির হইলে, আধিদৈবতপক্ষ স্বতই খোঁড়া হইয়া পড়ে ।


11) আধ্যাত্মিক মাৰ্গ - কর্মযোগের সহিত সম্বন্ধ


আধিভৌতিক পক্ষ একদেশদর্শী ও অপূর্ণ এবং আধিদৈবতপক্ষের সহজ যুক্তিও অকর্মণ্য সিদ্ধ হইয়া গেলে, কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি নির্ধারণের অন্য কোন মাৰ্গ আছে কি না, দেখা আবশ্যক । অন্য এক মার্গ আছে – তাহাকে আধ্যাত্মিক মাৰ্গ বলে । কারণ, বাহ্যকর্মাপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ হইলেও যখন সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভূ দেবতার অস্তিত্ব সিদ্ধ হইতে পারে না, তখন শুদ্ধ কর্ম সম্পাদনের বুদ্ধিকে কিরূপে শুদ্ধ রাখিতে হইবে, শুদ্ধ বুদ্ধি কাহাকে বলে, কিংবা বুদ্ধিকে শুদ্ধ কেমন করিয়া করা যায়, কর্মযোগশাস্ত্ৰেও এই সকল প্রশ্নের বিচার আবশ্যক হইয়া পড়ে । এবং এই বিচার শুধু বাহ্যজগতের বিচারকারী আধিভৌতিক শাস্ত্ৰকে ছাড়িয়া দিয়া অধ্যাত্মজ্ঞানে প্রবেশ না করিলে সম্পূর্ণ হইতে পারে না । আত্মা কিংবা পরমেশ্বরের সর্বব্যাপী প্ৰকৃত স্বরূপের জ্ঞান যে বুদ্ধির হয় নাই সে বুদ্ধি শুদ্ধ নহে, এই বিষয়ে আমাদের শাস্ত্রকারদিগের ইহাই চরম সিদ্ধান্ত । এই প্রকারের বুদ্ধিকে আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধি কেন বলা হয় তাহাই বলিবার জন্য গীতাতে অধ্যাত্মশাস্ত্রের নিরূপণ করা হইয়াছে । কিন্তু এই পূর্বাপর সম্বন্ধের প্রতি ঠিক লক্ষ্য না করিয়া গীতাসম্বন্ধীয় সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের মধ্যে কেহ কেহ স্থির করিয়াছেন যে, বেদান্তই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । গীতার প্রতিপাদ্যবিষয়সম্বন্ধে উক্ত টীকাকারদিগের কৃত এই নির্ণয় যে ঠিক নহে, তাহা পরে সবিস্তার দেখান। যাইবে । এখানে শুধু ইহাই দেখাইব যে, বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিবার জন্য আত্মারও বিচার করা নিশ্চয় আবশ্যক হয় । এই আত্মার বিষয়ে এই বিচার দুই দিক্‌ দিয়া করা হয় - (১) আপন পিণ্ডের, ক্ষেত্রের, বা শরীরের এবং মনের ব্যাপারসমূহ নিরীক্ষণ করিয়া উহা হইতে ক্ষেত্ৰজ্ঞরূপী আত্মা কিরূপে নিষ্পন্ন হয় তাহার বিচার করা – [গী|অ|১৩] । ইহারই সংজ্ঞা - শারীরক কিংবা ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার; এবং এই কারণেই বেদান্তসূত্রকে “শারীরক (শরীরের বিচারকারী) সূত্র” বলে । নিজের শরীর ও মনের এইরূপ বিচার হইলে পর (২) দেখা আবশ্যক যে, তাহা হইতে নিষ্পন্ন তত্ত্ব, এবং আমাদের চতু্র্দিকে যে দৃশ্য জগৎ বা ব্ৰহ্মাণ্ড আছে তাহার পৰ্যবেক্ষণের দ্বারা নিষ্পন্ন তত্ত্ব, এই দুই একই কিংবা বিভিন্ন । এই রীতি অনুসারে সম্পাদিত জগতের বিচার-আলোচনাকে “ক্ষরাক্ষরবিচার” কিংবা “ব্যক্তাব্যক্তবিচার” বলে । সৃষ্টির অন্তর্ভূত সমস্ত নশ্বর প্রদাৰ্থ ক্ষর কিংবা ব্যক্ত এবং সৃষ্টির অন্তর্গত নশ্বর পদার্থের মধ্যে যাহা সারভূত নিত্য তত্ত্ব তাহাই অক্ষর কিংবা অব্যক্ত [গী|৮|২১; ১৫|১৬] । ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিচারের দ্বারা এবং ক্ষরাক্ষরবিচারের দ্বারা নিষ্পন্ন এই দুই তত্ত্বের পুনৰ্বার বিচার করিলে দেখা যায় যে, এই দুই তত্ত্ব, যাহা হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে এবং এই দুয়ের অতীত (পর) সমস্তের মুলীভূত যে এক তত্ত্ব আছে তাহাকেই ‘পরমাত্মা’ বা ‘পুরুষোত্তম’ বলা হয় [গী|৮-২০] । ভগবদ্‌গীতাতে এই সকল বিষয়ের বিচার করা হইয়াছে; এবং পরিশেষে কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি বুঝাইবার জন্য দেখানো হইয়াছে যে, সকলের মুলীভূত পরমাত্মারূপ তত্ত্বের জ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধি কিরূপে শুদ্ধ হয় । তাই এই উপপত্তি আমাদের বুঝিতে হইলে আমাদেরও সেই মাৰ্গ দিয়া যাইতে হইবে । তন্মধ্যে ব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞান কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার পরবর্তী প্রকরণে বিবৃত হইবে । সদসদ্‌বিবেকদেবতার প্রকৃত স্বরূপনির্ণয় করিবার জন্য এই প্রকরণে যাহা শুরু করা হইয়াছে সেই পিণ্ডজ্ঞান কিংবা ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার অপুর্ণ থাকায় তাহা এক্ষণে পূরণ করিয়া লওয়া যাইবে ।


11.1) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্র শব্দের অর্থ


পাঞ্চভৌতিক স্থূলদেহ, পঞ্চ কর্মেন্দ্ৰিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, শব্দ-স্পর্শ রূপ-রসগন্ধাত্মক জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের পাঁচ বিষয়, সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মন এবং ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি, - এই সকল বিষয়ে বিচার আলোচনা হইয়া গিয়াছে । কিন্তু ইহাতেই শরীরসম্বন্ধীয় বিচার পুর্ণ হয় না । মন ও বুদ্ধি, ইহারা কেবল বিচার করিবার সাধন বা ইন্দ্ৰিয় । জড় শরীরের মধ্যে ইহার অতিরিক্ত প্ৰাণরূপী চেতনা অর্থাৎ চেষ্টাচাঞ্চল্য যদি না থাকিত তাহা হইলে মন ও বুদ্ধি থাকা ও না থাকা সমান অর্থাৎ অনাবশ্যক বুঝা যাইত । সুতরাং শরীরের মধ্যে উপরি-উক্ত বিষয়গুলির অতিরিক্ত চেতনা বলিয়া আর এক তত্ত্বেরও সমাবেশ করা চাই । কখন কখন চেতনাশব্দের অর্থ “চৈতন্য”ও করা হয় । কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে চেতনা শব্দ “চৈতন্য” অর্থে প্ৰযুক্ত হয় নাই । ইহা যেন মনে রাখা হয়; জড়দেহের মধ্যে যে প্ৰাণ-চেষ্টা বা জীবনব্যাপার দেখা যায় সেই অর্থই এখানে অভিপ্ৰেত । যে চিৎশক্তির দ্বারা জড়েরও মধ্যে চেষ্টা বা ব্যাপার উৎপন্ন হয় তাহাই চৈতন্য; এই শক্তিটি কি, এক্ষণে তাহারই বিচার করিব । শরীরের মধ্যে পরিদৃশ্যমান জীবনব্যাপার কিংবা চেতনার অতিরিক্ত বস্তু যাহাতে করিয়া আত্মপরভেদ উৎপন্ন হয় তাহাও এক পৃথক্‌ গুণ । কারণ, উপরি-কথিত বিচার অনুসারে বুদ্ধি সারাসারের বিচার পূর্বক নির্ণয়কারী এক ইন্দ্ৰিয় হওয়ায়, আত্মপর-ভেদের মূলস্বরূপ অহঙ্কারকে ঐ বুদ্ধি হইতে পৃথক্‌ স্বীকার করিতে হয় । ইচ্ছাদ্বেষ, সুখদুঃখ প্ৰভৃতি দ্বন্দ্বগুলি মনেরই গুণ; কিন্তু নৈয়ায়িক এই গুণ আত্মার বলিয়া মনে করায়, এই ভ্ৰম দূর করিবার জন্য বেদান্তশাস্ত্ৰ মনের মধ্যেই ইহার সমাবেশ করিয়া থাকে । রূপ পঞ্চমহাভূত যে মূল তত্ত্ব হইতে নিৰ্গত হইয়াছে সেই প্ৰকৃতিরূপ তত্ত্বেরও সমাবেশ শরীরেই করা হইয়া থাকে [গী|১৩|৫,৬] । এই সমস্ত তত্ত্ব যে শক্তির দ্বারা স্থির থাকে সেই শক্তিও আবার এই সকল হইতে পৃথক । তাহাকে ‘ধৃতি’ বলে [গী|১৮|৩৩] । এই সমস্ত বিষয় একত্ৰ করিলে যে সমুচ্চয়রূপ পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় তাহা শাস্ত্ৰে সবিকার শরীর কিংবা ক্ষেত্র নামে অভিহিত হইয়াছে; এবং ইহাকে ব্যবহারে আমরা চলছে-ফিরছে’; (সবিকার) এইরূপ মনুষ্যশরীর বা পিণ্ড বলিয়া থাকি । ক্ষেত্র শব্দের এই ব্যাখ্যা আমি গীতা অবলম্বনেই করিয়াছি; কিন্তু ইচ্ছাদ্বেষাদিগুণ গণনা করিবার সময় কখনও এই ব্যাখ্যার অল্পস্বল্প ইতরবিশেষও করা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা – শান্তিপর্বের জনক-সুলভা-সংবাদে [শাং|৩২০] শরীরের ব্যাখা করিবার সময় পঞ্চকর্মেন্দ্ৰিয়ের পরিবর্তে কাল, সদসদ্‌ভাব, বিধি, শুক্র ও বলের সমাবেশ করা হইয়াছে । এই গণনা অনুসারে পঞ্চমহাভূতেই পঞ্চকর্মেন্দ্ৰিয়ের সমাবেশ করা আবশ্যক হয়; এবং স্বীকার করিতে হয় যে, গীতার গণনানুসারে কালের অন্তর্ভাব আকাশে এবং বিধিশুক্রবলাদির অন্তর্ভাব অন্য মহাভূতসমূহে করা হইয়াছে । যাহাই হউক, ইহা নিঃসন্দেহ যে, ক্ষেত্রশব্দের এক অর্থই সকলের অভিপ্ৰেত; অর্থাৎ মানসিক ও শারীরিক সমস্ত দ্রব্য ও গুণের প্রাণরূপী বিশিষ্ট-চেতনাযুক্ত যে ‘সমুদায়', তাহারই নাম ক্ষেত্র । শরীর শব্দ মৃত দেহ সম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হয় বলিয়া এই বিষয়ের বিচারকালে শরীর শব্দ হইতে ভিন্ন ক্ষেত্ৰশব্দই অধিক ব্যবহৃত হয় । ‘ক্ষেত্র’ শব্দের মূল অর্থ ক্ষেত; কিন্তু উপস্থিত প্রকরণে, ‘সবিকার ও সজীব মনুষ্যদেহ’ এই অর্থে তাহার লাক্ষণিক উপযোগ করা হইয়াছে । এই সবিকার ও সজীব মনুষ্যদেহই আমার উপরি-উক্ত ‘বড় কারখানা’ । বাহিরের মাল এই কারখানায় আনিবার এবং কারখানা হইতে ভিতরের মাল বাহিরে পাঠাইবার জন্য জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সমূহ ঐ কারখানার যথাক্রম দ্বার; এবং মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার ও চেতনা ঐ কারখানার কর্মচারী । এই কর্মচারী যে কিছু ব্যবহার করে বা করায়, তাহাকে এই ক্ষেত্রের ব্যাপার, বিকার বা ধর্ম বলা যায় ।


11.2) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্রজ্ঞ শব্দের অর্থ


এই প্রকারে ক্ষেত্র শব্দের অর্থ নির্ধারিত হইলে পর এই প্রশ্ন সহজে উঠে যে, এই ক্ষেত্র কিংবা ক্ষেত কাহার, এই কারখানার কোন মালিক আছে কি না ? আত্মা শব্দ মন, অন্তঃকরণ কিংবা আমি স্বয়ং - এইরূপ নানা অর্থে ব্যবহৃত হইলেও তাহার মুখ্য অর্থ ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা শরীরের মালিক বা স্বামী । মনুষ্য যে যে ক্রিয়া করে, - তাহা মানসিক হোক বা শারীরিক হোক্‌ - সে সমস্ত তাহার বুদ্ধি-আদি অন্তরিন্দ্ৰিয়, চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, কিংবা হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয় করিয়া থাকে । এই সমস্ত ইন্দ্ৰিয়সমূহের মধ্যে মন ও বুদ্ধি সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ । কিন্তু উহারা শ্রেষ্ঠ হইলেও অন্য ইন্দ্ৰিয়সমূহের ন্যায় উহারাও মূলে জড়দেহের কিংবা প্ৰকৃতিরই বিকার (পূর্ব প্রকরণ দেখ) । তাই, মন ও বুদ্ধি সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ হইলেও উহারা আপন-আপন বিশিষ্ট ব্যাপারের বাহিরে অন্য কিছুই করিতে পারে না; এবং পারাও সম্ভব নহে । মন চিন্তা করে এবং বুদ্ধি নিশ্চয় করে, ইহা সত্য; কিন্তু ইহা হইতে এ কথা স্থির হয় না যে, এই কাজ মন ও বুদ্ধি কি জন্য করে, অথবা বিভিন্ন সময়ে মন ও বুদ্ধির যে পৃথক্‌ পৃথক্‌ ব্যাপার ঘটিয়া থাকে, তাহাদের একত্বের দ্বারা জ্ঞান উৎপন্ন হইবার জন্য যে একীকরণ আবশ্যক হয় সেই একীকরণ কে করে, কিংবা তদনুসারে পরে সমস্ত ইন্দ্ৰিয় স্ব স্ব ব্যাপারকে তদনুকুল করিবার সন্ধান কি করিয়া পায় । মনুষ্যের জড়দেহই এই সমস্ত কাজ করে এ কথা বলা যাইতে পারে না । কারণ, শরীরের চেতনা অর্থাৎ নড়াচড়াব্যাপার নষ্ট হইলে যে জড়দেহ অবশিষ্ট থাকে, সে এ কাজ করিতে পারে না । জড়দেহের মাংস স্নায়ু ইত্যাদি উপাদানসমূহ অন্নেরই পরিণাম, এবং নিত্য ক্ষয়গ্ৰস্ত ও নিত্য নূতন নির্মিত হয়; সেইজন্য, কাল যে ‘আমি’ অমুক বিষয় দেখিয়াছিলাম, সেই আমি আজি অন্য বিষয় দেখিতেছি, এইরূপ যে একত্ববুদ্ধি তাহা নিত্যপরিবর্তনশীল জড়দেহের ধর্ম, এইরূপ মানিতে পারা যায় না । ভাল এখন জড়দেহ ছাড়িয়া চেতনাকেই যদি মালিক বলা যায় তাহা হইলে এই আপত্তি উঠে যে, গাঢ় নিদ্রাতে প্ৰাণাদি বায়ুর শ্বাসোচ্ছ্বাসাদি অথবা রক্তচলাচল-আদি ব্যাপার অর্থাৎ চেতনা বজায় থাকিলেও ‘আমি’-জ্ঞান থাকে না [বৃ|২|১|১৫,১৮] । তাই, চেতনা কিংবা প্ৰাণাদির ব্যাপারও কেবল জড়েরই একপ্রকার বিশিষ্ট গুণ; তাহা সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারের একীকরণ করিবার মূল প্ৰভুশক্তি নহে, এইরূপ সিদ্ধ হইতেছে [কঠ|৫|৫] । ‘আমার’ ও ‘তোমার’ এই সম্বন্ধবোধক শব্দের দ্বারা কেবল অহঙ্কাররূপী গুণের ৰোধ হইয়া থাকে; কিন্তু ‘অহং’ অর্থাৎ ‘আমি’ কে, এ বিষয়ের নির্ণয় হয় না । এই ‘আমি’কে যদি নিছক ভ্রম বল, তাহা হইলে বলিতে হয় যে, প্ৰত্যেকের প্রতীতি কিংবা অনুভূতি সেরূপ নহে; এবং এই অনুভূতিকে ছাড়িয়া অন্য কোন বিষয়ের কল্পনা করা কেমন ? না, যেমন শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামী বলিয়াছেন -
“প্রতীতীবীণ জেঁ বোলণে ৷ তেঁ অবঘেচি কণ্টারবাপে ৷
তোঁড় পসরুণ চৈসেঁ সুণেঁ ৷ রডোন গেলে ॥”
অর্থাৎ - মুখব্যাদান করিয়া কুকুরের কান্না যেমন বিরক্তিকর, প্ৰতীতি বিনা যাহা কিছু বলা হয় সে সমস্তই তেমনি বিরক্তিকর [দা|৯|৫|১৫] । এত করিয়াও তবু ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারের একীকরণের উপপত্তি কিছুই পাওয়া যায় না । কেহ কেহ এরূপ বলেন যে, ‘আমি’ বলিয়া কোন পৃথক পদার্থ নাই; কিন্তু ‘ক্ষেত্র’ শব্দে মন, বুদ্ধি, চেতনা, জড়দেহ প্ৰভৃতি যে সকল তত্ত্বের সমাবেশ করা হইয়া থাকে, সেই সমস্তের সংঘাতকে বা সমুচ্চয়কে ‘আমি’ বলা যায় । কিন্তু কাঠের উপর কাঠ চাপাইলেই বাক্স হয় না, কিংবা ঘড়ির সমস্ত চাকা একত্র যুক্ত করিলেই তাহাতে গতিও উৎপন্ন হয় না, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । তাই, নিছক্‌ সংঘাতের দ্বারা বা সমুচ্চয়ের দ্বারাই কর্তৃত্ব আইসে এরূপ বলা চলে না । বলা বাহুল্য যে, ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপার নিরর্থক পাগলামি নহে; কিন্তু তাহাতে কোন বিশিষ্ট অভিপ্ৰায়, উদ্দেশ্য বা হেতু থাকে । এই ক্ষেত্ররূপ কারখানার মন, বুদ্ধি আদি সমস্ত কর্মচারীকে এই বিশিষ্ট অভিপ্ৰায় বা উদ্দেশ্য কে বলিয়া দেয় ? - সংঘাত অর্থে শুধু সমূহ । কতকগুলি পদার্থ একত্ৰ করিলেও তাহার একপ্রাণত্ব বিধান করিতে হইলে, তাহার মধ্য দিয়া একটা যোগসূত্র স্থাপন করা আবশ্যক; নচেৎ উহা পুনৰ্বার কখন-না-কখন পৃথক পৃথক হইয়া যাইতে পারে । এই যোগসূত্রটি কি, এক্ষণে তাহাই আমাদের দেখিতে হইবে । সংঘাত গীতার স্বীকৃত নহে এরূপ নহে; তবে, তাহার গণনা ক্ষেত্রেই করা হইয়া থাকে [গী|১৩|৬] । ক্ষেত্রের মালিক কিংবা ক্ষেত্ৰজ্ঞ কে, সংঘাতের দ্বারা তাহার সিদ্ধান্ত হয় না । সমুচ্চয়ের মধ্যে কোন নূতন গুণ উৎপন্ন হয়, এইরূপ কেহ কেহ মনে করেন । কিন্তু প্ৰথমত এই মতই তো সত্য নহে, কারণ পুর্বে যাহার অস্তিত্ব কোন আকারে ছিল না, তাহা এ জগতে নূতন উৎপন্ন হয় না, ইহা তত্ত্বজ্ঞানীরা পূৰ্ণবিচারান্তে সিদ্ধ করিয়াছেন [গী|২|১৬] । কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ক্ষণতরে একটু পাশে সরাইয়া রাখিলেও এই প্রশ্ন সহজেই উপস্থিত হয় যে, সংঘাতে উৎপন্ন নূতন গুণকেই ক্ষেত্রের মালিক বলিয়া কেন স্বীকার করা যাইবে না ? এই সম্বন্ধে কতকগুলি আধুনিক আধিভৌতিকশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেন যে, দ্রব্য ও তাহার গুণ ভিন্ন ভিন্ন থাকিতে পারে না, গুণের কোন-না- কোন অধিষ্ঠান থাকা চাই । এইজন্য সমুচ্চায়োৎপন্ন গুণের বদলে ইহাঁরা সমুচ্চয়কেই এই ক্ষেত্রের মালিক বলেন । ঠিক কথা; কিন্তু আবার ব্যবহারেও ‘অগ্নি’ শব্দের বদলে জ্বালানি কাঠ, ‘বিদ্যুৎ’ শব্দের বদলে মেঘ, কিংবা পৃথিবীর ‘আকর্ষণের’ বদলে পৃথিবী, কেন বলা যায় না ? ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপার এক ব্যবস্থা ও এক পদ্ধতি অনুসারে চালাইবার জন্য, মন ও বুদ্ধি ব্যতীত কোন ভিন্ন শক্তি থাকা চাই, এই কথা যদি নির্বিবাদ হয়; এবং যদি ইহা সত্য হয় যে, ঐ শক্তির অধিষ্ঠান অদ্যাপি আমাদের অগম্য, কিংবা সেই শক্তি বা অধিষ্ঠানের পুর্ণস্বরূপ ঠিক বলিতে পারা যায় না; তবে সেই শক্তিই নাই এ কথা বলা কিরূপে ন্যায়সঙ্গত হয় ? যেমন কোনও মানুষ নিজের কাঁধের উপর বসিতে পারে না, সেইরূপই সংঘাতের জ্ঞান সংঘাত আপনিই সম্পাদন করিয়া লয় এরূপ বলা যাইতে পারে না । অতএব, দেহ ইন্দ্রিয়াদি সংঘাতের ব্যাপার যাহার উপভোগের জন্য কিংবা লাভের জন্য হইয়া থাকে, সে সংঘাত হইতে ভিন্ন, তর্কদৃষ্টিতেও এই দৃঢ় অনুমান হয় । সংঘাত হইতে ভিন্ন এই তত্ত্ব স্বয়ং সমস্ত তত্ত্বের জ্ঞাতা বলিয়া, জগতের অন্য পদার্থসমূহের ন্যায় ইহা নিজেই নিজের ‘জ্ঞেয়’ অর্থাৎ গোচর হইতে পারে না এ কথা সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া তাহার অস্তিত্বসম্বন্ধে কোন বাধা হয় না, কারণ সমস্ত পদার্থকে এই একই ‘জ্ঞেয়’ কোঠারই শামিল করিতে হইবে এরূপ কোন কথা নাই । 

সকল পদার্থের বর্গ বা বিভাগ হয়; যেমন জ্ঞাতা, ও জ্ঞেয় - এই দুই বৰ্গ - অর্থাৎ যে জানে, আর জানিবার বিষয় । এবং যখন কোন বস্তু দ্বিতীয় বর্গের (জ্ঞেয়) শামিল না হয়, তখন প্ৰথম বর্গের মধ্যে তাহার সমাবেশ হয়, এবং তাহার সত্তাও জ্ঞেয়বস্তুর সমানই পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় । অধিক কি, ইহাও বলা যায় যে, সংঘাতের অতীত আত্মা স্বয়ং জ্ঞাত হওয়ায়, সে তাহার জ্ঞানের বিষয় না হইলে আশ্চর্য্যের বিষয় নহে । এই অভিপ্ৰায় অনুসারেই বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন [বৃ|২|৪|১৪] “ওরে ! যে সমস্ত বিষয় জানে তাহার জ্ঞাতা অন্য কোথা হইতে আসিবে” ? - বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজনীয়াৎ । তাই শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয় যে, এই চেতনাবিশিষ্ট সজীব শরীরে (ক্ষেত্রে) এমন এক শক্তি আছে, যাহা হস্তপদাদি ইন্দ্ৰিয়াদি হইতে উচ্চে উঠিতে উঠিতে প্ৰাণ, চেতনা, মন ও বুদ্ধি এই পরতন্ত্র ও একদেশদশী কর্মচারীদিগেরও বাহিরে থাকিয়া তাহাদের সমস্ত ব্যাপারের একীকরণ করে এবং তাহারা কিরূপ ভাবে কাজ করিবে তাহার নির্দেশ করিয়া দেয়; কিংবা যাহা তাহাদের কর্মের নিত্য সাক্ষীস্বরূপ থাকিলেও তাহাদের হইতে ভিন্ন, অধিক ব্যাপক ও সমর্থ । সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুই শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত মান্য; এবং অৰ্বাচীনকালে জর্মন তত্ত্বজ্ঞ ক্যান্টও বলিয়াছেন যে, বুদ্ধিব্যাপারের সূক্ষ্ম পরীক্ষা করিলে এই তত্ত্বই নিষ্পন্ন হয় । মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চেতনা এই সমস্ত, দেহের অর্থাৎ ক্ষেত্রেরই গুণ বা অবয়ব । ইহাদের প্ৰবর্তক ইহাদের হইতে ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও ইহাদের অতীত - “যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ” [গী|৩|৪২] । সাংখ্য-শাস্ত্ৰে ইহারই নাম পুরুষ । বেদান্তে ইহাকেই ক্ষেত্ৰজ্ঞ অর্থাৎ ক্ষেত্রের জ্ঞাত আত্মা বলে; এবং “আমি আছি” এই যে প্ৰত্যেক মনুষ্যের সাক্ষাৎপ্ৰতীতি, ইহাই আত্মার অস্তিত্বের সর্বোৎকৃষ্ট প্ৰমাণ [বেসু|শাং|ভা|৩|৩|৫৩,৫৪] । “আমি নাই” এরূপ কেহ মনে করে না । শুধু তাহা নহে; মুখে “আমি নাই” এইরূপ উচ্চারণ করিবার সময়েও ‘নাই’ এই ক্রিয়াপদের কর্তার অর্থাৎ ‘আমি’র কিংবা আত্মার বা ‘আপনার’ অস্তিত্ব সে প্ৰত্যক্ষ রীতিতে স্বীকার করিয়াই থাকে । এই প্রকারে ‘আমি’ এই অহঙ্কারযুক্ত সগুণরূপে, দেহের মধ্যে স্বয়ংপ্ৰকাশ আত্মতত্ত্বের অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞের মূলগত শুদ্ধ ও গুণবিরহিত স্বরূপটি কি, তাহারই যথাশক্তি নির্ণয়াৰ্থ বেদান্তশাস্ত্রের উৎপত্তি হইয়াছে [গী|১৩|৪] । 


11.3) ক্ষর-অক্ষর বিচারের প্রস্তাবনা - “যাহা পিণ্ডে, তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”


তথাপি এই নির্ণয় কেবল দেহের অর্থাৎ ক্ষেত্রের বিচার করিয়াই স্থিরীকৃত হয় নাই । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞের বিচার ব্যতীত বাহ্য জগতের অর্থাৎ ব্ৰহ্মাণ্ডেরও বিচার করিয়া কি নিষ্পন্ন হয় তাহা দেখা আবশ্যক, ইহা পুর্বে বলা হইয়াছে । এই ব্ৰহ্মাণ্ড-বিচারের নামই “ক্ষরাক্ষর বিচার” । ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞ-বিচারের দ্বারা নির্ণয় হয় যে, ক্ষেত্রে (অর্থাৎ দেহের মধ্যে বা পিণ্ডের মধ্যে) মূলতত্ত্ব (ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা আত্মা) কোনটী; এবং ক্ষরাক্ষর-বিচারের দ্বারা বাহ্য জগতের - অর্থাৎ ব্ৰহ্মাণ্ডের মূলতত্ত্বের জ্ঞান হয় । যখন এই  প্রকারে পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ডের মূলতত্ত্ব প্রথমে পৃথক পৃথক নির্ধারিত হয়, তখন বেদান্তশাস্ত্রে চরম সিদ্ধান্ত করা হয় যে, এই দুই তত্ত্ব একরূপ অৰ্থাৎ একই - কিংবা “যাহা পিণ্ডে আছে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে আছে” । ইহাই চরাচর সৃষ্টির চরম সত্য । 
(ক্ষরাক্ষর বিচার ও ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার - আমাদের শাস্ত্রের এই বর্গীকরণ, গ্ৰীণ সাহেবের জানা ছিল না । অথাপি আপন “Prolegomena to Ethics” গ্রন্থের আরম্ভে তিনি অধ্যাত্মের যে বিচার করিয়াছেন তাহাতে প্রথমে “Spiritual Principle in Nature” এবং “Spiritual Principle in Man” এই দুই পৃথক ভাগ করিয়া পরে তাহাদের ঐক্য দেখাইয়াছেন । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞ-বিচারে Pshychology প্রভৃতি মানসশাস্ত্রের এবং ক্ষরাক্ষর বিচারে Physics, Metaphysics প্রভৃতি শাস্ত্রের সমাবেশ হইয়া থাকে । এই সমস্তের বিচার করিয়া পরে আত্মস্বরূপের বিচার করিতে হয়, ইহা পাশ্চাত্য বিদ্বানদিগেরও মান্য ।)


12) পাশ্চাত্যের ও বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য


পাশ্চাত্য দেশেও এই বিষয়ের বিচারালোচনা হইয়াছে, এবং ক্যাণ্ট প্রভৃতি কোন কোন তত্ত্বজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত আমাদের বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত অনেকাংশে যুড়ি মিলিয়া চলিয়াছে । ইহার প্রতি লক্ষ্য করিলে, এবং এখনকার মত পূর্বে আধিভৌতিক শাস্ত্রের উন্নতি না হইলেও যাঁহারা অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা অতি প্ৰাচীনকালে বেদান্তের সিদ্ধান্ত বাহির করিয়াছেন, তাঁহাদের অলৌকিক বুদ্ধিবৈভক দেখিয়া আশ্চর্য না হইয়া থাকা যায় না । শুধু আশ্চর্য হইলে চলিবে না, সেই সম্বন্ধে আমাদের উচিত গর্ব অনুভব করাও আবশ্যক ।

কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার বিচার (Kapila-Samkhya Philosophy - Mutable & Immutable)

প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি ৷ [গীতা |১৩|১৯]

(“প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়কে অনাদি বলিয়া জান ।”)

1) ক্ষর ও অক্ষরের বিচারমূলক শাস্ত্র



শরীর এবং শরীরের অধিস্বামী বা অধিষ্ঠাতা-ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ-ইহাদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্য জগৎ এবং তাহার মূলতত্ত্ব - ক্ষর ও অক্ষর - ইহাদেরও বিচার করিবার পশ্চাৎ আবার আত্মার স্বরূপ নির্ণয় করা আবশ্যক, ইহা পূর্ব প্ৰকরণে বলা হইয়াছে । যোগ্য রীতিতে এই ক্ষরাক্ষর জগতের বিচার করিবার তিন শাস্ত্র আছে । প্রথম ন্যায়শাস্ত্র এবং দ্বিতীয় কাপিল সাংখ্যশাস্ত্র; কিন্তু এই দুই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অপূর্ণ স্থির করিয়া বেদান্তশাস্ত্ৰ ব্ৰহ্মস্বরূপের নির্ণয় তৃতীয় রীতিতে করিয়াছেন । তাই বেদান্তের উপপত্তি দেখিবার পূর্বে, ন্যায় ও সাংখ্যের সিদ্ধান্ত কি, তাহা আমাদের দেখা আবশ্যক । বাদরায়ণাচার্যের বেদান্তসূত্রে এই পদ্ধতিই স্বীকৃত হইয়াছে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে ন্যায় ও সাংখ্যের মতকে খণ্ডন করা হইয়াছে । এই বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ এখানে করিতে না পারিলেও ভগবদ্‌গীতার রহস্য বুঝাইবার জন্য যতটা আবশ্যক ততটুকু এ বিষয়ের উল্লেখ এই প্রকরণে ও পরবর্তী প্রকরণে আমি স্পষ্টরূপে করিয়াছি । নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত অপেক্ষা সাংখ্য সিদ্ধান্তের অধিক গুরুত্ব আছে । কারণ, কোন শিষ্ট ও প্রমুখ বেদান্তী কাণাদ-ন্যায়মত স্বীকার না করিলেও কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের অনেক সিদ্ধান্ত মনু-আদি স্মৃতি-গ্রন্থে এবং গীতাতেও সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । এই কথা বাদরায়ণাচার্যও বলিয়াছেন [বে|সূ|২|১|১২ ও ২|২|১৭] । তাই প্রথমেই পাঠকের সাংখ্যসিদ্ধান্ত জানা আবশ্যক । তথাপি সাংখ্যশাস্ত্রের অনেক সিদ্ধান্ত বেদান্তে নিঃসন্দেহ পাওয়া গেলেও সাংখ্য ও বেদান্তের শেষ সিদ্ধান্ত পরস্পর অত্যন্ত ভিন্ন, ইহা পাঠক যেন বিস্মৃত না হন । এখানে এক প্রশ্ন উপস্থিত হয় এই যে, বেদান্ত ও সাংখ্যের যে সিদ্ধান্ত সাধারণ, তাহা প্ৰথমে কে আবিষ্কার করে – বেদান্ত না সাংখ্য ? কিন্তু এই গ্রন্থে, এত গভীর বিচারে প্রবেশ করা আবশ্যক নহে । এই প্রশ্নের উত্তর তিনপ্রকারে দেওয়া যাইতে পারে । প্রথম এই যে, উপনিষৎ (বেদান্ত) ও সাংখ্য, ইহাদের বৃদ্ধি দুই বৈমাত্ৰ ভাইয়ের মতো এক সঙ্গেই হওয়ায়, উপনিষদের যে সিদ্ধান্ত সাংখ্য মতের অনুরূপ দৃষ্ট হয়, তাহা উপনিষৎকারেরা স্বতন্ত্র রীতিতে অন্বেষণ করিয়া বাহির করিয়াছেন । দ্বিতীয় এই যে, বেদান্তী কখনও কোন সিদ্ধান্ত সাংখ্যশাস্ত্ৰ হইতে লইয়া সেগুলিকে বেদান্তের অনুকুল স্বরূপ প্ৰদান করিয়াছেন । তৃতীয় এই যে, কপিলাচাৰ্য আপন মত অনুসারে প্রাচীন বেদান্তের সিদ্ধান্তেই কতক পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করিয়া সাংখ্যশাস্ত্র রচনা করিয়াছেন । এই তিনটী মতের মধ্যে তৃতীয় মতই অধিক বিশ্বাস্য বলিয়া মনে হয়; কারণ বেদান্ত ও সাংখ্য উভয়ই খুব প্রাচীন হইলেও তাহাদের মধ্যে বেদান্ত বা উপনিষৎ সাংখ্য অপেক্ষাও অধিক প্ৰাচীন (শ্রৌত) । সে যাহাই হোক্‌, প্ৰথমে ন্যায় ও সাংখ্যের সিদ্ধান্তগুলির সহিত আমাদের ভালরূপ পরিচয় হইলে, বেদান্তের - বিশেষত গীতান্তৰ্গত বেদান্তের - তত্ত্বসকল শীঘ্রই আমাদের উপলব্ধি হইবে । এই জন্য, ক্ষরাক্ষর জগতের রচনা সম্বন্ধে এই দুই স্মার্তশাস্ত্রের কি মত, প্ৰথমে তাহার বিচার করিব ।


2) কাণাদদিগের পরমাণুবাদ



কোনো বিবক্ষিত কিংবা গৃহীত বিষয় হইতে তর্কের দ্বারা কোন অনুমান কেমন করিয়া বাহির করিতে হইবে; এবং এই অনুমানগুলির মধ্যে কোন্‌টি সত্য ও কোন্‌টি ভ্রান্ত, ইহা কি প্রকারে নির্ণয় করা যাইবে, ন্যায়শাস্ত্রের ইহাই উপযুক্ত বিষয় - এইরূপ অনেকে মনে করেন, কিন্তু তাহা ঠিক নহে । অনুমানাদি প্ৰমাণখণ্ড ন্যায়শাস্ত্রের এক ভাগ সত্য, কিন্তু ইহা তাহার মুখ্য বিষয় নহে; প্রমাণসমূহের অতিরিক্ত, জগতের অন্তর্ভূত অনেক বস্তুর, অর্থাৎ প্রমেয় পদার্থের শ্রেণীবন্ধন বা বৰ্গীকরণ করিয়া, নিম্ন বর্গ হইতে উচ্চতর বর্গে আরোহণ করিতে করিতে, সৃষ্টির অন্তর্গত সমস্ত পদার্থের মূল বর্গ কিংবা পদার্থ কত, তাহাদের গুণধর্ম কি, তাহা হইতে পরে অন্য পদার্থের উৎপত্তি কেমন করিয়া হয় এবং এই বিষয় কি প্রকারে সিদ্ধ হইতে পারে, ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেরও বিচার ন্যায়শাস্ত্রে করা হইয়াছে । ইহাই বলা উচিত যে, শুধু অনুমানখণ্ডের বিচার করিবার জন্য নহে, বরঞ্চ উক্ত প্ৰশ্নসমূহের বিচার করিবার জন্যই ন্যায়শাস্ত্র রচিত হইয়াছে । কণাদকৃত ন্যায়সূত্রের আরম্ভ ও পরবর্তী রচনাও এইপ্রকার । কণাদের অনুযায়ীদিগকে কাণাদ বলা যায় । ইহাদের মত এই যে, পরমাণুই জগতের মূল কারণ । কণাদের পরমাণুর ব্যাখ্যা ও পাশ্চাত্য আধিভৌতিকশাস্ত্রকারদিগের পরমাণুব্যাখ্যা একই প্রকার । যে কোন পদার্থের বিভাগ করিতে করিতে শেষে যখন আর বিভাগ হইতে পারে না তখন তাহাকে (পরম-অণু) পরমাণু বলে । এই পরমাণু যেমন-যেমন একত্র হয়, তেমনি-তেমনি সংযোগের কারণ তাহাদের মধ্যে নূতন নূতন গুণ উৎপন্ন হইয়া ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় । মন ও আত্মারও পরমাণু আছে; এবং উহা একত্ৰ হইলেই চৈতন্য হয় । পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু, ইহাদের পরমাণু স্বভাবতই পৃথক পৃথক বা ভিন্ন ভিন্ন । পৃথিবীর মূল পরমাণুতে চার প্রকার গুণ (রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ), জলের পরমাণুতে তিন গুণ, তেজের পরমাণুতে দুই গুণ, এবং বায়ুর পরমাণুতে একটি গুণ আছে । এইরূপ সমস্ত জগৎ প্রথম হইতেই সূক্ষ্ম ও নিত্য পরমাণুর দ্বারা পরিপূর্ণ । পরমাণু ব্যতীত জগতের অন্য কোন মূল কারণ নাই । সূক্ষ্ম ও নিত্য পরমাণুগণের পরস্পরসংযোগ যখন ‘আরম্ভ’ হয়, তখন সৃষ্টির অন্তর্গত ব্যক্ত পদার্থ সকল রচিত হইতে থাকে । ব্যক্ত সৃষ্টির উৎপত্তি সম্বন্ধে নৈয়ায়িক-প্রতিপাদিত এই কল্পনার পারিভাষিক সংজ্ঞা – ‘আরম্ভ-বাদ’ । কোনো নৈয়ায়িক ইহা ছাড়াইয়া কখন যান না । এক জনের সম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প আছে যে, মরণসময়ে ঈশ্বরের নাম লইতে বলিলে তিনি চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “পীলবঃ ! পীলবঃ !” পরমাণু ! পরমাণু ! পরমাণু ! অন্য কোন নৈয়ায়িক স্বীকার করেন যে, পরমাণুর সংযোগের নিমিত্তকারণ ঈশ্বর । এইপ্রকারে তিনি সৃষ্টির কারণপরম্পরার শৃঙ্খলটি পূর্ণ করিয়া লন । এই প্ৰকার নৈয়ায়িকদিগকে “সেশ্বর নৈয়ায়িক” বলা হয় । বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে, এই পরমাণুবাদের [২|২|১১-১৭] এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গেই “ঈশ্বর কেবল নিমিত্ত কারণ” এই মতেরও খণ্ডন করা হইয়াছে ।

উপরি-উক্ত পরমাণুবাদ পাঠ করিয়া, রসায়নশাস্ত্ৰজ্ঞ ডাল্টন নামক পণ্ডিতপ্ৰতিপাদিত পরমাণুবাদ, ইংরেজিশিক্ষিত পাঠক স্মরণ না করিয়া থাকিতে পারেন না । কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে ডাল্টনের পরমাণুবাদকে ডার্বিন নামক প্ৰসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্রজ্ঞের উৎক্রান্তিবাদ যেরূপ এক্ষণে পশ্চাতে ফেলিয়াছে, সেইরূপ আমাদের দেশেও প্রাচীনকালে সাংখ্যমত কণাদের মতকে পশ্চাতে নিঃক্ষেপ করিয়াছিল । মূল পরমাণুতে গতি কিরূপে আসিল ইহা কাণাদেরা বলিতে পারে না । তদ্ব্যতীত, বৃক্ষ পশু মনুষ্য ইত্যাদি সচেতন প্ৰাণীদিগের পর-পর উচ্চতর পদবী কি করিয়া হইল এবং অচেতনে সচেতনত্ব কি করিয়া আসিল, এ সকল বিষয়েরও তাহারা যথোচিত নিৰ্ণয় করিতে পারে না । পাশ্চাত্য দেশে উনবিংশ শতাব্দীতে লামার্ক ও ডার্বিন এবং আমাদের দেশে পুরাকালে কপিল মুনি এই নির্ণয় করিয়াছেন । একই মূলপদার্থের গুণসমূহের বিকাশ হইয়া জগতের সমস্ত রচনা হইয়াছে, এই দুই মতের ইহাই তাৎপর্য । সেইজন্য প্রথমে হিন্দুস্থানে এবং সমস্ত পাশ্চাত্যদেশেও পরমাণুবাদের উপর বিশ্বাস দাঁড়ায় নাই । এখন তো আধুনিক পদার্থশাস্ত্ৰজ্ঞেরা সিদ্ধ করিয়াছেন যে, পরমাণু অবিভাজ্য নহে । আজকাল যেরূপ সৃষ্টির অনেক পদার্থের পৃথক্‌করণ ও পরীক্ষণ করিয়া অনেক সৃষ্টিশাস্ত্রের প্রমাণ অনুসারে পরমাণুবাদ বা উৎক্রান্তিবাদ সিদ্ধ করা হইয়া থাকে, পূর্বে সেরূপ অবস্থা ছিল না । সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থের উপর নূতন নূতন ও ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা প্রয়োগ করিয়া দেখা, কিংবা তাহাদিগকে অনেক প্রকারে পৃথক্কৃত করিয়া তাহাদের গুণধর্ম নির্ধারণ করা, কিংবা সজীব জগতের প্রাচীন ও নূতন অনেক প্রাণীদিগের শারীরিক অবয়বসমূহের একত্র তুলনা করা, ইত্যাদি আধিভৌতিকশাস্ত্রের অর্বাচীন যুক্তি কণাদের কিংবা কপিলের উপলদ্ধ ছিল না । তাঁহাদের দৃষ্টির সম্মুখে সেই সময় যে সকল সামগ্ৰী ছিল তাহা হইতেই তাঁহারা আপন সিদ্ধান্ত বাহির করিয়াছিলেন । তথাপি আশ্চর্যের বিষয় যে, সৃষ্টির অভিবৃদ্ধি ও তাহার সংগঠন কি করিয়া হইয়াছিল এই সম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রকারগণ কর্তৃক প্রদত্ত তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে এবং অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্রের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে অধিক প্ৰভেদ নাই ।


3) কাপিল সাংখ্য 


সৃষ্টিশাস্ত্রের জ্ঞান বৃদ্ধি হওয়া প্ৰযুক্ত এই মতের (আধিভৌতিক শাস্ত্রের) আধিভৌতিক উপপত্তির বর্ণন বর্তমানকালে অধিক নিয়মবদ্ধ প্ৰণালীতে করা যাইতে পারে, এবং আধিভৌতিক জ্ঞানের বৃদ্ধির দরুন ব্যবহারিক দৃষ্টিতেও মনুষ্যের অনেক লাভ হইয়াছে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু ‘একই অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে নানাবিধ ব্যক্ত সৃষ্টি কি করিয়া হইল’ এই বিষয়ে অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্ৰকারও কপিল অপেক্ষা বেশী কিছুই বলিতে পারেন নাই । ইহার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিবার জন্যই পরে আমি কপিলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই তুলনা করিবার অভিপ্ৰায়ে স্থানে স্থানে হেকেলের সিদ্ধান্তগুলিরও সংক্ষেপে বৰ্ণনা করিয়াছি । হেকেল নিজ গ্রন্থে স্পষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন যে, তিনি এই সিদ্ধান্ত নূতন বাহির করেন নাই; ডার্বিন, স্পেনসর প্রভৃতি তৎপূর্ববৰ্তী আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের গ্রন্থের প্রমাণ অনুসারেই নিজের সিদ্ধান্তসমূহ প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন । তথাপি সিদ্ধান্ত যথাযথ নিয়মানুসারে লিখিয়া সর্বপ্রথম তিনিই এই সকল, একত্ৰ জুড়িয়া “বিশ্বের রহস্য” নামক গ্রন্থে সেগুলিকে একত্ৰ করিয়া সরল প্ৰণালীতে বিবৃত করিয়াছেন । (“The Riddle of the Universe”, by Earnest Hackel, এই গ্রন্থের R. P. A. Cheap reprint সংস্করণের আমি সর্বত্র উপযোগ করিয়াছি ।) এই কারণে সুবিধার জন্য হেকেলকেই আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞদিগের প্রধান মানিয়া তাঁহারই মত এই প্রকরণে ও পরবর্তী প্রকরণে বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছি । এই উল্লেখ খুবই যে সংক্ষিপ্ত, তাহা আর বলিয়া দিতে হইবে না । কিন্তু এখানে ইহা অপেক্ষা এই সকল সিদ্ধান্তের অধিক বিচার করা যাইতে পারে না । যাহারা এই সম্বন্ধে সবিস্তার জানিতে চাহেন তাহাদের স্পেনসরডার্বিনহেকেল প্রভৃতির মূলগ্রন্থ অবলোকন করা আবশ্যক । 


3.1) ‘সাংখ্য’ শব্দের অর্থ



কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের বিচার করিবার পূর্বে, ‘সাংখ্য’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন দুইটী অর্থ আছে তাহা এখানে বলা আবশ্যক । প্ৰথম অর্থ কপিলাচার্যপ্ৰতিপাদিত সাংখ্যশাস্ত্ৰ । তাহাই এই প্রকরণে এবং ভগবদ্‌গীতাতেও একবার [গী|১৮|১৩] উল্লেখ করা হইয়াছে । কিন্তু, এই বিশিষ্ট অর্থ ব্যতীত সর্বপ্রকারের তত্ত্বজ্ঞানেরও সাধারণত এই নামই দিবার রীতি আছে; এবং এই ‘সাংখ্য’ শব্দে বেদান্তশাস্ত্রেরও সমাবেশ হয় । ‘সাংখ্যনিষ্ঠা’ কিম্বা ‘সাংখ্যযোগ’ শব্দে, ‘সাংখ্য’ শব্দের এই সাধারণ অর্থই বিবক্ষিত হইয়া থাকে । এই নিষ্ঠার অন্তর্গত জ্ঞানীপুরুষদিগকেও ভগবদ্‌গীতাতে যেখানে [গী|২|৩৯; ৩|৩; ৫|৪,৫ ও ১৩|১৪] ‘সাংখ্য’ বলা হইয়াছে, সেই স্থানে ‘সাংখ্য’ শব্দের অর্থ কেবল ক্যাপিলসাংখ্যমার্গীই নহে; বরঞ্চ উহাতে আত্মানাত্মবিচারের দ্বারা সন্ন্যাসপূর্বক ব্ৰহ্মজ্ঞানেতেই যাহারা নিমগ্ন থাকে সেই সকল বৈদান্তিকেরও সমস্ত কর্মের সমাবেশ করা হইয়া থাকে । শব্দশাস্ত্রজ্ঞদিগের মত এই যে, ‘সাংখ্য’ শব্দ ‘সং-খ্যা’ ধাতু হইতে বাহির হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার প্রথম অর্থ ‘গণনাকারী’; এবং কপিলশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব গণনায় পঞ্চবিংশতি হওয়াতেই ঐ ‘গণনাকারী’র অর্থে এই বিশিষ্ট ‘সাংখ্য’ নাম দেওয়া হইয়াছে; তাহার পর আবার ‘সাংখ্য’ অর্থাৎ সাধারণতঃ সমস্ত প্ৰকার তত্ত্বজ্ঞান — এই ব্যাপক অর্থ দাঁড়াইয়া গিয়াছে — এইরূপ শব্দশাস্ত্ৰ সমূহের মত । তাই, কপিলভিক্ষুকে ‘সাংখ্য’ বলিবার রীতি প্ৰথমে দাঁড়াইয়া গেলে, পরে বেদান্তী সন্ন্যাসীকেও ঐ নাম দেওয়া হইয়া থাকিবে ইহাই কারণ মনে হয় । যাহাই হৌক, সাংখ্য শব্দের এই অৰ্থভেদ প্ৰযুক্ত পাছে গোলযোগ হয় এইজন্য ইচ্ছা করিয়াই আমি এই প্ৰকরণের “কাপিলসাংখ্যশাস্ত্ৰ” এই লম্বাচৌড়া নাম দিয়াছি ।


3.2) কাপিল সাংখ্যবিষয়ক গ্রন্থ



কাণাদ ন্যায়শাস্ত্রের ন্যায় এই কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রেরও সূত্ৰ আছে । কিন্তু গৌড়পাদ বা শারীরকভাষ্যকার শ্ৰীশঙ্করাচার্য এই সকল সূত্র আপন গ্রন্থের প্রমাণ স্বরূপে গ্ৰহণ করেন নাই বলিয়া ঐ সকল সূত্র প্ৰাচীন না হইতে পারে এইরূপ অনেক বিদ্বান লোকের মত । ঈশ্বরকৃষ্ণের* সাংখ্যকারিকা তদপেক্ষা প্রাচীন বলিয়া তাহারা মনে করেন এবং তাহার উপর শঙ্করাচার্যের গুরু গৌড়পাদ ভাষ্য লিখিয়াছেন । শঙ্করভাষ্যে এই কারিকা হইতেও অনেক কথা উদ্ধৃত হইয়াছে । ৫৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্বে চিনীয় ভাষায় অনূদিত উক্ত গ্রন্থের ভাষান্তর অধুনা পাওয়া গিয়াছে । ‘ষষ্ঠিতন্ত্র’ নামক ষাট প্রকরণের এক প্রাচীন ও বিস্তৃত গ্রন্থের তাৎপর্য (কোন কোন প্রকরণ ছাড়িয়া দিয়া) সত্তর আর্য্যাশ্লোকে এই গ্রন্থে দেওয়া হইয়াছে, ইহা ঈশ্বরকৃষ্ণ নিজের কারিকার শেষভাগে বলিয়াছেন । এই ষষ্ঠিতন্ত্র গ্রন্থ এখন পাওয়া যায় না । তাই এই কারিকার আধারেই কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্তগুলি আমি এখানে আলোচনা করিয়াছি । 

*(ঈশ্বরকৃষ্ণ সম্বন্ধে এক্ষণে বৌদ্ধগ্রন্থাদি হইতে অনেক বিবরণ পাওয়া গিয়াছে । বৌদ্ধ-পণ্ডিত বসুবন্ধুর গুরু এই ঈশ্বরকৃষ্ণের সমকালীন প্রতিপক্ষ ছিলেন; এই বসুবন্ধুর পরমাৰ্থ কর্তৃক (খৃষ্টাব্দ ৪৯৯-৫৬৯) চিনীয় ভাষায় লিখিত চরিত্র এক্ষণে প্রকাশিত হইয়াছে । তাহা হইতে ঈশ্বরকৃষ্ণের কাল প্রায় খৃষ্টাব্দ ৪৫০ হইবে, এইরূপ ডাক্তার টককসু স্থির করিয়াছেন । Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain & Ireland, 1905, PP. 33-53, কিন্তু ডাক্তার ভিন্সেন্ট স্মিথের মতে স্বয়ং বসুবন্ধুর কালই খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে (প্রায় ২৮০-৩৬০) ধরিতে হয় । কারণ সেই গ্রন্থের ভাষান্তর খৃঃ ৪০৪এ চিনীয় ভাষায় হইয়াছে । বসুবন্ধুর কাল এইরূপ পিছাইয়া পড়ায় ঈশ্বরকৃষ্ণের কালও সেইরূপ প্ৰায় দুইশত বৎসর পশ্চাৎ অর্থাৎ খঃ ২৪০ ধরিতে হয় । Vincent Smith's “Early History pf India”, 3d Ed, P.328.)


মহাভারতে কয়েক অধ্যায়ে সাংখ্যমতের নিরূপণ করা হইয়াছে । কিন্তু তাহাতে বৈদান্তিকমতের মিশ্রণ থাকায় শুদ্ধ কাপিল সাংখ্যমতটি কি তাহা স্থির করিবার জন্য অন্য গ্ৰন্থও দেখা আবশ্যক হয় । এই কার্যে উক্ত সাংখ্যকারিকা অপেক্ষা অধিকতর প্রাচীন অন্য গ্ৰন্থ, এক্ষণে পাওয়া যায় না । “সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ” [গী|১০|২৬] সিদ্ধদিগের মধ্যে কপিল মুনি আমি - ভগবান গীতায় যে এইরূপ বলিয়াছেন তাহা হইতে কপিলের যোগ্যতা সিদ্ধ হইতেছে । তথাপি কপিল ঋষি কোথায় এবং কখন আবির্ভূত হইয়াছিলেন তাহার ঠিকানা নাই । শান্তিপর্বের একস্থলে [৩৪০|৬৭] উল্লেখ আছে যে, সনৎকুমারসনকসনন্দনসনৎসুজাতসনসনাতন এবং কপিল - ব্ৰহ্মদেবের এই সাত মানসপুত্র । জন্মিবামাত্রই তাঁহাদের জ্ঞান হইয়াছিল । আর এক স্থানে [শাং|২১৮] । কপিল-শিষ্য আসুরির শিষ্য পঞ্চশিখ জনককে সাংখ্যশাস্ত্রের উপদেশ দিয়াছিলেন তাহার উল্লেখ আছে । সেইরূপ আবার, শান্তিপর্বে [৩০১|১০৮|১০৯] ভীষ্ম বলিয়াছেন যে, সাংখ্যেরা সৃষ্টিরচনা সম্বন্ধে যে জ্ঞান এক সময় প্ৰবর্তিত করিয়াছেন, তাহাই “পুরাণে, ইতিহাসে, অর্থশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি সর্বস্থানে” দেখিতে পাওয়া যায় । অধিক কি, “জ্ঞানং চ লোকে যদিহাস্তি কিঞ্চিৎ সাংখ্যগতং তচ্চ মহন্মহাত্মন্‌” — এই জগতের সমস্ত জ্ঞান সাংখ্যগণ হইতেই নিঃসৃত হইয়াছে । পাশ্চাত্য গ্ৰন্থকার অধুনা সকল স্থলে উৎক্রান্তিবাদের কিরূপ উপযোগ করিতেছেন তাহার প্রতি লক্ষ্য করিলে উৎক্রান্তিশাস্ত্রেরই অনুরূপ আমাদের প্রাচীন সাংখ্যশাস্ত্রেরও ন্যূনাধিক অংশ এদেশবাসী সকলেই যে স্বীকার করিয়াছিলেন তাহা কিছুই আশ্চর্য মনে হইবে না । ‘গুরুত্বাকর্ষণ’, জগৎরচনার ‘উৎক্রান্তিতত্ত্ব’* বা ব্ৰহ্মাত্মৈক্য, এই রকমের উচ্চ কল্পনা শত শত বৎসরেই কোন এক মহাত্মার মনে উদয় হইয়া থাকে । তাই, যে সময়ে যে সাধারণ সিদ্ধান্ত বা ব্যাপক তত্ত্ব সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহারই উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া কোন গ্রন্থের তত্ত্ব প্রতিপাদন করিবার রীতি সাধারণত সর্বদেশের গ্রন্থেই দেখিতে পাওয়া যায় ।

*(উৎক্রান্তিবাদ এই শব্দ Evolution Theory এই অর্থে আজকাল প্রচলিত হওয়া প্রযুক্ত আমি এখানে ব্যবহার করিয়াছি । কিন্তু ‘উৎক্রাক্তি’ এই শব্দের অর্থ সংস্কৃত ভাষায় ‘মরণ’ । তাই উৎক্রান্তিতত্ত্বশব্দ অপেক্ষা গুণবিকাশ, গুণৎকর্ষ কিংবা গুণপরিণাম প্রভৃতি সাংখ্যদিগের শব্দের উপযোগ করা আমার মতে অধিক প্রশস্ত ।)

3.3) কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত


3.3.1) সৎকার্যবাদ

সে যাক; কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের অভ্যাস আজকাল প্রায় লুপ্ত হওয়া প্রযুক্ত এই প্রস্তাবনা করা আবশ্যক হইয়াছে । এক্ষণে কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মুখ্য সিদ্ধান্তগুলি কি তাহা দেখা যাক্‌ । সাংখ্যশাস্ত্রের প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, এই জগতে নূতন কিছুই উৎপন্ন হয় না; কারণ, শূন্য অর্থাৎ যাহা পুর্বে ছিলই না তাহা হইতে শূন্য ছাড়া অন্য কিছুই নিষ্পন্ন হইতে পারে না । তাই, উৎপন্ন বস্তুতে অর্থাৎ কার্যে যে গুণ দৃষ্টিগোচর হয় তাহা, যাহা হইতে উক্ত বস্তু উৎপন্ন হইয়াছিল তাহাতে অর্থাৎ কারণে সূক্ষ্ম আকারে অবশ্যই ছিল, ইহা সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে [সাং|কা|৯] । বৌদ্ধ ও কাণাদদিগের মতে, এক পদার্থের নাশ হইয়া তাহা হইতে অন্য নূতন পদার্থ প্রস্তুত হয়; উদাহরণ যথা – বীজের নাশ হইয়া তাহা হইতে অঙ্কুর এবং অঙ্কুরের নাশ হইয়া তাহা হইতে বৃক্ষ ইত্যাদি হয় । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রী ও বেদান্তীগণ এ মত স্বীকার করেন না । তাঁহারা প্ৰতিপাদন করেন যে, বৃক্ষের বীজে যে দ্রব্য আছে তাহা বিনষ্ট না হইয়া তাহাই ভূমি হইতে ও বায়ু হইতে অন্য দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লওয়া প্ৰযুক্ত বীজ অঙ্কুরের নূতন রূপ বা অবস্থা প্ৰাপ্ত হয় [বেসূ|শাং|ভা|২|১|২৮] । সেইরূপ কাঠ জ্বলিলে তাহারই ছাই, ধোঁয়া ইত্যাদি রূপান্তর হয়; কাঠের মূল দ্রব্য বিনষ্ট হইয়া ধূম নামক কোন নুতন পদার্থ উৎপন্ন হয় না । ছান্দোগ্যোপনিষদে উক্ত হইয়াছে [ছাং|৬|২|২] যে, “কথমসতঃ সজ্জায়েত” – যাহা নাই তাহা হইতে যাহা আছে তাহা কি প্রকারে উৎপন্ন হইবে ? জগতের মূল কারণের প্রতি ‘অসৎ’ শব্দের উপযোগ কখনো কখনো উপনিষদে করা হইয়াছে [ছাং|৩|১৯|১; তৈ|২|৭|১]; কিন্তু এখানে অসৎ শব্দের অর্থ ‘অভাব = নাই’ নহে; বেদান্তসূত্রে স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, [বেসু|২|১|১৬, ১৭] কেবল নাম রূপাত্মক ব্যক্ত স্বরূপের বা অবস্থার অভাবই বিবক্ষিত । দুগ্ধ হইতেই দধি হয়, জল হইতে হয় না; তিল হইতে তৈল্য বাহির হয়, বালুকা হইতে বাহির হয় না; ইত্যাদি প্ৰত্যক্ষ অনুভব হইতেও এই সিদ্ধান্ত প্ৰকাশ পাইতেছে । কারণে যে গুণ নাই সেই গুণ ‘কার্যে’ স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয় ইহা যদি স্বীকার করা যায়, তবে জল হইতে দধি কেন হয় না, ইহার কারণ আমি বলিতে পারি না । সার কথা - যাহা মূলেতেই নাই তাহ হইতে, যাহা এক্ষণে অস্তিত্বে আছে তাহা উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই, যে কোন কার্য ধর না কেন, তাহার বর্তমান দ্রব্যাংশ ও গুণ মূল কারণেও কোন না কোন আকারে থাকা চাই, সাংখ্যেরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । এই সিদ্ধান্তেরই নাম ‘সৎকার্যবাদ’ । অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রীরাও এই সিদ্ধান্ত খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন যে, পদার্থসমূহের জড়দ্রব্য ও কর্মশক্তি উভয়ই চিরস্থায়ী; কোন পদার্থের যতই রূপান্তর হোক না কেন, শেষে সৃষ্টির সমগ্র দ্রব্যাংশের ও কর্মশক্তির মোট পরিমাণ নিয়ত সমানই থাকে । উদাহরণ যথা - দীপ জ্বলিয়া তৈল বিনষ্ট হইতেছে মনে হইলেও আসলে তৈলের পরমাণু মোটেই বিনষ্ট হয় না । কাজল, ধোঁয়া বা অন্য সূক্ষ্ম দ্রব্যের আকারে ঐ পরমাণুর অস্তিত্ব থাকে । এই সূক্ষ্ম দ্রব্যসকল একত্ৰ করিয়া ওজন করিলে তাহা এবং তৈল পুড়িবার সময় তাহার সহিত মিশ্ৰিত বায়ুস্থিত পদার্থ এই দুইয়ের ওজন সমান হইয়া থাকে । এক্ষণে ইহাও সিদ্ধ হইয়াছে যে, এই নিয়ম কর্মশক্তিসম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, আধুনিক পদার্থবিদ্যাশাস্ত্রের এবং সাংখ্যের সিদ্ধান্ত দেখিতে এক হইলেও সাংখ্যগণের সিদ্ধান্ত এক পদার্থ হইতে অন্য পদার্থ উৎপত্তি বিষয়ে অর্থাৎ কেবল কার্যকারণভাবেরই সম্বন্ধে উপযুক্ত । কিন্তু অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত ইহা হইতে অধিক ব্যাপক । ‘কার্যের’ কোন গুণই ‘কারণ’-বহির্ভূত গুণ হইতে উৎপন্ন হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, যখন কারণ কার্যের স্বরূপ প্ৰাপ্ত হয়, তখন সেই কার্যের দ্রব্যাংশ ও কর্মশক্তির একটুও নাশ হয় না; পদার্থের বিভিন্ন অবস্থার দ্রব্যাংশ ও কর্মশক্তির মোট পরিমাণ সর্বদাই একই থাকে, বাড়েও না কমেও না । এই বিষয় প্ৰত্যক্ষ পরীক্ষার দ্বারা গণিতপদ্ধতি অনুসারে এক্ষণে স্থিরীকৃত হইয়াছে । ইহাই উক্ত দুই সিদ্ধান্তের গুরুতর বিশেষত্ব । এই প্রকার দৃষ্টিতে দেখিলে জানা যায় যে, ভগবদ্‌গীতার “নাসতো বিদ্যতে ভাবঃ” - যাহা মূলেই নাই তাহার কখন অস্তিত্ব আসিতে পারে না - ইত্যাদি যে সিদ্ধান্ত দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে প্ৰদত্ত হইয়াছে [গী|২|১৬] তাহা সৎকার্যবাদের মতো দেখিতে হইলেও, কেবল কার্যকারণাত্মক সৎকার্যবাদ অপেক্ষা অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত তাহার সাদৃশ্য অধিক । উপরে প্রদত্ত ছান্দোগ্য-উপনিষদের বচনেরও ইহাই ভাবার্থ । সার কথা - সৎকার্যবাদের সিদ্ধান্ত বেদান্তীরা স্বীকার করেন । কিন্তু অদ্বৈত বেদাস্তশাস্ত্রের মত এই যে, এই সিদ্ধান্ত সগুণ সৃষ্টির বাহিরে একটুও প্রযুক্ত হইতে পারে না, এবং নির্গুণ হইতে সগুণের উৎপত্তি কিরূপ দেখায় তাহার উপপত্তি অন্য প্রকারে লাগাইতে হইবে । এই বেদান্তমতের বিচার পরে অধ্যাত্মপ্রকরণে বিস্তৃতভাবে করা যাইবে । আপাতত সাংখ্যমতবাদের দৌড় কোন পর্যন্ত, তাহারই বিচার করা কর্তব্য হওয়ায় সৎকাৰ্যবাদের সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়া ক্ষরাক্ষরশাস্ত্ৰে সাংখ্যেরা তাহার কিরূপ উপযোগ করিয়াছেন তাহার বিচার করিব ।

3.3.2) জগতের মূল দ্রব্য অথবা প্রকৃতি একই

সাংখ্যমতানুসারে সৎকার্যবাদ সিদ্ধ হইলে পর, এই মতটি আপনা-আপনিই খণ্ডিত হইয়া যায় যে, দৃশ্য জগতের উৎপত্তির পুর্বে কোন পদার্থই ছিল না, উহা শূন্য হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । কারণ, শূন্য অর্থে – ‘যাহা কিছুই নাই’ বুঝায়; এবং যাহা নাই তাহা তইতে ‘যাহা অস্তিত্বে আছে’ তাহা কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । ইহা হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, জগৎ কোন না কোন পদার্থ হইতে অবশ্য উৎপন্ন হইয়াছে; এবং এক্ষণে জগতের যে গুণ দেখিতে পাই তাহাই এই মূল পদার্থেও অবশ্য থাকা চাই । এক্ষণে জগতের দিকে চাহিয়া দেখিলে বৃক্ষ, পশু, মনুষ্য, পাথর, সোনা, রূপা, হীরা, জল, বায়ু প্ৰভৃতি অনেক পদার্থ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় । এবং এই সকলের রূপ ও গুণও বিভিন্ন । সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্ত এই যে, এই বিভিন্নতা বা নানাত্ব আদিতে অর্থাৎ মূল পদার্থে নাই; মূলে সমস্ত পদার্থের মূলবস্তু একই । অৰ্বাচীন রসায়নশাস্ত্ৰজ্ঞগণ বিভিন্ন দ্রব্যের পৃথককরণ করিয়া প্ৰথমে বাষট্টি (৬২) মূল তত্ত্ব বাহির করিয়াছিলেন; কিন্তু এখন পাশ্চাত্য পদার্থশাস্ত্রবেত্তারাও স্থির করিয়াছেন যে, এই ৬২ মূল তত্ত্ব স্বতন্ত্র বা স্বয়ং সিদ্ধ নহে, কিন্তু এই সকলের মূলে একটি কোন পদার্থ আছে এবং সেই পদার্থ হইতেই সূর্য, চন্দ্র, তারকা, পৃথ্বী প্রভৃতি সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে । সেই কারণে এক্ষণে এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অধিক বিচার আলোচনা আবশ্যক নাই । জগতের সমস্ত পদার্থের এই যে মূল বস্তু তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘প্রকৃতি’ বলে । প্ৰকৃতির অর্থ ‘মূলের’ । এই প্রকৃতি হইতে পরে যে সকল পদার্থ উৎপন্ন হয় তাহাকে ‘বিকৃতি’ অর্থাৎ মূল বস্তুর বিকার নাম দেওয়া হইয়াছে ।

3.3.3) সত্ত্ব, রজ ও তম উহার তিন গুণ

কিন্তু সমস্ত পদার্থের মধ্যে মূল বস্তু একই হইলেও যদি এই মূল বস্তুর গুণও একই হয়, তবে সৎকার্যবাদ অনুসারে এই একই গুণ হইতে অনেক গুণ উৎপন্ন হওয়া সম্ভব নহে । এবং এদিকে যখন এই জগতের পাথর, মাটি, জল, সোণা ইত্যাদি বিভিন্ন পদার্থ দেখি, তখন ঐ সকলে বিভিন্ন অনেক গুণ চোখে পড়ে । তাই প্রথমে পদার্থসমূহের গুণ সকল নিরীক্ষণ করিয়া সাংখ্যেরা এই গুণসমূহের সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন ভেদ বা বর্গ নির্ধারণ করিয়াছেন । কারণ যে কোন পদার্থ ধর না কেন, তাহার শুদ্ধ, নির্মল কিংবা পূৰ্ণাবস্থা, এবং তদ্বিরুদ্ধ নিকৃষ্টাবস্থা এই দুই ভেদ স্বভাবতই দৃষ্টিগোচর হয় । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেই পদার্থের নিকৃষ্ট অবস্থা হইতে পুর্ণাবস্থার দিকে উন্নত হইবার প্রবৃত্তিও দৃষ্টিগোচর হয় । ইহাই তৃতীয় অবস্থা । এই তিন অবস্থার মধ্যে শুদ্ধাবস্থা বা পূৰ্ণাবস্থাকে সাত্ত্বিক, নিকৃষ্টাবস্থাকে তামসিক ও প্ৰবর্তক অবস্থাকে রাজসিক বলা যায় । সাংখ্যগণ বলিয়া থাকেন যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ সমস্ত পদার্থের মূলবস্তুরও অর্থাৎ প্ৰকৃতিতে প্রারম্ভ হইতেই আছে । অধিক কি, এই তিন গুণকেই প্রকৃতি বলিলে অনুচিত হইবে না । 

3.3.4) ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা ও পারস্পরিক সংঘর্ষ-বিবাদে নানা পদার্থের উৎপত্তি

এই তিন গুণের মধ্যে প্ৰত্যেকেরই বল আরম্ভে একইরূপ থাকায় প্রথম প্রথম এই প্ৰকৃতি সাম্যাবস্থায় থাকে । এই সাম্যাবস্থা জগতের আরম্ভে ছিল; এবং জগতের লয় হইলে পুনৰ্বার হইবে । সাম্যাবস্থাতে কোন নড়াচড়া নাই, যাহা কিছু সমস্ত স্তব্ধ থাকে । কিন্তু যখন এই তিন গুণ কম বেশী হইতে আরম্ভ হয়, তখন প্রবৃত্তাত্মক রজোগুণের দরুণ, মূল প্রকৃতি হইতে বিভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন হইয়া সৃষ্টির আরম্ভ হয় । এখন এখানে এই প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ প্রথমে সাম্যাবস্থায় থাকিলে তাহার মধ্যে ন্যূনাধিক্য কিরূপ উৎপন্ন হইল ? সাংখ্যেরা তাহার উত্তরে বলেন যে, ইহা প্ৰকৃতির মূল ধর্মই [সাং|কা|৬১] । প্রকৃতি জড় হইলেও, তাহা আপনা-আপনিই সমস্ত ব্যবহার করিতে থাকে । এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণের লক্ষণই জ্ঞান অর্থাৎ জানা এবং তমোগুণের লক্ষণ অজ্ঞান । রজোগুণ ভালমন্দ কর্মের প্ৰবর্তক । এই তিন গুণ কখনই পৃথক পৃথক থাকিতে পারে না । সকল পদার্থে সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের মিশ্রণ থাকে; এবং এই মিশ্ৰণ নিয়তই এই তিনের অন্যোন্য-ন্যূনাধিক্য অনুসারে হয় । তাই মূলবস্তু এক হইলেও গুণভেদের দরুণ এক মূল বস্তুরই সোনা, লোহা, মাটি, জল, আকাশ, মানবশরীর ইত্যাদি অনেক বিভিন্ন বিকার হইয়া থাকে । যাহাকে আমরা সাত্ত্বিক গুণের পদাৰ্থ বলি, তাহাতে রজ ও তম এই দুই গুণ অপেক্ষা সত্ত্বের বল বা পরিমাণ অধিক থাকায়, সেই পদার্থে সদাবস্থিত রজ ও তম চাপা পড়ে, কাজেই আমাদের চোখে পড়ে না । বস্তুত সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ অন্য পদার্থের ন্যায় সাত্ত্বিক পদার্থেও থাকে । নিছক্‌ সত্ত্বগুণী, নিছক রজোগুনী, কিংবা নিছক তমোগুণী কোন পদার্থই নাই । প্ৰত্যেক পদার্থে তিন গুণেরই সংঘর্ষ চলিতে থাকে; এবং এই সংঘর্ষে যে গুণ প্ৰবল হয় তদনুসারে প্রত্যেক সাত্ত্বিক, রাজসিক বা তামসিক বলা যায় [সাং|কা|১২; মভা|অশ্ব-অনুগীতা-৩৬ ও শাং|৩০৫] । উদাহরণ যথা - নিজের শরীরে রজ ও তম এই দুইয়ের উপর সত্ত্বের প্রাধান্য হইলে আমাদের অন্তঃকরণে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, সত্য কি তাহা আমরা জানিতে পারি, এবং চিত্তবৃত্তি শান্ত হয় । সেই সময়ে ইহা বুঝিতে হইবে না যে, নিজের রজোগুণ ও তমোগুণ একেবারেই থাকে না; তবে কিনা, সেগুলি সত্ত্বগুণের প্রভাবে দমিয়া থাকায় তাহাদের কোন অধিকার দাঁড়াইতে পারে না [গী|১৪|১০] । সত্ত্বের বদলে রজোগুণ যদি প্ৰবল হয় তবে ওন্তঃকরণে লোভ জাগ্রত হইয়া আকাঙ্ক্ষা বাড়িতে থাকে এবং তাহা আমাকে অনেক কার্যে প্ৰবৃত্ত করায় । সেইরূপ সত্ত্ব ও রজ এই দুইয়ের উপর তমোগুণের প্ৰাধান্য হইলে নিদ্রা, আলস্য, স্মৃতিভ্ৰংশ প্রভৃতি দোষ শরীরে উৎপন্ন হয় । তাৎপর্য এই যে, জাগতিক পদার্থে সোনা, লোহা, পারা ইত্যাদি যে নানাত্ব বা প্ৰভেদ দৃষ্ট হয়, তাহা প্ৰকৃতির সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণেরই পরস্পর ন্যূনাধিকতার ফল । মূল প্ৰকৃতি এক হইলেও জানা চাই যে, এই নানাত্ব বা ভিন্নতা কিরূপে উৎপন্ন হয় । ইহারই যে বিচার তাহাকে বিজ্ঞান বলে । ইহাতেই সমস্ত আধিভৌতিক শাস্ত্রেরও সমাবেশ হয় । উদাহরণ যথা - রসায়নশাস্ত্ৰ, বিদ্যুৎশাস্ত্ৰ, পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্ৰ, এই সমস্ত বিবিধ জ্ঞানই বিজ্ঞান ।

3.3.5) প্রকৃতি অব্যক্ত, অখণ্ডিত, একই ও অচেতন

সাম্যাবস্থায় প্ৰকৃতি সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘অব্যক্ত’ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর কথিত হইয়াছে । এই প্রকৃতির সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের পরস্পর ন্যূনাধিকতার কারণে যে অনেক পদাৰ্থ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় অর্থাৎ যাহা আমরা দেখি, শুনি, আস্বাদ করি, আঘ্রাণ করি বা স্পর্শ করি, সাংখ্যশাস্ত্রে তাহাই ‘ব্যক্ত’ বলা হইয়াছে । ‘ব্যক্ত’ অর্থে স্পষ্টরূপে আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর পদার্থ; তাহা আকৃতির দ্বারা, রূপের দ্বারা গন্ধের দ্বারা বা অন্য কোন যে গুণের দ্বারাই ব্যক্তি হউক । ব্যক্ত পদার্থ অনেক । তন্মধ্যে গাছ পাথর প্রভৃতি কতকগুলি স্থূল; আর মন, বুদ্ধি, আকাশ প্ৰভৃতি কতকগুলি ইন্দ্ৰিয়গোচর অর্থাৎ ব্যক্ত হইলেও সূক্ষ্ম । সুক্ষ্মের অর্থ এ স্থলে ক্ষুদ্র নহে; কারণ, আকাশ সূক্ষ্ম হইলেও সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে । তাই, সূক্ষ্ম অর্থে স্থূলের বিপরীত, বা বায়ু হইতেও অনেক সূক্ষ্ম, এইরূপ বুঝিতে হইবে । ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল” এই দুই শব্দের দ্বারা যে-কোন বস্তুর শরীররচনার জ্ঞান হয়; এবং ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই শব্দের দ্বারা, উক্ত বস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা আমাদের পক্ষে সন্তব বা সম্ভব নহে, ইহাই বোধগম্য হয় । তাই, দুই বিভিন্ন পদার্থের (উভয়ই সূক্ষ্ম হইলেও) মধ্যে একটি ব্যক্ত এবং অন্যটি অব্যক্ত হইতে পারে । উদাহরণ যথা - বায়ু সূক্ষ্ম হইলেও স্পর্শেন্দ্রিয় তাহা জানিতে পারে বলিয়া তাহাকে ব্যক্ত বলি; এবং সমস্ত পদার্থের মূলবস্তু বা মূল প্রকৃতি, বায়ু অপেক্ষাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম হওয়া প্ৰযুক্ত কোন ইন্দ্রিয়ই তাহাকে জানিতে পারে না, তাই প্ৰকৃতিকে অব্যক্ত বলি । প্ৰকৃতি যদি কোন ইন্দ্রিয়েরই গোচর না হয়, তবে প্রকৃতি আছে কি না তাহার প্রমাণ কি, এই প্রশ্ন আসিয়া উপস্থিত হয় । সাংখ্যেরা এই প্রশ্নের উত্তর দেন যে, অনেক ব্যক্ত পদার্থের অবলোকন হইতে সৎকার্যবাদ অনুসারে এই অনুমান সিদ্ধ হয় যে, এই সকল পদার্থের মূল রূপ (প্ৰকৃতি) ইন্দ্ৰিয়সমক্ষে প্ৰতিভাত না হইলেও সূক্ষ্মরূপে তাহার অস্তিত্ব অবশ্য থাকাই চাই [সাং|কা|৮] । বেদান্তীরাও ব্ৰহ্মের অস্তিত্ব সিদ্ধ করিবার সময় এই যুক্তিই স্বীকার করিয়াছেন [কঠ|৬|১২, ১৩ উহার শাঙ্কর ভাষ্য দেখ] । প্ৰকৃতিকে এই প্রকার অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত স্বীকার করিলে নৈয়ায়িকদিগের পরমাণুবাদ আপনা-আপনিই সমূলে খণ্ডিত হইয়া যায় । কারণ পরমাণু অব্যক্ত ও অসংখ্য হইলেও, প্রত্যেক পরমাণুর স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা অবয়ব হওয়া প্ৰযুক্ত এই প্রশ্ন আবার বাকী থাকিয়া যায় যে, দুই পরমাণুর মধ্যস্থলে কোন পদার্থ আছে । এইজন্য সাংখ্যশাস্ত্রের এইরূপ সিদ্ধান্ত যে প্রকৃতিতে পরমাণুরূপ অবয়বভেদ নাই; কিন্তু উহা সর্বদাই একসংলগ্ন, মধ্যে একটুও ব্যবধান থাকে না, এক-সমান; অথবা ইহা বলা যায় যে, উহা অব্যক্ত (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর) ও নিরবয়বরূপে নিরন্তর সর্বত্র পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে । পরব্রহ্মের বর্ণনা করিবার সময় দাসবোধে [দা|২০|২|৩] শ্রীসমর্থ রামদাস স্বামী বলেন -
জিকড়ে পহাবে তিকড়ে অপার ৷
কোনীকড়ে নাহি পার ॥
এক জিনসী স্বতন্ত্র ৷ দুসরে নাহীঁ ॥
অর্থাৎ - যে দিকে দেখিবে সেই দিকেই অসীম, কোন দিকেই সীমা নাই; একমাত্ৰ বস্তু ও স্বতন্ত্র, তাঁহাতে দ্বৈত বা অন্য কিছুই নাই । সাংখ্যদিগের প্রকৃতি সম্বন্ধেও এই বর্ণনা প্ৰযুক্ত হইতে পারে । ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি অব্যক্ত, স্বয়ম্ভূ, ও একই প্ৰকার; এবং উহা চারিদিকে নিরন্তর নিবিড়ভাবে পূর্ণ । আকাশ, বায়ু ইত্যাদি ভেদ পরে হইয়াছে এবং তাহা সূক্ষ্ম হইলেও ব্যক্ত; এই সমস্তের মূল প্রকৃতি এইরূপ এবং সর্বব্যাপী ও অব্যক্ত । মনে থাকে যেন, বেদান্তীদিগের পরব্রহ্মে এবং সাংখ্যদিগের প্রকৃতিতে আকাশ পাতাল ব্যবধান । কারণ, পরব্ৰহ্ম চৈতন্যরূপ ও নির্গুণ; কিন্তু প্ৰকৃতি জড়রূপ ও সত্ত্বরজস্তমোময় অর্থাৎ সগুণ । এই সম্বন্ধে অধিক বিচার পরে করা যাইবে । এক্ষণে সাংখ্যদিগের মত কি, তাহাই আমাদের আলোচ্য । 

3.3.6) অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত

‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল’, ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’, ইহাদের এইরূপ অর্থ করিলে, সৃষ্টির আরম্ভে প্ৰত্যেক পদার্থ সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত প্ৰকৃতির রূপে থাকে, তাহার পর উহা (স্থূল হোক বা সূক্ষ্মই হোক) ব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়গোচর হইয়া থাকে, এবং প্ৰলয়কালে এই ব্যক্তস্বরূপের নাশ হইলে আবার উহা অব্যক্ত প্ৰকৃতির মধ্যে মিশিয়া গিয়া অব্যক্ত হইয়া পড়ে, এইরূপ বলিতে হয় । গীতাতেও এই মত ব্যক্ত হইয়াছে [গী|২|২৮ ও ৮|১৮] । সাংখ্যশাস্ত্ৰে এই অব্যক্ত প্ৰকৃতিকে ‘অক্ষর’, এবং প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন সমস্ত পদার্থকে ‘ক্ষর’ সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে । এখানে ক্ষর অর্থে সম্পূর্ণ নাশ নহে; কেবল ব্যক্তরূপের নাশই এস্থলে বিবক্ষিত । প্ৰধান, গুণক্ষোভিণী, বহুধানক, প্রসবধর্মিণী, ইত্যাদি প্ৰকৃতির আরও অনেক নাম আছে । সৃষ্টির সমস্ত পদার্থের মুখ্য মূল হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতিকে প্রধান বলা হয় । ত্ৰিগুণের সাম্যাবস্থা আপনিই আপনাকে ভাঙ্গিয়া ফেলে বলিয়া উহাকে গুণক্ষোভিণী বলে । গুণত্ৰয়রূপী পদার্থ ভেদের বীজ প্ৰকৃতিতে আছে বলিয়া উহাকে বহুধানক বলে এবং প্রকৃতি হইতেই সমস্ত পদার্থ প্ৰসূত হয় বা উৎপন্ন হয় বলিয়া উহাকে প্রসবধর্মিণী বলে । বেদান্তশান্ত্রে এই প্ৰকৃতিকেই ‘মায়া’ অর্থাৎ মায়িক অবভাস বলা হইয়াছে ।

3.3.7) হেকেলের জড়াদ্বৈত

সৃষ্টির সমস্ত পদার্থকে ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’ বা ‘ক্ষর’ ও ‘অক্ষর’ এই দুই বিভাগে বিভক্ত করিলে পর দেখিতে হইবে যে, ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞ বিচারে কথিত আত্মা, মন, বুদ্ধি, অহংকার ও ইন্দ্ৰিয়াদি সাংখ্যমতে কোন বিভাগে বা বর্গে ফেলিতে হইবে । ক্ষেত্র ও ইন্দ্ৰিসমূহ তো জড়ই, তাই ব্যক্ত পদার্থে উহাদের সমাবেশ হইতে পারে; কিন্তু মন, অহঙ্কার, বুদ্ধি ও বিশেষত আত্মা, ইহাদের কিরূপ ব্যবস্থা করা যাইবে ? যুরোপ খণ্ডের আধুনিককালের প্রসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞ হেকেল আপন গ্রন্থে প্ৰতিপাদন করিয়াছেন, যে, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও আত্মা, এ সমস্তই শারীরধর্মা । উদাহরণ যথা - মনুষ্যের মস্তিষ্ক বিগড়াইয়া গেলে তাহার স্মরণশক্তি লোপ পায় এবং সে উন্মাদগ্ৰস্তও হয়, ইহা আমরা দেখিতে পাই । সেইরূপ মাথায় গুরুতর আঘাত লাগিয়া মস্তিষ্কের কোন অংশ অসাড় হইয়া গেলেও সেই অংশের মানসিক শক্তি বিলুপ্ত হয়, এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় । সারকথা এই যে, মনোধর্মও মস্তিষ্কেরই গুণ; অতএব উহাকে জড়বস্তু হইতে কখনই পৃথক করা যায় না, এবং সেইজন্য মস্তিষ্কের সঙ্গে সঙ্গেই মনোধর্ম ও আত্মাকেও, ‘ব্যক্তি’ পদার্থের বর্গে ফেলা আবশ্যক । এই জড়বাদ মানিয়া লইলে শেষে কেবল অব্যক্ত ও জড় প্রকৃতিই অবশিষ্ট থাকিয়া যায় । কারণ, সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ এই মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে । এই অবস্থায় প্রকৃতি ব্যতীত জগতের কর্তা বা উৎপাদক আর কেহই হইতে পারে না । তখন তো ইহাই বলিতে হয় যে, মূল প্ৰকৃতির শক্তি বাড়িতে বাড়িতেই তাহাই চৈতন্য বা আত্মার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হইয়াছে । সৎকার্যবাদের ন্যায় এই মূল প্ৰকৃতির কতকগুলি নিয়ম প্রস্তুত হইয়াছে; এবং তদনুসারে সমস্ত জগৎ ও তাহার সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যও এই নিয়মানুসারে জীবন নির্বাহ করিতেছে । জড় প্রকৃতি ব্যতীত আত্মা বলিয়া কোন পৃথক পদাৰ্থ নাই, কাজেই উহা অবিনাশীও নহে, স্বতন্ত্রও নহে । তবে মোক্ষের আবশ্যকতা কি ? আমার ইচ্ছানুসারে আমি অমুক কর্ম করিব এইরূপ প্ৰত্যেকে যে মনে করে তাহা নিছক ভ্ৰম । প্ৰকৃতি তাহাকে যে দিকে টানিবে সেই দিকেই তাহাকে যাইতে হইবে । সারকথা - ৺শঙ্করমোরো রান্‌ডে কলহপুরী নাটকের আরম্ভের ধ্রুপদে যাহা বলিয়াছেন তদনুসারে বলিতে হয় -
বিশ্ব সর্ব হেঁ তুরুঙ্গ মোঠো প্ৰাণীমাত্র কৈদী ৷
পদার্থধর্মাঞ্চিয়া শৃঙ্খলা ত্যাঁতেঁ কোণি ন ভেদী ॥
এই সমস্ত বিশ্ব এক বৃহৎ কারাগার, প্রাণীমাত্রই কয়েদী এবং পদার্থের গুণধর্ম শৃঙ্খল — এই শৃঙ্খল কেহ ভাঙ্গিতে পারে না । ইহাই হেকেলের মতের সারাংশ । ঐ মতানুসারে একমাত্র জড় ও অব্যক্ত প্ৰকৃতিই সমস্ত সৃষ্টির মূল হওয়া প্ৰযুক্ত হেকেল আপন মতের নাম দিয়াছেন – ‘অদ্বৈত’ ! কিন্তু এই অদ্বৈত জড়মূলক অর্থাৎ একমাত্র জড়প্রকৃতিতেই সমস্ত বিষয়ের সমাবেশ করে বলিয়া য়ামি উহাকে জড়াদ্বৈত বা আধিভৌতিকশাস্ত্রাদ্বৈত বলিব ।

3.3.8) প্রকৃতি হইতেই মন ও বুদ্ধির উৎপত্তি

কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রকারেরা এই জড়াদ্বৈত স্বীকার করেন না । তাঁহারা বলেন যে, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, ইহারা পঞ্চভূতাত্মক জড়প্রকৃতিরই ধর্ম, এবং অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই বুদ্ধি, অহঙ্কার প্রভৃতি গুণ ক্রমে ক্রমে উৎপন্ন হয় । কিন্তু তাহার মত এই যে, জড় প্রকৃতি হইতে চৈতন্য উৎপন্ন হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, যেমন কোন মনুষ্য আপন কাঁধের উপর বসিতে পারে না, সেইরূপ প্ৰকৃতির জ্ঞাতা বা দ্রষ্টা প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন না হইলে ‘আমি ইহা জানিতেছি, উহা জানিতেছি’ এইপ্ৰকার ভাষাও প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । এবং জগতের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি করিলে সকলেরই ইহা অনুভূত হয় যে, আমি যাহা কিছু জানিতেছি বা দেখিতেছি, তাহা আমা হইতে ভিন্ন । তাই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, দ্রষ্টা ও দৃষ্টবস্তু কিংবা প্ৰকৃতির দ্রষ্টা ও জড়প্রকৃতি এই দুই পদার্থ মূলতই ভিন্ন ভিন্ন মানিতে হয়, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন [সাং|কা|১৭] । পূর্বপ্রকরণে যাহাকে ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা আত্মা বলা হইয়াছে তাহাই এই দ্রষ্টা, জ্ঞাতা বা উপভোক্তা, এবং ইহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘পুরুষ’ বা ‘জ্ঞ’ (জ্ঞাতা) বলা হইয়াছে । এই জ্ঞাতা প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন হওয়া প্রযুক্ত স্বভাবতই তাহা সত্ত্ব, রজ ও তম, প্রকৃতির এই তিন গুণের বাহিরে অর্থাৎ উহা নির্গুণ ও অবিকারী এবং জানা দেখা ব্যতীত অন্য কোন কাজ করে না । অতএব জগতে যাহা কিছু ভাঙ্গাগড়া চলিতেছে তৎসমস্ত একমাত্র প্রকৃতিরই কাজ, এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । সারকথা - প্রকৃতি অচেতন, পুরুষ সচেতন; প্রকৃতিই সমস্ত কর্মচেষ্টা করিতেছে, পুরুষ উদাসীন ও অকর্তা; প্রকৃতি ত্ৰিগুণাত্মক, পুরুষ নিগুৰ্ণ; প্রকৃতি অন্ধ, পুরুষ সাক্ষী । এই প্রকারে এই সৃষ্টির মধ্যে এই দুই ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব অনাদিসিদ্ধ, স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভু, ইহাই সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত । ইহারই প্ৰতি লক্ষ্য রাখিয়া ভগবদ্‌গীতাতে প্ৰথমে বলা হইয়াছে “প্ৰকৃতিং পুরুষং চৈব বিন্ধ্যনাদী উভাবপি” - প্ৰকৃতি ও পুরুষ ইহারা উভয়েই অনাদি [গী|১৩|১৯/২০]; ইহার পরে উহাদের এইরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে যে, “কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে” অর্থাৎ দেহ ও ইন্দ্রিয়সমূহের ব্যাপার প্রকৃতি করিয়া থাকে; এবং “পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে” অর্থাৎ পুরুষ সুখদুঃখের উপভোগ করিবার কারণ । গীতাতে প্ৰকৃতি ও পুরুষ অনাদি স্বীকৃত হইলেও এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখা চাই যে, সাংখ্যদের ন্যায় গীতাতে এই দুই তত্ত্ব স্বতন্ত্র কিংবা স্বয়ম্ভূ বলিয়া স্বীকৃত নহে । কারণ, গীতাতে ভগবান প্ৰকৃতিকে আপন মায়া বলিয়াছেন [গী|৭|১৪; ১৪|৩]; এবং পুরুষসম্বন্ধেও “মমৈবাংশো জীবলোকে” [গী|১৫|৭] - উহা আমারই অংশ, এইরূপ বলিয়াছেন । ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, গীতা সাংখ্যশাস্ত্ৰকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন । কিন্তু আপাতত সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া শুধু সাংখ্যশাস্ত্র পরে কি বলিতেছেন তাহাই দেখিব ।

3.3.9) প্রকৃতি ও পুরুষ দুই স্বতন্ত্র তত্ত্ব

সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে, সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ তিন বর্গে বিভক্ত । প্ৰথম অব্যক্ত (মূল প্রকৃতি), দ্বিতীয় ব্যক্ত (প্রকৃতির বিকার) এবং তৃতীয় পুরুষ অর্থাৎ ‘জ্ঞ’ । কিন্তু ইহাদের মধ্যে প্ৰলয়কালে ব্যক্ত পদার্থের স্বরূপ নষ্ট হয়; তাই এখন কেবল মূলে প্ৰকৃতি ও পুরুষ, এই দুই তত্ত্বই বাকী রহিয়া যায় । এই দুই মূলতত্ত্ব সাংখ্যদিগের মতে অনাদি ও স্বয়ম্ভূ; তাই সাংখ্যদিগকে দ্বৈতবাদী (এই দুই মূলতত্ত্ব যাঁহারা স্বীকার করেন) বলা হইয়া থাকে । ইহাঁরা প্ৰকৃতি ও পুরুষের বাহিরে ঈশ্বর, কাল, স্বভাব বা অন্য কোন মূল তত্ত্বই মানেন না । *
*(ঈশ্বরকৃষ্ণ একজন পাকা নিরীশ্বরবাদী । তিনি নিজের সাংখ্যকারিকার উপসংহারাত্মক তিন আৰ্য্যাতে বলিয়াছেন যে, মূলবিষয়ের উপর ৭০ আৰ্য্যা শ্লোক ছিল । কিন্তু কোলব্রুক ও উইলসনের অনুবাদের সহিত বোম্বায়ে রা, রা, তুকারাম-তাত্যা যে সংস্করণ ছাপাইয়াছেন তাহাতে মূলবিষয়ের উপর কেবল মাত্ৰ ৬৯ আৰ্য্যা আছে । এই হেতু ৭০ম আৰ্য্যা কোন্‌টি, এইরূপ উইলসন্‌ সাহেবের সন্দেহ হইল । কিন্তু ঐ আৰ্য্যাটি না পাওয়ায় তাঁহার সন্দেহের সমাধান হয় নাই । আমার মতে, এই আৰ্য্যা এখনকার ৬১ম আৰ্য্যার পরে হইবে । কারণ,  ৬১ম আৰ্য্যার উপর গৌড়পাদের যে ভাষ্য আছে তাহা এক আৰ্য্যার উপর নহে, দুই আৰ্য্যার উপর । এবং এই ভাষ্যের মূলশ্লোকের পদগুলি লইয়া আৰ্য্যা রচনা করিলে তাহা -
কারণমীশ্বরমেকে ব্রুবন্তি কালং পরে স্বভাবং বা ৷
প্ৰজাঃ কথং নির্গুণতো ব্যক্তঃ কালঃ স্বভাবশ্চ ॥
এইরূপ দাঁড়ায় । এই আৰ্য্যা অগ্রপশ্চাৎ সন্দর্ভেরও (অর্থ বা ভাবের) সহিত ঠিকঠিক মিলেও । এই আৰ্য্যা নিরীশ্বর মতের প্রতিপাদক হওয়ায় মনে হয় যে, কেহ ইহা পরে ছাঁটিয়া ফেলিয়াছে । কিন্তু এই আর্য্যার শোধনকারী মনুষ্য সেই আৰ্য্যার ভাষ্যও ছাঁটিয়া ফেলিতে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছেন, তাই এক্ষণে এই আৰ্য্যা আমরা খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলাম; এবং এই জন্য ঐ মনুষ্যকে আমাদের ধন্যবাদ দিতে হয় । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথম মন্ত্র হইতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, প্ৰাচীনকালে কোন কোন লোক স্বভাব ও কালকে এবং বেদান্তী তাহাদিগকেও ছাড়াইয়া গিয়া ঈশ্বরকে জগতের মূল কারণ মানিতেন । মন্ত্রটা এই -
স্বভাবমেকে কবয়ো বদন্তি কালং তথান্যে পরিমুহ্যমানাঃ ৷
দেবস্যৈষা মহিমা তু লোকে যেনেদং ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রম্‌ ॥
কিন্তু ইহা দেখাইবার জন্যই ঈশ্বরকৃষ্ণ উপরি-উক্ত আর্য্যাকে বর্তমান ৬১ম আর্য্যার পরে বসাইয়াছেন যে, এই তিন মূল কারণ (অর্থাৎ স্বভাব, কাল ও ঈশ্বর) সাংখ্যেরা স্বীকার করেন না ।)


কারণ, সগুণ ঈশ্বর, কাল ও স্বভাব, এই সমস্ত ব্যক্ত হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন ব্যক্ত পদার্থের মধ্যেই তাহাদের সমাবেশ হইয়া থাকে; এবং নির্গুণ বলিয়া মানিলে, সৎকার্যবাদ অনুসারে নির্গুণ মূলতত্ত্ব হইতে ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই, তাঁহারা স্থির নির্ধারণ করিয়াছেন যে, প্রকৃতি ও পুরুষকে ছাড়িয়া এই সৃষ্টির তৃতীয় কোন মূলতত্ত্ব নাই । এই প্রকারে তাঁহারা দুই মূলতত্ত্ব নির্ধারণ করিলে পর, তাঁহারা আপন মতানুসারে ইহাও সিদ্ধ করিলেন যে, সেই দুই মূলতত্ত্ব হইতে সৃষ্টি কিরূপে উৎপন্ন হইল । 


3.3.10) পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগে সৃষ্টির বিস্তার

তাঁহারা বলেন যে, নির্গুণ পুরুষ স্বতঃ কিছু করিতে না পারিলেও প্ৰকৃতির সঙ্গে উহার সংযোগ হইলে, যেমন গরু নিজের বাছুরের জন্য দুধ দেয় কিংবা লৌহ চুম্বকের সন্নিধানে আসিলে লৌহে আকর্ষণশক্তি আসে, সেইরূপ মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি স্বকীয় গুণসমূহের (সূক্ষ্ম ও স্থুল) ব্যক্ত বিস্তার পুরুষের সন্মুখে স্থাপন করে [সাং|কা|৫৭] । পুরুষ সচেতন ও জ্ঞাতা হইলেও, কেবল অর্থাৎ নির্গুণ হওয়া প্ৰযুক্ত, তাহার নিকট স্বতঃ কর্ম করিবার কোন সাধন নাই; এবং প্রকৃতি কর্মকর্তা হইলেও জড় বা অচেতন হওয়া প্ৰযুক্ত, সে জানে না যে কোন্‌ কাজ করিতে হইবে । এই কারণে ইহা খঞ্জ ও অন্ধের জুড়ী; অন্ধের কাঁধের উপর খঞ্জ বসিয়া অন্যোন্যসহায়তায় দুজনেই যেরূপ পথ চলিতে থাকে, সেইরূপই জড় প্ৰকৃতি ও সচেতন পুরুষের সংযোগ হইলে সৃষ্টির সকল কর্মের আরম্ভ হইয়া থাকে [সাং|কা|২১] । এবং যেমন নাটকে প্রেক্ষকদিগের মনোরঞ্জনার্থ রঙ্গভূমির উপর একই নটী এখন এক বেশে, খানিক পরে আর এক বেশে নাচিতে থাকে, সেইরূপ পুরুষের লাভের জন্য (পুরুষার্থের জন্য) পুরুষ কোন রকম প্ৰতিদান না করিলেও, এই প্ৰকৃতি সত্ত্বরজতম গুণসমূহের ন্যূনাধিক্য অনুসারে অনেক রূপ গ্রহণ করিয়া তাহার সম্মুখে সমান নাচিতে থাকে [সাং|কা|৫৯] । প্ৰকৃতির এই নৃত্যে মোহবশত ভুলিয়া বা বৃথাভিমানবশত যে পর্যন্ত পুরুষ এই প্ৰকৃতির কর্তৃত্ব আপনারই কর্তৃত্ব বলিয়া স্বীকার করে এবং সুখদুঃখের জালে আপনাকে যে পর্যন্ত জড়াইয়া রাখে, সে পর্যন্ত কখনো তাহার মোক্ষপ্ৰাপ্তি হইতে পারে না [গী|৩|২৭] । 

3.3.11) কৈবল্য অর্থাৎ মোক্ষ-প্রাপ্তি

কিন্তু যে সময়ে পুরুষের এই জ্ঞান হয় যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি পৃথক এবং আমি পৃথক, সেই সময়ে সে মুক্ত হয় [গী|১৩|২৯,৩০; ১৪|২০]; কারণ বস্তুত পুরুষ কর্তাও নহে, বদ্ধও নহে – সে তো স্বপ্তন্ত্র ও স্বভাবতই কৈবল্য-অবস্থাপন্ন বা অকর্তা । যাহা কিছু হয় সে সমস্ত প্ৰকৃতিরই খেলা । অধিক কি, মন ও বুদ্ধিও প্রকৃতিরই বিকার হওয়া প্ৰযুক্ত বুদ্ধির যে জ্ঞান হয় তাহাও প্ৰকৃতির কার্যেরই ফল । এই জ্ঞান তিন প্রকারের – সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক [গী|১৮|২০-২২] । তন্মধ্যে বুদ্ধির সাত্ত্বিক জ্ঞান হইলে পুরুষ জানিতে পারে যে, আমি প্রকৃতি হইতে পৃথক্‌ । সত্ত্ব, রজঃ ও তম এই গুণত্ৰয় প্রকৃতিরই ধর্ম, পুরুষের নহে । পুরুষ নির্গুণ এবং ত্ৰিগুণাত্মক, প্ৰকৃতি উহার দর্পণ [মভা|শাং|২০৪|৮] । এই দর্পণ যখন স্বচ্ছ বা নির্মল থাকে, অর্থাৎ যখন নিজের এই বুদ্ধি, যাহা প্ৰকৃতির বিকার, সাত্ত্বিক হয়, তখন এই স্বচ্ছ দর্পণে পুরুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপ দেখিতে থাকে এবং উহার এই বোধ হয় যে আমি প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন । সেই সময়ে এই প্ৰকৃতি লজ্জিত হইয়া ঐ পুরুষের সম্মুখে নৃত্য, খেলা ও জালবিস্তার বন্ধ করিয়া দেয় । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে পুরুষ সমস্ত পাশ ও জাল হইতে মুক্ত হইয়া নিজের স্বাভাবিক কৈবল্যপদ প্ৰাপ্ত হয় । ‘কৈবল্য’ অর্থাৎ কেবলত্ব, একাকীত্ব বা প্ৰকৃতির সহিত সংযোগ না থাকা । পুরুষের এই নৈসৰ্গিক বা স্বাভাবিক অবস্থাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে মোক্ষ (বন্ধন-মোচন) বলে । 

3.4) মোক্ষ কাহার হয়, প্রকৃতির বা পুরুষের ?



এই (মোক্ষ) অবস্থার বিষয়ে সাংখ্যবাদী এক সুক্ষ্ম প্রশ্ন উপস্থিত করিয়াছেন । তাঁহাদের প্রশ্ন এই যে, পুরুষ প্ৰকৃতিকে ছাড়ে, না প্ৰকৃতি পুরুষকে ছাড়ে । অনেকের নিকট এই প্রশ্ন, বর অপেক্ষা কনে ঢ্যাঙা কিংবা কনে অপেক্ষা বর বেঁটে, এইরূপ ধরণের প্রশ্নের ন্যায় নিরর্থক প্ৰতীত হইবে । কারণ, দুই বস্তুর এক বস্তু হইতে অপরটীর বিয়োগ হইলে পর কে কাহাকে ছাড়িল ইহা দেখার কোন ফল নাই; উভয়ই পরস্পরকে ছাড়ে, ইহাই আমরা দেখিতে পাই । কিন্তু একটু সুক্ষ্ম বিচার, করিয়া দেখিলে সাংখ্যদিগের এই প্রশ্ন তাঁহাদের দৃষ্টিতে অযোগ্য নহে, এইরূপ উপলব্ধি হইবে । সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে পুরুষ নির্গুণ, অকর্তা ও উদাসীন হওয়া প্ৰযুক্ত তত্ত্বদৃষ্টিতে ‘ছাড়া’ বা ‘ধরা’ এই দুই ক্রিয়ার কর্তৃত্ব পুরুষে বৰ্ত্তিতে পারে না [গী|১৩|৩১, ৩২] । তাই, সাংখ্যবাদী স্থির করিয়াছেন যে, সেই প্রকৃতিই ‘পুরুষ’কে ছাড়িয়া যায়, অর্থাৎ প্ৰকৃতিই ‘পুরুষ’ হইতে আপনার মোক্ষসাধন করিয়া লয়, কারণ কর্তৃত্ব প্রকৃতিরই ধর্ম, [সাং|কা|৬২ ও গী|১৩|৩৪] । সার কথা, পুরুষের মোক্ষ নামে এমন কোন পৃথক অবস্থা নাই যাহা ‘পুরুষ’ বাহির হইতে প্রাপ্ত হয়; কিংবা পুরুষের মূল ও স্বাভাবিক অবস্থা হইতে ভিন্ন কোন অবস্থাই নাই । ঘাসের উপরকার ছাল হইতে ভিতরকার শাঁস যেরূপ পৃথক্‌ কিংবা জলস্থ মাছ যেরূপ জল হইতে পৃথক্‌, সেইরূপ প্রকৃতি ও পুরুষের সম্বন্ধ । প্রকৃতির গুণের দ্বারা মুগ্ধ হইয়া সাধারণ কোন ব্যক্তি নিজের এই স্বাভাবিক বিভিন্নতা বুঝিতে পারে না, তাই সংসার চক্রে নিমগ্ন থাকে । কিন্তু এই ভিন্নতা যে জানিতে পারে সে মুক্তই হয় । এই প্রকার পুরুষকে ‘জ্ঞানী’ বা ‘বুদ্ধ’ ও ‘কৃতকৃত্য’ বলে, ইহা মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|১৯৪|৫৮; ২৪৮|১১ ও ৩০৬-৩০৮] । “এতদ্‌বুদ্ধা বুদ্ধিমান্‌ স্যাৎ” [গী|১৫|২০] এই গীতা বচনে ‘বুদ্ধিমান’ শব্দেরও এই অর্থ । অধ্যাত্মশাস্ত্রদৃষ্টিতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপও ইহাই [বেসু|শাং|ভা|১|১|৪] । কিন্তু সাংখ্য হইতে অদ্বৈত বেদান্তের বিশেষ উক্তি এই যে, পুরুষ স্বভাবত কৈবল্য অবস্থায় আছে এইরূপ কারণ না দিয়া, আত্মা মূলেই পরব্রহ্মস্বরূপ এবং যখন সে আপন মূলস্বরূপ, অর্থাৎ পরব্রহ্মকে জানিতে পারে তখন তাহাই উহার মোক্ষ । সাংখ্য ও ও বেদান্ত, ইহাদের মধ্যে এই ভেদ পরবর্তী প্রকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখান যাইবে ।


3.5) সাংখ্যের অসংখ্য পুরুষ এবং বেদান্তীদিগের এক পুরুষ



পুরুষ (আত্মা) নির্গুণ, উদাসীন ও অকর্তা - সাংখ্যদিগের এই মত যদিও অদ্বৈত বেদান্তের সম্পূর্ণ মান্য, তথাপি একই প্ৰকৃতির দ্রষ্টা স্বতন্ত্র পুরুষ মুলেই অসংখ্য, - পুরুষসম্বন্ধে সাংখ্যদিগের এই দ্বিতীয় কল্পনা বেদান্তীরা স্বীকার করেন না [গী|৮|৪; ১৩|২০-২২; মভা|শাং|৩৫১; এবং বেসূ|শাং|ভা|২|১|১] । বেদান্তীরা বলেন যে, উপাধিভেদপ্ৰযুক্ত সমস্ত জীব ভিন্ন ভিন্ন প্ৰতিভাত হয়, বস্তুত সমস্তই ব্ৰহ্ম । সাংখ্যদিগের মত এই যে, যখন দেখি যে, প্ৰত্যেক মনুষ্যের জন্ম, মরণ ও জীবন ভিন্ন ভিন্ন এবং যখন এই জগতে ভেদ দেখিতে পাওয়া যায় যে, কেহ সুখী, কেহ দুঃখী, তখন মানিতে হয় যে, প্ৰত্যেক আত্মা বা পুরুষ মূলেই ভিন্ন এবং তাহাদের সংখ্যাও অনন্ত [সাং|কা|১৮] । কেবল প্রকৃতি ও পুরুষই সমস্ত সৃষ্টির মূলতত্ত্ব ধরিলাম; কিন্তু উহাদের মধ্যে, পুরুষ শব্দে সাংখ্যদিগের মতানুসারে ‘অসংখ্য পুরুষের সমুদায়’ এর সমাবেশ হয় । এই সকল অসংখ্য পুরুষ ও ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতির সংযোগ হইতে সৃষ্টির সমস্ত ব্যবহার চলিতেছে । প্ৰত্যেক পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হইলে পর প্রকৃতি আপন গুণের বিস্তার সেই পুরুষের সন্মুখে স্থাপন করে, এবং পুরুষ তাহা উপভোগ করিতে থাকে । এইরূপ হইতে হইতে, যে পুরুষের আশপাশের প্রকৃতির খেলা সাত্ত্বিক হয়, সেই পুরুষেরই (সকল পুরুষের নহে) যথার্থ জ্ঞান লাভ হয়; এবং তাহারই নিকটে প্রকৃতির সমস্ত খেলা বন্ধ হইয়া যায়, আর সে আপনার মূল ও কৈবল্য স্বরূপে উপনীত হয় । কিন্তু তাহার মোক্ষলাভ হইলেও অবশিষ্ট পুরুষদিগের সংসারে আবদ্ধ থাকিতেই হয় । পুরুষ এইরূপ কৈবল্যপদে উপনীত হইলেই সে প্রকৃতির জাল হইতে একেবারেই মুক্ত হইয়া যায় - কেহ কেহ এরূপ মনে করিতে পারেন কিন্তু সাংখ্যমতানুসারে এরূপ বুঝিলে ভুল হইবে । 



দেহ ও ইন্দ্রিয়রূপী প্রকৃতির বিকার মনুষ্যকে তাহার মরণ পর্যন্ত ছাড়ে না । সাংখ্যবাদীরা ইহার এই কারণ বলেন যে, “যেরূপ কুমারের চাকা হইতে কলসী তৈয়ার করিয়া বাহির করিয়া লইলেও পূর্বসংস্কারবশতঃ তাহা কিয়ৎক্ষণ পর্যন্ত ঘুরিতেই থাকে, সেইরূপ কৈবল্যপ্রাপ্ত মনুষ্যেরও শরীর কিছুদিন অবশিষ্ট থাকে” [সাং|কা|৬৭] । তথাপি সেই শরীর হইতে কৈবল্যপ্ৰাপ্ত পুরুষের কোন প্ৰতিবন্ধক কিংবা সুখদুঃখের বাধা হয় না । কারণ, এই শরীর জড়প্রকৃতির বিকার হওয়া প্ৰযুক্ত, স্বয়ং জড়ই, সেইজন্য সুখই বা কি, দুঃখই বা কি, তাহার নিকট দুই-ই সমান; এবং যদি ইহা বলা যায় যে পুরুষের সুখদুঃখের বাধা হয়, তবে ইহাও ঠিক নহে; কারণ সে জানে যে, প্ৰকৃতি হইতে আমি ভিন্ন, সমস্ত কর্তৃত্ব প্রকৃতিরই, আমার নহে । এই অবস্থাতে প্ৰকৃতির যতই খেলা হউক না কেন, পুরুষের সুখদুঃখ হয় না, সে সর্বদা উদাসীনই থাকে । প্ৰকৃতির ত্ৰিগুণ হইতে মুক্ত হইয়া যে পুরুষের এই জ্ঞান হয় নাই, তাহার জন্মমরণের পুনরাবৃত্তির একেবারে শেষ হয় না; চাই সে, সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ প্ৰযুক্ত দেবযোনিতে জন্মগ্রহণ করুক কিংবা রজোগুণের উৎকর্ষ হেতু মানব-যোনিতে, অথবা তমোগুণের প্রাবল্যে পশুর শ্রেণীতে উৎপন্ন হউক [সাং|কা|৪৪|৫৪] ৷ জন্মমরণরূপী চক্রের এই ফল, প্ৰত্যেক মনুষ্য তাহার চতুঃপার্শ্বস্থ প্ৰকৃতি অর্থাৎ তাহার বুদ্ধির সত্ত্ব্রজতমোগুণের উৎকর্ষ অপকর্ষ প্ৰযুক্ত প্ৰাপ্ত হয় । “উৰ্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থাঃ” - সাত্তিক বৃত্তির পুরুষ স্বর্গে যায় এবং তামসিক পুরুষ অধোগতি প্ৰাপ্ত হয়, ইহা গীতাতেও উক্ত হইয়াছে [গী|১৪|১৮] । কিন্তু এই স্বৰ্গাদি ফল অনিত্য । জন্মমরণ হইতে যে আপনাকে মুক্ত করিতে চাহে, কিংবা সাংখ্যদিগের পরিভাষায়, যে প্রকৃতি হইতে আপনার ভিন্নতা অর্থাৎ কৈবল্য চিরস্থির রাখিতে চাহে, তাহার ত্ৰিগুণাতীত হইয়া বিরক্ত (সন্ন্যস্ত) হওয়া ভিন্ন অন্য মাৰ্গ নাই । এই বৈরাগ্য ও জ্ঞান কপিলাচার্য জন্ম হইতেই প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন । কিন্তু সকলেই এই অবস্থা, জন্ম হইতেই পাইতে পারে না । তাই, তত্ত্ববিবেকরূপ সাধনের দ্বারা প্ৰকৃতি ও পুরুষের ভেদ উপলব্ধি করিয়া আপন বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ করিবার প্রযত্ন প্ৰত্যেকের করা আবশ্যক । এইরূপ প্ৰযত্নের দ্বারা বুদ্ধি সাত্ত্বিক হইলে পরে সেই বুদ্ধিরই জ্ঞান, বৈরাগ্য, ও ঐশ্বর্য প্রভৃতি গুণ সকল উৎপন্ন হয় এবং শেষে মনুষ্য কৈবল্য প্ৰাপ্ত হয় । মনুষ্য যাহা পাইতে ইচ্ছা করিবে তাহাই প্ৰাপ্ত হইবার যোগসামর্থ্যকেই এইস্থানে ঐশ্বর্য বলা হইয়াছে । সাংখ্যমতানুসারে, ধর্মের গণনা সাত্ত্বিক গুণের মধ্যেই করা হয়; কিন্তু শুধু ধর্মের দ্বারা কেবল স্বৰ্গপ্রাপ্তি হয় মাত্র, এবং জ্ঞান ও বৈরাগ্যের (সন্ন্যাস) দ্বারা মোক্ষ কিংবা কৈবল্য প্ৰাপ্ত হইয়া পুরুষের দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি হয়, কপিলাচার্য, শেষে এইরূপ ভেদ করিয়াছেন ।


4) ত্রিগুণাতীত অবস্থা



ইন্দ্রিয়সমূহে ও বুদ্ধিতে প্ৰথমে সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ হইয়া উপরে উঠতে উঠিতে পরিশেষে পুরুষের এই জ্ঞান যখন হয় যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি পৃথক্‌ ও আমি পৃথক্‌, তখন সে ত্ৰিগুণাতীত অর্থাৎ সত্ত্ব রজ ও তম এই তিন গুণেরই বাহিরে পৌঁছিয়াছে ইহা সাংখ্যবাদী বলেন । এই ত্ৰিগুণাতীত অবস্থায় সত্ত্ব, রজ ও তম ইহাদের মধ্যে কোন গুণই অবশিষ্ট থাকে না । তাই, সূক্ষ্মরূপে বিচার করিলে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিন অবস্থা হইতে এই ত্রিগুণাতীত অবস্থা ভিন্ন, স্বীকার করিতে হয় এবং এই অভিপ্ৰায়েই ভাগবতে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক, - ভক্তির এই তিন ভেদ করিবার পর চতুর্থ আর এক ভেদ করা হইয়াছে । তিন গুণেরই পারগামী পুরুষ নির্হেতুক ও অভেদভাবে যে ভক্তি করিয়া থাকেন তাহাকে নির্গুণ ভক্তি বলে [ভাগ|৩|২৯|৭-১৪] । কিন্তু সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক এই তিন বর্গ অপেক্ষা বৰ্গীকরণের তত্ত্বসকলের ফাজিল বৃথা, বৃদ্ধি করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । তাই সাংখ্যবাদী বলেন যে সত্ত্বগুণের অত্যন্ত উৎকর্ষের দ্বারাই শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এই জন্য তিনি এই অবস্থার গণনা সাত্ত্বিক বৰ্গেই করিয়া থাকেন । গীতাতেও এই মত স্বীকৃত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - যে অভেদাত্মক জ্ঞানের দ্বারা জানা যায় যে, যাহা কিছু সমস্তই এক তাহাকেই “সাত্ত্বিক জ্ঞান” বলে এইরূপ গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|১৮|২০] । ইহা ব্যতীত সত্ত্বগুণের বর্ণনার পরেই গীতার ১৪ম অধ্যায়ের শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনা আসিয়াছে । 


5) সাংখ্যের ও তৎসদৃশ গীতার সিদ্ধান্তের ভেদ



কিন্তু ভগবদ্‌গীতার প্রকৃতি ও পুরুষ বিশিষ্টাদ্বৈত স্বীকৃত নহে, তাই মনে রাখা আবশ্যক যে, গীতাতে ‘প্ৰকৃতি’, ‘পুরুষ’, ‘ত্ৰিগুণাতীত’ ইত্যাদি সাংখ্যদিগের পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ একটু ভিন্ন অর্থে করা হইয়াছে; কিংবা ইহা বলিতে হয় যে, গীতাতে সাংখ্যের দ্বৈতের উপর অদ্বৈত পরব্রহ্মের ছাপ সর্বত্র লাগাইয়া রাখা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - সাংখ্যদিগের প্রকৃতিপুরুষ-ভেদই গীতার ১৩ম অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে [গীতা|১৩|১৯-৩৪] । কিন্তু সেস্থলে ‘প্ৰকৃতি’ ও ‘পুরুষ’ এই দুই শব্দ ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্রজ্ঞের সহিত সমানার্থক । সেইরূপ, ১৪ম অধ্যায়ের ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনও [গী|১৪|২২-২৭] ত্রিগুণাত্মক মায়াজাল হইতে মুক্ত এবং প্রকৃতি ও পুরুষেরও অতীত পরমাত্মার জ্ঞাত সিদ্ধ পুরুষের, বিষয়ে করা হইয়াছে । প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই পৃথক্‌ তত্ত্ব স্বীকার করিয়া পুরুষের কৈবল্যই ত্ৰিগুণাতীত অবস্থা যাহারা মানে, এই বৰ্ণন সাংখ্যদের ঐ সিদ্ধান্তের অনুযায়ী নহে । এই ভেদ পরে অধ্যাত্মপ্রকরণে আমি স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি । কিন্তু গীতাতে অধ্যাত্মবাদই প্রতিপাদিত হইলেও অধ্যাত্মতত্ত্বসকল বিবৃত করিবার সময় ভগবান, সাংখ্যপরিভাষার ও যুক্তিবাদের উপযোগ স্থানে স্থানে করিয়াছেন বলিয়া, গীতায় কেবল সাংখ্যমতই গ্ৰাহ্য, এইরূপ কোন কোন পাঠকের ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা আছে । এই ভ্রম দূর করিবার জন্য সাংখ্যশাস্ত্র ও গীতার তৎসদৃশ সিদ্ধান্তের ভেদ পুনর্বার এখানে বলা হইয়াছে । বেদান্তসূত্ৰভাষ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্য বলিয়াছেন যে, “প্ৰকৃতি ও পুরুষের বাহিরে এই জগতের পরব্রহ্মরূপী একই মূল তত্ত্ব আছে এবং তাহা হইতে প্রকৃতি-পুরষাদি সমস্ত সৃষ্টিই উৎপন্ন হইয়াছে”, উপনিষদের এই অদ্বৈত, সিদ্ধান্তকে না ছাড়িয়া সাংখ্যদিগের শেষ সিদ্ধান্ত আমার অগ্ৰাহ্য নহে [বেসু|শাং|ভা|২|১|৩] । এই বিষয় গীতার উপপাদনের বিষয়েও চরিতার্থ হয় ।

বিশ্বের রচনা ও সংহার (Creation & Destruction)

গুণা গুণেষু জায়ন্তে তত্রৈব নিবিশন্তি চ ৷ [মভা|শান্তি|৩|৫|২৩]

(“গুণ হইতেই গুণ উৎপন্ন হয় এবং গুণেতেই গুণ লয় পায়” ।)

1) প্রকৃতির বিস্তার ও জ্ঞানবিজ্ঞান


কাপিলসাংখ্য অনুসারে, প্ৰকৃতি ও পুরুষ, জগতের এই যে দুই স্বতন্ত্ৰ মূলতত্ত্ব আছে তাহাদের স্বরূপ কি, এবং দুয়ের সংযোগরূপ নিমিত্ত-কারণ ঘটিলে পর, পুরুষের সম্মুখে প্ৰকৃতি আপন গুণত্রয়ের যে বাজার বসাইয়া থাকে, তাহা হইতে কিরূপে মুক্তিলাভ করা যাইবে, ইহার বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু এই প্ৰকৃতির বাজার-লীলা, মরাঠী কবি যাহার ভাবব্যঞ্জক নাম দিয়াছেন “সংসারের খেলা” এবং জ্ঞানেশ্বর মহারাজও যাহাকে “প্রকৃতির টাকশাল” বলিয়াছেন, সেই প্ৰকৃতির সংসার কি অনুক্ৰম অনুসারে পুরুষের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়া থাকে ও তাহার লয় কিরূপে হয় ইহার ব্যাখ্যা এখনো বাকী রহিয়া গিয়াছে; এই প্ৰকরণে সেই ব্যাখ্যা করিব । প্রকৃতির এই ব্যাপারকেই “বিশ্বের রচনা ও সংহার” বলে । সাংখ্যমতানুসারে এই সমস্ত জগৎ বা সৃষ্টি অসংখ্য পুরুষের লাভের জন্যই প্ৰকৃতি নির্মাণ করিয়াছেন । প্রকৃতি হইতে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড কিরূপে নির্মাণ হয়, ‘দাসবোধের’ দুই তিন স্থানে শ্ৰীসমর্থ রামদাসস্বামীও তাহার সুরস বর্ণনা করিয়াছেন; এবং সেই বৰ্ণনা হইতেই “বিশ্বের রচনা ও সংহার” এই নাম আমি গ্রহণ করিয়াছি । সেইরূপ, ভগবদ্গীতার সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে এই বিষয় মুখ্যভাবে প্ৰতিপাদ্য হইয়া পরে একাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে - “ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্ৰতৌ বিস্তরশো ময়া” [গী|১১|২] ভূতসকলের উৎপত্তি ও প্রলয় (যাহা আপনি) বিস্তারিতরূপে (বলিয়াছেন তাহা) আমি শুনিয়াছি, এক্ষণে আপনার বিশ্বরূপ দেখাইয়া আমাকে কৃতাৰ্থ করুন - এই যে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করিয়াছেন, তাহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, বিশ্বের রচনা ও সংহার ক্ষর-অক্ষর-বিচারের এক মুখ্য ভাগ । সৃষ্টির অন্তর্গত অনেক (নানা) ব্যক্ত পদার্থের মধ্যে একই অব্যক্ত মূল দ্রব্য আছে ইহা যাহা দ্বারা বুঝা যায় তাহাই জ্ঞান [গী|১৮|২০]; এবং যাহা দ্বারা একই মূলভূত অব্যক্ত দ্রব্য হইতে ভিন্ন ভিন্ন অনেক ব্যক্ত পদার্থসকল কিরূপে পৃথকতাবে নির্মিত হইয়াছে বুঝা যায় তাহাই বিজ্ঞান [গী|১৩|৩০]; এবং ইহার মধ্যে কেবল ক্ষরাক্ষর বিচারের সমাবেশ হয় না, ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞজ্ঞান ও অধ্যাত্মবিষয়াসকলেরও সমাবেশ হয় ।


2) বিভিন্ন সৃষ্ট্যুৎপত্তিক্রম এবং উহাদের অন্তিম একবাক্যতা


ভগবদ্‌গীতার মতে প্রকৃতি, আপন সংসারের কাৰ্য স্বতন্ত্ররূপে নিৰ্বাহ করেন না, পরন্তু তিনি পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এই কার্য নিৰ্বাহ করিয়া থাকেন [গী|৯|১০] । সাংখ্যশাস্ত্রের মতে পুরুষের সংযোগরূপ নিমিত্ত-কারণই প্রকৃতির সংসারকার্য আরম্ভ করিবার পক্ষে যথেষ্ট । প্ৰকৃতি এই বিষয়ে আর কাহারও অপেক্ষা রাখেন না । সাংখ্যের ব্যক্তব্য এই যে, পুরুষ ও প্ৰকৃতির সংযোগ হইলেই, প্ৰকৃতি-টাকশালের কাজ আরম্ভ হয় এবং বসন্ত ঋতুতে যেরূপ পল্লব ফুটিয়া ক্ৰমে ক্রমে পাতা, ফুল ও ফল বাহির হয় [মভা|শাং|২৩১|৭৩; মনু|১|৩০] সেইরূপ প্ৰকৃতির মূল সাম্যাবস্থা ভাঙ্গিয়া তাহার গুণসমূহের বিস্তার হইতে থাকে । ইহার বিপরীতে বেদসংহিতাতে, উপনিষদে ও স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে প্রকৃতিকে মূল বলিয়া স্বীকার না করিয়া, পরব্ৰহ্মকে মূল বলিয়া স্বীকার করিয়া তাহা হইতে স্থষ্টির উৎপত্তি হইবার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা করা হইয়াছে; যথা — “হিরণ্যগৰ্ভঃ সমবৰ্ত্ততাগ্ৰে ভুতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ” প্রথমে হিরণ্যগৰ্ভ [ঋ|১০|১২১|১], এবং এই হিরণ্যগৰ্ভ হইতে কিংবা সত্য হইতে সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২; ১০|১৯০]; কিংবা প্ৰথমে জল উৎপন্ন হইয়া [ঋ|১০|৮২|৬; তৈ|ব্রা|১|১|৩|৭; ঐ|উ|১|১|২] তাহা হইতে সৃষ্টি হইল; এই জলেতে এক অণ্ড উৎপন্ন হইবার পর তাহা হইতে ব্ৰহ্মা, এবং ব্ৰহ্মা হইতে কিংবা মূল অণ্ড হইতেই সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হইল [মনু|১|৮|১৩; ছাং|৩|১৯]; কিংবা সেই ব্ৰহ্মাই (পুরুষ) অর্ধভাগে স্ত্রী হইয়াছিলেন [বৃ|১|৪|৩; মনু|১|৩২]; কিংবা জল উৎপন্ন হইবার পূর্বেই পুরুষ হইয়াছিল [কঠ|৪|৬]; অথবা প্ৰথমে পরব্ৰহ্ম হইতে তেজ, জল ও পৃথ্বী (অন্ন) এই তিন তত্ত্ব উৎপন্ন হইবার পরে তাহাদের মিশ্রণে সমস্ত পদার্থ নির্মিত হইয়াছিল [ছাং|৬|২-৬] । উপরোক্ত বর্ণনাসমূহে অনেক ভিন্নতা থাকিলেও পরিশেষে বেদান্তে স্থিরীকৃত হইয়াছে যে [বেসূ|২|৩|১-১৫], আত্মরূপী মূল ব্ৰহ্ম হইতেই আকাশাদিক্ৰমে পঞ্চমহাভূত নিঃসৃত হইয়াছে [তৈ|উ|২|১], কঠ [৩|১১], মৈত্রায়ণী [৬|১০], শ্বেতাশ্বর [৪|১০; ৬|১৬], প্রভৃতি উপনিষদেও, প্ৰকৃতি মহৎ ইত্যাদি তত্ত্বেরও স্পষ্ট উল্লেখ আছে । ইহা হইতে দেখা যাইতেছে যে, বেদান্তী প্ৰকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার না করিলেও, একবার যখন শুদ্ধ ব্ৰহ্মেতেই মায়াত্মক প্ৰকৃতিরূপ বিকার প্রকাশ পায়, তখন পরে সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমসম্বন্ধে তাহার ও সাংখ্যবাদীর পরিণাম একবাক্যতা হইয়া গিয়াছে, এবং এই কারণেই মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [শাং|৩০১|১০৮|১০৯] । “ইতিহাস, পুরাণ অর্থশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতিতে যে কিছু জ্ঞান আছে সে সমস্ত সাংখ্য হইতেই আসিয়াছে” - কপিল হইতে এই জ্ঞান বেদান্তীরা কিংবা পৌরাণিকেরা গ্ৰহণ করিয়াছে এরূপ তাহার অর্থ নহে; কিন্তু সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমের জ্ঞান সর্বত্রই এক প্ৰকার, এই অর্থই এখানে অভিপ্ৰেত । কেবল তাহাই নহে, ‘জ্ঞান’ এই ব্যাপক অর্থেই, এই স্থানে ‘সাংখ্য’ শব্দ প্রয়োগ করা হইয়াছে, এ কথা বলিলেও চলে । কপিলাচাৰ্য শাস্ত্রদৃষ্টিতে সৃষ্টির উৎপত্তিক্রম বিশেষ পদ্ধতিসহকারে বিবৃত করিয়াছেন, এবং ভগবদ্‌গীতাতেও এই সাংখ্যক্রম মুখ্যরূপে স্বীকৃত হওয়ায়, এই প্রকরণে তাহারই বিচার করা হইয়াছে ।


3) আধুনিক উৎক্রান্তিবাদের সহিত সাংখ্যের গুণোৎকর্ষতত্ত্বের সাম্য


ইন্দ্রিয়ের অগোচর অর্থাৎ অব্যক্ত, সূক্ষ্ম একবস্তুমাত্র এবং চারিদিকে অখণ্ডরূপে পরিপূর্ণ এক নিরবয়ব মূল দ্রব্য হইতে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে, সাংখ্যদিগের এই সিদ্ধান্ত পাশ্চাত্যদেশের অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্ৰজ্ঞদিগের শুধু গ্ৰাহ্য নহে, পরন্তু এই মূল দ্রব্যের অন্তৰ্ভুত শক্তির ক্রমশ বিকাশ হইয়া আসিতেছে এবং এই পূর্বাপর ক্রম কিংবা ধারা ছাড়িয়া মাঝখানে উপরি-পড়ার মতন হঠাৎ কিছুই নির্মাণ হয় নাই, ইহাও তাঁহারা এক্ষণে স্থির করিয়াছেন । এই মতকে উৎক্রান্তিবাদ বা বিকাশ-সিদ্ধান্ত বলে । এই সিদ্ধান্ত পাশ্চাত্যরাষ্ট্রে বিগত শতাব্দীতে যখন প্ৰথম আবিষ্কৃত হইল, তখন সেখানে খুব গোলযোগ বাধিয়া গিয়াছিল । খৃষ্টধর্মের পুস্তকসমূহে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, ঈশ্বর পঞ্চ মহাভূত ও জঙ্গমশ্রেণীর প্রত্যেক জাতীয় প্ৰাণীকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্ৰভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এই মতই উৎক্রান্তিবাদ বাহির হহবার পূর্বে সমস্ত খৃষ্টানমণ্ডলী সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিত । তাই, যখন উৎক্রান্তিবাদ এই সিদ্ধান্তকে মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করিল তখন চারিদিক হইতে উৎক্রান্তিবাদের উপর আক্ৰমণ আরম্ভ হইল এবং অদ্যাপি ঐ আক্রমণ অল্পবিস্তর চলিতেছে । তথাপি বৈজ্ঞানিক সত্যের বল অধিক হওয়ায়, সৃষ্টির উৎপত্তিসম্বন্ধে উৎক্রান্তি মতটাই সমস্ত বিদ্বানের নিকট এক্ষণে গ্ৰাহ্য হইতে চলিয়াছে । এই মতানুসারে সৌর জগতে প্ৰথমে একই বস্তুসার সূক্ষ্ম দ্রব্য ভরিয়াছিল; উহার গতি বা উষ্ণতার পরিমাণ ক্ৰমে ক্ৰমে কমিতে লাগিল; তখন উক্ত দ্রব্যের অধিকাধিক সঙ্কোচ হইয়া পৃথ্বীসমেত সমস্ত গ্ৰহ ক্ৰমে ক্ৰমে সৃষ্ট হইল এবং সূর্যই শেষ অবশিষ্ট অংশ রহিল । পৃথিবীও সূর্যের ন্যায় প্ৰথমে এক উষ্ণ গোলক ছিল; কিন্তু যেখানে যেখানে তাহার উষ্ণতা কম হইতে লাগিল সেইখানে সেইখানেই মূল দ্রব্যসমূহের কোন দ্রব্য পাতলা ছিল এবং কোন দ্রব্য ঘন হইয়া, পৃথিবীর উপর বায়ু ও জল এবং তাহার নীচে পৃথিবীর কঠিন জড় গোলার সৃষ্টি হইল; এবং পরে, এই সকল বস্তুর সংমিশ্রণে বা সংযোগে সমস্ত সজীব ও নির্জীব সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে । এই প্রকারে ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্যও ক্রমে ক্ৰমে বৃদ্ধি পাইয়া বৰ্তমান অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে ডার্বিনপ্রভৃতি পণ্ডিতেরা এইরূপ প্রতিদিন করিয়াছেন । 


3.1) আধিভৌতিকবাদী ও অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে মতভেদ


তথাপি আত্মা বলিয়া মূলে পৃথক কোন তত্ত্ব স্বীকার করা যাইবে কি, যাইবে না, এই সম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদী ও অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে এখনও অনেক মতভেদ আছে । হেকেল প্রভৃতি কোন কোন পণ্ডিত জড় হইতেই বাড়িতে বাড়িতে আত্মা ও চৈতন্য উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ স্বীকার করিয়া জড়াদ্বৈত প্ৰতিপাদন করেন; এবং ইহার বিপরীতে ক্যাণ্ট প্রভৃতি অধ্যাত্মজ্ঞানী বলেন যে, জগৎসম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান তাহা আমাদের আত্মার একীকরণ ব্যাপারের ফল হওয়ায় আত্মাকে এক স্বতন্ত্র তত্ত্ব বলিয়া মানিতে হয় । কারণ, বাহ্য জগতের জ্ঞাতা যে আত্মা সেই আত্মা স্বতঃ গোচরীভূত জগতের এক ভাগ কিংবা এই বাহ্য জগৎ হইতেই তাহা উৎপন্ন হইয়াছে এই কথা বলা, - “আপন স্কন্ধের উপরে আপনি বসিতে পারি” - এই কথার ন্যায় তর্কদৃষ্টিতে অসম্ভব । এই কারণেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুই স্বতন্ত্র তত্ত্ব স্বীকৃত হইয়াছে । সারকথা এই যে, আধিভৌতিক জগৎজ্ঞান যতই বাড়ুক না কেন, জাগতিক মূলতত্ত্বের স্বরূপের বিচার সর্বদাই বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসারেই করিতে হইবে, অদ্যাপি পাশ্চাত্য দেশের অনেক বড় বড় পণ্ডিত ইহা প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । কিন্তু এক জড় প্রকৃতি হইতে পরে সমস্ত ব্যক্ত পদাৰ্থ কি ক্রম-অনুসারে নিঃসৃত হইয়াছে, ইহা বিচার করিয়া দেখিলে, পাশ্চাত্য উৎক্রান্তিমত ও সাংখশাস্ত্ৰে বৰ্ণিত প্ৰকৃতির প্রপঞ্চতত্ত্ব, এই উভয়ের মধ্যে বিশেষ কোন ভেদ উপলব্ধ হইবে না । কারণ, অব্যক্ত, সূক্ষ্ম ও একবস্তুসার মূল প্ৰকৃতি হইতেই ক্ৰমে ক্ৰমে (সূক্ষ্ম ও স্থুল) বস্তুবহুল ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ হইয়াছে, এই মুখ্য সিদ্ধান্ত উভয়েরই সমান সম্মত । কিন্তু আধিভৌতিক শাস্ত্রের জ্ঞান এক্ষণে অত্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় সাংখ্যদিগের “সত্ত্ব, রজ, তম” এই তিন গুণের বদলে অর্বাচীন সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞগণ গতি, উষ্ণতা ও আকর্ষণশক্তিকেই প্ৰধান গুণ বলিয়া ধরিয়াছেন । এ কথা সত্য যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই ত্ৰিগুণের ন্যূনাধিক্যের পরিমাণ অপেক্ষা উষ্ণতা কিংবা আকর্ষণশক্তির ন্যূনাধিক্যের ধারণা আধিভৌতিকশাস্ত্রদৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত শীঘ্ৰ বোধগম্য হয় । তথাপি “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” [গী|৩|২৮] এইরূপ যে গুণত্রয়ের বিকাশ কিংবা গুণোৎকর্ষের তত্ত্ব তাহা উভয়দিকেই এক । ঘড়ির পাখা বন্ধ হইয়া গেলে তাহা যেরূপ আস্তে আস্তে খোলা যায়, সেইরূপ সত্ত্ব, রজ ও তম ইহাদের সাম্যাবস্থা হইলে প্রকৃতির ঘড়ি আস্তে আস্তে খুলিয়া চলিতে থাকিলে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ সৃষ্টি হয়, ইহাই হইল - সাংখ্যশাস্ত্রের কথা; এই কথায় ও উৎক্রান্তিবাদে বস্তুত কোন ভেদ নাই । তথাপি খৃষ্টধর্মের ন্যায় গুণোৎকর্ষতত্ত্বকে উপেক্ষা না করিয়া গীতাতে এবং অংশত উপনিষদাদি বৈদিক গ্রন্থেও অদ্বৈত বেদান্ত মতের অবিরোধই স্বীকৃত হইয়াছে; এই ভেদ তাত্ত্বিক ধর্মদৃষ্টিতে মনে রাখিবার যোগ্য ।


4) গুণোৎকর্ষের অথবা গুণ-পরিণামবাদের নিরুপণ



4.1) ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধির উৎপত্তি


ভাল, প্ৰকৃতি-কলিকা-বিকাশের ক্রমসম্বন্ধে সাংখ্যকারের কি মত এখন দেখা যাক্‌ । এই ক্রমকেই গুণোৎকর্ষ কিংবা গুণপরিণামবাদ বলে কোনও কাজ করিবার পূর্বে মনুষ্য উক্ত কাজ করিবে বলিয়া আপন বুদ্ধির দ্বারা নিশ্চয় করিয়া থাকে, কিংবা তাহা করিবার বুদ্ধি বা সঙ্কল্প তাহার প্রথমে হওয়া চাই, ইহা আর কাহাকেও বলিতে হইবে না । অধিক কি, উপনিষদেও এইরূপ বর্ণনা আছে যে, মূল এক পরমাত্মারও “আমি বহু হইব” - এই বুদ্ধি বা সঙ্কল্প হইবার পর, জগৎ উৎপন্ন হইল [ছাং|৬|২|৩; তৈ|২|৩] । এই ন্যায় অনুসারে অব্যক্ত প্রকৃতিও আপনা হইতেই সাম্যাবস্থা ভাঙ্গিয়া পরে ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ করিবে বলিয়া নিশ্চয় করে । নিশ্চয় অর্থাৎ ব্যবসায় এবং তাহা করা বুদ্ধিরই লক্ষণ । তাই প্ৰকৃতিতে ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধিরূপ গুণ প্ৰথমে উৎপন্ন হয়, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । সারকথা, এই যে মনুষ্যের যেরূপ কোন কার্য করিবার বুদ্ধি প্রথমে হয়, সেইরূপ প্রকৃতিরও স্বকীয় বিস্তার করিবার বুদ্ধি প্ৰথমে হওয়া চাই । কিন্তু মনুষ্যপ্ৰাণী সচেতন হওয়া প্ৰযুক্ত, অর্থাৎ সেই স্থলে প্ৰকৃতির বুদ্ধির সহিত সচেতন পুরুষের (আত্মার) সংযোগ প্ৰযুক্ত, মনুষ্যের ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধি মনুষ্য বুঝে, এবং প্রকৃতি স্বয়ং অচেতন অর্থাৎ জড় হওয়া প্ৰযুক্ত, তাহার নিজের বুদ্ধির কোন জ্ঞান থাকে না । এই দুয়ের মধ্যে বিলক্ষণ পার্থক্য আছে । এই পার্থক্য, পুরুষের সংযোগ দ্বারা প্ৰকৃতিতে উৎপন্ন চৈতন্যপ্রযুক্ত হইয়া থাকে; তাহা শুধু জড় বা অচেতন প্ৰকৃতির গুণ নহে । মানবী ইচ্ছার অনুরূপ কিন্তু অস্বয়ংবেদ্যশক্তি জড়পদার্থেও আছে এইরূপ না মানিলে গুরুত্বাকর্ষণ কিংবা রসায়নক্রিয়ার বা লৌহচুম্বকের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ ইত্যাদি গুণসকল কেবল জড় জগতের স্বেচ্ছানির্বাচনের কার্য এ যুক্তি খাটে না । এই কথা অর্বাচীন আধিভৌতিক সূষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞও এক্ষণে বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন । * 
*(Without the assumption of an atomic soul the commonest and the most general phenomena of chemistry are inexplicable. Pleasure and pain, desire and aversion, attraction and repulsion must be common to all atoms of an aggregate; for the movements of atoms which must take place in the formation and dissolution of a chemical compound can be explained only by attributing to them Sensation and Will” - Haeckel in the "Perigenesis of the Plastidule" cited in Martineau’s Types of Ethical Theory, Vol II, P. 399, 3rd Ed.

Haeckel himself explains this statement as follows : “I explicitly stated that I conceived the elementary psychic qualities of sensation and will which may be attributed to atoms, to be unconscious - just as unconscious as the elementary memory, which I in common with the distinguished psychologist Ewald Hering consider to be a common function of all organised matter, or more correctly the living substances” - The Riddle of the Universe, Chap. IX. P. 63, R. P. A. Cheap. Ed.)

আধুনিক সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞদিগের এই মতের প্রতি লক্ষ্য করিলে, প্ৰকৃতিতে প্ৰথম বুদ্ধি উৎপন্ন হয়, সাংখ্যের এই সিদ্ধান্তে আশ্চর্য হইবার কোন কারণ থাকিবে না । প্রকৃতির মধ্যে প্রথম উৎপন্ন এই গুণকে ইচ্ছা হয় তো অচেতন বা অস্বয়ংবেদ্য বা আপনাকে আপনি জানিতে অক্ষম বল, - যাহাই বল না কেন, মনুষ্যের বুদ্ধি ও প্ৰকৃতির বুদ্ধি, এ উভয়ই মূলে সে একই বর্গের অন্তভূর্ক্ত তাহা সুস্পষ্ট; এবং সেইজন্য উহাদের ব্যাখ্যাও, উভয়স্থলে একই প্রকার করা হইয়াছে । এই বুদ্ধিরই – ‘মহৎ, জ্ঞান, মতি, আসুরী, প্ৰজ্ঞা, খ্যাতি,’ প্রভৃতি অন্য নামও আছে । অনুমান হয় যে, তন্মধ্যে মহৎ (পুংলিঙ্গী প্রথমার একবচন মহান্‌ - বড়) এই নাম, প্ৰকৃতি এক্ষণে বড় হওয়ায় তাহার প্রতি প্ৰযুক্ত হইয়াছে কিংবা এই গুণের শ্রেষ্ঠত্ত প্ৰযুক্ত এই নাম দেওয়া হইয়াছে । প্রকৃতির মধ্যে প্রথম উৎপন্ন মহান্‌ কিংবা বুদ্ধিগুণ সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনের মিশ্রণেরই পরিণাম হওয়ায়, প্রকৃতির এই বুদ্ধি দেখিতে এক হইলেও পরে উহা অনেক প্রকারের হইতে পারে । কারণ, এই সত্ত্ব, রজ ও তম গুণ প্ৰথম দৃষ্টিতে তিন হইলেও বিচারদৃষ্টিতে প্ৰতীত হয় যে, উহাদের মিশ্রণে প্ৰত্যেকের পরিমাণ অনন্তরূপে ভিন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত এই তিন হইতেই প্ৰত্যেকগুণের অনন্ত ভিন্ন পরিমাণে উৎপন্ন বুদ্ধির প্রকারও তিন গুণ অনন্ত হইতে পারে । অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন এই বুদ্ধিও প্রকৃতির ন্যায় সূক্ষ্ম । কিন্তু পূৰ্বপ্রকরণে ব্যক্ত ও অব্যক্ত, সূক্ষ্ম ও স্থূল, ইহাদের যে অর্থ বলা হইয়াছে, তদনুসারে এই বুদ্ধি প্ৰকৃতির ন্যায় সূক্ষ্ম হইলেও প্রকৃতির ন্যায় অব্যক্ত নহে - তাহা মনুষ্যের জ্ঞানগম্য হইতে পারে । তাই, এক্ষণে সিদ্ধ হইল যে, ‘ব্যক্ত’ এই মনুষ্যগোচর বৃহৎ পদাৰ্থবর্গের মধ্যে বুদ্ধির সমাবেশ হয়; এবং শুধু বুদ্ধি নহে, বুদ্ধির পরে, প্ৰকৃতির সমস্ত বিকারই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ব্যক্ত বলিয়াই স্বীকৃত হয় । এক মূল প্রকৃতি ব্যতীত কোন তত্ত্বই অব্যক্ত নহে ।


4.2) অহঙ্কারের উৎপত্তি


অব্যক্ত প্ৰকৃতির মধ্যে এই প্রকারে ব্যক্ত ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধি উৎপন্ন হইলেও প্রকৃতি এখনও এক বস্তুসারই রহিয়াছে । এই এক বস্তুপরতা ভাঙ্গিয়া বস্তুপরতা উৎপন্ন হওয়াকেই ‘পৃথকত্ব’ বলে । উদাহরণ যথা - পারা জমির উপর পড়িয়া ছোট ছোট গোলায় পরিণত হওয়া । বুদ্ধির পর, এই পৃথকত্ব বা বহুত্ব উৎপন্ন না হইলে একই প্রকৃতির অনেক পদার্থ হওয়া সম্ভব নহে । বুদ্ধির পরে উৎপন্ন পৃথকত্ব গুণকেই ‘অহঙ্কার’ বলে কারণ, পৃথকত্ব ‘আমি-তুমি’ এই সকল শব্দের দ্বারাই প্ৰথমে ব্যক্ত করা হইয়া থাকে; এবং ‘আমি-তুমি’র অর্থই অহংকার, - অহং অহং (আমি আমি) করা । প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন অহঙ্কার গুণকে ইচ্ছা হয় তো অ-স্বয়ংবেদ্য বা আপনাকে আপনি জানিতে অসমৰ্থ বল । কিন্তু মনুষ্যে প্ৰকটীভূত অহঙ্কার এবং যে অহঙ্কার প্রযুক্ত গাছ, পাথর, জল কিংবা ভিন্ন ভিন্ন মূল পরমাণু একবস্তসার প্রকৃতি হইতে নির্মিত হয়, ইহাদের জাতি একই । প্ৰভেদ এই যে, পাথরের চৈতন্য না থাকায় তাহার ‘অহং'এর জ্ঞান হয় না এবং মুখ না থাকায় ‘আমি পৃথক্‌ তুমি পৃথক্‌’ এইরূপ স্বাভিমানসহকারে সে নিজের পার্থক্য অন্যকে বলিতে পারে না । অন্য হইতে পৃথকরূপে থাকিবার তত্ত্ব অৰ্থাৎ অভিমানের কিংবা অহঙ্কারের তত্ত্ব সকল স্থানেই এক । এই অহঙ্কারকেই তৈজস, অভিমান, ভুতাদি, ধাতুপ্রভৃতিও বলা যায় । অহঙ্কার বুদ্ধিরই এক উপভেদ হওয়া প্ৰযুক্ত বুদ্ধি না হইলে অহঙ্কার উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই অহঙ্কার অন্য একটী গুণ অর্থাৎ বুদ্ধির পরবর্তী এক গুণ ইহা সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক-ভেদে বুদ্ধির ন্যায় অহঙ্কারেরও অনন্ত প্রকার হইয়া থাকে ইহা বলা বাহুল্য । এই প্রকারে পরবর্তী গুণসমূহেরও প্ৰত্যেকের তিন-গুণ অনন্তম্ভেদ । অধিক কি, ব্যক্ত জগতে প্ৰত্যেক বস্তুর এইরূপ অনন্ত সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক ভেদ হইয়া থাকে; এবং এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করিয়াই গীতাতে গুণত্রয়-বিভাগ ও শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ উক্ত হইয়াছে [গী|অ|১৪ ও ১৭] ।


4.3) সেন্দ্ৰিয় এগারো তত্ত্বের ও নিরিন্দ্রিয় পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি


ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও অহঙ্কার এই দুই ব্যক্ত গুণ, মূল সাম্যাবস্থা প্ৰকৃতিতে উৎপন্ন হইলে প্ৰকৃতির একত্ব ভাঙ্গিয়া গিয়া, তাহার অনেক পদার্থ নির্মাণের সূত্রপাত হয় । তথাপি তাহার সূক্ষ্মত্ব অদ্যাপি বজায় আছে । অর্থাৎ নৈয়ায়িকদিগের সূক্ষ্ম পরমাণু এক্ষণে আরম্ভ হয়, এইরূপ বলিলেও চলে । কারণ অহঙ্কার উৎপন্ন হইবার পূর্বে প্রকৃতি অখণ্ড ও নিরবয়ব ছিল । নিছক্‌ বুদ্ধি ও নিছক্‌ অহঙ্কার - বস্তুতঃ দেখিতে গেলে ইহারা কেবল গুণ । তাই, প্ৰকৃতির দ্রব্য হইতে উহারা পৃথক থাকে, উপরি-উক্ত সিদ্ধান্তের এরূপ অর্থ গ্ৰহণ করিতে হইবে না । আসল কথা এই যে, যখন মূল ও নিরবয়ব একই প্রকৃতিতে এই গুণগুলি উৎপন্ন হয়, তখন উহারই বিবিধ ও সাবয়ব-দ্রব্যাত্মক ব্যক্ত রূপ উৎপন্ন হয় । এইপ্ৰকার যখন মূল প্ৰকৃতিতে অহঙ্কারের ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ নির্মাণ করিবার শক্তি আসে তখন পরে উহার বৃদ্ধি দুই শাখায় বিভক্ত হয় । এক শাখা, মনুষ্যপ্ৰভৃতি সেন্দ্ৰিয় প্রাণীগণের সৃষ্টি; এবং দ্বিতীয়, নিরিন্দ্রিয় পদার্থের সৃষ্টি । এই স্থানে ইন্দ্রিয়শব্দে “ইন্দ্রিয়বান্‌ প্ৰাণীদিগের ইন্দ্রিয়ের শক্তি” এই অর্থই বুঝিতে হইবে । কারণ, সেন্দ্রিয় প্ৰাণীদিগের জড়দেহের সমাবেশ জড়ে অর্থাৎ নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টিতে হইয়া থাকে, এবং এই প্ৰাণীদিগের আত্মা ‘পুরুষ’ নামক পৃথক বর্গের ভিতরেই পড়ে । তাই সাংখ্যশাস্ত্রে সেন্দ্রিয় জগতের বিচার করিবার সময় দেহ ও আত্মা ছাড়িয়া কেবল ইন্দ্রিয়েরই বিচার করা হইয়াছে । জগতে সেন্দ্রিয় ও নিরিন্দ্রিয় পদার্থের অতিরিক্ত তৃতীয় পদার্থ থাকা সম্ভব না হওয়ায় অহঙ্কার হইতে দুইয়ের অধিক শাখা বাহির হইতে পারে না ইহা বলিতে হইবে না । তন্মধ্যে নিরিন্দ্রিয় পদার্থ অপেক্ষা ইন্দ্রিয়শক্তি শ্রেষ্ঠ হওয়া, প্ৰযুক্ত ইন্দ্ৰিয়জগতের সাত্ত্বিক অর্থাৎ সত্ত্বগুণের উৎকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন এবং নিরিন্দ্রিয় জগতের তামসিক অর্থাৎ তমোগুণের উৎকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন, এইরূপ নাম আছে । সারকথা এই যে, অহঙ্কায় আপন শক্তির দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন করিতে আরম্ভ করিলে তাহাতেই এক সময় সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ হইয়া একদিকে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয় ও মন মিলিয়া ইন্দ্রিয়জগতের মূলভূত এগারো ইন্দ্ৰিয় এবং অন্যদিকে তমোগুণের উৎকর্ষ হইয়া তাহা হইতে নিরিন্দ্রিয় জগতের মূলভূত পাঁচ তন্মাত্র দ্রব্য উৎপন্ন হয় । কিন্তু প্ৰকৃতির সূক্ষ্মত্ব অদ্যাপি বজায় থাকা প্ৰযুক্ত অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন এই ১৬ তত্ত্বও সূক্ষ্ম হইয়াই থাকে । *
*(ইংরাজি ভাষায় এই অর্থই সংক্ষেপে বলিতে হইলে এইরূপ বলিতে হয় -
The Primeval matter (Prakriti) was at first homogeneous. It resolved (Buddhi) to unfold itself, and by the Principle of differentiation (Ahankara) became heterogeneous. It then, branched off into two sections - one organic (Sendriya) and the other inorganic (Nirindriya). There are eleven elements of the organic and five of the inorganic creation. Purusha or the observer is different from all these and falls under none of the above, categories.)


4.4) তন্মাত্র পাঁচই কেন এবং সূক্ষ্মেন্দ্রিয় এগারোই কেন, তাহার নিরুপণ


শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ - ইহাদের তন্মাত্র, অর্থাৎ মিশ্রণ না হইয়া প্ৰত্যেক গুণের পৃথক পৃথক অতিসূক্ষ্ম মূলস্বরূপ-নিরিন্দ্ৰিয় জগতের মূলতত্ত্ব এবং মনসমেত এগারো ইন্দ্ৰিয় সেন্দ্ৰিয় জগতের বীজ । এই বিষয়ে সাংখ্যশাস্ত্ৰপ্ৰদত্ত উপপত্তি যে, নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলতত্ত্ব পাঁচই বা কেন এবং সেন্দ্ৰিয় সৃষ্টির মূলতত্ত্ব এগারোই বা কেন মানা আবশ্যক হয় তাহা বিচার করিবার যোগ্য বিষয় । অর্বাচীন সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞানী জাগতিক পদার্থের ঘন, তরল ও বায়ুরূপী তিন প্রকার ভেদ করিয়াছেন । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্ৰে পদার্থসমূহের বর্গীকরণ ইহা হইতে ভিন্ন । সাংখ্য বলেন যে জাগতিক সমস্ত পদার্থের জ্ঞান মনুষ্যের পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা হইয়া থাকে; এবং এই জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের রচনায় এইরূপ কিছু বিশেষত্ব আছে যে, এক ইন্দ্রিয়ের একই গুণ জ্ঞানগোচর হইয়া থাকে । চোখে আঘ্রাণ হয় না, কানেও দেখা যায় না; এবং ত্বকের মিষ্টতিক্ত জ্ঞান হয় না, জিহ্বার শব্দ জ্ঞান হয় না; নাক সাদা-কালো বুঝিতে পারে না । পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় ও তাহাদের শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচ বিষয়, এইরূপ যদি স্থির হইয়া থাকে, তবে জগতের সমস্ত গুণ ইহা অপেক্ষা অধিক স্বীকার করিতে পারা যায় না । কারণ, পাঁচ অপেক্ষা অধিক গুণ যদি কল্পনা করাও যায় তাহা হইলে তাহা জানিবার কোন উপায় আমাদের নাই । এই পাঁচ গুণের মধ্যে প্ৰত্যেকের অনেক ভেদ হইতে পারে । উদাহরণ যথা - শব্দ, এই গুণ একই হইলেও ছোট, বড়, কৰ্কশ, ভাঙ্গা চেরা, মধুর কিংবা সঙ্গীতশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে নিষাদ, গান্ধার, ষড়জ ইত্যাদি অথবা ব্যাকরণশাস্ত্ৰ অনুসারে কণ্ঠ্য, তালব্য, ওষ্ঠ্য প্ৰভৃতি এক শব্দেরই অনেক প্রকার ভেদ হইয়া থাকে । রস কিংবা রুচি, ইহারা বস্তুত এক হইলেও তাহারও মধুর, টক্, নোনতা, ঝাল, তিতো কিংবা কষা ইত্যাদি অনেক ভেদ হইয়া থাকে; এবং রূপ একটি গুণ হইলেও, সাদা, কালো, সবুজ, নীল, হলদে, তাঁবাটে এই প্ৰকার অনেক প্রকারেরও হইয়া থাকে । সেইরূপ আবার মিষ্টতা, এই এক বিশিষ্ট রুচির কথা যদি ধর, তাহাতেও আখের মিষ্টতা ভিন্ন, দুধের ভিন্ন, গুড়ের ভিন্ন, চিনির ভিন্ন, এইরূপ তাহারও আবার অনেক ভেদ আছে; এবং পৃথক পৃথক গুণের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণ যদি ধর – এই গুণবৈচিত্র অনন্তপ্রকারে অন্ত হইতে পারে । কিন্তু যাহাই হউক না কেন, পদার্থসকলের মূল গুণ পাঁচ অপেক্ষা কখনই অধিক হইতে পারে না । কারণ, ইন্দ্ৰিয় পাঁচই এবং প্ৰত্যেকের এক এক গুণই বোধগম্য হয় । এইজন্য, কেবলমাত্র শব্দগুণের কিংবা কেবলমাত্র স্পর্শগুণের এইরূপ পৃথক্‌ পৃথক্‌ পদার্থ অর্থাৎ অন্য গুণের মিশ্রণরহিত পদার্থ আমাদের নজরে না আসিলেও মূলে কেবলমাত্র শব্দ, কেবলমাত্র স্পৰ্শ, কেবলমাত্র রূপ, কেবলমাত্র রস ও কেবলমাত্ৰ গন্ধ অর্থাৎ শব্দতন্মাত্র, স্পৰ্শতন্মাত্র, রূপতন্মাত্র, রসতন্মাত্র ও গন্ধতন্মাত্র – এইরূপ মূল প্রকৃতির পাঁচ ভিন্ন ভিন্ন সূক্ষ্ম তন্মাত্ৰবিকার কিংবা দ্রব্য অবশ্যই আছে, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । পঞ্চতন্মাত্র কিংবা তাহা হইতে উৎপন্ন পঞ্চ মহাভূত সম্বন্ধে উপনিষৎকারেরা কি বলেন তাহার বিচার পরে করিয়াছি ।


4.5) সূক্ষ্ম সৃষ্টি হইতে স্থুল বিশেষের উৎপত্তি


নিরিন্দ্রিয় জগতের এইপ্ৰকার বিচার করিয়া উহাতে পাঁচটিমাত্ৰ সূক্ষ্ম মূলতত্ত্ব আছে এইরূপ নির্ধারণ করা হইয়াছে । এবং যখন সেন্দ্ৰিয় জগৎ দেখি, তখনও পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয় ও মন - এই এগারোর অধিক ইন্দ্ৰিয় কাহারও নাই এইরূপ প্ৰতীতি হয় । স্থূল দেহে হস্তপদাদি ইন্দ্ৰিয় স্থূল প্ৰতীত হইলেও ইহাদের মধ্যে প্রত্যেকের মূলে কোনপ্রকার সূক্ষ্ম মূলতত্ত্ব না মানিলে ইন্দ্রিয়সমূহের বিভিন্নতার যথোচিত কারণ বুঝা যায় না । পাশ্চাত্য আধিভৌতিক উৎক্রান্তিবাদে এই সম্বন্ধে খুবই আলোচনা হইয়াছে । এই মতে আদিম ক্ষুদ্রতম গোলাকার জন্তুর ত্বকই একমাত্র ইন্দ্ৰিয়; এবং এই ত্বক হইতে অন্য ইন্দ্ৰিয় ক্ৰমে ক্রমে উৎপন্ন হইয়াছে । উদাহরণ যথা - মূল-জন্তুর ত্বকের সহিত আলোকের সংযোগ হইলে পর চোখ হইল ইত্যাদি । আলোকাদির সংযোগে স্থূল ইন্দ্ৰিয়াদির প্ৰাদুর্ভাব হইয়া থাকে, - আধিভৌতিকবাদীদিগের এই তত্ত্ব সাংখ্যদিগেরও গ্ৰাহ্য । মহাভারতে [শাং|২১৩|১৬] সাংখ্যপ্রক্রিয়ানুসারে ইন্দ্রিয়সমূহের আবির্ভাবের এই প্রকার বর্ণনা আছে :- 
শব্দরাগাৎ শ্রোত্রমস্য জায়তে ভাবিতাত্মনঃ ৷
রূপরাগাৎ তথা চক্ষুঃ ঘ্রাণং গন্ধজিঘৃক্ষয়া ॥
অর্থাৎ “প্রাণীর আত্মায় শব্দ শুনিবার ভাবনা হইলে পর কান, রূপ চিনিবার ইচ্ছার চোখ, এবং গন্ধ আঘ্রাণ করিবার বুদ্ধি হইতে নাক উৎপন্ন হয়” । কিন্তু সাংখ্যেরা এইরূপ বলেন যে, ত্বকের আবির্ভাব প্ৰথমে হইলেও মূল-প্রকৃতিতেই যদি ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্ৰিয় উৎপন্ন হইবার নৈসৰ্গিক শক্তি না থাকে, তবে সজীব জগতের অন্তর্ভূত অত্যন্ত ক্ষুদ্র কীটের চর্মের উপর সূর্যালোকের যতই আঘাত বা সংযোগ হউক না, তাহার চোখ – এবং চোখ শরীরের এক বিশিষ্ট অংশ - কোথা হইতে আসিবে ? ডার্বিনের সিদ্ধান্ত এইমাত্র বলে যে, এক চক্ষুযুক্ত এবং দ্বিতীয় চক্ষুহীন – এই দুই প্রাণী সৃষ্ট হইলে পর, জড়জগতের যুঝাযুঝি বা ঝটাপটিতে চক্ষুযুক্ত প্রাণী অধিককাল টিকিয়া থাকে এবং দ্বিতীয় বিনষ্ট হয় । কিন্তু নেত্ৰাদি ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্ৰিয় প্ৰথমে উৎপন্ন কেন হয়, ইহার উপপত্তি পাশ্চাত্য আধিভৌতিক সৃষ্টিশাস্ত্ৰ, বলেন নাই । সাংখ্যদিগের মত এই যে, এই সমস্ত ইন্দ্ৰিয় এক মূল ইন্দ্ৰিয় হইতেই পরম্পরায় উৎপন্ন না হইয়া, অহঙ্কার প্রযুক্তি প্ৰকৃতির বহুত্ব আরম্ভ হইলে পর, প্ৰথমে সেই অহঙ্কার হইতে পাঁচ সূক্ষ্ম কর্মেন্দ্ৰিয়, পাঁচ সূক্ষ্ম জ্ঞানেন্দ্ৰিয় ও মন মিলিয়া এগারো ভিন্ন ভিন্ন শক্তি বা গুণ, মূল প্রকৃতিতেই যুগপৎ স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্ট হইয়া পরে তাহা হইতে স্থূল সেন্দ্ৰিয় জগৎ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এই এগারটির মধ্যে মন, জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের যোগে সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক কাজ অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় গৃহীত সংস্কারসকলের যোগাযোগ করিয়া বুদ্ধির সম্মুখে নিৰ্গমার্থ স্থাপন করে; এবং কর্মেন্দ্ৰিয়ের যোগে ব্যাকরণাত্মক কাজ অর্থাৎ বুদ্ধিকৃত নির্ণয় কর্মেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কাজে প্রয়োগ করে - এই প্রকারে উহা উভয়বিধ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দুই প্রকারের কাজ করিয়া থাকে, ইহা পূর্বে ষষ্ঠ প্রকরণে কথিত হইয়াছে । উপনিষদেও ইন্দ্ৰিসমূহেরই প্ৰাণ এই নাম দেওয়া হয়; এবং সাংখ্যদিগের মতানুসারে উপনিষৎকারদিগেরও এই মত যে, এই প্ৰাণ পঞ্চ মহাভূতাত্মক না হইয়া পরমাত্মা হইতে পৃথক, উৎপন্ন হইয়াছে [মুণ্ড|২|১|৩] । এই প্রাণের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা উপনিষদে কোথাও সাত, কোথাও দশ, এগার, বার বা তের বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু, উপনিষদের এই সমস্ত বাক্যের একবাক্যতা করিলে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা এগারই সিদ্ধ হয়, বেদান্তসূত্রের ভিত্তিতে শ্ৰীশঙ্করাচার্য ইহাই স্থির করিয়াছেন [বেসু|শাংভা|২|৪|৫|৬]; এবং গীতাতে “ইন্দ্রিয়াণি দশৈকং চ” [গী|১৩|৫] - ইন্দ্রিয় দশ এবং এক অর্থাৎ এগার - এইরূপ স্পষ্টই উক্ত হইয়াছে । অতএব এই বিষয়ে সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুই শাস্ত্ৰেই কোন মতভেদ নাই ।

সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্তের সারাংশ এই যে, সেন্দ্ৰিয় জগতের মূলভূত এগায় ইন্দ্ৰিয়াশক্তি বা গুণ সাত্ত্বিক অহংকার হইতে উৎপন্ন হয়; এবং নিরিন্দ্রিয়-জগতের মূলভূত পাঁচ তন্মাত্র দ্রব্য তামস অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন হয়; পরে পঞ্চতন্মাত্র দ্রব্য হইতে ক্ৰমান্বয়ে স্থূল পঞ্চমহাভূত (ইহার ‘বিশেষ’ এইরূপ নামও আছে) এবং স্থূল নিরিন্দ্রিয় পদাৰ্থ উৎপন্ন হইয়া থাকে, এবং এই পদার্থসমূহের সহিত যথাসম্ভব এগার সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হইলে সেন্দ্ৰিয় জগৎ সৃষ্ট হয় ।


5) পঁচিশ তত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ


সাংখ্যমতে প্ৰকৃতি হইতে আবিভূর্ত তত্ত্বসমূহের ক্রম - যাহার বর্ণনা এতক্ষণ করা হইয়াছে - নিম্নপ্রদত্ত বংশবৃক্ষ হইতে স্পষ্ট দৃষ্ট হইবে –
ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ

6) সাংখ্যের ব্রহ্মবৃক্ষ এবং গীতার অশ্বত্থ-বৃক্ষ


স্থূল পঞ্চ-মহাভূত ও পুরুষ ধরিয়া সর্ব-সমেত ২৫ তত্ত্ব । ইহার মধ্যে মহান্‌ কিংবা বুদ্ধি হইতে পরবর্তী ২৩ গুণ-মূল প্রকৃতির বিকার । কিন্তু তাহার মধ্যেও এই প্ৰভেদ যে, সূক্ষ্ম তন্মাত্র ও পাঁচ স্থূল মহাভূত, এ সকল দ্রব্যাত্মক বিকার; এবং বুদ্ধি, অহঙ্কার ও ইন্দ্ৰিয়, ইহারা কেবল শক্তি বা গুণ; এই ২৩ তত্ত্ব ব্যক্ত এবং মূল প্রকৃতি অব্যক্ত । এই ২৩ তত্ত্বের মধ্যে সাংখ্য আকাশেই দিক্‌ ও-কালেরও সমাবেশ করিয়া থাকেন । প্রাণকে পৃথক্‌ স্বীকার না করিয়া, যখন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার শুরু হয় তখন উহাদিগকেই সাংখ্য প্ৰাণ বলেন [সাং|কা|২৯] । কিন্তু বেদান্তী এ মত স্বীকার করেন না, তাঁহারা প্রাণকে স্বতন্ত্র তত্ত্ব বলিয়া বুঝেন [বেসু|২|৪,৯] । ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, সাংখ্যেরা যেরূপ বলেন যে, প্ৰকৃতি ও পুরুষ উভয়ই স্বয়ম্ভূ ও স্বতন্ত্র, বেদান্তীরা তাহা না বলিয়া উভয়কে এক পরমেশ্বরেরই দুই বিভূতি বলিয়া মানিয়া থাকেন । সাংখ্য ও বেদান্ত ইহাদের মধ্যে এই ভেদ বাদে বাকী জগদুৎপত্তিক্রম উভয়েরই গ্রাহ্য । উদাহরণ যথা - মহাভারতের অনুগীতায় ‘ব্ৰহ্মবৃক্ষ’ কিংবা ‘ব্ৰহ্মবন’ - ইহাদের যে দুইবার বর্ণন আছে [মভা|অশ্ব|৩৫|২০-২৩; ৪৭|১২-১৫] তাহা সাংখ্যদিগের তত্ত্ব অবলম্বন করিয়াই করা হইয়াছে - 
অব্যক্তবীজপ্রভবো বুদ্ধিস্কন্ধময়ো মহান্‌ ৷
মহাহংকারবিটপ ইন্দ্ৰিয়ান্তরকোটরঃ ॥
মহাভূতবিশাখশ্চ বিশেষপ্রতিশাখবান্‌ ৷
সদাপর্ণঃ সদাপুস্পঃ শুভাশুভফলোদয়ঃ ॥
আজীব্যঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মবৃক্ষঃ সনাতনঃ ৷
এনং ছিত্বা চ ভিত্ত্বা চ তত্ত্বজ্ঞানাসিনা বুধঃ ॥
হিত্বা সঙ্গময়ান্‌ পাশান্‌ মৃত্যুজন্মজরোদয়ান্‌ ৷
নির্মমো নিরহঙ্কারো মুচ্যতে নাত্ৰ সংশয়ঃ ॥
অর্থাৎ “অব্যক্ত (প্ৰকৃতি) যাহার বীজ, বুদ্ধি (মহান্‌) যাহার স্কন্ধ, অহঙ্কার যাহার মুখ্য পল্লব, মন ও দশ ইন্দ্রিয় যাহার ভিতরকার কোটর, সূক্ষ্ম মহাভূত (পঞ্চতন্মাত্র) যাহার বড় বড় শাখা এবং বিশেষ অর্থাৎ স্থূল মহাভূত যাহার ছোট ছোট ডাল-পালা, এইরূপ সদা-পুষ্পপত্ৰধারী ও শুভাশুভফলধারী, সমস্ত প্ৰাণীমাত্রের আধারভূত পুরাতন বৃহৎ ব্ৰহ্মবৃক্ষ । ইহাকে তত্ত্বজ্ঞানরূপ তরবারির দ্বারা ছেদন করিয়া, ও টুকরা টুকরা করিয়া, জ্ঞানী পুরুষ জন্ম, জরা ও মৃত্যুর সঙ্গময় পাশকে ছিন্ন করিবেন এবং মমত্ববুদ্ধি ও অহঙ্কার ত্যাগ করিবেন, তাহা হইলেই তিনি মুক্ত হইবেন, ইহাতে সংশয়মাত্ৰ নাই ।” সংক্ষেপে এই ব্ৰহ্মবৃক্ষই “সংসারের লীলা” কিংবা প্ৰকৃতির বা মায়ার ‘প্ৰপঞ্চ’ । ইহাকে ‘বৃক্ষ’ বলিবার রীতি বহু প্ৰাচীনকাল - ঋগ্বেদের কাল - হইতেই চলিয়া আসিয়াছে; ইহাকেই উপনিষদে ‘সনাতন অশ্বত্থ বৃক্ষ’ বলা হইয়াছে [কঠ|৬|১] । কিন্তু বেদে এই বৃক্ষের মুল (পরব্রহ্ম) উপরে এবং শাখা (দৃশ্য জগতের বিস্তার) নীচে, এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে । এই বৈদিক বর্ণনা এবং সাংখ্যদিগের তত্ত্ব, ইহাদিগকে একত্র জুড়িয়া গীতায় অশ্বত্থ বৃক্ষের বর্ণনা রচিত হইয়াছে, ইহা গীতার, ১৫|১ ও ২ শ্লোকসম্বন্ধীয় আমার টীকাতে স্পষ্ট করিয়া দেখান হইয়াছে ।


7) পঁচিশ তত্ত্বের বর্গীকরণ



7.1) সাংখ্যের বর্গীকরণের রীতি


সাংখ্য ও বেদান্তী উপরি-প্রদত্ত পঁচিশ তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে বৰ্গীকরণ করা প্ৰযুক্ত, এই বৰ্গীকরণ সম্বন্ধেও কিঞ্চিৎ বিবরণ এখানে দেওয়া আবশ্যক । সাংখ্য বলেন যে, এই পঁচিশ তত্ত্বের মূল-প্রকৃতি, প্রকৃতি-বিকৃতি, বিকৃতি এবং অ-প্রকৃতি-অ-বিকৃতি এই চারি বর্গ । (1) প্রকৃতিতত্ত্ব অন্য কাহা হইতে উৎপন্ন হয় নাই বলিয়া উহা মূলপ্রকৃতি এই নাম প্ৰাপ্ত হইয়াছে । (2) এই মূলপ্রকৃতি ছাড়িয়া অন্য ভিত্তির উপর আসিলে “মহান্‌” তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় । এই মহান্‌ তত্ত্ব প্রকৃতি হইতে নিঃসৃত বলিয়া ‘মহান্‌’ অহঙ্কারের প্রকৃতি বা মূল । এই প্রকারে মহান্‌ অথবা বুদ্ধি একপক্ষে অহঙ্কারের প্রকৃতি বা মূল; এবং অন্যপক্ষে মূল প্রকৃতির বিকৃতি কিংবা বিকার । তাই সাংখ্যেরা তাহাকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি এই বর্গের মধ্যে ফেলিয়াছে; এবং এই ন্যায়-অনুসারে অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্ৰ, ইহাদের সমাবেশও ‘প্ৰকৃতি-বিকৃতি’ এই বর্গের মধ্যেই করিতে পারা যায় । যে তত্ত্ব বা গুণ স্বয়ং অন্য হইতে নিঃসৃত (বিকৃতি) হইবার পরে নিজেই অন্য তত্ত্বের মূলভূত (প্রকৃতি) হয়, তাহাকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি’ বলা যায় । এই বর্গের সাত তত্ত্ব – মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র । (3) কিন্তু পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয়, মন এবং স্থূল পঞ্চ মহাভূত এই ষোল তত্ত্ব হইতে পরে অন্য কোন তত্ত্বই নিঃসৃত হয় নাই । উল্টা, তাহাই অন্য তত্ত্ব হইতে নিঃসৃত হইয়াছে । তাই, এই ষোল তত্ত্বকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি’ না বলিয়া কেবল ‘বিকৃতি’ কিংবা ‘বিকার’ বলা হয় । (4) পুরুষ প্ৰকৃতিও নহে এবং বিকৃতিও নহে; উহা স্বতন্ত্র ও উদাসীন দ্রষ্টা । ঈশ্বরকৃষ্ণ এইরূপ বর্গীকরণ করিয়া আবার উহার এইরূপে স্পষ্টীকরণ করিয়াছেন :-
মূলপ্ৰকৃতিরবিকৃতিঃ মহদাদ্যাঃ প্রকৃতি-বিকৃতয়ঃ সপ্ত ৷
ষোড়শকন্তু বিকারো ন প্ৰকৃতি র্ন বিকৃতিঃ পুরুষঃ ॥
অর্থাৎ - “এই মূল প্ৰকৃতি অবিকৃতি অর্থাৎ কোনরূপ বিকার নহে । মহদাদি সাত (অর্থাৎ মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র) তত্ত্ব প্ৰকৃতি-বিকৃতি; এবং মনসমেত এগার ইন্দ্ৰিয় ও স্থূল পঞ্চ মহাভূত মিলাইয়া ষোল তত্ত্বকে শুধু বিকৃতি কিংবা বিকার বলা হয় । পুরুষ প্ৰকৃতি নহে এবং বিকৃতিও নহে” [সাং|কা|৩] । পরে এই পঞ্চবিংশ তত্ত্বের আবার অব্যক্তব্যক্ত ও জ্ঞ এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । তন্মধ্যে এক মূল প্রকৃতিই অব্যক্ত, প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন তেইশ তত্ত্ব ব্যক্ত, এবং পুরুষ জ্ঞ । সাংখ্যদিগের বর্গীকরণের ইহাই ভেদ । পুরাণ, স্মৃতি, মহাভারত প্রভৃতি বৈদিকমার্গীয় গ্ৰন্থসমূহে প্ৰায় এই পঁচিশ তত্ত্বই কথিত হইয়া থাকে [মৈক্র্য|৬|১০; মনু|১|১৪|১৫ দেখ] । কিন্তু উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে যে, এই সমস্ত তত্ত্ব পরব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; কিন্তু তাহাতে উহাদের বিশেষ বিচার বা বর্গীকরণও করা হয় নাই । উপনিষদের পরবর্তী গ্রন্থাদিতে মাত্র উহাদের বর্গীকরণ করা হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু উপরিউক্ত সাংখ্যদিগের বর্গীকরণ হইতে তাহা ভিন্ন । সমস্ত ধরিয়া পঁচিশ তত্ত্ব; তন্মধ্যে ষোল তত্ত্ব (11 ইন্দ্রিয় + 5 মহাভূত) সাংখ্য মতানুসারেই স্পষ্টই অন্য তত্ত্ব হইতে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত বিকার বলিয়া তাহাকে প্রকৃতি কিংবা মূলভূত পদার্থ বর্গের মধ্যে ধরা হয় নাই । বাকী নয় তত্ত্ব অবশিষ্ট রহিল – (1)পুরুষ, (2)প্রকৃতি, (3)মহৎ, (4)অহঙ্কার, ও (5-9) পাঁচ তন্মাত্র । ইহার মধ্যে পুরুষ ও প্রকৃতিকে ছাড়িয়া, দিয়া, সাংখ্য বাকী সাতকে প্ৰকৃতি-বিকৃতি বলেন । 


7.2) বেদান্তীদিগের ও গীতার বর্গীকরণের রীতি


কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র স্বীকৃত হয় না; এক পরমেশ্বর হইতেই পুরুষ ও প্রকৃতি উৎপন্ন হয় এই রূপ তাঁহাদের সিদ্ধান্ত । এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করিলে মূলপ্রকৃতি ও প্রকৃতি-বিকৃতি, এই যে ভেদ সাংখ্য করেন তাহার অবকাশ থাকে না । কারণ, প্রকৃতিও পরমেশ্বর হইতে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত তাহাকে মূল বলা যাইতে পারে না, তাহা প্রকৃতি-বিকৃতির বর্গের মধ্যেই আইসে । তাই সৃষ্টি উৎপত্তি বৰ্ণনা করিবার সময় বেদান্তী বলেন যে, এক পরমেশ্বর হইতেই এক পক্ষে জীব ও অন্য পক্ষে (মহদাদি সাত প্ৰকৃতি-বিকৃতিসহ) অষ্টধা অর্থাৎ আট প্রকারের প্রকৃতি নির্মিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩০৬|২৯ ও ৩১০|১০ দেখ] । অর্থাৎ বেদান্তীদিগের মতে পঁচিশ তত্ত্বের মধ্যে ষোল তত্ত্ব ছাড়িয়া দিয়া বাকী নয় তত্ত্বের ‘জীব’ ও ‘অষ্টধা প্ৰকৃতি’ এই দুই প্ৰকার বর্গীকরণই হইয়া থাকে । বেদান্তীদিগের এই বৰ্গীকরণ ভগবদ্‌গীতাতে স্বীকৃত হইয়াছে । কিন্তু ইহাতেও শেষে একটু পার্থক্য ঘটিয়াছে । সাংখ্য যাহাকে পুরুষ বলেন তাহাকেই গীতায় জীব বলা হয়; এবং জীবই ঈশ্বরের পরা প্ৰকৃতি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ স্বরূপ এইরূপ উক্ত হইয়াছে, এবং সাংখ্য যাহাকে মূল প্রকৃতি বলেন তাহাকেই গীতাতে পরমেশ্বরের ‘অপর’ অর্থাৎ কনিষ্ঠ স্বরূপ বলা হইয়াছে [গী|৭|৪,৫] । এই প্রকার প্রথমে দুই বৃহৎ বর্গ করিবার পর, উহার মধ্যে দ্বিতীয় বর্গের অর্থাৎ কনিষ্ঠ স্বরূপের পরবর্তী ভেদ কিংবা প্রকার যেখানে বলতে হইবে সেখানে এই কনিষ্ট স্বরূপের অতিরিক্ত ও তাহা হইতে নিঃসৃত বাকী তত্ত্ব বিবৃত করা আবশ্যক । কারণ, এই কনিষ্ঠ স্বরূপ (অৰ্থাৎ সাংখ্যদিদের মূলপ্রকৃতি) স্বয়ং আপনারই এক প্রকার বা ভেদ হইতে পারে না । উদাহরণ যথা, বাপের কত ছেলে যখন বলিতে হয় তখন তাহার মধ্যে বাপকে গণনা করা যাইতে পারে না । তাই, পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপের ভেদ কত হইয়াছে তাহা বলিবার সময় বেদান্তীরা অষ্টধা প্রকৃতির মধ্যে মূলপ্রকৃতিকে ছাড়িয়া দেওয়ায় বাকী মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটী সেই মূলপ্রকৃতির ভেদ কিংবা প্রকার বলিতে হয় । কিন্তু এইরূপ করিলে পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপ বা মূল প্রকৃতি সাত প্ৰকার বলিতে হয়; এবং উপরে বলা হইয়াছে যে, বেদান্তী প্ৰকৃতিকে অষ্টধা অর্থাৎ আট প্রকারের বলিয়া স্বীকার করেন । বেদান্তী যে প্ৰকৃতিকে আট প্রকারের বলেন, গীতা কি তাহাকেই সাত প্ৰকারের বলেন - এই স্থানে এই বিরোধ দেখা যায় । এই বিরোধ না রাখিয়া ‘অষ্টধা প্ৰকৃতি’র বর্ণনাকেই বজায় রাখা গীতার অভীষ্ট । তাই মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই সাতের মধ্যেই অষ্টম তত্ত্ব মনকে পুরিয়া দিয়া পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপ অর্থাৎ মূল প্রকৃতিকে অষ্টধা করিয়াই গীতায় বর্ণিত হইয়াছে [গী|৭|৫] । তন্মধ্যে মনের ভিতরেই দশ ইন্দ্রিয়ের এবং পঞ্চতন্মাত্রের মধ্যে পঞ্চ মহাভূতের সমাবেশ করা হইয়াছে । এখন ইহা প্রতীত হইবে যে, গীতার বর্গীকরণ সাংখ্যদিগের ও বেদান্তীদিগের বর্গীকরণ হইতে ভিন্ন দেখিতে হইলেও সমস্ত তত্ত্বগুলির সংখ্যা তৎপ্রযুক্ত ন্যূনাধিক হয় না । স্বীকৃত হইয়াছে, তত্ত্ব সর্বত্র পঞ্চবিংশতিই । তথাপি বর্গীকরণের উক্ত ভিন্নতার কারণে পাছে ভ্ৰমে পড়িতে হয় বলিয়া এই তিন বর্গীকরণ কোষ্টকের আকারে একত্র করিয়া পরে দেওয়া হইয়াছে । গীতার ১৩ অধ্যায়ে [১৩|৫] বৰ্গীকরণের বিষয় বলিবার সময় সাংখ্যদিগের পঁচিশ তত্ত্ব যেমনটি তেমনিই পৃথক্‌ পৃথক্‌ বর্ণিত হইয়াছে; এবং তাহা ধরিয়া বৰ্গীকরণ ভিন্ন হইলেও দুই স্থানেই তত্ত্বসংখ্যা একই - ইহা স্পষ্ট দেখা যায় ।
পঁচিশ তত্ত্বের বর্গীকরণ

8) বেদান্তগ্রন্থে বর্ণিত স্থূল পঞ্চ মহাভুতের উৎপত্তিক্রম


যাক্‌ এই পৰ্যন্ত বিচার করা হইয়াছে যে, মূল সাম্যাবস্থায় অবস্থিত একমাত্র নিরবয়ব অব্যক্ত জড় প্ৰকৃতিতে ব্যক্ত সৃষ্টি উৎপন্ন করিবার অস্বয়ংবেদ্য বুদ্ধি কিরূপে প্রকট হইল; আবার ‘অহঙ্কার’ দ্বারা সেই প্ৰকৃতির মধ্যেই সাবয়ব বহুবস্তুত্ব কিরূপে আসিল; এবং পরে ‘গুণ হইতে গুণ’, এই গুণপরিণামবাদ অনুসারে একপক্ষে সাত্ত্বিক অর্থাৎ সেন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলভূত সূক্ষ্ম এগার ইন্দ্রিয় এবং অপর পক্ষে তামসিক অর্থাৎ নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলভূত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্র কিরূপে নির্মিত হইল । এখন ইহার পরবর্তী সৃষ্টি অর্থাৎ স্থূল পঞ্চমহাভূত বা তাহা হইতে উৎপন্ন অন্য জড়পদার্থ কি ক্রম-অনুসারে নির্মিত হইল, তাহার ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । সূক্ষ্ম-তন্মাত্র হইতেই ‘স্থূল পঞ্চ মহাভূত’ অথবা ‘বিশেষ’, গুনপরিণামে উৎপন্ন হইয়াছে, ইহাই সাংখ্যশাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু বেদান্তশাস্ত্রসম্বন্ধীয় গ্ৰন্থাদিতে এ প্রশ্নের অধিক বিচার করা প্ৰযুক্ত প্রসঙ্গক্রমে তাহারও সংক্ষেপে বর্ণন - এই সুচনারই সঙ্গে ইহা যে বেদান্তশাস্ত্রের মত, সাংখ্যদিগের নহে – করা আবশ্যক মনে হয় । ‘স্থূল পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ, ইহাদিগকে পঞ্চ মহাভূত বা বিশেষ বলে । ইহাদের উৎপত্তিক্রম তৈত্তিরীয় উপনিষদে এইরূপ প্রদত্ত হইয়াছে যে - “আত্মনঃ আকাশঃ সম্ভূতঃ । আকাশাদ্‌ বায়ুঃ । বায়োরগ্নিঃ । অগ্নেরাপঃ । অদ্ভ্যঃ পৃথিবী । পৃথিব্যা ওষধয়ঃ । ইত্যাদি” [তৈ|উ|২|১] – অর্থাৎ প্ৰথমে পরমাত্মা হইতে (সাংখ্যদের কথামত জড় মূল প্ৰকৃতি হইতে নহে) আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে অগ্নি, অগ্নি হইতে জল এবং জল হইতে পরে পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে । তৈত্তিরীয় উপনিষদে এই ক্রমের কারণ কি তাহা কথিত হয় নাই । কিন্তু উত্তর-বেদান্তগ্রন্থসমূহে পঞ্চমহাভূতের উৎপত্তিক্রমের কারণ-বিচার সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত গুণপরিণামের তত্ত্বের উপরেই করা হইয়াছে দেখা যায় । এই উত্তরবেদান্তীগণ বলেন যে, “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” এই ন্যায় অনুসারে প্রথমে একই গুণের পদার্থ উৎপন্ন হইয়া তাহা হইতে দুই গুণের, তিন গুণের পদার্থ উৎপন্ন হইতে হইতে ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে । পঞ্চমহাভূতের মধ্যে আকাশের শব্দ এই একই মুখ্য গুণ থাকা প্ৰযুক্ত আকাশ প্ৰথমে উৎপন্ন হইল । তাহার পর বায়ু; কারণ, বায়ুর শব্দ ও স্পর্শ এই দুই গুণ আছে । বারটা বাজিলে শুধু শোনা যায় নহে, উহা স্পর্শেন্দ্ৰিয়েরও গোচর হয় । বায়ুর পর অগ্নি । কারণ, শব্দ ও স্পর্শ এই দুই ছাড়া অগ্নিতে রূপ, এই তৃতীয় গুণ আছে । এই তিন গুণের সঙ্গেই রুচি বা রস, ইহা জলের চতুর্থ গুণ হওয়া প্ৰযুক্ত অগ্নির পরে জল হওয়া আবশ্যক; এবং শেষে পৃথিবীতে এই চারিগুণ অপেক্ষা গন্ধ এই গুণটি বিশেষ হওয়া প্ৰযুক্ত জল হইতে পরে পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ সিদ্ধ হয় । যাস্ক এই সিদ্ধান্তই দিয়াছেন [নিরুক্ত|১৪|৪] । 


9) পঞ্চীকরণ ও চুরাশি লক্ষ জীবযোনি


স্থূল পঞ্চ মহাভূত এই ক্ৰম-অনুসারে উৎপন্ন হইলে পর “পৃথিব্যা ওষধয়ঃ । ওষধিভ্যোহন্নম্‌ । অন্নাৎ পুরুষঃ” [তৈ|২|১] । অর্থাৎ - পৃথিবী হইতে বনস্পতি, বনস্পতি হইতে অন্ন, এবং অন্ন হইতে পুরুষ উৎপন্ন হইল, - এইরূপ তৈত্তিরীয়োপনিষদেও পরে বর্ণিত হইয়াছে । এই সৃষ্টি পঞ্চমহাভূতের মিশ্রণে উৎপন্ন হওয়ায় সেই মিশ্ৰণক্রিয়াকে বেদান্তগ্রন্থে ‘পঞ্চীকরণ’ এই নাম প্রদত্ত হইয়াছে । পঞ্চীকরণের অর্থে “পাঁচ মহাভূতের মধ্যে প্রত্যেকের ন্যূনাধিক অংশ লইয়া সেই সমস্তের মিশ্রণে নূতন পদার্থ প্ৰস্তুত হওয়া” । এই পঞ্চীকরণ কাজেই অনেক প্রকারের হইতে পারে । শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামী “দাসবোধ” গ্রন্থে এই কথারই সমর্থন করিয়া বৰ্ণন করিয়াছেন -
কালেঁ পাঁঢরে মেলবিতাঁ । পাববেঁ হোতেঁ তত্ত্বত ।
কালেঁ পিবলেঁ মেলবিতাঁ । হিববেঁ হোয় ॥
অর্থাৎ “কালো ও সাদা মিলিয়া নীল রং হয়, কালো হল্‌দে মিশিয়া সবুজ রং হয় ।” দাসবোধের নবম দশকে [দা|৯|৬|৪০] এইরূপ বলিয়া তেরো দশকে [দা|১৩|৩|১০-১৫] –
ত্যা ভূগোরাচে পোটী । অনন্ত বীজাঁচিয়া কোটী ৷
পৃথ্বী মান্যা হোতাঁ ভেটী । অঙ্কুর নিবতী ॥
পৃথ্বী বল্লী নানা রঙ্গ । পত্ৰেঁ পুষ্পাঁচে তরঙ্গ ।
নানা স্বাদ তে মগ । ফলেঁ জালীঁ ॥
* * *
অণ্ডজ, জারজ, স্বেদজ উদ্ভীজ ।
পৃথ্বী পানী সকলাচে বীজ ঐসে হে মরম চীজ । সৃষ্টি বচনেচে ॥
চারি খানী চরি বাণী । 
চৌর‍্যাশী লক্ষ জীব যোনী
নির্মাণ ঝালে লোক তিহ্নী । পিণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড ॥
অর্থাৎ — সেই ভূগোলের উদরে অনন্ত কোটি বীজ রহিয়াছে । মাটির সহিত মিলন হইয়া অঙ্কুরের উৎপত্তি হয় । পৃথিবীতে লতার নানা রঙ্গ, পত্রপুষ্পের তরঙ্গ । তারপর নানা আস্বাদের নানা ফল । অণ্ডজ, জারজ, স্বেদজ উদ্ভিদ - পৃথ্বী ও জল সকলের বীজ । এই সৃষ্টি-রচনা আশ্চর্য । এই প্রকার চারি খণ্ড, চারি বাণী, চুরাশি লক্ষ * জীবযোনি, তিন লোক, পিণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড নির্মিত হয় । কিন্তু পঞ্চীকরণের দ্বারা শুধু জড় পদার্থ কিংবা জড় দেহই উৎপন্ন হয় । এই জড় দেহের সচেতন প্ৰাণী হইতে হইলে প্ৰথমে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়ের সহিত এবং পরে আত্মার সহিত অর্থাৎ পুরুষের সহিত তাহার সংযোগ হওয়া আবশ্যক ইহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না ।
*(চৌরাশী লক্ষ যোনির কল্পনা পৌরাণিক হওয়ায় ইহা আনুমানিক স্পষ্টই দেখা যাইতেছে তথাপি ইহা একেবারেই ভিত্তিহীন নহে । পাশ্চাত্য আধিভৌতিকশাস্ত্রী উৎক্রান্তিবাদ-অনুসারে সৃষ্টির আরম্ভে উৎপন্ন এক ক্ষুদ্র গোল সজীব জন্তু হইতে মনুষ্য প্ৰাণী উৎপন্ন হষ্টয়াছে, এইরূপ মানেন । এই কল্পনা অনুসারে সূক্ষ্ম গোল জন্তু হইতে স্থূল গোল জন্তুর উৎপত্তি, এই স্থূল জন্তু হইতে পুনরায় ক্ষুদ্র কীটের উৎপত্তি, ক্ষুদ্র কীট হইতে তাহার পরবর্তী প্রাণীর উৎপত্তি; প্ৰত্যেক যোনি অর্থাৎ জাতির মধ্যে এইরূপ অনেক ধাপ চলিয়া গিয়াছে, স্পষ্টই দেখা যাইতেছে । এই সম্বন্ধে এক ইংরেজ জীবশাস্ত্ৰজ্ঞ এইরূপ গণনা করিয়াছেন যে, জলের ক্ষুদ্ৰ মৎসদিগের গুণধর্ম বাড়িতে বাড়িতে তাহাদের মনুষ্যের স্বরূপ প্রাপ্ত হইবার পূর্বে মধ্যবর্তী বিভিন্ন জাতির মোট সংখ্যা ৫৩ লক্ষ ৭৫ হাজার ধাপ চলিয়া গিয়াছে; এবং কখনও বা এই সংখ্যার দশগুণও হইতে পারে । জলের ক্ষুদ্ৰ জলচর হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত এই যোনি উৎপন্ন হয় । ইহার মধ্যেও ক্ষুদ্র জলচরের পূর্ববর্তী সজীব জন্তু ধরিলে আরো কত লক্ষ বংশ ধরিতে হয় তাহার কল্পনাও করা যায় না । ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে আমাদের পুরাণের চৌরাশী লক্ষ যোনির কল্পনা অপেক্ষা আধিভৌতিক শাস্ত্রের পৌরাণিক বংশকল্পনা কত বাড়িয়া গিয়াছে । কালের কল্পনা সম্বন্ধেও এই ন্যায়ই প্রযুক্ত হইতে পারে । সজীব জগতের সূক্ষ্ম জন্তু এই পৃথিবীতে কখন্‌ উৎপন্ন হইল, স্থূল পরিমাণেও তাহা নিশ্চয় করিতে না পারায় সূক্ষ্ম জলচরের উৎপত্তিও কোটি বৎসর পূর্বে হইয়াছে এইরূপ ভূগর্ভগত জীবশাস্ত্রজ্ঞেরা বলেন । এই সম্বন্ধে সংক্ষেপে জ্ঞানলাভ করিতে হইলে “The Last Link” by Ernst Haeckel with notes & c by Dr. Gadow (1898) এই পুস্তক দেখিবে । এই পুস্তকে ডঃ গাডো যে দুই তিন উপযুক্ত পরিশিষ্ট যোজিত করিয়াছেন তাহাতে উপরি-উক্ত অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় আছে । পুরাণের চৌরাশী লক্ষ যোনির হিসাব এই প্রকারে করা হইয়াছে - ৯ লক্ষ জলচর, ১০ লক্ষ পক্ষী, ১১ লক্ষ কৃমি, ২০ লক্ষ পশু, ৩০ লক্ষ স্থাবর ও ৪ চার লক্ষ মনুষ্য [দাস|২০|৬ দেখ])


10) ত্রিবৃৎকরণের সহিত পঞ্চীকরণের তুলনা


উত্তর বেদান্ত-গ্ৰন্থসমূহে বর্ণিত এই পঞ্চীকরণ প্ৰাচীন উপনিষদের নহে ইহাও এখানে বলা আবশ্যক । পঞ্চতন্মাত্র বা পাঁচ মহাভূত স্বীকার না করিয়া ছান্দোগ্যোপনিষদে ‘তেজ, জল ও অন্ন (পৃথ্বী)’ এই তিন সূক্ষ্ম মূলতত্ত্বের মিশ্রণ অর্থাৎ ‘ত্ৰিবিৎকরণ’ হইতে বিবিধ সৃষ্টি উৎপন্ন হইল এইরূপ বৰ্ণনা আছে । এবং “অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ” [শ্বেতা|৪|৫] অর্থাৎ - লাল বা তেজরূপী, সাদা বা জলরূপী এবং কালো বা পৃথ্বীরূপী, এই তিন রং-বিশিষ্ট তিন তত্ত্বের এক যে প্ৰজা (সৃষ্টি) উৎপন্ন হইয়াছে - এইরূপ শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে উক্ত হইয়াছে । ছান্দোগ্যোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্বেতকেতু ও তাঁহার পিতার সংবাদ (কথোপকথন) প্রদত্ত হইয়াছে । তাহার আরম্ভেই শ্বেতকেতুকে তাহার পিতা স্পষ্ট বলিতেছেন যে, “বৎস ! জগতের আরম্ভে ‘একমেবাদ্বিতীয়ং সৎ’ ব্যতীত অর্থাৎ যথা তথা সমস্ত একবস্তুময় ও নিত্য পরব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই ছিল না । যাহা অসৎ (অর্থাৎ ‘নাই’) তাহা হইতে সৎ কিরূপে উৎপন্ন হইবে ? তাই আরম্ভে সৎ-ই সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল । তাহার পর, উহা, অনেক অর্থাৎ বহু বস্তু হইবে মনে করাতে তাহা হইতে ক্ৰমে সূক্ষ্ম তেজ (অগ্নি), জল, ও পৃথিবী উৎপন্ন হইল । তাহার পর এই তিন তত্ত্বের মধ্যেই জীবরূপে পরব্রহ্ম প্ৰবেশ করিলে, তাহাদের ত্ৰিবিৎকরণের দ্বারা জগতের অনেক নাম রূপাত্মক বস্তু নির্মিত হইল । স্থূল অগ্নি, সূর্য বা বিদ্যুৎ ইহাদের জ্যোতিতে যে তাম্র (লোহিত) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম তেজোরূপী মূলতত্ত্বের পরিণাম, যে সাদা (শুক্ল) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম জলতত্ত্বের এবং যে কালো (কৃষ্ণ) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম পৃথ্বীতত্ত্বের পরিণাম । সেইরূপ আবার মনুষ্য যে অল্প ভক্ষণ করে তাহাতেও সূক্ষ্ম তেজ, সূক্ষ্ম জল ও সূক্ষ্ম অন্ন (পৃথ্বী) এই তিন মূলতত্ত্বই ভরিয়া থাকে । দধি ঘুঁটিলে যেমন মাখন উপরে আইসে সেইরূপ উপরি-উক্ত তিন সূক্ষ্ম তত্ত্বের দ্বারা উৎপন্ন অন্ন উদরে গেলে, তন্মধ্যে তেজতত্ত্ব হইতে মনুষ্যের দেহে অস্থি, মজ্জা ও বাণীরূপে অনুক্ৰমে স্থূল, মধ্যম ও সূক্ষ্ম পরিণাম উৎপন্ন হয়; এবং সেইরূপ জল এই তত্ত্ব হইতে মূত্র, রক্ত ও প্ৰাণ; এবং অন্ন অর্থাৎ পৃথ্বী এই তত্ত্ব হইতে পুরীষ, মাংস ও মন এই তিন দ্রব্য নির্মিত হইয়া থাকে” [ছাং|৬,২-৬] । মূল মহাভূত পাঁচ না মানিয়া তিনই মানিয়া ত্রিবিৎকরণের দ্বারা সমস্ত দৃশ্য পদার্থের উৎপত্তির ব্যবস্থা করিবার ছান্দোগ্যোপনিষদের এই পদ্ধতিই বেদান্তসূত্রেও [২|৪|২০] উক্ত হইয়াছে । বাদরায়ণাচার্য পঞ্চীকরণের নামও করেন নাই । তথাপি তৈত্তিরীয় [২|১], প্রশ্ন [৪|৮], বৃহদারণ্যক [৪|৪|৫] প্রভৃতি অন্য উপনিষদে এবং বিশেষত শ্বেতাশ্বতর [২|১২], বেদান্তসূত্র [২|৩|১-১৪] ও পরিশেষে গীতাতেও [৭|৪; ১৩|৫] তিনের বদলে পাঁচ মহাভূত উক্ত হইয়াছে । গর্ভোপনিষদের আরম্ভেই মনুষ্যদেহ ‘পঞ্চাত্মক’ কথিত হইয়াছে; মহাভারত ও পুরাণে তো পঞ্চীকরণ স্পষ্টই বর্ণিত হইয়াছে [মভা|শাং|১৮৪-১৮৬] । ইহা হইতে প্ৰতিপন্ন হইতেছে যে, ত্ৰিবিৎকরণ প্রাচীন হইলেও যখন মহাভূতের সংখ্যা তিনের বদলে পাঁচ স্বীকৃত হইতে লাগিল, তখন ত্রিবিৎকরণের দৃষ্টান্তেই পঞ্চীকরণের কল্পনার প্রাদুর্ভাব হইল এবং ত্ৰিবিৎকরণ পশ্চাতে পড়িয়া রহিল; এবং পরিশেষে পঞ্চীকরণের কল্পনা বেদান্তীদিগের গ্ৰাহ্য হইল । পরে এই পঞ্চকীকরণ শব্দের অর্থে এই কথাও বলা হইয়াছে যে, মনুষ্যের শরীর কেবল পঞ্চমহাভূতে গঠিত নহে, কিন্তু শরীরের মধ্যে ঐ পঞ্চ মহাভূতের প্রত্যেক পাঁচ প্রকার বিভক্তও হইয়াছে । উদাহরণ যথা – ত্বক্‌ মাংস, অস্থি, মজ্জা ও স্নায়ু এই পাঁচটি বিভাগ অন্নময় পৃথ্বীতত্ত্বের ইত্যাদি ইত্যাদি [মভা|শাং|১৮৪|২০-২৫; ও দাসবোধে|১৭|৮ দেখ] । এই কল্পনাও উপরিপ্রদত্ত ছান্দোগ্যোপনিষদের ত্ৰিবিৎকরণের বর্ণনা হইতে সূচিত দেখা যায় । কারণ, সেখানেও শেষে এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে যে ‘তেজ, জল, ও পৃথ্বী’ এই তত্ত্বগুলির প্রত্যেকের তিন তিন প্ৰকার মনুষ্যের দেহে প্ৰাপ্ত হওয়া যায় ।


11) সজীব সৃষ্টি ও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত লিঙ্গশরীর


মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে কিংবা বেদান্তসিদ্ধান্তু অনুসারে পরব্রহ্ম হইতে অনেক নামরূপধারী জগতের অচেতন অর্থাৎ নির্জীব বা জড়পদার্থ কিরূপে উৎপন্ন হইয়াছে তাহার বিচার শেষ করা গিয়াছে । এক্ষণে বিচার করিব যে, জগতের সচেতন অর্থাৎ সজীব প্ৰাণীদিগের উৎপত্তি সম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রের বিশেষ বক্তব্য কি আছে; তাহার পর দেখিতে হইবে যে, বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত তাহার কতটা মিল আছে । সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়াদির সহিত মূল প্ৰকৃতি হইতে নিঃসৃত পৃথিব্যাদি স্থূল পঞ্চমহাভূতের সংযোগ হইলে সজীব প্রাণীর শরীর প্রস্তুত হয় । কিন্তু এই শরীর সেন্দ্ৰিয় হইলেও জড় ছাড়া আর কিছুই নহে । এই ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরিত করিবার তত্ত্ব জড় প্রকৃতি হইতে ভিন্ন এবং তাহাকে ‘পুরুষ’ বলা হয় । সাংখ্যের এই সিদ্ধান্ত পূর্বপ্রকরণে বর্ণন করিয়াছি যে, যদিও ‘পুরুষ’ মূলে অকর্তা, তথাপি প্ৰকৃতির সহিত তাহার সংযোগ হইলে পর সজীব সৃষ্টির আরম্ভ হয়; এবং “আমি পৃথক ও প্রকৃতি পৃথক” এই জ্ঞান হইলে পর প্রকৃতির সহিত পুরুষের সংযোগ চলিয়া যায় এবং সে মুক্ত হয়; এরূপ না হইলে জন্মমরণের ফেরের মধ্যে তাহাকে পড়িতে হয় । কিন্তু পুরুষ পৃথক্‌ ও প্ৰকৃতি পৃথক্‌ এই জ্ঞান হইবার পূর্বেই যাহার মরণ হয়, তাহার নব নব জন্ম কিরূপে হয়, তাহার বিচার করা হয় নাই । অতএব এখানে তৎসম্বন্ধে বেশী বিচার করা আবশ্যক বলিয়া মনে হয় । জ্ঞান প্রাপ্ত না হইয়া যে মনুষ্য মরে, তাহার আত্মা প্ৰকৃতিচক্র হইতে একেবারে ছাড়ান পায় না, ইহা সুস্পষ্ট । কারণ ছাড়ান পাইলে, জ্ঞানের কিংবা পাপপুণ্যের কোনই মাতব্বরী থাকে না; চার্বাকের ন্যায় ইহাও বলিতে হয় যে, মরিবার পর প্রত্যেক ব্যক্তিই প্ৰকৃতি হইতে ছাড়ান পায় বা মোক্ষ লাভ করে । ভাল; যদি বলা যায় যে, মরিবার, পর শুধু আত্মা অর্থাৎ পুরুষ অবশিষ্ট থাকিয়া আপনা হইতেই নব নব জন্ম গ্ৰহণ করে, তাহা হইলে পুরুষ অকর্তা ও উদাসীন এবং সমস্ত কর্তৃত্ব প্ৰকৃতির - এই মূলভূত সিদ্ধান্তের বাধা হয় । তাছাড়া যখন আমি মানিতেছি যে, আত্মা আপনা হইতেই নব নব জন্মগ্রহণ করে, তখন ইহা তাহার গুণ বা ধর্ম হইয়া যাইতেছে; এবং তখন তো এরূপ অনবস্থা প্ৰাপ্ত হয় যে, জন্মমরণের ফের হইতে সে কখনই মুক্তি পাইতে পারে না । অতএব সিদ্ধ হইতেছে যে, যদি জ্ঞান প্ৰাপ্ত না হইয়াই কোন মনুষ্য মরিয়া যায়, তথাপি পরে নব নব জন্ম প্ৰাপ্ত করাইবার জন্য উহার আত্মার সহিত প্ৰকৃতির সম্বন্ধ অবশ্যই থাকা চাই । মৃত্যুর পর স্থূল দেহের নাশ হওয়া প্ৰযুক্ত উক্ত সম্বন্ধ এক্ষণে স্থূল মহাভূতাত্মক প্রকৃতির সহিত থাকিতে পারে না, ইহা স্পষ্টই রহিয়াছে । কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, প্ৰকৃতি কেবল স্থূল পঞ্চ মহাভূত হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে । প্ৰকৃতি হইতে সমস্ত তেইস তত্ত্ব উৎপন্ন হয়; এবং স্থূল পঞ্চমহাভূত ঐ তেইস তত্ত্বের শেষের পাঁচ । এই শেষের পাঁচ তত্ত্বকে (স্থূল পঞ্চ মহাভূত) তেইস তত্ত্ব হইতে পৃথক করিলে আঠারো তত্ত্ব অবশিষ্ট থাকে । অতএব, এক্ষণে কাজে কাজেই বলিতে হয় যে, জ্ঞানপ্ৰাপ্ত না হইয়া যে মরে সেই পুরুষ পঞ্চমহাভূতাত্মক স্থূল শরীর হইতে অর্থাৎ শেষের পাঁচ তত্ত্ব হইতে মুক্ত হইলেও প্রকৃতির অন্য আঠার তত্ত্বের সহিত তাহার সম্বন্ধ এই প্রকার মরণের দ্বারা কখনই ছিন্ন হয় না । মহান্‌ (বুদ্ধি), অহঙ্কার, মন, দশ ইন্দ্ৰিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র এই কয়েকটী আঠারো তত্ত্ব (পূর্বে প্রদত্ত ব্ৰহ্মাণ্ডের বংশবৃক্ষ দেখ) । এ সমস্তই সূক্ষ্ম তত্ত্ব । তাই এই তত্ত্বগুলির সহিত পুরুষের সংযোগ বজায় রাখিয়া যে দেহ নির্মিত হয় তাহাকে স্থূল শরীরের বিরুদ্ধ সূক্ষ্ম কিংবা লিঙ্গশরীর বলা হয় [সাং|কা|৪০] । 

যখন কোন প্রাণী জ্ঞান না পাইয়া মরে, তখন মৃত্যুর সময় তাহার আত্মার সঙ্গেই প্ৰকৃতির উক্ত আঠার তত্ত্বের নির্মিত এই লিঙ্গশরীরও স্থূল দেহ হইতে বাহির হইয়া যায়; এবং জ্ঞানপ্ৰাপ্তি না হওয়া পৰ্যন্ত সেই পুরুষ ঐ লিঙ্গশরীরেরই কারণে নব নব জন্ম পরিগ্ৰহ করিয়া থাকে । এই সম্বন্ধে কাহার কাহার এই সন্দেহ হয় যে, মনুষ্য মরিবার পর প্রাণের সঙ্গে সঙ্গেই জড়দেহ হইতে বুদ্ধি, অহঙ্কার, মন ও দশ ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপারও নষ্ট হওয়া প্রত্যক্ষ হয় বলিয়া লিঙ্গশরীরের মধ্যে এই তের তত্ত্বের সমাবেশ করিতে কোন বাধা নাই, কিন্তু লিঙ্গশরীরের মধ্যে এই তের তত্ত্বের সহিত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্রের সমাবেশ কেন স্বীকার করিব ? ইহার উত্তরে সাংখ্যেরা বলেন যে, শুধু বুদ্ধি, শুধু অহঙ্কার, মন ও দশ ইন্দ্ৰিয় এই তের তত্ত্ব - প্রকৃতির শুধু গুণ; এবং ছায়ার যেরূপ কোন পদার্থের আশ্রয় আবশ্যক হয় কিংবা চিত্রের জন্য যেরূপ দেওয়াল কাগজ প্রভৃতির আশ্রয় দরকার হয়, সেইরূপ এই গুণাত্মক তের তত্ত্বেরও একত্ৰ থাকিবার জন্য কোন-না-কোন দ্রব্যের আশ্ৰয় চাই । এখন আত্মা (পুরুষ) স্বয়ং নির্গুণ ও অকর্তা, সুতরাং তাহা কোন গুণেরই আশ্রয় হইতে পারে না । মনুষ্য জীবিত থাকিতে, তাহার দেহের স্থূল পঞ্চ মহাভূতই এই তের তত্ত্বের আশ্ৰয় হইয়া থাকে । কিন্তু মরণান্তর অর্থাৎ স্থূল দেহের নাশানান্তর স্থূল পঞ্চ মহাভূতের এই আশ্রয় বিনষ্ট হয় । তখন এই গুণাত্মক তের তত্ত্বের অন্য কোন দ্রব্যকে আশ্রয় করা চাই । যদি মূল প্রকৃতিকেই আশ্রয় বলি, তবে উহা অব্যক্ত ও অবিকৃত অবস্থার অর্থাৎ অনন্ত ও সর্বব্যাপী হওয়া প্ৰযুক্ত উহা একটি ক্ষুদ্র লিঙ্গশরীরস্থ অহঙ্কার বুদ্ধি-আদি গুণের আধার হইতে পারে না । তাই মূল প্ৰকৃতিরই দ্রব্যাত্মক বিকারের মধ্যে স্থূল পঞ্চমহাভূতের বদলে তাহাদের মূলভূত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্র দ্রব্যের সমাবেশ, উক্ত তের গুণের সহিতই তাহাদের আশ্রয়ের দৃষ্টিতে লিঙ্গশরীরের মধ্যে সমাবেশ করিতে হয় [সাং|কা|৪১] । অনেক সাংখ্যগ্ৰন্থকার লিঙ্গশরীর ও স্থূল শরীরের মধ্যে পঞ্চতন্মাত্রনির্মিত তৃতীয় এক শরীর কল্পনা করিয়া প্রতিপাদন করেন যে, এই তৃতীয় শরীর লিঙ্গশরীরের আশ্রয় । কিন্তু সাংখ্যকারিকার একচল্লিশ শ্লোকের প্রকৃত অর্থ সেরূপ নহে, টীকাকারেরা ভ্ৰান্তিবশত তৃতীয় শরীর কল্পনা করিয়াছে, এইরূপ আমার মনে হয় । আমার মতে এই শ্লোকের উদ্দেশ্য কেবল ইহাই বুঝানো যে, বুদ্ধি আদি ১৩ তত্ত্বের সহিত লিঙ্গশরীরে পঞ্চতন্মাত্রেরও সমাবেশ কেন করা হইয়াছে । * ইহার অতিরিক্ত অন্য কোন কারণ নাই ।
*(আমাদেরই মতানুযায়ী ভট্টকুমারিলও এই শ্লোকের অর্থ করিয়াছেন, ইহা তাঁহার মীমাংসাশ্লোকবার্তিক গ্রন্থের এক শ্লোক হইতে [আত্মবাদ|শ্লো|৬২] দেখিতে পাওয়া যায় । সেই শ্লোকটি এই -
অন্তরাভবদেহো হি নেষ্যতে বিন্ধ্যবাসিনা ৷
তদস্তিত্বে প্ৰমাণং হি ন কিঞ্চদবগম্যতে ॥ ৬২ ৷৷
“অন্তরাভব অর্থাৎ লিঙ্গশরীর ও স্থূল শরীর এই দুয়ের মধ্যস্থিত দেহ কিংবা শরীর বিন্ধ্যবাসীর সম্মত নহে । এই প্রকারের মধ্যবর্তী দেহ আছে বলিবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ।” ঈশ্বরকৃষ্ণ বিন্ধ্যপর্বতের উপর থাকিতেন বলিয়া উহাকে বিন্ধ্যবাসী বলা হইয়াছে । অন্তরাভব শরীরের ‘গন্ধর্ব’ এই নামও আছে । অমরকোষ [৩|৩|১৩২] এবং তাহার উপর কৃষ্ণাজী গোবিন্দ ওক প্রকাশিত ক্ষীরস্বামীর টীকা ও মূল গ্রন্থের প্রস্তাবনা পৃ ৮ দেখ ।)


12) বেদান্তে বর্ণিত লিঙ্গশরীর


একটু বিচার করিয়া দেখিলেই বুঝা যায় যে, সূক্ষ্ম আঠারো তত্ত্বের সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীর ও উপনিষদে বর্ণিত লিঙ্গশরীর এই দুয়ের মধ্যে বেশী পার্থক্য নাই । বৃহদারণ্যকোপনিষদে উক্ত আছে যে, “জোঁক (জলৌকা) যেরূপ একগাছা ঘাসের এক ডগায় পৌছিলে অন্য একগাছা ঘাসের উপর (সামনের পা দিয়া) শরীরের সামনের ভাগ রাখিয়া, পূর্ব ঘাসের উপর অবস্থিত দেহের পশ্চাদ্‌ভাগটা টানিয়া লয়, সেইরূপ আত্মা এক শরীর ছাড়িয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করে” [বৃ|৪|৪|৩] । কিন্তু কেবল এই দৃষ্টান্ত হইতে, শুধু আত্মাই অন্য শরীরে যায়, এবং তাহাও এক শরীর ছাড়িবামাত্ৰই যায়, এই দুই অনুমান সিদ্ধ হয় না । কারণ, বৃহদারণ্যকোপনিষদেই পরে [বৃ|৪|৪|৫] বর্ণিত হইয়াছে যে, আত্মার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চ (সূক্ষ্ম) ভূত, মন, ইন্দ্ৰিয়সকল, প্রাণ ও ধর্মাধর্মও শরীর হইতে বাহির হইয়া যায়; আর ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, আপন আপন কর্ম-অনুসারে আত্মা ভিন্ন ভিন্ন লোক প্ৰাপ্ত হয়, এবং সেই সেই লোকে কিছুকাল বাস করে [বৃ|৬|২|১৪,১৫] । সেইরূপ, ছান্দোগ্যোপনিষদেও অপ (জল) মূলতত্ত্বের সঙ্গে জীবের যে গতি বৰ্ণিত হইয়াছে [ছাং|৫|৩|৩; ৫|৯|১], এবং বেদান্তসূত্রে তাহার যে অর্থ নির্ণয় করা হইয়াছে [বেসূ|৩|১|১-৭], তাহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, লিঙ্গশরীরে জল, তেজ ও অন্ন এই তিন মূলতত্ত্বেরই সমাবেশ ছান্দোগ্যোপনিষদেরও অভিপ্রেত । সার-কথা, মহদাদি আঠারো সূক্ষ্ম তত্ত্বের নির্মিত সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীরেই প্রাণ ও ধর্মাধর্ম অর্থাৎ কর্ম সামিল করিলেই বেদান্তীর লিঙ্গশরীর হয় দেখা যাইতেছে । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্র অনুসারে এগারো ইন্দ্ৰিয়বৃত্তির মধ্যেই প্ৰাণের এবং বুদ্ধীন্দ্ৰিয়ের ব্যাপারের মধ্যেই ধর্মাধর্মের সমাবেশ হওয়া প্ৰযুক্ত উক্ত ভেদ কেবল শাব্দিক, - লিঙ্গশরীরের গঠনসম্বন্ধে বেদান্ত ও সাংখ্যের মধ্যে বস্তুত কোন ভেদ নাই বলিলেও চলে । এইজন্য মৈত্র্যুপনিষদে [মৈ|৬|১০] “মহদাদিসূক্ষ্মপৰ্যন্ত” এই সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীরের লক্ষণ “মহদাদ্যবিশেষান্তং” এইরূপ পর্যায়ের দ্বারা যেমনটি তেমনি ঠিক রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে ।*
*(দ্বাত্রিংশৎ উপনিষদের পুণা আনন্দাশ্ৰম-সংস্করণের মৈত্র্যুপনিষদের উক্ত মন্ত্রের পাঠ “মহদাদ্যং বিশেষান্তং” এইরূপ দেওয়া হইয়াছে এবং উহাই টীকাকারও স্বীকার করিয়াছেন । এই পাঠ গ্ৰহণ করিলে লিঙ্গশরীরের মধ্যে আরম্ভের মহৎ-তত্ত্বের সমাবেশ করিয়া বিশেষান্তং এই পদের দ্বারা সূচিত বিশেষ অর্থাৎ পঞ্চ মহাভূত ছাড়িয়া দিতে হয় । অথবা এই অৰ্থ করা আবশ্যক হয় যে, ‘মহদাদ্যং’ ইহার মধ্যে ‘মহৎ’কে ধরিয়ে হইবে এবং ‘বিশেষান্তং’ ইহার মধ্যে ‘বিশেষ’কে ছাড়িতে হইবে । কিন্তু যেখানে আদ্যন্ত বলা হইয়াছে সেখানে দুই-ই ধরা কিংবা ছাড়া যুক্তিসিদ্ধ । তাই প্রোফেসর ডয়সন্‌ বলিয়াছেন যে, মহদাদ্যং এই পদের অনুস্বার ছাঁটিয়া ফেলিয়া “মহদাদ্যর্বিশেষান্তম্‌” (মহদাদি + অইশেষান্তম্‌) এই পাঠ গ্রহণ করা উচিত । এইরূপ করিয়া অবিশেষ পদ ধরিলে, মহৎ ও অবিশেষ অর্থাৎ আদি ও অন্ত এই দুয়েতেই একই নিয়মের প্রয়োগ হইবে এবং লিঙ্গশরীরে উভয়েরই সমাবেশ করা যাইবে । এই পাঠের ইহাই বিশেষ গুণ । কিন্তু যে-কোন পাঠই গ্ৰহণ করা না কেন, অর্থের ভেদ হয় না, ইহা মনে রাখা আবশ্যক ।)

ভগবদ্‌গীতাতে “মনঃষষ্ঠানীন্দ্ৰিয়াণি” [গী|১৫|৭] অর্থাৎ মন ও পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় লইয়াই সুক্ষ্ম শরীর হয়, এইরূপ বলিয়া পরে বলা হইয়াছে - “বায়ুৰ্গন্ধানিবাশয়াৎ” [১৫|৮] অর্থাৎ বায়ু যেরূপ ফুল হইতে সুগন্ধ হরণ করে সেইরূপ জীব স্থূল শরীর ছাড়িবার সময় লিঙ্গশরীর সঙ্গে লইয়া যায় । তথাপি গীতার অধ্যাত্মজ্ঞান উপনিষদ হইতেই গৃহীত হওয়ায় বলা যায় যে, ‘মনের সহিত ছয় ইন্দ্রিয়’ এই শব্দগুলির মধ্যেই পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয়, পঞ্চতন্মাত্র, প্রাণ ও পাপপুণ্য ইহাদের সংগ্ৰহই ভগবানের অভিপ্ৰেত । মনুস্মৃতিতেও বর্ণিত হইয়াছে যে, মনুষ্য মরিবার পর এই জন্মের পাপপুণ্য-ফল ভোগ করিবার জন্য পঞ্চতন্মাত্রাত্মক সূক্ষ্ম শরীর প্রাপ্ত হয় [মনু|১২|১৬,১৭] । “বায়ুৰ্গন্ধানিবাশয়াৎ” গীতার এই দৃষ্টান্ত হইতে এই শরীর যে সূক্ষ্ম, তাহাই সিদ্ধ হয়; কিন্তু তাহার আকার কত বড় তাহা বুঝা যায় না । মহাভারতের সাবিত্রী উপাখ্যানে [মভা|বন|২৯৭|১৬] সত্যবানের (স্থূল) শরীর হইতে অঙ্গুষ্ঠপরিমিত এক পুরুষকে যম বাহির করিল, - “অঙ্গুষ্ঠমাত্ৰং পুরুষং নিশ্চকৰ্ষ যমো বলাৎ” এই যে বর্ণনা আছে, তাহা হইতে এই দৃষ্টান্তেরই জন্য লিঙ্গশরীর অঙ্গুষ্ঠ আকারবিশিষ্ট মানা হইয়াছে বলিয়া প্রতীত হয় ।


13) লিঙ্গশরীর পশু, পক্ষী, মনুষ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন দেহ কেন উৎপন্ন করে ?


লিঙ্গশরীর আমাদের চোখে না দেখা গেলেও, তাহার অস্তিত্ব কোন্‌ অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ হয়, এবং সেই শরীরের অবয়ব-গঠন কিরূপ, তাহার বিচার করা হইল । কিন্তু, প্ৰকৃতি ও পাঁচ স্থূল মহাভূতের অতিরিক্ত আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় হইতে লিঙ্গশরীর নির্মিত হয়, এই কথা বলিলেই যথেষ্ট বলা হয় না বলিয়া মনে হয় । এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, লিঙ্গশরীর যেখানে যেখানে থাকিবে, সেখানে সেখানে, এই আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় নিজনিজ গুণধর্মানুসারে মাতাপিতার স্থূল দেহ হইতে এবং পরে স্থূল জগতের অন্ন হইতে হস্তপদাদি স্থূল অবয়ব বা স্থূল ইন্দ্ৰিয় উৎপন্ন করিবে অথবা তাহাদের পোষণ করিবে । কিন্তু এখন বলা আবশ্যক যে, আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয়ে উৎপন্ন লিঙ্গশরীর পশু, পক্ষী, মনুষ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন দেহ কেন উৎপন্ন করে । সজীব জগতের সচেতন তত্ত্বকে সাংখ্যবাদী ‘পুরুষ’ বলেন; এবং সাংখ্যদিগের মতে এই পুরুষ অসংখ্য হইলেও প্ৰত্যেক পুরুষ স্বভাবতই উদাসীন ও অকৰ্তা হওয়া প্ৰযুক্ত পশুপক্ষী-আদি প্ৰাণীদিগের ভিন্ন ভিন্ন দেহ উৎপন্ন করিবার কর্তৃত্ব পুরুষেতে আসিতে পারে না । বেদান্তশাস্ত্রে পাপপুণ্যাদি কর্মের পরিণাম হইতে এই ভেদ উৎপন্ন হয়, উক্ত হইয়াছে । এই কর্মবিপাকের বিচার পরে করা যাইবে । সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে কর্মকে পুরুষ ও প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন তৃতীয় তত্ত্ব মানিতে পারা যায় না; এবং পুরুষ যখন উদাসীন, তখন বলিতেই হয় যে, কর্ম প্রকৃতির সত্ত্বরজতমগুণেরই বিকার । লিঙ্গশরীরে যে আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় আছে, তন্মধ্যে বুদ্ধিতত্ত্ব প্রধান । কারণ, বুদ্ধি হইতেই পরে অহঙ্কারাদি সতেরো তত্ত্ব উৎপন্ন হয় । অতএব বেদান্ত যাহাকে কর্ম বলে, তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে সত্ত্ব রজ ও তম এই তিন গুণের ন্যূনাধিক পরিমাণে উৎপন্ন বুদ্ধির ব্যাপার, ধর্ম বা বিকার বলা হয় । বুদ্ধির এই ধর্মের সংজ্ঞা – ‘ভাব । সত্ত্ব রজ ও তম এই গুণত্রয়েয় তারতম্যে এই ভাব অনেক প্ৰকারের হইয়া থাকে । ফুলেতে যেরূপ গন্ধ ও কাপড়ে যেরূপ রং, সেইরূপ লিঙ্গশরীরে এই ভাব লাগিয়া থাকে [সাং|কা|৪০] । এই ভাব অনুসারে কিংবা বেদান্তের পরিভাষায় কর্মানুসারে লিঙ্গশরীর নব নব জন্ম গ্ৰহণ করে; এবং জন্মগ্রহণ করিবার সময় পিতামাতার শরীর হইতে যে দ্রব্য লিঙ্গশরীর আকর্ষণ করিয়া লয় সেই সকল দ্রব্যেতেও অন্যভাব আসিয়া থাকে । ‘দেবযোনি, মনুষ্যযোনি, পশুযোনি ও বৃক্ষযোনি’ এই সকল ভেদ এই ভাবের সমুচ্চয়েরই পরিণাম [সাং|কা|৪৩-৫৫] । এই সমস্ত ভাবের মধ্যে সাত্ত্বিক গুণের উৎকর্ষ হইয়া যখন মনুষ্য জ্ঞান ও বৈরাগ্য প্রাপ্ত হয় এবং সেই প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি ও পুরুষের ভেদ বুঝিতে আরম্ভ করে, তখন মনুষ্য আপনার মূলস্বরূপ কৈবল্যপদে উপনীত হয়; এবং তখন এই লিঙ্গশরীর হইতে মুক্তি পাইয়া তাহার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি হয় । কিন্তু এই প্ৰকৃতিপুরুষের ভেদজ্ঞান না হইয়া শুধু সাত্ত্বিকগুণেরই উৎকর্ষ হইলে লিঙ্গশরীর দেবযোনিতে অর্থাৎ স্বৰ্গে জন্ম গ্ৰহণ করে; রজোগুণের প্রাবল্য হইলে মনুষ্যযোনিতে অর্থাৎ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং তমোগুণের আধিক্য হইলে তাহাকে তির্যকযোনিতে প্ৰবেশ করিতে হয় [গী|১৪|১৮] । “গুণা গুণেষু জায়ন্তে” এই তত্ত্ব ধরিয়াই সাংখ্যশাস্ত্ৰে বৰ্ণিত হইয়াছে যে, মানবযোনিতে জন্ম হইলে পর রেতবিন্দু হইতে ক্ৰমে ক্ৰমে কলল, বুদ্‌বুদ, মাংস, পেশী ও ভিন্ন ভিন্ন স্থূল ইন্দ্ৰিয়সকল কিরূপে গঠিত হয় [সাং|কা|৪৩; মভা|শাং|৩২০] । সাংখ্য ও গর্ভোপনিষদের বর্ণনা প্ৰায় একই প্ৰকার । উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে বুঝা যাইবে যে, সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘ভাব’ শব্দের যে পারিভাষিক অর্থ বলা হইয়াছে, তাহা বেদান্তশাস্ত্ৰে বিবক্ষিত না হইলেও ভগবদ্‌গীতাতে [গী|১০|৪,৫; ৭|১২]“বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ” ইত্যাদি গুণের (পরবর্তী শ্লোকে) যে ‘ভাব’ নাম দেওয়া হইয়াছে, অনুমান হয়, তাহা সাংখ্যশাস্ত্রের পরিভাষা মনে করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।


14) উৎপত্তি-প্রলয়


এই প্রকারে সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে কিংবা বেদান্ত অনুসারে মূল সৎ-রূপী পরব্রহ্ম হইতে সৃষ্টির সমস্ত সজীব ও নির্জীব ব্যক্ত পদার্থ ক্ৰমে ক্রমে সৃষ্ট হইয়াছে; এবং যখন সৃষ্টির সংহারের সময় উপস্থিত হয়, তখন উপরে কথিত জগৎ-উৎপত্তির গুণপরিণামক্রমের বিপরীত ক্ৰমে সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ অব্যক্ত প্ৰকৃতিতে কিংবা মূল ব্ৰহ্মেতে লয় প্রাপ্ত হয় । এইরূপ সিদ্ধান্ত সাংখ্য ও বেদান্ত উভয় শাস্ত্রেরই মান্য [বেসু|২|৩|১৪; মভা|শাং|২৩২] । উদাহরণ যথা, পঞ্চ মহাভূতের মধ্যে পৃথিবীর লয় জলেতে, জলের অগ্নিতে, অগ্নির বায়ুতে, বায়ুর আকাশে, আকাশের তন্মাত্রে, তন্মাত্রের অহংকারে, অহঙ্কারের বুদ্ধিতে, এবং বুদ্ধি বা মহানের প্রকৃতিতে লয় হয়, এবং বেদান্তানুসারে প্রকৃতি মূল ব্ৰহ্মেতে লয় প্রাপ্ত হয় । 


15) কালগণনা


জগতের উৎপত্তি বা সৃষ্টি হইলে পর উহার লয় ও সংহার পর্যন্ত কতকাল অতীত হয়, ইহা সাংখ্যকারিকায় কোথাও কথিত হয় নাই । তথাপি মনে হয় যে, মনুসংহিতা [১|৬৬-৭৩], ভগবদ্‌গীতা [৮|১৭], এবং মহাভারতে [শাং|২৩১] বর্ণিত কালগণনা সাংখ্যদিগেরও মান্য । 


15.1) দেবতাদের দিবারাত্রি ও বৎসর


আমাদের উত্তরায়নই দেবতাদের দিন এবং আমাদের দক্ষিণায়নই দেবতাদের রাত্ৰি । কারণ, শুধু স্মৃতিগ্রন্থাদিতে নহে পরন্তু জ্যোতিষশাস্ত্ৰের সংহিতাদিতেও বর্ণনা আছে [সূর্যসিদ্ধান্ত|১|১৩; ১২|৩৫, ৬৭] যে, দেবতা মেরুপর্বতের উপর অর্থাৎ উত্তর ধ্রুবস্থানে থাকেন । অর্থাৎ দুই অয়নের আমাদের এক বৎসরই দেবতাদের এক দিবারাত্রি এবং আমাদের ৩৬০ বৎসরে দেবতাদের ৩৬০ দিবারাত্রি বা এক বৎসর । 


15.2) চারিযুগ + সন্ধিকাল = মহাযুগ


সত্যত্রেতাদ্বাপর ও কলি এইরূপ আমাদের চারি যুগ ৷ এই চারিযুগের কালগণনা এইরূপ - সত্যযুগের চারি হাজার বৎসর, ত্ৰেতাযুগের তিনি হাজার, দ্বাপরের দুই হাজার এবং কলির এক হাজার বৎসর । কিন্তু এক যুগ শেষ হইতেই অন্য যুগ একেবারে আরম্ভ না হইয়া মধ্যে দুয়ের গোলযোগ অর্থাৎ সন্ধিকালের কএক বৎসর চলিয়া যায় । এই প্রকারে সত্যযুগের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে চারিশত বর্ষের, ক্রেতাযুগের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে তিনশত বর্ষের, দ্বাপরের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে দুই শত বর্ষের, এবং কলিযুগের পুর্ব পশ্চাৎ প্রত্যেক দিকে একশত বর্ষের সন্ধিকাল মিলিয়া মোট চারিযুগের আদ্যন্তের সন্ধিকাল দুই হাজার বৎসর হয় । এই দুই হাজার বৎসর এবং সত্য, ত্ৰেতা, দ্বাপর ও কলি ইহাদের পূর্ববর্ণিত সাংখ্যমতে চারি যুগের দশ হাজার বৎসর মিলিয়া মোট বারো হাজার বৎসর হয় । এই বারো হাজার বৎসর মনুষ্যদিগের না দেবতাদিগের ? মনুষ্যের বলিয়া ধরিলে, কলিযুগের আরম্ভ হইতে এক্ষণে পাঁচ হাজার বৎসরের উপর হইয়া গিয়াছে; কাজেই বলিতে হয় যে, হাজার মানব-বৎসরের কলিযুগ শেষ হইয়াছে, পুনরায় তার পরে আগন্তব্য সত্যযুগও শেষ হইয়া এক্ষণে ক্রেতাযুগ আসিয়াছে । এই বিরোধকে ঠেকাইবার জন্য এই বারো হাজার বৎসর দেবতাদের, এইরূপ পুরাণে নিৰ্ধারিত হইয়াছে । দেবতাদিগের বারো হাজার বৎসর, মনুষ্যদের ৩৬০ x ১২,০০০ = ৪৩,২০,০০০ অর্থাৎ তেতাল্লিশ লক্ষ, বিশ হাজার বৎসর হয় । এখনকার পঞ্জিকায় যুগপরিমাণ এই পদ্ধতিতেই বর্ণিত হইয়া থাকে । (দেবতাদের) বারো হাজার বৎসর মিলিয়া মনুষ্যদের এক মহাযুগ বা দেবতাদের এক যুগ হয় । 


15.3) মন্বন্তর ও কল্প


দেবতাদের একাত্তর যুগে এক মন্বন্তর বলা যায় এবং এইরূপ মন্বন্তর চৌদ্দটী । কিন্তু প্ৰথম মন্বন্তরের আরম্ভে ও শেষে, এবং পরে প্রত্যেক মন্বন্তরের শেষে দুই দিকে সত্যযুগের ন্যায় একাদিক্ৰমে এইরূপ পনেরো সন্ধিকাল হইয়া থাকে ৷ এই পনেরো সন্ধিকাল ও চৌদ্দ মন্বন্তর মিলিয়া দেবতাদের এক হাজার যুগ কিংবা ব্ৰহ্মদেবের এক দিন হয় [সূর্যসিদ্ধান্ত|১|১৫-২০]; এবং মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতে লিখিত হইয়াছে যে, এইরূপ হাজার যুগ মিলিয়া ব্ৰহ্মদেবের এক রাত্রি হয় [মনু|১|৬৯-৭৩ ও ৭৯; মভা|শাং|২৩১|১৮-২১; এবং যাস্কের নিরুক্ত|১৪|৯ দেখ] । এই গণনানুসারে ব্ৰহ্মদেবের একদিন মনুষ্যের চার অর্বুদ বত্রিশ কোটি বৎসর হয়, এবং ইহারই নাম – কল্প । (জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তিতে যুগাদির গণনার বিচার স্বর্গীয় শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বীয় ‘ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে ঠিকঠিকানা করিয়াছেন । তাহা দেখ পৃঃ১০৩-১০৫; ১৯৩ ইত্যাদি ।)

ভগবদ্গীতাতে [গী|৮|১৮ ও ৯|৭ দেখ], স্মৃতিগ্রন্থে এবং মহাভারতেও কথিত হইয়াছে যে, ব্ৰহ্মদেবের এই দিন কিংবা কল্প আরম্ভ হইলে পর -
অব্যক্তাদ্‌ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্ৰভবন্ত্যহরাগমে ৷
রাত্ৰ্যাগমে প্ৰলীয়ন্তে তত্ৰৈবাব্যক্তসঙ্গকে ॥
“অব্যক্ত হইতে জগতের সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ উৎপন্ন হইয়া থাকে; এবং ব্ৰহ্মদেবের রাত্রি শুরু হইলে, সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ আবার অব্যক্তের মধ্যে লয় প্ৰাপ্ত হয়” । ইহা ব্যতীত অন্যান্য প্রলয়েরও কথা পুরাণ-সমূহে বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই প্ৰলয়সমূহে সূৰ্যচন্দ্ৰাদি সমস্ত জগতের নাশ না হওয়ায়, ব্ৰহ্মাণ্ডের উৎপত্তি ও সংহারের বিচার করিবার সময় ইহাদিগকে জমার মধ্যে ধরা হয় না । কল্প - ব্রহ্মদেবের এক দিন কিংবা রাত্রি; এবং এইরূপ ৩৬০ দিন ও ৩৬০ রাত্রিই তাঁহার এক বৎসর । তাই পুরাণাদিতে বৰ্ণনা আছে [বিষ্ণুপুরাণ|১|৩ দেখ] যে, ব্ৰহ্মদেবের আয়ু একশত বৎসর, তাহার অর্ধেক চলিয়া গিয়াছে, দ্বিতীয় অর্ধেক অর্থাৎ ৫১ বৎসরের প্রথম দিন কিংবা শ্বেতবারাহ নামক কল্প এখন শুরু হইয়াছে; এবং এই কল্পের চৌদ্দ মন্বন্তরের মধ্যে ছয় মন্বন্তর গিয়া সপ্তম অর্থাৎ বৈবস্বত মন্বন্তরের ৭১ মহাযুগের মধ্যে ২৭ মহাযুগ পুর্ণ হইয়া ২৮তম মহাযুগের অন্তৰ্গত কলিযুগের প্রথম পাদ অর্থাৎ চতুর্থ ভাগ এখন চলিতেছে । ১৯৫৬ সন্বতে (১৮২১ সকে) এই কলিযুগের ঠিক ৫০০০ বৎসর অতীত হইয়াছিল । এই অনুসারে হিসাব করিলে দেখা যাইবে যে, কলিযুগের প্রলয় হইতে ১৮২১ অব্দে (১৯৫৬ সম্বতে) মনুষ্যের চারি লক্ষ সাতাশ হাজার বৎসর বাকী ছিল; আর বর্তমান মন্বন্তরের শেষে কিংবা এখনকার কল্পান্তে যে মহাপ্ৰলয় হইবে সে ত দূরেই রহিয়া গেল ! মানবী চার অব্জ বত্ৰিশ কোটি বৎসরের ব্ৰহ্মদেবের যে দিন এখন চলিতেছে, তাহার পূর্ণ মধ্যাহ্নও এখনো হইল না অর্থাৎ সাত মন্বন্তর এখনও অতীত হয় নাই !


16) সৃষ্টির উৎপত্তির অন্য ক্রমের সহিত বিরোধ ও একতা


জগতের উৎপত্তি ও সংহারের এখন পর্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা বেদান্তের উপর এবং পরব্রহ্মকে ছাড়িয়া দিলে সাংখ্যশাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞানের উপর করা হইয়াছে, সেই কারণে জগৎ উৎপত্তিক্রমের এই পরম্পরাই আমাদের শাস্ত্রকার সর্বদা প্ৰমাণ বলিয়া মনে করেন, এবং ভগবদ্‌গীতাতেও এই ক্রমই প্রদত্ত হইয়াছে । এই প্রকরণের আরম্ভেই কথিত হইয়াছে যে, সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমের সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন বিচারও দেখা যায়; যেমন শ্রুতি স্মৃতি পুরাণের কোন কোন স্থানে কথিত আছে যে, প্ৰথমে ব্ৰহ্মদেব বা হিরণগৰ্ভ উৎপন্ন হয়েন কিংবা জল প্ৰথমে উৎপন্ন হয় এবং তাহাতে পরমেশ্বরের বীজ হইতে এক সুবৰ্ণময় অণ্ড উৎপন্ন হয় । কিন্তু এই সমস্ত বিচার গৌণ ও উপলক্ষণাত্মক বুঝিয়া তাহাদের উপপত্তি বুঝাইবার প্রসঙ্গ যখন আসে তখন ইহাই বলা যায় যে, হিরণ্যগর্ভ কিংবা ব্ৰহ্মদেব অর্থে প্ৰকৃতিই বুঝায় । ভগবদ্‌গীতাতেও “মম যোনির্মহৎ ব্ৰহ্ম” [গী|১৪|৩] এইরূপ ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতিকেই ব্ৰহ্ম বলা হইয়াছে, এবং ভগবান ইহাও বলিয়াছেন যে, আমার বীজ হইতে এই প্ৰকৃতিতে ত্ৰিগুণের দ্বারা অনেক মূর্তি উৎপন্ন হয় । অনাত্র এইরূপ বর্ণন আছে যে, ব্ৰহ্মদেব হইতে আরম্ভে দক্ষাদি সাত মানসপুত্র বা সাত মনু উৎপন্ন হইয়া তাঁহারা পরে চরাচর জগৎ নির্মাণ করিলেন [মভা|আ|৬৫-৬৭; মভা|শাং|২০৩; মনু|১|৩৪-৬৩]; এবং ইহার উল্লেখ একবার গীতাতেও করা হইয়াছে [গী|১০|৬] । কিন্তু বেদান্তগ্ৰন্থ ইহাই প্ৰতিপাদন করে যে, এই সকল বিভিন্ন বর্ণনাতে ব্ৰহ্মদেবকেই প্ৰকৃতি ধরিলে উপরি-প্রদত্ত তাত্ত্বিক জগদুৎপত্তিক্রমের সহিত মিল হইয়া যায়; এবং এ নিয়ম অন্যত্রও উপযোগী হইতে পারে । উদাহরণ যথা, শৈব ও পাশুপতদর্শনে শিবকে নিমিত্ত-কারণ জ্ঞান করিয়া তাহা হইতে কার্যকারণাদি পাঁচ পদার্থ উৎপন্ন হয়, এইরূপ মত দেখা যায়; এবং নারায়ণীয় ভাগবত ধর্মে বাসুদেবকে প্ৰধান মানিয়া বাসুদেব হইতে প্ৰথমে সংকর্ষণ (জীব), সংকর্ষণ হইতে প্ৰদ্যুম্ন (মন) এবং প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার) উৎপন্ন হয় এইরূপ বর্ণনা আছে । কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰানুসারে জীব প্ৰত্যেকবারই নব নব উৎপন্ন হয় না, উহা নিত্য ও সনাতন পরমেশ্বরের, নিত্য (অতএব অনাদি) অংশ; তাই বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে [বেসূ|২|২|৪২-৪৫] ভাগবতধর্মোক্ত জীবের উৎপত্তিবিষয়ক উপরি-উক্ত মতের খণ্ডন করিয়া ঐ মত বেদবিরুদ্ধ অতএব তাজ্য, এইরূপ কথিত হইয়াছে । এবং গীতাতে বেদান্তসূত্ৰের এই সিদ্ধান্তেরই অনুবাদ করা হইয়াছে [গী|১৩|৪; ১৫|৭] । সেইরূপ আবার সাংখ্যবাদী প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই উভয়কে স্বতন্ত্র তত্ত্ব মানিয়া থাকেন; কিন্তু এই দ্বৈত অস্বীকার করিয়া প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই তত্ত্ব নিত্য ও নির্গুণ এক পরমাত্মারই বিভূতি, ইহাই বেদান্ত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতাতেও এই সিদ্ধান্ত গ্ৰাহ্য হইয়াছে [গী|৯|১০] । কিন্তু এই সম্বন্ধে সবিস্তার বিচার পরবর্তী প্রকরণে করা যাইবে । এখানে ইহাই বক্তব্য যে, ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মে বর্ণিত বাসুদেবভক্তির ও প্রবৃত্তিপর ধর্মেৱ তত্ত্ব ভগবদ্‌গীতায় মান্য হইলেও গীতাতে ভাগবতধর্মের এই কল্পনা স্বীকৃত হয় নাই যে, বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ বা জীব উৎপন্ন হয় এবং তাহার পরে প্ৰদ্যুম্ন (মন) এবং প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার) প্রাদুর্ভূত হয় । সংকর্ষণ, প্ৰদ্যুম্ন, বা অনিরুদ্ধ, ইহাদের নামও গীতায় কোথাও আসে নাই । পাঞ্চরাত্রে কথিত ভাগবতধর্ম এবং গীতার ভাগবত ধর্মের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ । এই বিষয়ের উল্লেখ এখানে জানিয়া বুঝিয়া করা হইয়াছে; কারণ “ভগবদ্গীতাতে ভাগবতধর্ম বলা হইয়াছে” এইটুকু হইতে কেহ ইহা না বুঝেন যে জগতের উৎপত্তি ক্রমসম্বন্ধে কিংবা জীব-পরমেশ্বর স্বরূপ সম্বন্ধে ভাগবতাদি ভক্তি-সম্প্রদায়ের মতও গীতার মান্য । 

এক্ষণে সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই বাহিরে ব্যক্তাব্যক্ত ও ক্ষরাক্ষর জগতে মূলের অন্য কোন তত্ত্ব আছে কি না তাহার বিচার করিব । ইহারই নাম অধ্যাত্ম কিংবা বেদান্ত ।

অধ্যাত্ম (Spirituality)

পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ ৷
যঃ স সর্ব্বেষু ভুতেষু নশ্যাৎসু ন বিনশ্যতি ॥ [গীতা |৮|২০]

(“সেই (সাংখ্যা) অব্যক্ত হইতেও শ্রেষ্ঠ ও সনাতন যে অন্য অব্যক্ত পদাৰ্থ, যাহা সমস্ত প্ৰাণী বিনষ্ট হইলেও নাশ প্রাপ্ত হয় না”, তাহাই চরম গতি” ।)

1) প্রকৃতি ও পুরুষরূপে দ্বৈতসম্বন্ধে আপত্তি


পূৰ্ববর্তী দুই প্রকরণের মর্মার্থ এই যে, ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে যাহাকে ক্ষেত্ৰজ বলে তাহারই নাম সাংখ্যশাস্ত্ৰে পুরুষ; সমস্ত ক্ষরাক্ষর বা চরাচর জগতের সংহা্র ও সৃষ্টির বিচার করিবার সময়, সাংখ্যমতানুসারে শেষে প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুই-ই স্বতন্ত্র ও অনাদি মূলতত্ত্ব থাকিয়া যায়; এবং আপনার সমস্ত দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি করিয়া মোক্ষলাভ করিতে হইলে, প্ৰকৃতি হইতে আপন ভিন্নতা অর্থাৎ কৈবল্য উপলব্ধি করিয়া পুরুষের ত্ৰিগুণাতীত হওয়া চাই । প্ৰকৃতি ও পুরুষের সংযোগ হইলে পর প্রকৃতি আপন প্ৰপঞ্চ পুরুষের সম্মুখে কেমন করিয়া বিস্তার করে এই বিষয়ের ক্রম আধুনিক সৃষ্টিশাস্ত্রবেত্তাগণ সাংখ্যশাস্ত্ৰ হইতে কিঞ্চিৎ ভিন্ন করিয়া বলিয়াছেন; এবং আধিভৌতিক শাস্ত্রসমূহের যেমন যেমন উন্নতি হইবে, তেমনি তেমনি এই ক্রম বিষয়ে আরও সংশোধন হইতে থাকিবার সম্ভাবনা আছে । যাই হোক, এক অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ গুণোৎকর্ষ অনুসারে ক্ৰমে ক্ৰমে উৎপন্ন হইয়াছে, এই মূল সিদ্ধান্তে কোনই পার্থক্য হইতে পারে না । তথাপি, এই বিষয় অন্য শাস্ত্রের, আমাদের নহে, এইরূপ মনে করিয়া বেদান্ত-কেশরী সেই সম্বন্ধে বিবাদ করিতে বসেন না । তিনি এই সমস্ত শাস্ত্রের অগ্ৰে চলিয়া পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডেরও মূলে কোন শ্ৰেষ্ঠ তত্ত্ব আছে এবং মনুষ্য কেমন করিয়া সেই শ্রেষ্ঠতত্ত্বে মিলিত হইতে পারে অর্থাৎ কেমন করিয়া তদ্রূপ হইতে পারে তাহা বুঝাইবার জন্য প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন । তাঁহার এই রাজ্যের মধ্যে অন্য কোন শাস্ত্রের গর্জন চলিতে দেন না । সিংহের সম্মুখে যেরূপ শৃগাল চুপ হইয়া যায় সেইরূপ বেদান্তের সম্মুখে অন্য শাস্ত্ৰসকলও নীরব হইয়া যায় । তাই একজন প্রাচীন সুভাষিতকার বেদান্তের যথার্থ বর্ণনা করিয়াছেন যে, -
তাবৎ গর্জন্তি শাস্ত্ৰাণি জম্বুকা বিপিনে যথা ৷
ন গর্জতি মহাশক্তিঃ যাবৎ বেদান্তকেসরী ॥
ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞের বিচারান্তে নিষ্পন্ন ‘দ্রষ্টা’ অৰ্থাৎ পুরুষ বা আত্মা এবং ক্ষরাক্ষর জগতের বিচারান্তে নিষ্পন্ন সত্ত্ব-রজ-তমোগুণময়ী অব্যক্ত প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র এবং জগতের মূলতত্ত্বকে এইরূপ দ্বিধা বলিয়৷ মানিতেই হয় - এইরূপ সাংখ্য বলেন । কিন্তু বেদান্ত আরও অগ্রসর হইয়া এইরূপ বলেন যে, সাংখ্যের পুরুষ নির্গুণ হইলেও অসংখ্য হওয়া প্ৰযুক্ত ইহা মানা সংগত নহে যে, এই অসংখ্য পুরুষের লাভ কিসে হয় তাহা বুঝিয়া প্ৰত্যেক পুরুষের সহিত তদনুসারে ব্যবহার করিবার সামর্থ্য প্রকৃতির আছে । এরূপ মানা অপেক্ষা সাত্ত্বিক তত্ত্বজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইহা স্বীকার করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত হইবে যে, ঐ একীকরণের জ্ঞানক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত নির্বিবাদ প্রয়োগ করা হৌক এবং প্রকৃতি ও অসংখ্য পুরুষের একই পরমতত্ত্বে অবিভক্তরূপে সমাবেশ করা হৌক যাহা “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই অনুসারে নিম্ন হইতে উচ্চ পর্যন্ত শ্ৰেণীসমূহে দেখা যায় এবং যাহার সহায়তাতেই সৃষ্টির অনেক ব্যক্ত পদার্থ এক অব্যক্ত প্ৰকৃতিতে সমাবেশ করা হয় [গী|১৮, ২০-২২] । ভিন্নতার অবভাস হওয়া অহঙ্কারের পরিণাম; এবং পুরুষ যদি নির্গুণ হয়, তবে অসংখ্য পুরুষের পৃথক থাকিবার গুণ উহাতে থাকিতে পারে না । কিংবা বলিতে হয় যে, বস্তুত পুরুষ অসংখ্য নহে, কেবল প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন অহঙ্কার গুণরূপী উপাধির কারণেই উহাতে অসংখ্যতা দেখা যায় । তা ছাড়া আর এক প্রশ্ন এই উঠে যে, স্বতন্ত্র প্রকৃতির সহিত স্বতন্ত্র পুরুষের যে সংযোগ হইয়াছে তাহা সত্য বা মিথ্যা ? সত্য বলিয়া মানিলে সেই সংযোগ কখনই দূর হইতে পারে না, সুতরাং সাংখ্যমতানুসারে আত্মা কখনই মুক্তি লাভ করিতে পারে না । মিথ্যা বলিয়া যদি মানা যায়, তাহা হইলে, পুরুষের সংযোগ প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি, পুরুষের সম্মুখে নিজের বাজার সাজাইতে যে বসিয়া যান, সে কথা নির্মূল হয় । গাভী যেরূপ বাছুরের জন্য দুধ দেয় সেইরূপ পুরুষের লাভের জন্যই প্ৰকৃতি কার্যতৎপর থাকেন, এই দৃষ্টান্তও খাটে না; কারণ, গরুর পেটেই বাছুর হয় বলিয়া বাছুরের উপর গরুর সন্তানবাৎসল্যের উদাহরণ যেরূপ দেখান যায়, প্ৰকৃতি ও পুরুষ সম্বন্ধে সেরূপ দেখান যায় না [বেসু|শাং|ভা|২|২|৩] । প্ৰকৃতি ও পুরুষ সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে মূলেই অত্যন্ত ভিন্ন - একটি জড়, আর একটি সচেতন । জগতের আরম্ভ হইতেই এই দুই পদার্থ যদি অত্যন্ত ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হইল, তবে আবার একের প্রবৃত্তি অন্যটির লাভের জন্য কেন হইবে ? ইহাই উহাদের স্বভাব, ইহা কিছুমাত্ৰ সন্তোষজনক উত্তর নহে । স্বভাবকেই যদি মানিতে হয়, তাহা হইলে হেকলের জড়াদ্বৈত মন্দই বা কি ? মূল প্ৰকৃতির গুণের বৃদ্ধি হইতে হইতে সেই প্ৰকৃতিতে আপনাকে দেখিবার ও আপনার সম্বন্ধে বিচার করিবার চৈতন্যশক্তি উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ ইহা তাহার স্বভাবই, হেকলেরও ইহাই সিদ্ধান্ত কি না ? কিন্তু এইমত স্বীকার না করিয়া সাংখ্যশাস্ত্র এই ভেদ করিয়াছেন যে, ‘দ্রষ্টা’ পৃথক এবং ‘দৃশ্যজগৎ’ পৃথক । এখন এই প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে, যে ন্যায়ানুসারে সাংখ্যবাদী এই ভেদ দেখান সেই ন্যায়ের উপযোগ করত আরও অগ্ৰে চলিব না কেন ? বাহ্য জগৎ তন্নতন্ন করিয়া পরীক্ষা করিলেও এবং চক্ষুর স্নায়ুর মধ্যে অমুক অমুক গুণধর্ম আছে নির্ধারণ করিলেও, এই সকল বিষয়ের জ্ঞাতা বা ‘দ্রষ্টা’ ভিন্ন রহিয়াই যায় । 


2) উভয়ের অতীত বিষয়ের বিচার করিবার পদ্ধতি


‘দ্রষ্টা’ পুরুষ ‘দৃশ্যজগৎ’ হইতে ভিন্ন, ইহা বিচার করিবার কোন সাধন বা উপায় কি নাই ? এবং ইহা জানিবার কোন মার্গ আছে কি নাই যে, এই দৃশ্য জগতের প্রকৃত স্বরূপ, আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা যেরূপ দেখি তাহাই ঠিক কিংবা তাহা হইতে ভিন্ন ? সাংখ্যবাদী বলেন যে, এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া অসম্ভব বলিয়া প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই তত্ত্ব মূলেই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এইরূপ ধরিয়া লইতে হয় । নিছক্‌ আধিভৌতিক শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে বিচার করিলেও সাংখ্যের উক্ত মত অসঙ্গত বলিতে পারা যায় না । কারণ, জগতের অন্য পদার্থ যেরূপ আমাদের ইন্দ্রিয়ের গোচর হইলে আমরা তাহাদের গুণধর্মের পরীক্ষা করিয়া থাকি, সেইরূপ এই ‘দ্রষ্টা’ পুরুষ যাহাক বেদান্ত ‘আত্মা’ বলেন সে দ্রষ্টার অর্থাৎ আপনারই ইন্দ্রিয়ের ভিন্ন-ভিন্নরূপে কখনও গোচর হইতে পারে না । এবং যে পদার্থ এইরূপ ইন্দ্রিয়ের গোচর হইতে পারে না অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াতীত, মানবী ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাহার পরীক্ষা কি প্রকারে সম্ভব ? ভগবান ভগবদ্গীতাতেও ঐ আত্মার এই প্রকার বর্ণনা করিয়াছেন [গী|২|২৩] -
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্ৰাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ৷
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥
অর্থাৎ আত্মা এরূপ পদার্থ নহে যে জগতের অন্য পদার্থের ন্যায় আমরা তাহার উপর উষ্ণ জল প্ৰভৃতি তরল পদার্থ ঢালিয়া দিলে তাহা দ্রব হইবে, কিংবা প্রয়োগশালার তীক্ষ্ণ শস্ত্রের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া তাহার আন্তরিকস্বরূপ দেখিয়া লইব, অথবা অগ্নির উপর রাখিলে তাহা ধোঁয়া হইয়া যাইবে কিংবা বাতাসে তাহা শুকাইয়া যাইবে ! সারকথা, জাগতিক পদার্থের পরীক্ষা করিবার, আধিভৌতিক শাস্ত্রবেত্তাদিগের যে কোন উপায় আছে সে সমস্ত এস্থলে নিষ্ফল হইয়া যায় । তখন সহজেই প্রশ্ন উঠে যে, তবে আত্মার পরীক্ষা হইবে কি প্রকারে ? প্রশ্নটি কঠিন বলিয়া মনে হয় সত্য; কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলে ইহার মধ্যে কিছুই কঠিন নাই । সাংখ্যবাদীগণও ‘পুরুষকে’ নির্গুণ ও স্বতন্ত্র কিরূপে স্থির করিলেন ? আপন অন্তঃকরণের অনুভূতি হইতেই কি নহে ? তবে এই রীতিই প্রকৃতি ও পুরুষের স্বরূপ নির্ণয়ে কেন প্রয়োগ করা যাইবে না ? আধিভৌতিক শাস্ত্রের বিষয় ইন্দ্রিয়গোচর হইয়া থাকে; এবং অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিষয় ইন্দ্ৰিয়াতীত অর্থাৎ নিছক স্বসম্বেদ্য হয় অথবা আপনিই আপনাকে জানিবার যোগ্য । কেহ যদি এইরূপ বলেন যে, ‘আত্মা’ যদি স্বসম্বেদ্য হয় তবে প্ৰত্যেক মনুষ্যের ঐ বিষয়ে যেরূপ জ্ঞান হইবে তাহাই হইতে দাও; তবে অধ্যাত্মশাস্ত্রের প্রয়োজন কি ? হাঁ, প্রত্যেক মনুষ্যের মন কিংবা অন্তঃকরণ যদি সমান শুদ্ধ হয়, তবে এই প্রশ্ন যোগ্য প্রশ্ন হইবে । কিন্তু যখন সকল লোকের মনের শুদ্ধি ও শক্তি এক প্রকার নহে বলিয়া আমরা জানি, তখন যাঁহাদের মন অত্যন্ত শুদ্ধ, পবিত্র ও বিশাল, তাঁহাদেরই প্ৰতীতি এই বিষয়ে আমাদের প্রমাণ বলিয়া মানিতে হইবে । অনৰ্থক “আমার এইরূপ মনে হয়” কিংবা “তোমার এইরূপ মনে হয়” বলিয়া বাদবিতণ্ডা বাড়াইয়া কোন লাভ নাই । যুক্তিবাদ ছাড়িয়া দেও, বেদান্তশাস্ত্র সে কথা একেবারেই বলে না । বেদান্তশাস্ত্ৰ ইহাই বলে যে, অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিষয় স্বসম্বেদ্য অর্থাৎ নিছক আধিভৌতিক যুক্তির দ্বারা নির্ণীত হইবার নহে বলিয়া যে সকল যুক্তি অত্যন্ত শুদ্ধ, পবিত্র ও বিশাল মন-বিশিষ্ট মহাত্মাদিগের এই বিষয়ে অপরোক্ষ অর্থাৎ সাক্ষাৎ অনুভবের বিরুদ্ধে না যায় সেই সকল যুক্তিই গ্ৰাহ্য হইতে পারে । আধিভৌতিক শাস্ত্ৰে যেরূপ প্ৰত্যক্ষের বিরুদ্ধ অনুভব ত্যাজ্য বলিয়া মানা হয়, সেইরূপ বেদান্তশাস্ত্রে যুক্তি অপেক্ষা উক্ত স্বানুভূতির অর্থাৎ আত্মপ্রতীতির প্রামাণিকতা অধিক বলিয়া বিবেচিত হয় । যে যুক্তি এই অনুভূতির অনুকুল তাহাই বেদান্তীদিগের মান্য । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য আপন বেদান্তসূত্রের ভাষ্যে এই সিদ্ধান্তই দিয়াছেন । অধ্যাত্মশাস্ত্রের অনুশীলনকারীদিগের ইহা সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক –
অচিন্ত্যা খলু যে ভাবা ন তাংস্তর্কেণ সাধয়েৎ ৷
প্রকৃতিভ্যঃ পরং যত্তু তদচিন্ত্যস্য লক্ষণম্ ॥
“ইন্দ্রিয়াতীত হওয়া প্ৰযুক্ত যে পদার্থের চিন্তা করা অসাধ্য তাহার নির্ণয় কেবল তর্কের দ্বারা কিংবা অনুমানের দ্বারা করিবে না; সমস্ত জগতের মূল প্রকৃতিরও বাহিরে যে পদার্থ তাহা এইরূপ অচিন্তনীয়” - এই একটী পুরাতন শ্লোক মহাভারতের মধ্যে [মভা|ভীষ্ম|৫|১২] পাওয়া যায় এবং ‘সাধয়েৎ’ ইহার বদলে ‘যোজয়েৎ’ এইরূপ পাঠভেদে বেদান্তসূত্ৰসম্বন্ধীয় শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ভাষ্যেতেও গৃহীত হইয়াছে [বেসূ|শাং|ভা|২|১|২৭] । মুণ্ডক ও কঠোপনিষদেও আত্মজ্ঞান শুধু তর্কের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় না, ইহা কথিত হইয়াছে [মূং|৩|২|৩; কঠ|২|৮|৯ ও ২২] । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে উপনিষদ্‌ গ্ৰন্থাদির বিশেষ মাহাত্ম্যের কারণও ইহাই । মনকে কি করিয়া একাগ্ৰ করিবে, সে বিষয়ে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে অনেক আলোচনা হইয়া পরিশেষে এই বিষয়ে (পাতঞ্জল) যোগশাস্ত্ৰ নামক এক স্বতন্ত্র শাস্ত্রই রচিত হইয়াছে । যে সকল বড় বড় ঋষি এই শাস্ত্ৰে নিপুণ ছিলেন, এবং স্বভাবতই যাঁহাদের মন পবিত্র ও বিশাল ছিল, সেই সকল মহাত্ম্যাগণ মনকে অন্তর্মুখ করিয়া আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে যে অনুভূতি পাইয়াছিলেন, কিংবা সেই সম্বন্ধে তাঁহাদের শুদ্ধ ও শান্ত বুদ্ধির যে স্ফুরণ হইয়াছিল তাহাই উপনিষদ্‌গ্রন্থে কথিত হইয়াছে । তাই, যে কোন অধ্যাত্মতত্ত্বের নির্ণয়করণে এই শ্রুতিগ্ৰন্থসমূহে কথিত অনুভূতির শরণ গ্ৰহণ ভিন্ন আমাদের অন্য পন্থা নাই [কঠ|৪|১] । মনুষ্য কেবল স্বীয় তীক্ষ্ণবুদ্ধির দ্বারা এই আত্মপ্ৰতীতির পোষক ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের যুক্তি দেখাইতে পারে; কিন্তু তন্নিবন্ধন মূল প্ৰতীতির প্রামাণ্য এতটুকুও ন্যূনাধিক হইতে পারে না । ভগবদ্‌গীতা স্মৃতিগ্রন্থের অন্তৰ্গত সত্য; কিন্তু এই বিষয়ে তাহার যোগ্যতা উপনিষদের সমানই যে স্বীকৃত হয় ইহা প্ৰথম প্রকরণের আরম্ভেই বলিয়াছি । অতএব গীতা ও উপনিষদে প্ৰকৃতির অতীত এই অচিন্ত্য পদার্থ সম্বন্ধে কি কি সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে এই প্রকরণে শেষদিকে কেবল তাহাই উক্ত হইয়াছে; এবং উহাদের কারণের অর্থাৎ, শাস্ত্ররীতিতে উহাদের উপপত্তিয় বিচার পরে করা হইয়াছে ।


3) উভয়ের অতীত একই পরমাত্মা অথবা পরমপুরুষ


প্ৰকৃতি ও পুরুষ, সাংখ্যদিগের এই দ্বৈত ভগবদ্‌গীতার মান্য নহে । গীতান্তর্ভূত অধ্যাত্মজ্ঞানের এবং বেদান্তশাস্ত্রেরও প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই অতীত এক সর্বব্যাপী, অব্যক্ত ও অমৃত তত্ত্ব চরাচর জগতের মূলে আছে । সাংখ্যদিগের প্রকৃতি অব্যক্ত হইলেও ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ । কিন্তু যাহা সগুণ তাহা নশ্বর বলিয়া, এই সগুণ ও অব্যক্ত প্ৰকৃতিরও নাশ হইলে পর শেষে যে কোন অব্যক্ত অবশিষ্ট থাকে, তাহাই সমস্ত জগতের মধ্যে সত্য ও নিত্য তত্ত্ব, প্ৰকৃতিপুরুষ বিচার করিবার সময় এই প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত ভগবদ্‌গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ২০তম শ্লোকে ইহা কথিত হইয়াছে । আরো পরে ১৫ম অধ্যায়ে [গী|১৫|১৭] ক্ষর ও অক্ষর – ব্যক্ত ও অব্যক্ত - সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে এই দুই তত্ত্ব বলিবার পর উক্ত হইয়াছে :- 
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ ৷
যো লোকত্ৰয়মাবিশ্য বিভৰ্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥
অর্থাৎ এই দুই হইতে ভিন্ন যে পুরুষ তিনিই উত্তম পুরুষ, পরমাত্মসংজ্ঞক, অব্যয় ও সর্বশক্তিমান, এবং তিনিই ত্ৰিলোকে ব্যাপ্ত হইয়া তাহাদের সংরক্ষণ করেন । এই পুরুষ ক্ষর ও অক্ষর অর্থাৎ ব্যক্ত ও অব্যক্ত এই দুয়েরই অতীত হওয়ায় তাঁহার যথার্থ সংজ্ঞা ‘পুরুষোত্তম’ হইয়াছে [গী|১৫|৮] । মহাভারতেও ভূগু ঋষি ভরদ্বাজকে ‘পরমাত্মা’ ব্যাখ্যা করিবার সময় বলিয়াছেন -
আত্মা ক্ষেত্ৰজ্ঞ ইত্যুক্তঃ সংযুক্তঃ প্ৰাকৃতৈররগুণৈঃ ৷
তৈরেব তু বিনির্মুক্তঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ ॥
অর্থাৎ “আত্মা যখন প্ৰকৃতিতে বা দেহের মধ্যে বন্ধ থাকে, তখন তাহাকে ক্ষেত্ৰজ (জীবাত্মা) বলে; তাহাই প্ৰাকৃত অর্থাৎ প্রকৃতি বা দেহের গুণ হইতে মুক্ত হইলে তাহার ‘পরমাত্মা’ এই সংজ্ঞা হয় [মভা|শাং|১৮৭|২৪] । ‘পরমাত্মা’র উক্ত দুই ব্যাখ্যা ভিন্ন মনে হওয়া সম্ভব, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা ভিন্ন নহে । ক্ষরাক্ষর জগৎ ও জীব (অথবা সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে, অব্যক্ত প্ৰকৃতি ও পুরুষ) এই দুয়েরই অতীত একই পরমাত্মা আছেন এই কারণেও বলা যায় যে তিনি ক্ষরাক্ষরের অতীত, আবার কখনও বলা যায় যে তিনি জীব বা জীবাত্মার (পুরুষের) অতীত - এইরূপে এক পরমাত্মারই এই দুইটি লক্ষণ কিংবা ব্যাখ্যা করা হইলেও বস্তুত কোন ভিন্নতা হয় না । এই অভিপ্রায় মনে রাখিয়া কালিদাসও কুমারসম্ভবে পরমেশ্বরের বর্ণনা করিয়াছেন যে, পুরুষের লাভের জন্য সচেষ্ট প্রকৃতিও তুমিই, এবং নিজে উদাসীন থাকিয়া সেই প্রকৃতির দ্রষ্টা পুরুষও তুমিই [কুমা|২|১৩] । সেরূপ আবার গীতাতেও ভগবান বলিতেছেন “মম যোনির্মহদ্‌ব্রহ্ম” – এই প্রকৃতি আমার যোনি বা আমার এক স্বরূপ [১৪|৩] এবং জীব বা আত্মাও আমারই অংশ [১৫|৭] । ৭ম অধ্যায়েও ভগবান বলিতেছেন যে, - 
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ ৷
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥
অর্থাৎ “পৃথ্বী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, এই আট প্রকারের আমার প্রকৃতি; ইহা ব্যতীত (অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং) সমস্ত জগৎ যাহা ধারণ করিয়া আছে সেই জীবও আমার অপর প্রকৃতি [গী|৭|৪,৫] । মহাভারতের শান্তিপর্বের অনেক স্থানে সাংখ্যের পঁচিশ তত্ত্বের বিচার করা হইয়াছে; কিন্তু সেখানে ইহাও বলা হইয়াছে যে, এই পঁচিশ তত্ত্বের অতীত ষড়বিংশতম এক পরম তত্ত্ব আছে, যাঁহাকে জানিতে না পারিলে মনুষ্য ‘বুদ্ধ’ হয় না [শাং|৩০৮] । আমাদের নিজের জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা জাগতিক পদার্থের যে জ্ঞান হয় তাহাই আমাদের সমস্ত জগৎ; তাই প্ৰকৃতি বা জগতকেই কখন কখন “জ্ঞান” এই নাম দেওয়া হয় এবং এই দৃষ্টিতে ‘পুরুষ’ জ্ঞাত বলিয়া উক্ত হয় [শাং|৩|৬|৩৫-৪১] । কিন্তু প্ৰকৃত ‘জ্ঞেয়’ যিনি [গী|১৩|১২] । তিনি প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই, অর্থাৎ জ্ঞান ও জ্ঞাতা উভয়েরই অতীত হওয়ায় গীতায় তাহাকেই ‘পরমপুরুষ’ বলা হইয়াছে । ত্ৰিলোক ব্যাপ্ত করিয়া তাহার ধারয়িতা এই যে পরম বা পর-পুরুষ, তাঁহাকে জানো, তিনি এক, অব্যক্ত, নিত্য, ও অক্ষর, - এ কথা শুধু ভগবদ্‌গীতা নহে, বেদান্তশাস্ত্রের সকল গ্ৰন্থই উচ্চকণ্ঠে বলিয়াছেন । ‘অক্ষর’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই বিশেষণ বা শব্দ সাংখ্যশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতির উদ্দেশে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে; কারণ, জগতের প্রকৃতি অপেক্ষা সূক্ষ্মতর অন্য কোন মূল কারণ নাই, ইহাই সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্ত [সাং|কা|৬১] । কিন্তু বেদান্তদৃষ্টিতে দেখিলে, পরব্ৰহ্মই এক অ-ক্ষর হন অর্থাৎ তাঁহার কখন নাশ হয় না; তিনিই অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর; অতএব গীতায় ‘অক্ষর’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই শব্দই প্ৰকৃতির অতীত পরব্রহ্মের স্বরূপ দেখাইবার জন্যও প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে, এই বিষয় পাঠকের সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক [গী|৮|২০; ১১|৩৭; ১৫|১৬, ১৭] । বেদান্তের এই প্রকার দৃষ্টি স্বীকার করিলে, প্ৰকৃতি অব্যক্ত হইলেও তাহাকে ‘অক্ষর’ বলা যে ঠিক নহে, এ কথা সত্য । জগদ্যুৎপত্তিক্ৰমসম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত সাংখ্যদিগের নিশ্চিত পরিভাষাতে কোন অদলবদল না করিয়া তাঁহাদের শব্দেই গীতাতে ক্ষরাক্ষর কিংবা ব্যক্তাব্যক্ত জগতের বর্ণনা করা হইয়াছে; কিন্তু মনে রেখো যে, এই বর্ণণ হইতে প্রকৃতি ও পুরুষের অতীত এই তৃতীয় উত্তম পুরুষের সর্বশক্তিত্বে কোন বাধা আসে না । সেইজন্য গীতারও মান্য, তাই, ভগবদ্‌গীতাতে পরব্রহ্মের স্বরূপ বলিবার যেখানে প্ৰসঙ্গ আসিয়াছে, সেখানে সাংখ্য ও বেদান্তের মতান্তর বিষয়ক সন্দেহ মিটাইবার জন্য, (সাংখ্য) অব্যক্তেরও অতীত অব্যক্ত এবং (সাংখ্য) অক্ষরেরও অতীত অক্ষর এইরূপ ভাষা প্রয়োগ করা আবশ্যক হইয়াছে । উদাহরণ যথা – এই প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত শ্লোক দেখ । সারকথা, গীতা পড়িবার সময় সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক যে, ‘অব্যক্ত’ এবং ‘অক্ষর’ এই দুই শব্দই কখন সাংখ্যদিগের প্রকৃতির উদ্দেশে, এবং কখন বেদান্তের পরব্রহ্মের উদ্দেশে - অর্থাৎ দুই বিভিন্ন প্ৰকারে গীতায় প্ৰযুক্ত হইয়াছে । সাংখ্যদিগের অব্যক্ত প্ৰকৃতিরও অতীত অপর অব্যক্তই, বেদান্তের মতে জগতের মূল । জগতের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে সাংখ্য ও বেদান্তের মধ্যে ইহাই উপরি-উক্ত পার্থক্য । এই পার্থক্য হইতে অধ্যাত্মশাস্ত্রোক্ত মোক্ষের স্বরূপ এবং সাংখ্যদিগের মোক্ষস্বরূপে কিরূপ পার্থক্য হইয়াছে তাহা পরে বলা যাইবে ।


4) প্রকৃতি (জগৎ), পুরুষ (জীব) এবং পরমেশ্বর, এই ত্রয়ী


প্ৰকৃতি ও পুরুষ, সাংখ্যদের এই দ্বৈতকে না মানিয়া, যখন ইহা স্বীকার করা হইয়াছে যে, এই জগতের মূলে পরমেশ্বররূপী অথবা পুরুষোত্তমরূপী এক তৃতীয় নিত্য তত্ত্ব আছে এবং প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই তাঁহার বিভূতি, তখন সহজেই এই প্রশ্ন আসে যে, এই তৃতীয় মূলভূত তত্ত্বের স্বরূপ কি, এবং প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়ের সহিত উহার কি সম্বন্ধ ? প্ৰকৃতি, পুরুষ ও পরমেশ্বর - এই ক্ৰয়ীকে অধ্যাত্মশাস্ত্রে, যথাক্রমে জগৎ, জীব ও পরব্রহ্ম বলা হয়; এবং এই তিন বস্তুরই স্বরূপ ও ইহাদের পরম্পরসম্বন্ধ নির্ণয় করাই বেদান্তশাস্ত্রের মুখ্য কার্য; উপনিষদেও ইহারই আলোচনা করা হইয়াছে । কিন্তু এই বিষয়ে সমস্ত বেদান্তের মতের ঐক্য নাই । কেহ কেহ মনে করেন যে, এই তিন পদার্থ মুলে একই; এবং কেহ বা মনে করেন যে, জীব ও জগৎ পরমেশ্বর হইতে আদিতেই অল্প বা অত্যন্ত ভিন্ন । ইহা হইতেই বেদান্তীদিগের অদ্বৈতী, বিশিষ্টাদ্বৈতী ও দ্বৈতী এইরূপ ভেদ হইয়াছে । জীব ও জগতের সমস্ত ব্যবহার পরমেশ্বরের ইচ্ছায় চলিতেছে এই সিদ্ধান্ত সকলেরই সমান গ্ৰাহ্য । কিন্তু কতক লোক বলেন যে, জীব, জগত ও পরব্রহ্ম এই তিন বস্তুর মূলস্বরূপ আকাশের ন্যায় এক ও অখণ্ড; আবার অন্য বেদান্তী বলেন যে, জড় ও চৈতন্য এক হইতে পারে না বলিয়া, দাড়িমের ফলের অনেক দানা থাকিলেও তাহার ফলের একত্ব যেমন লোপ পায় না, তেমনি জীব ও জগৎ পরমেশ্বরের মধ্যে ওতপ্ৰোত থাকিলেও উহা পরমেশ্বর হইতে মূলেতে ভিন্ন এবং তিনিই “এক” বলিয়া যখন উপনিষদে বর্ণিত হয় তখন তাহার অর্থে ‘দাড়িমের ফলের ন্যায় এক” এইরূপ বুঝিতে হইবে । জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে যখন এই মতান্তর উপস্থিত হইল, তখন ভিন্ন ভিন্ন সাম্প্রদায়িক টীকাকার নিজ নিজ মতানুসারে উপনিষদসমূহের এবং গীতারও শব্দসকলের টানিয়া বুনিয়া অৰ্থ বাহির করিতে লাগিলেন । তাহার পরিণামে গীতার প্রকৃত স্বরূপ - উহার প্রতিপাদ্য সত্য - কর্মযোগ বিষয় তো একপাশে থাকিয়া গেল এবং অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের মতে গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইহাই হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, গীতা বেদান্তের দ্বৈতমতের বা অদ্বৈতমতের ! হৌক; এই সম্বন্ধে বেশী বিচার করিবার পূর্বে ইহাই দেখিতে হইবে যে, জগৎ (প্ৰকৃতি), জীব, (আত্মা কিংবা পুরুষ), এবং পরব্রহ্ম (পরমাত্মা কিংবা পুরুষোত্তম) ইহাদের পরস্পর সম্বন্ধবিষয়ে স্বয়ং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ গীতায় কি বলিয়াছেন । এই বিষয়ে গীতা ও উপনিষদ উভয়েরই যে একই মত এবং গীতার সমস্ত বিচার উপনিষদে যে প্ৰথমেই আসিয়াছে, পরবর্তী বিচার হইতে পাঠকদিগের তাহা উপলব্ধি হইবে ।


5) গীতাতে বর্ণিত পরমেশ্বরের স্বরূপ


প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই উভয়েরই অতীত যে পুরুষোত্তম পর-পুরুষ, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম, তাঁহার বর্ণনা করিবার সময় ভগবদ্‌গীতায় প্ৰথমে তাহার ব্যক্ত ও অব্যক্ত (দৃষ্টির গোচর ও দৃষ্টির অগোচর) এই দুই স্বরূপ কথিত হইয়াছে । 


5.1) ব্যক্ত অথবা সগুণ রূপ এবং উহার গৌণতা


তন্মধ্যে ব্যক্ত স্বরূপ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়-গোচর রূপ যে সগুণই হইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই । বাকী রহিল অব্যক্ত । এই অব্যক্ত রূপ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও উহা যে নির্গুণই হইবে, তাহা বলা যাইতে পারে না । কারণ, আমাদের দৃষ্টিগোচর না হইলেও, তাহার মধ্যে সকল গুণই সুক্ষ্মরূপে থাকিতে পারে । তাই, অব্যক্তেরও সগুণ, সগুণ-নির্গুণ ও নির্গুণ এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । ‘গুণ’ শব্দে শুধু মনুষ্যের বহিরিন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা নহে, মনের দ্বারাও যে সকল গুণের জ্ঞান হয়, সেই সমস্ত গুণই এই স্থলে বিবক্ষিত হইয়াছে । পরমেশ্বরের মূর্তিমান অবতার ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ স্বয়ং সাক্ষাৎ অর্জুনের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া উপদেশ করিতেছিলেন, তাই গীতার স্থানে স্থানে তিনি আপনার সম্বন্ধে প্ৰথম পুরুষের নির্দেশ এই প্ৰকার করিয়া ছিলেন - যথা, “প্ৰকৃতি আমার স্বরূপ” [৯|৮], “জীব আমার অংশ” [১৫|৭], “সমস্ত ভূতের অন্তরাত্মা আমি” [১০|২০], “জগতে যে যে শ্ৰীমান্‌ কিংবা বিভূতিমান মূর্তি আছে সে সমস্ত আমার অংশ হইতে হইয়াছে” [৪০|৪১], “আমার পরে মন রাখিয়া আমার ভক্ত হও” [৯|৩৪], “তবে তুমি আমারই সহিত মিলিত হইবে, তুমি আমার প্রিয় ভক্ত বলিয়া তোমাকে আমি ইহা নিশ্চয় করিয়া বালিতেছি” [১৮|৬৫] । এবং যখন নিজের বিশ্বরূপ দেখাইয়া অর্জুনকে ইহা প্ৰত্যক্ষ উপলব্ধি করাইলেন যে, সমস্ত চরাচর জগৎ আপনি ব্যক্ত স্বরূপেই ওতপ্ৰোত হইয়া আছে, তখন ভগবান তাঁহাকে এই উপদেশ করিলেন যে, অব্যক্ত রূপ অপেক্ষা ব্যক্তরূপের উপাসনা করা অধিক সহজ; তাই তুমি আমার উপরই তোমার ভক্তি স্থাপন কর [গী|১২|৮] আমিই ব্ৰহ্মের, অব্যয় মোক্ষের, শাশ্বত ধর্মের ও নিত্য সুখের মূল স্থান [গী|১৪|২৭] । ইহা দ্বারা জানা যায় যে, আরম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত গীতার অধিকাংশ স্থলেই ভগবানের ব্যক্ত স্বরূপই মুখ্যরূপে বৰ্ণিত হইয়াছে ।


5.2) অব্যক্ত কিন্তু মায়া দ্বারা ব্যক্ত


এইটুকু হইতেই নিছক ভক্তিমানী পণ্ডিত ও টীকাকারগণ এই মত প্ৰকাশ করিয়াছেন যে, গীতাতে পরমেশ্বরের ব্যক্ত রূপই অন্তিম সাধ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে; কিন্তু তাহা সত্য বলিয়া মানিতে পারা যায় না । কারণ, উপরিউক্ত বৰ্ণনার সঙ্গেই ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, আমার ব্যক্ত স্বরূপ মায়িক, এবং তাহার অতীত (পর) অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর স্বরূপই আমার সত্য স্বরূপ । উদাহরণ যথা সপ্তম অধ্যায়ে বলিয়াছেন -
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ৷
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥
অর্থাৎ - “আমি অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও অজ্ঞান লোক আমাকে ব্যক্ত মনে করে, এবং ব্যক্তের অতীত আমার শ্রেষ্ঠ ও অব্যয় স্বরূপ তাহারা জানে না”; এবং ইহার পরবর্তী শ্লোকে [৭|২৫], ভগবান বলিতেছেন যে, “আমি আমার যোগমায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় মূর্খ লোক আমাকে জানে না ।” আবার চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি আপন ব্যক্ত স্বরূপের উপপত্তি এই প্রকার বলিয়াছেন - “আমি জন্মবিরহিত ও অব্যয় হইলেও আপন প্ৰকৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া আমি নিজ মায়ার দ্বারা (স্বাত্মমায়য়া) জন্মগ্রহণ করি অর্থাৎ ব্যক্ত হইয়া থাকি” [৪-৬] । এবং পরে সপ্তম অধ্যায়ে বলিতেছেন - “এই ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি আমার দৈবী মায়া; এই মায়াকে যে কাটাইয়া উঠে সে-ই আমাকে প্রাপ্ত হয়, এবং সেই মায়ার দ্বারা যাহার জ্ঞান নষ্ট হয় সেই মূঢ় নরাধম আমার সহিত মিলিত হইতে পারে না” [৭|১৫] । শেষে আঠারো অধ্যায়ে [১৮|৬১] ভগবান উপদেশ করিয়াছেন -“হে অর্জুন ! সমস্ত প্ৰাণীর হৃদয়ে জীবরূপে পরমাত্মাই বাস করেন, এবং তিনি আপন মায়ার দ্বারা সমস্ত প্ৰাণীকে যন্ত্রের ন্যায় ঘুরাইয়া থাকেন ।” অর্জুনকে ভগবান যে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছেন তাহাই ভগবান নারদকেও দেখাইয়াছিলেন, এইরূপ মহাভারতের শান্তিপর্বান্তর্গত নারায়ণী প্রকরণে কথিত হইয়াছে [শাং|৩৩৯]; এবং নারায়ণীয় কিংবা ভাগবত ধর্মই গীতার প্রতিপাদ্য ইহা আমি প্ৰথম প্রকরণেই দেখাইয়াছি । নারদকে এইরূপ সহস্ৰ চক্ষুর, রঙ্গের এবং অন্য দৃশ্য গুণের বিশ্বরূপ দেখাইবার পর ভগবান বলিয়াছেন -
মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ ৷
সর্বভুতগুণৈর্যুক্তং নৈবং ত্বং জ্ঞাতুমৰ্হসি ॥
“তুমি আমার যে রূপ দেখিতেছ তাহা আমার উৎপাদিত মায়া; ইহা হইতে তুমি এরূপ বুঝিও না যে, সমস্ত ভূতের গুণের দ্বারা আমি যুক্ত ।” আবার ইহা বলিয়াছেন যে, “আমার প্রকৃত স্বরূপ সর্বব্যাপী, অব্যক্ত ও নিত্য এবং তাহা সিদ্ধপুরুষেরা জানেন,” [শাং|৩৩৯|৪৪|৪৮] । এইজন্য, বলিতে হয় যে, গীতায় বর্ণিত অর্জুনকে ভগবানের প্রদর্শিত বিশ্বরূপও মায়িকই ছিল । সারকথা, উপসনার নিমিত্ত ভগবান গীতায় ব্যক্ত স্বরূপের প্রশংসা করিলেও পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠস্বরূপ অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর; এবং সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত হওয়াই তাঁহার মায়া; এবং এই মায়া কাটাইয়া শেষে পরমাত্মার শুদ্ধ ও অব্যক্ত স্বরূপের জ্ঞান না হইলে মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয় না, ইহাই, যে গীতার সিদ্ধান্ত, তাহা উপরি-উক্ত বিচার হইতে নিঃসন্দেহ দেখা যায় । মায়া জিনিসটা কি তাহার অধিক বিচার পরে করিব । উপরে প্রদত্ত বচনাদি হইতে এইটুকু স্পষ্ট হইতেছে যে, এই মায়াবাদ শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য নূতন বাহির করেন নাই, তাহার পূর্বে তাহা ভগবদ্‌গীতায়, মহাভারতে এবং ভাগবত ধর্মেতেও গ্রাহ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিল । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও জগতের উৎপত্তি এইরূপ প্ৰদত্ত হইয়াছে । “মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনিং তু মহেশ্বরং” [শ্বেতা|৪|১০] অর্থাৎ মায়াই (সাংখ্যের) প্ৰকৃতি, এবং পরমেশ্বর সেই মায়ার অধিপতি; তিনিই আপন মায়া দ্বারা বিশ্ব নির্মাণ করেন ।


5.3) অব্যক্তেরই তিন ভেদ - সগুণ, নির্গুণ ও সগুণ-নির্গুণ


পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠস্বরূপ ব্যক্ত নহে, অব্যক্ত, - ইহা এখন স্পষ্ট হইলেও, এই শ্ৰেষ্ঠ অব্যক্তস্বরূপ সগুণ বা নির্গুণ ইহারও এইখানে কিছু বিচার করা আবশ্যক । কারণ, যখন সগুণ অব্যক্তের আমার সম্মুখে এই এক উদাহরণ আছে যে, সাংখ্যশাস্ত্রের প্রকৃতি অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও সগুণ অর্থাৎ সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী, তখন কাহারও কাহারও মতে পরমেশ্বরের অব্যক্ত ও শ্রেষ্ঠ স্বরূপও ঐ প্রকার সগুণ বলিয়া মানিতে হয় । আপন মায়ার দ্বারাই হোক না কেন; কিন্তু যখন ঐ অব্যক্ত পরমেশ্বর ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ করেন [গী|৯|৮] এবং সকলের হৃদয়ে থাকিয়া তাহাদের দ্বারাই সমস্ত ব্যাপার করাইয়া থাকেন [১৮|৬১], যখন তিনি সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু [৯|২৪], যখন প্ৰাণীদিগের সুখ-দুঃখাদি সমস্ত ‘ভাব’ তাঁহা হইতে উৎপন্ন হয় [১০|৫], এবং যখন প্রাণীগণের হৃদয়ে শ্ৰদ্ধা উৎপাদনকারীও তিনিই এবং “লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়ৈব বিহিতান্‌ হি তান্‌” [৭|২২] - প্ৰাণীদিগের বাসনার ফলদাতাও তিনিই; তখন তো এই কথাই সিদ্ধ হইতেছে যে, তিনি অব্যক্ত অৰ্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর হইলেও দয়া, কর্তৃত্ব প্রভৃতি গুণের দ্বারা যুক্ত সুতরাং ‘সগুণ’ । কিন্তু উল্টাপক্ষে ভগবান এইরূপও বলিতেছেন যে “ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি” - কর্ম অর্থাৎ গুণও আমাকে কখন স্পৰ্শ করিতে পারে না [৪|১৪]; প্ৰকৃতির গুণের দ্বারা মোহ প্ৰাপ্ত হইয়া মূর্খলোক আত্মাকেই কর্তা বলিয়া মনে করে [৩|২৭; ১৪|১৯]; কিংবা এই অব্যয় ও অকর্তা পরমেশ্বরই প্ৰাণিমাত্রের হৃদয়ে জীবরূপে থাকা প্ৰযুক্ত [১৩|৩১], প্ৰাণিমাত্রের কর্তৃত্ব ও কর্ম এই দুই হইতেই বস্তুত তিনি অলিপ্ত হইলেও অজ্ঞানে অভিভূত লোক মোহে পতিত হয় [৫|১৪,১৫] । এই প্রকার অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর পরমেশ্বরের স্বরূপ-সগুণ ও নির্গুণ - এই দুই প্রকারেই বর্ণিত হইয়াছে এরূপ নহে; কিন্তু কোন কোন স্থলে এই দুই রূপকে একত্রে মিশাইয়া পরমেশ্বরের বর্ণনা করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা – “ভূতভৃৎ ন চ ভূতস্থো” [৯|৫] – আমি ভূতসমূহের আধার হইলেও তাহাদের মধ্যে আমি নাই; “পরব্রহ্ম সৎও নহেন অসৎও নহেন” [১৩|১২]; “সর্বেন্দ্রিয় আছে বলিয়া প্রতিভাত অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত; এবং নির্গুণ হইয়াও গুণের উপভোক্তা” [১৩|১৪]; “দূরে এবং নিকটেও আছেন” [১৩|১৫]; “অবিভক্ত অথচ বিভক্তরূপে দৃষ্ট” [১৩|১৬] - এইপ্ৰকার পরমেশ্বর-স্বরূপের পরস্পরবিরুদ্ধ অর্থাৎ সগুণ-নির্গুণমিশ্রিত বর্ণনাও করা হইয়াছে । তথাপি প্রারম্ভে দ্বিতীয় অধ্যায়েই বলা হইয়াছে যে, “এই আত্মা, অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকার্য” [২|২৫]; আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে “এই পরমাত্মা অনাদি, নির্গুণ ও অব্যয় হওয়া প্ৰযুক্ত শরীরের মধ্যে থাকিলেও কিছুই করেন না এবং তিনি কিছুতেই লিপ্ত হন না” [১৩|৩১] । এইরূপ পরমাত্মার শুদ্ধ, নির্গুণ, নিরবয়ব, নির্বিকার, অচিন্ত্য, অনাদি ও অব্যক্ত স্বরূপেরই শ্রেষ্ঠত্ব গীতায় বর্ণিত হইয়াছে ।


6) উপনিষদে উপাসনার জন্য ব্যাখ্যাত বিদ্যা ও প্রতীক


ভগবদ্‌গীতার ন্যায় উপনিষদেও অব্যক্ত পরমেশ্বরের স্বরূপ কখন সগুণ, কখন সগুণ-নির্গুণ এইরূপ উভয়বিধ এবং কখন শুদ্ধ নির্গুণ, এই তিন প্ৰকার বর্ণিত হইয়াছে দেখা যায় । উপাসনায় সর্বদা প্ৰত্যক্ষ মূর্তিই চোখের সম্মুখে থাকিতে হইবে এমন কোন কথা নাই । নিরাকার অর্থাৎ চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগোচর স্বরূপের উপাসনাও হইতে পারে । কিন্তু যাঁহার উপাসনা করিতে হইবে তিনি চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের গোচর না হইলেও, মনের গোচর না হইলে তাঁহার উপাসনা হইতে পারে না । উপাসনা অর্থে চিন্তন, মনন বা ধ্যান । চিন্তিত বস্তুর কোন রূপ না থাকিলেও অন্য কোনও গুণ মনের উপলব্ধি না হইলে মন কিসের চিন্তা করিবে ? তাই উপনিষদে যে যে স্থানে অব্যক্ত অর্থাৎ চক্ষের অগ্রাহ্য পরমাত্মার উপাসনা (চিন্তন, মনন, ধ্যান) কথিত হইয়াছে, সেই সেই স্থানে অব্যক্ত পরমেশ্বর সগুণ বলিয়াই কল্পিত হইয়াছেন । পরমাত্মা সম্বন্ধে কল্পিত এই গুণ উপাসকের অধিকার অনুসারে ন্যূনাধিক ব্যাপক বা সাত্ত্বিক হইয়া থাকে; এবং যাহার যেরূপ নিষ্ঠা তাহার সেইরূপ ফলও লাভ  হয় । ছান্দোগ্যোপনিষদে [৩|১৪|১] উক্ত হইয়াছে, “পুরুষ ক্রতুময়, যাহার যেরূপ ক্রতু (নিশ্চয়), মরিবার পর সে সেইরূপই ফল প্ৰাপ্ত হয়”, এৰং ভগবদ্‌গীতাতেও কথিত হইয়াছে যে, “দেবতাদের প্রতি ভক্তিমান দেবতাদের সহিত এবং পিতৃগণের প্রতি ভক্তিমান পিতৃগণের সহিত গিয়া মিলিত হয়েন” [গী|৯|২৫], অথবা “যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ” - যাহার যেরূপ শ্ৰদ্ধা তাহার সেইরূপ সিদ্ধি লাভ হয় [১৭|৩] । তাৎপর্য এই যে, উপাসকের অধিকারভেদে উপাস্য অব্যক্ত পরমাত্মার গুণও উপনিষদে ভিন্ন ভিন্নরূপে বর্ণিত হইয়াছে । উপনিষদের এই প্রকরণকে ‘বিদ্যা’ বলে । বিদ্যা ঈশ্বরপ্রাপ্তির (উপাসনারূপ) মাৰ্গ, এবং এই মাৰ্গ যে প্রকরণে কথিত হইয়া থাকে, তাহাও শেষে ‘বিদ্যা’ নামে অভিহিত হয় । শাণ্ডিল্যবিদ্যা [ছাং|৩|১৪]পুরুষবিদ্যা [ছাং|৩|১৬,১৭]পর্যঙ্কবিদ্যা [কৌষী|১]প্রাণোপাসনা [কোষী|২] ইত্যাদি অনেক প্রকারের উপাসনা উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে এই সকল বিষয়ের বিচার করা হইয়াছে । এই প্রকরণে অব্যক্ত পরমাত্মার সগুণ বৰ্ণন এই প্রকারে করা হইয়াছে যে তিনি মনোময়, প্ৰাণশরীর, ভারূপ, সত্যসঙ্কল্প, আকাশাত্মা, সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ ও সর্বারস [৩|১৪|২] । তৈত্তিরীয়োপনিষদে তো অন্ন, প্ৰাণ, মন, জ্ঞান বা আনন্দ - এই সকল রূপেও পরমাত্মাৱ ক্ৰমোচ্চ উপাসনা কথিত হইয়াছে [তৈা|২,১-৫; ৩|২-৬] । বৃহদারণ্যকে [২|১] অজাতশত্রুকে গাৰ্গ্য বালাকী সর্বপ্রথম আদিত্য, চন্দ্ৰ, বিদ্যুৎ, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল বা দিক্‌সমূহে অধিষ্ঠিত পুরুষসমূহেরই ব্ৰহ্মরূপে উপাসনা কথিত হইয়াছে; কিন্তু পরে প্রকৃত ব্ৰহ্ম এই সকলেরও অতীত, ইহা অজাতশত্রু তাহাকে বলিয়া শেষে প্ৰাণোপাসনাকেই মুখ্য প্রতিপাদন করিয়াছেন । ইহাতেই এই পরম্পরা কিছু সম্পূর্ণ হয় না । উপরি-উক্ত সমস্ত ব্ৰহ্মরূপকে ‘প্রতীক’ অৰ্থাৎ এই সকলকে উপাসনার জন্য কল্পিত গৌণ ব্ৰহ্মস্বরূপ কিংবা ব্রহ্মনিদর্শক চিহ্ণ বলা যায়; এবং এই গৌণ রূপকেই কোন মূর্তির রূপে চোখের সামনে রাখিলে তাহাকেই ‘প্ৰতিমা’ বলা হয় । কিন্তু মনে রেখো, সমস্ত উপনিষদের ইহাই সিদ্ধান্ত যে, প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ ইহা হইতে ভিন্ন [কেন|১|২-৮] । এই ব্ৰহ্মের লক্ষণ বৰ্ণনা করিবার সময় কোন স্থানে “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম” [তৈত্তি|২|১] কিংবা “বিজ্ঞানমানন্দং ব্ৰহ্ম” [বৃ|৩|৯|২৮] বলা হইয়াছে; অর্থাৎ ব্ৰহ্ম সত্য (সৎ), জ্ঞান (চিৎ) এবং আনন্দ রূপ অৰ্থাৎ সচ্চিদানন্দস্বরূপ, - এই প্রকারে তিনগুণেরই মধ্যে সমস্ত গুণের সমাবেশ করিয়া বৰ্ণন করা হইয়াছে । এবং অন্যস্থানে, ভগবদ্‌গীতারই ন্যায় পরস্পরবিরুদ্ধ গুণসমূহ একত্ৰ করিয়া ব্ৰহ্মের বর্ণন এইপ্ৰকার করা হইয়াছে যে, “ব্ৰহ্ম সৎও নহেন, অসৎও নহেন” [ঋ|১০|১৯০] অথবা “অণোরণীয়ান্‌ মহতো মহীয়ান্‌” অর্থাৎ অণু অপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ অপেক্ষাও বৃহৎ [কঠ|২|২০]“তদেজতি তন্নৈজতি তদ্‌দূরে তদ্বন্তিকে” অর্থাৎ তিনি চলেন এবং চলেন না, তিনি দূরেও আছেন, এবং নিকটেও আছেন [ঈশ|৫; মুং|৩|১|৭], অথবা ‘সর্বেন্দ্ৰিয়গুণাভাস’ অথচ ‘সর্বেন্দ্ৰিয়বিবর্জিত’ [শ্বেতা|৩|১৭] । যম নচিকেতাকে এই জ্ঞানোপদেশ দিয়াছেন যে, শেষে উপযুক্ত সমস্ত লক্ষণ ছাড়িয়া দিয়া ধর্ম ও অধর্মের, কৃত ও অকৃতের, কিংবা ভূত ও ভব্যেরও অতীত যিনি তাঁহাকেই ব্ৰহ্ম বলিয়া জান [কঠ|২|১৪] । এইপ্ৰকার মহাভারতের নারায়ণীয় ধর্মে ব্ৰহ্মা রুদ্রকে [মভা|শাং|৩৫১|১১], এবং মোক্ষধর্মে নারদ শুকদেবকে বলিয়াছেন [৩৩১|৪৪] । বৃহদারণ্যক উপনিষদেও [২|৩|২] পৃথিবী, জল ও অগ্নি, এই তিনটীকে ব্ৰহ্মের মূর্তরূপ বলা হইয়াছে; আবার বায়ু ও আকাশকে অমূর্তরূপ বলিয়া দেখানো হইয়াছে যে, এই অমূর্তের সারভূত পুরুষের রূপ বা রং বদল হয়; এবং শেষে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, ‘নেতি নেতি’ অর্থাৎ এতক্ষণ পর্যন্ত যাহা কিছু বলা হইল, তাহা নহে, তাহা ব্ৰহ্ম নহে, - এই সমস্ত নামরূপাত্মক মূর্ত বা অমূর্ত পদার্থের অতীত (পর) যে ‘অগৃহ্য’ বা ‘অবৰ্ণনীয়’ আছেন তাঁহাকেই পরব্রহ্ম জানিবে [বৃহ|২|৩|৬ এবং বেসূ|৩|২|২২] । অধিক কি, যে যে পদার্থের কোন নাম দেওয়া যাইতে পারে সেই সমস্তেরও অতীত যিনি, তিনিই পরব্ৰহ্ম এবং সেই ব্ৰহ্মের অব্যক্ত ও নির্গুণ স্বরূপ দেখাইবার জন্য ‘নেতি নেতি’ এই এক ক্ষুদ্র নির্দেশ, আদেশ বা সূত্রই হইয়া গিয়াছে এবং বৃহদারণ্যকোপনিষদেই উহার চারিবার প্রয়োগ হইয়াছে [বৃহ|৩|৯|২৬; ৪|২|৪; ৪|৪|২২; ৪|৫|১৫] । সেইরূপ অন্য উপনিষদেও পরব্রহ্মের নির্গুণ ও অচিন্ত্যরূপের বর্ণন পাওয়া যায়, যথা - “যতো বাচো নিবৰ্ত্তন্তে অপ্ৰাপ্য মনসা সহ” [তৈত্তি|২|৯]; “অদ্রেশ্যং (অদৃশ্য), অগ্ৰাহ্য” [মুং|১|১|৬] “ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা” [মুং|৩|১|৮] – চোখে দেখা যায় না কিংবা নাক্যের দ্বারা বলা যায় না; অথবা -
অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ ৷
অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মত্যুমুখাৎ প্ৰমুচ্যতে ॥
অর্থাৎ সেই পরব্রহ্ম পঞ্চ মহাভূতের শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচ গুণবিরহিত, অনাদি, অনন্ত, ও অব্যয় [কঠ|৩|১৫; বেসূ|৩|২|২২-৩০ দেখ] । মহাভারতের শান্তিপর্বে নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মের বর্ণনাতেও ভগবান নারদকে আপন বাস্তব স্বরূপ “অদৃশ্য, অঘ্রেয়, অস্পৃশ্য, নির্গুণ, নিষ্ফল (নিরবয়ব), অজ, নিত্য, শাশ্বত ও নিষ্ক্রিয়” এইরূপ বলিয়া তিনিই জগতের উৎপত্তি ও প্ৰলয়কর্তা ত্ৰিগুণাতীত পরমেশ্বর, এবং ইহাঁকেই ‘বাসুদেব পরমাত্মা’ বলা হয়, এইরূপ বলিয়াছেন [মভা|শাং|৩৩৯|২১-২৮] ।


7) ত্রিবিধ অব্যক্তরূপের মধ্যে নির্গুণই শ্রেষ্ঠ


উপরি-উক্ত বচনাদি হইতে উপলব্ধি হইবে যে, শুধু ভগবদ্‌গীতায় নহে, মহাভারতের অন্তৰ্গত নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মে এবং উপনিষদেও পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্ত স্বরূপই শ্রেষ্ঠ স্বীকৃত হইয়াছে, এবং এই শ্ৰেষ্ঠ অব্যক্ত স্বরূপ সেখানে সগুণ, সগুণ-নির্গুণ ও শেষে কেবল নিগুৰ্ণ এই তিনপ্রকারে বর্ণিত হইয়াছে । এখন প্রশ্ন এই যে, অব্যক্ত ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপের এই তিন পরস্পর-বিরোধী রূপের মিল কিরূপে করা যাইবে ? এই তিনের মধ্যে সগুণ-নিগুৰ্ণ অর্থাৎ উভয়াত্মক যে রূপ তাহা সগুণ হইতে নির্গুণে (কিংবা অজ্ঞেয়ে) যাইবার সোপান বা সাধন এইরূপ বলা যাইতে পারে । কারণ, প্ৰথমে সগুণ রূপের জ্ঞান হইলে পরই আস্তে আস্তে এক এক গুণ ছাড়িয়া দিলে নির্গুণ স্বরূপের অনুভব হইতে পারে এবং এই পদ্ধতি অনুসারেই ব্ৰহ্মপ্রতীকের ক্ৰমোচ্চ উপাসনা উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগুবল্লীতে বরুণ ভৃগুকে প্ৰথমে এই উপদেশ দিলেন যে, অন্নই ব্ৰহ্ম; তদনন্তর ক্রমে ক্রমে প্ৰাণ, মন, বিজ্ঞান ও আনন্দ এই ব্ৰহ্মস্বরূপের জ্ঞান তাঁহাকে দিলেন [তৈত্তি|৩|২-৬] । কিংবা এরূপও বলা যাইতে পারে যে, গুণবোধক বিশেষণের দ্বারা কেহ নির্গুণের বর্ণনা কখনই করিতে পারে না বলিয়া, অগত্যা পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের দ্বারাই তাঁহার বর্ণনা করিতে হয় । কারণ, ‘দূর’ বা ‘সৎ’ শব্দ উচ্চারণ করিবামাত্র অন্য কোন বস্তু ‘নিকট’ বা ‘অসৎ’ এইরূপ পরোক্ষ ভাবে আমাদের মনে উপলব্ধি হইয়া থাকে । কিন্তু একই ব্ৰহ্ম যদি সর্বব্যাপী হয়েন তবে পরমেশ্বরকে ‘দূর’ বা ‘সৎ’ বিশেষণ দিয়া ‘নিকট’ বা ‘অসৎ’ কাহাকে বলিব ? এই অবস্থাতে ‘দূর নহেন, নিকট নহেন; সৎ নহেন, অসৎ নহেন’ - এইরূপ ভাষার উপযোগ করিলে, দূর ও নিকট, সৎ ও অসৎ ইত্যাদি পরস্পরসাপেক্ষ গুণের জোড় উঠাইয়া দিয়া, বাকী যাহা কিছু নির্গুণ সর্বব্যাপী, সর্বদা নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তাহাই ব্ৰহ্ম এইরূপ বোধ হইবার জন্য, ব্যবহারক্ষেত্রে পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের ভাষাই প্ৰয়োগ করা ভিন্ন গত্যন্তর নাই [গী|১৩|১২] । যাহা কিছু আছে তাহা সমস্তই ব্ৰহ্ম হওয়ায় দূরে তিনিই, নিকটেও তিনিই, সৎও তিনিই এবং অসৎও তিনিই । তাই, অন্য দৃষ্টিতে দেখিলে, সেই ব্ৰহ্মের পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের দ্বারা একই সময়ে বর্ণনা করা চলে [গী|১১|৩৭; ১৩|১৫] । কিন্তু সগুণ-নির্গুণ এই উভয়বিধ বৰ্ণনার উপপত্তি এইরূপ করিলেও একই পরমেশ্বর কিরূপে সগুণ ও নির্গুণ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ স্বরূপ প্ৰাপ্ত হন, সে কথার ব্যাখ্যা অবশিষ্টই রহিয়া যায় । মানিলাম, যখন অব্যক্ত পরমেশ্বর ব্যক্ত বা ইন্দ্ৰিয়গোচর রূপ ধারণ করেন তখন উহা তাহার মায়া, কিন্তু ব্যক্ত কিংবা ইন্দ্ৰিয়ের গোচর না হইয়া অব্যক্ত থাকিয়াই যখন তিনি নির্গুণের স্থানে সগুণ হইয়া যান তখন তাঁহাকে কি বলিবে ? উদাহরণ যথা - একই নিরাকার পরমেশ্বরকে কেহ ‘নেতি নেতি’ বলিয়া নির্গুণ বলেন, আবার কেহ তাঁহাকে সত্ত্বগুণসম্পন্ন, সর্বকর্মা ও দয়ালু বলেন । ইহার রহস্য কি ? উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পক্ষ কোনটি ? এই নির্গুণ অব্যক্ত ব্ৰহ্ম হইতে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ ও জীব কিরূপে উৎপন্ন হইল ? এই সকল বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আবশ্যক । সমস্ত সঙ্কল্পের দাতা অব্যক্ত পরমেশ্বর বাস্তবিক সগুণ; উপনিষদে ও গীতায় নিগুৰ্ণস্বরূপের যে বর্ণনা আছে, তাহা অতিশয়োক্তি বা নিরর্থক প্ৰশংসাপর উক্তি - এইরূপ বলিলে অধ্যাত্মশাস্ত্রের মূল ভিত্তিকেই আঘাত করা হয় । যে বড় বড় মহাত্মাগণ ও ঋষিরা মনকে একাগ্র করিয়া সূক্ষ্ম ও শান্ত বিচারের দ্বারা এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, “যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ” [তৈ|২|৯] মনেরও যিনি দুৰ্গম, বাক্যও যাঁহাকে বর্ণনা করিতে পারে না, তিনিই চরম ব্ৰহ্মস্বরূপ - তাঁহাদের আত্মপ্রতীতি অতিশয়োক্তি, কি প্রকারে বলা যায় ? আমরা সাধারণ মনুষ্য, আমাদের ক্ষুদ্ৰ মনে অনন্ত ও নির্গুণ ব্ৰহ্মেয় ধারণা হয় না বলিয়া প্ৰকৃত ব্ৰহ্ম সগুণই হইবে বলা আর সূর্যাপেক্ষা আমাদের দীপ শ্রেষ্ঠ বলা একই ! হাঁ, যদি এই নির্গুণ রূপের উপপত্তি উপনিষদে অথবা গীতায় না দেওয়া হইত তবে পৃথক কথা হইত । কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে । 


8) উক্ত সিদ্ধান্তসমূহের শাস্ত্রীয় উপপত্তি


দেখ না, ভগবদ্‌গীতায় তো স্পষ্টই বলা হইয়াছে যে, পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত স্বরূপ অব্যক্তই; এবং তিনি ব্যক্ত জগতের রূপ যে ধারণ করেন সে তো তাঁর মায়া [গী|৪|৬]; কিন্তু ভগবান ইহাও বলিয়াছেন যে, প্রকৃতির গুণের দ্বারা “মোহ প্ৰাপ্ত হইয়া মূর্খ লোক (অব্যক্ত ও নির্গুণ) আত্মাকেই কর্তা মনে করে” [গী|৩|২৭-১৯], কিন্তু ঈশ্বর তো কিছুই করেন না, কেবল অজ্ঞানের দ্বারা লোক ভ্ৰান্ত হয় [গী|৫|১৫] অর্থাৎ ভগবান স্পষ্টাক্ষরে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, অব্যক্ত আত্মা বা পরমেশ্বর বস্তুত নির্গুণ হইলেও [গী|১৩|৩১] মোহ বা অজ্ঞানবশতঃ লোকে তাঁহার উপর কর্তৃত্বাদিগুণের অধ্যারোপ করিয়া তাঁহাকে সগুণ অব্যক্ত করিয়া তোলে [গী|৭|২৪] । ইহা হইতে পরমেশ্বরের স্বরূপ বিষয়ে গীতার এই সিদ্ধান্ত বুঝা যায় – 
(১) গীতায় পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপের অনেক বর্ণনা থাকিলেও পরমেশ্বরের মূল ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপ নির্গুণ ও অব্যক্তই, এবং মনুষ্য অজ্ঞান বা মোহবশত তাঁহাকে সগুণ মনে করে, 
(২) সাংখ্যদিগের প্রকৃতি বা তাহার ব্যক্ত প্ৰপঞ্চ অর্থাৎ সমস্ত জগৎ এই পরমেশ্বরের মায়া; এবং 
(৩) সাংখ্যদিগের পুরুষ বা জীবাত্মা যথার্থত পরমেশ্বররূপী, পরমেশ্বরেরই ন্যায় নির্গুণ ও অকর্তা, কিন্তু অজ্ঞানবশত লোকে তাহাকে কর্তা বলিয়া মনে করে । 

বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তও এইরূপ; কিন্তু উত্তরবেদান্ত গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত বলিবার সময় মায়া ও অবিদ্যা এই দুয়ের মধ্যে একটু প্ৰভেদ করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - পঞ্চদশীতে প্ৰথমে কথিত হইয়াছে যে, আত্মা ও পরব্রহ্ম উভয়ই মূলে একই অর্থাৎ ব্ৰহ্মস্বরূপ; এই চিৎস্বরূপ ব্ৰহ্ম যখন মায়াতে প্ৰতিবিম্ব হন তখন সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী (সাংখ্যদিগের মূল) প্ৰকৃতি নির্মিত হয় । কিন্তু পরে এই মায়ারই আবার ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ এইরূপ দুই ভেদ করিয়া বলা হইয়াছে যে, মায়ার ত্ৰিগুণের মধ্যে ‘শুদ্ধ’ সত্ত্বগুণের যখন উৎকর্ষ হয় তখন তাহাকে কেবল মায়া বলা হয়, এবং এই মায়াতেই প্ৰতিবিন্বিত ব্ৰহ্মকে সগুণ অর্থাৎ ব্যক্ত ঈশ্বর (হিরণ্যগৰ্ভ) বলা হয়; এবং এই সত্ত্বগুণ ‘অশুদ্ধ’ হইলে ‘অবিদ্যা’ হয় এবং তাহাতে প্ৰতিবিন্বিত ব্ৰহ্মকে ‘জীব’ এই নাম দেওয়া হয় [পঞ্চ|১|১৫-১৭] । এইভাবে দেখিলে একই মায়ার স্বরূপত দুই ভেদ করিতে হয় - অর্থাৎ উত্তরকালীন বেদান্তের দৃষ্টিতে দেখিলে, পরব্রহ্ম হইতে ‘ব্যক্ত ঈশ্বর’ উৎপন্ন হইবার কারণ মায়া এবং ‘জীব’ উৎপন্ন হইবার কারণ অবিদ্যা মানিতে হয় । কিন্তু গীতাতে এইপ্রকার ভেদ করা হয় নাই । গীতা বলেন যে, ভগবান স্বয়ং যে মায়ার দ্বারা ব্যক্ত অর্থাৎ সগুণ রূপ ধারণ করেন [৭|২৫], কিংবা যে মায়ার দ্বারা অষ্টধা প্ৰকৃতি অর্থাৎ জগতের সমস্ত বিভূতি তাঁহা হইতে উৎপন্ন হয় [৪|৬], সেই মায়ারই অজ্ঞানের দ্বারা জীব মোহ প্ৰাপ্ত হয় [৭|৪-১৫] । ‘অবিদ্যা’ এই শব্দ গীতার কোথাও আসে নাই, এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে যেখানে ঐ শব্দ আসিয়াছে সেখানে তাহার অর্থও এইপ্রকারে স্পষ্ট করা হইয়াছে যে, মায়ার প্রপঞ্চকেই অবিদ্যা সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, [শ্বেত|৫|১] । তাই, উত্তরবেদান্তগ্রন্থে কেবল নিরূপণের সুবিধার জন্য জীব ও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অবিদ্যা ও মায়ার সূক্ষ্ম ভেদ স্বীকার না করিয়া আমি ‘মায়া’, ‘অবিদ্যা’ ও ‘অজ্ঞান’ এই শব্দগুলিকে সমানার্থকই মানি; এবং এক্ষণে শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে সংক্ষেপে এই বিষয়ের বিচার করিব যে, ত্ৰিগুণাত্মক মায়া অবিদ্যা বা অজ্ঞান ও মোহ ইহাদের সামান্যত তাত্ত্বিক স্বরূপ কি, এবং উহার সাহায্যে গীতা ও উপনিষদের সিদ্ধান্তসমূহের উপপত্তি কিরূপে লাগানো যায় ।


9) নির্গুণ ও সগুণের গহন অর্থ


নির্গুণ ও সগুণ এই শব্দ দুটি দেখিতে ছোট হইলেও উহার মধ্যে কোন্‌ কোন্‌ বিষয়ের সমাবেশ হয় তাহা দেখিতে গেলে, সত্যই সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড চক্ষের সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হয় । যথা, জগতের মূল যখন ঐ অনাদি পরব্রহ্মই, যিনি এক, নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন, তখন তাহাতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের গোচর অনেক প্ৰকার ব্যাপার ও গুণ কি প্রকারে উৎপন্ন হইল এবং এইপ্ৰকার তাঁহার অখণ্ডতা কি প্রকারে ভগ্ন হইল; কিংবা যিনি মূলেতে একই তাঁহাতে ভিন্ন ভিন্ন বহুবিধা পদাৰ্থ কিরূপে দৃষ্ট হইতেছে; যে পরব্রহ্ম নির্বিকার এবং যাঁহাতে, মধুর, অম্ল, কটু কিংবা ঘন, তরল অথবা শীতোষ্ণাদি ভেদ নাই, তাঁহাতেই বিভিন্ন রুচি, ন্যূনাধিক ঘন-তরলতা কিংবা শীতল ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ, আলোক ও অন্ধকার, মৃত্যু ও অমরতা ইত্যাদি অনেক প্রকারের দ্বন্দ্ব কিরূপে উৎপন্ন হইল; যে পরব্রহ্ম শান্ত ও নির্বাত, তাঁহাতেই নানাবিধ ধ্বনি ও শব্দ কিরূপে উৎপন্ন হইল; যে পরব্রহ্মে অন্তর-বাহির কিংবা দূর-নিকট ভেদ নাই, তাঁহাতে অগ্রপশ্চাৎ এ-পার ও-পার কিংবা দূর-নিকট অথবা পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি দিক্‌কৃত স্থলকৃত ভেদ কিরূপে আসিল; যে পরব্রহ্ম অবিকারী, ত্রিকালে অবাধিত, নিত্য ও অমৃত, তাঁহাতে ন্যূনাধিক কালপরিমাণে নশ্বর পদার্থসমূহ কিরূপে হইল; কিংবা যাঁহাতে কার্যকারণভাবের স্পৰ্শমাত্ৰ নাই সেই পরব্রহ্মের কার্যকারণরূপ, - যথা মৃত্তিকা ও ঘট - কেন দেখা যায়; এই প্রকার অনেক বিষয়ের সমাবেশ উক্ত ছোট শব্দ দুটির মধ্যে হইয়াছে । কিংবা সংক্ষেপে বলিতে হইলে, এক্ষণে এই বিষয়ের বিচার করিতে হইবে যে, একেরই মধ্যে নানাত্ব, নির্দ্বন্দ্বে, অনেক প্রকার দ্বন্দ্ব, অদ্বৈতে দ্বৈত, অথবা অসঙ্গে সঙ্গ কিরূপে জুটল । সাংখ্যকারেরা এই বিবাদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এই দ্বৈত কল্পনা করিয়াছেন যে, নির্গুণ ও নিত্য পুরুষের ন্যায় ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ প্ৰকৃতিও নিত্য ও স্বতন্ত্র । কিন্তু জগতের মূলতত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার মানবমনের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, এই দ্বৈতের দ্বারা তাহার সমাধান হয় না । শুধু নহে, প্ৰত্যুত যুক্তিবাদেও এই দ্বৈত টেঁকে না । - তাই, প্রকৃতি ও পুরুষের বাহিরে গিয়া উপনিষৎকারেরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, সচ্চিদানন্দ ব্ৰহ্ম হইতেও শ্রেষ্ঠপদবীর ‘নিগুৰ্ণ’ ব্ৰহ্মই জগতের মূল । কিন্তু এক্ষণে নির্গুণ হইতে সগুণ কিরূপে উৎপন্ন হইল, তাহার উপপত্তি দেওয়া আবশ্যক । কারণ সাংখ্যের ন্যায় বেদান্তশাস্ত্রেরও ইহাই সিদ্ধান্ত যে, যাহা নাই তাহা হইতেই পারে না; এবং তাহা হইতে যাহা আছে তাহা কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । এই সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্গুণ অর্থাৎ যাহাতে গুণ নাই সেই ব্ৰহ্ম হইতে, সগুণ অর্থাৎ যাহাতে গুণ আছে এইরূপ জাগতিক পদার্থ উৎপন্ন হইতে পারে না । তবে আবার সগুণ আসিল কোথা হইতে ? সগুণ কিছু নাই যদি বল, তাহা তো চোখের সামনে দেখা যাইতেছে । এবং নির্গুণের ন্যায় সগুণও সত্য যদি বল, তাহা হইলে দেখিতেছি যে, ইন্দ্রিয়ের গোচর শব্দ-স্পর্শ রূপ-রসাদি সমস্ত গুণের স্বরূপ আজ এক প্রকার কল্য অন্য প্ৰকার - অর্থাৎ উহা নিত্য পরিবর্তনশীল, অতএব নশ্বর, বিকারী ও অ-শাশ্বত, তখন তো (পরমেশ্বর বিভাজ্য এইরূপ কল্পনা করিয়া) ইহাই বলিতে হয় যে এইরূপ সগুণ পরমেশ্বরও পরিবর্তনশীল ও নশ্বর । কিন্তু বিভাজ্য ও নশ্বর হইয়া যিনি জাগতিক নিয়মপদ্ধতির মধ্যে নিত্য পরতন্ত্র হইয়া কাজ করেন তাঁহাকে কেমন করিয়া পরমেশ্বর বলিবে ? সারকথা, চাই ইন্দ্ৰিয়গোচর সমস্ত সগুণ পদার্থ পঞ্চমহাভূত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে স্বীকার কর, কিংবা সাংখ্যের ন্যায় অথবা আধিভৌতিক দৃষ্টিতে মনে কর যে, সমস্ত পদার্থ একই অব্যক্ত কিন্তু সগুণ মূল প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; - যে কোন পক্ষই স্বীকার কর না কেন ইহা নির্বিবাদরূপে সিদ্ধ যে, নশ্বর গুণ যে পৰ্যন্ত এই মূল প্ৰকৃতি হইতেও বিচ্যুত না হয় সে পৰ্যন্ত পঞ্চ মহাভূতকে বা প্ৰকৃতিরূপ এই সগুণ মূল পদার্থকে জগতের অবিনাশী, স্বতন্ত্র ও অমৃত তত্ত্ব মানিতে পারা যায় না । তাই যিনি প্রকৃতিবাদ স্বীকার করেন তাঁহার পরমেশ্বরকে নিত্য, স্বতন্ত্র ও অমৃত বলা ছাড়িয়া দিতে হয়; অথবা পঞ্চ মহাভূতের অথবা সগুণ মূল প্ৰকৃতিরও অতীত কোন্‌ তত্ত্ব আছে তাহার অনুসন্ধান করিতে হয় । ইহা ব্যতীত অন্য কোন মাৰ্গ নাই । মৃগতৃষ্ণিকায় তৃষ্ণা নিবারণ কিংবা বালুকা হইতে তৈল বাহির হওয়া যেরূপ অসম্ভব, সেইরূপ প্ৰত্যক্ষ নশ্বর বস্তু হইতে অমৃতত্ব প্ৰাপ্তির আশাও ব্যর্থ; এবং এইজন্য, যাজ্ঞবল্ক্য আপনার পত্নী মৈত্ৰেয়ীকে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, যতই কেন সম্পত্তিলাভ হউক না, তাহা দ্বারা অমৃতত্ব লাভের আশা নাই — “অমৃতত্বস্য তু নাশাস্তি বিত্তেন” [বৃ|২|৪|২] । 


10) অমৃততত্ত্বের স্বভাবসিদ্ধ কল্পনা


ভাল, এখন যদি অমৃতত্বকে মিথ্যা বল, তবে মানুষের এই স্বাভাবিক ইচ্ছা দেখা যায় যে, সে কোন রাজার নিকট হইতে প্ৰাপ্ত ইনাম বা পুরস্কার কেবল নিজে নহে বরঞ্চ পুত্রপৌত্ৰাদিক্ৰমে অর্থাৎ চিরকাল উপভোগ করিতে চায়; অথবা ইহাও দেখা যায় যে, চিরস্থায়ী বা শাশ্বত কীর্তির অবসর উপস্থিত হইলে আমরা জীবনেরও পরোয়া রাখি না । ঋক্‌বেদের ন্যায় অতি প্ৰাচীন গ্রন্থেও পূর্বতন ঋষিদের এই প্রার্থনা যে, “হে ইন্দ্ৰ ! তুমি ‘অক্ষিতশ্রব’ অর্থাৎ অক্ষয় কীর্তি’ বা ধন দাও” [খ|১|৯|৭], অথবা “হে সোম ! তুমি আমাকে বৈবস্বত (যম) লোকে অমর কর” [ঋ|৯|১১৩|৮] । পূৰ্বঋষিদিগের প্রার্থনা ছাড়িয়া দিলেও অর্বাচীনকালে এই দৃষ্টিই স্বীকার করিয়া স্পেনসরকোঁৎ প্রভৃতি নিছক আধিভৌতিক পণ্ডিতও প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, “কোন ক্ষণিক সুখে না ভুলিয়া বর্তমান ও ভাবী মানবজাতির চিরন্তন সুখের জন্য চেষ্টা করাই এই জগতে মনুষ্যমাত্রের নৈতিক পরম কর্তব্য”। আমাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে নিরন্তর কল্যাণের অর্থাৎ অমৃতত্বের এই কল্পনা আসিল কোথা হইতে ? যদি বল তাহা স্বভাবসিদ্ধ, তাহা হইলে এই বিনশ্বর দেহের বাহিরে কোন প্ৰকার অমৃত বস্তু আছে এইরূপ বলিতে হয় । এবং এই প্রকার অমৃত বস্তু কিছু নাই যদি বল, তবে আমাদের যে মনোবৃত্তির সাক্ষাৎ প্রতীতি হয় তাহার অন্য কোন উপপত্তিও দেওয়া যাইতে পারে না ! এই কঠিন সমস্যার স্থলে কোন কোন আধিভৌক্তিক পণ্ডিত এই উপদেশ করেন যে, এই প্রশ্ন কখনই মীমাংসা হইবার নহে, তাই ইহার বিচার না করিয়া, দৃশ্য জগতের পদার্থসমূহের গুণধর্মের বাহিরে আমাদের মনকে ধাবিত হইতে দিবে না । এই উপদেশ সহজ বলিয়া মনে হয়; কিন্তু মনুষ্যের মনে তত্ত্বজ্ঞানের যে স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা আছে তাহা কে আটক করিবে, আর কি করিয়া আটক করিবে ? এবং এই দুর্দমনীয় জ্ঞানস্পৃহাকে একবার নিহত করিলে, পরে জ্ঞানের বৃদ্ধি কোথা হইতে হইবে ? যে দিন মনুষ্য এই পৃথিবীতে উৎপন্ন হইয়াছে সেই দিন অবধি সে ইহার বিচার বরাবর করিয়া আসিয়াছে যে, “সমস্ত দৃশ্য ও নশ্বর জগতের মুলীভূত অমৃত তত্ত্ব কি, এবং তাহা আমি কিরূপে প্ৰাপ্ত হইব” । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যতই উন্নতি হোক না কেন, মনুষ্যের অমৃততত্ত্বসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দিকে এই স্বাভাবিক প্ৰবৃত্তি কখনই হ্রাস হইবার নহে । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যতই উন্নতি হোক না কেন, সমস্ত আধিভৌতিক জগৎবিজ্ঞানকে বগলে রাখিয়া আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান তাহার অগ্ৰেই নিয়ত দৌড়িতে থাকিবে ! দুই চারি হাজার বৎসর পূর্বে এই অবস্থাই ছিল, এবং এক্ষণে পাশ্চাত্য দেশেও ঐ প্রকার অবস্থাই দৃষ্টিগোচর হয় । অধিক কি, মানববুদ্ধির এই আকাঙ্ক্ষা যে দিন চলিয়া যাইবে সেই দিন তাহাকে “স বৈ মুক্তোহথবা পশুঃ” এইরূপ বলিতে হইবে ।


11) সৃষ্টিজ্ঞান কিরূপে এবং কাহার হয় ?


যাক্‌ । দিককালে অসীম, অমৃত, অনাদি, স্বতন্ত্র, সম, এক, নিরন্তর, সর্বব্যাপী ও নির্গুণ তত্ত্বের অস্তিত্বসম্বন্ধে অথবা সেই নির্গুণ তত্ত্ব হইতে সগুণ জগতের উৎপত্তিবিষয়ে আমাদের প্রাচীন উপনিষদে যাহা উপপাদিত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা অধিক সযুক্তিক উপপাদন অন্য কোন দেশের তত্ত্বজ্ঞানী অদ্যাপি বাহির করেন নাই । “অর্বাচীন জর্মান তত্ত্বজ্ঞ ক্যাণ্ট মনুষ্যের বাহ্যজগতের নানাত্বজ্ঞান একত্বের দ্বারা কেন ও কি প্রকারে হয়; এবং তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিয়া এই উপপত্তিকেই অর্বাচীনশাস্ত্ৰ-পদ্ধতিতে অধিক স্পষ্ট করিয়াছেন; এবং হেগেল নিজের বিচারে কাণ্ট হইতে কিছু আগাইয়া গেলেও তাঁহারও সিদ্ধান্ত বেদান্তকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে নাই । শোপেন্‌হৌরের কথাও তাই । তিনি ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত উপনিষদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং তিনি একথাও লিখিয়া রাখিয়াছেন যে, ‘জগতের সাহিত্যের এই অত্যুত্তম গ্ৰন্থ’ হইতে কোন কোন বিচার তিনি আপন গ্রন্থে গ্ৰহণ করিয়াছেন । এই গভীর বিচার এবং তাহার সাধকবাধক প্রমাণে কিংবা বেদান্তের সিদ্ধান্ত এবং ক্যাণ্ট প্রভৃতি পাশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞদিগের সিদ্ধান্তে কতটা সাদৃশ্য ও কতটা বৈষম্য; অথবা উপনিষদ ও বেদান্তসূত্র প্রভৃতি প্ৰাচীন গ্রন্থোক্ত বেদান্ত এবং তদুত্তরকালীন গ্রন্থোক্ত বেদান্ত - ইহাদের মধ্যে ক্ষুদ্র বৃহৎ ভেদ কি কি আছে, এই সকল বিষয়ের সবিস্তর নিরূপণ এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে সম্ভব নহে । তাই, গীতার অধ্যাত্মসিদ্ধান্তের সত্যতা, উপপত্তি ও মহত্ত্বের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা আবশ্যক মনে করিয়া, মুখ্যরূপে উপনিষদ, বেদান্তসূত্র ও তাহার শাঙ্করভাষ্য-অবলম্বনে, আমি কেবল ঐ সকল বিষয়ের প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়াছি মাত্র । প্রকৃতি ও পুরুষরূপী সাংখ্যোক্ত দ্বৈতের অতীত কি, তাহা নির্ণয় করিবার জন্য জগৎদ্রষ্টা ও দৃশ্যজগৎ এই দ্বৈতী ভেদের উপরেই দাঁড়াইয়া না থাকিয়া জগৎদ্রষ্টা পুরুষের বাহ্য-জগৎ সম্বন্ধে যে জ্ঞান হয় তাহার স্বরূপ কি, তাহা কি করিয়া ও কাহার হয়, এই বিষয়েরও সূক্ষ্ম বিচার করা আবশ্যক । 


12) জ্ঞানক্রিয়ার বর্ণনা


বাহ্য জগতের পদার্থ মনুষ্যের চক্ষে যেরূপ প্ৰতিভাত হয়, পশুদের নিকটেও সেইরূপ প্ৰতিভাত হইয়া থাকে । কিন্তু মনুষ্যের ইহাই বিশেষত্ব যে, চক্ষু, কৰ্ণ ইত্যাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়যোগে উহার মনের উপর সংঘটিত সংস্কারসমূহের একীকরণ করিবার শক্তি উহাতে বিশেষরূপে থাকা প্ৰযুক্ত, বাহ্যজগতের পদার্থ মাত্রের জ্ঞান উহার হইয়া থাকে । এই বিশেষ শক্তি যে একীকরণের ফল, সেই শক্তি মন ও বুদ্ধিরও অতীত, অর্থাৎ উহা আত্মার শক্তি, ইহা পূর্বে ক্ষেত্রক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে বলিয়াছি । কেবল একটীমাত্র পদার্থের নহে, প্ৰত্যুত জগতের অন্তৰ্গত ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের কার্যকারণভাবাদি যে অনেক সম্বন্ধ - যাহাকে জাগতিক নিয়ম বলে - তাহারও জ্ঞান এই প্রকারেই হইয়া থাকে । কারণ, ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ দৃষ্টিগোচর হইলেও, তাহাদের কার্য্যকারণাদি সম্বন্ধ প্ৰত্যক্ষগোচর হয় না; কিন্তু দ্রষ্টা স্বীয় মানসিক ব্যাপারের দ্বারা তাহা নির্ধারণ করিয়া থাকে । উদাহরণ যথা - কোন এক পদার্থ আমাদের চক্ষুর সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলে তাহার রূপ ও গতি দেখিয়া আমরা স্থির করি যে, তাহা একজন যুদ্ধের সেপাই এবং সেই সংস্কার মনে স্থায়ী রহিয়া যায় । ইহার পরেই আর কোন পদার্থ ঐ প্রকার রূপ ও গতি লইয়া চক্ষুর সম্মুখে আসিলে আবার সেই মানসিক ক্রিয়া শুরু হয় এবং উহাও আর এক সিপাই এইরূপ আমাদের বুদ্ধি নিশ্চিত ধারণা করে । এই প্রকার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষণে একের পর এক করিয়া যে অনেক সংস্কার আমাদের মনের উপর সংঘটিত হয়, আমাদের স্মরণশক্তি দ্বারা সেগুলি স্মরণ করিয়া একত্ৰ করি; এবং যখন ঐ পদার্থসমূহ আমাদের সম্মুখে আসে, তখন ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারের জ্ঞান একতা প্ৰাপ্ত হয়, আর আমরা বলি যে আমাদের সম্মুখ দিয়া ‘সৈন্য’ চলিতেছে । এই সৈন্যের পশ্চাতে আগত পদার্থের রূপ দেখিয়া তাহাকে ‘রাজা’ বলিয়া নির্ধারিত করি । এবং সৈন্যসম্বন্ধীয় পূর্ব সংস্কার ও ‘রাজা’ সম্বন্ধীয় এই নূতন সংস্কার - এই দুই সংস্কারকে একত্র করিয়া আমরা বলিয়া থাকি যে, ‘রাজার সোয়ারী’ চলিয়াছে । এই জন্য বলিতে হয় যে, জগৎ-জ্ঞান কেবল ইন্দ্ৰিয়ে প্ৰতিভাত জড় পদার্থের জ্ঞান নহে; কিন্তু ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা মনের উপর সংঘটিত অনেক সংস্কারের বা পরিণামের যে ‘একীকরণ’ ‘দর্শক’ আত্মা করে, তাহারই ফল এই জ্ঞান । এই জন্য ভগবদ্গীতাতেও জ্ঞানের লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে যে, “অবিভক্তং বিভক্তেষু” অর্থাৎ যাহা বিভক্ত বা ভিন্ন ভিন্ন, তাহার মধ্যে অবিভক্ততা বা একত্ব যাহা দ্বারা বুঝা যায় তাহাই প্ৰকৃত জ্ঞান [গী|১৮|২০] । (Cf. “Knowledge is first produced by the synthesis of what is manifold” Kant's “Critique of Pure Reason”, P.64, Max Muller's translation 2nd Ed.) 


13) নামরূপের ব্যাখ্যা ও বস্তুতত্ত্ব


কিন্তু ইন্দ্ৰিয়-যোগে মনের উপর যে সংস্কার প্রথমে সংঘটিত হয়, তাহা কিরূপ, এই বিষয়ের সূক্ষ্ম বিচার করিলে আবার দেখিতে পাওয়া যায় যে, চোখ, কান, নাক প্রভৃতি ইন্দ্ৰিয় দ্বারা পদার্থ মাত্রের রূপ, শব্দ, গন্ধ প্রভৃতি গুণ জানিতে পারিলেও এই বাহ্য গুণ যে দ্রব্যের মধ্যে আছে সেই দ্রব্যের অন্তরঙ্গ স্বরূপসম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্ৰিয় আমাদিগকে কিছুই বলিতে পারে না । ভিজা মাটির ঘট হইল ইহা আমরা দেখি সত্য, কিন্তু যাহাকে আমরা ‘ভিজা মাটি’ বলি, সেই পদার্থের মূল তাত্ত্বিক স্বরূপ কি, তাহা আমরা জানিতে পারি না । চিকনাই, আর্দ্রতা, ময়লা রঙ বা গোলার ন্যায় আকার (রূপ) ইত্যাদি গুণ, ইন্দ্ৰিয়যোগে মন পৃথক পৃথকরূপে অবগত হইলে পর, সেই সমস্ত সংস্কারের একীকরণ করিয়া ‘দ্রষ্টা’ আত্মা, বলিয়া থাকে যে ইহা ‘ভিজা মাটি’; এবং পরে এই দ্রব্যের (কারণ, দ্রব্যের তাত্ত্বিক স্বরূপ বদলিয়াছে এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই) ভিতর ফাপা ও গোলাকার রূপ, খনখনে আওয়াজ ও শুষ্কতা ইত্যাদি গুণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মন অবগত হইলে পর, তাহাদের একীকরণ করিয়া ‘দর্শক’ আত্মা তাহাকে ‘ঘট’ বলিয়া থাকে । সারকথা, সমস্ত পরিবর্তন বা ভেদ, ‘রূপ বা আকারেই’ হইতে থাকে; এবং মনের উপর উক্ত গুণসমূহের যে সংস্কার সংঘটিত হয়, ‘দ্রষ্টা’ সেই সকল সংস্কারের একীকরণ করিবার পর, একই তাত্ত্বিক পদার্থ অনেক নাম প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । ইহার সর্বাপেক্ষা সহজ উদাহরণ - সমুদ্র ও তরঙ্গ, কিংবা সুবর্ণ ও অলঙ্কার । কারণ, এই দুই উদাহরণে রং, ঘনত্ব, তরলতা, ওজন প্রভৃতি গুণ একই থাকে, কেবল রূপ (আকার) ও নাম এই দুই গুণ বদল হয় । সেই জন্যই বেদান্তে এই সহজ দৃষ্টান্ত সর্বদাই প্রদত্ত হইয়া থাকে । সোনা একই, কিন্তু তাহার আকারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যে পার্থক্য ঘটিয়াছে, ইন্দ্ৰিয়যোগে গৃহীত তাহারই সংস্কারসকল মনের দ্বারা একত্ৰ করিয়া ‘দ্রষ্টা’, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে একই মূল পদার্থের একবার ‘ঠুসী’, একবার ‘পোঁটী’, একবার ‘সল্লে’, একবার ‘তন্মণি’ এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়া থাকে । আমরা সময়ে সময়ে পদার্থসমূহের এই প্রকার যে নাম দিয়া থাকি, সেই নামকে এবং যে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির দরুণ উক্ত নাম বদলাইতে থাকে সেই আকৃতিসমূহকে উপনিষদে ‘নামরূপ’ (নাম ও রূপ) বলা হয়; এবং অন্য সমস্ত গুণেরও উহারই মধ্যে সমাবেশ করা যায় [ছা|৩ ও ৪; বৃ|১|৪|৭] । কারণ, যে কোন গুণ ধর না কেন, তাহার কোন না কোন নাম বা রূপ থাকিবেই । কিন্তু এই নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে বদল হইলেও, মূলে তাহাদের আধারভূত এই নামরূপ হইতে ভিন্ন ও অপরিবর্তনীয় কোন দ্রব্য আছে বলিতে হয় । জলের উপর যেমন ফেণপুঞ্জ (বা তরঙ্গ) থাকে, সেইরূপ একই মূল দ্রব্যের উপর অনেক নামরূপের আবরণ আসিয়া পড়িয়াছে — ইহা বলিতেই হইবে । আমাদের ইন্দ্ৰিয়গণ, নামরূপ ব্যতীত আর কিছুই উপলব্ধি করিতে পারে না সত্য; তাই এই নামরূপের আধারভূত অথচ নামরূপ হইতে ভিন্ন ঐ যে মূল দ্রব্য, ইন্দ্ৰিয়গণ তাহাকে জানিতে সমর্থ হয় না । কিন্তু সমস্ত জগতের আধারভূত এই তত্ত্ব অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অজ্ঞেয় হইলেও তাহা সৎ, অর্থাৎ সত্য সত্যই সর্বকালে সকল নামরূপের মূলে এবং নামরূপের মধ্যেও বাস করিতেছে, তাহার কখনই লোপ পায় না, আমাদের বুদ্ধির দ্বারা এই নিশ্চিত অনুমান করিতে হয় । কারণ, ইন্দ্ৰিয়গোচর নামরূপ ব্যতীত মূলে কিছুই নাই, এইরূপ মানিলে ‘হার’ ও ‘বলয়’ প্ৰভৃতি বিভিন্ন পদার্থ একই পদার্থে নির্মিত হইয়াছে, আমাদের এই যে জ্ঞান এক্ষণে হয় তাহার কোনই ভিত্তি থাকিবে না । এই অবস্থাতে ইহা ‘হার’ ইহা ‘বলয়', ইহাই বলা যাইতে পারে । কিন্তু ‘হার সোনার’, এবং ‘বলয় সোনার’ ইহা কখনও বলা যাইতে পারে না । তাই ন্যায়ত ইহা সিদ্ধ হয় যে, ‘সোনার হার’, ‘সোনার বালা’ ইত্যাদি বাক্যে ‘সোনার’ এই শব্দের দ্বারা যে সোনার সঙ্গে নামরূপাত্মক হার ও বালার সম্বন্ধ যোজিত হইয়াছে, সেই সোনা কেবল শশশৃঙ্গবৎ অভাবরূপী নহে, উহা সমস্ত অলঙ্কারের আধারভূত দ্রব্যাংশেরই বোধক । এই ন্যায়টি জাগতিক সমস্ত পদার্থে প্রয়োগ করিলে এই সিদ্ধান্ত বাহির হয় যে, পাথর, মুক্তা, রূপা, লোহা, কাঠ প্রভৃতি বিভিন্ন নাম রূপাত্মক যে সকল পদার্থ আমাদের নজরে আসে সে সমস্ত একই কোন নিত্য দ্রব্যের উপর বিভিন্ন নামরূপের গিল্টি চড়াইয়া উৎপন্ন হইয়াছে; অর্থাৎ সমস্ত ভেদ কেবল নামরূপেরই, মূল দ্রব্যের নহে, নানাপ্রকার নামরূপের নীচে মূলে একই পদাৰ্থ নিত্য বাস করিতেছে । ‘সমস্ত পদার্থে এইরূপ নিত্যরূপে সর্বদাই থাকা’ - ইহাকেই সংস্কৃত ভাষায় ‘সত্তাসামান্যত্ব’ বলে ।

আমাদের বেদান্তশাস্ত্রের উক্ত সিদ্ধান্তই কাণ্ট প্রভৃতি অর্বাচীন পাশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞানীরাও স্বীকার করিয়াছেন । নামরূপাত্মক জগতের মূলে অবস্থিত, নামরূপ হইতে ভিন্ন, এই যে কোন অদৃশ্য দ্রব্য আছে তাহাকেই তাঁহারা আপন গ্রন্থে ‘বস্তুতত্ত্ব’ বলিয়া এবং নেত্ৰাদি ইন্দ্ৰিয়ের গোচর নামরূপকে ‘বহিদৃশ্য’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন । (কাণ্টের “Critique of Pure Reason” গ্রন্থে এই বিচার করা হইয়াছে । নামরূপাত্মক জগতের মূলে অবস্থিত দ্রব্যকে তিনি ‘ডিং আন্‌ জিশ্‌’ (Ding an Sich - Thing in itself) এইরূপ নাম দিয়াছেন এবং ইহারই ভাষান্তর আমরা বস্তুতত্ত্ব করিয়াছি । নামরূপের অবভাস  কাণ্টের ‘এরশায়নুঙ্গ্‌’ (Ercheinung - appearance) । কাণ্টের মতে বস্তুতত্ত্ব অজ্ঞেয় ।)


14) সত্যের ব্যাখ্যা



কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰে, নিত্য পরিবর্তনশীল নামরূপাত্মক বহির্দৃশ্যকে ‘মিথ্যা’ বা ‘নশ্বর’ এবং মূল দ্রব্যকে ‘সত্য’ বা ‘অমৃত’ বলিবার রীতি আছে । সাধারণ লোক ‘চক্ষুর্বৈ সত্যং’ অর্থাৎ চোখে যাহা দেখা যায় তাহাই সত্য, এইরূপ সত্য শব্দের ব্যাখ্যা করিয়া থাকে; এবং লোকব্যবহারেও দেখা যায় যে, লাখ টাকা পাইয়াছি এইরূপ স্বপ্ন দেখা কিংবা লাখ টাকা পাইবার কথা কানে শোনা, এবং লাখ টাকা হাতে পাওয়া, - ইহাদের মধ্যে অনেক প্রভেদ আছে । এইজন্য কাণাঘুসা কোন কথা যে শুনে এবং চক্ষে যে দেখে, এই উভয়ের মধ্যে কাহার উপর অধিক বিশ্বাস স্থাপন করিবে ইহার মীমাংসার জন্য বৃহদারণ্যক উপনিষদে, ‘চক্ষুর্বৈ সত্যং’ এই বাক্য আসিয়াছে [বৃ|৫|১৪|৪] । কিন্তু টাকা পদার্থটি — ‘টাকা’ দৃশ্যটি নাম ও রূপে অর্থাৎ বৰ্ত্তুল আকৃতিতে সত্য কিনা - যে শাস্ত্ৰ ইহার নির্ণয় করিবে সেই শাস্ত্ৰে সত্যের এই আপেক্ষিক ব্যাখ্যা কি উপযোগী ? ব্যবহারে দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তির কথায় যদি মিল না থাকে, যদি সে এখন এক কথা পরক্ষণে আর এক কথা বলিতে থাকে তখন লোকে তাহাকে মিথ্যুক বলে । আবার ঐ ন্যায়ই প্রয়োগ করিয়া ‘টাকার’ নামরূপকে (আভ্যন্তরিক দ্রব্যকে নহে) মিথ্যুক কিংবা মিথ্যা বলিতে বাধা কি ? কারণ, টাকার এই চক্ষুগ্রাহ্য নামরূপ আজ টাকা হইতে বাহির করিয়া লইয়া কাল তাহার স্থানে ‘চেন’ কিংবা ‘পেয়ালা’ এই নামরূপ দেওয়া হইয়া থাকে অর্থাৎ নামরূপ নিত্য তফাৎ হয়, নামরূপের মিল থাকে না, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । এখন চোখে যাহা দেখা যায় তাহা ব্যতীত আর কিছুই সত্য নহে এইরূপ বলিলে, একীকরণের যে মানসিক ক্রিয়াতে জগৎজ্ঞান হয় সেই ক্রিয়াও চোখে দেখা যায় না অতএব তাহাকেও মিথ্যা বলিতে হয়; সেইজন্য আমাদের সমস্ত জ্ঞানকেই মিথ্যা বলিতে হয় । 


14.1) বিনশ্বর হইলে নামরূপ অসত্য এবং নিত্য হইলে বস্তুতত্ত্ব সত্য



এই বাধা এবং এইরূপ অন্য বাধার কথা মনে আনিয়া, যাহা চোখে দেখা যায় এইরূপ সত্যকে, সত্যের এই লৌকিক ও আপেক্ষিক লক্ষণকে সত্য বলিয়া স্বীকার না করিয়া, যাহা অবিনাশী অর্থাৎ অন্য সমস্ত বিষয় লোপ পাইলেও যাহা কখনই লোপ পায় না তাহাই সত্য, সমস্ত উপনিষদে এই প্রকার সত্য শব্দের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । এবং মহাভারতেও সত্যের এইরূপ লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে -
সত্যং নামাহব্যয়ং নিত্যমবিকারি তথৈব চ ৷ *
অর্থাৎ - “যাহা অব্যয় অর্থাৎ কখন বিনাশ পায় না, নিত্য অর্থাৎ চিরকাল সমান থাকে এবং অবিকারী অর্থাৎ যাহার পরিবর্তন কখনই হয় না, তাহাই সত্য” – [মভা|শাং|১৬২|১০] । *(গ্রীন real এর (সৎ বা সত্য) ব্যাখ্যা করিবার সময় “whatever anything is really, it is unalterably” এইরূপ বলিয়াছেন (Prolegomena to Ethics $25) । গ্রীনের এই ব্যাখ্যা এবং মহাভারতের উপরি-উক্ত ব্যাখ্যা এই দুই তত্ত্বতঃ একই ।)


15) বস্তুতত্ত্বই অক্ষরব্রহ্ম এবং নামরূপ মায়া


এখন এক কথা বলা, আর এক সময়ে আর এক কথা বলা - এই ব্যবহারকে যে মিথ্যা ব্যবহার বলা হয়, ইহাই তাহার বীজ । সত্যের এই নিরপেক্ষ লক্ষণ স্বীকার করিলে বলিতে হয় যে, চোখে দেখিলেও ক্ষণপরিবর্তনশীল নাম রূপ মিথ্যা; এবং চোখে না দেখা গেলেও নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত ও নামরূপের মূলে সতত সমানভাবে অবস্থিত অমৃত বস্তুতত্ত্বই সত্য । ভগবদ্‌গীতাতে “যঃ স সর্বেষু ভুতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি” [গী|৮|২০; ১৩|২৭] সমস্ত পদার্থ অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের নামরূপাত্মক শরীর লোপ পাইলেও যাহা লোপ পায় না তাহাই অক্ষর ব্ৰহ্ম - ব্ৰক্ষের এইরূপ যে বৰ্ণনা করা হইয়াছে তাহা এই ভাবেই করা হইয়াছে । মহাভারতে নারায়ণীয় কিংবা ভাগবত ধর্মের নিরূপণে, “যঃ স সর্বেষু” ইহার বদলে ‘ভূতগ্রামশরীরেষু’ এইরূপ পাঠভেদে এই শ্লোকই পুনর্বার আসিয়াছে [মভা|শাং|৩৩৯|২৩] । সেইরূপ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৬ ও ১৭ শ্লোকের তাৎপর্যও ইহাই । 


16) সত্য ও মিথ্যা শব্দের বেদান্তশাস্ত্রানুসারী অর্থ


বেদান্তে ‘অলঙ্কার’ মিথ্যা এবং ‘সুবৰ্ণ’ সত্য এইরূপ যে বলা হয়, তাহার অর্থে অলঙ্কার নিরুপযোগী কিংবা একেবারেই মিথ্যা, অর্থাৎ চক্ষুর অগোচর, অথবা মাটীতে গিল্টী করা অর্থাৎ উহার মূলেই অস্তিত্ব নাই এরূপ অভিপ্রেত নহে । এখানে ‘মিথ্যা’ শব্দ এইস্থানে পদার্থের বর্ণরূপাদি গুণ ও আকৃতি অর্থাৎ উপরকার বাহ্য দৃশ্য সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইয়াছে, আভ্যন্তরিক তাত্ত্বিক দ্রব্যের লক্ষণসম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হয় নাই । তাত্ত্বিক দ্রব্য চিরকালই সত্য, ইহা মনে রাখিতে হইবে । পদার্থমাত্রেরই নামরূপাত্মক আবরণের নীচে মূলদেশে কি তত্ত্ব আছে বেদান্তী তাহাই দেখেন; তত্ত্বজ্ঞানের প্রকৃত বিষয়ই ত তাহাই । ব্যবহারে আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই যে, কোন গহনা গড়াইবার জন্য আমরা অনেক মজুরী দিলেও আপৎকালে সেই গহনা পোদ্দারের নিকট বিক্রয় কবিবার সময়, পোদ্দার আমাদিগকে স্পষ্ট এই কথা বলে যে “গহনা গড়াইতে তোলা-পিছু কত খরচা হইয়াছে আমি তা দেখিব না  তুমি এই গহনা যদি সোনার দরে দাও ত কিনিব ।” বেদান্তের পরিভাষায় এই বিচারই ব্যক্ত করিতে হইলে “পোদ্দারের চোখে গহনা মিথ্যা ও গহনার সোনাটাই সত্য” এইরূপ বলিতে হয় । নূতন গঠিত গৃহ বিক্রয় করিবার সময় তাহার সুন্দর আকার (রূপ), অথবা সুবিধাজনক রচনা (আকৃতি) করিতে কত খরচা হইয়াছে সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া, গৃহের মালমস্‌লা ও কাঠের দামে আমাকে বিক্রয় কর, খরিদ্দার এইরূপ বলিয়া থাকে । নামরূপাত্মক জগৎ মিথ্যা এবং ব্ৰহ্ম সত্য বেদান্তের এই উক্তির অর্থ উক্ত দৃষ্টান্ত হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । 

‘দৃশ্য জগৎ মিথ্যা’ ইহার অর্থে জগৎ চক্ষে দেখা যায় না এরূপ ধরিবে না; একই দ্রব্যের নামরূপের ভেদে উৎপন্ন জগতের অনেক স্থলকৃত কিংবা কালকৃত দৃশ্য নশ্বর অতএব মিথ্যা, এবং এই সমস্ত নামরূপাত্মক দৃশ্যের আবরণের নীচে নিয়ত অবস্থিত অবিনাশী ও অপরিবর্তনীয় দ্রব্যই নিত্য ও সত্য, ইহাই তাহার প্রকৃত অর্থ । পোদ্দারের নিকট গোট, তাবিজ, বাজুবন্দ, হার প্রভৃতি গহনা মিথ্যা এবং সেই সব গহনার সোনাই সত্য; কিন্তু জগতের যে স্বর্ণকার, তাঁহার কারখানায় মূল একই দ্রব্যের ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ দিয়া সোনা, পাথর, কাঠ, জল, বায়ু প্ৰভৃতি, সমস্ত গহনা গড়া হয় বলিয়া বেদান্তী পোদ্দার অপেক্ষা আরও কিছু বেশী তলাইয়া সোনা, রূপা কিংবা পাথর প্রভৃতি নাম রূপকে গহনারই ন্যায় মিথ্যা জানিয়া এই সমস্ত, পদার্থের মূলে অবস্থিত দ্রব্য অর্থাৎ বস্তুতত্ত্বই সত্য অর্থাৎ অবিকারী সত্য, এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন । এই বস্তুতত্ত্বে নামরূপ আদি কোন গুণই না থাকা প্ৰযুক্ত উহা নেত্ৰাদি ইন্দ্রিয়ের গোচর কখনই হইতে পারে না । কিন্তু চক্ষে না দেখিলেও, নাকে আঘ্রাণ না করিলেও, হাতে স্পর্শ না করিলেও অব্যক্তরূপে তাহা থাকেই, কেবল এইটুকু বুদ্ধির দ্বারা যে অনুমান করা যায় তাহা নহে, কিন্তু জগতে যাহার কখন পরিবর্তন হয় না এমন একটা কিছু যাহা আছে তাহাই সত্য বস্তুতত্ত্ব, এরূপও নিশ্চয় করিতে হয় । ইহাকেই জগতের মূল সত্য বলে । কিন্তু সত্য ও মিথ্যা, ইহাদের বেদান্তশাস্ত্রোক্ত পারিভাষিক অর্থ লক্ষ্য না করিয়া কিংবা আমরা এই শব্দের যে অর্থ মনে করি তাহা হইতে ভিন্ন অর্থ হইতে পারে কি না ইহা দেখিবার কষ্ট স্বীকার না করিয়া “আমাদের চোখে প্ৰত্যক্ষদৃষ্ট জগতও বেদান্তী মিথ্যা বলে, এর উপায় কি ?” এই কথা বলিয়া কতকগুলি অজ্ঞ বিদেশী এবং স্বদেশী পণ্ডিতন্মন্য লোকও অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিবাদ করিয়া থাকেন । কিন্তু যাস্কের উক্তি অনুসারে বলিতে পারি যে, অন্ধ যে স্তম্ভ দেখিতে পায় না তাহা কিছু স্তম্ভের দোষ নহে ! নিত্য পরিবর্তনশীল অতএব নশ্বর নামরূপ সত্য নহে; যে ব্যক্তি সত্য অর্থাৎ চিরস্থায়ী তত্ত্ব দেখিতে চায় তাহার দৃষ্টি নামরূপ ছাড়াইয়া নামরূপের বাহিরে যাওয়া চাই, ছান্দোগ্য [৬|১; ও ৭|১], বৃহদারণ্যক [১|৬|৩], মুণ্ডক [৩|২|৮], এবং প্রশ্ন [৬|৫] প্রভৃতি উপনিষদে ইহা বারবার উক্ত হইয়াছে । এই নামরূপকে কঠ [২|৫] মুণ্ডক [১|২|৯] প্রভৃতি উপনিষদে ‘অবিদ্যা’ এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে ‘মায়া’ নামে কথিত হইয়াছে । ভগবদ্‌গীতায় ‘মায়া’ ‘মোহ’, ‘অজ্ঞান’ এই সকল শব্দের দ্বারা ঐ অর্থই বিবক্ষিত । জগতের আরম্ভে যাহা কিছু ছিল তাহা নামরূপবৰ্জিত অৰ্থাৎ নির্গুণ ও অব্যক্ত ছিল; পরে তাহা নামরূপ প্ৰাপ্ত হইয়া ব্যক্ত ও সগুণ হইয়া পড়িল [বৃ|১|৪|৭; ছাং|৬|১|২,৩] । তাই বিকারী কিংবা নশ্বর নামরূপকেই ‘মায়া’ সংজ্ঞা দিয়া এই সগুণ বা দৃশ্য জগৎ এক মূল দ্রব্যের অর্থাৎ ঈশ্বরের মায়ার খেলা কিংবা লীলা এইরূপ বলা হয় । এইরূপ দৃষ্টিতে দেখিলে সাংখ্যদিগের প্রকৃতি অব্যক্ত হইলেও উহা সত্ত্বরজস্তমোগুণী অতএব নামরূপের দ্বারা যুক্ত মায়াই । এই প্ৰকৃতি হইতে (৮ম প্রকরণে বর্ণিত) বিশ্বের যে উৎপত্তি বা বিস্তার হইতেছে, তাহাও সেই মায়ার সগুণ নামরূপাত্মক বিকার । 


17) আধিভৌতিক শাস্ত্রের নামরূপাত্মকতা


যে কোন গুণই বল, তাহা ইন্দ্ৰিয়গোচর সুতরাং নামরূপাত্মক হইবেই হইবে । সমস্ত আধিভৌতিক শাস্ত্রও এইরূপ মায়ার গণ্ডীর মধ্যে আসে । ইতিহাস, ভূজ্ঞান, বিদ্যুৎশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্ৰ, পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতি যে-কোন শাস্ত্ৰ ধর না কেন, তাহার মধ্যে যে বিচার-আলোচনা করা হইয়া থাকে তাহাতে সমস্ত নামরূপেরই বিচার থাকে অর্থাৎ কোন পদার্থের এক নামরূপ চলিয়া গিয়া সেই পদার্থের অন্য নামরূপ কি করিয়া হয় তাহারই বিচার-আলোচনা করা হয় । উদাহরণ যথা, যার নাম জল তাহার বাষ্প নাম কখনও কিরূপে আসে, কিংবা এক কুচুকুচে কালো জাম হইতে তাম্র, সবুজ, নীল প্ৰভৃতি অনেক প্রকারের রঙ (রূপ) কি করিয়া হয় ইত্যাদি নামরূপের ভেদেরই বিচার এই শাস্ত্রে করা হইয়া থাকে । তাই, নামরূপের মধ্যেই মগ্ন এই শাস্ত্রের অভ্যাসের দ্বারা নামরূপের বাহিরে অবস্থিত সত্য বস্তুর জ্ঞান হইতে পারে না । যে ব্যক্তি সত্য ব্ৰহ্মবস্তুর অনুসন্ধান করিতে চায়, তাহার দৃষ্টিকে এই সমস্ত আধিভৌতিক অর্থাৎ নামরূপাত্মক শাস্ত্রের বাহিরে লইয়া যাইতে হইবে, ইহা সুস্পষ্ট । এবং এই অর্থ ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ের প্রারম্ভিক কথার মধ্যে ব্যক্ত করা হইয়াছে । কথারম্ভে নারদ ঋষি সনৎকুমার অর্থাৎ স্কন্দের নিকট গিয়া “আমাকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দাও”, এইরূপ বলিলেন; তখন সনৎকুমার “তুমি কি শিখিয়াছ আগে বল তার পর আমি বলিব” এইরূপ প্রশ্ন করিলেন । নারদ বলিলেন “আমি ঋগবেদাদি চারি ও ইতিহাস পুরাণরূপী পঞ্চম সমেত সমস্ত বেদ, ব্যাকরণ, গণিত, তৰ্কশাস্ত্ৰ, কালশাস্ত্ৰ, নীতিশাস্ত্ৰ, বেদাঙ্গ, ধর্মশাস্ত্ৰ, ভূতবিদ্যা, ক্ষাত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্পদেবজনবিদ্যা প্রভৃতি সমস্তই শিক্ষা করিয়াছি; কিন্তু তাহার দ্বারা আত্মজ্ঞান হয় নাই বলিয়া এক্ষণে আপনার নিকট আসিয়াছি ।” তাহাতে সনৎকুমার “তুমি যাহা কিছু শিখিয়াছ তাহা সমস্ত নামরূপাত্মক, প্রকৃত ব্ৰহ্ম এই নাম ব্ৰহ্মের অতীত” এইরূপ উত্তর দিয়া পরে ক্ৰমে ক্রমে এই নামরূপ অর্থাৎ সাংখ্যদিগের অব্যক্ত প্ৰকৃতির অতীত কিংবা বাণী, আশা, সঙ্কল্প, মন, বুদ্ধি (জ্ঞান) ও প্রাণ - ইহাদেরও অতীত এবং ইহাদের খুব উপরে অবস্থিত যে পরমাত্মারূপী অমৃত তত্ত্ব, নারদকে তাহারই সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন ।


18) বিজ্ঞান-বাদ বেদান্তের গ্রাহ্য নহে


উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনার তাৎপর্য এই যে, মানব-ইন্দ্ৰিয়ের নামরূপের অতিরিক্ত আর কিছুরই প্ৰত্যক্ষ জ্ঞান না হইলেও এই অনিত্য নামরূপের আবরণের নীচে চক্ষুর অগোচর অতএব অব্যক্ত কোন কিছু নিত্য দ্রব্য অবশ্যই থাকিবে এবং তৎপ্ৰযুক্তই সমস্ত জগতের জ্ঞান আমাতে একত্বের দ্বারা হইয়া থাকে । যাহা কিছু জ্ঞান হয় তাহা আত্মারই হইয়া থাকে, তাই আত্মা জ্ঞাতা । এই জ্ঞাতার যে জ্ঞান হয় তাহা নামরূপাত্মক জগতেরই জ্ঞান; তাই, নামরূপাত্মক বাহ্য জগতই জ্ঞান [মভা|শাং|৩০৬|৪০]; এবং এই নামরূপাত্মক জগতের মূলে যে কিছু বস্তুতত্ত্ব আছে তাহাই জ্ঞেয় । এই বৰ্গীকরণ স্বীকার করিয়া ভগবদ্‌গীতায় জ্ঞাতাকে ক্ষেত্ৰজ্ঞ আত্মা এবং জ্ঞেয়কে ইন্দ্ৰিয়াতীত নিত্য পরব্ৰহ্ম [গী|১৩|১২-১৭] বলা হইয়াছে; এবং পরে জ্ঞানের তিন ভেদ করিয়া ভিন্নত্ব কিংবা নানাত্বের দ্বারা উৎপন্ন জগৎজ্ঞানকে রাজসিক এবং শেষে নানাত্বের যে জ্ঞান একত্বরূপ হইতে হয় তাহাকে সাত্ত্বিক জ্ঞান বলা হইয়াছে [গী|১৮|২০,২১] । এই সম্বন্ধে কেহ কেহ এইরূপ তর্ক করেন যে, জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইরূপ ত্ৰিবিধ ভেদ করা ঠিক নহে; আমাদের যাহা কিছু জ্ঞান হয়, এই জগতে তাহা হইতে ভিন্ন আর কিছু আছে এরূপ বলিবার পক্ষে আমাদের কোন প্ৰমাণ নাই । গরু ঘোড়া প্ৰভূত যে সকল বাহ্য বস্তু আমরা দেখিতে পাই তাহা আমাদের জ্ঞানই, এবং এই জ্ঞান সত্য হইলেও তাহা কি করিয়া উৎপন্ন হইল বুঝাইবার জন্য আমার জ্ঞান ব্যতীত অন্য কোন উপায় থাকে না; অতএব এই জ্ঞান ব্যতীত বাহ্য পদাৰ্থ বলিয়া কোন স্বতন্ত্র বস্তু আছে কিংবা এই সকল বাহ্য বস্তুর মূলে অন্য কোন স্বতন্ত্র তত্ত্ব আছে এরূপ বলিতে পারা যায় না । কারণ, জ্ঞাতা না থাকিলে জগৎ থাকে কোথায় ? এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে, জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় ইহাদের মধ্যে জ্ঞেয় এই তৃতীয় বৰ্গ থাকে না; জ্ঞাতা ও তাহার জ্ঞান এই দুই শুধু বাকী থাকে; এবং এই যুক্তিবাদকে আর একটু দূরে লইয়া গেলে ‘জ্ঞাতা’ বা ‘দ্রষ্টা’ওতো, একপ্রকারের জ্ঞানই, তাই শেষে জ্ঞান ব্যতীত আর কোন বস্তুই অবশিষ্ট থাকে না । ইহাকে ‘বিজ্ঞানবাদ’ বলে; এবং ইহাকেই যোগাচারপন্থী বৌদ্ধেরা প্ৰমাণ বলিয়া ধরিয়াছে । জ্ঞাতার জ্ঞান ব্যতীত স্বতন্ত্র অন্য কিছুই এই জগতে নাই; অধিক কি, জগতই নাই, যাহা কিছু আছে তাহা মনুষ্যের জ্ঞানই, এইরূপ এই মার্গের বিদ্বানেরা প্রতিপাদন করিয়াছেন । ইংরেজ গ্রন্থকারদিগের মধ্যেও হিউমের ন্যায় পণ্ডিত এই প্ৰকার মতের অগ্ৰণী । কিন্তু বেদান্তীদিগের নিকট এই মত মান্য নহে; বাদরায়ণাচার্য বেদান্তসূত্রে [বেসূ|২|২|২৮-৩২] এবং শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য উক্ত সূত্রসমূহের ভাষ্যে এই মত খণ্ডন করিয়াছেন । মনুষ্যের মনের উপর উৎপন্ন সংস্কারই শেষে মনুষ্য জানিয়া থাকে, ইহা মিথ্যা নহে; এবং ইহাকেই আমরা জ্ঞান বলি । কিন্তু জ্ঞান ব্যতীত যদি অন্য কিছু না থাকে, তবে ‘গরু’সম্বন্ধীয় জ্ঞান ভিন্ন, ‘ঘোড়া’সম্বন্ধীয় জ্ঞান ভিন্ন, এবং ‘আমি’বিষয়ক জ্ঞান ভিন্ন, - “এইরূপ বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যেই যে ভিন্নতা আমাদের বুদ্ধি উপলব্ধি করে তাহার কারণ কি ? জ্ঞান হইবার মানসিক ক্রিয়া সর্বত্র একই মানিলাম; কিন্তু তদ্ব্যতীত অন্য কিছুই নাই বলিলে গরু ঘোড়া ইত্যাদি বিভিন্ন ভেদ আসিল কোথা হইতে ? স্বপ্নজগতের ন্যায় মন আপনিই আপন মর্জি অনুসারে জ্ঞানের এই ভেদ স্থাপন করে এইরূপ কেহ যদি বলেন, তাহা হইলে স্বপ্নজগৎ হইতে ভিন্ন জাগ্ৰত অবস্থার জ্ঞানে যে একপ্রকার সুসঙ্গতি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার কারণ বলিতে পারা যায় না [বেসু|শাংভা|২|২|২৯; ৩|২|৪] । তাছাড়া, জ্ঞান ব্যতীত অন্য কোন বস্তু নাই, এবং ‘দ্রষ্টার’ মনই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ নির্মাণ করে এইরূপ বলিলে, প্ৰত্যেক দ্রষ্টার ‘আমার মন’ অৰ্থাৎ ‘আমিই স্তম্ভ’ কিংবা ‘আমিই গরু’ এইরূপ ‘আমি-পূর্বক’ সমস্ত জ্ঞান হওয়া চাই । কিন্তু তাহা না হইয়া, আমি পৃথক, স্তম্ভ গরু প্ৰভৃতি পদার্থও আমা হইতে ভিন্ন, যখন এইরূপ প্ৰতীতি সকলের হইয়া থাকে, তখন দ্রষ্টার মনে সমস্ত জ্ঞান উৎপন্ন হইবার জন্য এই আধারভূত বাহ্যজগতে অন্য কোন স্বতন্ত্র বাথ্য বস্তু অবশ্যই থাকিবে, এইরূপ শঙ্করাচার্য সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [বেসু|শাংভা|২|২|২৮] । কাণ্টের মতও এইরূপ; জাগতিক জ্ঞানলাভের জন্য মনুষ্যের বুদ্ধির একীকরণ আবশ্যক হইলেও, এই জ্ঞানকে বুদ্ধি একেবারেই আপন হইতে অর্থাৎ নিরাধার কিংবা সম্পূর্ণ নূতন উৎপন্ন করে না, তাহা সর্বদাই জাগতিক বাহ্য বস্তুর অপেক্ষা করে, ইহা তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন । এই স্থানে কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, “কিহে ! শঙ্করাচার্য একবার বাহ্য জগত মিথ্যা বলেন এবং পুনরায় বৌদ্ধদিগের মত খণ্ডন করিবার সময় সেই বাহ্য জগতের অস্তিত্বই ‘দ্রষ্টা’র অস্তিত্বেরই ন্যায় সত্য, এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন ! কেমন করিয়া ইহার সমন্বয় করা যাইবে ?” এই প্রশ্নের উত্তর পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে । আচার্য বাহ্য জগতকে যখন মিথ্যা বা অসত্য বলেন, তখন বাহ্যজগতের দৃশ্য নামরূপ অসত্য অর্থাৎ নশ্বর ইহাই তাহার অর্থ বুঝিতে হইবে । এ নামরূপাত্মক বাহ্য দৃশ্য মিথ্যা হইলেও উহার দ্বারা তাহার মূলে কোন প্রকার ইন্দ্রিয়াতীত সত্য বস্তু আছে, এই সিদ্ধান্তের কোন বাধা হয় না । সারকথা, ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে যেমন এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে দেহেন্দ্রিয়াদি নশ্বর নামরূপের মূলে কোন নিত্য আত্মতত্ত্ব আছে; সেইরূপ বলিতে হয় যে, নামরূপাত্মক বাহ্য জগতের মূলেও কোন নিত্য আত্মতত্ত্ব আছে । তাই, দেহেন্দ্ৰিয় ও বাহ্য জগৎ এই দুয়ের নিত্য পরিবর্তনশীল অর্থাৎ মিথ্যা দৃশ্যমান বস্তুর মূলে দুইদিকেই কোন নিত্য অর্থাৎ সত্য বস্তু আচ্ছাদিত হইয়া আছে, এইরূপ বেদান্তশাস্ত্ৰ নির্ধারণ করিয়াছেন । ইহার পরে দুই দিকের এই যে নিত্য তত্ত্ব, ইহা বিভিন্ন কি একরূপ এই প্রশ্ন আসে । কিন্তু ইহার বিচার আবার করিব । অনেক সময় এই মতের অর্বাচীনতা সম্বন্ধে যে আপত্তি করা হয় প্ৰথমে তাহার একটু বিচার করিব ।


19) মায়াবাদের প্রাচীনতা


কেহ কেহ বলেন যে, বৌদ্ধদের বিজ্ঞানবাদ বেদান্তশাস্ত্রের অভিমত না হইলেও, চক্ষুর গোচর বাহ্যজগতের নাম রূপাত্মক স্বরূপ মিথ্যা এবং তাহার মূলদেশে যে অব্যয় ও নিত্য দ্রব্য আছে তাহাই সত্য, শঙ্করাচার্যের এই মত - যাহাকে মায়াবাদ বলে - প্রাচীন উপনিষদে বর্ণিত না থাকা প্ৰযুক্ত উহাকেও বেদান্তশাস্ত্রের মূল-ভাগ মানিতে পারা যায় না । কিন্তু উপনিষদ্‌ মনোযোগের সহিত পাঠ করিলে এই আপত্তি যে ভিত্তিহীন, ইহা যে-কোন ব্যক্তির সহজে উপলব্ধি হইবে । ইহা প্ৰথমেই বলা হইয়াছে যে, ‘সত্য’ শব্দ ব্যবহারে চক্ষুর গোচর বস্তুর প্রতি প্ৰযুক্ত হয় । এইজন্য ‘সত্য’ শব্দের এই ব্যবহারিক অর্থ লইয়াই উপনিষদের কোন কোন স্থানে চক্ষুর গোচর নাম রূপাত্মক বাহ্য পদার্থকে ‘সত্য’ এবং সেই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত দ্রব্যকে ‘অমৃত’ নাম দেওয়া হইয়াছে । উদাহরণ যথা, বৃহদারণ্যক উপনিষদে [১|৬|৩] “তদেতদমৃতং সত্যেন ছন্নং” - সেই অমৃত সত্যের দ্বারা আচ্ছাদিত - এইরূপ বলিয়া অমৃত ও সত্য এই দুই শব্দের “প্ৰাণো বা অমৃতং নামরূপে সত্যং তাভ্যাময়ং প্রাণশছন্নঃ” - প্ৰাণ অমৃত এবং নামরূপ সত্য, এবং এই নামরূপ সত্যের দ্বারা প্ৰাণ আচ্ছাদিত - এইরূপ ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । এখানে প্ৰাণের অর্থ প্ৰাণস্বরূপ পরব্রহ্ম । ইহা হইতে দেখা যায় যে, পরবর্তী উপনিষদে যাহাকে ‘মিথ্যা’ ও ‘সত্য’ বলা হইয়াছে পূর্বে তাহারই অনুক্রমে ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ এই নাম ছিল । কোন কোন স্থানে এই অমৃতকে ‘সত্যস্য সত্যং’ - চক্ষুর গোচর সত্যের ভিতরকার চরম সত্য [বৃ|২|৩|৬] বলা হইয়াছে । কিন্তু ইহা হইতেই উক্ত আপত্তি সিদ্ধ হয় না যে, উপনিষদের কোন কোন স্থানে চক্ষুর গোচর জগৎকেই সত্য বলা হইয়াছে - কারণ, বৃহদারণ্যকেই শেষে আত্মরূপ পরব্রহ্ম ব্যতীত অন্য সমস্ত ‘আৰ্ত্তম্‌’ অর্থাৎ নশ্বর, এই রূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [বৃ|৩|৭|২৩] । জগতের মূল তত্ত্বের অনুসন্ধান যখন প্রথম আরম্ভ হয়, তখন চক্ষুর গোচর জগতকে প্ৰথম হইতেই সত্য মানিয়া লইয়া তাহার অভ্যন্তরে অন্য কোন্‌ সূক্ষ্ম সত্য লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান হইতে লাগিল । কিন্তু পরে এইরূপ দেখা গেল যে, যে দৃশ্য জগতের রূপকে আমরা সত্য বলিয়া মনে করি, তাহা আসলে নশ্বর এবং তাহার অভ্যন্তরে কোন অবিনশ্বর বা অমৃত তত্ত্ব আছে । দুয়ের মধ্যে এই ভেদ যেমন যেমন অধিক ব্যক্ত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইল, সেই অনুসারে ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ এই দুই শব্দের স্থানে ‘অবিদ্যা’ ও ‘বিদ্যা’ এবং পরিশেষে ‘মায়া ও সত্য’ কিংবা ‘মিথ্যা ও সত্য’ এই পরিভাষা প্রচলিত হইতে লাগিল । কারণ ‘সত্য’ শব্দের ধাত্ব্যৰ্থ ‘নিত্যস্থায়ী’ হওয়া প্ৰযুক্ত নিত্য পরিবর্তনশীল ও নশ্বর নামরূপকে সত্য বলা উত্তরোত্তর অধিকতর অসঙ্গত বলিয়া মনে হইতে লাগিল । কিন্তু এই প্রকারে ‘মায়া’ কিংবা ‘মিথ্যা’ শব্দ পূর্বাবধি প্ৰচলিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের চক্ষুর গোচর জাগতিক বস্তুর বাহ্য আবির্ভাব নশ্বর ও অসত্য, এবং তাহার মূলস্থিত ‘তাত্ত্বিক দ্রব্য’ই সৎ কিংবা সত্য, এই বিচার অতীব প্রাচীন কাল হইতেই চলিয়া আসিয়াছে । ঋগ্‌বেদেই “একং সদ্‌ বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি” [১|১৬৪|৪৬ ও ১০|১১৪|৫] - যাহা মূলে এক ও নিত্য (সৎ) তাহাকেই বিপ্ৰ (জ্ঞাতা) বিভিন্ন নাম দিয়া থাকেন - অর্থাৎ এক সত্য বস্তুই নামরূপের দ্বারা বিভিন্ন প্ৰতীত হয় এইরূপ কথিত হইয়াছে । “এক রূপের অনেক রূপ করিয়া দেখান” এই অর্থে ঋগ্‌বেদেও ‘মায়া’ শব্দের প্রয়োগ হইয়াছে, “ইন্দ্ৰো মায়াভিঃ পুরুরূপঃ ঈয়তে” ইন্দ্ৰ নিজের মায়ার দ্বারা অনেক রূপ ধারণ করেন [ঋ|৬|৪৭|১৮] । তৈত্তিরীয় সংহিতায় এক স্থলে [তৈ সং|৩|১১] এই অর্থেই ‘মায়া’ শব্দের প্রয়োগ করা হইয়াছে; এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে এই ‘মায়া’ শব্দ নামরূপের সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইয়াছে । কিন্তু মায়াশব্দের নামরূপ সম্বন্ধে প্রয়োগ করিবার রীতি শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের কাল অবধিই প্রচলিত হইলেও ইহা তো নির্বিবাদ যে, নামরূপকে অনিত্য কিংবা অসত্য কল্পনা করা উহার পূর্ববৰ্তী, ‘মায়া’ শব্দের বিপরীত অৰ্থ করিয়া শ্ৰীশঙ্করাচার্য এই কল্পনা নূতন বাহির করেন নাই । শ্রীশঙ্করাচার্যের ন্যায় যাঁহাদের নামরূপাত্মক জগৎ-স্বরূপকে ‘মিথ্যা’ নাম দিবার সাহস হয় না, অথবা গীতায় যেমন ভগবান ঐ অর্থে মায়া শব্দের উপযোগ করিয়াছেন, তাহা করিতেও যাঁহারা ভয় পান, তাঁহারা ইচ্ছা করেন তো বৃহদারণ্যক উপনিষদের ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ শব্দের স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করিতে পারেন । যাই বলনা কেন, নামরূপ ‘নশ্বর’ এবং নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত তত্ত্ব ‘অমৃত’ বা ‘অবিনশ্বর’ এবং এই ভেদ প্ৰাচীন বৈদিক কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, এই সিদ্ধান্তে কোনই বাধা আসে না । 


20) নামরূপে আচ্ছাদিত নিত্য ব্রহ্মের এবং শরীর আত্মার স্বরূপ একই


যাক্‌ । নামরূপাত্মক বাহ্য জগতের পদার্থমাত্রের যে জ্ঞান আমাদের আত্মায় উৎপন্ন হয় তাহা উৎপন্ন হইতে হইলে আমাদের আত্মার আধারভূক্ত, এবং আত্মার সহিত সমশ্রেণীর বাহ্যজগতের নানা পদার্থের মূলে বর্তমান ‘কোন-না-কোন কিছু’ এক মূলীভূত নিত্য এবং পদার্থ থাকা চাই; নচেৎ এই জ্ঞান হইতেই পারে না । কিন্তু এইটুক স্থির করিলেই অধ্যাত্মশাস্ত্রের কাজ শেষ হয় না । বাহ্য জগতের মূলে অবস্থিত এই নিত্য বস্তুকেই বেদান্তী ‘ব্ৰহ্ম’ বলেন; এবং সম্ভব হইলে এই, ব্রহ্মের স্বরূপ নির্ধারণ করাও আবশ্যক । সমস্ত নামরূপাত্মক পদার্থের মূলে অবস্থিত এই নিত্য তত্ত্ব অব্যক্ত হওয়া প্রযুক্ত তাহার স্বরূপ নামরূপাত্মক পদার্থের ন্যায় ব্যক্ত ও স্থল (জড়) হইতে পারে না, ইহা সুস্পষ্ট । কিন্তু ব্যক্ত ও স্থূল পদার্থ ছাড়িয়া দিলেও মন, স্মৃতি, বাসনা প্রাণ ও জ্ঞান প্রভৃতি স্থূল নহে এমন অনেক অব্যক্ত পদার্থ আছে, এবং ইহা অসম্ভব নহে যে, পরব্রহ্মও তাহাদেরই মধ্যে কোন না-কোন একটীর স্বরূপবিশিষ্ট । কেহ কেহ বলেন যে, প্ৰাণের ও পরব্রহ্মের স্বরূপ একই । জর্মন পণ্ডিত শোপেনহর পরব্রহ্মকে বাসনাত্মক স্থির করিয়াছেন । বাসনা মনের ধর্ম হওয়ায়, এই মতানুসারে ব্ৰহ্মকে মনোময় বলা যাইতে পারে [তৈ|৩|৪] । কিন্তু এখন পর্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে বলা যাইতে পারে যে, ‘প্রজ্ঞানং ব্ৰহ্ম’ [ঐ|৩|৩], কিংবা ‘বিজ্ঞানং ব্ৰহ্ম’ [তৈ|৩|৫] - জড়জগতের নানাত্বের যে জ্ঞান এক স্বরূপ হইতে আমার হয় তাহাই ব্ৰহ্মের স্বরূপ । হেগেলের সিদ্ধান্ত এই ধরণেরই । কিন্তু উপনিষদে চিদ্‌রূপী জ্ঞানের ন্যায়ই সৎকে (অর্থাৎ জাগতিক সমস্ত বস্তুর অস্তিত্বের সাধারণ ধর্ম বা সত্তাসামান্যত্বকে) এবং আনন্দকেও ব্ৰহ্মস্বরূপেরই অন্তর্ভুক্ত করিয়া ব্ৰহ্মকে সচ্চিদানন্দরূপ বলা হইয়াছে । ইহা ব্যতীত অন্য ব্ৰহ্মস্বরূপ হইতেছে ওঁকার । ইহার উপপত্তি এইরূপ - প্ৰথমে সমস্ত বেদ অনাদি ওঁকার হইতে নিঃসৃত হইয়াছে; এবং উহা বাহির হইবার পর সেই বেদের নিত্য শব্দ হইতেই পরে ব্ৰহ্মা যখন সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিলেন [গী|১৭|২৩; মভা|শাং|২৩১|৫৬-৫৮], তখন ওঁকার ব্যতীত মূলারম্ভে অন্য কিছু ছিল না । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, ওঁকারই প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ [মাণ্ডুক্য|১; তৈত্তি|১,৮] । কিন্তু শুধু অধ্যাত্মশাস্ত্ৰদৃষ্টিতে বিচার করিলে পরব্রহ্মের এই সমস্ত স্বরূপই ন্যূনাধিক নামরূপাত্মক হইয়া পড়ে । কারণ এই সমস্ত স্বরূপ মানব-ইন্দ্রিয়ের গোচর, এবং মনুষ্য এইপ্রকারে যাহা জানে তাহা নামরূপের গণ্ডীর মধ্যেই পড়িয়া যায় । তবে, এই নামরূপের মূলে অবস্থিত যে অনাদি, অন্তর বাহিরে পূর্ণরূপে অবস্থিত, একাত্মক, নিত্য ও অমৃত তত্ত্ব [গী|১৩|১২-১৭] আছে, তাহার বাস্তব স্বরূপের নির্ণয় কি করিয়া হইবে ? অনেক অধ্যাত্মশাস্ত্ৰজ্ঞ বলেন যে, আর যাহাই হউক না কেন, এই তত্ত্ব আমাদের ইন্দ্ৰিয়ের অজ্ঞেয় থাকিবেই; ক্যাণ্ট তো এই প্রশ্নের বিচার করাই ছাড়িয়া দিয়াছেন । সেইরূপ উপনিষদেও “নেতি নেতি” - অৰ্থাৎ যাহার সম্বন্ধে কিছু বলা যাইতে পারে তাহা নহে; ব্ৰহ্ম তাহারও অতীত, এবং চক্ষুর অদৃশ্য; “যতো বাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ” - বাক্যমনের অগোচর - এই প্রকারে, পরব্রহ্মের অজ্ঞেয় স্বরূপের বর্ণনা করা হইয়াছে । তথাপি এই অগম্য অবস্থাতেও মনুষ্য আপন বুদ্ধির দ্বারা ব্ৰহ্মস্বরূপের একপ্ৰকার নির্ণয় করিতে পারে, ইহা অধ্যাত্মশাস্ত্র স্থির করিয়াছে । বাসনা, স্মৃতি, ধৃতি, আশা, প্ৰাণ, জ্ঞান প্রভৃতি যে সকল অব্যক্ত পদার্থ উপরে বলা হইয়াছে তন্মধ্যে যাহা অতিশয় ব্যাপক কিম্বা সর্বশ্রেষ্ঠ নির্ধারিত হইবে তাহা সেই পরব্রহ্মের স্বরূপ মানিতে হইবে । কারণ সমস্ত অব্যক্ত পদার্থের মধ্যে পরব্রহ্ম শ্ৰেষ্ঠ এই বিষয়টি নির্বিবাদ । এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে, আশা, স্মৃতি, বাসনা, ধৃতি ইত্যাদি মনের ধর্ম হওয়ায় মন ইহাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা জ্ঞান শ্ৰেষ্ঠ; এবং জ্ঞান বুদ্ধির ধর্ম বলিয়া জ্ঞান অপেক্ষা বুদ্ধি শ্ৰেষ্ঠ; এবং শেষে বুদ্ধিও যাহার ভূত্য সেই আত্মা সকল হইতে শ্ৰেষ্ঠ [গী|৩|৪২] । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞপ্রকরণে ইহার বিচার করা হইয়াছে । এখন বাসনা, মন প্রভৃতি সমস্ত অব্যক্ত পদার্থের মধ্যে যদি আত্মা শ্রেষ্ঠ হয় তবে পরব্রহ্মের স্বরূপও অবশ্য তাহাই হইবে ইহা স্বতই নিষ্পন্ন হইল । ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে এই যুক্তিবাদই স্বীকৃত হইয়াছে; এবং সনৎকুমার নারদকে বলিয়াছেন যে, বাক্য অপেক্ষা মন অধিক যোগ্য (ভূয়স্‌), মন অপেক্ষা জ্ঞান, জ্ঞান অপেক্ষা বল, এবং এইপ্ৰকার ক্রমশঃ ঊর্দ্ধে উঠিয়া আত্মা যখন সকল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ (ভূমন্‌) তখন আত্মাকেই পরব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ বলিতে হয় । ইংরেজ গ্ৰন্থকারদিগের মধ্যে গ্ৰীণ এই সিদ্ধান্তই স্বীকার করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহার যুক্তিবাদ একটু ভিন্ন হওয়ায় তাহা এখানে বেদান্তের পরিভাষায় সংক্ষেপে বলিব । গ্ৰীণ বলেন যে, ইন্দ্ৰিয়াদির যোগে আমাদের মনের উপর বাহ্য নামরূপের যে সকল সংস্কার সংঘটিত হয় তাহাদের একীকরণ করিয়া আত্মার জ্ঞান উৎপন্ন হয়; ঐ জ্ঞানের অনুরূপ বাহ্যজগতের ভিন্ন ভিন্ন নামরূপের মূলেও একত্বের দ্বারা উৎপন্ন কোনপ্রকার বস্তু থাকা চাই; নচেৎ আত্মার একীকরণের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান স্বকপোলকল্পিত ও নিরাধার হইয়া বিজ্ঞানবাদের ন্যায় মিথ্যা হইয়া পড়িবে । এই ‘কোন এক’ বস্তুকে আমরা ব্ৰহ্ম বলি । প্ৰভেদ এই যে কাণ্টের পরিভাষা স্বীকার করিয়া গ্ৰীণ তাহাকে বস্তুতত্ত্ব বলেন যাহাই বলনা কেন, শেষে বস্তুতত্ত্ব (ব্ৰহ্ম) ও আত্মা পরস্পরের অনুরূপ এই দুই পদার্থই অবশিষ্ট থাকে । তন্মধ্যে ‘আত্মা’ মন ও বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়াতীত হইলেও, নিজের প্রতীতিকে প্ৰমাণ মানিয়া আমরা নির্ধারণ করিয়া থাকি যে, আত্মা জড় নহে, - উহা চিৎরূপী বা চৈতন্যরূপী । আত্মার স্বরূপ এইরূপ নির্ধারিত করিলে পর, বাহ্যজগতের অন্তর্গত ব্রহ্মের স্বরূপ কি তাহা স্থির করিতে হইবে । এই বিষয়ে দুইটী মাত্র পক্ষই সম্ভব - এই ব্ৰহ্ম বা বস্তুতত্ত্ব (১) আত্মস্বরূপাত্মক কিংবা (২) আত্মা হইতে ভিন্ন স্বরূপাত্মক । কারণ ব্রহ্ম ও আত্মা ব্যতীত তৃতীয় বস্তুই অবশিষ্ট থাকে না । কিন্তু সকলেই ইহা জানে যে, কোনও দুই পদার্থ স্বরূপত ভিন্ন হইলে তাহাদের পরিণাম কিংবা কাৰ্যও অবশ্য ভিন্ন হইবে । তাই, পদার্থের পরিণাম হইতেই উক্ত পদার্থ ভিন্ন কিংবা একরূপ, তাহার নির্ণয় আমরা যে কোন শাস্ত্ৰে করিয়া থাকি । উদাহরণ যথা - দুই গাছের মূল, ডালপালা, ছাল, পাতা, ফুল ফল প্রভৃতি দেখিয়া আমরা স্থির করি যে, ঐ দুইটী গাছ একই অথবা ভিন্ন । এই রীতি উপস্থিত ক্ষেত্রে প্রয়োগ কবিলে, আত্মা ও ব্ৰহ্ম এক-স্বরূপাত্মকই হইবে, এইরূপ উপলব্ধি হয় । কারণ, ভিন্ন ভিন্ন জাগতিক পদার্থের যে সংস্কার মনের উপর হয়, এই আত্মার ব্যাপারের দ্বারা তাহাদের একীকরণ হয়; একীকরণের সঙ্গে যে একীকরণ দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন বাহ্য পদার্থের মূলে অবস্থিত বস্তুতত্ত্ব অর্থাৎ ব্ৰহ্ম উক্ত পদার্থসমূহের নানাত্ব ভাঙ্গিয়া দেয় সেই একীকরণের মিল হওয়া চাই, নচেৎ সমস্ত জ্ঞান নিরাধার ও মিথ্যা হইয়া পড়িবে, ইহা উপরে বলা হইয়াছে । একই নমুনার এবং সম্পূর্ণ এক অন্যের সহিত মিলাইয়া একীকরণকারী এই তত্ত্ব দুই স্থানে হইলেও পরস্পর হইতে ভিন্ন থাকিতে পারে না; অতএব ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইহার মধ্যে, আত্মার যে রূপ তাহাই ব্রহ্মেরও রূপ হইবে । (Green's Prolegomena to Ethics. $$ 26-36). 

সারকথা, যে কোন প্রকারেই বিচার করা হোক না কেন, ইহাই সিদ্ধ হইতেছে যে বাহ্যজগতের নামরূপে আচ্ছাদিত ব্ৰহ্মতত্ত্ব নামরূপাত্মক প্রকৃতির ন্যায় জড় তো নহে, পরন্তু বাসনাত্মক ব্ৰহ্ম, মনোময় ব্ৰহ্ম, জ্ঞানময় ব্ৰহ্ম, প্ৰাণব্ৰহ্ম, কিংবা ওঁকাররূপী শব্দব্ৰহ্ম, এই সমস্ত ব্ৰহ্মের রূপও নিম্নপদবীর এবং প্রকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ ইহার অতীত ও ইহা হইতে অধিক যোগ্য অর্থাৎ শুদ্ধ আত্মস্বরূপ । ইহাই যে গীতারও সিদ্ধান্ত তাহা এই সম্বন্ধে গীতার অনেক স্থানে যে উল্লেখ আছে তাহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় [গী|২|২০; ৭|৫; ৮|৪; ১৩|৩১; ১৫|৭,৮ দেখ] । তথাপি ব্রহ্মের ও আত্মার স্বরূপ এক, এই সিদ্ধান্ত কেবল এই যুক্তিপ্রয়োগে আমাদের ঋষিরা যে প্ৰথমে সন্ধান করিয়াছিলেন এরূপ বুঝিবে না । কারণ, অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে কেবল বুদ্ধির সাহায্যে কোন অনুমানই নিশ্চিত করা যাইতে পারে না, তাহার সহিত সর্বদা আত্মপ্ৰতীতির যোগ হওয়া চাই, ইহা এই প্রকরণের আরম্ভেই বলিয়াছি । তাছাড়া আধিভৌতিক শাস্ত্রেও অনুভূতি আগে আসে তাহার পর তাহার উপপত্তি জানা যায়, কিংবা অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা হয়, ইহা ত আমরা সর্বদাই দেখিতে পাই । এই ন্যায় অনুসারে উপরিপ্রদত্ত ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্যের বুদ্ধিগম্য উপপত্তি বাহির হইবার শত শত বৎসর পূর্বে আমাদের প্রাচীন ঋষিরা “নেহ নাহস্তি কিঞ্চন” [বৃ|৪|৪|১৯; কঠ|৪|১১] এই জগতের দৃশ্যমান অনেকত্ব সত্য নহে, তাহার মূলে চারিদিকে একই অমৃত, অব্যয় ও নিত্য তত্ত্ব আছে [গী|১৮|২০] এইরূপ প্ৰথমে নির্ণয় করিয়া, শেষে বাহ্যজগতের নানারূপের দ্বারা আচ্ছাদিত অবিনাশী তত্ত্ব এবং আমাদের শরীরান্তর্ভূত বুদ্ধির অতীত আত্মতত্ত্ব এই দুই একই অর্থাৎ একপদার্থী, অমর ও অব্যয় কিংবা যে তত্ত্ব ব্ৰহ্মাণ্ডে তাহাই পিণ্ডে অর্থাৎ মনুষ্যের দেহেতেই অবস্থিত, এই সিদ্ধান্ত তাঁহারা অন্তদৃষ্টির দ্বারা বাহির করিয়াছেন; এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞ্যবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে, গার্গী বারুণী প্রভৃতিকে এবং জনককে সম্পূর্ণ বেদান্তের এই রহস্যই বলিয়াছেন [বৃ|৩|৫-৮; ৪|২-৪] । “অহং ব্রহ্মাস্মি” – আমিই ব্রহ্ম, - ইহা যিনি জানিয়াছেন তিনি সমস্তই জানিয়াছেন এইরূপ এই উপনিষদেই পূর্বে বলা হইয়াছে [বৃ|১|৪|১০]; ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্বেতকেতুকে তাঁহার পিতা অদ্বৈতবেদান্তের এই তত্ত্বই অনেক প্রকারে বুঝাইয়া দিয়াছেন । “মাটীর এক গোলায় কি আছে তাহা জানিতে পারিলে মৃত্তিকার নামরূপাত্মক সমস্ত বিকার যেরূপ বুঝা যায় সেইরূপ যে এক বস্তুর জ্ঞান হইলে সমস্ত বস্তুই জানা যায়, সেই বস্তু আমাকে বল, তদ্বিষয়ক জ্ঞান আমার নাই” অধ্যায়ের আরম্ভে শ্বেতকেতু আপন পিতাকে এইরূপ প্রশ্ন করিলে, তাঁহার পিতা তখন নদী, সমুদ্র, জল ও লবণ ইত্যাদি অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইলেন যে, বাহ্য জগতের মূলে যে দ্রব্য আছে তাহা (তৎ) এবং তুমি (ত্বম্‌) অর্থাৎ তোমার দেহান্তর্গত আত্মা একই – “তত্ত্বমসি”; এবং আপনাকে আপনি জানিলে, সমস্ত জগতের মূলে কি আছে তাহা স্বতই তুমি জানিতে পারিবে । এইরূপ শ্বেতকেতুর পিতা নূতন নূতন বিভিন্ন দৃষ্টান্তের দ্বারা শ্বেতকেতুকে উপদেশ দিলেন; এবং প্রতিবারই “তত্ত্বমসি” - তাহাই তুমি - এই সূত্রের পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন [ছাং|৬|৮-১৬] । “তত্ত্বমসি” ইহাই অদ্বৈতবেদান্তের মহাবাক্যগুলির মধ্যে মুখ্য বাক্য ।


21) আত্মা ও ব্ৰহ্মকে চিদ্‌রূপী কেন বলে ?


ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী - ইহা নির্ণয় হইল । কিন্তু আত্মা চিদ্‌রূপী বলিয়া ব্ৰহ্মও চিদ্‌রূপী, এরূপ কেহ কেহ মনে করিতে পারেন । তাই এখানে ব্রহ্মের ও সেই সঙ্গে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ কি, তাহার আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । আত্মার সান্নিধ্যে জড়াত্মক বুদ্ধিতে উৎপন্ন ধর্মকে চিৎ অর্থাৎ জ্ঞান বলে । কিন্তু যখন বুদ্ধির এই ধর্মকে আত্মার উপর চাপানো উচিত নহে, তখন তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আত্মার মূল স্বরূপকেও নির্গুণ ও অজ্ঞেয় বলিয়াই মানিতে হইবে । তাই কাহারও কাহারও মত এই যে, ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী হইলেও এই উভয়কে কিংবা ইহাদের মধ্যে কোন একটিকে চিদ্‌রূপী বলা কিয়দংশে গৌণ । কেবল চিদ্‌রূপসম্বন্ধেই এই আপত্তি নহে; কিন্তু ‘সৎ’ এই বিশেষণও পরব্রহ্মের উপর চাপানো ঠিক নহে ইহাও ঐ সঙ্গে স্বতঃই প্রাপ্ত হওয়া যায় । কারণ সৎ ও অসৎ এই দুই ধর্ম পরস্পর-বিরুদ্ধ ও নিয়ত পরস্পরসাপেক্ষ অর্থাৎ দুই বিভিন্ন বস্তুর উদ্দেশ্যেই বলা হইয়া থাকে । যে ব্যক্তি আলোক কখনই দেখে নাই, সে আঁধারের কল্পনা করিতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, আলো ও আঁধার এই দুটি শব্দের দ্বন্দ্বও সে বুঝিতে পারিবে না । সৎ ও অসৎ এই শব্দদ্বয়ের দ্বন্দ্বসম্বন্ধে এই ন্যায়ই উপযোগী । কোন কোন বস্তুর নাশ হইয়া থাকে ইহা আমাদের উপলব্ধি হইলে, আমরা সমস্ত বস্তুর অসৎ (নশ্বর) ও সৎ (অবিনশ্বর) এই দুই বর্গ নির্দেশ করিতে থাকি; কিংবা সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দ বুঝতে হইলে মনুষ্যের দৃষ্টির সম্মুখে দুই প্রকারের বিরূদ্ধ ধর্ম আসা আবশ্যক । কিন্তু মূলারম্ভে যদি একই বস্তু ছিল, তবে দ্বৈত উৎপন্ন হইলে পর দুই বস্তুর উদ্দেশে যে সাপেক্ষ সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দের প্রচার হইয়াছে, এই মূল বস্তুতে উহাদের কিরূপে প্রয়োগ করা যাইবে ? কারণ ইহাকে সৎ বলিলে সেই সময়ে তাহার বিরুদ্ধ কোন অসৎ ছিল কি না এই সন্দেহ উপস্থিত হয় । তাই পরব্রহ্মের কোন বিশেষণ না দিয়াই “জগতের আরম্ভে সৎও ছিল না অসৎও ছিল না, যাহা কিছু ছিল তাহা একই ছিল”, ঋগ্‌বেদের নাসদীয় সূক্তে জগতের মূলতত্ত্বের এইরূপ বর্ণনা আছে [ঋ|১০|১২৯] । সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দের জুড়ী (কিংবা দ্বন্দ্ব) পরে বাহির হইয়াছে; এবং সৎ ও অসৎ, শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্দ্ব হইতে যাহার বুদ্ধি মুক্ত হইয়াছে সে এই সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্ব ব্ৰহ্মপদে উপনীত হয় এইরূপ গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|৭|২৮; ২|৪৫] । অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিচার কিরূপ গভীর ও সূক্ষ্ম তাহা ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে । কেবল তর্কদৃষ্টিতে বিচার করিলে, পরব্রহ্মের কিংবা আত্মারও অজ্ঞেয়ত্ব স্বীকার না করিয়া উপায় নাই । কিন্তু ব্ৰহ্ম এইরূপ অজ্ঞেয় ও নির্গুণ অতএব ইন্দ্ৰিয়াতীত হইলেও ইহা প্ৰতীতি হইতে পারে যে, প্ৰত্যেক মনুষ্যের নিজ নিজ আত্মার সাক্ষাৎ প্ৰতীতি হওয়ায়, আমার নির্গুণ ও অনির্বাচ্য আত্মার যে স্বরূপ সাক্ষাৎকারে আমি জানিতে পারি তাহাই পরব্রহ্মেরও স্বরূপ । সেইজন্য ব্ৰহ্ম ও আত্মা একস্বরূপী, এই সিদ্ধান্ত নিরর্থক হইতে পারে না । এই দৃষ্টিতে দেখিলে, “ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী” ইহা অপেক্ষা ব্ৰহ্মস্বরূপ সম্বন্ধে বেশী কিছু বলা যাইতে পারে না; অবশিষ্ট বিষয়সম্বন্ধে স্বানুভূতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হয় । কিন্তু বুদ্ধিগম্য শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনে যতদূর সম্ভব শব্দের দ্বারা খোলসা ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । তাই ব্ৰহ্ম সর্বত্র সমান ব্যাপ্ত অজ্ঞেয় অনিৰ্বাচ্য হইলেও জড়জগতের ও আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্মতত্ত্বের ভেদ ব্যক্ত করিবার জন্য আত্মার সন্নিধানে জড়প্রকৃতিতে চৈতন্যরূপী যে গুণ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাহাকেই আত্মার প্রধান লক্ষণ মানিয়া, অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ আত্মা ও ব্ৰহ্ম দুইকেই চিদ্‌রূপী বা চৈতন্যরূপী বলিয়া থাকে । কারণ সেরূপ না করিলে আত্মা ও ব্রহ্ম দুই-ই নির্গুণ, নিরঞ্জন ও অনির্বাচ্য হওয়ায় তাহাদের স্বরূপ বৰ্ণন একেবারেই বন্ধ করিতে হয়, কিংবা শব্দের দ্বারা কোন কিছু বর্ণনা করিতে হইলে “নেতি নেতি” । “এতস্মাদন্যৎপরমস্তি” -  ইহা নহে, ইহা (ব্ৰহ্ম) নহে, (ইহা নামরূপ), প্ৰকৃত ব্ৰহ্ম ইহার অতীত আর কিছু; এইরূপ নিয়ত “না”-“না” ধারা পাঠের ন্যায় আবৃত্তি করিতে থাকা ভিন্ন অন্য উপায় নাই [বৃ|২|৩|৬] । তাই চিৎ (জ্ঞান), সৎ (সত্তামাত্রত্ব কিংবা অস্তিত্ব) ও আনন্দ - সাধারণত, ব্ৰহ্মস্বরূপের এই লক্ষণগুলি বলা হয় । এই লক্ষণগুলি অন্য সমস্ত লক্ষণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ইহাতে সংশয় নাই । তথাপি শব্দের দ্বারা যতদূর হইতে পারে ব্রহ্মের স্বরূপ জানাইবার জন্য এই লক্ষণগুলি কথিত হইয়াছে; প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ নির্গুণ হওয়ায় তাহার জ্ঞানলাভ করিতে হইলে তাহার অপরোক্ষ অনুভূতি আবশ্যক হয়, ইহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না । এই অনুভূতি কিরূপে আসিতে পারে, অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়াতীত অতএব অনিৰ্বাচ্য ব্ৰহ্মস্বরূপ ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষের কিরূপে ও কখন অনুভবে আইসে, আমাদের শাস্ত্রকারেরা ইহার যে বিচার করিয়াছেন তাহা এক্ষণে সংক্ষেপে বলিব ।


22) ব্রহ্মাত্মৈক্য অর্থাৎ এই জ্ঞান যে “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”


ব্ৰহ্ম ও আত্মা এক – এই সমীকরণকে মারাঠীতে “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে” এইরূপ বলা হইয়া থাকে । এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্য অনুভূতিতে আসিলে পর জ্ঞাতা অর্থাৎ দ্রষ্টা আত্মা পৃথক এবং জ্ঞেয় অর্থাৎ দৃষ্ট বস্তু ভিন্ন, এই ভেদ থাকিতে পারে না । কিন্তু মনুষ্য যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন তাহার নেত্ৰাদি ইন্দ্ৰিয় যদি তাহা হইতে বিচ্যুত না হয়, তবে ইন্দ্রিয় ভিন্ন ও ইন্দ্ৰিয়গোচর বিষয় ভিন্ন – এই ভেদ কি করিয়া চলিয়া যাইবে ? এবং এই ভেদ না চলিয়া গেলে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি কি করিয়া ঘটিবে ? এইরূপ এক সংশয় আসিতে পারে । কেবল ইন্দ্ৰিয়দৃষ্টিতেই বিচার করিলে এই সংশয় সম্পূর্ণ অসঙ্গতও মনে হয় না । কিন্তু একটু তলাইয়া বিচার করিলে এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্ৰিয়গণ বাহ্য বিষয় দেখিবার কাজটা কেবল আপনা হইতেই করে এরূপ নহে । “চক্ষুঃ পশ্যতি রূপাণি মনসা ন তু চক্ষুষা” [মভা|শাং|৩১১|১৭] যে কোন বস্তু দেখিতে হইলে (এবং শুনিতে হইলে) নেত্রের (ও কান প্রভৃতির) মনের সাহায্য আবশ্যক হয়; মন শূন্য থাকিলে অন্য কোন বিষয়ে ডুবিয়া থাকিলে, বস্তু চোখের সম্মুখে থাকিলেও দেখা যায় না, ইহা পূর্বে বলা হইয়াছে । এই ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার প্রতি লক্ষ্য করিলে, ইহা সহজে অনুমান করা যায় যে, নেত্রাদি ইন্দ্রিয় ঠিক্‌ থাকিলেও মনকে যদি তাহা হইতে বাহির করিয়া আনা যায়, তাহা হইলে ইন্দ্ৰিয়বিষয়ের দ্বন্দ্ব বাহ্য জগতে থাকিলেও আমাদিগের নিকট না থাকিবার মতনই হয় । পরিণামে মন কেবল আত্মাতে অর্থাৎ আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্মেতেই রত হওয়ায় আমাদিগের ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের সাক্ষাৎকার হয় । ধ্যানের দ্বারা, সমাধির দ্বারা, একান্ত উপাসনার দ্বারা, কিংবা অত্যন্ত ব্ৰহ্মবিচারান্তে শেষে এই মানসিক অবস্থা যে ব্যক্তি প্ৰাপ্ত হয়, দৃশ্য জগতের দ্বন্দ্ব বা ভেদ তাহার নেত্রসম্মুখে থাকিলেও না থাকিবার মতই হয়; এবং পরে স্বতই তাহার অদ্বৈত ব্ৰহ্মস্বরূপের পূর্ণ সাক্ষাৎকার হয় । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞানের শেষে এই যে নিত্য অবস্থা প্ৰাপ্ত হয়, সেই অবস্থার মধ্যে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান এই তিনপ্রকারের ভেদ অর্থাৎ ত্ৰিপুটী অবশিষ্ট থাকে না, কিংবা উপাস্য ও উপাসক এই দ্বৈতভাবও থাকে না । তাই, এই অবস্থার কথা অন্য কাহাকে বুঝাইতে পারা যায় না । কারণ ‘অন্য’ এই শব্দ উচ্চারণ করিবামাত্র এই অবস্থা বিঘট্টিত হয় এবং মনুষ্য অদ্বৈত হইতে দ্বৈতে আসিয়া পড়ে, ইহা স্পষ্টই প্ৰকাশ পায় । অধিক কি, এই অবস্থা আমি নিজে উপলব্ধি করিয়াছি, ইহা বলাও মুস্কিল ! কারণ, ‘আমি’ বলিলেই অন্য হইতে ভিন্ন এই ভাবনা মনে আসে এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্য হইবার পক্ষে উহা সম্পূর্ণ বাধক হয় । এই কারণে “যত্র হি দ্বৈতমিব ভবতি তদতির ইতরং পশ্যতি ... জিঘ্রতি ... শৃণোতি ... বিজানাতি । ... “যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূৎ তৎ কেন কং পশ্যেৎ ... জিঘ্রেৎ ... শৃণুয়াৎ ... বিজানীয়াৎ । ... বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ । এতাবদরে খলু অমৃতত্ত্বমিতি ।” — দ্রষ্টা ও দ্রষ্টব্য পদার্থ এই দ্বৈত যে পর্যন্ত স্থায়ী হয় সে পর্যন্ত এক আর এককে দেখে, আঘ্রাণ করে, শ্ৰবণ করে, এবং জানে; কিন্তু সমস্ত যখন আত্মাময় হইয়া যায় (অর্থাৎ আত্ম-পর ভেদই থাকে না) তখন কে কাহাকে দেখিবে, আঘ্রাণ করিবে, শুনিবে বা জানিবে ! ওরে ! যে স্বয়ং জ্ঞাতা তাহার জ্ঞাতা আর কোথা হইতে আসিবে ? - যাজ্ঞবল্ক্য বৃহদারণ্যকে এই চরম ও পরম অবস্থার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন [বৃ|৪|৫|১৫; ৪|৩|২৭] । 


23) ব্রহ্মানন্দ


এইরূপ সমস্তই আত্মীভূত কিংবা ব্ৰহ্মভুত হইলে পর, সে অবস্থায় ভীতি, শোক কিংবা সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বও থাকিতে পারে না [ঈশ|৭] । কারণ, যাহার ভয় হইবে, কিংবা যাহার জন্য শোক হইবে, তাহার আপনা হইতে - আমা হইতে - ভিন্ন হওয়া চাই এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি আসিলে পর এইপ্ৰকার ভিন্নতার কোন অবকাশ থাকে না । এই দুঃখশোকবিরহিত অবস্থাকেই ‘আনন্দময়’ এই নাম দিয়া এই আনন্দই ব্রহ্ম এইরূপ তৈত্তিরীয় উপনিষদে উক্ত হইয়াছে [তৈ|২|৮; ৩|৬] । কিন্তু এই বর্ণনাও গৌণ । কারণ, আনন্দের অনুভবকারী এখন থাকে কোথায় ? তাই, লৌকিক আনন্দ হইতে আত্মানন্দ কিছু বিশেষ প্রকারের, এইরূপ বৃহদারণ্যকে কথিত হইয়াছে [বৃ|৪|৩|৩২] । ব্ৰহ্মবৰ্ণনায় যে ‘আনন্দ’ শব্দ প্ৰযুক্ত হয় সেই শব্দের গৌণত্বের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই অন্য স্থানে ‘আনন্দ’ শব্দকে ছাঁটিয়া ব্ৰহ্মবেত্তা পুরুষের শেষ বর্ণনা এইমাত্র করা হয় যে, “ব্ৰহ্ম ভবতি য এবং বেদ” [বৃ|৪|৪|২৫] কিংবা “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” [মুং|৩|২,৯] - যে ব্ৰহ্মকে জানে সে ব্ৰহ্ম হইয়া যায় । এই অবস্থার এইরূপ দৃষ্টান্ত উপনিষদে প্রদত্ত হইয়াছে [বৃ|২|৪|১২; ছাং|৬|১৩] - লবণখণ্ড জলের মধ্যে মিশিয়া গেলে, সেই জলের মধ্যে অমুক ভাগ লবণাক্ত এবং অমুক ভাগ লবণাক্ত নহে এইরূপ ভেদ যেমন থাকে না, তেমনি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের জ্ঞান হইলে পর সমস্ত ব্ৰহ্মময় হইয়া যায় । কিন্তু “জয়াচী বদে নিত্য বেদান্ত বাণী” - যিনি বলেন নিত্য বেদান্তের বাণী - সেই তুকারাম বাবা এই লবণাক্ত দৃষ্টান্তের বদলে -
গোড়পণে জৈসা গুড় ৷ তৈসা দেব ঝালা সকল ॥
আতাঁ ভজো কোণেপরী ৷ দেব সবাহ্য অন্তঁরী ॥
অর্থাৎ “গুড়ের মধ্যে যেরূপ মিষ্টতা, সেইরূপ সমস্তের মধ্যেই ভগবান, এখন যে রকমেই ভজনা কর - ভগবান বাহিরেও আছেন, অন্তরেও আছেন” - এইরূপ গুড়ের মিষ্টতার দৃষ্টান্ত দ্বারা নিজের অনুভূতির বর্ণনা করিয়াছেন [তু|গা|৩৬২৭] । পরব্রহ্ম ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর ও মনেরও অগম্য হইলেও তিনি স্বানুভবগম্য এইরূপ যে বলা হয় তাহার তাৎপর্যই এই । পরব্রহ্মের যে অজ্ঞেয়তা বৰ্ণনা করা হইয়া থাকে, তাহা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এই দ্বৈতী অবস্থাসম্বন্ধীয়, অদ্বৈত-সাক্ষাৎকারের অবস্থাসম্বন্ধীয় নহে । 


24) আমিত্বের মৃত্যু


আমি ভিন্ন এবং জগৎ ভিন্ন এই বুদ্ধি যে পৰ্যন্ত স্থায়ী হয়, সে পর্য্যন্ত যাহাই কর না কেন ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের সম্পূর্ণ জ্ঞান হইতে পারে না । কিন্তু নদী সমুদ্র হইতে না পারিলেও সমুদ্রে পড়িয়া তাহার যেরূপ সমুদ্র-রূপ হইয়া থাকে, সেইরূপ পরব্রহ্মের মধ্যে ডুব দিলে তাহার অনুভব মনুষ্যের হইয়া থাকে; এবং তাহার পর, “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” [গী|৬|২৯] সমস্ত ভূত আপনাতে এবং আপনি সর্বভূতে - এই রূপ তাঁহার ব্ৰহ্মময় অবস্থা হইয়া পড়ে । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান এইরূপ কেবল স্বানুভূতিকেই অবলম্বন করিয়া আছে, এই অর্থ ব্যক্ত করিবার উদ্দেশ্যে “অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাং” [কেন|২|৩] আমি পরব্রহ্মকে জানি যাহারা বলে তাহারা তাঁহাকে জানে না এবং যাহারা বলে আমি পরব্রহ্মকে জানি না তাহারাই তাঁহাকে জানে, কেনোপনিষদে এইরূপ পরব্রহ্মস্বরূপের বিরোধাভাসাত্মক অতি সুন্দর বর্ণনা করা হইয়াছে । কারণ, পরব্রহ্মকে আমি জানি এইরূপ যখন কেহ বলে, সেই সময় আমি (জ্ঞাতা) ভিন্ন, এবং আমার জানা (জ্ঞেয়) ব্ৰহ্ম ভিন্ন, এই দ্বৈতবুদ্ধি মনে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপী অদ্বৈত অনুভব এই সময় ততটা কাঁচা কিংবা অপূর্ণই হইয়া থাকে । তাই, এইরূপ যে বলে সে প্রকৃত ব্ৰহ্মকে জানে না ইহা তাহার নিজের মুখেই সিদ্ধ হয় । উল্টাপক্ষে, ‘আমি’ ও ‘ব্ৰহ্ম’ এই দ্বৈতী ভেদ লুপ্ত হইয়া ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের যখন, পূর্ণ অনুভূতি আসে তখন “আমি তাহা (অর্থাৎ আমা হইতে ভিন্ন অন্য কিছু) জানি” এই ভাষা তাহার মুখ হইতে বাহির হইতে পারে না । তাই এই অবস্থায়, অর্থাৎ আমি ব্ৰহ্মকে জানি ইহা বলিতে যখন কোন জ্ঞানী মনুষ্য অসমর্থ হয়, তখন সে ব্ৰহ্মকে জানিয়াছে এইরূপ বলা হইয়া থাকে । দ্বৈতীভাবের এইরূপ সম্পূর্ণ লোপ হইয়া জ্ঞাতার সমস্তই ব্রহ্মেতে রঞ্জিত হওয়া, লয় পাওয়া, নিঃশেষে মিশাইয়া যাওয়া, মাখামাখি হওয়া, ‘মরিয়া’ যাওয়া সাধারণতঃ দুষ্কর বলিয়া মনে হয় । কিন্তু প্ৰথম দৃষ্টিতে এই ‘নির্বাণ’ অবস্থা দুর্ঘট মনে হইলেও, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা শেষে মনুষ্যের সাধ্য হইতে পারে এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা অনুভবের দ্বারা স্থির করিয়াছেন । আমিত্বের দ্বৈতভাব এই অবস্থাতে নাশ কিংবা লোপ পায় বলিয়া ইহা আত্মনাশেরই এক প্ৰকারভেদ, এইরূপ কেহ কেহ সন্দেহ করেন । কিন্তু এই অবস্থা অনুভূতিতে উপলব্ধি করিবার সময় উহার বর্ণনা করা যাইতে পারে না, তবে পরে তাহার স্মরণ হইতে পারে, ইহার প্ৰতি লক্ষ্য করিলে উক্ত সন্দেহ নির্মূল হয় * ইহা অপেক্ষাও বলবত্তর প্রমাণ সাধুসন্তদিগের অনুভূতি ।
* (ধ্যানের দ্বারা ও সমাধির দ্বারা প্ৰাপ্ত এই অদ্বৈতের কিংবা অভেদভাবের অবস্থা Nitrous Oxide gas নামক একপ্রকার রাসায়নিক বায়ু আঘ্রাণ করিলেও প্রাপ্ত হওয়া যায় । এই বায়ুকে ‘লাফিং গ্যাস’ (laughing gas) বলে । (Will to Believe and Other Essays on Popular Philosophy by William James, pp. 294. 298.) কিন্তু এই অবস্থা কৃত্রিম । সমাধির দ্বারা প্রাপ্ত অবস্থা সত্য ও স্বাভাবিক । এই দুইয়ের মধ্যে ইহাই গুরুতর প্রভেদ । তথাপি এই কৃত্ৰিম অবস্থার প্রমাণ হইতে অভেদাবস্থার অস্তিত্বসম্বন্ধে কোন বিরোধ থাকে না, তাই এইখানে উহার উল্লেখ করিয়াছি ।)


25) তুরীয়াবস্থা অথবা নির্বিকল্প সমাধি


পূর্বেকার সিদ্ধপুরুষদের অনুভূতির বর্ণনা রাখিয়া দেও; কিন্তু নিতান্ত আধুনিক ভগবদভক্ত শিরোমণি তুকারাম বাবাও -“আদুলে” মরণ পাহিলেঁ ম্যাঁ ঢোলাঁ । তো জালা সোহলা অনুপম ।” অর্থাৎ নিজের মরণ নিজের চোখে দেখেছি, সে এক অনুপম উৎসব, এইরূপ আলঙ্কারিক ভাষায় এই পরম অবস্থার বেশ চমৎকার বর্ণনা করিয়াছেন [গা|৩৫৮৯] । ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত সগুণ ব্ৰহ্মের উপাসনা হইতে ধ্যানের দ্বারা ক্ৰমশঃ উর্ধে উঠিতে উঠিতে উপাসক শেষে “অহং ব্ৰহ্মাস্মি” [বৃ|১|৪|১০] -আমিই ব্ৰহ্ম এইরূপ অবস্থায় আসিয়া পৌঁছায়; তাহার এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্য অবস্থার সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে । তাহার পর তাঁহার মধ্যে সে এরূপ নিমজ্জিত হয় যে, আমি কি অবস্থাতে আছি, অথবা কাহার অনুভব করিতেছি, সেদিকে তাহার লক্ষ্যই যায় না । এই অবস্থায় জাগরণ বজায় থাকায় এই অবস্থাকে স্বপ্ন কিংবা সুষুপ্তি অর্থাৎ নিদ্ৰা বলিতে পারা যায় না; যদি জাগৃতি বল, তবে জাগ্ৰত অবস্থাতে সাধারণত যে সমস্ত ব্যবহার উৎপন্ন হয় সে সমস্ত বন্ধ থাকে । তাই স্বপ্ন, সুষুপ্তি, (নিদ্ৰা) কিংবা জাগরণ, এই তিন ব্যবহারিক অবস্থা হইতে ভিন্ন ইহা এক চতুৰ্থ কিংবা তুরীয় অবস্থা এইরূপ শাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে; এবং এই অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হইলে, নির্বিকল্প অর্থাৎ যাহাতে দ্বৈতের কিঞ্চিন্মাত্রও স্পর্শ নাই, এইরূপ সমাধিযোগে প্ৰবৃত্ত করাই পাতঞ্জল যোগদৃষ্টিতে মুখ্য সাধন । এবং এই কারণেই গীতাতে এই নির্বিকল্প সমাধিযোগ অভ্যাসের দ্বারা আয়ত্ত করিতে মনুষ্য যেন অবহেলা না করে, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৬|২০-২৩] । এই ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্য অবস্থাই জ্ঞানের পূর্ণ অবস্থা । কারণ, সমস্ত জগৎ ব্ৰহ্মরূপ অর্থাৎ একই হইয়া গেলে “অবিভক্তং বিভক্তেষু” - অনেকের একত্ব করা চাই গীতার জ্ঞানক্রিয়ার এই লক্ষণের পূর্ণতা হয়, এবং ইহার পর কাহারও অধিক জ্ঞান হইতে পারে না । 


26) অমৃতত্ত্ব-সীমা এবং মরণের মরণ


সেইরূপ আবার, নামরূপের অতীত এই অমৃতত্বের অনুভব আসিলে পর, জন্মমরণের আবৃত্তিও মানুষের আপনা-আপনিই চুকিয়া যায় । কারণ, জন্মমরণ তো নামরূপেতেই আছে এবং ইহা তাহার অতীত [গী|৮|২১] । তুকারাম এইজন্য এই অবস্থাকে ‘মরণের মরণ’ এই নাম দিয়াছেন [গা|৩৫৮৯]; এবং যাজ্ঞবল্ক্য এই অবস্থাকে অমৃতত্বের সীমা বা পরাকাষ্ঠা বলিয়াছেন । ইহাই জীবন্মুক্তাবস্থা । এই অবস্থায় আকাশগমনাদি কতকগুলি অপূর্ব ও অলৌকিক সিদ্ধিলাভ হয় এইরূপ পাতঞ্জল যোগসূত্রে এবং অন্যত্রও বর্ণিত আছে [পাতঞ্জল সূ|৩|১৬-৫৫]; এবং এইজন্য কাহারও যোগাভ্যাসের সখ হইয়া থাকে । কিন্তু যোগবাসিষ্ঠকারের উক্তি অনুসারে আকাশগমনাদি সিদ্ধি ব্ৰহ্মনিষ্ঠ অবস্থার সাধ্য বা অংশ নহে; জীবন্মুক্ত পুরুষ এই সিদ্ধিলাভ করিবার উদ্যোগ করেন না এবং অনেক সময় তাহার এই সিদ্ধি দেখাও যায় না [যো|৫|৮৯] । তাই, শুধু যোগবাসিষ্ঠে নহে, গীতাতেও এই সিদ্ধির কোন উল্লেখ নাই । ইহা চমৎকার মায়ার খেলা, ব্ৰহ্মবিদ্যা নহে, এইরূপ বসিষ্ঠ রামকে স্পষ্ট বলিয়াছেন । উহা কদাচিৎ সত্য হয়, সত্য হইবে না এইরূপ আমি বলি না । যাহা হউক উহা ব্রহ্মবিদ্যার বিষয় নহে এইটুকু নির্বিবাদ । তাই এই সিদ্ধি লাভ হউক বা না হউক, তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কিংবা তাহার ইচ্ছা বা আশাও না করিয়া সর্বভূতের মধ্যে এক আত্মা উপলব্ধি করা, ব্ৰহ্মনিষ্ঠের এই পরম অবস্থা আমাদের যে প্রকারে লাভ হইতে পারে তৎপক্ষেই মনুষ্যের চেষ্টা ও প্ৰযত্ন করা চাই, অলৌকিক সিদ্ধি লাভের আকাঙ্ক্ষা করিবে না, ইহাই ব্ৰহ্মবিদ্যাশাস্ত্রের উক্তি । ব্ৰহ্মজ্ঞানই আত্মার শুদ্ধাবস্থা, জাদু অথবা ধোঁকা লাগাইবার কেরামতী ব্যাপার নহে । এই কারণে উক্ত চমৎকার শক্তির দ্বারা ব্ৰহ্মজ্ঞানের মাহাত্ম্যের বৃদ্ধি তো হয়ই না, ব্ৰহ্মবিদ্যার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে উক্ত আশ্চর্য শক্তি প্ৰমাণও হইতে পারে না । পক্ষীর ন্যায় এক্ষণে মানুষও বিমানে করিয়া আকাশে উড়িয়া থাকে; কিন্তু তাই বলিয়া সেই মানুষকে কেহ ব্ৰহ্মবেত্তার মধ্যে গণনা করে না । এমন কি, আকাশগমনাদি সিদ্ধিপ্ৰাপ্ত কোন ব্যক্তি মালতীমাধব নাটকের অঘোরঘণ্টের ন্যায় ক্রূর ঘাতক পর্যন্ত হইতে পারে ।


27) দ্বৈতবাদের উৎপত্তি গীতা ও উপনিষদ উভয় অদ্বৈত বেদান্তেরই প্রতিপাদন করে


ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ আনন্দময় অবস্থার অনিৰ্বাচ্য অনুভূতি অন্যকে পূর্ণরূপে বলা যাইতে পারে না । কারণ, তাহা অন্যকে বলিতে গেলে ‘আমি-তুমি’ এই দ্বৈতাত্মক ভাষা প্রয়োগ করা আবশ্যক হয়; এবং এই দ্বৈতী ভাষায় অদ্বৈতের সমস্ত অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না । তাই এই চরম অবস্থার উপনিষদে যে বর্ণনা আছে তাহাও অপূর্ণ ও গৌণ বলিয়া বুঝিতে হইবে । এবং এই বর্ণনা যখন গৌণ, তখন জগতের উৎপত্তি, রচনা প্ৰভৃতি বুঝাইবার জন্য উপনিষদের অনেক স্থানে যে শুদ্ধ দ্বৈতী বৰ্ণনা পাওয়া যায়, তাহাও গৌণ বলিয়াই মানিতে হইবে । উদাহরণ যথা, - আত্মস্বরূপী, শুদ্ধ, নিত্য, সর্বব্যাপী ও অবিকারী ব্ৰহ্ম হইতেই পরে হিরণ্যগৰ্ভ নামক সগুণ পুরুষ অথবা অপ (জল) প্রভৃতি জগতের ব্যক্ত পদার্থ ক্ৰমে ক্রমে সৃষ্ট হয়, কিংবা এই নামরূপ সৃষ্টি করিয়া পরে জীবরূপে পরমেশ্বর তাহাতে প্ৰবেশ করেন [তৈ|২|৬; ছাং|৬|২|৩; বৃ|১|৪|৭], এইরূপ দৃশ্য জগতের উৎপত্ত্বির যে বর্ণনা উপনিষদে করা হইয়াছে তাহা অদ্বৈত দৃষ্টিতে যথার্থ হইতে পারে না । কারণ, জ্ঞানগম্য নির্গুণ পরমেশ্বরই যদি চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, তবে এক অপর এককে উৎপন্ন করিয়াছে এই কথাও তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে নির্মূল হইয়া পড়ে । কিন্তু সাধারণ লোককে জগৎ-রচনা বুঝাইয়া দিবার জন্য ব্যবহারিক অর্থাৎ দ্বৈতের ভাষাই একমাত্ৰ সাধন হওয়ায়, ব্যক্ত জগতের অর্থাৎ নামরূপের উৎপত্তির উপরি-উক্ত বর্ণনা উপনিষদে পাওয়া যায় । তথাপি তাহাতেও অদ্বৈতের যোগসূত্রটি বজায় আছে এবং এই প্ৰকার দ্বৈতের ব্যবহারিক ভাষা ব্যবহৃত হইলেও মূলে অদ্বৈতই সত্য, এইরূপ অনেক স্থানে কথিত হইয়াছে । সূর্য ভ্ৰমণ করে না এইরূপ এক্ষণে নিশ্চিত জ্ঞান হইলেও, সূৰ্য উদয় হইল কিংবা অস্ত হইল এই ভাষা যেমন আমরা ব্যবহার করি সেইরূপ একই আত্মস্বরূপী পরব্ৰহ্ম চারিদিকে অখণ্ড রূপে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন, তিনি নির্বিকার এইরূপ নিশ্চয়াত্মক নির্ধারণ হইলেও “পরব্রহ্ম হইতে ব্যক্ত জগৎ সৃষ্টি হইয়াছে” এইরূপ ভাষা উপনিষদে প্ৰয়োগ হইয়া থাকে; এবং গীতাতেও সেইরূপ “আমার প্রকৃত স্বরূপ অব্যয় ও অজ” [গী|৭|২৫] উক্ত হইলেও “আমি সমস্ত জগৎ উৎপন্ন করিয়া থাকি” [গী|৪|৯] ইহা ভগবান বলিয়াছেন । কিন্তু এই বর্ণনার মর্মের প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া উহা শব্দশঃ সত্য এবং উহাই মুখ্য এইরূপ কল্পনা করিয়া কোন কোন পণ্ডিত, দ্বৈত কিংবা বিশিষ্টাদ্বৈত মত উপনিষদের প্রতিপাদ্য, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । তাঁহারা বলেন যে, সর্বত্র একই নির্গুণ ব্ৰহ্ম ব্যাপ্ত হইয়া আছেন এইরূপ মানিলে, এই নিৰ্বিকার ব্ৰহ্ম হইতে সবিকার বিনশ্বর সগুণ পদার্থ কিরূপে সৃষ্ট হইল ইহার উপপত্তি পাওয়া যায় না । কারণ, নাম-রূপাত্মক জগৎকে ‘মায়া’ বলিলে নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ মায়া উৎপন্ন হওয়া তৰ্কদৃষ্টিতে সম্ভব না হওয়ায় অদ্বৈতবাদ খঞ্জ হইয়া পড়ে । ইহা অপেক্ষা সাংখ্যশাস্ত্রের উক্তি অনুসারে প্রকৃতির ন্যায় নামরূপাত্মক ব্যক্ত জগতের কোন সগুণ অথচ ব্যক্ত রূপকে নিত্য মনে করিয়া লৌহ যন্ত্রের মধ্যে বাষ্পের ন্যায় তাহার অন্তরে পরব্রহ্মরূপ অন্য কোন নিত্য তত্ত্ব খেলিতেছে, [বৃ|৩|৭], এবং এই দুয়ের মধ্যে দাড়িম ফলের মধ্যে তাহার দানার ন্যায় ঐক্য আছে এইরূপ মনে করা অধিক প্রশস্ত । কিন্তু আমার মতে, উপনিষদের তাৎপর্য এইরূপ নির্ধারণ করা ঠিক নহে । উপনিষদে কখন দ্বৈতী ও কখন শুদ্ধ অদ্বৈতী বৰ্ণনা থাকায় এই দুয়ের কোন প্রকার সমন্বয় করিতে হইবে ইহা সত্য । কিন্তু অদ্বৈতবাদকে মুখ্য মানিয়া, নিগুৰ্ণ ব্ৰহ্ম সগুণ হওয়া পৰ্যন্ত মায়িক দ্বৈতের অবস্থা প্ৰাপ্ত হয়, এইরূপ মনে করিলে সমস্ত বৰ্ণনার যেরূপ সমন্বয় হয়, দ্বৈতপক্ষকে প্ৰধান করিয়া মানিলে সেরূপ সমন্বয় হয় না । উদাহরণ যথা - তৎ ত্বমসি” এই বাক্যান্তর্গত পদের অন্বয় দ্বৈত মত অনুসারে কখনই ঠিক লাগে না । দ্বৈতীদিগের মনে ইহা একটা খটকা বলিয়া মনে হয় না এরূপ নহে । কিন্তু তত্ত্বম্‌ = তস্য ত্বম্‌ - অর্থাৎ তোমা হইতে ভিন্ন এরূপ যে কোন ব্যক্তি তাহার তুমি, সে তুমি নও - এইরূপে কোন রকমে এই মহাবাক্যের অর্থ করিয়া দ্বৈতী নিজের মনকে প্ৰবোধ দিয়া থাকেন । কিন্তু যাঁহার সংস্কৃত জ্ঞান কিছুমাত্ৰ আছে, যাঁহার বুদ্ধি আগ্রহের দ্বারা বিদ্ধ হয় নাই তিনিই এই ‘টানাবুনা’ অর্থ সত্য নহে বলিয়া বুঝিতে পারিবেন । কৈবল্যোপনিষদে আবার “স ত্বমেব ত্বমব তৎ” [কৈ|১|১৬] এইরূপ “তৎ” ও “ত্বম্‌” শব্দদুইটীকে উল্টাপাল্টা করিয়া উক্ত মহাবাক্যের অদ্বৈতপর সিদ্ধান্তই দেখান হইয়াছে । অধিক কি বলিব ? সমস্ত উপনিষদের অধিকাংশ কাটিয়া না ফেলিলে কিংবা জানিয়া বুঝিয়া তাহার প্রতি দুৰ্লক্ষ্য না করিলে উপনিষদশাস্ত্রের অদ্বৈত ব্যতীত অন্য কোন রহস্য আছে, এরূপ দেখান যাইতে পারে না । কিন্তু এই বাদপ্রতিবাদ কখনই শেষ হইবে না মনে করিয়া সেই সম্বন্ধে আমি অধিক আলোচনা করিতে চাহি না । যাঁহার অদ্বৈত ব্যতীত অন্য মত ভাল লাগে তিনি তাহা স্বীকার করিতে পারেন । যে মহাত্মারা উপনিষদে “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন” [বৃ|৪|৪|১৯; কঠ|৪|১১] - এই জগতে নানাত্ব কিছুই নাই - যাহা কিছু আছে মূলে সমস্ত “একমেবাদ্বিতীয়ং” [ছাং|৬|২|২], এইরূপ আপন প্ৰতীতি স্পষ্ট বলিয়া পরে “মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি” — এ জগতে যে নানাত্ব দেখে সে জন্মমরণের ফেরে পড়িয়া যায় - এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, সেই মহাত্মাদের লক্ষ্য অদ্বৈত ব্যতীত অন্য কোনরূপ হইতে পারে এরূপ আমার মনে হয় না । কিন্তু অনেক বৈদিক শাখার অনেক উপনিষদ থাকা প্ৰযুক্ত সমস্ত উপনিষদের তাৎপর্য একই কি না এই সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কদাচিৎ যেরূপ অবকাশ পাওয়া যায়, গীতা-সম্বন্ধে সেরূপ নহে । গীতা একই গ্রন্থ হওয়ায়, একই প্রকারের বেদান্ত তাহার প্রতিপাদ্য ইহা স্পষ্ট রহিয়াছে; এবং সেই বেদান্ত কি, ইহার নির্ণয় করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে “সমস্ত ভূতের নাশ হইলেও যে একই বজায় থাকে” [গী|৮|২০] তাহাই প্ৰকৃত সত্য হওয়ায়, পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ড মিলিয়া সর্বত্র তাহাই ওতপ্রোত হইয়া আছে [গী|১৩|৩১], এইরূপ অদ্বৈতমূলক সিদ্ধান্ত না করিলে চলে না । অধিক কি, আত্মৌপম্যবুদ্ধির যে নীতিতত্ত্ব গীতাতে বলা হইয়াছে, তাহার পুরাপুরি উপপত্তিও অদ্বৈত ব্যতীত অন্য প্রকারের বেদান্ত-দৃষ্টিতে উপযোগী হয় না । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের সময়ে কিংবা তদুত্তরকালে অদ্বৈতমতপ্রতিপাদক যে সকল যুক্তি অথবা প্রমাণ বাহির হইয়াছে তাহার সমস্তই গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে এরূপ বলা আমার উদ্দেশ্য নহে । দ্বৈত, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্ৰভৃতি সম্প্রদায় বাহির হইবার পূর্বেই গীতা হইয়াছে; এবং সেইজন্য তাহাতে কোন বিশিষ্ট সাম্প্রদায়িক যুক্তির সমাবেশ হইতে পারে না, ইহা আমিও স্বীকার করি । কিন্তু সেইজন্য গীতাতে যে বেদান্ত আছে তাহা সাধারণত শঙ্করসম্প্রদায়ের জ্ঞানা্নুরূপ অদ্বৈতী, দ্বৈতী নহে, ইহা বলিতে কোন বাধা নাই । তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে গীতা ও শাঙ্করসম্প্রদায় মধ্যে এই প্রকার সাধারণ মিল থাকিলেও আচার দৃষ্টিতে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা গীতা কর্মযোগকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায়, গীতাধর্ম শাঙ্করসম্প্রদায় হইতে ভিন্ন হইয়াছে এইরূপ আমার মত । কিন্তু তাহার বিচার পরে করা যাইবে । এখনকার বিষয় তত্ত্বজ্ঞানসম্বন্ধীয়; তাই এই তত্ত্বজ্ঞান গীতা ও শাঙ্করসম্প্রদায়ের মধ্যে একই প্ৰকার অর্থাৎ অদ্বৈতী ইহাই এখানে বক্তব্য । অন্য সাম্প্রদায়িক ভাষ্য অপেক্ষা গীতার শাঙ্করভাষ্যের গৌরব যে বেশী হইয়াছে তাহার কারণও এই ।


28) নির্গুণে সগুণ মায়ার উৎপত্তি কিরূপে হয়


সমস্ত নামরূপ জ্ঞানদৃষ্টিতে একপাশে সরাইয়া রাখিবার পর, একই নিৰ্বিকার ও নির্গুণ তত্ত্ব থাকিয়া যায়; সেই জন্য পূর্ণ ও সূক্ষ্ম বিচারান্তে অদ্বৈতসিদ্ধান্তই স্বীকার করিতে হয় । ইহা সিদ্ধান্ত হইলে পর এই এক নির্গুণ ও অব্যক্ত দ্রব্য হইতে নানাবিধ ব্যক্ত সগুণ সৃষ্টি কি করিয়া হইল, অদ্বৈত বেদান্তদৃষ্টিতে তাহার বিচার করা আবশ্যক । নিগুৰ্ণ পুরুষেরই সহিত ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ প্ৰকৃতিকে অনাদি ও স্বতন্ত্র মানিয়া সাংখ্যেরা এই প্রশ্ন ছাড়িয়া দিয়াছে, ইহা পূর্বেই বলিয়াছি । কিন্তু সগুণ প্ৰকৃতিকে এইরূপ স্বতন্ত্র বলিয়া মানিলে জগতের মূলতত্ত্ব দুই হয়; এবং এইরূপ করিলে অনেক কারণে পূর্ণরূপে নির্ধারিত অদ্বৈতমতে বাধা আসে । সগুণ প্ৰকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া না মানিলে একই মূল নির্গুণ দ্রব্য হইতে নানাবিধ সগুণ সৃষ্টি কিরূপে উৎপন্ন হইল তাহা বলিতে পারা যায় না । কারণ, নির্গুণ হইতে সগুণ - অর্থাৎ যাহা কিছু নাই তাহা হইতে অন্য কিছু - উৎপন্ন হইতে পারে না, সৎকার্যবাদের এই সিদ্ধান্ত অদ্বৈতীদিগেরও মান্য হইয়াছে । এইজন্য, দুইদিক্‌ হইতেই বাধা । এখন এই জটিল প্যাঁচ ঘুচিবে কি করিয়া ? অদ্বৈতকে না ছাড়িয়াই নিগুৰ্ণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইবার মার্গটি কি তাহা বলিতে হইবে; এবং সৎকার্যবাদের দৃষ্টিতে উহা বন্ধ হইবার মতো দেখায়। পেঁচটা খুবই বড় সত্য । অধিক কি, কাহারও কাহারও মতে, অদ্বৈত সিদ্ধান্ত স্বীকার করিবার পক্ষে ইহাই মুখ্য বাধা এবং এই জন্যই তাহারা দ্বৈতকে অঙ্গীকার করিয়া থাকে । কিন্তু অদ্বৈতী পণ্ডিতেরা নিজ বুদ্ধির দ্বারা এই বিকট বাধা হইতে মুক্ত হইবারও এক সযুক্তিক ও অক্ষুণ্ণ মাৰ্গ বাহির করিয়াছেন । তাঁহারা এইরূপ বলেন যে, কার্য ও কারণ এই দুই-ই যখন একই গণ্ডীর মধ্যে কিংবা একই বর্গের মধ্যে থাকে তখনই সৎকার্যবাদের কিংবা গুণপরিণামবাদের সিদ্ধান্তের উপযোগ হয় । এবং সেই জন্য সত্য ও নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সত্য ও সগুণ মায়া উৎপন্ন হইতে পারে না ইহা অদ্বৈত বেদান্তও স্বীকার করিবে । কিন্তু এই স্বীকৃতি তখনকারই যখন দুই পদার্থই সত্য । যেখানে এক পদার্থ সত্য এবং অন্যটি শুধু তাহার অনুরূপ, সেখানে সৎকার্যবাদ প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । পুরুষের ন্যায় প্ৰকৃতিকেও সাংখ্য স্বতন্ত্ৰ ও সত্য পদাৰ্থ বলিয়া মানে । তাই উহা নির্গুণ পুরুষ হইতে সগুণ প্ৰকৃতির উৎপত্তির উপপত্তি সৎকার্যবাদ অনুসারে করিতে পারে না । কিন্তু অদ্বৈতবাদের এই সিদ্ধান্ত যে, মায়া অনাদি হইলেও তাহা সত্য ও স্বতন্ত্র নহে, গীতার উক্তি অনুসারে তাহা, ‘মোহ’, ‘অজ্ঞান’ কিংবা ‘ইন্দ্ৰিয়ের নিকট প্ৰতীয়মান বিষয়’; তাই সৎকার্যবাদ হইতে নিষ্পন্ন আপত্তি অদ্বৈত সিদ্ধান্তে প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । পিতা হইতে পুত্র হইলে পিতার গুণ-পরিণামে হইয়াছে বলিব; কিন্তু পিতা একই ব্যক্তি হইয়া তিনি যখন কখনও বালকের, কখনও যুবকের এবং কখনও বৃদ্ধের রূপ গ্ৰহণ করেন দেখা যায়, তখন - এই ব্যক্তিতে এবং ইহার অনেক রূপের মধ্যে গুণ পরিণামরূপী কার্য-কারণভাব থাকে না, এইরূপ আমরা সর্বদা দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার সূর্য একই, ইহা নিশ্চিত হইলে পর, জলেতে চক্ষুগোচর তাহার প্রতিবিম্ব একটা ভ্ৰম, গুণ-পরিণাম প্ৰযুক্ত উৎপন্ন অন্য সূর্য নহে, এইরূপ আমরা বলি । সেইরূপ দুর্বীণে কোন গ্রহের প্রকৃত স্বরূপ নিশ্চিত করিলে পর, সেই গ্রহের কেবল চক্ষুদৃষ্ট স্বরূপ চক্ষের দুর্বলতা প্ৰযুক্ত ও অতি দীর্ঘ অন্তর প্রযুক্ত উৎপন্ন শুধু প্ৰতীয়মান আবির্ভাব মাত্ৰ, এইরূপ জ্যোতিঃশাস্ত্ৰ স্পষ্ট বলে ।

ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, কোন বিষয় ইন্দ্ৰিয়ের প্রত্যক্ষগোচর হইলেই তাহাকে স্বতন্ত্র ও সত্য বস্তু বলিয়া মানিতে পারা যায় না । আবার ঐ ন্যায়ই অধ্যাত্মশাস্ত্ৰেও প্রয়োগ করিয়া জ্ঞানচক্ষুরূপ দুর্বীণের দ্বারা নির্ধারিত নির্গুণ পরব্ৰহ্মই সত্য, এবং জ্ঞানশূন্য চর্মচক্ষুর গোচর নামরূপ এই পরব্রহ্মের কার্য নহে, উহা ইন্দ্ৰিয়ের দুর্বলতা হইতে উৎপন্ন শুধু একটা ভ্রম অর্থাৎ মোহাত্মক প্ৰতীয়মান রূপ মাত্র, এইরূপ বলিতে বাধা কি ? নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইতে পারে না, এই আপত্তিও এখানে থাকে না । কারণ, দুই বস্তু একই গণ্ডীভুক্ত নহে; একটী সত্য, অপরটা শুধু প্ৰতীয়মান রূপ মাত্ৰ; এবং মূলে একই বস্তু থাকিলেও দ্রষ্টা পুরুষের দৃষ্টিভেদে, অজ্ঞানে, দৃষ্টিবিভ্রমে সেই একই বস্তুর প্রতীয়মান” রূপ পরিবর্তিত হয় এইরূপ আমাদের অনুভব আছে । উদাহরণ যথা - কানে শোনা শব্দ আর চোখে দেখা রঙ, এই দুই গুণ ধরন । তন্মধ্যে কানে আমরা যে শব্দ বা আওয়াজ শুনিতে পাই তাহার সূক্ষ্ম পরীক্ষা করিয়া ‘শব্দ’ বায়ুর তরঙ্গ কিংবা গতি এইরূপ আধিভৌতিক শাস্ত্ৰ পূর্ণরূপে সিদ্ধ করিয়াছেন । সেইরূপ আবার চোখে দেখা লাল, হলদে, নীল প্রভৃতি রংও মূলে একই সূর্যালোকের বিকার, এবং সূর্যালোকও একপ্রকার গতি এইরূপ এক্ষণে সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের দ্বারা নির্ধারিত হইয়াছে । ‘গতি’ মূলে একই হওয়ায় কান যদি তাহাকে শব্দ ও চোখ যদি তাহাকে রং বলে । তবে এই ন্যায়ই অধিকতর ব্যাপকরূপে সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের প্রতি প্রয়োগ করিলে, সমস্ত নামরূপের উৎপত্তি সম্বন্ধে সৎকার্যবাদের সহায়তা ব্যতীতই ঠিক ঠিক উপপত্তি এই প্ৰকার দেওয়া যাইতে পারে যে, মনুষ্যের বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয় আপনা আপন দিক হইতে এক নির্বিকার বস্তুর উপরেই শব্দরূপাদি অনেক নামরূপাত্মক গুণসমূহের ‘অধ্যারোপ’ করিয়া নানাপ্রকার প্রতীয়মান রূপ উৎপন্ন করিয়া থাকে, কিন্তু মূলের একই বস্তুতে এই প্রতীয়মান রূপ, গুণ কিংবা এই নামরূপ থাকিবেই এমন কোন কথা নাই । এবং এই অর্থই সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে রজ্জুতে সৰ্পভ্ৰম, শুক্তিতে রজতভ্রম, অথবা চোখে আঙ্গুল দিলে এক বস্তুকে দুইটী দেখা, অথবা অনেক রংয়ের চসমা পরিলে এক পদার্থকে বিভিন্ন রংয়ের দেখা ইত্যাদি অনেক দৃষ্টান্ত বেদান্তশাস্ত্ৰে পাওয়া যায় । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহ মনুষ্যকে কখনই ছাড়িয়া যায় না বলিয়া জগতের নামরূপ কিংবা গুণ তাহার নজরে অবশ্যই পড়িবে । কিন্তু ইন্দ্ৰিয়বান মনুষ্যের দৃষ্টিতে জগতের এই যে আপেক্ষিক স্বরূপ দেখা যায়, তাহাই এই জগতের মূলগত অর্থাৎ নিরপেক্ষ ও নিত্য স্বরূপ, এরূপ বলিতে পারা যায় না । মনুষ্যের বর্তমান ইন্দ্ৰিয় অপেক্ষা যদি সে ন্যূনাধিক ইন্দ্ৰিয় প্ৰাপ্ত হয়, তাহা হইলে এই জগৎ তাহার চোখে এখন যেরূপ দেখায় তখন সেরূপ দেখা যাইবে না । এবং ইহা যদি সত্য হয়, তবে দ্রষ্টা মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের অপেক্ষা না রাখিয়া জগতের মূলে যে তত্ত্ব আছে তাহার নিত্য ও প্ৰকৃত স্বরূপ কি তাহা বল, এইরূপ কেহ জিজ্ঞাসা করিলে, ঐ মূলতত্ত্ব নির্গুণ বটে, কিন্তু মনুষ্যের নিকট উহা সগুণ দেখায়; ইহা মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের ধর্ম, মূল বস্তুর গুণ নহে, এইরূপ উত্তর দিতে হয় । আধিভৌতিক শাস্ত্ৰে কেবল ইন্দ্ৰিয়-গোচর বিষয়েরই বিচার হয় বলিয়া এইপ্ৰকার প্রশ্ন কখনই উত্থিত হয় না । কিন্তু মনুষ্য ও তাহার ইন্দ্ৰিয় নষ্ট প্রায় হইলে, পরমেশ্বরও লোপ প্ৰাপ্ত হন, কিংবা মনুষ্যের নিকট তিনি অমুক প্রকার দৃষ্ট হন বলিয়া তাঁহার ত্রিকালঅবাধিত নিত্য ও নিরপেক্ষ স্বরূপও তাহাই হইবে, এরূপ বলা যাইতে পারে না । তাই, জগতের মূলে অবস্থিত সত্যের মূলস্বরূপ কি, যে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে ইহার বিচার করিতে হয় তাহাতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের আপেক্ষিক দৃষ্টি ছাড়িয়া দিয়া কেবল জ্ঞানদৃষ্টিতে অর্থাৎ যতদূর সম্ভব বুদ্ধির দ্বারাই শেষ বিচার করা আবশ্যক হয় । এইরূপ করিলে ইন্দ্ৰিয়গোচর সমস্ত গুণই স্বতই চলিয়া যায় এবং ইহা সিদ্ধ হয় যে, ব্ৰহ্মের নিত্য স্বরূপ ইন্দ্ৰিয়াতীত অর্থাৎ নির্গুণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ । কিন্তু যে নির্গুণ, তাহার বর্ণনা কে-ই বা করিবে, আর কি প্রকারে করিবে ? এইজন্য পরব্রহ্মের চরম অর্থাৎ নিরপেক্ষ ও নিত্য স্বরূপ কেবল নির্গুণ নহে, তাহ অনির্বাচ্যও বটে; এবং এই নির্গুণ স্বরূপে মনুষ্য স্বকীয় ইন্দ্ৰিয়যোগে সগুণ রূপ দেখিতে পায়, অদ্বৈতবেদান্তে এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে । কিন্তু নির্গুণকে সগুণ করিবার এই শক্তি ইন্দ্ৰিয়ের আসিল কোথা হইতে, এইখানে আবার এই প্রশ্ন উত্থিত হয় । অদ্বৈত বেদান্তশাস্ত্ৰ ইহার উত্তরে এইরূপ বলেন যে, মানবজ্ঞানের গতি এখানে বাধিত হয়, এইজন্য ইহা ইন্দ্রিয়সমূহের অজ্ঞান এবং নিগুৰ্ণ পরব্রহ্মে সগুণ জগতের রূপ দেখা সেই অজ্ঞানের পরিণাম; কিংবা ইন্দ্রিয়াদিও পরমেশ্বরের জগতেরই অন্তৰ্ভুক্ত হওয়ায় এই সগুণ স্বষ্টি (প্রকৃতি) নির্গুণ পরমেশ্বরেরই এক ‘দৈবী মায়া’ [গী|৭|১৪] এখানে এইটুকু নিশ্চিত অনুমান করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে হয় । অপ্ৰবুদ্ধ অর্থাৎ কেবল ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা প্ৰত্যক্ষকারী লোকের নিকট পরমেশ্বর ব্যক্ত ও সগুণ দৃষ্ট হইলেও পরমেশ্বরের প্রকৃত ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপ নির্গুণ, তাহা জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখাতেই জ্ঞানের চরম সীমা, ইত্যাদি গীতাতে যে বৰ্ণনা আছে [গী|৭|১৪,২৪,২৫], তাহার তত্ত্ব পাঠকের এক্ষণে উপলব্ধি হইবে । পরমেশ্বর মূলে নির্গুণ, তাহার মধ্যেই মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয় সগুণ জগতের বিবিধ প্রতীয়মান রূপ দেখিতে পায়, এইরূপ নিৰ্ণয় করিলেও উক্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে ‘নির্গুণ’ শব্দের অর্থ কি বুঝাইবার জন্য এই বিষয়ে আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । আমাদের ইন্দ্ৰিয় যখন বায়ু তরঙ্গের উপর শব্দরূপাদি গুণের কিংবা শুক্তির উপর রজতের অধ্যারোপ করে তখন বায়ুতরঙ্গের মধ্যে শব্দরূপাদির কিংবা শুক্তির মধ্যে রজতের গুণ থাকে না ইহা সত্য; কিন্তু অধ্যারোপিত গুণ তাহাতে না থাকিলেও উহা হইতে ভিন্ন গুণ মূল পদার্থের মধ্যে থাকিবেই না এরূপ বলিতে পারা যায় না; কারণ, শুক্তির মধ্যে রজতের গুণ না থাকিলেও রজতের গুণের অতিরিক্ত অন্য গুণ উহাতে থাকে । ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । ইহা হইতে আপন অজ্ঞানে মূল ব্ৰহ্মের উপর ইন্দ্ৰিয়াদির অধ্যারোপিত গুণ এই ব্রহ্মের মধ্যে নাই বলিলেও অন্য গুণ পরব্রহ্মের মধ্যে কি নাই, এবং যদি থাকে তবে তিনি নির্গুণ হন কিরূপে, এইরূপ আর এক সংশয় এই স্থানে আসে । কিন্তু আর একটু সূক্ষ্ম বিচার করিলে বুঝা যাইবে যে, ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা অধ্যারোপিত গুণ ব্যতীত মূল ব্রহ্মের মধ্যে অন্য গুণ থাকিলেও তাহা, আমরা জানিব কিরূপে ? মনুষ্য যে গুণ অবগত হয় তাহা নিজের ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারাই অবগত হয়; এবং যে গুণ ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় না তাহা মনুষ্য জানিতেই পারে না । সার কথা এই যে, ইন্দ্ৰিয় দ্বারা অধ্যারোপিত গুণ ব্যতীত যদি অন্য কোন গুণ, পরব্রহ্মে থাকে, তাহা জানা আমাদের সাধ্য নহে, এবং তাহা পরব্রহ্মের মধ্যে আছে এইরূপ বিধান করাও ন্যায়শাস্ত্ৰসৃষ্টিতে ঠিক্‌ নহে । তাই গুণ শব্দের “মনুষ্যের জ্ঞানগম্য গুণ” অর্থ গ্ৰহণ করিয়া ব্ৰহ্ম ‘নির্গুণ’ ইহা বেদান্তী সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । মনুষ্যের অচিন্তনীয়  এইরূপ গুণ কিংবা শক্তি মূল পরব্রহ্মস্বরূপে আছে অদ্বৈত বেদান্তও এরূপ বলেন না, আর অপর কেহ তাহা বলিতে পারে না । অধিক কি, বেদান্তীগণও ইন্দ্ৰিয়াদির উপরি-উক্ত অজ্ঞান কিংবা মায়াকে সেই মূল পরব্রহ্মেরই এক অচিন্ত্য শক্তি বলিয়া থাকেন, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে ।


29) বিবর্ত্তবাদ এবং গুণ পরিণামবাদ


ত্ৰিগুণাত্মক মায়া কিংবা প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র কোন বস্তু নহে; কিন্তু একই নির্গুণ ব্ৰহ্মর উপর মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয় অজ্ঞানবশতঃ সগুণ দৃশ্য রূপের অধ্যারোপ  করিয়া থাকে । এই মতকে ‘বিবৰ্ত্তবাদ’ বলে । নির্গুণ ব্ৰহ্ম একই মূলতত্ত্ব হওয়ায়, নানাবিধ সগুণ জগৎ প্রথমে কিরূপে দেখিতে পাওয়া গেল, - অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে এই বিষয়ের ইহাই উপপত্তি । কাণাদন্যায়শাস্ত্ৰে অসংখ্য পরমাণুই জগতের মূল কারণ স্বীকার করা হইয়াছে; এবং নৈয়ায়িক এই পরমাণুকে সত্য বলিয়া মানেন । তাই, এই অসংখ্য পরমাণুর সংযোগ হইতে আরম্ভ হইলে পর জগতের অনেক পদার্থ উৎপন্ন হইতে লাগিল, এইরূপ তাঁহারা নির্ধারণ করিয়াছেন । এই মতানুসারে পরমাণুদের সংযোগ আরম্ভ হইবার পর জগৎ সৃষ্ট হয়, তাই ইহাকে ‘আরম্ভবাদ’ বলে। কিন্তু নৈয়ায়িকদিগের অসংখ্য পরমাণুসম্বন্ধীয় মত স্বীকার না করিয়া “একপদার্থী, সত্য ও ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতিই” জড় জগতের মূল কারণ, এবং এই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির অন্তর্গত গুণের বিকাশে কিংবা পরিণামে ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়, ইহা সাংখ্যেরা বলেন । এই মতকে ‘গুণপরিণামবাদ’ বলে । কারণ, এক মূল সগুণ প্ৰকৃতির গুণবিকাশেই সমস্ত ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ ইহাতে প্ৰতিপাদিত হয় । কিন্তু এই দুই মতবাদকে অদ্বৈতবেদান্তী স্বীকার করেন না । পরমাণু অসংখ্য হওয়া প্ৰযুক্ত অদ্বৈতমতানুসারে উহা জগতের মূল হইতে পারে না; এবং অবশিষ্ট প্রকৃতি এক হইলেও উহা পুরুষ হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হওয়ায় এই দ্বৈতও অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হয় । কিন্তু এই প্রকারে এই দুই মতবাদকে ছাড়িয়া দিলে এক নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ জগৎ কিরূপে উৎপন্ন হইল ইহার অন্য কোন উপপত্তি দেওয়া আবশ্যক । কারণ, সৎকার্যবাদ অনুসারে নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইতে পারে না । এই সম্বন্ধে বেদান্তী বলেন যে, সৎকার্যবাদের এই সিদ্ধান্ত, কার্য ও কারণ এই দুই বস্তু যেখানে সত্য সেইখানেই খাটে । মূল বস্তু যেখানে একই এবং তাহার শুধু বাহ্যরূপ যেখানে বদল হয় সেখানে এই ন্যায়ের প্রয়োগ হইতে পারে না । কারণ, একই বস্তুর বিভিন্ন রূপ দেখা সেই বস্তুর ধর্ম না হইয়া দ্রষ্টা পুরুষের দৃষ্টিভেদে এই বিভিন্ন বাহ্যরূপ উৎপন্ন হইতে পারে, ইহা সর্বদাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় (appearances are the results of subjective conditions, viz. The senses of the observer and not of the thing in itself) । এই ন্যায় নির্গুণ ব্ৰহ্ম ও সগুণ জগতের সম্বন্ধে প্ৰয়োগ করিলে ব্ৰহ্ম নির্গুণ, এবং মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ধর্মপ্রযুক্ত তাহাতেই সগুণত্বের প্রতীয়মান রূপ উৎপন্ন হয়, এইরূপ বলিতে হয় । ইহা বিবৰ্ত্তবাদ । একই মূল সত্য দ্রব্যের উপরেই অনেক অসত্য অর্থাৎ নিত্য পরিবর্তনশীল রূপের অধ্যারোপ হইয়া থাকে, ইহাই বিবৰ্ত্তবাদের মত; এবং গুণ পরিণামবাদে প্রথমেই দুই সত্য দ্রব্যকে মানিয়া লওয়া হয়; তন্মধ্যে একের গুণের বিকাশ হইয়া জগতের নানা গুণযুক্ত অন্যান্য বস্তু উৎপন্ন হয় । রজ্জুতে সর্পভ্ৰম বিবৰ্ত্ত; এবং নারিকেল ছোবড়ায় দড়ি হওয়া কিংবা দুধ হইতে দৈ হওয়া গুণপরিণাম । এই কারণে বেদান্তসার গ্রন্থের এক সংস্করণে এই দুই মতবাদের এই লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে -
যস্তাত্ত্বিকোহন্যথাভাবঃ পরিণাম উদীরিতঃ ৷
অতাত্ত্বিকোহন্যথাভাবো বিবৰ্ত্ত: স উদীরিতঃ ॥
“কোন মূল বস্তু হইতে যখন তাত্ত্বিক অর্থাৎ সত্যই অন্য প্রকারের বস্তু প্ৰস্তুত হয় তখন তাহাকে (গুণ-) ‘পরিণাম’ বলে; এবং সেরূপ না হইয়া মূল বস্তুই যখন অসত্যরূপে (অতাত্ত্বিক) প্ৰকাশ পায়, তখন তাহাকে ‘বিবর্ত’ বলে [বে|সা|২১] । আরম্ভবাদ নৈয়ায়িকদিগের, গুণপরিণামবাদ সাংখ্যদিগের, এবং বিবর্ত্তবাদ অদ্বৈতবেদান্তীদিগের । অদ্বৈতবেদান্তী পরমাণু কিংবা প্ৰকৃতি এই দুই সগুণ বস্তুকে নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বলিয়া মানেন না । কিন্তু আবার এই আপত্তি হয় যে, সৎকাৰ্যবাদ অনুসারে নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হওয়া অসম্ভব । ইহা দূর করিবার জন্যই বিবৰ্ত্তবাদ বাহির হইয়াছে । কিন্তু তাহা হইতে কেহ কেহ যে ধারণা করেন যে, বেদান্তী গুণপরিণামবাদ কখনই স্বীকার করেন না, কিংবা কখনও করিবেন না, তাহা ভুল । নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ প্ৰকৃতির অর্থাৎ মায়ার উদ্ভব হওয়াই অসম্ভব অদ্বৈত মতের উপর সাংখ্যদিগের কিংবা অন্য দ্বৈতীদিগেরও এই যে মুখ্য আপত্তি তাহা অপরিহার্য নহে । একই নির্গুণ ব্ৰহ্মেতে মায়ার অনেক প্রতীয়মান বাহ্য রূপ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গণ প্ৰত্যক্ষ করিতে পারে । ইহা দেখানোই বিবৰ্ত্তবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য । এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে পর, অর্থাৎ এক নির্গুণ পরব্রহ্মেতেই সগুণ প্ৰকৃতির রূপ দেখা যাইতে পারে, বিবৰ্ত্তবাদে ইহা সিদ্ধ হইলে পর, এই প্রকৃতির পরবর্তী বিস্তার গুণপরিণামের দ্বারা উৎপন্ন হইয়াছে, ইহা স্বীকার করিতে বেদান্তশাস্ত্রের কোনও বাধা নাই। মূলপ্রকৃতি স্বয়ং এক প্রতীয়মান রূপ, সত্য নহে - ইহাই অদ্বৈত বেদান্তের মুখ্য উক্তি । প্রকৃতির প্রতীয়মান রূপ একবার দেখা দিলে তাহার পর এই প্ৰতীয়মান রূপ হইতে নিৰ্গত অন্য প্ৰতীয়মান রূপকে স্বতন্ত্র না মানিয়া এক প্ৰতীয়মানরূপের গুণ হইতে অন্য প্রতীয়মান রূপের গুণ, এইরূপ নানাগুণাত্মক’রূপ উৎপন্ন হইয়া থাকে, ইহা মানিতে অদ্বৈত বেদান্তের কোন বাধা নাই । তাই “প্ৰকৃতি আমারই মায়া” [গী|৭|১৪; ৪|৬] ভগবান ইহা গীতাতে বলিলেও আবার গীতাতেই ইহা বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর-অধিষ্ঠিত [গী|৯|১০] এই প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তার এই “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” [গী|৩|২৮; ১৪|২৩] এই নীতি অনুসারেই হইয়া থাকে । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, বিবৰ্ত্তবাদ অনুসারে মূল নির্গুণ পরব্রহ্মেতে একবার মায়ার দৃশ্য রূপ উৎপন্ন হইলে পর, এই মায়িক রূপের অর্থাৎ প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তারের উপপত্তির জন্য গুণোৎকর্ষের তত্ত্ব গীতাতেও স্বীকৃত হইয়াছে । সমস্ত দৃশ্য জগৎকেই একবার মায়াত্মক রূপ বললে, এই রূপের রূপান্তরের জন্য গুণোৎকর্ষের ন্যায় কোন একটা নিয়ম চাই-ই এরূপ বলিবার প্রয়োজন নাই । মায়াত্মক রূপের বিস্তারও নিয়মবদ্ধই থাকে ইহা বেদান্তীরা অস্বীকার করেন না । তাঁহাদের কথাটা এই যে, মূল প্রকৃতির ন্যায় এই নিয়মও মায়িক, এবং পরমেশ্বর এই সমস্ত মায়িক নিয়মের অধিপতি এবং তাহাদের অতীত; তাঁহার সত্তাতেই এই নিয়মের নিয়ম স্ব অর্থাৎ নিত্যত্ব প্ৰাপ্ত হইয়াছে । ত্রিকালে অবাধিত নিয়ম স্থাপন করিবার সামৰ্থ্য, প্রতীয়মান-রূপবিশিষ্ট সগুণ সুতরাং নশ্বর প্রকৃতির হইতে পারে না ।


30) ব্রহ্মের সত্যানৃতত্ব


উপরে যাহা আলোচিত হইল তাহা হইতে জগৎ, জীব ও পরমেশ্বর - অথবা অধ্যাত্মশাস্ত্রের পরিভাষা অনুসারে মায়া (অর্থাৎ মায়ার দ্বারা উৎপন্ন জগৎ), আত্মা ও পরব্রহ্ম - ইহাদের স্বরূপ ও পরস্পর সম্বন্ধ কি তাহা জানা যাইবে । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে জাগতিক সমস্ত বস্তু এই দুই বর্গে বিভক্ত - “নামরূপ” এবং তাহাদের আবরণের নিম্নে ‘নিত্য তত্ত্ব’ । তন্মধ্যে নামরূপকেই সগুণ মায়া কিংবা প্ৰকৃতি বলে । কিন্তু নামরূপকে একপাশে সরাইয়া রাখিলে যে ‘নিত্য দ্রব্য’ অবশিষ্ট থাকে, তাহা নির্গুণই থাকিবে । কারণ কোন গুণই নামরূপবৰ্জিত হইতে পারে না । এই নিত্য ও অব্যক্ত তত্ত্বই পরব্রহ্ম; এবং মনুষ্যের দুর্বল ইন্দ্ৰিয়ের নিকট এই নির্গুণ পরব্রহ্মেই সগুণ মায়ার উদ্‌ভব হইয়াছে বলিয়া মনে হয় । এই মায়া সত্য পদার্থ নহে; পরব্রহ্মই সত্য অর্থাৎ ত্ৰিকালাবাধিত ও অপরিবর্তনীয় বস্তু । দৃশ্য জগতের নামরূপ এবং তাহা দ্বারা আচ্ছাদিত পরব্রহ্ম, ইহাদের স্বরূপসম্বন্ধে এই সিদ্ধান্ত হইয়াছে । এক্ষণে এই ন্যায় অনুসারে মনুষ্যের বিচার করিলে ইহাই সিদ্ধ হয় যে, মনুষ্যের দেহ ও ইন্দ্ৰিয় দৃশ্য জগতের অন্যান্য পদার্থের ন্যায় নামরূপাত্মক অর্থাৎ অনিত্য মায়ার বর্গে পড়ে; এবং এই দেহেন্দ্ৰিয়ে আচ্ছাদিত আত্মা নিত্যস্বরূপ পরব্রহ্মের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; কিংবা ব্ৰহ্ম ও আত্মা একই । যে অদ্বৈতীসিদ্ধান্ত এবং বৌদ্ধসিদ্ধান্ত এই অর্থে বাহ্য জগতাকে স্বতন্ত্র সত্য পদাৰ্থ বলিয়া স্বীকার করে না তাহাদের উভয়ের ভেদ পাঠকের এখন অবশ্যই উপলব্ধ হইয়াছে । বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলেন যে, বাহ্য জগৎই নাই; তিনি একমাত্র জ্ঞানকেই সত্য বলিয়া স্বীকার করেন; এবং বেদান্তশাস্ত্রী বাহ্য জগতের নিত্যপরিবর্তনশীল নামরূপকেই অসত্য বলিয়া মনে করেন, এবং এই নামরূপের মূলে ও মনুষ্যের দেহে, উভয়েতেই একই আত্মস্বরূপী নিত্য দ্রব্য ব্যাপ্ত হইয়া আছে, এবং এই একপদার্থাত্মক আত্মতত্ত্বই চরম সত্য এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । সাংখ্যবাদী “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই ন্যায় অনুসারে সৃষ্ট পদার্থের নানাত্বের একীকরণকে জড়প্ৰকৃতিরই পক্ষে স্বীকার করেন । কিন্তু বেদান্তীরা সৎকার্যবাদের বাধাটা বাহিরে ফেলিয়া দিয়া স্থির করিয়াছেন যে, “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”; এই কারণে এক্ষণে সাংখ্যেতে অসংখ্য পুরুষের ও প্রকৃতির একই পরমাত্মাতে অদ্বৈতভাবে কিংবা অবিভাগে সমাবেশ হইয়াছে । শুদ্ধাধিভৌতিক পণ্ডিত হেকেলকে অদ্বৈতী ধরিলাম । কিন্তু তিনি এক জড় প্রকৃতিতেই চৈতন্যেরও সংগ্ৰহ করেন; এবং বেদান্ত জড়কে প্ৰাধান্য না দিয়া দেশকালে অসীম, অমৃত ও স্বতন্ত্র চিদ্‌রূপী পরব্রহ্মই সমস্ত জগতের মূল এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন । হেকেলের জড়াদ্বৈত এবং অধাত্মশাস্ত্রের অদ্বৈত এই দুয়ের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ । অদ্বৈত বেদান্তের এই সিদ্ধান্তই গীতাতেই আছে, এবং এক প্ৰাচীন কবি সমস্ত অদ্বৈত বেদান্তের সার এইরূপে বৰ্ণনা করিয়াছেন -
শ্লোকার্ধেন প্ৰবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্ৰন্থকোটিভিঃ ৷
ব্ৰহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ ॥
“কোটি গ্রন্থের সার অর্ধ শ্লোকে বলিতেছি - 
(১)ব্ৰহ্ম সত্য 
(২)জগৎ অর্থাৎ জগতের সমস্ত নামরূপই মিথ্যা কিংবা নশ্বর; এবং
(৩)মানুষের আত্মা ও ব্ৰহ্ম মূলে একই, দুই নহে” । 
এই শ্লোকের ‘মিথ্যা’ শব্দ কাহারও কানে খারাপ লাগিলে তিনি বৃহদারণ্যকোপনিষদ অনুসারে ইহার তৃতীয় চরণের ‘ব্ৰহ্মামৃতং জগৎ সত্যং’ এই পাঠান্তর স্বচ্ছন্দে করিয়া লইতে পারেন; সেইজন্য ভাবার্থের বদল হইবে না ইহা পূৰ্বেই বলিয়াছি । তথাপি সমস্ত দৃশ্য জগতের অদৃশ্য অথচ নিত্য পরব্রহ্মরূপী মুলতত্ত্বকে সৎ (সত্য) বলিবে কি অসৎ (অসত্য-অনৃত) বলিবে, ইহা লইয়া কোন কোন বেদান্তী বড়ই অনৰ্থক বিবাদ করিয়া থাকেন । তাই এই বিষয়ের প্রকৃত বীজ কি, তাহার একটু ব্যাখ্যা করিতেছি । সৎ কিংবা সত্য এই একই শব্দের দুই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হওয়ায় এই মতবাদ বিপুল হইয়া উঠিয়াছে; এবং ‘সৎ’ এই শব্দকে প্ৰত্যেক ব্যক্তি কি অর্থে প্রয়োগ করেন, তৎপ্রতি ঠিক লক্ষ্য করিলে, কোন গোলযোগ থাকে না । কারণ ব্ৰহ্ম অদৃশ্য হইলেও নিত্য, এবং নামরূপাত্মক জগৎ দৃশ্য হইলেও প্রতিক্ষণে পরিবর্তনশীল, এই ভেদ সকলেরই সমান স্বীকার্য । এই সৎ কিংবা সত্য শব্দের ব্যবহারিক অর্থ হইতেছে (১) চক্ষের সম্মুখে এক্ষণে জাজ্জল্যমান অর্থাৎ ব্যক্ত (কাল উহার বাহ্য রূপ বদলাক বা নাই বদলাক); এবং দ্বিতীয় অর্থ (২) চক্ষের অগোচর অর্থাৎ অব্যক্ত হইলেও যে স্বরূপ চিরকাল এক রকমই থাকে, কখনও পরিবর্তিত হয় না । ইহার মধ্যে, প্রথম অর্থ যাঁহার সম্মত তিনি চক্ষুগোচর নামরূপাত্মক জগৎকে সত্য বলেন, এবং পরব্রহ্মকে তদ্বিরুদ্ধ অর্থাৎ চক্ষের অদৃশ্য সুতরাং অসৎ বা অসত্য বলেন । উদাহরণ যথা - তৈক্তিরীয় উপনিষদে দৃশ্য জগতের প্রতি ‘সৎ’ ও দৃশ্য জগতের অতীতের প্রতি ‘ত্যৎ’ (অর্থাৎ যাহা অতীত) কিংবা ‘অনৃত’ (চক্ষের অদৃশ্য) শব্দ প্রয়োগ করিয়া ব্ৰহ্মের এই প্ৰকার বর্ণন করা হইয়াছে যে, যাহা কিছু মূলে বা আরম্ভে ছিল সেই দ্রব্যই “সচ্চ ত্যচ্চভবৎ । নিরুক্তং চানিরুক্তং চ । নিলয়নং চানিলয়নং চ । বিজ্ঞানং চাবিজ্ঞানং চ । সত্যং চানৃতং চ ।” [তৈ|২|৬] -  সৎ (চক্ষের গোচর) এবং ‘তাহা’ (যাহা অতীত), বাচ্য ও অনির্বাচ্য, সাধার ও নিরাধার, জ্ঞাত ও অবিজ্ঞাত (অজ্ঞেয়), সত্য ও অনৃত - এইরূপ দ্বিধা হইয়া গিয়াছে । কিন্তু ব্ৰহ্মকে এইরূপ ‘অনৃত’ বলিলেও অনৃতের অর্থ মিথ্যা নহে; পরে তৈত্তিরীয় উপনিষদেই “এই অনৃত ব্ৰহ্ম জগতের ‘প্ৰতিষ্ঠা’ কিংবা আধার, তাহার অন্য আধারের অপেক্ষা নাই, এবং তাহাকে যে জানিয়াছে সে অভয় হইয়াছে” এইরূপ উক্ত হইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, শব্দভেদে ভাবার্থের বদল হয় না । সেইরূপ আবার শেষে “অসদ্‌ বা ইদমগ্ৰ আসীৎ” - “এই সমস্ত জগৎ প্ৰথমে অসৎ (ব্ৰহ্ম) ছিল”, এবং ঋগ্বেদের [১০|১২৯|৪] বর্ণন অনুসারে তাহা হইতেই পরে সৎ অর্থাৎ নামরূপাত্মক ব্যক্ত জগৎ নিঃসৃত হইয়াছে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [তৈ|২|৭] । ইহা হইতেও স্পষ্টই দেখা যায় - ‘অসৎ’ শব্দ এই স্থানে অব্যক্ত অর্থাৎ, “চক্ষের অদৃশ্য” এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণাচার্য উক্ত বচনের এইরূপ অর্থই করিয়াছেন, [বেসূ|২|১|১৭] । কিন্তু ‘সৎ’ কিংবা ‘সত্য’ এই শব্দের, - চক্ষে দেখা না গেলেও চিরস্থায়ী কিংবা নিত্য এইরূপ (অর্থাৎ উপরে প্রদত্ত দুই অর্থের মধ্যে দ্বিতীয়) অর্থ যাঁহাদের সন্মত, তাঁহারা অদৃশ্য অথচ অপরিবর্তনীয় পরব্রহ্মকেই সৎ কিংবা সত্য নাম দিয়া, নামরূপাত্মক মায়াকে অসৎ অর্থাৎ অসত্য সুতরাং নশ্বর, এইরূপ বলিয়া থাকেন । উদাহরণ যথা - “সদেব সৌম্যেদমগ্ৰ আসীৎ কথমসতঃ সজ্জায়েত” - হে সৌম্য, সমস্ত জগৎ প্ৰথমে সৎ (ব্ৰহ্ম) ছিল, যাহা অসৎ অর্থাৎ যাহা ‘নাই’ তাহা হইতে সৎ অর্থাৎ “যাহা আছে” তাহা কিরূপে উৎপন্ন হইবে - এইরূপ ছান্দোগ্য উপনিষদে উক্ত আছে [ছাং|৯|২|১,২] । আবার ছন্দোগ্য উপনিষদেই এই পরব্রহ্মকে একস্থানে অব্যক্ত অর্থে ‘অসৎ’ বলা হইয়াছে [ছাং|৩|১৯|১] । * (অধ্যাত্মশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় ইংরেজ গ্রন্থকারদিগের মধ্যেও, সৎ শব্দ জগতের প্রতীয়মান আবির্ভাব (মায়া) সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইবে, অথবা বস্তুতত্ত্ব (ব্ৰহ্ম) সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইবে এই বিষয়ে মতভেদ আছে । কান্ট জগতের প্রতীয়মান আবির্ভাবকে সৎ বুঝিয়া (real) বস্তুতত্ত্বকে অবিনাশী বলেন । কিন্তু হেগেল ও গ্রীন প্রভৃতি উক্ত আবির্ভাবকে অসৎ (unreal) বুঝিয়া বস্ততত্ত্বকে (real) সৎ বলেন ।)


31) ওঁ-তৎসৎ এবং অন্য ব্রহ্মনির্দেশ


একই পরব্রহ্মের প্রতি বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন অর্থে একবার ‘সৎ’ ও একবার ‘অসৎ’ এইরূপ পরস্পরবিরুদ্ধ নাম দিবার এই গোলযোগ - অর্থাৎ বাচ্য অর্থ একই হইলেও শুধু শব্দবাদ বাড়াইবার পক্ষে সাহায্যকারী - পদ্ধতি পরে ভাঙ্গিয়া গিয়া শেষে ব্ৰহ্ম সৎ বা সত্য অর্থাৎ নিত্যস্থায়ী, এবং দৃশ্য জগৎ অসৎ অর্থাৎ নশ্বর, এই এক পরিভাষাই স্থায়ী হইয়া গিয়াছে । ভগবদ্‌গীতাতে এই শেষের পরিাভাষা স্বীকৃত হইয়াছে এবং তদনুসারে দ্বিতীয় অধ্যায়ে [গী|২|১৬-১৮] পরব্রহ্ম সৎ ও অবিনাশী, এবং নামরূপ অসৎ অর্থাৎ বিনশ্বর, এইরূপ উক্ত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রের সিদ্ধান্তও এইরূপ । পুনশ্চ দৃশ্য জগতকে ‘সৎ’ বলিয়া পরব্ৰহ্মকে ‘অসৎ’ বা ‘তৎ’ (তাহা=অতীত) বলিবার তৈত্তিরীয়োপনিষদীয় সেই পুরাতন পরিভাষার চিহ্ন এখনও একেবারে লুপ্ত হয় নাই । ওঁ তৎসৎ এইরূপ যে ব্রহ্মনিৰ্দেশ গীতাতে প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৭|২৩] তাহার মূল অর্থ কি হইতে পারে - এই পুরাতন পরিভাষার দ্বারা ইহার সুন্দর ব্যাখ্যা হয় । এই ‘ওঁ’ গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; উপনিষদে অনেক প্রকারে ইহার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে [প্ৰ|৫; মাং|৮-১২; ছাং|১|১] । ‘তৎ’ অর্থাৎ তাহা কিংবা দৃশ্য জগতের অতীত, দুরবর্তী অনিৰ্বাচ্য তত্ত্ব; এবং ‘সৎ’ অর্থাৎ চক্ষের সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্ৰহ্ম, ইহাই এই সংকল্পের অর্থ । এবং সেই অর্থেই “সদসচ্চাহমৰ্জ্জুন” [গী|৯|১৯] - সৎ অর্থাৎ পরব্রহ্ম ও অসৎ অর্থাৎ দৃশ্য জগৎ দুই-ই আমি, এইরূপ ভগবান গীতাতে বলিয়াছেন । তথাপি গীতায় কর্মযোগই প্রতিপাদ্য হওয়ায় সপ্তদশ অধ্যায়ের শেষে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, এই ব্রহ্মনির্দেশের দ্বারাও কর্মযোগের পূর্ণ সমর্থন হয়; “ওঁ তৎসৎ” এর ‘সৎ’ শব্দের অর্থ লৌকিক দৃষ্টিতে ভাল অর্থাৎ সদ্‌বুদ্ধিতে কৃত কিংবা যাহার ভাল ফল পাওয়া যায় সেই কর্ম; এবং তৎ-এর অর্থ অতীত কিংবা ফলাশা ছাড়িয়া কৃত কর্ম । সংকল্পে যাহাকে ‘সৎ’ বলা হইয়াছে তাহা দৃশ্য জগৎ অর্থাৎ কর্মই হওয়ায় (পর প্রকরণ দেখ) এই ব্ৰক্ষ্মনির্দেশের এই কর্মমূলক অর্থ মূল-অর্থ হইতে সহজেই নিষ্পন্ন হয় । ওঁ তৎসৎনেতি নেতিসচ্চিদানন্দ, এবং সত্যস্য সত্যং ব্যতীত আরও কতকগুলি ব্ৰহ্মনির্দেশ উপনিষদে প্ৰদত্ত হইয়াছে; কিন্তু গীতাৰ্থ বুঝিবার পক্ষে তাহাদের উপযোগ না থাকায় এখানে সেগুলি বুঝানো হয় নাই ।


32) জীব পরমেশ্বরের 'অংশ' কি প্রকারে


জগৎ, জীব ও পরমেশ্বর (পরমাত্মা) ইহাদের পরস্পর-সম্বন্ধের এইরূপ নিষ্পত্তি হইলে পর, “জীব আমারই অংশ” [গী|১৬|৭] এবং “আমিই এক ‘অংশের দ্বারা’ এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি” [গী|১০|৪২] এইরূপ যাহা ভগবান গীতায় বলিয়াছেন - এবং বাদরায়ণাচাৰ্যও বেদান্তসূত্রে ইহাই বলিয়াছেন [বেসু|২|৩|৪৩|৪|১৯] - কিংবা পুরুষসূক্তে “পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি” - “স্থিরচর ব্যাপুনি অবঘা জো জগদাত্মা দশাংগুলে উরলা” - সমস্ত চরাচর ব্যাপিয়া যে জগদাত্মা দশাঙ্গুলে রহিয়াছেন — এইরূপ যে বর্ণনা আছে, তন্মধ্যে ‘পাদ বা অংশ’ শব্দের অর্থনির্ণয়ও সহজ হয় । পরমেশ্বর বা পরমাত্মা সর্বব্যাপী হইলেও নিরবয়ব একপদার্থাত্মক ও নামরূপবিরহিত সুতরাং অচ্ছেদ্য এবং নির্বিকার হওয়া প্রযুক্ত তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন টুকরা হওয়া সম্ভব নহে [গী|২|২৫] । তাই, চতুর্দিকে ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত এই একপদার্থী পরব্ৰহ্ম এবং মনুষ্যের দেহান্তৰ্গত আত্মা, এই দুয়ের ভেদ দেখাইবার জন্য ব্যবহারে ‘শারীর আত্মা’ পরব্রহ্মেরই ‘অংশ’ এইরূপ বলিতে হইলেও, ‘অংশ’ বা ‘ভাগ’ শব্দের ‘কাটিয়া ফেলা বিচ্ছিন্ন টুকরা’, বা ‘ডালিমের অনেক দানার মধ্যে একটি দানা’ এইরূপ অর্থ না করিয়া, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে গৃহস্থিত আকাশ, ঘটস্থ আকাশ (মঠাকাশ, ঘটাকাশ) এই সকল যেরূপ সর্বব্যাপী এক আকাশেরই ভাগ, সেইরূপ শারীর আত্মাও পরব্রহ্মের অংশ, এইরূপ অর্থ করিতে হয় [অমৃতবিন্দু উপনিষৎ ১৩ দেখ] । 


33) পরমেশ্বর দিককাল সীমাহীন


সাংখ্যদিগের প্রকৃতি এবং হেকেলের আধিভৌতিক জড়াদ্বৈতবাদে স্বীকৃত একপদার্থমূলক তত্ত্ব, - ইহাও এইরূপ সত্য নির্গুণ পরমেশ্বরেরই সগুণ অর্থাৎ সসীম অংশ । অধিক কি, আধিভৌতিক শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে ইহাই প্ৰকাশ পায় যে, যে কোন ব্যক্ত বা অব্যক্ত মূলতত্ত্ব (তাহা আকাশের মত যতই কেন ব্যাপক হউক না) আছে, সে সমস্ত দেশ ও কালের দ্বারা বদ্ধ নামরূপমাত্র সুতরাং সসীম ও নশ্বর । ইহা সত্য যে, সেই তত্ত্বসমূহের ব্যাপকতার কারণে ততটুকুই পরব্রহ্ম তাহাদের দ্বারা আচ্ছাদিত; কিন্তু পরব্রহ্ম তাহাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ না হইয়া সেই সমস্তের মধ্যে ওতপ্ৰোত আছেন এবং তদতিরিক্ত জানি না তিনি কতটা বাহিরে আছেন, যাহার কোন সন্ধান নাই । পরমেশ্বরের ব্যাপকতা দৃশ্য জগতের বাহিরে কতটা, তাহা দেখাইবার জন্য ‘ত্ৰিপাদ’ শব্দ পুরুষসূক্তে প্ৰযুক্ত হইলেও তাহার অর্থ ‘অনন্তই’ বিবক্ষিত । বস্তুত দেখা যায় যে দেশ ও কাল, পরিমাণ বা সংখ্যা ইত্যাদি সমস্ত নামরূপেরই প্ৰকার; এবং ইহা বলিয়া আসিয়াছি যে পরব্রহ্ম এই সমস্ত নামরূপের অতীত । এইজন্য, যে নামরূপাত্মক ‘কালের’ দ্বারা সমস্ত কবলিত রহিয়াছে সেই কালকেও যিনি আচ্ছাদন করিয়া রহিয়াছেন তিনিই পরব্রহ্ম, উপনিষদে ব্ৰহ্মস্বরূপের এইরূপ বর্ণনা দেখা যায় [মৈ|৬|১৫]; এবং “ন তদ্‌ভাসয়তে সূৰ্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ” - পরমেশ্বরকে প্ৰকাশ করিবার পক্ষে সূর্য চন্দ্ৰ কিংবা অগ্নির সমান কোন প্ৰকাশক সাধন নাই, কিন্তু তিনি স্বপ্ৰকাশ, ইত্যাদি যে বর্ণনা গীতাতে ও উপনিষদে আছে [গী|১৫|৬; কঠ|৫|১৫; শ্বে|৬|১৩] তাহারও ইহাই তাৎপর্য । সূর্য চন্দ্ৰ তারা সমস্তই নামরূপাত্মক নশ্বর পদার্থ । যাঁহাকে “জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ” [গী|১৩|১৭; বৃ|৪|১৬] - জ্যোতির জ্যোতি বলা হয় সেই স্বপ্ৰকাশ ও জ্ঞানময় ব্ৰহ্ম এই সমস্তের অতীত অনন্ত ব্যাপিয়া আছেন; তাঁহার অন্য প্ৰকাশক পদার্থের অপেক্ষা নাই; এবং উপনিষদেও স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, সূর্য চন্দ্ৰ প্ৰভৃতি যে আলোক প্রাপ্ত হয় তাহাও এই স্বপ্ৰকাশ ব্ৰহ্ম হইতেই তাহারা প্রাপ্ত হয় [মুং|২|২|১০] । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যুক্তি অনুসারে ইন্দ্রিয়গোচয় অতি সূক্ষ্ম বা অত্যন্ত দূরের পদার্থ ধর না কেন, সে সমস্তই দেশকালাদি নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ, অতএব ‘জগতেই’ উহাদের সমাবেশ হয় । সত্য পরমেশ্বর উহাদের মধ্যে থাকিয়াও উহাদের হইতে পৃথক্‌, উহাদের অপেক্ষা অধিক ব্যাপক, এবং নামরূপের জাল হইতে স্বতন্ত্র; অতএব কেবল নামরূপেরই বিচারকারী আধিভৌতিক শাস্ত্রের যুক্তি বা সাধন বর্তমান অবস্থা অপেক্ষা শতগুণ সূক্ষ্ম ও প্ৰগল্‌ভ হইলেও তাহার দ্বারা জগতের মূল “অমৃত তত্ত্বের” সন্ধান পাওয়া সম্ভব নহে । সেই অবিনাশী, নির্বিকার ও অমৃততত্ত্বকে কেবল অধ্যাত্মশাস্ত্রের জ্ঞানমার্গের দ্বারাই অনুসন্ধান করিতে হইবে ।


34) অধ্যাত্মশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত


এ পর্যন্ত অধ্যাত্মশাস্ত্রের যে মুখ্য মুখ্য সিদ্ধান্ত ও শাস্ত্রীয় রীতিতে তাহাদের যে সংক্ষিপ্ত উপপত্তি বলা হইয়াছে, তাহা হইতে ইহা সুস্পষ্ট হইবে যে, পরমেশ্বরের নামরূপাত্মক সমস্ত ব্যক্ত স্বরূপ কেবল মায়িক ও অনিত্য এবং ইহা অপেক্ষা তাহার অব্যক্ত স্বরূপ শ্ৰেষ্ঠ, এবং তাহারও মধ্যে নির্গুণ অর্থাৎ নামরূপরহিত স্বরূপই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; এবং নির্গুণই সগুণরূপে অজ্ঞানফলে প্ৰতিভাত হয় ইহা গীতায় বলা হইয়াছে । কিন্তু কেবল শব্দের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত গ্রথিত করিবার কাজ, সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ন্যায় যাহাদের দুই অক্ষরের কোন জ্ঞান হইয়াছে তাহারাই করিতে পারেন, ইহাতে কোন অসাধারণত্ব নাই । এ বিষয়ে বিশেষত্ব এই যে, এই সমস্ত সিদ্ধান্ত বুদ্ধিতে আসিয়া মনের মধ্যে প্ৰবেশ করে, হৃদয়ের মধ্যে মগ্ন হয় এবং অস্থিমাংসের মধ্যে বিদ্ধ হইয়া যায় । এই প্ৰকার হইবার পর একই পরব্রহ্ম সমস্ত প্ৰাণীর মধ্যে ওতপ্রোত হইয়া আছেন, পরমেশ্বরের স্বরূপের এই প্রকার পূর্ণ জ্ঞান লাভ হয়, এবং সেই ভাবের দ্বারা সঙ্কটকালেও সম্পূর্ণ সমতার সহিত আচরণ করিবার স্থির স্বভাব উৎপন্ন হয়; কিন্তু ইহার জন্য বহুবংশাগত সংস্কারের, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের, দীর্ঘ উদ্যোগের এবং ধ্যান ও উপাসনার সহায়তা আবশ্যক হয় । এই সমস্তের সাহায্যে “সর্বভূতে একই আত্মা” এই তত্ত্ব যখন কোন মনুষ্যের সঙ্কট সময়েও তাহার প্রত্যেক কর্মে সহজভাবে স্পষ্ট উপলব্ধি হয়, তখনই বুঝিতে হইবে যে, তাহার ব্ৰহ্মজ্ঞান প্রকৃতই পরিপক্ক হইয়াছে এবং এই প্রকারেই মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয় [গী|৫|১৮-২০; ৬|২১,২২] – ইহাই অধ্যাত্মশাস্ত্রের উপরিউক্ত সর্ব সিদ্ধান্তের সারভূত ও শিরোমণিভূত চরম সিদ্ধান্ত । এই আচরণ যে ব্যক্তিতে দেখা যায় না তাহাকে ‘কাঁচা’ বুঝিতে হইবে - ব্ৰহ্মজ্ঞানের অগ্নিতে সে এখনও সম্পূর্ণ পক্ক হয় নাই । প্রকৃত সাধু এবং নিছক বেদান্তশাস্ত্রী, ইহাদের মধ্যে ইহাই ভেদ । 


35) দেহেন্দ্রিয়ে প্রবিদ্ধ সাম্যবুদ্ধি


এবং এই অভিপ্ৰায়েই গীতাতে জ্ঞানের লক্ষণ বলিরার সময় “বাহ্য জগতের মূল তত্ত্বকে শুধু বুদ্ধিতে জানা” জ্ঞান না বলিয়া “অমানিত্ব, ক্ষান্তি, আত্মনিগ্ৰহ, সমবুদ্ধি” ইত্যাদি উদাত্ত মনোবৃত্তি জাগৃত হইয়া যাহার দ্বারা চিত্তের পূর্ণ শুদ্ধি আচরণে সর্বদা ব্যক্ত হয় তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|১৬|৭-১১] । জ্ঞানের দ্বারা যাহার ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ আত্ম-অনাত্ম বিচারে স্থির হয় এবং যাহার মনে সর্বভূতাত্মৈক্য-জ্ঞানের পূর্ণ প্ৰকাশ পায় সেই ব্যক্তির বাসনাত্মক বুদ্ধিও নিঃসন্দেহ শুদ্ধ হয় । কিন্তু কাহার বুদ্ধি কিরূপ বুঝিতে হইলে তাহার আচরণ ব্যতীত অন্য বাহ্য সাধন না থাকায় এখনকার কেবল কেতাবী জ্ঞানপ্রচারের কালে ইহা বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত যে, ‘জ্ঞান’ বা ‘সমবুদ্ধি’ শব্দেই শুদ্ধ (ব্যবসায়াত্মক) বুদ্ধি, শুদ্ধ বাসনা (বাসনায়ক বুদ্ধি) ও শুদ্ধ আচরণ, এই তিন শুদ্ধ বিষয়ের সমাবেশ করা হয় । ব্ৰহ্মসম্বন্ধে শুষ্ক বাক্‌পাণ্ডিত্য প্ৰদৰ্শক এবং তাহা শুনিয়া “বাঃ বাঃ” বলিয়া শিরঃসঞ্চালক, কিংবা অভিনয়দর্শকের ন্যায় “আরও একবার” বলিবার লোক অনেক আছে [গী|২|২৯; ক|২|৭] । কিন্তু উপরি-উক্ত অনুসারে যে ব্যক্তি অন্তর্বাহ্যশুদ্ধ অর্থাৎ সাম্যশীল হইয়াছে সেই প্ৰকৃত আত্মনিষ্ঠ এবং তাহারই মুক্তি লাভ হয়, নিছক্‌ পণ্ডিতের হয় না - সে যতই কেন বুদ্ধিমান বা বিদ্বান হোক না । “নায়মাত্মা প্ৰবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন” এইরূপ উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে [ক|২|২২; মুং|৩|২|৩] । এইরূপ তুকারাম বাবাও বলিয়াছেন — “ঝালাসি পণ্ডিত পুরাণ সাঙ্গসী । পরী তুঁ নেণসি মী হেঁ কোণ ।।” অর্থাৎ - “পণ্ডিত হইয়াছে, পুরাণ বলিতেছ । কিন্তু তুমি জান না যে ‘আমি’ কে ।” [গা|২৫|৯৯] । 


36) মোক্ষরূপ ও সিদ্ধাবস্থার বর্ণনা


আমাদের জ্ঞান কত কম তাহা দেখ । ‘মুক্তি লাভ হয়’ এই শব্দ আমাদের মুখ হইতে সহজেই বাহির হইয়া পড়ে । মনে করি আত্মা হইতে এই মুক্তি কোন পৃথক বস্তু ! ব্ৰহ্ম ও আত্মার একত্ব জ্ঞান হইবার পূর্বে দ্রষ্টা ও দৃশ্য জগতে ভেদ ছিল ঠিক; কিন্তু আমাদের অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে নিশ্চিত অবধারিত হইয়াছে যে, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের পূর্ণ জ্ঞান হইলে আত্মা ব্ৰহ্মেতে মিশিয়া যায় এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষ আপনিই ব্ৰহ্মরূপ হইয়া যান; এই আধ্যাত্মিক অবস্থাকেই ‘ব্রহ্মনিৰ্বাণ’ মোক্ষ নাম দেওয়া হইয়াছে; এই ব্ৰহ্মনিৰ্বাণ কেহ কাহাকে দিতে পারে না, ইহা অন্য কোথা হইতে আসে না, অথবা তাহার জন্য অন্য কোন লোকে যাইবারও প্রয়োজন নাই । পূর্ণ আত্মজ্ঞান যখন ও যেখানে হইবে সেইক্ষণে ও সেই স্থানেই মোক্ষ ধরা রহিয়াছে; কারণ মোক্ষ তো আত্মারই মূল শুদ্ধাবস্থা; উহা পৃথক স্বতন্ত্র কোন বস্তু বা স্থল নহে । শিবগীতাতে এই শ্লোক আছে [১৩|৩২] -
মোক্ষস্য ন হি বাসোহস্তি ন গ্রামান্তরমেব বা ৷
অজ্ঞানহৃদয়গ্ৰন্থি-নাশো মোক্ষ ইতি স্বতঃ ॥
অর্থাৎ “মোক্ষ অমুক স্থানে লাভ হয়, কিংবা মোক্ষের জন্য অন্য কোন গ্রামে অর্থাৎ প্রদেশে যাইতে হয়, এরূপ নহে; আপন হৃদয়ের অজ্ঞান-গ্রন্থির নাশ হওয়াকেই মোক্ষ বলে ।” এই প্রকারে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ হইতে নিষ্পন্ন এই অর্থই “অভিতো ব্ৰহ্মনিৰ্বাণং বৰ্ত্ততে বিদিতাত্মনাম,” [গী|৫|২৬] - যাঁহার পূর্ণ আত্মজ্ঞান হইয়াছে তাঁহার সকল স্থানেই ব্রহ্মনিৰ্বাণরূপী মোক্ষলাভ হয়, এবং “যঃ সদা মুক্ত এব সঃ [গী|৫|২৮] ভগবদ্‌গীতার এই শ্লোকসমূহে এবং “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” - যিনি ব্ৰহ্মকে জানিয়াছেন তিনি ব্ৰহ্মই হইয়াছেন [মুং|৩|২|৯] - ইত্যাদি উপনিষদবাক্যেও বর্ণিত হইয়াছে । মনুষ্যের আত্মার জ্ঞানদৃষ্টিতে এই যে পূর্ণাবস্থা হয়, ইহাকেই ‘ব্ৰহ্মভূত’ [গী|১৮|৫৪], বা ‘ব্ৰাহ্মী স্থিতি’ [গী|২|৭২], বলা হইয়া থাকে; এবং ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ [গী|২|৫৫-৭২], ‘ভক্তিমান্‌’ [গী|১২|১৩-২০] বা ‘ত্ৰিগুণাতীত’ [গী|১৪|২২-২৭] পুরুষদিগের ভগবদ্‌গীতায় যে বর্ণনা আছে তাহাও এই অবস্থারই বর্ণনা । ‘ত্রিগুণাতীত’ পদ হইতে প্ৰকৃতি ও পুরুষ উভয়কে স্বতন্ত্র মানিয়া সাংখ্য যেরূপ পুরুষের কৈবল্যকে মোক্ষ বলেন, সেইরূপ মোক্ষই গীতারও অভিমত, এরূপ বুঝা যেন না হয়; আধ্যাত্মশাস্ত্রের “অহং ব্ৰহ্মাস্মি”- আমিই ব্ৰহ্ম – [বৃ|১|৪|১০] - এই ব্ৰাহ্মী অবস্থা কখন ভক্তিমার্গের দ্বারা, কখন চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জল যোগমার্গের দ্বারা এবং কখন বা গুণাগুণবিচাররূপ সাংখ্যমার্গের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, ইহাই গীতার অভিপ্ৰায় । এই মাৰ্গসমূহের মধ্যে অধ্যাত্মবিচার কেবল বুদ্ধিগম্য মার্গ হওয়া প্ৰযুক্ত পরমেশ্বরস্বরূপের জ্ঞানলাভার্থ সাধারণ মনুষ্যের পক্ষে ভক্তিই সুলভ সাধন ইহা গীতাতে উক্ত হইয়াছে । এই সাধনের সবিস্তার বিচার আমি পরে ত্ৰয়োদশ প্রকরণে করিয়াছি । সাধন যাহাই হোক না, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অর্থাৎ প্ৰকৃত পরমেশ্বরের স্বরূপের জ্ঞান হইয়া জগতের সর্বভূতের মধ্যে একই আত্মাকে উপলব্ধি করা এবং তদনুসারে কার্য করাই অধ্যাত্মজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা; এবং এই অবস্থা যাহার লাভ হইয়াছে সেই পুরুষই ধন্য ও কৃতকৃত্য হন - এইটুকুতো নির্বিবাদ । ইহা পূৰ্বেই বলা হইয়াছে যে, কেবল ইন্দ্ৰিয়সুখ পশু ও মনুষ্যের একই সমান হওয়া প্ৰযুক্ত মনুষ্যজন্মের সার্থকতা কিংবা মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জ্ঞানলাভেই হইয়া থাকে । সমস্ত ভূতের বিষয়ে কায়মনোবাক্যে সর্বদা এইপ্ৰকার সাম্যবুদ্ধি স্থাপন করিয়া সমস্ত কর্ম করাই নিত্য মুক্তাবস্থা, পূর্ণযোগ বা সিদ্ধাবস্থা । গীতায় এই অবস্থার যে বৰ্ণনা আছে তন্মধ্যে দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তিমান পুরুষের বর্ণনার উপর টীকা করিবার সময় জ্ঞানেশ্বর মহারাজ * অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া ব্ৰহ্মভূত পুরুষের সাম্যাবস্থার সুরস ও চটক্‌দার নিরূপণ করিয়াছেন; এবং তাহাতে গীতার চারি স্থানে বর্ণিত ব্ৰাহ্মী স্থিতির সার বিবৃত হইয়াছে ইহা বলিতে বাধা নাই । যথা - “হে পাৰ্থ ! যাহার হৃদয়ে বৈষম্য কিছুমাত্র নাই, যিনি শত্রুমিত্র সকলকে সমান ভাবেন; অথবা হে পাণ্ডব ! যিনি প্ৰদীপের ন্যায় ইহা আমার ঘর বলিয়া এখানে আলোক দিব, উহা অপরের ঘর বলিয়া ওখানে অন্ধকার করিয়া রাখিব, এ প্রকার ভেদজ্ঞান করেন না; বীজ যে বপন করে এবং গাছ যে কাটে, উভয়ের উপরেই বৃক্ষ যেমন সমভাবে ছায়াদান করে;” ইত্যাদি [জ্ঞা|১২|১৮] । 
* (জ্ঞানেশ্বর মহারাজের “জ্ঞানেশ্বরী” গ্রন্থের হিন্দী অনুবাদ নাগপুরে সবজজ শ্ৰীযুক্ত রঘুনাথ মালব ভগড়ে বি-এ, করিয়াছেন; এবং এই গ্ৰন্থ উহার নিকট পাওয়া যায় । বর্তমানে প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক প্রভুপাদ শ্রীযুক্ত প্রাণকিশোর গোস্বামী তাহা বাংলা ভাষাতেও সম্পূর্ণ অনুবাদ করিয়াছেন ।) 

সেইরূপ “পৃথিবীর ন্যায় তিনি এ প্রকার ভেদ একেবারেই জানেন না যে, উত্তমকে গ্ৰহণ করিতে হইবে এবং অধমকে ত্যাগ করিতে হইবে; যেমন দয়ালু ব্যক্তি ইহা ভাবেন না যে, রাজার শরীর রক্ষা করি এবং দরিদ্রের শরীর বিনষ্ট করি; যেমন জল এই ভেদ করে না যে, গরুর তৃষ্ণা শান্তি করি এবং ব্যাঘ্রের পক্ষে বিষ হইয়া তাহার সর্বনাশ করি; সেইরূপই সর্বভূতে যাঁহার একই মৈত্রী; যিনি স্বয়ং মূর্তিমান দয়া, এবং যিনি ‘আমি’ ও ‘আমার’ ব্যবহার করিতে জানেন না, এবং যাহাতে সুখদুঃখের আভাসও দেখা যায় না” ইত্যাদি [জ্ঞা|১২|১৩] * অধ্যাত্মবিদ্যার দ্বারা শেষে যাহা লাভ হয় তাহা ইহাই ।
* (পার্থ জয়াচিয়া ঠাষী । বৈষম্যাচী বাৰ্ত্তা নাহী । বিদুমিত্রা দোহী । সরিসা পাডু ।। 
কাঁ ঘরিচিয়া উজিযেতু করারা পারখিয়া অঁধারু পাডাবা । হে নেনেচি গা পাণ্ডবা । দীনূ জৈসা ।। জো খাণ্ডাবয়া ঘাকে ঘালী । কাঁ লাবণী জয়ানে কেলী ।। দেঘাঁ একাচি সাডলী । বৃক্ষুদে জৈসা ।।
কিংবা তৎপূর্বে [জ্ঞা|১২|১৩] সেই অধ্যায়ে –
উত্তমানে ধরিজে । অধমানে অহ্বেরিজে । হেঁ কাঁহীঁচ নেণিজে । অসুধা জেবীঁ ।।
কাঁ রায়াচেঁ দেহ চালুঁ । রক্ষা পবৌতে গালুঁ । হেঁনে ক্ষণেচি কৃপালু । প্রাণু সৈঁ গা ।।
গাঈচা তৃষা হরুঁ । কাঁ ব্যাঘ্রা বিষ হোউনি মারু । ঐ সে নেণেচি কাঁকরু, তোর জৈসেঁ ।।
তৈসী আষ বিবাঁচি ভূতমাত্রী । একপণে জয়া মৈত্রী ।। কৃপেশী ধাত্রী । আপণচি জো ।।
আণি মী হে ভাব নেণে । মাঝেঁ কহীঁচি ন ক্ষণে । সুখদুঃখ জাণণেঁ । নাহিঁ জয়া ।।)


37) ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের সার্থ বিবরণ


সমস্ত মোক্ষধর্মের মূল অধ্যাত্মজ্ঞানের পরম্পরা আমাদের নিকট উপনিষদ হইতে আরম্ভ করিয়া জ্ঞানেশ্বর, তুকারাম, রামদাস, কবীরদাস, তুলসীদাস, ইত্যাদি আধুনিক সাধুপুরুষ পর্যন্ত কিরূপ অব্যাহত চলিয়া আসিয়াছে, তাহা উপরিউক্ত বিচার-আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । কিন্তু উপনিষদেরও পূর্বে অর্থাৎ অত্যন্ত প্ৰাচীন কালেই আমাদের দেশে এই জ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল এবং তখন হইতে পরে ক্রমে ক্ৰমে উপনিষদের বিচারের বৃদ্ধি হইতে চলিয়াছে । ইহা পাঠককে ভালরূপে বুঝাইবার জন্য উপনিষদের ব্রহ্মবিদ্যার আধারভূত ঋগ্‌বেদের এক প্ৰসিদ্ধ সূক্ত ভাষান্তর সহ এইখানে শেষে দিয়াছি । জগতের অগম্য মূলতত্ত্ব এবং তাঁহা হইতে এই বিবিধ দৃশ্য জগতের উৎপত্তির বিষয়ে এই সূক্তে যে বিচার প্রদর্শিত হইয়াছে সেরূপ প্ৰগল্‌ভ, স্বতন্ত্র ও মূলস্পর্শী তত্ত্বজ্ঞানের মার্মিক বিচার অন্য কোন ধর্মেরই মূল গ্রন্থে পাওয়া যায় না । শুধু তাহাই নহে, এই প্রকার অধ্যাত্মবিচারে পূর্ণ এত প্ৰাচীন লেখাও অদ্যাপি কোথাও উপলব্ধ হয় নাই । তাই, মনুষ্যের মনের প্রবৃত্তি এই নশ্বর ও নামরূপাত্মক জগতের অতীত নিত্য ও অচিন্ত্য ব্ৰহ্মশক্তির দিকে সহজেই কিরূপ ধাবমান হয় ইহা দেখাইবার জন্য ধর্ম-ইতিহাসের দৃষ্টিতেও এই সূক্তের গুরুত্ব বুঝিয়া আশ্চর্য হইয়া অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত আপনাপন ভাষায় তাহার চমৎকার ভাষান্তর করিয়াছেন । ইহা ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ১২৯তম সূক্ত হইতেছে; এবং এই সূক্তের প্রারম্ভিক শব্দ হইতে ইহাকে “নাসদীয় সূক্ত” বলে । এই সূক্তই তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে [২|৮|৯] প্রদত্ত হইয়াছে; মহাভারতের নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মে, এই সূক্তেরই আধারে ভগবদিচ্ছায় সর্বপ্রথমে জগতের সৃষ্টি কিরূপে হইল, তাহার বর্ণনা করা হইয়াছে [মভা শাং|৩৪২|৮] । সর্বানুক্ৰমণিকা অনুসারে ইহার ঋষি পরমেষ্টি প্রজাপতি, এবং দেবতা পরমাত্মা; ইহাতে ত্ৰিষ্টুভ বৃত্তের অর্থাৎ এগারো অক্ষরের চার চরণের সাত ঋক আছে । ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ শব্দ দ্ব্যর্থী হওয়া প্ৰযুক্ত জগতের মূল দ্রব্যকে ‘সৎ’ বলা সম্বন্ধে উপনিষৎকারদিগের যে মতভেদের কথা পূর্বে এই প্রকরণে উল্লেখ করিয়াছি সেই মতভেদ ঋগ্বেদেও দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - এই মূল কারণ সম্বন্ধে কোন স্থানে উক্ত হইয়াছে “একং সদ্‌বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি” [ঋ|১|১৬৪|৪৬] কিংবা “একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি” [ঋ|১|১১৪|৫] - তিনি এক ও সৎ অর্থাৎ নিত্যস্থায়ী, কিন্তু তাঁহাকেই লোকে বিভিন্ন নাম দিয়া থাকে; আবার কোন কোন স্থলে ইহার উল্টাও বলা হইয়াছে যে, “দেবানাং পূর্ব্যে যুগেহসতঃ সদজায়ত” [ঋ|১০|৭২|৭] - দেবতাদেরও পূর্বে অসৎ অর্থাৎ অব্যক্ত হইতে ‘সৎ’ অর্থাৎ ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে । ইহা ছাড়া, কোন-না-কোন এক দৃশ্য তত্ত্ব হইতে জগতের উৎপত্তি হওয়া সম্বন্ধে ঋগ্বেদেই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দেখা যায়; যেমন জগতের আরম্ভেমূল হিরণ্যগৰ্ভ ছিলেন, এবং অমৃত ও মৃত্যু এই দুই তাঁহারই ছায়া; তিনিই পরে সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিলেন [ঋ|১০|১২১|১|২] প্ৰথমে বিরাট্‌রূপী পুরুষ ছিলেন; তাঁহা হইতে যজ্ঞের দ্বারা সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৯০]; প্ৰথমে আপ (জল) ছিল, তাহাতে প্ৰজাপতি উৎপন্ন হইলেন [ঋ|১০|৭২|৬; ১০|৮২|৬]; ঋত ও সত্য প্ৰথমে উৎপন্ন হইল, অনন্তর রাত্রি (অন্ধকার) ও তাহার পর সমুদ্র (জল), সম্বৎসর প্রভৃতি উৎপন্ন হইল [ঋ|১০|১৯০|১] । ঋগ্বেদে বর্ণিত এই মূল দ্রব্যসমূহের পরে অন্যান্য স্থানে এই প্রকার উল্লেখ করা হইয়াছে, যথা – (১) জলের, তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে ‘আপো বা ইদমগ্রে সলিলমাসীৎ’ এই সমস্ত প্ৰথমে কেবল তরল জল ছিল [তৈ|ব্ৰা|১|১|৩|৫]; (২) অসতের, তৈত্তিরীয় উপনিষদে ‘অসদ্বা হদমগ্ৰ আসীৎ’ ইহা প্ৰথমে অসৎ ছিল [তৈ|২|৭]; (৩) সতের, ছান্দ্যোগ্যে ‘সদেব সৌম্যেদমগ্ৰ আসীৎ” এই সমস্ত প্ৰথমে সৎই ছিল [ছাং|৬|২]; কিংবা (৪) আকাশের, ‘আকাশঃ পরায়ণম্‌’ আকাশই সমস্তের মূল [ছাং|১|৯], (৫) মৃত্যুর, বৃহদারণ্যকে নৈবেহ কিঞ্চনাগ্ৰ ‘আসীন্মৃত্যুনৈবেদমাবৃতমাসীৎ’ প্ৰথমে ইহা কিছুই ছিল না, সমস্তই মৃত্যুর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল [বৃ|১|২|১]; এবং (৬) তমের, মৈক্র্যপনিষদে ‘তমো বা ইদমগ্ৰ আসীদেকম্‌’ [মৈ|৫|২] প্ৰথমে এই সমস্ত একমাত্র তম (তমোগুণী, অন্ধকার) ছিল - পরে তাহা হইতে রজ ও সত্ত্ব হইল । শেষে এই সকল বেদবচনের অনুসরণ করিয়া মনুস্মৃতিতে জগতের আরম্ভের বর্ণনা এই প্রকার করা হইয়াছে -
আসীদিদং তমোভূতমপ্ৰজ্ঞাতমলক্ষণম ৷
অপ্ৰতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্ৰসুপ্তমিব সর্বতঃ ॥
অর্থাৎ “এই সমস্ত প্ৰথমে তমের দ্বারা অর্থাৎ অন্ধকারের দ্বারা ব্যাপ্ত ছিল, ভেদাভেদ উপলব্ধি হইত না, অগম্য ও নিদ্রিতের ন্যায় ছিল; অনন্তর তাহার মধ্যে অব্যক্ত পরমাত্মা প্ৰবেশ করিয়া প্ৰথমে জল উৎপন্ন করিলেন” – [মনু|১|৫-৮] । জগৎ আরম্ভের মূলদ্রব্যসম্বন্ধে উক্ত বৰ্ণনা কিংবা এইপ্ৰকার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা নাসদীয় সূক্তের সময়েও অবশ্য প্রচলিত ছিল; এবং সেই সময়েও ইহাদের মধ্যে কোন মূলদ্রব্য সত্য ধরা যাইবে এই প্রশ্ন উপস্থিত হইয়াছিল । তাই উহার সত্যাংশ সম্বন্ধে এই সূক্তের ঋষি বলিতেছেন যে -
নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরে যৎ ৷
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্‌ গহনং গভীরম্‌ ॥ ১ ॥
১ । তখন অর্থাৎ মূলারম্ভে অসৎ ছিল না এবং সৎও ছিল না । অন্তরীক্ষ ছিল না এবং তাহারও অতীত আকাশও ছিল না । (এইরূপ অবস্থাতে) কে (কাহাকে) আবরণ করিল ? কোথায় ? কাহার সুখের জন্য ? অগাধ ও গহন জলও কোথায় ছিল ? 
(প্ৰথম ঋক্‌ - চতুর্থ চরণে ‘আসিৎ কিং’ এই অন্বয় করিয়া আমি উক্ত অর্থ দিয়াছি; এবং উহার ভাবার্থ হইতেছে ‘জল সে সময়ে ছিল না’ [তৈ|ব্রা|২|২|৯ দেখ] ।)
ন মৃত্যুরাসীদ্‌ মৃতং ন তর্হি ন রাত্ৰ্যা অহ্ন আসীৎ প্ৰকেতঃ ৷
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাহস ॥ ২ ॥
২ । তখন মৃত্যু অর্থাৎ মৃত্যুগ্রস্ত নশ্বর দৃশ্য জগৎ সৃষ্ট হয় নাই, সেইজন্য (অন্য) অমৃত অর্থাৎ অবিনাশী নিত্য পদার্থ (এই ভেদ)ও ছিল না । (এইপ্ৰকার) রাত্রি ও দিনের ভেদ জানিবার কোন সাধন (=প্রকেত) ছিল না । (যাহা ছিল) তাহা একমাত্র আপনি শক্তি (স্বধা) দ্বারাই বায়ু বিনা শ্বাসোচ্ছ্বাস করিত অর্থাৎ স্ফূৰ্ত্তিমান হইত । তাহা ব্যতীত কিংবা তাহার বাহিরে অন্য কিছুই ছিল না ।
তম আসীত্তমসা গৃঢ়মগ্রেহপ্ৰকেতং সলিলঃ সর্বমা ইদম্‌ ৷
তুচ্ছেনান্বপিহিতং যদাসীৎ তপসস্তন্মহিনাহজায়তৈকম্‌ ॥ ৩ ॥
৩ । যে (যৎ) এইরূপ বলা যায় যে, অন্ধকার ছিল, আরম্ভে এই সমস্ত অন্ধকারে ব্যাপ্ত (এবং) ভেদাভেদবিরহিত জল ছিল, কিংবা আভু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ব্ৰহ্ম (আরম্ভেই) তুচ্ছের দ্বারা অর্থাৎ মিথ্যা মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত ছিলেন, তাহা (তৎ) মূলে এক (ব্রহ্মই) তপের মহিম্র দ্বারা (রূপান্তরে পরে) প্রকট হইয়াছিলেন ।
(তৃতীয় ঋক্‌ - কেহ কেহ ইহার প্রথম তিন চরণ স্বতন্ত্র কল্পনা করিয়া উহার এইরূপ বিধানাত্মক অর্থ করেন যে, “অন্ধকার, অন্ধকারে পরিব্যাপ্ত জল, কিংবা তুচ্ছের দ্বারা আচ্ছাদিত আভু (শূন্যগর্ভ) ছিলেন” । কিন্তু আমার মতে ইহা ভুল । কারণ প্রথম দুই ঋকে, মূলারম্ভে কিছুই ছিল না এইরূপ যখন স্পষ্ট বিধান আছে, তখন তাহার বিপরীত, অন্ধকার কিংবা জল মূলারম্ভে ছিল, এই সূক্তে ইহা উক্ত হইতে পারে না । তাছাড়া, এইরূপ অৰ্থ করিলেও তৃতীয় চরণের যৎ শব্দকে নিরর্থক মানিতে হয় । তাই তৃতীয় চরণের যৎ-এর সহিত চতুর্থ চরণের তৎ পদের সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া উপরি-উক্ত অর্থ করা আবশ্যক বলিয়া মনে করি । ‘মূলারম্ভে জল প্রভৃতি পদার্থ ছিল’ এইরূপ যাহারা বলে তাহাদের উত্তরস্বরূপে এই ঋক্ এই সূক্তে আসিয়াছে; এবং তোমার কথা অনুসারে তম, জল, প্রভৃতি পদার্থ মূলে ছিল না, উহা এক ব্ৰহ্মেরই পরবর্তী বিস্তুার, এইরূপ বলাই ঋষির উদ্দেশ্য । ‘তুচ্ছ’ ও ‘আভু’ এই দুই শব্দ পরস্পর-প্রতিযোগী হওয়া প্রযুক্ত তুচ্ছের বিপরীত আভু শব্দের অর্থ বড় কিংবা সমর্থ হইতেছে; এবং ঋগ্‌বেদে অন্য যে দুই স্থানে এই শব্দ আসিয়াছে [ঋ|১০|২৭|১|৪] তথায় সায়ণাচার্যও উহার এই অর্থই করিয়াছেন । পঞ্চদশীতে [চিত্র|১২৯|১৩০] তুচ্ছ এই শব্দ মায়ার প্রতি প্ৰযুক্ত হইয়াছে [নৃসিং|উত্ত|৯ দেখ], সুতরাং আভুর অৰ্থ শূন্যগর্ভ না হইয়া ‘পরব্রহ্ম’ই হইতেছে । ‘সৰ্ব্বং আঃ ইদম্’ এই স্থানে আঃ (আ + অস্‌) অস্‌ ধাতুর ভূতকালের রূপ; তাহার অর্থ ‘আসীৎ’ ।)
কামন্তদগ্রে সমবৰ্ত্ততাধি মনসো রেতঃ প্ৰথমং যদাসীৎ ৷
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্‌ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা ॥ ৪ ॥
৪ । ইহার মনের যে রেত অর্থাৎ বীজ প্ৰথমে নিঃসৃত হয় তাহাই আরম্ভে কাম (অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টি করিবার প্রবৃত্তি কিংবা শক্তি) হইয়াছে । জ্ঞানীরা অন্তঃকরণে বিচার করিয়া বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারণ করিয়াছেন যে, (ইহাই) অসৎ-এর মধ্যে অর্থাৎ মূল পরব্রহ্মের মধ্যে সৎ-এর অর্থাৎ নশ্বর দৃশ্য জগতের (প্ৰথম) সম্বন্ধ ।
তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষাম্‌ অধঃ স্বিদাসীদুপরি স্বিদাসীৎ ৷
রেতোধা আসন্‌ মহিমান আসন্‌ স্বধা অবস্তাৎ প্ৰযতিঃ পরস্তাৎ ॥ ৫ ॥
৫ । (এই) রশ্মি বা সূত্র বা কিরণ ইহার মধ্যে অন্তরালরূপে প্রসারিত; এবং যদি বল যে ইহা নীচে ছিল তবে ইহা উপরেও ছিল । (ইহাদের ভিতর কিছু) রেতোধা অর্থাৎ বীজপ্ৰদ হয় এবং (বাড়িয়া) বড়ও হয় । তাহারই স্বশক্তি এদিকে ছিল এবং প্ৰযতি অর্থাৎ প্রভাব ওদিকে (ব্যাপ্ত) হইয়া থাকে । 
কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্ৰ বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ ৷
অর্বাগ্‌ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব ॥ ৬ ॥
৬ । (সৎ-এর) এই বিসর্গ অর্থাৎ বিস্তার কাহা হইতে বা কোথা হইতে আসিল - ইহা (ইহা অপেক্ষা অধিক) প্ৰ অৰ্থাৎ বিস্তারপূর্বক এখানে কে বলিবে ? কে ইহাকে নিশ্চিত জানে ? দেবতারাও এই (সৎ জগতের) বিসর্গের পরে হইল । আবার উহা যেখান হইতে নিঃসৃত হইল, তাহা কে জানিবে ?
ইয়ং বিসৃষ্টিৰ্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন ৷
যো অসাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্‌ সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ ॥ ৭ ॥
৭ । (সৎ-এর) এই বিসর্গ অর্থাৎ বিস্তার যেখান হইতে আসিয়াছে, কিংবা সৃষ্ট হইয়াছে বা হয় নাই, - তাহাই পরম আকাশে অবস্থিত এই জগতের যে অধ্যক্ষ (হিরণ্যগৰ্ভ), তিনিই জানেন; কিংবা না জানিতেও পারেন ! (কে বলিতে পারে) ?

চক্ষের বা সাধারণত সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের গোচর সবিকার ও বিনশ্বর নামরূপাত্মক নানা দৃশ্যের জালে বিজড়িত না থাকিয়া তাহার অতীত কোন এক ও অমৃত তত্ত্ব আছে ইহা জ্ঞানদৃষ্টিতে উপলব্ধি করাই সমস্ত বেদান্তশাস্ত্রের রহস্য । এই মাখনের গোলা পাইবার জন্যই উক্ত সূক্তের ঋষির বুদ্ধি একেবারেই দৌড়িয়া গিয়াছিল; ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, তাঁহার অন্তদৃষ্টি কত তীব্র ছিল ! মূলারম্ভে অর্থাৎ জগতের নানা পদার্থ অস্তিত্বে আসিবার পূর্বে যাহা কিছু ছিল তাহা সৎ বা অসৎ, মৃত্যু বা অমৃত, আকাশ বা জল, আলো বা অন্ধকার ছিল, ইত্যাদি অনেক প্ৰশ্নকারীদিগের সহিত বিবাদ করিতে না বসিয়া, উক্ত ঋষি সকলের পুরোভাগে ধাবমান হইয়া বলিলেন যে, সৎ ও অসৎ, মৰ্ত্ত্য ও অমৃত, অন্ধকার ও আলো, আচ্ছাদনকারী ও আচ্ছাদিত, সুখদাতা ও সুখভোক্তা, এই প্রকার দ্বৈতের পরস্পরসাপেক্ষ ভাষা দৃশ্য জগতের সৃষ্টির পরে হওয়ায়, জগতে এই দ্বন্দ্ব উৎপন্ন হইবার পূর্বে, অর্থাৎ এক ও দুই এই ভেদও যখন ছিল না, তখন কে কাহাকে আচ্ছাদিত করিত ? তাই এই সূক্তের ঋষি আরম্ভেই নিৰ্ভয়ে বলিতেছেন যে, মূলারম্ভের এক দ্রব্যকে সৎ বা অসৎ, আকাশ বা জল, আলো বা অন্ধকার, অমৃত বা মৃত্যু ইত্যাদি পরস্পরসাপেক্ষ কোন নাম দেওয়া উচিত নহে; যাহা কিছু ছিল তাহা এই সমস্ত পদার্থ হইতে ভিন্ন ছিল এবং তাহা একমাত্র একই চতুর্দিকে আপনার অপার শক্তিতে স্ফূৰ্ত্তিমান ছিল; তাহার জুড়ী কিংবা তাহার আচ্ছাদক অন্য কিছুই ছিল না । দ্বিতীয় ঋকে ‘আনীৎ’ এই ক্রিয়াপদের ‘অন্‌’ ধাতুর অর্থ শ্বাসোচ্ছাস গ্ৰহণ করা বা স্ফুরণ হওয়া, এবং ‘প্ৰাণ’ শব্দও সেই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে; কিন্তু যাহা না সৎ এবং না-অসৎ, তাহা সজীব প্রাণীর ন্যায় শ্বাসোচ্ছ্বাস গ্ৰহণ করিতেছিল, তাহা কে বলিতে পারে ? এবং শ্বাসোচ্ছ্বাস চলিবার জন্য তখন বায়ুই বা কোথায় ? তাই ‘আনীৎ’ এই পদের সঙ্গেই ‘অবাতং’ = বায়ুহীন, ও ‘স্বধয়া’ = আপনার নিজ মহিমাতে - এই দুই পদ জুড়িয়া “জগতের মূলতত্ত্ব জড় ছিল না” এই অদ্বৈতাবস্থার অর্থ দ্বৈতের ভাষায় খুব নিপুণভাবে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে যে, “তাহা এক বায়ু বিনা আপন শক্তিতেই শ্বাসোচ্ছ্বাস করিতেছিল কিংবা স্ফুরিত হইতেছিল” । ইহাতে বাহ্য দৃষ্টিতে যে বিরোধ দেখা যায়, তাহা দ্বৈতী ভাষার অপূর্ণতাপ্রযুক্ত উৎপন্ন হইয়াছে । “নেতি নেতি” “একমেবাদ্বিতীয়ম্‌” বা “স্বে মহিম্নি প্রতিষ্ঠিতঃ” [ছাং|৭|২৪|১] – আপনারই মহিমাতে অর্থাৎ অন্য কাহারও অপেক্ষা না রাখিয়া একাই অবস্থিত - ইত্যাদি পরব্রহ্মের যে বর্ণনা উপনিষদে আছে তাহাও উপরোক্ত অর্থেরই দ্যোতক । সমস্ত জগতের মূলারম্ভে চারিদিকে যে অনিৰ্বাচ্য তত্ত্ব স্ফূরিত ছিল বলিয়া এই সূক্তে উক্ত হইয়াছে, সমস্ত দৃশ্য জগতের প্ৰলয় হইলেও তাহাই নিঃসন্দেহ অবশিষ্ট থাকিবে । তাই গীতাতে “সমস্ত পদার্থের নাশ হইলেও যাহার নাশ হয় না” [গী|৮|২০], এইরূপ এই পরব্ৰহ্মেরই কোন পর্যায়ে বর্ণনা করা হইয়াছে; এবং পরে এই সূক্ত ধরিয়াই স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, “তাহা সৎও নহে, অসৎও নহে” [গী|১৩|১২] । কিন্তু প্রশ্ন এই যে, নির্গুণ ব্ৰহ্ম ব্যতীত মূলারম্ভে যদি অন্য কিছুই ছিল না তবে “আরম্ভে জল, অন্ধকার, বা আভু ও তুচ্ছ ইহাদের দ্বন্দ্ব ছিল” ইত্যাদি যে বৰ্ণনা বেদেতে আছে তাহার ব্যবস্থা কি হইবে ? তাই, তৃতীয় খকে কবি বলিতেছেন যে, জগতের আরম্ভে অন্ধকার ছিল কিংবা অন্ধকারে আবৃত জল ছিল, কিংবা আভু (ব্ৰহ্ম) ও তাঁহার আচ্ছাদনকারী মায়া (তুচ্ছ) এই দুই প্রথম হইতেই ছিল ইত্যাদি, ঐ সমস্ত যখন একমাত্র মূল পরব্রহ্মের তপমাহাত্ম্যে তাঁহার বিবিধ রূপে বিস্তার হইয়াছিল সেই সময়েরই — এইরূপ যত বৰ্ণনা তাহা মূলারম্ভের স্থিতিবিষয়ক নহে । এই ঋকে ‘তপ’ শব্দে মূল ব্রহ্মের জ্ঞানময় বিশেষ শক্তি বিবক্ষিত এবং তাহার বর্ণনা চতুর্থ ঋকে করা হইয়াছে [মুং|১|১|৯ দেখ] । “এতাবান্‌ অস্য মহিমাহতো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ” [ঋ|১০|৯০|৩] এই ন্যায় অনুসারে সমস্ত জগৎই যাহার মহিমা, সেই মূল দ্রব্য যে এই সমস্তের অতীত, সমস্ত হইতে শ্ৰেষ্ঠ ও ভিন্ন, তাহা আর বলিতে হইবে না । কিন্তু দৃশ্য বস্তু ও দ্রষ্টা, ভোক্তা ও ভোগ্য, আচ্ছাদক ও আচ্ছাদ্য, অন্ধকার ও আলো, মৃত্যু ও অমৃত ইত্যাদি সমস্ত দ্বৈতকে এই প্ৰকার পৃথক করিয়া এক অমিশ্ৰ চিদ্‌রূপী, অসাধারণ পরব্রহ্মই মূলারম্ভে ছিলেন ইহা নির্ধারণ করিলেও যখন ইহা বুঝাইবার সময় আসিয়াছে যে, এই অনির্বাচ্য নির্গুণ একমাত্ৰ এক তত্ত্ব হইতে আকাশ, জল প্ৰভৃতি দ্বন্দ্বাত্মক নশ্বর সগুণ নামরূপাত্মক বিবিধ সৃষ্টি কিংবা এই জগতের মূলভূত ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি কিরূপে উৎপন্ন হইল, তখন তো আমাদের উল্লিখিত ঋষিকেও মন, কাম, অসৎ ও সৎ এইরূপ দ্বৈতের ভাষাই প্রয়োগ করিতে হইয়াছে; এবং শেষে ঋষি স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছেন যে, এই প্রশ্ন মনুষ্যের বুদ্ধির সীমার বাহিরে । চতুর্থ ঋকে মূল ব্ৰহ্মকেই ‘অসৎ’ বলা হইয়াছে; কিন্তু তাহার অর্থ “কিছু নাই” ইহা গ্ৰহণ করিতে পারা যায় না; কারণ দ্বিতীয় ঋকেই ‘তাহা আছে’ এইরূপ স্পষ্ট বিধান আছে । শুধু এই সূক্তে নহে, কিন্তু অন্যত্রও দৃশ্য জগতের সহিত যজ্ঞের উপমা দিয়া এই যজ্ঞ করিবার ঘৃত, সমিধ প্রভৃতি সামগ্ৰী প্ৰথমে কোথা হইতে আসিল [ঋ|১০|১৩০|৩] ? কিংবা গৃহের দৃষ্টান্ত লইয়া মূল এক নির্গুণ হইতে চক্ষুর প্রত্যক্ষগোচর আকাশ পৃথিবীর এই বৃহৎ অট্টালিকা গঠন করিবার কাষ্ঠন (মূল প্ৰকৃতি) কোথা হইতে মিলিল ? - কিস্বিদ্বনং ক উ স বৃক্ষ আস যতো দ্যাবা পৃথিবী নিষ্টতক্ষুঃ, এইরূপ ব্যবহারিক ভাষা স্বীকার করিয়াই ঋগ্‌বেদ ও বাজসনেয়ীসংহিতায় কঠিন বিষয়সমূহের বিচার এই প্রকার প্ৰশ্ন দ্বারা করা হইয়াছে [ঋ|১০|৩১|৭; ১০|৮১|৪; বাজ সং|১৭|২৭] । সেই অনিৰ্বাচ্য একমাত্ৰ এক ব্ৰহ্মেরই মনে জগৎ সৃষ্টি করিবার ‘কাম’-রূপী তত্ত্ব কোন প্রকারে উৎপন্ন হইয়াছে, এবং বস্ত্রের সূত্রের ন্যায় কিংবা সূর্যালোকের ন্যায় তাহারই শাখা বাহির হইয়া নীচে উপর চারিদিকে প্রসারিত হইয়া সৎএর সমস্ত বিস্তার হইয়াছে অর্থাৎ আকাশপৃথিবী-রূপ এই বৃহৎ অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছে, উপরোক্ত সূক্তের চতুর্থ ও পঞ্চম ঋকে [বাজ সং|৩৩|৭৪ দেখ] এইরূপ যাহা উক্ত হইয়াছে, তাহা অপেক্ষা এই প্রশ্নের বেশী উত্তর দেওয়া যাইতে পারে না । এই সূক্তের অর্থও উপনিষদে আরও স্পষ্ট করা হইয়াছে - “সোহকাময়ত ৷ বহু স্যাং প্ৰজায়েয়েতি ৷” [তৈ|২|৬; ছাং|৬|২,৩] - সেই পরব্রহ্মেরই বহু হইবার ইচ্ছা হইল – [বৃ|১|৪ দেখ]; অথর্ববেদেও এইরূপ বর্ণনা আছে যে, এই সমস্ত দৃশ্য জগতের মূলভূত দ্রব্য হইতেই সর্ব প্ৰথমে ‘কাম’ উৎপন্ন হইল, [অথর্ব|৯|২|১৯] । কিন্তু এই সূক্তের বিশেষত্ব এই যে, নির্গুণ হইতে সগুণের, অসৎ হইতে সৎ-এর, নির্দ্বন্দ্ব হইতে দ্বন্দ্বের কিংবা অসঙ্গ হইতে সঙ্গের উৎপত্তির প্রশ্ন মানব-বুদ্ধির অগম্য বলিয়া সাংখ্যের ন্যায় কেবলমাত্র তর্কের বশীভূত হইয়া মূল প্রকৃতিকেই বা তাহার ন্যায় অন্য কোন তত্ত্বকে স্বয়ংভূ ও স্বতন্ত্র মানা হয় নাই; কিন্তু এই সূক্তের ঋষি প্ৰতিপাদন করিতেছেন যে, “যাহা বুঝা যায় নাই, স্পষ্ট বল যে তাহা বুঝা যায় নাই; কিন্তু সেই জন্য শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা ও আত্মপ্ৰতীতির দ্বারা অবধারিত অনির্বাচ্য ব্ৰহ্মের যোগ্যতাকে দৃশ্য জগৎরূপ মায়ার উপর আরোপ করিয়া পরব্রহ্মসম্বন্ধে অদ্বৈত বুদ্ধি ছাড়িয়া দেওয়া ন্যায্য নহে !” তাছাড়া, ইহা দেখিতে হইবে যে, প্রকৃতিকে এক স্বতন্তু ত্রিগুণাত্মক ভিন্ন পদাৰ্থ বলিয়া মানিলেও তাহাতে জগৎ সৃষ্টি করিবার জন্য বুদ্ধি (মহান) বা অহঙ্কার প্রথমে কি করিয়া উৎপন্ন হইল, এই প্রশ্নের উত্তর তো দেওয়া যায় না । এবং এই দোষ যখন কিছুতে এড়ানো যায় না, তখন প্রকৃতিকে আবার স্বতন্ত্র বলিয়া মানিলেই বা কি লাভ ? মূল ব্ৰহ্ম হইতে সৎ অর্থাৎ প্ৰকৃতি কিরূপে উৎপন্ন হইল তাহা জানা যায় না এইটুকুই বল । ইহার জন্য প্রকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া মানিবার কোনই আবশ্যকতা নাই । মানববুদ্ধির কথা দূরে থাক্‌, সৎ-এর উৎপত্তি কিরূপে হইল, দেবতারাও তাহা জানিতে পারেন না । কারণ দেবতারাও দৃশ্য জগৎ আরম্ভ হইবার পর উৎপন্ন হওয়ায়, তাহার পুর্বের ব্যাপার তাহারা কি প্রকারে জানিবেন ? [গী|১০|২ দেখ] । কিন্তু দেবতাদের অপেক্ষাও হিরণ্যগৰ্ভ অনেক প্রাচীন ও শ্ৰেষ্ঠ এবং ঋগ্‌বেদেই উক্ত হইয়াছে যে, একমাত্ৰ তিনিই আরম্ভে “ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ” [ঋ|১০|১২১|১] - সমস্ত জগতের ‘পতি’ অর্থাৎ ‘রাজা’ বা অধ্যক্ষ ছিলেন । তখন তিনি এই বিষয় জানিতে পারিবেন না কেন ? এবং তিনি যদি জানিয়া থাকেন, তবে উহা দুৰ্ব্বোধ কেন বলিতেছ, এইরূপ কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন । তাই, এই সূক্তের ঋষি প্ৰথমে তো উক্ত প্রশ্নের এই ঔপচারিক উত্তর দিলেন যে, -“হাঁ; তিনি এই বিষয় জানিয়া থাকিবেন”; কিন্তু আপনি বুদ্ধির দ্বারা ব্ৰহ্মদেবেরও জ্ঞানের গভীরতা-দ্ৰষ্টা এই ঋষি আশ্চর্য হইয়া শেষে সভয়ে তখনই আবার বলিয়াছেন যে, “অথবা নাও জানিতে পারেন ! কে বলিবে ? কারণ তিনিও সৎএর শ্রেণীতে পড়ায়, ‘পরম’ বলা হইলেও ‘আকাশের’ মধ্যেই অবস্থিত জগতের এই অধ্যক্ষের সৎ, অসৎ, আকাশ ও জল ইহাদেরও পূৰ্ববৰ্ত্তী বিষয়সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান কোথা হইতে আসিবে ?” কিন্তু এক ‘অসৎ’ অর্থাৎ অব্যক্ত ও নির্গুণ দ্রব্যেরই সহিত বিবিধ নামরূপাত্মক সৎ-এর অর্থাৎ মূলপ্ৰকৃতির সম্বন্ধ কিরূপে স্থাপিত হইল ইহা বুঝা না গেলেও মূলব্ৰহ্ম যে একই সে বিষয়ে ঋষি নিজের অদ্বৈতবুদ্ধিকে অপসারিত হইতে দেন নাই । এ বিষয়ে এই একটী উৎকৃষ্ট উদাহরণ যে, অচিন্ত্য বস্তুর গহন-অরণ্যে মানববুদ্ধি, সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা ও নির্মল প্রতিভার বলে সিংহের ন্যায় নির্ভয়ে বিচরণ করিয়া সেখানে তর্কের অতীত বিষয় যথাশক্তি কেমন নির্ধারণ করিয়া থাকে ! ঋগ্‌বেদে যে এইরূপ সূক্ত পাওয়া যায় ইহা বাস্তবিকই আশ্চর্য ও গৌরবের বিষয় ! এই সুক্তান্তৰ্গত বিষয়সম্বন্ধে পরে আমাদের দেশে ব্ৰাহ্মণে [তৈত্তি ব্ৰা|২|৮|৯], উপনিষদে, এবং তাহার পরে বেদান্তশাস্ত্ৰবিষয়ক গ্রন্থে সূক্ষ্মভাবে বিচার করা হইয়াছে । এবং আধুনিককালে পাশ্চাত্য দেশেও কাণ্ট প্রভৃতি তত্ত্বজ্ঞানী কর্তৃক ঐ বিষয়েরই অনেক সূক্ষ্ম আলোচনা করা হইয়াছে । কিন্তু মনে রেখো যে, এই সূক্তের ঋষির শুদ্ধ বুদ্ধিতে যে পরম সিদ্ধান্তের স্ফুরণ হইয়াছে সেই সিদ্ধান্তই পরে প্রতিপক্ষকে বিবৰ্ত্তবাদের ন্যায় সমুচিত উত্তর প্রদান করিয়া আরও দৃঢ়, স্পষ্ট কিংবা তর্কদৃষ্টিতে নিঃসন্দেহ করিয়াছে — ইহার পরে এখনও কেহ অগ্রসর হইতে সমর্থ হয় নাই, সমর্থ হইবে বলিয়া অধিক আশাও নাই ।


38) পূর্বাপর প্রকরণের সঙ্গতি


অধ্যাত্মপ্রকরণ সমাপ্ত হইল ! এক্ষণে অগ্ৰে চলিবার পূর্বে ‘কেসরী’র অনুকরণে যে রাস্তা ধরিয়া এতক্ষণ চলা গেল তাহার প্রতি আর একবার কটাক্ষপাত করা উচিত । কারণ, এইরূপ সিংহাবলোকন না করিলে, প্ৰকৃত বিষয়ানুসন্ধান হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া অন্য পথে বিচরণ করিবার সম্ভাবনা থাকে । গ্রন্থের আরম্ভে পাঠককে বিষয়ের মধ্যে প্ৰবেশ করাইয়া দিয়া কর্মজিজ্ঞাসার স্বরূপ সংক্ষেপে বলিয়া তৃতীয় প্রকরণে কর্মযোগশাস্ত্ৰই গীতার যে মূখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় তাহা দেখান হইয়াছে । অনন্তর, চতুৰ্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রকরণে সুখদুঃখবিচারপূর্বক প্রতিপাদন করা হইয়াছে যে, এই শাস্ত্রের আধিভৌতিক উপপত্তি একদেশদর্শী ও অপূর্ণ, এবং আধিদৈবিক উপপত্তি খঞ্জ । আবার কর্মযোগের আধ্যাত্মিক উপপত্তি বলিবার পূর্বে, আত্মা কি তাহা জানিবার জন্য ষষ্ঠ প্রকরণে প্ৰথমেই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার এবং পরে সপ্তম ও অষ্টম প্রকরণে সাংখ্যশাস্ত্ৰাৰ্গত দ্বৈতমতের ক্ষরাক্ষরবিচার করা হইয়াছে । আবার এই প্রকরণে আসিয়া আত্মার স্বরূপ কি এবং পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ডে দুইদিকে একই অমৃত ও নির্গুণ আত্মতত্ত্ব কিরূপে ওত-প্রোত ও পরিপূর্ণ হইয়া আছে তাহার নিরূপণ করিয়াছি । এই প্রকার এখানে ইহাও নির্ধারণ করা হইয়াছে যে, সর্বভূতে একই আত্মা - এই সমবুদ্ধিযোগ সম্পাদনা করিয়া তাহা সর্বদাই জাগৃত রাখাই আত্মজ্ঞান ও আত্মসুখের পরাকাষ্ঠা; এবং আরও বলা গিয়াছে যে, নিজের বুদ্ধিকে এইরূপ শুদ্ধ আত্মনিষ্ঠাবস্থায় আনাতেই মনুষ্যের মনুষ্যত্ব অর্থাৎ নরদেহের সার্থকতা বা মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ । এই প্ৰকার মানবজাতির আধ্যাত্মিক পরমসাধ্যের নির্ণয় হইলে পর, সংসারে আমাদের যে ব্যবহার করিতে হয় তাহা কি ভাবে করিতে হইবে, কিংবা যে শুদ্ধ বুদ্ধিতে এই ব্যবহার করিতে হইবে তাহার স্বরূপ কি - এই যে কর্মযোগশাস্ত্রের মুখ্য প্রশ্ন তাহারও মীমাংসা সহজ হইয়া পড়ে । কারণ এই সমস্ত ব্যবহার পরিণামে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ সমবুদ্ধির পোষক, কিংবা অবিরোধীভাবে যে করিতে হইবে ইহা আর এক্ষণে বলিতে হইবে না । কর্মযোগের এই আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ভগবদ্‌গীতায় অর্জুনকে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু কর্মযোগের প্ৰতিপাদন কেবল ইহাতেই শেষ হয় না । কারণ কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, নামরূপাত্মক জগতের ব্যবহার আত্মজ্ঞানের বিরুদ্ধ হওয়ায় তাহা জ্ঞানীপুরুষের ত্যাগ করা উচিত; এবং ইহাই যদি সত্য হয়, তবে জগতের সমস্ত ব্যবহার ত্যাজ্য নির্ধারিত হইবে এবং কর্মাকর্মশাস্ত্ৰও নিরর্থক হইবে ! তাই এই বিষয়ের নির্ণয় করিবার জন্য কর্মের নিয়ম কি, ও তাহার পরিণাম কি, অথবা বুদ্ধি শুদ্ধ হইলেও ব্যবহার অর্থাৎ কর্ম কেন করিতে হইবে ইত্যাদি প্রশ্নেরও কর্মযোগশাস্ত্রে অবশ্য বিচার করা আবশ্যক । ভগবদ্‌গীতাতে তাহারও বিচার করা, হইয়াছে । সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোকেরা এই প্রশ্নের কোনই গুরুত্ব উপলব্ধি না করায় ভগবদ্‌গীতার বেদান্ত বা ভক্তিবিষয়ক নিরূপণ শেষ হইতে না হইতেই, তাঁহারা আপন পুঁথি গুটাইতে প্ৰায় শুরু করিয়া দেন । কিন্তু সেরূপ করিলে আমার মতে গীতার মুখ্য অভিপ্ৰায়ের প্রতি উপেক্ষা করা হয় । এইজন্য ভগবদ্‌গীতায় উক্ত প্রশ্নের কি উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে এক্ষণে ক্রমশঃ তাহার আলোচনা করিব ।

কর্মবিপাক ও আত্মস্বাতন্ত্র্য (Effect of Karma and Freedom of Will)

কর্ম্মণা বধ্যতে জন্তু বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে ৷ [মভা|শান্তি |২৪0|৭]

(“কর্ম দ্বারা জীব বদ্ধ হয় এবং বিদ্যার দ্বারা তাহার মুক্তি হয়” ।)

1) মায়াসৃষ্টি ও ব্রহ্মসৃষ্টি


এই জগতে যাহা কিছু আছে তাহা পরব্রহ্মই, পরব্রহ্ম ব্যতীত স্বতন্ত্র অন্য কিছু নাই, এই সিদ্ধান্ত পরিণামে সত্য হইলেও মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়-গোচর দৃশ্যজগতের পদার্থসমূহ অধ্যাত্মশাস্ত্রের চালুনী দিয়া সংশোধন করিতে গেলে উক্ত পদাৰ্থ সকলের ইন্দ্ৰিয়প্ৰত্যক্ষ কিন্তু চিরবর্তনশীল সুতরাং অনিত্য নামরূপাত্মক আবির্ভাব, এবং সেই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত অদৃশ্য “অথচ নিত্য পরমাত্মতত্ত্ব, এইরূপ নিত্য-অনিত্য-রূপী দুই বিভাগ হইয়া যায় । রসায়নশাস্ত্ৰে কোন পদার্থের বিশ্লেষণ করিয়া তাহার উপাদান দ্রব্য যেরূপ পৃথকরূপে বাহির করা হয় সেই প্ৰকার এই দুই বিভাগকে চক্ষের সম্মুখে পৃথকরূপে স্থাপন করা যাইতে পারে না সত্য । কিন্তু জ্ঞানদৃষ্টিতে সেই দুইকে পৃথক করিয়া শাস্ত্রীয় উপপত্তির সুবিধার জন্য উহাদিগকে অনুক্রমে ‘ব্ৰহ্ম’ ও ‘মায়া’ এবং কখন কখন ‘ব্ৰহ্ম-জগৎ’ ও ‘মায়াজগত’ এইরূপ নাম দেওয়া হইয়া থাকে । তথাপি ইহা যেন মনে থাকে, ব্ৰহ্ম মূলেই নিত্য ও সত্য হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার সঙ্গে ‘জগৎ’ শব্দ এইরূপ প্রসঙ্গে অনুপ্রাসার্থ প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । ‘ব্ৰহ্ম-জগৎ’ এই শব্দের দ্বারা, ব্ৰহ্মকে কেহ উৎপন্ন করিয়াছে, এরূপ বুঝিতে হইবে না । এই দুই জগতের মধ্যে, দেশকালাদি নামরূপের দ্বারা অনাবদ্ধ অনাদি নিত্য, অবিনাশী, অমৃত, স্বতন্ত্র, এবং সমস্ত দৃশ্য জগতের আধারভুত হইয়া তাহার অন্তৰ্যামীরূপে অবস্থিত ব্ৰহ্মজগতে জ্ঞানচক্ষু দ্বারা বিচরণ করিয়া, আত্মার শুদ্ধ স্বরূপ কিংবা আপনার পরম সাধ্যের বিচার পূর্ব প্রকরণে করা হইয়াছে; এবং বস্তুত বলিতে গেলে শুদ্ধ অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ ঐখানে শেষ হইয়াছে । কিন্তু মনুষ্যের আত্মা মূলে ব্ৰহ্মজগতের হইলেও দৃশ্যজগতের অন্য বস্তুর ন্যায় তাহাও নামরূপাত্মক দেহেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং এই দেহেন্দ্ৰিয়াদি নামরূপ নশ্বর হওয়ায় তাহা হইতে মুক্ত হইয়া অমৃতত্ব কিরূপে প্ৰাপ্ত হইবে, ইহাই প্ৰত্যেক মনুষ্যের স্বাভাবিক ইচ্ছা হয় । এবং সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিবার জন্য মনুষ্য কিরূপ আচরণ করিবে, কর্মযোগশাস্ত্রের এই বিষয়ের বিচারার্থ, কর্মের নিয়মে বদ্ধ, অনিত্য মায়া-জগতের দ্বৈতী রাজ্যেও আমাদিগকে প্ৰবেশ করিতে হইবে । পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ড, দুয়েরই মূলে যদি একই নিত্য ও স্বতন্ত্র আত্মা থাকে তবে পিণ্ডের অর্থাৎ শরীরের আত্মাকে ব্ৰহ্মাণ্ডের আত্মা বলিয়া জানায় কি বাধা আছে, এবং তাহা কিরূপে দূর হইতে পারে, এই প্রশ্ন সহজেই উত্থিত হয় । এ প্রশ্ন নিরসন করিতে হইলে নামরূপের বিচার করা আবশ্যক হয় । কারণ, বেদান্তদৃষ্টিতে আত্মা কিংবা পরমাত্মা এবং তৎসম্বন্ধীয় নামরূপের আবরণ, সমস্ত পদার্থ এই দুই বর্গে বিভক্ত হওয়ায়, নামরূপাত্মক আবরণ ব্যতীত এক্ষণে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । নামরূপের এই আবরণ কোন স্থানে ঘন, কোন স্থানে তরল হওয়া প্ৰযুক্ত দৃশ্যজগতের পদার্থসমূহের মধ্যে সচেতন ও অচেতন, এবং সচেতনের মধ্যেও পশু, পক্ষী, মনুষ্য, দেব, গন্ধর্ব, রাক্ষস ইত্যাদি ভেদ হয়, - বেদান্তের এইরূপ মত । আত্মারূপী ব্ৰহ্ম কোথাও নাই এরূপ নহে । ব্রহ্ম প্রস্তরের মধ্যেও আছেন, মনুষ্যের মধ্যেও আছেন । কিন্তু দীপ একই হইলেও লোহার ভিতর কিংবা ন্যূনাধিক স্বচ্ছ কাচের লন্ঠনের মধ্যে রক্ষিত হইলে তাহার যেরূপ ভেদ হইয়া থাকে সেইরূপ আত্মতত্ত্ব সর্বত্র একই হইলেও তৎসম্বন্ধীয় কোষের অর্থাৎ নামরূপাত্মক আবরণের তারতম্যভেদে অচেতন ও সচেতন এই ভেদ হইয়া থাকে । অধিক কি, সচেতনের মধ্যেও মনুষ্য ও পশুর জ্ঞানসম্পাদনা করিবার সমান সামর্থ্য কেন নাই, উহাই তাহার কারণ । 


2) দেহের কোষ ও কর্মাশ্রয়ীভূত লিঙ্গশরীর


আত্মা সর্বত্র একই সত্য; তথাপি তাহা মূলে নির্গুণ ও উদাসীন হওয়ায় মন, বুদ্ধি প্ৰভৃতি নামরূপাত্মক সাধন ব্যতীত আপনা হইতে কিছুই করিতে পারে না; এবং এই সকল সাধন মনুষ্য-যোনি ব্যতীত অন্যত্র পূর্ণরূপে না থাকায়, মনুষ্যজন্ম সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া উক্ত হইয়াছে । এই শ্রেষ্ঠ জন্ম লাভ হইলে, আত্মার নামরূপাত্মক আবরণের স্থূল ও সূক্ষ্ম এই দুই ভেদ হইয়া থাকে । তন্মধ্যে স্থূল আবরণ মনুষ্যের শুক্ৰশোণিতাত্মক স্থূল দেহই । শুক্র হইতে পরে স্নায়ু, অস্থি ও মজ্জা এবং শোণিত হইতে ত্বক, মাংস ও কেশ উৎপন্ন হয়, এইরূপ মানিয়া এই সমস্তকে বেদান্তী ‘অন্নময় কোষ’ বলেন । এই স্থূল কোষ ছাড়িয়া তাহার ভিতরে কি আছে দেখিলে, অনুক্ৰমে বায়ুরূপী প্ৰাণ অর্থাৎ ‘প্ৰাণময় কোষ’, মন অর্থাৎ ‘মনোময় কোষ’, বুদ্ধি অর্থাৎ ‘জ্ঞানময় কোষ’ ও শেষে ‘আনন্দময় কোষ’ পাওয়া যায় । আত্মা তাহারও অতীত । তাই তৈত্তিরীয় উপনিষদে, অন্নময় কোষ হইতে উর্ধে উঠিতে উঠিতে, শেষে আনন্দময় কোষের কথা বলিয়া, বরুণ ভৃগুকে আত্মস্বরূপের পরিচয় করাইয়া দিয়াছেন [তৈ|২|১-৫; ৩|২-৬] । এই সমস্ত কোষের মধ্যে স্থূলদেহের কোষ ছাড়িয়া অবশিষ্ট প্ৰাণাদি কোষ, সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়াদি ও পঞ্চতন্মাত্রকে বেদান্তী ‘লিঙ্গ’ কিংবা ‘সূক্ষ্ম শরীর’ বলেন । তাঁহারা ‘একই আত্মার বিভিন্ন যোনিতে কিরূপে জন্ম লাভ হয়’ সাংখ্য শাস্ত্রের ন্যায় বুদ্ধির অনেক ‘ভাব’ মানিয়া ইহার উপপত্তি করেন না; তাহার বদলে এই সমস্ত কর্মবিপাকের কিংবা কর্মফলের পরিণাম, - ইহাই বেদান্তের সিদ্ধান্ত । এই কর্ম লিঙ্গশরীরের আশ্রয়ে অর্থাৎ আধারে অবস্থিতি করে, এবং আত্মা স্থূলদেহ ছাড়িয়া গেলে এই কর্মও লিঙ্গশরীর দ্বারা তাহার সঙ্গে গিয়া আত্মাকে পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন জন্ম গ্ৰহণ করায়, এইরূপ গীতাতে, বেদান্তসূত্রে ও উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তাই, নামরূপাত্মক জন্মমরণের পুনরাবৃত্তি হইতে মুক্ত হইয়া নিত্য পরমেশ্বরস্বরূপী হইবার পক্ষে কিংবা মোক্ষলাভের পক্ষে দেহস্থ আত্মার প্রতিবন্ধক কি ইহার বিচার করিবার সময় লিঙ্গশরীর ও কর্ম এই দুয়েরই বিচার করা আবশ্যক হয় । তন্মধ্যে সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুইয়ের দৃষ্টিতেই পূর্বেই লিঙ্গশরীরের বিচার করা হইয়াছে; সুতরাং ইহার পুনরালোচনা এখানে করিব না । 


3) কর্ম, নামরূপ ও মায়ার পারস্পরিক সম্বন্ধ


যে কর্মের দরুণ আত্মার ব্ৰহ্মজ্ঞান না হইয়া অনেক জন্মের ফেরে পড়িতে হয় সেই কর্মের স্বরূপ কি এবং তাহা হইতে মুক্ত হইয়া অমৃতত্ব লাভ করিবার জন্য এই জগতে মনুষ্যের কিরূপ আচরণ করা উচিত, এই প্রকরণে তাহাই বিচার করিয়াছি ।

সৃষ্টির আরম্ভকালে মূল অব্যক্ত ও নির্গুণ পরব্ৰহ্ম যে-দেশকালাদি নানারূপাত্মক সগুণ শক্তি দ্বারা ব্যক্ত অর্থাৎ দৃশ্যজগৎরূপে প্ৰতীয়মান হয় বেদান্তশাস্ত্ৰে তাহারই নাম ‘মায়া’ [গী|৭|২৪,২৫]; এবং তাহার মধ্যে কর্মেরও সমাবেশ হয় [বৃ|১|৬|১] । অধিক কি, ‘মায়া’ ও ‘কর্ম’ দুই-ই সমানার্থক বলিলেও চলে । কারণ, প্ৰথমে কোন-না-কোন কর্ম অৰ্থাৎ, ব্যাপার হওয়া ব্যতীত অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া কিংবা নির্গুণের সগুণ হওয়া সম্ভব নহে । এইজন্য আমি আমার মায়া দ্বারা প্ৰকৃতিতে জন্মিয়া থাকি [গী|৪,৬], প্ৰথমে ইহা বলিয়া পরে অষ্টম অধ্যায়ে গীতাতেই “অক্ষর পরব্রহ্ম হইতে পঞ্চমহাভূতাদি বিবিধ সৃষ্টি হইবার যে ক্রিয়া তাহাই কর্ম” এইরূপ কর্মের লক্ষণ প্রদত্ত হইয়াছে [গী|৮|৩] । 


3a) কর্ম ও মায়ার ব্যাখ্যা


কর্ম অর্থে ব্যাপার কিংবা ক্রিয়া; কিন্তু তাহা মনুষ্যকৃতই হউক, জগতের অন্য পদার্থেরই ক্রিয়া হউক, অথবা মূল জগৎ উৎপন্ন হইবারই হউক - এইরূপ ব্যাপক অর্থ এই স্থানে বিবক্ষিত । কিন্তু যে কোন কর্মই ধর না কেন, তাহার পরিণাম সর্বদা ইহাই হয় যে, এক প্রকারের নামরূপ বদলাইয়া তাহার স্থানে অন্য নামরূপ করা; কারণ, এই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত মূল দ্রব্য কখন বদলায় না, - একই রকম থাকে । উদাহরণ যথা – বয়নক্রিয়া দ্বারা ‘সুতা’ এই নাম গিয়া সেই দ্রব্যের নাম হয় ‘বস্ত্র’; এবং কুম্ভকারী ব্যাপারে ‘মাটি’ এই নামের বদলে ‘ঘট’ এই নাম হয় । তাই মায়ার ব্যাখ্যা করিবার সময় কর্মকে ছাড়িয়া দিয়া নাম ও রূপ এই দুইকেই কেহ কেহ ‘মায়া’ বলেন । তথাপি যখন কর্মের স্বতন্ত্র বিচার করিতে হয় তখন কর্মস্বরূপ ও মায়াস্বরূপ একই, তাহা বলিবার সময় উপস্থিত হয় । তাই মায়া, নামরূপ ও কর্ম, এই তিনিই মূলে একস্বরূপই, - ইহা আরম্ভেই বলা অধিক সুবিধা । উহার মধ্যেও এই সূক্ষ্মভেদ করা যাইতে পারে, যে, মায়া একটি সামান্য শব্দ; এই মায়ার আবির্ভাবের বিশিষ্টাৰ্থক নাম “নামরূপ” এবং মায়ার ব্যাপারের বিশিষ্টাৰ্থক নাম “কর্ম” । কিন্তু সাধারণতঃ এই ভেদ দেখাইবার আবশ্যকতা না থাকায়, তিন শব্দকেই অনেক সময় সমান অর্থে প্রয়োগ করা হইয়া থাকে । 


4) মায়ার মূল অগম্য - অতএব মায়াত্মক কর্মও অনাদি


পরব্রহ্মের এক অংশের উপর নশ্বর মায়ার এই যে আচ্ছাদন (কিংবা উপাধি = উপরে স্থাপিত আবরণ) আমাদের চোখে দেখা যায় তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি’ বলে । সাংখ্যবাদী পুরুষ ও প্ৰকৃতি এই দুই তত্ত্বকে স্বয়ম্ভু, স্বতন্ত্র ও অনাদি বলিয়া মানেন । কিন্তু মায়া, নামরূপ কিংবা কর্ম, ক্ষণপরিবর্তনশীল হওয়ায় উহাকে নিত্য ও অবিনাশী পরব্রহ্মের ন্যায় স্বয়ম্ভু ও স্বতন্ত্র বলিয়া মানা ন্যায়দৃষ্টিতে অসঙ্গত । কারণ, নিত্য ও অনিত্য এই দুই কল্পনা পরস্পরবিরুদ্ধ হওয়ায়, দুয়ের অস্তিত্ব একই সময়ে স্বীকার করা যায় না । তাই বেদান্তীরা নির্ধারণ করিয়াছেন যে, বিনাশী প্ৰকৃতি কিংবা কর্মাত্মক মায়া স্বতন্ত্র নহে; কিন্তু এক নিত্য সর্বব্যাপী ও নির্গুণ পরব্রহ্মেতেই মনুষ্যের দুর্বল ইন্দ্ৰিয় সমূহ মায়া-দৃশ্য দর্শন করে । 

কিন্তু মায়া পরতন্ত্র এবং পরব্রহ্মেতেই এই মায়াদৃশ্য দেখা যায় বলিলেই সমস্ত কথার মীমাংসা হয় না । গুণপরিণামে না হইলেও বিবর্তবাদে নির্গুণ ও নিত্য ব্ৰহ্মেতে নশ্বর সগুণ নামরূপের অর্থাৎ মায়ার রূপ দেখা সম্ভব হইলেও এখানে এই আর এক প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে, মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়গোচর এই সগুণ রূপ, নিগুৰ্ণ পরব্রহ্মের মধ্যে মূলারম্ভে, কিরূপ অনুক্রমে, কখন্‌ ও কেন প্ৰকাশ পাইল ? অথবা এই অর্থই ব্যবহারিক ভাষায় বলিতে হইলে, নিত্য ও চিদরূপী পরমেশ্বর, নামরূপাত্মক বিনাশী ও জড় জগৎ কখন্‌ ও কেন উৎপন্ন করিলেন ? কিন্তু ঋগবেদের নাসদীয় সূক্তের বর্ণনানুসারে এই বিষয় শুধু মনুষ্যের নহে, দেবতা ও বেদেরও অগম্য হওয়ায় [ঋ|১০|১২৯; তৈ ব্ৰা|২|৮|৯], এই প্রশ্নের - “জ্ঞানদৃষ্টিতে নির্ধারিত নির্গুণ পরব্রহ্মেরই ইহা এক অচিন্ত্য লীলা” - ইহা অপেক্ষা বেশী কোন উত্তর দেওয়া যায় না [বেসূ|২|১|৩৩] । যখন অবধি দেখিতেছি তখন অবধিই নির্গুণ ব্ৰহ্মের সঙ্গে সঙ্গেই নামরূপাত্মক নশ্বর কর্ম কিংবা সগুণ মায়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছে - এইরূপ গোড়ায় ধরিয়া লইয়াই আমাকে অগ্রসর হইতে হইবে । এইজন্য মায়াত্মক কর্ম অনাদি এইরূপ বেদান্ত-সূত্রে উক্ত হইয়াছে [বেসূ|২|১, ৩৫-৩৭]; ভগবদ্‌গীতাতেও ভগবান, প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা ‘আমারই মায়া’ [গী|৭|১৪] এইরূপ বর্ণনা করিয়া পরে এই প্ৰকৃতি অর্থাৎ মায়া ও পুরুষ উভয়ই ‘অনাদি’ বলিয়াছেন [গী|১৩|১৯] । 

সেইরূপ আবার শ্ৰীশঙ্করাচার্য আপন ভাষ্যে মায়ার লক্ষণ দিবার সময় বলিয়াছেন যে, “সর্বজ্ঞেশ্বরস্যাহত্মভুতে ইবাহবিদ্যাকল্পিতে নামরূপে তত্ত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীয়ে সংসারপ্ৰপঞ্চবীজভুতে সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্য ‘মায়া’, ‘শক্তি’, ‘প্রকৃতি’রিতি চ শ্রুতিস্মৃত্যোরভিলপ্যেতে” [বেসূ|শাং ভা|২|১|১৪] । “(ইন্দ্রিয়গণের) অজ্ঞানবশত মূলব্ৰহ্মেতে কল্পিত নামরূপকেই শ্রুতি ও স্মৃতি গ্রন্থে সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ‘মায়া’ ‘শক্তি’ কিংবা ‘প্রকৃতি’ বলা হয়”; এই নামরূপ সর্বজ্ঞ পরমেশ্বরের আত্মভূত দ্বারা জানা যায়, কিন্তু ইহা জড় হওয়া প্রযুক্ত ইহা পরমেশ্বর হইতে ভিন্ন বা অভিন্ন (তত্ত্বান্যত্ব), এবং ইহাই জড় জগতের (দৃশ্য) বিস্তারের মূল, তাহা বলিতে পারা যায় না”; এবং “এই মায়ার যোগেই পরমেশ্বর হইতে এই জগত সৃষ্ট হইয়াছে এইরূপ দেখা যায় বলিয়া এই মায়া নশ্বর হইলেও দৃশ্য জগতের উৎপত্তির পক্ষে আবশ্যক ও অত্যন্ত উপযুক্ত এবং ইহাকেই উপনিষদে অব্যক্ত, আকাশ, অক্ষর, এই সকল নাম দেওয়া হইয়াছে” [বেসূ|শাং ভা|১|৪|৩] । ইহা হইতে দেখিতে পাওয়া যায় যে চিন্ময় (পুরুষ) ও অচেতন মায়া (প্রকৃতি), এই দুই তত্ত্বকে সাংখ্যবাদী স্বয়ম্ভূ, স্বতন্ত্র ও অনাদি বলিয়া মানেন; কিন্তু বেদান্তী মায়ার অনাদিত্ব একভাবে স্বীকার করিলেও মায়াকে স্বয়ম্ভূ ও স্বতন্ত্র স্বীকার করেন না; এবং এই কারণে সংসারাত্মক মায়াকে বৃক্ষরূপে বর্ণনা করিবার সময় এইরূপ গীতায় উল্লেখ আছে - “ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো নচাদির্ন চ সংপ্ৰতিষ্ঠা” [গী|১৫|৩] - এই সংসারবৃক্ষের রূপ, অন্ত, আদি, মূল কিংবা তল পাওয়া যায় না । সেইরূপ তৃতীয় অধ্যায়ে ‘কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি’ [গী|৩|১৫] ব্ৰহ্ম হইতে কর্ম উৎপন্ন হইয়াছে ; ‘যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ’ [৩|১৪] যজ্ঞও কর্ম হইতেই উৎপন্ন হয়; কিংবা ‘সহযজ্ঞাঃ প্ৰজাঃ সৃষ্ট্বা’ [গী|৩|১০] ব্ৰহ্মদেব প্ৰজা (জগৎ) ও যজ্ঞ (কর্ম) একসঙ্গেই সৃষ্টি করিয়াছেন - এইরূপ যে বৰ্ণনা আছে তাহার তাৎপর্যও এই যে, “কর্ম কিংবা কর্মরূপী যজ্ঞ, জগৎ অর্থাৎ প্ৰজা, এই সমস্ত এক সঙ্গেই সৃষ্ট হইয়াছে” । এখন এই জগৎ প্ৰত্যক্ষ ব্ৰহ্মদেব হইতে সৃষ্ট হইয়াছেই বলো কিংবা মীমাংসকের মতানুসারে সেই ব্ৰহ্মদেব নিত্য বেদশব্দ হইতে উহা উৎপন্ন করিয়াছেনই বলো, উভয়ের অর্থ একই [মভা শাং|২৩১; মনু|১|২১] । সারকথা, কর্ম অর্থে দৃশ্য জগতের সৃষ্টি হইবার সময় মূল নির্গুণ ব্রহ্মেতেই দৃশ্যমান ব্যাপার । এই ব্যাপারকেই নামরূপাত্মক মায়া বলা হয়; এবং এই মূলকর্ম হইতেই চন্দ্ৰসূর্যাদি জাগতিক সমস্ত পদার্থের ব্যাপার পরে পরম্পরাক্রমে উৎপন্ন হইয়াছে [বৃ|৩|৮|৯] । জাগতিক সমস্ত ব্যাপারের মূলভূত এই যে জগৎ উৎপত্তিকালের কর্ম কিংবা মায়া তাহা ব্ৰহ্মেরই কোন এক অচিন্ত্য লীলা, স্বতন্ত্র বস্তু নহে, এইরূপ জ্ঞানীপুরুষেরা বুদ্ধির দ্বারা নিরূপণ করিয়াছেন । [“What belongs to mere appearance is necessarily subordinated to the nature of the thing in itself”. Kant's Metaphysics of Morals (Abbot's translation, in Kant's “Theory of Ethics” P.81)]

কিন্তু জ্ঞানের গতি এখানে বাধিত হওয়া প্ৰযুক্ত এই লীলা, নামরূপ কিংবা মায়াত্মক কর্ম ‘কখন্‌’ উৎপন্ন হইয়াছে তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না । তাই, কেবল কর্মজগতেরই বিচার যখন করিতে হইবে, তখন এই পরতন্ত্র ও নশ্বর মায়া এবং মায়ার সঙ্গে সঙ্গে তদঙ্গভূত কর্মকেও ‘অনাদি’ বলা বেদান্তশাস্ত্রের রীতি [বেসূ|২|১|৩৫] । ইহা মনে রাখা আবশ্যক - যে, সাংখ্যবাদীর ন্যায় অনাদি বলিবার এরূপ অর্থ নহে যে, মায়া মূলেতেই পরমেশ্বরের সমানই নিরারম্ভ ও স্বতন্ত্র; - অনাদি শব্দে দুর্জ্ঞেয়ারম্ভ আর্থাৎ যাহার আদি (আরম্ভ) জানা যায় না, এইরূপ অর্থ এই স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে । 


5) কর্মের অখণ্ডিত প্রযত্ন - কর্মবিপাক


কিন্তু চিদ্‌রূপ ব্ৰহ্ম কর্মাত্মক অর্থাৎ দৃশ্যজগৎরূপে কখন্‌ ও কেন প্ৰকাশিত হইলেন ইহার সন্ধান আমরা না পাইলেও এই মায়াত্মক কর্মের পরবর্তী সমস্ত ব্যাপারের নিয়ম নির্ধারিত আছে এবং তন্মধ্যে অনেক নিয়মই আমরা নিশ্চিত রূপে জানিতে পারি । মূল প্রকৃতি হইতে অৰ্থাৎ অনাদি মায়াত্মক কর্ম হইতে জগতের নামরূপাত্মক বিবিধ পদার্থ কিরূপ অনুক্রমে উৎপন্ন হইল, অষ্টম প্রকরণে সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে ইহার বিচার করা হইয়াছে; সেইখানেই আধুনিক আধিভৌতিক শাস্ত্রের সিদ্ধান্তও তুলনার জন্য কথিত হইয়াছে । বেদান্তশাস্ত্ৰ প্রকৃতিকে পরব্রহ্মের ন্যায় স্বয়ম্ভূ বলিয়া মানে না সত্য; কিন্তু প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তারের সাংখোক্ত ক্রম বেদান্তেরও স্বীকৃত বলিয়া এখানে তাহার পুনরুক্তি করি নাই । কর্মাত্মক মূল প্রকৃতি হইতে বিশ্বোৎপত্তির যে ক্ৰম পূর্বে বলা হইয়াছে তাহাতে যে সাধারণ নিয়মে মনুষ্যকে কর্মফল ভোগ করিতে হয় তাহার কোনই বিচার করা হয় নাই । তাই এই সকল নিয়ম এক্ষণে বিচার করা আবশ্যক । ইহাকেই ‘কর্মবিপাক’ বলে । এই কর্মবিপাকের প্ৰথম নিয়ম এই যে, কর্ম একবার শুরু হইলে তাহার ব্যাপার কিংবা চেষ্টা পরে অখণ্ডরূপে সমান চলিতে থাকে; এবং ব্ৰহ্মার দিন শেষ হইয়া জগতের সংহার হইলেও এই কর্ম বীজ রূপে অবশিষ্ট থাকে এবং পুনর্বার জগতের আরম্ভ হইলে সেই কর্মবীজ হইতেই পুনৰ্বার অঙ্কুর পূর্ববৎ উদ্গত হয় । মহাভারতে উক্ত আছে যে,-
যেষাং যে যানি কর্মাণি প্ৰাক্‌সৃষ্ট্যাং প্রতিপেদিরে ৷
তান্যেব প্ৰতিপদ্যন্তে সৃজ্যমানাঃ পুনঃ পুনঃ ॥
অর্থাৎ “প্ৰত্যেক প্ৰাণী পূর্বের সৃষ্টিতে যে যে কর্ম করিয়াছে সেই সেই কর্ম (তাহার ইচ্ছা হউক বা না হউক) সে যথাপূর্ব প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে” [মভা শাং|২৩১|৪৮,৪৯ ও গী|৮|১৮ ও ১৯ দেখ] । “গহনা কর্মণো গতিঃ” [গী|৪|১১] - কর্মের গতি কঠিন; শুধু তাহাই নহে, কর্মের বন্ধনও অতীব কঠিন । কেহই কর্ম হইতে মুক্ত হয় না । কর্মবশতই বায়ু বহিতেছে, কর্মবশতই সূৰ্যচন্দ্রাদি পরিভ্রমণ করিতেছে; এবং ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শঙ্কর আদি সগুণ দেবতারাও কর্মবশতই কার্যে নিমগ্ন রহিয়াছেন, ইন্দ্রাদির কথা দূরে থাক্‌ ! সগুণ অর্থে নামরূপাত্মক, এবং নামরূপাত্মক অর্থে কর্ম কিংবা কর্মের পরিণাম । মায়াত্মক কর্ম মূলারম্ভে কোথা হইতে আসিল ইহা যখন বলা যায় না, তখন তদঙ্গভূত মনুষ্য এই কর্মের ফেরে প্রথমে কিরূপে আবদ্ধ হইল তাহাই বা কি প্রকারে বলা যায় ? কিন্তু যে কোন প্রকারেই হউক না, সেই কর্মের ফেরে একবার আট্‌কা পড়িলে পরে, তাহার এক নামরূপাত্মক দেহের নাশ হইলে কর্মের পরিণাম বশতঃ তাহাকে পরে এই জগতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করিতে হয় । কারণ, আধুনিক আধিভৌতিক শাস্ত্রীরাও এক্ষণে স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, কর্মশক্তির কখনই নাশ হয় না; যে শক্তি আজ এক নামরূপে দেখা যায় তাহাই সেই নামরূপের নাশ হইলে অন্য নামরূপে প্রকট হইয়া থাকে ।* 
* [এই কল্পনা কেবল হিন্দুধর্মের কিংবা আস্তিকবাদীদিগেরই স্বীকৃত এরূপ নহে । বৌদ্ধেরা আত্মা না মানিলেও বৈদিক ধর্মান্তর্গত পুনর্জন্মের কল্পনা তাহারা সম্পূৰ্ণরূপে আপন ধর্মের মধ্যে গ্ৰহণ করিয়াছে; বিংশতি শতাব্দীতে “পরমেশ্বর মরিয়াছেন” এইরূপ যিনি বলেন সেই পাক্কা নিরীশ্বরবাদী জর্মণ পণ্ডিত নিৎসেও পুনর্জন্মবাদ স্বীকার করিয়াছেন । কর্মশক্তির যে রূপান্তর নিয়ত হইয়া থাকে তাহা সীমাবিশিষ্ট এবং কাল অনন্ত হওয়া প্রযুক্ত, যে নামরূপ একবার হইয়াছে তাহা কখন না কখন পরে উৎপন্ন হইবেই এবং সেই জন্য কর্মের চক্র কিংবা ফের নিছক্‌ আধিভৌতিক দৃষ্টিতেই সিদ্ধ হয়, এবং এইরূপ কল্পনা ও উপপত্তি আমাদের বুদ্ধিতে স্বতঃস্ফুর্ত হয় - এইরূপ তিনি লিখিয়াছেন ! Nietzsche’s “Eternal Recurrence, (Complete Works, Engl. Trans. Vol. X I, PP, 235 256.)]

এবং এক নামরূপের নাশ হইলে পর তাহাকে যখন ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ প্ৰাপ্ত হইতেই হয় তখন এই ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ নিৰ্জীবই হইবে, তাহা হইতে ভিন্ন প্রকারের কখনই হইতে পারে না, এইরূপও মানিতে পারা যায় না । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে এই নামরূপাত্মক পরম্পরাকেই জন্ম-মরণের ফের কিংবা সংসার বলে; এবং এই নামরূপের আধারভূত শক্তির নাম সমষ্টিরূপে ব্ৰহ্ম ও ব্যাষ্টিরূপে জীবাত্মা হইয়াছে । বস্তুত দেখিতে গেলে, এই আত্মা জন্মেও না মরেও না; ইহা নিত্য ও চিরস্থায়ী । কিন্তু কর্মের ফেরে আটকা পড়ায় এক নামরূপের নাশ হইলে পর তাহাকেই অন্য নামরূপ প্ৰাপ্ত হইতেই হয় । আজ যাহা করিবে তাহার ভোগ কাল হইবে, কাল যাহা করিবে পরশ্ব তাহার ভোগ হইবে; — শুধু তাহা নহে, এই জন্মে যাহা করিবে তাহা পরজন্মে ভোগ করিতে হইবে, - এইরূপে এই ভবচক্র সর্বদাই চলিতেছে । কেবল আমাদের নহে, কখন কখন আমাদের নামরূপাত্মক দেহ হইতে উৎপন্ন আপন পুত্ৰ, পৌত্র ও প্রপৌত্রদেরও এই কর্মফল ভোগ করিতে হয় এইরূপ মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [মনু|৪|১৭৩; মভা|আ|৮০|৩] । শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিতেছেন; -
পাপং কর্ম কৃতং কিঞ্চিদ্‌যদি তস্মিন্ন দৃশ্যতে ৷ 
নৃপতে তস্য পুত্ৰেষু পৌত্রেন্বপি চ নপ্তৃষু ॥
“হে রাজন্‌ ! কোন পাপকর্মের ফল পাওয়া গেল না এইরূপ দেখা গেলেও সেই কর্মফল পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্রের ভুগিতে হয়” [শাং|১২৯|২১] । কোন কোন উৎকট রোগ বংশপরম্পরাক্রমে চলিতে থাকে, এইরূপ আমরাও প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার, কেহ জন্ম হইতেই দরিদ্র হয় এবং কেহ রাজকুলে জন্মগ্রহণ করে । ইহারও উপপত্তি কর্মবাদের দ্বারাই নিষ্পন্ন হইয়া থাকে; এবং অনেকের মতে, ইহাই কর্মবাদের সত্যতা সম্বন্ধে প্ৰমাণ । 


6) পরমেশ্বর কর্মচক্রে হস্তক্ষেপ করেন না


কর্মের এই চক্র ‘বা চাকীকল’ একবার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে পরমেশ্বরও তাহা বন্ধ করিতে পারেন না । সমস্ত জগৎ পরমেশ্বরের ইচ্ছাতেই চলিতেছে, এই দৃষ্টিতে দেখিলে বলিতে হয় যে, কর্মফলের বিধাতা পরমেশ্বর হইতে ভিন্ন আর কেহ হইতে পারে না [বেসূ|৩|২|৩৮; কৌ|৩|৮]; এবং সেই জন্য, “লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়ৈব বিহিতান্‌ হি তান্‌” [গী|৭|২২] – আমার নির্দিষ্ট বাঞ্ছিত ফল মনুষ্য প্রাপ্ত হয় — এইরূপ ভগবান বলিয়াছেন । কিন্তু কর্মফল নির্দিষ্ট করিয়া দিবার কাজ পরমেশ্বরের হইলেও যাহার যেরূপ ভালমন্দ কর্ম, কর্মাকর্মের যোগ্যতা, তদনুরূপই এই ফল নির্দিষ্ট হইয়া থাকে; পরমেশ্বর এই বিষয়ে বস্তুত উদাসীন; মনুষ্যে মনুষ্যে ভালমন্দের ভেদ হইলেও পরমেশ্বর বৈষম্য (বিষম বুদ্ধি) ও নৈঘৃণ্য (নিৰ্দয়তা) দোষের পাত্র হন না, এইরূপ বেদান্তশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত [বেসূ|২|১|৩৪] । এই অর্থেই গীতাতেও উক্ত হইয়াছে – “সমোহহং সর্বভূতেষু” [গী|৯|২৯] – ঈশ্বর সকলের সম্বন্ধেই সমান; কিংবা -
নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভূঃ ॥
পরমেশ্বর কাহারও পাপ গ্ৰহণ করেন না, পুণ্যও গ্ৰহণ করেন না, কর্ম কিংবা মায়ার স্বাভাবিক চক্ৰ চলিতে থাকায় প্রাণীমাত্রেরই আপনি আপন কর্মানুরূপ সুখদুঃখ ভোগ করিতে হয়, [গী|৫|১৪,১৫] । সারকথা, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় জাগতিক কর্মের কখন্‌ আরম্ভ হইয়াছে কিংবা তদঙ্গভূত মনুষ্য, প্ৰথমে কর্মের চক্রে কিরূপে পতিত হইল ইহার উত্তর দেওয়া আমাদের বুদ্ধির অসাধ্য হইলেও কর্মের পরবর্তী পরিণাম অর্থাৎ ফল কেবল কর্মের নিয়মেই হইয়া থাকে এইরূপ যখন দেখা যায়, তখন জগতের আরম্ভ হইতে প্রত্যেক প্রাণী নামরূপাত্মক অনাদি কর্মের নিয়মের মধ্যে আটকাইয়া পড়িয়াছে তাহা আমাদের বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারণ করিতে পারি । ‘কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ’ এই যে বচন এই প্রকরণের আরম্ভেই দেওয়া হইয়াছে, তাহার অর্থই এই ।


7) কর্মবন্ধের সুদৃঢ়তা


এই অনাদি কর্মপ্রবাহের পর্য্যায়শব্দ অনেক, যথা, সংসার, প্রকৃতি, মায়া, দৃশ্য জগৎ, জাগতিক নিয়ম ইত্যাদি । কারণ সৃষ্টিশাস্ত্রের নিয়ম নামরূপের মধ্যে অবস্থিত পরিবর্তনেরই নিয়ম; এবং এই দৃষ্টিতে দেখিলে, সমস্ত আধিভৌতিক, শান্ত্র নামরূপাত্মক মায়াপ্রপঞ্চের মধ্যেই আসে । এই মায়ার নিয়ম ও বন্ধন সুদৃঢ় ও সর্বব্যাপী । তাই, এই নামরূপাত্মক মায়ার কিংবা দৃশ্যজগতের অতীত অথবা মূলস্থ অন্য কোন নিত্য তত্ত্ব নাই এইরূপ যিনি মানেন সেই হেকেলের ন্যায় নিছক আধিভৌতিক শাস্ত্ৰজ্ঞ এই জগৎচক্ৰ যে দিকে টানিবে মনুষ্যকে সেইদিকেই যাইতে হইবে, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । এই সকল পণ্ডিত এইরূপ বলেন যে, নামরূপাত্মক নশ্বর স্বরূপ হইতে আমি মুক্ত হইব কিংবা অমুক কাজ করিলে আমার অমৃতত্ব লাভ হইবে, এইরূপ প্ৰত্যেক মানুষ্যের যে ধারণা, তাহা নিছক ভ্ৰান্তি; আত্মা কিংবা পরমাত্মা বলিয়া স্বতন্ত্র পদার্থ নাই, এবং অমৃতত্বও মিথ্যা; শুধু তাহাই নহে, এই জগতে কোন মনুষ্যই আপনি ইচ্ছাতে কিছুই করিতে পারে না - তাহার সে স্বাতন্ত্র্য নাই । মনুষ্য আজ যে কাজ করে, তাহা পূর্বে তাহার নিজের কিংবা তাহার পূর্বপুরুষের দ্বারা কৃত কর্মেরই পরিণাম; সুতরাং উক্ত কাজ করা কিংবা না করা, তাহার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না । উদাহরণ যথা - অন্যের কোন ভাল জিনিস দেখিলে উহা চুরি করিব এইরূপ বুদ্ধি পূর্বকর্মবশতঃ কিংবা বংশপরম্পরাগত সংস্কারবশতঃ কোন কোন ব্যক্তির মনে, তাহার ইচ্ছা না হইলেও, উৎপন্ন হইয়া উক্ত ব্যক্তিকে ঐ বস্তু চুরি করিতে প্ৰবৃত্ত করে । সারকথা, ‘অনিচ্ছন্‌,অপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ’ [গী|৩|৩৬] ইচ্ছা না থাকিলেও মনুষ্য পাপ করে - এইরূপ গীতাতে যাহা উক্ত হইয়াছে সেই তত্ত্ব সর্বত্র একইরূপ উপযোগী, তাহার ব্যতিক্রম নাই, তাহা হইতে মুক্ত হইবারও পথ নাই, ইহাই এই আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মত । এই মতানুসারে দেখিলে মানিতে হয় যে, মনুষ্যের আজ যে বুদ্ধি কিংবা ইচ্ছা হইতেছে তাহা কল্যকার কর্মের ফল, এবং কল্যকার বুদ্ধি পরশ্বের কর্মের ফলঃ এবং শেষে এই কারণপম্পরার অন্ত না পাওয়ায় মনুষ্য নিজের স্বতন্ত্র বুদ্ধতে কখনই কিছু করিতে পারে না, যাহা কিছু ঘটে তাহা পূর্বকর্মের অর্থাৎ দৈবেরই ফলকারণ, প্ৰাক্তন কর্মেরই লোকে “দৈব” নাম দিয়া থাকে । এইরূপ, যদি কোন কাজ করিবার কিংবা না করিবার স্বাতন্ত্র্যই মনুষ্যের নাই, তবে মনুষ্য আপন আচরণ অমুক প্রকারে সংশোধন করিবে, অমুক প্রকারে ব্ৰহ্মাত্মৈক্য-জ্ঞান সম্পাদন করিয়া বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ করিবে, এ কথাও ব্যর্থ হইয়া পড়ে । নদীর প্রবাহে পতিত কাষ্ঠখণ্ডের ন্যায়, মায়া, প্রকৃতি, সৃষ্টিক্রম, কিংবা কর্মপ্রবাহ যেদিকে তাহাকে টানিবে নীরবে সেই দিকেই যাইতে হইবে - তাহাতে প্ৰগতিই হউক বা অধোগতিই হউক । এই সম্বন্ধে অন্য কতকগুলি উৎক্রান্তিবাদী এইরূপ বলেন যে, প্ৰকৃতির স্বরূপ স্থির নহে, নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়; এই কারণে যে জাগতিক নিয়মে পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে তাহা দেখিয়া, মনুষ্য আপনার লাভ যাহাতে হয় এইরূপে বাহ্য জগতকে বদলাইয়া লইবে; এবং প্রত্যক্ষ ব্যবহারে এই নীতিসূত্ৰ-অনুসারেই অগ্নি কিংবা বিদ্যুৎ-শক্তিকে মনুষ্য আপনার কাজে লাগাইয়া থাকে, এইরূপ আমরা দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার, চেষ্টার দ্বারা মনুষ্যস্বভাবও ন্যূনাধিক পরিমাণে পরিবর্তিত হয়, ইহাও অনুভূতির বিষয় । 


8) প্রবৃত্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রস্তাবনা


কিন্তু জগৎসৃষ্টির কার্যে কিংবা মনুষ্যের স্বভাব পরিবর্তন হয় বা হয় না, কিংবা পরিবর্তন করিতে হইবে কি না - ইহা উপস্থিত প্রশ্ন নহে; এই পরিবর্তন করিবার যে বুদ্ধি বা ইচ্ছা মনুষ্যের হইয়া থাকে, সেই বিষয়ে তাহার স্বাধীনতা আছে কি না ইহাই অগ্ৰে স্থির করিতে হইবে । এবং আধিভৌতিক শাস্ত্রদৃষ্টিতে, এই বুদ্ধি হওয়া বা না-হওয়াই যদি ‘বুদ্ধিঃ কর্মানুসারিণী’ এই নীতি অনুসারে প্ৰকৃতির, কর্মের, কিংবা জগতের নিয়মে প্ৰথমেই নির্ধারিত হইয়া থাকে তবে এই আধিভৌতিক শাস্ত্ৰানুসারে কোন কর্ম করিবার কিংবা না করিবার স্বাতন্ত্র্য মনুষ্যের নাই, এইরূপই নিষ্পন্ন হয় । এই মতবাদকে ‘বাসনা-স্বাতন্ত্র্য’, ‘ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র’, কিংবা ‘প্রবৃত্তি-স্বাতন্ত্র্য’ বলে । শুধু কর্মবিপাকের কিংবা শুধু আধিভৌতিক শাস্ত্রের দৃষ্টিতেই যদি বিচার করা যায় তবে কোন মনুষ্যেরই কোন প্ৰকার প্ৰবৃত্তি-স্বাতন্ত্র্য বা ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য নাই - কর্মের অভেদ্য লৌহবেষ্টনে গাড়ীর চাকার মতো প্ৰত্যেক মনুষ্য চারিদিকে দৃঢ় রূপে আবদ্ধ রহিয়াছে, পরিণামে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হয় । কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সত্যতার পক্ষে মনুষ্যের অন্তঃকরণ সাক্ষ্য দিতে প্ৰস্তুত নহে । প্রত্যেক মনুষ্যের অন্তঃকরণ বলে যে, সূর্যকে পশ্চিমদিকে উদিত করিবার সামৰ্থ্য আমার না থাকিলেও আমার এইটুকু শক্তি নিশ্চয়ই আছে যে, আমি নিজে যে কাজ করিতে পারি, তাহার সারাসার বিচারপূর্বক করা বা না করা, কিংবা যখন আমার সম্মুখে পাপ ও পুণ্যের বা ধর্ম অধর্মের দুই মার্গ উপস্থিত হয়, সেই দুই মার্গের মধ্যে ভাল কিংবা মন্দকে স্বীকার করা আমার ইচ্ছাধীন অর্থাৎ আয়ত্তের মধ্যে । এই ধারণা সত্য কি মিথ্যা, এক্ষণে তাহাই আমাদের দেখিতে হইবে । যদি মিথ্যা বলো, তবে এই ধারণাকেই ভিত্তি করিয়া হত্যা প্রভৃতি অপরাধকারীকে অপরাধ স্থির করিয়া দণ্ড দেওয়া হয়; আর যদি সত্য বলিয়া মানো তবে কর্মবাদ, কর্মবিপাক, কিংবা দৃশ্যজগতের নিয়ম মিথ্যা প্ৰতীত হয় । আধিভৌতিক শাস্ত্রে কেবল জড়পদার্থ সংক্রান্ত ব্যাপারেরই বিচার করা হয় বলিয়া এই প্রশ্ন উত্থিত হয় না । কিন্তু যে কর্মযোগশাস্ত্ৰে জ্ঞানবান মনুষ্যকে কর্তব্যাকর্তব্যের বিচার করিতে হয়, তাহাতে এই প্রশ্নটি গুরুতর হওয়ায় তাহার উত্তর দেওয়া আবশ্যক । কারণ, মনুষ্যের কোনই প্রবৃত্তিস্বাতন্ত্র্য নাই এইরূপ একবার স্থির সিদ্ধান্ত হইলে, অমুক প্রকারে বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিবে, কিংবা অমুক কার্য করিবে এবং অমুক কার্য করিবে না, অমুক ধর্ম, অমুক অধর্ম ইত্যাদি বিধিনিষেধশাস্ত্রের সমস্ত গোলযোগই স্বতঃই অন্তৰ্হিত হইবে [বেসূ|২|৩|৩৩],* এবং তখন পরম্পরাক্রমে কিংবা প্রত্যক্ষ রীতিতে মহামায়া প্রকৃতির দাসত্বে থাকাই পরম পুরুষার্থ হইবে । অথবা পুরুষার্থ’ই কেন ? - আপনার অধীনে থাকার কথা হয় তো পুরুষাৰ্থ ঠিক । কিন্তু যেখানে আপনার বলিয়া তিলমাত্ৰ সত্তা বা ইচ্ছা রহিল না, সেখানে পরতন্ত্রতা কিংবা দাস্য ছাড়া আর অন্য কি হইতে পারে ? লাঙ্গলে জোড়া গরুর মতো সকলে প্ৰকৃতির হুকুমে খাটিয়া মরে, তাই শঙ্কর কবি বলেন “পদার্থধর্মের শৃঙ্খল” নিত্য আমাদের পায়ে পরিতে হয় । আমাদের দেশে কর্মবাদে কিংবা দৈববাদে এবং পাশ্চাত্য দেশে প্রথম প্রথম খৃষ্টধর্মান্তর্গত ভবিতবাতাবাদে এবং আধুনিককালে শুদ্ধ আধিভৌতিক শাস্ত্রের সৃষ্টিক্রমবাদে ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যের দিকে পণ্ডিতগণের মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় এই বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হইয়া গিয়াছে; এখনও চলিতেছে । কিন্তু ঐ সমস্ত এইখানে বলা অসম্ভব বলিয়া বেদান্তশাস্ত্রে ও ভগবদ্গীতায় এই প্রশ্নের কি উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে, কেবল তাহারই বিচার এই প্রকরণে করিয়াছি । 
*(বেদান্তসূত্রের এই অধিকরণকে ‘জীবকর্তৃত্বাধিকরণ’ বলে । তাহার প্রথম সূত্রই ‘কর্তা শাস্ত্রার্থবস্বাৎ” অর্থাৎ বিধিনিষেধশাস্ত্রে অর্থবস্তু হইবার জন্য জীবকে কর্তা বলিয়া মানা আবশ্যক হয় । পাণিনির “স্বতন্ত্রঃ কর্তা” সূত্রের [পা|১|৪|৫৪] ‘কর্তা’ শব্দেই আত্মস্বাতন্ত্র বুঝায় এবং ইহা হইতে দেখা যাইতেছে যে, এই অধিকরণ ইহারই সংক্রান্ত ।)


9) কর্মবিভাগ


কর্ম প্ৰবাহ অনাদি এবং কর্ম একবার শুরু হইলে কর্মচক্রের উপর পরমেশ্বরও হস্তক্ষেপ করেন না সত্য । তথাপি অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত যে, দৃশ্যজগৎ শুধু নামরূপ অথবা কর্মমাত্র নহে; কিন্তু এই নামরূপাত্মক আবরণের নীচে আধারভূত এক আত্মরূপী স্বতন্ত্র ও অবিনাশী ব্ৰহ্মজগৎ আছে এবং মনুষ্যের দেহান্তর্ভূত আত্মা সেই নিত্য ও স্বতন্ত্র পরব্রহ্মেরই অংশ । এই সিদ্ধান্তের সহায়তায় প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে যাহা অনিবাৰ্য বাধা বলিয়া মনে হয় সেই বাধা হইতেও মুক্ত হইবার এক পন্থা আছে, এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা স্থির করিয়াছেন । কিন্তু ইহার বিচার করিবার পূর্বে কর্মবিপাক-প্রক্রিয়ার শেষ অংশের বর্ণনা সম্পূর্ণ করা আবশ্যক । যেরূপ কর্ম করিবে সেইরূপ ভোগ হইবে, এই নিয়ম কেবল এক ব্যক্তির প্রতিই প্ৰযুক্ত হয় না; পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র, এমন-কি সমস্ত জগতের পক্ষেও ইহা উপযোগী । নিজ কর্মানুসারে ফলভোগ করিতেই হয় । এবং পরিবারের মধ্যে, জাতির মধ্যে কিংবা দেশের মধ্যে প্ৰত্যেক মনুষ্যের সমাবেশ হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰত্যেক মনুষ্যকে স্বীকৃত কর্মের ফল শুধু নহে, পারিবারিক, সামাজিক কর্মের ফলও অংশতঃ ভোগ করিতে হয় । কিন্তু প্ৰচলিত ব্যবহারে প্রায় এক মনুষ্যের কর্মসম্বন্ধেই বিচার করা হয় বলিয়া কর্মবিপাক প্রক্রিয়াতে কর্মবিভাগ প্ৰায় একটী মনুষ্যকে লক্ষ্য করিয়াই করা হয় । 


9a) অশুভ কর্মবিভাগ : কায়িক, বাচিক ও মানসিক (মনু)


উদাহরণ যথা, - মনুষ্যকৃত অশুভ কর্মের – কায়িক, বাচিক ও মানসিক - মনু এই তিন ভেদ করিয়া, ব্যভিচার, হিংসা ও চৌর্য এই তিনটীকে কায়িক; কটু, মিথ্যা, কম করিয়া বলা ও প্রলাপ বকা এই চারিটীকে বাচিক; এবং পরদ্রব্যাভিলাষ, অন্যের মন্দ চিন্তা এবং মিথ্যা আগ্রহ করা এই তিনটীকে মানসিক - এই প্রকারে সবশুদ্ধ দশ প্রকার অশুভ কিংবা পাপ কর্মের উল্লেখ করিয়া [মনু|১২|৫-৭; মভা|অনু|১৩], সেই সব কর্মের ফলও বলিয়াছেন । তথাপি এই ভেদ চিরস্থির নহে । 


9b) সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক (ভগবদ্গীতা)


কারণ এই অধ্যায়েই পরে সমস্ত কর্মের - সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক - এই তিন ভেদ করা হইয়াছে এবং প্রায় ভগবদ্গীতার বর্ণনানুসারেই এই তিন প্রকার গুণের কিংবা কর্মের লক্ষণও প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৪|১১-১৫; ১৮|২৩-২৫; মনু|১২|৩১-৩৪] । 


9c) সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ (কর্মবিপাক)


কিন্তু কর্মবিপাক প্রকরণে কর্মের যে বিভাগ সাধারণত পাওয়া যায় তাহা এই দুই হইতেও ভিন্ন; তাহাতে কর্মের সঞ্চিত, প্রারব্ধ, ও ক্রিয়মাণ, এই তিন ভেদ করা হইয়া থাকে । কোন মনুষ্য এই ক্ষণ পর্যন্ত যে কর্ম করিয়াছে — তাহা এই জন্মেই করা হউক বা পূর্ব জন্মেই হউক - সে সমস্তকে তাহার ‘সঞ্চিত’ কর্ম বলে । এই ‘সঞ্চিতের’ অপর নাম ‘অদৃষ্ট’ এবং মীমাংসকদিগের পরিভাষায়, ইহারই নাম ‘অপূর্ব’ । এই নাম হইবার কারণ এই যে, কর্ম কিংবা ক্রিয়া যে সময় করা হয়, শুধু সেই সময়েই তাহা দৃশ্য হইয়া থাকে, এবং সেই সময় চলিয়া গেলে পরে সেই কর্ম স্বরূপত অবশিষ্ট না থাকায় তাহার সূক্ষ্ম সুতরাং অদৃশ্য অর্থাৎ অপূর্ব বিশিষ্ট পরিণামই অবশিষ্ট থাকিয়া যায় [বেসূ|শাং ভা|৩|২|৩৯,৪০] । যাহাই বলনা কেন, ইহা নির্বিবাদ যে, ‘সঞ্চিত’, ‘অদৃষ্ট’ কিংবা ‘অপূর্ব’ শব্দের অর্থে এই ক্ষণ পৰ্যন্ত যে যে কর্ম করা হইয়াছে সেই সমস্তের পরিণামের সমষ্টি । এই সঞ্চিত কর্ম সমস্ত একেবারে ভোগ করা যায় না । কারণ, এই সঞ্চিত কর্মের মধ্যে কিছু ভাল ও কিছু মন্দ অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী ফলপ্ৰদ থাকিতে পারে । উদাহরণ যথা - কোন সঞ্চিত কর্ম স্বৰ্গপ্রদ এবং কোনটী নরকপ্ৰদ হওয়া প্ৰযুক্ত সেই সমস্তের ফল একই সময়ে ভোগ করা যায় না - একটার পর একটা ভোগ করিতে হয় । তাই ‘সঞ্চিতের’ মধ্যে যে কর্মের ফল প্ৰথম আরম্ভ হয়, তাহাকেই ‘প্রারব্ধ’ অর্থাৎ শুরু-হওয়া ‘সঞ্চিত’ বলে । ব্যবহারে সঞ্চিতের অর্থেই ‘প্রারব্ধ’ শব্দের অনেক প্রকার প্রয়োগ হইয়া থাকে । কিন্তু ইহা ভুল । শাস্ত্রদৃষ্টিতে দেখিলে, ‘সঞ্চিতের’ অর্থাৎ সমস্ত ভূতপূর্ব কর্মের যে সমষ্টি, তাহারই এক অবান্তর ভেদকেই ‘প্রারব্ধ’ বলিয়া উপলব্ধি হয় । প্রারদ্ধ কিছু সমস্ত সঞ্চিত নহে; সঞ্চিতের মধ্যে যে অংশের ফলের (কার্যের) ভোগ আরম্ভ হইয়াছে তাহাই প্রারব্ধ; এবং সেইজন্য এই প্রারদ্ধেরই আর এক নাম - আরব্ধ কার্য । প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ব্যতীত ক্রিয়মাণ বলিয়া কর্মের তৃতীয় আর এক ভেদ আছে । ‘ক্রিয়মাণ’ - ইহা বর্তমান কালবাচক ধাতু সাধিত শব্দ এবং তাহার অর্থ - “যাহা এক্ষণে হইতেছে কিংবা যাহা এক্ষণে করিতেছি সেই কর্ম ।” কিন্তু এক্ষণে আমরা যাহা কিছু করিতেছি তাহা সঞ্চিত কর্মের মধ্যে যে কর্মের ভোগ আরম্ভ হইয়াছে তাহারই অর্থাৎ প্রারব্ধেরই পরিণাম; তাই কর্মের এই তৃতীয় ‘ক্রিয়মাণ’ ভেদ মানিবার আমি কোন কারণ দেখিতে পাই না । প্রারব্ধ কারণ এবং ক্রিয়মাণ তাহার ফল অর্থাৎ কাৰ্য, দুয়ের মধ্যে এই ভেদ করা যাইতে পারে সত্য; কিন্তু কর্মবিপাক প্রক্রিয়ায় এই ভেদের কোন উপযোগ হইতে পারে না । সঞ্চিতের মধ্যে প্রারব্ধ বাদ দিলে বাকী যে কর্ম থাকে তাহা দেখাইবার জন্য ভিন্ন শব্দের প্রয়োজন হয় । 


9d) প্রারব্ধ (আরব্ধ) ও অনারব্ধ


তাই, বেদান্তসূত্রে প্রারব্ধকেই ‘প্রারব্ধকার্য’ এবং যাহা প্রারব্ধ নহে, তাহাকে অনারব্ধ কার্য বলা হইয়াছে [বেসূ|৪|১|১৫] । আমার মতে, সঞ্চিত কর্মে এই প্ৰকার অর্থাৎ প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্য এইরূপ দ্বিধা ভেদ করাই শাস্ত্রদৃষ্টিতে অধিক যুক্তিসঙ্গত । তাই, ‘ক্রিয়মাণ’কে ধাতু সাধিত বর্তমানকালবাচক মনে না করিরা “বর্তমানসামীপ্যে বর্তমান্‌বদবা” এই পাণিনিসূত্র অনুসারে [পা|৩|৩|১৩১] ভবিষ্যৎকালবাচক মনে করিলে তাহার অর্থ “যাহা শীঘ্রই পরে ভোগ করিতে হইবে” এইরূপ করিতে পারা যায়; এবং তখন ‘ক্রিয়মাণ’ এরই অর্থ ‘অনারব্ধ কার্য’ এইরূপ হইবে; ‘প্রারব্ধ’ ও ‘ক্রিয়মাণ’ এই দুই শব্দ অনুক্ৰমে বেদান্তসূত্রের ‘আরব্ধকার্য’ ও ‘অনারব্ধকাৰ্য’ এই দুই শব্দের সহিত সমানার্থক হইবে । কিন্তু ‘ক্রিয়মাণ’ এর সেরূপ অর্থ অধুনা কেহ করে না; ক্রিয়মাণ অর্থে চলিতেছে যে কর্ম এইরূপ অর্থই করা হয় । কিন্তু এইরূপ অর্থ গ্ৰহণ করিলে প্রারব্ধের ফলকেই ক্রিয়মাণ বলিতে হয় - এবং যে কর্ম অনারব্ধকার্য তাহা বুঝাইবার জন্য সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ এই তিন শব্দের মধ্যে কোন শব্দই পর্যাপ্ত হয় না, এই একটা বড় রকমের আপত্তি উত্থিত হয় । ইহা ছাড়া, ক্রিয়মাণশব্দের রূঢ়ার্থ ছাড়াও ভাল নহে । তাই কর্মবিপাক প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ কর্মের এই লৌকিক ভেদ স্বীকার না করিয়া, প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্য এই দুই বর্গে আমি উহাদিগকে বিভক্ত করিয়াছি এবং তাহাই শাস্ত্রদৃষ্টিতেও সুবিধাজনক বলিয়া মনে হয় । ‘ভোগ করা’ এই ক্রিয়ার, ভুক্ত (অতীত), ভোগ করা এক্ষণে আরম্ভ হইয়াছে (বর্তমান) এবং পরে ভোগ করিতে হইবে (ভবিষ্যৎ), এইরূপ কালকৃত তিন ভেদ হয় । কিন্তু কর্মবিপাকপ্রক্রিয়াতে এইরূপ কর্মের তিন প্ৰকার ভেদ হইতে পারে না । কারণ, সঞ্চিতের মধ্যে যে কর্ম প্রারব্ধ হইয়া ভোগ করা যায়, তাহার ফল পুনৰ্বার সঞ্চিতের মধ্যে গিয়াই মিলিত হয় । তাই কর্মভোগের বিচার করিবার সময় সঞ্চিতের (১) ভোগ আরম্ভ হইলে প্রারব্ধ এবং (২) আরম্ভ না হইলে অনারব্ধ - এই দুই ভেদ হইতে পারে; ইহার অধিক বর্গে ‘সঞ্চিত’কে বিভক্ত করিবার কোন প্রয়োজন নাই । 


10) 'প্রারব্ধকর্মনাং ভোগাদেব ক্ষয়ঃ'


এইরূপ সমস্ত কর্মফলের দ্বিধা বৰ্গীকরণ করিবার পর, তাহার উপভোগ সম্বন্ধে কর্মবিপাক প্রক্রিয়া এই বলে যে, সঞ্চিত সমস্তই ভোগ্য । তন্মধ্যে যে কর্মফলের ভোগ আরম্ভ হইয়া এই দেহ কিংবা জন্ম প্রাপ্ত হওয়া যায়, অর্থাৎ সঞ্চিতের মধ্যে যে কর্ম প্রারব্ধ হইয়াছে তাহার ভোগ ব্যতীত অব্যাহতি নাই — “প্রারব্ধকর্মণাং ভোগাদেব ক্ষয়ঃ” । হাত হইতে বাণ একবার মুক্ত হইলে তাহা যেমন আর ফিরিয়া পাওয়া যায় না, শেষ পর্যন্ত তাহা চলিয়াই যায়; কিংবা কুম্ভকারের চাকা একবার গতিপ্রাপ্ত হইলে তাহা যেরূপ উক্ত গতির শেষ হওয়া পৰ্যন্ত ঘুরিতেই থাকে, প্রারব্ধ অর্থাৎ যাহার ফলভোগ আরম্ভ হইয়াছে সেই কর্মেরও ঠিক সেইরূপ অবস্থা । যাহা শুরু হইয়াছে তাহার শেষ হওয়া চাই; নচেৎ তাহা হইতে অব্যাহতি নাই । কিন্তু অনারব্ধকার্য-কর্মের বিষয় সে বিধি নহে — এই সমস্ত কর্মকে জ্ঞানের দ্বারা সম্পূর্ণ নাশ করা যাইতে পারে । প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্যে এই যে গুরুতর ভেদ আছে সেই কারণে জ্ঞানীপুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু আসা পর্যন্ত অর্থাৎ দেহের জন্মাবধি প্রারব্ধ কর্ম শেষ হওয়া পর্যন্ত, - শান্তভাবে অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হয় । সেইরূপ না করিয়া হঠাৎ দেহত্যাগ করিলে - জ্ঞানের দ্বারা তাহার অনারব্ধকর্মের ক্ষয় হইলেও - দেহারম্ভক প্রারব্ধকর্মের ভোগ অপূর্ণ থাকে এবং তাহা ভোগ করিবার জন্য পুনৰ্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় এবং তাহার মোক্ষও দূরে পড়িয়া যায় । বেদান্ত ও সাংখ্য এই দুই শাস্ত্ৰেই এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে [বেসূ|৪|১|১৩-১৫; সা. কা|৬৭] । ইহা ব্যতীত হঠাৎ আত্মহত্যা করা এক নূতন কর্ম হইবে এবং তাহার ফল ভোগ করিবার জন্য নব জন্ম গ্ৰহণ করা পুনরায় আবশ্যক হইবে । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, কর্মশাস্ত্রদৃষ্টিতেও আত্মহত্যা করা নির্বুদ্ধিতা ।


11) মীমাংসকদের নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধিভাব বেদান্তের অগ্রাহ্য


কর্মফলভোগদৃষ্টিতে কর্মের কি কি ভেদ তাহা বলা হইল । এক্ষণে, কর্মের বন্ধন হইতে কিরূপে অর্থাৎ কোন যুক্তিতে মুক্ত হওয়া যায় তাহার বিচার করিব । প্রথম যুক্তি কর্মবাদীদিগেরই । অনারব্ধকার্য অর্থে পরে ভোগার্থ সঞ্চিত কর্ম, তাহা উপরে বলিয়াছি - তাহা এ জন্মেই ভোগ করিতে হউক কিংবা অন্য জন্মেই ভোগ হউক । কিন্তু এই অর্থের দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কোন কোন মীমাংসক কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আপনার মতে মোক্ষলাভের এক সহজ উপায় বাহির করিয়াছেন । 


11a) মীমাংসকদের কর্মবিভাগ : নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ


তৃতীয় প্রকরণে কথিত অনুসারে মীমাংসক দৃষ্টিতে সমস্ত কর্মের নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ এই চারি ভেদ হয় । তন্মধ্যে সন্ধ্যাদি নিত্যকর্ম না করিলে পাপ হয় এবং নৈমিত্তিক কর্ম নিমিত্ত উপস্থিত হইলেই করিতে হইবে । তাই, এই দুই কর্ম করিতেই হইবে, এইরূপ মীমাংসকেরা বলেন । বাকী রহিল কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম । তন্মধ্যে নিষিদ্ধ কর্ম করিলে পাপ হয় বলিয়া করিতে নাই; এবং কাম্য কর্ম করিলে তাহার ফলভোগ করিবার জন্য পুনর্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় বলিয়া তাহাও করিতে নাই । 

এই প্রকার বিভিন্ন কর্মের পরিণামের তারতম্য বিচার করিয়া মনুষ্য কোন কর্ম ছাড়িয়া দিলে এবং কোন কর্ম যথাশাস্ত্ৰ করিতে থাকিলে সে আপনাপনিই মুক্ত হইবে । কারণ, এই জন্মের ভোগের দ্বারাই প্রারব্ধকর্মের অবসান হয়; এবং এই জন্মে সমস্ত নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সাধন করিলে ও নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করিলে নরকগতি ঘটে না, এবং কাম্য কর্ম ত্যাগ করিলে স্বৰ্গাদি সুখভোগেরও আবশ্যকতা থাকে না । ইহলোক, নরক ও স্বৰ্গ এই তিন গতি হইতে এইরূপে অব্যাহতি পাইলে মোক্ষ ব্যতীত আত্মার আর কোন গতি থাকে না । এই মতবাদকে ‘কর্মমুক্তি’ কিংবা ‘নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি’ বলে । কর্ম করিলেও যাহা না করার সমান হয়, অর্থাৎ যখন কর্মের পাপপুণ্যের বন্ধন কর্তার হয় না, সেই অবস্থাকে ‘নৈষ্কর্ম্য’ বলে । কিন্তু মীমাংসকদিগের উপরিউক্ত যুক্তিতে এই নৈষ্কর্ম্য পূর্ণরূপে সাধিত হয় না, ইহা বেদান্তশাস্ত্ৰ স্থির করিয়াছেন [বেসূ|শাং|ভা|৪|৩|১৪]; এবং গীতাতেও এই অভিপ্ৰায়েই “কর্ম না করিলে নৈষ্কর্ম্য হয় না, এবং কর্ম ছাড়িলে সিদ্ধিও হয় না” - উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৪] । ধর্মশাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে যে, গোড়ায় সমস্ত নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করাই দুঃসাধ্য; এবং কোন নিষিদ্ধ কর্ম করিলে শুধু নৈমিত্তিক প্ৰায়শ্চিত্তের দ্বারা তাহার সমস্ত দোষ খণ্ডিত হয় না । তথাপি উক্ত বিষয় সম্ভব বলিয়া মানিলে ও প্রারব্ধ কর্ম ভোগের দ্বারা এবং এ জন্মে কর্তব্য কর্ম উপরি-উক্ত অনুসারে করিলে কিংবা না করিলে সমস্ত সঞ্চিত কর্মের সমষ্টি শেষ হয়, মীমাংসকদিগের এই কথা আদৌ ঠিক মনে হয় না । কারণ, দুই ‘সঞ্চিত’ কর্মের ফল পরস্পরবিরোধী - উদাহরণ যথা, একের ফল স্বৰ্গসুখ এবং অন্যটির ফল নরকযাতনা হইলে, তাহা একই কালে ও একই স্থলে ভোগ করা অসম্ভব হওয়ায়, কেবল এই জন্মে প্রারব্ধ কর্মের দ্বারা এবং এই জন্মে কর্তব্য কর্মের দ্বারা সমস্ত সঞ্চিত কর্মের ফলভোগ সম্পূর্ণ হইতে পারে না । মহাভারতের পরাশরগীতায় আছে –
কদাচিৎ সুকৃতং তাত কুটস্থমিব তিষ্ঠতি ৷
মজ্জামানস্য সংসারে যাবদ্‌ দুঃখাদ্‌ বিমুচ্যতে ॥
কখন কখন মানুষের সাংসারিক দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ করা পর্যন্ত তাহার পূর্বকৃত পুণ্য (উহা নিজের ফল দিবার পথ দেখিয়া) চুপ করিয়া বসিয়া থাকে” [মভা|শাং|২৯০|১৭]; এবং এই নীতিসুত্ৰই সঞ্চিত পাপকর্মের সম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । সঞ্চিতকর্মভোগ এইরূপে একই জন্মে শেষ না হইয়া এই সঞ্চিত’ কর্মের মধ্যে অনারব্ধকার্যরূপ এক অংশ সর্বদা অবশিষ্টই থাকে; এবং এই জন্মের সমস্ত কর্ম উপরি-উক্ত যুক্তিতে সাধন করিলেও অবশিষ্ট অনারব্ধকার্যের সঞ্চিত ভোগ করিবার জন্য পুনরায় জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হয় । তাই, মীমাংসকদিগের উপরি-উক্ত সহজ মোক্ষ-উপায়টি মিথ্যা ও ভ্রান্তিমূলক, এইরূপ বেদান্তের সিদ্ধান্ত । কোন উপনিষদেই কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের এই পথের কথা বলা হয় নাই । কেবল তর্কের জোরে ইহাকে খাড়া করা হইয়াছে; ঐ তর্কও শেষ পর্যন্ত টিকে না । সারকথা, কর্মের দ্বারা কর্ম হইতে মুক্ত হইবার আশা অন্ধের অন্ধকে পথ দেখাইয়া পার করাইবার আশার ন্যায় ব্যর্থ । ভাল, মীমাংসকদিগের এই যুক্তি স্বীকার না করিয়া, আগ্রহের সহিত সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া নিরুদ্যোগী হইয়া বসিয়া থাকিলো কর্মের বন্ধন ঘুচিবে এইরূপ যদি বলো, তবে তাহাও হইতে পারে না । কারণ, অনারব্ধকর্মের ফলভোগ তখনও অবশিষ্ট থাকে শুধু নহে, কর্মত্যাগের আগ্ৰহ ও চুপ করিয়া বসিয়া থাকা — এই দুই-ই তামসিক কর্ম হইয়া যায়; এবং এই তামসিক কর্মের ফল ভোগ করিবার জন্য পুনৰ্বার জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হয় [গী|১৮|৭ ও ৮ দেখ] । তাছাড়া, যতদিন দেহ থাকে সেই পৰ্যন্ত শ্বাসোচ্ছ্বাস কিংবা শোওয়া, বসা ইত্যাদি কর্ম চলিতে থাকায় সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া দিবার আগ্রহও ব্যর্থই হয়, - এই জগতে কেহ ক্ষণকালের জন্যও কর্ম ছাড়িতে পারে না, গীতার অনেক স্থলে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৫; ১৮|১১ দেখ] ।


12) জ্ঞান বিনা কর্মবন্ধ হইতে মুক্তি নাই


কর্ম ভালোই হউক বা মন্দই হউক, তাহার ফলভোগের জন্য কোন-না-কোন জন্ম গ্ৰহণ করিয়া মনুষ্যকে সর্বদাই প্ৰস্তুত থাকিতে হইবে; কর্ম অনাদি, তাহার অবিছিন্ন ধারাবাহিক ব্যাপারে পরমেশ্বরও হস্তক্ষেপ করেন না; সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া অসম্ভব; এবং মীমাংসকের কথা অনুসারে কোন কর্ম করিলে এবং কোন কর্ম ছাড়িয়া দিলেও কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া যায় না - ইত্যাদি বিষয় সিদ্ধ হইলে পর, কর্মাত্মক নামরূপের নশ্বর চক্ৰ হইতে মুক্ত হইয়া, তাহার মূলে স্থিত অমৃত ও অবিনাশী তত্ত্বে মিলিত হইবার জন্য মনুষ্যের যে স্বাভাবিক ইচ্ছা হয়, তাহা তৃপ্ত করিবার কোন পথ, এই প্রথম প্রশ্নটী পুনর্বার উপস্থিত হয় । বেদে ও স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে যাগযজ্ঞাদি পারলৌকিক কল্যাণের বহুবিধ সাধন বর্ণিত হইয়াছে; কিন্তু মোক্ষশাস্ত্রদৃষ্টিতে সে সমস্ত নিম্ন শ্রেণীর সাধন । কারণ যাগযজ্ঞাদি পুণ্যকর্মের দ্বারা স্বৰ্গ প্ৰাপ্তি হইলেও পুণ্যকর্মের ফল শেষ হইলে, দীর্ঘকালেই হউক না কেন - কখন-না-কখন নীচের কর্মভূমিতে পুনৰ্বার ফিরিয়া আসিতেই হয় [মভা|বন|২৫৯|২৬০; গী|৮|২৫ ও ৯|২০] । স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, কর্মের কাঁইচী হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়া অমৃততত্ত্বে মিশিয়া যাইবার এবং জন্মমরণের ঝঞ্ঝাট চিরকালের জন্য পরিহার করিবার পক্ষে ইহা প্ৰকৃত মার্গ নহে; এই ঝঞ্ঝাট দূর করিবার অর্থাৎ মোক্ষ প্ৰাপ্তির অধ্যাত্মশাস্ত্ৰানুসারে জ্ঞানই একমাত্র পন্থা । 


13) জ্ঞান শব্দের অর্থ


‘জ্ঞান’ অর্থে ব্যবহার-জ্ঞান বা নামরূপাত্মক সৃষ্টিশাস্ত্রের জ্ঞান নহে; এস্থলে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানই উহার অর্থ । ইহাকে ‘বিদ্যা’ও বলে; এবং “কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে” - মনুষ্য কর্মের দ্বারাই বদ্ধ হয় এবং বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয় - এই প্রকরণের আরম্ভে এই যে বচন প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাতে ‘বিদ্যা’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ই বিবক্ষিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতাতে -
জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন ৷
“জ্ঞানরূপ অগ্নির দ্বারা সমস্ত কর্ম ভস্ম হয়” [গী|৪|৩৭], ইহা ভগবান অর্জুনকে বলিয়াছেন; মহাভারতেরও দুই স্থলে উক্ত হইয়াছে যে, -
বীজান্যগ্নু পদগ্ধানি ন রোহন্তি যথা পুনঃ ৷
জ্ঞানদগ্ধৈস্তথা ক্লেশৈৰ্নাত্মা সম্পদ্যতে পুনঃ ॥
“দগ্ধ বীজ যেরূপ গজায় না সেইরূপ জ্ঞানের দ্বারা (কর্মের) ক্লেশ দগ্ধ হইলে তাহা আত্মাকে পুনঃ প্ৰাপ্ত হয় না” [মভা|বন|১৯৯|১০৬|১০৭; শা|২১১|১৭] । উপনিষদেও এইরূপ জ্ঞানের মাহাত্ম্য প্রতিপাদন করিবার অনেক বচন আছে – “য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি” [বৃ|১|৪|১০], - আমিই ব্ৰহ্ম এইরূপ যে জানে সেই অমৃত ব্ৰহ্ম হয়; যেমন পদ্মাপত্রে জল লাগিয়া থাকে না সেইরূপ যাহার ব্ৰহ্মজ্ঞান হইয়াছে তাহাকে কর্ম দূষিত করিতে পারে না [ছাং|৪|১৪|৩]; ব্ৰহ্মজ্ঞানী ব্ৰহ্মকে লাভ করে [তৈ|২|১]; যে সমস্তই আত্মময় জানিয়াছে তাহাকে পাপ স্পর্শ করে না [বৃ|৪|৪|২৩]“জ্ঞাত্বা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ” [শ্বে|৫|১৩; ৬|১৩] পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে পর সমস্ত পাশ হইতে মুক্ত হয়; “ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্দৃষ্টে পরাবরে” [মুং|২|২|৮] - পরব্রহ্মের জ্ঞান হইলে পর তাহার সমস্ত কর্মের ক্ষয় হয়; ‘বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে’ [ঈশা|১১, মৈত্র্যু|৭|৯] বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ হয়; “তমেব বিদিত্বাহতিমৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়” [শ্বে|৩|৮] পরমেশ্বরকে জানিলে অমর হয়, ইহা ব্যতীত মোক্ষলাভের অন্য পন্থা নাই । এবং শাস্ত্রদৃষ্টিতে বিচার করিলেও এই সিদ্ধান্তই দৃঢ় হয় । কারণ, দৃশ্য জগতে যাহা কিছু আছে তৎসমস্ত কর্মময় হইলেও তাহা এই জগতের আধারভুত পরব্রহ্মেরই লীলা হওয়া প্ৰযুক্ত কোন কর্মই পরব্রহ্মকে যে বন্ধন করিতে পারে না তাহা সুস্পষ্ট - অর্থাৎ সমস্ত কর্ম করিলেও পরব্রহ্ম অলিপ্তই থাকেন । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰানুসারে এই জগতের সমস্ত পদার্থ কর্ম (মায়া) এবং ব্ৰহ্ম এই দুই বর্গে বিভক্ত, ইহা এই প্রকরণের আরম্ভেই বলা হইয়াছে । তাই স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, এই দুই বর্গের মধ্যে কোন এক বৰ্গ হইতে অর্থাৎ কর্ম হইতে মুক্ত হইতে ইচ্ছা করিলে দ্বিতীয় বর্গের মধ্যে অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপে প্ৰবেশ করিতে হইবে । এই এক মাৰ্গই তাহার নিকট উন্মুক্ত । কারণ, সমস্ত বিষয়ের কেবল দুই বৰ্গ হওয়ায় কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া ব্যতীত ব্ৰহ্মস্বরূপের অন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । কিন্তু ব্ৰহ্মস্বরূপের এই অবস্থা লাভ করিতে হইলে ব্ৰহ্মস্বরূপ কি, আগে তাহা ঠিক জানা আবশ্যক; নচেৎ এক করিতে গিয়া আর এক হইয়া সমস্তই ব্যর্থ হইবে ! “বিনায়কং প্রকুর্বাণো রচয়ামাস বানরম্‌” - অৰ্থাৎ “গণেশ করিতে বানর” হইবে ! এইজন্য, অধ্যাত্মশাস্ত্রের যুক্তিবাদেও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় যে, ব্ৰহ্মস্বরূপের অর্থাৎ ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের ও ব্ৰহ্মের অলিপ্ততার জ্ঞান পাইয়া তাহাই বিশেষরূপে মরণ পৰ্যন্ত দৃঢ় করিয়া ধরিয়া রাখাই কর্মপাশ হইতে মুক্ত হইবার প্রকৃত সাধন । “কর্মে আমার কোনই আসক্তি নাই; তাই কর্ম আমাকে বদ্ধ করিতে পারে না - এবং এই তত্ত্ব যে জানিয়াছে সে কর্মপাশ হইতে মুক্ত হয়” এইরূপ ভগবান্‌ গীতায় বলিয়াছেন [গী|৪|১৪; ১৩|২৩] তাহার তাৎপৰ্যও এই । এই স্থানে ‘জ্ঞান’ অর্থে শুধু শাব্দিক জ্ঞান কিংবা শুধু মানসিক ক্রিয়া নহে; কিন্তু বেদান্তসূত্রের শঙ্করভাষ্যের আরম্ভেই কথিত-অনুসারে ‘জ্ঞান’ অর্থে “মানসিক জ্ঞান প্ৰথমে হইলে পর এবং ইন্দ্ৰিয়দিগকে জয় করিলে পর ব্ৰহ্মীভূত হইবার অবস্থা বা ব্ৰাহ্মী স্থিতি” - এই অর্থই সকল সময়ে ও সকল স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, ইহা বিস্মৃত হইবে না । পূর্বপ্রকরণের শেষে জ্ঞানসম্বন্ধে অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্তই দেওয়া হইয়াছে; মহাভারতেও “জ্ঞানেন কুরুতে যত্নং যন্ত্রেন প্ৰাপ্যতে মহৎ” - জ্ঞান অর্থাৎ মানসিক ক্রিয়ারূপ জ্ঞান হইলে পর মনুষ্য যত্ন করে এবং এই যত্নের দ্বারাই মহৎতত্ত্ব (পরমেশ্বর) প্ৰাপ্ত হয় - এইরূপ জনক সুলভাকে বলিয়াছেন [শাং|৩২০|৩০] । মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য কোন পথ দিয়া কোথায় যাইতে হইবে - ইহা অপেক্ষা অধ্যাত্মশাস্ত্র কখনই বেশী বলিতে পারে না । শাস্ত্রের দ্বারা এই বিষয় ব্যক্ত হইলে পর, শাস্ত্ৰোক্ত মার্গে কোন কণ্টক বা বাধা থাকিলে তাহা অপসারিত করিয়া পথ পরিষ্কার করা এবং সেই পথে চলিতে চলিতে শেষে ধ্যেয় বস্তুকে লাভ করা - এই সমস্ত কার্য প্ৰত্যেককে নিজের চেষ্টায় করিতে হইবে । কিন্তু এই প্ৰযত্নও পাতঞ্জল যোগ, অধ্যাত্মবিচার, ভক্তি, কর্মফলত্যাগ ইত্যাদি অনেক প্রকারে করা যাইতে পারে [গী|১২|৮-১২], এবং সেই জন্য, অনেক সময় মনুষ্য গোলযোগে পড়িয়া যায় । তাই গীতায় প্ৰথমে নিষ্কাম কর্মযোগের মুখ্যমাৰ্গ বলিয়া তৎসিদ্ধির জন্য ষষ্ঠ অধ্যায়ে যম-নিয়ম আসন-প্ৰাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধিরূপ অঙ্গভূত সাধনাদিরও বর্ণনা করা হইয়াছে; এবং পরে সপ্তম অধ্যায় হইতে, কর্মযোগ আচরণ করিয়াই অধ্যাত্মবিচারের দ্বারা কিংবা তাহা অপেক্ষা সহজ উপায় ভক্তিমার্গে এই পরমেশ্বরের জ্ঞান কিরূপে উৎপন্ন হয় তাহা উক্ত হইয়াছে [গী|১৮|৫৬] ।


14) জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য শারীর আত্মা স্বতন্ত্র


কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের উপায় কর্মত্যাগ নহে; ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ রাখিয়া পরমেশ্বরের ন্যায় কার্য করিতে থাকিলেই শেষে মোক্ষলাভ হয়; কর্মত্যাগ করা ভ্ৰম; কারণ কর্ম হইতে কেহই অব্যাহতি পায় না; - ইত্যাদি বিষয় এক্ষণে নির্বিবাদ নির্ধারিত হইলেও এই প্ৰথমকার প্রশ্নটি আবারও উপস্থিত হয় যে, এই মার্গে সিদ্ধ হইবার জন্য জ্ঞানলাভের যে চেষ্টা আবশ্যক সেই চেষ্টা কি মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত ? কিংবা নামরূপ কর্মাত্মক প্ৰকৃতি যে দিকে টানিবে সেই দিকেই যাহতে হইবে ? ভগবান গীতাতে বলিয়াছেন যে, “প্ৰকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্ৰহঃ কিং করিষ্যতি” [গী|৩|৩৩] - নিগ্ৰহ কি করিবে ? প্ৰাণিমাত্ৰই আপন আপন প্ৰকৃতির পথেই চলিয়া থাকে; “মিথ্যৈষ ব্যবসায়স্তে প্রকৃতিস্ত্বাং নিযোক্ষ্যতি” - তোমার প্রতিজ্ঞা নিরর্থক; তুমি যেদিকে যাইতে চাহিবে না, সেইদিকে প্রকৃতি তোমাকে টানিবে [গী|১৮|৫৯; ২|৬০] বলিয়াছেন; আবার মনুও - “বলবান্‌ ইন্দ্ৰিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি” [মনু|২|২১৫] - বিদ্বানকেও ইন্দ্ৰিয়গণ আকর্ষণ করে - এইরূপ বলিয়াছেন । কর্মবিপাক প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তও তাহাই । কারণ, মনুষ্যের মনের সমস্ত প্রেরণা পূর্বকৰ্মবশতই উৎপন্ন হয় এইরূপ মানিলে, এক কর্ম হইতে অন্য কর্মে, এইরূপে সর্বদাই তাহাকে ভবচক্রের মধ্যে থাকিতে হয়, এইরূপ অনুমান না করিলে চলে না । অধিক কি, কর্ম হইতে মুক্ত হইবার প্রেরণা ও কর্ম ইহারা পরস্পরবিরুদ্ধ এইরূপ বলিলেও চলে । এবং ইহা যদি সত্য হয় তবে জ্ঞানলাভার্থ কেহই স্বতন্ত্র নহে এইরূপ আপত্তি আসে । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ এই প্রশ্নের এই উত্তর দেন যে, নামরূপাত্মক সমস্ত দৃশ্য-জগতের আধারভুত যে তত্ত্ব তাহাই মনুষ্যের দেহের মধ্যেও আত্মরূপে ক্রীড়া করে বলিয়া মনুষ্যের কার্যের যে বিচার করিতে হইবে তাহা দেহ ও আত্মা এই দুই দিক হইতেই করা আবশ্যক । তন্মধ্যে, আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্ম মূলে একমাত্র,অদ্বিতীয় হওয়া প্ৰযুক্ত কখনই পরতন্ত্র হইতে পারেন না । কারণ, এক অপরের অধীনে আসিতে হইলে এক ও অন্য এই ভেদ নিয়ত স্থায়ী হওয়া চাই ৷ প্ৰকৃতপক্ষে নামরূপাত্মক কর্মই সেই অন্য পদার্থ । কিন্তু এই কর্ম অনিত্য ও মূলে পরব্রহ্মেরই লীলা হওয়ায়, পরব্রহ্মের এক অংশের উপর তাহার আবরণ থাকিলেও তাহা পরব্ৰহ্মকে কখনই দাস করিতে পারে না, ইহা নির্বিবাদ । তাছাড়া, যে আত্মা কর্মজগতের ব্যাপারাদির একীকরণ করিয়া জগৎ-জ্ঞান উৎপন্ন করে তাহার কর্মজগৎ হইতে ভিন্ন অর্থাৎ ব্ৰহ্মজগতেরই হওয়া চাই ইহা পূর্বেই উক্ত হইয়াছে । তাই পরব্রহ্ম ও তাহার অংশ শারীর আত্মা এই দুই-ই মূলে স্বতন্ত্র অর্থাৎ কর্মাত্মক প্রকৃতিসত্তার বাহিরের বস্তু, এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । তন্মধ্যে পরমাত্মা অনন্ত, সর্বব্যাপী, নিত্য, শুদ্ধ ও মুক্ত, ইঁহার বাহিরে পরমাত্মা সম্বন্ধীয় জ্ঞান মনুষ্যের বুদ্ধিতে উৎপন্ন হইতে পারে না । কিন্তু এই পরমাত্মারই অংশ জীবাত্মা মূলে শুদ্ধ, মুক্তস্বভাব, নির্গুণ ও অকর্তা হইলেও দেহ ও বুদ্ধি-আদি ইন্দ্ৰিয়গণের গণ্ডীর মধ্যে আটকাইয়া পড়ায় তাহা মনুষ্যের মনে যে স্ফুরণ উৎপন্ন করে তাহার প্রত্যক্ষ অনুভবরূপী জ্ঞান আমাদের হইতে পারে । মুক্ত বাষ্পের মধ্যে কোন বল না থাকিলেও তাহা কোন ভাণ্ডের ভিতর আবদ্ধ হইলে পরে তাহার উপর যেরূপ সেই চাপ পড়ে, সেই নিয়মেই অনাদি-পূর্ব-কর্মাৰ্জিত জড় দেহ ও ইন্দ্ৰিয়াদির দ্বারা পরমাত্মারই অংশভুত জীব [গী|১৫|৭] আবদ্ধ হইয়া পড়িলে এই গণ্ডী হইতে তাহাকে মুক্তি দিবার মতো অর্থাৎ মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি দেহেন্দ্ৰিয়দিগের হয়; এবং ইহাকেই ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ‘আত্মার স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি’ বলে । ‘ব্যবহার দৃষ্টিতে’ বলিবার কারণ এই যে, শুদ্ধ মুক্তাবস্থায় কিংবা ‘তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে’ আত্মা ইচ্ছারহিত ও অকর্তা, সমস্ত কর্তৃত্ব প্ৰকৃতিরই [গী|১৩|২৯; বেসূ|শাংতা|২|৩|৪০] । কিন্তু এই প্রকৃতি আপনা হইতে মোক্ষানুকুল কর্ম করে, সাংখ্যের ন্যায় বেদান্ত এইরূপ বলে না । কারণ তাহা মানিলে, জড়প্রকৃতি অন্ধভাবে অজ্ঞানীদিগকেও মুক্ত করিতে পারে এইরূপ বলিতে হয় । এবং মূলে যে আত্মা অকর্তা সে স্বতন্ত্রভাবে অর্থাৎ নিমিত্ত ব্যতীত আপনার স্বাভাবিকগুণেই কর্মপ্ৰবর্তক  হয়, ইহাও বলিতে পারা যায় না । তাই, আত্মা মূলে অকর্তা হইলেও বন্ধনের নিমিত্ত সে এইটুকুর জন্য চক্ষুগোচর ও কর্মপ্ৰবর্তক  হইয়া পড়ে, এবং যে নিমিত্তেই হউক একবার এইরূপ আগন্তুক প্ৰবৰ্ত্তকতা তাহাতে আসিলে, তাহা কর্মের নিয়ম হইতে ভিন্ন অর্থাৎ স্বতন্ত্র হইয়া পড়ে, বেদান্তশাস্ত্ৰে আত্মস্বাতন্ত্র্যের উক্ত সিদ্ধান্ত এই প্রকারে বিবৃত হইয়া থাকে । “স্বতন্ত্ৰ” অর্থে নির্নিমিত্তক নহে এবং আত্মা আপনার মূল শুদ্ধাবস্থায় কর্তাও হয় না । কিন্তু বারম্বার এই লম্বা চৌড়া কর্মকথা বলিতে না বসিয়া, ইহাকেই সংক্ষেপে আত্মার স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি কিংবা প্রেরণা এইরূপ বলিবার রীতি হইয়াছে । আত্মা বন্ধনের উপাধিতে বদ্ধ হওয়ায়, তদ্বারা ইন্দ্ৰিয় গৃহীত স্বতন্ত্র প্রেরণা এবং বাহ্যজগতের পদার্থসমূহের সংযোগে ইন্দ্রিয়ে উৎপন্ন প্রেরণা এই দুই একেবারে ভিন্ন । ‘খাও, পিয়ো, মজা লুটো’ - ইহা ইন্দ্ৰিয়ের প্রেরণা; এবং আত্মার প্রেরণা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার জন্য হয় । প্ৰথম প্রেরণাটি শুধু বাহ্য অর্থাৎ কর্মজগতের; দ্বিতীয় প্রেরণা আত্মার অর্থাৎ ব্রহ্মজগতের; এবং এই দুই প্রেরণা প্ৰায় পরস্পরবিরোধী হওয়ায় তাহাদের ঝগড়াতেই মনুষ্যের সমস্ত জীবন কাটিয়া যায় । ইহাদের ঝগড়ার সময় যখন মনে সন্দেহ হয় তখন কর্মজগতের প্রেরণাকে স্বীকার না করিয়া [ভাগ|১১|১০|৪], যদি মনুষ্য শুদ্ধ আত্মার স্বতন্ত্র প্রেরণা অনুসারে কাজ করে - এবং ইহাকেই প্ৰকৃত আত্মজ্ঞান কিংবা প্ৰকৃত আত্মনিষ্ঠা বলে - তবে তাহার সমস্ত আচরণ স্বভাবতই মোক্ষানুকূলই হইবে; এবং শেষে
বিশুদ্ধধর্মা শুদ্ধেন বুদ্ধেন চ স বুদ্ধিমান্‌ ৷
বিমলাত্মা চ ভবতি সমেত্য বিমলাত্মনা ৷
স্বতন্ত্রশ্চ স্বতন্ত্রেণ স্বতন্ত্রত্বমবাপণুতে ॥
“মূলে স্বতন্ত্র শারীর আত্মা, নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ নির্মল ও স্বতন্ত্র পরমাত্মাতে মিলিত হয় [মভা|শাং|৩০৮|২৭-৩০] । জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় এইরূপ যাহা উপরে বলা হইয়াছে তাহার অর্থই এই । কিন্তু উল্টাপক্ষে, জড় ইন্দ্রিয়গণের প্ৰাকৃত ধর্মের অর্থাৎ কর্মজগতের প্রেরণার প্রাবল্য হইলে মনুষ্য অধোগতি প্রাপ্ত হয় । বদ্ধ শারীর আত্মার ইন্দ্রিয়দিগকে মোক্ষানুকুল কর্ম করাইতে এবং ব্ৰক্ষাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভের এই যে স্বতন্ত্র শক্তি তাহা মনে করিয়াই ভগবান
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ৷
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥
“মনুষ্য আপনিই আপনাকে উদ্ধার করিবে; আপনি আপনাকে অবসন্ন করিবে না; কারণ (প্ৰত্যেকেই) আপনি আপনার বন্ধু (হিতকারী) এবং আপনিই আপনার শত্ৰু (অনিষ্টকারী)” [গী|৬|৫], এইরূপ আত্মস্বাতন্ত্র্যের অর্থাৎ স্বাবলম্বনের তত্ত্ব অর্জুনকে উপদেশ দিয়াছেন । এবং এই হেতুই যোগবাসিষ্টে দৈবের নিরাকরণ করিয়া পৌরুষের মাহাত্ম্য সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে [যো|২|সর্গ ৪-৮] । সর্বভূতে একই আত্মা, এই তত্ত্বটি বুঝিয়া এই অনুসারে যে মনুষ্য আচরণ করে তাহারই আচরণকে সদাচরণ কিংবা মোক্ষানুকূল আচরণ বলে; এবং এই প্রকার আচরণের দিকে দেহেন্দ্ৰিয়াদির প্রবৃত্তি উৎপাদন করাই বদ্ধ জীবাত্মারও স্বতন্ত্র ধর্ম হওয়ায় দুরাচারী মনুষ্যের অন্তঃকরণ সদাচারের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয় এবং সেই হেতু নিজ কর্মের জন্য, দুরাচারী ব্যক্তিরও পশ্চাত্তাপ হইয়া থাকে । আধিদৈবতবাদী পণ্ডিত ইহাকে সদসদ্‌বিবেক-বুদ্ধিরূপ দেবতার স্বতন্ত্র স্ফুরণ বলেন । কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার করিলে বুঝা যাইবে যে, বুদ্ধি-ইন্দ্রিয় জড়প্রকৃতিরই বিকার হওয়ায় উহা আপনারই প্রেরণা হইতে কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারে না, এই প্রেরণা উহা কর্মজগতের বাহিরের আত্মা হইতে পায় । এই প্ৰকার এই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের ‘ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য’ শব্দও বেদান্ত-দৃষ্টিতে ঠিক নহে । কারণ ইচ্ছা মনের ধর্ম । পূর্বে অষ্টম প্রকরণে বর্ণিত অনুসারে বুদ্ধি ও বুদ্ধির সঙ্গে মনও কর্মাত্মক জড়প্রকৃতির অসম্বেদ্য বিকার হওয়া-প্ৰযুক্ত এই দুই আপনা হইতে কর্মের বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে না । তাই প্ৰকৃত স্বাতন্ত্র্য মনেরও নহে কিংবা বুদ্ধিরও নহে, তাহা আত্মারই – এইরূপ বেদান্তশাস্ত্রে নির্ধারিত হইয়াছে । আত্মার এই স্বাতন্ত্র্য কেহ দিতে পারে না, কেহ কাড়িয়াও লইতে পারে না । স্বতন্ত্র পরমাত্মার অংশরূপ জীবাত্মা বন্ধনের উপাধিতে আটকিয়া পড়িলে সে আপনা হইতেই স্বতন্ত্রভাবে উপরি-উক্ত অনুসারে বুদ্ধি ও মন প্রেরণা করিয়া থাকে । অন্তঃকরণের এই প্রেরণার প্রতি উপেক্ষা করিয়া যদি কেহ কাজ করে তাহা হইলে
যে যেঁ কোণাচেঁ কায় বা গেলে ৷
জ্যাচে ত্যানেঁ অনহিত কেলেঁ ॥
‘সে আপনার পায়ে আপনি কুঠার মারিতে প্রস্তুত’ এইরূপ তুকারামবাবার মতো বলিতে হয় [গা|৪৪৪৮] ! ভগবদ্গীতায় ‘ন হিনস্ত্যাত্মনাহত্মানং’ - যে আপনাকে আপনি হনন করে না তাহার উত্তম গতি লাভ হয়, এই তত্ত্বের উল্লেখ পরে করা হইয়াছে [গী|১৩|২৮]; “দাসবোধে”ও ইহার স্পষ্ট অনুবাদ করা হইয়াছে [দাস|১৭|৭|৭-১০ দেখ] । যদিও দেখা যায় যে, মনুষ্য কর্ম জগতের অভেদ্য বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ, তথাপি মনুষ্য স্বভাবতই মনে করে যে, আমি যে কোন কর্ম স্বতন্ত্ৰভাবে করিতে পারি । অনুভবের এই তত্ত্বের উপপত্তি উপরিউক্ত-অনুসারে জড়-জগৎ হইতে ব্ৰহ্মজগৎ ভিন্ন বলিয়া না মানিলে অন্য কোনরূপেই সঙ্গত হয় না । তাই, যে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ মানে না তাহাকে এই বিষয়ে মনুষ্যের নিত্য দাসত্ব স্বীকার করিতে হইবে অথবা প্ৰকৃতিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন বুদ্ধির অগম্য বলিয়া ছাড়িয়া দিতে হইবে; অন্য পন্থা নাই । প্ৰকৃতিস্বাতন্ত্র্যের কিংবা ইচ্ছাস্বাতন্ত্রোর এই উপপত্তি, - জীবাত্মা ও পরমাত্মা মূলে একরূপ অদ্বৈতবাদের এই সিদ্ধান্তের অনুসরণ করিয়া দিয়াছি [বেসূ|শাং ভা|২|৩|৪০] । কিন্তু এই অদ্বৈত মত যিনি মানেন না, কিংবা ভক্তির জন্য যিনি দ্বৈত স্বীকার করেন, তিনি বলেন যে, জীবাত্মার এই সামর্থ্য তাহার নিজের নহে, উহা পরমেশ্বর হইতে ইহা প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । তথাপি কখনও “ন ঋতে শ্ৰান্তস্য সখ্যায় দেবাঃ” [ঋ|৪|৩৩|১১] - শ্ৰান্ত হওয়া পর্যন্ত প্ৰযত্নকারী মনুষ্য ছাড়া অন্যকে দেবতার সাহায্য করেন না - ঋগ্বেদের এই তত্ত্ব অনুসরণ করিয়া বলা যায় যে, এই সামর্থ্য লাভের জন্য জীবাত্মার প্রথমে আপনা হইতেই প্ৰযত্ন করা আবশ্যক, অর্থাৎ আত্ম প্রযত্নের এবং পর্যায়ক্ৰমে আত্মস্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব পুনরপি দৃঢ়রূপে স্থাপিতই থাকে [বেসূ|২|৩|৪১,৪২; গী|১০|৫ ও ১০] । আর কত বলিব ? বৌদ্ধেরা আত্মার কিংবা পরব্রহ্মের অস্তিত্ব মানে না; কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান ও আত্মজ্ঞান তাহারা না মানিলেও তাহাদের ধর্মগ্রন্থেই “অত্তনা (আত্মনা) চোদয়হত্তানং” – আপনাকে আপনিই মার্গে প্রবৃত্ত করিতে হইবে - এই উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, এবং তাহার সমর্থনাৰ্থ বলা হইয়াছে -
অত্তা (আত্মা) হি অত্তনো নাথো অত্তা হি অত্তনো গতি ৷
তস্মা সঞ্জময়হত্তানং অসূসং (অশ্বং) ভদ্দং ব বাণিজো ॥
আপনিই আপনার কর্তা, আপনার আত্মা ছাড়া অন্য ত্ৰাণকর্তা নাই; অতএব কোন বণিক যেরূপ আপনার উত্তম অশ্বকে সংযত করে সেইরূপ আপনিই আপনাকে সংযমন করিবে” [ধর্মপদ|৩৮০]; গীতার ন্যায় আত্মস্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব ও আবশ্যকতাও বর্ণিত হইয়াছে [মহাপরিনিব্বাণসুত্ত|২|৩৩-৩৫ দেখ] । আধিভৌতিক ফরাসী পণ্ডিত কোঁৎ-এর নির্ধারণও এই বর্গের মধ্যে ধরিতে হইবে । কারণ কোন অধ্যাত্মবাদকেই তিনি না মানিলেও, কোন উপপত্তি বিনা কেবল প্রত্যক্ষ সিদ্ধ বলিয়া, প্রযত্নের দ্বারা মনুষ্য নিজের আচরণ ও পরিস্থিতি সংশোধন করিতে পারে ইহা তিনি স্বীকার করিয়াছেন ।


15) পরন্তু কর্ম করিবার সাধন জীবাত্মার নিজের কাছে নাই


কর্ম হইতে মুক্ত হইয়া সর্বভুতে এক আত্মা উপলব্ধি করিবার যে আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থা তাহা প্রাপ্ত হইবার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানই একমাত্ৰ মহৌষধ, এবং এই জ্ঞান লাভ করা আমাদের আয়ত্তাধীন, ইহা সিদ্ধ হইলেও আর একটি কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, এই স্বতন্ত্র আত্মাও আপনার বক্ষস্থিত প্ৰকৃতির বোঝাকে একেবারে অর্থাৎ ক্ষণমাত্রে ফেলিয়া দিতে পারে না । কোন কারিগরের নিজের দক্ষতা থাকিলেও যন্ত্র না হইলে যেমন তাহার চলে না এবং যন্ত্র খারাপ হইলে তাহা মেরামৎ করিতে তাহার সময় লাগে, জীবাত্মারও সেইরূপ অবস্থা । জ্ঞানলাভের প্রেরণা করিবার সময় জীবাত্মা স্বতন্ত্র একথা সত্য, কিন্তু জীবাত্মা তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে মূলে নিগুৰ্ণ ও কেবল কিংবা পূর্বে সপ্তম প্রকরণে ইক্ত-অনুসারে চক্ষুমান্‌ কিন্তু খঞ্জ হওয়া প্রযুক্ত [মৈক্র্যু|৩|২,৩; গী|১৩|২০], উক্ত প্রেরণা অনুসারে পরে কোন কর্ম করিতে হইলে যে সামগ্রী কিংবা যে সাধন আবশ্যক হয় (যথা কুম্ভকারের চাকা ইত্যাদি) তাহা এই আত্মার নিজের নিকট থাকে না – যে সাধন উপলব্ধ হয় যথা দেহ ও বুদ্ধি-আদি ইন্দ্রিয় সেই সমস্ত মায়াত্মক প্ৰকৃতির বিকার । তাই, নিজের মুক্তির কার্য ও জীবাত্মাকে প্রারব্ধকর্মানুসারে প্রাপ্ত দেহেন্দ্ৰিয়াদি সাধন বা উপাধির দ্বারাই করিয়া লইতে হয় । এই সাধনগুলির মধ্যে বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয় মুখ্য হওয়ায় কোন কার্য করিতে হইলে, আত্মা বুদ্ধিকেই সমুচিত প্রেরণা করে । কিন্তু পূর্বকর্মানুসারে এবং প্ৰকৃতি-স্বভাব-বশতঃ এই বুদ্ধি যে সর্বদা শুদ্ধ ও সাত্ত্বিকই থাকিবে এরূপ কোন নিয়ম নাই । তাই, প্ৰথমে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির প্রপঞ্চ হইতে মুক্ত হইয়া এই বুদ্ধি অন্তর্মুখ, শুদ্ধ, সাত্ত্বিক কিংবা আত্মনিষ্ঠ হইতে হইবে; অর্থাৎ এই বুদ্ধি এরূপ হইবে যে, জীবাত্মার প্রেরণার হুকুম শুনিয়া তাহার যাহাতে কল্যাণ হয় এইরূপ কর্ম করিবে । ইহা হইতে গেলে বহুকাল বৈরাগ্য অভ্যাস করা আবশ্যক । এতটা করিয়াও ক্ষুধাতৃষ্ণা প্ৰভৃতি দেহ ধর্ম এবং যে সঞ্চিত কর্মের ফলভোগ আরম্ভ হইয়াছে সেই কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া ত যায়ই না । তাই, বন্ধন-উপাধি-বদ্ধ জীবাত্মার দেহেন্দ্ৰিয়াদিগকে মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রেরণা করিবার স্বাতন্ত্র্য থাকিলেও পরে প্রকৃতির যোগেই সমস্ত কার্য করাই হয় বলিয়া সেই পরিমাণে ছুতার কুমোর প্রভৃতি কারিগরের ন্যায় সেই আত্মা পরাবলম্বী হইয়া যায় এবং তাহাকে দেহেন্দ্ৰিয়াদি যন্ত্র প্রথমে সাফ্‌ করিয়া তাহাদিগকে নিজের অধীনে আনিতে হইবে [বেসূ|২|৩|৪০] । এই কার্য একবারে হইতে পারে না; ধৈর্য সহকারে ধীরে ধীরে করিতে হইবে; নচেৎ অশায়েস্তা ঘোড়ার মত ইন্দ্ৰিয় সকল খানার ভিতর নিশ্চয়ই পতিত হইবে । এই জন্য ভগবান বলিয়াছেন - ইন্দ্ৰিয়-নিগ্ৰহাৰ্থ বুদ্ধিকে ধৃতির অর্থাৎ ধৈর্যের সাহায্য গ্ৰহণ করিতে হইবে [গী|৬|২৫]; এবং পরে অষ্টাদশ অধ্যায়ে বুদ্ধির ন্যায় ধৃতির সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক এই তিন নৈসর্গিক ভেদ প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে [গী|১৮|৩৩-৩৫] । তন্মধ্যে তামসিক ও রাজসিক পৈঠাকে ছাড়িয়া দিয়া বুদ্ধিকে সাত্বিক করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিতে হয়; তাই ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই প্রকার ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহাভ্যাসরূপ যোগের উপযুক্ত স্থান, আসন ও আহার কি, তাহার সংক্ষিপ্ত বৰ্ণনা আছে । এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে যে, ‘শনৈঃ শনৈঃ’ [গী|৬|২৫] অভ্যাস করিলে পর, চিত্ত স্থির হইয়া ইন্দ্রিয়গণ আয়ত্তাধীন হয় এবং পরে কালক্রমে (একেবারে নহে) ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া, “আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধুন্তি ধনঞ্জয়” - সেই জ্ঞানের দ্বারা কর্মের বন্ধন মোচন হয় [গী|৪|৩৮-৪১] । কিন্তু ভগবান একান্তে যোগাভ্যাস করিতে বলিতেছেন বলিয়া [গী|৬|১০] জগতের সমস্ত ব্যবহার ছাড়িয়া যোগাভ্যাসেই সমস্ত জীবন ক্ষেপণ করাই গীতার তাৎপর্য এইরূপ অর্থ বুঝিতে হইবে না । কোন ব্যবসায়ী যেরূপ নিজের অল্পস্বল্প যাহা কিছু থাকে তাহা লইয়াই প্ৰথমে ব্যবসা আস্তে আন্তে শুরু করিয়া দিয়া শেষে অপার সম্পত্তি লাভ করে, সেইরূপই গীতার কর্মযোগেরও কথা । আপনার যতটা সাধ্য ততটা ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিয়া প্ৰথমে কর্মযোগ শুরু করিতে হইবে, এবং তাহার দ্বারাই শেষে অধিকাধিক ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহসামর্থ্য লাভ করা যায় । তথাপি একেবারে হাত গুটাইয়া বসিয়াও যোগাভ্যাস করিলে চলে না । কারণ, তাহার ফলে বুদ্ধির একাগ্রতার অভ্যাস কমিয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে । তাই, যাহাতে কর্মযোগ বরাবর সমান চালাইতে পারা যায় এইজন্য অল্প সময় নিত্য-নিয়মিত কিংবা মাঝে মাঝে কিছুকাল একান্তে থাকাও আবশ্যক হয় [গী|১৩|১০] । তাহার জন্য জাগতিক ব্যবহার ছাড়িবে এরূপ ভগবান্‌ কোথাও বলেন নাই । উল্টা, জাগতিক ব্যবহার নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে থাকিবে, তাহার জন্যই ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের অভ্যাস করিতে বলিয়াছেন । এই ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের সঙ্গেই নিষ্কাম কর্মযোগও যথাশক্তি প্ৰতোকের করিতে হইবে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হওয়া পৰ্যন্ত প্ৰতীক্ষা করিয়া থাকিবে না, এইরূপ গীতার উপদেশ । মৈক্র্যপনিষদে এবং মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, মনুষ্য বুদ্ধিমান ও নিগ্রহী হইলে এইপ্ৰকার যোগাভ্যাসে ছয় মাসের মধ্যে সাম্যবুদ্ধি প্রাপ্ত হইতে পারে; [মৈক্র্যু|৬|২৮; মভা|শাং|২৩৯|৩২; অশ্ব|অনুগীতা|১৯|৬৬] । 


16) মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য আচরিত স্বল্প কর্মও ব্যর্থ যায় না


কিন্তু ভগবান কর্তৃক বর্ণিত বুদ্ধির এই সাত্ত্বিক, সম কিংবা আত্মনিষ্ঠা অবস্থা ছয়মাসে কেন, ছয় বৎসরেও প্রাপ্ত হয় না; এবং এই অভ্যাস অপূর্ণ থাকিবার কারণে এই জন্মে পূর্ণ সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে না শুধু নহে, পরজন্মে গোড়া হইতে আবার শুরু করিতে হইবে বলিয়া, পরজন্মের যোগাভ্যাসও পুনৰ্বার পূর্বের মতোই অপূর্ণ থাকিবে; তাই এইরূপ আশঙ্কা হয় যে, এইপ্ৰকার পুরুষ পূর্ণসিদ্ধি কখনই লাভ করিতে পরিবে না; ফলতঃ এইরূপ মনে করাও সম্ভব যে, কর্মযোগের আচরণ করিবার পূর্বে পাতঞ্জলযোগের দ্বারা সম্পূর্ণ নিৰ্বিকল্প সমাধির শিক্ষা করা প্ৰথমে আবশ্যক । অর্জুনের মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হওয়ায়, এই প্রসঙ্গে মনুষ্যের কি করা উচিত এইরূপ শ্ৰীকৃষ্ণকে অর্জুন গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে [গী|৬|৩৭-৩৯] প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন । ভগবান এই প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দিয়াছেন যে, আত্মা অমর হওয়ায় তাহার উপর লিঙ্গশরীর দ্বারা এই জন্মে যে অল্প-বিস্তর সংস্কার উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহাই পরে দৃঢ়স্থায়ী হয় এবং এই ‘যোগভ্ৰষ্ট’ ব্যক্তি অৰ্থাৎ কর্মযোগ সম্পূৰ্ণ সাধন না করিয়া তাহা হইতে যে ভ্ৰষ্ট হইয়াছে সেই ব্যক্তি পরজন্মে আপন প্ৰযত্নে সেখান হইতেই পরে আরম্ভ করে এবং এইরূপ হইতে হইতে ক্ৰমে “অনেকজন্মসংসিদ্ধ-স্ততো-যাতি পরাং গতিম্‌” - [গী|৬|৪৫] - অনেক জন্মের পর, শেষে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করিয়া সে মোক্ষ প্রাপ্ত হয় । “স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্ৰায়তে মহতো ভয়াৎ” [গী|২|৪০] এই ধর্মের অর্থাৎ কর্মযোগমার্গের স্বল্প আচরণেই মহা সঙ্কট হইতে উদ্ধার হয় - এইরূপ দ্বিতীয় অধ্যায়ে যাহা উক্ত হইয়াছে তাহা এই সিদ্ধান্তেরই অনুরূপ বাক্য । সারকথা, মনুষ্যের আত্মা মূলে স্বতন্ত্র হইলেও পূর্বকর্মানুসারে আপন প্রাপ্ত দেহের অশুদ্ধ প্ৰকৃতি-স্বভাব-বশতঃ একজন্মেই মনুষ্যের পূর্ণ সিদ্ধি লাভ হইতে পারে না । কিন্তু তাহাতেও “নাত্মানমবমন্যেত পূর্বাভিরসমৃদ্ধিভিঃ” [মনু|৪|১৩৭] কেহ যেন নিরাশ না হয়; একজন্মেই পরমসিদ্ধি লাভ করিবার দুরাগ্রহে পতিত হইয়া, পাতঞ্জল যোগাভ্যাসে অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের নিছক্‌ কসরৎ-কার্যেই সমস্ত জীবন যেন অনর্থক কাটিয়া না যায় । আত্মার কোন ত্বরা নাই, আজ যাহা সাধ্য ততটা যোগবলই আয়ত্ত করিয়া কর্মযোগের আচরণ শুরু করিয়া দিবে অৰ্থাৎ তাহা দ্বারাই ধীরে ধীরে বুদ্ধি অধিকাধিক সাত্ত্বিক ও শুদ্ধ হইয়া কর্মযোগের এই স্বল্পাচরণ কেন, জিজ্ঞাসা পৰ্যন্ত, - চৰ্কায় অৰ্পিতের ন্যায়, মনুষ্যকে বলপূর্বক সামনে ক্রমশঃ ঠেলিতে ঠেলিতে শেষে, - আজ নয় তো কাল, এ জন্মে নয় তো পরজন্মে, তাহার আত্মাকে পূৰ্ণব্ৰহ্ম-প্ৰাপ্তি করাইয়া দেয় । সেইজন্য কর্মযোগমার্গের অত্যন্ত স্বল্পাচরণ কিংবা জিজ্ঞাসা পর্যন্তও কখনই ব্যর্থ হয় না, ইহাই কর্মযোগশাস্ত্রের বিশেষ গুণ — এইরূপ গীতাতেই ভগবান স্পষ্ট বলিয়াছেন [গী|৬|১৫ সম্বন্ধে আমার টীকা দেখ] । কেবল এই জন্মের দিকে দৃষ্টি না দিয়া এবং ধৈর্যত্যাগ না করিয়া নিষ্কাম কর্ম করিবার উদ্যোগ স্বাতন্ত্র্যসহকারে ও ধীরে ধীরে যথাশক্তি আমাদের করা কৰ্তব্য । প্রাক্তন সংস্কারবশতঃ প্ৰকৃতির বন্ধন এই জন্মে আজ মোচন হইবার নহে বলিয়া মনে হয়; কিন্তু তাহাই ক্রমে ক্রমে বিবৃদ্ধমান কর্মযোগের অভ্যাসে কাল কিংবা পরজন্মে আপনা-আপনিই শিথিল হইয়া যায় এবং এইরূপ হইতে হইতে “বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্‌ মাং প্ৰপদ্যতে” [গী|৭|১৯] - কখন না কখন পূর্ণ জ্ঞান প্ৰাপ্তি দ্বারা প্ৰকৃতির বন্ধন কিংবা পরাধীনতা হইতে মুক্ত হইয়া আত্মা অবশেষে আপন মূল পূর্ণ নির্গুণ মুক্তাবস্থা অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্ত হয় । মনুষ্য কি না পারে ? “নর করণী করে তো নরসে নারায়ণ হোয়” নর যদি উচিত কাজ করে সে নর নারায়ণ হয় - এই যে চলিত কথা আছে তাই এই বেদান্তসিদ্ধান্তেরই অনুরূপ বাক্য; যোগবাসিষ্ঠকার এই কারণেই মুমুক্ষু-প্রকরণে উদ্যোগের প্রশংসা করিয়া, উদ্যোগের দ্বারাই সমস্তই প্ৰাপ্ত হওয়া যায় এইরূপ নিঃসন্দিগ্ধ বিধান করিয়াছেন [যো|২|৪|১৬-১৮] ।


17) কর্মক্ষয়ের স্বরূপ


যাক্‌ । জ্ঞানলাভার্থ প্ৰযত্ন করিবার জন্য জীবাত্মা মূলে স্বতন্ত্র এবং স্বাবলম্বনপূর্বক দীর্ঘ উদ্যোগের দ্বারা শেষে কখন-না-কখন প্ৰাক্তন কর্মের বন্ধনপাশ হইতে মুক্ত হয়, ইহা সিদ্ধ হইলেও কর্মক্ষয় কি, ও কখন কর্মক্ষয় হয় এবিষয়ে আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । কর্মক্ষয় অর্থে সমস্ত কর্মের বন্ধন হইতে পূর্ণরূপে অর্থাৎ নিঃশেষে মুক্ত হওয়া । কিন্তু পুরুষ জ্ঞানী হইলেও তাহার যতদিন দেহ থাকে ততদিন পর্যন্ত সে তৃষ্ণা, ক্ষুধা, শোয়া, বসা ইত্যাদি কর্ম হইতে মুক্ত হয় না এবং প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয়ও ভোগ ব্যতীত হয় না, তাই সে আগ্রহপূর্বক দেহত্যাগাদি করিতে পারে না ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । জ্ঞান হইবার পূর্বে কৃতকর্ম জ্ঞানের দ্বারা নাশ নিঃসন্দেহ হয়; কিন্তু যখন জ্ঞানী পুরুষের যাবজ্জীবন জ্ঞানোত্তরকালেও ন্যূনাধিক কর্ম করিতেই হয় তখন এইরূপ কর্ম হইতে তাহার মুক্তি কি করিয়া হইবে ? এবং মুক্ত না হইলে, পূর্বকর্মক্ষয় কিংবা পরে মোক্ষও হয় না, এই সংশয় উঠতে পারে । ইহার উত্তরে বেদান্তশাস্ত্র এইরূপ বলেন যে, নামরূপাত্মক কর্ম জ্ঞানী ব্যক্তির নামরূপাত্মক দেহ হইতে মুক্ত না হইতে পারিলেও, আত্মার সেই কর্ম আপনাতে গ্ৰহণ করা বা না করা বিষয়ে স্বাধীনতা থাকায়, ইন্দ্ৰিয়দিগকে জয় করিয়া, কর্মে প্রাণীমাত্রের যে আসক্তি থাকে তাহাকে যদি ক্ষয় করা যায় তাহা হইলে কর্ম করিলেও তাহার অঙ্কুর বিনষ্ট প্রায় হয় । কর্ম স্বভাবতঃ অন্ধ, অচেতন, কিংবা মৃত । কর্ম আপনা হইতে কাহাকে ধরে না এবং ছাড়েও না; উহা স্বত ভালোও নহে, মন্দও নহে । মনুষ্য আপনাকে এই কর্মে আবদ্ধ রাখিয়া নিজ আসক্তির দ্বারা উহাকে ভালো কিংবা মন্দ, শুভ কিংবা অশুভ প্ৰস্তুত করিয়া লয় । তাই, এই মমত্বযুক্ত আসক্তি হইতে মুক্ত হইলে, কর্মের বন্ধন স্বতই ভাঙ্গিয়া যায় এইরূপ বলা যায়; - তারপর সেই কর্ম থাকুক বা চলিয়া যাক্‌ । 


18) কর্ম দূর হয় না, ফলাশা ছাড়


গীতারও স্থানে স্থানে এই উপদেশই দেওয়া হইয়াছে - প্ৰকৃত নৈষ্কর্ম ইহাতেই, কর্মত্যাগে নহে [গী|৩|৪]; কর্মেই তোমার অধিকার, ফল লাভ করা বা না করা তোমার অধিকারের বিষয় নহে [গী|২|৪৭]“কর্মেন্দ্ৰিয়ৈঃ কর্মযোগমসত্তঃ” [গী|৩|৭] - ফলের আশা না রাখিয়া কর্মেন্দ্ৰিয়দিগকে কর্ম করিতে দেও; “ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গম্‌” [গী|৪|২০] - কর্মফল ত্যাগ করিয়া “সর্বভুতাত্মভূতাত্মা কুৰ্বন্নপি ন লিপ্যতে” [গী|৫|৭] - সমস্ত ভূতে যাহার সমদৃষ্টি হইয়াছে সেই পুরুষ কর্ম করিলেও কর্মের দ্বারা বদ্ধ হয় না; “সৰ্বকর্মফলত্যাগং কুরু” [গী|১২|১১] - সমস্ত কর্মফল ত্যাগ কর; “কার্যমিত্যেব যৎকর্ম নিয়তং ক্রিয়তে” [গী|১৮|৯] -  কেবল কৰ্তব্য বলিয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে সে সাত্ত্বিক; “চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য” [গী|১৮|৫৭] - সমস্ত কর্ম আমাকে অৰ্পণ করিয়া কাজ কর । উপরে যাহা বলিয়া আসিলাম, তাহাদের ইহাই বীজ । 


19) কর্মের বন্ধকত্ব মনে, কর্মে নহে


জ্ঞানী মনুষ্য সমস্ত ব্যবহারিক কর্ম করিবে কি করিবে না, এই প্রশ্ন স্বতন্ত্র । তৎসম্বন্ধে গীতাশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত কি, তাহার বিচার পরবর্তী প্রকরণে করা যাইবে । এখন কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত কর্ম ভস্ম হইয়া যায় । ইহার প্রকৃত অর্থ কি; এবং উপরি-প্রদত্ত বচনাদি হইতে, এই বিষয়ে গীতার কি অভিপ্রায় তাহা ব্যক্ত হয় । ব্যবহারেও এই নীতিসূত্রই আমরা প্রয়োগ করি । উদাহরণ যথা – অজ্ঞাতসারে কোন ব্যক্তি যদি কাহাকে ধাক্কা মারে তাহা হইলে আমরা সেই ব্যক্তিকে গুণ্ডা বলি না; এবং ফৌজদারী আইনেও নিছক্‌ অপঘাতঘটিত হত্যাকে হত্যা বলিয়া ধরে না । আগুনে ঘর পুড়িয়া গেলে, কিংবা বৃষ্টির বন্যায় ক্ষেত ভাসিয়া গেলে, আগুনকে কিংবা বৃষ্টিকে কি কেহ অপরাধী মনে করে ? শুধু কর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে, প্ৰত্যেক কর্মে মনুষ্যের দৃষ্টিতে কিছু না কিছু দোষ কিংবা মন্দ পাওয়া যাইবেই যাইবে, - “সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধুমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ” [গী|১৮|৪৮] । কিন্তু গীতা যে দোষকে ছাড়িতে বলে তাহা ইহা নহে । মনুষ্যের কোন কর্মকে আমরা যে শুভাশুভ বলি, তাহার ভালমন্দত্ব কর্মে থাকে না, তাহা সেই কর্মের কর্তার বুদ্ধিতে থাকে । ইহা মনে রাখিয়া গীতায় সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, কর্মের মন্দত্ব ঘুচাইতে হইলে কর্তার আপনি বুদ্ধি ও মনকে শুদ্ধ রাখিতে হইবে, [গী|২|৪৯-৫১]; এবং উপনিষদেও -
মনএব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ ৷
বন্ধায় বিষয়াসঙ্গি মোক্ষে নির্বিষয়ং স্মৃতম ॥
“মনুষ্যের (কর্মের) বন্ধন কিংবা মোক্ষ প্ৰাপ্তির পক্ষে মনই (এব) কারণ; মন বিষয়াসক্ত হইলে, বন্ধন এবং নিষ্কাম কিংবা নির্বিষয় অর্থাৎ নিঃসঙ্গ হইলে মোক্ষ” - এইরূপে কর্মকর্তা মনুষ্যের বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে [মৈক্র্য|৬|৩৪; অমৃতবিন্দু|২] । ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান লাভ করিয়া বুদ্ধির এই সাম্যাবস্থা কিরূপে সম্পাদন করিবে ইহাই ভগবদ্গীতায় মুখ্যরূপে উক্ত হইয়াছে । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে কর্ম করিলেও সম্পূর্ণ কর্মক্ষয় হইয়া থাকে । নিরগ্নি হইয়া অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া অগ্নিহোত্ৰাদি কর্ম ত্যাগ করিলে কিংবা অক্রিয় থাকিলে অর্থাৎ কোন কর্ম না করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে কর্মের ক্ষয় হয় না [গী|৬|১] । মনুষ্যের ইচ্ছা থাক্‌ বা না থাক্‌, প্ৰকৃতির চক্ৰ সর্বদা ঘুরিতে থাকায় মনুষ্যকেও সেই সঙ্গে চলিতে হয় [গী|৩|৩৩; ১৮|৬০] । কিন্তু অজ্ঞান লোকেরা এইরূপ অবস্থায় প্রকৃতির অধীনে থাকিয়া যেরূপ নাচিতে থাকে সেরূপ না করিয়া ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির ও শুদ্ধ রাখিয়া যে ব্যক্তি সৃষ্টিক্রমানুসারে প্রাপ্ত কর্ম কেবল কৰ্তব্য বলিয়া অনাসক্ত বুদ্ধিতে ও শান্তভাবে করে সে-ই প্ৰকৃত বৈরাগী, প্ৰকৃত স্থিতপ্ৰজ্ঞ ও ব্রহ্মপদপ্রাপ্ত পুরুষ [গী|৩|৭; ৪|২১; ৫|৭-৯; ১৮|১১] । যদি কোন জ্ঞানী পুরুষ কোনও ব্যবহারিক কর্ম না করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া বনে গমন করেন, তাহা হইলে এই প্রকার ব্যবহারিক কর্ম ত্যাগ করায় তাহার কর্মের ক্ষয় হইল এরূপ মনে করা বড় ভুল [গী|৩|৪] । সে কর্ম করুক বা না করুক, তাহার কর্মের যে ক্ষয় হয়, তাহা তাহার বুদ্ধি সাম্যাবস্থায় পৌঁছিয়াছে বলিয়াই হয়, কর্ম ছাড়িবার দরুন কিংবা না করিবার দরুন নহে, এই তত্ত্বটি সর্বদা মনে রাখা উচিত । অগ্নির দ্বারা যেরূপ কাষ্ঠ দগ্ধ হয় সেইরূপ জ্ঞানের দ্বারা কর্ম দগ্ধ হয়; এই দৃষ্টান্ত অপেক্ষা, পদ্মপত্রের উপর জল থাকিলেও উক্ত পত্রে যেমন জল লাগিয়া থাকে না সেইরূপ জ্ঞানী পুরুষকে - অৰ্থাৎ ব্ৰহ্মাৰ্পণ করিয়া অথবা আসক্তি ছাড়িয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে তাহাকে কর্ম লেপিয়া ধরে না, উপনিষদের ও গীতার এই দৃষ্টান্ত [ছাং|৪|১৪|৩; গী|৫|১০] কর্মক্ষয়ের প্রকৃত স্বরূপ দেখাইবার পক্ষে অধিক উপযোগী । কর্ম স্বরূপত কখনই দগ্ধ হয় না; এবং উহাকে দগ্ধ করিবার কোন আবশ্যকতাও হয় না । কর্ম নামরূপ এবং নামরূপ দৃশ্য জগৎ ইহা যদি সিদ্ধ হয় তবে এই সমস্ত দৃশ্য জগৎ দগ্ধ হইবে কি করিয়া ? এবং কচিৎ কখন দগ্ধ হইলেও সৎকার্যবাদ অনুসারে বড় জোর তাহার নামরূপই পরিবর্তিত হইবে । নামরূপাত্মক স্বকর্ম কিংবা মায়া নিত্য বদলায় বলিয়া নামরূপকে আপন রুচি অনুসারে মনুষ্য যদি বদলাইয়া লয়, তাহা হইলেও মনুষ্য যতই আত্মজ্ঞানী হউক না কেন, এই নামরূপাত্মক কর্মের সমূলে নাশ করিতে পারে না; তাহা কেবল পরমেশ্বরই করিতে পারেন, এ কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই [বেসূ|৪|৪|১৭ দেখ] । কিন্তু মূলে এই জড় কর্মের মধ্যে ভালমন্দের যে বীজ অবস্থিতই নাই এবং মনুষ্য আপন মমত্ববুদ্ধির দ্বারা তাহার মধ্যে যাহাকে উৎপাদন করিয়া থাকে তাহার নাশ করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত, এবং তাহার দ্বারা যাহা দগ্ধ করা যাইতে পারে তাহা ইহাই । সমস্ত ভূতে সমত্ববুদ্ধি স্থাপন করিয়া আপনার সমস্ত কর্মের এই মমত্ববুদ্ধি যিনি দগ্ধ করিয়াছেন তিনিই ধন্য, কৃতকৃত্য ও মুক্ত; সমস্ত কর্ম করিতে থাকা সত্ত্বেও তাহার কর্ম জ্ঞানাগ্নির দ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, এইরূপ উক্ত হয় [গী|৪|১৯; ১৮|৫৬] । 


20) জ্ঞান হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ অনারব্ধ কর্মক্ষয়


এই প্রকারে কর্ম দগ্ধ হওয়া সম্পূর্ণরূপে মনের নির্বিষয়তার উপর এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের অনুভূতির উপর নির্ভর করে বলিয়া, অগ্নি কখনও উৎপন্ন হইলেই যেরূপ তাহার দহন করিবার ধর্ম তাহাকে ছাড়ে না, সেইরূপ ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান যখনই হউক না কেন, তাহার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাহার কর্মক্ষয়রূপ পরিণাম সংঘটিত হইতে কালের অপেক্ষায় থাকিতে হয় না । জ্ঞান হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ কর্মক্ষয় হইয়া থাকে । 


20a) মৃত্যুকালের গুরুত্ব


তথাপি অন্য সমস্ত কাল অপেক্ষা মৃত্যুকাল এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুতর বলিয়া ধরা যায় । কারণ, মৃত্যুই আয়ুর চরম কাল; এবং তাহার পূর্বে কোন এক সময়ে ব্ৰহ্মজ্ঞান হইয়া অনারব্ধ সঞ্চিতের ক্ষয় হইলেও প্ৰারব্ধ নষ্ট হয় না । তাই, এই ব্ৰহ্মজ্ঞান যদি শেষ পৰ্যন্ত বরাবর সমানভাব স্থায়ী না হয়, তাহা হইলে প্ৰারব্ধ কর্মানুসারে মরণ পৰ্যন্ত ভালমন্দ, কর্ম যাহা ঘটিবে সে সমস্ত সকাম হইবে এবং তাহার ফলভোগ করিবার জন্য পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হইবে । যে সম্পূর্ণ জীবন্মুক্ত হইয়াছে তাহার এই ভয় থাকে না, ইহা স্বীকার করি । কিন্তু এই বিষয়ের শাস্ত্রদৃষ্টিতে যখন বিচার করিতে হয় তখন মৃত্যুর পূর্বে উৎপন্ন ব্ৰহ্মজ্ঞান কখনও বা শেষ পৰ্যন্ত টিকিয়া না-ও থাকিতে পারে এ বিষয়ের বিচার করা নিশ্চয় অবশ্যক । তাই মৃত্যুর পূর্বের কাল অপেক্ষা শাস্ত্রকার মৃত্যুকালকেই বিশেষরূপে গুরুতর কাল বলিয়া মনে করেন; এবং তখন অর্থাৎ মৃত্যুকালে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের অনুভূতি সংঘটিত হওয়া আবশ্যক, নচেৎ মোক্ষলাভ সম্ভব নহে, এইরূপ নির্ধারণ করেন । এই অভিপ্ৰায়েই “অন্তকালে অনন্যভাবে আমাকে স্মরণ করিলে মনুষ্য মুক্ত হয়” এইরূপ উপনিষদের ভিত্তিতে গীতায় উক্ত হইয়াছে [গী|৮|৫] । এই সিদ্ধান্তানুসারে বলিতে হয় যে, যাহার সমস্ত জীবন দুরাচারে কাটিয়াছে, কেবল মৃত্যুসময়ে তাহার পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে সেও মুক্ত হয় । অনেকের মতে এরূপ হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে । কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলে, ইহাতে অসঙ্গত কিছুই নাই, এইরূপ প্ৰতীতি হইবে । যাহার সমস্ত জীবন দুরাচারে কাটিয়াছে তাহার কেবল মৃত্যুকালেই সুবুদ্ধি ও ব্ৰহ্মজ্ঞান উৎপন্ন হইতে পারে না । অন্য বিষয়ের ন্যায় মনকে ব্ৰহ্মনিষ্ঠ করিবার অভ্যাস করা চাই; এবং সমস্ত জীবনের মধ্যে একবারও যাহার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি হয় নাই তাহার কেবল অন্তকালেই তাহা একবারে পাওয়া পরম দুর্ঘট, এমন কি, অসম্ভব । তাই, এই সম্বন্ধে গীতার আর একটা বড় কথা আছে – প্রত্যেকেই মনকে বিষয়-বাসনা-শূন্য করিবার অভ্যাস নিত্যকাল রাখিবে, যাহার ফলে অন্তকালেও সেই অবস্থাটীই বজায় রাখিবার পক্ষে কোন বাধা ঘটিবে না, এবং মনুষ্য শেষে মুক্ত হইবে [গী|৮|৬,৭ ও ২|৭২] । কিন্তু শাস্ত্ৰ ছাঁকিয়া সত্য নিৰ্বাচনের জন্য স্বীকার করা যাউক যে, পূর্বসংস্কারাদি কারণবশতঃ কাহারও কেবল মৃত্যুকালেই সহসা পরমেশ্বরের জ্ঞানলাভ হইল । লক্ষ লক্ষ এমনকি কোটি কোটি মনুষ্যের মধ্যে এই প্রকারের এক-আধটা উদাহরণ পাওয়া যাইবে সন্দেহ নাই । 

কিন্তু তাহা কত দুর্লভ বা দুর্ঘট তাহার বিচার একপাশে রাখিয়া দিয়া, এইরূপ অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে কি হইবে, এক্ষণে আমাদের ইহাই আলোচ্য । মৃত্যুকালেই জ্ঞান হোক্‌ না কেন, তাহা দ্বারা মনুষ্যের অনারব্ধ সঞ্চিতের ক্ষয় হইবেই; এবং আরব্ধকার্য-সঞ্চিতের ক্ষয় এই জন্মের ভোগের দ্বারা মৃত্যুকালে হয় । তাই, তাহার কোন কর্ম ভোগ করাই অবশিষ্ট থাকে না; এবং এইরূপ অগত্যা সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে, সমস্ত কর্ম হইতে অর্থাৎ সংসারচক্ৰ হইতে সে মুক্ত হয় । এই সিদ্ধান্ত “অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্‌” ইত্যাদি [গী|৯|৩০] – খুব দুরাচারী মনুষ্যও পরমেশ্বরকে অনন্যভাবে ভজনা করিলে মুক্ত হয়ই হয় - এই গীতাবাক্যে উক্ত হইয়াছে; এবং এই সিদ্ধান্ত জগতের অন্য ধর্মেও গ্ৰাহ্য হইয়াছে । ‘অনন্যভাব’ অর্থে পরমেশ্বরে মানুষের চিত্তবৃত্তি পূর্ণরূপে লীন হওয়া; চিত্তবৃত্তি অন্যদিকে রাখিয়া মুখে “রাম রাম” বিড়্‌ বিড়্‌ করা নয়, এইটুকু মাত্র এই স্থানে মনে রাখা চাই । মোট কথা, ব্ৰহ্মজ্ঞানের মহিমাই এইরূপ যে, জ্ঞান হইলেই সমস্ত অনারব্ধ সঞ্চিতের একেবারেই ক্ষয় হয় । এই অবস্থা যখনই প্রাপ্ত হই না কেন, সর্বদা ইষ্ট তো বটেই । কিন্তু সেই অবস্থাকেই মৃত্যুকালে স্থির রাখা, কিংবা পূর্বে প্ৰাপ্ত না হইলেও অন্তত অন্তকালে প্ৰাপ্ত হওয়া নিতান্তই অবশ্যক । নতুবা মৃত্যুকালে কিছু বাসনা অবশিষ্ট থাকিলে পুনর্জন্ম এড়ানো যাইবে না, এবং পুনর্জন্ম এড়াইতে না পারিলে মোক্ষও পিছাইয়া পড়িবে এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা স্থির করিয়াছেন ।


21) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড


কর্মবন্ধন কি, কর্মক্ষয় কাহাকে বলে এবং তাহা কি প্রকারে ও কখন্‌ হয়, ইহা বলিয়াছি । এখন উপস্থিতপ্ৰসঙ্গে, যাহাদের কর্মফল নষ্ট হইয়াছে তাহারা এবং যাহারা কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় নাই তাহারা মৃত্যুর পর বৈদিক ধর্মানুসারে কোন গতি প্রাপ্ত হয় ইহার একটু বিচার করিয়া এই প্রকরণ শেষ করিব । এই সম্বন্ধে উপনিষদে অনেক আলোচনা হইয়াছে [ছাং|৪|১৫; ৫|১০; বৃ|৬|২, ২-১৬; কৌ|১|২-৩] । তাহাদের একবাক্যতা বেদান্তসূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে করা হইয়াছে । কিন্তু এই সমস্ত আলোচনা বিবৃত করিবার এখানে কোন প্রয়োজনই নাই । কেবল ভগবদ্গীতায় যে দুই মাৰ্গ [গী|৮|২৩-২৭] প্রদত্ত হইয়াছে সেই সম্বন্ধেই এক্ষণে আমাদের বিচার কৰ্তব্য । বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই দুই প্ৰসিদ্ধ ভেদ আছে । 


21a) শ্রৌতযজ্ঞ ধর্ম বা ত্রয়ীধর্ম


তন্মধ্যে, কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য সূর্য, অগ্নি, ইন্দ্ৰ, বরুণ, রুদ্র ইত্যাদি বৈদিক দেবতাদিগকে যজ্ঞের দ্বারা পূজা করিয়া, তাহাদের প্রসাদে ইহলোকে পুত্ৰ-পৌত্ৰাদি সন্ততি এবং গো অশ্ব ধনধান্যাদি সম্পত্তি লাভ করিয়া শেষে মৃত্যুর পর সদ্‌গতি লাভ করা । বর্তমানকালে এই যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত ধর্ম লুপ্তপ্ৰায় হওয়ায় উক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য দেবভক্তি ও দানধর্মাদি শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্ম লোকে করিয়া থাকে । ঋগ্‌বেদ হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, প্ৰাচীনকালে লোক শুধু স্বার্থের জন্য নহে, সমস্ত সমাজের কল্যাণার্থও যজ্ঞের দ্বারাই, দেবতাদের আরাধনা করিত । উক্ত কার্যের জন্য যে দেবতার আনুকুল্য সম্পাদন করিতে হয় সেই ইন্দ্রাদি দেবতাদের স্তবস্তুতির দ্বারাই ঋগবেদের সূক্তগুলি পূর্ণ; এবং তাহাতে স্থানে স্থানে “হে দেব ! আমাদিগকে সন্ততি দেও, সমৃদ্ধি দেও” “আমাদিগকে শতায়ু কর” “আমাদিগকে, আমাদের সন্তানসন্ততিকে, আমাদের বীরপুরুষদিগকে এবং আমাদের গরু-বাছুরকে মারিও না” এইরূপ প্রার্থনা করা হইয়াছে । (এই মন্ত্র অনেক স্থানে প্রদত্ত হইয়াছে; কিন্তু সে সমস্ত না দিয়া এই বহুল প্রচলিত মন্ত্রটি এই স্থানে বলিলেই যথেষ্ট — “মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ৌ মা নো গোষু মা নো অশ্বেষু রীরিষঃ । বীরান্মা নো রুদ্র ভামিতো বর্ধীর্হবিষ্মন্তঃ সদমিত্বা হবমাহে ॥” [ঋ|১|১১৪|৮]) এই যাগযজ্ঞ তিন বেদেরই বিধান হওয়ায় এই মার্গের পুরাতন নাম – ‘ত্রয়ীধর্ম’; এই যজ্ঞ কিরূপে করিতে হইবে ব্ৰাহ্মণগ্রন্থে তাহার বিস্তৃত বর্ণনা আছে । 


21b) জৈমিনির ‘পূর্বমীমাংসা’


কিন্তু বিভিন্ন ব্ৰাহ্মণগ্রন্থে যজ্ঞের বিভিন্ন বিধি বর্ণিত থাকায় কোনটি গ্রাহ্য তৎসম্বন্ধে সন্দেহ উপস্থিত হইতে লাগিল; তাই জৈমিনি এই পরস্পরবিরুদ্ধ বাক্যগুলির সমন্বয় কিরূপে করা যাইবে তৎসম্বন্ধীয় অর্থনির্ণায়ক নিয়মসমূহের সংগ্ৰহ করিলেন । জৈমিনির এই নিয়মকেই ‘মীমাংসাসূত্র’ কিংবা ‘পূর্বমীমাংসা’ বলে; এবং সেই জন্য এই প্ৰাচীন কর্মকাণ্ডের নাম পরে ‘মীমাংসক মাৰ্গ’ হইয়াছে; ঐ নামই এক্ষণে প্ৰচলিত হওয়ায় আমিও এই গ্রন্থে অনেকবার উহার উপযোগ করিয়াছি । কিন্তু ‘মীমাংসা’ শব্দই পরে প্রচলিত হইলেও যাগযজ্ঞাদির এই মার্গ অতি প্ৰাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, ইহা মনে রাখা উচিত । এই কারণে গীতায় ‘মীমাংসা’ শব্দ কোথাও আসে নাই; তাহার বদলে ‘ত্ৰয়ীধর্ম’ [গী|৯|২০,২১] কিংবা ‘ত্ৰয়ী বিদ্যা’ নাম আসিয়াছে । 


21c) বাদরায়ণাচার্যর ‘উত্তরমীমাংসা’


যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতকর্মপ্ৰতিপাদক ব্ৰাহ্মণগ্ৰন্থাদির পরে আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত । ইহাতে যাগযজ্ঞাদি কর্ম গৌণ ও ব্ৰহ্মজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ এইরূপ প্ৰতিপাদিত হওয়ায় ইহার ধর্মকে ‘জ্ঞানকাণ্ড’ বলা হয় । তথাপি, বিভিন্ন উপনিষদে বিভিন্ন বিচার থাকায় উহাদেরও সমন্বয় করা আবশ্যক । এই কার্য বাদরায়ণাচার্য স্বকীয় বেদান্তসূত্ৰে করিয়াছেন । এই গ্ৰন্থকে ব্ৰহ্মসূত্র কিংবা শারীরসূত্র বা ‘উত্তরমীমাংসা’ বলে ।

এই প্রকার পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা অনুক্ৰমে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড সম্বন্ধে প্ৰধান গ্ৰন্থ । বস্তুতঃ এই দুই গ্ৰন্থ মূলে মীমাংসারই অর্থাৎ বৈদিক বচনাদির অর্থের আলোচনা করিয়াছে । তথাপি কর্মকাণ্ড প্ৰতিপাদককে শুধু ‘মীমাংসক’ এবং জ্ঞানকাণ্ড-প্রতিপাদককে ‘বেদান্তী’ বলাই এক্ষণে রীতি হইয়াছে । কর্মকাণ্ডীরা অর্থাৎ মীমাংসকেরা বলেন যে শ্রৌতধর্মে চাতুর্মাস্য, জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যাগযজ্ঞাদি কর্মই প্ৰধান; এবং তাহা যে ব্যক্তি করিবে, সে-ই বেদের আদেশ অনুসারে মোক্ষলাভ করে । এই যাগযজ্ঞাদি কর্ম কেহই ছাড়িতে পারিবে না । যদি ছাড়ে, তবে শ্রৌতধর্ম হইতে সে বিচ্ছিন্ন হইল এইরূপ বুঝিতে হইবে । কারণ, জগতের উৎপত্তির সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের উৎপত্তি হইয়াছে; এবং মনুষ্য যজ্ঞ করিয়া দেবতাদিগকে তৃপ্ত করিবে, এবং দেবতারাও মনুষ্যের যে যে বিষয় আবশ্যক তাহা পুরণ করিবেন, এই চক্ৰ অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে । এক্ষণে আমি এই বিচারের বিশেষ গুরুত্ব আছে বলিয়া মনে করি না, কারণ যাগযজ্ঞরূপ শ্রৌতধর্ম এক্ষণে প্রচলিত নাই । কিন্তু গীতাকালের অবস্থা ভিন্ন হওয়ায় ভগবদ্গীতাও [গী|৩|১৬-২৫] যজ্ঞকর্মের মাহাত্ম্য উপরি-উক্ত-অনুসারেই বর্ণিত হইয়াছে । তথাপি গীতা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, সে সময়েও উপনিষদের জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষদৃষ্টিতে এই যজ্ঞকর্মাদির গৌণত্ব উপলব্ধ হইয়াছিল [গী|২|৪১-৪৬] । এই গৌণত্বই অহিংসাধর্মের, বিস্তারের পর ক্রমেই বাড়িয়া গিয়াছিল । যাগযজ্ঞ বেদবিহিত হইলেও তাহার জন্য পশুবধ প্ৰশস্ত নহে, ধান্যের দ্বারাই যজ্ঞ করিবে, এইরূপ ভাগবতধর্মে স্পষ্ট প্ৰতিপাদন করা হইয়াছে [মভা|শাং|৩৩৬|১০ ও ৩৩৭ দেখ] । সেই জন্য (এবং কিয়দংশে পরে জৈনেরাও এইরূপ কথাই উত্থাপন করায়) এখনকার কালে শ্রৌতযজ্ঞমার্গের এইরূপ অবস্থা হইয়াছে যে, নিত্য শ্রৌতাগ্নিহোত্ৰপালনকারী অগ্নিহোত্রী কাশীর ন্যায় বড় বড় ধর্মক্ষেত্রেও খুব কমই দেখিতে পাওয়া যায়; এবং দশ কুড়ি বৎসরের মধ্যে একটী জ্যোতিষ্টোমাদি পশুযজ্ঞ হইয়াছে বলিয়া কদাচিৎ শুনিতে পাওয়া যায় । তথাপি শ্রৌতধর্মই সমস্ত বৈদিক ধর্মের মূল হওয়ায় তৎসম্বন্ধে আদরবুদ্ধি অদ্যাপি বজায় আছে এবং জৈমিনীয় সূত্র অৰ্থনির্ণায়ক শাস্ত্রের তৌলের উপর প্রমাণ গণ্য হয় । 


21d) স্মার্তযজ্ঞ (পঞ্চমহাযজ্ঞ)


শ্রৌত যাগযজ্ঞাদি ধর্ম এইরূপ শিথিল হইলেও মন্বাদি স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত অন্য যজ্ঞ - যাহাকে পঞ্চমহাযজ্ঞ বলে - অদ্যাপি প্ৰচলিত আছে এবং এই সম্বন্ধেও শ্রৌতযাগযজ্ঞচক্রাদিরই উক্ত নিয়ম প্ৰযুক্ত হয় । উদাহরণ যথা, মম্বাদি স্মৃতিকারেরা বেদাধ্যয়নরূপ ব্ৰহ্মযজ্ঞ, তৰ্পণরূপ পিতৃযজ্ঞ, হোমরূপ দেবযজ্ঞ, বলিরূপ ভূতযজ্ঞ এবং অতিথিসন্তৰ্পণরূপ মনুষ্যযজ্ঞ, এইরূপ পাঁচ অহিংসাত্মক ও নিত্য গৃহযজ্ঞের কথা বলিয়াছেন; এই পাঁচ যজ্ঞেই অনুক্ৰমে ঋষিগণ, পিতৃগণ, দেবতাগণ, ভূতগণ ও মনুষ্যগণকে প্রথমে তৃপ্ত করিয়া তাহার পর গৃহস্থ নিজে অন্ন গ্ৰহণ করিবে এইরূপ গাৰ্হস্থ্যধর্মের বিধি প্ৰদত্ত হইয়াছে [মনু|৩|৬৮-১২৩] । এই যজ্ঞ করিয়া যে অন্ন অবশিষ্ট থাকে তাহার নাম ‘অমৃত’; এবং সমস্ত,লোকের আহার হইয়া যে অন্ন উদ্‌বৃত্ত হয় তাহাকে ‘বিঘস’ বলে [মনু|৩|২৮৫] । এই ‘অমৃত’ ও ‘বিঘস’ অন্নই গৃহস্থের পক্ষে বিহিত ও শ্রেয়স্কর ৷ এইরূপ না করিয়া যে কেহ কেবল আপনার উদরের জন্য অন্ন পাক করিয়া খায় সে অঘ অর্থাৎ পাপ ভক্ষণ করে, এবং তাহাকে মনুস্মৃতি ঋগ্‌বেদ ও গীতা প্রভৃতি সকল গ্রন্থেই ‘অঘাশী’ বলা হইয়াছে [ঋ|১০|১১৭|৬; মনু|৩|১১৮; গী|৩|১৩] । এই স্মাৰ্ত্ত পঞ্চমহাযজ্ঞ ছাড়া দান, সত্য, দয়া, অহিংসা প্ৰভৃতি সর্বভূতহিতপ্ৰদ অন্য ধর্মও উপনিষদে ও স্মৃতিগ্রন্থে গৃহস্থের পক্ষে বিহিত বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে [তৈ|১|১১]; এবং তাহাতেই, পরিবারের বৃদ্ধি করিয়া বংশ বজায় রাখিবে – ‘প্রজাতন্তুং মা ব্যাবচ্ছেৎসীঃ’ - এইরূপ স্পষ্ট উল্লেখ আছে । এই সমস্ত কর্মকে একপ্রকার যজ্ঞ বলিয়াই মানা যায় এবং তাহা করিবার কারণ তৈত্তিরীয় সংহিতায় এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, ব্ৰাহ্মণ জন্মতই আপনার পৃষ্ঠের উপর তিন প্রকার ঋণ লইয়া আসে - এক ঋষিদের, দ্বিতীয় দেবতাদিগের ও তৃতীয় পিতৃগণের । তন্মধ্যে ঋষিদের ঋণ বেদাভ্যাসে, দেবতাদের ঋণ যজ্ঞের দ্বারা এবং পিতৃগণের ঋণ পুত্রোৎপত্তির দ্বারা শোধ করা আবশ্যক, নচেৎ তাহার সদ্‌গতি হইবে না [তৈ|সং|৬|৩|১০|৫] । (তৈত্তিরীয় সংহিতার বচনটি এই – “জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভিঋর্ণবা জায়তে ব্রহ্মচর্য্যেণর্ষিভ্যো যজ্ঞেন দেবেভ্যঃ প্রজয়া পিতৃভ্য এব বা অনৃণে যঃ পুত্রী বজ্বা ব্রহ্মচারিবাসাতি” ।) জরৎকারু যখন এই প্ৰকার না করিয়া বিবাহ করিবার পূর্বেই কঠোর তপশ্চর্যায় প্রবৃত্ত হইলেন তখন সন্তানক্ষয় প্ৰযুক্ত তাঁহার যাযাবর নামক পিতৃপুরুষ আকাশে ঝুলিয়া আছেন তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল এবং তাঁহার আদেশক্রমে পরে তিনি বিবাহ করিলেন, এইরূপ মহাভারতের আদি পর্বে এক কথা আছে [মভা|আ|১৩] । 


22) কর্মপ্রধান গার্হস্থ্যবৃত্তি


এই সমস্ত কর্ম অথবা যজ্ঞ কেবল ব্ৰাহ্মণদিগেরই করিতে হইবে এরূপ নহে । বৈদিক যাগযজ্ঞ ব্যতীত অন্য সমস্ত কর্ম যথাধিকার স্ত্রী ও শূদ্রের পক্ষেও বিহিত হওয়ায় স্মৃতিকারদিগের কথিত চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা অনুসারে অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মই যজ্ঞ; উদাহরণ যথা, ক্ষত্ৰিয়দিগের যুদ্ধও এক যজ্ঞ; এবং যজ্ঞ শব্দের এই ব্যাপক অর্থই এই প্রকরণে বিবক্ষিত হইয়াছে । যাহার পক্ষে যাহা বিহিত তাহাই তাহার তপ [১১|২৩৬] এইরূপ মনু বলিয়াছেন । মহাভারতেও -
আরম্ভযজ্ঞাঃ ক্ষত্ৰাশ্চ হবিৰ্যজ্ঞা বিশঃ স্মৃতাঃ ৷
পরিচারযজ্ঞাঃ শূদ্ৰাশ্চ জপযজ্ঞা দ্বিজাতয়ঃ ॥
আরম্ভ (উদ্যোগ), হবি, সেবা ও জপ এই চার যজ্ঞ, ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য শূদ্র ও ব্রাহ্মণ এই চার বর্ণের পক্ষে যথানুক্ৰমে বিহিত এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|২৩৭|১২] । সার কথা, এই জগতের সমন্ত মনুষ্যকে যজ্ঞার্থই ব্ৰহ্মদেব সৃষ্টি করিয়াছেন [মভা|অনু|৪৮|৩; ও গী|৩|১০ ও ৪|৩২ দেখ] । ফলত চাতুর্বর্ণ্যাদি সমস্ত শাস্ত্রোক্ত কর্মই একপ্রকার যজ্ঞ; এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ অধিকারানুসারে এই যজ্ঞ অর্থাৎ শাস্ত্রোক্ত কর্ম - ধন্ধা, ব্যবসায় বা কৰ্তব্যব্যবহার - যদি তাহারা প্ৰচলিত না রাখে তাহা হইলে সমস্ত সমাজের ক্ষতি হইয়া অবশেষে তাহার ধ্বংস হইবারও সম্ভাবনা হইয়া থাকে । তাই এই ব্যাপক অর্থে সিদ্ধ হইতেছে যে, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যজ্ঞের আবশ্যকতা সর্বদাই হইয়া থাকে ।


23) জ্ঞানযুক্ত ও জ্ঞানরহিত কর্ম


এক্ষণে এই প্রশ্ন উত্থিত হইতেছে যে, যদি বেদ-অনুসারে এবং চাতুর্বর্ণাদি স্মাৰ্ত্ত ব্যবস্থানুসারে গৃহস্থের পক্ষে সেই কেবল কর্মময়, যজ্ঞপ্রধান বৃত্তি বিহিত বলিয়া স্বীকৃত হইল, তবে কি এই সাংসারিক কর্ম ধর্ম-শাস্ত্ৰানুসারে যথা-বিধি (অর্থাৎ নীতি ও ধর্মের আদেশ অনুসারে) করিলে তাহার দ্বারাই মনুষ্য জন্মমরণের ফের হইতে মুক্ত হয় ? আর যদি বলা যায় যে সে মুক্ত হয়, তাহা হইলে জ্ঞানের মাতব্বরী ও যোগ্যতা কি রহিল ? ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান হইয়া কর্মে বিরক্ত না হইলে নামরূপাত্মক মায়া হইতে কিংবা জন্মমরণের ফের হইতে মুক্তি নাই, এইরূপ জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ উপনিষদ্‌ স্পষ্ট বলেন; এবং শ্রৌতস্মার্ত ধর্ম যদি দেখ, তবে প্রত্যেকের সমস্ত জীবন কর্মপ্ৰধান কিংবা ব্যাপকার্থে যজ্ঞময়, এইরূপ দেখা যায় । তাছাড়া যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধক হয় না এবং যজ্ঞের দ্বারাই স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হয় এইরূপ বেদও স্পষ্ট বলিয়াছেন । স্বর্গের কথা একপাশে সরাইয়া রাখিলেও ইন্দ্ৰাদি দেবতারা সন্তুষ্ট না হইলে বৃষ্টি পড়ে না এবং যজ্ঞ না করিলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন না, এইরূপ নিয়ম ব্ৰহ্মদেবই স্থাপন করিয়াছেন । তবে যজ্ঞ অর্থাৎ কর্ম ব্যতীত মনুষ্যের কাজ চলিবে কি করিয়া ?
আগ্নৌ প্রাস্তাহুতিঃ সম্যগাদিত্যমুপাতিষ্ঠাতে ৷
আদিত্যাজ্জায়তে বৃষ্টি বৃর্ষ্টেরন্নং ততঃ প্ৰজাঃ ॥
“যজ্ঞে হুত দ্রব্যাদি অগ্নি দ্বারা সূর্যের নিকট পৌছায় এবং সূর্য হইতে পর্জন্য, পর্জন্য হইতে অন্ন, এবং অন্ন হইতে প্রজা উৎপন্ন হয়” ইহলোকে মনুস্মৃতি, মহাভারত, উপনিষদ ও গীতাতে এইরূপ ক্রম দেওয়া হইয়াছে [মনু|৩|৭৬; মভা|শাং|২৬২|১১; মৈক্র্যু|৬৩৭; ও গী|৩|১৪ দেখ] । এবং এই যজ্ঞ যদি কর্মের দ্বারাই সাধ্য হয় তবে কর্ম ছাড়িলে কাজ চলিবে কি করিয়া ? যজ্ঞময় কর্ম ছাড়িলে সংসারচক্র বন্ধ হইয়া যাইবে, কেহ খাইতেও পাইবে না ! ইহার উত্তরে ভাগবত ধর্ম ও গীতাশাস্ত্র বলেন যে, যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কিংবা অন্য কোন স্মাৰ্ত্ত বা ব্যবহারিক যজ্ঞময় কর্ম ছাড়ো আমরা এ কথা বলি না; অধিক কি, পুর্বাপর চলিয়া আসিতেছে এই যে যজ্ঞের চক্র ইহা বন্ধ হইয়া গেলে জগৎ উৎসন্ন হইবে, তোমাদের এই কথা আমাদেরও মান্য । তাই, কর্মময় যজ্ঞ কখনই ত্যাগ করা উচিত নহে ইহাই আমাদের সিদ্ধান্ত [মভা|শাং|৩৪০; গী|৩|১৬] । কিন্তু জ্ঞান ও বৈরাগ্যের দ্বারা কর্মময় না হইলে মোক্ষ নাই এইরূপ জ্ঞানকাণ্ডে অর্থাৎ উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তাই, এই দুই সিদ্ধান্ত মিলাইয়া সমস্ত কর্ম জ্ঞানের সহিত অর্থাৎ ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কাম কিংবা বিরক্ত বুদ্ধিতে করিতে হইবে ইহাই আমাদের শেষ কথা [গী|৩|১৭-১৯ দেখ] । স্বৰ্গফলের কাম্যবুদ্ধি মনে স্থাপন করিয়া জ্যোতিষ্টোমাদি যাগযজ্ঞ করিলে, বেদের কথা অনুসারে তুমি স্বৰ্গফল পাইবে ইহাতে সন্দেহ নাই; কারণ, বেদাজ্ঞা কখনই মিথ্যা হইতে পারে না । কিন্তু স্বৰ্গফল নিত্য অর্থাৎ স্থায়ী হয় না বলিয়া উক্ত হইয়াছে যে, -
প্ৰাপ্যান্তং কর্মণস্তস্য যৎকিঞ্চেহ করোত্যয়ম্‌ ৷
তস্মাল্লোকাৎ পুনরেত্যস্মৈ লোকায় কর্মণে ॥ *
* (এই মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণ পড়িবার সময় ‘পুনরেতি’ এবং ‘অস্মৈ’ এইরূপ পদচ্ছেদ করিয়া পড়িলে এই চরণে অক্ষরের কমী পড়িবে না । বৈদিক গ্ৰন্থ পড়িবার সময় অনেক সময় এইরূপ করা আবশ্যক হয় ।)

“ইহলোকে অনুষ্টিত যাগযজ্ঞাদি পুণ্যকর্মের ফল স্বৰ্গভোগের দ্বারা শেষ হইলে, যজ্ঞকারী কর্মকাণ্ডী মনুষ্যকে স্বৰ্গলোকে হইতে এই কর্মলোকে অর্থাৎ ভূলোকে পুনর্বার আসিতে হয়” [বৃ|৪|৪|৬; বেসূ|৩|১|৮; মভা|বন|২৬০|৩৯] । স্বৰ্গ হইতে নীচে আসিবার কোন্‌ পথ তাহাও ছান্দোগ্যউপনিষদে উক্ত হইয়াছে [ছাং|৫|১০|৩-৯] । “কামাত্মানঃ স্বৰ্গপরাঃ” কিংবা “ত্ৰৈগুণ্যবিষয়া বেদাঃ” [গী|২|৪৩,৪৫] এইরূপ কিছু গৌণত্বসূচক যে বর্ণনা ভগবদ্গীতায় আছে তাহা এই কর্মকাণ্ডী লোকদিগকেই লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছে; এবং নবম অধ্যায়ে আরও স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, “গতাগতং কামকামা লভন্তে” [গী|৯|২১] - তাহাদিগকে স্বৰ্গলোকে ও ইহলোকে বারবার যাতায়াত করিতে হয় । এই যাতায়াত না ঘুচিলে আত্মার প্রকৃত শান্তি, পুর্ণাবস্থা কিংবা মোক্ষলাভ হয় না । তাই, গীতার সমস্ত উপদেশের সার এই যে, শুধু যাগযজ্ঞাদি কেন, চাতুর্বর্ণের সমস্ত কর্মই তুমি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা ও সাম্যবুদ্ধির দ্বারা আসক্তি ছাড়িয়া কর, এই প্রকারে কর্মচক্ৰ বজায় রাখিয়াও তুমি মুক্ত হইবে [গী|১৮|৫|৬] । দেবতাদের উদ্দেশে, তিল তণ্ডুল কিংবা পশু “ইদং অমুকদেবতায়ৈ ন মম” বলিয়া অগ্নিতে হবন করিলেই যজ্ঞ হয় এরূপ নহে । প্ৰত্যক্ষ পশু বধ করা অপেক্ষা প্ৰত্যেকের শরীরে কাম-ক্ৰোধাদি যে পশুবৃত্তি আছে, সাম্যবুদ্ধিরূপ সংযম-অগ্নিতে তাহাদের হোম করাই অধিক শ্রেয়ষ্কর যজ্ঞ [গী|৪|৩৩] । এই অভিপ্ৰায়েই “যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, এইরূপ গীতায় ও নায়ায়ণীয় ধর্মে ভগবান্‌ বলিয়াছেন [গী|১০|২৫; মভা|শাং|৩|৩৭] । মনুস্মৃতিতেও জপের দ্বারাই ব্ৰাহ্মণ সিদ্ধিলাভ করিতে পারে - তারপর আর যাহা করুক বা না করুক, - এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মনু|২|৮৭] । অগ্নিতে আহুতি দিবার সময় ‘ন মম’ - ইহা আমার নয় - এইরূপ বলিয়া উক্ত দ্রব্যের উপর নিজের মমত্ববুদ্ধি ত্যাগ করাই যজ্ঞের মুখ্য তত্ত্ব; এবং দানাদি কর্মেরও ইহাই বীজ, তাই এই কর্মের যোগ্যতাও যজ্ঞের সহিত সমান । অধিক কি, যাহাতে নিজের কিছু মাত্র স্বার্থ নাই এইরূপ কর্ম শুদ্ধ বুদ্ধিতে করিলে তাহাকে যজ্ঞ বলিলেও চলে । যজ্ঞের এই ব্যাখ্যা স্বীকার করিলে, বুদ্ধিকে নির্মম কিংবা নিষ্কাম রাখিয়া অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মকেই ব্যাপক অর্থে যজ্ঞ বলা যায়; এবং দ্রব্যময় যজ্ঞের পক্ষপাতী মীমাংসকের ‘যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধনকারণ হয় না’ এই নিয়মসূত্র ঐ সমস্ত নিষ্কাম কর্মেও প্রযুক্ত হয় । এই কর্ম করিবার সময় ফলাশাও ত্যাগ করা প্ৰযুক্ত স্বর্গের যাতায়াতও ঘটে না এবং এই কর্ম করিলেও শেষে মোক্ষরূপ সদ্‌গতি লাভ হয় [গী|৩|৯] ৷ সার কথা, সংসার যজ্ঞময় কিংবা কর্মময় হইলৈও কর্ম-অনুষ্ঠানকারীদিগকে দুই বর্গে বিভক্ত করা হইয়া থাকে । এক, শাস্ত্ৰোক্ত রীতিতে কিন্তু ফলাশা রাখিয়া যাহারা সংসারযাত্রা নিৰ্বাহ করে (কর্মকাণ্ডী লোক); আর দুই, নিষ্কাম বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া যাহারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করে (জ্ঞানী লোক) । তন্মধ্যে প্ৰথম অর্থাৎ নিছক কর্মকাণ্ডী লোকদিগের স্বৰ্গপ্ৰাপ্তিরূপ অনিত্য ফল, এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা কিংবা নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্মকারী জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের নিত্য মোক্ষফল লাভ হয়, এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত । মোক্ষের জন্য কর্ম ছাড়িতে গীতা কোথাও বলেন নাই । উল্টা, অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে স্পষ্টরূপে উক্ত হইয়াছে যে, ‘ত্যাগ = ছাড়া’ শব্দে গীতাতে কর্মত্যাগের পরিবর্তে ‘ফলত্যাগ’ই সর্বত্র বিবক্ষিত ।


24) মৃত্যুর পর বিভিন্ন গতি - দেবযান ও পিতৃযান


কর্মকাণ্ডী ও কর্মযোগীদিগের প্রাপ্য ফল এইপ্ৰকারে বিভিন্ন হওয়ায়, প্ৰত্যেককে মৃত্যুর পর ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন ভিন্ন লোকে যাইতে হয় । এই মার্গের নাম অনুক্রমে ‘পিতৃযান’ ও ‘দেবযান’ [শাং|১৭|১৫|১৬] । এবং উপনিষদের ভিত্তিতে এই দুই মাৰ্গই গীতার অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে । যাহার জ্ঞানলাভ হইয়াছে সেই ব্যক্তির - এবং এই জ্ঞান অন্ততঃ অন্তিমকালে তো অবশ্যই হইয়া গিয়াছে [গী|২|৭২] - শরীর মৃত্যুর পর চিতায় দগ্ধ হইলে, সেই অগ্নি হইতে জ্যোতি (জ্বালা), দিবা, শুক্লপক্ষ, এবং উত্তরায়ণের ছয় মাসে - প্ৰয়াণ করিতে করিতে সেই ব্যক্তি ব্ৰহ্মপদে গিয়া পৌছায় এবং সেখানে তাহার মোক্ষলাভ হওয়ায় সে পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করিয়া এই মৃত্যুলোকে ফিরিয়া আসে না; কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু কর্মকাণ্ডী অর্থাৎ যাহার জ্ঞান হয় নাই, সে সেই অগ্নি হইতে ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ ও দক্ষিণায়নের ছয় মাস এই ক্রমানুসারে চলিয়া চন্দ্ৰলোকে পৌঁছিয়া তাহার কৃত পুণ্যের সমস্ত ফল ভোগ করিয়া পুনর্বার ইহলোকে জন্মগ্রহণ করে; এই দুই মার্গের এইরূপ ভেদ [গী|৮|২৩-২৭] । ‘জ্যোতি’ (জ্বালা) শব্দের স্থানে উপনিষদে ‘অৰ্চি’ (জ্বালা) এই শব্দ থাকায় প্রথম মার্গের ‘অৰ্চিরাদি’ এবং দ্বিতীয়ের ‘ধূম্রাদি’ এইরূপ নামও আছে । আমাদের উত্তরায়ণ উত্তর ধ্রুবস্থানে অবস্থিত দেবতাদের দিন এবং আমাদের দক্ষিণায়নই তাঁহাদের রাত্রি, এই পরিভাষার প্ৰতি লক্ষ্য করিলে, এই দুই মার্গের মধ্যে অৰ্চিরাদি (জ্যোতিরাদি) কিংবা প্ৰথম মার্গ আরম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত প্ৰকাশময় এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ ধূম্রাদি মার্গ অন্ধকারময়, ইহা স্পষ্টই দেখা যায় । জ্ঞান প্ৰকাশময় এবং পরব্রহ্ম ‘জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ’ [গী|১৩|১৭] - জ্যোতির জ্যোতি - হওয়া প্ৰযুক্ত মৃত্যুর পর জ্ঞানী ব্যক্তির মাৰ্গ প্ৰকাশময় হওয়াই সঙ্গত; গীতায় এই দুই মার্গের – ‘শুক্ল’ ও ‘কৃষ্ণ’ এই যে দুই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, প্ৰকাশময় ও অন্ধকারময়ই তাহার অর্থ । গীতায় উত্তরায়ণের পরবর্তী পৈঠার উল্লেখ নাই । কিন্তু যাস্কের নিরুক্তে উত্তরায়ণের পর দেবলোক, সূর্য, বৈদ্যুত, ও মানস পুরুষের বর্ণনা আছে [নিরুক্ত|১|৯]; এবং উপনিষদে দেবযানের যে বৰ্ণনা আছে তাহার সমন্বয় করিয়া বেদান্তসূত্রে উত্তরায়ণের পরে সম্বৎসর, বায়ুলোক, সূর্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, বরুণলোক, ইন্দ্রলোক, প্রজাপতিলোক ও পরিশেষে ব্ৰহ্মলোক এইরূপ পরবর্তী সমস্ত পৈঠা প্ৰদত্ত হইয়াছে [বৃহ|৫|১০; ৬|২|১৫; ছাৎ|৫|১০; কৌষী|১|৩; বেসূ|৪|৩|১-৬] ।


25) দেবযান ও পিতৃযান - কালবাচক বা দেবতাবাচক ?


দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের পৈঠা বা আড্ডার বর্ণনা করা হইল । কিন্তু ইহাদের মধ্যে দিবস, শুক্ল পক্ষ, উত্তরায়ণ প্ৰভৃতির যে বৰ্ণনা আছে তাহার সাধারণ অর্থ কালবাচক হওয়ায় দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের সহিত কালের কোন সম্বন্ধ আছে কিংবা প্ৰথমে কখন ছিল কি না, এই প্রশ্ন স্বভাবতঃ উপস্থিত হয় । দিন, রাত্রি, শুক্লপক্ষ প্ৰভৃতি শব্দের অর্থ কালবাচক হইলেও অগ্নি, জ্যোতি, বায়ুলোক, বিদ্যুৎ প্রভৃতি অন্য যে সকল পৈঠা বর্ণিত হইয়াছে তাহাদের অর্থ কালবাচক হইতে পারে না; এবং জ্ঞানী ব্যক্তি দিন কিংবা রাত্রে মরিলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন গতি লাভ হয় এইরূপ মানিলে জ্ঞানেরও কোন মাহাত্ম্য থাকে না । তাই, অগ্নি দিন উত্তরায়ণ প্ৰভৃতি সমস্ত শব্দই কালবাচক স্বীকার না করিয়া বেদান্তসূত্রে ঐ সকল শব্দের দ্বারা তত্তদাভিমানী দেবতা কল্পনা করিয়া এই সকল দেবতা, জ্ঞানী ও কর্মকাণ্ডী ব্যক্তির আত্মাকে বিভিন্ন মাৰ্গ দিয়া ব্ৰহ্মলোকে ও চন্দ্ৰলোকে লইয়া যান, এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [বেসূ|৪|২০|১৯-২১; ৪|৩|৪] । কিন্তু এই মর ভগবদ্গীতার অভিমত কি না সে বিষয়ে সন্দেহ হয় । কারণ, উত্তরায়ণের পরবর্তী পৈঠা যাহা কালবাচক নহে, গীতায় বর্ণিত হয় নাই । তাহাই নহে, এই মার্গ বলিবার পূর্বেই - “যে সময়ে মরিলে কর্মযোগী ফিরিয়া আসে কিংবা আসে না, সেই কালের কথা এক্ষণে তোমাকে বলিব” [গী|৮|২৩] এইরূপ ভগবান কালের বিষয় স্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন; এবং মহাভারতেও ভীষ্ম শরশয্যায় পড়িলে দেহত্যাগ করিবার জন্য উত্তরায়ণ কালের অর্থাৎ সূর্যের উত্তরদিকে গমনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন [ভীম|১২০; অনু|১৬৭] । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, দিন, শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণ কালই কোন-না-কোন সময়ে মরণের প্রশস্ত কাল বলিয়া মানা হইত । ঋগ্‌বেদেও দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের যেখানে বর্ণনা আছে [ঋ|১০|৮৮|১৫ ও বৃ|৬|২|১৫], সেখানে কালবাচক অর্থই বিবক্ষিত । এই এবং অন্য অনেক প্ৰমাণ হইতে আমি স্থির করিয়াছি যে, উত্তর গোলার্ধের যে স্থানে সূর্য ক্ষিতিজের উপর বরাবর ছয় মাস দৃশ্য হইয়া থাকে সেই স্থানে অর্থাৎ উত্তর ধ্রুবের নিকট অথবা মেরুস্থানে বৈদিক ঋষিদিগের যখন বসতি ছিল তখন হইতেই ছয় মাস উত্তরায়ণের প্রকাশকালকেই মৃত্যুর প্রশস্ত কাল বলিয়া মানিবার প্ৰথা প্রচলিত হইয়া থাকিবে । ইহার সবিস্তর বিচার আমি আমার অন্য গ্রন্থে করিয়াছি কারণ যাহাই হউক না কেন, এই ধারণাটি যে খুবই প্ৰাচীন, তাহাতে সন্দেহ নাই; এবং এই ধারণাই দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের মধ্যে স্পষ্ট পরিস্ফুট না থাকিলেও পর্যায়ক্রমে উহাদের অন্তর্ভূত হইয়া গিয়াছে । অধিক-কি, এই দুই মার্গেরই মূল এই প্ৰাচীন ধারণার ভিতরেই আছে, এইরূপ আমার মনে হয় । নচেৎ ভগবদ্গীতায় দেবযান ও পিতৃযান লক্ষ্য করিয়া একবার যে ‘কাল’ [গী|৮|২৩] এবং অপর একবার ‘গতি’ বা ‘সৃতি’ অর্থাৎ মাৰ্গ [গী|৮|২৬ ও ২৭] বলা হইয়াছে, অর্থাৎ এই দুই ভিন্ন ভিন্ন অর্থের শব্দ যে প্ৰযুক্ত হইয়াছে, তাহাদের উপপত্তি ঠিক লাগানো যায় না । বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্যে দেবযান ও পিতৃযানের কালবাচক অর্থ স্মাৰ্ত্ত, যাহা কর্মযোগের পক্ষেই খাটে; এবং প্ৰকৃত ব্ৰহ্মজ্ঞানী উপনিষদে বর্ণিত শ্রৌত অর্থাৎ দেবতা প্ৰদৰ্শিত প্ৰকাশময় মার্গের দ্বারা ব্ৰহ্মলোকে গমন করেন এইরূপ ভেদ করিয়া ‘কালবাচক’ ও ‘দেবতাবাচক’ অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে [বেসূ|শাং ভা|৪|২|১৮-২১] । কিন্তু মূল সূত্রে দেখা যায়, যেন কালের অপেক্ষা না রাখিয়া উত্তরায়ণাদি শব্দের দ্বারা দেবতা কল্পনা করিয়া দেবযানের যে দেবতাবাচক অর্থ বাদরায়ণাচার্য নির্ধারণ করিয়াছেন তাহাই তাঁহার মতে সর্বত্র অভিপ্রেত হইয়া থাকিবে; এবং গীতায় বর্ণিত মার্গ উপনিষদের এই দেবযান গতিকে ছাড়িয়া স্বতন্ত্র হইতে পারে এরূপ মনে করাও সঙ্গত নহে । কিন্তু এ স্থলে এত গভীর জলে প্ৰবেশ করিবার আবশ্যকতা নাই । কারণ দেবযান ও পিতৃযানের দিন, রাত্রি, উত্তরায়ণ প্রভৃতি শব্দ ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মূলারম্ভে কালবাচক ছিল কি না এই সম্বন্ধে মতভেদ থাকিলেও এই কালবাচক অর্থ পরে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল, ইহা নির্বিবাদ । কালের অপেক্ষা না রাখিয়া মনুষ্য যে সময়েই মরুক না কেন, জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কর্মানুসারে প্রকাশময় মাৰ্গ দিয়া এবং নিছক কর্মকাণ্ডী ব্যক্তি অন্ধকারময় মাৰ্গ দিয়া পরলোকে যাত্রা করে, দেবযান ও পিতৃযান এই দুই শব্দের এই অর্থই শেষে নির্ধারিত ও রূঢ় হইয়া গিয়াছে । তাহার পর, দিন ও উত্তরায়ণ প্ৰভৃতি শব্দে বাদরায়ণাচার্যের কথা অনুসারে দেবতাই মনে কর কিংবা উহার লক্ষণ হইতে প্ৰকাশময় মার্গের ক্ৰমবর্ধনশীল পৈঠাই মনে কর, দেবযান ও পিতৃযান ইহাদের রূঢ় অর্থ যে মাৰ্গবাচক এই সিদ্ধান্তে কোন প্রকার ভেদ হয় না ।


26) তৃতীয় গতি - নরক


কিন্তু কি দেবযান, কি পিতৃযান, - শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্মকারীই ঐ দুই মাৰ্গ প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । কারণ, পিতৃযানমাৰ্গ দেবযান অপেক্ষা নিম্ন পৈঠার হইলেও, তাহাও চন্দ্ৰলোকে অর্থাৎ একপ্ৰকার স্বৰ্গলোকেই উপনীত হইবার মাৰ্গ । তাই ইহলোকে শাস্ত্রোক্ত কোনপ্রকার পুণ্য কর্ম করিলেই সেখানকার সুখভোগের যোগ্যতা হয়, ইহা স্পষ্টই দেখা যায় [গী|৯|২০|২১] । যাহারা কিছুমাত্র শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্ম না করিয়া সংসারে যাবজ্জীবন পাপাচরণে নিমগ্ন থাকে তাহারা ঐ দুয়ের মধ্যে কোন মার্গ দিয়াই যাইতে পারে না । তাহারা মৃত্যুর পর একেবারেই পশুপক্ষী আদি তির্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ করে, এবং পুনঃ পুনঃ যমলোকে অর্থাৎ নরকে গমন করে এইরূপ উপনিষদে স্পষ্ট বর্ণিত হইয়াছে । ইহাকেই ‘তৃতীয়’ মাৰ্গ বলে [ছাং|৫|১০|৮; কঠ|২|৬|৭]; এবং ভগবদ্গীতাতেও নিছক্‌ পাপী অর্থাৎ আসুরী পুরুষেরা এই নিরয়গতিই প্ৰাপ্ত হয়, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|১৬|১৯-২১; ৯|১২; বেসূ|৩|১|১২,১৩; নিরুক্ত|১৪|৯] ।


27) ব্ৰহ্মজ্ঞানী এইখানেই মোক্ষ লাভ করেন


বৈদিক ধর্মের প্রাচীন পরম্পরাক্রমে মনুষ্য স্বীয় কর্মানুরূপ মরণান্তর তিনপ্রকার গতি কি ক্ৰম-অনুসারে প্রাপ্ত হয় তাহা উপরে উক্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে দেবযান মার্গের দ্বারাই মোক্ষ লাভ হয়; তথাপি ক্রমে ক্রমে অর্থাৎ অৰ্চিরাদি সোপানে পর-পর আরোহণ করিয়া পরিশেষে এই মোক্ষ লাভ হয়; তাই এই মার্গের আর এক নাম ‘ক্রমমুক্তি’, এবং মরণান্তর ব্ৰহ্মলোকে গিয়া সেখানে শেষে মুক্তিলাভ হয় বলিয়া ইহার ‘বিদেহমুক্তি’ এই নামও হইয়াছে । কিন্তু খাঁটি অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ ইহার পরে আরও এই কথা বলেন যে, ব্ৰহ্ম ও নিজের আত্মা এক - এই পূর্ণ সাক্ষাৎকার যাহার মনে নিত্য জাগৃত আছে সেই ব্যক্তি ব্ৰহ্মকে লাভ করিবার জন্য অন্য কোন স্থানে কেন যাইবে ? কিংবা মরণেরও পথই বা সে কেন দেখিবে ? উপাসনার জন্য স্বীকৃত সূর্যাদি প্রতীকের অর্থাৎ সগুণ ব্ৰহ্মের উপাসনার দ্বারা যে ব্ৰহ্মজ্ঞান হয় তাহা প্ৰথমে একটু অপূর্ণ থাকে সত্য, কারণ, তাহার দরুণ সূর্যলোক কিংবা ব্ৰহ্মলোক ইত্যাদির কল্পনা মনে উদিত হইয়া তাহাই মরণ সময়েও ন্যূনাধিক পরিমাণে মনে স্থায়ী হইয়া থাকে । তাই, এই ক্ৰটি পরিহার করিয়া মোক্ষলাভার্থ এই সকল লোককে দেবযান মাৰ্গ দিয়াই যাইতে হয়, - [বেসূ|৪|৩|১৫] । কারণ, মরণ সময়ে যাহার যেরূপ ভাবনা কিংবা ক্ৰতু হয় তাহার সেইরূপ গতি হয় ইহা অধ্যাত্মশাস্ত্রের স্থির সিদ্ধান্ত [ছাং|৩|১৪|১] । কিন্তু সগুণোপাসনা কিংবা অন্য কোন কারণে ব্ৰহ্ম ও নিজের আত্মার মধ্যে কোন দ্বৈতী অন্তরাল [তৈ|২|৭] যাহার মনে একটুও অবশিষ্ট থাকে না, সেই ব্যক্তি সর্বদাই ব্ৰহ্মরূপে থাকায় তাঁহাকে ব্ৰহ্মলাভের জন্য অন্য কোথাও যাইতে হয়ে না, ইহা স্পষ্টই রহিয়াছে । এইজন্য শুদ্ধ ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা যে ব্যক্তি পূর্ণ নিষ্কাম হইয়াছে, “ন তস্য প্ৰাণা উৎক্রামন্তি ব্রহ্মৈব সন্‌ ব্ৰহ্মাপ্যেতি” — তাঁহার প্রাণ আর কোথাও যায় না, সে নিত্য ব্ৰহ্মভূত হইয়া ব্ৰহ্মেতেই লয় প্ৰাপ্ত হয় - এইরূপ বৃহদারণ্যকে [বৃ|৪|৪|৬] যাজ্ঞবল্ক্য জনককে বলিয়াছেন; এই প্রকার ব্যক্তি “অত্র ব্ৰহ্ম সমশ্নুতে”[কঠ|৬|১৪] এইখানেই ব্ৰহ্ম লাভ করেন, এইরূপ বৃহদারণ্যক ও কঠোপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে । এই শ্রুতির ভিত্তিতে, মোক্ষার্থে স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই এইরূপ শিবগীতাতেও উক্ত হইয়াছে । ব্ৰহ্ম এরূপ কোন বস্তু নহে যে, তাহা অমুক স্থানে আছে ও অমুক স্থানে নাই [ছাং|৭|২৫; মুং|২|২|১১] । তবে, কোন সময়ে পূর্ণ ব্ৰহ্ম প্রাপ্তির জন্য পূর্ণজ্ঞানী পুরুষকে উত্তরায়ণ, সূর্যলোক আদি মাৰ্গ দিয়া ক্রমে  ক্রমে যাইতে হইবে কেন ? “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” [মুং|৩|২|৯] যে ব্ৰহ্মকে জানে সে এখানেই, এই লোকেই ব্ৰহ্ম হইয়া গিয়াছে । একজনের অপরের কাছে যাইতে হইলে, ‘এক’ ও ‘অন্য’ এই স্থলকৃত কিংবা কালকৃত ভেদ থাকে; এবং এই ভেদ, শেষের অদ্বৈত ও শ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মোপলব্ধির মধ্যে থাকিতে পারে না । তাই, “যস্য সর্বমাত্মৈবাহভূৎ” [বৃ|২|৪|১৪], কিম্বা “সৰ্ব্বং খল্বিদং ব্ৰহ্ম” [ছাং|৩|১৪|১], অথবা আমিই ব্ৰহ্ম -“অহং ব্ৰহ্মাস্মি” [বৃ|৪|১০] এইরূপ যাহার মনের নিত্য অবস্থা দাঁড়াইয়াছে সে ব্ৰহ্ম-প্ৰাপ্তির জন্য অন্যস্থানে কেন যাইবে ? - সে সর্বদাই ব্ৰহ্মভূতই হইয়া থাকে । পূর্বপ্রকরণের শেষে যাহা বলা হইয়াছে গীতাতে সেই ভাবেই পরম জ্ঞানীপুরুষের এই প্রকার বর্ণন করা হইয়াছে যে, “অভিতো ব্ৰহ্মনিৰ্বাণং বৰ্ত্ততে বিদিতাত্মনাম্‌” [গী|৫|২৬] - যাঁহারা দ্বৈতভাব ত্যাগ করিয়া আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন তাঁহাদিগের প্রারব্ধকর্মক্ষয়ার্থ মৃত্যুর পথ দেখিতে হইলেও মোক্ষলাভের জন্য কোথাও যাইতে হয় না, কারণ ব্ৰহ্মনিৰ্বাণরূপ মোক্ষ তো সর্বদাই তাঁহাদের সম্মুখে হাত জোড় করিয়া দণ্ডায়মান; কিংবা “ইহৈব তৈর্জিতঃ সৰ্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ” [গী|৫|১৯] - যাঁহাদিগের মনে সর্বভূতান্তৰ্গত ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ সাম্য প্ৰতিভাত হয় তাঁহারা (দেবযান মার্গের অপেক্ষা না রাখিয়া) এখানেই জন্মমরণকে জয় করিয়াছেন; অথবা “ভূতপৃথগ্‌ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি” - সমস্ত ভূতের নানাত্ব নষ্ট হইয়া সেই সমস্ত একস্থ অর্থাৎ ব্ৰহ্মরূপ বলিয়া যাহারা মনে হয়, সে-ই ‘ব্ৰহ্ম সম্পদ্যতে’ – ব্রহ্মে মিলিত হয় [গী|১৩|৩০] । সেরূপ আবার, “দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গ তত্ত্বতঃ যাহারা জানে সেই কর্মযোগীরা মোহ প্ৰাপ্ত হয় না” [গী|৮|২৭], এইরূপ গীতার যে বচন উপরে প্রদত্ত হইয়াছে তাহার মধ্যেও “তত্ত্বত যাহারা জানে” এই পদের অর্থ “পরম ব্ৰহ্মস্বরূপ যাহারা জানে” ইহাই বিবক্ষিত [ভাগ|৭|১৫|৫৬ দেখ] । ইহাই পূর্ণ ব্ৰহ্মীভুত কিংবা পরাকাষ্ঠা ব্রহ্মস্থিতি; এবং শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য আপন শারীরক ভাষ্যে [বেসূ|৪|৩|১৪] ইহাই অধ্যাত্মজ্ঞানের অত্যন্ত পরাকাষ্ঠা কিংবা পূর্ণাবস্থা এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । অধিক কি, এই অবস্থা লাভ করিতে হইলে একপ্রকার পরমেশ্বরই হইতে হয়, এইরূপ বলাতেও কোন অতিশয়োক্তি হইবে না । এবং এই প্রকারে ব্ৰহ্মীভূত ব্যক্তি কর্মজগতের সমস্ত বিধিনিষেধের অতীত অবস্থায় উপনীত হন, ইহাও আর বলিতে হইবে না; কারণ তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞান সর্বদাই জাগৃত থাকা প্ৰযুক্ত তাঁহারা যাহা কিছু করেন তাহা সর্বদাই নিষ্কাম বুদ্ধির দ্বারা প্রেরিত হয় বলিয়া পাপপুণ্যের দ্বারা নির্লিপ্ত থাকে । এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে, ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির জন্য অন্য কোথাও যাইবার কিংবা মরণেরও কোন আবশ্যকতা না থাকায় এইরূপ স্থিতপ্ৰজ্ঞ ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষকে ‘জীবন্মুক্ত’ বলে [যো|৩|৯ দেখ] । বৌদ্ধেরা আত্মা কিংবা ব্ৰহ্ম না মানিলেও জীবন্মুক্তের এই নিষ্কাম অবস্থাই মনুষ্যের পরম সাধ্য এই কথা তাঁহারা স্বীকার করেন । অল্প শব্দভেদে এই মতকে তাঁহারা আপন ধর্মে গ্ৰহণ করিয়াছেন (পরিশিষ্ট প্রকরণ দেখ) । পরাকাষ্ঠার নিষ্কামত্বের এই অবস্থা এবং সাংসারিক কর্ম ইহাদের মধ্যে স্বভাবতই পরস্পর-বিরোধ থাকা প্ৰযুক্ত যে এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইয়াছে সে কর্ম হইতে স্বতই মুক্ত হইয়া সন্ন্যাসী হইয়া যায়, এইরূপ অনেকে বলেন । কিন্তু এ মত গীতার মান্য নহে; স্বয়ং পরমেশ্বর যেরূপ কর্ম করেন সেইরূপ জীবন্মুক্তেরও নিষ্কামবুদ্ধিতে লোক-সংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ সমস্ত ব্যবহার করাই অধিক শ্রেয়স্কর, কারণ, নিষ্কামত্ব ও কর্ম এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ নাই, এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত । ইহা পরবর্তী প্রকরণের নিরূপণে স্পষ্ট দেখা যাইবে । গীতার এই তত্ত্ব যোগবাসিষ্ঠেও স্বীকৃত হইয়াছে [যো|৬|উ|১৯৯] ।

সন্ন্যাস ও কর্মযোগ (Renunciation and Karma-Yoga)

সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্ৰেয়সকরা বুভৌ ৷
তয়োস্তু কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে ॥ [গীতা |৫|২]

(“সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ই নিঃশ্রেয়স্কর অর্থাৎ মোক্ষদায়ক; কিন্তু এই উভয়েরই মধ্যে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগই অধিক শ্ৰেষ্ঠ ।” দ্বিতীয় চরণের ‘কর্মসন্ন্যাস’ পদ হইতে বুঝা যায় যে, প্ৰথম চরণের ‘সন্ন্যাস’ শব্দের কি অর্থ করিতে হইবে । গণেশগীতায় চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভে গীতার এই প্রশ্নোত্তরই লওয়া হইয়াছে । সেখানে এই শ্লোক অল্প শব্দভেদে এই প্রকারে আসিয়াছে -
“ক্রিয়াযোগো বিয়োগশ্চাৰ্গাপ্যুভৌ মোক্ষস্য সাধনে ৷
ভয়োর্মধ্যে ক্রিয়াযোগস্ত্যাগাত্তস্য বিশিষ্যতে ॥”)

1) অর্জুনের প্রশ্ন এই যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোন্‌টী



পূৰ্বপ্রকরণে সবিস্তর বিচার করিয়াছি যে, সর্বভুতে একত্বে অবস্থিত পরমেশ্বরের অনুভবাত্মক জ্ঞান হওয়াই অনাদি কর্মের ফের হইতে মুক্তিলাভের একমাত্র মাৰ্গ; এবং এই অমৃত ব্ৰহ্মের জ্ঞানলাভে মনুষ্যের স্বাতন্ত্র্য আছে কি না এবং এই জ্ঞান লাভ করিবার জন্য, মায়াজগতের অনিত্য ব্যবহার কিংবা কর্ম মনুষ্য কেন করিবে । শেষে এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে যে, বন্ধন কর্মের ধর্ম বা গুণ নহে, উহা মনের ধর্ম; তাই ব্যবহারিক কর্মের ফলে আমাদের যে আসক্তি হইয়া থাকে তাহা ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা ক্ৰমশ হ্রাস করিয়া উক্ত কর্ম শুদ্ধ অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে করিয়া গেলে, কিছুকাল পরে সাম্যবুদ্ধিরূপ আত্মজ্ঞান দেহেন্দ্ৰিয়াদি মধ্যে প্রবিষ্ট হয় ও পরিশেষে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ হয় । মোক্ষরূপ পরম সাধ্য কিংবা আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থা লাভ করিতে হইলে তাহার জন্য কিরূপ সাধন করিতে হয়, ইহার নিষ্পক্তি এইরূপ হইয়াছে । এক্ষণে, এই প্ৰকার আচরণের দ্বারা অর্থাৎ যথাশক্তি ও যথাধিকার নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকিলে, কর্মবন্ধন মোচন হইয়া চিত্তশুদ্ধির দ্বারা শেষে পুৰ্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান প্ৰাপ্ত হইলে পর, সিদ্ধাবস্থায় জ্ঞানী বা স্থিতপ্ৰজ্ঞ ব্যক্তি কর্মই করিতে থাকিবে, কিংবা যাহা কিছু পাইবার তাহা পাইয়া কৃতকৃত্য হওয়ায় মায়া-জগতের সমস্ত ব্যবহার নিরর্থক ও জ্ঞানের বিরুদ্ধ বুঝিয়া সমস্ত ছাড়িয়া দিবে এই গুরুতর প্রশ্নের বিচার উপস্থিত হয় । কারণ, সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা (কর্মসন্ন্যাস) বা তাহাই আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে করা (কর্মযোগ), এই দুই পক্ষ তর্কদৃষ্টিতে এই স্থলে সম্ভব । এবং ইহার মধ্যে যে পক্ষ শ্রেষ্ঠ স্থির হইবে, তাহারই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া প্রথম হইতে অর্থাৎ সাধনাবস্থাতেই আচরণ করা সুবিধাজনক বলিয়া এই উভয়ের তারতম্যের বিচার ব্যতীত কর্মাকর্মের কোন আধ্যাত্মিক বিচারই সম্পূর্ণ হয় না । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হইলে, কর্ম করা আমার না করা দুই-ই সমান [গী|৩|১৮], কারণ সমস্ত ব্যবহারে কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ হওয়ায়, জ্ঞানের দ্বারা সর্বভূতে যাহার সমত্ব-বুদ্ধি হইয়াছে, তাহার উপর কোন কর্মেরই শুভাশুভত্বের লেপ লাগে না [গী|৪|২০,২১] - অর্জুনকে কেবল এইটুকু বলিলে কাৰ্যনিৰ্বাহ হইত না । তাঁহার প্রতি ভগবানের ইহাই নিশ্চিত উপদেশ ছিল যে, তুমি যুদ্ধ কর - যুদ্ধ্যস্ব ! [গী|২|১৮]; এবং এই বজ্রনাদী স্পষ্ট উপদেশের সমর্থনে ‘যুদ্ধ করিলেও ভাল এবং না করিলেও ভাল’ এইরূপ ধরা-ছাড়া উত্তর অপেক্ষা অন্য কোন বলবত্ত্বর কারণ দেখান আবশ্যক ছিল । অধিক কি, কোন কর্মের ভয়ঙ্কর পরিণাম চক্ষের সম্মুখে দেখা গেলেও, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহা কেন করিবে, ইহা বলিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের সৃষ্টি; ইহাই গীতার বৈশিষ্ট্য । কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় এবং জ্ঞানের দ্বারা মুক্ত হয়, ইহা সত্য হইলে, জ্ঞানী ব্যক্তির কর্ম করাই দরকার কেন ? কর্মক্ষয় অর্থে কর্মত্যাগ নহে; কেবল ফলাশা ছাড়িলেই কর্মের ক্ষয় হয়, সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা যায় না; ইত্যাদি সিদ্ধান্ত সত্য হইলেও, ইহা হইতে পুরাপুরি সিদ্ধ হয় না যে, যতটুকু কর্ম ত্যাগ করা যায় তাহাও ত্যাগ করিবে না । এবং ন্যায়তঃ দেখিলেও এই অর্থই নিষ্পন্ন হয় । কারণ, চতুৰ্দিক জলময় হইলে যেরূপ জলের জন্য কূপের দিকে কেহ ছুটিয়া যায় না, সেইরূপ কর্মের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় সেই জ্ঞান হইলে জ্ঞানী পুরুষকে কর্মের কোন অপেক্ষা রাখিতে হয় না, এইরূপ গীতাতেই উক্ত হইয়াছে [গী|২|৪৬] । এই জন্য তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে প্রথমে ইহাই জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তোমার মতে কর্মাপেক্ষা নিষ্কাম কিংবা সাম্যবুদ্ধি যদি শ্ৰেষ্ঠ হয়, তবে স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় আমারও বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিলেই হইল; এই ঘোর যুদ্ধকর্মে কেন আমাকে স্থাপন করিলে ? [গী|৩|১] এই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় ভগবান ‘কর্ম ত্যাগ করিতে কেহ পারে না’, ইত্যাদি কারণ বলিয়া চতুর্থ অধ্যায়ে কর্মের সমর্থন করিয়াছেন । কিন্তু সাংখ্য (সন্ন্যাস) ও কর্মযোগ এই দুই মাৰ্গই যদি শাস্ত্রে বলা হইয়া থাকে, তবে জ্ঞানলাভের পরে ইহাদের মধ্যে যাহার যে মাৰ্গ ভাল লাগিবে সে-ই সে মাৰ্গ স্বীকার করুক, এইরূপ বলিতে হয় । তাই পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন আবার এই প্রশ্ন করিলেন যে, দুই মাৰ্গ মিশা-মিশি করিয়া আমাকে না বলিয়া, এই দুয়ের মধ্যে ভালো যেটি তাহাই আমাকে ঠিক্‌ করিয়া বলো [গী|৫|১] । জ্ঞানোত্তর কর্ম করা কিংবা না করা যদি সমানই হয় তবে আমার ইচ্ছামত তাহা আমি করিব কিংবা করিব না । কর্ম করাই উত্তম পক্ষ হইলে, আমাকে তাহার কারণ বলো, তাহা হইলে আমি তোমার কথা অনুসারে চলিব । অর্জুনের এই প্রশ্ন কিছুই অপূর্ব নহে । যোগবাসিষ্ঠে রাম বসিষ্ঠকে [যো|৫|৫৬|৬] এবং গণেশগীতায় [৪|১] বরেণ্য নামক রাজা গণেশকে এই প্রশ্নই করিয়াছেন । 


2) এই পন্থার অনুরূপই পাশ্চাত্য পন্থা



কেবল, আমাদের দেশে নহে, যুরোপ-খণ্ডের যেখানে তত্ত্বজ্ঞানের বিচার সর্বপ্রথম শুরু হয় সেই গ্রীস দেশেও প্রাচীন কালে এই প্রশ্ন উপস্থিত হইয়াছিল, ইহা অ্যারিষ্টটলের গ্রন্থে দেখা যায় । এই প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক জ্ঞানীপুরুষ স্বীয় নীতিশাস্ত্ৰ সম্বন্ধীয় গ্রন্থের শেষে [১০|৭ ও ৮] এই প্রশ্নই উপস্থিত করিয়া, নিজের এই মত প্ৰথমে বলিয়াছেন যে, সংসারের কিংবা রাজকাৰ্য্যের ব্যস্ততায় আয়ুক্ষেপ করা অপেক্ষা জ্ঞানীপুরুষের শান্তভাবে তত্ত্ববিচারে আয়ুক্ষেপ করিলেই প্রকৃত ও পুর্ণ আনন্দ হয়, তথাপি, ইহার পর লিখিত স্বীয় রাজধর্মসম্বন্ধীয় গ্রন্থে [৭|২ ও ৩] অ্যারিষ্টটল বলিয়াছেন যে, “বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের মধ্যে কেহ কেহ তত্ত্ববিচারে এবং কেহ কেহ রাষ্ট্রকার্যে ব্যাপৃত দেখা যায়; এবং এই দুই মার্গের মধ্যে কোনটি ভাল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে হয় যে, প্ৰত্যেক মাৰ্গই অংশতঃ সত্য । তথাপি কর্ম অপেক্ষা অকর্মকে ভাল বলা ভুল । [“And it is equally a mistake to place inactivity above action for happiness is activity, and the actions of the just and wise are the realization of much that is noble” - Aristotle's Politics, translated by Jowett, Vol I. P.212. The italics are ours].

কারণ, আনন্দও এক কর্মই এবং প্রকৃত শ্রেয়োলাভও অনেকাংশে জ্ঞানযুক্ত ও নীতিযুক্ত কর্মেতেই আছে, এইরূপ বলিতে বাধা নাই" । অ্যারিষ্টটল দুই স্থানে দুই বিভিন্ন বিধান করিয়াছেন দেখিয়া “কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ” [গী|৩|৮], অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ - গীতার এই স্পষ্ট কথার গুরুত্ব পাঠকের উপলব্ধ হইবে । বিগত শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত অগষ্টম্‌ কোঁৎ স্বকীয় আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞানে বলিয়াছেন যে, - “তত্ত্ববিচারেই নিমগ্ন হইয়া আয়ুক্ষেপণ শ্রেয়স্কর বলা ভ্রান্তিমূলক; যে তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ এইপ্রকারে জীবন নিৰ্বাহ করিয়া সাধ্যমত লোকের কল্যাণসাধনে বিরত হন, তিনি নিজের সাধনগুলির অপব্যবহার করেন, এইরূপ বলিতে হইবে ।” উল্টাপক্ষে জর্মান তত্ত্ববেত্ত্বা শোপেনহর প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, জগতের সমস্ত ব্যবহার, এমন কি জীবনধারণ করাও, দুঃখময় হওয়ায় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া এই সমস্ত কর্মের যত শীঘ্ৰ সম্ভব নাশ করাই এই জগতে মনুষ্যের প্রকৃত কর্তব্য । কোঁতের মৃত্যু হয় ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে এবং শোপেনহরের মৃত্যু হয় ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে । শোপেনহরের পন্থা হার্টমান পরে বজায় রাখিয়াছেন । স্পেনসর মিল প্ৰভৃতি ইংরেজ-তত্ত্বশাস্ত্রজ্ঞের মত কোঁৎ-এরই ন্যায়, ইহা বলা বাহুল্য । কিন্তু ইহাঁদিগকেও ছাড়াইয়া গিয়া নিতান্ত আধুনিক আধিভৌতিক জর্মন পণ্ডিত নিংশে স্বকীয় গ্রন্থে সবলে বলিয়াছেন যে, “মুর্খশিরোমণি” অপেক্ষা সৌম্যতার নাম কর্মসন্ন্যাসীদিগের প্রতি প্ৰয়োগ করা যাইতে পারে না ।*
* [কর্মযোগ ও কর্মত্যাগ (সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাস) এই দুই মার্গের নাম ইনি আপন Pessimism নামক গ্রন্থে – অন্যক্রমে Optimism ও Pessimism দিয়াছেন । কিন্তু আমার মতে এই নাম ঠিক নহে । Pessimism শব্দের অর্থ – “উদাস্‌ নিরাশাবাদী কিম্বা কাঁদুনে কিংবা গোম্‌শা মুখো” । কিন্তু সংসার অনিত্য ভাবিয়া যাহারা সংসার ত্যাগ করে তাহারা আনন্দে থাকে এবং সংসার ত্যাগ করিলেও তাহা আনন্দের সহিতই ত্যাগ করে । তাই তাহাদের সম্বন্ধে Pessimist শব্দ প্রয়োগ করা আমার মতে ঠিক নহে । ইহা অপেক্ষা কর্মযোগের Energism এবং সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমার্গের Quietism এইরূপ নাম দেওয়াই অধিক প্রশস্ত । বৈদিক ধর্মানুসারে দুই মার্গে ব্ৰহ্মজ্ঞান একই হওয়ায় দুয়েতেই আনন্দ ও শান্তি একই হইয়া থাকে । এক মার্গ আনন্দময় এবং অন্য মার্গ দুঃখময় কিংবা এক আশাবাদী এবং অন্য নিরাশাবাদী এইরূপ ভেদ আমি করি না ।]


3) সন্ন্যাস ও কর্মযোগের পর্যায় শব্দ



য়ুরোপখণ্ডে আরিষ্টটল হইতে এখন পৰ্যন্ত এই বিষয়ে যেরূপ দুই পক্ষ আছে, সেইরূপ প্ৰাচীনকাল হইতে এখন পৰ্যন্ত হিন্দুস্থানের বৈদিক ধর্মেও এই সম্বন্ধে দুই মার্গ সমান চলিয়া আসিতেছে [মভা|শাং|৩৪৯|৭] । তন্মধ্যে এক মার্গের নাম সন্ন্যাসমাৰ্গ, সাংখ্যনিষ্ঠা কিংবা শুধু সাংখ্য (অথবা জ্ঞানেতেই নিত্য নিমগ্ন থাকায় জ্ঞাননিষ্ঠাও) বলা হয়; দ্বিতীয় মার্গের নাম কর্মযোগ, কিংবা সংক্ষেপে শুধু যোগ, অথবা কর্মনিষ্ঠা বলা হয় । সাংখ্য ও যোগ এই দুই শব্দে অনুক্ৰমে কাপিলসাংখ্য ও পাতঞ্জল যোগ অর্থ বিবক্ষিত নহে ইহা পূর্বে তৃতীয় প্রকরণেই আমি বলিয়াছি । কিন্তু ‘সন্ন্যাস’ শব্দও একটু সন্দিগ্ধ হওয়ায় তাহার অর্থ একটু বেশী ব্যাখ্যা করা এখানে আবশ্যক । ‘সন্ন্যাস’ শব্দে ‘বিবাহ না করা’ কিংবা বিবাহ করিলে, ‘স্ত্রীপুত্ৰ ত্যাগ করিয়া গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করা’, অথবা ‘কেবল চতুর্থ আশ্রম গ্ৰহণ করা’ এইটুকু অর্থ এস্থানে বিবক্ষিত নহে । কারণ, বিবাহ না করিয়াও ভীষ্ম আমরণ রাজকাৰ্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন; এবং ব্ৰহ্মচৰ্য হইতে একেবারেই চতুর্থাশ্ৰম গ্ৰহণ করিয়া শ্ৰীমৎ শঙ্করাচাৰ্য, কিংবা আমাদের মহারাষ্ট্রদেশে আমরণ ব্ৰহ্মচারী গোস্বামী থাকিয়া শ্ৰীসমর্থ রামদাস জ্ঞানবিস্তারের দ্বারা জগতের উদ্ধার চেষ্টা করিয়াছেন । জ্ঞানোত্তর জগতের ব্যবহার কেবল কর্তব্য বলিয়া লোকের কল্যাণার্থ করিবে কিংবা তাহা মিথ্যা বলিয়া সমস্ত ছাড়িয়া দিবে ইহাই এখানে মুখ্য প্রশ্ন । এই ব্যবহার যে করে সে-ই কর্মযোগী; তারপর সে বিবাহ করুক বা না করুক অথবা গেরুয়া বসন পরুক বা না পরুক তাহাতে কিছুই আসে যায় না । একথা বলা যায় যে, এইরূপ কর্ম করিতে হইলে বিবাহ না করা কিংবা গেরুয়া বসন পরা কিংবা শহরের বাহিরে বৈরাগী হইয়া থাকাই অনেক সময় বিশেষ সুবিধাজনক হয় । কারণ, তাহা হইলে নিজের পশ্চাতে পরিবার-পোষণের ঝঞ্ঝাট না থাকায় আমাদের সমস্ত সময় ও পরিশ্রম লোককাৰ্য্যার্থে ব্যয় করিবার পক্ষে কোন বাধাই থাকে না । এইরূপ পুরুষের সন্ন্যাসী বেশ থাকিলেও, সে তত্ত্ব-দৃষ্টিতে কর্মযোগীই । কিন্তু উল্টাপক্ষে অর্থাৎ জাগতিক সমস্ত ব্যবহারকে অসার ভাবিয়া ও ত্যাগ করিয়া, যাহারা চুপ করিয়া বসিয়া থাকে তাহাদিগকে সন্ন্যাসী বলিতে হয়, চাই তাহারা প্রত্যক্ষ চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করুক আর নাই করুক । মোদ্দা কথা, গীতার কটাক্ষ গেরুয়া বস্ত্রের উপরে কিংবা শুভ্ৰ বস্ত্রের উপরে, অথবা বিবাহ কিংবা ব্ৰহ্মচর্য্যের উপরেও নহে; জ্ঞানী পুরুষ জাগতিক ব্যবহার করে কিংবা করে না এই এক বিষয়ের উপরেই নজর রাখিয়া সন্ন্যাস ও কর্মযোগ, গীতায় এই দুই মার্গের ভেদ করা হইয়াছে । বাকী বিষয় গীতাধর্মে গুরুত্বসূচক নহে । সন্ন্যাস কিংবা চতুর্থাশ্রম শব্দ অপেক্ষা কর্মসন্ন্যাস কিংবা কর্মত্যাগ শব্দই এস্থলে অধিক অন্বৰ্থক ও নিঃসন্দিগ্ধ । কিন্তু এই দুই অপেক্ষা শুধু সন্ন্যাস শব্দ প্ৰয়োগ করিবারই অধিক চলন থাকায় তাহার পারিভাষিক অর্থ এইখানে খুলিয়া বলিয়াছি । যাহারা জাগতিক ব্যবহারকে অসার মনে করে তাহারা সংসার হইতে নিবৃত্ত হইয়া অরণ্যে গিয়া স্মৃতিধর্মানুসারে চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করে বলিয়া কর্মত্যাগের এই মাৰ্গকে সন্ন্যাস বলে । কিন্তু তাহার প্ৰধান অংশ কর্মত্যাগই, গেরুয়া বসন নহে ।


4) কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের অঙ্গ নহে, দুইই স্বতন্ত্র, এই সম্বন্ধে টীকাকারদের গোলমাল



পূর্ণজ্ঞান হইবার পর কর্ম করিবে (কর্মযোগ) কিংবা কর্ম ত্যাগ করিবে (কর্মসন্ন্যাস), এইরূপ দুই পক্ষ প্ৰচলিত থাকিলেও, শেষে মোক্ষলাভের দুই মার্গ স্বতন্ত্র অর্থাৎ সমানরূপেই সমর্থ; কিংবা কর্মযোগ পূর্বাঙ্গ অর্থাৎ প্ৰথম পৈঠামাত্র এবং শেষে মোক্ষলাভার্থ কর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসই গ্ৰহণ করিতে হইবে, এই প্রশ্ন গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা এই স্থানে উপস্থিত করিয়াছেন । গীতার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের বর্ণন হইতে এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া জানা যায় । কিন্তু যখনই হউক না কেন, সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করিয়া সাংসারিক কর্ম ত্যাগ না করিলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ যাহাদের মত - এবং তাহাই গীতারও প্ৰতিপাদ্য হইবে এই বুদ্ধিতে গীতার টীকা করিতে যাহারা প্ৰবৃত্ত হইয়াছে - তাহারা গীতার এইরূপ তাৎপৰ্য্যাৰ্থ বাহির করিয়া থাকে যে, “কর্মযোগ স্বতন্ত্ররূপে মোক্ষলাভের মাৰ্গ নহে, প্ৰথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্ম করিয়া শেষে সন্ন্যাসই গ্ৰহণ করিতে হইবে, সন্ন্যাসই চরম অর্থাৎ মুখ্য নিষ্ঠা ।” কিন্তু এই অর্থ স্বীকার করিলে ‘সাংখ্য (সন্ন্যাস) ও যোগ (কর্মযোগ) জগতে এই দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে’ [গী|৩|৩], এইরূপ ভগবান যাহা বলিয়াছেন, সেই দ্বিবিধ পদের সার্থকতা আদৌ থাকে না । কর্মযোগ শব্দের তিন অর্থ হইতে পারে - (১) জ্ঞান হউক বা না হউক, যাগযজ্ঞাদি চাতুর্বর্ণের কিংবা শ্রৌতস্মার্ত্ত কর্ম করিয়াও মোক্ষলাভ হয় - ইহাই প্ৰথম অর্থ । কিন্তু মীমাংসকদিগের এই পক্ষ গীতার মান্য নহে [গী|২|৪৫] । (২) চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্ম করা (কর্মযোগ) আবশ্যক বলিয়া কেবল চিত্তশুদ্ধির জন্যই কর্ম করা – ইহাই দ্বিতীয় অর্থ । এই অর্থে কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ কিংবা পূর্বায়োজন । কিন্তু গীতার বর্ণিত কর্মযোগ ইহা নহে । (৩) নিজের আত্মার কল্যাণ কিসে হয় তাহা যিনি জানেন সেই জ্ঞানী পুরুষ যুদ্ধাদি স্বধর্মোক্ত সাংসারিক কর্ম আমরণ করিবেন কি করিবেন না ইহাই গীতার মুখ্য প্রশ্ন; এবং ইহার উত্তর এই যে, জ্ঞানী পুরুষকেও চাতুর্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে হইবে, [গী|৩|২৫], - ইহাই কর্মযোগ শব্দের তৃতীয় অর্থ; এবং এই কর্মযোগই গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । ইহা সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ কখনই হইতে পারে না, কারণ এই মার্গে কর্ম হইতে কখনই মুক্তি নাই । এখন প্রশ্ন হইতেছে মোক্ষলাভের বিষয়ে । এই বিষয়ে গীতায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, জ্ঞানলাভ হইলে, নিষ্কাম কর্ম বন্ধন না হইয়া, সন্ন্যাসের দ্বারা যে মোক্ষ লাভ করিবার কথা, সেই মোক্ষ কর্মযোগের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় [গী|৫|৫] । তাই, গীতার কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ নহে; কিন্তু জ্ঞানোত্তর এই দুই মাৰ্গই মোক্ষদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র অর্থাৎ তুল্যবল । [গী|৫|২]“লোকেহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” [গী|৩|৩] এই গীতাবাক্যের এই অর্থই গ্ৰহণ করিতে হইবে । এবং এই কারণেই, ভগবান পরবর্তী চরণে “জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাং” এই দুই মার্গকে পৃথক রূপে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন । পরে ১৩ম অধ্যায়ে “অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে” [গী|১৩|২৪] এই শ্লোকের ‘অন্যে’ (এক) ও ‘অপর’ (দ্বিতীয়) এই দুই পদ উক্ত দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া না মানিলে অন্বৰ্থক হয় না । তাছাড়া, যে নারায়ণীয় ধর্মের প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ (যোগ) গীতায় প্রতিপাদিত হইয়াছে, মহাভারতে তাহার ইতিহাস দেখিলেও এই সিদ্ধান্তই দৃঢ় হয় । জগতের আরম্ভে ভগবান হিরণ্যগৰ্ভকে অর্থাৎ ব্ৰহ্মদেবকে জগৎ সৃষ্টি করিতে বলিলে, তাহা হইতে মরীচি-আদি সাত মানসপুত্ৰ উৎপন্ন হয় । তাঁহারা সৃষ্টিক্রম ঠিক শুরু করিবার জন্য যোগ অর্থাৎ কর্মময় প্রবৃত্তিমাৰ্গ অবলম্বন করিলেন । ব্ৰহ্মার সনৎকুমারকপিল প্ৰভৃতি অন্য সাতপুত্র জন্মিলেই নিবৃত্তিমাৰ্গ অর্থাৎ সাংখ্য অবলম্বন করিলেন । এইরূপ দুই মার্গের উৎপত্তি বলিয়া, এই দুই মার্গ মোক্ষদৃষ্টিতে তুল্যবল অর্থাৎ বাসুদেবস্বরূপী একই পরমেশ্বর-প্ৰাপ্তির ভিন্ন ভিন্ন ও স্বতন্ত্র মাৰ্গ, এইরূপ পরে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৪৮|৭৪; ৩৪৯|৬৩-৭৩] । সেইরূপ আবার, যোগের অর্থাৎ প্রবৃত্তিমার্গের প্রবর্তক হিরণ্যগৰ্ভ এবং সাংখ্যমার্গের মূলপ্ৰবর্তক কপিল এইরূপ ভেদও করা হইয়াছে; কিন্তু হিরণ্যগৰ্ভ পরে কর্ম ত্যাগ করিয়াছেন এরূপ কোথাও উক্ত হয় নাই । উল্টা, জগতের ব্যবহার যাহাতে সুচারুরূপে চলে তজ্জন্য ভগবান কর্মরূপ যজ্ঞচক্র উৎপন্ন করিয়া তাহা সতত চলমান রাখিবার জন্য তাঁহাকে এবং অন্য দেবতাকে বলিয়াছিলেন, এইরূপ বর্ণনা আছে [মভা|শাং|৩৪০|৪৪-৭৫ ও ৩৩৯|৬৬,৬৭ দেখ] । ইহা হইতে সাংখ্য ও যোগ এই দুই মার্গ প্রথম হইতেই যে স্বতন্ত্র, তাহা নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় । ইহা হইতে আরও দেখা যায় যে, গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা কর্মযোগকে যে গৌণত্ব দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা নিছক সাম্প্রদায়িক আগ্রহের পরিণাম; এবং কর্মযোগ জ্ঞানলাভের কিংবা সন্ন্যাসের কেবল সাধন মাত্ৰ বলিয়া এই টীকাকারেরা স্থানে স্থানে যে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন, তাহা তাঁহাদের নিজের কথা, গীতার প্রকৃত ভাবাৰ্থ সেরূপ নহে । আমার মতে, সন্ন্যাসমাৰ্গীয় গীতার টীকাসমূহের ইহাই মুখ্য দোষ । এবং টীকাকারদিগের এই সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহ হইতে মুক্তি না হইলে গীতার প্রকৃত রহস্যের জ্ঞান হওয়া কখনই সম্ভব নহে ।


5) গীতার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এই যে, এই দুই মার্গ মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ



কর্মসন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই-ই স্বতন্ত্রভাবে সমান মোক্ষপ্ৰদ, এক অন্যটির পূর্বাঙ্গ নহে এইরূপ নির্ধারিত হইলেও সব কথার মীমাংসা হয় না । কারণ, যদি দুই মাৰ্গই সমান মোক্ষপ্ৰদ হয় তবে উহাদের মধ্যে আমাদের যেটি ভাল লাগে আমরা তাহাই অবলম্বন করিব, এইরূপ বলিতে হয় । এবং তাহা হইলে, অর্জুনের যুদ্ধ করা কর্তব্য এইরূপ সিদ্ধ না হইয়া, ভগবানের উপদেশে পরমেশ্বরজ্ঞান হইলেও অর্জুন আপন অভিরুচি অনুসারে যুদ্ধ করিবে কিম্বা যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে, এইরূপ দুই পক্ষই সম্ভব হয় । তাই “এই দুই মার্গের মধ্যে অধিক প্রশস্ত যেটি সেই এক মার্গের কথাই আমাকে ঠিক করিয়া বল” [গী|৫|১] অর্থাৎ যে আচরণ করিলে গোলযোগ হইবে না, অর্জুন সহজভাবে ও সরলভাবে সেই প্রশ্ন করিয়াছেন । গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন এই প্রশ্ন করিলে পরবর্তী শ্লোকে ভগবান তাহার এই স্পষ্ট উত্তর দিয়াছেন যে “সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মাৰ্গ নিঃশ্ৰেয়স অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰদ কিংবা মোক্ষদৃষ্টিতে সমতুল্য হইলেও এই দুয়ের মধ্যে কর্মযোগের মাতব্বরী কিংবা যোগ্যতা বিশেষভাবে আছে (বিশিষ্যতে)” [গী|৫|২]; এবং এই শ্লোক আমি এই প্রকরণের আরম্ভেই দিয়াছি । কর্মযোগের শ্রেষ্ঠত্বসম্বন্ধে এই একটি মাত্ৰ বচন যে গীতায় আছে তাহা নহে; অনেক বচন আছে; যথা “তস্মাদ্‌যোগায় যুজ্যস্ব” [গী|২|৫০] - অতএব তুমি কর্মযোগই স্বীকার কর; “মা (কর্মফলহেতুর্ভূর্মা) তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি” [গী|২|৪৭] - কর্ম না করিবার আগ্রহ রাখিও না;
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন ৷
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে ॥
কর্ম একেবারে ছাড়িবার ঝগড়ায় না পড়িয়া “ইন্দ্রিয়দিগকে মনের দ্বারা নিয়মিত করিয়া অনাসক্তবুদ্ধিতে কর্মেন্দ্ৰিয়াদির দ্বারা কর্ম করিবার যোগ্যতা ‘বিশিষ্যতে’ অর্থাৎ বিশেষ” [গী|৩|৭]; কারণ যখন যাহাই হউক না কেন, “কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ” [গী|৩|৮] অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ; “অতএব তুমি কর্মই কর” [গী|৮|১৫]; কিংবা “যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ” [গী|৪|৪২] - কর্মযোগ স্বীকার করিয়া যুদ্ধার্থে দণ্ডায়মান হও; “(যোগী) জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ” জ্ঞানমাৰ্গী (সন্ন্যাসী) অপেক্ষা কর্মযোগীর যোগ্যতা অধিক; “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” [গী|৬|৪৬] - অতএব হে অর্জুন ! তুমি (কর্ম-) যোগী হও; কিংবা “মামনুস্মর যুদ্ধ্য চ” [গী|৮|৭] - আমাকে স্মরণ করিয়া যুদ্ধ কর; এই প্রকার অনেক বচনে গীতায় অর্জুনকে স্থানে স্থানে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহাতেও সন্ন্যাস বা অকর্ম অপেক্ষা কর্মযোগ অধিক যোগ্য এইরূপ দেখাইবার জন্য ‘জ্যায়ঃ’‘অধিকঃ’, ‘বিশিষ্যতে’ এইরূপ স্পষ্ট পদ আছে । ১৮ম অধ্যায়ের উপসংহারেও “নিয়ত কর্মসন্ন্যাস করা উচিত নহে; আসক্তিবিরহিত হইয়া সমস্ত কর্ম সর্বদা করিতে হইবে, ইহাই আমার নিশ্চিত ও উত্তম মত,” এইরূপ ভগবান পুনর্বার বলিয়াছেন [গী|১৮|৬,৭] । ইহা হইতে নির্বিবাদ সিদ্ধ হয় যে, সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা কর্মযোগই গীতায় শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে ।


6) সন্ন্যাসমার্গী টীকাকারদের কৃত বিপর্য্যাস



কিন্তু সন্ন্যাস কিংবা ভক্তিই চরম ও শ্রেষ্ঠ কর্তব্য; কর্ম চিত্তশুদ্ধির কেবল সাধনমাত্ৰ, মুখ্য সাধ্য বা কর্তব্য নহে, এইরূপ যাঁহাদের সাম্প্রদায়িক মত, এই সিদ্ধান্ত তাঁহাদের রুচিবে কি প্রকারে ? সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা গীতায় কর্মযোগের অধিক গুরুত্ব স্পষ্টরূপে প্ৰদত্ত হইয়াছে, এই কথা তাঁহাদের যে মনে হয় নাই এরূপ নহে । কিন্তু ইহা মানিলে, নিজের সাম্প্রদায়িক যোগ্যতা কমিয়া যাইবে, স্পষ্টই দেখা যায় । তাই, পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুনকৃত প্রশ্ন এবং ভগবান-প্রদত্ত উত্তর, দুই-ই সরল, সযুক্তিক ও স্পষ্টার্থক হইলেও, ইহার কোন অর্থ কি প্রকারে করা যাইবে, এই সম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক টীকাকারগণ বড়ই মুষ্কিলে পড়িয়াছেন । প্ৰথম মুষ্কিল এই ছিল যে, ‘সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মার্গের মধ্যে কোন্‌ মার্গ শ্রেষ্ঠ’ ? এই প্রশ্নই উপস্থিত হয়ই না, যদি না এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া মানা যায় । কারণ, টীকাকারদিগের কথা অনুসারে কর্মযোগ যদি জ্ঞানের কেবল পুর্বাঙ্গ হয়, তবে পুর্বাঙ্গ গৌণ এবং জ্ঞান কিংবা সন্ন্যাসই শ্ৰেষ্ঠ, ইহা স্বতই সিদ্ধ হয় । এবং তাহার পর, প্রশ্ন করিবার কোন অবসর থাকে না । ভাল; এই প্ৰশ্নকে উচিত প্রশ্ন বলিলেও, এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র স্বীকার করিতে হয়; এবং এইরূপ স্বীকার করিলে, নিজের সম্প্রদায়ই একমাত্র মোক্ষমাৰ্গ, এই কথার সহিত বিরোধ উপস্থিত হয় ! এই জন্য, এই টীকাকারগণ অর্জুনের প্রশ্নই ঠিক নহে এইরূপ ব্যাখ্যা প্ৰথমে করিয়াছেন এবং ইহা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, ভগবানের উত্তরের তাৎপৰ্যও এইরূপই । কিন্তু এত চেষ্টা করিয়াও তাঁহারা “কর্মযোগের যোগ্যতা কিংবা প্রামাণ্য অধিক” [গী|৫|২] ভগবানের এই স্পষ্ট উত্তরের অর্থ লাগাইতে পারেন নাই ! তাই, শেষে “কর্মযোগো বিশিষ্যতে” - কর্মযোগের প্রামাণ্য বিশেষ রকমের - এই বচন কর্মযোগের স্তুতিমাত্র অর্থাৎ অর্থবাদাত্মক, ভগবানেরও মতে সন্ন্যাসমাৰ্গই বাস্তবিক, শ্ৰেষ্ঠ, [গী|শাং ভা|৫|২; ৬|১,২; ১৮|১১ দেখ] এইরূপ পূর্বাপর সন্দর্ভবিরুদ্ধ নিজের মনগড়া আর একটা টিপ্পনী করিয়া কোন প্রকারে মনকে আশ্বস্ত করিতে হইয়াছে । শাঙ্করভাষ্যে শুধু নহে, রামানুজভাষ্যেও এই শ্লোক কর্মযোগের স্তুতিবাচক অর্থাৎ অর্থবাদাত্মক বলিয়াই স্বীকার করা হইয়াছে [গী|রা.ভা|৫|১] । রামানুজাচাৰ্য অদ্বৈতী না হইলেও তাঁহার মতে ভক্তিই মুখ্য সাধ্য হওয়ায়, কর্মযোগ জ্ঞানযুক্ত ভক্তির সাধনই হইয়া যায় [গী|রা.ভা|৩|১ দেখ] । 


7) তাহার উত্তর



মূলগ্ৰন্থ হইতে টীকাকারদিগের সম্প্রদায় ভিন্ন; কিন্তু টীকাকার, নিজের মাৰ্গই মূল গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে এই দৃঢ় ধারণায় সেই গ্রন্থের টীকা করিতে প্ৰবৃত্ত হন । এই হেতু মূলগ্রন্থের কিরূপ টানা-বুনা ব্যাখ্যা হয় তাহা পাঠক দেখুন । “অর্জুন ! তোমার প্রশ্নটি ঠিক্‌ নহে” এইরূপ কৃষ্ণের কিংবা ব্যাসের সংস্কৃত ভাষায় স্পষ্টশব্দে বলা আসে নাই কি ? কিন্তু তাহা না করিয়া যখন “কর্মযোগই বিশেষরূপে যোগ্য” এইরূপ অনেক স্থানে স্পষ্ট বলিয়াছেন তখন সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের উক্ত অর্থ সরল নহে, এ কথা বলিতেই হয়; এবং পূর্বাপর সন্দর্ভ দেখিলেও এই অনুমান দৃঢ় হয় । কারণ গীতাতেই, জ্ঞানী পুরুষ কর্মের সন্ন্যাস না করিয়া, জ্ঞানোত্তরেও অনাসক্ত বুদ্ধিতে নিজের সমস্ত ব্যবহার করিয়া থাকেন, এইরূপ অনেক স্থানে বর্ণনা আছে [গী|২|৬৪; ৩|১৯; ৩|২৫; ১৮|৯ দেখ] । ইহার উপর শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য আপন ভাষ্যে প্ৰথমে এই প্রশ্ন করিয়াছেন যে, জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, কিংবা জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ে মোক্ষলাভ হয়; এবং পুনরায় এই গীতাৰ্থ স্থির করিয়াছেন যে, কেবল জ্ঞানেই সমস্ত কর্ম দগ্ধ হইয়া গিয়া মোক্ষলাভ হয়, মোক্ষলাভের জন্য কর্মের আবশ্যকতা নাই । ইহা হইতে পরে এই অনুমান করা হইয়াছে যে, যখন গীতার দৃষ্টিতেও মোক্ষের জন্য কর্মের আবশ্যকতা নাই, তখন চিত্তশুদ্ধি হইলে সমস্ত কর্ম নিরর্থকই হইয়া থাকে; এবং তাহা স্বভাবতই বন্ধক অর্থাৎ জ্ঞানের বিরুদ্ধ হওয়ায়, জ্ঞানোত্তর জ্ঞানী পুরুষকে কর্ম ত্যাগ করিতে হয়” - এই মতই গীতায় ভগবানেরও গ্রাহ্য হইয়াছে । ‘জ্ঞানোত্তর জ্ঞানী পুরুষকেও কর্ম করিতে হয়’ - এই মতের নাম “জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয় পক্ষ”; এবং শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের উপরি-উক্ত যুক্তিবাদই তদ্বিরুদ্ধে মুখ্য আপত্তি । এইরূপ যুক্তিবাদই মধ্বাচাৰ্যও স্বীকার করিয়াছেন [গী|মভা|৩|৩১ দেখ] । কিন্তু এই যুক্তিবাদ আমার মতে সন্তোষজনক কিংবা নিরুত্তরও নহে । কারণ, (১) কাম্য কর্ম বন্ধক হইয়া জ্ঞানের বিরূদ্ধ হইলেও এই যুক্তি নিষ্কাম কর্মের সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হয় না; এবং (২) জ্ঞানোত্তর মোক্ষের জন্য কর্ম অনাবশ্যক হইলেও ‘অন্য কোন বলবৎ কারণের জন্য জ্ঞানী পুরুষের জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই কর্ম করা অবশ্যক’, এইরূপ সিদ্ধ হইবার পক্ষে উহা দ্বারা কোন বাধা হয় না । মুমুক্ষুর চিত্ত শুদ্ধ করাই জগতে কর্মের উপযোগ নহে, কিংবা ইহারই জন্য কর্ম উৎপন্নও হয় নাই; তাই, মোক্ষ ব্যতীত অন্য কারণবশতঃ স্বধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্মজগতের সমস্ত ব্যবহার জ্ঞানী পুরুষেরও নিষ্কাম বুদ্ধিতে করা আবশ্যক, এইরূপ বলা যাইতে পারে । এই কারণগুলি কি, তাহার সবিস্তুর বিচার এই প্রকরণে পরে করা হইয়াছে । এক্ষণে এইটুকুই বলিতেছি যে, সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য প্ৰস্তুত অর্জুনকে এই সমস্ত কারণ বলিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের প্রবৃত্তি হইয়াছে; এবং এইরূপ অনুমান করিতে পারা যায় না যে, চিত্তশুদ্ধির পর মোক্ষের জন্য কর্মের অনাবশ্যকতা বুঝাইয়া গীতায় সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । জ্ঞানোত্তর সন্ন্যাসাশ্রম গ্ৰহণ করিয়া কর্মত্যাগ করিতেই হইবে ইহা শাঙ্কর-সম্প্রদায়ের মত সত্য; কিন্তু তাহা হইতে ইহা সিদ্ধ হয় না যে গীতার তাৎপৰ্যও তাহাই হইবে, কিংবা শাঙ্কর অথবা অন্য কোন সম্প্রদায়কে ‘ধর্ম’ মনে করিয়া তাহারই অনুকূলে গীতার কোনরূপ অর্থ করিতেই হইবে । জ্ঞান প্ৰাপ্তির পরেও সন্ন্যাসমার্গ অবলম্বন অপেক্ষা কর্মযোগ স্বীকার করাই উত্তম পক্ষ, ইহাই তো গীতার স্থির সিদ্ধান্ত । তারপর, তাহাকে তুমি পৃথক সম্প্রদায়ই বল, কিংবা তাহার আর কোন নাম দেও, তাহাতে কিছুই আসে যায় না । কিন্তু গীতা কর্মযোগকেই শ্ৰেষ্ঠ মনে করিলেও, সন্ন্যাসমার্গ সর্বথা পরিত্যাজ্য বলিয়া মনে করিতে হইবে, অন্য পরমতাসহিষ্ণু সম্প্রদায়ের ন্যায় গীতার এরূপ আগ্রহ নাই ইহা মনে রাখা আবশ্যক । সন্ন্যাসমার্গসম্বন্ধে গীতার কোথাও অনাদরবুদ্ধি প্ৰদৰ্শিত হয় নাই । পক্ষান্তরে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মার্গ একই প্ৰকার নিঃশ্ৰেয়স্কর অর্থাৎ মোক্ষপ্রদ কিংবা মোক্ষদৃষ্টিতে সমান মূল্যবান, এইরূপ ভগবান স্পষ্ট বলিয়াছেন । এবং পরে “একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি” [গী|৫|৫] এই দুই মাৰ্গ একই অর্থাৎ তুল্যবল ইহা যে জানে সেই প্রকৃত তত্ত্ব জানে; কিংবা ‘কর্মযোগ’ হইলেও তাহাতে ফলাশার ‘সন্ন্যাস’ করাই আবশ্যক হয় - “ন হ্যসন্ন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন” [গী|৬|২] - এইরূপ যুক্তি দ্বারা এই দুই ভিন্ন মার্গের একরূপতা করিয়াও দেখানো হইয়াছে । জ্ঞানোত্তর (প্ৰথমেই নহে) কর্ম ত্যাগ করা বা কর্মযোগ স্বীকার করা, দুই মার্গ মোক্ষদৃষ্টিতে একই যোগ্যতার হইলেও লোকব্যবহারদৃষ্টিতে বিচার করিলে বুদ্ধিতে সন্ন্যাস রাখিয়া অর্থাৎ বুদ্ধিকে নিষ্কাম করিয়া দেহেন্দ্ৰিয়াদিযোগে আমরণ লোকসংগ্ৰহকারী কর্ম করিতে থাকা, - এই মাৰ্গই সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ হয় । কারণ, সন্ন্যাস ও কর্ম এই দুই-ই তাহাতে বজায় থাকে, এইরূপ ভগবানের নিশ্চিত উপদেশ; এবং তদনুসারে অর্জন পরে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন । জ্ঞানী ও অজ্ঞানী ইহাদের মধ্যে ইহাই যাহা কিছু ভেদ । কেবল শারীর কর্ম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা সংঘটিত কর্ম দেখিলে, উভয়েই একই হইবেই; কিন্তু অজ্ঞান মনুষ্য তাহা আসক্ত বুদ্ধিতে এবং জ্ঞানী মনুষ্য অনাসক্ত বুদ্ধিতে করিয়া থাকে [গী|৩|২৫] । গীতার এই সিদ্ধান্তই ভাস কবি স্বীয় নাটকে বলিয়াছেন -
প্ৰাজ্ঞস্য মূর্খস্য চ কাৰ্যযোগে ৷
সমত্বমভ্যেতি তনুর্ন বুদ্ধিঃ ॥
“জ্ঞানী ও মূর্খ ইহাদের কর্ম করিবার পক্ষে দেহ একরকমই, কেবল বুদ্ধিই ভিন্ন হইয়া থাকে [অবিমার|৫|৫] ।


8) অর্জুনকে অজ্ঞানী মানিতে পারি না



কতকগুলি সন্ন্যাসমার্গের ক্ষুদ্রবুদ্ধি লোক এই সম্বন্ধে আরও এই কথা বলে যে “গীতায় অর্জুনকে কর্ম করিবার উপদেশ দেওয়া হইয়াছে সত্য; কিন্তু অর্জুন অজ্ঞান বলিয়া চিত্তশুদ্ধিকর কর্ম করিবারই তাঁহার অধিকার ছিল - এই কথা মনে রাখিয়াই ভগবান এই উপদেশ করিয়াছেন । সিদ্ধাবস্থায় ভগবানের মতেও কর্মত্যাগই শ্রেষ্ঠ” । এই যুক্তিবাদের সরল ভাবাৰ্থ ইহাই দেখা যায় যে, ভগবান অর্জুনকে যদি “তুমি অজ্ঞানী” এইরূপ বলিতেন, তবে কঠোপনিষদে নচিকেতা যেরূপ পূর্ণজ্ঞান লাভের জন্য জেদ করিয়াছিলেন, অর্জুন সেইরূপ জেদ করিতেন; এবং তাঁহাকে পুর্ণ জ্ঞানের কথা বলিতেই হইত; এবং সেইরূপ পুর্ণজ্ঞানের উপদেশ তাঁহাকে দিলে তিনি যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিতেন এবং তাহা হইলে তো ভগবানের ভারতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্ত উদ্দেশ্যই বিফল হইয়া যাইত এই ভয়ে আপনার অত্যন্ত প্রিয় ভক্তকে ঠকাইবার জন্য শ্ৰীকৃষ্ণ গীতার উপদেশ করিয়াছিলেন ! কেবল নিজ সম্প্রদায়ের সমর্থনার্থ ভগবানেরও উপর যাহারা এই প্রতারণারূপ গৰ্হিত কাৰ্য আরোপ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে তাহাদের সহিত কোন প্রকার বাদানুবাদ না করাই শ্ৰেয়স্কর । কিন্তু সাধারণ লোক এই ভ্ৰান্ত যুক্তিবাদের দ্বারা পাছে প্ৰতারিত হয় সেইজন্যই এইটুকু বলিতেছি যে “তুমি অজ্ঞানী, সেইজন্য কর্ম কর” অর্জুনকে এইরূপ স্পষ্টাক্ষরে বলিতে শ্ৰীকৃষ্ণের ভয় পাইবার কোন কারণ ছিল না; এবং ইহার পরেও যদি অর্জুন কোন গোলযোগ করিতেন, তাহা হইলে অর্জুনকে অজ্ঞানী রাখিয়াই তাঁহা দ্বারা প্রকৃতি-ধর্মানুসারে যুদ্ধ করাইবার সামর্থ্য শ্ৰীকৃষ্ণের ছিল [১৮|৫৯ ও ৬১ দেখ] । কিন্তু সেরূপ না করিয়া ‘জ্ঞান’ ও ‘বিজ্ঞান’ই পুনঃ পুনঃ বুঝাইয়া [গী|৭|২; ৯|১; ১০|১; ১৩|২; ১৪|১], ১৫ম অধ্যায়ের শেষে “এই শাস্ত্ৰ বুঝিয়া লইতে পারিলে মনুষ্য জ্ঞাতা ও কৃতাৰ্থ হয়” [গী|১৫|২০], এইরূপ ভগবান অর্জুনকে বলিয়াছেন । এইরূপে তাঁহাকে পূর্ণ জ্ঞানী করিয়া তাঁহা দ্বারা তাঁহার স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধ করাইয়াছেন [গী|১৮|৬৩ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হয় যে, জ্ঞাতা পুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও নিষ্কাম কর্ম করিতেই থাকিবে - এই মতই সর্বোত্তম, এবং ইহাই ভগবানের অভিপ্ৰায় । তাছাড়া, অর্জুন অজ্ঞানী ছিলেন ইহা একবার মানিয়া লইলেও, তাঁহাকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহার সমর্থনার্থ, জনকাদি প্ৰাচীন কর্মযোগীদের এবং ভগবান নিজেরও যে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই অজ্ঞানী ছিলেন এরূপ কখন বলা বাইতে পারে না । তাই, সাম্প্রদায়িক আগ্রহের এই শুষ্ক তর্ক সর্বথা অনুচিত ও ত্যাজ্য, এবং গীতায় জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগের উপদেশই দেওয়া হইয়াছে, একথা বলিতেই হয় ।


9) এই বিষয়ে গীতায় নির্দিষ্ট কারণ যে, কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ কেন



যাক্‌ । সিদ্ধাবস্থাতেও কর্মত্যাগ (সাংখ্য) ও কর্মযোগ (যোগ), এই দুই মার্গ শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্য দেশেও পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে দেখা যায় । অনন্তর এই বিষয়ে, গীতাশাস্ত্রের দুই মুখ্য সিদ্ধান্ত বলা হইয়াছে - (১) এই দুই মার্গ স্বতন্ত্র অর্থাৎ মোক্ষদৃষ্টিতে পরস্পরনিরপেক্ষ ও তুল্যবল, একটি অপরটির অঙ্গ নহে; এবং (২) ইহাদের মধ্যে কর্মযোগই অধিক প্রশস্ত । এই দুই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত স্পষ্ট হইলেও টীকাকারেরা কেন ও কি প্রকারে তাহাদের বিপৰ্যয় করিয়াছে তাহাই ব্যক্ত করিবার জন্য এই সমস্ত প্ৰস্তাবনা লিখিতে হইয়াছে । এক্ষণে, সিদ্ধাবস্থাতেও কর্মত্যাগী অপেক্ষা নিষ্কামবুদ্ধিতে আমরণ কর্ম করিবার মার্গ অর্থাৎ কর্মযোগই অধিক শ্রেয়স্কর, এই যে উপস্থিত প্রকরণের মুখ্য উদ্দেশ্য তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য গীতায় যে সকল কারণ প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই নিরূপণ করিব । তন্মধ্যে দুই এক বিষয়ের ব্যাখ্যা পূর্বে সুখ-দুঃখ-বিবেচন-প্রকরণে করা হইয়াছে । কিন্তু এই বিচার কেবল সুখদুঃখসম্বন্ধেই হওয়ায় সেখানে এই বিষয়ের পূর্ণ আলোচনা করিতে পারা যায় নাই । তাই, তাহারই জন্য এই স্বতন্ত্র প্রকরণ আরম্ভ করা হইয়াছে । বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই দুই ভাগ আছে । তাহাদের মধ্যে প্ৰভেদ কি তাই পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । কর্মকাণ্ডে অর্থাৎ ব্ৰাহ্মণাদি শ্রৌতগ্রন্থে এবং অংশতঃ উপনিষদেও এইরূপ স্পষ্ট বচন আছে যে, প্রত্যেক গৃহস্থ – ব্রাহ্মণই হউক বা ক্ষত্রিয়ই হউক – অগ্নিহোত্র পালন করিয়া জ্যোতিষ্টোমাদি যাগযজ্ঞ অধিকারানুসারে করিবে এবং বিবাহ করিয়া বংশ বৃদ্ধি করিবে । উদাহরণ যথা - “এতদ্বৈ জরামর্য্যং সত্ৰং যদগ্নিহোত্ৰম্‌” - অগ্নিহোত্ররূপ এই সত্ৰ মরণ পৰ্যন্ত বজায় রাখিতে হইবে [শ|ব্ৰা|১২|৪|১|১]“প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ” - বংশের ধারা ভঙ্গ করিবে না [তৈ উ|১|১১|১]; কিংবা “ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ব্বং” — জগতে যাহা কিছু আছে তাহা পরমেশ্বরের দ্বারা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ আমার নাহে তাঁহার, এইরূপ বুঝিবে, এবং এই নিষ্কাম বুদ্ধিতে
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ ৷
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে ॥
“কর্ম করিতে থাকিয়াই শত বৎসর অর্থাৎ পুরুষের পরমায়ুর শেষ সীমা পৰ্যন্ত বাঁচিবার ইচ্ছা করিবে, এবং এইরূপ ঈশাবাস্য বুদ্ধিতে কর্ম করিলে সেই কর্ম, তোমার (অর্থাৎ পুরুষের) বন্ধন হইবে না; ইহা ব্যতীত (উক্ত বন্ধন পরিহার করিবার জন্য) অন্য মার্গ নাই, [ঈশ|১ ও ২];” ইত্যাদি বচন দেখ । কিন্তু কর্মকাণ্ড হইতে জ্ঞানকাণ্ডে উঠিবার পথে “ব্রহ্মবিদ্যাপ্নোতি মোক্ষম্‌” [তৈ|২|১|১] - ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়; “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে হয়নায়” [শ্বে|৩|৮] - (জ্ঞান ব্যতীত) মোক্ষলাভের অন্য পন্থা নাই; “পূর্বে বিদ্বাংসঃ প্ৰজাং ন কাময়ন্তে । কিং প্ৰজয়া করিষ্যামো যেষাং নোহয়মাত্মাহয়ং লোক ইতি তে হ স্ম পুত্ৰৈষণায়াশ্চ বিত্তৈষণায়াশ্চ লোকৈষণায়াশ্চ ব্যুত্থায়াথ ভিক্ষাচৰ্য্যং চরন্তি” [বৃ|৪|৪|২২ ও ৩|৫|১] - পূর্বকালের জ্ঞানী পুরুষেরা পুত্ৰাদি ভাল বাসিতেন না, এবং সমস্ত লোকই যখন আমার আত্মা হইল, তখন আমার (অন্য) সন্তানের কি প্রয়োজন, এইরূপ বলিয়া তাঁহারা সন্ততি, সম্পত্তি ও স্বর্গাদির মধ্যে কোন কিছুরই ‘এষণা’ অর্থাৎ ইচ্ছা না করিয়া তাহা হইতে নিবৃত্ত হইয়া কেবল ভিক্ষা করিয়াই ঘুরিয়া বেড়াইতেন; কিংবা “এই প্রকারে বিরাগী পুরুষদিগের মোক্ষলাভ হয়” [মুং|১|২|১১]; অথবা পরিশেষে “যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্ৰব্ৰজেৎ” [জাবা|৪] - যে দিন বুদ্ধি বিরক্ত হইবে সেই দিন সন্ন্যাস লইবে; - এইরূপ বিরুদ্ধপক্ষীয় বচনাদিও বৈদিক গ্রন্থেই পাওয়া যায় । এই প্রকার বেদাজ্ঞা দ্বিবিধ হওয়ায় [মভা|শাং|২৪০|৬] প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি কিংবা কর্মযোগ ও সাংখ্য, ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোনটি তাহা নির্ণয় করিবার জন্য অন্য কোন সাধন আছে কি নাই, ইহা দেখা আবশ্যক । 


10) আচার অনাদিকাল হইতে দ্বিবিধ, অতএব উহা শ্রেষ্ঠতানির্ণয়ে উপযোগী নহে



আচার অর্থাৎ শিষ্ট লোকদিগের আচরণ, রীতি কিংবা চাল কিরূপ, তাহা দেখিয়া এই প্রশ্নের নির্ণয় হইতে পারে । কিন্তু এই বিষয়ে শিষ্টাচারও উভয়বিধ । শুকযাজ্ঞবল্ক্য প্ৰভৃতি সন্ন্যাসমাৰ্গ, এবং জনক, শ্ৰীকৃষ্ণ, জৈগীষব্য প্রভৃতি জ্ঞানীপুরুষ কর্মমাৰ্গই অবলম্বন করিয়াছিলেন, ইহা ইতিহাস হইতে প্ৰকাশ পায় । এই অভিপ্ৰায়েই “তুল্যং তু দর্শনং” [বেসূ|৩|৪|৯] অর্থাৎ আচারদৃষ্টিতে এই দুই পন্থা তুল্যবল, ইহা সিদ্ধান্তপক্ষে বাদরায়াণাচাৰ্য বলিয়াছেন - 
বিবেকী সর্বদা মুক্তঃ কুর্বতো নাস্তি কর্তৃতা ৷
অলেপবাদমাশ্ৰিত্য শ্ৰীকৃষ্ণজনকৌ যথা ॥
পুৰ্ণব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষ সমস্ত কর্ম করিয়াও শ্ৰীকৃষ্ণ ও জনকের ন্যায় অকর্তা, অলিপ্ত, ও সর্বদা মুক্তই থাকেন” - এইরূপ স্মৃতিবচনও আছে । (ইহা স্মৃতির বচন বলিয়া আনন্দগিরি কঠোপনিষদের [কঠ|২|১৯] শাঙ্করভাষ্যের টীকায় উদ্ধৃত করিয়াছেন । ইহার মূল বচনটি কোথাকার তাহা আমি জানি না ।) সেইরূপ আবার, ভগবদ্‌গীতাতেও কর্মযোগীদিগের পরম্পরা বলিতে গিয়া মনুইক্ষাকু ইত্যাদির নাম বলিয়া উক্ত হইয়াছে - “এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম পূৰ্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ” [গী|৪|১৫] - ইহা জানিয়া পূর্বে জনকাদি জ্ঞানী পুরুষ কর্ম করিায়াছেন । জনক ব্যতীত এই প্রকার আরও অনেক উদাহরণ যোগবাসিষ্ঠে ও ভাগবতে প্ৰদত্ত হইয়াছে [যো|৫|৭৫; ভাগ|২|৮|৪৩-৪৫] । জনকাদির পূৰ্ণব্ৰহ্মজ্ঞান হয় নাই এইরূপ কাহারও সন্দেহ হইতে পারে । তাই বলিতেছি যে, ইহাঁরা সকলে জীবন্মুক্ত ছিলেন এইরূপ যোগবাসিষ্ঠে স্পষ্ট কথিত হইয়াছে । শুধু যোগবাসিষ্ঠে নহে, মহাভারতেও ব্যাস আপন পুত্র শুককে মোক্ষধর্মের পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিবার জন্য শেষে জনকের নিকট পাঠাইলেন এইরূপ কথা বিবৃত হইয়াছে [মভা|শাং|৩২৫ ও যো|২|১ দেখ] । সেইরূপ উপনিষদেও অশ্বপতি কৈকেয়ী রাজা উদ্দালক ঋষিকে [ছাং|৫|১১-২৪], এবং কাশিরাজ অজাতশত্রু গার্গ্য বালাকীকে [বৃ|২|১] ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ করিয়াছেন এইরূপ কথা আছে । তথাপি অশ্বপতি কিংবা জনক রাজকাৰ্য ছাড়িয়া দিয়া কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়াছেন এইরূপ কোথাও বৰ্ণনা নাই । 


11) জনকের তিন এবং গীতার দুই নিষ্ঠা



উল্টা, জনকসুলভা-সংবাদে জনক “আমি মুক্তসঙ্গ হইয়া আসক্তি না রাখিয়া রাজ্য করিতেছি এবং আমার এক হাতে চন্দন মাখিলেও, এবং অন্য হস্ত কাটিয়া ফেলিলেও আমার পক্ষে দুই-ই সমান” ইত্যাদি আপন অবস্থার বর্ণনা প্ৰথমে করিয়া [মভা|শাং|৩২০|৩৬] পরে সুলভাকে বলিতেছেন –
“মোক্ষে হি ত্ৰিবিধা নিষ্ঠা দৃষ্টাহন্যৈর্মোক্ষবিত্তমৈঃ ৷
জ্ঞানং লোকোত্তরঙ যচ্চ সর্বত্যাগশ্চ কর্মণাম্‌ ॥
জ্ঞাননিষ্ঠাং বদন্ত্যেকে মোক্ষশাস্ত্ৰবিদো জনাঃ ৷
কর্মনিষ্ঠাং তথৈবান্যে যতয়ঃ সূক্ষ্মদৰ্শিনঃ ॥
প্ৰহায়োভয়মপ্যেবং জ্ঞানং কর্ম চ কেবলম্‌ ॥
তৃতীয়েয়ং সমাখ্যাত নিষ্ঠা তেন মহাত্মনা ॥”
অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য তিন প্ৰকার নিষ্ঠা মোক্ষশাস্ত্রবেত্তারা বলিয়া থাকেন - (১) “জ্ঞান” লাভ করিয়া সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা; ইহাকেই কোন কোন মোক্ষশাস্ত্রজ্ঞ জ্ঞাননিষ্ঠা বলেন; (২) সেইরূপ আবার, অন্য সূক্ষ্মদৰ্শী লোকে কর্মনিষ্ঠা বলেন; কিন্তু কেবল জ্ঞান ও কেবল কর্ম এই দুই নিষ্ঠা ছাড়িয়া দিয়া, (৩) এই তৃতীয় (অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা আসক্তির ক্ষয় করিয়া কর্ম করিবার) নিষ্ঠা (আমাকে) সেই মহাত্মা (পঞ্চশিখ) বলিয়াছেন” [মভা|শাং|৩২০|৩৮-৪০] । নিষ্ঠা শব্দের সাধারণ অর্থ অন্তিম স্থিতি, আধার কিংবা অবস্থা । কিন্তু এই স্থানে এবং গীতাতেও নিষ্ঠা শব্দের “যে প্রকার জীবন যাপন করিলে শেষে মোক্ষলাভ হয় সেইরূপ জীবনযাত্রার মাৰ্গ” এইরূপ অর্থ বিবক্ষিত । গীতার শাঙ্করভাষ্যেও নিষ্ঠা = অনুষ্ঠেয়তাৎপৰ্য - অর্থাৎ জীবনে যাহা কিছু অনুষ্ঠেয় অর্থাৎ আচরণীয় তাহার প্রতি তৎপরতা অর্থাৎ তাহাতে মগ্ন থাকা, এই অর্থই করা হইয়াছে । জীবনের এই মাৰ্গ মধ্যে জৈমিনি প্ৰভৃতি মীমাংসকেরা জ্ঞানের গুরুত্ব না দিয়া কেবল যাগযজ্ঞাদি কর্ম করিলেই মোক্ষলাভ হয় বলিয়াছেন –
ঈজানা বহুভিঃ যজ্ঞৈঃ ব্ৰাহ্মণা বেদপারগাঃ ৷
শাস্ত্ৰাণি চেৎ প্ৰমাণং স্যুঃ প্ৰাপ্তাস্তে পরমাং গতিম ॥
কারণ, ঐরূপ না মানিলে শাস্ত্রের অর্থাৎ বেদের আজ্ঞা ব্যর্থ হইবে, [জৈসূ|৫|২|২৩ শঙ্করভাষ্য দেখ] । এবং উপনিষৎকার ও বাদরায়ণাচাৰ্য সমস্ত যাগযজ্ঞাদি গৌণ স্থির করিয়া কেবল জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, জ্ঞানব্যতীত আর কিছুরই দ্বারা ব্ৰহ্মলাভ হইতে পারে না, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [বেসূ|৩|৪|১,২] । কিন্তু এই দুই নিষ্ঠাকে ছাড়িয়া দিয়া আসক্তিবিরহিত কর্ম করিবার এক তৃতীয় নিষ্ঠাই পঞ্চশিখ (নিজে সাংখ্যমাৰ্গী হইলেও) আমাকে বলিয়ছেন, এইরূপ জনক বলেন । “দুই নিষ্ঠা ছাড়িয়া দিয়া” এই শব্দগুলি হইতে স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে, এই তৃতীয় নিষ্ঠাটি পূর্বের দুই নিষ্ঠার মধ্যে কোন নিষ্ঠারই অঙ্গীভূত নহে, - প্ৰত্যুত স্বতন্ত্রভাবে বর্ণিত হইয়াছে । বেদান্তসূত্রেও [বেসূ|৩|৪|৩২-৩৫] জনকের এই তৃতীয় নিষ্ঠার উল্লেখ করা হইয়াছে; ভগবদ্‌গীতায় জনকের এই তৃতীয় নিষ্ঠাই — তাহার ভিতর ভক্তি নূতন যোগ করিয়া - বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু মীমাংসকদিগের নিছক কর্মমার্গ অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মমার্গ মোক্ষপ্ৰদ নহে, শুধু স্বৰ্গপ্ৰদ - এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত [গী|২|৪২-৪৪; ৯|২৭]; তাই যে মার্গ মোক্ষপ্ৰদ নহে তাহার ‘নিষ্ঠা’ নামই দেওয়া যায় না । কারণ, যাহার দ্বারা শেষে মোক্ষলাভ হয় সেই মাৰ্গকেই নিষ্ঠা বলা উচিত - এই ব্যাখ্যা সকলেরই স্বীকৃত । অতএব সকলের মতের সাধারণ বৰ্ণনা করিবার সময় জনক তিন নিষ্ঠার কথা বলিলেও মীমাংসকদিগের নিছক্‌ অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মমার্গ ‘নিষ্ঠা’ হইতে বাহির করিয়া দিয়া সিদ্ধান্তপক্ষে স্থির নির্ধারিত দুই নিষ্ঠাই গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে বর্ণিত হইয়াছে [গী|৩|৩] । নিছক্‌ জ্ঞান (সাংখ্য) ও জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম (যোগ) এই দুই-ই নিষ্ঠা; এবং সিদ্ধান্তপক্ষীয় এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে দ্বিতীয় (অর্থাৎ জনকের কথা অনুসারে তৃতীয়) নিষ্ঠার সমর্থনাৰ্থ “কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ” [গী|৩|২৫] জনকাদি এইরূপ কর্ম করিয়াই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন - এই পুরাতন দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইয়াছে । 

জনকাদি ক্ষত্রিয় রাজার কথা ছাড়িয়া দিলেও ব্যাস বিচিত্ৰবীৰ্যের বংশ বজায় রাখিবার জন্য ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুই ক্ষেত্ৰজ পুত্র উৎপন্ন করিলেন এবং তিন বৎসর সতত পরিশ্রম করিয়া জগতের উদ্ধারার্থ মহাভারতও লিখিলেন; এবং কলিযুগে স্মার্ত অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের প্রবর্তক শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যও স্বকীয় অলৌকিক জ্ঞানের দ্বারা ও উদ্যোগে ধর্মসংস্থাপন করিলেন - ইহা সৰ্বশ্ৰুত কথা । অধিক কি, স্বয়ং ব্ৰহ্মদেব যখন কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত হন তখনই সৃষ্টির আরম্ভ হয়; ব্ৰহ্মদেব হইতেই মরীচি, আদি সাত মানসপুত্র উৎপন্ন হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ না করিয়া সৃষ্টিক্ৰম বজায় রাখিবার জন্য আমরণ প্ৰবৃত্তিমাৰ্গই অঙ্গীকার করেন; এবং সনৎকুমারাদি অন্য সাত মানসপুত্র জন্ম হইতেই বিরক্ত অর্থাৎ নিবৃত্তিপন্থী - এইরূপ মহাভারতে নারায়ণীয় ধর্মনিরূপণে বর্ণিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৩৯ ও ৩৪০] । ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষেরা এবং ব্ৰহ্মদেবও কর্ম করিবারই এই প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ কেন স্বীকার করিলেন ? বেদান্তসূত্রে তাহার এই প্ৰকার উপপত্তি কথিত হইয়াছে - “বাবদধিকারমবস্থিতিরাধিকারিণাম” [বেসূ|৩|৩|৩২] - যাহার ঈশ্বরপ্রদত্ত যে অধিকার, তাহা পূর্ণ না হওয়া পৰ্যন্ত কর্ম হইতে মুক্তি লাভ হয় না । এই উপপত্তির বিচার পরে করা যাইবে । উপপত্তি যাহাই হউক না কেন, প্ৰবৃত্তি ও নিবৃত্তি এই দুই পন্থা জগতের আরম্ভ হইতে ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষদিগের মধ্যে প্ৰচলিত আছে - এ কথাও নিৰ্বিবাদ । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পাইতেছে যে, ইহাদের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ তাহার নির্ণয় কেবল আচার দেখিয়াই করা যাইতে পারে না ।


12) কর্মকে বন্ধক বলিলেই, ইহা সিদ্ধ হয় না যে, তাহা ত্যাগ করিতে হইবে; ফলাশা ছাড়িয়া দিলে নির্বাহ হইয়া যায়



পূর্বাচার এইরূপ দ্বিবিধ হওয়ায় কেবল আচার দেখিয়াই নিবৃত্তি শ্ৰেষ্ঠ কিংবা প্ৰবৃত্তি শ্রেষ্ঠ ইহার নিষ্পত্তি করিতে না পারিলেও, সন্ন্যাসমার্গী লোকদিগের আর একটী যুক্তিক্ৰম এই যে, কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ ব্যতীত মোক্ষ হয় না ইহা যদি নির্বিবাদ হয়, তবে জ্ঞানলাভ হইলে পর তৃষ্ণামূলক কর্মের ঝঞ্চাট যত শীঘ্ৰ হয় দূর করিয়া দেওয়াই শ্রেয়ষ্কর । মহাভারতের শুকানুশাসনে - ইহাকেই ‘শুকানুপ্রশ্ন’ও বলে - সন্ন্যাসমার্গেরই প্ৰতিপাদন আছে । সেই স্থানে শুক ব্যাসকে প্রশ্ন করিতেছেন -
যদিদং বেদবচনং কুরু কর্ম ত্যজেতি চ ৷
কাং দিশং বিদ্যয়া যান্তি কাং চ গচ্ছন্তি কর্মণা ॥
“বেদ কর্মত্যাগ করিতেও বলেন আবার কর্ম করিতেও বলেন; এরূপ স্থলে, বিদ্যার দ্বারা অর্থাৎ কর্মারহিত জ্ঞানের দ্বারা এবং নিছক্‌ কর্মের দ্বারা কোন্‌ গতি লাভ হয়, তাহা আমাকে বল” [শাং|২৪০|১] তাহার উত্তরে ব্যাস বলিলেন -
কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে ৷
তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি যতয়ঃ পারদর্শিনঃ ॥
“কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় ও বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয়; তাই পারদর্শী যতি কিংবা সন্ন্যাসী কর্ম করে না” [শাং|২৪০|৭] । এই শ্লোকের প্রথম চরণের বিচার পূৰ্বপ্রকরণে আমি করিয়াছি । “কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে” এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে কোন বিবাদ নাই । কিন্তু মনে থাকে যেন, সেখানে ইহাই দেখানো হইয়াছে যে, “কর্মণা বধ্যতে|” এই কথার বিচারে সিদ্ধ হয় যে, কর্মের দ্বারা জড় কিংবা চেতন, কেহ বদ্ধও হয় না, মুক্তও হয় না; মনুষ্য ফলাশায় কিংবা নিজের আসক্তিনিবন্ধন কর্মে বদ্ধ হয়; এই আসক্তির মোচন হইলে কেবল বাহ্যেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কর্ম করিলেও সে মুক্ত । এই অর্থই মনে করিয়া অধ্যাত্মরামায়ণে [২|৪|৪২] রামচন্দ্ৰ লক্ষণকে বলিতেছেন যে -
প্ৰবাহপতিতঃ কাৰ্য্যং কুৰ্বন্নপি ন লিপ্যতে ৷
বাহ্যে সর্বত্র কর্তৃত্বমাবহন্নপি রাঘব ॥
“কর্মময় সংসারের প্রবাহে পতিত মনুষ্য বাহ্যতঃ সমস্ত কর্তব্য কর্ম করিয়াও অলিপ্ত থাকে” । অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্তের প্রতি লক্ষ্য করিলে দেখা যায় যে, কর্ম দুঃখময় বলিয়া ছাড়িবার আবশ্যকতা নাই; মনকে শুদ্ধ ও সম করিয়া ফলাশা ছাড়িলেই সমস্ত কাজ হয় । তাৎপৰ্য এই যে, জ্ঞান ও কাম্য কর্মের মধ্যে বিরোধ হইলেও নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞান ইহাদের মধ্যে কোনও বিরোধ হইতে পারে না । তাই অনুগীতায় “তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি” – অতএব কর্ম করে না – এই বাক্যের বদলে -
তস্মাৎ কর্মসু নিঃস্নেহা যে কেচিৎ পারদর্শিনঃ ॥
“অতএব পারদর্শী পুরুষ কর্মেতে আসক্তি রাখে না” [অশ্ব|৫১|৩৩] এইরূপ বাক্য আসিয়াছে । তৎপুর্বে -
কুৰ্বতে যে তু কর্মাণি শ্ৰদ্দধানা বিপশ্চিতঃ ৷
অনাশীৰ্যোগসংযুক্তাস্তে ধীরাঃ সাধুদৰ্শিনঃ ॥
“যে সকল জ্ঞানী পুরুষ শ্ৰদ্ধাপূর্বক ফলাশা না রাখিয়া (কর্ম-) যোগমার্গ অবলম্বন করিয়া কর্ম করে তাহারাই সাধুৰ্দশী” [অশ্ব|৫০|৬, ৭] - এইরূপ কর্মযোগ স্পষ্ট প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । সেইরূপ -
যদিদং বেদবচনং কুরু কর্ম ত্যজোতি চ ৷
এই পূর্বার্ধে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রতি শৌনকের এই উপদেশ -
তস্মাদ্ধর্মানিমান্‌ সর্বান্নাভিমানাৎ সমাচারেৎ ॥
“কর্ম কর এবং কর্ম ছাড়ো বেদ, উভয়ই বলেন; তাই (কর্তৃত্বের) অভিমান না রাখিয়া আমাদিগের সমস্ত কর্ম করিতে হইবে” [বন|২|৭৩] । শুকানুপ্রশ্নেও ব্যাসদেব শুককে দুইবার স্পষ্ট বলিয়াছেন -
এষা পূর্বতরা বৃত্তির্ব্রাহ্মণস্য বিধীয়তে ৷
জ্ঞানবানেব কর্মাণি কুৰ্বন্‌ সর্বত্ৰ সিধ্যতি ॥
“জ্ঞানবান্‌ হইয়া সমস্ত কর্ম করিয়াই সিদ্ধিলাভ করা, ইহাই ব্ৰাহ্মণের পূর্বকালের (পুর্বতন) পুরাতন বৃত্তি” [মভা|শাং|২৩৭|১; ২৩৪|২৯] । “জ্ঞানবানের” এই পদের দ্বারা জ্ঞানোত্তর ও জ্ঞানযুক্ত কর্মই এইস্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, ইহা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে । যাক; দুই পক্ষের এই বচনগুলি নিরাগ্রহ বুদ্ধিতে শান্তভাবে বিচার কারলে বুঝা যাইবে যে, “কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ” এই যুক্তিক্ৰমে “তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি” - অতএব কর্ম করে না - কর্মত্যাগমূলক এই একই অনুমান নিষ্পন্ন বা হইয়া, “তস্মাৎ কর্মসু নিঃস্নেহা” - অতএব কর্মে আসক্তি রাখে না - এই নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিবার অন্য অনুমানও ততটাই যোগ্য এইরূপ সিদ্ধ হয় । কেবল আমিই এইরূপ দুই অনুমান করিতেছি এরূপ নহে, স্বয়ং ব্যাসও এই অর্থই শুকানুপ্রশ্নের নিম্নোক্ত শ্লোকে স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছেন -
দ্বাবিমাবথ পন্থার্নৌ যস্মিন্‌ বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ ৷
প্ৰবৃত্তিলক্ষণো ধৰ্ম্মঃ নিবৃত্তিশ্চ বিভাষিতঃ ॥*
“এই দুই মার্গের উপর বেদ (একই রূপ) প্রতিষ্ঠিত - একটি প্রবৃত্তিমূলক ধর্ম, অন্যটি নিবৃত্তিমূলক অর্থাৎ সন্ন্যাসগ্রহণের ধর্ম” [মভা|শাং|২৪০-৬] । *(এই চরণের ‘নিবৃত্তিশ্চ সুভাষিতঃ’ ‘নিবৃত্তিশ্চ বিভাবিতঃ' এইরূপ পাঠান্তৱও আছে । যে কোন পাঠই গ্ৰহণ করা না কেন, প্রথমে ‘দ্বাবিমৌ’ এইরূপ উক্ত হইয়াছে; ইহা হইতে দুই পন্থা যে স্বতন্ত্র তাহা নির্বিবাদরূপে সিদ্ধ হইতেছে ।)

সেইরূপ আবার নারায়ণীয় ধর্মেতেও এই দুই পন্থাই পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টির আরম্ভ হইতে প্ৰচলিত থাকার বর্ণনা আছে ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কিন্তু মনে রেখো, মহাভারতে প্ৰসঙ্গানুসারে এই দুই পন্থা বর্ণিত হওয়ায় প্ৰবৃত্তিমার্গেরই ন্যায় নিবৃত্তিমার্গের সমর্থক বচনাদিও মহাভারতেই পাওয়া যায় । গীতার সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকায় নিবৃত্তিমার্গের এই বচনকেই মুখ্য মনে করিয়া, তাহা ছাড়া যেন আর কোন পন্থাই নাই কিংবা যদি থাকে তো সে গৌণ অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের অঙ্গ, এইরূপ প্ৰতিপাদনের চেষ্টা করা হইয়া থাকে । কিন্তু এই প্রতিপাদন সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহমূলক; এবং সেইজন্য গীতাৰ্থ সরল ও স্পষ্ট হইলেও আজিকার কালে তাহা অনেকের দুৰ্বোধ হইয়া পড়িয়াছে । “লোকেহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” [গী|৩|৩] গীতার এই শ্লোকের জুড়ী “দ্বাবিমাবথ পন্থানৌ” এই শ্লোক; এই স্থানে দুই তুল্যবল মাৰ্গ বুঝাইবার হেতু আছে, এইরূপ স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু এই সুস্পষ্ট অর্থের প্রতি কিংবা পূর্বাপর সন্দর্ভের প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া এই শ্লোকেই দুয়ের বদলে এক মাৰ্গই প্ৰতিপাদ্য এইরূপ কেহ কেহ দেখাইবার চেষ্টা করিয়া থাকেন !


13) কর্ম দূর হইতে পারে না



এই প্রকারে সুস্পষ্ট হইল যে, কর্মসন্ন্যাস (সাংখ্য) ও নিষ্কাম কর্ম (যোগ) বৈদিক ধর্মের দুই স্বতন্ত্র মাৰ্গ এবং সে বিষয়ে গীতার এই সিদ্ধান্ত যে, উহারা বিকল্পাত্মক নহে, কিন্তু “সন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগের যোগ্যতা বিশেষ রকমের” । “এক্ষণে কর্মযোগ সম্বন্ধে গীতা পরে বলেন যে, যে জগতে আমরা থাকি সেই জগৎ এবং তাহাতে ক্ষণকাল জীবিত থাকাও যদি কর্ম হয়, তবে কর্ম ছাড়িয়া কোথায় যাইব ? এবং এই জগতে অর্থাৎ কর্মভূমিতেই যদি থাকিতেই হয় তবে কর্ম হইতে মুক্ত হইবই বা কি প্রকারে ? যতদিন দেহ থাকে সে পৰ্যন্ত, ক্ষুধা তৃষ্ণা প্ৰভৃতি বিকার আমাদিগকে যেমন ছাড়ে না প্ৰত্যক্ষ দেখি, [গী|৫|৮,৯], এবং তন্নিবারণার্থ ভিক্ষা মাগিবার লজ্জাজনক কর্ম করাও যদি সন্ন্যাসধর্মানুসারে বৈধ হয় তবে অনাসক্তবুদ্ধিতে অন্য ব্যবহারিক শাস্ত্ৰোক্ত কর্ম করিতেই কি প্রকারে প্রত্যবায় হয় ? কর্ম করিলে কর্মপাশে বদ্ধ হইয়া ব্ৰহ্মানন্দ হারাইবে কিংবা ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ অদ্বৈত বুদ্ধি বিচলিত হইবে এই ভয়ে অন্য কর্ম যদি কেহ ছাড়িয়া দেয়, তবে তাহার মনোনিগ্ৰহ অদ্যাপি দৃঢ় হয় নাই বলিতে হয়; এবং মনোনিগ্ৰহ অদৃঢ় থাকিতে যে কর্মত্যাগ, তাহা গীতানুসারে মোহাত্মক অর্থাৎ তামস কিংবা মিথ্যাচার [গী|১৮|৭; ৩|৬] । এই অবস্থায় এই অর্থ স্বতই প্ৰকাশ পায় যে, এইরূপ অদৃঢ় মনোনিগ্ৰহকে চিত্তশুদ্ধির দ্বারা পূর্ণ করিতে হইলে, নিষ্কামবুদ্ধিপরিবর্ধক যজ্ঞদানাদি গৃহস্থাশ্রমের শ্রৌত কিংবা স্মার্ত কর্মই মনুষ্যের করিতে হইবে । ফলকথা, এইপ্ৰকার কর্মত্যাগ কখনই শ্রেয়স্কর হয় না । ভাল; যদি বলো, মন নির্বিষয় এবং তাহা উহার অধীন, তবে উহার কর্মের ভয়ই কেন, কিংবা কর্ম না করিবার ব্যর্থ আগ্রহই বা সে করে কেন ? বর্ষার জন্য যে ছত্র, তাহার পরীক্ষা যেরূপ বর্ষাকালেই হইয়া থাকে, সেইপ্ৰকার কিংবা-
বিকারহেতৌ সতি বিক্রিয়ন্তে
যেষাং ন চেতাংর্সি ত এবং ধীরাঃ ॥
“যে সকল কারণে বিকার উৎপন্ন হয় সেই সব কারণ কিংবা বিষয় চোখের সামনে থাকিলেও যাঁহাদিগের অন্তঃকরণ মোহের বিকারে পতিত হয় না, সেই সকল পুরুষকেই ধৈৰ্যশালী বলা যায়” [কুমার|১|৫৯] - কালিদাসের এই ব্যাপক নীতিসূত্ৰ অনুসারে মনোনিগ্ৰহকে কর্মের কষ্টিপাথরেই পরোখ করিয়া, তাহা পূর্ণ হইয়াছে কিনা তাহার সাক্ষ্য শুধু অন্যের নিকট নহে, আপনার নিকটেও পাওয়া যায় । এই দৃষ্টিতেও শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত অর্থাৎ প্রবাহপতিত কর্ম করাই কর্তব্য এইরূপ সিদ্ধ হয় [গী|১৮|৬] । ভাল; যদি বল, “মন বশে থাকায় শাস্ত্ৰোক্ত কর্ম করিলে চিত্তশুদ্ধি বিগড়াইয়া যাইবার কোন ভয় নাই; কিন্তু মোক্ষলাভের পক্ষে অনাবশ্যক ব্যর্থ কর্ম করিয়া দেহকে কষ্ট দিতে চাহি না”, তবে কায়ক্লেশভয়ে অর্থাৎ কেবল দেহের কষ্ট হইবে এই ক্ষুদ্র ভয়ে কৃত এই কর্মত্যাগ রাজসিক; ত্যাগের ফল এইরূপ রাজস কর্মত্যাগে পাওয়া যায় না [গী|১৮|৮] । তবে কর্মত্যাগই করিব কেন ? সমস্ত কর্ম মায়াজগতের অতএব অনিত্য হওয়া প্ৰযুক্ত ব্ৰহ্ম-জগতের নিত্য আত্মার উহার মধ্যে পতিত হওয়া উচিত নহে, এ কথা যদি কেহ বলেন, তাহাও ঠিক নহে । কারণ পরব্রহ্ম যদি নিজেই মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত থাকেন তবে এইরূপ মায়ায় মধ্যে মনুষ্যেরও কাজ করিতে বাধা কি ? ব্ৰহ্মজগৎ ও মায়াজগৎ, সমস্ত জগতের যেরূপ এই দুই ভাগ আছে, সেইরূপ মনুষ্যেরও আত্মা ও দেহেন্দ্ৰিয়াদি এইরূপ দুই ভাগ আছে । তন্মধ্যে আত্মা ও ব্রহ্মের যোগ করিয়া দিয়া ব্ৰহ্মেতে আত্মার লয় কর এবং এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিকে নিঃসঙ্গ রাখিয়া কেবল মায়িক দেহেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা মায়া-জগতের ব্যবহার কর । এইরূপ করিলে, মোক্ষের কোন প্রতিবন্ধক আসিবে না; এবং উক্ত দুই ভাগের যোগ আপোষে নিবদ্ধ হইলে জগতের কোন ভাগের উপেক্ষা বা বিচ্ছেদ করিবার দোষও লাগিবে না; এবং ব্ৰহ্মজগৎ ও মায়াজগৎ - পরলোক ও ইহলোক - এই দুই লোকেরই কর্তব্য করাতে তোমার শ্ৰেয় লাভ হইবে । ঈশোপনিষদে এই তত্ত্বই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে [ঈশ|১১] । এই শ্রুতিবচনের সবিস্তার বিচার পরে করা যাইবে । এক্ষণে এইটুকুই বলিতেছি যে, ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্যের অনুভবকারী জ্ঞানী পুরুষ মায়াজগতের ব্যবহার কেবল শরীরের দ্বারা অথবা কেবল ইন্দ্ৰিয়াদির দ্বারাই করিয়া থাকে, এইরূপ গীতাতে যাহা বর্ণিত হইয়াছে [গী|৪|২১; ৫|১২] তাহার তাৎপৰ্যও ইহাই; এই হেতু, ১৮ম অধ্যায়ে “নিঃসঙ্গবুদ্ধিতে ফলাশা ছাড়িয়া কেবল কর্তব্য বলিয়া কর্ম করাই প্ৰকৃত ‘সাত্বিক’ কর্মত্যাগ” - কর্ম না করা প্রকৃত কর্মত্যাগ নহে, এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [গী|১৮|৯] । কর্ম মায়াজগতের হইলেও তাহা পরমেশ্বরই কোন অজ্ঞেয় কারণে উৎপন্ন করিয়াছেন; তাহা বন্ধ করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত নহে, তাহা পরমেশ্বরেরই অধীন; অতএব বুদ্ধিকে নিঃসঙ্গ রাখিয়া কেবল শারীর কর্ম করিলে মোক্ষের বাধা হয় না, ইহা নির্বিবাদ । তবে, চিত্তেতে বৈরাগ্য রাখিয়া কেবল ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা শাস্ত্ৰ প্ৰাপ্ত কর্ম করিতে বাধাই বা কি ? 


14) কর্ম ছাড়িয়া দিলে আহারও জুটিবে না



“ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ” [গী|৩|৫; ১৮|১১] - এই জগতে ক্ষণকালও কর্ম ছাড়া থাকিতে পারা যায় না, এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে; আবার অনুগীতায় “নৈষ্কর্মং ন চ লোকেহস্মিন, মুহুর্তমপি লভ্যতে” [অশ্ব|২০|৭] - এই লোকে (কেহই) এক মুহূর্তও কর্ম হইতে মুক্ত নহে - এইরূপ বলা হইয়াছে । শুধু মনুষ্য কেন, সূৰ্যচন্দ্ৰাদি পৰ্যন্ত সকলে নিরন্তর কর্মই করিতেছে ! অধিক কি, কর্মই জগৎ, আর জগৎই কর্ম ইহা স্থির সিদ্ধান্ত; তাই জগতের ভাঙ্গাগড়ার কিংবা কর্মের ক্ষণমাত্র বিরাম নাই, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । দেখ, একদিকে ভগবান গীতাতে বলিতেছেন - “কর্ম ছাড়িলে খাওয়া পৰ্যন্ত হইবে না” [গী|৩|৮]; অপরদিকে বনপর্বে দ্রৌপদী যুধিষ্টিরকে বলিতেছেন - “অকর্মণা বৈ ভূতানাং বৃত্তিঃ স্যান্ন হি কাচন” [বন|৩২|৮], কর্ম ব্যতীত প্রাণীমাত্রের জীবনযাত্রা নিৰ্বাহ হয় না; সেইরূপ দাসবোধেও প্ৰথমে ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিয়া তাহার পর “প্রপঞ্চ সাঁতুন পরমার্থ কেলা । তরী অন্ন মিলে না খায়ালা ।” অর্থাৎ - “প্রপঞ্চ ছাড়িয়া পরমার্থ করিল, তবু খাইতে অন্ন মিলিল না” [দা|১২|১|৩] । এইরূপ শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামীও বলিয়াছেন । ভাল; স্বয়ং ভগবানের চরিত্র আলোচনা কর; দেখিবে যে, ভগবান যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন অবতার হইয়া, এই মায়িক জগতে সাধুর পরিত্রাণ ও দুষ্টের বিনাশসাধন রূপ কর্ম করিয়াই আসিতেছেন [গী|৪|৮ ও মভা|শাং|৩৩৯|১০৩ দেখ] । এই এই কর্ম যদি আমি না করি তবে জগৎ ধ্বংস হইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হয়, ইহা তিনি গীতাতে বলিয়াছেন [গী|৩|২৪] । ইহা হইতে সিদ্ধ হইতেছে যে, যখন স্বয়ং ভগবান জগতের ধারণার্থ কর্ম করিতেছেন, তখন জ্ঞানোত্তর কর্ম নিরর্থক, এই কথার কোন ফল নাই । তাই, “যঃ ক্রিয়াবান্‌ স পণ্ডিতঃ” [মভা|বন|৩১২|১০৮] - যে ক্রিয়াবান্‌ সে-ই পণ্ডিত - “এই নীতিসূত্র অনুসারে অর্জুনকে উপলক্ষ্য করিয়া ভগবান সকলকেই এই উপদেশ করিতেছেন যে, এই জগতে কর্ম হইতে কেহই মুক্ত হইতে পারে না; কর্মের বাধা হইতে বাঁচিবার জন্য মনুষ্যের সর্বদা নিজ ধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্তব্য, ফলাশা ছাড়িয়া, বিরক্ত বুদ্ধিতে করা - এই একমার্গ (যোগ) মনুষ্যের আয়ত্তাধীন এবং ইহাই উত্তমও বটে । প্ৰকৃতি তো নিজের কাজ সর্বদা করিতেই থাকিবে; কিন্তু উহাতে কর্তৃত্বের অভিমান-বুদ্ধি ছাড়িয়া দিলেই তুমি মুক্তই [গী|৩|২৭; ১৩|২৯; ১৪|১৯; ১৮|১৬] । মুক্তির জন্য কর্মত্যাগ কিংবা সাংখ্যের অনুসারে কর্মসন্ন্যাসরূপ বৈরাগ্যের আবশ্যকতা নাই; কারণ এই কর্মভূমিতে সম্পূর্ণ কর্মত্যাগ করা সম্ভবই নহে ।


15) জ্ঞান হইলে নিজের কর্তব্য যদি না থাকে, অথবা বাসনার যদি ক্ষয় হইয়া যায়, তবু কর্ম দূর হয় না



এই সম্বন্ধেও কেহ এইরূপ ফ্যাকড়া বাহির করেন যে, মানিলাম যে, কর্মবন্ধন ছেদন করিবার জন্য কর্ম ছাড়িবার আবশ্যকতা নাই, কেবল কর্মফলাশা ত্যাগ করিলেই সমস্ত নিৰ্বাহ হয়; কিন্তু যখন জ্ঞানের দ্বারা আমার বুদ্ধি নিষ্কাম হয় তখন সমস্ত বাসনা ক্ষয় হয় এবং কর্মে প্ৰবৃত্তি হইবার কোন কারণই অবশিষ্ট থাকে না; এবং এইরূপ অবস্থায় অর্থাৎ কায়ক্লেশভয়ে নহে - বাসনাক্ষয় প্ৰযুক্ত সমস্ত কর্ম আপনা হইতেই ছাড়িয়া যায় । এই জগতে মোক্ষই মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ । যে সেই মোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা লাভ করে তাহার প্রজা, সম্পত্তি কিংবা স্বৰ্গলোকাদির সুখ - এই সমস্তের কোনও “এষণা” (ইচ্ছা) থাকে না [বৃ|৩|৫|১ ও ৪|৪|২২] বলিয়া কর্ম না ছাড়িলেও শেষে সেই জ্ঞানের স্বাভাবিক পরিণাম ইহাই হয় যে, কর্ম আপনিই ছুটিয়া যায় । এই অভিপ্রায়ে -
জ্ঞানামৃতেন তৃপ্তস্য কৃতকৃত্যস্য যোগিনঃ ৷
ন চাস্তি কিঞ্চিৎ কর্তব্যমস্তি চেন্ন স তত্ত্ববিৎ ॥
“জ্ঞানামৃত পান করিয়া যে কৃতকৃত্য হইয়াছে সেই পুরুষের পরে কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট থাকে না; এবং যদি থাকে তো সে তত্ত্বজ্ঞানী নহে” এইরূপ উত্তরগীতায় [১|২৩] উক্ত হইয়াছে । [ইহা শ্রুতির শ্লোক – এই ধারণা ঠিক্‌ নহে । বেদান্তসূত্রের শাঙ্কর ভাষ্যে এই শ্লোকটি নাই । কিন্তু সনৎসুজাতীয়ের ভাষ্যে আচার্য তাহা গ্রহণ করিয়া সেখানে তিনি লিঙ্গপুরাণে ইহা আছে বলিয়াছেন । সুতরাং শ্লোকটি সন্ন্যাস মার্গের, কর্মযোগের নহে নিঃসন্দেহ । বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থেও এইরূপ বচনাদি আছে (পরিশিষ্ট প্রকরণ দেখ) ।] ইহা জ্ঞানী পুরুষের দোষ বলিয়া যদি কাহারও সন্দেহ হয়, তাহা ঠিক নহে; কারণ ইহাই ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষের এক অলঙ্কার - “অলঙ্কারো হ্যয়মস্মাকং যদ্‌ব্রহ্মাত্মাবগতৌ সত্যাং সর্বকর্তব্যতাহানিঃ” [বেসূ|শাং|ভা|১|১|৪] - এইরূপ শঙ্করাচাৰ্য বলিয়াছেন । সেইরূপ গীতাতেও “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” [গী|৩|১৭] জ্ঞানীর পরে আর কিছুই করিবার থাকে না; তাঁহার সমস্ত বৈদিক কর্মের কোনই প্রয়োজন নাই [গী|২|৪৬]; অথবা “যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে” [গী|৬|৩] । যে যোগারূঢ় তাহার শমই কারণ এইরূপ বচন আছে । তাছাড়া “সর্বারম্ভপরিত্যাগী” [গী|১২|১৬] অর্থাৎ সমস্ত উদ্যোগ যে ত্যাগ করে, এবং “অনিকেতঃ” [গী|১২|১৯] অর্থাৎ যাহার গৃহ নাই ইত্যাদি বিশেষণ ও জ্ঞানীপুরুষের বর্ণনায় গীতাতে সংযোজিত হইয়াছে । ইহা হইতে - জ্ঞানলাভের পর কর্মবন্ধন আপনা আপনিই মোচন হয় – এই কথা ভগবদ্‌গীতার মান্য এইরূপ কাহারও কাহারও মত । কিন্তু আমার মতে, গীতা-বাক্যগুলির এই অর্থ এবং উপরি-উক্ত যুক্তিবাদও ঠিক্‌ নহে । তাই তদ্বিরুদ্ধে আমার যাহা বক্তব্য তাহা এইখানে সংক্ষেপে বলিতেছি ।


16) অতএব জ্ঞানপ্রাপ্তির পরেও নিঃস্বার্থবুদ্ধিতে কর্ম অবশ্য করা চাই



মনুষ্য জ্ঞানী হইলে তাহার সকল প্রকার ইচ্ছা কিংবা বাসনা বিলুপ্ত হওয়া উচিত, এই কথা গীতার আদৌ মান্য নহে, ইহা সুখদুঃখবিবেকপ্রকরণে আমি দেখাইয়াছি । শুধু বাসনা বা ইচ্ছা থাকাতে কোন দুঃখ নাই, আসক্তিই দুঃখের প্ৰকৃত মূল । তাই, সর্বপ্রকার বাসনা বিনষ্ট না করিয়া জ্ঞানী কেবল আসক্তি ‘ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম করিবে, ইহাই গীতার সিদ্ধান্ত । আসক্তি চলিয়া যাইবার সঙ্গেই সমস্ত কর্মও যে ছাড়িয়া যাইবে তাহা নহে । অধিক কি, বাসনা হইতে মুক্ত হইলেও সমস্ত কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া যায় না । বাসনা থাক বা না থাক, শ্বাসোচ্ছাসাদি কর্ম নিত্য সমান চলিতে থাকে, এইরূপ আমরা দেখিতে পাই । বেশী দূরে যাইতে হইবে কেন ? ক্ষণমাত্র জীবিত থাকাও তো কর্মই; পূর্ণজ্ঞান হইলেও আপনার বাসনা দ্বারা কিংবা বাসনাক্ষয়ের দ্বারা উহা হইতে মুক্ত হওয়া যায় না । বাসনা হইতে মুক্ত বলিয়া কোনও জ্ঞানী পুরুষ প্রাণ বিসর্জন করে না, এ কথা প্ৰত্যক্ষসিদ্ধ; এবং সেইজন্যই “নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ” [গী|৩|৫] যে-ই হউক না কেন, সে কর্ম না করিয়া থাকিতে পারে না - এই বচন গীতায় দেখিতে পাওয়া যায় । এই কর্মভূমিতে কর্ম তো নিসর্গতঃ প্ৰাপ্ত, প্ৰবাহপতিত ও অপরিহার্য, তাহা মনুষ্যের বাসনার উপর ঝুলিয়া নাই, ইহা গীতাশাস্ত্রের কর্মযোগের প্রথম সিদ্ধান্ত । কর্ম ও বাসনার পরস্পর নিত্যসম্বন্ধ নাই এইরূপে ইহা সিদ্ধ হইলে পর বাসনাক্ষয়ের সঙ্গেই কর্মেরও ক্ষয় স্বীকার করা ভিত্তিহীন হইয়া পড়ে । তাহার পর, বাসনাক্ষয়ের পরেও প্ৰাপ্ত কর্ম জ্ঞানীপুরুষের কি প্রকারে করিতে হইবে এই প্রশ্ন সহজেই উত্থিত হয় । এই প্রশ্নের উত্তর গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত হইয়াছে [গী|৩|১৭-১৯ ও তাহার উপর আমার টীকা দেখ] । জ্ঞানীপুরুষের জ্ঞানোত্তর নিজের বলিয়া কোন কর্তব্য থাকে না, এ কথা গীতার মান্য । ইহার পর গীতা ইহাও বলিতেছেন যে, যে কেহই হউক না কেন, কর্মবন্ধন হইতে কেহই মুক্ত হয় না । জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য থাকে না এবং কর্ম মোচন হয় না, এই দুই সিদ্ধান্ত কেহ কেহ পরস্পরবিরোধী বলিয়া মনে করেন; কিন্তু গীতার কথা সেরূপ নহে । গীতা উহাদের এই মিল করিয়া বলেন যে, যখন কর্ম অপরিহাৰ্য, তখন জ্ঞানী পুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও তাহা করিতেই হইবে । কিন্তু তাহার নিজের জন্য কোন কর্তব্য থাকে না, অতএব তাহার আপনার সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করাই কর্তব্য । সার কথা, তৃতীয় অধ্যায়ের ১৭ম শ্লোকের “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই বাক্যে, ‘কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ এই শব্দগুলি অপেক্ষা ‘তস্য’ (অর্থাৎ সেই জ্ঞানী পুরুষের) এই শব্দ অধিক গুরুত্বসূচক; এবং তাহার ভাবাৰ্থ এই যে, ‘তাহার নিজের’ জন্য প্ৰাপ্ত কোন কর্ম থাকে না, এই কারণেই, এক্ষণে অর্থাৎ জ্ঞানোত্তর, তাহার আপন কর্তব্য তাহাকে নিরপেক্ষ বুদ্ধিতে করিতে হইবে । পরে ১৯ম শ্লোকে ‘তস্মাৎ’: এই কারণবোধক পদ প্রয়োগ করিয়া অর্জুনকে এই অর্থের উপদেশ করিয়াছেন, “তস্মাদসক্ত: সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” [গী|৩|১৯] - তাই শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত নিজ কর্তব্য তুমি আসক্তি না রাখিয়া করিয়া যাও, কর্ম ছাড়িও না । তৃতীয় অধ্যায়ের ১৭-১৯ এই তিন শ্লোকে পরিব্যক্ত কার্যকারণভাব এবং অধ্যায়ান্তর্ভূত সমস্ত প্রকরণের সন্দর্ভের প্রতি লক্ষ্য করিলে, সন্ন্যাসমার্গীর কথা অনুসারে “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত মানা যুক্তিসিদ্ধ নহে এইরূপ উপলব্ধি হইবে । নিম্ন-প্রদত্ত দৃষ্টান্তই তাহার উত্তম প্ৰমাণ ।


17) ভগবানের এবং জনকের উদাহরণ



 ‘জ্ঞানলাভের পর কোন কর্তব্য অবশিষ্ট না থাকিলেও, শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম করিতে হয়’, এই সিদ্ধান্তের পুষ্টিসাধনাৰ্থ ভগবান্‌ বলিতেছেন -
ন মে পার্থাহস্তি কর্তব্যং ত্ৰিষু লোকেষু কিঞ্চন ৷
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি ॥
“হে পাৰ্থ ! ‘আমার’ বলিয়া ত্ৰিভুবনে কোন কর্তব্য (অবশিষ্ট) নাই, অথবা অপ্ৰাপ্ত কোন বস্তু পাইবার (বাসনা) নাই; তথাপি আমি কর্ম করিতেছি” [গী|৩|২২] । ‘ন মে কর্তব্যমস্তি’ - আমার কর্তব্য নাই - এই শব্দ পূৰ্বোক্ত শ্লোকের ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ - তাহার কোন কর্তব্য থাকে না - এই শব্দগুলির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছে । ইহা হইতে “জ্ঞানের দ্বারা কর্তব্য অবশিষ্ট থাকিলেও, অধিক কি, এই কারণে, শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম অনাসক্ত বুদ্ধিতে করিতেই হইবে” এই অর্থ এই চার পাঁচ শ্লোকের প্রতিপাদ্য এইরূপ স্পষ্ট সিদ্ধ হয় । নতুবা, ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ ইত্যাদি শ্লোকে উক্ত সিদ্ধান্তের দৃঢ়ীকরণার্থ ভগবান্‌ নিজের যে দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহা একেবারেই অসংবদ্ধ হইবে, এবং সিদ্ধান্ত এক আর তাহার উদাহরণ একেবারেই বিরুদ্ধ – এইরূপ অনবস্থা দোষ ঘটিবে । এই অনবস্থা পরিহারার্থ সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকার, ‘তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর’ ইহার মধ্যে ‘তস্মাৎ’ এই শব্দেরও অর্থ ভিন্ন প্রকার করিয়া থাকেন । তাঁহার কথন এই যে, জ্ঞানীপুরুষ কর্মত্যাগ করিবেন ইহাই গীতার মুখ্য সিদ্ধান্ত; কিন্তু অর্জুন সেরূপ জ্ঞানী ছিলেন না বলিয়া – ‘তস্মাৎ’ - তাঁহাকে ভগবান কর্ম করিতে বলিয়াছেন । ‘গীতা-উপদেশের পরেও অর্জুন অজ্ঞানীই ছিলেন’ এই যুক্তি ঠিক্‌ নহে আমি উপরে দেখাইয়াছি । তাছাড়া ‘তস্মাৎ’ এই শব্দের এইরূপ টানিয়া বুনিয়া অর্থ করিলেও “ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং” ইত্যাদি শ্লোকে ভগবান্‌ “আমার কোন কর্তব্য না থাকিলেও আমি কর্ম করিয়া থাকি” এই মুখ্য সিদ্ধান্তের সমর্থনার্থ আপনার যে দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহার সঙ্গতিও এই পক্ষে সুচারুরূপে হয় না । তাই “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই বাক্যে “কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই শব্দগুলিকে মুখ্য বলিয়া না মানিয়া, ‘তস্য’ শব্দকেই প্ৰধান বলিয়া মানিতে হইবে; এবং তাহা করিলে “তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” ইহার অর্থ “তুমি জ্ঞানী বলিয়াই তোমার স্বার্থের জন্য তোমার কর্ম নাই এ কথা সত্য; কিন্তু তোমার নিজের কর্ম নাই বলিয়াই, এক্ষণে শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত কর্ম ‘আমার নহে’ এই বুদ্ধিতে অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে কর” এইরূপ করিতে হয় । সংক্ষেপে এই অনুমান হয় যে, ‘আমার অনাবশ্যক’ ইহা কর্ম ছাড়িবার কারণ হইতে পারে না । কিন্তু কর্ম অপরিহাৰ্য অতএব শাস্ত্ৰতঃপ্রাপ্ত অপরিহাৰ্য কর্ম স্বাৰ্থত্যাগবুদ্ধিতে করাই উচিত । ইহাই গীতা বলেন; এবং প্রকরণের সমতার দিকে দেখিলেও, এই অর্থই গ্ৰহণ করিতে হয় । কর্মসন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুয়ের মধ্যে যে বড় রকম ভেদ আছে তাহা ইহাই । “তোমার কোন কর্তব্য অবশিষ্ট নাই; অতএব তুমি কোন কর্ম করিও না,” এইরূপ সন্ন্যাস-পক্ষীয় লোকেরা বলেন; এবং “তোমার কোন কর্তব্য অবশিষ্ট নাই বলিয়াই, এখন তোমার যে কর্ম করিতে হইবে তাহা স্বার্থপর বাসনা ছাড়িয়া অনাসক্ত বুদ্ধিতে কর” এইরূপ গীতা বলেন । একই হেতু বাক্য হইতে এই প্ৰকার দুই ভিন্ন ভিন্ন অনুমান কেন বাহির হয় ? ইহার উত্তর এই যে, গীতা কর্ম অপরিহাৰ্য মানেন বলিয়া, “কর্ম ছাড়ো” এই অনুমান, গীতার তত্ত্ববিচারানুসারে বাহির হইতেই পারে না । তাই, “তোমার অনাবশ্যক” এই হেতু বাক্য হইতেই স্বাৰ্থ বুদ্ধি ছাড়িয়া কর্ম কর, গীতায় এই অনুমান বাহির করা হইয়াছে । রামচন্দ্রকে সমস্ত ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিবার পর, নিষ্কাম কর্মে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য যোগবাসিষ্ঠে বসিষ্ঠ যে যুক্তি বলিয়াছেন তাহাও এই প্রকার । যোগবাসিষ্ঠ গ্রন্থের শেষে ভগবদ্‌গীতার উক্ত সিদ্ধান্তই অক্ষরশঃ প্রদত্ত হইয়াছে [যো|৬|উ|১৯৯ ও ২১৬|১৪; এবং গী|৩|১৯-এর অনুবাদের উপর আমার টিপ্পনী দেখ] । যোগবাসিষ্ঠেরই ন্যায় বৌদ্ধধর্মের মহাযানপন্থার গ্রন্থেও এই বিষয়ে গীতার অনুসরণ করা হইয়া হইয়াছে । কিন্তু বিষয়ান্তর হইবে বলিয়া তাহার আলোচনা এখানে না করিয়া তৎসম্বন্ধীয় বিচার আমি পরে পরিশিষ্ট প্রকরণে করিয়াছি ।

আত্মজ্ঞান হইলে পর ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই অহঙ্কারের ভাষাই থাকে না [গী|১৮|১৬ ও ২৬], এবং সেই জন্য জ্ঞানীপুরুষকে “নির্‌-মম” বলে । নির্মম অর্থে ‘যে আমার-আমার বলে না’ । জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জ্ঞানী পুরুষের বর্ণনা করিবার সময় এই অর্থই এই আবী-শ্লোকে ব্যক্ত করিয়াছেন -
আণি মী হে ভাষ নেঁণে ৷ মাঝেঁ কাঁহিঁচ ন হ্মণে ৷
সুখ দুঃখ জাণণেঁ । নাহি জয়া ॥
অর্থাৎ - ‘আমি’ এই বাক্য জানি না, ‘আমার’ বলিয়া কিছুই নাই - সুখ দুঃখ জ্ঞান নাই । কিন্তু ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই বুদ্ধি চলিয়া গেলেও এই শব্দের বদলে ‘জগৎ’ ও 'জগতের’ - কিংবা ভক্তিদৃষ্টিতে ‘পরমেশ্বর’ ও ‘পরমেশ্বরের’ - এই শব্দ আসে, ইহা বিস্মৃত হইবে না । জগতের প্রত্যেক সাধারণ মনুষ্য নিজের সমন্ত কর্ম ‘আমার’ কিংবা ‘আমার জন্য’ বলিয়া করিয়া থাকে । কিন্তু যিনি জ্ঞানী হইয়াছেন তাঁহার মমত্ববুদ্ধি চলিয়া যাওয়ায় তিনি ঈশ্বরসৃষ্ট জগতের সমস্ত কর্ম পরমেশ্বরের এবং তাহা করিবার জন্যই পরমেশ্বর আমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, এইরূপ বুদ্ধিতে (অর্থাৎ নির্মম বুদ্ধিতে) সেই কর্ম করিতে থাকেন । জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর মধ্যে ইহাই ভেদ [গী|৩|২৭, ২৮] । গীতার এই সিদ্ধান্তের প্রতি লক্ষ্য করিলে জানা যায় যে, “যোগারূঢ় পুরুষের জন্য শমই কারণ হয়” [গী|৬|৩ ও তাহার উপর আমার টীকা দেখ] এই শ্লোকের সরল অর্থ কি । গীতার টীকাকার বলেন যে, এই শ্লোকে যোগারূঢ় ব্যক্তি পরে (জ্ঞান হইলে পর) শম অৰ্থাৎ শান্তি অবলম্বন করিবে, সে আর কিছু করিবে না, এইরূপ উক্ত হইয়াছে । কিন্তু এই অর্থ ঠিক্‌ নহে । শম মনের শান্তি; তাহাকে চরম ‘কাৰ্য’ না বলিয়া শম কিংবা শান্তি অন্য কিছুর কারণ - শমঃ কারণমুচ্যতে - ইহাই এই শ্লোকে উক্ত হইয়াছে । এখন শমকে কারণ বলিয়া মানিয়া পরে তাহার ‘কাৰ্য’ কি, দেখিতে হইবে । পূর্বাপর সন্দর্ভের বিচার করিলে, ‘কর্ম’ই সেই কাৰ্য এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । এবং তখন যোগারূঢ় ব্যক্তি চিত্তকে শান্ত করিয়া সেই শান্তির বা শমের দ্বারাই পরে নিজের সমস্ত কর্ম করিবেক এইরূপ এই শ্লোকের অর্থ হয়; টীকাকারদিগের কল্পনানুসারে ‘যোগারূঢ় ব্যক্তি কর্ম ত্যাগ করিবে’ এই অর্থ করা যাইতে পারে না । সেইরূপ আবার, “সর্বারম্ভপরিত্যাগী” ও “অনিকেত” প্রভৃতি শব্দের অর্থও কর্মত্যাগমূলক নহে, ফলাশা-ত্যাগমূলকই করা উচিত; গীতার অনুবাদে যে সকলস্থলে এই পদ আসিয়াছে, সেই স্থলে সংযোজিত টিপ্পনীতে আমি এই বিষয় খুলিয়া দেখাইয়াছি । ফলাশা ছাড়িয়া জ্ঞানী পুরুষেরও চাতুর্বর্ণ্যাদি সমস্ত কর্ম যথাশাস্ত্র করা উচিত, ইহা সিদ্ধ করিবার জন্য আপনার নিজের দৃষ্টান্ত ছাড়া ভগবান্‌ আর একটা দৃষ্টান্ত জনকের দিয়াছেন । জনক একজন বড় কর্মযোগী ছিলেন । তাঁহার স্বাৰ্থ বুদ্ধি কতটা চলিয়া গিয়াছিল ‘আমার রাজধানী দগ্ধ হইলেও তাহাতে আমার কিছুই দগ্ধ হয় নাই’ - ‘মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে দহ্যতি কিঞ্চন’ [শাং|২৭৫|৪ ও ২১৯|৫০] তাঁহার মুখের এই বাণী হইতেই তাহার পরিচয় পাওয়া যায় । এইরূপ নিজের স্বাৰ্থ কিংবা লাভালাভ কিছুই না থাকিলেও রাজ্যের সমস্ত কর্ম করিবার কারণ বলিবার সময় জনক নিজেই বলিতেছেন - 
দেবেভ্যশ্চ পিতৃভ্যশ্চ ভূতেভ্যোহতিথিভিঃ সহ ৷
ইত্যৰ্থং সর্ব এবৈতে সমারম্ভা ভবন্তি বৈ ॥
“দেবতা, পিতৃগণ, সমস্ত ভূত অর্থাৎ প্ৰাণী ও অতিথি ইহাদের জন্য এই সমস্ত কর্ম চলিতেছে, আমার জন্য নহে” [মভা|অশ্ব|৩২|২৪] । নিজের কোন কর্তব্য অবশিষ্ট না থাকিলেও কিংবা নিজের কোন বস্তু লাভ করিবার বাসনা না থাকিলেও জনক ও শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় পুরুষ জগতের কল্যাণ করিতে যদি প্ৰবৃত্ত না হয়েন, তাহা হইলে এই জগৎ উৎসন্ন হইবে - উৎসীদেয়ুরিমে লোকাঃ – [গী|৩|২৪] ।


18) ফলাশাত্যাগ, বৈরাগ্য ও কর্মোৎসাহ



কেহ কেহ এইরূপ বলেন যে, ‘ফলাশা ত্যাগ করিবে, সর্বপ্রকার ইচ্ছা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা নাই,’ গীতার এই সিদ্ধান্ত এবং বাসনাক্ষয়ের সিদ্ধান্তে অধিক তফাৎ করা যায় না । কারণ, বাসনাই ছাড়া হউক কি ফলাশাই ছাড়া হউক, উভয়পক্ষে কর্মের প্রবৃত্তি হইবার কোনও কারণ দেখা যায় না; তাই কোন এক পক্ষকে স্বীকার করিলেও শেষে তাহার পরিণাম কর্মত্যাগই ঘটে । কিন্তু এই আপত্তি অজ্ঞানমূলক, কারণ ‘ফলাশা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ না বুঝিবার কারণেই ইহা উৎপন্ন হইয়াছে । ফলাশা ত্যাগের সর্বপ্রকার ইচ্ছা ত্যাগ কিংবা আমার কর্মের ফল কেহ কখনই পাইবে না, কিংবা পাইলেও কেহ গ্ৰহণ করিবে না - এই বুদ্ধি হওয়া অর্থ নহে; প্রত্যুত পঞ্চম প্রকরণে প্ৰথমেই আমি বলিয়াছি যে, - অমুক ফল পাইবার জন্যই আমি এই কর্ম করিতেছি এই প্রকার ফলবিষয়ক মমত্বযুক্ত আসক্তি কিংবা বুদ্ধির আগ্রহকে, - গীতা নাম দিয়াছেন ‘ফলাশা’, ‘সঙ্গ’ কিংবা ‘কাম’ । কিন্তু, ফললাভের আগ্ৰহ কিংবা বৃথা আসক্তি না রাখিলেও, প্ৰাপ্ত কর্ম কেবল কর্তব্য বলিয়া করিবার বুদ্ধি ও উৎসাহকেও উক্ত আগ্রহের সহিত আমাদের মন হইতে বিদূরিত করতে হইবে এরূপ নহে । নিজের লাভ ছাড়া এই জগতে যে আর কিছুই দেখে না, এবং যে কেবল ফলাশার আগ্রহেই কর্মে ব্যাপৃত থাকে, সে ফলাশা ছাড়িয়া কর্ম করা সম্ভব বলিয়া মনে করে না; কিন্তু জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার বুদ্ধি সম ও বিরক্ত হইয়াছে তাঁহার পক্ষে কিছু কঠিন নহে । আমি কোন কর্মের যে ফল প্রাপ্ত হই তাহা কেবল আমারই কর্মের ফল এই ধারণাই প্রথমতঃ ভ্রান্তিমূলক । জলের দ্রবত্ব কিংবা অগ্নির উষ্ণতার সাহায্য না পাইলে, মনুষ্য যতই মাথা ঘামাক না কেন, তাহার চেষ্টায় পাক-কাৰ্য কখনও সম্পন্ন হইতে পারে না; এবং অগ্নিপ্রভৃতিতে এই গুণধর্ম থাকা বা না থাকা – মনুষ্যের আয়ত্তাধীন কিংবা প্রযত্নাধীন নহে । তাই, কর্মজগতের এই স্বতঃসিদ্ধ বিবিধ ব্যাপারের কিংবা ধর্মের প্রথমে যথাশক্তি জ্ঞান লাভ করিয়া যাহাতে উহা আমাদের প্রযত্নের অনুকুল হয় সেই ভাবেই মনুষ্যকে নিজের কর্মে প্রবৃত্ত হইতে হয় । সুতরাং মনুষ্য স্বীয় প্রযত্বের দ্বারা যে ফল লাভ করে তাহা কেবল তাহারই প্রযত্নের ফল নহে, বরং উহার কর্ম ও কর্ম জগতের তদনুকূল অনেক স্বতঃসিদ্ধ ধর্ম এই দুয়ের সংযোগজাত ফল, এইরূপ বলিতে হয় । কিন্তু মনুষ্যের প্ৰযত্ন সফল হইবার পক্ষে এইরূপ যে সমস্ত জগৎব্যাপারের অনুকূলতা আবশ্যক হয়, সেই সমস্তের যথার্থ জ্ঞান অনেক সময় মনুষ্যের থাকে না; এবং কোন কোন স্থলে, হওয়া সম্ভবও নহে । ইহাকেই “দৈব’ বলে । আমাদের আয়ত্তের বহির্ভূত এবং আমাদের অজ্ঞাত জগৎ-ব্যাপারের সাহায্য ফলসিদ্ধির জন্য যদি নিতান্তই আবশ্যক হয় তবে “কেবল নিজের প্রযত্নের দ্বারাই আমি অমুক কর্ম করিব” এইরূপ অভিমান পোষণ করা যে মূর্খতামাত্র, তাহা বলিতেই হইবে না [গী|১৮|১৪-১৬ দেখ] । কারণ, কর্মজগতের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত ব্যাপারের মানবীয় প্রযত্নে সংযোগ সাধিত হইলে পর যে ফল হয়, তাহা কেবল কর্মের নিয়মেই হয় বলিয়া, আমরা ফলাশার আগ্ৰহ রাখি বা না রাখি, ফলসিদ্ধিসম্বন্ধে কোন তফাৎ হয় না; আমাদের ফলাশা অবশ্য আমাদের দুঃখজনক হয় । কিন্তু মনে রেখো যে, মনুষ্যের জন্য আবশ্যক বিষয় একা জগৎ-ব্যাপার আপনা হইতেই ঘটাইয়া আনে না । রুটি রুচিকর হইতে হইলে যেরূপ আটার নেচীতে একটু নুন দিতে হয় সেইরূপ কর্মজগতের এই স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার মনুষ্যের উপযোগী করিতে হইলে তাহার উপর মনুষ্যের একটু প্রযত্নের চাপ দিতে হয় । তাই জ্ঞানী ও বিবেকী ব্যক্তি সাধারণ লোকের ন্যায় ফলের আসক্তি কিংবা আগ্ৰহ না রাখিয়া জগতের কর্মসাধনাৰ্থ প্ৰবাহ-পতিত কর্মের (অর্থাৎ কর্মের অনাদি প্রবাহের মধ্যে শাস্ত্ৰতঃপ্ৰাপ্ত যথাধিকার কর্মের) ছোট বড় অংশ শান্তভাবে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিয়া থাকেন । এবং ফলপ্ৰাপ্তির জন্য কর্মসংযোগের উপর কিংবা ভক্তিদৃষ্টিতে পরমেশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন । “তোমার কেবল কর্ম করিবারই অধিকার আছে ফললাভ তোমার আয়ত্তাধীন নহে” [গী|২|৪৭] ইত্যাদি যে উপদেশ অর্জুনকে দেওয়া হইয়াছে তাহার বীজও ইহাই । এইরূপে ফলাশা না রাখিয়া কর্ম করিতে থাকিলে, পরে কোন কারণে কদাচিৎ কর্ম নিষ্ফল হয়; তবু উদ্যোগ করিয়া আমাদের নিজের অধিকারের কর্ম করায়, নিষ্ফলতা হইতে দুঃখ পাইবার কোন কারণ থাকে না । উদাহরণ যথা, পরমায়ুর বন্ধনরজ্জু (অর্থাৎ শরীরপোষক ধাতুসমূহের নৈসৰ্গিক শক্তি) দৃঢ় না থাকিলে শুধু ঔষধে রোগীর কখনই উপকার হয় না, এইরূপ বৈদ্যশাস্ত্ৰ স্পষ্ট বলে; এবং এই বন্ধনরজ্জুর দৃঢ়তা অনেক প্রাক্তন কিংবা বংশানুক্রমিক সংস্কারের ফল । এই বিষয় বৈদ্যের দ্বারা সিদ্ধ হইবার নহে, এবং তৎসম্বন্ধে বৈদ্যের নিশ্চ‍য়াত্মক জ্ঞানও হইতে পারে না । তথাপি, রোগীকে ঔষধ দেওয়া নিজের কর্তব্য মনে করিয়া কেবল পরোপকার-বুদ্ধিতে হাজার হাজার রোগীকে বৈদ্য যথাজ্ঞান ঔষধ দিয়া থাকেন, এইরূপ আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । এইরূপ কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করিলে পর, কোন রোগী ভাল না হইলে তাহার দরুণ সেই বৈদ্য উদ্বিগ্ন হন না শুধু নহে, কিন্তু অমুক রোগে অমুক ঔষধের দ্বারা শতকরা লোকের উপকার হইয়া থাকে এইরূপ শাস্ত্রীয় নিয়মই তিনি অতীব শান্তচিত্তে খুঁজিয়া বাহির করেন । কিন্তু এই বৈদ্যের পুত্ৰ পীড়িত হইলে তাহাকে ঔষধ দিবার সময় তিনি পরমায়ুর বন্ধনরজ্জুর বিষয় ভুলিয়া গিয়া “আমার ছেলেকে আরাম করিতেই হইবে” এই মমত্বযুক্ত ফলাশাবশতঃ উৎকন্ঠিতচিত্ত হওয়ায় ওন্য বৈদ্য ডাকিতে হয়; কিংবা অন্য বৈদ্যের পরামর্শ লওয়া আবশ্যক হয় ! কর্মফলে মমত্বরূপ আসক্তি কাহাকে বলে এবং ফলাশা না থাকিলেও কেবল কর্তব্য বুদ্ধিতে কোনও কর্ম কিরূপে করিতে পারা যায়, এই ক্ষুদ্র উদাহরণ হইতে তাহা উপলব্ধি হইবে । এইরূপ ফলাশা বিলোপের জন্য জ্ঞানের দ্বারা মনে বৈরাগ্য অটল হইতে হইলেও কোন কাপড়ের রং (রাগ) উঠাইয়া ফেলিতে বলিলে যেমন সেই কাপড়কে নষ্ট করিতে বলা হয় না, সেইরূপ ‘কর্মে বাসনা, আসক্তি কিংবা অনুরাগ রাখিবে না’ এইরূপ বলিলে, সেই কর্ম ত্যাগ করিতে হইবে এমন নহে । বৈরাগ্য-বুদ্ধিতে কর্ম করাই যদি অসম্ভব হয় তো সে কথা আলাদা । কিন্তু বৈরাগ্যবুদ্ধিতে কর্ম করিতে পারা যায় শুধু নহে, কর্ম হইতে কেহই মুক্ত হইতে পারে না, ইহাও আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । তাই অজ্ঞানী লোক যে কর্ম ফলের আশায় করিয়া থাকে, তাহাই জ্ঞানী পুরুষ, জ্ঞানলাভের পরেও, লাভালাভ ও সুখদুঃখ সমান মনে করিয়া [গী|২|৩৮] ধৈৰ্য ও উৎসাহ-সহকারে, কিন্তু শুষ্ক বুদ্ধিতে অর্থাৎ ফলসম্বন্ধে বিরক্ত কিংবা উদাসীন থাকিয়া [গী|১৮|২৬], কেবল কর্তব্য বলিয়া আপন আপন অধিকারানুসারে শান্তচিত্তে করিতে থাকেন [গী|৬|৩] । ইহাই নীতিদৃষ্টিতে ও মোক্ষদৃষ্টিতে উত্তম জীবনযাপনের প্রকৃত তত্ত্ব । অনেক স্থিতপ্ৰজ্ঞ, মহাভগবদ্‌ভক্ত ও পরম জ্ঞানী পুরুষেরা, এমন-কি স্বয়ং ভগবানও এই মাৰ্গই স্বীকার করিয়াছেন । ইহা কর্ম-যোগশাস্ত্রেরই পুরুষার্থের পরাকাষ্ঠা বা পরমার্থ, এই ‘যোগে’র দ্বারাই পরমেশ্বরের ভজন-পূজন হয় এবং পরিশেষে সিদ্ধিলাভও হয় [গী|১৮|৪৬], ভগবদ্‌গীতা ইহা উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন । তাহার পরেও যদি আপনা হইতে কেহ ভুল বুঝে তবে তাহা দুৰ্ভাগ্য বলিতে হইবে । আত্মদৃষ্টি স্পেন্‌সর সাহেবের অভিমত ছিল না, তথাপি তিনিও স্বপ্রণীত ‘সমাজশান্ত্রের অভ্যাস’ গ্রন্থের শেষে গীতার ন্যায়ই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন; এই বিষয় আধিভৌতিক পদ্ধতি অনুসারেও সিদ্ধ যে, এই জগতে কোন কিছুই একেবারে সংঘটিত করা সম্ভব নহে, তাহার কারণীভূত ও অবশ্যম্ভাবী অন্য হাজার বিষয় পূর্বে যেরূপ ঘটিয়াছে তদনুসারে মনুষ্যের প্রযত্ন সফল, নিষ্ফল কিংবা ন্যূনাধিক পরিমাণে সফল হইয়া থাকে; এই কারণে সাধারণ লোক ফলাশায় কোন কর্মে প্ৰবৃত্ত হইলেও, বুদ্ধিমান ব্যক্তির ফলের আশা না রাখিয়া শান্তভাবে ও উৎসাহ সহকারে কর্তব্য করাই উচিত । *
* (“Thus admitting that for the fanatic some wild anticipation is needful as a stimulus, and recognizing the usefuness of his delusion as adapted to his particular nature and his particular function, the man of higher type must be content with greatly moderated expectations, while he perseveres with undiminished efforts. He has to see how comparatively little can be done, and yet to find it worth while to do that little; so uniting philanthrophic energy with philosophic calm.” - Spencer's Study of Sociology. 8th Ed. P. 403. The italics are ours. এই বাক্যে fanatics এর বদলে ‘প্রকৃতির গুণের দ্বারা বিমূঢ়’ [গী|৩|২৯] কিংবা ‘অহঙ্কারবিমুঢ়’ [গী|৩|২৭] অথবা ভাসকবির ‘মুর্খ’ শব্দ এবং man of higher types এর স্থানে ‘বিদ্বান’ [গী|৩|২৭] এবং greatly moderated expectations এর স্থানে ‘ফলৌদাসীন্য’ অথবা ‘ফলাশাত্যাগ’ এই সমানার্থক শব্দ বসাইলে গীতা-সিন্ধান্তের স্পেন্‌সর সাহেব যেন একরকম অনুবাদ করিয়াছেন এইরূপ মনে হইবে !)


19) লোকসংগ্রহ ও তাহার লক্ষণ



ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কামবুদ্ধিতে সংসারে প্রাপ্ত কর্ম জ্ঞানীপুরুষকে অবশ্য আজীবন করিতে হইবে ইহা সিদ্ধ হইলেও এই কর্ম কিসের দরুণ ও কেন প্ৰাপ্ত হয় ইহা না বলিলে কর্মযোগের বিচার পুরাপুরি হয় না । তাই, “লোকসংগ্ৰহমেবাহপি সংপশ্যন্‌ কর্তুমর্হসি” [গী|৩|২০] - লোকসংগ্রহের হিসাবে দেখিলেও তোমার কর্ম করাই উচিত - কর্মযোগের সমর্থনে অর্জুনকে ভগবান শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটি বলিয়াছেন । লোকসংগ্রহের অর্থ ইহা নহে যে, ‘মনুষ্যদিগকে শুধু জমা করিবে’ কিংবা ‘নিজের কর্মত্যাগ করিবার অধিকার হইলেও, কর্মত্যাগ করা অজ্ঞানী লোকদের উচিত নহে এবং তাহাদের নিজের (জ্ঞানী পুরুষের) কর্মতৎপরতা ভাল লাগিবে এই কারণে জ্ঞানী পুরুষ কাজ করিবার ভাণ করুন’ । কারণ, লোকেরা অজ্ঞানী থাকিবে কিংবা তাহাদিগকে অজ্ঞানী রাখিবার জন্য জ্ঞানীপুরুষ কর্ম করিবার ভাণ করিবে, গীতার ইহা শিখাইবার কোন হেতু নাই । ভাণ করা দূরে থাক্‌; কিন্তু ‘লোকে তোমার অপকীর্তি গাহিবে’ [গী|২|৩৪] ইত্যাদি সাধারণ লোককে বুঝাইবার মতো যুক্তিবাদেও যখন অর্জুনের সন্তোষ হইল না তখন তাহা অপেক্ষা গুরুতর ও তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বলবত্তর কারণ ভগবান এক্ষণে বলিতেছেন । তাই ‘সংগ্ৰহ’ এই শব্দের জমা করা, রাখা, পালন করা, নিয়ন্ত্রিত করা প্রভৃতি যে সকল অর্থ অভিধানে প্রদত্ত হইয়াছে, সেই সমস্ত অর্থ যথাসম্ভব গ্ৰহণ করিতে হয়; এবং ঐরূপ করিলে লোকসংগ্ৰহ করা অর্থাৎ “তাহাদিগকে একত্র সম্বন্ধ করিয়া তাহাদের পরস্পরানুকুল্যের দ্বারা যে সামর্থ্য উৎপন্ন হয় তাহা তাহাদের মধ্যে যাহাতে আসে এই প্রকারে তাহাদের পালন পোষণ কিংবা নিয়মন করা, এবং তদ্দারা তাহাদের সুস্থিতি বজায় রাখিয়া, তাহাদিগকে শ্রেয়োলাভের পথে প্রবর্তিত করা”, এইরূপ ইহার অর্থ হয় । ‘রাষ্ট্রের সংগ্রহ’ শব্দ এই অর্থে মনুস্মৃতিতে প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৭|১৪], এবং শাঙ্কর ভাষ্যে লোকসংগ্ৰহ = লোকস্যোন্মাৰ্গপ্রবৃত্তিনিবারণং এইরূপ এই শব্দের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে যে, সংগ্ৰহ শব্দের আমি যে অর্থ করিতেছি তাহা অপূর্ব কিংবা ভিত্তিহীন নহে । সংগ্ৰহ শব্দের অর্থ ত এই হইল; কিন্তু ‘লোকসংগ্রহ’ শব্দে ‘লোক’ শব্দ কেবল মনুষ্যবাচী নহে, ইহাও এখানে বলা আবশ্যক । জগতের ইতর প্রাণী অপেক্ষা মনুষ্য শ্রেষ্ঠ হওয়ায়, ‘লোকসংগ্রহ’ শব্দে মুখ্যরূপে মানবজাতিরই কল্যাণের সমাবেশ হয়, একথা সত্য; তথাপি ভূলোক, সত্য লোক, পিতৃলোক, দেবলোক প্রভৃতি যে অনেক লোক অর্থাৎ জগৎ ভগবান সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহাদেরও উত্তমরূপে ধারণ, পোষণ হইয়া সেই সমস্তও সুচারুরূপে চলিবে এইরূপ ভগবানের ইচ্ছা; তাই মনুষ্যলোকের ন্যায়ই এই সমস্ত লোকের ব্যবহারও সুব্যবস্থিত রূপে চলিবে (লোকানাং সংগ্ৰহঃ) এই ব্যাপক অর্থ ‘লোকসংগ্রহ’ পদের দ্বারা এই স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, এইরূপ বলিতে হয় । জনক-কৃত আপন কর্তব্যের যে বর্ণনা উপরে প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাতে দেবতা ও পিতৃগণেরও উল্লেখ আছে, এবং ভগবদ্‌গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে এবং মহাভারতের নারায়ণীয়-উপাখ্যানে যে যজ্ঞচক্রের বর্ণনা আছে তাহাতেও দেবলোক ও মনুষ্যলোক এই দুয়েরই ধারণপোষণ হইবে বলিয়া ব্ৰহ্মদেব যজ্ঞ উৎপন্ন করেন এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৩|১০-১২] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, শুধু মনুষ্যলোকের নহে, দেবাদি সমস্ত লোকের ধারণপোষণ হইয়া পরস্পর পরস্পরের শ্ৰেয়সম্পাদন করিবে, এই অর্থই লোকসংগ্রহপদে ভগবদ্‌গীতায় বিবক্ষিত হইয়াছে । সমস্ত জগতের পালন-পোষণ করিয়া লোকসংগ্ৰহ করিবার ভগবানের এই যে অধিকার, তাহাই জ্ঞানী পুরুষ নিজের জ্ঞানপ্ৰযুক্তই প্ৰাপ্ত হয়েন । জ্ঞানীপুরুষেরা যাহা প্রমাণ বলিয়া মনে করেন, তাহাই অন্য লোকেরাও প্রমাণ মনে করিয়া সেইরূপ আচরণ করিয়া থাকে [গী|৩|২১] । কারণ, সমস্ত জগতের ধারণ-পোষণ কিসে হইবে, শান্তচিত্তে ও সমবুদ্ধিতে তাহার বিচার করিয়া তদনুসারে ধর্মবন্ধন স্থাপন করা জ্ঞানীপুরুষদিগের কাজ, ইহা সাধারণ লোকের ধারণা । এই ধারণা ভ্ৰান্তিমূলকও নহে । অধিক কী, সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে এই বিষয় ঠিক আসে না বলিয়া জ্ঞানীপুরুষদিগের উপর তাহারা ভরসা রাখে, এরূপ বলিলেও চলে । এই কথা মনে করিয়াই শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্টিরকে বলিয়াছেন -
লোকসংগ্ৰহসংযুক্তং বিধাত্রা বিহিতং পুরা ৷
সূক্ষ্মধর্মার্থনিয়তং সতাং চরিতমুত্তমম্‌ ॥
“লোকসংগ্ৰহকারক সূক্ষ্মীধর্মার্থনিয়ত সাধুদিগের উত্তম চরিত্র বিধাতারই বিধান”- [মভা|শাং|২৫৮|২৫] । লোকসংগ্ৰহ অর্থে, নিরর্থক কোন প্রকার মনগড় মিথ্যা কিংবা লোকদিগকে অজ্ঞানে রাখিবার কৌশল নহে; জ্ঞানযুক্ত কর্ম জগৎ হইতে বিলুপ্ত হইলে জগতের বিনাশ সম্ভাবনা হয় বলিয়া ইহাই সিদ্ধ হয় যে, বিধাতাবিহিত সাধুপুরুষদিগের কর্তব্যসমূহের মধ্যে ইহা এক মুখ্য কর্তব্য । এবং “আমি এই কর্ম না করিলে সমস্ত জগৎ ধ্বংস হইবে” [গী|৩|২৪] এই ভগবদ্‌বচনের ভাবার্থও এই । জ্ঞানীপুরুষ সমস্ত জগতের চক্ষু; ইহাঁরা যদি নিজের কর্ম ত্যাগ করেন তাহা হইলে অন্ধসমাচ্ছন্ন হইয়া সমস্ত জগৎ ধবংস না হইয়া যায় না । লোকদিগকে জ্ঞানী করিয়া উন্নতির পথে আনয়ন করা জ্ঞানীপুরুষদিগেরই কর্তব্য । কিন্তু এই কার্য কেবল মুখভারতীতে অর্থাৎ শুষ্ক উপদেশের দ্বারাই কখনও সিদ্ধ হয় না । কারণ যাহাদের সদাচরণের অভ্যাস নাই, যাহাদের বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হয় নাই, তাহাদিগকে শুধু শুষ্ক ব্ৰহ্মজ্ঞান শুনাইলে, “তুমি সে আমি, আমি সে তুমি” এই প্রকারে তাহাদিগকে জ্ঞানের অপব্যবহার করিতে সর্বদাই দেখা যায় । তাছাড়া, কোন উপদেশের সত্যতার পরীক্ষাও লোকেরা তাহার আচরণ দেখিয়াই করিয়া থাকে । তাই, জ্ঞানী মনুষ্য নিজে কাজ যদি না করেন, তাহা হইলে তিনি সাধারণ লোককে অলস করিবার এক বড় কারণ হইবেন । ইহাকেই ‘বুদ্ধিভেদ’ বলে । এবং এই বুদ্ধিভেদ না হইয়া লোকেরা সত্যসত্যই নিষ্কাম হইয়া নিজেদের কর্তব্যসম্বন্ধে জাগৃত হইবে বলিয়া সংসারে থাকিয়াই নিজ কর্মের দ্বারা লোকদিগকে সদাচরণের অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিবার প্রত্যক্ষ শিক্ষা দেওয়াই জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য (ভড়ং নহে) হইয়া পড়ে । তাই কর্মত্যাগের অধিকার তিনি (জ্ঞানীপুরুষ) কখনই প্ৰাপ্ত হন না; নিজের জন্য না হইলেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ চাতুর্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম যথাধিকার তাঁহার করিতে হইবে এইরূপ গীতার উপদেশ কিন্তু জ্ঞানীপুরুষের চাতুর্বর্ণ্যের কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করাও আবশ্যক নহে, এমন-কি করা উচিত নহে, এইরূপ সন্ন্যাসমার্গীদের মত হওয়ায় “জ্ঞানীপুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ কর্ম করিবেন” এই গীতাসিদ্ধান্তের সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকারেরা কতকগুলো গোলমেলে অর্থ করিয়া, প্ৰত্যক্ষভাবে নহে পরন্তু পৰ্যায়ক্রমে এইরূপ কথা বলিতেও তাঁহারা প্ৰস্তুত যে, স্বয়ং ভগবানও ভড়ং করিবার উপদেশ করিতেছেন । কিন্তু গীতার লোকসংগ্ৰহ শব্দের এই তৈলাক্ত রকমের অর্থ ঠিক নহে, ইহা পূর্বাপর সন্দর্ভ হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । জ্ঞানী পুরুষ কর্মত্যাগের অধিকার প্রাপ্ত হন এই মতই গীতার আদৌ মান্য নহে; এবং তাহার সমর্থনে গীতার যে সকল কারণ দেওয়া হইয়াছে তন্মধ্যে লোকসংগ্রহ একটি মুখ্য কারণ । তাই, জ্ঞানীপুরুষের কর্ম থাকে না ইহা প্ৰথমে মানিয়া লইয়া লোকসংগ্ৰহ পদের ভড়ং-মূলক অর্থ করা সর্বথাই অনায্য । 


20) ব্রহ্মজ্ঞানের ইহাই প্রকৃত পর্যবসান



মনুষ্য এই জগতে কেবল নিজের জন্যই জন্মে নাই । অজ্ঞতাবশতঃ সাধারণ লোক নিজ স্বার্থের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকে ইহা সত্য । কিন্তু “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” [গী|৬|২৯] – আমি সমস্ত ভূতে এবং সমস্ত ভূত আমাতে – এই প্রকার সমস্ত জগৎই যাঁহার আত্মভূত হইয়াছে তিনি “আমার মোক্ষ লাভ হইয়াছে, এক্ষণে লোকেরা দুঃখী হইলেও আমার তাহাতে কিসের ভাবনা” এইরূপ কথা বলিলে, তাঁহার নিজমুখেই জ্ঞানের হীনতা স্বীকার করা হয় । জ্ঞানীপুরুষের আত্মা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি আছে কি ? তাঁহার আত্মার উপর যে পৰ্যন্ত অজ্ঞানের আবরণ ছিল সে পৰ্যন্ত “আমি” ও “লোক” এই ভেদ বজায় ছিল । কিন্তু জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর সমস্ত “লোকের আত্মাই তাঁহার আত্মা । তাই যোগবাসিষ্ঠে বসিষ্ঠ রামকে এইরূপ বলিয়াছেন -
যাবল্লোকপরামর্শো নিরূঢ়ো নাস্তি যোগিনঃ ৷
তাবদ্‌রূঢ়সমাধিত্বং ন ভবেত্যেব নির্মালম্‌ ॥
“যে পৰ্যন্ত লোকের পরামর্শ লইবার (অর্থাৎ লোকসংগ্রহের) কাজ একটুও অবশিষ্ট থাকে, সমাপ্ত না হয়, সে পৰ্যন্ত যোগারূঢ় পুরুষের অবস্থা নির্দোষ, এরূপ কখনই বলা যাইতে পারে না” [যো|৬; পূ|১২৮|৯৭] । কেবল আপন সমাধিসুখেই নিমগ্ন থাকা এক প্রকার নিজের স্বার্থসাধনা মনে হয় । সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোকেরা ইহার প্রতি লক্ষ্য করে না, ইহাই তাঁহাদের যুক্তিবাদের মুখ্য দোষ । ভগবান অপেক্ষা কেহই অধিক জ্ঞানী, অধিক নিষ্কাম কিংবা অধিক যোগারূঢ় হইতে পারে না । কিন্তু ভগবানও “সাধুদিগের সংরক্ষণ, দুষ্টদিগের নাশ ও ধর্মসংস্থাপন” এইপ্ৰকার লোকসংগ্রহের কাজ করিবার জন্যই যদি সময়ে সময়ে অবতার হন [গী|৪|৮], তবে জ্ঞানী পুরুষের লোকসংগ্রহের কাজ ছাড়িয়া দিয়া “যে পরমেশ্বর এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি তাঁহার ইচ্ছামতো ভরণপোষণ করিবেন, সে দিক্‌ দেখা আমাদের কাজ নহে” এইরূপ বলা সর্বথাই অনুচিত । কারণ জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর, পরমেশ্বর, “আমি” ও “জগ,” - এই ভেদই থাকে না; এবং যদি থাকে, তবে তিনি জ্ঞানী নহেন, তিনি জ্ঞানী বলিয়া ভড়ং করেন বলিতে হইবে । জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানী পুরুষ যদি পরমেশ্বররূপী হন, তবে পরমেশ্বর যে কাজ করেন তাহা পরমেশ্বরের ন্যায় অর্থাৎ নিঃসঙ্গ বুদ্ধিতে করিবার অবশ্যকতা হইতে জ্ঞানী পুরুষ কি করিয়া অব্যাহতি পাইবেন [গী|৩|২২ ও ৪|১৪ ও ১৫] ? তাছাড়া, পরমেশ্বর যাহা কিছু করেন তাহাও জ্ঞানীপুরুষের রূপে কিংবা জ্ঞানীপুরুষের দ্বারাই করিয়া থাকেন । তাই, “সকল ভূতে এক আত্মা” পরমেশ্বরের স্বরূপের এইরূপ অপরোক্ষ জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তাঁহার মনে সর্বভূতের প্রতি অনুকম্পাদি উচ্চবৃত্তি পূৰ্ণ জাগৃত থাকিয়া স্বভাবতই লোককল্যাণের দিকে তাঁহার মনের প্রবৃত্তি হইবে । এই অভিপ্ৰায়ে তুকারাম বাবা সাধুপুরুষের লক্ষণ এই প্রকার বলিয়াছেন -
জে কা রজলে গাঁজলে ৷ তাঁসি ভণে জো আছুলে ৷
তোচি সাধু ওড়্‌খাবা ৷ দেব তেথেঁ চি জাণাবা ॥ [গা|৯৬৫|১-২]
অর্থাৎ “সকলের সুখদুঃখকে যে আপনার বলে তাহাকেই সাধু বলিয়া জানিবে - দেবতা সেইখানেই জানিবে;” কিংবা - 
পরউপকারী বেঁচিয়েল্যা শক্তী ৷ তেণে আত্মস্থিতী জাণীতলী [গা|৪৫৬২]
অর্থাৎ “পরোপকারে যিনি নিজশক্তি ব্যয় করিয়াছেন তিনিই আত্মস্থিতি জানেন;” এবং শেষে সাধুদিগের (অর্থাৎ ভক্তির দ্বারা পরমেশ্বরের পূর্ণজ্ঞান যাঁহারা লাভ করিয়াছেন সেই সকল মহাত্মাদের) কাৰ্য্যের বর্ণনা এই প্ৰকার করিয়াছেন -
জগাচ্যা কল্যাণা সস্তাঞ্চা বিভূতি ৷
দহে কষ্টবিতো উপকারেঁ ॥
অর্থাৎ “জগতের কল্যাণই সাধুদিগের বিভূতি, উহাঁরা কষ্ট করিয়াও দশজনের উপকার করেন” [গা|৯২৯]“স্বার্থো যস্য পরার্থ এবং স পুমানেকঃ সতামগ্ৰণীঃ”- পরার্থই যাহার স্বাৰ্থ হইয়াছে সেই ব্যক্তিই সাধুদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ - এইরূপ ভর্তৃহরি বলিয়াছেন । 


21) তথাপি সেই লোকসংগ্রহও চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা অনুযায়ী ও নিষ্কাম হইবে



মনু প্ৰভৃতি শাস্ত্রকার কি জ্ঞানী ছিলেন না ? কিন্তু তৃষ্ণাদুঃখরূপ রজ্জুর একটা মস্ত জুজু তৈরি করিয়া তৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গেই পরোপকারবুদ্ধি প্ৰভৃতি সমস্ত উচ্চ বৃত্তিকে বিদলিত না করিয়া তাহারা লোকসংগ্ৰহকারক চাতুর্বর্ণ্যাদি শাস্ত্রীয় সীমা স্থাপনের কাৰ্য করিয়াছেন । ব্ৰাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্ৰিয়ের যুদ্ধ, বৈশ্যের কৃষি, গোরক্ষণ ও বাণিজ্যব্যবসায় কিংবা শূদ্রের সেবা, এই যে গুণকর্মস্বভাবানুরূপ ভিন্ন ভিন্ন কর্ম শাস্ত্ৰে বৰ্ণিত হইয়াছে তাহা কেবল প্ৰত্যেক ব্যক্তির হিতেরই জন্য এরূপ নহে; প্রত্যুত মনুস্মৃতিতে আছে [মনু|১|৮৭] যে, চাতুর্বর্ণ্যের ব্যবসায়বিভাগ লোকসংগ্ৰহাৰ্থই প্ৰবৃত্ত হইয়াছে; সমস্ত সমাজের রক্ষণার্থে কতকগুলি ব্যক্তির যুদ্ধকলা নিত্য অভ্যাস করিয়া প্ৰস্তুত থাকা আবশ্যক এবং কাহারও কাহারও কৃষিকর্ম, বাণিজ্য, জ্ঞানার্জন প্রভৃতি কার্যের দ্বারা সমাজের অন্য অভাব পূর্ণ করা আবশ্যক গীতার অভিপ্রায়ও ঐরূপ [গী|৪|১৩; ১৮|৪|১ দেখ] । এই চাতুর্বর্ণ্যধর্মের মধ্যে কোন এক ধর্ম বিলুপ্ত হইলে সমাজ ততটুকু পঙ্গু হইয়া যাইবে এবং শেষে তাহার নাশ হহবারও সম্ভাবনা থাকে ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কর্মবিভাগের এই ব্যবস্থা একই প্রকার থাকে না, যেন স্মরণ থাকে । প্ৰাচীন গ্রীক তত্ত্বজ্ঞ প্লেটো এই বিষয়ক আপন গ্রন্থে এবং আধুনিক ফরাসী শাস্ত্রজ্ঞ কোঁৎ আপন “আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞানে” সমাজধারণার্থ যে ব্যবস্থা সূচিত করিয়াছেন, তাহা চাতুর্বর্ণ্যের সদৃশ হইলেও বৈদিক ধর্মের, চাতুর্বণ্য ব্যবস্থা, হইতে উহা অল্পাধিক অংশে যে ভিন্ন, ইহা উক্ত গ্ৰন্থ পাঠ করিলেই উপলব্ধি হইবে । ইহার মধ্যে কোন্‌ সমাজব্যবস্থা উত্তম, অথবা এই উত্তমতা আপেক্ষিক, এবং যুগকালানুসারে ইহাতে কোন ফেরফার হইতে পারে কি না, ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন এইস্থানে উঠে; এবং ‘লোকসংগ্ৰহ’ এখনকার কালে পাশ্চাত্যদেশে একটা বড় রকমের শাস্ত্ৰ হইয়া দাঁড়াইয়াছে । কিন্তু গীতার তাৎপৰ্যনিৰ্ণয়ই আমাদের উপস্থিত বিষয় হওয়ায় এখানে এই প্রশ্নের বিচারে প্ৰবৃত্ত হইবার কারণ নাই । গীতাকালে চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা জারী ছিল এবং উহা গোড়ায় লোকসংগ্ৰহ করিবার জন্যই প্ৰবৃত্ত হয়, ইহা নির্বিবাদ । তাই চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা অনুসারে নিজনিজ প্ৰাপ্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে যেরূপ করিতে হইবে তাহার প্রত্যক্ষ শিক্ষা নির্দেশ করাই গীতার এই লোকসংগ্ৰহ পদের অর্থ । ইহাই এখানে মুখ্য বক্তব্য । জ্ঞানী পুরুষ সমাজের শুধু চক্ষু নহে, সমাজের গুরুও বটে । তাই ইহা স্বতই সিদ্ধ হয় যে, উক্ত প্রকার লোকসংগ্রহ করিবার জন্য তিনি আপন কালের সমাজব্যবস্থায় যদি কোন ত্রুটি দেখেন, তবে তিনি তাহা শ্বেতকেতুর ন্যায় দেশকালানুরূপ পরিমার্জিত করিবেন এবং সমাজের ধারণ-পোষণ শক্তিকে হ্রাস হইতে না দিয়া, তাহা যাহাতে বর্ধিত হইতে পারে এইরূপ উদ্যোগ করিবেন । এই প্রকার লোকসংগ্রহের জন্যই জনক সন্ন্যাস গ্ৰহণ না করিয়া আমরণ রাজত্ব করিতে থাকিলেন এবং মনু প্ৰথম রাজা হইবেন বলিয়া স্বীকার করিলেন; এবং এই কারণেই “স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমৰ্হসি [গী|২|৩১] স্বধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্ম সম্বন্ধে কাঁদিতে বসা তোমার উচিত নহে; কিংবা “স্বভাবনিয়তং কর্ম কুৰ্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্‌ [গী|১৮|৪৭] স্বভাব ও গুণানুরূপ নির্ধারিত চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা অনুসারে নির্দিষ্ট কর্ম সাধন করিলে তোমার কোন পাপ হইবে না, ইত্যাদি প্রকার চাতুর্বর্ণকর্মানুসারে প্রাপ্ত যুদ্ধ করিতে অর্জুনকে গীতায় বারংবার উপদেশ করা হইয়াছে । পরমেশ্বরের জ্ঞান যথাশক্তি অর্জন করিও না, এরূপ কেহই বলে না । অধিক-কি, এই জ্ঞান অর্জন করাই এই জগতে মনুষ্যের ইতিকর্তব্য, ইহা গীতারও সিদ্ধান্ত । কিন্তু পরে গীতার বিশেষ উক্তি এই যে, নিজের আত্মার কল্যাণেই সমষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণার্থ যথাশক্তি চেষ্টারও সমাবেশ হয় বলিয়া লোকসংগ্ৰহ করাই ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের প্রকৃত পৰ্যবসান । তথাপি, কোন ব্যক্তি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হইলেই সমস্ত ব্যবহারিক কর্ম স্বহস্তে করিবার যোগ্য হয় এরূপ নহে ৷ ভীষ্ম ও ব্যাস দুইজনেই মহাজ্ঞানী ও পরম ভগবদ্‌ভক্ত ছিলেন । কিন্তু ব্যাসও ভীষ্মের ন্যায় যুদ্ধের কাজই করিয়াছেন, এরূপ কেহ বলে না । দেবতাদের দিকে দেখিলে, সেখানেও জগতের সংহার করিবার কাজ শঙ্করের বদলে বিষ্ণুর উপর সমৰ্পিত হইয়াছে এরূপ দেখা যায় না । জীবন্মুক্তাবস্থা — মনের নির্বিষয়তার, সম ও শুদ্ধবুদ্ধির এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির শেষ পৈঠা; উহা আধিভৌতিক কর্মবুদ্ধির পরীক্ষা নহে । তাই, স্বভাব ও গুণানুরূপ প্ৰবৃত্ত চাতুর্বর্ণ্যাদি ব্যবস্থা অনুসারে যে কর্ম আমরা চিরজন্ম করিয়া আসিতেছি, স্বভাব অনুসারে সেই কর্ম বা ব্যবসায় জ্ঞানীপুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ চলিত রাখিতে হইবে, কারণ তাহার ভিতরেই বিশেষজ্ঞ হইবার সম্ভাবনা থাকে, অন্য ফালতো ব্যবসায় করিলে তাহাতে সমাজের ক্ষতি হইবে, গীতার এই বিশেষ উপদেশ পুনৰ্বার এই প্ৰকরণেই বিচার করা হইয়াছে [গী|৩|৩৫; ১৮-৪৭] । প্ৰত্যেক মনুষ্যে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রকৃতি, স্বভাব ও গুণের অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতাকেই অধিকার বলা হয়; এবং “পুরুষ ব্ৰহ্মজ্ঞানী হইলেও এই অধিকার অনুসারে নির্দিষ্ট কর্ম, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ করিয়া যাইবে, কর্মত্যাগ করিবে না”- “যাবদধিকারমবস্থিতিরাধিকারিণাম্‌” [বেসূ|৩|৩|৩২] এইরূপ বেদান্তশাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে । বেদান্তসূত্রকারের এই উপপত্তি কেবল বড়-অধিকারের ব্যক্তিদের সম্বন্ধেই খাটে, কেহ কেহ এইরূপ বলেন; এবং এই সূত্রের ভাষ্যে, তৎসমর্থনাৰ্থ যে উদাহরণ দেওয়া হইয়াছে তাহাতে দেখা যায় যে, সমস্ত উদহরণই ব্যাস-আদি বড় বড় অধিকারী পুরুষদিগেরই দেওয়া আছে । কিন্তু মূলসূত্রে অধিকারের ছোট-বড়ত্ব সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নাই, তাই “অধিকার” শব্দে ছোট-বড় সমস্ত অধিকার ধরিতে হয়; এবং এই অধিকার কে কি প্রকারে প্রাপ্ত হয় ইহার সুক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র বিচার করিলে দেখা যায় যে, মনুষ্যের সঙ্গেই সমাজ ও সমাজের সঙ্গেই মনুষ্য পরমেশ্বর উৎপন্ন করায়, যাহার যতটা বুদ্ধিবল, প্ৰাণবল, দ্রব্যবল কিংবা শরীরবল স্বভাবত হইতে পারে কিংবা স্বধর্মের দ্বারা অর্জন করা যাইতে পারে, সেই হিসাবেই যথাশক্তি জগতের ধারণপোষণ ক্ষরিবার ন্যূনাধি্ক অধিকার (চাতুর্বর্ণ্যাদি কিংবা অন্য গুণকর্মবিভাগরূপ সামাজিক ব্যবস্থা হইতেই) প্ৰত্যেকেই জন্মত প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । কল ভাল চালাইবার জন্য বড় চাকার মতো খুব ছোট চাকারও যেমন দরকার হয়, সেইরূপই সমস্ত জগতের এই বৃহৎ বিরাট সৃষ্টিসংহারের কাজ অথবা চক্ৰ সুব্যবস্থিতিরূপে চলমান রাখিবার জন্য ব্যাস আদির বড় বড় অধিকারের সমানই অন্য মনুষ্যের ছোট ছোট অধিকারও পূর্ণ ও যোগ্যরীতিতে করিয়া আমলে আনা কর্তব্য । কুমার ঘট এবং তাঁতি বস্ত্ৰ তৈয়ার না করিলে, রাজা দ্বারা যথোচিত রাজ্যরক্ষণ হইলেও লোকসংগ্রহের কাজ পূরাপুরি হইতে পারে না; কিংবা আগ্‌-গাড়ীতে সামান্য নিশান-ওয়ালা কিংবা পয়েণ্টন্মেন (রেল-জুড়িবার শিপাই) যদি নিজের কর্তব্য না করে, তবে এখন যেমন আগ্‌গাড়ী বায়ুবেগে নিৰ্ভয়ে ছুটিয়া চলে, সেরূপ আর চলিতে পরিবে না । তাই বেদান্তসূত্রকারেরই উপরি-উক্ত যুক্তিবাদের দ্বারা এক্ষণে নিষ্পন্ন হইল যে, ব্যাস-আদি বড় বড় অধিকারী শুধু নহে অন্য লোকেরও – তা তিনি রাজাই হউন বা প্ৰজাই হউন - লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যথানিৰ্দিষ্ট ছোটবড় অধিকারের কর্ম জ্ঞানলাভের পরেও ত্যাগ না করিয়া নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্তব্য জানিয়া যথাশক্তি, যথামতি ও যথাসম্ভব করিয়া যাওয়া উচিত । আমি না করি, অন্য কেহ এই কাজ করিবে এরূপ বলা উচিত নহে । কারণ, তাহা হইলে সমগ্ৰ কর্মে আবশ্যক ব্যক্তির মধ্যে একজন কম হইয়া যায় এবং সংঘশক্তি কমিয়া যায় শুধু নহে কিন্তু জ্ঞানীপুরুষ সেই কর্ম যতটা বিশুদ্ধভাবে করিবেন সেরূপ অন্যের সাধ্যায়ত্ত নহে; ফলত এই হিসাবে লোকসংগ্রহও খোঁড়াই থাকিয়া যাইবে । তাছাড়া জ্ঞানী পুরুষের কর্মত্যাগরূপ উদাহরণ হইতে লোকের বুদ্ধিও বিগ্‌ড়াইয়া যায় ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হইবার পর নিজের আত্মার মোক্ষলাভ হইলেই সন্তুষ্ট হইয়া জগতের উচ্ছেদ হইলেও তাহার পরোয় না রাখিয়া “লোকসংগ্ৰহধৰ্ম্মং চ নৈব কুৰ্য্যান্ন কারয়েৎ” - লোকসংগ্ৰহ করিবে না, করাইবেও না [মভা|অশ্ব|অনুগীতা|৪৬|৩৯] এইরূপ সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোক কখন কখন বলিয়া থাকেন সত্য । কিন্তু ব্যাসাদির আচরণের তাঁহারা যে উপপত্তি দেন তাহা হইতে, এবং বসিষ্ঠ ও পঞ্চশিখ প্ৰভৃতি রাম-জনকাদিকে আপনাপন অধিকার অনুসারে সমাজের ধারণ-পোষণাদি কর্মই আমরণ করিতে যে বলিয়াছেন তাহা হইতে স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে, সন্ন্যাসমার্গীর কর্মত্যাগের উপদেশ একদেশদর্শী, সর্বথা-সিদ্ধ শাস্ত্রীয় সত্য নহে । তাই বলিতে হয় যে, এই প্রকার একপক্ষীয় উপদেশের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া, ভগবানের নিজেরই উদাহরণ অনুসারে জ্ঞানলাভের পরেও আপন অধিকার বুঝিয়া তদনুসারে লোকসংগ্ৰহকারী কর্ম আমরণ করিতে থাকাই শাস্ত্রোক্ত ও উত্তম মাৰ্গ; তথাপি এই লোকসংগ্ৰহ ফলাশা রাখিয়া করিতে নাই । কারণ, লোকসংগ্রহই হউক না কেন, ফলের আশা রাখিলে কর্ম নিষ্ফল হইলে দুঃখ না হইয়া যায় না । তাই আমি “লোকসংগ্ৰহ করিব” এই অভিমান, বা ফলাশার বুদ্ধি মনে না রাখিয়া, লোকসংগ্রহও কেবল কর্তব্য বুদ্ধিতেই করিতে হয় । সেই কারণে ‘লোকসংগ্ৰহাৰ্থ অর্থাৎ লোকসংগ্ৰহরূপ ফললাভের জন্য কর্ম করিতে হইবে, গীতা এইরূপ না বলিয়া ‘লোকসংগ্ৰহমেবাপি সংপশ্যন্‌’ লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াও (সংপশ্যন্‌) তোমাকে কর্ম করিতে হইবে এইরূপ বলিয়াছেন [গী|৩|২০] । এই প্রকার গীতায় যে একটু লম্বাচৌড়া শব্দযোজনা করা হইয়াছে - ইহাই তাহার বীজ । লোকসংগ্ৰহ মহৎ কর্তব্য সত্য; কিন্তু এই শ্লোকের পূর্ব শ্লোকে [গী|৩|১৯] অনাসক্তবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করিবার ভগবান্ অর্জুনকে যে উপদেশ করিয়াছেন সেই উপদেশ লোকসংগ্রহের জন্যও উপযুক্ত, ইহা বিস্মৃত হইবে না ।” 


22) স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত চার আশ্রমের, জীবনযাপনের মার্গ



জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে যে বিরোধ তাহা জ্ঞান ও কাম্য কর্মেরই বিরোধ; জ্ঞান ও নিষ্কাম কর্মে অধ্যাত্মদৃষ্টিতেও কোন বিরোধ নাই । কর্ম অপরিহার্য এবং লোকসংগ্ৰহ-দৃষ্টিতে উহার আবশ্যকতাও যথেষ্ট হওয়ায়, যাবজ্জীবন যথাধিকার নিঃসঙ্গবুদ্ধিতে চাতুৰ্বর্ণের কর্ম জ্ঞানীপুরুষের করিতেই হইবে । যদি এই বিষয়ই শাস্ত্রীয় যুক্তিবাদের দ্বারা সিদ্ধ হয়, এবং গীতারও যদি ইহাই অর্থ হয়, তবে বৈদিক ধর্মের স্মৃতিগ্রন্থে কথিত চারি আশ্রমের মধ্যে সন্ন্যাসাশ্রমের কি দশা হইবে, এই সন্দেহ সহজেই মনে উদয় হয় । মনু প্ৰভৃতি স্মৃতিসমূহে ব্ৰহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্ৰস্থ ও সন্ন্যাসী - এই চারি আশ্রমের কথা বলিয়া অধ্যয়ন, যাগ-যজ্ঞ, দান কিংবা চাতুর্বর্ণ্য ধর্মানুসারে নির্দিষ্ট অন্য কর্মের শাস্ত্রোক্ত আচরণের দ্বারা, প্ৰথম তিন আশ্রমে আস্তে আস্তে চিত্তশুদ্ধি হওয়া চাই এবং শেষে সমস্ত কর্ম স্বরূপত ত্যাগ করিবে ও সন্ন্যাস লইয়া মোক্ষ অর্জন করিবে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মনু|৬|১ ও ৩৩-৩৭ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, যাগযজ্ঞ ও দানাদি কর্ম গৃহস্থাশ্রমে বিহিত হইলেও তাহা চিত্তশুদ্ধির জন্য অর্থাৎ সেগুলির ইহাই উদ্দেশ্য যে, বিষয়াসক্তি বা স্বার্থপরবুদ্ধি চলিয়া গিয়া পরোপকারবুদ্ধি বাড়িয়া বাড়িয়া সর্বভূতে একই আত্মা রহিয়াছে এই উপলব্ধির শক্তি পাওয়া যাইবে; এবং এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে পর মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য শেষে সমস্ত কর্ম স্বরূপত ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসাশ্রমই গ্ৰহণ করিবে, ইহাই সমস্ত স্মৃতিকারদিগের অভিপ্ৰায় । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য কলিযুগে যে সন্ন্যাসধর্মের স্থাপনা করিয়াছেন, সেই মার্গ ইহাই; এবং স্মার্তমাৰ্গীয় কালিদাসও রঘুবংশের আরম্ভে
শৈশবেহভ্যস্তবিদ্যানাং যৌবনে বিষয়ৈষিণাম্‌ ৷
বার্ধক্যে মুনিবৃত্তীনাং যোগেনান্তে তনুত্যজাম্‌ ॥
“বাল্যকালে অভ্যাস (ব্রহ্মচৰ্য) কারী, যৌবনে বিষয়োপভোগরূপ সংসার (গৃহস্থাশ্ৰম) কারী, শেষ বয়সে মুনিবৃত্তি কিংবা বানপ্ৰস্থ ধর্ম অবলম্বনকারী এবং শেষে (পাতঞ্জল) যোগের দ্বারা সন্ন্যাসধর্মানুসারে ব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে আত্মাকে লইয়া গিয়া প্ৰাণত্যাগকারী” এইরূপ পরাক্রান্ত, সূৰ্যবংশীয় রাজাদের বর্ণনা প্রদত্ত হইয়াছে [রঘু|১|৮] । সেইরূপ আবার মহাভারতে শুকানুপ্রশ্নে -
চতুষ্পদী হি নিঃশ্রেণী ব্ৰহ্মণ্যেষা প্রতিষ্ঠিতা ৷
এতামারুহ্য নিঃশ্রেণীং ব্ৰহ্মলোকে মহীয়তে ॥
“চারি আশ্রমরূপ চারি পৈঁঠার এই সোপান শেষে ব্ৰহ্মপদে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; এই পৈঁঠা দ্বারা অর্থাৎ এক আশ্রম হইতে অন্য উপরের আশ্রমে আরোহণ করিতে থাকিলে পর মনুষ্য শেষে ব্ৰহ্মলোকে মহত্ব লাভ করে [শাং|২৪১|১৫] এই কথা বলিয়া, পরে এই ক্রমপরম্পরার বর্ণনা করিয়াছেন -
কষায়ং পাচয়িত্বাশু শ্রেণিস্থানেষু চ ত্ৰিষু ৷
প্ৰব্ৰজেচ্চ পরং স্থানং পারিব্রাজ্যমনুত্তমম্‌ ॥
“এই সোপানের তিন পৈঁঠায় মনুষ্য আপদ কিল্বিষের (পাপের) অর্থাৎ স্বার্থপর আত্মবুদ্ধিৱ কিংবা বিষয়াসক্তিরূপ দোষের শীঘ্রই ক্ষয় করিয়া আবার সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে; পারিব্রাজ্য অর্থাৎ সন্ন্যাসই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্থান” [শাং|২৪৪|৩] । এক আশ্রম হইতে অন্য আশ্রমে যাইবার এই ক্রমপরম্পরাই মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৬|৩৪] । কিন্তু ইহার মধ্যে অন্তিম অর্থাৎ সন্ন্যাস আশ্রমের দিকে লোকের অতিরিক্ত প্ৰবৃত্তি হইলে সংসারের কর্তৃত্ব নষ্ট হইয়া সমাজও পঙ্গু হইবে এই কথা মনুর খুব উপলব্ধি হইয়াছিল । তাই, পূর্বাশ্রমে গৃহধর্ম অনুসারে পরাক্রমের ও লোকসংগ্রহের সমস্ত কাৰ্য অবশ্য কর্তব্য, মনু এই কথা বলিয়া, পরে -
গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্বলীপলিতমাত্মনঃ ৷
অপত্যেস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ ॥
“শরীরে বলি পড়িতে আরম্ভ হইলে ও পৌত্রমুখ দেখিতে পাইলে গৃহস্থ বানপ্ৰস্থ হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে” - এইরূপ মনু স্পষ্ট সীমা নির্দেশ করিয়াছেন [মনু|৬|২] । এই সীমা পালন করিতে হইবে, কারণ মনুস্মৃতিতেই উক্ত হইয়াছে যে, প্ৰত্যেক মনুষ্য জন্মতই আপন পৃষ্ঠের উপর ঋষিগণ, পিতৃগণ ও দেবগণের তিন ঋণভার (কর্তব্য) লইয়াই উৎপন্ন হইয়াছে । তাই, বেদাধ্যয়নের দ্বারা ঋষিঋণ, পুত্রোৎপাদনের দ্বারা পিতৃঋণ এবং যজ্ঞকর্মের দ্বারা দেবঋণ এইরূপ তিনি ঋণই প্ৰথমে পরিশোধ না করিয়া মনুষ্য সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিতে পারে না । সেরূপ করিলে (অর্থাৎ সন্ন্যাস লইলে) জন্মত-প্ৰাপ্ত এই ঋণ শোধ না করিবার দরুণ সে অধোগতি প্ৰাপ্ত হইবে [মনু|৬|৩৫-৩৭ ও পূর্বপ্রকরণে প্ৰদত্ত তৈ. সং. মন্ত্র দেখ] । প্ৰাচীন হিন্দুধর্মশাস্ত্রানুসারে পিতার ঋণের পরিশোধের কালসীমা নির্দেশ করা নাই, তাহা পুত্রের ও পৌত্রেরও শোধ করিতে হইবে; এবং কাহারও ঋণ রাখিয়া মরা অত্যন্ত দুৰ্গতি বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে, এই কথা মনে করিলে জন্মতঃ প্ৰাপ্ত উক্ত বড় রকমের সামাজিক কর্তব্যকে ‘ঋণ’ বলায় আমাদের শাস্ত্রকারদিগের কি হেতু ছিল, তাহা পাঠকের সহজেই উপলব্ধি হইবে । স্মৃতিকারদিগের নির্দিষ্ট এই সীমা অনুসারে সূৰ্যবংশীয় রাজারা কাজ করিতেন, এবং পুত্র রাজ্য চালাইতে সমর্থ হইলে তাহাকে সিংহাসনে বসাইয়া (প্ৰথম হইতেই নহে) নিজে গৃহস্থাশ্ৰম হইতে নিবৃত্ত হইতেন এইরূপ কালিদাস রঘুবংশে বলিয়াছেন [রঘু|৭|৬৮] । এই নিয়ম পালন না করিয়া দক্ষপ্ৰজাপতির হৰ্যশ্ব নামক পুত্রদিগকে প্রথমে এবং তাহার পর শবলাশ্ব নামক অন্য পুত্রদিগকেও, তাহাদের বিবাহের পূর্বেই, নারদ নিবৃত্তি-মার্গের উপদেশ করিয়া ভিক্ষু করিয়া তুলিয়াছিলেন বলিয়া এই অশাস্ত্র ও গৰ্হিত আচরণ সম্বন্ধে নারদকে ভৎসনা করিয়া দক্ষপ্ৰজাপতি তাঁহাকে শাপ দিয়াছিলেন; ভাগবতে এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে [ভাগ|৬|৫|৩৫-৪২] । ইহা হইতে উপলব্ধি হয় যে, আমরা গাৰ্হস্থ্য জীবন যথাশাস্ত্র সম্পূর্ণ করিয়া আমাদের ছেলেরা সন্ত্রীক কর্তা হইলে, বার্ধক্যের অনর্থক আশায় কারণে তাহাদের কর্তৃত্বের বাধা না আনিয়া নিছক্ মোক্ষপরায়ণ হইয়া আপনা হইতেই আনন্দের সহিত সংসার হইতে নিবৃত্ত হইব, ইহাই এই আশ্রম ব্যবস্থার মূল হেতু ছিল । এই হেতুই বিদুরনীতিতে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলিয়াছেন -
উৎপাদ্য পুত্রাননৃণাংশ্চ কৃত্বা বৃত্তিং চ তেভ্যোহনুবিধায় কাঞ্চিৎ ৷
স্থানে কুমারীঃ প্রতিপাদ্য সর্ব্বা অরণ্যসংস্থোহয়ং মুনিৰ্বুভূষেৎ ॥
“গৃহস্থাশ্রমে পুত্র উৎপাদন করিয়া, তাহাদিগকে অঋণী করিয়া, তাহাদের জীবিকার কিছু সুবিধা করিয়া দিয়া, এবং কন্যাদিগকে যোগ্য পাত্রে ন্যস্ত করিয়া, পরে বানপ্ৰস্থ হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা করিবে” [মভা|উ|৩৬|৩৯] । আমাদিগের মধ্যে সাধারণ লোকের সংসারসম্বন্ধে বর্তমান ধারণাও প্ৰায় বিদুরের কথারই মতো । তথাপি কখন-না-কখন সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণই মনুষ্যমাত্রের পরমসাধ্য বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায়, জাগতিক কর্মের সংসিদ্ধির জন্য স্মৃতিকারদিগের নির্দিষ্ট প্রথম তিন আশ্রমের শ্ৰেয়স্কর সীমা আস্তে আস্তে পিছাইয়া পড়িতে পড়িতে, কেহ জন্ম হইতেই, কিংবা অল্পবয়সেই জ্ঞানলাভ করিলে, তাহার এই তিন পৈঁঠায় ক্ৰমে ক্ৰমে আরোহণ করিবার আবশ্যকতা নাই - একবারেই সন্ন্যাসগ্রহণে তাহার কোন বাধা নাই – ‘ব্ৰহ্মচৰ্য্যাদেব প্ৰব্ৰজেদ্‌গৃহাদ্‌বা বনাদ্‌বা’ [জাবা|8] এই শেষের পৈঁঠায় আসিয়া থামিয়াছে ! এই অভিপ্ৰায়েই মহাভারতে গোকাপিলীয় সংবাদে কপিল স্যুরস্মিকে বলিয়াছেন -
শরীরপক্তিঃ কর্মাণি জ্ঞানং তু পরমা গতিঃ ৷
কষায়ে কর্মভিঃ পক্কে রসজ্ঞানে চ তিষ্ঠতি ॥ *
* (বেদান্ত-সূত্রের শাঙ্কর ভাষ্যে [৩|৪|২৪] এই শ্লোক গৃহীত হইয়াছে; তাহাতে উহার পাঠ “কষায়পক্তিঃ কর্মাণি জ্ঞানং তু পরমা গতিঃ ৷ কষায়ে কর্মভিঃ পক্কে ততো জ্ঞানং প্রবর্ততে ॥” – এইরূপ আছে । আমি এই শ্লোক, মহাভারতে যেমনটি পাইয়াছি তাহাই দিয়াছি ।)
“সকল কর্ম, শারীরিক (বিষয়াসক্তিরূপ) রোগ বহিষ্কৃত করিবার জন্য আছে, জ্ঞানই সর্বোত্তম এবং চরম গতি; কর্মের দ্বারা শরীরের কষায় কিংবা অজ্ঞানরূপ রোগ বিনষ্ট হইলে পর, রসজ্ঞানের আকাংক্ষা উৎপন্ন হয়” [শাং|২৬৯|৩৮] । সেইরূপ এই প্ৰকার মোক্ষধর্মে পিঙ্গলগীতাতেও “নৈরাশ্যং পরমং সুখং” - কিংবা “যোহসৌ প্ৰাণান্তিকো রোগস্তাং তৃষ্ণাং ত্যজতঃ সুখম্” - তৃষ্ণারূপ প্রাণান্তিক রোগ না গেলে সুখ নাই [শাং|১৭৪|৬৫ ও ৫৮] এইরূপ উক্ত হইয়াছে । জাবাল ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের বচন ব্যতীত কৈবল্য ও নারায়ণোপনিষদেও  বর্ণিত হইয়াছে যে, “ন কর্মণা না প্ৰজয়া ন ধনেন ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ” কর্মের দ্বারা, প্ৰজার দ্বারা, অথবা ধনের দ্বারা নহে - ত্যাগের দ্বারাই (কিংবা ন্যাসের দ্বারা) কোন কোন ব্যক্তি মোক্ষ অর্জন করে – [কৈ|১|২; নারা.উ.|১২|৩ ও ৭৮ দেখ] । জ্ঞানী পুরুষকেও শেষ পৰ্যন্ত কর্মই করিতে হইবে ইহাই যদি গীতার সিদ্ধান্ত হয় তবে এই বচনগুলির কি প্রকার প্ৰয়োগ কি ভাবে লাগাইতে হইবে তাহা বলা আবশ্যক । অর্জুনের মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হওয়াতেই অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে “তাহা হইলে আমাকে সন্ন্যাস কি, ও ত্যাগ কি, তাহা পৃথক্‌ করিয়া বলো” [১৮|১] এইরূপ ভগবানকে অর্জুন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন । কিন্তু ভগবান এই প্রশ্নের কি উত্তর দিলেন তাহা দেখিবার পূর্বে স্মৃতিগ্রন্থে প্রতিপাদিত এই আশ্ৰমমার্গ ব্যতীত অন্য এক তুল্যবল বৈদিক মার্গেরও বিচার এখানে কিছু করা আবশ্যক ।


23) গৃহস্থাশ্রমের মহত্ব



ব্ৰহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্ৰস্থ ও শেষে সন্ন্যাসী এইরূপ আশ্রমের পর-পর-উচ্চ চার পৈঁঠার এই যে সোপান তাহাকেই ‘স্মার্ত’ অর্থাৎ ‘স্মৃতিকারগণের প্রতিপাদিত মাৰ্গ’ বলে । কর্ম কর ও কর্ম ছাড়ো - এইরূপ উভয় প্রকারের পরস্পরবিরুদ্ধ বেদের যে আজ্ঞা তাহার সমন্বয়ার্থ স্মৃতিকারের বয়োভেদানুরূপ আশ্রমের এই ব্যবস্থা করিয়াছেন; এবং স্বরূপত কর্মসন্ন্যাসকেই যদি চরম ধ্যেয় বলিয়া মানা যায় তবে সেই ধ্যেয়সিদ্ধির জন্য স্মৃতিকারগণের অঙ্কিত জীবনের চারি পৈঁঠার এই মার্গে সাধ্যের পূর্বায়োজন অর্থাৎ সাধনরূপে কিছু অসঙ্গত বলা যায় না । জীবনের এই প্রকার ক্রমোচ্চ পৈঁঠার ব্যবস্থা দ্বারা জাগতিক ব্যবহারের লোপ না ঘটিয়া, যদিও বৈদিক কর্ম ও ঔপনিষদিক জ্ঞানকে একত্র সংযুক্ত করিতে পারা যায় সত্য; তথাপি গৃহস্থাশ্রমই অন্য তিন আশ্রমের পরিপোষক হওয়ায় [মনু|৬|৮৯] মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতেও শেষে গৃহস্থাশ্রমেরই মাহাত্ম্য স্পষ্ট স্বীকার করা হইয়াছে -
যথা মাতরমাশ্রিত্য সর্বে জীবন্তি জন্তবঃ ৷
এবং গাৰ্হস্থ্যমাশ্ৰিত্য বৰ্তন্ত ইতরাশ্রমাঃ ॥
“মায়ের (পৃথিবীর) আশ্রয়ে সমস্ত জন্তু যেরূপ জীবিত থাকে, সেইরূপ গৃহস্থাশ্রমের আশ্রয়ে অন্য আশ্রম সকল রহিয়াছে” [শাং|২৬৮|৬; ও মনু|৩|৭৭ দেখ] । মনু তো অন্য আশ্রমগুলিকে নদী এবং গৃহস্থাশ্রমকে সাগর বালয়াছেন [মনু|৬|৯০; মভা. শাং|২৯৫|৩৯] । গৃহস্থাশ্রমের শ্রেষ্ঠত্ব এইরূপে যদি নির্বিবাদ হইল তবে গৃহস্থাশ্রম ছাড়িয়া ‘কর্ম সন্ন্যাস কর’ এইরূপ উপদেশ করায় লাভ কি ? জ্ঞানলাভের পরে গৃহস্থাশ্রমের কর্ম করা কি অসম্ভব ? অসম্ভব না হইলে জ্ঞানী পুরুষ সংসার হইতে নিবৃত্ত হইবেক এইরূপ বলার অর্থ কি ? ন্যূনাধি্ক স্বাৰ্থ বুদ্ধিতে যাহারা কাজ করে সেই সাধারণ লোকদিগের অপেক্ষা পূর্ণ নিষ্কামবুদ্ধিতে যাঁহারা কাজ করেন সেই জ্ঞানীপুরুষেরা কাজে কাজেই লোকসংগ্ৰহে অধিক সমর্থ ও যোগ্য হইয়া থাকেন । তাই, জ্ঞানের দ্বারা যখন জ্ঞানীপুরুষের এই সামৰ্থ্য পূর্ণাবস্থায় উপনীত হয় তখনও সমাজ ছাড়িয়া যাইবার স্বাধীনতা জ্ঞানীপু্রুষের জন্য রাখিলে, চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা যাহার হিতের জন্য করা হইয়াছে সেই সমাজেরই তাহাতে অত্যন্ত ক্ষতি করা হয় । শরীরের সামর্থ্য না থাকিলে কেহ যদি সমাজ ছাড়িয়া বনে যায়, তো সে আলাদা কথা; তাহা দ্বারা সমাজের কোন বিশেষ হানি হইবে না । অনুমান হয় যে, সন্ন্যাসাশ্রমের সীমা বৃদ্ধকালে নির্দেশ করায় মনুর বোধ হয় এই অভিপ্রায়ই ছিল । কিন্তু এই শ্রেয়স্কর সীমা পরে ব্যবহারে বজায় থাকে নাই ইহা উপরে বলিয়াছি । 


24) ভাগবত ধর্ম



তাই, কর্ম কর ও কর্ম ছাড়ো এই উভয়বিধ বেদবচনের মিল করিবার জন্যই স্মৃতিকারগণ আশ্রমের ক্ৰমোচ্চ শ্রেণীপরম্পরা স্থাপন করিলেও এই বিভিন্ন বেদবাক্যসকলের সমন্বয় করিবার নির্বিবাদ অধিকার স্মৃতিকারদিগেরই ন্যায়, - এমনকি তাঁহাদের হইতেও অধিক - যে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আছে, তিনিই ভাগবত ধর্মের নামে জনকাদির প্রাচীন জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক মার্গের পুনরুজ্জীবন ও পূর্ণ সমর্থন করিয়াছেন । ভাগবতধর্মে শুধু অধ্যাত্মবিচারের উপরেই নির্ভর না করিয়া বাসুদেবভক্তির সুলভ সাধনারও উপর ভর দেওয়া হইয়াছে । এই বিষয় পরে ত্ৰয়োদশ প্রকরণে সবিস্তার বিচার করা যাইবে । ভাগবতধর্ম ভক্তিমূলক হইলেও, তাহাতেও পরমেশ্বরের জ্ঞানলাভ হইলে পর কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস না লইয়া, কেবল ফলাশা ছাড়িয়া জ্ঞানীপুরুষদিগকেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সমস্ত কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে আচরণ করিতে হইবে, জনকমার্গের এই মহৎ তত্ত্বটি বজায় আছে; তাই কর্মদৃষ্টিতে এই দুই মার্গ একই প্রকার অর্থাৎ জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক কিংবা প্ৰবৃত্তিমূলক । পরব্রহ্মেরই সাক্ষাৎ অবতার নর ও নারায়ণ ঋষি এই প্ৰবৃত্তিমূলক ধর্মের প্রথম প্ৰবর্তক এবং সেইজন্যই এই ধর্মের প্রাচীন নাম – নারায়ণীয় ধর্ম । এই দুই ঋষি পরম জ্ঞানী ও নিষ্কাম কর্মের উপদেষ্টা ছিলেন এবং নিষ্কাম কর্ম নিজেও করিতেন [মভা.উ|৪৮|২১]; এবং সেইজন্যই “প্রবৃত্তিলক্ষণশ্চৈব ধর্মো নারায়ণাত্মকঃ”[মভা.শাং|৩৪৭|৮১], কিংবা “প্ৰবৃত্তিলক্ষণং ধৰ্ম্মং ঋষির্নারায়ণোহব্ৰবীৎ” - নারায়ণ ঋষিপ্ৰবর্তিত ধর্ম আমরণ প্ৰবৃত্তিমূলক [মভা.শাং|২১৭|২], মহাভারতে এই ধর্মের এইরূপ বৰ্ণনা করা হইয়াছে । ভাগবতে স্পষ্ট উক্ত হহয়াছে যে, ইহাই সাত্ত্বত কিংবা ভাগবতধর্ম; এবং এই সাত্ত্বত কিংবা মূল ভাগবত ধর্মের স্বরূপ ‘নৈষ্কর্ম্যলক্ষণ’ - অৰ্থাৎ নিষ্কাম প্ৰবৃত্তিমূলক [ভাগ|১|৩|৮ ও ১১|৪|৬ দেখ] । এই প্ৰবৃত্তিমার্গেরই আর এক নাম ছিল ‘যোগ’, তাহা “প্রবৃত্তিলক্ষণো যোগঃ জ্ঞানং সন্ন্যাসলক্ষণং” অনুগীতার এই শ্লোক হইতে স্পষ্ট দেখা যায় [মভা.অশ্ব|৪৩|২৫] । এইজন্যই নারায়ণের অবতার শ্ৰীকৃষ্ণ নরের অবতার অর্জুনকে গীতায় যে ধর্ম উপদেশ করিয়াছেন, গীতাতেই তাহার নাম ‘যোগ’ উক্ত হইয়াছে । 


25) ভাগবত ও স্মার্তের মূল অর্থ



ভাগবত ও স্মার্ত, দুই পথ উপাস্য-ভেদপ্রযুক্ত প্রথমে উৎপন্ন হয়, অধুনা কাহারও কাহারও এইরূপ ধারণা । কিন্তু আমাদের মতে এই ধারণা ভ্ৰান্তিমূলক । কারণ এই দুই মার্গের উপাস্য ভিন্ন হইলেও উহাদের ‘অন্তর্ভূত অধ্যাত্মজ্ঞান একই । এবং অধ্যাত্মজ্ঞানের ভিত্তি একই হইলে এই উচ্চাঙ্গ জ্ঞানে পারদর্শী প্ৰাচীন জ্ঞানী পুরুষ কেবল উপাস্যভেদের জন্য বিবাদ করিতে বসিবেন ইহা সম্ভব নহে । এই কারণেই, যাহাকেই ভক্তি কর না কেন, সেই ভক্তি একমাত্র পরমেশ্বরেই গিয়া পৌঁছায়, ভগবদ্‌গীতা [৯|১৪] ও শিবগীতা [১২|৪] এই দুই গ্রন্থে এইরূপ উক্ত হইয়াছে । নারায়ণ ও রুদ্র একই, যাহারা রুদ্রের ভক্ত তাহারা নারায়ণেরও ভক্ত এবং যাহারা রুদ্রের দ্বেষী তাহার নারায়ণেরও দ্বেষী, - এইরূপে মহাভারতের নারায়ণীয় ধর্মে তো এই দুই দেবতার অভেদ বর্ণিত হইয়াছে [মভা.শাং|৩৪১|২০-২৬ ও ৩৪২|১২৯ দেখ] । শৈব ও বৈষ্ণব এই ভেদ প্ৰাচীনকালে ছিল না এ কথা আমি বলি না । কিন্তু স্মার্ত ও ভাগবত এই দুই ভিন্ন পন্থা হইবার পক্ষে, শিব কিংবা বিষ্ণু এই উপাস্যভেদ কারণ নহে; জ্ঞানোত্তর নিবৃত্তি কিংবা প্ৰবৃত্তি, কর্ম ত্যাগ করিবে কি করিবে না, কেবল ইহারই মহত্ত্বের সম্বন্ধে মতভেদ হওয়ায় এই দুই পন্থা প্ৰথমে উৎপন্ন হয়, ইহাই আমার বলিবার তাৎপৰ্য । পরে, কালক্রমে যখন মূল ভাগবতধর্মের প্ৰবৃত্তি-মার্গ কিংবা কর্মযোগ লুপ্ত হইয়া তাহাও কেবল বিষ্ণুভক্তিমূলক অর্থাৎ বহু-অংশে নিবৃত্তিমূলক আধুনিক স্বরূপ প্রাপ্ত হইল এবং তৎপ্রযুক্ত তোমার দেবতা ‘শিব’, আমার দেবতা ‘বিষ্ণু’ রকম বৃথাভিমানে মনুষ্যেরা যখন ঝগড়া করিতে লাগিল, তখন ‘স্মার্ত’ ও ‘ভাগবত’ শব্দ অনুক্রমে ‘শৈব’ ও ‘বৈষ্ণব’ শব্দের সহিত সমানার্থক হইয়া পরিশেষে এই আধুনিক ভাগবতধর্মীদিগের বেদান্ত (দ্বৈত কিংবা বিশিষ্টাদ্বৈত) ভিন্ন হইল এবং বেদান্তেরই ন্যায় জ্যোতিষের রীতিও অর্থাৎ একাদশী করিবার ও কপালে ফোঁটা কাটিবার রীতিও স্মার্ত্তমাৰ্গ হইতে ভিন্ন হইল ! কিন্তু এইভেদ প্ৰকৃত ভেদ নাহে অৰ্থাৎ মূলগত প্ৰাচীন ভেদ নহে - ইহা ‘স্মার্ত্ত’ শব্দ হইতেই ব্যক্ত হইতেছে । ভাগবতধর্ম ভগবানই প্ৰবর্তিত করায়, তাহার উপাস্য দেবতাও যে শ্ৰীকৃষ্ণ কিংবা বিষ্ণু, তাহা কিছু আশ্চৰ্য নহে । কিন্তু ‘স্মার্ত্ত’ শব্দের ধাত্বর্থ ‘স্মৃত্যুক্ত’ - কেবল এটুকুই – হওয়ায় স্মার্তধর্মের উপাস্য দেবতা শিবই হইবেন এরূপ বলা যায় না । কারণ, মন্বাদি প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থে একমাত্র শিবেরই উপাসনা করিতে হইবে এরূপ কোন নিয়ম প্রদত্ত হয় নাই । উল্টা, বিষ্ণুরই অধিক বর্ণনা আছে; কোন কোন স্থানে গণপতি প্ৰভৃতি উপাস্য দেবতার কথাও উক্ত হইয়াছে । তাছাড়া শিব ও বিষ্ণু এই দুই দেবতা বৈদিক অর্থাৎ বেদেতেই বর্ণিত হওয়ায় ইহাদের মধ্যে একটিকেই স্মার্ত্ত বলা যুক্তিসিদ্ধ নহে । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যকে স্মার্তমতের প্রবর্তক বলা হইয়া থাকে । কিন্তু শাঙ্করমঠে উপাস্য দেবতা - শারদা এবং শাঙ্করভাষ্যে প্ৰতিমাপূজার যেখানে যেখানে প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইয়াছে, সেইখানে সেইখানেই শিবলিঙ্গের নির্দেশ না করিয়া শালগ্রামের অর্থাৎ বিষ্ণুপ্ৰতিমারই উল্লেখ আচাৰ্য করিয়াছেন [বেসূ|শাংভা|১|২|৭; ১|৩|১৮ ও ৪|১|৩; ছাং|শাংভা|৮|১|১] । সেইরূপ পঞ্চায়তনপূজাও প্রথমে শঙ্করাচাৰ্যই প্ৰবর্তিত করেন, এইরূপ কথা প্রচলিত আছে । ইহা হইতে ইহাই সিদ্ধ হয় যে, প্রথম প্রথম স্মার্ত্ত ও ভাগবত পন্থার মধ্যে ‘শিবভক্ত’ কিংবা ‘বিষ্ণুভক্ত’ এই সব উপাস্যভেদের কোন ঝগড়া ছিল না; কিন্তু যাহার দৃষ্টিতে স্মৃতিগ্রন্থে সুস্পষ্টরূপে বৰ্ণিত আশ্রম-ব্যবস্থানুসারে যৌবনকালে যথাশাস্ত্ৰ সংসার করিবার পর, বার্ধক্যে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া চতুর্থাশ্রম কিংবা সন্ন্যাস গ্রহণ চরম সাধ্য ছিল তিনিই স্মার্ত, এবং ভগবানের উপদেশ অনুসারে জ্ঞান ও উজ্জ্বল ভগবদ্‌ভক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমরণ গৃহস্থাশ্রমের কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে হইবে এইরূপ যিনি বুঝিতেন তিনিই ভাগবত বলিয়া উক্ত হইতেন । ইহাই এই দুই শব্দের মূল অর্থ; এবং এই হেতু এই দুই শব্দ, সাংখ্য ও যোগ কিংবা সন্ন্যাস ও কর্মযোগের সহিত অনুক্রমে সমানার্থক । ভগবানের অবতার-কাৰ্য্যের কথা ধরিয়াই বলো, কিংবা জ্ঞানযুক্ত গাৰ্হস্থ্যধর্মের মহত্বের প্ৰতি লক্ষ্য করিয়াই বলো, সন্ন্যাসাশ্রম লুপ্তপ্রায় হইয়াছিল; এবং কলি-বর্জিতের প্রকরণে অর্থাৎ কলিযুগে যে সকল বিষয় শাস্ত্ৰে নিষিদ্ধ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে সন্ন্যাস পরিগণিত হইয়াছিল । [নির্ণয়সিন্ধু, তৃতীয় পরিচ্ছেদ, কলিবর্জ্য প্রকরণ দেখ । উহাতে “অগ্নিহোত্ৰং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্ ৷ দেবরাচ্চ সুতোৎপত্তিঃ কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ ॥” এবং “সন্ন্যাসশ্চন কর্তব্যো ব্ৰাহ্মণেন বিজানতা” ইত্যাদি স্মৃতিবচন প্রদত্ত হইয়াছে । ইহার অর্থ, - অগ্নিহোত্র, গোবধ, সন্ন্যাস, শ্রাদ্ধপ্রসঙ্গে মাংস ভক্ষণ ও নিয়োগ, কলিযুগে নিষিদ্ধ । তন্মধ্যে সন্ন্যাসের নিষিদ্ধতাও শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য পূৰ্ব হইতে ছাঁটিয়া ফেলিয়াছেন ।] আবার জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্ৰবর্তকেরা কাপিল সাংখ্যের মত স্বীকার করিয়া, সংসার হইতে বাহির হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষ নাই এই মত বিশেষরূপে প্ৰচলিত করেন । স্বয়ং বুদ্ধ ত যৌবনেই রাজ্য ও স্ত্রীপুত্র ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছিলেন; ইহা ইতিহাসে প্ৰসিদ্ধ আছে । 


26) গীতাতে কর্মযোগ অর্থাৎ ভাগবতধর্মই প্রতিপাদ্য



জৈন ও বৌদ্ধ মত শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য খণ্ডন করিলেও জৈন ও বৌদ্ধের যে সন্ন্যাসধর্ম বিশেষরূপে প্ৰচলিত করিয়াছিলেন তাহাই শ্রৌতস্মার্ত সন্ন্যাস বলিয়া আচাৰ্য বজায় রাখিয়াছেন এবং গীতায় সেই সন্ন্যাসধর্মই প্ৰতিপাদ্য বিষয়, গীতার এইরূপ অৰ্থও তিনি বাহির করিয়াছেন । কিন্তু বস্তুত গীতা স্মার্তমার্গের গ্ৰন্থ নহে; সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমাৰ্গ হইতেই গীতার আরম্ভ হইলেও পরে সিদ্ধান্তপক্ষে প্রবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্মই তাহাতে প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে । ইহা স্বয়ং মহাভারতকারের বচন এবং প্রথম প্ৰকরণেই আমি তাহা দিয়াছি । এই দুই পন্থাই বৈদিক হওয়ায় সৰ্ব্বাংশে না হউক বহুলাংশে উভয়ের সমন্বয় করিতে পারা যায় । কিন্তু এইরূপ সমন্বয় করা এক কথা; এবং গীতায় সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে, কর্মমাৰ্গকে যদি কোথাও মোক্ষপ্ৰদ বলা হইয়া থাকে তো সে শুধু অর্থবাদ কিংবা ফাঁকা স্তুতিমাত্ৰ, এইরূপ বলা আর এক কথা । রুচিবৈচিত্ৰ্যপ্রযুক্ত ভাগবত ধর্মাপেক্ষা স্মার্তধর্মই কাহার বেশী মিষ্ট লাগিবে না কিংবা কর্মসন্ন্যাস পক্ষে সাধারণতঃ যে সকল কারণ বলা হইয়া থাকে, তাহাই যে কেহ অধিক বলবত্তর মনে করিবে না তাহা কে বলিতে পারে ? উদাহরণ যথা – 
স্মার্ত কিংবা সন্ন্যাসধর্মই যে শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের মান্য ছিল, অন্য সমস্ত মাৰ্গ তিনি অজ্ঞানমূলক বলিয়া মনে করিতেন, এ বিষয়ে কাহারও সন্দেহ নাই । কিন্তু সেই জন্যই যে গীতার ভাবাৰ্থও তাঁহাই হইবে তাহা বলিতে পারা যায় না । গীতার সিদ্ধান্ত তোমার মানা না হয়, তুমি তাহা স্বীকার করিও না । কিন্তু নিজের জেদ বজায় রাখিবার জন্য “এই জগতে জীবনের দুই প্রকার স্বতন্ত্র মোক্ষপ্ৰদ মাৰ্গ কিংবা নিষ্ঠা আছে” এইরূপ যাহা গীতার আরম্ভে উক্ত হইয়াছে তাহার অর্থ “সন্ন্যাসনিষ্ঠাই একমাত্ৰ প্ৰকৃত ও শ্রেষ্ঠ মাৰ্গ” এরূপ করা সঙ্গত নহে । গীতায় বর্ণিত এই দুই মাৰ্গ বৈদিক ধর্মে জনক-যাজ্ঞবল্ক্যের পূর্ব হইতেই স্বতন্ত্রভাবে চলিয়া অ্যাসিয়াছে । তন্মধ্যে জনকের ন্যায় সমাজের ধারণপোষণ করিবার অধিকার ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে, বংশপরম্পরাক্রমে কিংবা নিজ সামর্থ্যে যিনি প্ৰাপ্ত হইতেন তিনি জ্ঞানলাভের পরেও আপন কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাকিয়া জগতের কল্যাণসাধনেই নিজের সমস্ত জীবিতকাল ক্ষেপণ করিতেন, এইরূপ পাওয়া যায় । সমাজের এই অধিকারের প্রতি দৃষ্টি করিয়াই “সুখং জীবন্তি মুনয়ো ভৈক্ষ্যবৃত্তিং সমাশ্ৰিতাঃ” [শাং|১৭৮|১১] - অরণ্যবাসী মুনি আনন্দে ভিক্ষাবৃত্তি স্বীকার করিয়া থাকেন - আবার, “দণ্ড এব হি রাজেন্দ্ৰ ক্ষত্রধর্মো ন মুণ্ডনম্‌” [শাং|২৩|৪৬] - দণ্ডের দ্বারা লোকের ধারণপোষণ করাই ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম, মুণ্ডন করাইয়া লওয়া নহে - এইরূপ মহাভারতে অধিকারভেদে দুয়েরই বর্ণনা আছে । কিন্তু ইহা হইতে এমনও বুঝিতে হইবে না যে, কেবল প্ৰজাপালনের অধিকারী ক্ষত্ৰিয়েরই নিজের অধিকার হেতুই কর্মযোগ বিহিত ছিল । যে, যে কর্ম করিবার অধিকারী, জ্ঞানলাভের পরেও তাহাকে সেই কর্ম করিতে হইবে ইহাই কর্মযোগের উক্ত বচনের প্রকৃত ভাবাৰ্থ; এবং এই কারণেই “এষা পূর্বতরা বৃত্তি ব্ৰাহ্মণস্য বিধীয়তে” [শান্তি|২৩৭] - জ্ঞানলাভের পর ব্ৰাহ্মণও আপন অধিকারানুসারে যাগযজ্ঞাদি কর্ম প্ৰাচীন কালে বজায় রাখিতেন - এইরূপ মহাভারতে উক্ত হইয়াছে । মনুস্মৃতিতেও সন্ন্যাসাশ্রমের বদলে সমস্ত বর্ণের পক্ষে বৈদিক কর্মযোগই বিকল্পে বিহিত বলিয়া ধৃত হইয়াছে [মনু|৬|৮৬-৯৬] । ভাগবত ধর্ম কেবল ক্ষত্ৰিয়ের জন্যই, এরূপ কোথাও উক্ত হয় নাই; উল্টা, স্ত্রীশূদ্রাদি সমস্ত, লোকের উহা সুলভ এইরূপে তাহার মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে [গী|৯|৩২] । মহাভারতে তুলাধার (বৈশ্য) ও ব্যাধ (বহেলিয়া) এই ধর্মই আচরণ করিত, এবং তাহারা ব্ৰাহ্মণদিগকেও ঐধর্ম উপদেশ দিয়াছে এইরূপ আখ্যায়িকা আছে [শাং|২৬১; বন|২১৫] । নিষ্কাম কর্মযোগের আচরণ করিতে অগ্রসর পুরুষদিগের যে সকল উদাহরণ ভাগবত ধর্মগ্রন্থে প্রদত্ত হয় তাহা কেবল জনকশ্ৰীকৃষ্ণআদি ক্ষত্রিয়দেরই নহে - তাহাতে বসিষ্ঠ, জৈগীষব্য ওব্যাস প্রভৃতি জ্ঞানী ব্ৰাহ্মণদিগেরও সমাবেশ করা কইয়া থাকে । 


27) গীতার কর্মযোগ এবং মীমাংসকদের কর্মযোগের প্রভেদ



গীতায় কর্মমার্গই প্ৰতিপাদ্য হইলেও শুধু অর্থাৎ জ্ঞানবর্জিত কর্ম করিবার মার্গকে মোক্ষপ্ৰদ বলিয়া গীতা স্বীকার করেন না এ কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই । জ্ঞানবর্জিত কর্ম করিবারও দুই প্ৰকারভেদ আছে । এক, দম্ভের সহিত কিংবা আসুরী বুদ্ধিতে কর্ম করা এবং অন্যটি শ্রদ্ধার সহিত । তন্মধ্যে দম্ভের মাৰ্গ কিংবা আসুরী মাৰ্গকে গীতা [গী|১৬|১৬ ও ১৭|২৮], এবং মীমাংসকেরাও গৰ্হিত ও নরকপ্ৰদ বলিয়া স্বীকার করেন; ঋগ্‌বেদেও অনেক স্থানে শ্রদ্ধার মাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে [ঋ|১০|১৫১; ৯|১১৩|২ ও ২|১২|৫] । কিন্তু দ্বিতীয় অর্থাৎ জ্ঞানব্যতীত অথচ শাস্ত্রের উপর শ্রদ্ধা রাখিয়া কর্ম করিবার মাৰ্গসম্বন্ধে মীমাংসকেরা বলেন যে, পরমেশ্বর-স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান না হইলেও শাস্ত্রের উপর বিশ্বাস রাখিয়া কেবল শ্ৰদ্ধার সহিত যাগযজ্ঞাদি কর্ম আমরণ করতে থাকিলে শেষে মোক্ষলাভই হয় । মীমাংসকদিগের এই মাৰ্গ যে কর্মকাণ্ডরূপে বহু প্ৰাচীনকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে তাহা পূর্ব প্ৰকরণে বলিয়াছি । বেদসংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহে সন্ন্যাসাশ্রম অবশ্যকর্তব্য বলিয়া কোথাও উক্ত হয় নাই । বরঞ্চ, গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়াই যে মোক্ষলাভ হয় এইরূপ বেদের স্পষ্ট বিধান থাকার কথা জৈমিনি বলিয়াছেন [বেসূ|৩|৪|১৭-২০ দেখ]; তাঁহার এই উক্তি কিছু ভিত্তিহীনও নহে । কারণ, কর্মকাণ্ডের এই প্ৰাচীন মাৰ্গকে গৌণ বলিয়া স্বীকার করা উপনিষদেই প্ৰথমে আরম্ভ হইয়াছে, দেখা যায় । উপনিষদ্‌ বৈদিক হইলেও যে সংহিতা ও ব্ৰাহ্মণের পরবর্তী, তাহা উপনিষদের বিষয়-প্ৰতিপাদন হইতেই প্ৰকাশ পায় । ইহার অর্থ এরূপ নহে যে পরমেশ্বরের জ্ঞান তৎপূর্বে হয়ই নাই । হাঁ; মোক্ষলাভের জন্য, জ্ঞানোত্তর বৈরাগ্যের দ্বারা কর্মসন্ন্যাস করা বিধেয়, এই মত উপনিষৎকালেই অবশ্য প্ৰথমে আমলে আসে; এবং তদনন্তর সংহিতা ও ব্রাহ্মণে বর্ণিত কর্মকাণ্ডের গৌণত্ব আসিয়াছে । তৎপূর্বে কর্মকেই প্রধান বলিয়া মানা হইত । উপনিষদের কালে বৈরাগ্যযুক্ত জ্ঞানের অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের এইরূপ প্রাধান্য হইতে থাকিলে, যাগযজ্ঞাদি কর্মের প্ৰতি কিংবা চাতুর্বর্ণ্যধর্মেরও প্রতি জ্ঞানীপুরুষ উপেক্ষা করিতে লাগিলেন; এবং সেই অবধিই লোকসংগ্ৰহ করা আমাদের কর্তব্য এই ধারণা মন্দীভূত হইল । স্মৃতিকারেরা স্বস্ব গ্রন্থে, গৃহস্থাশ্রমে যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত কিংবা চাতুৰ্বর্ণ্যের স্মার্তকর্ম করাই কর্তব্য, এইরূপ বলিয়া গৃহস্থাশ্রমের মাহাত্ম্য কীর্তন করিয়াছেন সত্য; কিন্তু স্মৃতিকারদিগের মতেও শেষে বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসাশ্রমই শ্ৰেষ্ঠ হওয়ায়, উপনিষদের জ্ঞানপ্রভাবে কর্মকাণ্ডের যে গৌণত্ব আসিয়াছিল, স্মৃতিকারদিগের আশ্রমব্যবস্থায় সেই গৌণত্ব হ্রাস হইতে পারে নাই । এই ব্যবস্থায় জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে কাহাকেই গৌণত্ব না দিয়া, ভক্তির সহিত এই দুয়েরই সমন্বয় করিবার জন্য গীতা প্ৰবৃত্ত হইলেন । জ্ঞানব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না এবং যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা বড়জোর স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত গীতার মান্য [মুণ্ড|১|২|১০; গী|২|৪১-৪৫] । কিন্তু ইহাও গীতার সিদ্ধান্ত যে, সৃষ্টিক্রম চলিত রাখিতে হইলে যজ্ঞ কিংবা কর্মচক্রকেও বজায় রাখা আবশ্যক, কর্ম ত্যাগ করা নিছক পাগ্‌লামি বা মূর্খতা । তাই যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত কর্ম কিংবা চাতুর্বর্ণ্যাদি ব্যবহারিক কর্ম অজ্ঞানপূর্বক শ্ৰদ্ধার সহিত না করিয়া জ্ঞানবৈরাগ্যযুক্ত বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া কর; তাহা হইলে এই চক্রও বিস্খলিত হইবে না, এবং তোমার অনুষ্ঠিত কর্ম মোক্ষের প্রতিবন্ধকও হইবে না, এইরূপ গীতার উপদেশ । জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডের (সন্ন্যাস ও কর্মের) সমন্বয় করিবার গীতার এই নৈপুণ্য স্মৃতিকারদিগের অপেক্ষা যে অধিক সরস তাহা আর বলিতে হইবে না । কারণ, ব্যষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণ একটুও কম না করিয়া তাহার সঙ্গে জগতের সমষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণও গীতামার্গের দ্বারা সংসাধিত হয় । কর্ম অনাদি ও বেদপ্ৰতিপাদিত হওয়ায় তোমার জ্ঞান না হইলেও শ্রদ্ধার সহিত তাহা করাই আবশ্যক, এইরূপ মীমাংসক বলেন । অনেকগুলি উপনিষৎকার (সকলে নহে) কর্মকে গৌণ স্থির করিয়া বলেন যে, বৈরাগ্যের দ্বারা কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য; নিদানপক্ষে তাঁহাদের সেই দিকে যে ঝোঁক্‌ তাহা মানিতে বাধা নাই । এবং স্মৃতিকার বয়োভেদ অর্থাৎ আশ্ৰমব্যবস্থা দ্বারা উক্ত দুই মতের এইরূপ সমন্বয় করেন যে, পূর্ব আশ্রমে এই সকল কর্ম করিতে থাকিয়া চিত্তশুদ্ধি হইলে পর বার্ধক্যে বৈরাগ্যের দ্বারা সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া সন্ন্যাস লাইবে । কিন্তু গীতার পন্থা এই তিন পন্থা হইতে ভিন্ন । জ্ঞান ও কাম্যকর্মের মধ্যে বিরোধ থাকিলেও, জ্ঞান ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে কোনই বিরোধ নাই; তাই, নিষ্কামবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম সর্বদা করিরা যাও, তাহা কখনও ছাড়িও না, গীতা এইরূপ বলেন । এখন এই চারি মতের তুলনা করিলে দেখা যায় যে, জ্ঞান হইবার পূর্বে কর্মের আবশ্যকতা আছে ইহা সকলেরই মান্য কিন্তু এইরূপ অবস্থায় শ্রদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত কর্মের ফল স্বৰ্গ ছাড়া আর কিছু নহে, এইরূপ উপনিষদে ও গীতায় উক্ত হইয়াছে । ইহার পরে অর্থাৎ জ্ঞান-লাভ হইলে পর কর্ম করিবে কি করিবে না এই সম্বন্ধে উপনিষৎকারদিগের মধ্যেও মতভেদ আছে । জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত কাম্যবুদ্ধির হ্রাস হইলে পর যে ব্যক্তি মোক্ষের অধিকারী হইয়াছেন তাঁহার কেবল স্বর্গপ্রাপ্তিকর কাম্য কর্ম করিবার কোন প্রয়োজনই থাকে না এইরূপ কোন কোন উপনিষৎকার বলেন; কিন্তু ঈশাবাস্যাদি অন্য কতকগুলি উপনিষৎ, মৃত্যুলোকের ব্যবহার বজায় রাখিবার জন্য কর্ম করাই আবশ্যক, এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । উপনিষদে বর্ণিত এই দুই মার্গের মধ্যে দ্বিতীয় মাৰ্গই গীতার প্রতিপাদ্য, ইহা স্পষ্ট দেখা যায় [গী|৫|২] । কিন্তু মোক্ষের অধিকারী জ্ঞানী পুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কামবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করিবেক এইরূপ বলিলেও, যে যাগযজ্ঞাদি কর্মের স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি ছাড়া অন্য কোন ফল নাই সেই কর্ম তিনি কেনই বা করিবেন এই প্রশ্ন এই স্থানে স্বভাবতই উপস্থিত হয় । তাই ১৮শ অধ্যায়ের আরম্ভে ঐ প্রশ্নই উপস্থিত করিয়া, ভগবান স্পষ্ট নির্ণয় করিয়া দিয়াছেন যে, “যজ্ঞ, দান, তপ” প্ৰভৃতি কর্ম সর্বদাই চিত্তশুদ্ধিকারক অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধি উৎপাদক ও বর্ধক হওয়া প্ৰযুক্ত “এই সকল কর্মও” (এতান্যপি) অন্য নিষ্কাম কর্মেরই ন্যায় লোকসংগ্ৰহাৰ্থ, ফলাশা ও আসক্তি ত্যাগ করিয়া জ্ঞানীপুরুষের নিয়ত করা কর্তব্য [গী|১৮|৬] । পরমেশ্বরে সমর্পণ করিয়া সমস্ত কর্ম এইরূপ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাকিলে, ব্যাপকার্থে ইহাই এক বড়রকমের যজ্ঞ হইয়া যায়; এবং তাহার পর, এই যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধনস্বরূপ হয় না [গী|৪|২৩]; কিন্তু সমস্ত কর্মই নিষ্কাম বুদ্ধিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, যজ্ঞ হইতে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তিরূপ যে বন্ধনাত্মক ফল পাইবার কথা ছিল তাহাও পাওয়া যায় না, এবং এই সকল কর্ম মোক্ষের অন্তরায় হইতে পারে না । মোদ্দা কথা, মীমাংসকদিগের কর্মকাণ্ড গীতায় বজায় রাখা হইলেও এরূপ কৌশলে বজায় রাখা হইয়াছে যে তাহার দরুন স্বৰ্গে গমনাগমন না ঘটিয়া সমস্ত কর্মই নিষ্কাম বুদ্ধিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় শেষে মোক্ষলাভ না হইয়া যায় না । মীমাংসকদিগের কর্মমার্গ এবং গীতার কর্মযোগের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ - দুই এক নহে, ইহা মনে রাখিতে হইবে ।


28) স্মার্ত সন্ন্যাস ও ভাগবত সন্ন্যাসের প্রভেদ



ভগবদ্‌গীতায় প্রবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্ম কিংবা কর্মযোগই যে প্ৰতিপাদ্য, এবং এই কর্মযোগে ও মীমাংসকদিগের কর্মকাণ্ডে যে কি প্ৰভেদ তাহা এখানে বলিয়াছি । এক্ষণে গীতার কর্মযোগ এবং জ্ঞানকাণ্ডকে ধরিয়া স্মৃতিকারদিগের বর্ণিত আশ্রমব্যবস্থার মধ্যে প্ৰভেদ কি, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে তাহার একটু বিচার করিব । এই ভেদ অতীব সূক্ষ্ম এবং বাস্তবিক বলিতে হইলে এই সম্বন্ধে বাদবিতণ্ডা করিবার কোন কারণ নাই । জ্ঞানলাভ হওয়া পর্যন্ত চিত্তশুদ্ধির জন্য প্রথম দুই (ব্রহ্মচারী ও গৃহস্থ) আশ্রমের কাৰ্য সকলেরই করা কর্তব্য ইহা উভয় পক্ষেরই মান্য । পূর্ণ জ্ঞান হইলে পর কার্য করিবেক কিংবা সন্ন্যাস লইবেক এইটুকুই যা মতভেদ । কিন্তু এইরূপ জ্ঞানী পুরুষ যে কোন সমাজে অল্পই দেখা যায়; তাই, এই অল্পসংখ্যক জ্ঞানী লোকের কর্ম করা বা না করা একই, সে সম্বন্ধে বিশেষ দাপাদাপি করিবার আবশ্যকতা নাই, এইরূপ কেহ কেহ মনে করিতে পারেন । কিন্তু এ কথা বলা ঠিক নহে । কারণ জ্ঞানী পুরুষের আচরণ অন্য সমস্ত লোক প্ৰমাণ বলিয়া মানে এবং নিজের চরম সাধ্য অনুসারে মনুষ্য প্রথম হইতেই আপন আচরণের গতিপথ নির্ধারণ করায় “জ্ঞানী পুরুষের কি করা কর্তব্য’ এই প্রশ্ন লৌকিক দৃষ্টিতে একটা বড় প্রশ্ন হইয়া পড়ে । জ্ঞানীপুরুষ শেষে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবেক স্মৃতিগ্রন্থে ইহা বলা হইয়াছে সত্য; কিন্তু স্মার্তমার্গের অনুসারেই এই নিয়মের ব্যতিক্রমও আছে তাহা উপরে বলা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য জনককে ব্ৰহ্মজ্ঞানের অনেক উপদেশ করিয়াছেন; কিন্তু তিনি জনককে কোথাও বলেন নাই যে, “তুমি এখন রাজ্য ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্রহণ কর” । বরং, যে জ্ঞানী পুরুষ জ্ঞানোত্তর সংসার ত্যাগ করেন, সংসার তাঁর ভাল লাগে না (ন কাময়ন্তে) বলিয়াই তিনি ত্যাগ করেন – এইরূপ বলিয়াছেন [বৃ|৪|৪|২২] । ইহা হইতে বৃহদারণ্যকের এই অভিপ্রায় প্ৰকাশ পায় যে, জ্ঞানোত্তর সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা বা না করা প্ৰত্যেকের ইচ্ছাধীন অর্থাৎ বৈকল্পিক বিষয়, ব্ৰহ্মজ্ঞান ও সন্ন্যাসের মধ্যে কোন নিত্য সম্বন্ধ নাই; এবং বেদান্তসূত্রে বৃহদারণ্যক-উপনিষদের এই বচনের অর্থ ঐরূপই করা হইয়াছে [বেসূ|৩|৪|১৫] । জ্ঞানোত্তর কর্মসন্ন্যাস ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না, ইহা শঙ্করাচাৰ্য্যেয় স্থির সিদ্ধান্ত; এই জন্য আপন ভাষ্যে তিনি সমস্ত উপনিষদ এই সিদ্ধান্তের অনুকুল দেখাইবার জন্য চেষ্টা করিায়াছেন । তথাপি জনকাদির ন্যায় জ্ঞানোত্তরও যথাধিকার আমরণ কর্ম করিবার কোন বাধা নাই ইহা শ্রীশঙ্করাচার্যও স্বীকার করিয়াছেন [বেসূ|শাংভা|৩|৩|৩২; এবং গী|শাংভা|২|১১ ও ৩|২০ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, সন্ন্যাস কিম্বা স্মার্তমার্গেও জ্ঞানোত্তর কর্ম সম্পূর্ণই ত্যাজ্য বলা যায় না; কোন কোন জ্ঞানী পুরুষকে ব্যতিক্ৰমস্থল মানিয়া, এই মার্গেও যথাধিকার কর্ম করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে । এই ব্যতিক্রমের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করিয়া গীতা বলেন যে, চাতুর্বর্ণ্যবিহিত কর্ম জ্ঞানলাভ হবার পরেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ কর্তব্য বলিয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে প্ৰত্যেক জ্ঞানী পুরুষের করা কর্তব্য । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, গীতাধর্ম ব্যাপক হইলেও তাহার তত্ত্ব সন্ন্যাসমার্গীদিগের দৃষ্টিতেও নিৰ্দোষ; এবং বেদান্তসূত্র স্বতন্ত্রভাবে পাঠ করিলে বুঝা যাইবে যে, উহাতেও জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগ সন্ন্যাসের বিকল্প বলিয়া গৃহীত হইয়াছে [বেসূ|৩|৪|২৬; ৩|৪|৩২-৩৫] । [বেদান্তসূত্রের এই অধিকরণের অর্থ শাঙ্করভাষ্যে একটু ভিন্নরূপে করা হইয়াছে । কিন্তু ‘বিহিতত্বাচ্চাশ্রমকর্মাপি’ [৩|৪|৩২] ইহার অর্থ আমাদের মতে, “জ্ঞানীপুরুষ আশ্রমকর্মও করিলেও উত্তম, কারণ উহা বিহিত” । মোদ্দাকথা, জ্ঞানীপুরুষ কর্ম করুন বা না করুন, দুই পক্ষই আমার মতে বেদান্তসূত্রে স্বীকৃত হইয়াছে ।]


29) উভয়ের একতা



নিষ্কামবুদ্ধিতেই হউক যদি আমরণ কর্মই করিতে হয় তবে স্মৃতিগ্রন্থে কথিত কর্মত্যাগীরূপ চতুর্থাশ্রম কিংবা সন্ন্যাসাশ্রমের কি অবস্থা হইবে তাহা এক্ষণে বলা আবশ্যক । অর্জুন মনে ভাবিয়াছিলেন যে, ভগবান কখন-না-কখন কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না বলিবেনই; এবং তখন ভগবানের মুখেই যুদ্ধ ছাড়িয়া দিবার পক্ষে আমি স্বাধীনতা পাইব । কিন্তু যখন অর্জুন দেখিলেন যে, ১৭শ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত ভগবান কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসাশ্রমের একটি কথাও বলিলেন না, সর্বক্ষণ এই উপদেশই করিলেন যে, ফলের আশা ত্যাগ কর, তখন ১৮শ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন ভগবানকে প্রশ্ন করিলেন – “তবে, সন্ন্যাস ও ত্যাগের ভেদ কি তাহা আমাকে আবার বলো” । অর্জুনকে এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান বলিতেছেন, “অর্জুন, এতক্ষণ তোমাকে যে কর্মযোগের কথা বলিয়াছি তাহার মধ্যে সন্ন্যাস নাই এরূপ যদি তোমার ধারণা হয় তবে তাহা ভুল । কর্মযোগী পুরুষ সমস্ত কর্মের ‘কাম্য’ অর্থাৎ আসক্তবুদ্ধিতে কৃত কর্ম এবং ‘নিষ্কাম’ অর্থাৎ আসক্তি ছাড়িয়া কৃত কর্ম এই দুই ভেদ করেন । (ইহাকেই মনুস্মৃতি ২৩|৮৯-এ অনুক্রমে ‘প্রবৃত্ত’ ও ‘নিবৃত্ত’ নাম দিয়াছেন) । তন্মধ্যে ‘কাম্য’ বর্গের সমস্ত কর্ম কর্মযোগী একেবারেই ত্যাগ করেন, অর্থাৎ সেই সমস্ত কর্মের ‘সন্ন্যাস’ করেন । বাকী রহিল ‘নিষ্কাম’ কিংবা ‘নিবৃত্ত’ কর্ম; এই নিষ্কাম কর্ম কর্মযোগী করেনই তো, কিন্তু সেই সমস্তের মধ্যে তিনি ফলাশা সর্বথাই ত্যাগ করিয়া থাকেন । সারকথা, কর্মযোগমার্গেও ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ হইতে অব্যাহতি হইল কৈ ? স্মার্তমাৰ্গী স্বরূপতঃ কর্মসন্ন্যাস করিয়া থাকেন, আর কর্মমার্গের যোগী তাহা না করিয়া কর্মের ফলাশা সন্ন্যাস করেন । সন্ন্যাস দুই পক্ষেই বজায় আছে [গী|১৮|১-৬ এর উপর আমার টীকা দেখ] । সমস্ত কর্ম যিনি পরমেশ্বরে অর্পণপূর্বক নিষ্কামবুদ্ধিতে করেন, গৃহস্থাশ্রমী হইলেও তাঁহাকে ‘নিত্যসন্ন্যাসীই’ বলিতে হইবে [গী|৫|৩], ইহাই ভাগবত ধর্মের মুখ্য তত্ত্ব; এবং ভাগবত পুরাণেও সমস্ত আশ্ৰমধর্মের কথা প্ৰথমে বলিয়া, শেষে নারদ যুধিষ্ঠিরকে এই তত্ত্বই উপদেশ করিয়াছেন । বামন পণ্ডিত গীতাসম্বন্ধীয় স্বলিখিত টীকা যথার্থদীপিকায় [১৮|২] যাহা বলিয়াছেন তদনুসারে “শিখা বোডুনী তোডিলা দোরা” - মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী কিম্বা হস্তে দণ্ড গ্রহণ করিয়া ভিক্ষা মাগিতে লাগিল, অথবা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া অরণ্যে গিয়া বাস করিল, এইরূপ করিলেই যে সন্ন্যাস হয় তাহা নহে । সন্ন্যাস ও বৈরাগ্য বুদ্ধির ধর্ম; দণ্ড, শিখা বা পৈতার নহে । বুদ্ধির অর্থাৎ জ্ঞানের ধর্ম নহে, দণ্ড আদিরই ধর্ম যদি বলো, তবে যে ব্যক্তি রাজচ্ছত্র কিংবা ছত্ৰদণ্ড হস্তে ধারণ করে তাহাদেরও সন্ন্যাসীর মোক্ষলাভ করিতে হয়; জনক-সুলভ-সংবাদে এইরূপই উক্ত হইয়াছে -
ত্ৰিদণ্ডাদিষু যদ্যস্তি মোক্ষো জ্ঞানে ন কস্যচিৎ ৷
ছত্রাদিষু কথং ন স্যাৎ তুল্যহেতৌ পরিগ্ৰহে ॥ [শাং|৩২০|২]
কারণ, হস্তে দণ্ডপরিগ্রহে এই মোক্ষের হেতু উভয় স্থানে একই । তাৎপৰ্য, - কায়িক, বাচিক ও মানসিক সংযমই প্রকৃত ত্রিদণ্ড [মনু|১২|২০]; এবং কাম্যবুদ্ধির সন্ন্যাসই প্ৰকৃত সন্ন্যাস [গী|১৮|২]; এবং ভাগবতধর্মে উহা হইতে যেরূপ নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না [গী|৬|২] সেইরূপই বুদ্ধি স্থির রাখিবার কর্ম কিংবা ভোজনাদি কর্ম হইতেও সাংখ্য মার্গে শেষ পৰ্যন্ত নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না । আবার ত্ৰিদণ্ডী কিংবা কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস কর্মযোগমার্গে নাই বলিয়া ঐ মার্গ স্মৃতিবিরুদ্ধ কিংবা ত্যাজ্য, এইরূপ বৃথা সন্দেহ করিয়া গেরুয়া বস্ত্র কিংবা সাদা বস্ত্রের জন্য ঝগড়া করিতে বসায় লাভ কি ?

ভগবান্‌ খুব নিরভিমান বুদ্ধিতে ইহাই বলিয়াছেন –
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ৷
সাংখ্য ও (কর্ম) যোগ মোক্ষদৃষ্টিতে দুই নহে, একই, ইহা যিনি জানিয়াছেন তিনিই পণ্ডিত [গী|৫|৫] । এবং মহাভারতেও, একান্তিক অর্থাৎ ভাগবত ধর্ম সাংখ্যধর্মের সমানই, “সাংখ্যযোগেন তুল্যে হি ধর্ম একান্ত-সেবিতঃ” [শাং|৩৪৮|৭৪] - এইরূপ উক্ত হইয়াছে । মোদ্দা কথা, পরার্থে সমস্ত স্বার্থের লয় করিয়া, আপনি আপনি যোগ্যতানুরূপ ব্যবহারে প্রাপ্ত সমস্ত কর্মই সর্বভূতহিতার্থ আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিতে থাকাই প্রকৃত বৈরাগ্য কিংবা ‘নিত্য সন্ন্যাস’ [৫|৩]; এই কারণেই কর্মযোগমার্গে স্বরূপতঃ কর্মের সন্ন্যাস করিয়া কখনই ভিক্ষা মাগে না । কিন্তু বাহ্যাচরণ দ্বারা দেখিলে এইরূপ ভেদ প্রতীয়মান হইলেও সন্ন্যাস ও ত্যাগের প্রকৃত তত্ত্ব কর্মযোগমার্গেও বজায় থাকে । তাই, স্মৃতিগ্রন্থের আশ্রম ব্যবস্থা ও নিষ্কাম কর্মযোগের মধ্যে বিরোধ নাই, ইহাই গীতার শেষ সিদ্ধান্ত । 


30) মনুস্মৃতির বৈদিক কর্মযোগের এবং ভাগবতধর্মের প্রাচীনতা



উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনা হইতে কাহারও কাহারও এইরূপ ধারণা হইতে পারে যে, সন্ন্যাসধর্মের সহিত কর্মযোগের সমন্বয় করিবার জন্য গীতার মধ্যে যে এতটা ধস্তাধস্তি করা হইয়াছে, স্মার্ত কিংবা সন্ন্যাসধর্ম প্রাচীন হওয়া এবং কর্মযোগমার্গ তাহার পরে নিঃসৃত হওয়াই তাহার কারণ । কিন্তু ইতিহাসদৃষ্টিতে বিচার করিলে সকলেরই উপলব্ধি হইবে যে, প্ৰকৃত অবস্থা তাহা নহে । বৈদিক ধর্মের অত্যন্ত প্ৰাচীন স্বরূপ কর্মকাণ্ডাত্মকই ছিল, তাহা পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি । পরে ঔপনিষদিক জ্ঞানের দ্বারা কর্মকাণ্ডের গৌণতা প্ৰচলিত হইতে থাকে এবং কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস আস্তে আস্তে প্রচারিত হইতে আরম্ভ হয় । বৈদিক ধর্মবৃক্ষের বৃদ্ধির কিন্তু এই দ্বিতীয় সোপান । কিন্তু এই সময়েও ঔপনিষদিক জ্ঞানের কর্মকাণ্ডের সহিত মিল করিয়া জনকাদি জ্ঞানীপুরুষ আপন কর্ম আমরণ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিয়া আসিয়াছেন । সুতরাং বলিতে হয় যে, বৈদিক ধর্মবৃক্ষের এই দ্বিতীয় সোপান দুই প্রকার ছিল – এক জনকাদির, এবং দ্বিতীয়টী যাজ্ঞবল্ক্যাদির । স্মার্ত আশ্রম-ব্যবস্থা ইহার পরবরতী কিংবা তৃতীয় সোপান । কিন্তু দ্বিতীয় সোপানের ন্যায় তৃতীয়টিরও দুই ভেদ আছে । স্মৃতিগ্রন্থে কর্মত্যাগরূপ চতুর্থাশ্রমের মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে সত্য; কিন্তু তাহারই সঙ্গে জনকাদির জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগেরও - সন্ন্যাসাশ্রমের বিকল্প সুত্ৰে - স্মৃতিকারেরা বর্ণনা করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থে মূলীভূত মনুস্মৃতিই ধর না কেন । ঐই স্মৃতির ষষ্ঠ অধ্যায়ে মনুষ্য ব্ৰহ্মচৰ্য, গাৰ্হস্থ্য ও বানপ্ৰস্থ আশ্রম সমূহে উঠিতে উঠিতে, শেষে কর্মত্যাগরূপ চতুর্থ আশ্রম গ্ৰহণ করিবে এইরূপ উক্ত হইয়াছে । কিন্তু সন্ন্যাসাশ্রম অর্থাৎ যতিধর্মের নিরূপণ শেষ করিবার পর “যতিদিগের অর্থাৎ সন্ন্যাসীদিগের এই ধর্ম বলিলাম, এক্ষণে বেদসন্ন্যাসিকদিগের কর্মযোগ বলিতেছি” এইরূপ প্রস্তাবনা করিয়া এবং গৃহস্থাশ্রম অন্য আশ্রম হইতে কেন শ্রেষ্ঠ তাহা বলিয়া, মনু সন্ন্যাসাশ্রম কিংবা যতিধর্মকে বৈকল্পিক মানিয়া নিষ্কাম গাৰ্হস্থ্যবৃত্তির কর্মযোগ বৰ্ণনা করিয়াছেন, [মনু|৬|৮৬-৯৬]; এবং পরে দ্বাদশ অধ্যায়ে তাহারই “বৈদিক কর্মযোগ” নাম দিয়া, এই মাৰ্গও চতুর্থাশ্রমেরই ন্যায় নিঃশ্রেয়ষ্কর অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰদ এইরূপ বলিয়াছেন [মনু|১২|৮৬-৯০] । মনুর এই সিদ্ধান্ত যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে । এই স্মৃতির তৃতীয় অধ্যায়ে যতিধর্মের নিরূপণ শেষ হইলে পর, ‘অথবা’ পদ প্রয়োগ করিয়া লিখিত হইয়াছে যে, পরে জ্ঞাননিষ্ঠ ও সত্যবাদী গৃহস্থও (সন্ন্যাস গ্রহণ না করিয়া) মুক্তি লাভ করে [যাজ্ঞ|৩|২০৪ ও ২০৫] । সেইরূপ, যাষ্কও স্বীয় নিরুক্তে লিখিয়াছেন যে, কর্মত্যাগী তপস্বী ও জ্ঞানযুক্ত কর্মকারী কর্মযোগী একই দেবযান গতি প্ৰাপ্ত হন [নি|১৪|৯] । এতদ্‌ব্যতীত এই বিষয়ে অন্য প্রমাণ ধর্মসূত্ৰকারদিগের । এই ধর্মসূত্র গদ্যাত্মক হওয়ায় শ্লোকে লিখিত স্মৃতিগ্রন্থের পূর্ববৰ্ত্তী হইবে, এইরূপ বিদ্বানদিগের মত । এই মত ঠিক কি ভুল, তাহা এক্ষণে আমাদের দ্রষ্টব্য নহে । তাহা ঠিক্ই হউক বা ভুলই হউক, এই প্রসঙ্গের মুখ্য বিষয় এই যে, উপরে প্রদত্ত মনুযাজ্ঞবল্ক্যাদি স্মৃতির বচন প্ৰদৰ্শিত গৃহাস্থাশ্রমের কিংবা কর্মযোগের মহত্ত্ব অপেক্ষাও ধর্মসূত্রে অধিক মহত্ত্ব বর্ণিত হইয়াছে । মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য কর্মযোগকে চতুর্থাশ্রমের বিকল্প বলিয়াছেন । কিন্তু বৌধায়ন ও আপস্তম্ব সেরূপ না বলিয়া গৃহস্থাশ্ৰমই মুখ্য ও তাহার দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ হয় এইরূপ স্পষ্ট বিধান করিয়াছেন । বৌধায়ন ধর্মসূত্রে “জায়মানো বৈ ব্ৰাহ্মণস্ত্রিভিঋর্ণবা জায়াতে” প্ৰত্যেক ব্ৰাহ্মণ জন্মতই তিন ঋণ আপন পৃষ্ঠে গ্ৰহণ করিয়াছে - ইত্যাদি তৈত্তিরীয় সংহিতার বচন প্রথমে দিয়া তাহার পর এই সকল ঋণ শোধ করিবার জন্য যাগযজ্ঞাদিপূর্বক গৃহস্থাশ্রমের আশ্রয়কারী মনুষ্য ব্ৰহ্মলোকে উপনীত হয়, এবং ব্ৰহ্মচৰ্য কিংবা সন্ন্যাসের যাহারা প্ৰশংসা করে সেই সব ইতর লোক ধূলিতে মিলিত হয়, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [বৌ|২|৬|১১|৩৩ ও ৩৪]; এবং আপস্তম্বসূত্রেও ঐরূপ বিধানই আছে [আপ|২|৯|২৪|৫] । এই দুই ধর্মসূত্রে সন্ন্যাসাশ্রম বর্ণিত হয় নাই - এরূপ নহে; কিন্তু উহার বর্ণন করিয়াও গৃহস্থাশ্রমেরই মহত্ব অধিক স্বীকৃত হইয়াছে । ইহা হইতে, এবং বিশেষত মনুস্মৃতিতে কর্মযোগকে ‘বৈদিক’ বিশেষণে বিশিষ্ট করাতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, মনুস্মৃতির সময়েও কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস আশ্রম অপেক্ষা, নিষ্কাম কর্মযোগরূপ গৃহস্থাশ্ৰম প্রাচীন বলিয়া ধারণা ছিল এবং মোক্ষদৃষ্টিতে তাহার যোগ্যতা চতুর্থাশ্রমেরই ন্যায় পরিগণিত হইত । গীতার টীকাকারদিগের ঝোঁক সন্ন্যাস কিংবা কর্মত্যাগযুক্ত ভক্তির উপরেই থাকা প্ৰযুক্ত তাঁহাদের টীকায় উপরোক্ত স্মৃতিবচনসমূহের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না । কিন্তু তাঁহারা ইহার প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিলেও কর্মযোগের প্রাচীনত্ব তাহাতে কমে না । কর্মযোগমার্গ এইরূপ প্ৰাচীন হওয়াতেই উহাকে যতিধর্মের বিকল্প বলিয়া স্মৃতিকারদিগের মানিতে হইয়াছে, এইরূপ বলিতে বাধা নাই । ইহা হইল বৈদিক কর্মযোগের কথা ৷ শ্ৰীকৃষ্ণের পূর্বে জনকাদি এই পন্থা অনুসারেই আচরণ করিতেন । কিন্তু পরে ভগবান তাহাতে ভক্তিকেও মিলাইয়া দিয়া তাহার প্রচার অধিক বিস্তৃত করায় তাহাই ‘ভাগবতধর্ম’ নাম পাইয়াছে । ভগবদ্‌গীতা এই প্ৰকারে সন্ন্যাসাপেক্ষাও কর্মযোগকে অধিক মান্য বলিয়া স্থির করিলেও তা হাতে পরে গৌণত্ব আসিয়া সন্ন্যাসমার্গেরই প্ৰাধান্য কেন হইল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ইহার বিচার পরে করা যাইবে । কর্মযোগ স্মার্তমার্গের পরবর্তী নহে, পুরাতন বৈদিক কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, ইহাই এখানে বক্তব্য ।


31) গীতার অধ্যায়সমাপ্তিসূচক সঙ্কল্পের অর্থ



ভগবদ্‌গীতার প্রতি অধ্যায়ের শেষে “ইতি শ্ৰীমদ্ভগবদগীতাসু উপনিষৎস, ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই যে সঙ্কল্প থাকে, তাহার মর্ম এক্ষণে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । এই সঙ্কল্পের অর্থ এই যে, ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদে অন্য উপনিষদের ন্যায় ব্রহ্মবিদ্যা ত আছেই, কিন্তু শুধু ব্ৰহ্মবিদ্যাই নহে; প্রত্যুত ব্ৰহ্মবিদ্যার মধ্যে ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ (বেদান্তী সন্ন্যাসী ও বেদান্তী কর্ম-যোগী) এই যে দুই পন্থা উৎপন্ন হয় তন্মধ্যে যোগের অর্থাৎ কর্মযোগের প্ৰতিপাদনই ভগবদ্‌গীতার মুখ্য বিষয় । অধিক-কি, ভগবদ্‌গীতোপনিষৎই কর্মযোগের মুখ্য গ্ৰন্থ, ইহা বলিতেও কোনই বাধা নাই । কারণ, কর্মযোগ বৈদিক কাল হইতেই চলিয়া আসিলেও “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি” [ঈশ|২], কিংবা “আরভ্য কর্মাণি গুণান্বিতানি” [শ্বে|৬|৪], অথবা “বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধ্যায় আদি কর্ম করিবে” [তৈ|১|৯], এই প্রকার কতকগুলি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ব্যতীত উপনিষদে এই কর্মযোগের সবিস্তর বিচার কোথাও করা হয় নাই । এ বিষয়ে ভগবদ্‌গীতাই মুখ্য ও প্রামাণিক গ্ৰন্থ; এবং কাব্যদৃষ্টিতেও ইহাই সঙ্গত মনে হয় যে, ভারতভূমির কর্তৃপুরুষদিগের চরিত্র যে মহাভারতে বর্ণিত হইয়াছে তাহাতেই অধ্যাত্মশাস্ত্ৰকে ধরিয়া কর্মযোগেরও উপপত্তি ব্যাখ্যাত হইবে । 


32) গীতার অপূর্বতা এবং প্রস্থানত্রয়ীর তিন ভাগের সার্থকতা



প্ৰস্থানত্রয়ের মধ্যে ভগবদ্‌গীতার সমাবেশ কেন করা হইয়াছে তাহারও উপপত্তি এক্ষণে ঠিক বুঝা যাইতেছে । উপনিষদ মুলীভুত হইলেও উহা বহু ঋষি কর্তৃক কথিত হওয়ায় উহার বিচার সংকীর্ণ ও কোন কোন স্থানে পরস্পরবিরুদ্ধ বলিয়া প্ৰতীয়মান হয় । তাই, উপনিষদের সঙ্গে সঙ্গেই উহাদের সমন্বয়কারী বেদান্তসূত্রেরও প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে গণনা করা অবশ্যক ছিল । কিন্তু উপনিষদ ও বেদান্তসূত্র এই দুয়ের অপেক্ষা গীতায় বেশী কিছু না থাকিলে, প্ৰস্থানত্রয়ের মধ্যে গীতাকে ধরিবার কোনই কারণ ছিল না । কিন্তু উপনিষদেয়র টান প্রায়ই সন্ন্যাসমার্গের দিকে, এবং তাহাতে বিশেষ করিয়া জ্ঞানমাৰ্গই প্রতিপাদিত হইয়াছে; এবং ভগবদ্গীতায় এই জ্ঞানকে ধরিয়া ভক্তিযুক্ত কর্মযোগের সমর্থন আছে, - বস্‌, এইটুকু বলিলে, গীতাগ্রন্থের অপূর্বত সিদ্ধ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্ৰস্থানত্রয়ের তিন ভাগের সার্থকতাও পরিব্যক্ত হয় । কারণ বৈদিক ধর্মের প্রামাণিক গ্রন্থে জ্ঞান ও কর্ম (সাংখ্য ও যোগ) এই দুই বৈদিক মার্গের বিচার না থাকিলে প্ৰস্থানত্রয় ততটা অপূর্ণই রহিয়া যাইত । কাহার কাহার এইরূপ ধারণা আছে যে, উপনিষদ যখন সাধারণতঃ নিবৃত্তিমূলক, তখন গীতার প্রবৃত্তিমূলক অর্থ ধরিলে প্ৰস্থানত্রয়ের তিন ভাগের মধ্যে বিরোধ উৎপন্ন হইয়া তাহাদের প্রামাণ্যও কমিয়া যাইবে । সাংখ্য অর্থাৎ সন্ন্যাসই যদি একমাত্র বৈদিক মোক্ষমার্গ হয় তবেই এই সন্দেহ ঠিক্‌ হইবে । কিন্তু উপরে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে যে, নিদানপক্ষে ঈশাবাস্যাদি কোন কোন উপনিষদে কর্মযোগের স্পষ্ট উল্লেখ আছে । তাই, বৈদিক ধর্মপুরুষকে কেবল এক-হস্তবিশিষ্ট অর্থাৎ সন্ন্যাসপ্রধান না বুঝিয়া, তাহার ব্রহ্মবিদ্যারূপ একই মস্তক এবং মোক্ষদৃষ্টিতে তুল্যবল সাংখ্য ও কর্মযোগ তাহার দক্ষিণ ও বাম দুই হস্ত, এইরূপ গীতার ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলে, উপনিষদ ও গীতার মধ্যে কোনই বিরোধ থাকে না । উপনিষদে এক মার্গের এবং গীতায় অন্য মার্গের সমর্থন আছে; তাই প্ৰস্থানত্রয়ীর এই দুই ভাগও দুই হস্তের ন্যায়  পরস্পরবিরুদ্ধ না হইয়া সাহায্যকারী বলিয়াই উপলব্ধি হইবে । এইরূপই গীতায় কেবল উপনিষদই প্রতিপাদিত হইয়াছে মানিলে, চর্বিতচর্বণের যে ব্যর্থতা গীতায় প্রযুক্ত হইত, তাহাও হয় না । 


33) সন্ন্যাস (সাংখ্য) এবং কর্মযোগ (যোগ), উভয় মার্গের ভেদ-অভেদের নক্সার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা



যাক্‌ । গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা এই বিষয় উপেক্ষা করায় সাংখ্য ও যোগ এই দুই স্বতন্ত্র মার্গের প্রবর্তক স্ব স্ব গ্রন্থের সমর্থনার্থ যে সকল মুখ্য কারণ বলেন, তাহাদের সাম্য ও বৈষম্য শীঘ্ৰ নজরে পড়িবে বলিয়া, নিম্নলিখিত যুগল তালিকায় উক্ত কারণসকল পরস্পরের পাশাপাশি সংক্ষেপে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে । স্মৃতিগ্রন্থে প্রতিপাদিত স্মার্ত আশ্ৰমব্যবস্থা ও মূল ভাগবত ধর্মের মুখ্য প্রভেদগুলি কি তাহাও উহা হইতে দৃষ্ট হইবে -
ব্ৰহ্মবিদ্যা কিংবা আত্মজ্ঞান লাভ হইলে পর ।

ক্রঃসংকর্মসন্ন্যাস (সাংখ্য)কর্মযোগ (যোগ)
মোক্ষ আত্মজ্ঞানের দ্বারাই লাভ হয়, কর্মের দ্বারা নহে । জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা যে স্বৰ্গসুখ লাভ হয় তাহা অনিত্য ।আত্মজ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষ লাভ হয়, কর্মের দ্বারা নহে । জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা যে স্বৰ্গসুখ লাভ হয় তাহা অনিত্য ।
আত্মজ্ঞান পাইতে হইলে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির, নিষ্কাম, বিরক্ত ও সম করা চাই ।আত্মজ্ঞান পাইতে হইলে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির, নিষ্কাম, বিরক্ত ও সম করা আবশ্যক ।
তাই, ইন্দ্রিয়ের বিষয়পাশ হইতে মুক্ত (স্বতন্ত্র) হও ।তাই, ইন্দ্ৰিয়ের বিষয় ত্যাগ না করিয়া, তাহাতেই বৈরাগ্য অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্ম করিয়া, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ কষ্টিপাথর প্রয়োগ কর । নিষ্কামের অর্থ নিষ্ক্রিয় নহে ।
তৃষ্ণামূলক কর্ম দুঃখময় ও বন্ধনস্বরূপ ।দুঃখ ও বন্ধন কেন হয় ইহার ঠিক বিচার করিলে এরূপ দেখা যাইবে যে, অচেতন কর্ম কাহাকেও বন্ধন করে না, কিংবা ছাড়ে না, তাহার প্ৰতি কর্তার মনে যে কামনা কিংবা ফলাশা হয় তাহাই বন্ধন ও দুঃখের মূল ।
তাই, চিত্তশুদ্ধি হওয়া পৰ্যন্ত, কর্ম করিলেও শেষে ত্যাগ করিতে হইবে ।তাই চিত্তশুদ্ধি হইবার পরেও, ফলাশা ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম ধৈৰ্য ও উৎসাহের সহিত কর । কর্ম ছাড়িব বলিলেও কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না । সৃষ্টির অর্থই কর্ম, তাহার বিরাম নাই ।
যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম, বন্ধন না হওয়ায় গৃহস্থাশ্রমে উহা করিতে বাধা নাই ।নিষ্কামবুদ্ধিতে কিংবা ব্ৰহ্মার্পণবিধির দ্বারা অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মই এক বৃহৎ ‘যজ্ঞ’ । ইহার জন্য স্বধর্মবিহিত সমস্ত কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া সর্বদা করিতে হইবে ।
দেহের ধর্ম দেহ ছাড়ে না বলিয়া সন্ন্যাস গ্রহণের পর উদরের জন্য ভিক্ষা করা অসঙ্গত নহে ।উদরের জন্য ভিক্ষা করাও কর্ম এবং তাহা ‘লজ্জাজনক’ । এই সব কর্ম যদি করিতেই হয় তবে অন্য কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে কেন না করিবে ? তাছাড়া, গৃহস্থাশ্রমী ব্যতীত ভিক্ষা আর কে দিবে ?
জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর নিজের কর্তব্য অবশিষ্ট থাকে না এবং লোকসংগ্রহ করিবারও আবশ্যকতা নাই ।জ্ঞানলাভের পর, আপনার জন্য কিছু অর্জন করিবার না থাকিলেও, কর্ম ছাড়ে না । এই জন্য যাহা কিছু শাস্ত্রতঃ প্ৰাপ্ত হইবে, তাহা ‘আমার নহে’ ? এইরূপ নির্মমবুদ্ধিতে লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া করিয়া যাও । লোকসংগ্রহ কাহাকেও ছাড়ে না । উদাহরণ যথা - ভগবানের চরিত্র দেখ ।
কিন্তু ব্যতিক্রমস্থলরূপে অধিকারী কোন পুরুষের জ্ঞানলাভের পরেও নিজের ব্যবহারিক অধিকার জনকাদির ন্যায় আমরণ বজায় রাখিতে বাধা নাই ।গুণবিভাগরূপ চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থানুসারে ছোট-বড় অধিকার সকলেই জন্মত প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । স্ব-ধর্মানুসারে প্রাপ্ত এই অধিকার, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সকলকেই অনাসক্তবুদ্ধিতে আমরণ অব্যতিক্রমে চালাইতে হইবে । কারণ, এই চক্র জগতের ধারণার্থ পরমেশ্বরই সৃষ্টি করিয়াছেন ।
১০কিন্তু যাহাই কর না কেন, কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসই শ্ৰেষ্ঠ । অন্য অন্য আশ্রমের কর্ম চিত্তশুদ্ধির সাধনমাত্র কিংবা পূর্বায়োজন, জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে তো স্বভাবতই বিরোধ আছে । তাই পূর্বাশ্রমে যত শীঘ্ৰ পারা যায় চিত্তশুদ্ধি সম্পাদন করিয়া শেষে কর্মত্যাগ রূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে । চিত্তশুদ্ধি জন্মতই কিংবা পূর্ববয়সে হইয়া থাকিলে, গৃহস্থাশ্রমের কর্ম করা অবশ্যক নহে । স্বরূপতঃ কর্মত্যাগ করাই প্রকৃত সন্ন্যাসাশ্রম ।সাংসারিক কর্ম শাস্ত্রোক্ত রীতিতে করিলে চিত্তশুদ্ধি হয় সত্য । কিন্তু চিত্তশুদ্ধিই কর্মের একমাত্ৰ উপযোগ নহে । জাগতিক কর্ম চালাইবার জন্যও কর্ম আবশ্যক । সেইরূপ আবার, কাম্য কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে বিরোধ থাকিলেও নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যেয়াদৌ বিরোধ নাই । তাই, চিত্তশুদ্ধির পরেও ফলাশা ত্যাগ করিয়া চাতুৰ্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে জগতের সংগ্ৰহাৰ্থ করিতে থাকো । ইহাই প্ৰকৃত সন্ন্যাস । স্বরূপতঃ কর্ম ত্যাগ করা কখনও উচিত নহে, আর সাধ্যাত্তও নহে ।
১১কর্মসন্ন্যাস গ্রহণের পরও শমদমাদি ধর্ম পালন করিতে হইবে ।জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর, ফলাশা ত্যাগরপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া শমদমাদি ধর্ম ব্যতীত আত্মৌপম্যদৃষ্টিতে প্রাপ্ত সমস্ত ধর্ম পালন কর; এবং এই শমের দ্বারা অর্থাৎ শান্তবুদ্ধি হইতেই শাস্ত্ৰতঃ-প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম লোক-সংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ করিয়া যাও । নিষ্কাম কর্ম ছাড়িও না ।
১২এই মার্গ অনাদি ও শ্রুতি-স্মৃতি-প্ৰতিপাদিত ।এই ধর্ম অনাদি ও শ্রুতি-স্মৃতি-প্ৰতিপাদিত ।
১৩শুক-যাজ্ঞবল্ক্যাদি এই মার্গ অনুসরণ করিয়াছেন ।ব্যাস-বসিষ্ঠজৈগীষব্যাদি এবং জনক-শ্ৰীকৃষ্ণাদি এই মার্গ অনুসরণ করিয়াছেন ।
শেষে মোক্ষ ।

এই দুই মার্গ কিংবা নিষ্ঠা ব্রহ্মবিদ্যামূলক; দুয়েরই প্ৰতি মনের নিষ্কাম অবস্থা ও শান্তি একই প্রকার হওয়া প্ৰযুক্ত, দুই মার্গের দ্বারাই শেষে একই মোক্ষ লাভ হইয়া থাকে [গী|৫|৫] । জ্ঞানলাভের পর কর্মত্যাগ এবং কাম্যকর্ম ছাড়িয়া নিষ্কাম কর্ম নিত্য করিতে থাকা, এই দুইয়ের মধ্যে ইহাই মুখ্য ভেদ ।


34) জীবনযাপনের বিভিন্ন মার্গ



কর্ম ত্যাগ করা ও কর্ম করা, উপরি-উক্ত দুই মার্গ জ্ঞানমূলক অর্থাৎ জ্ঞানলাভের পর জ্ঞানীপুরুষ কর্তৃক স্বীকৃত ও আচরিত হয় । কিন্তু কর্ম ত্যাগ করা ও কর্ম করা এই দুই বিষয় জ্ঞান না হইলেও হইতে পারে । তাই অজ্ঞানমূলক কর্মের এবং কর্মত্যাগেরও এখানে কিছু বিচার করা আবশ্যক । গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে ত্যাগের যে তিন প্রকার ভেদ বলা হইয়াছে ইহাই তাহার বীজ । জ্ঞান না হইলেও কোন কোন লোক কেবল কায়ক্লেশভয়ে কর্ম ত্যাগ করিয়া থাকে । ইহাকে গীতায় রাজসিক ত্যাগ বলা হইয়াছে [গী|১৮|৮] । সেইরূপ আবার, জ্ঞান না হইলেও শুধু শ্ৰদ্ধার সহিত কতকগুলি লোক যাগযজ্ঞাদি কর্ম করিয়া থাকে । কিন্তু কর্ম করিবার, এই মার্গ মোক্ষপ্রদ নহে, শুধু স্বর্গপ্রদ এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে [গী|৯|২০] । যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতধর্ম অধুনা প্রচলিত না থাকায়, মীমাংসকদিগের এই নিছক কর্মমাৰ্গসম্মন্ধে গীতার সিদ্ধান্ত এক্ষণে তেমন উপযোগী নহে, এইরূপ কাহারো কাহারো ধারণা । কিন্তু তাহা ঠিক নহে । কারণ, শ্রৌত যাগযজ্ঞ লুপ্ত হইলেও স্মার্ত যজ্ঞ অর্থাৎ চাতুৰ্বর্ণের কর্ম অদ্যাপি চলিতেছে । তাই, অজ্ঞানবশতঃ কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত যাগযজ্ঞাদি কাম্যকর্ম যাহারা করে তাহাদের সম্বন্ধে গীতার যে সিদ্ধান্ত, তাহা জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত চাতুৰ্বর্ণের কর্মকর্তাদিগেরও সম্বন্ধে বর্তমান অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে খাটে । জগতের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি করিলে জানা যাইবে যে সমাজে এই প্রকার শাস্ত্রের উপর শ্রদ্ধা রাখিয়া যাহারা নিয়মপূর্বক নিজ নিজ কর্ম করে তাহাদেরই বিশেষ আদর হইয়া থাকে, কিন্তু তাহারা পরমেশ্বরের স্বরূপ পূর্ণরূপে অবগত নহে । তাই, গণিতশাস্ত্রের সম্পূর্ণ উপপত্তি না বুঝিয়া কেবল মুখের হিসাবের উপর যাহারা গণনা করে তাহাদের ন্যায় এই শ্রদ্ধালু ও কর্মঠ লোকদিগের অবস্থা । সমস্তু কর্ম  শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে ও শ্রদ্ধাসহকারে অনুষ্ঠান করা হেতু তাহা নির্ভুল (শুদ্ধ) হইয়া পুণ্যপ্ৰদ অৰ্থাৎ স্বৰ্গপ্রদ হয় ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হওয়ায়, স্বর্গলাভ অপেক্ষা মহত্তর ফললাভ এই কর্মঠ লোকদিগের সাধ্যায়ত্ত নহে । এইজন্য স্বৰ্গসুখেরও অতীত অমৃতত্ব যিনি অর্জন করিবেন — এবং ইহাই এক পরম পুরুষাৰ্থ - তাঁহার উহাকে প্ৰথম সাধন বলিয়া এবং পরে সিদ্ধাবস্থায় লোকসংগ্ৰহাৰ্থ অর্থাৎ আমরণ “সর্বভুতে একই আত্মা” এই জ্ঞানযুক্ত বুদ্ধিতে নিষ্কাম কর্ম করিবার মাৰ্গকেই স্বীকার করিতে হইবে । জীবনের সমস্ত মাৰ্গ অপেক্ষা এই মাৰ্গ উত্তম । গীতাকে অনুসরণ করিয়া উপরি-উক্ত তালিকায় এই মাৰ্গকে কর্মযোগ বলা হইয়াছে; এবং ইহাকেই কেহ কেহ কর্মমার্গ কিংবা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গও বলেন । কিন্তু কর্মমার্গ বা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ, এই দুই শব্দের দ্বারা জ্ঞানবিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত কর্ম করিবার স্বৰ্গপ্রদ মাৰ্গই সাধারণত বুঝায় - এই এক দোষ । তাই জ্ঞানবিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধাযুক্ত কর্ম এবং জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম এই দুয়ের ভেদ দেখাইবার জন্য দুই ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা আবশ্যক হয় । এবং এই কারণেই মনুস্মৃতিতে এবং ভাগবতেও প্ৰথম প্রকারের অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মকে ‘প্রবৃত্ত কর্ম’ এবং দ্বিতীয় প্রকারের অর্থাৎ জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্মকে ‘নিবৃত্ত কর্ম’ নাম দেওয়া হইয়াছে [মনু|১২|৮৯; ভাগ|৭১৫|৪৭] । কিন্তু এই দুই শব্দও আমার মতে যতটা হওয়া উচিত ততটা নিঃসন্দিগ্ধ নহে । কারণ, ‘কর্ম হইতে পরাবৃত্ত হওয়া’, ‘নিবৃত্তি’ শব্দের সাধারণ অর্থ । এই সন্দেহ দূর করিবার জন্য ‘নিবৃত্ত’ শব্দের পরে ‘কর্ম’ এই বিশেষণ যুক্ত হইয়াছে; এবং এইরূপ করায়, ‘নিবৃত্ত’ এই বিশেষণের অর্থ ‘কর্ম হইতে পরাবৃত্ত’ না হইয়া নিবৃত্ত কর্ম = নিষ্কাম কর্ম, এই অর্থ নিষ্পন্ন হয় । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ‘নিবৃত্ত’ এই শব্দ যে পৰ্যন্ত উহাতে আছে সে পৰ্যন্ত কর্মত্যাগের কল্পনা মনে না আসিয়া ক্ষান্ত হয় না । এইজন্য জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম করিবার মাৰ্গকে ‘নিবৃত্তি কিংবা নিবৃত্ত কর্ম’ না বলিয়া কর্মযোগ নাম দেওয়া আমার মতে উত্তম । কারণ, কর্মের পরে যোগ শব্দ যুক্ত থাকিলে স্বভাবতই তাহার ‘মোক্ষের অন্তরায় না হইয়া কর্ম করিবার কৌশল’ এই অৰ্থ হয়; এবং অজ্ঞানযুক্ত কর্মের নিরাসও আপনা-আপনি হয় । তথাপি ইহা বিস্মৃত হইবে না যে, গীতার কর্মযোগ জ্ঞানমূলক এবং ইহাকেই কর্মমার্গ কিংবা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বলা কেহ যদি ইষ্ট মনে করেন তাহাতে বাধা নাই । কোন কোন স্থলে আমিও ভাষাবৈচিত্রের জন্য এই শব্দ গীতার কর্মযোগের বর্ণনায় প্রয়োগ করিয়াছি । যাক্‌ । কর্ম করা কিংবা কর্ম ত্যাগ করা, ইহাদের এইরূপ জ্ঞানমূলক ও অজ্ঞানমূলক যে ভেদ আছে, তন্মধ্যে প্রত্যেকের সম্বন্ধে গীতাশাস্ত্রের অভিপ্ৰায় এইরূপ -

ক্রঃসংজীবনের মার্গশ্ৰেণীগতি
কামোপভোগকেই পুরুষাৰ্থ মনে করিয়া অহঙ্কারবশতঃ আসুরী বুদ্ধিতে, দম্ভ কিংবা লোভবশে কেবল আত্মসুখের জন্য কর্ম করা, [গী|১৬|১৬] - আসুর কিংবা রাক্ষস মার্গ ।অধমনরক
সর্বভুতে এক আত্মা এইরূপ, পরমেশ্বরস্বরূপের যথার্থ জ্ঞান না হইলেও বেদাজ্ঞাকে কিংবা শাস্ত্ৰাজ্ঞাকে অনুসরণ করিয়া শ্ৰদ্ধার সহিত ও নীতি অনুসারে নিজ নিজ কাম্য কর্ম করা [গী|২|৪১, ৪৪ ও ৯-২০] – কেবল কর্ম, ত্রয়ী ধর্ম, কিংবা মীমাংসক মার্গ ।মধ্যম (মীমাংসকমতে উত্তম)স্বর্গ (মীমাংসকমতে মোক্ষ)
শাস্ত্রোক্ত নিষ্কাম কর্মের দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে, শেষে বৈরাগ্যের দ্বারা সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া কেবল জ্ঞানেই তৃপ্ত হইয়া থাকা [গী|৫|২] – কেবল জ্ঞান, সাংখ্য কিংবা স্মার্ত্ত মাৰ্গ ।উত্তমমোক্ষ
প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য এবং তাহার দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান লাভ করিয়া পরে কেবল লোকসংগ্ৰহার্থ আমরণ ভগবানের ন্যায় নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকা [গী|৪|২] – জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়, কর্মযোগ কিংবা ভাগবত মার্গ ।সৰ্ব্বোত্তমমোক্ষ

(জনকবর্ণিত তিন নিষ্ঠা - ২, ৩ ও ৪; গীতার দুই নিষ্ঠা - ৩ ও ৪)


35) গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, এই সকলের মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ



সার-কথা, - মোক্ষলাভের জন্য কর্মের আবশ্যকতা না থাকিলেও উহার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য কারণে - এক তো অপরিহার্য বলিয়া এবং তাছাড়া জগতের ধারণপোষণার্থ আৰশ্যক বলিয়া - নিষ্কাম বুদ্ধিতে সর্বদাই সমস্ত কর্ম করিতে থাকা - ইহাই গীতায় সর্বোত্তম বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে । অথবা “কৃতবুদ্ধিষু কর্তারঃ কর্তৃষু ব্ৰহ্মবাদিনঃ” [মনু|১|৯৭] এই মনুবচনানুসারে কর্তৃত্ব ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের সংযোগই সর্বাপেক্ষা উত্তম, এবং শুধু কর্তৃত্ব কিংবা শুধু ব্ৰহ্মজ্ঞান ইহাদের প্রত্যেকটাই একদেশদর্শী, এইরূপ গীতার শেষ সিদ্ধান্ত ।

বাস্তবিক বলিতে গেলে, এই প্রকরণ এইখানেই শেষ হইল । কিন্তু গীতার সিদ্ধান্ত যে শ্রুতিস্মৃতিপ্রতিপাদিত তাহাই দেখাইবার জন্য উপরে স্থানে স্থানে যে সকল বচন উদ্ধৃত হইয়াছে তৎসম্বন্ধে দুই একটি কথা বলা আবশ্যক । কারণ, উপনিষদের সাম্প্রদায়িক ভাষ্য হইতে সমস্ত উপনিষদ সন্ন্যাসমূলক কিংবা নিবৃত্তিমূলক, অনেকের এইরূপ ধারণা হইয়াছে । উপনিষদে সন্ন্যাসমার্গ আদৌ নাই সে কথা আমি বলি না । বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হইয়াছে - পরব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোন বস্তু সত্য নহে এইরূপ অনুভূতি হইলে পর “কোন কোন জ্ঞানী পুরুষ পুত্ৰৈষণা, বিত্তৈষণা এবং লোকৈষণার পরোয়া না করিয়া “সন্তানসন্ততিতে আমার কি প্রয়োজন ? সংসারই আমার আত্মা’ এইরূপ বলিয়া ভিক্ষা মাগিয়া আনন্দে ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়ায়” [বৃ|৪|৪|২২] । কিন্তু সমস্ত ব্ৰহ্মজ্ঞানীকে এই পক্ষই স্বীকার করিতে হইবে এরূপ নিয়ম বৃহদারণ্যকে কোথাও প্রদত্ত হয় নাই । অধিক কি, যাহাকে এই উপদেশ দেওয়া হইয়াছে সেই জনক রাজা ব্ৰহ্মজ্ঞানের শিখরে পৌঁছিয়া অমৃত হইয়াছিলেন এইরূপ তাঁহার বর্ণনা এই উপনিষদে করা হইয়াছে । কিন্তু তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের ন্যায় জগৎ ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়াছিলেন সে কথা কোথাও বলা নাই । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, জনকের নিষ্কামকর্মমার্গ এবং যাজ্ঞবল্ক্যের কর্মসন্ন্যাসমার্গ এই দুই মার্গ সম্বন্ধে বৃহদারণ্যকের বিকল্পে সম্মতি আছে এবং বেদান্তসূত্রকারও এই অনুমানই করিয়াছেন [বেসু|৩|৪|১৫] । কঠোপনিষৎ ইহা অপেক্ষাও অগ্রসর হইয়াছেন । আমার মতে কঠোপনিষদে যে নিষ্কামকর্মযোগই প্রতিপাদ্য হইয়াছে ইহা পূর্বে পঞ্চম প্রকরণে আমি দেখাইয়াছি । ছান্দোগ্য উপনিষদে [৮|১৫|১] এই অর্থই প্ৰতিপাদ্য, এবং শেষে “গুরুর নিকট অধ্যয়ন করিয়া পরে পরিবারের মধ্যে থাকিয়া ধর্মাচরণকারী, জ্ঞানী পুরুষ ব্ৰহ্মলোক প্ৰাপ্ত হয়, পুনৰ্বার ফিরিয়া আসে না”, এইরূপ স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তৈত্তিরীয় ও শ্বেতাশ্বতর এই দুই উপনিষদের এই অর্থেরই বাক্য উপরে প্রদত্ত হইয়াছে [তৈ|১|৯ ও শ্বে|৬|৪] । তাছাড়া, ইহাও ভাবিবার বিষয় যে, উপনিষদে যাঁহারা অপরকে ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে অথবা তাঁহাদের ব্ৰহ্মজ্ঞানী শিষ্যদের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যের ন্যায় দুই-এক জন ব্যক্তি ছাড়া কাহাকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে দেখা যায় না । বরং তাঁহারা গৃহস্থাশ্রমীই ছিলেন তাঁহাদের বৰ্ণনা হইতে ইহাই দেখিতে পাওয়া যায় । তাই, সমস্ত উপনিষদই সন্ন্যাসমূলক নহে এইরূপ মানিতে হয় । কোন কোন উপনিষদে সন্ন্যাস ও কর্মযোগের বিকল্প এবং কাহারও কাহারও মধ্যে কেবল জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়ই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । 


36) এই সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্র



কিন্তু উপনিষদের সাম্প্রদায়িক ভাষ্যে এই ভেদ না দেখাইয়া, সমস্ত উপনিষদ কেবল একই অৰ্থ - বিশেষতঃ সন্ন্যাস - প্রতিপাদক এইরূপ উক্ত হইয়া থাকে । সারকথা, সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের হাতে গীতা ও উপনিষদেরও একই অবস্থা হইয়াছে; অর্থাৎ গীতার কতকগুলি শ্লোকের ন্যায় উপনিষদের কতকগুলি মন্ত্রেরও এই ভাষ্যকারেরা টানাবুনা অর্থ করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - ঈশাবাস্য উপনিষৎ ধর না কেন । এই উপনিষৎ ছোট অর্থাৎ শুধু অষ্টাদশ শ্লোকের হইলেও ইহার যোগ্যতা অন্য উপনিষদ অপেক্ষা অধিক বলিয়া সকলে বুঝিয়ে থাকে । কারণ, এই উপনিষৎ স্বয়ং বাজসনেয়ী সংহিতাতেই কথিত হইয়াছে, এবং অন্যান্য উপনিষদ আরণ্যক গ্রন্থে কথিত হইয়াছে । সংহিতা অপেক্ষা ব্ৰাহ্মণ এবং ব্ৰাহ্মণ অপেক্ষা আরণ্যক গ্ৰন্থ উত্তরোত্তর কম প্রামাণ্য, এ কথা সর্বমান্য । এই সমুদয় ঈশাবাস্যোপনিষৎ অথ হইতে ইতি পৰ্যন্ত জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক । ইহার প্রথম মন্ত্রে (শ্লোকে) “জগতে যাহা কিছু আছে তাহা ঈশাবাস্য অর্থাৎ পরমেশ্বরাধিষ্ঠিত বলিয়া বুঝিবে” এইরূপ বলিয়া দ্বিতীয় মন্ত্রে “যাবজ্জীবন শত বৎসর নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকিয়াই বাঁচিবার বাসনা মনে পোষণ করিবে” এইরূপ স্পষ্ট বিধান আছে । বেদান্তসূত্রে, কর্মযোগের বিচার করিবার সময় এবং অন্যান্য গ্রন্থেও ঈশাবাস্যের এই বচনই জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষের সমর্থক বলিয়া প্রদত্ত হইয়া থাকে । কিন্তু ঈশাবাস্যোপনিষৎ ইহাতেই পৰ্য্যাপ্ত হয় না । দ্বিতীয় মন্ত্রে উক্ত বিধানের সমর্থনার্থ পরে ‘অবিদ্যা’ (কর্ম) ও ‘বিদ্যা’ (জ্ঞান) ইহাদের বিচার আরম্ভ করিয়া, নবম মন্ত্রে “শুধু অবিদ্যা-(কর্ম) সেবক পুরুষ অন্ধকারে প্রবেশ করে এবং শুধু বিদ্যা অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞানে নিমজ্জিত পুরুষ আরও অধিক অন্ধকারে পতিত হয় ?” এইরূপ উক্ত হইয়াছে । শুধু অবিদ্যা (কর্ম) এবং শুধু বিদ্যা (জ্ঞান) ইহাদের প্ৰত্যেকের পৃথকভাবে এইরূপ ন্যূনতা দেখাইয়া, একাদশ মন্ত্রে নিম্নলিখিত অনুসারে ‘বিদ্যা’ ও ‘অবিদ্যা’ এই দুয়ের সমুচ্চায়ের অবশ্যকতা এই উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে -
বিদ্যাং, চাহবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ ৷
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াংমৃতমশ্নুতে ॥
“বিদ্যা (জ্ঞান) ও অবিদ্যা (কর্ম) উভয়কে পরস্পরের সহিত যে ব্যক্তি জানে, সে অবিদ্যার (কর্মের) দ্বারা মৃত্যু অর্থাৎ নশ্বর মায়া জগত্তের প্রপঞ্চ (উত্তমরূপে) পার হইয়া, বিদ্যার (ব্রহ্মজ্ঞানের) দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করে” । এই মন্ত্রের ইহাই স্পষ্ট ও সরল অর্থ । এবং এই অর্থই বিদ্যায় ‘সংভূতি’, অর্থাৎ জগতের আদিকারণ এবং তাহা হইতে ভিন্ন অবিদ্যায় ‘অসংভূতি’ কিংবা ‘বিনাশ’ এইরূপ অন্য নাম দিয়া ইহার পরবর্তী তিন মন্ত্রে পুনর্বার বর্ণিত হইয়াছে [ঈশ|১২-১৪] । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, সমস্ত ঈশাবাস্যোপানিষৎ বিদ্যা ও অবিদ্যার এককালীন (উভয়ং সহ) সমুচ্চয়  প্রতিপাদন করিয়াছে । উপরি-উক্ত মন্ত্রে বিদ্যা ও অবিদ্যা, এই দুই শব্দেরই ন্যায় মৃত্যু ও অমৃত এই দুই শব্দ পরস্পর-প্রতিযোগী । তন্মধ্যে অমৃত শব্দে অবিনাশী ব্ৰহ্ম অৰ্থ স্পষ্ট, এবং তদ্বিরুদ্ধ মৃত্যু শব্দে নশ্বর, মৃত্যুলোক অথবা ঐহিক সংসার এই অর্থ নিষ্পন্ন হয় । এই অর্থেই, এই দুই শব্দ ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তেও প্রদত্ত হইয়াছে [ঋ|১০|১২৯|২] । বিদ্যাদি শব্দের এই সরল অর্থ গ্ৰহণ করিয়া (অর্থাৎ বিদ্যা = জ্ঞান, অবিদ্যা = কর্ম, অমৃত = ব্ৰহ্ম এবং মৃত্যু = মৃত্যুলোক এইরূপ বুঝিয়া)  ঈশাবাস্যের উপরিপ্রদত্ত একাদশ মন্ত্রের অর্থ করিলে, প্ৰথমে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই মন্ত্রেীয় প্রথম চরণে বিদ্যা ও অবিদ্যার এককালীন সমুচ্চয় বর্ণিত হইয়াছে; ঐ বিষয়ই দৃঢ় করিবার জন্য দ্বিতীয় চরণে এই দুয়ের মধ্যে প্ৰত্যেকের ফল কি তাহা পৃথক করিয়া কথিত হইয়াছে । ঈশাবাস্য-উপনিষদের এই দুই ফল ইষ্ট এবং সেই জন্যই জ্ঞান ও কর্ম এই দুইয়েরই এককালীন সমুচ্চয় এই উপনিষদে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । মৃত্যুলোকের প্রপঞ্চ ঠিক্‌ চালানো কিংবা তাহা হইতে উত্তমরূপে পার হওয়াকেই গীতায় ‘লোকসংগ্ৰহ’ নাম প্রদত্ত হইয়াছে । মোক্ষলাভ মনুষ্যের কর্তব্য সত্য, - কিন্তু তাহারই সঙ্গে সঙ্গেই তাহার লোকসংগ্ৰহও আবশ্যক । এই হেতু জ্ঞানী পুরুষ লোকসংগ্ৰাহক কর্ম ত্যাগ করিবেক না এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত; এবং এই সিদ্ধান্তই শব্দভেদে “অবিদ্যয়া মৃত্যুৎ তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই উপরি-উক্ত মন্ত্রে প্রদত্ত হইয়াছে । সারকথা – গীতা উপনিষদ্‌কে অবলম্বন করিয়া আছে শুধু নহে, ঈশাবাস্যোপনিষদে স্পষ্টরূপে বর্ণিত অর্থই গীতায় সবিস্তর প্রতিপাদিত হইয়াছে, এইরূপ ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে । ঈশাবাস্যোপনিষৎ যে বাজসনেয়ী সংহিতায় আছে, তাহাই বাজসনেয়ী সংহিতার শতপথ ব্ৰাহ্মণভাগ । এই শতপথব্রাহ্মণের আরণ্যকে বৃহদারণ্যকোপনিষৎ প্রদত্ত হইয়াছে; তাহাতে “শুধু বিদ্যায় অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞানে নিমগ্ন-পুরুষ আরও অধিক অন্ধকারে প্রবেশ করে” ঈশাবাস্যের এই নবম মন্ত্র অক্ষরশঃ “গৃহীত হইয়াছে [বৃ|৪|৪|১০] । এই বৃহদারণ্যকোপনিষদেই জনকের কথা আছে; এবং সেই জনকের দৃষ্টান্ত কর্মযোগসমর্থনাৰ্থ ভগবান কর্তৃক গীতায় গৃহীত হইয়াছে [গী|৩|২০] । ইহা হইতে - ঈশাবাস্যের ও ভগবদ্গীতার কর্মযোগের যে সম্বন্ধ আমি উপরে দেখাইয়াছি, তাহাই অধিক দৃঢ় ও নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হয় । 


37) ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্যের বিচার



কিন্তু সমস্ত উপনিষদেই মোক্ষপ্রাপ্তির একই মার্গ প্রতিপাদ্য হইয়াছে এবং তাহাই বৈরাগোর কিংবা সন্ন্যাসেরই মাৰ্গ, উপনিষদে দুই দুই মার্গ প্ৰতিপাদিত হইতে পারে না, এইরূপ যাঁহাদিগের সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত, তাঁহদিগকে ঈশাবাস্যোপনিষদের স্পষ্টার্থক মন্ত্রগুলিকেও টানিয়াবুনিয়া কোন প্রকারে পৃথক অর্থ লাগাইয়া দিতে হয়, নচেৎ এই সকল মন্ত্ৰ তাঁহাদের সম্প্রদায়ের প্রতিকুলে যায়; এবং সেরূপ হওয়া তাঁহাদেৱ ইষ্ট নহে । এই জন্য একাদশ মন্ত্রের ব্যাখ্যা করিবার সময় শাঙ্করভাষ্যে ‘বিদ্যা’ এই শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ এইরূপ না করিয়া উপাসনা করা হইয়াছে । বিদ্যা শব্দের অর্থ যে উপাসনা হয় না এমন নহে । শাণ্ডিল্যবিদ্যা প্ৰভৃতি স্থানে তাহার উপাসনা অৰ্থই বিবক্ষিত হইয়াছে; কিন্তু তাহা মুখ্য অর্থ নহে । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের মনে একথা যে উদয় হয় নাই তাহাও নহে; অধিক কি, উদয় না হওয়া অসম্ভব ছিল । “বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতং” [কেন|২|১২], কিংবা “প্ৰাণসাধ্যাত্মং বিজ্ঞায়ামৃতমশ্নুতে” [প্রশ্ন|৩|১২], এইরূপ বচন অন্যান্য উপনিষদেও আছে । মৈত্র্যুপনিষদের সপ্তম প্ৰপাঠকে “বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ” ইত্যাদি উপরিপ্ৰদত্ত ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রই অক্ষরশঃ গৃহীত হইয়াছে; তাহারই সংলগ্ন তাহার পূর্বে কঠ|২|৪ ও পরে কঠ|২|৫ - এই মন্ত্র প্রদত্ত হইয়াছে । অর্থাৎ এই তিন মন্ত্রই এক স্থানে পর-পর প্রদত্ত হইয়াছে; মধ্যের মন্ত্রটি ঈশাবাস্যের মন্ত্র । তিনটীতেই ‘বিদ্যা’ শব্দ আছে । তাই কঠোপনিষদে বিদ্যা শব্দের যে অর্থ, সেই (জ্ঞান) অর্থই ঈশাবাস্যেও গ্ৰহণ করিতে হইবে - মৈত্র্যুপনিষদের ইহাই অভিপ্ৰায়, স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু ঈশাবাস্যের শাঙ্করভাষ্যে উক্ত হইয়াছে যে “বিদ্যা = আত্মজ্ঞান ও অমৃত = মোক্ষ এই অর্থই যদি ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রে গ্রহণ করা যায় তবে জ্ঞান (বিদ্যা) ও কর্ম (অবিদ্যা) ইহাদের সমুচ্চয় এই উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে এইরূপ বলিতে হয়; কিন্তু যখন এই সমুচ্চয় ন্যায়সিদ্ধ নহে, তখন বিদ্যা = দেবতার উপাসনা এবং অমৃত = দেবলোক এই গৌণ অর্থই এই স্থানে গ্ৰহণ করিতে হইবে” । সার-কথা, ইহা সুস্পষ্ট যে “জ্ঞান হইলে পর, সন্ন্যাস লইবে, কর্ম করিবে না; কারণ, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় কোথাও ন্যায্য নহে” - “শাঙ্করসম্প্রদায়ের এই মুখ্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ ঈশাবাস্যের মন্ত্র যাহাতে না হয় তাহার জন্য বিদ্যা শব্দের গৌণার্থ স্বীকার করিয়া সমস্ত শ্রুতিবচনের নিজ সম্প্রদায়ানুরূপ সমন্বয় করিবার জন্য শাঙ্করভাষ্যে ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রে উপরিলিখিতানুসারে অর্থ করা হইয়াছে । সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখিলে, এই অর্থ গুরুত্বব্যঞ্জক না হইলেও আবশ্যক বটে । কিন্তু সম্বস্ত উপনিষদে এক অর্থই প্ৰতিপাদিত হওয়া উচিত, - দুই মাৰ্গ শ্রুতিপ্ৰতিপাদিত হইতে পারে না - এই মূলসিদ্ধান্তই যাঁহাদের মান্য নহে, তাঁহাদের পক্ষে - উক্ত মন্ত্রে ‘বিদ্যা’ ও ‘অমৃত’ শব্দদ্বয়ের অর্থ উল্টাইবার কোনই কারণই থাকে না । পরব্রহ্ম ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’ এই তত্ত্ব মানিলেও তাঁহার জ্ঞান হইবার উপায় একাধিক হইবে না, এইরূপ সিদ্ধ হয় না । একই ছাদের উপর যাইবার দুই সিঁড়ি কিংবা একই শহরে যাইবার দুই রাস্তা যেরূপ থাকিতে পারে, সেইরূপ মোক্ষলাভের উপায় কিংবা নিষ্ঠার কথা; এবং এই অভিপ্ৰায়েই “লোকোহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” এইরূপ ভগবদ্‌গীতায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । নিষ্ঠা দুই প্ৰকার হওয়া সম্ভব কহিলে পর কোন কোন উপনিষদে শুধু জ্ঞাননিষ্ঠার, আবার কতকগুলি উপনিষদে জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়নিষ্ঠার বর্ণন আসা কিছুমাত্র অসম্ভব নহে । অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠার বিরোধ আসে বলিয়া ঈশাবাস্যোপনিষদের শব্দের সরল, সহজ ও স্পষ্ট অর্থ ছাড়িয়া দিবার কোন কারণ থাকে না । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচাৰ্যোর দৃষ্টি সরল অর্থাপেক্ষা সন্ন্যাসনিষ্ঠামূলক সমন্বয়ের দিকে বিশেষভাবে ছিল, ইহা বলিবার আরও এক কারণ আছে । তৈত্তিরীয়-উপনিষদের শাঙ্করভাষ্যে [তৈ|২|১১] “অবিদ্যা মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” ঈশাবাস্যের এইটুকু অংশই প্রদত্ত হইয়াছে, এবং তাহারই সহিত “তপস্যা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই মনুবচনও [মনু|১২|১০৪] দেওয়া হইয়াছে; এবং এই দুই বচনে “বিদ্যা” শব্দের একই মুখ্যার্থ (অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞান) আচাৰ্য স্বীকার করিয়াছেন । কিন্তু আচাৰ্য এইস্থানে এইরূপ বলেন যে “তীর্ত্বা =  তরিয়া যাওয়া” এই পদ হইতে প্ৰথমে মৃত্যুলোক পার হইবার ক্রিয়া সম্পূর্ণ হইলে তাহার পরে (একই সময়ে নহে বিদ্যার ধারা অমৃতত্ব লাভ করিবার ক্রিয়া সংঘটিত হয় । কিন্তু এই অর্থ পূর্বার্ধের “উভয়ং সহ” শব্দগুলির বিরুদ্ধ হয়, ইহা বলা বাহুল্য; এবং প্ৰায় এই কারণেই ঈশাবাস্যের শাঙ্করভাষ্যে এই অর্থ পরিত্যক্তও হইয়া থাকিবে । যাহাই হউক, ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্যে পৃথক ব্যাখ্যা করিবার কারণ কি, তাহা ইহা হইতে ব্যক্ত হয় । এই কারণ সাম্প্রদায়িক; এবং ভাষ্যকারের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকে যাঁহারা স্বীকার না করেন তাঁহাদের নিকট প্ৰস্তুত ভাষ্যের এই ব্যাখ্যা মান্য হইবে না । শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য্যের ন্যায় অলৌকিক-জ্ঞানীপুরুষ-প্রতিপাদিত অর্থ ছাড়িয়া দিবার প্রসঙ্গ যতই পরিহার করা যায় ততই ভাল, এ কথা আমিও স্বীকার করি । কিন্তু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছাড়িলে, এই প্রসঙ্গ তো আসিবেই; এবং এই জন্যই আমার পূর্বেও ঈশাবাস্য মন্ত্রের অর্থ শাঙ্কর ভাষ্য হইতে ভিন্ন প্রকারে (আমি যেরূপ বলিতেছি সেইরূপই) অন্য ভাষ্যকারেরাও প্রয়োগ করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - বাজসনেয়ী সংহিতার সুতরাং ঈশাবাস্যোপনিষদের উপরও উবটাচাৰ্য্যের যে ভাষ্য আছে তাহাতে “বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ” এই মন্ত্রর ব্যাখ্যাঃ করিবার সময় “বিদ্যা = আত্মজ্ঞান ও অবিদ্যা = কর্ম এই দুয়ের সমন্বয়ের দ্বারাই অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ হয়” এইরূপ অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে । অনন্তাচাৰ্য এই উপনিষদের নিজ ভাষ্যে এই জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক অর্থই স্বীকার করিয়া শেষে স্পষ্ট লিখিয়াছেন যে, “এই মন্ত্রের সিদ্ধান্ত এবং “যৎসাংখ্যৈঃ প্ৰাপ্যতে স্থানং তদ্‌যোগৈরপি গম্যতে” [গী|৫|৫] এই গীতা বচনের অর্থ একই; এবং গীতার এই শ্লোকের ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ শব্দ অনুক্ৰমে ‘জ্ঞান’ ও ‘কর্মের’ বাচক” ।* সেইরূপ আবার, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির উপর [যা|৩|৫৭ ও ২০৫] আপন টীকায় আপরার্কদেবও ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্ৰ দিয়া অনন্তাচাৰ্য্যেরই ন্যায় তাহার জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক অৰ্থ করিয়াছেন । ইহা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে যে, আমি আজ নূতন করিয়া ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্রের শাস্করভাষ্য হইতে ভিন্ন অর্থ করি নাই ।
*(ঈশাবাস্যোপনিষদের এই সব ভাষ্য পুণার আনন্দাশ্রমে মুদ্রিত ঈশাবাস্যোপনিষদের সংস্করণে প্রদত্ত হইয়াছে; যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির অপরার্কের টীকাও আনন্দাশ্রমেই আলাদা ছাপা হইয়াছে । প্ৰো. মোক্ষমূলর উপনিষদের যে ভাষান্তর করিয়াছেন তাহাতে ঈশাবাস্যের ভাষান্তর শাঙ্করভাষ্যকে অবলম্বন করিয়া করা হয় নাই । ইহার কারণ তিনি ভাষান্তরের শেষে দিয়াছেন (Sacred Books of the East Series Vol. 1. pp. 314-320) অনন্তাচার্যের ভাষ্য মোক্ষমূলর সাহেবের জানা ছিল না; এবং শাঙ্করভাষ্যে পৃথক অর্থ কেন করা হইয়াছে, তাহার মর্মও মোক্ষমুলার সাহেবের উপলব্ধি হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না ।)


38) মনু ও অন্যান্য স্মৃতির জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়াত্মক বচন



স্বয়ং ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্র সম্বন্ধে এই বিচার হইল । এক্ষণে শঙ্করভাষ্যে “তপসা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই যে মনুবচন প্রদত্ত হইয়াছে তাহার, একটু বিচার করিব । মনুস্মৃতির দ্বাদশ অধ্যায়ে এই শ্লোক ১০৪ সংখ্যার, এবং মনু ১২|৮৬ হইতে উপলব্ধি হইবে যে, ঐ প্রকরণ বৈদিক কর্মযোগের । কর্মযোগের এই বিচার-আলোচনায় -
তপো বিদ্যা চ বিপ্ৰস্য নিঃশ্ৰেয়সকরং পরম্‌ ৷
তপসা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে ॥
প্রথম চরণে “তপ ও (চ) বিদ্যা (অর্থাৎ দুই-ই) ব্রাহ্মণের উত্তম মোক্ষপ্রদ” এইরূপ বলিয়া আবার প্রত্যেকের উপযোগ দেখাইবার জন্য “তপস্যার দ্বারা দোষ নষ্ট হইয়া বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ হয়” এইরূপ দ্বিতীয় চরণে উক্ত হুইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, এই স্থানে জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়ই মনুর অভিপ্ৰেত, এবং ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রের অর্থই মনু এই শ্লোকে বর্ণন করিয়াছেন । হারীতস্মৃতির বচন হইতেও এই অর্থই অধিক দৃঢ় হয় । এই হারীতস্মৃতি স্বতন্ত্র তো উপলব্ধি হয়ই এবং তাছাড়া নৃসিংহপুরাণেও [নৃ|পু|অ|৫৭|৬১] প্রদত্ত হইয়াছে । এই নৃসিংহপুরাণে [৬১|৯-১১] এবং হারীতস্মৃতিতে [৭|৯-১১] জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় সম্বন্ধে এই এক শ্লোক আছে -
যথাশ্বা রথহীনাশ্চ রথাশ্চাশ্বৈর্বিনা যথা ৷
এবং তপশ্চ বিদ্যা চ উভাবপি তপস্বিনঃ ॥
যথান্নং মধুসংযুক্তং মধুচান্নেন সংযুতম্‌ ৷
এবং তপশ্চ বিদ্যা চ সংযুক্তং ভেষজং মহৎ ॥
দ্বাভ্যামেব হি পক্ষাভ্যাং যথা বৈ পক্ষিণাং গতিঃ ৷
তথৈব জ্ঞানকর্মাভ্যাং প্রাপ্যতে ব্ৰহ্ম শাশ্বতম্ ॥
“যেরূপ রথ ব্যতীত অশ্ব ও অশ্ব ব্যতীত রথ (চলে না) তপস্বীর তপস্বা ও বিদ্যারও সেই অবস্থা । যেরূপ অন্ন মধুসংযুক্ত এবং মধু অন্নসংযুক্ত, সেইরূপ তপস্যা ও বিদ্যা সংযুক্ত হইলে এক মহা ঔষধ প্ৰস্তুত হয় । যেরূপ পক্ষীর গতি দুই পক্ষ-যোগেই হইয়া থাকে সেইরূপই জ্ঞান ও কর্ম (এই দুয়ের) দ্বারা শাশ্বত ব্ৰহ্ম লাভ হয়” । হারীতস্মৃতির এই বচন বৃদ্ধাত্ৰেয়স্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়েও পাওয়া যায় । এই সকল বচন হইতে, এবং বিশেষতঃ তৎপ্রদত্ত দৃষ্টান্ত হইতে মনুস্মৃতির বচনের কি অর্থ করা উচিত, তাহা স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । তপ শব্দের মধ্যেই মনু চাতুর্বর্ণের কর্মের সমাবেশ করিয়াছেন । ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে [মনু|১১|২৩৬]; এবং এক্ষণে উপলব্ধি হইবে যে, তৈত্তিরীয় উপনিষদে “তপ ও স্বাধ্যায়প্রবচন” ইত্যাদি যে সকল আচরণ করিতে বলা হইয়াছে [তৈ|১|৯] তাহাও জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষ স্বীকার করিয়াই বলা হইয়াছে । সমগ্ৰ যোগবাসিষ্ট গ্রন্থের তাৎপৰ্যই এই । কারণ, এই গ্রন্থের আরম্ভেই সুতীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন যে, শুধু জ্ঞানের দ্বারা, কেবল কর্মের দ্বারা কিংবা দুয়ের সমুচ্চয়ের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় তাহা আমাকে বলো । এবং তাহার উত্তর দিবার সময়, হারীতস্মৃতির পক্ষীদৃষ্টান্ত গ্ৰহণ করিয়া “আকাশে পক্ষীদের গতি যেরূপ দুই পক্ষযোগেই হইয়া থাকে সেইরূপ জ্ঞান ও কর্ম এই দুয়ের দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়, কেবল একটির দ্বারা এই সিদ্ধি লাভ হয় না” এইরূপ বলিয়া, পরে সেই অর্থকেই সবিস্তর সপ্রমাণ করিবার জন্য সমস্ত যোগবাসিষ্ঠ গ্ৰন্থ উক্ত হইয়াছে [যো|১|১|৬-৯] । সেইরূপ মুখ্য কথার মধ্যে বসিষ্ঠ রামকে “জীবন্মুক্তের ন্যায় বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিয়া তুমি সমস্ত কর্ম কর” [যো|৫|১৮|১৭-২৬] কিংবা “কর্ম ত্যাগ করা আমরণ যুক্তিসিদ্ধ না হওয়ায় [যো|৬|উ|২|৪২], স্বধর্মানুসারে নির্দিষ্ট রাজ্যপালনের কাজ কর” [যো|৫|৫|৫৪ ও ৬|উ|২১৩|৫০], এইরূপ স্থানে স্থানে পুনঃ পুনঃ উপদেশ করিয়াছেন । এই গ্রন্থের উপসংহার এবং পরে রামচন্দ্রের অনুষ্ঠিত কাৰ্যও এই উপদেশেরই অনুরূপ । কিন্তু যোগবাসিষ্ঠের টীকাকার সন্ন্যাসমার্গীয় ছিলেন, তাই পক্ষীর দুই পক্ষের উপমা স্পষ্ট হইলেও, তিনি জ্ঞান ও কর্ম এই দুই যুগপৎ অর্থাৎ একই কালে বিহিত নহে, এইরূপ নিজের অভিপ্রেত মত লাগাহিয়া দিয়াছেন । কিন্তু এই অর্থ যে টানাবুনা, ক্লিষ্ট ও সাম্প্রদায়িক, তাহা টীকা ছাড়িয়া দিয়া মূলগ্ৰন্থ পাঠ করিলেই যে-কোন ব্যক্তিরই সহজে উপলব্ধি হইবে । যোগবাসিষ্ঠেরই ন্যায় মাদ্রাজ প্রান্তে গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠ-তত্ত্বসারায়ণ নামক এক গ্ৰন্থ প্ৰসিদ্ধ আছে । তাহার জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাও, এই তিন ভাগ আছে । এই গ্ৰন্থকে যতটা পুরাতন বলা হয় তত পুরাতন মনে করি না, ইহা আমি পূর্বে বলিয়াছি । কিন্তু প্ৰাচীন না হইলেও জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষই তাহাতে প্ৰতিপাদ্য হওয়ায়, এই স্থানে তাহার উল্লেখ করা আবশ্যক । ইহাতে অদ্বৈত বেদান্ত আছে; এবং নিষ্কাম কর্মের উপরই ইহা বিশেষ ঝোঁক দেওয়ায় ইহার সম্প্রদায় শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের সম্প্রদায় হইতে যে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র, ইহা বলিতে বাধা নাই । মাদ্রাজ অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের নাম ‘অনুভবাদ্বৈত’; এবং বস্তুত দেখিতে গেলে, ইহা গীতার কর্মযোগেরই এক নকল মাত্ৰ, এইরূপ উপলব্ধি হইবে । কিন্তু কেবল ভগবদ্‌গীতারই ভিত্তিতে এই সম্প্রদায় সিদ্ধ না করিয়া, ইহাতে বলা হইয়াছে যে, সমস্ত ১০৮ উপনিষদ হইতে ঐ অর্থই সিদ্ধ হয় । এইরূপ রামগীতা ও সূৰ্যগীতা এই দুই নূতন গীতাও ইহাতে প্রদত্ত হইয়াছে । অদ্বৈত মত স্বীকার করা অর্থে কর্মসন্ন্যাস-পক্ষকেই স্বীকার করা এইরূপ যে কাহারও কাহারও ধারণা, তাহা এই গ্ৰন্থ হইতে দূর হইবে । উপরিপ্রদত্ত প্ৰমাণে এক্ষণে স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, যে নিষ্কাম কর্মযোগ, সংহিতা, ব্ৰাহ্মণ, উপনিষৎ, ধর্মসূত্ৰ, মনুযাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি, মহাভারত, ভগবদ্‌গীতা, যোগবাসিষ্ঠ ও পরিশেষে তত্ত্বসারায়ণ প্ৰভৃতি গ্রন্থেও প্রতিপাদিত হইয়াছে, তাহাকে শ্রুতিস্মৃতি-প্রতিপাদিত না মানিয়া কেবল সন্ন্যাসমার্গকেই শ্রুতিস্মৃতি-প্ৰতিপাদিত বলা সর্বথা ভিত্তিহীন ।

এই মৃত্যুলোকের ব্যবহার চালাইবার জন্য কিংবা লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যথাধিকার নিষ্কাম কর্ম, এবং মোক্ষলাভার্থ জ্ঞান, এই দুয়ের এককালীন সমুচ্চয়ই, অথবা মহারাষ্ট্র কবি শিবদিন-কেসরীর বর্ণনা অনুসারে -
প্ৰপঞ্চ সাধুনি পরমার্থচ লাহো জ্যানে কেলাঁ ৷
তো নর ভলা ভলা রে ভলা ভলা ॥

“যিনি প্ৰপঞ্চ সাধন করিয়া (সংসারের সমস্ত কর্তব্য যথোচিত পালন করিয়া) পরমার্থ লাভ করিয়াছেন তিনিই ভালো, ভালো, ভালো ভালো” - এই অর্থই গীতায় প্রতিপাদিত হইয়াছে । কর্মযোগের এই মাৰ্গ প্ৰাচীনকাল হইতে প্রচার হইয়া আসিতেছে; জনক প্রভৃতি ইহাই আচরণ করায় এবং স্বয়ং ভগবানের দ্বারা উহার প্রসার ও পুনরুজ্জীবন হওয়া প্ৰযুক্ত, ইহাকেই ভাগবতধর্ম বলা হয় । এই সকল বিষয় ভালরূপে সিদ্ধ হইল । এই মার্গের জ্ঞানীপুরুষ পরমার্থযুক্ত স্বকীয় প্রপঞ্চ - জাগতিক ব্যবহার - কিরূপভাবে চালান, লোকসংগ্ৰহদৃষ্টিতে, ইহা দেখাও আবশ্যক । কিন্তু উপস্থিত প্রকরণ অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়া প্ৰযুক্ত পরবর্তী প্রকরণে তাহার স্পষ্টীকরণ করিব ।

সিদ্ধাবস্থা ও ব্যবহার (State of a Perfect, and Worldly Affairs)

সর্ব্বেষাং যঃ সুহৃন্নিত্যং সর্ব্বেষাং চ হিতে রতঃ ৷ 
কর্ম্মণা মনসা বাচা স ধর্ম্মং বেদ জাজলে ॥ [মভা|শান্তি|২৬১|৯]

(“কর্মে, মনে ও বাক্যে সকলের হিতসাধনে যিনি রত এবং সকলের যিনি নিত্য সুহৃৎ - হে জাজলে, তিনিই ধর্মকে জানেন” ।)

ভক্তিমার্গ

সর্বধৰ্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ ৷
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ [গীতা |১৮|৬৬]

(“সর্বপ্রকার ধর্ম অৰ্থাৎ পরমেশ্বর-প্রাপ্তির সাধন ছাড়িয়া একান্তভাবে আমার শরণ গ্রহণ কর, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত করিব, ভীত হইও না”।)


 ✍লোকমান্য বাল-গঙ্গাধর তিলক

Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য


বর্তমান গীতার কালনির্ণয়ের জন্য উপরে যে বৌদ্ধগ্রন্থের প্রমাণ দেওয়া গিয়াছে, তাহার পূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করিবার জন্য গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ বা বৌদ্ধধর্মের সাধারণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্বন্ধেও এখানে একটু বিচার করা আবশ্যক । গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ প্ৰবৃত্তিমার্গেরই অনুসরণ করেন - ইহাই গীতাধর্মের বিশেষত্ব, ইহা পূর্বে অনেকবার বলিয়াছি । কিন্তু এই বিশেষ গুণটিকে ক্ষণকাল একপাশে রাখিয়া, এইরূপ পুরুষের কেবল মানসিক ও নৈতিক গুণসমূহেরই বিচার করিলে, গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ [গী|২|৫৫, ৭২], ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষ [৪|১৯-২৩; ৫|১৮-২৮] এবং ভক্তিযোগী পুরুষের [১২|১৩-১৯] যে লক্ষণ বলা হইয়াছে, সেই সব লক্ষণ এবং নির্বাণ-পদের অধিকারী অৰ্হৎদিগের অর্থাৎ পূর্ণ অবস্থায় উপনীত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে যে সকল লক্ষণ প্রদত্ত হইয়াছে সেই সব লক্ষণ - এই উভয়ের মধ্যে বিলক্ষণ সাম্য আছে দেখিতে পাওয়া যায় [ধম্মপদ শ্লো|৩৬০-৪২৩ ও সুত্তনিপাতের মধ্যে মুনিসুত্ত ও ধম্মিকসুত্ত দেখ] । অধিক কি, এই বর্ণনাসমূহের শব্দসাম্য হইতে দেখা যায় যে, স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ভক্তিমান ব্যক্তির সমানই প্রকৃত ভিক্ষুও ‘শান্ত’, ‘নিষ্কাম’, ‘নির্মম’, ‘নিরাশী’ (নিরিস্‌সিত), ‘সমদূঃখসুখ’, ‘নিরারম্ভ’, ‘অনিকেতন’, বা ‘অনিবেশন’ অথবা ‘সমনিন্দাস্তুতি’, এবং ‘মানাপমান ও লাভালাভে সমদর্শী’ থাকে [ধম্মপদ|৪০, ৪১ ও ৯১; সুত্তনি|মুনিসুত্ত|১|৭ ও ১৪; দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্ত ২১-২৩; ও বিনয়পিটক চুল্লবগ্‌গ|৭|৪|৭ দেখ] । জ্ঞানী পুরুষের নিকট যাহা আলোক অজ্ঞানের নিকট তাহাই অন্ধকার, দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্তের ৪০ শ্লোকের এই বিচার “যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী” [গী|২|৩৯] গীতার এই বিচারের অনুরূপ; এবং “অরোসনেয্যো ন রোসেতি” - অৰ্থাৎ, নিজেও কষ্ট পায় না, অন্যকেও কষ্ট দেয় না, মুনিসুত্তের ১০ শ্লোকের এই বর্ণনা গীতার “যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ” [গী|১২|১৫] এই বর্ণনার সদৃশ । সেইরূপ সল্লসুত্তের “যাহার জন্ম তাহারই মৃত্যু” এবং “ভূতদিগের আদি ও অন্ত অব্যক্ত হওয়ায় তাহার জন্য শোক করা বৃথা” [সল্লমুত্ত|১ ও ৯ এবং গী|২|২৭ ও ২৮] ইত্যাদি বিচার অল্প শব্দভেদে গীতারই বিচার । গীতার দশম অধ্যায়ে কিংবা অনুগীতার [মভা|অশ্ব|৪৩|৪৪] “জ্যোতিষ্মানদিগের মধ্যে সূৰ্য, নক্ষত্রদিগের মধ্যে চন্দ্র, এবং বেদমন্ত্রের মধ্যে গায়ত্ৰী” ইত্যাদি যে বৰ্ণনা আছে তাহাই অবিকল সেলসুত্তের ২৭ ও ২২ শ্লোকে এবং মহাবগ্‌গে [৬|৩৫|৮] পাওয়া যায় । ইহা ব্যতীত ছোট-খাটো শব্দ সাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য, ৺তৈলং স্বকীয় গীতার ইংরাজী ভাষান্তরের টিপ্পনীতে দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রশ্ন উঠে যে, এই সাদৃশ্য কিরূপে উৎপন্ন হইল ? এই বিচার মূলে বৌদ্ধদিগের, বা বৈদিক ধর্মের ? এবং ইহা হইতে কি অনুমান হয় ? কিন্তু এই প্ৰশ্নসমূহের নির্ণয় করিবার জন্য সে সময়ে যে সাধন পাওয়া গিয়াছিল, তাহা অপূর্ণ থাকায় উপরিউক্ত আশ্চৰ্য শব্দসাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য প্রদর্শন অপেক্ষা আর বেশী কিছু এই বিষয়ে ৺ তৈলং লিখিতে পারেন নাই । কিন্তু এক্ষণে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে সকল নানা বিবরণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে এই সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারে বলিয়া এখানে বৌদ্ধধর্মের সেই সকল বিষয় সংক্ষেপে বলিতেছি । ৺তৈলং-কৃত গীতার ইংরাজী ভাষান্তর যাহা ‘প্ৰাচ্যধর্মগ্রন্থমালায়’ প্ৰকাশিত হইয়াছে, উহাতে পরে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বৌদ্ধধর্মগ্রন্থসমূহের ইংরাজী অনুবাদ প্ৰকাশ করিয়াছেন । এই সকল বিষয় প্রায় সেই সকল গ্ৰন্থ হইতে সংগ্ৰহ করা হইয়াছে এবং প্রমাণার্থ উপস্থাপিত বৌদ্ধগ্রন্থের স্থলনির্দেশও এই সকল ভাষান্তরেরই অনুযায়ী করা হইয়াছে । কোন কোন স্থলে পালী শব্দ ও বাক্য মূল পালী গ্ৰন্থ হইতেই গৃহীত হইয়াছে ।


2) বুদ্ধের নির্বাণকাল


এই কথা এখন নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, জৈনধর্মের ন্যায় বৌদ্ধধর্মও আপন বৈদিক ধর্মরূপ পিতারই পুত্র, যে নিজের সম্পত্তির অংশ লইয়া কোন কারণে পৃথক হইয়া গিয়াছে; অর্থাৎ উহা পরকীয় নহে, কিন্তু তৎপূর্বে এখানে যে ব্ৰাহ্মণধর্ম ছিল, উহারই এখানেই উৎপন্ন এক শাখা । সিংহল দ্বীপের মহাবংস কিংবা দীপবংসাদি পুরাতন পালীগ্রন্থে, বুদ্ধের পরবর্তী রাজাদিগের ও বৌদ্ধ আচাৰ্য-পরম্পরার যে বৰ্ণনা আছে, তাহা হইতে হিসাব করিয়া দেখিলে নিষ্পন্ন হয় যে, ৮০ বৎসর বয়সে খৃষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয় । কিন্তু ইহাতে কতকগুলি কথা অসম্বদ্ধ আছে; এইজন্য প্ৰোঃ মোক্ষমুলার এই গণনাসম্বন্ধে সূক্ষ্ম বিচার করিয়া বুদ্ধের প্রকৃত নিৰ্বাণকাল খৃষ্টপূর্ব ৪৭৩ অব্দে হইয়াছিল বলিয়াছেন; এবং ঐ কালই অশোকের শিলালিপি হইতে সিদ্ধ হয় ইহা বুহ্লরও দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রোঃ রিজ-ডেভিড্‌স্‌ এবং ডাঃ কের্ণ-এর ন্যায় কোন কোন তত্ত্বানুসন্ধায়ী, ইহা অপেক্ষা ৬৫ ও ১০০ বৎসর আরও পরের দিকে হটাইতে চাহেন । প্ৰোঃ গায়গর সম্প্রতিই এই সমস্ত মতের বিচার করিয়া খৃঃ পুঃ ৪৮৩ অব্দকে বুদ্ধের নির্বাণকাল স্থির করিয়াছেন । (প্রোঃ মোক্ষমূলর স্বকীয় ধর্মপদের ইংরাজী ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় বুদ্ধের নির্বাণকাল-সম্বন্ধীয় বিবরণ দিয়াছেন S. B. E. Vọl. X. Intro. pp. xxxv-xiv এবং ডাঃ গায়গর ১৯১২ অব্দে প্রকাশিত স্বীয় মহাবংসের ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় উহার সমালোচনা করিয়াছেন – তাহা দেখ - The Mahavamsa by Dr. Geiger Pali Text Society Intro p. xxiif.)


3) বুদ্ধের পূর্বেই বৈদিকধর্মের পুর্ণাবস্থা-প্রাপ্তি


তন্মধ্যে যে কালই স্বীকার কর না কেন, বুদ্ধের জন্ম হইবার পূর্বেই বৈদিকধর্ম পুর্ণাবস্থায় উপনীত হইয়াছিল, এবং শুধু উপনিষদ নহে, কিন্তু ধর্মসূত্রের ন্যায় গ্ৰন্থও তাহার পূর্বেই রচিত হইয়াছিল, ইহা নির্বিবাদ । কারণ, পালী ভাষার প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহেই লিখিত আছে যে, “চারি বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস ও নিঘণ্টু” প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী সাত্ত্বিক গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণদিগকে এবং জটাধারী তপস্বীদিগকে গৌতম বুদ্ধ তর্ক করিয়া আপন ধর্মে দীক্ষিত করেন (সুত্ত্বনিপাতের মধ্যে সেলসুত্তের সেলের বর্ণনা ও বথ্‌থু গাথা ৩০-৪৫) । কঠাদি উপনিষদে [কঠ|১|১৮; মুণ্ড|১|২|১০]; এবং উহাদিগকেই লক্ষ্য করিয়া গীতায় [২|৪০-৪৫; ৯|২০, ২১] যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতকর্মের যেরূপ লঘুতা বর্ণিত হইয়াছে, সেইরূপ এবং কোন কোন অংশে সেই সকল শব্দেরই দ্বারা তেবিজ্জসুত্তে (ত্রৈবিদ্য সূত্রে) বুদ্ধও স্বমতানুসারে ‘যাগযজ্ঞাদিকে’ অনুপযোগী ও ত্যাজ্য স্থির করিয়াছেন এবং ব্ৰাহ্মণ যাহাকে ‘ব্ৰহ্মসহব্যতায়’ (ব্ৰহ্মসহব্যতায় = ব্ৰহ্মসাযুজ্যতা) বলেন সেই অবস্থা কিরূপে প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, তাহার নিরূপণ করিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড - কিংবা গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাসধর্ম, অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি - এই দুই শাখা সম্পূর্ণরূপে প্ৰচলিত হইবার পর, তাহার সংস্কার-সাধনের জন্য বৌদ্ধধর্ম উৎপন্ন হয় । সংস্কার-সাধনের সাধারণ নিয়ম এই যে, উহাতে পূর্বের কোন কোন বিষয় বজায় থাকে এবং কোন কোন বিষয় পরিবর্তিত হয় । তাই এই নিয়মানুসারে, বৌদ্ধধর্মে বৈদিক ধর্মের কোন কোন কথা বজায় রাখা হইয়াছে এবং কোন কোন বিষয় পরিত্যক্ত হইয়াছে, এক্ষণে তাহার বিচার করিব । এই বিচার গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাস এই দুইয়ের পৃথক পৃথক দৃষ্টিতে করিতে হইবে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম মূলে সন্ন্যাসমাৰ্গীয় কিংবা নিবৃত্তিপ্রধানই হওয়ায় প্ৰথমে দুইয়ের সন্ন্যাসমার্গের বিচার করিয়া তাহার পর উভয়ের গাৰ্হস্থ্যধর্মের তারতম্য সম্বন্ধে বিচার করিব ।


4) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - সন্ন্যাসমার্গের বিচার


বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের প্রতি লক্ষ্য করিলে উপলব্ধি হইবে যে, কর্মময় জগতের সমস্ত ব্যবহার তৃষ্ণামূলক সুতরাং দুঃখময়; উহা হইতে অর্থাৎ জন্মমরণের ভবচক্র হইতে আত্মার চিরমুক্তি সাধনের জন্য মনকে নিষ্কাম ও বিরক্ত করিয়া উহাকে দৃশ্য জগতের মূলে অবস্থিত আত্মস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্মে সমাধান পূর্বক সাংসারিক কর্মসকল সর্বথা ত্যাগ করা উচিত; এই আত্মনিষ্ঠ অবস্থাতেই সর্বদা নিমগ্ন থাকা সন্ন্যাসধর্মের মুখ্য তত্ত্ব । দৃশ্যজগৎ নামরূপাত্মক ও নশ্বর; এবং তাহার অখণ্ডিত ব্যাপার কর্মবিপাক প্ৰযুক্তই বরাবর বজায় আছে ।
কম্মনা বত্ততী লোকো কম্মনা বত্ততী পজা (প্ৰজা) ৷
কম্মনিবন্ধনা সত্তা (সত্ত্বখানি) রথস্‌সাহণীব যায়তো ॥
অর্থাৎ “কর্মের দ্বারাই লোক ও প্ৰজা বজায় আছে; চল্‌তি গাড়ী যেরূপ রথের কীলকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেইপ্ৰকার প্রাণীমাত্র কর্মের দ্বারা বদ্ধ হইয়া আছে” [সুত্তনি|বাসেঠসুত্ত|৬১] । বৈদিক ধর্মের জ্ঞানকাণ্ডের উক্ত তত্ত্ব, অথবা জন্ম-মরণের চক্র বা ব্রহ্মা, ইন্দ্র, মহেশ্বর, ঈশ্বর, যম, প্রভৃতি অনেক দেবতা এবং উঁহাদের বিভিন্ন স্বর্গপাতালাদি লোকসমূহের ব্রাহ্মণধর্মে বর্ণিত অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য ছিল; এবং সেইজন্যই নামরূপ, কর্মবিপাক, অবিদ্যা, উপাদান ও প্ৰকৃতি প্ৰভৃতি বেদান্ত বা সাংখ্যশাস্ত্রের শব্দ ও ব্ৰহ্মাদি বৈদিক দেবতাদিগের কথাও (বুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া) ন্যূনাধিক ভেদে বৌদ্ধগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় । দৃশ্য জগৎ নশ্বর ও অনিত্য এবং উহার ব্যবহার কর্ম-বিপাকনিবন্ধন চলিতেছে, ইত্যাদি কর্মজগৎসংক্রান্ত বৈদিক ধর্মের সিদ্ধান্ত বুদ্ধের মান্য হইলেও নামরূপাত্মক নশ্বর জগতের মূলে নামরূপের অতিরিক্ত আত্মস্বরূপ পরব্রহ্মের সমান এক নিত্য ও সর্বব্যাপী বস্তু আছে, বৈদিক ধর্মের অর্থাৎ উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই দুই ধর্মের মধ্যে ইহাই শুরুতর প্রভেদ । গৌতম বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, আত্মা বা ব্ৰহ্ম বস্তুত কিছু নাই - কেবল ভ্রম; তাই আত্মানাত্মবিচারে বা ব্ৰহ্মচিন্তনের গোলযোগে পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করা কাহারও উচিত নহে [সব্বাসবসুত্ত|৯-১৩ দেখ] । আত্মার সম্বন্ধে কোন প্রকার কল্পনাই বুদ্ধের মান্য ছিল না,ইহা দীঘ্‌ঘনিকায়ের অন্তর্গত ব্ৰহ্মজালসুত্ত হইতেও স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । (ব্ৰহ্মজালসুত্তের ভাষান্তর ইংরাজীতে হয় নাই, কিন্তু তাহার সংক্ষিপ্ত সার রিজ্‌-ডেভিড্‌স্‌ S. B. E. Vol XXVI Intro, pp, xxiii-xxv-এ দিয়াছেন – তাহা দেখ ।)

এই সকল সুত্তে প্ৰথমে বলা হইয়াছে যে, আত্মা ও ব্ৰহ্ম এক কি দুই; আবার এই প্ৰকার ভেদই বলিবার সময় আত্মার ৬২ প্রকার বিভিন্ন কল্পনার কথা বলিয়া বলা হইয়াছে যে, এই সমস্তই মিথ্যা ‘দৃষ্টি’; এবং মিলিন্দ-প্রশ্নেও বৌদ্ধধর্মানুসারে “আত্মা বলিয়া কোন যথার্থ বস্তু নাই” এইরূপ নাগসেন গ্ৰীক মিলিন্দকে (Minander) স্পষ্ট বলিয়াছেন [মি|প্র|২|৩|৬ ও ২|৭|১৫] । আত্মা ও তদ্বৎ ব্ৰহ্ম দুইই ভ্ৰম, সত্য নহে, এইরূপ স্বীকার করিলে তো ধর্মের ভিত্তিই ধসিয়া যায় । কারণ, তাহলে তো সমস্ত অনিত্য বস্তুই অবশিষ্ট থাকে, এবং নিত্য সুখ বা সেই সুখের ভোক্তাও কেহ থাকে না; এবং এই কারণেই তৰ্কদৃষ্টিতে এই মত শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য অগ্ৰাহ্য করিয়াছেন ।


4.1) প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি ? চারি আৰ্যসত্য :


কিন্তু এখন আমাকে কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি, এইজন্য এই তর্ক এখানেই ছাড়িয়া দেখিব যে, বুদ্ধ স্বকীয় ধর্মের কি উপপত্তি বলিয়াছেন । আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য না হইলেও, 
(১) কর্ম-বিপাক নিবন্ধন নামরূপাত্মক দেহকে (আত্মাকে নহে) নশ্বর জগতের প্রপঞ্চে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হয়, এবং 
(২) পুনর্জন্মের এই চক্র বা সমস্ত সংসারই দুঃখময়, এই দুই বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ একমত ছিলেন; ইহা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া চিরন্তন শান্তি বা সুখ অর্জন করা অত্যাবশ্যক । এই প্ৰকার সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব এবং তন্নিবারণের আবশ্যকতা, এই দুই বিষয় স্বীকার করিলে বৈদিক ধর্মের এই প্রশ্নটি সমান থাকিয়া যায় যে, দুঃখ নিবারণ করিয়া অত্যন্ত সুখলাভের পন্থাটি কি; এবং উহার কোন-না-কোন সন্তোষজনক ঠিক্‌ ঠিক্‌ উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । উপনিষৎকারেরা বলিয়াছেন যে, যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা ভবচক্র হইতে মুক্তি লাভ করা যায় না এবং বুদ্ধ আরও একটু বেশী অগ্রসর হইয়া এই সমস্ত কর্মকে হিংসাত্মক সুতরাং সর্বথা ত্যাজ্য ও নিষিদ্ধ বলিয়াছেন । সেইরূপ স্বয়ং ‘ব্ৰহ্মকেই’ এক মহা ভ্ৰম বলিয়া মনে করিলে, দুঃখনিবারণার্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানের মাৰ্গকেও ভ্ৰান্তিমূলক ও অসম্ভব বলিয়া স্থির করিতে হয় । তাহা হইলে দুঃখময় ভবচক্র হইতে মুক্তিলাভের মার্গটি কি ? বুদ্ধ ইহার উত্তর দিয়াছেন যে, কোন রোগ দূর করিতে হইলে সেই রোগের মূল কি তাহা স্থির করিয়া সেই মূল কারণকেই উন্মূলিত করিবার জন্য সৎবৈদ্য যেরূপ চেষ্টা করিয়া থাকেন, সেইরূপ সাংসারিক দুঃখের রোগ দূর করিবার জন্য 
(৩) উহার কারণ অবগত হইয়া 
(৪) সেই কারণকেই দূর করিবার মার্গ বুদ্ধিমান ব্যক্তির অবলম্বন করা উচিত ।

এই কারণ-সমূহের বিচার করিলে দেখা যায় যে, তৃষ্ণা বা বাসনাই এই জগতের সমস্ত দুঃখের মূল; এবং এক, নাম-রূপাত্মক দেহের নাশ হইলে, অবশিষ্ট এই বাসনাত্মক বীজ হইতেই অন্যান্য নাম রূপাত্মক দেহ পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এবং তাহার পর বুদ্ধ স্থির করিয়াছেন যে, পুনর্জন্মের দুঃখময় সংসার হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ, ধ্যান ও বৈরাগ্যের দ্বারা তৃষ্ণার সম্পূর্ণ ক্ষয় করিয়া সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হওয়াই এক প্ৰকৃত মাৰ্গ, এবং এই বৈরাগ্যযুক্ত সন্ন্যাস হইতেই চিরন্তন শান্তি ও নিত্য সুখ লাভ করা যায় । তাৎপৰ্য এই যে, যাগযজ্ঞাদির এবং আত্মানাত্মবিচারের গোলযোগে না পড়িয়া, নিম্নোক্ত চারি প্রত্যক্ষ বিষয়ের উপরেই বৌদ্ধধর্ম খাড়া করা হইয়াছে - সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব, তাহার কারণ, তাহার নিরোধ বা নিবারণ করিবার আবশ্যকতা, এবং উহা সমূলে বিনষ্ট করিবার জন্য বৈরাগ্যরূপ সাধন; কিংবা বৌদ্ধ পরিভাষা অনুসারে অনুক্ৰমে দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ ও মার্গ । নিজ ধর্মের এই চারি মূলতত্ত্বকেই বুদ্ধ ‘আৰ্যসত্য’ নাম দিয়াছেন । উপনিষদের আত্মজ্ঞানের বদলে চারি আৰ্যসত্যের প্রত্যক্ষ ভিত্তির উপর এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মকে দাঁড় করাইলেও নিত্য শান্তি বা সুখ লাভ করিবার জন্য তৃষ্ণা কিংবা বাসনার ক্ষয় করিয়া মনকে নিষ্কাম করিবার যে মাৰ্গ বুদ্ধের উপদিষ্ট সেই মার্গ (চতুর্থ সত্য), এবং মোক্ষলাভের জন্য উপনিষদের বর্ণিত মার্গ - এই দুই মাৰ্গ বস্তুত একই হওয়ায়, দুই ধর্মের চরম দৃশ্যসাধ্য মনের নির্বিষয় অবস্থাই, ইহা স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু এই দুই ধর্মের মধ্যে প্ৰভেদ এই যে, ব্ৰহ্ম ও আত্মাকে যাঁহারা এক বলিয়া মানেন সেই উপনিষৎকারেরা মনের এই নিষ্কাম অবস্থাকে ‘আত্মনিষ্টা’, ‘ব্রহ্মসংস্থা’, ‘ব্ৰহ্মভূততা’, ‘ব্রহ্মনিৰ্বাণ’ [গী|৫|১৭-২৫; ছাং|২|২৩|১], অর্থাৎ ব্রহ্মেতে আত্মার লয় হওয়া, ইত্যাদি চরম আধারসূচক নাম দিয়াছেন, এবং বুদ্ধ উহাকে কেবল ‘নির্বাণ’ অর্থাৎ “বিরাম পাওয়া বা প্রদীপ নিভিবার ন্যায় বাসনার নাশ হওয়া” এই ক্রিয়াপ্রদর্শক নাম দিয়াছেন । কারণ, ব্ৰহ্ম বা আত্মা ভ্ৰম, ইহা বলিবার পর এই প্ৰশ্নই আর থাকে না যে, “বিরাম কে পায়, ও কেমন করিয়া পায়” [সুত্তনিপাতে রতনসুত্ত|১৪ ও বঙ্গীসসুত্ত|১২ ও ১৩ দেখ]এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তির এই গুঢ় প্রশ্নের বিচারও করা উচিত নহে, ইহা বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন [সব্বাসবসুক্ত|৯-১৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|২|৪ ও ৫ দেখ] । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, এই জন্য এক দেহের নাশ হইয়া অন্য দেহ প্ৰাপ্ত হইবার সাধারণ ক্রিয়া সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত ‘মরণ’ শব্দের উপযোগ বৌদ্ধধর্মের অনুসারে ‘নির্বাণ’ সম্বন্ধে করিতেও পারা যায় না । নির্বাণ তো ‘মরণের মরণ’ কিংবা উপনিষদের বর্ণনা অনুসারে “মৃত্যু পার হইবার পথ” - শুধু মরণ নহে । সাপ যেরূপ আপন নির্মোক পরিত্যাগ করিতে ভয় পায় না, সেইরূপ এই অবস্থায় উপনীত মনুষ্য নিজের শরীরের জন্য ভাবে না, বৃহদারণ্যক-উপনিষদে [৪|৪|৭] এই যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে, তাহাই প্রকৃত বৌদ্ধভিক্ষুর বর্ণনা করিবার সময় সুত্তনিপাতের অন্তৰ্গত উরগসুত্তের প্রত্যেক শ্লোকে গৃহীত হইয়াছে । “আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি পাপপুণ্যে সর্বদাই অলিপ্ত থাকায় [বৃ|৪|৪|২৩] মাতৃবধ কিংবা পিতৃবধের সদৃশ পাতকেরও দোষ তাহাকে স্পর্শ করে না”, বৈদিক ধর্মের এই তত্ত্ব [কৌষী|ব্রা|৩|১] ধম্মপদে শব্দশঃ যেমনটি-তেমনি বলা হইরাছে [ধম্ম|২৯৪ ও ২৯৫ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|৫|৭ দেখ] ।


4.2) সার কথা


ব্ৰহ্ম ও আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধ স্বীকার না করিলেও মনকে শান্ত, বিরক্ত ও নিষ্কাম করা প্রভৃতি মোক্ষলাভের যে সকল সাধন উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, সেই সকল সাধনই বুদ্ধের মতে নির্বাণলাভের পক্ষেও আবশ্যক, এই জন্য বৌদ্ধ যতি ও বৈদিক সন্ন্যাসীর বৰ্ণনা মানসিক অবস্থার দৃষ্টিতে একই রকমের; এবং সেই কারণেই পাপপুণ্যের দায়িত্ব সম্বন্ধে, এবং জন্ম-মরণের চক্ৰ হইতে মুক্তিলাভ বিষয়ে বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের সিদ্ধান্তই বৌদ্ধধর্মেও বজায় রাখা হইয়াছে । কিন্তু বৈদিক ধর্ম গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী হওয়ায়, এই বিচার আসলে যে বৈদিক ধর্মেরই সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই ।


5) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - গাৰ্হস্থ্যমার্গের বিচার



বৈদিক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসধর্মের ভেদাভেদ কি, তাহা বলিয়াছি । এক্ষণে গাৰ্হস্থ্যধর্ম সম্বন্ধে বুদ্ধ কি বলিয়াছেন তাহা দেখা যাক । আত্মানাত্মবিচারের তত্ত্ব জ্ঞানকে প্রাধান্য না দিয়া সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব প্রভৃতি দৃশ্য ভিত্তির উপরেই বৌদ্ধধর্মকে খাড়া করা হইলেও, মনে থাকে যেন, কোঁতের ন্যায় আধুনিক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের নিছক আধিভৌতিক ধর্মের সদৃশ - কিংবা গীতাধর্মেরও মত - বৌদ্ধধর্ম মূলে প্ৰবৃত্তিমূলক নহে । ইহা সত্য যে, উপনিষদের আত্মজ্ঞানের তাত্ত্বিক ‘দৃষ্টি’ বুদ্ধের মান্য নহে, কিন্তু “সংসার সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া মনকে নির্বিষয় ও নিষ্কাম করাই এই জগতে মনুষ্যের একমাত্র পরম কর্তব্য”, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বর্ণিত যাজ্ঞবল্ক্যের এই সিদ্ধান্ত [বৃ|৪|৪|৬] বৌদ্ধধর্মে সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখা হইয়াছে । এই জন্য বৌদ্ধধর্ম মূলে কেবল সন্ন্যাসপ্ৰধান হইয়াছে । সংসারকে ত্যাগ না করিয়া, কেবল গৃহস্থাশ্রমেই থাকিলে, পরম সুখ ও অৰ্হতাবস্থা লাভ করা কখনই সম্ভব নহে, ইহাই বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের তাৎপৰ্য হইলেও ইহা বুঝিতে হইবে না যে, উহাতে গাৰ্হস্থ্যবৃত্তির কিছুমাত্র বিচারই নাই । ভিক্ষু না হইয়া, বুদ্ধ, বুদ্ধের ধর্ম ও বৌদ্ধভিক্ষুদিগের সংঘ বা মণ্ডলী - এই তিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধৰ্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি”, এই সংকল্প উচ্চারণের দ্বারা যাহারা ঐ তিনের শরণাপন্ন হয়, বৌদ্ধগ্রন্থে তাহাদিগকে ‘উপাসক’ বলা হয় । ইহারাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী গৃহস্থ ।” এই উপাসকেরা স্বকীয় গাৰ্হস্থ্যবৃত্তি কিরূপে নিৰ্বাহ করিবে তৎসম্বন্ধে বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বয়ং বুদ্ধ কোন কোন স্থানে উপদেশ করিয়াছেন [মহাপরিনিব্বাণসুত্ত|১|২৪] । বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের মধ্যে হিংসাত্মক শ্রৌত যাগযজ্ঞ ও চাতুর্বর্ণ্যভেদ বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই বিষয়গুলি ছাড়িয়া দিলে, স্মার্ত্ত পঞ্চ মহাযজ্ঞ, দানাদি পরোপকারধর্ম ও নৈতিক আচরণ করাই গৃহস্থের কর্তব্য থাকিয়া যায়; এবং গৃহস্থ ধর্ম বর্ণনা করিবার সময় বৌদ্ধধর্মগ্রন্থে কেবল এই সকল বিষয়েরই উল্লেখ করা হয় । পঞ্চমহাযজ্ঞ প্রত্যেক গৃহস্থ অর্থাৎ উপাসকের অনুষ্ঠান করিতেই হইবে, ইহা বুদ্ধের মত । তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, সর্বভুতে দয়া ও (আত্মা স্বীকৃত না হইলেও) আত্মৌপম্যদৃষ্টি, শৌচ বা মনের পবিত্রতা, এবং বিশেষ করিয়া সৎপাত্রে অর্থাৎ বৌদ্ধ-ভিক্ষুকে এবং বৌদ্ধ-ভিক্ষু-সংঘকে অন্নবস্ত্ৰাদি দান করা প্ৰভৃতি নীতিধর্মের পালন বৌদ্ধ উপাসককে করিতে হইবে । বৌদ্ধধর্মে ইহাকেই ‘শীল’ বলে; এবং উভয়ের তুলনা করিলে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, পঞ্চমহাযজ্ঞের ন্যায় এই নীতিধর্মও ব্রাহ্মণধর্মের ধর্মসূত্র এবং প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থ [মনু|৬৯২ ও ১০, ৬৩ দেখ] হইতে বুদ্ধ গ্ৰহণ করিয়াছেন (See Dr. Kern's “Manual of Buddhism”, Grundriss III, 8; p.68.) । অধিক কি, স্বয়ং বুদ্ধ এই আচরণ বিষয়ে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণ-ধম্মিকসুত্তে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণদিগের স্তুতি করিয়াছেন; এবং মনুস্মৃতির কতক শ্লোক তো ধম্মপদে অক্ষরশ পাওয়া যায় [মনু|২|১২১ ও ৫|৪৫ এবং ধম্মপদ|১০৯ ও ১৩১ দেখ] । বৈদিকগ্ৰন্থ হইতে বৌদ্ধধর্মে কেবল পঞ্চমহাযজ্ঞ ও নীতিধর্মই লওয়া হইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু গৃহস্থাশ্রমে সম্পূৰ্ণ মোক্ষলাভ কখনও হয় না, বৈদিকধর্মে পূর্বে কোন কোন উপনিষৎকার কর্তৃক প্রতিপাদিত এই মতও বুদ্ধ স্বীকার করিয়াছেন । উদাহরণ যথা – সুত্তনিপাতের ধম্মিকসুত্তে ভিক্ষুর সঙ্গে উপাসকের তুলনা করিয়া বুদ্ধ স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, উত্তম শীলের দ্বারা গৃহস্থ বড় জোর ‘স্বয়ংপ্রকাশ’ দেবলোক প্ৰাপ্ত হইবে, কিন্তু জন্মমরণের চক্ৰ হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভের জন্য সংসার ও পুত্ৰকলত্ৰাদি ত্যাগ করিয়া শেষে উহাকে ভিক্ষু-ধর্মই স্বীকার করিতে হইবে [ধম্মিক সুত্ত|১৭|২৯; ও বৃ|৪|৪|৬ ও মভা|বন|২|৬৩ দেখ] । তেবিজ্জসুত্তে বৰ্ণিত হইয়াছে [তে|সু|১|৩৫; ৩|৫] যে, কর্মমাৰ্গীয় বৈদিক ব্ৰাহ্মণদিগের সহিত তর্ক করিবার সময় নিজের উক্ত সন্ন্যাসপ্রধান মত সিদ্ধ করিবার জন্য বুদ্ধ “তোমার ব্ৰহ্মের যদি স্ত্রীপুত্র ও ক্ৰোধ-লোভ নাই, তবে স্ত্রী-পুত্রের মধ্যে থাকিয়া ও যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্ম করিয়া তোমাদের ব্ৰহ্মপ্ৰাপ্তি কিরূপে হইবে” এই প্ৰকার যুক্তিবাদ করিতেন । এবং এই কথাও প্ৰসিদ্ধ আছে যে, স্বয়ং বুদ্ধ যৌবনকালেই নিজের স্ত্ৰীপুত্র ও রাজ্য ত্যাগ করিয়া ভিক্ষুধর্ম অঙ্গীকার করিবার ছয় বৎসর পরে তিনি বুদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হন । বুদ্ধের সমকালীন, কিন্তু তাঁহার পূর্বেই সমাধিপ্রাপ্ত, মহাবীর নামক শেষ জৈন তীর্থঙ্করেরও উপদেশ এইরূপই । কিন্তু তিনি বুদ্ধের ন্যায় অনাত্মবাদী ছিলেন না; এবং এই দুই ধর্মের মধ্যে গুরুতর, প্ৰভেদ এই যে, বস্ত্ৰপ্ৰাবরণাদি ঐহিক সুখত্যাগ এবং অহিংসা ব্ৰত প্ৰভৃতি ধর্মপালন জৈন যতি বৌদ্ধভিক্ষু অপেক্ষা অধিক কড়াকড়িভাবে পালন করিতেন; এবং অদ্যাপি পালন করিয়া থাকেন । আহারেরই জন্য ইচ্ছাপূর্বক মারা হয় নাই এইরূপ প্ৰাণীদিগের ‘পবত্ত’ (সং, প্ৰবৃত্ত) অর্থাৎ ‘তৈয়ারী মাংস’ (হাতী, সিংহ প্ৰভৃতি কোন কোন প্ৰাণীকে বর্জন করিয়া) বুদ্ধ স্বয়ং খাইতেন এবং ‘পবত্ত’ মাংস ও মৎস্য বৌদ্ধভিক্ষুদিগকেও তিনি খাইতে অনুমতি দিয়াছেন; এবং বস্ত্ৰ ব্যতীত নগ্ন হইয়া ভ্ৰমণ করা বৌদ্ধভিক্ষুধর্মের নিয়মানুসারে দোষ [মহাবগ্‌গ|৬|৩১|১৪ ও ৮|২৮|১] । সারকথা, অনাত্মবাদী ভিক্ষু হও, ইহা বুদ্ধের নিশ্চিত উপদেশ হইলেও, কায়ক্লেশময় উগ্র তপ সম্বন্ধে বুদ্ধের অভিমত ছিল না [মহাবগ্‌গ|৫|১|১৬ ও গী|৬|১৬]; বৌদ্ধভিক্ষুদিগের বিহারের অর্থাৎ তাহাদের থাকিবার মঠের সমস্ত ব্যবস্থাও এরূপ রাখা হইত যাহাতে শরীরের বেশী কষ্ট না হয় এবং প্ৰাণায়ামাদি যোগাভ্যাস সহজে হইতে পারে । তথাপি অৰ্হতাবস্থা বা নিৰ্বাণসুখ প্ৰাপ্তির জন্য গৃহস্থাশ্রম ছাড়িতেই হইবে, এই তত্ত্ব বৌদ্ধধর্মে পুরাপুরি বজায় থাকায় বৌদ্ধধর্ম যে সন্ন্যাসপ্রধান, ইহা বলিতে কোন প্ৰত্যবায় নাই ।


6) গীতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে শ্লোকসাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়


ব্ৰহ্মজ্ঞান ও আত্মানাত্ম-বিচার ভ্ৰমের একটা বড় জালমাত্ৰ, ইহাই যদিও বুদ্ধের স্থির মত ছিল, তথাপি এই প্ৰত্যক্ষ কারণের জন্য অর্থাৎ দুঃখময় সংসারচক্র হইতে মুক্ত হইয়া নিরন্তর শান্তি ও সুখ লাভ করিবার জন্য উপনিষদে বর্ণিত সন্ন্যাসমার্গীদিগের সাধন - বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে নিৰ্বিষয় করা - তাঁহার স্বীকৃত হইয়াছিল । এবং চাতুর্বর্ণ্যভেদ ও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া বৌদ্ধধর্মে বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের নীতিনিয়মই অল্প হেরফেরে গৃহীত হইয়াছে, ইহা যখন সিদ্ধ হইল, তখন যদি উপনিষদ ও মনুস্মৃতি ইত্যাদি গ্রন্থে বৈদিক সন্ন্যাসীদিগের যে বৰ্ণনা আছে তাহা, এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বা অৰ্হৎদিগের বর্ণনা অথবা অহিংসাদি নীতিধর্ম, দুই ধর্মে একই সমান - কখন কখন শব্দশও একই - দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কিছু আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, এই সমস্ত কথা মূল বৈদিক ধর্মেরই । কিন্তু কেবল এই বিষয়গুলিই বৌদ্ধেরা বৈদিকধর্ম হইতে গ্ৰহণ করে নাই, প্ৰত্যুত দশরথজাতকের মত বৌদ্ধধর্মের জাতকগ্ৰন্থও প্রাচীন বৈদিক পুরাণ-ইতিহাসকথার বৌদ্ধধর্মানুকুল করিয়া রচিত রূপান্তরমাত্র । শুধু বৌদ্ধেরা কেন, জৈনেরাও স্বকীয় অভিনব পুরাণসমূহে বৈদিক কথা-সকলের এইরূপ রূপান্তর করিয়াছে । খৃষ্টের পর আবির্ভূত মহম্মদীয় ধর্মে খৃষ্টচরিত্রের এইরূপ এক বিপৰ্যয় করা হইয়াছে, ইহা সেল সাহেব লিখিয়াছেন (See Sale's Koran “To the Reader” (Preface) p. x and the Preliminary Discourse, Sec, IV, p.58; Chandos Classics Ed.). আধুনিক গবেষণা হইতে সিদ্ধ হইয়াছে যে, বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারের অন্তৰ্গত সৃষ্টির উৎপত্তি, প্ৰলয় ও নোয়া প্রভৃতির কথা, প্রাচীন খাল্‌দীয় জাতির ধর্মকথার এইরূপ রূপান্তর করিয়া ইহুদীরা বর্ণনা করিয়াছে । উপনিষৎ, প্ৰাচীন ধর্মসূত্র ও মনুস্মৃতিতে বর্ণিত কথা কিংবা বিচার যখন বৌদ্ধগ্রন্থে এইরূপ – অনেক সময় একেবারে শব্দশ – গৃহীত হইয়াছে, তখন সহজেই এই অনুমান হয় যে, ইহা আসলে মহাভারতেরই । বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা এই সকল উহা হইতেই উদ্ধৃত করিয়া থাকিবেন । বৈদিক ধর্মগ্রন্থের যে ভাব ও শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহার কয়েকটি উদাহরণ প্রদত্ত হইল — “জয়ের দ্বারা বৈরতা বৃদ্ধি হয়; এবং বৈরতা দ্বারা বৈরতার উপশম হয় না” [মভা|উদ্যো|৭১|৫৯ ও ৬৩] “অন্যের ক্রোধকে শান্তির দ্বারা জয় করিবে” ইত্যাদি বিদুরনীতির উপদেশ [মভা|উদ্যো|৩৮|৭৯], এবং জনকের এই উক্তি - “আমার এক বাহু চন্দনে চর্চিত করা ও অন্য বাহু কাটিয়া ফেলা আমার নিকট উভয়ই সমান” [মভা|শাং|৩২০|৩৬]; ইহার অতিরিক্ত মহাভারতের আরও অনেক শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশ পাওয়া যায় [ধম্মপদ|৫ ও ২২৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৭|৩|৫] । ইহা নিঃসন্দেহ যে, উপনিষৎ, ব্রহ্মসূত্র ও মনুস্মৃতি প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থ বুদ্ধাপেক্ষা প্রাচীন, তাই উহাদের যে সকল শ্লোক বা বিচার বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে নিঃসংশয়ে বলিতে পারা যায় যে, বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা সেগুলি উক্ত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন । কিন্তু এই কথা মহাভারতের বিষয়ে বলিতে পারা যায় না । মহাভারতেই বৌদ্ধ ‘ডাগোবাদিগের’ যে উল্লেখ আছে, তাহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মহাভারতের শেষ সংস্করণ বুদ্ধের পরে হইয়াছে । অতএব কেবল শ্লোকসাদৃশ্য হইতে স্থির সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না যে, বর্তমান মহাভারত বৌদ্ধগ্রন্থের পূর্ববর্তীই, এবং গীতা মহাভারতেরই এক অংশ হওয়ায় ঐ ন্যায়ই গীতাসম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । তাছাড়া, গীতাতেই ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ আছে এবং ব্ৰহ্মসূত্রে বৌদ্ধমতের খণ্ডন আছে, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । অতএব স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা প্ৰভৃতি সম্বন্ধে (বৈদিক ও বৌদ্ধ) উভয়ের সাদৃশ্য ছাড়িয়া দিয়া এখানে বিচার করিব যে, উক্ত সংশয় দূর করিবার এবং গীতাকে নির্বিবাদরূপে বৌদ্ধগ্রন্থ হইতে প্রাচীন প্রমাণিত করিবার জন্য বৌদ্ধগ্রন্থে অন্য কোন উপকরণ পাওয়া যায় কি না ।


7) বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপের পরিবর্তন


বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপ নিছক নিরাত্মবাদী ও নিবৃত্তিমূলক, ইহা উপরে বলা হইয়াছে । কিন্তু উহার এই স্বরূপ বেশী দিন টিকে নাই । ভিক্ষুদিগের আচার সম্বন্ধে মতভেদ ঘটিল এবং বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাহার মধ্যে কেবল অনেক উপপন্থাই গঠিত হইতে আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু ধর্মতত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ মতভেদ উৎপন্ন হইল । আজকাল কেহ কেহ এই তর্কও করিতে আরম্ভ করিয়াছেন যে, ‘আত্মা নাই’ এই উক্তি দ্বারা এই কথা বলাই বুদ্ধের মনোগত অভিপ্ৰায় যে, “অচিন্ত্য আত্মজ্ঞানের শুষ্ক তর্কের মধ্যে না গিয়া বৈরাগ্য ও অভ্যাসের দ্বারা মনকে নিষ্কাম করিতে প্ৰথমে চেষ্টা কর, আত্মা থাক্‌ বা নাই থাক্‌; মনোনিগ্রহের কাজই মুখ্য এবং তাহা সিদ্ধ করিবার চেষ্টা প্ৰথমে করা আবশ্যক”; ব্ৰহ্ম বা আত্মার আদৌ অস্তিত্ব নাই এরূপ বলা তাহার অভিপ্ৰায় নহে । কারণ, তেবিজ্জসুত্তে স্বয়ং বুদ্ধ ‘ব্রহ্মসব্যতায়’ অবস্থার উল্লেখ করিয়াছেন এবং সেলসুত্তে ও থের-গাথাতে “আমি ব্ৰহ্মভুত” এইরূপ তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন [সেলসু|১৪; থেরগা|৮৩১ দেখ]  । কিন্তু মূল কারণ যাহাই হৌক, ইহা নির্বিবাদ যে, এই প্রকার নানাবিধ মত, তর্ক ও উৎসাহী পন্থা তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে রচিত হইয়া প্রচার করিতেছিল যে, “আত্মা বা ব্ৰহ্মের মধ্যে কোন নিত্য বস্তুই জগতের মূলে নাই, যাহা কিছু দেখা যায় তাহা ক্ষণিক বা শূন্য” অথবা “যাহা কিছু দেখা যায় তাহা জ্ঞান, জ্ঞান-ছাড়া জগতে কিছুই নাই” ইত্যাদি [বেসূ|শাং ভা|২|২|১৮-২৬ দেখ] । এই নিরীশ্বর ও অনাত্মবাদী বৌদ্ধ মতকেই ক্ষণিকবাদ, শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ বলা হয় । এই সমস্ত পন্থার এখানে বিচার করিবার কোন প্ৰয়োজন নাই । আমাদের প্রশ্ন ঐতিহাসিক । তাই, উহার মীমাংসা পক্ষে ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা যতটুকু আবশ্যক তাহাই এখানে করা হইতেছে । 


7.1) ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা


বুদ্ধের মূল উপদেশে আত্মা বা ব্ৰহ্মের (অর্থাৎ পরমাত্মা বা পরমেশ্বরের) অস্তিত্বই অস্বীকৃত কিংবা গৌণ বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায় স্বয়ং বুদ্ধের জীবদ্দশায় ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরকে লাভ করিবার মার্গের উপদেশ করা সম্ভব ছিল না; এবং তাঁহার ভব্য মূর্তি ও চরিত্র লোকদিগের চক্ষের সম্মুখে যে পৰ্যন্ত প্ৰত্যক্ষ ছিল সে পৰ্যন্ত এই মার্গের কোন আবশ্যকতাই ছিল না । কিন্তু পরে ইহা আবশ্যক হইল যে, এই ধর্ম সাধারণ লোকের প্রিয় হউক এবং ইহার আরও বেশী প্রচারও হউক । অতএব সংসার ত্যাগ করিয়া ও ভিক্ষু হইয়া মনোনিগ্রহের দ্বারা স্বস্থানে থাকিয়াই নিৰ্বাণ লাভ করিবার - কিসে তাহা না বুঝিয়া - এই নিরীশ্বর নিবৃত্তিমাৰ্গ অপেক্ষা কোন সহজ ও প্ৰত্যক্ষ-মার্গের প্রয়োজন হইল । খুব সম্ভব যে, সাধারণ বুদ্ধভক্তেরা তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক ভক্তিমার্গের অনুকরণ করিয়া, আপনারাই বুদ্ধের উপাসনা প্ৰথম প্ৰথম আরম্ভ করিয়া থাকিবে । অতএব বুদ্ধের নির্বাণের পর শীঘ্রই বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা বুদ্ধকেই “স্বয়ম্ভূ ও অনাদ্যনন্ত পুরুষোত্তমের” রূপ প্ৰদান করেন; এবং তাঁহারা বলিতে লাগিলেন যে, বুদ্ধের নির্বাণ পাওয়াও বুদ্ধেরই লীলা; “প্রকৃত বুদ্ধের কখনও বিনাশ হয় না - তাঁহার অস্তিত্ব চিরস্থায়ী” । সেইরূপ আবার, বৌদ্ধগ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইতে লাগিল যে, প্রকৃত বুদ্ধ “সর্বজগতের পিতা এবং লোকেরা তাঁহারই সন্তান” অতএব তিনি সকলের প্রতিই “সমদৃষ্টি, কাহাকেও তিনি প্রীতি করেন না, কাহাকেও তিনি দ্বেষও করেন না”, “ধর্মের ব্যবস্থা বিগ্‌ড়াইয়া গেলে তিনি ‘ধর্ম কার্যের’ জন্যই সময়ে সময়ে বুদ্ধের রূপে প্ৰকট হইয়া থাকেন”, এবং এই দেবাদিদেব বুদ্ধের প্রতি “ভক্তি করিলে, তাঁহার গ্রন্থের পুজা করিলে এবং তাঁহার ডাগোবার সম্মুখে কীর্তন করিলে” অথবা “তাঁকে ভক্তি-পূর্বক দুই-চারি কমল বা একটী ফুল দিলেই” মনুষ্য সদ্‌গতিলাভ করে [সদ্ধর্মপুণ্ডরীক|২|৭৭-৯৮; ৫|২২; ১৫|৫-২২ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৩|৭|৭ দেখ] । (সদ্ধর্মপুণ্ডরীক গ্রন্থের প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালার ২১ খণ্ডে ভাষান্তর হইয়াছে । এই গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত । এক্ষণে মূল সংস্কৃত ভাষার গ্ৰন্থও ছাপা হইয়াছে ।) মিলিন্দপ্রশ্নে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, “মনুষ্যের সমস্ত জীবিতকাল দুরাচরণে অতিবাহিত হইলেও মৃত্যুসময়ে যদি সে বুদ্ধের শরণ লয়, তাহা হইলে তাহার স্বৰ্গলাভ না হইয়া যায় না” [মি|প্র|৩|৭|২]; এবং  সদ্ধর্মপুণ্ডরীকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে সবিস্তার বর্ণিত হইয়াছে যে, সমস্ত লোকের “অধিকার, স্বভাব ও জ্ঞান একই প্ৰকার না হওয়ায়, অনাত্মপর নিবৃত্তিপ্রধান মাৰ্গ ব্যতীত ভক্তির এই মাৰ্গ (যান) বুদ্ধই কৃপা করিয়া স্বকীয় ‘উপায়কুশলতা দ্বারা’ নির্মাণ করিয়াছেন” । নিৰ্বাণাবস্থা প্ৰাপ্তির জন্য ভিক্ষুধর্মকেই স্বীকার করিতে হইবে, বুদ্ধ স্বয়ং এই যে ধর্মতত্ত্ব উপদেশ করিয়াছেন, ইহা একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ, তাহা করিলে বুদ্ধের মূল উপদেশেই হরতাল লাগানো হইত । কিন্তু ইহা বলা কিছু অনুচিত ছিল না যে, ভিক্ষু হইল তো কি হইল, অরণ্যে ‘গণ্ডারের’ মত একাকী ও উদাসীনভাবে না থাকিয়া ধর্মপ্রচারাদি লোকহিতকর ও পরোপকার-কার্য ‘নিরিস্‌সিত’ বুদ্ধিতে করাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কর্তব্য; এই মতই মহাযান পন্থার সদ্ধর্মপুণ্ডরীকাদি গ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে (সুত্ত-নিপাতে খগ্‌গ-বিসাণসুত্তের ৪১ শ্লোকের ধ্রুবপদ “একো চরে খগ্‌গবিসাণ কপ্পো” এইরূপ আছে । খগ্‌গবিসাণ অর্থাৎ গণ্ডার, এবং উহারই ন্যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর বনে একাকী বাস করিতে হয়, উহার এই অর্থ ।) । এবং নাগসেন মিলিন্দিকে বলিয়াছেন যে, “গৃহস্থাশ্ৰম নিৰ্বাহ করিয়া নিৰ্বাণপদ লাভ করা একেবারেই অসম্ভব নহে, - এবং ইহার অনেক উদাহরণও আছে ।” [মি|প্ৰ|৬|২|৪] । ইহা যে-কোন-লোকের সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, এই বিচার অনাত্মবাদী ও নিছক্‌ সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মের নহে, অথবা শূন্যবাদ বা বিজ্ঞানবাদ স্বীকার করিয়াও ইহার উপপত্তি জানা যায় না; এবং প্রথম প্রথম অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মীর নিজেদেরই মনে হইত যে এই বিচার বুদ্ধের মূল উপদেশের বিরুদ্ধ । কিন্তু আবার এই নূতন মতটিই স্বভাবত অধিকাধিক লোকপ্রিয় হইতে লাগিল; এবং বুদ্ধের মূল উপদেশ অনুসারে যাহারা চলিত তাহাদেব নাম হইল “হীনযান” (হাল্কা মাৰ্গ) এবং এই নূতন পন্থার নাম হইল ‘মহাযান’ (বড় মার্গ) । 
(হীনযান ও মহাযান এই দুই পন্থায় ভেদ-বৰ্ণনা-কালে ডাঃ কেৰ্ণ বলেন - Not the Arhat who has shaken off all human feeling, but the generous, self-sacrificing, active Bodhisattva is the ideal of the Mahayanists, and this attractive side of the creed has, more perhaps than anything else, contributed to their wide conquests, whereas S. Buddhism has not been able to make converts except where the soil had been prepared by Hinduism and Mahayanism,” - Manual of Indian Buddhism. 69. Southern Buddhism অর্থাৎ হীনযান । মহাযানপন্থায় ভক্তিরও সমাবেশ হইয়াছিল Mahayanism lays a great stress on devotion, in this respect as in many others harmonising with the current of feeling in India which led to the growing importance of Bhakti.” Ibid p.124.)

চীনতিব্বৎ ও জাপান প্রভৃতি দেশে আজকাল যে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত আছে তাহা মহাযান পন্থার; এবং বুদ্ধের নির্বাণের পরে মহাযানপন্থী ভিক্ষু-সংঘের দীর্ঘ উদ্যোগেই বৌদ্ধধর্মের এত শীঘ্ৰ বিস্তার হয় । বৌদ্ধধর্মে এই যে সংস্কার সাধিত হইয়াছিল, তাহা শালিবাহন শকের প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে হইয়া থাকিবে এইরূপ ডাঃ কেৰ্ণ স্থির করিয়াছেন । (See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism”, pp.6, 69 and 119, মিলিন্দ, মিনণ্ডর নামক গ্রীক রাজা, প্রায় খৃঃ পূঃ ১৪০ কিংবা ১৫০ অব্দে ভারতবর্ষের বায়ুকোণে ব্যাক্‌ট্ৰীয়া দেশে রাজত্ব করিতেন । তাঁহাকে নাগসেন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন ইহা মিলিন্দপ্রশ্নে উক্ত হইয়াছে । মহাযানপন্থার লোকেরাই বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰচার কাৰ্য করিত, তাই ইহা সুস্পষ্ট যে, মহাযানপন্থা তখন আবির্ভূত হইয়াছিল ।) কারণ, শক রাজা কনিষ্কের শাসনকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যে এক মহাপরিষৎ বসিয়াছিল উহাতে মহাযানপন্থার ভিক্ষুরা উপস্থিত ছিল, এইরূপ বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লেখ আছে । এই মহাযানপন্থার ‘অমিতায়ুসুত্ত’ নামক প্রধান সুত্ৰগ্রন্থের চিনীয় ভাষায় ভাষান্তর প্রায় ১৪৮ খৃষ্টাব্দে করা হয়; তাহা এখন পাওয়া গিয়াছে । কিন্তু আমার মতে, এই কাল ইহা হইতেও প্ৰাচীন হইবে । কারণ, খৃষ্টের প্রায় ২৩০ বৎসর পূর্বে প্ৰকাশিত অশোকের শিলালিপিতে সন্ন্যাসমূলক নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্মের বিশেষ ভাবে কোনই উল্লেখ নাই; উহাতে সর্বত্র প্রাণীমাত্রের প্রতি দয়াপর প্রবৃত্তিমূলক বৌদ্ধধর্মই উপদিষ্ট হইয়াছে । তখন ইহা সুস্পষ্ট যে, তৎপূর্বেই বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থায় প্রবৃত্তিপ্রধান স্বরূপ আসিতে আরম্ভ হইয়াছিল । বৌদ্ধ যতি নাগার্জুন এই পথের মুখ্য প্ৰবর্তক ছিলেন, মূল সংস্থাপক নহে ।


8) বৌদ্ধধর্মে ভক্তিমার্গের উন্মেষে ভগবদ্গীতার প্রভাব ?


ব্ৰহ্ম বা পরমাত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া, উপনিষদের মতানুসারে কেবল নিবৃত্তিমার্গের মনকে নিৰ্বিষয় করিবার উপদেশ যে মূল নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহা হইতেই পরে ক্রমশ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপর প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বাহির হওয়া কখনও কি সম্ভব ছিল; এই জন্য বুদ্ধের নির্বাণের পর, শীঘ্রই বৌদ্ধধর্ম যে এই কর্মপ্রধান ভক্তির স্বরূপ প্রাপ্ত হইল, ইহা হইতে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, ইহার জন্য বৌদ্ধধর্মের বাহিরের তৎকালীন কোন-না-কোন অন্য কারণ থাকিবে; এবং এই কারণের বিচারে প্রবৃত্ত হইলে, ভগবদ্গীতার উপর দৃষ্টি না পড়িয়া থাকিতে পারে না । কারণ, ভারতবর্ষে তৎকালে প্ৰচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে জৈন ও উপনিষদ্‌ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্তিপরই ছিল, ইহা আমি গীতারহস্যের একাদশ প্ৰকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি; এবং বৈদিক ধর্মান্তৰ্গত পাশুপত কিংবা শৈব ও প্রভৃতি পন্থা ভক্তিপর হইলেও প্রবৃত্তিমাৰ্গ ও ভক্তির মিলন ভগবদ্গীতা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাইতেছিল না । গীতায় ভগবান আপনাকে পুরুষোত্তম নামে অভিহিত করিয়াছেন এবং এই বিচার ভগবদ্গীতাতেই আসিয়াছে যে, “আমি পুরুষোত্তমই সমস্ত লোকের ‘পিতা’ ও ‘পিতামহ’ [৯|১৭]; আমার নিকট সকলেই সমান (‘সম’), আমার কেহ দ্বেষ্যও নাই, কেহ প্রিয়ও নাই [৯|২৯]; আমি অজ ও অব্যয় হইয়াও ধর্মসংরক্ষণার্থ সময়ে সময়ে অবতার ধারণ করি [৪|৬-৮]; মনুষ্য যতই দুরাচারী হোক না, আমাকে ভজনা করিলে সে সাধু হইয়া যায় [৯|৩০], কিংবা আমাকে ভক্তিপূর্বক ফুল, পত্র কিংবা একটু জলও দিলে আমি তাহা সন্তোষের সহিত গ্ৰহণ করি [৯|২৬]; এবং অজ্ঞলোকের জন্য ভক্তি এক সুলভ মাৰ্গ” [১২|৫]; ইত্যাদি । এই প্ৰকারই ব্ৰহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির লোকসংগ্ৰহাৰ্থ প্ৰবৃত্তিধর্মকেই স্বীকার করা কর্তব্য, এই তত্ত্ব গীতা ছাড়া অন্য কোথাও সবিস্তার প্রতিপাদিত হয় নাই । তাই, এইরূপ অনুমান অগত্যা করিতে হয় যে, মূল বৌদ্ধধর্মে যেরূপ বাসনাক্ষয়ের নিছক নিবৃত্তিপর মাৰ্গ উপনিষৎ হইতে গৃহীত হইয়াছে, সেইরূপই পরে মহাযানপন্থা বাহির হইলে পর উহাতে প্ৰবৃত্তি প্ৰধান ভক্তিতত্ত্বও ভগবদ্গীতা হইতেই গৃহীত হইয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাটা কিছু অনুমানের উপরেই অবলম্বিত নহে । তিববতীয় ভাষায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধে বৌদ্ধধর্মী তারানাথের যে এক গ্ৰন্থ আছে তাহাতে স্পষ্ট লিখিত হইয়াছে যে, মহাযানপন্থার মুখ্য প্ৰবর্তকের অর্থাৎ “নাগার্জুনের গুরু রাহুলভদ্র নামক বৌদ্ধ প্ৰথমে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, এবং জ্ঞানী শ্ৰীকৃষ্ণ ও গণেশ এই ব্ৰাহ্মণের (মহাযানপন্থার) কল্পনা উদ্রেক করিবার কারণ হইয়াছিলেন” । ইহা ব্যতীত অন্য এক তিব্বতীয় গ্রন্থেও এইরূপ উল্লেখই পাওয়া যায় ।
(See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism” p. 122. “He (Nagarjuna) was a pupil of the Brahmana Rahulabhadra, who himself was a Mahayanist. This Brahmana was much indebted to sage Krishna and still more to Ganesha. This quasi-historical notice, reduced to its less allegorical expression, means that Mahayanisim is much indebted to the Bhagabadgita and more even to Shivaism.” ‘গণেশ’ শব্দে ডাঃ কের্ণ শৈবপন্থা বুঝিয়াছেন মনে হয় । ডাঃ কের্ণ, প্রাচ্যধর্মপুস্তক-মালায় সদ্ধর্মপুণ্ডরীকগ্রন্থের ভাষান্তর করিয়াছেন এবং তাঁহার প্রস্তাবনায় এই মতই তিনি প্রতিপাদন করিয়াছেন (S.B.E. Vol. XXI, Intro. pp. xxv-xxviii.)

তারানাথের গ্ৰন্থ প্রাচীন নহে, একথা সত্য; কিন্তু উহার বর্ণনা প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তি ছাড়িয়া হয় নাই ইহা বলা বাহুল্য । কারণ, কোনও বৌদ্ধ গ্ৰন্থকার স্বকীয় ধর্মপন্থার তত্ত্ব বলিবার সময় বিনা, কোন কারণে পরধর্মীর এই প্রকার উল্লেখ করিবে ইহা সম্ভবপর নহে । এইজন্য স্বয়ং বৌদ্ধগ্রন্থকারগণ কর্তৃক এই বিষয়ে শ্ৰীকৃষ্ণের নামোল্লেখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য । কারণ ভগবদ্গীতা ব্যতীক্ত শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত অন্য প্ৰবৃত্তিপর ভক্তিগ্ৰন্থ বৈদিক ধর্মেই নাই; অতএব ইহা হইতে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয় যে, মহাযানপন্থার আবির্ভাবের পূর্বেই শুধু ভাগবতধর্ম নহে, ভাগবতধর্মসম্বন্ধীয় শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত গ্ৰন্থ অর্থাৎ ভগবদ্গীতাও সে সময়ে প্রচলিত ছিল; এবং ডাঃ কেৰ্ণও এই মত সমর্থন করেন । গীতার অস্তিত্ব যখন বৌদ্ধধর্মীয় মহাযানপন্থার পূর্ববর্তী স্থির হইল, তখন মহাভারতও উহার সঙ্গে ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে । বুদ্ধের মৃত্যুর পর সত্বরই তাঁহার মত সকল একত্ৰ সংগ্ৰহ করা হইয়াছিল, ইহা বৌদ্ধগ্রন্থে উক্ত হইয়াছে; কিন্তু ইহা হইতে সিদ্ধ হয় না যে, বর্তমান কালে প্ৰাপ্ত অতি প্ৰাচীন বৌদ্ধগ্ৰন্থও সেই সময়েই রচিত হইয়াছিল । মহাপরিনিব্বাণসুত্ত বর্তমান বৌদ্ধ গ্ৰন্থসমূহের মধ্যে প্ৰাচীন গ্ৰন্থ বলিয়া স্বীকৃত হয় । কিন্তু উহাতে পাটলিপুত্র নগর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাহা হইবে প্রোফেসর রিস্‌-ডেভিড্‌স্‌ দেখাইয়াছেন যে, এই গ্ৰন্থ বুদ্ধের নির্বাণের অন্যূন শত বৎসর পূর্বেও বোধ হয় রচিত হয় নাই । এবং বুদ্ধের শত বৎসর পরে, বৌদ্ধধর্মীয় ভিক্ষুদের যে দ্বিতীয় পরিষদের অধিবেশন হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা বিনয়পিটকের অন্তর্গত চুল্লবগ্‌গ গ্রন্থের শেষে দেওয়া হইয়াছে । ইহা হইতে জানা যায় যে, সিংহলদ্বীপের পালিভাষায় লিখিত বিনয়পিটকাদি প্ৰাচীন বৌদ্ধ গ্ৰন্থ, এই পরিষদের পরে রচিত (See S.B.E. Vol. XI. Intro. pp, xv xx and p.58.) । এই বিষয়ে বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরাই বলিয়াছেন যে, অশোকের পুত্ৰ মহেন্দ্ৰ খৃঃ পূঃ প্ৰায় ২৪১ অব্দে সিংহল দ্বীপে যখন বৌদ্ধধর্ম প্রচার করিতে আরম্ভ করেন, সেই সময় এই গ্ৰন্থও সেখানে গিয়াছে, এবং তাহার প্রায় ১৫০ বৎসর পরে ইহা সেখানে সর্বপ্রথম পুস্তকাকারে লিখিত হয় । এই গ্ৰন্থ কণ্ঠস্থ করিবার রীতি ছিল, তৎপ্রযুক্ত মহেন্দ্রের কাল হইতে উহাতে কোনও পরিবর্তন হয় নাই, ইহা মনে করিলেও, কি প্রকারে বলা যাইতে পারে যে, বুদ্ধের নির্বাণের পরে এই গ্ৰন্থ যখন সর্বপ্রথম রচিত হয় তখন, অথবা পরে মহেন্দ্ৰ বা অশোকের কাল পৰ্যন্ত, তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতে ইহাতে কোন কিছুই গৃহীত হয় নাই ? অতএব মহাভারত বুদ্ধের পরে হইলেও অন্য প্ৰমাণ হইতে উহার, আলেক্‌জণ্ডর বাদ্‌শার পূৰ্ববর্তী, অর্থাৎ খৃঃ পূঃ ৩২৫ অব্দের পূর্ববর্তী হওয়া সিদ্ধ হয়; এইজন্য মনুস্মৃতির শ্লোকের ন্যায় মহাভারতের শ্লোকও মহেন্দ্রের সিংহলে নীত পুস্তকসমূহের মধ্যে পাওয়া সম্ভব ।


9) সার কথা


বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁহার ধর্মের প্রসার হইতেছে দেখিয়া শীঘ্রই প্ৰাচীন বৈদিক গাথা ও কথাসমূহ মহাভারতে একত্র সংগ্ৰহ করা হয়; উহার যে শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশঃ পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ গ্রন্থকারেরা মহাভারত হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন, মহাভারতকার বৌদ্ধ গ্ৰন্থ হইতে গ্ৰহণ করেন নাই । কিন্তু যদি স্বীকার করা যায় যে, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরা এই সকল শ্লোক মহাভারত হইতে না লইয়া মহাভারতেরও আধারভূত কিন্তু এক্ষণে বিলুপ্ত তৎপূর্ববর্তী প্রাচীন বৈদিক গ্ৰন্থাদি হইতে লইয়া থাকিবেন; এবং সেইজন্য মহাভারতের কালনির্ণয় উপযুক্ত শ্লোকসাদৃশ্য হইতে সম্পূর্ণরূপে হয় না, তথাপি নিম্নোক্ত চারি বিষয় হইতে ইহা তো নিঃসন্দেহ সিদ্ধ হয় যে, বৌদ্ধধর্মে মহাযানপন্থার প্রাদুর্ভাব হইবার পূর্বে কেবল ভাগবতধর্মই প্ৰচলিত ছিল না, বরং সে সময় ভগবদ্গীতাও সর্বমান্য হইয়াছিল, এবং এই গীতারই আধারে মহাযানপন্থা বাহির হইয়াছে, এবং শ্ৰীকৃষ্ণপ্রণীত গীতার তত্ত্ব বৌদ্ধধর্ম হইতে গৃহীত হয় নাই । এই চারিটি বিষয় হইতেছে –
(১) নিছক্‌ অনাত্মবাদী ও সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্ম হইতেই পরে ক্রমশঃ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপ্রধান ও প্ৰবৃত্তিপ্ৰধান তত্ত্ব বাহির হওয়া অসম্ভব,
(২) মহাযানপন্থার উৎপত্তি সম্বন্ধে স্বয়ং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারগণ শ্ৰীকৃষ্ণের নাম স্পষ্ট নির্দেশ করিয়াছেন,
(৩) মহাযানপন্থার মতের সহিত গীতার ভক্তিপর ও প্ৰবৃত্তিপর তত্ত্বের অৰ্থতঃ ও শব্দশঃ সাদৃশ্যআছে, এবং
(৪) বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালে প্ৰচলিত অন্যান্য জৈন ও বৈদিক পন্থায় প্রবৃত্তিপর ভক্তিমার্গের প্রচার ছিল না ।
উপযুক্ত প্ৰমাণসমূহ হইতে বর্তমান গীতার যে কাল নির্ণীত হইয়াছে তাহার সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে ।

গীতা ও বাইবেল

1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য – পাদ্রিদের ভ্রান্ত প্রচার


উপর্য্যুক্ত আলোচনা হইতে স্থির হইল যে, ভারতবর্ষে ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব প্রায় ১৪ শতাব্দীতে হইয়াছিল, এবং খৃষ্টের পূর্বে প্ৰাদুর্ভূত সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মে প্ৰবৃত্তিপ্রধান ভক্তিতত্ত্বের প্রবেশ, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারদিগেরই মতে, শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰণীত গীতারই কারণে হইয়াছে । গীতার অনেক সিদ্ধান্ত খৃষ্টানদিগের নূতন বাইবেলেও পাওয়া যায়; বস্‌, এই ভিত্তির উপরেই খৃষ্টধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব গীতায় গৃহীত হইয়া থাকিবে, এইরূপ কতকগুলি পাদ্রি স্বকীয় গ্রন্থে প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন, এবং বিশেষতঃ ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে; ডাঃ লরিনসর গীতার জর্মন অনুবাদগ্রন্থে যাহা কিছু প্ৰতিপাদন করিয়াছেন তাহার নির্মূলত্ব এক্ষণে স্বতই সিদ্ধ হয় । লরিনসর স্বকীয় পুস্তকের (গীতার জর্মন ভাষান্তরের) শেষে ভগবদ্গীতা ও বাইবেলের-বিশেষত নূতন বাইবেলের প্ৰায় শতাধিক স্থলে শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছেন এবং তন্মধ্যে কতকগুলি অসাধারণ ও ভাবিয়া দেখিবার যোগ্যও আছে । উদাহরণ যথা - “সেইদিন তোমরা জানিতে পরিবে যে, আমি আমার পিতার মধ্যে, তোমরা আমার মধ্যে এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি” [জন|১৪|২০], এই বাক্য গীতার “যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি” [গী|৪|৩৫] এবং “যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি” [গী|৬|৩০] এই বাক্যগুলির সহিত কেবল সমানার্থকই নহে, প্ৰত্যুত শব্দশও একই । সেইরূপ জনের পরবর্তী “যে আমাকে প্ৰীতি করে আমিও তাহাকে প্ৰীতি করি ।” এই বাক্য [১৪|২১], গীতার “প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যৰ্থং অহং স চ মম প্ৰিয়ঃ” [গী|৭|১৭] এই বাক্যের সহিত সর্বাংশেই সদৃশ । এই বাক্য এবং এই প্রকার অন্য সদৃশ বাক্য হইতে ডাক্তার লরিনসর এইরূপ অনুমান করেন যে, বাইবেল গীতাকারের বিদিত ছিল, এবং গীতা খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পরে রচিত হইয়া থাকিবে । ডাঃ লরিনসরের পুস্তকের এই অংশের ইংরাজী অনুবাদ ‘ইণ্ডিয়ান আন্টিকোয়ারি’র দ্বিতীয় খণ্ডে সেই সময়ে প্ৰকাশিত হইয়াছিল । এবং ৺ তৈলং ভগবদ্গীতার যে পদ্যাত্মক ইংরাজী অনুবাদ করিয়াছেন তাহার প্রস্তাবনায় তিনি লরিনসরের মতের সম্পূর্ণ খণ্ডন করিয়াছেন । (See Bhagavadgita translated into English Blank Verse with Notes &c. by K. T. Telang, 1875 (Bombay). This book is different from the translation in the S.B.E. Series.)

ডাঃ লরিনসর পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া পরিগণিত ছিলেন না, এবং সংস্কৃত অপেক্ষা খুষ্টধর্মের জ্ঞান ও অভিমান তাহার অধিক ছিল । তাই, তাঁহার মত, শুধু ৺ তৈলঙ্গের নহে, কিন্তু মোক্ষমূলার প্রভৃতি প্ৰধান প্ৰধান পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগেরও অগ্রাহ্য হইয়াছিল । বেচারা লরিনসরের এ কল্পনাও হয় তো আসে নাই যে, একবার যখন গীতার কাল নিঃসংশয়রূপে খৃষ্টপূর্ব বলিয়া স্থির হইল, তখনই গীতা ও বাইবেলের মধ্যে যে শত শত অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছি তাহা ভূতের মতো উল্টা আমারই ঘাড়ে চাপিবে । কিন্তু ইহাতে সন্দেহ নাই যে, যাহা কখনও স্বপ্নেরও গোচর হয় না, তাহাই কখন কখন চক্ষের সম্মুখে আসিয়া খাড়া হয় ও সত্য সত্য প্রত্যক্ষ হয়, তবে এখন ডাঃ লরিনসরের কথার উত্তর দিবার কোনই আবশ্যকতা নাই । তথাপি কোন কোন বড় ইংরাজী গ্রন্থে এখনও এই মিথ্যা মতেরই উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাই এখানে এই সম্বন্ধে আধুনিক গবেষণার পর যাহা নিষ্পন্ন হইয়াছে, তাহাই সংক্ষেপে বলা অবশ্যক মনে হয় । 


2) যুক্তির দ্বারা গ্রন্থদ্বয়ের সাম্য বিচার


প্ৰথমে ইহা মনে রাখা উচিত যে, যখন কোন দুই গ্রন্থের সিদ্ধান্ত একরকম হয়, তখন কেবল এই সিদ্ধান্তের সাম্য হইতেই কোন গ্ৰন্থটি প্রথম এবং কোনটি পরবর্তী, তাহা নির্ণয় করা যাইতে পারে না । কারণ এস্থলে এই দুই-ই সম্ভব যে, (১) এই দুয়ের মধ্যে প্রথম গ্রন্থের বিচার দ্বিতীয় গ্রন্থ হইতে, কিম্বা (২) দ্বিতীয় গ্রন্থের বিচার প্রথম গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়া থাকিবে । তাই প্ৰথমে যখন দুই গ্রন্থের কাল স্বতন্ত্রভাবে করিয়া লওয়া হয়, তখন আবার বিচারসাদৃশ্য হইতে স্থির করিতে হয় যে, অমুক গ্ৰন্থকার অমুক গ্ৰন্থ হইতে অমুক বিচার গ্রহণ করিয়াছেন । তাছাড়া, একই রকম বিচার দুই বিভিন্ন দেশের দুই গ্ৰন্থকারের মনে স্বতন্ত্রভাবে একই কালে কিংবা অগ্রপশ্চাতে উদয় হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে; এই জন্য, ঐ দুই গ্রন্থের সাম্য দেখিবার সময় ইহাও বিচার করিতে হয়যে, উহার উদ্ভব স্বতন্ত্রভাবে হওয়া সম্ভব কি না; এবং যে দুই দেশে এই গ্ৰন্থ রচিত হইল, তাহাদের মধ্যে তৎকালে যাতায়াত বা কারবার থাকায় এক দেশ হইতে এই বিচার অপর দেশে যাওয়া সম্ভব ছিল কি না । এই প্রকার সকল দিক হইতে দেখিলে দেখা যায় যে, খৃষ্টধর্ম হইতে কোন বিষয়ই গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব ছিল না; বরঞ্চ গীতার তত্ত্বসমূহের ন্যায় যে কিছু তত্ত্ব খৃষ্টীয় বাইবেলে পাওয়া যায়, সেগুলি বাইবেলেই, অন্তত বৌদ্ধ ধর্ম হইতে - অৰ্থাৎ পর্যায়ক্ৰমে গীতা বা বৈদিক ধর্ম হইতেই - খৃষ্ট কিংবা তাঁহার শিষ্যদের কর্তৃক গৃহীত হওয়াই খুব সম্ভব; এবং কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত এক্ষণে ইহা স্পষ্টরূপে বলিতেও আরম্ভ করিয়াছেন । এই প্রকারে দাঁড়িপাল্লা অন্যদিকে ঝুঁকিয়াছে দেখিয়া গোঁড়া খৃষ্টভক্তেরা আশ্চৰ্য হইবেন এবং এই কথা অস্বীকারের দিকেই যদি তাহাদের মনের প্রবণতা হয়, তাহাতে আশ্চৰ্য হইবার কিছুই নাই । কিন্তু ইহাঁদিগকে আমি এইটুকু বলিতে চাহি যে, এই প্রশ্ন ধর্মঘটিত নহে, ইহা ঐতিহাসিক; অতএব ইতিহাসের চিরন্তন পদ্ধতি অনুসারে অধুনা উপলব্ধ বিষয়সমূহের শান্তভাবে বিচার করা আবশ্যক । তার পর ইহা হইতে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেই সিদ্ধান্তই সকলের পক্ষে, বিশেষত বিচারসাদৃশ্যের প্রশ্ন যাঁহারা প্রথমে উপস্থিত করিয়াছেন তাঁহাদের পক্ষে আনন্দের সহিত ও পক্ষপাতরহিত বুদ্ধিতে গ্রহণ করাই ন্যায্য ও যুক্তিসিদ্ধ ।


3) ইহুদী বাইবেল ও খৃষ্টধর্মের নব-বিধান


ইহুদী বাইবেলে অর্থাৎ বাইবেলের পুরাতন বিধানে প্ৰতিপাদিত প্ৰাচীন ইহুদী ধর্মের সংস্করণ হিসাবে খৃষ্টধর্মের নব-বিধান বাহির হইয়াছে । ইহুদী ভাষায় ঈশ্বরকে ‘ইলোহা’ (আরবী ‘ইলাহ’) বলে । কিন্তু মোজেসের (Moses) স্থাপিত নিয়মানুসারে ইহুদীধর্মের মুখ্য উপাস্য দেবতার বিশেষ সংজ্ঞা হইল ‘জিহোভা’ । পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই এক্ষণে স্থির করিয়াছেন যে, এই ‘জিহোভা’ শব্দ মূলে ইহুদী শব্দ নহে; খাল্‌দীয় ভাষার ‘যবে’ (সংস্কৃত যহ্ব) শব্দ হইতে আসিয়াছে । ইহুদীরা মূর্তিপূজক নহে । অগ্নিতে পশু বা অন্য বস্তুর হোম করা; ঈশ্বরের ব্যাখ্যাত নিয়ম-সকল পালন করা এবং তাঁহার দ্বারা ইহলোকে নিজের ও নিজের জাতির কল্যাণ সাধন করা - ইহাই উহাদের ধর্মের মুখ্য আচার । সংক্ষেপে বলিতে হইলে, বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড অনুসারে, ইহুদী ধর্মকেও যজ্ঞময় ও প্ৰবৃত্তিপর বলা যায় । ইহার বিরুদ্ধে অনেক স্থানে খৃষ্টের উপদেশ আছে যে, ‘আমি (হিংসাকারক) যজ্ঞ চাহি না, আমি (ঈশ্বরের) কৃপা চাই’ [মাথ্যু|৯|১৩], ঈশ্বর ও দ্রব্য উভয়ের সাধন এক-সঙ্গে হইতে পারে না” [মাথ্যু|৬|২৪], ‘যে অমৃতত্ব লাভ করিতে চাহে, তাহাকে স্ত্রীপুত্ৰ ত্যাগ করিয়া আমার ভক্ত হইতে হইবে’ [মাথ্যু|১৯|২১]; এবং তাঁহার শিষ্যদিগকে ধর্মপ্রচারার্থ যখন দেশবিদেশে প্রেরণ করেন, তখন সন্ন্যাসধর্মের এই নিয়ম সকল পালন করিবার জন্য খৃষ্ট তাহাদিগকে উপদেশ করিলেন যে, “তোমরা তোমাদের কাছে সোনা, রূপা কিংবা অনাবশ্যক বস্ত্ৰাচ্ছাদনও রাখিবে না” [মাথ্যু|১০|৯-১৩] । ইহা সত্য যে, আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসকল খৃষ্টর এই সমস্ত উপদেশ গুটাইয়া তাকে উঠাইয়া রাখিয়াছেন; কিন্তু আধুনিক শঙ্করাচার্য হাতী ঘোড়া ব্যবহার করিলে শাঙ্কর সম্প্রদায়কে যেরূপ দরবারী বলা যায় না, সেইরূপ আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসমূহের এই আচরণের জন্য মূল খৃষ্টধর্মও প্ৰবৃত্তিপর ছিল, একথা বলা যায় না । মূল বৈদিক ধর্ম কর্মকাণ্ডাত্মক হইলে পরও, যে প্রকার তাহার মধ্যে পরে জ্ঞানকাণ্ডের আবিভাব হইয়াছিল, সেইপ্রকারই ইহুদী ও খৃষ্টধর্মেরও সম্বন্ধ । কিন্তু বৈদিক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ জ্ঞানকাণ্ডের ও তাহার পর ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি শত শত বৎসর পৰ্যন্ত হইতে চলিয়াছে; কিন্তু একথা খৃষ্টধর্মে খাটে না ।


4) এসী/এসীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়


ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, খৃষ্টের অনধিক প্রায় ২০০ বৎসর পূর্বে এসী বা এসীন (Essenes) নামক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইহুদিদিগের দেশে সহসা আবির্ভূত হইয়াছিল । এই এসী লোকেরা ইহুদীধর্মাবলম্বী হইলেও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া উহারা কোন নির্জনস্থানে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তায় কালাতিপাত করিত, এবং জীবিকার জন্য বড় জোর কৃষিকার্যের মত কোন নিরুপদ্রব ব্যবসায় করিত । অবিবাহিত থাকা, মদ্যমাংস বর্জন করা, শপথ গ্ৰহণ না করা, সংঘের সহিত মঠে থাকা, এবং কেহ কোন দ্রব্য পাইলে তাহা সমস্ত সংঘের সামাজিক লাভ মনে করা প্ৰভৃতি এই সম্প্রদায়ের মুখ্য তত্ত্ব ছিল । এই মণ্ডলীর মধ্যে কেহ প্ৰবেশ করিতে চাহিলে, তাহাকে তিন বৎসর উমেদারী করিয়া তাহার পর কতকগুলি নিয়ম পালন করিব বলিয়া স্বীকার করিতে হইত । উহাদের মুখ্য মঠ মৃতসমুদ্রের (Dead Sea) পশ্চিমাধারে এঙ্গদীতে (Ein Gedi) ছিল; সেখানেই উহারা সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়া শান্তিতে অবস্থিতি করিত । স্বয়ং খৃষ্ট এবং তাঁহার শিষ্যেরা নববিধান বাইবেলে এসী সম্প্রদায়ের মতের যেরূপ সম্মান পূর্বক নির্দেশ করিয়াছেন [মাথ্যু|৫|৩৪; ১৯|১২; জেম্‌স্‌|৫|১২; কৃত্য|৪|৩২-৩৫], তাহা হইতে দেখা যায় যে, যিশু খৃষ্ট এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন; এবং এই পন্থার সন্ন্যাসধর্ম তিনি অধিক প্রচার করিয়াছেন ।


5) ইহুদীদের মধ্যে সন্ন্যাসপর ধর্মের উৎপত্তি


খৃষ্টের সন্ন্যাসপর ভক্তিমার্গের পরম্পরা এই প্রকারে এসী-সম্প্রদায়ের পরম্পরার সহিত মিলাইয়া দিলেও মূল কর্মময় ইহুদী ধর্মের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী সম্প্রদায়ই বা কিরূপে প্রাদুর্ভূত হইল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাহার কোন-না কোন সযুক্তিক উপপত্তি বলা আবশ্যক । খৃষ্ট এসীন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, এইরূপ কেহ কেহ বলিয়া থাকেন । এখন ইহা সত্য বলিয়া মনে করিলেও বাইবেলের নববিধানে যে সন্ন্যাসপর ধর্ম বৰ্ণিত হইয়াছে তাহার মূল কি, কিংবা কর্ম প্ৰধান ইহুদীধর্মে তাহার আবির্ভাব সহসা কিরূপে হইল এই প্রশ্নটিকে এড়াইতে পারা যায় না । ইহাতে কেবল এইটুকু ভেদ হয় যে, এসীন সম্প্রদায়ের উৎপত্তিসম্বন্ধীয় প্রশ্নের বদলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । কারণ, এক্ষণে সমাজশাস্ত্রের এই মামুলী সিদ্ধান্ত স্থির হইয়া গিয়াছে যে, কোনও বিষয় কোথাও হঠাৎ উৎপন্ন হয় না, উহা আস্তে আস্তে অনেক দিন পুর্ব হইতে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; এবং যেস্থলে এই প্ৰকার বৃদ্ধি নজরে না আসে, সেস্থলে প্রায়ই উহা পরকীয় দেশ হইতে কিংবা পরকীয় লোক হইতে গৃহীত হইয়া থাকে” । এই কঠিন সমস্যা প্ৰাচীন খৃষ্টীয় গ্ৰন্থকারদিগের নজরে যে আসে নাই এরূপ নহে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম যুরোপীয়দিগের জ্ঞানগোচরে আসিবার পূর্বে অর্থাৎ খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পৰ্যন্ত তত্ত্বানুসন্ধায়ী খৃষ্টীয় বিদ্বানদিগের এই মত ছিল যে, গ্ৰীক ও ইহুদি লোকদিগের পরস্পর নিকট-সম্বন্ধ ঘটিলে পর গ্রীকলোকদিগের - বিশেষতঃ পাইথাগোরসের-তত্ত্বজ্ঞানের কল্যাণে কর্মময় ইহুদীধর্মে এসী-সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসমার্গের আবির্ভাব হইয়া থাকিবে । কিন্তু আধুনিক গবেষণা হইতে এই সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানা যায় না । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, যজ্ঞময় ইহুদী ধর্মেই একা এক সন্ন্যাসপর এসী-ধর্মের বা খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হওয়া স্বভাবত সম্ভব ছিল না, এবং তাহার জন্য ইহুদীধর্মের বাহিরে উহার অন্য কোন-না-কোন কারণ হইয়াছিল - এই কল্পনাটি নূতন নহে, কিন্তু খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে খৃষ্টান পণ্ডিতদিগেরও এই মত গ্ৰাহ্য হইয়াছিল ।


6) বৌদ্ধধর্মের সহিত এসী/খৃষ্টধর্মের সাম্য


কোলব্রুক বলিয়াছেন যে, পাইথাগোরসের তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বজ্ঞানের কোথাও অধিক সাম্য আছে; তাই উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করিলেও বলা যাইতে পারে যে, এসী-সম্প্রদায়ের জনকত্ব পরম্পরাক্রমে ভারতবর্ষেই আসে । (See Colebrooke's Miscellaneous Essays, Vol.1, pp. 399-400.) কিন্তু এতটা ঘোর-ফের করিবারও কোন আবশ্যকতা নাই । বৌদ্ধগ্ৰন্থ ও বাইবেলের নববিধান তুলনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, পাইথাগোরীয় মণ্ডলীর সহিত এসী বা খৃষ্টধর্মের যত সাম্য আছে, তদপেক্ষা অধিক ও বিশেষ সাম্য বৌদ্ধধর্মের সহিত শুধু এসীধর্মেরই নহে, কিন্তু খৃষ্টচরিত্র ও খৃষ্ট-উপদেশেরও আছে । খৃষ্টকে ভুলাইবার জন্য যেরূপ শয়তান চেষ্টা করিয়াছিল এবং যে প্রকার সিদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হইবার সময় খৃষ্ট যেরূপ ৪০ দিন উপবাস করিয়াছিলেন, সেইরূপই বুদ্ধকেও মারের ভয় দেখাইয়া মোহমুগ্ধ করিবার জন্য চেষ্টা করা হইয়াছিল এবং সেই সময় বুদ্ধ ৪৯ দিন (সাত সপ্তাহ) উপবাসী ছিলেন, ইহা বুদ্ধচরিত্রে বর্ণিত হইয়াছে । এই প্রকারেই পূৰ্ণশ্ৰদ্ধার প্রভাবে জলের উপর দিয়া চলা, মুখের দেহের কান্তি সম্পূর্ণ সুৰ্যের সদৃশ করা, অথবা শরণাগত চোর ও বেশ্যাদিগকেও সদ্‌গতি দেওয়া, ইত্যাদি কথা বুদ্ধ ও খৃষ্ট উভয়ের চরিত্রে একই সমান পাওয়া যায়; এবং “তুমি আপন প্রতিবেশীকে এবং বৈরীকেও প্রীতি করিবে” প্ৰভৃতি খৃষ্টের যে মুখ্য মুখ্য নৈতিক উপদেশ আছে, তাহাও কখন কখন একেবারে অক্ষরশঃ মূল বৌদ্ধধর্মের মধ্যে খৃষ্টের পূর্বেই আসিয়াছে । উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, ভক্তির তত্ত্ব মূল বৌদ্ধধর্মে ছিল না; কিন্তু তাহাও পরে, অর্থাৎ খৃষ্টের ন্যূন দুই তিন শতাব্দী পূর্বেই, মহাযান বৌদ্ধপন্থায় ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত হইয়াছিল 

মিঃ আৰ্থর লিলী স্বকীয় পুস্তকে প্রমাণের সহিত স্পষ্ট দেখাইয়াছেন যে, এই সাম্য শুধু এইটুকু বিষয়েই পর্যাপ্ত নহে, ইহা ব্যতীত খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে আরও শত শত ছোটখাটো বিষয়ে এইরূপই সাম্য আছে । অধিক কি, খৃষ্টকে ক্রুশে চড়াইয়া বধ করিবার দরুণ খৃষ্টানদিগের নিকট ক্রুশের চিহ্ন পবিত্র ও পূজ্য সেই ক্রুশের চিহ্নকে ‘স্বস্তিক’  আকারে বৈদিক ও বৌদ্ধধর্মের লোকেরা খৃষ্টের শত শত বৎসর পুর্বাবধিই শুভদায়ক বলিয়া মনে করিত; এবং ইজিপ্ট প্রভৃতি পৃথিবীর পুরাতন খণ্ডের দেশেই শুধু নহে, কিন্তু কলম্বসের কয়েক শতাব্দী পূর্বে আমেরিকার পেরু ও মেক্‌সিকো দেশেও স্বস্তিক-চিহ্ন শুভাবহ বলিয়া বিবেচিত হইত, ইহা প্রত্নতত্ত্ববেত্তারা স্থির করিয়াছেন । (See “The Secret of the Pacific” by C. Reginald Enock, 1912, pp, 248-252.) ইহা হইতে অনুমান করিতে হয় যে, খৃষ্টের পূর্বেই স্বস্তিক চিহ্ন সমস্ত লোকের পূজ্য ছিল, পরে খৃষ্টভক্তেরা কোন-এক বিশেষ ধরণে উহারই উপযোগ করিয়া লয় । বৌদ্ধ ভিক্ষু ও প্রাচীন খৃষ্টধর্মোপদেশকদিগের, বিশেষত প্ৰাচীন পাদ্রীদিগের, পরিচ্ছদ ও ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যেও অনেক সাম্য আছে । উদাহরণ যথা, ‘ব্যাপ্‌টিজ্‌ম্‌-এর অনুষ্ঠান অর্থাৎ স্নানোত্তর দীক্ষা দিবার অনুষ্ঠানও খৃষ্টের পূর্বেই প্রচলিত ছিল । এক্ষণে ইহা সপ্রমাণ হইয়াছে যে, দূর-দূর দেশে ধর্মোপদেশক পাঠাইয়া ধর্ম প্রচার করিবার পদ্ধতি খৃষ্টীয় ধর্মোপদেশকদিগের পূর্বেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদিগের সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়াছিল ।

এই প্রশ্ন যে-কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, বুদ্ধ ও খৃষ্টের চরিত্র ও নৈতিক উপদেশে এবং এই দুই ধর্মের অনুষ্ঠানবিধির মধ্যে এই যে অসাধারণ ও ব্যাপক সাম্য দেখিতে পাওয়া যায়, ইহার কারণ কি ? 
(এই সম্বন্ধে মিঃ আর্থর লিলী Buddhism in Christendom এই নামে এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ লিখিয়াছেন; তাছাড়া স্বকীয় মত সংক্ষেপে Buddha and Buddhism নামক গ্রন্থের শেষ চার ভাগে স্পষ্টরূপে নিরূপণ করিয়াছেন । আমি পরিশিষ্টের এই ভাগে যে বিচার আলোচনা করিয়াছি তাহা মুখ্যরূপে এই দ্বিতীয় গ্রন্থের আধারেই করিয়াছি । Buddha and Buddhism গ্রন্থ The World’s Epoch-makers Series-এ ১৯০০ খৃষ্টাব্দে প্ৰকাশিত হয় এবং তাহার দশম ভাগে, বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্মের মধ্যে প্রায় ৫০টা সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন ।)


7) বৌদ্ধধর্মের সহিত এই সাম্যের কারণ


বৌদ্ধ ধর্ম-গ্রন্থের অনুশীলনের ফলে এই সাম্য যখন প্রথম-প্ৰথম পাশ্চাত্যদিগের নজরে পড়িল, তখন কোন কোন খৃষ্টীয় পণ্ডিত বলিতে লাগিলেন যে, বৌদ্ধের এই তত্ত্ব ‘নেষ্টোরিয়ান’ (Nestorianism) নামক আসিয়াখণ্ডে (Sasanian Empire) প্রচলিত খৃষ্টীয় পন্থা হইতে গ্ৰহণ করিয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাই সম্ভবপর নহে; কারণ, নেষ্টার সম্প্রদায়ের প্রবর্তকই খৃষ্টের প্রায় সওয়া চারি শত বৎসর পরে আবির্ভূত হইয়াছিলেন; এবং এখন অশোকের শিলালিপি হইতে নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পূর্বে এবং নেষ্টারের প্রায় নয় শত বৎসর পূর্বে - বুদ্ধের জন্ম হইয়া গিয়াছিল । অশোকের সময়ে, অর্থাৎ খৃষ্টের অন্তত আড়াই শত বৎসর পূর্বে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে ও আশপাশের দেশে খুব প্রচলিত হইয়াছিল; এবং বুদ্ধ-চরিত্ৰাদি গ্ৰন্থও তখন রচিত হইয়াছিল । এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনত্ব যখন নির্বিবাদ, তখন খৃষ্টীয় ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তৎসম্বন্ধে দুই পক্ষমাত্র অবশিষ্ট থাকিয়া যায়; (১) ঐ সাম্য স্বতন্ত্র ভাবে দুইদিকে উৎপন্ন হইয়া থাকিবে, কিংবা (২) বৌদ্ধ ধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব খৃষ্ট বা খৃষ্টের শিষ্যেরা গ্ৰহণ করিয়া থাকিবেন । প্রোঃ রিস-ডেভিড্‌স্‌ বলেন যে, এই বিষয়ে বুদ্ধ ও খৃষ্টের পরিস্থিতির ঐক্য নিবন্ধন, উভয়ের মধ্যেই এই সাম্য, স্বভাবতই স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইয়াছে । (See Buddhist Suttas, S.B.E. Series Vol XI, p.163.) কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলেই সহজে উপলব্ধি হইবে যে, এই কল্পনা সন্তোষজনক নহে । কারণ, কোন নূতন বিষয় কোথাও যখন স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয়, তখন উহা ক্ৰমে ক্ৰমেই হইয়া থাকে এবং সেইজন্য উহার উন্নতির ক্রমও আমরা বলিতে পারি । উদাহরণ যথা - বৈদিক কর্মকাণ্ড হইতে জ্ঞানকাণ্ড, এবং জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ উপনিষৎ হইতেই পরে ভক্তি, পাতঞ্জল যোগ কিংবা শেষে বৌদ্ধধর্ম কেমন করিয়া নিঃসৃত হইল, যুক্তিসহকারে তাহার ক্রমপরম্পরা ঠিক দেখান যাইতে পারে । কিন্তু যজ্ঞময় ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসপার এসী বা খৃষ্টধর্মের উদ্ভব এই প্রকারে হয় নাই । উহা একেবারেই উৎপন্ন হইয়াছে; এবং উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, প্রাচীন খৃষ্টান পণ্ডিতও ইহা মানিতেন যে, এইভাবে উহার একেবারে উৎপন্ন হইবার কোন কিছু কারণ ইহুদীধর্মের বাহিরে ঘটিয়া থাকিবে । তাছাড়া, খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তাহা এত অসাধারণ ও সম্পূর্ণ যে, সেরূপ সাম্য স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইতেই পারে না । ইহা যদি সপ্ৰমাণ হইয়া গিয়া থাকিত যে, সে সময় বৌদ্ধধর্মের কথা ইহুদীদিগের জানাই সর্বথা অসম্ভব ছিল, তবে সে কথা স্বতন্ত্র ছিল । কিন্তু ইতিহাস হইতে সপ্ৰমাণ হয় যে, আলেক্‌জাণ্ডারের পরবর্তী সময়ে - এবং বিশেষতঃ অশোকের সময়েই (অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ বৎসরে) - বৌদ্ধ যতির পূর্বদিকে ইজিপ্টের অন্তর্গত আলেকজান্দ্ৰিয়া এবং গ্রীস পৰ্যন্ত প্ৰবেশ করিয়াছিল । অশোকের এক শিলালিপিতে এইরূপ লিখিত আছে যে, তিনি ইহুদীলোকদিগের এবং আশপাশের দেশসমূহের গ্ৰীক রাজা আন্টিওকসের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন । সেইরূপ বাইবেলে ইহা বর্ণিত হইয়াছে [মাথ্যু|২|১] যে, খৃষ্ট যখন জন্মিয়াছিলেন তখন পুর্বাঞ্চলের কোন, জ্ঞানী ব্যক্তি জেরুজালেমে গিয়াছিলেন, খৃষ্টানেরা বলেন যে, এই জ্ঞানী পুরুষেরা ‘মগী’ অর্থাৎ সম্ভবত ইরাণীধর্মের লোক হইবেন, - ভারতবর্ষের নহে । কিন্তু যাহাই বল না কেন, উভয়ের অর্থ তো একই । কারণ, এই কালের পুর্বেই বৌদ্ধধর্মের প্রসার কাশ্মীর ও কাবুলে হইয়া গিয়াছিল; এবং উহা পূর্বদিকে ইরান ও তুর্কিস্থান পৰ্যন্তও পৌঁছিয়াছিল, ইহা ইতিহাস হইতে স্পষ্ট জানা যায় । তাছাড়া, খৃষ্টের সময়ে ভারতবর্ষের এক যতি লোহিতসমুদ্রের উপকূলে এবং আলেকজান্দ্ৰিয়ার আশপাশের প্রদেশে প্রতিবৎসর আসিতেন, এইরূপ প্লুটার্ক স্পষ্ট লিখিয়াছেন ।
(“See Plutarch's Morals - Theosophical Essays”, translated by C. N. King (George Bell & Sons) pp. 96, 97. পালীভাষার মহাবংশে [২৯|৩৯] যবনদিগের অর্থাৎ গ্ৰীকদিগের অলসন্দা (যোননগরী হলসন্দা) নামক নগরের উল্লেখ আছে । উহাতে কথিত হইয়াছে যে, খৃষ্টীয় শতাব্দীর কয়েক বৎসর পূর্বে সিংহলে এক দেবালয়ের নির্মাণকালে অনেক বৌদ্ধ যতি উৎসব উপলক্ষে গিয়াছিল । মহাবংশের ইংরাজী অনুবাদক অলসন্দা শব্দে ইজিপ্টদেশের আলেকজান্দ্ৰিয়া নগর গ্রহণ না করিয়া, কাবুলের মধ্যে এই নামে আলেক্‌জাণ্ডার এক যে গ্রাম স্থাপন করেন, অলসন্দা শব্দে এই স্থানই বিবক্ষিত এইরূপ বলেন । কিন্তু ইহা ঠিক নহে । কারণ, এই ক্ষুদ্র গ্রামকে কেহই যবনদিগের নগর বলিত না । তাছাড়া উপরি-উক্ত অশোকের শিলালিপিতেই যবনদিগের রাজ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু পাঠাইবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে ।)

তাৎপৰ্য, খৃষ্টের দুই তিন শত বৎসর পূর্বেই, ইহুদীদের দেশে বৌদ্ধ যতিগণ যে প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে এখন আর কোন সংশয় নাই; এবং এই গতিবিধি যখন সপ্ৰমাণ হইল, তখন ইহুদীলোকের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী ধর্মের এবং পরে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তি প্রধান খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হইবার পক্ষে বৌদ্ধধর্মই যে বিশেষ কারণ হইয়া থাকিবে তাহা সহজেই নিষ্পন্ন হয় । ইংরাজ গ্রন্থকার লিলীও ইহাই অনুমান করিয়াছেন (See Lillie's Buddha and Buddhism pp, 158 ff.); এবং ইহার সমর্থনে ফরাসী পণ্ডিত এমিল্‌ বুর্ণুফ্‌ এবং রোস্নীর এই প্রকার মত আপন গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন; এবং জর্মনদেশে লিপজিকের তত্ত্বজ্ঞানশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রোঃ সেডন এই বিষয়সংক্রান্ত স্বকীয় গ্রন্থে এই মতই প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন । জর্মন প্রোফেসর শ্ৰডর তাঁহার এক নিবন্ধে বলেন যে, খৃষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণরূপে সমান নহে; দুয়ের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে সাম্য থাকিলেও অন্য বিষয়ে বৈষম্যও অনেক আছে এবং সেইজন্য খৃষ্টধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম হইতে নিঃসৃত এই মত গ্ৰাহ্য হইতে পারে না । কিন্তু এই কথা আসল বিষয়ের বহির্ভূত হওয়ায় এই কথার কোন মূল্য নাই । খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্ম সর্বাংশে একই, এ কথা কেহই বলে না; কারণ তাহা যদি হইত, তবে এই দুই ধর্ম ভিন্ন বলিয়া ধরা হইত না । মুখ্য প্রশ্ন তো এই যে, যখন মূলে ইহুদি ধর্ম নিছক কর্মময়, তখন উহাতে সংস্কারের আকারে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তিমাৰ্গপ্রতিপাদক খৃষ্টধর্মের আবির্ভাবের সম্ভবতঃ কি কারণ হইয়াছিল । এবং খৃষ্টধর্মাপেক্ষা বৌদ্ধধর্ম নিঃসংশয় প্রাচীন; উহার ইতিহাসের প্ৰতি লক্ষ্য করিলে, সন্ন্যাসপর ভক্তি ও নীতির তত্ত্ব খৃষ্ট স্বতন্ত্ররূপে আবিষ্কার করিষাছিলেন এই কথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না । খৃষ্ট দ্বাদশ বৎসর বয়স হইতে ত্ৰিশ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত কি করিতেন, অথবা কোথায় ছিলেন এই সম্বন্ধে বাইবেলে কোন সংবাদই পাওয়া যায় না । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, এই কাল তিনি সম্ভবত জ্ঞানার্জনে, ধর্মচিন্তনে, ও প্ৰবাসে অতিবাহিত করিয়াছিলেন । অতএব, জীবনের এই সময়ে তাঁহার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহিত প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সম্বন্ধ ঘটিয়াছিল কি না তাহা দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত কে বলিতে পারে ? কারণ, বৌদ্ধ যতিদিগের গতিবিধি সেই সময়ে গ্রীস দেশ পৰ্যন্ত ছিল । নেপালের এক বৌদ্ধ মঠের গ্রন্থে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, যিশু সেই সময়ে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন এবং সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন । নিকোলস নোটোভিশ নামক এক রুসিয়ান ভদ্রলোক এই গ্ৰন্থ প্রাপ্ত হইয়া ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ফরাসী ভাষায় তাহার ভাষান্তর প্রকাশ করিয়াছিলেন । নোটোভিশের ভাষান্তর ভাল হইলেও মূল গ্ৰন্থ পরে কোন মিথ্যুক মিথ্যা করিয়া রচনা করিয়াছে, এইরূপ অনেক খৃষ্ঠান পণ্ডিত বলেন । উক্ত গ্ৰন্থ এই পণ্ডিতেরা সত্য মনে করুন বলিয়া আমারও বিশেষ কোন আগ্রহ নাই । নোটোভিশ যে গ্রন্থ পাইয়াছেন তাহা সত্যই হউক বা প্রক্ষিপ্তই হউক, কেবল ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমি যে বিচার-আলোচনা উপরে করিয়াছি তাহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, খৃষ্টের না হউক, নিদান পক্ষে বাইবেলের নববিধানে তাঁহার চরিত্ৰলেখক ভক্তদিগের বৌদ্ধধর্মের কথা জানা অসম্ভব ছিল না; এবং ইহা যদি অসম্ভব না হয় তবে খৃষ্ট এবং বুদ্ধের চরিত্র ও উপদেশে যে অসাধারণ সাম্য পাওয়া যায়, উহার স্বতন্ত্র ভাবে উৎপত্তি স্বীকার করাও যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না ।
(রমেশচন্দ্র দত্তেরও এইরূপ মত; তিনি তাঁহার গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন । Romesh Chandra Dutt's History of Civilization in Ancient India, Vol II, Chap. xx. P.328-340.) 


8) সার কথা : বৈদিক ধর্ম ⇒ বৌদ্ধ ধর্ম ⇒ খৃষ্টধর্ম


সার কথা, মীমাংসকদিগের নিছক্‌ কর্মমাৰ্গ, জনকাদির জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগ (নৈষ্কর্ম্য), উপনিষৎকারদিগের ও সাংখ্যাদিগের জ্ঞাননিষ্ঠা ও সন্ন্যাস, চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জল যোগ, এবং পাঞ্চরাত্র বা ভাগবত ধর্ম অর্থাৎ ভক্তি - এই সমস্ত ধর্মাঙ্গ ও তত্ত্বই মূলে প্ৰাচীন বৈদিক ধর্মেরই অন্তর্ভূত । তন্মধ্যে ব্ৰহ্মজ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিকে ছাড়িয়া, চিত্তনিরোধ রূপ যোগ ও কর্মসন্ন্যাস এই দুই তত্ত্বেরই ভিত্তিতে বুদ্ধ সর্বপ্রথম আপন সন্ন্যাসপর ধর্ম চারি বর্ণকে উপদেশ করেন; কিন্তু পরে উহাতেই ভক্তি ও নিষ্কাম কর্ম মিলাইয়া দিয়া বুদ্ধের অনুগামীরা তাঁহার ধর্ম চারিদিকে প্রচার করেন । অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰকার প্রচার হইলে পর, নিছক কর্মপর ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসমার্গের তত্ত্ব প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ হয়; এবং শেষে উহাতেই ভক্তি মিলাইয়া দিয়া খৃষ্ট স্বকীয় ধর্ম প্ৰবর্তিত করেন । ইতিহাস হইতে নিষ্পন্ন এই পরম্পরা দেখিলে, ডাঃ লরিনসরের এই উক্তি তো অসত্য সিদ্ধ হয় যে, গীতাতে খৃষ্টধর্ম হইতে কোন কিছু গৃহীত হইয়াছে, বরং বিপরীতে, আত্মৌপম্যদৃষ্টি, সন্ন্যাস, নির্বৈরত্ব ও ভক্তির যে সকল তত্ত্ব বাইবেলের নববিধান-ভাগে পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ ধর্ম হইতে অর্থাৎ পরম্পরাক্রমে বৈদিক ধর্ম হইতে খৃষ্টধর্মে গৃহীত হওয়া খুব সম্ভবমাত্র নহে, বরঞ্চ গৃহীত হওয়াই বিশ্বাসযোগ্য । এবং ইহার জন্য হিন্দুদিগকে অপরের মুখের দিকে তাকাইবার কোনও আবশ্যকতা ছিলই না, ইহা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় ।


9) উপসংহার


এই প্রকারে, এই প্ৰকরণের আরম্ভে প্ৰদত্ত সাত প্রশ্নের বিচার শেষ হইল । এক্ষণে ইহারই সঙ্গে কতকগুলি এইরূপ গুরুতর প্রশ্ন উদিত হয় যে, ভারতবর্ষে যে ভক্তিপন্থা আজকাল প্ৰচলিত আছে, উহার উপর ভগবদ্গীতার কি পরিণাম ঘটয়াছে ? কিন্তু এই সকল প্ৰশ্নকে গীতাগ্রন্থসম্বন্ধীয় বলা অপেক্ষা হিন্দুধর্মের আধুনিক ইতিহাসের অন্তর্গত এইরূপ বলাই সঙ্গত, সেইজন্য, এবং বিশেষতঃ এই পরিশিষ্ট প্রকরণ অল্প অল্প করিলেও আমার নির্দিষ্ট সীমা অনেক অতিক্রম করিয়াছে; অতএব গীতার বহিরঙ্গের বিচার-আলোচনা এইখানেই শেষ করা গেল ।
Reference:
"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ