হিজরি ১১ সালে (আনুমানিক ৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) যে উজ্জ্বল তারকা আরব-জগতে ২৩ বছর ধরে জ্বলজ্বল করছিল তা অবশেষে অস্তমিত হয়ে গেল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আনসারদের মাঝে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় নবির মরদেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বানু সায়েদা সভাকক্ষে আনসাররা জমায়েত হলেন। তাঁরা আওয়াজ তুললেন, “আমাদের জন্য একজন আমির, তোমাদের জন্য আরেক আমির। এর ফলে যা হবার তাই হল। মক্কা থেকে আসা মুহাজির এবং মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌছায়। ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলে এটা পরিষ্কার জানা যায় যে, নবির মৃত্যুর পর মুসলমানদের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতার লড়াই দানা বাঁধে। এই ক্ষমতার সংগ্রামে ‘ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে হাতিয়ার হিসেবে।
নবুওতি লাভের পর মুহামদ মক্কায় অবস্থান করেন তের বছর। এরপর তিনি চলে যান মদিনায়। এই তের বছর মুহাম্মদ মূলত আধ্যাত্মিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ-সময় কোরানের যে আয়াতগুলি নাজিল হয় তার সবই ছিল ধর্মোপদেশ, পথনির্দেশ এবং উত্তম কাজ করার আবেদন, যাতে করে মক্কাবাসীরা অসৎ কর্ম থেকে বিরত থাকে। মদিনায় হিজরতের পর এ-ধরনের নৈতিকতাভিত্তিক এবং আধ্যাতিকধর্মী আয়াত নাজিল হওয়া কমে যায়। এর বদলে মদিনার আয়াতগুলোতে প্রধানত গুরুত্ব পায় আদেশ-নিষেধ এবং আইন। আল্লাহ এই আয়াতগুলি তখনকার মদিনার মুসলমানদেরকে তাদের শক্রর বিরুদ্ধে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য প্রেরণ করেন। ফলে মাদানি আয়াতের মাধ্যমে মুহাম্মদ এক নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সচেষ্ট হন। মদিনার অনুকূল পরিস্থিতির জন্য নবি মুসলমানদের এক নতুন সমাজ সৃষ্টিতে সফল হন।
কোরান এবং মুহাম্মদের জীবনযাপন থেকে এটা পরিষ্কার যে, মক্কা ও মদিনার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তা যাই হোক সব কিছুর পিছনে মুহাম্মদের একটি উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে মদিনায় এক ইসলামি রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি তাঁর আজন্ম লালিত লক্ষ অর্জন করেন। নবি কৌশলী হয়েছেন, শক্তি প্রয়োগ করেছেন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, রক্তপাত হয়েছে। এই যাবতীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করেছেন। এ- হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নবির মৃত্যুর পরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা অনেকাংশে ধাক্কা খায়। নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তখন হয়ে ওঠে প্রধান উদ্দেশ্য। তথাপি সবকিছুর মূলে রয়েছে ইসলাম, এবং ইসলাম ছাড়া যে কোনো কিছুই টিকে থাকবে না তাও সবাই বুঝলেন। তাই নবি- পরবর্তী সবাই ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সচেষ্ট হলেন। সে জন্য পরবর্তী প্রায় ১২ বছর ইসলামের বিধান এবং নবির রীতিনীতি খুব কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হত। এই সময়টা ছিল দুই খলিফার ; যথাক্রমে হজরত আবু বকর (হিজরি ১১ বা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিজরি ১৩ বা ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং হজরত ওমর (হিজরি ১৩ বা খ্রিস্টাব্দ ৬৩৪ থেকে হিজরি ২৩ বা ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) । কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যত দিন যেতে লাগল তত ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হতে লাগল এবং ইসলামের লক্ষ থেকে সবাই দূরে সরে যেতে থাকলেন। ইসলাম ব্যবহৃত হতে থাকল নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য।
নবি মুহাম্মদ যখন মারা যান তখন মদিনার আনসারদের খাজরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন সাদ বিন ওবায়দা। তিনি সমগ্র মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব নিতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু ওমর ছিলেন অতিশয় দক্ষ ও কুশলী। তিনি অবিলম্বে আবু বকরকে নেতা ঘোষণা করে সাদ বিন ওবায়দার স্বপ্নকে অস্কুরেই বিনষ্ট করে তাঁকে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিলেন। আবু বকর নেতা হওয়ার পরও কখনো ভুলে গেলেন না ওমরের ঋণ। তিনি নেতৃত্ব নেবার পরপরই ঘোষণা দিলেন, নেতৃত্ব হচ্ছে নবির উত্তরাধিকারী হওয়া – যার নাম হচ্ছে খেলাফত। আবু বকর সুপারিশ করলেন যে তাঁর পরে খলিফা হবেন ওমর। ওমর খলিফা হবার পর মনে মনে ঠিক করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা হবেন আব্দুর রহমান বিন আউফ। তথাপি ওমর যখন ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করেন। সেই পরিষদ হজরত উসমানকে খলিফা নির্বাচিত করেন। হিজরি ৩৫ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে উসমান আততায়ীদের হাতে খুন হবার পর তাঁর খেলাফতের অবসান ঘটে। সুষ্ঠুভাবে রাজত্ব চালাবার জন্য খলিফা উসমান হজরত আলির কাছে আনুগত্য কামনা করেন। কিন্তু উসমানকে তাঁর পাঁচ বছরের খেলাফতের পুরোটাই কাটাতে হয়েছে গৃহযুদ্ধ সামলাতে। যেমন জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ এবং নাহরাবানের যুদ্ধ। এ-সময় কুরাইশ বংশের মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং কুরাইশ বংশের বানু শাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আস খলিফা উসমানের শক্র হয়ে পড়েন। তাই উসমানকে রাজত্ব চালানোর পাশাপাশি এই দুই গৃহশক্রকেও মোকাবেলা করতে হয়। শক্ৰদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-চলাকালীন অবস্থায় হিজরি ৪০ সালে (৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) জন্য প্রচণ্ড উন্মাদনা শুরু হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎপরবর্তী অনেক ঘটনার মাঝে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুয়াবিয়ার উমাইয়া খেলাফতের পত্তন এবং তাঁর উত্তরাধিকারগণ, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদের হাতে আলির পুত্র হোসেনের মৃত্যু, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের সাথে যুদ্ধে কাবাকে অপবিত্র করা, হাশেমি গোত্রের প্রবল প্রচারণার মুখে উমাইয়া খেলাফতের পতন এবং আব্বাসিয়াদের খেলাফত দখল, পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিদ্বন্দী ফাতেমি বংশের ক্ষমতা দখল, এবং পূর্বাঞ্চলে বিপ্লবী ইসমাইলি আন্দোলন। ইসমাইলি আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যখন হিজরি ৬৫৬ (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ) সালে মঙ্গলীয় বাহিনী হালাকু খানের নেতৃত্বে বাগদাদ দখল করে আব্বাসিয়া খেলাফতের পতন ঘটায়।
প্রশ্ন ওঠে নবি মুহাম্মদ আধ্যাতিক ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন তাঁর মৃত্যুর পর সেই রাষ্ট্র কেমন করে চালানো হল? নবির কি উচিত ছিল না তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করে যাওয়া, যাতে করে নতুন মুসলিম সমাজ জানতো তাদের প্রধান দায়িত্বসমূহ কী কী হবে? আরও কিছু প্রশ্ন আছে এর সাথে, যেমন নবির সহচরদের কী উচিত ছিল না যেভাবেই হোক নবির উত্তরাধিকারী কে হবে সে- ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসা? যেহেতু নবুওতি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত, তাই ভবিষ্যতে মুসলমানদের আধ্যাতিক নেতৃত্ব কী ক্ষমতা দখলে জড়িয়ে পড়বে? নবি যদি নিজেই তাঁর উত্তরাধিকারী ঠিক করে যেতেন তবে কাকে তিনি মনোনীত করতেন? আলি ছিলেন নবির চাচাতো ভাই, একই সাথে তাঁর মেয়ে ফাতেমার স্বামী, এবং হাশেমি গোত্রের প্রথম পুরুষ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়াও আলি ছিলেন একজন অসীম সাহসী যোদ্ধা ও সুদক্ষ সমরনায়ক। একাধিকবার বিপদে আলি নবির জীবন রক্ষা করেছেন। নবির কি উচিত ছিল না আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে যাওয়া? আবু বকর ছিলেন উচ্চপদাধিষ্ঠিত। লুকিয়ে মদিনা যাবার পথে মুহাম্মদ একদা গুহায় আশ্রয় নেন। আবু বকরও সেই রাতে মুহাম্মদের সাথে গুহায় থেকেছেন। ইসলামের প্রথম যুগে আবু বকর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের জন্য বয়ে আনেন প্রচুর সমান। এছাড়াও আবু বকর তাঁর সুন্দরী কন্যা আয়েশাকে বিয়ে দিয়েছেন নবির সাথে। মুহাম্মদর কি উচিত ছিল না আবু বকরকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাওয়া? ওমর ছিলেন এক সুদৃঢ়, একনিষ্ঠ, ও সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসেবে ওমর ছিলেন আপোষহীন। রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। নবি কি কখনও চিন্তা করেছিলেন যে ওমরই হবেন তাঁর যোগ্যতম উত্তরাধিকারী? মুহামদ মদিনাতে নবুওতি পালন করলেন দশ বছর। এই সুদীর্ঘ দশ বছরে তিনি কেন উত্তরাধিকারী সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলেন না? যে নবি এত দূরদর্শী এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণসম্পন্ন ছিলেন, যিনি শূন্য থেকে নিজের একক প্রচেষ্টায় মদিনাতে মুসলিম- সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন আমরা কী চিন্তা করতে পারি সেই নবি উত্তরাধিকারী মনোনয়নের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলা করে যাবেন? মৃত্যুর আগে নবি ইসলামকে আরব জাতীয়তাবাদ বলে নির্ধারিত করেছিলেন এবং বলে ছিলেন যে আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম থাকবে না। সেই নবিই কেমন করে তাঁর সদ্যভূমিষ্ঠ ইসলামি রাষ্ট্রের বলাবাহুল্য, এই ধরনের অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে জাগে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর কোনোদিনও পাওয়া যাবে না। ফলে এ-বিষয়ে আমরা যা যা জানতে পাই তা শুধুমাত্র অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। নবি পরবর্তী ইসলামের যে দ্বন্দু দেখা দিয়েছিল তার প্রধান কারণ হচ্ছে এই উত্তরাধিকারের বিষয়টি।
আমরা হয়তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি নবি তাঁর উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেননি। কথিত আছে হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) নবি বিদায় হজের পর যখন মদিনায় ফিরছিলেন তখন গাদির আল খুম নামের এক জলাধারের (কেউ কেউ বলেন কৃপ) কাছে যাত্রাবিরতি দেন এবং আলির হাত ধরে বললেন, “আমি যাদের বন্ধ (অভিভাবক) আলিও তাদের বন্ধু ( অভিভাবক) । উল্লেখ্য মাওলা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে নিকটে আসা, এর আরও দুটি অর্থ রয়েছে, অভিভাবক বন্ধু এবং আশ্রিত ব্যক্তি। শিয়ারা মনে করেন যে ওই বাক্য দ্বারা নবি আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োজিত করে গিয়েছেন। [ কোনো কোনো মুসলিম পণ্ডিতের তফসিরে (যেমন তফসির
হিসেবে আলিকে মনোনীত করে ছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় তিনি এ-ঘোষণাটি স্থগিত রেখেছিলেন, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। (*Ră : Saiyid Safdar Hosain, The Early History of Islam, Low Price Publications, Delhi, (First Published 1933), 2006, page 235) । শিয়াদের মধ্যে কেউ কেউ হজরত আলিকে নবির উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়নের ব্যাপারে সুরা ইনশিরাহ এর ১- ৮ নম্বর আয়াতের দিকে নির্দেশ করেন। যদিও এই সুরায় আলিকে সরাসরি মুহাম্মদের পরবর্তী নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, শুধুমাত্র নবিকে ভারমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।অনুবাদক] সুন্নিরা অবশ্য তা অস্বীকার করেন। সুন্নিরা বলেন, নবি যদি এই বাক্য বলে থাকেন তবে তা বলেছিলেন ইসলামের প্রতি আলির একনিষ্ঠতা আর সেবার প্রতি প্রশংসা করে। আলি যে ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন তা সকল মুসলিমই স্বীকার করেন। এখানে এটাও বলা যেতে পারে যে, আলিকে উদ্দেশ্য করে ওই বাক্যকে যদি নবির উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত বলে ধরা হয় তবে নবি অসুস্থ থাকাকালীন সময় যখন আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দেন, সেই উদাহরণটাও বলতে হয় নবির সিদ্ধান্ত ছিল যে আবু বকর হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী। খেলাফত বিষয়ে সুন্নিদের বক্তব্যকে আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও শিয়াদের সাথে এ-বিষয়ে অনেক বিরোধ রয়েছে। সুন্নিরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কোরানের এই আয়াতের উদ্ধৃতি দেন: , , , আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম মনোনীত করলাম। তবে যদি কেউ ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়, কিন্তু ইচ্ছা করে পাপের দিকে না ঝোঁকে (তার জন্য) আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ( সুরা মায়িদা : আয়াত ৩) ।
সুন্নিরা বলেন যে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুহামদের নবুওতির দায়িত্ব সম্পন্ন করেন এবং মুসলমানদের জন্য কোরানের নির্দেশাবলী বাধ্যতামূলক করে দেন। এই মত অনুযায়ী কোরান হচ্ছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ। তাই মুসলমানদের জন্য মুহামদ নির্বাচিত কোনো ঐশ্বরিক ও অভ্রান্ত উত্তরাধিকারীর দরকার নাই, যা শিয়ারা বিশ্বাস করেন। সুন্নিরা আরও বলেন, যে কোনো ব্যক্তি যদি কোরানের আদেশ মানেন এবং নবির আদর্শে চলেন তবে তিনি মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাই নবির সহচরদের অধিকার আছে যাকে তাঁরা যোগ্য মনে করবেন তাকেই মুসলমানদের নেতা হিসাবে নিয়োগ করবেন। এই নেতাই মুসলিমদের কোরান এবং সুন্নাহর (নবির আচার-ব্যবহার এবং তাঁর উদাহরণ) পথে চালাবেন। সুন্নিদের এই মতবাদ কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও বলতে হবে যে এটা বিগতকালীন ব্যাপারেও প্রযুক্ত – এর উদাহরণ। চার খলিফার আমলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ভিত্তিতে সুন্নিদের এই মতবাদ প্রসার পায়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে বুঝা যাবে যে এ- বক্তব্য সঠিক নয়।
নবির মৃত্যুর সাথে সাথে বানু সায়েদার হলঘরে যে কলহের সূত্রপাত হয়, তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে সবার মনে তখন প্রাধান্য পাচ্ছিল নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। তখন দরকার ছিল একজন উত্তরাধিকারীর যে মুসলমানদের কোরান এবং সুন্নাহর রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু দুই পক্ষই একজন সুদক্ষ উত্তরাধিকারী নিয়োগে ব্যর্থ হয়। এই কোলাহলপূর্ণ সমাবেশে মদিনার স্থানীয় মুসলমানরা (আনসার) এবং মক্কা থেকে আগত শরণার্থীরা (মুহাজির) এই দুই পক্ষই নেতৃত্বের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দাবি করল। আনসারদের দাবি ছিল তাঁরা নবিকে সাহায্য করেছিলেন, আর মক্কার মুহাজিররা দাবি করলেন নবির সাথে তাদের আত্মীয়তার।
এই সভায় উত্তরাধিকারী নির্বাচনের জন্য নবির নিজস্ব গোত্র, হাশেমি গোত্রের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। নবির ভ্রাতুষ্পপুত্র আলি এবং নবির চাচা আল আব্বাস ছিলেন নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এই দুইজন সেই বৈঠকে যোগদান করেননি। মুহাম্মদ তাঁর দশজন সহচরকে (ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দশজন পুরুষ) বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। বানু সায়েদার বৈঠকে সেই দশজনের মধ্যে আরও দুইজন অনুপস্থিত থাকলেন। তাঁরা হলে তালহা বিন উবায়দুল্লাহ এবং জুবায়ের বিন আওয়াম। তাঁরা ফাতেমা- আলির ঘরে নবির মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। এ- সময় আলিকে জানানো হয় বৈঠকে মুহাজিররা জিতেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, মুহাজিররা নবির আত্মীয়। ওদের উৎস একই গাছ, আর সেই গাছ হচ্ছেন নবি । এ-কথা শুনে আলি বললেন, ‘ওরা গাছের যুক্তি দিয়েছে কিন্তু গাছের ফলের কথা ভুলে গেছে। এই সংবাদ শুনে জুবায়েরও ক্ষেপে উঠলেন। রাগতস্বরে বললেন, ‘এরা যতক্ষণ পর্যন্ত না আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার তরবারি কোষবদ্ধ হবে না।
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান (মুয়াবিয়ার পিতা) বললেন, “ওহে আবদে মনাফের বংশধরেরা (হাশেমি এবং উমাইয়া গোত্রের সাধারণ উৎস) আজ যে মরুঝড় উঠেছে তা মিষ্টি ভাষায় শান্ত করা যাবে না। তাঁরা আবু বকরের মত নীচুগোত্রের লোককে তোমাদের নেতা নিযুক্ত করেছে। তাঁরা এতোই নীচুজাতের ব্যক্তিকে চায়, তবে আলি অথবা আল- আব্বাসকে সুযোগ দিল না কেন? মুহাম্মদের একসময়কার তীব্র বিরোধী (যিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম কবুল করেন) আবু সুফিয়ান আলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি আপনার হাত দিন, আমি আপনার কাছে আমার আনুগত্য জানাব। আপনি চাইলে আমি মদিনা ভরে দিব অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা। আবু সুফিয়ানের এই প্রস্তাব আলি প্রত্যাখ্যান করলেন।
নবি এবং ইসলামের প্রতি আলির ছিল অকৃত্রিম ও গভীর অনুরক্তি। এ- জন্য আলির নৈতিকতার মান অন্যান্য আরবের চেয়ে অনেক উপরে। এটা পরিষ্কার যে একমাত্র আলি ব্যতীত বাকি সব বিশিষ্ট কুরাইশ ব্যক্তির লোভ ছিল ক্ষমতা দখলের। এ-বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার জন্য তাবারির ইতিহাস থেকে এবং ইবনে হিশামের নবির জীবনী থেকে কিছু উদ্ধৃতি পুনরায় উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি ঘটনা ছিল এ-রকম: নবির অসুস্থতার শেষ দিনে আলি নবির গৃহ থেকে চলে যান। জনসাধারণ আলিকে ঘিরে ধরেন। তাঁরা নবির স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে চান। আলি উত্তর দিলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি সুস্থ হচ্ছেন। তখন আলিকে একপাশে নিয়ে আব্বাস বললেন, আমার মনে হয় তিনি মৃত্যুর পথে। তাঁর মুখে আমি যা দেখেছি সেই দৃশ্য আমি আগেও দেখেছি আব্দুল মোতালেবের ছেলেদের মৃত্যুকালে। আপনি নবির কাছে যান এবং জেনে নিন তাঁর পরে কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। কর্তৃত্ব যদি আমাদের হাতেই রাখতে হয় তা আমাদের জানা দরকার। আর কর্তৃত্ব যদি অন্যের হাতে বর্তায় তাহলে তাঁর উচিত হবে কাউকে সুপারিশ করা। আলি উত্তরে বললেন, আমি কখনোই এ-ধরনের প্রশ্ন করব না। তিনি যদি এই ব্যাপারটা আড়ালে রাখেন, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আমাদের দিকে তাকাবে না।
এটা অনস্বীকার্য যে প্রথম দুই খলিফার রাজত্ব ভালই চলেছিল। দুজনের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া যদিও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয় এবং তাঁদের ক্ষমতায় আরোহণের বিষয়ে নবির সহচরদের সর্বসম্মত সমর্থন ছিল না, তথাপি সরকার চালানোর নীতিতে তাঁরা কোরান ও নবির সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হননি। হজরত আবু বকর এবং হজরত ওমর সৎ ছিলেন। আলি ছিলেন নবির স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। তথাপি আবু বকর খলিফা হলে আলি ছয় মাস পরে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু ওমর খলিফার আসনে বসলে তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাতে তিনি কোনো দ্বিধা করলেন না। তৃতীয় খলিফা উসমানের সততা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। উসমান খেলাফতকালে অনেক ক্ষেত্রেই কোরানলঙ্ঘন করেছেন ফলে সমগ্র মুসলিম সমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হয় এবং অচিরেই তা বিদ্রোহের রূপ নেয়।
খলিফা নির্বাচন পরিষদের সমতিক্রমেই উসমান খলিফার পদ দখল করেন, এবং তাঁর প্রতি সাধারণ জনতার সমর্থনও ছিল। তাই উসমানের খেলাফতে কিছুটা গণতন্ত্রের আভাষ পাওয়া যায়। ওমর ছয় সদস্যের এক পরিষদ গঠন করে নির্দেশ দেন তাদের মধ্যে থেকে একজনকে খলিফা মনোনীত করতে, যে তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন। এই ছয় সদস্য ছিলেন : আলি, উসমান, তালহা, জুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং আব্দুর রহমান বিন আউফ। আব্দুর রহমান প্রস্তাব দিলেন যে আলি অথবা উসমান খলিফা হবেন। আলি অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাই আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানালেন। তাঁর দেখাদেখি পরিষদের অন্যান্য সদস্যরাও উসমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এর তিন দিন পূর্বে জনতার মতামত জানবার জন্য আব্দুর রহমান বিন আউফ এক জনমত যাচাই করেন।
উসমান জনগণের ইচ্ছায় খলিফার আসনে বসলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল তাঁর শাসন- দক্ষতার মান নবির আদর্শ থেকে অনেক দূরে। উসমানের বিরুদ্ধে কমপক্ষে পঞ্চাশটি অন্যায়ের অভিযোগ উঠে। এর জন্য মূলত দায়ী ছিলেন তাঁর নিজস্ব গোত্রের আত্মীয়স্বজনরা। ব্যক্তিগতভাবে উসমান ছিলেন বিনয়ী ও সাদাসিধে। কিন্তু উসমানের বড় দুর্বলতা ছিল, তিনি তাঁর নিকট আত্মীয়দের কাকুতিমিনতি বা অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারতেন না। খলিফা হিসেবে ওমরের চরিত্রের যে দৃঢ়তা ছিল তার সাথে উসমানের কোনো তুলনা হয় না। ওমর তাঁর সিদ্ধান্তে এতই দৃঢ় থাকতেন যে নবির কোনো সহচর পর্যন্ত ওমরকে তাঁর সিদ্ধান্ত হতে বিচ্যুত করতে পারতেন না।
খলিফা নির্বাচনে আলিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি খলিফা মনোনয়ন পেলে মদিনার আমজনতা এবং নবির প্রায় সমস্ত সাহাবিরা শুভেচ্ছার সাথে তা গ্রহণ করেন। কিন্তু আলির শাসনকাল ছিল খুব স্বল্প। এই স্বল্পকালে তাঁকে তিনটি গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। আলিকে বেশ কিছু নাশকতামূলক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার সমূখীনও হতে হয়। এছাড়াও নবির দুই প্রবীণ সহচর যথা তালহা এবং জুবায়ের আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেন। আলি যখন এই দুজনকে যথাক্রমে কুফা এবং বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করতে আপত্তি জানান তখনই তাঁরা আলির বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করেন।
এ- ধরনের প্রায় ভজন খানেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খলিফা নিয়োগে সুন্নি- মতামত নীতিগতভাবে মেনে নিলেও ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এটা সর্বাংশে সত্য নয় এবং এই পদ্ধতি মুসলমানদের কোনো উপকারে আসেনি। ক্ষমতা এবং সম্পদের উপর লোভের ফলে কোরান ও সুন্নাহকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, নবি মুহাম্মদ কি তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে অন্য কারো চেয়ে বেশি সক্ষম ছিলেন না? নবি মুহাম্মদ এ-বিষয়ে যে অদ্বিতীয়ভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন তা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কারণ মুহাম্মদ নবুওতির গুণে গুণান্বিত ছাড়াও নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে শীর্ষে ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। মানবচরিত্র এবং তাঁর সহচরদের মানসিকতা সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি যখন ক্ষমতার তুঙ্গে, তখন তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস কারো ছিল না। এতো অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নবি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে নীরব রইলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি নীরব ছিলেন? তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে তিনি কি চিন্তা-ভাবনায় আনেননি? অথবা তিনি কি জানতেন যে তিনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন তাই উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সময় আসেনি?
নবির অসুস্থতার সময় বয়স ছিল ৬৩ বছর। এটা তেমন বৃদ্ধ- বয়স নয়। তাঁর অসুস্থতা ছিল অল্পদিনের। এই অসুস্থতাকালীন ঘটনাবলী থেকে মনে হয়, নবি তাঁর অসুস্থতাকে মারাত্মক ভাবেননি। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভেবেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই হয়তো নবি তাঁর অসুস্থতার প্রথম দিনে স্ত্রীগণকে জানালেন, তিনি আয়েশার গৃহে সেবা-শুশ্রুষা পেতে চান। সেই সময় আয়েশা শিরঃপীড়ায় ভুগছিলেন। তাই রসিকতা করে নবি আয়েশাকে বললেন, ‘তুমি কি আমার আগেই মারা যেতে চাও যাতে করে আমাকে তোমার লাশ ধুতে হয় এবং দাফন করতে হয়?’ আয়েশাও রসিকতা করে জবাব দিলেন, তাহলে তো আপনি নির্বিঘ্নে আমার গৃহেই আপনার অন্যান্য স্ত্রীর সাহচর্য পেতে পারবেন। এ- থেকে বুঝা যায়, নবি ভেবেছিলেন তাঁর অসুখ তেমন মারাত্মক নয়।
এই অনুমানের সমর্থনে আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। রোগাক্রান্ত হবার শুরুর দিকে নবি সিরিয়ার খ্রিস্টান- আরবদের আক্রমণ করার জন্য এক সেনাবাহিনী গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই আক্রমণকারী বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নবির মুক্তক্রীতদাস ও পালকপুত্র জায়েদ বিন হারিসের পুত্র বিশবছর বয়স্ক ওসামাকে মনোনীত করেন। এই সিদ্ধান্তে মুসলিম সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুহাজির ও আনসারদের মাঝে বেশ কয়েকজন ঝানু সেনানায়ক ছিলেন যারা ওসামার পদটি পাবার জন্যে আগ্রহী ছিলেন। তবে অসন্তোষের খবর পেয়ে নবি ক্রুদ্ধ হোন। মসজিদের বেদিতে দাঁড়িয়ে নবি ঘোষণা দেন, এই ধরনের অসন্তোষ অবাধ্যতারই নামান্তর। তিনি আরও বলেন, ওসামার নিয়োগ সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। নবির এই ঘোষণা প্রকাশের পর অসন্তোষ- প্রকাশকারীরা চুপ হয়ে যান। এ-ঘটনা হতেও প্রতীয়মান হয় মুহাম্মদ ভেবেছিলেন তাঁর অসুস্থতা সাময়িক এবং আশা করছিলেন দ্রুত সেরে উঠবেন।
এই ঘটনার পক্ষে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়, যা উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের চাইতে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখনও নবি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কোরান সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজে হাত দেননি। কোরান হচ্ছে মুহাম্মদের নবুওতির হুকুমনামা এবং মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। মুহাম্মদের মৃত্যুকালে কোরান এককভাবে সংগৃহীত ছিল না। সে- সময় কোরান মুহাম্মদের বিভিন্ন সহচর ও ওহি লেখকদের মাঝে বিক্ষিপ্ত ছিল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলাম-বিশারদ এবং কোরান বর্ণনাকারীদের মধ্যে প্রচুর তফাৎ দেখা দেয়। এ-সমস্যা সৃষ্টি হত না, যদি মুহামদ তাঁর জীবদ্দশায় কোরান সংকলনের কাজটি সম্পন্ন করে যেতেন। বর্তমানে কোরানের আক্ষরিক ব্যাখ্যা নিয়ে যে সমস্যা আছে, তাও থাকত না। কোরানের যে- সব আয়াত রহিত হয়েছে কিংবা যে- সব আয়াত অন্য আয়াতকে রহিত করেছে সেগুলোকেও সহজে সনাক্ত করা যেত। সর্বোপরি কোরানকে সাজানো যেত সুরা এবং আয়াতের নাজিল হওয়ার কালক্রম অনুযায়ী। প্রচলিত আছে যে, হজরত আলি কালক্রম অনুযায়ী কোরানের একটি সংকলন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এটি সংরক্ষণ করা হয়নি।
মুহাম্মদের দুইজন ওহি লেখকের অন্যতম ছিলেন জায়েদ বিন সাবিত। কথিত আছে জায়েদ একবার বলেছিলেন : আবু বকর আমাকে ভেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘অনেকদিন যাবত ওমর আমাকে চাপাচাপি করছেন কোরান সংগ্রহ এবং সংকলিত করার জন্য। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে নারাজ। কারণ কোরান সংকলন যদি এতোই প্রয়োজনীয় ছিল তবে নবি নিজেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতেন। কিন্তু ইয়ামামার যুদ্ধে নবির অনেক সহচর মারা গেলেন। এদের অনেকেই কোরানের বিভিন্ন আয়াত মুখস্ত করে রেখেছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর সাথে তাঁরা কোরানও নিয়ে গেলেন কবরে। তাই আমি এখন কোরান সংকলনের ব্যাপারে ওমরের সাথে একমত।”
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ওমর কোরান সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এ- জন্য খলিফা আবু বকরকে প্ররোচিত করেন। এরপরও কোরান সংকলন করতে অনেক দিন পার হয়। উসমান কোরান সংকলনের জন্য একটি কমিটি করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কমিটি যে কোরান সংকলন করেন তা কালক্ৰমানুযায়ী হয়নি। এমন কী এই কমিটি হজরত আলি এবং বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যে কোরান ছিল তা ধর্তব্যেও আনলেন না।
উসমানের কমিটির প্রণীত কোরানের সূরাগুলির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সাজালেন। বেশি দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি আগে (সুরা ফাতিহা বাদে) এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি শেষে। এ-ধরনের বিন্যাস একেবারে অপ্রয়োজনীয়। কারণ যুক্তি অনুযায়ী মক্কি সুরাগুলি আসা ছিল কোরানের প্রথম দিকে এবং মাদানি সুরাগুলি থাকা উচিত ছিল শেষের দিকে। কিন্তু উসমানের কোরান- সংকলন কমিটি মক্কি সুরার মাঝে মাদানি সুরা আর মাদানি সুরার মাঝে মক্কি সুরা মিলিয়ে কোরানের বিন্যাস করলেন। যাহোক, নবির মৃত্যু হয়েছিল অকস্মাৎ, ফলে তিনি কোরান সংকলন ও সম্পাদনার সময় পাননি।
অনেকের ধারণা, অসুস্থতার শেষের দিন নবি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অসুখ মারাত্মক। সে দিন ২৮শে সফর হিজরি ১১ অথবা ১৩ই রবিউল আওয়াল, ইংরেজি ৮ই জুন ৬২৩ সন। এ-দিন জ্বরের তীব্রতা বেড়ে গেলে নবি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হল, তাঁর আর বেশি সময় নেই। তাই আশেপাশের সকলকে কাছে আসতে বললেন এবং এক দোয়াত কালি এবং এক খণ্ড কাগজ দেয়ার কথা বললেন : ‘আমি তোমাদের জন্যে কিছু লিখতে চাই (অথবা কাউকে দ্বারা লিখাতে চাই) । এটা করা হলে ভবিষ্যতে তোমরা বিপথে যাবে না। দুর্ভাগ্যবশত নবির শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। যারা নবির নিকটে ছিলেন তাঁরা প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর তাঁরা নিজেদের মধ্যেই বচসা শুরু করে দিলেন। উপস্থিত একজন বললেন, তিনি কি ক্রোধান্বিত হয়ে এ- সব বলছেন? তাঁকে কি ভূতে ধরেছে? তাহলে ওঝা নিয়ে আসি। এ- শুনে জয়নাব বিনতে জাহশ এবং কয়েকজন সাহাবি বলে উঠলেন, নবি যা চাইছেন তোমাদের উচিত তা অবিলম্বে নিয়ে আসা। ওমর বললেন :
নিবির জ্বর অত্যধিক। আমাদের জন্যে রয়েছেন আল্লাহ এবং কোরান, এগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। অন্যকিছুর দরকার নেই। এভাবে যারা চেয়েছিল নবির লিখিত পথনির্দেশ যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে ভুল পথে না যায় এবং যারা চাননি যে তিনি কিছু লিখুন, তারা দুই পক্ষে বিভিক্ত হয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দেন। নবি এই বচসা দেখে খুব মর্ম- পীড়িত হলেন। এক সময় তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে দুই পক্ষকেই তাঁর সামনে বাকযুদ্ধ বন্ধ করতে বললেন। কারোই ধারণা ছিল না যে নবি কী লিখতে চাচ্ছিলেন। আর তাছাড়া তিনি অসুস্থ, তাই কারো বোধগম্য ছিল না, কাকে দিয়ে লেখাবেন তাঁর নির্দেশগুলো। তিনি কি তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম লিখতে চেয়েছিলেন? এমন কিছু লিখতে চাচ্ছিলেন যা কোরানে ছিল না? অথবা কোরানের কোনো কিছু কি তিনি বাতিল করতে চাচ্ছিলেন? অথবা আরব জাতির প্রগতির জন্য কি কোনো নীতিমালা দিতে চেয়েছিলেন? এই সবই যদি হয় তবে তিনি মৌখিকভাবে তা বললেন না কেন? নবির এই নীরবতা চিরকালের জন্যে এক রহস্য হয়ে থাকবে।
উপরের ঘটনাতে একটি বিতর্কিত বিষয় আছে। ওমর ছিলেন একজন নির্ভীক, দৃঢ় ও অটল মানুষ। ইসলাম ও ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার উপর ওমর ছিলেন সম্পূর্ণ নিবেদিত। এহেন ওমর কেন মুহাম্মদের শেষ লিখিত নির্দেশের বিরোধী হলেন আর বললেন কোরানই হবে যথেষ্ট? ওমর কি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন যে, নবি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন? ওমর তো বাস্তববাদী, দূরদর্শীসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত। সে- জন্যেই কি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুহাম্মদ মৃত্যুর পূর্বে আলিকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে পারেন? এমন যদি হয়, তবে ওমর ভালভাবেই জানতেন যে আপামর মুসলিম সমাজ নবির ইচ্ছাকেই সম্মান দেখাবে। এবং এর ফলে ওমরের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। খলিফা মনোনয়ন নিয়ে শিয়াদের মধ্যে এ- ধারণাটাই বিদ্যমান। যৌক্তিকভাবে বিচার করলে শিয়াদের এই ধারণা অমূলক নয়। কেননা ওমর কেন নবিকে তাঁর শেষ ইচ্ছে লিখতে দিলেন না তার সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য কারণ আজ পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেননি।
ইসলামের ইতিহাসে ওমর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি ছিলেন নবির প্রিয়, সম্মানিত এবং প্রভাবশালী সাহাবি। রাজনৈতিক বিষয়াবলীতে ওমর ছিলেন শক্তিশালী স্তম্ভ। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়াও তিনি মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে ছিলেন দক্ষ। তাঁর দূরদর্শিতাও ছিল অপরিসীম। ফলে ধারণা করা যায়, ওমর পূর্বেই অনেক হিসাব নিকাশ করেছিলেন। তিনি জানতেন নবিকে যদি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সুযোগ দেওয়া হয় তবে তা নিঃসন্দেহে হবেন আলি অথবা আবু বকর। এদের মধ্যে আলি ছিলেন হাশেমি গোত্রের সবচেয়ে সমানিত ব্যক্তি। আবার তিনি নবির ভাই, নবির জামাতা, এক নির্ভীক যোদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠ ওহি- লেখক। এছাড়া আলির ছিল নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারা। ফলে আলি সহজে অন্য কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। আবু বকর ছিলেন ওমরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মদিনার দশ বছর আবু বকর ও ওমর একে-অপরের সান্নিধ্যের মধ্যে ছিলেন। নবির অন্যান্য সহচরদের চেয়ে আবু বকরের সাথেই ওমর বেশি মেলামেশা করতেন। যে কোনো ব্যাপারে তাঁদের দুজনের থাকত মতের মিল। আলি ও আবু বকর, এই দুজনের মাঝে ওমর অবশ্যই আবু বকরকে বেছে নিবেন মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী হিসেবে। আবু বকর ছিলেন ধীর ও শান্ত মেজাজের। আবু বকরের গোত্র প্রভাবশালী ছিল না। তাই ওমর জানতেন, আবু বকর মুহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হলে মূলত তিনিই হবেন আবু বকরের দক্ষিণ হস্ত। আর নবির উত্তরাধিকারী যদি আলি হন তবে আলি পাবেন নবির সহচরদের সম্মান এবং সমগ্র হাশেমি গোত্রের সমর্থন। এই অবস্থায় আলি ওমরকে পাশ কেটে চলবেন, বিষয়টি ওমর ভাল করেই বুঝেছিলেন। ওমর আবু বকরের বয়সের বিষয়েও সজাগ ছিলেন। মুহাম্মদ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন আবু বকরের বয়স ছিল ষাটের উর্ধ্বে। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে আবু বকর ছিলেন সম্মানিত। আর আলির বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ। তাই ওমর জানতেন আবু বকর নেতা হলে শীঘ্র ওমরের হাতে ক্ষমতা চলে আসবে কিন্তু আলি নেতা হলে সেটা হবে না। সংক্ষেপে বলা যায় আবু বকর নবির উত্তরাধিকারী হলে ওমরের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা হবে। এ-দিক দিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় ওমর কেন নবির শেষ নির্দেশের বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ওমর হয়তো ভেবেছিলেন মুহাম্মদ বোধহয় শেষ ইচ্ছাপত্র লিখে যেতে পারেন; এবং নবির মৃত্যুর পরে শাসনক্ষমতা শুধুমাত্র হাশেমি গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে যার ফলে অন্যান্যদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ রূদ্ধ হয়ে যাবে।
হতে পারে নবির লেখার উদ্দেশ্য উত্তরাধিকারী মনোনীত করা ছিল না। তিনি ভিন্ন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ওমর কোনোক্রমেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি এই ব্যাপারে আর বৃথা তর্কে যেতে চাননি। ওমর ভেবেছিলেন নবি শেষমেশ উইল করতে পারেন। তাই তিনি নিজের মনের কথা গোপন রেখে বলেছিলেন নবি প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বলছেন, তাই তাঁর পক্ষে কোরানে কিছু যোগ করার মতো অবস্থা নেই। ওমর আরও বললেন নবির কাছে যত ওহি এসেছে তা সবই এসেছিল যখন তিনি সুস্থ ও ভাল স্বাস্থ্যে ছিলেন। কোরানে যা থাকার সব কিছুই নবি পেয়ে গেছেন সে অবস্থায়, কাজেই নতুন আর কিছু লেখার প্রয়োজন নাই।
জানালেন না কেন? শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নবির উদ্দেশ্য ছিল আলিকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা। তাই যদি হয় তবে যখন বাহাস শুরু হল এবং যখন ওমর কাগজ-কলম আনতে নিষেধ দিলেন তখন নবি মৌখিকভাবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাঁর শেষ ইচ্ছেটা জানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু নবি তা করেননি। এ- সময় নবির কক্ষে অনেক ব্যক্তিই উপস্থিত ছিলেন। ফলে তিনি যা বলতেন তা মুখে মুখে সমগ্র মুসলিম- সমাজে ছড়িয়ে পড়ত। তাহলে কি নবির অন্য কোনো কারণ ছিল যার জন্য তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেননি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই রহস্যের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা সত্য নয়।
একটা বিষয় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মুহাম্মদ সারাটা জীবন যা করে এসেছেন তার সব কিছুর পেছনে সর্বদা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তেইশ বছর ধরে তাঁর মনে এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষার শিকড় গেড়ে ছিল। এই শিকড় তাঁর মনে- প্রাণে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে এই দুর্বার শক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বের অঙ্গ হয়ে পড়ে। নবির এই অদম্য উদ্দেশ্য ছিল এক ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যার ভিত্তি হতে হবে আরব জাতীয়তাবাদ। নবির ছিল সহজাত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মানুষের চরিত্র বুঝার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর সব সহচরের গুণ ও মেজাজের বৈশিষ্ট্য তিনি খুব ভাল করে জানতেন। নবি খুব ভালভাবে লক্ষ করেছিলেন ওমরের চরিত্রের একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা এবং নৈতিকতা। ওমর এবং আবু বকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও নবি ভাল করে জানতেন। ইসলামে দীক্ষা নেবার পর থেকে ওমর হয়ে যান নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর। নানা সময়েই ওমর নবিকে প্ররোচিত করেছিলেন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, যা পরিশেষে ইসলামের কল্যাণ বয়ে আনে। আবু বকর ছিলেন মুহাম্মদের বিশ্বস্ত অনুগামী। কিন্তু ওমর সেরকম ছিলেন না। ওমর ছিলেন নিজস্ব ধ্যান- ধারণার ব্যক্তি। অনেক ক্ষেত্রে ওমর তাঁর অভিপ্রায় নবির কাছে উপস্থাপিত করতেন এবং নবি প্রায়ই ওমরের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় পূরণ করতেন। মিশরীয় বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল সুয়তির (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখা “আল-ইতকান ফি উলুম আল- কোরান বইয়ের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘কোরানের সেইসব প্রত্যাদেশ যা সাহাবিদের অভিপ্রায়ে সংযোজিত। কোরানের আয়াতের কয়েকটি এসেছে ওমরের পরামর্শ থেকে।
মোজাহেদ বিন জাবর বলেছেন : কোনো বিষয়ে ওমর তাঁর মতামত জানালেন। কিছু পরে তা ওহি হয়ে কোরানে স্থান পেয়ে যেত। এমনকি ওমর নিজেই বলেছেন কোরানের তিনটি আয়াত তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শে কোরানে স্থান পেয়েছে। এই আয়াতগুলি হচ্ছে মুসলিম নারীদের পর্দার ব্যাপারে (সুরা আহজাব ; আয়াত ৫৯) , বদরের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে (সুরা আনফাল ; আয়াত ৬৭) , এবং ইব্রাহিমের তৈরি ঘর (কাবা) স্থান সম্পর্কে (সুরা বাকারা ; আয়াত ১২৫) । এ-বিষয়গুলিতে সুন্নাহ-সংকলনকারী, মুহাম্মদের জীবনীকারক, এবং কোরানের তফসিরকারকদের অনেক কিছু বলার আছে। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী ওমর ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য নবি ওমরকে বিশ্বাস করতেন। এ- ধরনের ব্যক্তি নবির ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে পাঁচজনের বেশি ছিলেন না।
মুহাম্মদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি কোনোভাবে কিছু লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন না। এমনও হতে পারে নবি মৌখিকভাবে কারো নাম উল্লেখ করলে তা হয়তো ওমর, আবু বকর এবং তাঁদের সহযোগীরা বিরোধিতা করে বসতেন। ফলে নবির জীবদ্দশাতেই ইসলামের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। নবি তাঁর জীবদ্দশায় যে অপরিসীম সমানের অধিকারী হয়েছিলেন তাতে তিনি ইচ্ছামাফিক যেকোনো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিছুদিন পূর্বে নবি ওসামা বিন জায়েদকে সেনাপতি নিয়োগ দেয়ায় অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি তীব্র তিরস্কারের সাথে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুহাম্মদের মৃত্যুর পর এ-বিষয় অন্যদিকে মোড় নেয়। তাঁর অবর্তমানে কার ক্ষমতা ছিল যে গোত্রে- গোত্রে শক্ৰতার অবসান ঘটাতে পারেন? কে নেতৃত্ব ও ধনদৌলতের প্রতি লোভ লালসার সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম ছিলেন? এক ইসলামি সমাজ গড়া ছিল নবির মুখ্য উদ্দেশ্য। নবি যে এত কষ্ট করে নতুন ইসলামি সমাজের ভিত্তি করলেন সেটার কি হবে? আরবরা কি আবার তাদের পরস্পর দীর্ঘকালব্যাপী হানাহানি ও খুনোখুনিতে মেতে উঠবে? নবির মনে হয়তো এ-ধরনের অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই তিনি শুধুমাত্র তাঁর ঘরে যারা ছিলেন তাদেরকে চলে যেতে বলে চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন। এছাড়া আরও অন্যান্য কারণও হয়তো থাকতে পারে, যার জন্য নবি তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী মনোনীত করেননি।
আলির যে অনেক গুণ ছিল তা তাঁর শক্রমিত্র উভয়েই একমত। আলি জীবনে কখনো মূর্তিপূজা করেননি। এগার বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম প্রচারের প্রথমদিকে ওহুদের যুদ্ধে আলি মুহামদকে মারাত্মক বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পরিখার যুদ্ধে আমর বিন আবদ ওয়াদকে আলি ধরাশায়ী করেন এবং খায়বার যুদ্ধে নাতাত দুর্গে আক্রমণ করেন। হিজরতের আগে রাতে (নবি ও আবু বকর সে- রাত একসাথে গুহায় কাটান) নিহত হবার আশংকা থাকা পরও নবির বিছানায় আলি শুয়ে ছিলেন। নবির সহচরদের মধ্যে আলিই সবচেয়ে বেশি শক্ৰ হত্যা করেছেন। নবির উদাহরণ পালনে অসীম সাহসিকতা, অকপটতা, বাকপটুতা ও নির্ভুলতায় আলি সবার প্রশংসা অর্জন করেছেন। মুহাম্মদের নিজস্ব গোত্র হাশেমিদের কাছে আলি ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। আলির এতো গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মুহাম্মদের সহচরদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। এমন- কী তিনি ছিলেন মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা (নবি তনয়া ফাতেমার স্বামী) । মুহাম্মদ হয়তো ভেবেছিলেন আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলে আত্মীয়পোষণের অভিযোগ আসতে পারে। ফলে আন্তঃগোত্রীয় ঈর্ষার জন্ম হতে পারে যা মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতিকর হবে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে আলির অনন্য-সব গুণাবলী হয়তো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় তাঁর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। অপরিসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের শাসন করতে দরকার স্থৈর্য, আত্মসংবরণ, এবং মধ্যপন্থী মানসিকতা। নিচুপদের লোকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়াও একান্ত কর্তব্য। নবি মুহাম্মদের মাঝে এই গুণাবলী যথেষ্ট ছিল। মক্কা বিজয়ের পর সামান্য কয়েকজন ছাড়া নবি তাঁর বিপক্ষের, সে যতই একগুঁয়ে অথবা জেদি হোক, কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেননি। হাওয়াজেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্জিত গনিমতের সকল মাল নবি কুরাইশ নেতাদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। কিন্তু এ- ব্যাপারে আলি ছিলেন অনমনীয়। যে দাবিগুলি তিনি অন্যায্য মনে করতেন তিনি সেগুলিকে কোনোদিন বিবেচনায় আনতেন না। হিজরি ১০ (৬৩১- ২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলি ইয়েমেনে এক সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর সৈন্যরা দাবি করেন যুদ্ধে পাওয়া গনিমতের মাল তাদেরকে সাথে সাথে ওই স্থানেই বিতরণ করে দিতে হবে। কিন্তু আলি তাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করে সকল মাল নবির কাছে জমা করলেন। পরে নবি ওই যুদ্ধে লব্ধ মাল সকলের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ করে দিলেন। সৈন্যরা আলির বিরুদ্ধে নালিশ করলে নবি আলিকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিলেন। উসমানের খলিফা হবার সময় উবায়দুল্লাহ বিন ওমর হত্যা করেন হরমুজানকে (এক ইরানি সেনাপতি, তাঁকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে মদিনাতে আনা হয় এবং পরে একজন উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়) । উবায়দুল্লাহ সন্দেহ করেছিলেন যে তাঁর পিতা সাবেক খলিফা ওমরের হত্যাকাণ্ডের সাথে হরমুজান জড়িত”। হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হলে উসমান আলির সাথে পরামর্শ করেন। আলি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ইসলামি আইন অনুযায়ী উবায়দুল্লাহকে এই হত্যার বদলা দিতে হবে। অর্থাৎ উবায়দুল্লাহর সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। উসমান আলির পরামর্শ মানেননি। উবায়দুল্লাহ ছিলেন খলিফা ওমরের দ্বিতীয় পুত্র। উসমান ওমরের এই দ্বিতীয় পুত্রের জীবনরক্ষা করলেন। উবায়দুল্লাহকে দিতে হল হত্যার খেসারত-অর্থাৎ রক্তের মূল্য। এরপর উসমান উবায়দুল্লাহকে ইরাকে পাঠিয়ে দিলেন।
নবি খুব ভাল করেই আলির সদগুণের সাথে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও নবি জানতেন যে আলি কোনো কিছুকে সঠিক মনে করলে সেই ব্যাপারে আপোষহীন থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে আলির এই আদর্শবান চরিত্র প্রশংসনীয়। কিন্তু এটা সত্যি অনেক ব্যক্তি ধর্মের লেবাস পরলেও ধনদৌলতের লোভ সামলাতে পারেননি। তাই বাস্তবতা যাচাইয়ে আলির এই আপোষহীন মানসিকতা যথাযোগ্য নয়। আলি যদি নেতৃত্ব নেন তবে এ- সকল লোভী ব্যক্তিরা বিপদ পড়বেন। তাতে সমগ্র মুসলিম সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং ইসলামের লক্ষ অর্জন করা যাবে না। নবি এ-বিষয়টিতেও সজাগ ছিলেন। আলির রাজত্বকাল ছিল স্বল্পসময়, হিজরি ৩৫, ১৮ জিলহজ থেকে হিজরি ৪০, ১৭ রমজান ( ১৭ জুন ৬৫৬- ২৪ জানুয়ারি ৬৬১) পর্যন্ত। এই সময় যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাঁরা প্রমাদ গোনেন। যারা পাপের পথে চলেছিলেন, আলি তাদের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে অস্বীকার করলেন। এমন কী খুব অল্প সময়ের জন্যেও আলি তাদেরকে ছাড় দিতে চাইলেন না। আলির এই অনমনীয় মনোভাবের জন্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়ার সাথে বিরোধ দেখা দেয়। তালহা এবং জুবায়ের ছিলেন নবির সহচরদের মধ্যে অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ দুই সাহাবি। নবির এই দুই সাহাবিও আলির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলেন।
সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, নবি তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার আগেই মারা যান। নবির এই সিদ্ধান্ত তাঁর প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতারই প্রমাণ করে। অনেক চিন্তাভাবনা করে নবি হয়ত শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ক্ষমতার লড়াইয়ে মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করা সঠিক হবে না। এই ক্ষমতার লড়াই প্রকৃতির নিয়ম মাফিক চলুক-নবি তাই চাইলেন। এই নিয়মে যে সবচাইতে বলবান সেই টিকে থাকবে, যাতে করে ইসলামও বেঁচে থাকবে।
এ- ঘটনার সাথে আধুনিককালের একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় উপস্থিত হতে পারলেন না। তাই তাঁর বিছানা থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে একটা চিঠি পাঠান। সেই চিঠিকে বলা হয় লেনিনের জবানবন্দি। চিঠিতে লেনিন সোভিয়েত বলশেভিক দলের দুই প্রখ্যাত সদস্যের প্রশংসা করলেন। এ-দুই ব্যক্তি ছিলেন স্টালিন এবং ট্রটস্কি। লেনিন লিখলেন এই দুই ব্যক্তি নতুন সরকারের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু লেনিন এও আশঙ্কা করলেন যে ভবিষ্যতে দুজনের মাঝে বিরোধ ঘটতে পারে। লেনিন পত্রে এই দুজনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার দিকগুলোও তুলে ধরলেন। কিন্তু উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে চুপ থাকলেন। মনে হয় লেনিনও চাইলেন যে প্রকৃতির নিয়মমাফিক যে যোগ্যতম ব্যক্তি সে-ই বিজয়ী হবে।
ইসলামের পূর্বে আরবরা তাদের নিজ নিজ গোত্র, বংশ অথবা বংশবৃত্তান্ত নিয়ে বড়াই করতেন। তাদের এই দাম্ভিকতার মূলে তাদের কোনো নৈতিক উৎকর্ষতা বা আচরণের সাধারণ মাধুর্য ছিল না। বরং তাদের গর্ব প্রকাশ পেত হত্যাকাণ্ডে শৌর্য দেখানো, লুটতরাজ এবং অন্য গোত্রের নারী অপহরণের মধ্যে। ইসলাম আরবদের এই অসভ্যতার মূলে আঘাত হানে এবং কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধাৰ্মিকতাকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু ইসলামের এই নতুন মানদণ্ড বেশিদিন থাকল না। সত্যি বলতে হিজরি ২৩ (৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে খলিফা ওমরের মৃত্যুর পর ইসলামের নৈতিকতার মানদণ্ডে ফাটল ধরে। উসমানের সময় ধাৰ্মিকতার স্থলে আত্মীয়পোষণ প্রাধান্য পেল। আবুজর গিফারির” এবং আমার বিন ইয়াসিরদের মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা পেছনে পড়ে রইলেন। এ- স্থানে উসমানের গোত্রের লোকেরা, যেমন মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং হাকাম বিন আবুল আসারা পেলেন শাসনকর্তার পদ।
ইসলামের সবচেয়ে উজ্জ্বল নীতি ছিল মহত্ত্ব এবং ধাৰ্মিকতা। উমাইয়া খেলাফতের সময় (হিজরি ৪১- ১৩২ বা ৬৬১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামের এই নীতিগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। এর স্থলে প্রাধান্য পায় গোত্র ও জাতিগত দাম্ভিকতা। এই দম্ভ আরও ব্যাপকতা লাভ করে ক্রমে। ফলে শুরু হয় আরব জাতীয়তাবাদের দাবি মেটানোর পালা। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বিজিত জাতি পদানত করে এবং তাদের সম্পদ হরণ করে।
আরবের উষর মরুভূমির বেদুইনরা আক্রমণ শুরু করেন সভ্যজগতের বিশাল এলাকা। মরুভূমির বেদুইনরা দখল করে নিলো সভ্যজগতের শাসন ক্ষমতা এবং হরণ করে এইসব বিজিত দেশগুলির বিশাল ধনসম্পদ। ক্ষমতা- মদমত্ততার দেশগুলিকে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে গণ্য করতে লাগল। আরবরা বিজিত দেশগুলোর জনতাকে অপরিসীম ঘৃণার চোখে দেখল। কখনো তাদেরকে আরবদের সমকক্ষ মনে করত না। এমনকি বিজিত দেশের যারা ইসলাম গ্রহণ করে আরবরা তাদেরকে পর্যন্ত ইসলামের যে সার্বজনীন সৌভ্রাতৃত্বের নীতি আছে তা থেকে বঞ্চিত করল।
কথিত আছে, এক ইরানি মুসলমান হয়ে আরব গোত্র বানু সুলায়ম গোত্রের আশ্রিত হন। সেই ইরানি বানু সুলায়ম গোত্রের এক মহিলাকেও বিবাহ করেন। এ- সংবাদ শোনার পর ওই গোত্রের একজন, মুহামদ বিন বশির মদিনাতে গিয়ে শাসনকর্তা ইব্রাহিম বিন হিশাম বিন আল মুগিরার কাছে ইরানির বিরুদ্ধে নালিশ করেন। মদিনার শাসক এক প্রতিনিধি পাঠালেন। সেই প্রতিনিধি ইরানিকে দুইশত বেত্ৰাঘাত করে মস্তক, মুখ ও ভ্রমুণ্ডণ করে দিল। তারপর ইরানিকে জোরপূর্বক তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া হল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহামদ বিন বশির এক গীতিকবিতা রচনা করেন। গীতিকবিতাটি কিতাব আল- আগানি’ ( Kerab ০LAghani গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। সেই গীতিকাব্যের কয়েকটি লাইন এখানে অনুবাদ করে দেয়া হল :
আপনি কোনো বিদেশির কাছ হতে শাসন ক্ষমতা পাননি।
এই জন্য ওই আশ্ৰিত অনারব পেল দুইশত বেত্ৰাঘাত
এবং তার মাথা মুণ্ডন করা হল।
এই হচ্ছে তার দৃষ্ট্রক্তমূলক শক্তি।
তাদের জন্যে রয়েছে খসরুর কন্যার?
এর পরেও কি ওই আশ্রিত বেশি পেতে চায়?
এই আশ্ৰিতের জন্য কি আছে?
ক্রীতদাসের সাথে ক্রীতদাসীর বিবাহ হয়।
আব্দুল্লাহ বিন কুতায়বা লিখিত ‘আইন আকবর’ গ্রন্থ থেকে আরও একটা তথ্য জানা যায় : এক আরব কাজির কাছে গিয়ে বলেন : “আমার পিতা মারা গেছেন। তাঁর উইলে লেখা আছে তাঁর সম্পত্তি আমার ভ্রাতা, আমার মাতা, আমি এবং এক হাজুন, আমাকে জানান কে কী পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন? ( হাজুন একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ইতর। তৎকালীন সময়ে কোনো অনারব মহিলার গর্ভের সন্তান বোঝাতে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হত) । কাজি উত্তর দিলেন : এখানে কোনো সমস্যা নাই। প্রত্যেকে পাবে এক তৃতীয়াংশ। আরব ব্যক্তি বললঃ আপনি আমাদের সমস্যা বুঝেননি। আমরা দুই ভাই এবং একজন হাজুন। কাজি উত্তর দিলেন: সম্পত্তিতে প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে। আরব ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন: এক হাজুন কেমন করে আমাদের সমান হয়?’ কাজি বললেন: ‘এ আল্লাহর আদেশ। ’
ইসলামের অতীত শতাব্দী থেকে এ- ধরনের শতশত উদাহরণ পাওয়া যায়। এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে ক্ষমতা দখল ও অন্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়োজনে ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছে। কোরানে যেসব ক্ষমাশীল এবং দয়াপূর্ণ আয়াত আছে সেগুলি কোনোদিন মেনে চলার ব্যবস্থা করা হয়নি। পৌত্তলিক আরবে যেভাবে আরবেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ দেখাতেন সেই মানসিকতারই নিশ্চয়তা পাওয়া গেল এ-যুগেও। তথাপি অনারব মুসলিমরা ইসলামের মহান শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত থাকেন। তাঁরা সারণ করেন কোরানের এই আয়াতটি তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানি। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত আয়াত ১৩) । আরবদের দাম্ভিক আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইরানে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী- ঘরানার এ গণআন্দোলনকে বলা হয় ‘শোবিয়া আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন থাকত না, যদি নবি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং যে ইসলামের পথ ধরে আবু বকর, ওমর এবং আলি চলেছিলেন, সেই ইসলামের ধারা অব্যাহত থাকত।
গনিমতের মাল
পাশ্চাত্য অনেক পণ্ডিত ইসলামকে একটি আঞ্চলিক বিষয় বলে মনে করেন। তাঁরা ইসলামের অনেক শাস্ত্রীয় নির্দেশকে আধুনিক বিশ্বের উপযোগী বলে মানতে চান না। এ-নির্দেশের মধ্যে রয়েছে: নামাজের পূর্বে অজু করা, দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়া যা মসজিদে গিয়ে পড়াই উত্তম, চন্দ্রবৰ্ষ অনুযায়ী বার মাস গণনা করা, এবং রমজান মাসে উপবাস করে সূর্যোদয় হতে সূর্যস্ত পর্যন্ত প্রধান কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা – তা বিশ্বের যে কোনো স্থানেই হোক। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের যেসব স্থান উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থিত সেখানে সূর্য অস্ত যায় না এবং সর্বদাই দিবস থাকে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা মনে করেন যে সপ্তম শতাব্দীতে রমজান মাসের উপবাসের প্রথা করা হয়েছিল হেজাজের জন্য। কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের অন্যান্য স্থান সম্বন্ধে অজ্ঞাত ছিলেন। ইসলামে সুদের ব্যবসা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা পুঁজি বিনিয়োগের এবং অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য ক্ষতিকর। ইসলামে দাসত্ব প্রথার মাধ্যমে মানুষকে পশুতুল্য ব্যবহারকে আইনসঙ্গত করা হয়েছে। নারীরা প্রায়শ অর্থনৈতিক কাজকর্মে তেমন অবদান রাখে না। তাই পুরুষদের চেয়ে তাদের বেশি অর্থের প্রয়োজন। ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে নারীদের প্রতি অসমতা রয়েছে। নারীরা পুরুষদের থেকে কম পান। তাই ইসলামের অসম উত্তরাধিকার আইনকে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অযৌক্তিক মনে করেন। ইসলামে নারীর সাক্ষ্যকে পুরুষদের অর্ধেক ধরা হয়। এই ব্যবস্থা হচ্ছে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোরানের আদেশ অনুযায়ী একবার চুরির অপরাধে হাতকাটা এবং চুরির পুনরাবৃত্তির জন্য পা কেটে ফেলা একেবারেই অসামাজিক প্রথা। কারণ এরূপ শাস্তির ফলে অপরাধী অক্ষম, বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। যার ফলে তার কাজকর্ম করার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ইসলাম পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ প্রথা অনুমোদন করে। এক স্বামী একক সময়ে চার স্ত্রী নিতে পারে এবং অগুণিত ক্রীতদাসী উপপত্নী হিসাবে রাখতে পারে। আবার যুদ্ধবন্দিনী-এমন কী যাদের স্বামী জীবিত থাকে সেইসব যুদ্ধবন্দিনীদের সাথেও যৌন সঙ্গমের অনুমতি রয়েছে। ব্যভিচারের জন্য ইসলামে রয়েছে পাথর ছুড়ে হত্যার শাস্তি যা ইসলাম ধার করেছে ইহুদিদের শাস্তিব্যবস্থা থেকে। ইসলামে বিদ্যমান এই প্রথাগুলিকে পাশ্চাত্যে অমানবিক বলে নিন্দা করে। ইসলামি নীতিতে বলা হয়েছে: কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি ও দেহের উপর তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ থাকবে। নিজস্ব সম্পত্তি উইল করার ব্যাপারে যে সীমাবদ্ধতা আছে সেটা ইসলামের নীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। মোদা কথা হল ধর্ম কোনোভাবে সর্বজনীন ও সর্বকালের জন্য নয়।
এটা সত্যি যে, আজকাল বেশিরভাগ মুসলিম দেশে ইসলামি আইন যেমন পাথর ছুড়ে হত্যা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কর্তন করা এবং চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত উত্তোলন করা হয় না। সব মুসলিম দেশে সুদসহ ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই তথ্যগুলো জানানো হলেও ইসলাম- সমালোচকেরা হজ নিয়ে কটাক্ষ করেন। হেজাজের পৌত্তলিকদের মূর্তিপূজার ঘরকে আল্লাহর ঘর বানানো, পৌত্তলিক- প্রথার মত কাবার কালো পাথরকে (হাজরে আসওয়াদ) চুম্বন করা, এবং হজ সংক্রান্ত অন্য সকল ধর্মীয় আচার। ইসলামের দাবি হচ্ছে, ইসলাম মানব সমাজকে পৌত্তলিকতা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু হজ সংক্রান্ত রীতিনীতি ইসলামের এ- দাবির সাথে পুরোপুরি খাপ খায় না।
এজন্য ইসলামকে একটি একক জাতির নিজস্ব চিন্তাধারা ও রীতিনীতির প্রকাশ হিসাবে ধরে নিতে হবে। যে ধর্ম কখনো বর্ণবৈষম্য ও অন্ধ গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠেনি এবং সমগ্র মানবসমাজকে ভালোর দিকে পথ নির্দেশ দেয় না সে ধর্ম কখনো সার্বজনীন ও স্থায়ী হতে পারে না।
ইসলাম- সমালোচকেরা একটা বিষয় ভুলে যান, সবচেয়ে উত্তম আইন হবে সেই আইন যা মানুষের প্রয়োজন ও যা সমাজে উপস্থিত সকল ক্ষতিকর অবস্থার মোকাবেলা করে। তৎকালীন আরব সমাজে হত্যা, লুটতরাজ, অন্যের অধিকার ও সমানে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা ছিল সর্বত্র বিরাজমান। এ- রকম অস্থির সমাজে একমাত্র কঠোর আইনই ফলপ্রসূ হবে। শাস্তি হিসাবে অঙ্গাদি কর্তন করা, পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা এবং রক্তের বদলে রক্ত-একমাত্র এসব বিধান ছাড়া কোনো কিছু ফলপ্রসূ ছিল না। ইসলামের পূর্বে এবং ইসলাম প্রচারের সমসাময়িককালেও দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। ইসলামের পূর্বে রোমান, অসিরীয়ান, এবং ক্যালডিয়ান সভ্যতার সময়েও দাসপ্রথা চালু ছিল। ক্রীতদাসের মুক্তির বিনিময়ে অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা ইসলামে আছে। এ নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের ইসলামে নারী পরিচ্ছেদে বেশকিছু মন্তব্য রয়েছে। পৌত্তলিক যুগে আরব- নারীদের অধিকার খুবই কম ছিল। মৃত স্বামীর স্ত্রীকে সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হত। যে ব্যক্তি মৃত স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারী হত তার বিধবা স্ত্রীও তার ভাগে পড়ত। কোরানে নারীদের যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা সেই সময়ের নারী অধিকারের জন্য এক বিপ্লবাত্মক অগ্রগতি। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতে মুহাম্মদ যেসব আদেশ দিয়ে গেছেন তা আজকের উনবিংশ এবং বিংশ শতকের সমাজের মানদণ্ডে বিচার করা অযৌক্তিক। আব্রাহাম লিঙ্কন যেভাবে দাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেভাবে নবি মুহাম্মদ লড়বেন, এটা আশা করা একেবারে অবাস্তব। ইসলাম- সমালোচকদের আরও অনেক সমালোচনার যথার্থ জবাব দেয়া যায়। ইসলামে চিন্তা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলা যায় যে মুসলিমরা বিজিত দেশের বাসিন্দাদের উপর দুইটি পছন্দের একটি বেছে নেবার সুযোগ দেবে ইসলাম অথবা জিজিয়া কর।
এটাও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে তরবারির লড়াইয়ে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে। আজকের বিংশ শতাব্দীর মানদণ্ডে যাচাই করলে এভাবে ইসলাম প্রচার করা অনুচিত ও অন্যায় মনে হবে। আধুনিক বিশ্ব কোনোভাবেই এই ধারণা গ্রহণ করবে না যে, আল্লাহ একমাত্র আরবদেরকেই নির্বাচিত করেছেন সমগ্র মানব- সমাজকে পথ দেখাতে। আল্লাহ সত্যিই যদি চাইতেন সিরিয়া, মিশর, এবং ইরানের বাসিন্দারা মুসলিম হবে, তবে তিনি যুদ্ধের আশ্রয় না নিয়ে অনেক মার্জিত ও শান্তিময় ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কারণ কোরানে বলা হয়েছে : . . . তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন ও যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। (সুরা নাহল : আয়াত ৯৩)। কোরানে আরও বলা হয়েছে যে তরবারি দ্বারা কাউকে পথ দেখানো যায় না। . . . প্রকৃত প্রমাণ দ্বারাই আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করার তাদের ধ্বংস করেন, আর প্রকৃত প্রমাণ দ্বারাই যাদেরকে জীবিত রাখা প্রয়োজন তাদেরকে জীবিত রাখেন।’ ( সুরা আনফাল: আয়াত ৪২) । . . . তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। (সুরা কাফিরুন ; আয়াত ৬) । এইরকম আরও ডজন খানেক কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করা যায়।
এই বিষয়ের গভীরে গেলে বুঝা যায় ইসলাম গ্রহণ অথবা জিজিয়া কর প্রদান করার যে শর্ত ছিল তা করা হয়েছিল আরববাসীর জন্য। মুহাম্মদ এই নীতি অবলম্বন করেন খায়বার দখল করার পর এবং মক্কা বিজয়ের পর যখন কুরাইশরা মুহাম্মদের প্রতি তাদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। নবি মুহাম্মদের উদ্দেশ্য ছিল আরবদেশকে একটি একক রাজনৈতিক ধারায় নিয়ে আসা। হাদিস থেকে জানা যায় যে নবি বলেছেন: আরব উপদ্বীপে একের বেশি ধর্ম থাকবে না। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ নবিকে পাঠালেন সুরা তওবা । এই সুরায় বলা হল যে, পৌত্তলিকরা অবিশুদ্ধ। তাই তারা আর কাবার মসজিদ প্রাঙ্গণে আসতে পারবে না। এই সুরার অনেক আয়াত থেকে বুঝা যায় যে ইসলামের ছত্রছায়ায় একটি আরব- জাতীয় পরিচয়ের জন্য নবি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাই বেদুইনদের জন্য কঠোর পদক্ষেপ এবং শক্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা এই সুরায় রাখা হয়। অবিশ্বাস ও কপটতায় মরুবাসী আরবরা ( বেদুইন) বড় বেশি পোক্ত। আর আল্লাহ তাঁর রসুলের ওপর যা অবতীর্ণ করেছেন তার (ন্যায়নীতির) সীমারেখা না শেখার যোগ্যতা এদের বেশি।’ (সুরা তওবা ; আয়াত ৯৭) । সুরা শোআল্লারাতে আল্লাহ বলেছেন: “যদি এ কোনো অনারবের (ভিন্নবাসী) ওপর অবতীর্ণ করা হত। ( ২৬; ১৯৮) । এ- আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহ জানতেন যে আরবদের চাইতে অনারবরা দ্রুত কোরান বোঝে এবং সহজেই কোরানের বাণী মেনে নেয়।
ইউরোপের পণ্ডিতেরা ইসলাম প্রসঙ্গ অনেক মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে দুটি প্রসঙ্গের উত্তর দেয়া যায় না। একটা হচ্ছে আল্লাহ শুধুমাত্র হেজাজের লোকদেরকে নিয়োগ করলেন সমগ্র বিশ্বকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে এবং তরবারি দিয়ে লড়াই করে বিশ্বব্যাপী একেশ্বরবাদ প্রচার করতে। যেহেতু এই বক্তব্যটি বিশ্বাস করা কঠিন তাই এ-নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাবে না। দ্বিতীয় হচ্ছে আরবদের অন্য দেশ দখলের পিছনে যে অর্থনৈতিক প্রেরণা ছিল তা নিয়ে।
এ অধ্যায়ের শুরুর দিকে বলা হয়েছে নবির মৃত্যুর পর নেতৃত্ব এবং রাজ্যশাসনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক ইসলামের রূপরেখা তৈরি করেছে। আরব বেদুইন যে অন্যের ধনদৌলত কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাতিকে পদানত করেছিল তার প্রচুর প্রমাণ আমরা পাই ইতিহাস থেকে। উষর, অনুর্বর, রৌদ্রতপ্ত আরব মরুভূমিতে বসবাস করত অতিশয় রুক্ষ যাযাবর বেদুইনরা। তারা অতিকষ্টে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা জানতো তাদের সীমান্তের বাইরে আরও অনেক উর্বর, ধনী, এবং উন্নত রাষ্ট্র এবং নগর আছে। সেসব জায়গায় বিলাসিতা আছে প্রচুর এবং জীবিকা অর্জন সহজ। তবে দুঃখের বিষয় ছিল যে ওই জনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডগুলো প্রবল ক্ষমতাধর পারস্য ও রোমের অধীনে। বিছিন্নভাবে নিঃস্ব, সহায়হীন যাযাবরদের দ্বারা এই শক্তিমান রাজত্ব জয় করা সম্ভব ছিল না। যাযাবর আরব বেদুইন গোত্রের মাঝে পরস্পর ধ্বংসাত্মক হানাহানি তখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ইসলাম এই আন্তঃগোত্রীয় হানাহানির অবসান ঘটায়, তাদের মাঝে এনে দেয় দৃষ্টির প্রসারতা। দীর্ঘদিন ধরে বেদুইনদের শক্তি বিচ্ছিন্ন-বিভাজিত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ইসলাম সে শক্তিকে সুসংহত করে একত্র করে। ফলে আরব ভূখণ্ডে জন্ম হয় এক অতিশয় শক্তিধর জাতির, যা এতদিন অসম্ভব ছিল ইসলাম তাকে সম্ভাবনাময় করে দিল।
ইসলাম- পূর্ব যুগে আরব ভূখণ্ডে দরিদ্র বেদুইনরা তাদের লোভ চরিতার্থ করার জন্য দুর্বল গোত্রের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুশো থেকে তিনশ উট কুক্ষিগত করে নিয়ে যেত। যখন তাদের এই শক্তিকে একত্রিত করা হল তখন তারা দেখল তারা আরও প্রচুর মাল দখল নিতে পারে। দূর-দূরান্তের উর্বর জমি দখল করে নিতে পারে, বিদেশি সুন্দরী শ্বেতাঙ্গ নারীও পেতে পারে। আরব- বেদুইনদের বৈশিষ্ট্য ছিল লড়াই করে অন্যের মাল লুট করতে এবং কাম চরিতার্থ করতে তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে কুষ্ঠিত হতো না। ইসলাম তাদের এই উৎসর্গীকৃত জীবনাচরণ ও পেশাদারী বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাল। আর বেদুইনরাও বুঝল যুদ্ধ জয় হলে অগণিত ধনসম্পদই শুধু হস্তগত হবে তাই নয় শক্রকে হত্যা করলে বেহেশত লাভ হবে কিংবা যুদ্ধের ময়দানে নিহত হলেও বেহেশতে যাবে। ইসলাম আরব বেদুইনদের লড়াকু জীবনাচরণের আধ্যাত্মিক প্রেরণা যোগান দেয়। ইসলাম গ্রহণের পর তামিম গোত্র দ্বারা তাগলিব গোত্রকে আক্রমণ, আউস গোত্র দ্বারা খাজরাজ, সাকিফ গোত্র দ্বারা গাতাফান গোত্রকে পরস্পর আক্রমণ করা সম্ভব হল না। তার বদলে আরব দৃষ্টিপাত করল সিরিয়া ও ইরাকের উপর।
তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে গনিমতের মাল লাভ করা ছিল মুসলিম সম্প্রদায়কে সুদৃঢ় করার অন্যতম হাতিয়ার। দ্বিতীয় হিজরি সালে মুহাম্মদ নাখলাতে কুরাইশদের মালবাহী কাফেলা আক্রমণ করে প্রচুর মালামাল হস্তগত করেন। ফলে মুসলিমরা নিজেদের একত্রিত শক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেলেন। এরপর বানু কায়নোকা, বানু কুরাইজার ধনসম্পদও হস্তগত হয় তাঁদের। ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্ত ভিত্তি লাভ করে। আরবদের যে গনিমতের মালের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে তা কোরানেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা ঘরে থেকে গিয়েছিল তারা বলবে, আমাদেরকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও।. . (সুরা ফাতাহ আয়াত ১৫) । এই আয়াতে এক বেদুইনের কথা বলা হয়েছে। সেই বেদুইন কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে এবং এক বৃক্ষের তলে (হুদাইবিয়ার সফরের সময়) নবির পক্ষে সর্বদা জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার নিতে অপরাগ ছিল। পরে যখন নবি খায়বারে ইহুদিদের বিরদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন সেই বেদুইন সংবাদ পেল যে আল্লাহ মুসলিমদেরকে অগাধ গনিমতের মাল লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই সে নবির অভিযানে যোগ দিতে চাইল। এদিকে গাতাফান গোত্র খায়বারের ইহুদিদের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। নবি যখন খায়বারে সামরিক অভিযান চালান তখন তিনি গাতাফান গোত্রকে খায়বারের গনিমতের মালের কিছু অংশ দেবার অঙ্গীকার করলেন যাতে তারা ইহুদিদের সাহায্যে এগিয়ে না যায়।
গনিমতের মালের প্রতি আরবদের যে কী অপরিসীম আকর্ষণ ছিল তার প্রচুর বিবরণ পাওয়া যায় হিজরির প্রথম দশকে। এর একটা বিশেষ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে। সেখানে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ হাওয়াজেন গোত্র থেকে পাওয়া গনিমতের মাল তাঁর কুরাইশ আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করে দিলেও আনসাররা কিছুই পেল না। ফলে আনসাররা নবির উপর গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই বিবরণগুলি আরবদের বিশেষ মনোবৃত্তির প্রমাণ দেয়। আর এটাও প্রমাণ করে নবি তাঁর সমাজের লোকদের মানসিকতা খুব ভাল করে বুঝতেন। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। নবি যেসব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন যেমন বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ, ইহুদিদের উৎখাত করা বা তাদেরকে অধীনস্থ করা, এসবের পিছনে নবির এক উচ্চতর উদ্দেশ্য ছিল। যা আরবদের গনিমতের মালের প্রতি আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ভিন্ন ছিল। মুহাম্মদ কেবল একজন ধর্মপ্রচারক নয়, একজন রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। রাষ্ট্রনায়কেরা মনে করেন তাঁদের উদ্দেশ্য সফলের জন্য যা দরকার তাই-ই করতে হবে। মুহামদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের বীজ রোপণ করা, আরবদেশ থেকে দুনীতিপরায়ণ পৌত্তলিক, কপটাচারীদের নির্মুল করা, এবং ইসলামের পতাকায় এক সংযুক্ত আরব রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করা। তাই তাঁর এই সুউচ্চ লক্ষ অর্জনে তিনি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত ছিলেন।
গনিমতের মাল মুহাম্মদ কখনো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। সে- সময় মুসলিম সমাজ ছিল ছোট। তাই নবি গনিমতের মাল ব্যবহার করে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে সচেষ্ট হন। মুহামদ তাঁর অতি সাদাসিধা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। বানু কুরাইজার বিপুল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পর নবির স্ত্রীগণও তাঁর কাছ থেকে অধিক ভাতা দাবি করলেন। কিন্তু নবি তাঁর স্ত্রীদের দুটির মধ্যে একটি পছন্দ করতে আহবান করলেন -তাদের বর্তমান ভাতা অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ। নবির সহচরেরা তাঁর মতই সাদাসিধে জীবন নির্বাহ করতেন। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁর কোনো সহচর লোভের বশবর্তী হননি। নবির মৃত্যুর পর মুসলমানরা অনেক দেশ জয় করেন। ফলে প্রচুর পরিমাণ গনিমতের মাল অর্জিত হয়। তখন নেতৃত্বের অনেকেই ধনদৌলতের প্রতি বশীভূত হন।
দ্বিতীয় খলিফা ওমর গনিমতের মাল বণ্টন কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুধু তাই নয় মুহাজির ও আনসার নেতাদের এবং অন্যান্য সুযোগ্য মদিনাবাসীদের বয়স্ক ভাতা ধার্যের সময়ও ন্যায়-নীতি মেনে চলতেন। সবাইকে নবির পথে রাখার জন্য ওমর নিজেও একান্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। মুক্তক্রীতদাস সালেম ( শুরুর দিকের হাদিস বর্ণনাকারী) এক হাদিসে জানিয়েছেন, খলিফা থাকাকালীন সময়ে ওমরের পাগড়িসহ সমস্ত পোশাক, এবং জুতার মূল্য চোদ দিরহামের বেশি ছিল না। অথচ খলিফা হবার আগে এগুলির মূল্য ছিল চল্লিশ দিনার। ঐতিহাসিক এবং কোরানের তফসিরকারক আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল তাবারি লিখেছেন যে, ওমরের মিতব্যয়িতা এতোই কঠোর ছিল যে তাঁর শাসনের শেষের দিকে প্রচুর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ওমর তা জানতে পেরে মসজিদের প্রচারবেদি থেকে ঘোষণা করলেন: ‘আমি ইসলামের পরিপালনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছি। ইসলাম এখন পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। কুরাইশরা এখন চাইছে আল্লাহর দান (গনিমতের মাল) তাঁর ইবাদতকারীদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে। আমি এই ব্যাপারে সতর্ক আছি। কুরাইশরা সহজ পথ (ইসলাম) থেকে বিচ্যুত হয়ে নরকের পথে পা বাড়ালে আমি তাদেরকে বাধা দিব। তাবারি আরও বলেছেন যে, খলিফা ওমরের অনুমতি ছাড়া নবির বিশিষ্ট সাহাবিদের পর্যন্ত মদিনার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ওমর কখনো অনুমতি দিলেও তা সীমাবদ্ধ থাকত শুধুমাত্র স্বল্পসময়ের জন্য, তাও শুধুমাত্র হেজাজ অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য। বিশিষ্ট সাহাবিরা বিজিত দেশে ভ্রমণ করলে মুসলমানরা ভাগ হয়ে যেতে পারে -এই চিন্তা নিয়ে ওমর সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। কখনো কোনো বিশিষ্ট কুরাইশ বিদেশিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করতে চাইলে ওমর বলতেন: নবির সময়ে আপনি যে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আপনি বিদেশ না দেখলেই ভাল, আর বিদেশিরা আপনাকে না দেখলেই ভাল।”
খলিফা ওমরের কঠোরতা প্রসঙ্গে মিশরীয় লেখক তাহা হোসেন তাঁর ‘ফেৎনাত আল কুবরা (২য় খণ্ড, কায়রো ১৯৪৭ এবং ১৯৫৩) বইয়ে লিখেছেন : ‘ক্ষমতা ও মুনাফার উপর কুরাইশদের প্রবল লোলুপতা ছিল। কুরাইশদের এই গোষ্ঠীগত মনোভাব খলিফা ওমর ভাল করে জানতেন। তাই ওমর কুরাইশদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। সে-সময় কাবা ছিল আরবদের মূর্তিপূজা এবং তীর্থযাত্রার প্রধান কেন্দ্র। কুরাইশদের উপর ন্যস্ত ছিল কাবাঘর ও তীর্থযাত্রীদের দেখাশোনার ভার। এটাই একমাত্র কারণ যে, কুরাইশরা তাদের গোত্রের আভিজাত্যের দাবিদার ছিল। অর্থাৎ আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার, প্রথা-রীতিনীতির সুযোগ নিয়ে কুরাইশরা গোটা আরবের মধ্যে সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠে। কুরাইশদের সৌভাগ্য যে, ধর্মীয় কারণে মক্কা এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল নিরাপদ। তাই কুরাইশরা পূর্ণভাবে বাণিজ্যে মনোনিবেশ করতে পারতেন। তারা হেজাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। কুরাইশরা ছিল ওমরের গোত্রের লোক। তাই ওমরও জানতেন কুরাইশদের সব আভিজাত্য, সমান এবং ধনদৌলত সব কিছুর পিছনে রয়েছে ছিল কাবা ও এর মূর্তিগুলো। তা না হলে কুরাইশরা কোনোদিনই মূর্তি পূজা করত না। ওমর আরও জানতেন কুরাইশরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেননি। মক্কা বিজয়ের পর নবি তাদের উপর ইসলাম চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কুরাইশরা মুসলমানদের ভয়ে পেত। তাছাড়া কুরাইশরা জানত যে, দীর্ঘদিনের বংশের ঐতিহ্য ভেঙে ইসলাম গ্রহণ তাদের জন্য এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। সেজন্যে ওমর ভাবলেন এই ধনসম্পদ লোলুপ সুযোগ-সন্ধানীদের যথেচ্ছার ভার দেওয়া বিপদজনক হবে।
ওমর যে আসলেই বিচক্ষণ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পর অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ওমরের উইলে লিখে গিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে যিনি খলিফা হবেন তিনি যেন ওমর নিয়োগকৃত শাসনকর্তাদের এক বছর তাদের পদে বহাল রাখেন। উসমান ওমরের ইচ্ছা পালন করলেন। এক বছর পর উসমান সরকারি পদগুলি থেকে নিয়োগকৃতদের রদবদল করেন। শাসনের শুরু হতেই উসমান মুহাজির ও আনসারদের সরকারি কোষাগার থেকে প্রচুর টাকা পয়সা দেয়া শুরু করেন। একবার উসমান বয়স্ক ভাতা শতকরা একশ ভাগ বাড়িয়ে দিলেন। উসমান ছিলেন তৃতীয় খলিফা। পূর্বগামীদের অনুরূপ ব্যক্তিগতভাবে উসমান সাধারণ জীবন নির্বাহ করতেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে উসমান কখনো সরকারি তহবিল তছরুপ করেননি। কিন্তু তিনি অযোগ্য ব্যক্তিদের অনেক দান, উপহার দিয়েছিলেন। এ কারণে অনেকের মাঝে পরশ্রীকাতরতা এবং লোভের জন্ম হয়, বাতিল হয়ে যায় আত্মসংযমী হবার প্রয়াস।
পূর্বেই বলা হয়েছে খলিফা ওমর অতি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন এবং সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। ইসলামের ইতিহাসে ওমর ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী খলিফা। তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম খলিফা যার উপাধি ছিল বিশ্বাসীদের নৃপতি’। আলিও ছিলেন কঠোর আত্মসংযমী ব্যক্তি। এ-ব্যাপারে আলির শক্রমিত্র উভয়েই একমত। আলির পোশাক ভর্তি ছিল তালিতে। বার বার তাঁর পোশাক সেলাইয়ের জন্যে আলি তাঁর দর্জির কাছে লজ্জিত থাকতেন। একবার আলির ভাই আকিল তাঁর ঋণ পরিশোধের জন্য আলিকে অনুরোধ করলেন সরকারি তহবিল থেকে টাকা দিতে। আলি কঠোরভাবে তিরস্কার করলেন আকিলকে। পরে আকিল চলে যান আলির প্রতিপক্ষ মুয়াবিয়ার কাছে। এ- ঘটনা থেকে বুঝা যায় আরবদের মানসিকতায় আর্থিক বিষয় কত গুরুত্বপূর্ণ।
এ- প্রসঙ্গে নবির অন্যতম প্রসিদ্ধ সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা দরকার। মক্কায় নবুওতির প্রথম দিকে সাদ ইসলাম গ্রহণ করেন। নবি যে দশজনকে বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন সাদ ছিলেন তাঁদের একজন। হিজরি ১৬ সালে (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) ওমরের খেলাফতে সাদ কুদসিয়ার যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন এবং ইরানিদের পরাজিত করে তাদের রাজধানী কুটাসফন (অথবা তাসিবন) দখল করে নেন। এই জন্য সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে ইসলামের বীর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস কুফার প্রথম শাসক নিয়োজিত হন। হিজরি ২৩ (৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে ওমরের মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ওমর নতুন খলিফা মনোনীত করার জন্য যে ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ গঠন করেন তাতে সাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে সাদও নতুন খলিফার জন্য একজন প্রার্থী হয়ে যান। হিজরি ৫৫ (৬৭৪-৫ খ্রিস্টাব্দ) সালে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস মদিনা শহরের নিকটবর্তী আল-আকিক উপত্যকায় অবস্থিত তাঁর বিশাল বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি রেখে যান যার পরিমাণ ছিল আনুমানিক দুই থেকে তিন লক্ষ দিরহাম।
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের পুত্র ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের কথাও বাদ দেয়া যায় না। হিজরি ৬১ সালে (৬৮১ খ্রিস্টাব্দ) ইরাকের শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ, ওমর বিন সাদ বিন ওয়াক্কাসকে এক শর্তে ইরানের রায়ি অঞ্চলের শাসনকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দেন। শর্ত ছিল প্রথমে ওমর বিন সাদকে এক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হবে যাতে তিনি হোসেন বিন আলিকে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার খেলাফত স্বীকার করাতে বাধ্য করেন। হোসেন এতে রাজি না হলে তার পরিণতি হোসেনকে বহন করতে হবে। অর্থাৎ হোসেনকে মেরে ফেলতে হবে। প্রথমে ওমর বিন সাদ এই শর্ত মানতে রাজি হলেন না। এক রাতে ওমর বিন সাদ তাঁর আত্মীয়দের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর আত্মীয়রা একমত হলেন তাঁর উচিত হবে না নবির দৌহিত্রের সাথে যুদ্ধ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ সফল হলেন। ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। যখন ওমর বিন সাদ হোসেনের সম্মুখীন হলেন তখন তিনি চাইলেন হোসেনের সাথে আপোষ করে নিতে। তিনদিন ধরে ওমর বিন সাদ হোসেনের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে বোঝাতে চাইলেন হোসেন যেন আত্মসমর্পণ করে ইয়াজিদের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করেন। এই দীর্ঘস্থায়ী আলোচনার কথা শুনে ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভাবলেন ওমর বিন সাদ হয়ত হোসেনের ইসলামি ভাবাবেগে পড়ে যাবেন এবং তাঁর পক্ষে চলে যাবেন।
সে- জন্য ওবায়দুল্লাহ তাঁর সামরিক কর্মকর্তা শেমর বিন দিল- জোওশানকে বার্তা পাঠালেন যে, ওমর বিন সাদ যদি গড়িমসি চালাতে থাকেন তবে তিনি যেন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে নেন। এই খবর শোনা মাত্র ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ভুলে গেলেন ইসলামের জন্য তাঁর পিতার অবদানের কথা। তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নবির নাতিকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়ে মারেন। ধর্ম, সমান এবং নৈতিকতার চেয়ে ওমর বিন সাদের কাছে প্রাধান্য তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ ছিলেন নবির অন্যতম সাহাবি। যে দশ জন সহচরকে নবি বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন তালহাও তাঁদের অন্যতম। খলিফা ওমর যে ছয় সদস্যের পরিষদ গঠন করেছিলেন তালহাও তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবার তালহা নিজেই খলিফা পদের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তালহা মদিনার বাহিরে থাকায় পরিষদের সভায় যোগ দিতে পারেননি। ফলে তালহার মতামত না জেনেই পরিষদ খলিফার মনোনয়ন দিয়ে দেন। মদিনায় ফিরে আসার পর তালহা খলিফার ব্যাপারে অনীহা দেখালেন এবং উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানাতে অস্বীকার করলেন। শেষে উসমান ব্যক্তিগতভাবে তালহার বাসগৃহে যান এবং খলিফার পদ ছেড়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তালহা বিব্রতবোধ করলেন এবং উসমানকে তাঁর আনুগত্য দিয়ে দিলেন। পুরস্কারস্বরূপ উসমান সরকারি তহবিল থেকে তালহাকে ৫০ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। এরপর থেকে তালহা হয়ে গেলেন উসমানের কাছের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরপরও তালহা উসমানের সাহায্যে আরও অনেক অর্থের লেনদেন করেন। যেমন একবার তালহা ইরাকের কিছু জমি বিনিময় করতে চাইলেন হেজাজ অথবা মিশরের সাথে। উসমান সাথে সাথে তৈরি হয়ে গেলেন তাঁর শাসিত ইসলামি সাম্রাজ্যের যে কোনো স্থানে উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠিয়ে দিতে যাতে তালহা যা চান তা পেয়ে যান। এ- ব্যাপারে অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। প্রথমে তালহা উসমানকে সমর্থন জানালেন। যখন অসন্তোষের কণ্ঠ উচ্চ হতে লাগল তখন তালহা বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন নিজের জিহবা সংবরণ করে। যখন বিদ্রোহীরা উসমানের গৃহ অবরোধ করে ফেলে তখন তালহা তাড়াতাড়ি বিদ্রোহীদের পক্ষ নিলেন। হিজরি ৩৬ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে জামালের যুদ্ধে (উটের যুদ্ধ) তালহা নিহত হন। একটি তথ্য অনুযায়ী উসমানের চাচাত ভাই মারোয়ান বিন আল-হাকাম এক তীর নিক্ষেপ করে তালহাকে হত্যা করেন। এরপর মারোয়ান বিন আল-হাকাম বলেন, উসমানের খুনের প্রতিশোধের জন্য তালহার রক্তই যথেষ্ট।’ (মারোয়ান ছিলেন আলির বিপক্ষে। হিজরি ৬৪ (৬৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারোয়ান উমাইয়া খলিফা নিযুক্ত হন।) উল্লেখ্য তালহা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি মোটেও অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন না। ওমরের সময়ও তালহা মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুকালে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল ত্রিশ লক্ষ দিরহাম। এর মধ্যে নগদ ছিল ২ লক্ষ দিনার আর বাকি ছিল দালানকোটা, কৃষিভূমি, ও অস্থাবর সম্পত্তি। ইবনে সাদে তাবাকাত গ্রন্থের বর্ণনায়, তালহার নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ১০০টি চামড়ার বস্তা, প্রত্যেক বস্তায় ছিল ১০০ কিলোগ্রাম বিশুদ্ধ স্বর্ণ।
ওমরের উত্তরাধিকার নিয়োগের জন্য যে ছয়জনকে মনোনীত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে আরও একজন ছিলেন জুবায়ের বিন আল- আওয়াম। তিনি নবির ফুফুর পুত্র। এছাড়াও নবির সাথে তাঁর অন্য আত্মীয়তাও ছিল। জুবায়ের বিন আল- আওয়াম ছিলেন প্রথম দিকের ইসলাম গ্রহণকারী। তিনিও সেই দশজনের একজন, যাকে বেহেশতের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। জুবায়ের নবির সঙ্গে অনেকগুলি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। নবি জুবায়েরকে আখ্যা দিয়েছিলেন আমার শিষ্য। তাই তিনি ছিলেন নবির সাহবিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। অনেকে বলেন যে ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান জুবায়েরকে সরকারি তহবিল থেকে ছয় লক্ষ দিরহাম দেন। জুবায়ের ভেবে পেলেন না এত বিপুল অর্থ দিয়ে তিনি কি করবেন? তাঁর বন্ধুরা যা পরামর্শ দিলেন জুবায়ের তাই-ই করলেন। বিভিন্ন নগরীর আশেপাশে তিনি অনেক বাড়ি, কৃষিজমি ক্রয় করেন। তাঁর মৃত্যুকালে ফোসতাত (পরবর্তীকালে কায়রো) , আলেকজান্দ্রিয়া, বসরা, কুফায় প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক বনে যান। মদিনাতে জুবায়ের এগারটি বাড়ির মালিক ছিলেন এবং এই বাড়িগুলি ভাড়া দিয়ে দেন। অনুমান করা হয় তাঁর সমগ্র ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৫, ২০০, ০০০ থেকে ৫২, ০০০, ০০০ দিরহাম। ইবনে সাদ তাঁর তাবাকাত বইয়ে লিখেছেন জুবায়ের অত্যন্ত ধাৰ্মিক ছিলেন। তিনি কারো কাছ থেকে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখতে চাইতেন না। তাঁর ভয় ছিল যে কোনো মুহুর্তে তিনি চরম দুর্দশায় পতিত হতে পারেন। ফলে ওইসব গচ্ছিত মাল বা ধনসম্পদ হারিয়ে যেতে পারে অথবা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু কেউ তাঁকে ঋণ দিলে তা গ্রহণ করতেন। এবং সেই অর্থ নিজের মনে করে লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতেন। তবে শর্ত ছিল তিনি মারা গেলে ওইসব ঋণের অর্থ তাঁর উত্তরাধিকারীরা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। সত্যি বলতে মৃত্যুকালে তিনি প্রায় বিশ লক্ষ দিরহাম ঋণ রেখে যান যা তাঁর পুত্ররা পরিশোধ করে দেন।
আব্দুর রহমান বিন আউফ নবির আরেকজন নিকটতম সাহাবি। তিনিও দশজনের মধ্যে একজন যে বেহেশতের নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন নবির কাছ থেকে। এই সাহাবি অতিশয় বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী এবং খলিফা আবু বকর ও খলিফা ওমরের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা। খলিফা নির্বাচনের জন্য ওমরের ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির একজন তিনি। আব্দুর রহমান কখন দারিদ্রতা দেখেননি। তাই বদান্যতায় ছিলেন সর্বাগ্রে। তিনি যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তি রেখে যান তা কোনোক্রমেই শুধুমাত্র মদিনার বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। মৃত্যুকালে তিনি চারজন স্ত্রী রেখে যান। প্রত্যেক স্ত্রী পান ৫০ হাজার স্বর্ণের দিনার, ১ হাজারটি উট এবং ৩ হাজার মেষ। আব্দুর রহমান উইলে তাঁর স্ত্রীদেরকে এই ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার নির্দেশ দিয়ে যান। খলিফা উসমানের আমলে হাকাম বিন হিজামের মতো গুণসম্পন্ন ব্যক্তি খুব কম ছিলেন। তিনি সরকারি তহবিল থেকে এক কপর্দকও নিতেন না। যখন সরকারি কোষাগার থেকে মুহাজির এবং আনসারদের মাঝে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হলো তখন তিনি সে ভাতা নিতে অস্বীকার করলেন।
আবুজর গিফারি* প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করে নবির ঘনিষ্ঠ সাহাবি হয়ে যান। গিফারি অতিশয় ধাৰ্মিক এবং কঠোর আত্মসংযমী বলে পরিচিত ছিলেন। অনেক হাদিসেরও বর্ণনাকারী। তিনি প্রায়ই বলতেন, সুরা তওবার ৩৪ আয়াতে যে বলা হয়েছে: . . . যারা সোনা ও রুপা জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মারাত্মক শাস্তির খবর দাও। (৯:৩৪) । এই আদেশ দেয়া হয়েছে সমগ্র মুসলিম সমাজকে যেন তারা সম্পদ কুক্ষিগত না করে তা দান করে দেয়। আবুজর গিফারি সিরিয়াতে থাকাকালীন শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে কোরানের ওই আদেশ লঙ্ঘন করার জন্য ভর্ৎসনা করেন। শাস্তিস্বরূপ মুয়াবিয়া আবুজরকে সিরিয়া থেকে নির্বাসিত করে হেজাজে পাঠিয়ে দেন। মদিনাতে এসে আবুজর একই কথা বললেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান তা শুনে আবুজরকে প্রহার করলেন এবং মদিনা থেকে বহিষ্কার করে দিলেন।
যাহোক এটা সত্যি যে, নবির কিছুসংখ্যক সাহাবি ধনসম্পত্তির লোভ সংবরণ করতে না পেরে তা হাসিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। অবস্থা এমন হয়ে উঠে যে, অদক্ষ এবং যারা নবি বা খলিফার সাথে জড়িত ছিল না তারাও পর্যন্ত নানা পন্থা অবলম্বন করে টাকা বানাতে লাগলেন। কথিত আছে জান্নাব নামে একজন দিনমুজুর মক্কায় বার্তাবাহক ভৃত্য হিসেবে কাজ করতেন, তিনিও কুফায় মৃত্যুকালে নগদ ৪০ হাজার দিরহাম রেখে যান।
যুদ্ধে যোগদানকারীরা গনিমতের মালের ভাগ পেয়ে এবং পরে বয়স্ক ভাতা পেয়ে অনেকে ধনী হয়ে যায়। যেসব অশ্বারোহী সৈনিক ইফ্রিকিয়ায় (বর্তমানে তিউনিসিয়া) আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল তারা প্রত্যেকে ৩ হাজার মিথকাল (১ মিথকাল ৪, ৭ গ্রামের সমান) পরিমাণ বিশুদ্ধ স্বর্ণ পায়। একজন পদাতিক সৈন্য পায় ১ হাজার মিথকাল।
ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের এইসব অজস্র নির্ভরযোগ্য উদাহরণে এটা পরিষ্কার হয়ে আসে যে, গনিমতের মালের ভাগ পাওয়া, অন্যের ভূমি জোরপূর্বক দখল করা, এবং অন্যের নারীদের অপহরণ করে তাদের দাসী বানিয়ে রাখা-এসবই ছিল আরব যোদ্ধাদের জন্য বড় আকর্ষণ। এজন্য তাদের সাহসের কোনো অভাব ছিল না। নির্মমতা দেখাতেও তারা কোনোপ্রকার কুষ্ঠা বোধ করতেন না। নবির আদর্শ, আদেশ-নিষেধকে অগ্রাহ্য করে ইসলামের ছত্রছায়ায় থেকে তাঁরা ক্ষমতা, ধনদৌলত, প্রভাবপ্রতিপত্তি হাসিলে ব্যস্ত ছিলেন। তারা ভুলে গেলেন ইসলামের সেই মহান বাণী, কোরানে যেমন বলা হয়েছে : “তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি পরহেজগার। (সুরা হুজুরাত ; আয়াত ১৩)। তবে এই ধরনের অসদাচরণের প্রতিক্রিয়াও অচিরেই শুরু হয়ে যায়। বিদেশিরা, বিশেষ করে ইরানিরা এই ধরনের অনৈতিক আচরণ- অত্যাচার মানতে চাইল না। তারা ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং দয়ালু নীতিগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু আরবদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবি মানতে অস্বীকার করে। ইরানিরা আরবদের শোষণের স্বীকার হতে চাইল না। আরবদের জাত্যাভিমান আর শ্রেষ্ঠত্বের দাবির উত্তরে ইরানিরা তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শোবিয়া গড়ে তুলে। এমন কী অনেকে ইসলামের বিরুদ্ধে (জিদিক) গিয়ে ধর্মবিরোধী হয়ে যান।
এই বইয়ের লেখক মিশর থেকে প্রকাশিত Al-zandaga wa-l-suʼubiyya fi-l-ʼasr al-“Abbasi al-awwat শিরোনামের একটি বই পড়েছিলেন। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি সেখানে দাবি করেন, ইরানিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (শোবিয়া) পুরোপুরি ইসলামি নীতি- আর্দশের বিরোধী। এটি ধর্মবিরোধী। কিন্তু বইটিতে দেখানো হয়নি যে আরবেরাও কোরান লঙ্ঘন করেছে। অন্তত এই আয়াতটি : ‘আল্লাহ অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন। আর তিনি অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমালঙ্ঘন নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।” (সুরা নাহল : আয়াত ৯০) ।
যেসব খলিফাকে বিশ্বাসীদের নৃপতি (আমিরুল মুমেনিন) উপাধি দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই এতো ভ্রষ্টাচারী ছিলেন যে, কথিত আছে তারা মদের নদী’তে স্নান করতেন। নবি তাঁর মহান আদর্শ সততা এবং উৎকর্ষতাকে মানবতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই খলিফারা নবির সেই মহত্ত্বের প্রতি কোনো ভ্ৰক্ষেপই করেননি। উমাইয়া খলিফারা অনারব মুসলমানদের উপর আরব মুসলমানদের কর্তৃত্ব এবং অন্য আরবদের উপর উমাইয়া গোত্রের আরবদের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে সচেষ্ট থাকলেন।
আলি ছিলেন নবির সহচরদের মধ্যে অন্যতম ধর্মপ্রাণ এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। তথাপি এই বিশ্বাসীদের শাহজাদা’রা মসজিদের প্রচারবেদি থেকে আলি বিন আবু তালিবের মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে গালিগালাজসহ কটুক্তি করতেন। বিশিষ্ট পণ্ডিত আব্দুল্লাহ বিন আল- আব্বাস ছিলেন নবির চাচাতো ভাই। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের বংশধর ছিলেন খলিফা মুতাওয়াক্কিল (২৩২- ২৪৭ হিজরি; ৮৪৭- ৮৬১ খ্রিস্টাব্দ) । নিজের দরবারে উপস্থিত গণ্যমান্যদের চিত্তবিনোদনের জন্য তিনি এক ভাঁড়কে নিয়োজিত করলেন যে আলির বেশ ধারণ করে নর্তন- কুর্দন করতো। এছাড়াও খলিফা মুতাওয়াক্কিল নবির নাতি হোসেন বিন আলির সমাধিতে লাঙ্গল চালিয়ে দেন এবং সেচ করতে থাকেন যাতে করে ওই সমাধির কোনো চিহ্ন পাওয়া না যায়; লোকজনের মন থেকে যেন নবির দৌহিত্রের স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাই ইরানিরা সঠিকভাবেই বিবেচনা করেছিল যে যারা এতো অসচ্চরিত্র এবং নবির আদর্শের প্রতি সীমাহীন উদাসীন তারা কোনোক্রমেই বিশ্বাসীদের শাহজাদা বা নৃপতি (আমিরুল মুমেনিন) খেতাবে ভূষিত হতে পারেন না।
——————-
পাদটীকা
৮৮. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমরকে ২৬ জুলহজ হিজরি ২৩ (৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে আৰু লুলু ছুরিকাহত করেন। আবু লুলু ছিলেন একজন ইরানি ক্রীতদাস। অনেক ঐতিহাসিক তাকে খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ওমর এক পরিষদ গঠন করেন খলিফা নির্বাচনের জন্য। এই পরিষদ উসমানকে ওমরের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে।
৮৯. আবুজর গিফারি নবি মুহাম্মদের ধর্মপ্রচারের শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন কঠোর তপস্বী, সমালোচক এবং হাদিস- বর্ণনাকারী। উসমানের খেলাফতের সময় সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া তাঁকে সিরিয়া থেকে বহিষ্কার করেন। আবুজর গিফারি হিজরি ৩২ সালে (৬৫২ খ্রিস্টাব্দ) সালে মারা যান। আবুজর গিফারি, আল মিকদাদ বিন আমর, এবং সালমান আল ফার্সিদেরকে প্রথমদিককার শিয়া’ বলা হয়।
৯০. আমার বিন ইয়াসিরও ধর্মপ্রচারের শুরুর দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি নবির সাথে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খলিফা ওমরের সময় তিনি কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং খুজিস্থান দখলে অনেক অবদান রাখেন। খলিফা উসমান তাঁকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন। নবির স্ত্রী আয়েশার বিরুদ্ধে জামালের যুদ্ধে আমার বিন ইয়াসির খলিফা আলির পক্ষে লড়াই করেন। তবে সিফিফনের যুদ্ধে আলির পক্ষ নিয়ে লড়াই করার সময় মৃত্যুবরণ
করেন।
৯১. আরবি ভাষায় প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে ইব্রাহিম আল মুয়াসেলির সময়কালের কবিতার সংকলন- গ্রন্থ। আব্বাসিয়া খলিফা হারুন আল-রশিদের আমলে ইব্রাহিম আল মুয়াসেলি ছিলেন রাজসভার সংগীতবিশারদ (হিজরি ১৭০ বা ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ১৯৩ বা ৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) । গ্রন্থটির সংকলক ছিলেন আবুল ফরজ আলি আল-ইসফাহানি (হিজরি ২৮৪ বা ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ৩৫৬ বা ৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ) উমাইয়া বংশের আরব। বসবাস করতেন পারস্যের ইসফাহানে।
৯২. ফার্সি শব্দ খাসরাও- এর আরবি উচ্চারণ হচ্ছে খসরু। এটি ইরানের এক রূপকথার রাজার নাম ছিল। পরবর্তীতে এই নামের দুজন সাসানিদ সম্রাট পারস্য শাসন করেন। প্রথমজন খসরু- ১ অনুশিরবন (৫৩১- ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এবং দ্বিতীয়জন খসরু- ২ পারভেজ (৫৯১-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) ।
৯৩. আব্দুল্লাহ বিন কুতায়বা (হিজরি ২১৩ বা ৮২৮ খ্রিস্টাব্দ-হিজরি ২৭৬ বা ৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ) ইরানি বংশোদ্ভূত। তিনি সরকারি কাজে নিয়োজিত ছিলেন বাগদাদে। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচিত আইন আল-আকবর আধ্যাত্মিক সত্য কাহিনির এবং কবিতার সংকলন। এ ছাড়াও এই গ্রন্থে আছে সচিবসংক্রান্ত কলাবিদ্যা ও অন্যান্য আরবি রচনা।
৯৪. তাহা হোসেন (১৮৮৯- ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) শৈশবকাল থেকে অন্ধ ছিলেন। কোরান অধ্যয়ন করেন মাদ্রাসা থেকে। পরে মিশরের আল-আজহার ধর্মীয় কলেজে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফ্রান্সে পড়াশোনা করতে যান এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর ডক্টরেট গবেষণার শিরোনাম ছিল : “La philosophie Sociale d’Ibn | প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতার উপর তাহা হোসেনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা কায়রো থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে নামে। দীর্ঘ বিতর্কের মধ্য দিয়ে কায়রো দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় নবি মুহাম্মদের জীবনী (Ala laimeshes-sira) ১৯৩৩ এবং ১৯৩৮ সালে। এই জীবনীগ্রন্থটিই তাহা হোসেনের অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ। মিশরীয় জাতীয়তাবাদে তিনি উদারনীতির অনুসারী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত মিশরীয় সংস্কৃতির ভবিষ্যত (Mosaqbal oth-headfa#Mer) নামের বইয়ে তাহা হোসেন মিশরের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশের সহযোগিতার আহ্বান জানান। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি মিশরের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সর্বোপরি তাঁকে সারণ করা হয় মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে কোরান অধ্যয়ন ও আজহার মহাবিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রজীবনের দিনগুলির উপর ভিত্তি করে আল আয়াম গ্রন্থের জন্য। কায়রো থেকে ২ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৯ ও ১৯৩৯ সালে। ইংরেজিতে প্রথম খণ্ডের অনুবাদক E H. Paxon এবং বইটির শিরোনাম An Egyptian Childhood প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩২ সালে লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় খণ্ডের অনুবাদক H Wayment, প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৮ সালে লন্ডন থেকে। বইটির শিরোনাম The Stream of Days
সারাংশ
বিশ্ব-ইতিহাসে ইসলামের উত্থান এবং বিস্তার এক অদ্বিতীয় ঘটনা। অতীত পর্যালোচনা করা অনেক ক্ষেত্রেই খুব দুরূহ বিষয়, কেননা প্রকৃত বিষয় জানতে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, যা সহজে প্রাপ্ত নাও হতে পারে। তাই প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণার। সে- তুলনায় ইসলামের ইতিহাস জানা অনেক সহজ কারণ এই ইতিহাসের সমর্থনে পাওয়া যায় অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্য। সচেতন এবং পক্ষপাতমুক্ত ঐতিহাসিকদের পক্ষে ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরা অনেক সহজ। ভবিষ্যত গবেষকদেরও উচিত ইসলাম নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলে তাঁদের মনে কোনো ধরনের পূর্বধারণা, অন্ধবিশ্বাস বা বিদ্বেষ থাকলে সেগুলি থেকে আগে মুক্ত হতে হবে। আমার এই ছোট বইটি সুগভীর গবেষণার ফসল নয়। তথাপি যথাসম্ভব যে কোনো ধরনের অন্ধআবেগ থেকে নির্মোহ থেকে অতিসংক্ষেপে এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে হজরত মুহাম্মদের তেইশ বছরের নবুওতি জীবন। এই অধ্যায়ে সে বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
(এক) মুহাম্মদ ছিলেন একজন অনাথ শিশু। ছয় বছরের পিতৃমাতৃহীন অসহায় শিশু লালিত-পালিত হন আত্নীয়ের গৃহে। ওই বয়সের শিশুরা সাধারণত যেসব সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে লালিত-পালিত হত, মুহামদ তা থেকে বঞ্চিতই ছিলেন। খুব ছোট বয়স থেকেই মুহাম্মদ মক্কার নিকটস্থ উষর মরুভূমিতে উটের চারণ করে সময় কাটাতেন। তাঁর দৃষ্টি ছিল তীক্ষ এবং মন ছিল কল্পনাপ্রবণ। পাঁচ থেকে ছয় বছর তিনি মরুভূমিতে অতিবাহিত করেন। মরুভূমির নিজস্ব নির্জনতা ও একাকীত্ব মুহাম্মদের মনে জন্ম দেয় ভাবাবেগ এবং দূরদর্শিতা। প্রতিবেশিদের ধনদৌলতের সাথে নিজের কর্পদকশূন্য অবস্থার তুলনা করে মুহাম্মদের মনে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় এক মানবিক বিরাগ। এই জটিল মানসিকতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর শিশুকালের খেলার সার্থীদের সাথে এবং নিকট আত্মীয়দের সাথে। তারপর ধনী পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং সবশেষে ওই সমস্ত ধনদৌলতের উৎসের উপর। সে উৎস ছিল কাবা ঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন। মুহাম্মদের জন্মের বহুপূর্ব থেকেই কাবা ছিল মূর্তিপূজার এক বিশাল মন্দির এবং আরব সমাজের ধর্মীয় কেন্দ্রভূমি। বাল্যকালে মুহাম্মদ কাবায় অনেক প্রার্থনা-অৰ্চনা করেছেন, পরবর্তীতে তাঁর কাছে এগুলো সব বৃথা মনে হয়, একেশ্বরবাদে একনিষ্ঠ হওয়ায়। সেজন্য বোধ করি তাঁর মনে মূর্তিপূজার প্রতি অগাধ ঘৃণা এসে যায়। [ একটি হাদিসের বর্ণনানুযায়ী : (৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে) নবি মুহামদ তখন পৌত্তলিক দেবদেবীর উপাসনা করতেন, একদা কাবা ঘরের দেবতাকে উৎসর্গ করা কোরবানির মাংস রান্না করে একেশ্বরবাদী হানিফ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট আরবি কবি জায়েদ বিন ওমরের ( খলিফা ওমরের চাচা) জন্য নিয়ে যান তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য, তখন জায়েদ মুহামদকে তিরষ্কার করেন এবং পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থেকে একেশ্বরবাদ চর্চার পরামর্শ দেন। দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬৭, নম্বর ৪০৭। – অনুবাদক । মূর্তিপূজা-বিরোধী চিন্তা কেবল মুহাম্মদের একার ছিল না। এ- সময় মক্কার অনেক বাসিন্দার কাছে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মপুস্তক ছিল। এছাড়াও অনেক চিন্তাশীল মক্কাবাসী ছিলেন যারা নিম্প্রাণ মূর্তিগুলো পূজা করাকে অসার মনে করতেন। তাঁদের কেউ কেউ হানিফ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই ব্যক্তিগুলোর সংস্পর্শে আসায় মুহাম্মদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এ-সময় তিনি একবার সিরিয়ায় বাণিজ্য ভ্রমণে যান। বাইরের জগতের সাথে নিজের অঞ্চলের লোকজনের সংস্কার-কুসংস্কার-প্রথা-নিয়ম-নীতি পালনে বিশাল পার্থক্য মুহাম্মদের কাছে দৃশ্যমান হয় এই সফরের সময়। ধর্মপুস্তকপ্রাপ্ত (ইহুদি ও খ্রিস্টান) লোকদের উপাসনালয় দেখে এবং যাজক- পুরোহিতদের সাথে আলাপ করে মুহাম্মদ তাঁদের নবি এবং ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারেন। এরপর মুহামদ নিজের ধারণায় প্রত্যয়ী হন।
(দুই) যখন একেশ্বরবাদ এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে পাওয়া মতবাদ মুহাম্মদের জীবনের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল, ঠিক সে- সময় তিনি মক্কার এক ধনী নারীকে ( খাদিজা) বিয়ে করেন। ফলে মুহাম্মদ বস্তুজীবনের বিড়ম্বনা থেকে নিকৃতি পেয়ে যান। মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন- নওফল ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর সাথে ঘন-ঘন সাক্ষাত মুহাম্মদের আসক্তিতে পরিণত হয়। মুহাম্মদের মন সর্বদা আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো এক সর্বশক্তিমান এবং ঈর্ষাপরায়ণ স্রষ্টার উপর। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস হলো যে, এই স্রষ্টা নিশ্চয়ই চান না, হেজাজের লোকজন অন্য দেবদেবীর পূজা করুক। ইহুদি- খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে এবং লোককাহিনিতে বর্ণিত, পৌত্তলিকতা উপাসনার অপরাধে সর্বশক্তিমান এক ঈশ্বর আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন – এই বর্ণনা পাঠে মুহাম্মদের মনে আশংকার সৃষ্টি করে। তিনি চিন্তা করলেন যে তাঁর নিজের লোকজনও একইভাবে দেবদেবীর উপাসনায় নিয়োজিত। এ- অপরাধে তাই স্রষ্টা হয়তো খুব শীঘ্ৰ তাদের এক ঘোরতর সাজা দিবেন। এ- অবস্থায় তাঁর নিজের জরুরি কর্তব্য লোকজনদের পথ দেখানো। মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাঁর আশংকা মিলে যায়। তিনি দাবি করতে শুরু করেন যে স্রষ্টা ( পরে আল্লাহ হিসেবে সম্বোধন করেন) তাঁকে দৈববাণী পাঠাচ্ছেন মক্কাবাসীকে হুশিয়ার করতে। বিবি খাদিজা এবং ওয়ারাকা বিন- নওফল মুহাম্মদের ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের দাবির সত্যতা মেনে নেন। তাঁরা জানালেন আল্লাহ-ই মুহামদকে অনুপ্রাণিত করেছেন। নিজের ঘর থেকে সমর্থন পেয়ে মুহাম্মদ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে গভীর বিশ্বাস জন্ম নিল যে আল্লাহ তাঁকেই মনোনীত করেছেন হেজাজের জনগণকে সাবধান বাণী জানানোর জন্য। যেমন করে স্রষ্টা হুদ এবং সালেহকে নবি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যথাক্রমে আদ ও সামুদ জনগোষ্ঠীকে সাবধান করার জন্য। মুহাম্মদ আরও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, নবি শুধুমাত্র ইহুদিদের মধ্য থেকেই আবির্ভূত হবেন তা নয়। আরব এবং ইহুদিরা একই বংশের লোক। তাই নবি আরবদের মধ্য থেকেও আসবে। এই বিশ্বাস আর আধ্যাতিক সন্ধিক্ষণে আচ্ছন্ন অবস্থায় মুহাম্মদ চল্লিশ বছরে পদার্পণ করলেন এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট তাঁর নতুন মতবাদ প্রচার শুরু করেন।
(তিন) মুহাম্মদ ওই সময়ের যতো চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করেছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই একমত ছিলেন যে, মানুষের হাতে তৈরি প্রস্তর- মূর্তির উপাসনা করা আসলে অকার্যকর। তিনি আশান্বিত হয়ে গেলেন যে, অতি মতবাদ মেনে নিলেন। ফলে হতাশ হবার কোনো কারণ থাকল না। মুহামদ জোরেশোরে চালাতে থাকলেন তাঁর প্রচার কাজ। এ-সময় ওহি আসে ; তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও। (সুরা শোআল্লারা ; আয়াত ২১৪) । কিন্তু এবার মুহাম্মদের ভাবনার সাথে পরিস্থিতি অনুকূল হলো না। তাঁর লোকজন তাঁকে উপহাস আর অবজ্ঞা করল। মুহাম্মদ ছিলেন সরল মনের ব্যক্তি। তিনি ভেবেছিলেন উপকারী বক্তব্য এবং যুক্তিপূর্ণ বাণী দিয়ে অতি সহজে তাঁদের মনে রেখাপাত করতে পারবেন। কিন্তু তা হলো না। আরবেরা যে তাদের সনাতন ধর্মের প্রতি এতোই অনুরক্ত থাকবে, মুহামদ তা শুরুতে ধরতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নতুন ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে পুরানো ধর্মকে উৎখাত করতে। কিন্তু পুরনো ধর্মব্যবস্থা ছিল কুরাইশ নেতাদের প্রচুর ধনসম্পদ এবং খ্যাতি ও যশের ভিত্তি। তাই মুহাম্মদের মতাদর্শ শুনে তারা প্রমাদ গুণলেন এবং নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে মুহাম্মদের চরম বিরোধিতায় নামলেন। মুহামদের চাচা আবু লাহাব ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথে প্রকাশ্যে বৈরিতা ঘোষণা করেন। একদা কুরাইশ প্রধানদের সভায় আবু লাহাব ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠেন : “তুমি ধ্বংস হও, মুহাম্মদ! আমাদের কি এইসব আবোল-তাবোল শোনানোর জন্য ডেকেছ?”
(চার) ওই সময় মাখজুম গোত্র এবং আবদে মনাফের বংশধরদের মধ্যে বিরোধ বাধে। আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে মাখজুম গোত্রের ভবিষ্যত নেতা আবু জেহলের এক উক্তি থেকে তৎকালীন নেতাদের মনোবৃত্তির স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মাখজুম গোত্র তখন অবস্থা- প্রতিপত্তি- সহায়- সম্পদে বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। তাই আবু জেহেল নবি হিসেবে সাজিয়েছে। এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হোসেন বিন আলিকে উদ্দেশ্য করে এক কবিতা রচনা করেন। এই কবিতায়ও একই মনোভাব প্রকাশ পায়। ইয়াজিদ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন : হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে। কিন্তু কোনো বার্তা আসেনি, কোনো দৈববাণীও আসেনি। কী উদ্দেশ্যে কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরোধিতা করেছে তা আল আখনাস বিন আবু শারিকের কাছে আবু জেহেলের উক্তি থেকে পরিষ্কার। মুহাম্মদ ছিলেন গরীব অনাথ। জীবনযাত্রার জন্য নির্ভরশীল ছিলেন স্ত্রীর সম্পদের উপর। এহেন দুঃস্থ ও নির্ভরশীল ব্যক্তির সাথে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নীত পদমর্যাদার অধিকারী ও ধনী কুরাইশ নেতাদের কোনো তুলনা হবার নয়। মুহাম্মদের ধর্মপ্রচার সফল হলে এই নেতাদের অবস্থান হয়ে পড়বে দুর্বল। এমনও হতে পারে যে, তাঁরা নিজেদের এতোদিনের সমানের আসন থেকে পড়ে যেতে পারেন। সত্য হচ্ছে যে, আবদুল মোতালেবের গোষ্ঠী কখনো মুহাম্মদের সমর্থক ছিলেন না। এমন কি আবু তালেব ও নবির অন্য চাচারা চান নাই কুরাইশ বংশের উপগোত্রের মধ্যে ফাটল ধরুক। নবুওতির দাবির পর মুহাম্মদ তের বছর মক্কায় বসবাস করেন। ক্রমে তিনি দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পারেন কুরাইশরা তাঁকে অবজ্ঞা করবে এবং তাঁর বিরোধিতা করে যাবে। শেষমেশ তাই-ই হল। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মুহাম্মদ ভাবলেন, প্রস্তুতি না নিয়ে তাঁর হয়তো উচিত ছিল না নবুওতির দাবিতে আত্মোৎসর্গ করা। ওয়ারাকা বিন- নওফল, ওমায়া বিন আবু-সালাত, এবং কাস বিন সায়েদার মতো একেশ্বরবাদীরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেই চুপচাপ থাকতেন। পরে তাঁরা নিজ নিজ পথে চলে যান। মুহামদ একবার চিন্তা করলেন যে তাঁরও হয়তো এ- রকম করা উচিত। মুহাম্মদের নবুওতির কর্মজীবন পর্যালোচনা করে বুঝা যায় যে, তিনি তাঁর বিশ্বাসে শেষমেশ এতোই অটল হলেন যে কোনো কিছুতেই তিনি আর ভীত বা নিরুৎসাহ হতেন না। কাজেই তাঁর লক্ষ থেকে তিনি পিছপা হলেন না। সকল বাধা সত্ত্বেও একবিশ্বাসে নিবিষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। হেজাজের জনগণকে নিজের বিশ্বাসে চালিত করার দায়িত্ব তিনি পালন করে গেলেন প্রায় ত্রিশটি বছর। শুধু বিশ্বাসের শক্তি নয়, মুহাম্মদের বাকপটুতা ছিল অসাধারণ। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা- বঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে এই গুণ থাকা সত্যি ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। তিনি আবেগপূর্ণ ভাষায় জনতাকে সুনীতিসম্পন্ন, সৎ এবং দয়াশীল হতে বলতেন। শোভন ব্যবহার, ন্যায়পরায়ণতা, এবং কর্তব্যনিষ্ঠতা যে মুক্তির পথ, তা প্রমাণের জন্য জন্য ভুরিভুরি উদাহরণ দিলেন অতীতের নবিদের কাহিনী থেকে।
(পাঁচ) অতীত ইতিহাস গবেষণা থেকে এটা এখন প্রমাণিত যে, মক্কার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মূর্তি পূজার বিরোধিতাকারী হানিফসহ বিভিন্ন একেশ্বরবাদীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তির দিকে ছিল। মক্কায় ধনী এবং ক্ষমতাশালী লোকদের চেয়ে অভাবী-দরিদ্র, বিত্তহীন লোকের সংখ্যা বেশি ছিল। ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই এই অভাবী-নিঃস্ব মানুষের পক্ষ হয়ে কথা বলতে লাগলেন তিনি। পৃথিবীর যাবতীয় বিপ্লবের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সকল বিপ্লবের আসল সৈনিক হচ্ছে বঞ্চিত এবং অত্যাচারিত জনগণ। স্বাভাবিকভাবে মক্কার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা অলস হয়ে বসে ছিলেন না। অসহায়, গরীব মানুষ যারা মুহাম্মদের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন, তাদেরকে নিয়ত নির্যাতন এবং হয়রানি করা হতে লাগল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মুহাম্মদ এবং সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিম, মক্কার প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য যেমন আবু বকর, ওমর, হামজাকে কোনো প্রকার উৎপীড়ন করতেন না। নিঃস্ব মুসলমানদের প্রায়শ ভয়ভীতির সম্মুখীন হতে হতো। তারাই ছিল নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তি, যেমন করে পিরামিডের ভিত্তি থাকে। এ- অবস্থায় তের বছর ধরে মুহামদ তাঁর প্রচারণা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর ভক্তের সংখ্যা একশ’র বেশি হলো না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এখান থেকে একমাত্র উপসংহার টানা যায় : মুহামদের সব নির্ভুল প্রচার, বাকপটুতা, কঠোর সংযম, এবং দোজখের ভয় দেখানো কোনোটাই কাজে আসল না। মক্কায় ইসলাম প্রচারে মুহাম্মদের যে নিরলস পরিশ্রম ছিল, তার প্রাপ্য তিনি পেলেন না।
(ছয়) শেষ পর্যন্ত নবিকে অস্ত্র তুলে নিতে হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। এছাড়া তাঁর আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ সবই তিনি করলেন। এখানে একটি বিষয় আমাদের সারণে রাখা উচিৎ, কার্য সম্পাদনের জন্য শক্তি প্রয়োগ শুধু নবি একাই করেননি। শক্তি প্রয়োগ আরব জাতির এক পুরনো অভ্যাস। হেজাজ এবং নেজদের মরুভূমির কঠোর পরিবেশে আরবদের কৃষিকাজের তেমন কোনো সুযোগ ছিল। তাঁরা তখন মনুষ্য- রচিত বা ঈশ্বর- প্রদত্ত দাবিকারী কোনো আইনের অধীনে বাস করত না। সাধারণত আরব বেদুইনদের জীবন চলত অন্য দলের উপর লুটতরাজ এবং হানাহানি করে। এই অবিরাম হানাহানি থেকে কিছুসময় বিশ্রাম নেবার জন্য তাঁরা বছরের চারটি মাস নির্ধারণ করেছিলেন যখন কেউ কারো উপর আক্রমণ করবেন না। এই চারটি মাসকে তাঁরা পবিত্র মাস হিসাবে গণ্য করতেন। বছরের অন্য সময়ে এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের এই লুটতরাজ, খুনোখুনি এবং নারীদের অপহরণের হাত থেকে দূরে থাকার একটি উপায় ছিল সদা সতর্ক থাকা এবং নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা। যখন মদিনায় বসবাসকারী আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা মুহামদের জীবন-রক্ষার আশ্বাস প্রদান করেন তখন তিনি মদিনাতে গমন করেন। মদিনায় তখন মুহাম্মদের মাতা আমিনার বংশের লোকেরা বসবাস করতেন। মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। মুহাম্মদ জীবনে যতো যুদ্ধ, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রায় সবই হয়েছে মদিনাতে আসার পর। এখানে নবির প্রধান লক্ষ ছিল মদিনা এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়গুলো। ইহুদি গোত্রগুলোর সাথে সংঘর্ষ থেকে নবি তাঁর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি পেলেন। এই ইসলামি রাষ্ট্রের আইনকর্তা রাষ্ট্রের প্রধান কার্যনির্বাহক এবং সামরিক প্রধান হলেন মুহামদ নিজেই। এবার নতুন এই রাষ্ট্রের উন্নতি এবং পরিসরে বিস্তৃতিতে মুহামদ পূর্ণমাত্রায় মনোনিবেশ করতে পারলেন।
(সাত) প্রাক-ইসলামি যুগে আরববাসী ছিল একইসাথে বাস্তববাদী এবং আবেগপ্রবণ। একটি আবেগময় কবিতা শুনে তাঁদের মন হয়ে যেত আন্দোলিত আবার কোনো কদৰ্য কবিতা শুনলে তাঁরা হত্যা করতেও উদ্যত হয়ে যেত। তাঁদের চিন্তাভাবনা ছিল সবসময় বৈষয়িক বিষয়াবলী এবং দৈনিক অভিজ্ঞতার উপরে। কোনো রকম আধ্যাতিক, অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক বিষয় তাঁদের ধর্তব্যের বাইরে ছিল। সহিংসতা তাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আইন ও বিচারের প্রতি তাঁদের কোনো ভ্রক্ষেপ থাকত না। লুটের মাল হস্তগত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবই করতে প্রস্তুত ছিল তাঁরা। একজন ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেছেন, আরব বেদুইন কোনো সময়ে ভিন্ন দলের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলে সে শক্রদলে যোগদান করতে দ্বিধা করত না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আরব বেদুইনদের এই ব্যবহার ছিল ব্যতিক্রমী। যে সমাজে কোনো সংগঠিত সরকার ছিল না, ছিল না কোনো শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা, সেই সমাজকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হতো ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ভীতির উপর।
আরবরা দম্ভ এবং আত্মপ্রশংসা করতে ভালবাসে। তাঁরা যে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোত্রগত গুণাবলী অতিরঞ্জিত করত তা নয়, তাঁরা তাদের দোষক্রটির জন্য পর্যন্ত গর্বিত থাকত। আত্মসমালোচনা করা তাঁদের অভ্যাসে ছিল না। ভোরবেলায় অপহরণ করা নারীকে ধর্ষণ করার পর তাঁরা কবিতা রচনা করত। এ- কবিতায় নিজেরা নিজেদের হিমতের বড়াই এবং সাহস প্রকাশ করত আবার ভুক্তভোগী নারীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিত। যেভাবে বেদুইন কবিরা তাঁদের আদিম সহজাত মনোবৃত্তি প্রকাশ করত তা সভ্যতার কোনো পর্যায়েই তা পড়ে না। বেদুইনদের আধ্যাত্মিক এবং অলৌকিক ধারণা বলতে যা কিছু ছিল তা মূলত পার্থিব জগত থেকে নেয়া কোনো মনগড়া চিত্র। একই রকম মানসিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি ইসলামি-যুগেও, বিশেষ করে হানবলিদের মধ্যে। হানবলিরা যে কোনো রকমের যৌক্তিক এবং বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনাকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। [ সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক আহমদ ইবনে হানবলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারীদের হানবলি বলা হয়। হানবলিরা ধর্মীয় বিষয়াবলীতে চরমপন্থা এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সিরিয়া এবং ইরাকে হানবলিদের প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। আধুনিক ইসলাম-গবেষকরা হানবলিদের কট্টরপন্থী ওয়াহাবিবাদ, সালাফি মতাদর্শের পূর্বসূরি বলে অভিহিত করে থাকেন। -অনুবাদক ।]
(আট) হিজরি সনের প্রথম দশ বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি মুহাম্মদ আরবদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর সুযোগ নিয়েছিলেন ইসলামের সাফল্য এবং শক্তি প্রয়োগের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে নবি পরাজয়ের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য দুর্বল গোত্রকে আক্রমণ করতেন। ফলে আরবের সাধারণ জনগণ সর্বদা আতঙ্কে থাকত। কোনো দুর্বল গোত্রের পরাজয় ইসলামের জন্য এনে দিত সফলতা নয়ত, আক্রমণ না- করার চুক্তি। ইসলামের বিস্তারের পিছনে রয়েছে আরবদের গনিমতের মালের প্রতি আকর্ষণ। গনিমতের মালের অংশ পাবার জন্য অনেকে জিহাদে যোগদানের আগ্রহ দেখায়। যারা জিহাদে যাবে তাদেরকে আল্লাহ গনিমতের মালের প্রতিশ্রুতি দিলেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির পর আল্লাহ বললেন : ‘আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে। তিনি তোমাদের জন্য এ ত্বরান্বিত করবেন। তিনি তোমাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন যেন বিশ্বাসীদের জন্য এ হয় এক নিদর্শন আর আল্লাহ তোমাদেরকে এ দিয়ে সরল পথে পরিচালনা করেন। (সুরা ফাতহ ; আয়াত ২০) । এছাড়া বেহেশতের অশেষ সুখের উৎসাহ দিয়ে বলা হলো : যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিচে নদী বইবে। এ-ই মহাসাফল্য। (সুরা বুরুজ ; আয়াত ১১) । নবির অনুসারীদের মধ্যে কতজন সুযোগ-সন্ধানী ছিলেন তাঁর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত কেউ সংকলন করেন নাই। তথাপি অনুমান করা যায় যে, নবির মৃত্যু অদি যত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের একটা বেশ বড় অংশই ভীতি অথবা সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই যে, নবির মৃত্যুর পরপরই বিপুল সংখ্যক আরব ইসলাম ত্যাগ করে আবার পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়, যার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও চালাতে হয় খলিফাদের।
মদিনা ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। এখানেও হজরত আলি বিন আবু তালেব, আমার বিন ইয়াসির এবং আবু বকর আস-সিদিকদের মতো ত্যাগী ও সৎ লোকের সংখ্যা ছিল অতি-নগণ্য। বেশির ভাগই ইসলাম গ্রহণ করেছিল গভীর বিশ্বাস থেকে নয়। বরং বিভিন্ন সুবিধা পাবার আশায়। নবির মৃত্যুর পরে ক্ষমতা দখল নিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলী এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নবির মৃত্যুর পরে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিরোধ লাগে ক্ষমতা দখল নিয়ে। এই বিরোধ- হাঙ্গামার জন্য নবির শবদেহ সৎকারে বিলম্ব ঘটে যায় তিন দিন পর্যন্ত। হজরত আলি, তালহা এবং জুবায়ের থেকে গেলেন ফাতেমার ঘরে। তাঁরা প্রতিদ্বন্দীদের নিয়ে যে ঝগড়া চলছিল তার সম্বন্ধে কিছুই জানলেন না। আবু বকর, ওমর, আবু উবায়দাসহ আরও কয়েকজন সাহাবি বিবি আয়েশার ঘরে ছিলেন। এ- সময় মদিনার আনসাররা খাজরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন ওবায়দার নেতৃত্বে এক গৃহে সমবেত হন। একজন ব্যক্তি বিবি আয়েশার গৃহে এসে আবু বকর এবং ওমরকে জানালেন, ক্ষমতা আনসারদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা থামাতে হবে। আনসাররা কী করছিলেন তা জানার জন্য সাথে সাথে হজরত আবু বকর এবং ওমর সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন সাদ বিন ওবায়দা তাঁদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমরা হচ্ছি আনসার। আমরাই ইসলামের আসল সৈনিক। আমরা ছিলাম নবির সমর্থক। আমাদের পেশিবহুল বাহুর জন্য ইসলামের শক্তি এসেছে। আর মক্কাবাসী তোমরা হচ্ছ মুহাজির। তোমরাও সাহায্য করেছ। তাই এসো, তোমরা আমাদের সাথে যোগদান কর। একথা শোনার সাথে সাথে ওমর ক্ষুব্ধ হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু আবু বকর ওমরের হাত ধরে তাঁকে থামালেন। এরপর আবু বকর তাঁর স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠস্বরে সাদ বিন ওবায়দাকে বললেন : ‘আনসারদের সম্পর্কে আপনি যা বলেছেন তা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষমতার আইনসমত অধিকার আছে শুধুমাত্র কুরাইশদের। কারণ কুরাইশরা অন্যান্য আরব গোত্রের উর্ধ্বে। তারপর আবু বকর করমর্দন করলেন ওমর এবং আবু উবায়দার সাথে এবং আনসারদের উদ্দেশ্যে বললেন : আপনারা তাঁদের যে কোনো একজনের প্রতি আনুগত্য প্রদান করুন।”
ওমর ছিলেন বাস্তব ও দূরদর্শী ব্যক্তি। তিনি এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে গা ভাসাতে চাননি। ওমর বুঝলেন ক্ষমতা দখলের এই যে পরিস্থিতি, তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে আবু বকরকে সবাই নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নেয়া। কারণ আবু বকরই ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাজির এবং তিনি নবির সাথে একই গুহায় বিপদসংকুল অবস্থায় বাস করেছিলেন। নবি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন নবি আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিয়েছিলেন। এসব কারণ চিন্তা করে ওমর উঠে দাঁড়ালেন এবং আবু বকরের সাথে করমর্দন করে তাঁর প্রতি নিজের আনুগত্যের ঘোষণা জানালেন। এভাবে ওমর এক ধাক্কায় নেতৃত্বের সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ওমরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ তর্ক করার অবকাশ পেলেন না। স্বাভাবিকভাবেই মুহাজিররা ওমরের আদেশ অনুসরণ করলেন তবে আনসাররা তাৎক্ষণিকভাবে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কিছু সময় পরে তাঁরাও আবু বকরের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। কথিত আছে যে, ওমর মদিনার খাজরাজ গোত্রের বয়োবৃদ্ধ ও রোগাক্রান্ত নেতা সাদ বিন ওবায়দার ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা দেখে এতোই ক্রোধান্বিত হন যে, তিনি তাঁকে সভাকক্ষের বাইরে টেনে নিয়ে আসেন এবং কয়েকজনের সাহায্যে বেদম প্রহার করেন। কথিত আছে, এ- প্রহারেই সাদ বিন ওবায়দা” ঘটনাস্থলেই মারা যান। হজরত আলি বিন আবু তালিব প্রথমে আবু বকরের খেলাফতের প্রতি আনুগত্য জানালেন না। কিন্তু ওমর ভালোভাবেই জানতেন, আলি সমর্থন না দিলে অচিরে হাশেমি গোত্রের অনেকেই আলির পথ অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ আবু বকর হাশেমি গোত্রের পূর্ণসমর্থন হারিয়ে ফেলবেন। ফলে আবু বকরের খেলাফত নিরাপদ থাকবে না। সে- জন্য ওমর প্রতিনিয়ত আলির সাথে দেখা করতে লাগলেন, আলাপ-আলোচনা, তর্ক চালালেন। শেষ পর্যন্ত ছয় মাস পরে আলি আবু বকরের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা দেন।
(নয়) মক্কার তের বছর বাদ দিলে ইসলামের ইতিহাসে বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে যুদ্ধ এবং ক্ষমতার লড়াই। নবি জীবিত থাকাকালীন সময়ে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল ইসলামের প্রসারের জন্য। পৌত্তলিকদের ইসলাম মেনে নিতে বল প্রয়োগও হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যে বারংবার বিরোধ আর সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার কারণ ছিল ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দিতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আবু বকরের ক্ষমতা দখল সম্ভব হয়েছে ওমরের দক্ষতার জন্য। মৃত্যুকালীন সময়ে আবু বকর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ওমর হবেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত। কোনো সমস্যা ছাড়াই আবু বকরের মৃত্যুর পর ওমর খলিফা হয়ে যান। কেউ তাঁর বিরোধিতা করেননি। দশ বছর পর ওমর তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তে ছয় সদস্য বিশিষ্ট এক পরিষদ গঠন করেন তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করার জন্য। এই পরিষদের সদস্যরা ছিলেন: আলি, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আউফ, তালহা, জুবায়ের এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস। এই পরিষদ যখন বৈঠকে বসে তখন কেউই খলিফার পদের জন্য কারো নাম প্রস্তাব করেননি। কারণ প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন খলিফা হতে। আব্দুর রহমান বিন আউফ খলিফা পদের প্রার্থী হওয়া থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। কেউ কোনো মন্তব্য করলেন না। তখন আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে পরিষদের বৈঠক তিনদিনের জন্য মুলতুবি রাখা হল। এমনটি করা হলো মুহাজির ও আনসারদের মনোভাব বোঝার জন্য। এই তিনদিন আব্দুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে পরিষদের প্রত্যেক সদস্যদেরকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তাদের কী ধারণা অন্যদের সম্পর্কে। শোনা যায় আব্দুর রহমান হজরত উসমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন উসমান যদি খলিফা মনোনীত না হন, তবে তিনি কাকে প্রস্তাব করবেন খলিফা হবার জন্য। উসমান জবাব দিলেন, খলিফা পদের জন্য আলিই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। আব্দুর রহমান তখন আলিকে একই প্রশ্ন করলেন। আলিও উত্তর দিলেন খলিফা পদের জন্য উসমানই হবেন যোগ্যতম ব্যক্তি। এ- থেকে সবাই বুঝতে পারলেন, পরবর্তী খলিফা হবেন আলি অথবা উসমান।
এই দুজনের (আলি এবং উসমানের) চরিত্রে অনেক পার্থক্য ছিল। উসমান ছিলেন আয়েশি, বিনয়ী, নিরহঙ্কার এবং উদার। আলি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর সাহস, অনুরক্ততা এবং ধর্মীয় ব্যাপারে কঠোরতার জন্য। ওমর ছিলেন ভীষণ কঠোর এবং প্রচণ্ড মিতব্যয়ী। তাই ওমরের দশ বছরের শাসন ছিল অনেকের কাছে অসহনীয়। ভোগবাদী ব্যক্তিদের কাছে ওমরের শাসন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই তাঁরা চাচ্ছিলেন না আলির শাসন আসুক। কারণ তাঁরা জানতো আলির শাসনও হবে ওমরের মতোই কঠোর এবং আত্মসংযমী। কোরানের বিশিষ্ট সুন্নি তফসিরকারক এবং পারস্যের মুসলিম পণ্ডিত আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরির আল-তাবারির (৮৩৮- ৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) মতে, এই ব্যক্তিরা কুরাইশ বংশের বানু সাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আসকে নিয়োগ করলেন মধ্যস্থতার জন্য। একদিন আমর আলির সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে জানালেন যে আব্দুর রহমান বিন আউফ প্রথমে আলিকে খলিফার পদ নিতে প্রস্তাব করবেন। কিন্তু আলির মতো উচ্চাসনের ব্যক্তির উচিত হবে না, সাথে সাথে আব্দুর রহমানের প্রস্তাবে রাজি হওয়া। খলিফার পদের মর্যাদা এবং সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দ্বিতীয়বার যেন আব্দুর রহমান আলিকে এই পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। যে দিন পরিষদের বৈঠক বসার কথা ছিল, সেদিন আব্দুর রহমান মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে আলির দিকে মুখ করে বললেন : তিনিই (আলি) হচ্ছেন একত্রে নবির চাচাতো ভাই এবং জামাতা, প্রথম মুসলিম এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত সৈনিক। আলি যদি প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শ পালন করবেন, এবং আগের দুই খলিফাদের (আবু বকর ও ওমর) উদাহরণ অনুকরণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) আলিকে খলিফা মেনে আলির প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করবেন। আলি উত্তর দিলেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির রীতি-নীতিতে থাকবেন এবং যা উত্তম মনে করবেন তাই করবেন। এরপর আব্দুর রহমান উসমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আলির পর তিনিই হচ্ছেন খলিফা পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। উসমান যদি অঙ্গীকার করেন, তিনি আল্লাহর কিতাব মেনে চলবেন, নবির আদর্শকে অনুসরণ করবেন এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার উদাহরণ গ্রহণ করবেন তবে তিনি (আব্দুর রহমান বিন আউফ) উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানাবেন। উসমান একইভাবে অঙ্গীকার করলেন এবং আলিকে বাদ দিয়ে আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি আনুগত্য জানালে উসমান খলিফা হয়ে গেলেন। এটা হচ্ছে তাবারির বক্তব্যের সারাংশ। যদিও এখানে পুনরাবৃত্তি দেখাবে তবুও তাবারির বই থেকে বালামির” ফার্সি অনুবাদ তুলে দেয়া হলো। এখানে আমরা দেখতে পাই, ওমরের খেলাফতে জনগণ বিরক্ত হয়ে উঠলে নবির কয়েকজন সাহাবির মনে প্রাধান্য পায় ক্ষমতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষ।
হিজরত ওমর মারা গেলে মরুভূমির বেদুইনরা ওমরের জন্য শোক-বিলাপ করতে মদিনায় আসেন। আব্দুর রহমান তাঁদের সাথে আলাপ করলেন। তাঁদের প্রত্যেকে বললেন, উসমান হবেন খলিফার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি। এক সন্ধ্যায় আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে দেখা করলেন। আবু সুফিয়ান আমরকে জানালেন যে, ওই সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান তাঁর সাথে দেখা করে বলেছেন, যে খলিফা পদের জন্য দুজন প্রতিদ্বন্দী রয়েছেন, তাঁরা হলেন উসমান এবং আলি। আবু সুফিয়ান বললেন, তিনি উসমানকে পছন্দ করেন। আমর ইবনে আল-আস বললেন, ইতিমধ্যে আব্দুর রহমান তাঁর সাথেও এই ব্যাপারে দেখা করেছেন। এরপর আমর বললেন, আবু সুফিয়ানের মতো তিনিও উসমানকে খলিফা হিসাবে পছন্দ করবেন। এরপর আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন: আমরা কি করতে পারি? উসমান হচ্ছেন আয়েশি; তাই হয়ত অনেক ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে তাঁর কর্তব্য অন্যের উপর বর্তে দিতে পারেন। কারো অনুপস্থিতে হয়তো আলি খলিফা হয়ে যেতে পারেন। আবু সুফিয়ান আমরের গৃহে সেই রাত কাটালেন এবং আমরকে বারবার জিজ্ঞাসা করলেন কী উপায়ে উসমানকে খলিফা নিশ্চিত করা যায়। সে রাত্রে আমর আলির গৃহে গেলেন এবং আলিকে বললেন : আপনি জানেন যে আমি আপনার বন্ধু। সেই পুরনো দিন থেকেই আপনি আমার কাছে প্রিয়। খলিফা পদের প্রার্থীর জন্য অন্য সবাই সরে গেছেন। এখন শুধু আপনি আর উসমান রয়েছেন এই পদের জন্য। আজ সন্ধ্যায় আব্দুর রহমান সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অনেকে আপনাকে চায়, আবার অনেকে উসমানকে চায়। এখন আব্দুর রহমান আমার সাথে আলাপ করলেন। আমি তাঁকে জানিয়েছি, আমি আপনাকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাই। আপনি যদি আমার কথায় মত দেন তবে আমি বলতে পারি, আগামীকালই আপনি খলিফার পদ পেয়ে যাবেন। আলি উত্তর দিলেন : ‘আপনি যা বলবেন আমি তা মানব।” আমর বললেন : “প্রথমে আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে আমাদের এই কথোপকথন আপনি কাউকে জানাবেন না। আলি এই ব্যাপারে আমরকে অঙ্গীকার দিলেন। আমর বললেন : আব্দুর রহমান একজন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি আপনাকে চাইবেন যখন তিনি দেখবেন যে আপনি সংশয়ী এবং খলিফার পদ নিতে বিলম্ব করছেন। তিনি যদি দেখেন যে আপনি খলিফার পদের জন্য অধীর এবং পদটা পেলে সাথে সাথে নিয়ে নিবেন তখন তিনি আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবেন । আলি উত্তর দিলেন ; আমি আপনার কথামত চলব। পরে, ওই রাতে আমর উসমানের গৃহে গিয়ে উসমানকে বললেন : আগামী কালই আপনি খলিফা হয়ে যাবেন যদি আপনি আমার কথা শোনেন। আর আপনি যদি আমার কথায় মন না দেন তবে আলি আপনার কাছ হতে খলিফার পদ কেড়ে নিবেন। উসমান বললেন : ‘আমি আপনার কথায় কান দিচ্ছি, আপনি বলুন। এরপর আমর বললেন: আব্দুর রহমান একজন সৎ এবং অকপট ব্যক্তি। কেউ কিছু সতর্কভাবেই বলুক বা স্পষ্টভাবেই বলুক, আব্দুর রহমান তার কোনো তোয়াক্কা করেন না। তাই আগামীকাল আপনাকে খলিফার পদের জন্য আহ্বান করা হলে আপনি অনিচ্ছা দেখাবেন না। কোনো শর্ত দেয়া হলে তাতেও অসমতি জানাবেন না। তিনি যা বলবেন আপনি সাথে সাথে তার সাথে রাজি হয়ে যাবেন । উসমান উত্তর দিলেন: আপনি যে পরামর্শ দিলেন আমি তা মেনে চলব। এরপর আমর উঠলেন এবং নিজের গৃহে ফিরে গেলেন।
পরের দিন আমর মসজিদে গেলেন। ভোরের নামাজে আব্দুর রহমান ইমামতি করলেন। তারপর আব্দুর রহমান প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘আল্লাহ ওমরকে আশীৰ্বাদ করুন। আপনারা সবাই জানেন যে ওমর তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম বলে যাননি। তাঁর স্থলাভিষিক্তের নাম বলে গেলে তিনি যে পাপ বা পুণ্যের মালিক হতেন তার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাই তিনি তা না করে আমাদের পাঁচ জনের উপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সাদ এবং জুবায়ের তাদের মতামতের ভার আমার উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। আর আমি খলিফা পদের প্রার্থী থেকে আমার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এখন পছন্দের জন্য দুইজন রয়েছেন, আলি এবং উসমান। আপনারা কাকে চান? আমি কার প্রতি আমার আনুগত্য দেখাব? আপনারা এই নামাজের পর গৃহে ফেরার আগে আমাকে জানান কে হবে বিশ্বাসীদের শাহজাদা? কেউ কেউ চাইলেন আলিকে, আবার কেউ চাইলেন উসমানকে। এই নিয়ে উভয় পক্ষে চলল হট্টগোল। সাদ বিন জিয়াদ তখন আব্দুর রহমানকে বললেন: আমরা আপনাকে সবচেয়ে পছন্দ করি। আপনি নিজেই আপনার উপর আনুগত্য জানান, কেউই তাতে আপত্তি জানাবে না। আব্দুর রহমান বললেন: এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিতর্ক বন্ধ করুন। ভালোভাবে চিন্তা করুন, এই দুজনের মধ্যে কে আপনাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবেন। আমার বিন ইয়াসির বললেন : বিরোধ এড়াতে চাইলে আপনি আলির উপর আনুগত্য দিয়ে দিন। মেকাদা” বললেন ; আমার সঠিক বলেছেন। আপনি আলির প্রতি আনুগত্য দেখালে কেউ তার বিরোধিতা করবেন না। আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ” (তিনি হজরত উসমানের দুধ- ভাই। ইসলাম ত্যাগ করে পরবর্তীতে নবির মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে আবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে খলিফা উসমানের আমলে মিশরের গর্ভনর নিযুক্ত হন) জনতার মাঝে উঠে দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আপনি উসমানের উপর আনুগত্য না দেখালে কিছু লোক আপনার বিপক্ষে যাবে। আব্দুল্লাহকে অভিশাপ দিয়ে আমার বললেন ; ওহে ধৰ্মত্যাগী! তুমি এখানে কেন? আমাদের জন্য কে হবেন বিশ্বাসীদের শাহজাদা তা তোমার মতো মুসলিমের বলার প্রয়োজন নাই। মাখজুম গোত্রের এক ব্যক্তি আমারকে উদ্দেশ্য করে বললেন ; ওহে ক্রীতদাস এবং ক্রীতদাসের সন্তান। তুমি এখানে কুরাইশদের বিষয়ে নাক গলাচ্ছ কেন?
উপস্থিত মুসলমানরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে শুরু হল তুমুল বিবাদ। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুর রহমানকে বললেন : ‘এখনি এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করুন। নয়তো খুনোখুনি লেগে যাবে। আব্দুর রহমান আবার উঠে দাঁড়ালেন, এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আপনারা শান্ত হোন। আমি যেভাবে ভাল বুঝি সেভাবে সমাধান করছি। এবার জনতা চুপ হল। আব্দুর রহমান আলিকে ডাকলেন : ‘আলি, আপনি দাঁড়ান। আলি দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছে গেলেন। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত দিয়ে আলির ডান হাত ধরলেন। নিজের ডান হাত উত্তোলন করে আলির ডান হাত করমর্দনের প্রস্তুতি নিলেন এবং আলিকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? আলি সারণ করলেন রাত্রে আমরের দেয়া উপদেশ। আলি উত্তর দিলেন : “এই সব শর্তে কাজ করা দুরূহ হবে। আল্লাহ যেসব আদেশ দিয়েছেন তার সবগুলো আদেশ কেউ কি জানেন? আর নবির সকল সুন্নাহ কি কেউ জানেন? তবে আমার জ্ঞান, সাধ্য, এবং শক্তি অনুযায়ী আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। আমি আল্লাহর কাছে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছি। আব্দুর রহমান তাঁর বাম হাত থেকে আলির হাত ছেড়ে দিলেন, এবং তখনও তাঁর নিজের হাত উত্তোলিত রেখে আলিকে বললেন : “আপনার শর্তে চললে শিথিলতা ও দুর্বলতা এসে যাবে। তারপর আব্দুর রহমান উসমানকে বললেন : আপনি এখানে আসুন। উসমান দাঁড়ালেন এবং আব্দুর রহমানের কাছ গেলেন। আব্দুর রহমান আগের মতো তাঁর বাম হাত দিয়ে উসমানের ডান হাত ধরলেন এবং বললেন : আপনি কি আল্লাহর নামে শপথ নিবেন যে আপনি মুসলমানদের জন্য কোরান, নবির সুন্নাহ এবং আগের দুই খলিফার উদাহরণ মেনে নিম্পত্তি করবেন? উসমান উত্তর দিলেন: হ্যাঁ, আমি তা করব। আব্দুর রহমান এবার তাঁর ডান হাত দিয়ে আলির বাম হাত ধরে উসমানের হাতের উপর রাখলেন; এবং আব্দুর রহমান উসমানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বললেন: আল্লাহ আপনাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহ আপনাকে আশীৰ্বাদ করুন। উপস্থিত সবাই তখন উসমানের নিকটে গিয়ে উসমানের প্রতি তাঁদের আনুগত্য জানাল। আলি বিসিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে আলি বললেন : ‘আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আলি ভাবলেন আমর ইবনে আল- আস তাঁকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তা আব্দুর রহমান, উসমান, জুবায়ের এবং সাদের সাথে যোগসাজশ করেই দিয়েছেন।
হতাশ হয়ে আলি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং চলে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। আব্দুর রহমান আলিকে বললেন : আপনি কি আনুগত্য দেখাতে নারাজ? আল্লাহ বলেছেন : “যারা তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ নেয় তারা তো আল্লাহর আনুগত্যের শপথ নেয়। আল্লাহ ওদের শপথের সাক্ষী। সুতরাং যে তা ভাঙে ভাঙার প্রতিফল তারই, (সুরা ফাতহ ; আয়াত ১০) । আপনি কি জানেন না, আমি নিজেই এই প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে গিয়েছিলাম যেহেতু আমার ধারণা ছিল আমি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না কেন আপনি তা মেনে নিবেন? ওমর কি বলেননি যে আব্দুর রহমানের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না, তাঁকে মেরে ফেলতে হবে?’ এ- কথা শোনার পর আলি ফিরে গেলেন এবং উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য দিয়ে দিলেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হলো ওই দিনেরই অপরাহ্নের নামাজের আগে। এরপর উসমান ইমাম হলেন।
এ- হল তাবারির পূর্ণ বিবরণ। বিবরণ থেকে বুঝা যায় আলি খলিফা হলে কী হবে তা নিয়ে আৰু সুফিয়ান উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তাই উসমানের খলিফা হওয়া নিশ্চিত করতে আবু সুফিয়ান আমর ইবনে আল- আসের সাথে যোগসাজশ করছিলেন। ১২ বছর আগে যখন আবু বকর খলিফা হন তখন আবু সুফিয়ান এতোই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে, তিনি আলিকে প্ররোচিত করেছিলেন যেন আলি আবু বকরের প্রতি আনুগত্য না দেখান। এছাড়াও আবু সুফিয়ান বলেছিলেন প্রয়োজন পড়লে তিনি মদিনা ভরে দিবেন কুরাইশ সৈন্য দিয়ে। কিন্তু যখন সময় আসল আলি এবং উসমানের মধ্যে পছন্দের তখন আবু সুফিয়ান নিলেন উসমানের পক্ষ। তার কারণ ছিল আবু সুফিয়ান জানতেন উসমানের শাসন তাঁর জন্যে ভালো হবে। আবু সুফিয়ান আলিকে ভয় করতেন কারণ আলি ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ, যা আবু সুফিয়ানের জন্য বিপদসংকুল।
এটা এখন বলা যায়, ওমরের পর যদি আলি খলিফা হতেন তবে ইসলামের উজ্জ্বল দিনগুলি আরও অনেক দিন থাকত এবং ইসলামের প্রধান নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকত না। উসমানের স্বার্থপর আত্মীয়স্বজনেরা সুযোগ পেতেন না প্রধান প্রধান সরকারি পদগুলো কুক্ষিগত করতে। এছাড়া যেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুয়াবিয়া এবং উমাইয়া বংশের উত্থান হয় সেগুলোও এড়িয়ে যাওয়া যেত।
(দশ) নবির মৃত্যুর পর তাঁর সহচরেরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক দল তাঁকে সত্যি সত্যি আল্লাহর নবি’ হিসাবে গ্রহণ করেন আর আরেক দল তাঁকে গ্রহণ করেন এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানে অবদান রাখেন। তাঁরা মনে করতেন যে, তাঁরাই হচ্ছেন এই রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী এবং এর সংরক্ষণ ও প্রতিরক্ষার জন্য তাঁরা বাধ্য। কিন্তু উভয় দলই নবির প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় দলে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ওমর ছিলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাষ্ট্রের সংরক্ষণের প্রতি উদ্বেগ থেকে ওমরকে শক্তভাবে তরবারি ধরতে হয়। এই তরবারি উচিয়েই তিনি নবির গৃহের দরজা থেকে বের হয়ে নবির মসজিদে আসেন এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : নবি মুহাম্মদ মরেননি, নবি মুসার মতো তিনি চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকবেন। আবু বকর ওমরকে সারণ করিয়ে দিলেন কোরানের বাণী : তোমার মৃত্যু হবে, এবং তাদেরও। (সুরা জুমার ; আয়াত ৩১) । এরপর আবু বকর মসজিদের প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে বললেন : তোমরা যদি ব্যক্তি মুহামদকে উপাসনা করে থাকো তবে সেই মুহাম্মদ মৃত। কিন্তু তোমরা যদি আল্লাহর উপাসনা করো তবে জেনে রাখো আল্লাহ কোনোদিন মারা যান না। তারপর আবু বকর এই আয়াত আবৃত্তি করলেন : মুহাম্মদ রসুল ছাড়া আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসুল গত হয়েছে। সুতরাং সে যদি মারা যায় বা নিহত হয় তবে কি তোমরা পিঠ ফিরিয়ে পিছু হটবে? আর যে পিঠ ফিরিয়ে সরে পড়ে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন। (সূরা আল-ইমরান ; আয়াত ১৪৪) । নবির মৃত্যুর পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দিতা দেখা দেয় শেষ পর্যন্ত তা ওমরের বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং কুশলতার জন্যই এড়ানো গেল। সে- জন্য ওমরের প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। ওমরের প্রচেষ্টার জন্যই আবু বকর খলিফা হয়ে যান। আর ওমরের নির্দেশেই আবু বকর ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং কঠোর হস্তে বিদ্রোহী গোত্রদের দমন করেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে ওমরের মনে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, ইসলাম ধর্ম না ইসলামি রাষ্ট্র? যাহোক, একটি ইসলামি রাষ্ট্র যখন গঠিত হয়েছে তখন তাকে রক্ষা করতেই হবে। মুহাম্মদের প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকার আরবদের মাঝে বিরাজমান অজ্ঞানতা এবং বর্বরতার অবসান ঘটায়। এই অবস্থানকে সুদৃঢ় করা অতীব প্রয়োজন ছিল। বেদুইনদের মধ্যে যে অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিরাজমান ছিল তা নির্বাপিত করে ইসলামের ছায়ায় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। ওমর ছিলেন খুবই বাস্তববাদী ব্যক্তি। তিনি আরবদের চরিত্র ভালো করে জানতেন। ইসলামত্যাগীদের বিরুদ্ধে (রিদা যুদ্ধ) যুদ্ধের পর যে সৈন্যরা ফিরে এলো ওমর তাদেরকে রোম এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এই ধরনের যুদ্ধের কথা আগে কেউ চিন্তাই করতে পারতেন না। ওমর জানতেন যে মরুভূমির বেদুইনরা কোনো দিন কৃষি কাজ অথবা শিল্পে মন দিবে না। কারণ এইসব বিষয়ে বেদুইনরা একেবারে অজ্ঞ। তাদের মধ্যে যে সুপ্তশক্তি আছে তার বহিঃপ্রকাশ দরকার। আরবের সীমান্তের বাইরে যে বিপুল ধনসম্ভার আছে তা দখল নেবার জন্য এই অশান্ত টগবগে বেদুইনদের প্রস্তুত করার চেয়ে আর ভালো কাজ কি হতে পারে? ইতিহাস প্রমাণ করে, হজরত ওমরের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
(এগারো) ইরান এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। [ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ডগলাস হওয়ার্ড জনসনের মতো ঐতিহাসিকদের মতে গ্রিক-রোমান বনাম পারস্য সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক যুদ্ধ খ্রিস্ট পূর্ব ৯২ অব্দ থেকে শুরু হয়ে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। -অনুবাদক । কয়েক শতাব্দী ব্যাপী চলমান যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, ওই দুই সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর আরব বসবাস করতো। দুই থেকে তিন শতাব্দী ধরে উত্তর আরব অঞ্চল থেকে আগত আরবেরা জর্দানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং সিরিয়া ও ইরাকে অনুপ্রবেশ করেছিল। রোমান ও ইরানের কর্তৃত্বতায় তারা একাধিক রাজ্য গঠন করেছিল। তারা (আরব সম্প্রদায়) অথবা তাদের চাইতে নিচু- সম্প্রদায়ের লোকেরা আরব খলিফার সৈন্যদের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধ করত। ফলে এদের সহায়তা নিয়ে ওমরের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছিটিয়ে থাকা আরবেরাই ওমরকে প্রেরণা দেয় সৈন্য-সামন্ত নিয়ে অগ্রসর হতে; কারণ তখন ইসলাম আরব জাতীয়তাবাদকে একটি সুসংঘটিত শক্তিতে পরিণত করেছে। এই যুদ্ধগুলি জয় ছিল একেবারে মহাকাব্যের কাহিনীর মতো, বিজয়ী হওয়ায় লব্ধ গনিমতের মাল আরবদের প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করে। একে একে সামরিক বিজয় তাদের মনে দীর্ঘদিনের বিদেশিদের বশ্যতার যে কলঙ্ক ছিল তা দূর করে দিল।
(বারো) এটা সত্যি যে অনেকে আন্তরিক বিশ্বাস নিয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সিরিয়া এবং ইরাকে যখন আক্রমণ চালানো হয় তখনো অনেকেই ইসলামের আদেশ মান্য করে এই ধর্মযুদ্ধে (জিহাদ) যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাও পাওয়া যায় যে গনিমতের মালের লোভেও অনেকে এই আক্রমণে শরিক হয়েছিলেন। কঠোর সংযম, তপস্যা, এবং পার্থিব ধনদৌলতের প্রতি অনীহা সীমিত সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নবির অনেক সাহাবিও যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে প্রচুর ধনদৌলতের অধিকারী হন। এরকম দুজন হচ্ছেন হজরত তালহা এবং হজরত জুবায়ের। নবি একসময় তাদেরকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন। খলিফা ওমর তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের জন্য যে পরিষদ গঠন করেছিলেন তার সদস্যও ছিলেন তাঁরা উভয়ে। তাঁরা উভয়ে মৃত্যুর সময়ে মক্কা, মদিনা, ইরাক, এবং মিশরে বিশাল ধনসম্পদ রেখে যান যার পরিমাণ ছিলো তিন থেকে চার কোটি দিরহাম। উসমানের হত্যার পর এরা দুজনেই আলির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা যখন দেখলেন যে আলি পূর্বের খলিফা উসমানের মতো অপচয়ের পথ ধরবেন না এবং সরকারি তহবিলে অবৈধ হস্তক্ষেপ করবেন না, তখন আলির উপর থেকে তাঁরা আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিলেন।
নবির স্ত্রী আয়েশা হলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম সমানিত নারী। নবি তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে গভীর ভালোবাসতেন। কোরানে আয়েশার ছিল অগাধ জ্ঞান এবং নবির উক্তি ও কর্ম সম্পর্কে তিনি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস বলেছেন। আলি যখন খলিফা মনোনীত তখন আয়েশা হজরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিষয় ধরে জনতার রায়ের প্রতি ভ্রক্ষেপ দেখালেন। বিবি আয়েশা মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করলেন আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে। এটি জামালের যুদ্ধ (উটের যুদ্ধ) নামে পরিচিত। কিন্তু আয়েশার এরকম পদক্ষেপের পিছনে প্রধান কারণ ছিল খলিফা উসমান সরকারি কোষাগার থেকে তাঁকে যে ভাতা দিতেন আলি খলিফা হবার পর সেই ভাতা বন্ধ করে দেন। আর একটি কারণ হতে পারে, যখন আয়েশার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয়েছিল তখন হজরত আলি বিবি আয়েশার বিরুদ্ধে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছিলেন। যদিও হজরত আলির এই মন্তব্য পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ, নাহরাবানের যুদ্ধ, এসব যুদ্ধের মূল কারণ ছিল, খলিফা উসমানের আমলে যে শিথিলতা চলছিল, আলি তা আর চলতে দিলেন না।
খলিফা ওমরের শাসনামলে যারা কঠোর সীমাবদ্ধতার মাঝে ছিলেন, তাঁরা উসমানের সময় বিলাসিতা ও আরামের সাথে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। আলি খলিফা হবার পর কৃচ্ছতা সাধনের নীতি অবলম্বন করলেন। আলির এই নীতিতে অনেকেই বিরাগ হলেন। মুয়াবিয়াসহ অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন।
(তের) নবি জীবিত থাকাকালে আত্মিক-বিষয়ে উদাসীন, যোদ্ধা বেদুইন গোত্রের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেছিলেন প্রথমত কোরানের বাণী ও কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে। শক্তি ব্যবহার করেছেন একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে। নবির মৃত্যুর পর খলিফারা এই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। খলিফারা নবির নাম ভাঙ্গিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য কায়েমে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ- সময়েই নবিকে “অতিমানব’ হিসেবে পরিচিত করানো শুরু হয়। অনেক অবাস্তব বর্ণনাকে নবির অলৌকিক ঘটনা দাবি করে তাঁকে এক রহস্যময় অতিমানবে পরিণত করা হয়। যে নবি জীবিতকালে নিজেকে সাধারণ আল্লাহর দাস বলে পরিচিত করেছিলেন মৃত্যুর পরে তাঁকে মানুষের স্তর থেকে উঠিয়ে ফেরেশতা- রূপ দেয়া হয়। একজন মহামানবের মৃত্যুর পর তাঁর চরিত্রকে কেন্দ্র করে এ-ধরনের গুজব বা অবাস্তব- বর্ণনা রচনা করা একটা বহুল প্রচলিত অভ্যাস। সত্য এই যে, দুনিয়ার সব মহামানবের তাঁদের মহানুভবতা, তাঁদের যুগান্তকারী ভূমিকা, তাঁদের অনন্যসাধারণ কর্ম থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষদের মতোই তাদেরও নানা দুর্বলতা ছিল। তাঁরাও বিভিন্ন সময় ভুল করেছিলেন। তাঁদের ক্ষুধা পেয়েছে, পিপাসার্ত হয়েছেন, শীত-গ্রীষ্মে কষ্ট পেয়েছেন। তাঁদেরও যৌন- কামনা ছিল, যা হয়তো সাধারণ আচরণের বাইরে চলে যেত। তাঁরা পথ চলতে গিয়ে হোচট খেয়েছেন। তাঁরা বিরোধিতা সহ্য করেননি। এমনকি অনেক সময় তাঁরা পরশ্রীকাতর হয়েছেন। যা- হোক মহামানবদের মৃত্যুর পর অন্যান্যদের সাথে যে তাঁদের বিরোধ, তাঁদের ব্যর্থতা, তাঁদের দুর্বলতা জনসাধারণ ভুলে যায়। দেখা যায় যে জনতা কেবল মহামানবদের উৎকৃষ্ট কাজগুলিকেই মনে রাখে। এ- জন্য আমরা আবু আলি সিনা (হিজরি ৩৭০ বা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দ- হিজরি ৪২৮ বা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর রচিত “আল কানুন ( আরবিতে) এবং দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ের উপর লেখা আশ শেফা (আরবিতে) ও দানেশনামা-ই আলাই (ফার্সিতে) বইগুলির কথা মনে রেখেছি। এছাড়াও আমরা মনে রেখেছি তাঁর ঝুঁকিপূর্ণ কর্মজীবনের কথা। কিন্তু তাঁর জীবনের ব্যর্থতাকে আমরা গোপন রেখেছি অথবা কৌশলে ঢেকে রেখেছি। দুনিয়ার কোটি কোটি লোক গভীর বিশ্বাস নিয়ে ধর্ম পালন করে থাকেন। ফলে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে “অতিমানবীয় চরিত্র দাঁড় করানো খুব প্রচলিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
পরিখা যুদ্ধের (আহজাবের যুদ্ধ) সময় কুরাইশ প্রধান ওয়ায়না বিন হোসেন নামের গাতাফান গোত্রের এক ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি করে নবির কাছে পাঠাল। সে নবিকে প্রস্তাব দিল, নবি যদি মদিনার সে বছরের সমস্ত খেজুর দিতে রাজি হন, তবে তারা তাদের সমিলিত অবরোধকারী সৈন্য সরিয়ে নিবে। নবি রাজি হলেন না। তখন সেই প্রতিনিধি বলল, তারা মদিনার এক-তৃতীয়াংশ খেজুরে রাজি আছে। অর্থাৎ এ-পরিমাণ খেজুর পেলে তারা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিবে। এর আগে নবি মদিনা রক্ষার জন্য পরিখা খনন করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই সব গোত্রের সাথে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন করা তাঁর জন্য এক বিরাট বিপদ। তথাপি নবি গাতাফান গোত্রের প্রতিনিধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। যুদ্ধ-বিরতির চুক্তি লেখার সময় সাদ বিন মুয়াজ (আউস গোত্রের একজন নেতা) নবির কাছে জানতে চাইলেন তাঁর এই সিদ্ধান্ত আল্লাহ প্রদত্ত কি না? নবি বললেন, “এ আল্লাহ প্রদত্ত নয়; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিলে অবরোধকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং তাদের ও ইহুদিদের সাথে যোগসাজশের যে ঝুঁকি আছে, তাও ভেঙে দেয়া যাবে, পরবর্তীতে ইহুদিদেরকে দেখে নেয়া যাবে। সাদ বিরক্তিভরে উত্তর দিলেন তাঁদের পৌত্তলিক আমলে কেউ সাহস করত না, একটা খেজুরও তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করতে। এখন তারা মুসলিম হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারা মৈত্রীচুক্তি করার নামে অপমানিত হতে চায় না। গাতাফান গোত্রের অপমানের একমাত্র সঠিক জবাব হবে তরবারি। এ- বক্তব্য শোনার পর নবি তাঁর ভাবনা পরিবর্তন করলেন। তিনি সাদের কথা মেনে নিয়ে গাতাফান গোত্রের সাথে চুক্তি সই করা থেকে সরে আসলেন। এ-ধরনের অনেক ঘটনা নবির তেইশ বছরের নবুওতির সময়কালে ঘটেছিল। অনেক সময় নবির কোনো সহচর তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে আলাপ করে পরামর্শ নিতেন, আবার অনেক সময় নবিও তাঁর সহচরদের উপদেশ গ্রহণ করতেন। সহচররা অনেক উপর ছেড়ে দিতেন। যা- হোক নবির মৃত্যুর পর তাঁর মানুষসুলভ চরিত্রের কথা সবাই ভুলে যান। নবির প্রত্যেকটি কর্ম আদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হতে লাগল। তাঁর প্রত্যেক কাজকেই আল্লাহর ইচ্ছা মনে করা হতে লাগল। সরকারি এবং বিচারবিভাগীয় কর্তারা নবির প্রত্যেক কাজকে অতীতের উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করতে লাগলেন। তখনকার দিনের সরল মনের সাধারণ নবি যা ছিলেন তারচেয়েও অনেক উচু আসনে বসিয়ে দিলেন। যে কেউ দাবি করত, সে নিজে নবির মুখ হতে কিছু শুনেছে তখন সে পেয়ে যেত অশেষ মর্যাদা ও কদর। কোরানে যে- সব আদেশ এবং আইনের কথা বলা হয়েছে তা পরিষ্কার এবং পূর্ণাঙ্গ নয়। সে- জন্য বিশ্বাসীদেরকে খুঁজতে হতো নবির উদাহরণ। যেমন কোরানে মুসলমানদের দৈনিক নামাজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে এই নামাজ পালন করতে
হবে তার বিশদ কিছু নেই। তাই নামাজ পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি নবির উদাহরণ থেকে নিতে হলো। এ- জন্যে প্রয়োজন পড়ল নবির জীবনকালের কাজ-কর্মের রীতিনীতি সঙ্কলনের। একে সুন্নাহ বলা হয়। তাঁর বাণীগুলিকে হাদিস হিসাবে সঙ্কলন করা হতে লাগল। ফলে হিজরি ৩- ৪ (খ্রিস্টাব্দ ৯-১০) শতাব্দীর মধ্যে সুন্নাহ ও হাদিসের সংখ্যা হাজার হাজার হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, শতশত অনুসন্ধান হতে লাগল সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। ফলে এক শ্রেণীর পেশাদার হাদিস- সংকলকের আবির্ভাব হতে লাগল যারা প্রচুর সম্মানের অধিকারী হলেন। তাঁরা হাজার হাজার হাদিস এবং সুন্নাহ মুখস্ত করে ফেললেন। তাঁদের একজন হলেন ইবনে ওকদা (মৃত হিজরি ৩৩২ বা খ্রিস্টাব্দ ৯৪৩) । বলা হয়ে থাকে তিনি আড়াই লক্ষ হাদিস জানতেন। সেইসাথে হাদিস বর্ণনাকারীদের ধারা।
পারস্যের এক প্রবাদে বলা হয় ; ‘কেউ যদি একটি বিশাল প্রস্তর হাতে নেয়, তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, সে কখনো ওই প্রস্তর নিক্ষেপ করবে না। সাধারণ জ্ঞান থেকে আমরা বলতে পারি এই যে, বিশাল হাদিস সঙ্কলন করা হল সেগুলোর সবই নির্ভরযোগ্য নয়। এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এইসব হাদিস সংকলনে যারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইবনে তায়মিয়া (হিজরি ৬৬১ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬৩ – হিজরি ৭২৮ বা খ্রিস্টাব্দ ১৩২৮) বলেছেন : নবি মুহাম্মদের কাছ থেকে আসা ব্যতীত আর কিছুই সত্য নয়।’ শোনা যায় যে হাসান বিন মুহাম্মদ আল-আরবিলি (মৃত হিজরি ৬৬০ বা খ্রিস্টাব্দ ১২৬১) নামে আর একজন মুসলিম পণ্ডিত বলেছেন : আল্লাহ আমাদেরকে সত্য জানিয়েছেন কিন্তু ইবনে সিনা আমাদেরকে মিথ্যা বলেছেন।”
(চৌদ্দ) নবির মৃত্যুর পর যতই দিন যেতে লাগল এবং হেজাজ থেকে দূরত্ব যত বেশি হলো নবিকে নিয়ে অলৌকিক দাবি ততোই বেশি হতে লাগল। এভাবেই একজন মানুষ যিনি ইতিহাসের বিশাল মোড় ঘুরিয়ে ছিলেন নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, স্বকীয়তা, ধৈর্য, সাহস, কৌশলের সাথে, তাঁকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে এক উপকথার নায়কে রূপান্তরিত করা হলো।
(পনের) আরবদের আক্রমণে ইরান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। হিজরি ১৫-১৬ সালে (৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) কাদেসিয়ার যুদ্ধে বারবার পরাজয় এবং হিজরি ২১ সালে (৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) নেহাবন্দে পরাজয়ের গ্লানি আলেকজান্ডার এবং মঙ্গোলদের কাছে পরাজয়ের গ্লানির চাইতে বেশি ছিল। ইরানের দীর্ঘ দুৰ্দশার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই জাতি করুণভাবে পরাজিত হয়, কারণ এখানে কোনো যোগ্য নৃপতি অথবা নেতা অথবা রাষ্ট্রনায়ক, অথবা সেনাপতি ছিলেন না। ইরান পরাজিত হয় স্বল্পসংখ্যক, অদক্ষ আরব সেনাবাহিনীর হাতে। শহরের পর শহর, প্রদেশের পর প্রদেশ আরব সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর এসব স্থানের বাসিন্দারা আরবদের ধার্য করা শর্ত যেমন ইসলাম গ্রহণ অথবা জিজিয়া কর প্রদান করতে বাধ্য হয়। যারা জিজিয়া করের আশ্রয় নিল তারা পেল অতি নিম্নমর্যাদা। জিজিয়া কর এড়ানোর জন্য অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। আবার অনেকে অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্র পুরোহিত মবেদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ খুব সহজ। শুধু দরকার আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদের নবুওতি মেনে নেওয়া। ধীরে ধীরে ইসলাম জনসাধারণের মাঝে বিস্তার লাভ করে। সেই অতীতে ইরানিদের জাতীয় চরিত্র ছিল এই রকম, যখন কেউ তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করত তখন ইরানিরা বিজয়ী শাসকের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে যেত। তারা নতুন শাসকদের আজ্ঞাপালন, সেবা পরিচর্যায় নিয়োজিত হতো। এছাড়া কৃপা পাবার জন্য ইরানিরা তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি নতুন প্রভুদের হাতে সমর্পণ করে দিত। তাই আরবরা যখন ইরান দখল নেয়, তখন ইরানিরা আরবি ভাষা রপ্ত করে নেয়। আরবদের আদব-কায়দা অনুকরণ করা শুরু করে। অবশ্য ইরানিরাই আরবি ব্যাকরণ এবং বাক্যগঠনবিধি নিয়মাবদ্ধ করে। ইরানিরা তাদের নতুন প্রভুদের অধীনে চাকুরি পাবার জন্য যে কোনোভাবে আজ্ঞানুবর্তী হতে কুষ্ঠা বোধ করত না। ক্ষেত্রবিশেষে ইরানিরা ইসলামি রীতিনীতি পালনে আরব শাসকদেরও ছাড়িয়ে যায়। আর নিজেদের হাজার বছরের পারস্য সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতিনীতি, প্রথা, কৃষ্টির প্রতি অবজ্ঞা আর অবহেলা প্রদর্শন করে। আরব জাতি এবং আরব বীরদের উচ্চপ্রশংসায় তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই-ই নয় ইরানিরা প্রমাণ করতে চাইল বীরত্ব, বদান্যতা, এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র আরবদের মধ্যেই আছে। প্রাক-ইসলামি যুগের আরবের বেদুইন কবিদের কবিতাগাঁথা আর সাধারণ উক্তিকে পাণ্ডিত্যের রত্নভাণ্ডার এবং আচার আচরণের আদর্শ হিসাবে গণ্য করল ইরানিরা। তারা আরব গোত্রের আশ্রিত ব্যক্তি এবং আরব নেতাদের (আমির) ভৃত্য হয়ে নিজেদের ধন্য মনে করত। বিবাহের জন্য তাদের কন্যাদেরকে আরবদের হাতে তুলে দিলে যারপরনাই খুশি হতো। আরও খুশি হতো যখন তারা আরবি ভাষার নাম দিয়ে নিজেদের ভূষিত করত। স্বকীয়তা, সাহিত্য, কৃষ্টি ত্যাগ করে পরাজিত জাতি হিসেবে ইরানিরা শীঘ্রই আরবি সাহিত্য, হাদিস সংকলন, ইসলামি আইনের পেছনে নিজেদের মেধা- শ্রম- সময় ব্যয় করে। ইসলামি সাহিত্য নিয়ে যত মুখ্য কাজ হয়েছে, তার বেশির ভাগই করেছেন ইরানের জনগণ। যদিও প্রথমদিকে ইরানে ইসলাম গৃহীত হয়েছে ভীতি থেকে এবং আরব শাসকদের প্রচারণায়। তবে দুই-তিন প্রজন্ম পর চিত্র পাল্টে যায়। খোদ আরব-মুসলমানদের চেয়ে ইরানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়।
তোষামোদ এবং মিষ্টিকথা দিয়ে নতুন শাসকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে ইরানিরা এতোই সুদক্ষ হয়ে উঠে যে, কথিত আছে একজন প্রসিদ্ধ উজির আয়নায় কখনো নিজের চেহারা দেখতেন না, পাছে তিনি এক ইরানির চেহারা দেখে ফেলেন এই লজ্জায়। প্রথমদিকে ইরানিরা তাদের নতুন শাসকদের আজ্ঞাবহ হয়ে সেবা করত, মনোরঞ্জনের যথাসাধ্য চেষ্টা করত, কারণ তারা মনে করেছিলেন আরবরা ফিরে গেলে তারা নিজেরা শাসক হয়ে যাবে এবং গনিমতের মালের ভাগ পাবেন। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগল তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে দ্বন্দুের মধ্যে পড়ে গেল। হিজরি তৃতীয়- চতুর্থ শতাব্দীর (নবম-দশম খ্রিস্টাব্দ) দিকে ইরানে প্রচুর লোক ছিল, যারা নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে হেজাজকেই মানবজাতির জন্য স্রষ্টার আশীর্বাদ হিসেবে মনে করতো। ইরানের এই জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, কেমন করে এ ভূখণ্ডে কুসংস্কার আর অতিলৌকিক বিশ্বাস মানুষের মনে বিস্তার লাভ করেছিল। নবির নবুওতি লাভের পর প্রথম তের বছরের মক্কা জীবন আর পরের দশ বছরের মদিনা জীবনে যে ভয়াবহ বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন হেজাজে, সে-সম্পর্কে বাস্তব তথ্য জানা থাকলে ইরানের জনগণ এতো সহজে আরবের বশ্যতা স্বীকার করে নিত না। ধর্মও প্রতিষ্ঠা পেত না।
এ- প্রসঙ্গে মুহাম্মদ বাকের মাজলেসির’ (হিজরি ১০৩৭ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬২৭ – হিজরি ১১১০ বা খ্রিস্টাব্দ ১৬৯৯) লেখা বেহার আল- আনোয়ার’ বইয়ের কথা আবার উল্লেখ করা যেতে পারে। পারস্যের সাফাবিদ শাসনকালের শেষের দিকের এই লেখক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ (শিয়া ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামি আইনবিশারদ) । তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন : “কথিত আছে একদা ইমাম হাসান এবং হোসেন তাঁদের পিতামহের (নবি মুহাম্মদ) কাছে রোজা ভাঙার দিনে নতুন পোশাক উপহার চাইলেন। এ- সময় জিবরাইল ফেরেশতা এসে গেলেন এবং প্রত্যেকের জন্য একটি করে সাদা পোশাক দিয়ে দিলেন। নবি বললেন, এই দুই বালক রঙিন পোশাক পরতে পছন্দ করে, কিন্তু জিবরাইল নিয়ে আসলেন সাদা পোশাক। নবির কথা শুনে জিবরাইল বেহেশত থেকে একটি টব এবং একটি জগ নিয়ে আসলেন। এরপর জিবরাইল বালকদের বললেন, তিনি টবটি এক বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করে দিবেন। তারপর বালকেরা তাদের নিজস্ব পোশাক ওই টবে ডুবিয়ে দিলে তাঁরা যে রং চাইবেন তাই পাবেন। ইমাম
হাসান সবুজ রং চাইলেন এবং ইমাম হোসেন চাইলেন লাল রং। যখন পোশাকদ্বয় রঞ্জিত হচ্ছিল তখন জিবরাইল কেঁদে উঠলেন। নবি জিবরাইলকে তাঁর কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, কেননা বালকেরা তাদের পোশাকে রং পেয়ে খুশি হয়েছে। জিবরাইল বললেন, ‘হাসানের সবুজ রঙ পছন্দের অর্থ হলো তিনি বিষপানে শহীদ হবেন, এতে তাঁর দেহ সবুজ হয়ে যাবে। আর হোসেনের লাল রং পছন্দের অর্থ হল তিনি শহীদ হবেন যখন তাঁর রক্তে তাঁর পোশাক ভিজে যাবে। উল্লেখ্য এই কাল্পনিক বক্তব্য বাহাই মতাবলম্বী লেখক মির্জা জানি তাঁর “নক্তাত আল- কাফ-১৫২ বইয়েও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। বাহাইরা নিজেদের শিয়া ইসলামের সংস্কারক এবং এক নতুন শিয়া- ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপে মনে হয়, মুখে দাবি করলেও কুসংস্কার এই সংস্কারবাদী শিয়াদের মন থেকে বিদায় হয়নি।
মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম বছর নবি মুহাম্মদ এবং সাহাবিরা নিদারুণ আর্থিক অনটন আর অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করেন। নাখলাতে যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। নবির সাহাবির মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আউফ ছাড়া আর কারো ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো তেমন অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ছিল না। মদিনায় আসার পর আব্দুর রহমান আউফ মদিনার বাজারে একটি ব্যবসা স্থাপন করেন। এই ব্যবসায়ে তাঁর কিছু মুনাফা আসে। নবির আরও কয়েকজন সাহাবি মদিনার ইহুদি বাসিন্দাদের তালবাগানে চাষাবাদ এবং কূপখননের কাজ পান। অবশ্য এই সাহাবিরা খেজুর বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ বা চাষের কোনো কিছুই জানতেন না। ফলে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া তাঁদের অন্যকিছু করার সুযোগ ছিল না। নবির ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করার মানসিকতা অসম্ভব রকমের দৃঢ় ছিল। মদিনায় গিয়ে তিনি যখন অসহায় অবস্থায় পড়েন তখন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রায়ই দুই- একটি খেজুর খেয়ে বিছানায় যেতেন। অনেক সময় তাঁর কপালে রাতের আহারও জুটতো না। নবির প্রতি অসমান না দেখানোর জন্য এই সত্য প্রকাশ করা হয় না। এর পরিবর্তে শুধু নবির কীর্তি ও অবদানের কথা প্রকাশ করা হয়। নবির লক্ষ্য ছিল সমগ্র আরবে তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। তিনি দরিদ্রতা এবং অসঙ্গতিকে কোনো সময়ই তাঁর লক্ষের অন্তরায় হিসাবে দেখেননি। ইতিহাসে এই ধরনের মানসিক শক্তিতে বলীয়ান পুরুষের উদাহরণ পাওয়া বিরল।
মুহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবন থেকে বোঝা যায়, তিনি মনুষ্য সমাজেরই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো অতিমানব বা আলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন না। অলৌকিক শক্তির সাহায্যও তিনি কখনো লাভ করেননি। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়েছিলেন, তার কারণ যে তাঁরা সাহসী এবং অবিচল থেকে লড়াই অব্যহত রেখেছিলেন। আর কুরাইশদের মাঝে দেখা দিয়েছিল অবহেলা আর শিথিলতা। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ ছিল, তাঁরা নবির যুদ্ধ-কৌশলের প্রতি অনুগত ছিলেন না। সৃষ্টিকর্তা যদি সর্বদাই মুসলমানদের সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকতেন তবে মুসলমানদের শক্রর সাথে ভয়ঙ্কর লড়াই, যুদ্ধ, হানাহানি, সংঘর্ষে লিপ্ত হবার প্রয়োজন পড়ত না, কিংবা মদিনার রক্ষার জন্য পরিখা খননেরও দরকার ছিল না। এমন-কী বানু কুরাইজা গোত্রকে হত্যার প্রয়োজন পড়ত না। কোরানে রয়েছে : ‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। (সুরা সিজদা : আয়াত ১৩) । বুঝা যায়, এটা অনেক যৌক্তিক যে আল্লাহ ইচ্ছা করলেই দুনিয়ার সকল অবিশ্বাসী ও ভণ্ডদের হৃদয় ইসলাম দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ চান নাই বলে এমনটা হয়নি।
নবি একপক্ষ কালব্যাপী মদিনার ইহুদি গোত্র বানু কায়নোকার বাসস্থানে সামরিক অবরোধ দেন এবং তাদের খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে কায়নোকা গোত্রের ইহুদিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নবি তাঁদেরকে হত্যা করতে চাইলে তাদের পুরানো বন্ধু আব্দুল্লাহ বিন উবায় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন।
তিনি সতর্ক করে দেন, যদি ইহুদি বানু কায়নোকা গোত্রকে হত্যা করা হয়, তবে তিনি এর বিরোধিতায় নেমে পড়বেন এবং নবির সঙ্গ ছেড়ে দিবেন। আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের এ- বক্তব্যে নবির মুখ ক্রোধে কালো হয়ে যায়। তথাপি তিনি চিন্তাভাবনা করে তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্ত বদল করেন। হত্যার বদলে তিনদিনের সময় দেয়া হলো মদিনা ত্যাগ করার জন্য। এই ধরনের আরও ভজন- খানেক ঘটনা থেকে আমরা নবি মুহাম্মদের জীবনী এবং ইসলামের উত্থানের ইতিহাস জানতে পারি। এই ঘটনাগুলি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে, নবির জন্য কোনো অলৌকিক শক্তি আসলে কাজ করেনি। ইতিহাসের অন্যান্য ঘটনার মতোই মুহাম্মদের জীবনে যা ঘটেছিল তার পিছনে ছিল প্রাকৃতিক কারণ। কোনো দৈবের হাত নয়। এই বিশ্লেষণ বা দৃষ্টিভঙ্গি নবি মুহাম্মদকে কোনোভাবেই হীন বা দুর্বল করে না। বরং ইতিহাসের একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে নবি মুহামদের দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীকে আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে মানুষ অনেক সময় সবকিছুর বিশদ অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ করে যাচাই করতে অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাল্পনিক মন সবকিছুর পিছনে অলৌকিক ঈশ্বরের হাত দেখে। আদিমযুগের লোকেরা বজ্রপাত এবং বিদ্যুতকে স্রষ্টার কণ্ঠস্বর এবং ঝলক বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত ওই নৃপতি মানুষের অবাধ্যতার জন্য ক্ষেপে গিয়ে এই ধরনের কার্যকলাপ প্রদর্শন করেন। আমাদের চারপাশের অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও অনেক সময় ভুলে যান যে প্রত্যেক ঘটনার পিছনে কার্যকারণ রয়েছে। ফলে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনার পিছনেও স্বগীয় হস্তক্ষেপ আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা মনে করেন ওই সর্বশক্তিমান নৃপতি তাদেরই মতো। যেসব ব্যক্তি এই ধরনের চিন্তা করেন তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই মহাবিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহ বেহেশত থেকে নবির দৌহিত্র হাসান এবং হোসেনের জন্য পোশাক পাঠিয়ে দেন এবং স্রষ্টার বার্তাবাহক পোশাক দুটিকে সবুজ এবং লাল রঙে রঞ্জিত করে দেন।
এটা সত্য যে মাজলেসির লেখা বেহার আল আনোয়ার কোনো ব্যতিক্রমী বই নয়। আর এটাই একমাত্র বই নয় যে, কারকারা নামে এক মাছ যে সারসারার পুত্র, যে সারসারা আবার ঘারঘারার পুত্র, সে আলি বিন আবু যেতে পারেন। এই ধরনের শতশত বই ইরানের বাজারে পাওয়া যায়। যেমন কয়েকটা বইয়ের নাম হচ্ছে : হেলায়াল আল- মোল্লাকিন”, জান্নাল আল-কলুব, আনোয়ার-ই নোমানি, মেরসাদ আল- ইবাদ*। এছাড়াও রয়েছে নবি ও ওলামাদের কাহিনি সংকলন করে লেখা প্রচুর বই। একটা জাতির মানসিকতাকে বাস্তব-বুদ্ধি-চিন্তাশক্তি এবং যুক্তিবোধকে বর্জন করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলতে এই ধরনের যে কোনো একটি বই- ই যথেষ্ট। অলৌকিক গল্প ছড়িয়ে দেয়া আসলে মাদকদ্রব্য ব্যবসার পর্যায়েই পড়ে। এই মাদকে আসক্ত নারী-পুরুষ উভয়েই যুক্তি-চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
মুহাম্মদ তাঁর নবি জীবনে যা আয়ত্ত করেছেন, যা প্রচার করেছেন, যা প্রয়োগ করেছেন তার সবই লোকেরা জানে। লোকেরা আরও জানে যে তাঁর ক্ষুধা পেত, তিনি খাবার খেতেন, এবং সাধারণ জনগণ যেভাবে তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বশে চলে নবিও সেইভাবে চলেছেন। তাঁর চরিত্রকে অতিমানব হিসাবে দেখিয়ে, জনতাকে বিভ্রান্ত করা কোনো মতেই মানবজাতির জন্য মঙ্গলকর নয়।
——————
পাদটীকা
৯৬. আবু উবায়দা বিন আব্দুল্লাহ বিন আল জারাহ নবির ইসলাম প্রচারের শুরু দিকেই ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সাময়িকভাবে আবিসিনিয়ায় দেশান্তরী হন। যে দশজনকে বেহেশত গমনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন আবু উবায়দা তাঁদের একজন। তিনি সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন হিজরি ১৫ (৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হিজরি ১৮ (৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত। প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান হিজরি ১৮ সালে। তিনি হম, আলেপ্পো এবং আন্তিওক (Antioch) দখল করেন।
৯৭. ভিন্নমতে আহত সাদ বিন ওবায়দা অসুস্থ অবস্থায় মারা যান চার-পাঁচ বছর পর।
৯৮. আবু আলি মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বালামি (মৃত্যু হিজরি ৩৬৩ বা ৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ) । সামানিদ বংশের শাসনামলে (আমির আবদুল মালেক- ১ এবং মানসুর- ১- এর আমলে) তিনি বোখারার উজির ছিলেন। (উল্লেখ্য পারস্যে সামানিদ বংশের শাসনকাল ধরা হয় ৮১৯-৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।) আমিরদের অনুরোধে তিনি আল-তাবারির লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘History of the Prophets and Kings’ ফারসিতে অনুবাদ করেন ‘Tarikh-e Bal’ami নামে। নব্যফার্সি গদ্য লেখার মধ্যে এই লেখা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই অনুবাদ তাবারির মৌলিক আরবি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য। অনুবাদটিতে অনেক সম্পূরক বিষয় স্থান পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রধানত ইরানের বিষয়াবলী। এই গ্রন্থের ফরাসি সংকলন হচ্ছে : H. Zotenberg, Chronique de… Tabari traduite sur la version persane de… Belami, 4 vols. Paris 1876 1874, reprinted 1948.
৯৯. আমার বিন ইয়াসির এবং আল মিকদাদ বিন আমর ছিলেন ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকের মুসলমান। নবির উল্লেখযোগ্য সাহাবি এবং আলির বিশিষ্ট সমর্থক। আমারের মাতা ছিলেন একজন ক্রীতদাসী, যার মালিক ছিলেন কুরাইশ গোত্রের মাখজুম বংশের এক ব্যক্তি। ওমরের আমলে আমার কুফার শাসক নিয়োজিত হন এবং খুজেস্তান জয় করেন। হিজরি ৩৭ (৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলির পক্ষ নিয়ে সিফিফনের যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমার প্রাণ হারান। আমার, মিকদাদ, আবুজর গিফারি এবং সালমান আল-ফার্সিদেরকে প্রথম শিয়া মতাবলম্বী হিসাবে ধরা হয়।
১০০ দ্রষ্টব্য : তৃতীয় অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
১০১. বেহার আল- আনোয়ার’ হচ্ছে আরবি ভাষায় রচিত ১০২ খণ্ডের হাদিসের এক বিশাল সংকলন। মুহামদ বাকের মাজলেসি ফার্সি ভাষায় আরও জনপ্রিয় গ্রন্থও রচনা করেছেন। এর মধ্যে আছে নবি এবং বারো ইমামের জীবনী। তিনি ক্ষমতায় এসে ইরানের সুন্নি, সুফি, ইহুদি এবং অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্রপন্থীদের উপর নিপীড়ন চালান। এর ফলে পারস্যের সাফাবিদ রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে হিজরি ১১৩৫ (১৭২২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আফগান সুন্নিরা এই রাজত্বের অবসান ঘটায়।
১০২. দ্রষ্টব্য ; পাদটীকা ৩।
১০৩. মুহামদ বাকের মাজলেসি লিখিত ফার্সি গ্রন্থ।
১০৪. শায়খ নাজিম উদ্দিন দায়ার (মৃত হিজরি ৬৫৪ বা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত পুস্তক। তিনি সুফিবাদের বিশিষ্ট প্রবক্তা। তাঁর লেখা মেরশাদ আল ইবাদ গ্রন্থে ওমর খৈয়ামের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, যেখানে খৈয়ামকে দার্শনিক এবং নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ভৎসনা করা হয়েছে।
অনেক কষ্ট করে এতবড় লিখা লিখেছেন। ধন্যবাদ জানাই। তবেঁ অনেক বিষয়ই ভুল তথ্য এবং অসত্য। আশা করি সংশোধন করে নেবেন। প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমার ফেসবুক আইডি - www.facebook.com/sifat.alif.1
ReplyDelete