জন্ম ও বংশ পরিচয়
হযরত লূত (আ) কুরআন মজীদে উল্লিখিত ২৫ জন মহান নবীর অন্তর্ভুক্ত এবং ৬ : ৮৩-৮৬ আয়াতে যে ১৮ জন নবীর নাম উক্ত হইয়াছে, তিনি তাঁহাদেরও অন্তর্ভুক্ত। তিনি আনু, ২১২০ খৃ. পূ. অব্দে (আম্বিয়ায়ে কুরআন, ১খ, পৃ. ৩৭৭) তাঁহার পিতৃপুরুষের জন্মভূমি ফাদ্দান আরাম-এ জন্মগ্রহণ করেন (আরাইস, পৃ. ৭৯)। তিনি হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহোদর হারান-এর পুত্র (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৪৯; আরাইস, পৃ. ১০৯; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৭৬; নাজ্জার, পৃ. ৮৩; আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬১; আদিপুস্তক, ১১ : ২৭)। তাঁহার বংশলতিকা নিম্নরূপ : লূত ইব্ন হারান ইবন আযর (তারিখ অথবা তারিহ) ইব্ন নাখুর ইবন সারূগ ইব্ন আবগু ইব্ন ফালিগ ইব্ন আবির ইবন শালিখ ইব্ন কায়নান ইবন আরফাখশায ইবন সাম ইব্ন নূহ (আ) (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৭২)। কোনও কোনও সূত্রে হারান-এর পরিবর্তে হারূন ও ফারান এবং নার-এর পরিবর্তে বাখুর উক্ত হইয়াছে (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬১; জামহারাতু আনসাবিল আরাব, নির্ঘন্ট)। হযরত লূত (আ)-এর পিতামহ এবং হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারিখ বাইবেলে তেরাহ (আদি পুস্তক, ১১ ও ৩১) এবং কুরআন মজীদে (৬ : ৭৪) আযার (131) নামে উক্ত হইয়াছে। ইবন সাদ-এর মতে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর চতুর্থ স্ত্রী হাজূনী অথবা হাজূরা-এর গর্ভজাত সপ্ত সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল লুত (তাবাকাত, ১খ, পৃ. ৪৮; আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬০)। উক্ত স্ত্রী হাজুরা (1,৯০)-কে ইবরাহীম (আ) সারার মৃত্যুর পর বিবাহ করিয়াছিলেন (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬০)। ইনি এবং নবী হযরত লূত (আ) একই ব্যক্তি বলিয়া কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাফসীরকারগণ, ঐতিহাসিকগণ, উপরন্তু বাইবেল-ভিত্তিক সাহিত্যে লুত (আ) ইবরাহীম (আ)-এর ভ্রাতুস্পুত্র বলিয়া উল্লেখ রহিয়াছে।
দৈহিক গঠন
লূত (আ)-এর গাত্রবর্ণ ছিল শুভ্র, মুখমণ্ডলের গড়ন চমৎকার, সরু নাসিকা, কর্ণদ্বয় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, হস্ত-পদের অঙ্গুলিসমূহ লম্বা এবং দাঁতগুলি ছিল উজ্জ্বল। তাঁহার হাসিতে তাহার গাম্ভীর্যপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিত। তাঁহার জাতি তাঁহাকে নানাভাবে নির্যাতন করিলেও তিনি তাহাদেরকে কষ্ট দেন নাই (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬১-৬২)। তাঁহার সরু নাসিকা ও লম্বা আঙ্গুল তাহার দীর্ঘদেহী হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। ফলে শৈশব হইতেই তিনি নিঃসন্তান পিতৃব্য হযরত ইবরাহীম (আ)-এর গৃহে লালিত-পালিত হন। তিনি ছিলেন পিতৃব্যের একান্ত স্নেহভাজন । ছাআলাবী তাঁহার নামের ব্যাখ্যায় বলেন যে, ইবরাহীম (আ) তাঁহাকে আন্তরিকভাবে স্নেহ করিতেন বিধায় তিনি যেন তাঁহার অন্তরের সহিত আঁটিয়া গিয়াছিলেন, জড়াইয়া গিয়াছিলেন। তাই তাঁহার নামকরণ করা হইয়াছে লূত। লাতা, ইয়াতু অর্থাৎ সংযুক্ত হওয়া, বিজড়িত হওয়া (আরাইস, পৃ. ১০৯; বিদায়া, ১খ, ১৪৯)। তিনি শৈশবেই পিতৃহারা হইয়াছিলেন। ইবরাহীম (আ) তাঁহার পৌত্তলিক জাতির সহিত বিশ্বাস ও আদর্শগত বিরোধের কারণে তাঁহার জন্মভূমি ফাদ্দান আরাম (আরাইস, পৃ. ৭৯) হইতে কালদীয় এলাকার ঊর নামক শহরে স্থানান্তরিত হইয়াছিলেন (আরাইস, পৃ. ৮৩)। এই শহরটি দক্ষিণ ইরাকে ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল। বর্তমান তালুল আবীদ ঊর-এর স্থানেই অবস্থিত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হইয়াছে (ই.বি., ২৩খ, পৃ. ৩৭১)। ই.বি.-তে বলা হইয়াছে যে, তিনি ঊর-এ জন্মগ্রহণ করেন (পৃ. ৩৭১)। অতঃপর তাঁহারা দুর্ভিক্ষের কারণে (ই.বি., ২৩খ, পৃ. ৩৭১) উক্ত স্থান ত্যাগ করিয়া হারান বা হাররান নামক এলাকায় স্থানান্তরিত হন। এখানে লূত (আ)-এর পিতা হারান তাহার পিতা আযার-এর জীবদ্দশায় ইনতিকাল করেন (আদিপুস্তক, ১১ : ২৮)। স্থানান্তর গমনের এই সকল সফরে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারা, পিতা তারিখ (আর), ভ্রাতা নাহূর, ভ্রাতার স্ত্রী মালিকা এবং ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ)-ও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫০; আরাইস, পৃ. ১০৯; নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩; বাইবেলের আদিপুস্তক, ১১ : ৩১-৩২)। ইবন কাছীরের বর্ণনামতে তিনি বাবিল হইতে হাররানে আসেন (১খ, পৃ. ১৫০)। উর হইতে তিনি পুনরায় স্থানান্তরিত হইয়া পবিত্র ভূমি ফিলিস্তীনে চলিয়া আসেন এবং এই সফরেও তাঁহার স্ত্রী সারা, ভ্রাতুস্পুত্র লূত এবং লুতের স্ত্রীও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন (নাজ্জার, পৃ. ৮৩)। ইবরাহীম (আ)-এর এইভাবে ঘন ঘন স্থানান্তরের কারণ এই যে, উক্ত এলাকাসমূহের জনগোষ্ঠী ও শাসকগোষ্ঠী ছিল পৌত্তলিক বা মুশরিক। তাওহীদের আকীদায় বিশ্বাসীদের সহিত তাহাদের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। সুতরাং ইবরাহীম ও লূত (আ) নির্যাতনের শিকার হইয়াই বারবার আবাসিক এলাকা পরিবর্তন করিয়াছেন। এই দেশত্যাগ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“এবং আমি তাহাকে ও লূতকে উদ্ধার করিয়া লইয়া গেলাম সেই দেশে যেথায় আমি বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রাখিয়াছি” (২১ : ৭১) ।
উবায় ইবন কাব (রা), আবুল ‘আলিয়া, কাতাদা (র) প্রমুখের মতে উক্ত আয়াতে তাহাদের সিরিয়া গমন বুঝানো হইয়াছে এবং ইবন আব্বাস (রা)-র মতে মক্কাকে বুঝানো হইয়াছে (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫০; তাফসীরে কবীর, ২২খ, পৃ. ১৯০; রূহুল মাআনী, ১৭খ, পৃ. ৭০)। রূহুল মাআনীতে মিসরের কথাও উল্লিখিত হইয়াছে, তবে সিরিয়া সম্পর্কিত মতকে সহীহ বলা হইয়াছে। তাফসীরে কাশশাফে শুধু সিরিয়ার উল্লেখ আছে (২খ, পৃ. ৫৭৮)। পৃথিবীর বুকে ইবরাহীম (আ)-ই সর্বপ্রথম হিজরত করেন এবং তাঁহার স্ত্রীও তাঁহার সঙ্গী হন । লুত (আ)-ও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। হযরত উছমান (রা) সস্ত্রীক হাবশায় হিজরত করিলে মহানবী (স) বলেন :
“লূত (আ)-এর পর উছমানই সস্ত্রীক সর্বপ্রথম মুহাজির” (নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)।
11:15
ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, লূত (আ)-এর স্ত্রীও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। অতঃপর চাচা-ভ্রাতুস্পুত্র সিরিয়ায় পৌঁছিয়া কিনআনীদের এলাকা সিক্কীম (নাবলুস)-এ বসবাস করিতে থাকেন (নাজ্জার, পৃ. ৮৪)। এই এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তাহারা মিসর গমন করেন, বিভিন্ন বিপদাপদের পর প্রচুর সম্পদসহ পুনরায় পবিত্র ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫২; আরাইস, পৃ. ১০৯; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯১)। প্রত্যাবর্তনের পথে লুত (আ) পিতৃব্যের সম্মতিক্রমে সাদূমে বসতি স্থাপন করেন এবং এই ভ্রমণের এক পর্যায়ে নুবুওয়াত লাভ করেন (নাজ্জার, পৃ. ৯০-৯১; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯১; আরাইস, পৃ. ১০৯; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫২, ১৭৬; আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬২)। বাইবেলে বলা হইয়াছে : “আর ইবরাহীমের সহযাত্রী নূতেরও অনেক মেষ ও গো এবং তাম্বু ছিল। আর সেই দেশে একত্র বাস সম্পোষ্য হইল না, কেননা তাহাদের প্রচুর সম্পত্তি থাকাতে তাঁহারা একত্র বাস করিতে পারিলেন না। আর ইবরাহীমের পশুপালকদের ও নূতের পশুপালকদের পরস্পর বিবাদ হইল। … তাহাতে ইবরাহীম লূতকে কহিলেন, বিনয় করি, তোমাতে ও আমাতে এবং তোমার পশুপালকগণে ও আমার পশুপালকগণে বিবাদ না হউক। কেননা আমরা পরস্পর জ্ঞাতি। তোমার সম্মুখে কি সমস্ত দেশ নাই? বিনয় করি, আমা হইতে পৃথক হও, হয় তুমি বামে যাও, আমি দক্ষিণে যাই, নয় তুমি দক্ষিণে যাও আমি বামে যাই” (আদিপুস্তক, ১৩ : ৫-৯)।
এখানে দুইজনের পৃথক হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট। (১) তাঁহাদের উভয়ের সহায়-সম্পত্তি ও গবাদিপশুর প্রাচুর্যের কারণে স্থান সংকুলান হইতেছিল না। (২) তাহাদের দুইজনের পশুপালকদের মধ্যে বিবাদ হইয়াছিল এবং পশুপালকদের মধ্যে বিবাদ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক । যাহাতে সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে স্থান সংকুলান হয় এবং যাহাতে তাহাদের পশুচারকদের মধ্যে বিবাদ বাধিতে না পারে সেই লক্ষ্যে তাঁহারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে পৃথক হইয়াছিলেন। কোন কোন ইসলামী সূত্রে বলা হইয়াছে যে, দুই মহান নবীর পশু সম্পদে অত্যধিক বরকত হওয়ায় তাঁহারা স্থান সংকুলানের জন্য পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে দুই ভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ সম্পত্তি স্থানান্তরিত করেন (নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৯-৯০)। লুত (আ) স্থানান্তরিত হওয়ার পর এক পর্যায়ে এলমের কদলায়মূর শাহ তাহার অপর তিনজন যুক্তরাষ্ট্রীয় শাহগণকে সঙ্গে লই সাদূম ও ইহার চার যুক্তরাষ্ট্রীয় বাদশাহগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া জয়যুক্ত হইল এবং অন্যান্য লুণ্ঠিত সম্পদের সহিত হযরত লূত (আ)-কে তাঁহার সম্পদসহ বন্দী করিয়া লইয়া গেল । হযরত ইবরাহীম (আ) এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং জয়যুক্ত হইয়া লূত (আ)-কে মুক্ত করেন ও অনেক গানীমাত লাভ করেন (আদিপুস্তক, ১৪ ও ১-১৬; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫২-৫৩)।
কুরআন ও হাদীছে হযরত লূত (আ)
কুরআন মজীদের মোট ১৭টি সূরায় সাতাশবার নামোল্লেখসহ হযরত লূত (আ) ও তাঁহার কাওম সম্পর্কে আলোচনা বিদ্যমান : ৬ : ৮৬; ৭ ও ৮০-৮৪; ১১ ও ৬৯-৮৩; ১৫ : ৫১-৭৭; ২১ : ৫১-৭৫; ২২ : ৪২-৪৩; ২৫ ও ৪০; ২৬ ও ১৬০-১৭৫; ২৭ : ৫৪-৫৮; ২৯ : ২৬-৩৫; ৩৭ ও ১৩৩-১৩৮; ৩৮ ও ১৩; ৫০ ও ১৩; ৫১ : ২৪-৩৭; ৫৩ : ৫৩-৫৪; ৫৪ : ৩৩-৩৮ এবং ৬৬ : ১০।
সূরা আল-আনআম (৬)-এ ৮৩-৮৬ আয়াতে মোট আঠারজন নবীর নামোল্লেখ করা হইয়াছে, এই ৮৬ নং আয়াতে তিনজন নবীর নাম সহীহ আল-বুখারীর কিতাবুত তাফসীরে, বাব? “উলাইকাল্লাযীনা হাদাল্লাহু ফাবিহুদাহুম ইকতাদিহ্” (৬ ও ৯০) অনুচ্ছেদেও উক্ত হইয়াছে। সূরা আম্বিয়া (২১)-র ৭১ নং আয়াতে ইবরাহীম (আ)-এর সহিত তাঁহার বরকতময় ভূমিতে হিজরতের কথা ব্যক্ত হইয়াছে। সূরা হজ্জের ৪২-৪৮ আয়াতে কয়েকজন নবীর উম্মতের করুণ পরিণতির উল্লেখপূর্বক মহানবী (স)-কে সান্ত্বনা দিয়া বলা হইয়াছে যে, তাঁহার জাতি তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিলে তাহাদেরও অনুরূপ পরিণতি হইবে। এই প্রসঙ্গে কওমে লুতেরও উল্লেখ করা হইয়াছে। সূরা ‘আনকাবূতের ২৬ নং আয়াতে ইবরাহীম (আ)-এর উপর তাঁহার ঈমান আনার কথা ব্যক্ত হইয়াছে। ৩৮ : ১৩ এবং ৫০ ও ১৩ আয়াতে লূত (আ)-কে তাঁহার জাতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করার কথা উক্ত হইয়াছে। ৬৬ : ১০ আয়াতে লূত (আ)-এর স্ত্রীর কুফরী এবং পরিণামে তাহার জাহান্নামী হওয়ার কথা বলা ইয়াছে। ৫৩ ও ৫৩ আয়াতে “আল-মুতাফিকাহ” (উল্টানো আবাসভূমি) দ্বারা দূত (আ)-এর সম্প্রদায়কে বুঝানো হইয়াছে (তাফসীরে ইবন আব্বাস, পৃ. ৪৪৮; তাফসীরে তাবারী, ২৭ খ, পৃ. ৪৭; তাফসীরে কুরতুবী, ২৭খ, পৃ. ১২০; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৭০১, টীকা ৬; তাফহীমুল কুরআন, উক্ত সূরার টীকা ৪৬; মাআরেফুল কোরআন, সংক্ষিপ্ত সং, পৃ. ১৩১১) এবং পরবর্তী (৫৪) আয়াতে তাহাদের সর্বগ্রাসী শাস্তিতে আচ্ছন্ন হওয়ার কথা বলা হইয়াছে। অবশিষ্ট সূরাসমূহে লূত (আ)-এর দাওয়াত, তাঁহার জাতি কর্তৃক তাহা প্রত্যাখ্যান, তাঁহার জাতির অপকর্ম এবং পরিণতিতে তাহাদের করুণভাবে ধ্বংস হওয়ার বিষয় উক্ত হইয়াছে (যাহা নিবন্ধের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে উল্লেখ করা হইবে)।
সহীহ বুখারীতে হযরত লূত (আ) সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ বিদ্যমান ও
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) বলেন : “আল্লাহ লুত (আ)-কে ক্ষমা করুন। তিনি একটি মজবুত খুঁটির আশ্রয় লইতে চাহিয়াছিলেন” (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, বাব : লাকাদ কানা ফী ইয়ুসুফা…, ভারতীয় সং, ১খ, পৃ. ৪৭৯; ২খ, পৃ. ৬৭৯, তাফসীর সূরা ইয়ুসুফ : লাকাদ কানা ফী ইয়ুসুফা…)।
সুনান ইবন মাজায় হাদীছটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত :
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন : ইবরাহীম (আ)-এর তুলনায় আমরাই সন্দেহ পোষণের অধিক উপযুক্ত, যখন তিনি বলিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর (তাহা) আমাকে দেখাও। তিনি বলিলেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না? সে বলিল, কেন করিব না, তবে ইহা কেবল আমার অন্তরের প্রশান্তির জন্য” (২ : ২৬০)। আল্লাহ লূত (আ)-কে অনুগ্রহ করুন । তিনি এক শক্তিশালী স্তম্ভের আশ্রয় চাহিয়াছিলেন। আমি ইয়ুসুফ (আ)-এর মত তত কাল জেলখানায় বন্দী থাকিলে অবশ্যই আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতাম” (কিতাবুল ফিতান, বাবুস সাবুর আলাল বালা, দেওবন্দ সং, পৃ. ২৯১; বৈরূত সং, ২খ, পৃ. ১৩৩৫-৬, নং ৪০২৬)।
ইমাম ইবন কাছীর (র) তাহার ইতিহাস গ্রন্থে (১খ, পৃ. ১৮০) একটি হাদীছ উদ্ধৃত করিয়াছেন যাহা হইতে ‘শক্তিশালী স্তম্ভ” (রুকন শাদীদ)-এর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়?
“লূত (আ)-এর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। তিনি একটি সুদৃঢ় স্তম্ভের অর্থাৎ মহামহিম আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করিয়াছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁহার পর হইতে যে কোনও জাতির নিকট তাহাদের মধ্যকার প্রভাবশালী বংশ হইতেই নবী পাঠাইয়াছে”। হাদীছটি আল-মুসতাদরাক গ্রন্থেও সামান্য শাব্দিক পার্থক্যসহ উক্ত হইয়াছে (২খ, পৃ. ৫৬১)।
দাওয়াত ও তাবলীগের বিবরণ
হযরত লূত (আ) পিতৃব্য হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত বর্তমান ইরাকের বাবিল অর্থাৎ মেসোপটামিয়ার ঊর নামক স্থান হইতে বসতি ত্যাগ করিয়া কিছুকাল যাবত সিরিয়া, ফিলিস্তীন ও মিসর পরিভ্রমণ করিয়া দীনের প্রচারকার্যে অংশগ্রহণ করিতে থাকেন। এইভাবে তিনি নুবুওয়াত লাভের পূর্ব হইতেই দীনের প্রচারকার্যে ব্যাপৃত হন। তিনিই সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উপর ঈমান আনেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৭৬; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৪৯)। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে : ৬, “লূত তাহার প্রতি ঈমান আনিল” (২৯ ও ২৬)। নমরূদের অগ্নিকুণ্ড হইতে ইবরাহীম (আ) মুক্তিলাভ করার পরপরই তিনি তাঁহার প্রতি প্রথম ঈমান আনেন। তিনি হিজরতেও ইবরাহীম (আ)-এর সঙ্গী ছিলেন। উপরিউক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হইয়াছেঃ
“এবং ইবরাহীম বলিল, আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশে দেশত্যাগ করিতেছি। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (২৯ ও ২৬)।
উক্ত আয়াতে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর হিজরতের কথা বলা হইলেও তাঁহার সহিত লূত (আ)-ও ছিলেন। এখানে মুখ্য ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হইয়াছে মাত্র। মতান্তরে ২৯ ও ২৬ আয়াতের বক্তব্য হযরত লূত (আ)-এর (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬২; নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। কিন্তু এই মত প্রসঙ্গের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে (মাআরেফুল কোরআন, সৌদী সংস্করণ, পৃ. ১২২৭; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৫৩১, টীকা ৯)। এখানে আরও একটি জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উপর ঈমান আনার পূর্বে লূত (আ)-এর ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল? তাঁহার জাতি ছিল মুশরিক। কুরআন মজীদের যত জায়গায় তাহার সম্পর্কে আলোচনা আছে, উহার কোথায়ও বলা হয় নাই যে, তিনিও তাহার জাতির মত বিভ্রান্ত ছিলেন। তিনি শিশুকাল হইতে পিতৃব্য হযরত ইবরাহীম (আ)-এর তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হওয়ায় তাঁহার চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এই কথা বলা যায়। আল্লাহ তাআলা যাহাদেরকে নুবুওয়াত ও রিসালাতের পদে অভিষিক্ত করিয়াছেন তাহাদের জন্মাবধি তাঁহাদেরকে পৌত্তলিকতা (শিক)-সহ সকল প্রকারের পঙ্কিলতা হইতে মুক্ত ও পবিত্র রাখিয়াছেন। অতএব হযরত লূত (আ)-ও যাবতীয় পঙ্কিলতা হইতে মুক্ত ছিলেন। কয়েকজন নবীর নামোল্লেখের পর মহান আল্লাহ বলেন :
“তাহারা যদি শিক করিত তাহা হইলে তাহাদের কৃতকর্ম নিষ্ফল হইয়া যাইত” (৬ : ৮৮)। অনন্তর ২১ : ৭১ আয়াতে বলা হইয়াছে :
“এবং আমি তাহাকে ও লূতকে উদ্ধার করিয়া সেই দেশে লইয়া গেলাম যেথায় আমি বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রাখিয়াছি”।
উক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হইয়াছে যে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর সহিত লূত (আ)-কেও নিমরূদের (প্রচলিত নমরূদ) অত্যাচার হইতে উদ্ধার করিয়াছেন এবং তাঁহার সঙ্গে তাহাকেও বরকতময় ভূমিতে স্থানান্তরিত করিয়াছেন। অতএব আয়াতদ্বয়ের প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, তিনি সর্বাবস্থায় নিষ্পাপ ছিলেন।
হযরত লূত (আ) কখন নুবুওয়াতপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলা সম্ভব নহে। হাকেম নীশাপুরীর মতে তিনি মিসর হইতে সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তনকালে নুবুওয়াত লাভ করেন। ৬ : ৮৪-৮৬ আয়াতে উক্ত ১৮জন নবীর তালিকায় তিনিও অন্তর্ভুক্ত। ৬-৮৬ আয়াতের শেষাংশঃ
“ইসমাঈল, আল-ইয়াসাআ, ইউনুস ও লুত”।
নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ে তাঁহাকে পরিষ্কার ভাষায় “রাসূল” বলা হইয়াছে :
“নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল” (২৬ : ১৬২)।
“নিশ্চয় লূতও ছিল রাসূলগণের একজন” (৩৭ : ১৩৩)।
ইহা ব্যতীত অন্যান্য সূরাসমূহে তাঁহার সহিত সংশ্লিষ্ট আলোচনা হইতেও তাঁহার নুবুওয়াত লাভের প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সাদূমবাসীর হেদায়াতের জন্য তাহাদের নবীরূপে তথায় প্রেরণ করেন। হাকেম-এর বর্ণনায় সাদূম ছাড়াও আমূদ, আরাম, মাউর ও সার এই চারটি শহরের কথা উল্লেখ রহিয়াছে। কুরআন মজীদে তাহাদেরকে “লূত সম্প্রদায় (৬ ) নামে অভিহিত করা হইয়াছে।
লুত (আ) তাহাদেরকে সৎপথে আনয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তিনি তাহাদেরকে লা শারীক আল্লাহর আনুগত্য এবং পাপাচার ত্যাগ করিবার আহ্বান জানান, তাহাদের কুকর্মের সমালোচনা করেন।
“যখন উহাদের ভ্রাতা লূত উহাদেরকে বলিল, তোমরা কি সাবধান হইবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি ইহার জন্য তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে” (২৬ : ১৬১-১৬৪)।
অর্থাৎ তিনি তাঁহার জাতিকে স্পষ্টভাবে বুঝাইয়া দেন যে, তিনি তাহাদের নিকট আল্লাহর বাণী পৌঁছাইয়া দিতেছেন এবং তাহাদের কুকর্মের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করিতেছেন, যাহাতে তাহারা আল্লাহকে ভয় করে এবং সৎপথ অবলম্বন করে। তিনি আরও বলিলেন যে, এই ‘ওয়াজ-নসীহত ও আল্লাহর দীন গ্রহণের আহ্বানের পশ্চাতে তাহার কোন পার্থিব স্বার্থ নাই, সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনও উদ্দেশ্য নহে, তাহাদের নিকটও তিনি কোনরূপ পার্থিব স্বার্থ দাবি করেন না, আশাও করেন না। তাঁহার পুরস্কার তো তিনি আল্লাহর নিকটই আশা করেন । তাহার উপর আল্লাহ তাআলা তাঁহার বাণী তাহাদের নিকট পৌঁছাইবার যে দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন, তিনি সেই দায়িত্বই পালন করিতেছেন। এইরূপ নিঃস্বার্থ লোক সম্পর্কে তাহাদের বুঝা উচিত যে, তিনি কখনো মিথ্যা বলিতে পারেন না, তিনি যাহা বলেন, বিশ্বস্ততার সহিতই বলেন (আম্বিয়ায়ে কুরআন, পৃ. ২৩৬-৭)।
কিন্তু তাহারা তাঁহার দাওয়াতে সাড়া দিল না এবং (স্ত্রী ব্যতীত) পরিবারের সদস্যরা ছাড়া একটি লোকও তাহার প্রতি ঈমান আনিল না, পাপাচার হইতে নিবৃত্ত হয় নাই, বরং উদ্ধত মস্তকে আরো বেপরোয়া হইয়া কদর্যতায় লিপ্ত হইল। তাহাদের নিকট প্রশংসনীয় কাজ দুর্নামের বিষয় এবং দুষ্কর্ম প্রশংসনীয় বিষয় হইয়া দাঁড়াইল। তাহারা আল্লাহর নবীকে অমান্য তো করিলই, তাঁহাকে দেশ হইতে উৎখাতের হুমকি দিল এবং তিনি সত্যবাদী হইয়া থাকিলে তাহাদের উপর প্রতিশ্রুত শাস্তি আনয়নের আহ্বান জানাইল (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৭৮)।
“নূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে অস্বীকার করিল” (২৫ ও ১৬০)।
উহারা বলিল, হে লূত! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হইবে” (২৬ : ১৬৭)।
“তোমরা ইহাদেরকে তোমাদের জনপদ হইতে উচ্ছেদ কর, ইহারা তো এমন লোক যাহারা অতি পবিত্র হইতে চাহে” (৭ : ৮২)।
লূত (আ)-ও তাঁহার মুষ্টিমেয় অনুসারী “পবিত্র হইতে চাহে” বাক্যাংশের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণ বলিয়াছেন যে, তাহারা সমকামিতা হইতে পবিত্র থাকিতেন (তাফসীরে ইবন ‘আব্বাস, পৃ. ১৩২; তাফসীরে তাবারী, ১২খ, পৃ. ৫৫০, ৪০ খণ্ডের বৃহৎ সং; তাফসীরে ইবন কাছীর, বাংলা অনু., ৪খ, পৃ. ২৬৩)। কাতাদা (র) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত কথা দ্বারা তাহারা ব্যঙ্গচ্ছলে নির্দোষীকে দোষী সাব্যস্ত করিল (ইবনে কাছীর, পূ. স্থা.)। অর্থাৎ জঘন্য পাপাচারের সমালোচনা ও তাহা পরিহার করা তাহাদের নিকট দোষের বিষয় হইয়া দাঁড়াইল।
ইহা হইতে জানা যায় যে, লূত-সম্প্রদায় কেবল নির্লজ্জ, নৈতিকতাবর্জিত ও চরিত্রহীনই ছিল না, বরং নৈতিক অধঃপতনে তাহারা এতদূর নিম্নস্তরে নামিয়া গিয়াছিল যে, তাহারা নিজেদের মধ্যে কয়েকজন নেক চরিত্রের লোক, কল্যাণের দিকে আহ্বানকারী এবং অন্যায় ও পাপাচারের সমালোচনাকারী লোকের অস্তিত্বকে পর্যন্ত বরদাশত করিতে প্রস্তুত ছিল না। তাহারা পাপে এতদূর মগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল যে, সংশোধনের কোন প্রচেষ্টাকেই তাহারা সহ্য করিত পারিত না।
“সে (ত) উহাদেরকে আমার কঠোর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছিল । কিন্তু উহারা সতর্ককারী সম্বন্ধে বিতর্ক করিল” (৫৪ ও ৩৬)।
“সে (ত) বলিল, আমি তোমাদের এই কর্মকে ঘৃণা করি” (২৬ : ১৬৮)।
তাহারা বলিল, “আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন কর যদি তুমি সত্যবাদী হও” (২৯ ও ২৯)।
হযরত লূত (আ) বুঝিতে পারিলেন যে, তাহাদের উপর আল্লাহর গযব আপতিত হইবেই। কারণ তাহারা সৎপথের প্রদর্শক আল্লাহর নবীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহাদের চিন্তা-চেতনা এতই বিকৃত হইয়াছে যে, আল্লাহর ভয়ের সামান্য চিহ্নও তাহাদের অন্তরে অবশিষ্ট নাই, তাহার শাস্তির সতর্কবাণীকে উপহাস করিতেছে। লূত (আ) তখন আল্লাহর দরবারে তাহাদের নির্যাতন হইতে আত্মরক্ষার জন্য দুআ করিলেন ।
“হে আমার প্রতিপালক! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন” (২৯ ও ৩০)।
তিনি তাঁহার নিজের ও পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার জন্যও আল্লাহর নিকট দুআ করিলেন, তাহাদের ঈমানের হেফাজতের দুআ করিলেন, যাহাতে তাহারাও তাঁহার জাতির গর্হিত কর্মে লিপ্ত হইয়া মন্দ পরিণতির শিকার না হয় :
“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে, উহারা যাহা করে, তাহা হইতে রক্ষা করুন” (২৬ : ১৬৯)।
মহান আল্লাহ তাঁহার রাসূলের দুআ কবুল করিলেন এবং মুমিনদের হেফাজতের ব্যবস্থা করিলেন, কাফেরদের ধ্বংসের জন্য হযরত জিবরাঈল (আ)-এর নেতৃত্বে মীকাঈল ও ইসরাফীল (আ)-কে প্রেরণ করিলেন এবং সাদূমবাসী দ্রুত অশুভ পরিণতির দিকে অগ্রসর হইল (অবশিষ্ট বিবরণ “লূত জাতির পাপাচার” অনুচ্ছেদে সন্নিবিষ্ট করা হইয়াছে-নিন্ধকার)।
বৈবাহিক জীবন
আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর সঙ্গে দেশান্তর গমনে লূত (আ)-এর সহিত লূত-পত্নীও ছিল (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। তবে অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে এই সময় তাঁহার সহিত লূত-পত্নী ছিল না, তবে তিনি তখন বিবাহিত ছিলেন কি না তাহা স্পষ্ট নহে। কুরআন মজীদে লূত (আ), ভঁহার জাতি ও তাহার স্ত্রীর সহিত সংশ্লিষ্ট বর্ণনা হইতে অনুমিত হয় যে, তিনি সাদূমে পৌঁছিয়া তথাকার এক নারীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। তাহার বংশপরিচয় সম্পর্কে ইসলামী উৎস ও বাইবেল নীরব। তাহাদের সহিত তাঁহার বৈবাহিক সম্পর্ক থাকার কারণে হয়তো এই জাতিকে কওমে লূত বলা হইয়াছে। লূত (আ)-এর স্ত্রী যদি দেশত্যাগের দীর্ঘ সফরে তাঁহাদের সহিত থাকিত, তবে মিসরে ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারার বেলায় যাহা ঘটিয়াছিল, তাহার বেলায়ও অনুরূপ না ঘটিবার কোন কারণ ছিল না। অতএব এই ঘটনা হইতে অনুমিত হয় যে, লূত (আ) তখন বিবাহিত ছিলেন না। তবে নাজ্জারের কাসাস গ্রন্থে যে হাদীছ উক্ত হইয়াছে (পৃ. ৮৪) তাহা তাঁহার বিবাহিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
লূত (আ) বৈবাহিক জীবনে সুখী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। কারণ তাঁহার স্ত্রী তাঁহার উপর ঈমান আনে নাই; সে তাহার জ্ঞাতি সাদূমদের মত মুশরিক ছিল। লুত (আ)-এর বাড়িতে সুদর্শন যুবকের বেশে ফেরেশতাগণ আগমন করিলে তাহার স্ত্রীই তাহার লম্পট জাতিকে সেই খবর জানাইয়া দিয়াছিল। তাই তাঁহার স্ত্রীও সাদূমবাসীদের উপর পতিত গযবে ধ্বংস হয় (তাফসীরে তাবারী, ১২ খ, পৃ. ৫৫)। তাহার অবাধ্যচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও উহার পরিণতি সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“আল্লাহ কাফেরদের জন্য নূহের স্ত্রী ও নূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিতেছেন। উহারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সঙ্কর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু উহারা তাহাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল। ফলে নূহ ও লূত উহাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হইতে রক্ষা করিতে পারিল না। আর উহাদেরকে বলা হইল, তোমরা উভয়ে প্রবেশকারীদের সহিত দোযখে প্রবেশ কর” (৬৬ : ১০)।
ইব্ন কাছীর (র) লূত (আ)-এর স্ত্রীর নাম ওয়ালিহা এবং ছালাবী ওয়াইলা উল্লেখ করিয়াছেন (দ্র. বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮১; আরাইস, পৃ. ১১৩; সংক্ষিপ্ত ই.বি.-তে হালকা উক্ত হইয়াছে, ১ম সং, ২খ, পৃ. ৪০৭)। উপরিউক্ত আয়াতে “উহারা তাহাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল” কথার তাৎপর্য এই যে, তাহারা উভয়ে দুজন মহান নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁহাদের দীন গ্রহণ করে নাই, বরং কুফরের উপর থাকিয়া তাঁহাদের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল । বিশ্বাসঘাতকতা অর্থ এই নহে যে, তাহারা ব্যভিচারে লিপ্ত হইয়াছিল। কখনও নহে। কারণ আল্লাহ
তাআলা কোন নবীর স্ত্রীর সহিত ব্যভিচার করিবার ক্ষমতা রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। যেমন ইব্ন আব্বাস (রা)-সহ পূর্বকালের ও পরবর্তী কালের মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ বলেন, কোনও নবীর স্ত্রী কখনও ব্যভিচারে লিপ্ত হয় নাই (তাফসীর ইবন আব্বাস, পৃ. ৪৭৮; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮২)। উপমহাদেশীয় আলমগণের তাফসীর গ্রন্থাবলীতেও ইবন আব্বাস (রা)-র মত গৃহীত হইয়াছে। ইবন আব্বাস (রা) আরও বলেন, দুই নবীর স্ত্রীদ্বয় প্রকাশ্যে ঈমান আনিয়াছিল, কিন্তু বাস্তবে ছিল মুনাফিক (পূ. স্থা.) ।
ইসলামী উৎসসমূহে হযরত লূত (আ)-এর তিন কন্যা, মতান্তরে দুই কন্যা সন্তানের উল্লেখ পাওয়া যায়, জ্যেষ্ঠার নাম রীছা এবং কনিষ্ঠার নাম রাবিয়া (সংক্ষিপ্ত ই.বি., ১ম সং, ২খ, পৃ. ৪০৭), মতান্তরে যাওয়ারাআ ও যীতাআ (কুরতুবী, ৯খ, পৃ. ৭৬; রূহুল মাআনী, ১২খ, পৃ. ১০৬; তাবারীতে জ্যেষ্ঠার নাম রীছা)। তাঁহারাও পিতার দীনের অনুসারী নেককার মহিলা ছিলেন এবং পিতার সহিত আল্লাহর গযবের স্থান ত্যাগ করিয়া নিরাপদ স্থানে চলিয়া যান। তাঁহাদের একজন ছিলেন হযরত শুআয়ব (আ)-এর পিতামহী এবং অপরজন ছিলেন হযরত আয়ূব (আ)-এর মাতা (ইবন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৪১-৪২-এর বরাতে ই.বি., ২৩খ, পৃ. ৩৭৪)। বাইবেলে বলা হইয়াছে যে, হযরত লূত (আ)-এর সহিত সাদূম ত্যাগকারিনী তাহার দুই কন্যা ছিলেন অবিবাহিতা (আদিপুস্তক, ১৯ : ৮)। বাইবেলে আরো উক্ত হইয়াছে যে, মহান আল্লাহ হযরত লূত (আ)-কে নির্দেশ দিলেন, “তোমার জামাতা ও পুত্র-কন্যা যতজনই এই নগরে আছে, সে সকলকে এই স্থান হইতে লইয়া যাও” (আদিপুস্তক, ১৯ ও ১২)। “তখন লূত বাহিরে গিয়া, যাহারা তাঁহার কন্যাদিগকে বিবাহ করিয়াছিল, আপনার সেই জামাতাদিগকে কহিলেন, উঠ, এ স্থান হইতে বাহির হও, কেননা সদাপ্রভু এই নগর উচ্ছন্ন করিবেন” (আদিপুস্তক, ১৯ : ১৪)। এইসব উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ঐ দুই কন্যা ছাড়াও হযরত লূত (আ)-এর আরো পুত্র-কন্যা ছিল। “যাহারা তাহার কন্যাদিগকে বিবাহ করিয়াছিল, আপনার সেই জামাতাদিগকে…” বাক্যাংশ হইতে প্রতিভাত হয় যে, উক্ত দুই কন্যা ছাড়াও তাঁহার আরও কয়েকজন কন্যা সন্তান ছিল। কিন্তু বাইবেলে ও ইসলামী উৎসে ইহাদের সম্পর্কে কোন বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। অবশ্য কুরআন মজীদ হইতে ইহার একটি দূরবর্তী সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন বলা হইয়াছে, “আমি লূত ও তাহার পরিবারের সকলকে (আজমাঈন) উদ্ধার করিয়াছিলাম” (৩৭ : ১৩৪)। “সেথায় যেসব মুমিন (আল-মুমিনীন) ছিল আমি তাহাদের উদ্ধার করিয়াছিলাম” (৫১ : ৩৫)। এখানে যেসব মুমিন” বলিতে লূত পরিবারের সদস্যগণকেই বুঝানো হইয়াছে। কারণ অন্যত্র বলা হইয়াছে যে, ঐ জনপদে একটি পরিবার ব্যতীত আর কোন মুসলমান পরিবার ছিল না (দ্র. ৫১ : ৩৬)। লূত (আ)-এর পারিবারিক জীবন ও তাঁহার সন্তান-সন্তুতি সম্পর্কে ইহার অধিক কিছু জানা যায় না।
তাঁহার দুই কন্যার দুই পুত্রসন্তানই ফিলিস্তীনের দুইটি প্রভাবশালী সম্প্রদায়-মুআর ও আম্মুন-এর আদিপিতা এবং সেই সূত্রে হযরত লূত (আ) তাহাদের সকলের আদিপিতা (Ency. Brit., 1962, vol. 14, p. 401; Americana, vol. 17, p. 758; Colliers Ency., vol. 15, p. 20)। মৃত সাগর (লূত সাগর)-এর পূর্বদিকে ট্রান্স-জর্দানের মালভূমি অঞ্চল মুআবদের বসতি এলাকা। ইহার। দক্ষিণ সীমা River zered (বর্তমান ওয়াদী আল-হাসা), উত্তর সীমা সুনির্দিষ্ট নহে (Ency. Religion, vol. 10, p.1)। জর্দান ও মৃত সাগরের পূর্বে, ইদোম (Esau)-এর উত্তরে এবং আম্মুন (বর্তমান আম্মান)-এর দক্ষিণে মুআবদের বসতি (Ency. Brit., vol. 15, p. 626)। ইহারা যাযাবর জীবন যাপন করিত (পূ. এ., ১খ, পৃ. ৮১৯)।
আম্মুন জনগোষ্ঠীর বসতি ট্রান্স-জর্দান এলাকা, ইহা ইসরাঈলের সহিত লাগোয়া বলিয়া মনে করা হয়, বরং মোয়াব এলাকারই অধিক নিকটতর। মোয়াবের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে ইহাদের বসতি ছিল এবং তাহাদের প্রধান নগরী রাব্বাছ আম্মুন (বর্তমান আম্মান) জাব্বাক নদীর শাখা-নদীর তীরে অবস্থিত। তাহারাও যাযাবর জীবন যাপন করিত (Ency. Brit., vol. 1, p. 819)। কন্যাদ্বয়ের সন্তানের বংশধর হওয়ার সুবাদে হযরত লূত (আ) তাহাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষ (পূ. এ., vol. 14, p. 401)।
কওমে লূত-এর পরিচয়
লূত (আ)-এর সম্প্রদায় নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় তাঁহার স্বগোত্রীয় ছিল না, বরং যে জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাঁহাকে নবীরূপে প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহাদেরকে লূত সম্প্রদায় (১১ : ৭০, ৭৪; ২২ ও ৪৩; ২৬ : ১৬০; ৩৮ ও ১৩ এবং ৫৪ ও ৩৩), নূতের ভ্রাতৃবৃন্দ (৫০ ও ১৩); তাঁহার জাতি (৬ : ৮০; ৭ : ৮০; ১১৪৭৮; ২৭ : ৫৪, ৫৬ এবং ২৯ ও ২৮, ২৯) এবং তাহাদের ভ্রাতা (২৬ : ১৬১) বলিয়া কুরআন মজীদে সম্বোধন করা হইয়াছে। একটি আয়াতে এই সম্প্রদায়কে আল-মুতাফিকা (উল্টানো জনপদবাসী, ৫৩ ও ৫৩) বলা হইয়াছে তাহাদেরকে প্রদত্ত শাস্তির প্রকৃতি অনুযায়ী । এই জাতির আবাস ছিল সাদূম, ‘আমূদ, আরূম, সাউর ও সাকূর। এইগুলির মধ্যে সাদূমই ছিল তাহাদের সর্ববৃহৎ শহর। আল্লাহর গযবে ধ্বংসের সময় এসব শহরের মোট জনবসতি ছিল আনুমানিক চল্লিশ লক্ষ (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬২; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮২; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৩)। আল-কামিলে পাঁচটি শহরের নাম নিম্নরূপ : সাদূম, সাআ, আমুরা, দূমা ও সাউত (পূ. স্থা.)। আল-বিদায়া গ্রন্থে তাহাদের জনবসতির সংখ্যা সাতটি বলা হইয়াছে (পূ. স্থা.)। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে বর্তমান মৃত সাগর তাহাদের ধ্বংসাবশেষে সৃষ্ট। তৎপূর্বে এখানে কোন সমুদ্র ছিল না, তাই ইহার অপর নাম মৃতসাগর (নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১৩)। এই জাতি ছিল চরম উচ্ছল এবং পাপাচারী, যাহার কারণে তাহাদেরকে সমূলে ধ্বংস করা হইয়াছে (বিস্তারিত দ্র. লূত জাতির পাপাচার অনুচ্ছেদে)। সংক্ষিপ্ত ই.বি.-তে এলাকাগুলির নাম উল্লিখিত হইয়াছে সাদূম, আমোরা, আদমাহ, সেবাইম ও সোআির-রূপে। ছালাবীর মতে সোআর নগরী ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পায়। কারণ উহার অধিবাসিগণ হযরত লূত (আ)-এর প্রতি ঈমান আনিয়াছিল (১ম সং, ২খ, পৃ. ৪০৭)। বাইবেলের মতে হযরত লূত (আ) তাঁহার পরিবারবর্গসহ প্রথমে এই শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন (আদিপুস্তক, ১৯ ও ২০-২২)। ওয়াকিদী জনবসতিগুলি নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করিয়াছেন : সাদূম, আমূরা, আদমূতা, সাউরা ও সাকূরা (মুরূজ, ১খ, পৃ. ৫৭)।
লূত সম্প্রদায়ের পাপাচার ও তাহাদের মর্মান্তিক পরিণতি
এই সম্প্রদায় ছিল জঘন্য পাপাচারী। কুরআন মজীদে তাহাদের অন্যান্য পাপাচারের মধ্যে সর্বাধিক জঘন্য পাপকর্ম উল্লিখিত হইয়াছে তাহাদের সমকামিতা (লাওয়াতাত)। আল্লামা ইব্ন কাছীর (র) বলেন, তাহারা এমন একটি নিকৃষ্ট পাপকর্মের প্রচলন করে যাহা ইতোপূর্বে কোন আদম-সন্তান অথবা অন্য কোন জীব করে নাই। তাহা হইল নারীদের ত্যাগ করিয়া পুরুষে-পুরুষে তাহাদের কামতৃপ্তি লাভ করা। সাদূমবাসীদের পূর্বে কোন মানব সন্তানের তাহাতে লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, সে ইহার চিন্তাও করে নাই। দামিশক জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা উমায়্যা খলীফা ওয়ালীদ ইবন আবদুল মালিক বলেন, আল্লাহ তাআলা যদি আমাদেরকে লূত জাতির এই কুকর্মের কথা অবহিত না করিতেন তাহা হইলে আমরা চিন্তাও করিতে পারিতাম না যে, যৌন সম্ভোগের জন্য নারী ছাড়া পুরুষকেও ব্যবহার করা যায় (তাফসীরে ইবন কাছীর, ২খ, পৃ. ৩৪)। কুরআন মজীদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকবার তাহাদের নৈতিক অবক্ষয় ও লূত (আ)-এর উপদেশ সম্পর্কে আলোচনা আসিয়াছে। ১১ : ৭৮ আয়াতে বলা হইয়াছে যে, তাহারা নানারকম পাপাচারে লিপ্ত থাকিত। ১৫ : ৫৮ আয়াতে তাহাদেরকে অপরাধী সম্প্রদায়, ২১ : ৭৪ আয়াতে অশ্লীল কার্যকলাপে লিপ্ত সম্প্রদায়, ২২ ও ৪৩ আয়াতে রাসূলগণকে প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায়, ২৬ : ১৬০ আয়াতে রাসূলগণকে প্রত্যাখ্যানকারী ও সমকামিতায় লিপ্ত সম্প্রদায়, ২৭ : ৫৪-৫৫ আয়াতে অশ্লীল কর্মে ও সমকামিতায় লিপ্ত সম্প্রদায়, ২৯ ও ২৮-২৯ আয়াতে অশ্লীল কর্মে, সমকামিতায়, রাহাজানিতে ও প্রকাশ্য মজলিসে ঘৃণ্যকর্মে লিপ্ত সম্প্রদায় এবং ৩৮ : ১২-১৪ ও ২৯ :৩১ আয়াতে যালেম সম্প্রদায় এবং ৫০ : ১২-১৪ ও ৫৪ :৩৩ আয়াতে রাসূলগণকে প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায় হিসাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। উল্লিখিত আয়াতসমূহের পাঁচ জায়গায় আল্লাহর রাসূলগণকে প্রত্যাখ্যান এবং তিন স্থানে সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার কথা উক্ত হইয়াছে। এই বহুবিধ গর্হিত অপরাধসমূহের মধ্যে প্রধানত মহান নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়া সমকামিতা ত্যাগ না করার পরিণতিতেই এই জাতি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হইয়াছিল। হাকেম নীশাপুরী (র) তাহাদের মধ্যে এই ঘৃণ্য পাপাচার কিভাবে সংক্রমিত হইয়াছিল তাহার একটি বর্ণনা দিয়াছেন। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, যে বিষয়টি তাহাদেরকে নারীদের ত্যাগ করিয়া পুরুষদের সহিত কুকর্ম করিতে প্ররোচিত করিয়াছিল তাহা এই যে, তাহাদের আবাসিক এলাকায় এবং আবাসিক এলাকার বাহিরেও পথিপার্শ্বে তাহাদের ফলের বাগান ছিল। তাহারা দুর্ভিক্ষের শিকার হইলে তাহারা পরস্পর বলিল, তোমরা পথিপার্শ্বের বাগানসমূহের ফল পথিক-মুসাফিরদেরকে খাইতে নিষেধ করিলে তাহা দ্বারা তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা হইয়া যাইত। তাহারা বলিল, আমরা তাহাদেরকে কিভাবে নিষেধ করিব? তাহারা পরস্পরের মুখামুখী হইয়া বলিল, ঐ বাগানের ব্যাপারে তোমরা এই নীতি অবলম্বন কর যে, তোমাদের অপরিচিত কোন বিদেশী তোমাদের জনবসতিতে আসিলে তোমরা তাহার মালপত্র লুণ্ঠন করিয়া নিজ দখলে নাও এবং তাহার সহিত কুকর্ম কর। ইহা করিলে লোকেরা আর তোমাদের এলাকা দিয়া যাতায়াত করিবে না। (তাহাতে তোমাদের পথিপার্শ্বের বাগানের ফল রক্ষা পাইবে)। অতঃপর নিকটস্থ পাহাড় হইতে সুদর্শন ও সুশ্রী যুবকের বেশে শয়তান পথিকরূপে তাহাদের নিকট আবির্ভূত হইল। তাহারা তাহাকে দেখিবামাত্র তাহার দিকে ধাবিত হইয়া তাহার সহিত কুকর্ম করিল এবং তাহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া লইল। অতঃপর সে চলিয়া গেল। ইহার পর হইতে কোন আগন্তুকের আবির্ভাব হইলেই তাহারা তাহার সহিত উক্তরূপ কদর্য আচরণ করিত এবং ইহা তাহাদের অভ্যাসে পরিণত হইয় গেল। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাহাদের নিকট লূত (আ)-কে প্রেরণ করিলেন। তিনি তাহাদেরকে এই কদর্য অপকর্ম হইতে বিরত থাকিতে বলিলেন, তাহাদেরকে শাস্তির ভয় দেখাইলেন এবং তাহাদেরকে ইহা পরিহারের অনুরোধ করিলেন। তিনি বলিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা এমন কুকর্ম করিতেছ যাহা তোমাদের পূর্বে বিশ্ববাসীর কেহ করে নাই।… অতঃপর তিনি ইবন আব্বাস (রা) হইতে হাদীছের অবশিষ্ট অংশ বর্ণনা করেন (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬২)।
ইবরাহীম (আ)-এর শরীআতে আগন্তুক মেহমানের আপ্যায়নের সুব্যবস্থা করা ফরয ছিল (প্রাগুক্ত)। এই ফরয আদায় না করিয়া তাহারা আগন্তুকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া লওয়ার পর তাহার সহিত জোরপূর্বক কুকর্ম করিত এবং ইহার পরিণতিতে ঈমানের অন্যতম ভূষণ “লজ্জাশীলতা” তাহাদের চক্ষু ও চরিত্র হইতে বিদায় গ্রহণ করিল। সমকামিতার পাশাপাশি তাহারা রাহাজানি ও লুটতরাজে মাতিয়া থাকিত। তাহারা অভিনব পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীর পণ্য লুণ্ঠন করিত। কোন ব্যবসায়ী তাহাদের এলাকায় পৌঁছিলে তাহার পণ্য হইতে তাহাদের প্রত্যেকে একটু একটু করিয়া লইয়া যাইত। এইভাবে তাহার সর্বস্ব লুষ্ঠিত হইলে কোন ব্যক্তি আসিয়া বলিত, আমি তোমার এই যৎকিঞ্চিৎ মাল নিয়াছি, এই তাহা ফেরত দিলাম। বণিক বলিত, আমার সর্বস্ব লুণ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, আমি এই সামান্য জিনিস ফেরত লইয়া কি করিব? তুমি ইহা লইয়া যাও। অতঃপর সে উহা লইয়া চলিয়া যাওয়ার পর আরেকজন আসিয়া একই কথা বলিত। এইভাবে বণিক তাহার মূলধন হারাইয়া রিক্তহস্ত হইয়া যাইত (নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১২)।
ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারা (রা) তাঁহার এক দাসকে হযরত লূত (আ)-এর কুশলাদি জ্ঞাত হওয়ার জন্য তাঁহার নিকট প্রেরণ করেন। সে সাদূম শহরে পৌঁছিলে তথাকার এক ব্যক্তি তাহার মাথায় প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে রক্তাক্ত করিয়া বলে, এই রক্ত তোমার শরীরে থাকিলে তোমার ক্ষতি হইত। অতএব আমাকে রক্ত বাহির করার পারিশ্রমিক দাও। অতঃপর তাহাকে লইয়া বিচারকের দরবারে উপস্থিত হইলে সে রায় প্রদান করে যে, আহত ব্যক্তি সাদূমীকে তাহার মাথায় প্রস্তর নিক্ষেপ ও রক্তপাতের পারিশ্রমিক প্রদান করিবে। আগন্তুক ইহাতে ক্ষিপ্ত হইয়া বিচারকের মস্তকে প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে আহত করিবার পর বলিল, আমি যে তোমার মাথায় প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়াছি উহার পারিশ্রমিক সাদূমীকে প্রদান কর। এই বলিয়া সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে (নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১২)। ইমাম বুখারী (র) বলেন, সাদূমের কাযীর বিচার সংক্রান্ত ঘটনাটি পাঠ করিবার পরই আমি আল-মাআররীর নিম্নেক্ত কবিতার অর্থ অনুধাবন করিতে সক্ষম হইয়াছি :
“কে আছে এমন যে সাদূমে প্রচলিত আইব্ন কার্যকর করে না-এইরূপ একজন বিচারকের সন্ধান দিতে পারে” (যায়নুল আবিদীন, কাসাসুল কুরআন, পৃ. ১৪৫)!
এই ধরনের আরও বিচিত্র ঘটনা ইয়াহূদীদের তালমূদ গ্রন্থে বর্ণিত আছে। কখনও তাহারা আগন্তুককে আশ্রয় দিয়া গোপনে তাহার সর্বস্ব অপহরণ করিত। কোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাদ্য চাহিলে তাহাকে তাহারা আহার তো করাইতই না, বরং সে অনাহারে মারা গেলে তাহার পরিধেয় বস্ত্র খুলিয়া লইত। লুত (আ) ও তাহার কন্যাদ্বয় অভুক্তকে আহার করাইলে তাহারা তাঁহাদেরকে ভর্ৎসনা করিত (তালমূদের বরাতে সীরাতে সারওয়ার আলম, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৪২-৩)। এই কয়টি ঘটনা হইতে তাহাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের জঘন্য চিত্র ফুটিয়া উঠে। এই নির্লজ্জ ও আল্লাহদ্রোহী সম্প্রদায়কে সুপথে আনার জন্য হযরত লূত (আ) দীর্ঘ বিশ বৎসর (মুরূজুয যাহাব, ১খ, পৃ. ৫৭; আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬২) ধরিয়া দীনের দাওয়াত দিতে থাকেন, আল্লাহর গযবের ভয় দেখান, অপরাধীদেরকে পাপাচার ত্যাগ করিলে তাহাদের জন্য সৌভাগ্যের দরজা খুলিয়া যাওয়ার আশ্বাসবাণীও শুনান। তাহারা তাহার উপদেশে কর্ণপাত করা তো দূরের কথা, বরং তাহারা তাঁহার চরম শত্রু হইয়া দাঁড়ায় এবং তাঁহাকে আল্লাহর গযব আনার চ্যালেঞ্জ প্রদান করে। কুরআন মজীদের ভাষায় ন্যূত (আ)-এর নসীহত এবং তাহাদের গর্হিত আচরণের বিবরণ নিম্নরূপঃ
“আর আমি লূতকেও পাঠাইয়াছিলাম। সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা এমন কুক করিতেছ যাহা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেহ করে নাই। তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারী ছাড়িয়া পুরুষের নিকট গমন কর। তোমরা তো সীমালঙ্নকারী সম্প্রদায়। উত্তরে তাহার সম্প্রদায় শুধু বলিল, ইহাদেরকে তোমাদের জনপদ হইতে বহিস্কৃত কর, ইহারা তো এমন লোক যাহারা অতি পবিত্র হইতে চাহে” (৭ : ৮০-৮২)।
“নূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে অস্বীকার করিয়াছিল। যখন উহাদের ভাতা লূত উহাদেরকে বলিল, তোমরা কি সাবধান হইবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি ইহার জন্য তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাহি না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে। বিশ্বজগতের মধ্যে তো তোমরাই পুরুষের সহিত উপগত হও এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করিয়াছেন তাহাদেরকে তোমরা বর্জন করিয়া থাক। তোমরা তো সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। উহারা বলিল, হে লূত! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হইবে। লূত বলিল, আমি তোমাদের এই কর্মকে ঘৃণা করি। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার পরিবার-পরিজনকে উহারা যাহা করে, তাহা হইতে রক্ষা কর” (২৬ : ১৬০-১৬৯)।
“স্মরণ কর নূতের কথা, সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা জানিয়া-শুনিয়া কেন অশ্লীল কাজ করিতেছ? তোমরা কি কামতৃপ্তির জন্য নারীদের ছাড়িয়া পুরুষে উপগত হইবে? তোমরা তো এক অজ্ঞ সম্প্রদায়। উত্তরে তাহার সম্প্রদায় শুধু বলিল, লূত-পরিবারকে তোমাদের জনপদ হইতে বহিস্কৃত কর, ইহারা তো এমন লোক যাহারা পবিত্র সাজিতে চাহে” (২৭ : ৫৪-৫৬)।
“স্মরণ কর নূতের কথা, সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা তো এমন অশ্লীল কর্ম করিতেছ, যাহা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেহ করে নাই। তোমরাই তো পুরুষে উপগত হইতেছ, তোমরাই তো রাহাজানি করিয়া থাক এবং তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কর্ম করিয়া থাক। উত্তরে তাহার সম্প্রদায় শুধু এই বলিল, আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন কর যদি তুমি সত্যবাদী হও” (২৯ ও ২৮-২৯)।
লজ্জা-শরম ত্যাগ করিয়া মানুষ যদি একবার বেহায়া হইতে পারে, তবে তাহার পক্ষে হেন কাজ নাই যাহা সে করিতে পারে না। লূত, সম্প্রদায়ের বেলায়ও তাহাই ঘটিয়াছিল । “তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কর্ম করিয়া থাক” বাক্যাংশের ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে যে, তাহারা তাহাদের অশ্লীল ও লজ্জাকর ঘৃণ্য কর্ম প্রকাশ্যভাবে লোকজনের উপস্থিতিতে করিত। যেমন অপর আয়াতে বলা হইয়াছে, “তোমরা লোকচক্ষুর সামনে এই নির্লজ্জ কাজ করিতেছ” (২৭ : ৫৪)? তাফসীরে উছমানী, তাফহীমুল কুরআন ও মাআরিফুল কুরআনে এরূপ ব্যাখ্যাই করা হইয়াছে (২৯ ও ২৯ আয়াতাধীন তাফসীর দ্র.)। গর্হিত কর্মে লিপ্ত হওয়া যেমন অপরাধ, তাহা প্রকাশ্যে লোকচক্ষুর সামনে করা একটি অতিরিক্ত পাপ হিসাবে গণ্য (মাআরিফুল কুরআন, পূ, স্থা.)। লজ্জাশীলতার গুরুত্ব অপরিসীম। ইহাকে সুন্নাতুল মুরসালীন তথা নবী-রাসূলগণের আদর্শ (তিরমিযী, নিকাহ, বাব ১), ঈমানের অন্যতম শাখা এবং দীন ইসলামের চরিত্র আখ্যায়িত করা হইয়াছে। মহানবী (স) বলেন :
“লজ্জাশীলতা ঈমানের অন্যতম শাখা” (বুখারী ঈমান, বাব উমূরিল ঈমান, ১খ, পৃ. ৬, কলিকাতা সং; মুসলিম, ঈমান, বাব ও আদাদি শুআবিল ঈমান, ১খ, পৃ. ৪৭, দেওবন্দ সং; আবু দাউদ, আদাব, বাব ফিল হায়া, ২খ, পৃ. ৩২১, দেওবন্দ সং; নাসাঈ, ঈমান, বাবুল হায়া; মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, কিতাবুল জামে, বাব মা জাআ ফিল হায়া)।
“প্রতিটি ধর্মের একটি স্বকীয় চরিত্র আছে। ইসলামের স্বকীয় চরিত্র হইল লজ্জাশীলতা” (ইব্ন মাজা, যুহদ, বাবুল হায়া, ২খ, পৃ. ৩০৮, দেওবন্দ সং; বৈরূত সং, ২খ, বাব ১৭, নং ৪১৮১ ও ৪১৮২; মুওয়াত্তা, কিতাবুল জামে, বাব মা জায়া ফিল হায়া)।
“পূর্বকালের নুবুওয়াতের কথা হইতে মানুষ যাহা লাভ করিয়াছে তাহার মধ্যে এই বাক্যটিও আছে : তুমি যদি নির্লজ্জ হও তাহা হইলে যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পার” (বুখারী, আম্বিয়া, সর্বশেষ বাব, ১খ, পৃ. ৪৯৫, কলিকাতা সং; আদাব, বাব : ইযা লাম তাসতায়ি…, ২খ, পৃ. ৯০৪, করাচী সং; আবূ দাঊদ, আদাব, বাব ফীল হায়া, ২খ, পৃ. ৩২১, দেওবন্দ সং; ইবন মাজা, পূ. স্থা.)। শাস্তির ফেরেশতার আগমন
প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও পরে হযরত লূত (আ)-এর নিকট আগত মানবরূপী ফেরেশতাগণের সহিত লূত সম্প্রদায়ের আচরণেও তাহাদের কদর্য পাপাচারের চিত্র ফুটিয়া উঠে। শাস্তির ভয়াবহ বার্তাসহ ফেরেশতা আগমনের বিষয় কুরআন মজীদের চার স্থানে উল্লিখিত হইয়াছে।
“আমার ফেরেশতাগণ তো সুসংবাদ লইয়া ইবরাহীমের নিকট আসিল। তাহারা বলিল, সালাম। সেও বলিল, সালাম। সে অবিলম্বে কাবাবকৃত এক গো-বৎস লইয়া আসিল। সে যখন দেখিল, তাহাদের হস্ত উহার দিকে প্রসারিত হইতেছে না, তখন তাহাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করিল এবং তাহাদের সম্বন্ধে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। তাহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তো দূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হইয়াছি।… অতঃপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হইল এবং তাহার নিকট সুসংবাদ আসিল তখন সে দূতের সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার সহিত বাদানুবাদ করিতে লাগিল। ইবরাহীম তো অবশ্যই সহনশীল, কোমল হূদয়, সতত আল্লাহ অভিমুখী। হে ইবরাহীম! ইহা হইতে বিরত হও; তোমার প্রতিপালকের বিধান আসিয়া পড়িয়াছে; তাহাদের প্রতি আসিবে এমন শাস্তি যাহা অনিবার্য। আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ পূতের নিকট আসিল, তখন তাহাদের আগমনে সে বিষণ্ণ হইল এবং নিজকে তাহাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করিল এবং বলিল, ইহা নিদারুণ দিন। তাহার সম্প্রদায় তাহার নিকট উড্রান্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল এবং পূর্ব হইতে তাহারা কুকর্মে লিপ্ত ছিল। সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! ইহারা আমার কন্যা, তোমাদের জন্য ইহারা পবিত্র। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে হেয় করিও না। তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নাই? তাহারা বলিল, তুমি তো জান, তোমার কন্যাদেরকে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই, আমরা কি চাই তাহা তো তুমি জানই। সে বলিল, তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকিত অথবা যদি আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় লইতে পারিতাম! তাহারা বলিল, হে লূত! নিশ্চয় আমরা তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত ফেরেশতা। উহার। কখনও তোমর নিকট পৌঁছিতে পারিবে না। সুতরাং তুমি রাত্রির কোন এক সময় তোমার স্ত্রী ব্যতীত তোমার পরিজনসহ বাহির হইয়া পড় এবং তোমাদের মধ্যে কেহ যেন পিছন দিকে না তাকায়। উহাদের যাহা ঘটিবে তাহারও তাহাই ঘটিবে । নিশ্চয় প্রভাত উহাদের জন্য নির্ধারিত কাল। প্রভাত কি নিকটবর্তী নহে” (১১ : ৬৯-৮১)?
“আর তাহাদেরকে অবহিত কর ইবরাহীমের মেহমানদের কথা। যখন তাহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, সালাম, তখন সে বলিয়াছিল, আমরা তোমাদের আগমনে আতঙ্কিত। তাহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিতেছি…। সে বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের আর বিশেষ কি কাজ আছে : তাহারা বলিল, আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হইয়াছে। তবে নূতের পরিবারের বিরুদ্ধে নহে। আমরা তাহার স্ত্রী ব্যতীত তাহাদের সকলকে রক্ষা করিব। আমরা স্থির করিয়াছি যে, সে অবশ্যই পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ফেরেশতাগণ যখন লূত পরিবারের নিকট আসিল, তখন লূত বলিল, তোমরা তো অপরিচিত লোক। তাহারা বলিল, না, উহারা যে বিষয়ে সন্ধিগ্ধ ছিল আমরা তোমার নিকট তাহাই লইয়া আসিয়াছি। আমরা তোমার নিকট সত্য সংবাদ লইয়া আসিয়াছি এবং অবশ্যই আমরা সত্যবাদী। সুতরাং তুমি রাত্রির কোন এক সময়ে তোমাল পরিবারবর্গসহ বাহির হইয়া পড় এবং তুমি তাহাদের পশ্চাদনুসরণ কর এবং তোমাদের মধ্যে কেহ যেন পশ্চাত দিকে না তাকায়। তোমাদেরকে যেথায় যাইতে বলা হইয়াছে তোমরা তথায় চলিয়া যাও। আমি তাহাকে এই বিষয়ে ফয়সালা জানাইয়া দিলাম যে, প্রত্যুষে উহাদেরকে সমূলে বিনাশ করা হইবে। নগরবাসীরা উল্লসিত হইয়া উপস্থিত হইল। সে বলিল, ইহারা আমার মেহমান, অতএব তোমরা আমাকে বেইজ্জত করিও না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমাকে হেয় করিও না। উহারা বলিল, আমরা কি দুনিয়া সুদ্ধ লোককে আশ্রয় দিতে তোমাকে নিষেধ করি নাই? লূত বলিল, একান্তই যদি তোমরা কিছু করিতে চাহ তবে আমার এই কন্যাগণ রহিয়াছে। তোমার জীবনের শপথ! উহারা তো মত্ততায় বিমূঢ় হইয়া আছে” (১৫ : ৫১-৭২)।
“যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের নিকট আসিল, তখন তাহারা বলিয়াছিল, আমরা এই জনপদবাসীকে ধ্বংস করিব। ইহার অধিবাসীরা তো যালেম। ইবরাহীম বলিল, এই জনপদে তো দূত রহিয়াছে। উহারা বলিল, সেখানে কাহারা আছে তাহা আমরা ভাল জানি। আমরা তো লূতকে ও তাহার পরিজনবর্গকে রক্ষা করিবই, তাহার স্ত্রীকে ব্যতীত, সে তো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ দূতের নিকট আসিল, তখন তাহাদের জন্য সে বিষণ্ণ হইয়া পড়িল এবং নিজেকে তাহাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করিল। তাহারা বলিল, ভয় করিও না, দুঃখও করিও না, আমরা তোমাকে ও তোমার পরিবারবর্গকে রক্ষা করিব, তোমার স্ত্রী ব্যতীত, সে তো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আমরা এই জনপদবাসীদের উপর আকাশ হইতে শাস্তি নাযিল করিব, কারণ উহারা পাপাচার করিতেছিল” (২৯ ও ৩১-৩৪)।
“তোমার নিকট ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত আসিয়াছে কি? যখন তাহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, সালাম, তখন সেও বলিল, সালাম। ইহারা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর ইবরাহীম তাহার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি ভাজা মাংসল গো-বৎস লইয়া আসিল। সে তাহা তাহাদের সামনে রাখিল এবং বলিল, তোমরা খাইতেছ না কেন? ইহাতে তাহাদের সম্পর্কে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। উহারা বলিল, ভীত হইও না। অতঃপর উহারা তাহাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিল…। ইবরাহীম বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের বিশেষ কাজ কি? তাহারা বলিল, আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করা হইয়াছে- উহাদের উপর মাটির শক্ত ঢেলা নিক্ষেপ করার জন্য। সেইগুলি তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে সীমালংঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত” (৫১ : ২৪-৩৪)।
উল্লিখিত আয়াতসমূহে লক্ষ্য করা যায় যে, ফেরেশতাগণ একটি ব্যক্তিগত সুসংবাদ ও একটি জাতিগত দুঃসংবাদসহ প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিকট আগমন করেন। তাঁহারা তাহাকে একজন জ্ঞানবান পুত্রসন্তান লাভের সুসংবাদ প্রদানের পর লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসের দুঃসংবাদ সম্পর্কে অবহিত করেন। তিন সদস্যবিশিষ্ট ফেরেশতাগণের এই দলটির প্রধান ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আ) এবং অপর দুইজন ছিলেন হযরত মীকাঈল ও হযরত ইসরাফীল (আ) (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯১; বিদায়া, ১খ,পৃ. ১৭৯)। বাইবেলেও তিনজন ফেরেশতার আগমনের কথা আছে, যদিও তাহাদের নামোল্লেখ করা হয় নাই (দ্র. আদিপুস্তক, ১৮ : ২)। ফেরেশতাগণ কেন ইবরাহীম (আ)-এর নিকট আসিয়া তাঁহাকে লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসের বার্তা অবহিত করিয়া অতঃপর লুত (আ)-এর এলাকায় পৌঁছিয়া তাহাকেও একই বিষয় অবহিত করিয়াছিলেন, সরাসরি তাঁহার নিকট আসিলেন না কেন? এই প্রসঙ্গে ইবনুল আছীর (র) লিখিয়াছেন যে, আল্লাহ তাআলা তাহাদেরকে প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত সাক্ষাত করিয়া ইবরাহীম দম্পতিকে ইসহাক ও ইয়াকূব (আ)-এর জন্মের সুসংবাদ জানাইতে বলেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯১)। তাই তাহারা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক প্রথমে তাহার সহিত সাক্ষাত করেন। দ্বিতীয় কারণ এই হইতে পারে যে, হযরত লূত (আ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর শরীআতের অনুসারী। তাঁহার উপর কোন কিতাব নাযিল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না বা তাঁহাকে কোন স্বতন্ত্র শরীআতী ব্যবস্থাও প্রদান করা হয় নাই; বরং ইবরাহীম (আ)-এর শরীআতের বাস্তবায়নের জন্যই তাহার উপর সাদূম এলাকার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই হিসাবে সাদূমীরা ছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উম্মতেরই একটি অংশ। আল্লাহ্ তাঁহার উম্মাতের একটি অংশকে ধ্বংস করার বিষয়টি তাঁহাকে অবহিত করিয়াছেন। কুরআন ও বাইবেল হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায় । তাঁহাকে সাদূমবাসীর ধ্বংসের কথা জানানো হইলে ফেরেশতাগণের সহিত তাঁহার বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ এই ছিল যে, তাঁহার উম্মাতের একটি অংশের এইরূপ করুণ পরিণতিতে তিনি বিচলিত না হইয়া পারেন না (দ্র. ১১ : ৭৪ এবং ২৯ : ৩২)।
বাইবেলের বর্ণনাও কিঞ্চিৎ পার্থক্যসহ একইরূপ। তাহাতে বলা হইয়াছে যে, তিনজন পুরুষ লোক আসিয়া হযরত ইবরাহীম (আ)-এর এর সহিত সাক্ষাত করিয়া তাহাকে একজন পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ দিলেন। তিনি তাহাদের জন্য যথারীতি ভুনা গো-বৎস ও রুটি পেশ করিলে তাহারা তাহা আহার করেন। অতঃপর তাঁহারা সদোম অভিমুখে রওয়ানা হন এবং ইবরাহীম (আ) তাহাদেরকে বিদায় দিতে অগ্রসর হইলেন। এই অবস্থায় সদাপ্রভু তাহাকে সদোমবাসীর ধ্বংসের কথা অবহিত করেন। সদাপ্রভু বলিলেন যে, সদোমের ও ঘমোরার ক্রন্দন আত্যন্তিক এবং তাহাদের পাপ অতিশয় ভারী। ইবরাহীম (আ) সদাপ্রভুর নিকট আবেদন করিয়া বলিলেন, “সেই নগরে যদি পঞ্চাশজন ধার্মিক পাওয়া যায়, তবে আপনি কি তথাকার পঞ্চশজন ধার্মিকের অনুরোধে সেই স্থানের প্রতি দয়া না করিয়া তাহা বিনষ্ট করিবেন? দুষ্টের সহিত ধার্মিকের বিনাশ করা, এই প্রকার কর্ম আপনার হইতে দূরে থাকুক…. সমস্ত পৃথিবীর বিচারকর্তা কি ন্যায়বিচার করিবেন না? সদাপ্রভু কহিলেন, আমি যদি সদোমের মধ্যে পঞ্চশজন ধার্মিক দেখি, তবে তাহাদের অনুরোধে সেই সমস্ত স্থানের প্রতি দয়া করিব” (আদিপুস্তক, ১৮ ও ৮-২৬)। এইভাবে ইবরাহীম (আ) ক্রমাগত ৪৫ জন, ৪০ জন, ৩০জন, ২০ জন ও ১০ জন পর্যন্ত আসিয়া একই কথা বলিলে, সদাপ্রভু তাঁহাকে আশ্বাস দেন যে, দশজন মুমিন পাওয়া গেলেও তিনি সেই এলাকাবাসীকে ধ্বংস করিবেন না (বিস্তারিত দ্র. আদিপুস্তক, ১৮ ও ১-৩৩)। এখানেও উম্মতকে রক্ষা করার জন্য হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আকুতি লক্ষ্য করা যায়।
হযরত ইবরাহীম (আ) স্বভাবসুলভভাবে সম্মানিত মেহমানদের সেবা-যত্নে তৎপর হন এবং ভুনা গো-শাবক তাহাদের সামনে পেশ করেন, কিন্তু তাহারা আহার গ্রহণে বিরত থাকেন (দ্র. ১১ : ৭০ ও ৫১ ও ২৬)। ইহাতে ইবরাহীম (আ)-এর মনে ভীতির উদ্রেক হইল। তখন তাহারা পরিচয় পেশ করিয়া তাহাকে অভয় দান করেন এবং তাঁহাকে একজন ভাগ্যবান পুত্র সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করেন, সঙ্গে সঙ্গে লূত-সসম্প্রদায়ের ধ্বংসের বার্তাও অবহিত করেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯০-৯১)। ইবরাহীম (আ)-এর ভীতি ভাব দূরীভূত হইলে তিনি ফেরেশতাগণের সহিত লূত-সম্প্রদায়ের ধ্বংসের ব্যাপারে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হইলেন। তিনি বলিলেন, তাহাদের মধ্যে যদি ৫০ জন ঈমানদার মানুষ থাকে, তবুও কি তাহাদেরকে ধ্বংস করা হইবে? ফেরেশতাগণ বলিলেন, তাহাদের মধ্যে পঞ্চাশজন মুমিন থাকিলে তাহাদেরকে ধ্বংস করা হইবে না। ইবরাহীম (আ) ৪০ জন, ৩০ জন, ২০ জন, এইভাবে শেষ পর্যন্ত বলিলেন, যদি ১০ জন মুমিন থাকে? ফেরেশতাগণ বলিলেন, ১০ জন মুমিন থাকিলেও তাহাদের ধ্বংস করা হইবে না (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৭০-৭৩)। সাঈদ ইবন জুবায়র, সুদ্দী, কাতাদা ও মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের সূত্রে ইব্ন কাছীর যে সংখ্যা উল্লেখ করিয়াছেন তাহা পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপ : ৩০০ জন, অতঃপর ২০০ জন, অতঃপর ৪০ জন, অতঃপর ১৪ জন মুমিন থাকিলেও ফেরেশতাগণ লূত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করিবেন না বলিয়া ইবরাহীম (আ)-কে নিশ্চয়তা দেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনায় আছে, ইবরাহীম (আ) শেষ পর্যন্ত বলিলেন, যদি একজন মুমিন থাকে? ফেরেশতাগণ বলিলেন, একজন মুমিন থাকিলেও তাহাদেরকে ধ্বংস করা হইবে না (বিদায়া, ১খ, প্র. ১৭৯)। ছাআলিবীর বর্ণনায় উক্ত সংখ্যা পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপ ও ৪০০ জন, ৩০০ জন, ২০০ জন, ১০০ জন, ৪০ জন ও ১৪ জন (আরাইস, পৃ. ১১০)। অবশেষে ইবরাহীম (আ) বলিলেন, ৬ : “এই জনপদে তো দূত রহিয়াছে” (২৯ : ৩২)। ফেরেশেতাগণ জবাবে বলিন,
“সেথায় কাহারা আছে, তাহা আমরা ভালো জানি। আমরা তো লূতকে ও তাহার পরিজনবর্গকে রক্ষা করিবই, তাহার স্ত্রীকে ব্যতীত” (২৯ : ৩২)।
লত সম্প্রদায়ের জন্য ইবরাহীম (আ)-এর এই অস্থিরতা লক্ষ্য করিয়া মহান আল্লাহ তাঁহাকে চূড়ান্তভাবে জানাইয়া দিলেন যে, তিনি যেন তাহাদের জন্য কোনরূপ ওজরখাহি না করেন। কারণ তাহাদের ধ্বংসের বিষয়টি অবধারিত হইয়া গিয়াছে।
“হে ইবরাহীম! ইহা (বাদানুবাদ) হইতে বিরত হও; তোমার প্রতিপালকের বিধান আসিয়া পড়িয়াছে। তাহাদের প্রতি আসিবে এমন শাস্তি যাহা অনিবার্য” (১১ : ৭৬)।
অতঃপর ফেরেশতাগণ লূত সম্প্রদায়ের বসতি সাদূমের দিকে রওয়ানা হইয়া গেলেন। তাহারা লুত (আ)-এর সংগে তাঁহার কৃষিভূমিতে কর্মরত অবস্থায় সাক্ষাত করেন। তিনি তাহাদের সম্পর্কে চিন্তান্বিত হইয়া পড়েন : “আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ দূতের নিকট আসিল, তখন তাহাদের আগমনে সে বিষণ্ণ হইল, নিজকে তাহাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করিল এবং বলিল, ইহা নিদারুণ দিন” (১১ : ৭৭)। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বলিয়া দিয়াছেন যে, সাদূমীদের বিরুদ্ধে লূত (আ)–এর চারিবার সাক্ষ্য গ্রহণ না করা পর্যন্ত যেন তাহাদেরকে ধ্বংস না করা হয় । তিনি আগন্তুকদেরকে লইয়া নিজ বাড়িতে রওয়ানা হইলেন এবং পথিমধ্যে তাহাদেরকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তাহারা এই জনপদবাসীর চরিত্র সম্পর্ক অবহিত কিনা। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করিয়া তাহাদেরকে বলিলেন যে, ইহাদের তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট ও খবীস লোক পৃথিবীতে আছে কি তাহা তাঁহার জানা নাই।
তিনি উক্ত বাক্যের পরপর চারিবার সাক্ষ্য প্রদান করেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯২; বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৭৯; আরাইস, পৃ. ১১০-১১)। অপর বর্ণনায় কথিত আছে যে, তাহারা সাদূমের নগরদ্বারে পৌঁছিয়া লূত (আ)–এর কন্যাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এখানে থাকার মত কোন ব্যবস্থা আছে কিনা। লূত-কন্যা এখানে ব্যবস্থা আছে, এই কথা জানাইয়া ফেরেশতাদেরকে বলিলেন যে, তিনি ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত তাহারা যেন নগরে প্রবেশ না করেন। তিনি তাহাদের সম্পর্কে তাহার সম্প্রদায়ের পক্ষ হইতে অনিষ্টের আশংকা করিতেছিলেন। পিতার নিকট ফিরিয়া আসিয়া তিনি তাঁহাকে আগন্তুকদের কথা জানাইলেন। লূত (আ) নগরদ্বারে পৌঁছিয়া তাহাদের সহিত সাক্ষাত করেন এবং তাহাদেরকে নিজ বাড়িতে লইয়া যান। তাঁহার বিশ্বাসঘাতকিনী স্ত্রী সাদূমীদের নিকটে খবর পৌঁছায় যে, তাহার ঘরে অত্যন্ত সুদর্শন কয়েকজন যুবক আসিয়াছে। মানবরূপী ফেরেশতাত্রয়কে দেখিয়া হযরত লূত (আ) চিন্তাক্লিষ্ট হইয়া পড়েন (দ্র. ১১ : ৭৭ ও ২৯ ও ৩৩)। তাঁহার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ এই ছিল যে, একদিকে তাঁহার সম্প্রদায় বহিরাগতদেরকে আশ্রয় দিতে তাঁহাকে বারণ করিয়া দিয়াছিল (দ্র. ১৫ ৭০); দ্বিতীয়ত, তাহারা ছিল পাপাচারী (দ্র. ৭ : ৮০-৮১ এবং ১১ : ৭৮)। তাহারা এই সুদর্শন যুবকত্রয়ের খোঁজ পাইলে তাহাদেরকে অপদস্ত করিতে চাহিবে এবং অপকর্মে লিপ্ত হইবে, তাহাতে বাঁধা প্রদানের ক্ষমতা তাহার নাই (দ্র, ১১ : ৮০)। তিনি যাহা আশংকা করিলেন বাস্তবে তাহাই ঘটিল। পাষণ্ড শহরবাসী লূত-স্ত্রীর মারফত মেহমানদের কথা অবহিত হওয়া মাত্র উল্লসিত হইয়া (দ্র. ১৫ ও ৬৭) দ্রুতবেগে উদভ্রান্তের মত (দ্র. ১১ : ৭৮) ছুটিয়া আসিল এবং তথায় পৌঁছিয়া তাহার নিকট আগন্তুকদেরকে দাবি করিল (দ্র. ১১ : ৭৯ ও ৫৪ ও ৩৭)। ইহারা ঘুণাক্ষরেও টের পাইল না যে, তাহারাই ইহাদের সমূলে ধ্বংসের বার্তাবাহী দূত (দ্র. বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮০-৮১)। লূত (আ) ইহাদেরকে নানাভাবে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। তিনি বলিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার মেহমানদের অপদস্ত করিয়া আমাকে অপমান করিও না। এই যে আমার কন্যাগণ রহিয়াছে, যাহারা তোমাদের জন্য পবিত্র, তোমাদের মধ্যে কি একটি উত্তম লোকও নাই (দ্র. ১১ : ৭৮ এবং ১৫ : ৬৮-৬৯)। ইহারা উত্তরে বলিল, তোমার কন্যাদের আমাদের প্রয়োজন নাই, আমরা কি চাই তাহা তুমি অবশ্যই জান (দ্র, ১১ : ৬৯)। আমরা কি তোমাকে দুনিয়া শুদ্ধ আগন্তুকদেরকে আশ্রয় দিতে নিষেধ করি নাই (দ্র. ১৫ : ৭০)? ইহারা হযরত লূত (আ)-কে দেশ হইতে বহিষ্কারের হুমকি দিল (দ্র. ৭ ও ৮২; ২৭ : ৫৬)। তিনি তাহাদেরকে আল্লাহর গযবের ভয় দেখাইলেন?
“লূত উহাদেরকে আমার কঠোর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছে কিন্তু উহারা সতর্কবাণী সম্পর্কে বিতণ্ডা শুরু করিল” (৫৪: ৩৬)।
ইহাতে তাহারা ভীত-শংকিত না হইয়া বরং লূত (আ)-কে চ্যালেঞ্জ করিয়া বলিল, তুমি সত্যবাদী হইয়া থাকিলে আল্লাহর গযব লইয়া আস (দ্র. ২৯ : ২৯)। ইহারা আসলেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়া গিয়াছিল, তাই চরমভাবে দুর্বিনীত হইয়া উঠিল। মহান আল্লাহ মহানবী (স)-এর জীবনের শপথ করিয়া বলেন :
“তোমার জীবনের শপথ! উহারা তো মত্ততায় বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিল?” (১৫ : ৭২)।
তাফসীরকারগণ বলেন, নূহ (আ)-এর শত অনুনয়-বিনয় ও অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও তাহারা তাঁহার মেহমানদের উপর চড়াও হইতে উদ্যত হইলে তিনি ভিতর হইতে ঘরের দরজা বন্ধ করিযা দেন এবং তাহাদেরকে ঘরে প্রবেশে যথাসাধ্য বাধা দিতে থাকেন। তাহারা ঘরের দরজায় প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া দরজা ভাঙ্গিবার উপক্রম করিলে, তিনি দরজা খুলিয়া দেন এবং দরজার আড়াল হইতে তাহাদেরকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে নিষেধ করেন; অবশেষে একান্তই নিরুপায় হইয়া বলেন :
“তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকিত অথবা যদি আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় লইতে পারিতাম” (১১ ও ৮০)।
লূত (আ)-এর কথা শুনামাত্র মানবরূপী ফেরেশতাগণ তাঁহাকে বলিলেন, আপনার স্তম্ভ (আশ্রয়স্থল) খুবই সুদৃঢ়। তাহারা নিজেদের আসল পরিচয় ব্যক্ত করিবার সঙ্গে সঙ্গে উহাদের ধ্বংসের বার্তা শুনাইয়া দিলেন :
“তাহারা বলিল, হে লূত! নিশ্চয়, আমরা তোমার প্রতিপালক প্রেরিত ফেরেশতা। উহারা কখনও তোমার নিকট পৌঁছিতেই পারিবে না। সুতরাং তুমি রাত্রির কোন এক সময়ে তোমার পরিবারবর্গসহ বাহির হইয়া পড় এবং তোমাদের মধ্যে কেহ যেন পিছনদিকে না তাকায়, তোমার স্ত্রী ব্যতীত। উহাদের যাহা ঘটিবে তাহারও তাহাই ঘটিবে। নিশ্চয়ই প্রভাত উহাদের জন্য নির্ধারিত কাল। প্রভাত কি নিকটবর্তী নহে” (১১ : ৮১; আরও দ্র. ১৫ ৫৭-৬৬)?
“অতঃপর সাদূম ভ্রাতা লূত তাহাদের নিকট আগমন করিলেন। তিনি আগমন করিলেন তাহাদের নিকট তাহাদের জ্ঞান ও হিদায়াতসহ। (কিন্তু) তাহারা তাহার নিকট তাহার মেহমানদেরকে দাবি করিল। অতঃপর বলিল, আমরা আপনাকে নিষেধ করিয়াছিলাম জনপদে কোন মেহমানকে জায়গা না দিতে! শায়খ তখন তাহার কন্যাগণকে পেশ করিলেন, যাহারা ছিল সমতল ভূমিতে বিচরণকারী হরিণীর ন্যায়। কওম তখন রাগান্বিত হইয়া বলিল, হে শায়খ! ইহা এমন কর্ম যাহা আমরা অস্বীকার করিতেছি।”
কওম ও এক বৃদ্ধা মহিলা তাহাদের সিদ্ধান্তে ঐকমত্য হইল, আল্লাহ তাহাদের প্রচেষ্টা ও কামনা ব্যর্থ করিয়া দিলেন, আল্লাহ্ তখন শাস্তি প্রেরণ করিলেন। ভূমিকে উল্টাইয়া দিলেন এবং প্রবল বাতাসের মুখে উহাকে নিক্ষেপ করিলেন, অতঃপর উহাতে বিক্ষেপ করিলেন মাটির শক্ত ঢেলা যাহাতে তাহাদের নামাংকিত ছিল” (মুজামুল বুলদান, ৩, পৃ. ২০১)।
শাস্তি অবতরণ
কোন জাতির নিকট নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাব না পাঠানো পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা সেই জাতিকে তাহাদের অপরাধের কারণে ধ্বংস করেন না।
“আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাহাকেও শাস্তি দেই না” (১৭ : ১৫)।
নবী এবং তাঁহার আনীত বার্তা বান্দার অভিযোগ উত্থাপন করিতে না পারার জন্য আল্লাহর তরফ হইতে প্রমাণ (হুজ্জাত)। এই প্রমাণ পূর্ণরূপে পেশ না করা পর্যন্ত বান্দাকে শাস্তি প্রদান ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অন্যথায় বান্দা এই আপত্তি উত্থাপন করার সুযোগ পায় যে, তাহাদেরকে অনুসরণীয় বিষয় অবহিত করা হয় নাই, তাই তাহারা শাস্তিযোগ্য হইবে কেন? অতএব ন্যায়বিচারের স্বার্থে আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল প্রেরণ করিয়া মানবজাতিকে তাঁহার বিধান অবহিত করেন এবং তাহা মানিয়া লওয়ার আহবান জানান। একটি নির্দিষ্ট কাল ব্যাপিয়া নবী-রাসূলগণ দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাহাদের আহ্বানে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী সাড়া না দিলে তাহাদেরকে ক্রমান্বয়ে ছোটখাট বিপদ দ্বারা সতর্ক করা হয়। যেমন সূরা ইয়াসীনে অনুরূপ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হইয়াছে ।
“উহাদের নিকট এক জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর, যখন তাহাদের নিকট রাসূলগণ আসিয়াছিল। যখন উহাদের নিকট দুইজন রাসূল পাঠাইয়াছিলাম, তখন উহারা তাহাদেরকে মিথ্যাবাদী বলিয়াছিল। অতঃপর আমি তাহাদেরকে শক্তিশালী করিয়াছিলাম তৃতীয় একজন দ্বারা। তাহারা বলিয়াছিল, আমরা তো তোমাদের নিকট প্রেরিত হইয়াছি। উহারা বলিল, তোমরা আমাদের মতই মানুষ, দয়াময় আল্লাহ তো কিছুই নাযিল করেন নাই। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলিতেছ। তাহারা বলিল, আমাদের প্রতিপালক জানেন, আমরা অবশ্যই তোমাদের নিকট প্রেরিত হইয়াছি। স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব। উহারা বলিল, আমরা তো তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও তবে অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করিব এবং আমাদের পক্ষ হইতে অবশ্যই তোমাদের উপর মর্মন্তুদ শাস্তি আপতিত হইবে। তাহারা বলিল, তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই সাথে, ইহা কি এইজন্য যে, আমরা তোমাদেরকে উপদেশ দিতেছি? বস্তুত তোমরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। নগরীর প্রান্ত হইতে এক ব্যক্তি ছুটিয়া আসিল। সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসূলগণের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাহাদের, যাহারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চায় না এবং যাহারা সৎপথ প্রাপ্ত” (৩৬ : ১৩-২১)।
উদ্ধত সম্প্রদায় এই লোকটিকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার পর আল্লাহ তাআলা তাহাদেরকে ধ্বংসাত্মক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করান ও
“আমি তাহার মৃত্যুর পর তাহার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আকাশ হইতে কোন বাহিনী প্রেরণ করি নাই এবং প্রেরণের প্রয়োজনও ছিল না। উহা ছিল কেবলমাত্র এক মহানাদ। ফলে উহারা নিথর নিস্তব্ধ হইয়া গেল। পরিতাপ বান্দাদের জন্য, উহাদের নিকট যখনই কোন রাসূল আসিয়াছে তখনই উহারা তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়াছে। ইহারা কি লক্ষ্য করে না যে, উহাদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠী আমি ধ্বংস করিয়াছি, যাহারা উহাদের মধ্যে আর ফিরিয়া আসিবে না” (৩৬ : ২৮-৩১)?
অনুরূপভাবে হযরত নূহ (আ) দীর্ঘকাল ধরিয়া তাঁহার জাতিকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর পরও যখন তাহারা সৎপথে আসিল না, তখন আল্লাহ তাহাদেরকে ধ্বংস করেন (উদাহরণস্বরূপ দ্র. সূরা নূহ)। যে জাতির ধ্বংসের ঘটনাই কুরআন মজীদে উক্ত হইয়াছে সেখানেই লক্ষ্য করা যায় যে, নবী-রাসূলগণ একটি উল্লেখযোগ্য কাল ধরিয়া তাহাদের সৎপথে আনয়নের সার্বিক চেষ্টা করার পর যখন ব্যর্থ হইয়াছেন তখনই আল্লাহ তাহাদেরকে ধ্বংস করিয়াছেন। লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলার আযাব নাযিল হওয়ার বেলায় একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। তিনি শেষ মুহূর্তে বলিলেনঃ
“ইহারা আমার মেহমান। অতএব তোমরা আমাকে বেইজ্জত করিও না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর” (১৫ : ৬৮-৬৯; আরও দ্র. ১১ : ৭৮)।
কিন্তু তাহারা আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে লুত (আ)-কে কঠোর ভাষায় হুমকি দিল এবং তওবার সর্বশেষ সুযোগও গ্রহণ করিল না। অথচ আযাব নাযিলের এই সর্বশেষ মুহূর্তেও যদি তাহারা তওবা করিত তবে আল্লাহ তাহাদের তওবা কবুল করিতেন, যেমন তিনি আযাব নাযিলের পূর্ব মুহূর্তে হযরত ইয়ূনুস (আ)-এর জাতির তওবা কবুল করিয়া তাহাদেরকে ক্ষমা করিয়াছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন :
“তবে ইয়ূনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত কোন জনপদবাসী কেন এমন হইল না যাহারা ঈমান আনিত এবং তাহাদের ঈমান তাহাদের উপকারে আসিত? তাহারা যখন ঈমান আনিল তখন আমি তাহাদের উপর হইতে পার্থিব জীবনের হীনতাজনক শাস্তি দূর করিলাম” (১০ ও ৯৮)।
উল্লেখ্য যে, নীনাওয়াবাসী হযরত ইয়ূনুস (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করিলে তাহাদের কর্মফলের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহর গযব আসিলে তাহারা অনুতপ্ত হইয়া আল্লাহর দরবারে তওবা করে। আল্লাহ তাহাদের প্রতি দয়াপরবশ হইয়া তাহাদের তওবা কবুল করেন এবং তাহাদেরকে উপস্থিত শাস্তি হইতে নাজাত দেন।
এই পরিস্থিতিতে হযরত জিবরাঈল (আ) লূত সম্প্রদায়ের শাস্তির ব্যবস্থা করিবার জন্য আল্লাহ তাআলার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। তিনি তাঁহার অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া নিজের একটি ডানা বিস্তার করিলে উহার আঘাতে পাপাচারীদের চক্ষুসমূহের দৃষ্টিশক্তি লোপ পাইল এবং উহারা অন্ধ হইয়া নৃত (আ)-কে হুমকি দিয়া প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্কা খাইতে খাইতে বলিতে লাগিল, আগামী কাল তাঁহাকে দেখিয়া লইব (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯২; বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮১; আরাইস, পৃ. ১১২; বাইবেলের আদিপুস্তক, ১৯১১)। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদের বক্তব্য নিম্নরূপঃ
“উহারা নূতের নিকট হইতে তাহার মেহমানদেরকে অসদুদ্দেশে দাবি করিল, তখন আমি উহাদের দৃষ্টিশক্তি লোপ করিয়া দিলাম এবং বলিলাম, আস্বাদন কর আমার শান্তি ও সতর্কবাণীর পরিণাম” (৫৪ : ৩৭)।
আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হযরত লূত (আ) তাঁহার পরিবার-পরিজনসহ সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হইয়া যাওয়ার পর তিনি ফেরেশতাগণকে তাহাদের উপর শাস্তি কার্যকর করিতে বলিলেন। তাঁহারা বলিলেন যে, তাহারা প্রত্যুষে তাহাদেরকে ধ্বংস করিতে আদিষ্ট (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯২; বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮১)। লুত (আ)-এর সহিত কেবল তাঁহার পরিবারের সদস্যগণই ছিলেন। কুরআন মজীদের বক্তব্য হইতে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়?
“যখন আমি তাহাকে ও তাহার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করিলাম, এক বৃদ্ধা ব্যতীত, যে ছিল পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আমি অবশিষ্টদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়াছিলাম” (৩৭ : ১৩৪-১৩৬)।
তাঁহার সহিত ছিলেন তাঁহার ঈমানদার কন্যাদ্বয়। তাঁহার স্ত্রীও তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিল কিনা সেই বিষয়ে মতভেদ আছে। কাহারও কাহারও মতে তাঁহার সহিত শহর ত্যাগ করিয়াছিল (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮১; আরাইস, পৃ. ১১২; বাইবেলের আদিপুস্তক, ১৯ : ১৫)। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী লূত (আ) বাহিরে যাইয়া তাঁহার জামাতাদেরকে এই জনপদ ধ্বংস হওয়ার কথা জানাইয়া তাহাদেরকে তাঁহার সহিত শহর ত্যাগের আহবান জানাইলে তাহারা তাহার কথা উপহাস করিয়া উড়াইয়া দেয় (দ্র. আদিপুস্তক, ১৯ : ১৪)। নাজাতপ্রাপ্ত হিসাবে কেবল হযরত লূত (আ) ও তাহার কন্যাদ্বয়ের কথাই জানা যায় (দ্র. কুরআন, ৭ ৮৩)। ইহাতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তাহার দুই কন্যা ও স্ত্রীকে লইয়াই শহর ত্যাগ করিয়াছিলেন। লূত-পরিবার ব্যতীত ঐ জনপদে আর কোন মুসলমান ছিল না।
কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“সেইখানে যেসব মুমিন ছিল আমি তাহাদেরকে উদ্ধার করিলাম। আমি সেখানে একটি পরিবার ব্যতীত কোন আত্মসমর্পণকারী পাই নাই” (৫১ : ৩৫-৩৬)।
লূত-পরিবার ব্যতীত সেখানে যে একজন মুমিনও ছিল না লূত (আ)-এর বক্তব্য হইতেও উহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়:
“তোমাদের মধ্যে কি একটি ভালো মানুষও নাই” (১১ : ৭৮)?
উপরন্তু ১৫ : ৫০-৬০; ২৬ : ১৬৯-১৭২; ২৭ : ৫৭, ২৯ ও ৩২-৩৩ এবং ৩৭ : ১৩৪-১৩৬ আয়াতসমূহ হইতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, লূত (আ)-এর স্ত্রী ব্যতীত তাঁহার পরিবারের লোকজনই কেবল আল্লাহর গযব হইতে রক্ষা পায়। অতএব সর্বোতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ঐ জনপদে লূত-পরিবারের সদস্যগণ ব্যতীত আর কোন মুমিন লোক ছিল না। ১১ : ৭৮ : ১৫ : ৭১ আয়াতে বলা হইয়াছে [ ] (আমার এই কন্যাগণ), ইহার দ্বারা লুত (আ)-এর সম্প্রদায়ের কন্যাগণকে বুঝানো হইয়াছে।
লূত (আ)-এর প্রতি নির্দেশ ছিল যে, তিনি যেন তাঁহার পরিজনসহ রাত্রিকালে সাদূম ত্যাগ করেন, পথিমধ্যে তাহাদের কেহ যেন পশ্চাতে ফিরিয়া না তাকায় এবং তাহাদেরকে যেই এলাকায় সরিয়া যাইতে নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে, তাহারা যেন সেথায় চলিয়া যান, কারণ প্রত্যুষেই সাদূমবাসীকে সমূলে ধ্বংস করা হইবে (দ্র. ১১ : ৮১; ১৫ : ৬৫)। নির্দেশ মোতাবেক লূত (আ) রাত্রির অন্ধকারে সপরিবারে বসতি ত্যাগ করিয়া নিরাপদ স্থানে রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে তাহার স্ত্রী পশ্চাতে ফিরিয়া তাকাইলে শূন্য হইতে নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮২; আরাইস, পৃ. ১১৩)। বাইবেলে বলা হইয়াছে যে, সে পশ্চাতে তাকাইলে একটি লবণস্তম্ভে রূপান্তরিত হইয়া যায় (দ্র. আদিপুস্তক, ১৯ ও ২৬)। তাঁহারা নিরাপদ এলাকায় সরিয়া যাওয়ার পর ভোরবেলা সূর্য উদিত হইলে আল্লাহর অমোঘ নির্দেশ বাস্তবায়িত হইল (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮১-৮২; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৩; আরাইস, পৃ. ১১২; আদিপুস্তক, ১৯ ও ২৪)। হযরত জিবরাঈল (আ), মতান্তরে হযরত মীকাঈল (আ) তাহার দুইটি ডানা মাটির গর্ভে প্রবিষ্ট করাইয়সিদূমবাসীর সমগ্র এলাকা শূন্যে তুলিয়া ফেলিলেন। তখন মোরগ ও কুকুরের মত প্রাণীরা গগণবিদারী আর্তনাদে চীকার করিয়া উঠিল, শূন্য হইতে প্রস্তর বর্ষিত হইল এবং স্টোটা এলাকাকে উল্টাইয়া শূন্য হইতে সজোরে নিক্ষেপ করা হল্পল। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে একটি জনবসতি পৃথিবীর বুক ইতে নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল। চতুষ্পদ জন্তু হইতেও নিকৃষ্ট মানবরূপী পিশাচগুলির সঙ্গে নিষ্পাপ প্রাণীগুলিও ধ্বংস হইল (বিদয়া, ১খ, পৃ. ১৮২; আল-কামিল, ১২, পৃ. ৯৩; আরাইস, পৃ. ১১৩; বাইবেলের আদিপুস্তক, ১৯ ও ২৪-২৫)। চল্লিশ লক্ষ (মতান্তরে চার হাজার ও চার শত) জনবসতি সম্বলিত পাঁচটি এলাকা (বিদায়ায় সাতটি) সাদূম, সাবআ, আমুরা (বাইবেলে ঘরো), দূমা, সাউত ইত্যাদি চিরকালের জন্য মানবজাতির শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে পরিণত হইল (পূর্বোক্ত বরাত)। কুরআন মজীদের বিভিন্ন সূরায় এই গযব নাযিলের বিভিষীকাময় দৃশ্য এভাবে তুলিয়া ধরা হইয়াছে ।
“আমি তাহাদের উপর ভীষণভাবে বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াছিলাম। সুতরাং অপরাধীদের পরিণাম কি হইয়াছিল তাহা লক্ষ্য কর” (৭ : ৮৪)।
“অতঃপর যখন আমার আদেশ আসিল তখন আমি জনপদকে উল্টাইয়া দিলাম, এবং উহাদের উপর ক্রমাগত বর্ষণ করিলাম প্রস্তর কংকর, যাহা তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে চিহ্নিত ছিল। ইহা যালেমদের হইতে দূরে নহে” (১১ : ৮২-৮৩।
“অতঃপর সূর্যোদয়ের সময়ে মহানাদ উহাদেরকে আঘাত করিল। আর আমি জনপদকে উল্টাইয়া উপর-নীচ করিয়া দিলাম এবং উহাদের উপর প্রস্তর কংকর বর্ষণ করিলাম” (১৫ : ৭৩-৭৪)।
“উহারা তো সেই জনপদ দিয়াই যাতায়াত করে যাহার উপর বর্ষিত হইয়াছিল অশুভ বৃষ্টি। তবে কি উহারা ইহা প্রত্যক্ষ করে না? বস্তুত উহারা পুনরুত্থানের আশা করে না” (২৫ : ৪০)।
“আমি তাহাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াছিলাম। ভীতি প্রদর্শিতদের জন্য এই বৃষ্টি ছিল কত নিকৃষ্ট” (২৬ : ১৭৩; আরও দ্র. ২৭ : ৫৮)।
“তাহারা বলিল, আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করা হইয়াছে। যাহাতে আমরা তাহাদের উপর মাটির শক্ত ঢেলা নিক্ষেপ করি, যাহা সীমালঙ্নকারীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে চিহ্নিত” (৫১ : ৩২-৩৪)।
“তিনি উল্টানো আবাসভূমিকে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। উহাকে আচ্ছন্ন করিল কী সর্বগ্রাসী শাস্তি” (৫৩ ও ৫৩-৫৪)।
উক্ত আয়াতে “আল-মুতাফিকাহ” বলিতে হযরত লূত (আ)-এর শাস্তিপ্রাপ্ত সম্প্রদায় বুঝানো হইয়াছে অর্থাৎ লূত সম্প্রদায়ের বসতিসমূহ যাহা তাহাদেরসহ উল্টাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ফলে উহার উপরিভাগ নিচে এবং নিচের ভাগ উপরে করিয়া দেওয়া হইয়াছে (কুরতুবীর আহকামুল কুরআন, ২৭ খ, পৃ. ১২০, বৈরূত ১৯৬৬ খৃ.; তাফসীরে তাবারী, ২৭খ, পৃ. ৪৭, বৈরূত ১৩৯৮/১৯৭৮; তাফসীরে কবীর, ২৯খ, পৃ. ২৪; তাফসীরে ইবন আব্বাস, পৃ. ৪৪৮, বৈরূত সং; মুরূজুয যাহাব, ১খ, পৃ. ৫৭ তাফসীরে “উছমানী, পৃ. পৃ. ৭০১, টীকা ৬; তাফহীমুল কুরআন, ৫৩ ও ৫৩ আয়াতের ব্যাখ্যাধীন, টীকা ৪৬; মাআরেফুল কুরআন, সৌদী সং, পৃ. ১৩১১)।
“আমি উহাদের উপর প্রেরণ করিয়াছিলাম প্রস্তর বহনকারী প্রচণ্ড ঝটিকা, কিন্তু লূত পরিবারের উপর নহে, তাহাদেরকে উদ্ধার করিয়াছিলাম রাত্রের শেষাংশে” (৫৪ : ৩৪)।
“প্রত্যুষে বিরামহীন শাস্তি তাহাদেরকে আঘাত করিল এবং (আমি বলিলাম,) আস্বাদন কর আমার শাস্তি এবং সতর্কবাণীর পরিণাম” (৫৪ : ৩৮-৩৯)।
দীর্ঘ বিশটি বৎসর (মুরূজ, ১খ, পৃ. ৫৭) ধরিয়া আল্লাহর রাসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী একটি দুষ্ট-স্বভাব জাতিকে প্রদত্ত শাস্তি ছিল কত ভয়াবহ। একদিকে বজ্র নিনাদে প্রচণ্ড ঝটিকা তাড়িত প্রস্তর বৃষ্টি, অপরদিকে গোটা জনবসতির উপর ভূ-স্তরের উল্টানো মাটির চাপ! প্রতিটি পাথরের উপর অঙ্কিত ছিল নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম এবং তদনুসারে তাহা নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর আঘাত হানে। আল্লাহ তাআলার গযবে এলাকাটি দুর্গন্ধময় সমুদ্রে পরিণত হয়, ইহার পানি বা উপকূলের
জমি কোনটিই মানুষের উপকারে আসে না (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮২-৮৩)। ছাআলাবী তাঁহার কাসাস গ্রন্থে একটি হাদীছ উল্লেখ করিয়াছেন। মহানবী (স) মেঘের গর্জন শুনিলেই লূত সম্প্রদায়ের উপর বর্ষিত সেই প্রচণ্ড ঝটিকাবাহী প্রস্তর বৃষ্টির কথা স্মরণ করিয়া ভীত-বিহ্বল হইতেন?
“আমি অবশ্যি শুনিতে পাই বজ্রধ্বনিতে প্রলয়ংকরী ঝটিকার শব্দ। ফলে আমি এই কথা ভাবিয়া শংকিত হই যে, ইহা সেই প্রস্তর কিনা যাহা লূত জাতির জন্য অথবা তাহাদের অনুরূপ কুকর্মে লিপ্তদের জন্য প্রস্তুত করা হইয়াছিল” (পৃ. ১১২)।
লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসাবশেষ ও মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা
আল্লাহ তাআলা পাপাচারী যে জাতিকেই ধ্বংস করিয়াছেন, বহু কাল ব্যাপিয়া মানবজাতির শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং তাহাদেরকে সতর্ক করার জন্য তাহা দর্শনীয় করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি মানবজাতিকে অপরাধী যালেম সম্প্রদায়সমূহের ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করিয়া তাহা হইতে শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানাইয়াছেন?
“বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ, যাহারা সত্যকে অস্বীকার করিয়াছিল তাহাদের পরিণাম কী হইয়াছে” (৬ : ১১)।
“আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠাইয়াছি আল্লাহর ইবাদত করিবার এবং তাগুতকে ( সীমা লংঘনকারীকে) বর্জন করিবার নির্দেশ দিবার জন্য। অতঃপর উহাদের কতকের উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হইয়াছিল । অতএব তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ, যাহারা সত্যকে মিথ্যা বলিয়াছিল তাহাদের পরিণাম কী হইয়াছে” (১৬ : ৩৬)?
“বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং অপরাধীদের কী পরিণাম হইয়াছিল তাহা পর্যবেক্ষণ কর” (২৭ : ৬৯; আরও দ্র. ৩ : ১৩৭; ২৭ : ১৪; ২৮ : ৪০ ও ৩০:৪২)।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা লূত সম্প্রদায়ের পরিণতিও স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণের জন্য মানবজাতিকে আহবান জানাইয়াছেন?
“আমি তাহাদের উপর ভীষণভাবে বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াছিলাম। সুতরাং অপরাধীদের পরিণাম কী হইয়াছিল তাহা লক্ষ্য কর” (৭ : ৮৪)।
লূত সম্প্রদায়ের বিধ্বস্ত জনপদের ধ্বংসাবশেষের নিদর্শনসমূহ আল্লাহ তাআলা বোধশক্তিসম্পন্ন, বিবেকবান ও মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সজাগ মানুষের জন্য উপদেশ গ্রহণের বিষয় হিসাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখিয়া দিয়াছেন এবং তাহা রাসূলুল্লাহ (স)-এর যুগেও অবশিষ্ট ছিল। হিজায হইতে আরব বণিকদল যে পথ ধরিয়া সিরিয়া যাতায়াত করিত, উক্ত ধ্বংসাবশেষ সেই পথেই অবস্থিত ছিল। এই কারণে আরবগণ তসম্প্রদায়ের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিল (আম্বিয়ায়ে কুরআন, ১খ, পৃ. ২৫২)। আরবগণ, বিশেষত কুরায়শ গোত্র মহানবী (স)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করিয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিতে থাকিলে মহান আল্লাহ তাহাদেরকে বারবার স্মরণ করাইয়া দেন:
“ইহা (ধ্বংসাবশেষ) যালেমদের হইতে দূরে নহে” (১১ : ৮৩)।
অর্থাৎ এই প্রকারের শাস্তি আজও যালেমদের হইতে মোটেও দূরবর্তী নহে (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৩০৫, টীকা ১১; তাফহীমুল কুরআন, সূরা হূদ-এর ৯৩ নং টীকা)।
“ইহা তো লোক চলাচলের পথিপার্শ্বে এখনও বিদ্যমান। অবশ্যই ইহাতে মুমিনদের জন্য নিদর্শন রহিয়াছে” (১৫ : ৭৬-৭)।
অর্থাৎ হিজায হইতে সিরিয়া এবং ইরাক হইতে মিসর যাওয়ার পথিপার্শ্বে এই ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত এবং যাত্রীদল এই পুরা এলাকায় ছড়াইয়া থাকা ধ্বংসাবশেষের চিহ্নাদি দেখিতে পায় (তাফহীম, সূরা হিজর, টীকা ৪২)। এই ধ্বংসাবশেষ স্বচক্ষে দেখিয়া কেবল ঈমানদা জনগোষ্ঠীই শিক্ষা গ্রহণ করিয়া থাকে। কারণ তাহারা মনে করে যে, লূত জাতির পাপাচার ও দৌরাত্মের শাস্তিস্বরূপই এই সম্প্রদায়ের বসতি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। ঈমানদারগণ ব্যতীত অন্যরা যতদূর সম্ভব এই ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষ করিয়া ইহাকে একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা অথবা উহা কোন প্রাকৃতিক কারণে ঘটিয়াছে বলিয়া ব্যাখ্যা করে (তাফসীরে উছমানী, পৃ.৩৫২, টীকা ৫)।
“কিন্তু ইহাদের অধিকাংশই মুমিন নহে” (২৬ ও ১৭৪)।
“আমি বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ইহাতে (ধ্বংসাবশেষে) রাখিয়াছি একটি নিদর্শন” (২৯ ও ৩৫)।
“তোমরা তো উহাদের ধ্বংসাবশেষগুলি সকালে ও সন্ধ্যায় অতিক্রম করিয়া থাক। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করিবে না।” (৩৭ : ১৩৭-৮)।
আল্লামা শাববীর আহমাদ উছমানী বলেন, উক্ত আয়াতে নাফরমান মক্কাবাসীদেরকে বলা হইয়াছে যে, তথা হইতে যেসব কাফেলা সিরিয়ায় যাতায়াত করে তাহাদের রাস্তায় তাহারা লূত সম্প্রদায়ের বিধ্বস্ত জনপদ দেখিতে পায়। অর্থাৎ রাত-দিন তাহারা এই নিদর্শনসমূহ দেখিতেছে, ইহার পরও কি তাহারা শিক্ষা গ্রহণ করিবে না, তাহারা কি বুঝে না যে, এই অবাধ্য সম্প্রদায় যে করুণ পরিণতির শিকার হইয়াছে, অন্যান্য অবাধ্য সম্প্রদায়েরও অনুরূপ অবস্থা হইতে পারে (তাফসীর, পৃ. ৬০১, টীকা ৩)?
“যাহারা মর্মান্তিক শাস্তিকে ভয় করে, আমি তাহাদের জন্য উহাতে একটি নিদর্শন রাখিয়াছি” (৫১ : ৩৭)।
অর্থাৎ এখনো তথায় বিধ্বস্ত জনপদের নিদর্শন বিদ্যমান আছে এবং লূত সম্প্রদায়ের সাংঘাতিকভাবে ধ্বংস হওয়ার ঘটনায় আল্লাহর শাস্তিকে ভয়কারীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ আছে (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬৯৩, টীকা ৫)।
“আমি বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ইহাতে একটি স্পষ্ট নিদর্শন রাখিয়াছি” (২৯ ও ৩৫)।
উক্ত আয়াতসমূহ হইতে বুঝা গেল যে, লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসাবশেষ হইতে কেবল তাহারাই শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারিবে, সতর্ক ও সাবধান হইতে পারিবে, যাহারা আল্লাহর শাস্তিতে ভীত প্রজ্ঞাবান মুমিন।
বাইবেলের বর্ণনা, গ্রীক ও লাতিন প্রাচীনলিপি এবং আধুনিক কালের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ত সাগরের পূর্ব ও দক্ষিণের যে অঞ্চলটি জনশূন্য অবস্থায় পরিত্যক্ত আছে সেখানে বহু প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান, যাহা হইতে অনুমিত হয় যে, এক কালে এখানে মানববসতি ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিকগণের অনুমান এই যে, খৃ. পূ. ২৩০০-১৯০০ সাল পর্যন্ত এখানে মানববসতি ছিল এবং ঐতিহাসিকগণের ধারণা এই যে, হযরত ইবরাহীম (আ) হযরত ঈসা (আ)-এর দুই হাজার বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন। ইহাতে বুঝা যায় যে, এই অঞ্চলটি হযরত ইবরাহীম (আ) এবং তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্র হযরত লূত (আ)-এর যুগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই অঞ্চলের সর্বাধিক বসতিপূর্ণ ও শস্য-শ্যামল অংশকে বাইবেলে জর্দান এলাকা বলা হয়, মিসর দেশের ন্যায়, সদাপ্রভুর উদ্যানের ন্যায় জর্দান এলাকা বলা হইয়াছে যাহা সোয়র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং যাহা মিসর দেশের ন্যায়, সদাপ্রভুর উদ্যানের ন্যায় সবুজ-শ্যামল ছিল, সদোম ও ঘমোরা ছিল ইহার কেন্দ্রীয় শহর (দ্র. আদিপুস্তক, ১৩ : ১০)। আধুনিক কালের বিশেষজ্ঞগণের মতে এই এলাকাটি দূত সাগরে নিমজ্জিত হইয়াছে। প্রাচীন কালে লুত সাগর দক্ষিণ দিকে এতখানি বিস্তৃত ছিল না যতটা বর্তমানে বিস্তৃত (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জারের মতে লূত জাতির ধ্বংসাবশেষে দূত সাগরের সৃষ্টি, পূর্বে এখানে কোন সমুদ্র ছিল না)। ট্রান্স-জর্দানের বর্তমান শহর আল-কিরক (কারাক?)-এর সম্মুখে পশ্চিম দিকে এই সাগরে আল-লিসান নামে যে ক্ষুদ্র একটি দ্বীপ ছিল, প্রাচীন কালে তাহা ছিল সমুদ্রের পানির শেষ সীমানা। উহার নিম্নাংশ, যাহা বর্তমানে পানির নিচে, পূর্বে ইহা ছিল শস্য-শ্যামল একটি উপত্যকা। ইহাই ছিল সিদ্দিম উপত্যকা, যেখানে লূত জাতির বড় বড় শহর সাদূম, আমুরাহ, আদমা, দাবুইব্ন ও দুগার অবস্থিত ছিল। হযরত ঈসা (আ)-এর প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্বে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্পে এই এলাকা মাটির নিচে ধ্বসিয়া যায় এবং মৃত সাগরের পানি উহার উপর দিয়া প্রবাহিত হইতে থাকে। তাফসীরে মাজেদীর মতে ২০৬১ খৃ. পূ. সালে (পৃ. ৩০০, টীকা ১২৮ এবং পৃ. ৩৪৩, টীকা ১১১) ইহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উক্ত তাফসীরে আরও বলা হইয়াছে যে, লূত জাতির বসতি ছিল জর্দান নদীর অববাহিকায় যেখানে আজ মৃতসাগর অবস্থিত। তাহাদের বৃহৎ শহর সাদূম ও আমূরাহ (ঘমোরা) মৃত সাগরের তীরে অবস্থিত ছিল। মক্কার কুরায়শগণ সিরিয়া সফরকালে বরাবর এই পথ ধরিয়া যাতায়াত করিত (পূ. এ., পৃ. ৪৭৬, টীকা ১২৩; আরও দ্র. তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬০১, টীকা ৩; তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল-হিজর, টীকা ৪২)।
বাইবেল এবং প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী হইতে জানা যায় যে, কোথাও কোথাও খনিজ তৈল ও পিচ (asphall)-এর খনি ছিল এবং কোন কোন স্থান হইতে আগ্নেয় গ্যাস উদগীরিত হইত। বর্তমান কালেও সেখানে খনিজ তৈলের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় অনুমান করা হইয়াছে যে, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড আলোড়নের সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোল, গ্যাস ও পিচ ভূ-অভ্যন্তর হইতে উথলিয়া উঠে এবং সমগ্র অঞ্চল উহার বিষাক্ত বাষ্পে উড়িয়া যায়। বাইবেলে বলা হইয়াছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) ইহার ধ্বংসের খবর পাইয়া হেবরণ (আল-খলীল) হইতে এই প্রান্তরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতে আসিয়া দেখিতে পাইলেন যে, মাটির বুক হইতে ইটের ভাটার মত ধোঁয়া উড়িতেছে (তু আদিপুস্তক, ১৯ : ২৮)।
লূত সম্প্রদায়ের ধ্বংসের মধ্যে ঈমানদার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় নিহিত আছে। আল্লাহ তাআলাই তাঁহার ঈমানদার বান্দাদের রক্ষক। তিনি প্রয়োজনের মুহূর্তে সঙ্গিন পরিস্থিতির মধ্যে তাহাদের নাজাতের পথ বাহির করিয়া দেন, যেমন লূত সম্প্রদায়ের উপর আপতিত শাস্তি হইতে তিনি তাঁহার মুমিন বান্দাদের উদ্ধার করিয়াছেন।
“আমি লূতকে ও তাহার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করিয়াছিলাম, এক বৃদ্ধা (লূতের স্ত্রী) ব্যতীত, যে ছিল পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৭ : ১৩৪-১৩৫)।
“সেথায় যেসব মুমিন ছিল, আমি তাহাদেরকে উদ্ধার করিয়াছিলোম” (৫১ ৩৫)।
“আমি উহাদের উপর প্রেরণ করিয়াছিলাম প্রস্তর বহনকারী প্রচণ্ড ঝটিকা, কিন্তু লূত পরিবারের উপর নহে। তাহাদেরকে আমি রাত্রির শেষ প্রহরে উদ্ধার করিয়াছিলাম-আমার বিশেষ অনুগ্রহস্বরূপ। যাহারা কৃতজ্ঞ আমি এইভাবেই তাহাদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি” (৫৪ : ৩৪-৩৫)।
মুক্তির উপায় ঈমান ও নেক আমল
কুরআন মজীদে আল্লাহর গযবে যে কয়েকটি সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়ার কথা উল্লেখ আছে, তাহাতে লক্ষ্য করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তথাকার নেক বান্দাদেরকে তাহার বিশেষ ব্যবস্থায় গযব নাযিলের পূর্ব মুহূর্তে উদ্ধার করিয়া লইয়াছেন। অতএব মুক্তির একমাত্র উপায় হইতেছে ঈমান ও তদনুযায়ী আমল, কোন ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক নহে। হযরত লূত (আ)-এর স্ত্রী এবং হযরত নূহ (আ)-এর স্ত্রী ও এক পুত্রের ঈমান না থাকার কারণে নবীর সহিত আত্মীয়তা সম্পর্ক সত্ত্বেও তাহারা শাস্তি হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই, বরং অন্যান্য পাপীদের সহিত তাহারাও ধ্বংস হইয়া গিয়াছে।
“আল্লাহ কাফেরদের জন্য নূহের স্ত্রী ও দূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিতেছেন। উহারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু উহারা তাহাদের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল। ফলে নূহ ও লূত উহাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হইতে রক্ষা করিতে পারিল না এবং উহাদেরকে বলা হইল, তোমরা উভয়ে প্রবেশকারীদের সহিত জাহান্নামে প্রবেশ কর” (৬৬ : ১০)।
হযরত নূহ (আ)-এর নাফরমান পুত্র যখন ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ মহা প্লাবনে ডুবিয়া যাইতেছিল তখন তিনি বলিলেন :
“হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত” (১১ : ৪৫)।
মহান আল্লাহ তাঁহার মহান নবীর আবেদনের উত্তরে বলিলেনঃ
“হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নহে। সে অবশ্যই অসকর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই সেই বিষয়ে তুমি আমাকে অনুরোধ করিও না” (১১ : ৪৬)।
উপরিউক্ত ঘটনাত্রয় হইতে প্রতিভাত হয় যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সহিত আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা রক্তের বন্ধন কাহাকেও অপকর্মের পরিণতি হইতে রক্ষা করিতে পারে না। আল্লাহর অবাধ্য যেই ব্যক্তিই হউক তাহার ঠিকানা জাহান্নাম।
দীনের দাওয়াত দানকারীদের জন্য শিক্ষণীয়
হযরত লূত (আ)-এর জীবনে আল্লাহর দীনের দাওয়াত দানকারীর জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রহিয়াছে।
(১) তিনি তাঁহার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁহার মহান পথপ্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আনুগত্য করিয়াছেন সুখে-সম্পদে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায়। যুবক বয়সে জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া এবং পিতৃব্যের আহ্বানে সাড়া দিয়া তাহার প্রতি ঈমান আনিয়া তিনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।
২. ধৈর্যের সহিত দীর্ঘ বিশটি বৎসর ধরিয়া তিনি সাদূমবাসীদের মধ্যে আল্লাহর দীনের প্রচার
কাজ অব্যাহত রাখেন এবং নৈরাশ্য তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।
৩. তিনি মহাসত্যকে মানুষের সামনে পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে প্রচলিত পাপাচার ও অন্যায়-অত্যাচারের কঠোর ও তীব্র সমালোচনা করেন এবং অপরাধীদেরকে তাহা পরিহার করিয়া সচ্চরিত্রতা, সততা ও আল্লাহভীতি অবলম্বনের দাওয়াত দেন।
৪. আল্লাহর উপর ভরসা রাখিয়া দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পার্থিব উপায়-উপকরণও ব্যবহার করিতে হইবে।
৫. প্রতিকূল অবস্থায়ও পরোপকারে তৎপর থাকিতে হইবে। হযরত লূত (আ) তাঁহার ও তাঁহার পরিবারবর্গের জীবন বিপন্ন করিয়াও আগন্তুকগণের নিরাপত্তার চেষ্টা করিয়াছিলেন।…
৬. দাওয়াত দানকারীর দাওয়াত কেহ কবুল না করিলেও তিনি তাহার প্রচেষ্টার পূর্ণ প্রতিদান লাভ করিবেন এবং দাওয়াত দানের দায়িত্ব পালনকারীরূপে গণ্য হইবেন।
৭. হাজারও বাধা-বিপত্তির মধ্যে আল্লাহ তাআলা তাঁহার মুক্তির পথ বাহির করিয়া দেন।
হযরত লুত (আ)-এর দুইটি উক্তির তাৎপর্য
মানববেশে তিন ফেরেশতার আগমনে হযরত লূত (আ)-এর বাড়িতে যে এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছিল তাহাতে তিনি একান্তই নিরূপায় হইয়া সাদূমীদিগকে (লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছিলেন :
“হে আমার সম্প্রদায়! ইহারা আমার কন্যা, তোমাদের জন্য ইহারা পবিত্র” (১১ : ৭৮)।
“একান্তই তোমরা যদি কিছু করিতে চাহ তবে আমার এই কন্যাগণ রহিয়াছে” (১৫ : ৭১)।
হযরত লূত (আ)-এর এই কথার তাৎপর্য নির্ধারণে তাফসীরকার ও মুহাদ্দিছগণের মধ্যে তিনটি মত লক্ষ্য করা যায়। (১) ইমাম কুরতুবীর মতে, হযরত লূত (আ) এখানে তাঁহার ঔসরজাত কন্যাদেরকে বুঝাইয়াছেন। অর্থাৎ তাঁহার কথার তাৎপর্য হইল ।
“আমি ইহাদেরকে তোমাদের সহিত বিবাহ দেই, তোমরা যাহা ইচ্ছা করিয়াছ তাহা তোমাদের জন্য হালাল হইবে” (আহকামুল কুরআন, ৯খ, পৃ. ৭৬)। তাবিঈগণের মধ্যে হযরত কাতাদা (র)-এর মতে উক্ত আয়াতে লূত (আ)-এর কন্যাগণকে বুঝানো হইয়াছে (তাফসীরে কবীর, ১৭খ, পৃ. ১৩২)। আল্লামা যামাখশারীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করিয়াছেন (কাশশাফ, ২খ, পৃ. ২৮৩, বৈরূত সং)। হাসান ইবনুল ফাঁদল ও যাজ্জাজের মতও তাই, তবে তাহাদের মতে ইসলাম গ্রহণের শর্তে তিনি তাহাদের সহিত কন্যাগণের বিবাহ দিতে চাহিয়াছিলেন (রূহুল মাআনী, ১২৩, পৃ. ১০৬, বৈরূত সং)। কতক তাফসীরকারের মতে, তৎকালে কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে আন্ত-বিবাহ জায়েয ছিল এবং পরে তাহা নিষিদ্ধ হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (স) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে তাঁহার কন্যা যয়নব (রা)-কে আবুল আস ইবনুর রবীর সহিত এবং কন্যা ৰুকায়্যা (রা)-কে আবু লাহাবের পুত্র উতবার সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন, অথচ দুই জামাতাই তখন পৌত্তলিক ছিল (রুহুল মাআনী, ১২খ, পৃ. ১০৬; কুরতুবী, ৯খ, পৃ. ৭৬; কাশশাফ, ২খ, পৃ. ২৮৩)।
কতক তাফসীরকারের মতে, হযরত লূত (আ) কর্তৃক তাঁহার নিজ কন্যাদেরকে প্রদান সম্পর্কিত কথার ভিন্নতর তাৎপর্য আছে। যেমন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে উৎপীড়িত হইতে দেখিয়া উৎপীড়ককে বলিল, তাহাকে নির্যাতন করিও না, বরং তাহার পরিবর্তে আমাকে মার। বক্তার কথাটির তাৎপর্য এই নহে যে, নির্যাতিতকে ছাড়িয়া তাহাকেই নির্যাতন করা হউক, বরং ইহার অর্থ হইল, নির্যাতন করা হইতে নির্যাতককে বিরত করা। হযরত লূত (আ)-এর কথার তাৎপর্যও ইহাই। ইমাম রাযী, ইসফাহানী, আবুস সুউদ প্রমুখ তাফসীরকার এবং আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার এই মতকে অগ্রাধিকার দিয়াছেন (কাসাসুল কুরআন, বাংলা অনু., ১৩, পৃ. ২৬৫)।
অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে, হযরত লূত (আ) “ইহারা আমার কন্যা” কথাটি দ্বারা তাঁহার উম্মতের নারীদেরকে বুঝাইয়াছেন। কারণ নবীগণ স্ব স্ব উম্মতের জন্য পিতৃতুল্য। অর্থাৎ তিনি সাদূমীদেরকে বলিয়াছিলেন, তোমাদের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য নারিগণই তো আছে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সমকামিতা পরিহার কর। তাবিঈগণের মধ্যে মুজাহিদ ও সাঈদ ইবন জুবায়র (র) এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন (তাফসীরে কুরতুবী, ৯৩, পৃ. ৭৬; তাফসীরে কবীর, ১৭খ, পৃ. ৩২; তাফসীরে তাবারী, ১৫খ, পৃ. ৪১৩-৪ ইত্যাদি)। ইবন আব্বাস (রা) হইতেও অনুরূপ মত ব্যক্ত হইয়াছে (তাফসীরে ইবন আব্বাস, পৃ. ১৮৯ ও ২১৯)।
উপমহাদেশীয় তাফসীরকারগণ অন্যান্য মতের আলোচনা করে প্রধানত এই শেষোক্ত মতকেই অগ্রাধিকার দিয়াছেন। কারণ তাঁহাদের মতে নবী-রাসূলগণ হইলেন নিজ নিজ উম্মাতের আধ্যাত্মিক পিতা। (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৩০৫, টীকা ২; পৃ. ৩৫৮, টীকা ১৪; তাফহীমুল কুরআন, উর্দু, ৩খ, পৃ. ৫৭৩; তাফসীরে মাজেদী, উর্দু, পৃ. ৪৭৫, টীকা ১১৬)।
(২) হযরত লূত (আ) শত অনুনয়-বিনয় করিয়াও যখন সামীদেরকে নিবৃত্ত করিতে পারিলেন, তখন মনে মনে আক্ষেপ করিয়া বলিলেনঃ
“তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকিত অথবা যদি আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় লইতে পারিতাম” (১১ : ৮০)!
“যদি আমার শক্তি থাকিত”, “আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় লইতে পারিতাম” কথা দ্বারা হযরত লূত (আ) কোন শক্তির আশ্রয় লইতে চাহিয়াছেন? উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়ও মতভেদ আছে। তাফসীরকারগণ ইহার বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়াছেন। একদল তাফসীরকারের মতে এখানে পার্থিব শক্তিই বুঝানো হইয়াছে। অর্থাৎ তাঁহার দৈহিক শক্তি, সন্তান-সন্ততির শক্তি ও গোত্রীয় শক্তি, (তাফসীরে ইবন আব্বাস, পৃ. ১৭৯; কুরতুবী, ৯খ, পৃ. ৭৮; তাফসীরে কবীর, ১৭খ, পৃ. ৩৪; কী জিলালিল কুরআন, ৪খ, পৃ. ১৯১৪; তাফসীরে কাশশাফ, ২খ, পৃ. ২৮৩। ইমাম নববী (র)-ও একই কথা বলিয়াছেন। তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে, লূত (আ) অন্তরে আল্লাহর উপর ভরসা রাখিয়াই বাহ্যত এই কথা বলিয়াছেন (ফাতহুল বারী, ৬খ, পৃ. ৪১৬; উমদাতুল কারী, ১৫খ, পৃ. ২৭০)। উপরিউক্ত শক্তির কোনটিই লূত (আ)-এর ছিল না, তাঁহার প্রচুর সংখ্যক অনুসারীও ছিল না এবং তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীও ছিলেন না (মাআরিফুল কুরআন, উর্দু, ২খ, পৃ. ৪৯৩)। উপরন্তু তিনি ছিলেন তথায় একজন মুহাজির, ইরাক হইতে হিজরত করিয়া আসিয়াছিলেন।
প্রয়োজনের সময়ে পার্থিব উপায়-উপকরণের সাহায্য গ্রহণ একটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ব্যাপার, যাহা শরীআতের বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ বৈধ। যেমন মহান আল্লাহ বলেন :
“তোমরা তাহাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখিবে, এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করিবে আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে” (৮ : ৬০)।
ইমাম রাযী (র) বলেন, এখানে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র বুঝানো হইয়াছে এবং অন্যরা বলেন, শত্রুকে প্রতিহত করার যাবতীয় শক্তি বুঝানো হইয়াছে। হাদীছ হইতেও উক্ত মতে সমর্থন পাওয়া যায়। মহানবী (স) বলেন :
“আল্লাহ তাআলা লূত (আ)-এর পর হইতে যে কোন জাতির নিকট তাহাদের মধ্যকার প্রভাবশালী বংশ হইতেই নবী পাঠাইয়াছেন” (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮০; মুসতাদরাক হাকেম, ২খ, পৃ. ৫৬১)।
অনুরূপভাবে শুআয়ব (আ)-কে তাঁহার বংশের লোকেরা বলিয়াছিল :
“এবং আমরা তো তোমাকে আমাদের মধ্যে দুর্বলই দেখিতেছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকিলে আমরা তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া মারিয়া ফেলিম” (১১ : ৯১)।
অতএব পার্থিব শক্তির সাহায্য গ্রহণ বৈধ (তাফসীরে কবীর, ১৭খ, পৃ. ৩৪; তাফসীরে কুরতুবী, ৯থ, পৃ. ৭৮; ফাতহুল বারী, ৬খ, পৃ. ৪১৬; উমদাতুল কারী, ১৫খ, পৃ. ২৭০; তাফসীরে মাজেদী, পৃ. ৪৭৫, টীকা ১১৮)। কতক তাফসীরকার বলেন যে, লুত (আ) পার্থিব শক্তি অথবা আল্লাহর আশ্রয় কামনা করিয়াছেন-এই দুই অর্থই হইতে পারে (রূহুল মাআনী, ১২খ, পৃ: ১০৭)।
অপর একদল তাফসীরকার বলেন যে, লূত (আ) আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করিয়াছেন। ইবন হাজার আসকালানী ও বাদরুদ্দীন আয়নী (র) দৃঢ়তার সহিত এই মতকে অগ্রাধিকার দিয়াছেন এবং পূর্বোক্ত মতেরও আলোচনা করিয়া বলিয়াছেন যে, উক্তরূপ ব্যাখ্যাও করা যাইতে পারে (ফাতহুল বারী, ৬খ, পৃ. ৪১৫-৬; উমদাতুলকারী, ১৫খ, পৃ. ২৭০)।
হযরত লূত (আ)-এর ইনতিকাল
লূত (আ)-এর শেষ জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁহার সম্প্রদায়ের ধ্বংসের পর হয়তো তিনি আর দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন না। কারণ তিনি বেশি দিন জীবিত থাকিলে পুনরায় তাহার নবুওয়াতী দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত অতিরিক্ত কিছু তথ্য অন্তত বাইবেল, কুরআন মজীদ ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান থাকিত। এই সকল উৎসই এই ব্যাপারে নীরব। বাইবেল ভিত্তিক বর্ণনা হইতে এতখানি জানা যায় যে, তিনি গযব নাযিলের পূর্বে সপরিবারে প্রথমে সোয়ার (Zoar) নামক শহরে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাহা দূত সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। অতঃপর তিনি অজ্ঞাত এক পর্বতের গুহায় দুই কন্যাসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন (Ency. Brit., vol. 14, P. 401; Colliers Ency., vol. 15, P. 20)। তিনি এখানেই ইনতিকাল করেন কি না তাহা অজ্ঞাত এবং তাহার জীবনকাল সম্পর্কিত তথ্যও এখানেই শেষ। ইসলামী উৎসে বলা হইয়াছে যে, গযব নাযিলের পূর্বে তিনি সিরিয়া অভিমুখে প্রস্থান করেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৩; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৮১)।
লুত (আ) ছিলেন এমন একজন নবী যিনি নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত না হইয়া, তাহার সহিত সম্পর্কহীন ভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হইয়াছিলেন। তাঁহার পর হইতে যে কোন জাতির নিকট সেই জাতিভুক্ত কোন মহান ব্যক্তিকে নবীরূপে প্রেরণ করা হইয়াছে। মহান আল্লাহ বলেন :
“আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাহার স্বজাতির ভাষাভাষী করিয়া পাঠাইয়াছি তাহাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করিবার জন্য” (১৪৪)।
মহানবী (স) বলেন :
“আল্লাহ তাআলা লূত (আ)-এর পর হইতে যে কোনও জাতির নিকট তাহাদের মধ্যকার প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী বংশ হইতেই নবী প্রেরণ করিয়াছেন” (আল-মুসতাদরাক, ২খ, পৃ. ৫৬১)।
বাইবেল ভিত্তিক বর্ণনার পর্যালোচনা
বাইবেল এবং বাইবেল ভিত্তিক সাহিত্যেও লুত (আ)-এর হিজরত, লূত জাতির কেন্দ্র, তাহাদের অপকর্ম, নবীর সতর্কবাণী, ফেরেশতাগণের আগমন, লূত (আ)-এর সপরিবারে নিরাপদ আশ্রয়ে প্রস্থান, অতঃপর তাহাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিলের বিবরণ সামান্য পার্থক্যসহ মোটামুটি কুরআন মজীদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। খৃস্টান লেখকগণের রচিত বিশ্বকোষসমূহে লূত (LOT) শিরোনামের অধীনে বাইবেলের বর্ণনাই সন্নিবেশিত হইয়াছে (উদাহরণস্বরূপ দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ১১, ১২, ১৩; ১৪, ১৮ ও ১৯ অধ্যায় এবং লূক, ১৭ : ২৮-২৯; আরও দ্র. Ency. Brit., ১৯৬২ খৃ, ১৪খ, পৃ. ৪০১; Colliers Ency., vol. 15, P. 20; Ency. Religion, MacMillan & Co., New York 1987; Americana, vol 17, P. 758)
কিন্তু বাইবেল হযরত লূত (আ) ও তাঁহার অবিবাহিতা কন্যাদ্বয়ের প্রতি এক চরম ঘৃণাই অপবাদ আরোপ করিয়াছে (দ্র. আদিপুস্তক, ১৯ ও ৩১-৩৮), যাহা বাস্তব পরিস্থিতি, বুদ্ধি, যুক্তি ও বিবেকের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যে পরিস্থিতি হইতে আল্লাহ তাআলা লূত-পরিবারকে রক্ষা করিয়াছেন, যেই প্রকারের নৈতিক পাপাচারের কারণে আল্লাহ তাআলা সাদূমবাসীকে ধ্বংস করিয়াছেন, উন্নত নৈতিক গুণের কারণে তাহা হইতে পরিত্রাণপ্রাপ্ত একটি পরিবার কখনও নিকৃষ্ট নোংরামি ও ভ্রষ্টতায় লিপ্ত হইতে পারে না। পরিস্থিতির বিশ্লেষণপূর্বক মানুষের সুস্থ বুদ্ধি এই সাক্ষ্যই দিবে। কুরআন মজীদে হযরত লূত (আ)-এর যে মহান মর্যাদার উল্লেখ রহিয়াছে এবং তাঁহার স্ত্রী ব্যতীত তাঁহার পরিবারের সদস্যগণের যে প্রশংসা করা হইয়াছে, ইহার ভিত্তিতে বলা যায় যে, সেই পরিবারের প্রতি প্রচলিত বাইবেলে ঐরূপ জঘন্য একটি অপবাদ আরোপ করিয়া চরম অন্যায় করা হইয়াছে। হযরত লূত (আ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :
“আর আমি তকে দিয়াছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান এবং তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলাম এমন এক জনপদ হইতে যাহার অধিবাসীরা লিপ্ত ছিল অশ্লীল কর্মে… এবং আমি তাহাকে আমার অনুগ্রহভাজন করিয়াছিলাম। সে ছিল সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত” (২১ : ৭৪-৭৫)।
“আরও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম ইসমাঈল, আল-ইয়াসাআ, ইয়ূনুস ও লূতকে। ইহাদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছিলাম” (৬ : ৮৬)।
তাঁহার পরিবার এবং তাঁহার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন বংশধর সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী ।
“আর তাহাদের পিতৃপুরুষ, বংশধর ও ভ্রাতৃবৃন্দের কতককে (বিশ্বজগতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছিলাম)। আমি তাহাদেরকে মনোনীত করিয়াছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ : ৮৭)।
আল্লাহ তাআলা যাহাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন, কোন শক্তিই তাহাদেরকে বিন্দুমাত্র পথভ্রষ্ট করিতে পারে না।
“আল্লাহ যাহাকে সৎপথ দেখান সে-ই সৎপথ পায়” (৭ : ১৭৮; আরও দ্র. ১৭ ও ৯৭ এবং ১৮ ১৭)।
হযরত লূত (আ)-এর পরিবারটিকে আল্লাহ তা’আলা সৎপথ দেখাইয়াছেন এবং তাহারা গোটা সাদূমবাসীর যথেচ্ছ পাপাচারের মধ্যেও নিজেদের ঈমান ও আমল সুষ্ঠু রাখিয়া আল্লাহর নিকট হইতে মুমিন পরিবার (দ্র. ৫১ : ৩৬) হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হইয়াছে।
গ্রন্থপঞ্জী : (১) আয়াতসমূহের তরজমার জন্য আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯শ মুদ্রণ, ঢাকা ১৪১৭/১৯৯৭ (২) ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ফিত-তারীখ, ১ম সং, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭, সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠা নং নিবন্ধগর্ভে প্রদত্ত; (৩) ইবুন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, দারুল ফিকার আল-আরাবী, বৈরূত তা.বি.; (৪) ছাআলিবী, কাসাসুল আম্বিয়া, (আল-মুসাম্মা বিহি আরাইসুল মাজালিস), তা, বি.; (৫) আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল বৈরূত তা.বি.,.১, পৃ. ৪৮; (৭) হাকেম নীশাপূরী, আল-মুসতাদরাক, দারুল কিতাব আল-আরাবী, বৈরূত তা.বি., ২খ, পৃ. ৫৬০-৫৬৩; (৮) মালিক গোলাম আলী এ্যান্ড সন্স লিঃ, আনওয়ারে আম্বিয়া, ৫ম সং, লাহোর-হায়দরাবাদ-করাচী ১৯৮৫ খৃ., পৃ. ৩৯-৪৫; (৯) মুহাম্মাদ জামীল আহমাদ, আম্বিয়ায়ে কুরআন, করাচী-পেশাওয়ার-হায়দরাবাদ- লাহোর, তা.বি., ১খ, পৃ. ২৩৩-২৫৩; (১০) কাযী যায়নুল আবিদীন, কাসাসুল কুরআন, ১ম সং, দেওবন্দ ১৯৯৪ খৃ., পৃ. ১৪৩-১৫২; (১১) হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন (বাংলা অনু.), ৪র্থ মুদ্রণ, ঢাকা ১৯৯৯ খৃ., ১খ, পৃ. ২০৩-২০৫, ২৫২-২৭৪; (১২) আল-মাসউদী, মুরূজুয যাহাব ওয়া মাআদিনুল জাওহার, দারুল আন্দালুস, ৫ম সং, বৈরূত ১৯৮৩ খৃ., পৃ. ৫৭-৫৮; (১৩) য়াকূত আল-হামারী, মুজামুল বুলদান, বৈরূত তা.বি., ৩, পৃ. ২০০-২০১; (১৪) ইবন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, ১ম সং, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭, পৃ. ২৫; (১৫) ইমাম রাযী, তাফসীরে কবীর, বৈরূত তা.বি., ১৭খ, পৃ. ৩২, ৩৪; ২২খ, পৃ. ১৯০; (১৬) আল-আসী, রূহুল মাআনী, বৈরূত তা.বি., ১২খ, পৃ.১০৬, ১৭খ, পৃ. ৭০; (১৭) আয-যামাখশারী, তাফসীরে কাশশাফ, বৈরূত তা,বি., ২খ, পৃ. ১৮৩, ৫৭৮; (১৮)
কুরতুবী, আহকামুল কুরআন, বৈরূত ১৯৬৬ খৃ., ৯খ, পৃ. ৭৬, ৭৮, ২৭খ, পৃ. ১২০; (১৯) ইবন জারীর আত-তাবারী, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম, ৩য় সং, বৈরূত ১৩৯৮/১৯৭৮, ২৭খ, পৃ. ৪৭; ১২খ, পৃ. ৫৫, ৫৬; ৮খ, পৃ. ১৬৫-৬। (মিসরীয় সংস্করণ-যাহা ৪০ খণ্ডে সমাপ্ত) ১১খ, পৃ. ৫১২; ১২খ, পৃ. ৫৫০; ১৫খ, পৃ. ৪১৮-৯; (২০) আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী, তাফসীরে মাজেদী (উর্দু), লাহোর-করাচী তা, বি., পৃ. ৩০০ ও ৪৭৫; (২১) তাফসীরে উছমানী, সৌদী সংস্করণ, সংশ্লিষ্ট আয়াতাধীন তাফসীর; (২২) সায়্যিদ মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন (উর্দু), সংশ্লিষ্ট সূরাসমূহের সংশ্লিষ্ট আয়াতাধীন টীকা; (২৩) মুফতী শফী, মাআরিফুল কুরআন (উর্দু), ২য় সং, লাহোর ১৪০২/১৯৮২, ২খ, পৃ. ৪৯৩, ৩খ, পৃ. ৭৬, ৭৭ ও ৫৭৩-৫; (২৪) সায়্যিদ কুতব শহীদ, ফী জিলালিল কুরআন, ১১শ সং, কায়রো-বৈরূত ১৪০১/১৯৮১, ৪খ, পৃ. ১৯১৪; (২৫) সহীহ আল-বুখারী, কলিকাতা সং.; (২৬) সহীহ মুসলিম, দেওবন্দ সং; (২৭) জামে আত-তিরমিযী, দিল্লী সং; (২৮) সুনান নাসাঈ (আল-মুজতাবা), দেওবন্দ সং; (২৯) সুনান আবী দাউদ, কলিকাতা সং; (৩০) আলী মুত্তাকী, কানযুল উম্মাল, ১ম সং, হলব ১৩৯৪/১৯৭৪, ১১ খ., পৃ. ৫০৫, নং ৩২৩৬১; (৩১) ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী, বৈরূত তা. বি., ৬খ, পৃ. ৪১৫-৬; (৩২) বাদরুদ্দীন আল-আয়নী, উমদাতুল কারী, বৈরূত তা. বি., ১৫খ, পৃ. ২৭০; (৩৩) ইবন কাছীর, তাফসীর, সংশ্লিষ্ট সূরার সংশ্লিষ্ট আয়াতাধীন ব্যাখ্যা; (৩৪) ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন, বৈরূত তা.বি., ২খ, পৃ. ৭৮৬-৭; (৩৫) আবদুর রাহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহ্ওয়াযী, মাতবাআতুল মারিফা, ৫খ, পৃ. ২১; (৩৬) আবদুর রাহমান আল-জাযীরী, কিতাবুল ফিক্হ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ, বৈরূত তা.বি., ৫খ, পৃ. ১৩৯-১৪৪।
পাশ্চাত্য উৎস : (৩৭) বাংলা বাইবেল, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি; (৩৮) Colliers Encyclopaedia, vol. 15, P 20; (39) Encyclopedia Americana, vol. 17, P. 758; (40) Encyclopedia of Religion, MacMillan Co., New York 1987, vol. P. 16-17, vol. 10, P. 1; (41) Encyclopaedia Britannica, 1962, vol. 1, P. 819, vol. 14, P. 401, vol. 15, P. 626.
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ