![]() |
গীতা-৪র্থ অধ্যায়-জ্ঞান যোগ শ্লোক ৭-৮ |
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।৭।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮।।
-হে ভারত (অর্জুন), যদা যদা হি (যে যে সময়ে) ধর্মস্য গ্লানিঃ (ধর্মের হানি, ক্ষীণতা), অধর্মস্য অভ্যুত্থানম্ (অধর্মের উদ্ভব) ভবতি (হয়), তদা (তখন) অহম্ (আমি, অর্থাৎ পুন্য-আত্মা / জীবাত্মা) আত্মানং সৃজামি (আপনাকে সৃজন করি, অর্থাৎ শরীর ধারণ পূর্বক অবতীর্ণ হই)। তাৎপর্যঃ[লোক কল্যানের জন্য পরমাত্মার কৃপায় জন্মগ্রহণ করি ]
সাধুনাং পরিত্রাণায় (সাধুদিগের রক্ষার জন্য), দুস্কৃতাং বিনাশায় (দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য) ধর্মসংস্থাপনার্তায় চ (এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য) [আমি / জীবাত্মা] যুগে যুগে সম্ভবামি (যুগে যুগে অবতীর্ণ হই)।
সরলার্থঃ হে ভারত (অর্জুন), যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি (জীবাত্মা) সেই সময়ে দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই।
বিঃদ্রঃ এখানে ঈশ্বরের অবতার মিথ্যা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। যজুর্বেদ ৪০।৮ অনুযায়ী অজন্মা, স্বয়ম্ভূ, নিরাকার, শরীররহিত, স্নায়ু আদির বন্ধন রহিত। শ্রীকৃষ্ণ সয়ং ঈশ্বরও নন। অথর্ব্বেদ।কাং১০।প্রপাঃ২৩।অনুঃ৪।মং২০ "যিনি সকল পদার্থ উৎপন্ন করিয়া ধারণ করিতেছেন তিনিই পরমাত্মা"। ঈশ্বরের অবতার হয় না। কারণ, "অজ একপাৎ"[যজুঃ ৩৪।৫৩] "সপর্য়গাচ্ছুক্রমকায়ম্" ইত্যাদি যজুর্বেদের [৪০।৮] বচনে ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না সিদ্ধ হয়। ভ০গী০ ৪।৭ বেদ বিরূদ্ধ বচন, কিন্তু এইরূপ হইতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ ধর্মাত্মা ছিলেন এবং তিনি ধর্মের রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। "আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া শ্রেষ্ঠদিগকে রক্ষা এবং দুষ্টদিগকে বিনাশ করিয়া থাকি" এরূপ বলিয়াছিলেন তাহাতে কোন দোষ নাই। কারণ তিনি পুন্যাত্মা যোগীপুরুষ " পরোপকারায় সতাং বিভূতয়ঃ"; সৎপুরুষদিগের দেহ মন-ধন পরোপকারের জন্য। সুতরাং ইহা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর ইহা প্রমাণিত হয় না।
তে ব্রহ্মলোকে হ পরান্তকালে পরামৃতাৎ পরিমুচ্যন্তি সর্ব্বে।। [মুন্ডক ৩।২।৬]
মুক্ত জীবগন মুক্তি অবস্থায় ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া বহ্মে আনন্দ ভোগ করিয়া, পুনরায় মহাকল্পের (৩৬০০০ বার সৃষ্টি ও প্রলয়) পর মুক্তিসুখের অবসানে সংসারে প্রত্যাগমন করে। মহাকল্পের গনণা এইরূপঃ- তেতাল্লিশ লক্ষ, বিশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যগী; দুই সহস্র চতুর্যুগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এই রূপ বার মাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এক পরান্ত কাল হইয়া তাকে। মুক্তিসুখ ভোগের এই পরিমাণ কাল। মুক্তি জন্ম-মরণ সদৃশ নহে। কারণ (৩৬০০০) ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হইতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্য্যন্ত জীবদিগের মুক্তির আনন্দে তাকা এবং দুঃখ না থাকা কি সামান্য কথা..?
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হওয়া সত্ত্বেও য়েমন জীবনধারণের উপায় অবলল্বন করা হয়, সেরূপ মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া জন্মগ্রহণ করিতে হইলেও মুক্তির উপায় অবলল্বন করা নিতান্ত প্রয়োজনীয়।
বেদার্থ না জানিয়া সাম্পরদায়িক লোকদিগের দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া নিজের মূর্কতাবশতঃ ভ্রমজালে আবদ্ধ হইয়া অবতারবাদ সৃষ্টি করিয়াছেন। অনেক মনে প্রশ্ন আসিতে পারে যদি ঈশ্বরের অবতার না হয়, তবে কংস, রাবণ, দূর্য়োধন প্রভৃতি দুর্বত্তগণের বিনাশ কীরূপে হইতে পারে..? উত্তর- প্রথমতঃ যে জন্মগ্রহণ করে, সে অবশ্যই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। যদি ঈশ্বর অবতার দেহ ধারণ ব্যতীত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, তাঁহার নিকট কংস, রাবণ, দর্য়োধনাদি একটা কীট তুল্যও নহে। তিনি সর্বব্যাপক [ঋগ্বেদ ১।২।৭।১৬] বলিয়া ইহাদের শরীরেও পরিপূর্ণ হইয়া আছেন। যখনই ইচ্ছা তখনই মর্মচ্ছেদন করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিতে পারেন। যাহারা এই অনন্ত গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট পরমাত্মাকে একটি ক্ষুদ্র জীবের বধের জন্য জন্ম-মরণশীল বলে, তাহারা মূর্খ ভিন্ন অন্য কি বা হতে পারে।
যদি কেহ বলেন যে, ভক্তজনের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাহাও সত্য নহে। কারণ যে সকল ভক্ত ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে চলেন, তাঁহাদিগকে উদ্ধার করিবার পূর্ণ সামর্থ্য ঈশ্বরের আছে। পৃথিবী ও চন্দ্রসূর্য্যাদি সমন্বিত বহ্মান্ডের (জগতের) সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপ [ঋগ্বেদ ১।৬।১৬।১০] কর্ম্ম অপেক্ষা কংস-রাবণাদির বিনাশ, অর্জূনকে উপদেশ ইত্যাদি কি গুরুতর কর্ম্ম..??
তর্কের খাতিরে কেহ "অহং ব্রহ্মাস্মি" শব্দের দ্বারা কুযুক্তি দাঁড়কারিয়া শ্রীকৃষ্ণকেই ব্রহ্ম প্রমাণের চেষ্টা করেন। "অহং ব্রহ্মাস্মি" ইহা বেদ বাক্য নহে, কিন্তু ব্রাহ্মণগ্রন্থের বচন। এগুলি মহাবাক্য বলিয়া কোন সত্য শাস্ত্রে লিখিত হয় নাই। (অহম্) আমি (ব্রহ্ম ) অর্থাৎ ব্রহ্মস্থ (অস্মি) আছি। সকল পদার্থ ব্রহ্মস্থ বটে, কিন্তু জীব যেমন সাধর্ম্ম্যযুক্ত ও নিকটস্থ, অন্য কিছু তদ্রূপ নহে। আর জীবের ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে এবং মুক্তিতে জীব ব্রহ্মের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে থাকে। অর্থাৎ জীব বহ্মের সহচারী, জীব এবং ব্রহ্ম এক নহে। যেমন কেহ কাহাকে বলে "আমি ও এই ব্যাক্তি এক" অর্থাৎ অবিরোধী, সেরূপ যিনি সমাধিস্থ অবস্থায় পরমেশরের প্রমে বদ্ধ হিয়া তাহাতে নিমগ্ন তাকেন, তিনি বলিতে পারেন, "আমি এবং ব্রহ্ম এক অর্থাৎ অবিরোধী, অর্থাৎ এক অবকাশস্থ"। পরমেশ্বর জীব শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া জীবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্টের ন্যায় থাকিয়া বেদদ্বারা সমস্ত নাম রূপাদি বিদ্যা প্রকাশ করেন। তিনি শরীরের মধ্যে জীবকে প্রবিষ্ট করিয়া স্বয়ং জীবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া আছেন। অথর্ব্ব ১০।২৩।২০ অনুযায়ী পরমেশ্বর ঋগ্বেদ,যজুর্বেদ,সামবেদ এবং অতর্ব্ববেদ সৃষ্টির আদিতে প্রকাশিত হয়েছিল। শত০ব্রা০ ১১।৪।২।৩,মনুস্মৃতি ১।২৩ সুতরাং পরে মনুষ্যদিগকে বেদ জ্ঞান প্রদানের জন্যও শরীর ধারণের প্রয়োজন পড়ে না।
অনেকে বলেন ঈশ্বর শরীর ধারণপূর্ব্বক অবতীর্ণ হিতে পারেন না, ইহার বিচার নিষ্প্রয়োজন; কেন না, তিনি ইচ্ছাময় ও সর্ব্বশক্তিমান্ [ঋগ্বেদ ১।৭।১৯।৮]- এমন কথা বলিলে তাঁহার শক্তির সীমা নির্দ্দেশ করা হয়। যিনি অসম্ভব কার্য্য করিতে পারেন, তাঁকেই কি সর্ব্বশক্তিমান্ বলে..? যদি ঈশ্বর অসম্ভব কার্য অর্থাৎ কারণ ব্যাতীত কার্য্য় উৎপন্ন করিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি কারণ ব্যতীত দ্বিতীয় ঈশ্বর সৃষ্টি করিতে, স্বয়ং মৃত্যুগ্রস্থ হইতে এবং জড়, দুঃখী, অন্যায়কারী, অপবিত্র ও দুস্কর্মকারী ইত্যাদিও হইতে পারেন কি না..??!! ঈশ্বরের নিয়ম সত্য ও পূর্ণ বলিয়া তিনি তাহার পরিবর্ত্তন করিতে পারেন না, তিনি ন্যায়ধিশ। সুতরাং সর্ব্বশক্তিমান[ঋ০২।৮।১২।২] শব্দের অর্থঃ এই পর্য্যন্তই যে, পরমাত্মা কাহারও সাহায্য ব্যাতীত নিজের সকল কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারেন।
যুক্তি দ্বারাও ঈশ্বেরে জন্ম বা ঈশ্বরের অবতার [অংশাবতার ও পূর্ণাবতার] সিদ্ধ হয় না । অবতার
( আক্ষরিক অর্থে অবতরণকারী ) বৈদিক সাহিত্যে অবতার শব্দটি পাওয়া যায় না। [Daniel E Bassuk (১৯৮৭)। Incarnation in Hinduism and Christianity: The Myth of the God-Man। Palgrave Macmillan। পৃষ্ঠা 2–4। ] যেমন, যদি কেহ বলে যে, আনন্ত আকাশ ঘর্বস্থ হইল, অথবা মুষ্টি দ্বারা ধৃত হইল, তবে তাহা কখনও সত্য হইতে পারে না। কারণ আকাশ অনন্ত ও সর্ব্বব্যাপক। অতএব আকাশ ভিতরেও যায় না বাহিরেও আসে না। সেইরূপ পরমাত্মা অনন্ত ও সর্ব্বব্যাপক বলিয়া তাঁহার গমনাগমন কখনও সিদ্ধ হইতে পারে না। যে স্থানে যাহা নাই, সে স্থানেই তাহার গমনাগমন হইতে পারে। পরমেশ্বর কি গর্ভে ব্যাপক ছিলেন না যে, অন্য কোন স্থান হইতে আসিলেন..? তিনি কি বাহিরে তাকেন না যে, ভিতর হিতে বহির্গত হইলেন..? ঈশ্বর সম্বন্ধে বিদ্যাহীন ব্যতীত আর কে এইরূপ বলিতে ও বিশ্বাস করিতে পার ??!! অতএব ঈশ্বরের গমানাগমন ও জন্মমরণ সিদ্ধ হইতে পারে না।
আরো কতকগুলি লোক আছেন যে, তাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁহারা বলেন, ঈশ্বর নির্গুণ। সগুণেরই অবতার সম্ভব। ঈশ্বর নির্গুণ, সুতরাং তাঁহার অবতার অসম্ভব। অজ্ঞানী এবং অবিদ্বানদিগের কল্পনা এইরূপ যে নিরাকারকে নির্গুণ এবং সাকারকে সগুণ বলে অর্থাৎ পরমেশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না তখন নির্গুণ এবং যখন অবতার গ্রহন করেন তখন তাঁহাকে সগুণ কহা যায়। এই ধরনের এতদ্বারা বুঝিতে হইবে, সম্প্রদায় ভিত্তিক যে অবতার তাঁরা ঈশ্বরের অবতার নহেন। কারণ রাগ, দ্বেষ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, শোক, সুখ, জন্ম এবং মৃত্যু প্রভৃতি গুণ ও ধর্ম্ম বিশিষ্ট বলিয়া তাঁহারা মনুষ্য ছিলেন। পরমাত্মা সগুণ ও নির্গুণ উভয় প্রকারে প্রকাশিত হয়েন। সগুণ ও নির্গুণ বলিতে কি বোঝা আবশ্যক। যেমন জড়ের গুণ রূপাদি এবং চেতনের জ্ঞানাদি গুণ নাই, তদ্রুপ চেতনের ইচ্ছাদিগুণ এবং উহাতে জড়ের রূপাদি গুণ নাই। এইজন্য "যদগুণৈঃ সহ বর্ত্তমানং তৎ সগুণম্", "গুণেভ্যো যন্নির্গতং পৃথগ্ভূতং তন্নির্গুণম্", যাহা গুণের সহিত বর্ত্তমান উহাকে সগুণ এবং যাহা গুণরহিত উহাকে নির্গুণ কহে। নিজ নিজ স্বাভাবিক গুণের সহিত যুক্ত হওয়াতে এবং অপর বিরোধীয় গুণ রহিত হওয়াতে সকল পদার্তেরই সগুণতা এবং নির্গুণতা অথবা কেবল সগুণতা হইয়া তাকে, কিন্তু একেই সগুণতা এবং নির্গুণতা সর্ব্বদা থাকে। তদ্রূপ পরমেশ্বর আপনার অনন্ত জ্ঞান ও বলাদি গুণ বশতঃ সগুণ এবং জড়ের রূপাদি ও জীবের দ্বেষাদি গুণ হইতে পৃথক্ বলিয়া নির্গুণ কথিত হয়েন।
উপরিউক্ত শ্লোকে (গীতা ৪।৭-৮) "ধর্ম্মসংরক্ষণ" কি কেবল দুই একটা দুরাত্মা বধ করিলেই হয়..? ধর্ম্ম কি..? তাহার সংরক্ষন কি কি প্রকারে হইতে পারে সে বিষয় বিচারণীয়।
ধর্ম বিষয়ে মহাভারত কর্ণপর্বে বলাহয়েছেঃ-
" ধারণাত্ ধর্ম ইত্যাহুঃ ধর্মো ধারয়তি প্রজাঃ।
যঃ স্যাত্ ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।।"কর্ণপর্ব ৬৯।৫৮
অর্থাৎঃ সমাজকে, প্রজা সাধারণকে ধারণ করে রাখে যা তাই ধর্ম্ম, ইহা এমন এক সদাচার যা ধারণ করলে আত্মার উন্নতি ও মোক্ষ প্রাপ্তির পথ সুগম হয় ও সমাজ ব্যবস্থা ঠিক থাকে। সমাজের সমৃদ্ধি, কল্যাণ হয়, তাই বিচার করে
সেটিই ধর্ম্ম, তাই স্থির করতে হয়। মনুস্মৃতি ৬ষ্ঠ অং ৯২ শ্লোকে মনুমহারাজ ধর্ম্মের লক্ষন ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন "ধৃতিঃ ক্ষমা দম অস্তেয় শৌচং ইন্দ্রনিগৃহ। ধীঃ বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকম ধর্মস্য লক্ষণম্।।"
অর্থাৎ,
ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ- এই দশটি ধর্ম্মের লক্ষণ।
১.ধৃতি-ধারণা করা স্মরণ রাখিবার শক্তি।
২.ক্ষমা-কেহ অপকার করিলে যে তাহার প্রত্যপকারে প্রবৃত্তি হয়,সেই প্রবৃত্তিকে যে শক্তি দ্বারা নিরোধ করা যায়।
৩.দম-শোক,তাপাদি দ্বারা কোন প্রকার চিত্তবিকৃতি উপস্থিতি হইলে,যে শক্তি দ্বারা ঐ প্রবৃত্তির নিরোধ করা যায়।
৪.অস্তেয়-অবিধি পূর্ব্বক পরস্ব গ্রহণের প্রবৃত্তিকে যে শক্তি দ্বারা নিরূদ্ধ করা যায়।
৫.শৌচ-শরীর ও চিত্তের নির্ম্মলভাব।
৬.ইন্দ্রিয়নিগ্রহ-যে শক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে বিষয় হইতে নিরুদ্ধ করা যায়।
৭.ধী- শাস্ত্রাদি দ্বারা বস্তুর তত্ত্ব নিশ্চয় শক্তি-ধীশক্তি
৮.বিদ্যা- যে শক্তি দ্বারা অন্তরস্থ চৈতন্য স্বরূপ পরমাত্মার আন্তরিক প্রত্যক্ষ করা যায়,শরীরাদি হইতে আপনাকে পৃথকরূপে জানা যায়, যে শক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি অভিমান প্রভৃতি অন্তরস্থ পদার্থ সকল আম্র ও কাঁঠালের রসাস্বাদের ন্যায় পৃথক্ পৃথক্ রূপে জাজ্জল্যমান মানসিক প্রত্যক্ষ করিতে পারে।
৯.সত্য- কায় মন ও বাক্য দ্বারা সম্পূর্ণ যথার্থ আচরণ করা।
১০.অক্রোধ- যে শক্তি দ্বারা ক্রোধকে নিরুদ্ধ করা যায়
এই দশটি এবং বৈরাগ্য,ঔদাসীন্য,ভক্তি,শ্রদ্ধা,প্রেম,সন্তোষ প্রভৃতি কতকগুলি সৎগুণ। এতৎ সমস্তের মধ্যে আত্মবোধের ক্ষমাতাটিই সর্ব্বোচ্চ পরম ধর্ম্ম
*কেহ কেহ ধৈর্য্যকেই ধৃতি বলিতে চাহেন, কিন্তু তাহা নিতান্ত ভ্রম। যে ধৈর্য্যকে তাঁহারা ধৃতি বলিতে চাহেন,সেই ধৈর্য্য পরোক্ত দম শক্তি ও ইন্দ্রিয়
নিগ্রহাদি শক্তির মধ্যে অন্তর্নিহিত সুতরাং এখানে আবার ধৈর্য্য অর্থ করিলে মনুর পুনরুক্তি দোষ ঘটে।
পরমাত্মা বিষয়ে উপনিষদ্ ও দর্শন শাস্ত্রঃ-
"স য এষোণিমা। ঐতদাত্ম্যমিদ সর্ব্বং তৎসত্য স আত্মা তত্ত্বমসি..।।" ছান্দোঃ ৬।৮ মঃ ৬।৭
-পরমাত্মা জানিবার যোগ্য; তিনি অতি সূক্ষ এবং এই সমস্ত জগৎ এবং জীবের আত্মা। তিনিই সরূপ এবং নিজেই নিজের আত্মা। মূলে মূলাভাবাদমূলং মূলম্।। সাংখ্য সূ০ ১।৬৭ মূলের মূল অর্থাৎ কারণের করাণ হয় না শূন্যের জ্ঞাতা শূন্য নহে।
"ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা নানৈর্দেবৈঃস্তপসা কর্মনা বা"[মুন্ডক উপনিষদ ১।১।৬]
-ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যপী, অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিত্য এবং সর্বভূতের কারন।
গীতা-২য় অধ্যায়-সাংখ্য-যোগ
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।১৯।।
তাৎপর্যঃ "আমি" শব্দের অর্থ আত্মা, যে আত্মা কাহাকেও বধ করে না, বা তাহাকে কেঃ বধ করিতে পারে না; অর্জুনের সে ভ্রমদূর হইয়াছিল।
মহাভারত ভীষ্মপর্ব্ব হিন্দি পিডিএফ👈
মহাভারত প্রক্ষিপ্ত বিষয়ে আলোকপাতঃ-
মহাভারতের মধ্যে কোনটি মূল কাহিনীর অংশ, কোনটি পরের কালের যোজনা বা প্রক্ষিপ্ত তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে; আমার নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিতে কিছু নির্বাচন করেছি। প্রামাণ মহাভারত রামচন্দ্র শাস্ত্রী কিঞ্জবভেরকর ও নীলকন্ঠ টিকা সহ মহাভারত। ভীস্মপর্বের সংশোধিত সংস্করণ সংকলন করেছেন ডঃ শ্রীপদ কৃষ্ণ বলভেলকর। মহাভারতের প্রমাণ (বৃহৎ) সংস্করণে ভীষ্মপর্বে ১২২ অধ্যায়, ৫৮৬৯ শ্লোক আছে। সংশোধিত সংস্করণে ১১৭ অধ্যায় ও ৫৪০৬ শ্লোক করা হয়েছে; অর্থাৎ মোট ৪৬৩ শ্লোক বাদ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ-যোগ্য বাদ হল প্রমাণ সংস্করণের ২৩ অধ্যায়ের কৃষ্ণের উপদেশ মত অর্জূন কর্তৃক দুর্গাস্তোত্র।
প্রথমদিনের যুদ্ধ বিবরণের মধ্যে ভীষ্মসহ যুদ্ধ ও মৃত্যু বিবরণ ৪৭।৪৩-৬৭ শ্লোক ও ৪৮ অধ্যায় সম্পূর্ণ-মোট ১২৯ শ্লোক পরে যোজিত বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই শতকে দুর্গাপূজা প্রবর্তন হয় নাই। ডঃ কিঞ্জবডেকরের মন্তব্য এগুলো প্রক্ষিপ্ত। অবশিষ্ট অধ্যায়গুলি হতে মধ্যে মধ্যে দুটি তিনটি করে শ্লোক বাদ , মধ্যে মধ্যে অধ্যায় ও শ্লোকের পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য আর কোন বাদ নাই।
প্রথমদিনের যুদ্ধ বিবরণের মধ্যে ভীষ্মসহ যুদ্ধ ও মৃত্যু বিবরণ ৪৭।৪৩-৬৭ শ্লোক ও ৪৮ অধ্যায় সম্পূর্ণ-মোট ১২৯ শ্লোক পরে যোজিত বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই শতকে দুর্গাপূজা প্রবর্তন হয় নাই। ডঃ কিঞ্জবডেকরের মন্তব্য এগুলো প্রক্ষিপ্ত। অবশিষ্ট অধ্যায়গুলি হতে মধ্যে মধ্যে দুটি তিনটি করে শ্লোক বাদ , মধ্যে মধ্যে অধ্যায় ও শ্লোকের পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য আর কোন বাদ নাই।
প্রমাণ সংস্করণের ১৪ অধ্যায়ে দীর্ঘ ধৃতরাষ্ট্রবিলাপ ৬৫।২৭ হতে ৬৮।২০ বাসুদেবের মহিমাকীর্তন প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। উল্লেখ্য সঞ্জয় কৌরব শিবিরে পরামর্শ সভায় থাকতেন; আবার দিনশেষে হস্তিনাপুরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সব বর্ণনা করতেন। অনেকের ধারনা সঞ্জয় রাজপ্রাসাদে বসে বসে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে লাইভ সবকিছু দেখতেন ও সরাসরি মহারাজ কে বর্ননা করতেন !! কিন্তু ঘটনা তেমন নয়।
ভীষ্মপর্বের ১৩ অধ্যায়ে আছে যুদ্ধের দশম দিনে সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্র হতে অকস্মাৎ এসে ধৃতরাষ্ট্রকে জানালো যে ভরতকুলের পিতামহ্ ভীষ্ম শিখন্ডীর হস্তে নিহত হয়েছেঃ
"অথ গাবল্লনির্বিদ্বান্ সংয়ুগাদেত্য ভারত।
ধ্যায়তে ধৃতরাষ্ট্রায় সহসোৎপত্য দুঃখিত।
আচষ্ট নিহতং ভীষ্মং ভরতানাং পিতামহম্।।"
ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ করলেন এবং বিস্তারিত বিবরণ শুনতে চাইলেন। তখন সঞ্জয় প্রতম দিনের যুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে ধারাবাহিক ভাবে দশদিনের যুদ্ধ বিবরণ বলে গেল, যেন সব চোকের সামনে দেখাচ্ছে; সেই সময় ভগবদ্গীতা আবৃত্তি করেন যেন তিনি সব কথা শুনতে পাচ্ছেন। দ্রোণপর্ব, কর্নপর্ব,শল্য পর্ব ইত্যাদি দেখলে এই ধরনের যুদ্ধভূমি থেকে সঞ্জয়ের হস্তিনাপুরে এসে যুদ্ধের ধারাবাহিক বর্ননা শোনানোর ঘটনা দেখা যায়। হস্তিনাপুর থেকে যুদ্ধক্ষেত্র অন্যূন্য ৭০-৭৫ মাইল হবে। ভগবান শ্রীপরাশসুত কৃষ্ণদ্বৈয়পায়ন বেদব্যাস বিরচিত অষ্টাদশপর্ব সমন্বিত শান্তরস পরিপ্লুত মাহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫-৪২ পর্যন্ত অষ্টাদশ অধ্যায় সংকলিত অংশ শ্রীমদ্ভগবৎগীতা নামে পরিচিত। সংক্ষেপে বলা যায় যে মূল মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ মানবরূপে চিত্রিত, গীতায় তাঁকে ভগবান রূপে পরে কেউ প্রকাশ করেছেন শ্লোক পরিবর্তন ও সংযোগ করে।আচার্য অগ্নিব্রতনৈষ্টিক জীর মতে এই ২৫-৪২ অধ্যায়ে কিছু অংশ অপ্রাসঙ্গিক কারন শ্রীকৃষ্ণ কোন সাধারন পুরুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন নি অর্জূন বেদ, উপনিষদ ইত্য়াদি বৈদিক শাস্ত্র গুরুকুলে অধ্যয়ন করেছিলেন। অর্জূন(ধনঞ্জয়) উভয় সৈন্যমধ্য়ে তাঁহার পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শশুর ও মিত্রগণ অবস্থিতি করেছেন দেখে তাঁর শরীর অবসন্ন হয় ও গান্ডীব হস্ত হতে পতিত হয়।
তিনি প্রাণধন পরিত্যাগে সমুদ্যত হইয়াছিলেন, সেই সময় তিনি দিশাহারা হয়েছিলেন। সেই সময় ভগবান্ (সন্মানসূচক বাক্য) শ্রীকৃষ্ণ অশ্রুপূর্ণলোচন বিষন্নবদন অর্জূনকে সেই সময়ের মোহ গ্রস্থ থেকে বের করে ধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন কিছু উপদেশ দিয়ে সে সময় তিনি কর্ম্মযোগ ও আত্মা, পরমাত্মা বিষয়ে কথপোকথন করেন। এই কথোপকথনে অনেক শ্লোক শ্রীকৃষ্ণ কে ঈশ্বর প্রমানের জন্য বৈষ্ণব ও ইসকন যুক্ত করেছে।
সেই সময়ের উপদেশ কোন আর্য সমাজী মানেন না অর্থাৎ গীতাকে মানে না তা নয়। তাঁরা সকলে গীতার অসামঞ্জস্য শ্লোক কে মানেন না। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বা ওনাকে যাঁরা অনুসরণ করেন আমার মতে তাঁরা সকলেই গীতাকে মানেন, যদি তা না হয় তবে ধরে নিতে হবে হয় তিনি গীতা স্বাধ্যায় করেন নি তা না হলে তিনি গীতার ওপর মনন-চিন্তন করতে অসামর্থ্য ।
আমি গীতার অনেক ভাষ্যর পিডিএফ দেখেছি ও পড়েছি সেই সবের মধ্যে ৭০ শ্লোকের গীতাও একটা যা ১৪৭৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বালীদ্বীপের হিন্দুরাজাদের অধীনে ছিলো পরে তা মুসলমানদের হাতে আসে পরে তা ডঃ দেসাই মহোদয় দ্বারা উদ্ধার হয়। এই মাত্র ৭০ টি শ্লোকের গীতাতে প্রচলিত ৭০০ শ্লোকী গীতার যাবতীয় বিষয় অতি সামঞ্জস্যের সঙ্গে সন্নিবেশিত আছে। ৭০ শ্লোকী গীতা দ্বিরুক্তি দোষ হতে মুক্ত, অনেক পন্ডিদের মতে এটা মূল প্রাচীন গীতা অংশ।
গীতার মধ্যে পরস্পর বিরোধী শ্লোক আছে, নানা সাম্প্রদায়িক মতও তেমনই আছে। গীতা পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসাবাদ ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতবাদে গীতা পরিপূর্ণ। গীতার শ্লোক সংখ্যা ৭০০ ইহার মধ্যে প্রাচীন মূল গীতার শ্লোক কোন গুলো অনেক মতভেদ আছে ও অনেক রিসার্চ হয়ে চলেছে।
গীতা বর্তমানে অনেক আছে প্রায় ৩৫-৪০ টা ভাষ্য তার মধ্যে শ্লোকর বৈপরীত্য দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ তার মধ্যে অন্যতম যাতে অনেক বেদ বিরোধী কথা দেখতে পাওয়া যায়। কুসংস্কারযুক্ত শ্লোক (রাজযোগ ,শ্লোক-২৫), বেদ বিরোধী শ্লোক (রাজযোগ, শ্লোক-৩২, গীতা ৯।১১) , পরস্পর বিরোধী শ্লোক (গীতা ৪।১৩ ও ৩।৩৫, ১৭।১১-১২-১৩)। আরো একটা কথা প্রসঙ্গে বলছি অনেক আর্য় র্পন্ডিত প্রযোজনার্থে অষ্টাদশ পুরাণের শ্লোক উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেন তার মানে এই নয় যে উনি ঐ পুরান কে সম্পূর্ণ মানেন । মনুস্মৃতির শ্লোক রেফারেন্স হিসাবে প্রয়োগ করা হয় আর তার প্রক্ষিপ্ত অংশের বিরোধিতা করা হয়, যা মহর্ষি দয়নন্দও করেছেন। বেদের অনেক ভাষ্যকারের ভাষ্যতে ভুল থাকলে আর্য সমাজের পন্ডিতরা প্রতিবাদ করেন ইত্যাদি এরকম অনেক কিছু আছে যা প্রকাশ্য বলা ঠিক নয় তাই লেখা শেষ করছি।
আমাদের সকলের উচিৎ সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত থাকা ও সমগ্র বেদ ধর্মের মূল (বেদ অখিলোধর্মমূলম) তাই বেদ বিরূদ্ধ কথা গ্রহণ না করা। আর্য সমাজের সাথে কারো বিভেদ নেই যা আছে তা অসত্যের ওপর বেদ বিরোধী প্রচারের ওপর মানবতার ওপর যারা কুঠারাঘাত করে তাঁদের ওপর সমস্ত কুসংস্কারের ওপর। গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ।।৬১।।
সেই সময়ের উপদেশ কোন আর্য সমাজী মানেন না অর্থাৎ গীতাকে মানে না তা নয়। তাঁরা সকলে গীতার অসামঞ্জস্য শ্লোক কে মানেন না। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বা ওনাকে যাঁরা অনুসরণ করেন আমার মতে তাঁরা সকলেই গীতাকে মানেন, যদি তা না হয় তবে ধরে নিতে হবে হয় তিনি গীতা স্বাধ্যায় করেন নি তা না হলে তিনি গীতার ওপর মনন-চিন্তন করতে অসামর্থ্য ।
আমি গীতার অনেক ভাষ্যর পিডিএফ দেখেছি ও পড়েছি সেই সবের মধ্যে ৭০ শ্লোকের গীতাও একটা যা ১৪৭৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বালীদ্বীপের হিন্দুরাজাদের অধীনে ছিলো পরে তা মুসলমানদের হাতে আসে পরে তা ডঃ দেসাই মহোদয় দ্বারা উদ্ধার হয়। এই মাত্র ৭০ টি শ্লোকের গীতাতে প্রচলিত ৭০০ শ্লোকী গীতার যাবতীয় বিষয় অতি সামঞ্জস্যের সঙ্গে সন্নিবেশিত আছে। ৭০ শ্লোকী গীতা দ্বিরুক্তি দোষ হতে মুক্ত, অনেক পন্ডিদের মতে এটা মূল প্রাচীন গীতা অংশ।
গীতার মধ্যে পরস্পর বিরোধী শ্লোক আছে, নানা সাম্প্রদায়িক মতও তেমনই আছে। গীতা পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসাবাদ ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতবাদে গীতা পরিপূর্ণ। গীতার শ্লোক সংখ্যা ৭০০ ইহার মধ্যে প্রাচীন মূল গীতার শ্লোক কোন গুলো অনেক মতভেদ আছে ও অনেক রিসার্চ হয়ে চলেছে।
গীতা বর্তমানে অনেক আছে প্রায় ৩৫-৪০ টা ভাষ্য তার মধ্যে শ্লোকর বৈপরীত্য দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ তার মধ্যে অন্যতম যাতে অনেক বেদ বিরোধী কথা দেখতে পাওয়া যায়। কুসংস্কারযুক্ত শ্লোক (রাজযোগ ,শ্লোক-২৫), বেদ বিরোধী শ্লোক (রাজযোগ, শ্লোক-৩২, গীতা ৯।১১) , পরস্পর বিরোধী শ্লোক (গীতা ৪।১৩ ও ৩।৩৫, ১৭।১১-১২-১৩)। আরো একটা কথা প্রসঙ্গে বলছি অনেক আর্য় র্পন্ডিত প্রযোজনার্থে অষ্টাদশ পুরাণের শ্লোক উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেন তার মানে এই নয় যে উনি ঐ পুরান কে সম্পূর্ণ মানেন । মনুস্মৃতির শ্লোক রেফারেন্স হিসাবে প্রয়োগ করা হয় আর তার প্রক্ষিপ্ত অংশের বিরোধিতা করা হয়, যা মহর্ষি দয়নন্দও করেছেন। বেদের অনেক ভাষ্যকারের ভাষ্যতে ভুল থাকলে আর্য সমাজের পন্ডিতরা প্রতিবাদ করেন ইত্যাদি এরকম অনেক কিছু আছে যা প্রকাশ্য বলা ঠিক নয় তাই লেখা শেষ করছি।
আমাদের সকলের উচিৎ সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত থাকা ও সমগ্র বেদ ধর্মের মূল (বেদ অখিলোধর্মমূলম) তাই বেদ বিরূদ্ধ কথা গ্রহণ না করা। আর্য সমাজের সাথে কারো বিভেদ নেই যা আছে তা অসত্যের ওপর বেদ বিরোধী প্রচারের ওপর মানবতার ওপর যারা কুঠারাঘাত করে তাঁদের ওপর সমস্ত কুসংস্কারের ওপর। গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ।।৬১।।
"ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।."
অর্থাৎঃ হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেনভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।."
श्रीमद्भगवद्गीता_स्वामी_समर्पणानन्द_सरस्वती_pdf 👈দেখুন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উক্ত শ্লোকে আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করি না বলে বলেছেন

হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন !!
পরবর্তী শ্লোকে তিনি বলেছেন
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।।৬২।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে। [এখানে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অর্থাৎ পরমেশ্বরের শরণাগত হতে বলেছেন]
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নিকট যে গীতামৃত কীর্ত্তণ করেছিলেন, সেই পবিত্র গীতাজ্ঞান অর্জুন ভুলে গিয়ে অশ্বমেধপর্বে শ্রীকৃষ্ণের নিকট পুণরায় শুনতে চান । তখন ভগবান শ্রীকৃষ বলেন, “তুমি নিশ্চয় দুর্ম্মেধা, তাই আমার সেই সকল কথা স্মরণ রাখিতে পার নাই ৷” তিনি আরও বলিলেন—
পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসস্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্ ৷৷-মহাভারত অশ্বমেধিক পর্ব্ব ১৬।১৩
অর্থাৎ— ‘তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷’-(মহাভারত, আশ্বমেধিকপর্ব্ব, অনুগীতা ১৩)
"তৎসর্ব্বং পুরুষব্যাঘ্র ! নষ্টং মে ভ্রষ্ট চেতসঃ"
[মহাভারত,আশ্বমেধিক অনুগীতাপর্ব্ব, ১৬।১৩]
মহাভারতের যুদ্ধের কিছুদিন পরেই শ্রীকৃষ্ণ পুনঃ সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন।
মহাভারত- অশ্বমেধিক পর্ব-অধ্যায়-১৭, শ্লোক-১১,১২,১৩ এখানে, শ্রীকৃষ্ণ পরিস্কার ভাষায় বলছেন,তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বিষয়ে বলেছেন।
ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনজ্ঞয়।
স হি ধর্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্মষা ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।
পরং হি ব্রহ্মা কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন)হে, ধনজ্ঞয়(অর্জুন),সেই সমস্ত কথা(গীতার বাণী) আমার পক্ষে বলা আর সম্ভব নয়।সেই ধর্মটি পরমাত্নার স্বরূপ জানবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।আমি এখন সেই সমস্ত কথা,পুনরায় বলতে পারব না।সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে,পরব্রহ্মের বিষয় বলেছিলাম।এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলছি।
শ্রী কৃষ্ণ যে যোগেশ্বর সেটা আমরা গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৭৫ ও ৭৮ শ্লোকে পাই।
ব্যাসপ্রসাদাচ্ছ্রুতবানেতদ্গুহ্যমহং পরম্৷
যোগং যোগেশ্বরাত্কৃষ্ণাত্সাক্ষাত্কথয়তঃ স্বয়ম্৷৷-গীতা ১৮/৭৫ শ্লোক
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।১৮।৭৮।।
অনুবাদঃ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।
অর্থ : ব্যাসদেবের কৃপায় এই পরম গোপনীয় যোগের উপদেশ আমি স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছিলাম।
যোগেশ্বর এর অর্থ,মহাযোগী,শ্রেষ্ঠযোগী বা যোগদ্বারা যিনি ঈশ্বর কে জেনেছেন।
শ্রুতি বলেন, সেই পরমতত্ত্ব অনুভব করতে পারলে পরমাত্মা সাক্ষাৎকার হলে হৃদয় গ্রন্থি ভেদ হয়, সর্ব্বসংশয় নাশ হয়, সকল কর্ম্মেরও হয় ক্ষয় [মুন্ডক ২।২।৮]; শ্রী কৃষ্ণ যদি 'স্বয়ং ভগবান'ই হন, তাহলে এহেন "নরাকৃতি পরব্রহ্মের" কাছে দেবদুর্লভ দিব্যচক্ষু লাভ করে অর্জ্জুনের "দর্শন"টি কী ধরনের হ'ল যে তিনি অল্পদিন পরেই সব ভুলে গেলেন !! নিজেই শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন,
গীতা-একাদশ-অধ্যায় ৪৭-৪৮
ময়া প্রসন্নেন তবার্জুনেদং
রুপং পরং দর্শিতমাত্মযোগাৎ।
তেজোময়ং বিশ্বমনন্তমাদ্যং
যস্মে ত্বদন্যেন ন দৃষ্টপূর্বম্।।৪৭।।
ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্ন দানৈ-
র্ন চ ক্রিয়াভির্ন তপোভিরুগ্রৈঃ।
এবংরূপঃ শক্য অহং নৃলোকে
দ্রষ্টুং ত্বদন্যেন কুরুপ্রবীর।।৪৮।।
"হে অর্জ্জুন ! কৃপাপরবশ হয়ে আত্মযোগসামর্থে তোমাকে যে বিশ্বরূপ দর্শন করালাম, এরূপ দর্শন ইতিপূর্ব্বে কেউ কখনও করেনি; বেদ যজ্ঞধ্যয়ন দানক্রিয়া উগ্র তপস্যাদির দ্বারাও নরলোকে এরূপ দর্শনে কেউ সক্ষম হয় না। [এখানেও বৈষ্ণবদের 'নরাকৃতি পরব্রহ্ম' পূর্ণ পরমাত্মার কিঞ্চিৎ স্মৃতিভ্রংশ দেখা যাচ্ছে ! কারণ দিব্যচক্ষু দান না করেই বল্যে মা যশোদাকে একবার আর কৌরব সভায় দুর্য্যোধন কর্ণাদি যখন তাঁকে বন্দী করতে চেয়েছিলেন তখন একবার-তাঁদেরকে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন(মহাঃ উদ্যোগপর্ব্ব,১৩১ অঃ)]।
একটু সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে ভেবে দেখলে বোঝাযায় এসব সাম্প্রদায়িক প্রচার মাত্র ! তাছাড়া কৃষ্ণজী তো নিজেই বলেছেন, "পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগ যুক্তেন তন্ময়া, আমা কর্ত্তৃক যোগযুক্ত অবস্থায় পরব্রহ্ম বিষয়ে তাহা কথিত হইয়াছিল!" কৈ ও খানে বলেননি তো, "আমাকর্ত্তৃক আমার নিজের বিষয়ে যাহা কথিত হইয়াছিল ?"
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।গীতা ৪।৭।।
এখানে বলা হয়নি যে ঈশ্বর নিজে সৃষ্টি হন বা অবতরণ করেন, কারণ এমন কোন স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে ঈশ্বর থাকে না। এখানে মূলত বলা হয়েছে ঈশ্বর জীবাআত্মাকে প্রকাশ করেন। ধর্মের যখন গ্লানি হয় তখন সময়ে সময়ে আমরা এই ধরণে ধর্মাত্মাদের দেখেছি। আর মুক্তি প্রাপ্ত, মুক্ত আত্মা যে নিজের ইচ্ছা মত অবতরণ করতে পারেন তা নিচের কিছু উদাহরণ থেকে প্রমাণ হয়।
শতপথ ব্রহ্মণ গ্রন্থ থেকে দেখুন-
"শৃণ্বন্ শ্রোত্রং ভবতি, স্পর্শয়ন্ ত্বগ্ভবতি, পশ্যন চক্ষুর্ভবতি,রসয়ন্ রসনা ভবতি, জিঘ্রন্ ঘ্রাণং ভবতি, মন্বানো মনো ভবতি, বোধয়ন্ বুদ্ধির্ভবতি, চেতয়ঁশ্চিত্তম্ভবত্যহঙকুর্বাণো হঙ্কারো ভবতি।।"
(শতপথ ব্রাহ্মণ কাং ১৪)
অর্থাৎ মুক্তি অবস্থায় জীবাত্মা শুনিতে ইচ্ছা করিলে স্বশক্তি দ্বারাই শ্রোত্র, স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করিলে ত্বক, দেখিবার সংকল্প হইলে চক্ষু, স্বাদ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণ, সংকল্প বিকল্প করিবার জন্য মন, নিশ্চয় করিবার জন্য বুদ্ধি, স্মরণ করিবার জন্য চিত্ত, অহংবুদ্ধির জন্য যেমন ইন্দ্রিয়গোলকের দ্বারা স্বকার্য সিদ্ধ করে সেইরূপ মুক্তি অবস্থায় স্বশক্তি দ্বারা সমস্ত আনন্দ ভোগ করে।"এর থেকে একেবারে নিশ্চত ভাবে যানা যায় যে মুক্ত আত্মারা চাইলে অবতরণ করতে পারেন। কৃষ্ণজীও মুক্ত আত্মা ছিলেন, যার ফলে তিনি ইচ্ছা করেছিলেন যে যখনই ধর্মের গ্লাণি হয় অধর্ম বেড়ে যায় তখন সাধুদের রক্ষার জন্য তিনি অবতরণ করে। এই অবতরণ মুক্ত বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবাত্মার হয়,ঈশ্বর বা পরমাত্মার বা পরমেশ্বরের বা পরমব্রহ্মের নয়।
গীতা-ষষ্ঠ-অধ্যায়-ধ্যানযোগে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ বলেছেনঃ-
প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ।
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্।।৪৫।।
অনুবাদঃ যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।
মুক্ত আত্মারা যে দেহধারণ করে তার আরো কিছু প্রমাণ দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্ত সূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন।
প্রমাণ দেখুন-
"ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্পামননাৎ" (বেদান্তসূত্র ৪।৪।১১)
অর্থাৎ মুক্ত আত্মার দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি থাকে, ইহা জৈমিনি মুনির মত। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে যে, তারা নানা রূপ দেহধারণ করার ক্ষমতা আছে। তিনি(মুক্ত জীবাত্মা) এক প্রকার থাকেন, তিন প্রকার হন, পঞ্চ প্রকার, সপ্ত প্রকার এবং নব প্রকার হন।"
দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্ত সূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন।
(ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৬।২), (ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৮।২।১-১০)
শ্রীকৃষ্ণ মুক্ত আত্মা বা মোক্ষলাভ করা আত্মাই ছিলেন।
গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর সম্বন্ধে বলেছেনঃ
সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
আসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ।।১৩।১৫।।
অনুবাদঃ সেই পরমাত্মা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, তবুও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় বিবর্জিত। যদিও তিনি সকলের পালক, তবুও তিনি সম্পূর্ণ অনাসক্ত। তিনি প্রকৃতির গুণের অতীত, তবুও তিনি সমস্ত গুণের ঈশ্বর।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসিতে পারে দিব্যদৃষ্টি বিষয়ে গীতাতে যে কথন হয়েছে তার তাৎপর্য কি।
চিন্ময় কোন কিছু দর্শন বা অনুভব স্থুল দৃষ্টিতে হয় না। দিব্যবস্তু দর্শন করতে হলে দিব্যদৃষ্টির ও প্রয়োজন হয়। যোগী ব্যক্তি সমাধিস্থ অবস্থায় গুরুকৃপায় সেই দিব্যদৃষ্টি প্রভাবে, সব বস্তুরই অন্তঃরালে একই চিন্ময়সত্ত্বা অনুভব করেন। শ্রীকৃষ্ণের দেহাভ্যন্তেরও ছিলো সেই শ্বাশ্বত চিন্ময় সত্ত্বা যা প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে, পঞ্চকোশের আবরণে ঢাকা, কিন্তু মায়া রহিত, উপাধি রহিত ঐ অপ্রাকৃত সত্ত্বা অনুভব করতে হ'লে চাই আত্মদৃষ্টি (দিব্যদৃষ্টি)। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নারদকে বলেছেন-মহাভারতের শান্তি পর্বে
"মায়াহ্যেষা ময়া সৃষ্টা য়ষ্মাং পশ্যসি নারদ।
সর্ব্বভূতর্গুণ নৈর্যুক্তং ন তু মাং দ্রষ্টুমর্হসি।।"-অর্থাৎ "হে নারদ তুমি চর্ম্মচক্ষুতে আমার যে দিব্যগন্ধাদিযুক্ত দেহ দেখছো-ইহা মায়িক। মায়িক দেহের আবরণে ঢাকা আমার স্বরূপ দেথতে পার না। স্বরূপ দর্শন করতে হলে সচ্চিদাঘন আত্মাতে সমাধি করতে হবে।"
কৈ, উক্ত শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ নিজের দেহকে মায়িক বা প্রাকৃত, বলেই বলেছেন; "অপ্রাকৃত বা চিন্ময় দেহ" বলছেন না তো..?!! কৃষ্ণজী বুঝি কৃষ্ণভক্ত গণের মত "অপ্রাকৃত" জ্ঞানসম্পন্ন ন'ন ? ঈশ্বর যেটুকু বুদ্ধিবৃত্তি দিয়েছেন সেটুকুকে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকূপে অন্ধকূপ হত্যা না করে, প্রামাণিক শাস্ত্র বাক্যের উপর ভিত্তি করে সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বিচার করুন।
প্রকৃত প্রামাণ্য গ্রন্থে যাঁদের এলার্জি আছে তাঁরা অর্ব্বাচীন শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থকে তোমাদের ওঁ নিত্যলীলা প্রবিষ্ট এক হাজার আট শ্রীল প্রভুপাদরা মেনে গেছেন, তোমরা শ্রী পাদরাও যাকে একমাত্র "শ্বাশ্বতী শ্রুতি" বলে গদগদ হও, সেই শ্রীমদ্ভাগবতেই কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত সম্বন্ধে কি লেখা আছে দেখঃ- মৈত্রেয় বিদুর সংবাদে জানা যায়, ধর্ম্মের মূর্ত্তিনাম্নী পত্নীর গর্ভে নর ও নারায়ণ নামে দুইটি ঋষি উৎপন্ন হয়েছিলেন-
"মূর্ত্তিঃ সর্ব্বগুনোৎপত্তি নর নারায়ণাবৃষি
যয়োর্জন্মন্যদো বিশ্বমভ্যনন্দৎ সুনিব্বৃতম" [ভা০ ৪র্থ স্কন্ধ ১,৫১]
এই নরানারায়ণ ঋষি-উভয়েই গন্ধমাদন পর্ব্বতে তপস্যা করতে গিয়েছিলেন- "লব্ধবলোকৈর্ষযতুরচ্চিতো গন্ধমাদনম্" [ভাঃ ৪।১।৫৭]। মেত্রেয় বিদুরকে বলছেন, "ঐ নর এবং নারায়ণ ঋষিই ভূভার হরণের জন্য মানুষরূপে পুনঃ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন যদুকুলশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যজন করুকুলশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন-
"তাবিমৌ বৈ ভাগবতো হরেরংশাবিহাগতৌ।
ভারব্যয়ায় চ ভুবঃ কৃষ্ণৌ যদুকুরুদ্বহৌ।[ভা০ ৪।১।৫৮]
বৈষ্ণবমান্য শ্রীমদ্ভাগবতের চেয়েও প্রাচীনতম এবং প্রামাণিক গ্রন্থ সর্ব্বজনমান্য বেদব্যাসের মহাভারতেও কৃষ্ণের এই রকম প্রাকৃত দেহ নিয়েই জন্ম জন্মান্তর গ্রহণ এবং এক এক জন্মে কঠোর তপস্যার পরিচয় পাওয়া যায়।
শকুনি দুর্য্যোধনের দ্বারা কপট পাশা খেলায় রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে যখন বনবাসী হলেন, কৃষ্ণ এই সংবাদ শুনে ক্রোধে অগ্নিশর্ম্মা হয়ে উঠলে, তাঁকে শান্ত করবার জন্য অর্জ্জুন তাঁর পূর্ব্বজন্মের দেহকৃত ধর্ম্মসকল বর্ণনা করতে লাগলেন-"অর্জ্জুনোবাচ" [মহাভারত, বনপর্ব্ব, ১২শ-১১-১৬ শ্লোক]
উক্ত শ্লোকের কথন শ্রীকৃষ্ণও স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন,- "নরস্ত্বমসি দুর্দ্ধর্ষ হরিনারায়নোহ্যহম্। কালে লোকমিমং প্রাপ্তৌ নরনায়নাবৃষী।।- হে দুর্দ্ধর্ষ, তুমি নর, আমি নারায়ণ ঋষি। আমরা উভয়ে কালক্রমে এই লোকপ্রাপ্ত হয়েছি" [মহাঃবনপর্ব্ব, ১২শ, ৪৬]
ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকেও আমরা জানতে পারি শ্রীকৃষ্ণ, মহর্ষি ঘোর-অঙ্গিরসের নিকট ব্রহ্ম বিদ্যায় দীক্ষালাভ করেছিলেন। এমন কি, যে শ্রীমদ্ভাগবতকে ভিত্তি করে বৈষ্ণবরা বলে 'কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং" তাতেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ধরা পরে কৃষ্ণের সাধনা করার কথা।
যিনি সাক্ষাৎ পরমাত্মা, "নরাকৃতি পরব্রহ্ম"; পূর্ণ অসীম অনন্ত স্বতঃপ্রকাশ জ্ঞান স্বরূপ যিনি, তাঁর কি আবার সাধনার দরকার হয়। ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা বিষয়ে বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়:-
"ততশ্চ লব্ধসংস্কারৌ দ্বিজত্বং প্রাপ্ত সুব্রতৌ।
গর্গাদ যদুকুলাচার্যাদ্ গায়ত্রং ব্রতমাস্থিতৌ"[ভাগবত ১০।৪৫।২৯]
আচার্য গর্গের নিকট শ্রীকৃষ্ণের উপনয়ন এবং সন্দিপন মুনির আশ্রমে (গুরুকুলে) তিনি বদে শিক্ষা লাভ করেছিলেন
পিতামহ্ ভীষ্ম শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে কি বলেছিলেন দেখুন, তিনি ওনাকে মনুষ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে প্রশংশা করেছেনঃ-
"বেদ বেদাঙ্গ বিজ্ঞানং বলং বাচ্যধিকং তথা
নৃণাং লোকে হি কোহন্যোস্তি বিশিষ্টিঃ কেশাবাবৃতে।।
দানং দাক্ষং শ্রুতং শৌর্যং হ্রিং কীর্ত্তির্বুদ্ধিরুত্তমা।
সন্নতি শ্রীর্ধৃতিস্তষ্টিঃ পুষ্টিশ্চ নিয়তাচ্যুত্যে।।"[মহাঃ সভা পর্ব ৩৮।১৯,২০]
অর্থাৎ বেদ বেদাঙ্গ, বিজ্ঞান এবং বল আদি সব গুণ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে বিদ্যাম। মনুষ্যলোকে কেশবের অতিরিক্ত আর কে অধিক গুণসম্পন্ন..?
শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর
একজন স্বধর্ম্মনিষ্ঠ যোগী গৃহস্থ যেমন সাধনা করেন, নিত্য ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন তার প্রমান দেখুনঃ
"ব্রাহ্মে মুহূর্ত্তে উত্থায় মার্যূপস্পৃশ্য মাধবঃ
দধৌ প্রসন্নকরণ-আত্মানং তমসঃ পরম।
একং স্বয়ং জ্যোতিরনন্যব্যয়ং, স্ব-সংস্থয়া নিত্য নরস্তকল্মধম্
ব্রহ্মাখ্যমস্যোদ্ভব নাশ হেতুভ্যিঃ স্বশক্তিভির্লক্ষিত ভাবনির্বৃতিম্।।[শ্রীমদ্ভাগবত,১০,৭০]
অর্থাৎ- ব্রহ্মমুহুর্ত্তে উঠে জলস্পর্শ করে শ্রীকৃষ্ণ আচমন করে ইন্দ্রিয় সকলের প্রসন্নতা লাভ করলেন। অনন্তর যিনি উপাধিশূন্য, আত্মসংস্থিত, অব্যয় ও অখন্ড, অজ্ঞানরহিত বলে সাক্ষাৎ জ্যোতিঃস্বরূপ, জগতের উৎপত্তি এবং নাশের হেতুভূত স্বীয় শক্তিলক্ষণ দ্বারা যাঁর সত্ত্বা লক্ষিত হয়ে তাকে, শ্রীকৃষ্ণ সেই ব্রহ্মসত্ত্বার-নিত্যানন্দময় পরমাত্মার ধ্যানে নিমগ্ন হলে'ন।
আরো দেখুন শ্রীমদ্ভাগবতের ১০,৭০,৫-৭
![]() |
শ্রীমদ্ভাগবত ১০,৭০,৫-৭ |
-সাধুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ নির্ম্মল জলে স্নানপূর্ব্বক বসন ও উত্তরীয় পরিধান করলেন, যথাবিধান সন্ধা উপাসনা হোম ইত্যাদি করে সংযত বাক্ হয়ে ব্রহ্মমন্ত্র জপ করতে লাগলেন। তারপর প্রাতে সূর্য্য সমুদিত হ'তে দেখে সূর্য্য প্রনাম করে আত্মবান কৃষ্ণ দেবতা ঋষি পিতৃগণ বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বিপ্রগণকে অর্চ্চনা করলেন"।
এই ভাবে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কর্ম্ম তপশ্চরণের যে ইতিহাস পাই তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, Cycle of birth and death এর ভিতর দিয়ে আসতে আসতে যেমন একজন পূর্ণত্বের পথে এগিয়ে যায়, যেমন এক
একজন জন্ম জন্মান্তের তপস্যা করে করে অবশেষে একদিন ঋষিত্ব অর্জ্জন করে থাকেন, তেমনি বিভিন্ন জন্মে বিভিন্ন নরদেহ ধারণ করে, করে কঠোর ত্যাগ তপস্যা-সাধনার ভিতর দিয়ে অবশেষে কৃষ্ণকে কৃষ্ণরূপেই দেখতে পাই, মহাযোগী, স্থিতিপ্রজ্ঞ, ব্রহ্মবিদরূপে। অগস্ত্য, বিশ্বামিত্রাদি অদ্ভুতকর্ম্মা ঋষিদের মতই কৃষ্ণও ছিলেন, একজন মহাযোগৈশ্বর্য্যশালী ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। তাঁর যোগৈশ্বর্য্যাদি অদ্ভুত কাজের জন্য যদি তাঁকে পূর্ণ পরমাত্মা "অপ্রাকৃত চিন্ময় দেহধারী স্বয়ং পরমাত্মা" বলতে হয়, তাহলে ঐ সমস্ত ঋষিদেরও পরমাত্মা, পরমেশ্বর রূপে পূজা করা উচিৎ !! যাঁর কাছে তিনি
ব্রহ্মবিদ্যালাভ করেছিলেন সেই গুরু ঘোর ঋষিরই বা শ্রীবিগ্রহ অর্চ্চাদির পূজা বৈষ্ণবরা করেন না কেন ? নারায়ণ ঋষির অবতার কৃষ্ণের যদি ঘটা করে পূজা এবং নাম জপ কীর্ত্তন হয়, তবে যাঁর সম্বন্ধে কৃষ্ণ নিজমুখে বলেছিলেন,
"অনন্যঃ পার্থ! মত্তস্ত্বং, ত্বত্তশ্চাহং তথৈব চ; হে পার্ত! তুমি আমাহ'তে ভিন্ন নও আমিও তোমা হ'তে বিন্ন নই" [মহাভারত,বনপর্ব্ব,১২শ] তাঁর সেই অভিন্নহৃদয় সখা এবং সাথী নর-ঋষির অবতার অর্জ্জুনের নাম জপ, "অপ্রাকৃত চিন্ময় জ্ঞানে" তাঁর শ্রীবিগ্রহের পূজা জপাদি করে না কেন !!❓
খুব ভাল করে পূর্ব্বাপর বিচার করলে দেকা যায়, মাতাপিতার রজোবীর্য্য সংযোগে আর পাঁচজন মানুষ যেমন জন্মগ্রহণ করে, দেবকী বাসুদেবের শুক্র-শোনিত যোগে শ্রীকৃষ্ণের দেহ উৎপন্ন হয়েছিলো।
তারপর শৈশব,বাল্য,কৈশোর যোবন বার্দ্ধক্যের ভিতর দিয়ে পরিণামশীল দেহের যেমন পরিবর্ত্তন হয় শ্রী কৃষ্ণেরও তেমনি হয়েছিল। তাঁর দেহ "অপ্রাকৃত" ছিল না। ১২০ বছর বয়সে নিজ জীবনের মধ্যে দিয়ে নানা কার্য করে যাদবগণের মৃত্যুর পর যোগস্থ হয়ে দেহ রক্ষা করেন। পরে দারুকের কাছে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে, অর্জ্জুন তিয়ে সকলের ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া করতে অসমর্থ হওয়ায় কেবলমাত্র বসুদেব,শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামের দেহগুলি অগ্নিসংস্কার করে হস্তিনাপুরে চলে যান।" [মহাভারত, আদিপর্ব্ব, ২অ] "স কৃষ্ণঃ সহ রামেন ত্যক্তাদেহং দিবং গতঃ"- কাজেই যে দেহ কৃষ্ণ নিজে পরিত্যাগ করে গেলেন, অর্জ্জুন নিজ হাতে অগ্নিসংস্কার করে যেটি পুড়িয়েছেন, তা অপ্রাকৃত দেহ হয় কিরূপে ❓ "অপ্রাকৃত চিন্ময় দেহ" কি দাহ করা যায় ❓ মহাভারতের বেদব্যাস শ্রীকৃষ্ণের যে অপ্রাকৃত দেহতত্ত্ব জানলেন না, বৈষ্ণবরা বুঝি তা Special ভাবক্লিন্ন দৃষ্টিতে অনুভব করেছেন, "ব্রজের গোপীপদরেণু'র মহিমায় ❓
শ্রীকৃষ্ণ একজন প্রাকৃত দেহ বিশিষ্ট মানুষই ছিলেন এবং পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মে কঠোর তপস্যা করে, কৃষ্ণরূপেও মহাযোগ তপস্যা এবং জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে গেছেন; সর্ব্বব্যাপক ব্রহ্মসত্ত্বা, দেশকালের দ্বারা পিচ্ছিন্ন একটি সীমাবদ্ধ পাঞ্চভৌতিক দেহের মধ্যে এসেছিলেন, এধারনা কেবল তাদেরই হ'তে পরাএ, যারা জ্ঞানবিচারের নামে কানে আঙ্গুল দিয়ে কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপ করে!
©www.ধর্ম্মতত্ত্ব.com
অন্যান্য
ওম্ শম্
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ