আর্ষ গ্রন্থের অধ্যয়ন করলে জানতে পারবেন যে সবগুলোর মধ্যে সন্ধ্যাকেই ঈশ্বরের পূজা অর্থাৎ স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাসনার মার্গ বলা হয়েছে। যখন থেকে মানব জন্মেছে, তখন থেকে তারা এই পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিল, মহাভারতের পশ্চাৎ এই পরম্পরা ধীরে-ধীরে সমাপ্ত হতে থাকে। ঋষি দয়ানন্দ পুনঃ আমাদের সেই পরম্পরার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আর তখন থেকে আর্যরা (শ্রেষ্ঠ) সন্ধ্যোপাসনা করে।
সন্ধ্যা কি?
সন্ধ্যা শব্দ "সম্" উপসর্গপূর্বক "ধ্যৈ চিন্তায়াম্" ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন হওয়াতে এর অর্থ হল - সম্যক্ রূপ দ্বারা চিন্তন, মনন, ধ্যান, বিচার করা আদি। সন্ধ্যাকে সংজ্ঞায়িত করে ঋষি দয়ানন্দ পঞ্চমহাযজ্ঞ - বিধির মধ্যে লিখেছেন -
"সন্ধ্যায়ন্তি সন্ধ্যায়তে বা পরব্রহ্ম য়স্যাম্ সা সন্ধ্যা"
অর্থাৎ যেখানে পরব্রহ্ম পরমাত্মার ঠিক ভাবে ধ্যান করা হয়, তাকে সন্ধ্যা বলে। এরমধ্যে ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাসনা করা হয়। অন্যদিকে ভগবান মনু সন্ধ্যোপাসনার বিষয়ে মনুস্মৃতিতে লিখেছেন -
পূর্বা সন্ধ্যাম্ জপম্স্তিষ্ঠন্নৈশমেনো ব্যপোহতি।
পশ্চিমাম্ তু সমাসীনো মলম্ হন্তি দিবাকৃতম্।। (মনুঃ ২/১০২)
অর্থাৎ দুই সময় সন্ধ্যা করার ফলে পূর্ববেলাতে আসা দোষের উপর চিন্তন-মনন আর পশ্চাত্তাপ করে পরবর্তীতে সেগুলো না করার সংকল্প করা হয়।
সন্ধ্যার ফল
সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মের মধ্যে পরমপিতা পরমাত্মার পূজা বা সন্ধ্যার অভিপ্রায় হল স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাসনা। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারে -
স্তুতির দ্বারা ঈশ্বরের মধ্যে প্রীতি, তাঁর গুণ, কর্ম, স্বভাব দ্বারা নিজের গুণ, কর্ম, স্বভাবকে শোধরানো, প্রার্থনার দ্বারা নিরভিমানতা, উৎসাহ আর সহায় প্রাপ্ত করা, উপাসনার দ্বারা পরব্রহ্মের সঙ্গে মিলন আর তাঁর সাক্ষাৎকার হওয়া।"
সন্ধ্যা কিভাবে করবেন ?
প্রাতঃ আর সায়ংকালের সন্ধিবেলাতে নিত্যকর্ম হতে নিবৃত্ত হয়ে পবিত্র এবং একান্ত স্থানে সিদ্ধাসন, সুখাসন বা পদ্মাসন লাগিয়ে সন্ধ্যার জন্য বসবেন। এরপর সমস্ত রাগ, দ্বেষ, চিন্তা, শোক আদি থেকে মুক্ত হয়ে শান্ত আর একাগ্রচিত্ত হয়ে পরমাত্মার ধ্যানে নিজের মন আর আত্মাকে স্থির করে সন্ধ্যোপাসনা করবেন।
পূজ্য আচার্যশ্রী দ্বারা প্রতিপাদিত বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড (সূক্ষ্ম কণা থেকে শুরু করে বিশাল তারা পর্যন্ত) বেদ মন্ত্রের ঋচার দ্বারা নির্মিত আর এই মতই আমাদের প্রাচীন ঋষি-মুনিদের ছিল। এই মন্ত্র বাণীর পশ্যন্তী অবস্থায় সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান আছে। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বেদমন্ত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আর এইভাবে সংস্কৃত হল ব্রহ্মাণ্ডের ভাষা। আমরা যখন বেদ মন্ত্রের উচ্চারণ করি, তখন এর প্রভাব সৃষ্টির উপর পড়ে, যদিও আমরা সেটা অনুভব করতে পারবো না।
যারা প্রতিদিন সন্ধ্যা করে, প্রায়শঃ তাদের সন্ধ্যার মন্ত্রের সামান্য অর্থও জ্ঞাত হয় না, যারফলে তাদের মন সন্ধ্যাতে সঠিক ভাবে লাগে না। এই বিষয়টিকে ধ্যানে রেখে আর অনেক ব্যক্তির আগ্রহ করাতে পূজ্য আচার্যশ্রী সন্ধ্যার মন্ত্রের ত্রিবিধ ভাষ্য (আধিদৈনিক, আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক) করার নিশ্চয় করেন। পাঠক এই পুস্তকের মধ্যে সন্ধ্যার মন্ত্রের তিন প্রকারের ভাষ্য পড়ার জন্য পাবেন। সংসারে এমন কাজ প্রথমবার হয়েছে, এর জন্য আমরা সর্বদা আচার্য শ্রীর ঋণী থাকবো। আমার সহধর্মিণী শ্রীমতী মধুলিকা আর্যা এই পুস্তকের সম্পাদন এবং ঈক্ষ্যবাচন কুশলতাপূর্বক সম্পন্ন করেছেন, এইজন্য ওনাকে সাধুবাদ দেওয়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্রই বলা যেতে পারে।
পাঠকদের উচিত -
১) সন্ধ্যার মন্ত্রের তিন প্রকারের অর্থকে ভালো ভাবে আত্মসাত্ করবেন।
২) এই মন্ত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দ্বারা সৃষ্টিকে আরও অধিক গভীর ভাবে জানার চেষ্টা করবেন।
৩) এর ব্যবহারিক ব্যাখ্যাকে জেনে সেই অনুসারে আচরণ করার চেষ্টা করবেন।
৪) এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার অনুসারে ভাবনা বানিয়ে সন্ধ্যা করবেন অথবা সন্ধ্যা করার সময় এইরকম ভাবনা করবেন।
ঋষয়ো দীর্ঘসন্ধ্যত্বাদ্দীর্ঘমায়ুরবাপ্নুয়ুঃ।
প্রজ্ঞাম্ য়শশ্চ কীর্তিম্ চ ব্রহ্মবর্চসমেব।। (মনুঃ ৪/৯৪)
অর্থাৎ মন্ত্রার্থদ্রষ্টা ঋষিগণ দীর্ঘ সময় ধরে সন্ধ্যোপাসনা করার কারণে দীর্ঘায়ু, প্রজ্ঞা, যশ, কীর্তি আর ব্রহ্মতেজকে প্রাপ্ত করেছেন।
ঋষয়ো দীর্ঘসন্ধ্যত্বাদ্দীর্ঘমায়ুরবাপ্নুয়ুঃ।
প্রজ্ঞাম্ য়শশ্চ কীর্তিম্ চ ব্রহ্মবর্চসমেব।। (মনুঃ ৪/৯৪)
অর্থাৎ মন্ত্রার্থদ্রষ্টা ঋষিগণ দীর্ঘ সময় ধরে সন্ধ্যোপাসনা করার কারণে দীর্ঘায়ু, প্রজ্ঞা, যশ, কীর্তি আর ব্রহ্মতেজকে প্রাপ্ত করেছেন।
ঈশ্বরের গুণ কর্ম স্বভাবের ন্যায় নিজের গুণ কর্ম্ম স্বভাব পবিত্র করা এবং ঈশ্বর সর্ব্বব্যাপক, আমি তাঁহার নিকটে আছি এবং তিনি আমার নিকটে আছেন, এইরূপ জ্ঞানসহকারে যোগাভ্যাস দ্বারা ঈশ্বর সাক্ষাৎকার করার নাম উপাসনা। উপাসনার ফল জ্ঞানোন্নতি ইত্যাদি।
অথঃ ঈশ্বরস্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা মন্ত্র
ওতম্ বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব।
যদভদ্রন্তন্ন আসুব।।-[যজুঃ৩০।৩]
- হে সকল সৃষ্টির রচয়িতা পরমেশ্বর! আমাদের সব দূর্গুণ দূর করিয়া যাহা কিছু কল্যাণকর তাহাই দান করুন।।
ওতম্ হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ত্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।-[যজুঃ১৩।৪]
-যে পরমাত্মা গর্ভে জ্যোতিষ্ক মন্ডল ধারণ করিয়া আছেন, যিনি এই সৃষ্টির উৎপত্তির পূর্ব হইতেই বিদ্যমান আছেন এবং যিনি এই উৎপন্ন জগতের সর্ববিদিত স্বামী, তাঁহারই আশ্রয়ে পৃথ্বীলোক ও দ্যুলোক স্থিত রহিয়াছে। আমরা সেই সুখ স্বরূপ সৃষ্টিকর্ত্তা পরমাত্মাতে আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ।
যস্যচ্ছায়াহমৃতং যস্য মৃতুঃ কস্মৈ দেবায হবিষা বিধেম।।-[যজুঃ২৫।১৩]
-যিনি আত্মবল ও দেববলের দাতা, যাঁহার শাসনকে বিদ্বানেরা প্রশংসা করেন, যাঁহার আশ্রয়ই অমৃত ও যাঁহার বিয়োগই মৃত্যু, আমরা সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ যঃ প্রাণতো নিমিষতো মহিত্বৈক ইদ্রাজা জগতো বভূব।
য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুস্পদঃ কস্মৈ দেবায হবিষা বিধেমঃ।।-[যজুঃ২৩।৩]
-যিনি স্বীয় মহিমায় প্রাণী ও অপ্রাণী জগতের একমাত্র রাজা এবং সব দ্বিপদ ও চতুস্পদ প্রাণীর উপর শাসন করিতেছেন, আমরা সকলে সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ যেন দ্রৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢ়া যেন স্বঃ স্তুভিতং যেন নাকঃ।
যো অন্তরিক্ষে রজসো বিমানঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ।।-[যজুঃ৩২।৬]
-যাঁহার দ্বারা আকাশ উজ্জ্বল ও পৃথিবী স্বীয় কক্ষপথে দৃঢ় হইয়া আছে, যিনি আকাশে সব লোক লোকান্তকে নির্মাণ করিয়াছেন, আমরা সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ প্রজাপতে ন ত্বদেতান্যন্যো বিশ্বা জাতানি পরি তা বভুব।
যৎকামাস্তে জুহুমস্তন্নো অস্তু বয়ং স্যাম পতযো রযীণাম্।।-[ঋগ্বেদঃ১০।১২১।১০]
-হে প্রজাপতি পরমাত্মন্ ! তুমি ছাড়া এই সব উৎপন্ন জড় চেতনাদি পদার্থের উপর অন্য কাহারও রাজ্য নাই। আমরা তোমাকে যে ইচ্ছা করিয়া প্রার্থনা করিতেছি, আমাদের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হউক। আমরা সকলে যেন পার্থিব ও অপার্থিব ধনৈশ্বর্য্যের অধিপতি হইতে পারি।।
ও৩ম্ স নো বন্ধুর্জনিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবা অমৃতমানশানাস্ততীযে ধামান্নধ্যৈরযন্ত।।-[যজুঃ৩২।১০]
-সেই পরমাত্মা আমাদের জন্মদাতা, পালক, পোষক ও বন্ধু। তিনি সব লোক লোকান্তকে জানেন। মুক্ত পুরুষেরা মুক্তিকালে অমৃত সুখের আস্বাদন করিয়া তাঁহার আশ্রয়েই বিচরণ করেন।।
ও৩ম্ অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্ বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো ভূষিষ্ঠান্তে নম উক্তিং বিধেমঃ।।-[যজুঃ৪০।১৬]
-হে সর্বপ্রকাশক পরমাত্মন্ ! তুমি আমাদিগকে ঐশ্বর্ষ্যলাভের জন্য সুপথে চালনা কর। তুমি সব শুভ কর্মের জ্ঞাতা। তুমি আমাদের নিন্দনীয় পাপরাশি নষ্ট করিয়া দাও। আমরা বারংবার তোমাকে নমস্কার করিতেছি।।
🙏ইতি ঈশ্বর স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা মন্ত্রঃ🙏
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ