ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

18 March, 2021

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড

গবান শ্রী কৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী গীতার সমাদর আজ প্রত্যেক হিন্দু ঘরে ঘরে। কিন্তু এই কৃষ্ণের নামটিই নারীঘটিত কেলেঙ্কারির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে কিছু স্বার্থলোভী পশুতুল্য় মানুষের জন্য যা আজ যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা ছাড়া কিছু না। শ্রীকৃষ্ণ এর চরিত্র কে কিভাবে তুলে ধরেছে পুরাণে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৮৮ অধ্যায় এবং ২৮ অধ্যায় , ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড, ৭২ অধ্যায়, ৫৯ থেকে ৬৬ শ্লোক, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়, ৬১-৬২ শ্লোক, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়, ৬১-৬২ শ্লোক। ১৮+ যৌন পুরাণ গুলো আমাদের ঋষি, মহর্ষি, পুরুষোত্তম, আপ্ত পুরুষ, মহাবীরদের কলঙ্কিত করার জন্যই লিখা হয়েছিল ঋষি ব্যাসদেবের নামে মিথ্যা রটিয়ে। 

কৃষ্ণ এবং বিরজার সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ২য় অধ্যায়ে আছে। 

“একদিন গোলোকধামের জনহীন রাসমণ্ডলে কৃষ্ণ রাধার সাথে বিহার করছিলেন।  রাধা সঙ্গমসুখে আপন-পর কিছুই জানতে পারেননি। কৃষ্ণ বিহার করে অতৃপ্ত রাধাকে পরিত্যাগ করে শৃঙ্গার করার জন্য অন্য গোপির কাছে গমন করলেন। তখন রাধিকার সমতুল্য বিরজা ও তার শতকোটি সুন্দরী বান্ধবী বৃন্দাবনে অবস্থান করছিল। সেই সময় বিরজা কৃষ্ণকে দেখতে পান। শ্রীকৃষ্ণও শরচ্চন্দ্রমুখী মনোহর হাস্যবদনা কুটিল নয়নে নাথ সন্দর্শিনী নবযৌবনে বিরাজমানা রত্নালঙ্কারভূষিতা সূক্ষবস্ত্র পরিধানা বিরজাকে দেখলেন। তিনি সবসময়ই ষোলো বছর বয়সী। কৃষ্ণ তাকে রোমাঞ্চিত ও কামবাণ নিপীড়িত দেখে সত্বর নির্জন মহারণ্যে রত্নমণ্ডলের উপরে পুষ্পশয্যায় তার সাথে বিহার করলেন। বিরজা কোটি কামদেবের সমতুল্য রূপবান রত্নবেদির উপর উপবিষ্ট শৃঙ্গারাসক্ত প্রাণনাথ শ্রীহরিকে বক্ষে ধারণ করে কৃষ্ণের শৃঙ্গার কৌতুকবশে মূর্ছিত হলেন। তখন রাধিকার সখীগণ কৃষ্ণকে বিরজার সাথে বিহার করতে দেখে তাকে তা জানাল। তাদের কথা শুনে রাধা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তখন রাধা রক্ত পদ্মের মত রক্তচক্ষু হয়ে ভীষণভাবে কাঁদলেন এবং তাদের বললেন, আমায় তোমরা বিরজাসক্ত কৃষ্ণকে দেখাতে পার? যদি তোমরা সত্য বলে থাকো, তবে আমার সাথে চল ; গোপী বিরজার ও কৃষ্ণের যথোক্ত ফল প্রদান করব। আমি শাসন করলে আজ ঐ বিরজাকে কে রক্ষা করবে? আমার প্রিয় সখীগণ শীঘ্র সেই বিরজার সাথে কৃষ্ণকে নিয়ে এস।… তোমরা কেউই সেই কুটিল হাস্যমুখ হরিকে আমার ঘরে আসতে দেবে না। এখন আমার ঘরে গিয়ে তোমরা তাকে রক্ষা কর। কয়েকজন গোপি রাধার এই কথা শুনে ভীত হল।  সকল গোপিরা হাতজোড় করে রাধার সামনে দাঁড়িয়ে রাধাকে বলল, আমরা সেই বিরজার সাথে প্রভু কৃষ্ণকে দেখাবো। সুন্দরী রাধা তাদের কথা শুনে রথে আরোহণ করে ৬৩০০ কোটি গোপীর সাথে বিরজার ঘরে গমন করেন।  রাধা সেই ঘরের  দরজায় নিযুক্ত দ্বাররক্ষক শ্রীদামকে দেখলেন। শ্রীদাম কৃষ্ণের প্রিয়কারী গোপ। সে লক্ষ গোপের সাথে সেই ঘরের দরজায় পাহাড়া দিচ্ছিল। তাকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে রাধা তাকে বলেন ,ওরে রতিলম্পটের চাকর! দূর হ, দূর হ; তোর প্রভুর আমার চাইতেও সুন্দরী কান্তা কিরূপ? আমি তা দেখব। মহাবলবান বেত্রহস্ত শ্রীদাম রাধার কথা শুনে নিঃশঙ্কচিত্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ভেতরে যেতে দিলেন না। তখন রাধার সখীরা ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং  প্রভুভক্ত শ্রীদামকে জোর করে মণ্ডপের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়। গোলোকবিহারী কৃষ্ণ ঐ কোলাহল শুনতে পেয়ে এবং রাধাকে ক্রুদ্ধ জানতে পেরে, সেখান থেকে পালিয়ে যান। আর বিরজা রাধার আওয়াজ শুনে শ্রীকৃষ্ণকে পালাতে দেখে রাধার ভয়ে যোগবলে প্রাণত্যাগ করেন। বিরজার শরীর এক নদীতে পরিণত হয়।  সেই নদীতে গোলোকধাম বর্তুলাকারে ব্যপ্ত হয়। ঐ নদী প্রস্থে দশযোজন বিস্তৃত ও অতি গভীর এবং দৈর্ঘ্যে তার চাইতে দশগুণ। ঐ নদী মনোহর ও বহুবিধ রত্নের আধার হয়েছিল। “


এর ফলে রতিগৃহে গমন করে রাধা আর কৃষ্ণকে দেখতে পান না, বিরজাকেও নদীরূপে দেখে ঘরে ফিরে যান। তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রেয়সী বিরজাকে নদীরূপিনী দেখে সেই সুন্দরসলিলা বিরজার তীরে সজোরে কাঁদতে থাকেন। … কৃষ্ণ বিরজাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমার পুরোনো শরীর নদীতে পরিণত হয়েছে; এখন নতুন শরীর ধারণ করে জল থেকে উঠে এসো। একথা শুনে বিরজা কৃষ্ণের কাছে উঠে আসে।  … কৃষ্ণ সকামা রূপবতী সেই বিরজাকে দেখে শীঘ্রই তাকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করলেন। কৃষ্ণ সেই প্রিয়তমাকে একা পেয়ে নানারকমের বিপরীতাদি শৃঙ্গার করলেন। তখন রজঃস্বলা বিরজা হরির অমোঘ বীর্য ধারণ করে গর্ভবতী হন। তিনি দেবতাদের হিসাবে একশ বছর কৃষ্ণের গর্ভধারণ করলেন।এরপর বিরজার সাত পুত্রের জন্ম হয়। একসময় বিরজা শৃঙ্গারে আসক্ত হয়ে কৃষ্ণের সাথে আবারো সঙ্গম করছেন; এমন সময়ে তার ছোট ছেলে অন্য ভাইদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে ভীত হয়ে মায়ের কোলে এসে ওঠে। কৃপাময় কৃষ্ণ নিজের পুত্রকে ভীত দেখে বিরজাকে ত্যাগ করলেন। বিরজা পুত্রকে কোলে নিলেন আর শ্রীকৃষ্ণ রাধার ঘরে গমন করলেন। বিরজা পুত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রিয়তম কৃষ্ণকে আর কাছে দেখতে পান না। তখন শৃঙ্গারে অতৃপ্ত হওয়ায় বিরজা ভীষণভাবে কাঁদতে থাকেন এবং রেগে গিয়ে নিজ পুত্রকে এই বলে অভিশাপ দেন- তুমি লবনসমুদ্র হবে, কোন প্রাণী আর তোমার জল পান করবে না। …” ( শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৩য় অধ্যায়)  


এরপর  কৃষ্ণ আবার বিরজার সাথে বিহার করা শুরু করেন। কৃষ্ণ বিরজাকে বর দেন, “ আমি তোমার কাছে প্রতিদিন অবশ্যই আসবো। যেমন রাধা, তার মত তুমিও আমার প্রিয়তমা হবে  এবং আমার বরপ্রভাবে তুমি নিজের পুত্রদের সর্বদা রক্ষা করবে।”  


রাধার সখীরা বিরজার সাথে কৃষ্ণের এসকল কথা শুনতে পান এবং সেসব রাধাকে গিয়ে বলেন। এসব কথা শুনে রাধা কাঁদতে থাকেন এবং ভীষণ রেগে যান। এর মধ্যে কৃষ্ণ রাধার কাছে আসেন। রাধা কৃষ্ণকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে থাকেন, “এই গোলোকধামে আমি ছাড়াও তোমার অনেক স্ত্রী আছে, তাদের কাছে যাও, আমার কাছে আসার কি প্রয়োজন? তোমার প্রিয় স্ত্রী বিরজা আমার ভয়ে দেহ ত্যাগ করে নদী হয়েছে, তোমার নদ হওয়া উচিত। নদীর সাথে নদের সঙ্গমই ভালো হয়; কারণ শয়ন ভোজন স্বজাতিতেই পরম প্রীতিসহকারে হয়ে থাকে। দেবতাদের চূড়ামণি কৃষ্ণ নদীর সাথে বিহার করেন, একথা যদি আমি বলি তাহলে মহাজনেরা একথা শোনার সাথে সাথেই হেসে উঠবে। যারা তোমাকে সর্বেশ্বর বলে থাকেন, তারা তোমার অন্তর জানেন না, সর্বভূতাত্মা ভগবান কৃষ্ণ নদীকে সম্ভোগ করতে ইচ্ছা করছেন।” রাধা আরো বলেন, “হে বিরজাকান্ত কৃষ্ণ আমার কাছ থেকে চলে যাও। হে লোলুপ,  রতিচোর, অতিলম্পট! কেন আমাকে দুঃখ দিচ্ছ? … হে লম্পট! তোমার নিরন্তর মানব সংস্পর্শ হচ্ছে, এজন্য তুমি মানবযোনী প্রাপ্ত হও। গোলোক হতে ভারতে গমন কর।“


এমতাবস্থায় রাধার অনেক সখীরা কৃষ্ণকে রাধার কাছ থেকে দূরে যেতে বলেন। অনেক গোপি বলেন, “তুমি অন্য নারীর কাছে যাও; তুমি অন্য স্ত্রীলোলুপ; হে নাথ! আমরা তোমার যথোচিত ফল বিধান করবো।“ ( শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৩য় অধ্যায়)


এমন সময় শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু শ্রীদাম কৃষ্ণের পক্ষ নিয়ে রাধাকে অনেক কথা বলেন। শ্রীদামের সকল কথার বিবরণ দিয়ে অকারণে লেখাটিকে বড় করতে চাইছি না, তার কয়েকটি কথার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। শ্রীদাম রাধাকে বলেন, “ তুমি শীঘ্র ক্রোধ ত্যাগ করে কৃষ্ণের পাদপদ্ম সেবা কর। তুমি, অন্য নারী এবং সমগ্র জগতই কৃষ্ণের বশীভূত।“


শ্রীদামের এসবকথা শুনে রাধা ভীষণ রেগে যান। রাধা ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রীদামকে বলেন, “ ওরে ইতর, ওরে মহামূঢ়, ওরে রতিলম্পটের চাকর, শোন, তুই সমস্ত তত্ত্ব জেনেছিস, আমি তোর প্রভুকে জানতে পারিনি! ওরে ব্রজাধম, শ্রীকৃষ্ণ তোরই প্রভু, আমাদের নয়। জানতে পারলাম, তুই সবসময় জনকের স্তব এবং জননীর নিন্দা করে থাকিস। যেমনি অসুররা সবসময় দেবতাদের নিন্দা করে থাকে; ওরে মূঢ়, তেমনি তুই আমার নিন্দা করছিস। এই কারণে তুই অসুর হ। ওরে গোপ, গোলোক হতে বের হ, আসুরী যোনিতে গমন কর। ওরে মূঢ়, আজ তোকে এই অভিশাপ দিলাম; কোন ব্যক্তি তোকে রক্ষা করবে?”


কৃষ্ণ ও বিরজার কাহিনী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের অন্যত্রও বর্ণিত হয়েছে।  ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ষোড়শ অধ্যায়ে কৃষ্ণ বলছেন, “ একসময় আমি গোলোকধামে প্রাণাধিকা মানিনী রাধিকাকে পরিত্যাগ করে নিজ ঘর থেকে রাসমণ্ডলে গমন করেছিলাম। এরপর রাধিকা দাসীমুখে আমাকে বিরজার সাথে ক্রীড়া করতে শুনে ক্রোধভরে সেই স্থানে গমন করে আমাকে দেখতে পান এবং তৎক্ষণাৎ বিরজাকে নদীরূপা এবং আমাকে পলাতক জেনে সক্রোধে সখীদের সাথে পুনরায় গৃহে গমন করেন। পরে দেবী রাধিকা সেই স্থানে চুপচাপ ও সুস্থির আমাকে সুদামের সাথে অবস্থিত দেখে যথোচিত ভর্ৎসনা করেন। সুদাম তা সহ্য করতে না পেরে তার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করলে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমার সামনেই সুদামকে যথেষ্ট তিরস্কার করেন। সুদামও রাধিকাকে তিরস্কার করে। সুধাম রাধিকাকে তিরস্কার করলে  রাধিকা তার উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। এর ফলে তার চোখদুটি তখন রক্ত পদ্মের মত লাল হয়ে ওঠে। তিনি অতিশয় ব্যস্ত হয়ে আমার সভা হতে সুদামকে বহিষ্কৃত করতে আজ্ঞা দেন। আজ্ঞা দেওয়া মাত্র দুর্বার তেজস্বিনী লক্ষ সখী গাত্রোত্থান করে বারংবার কূটভাষী সুদামকে অতিশীঘ্র বহিষ্কৃত করে দিল। সেইসময়ে রাধিকা সুদামের কটূক্তিতে ক্রুদ্ধ হয়ে ‘তুই দানবযোনী প্রাপ্ত হবি’ বলে দারুণ অভিশাপ দেন।“


ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ৪৯ তম অধ্যায়েও কৃষ্ণ এবং বিরজার কাহিনীটি রয়েছে। এখানে পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞেস করেন, “ সুদাম  শ্রীরাধিকাকে কেন অভিশাপ দিলেন এবং শিষ্য হয়ে শ্রীদামের শাসক শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়াকে অভিশাপ দেওয়ার কারণ কি?” মহাদেব বললেন, “ হে দেবী!…একদিন কৃষ্ণ গোলোকে বৃন্দাবনে অবস্থিত শতশৃঙ্গপর্বতের একদেশে সৌভাগ্যে রাধিকাসদৃশী বিরজা নামের গোপীর সাথে নানাভূষণে বিভূষিত হয়ে ক্রীড়া করছিলেন; রত্ননির্মিত সেই রাসমণ্ডলের চতুর্দিকে রত্নপ্রদীপ জ্বলছিল। তারা উভয়ে বহুমূল্য রত্ন নির্মিত চম্পক পুষ্প শোভিত কস্তূরী কুমকুম প্রভৃতি দ্বারা বিলোপিত সুগন্ধি চন্দন চর্চিত সুগন্ধ মালতী পুষ্প মালাপক্তি পরিবেষ্টিত সুখশয্যায় অবস্থিত হলেন। তখন তাদের অবিশ্রাম রমণ হতে লাগল। রতিপণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ এবং বিরজা পরস্পর সখসম্ভোগ অনুভব করলেন। জন্মমৃত্যুশূণ্য গোলোকবাসিদের মন্বন্তর পরিমিতকাল তাদের সখসম্ভোগ অতীত হল। চার জন দূতী সেই বিষয় জানতে পেরে শ্রীরাধাকে জানালেন। শ্রীরাধাও দূতীমুখে সেই বিষয় শুনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে গলার হার দূরে নিক্ষেপ করলেন। সখীদের দ্বারা প্রবোধিতা হলেও রাধা কোপে আরক্ত মুখলোচনা হয়ে দেহ হতে রত্নালঙ্কার সকল দূরে নিক্ষেপ করলেন। বহ্নিশুদ্ধ বস্ত্রদ্বয়, অমূল্য রত্ননির্মিত ক্রীড়াপদ্মও দূরীকৃত করলেন এবং বিচিত্র পত্রাবলি রচনা ও সিন্দূরাদি বস্ত্রাঞ্চলদ্বারা মুছে ফেললেন। অঞ্জলি পূর্ণ জলে মুখরাগ এবং অলক্তাদি ধুয়ে ফেললেন। আলুলায়িত কেশে কবরী সকলকে মুক্ত করে ক্রোধে কম্পমানা হলেন। বসনভূষণাদি বিহীনা হয়ে শুক্ল বসন পরিধান পূর্বক যানারোহণেচ্ছায় ধাবমানা হলেন। প্রিয়সখীরা শ্রীরাধিকাকে সেই অবস্থা হতে নিবারিত করিলেন। রাধা ক্রোধে ওষ্ঠ ও অধর কম্পন করে সখীদের আহ্বান করলেন। ক্রোধে কম্পমান শ্রীরাধিকাকে সখীরা চতুর্দিকে পরিবৃত করলেন। রাধা ক্রুদ্ধ হয়ে  কোটি কোটি রথে এককোটি তিনলক্ষ প্রিয়সখী গোপিদের সাথে আরোহণ করলেন। … শ্রীরাধা মন অপেক্ষা দ্রুতগামী  রথে আরোহণ করে গমন করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণের সহচর সুদাম শ্রীরাধার আগমনকোলাহল শুনে শ্রীকৃষ্ণকে সাবধান করে গোপদের সাথে পালিয়ে গেলেন। প্রেমময়ী শ্রীরাধার প্রেমভঙ্গ ভয়ে ভীত হয়ে পতিব্রতা বিরজাকে পরিত্যাগ করে কৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন। বিরজাও সময় জেনে শ্রীরাধার ভয়ে ক্রোধে প্রাণ ত্যাগ করলেন। বিরজার সখীরা ভয়ে বিহ্বল এবং কাতর হয়ে তৎক্ষণাৎ বিরজার শরণ গ্রহণ করলেন। বিরজা গোলোকধামে নদীরূপে প্রবাহিত হলেন। শতকোটিযোজন দীর্ঘ এবং কোটি যোজন বিস্তৃত সেই নদী পরিখার মত গোলোককে বেষ্টন করল। … সেইকালে বিরজার সখীরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীরূপে বিরজার অনুগামিনী হলেন। পৃথিবীর অন্যান্য নদীও তার অংশে উৎপন্ন হয়েছে এবং সপ্তসাগরও বিরজা হতে উৎপন্ন হয়েছে। শ্রীরাধা সেই রাসমণ্ডলে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও বিরজার দেখা না পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। শ্রীকৃষ্ণও তার আটজন সখার সাথে শ্রীরাধার কাছে উপস্থিত হলেন। দ্বারাপালিকা গোপনীরা শ্রীকৃষ্ণকে বারংবার নিবারণ করলেন। রাসেশ্বরী রাধা শ্রীকৃষ্ণকে দেখে বহুতর তিরস্কার করলেন। কৃষ্ণ সখা সুদাম সখার এই নিন্দা শুনে বিরক্ত হয়ে শ্রীরাধিকাকে ভর্ৎসনা করলেন। শ্রীরাধিকা সুদামের কথায় আরো রেগে গিয়ে তাকে এই বলে অভিশাপ দেন, “ ক্রুরমতি! শীঘ্রই ক্রুরতর অসুরযোনিকে লাভ কর”।  সুদামও রাধাকে এই বলে অভিশাপ দিল- “গোলোক হতে ভূলোকে গমন করে গোপের ঘরে গোপকন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে  অসহ্য কৃষ্ণ বিরহ দুঃখ  শত বৎসর  অনুভব করবে। ভগবান পৃথিবীর ভার হরণের জন্য অবতীর্ণ হয়ে তোমার সাথে মিলিত হবেন”…

আবার দেখুন (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ প্রকৃতিখণ্ড/ ১৫ অধ্যায়) সেখানে গোলোকধামে তুলসী নামে একজন গোপিকা ছিলেন। কৃষ্ণ তার সাথেও লীলাখেলা করেছিলেন। তুলসীর সাথে রাসলীলা করতে গিয়ে কৃষ্ণ রাধার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। তখন রাধা তুলসীকে মানুষ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন।


এই ঘটনাটি তুলসী নিজে বর্ণনা করছেন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। তুলসি বুলেছেন, “ আমি তুলসী, আমি পূর্বে গোলোকে গোপিকা ছিলাম, শ্রীকৃষ্ণের কিঙ্করী হয়ে সবসময় তার সেবা করতাম। আমি রাধার অংশসম্ভূতা এবং তার প্রিয়তম সখী ছিলাম। একসময়ে আমি রাসমণ্ডলে গোবিন্দের সাথে ক্রীড়া-কৌতুক ভোগ করে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে রাসেশ্বরী রাধিকা হঠাৎ সেই স্থানে আগমন করে আমাকে সেই অবস্থায় দেখতে পান । … তখন  তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্ধ হয়ে গোবিন্দকে অনেক ভর্ৎসনা করলেন এবং আমাকে এই বলে অভিশাপ দিলেন, “ পাপিষ্ঠে! তুই মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ কর।“ (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ প্রকৃতিখণ্ড/ ১৫ অধ্যায়)


কৃষ্ণ এবং তুলসীর যে কাহিনী বলা হল, তার উল্লেখ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ৫৫ অধ্যায়েও আছে। এখানে বলা হয়েছে, “ একদিন তুলসীবনে তুলসী গোপীর সাথে শ্রীকৃষ্ণ ক্রীড়াসক্ত হলে শ্রীরাধিকা মানিনী হয়ে প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অন্তর্হিত হন। রাধা লীলাক্রমে তার নিজমূর্তি ও কলার বিনাশ করলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতাদের ঐশ্বর্য নষ্ট হয়, তাঁরা শ্রীশূণ্য ভার্যাহীন  হন এবং রোগ প্রভৃতি দ্বারা পীড়িত হলন।” তখন সকল দেবতারা কৃষ্ণের শরণাগত হন। এরপর কৃষ্ণ রাধার স্তব করে রাধাকে শান্ত করেন।


স্বধা নামে এক গোপিনীর সাথেও কৃষ্ণ লীলা করেছেন। এই প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, “ আগে   গোলোকধামে স্বধা নামে রাধিকার এক সখী  ছিল। স্বধা তার আত্মার স্বরূপ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে বক্ষে ধারণ করে স্বধানামে বিখ্যাত হয়েছিল।স্বধাকে রমণীয় বৃন্দাবনের নিকুঞ্জবনে প্রাণবল্লভ শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করতে দেখে কৃষ্ণ প্রাণেশ্বরী রাধিকা তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। ( প্রকৃতিখণ্ড, ৪১ অধ্যায়)


স্বাহা নামেও রাধার প্রিয় সখী  ছিল। স্বাহা তার  প্রাণবল্লভ শ্রীকৃষ্ণকে রমণের জন্য বলেছিলেন; তাই তিনি স্বাহা নামে খ্যাত হয়েছেন। স্বাহা রাসমণ্ডলে রাসবিহারী শ্রীকৃষ্ণের সাথে রমণ করে রতিরসে মত্ত হয়েছিলেন। রাধা,  কৃষ্ণকে স্বাহাকে আলিঙ্গন করতে দেখে স্বাহাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।“- ( প্রকৃতিখণ্ড, ৪১ অধ্যায়)


সুশীলা নামে রাধার এক সখীর সাথেও কৃষ্ণের সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ৪১ অধ্যায়ে আছে- সুশীলা নামে রাধার এক সখী ছিল। সুশীলা রাধার সামনেই কৃষ্ণের দক্ষিণ ক্রোড়ে উপবেশন করেছিলেন। এর ফলে রাধা তাকেও গোলোক থেকে ভূলোকে আসার অভিশাপ দিয়েছিলেন।


গোপি সুশীলার সাথে কৃষ্ণের লীলার বিস্তারিত বিবরণ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডের ৪২ তম অধ্যায়ে আছে। এখানে বলা হয়েছেঃ ।


“রাধার প্রধান সহচরী সুশীলা গোপি পূর্বে শ্রীরাধিকার সম্মুখে শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ ক্রোড়ে উপবেশন করেছিলেন। তখন কৃষ্ণ রাধার ভয়ে তার মাথা নিচু করে রেখেছিলেন। কৃষ্ণ গোপীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাধিকাকে ক্রোধে নিষ্ঠুর বাক্য বলার জন্য তেড়ে আসতে দেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুশীলা গোপী শান্তমূর্তি ভগবান কৃষ্ণকে ভয়ে পালিয়ে যেতে দেখে  ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। লক্ষকোটি গোপী শ্রীমতী রাধিকা ক্রোধান্বিত দেখে সঙ্কট বিবেচনা করে ভক্তিসহকারে হাতজোড় করে বলতে থাকেন,  হে দেবী! রক্ষা করুন,  রক্ষা করুন।  এমন কথা বলতে বলতে তাঁরা রাধার চরণ পঙ্কজে শরণ গ্রহণ করেন।… শ্রীদাম প্রভৃতি তিনলক্ষকোটি গোপও ভয়ে রাধার চরণপঙ্কজে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরমেশ্বরী রাধা জগতকান্ত কৃষ্ণকে পলাতক দেখে সহচরী সুশীলাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। আজ থেকে সুশীলা গোপী যদি গোলোকে আগমন করে , তাহলে সে আসার সাথে সাথে ভস্মীভূত হইবে। সুশীলাকে এই অভিশাপ দিয়ে ক্রুদ্ধ রাসেশ্বরী রাধা রাসমণ্ডলেই রাসবিহারীকে কৃষ্ণকে অহ্বান করতে থাকেন।“

সুতরাং আমরা দেখতে পেলাম কৃষ্ণ ছিলেন বহুনারীর সাথে একসাথে সম্পর্ককারী একজন সার্টিফায়েড পলিগামী। তিনি প্রায়শই একই সময়ে বহু নারীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তবে গোলোকধামের গোপিরা যাদের সাথে কৃষ্ণ একই সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হতেন তাঁরা কৃষ্ণের স্ত্রী এমন কথাও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে। এরা সকলে কৃষ্ণের স্ত্রী তা ধরে নিলেও কৃষ্ণ বহুবিবাহের দোষে দূষিত হন এবং এই বহুবিবাহের ফল কি হয়েছিল তা আমরা সকলেই দেখেছি। অন্য স্ত্রীদের সাথে কৃষ্ণকে দেখতে পেয়ে রাধা প্রায়ই তাদের তাড়া করতেন এবং নিজেও কষ্ট পেতেন। এর ফল ছিল পারিবারিক অশান্তি।

এমন স্বভাবের কৃষ্ণকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের অনেক স্থানে পরমাত্মা বলা হয়েছে। কিন্তু পরমাত্মার চাইতে দুরাত্মার সাথেই তার বেশি মিল দেখা যায়। ধর্মগ্রন্থের এইসব চরিত্র থেকে মানুষ ঠিক কি শিক্ষা পাবে?

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, এই বৃদ্ধা কুব্জা পূর্বে রাবণের বোন শূর্পণখা ছিলেন। শূর্পণখা রামকে আকাঙ্ক্ষা করে তপস্যা করেছিলেন। শূর্পণখার সেই আকাঙ্ক্ষা রামের পরবর্তী অবতার কৃষ্ণ পূরণ করেছিলেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডের ৭২ অধ্যায়ে আছে,

“কমললোচন শ্রীকৃষ্ণ মথুরার এইরূপ শোভা দর্শন করতে করতে গমনকালে পথের মধ্যে অতি জরাতুরা বৃদ্ধা কুব্জাকে দর্শন করলেন। দেখলেন, সেই রুক্ষাঙ্গী বিকৃতাকার কুব্জা লাঠির সাহায্যে অতি নম্র হয়ে গমন করছে। সেই সময়ে তার গায়ের সকল লোলমাংস চলিত হচ্ছে। …সেই বৃদ্ধার হাতের সোনার পাত্রে কস্তূরীকুমকুমাক্ত চন্দনদ্রব এবং মকরন্দ গন্ধযুক্ত মনোহর সুগন্ধী দ্রব্য ছিল। তখন সেই বৃদ্ধা কুব্জা সহসা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে হাসিমুখে হাতজোড় করে ভক্তিবিনত মস্তকে প্রণাম করে তার শ্যামবর্ণ দেহে স্বর্ণপাত্রে থাকা চন্দন বিলেপন করল। পরে তার সঙ্গীগণের গায়েও ঐ রকম চন্দন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রদক্ষিণ করে বারবার প্রণাম করতে লাগল। পরে কুব্জা শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টিমাত্রে রূপ ও যৌবনে লক্ষ্মীর সমান সৌন্দর্যশালীনি হল। তখন সে বহ্নিশুদ্ধবসন ও রত্নভূষণে ভূষিত মনোহর ধন্যা বারো বছর বয়সের কন্যায় রূপান্তরিত হল। তার ওষ্ঠ বিম্বফলতুল্য, বর্ণ গলন্ত সোনার মত , শ্রোণি ও দন্তপঙক্তি অতি মনোহর এবং পয়োধরযুগল বিল্বফল সদৃশ হল। তখন তার বদনমণ্ডলে নিরন্তর ঈষৎ হাস্য বিকাস পেতে লাগল। সেইসময় কুব্জার গলায় অমূল্য রত্ননির্মিত মনোহর হার বিরাজ করতে লাগল এবং পা দুটি রত্নমঞ্জিরে রঞ্জিত ও গমন গজেন্দ্ররাজের গমনের ন্যায় মন্থর হল। তখন সে মালতীমালা বেষ্টিত বামবঙ্কিম বর্তুলাকার মনোহর কবরীভার ধারণ করল। সেই সীমান্তিনীর সীমান্তের উপরিভাগে কস্তূরীবিন্দু ও চতুর্দিকে চন্দনবিন্দুর সাথে দাড়িম্ব কুসুমাকার সিন্দুরবিন্দু শোভা পেতে লাগল। তখন সেই রতিকর্মনিপুণা রত্নদর্পণহস্তা কুব্জা চঞ্চলকটাক্ষ বিক্ষেপ করে শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সম্পাদন করতে লাগল। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বাস দিয়ে অন্য স্থানে গমন করলে, সেই সতী কুব্জা কৃতার্থ হয়ে কমলার ন্যায় নিজের ভবনে গমন করল। পরে কুব্জা দেখল, তার ভবন কমলার আলয়ের মত রত্নসার নির্মিত ও রত্ন শয্যায় শোভিত হয়েছে। সেই ভবনে প্রদীপ্ত রত্ন-প্রদীপ-শ্রেণী এবং চতুর্দিকে রত্নময় দর্পণ সমূহ বিরাজ করছে। অসংখ্য দাস দাসীতে সেই ভবন পরিপূর্ণ হয়েছে এবং দাসীদের মধ্যে কেউ সিন্দুর , কেউ বস্ত্র, কেউ তাম্বুল, কেউ শ্বেত চামর ও কেউ বা মাল্য ধারণ করে আছে। কুব্জা সেখানে গিয়ে সুমনোহর মিষ্টান্ন ভোজন করে রত্ন নির্মিত খাটে শুয়ে দাসীগণ কর্তৃক সেবিত হতে লাগল। সেই সময় সেই কুব্জা কৃষ্ণের জন্য নিজের কাছে শয্যার উপর সকর্পূর তাম্বূল, কস্তূরী, কুঙ্কুমান্বিত চন্দন, মালতীমাল্যযুগল, কর্পূর প্রভৃতি সুবাসিত শীতল সলিল ও স্বাদু মিষ্টান্ন সকল সংস্থাপিত করে রাখল। তখন কুব্জা কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণের চরণ এবং কৃষ্ণের আগমন ও মনোহর মুখচন্দ্র চিন্তা করতে লাগল। … সেইসময় কুব্জা কামাসক্ত হয়ে নিরন্তর কোটি কামদেবের সমতুল্য মনোহর কামুক কৃষ্ণের রূপ চিন্তাতেই নিমগ্ন হল। এমন কি তার চোখে সমস্ত জগত কৃষ্ণময় বলে মনে হতে লাগল।”

এরপরে আমাদের মূল ঘটনার সাথে অপ্রাসঙ্গিক কিছু ঘটনার বিবরণ আছে। সেই সব বিবরণ বাদ দিয়ে প্রাসঙ্গিক বিবরণ তুলে ধরা হলঃ-

“ … এরপর সকলে উত্তম মিষ্টান্ন ভোজন করে খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে কুব্জাও নিদ্রিত হলে নিদ্রেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে গিয়ে দেখলেন কমলার মত সুন্দরী কুব্জা দাসীগণে পরিবৃতা হয়ে রত্নশয্যায় নিদ্রিত আছেন। তখন জগন্নাথ কৃষ্ণ দাসীগণের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে কেবল কুব্জারই নিদ্রা ভঙ্গ করে বলতে লাগলেন, মহাভাগে নিদ্রা ত্যাগ করে আমায় শৃঙ্গার দান কর। সুন্দরী, তুমি পূর্বে রাবণ ভগিনী শূর্পণখা ছিলে। কান্তে, তুমি রামাবতার কালে আমাকে লাভ করবার জন্য তপস্যা করেছিলে। এখন আমি কৃষ্ণরূপে জন্ম গ্রহণ করেছি। তুমি সেই তপঃপ্রভাবে আমাকে কান্তরূপে ভজনা কর। সুন্দরি! এখন তুমি আমার সাথে সুখ সম্ভোগ করে জন্ম-মৃত্যু-জরাশূণ্য সুদুর্লভ আমার গোলোকে গমন কর। শ্রীনিবাস শ্রীকৃষ্ণ এই বলে সেই কামুকী কুব্জাকে বুকে জড়িয়ে নগ্ন করে শৃঙ্গার ও চুম্বন করতে লাগলেন। তখন নবসঙ্গম সঙ্গতা সেই কুব্জা কমলার মত শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে তার গণ্ডস্থল চুম্বন করতে লাগলেন।… সেই দম্পতি রতিবিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞ, এজন্য ক্ষণকালও তাদেরর সুরতক্রীড়ার বিরাম রইল না, নিরন্তর নানাপ্রকার শৃঙ্গার হতে লাগল। সেইসময়ে ভগবান কৃষ্ণ তীক্ষ্ণ নখাঘাতে কুব্জার স্তনযুগল ও শ্রোণিমন্ডল এবং দাঁত দিয়ে কামড়ে তার ঠোঁট ক্ষত বিক্ষত করলেন।এরপর শ্রীকৃষ্ণ রাত্রি অবসানকালে বীর্যাধান করলে সুন্দরী কুব্জা সম্ভোগসময়ে মূর্ছাপন্ন হলেন। তখন কৃষ্ণের বক্ষে থাকা সেই কুব্জা দিন কি রাত, স্বর্গ কি মর্ত্য, কি স্থল কি জল কিছুই বোধ করতে পারলেন না। পরে সকাল হলে রজনীপতি যেন শ্রীকৃষ্ণের ব্যতিক্রম দর্শনেই লজ্জায় মলিন হলেন। এরপর গোলোক হতে রত্ন নির্মিত রথ উপস্থিত হলে কুব্জা বহ্নিশুদ্ধ বসনধারণ করে রত্নভূষণে ভূষিত হয়ে গলন্ত স্বর্ণের মত নিত্য জন্মাদিবিবর্জিত দিব্য দেহ ধারণ করে সেই রথে চড়ে গোলোকে গমন করলেন। সেই কব্জা গোলোকধামে চন্দ্রমুখী নামে গোপিকা হয়ে অবস্থান করতে লাগিলেন এবং কতিপয় গোপিকা তার পরিচর্যা কার্যে নিযুক্ত হল। …”

শূর্পণখা
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড

শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১২৬ তম অধ্যায়ে কুব্জা এবং কৃষ্ণের এই কাহিনীর উল্লেখ মেলে। এখানে রাধা কৃষ্ণকে বলেন, “আপনি বৃদ্ধা অধিকাঙ্গী, অপুত্রী, যুবাদের অস্পৃশ্যা ক্ষত্রিয়কামিনী কুব্জাকে তার প্রাক্তন পুণ্যবলে ভোগ করেছেন।” একথা বলতে বলতেই রাধা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।

কৃষ্ণের কুব্জার সাথে সহবাসের কথা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১১৫ তম অধ্যায়েও আছে। এখানে অনিরুদ্ধের সাথে যুদ্ধকালে বাণ অনিরুদ্ধকে বলেন, “ তোর পিতা বাসুদেব মথুরাতে ক্ষত্রিয় আর গোকুলে বৈশ্য। সেখানে তার নাম নন্দনন্দন। নন্দের পশুরক্ষক পরম লম্পট দুষ্ট গোপাল তোর পিতামহ বৃন্দাবনে গোপিদের উপপতি। সেই অধার্মিক পুতনাকে সদ্য বধ করে স্ত্রীহত্যাপাপে লিপ্ত হয়েছে; আবার মথুরায় এসে মৈথুনের মাধ্যমে কুব্জাকে বিনাশ করেছে। অতি নিষ্ঠুর যোনিলোলুপ কৃষ্ণ দুর্বল নরকাসুরকে পুত্রসমেত বধ করে তার মনোহর স্ত্রী সমূহ হরণ করেছে।”

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড

অনিরুদ্ধ বাণের কথার প্রত্যুত্তরে বলেন ,“কুব্জা পূর্বজন্মে দুরাত্মা রাবণের ভগিনী ছিল; তার নাম শূর্পণখা। সে কামবশে শ্রীরামের প্রতি অভিলাষবতী হয়। ধার্মিক প্রধান লক্ষ্মণ তার নাসিকা ছেদন করেছিলেন। পরে শূর্পণখা সেই পরমেশ্বর তার স্বামী হবেন , তপস্যাপ্রভাবে ব্রহ্মার কাছে এই বর লাভ করে। কুব্জারূপে উৎপন্না সেই শূর্পণখা সেই পুণ্যবলে শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হয়ে গোলোকে গমন করেছে; কৃষ্ণের আলিঙ্গন বলে গোলোকে গিয়ে একজন গোপী হয়েছে। “ [3]

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১০৬ অধ্যায়ে শিশুপাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেছেন। সেই সব অভিযোগের মধ্যে কৃষ্ণের কুব্জা সম্ভোগের কথাও মেলে। শিশুপাল বলেছেন- কৃষ্ণ সম্ভোগের মাধ্যমে কুব্জার প্রাণ সংহার করেছেন এবং বস্ত্রের জন্য রজককে হত্যা করেছেন।

শিশুপালের বিবরণ এবং বাণের অভিযোগ অর্থাৎ কৃষ্ণ সম্ভোগের মাধ্যমে কুব্জাকে হত্যা করেছেন এই অভিযোগ, সত্য নাকি অন্য বিবরণ সত্য তা নিশ্চিতভাবে বলা আমাদের সম্ভব নয়। তবে সম্ভোগশেষে দিব্য দেহ ধারণ করে গোলোকে গমন করা কোনো বাস্তবসম্মত কথা বলে মনে হয়না।

যাইহোক, কুব্জা এবং কৃষ্ণের কাহিনী পড়ার পর একটি প্রশ্ন মনে উদিত হয়। প্রশ্নটি হলঃ রামের পরবর্তী জন্মে কৃষ্ণ হয়ে যদি শূর্পণখার সাথে সহবাস করতে কৃষ্ণের আপত্তি না থাকে, তবে পূর্ববর্তী জন্মে কৃষ্ণ যখন রাম ছিলেন, তখন শূর্পণখার প্রস্তাব মানতে তার আপত্তি কেন হল? প্রথম ক্ষেত্রে যদি আপত্তি হয়ে থাকে, তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কেন আপত্তি হল না? কেন শূর্পণখার নাক কান কেটে দেওয়া হল?

এই ধরণের সকল জটিল প্রশ্নেরই একটি সরল উত্তর অনেকে দিয়ে থাকেন- এ সবই লীলা। সত্যই ‘নিজের বেলা লীলাখেলা, পাপপূণ্য পরের বেলা’। হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহে লীলাবতার কৃষ্ণ লীলার নামে যে সকল কাজ করে গিয়েছেন, তা যদি কোনো সাধারণ মানুষ করতো , তাহলে কি এসবকে শুধুই লীলা বলে উড়িয়ে দেওয়া হত? এখনো যদি কেউ কৃষ্ণের মত লীলাখেলা করে বেড়ায়, তাহলে সমাজ তাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবে? যদি তাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে তথাকথিত লীলাবতারদের কেন ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয়? এটা এক প্রকারের হিপোক্রেসি নয়?

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই লেখাটিতে নবভারত পাবলিশার্স হতে প্রকাশিত পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের বাংলা অনুবাদ ব্যবহার করা হয়েছে।

কৃষ্ণের জীবনে আদপে রাধার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। রাধাতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করার জন্য আলাদা একটা বই লেখা যায়। কৃষ্ণের জীবনে যে রাধার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই তাও প্রমাণ করা যায়। অথচ আমরা সেই গালগল্প বিশ্বাস করি। আমরা মুখে বলি 'যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে' অর্থাৎ মহাভারতে যা নেই তা ভারত বর্ষে নেই। মহাভারতের প্রতিটি পাতা আঁতিপাতি করে খুঁজেছি। কোথাও রাধার নাম পর্যন্ত নেই। অথচ রাধা ছাড়া বাকি অনেকের আছে। কৃষ্ণের জীবন দর্শন গীতা ,গীতা সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট গ্রন্থ। গীতার কোথাও রাধা নেই।
.
এমন নয় যে মহাভারতে কোথাও রাধার নাম উল্লেখের জায়খা ছিল না। নারদ নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকে গোকুল থেকে। সকলে আকুল সত্যভামা রুক্ষ্মিনীসহ অনেকের নাম আছে ,রাধা নেই। পান্ডবদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গোকুলে যাচ্ছেন কৃষ্ণ। নিজের বাবা মা পালিত বাবা মার জন্য মন খারাপ ।আরো অনেকের জন্য মন খারাপ ।রাধার নাম নেই ,মহাভারতের শেষ পর্বে কৃষ্ণের বহু প্রিয়জন ,বহু সখীর নাম আছে রাধার নাম নেই। তার মানে কৃষ্ণের জীবনে রাধা প্রক্ষিপ্ত ।আমাদের অবদমিত মনের ফসল ।কৃষ্ণের রাধা প্রেম ,ঝুলন খেলা এসব গল্প ,সত্য নয় ।অথচ সেই গল্পেই আমাদের বিশ্বাস ।আর গল্পের গরু যেমন গাছে ওঠে তেমনি রাধার গল্প বিশ্বাস করানোর জন্য আরো গল্প আরো বর্ণনা। বীরপুরুষকে কাপুরুষ বানানো ঠিক আমাদের মত করে। যে রাধার অস্তিত্ব শুধু গালগল্পে সেই রাধার জন্য ভগবানকে দিয়ে কি না করিয়েছি । ভণ্ডামী চূড়ান্ত।

তথ্যসূত্রঃ

  1. কৃষ্ণের ১৬ হাজার স্ত্রীর দিব্য ভবন এবং ১০৮ পটরমণীর জন্য পরিখা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১০৩ অধ্যায়[↑]
  2. ষোলো হাজার কন্যার পাণিগ্রহণ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড, ১১২ অধ্যায়[↑]
  3. কৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়[↑]

সহায়ক গ্রন্থঃ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক অনুবাদিত ও সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স

1 comment:

  1. জুতা পিটা করলে তূই সাইজ হবি

    ReplyDelete

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ