বেদ সমগ্র মানবের আদি জ্ঞান ভাণ্ডার। বেদের মধ্যে যে অক্ষর জ্ঞান সম্পদ স্তূপীকৃত রহিয়াছে তাহা আহরণের জন্য যুগে যুগে সব দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা আমরণ পরিশ্রম করিয়াছেন। সে পরিশ্রম এখনও শেষ হয় নাই। নাস্তি বেদাৎ পরং শাস্ত্রং -অত্রিস্মৃতি- ১৪৯ বেদ হইতে উৎকৃষ্ট শাস্ত্র নেই, অর্থাৎ বেদই প্রধান বেদই শ্রেষ্ঠ।
"বিদ্" ধাতু হইতে "বেদ" শব্দ নিস্পন্ন হইয়াছে, এই জন্য ইহার অর্থ এই যে, যাহার দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়, তাহারই নাম "বেদ"। বেদ চিরদিন গুরুপরম্পরানুসারে শ্রুত হইয়া আসিতেছে, এই জন্য ইহার অন্য নাম "শ্রুতি"। জৈমিনীকৃত মীমাংসা দর্শনের নানাস্থানে ও যাস্কের নিরুক্ত গ্রন্থে বেদার্থে "আম্নায়" শব্দের প্রোয়োগ দৃষ্ট হয়।
"ম্না অব্যাসে" অর্থাৎ যে বিদ্যা অভ্যাস করিতে হয়, তাহাই আম্নায়। গীতি, পদ্য ও গদ্য এই ত্রিবিধ বিদ্যা প্রকাশ বলিয়া বেদের অপর না "ত্রয়ী"। বেদের অতি প্রাচীন নাম "ছন্দস"। পাণিনির সূত্রে, পাতঞ্জল মহাভাষ্যে ও কাত্যায়নের বার্ত্তিকে, সর্ব্ববেদই ছন্দ নামে অভিহিত হইয়াছে। বেদের আর একটি নাম "স্বাধ্যায়"।
বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন করা অতি কর্ত্তব্য বলিয়া স্বাধ্যায় শব্দের বাচ্য। বেদের অপর প্রাচীন নাম "আগম"। ইহা ভিন্ন "সমান্নায়" ও :নিগম" শব্দও বেদার্থ বোধক। বেদ দুইভাগে প্রসিদ্ধঃ-মন্ত্রভাগ ও বিধিভাগ। মন্ত্রে সংহিতা এবং বিধিতে ব্রাহ্মণ বুঝায়।
বর্ত্তমান যুগের প্রসিদ্ধ পন্ডিতগণ ত্রিভাগে বেদ-বিভাগ করিয়াছেন। প্রথম সংহিতা;দ্বিতীয়,ব্রাহ্মণ(আরণ্যক ও উপনিষদ সহ); তৃতীয়, সূত্র(শ্রৌতসূত্র,ধর্ম্মসূত্র ও গৃহ্যসূত্র)। জৈমিনী স্বীয় দর্শন শাস্ত্রে এবং মহর্ষি বাদরায়ণ উত্তরমীমাংসা নামক ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্ম(পরমাত্মা) হইতে বেদের উৎপত্তি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। পুরাণ (ব্রহ্মণগ্রন্থ) প্রণেতারা বলিয়া গিয়াছেন যে বেদ ঋষিদিগের দ্বারা "দৃষ্ট" হইয়াছে। প্রাচীনগনের মতে "ঋষি" শব্দের অর্থই মন্ত্র দ্রষ্টা।
“অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো
যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ”।।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.১০)
সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ং প্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ। যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নিঃশ্বাস রূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহ হীন আমরা চলতে পারবো না, আমাদের মানব সভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান।
আদি ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ (VEDA) । এই বেদ (পুস্তক) কিন্তু কোনো একক ধর্মগ্রন্থ নয়। অনেকগুলো ধর্মগ্রন্থের সমষ্ঠি । এর মধ্যে আছে চারটি সংহিতা ( ঋকঃ, যজুঃ, সামঃ ও অথর্ববেদ ), ব্রাহ্মণ, আরন্যক এবং উপনিষদ ।রচনাকালের দিক থেকে সংহিতা চারটিই সবার আগে রচিত।তারপর ব্রাহ্মণ এবং আরন্যক,আর তারপরে উপনিষদ।
বেদ মন্ত্র বা ধ্বনি (তরঙ্গ) দ্বারা সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মান হয়েছে। ধ্বনি সৃষ্টির শুরুতে বিদ্যমান হয়, তা প্রলয় কালেও কালের ভেতর বিদ্যমান থাকে। বেদের মন্ত্র ও পদ ব্রহ্মান্ডের সমস্ত জ্ঞানকে জানান দেয়। "অনন্ত বৈ বেদা" (তৈ০স০ ৩।১০।১১)-বেদ কে যতো গভীর ভাবে জানা যাবে পুরো ব্রহ্মান্ডকেই তত বালো ভাবে জানা যাবে। সংসারে এই রূপ কোন ধ্বনি,বাক্য গ্রন্থ নেই।
বেদ মানব সভ্যতার প্রায় পুরানো লিখিত দলিল। বেদের ২৮ হাজার পাণ্ডুলিপিগুলি ভারতের পুনেতে ‘ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ টি পাণ্ডুলিপি খুব গুরুত্বপূর্ণ যা ইউনেস্কোর ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।এটি উল্লেখযোগ্য যে ইউনেস্কোর 158 তালিকায় মধ্যে 38 টি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় পান্ডুলিপি তালিকাভুক্ত রয়েছে।
"স্বয়ম্ভূ অভ্যানর্ষত্তদূষীর্ণামৃষিত্মম্।"
(নিরুক্ত : ২.১)
শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন। তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ঋষি পরাশর এবং জেলে কন্যা সত্যবতীর পুত্র। যিনি পৃথিবীতে ‘ব্যাসদেব’ নামেই প্রাতঃস্মরণীয়। ব্যাসদেব চিন্তা করলেন, অনন্ত এ বেদজ্ঞান একত্রে গ্রহণ করা মানবের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই তিনি বেদবিদ্যাকে চারভাগে বিভক্ত করে তাঁর প্রধান চার শিষ্যকে দান করলেন। পৈলকে দিলেন ঋগ্বেদ। জৈমিনিকে দিলেন সামবেদ। বৈশম্পায়নকে দিলেন যুজর্বেদ এবং পরিশেষে সুমন্তকে দিলে অথর্ববেদ। ব্যাসদেবের প্রধান এ চার শিষ্য জগতে বেদবিদ্যার প্রচার করেন তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে। এভাবেই গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদজ্ঞান শত শত শাখায় বিকশিত হয়ে ওঠে এবং জগতে বেদবিদ্যার অমৃতধারাকে দিকে দিকে প্রবাহিত করে তোলে।
तस्मै॑ नू॒नम॒भिद्य॑वे वा॒चा वि॑रूप॒ नित्य॑या ।
वृष्णे॑ चोदस्व सुष्टु॒तिम् ॥-ऋग्वेद - ८.७५.६
বেদ যে অনাদি তাহা বেদে উক্ত হইয়াছে "বাচা বিরূনিত্যয়া"
(ঋগ্বেদ০ ৮-৭৫-৬)
অর্থাৎ- বেদের শব্দসকল বিবিধ রূপযুক্ত এবং নিত্য। মহর্ষি বাদরায়ণ তাঁহার প্রণীত ব্রহ্মসূত্রে বেদের নিত্যত্ব স্থাপন করিয়া এই সূত্র রচনা করিয়াছেন "অতএব চ নিত্যত্বং"(ব্রহ্মসূত্র, ১।৩।২৯)
.অথর্বাঙ্গিরস এব মধুকৃত ।।
- ( ছান্দোগ্য উপনিষদ ॥ ৩.৪.১ )
অর্থাৎ , অথর্বাঙ্গিরস দ্বারা দৃষ্ট বেদ মন্ত্রই ( অথর্ববেদ ) মধুর রচনা করেছেন ।।
*বেদ মন্ত্র সংখ্যা ২০৩৭৯*
📕ঋগ্বেদের মন্ত্র সংখ্যা- ১০,৫৫২ জ্ঞান কান্ড
📗যজুর্বেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৯৭৫ কর্ম্মকান্ড
📙সামবেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৮৭৫ উপাসনা কান্ড
📘অথর্ববেদের মন্ত্র সংখ্যা-৫,৯৭৭ বিজ্ঞান কান্ড
ঋগ্বেদের মন্ত্র সংখ্যা- ১০,৫৮৯ জ্ঞান কান্ড (১০ মন্ডল ৮৫ অনুবাক ও ১০২৮ সূক্তে বিভক্ত)
যজুর্বেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৯৭৫ কর্ম্মকান্ড (৪০ অধ্যায় ৩০৩ অনুবাকে বিভক্ত)
সামবেদের মন্ত্র সংখ্যা-১,৮৯৩ উপাসনা কান্ড (৩ ভাগে বিভক্ত-পূর্বাচ্চিক,মহানাম্নী আর্চ্চিক ও উত্তরার্চ্চিক *মহানাম্নীকে পূর্বাচ্চিকের মধ্যেও ধরা হয়। পূর্বাচ্চিক ৪ কান্ডে বিভক্ত,৪ কান্ড ৬ প্রপাঠকে বিভক্ত,প্রপাঠক গুলি অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চ্চিকে ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক, এই প্রপাঠক গুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে,দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে) অথর্ববেদের মন্ত্র সংখ্যা-৫,৯৭৭ বিজ্ঞান (২০কান্ড ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত, ১১১ অনুবাক,৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত)
🔗বেদের মন্ত্র সংখ্যা নিয়ে কিছু পুস্তকের মধ্যে মত-পার্থক্য পাওয়া যায়। যেমন ঋগ্বেদের ১০৫৮৯ মন্ত্র। শুক্ল যজুর্বেদের দুটি শাখা যথাক্রমে মধ্যদিন ও কণ্ব, উভয়ের অধ্যায় সংখ্যা ৪০ কিন্তু মধ্যদিন সংহিতায় ১৯৭৫ টি মন্ত্র ও কণ্ব সংহিতায় ২০৮৬টি মন্ত্র রয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের বহুল ব্যবহৃত সংহিতা হল তৈত্রিয় সংহিতা। এতে ৭টি কান্ড, ৪৪টি প্রপাঠক রয়েছে, অনুবাক ৬৩১ মন্ত্র সংখ্যা ২১৯৮টি পাওয়া যায়। কৃষ্ণ যজুর্বেদের দ্বিতীয় সংহিতা হল মৈত্রাযণী সংহিতা। এই সংহিতায় ৪টি কাণ্ড, ৫৪টি প্রপাঠক এবং ২১৪৪টি মন্ত্র রয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৃতীয় সংহিতা হল কঠ সংহিতা [অষ্টাধ্যায়ী ৪।৩।১০১ পতঞ্জলি মহাভাষ্য]। বর্ত্তমানে কঠ লুপ্ত প্রায়।
বেদ সনাতনধর্মের প্রধাণ ধর্মগ্রন্থ এবং পরমেশ্বর হতে প্রকাশিত শাশ্বত জ্ঞান।
ধর্মের বিষয়ে বেদই সদা মুখ্য প্রমাণ।(মনু ২/১৩)
तस्मा॑द्य॒ज्ञात् स॑र्व॒हुत॒ऽऋचः॒ सामा॑नि जज्ञिरे।
छन्दा॑सि जज्ञिरे॒ तस्मा॒द्यजु॒स्तस्मा॑दजायत ॥७ ॥
-यजुर्वेद अध्याय:31 मन्त्र:7
हिन्दी - स्वामी दयानन्द सरस्वती
फिर उसी विषय को अगले मन्त्र में कहा है ॥
पदार्थान्वयभाषाः -हे मनुष्यो ! तुमको चाहिये कि (तस्मात्) उस पूर्ण (यज्ञात्) अत्यन्त पूजनीय (सर्वहुतः) जिसके अर्थ सब लोग समस्त पदार्थों को देते वा समर्पण करते उस परमात्मा से (ऋचः) ऋग्वेद (सामानि) सामवेद (जज्ञिरे) उत्पन्न होते (तस्मात्) उस परमात्मा से (छन्दांसि) अथर्ववेद (जज्ञिरे) उत्पन्न होता और (तस्मात्) उस पुरुष से (यजुः) यजुर्वेद (अजायत) उत्पन्न होता है, उसको जानो ॥७ ॥
भावार्थभाषाः -हे मनुष्यो ! आप लोग जिससे सब वेद उत्पन्न हुए हैं, उस परमात्मा की उपासना करो, वेदों को पढ़ो और उसकी आज्ञा के अनुकूल वर्त्त के सुखी होओ ॥७ ॥
বেদ শব্দটি "বিদ্" ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। "বিদ্" ধাতুর অর্থ - জানা।সেইজন্য বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ - জ্ঞান বা বিদ্যা দুই প্রকার পরা এবং অপরা। বেদ নৈমিত্তিক জ্ঞান। অলৌকিক জ্ঞান - পরাবিদ্যা। জাগতিক বিষয় সম্বন্ধীয় যাবতীয় লৌকিক জ্ঞান - অপরা বিদ্যা। পরা ও অপরা এই দুই বিদ্যাই স্থান পেয়েছে সেই জন্য বেদকে সর্ব জ্ঞানের ভান্ডার বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদের বেদত্ব ওই পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের জন্য।পরাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা ।
বিদঁ (জ্ঞানে) অযমদাদিগণস্য ধাতুঃ । অস্মাত্ ধাতোঃ বিহিতানাম্ পরস্মৈপদস্য প্রত্যযানাম্ বিকল্পেন ণল্-অতুস্-উস্-থল্-অথুস্-অ-ণল্-ব-ম- এতে আদেশাঃ ভবন্তি ।
অত্র বিদঁ (জ্ঞানে) অস্যৈব গ্রহণম্ করণীযম্, অন্যেষাম্ বিদ্-ধাতূনাম্ ন । অস্য কারণম্ এতত্ - অস্মিন্ সূত্রে 'বিদঃ' ইতি পঞ্চমী-বিভক্তেঃ প্রযোগঃ ক্রিযতে । অতঃ তস্মাদিত্যুত্তরস্য ( নীলেশবিস্তার ১.১.৬৭ )
"বিদ্" ধাতুর চারিপ্রকার অর্থ হয়
বেত্তি বেদ বিদ্ জ্ঞানে,বিন্তে বিদ্ বিচারণে।
বিদ্যতে বিদ্ সত্তায়াং, লাভে বিদন্তি বিন্দতে।। [পাণিনীয় মূলসৌতঃ ৩।৪।৮৩]
বেদ শব্দটি সংস্কৃত: “বিদ্” ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। “বিদ্” ধাতু দ্বারা “জ্ঞানার্থ”, “সত্যার্থ”, “লাভার্থ” ও “বিচারার্থ” এই চার প্রকার অর্থ নির্দেশ করে। “বিদ্” ধাতু করণ এবং অধিকরণ কারকে “ঘঞ্” প্রত্যয় যোগ করলে “বেদ” শব্দ সিদ্ধ হয়ে থাকে। বেদ শব্দটি মুখ্য ও গৌণ দুই অর্থ হয়ে থাকে। মুখ্যার্থ-জ্ঞানরাশি; আর গৌণার্থ-শব্দরাশি। বৈদিক জ্ঞানরাশি আত্মপ্রকাশ করে বৈদিক শব্দরাশির সাহায্যে। বেদগ্রন্থকে শব্দব্রহ্ম (বেদগ্রন্থ অনন্তপুরুষ পরব্রহ্মের বাগ্ময়ী মূর্তি) বলা হয়। বেদ শ্রুতি, ত্রয়ীবিদ্যা বা ত্রয়ী, নিগম, ছন্দস্ ইত্যাদি নামে পরিচিত।
এই চারিপ্রকার অর্থ হইতেছে - জানা, বিচার করা, অবস্থান করা ও লাভ করা। যাহা পাঠ করলে মানুষ সত্য জানিতে পারে, সত্য এবং অসত্যের বিচার করিতে পারে, প্রকৃত বিদ্বান হইতে পারে, প্রকৃত শান্তি এবং আনন্দ লাভ করিতে পারে, তাহার নাম বেদ। বেদ শব্দের দুই অর্থ - মুখ্য ও গৌণ। ইহার মুখ্য অর্থ হল জ্ঞান রাশি, আর গৌণ অর্থ হল শব্দরাশি। বৈদিক জ্ঞান রাশি আত্মপ্রকাশ করে বৈদিক শব্দরাশির সাহায্যে। বেদ বলিতে বিশেষতঃ ঈশ্বর, জীব ও জগৎ সম্বন্ধে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টিও যেমন অনাদি ও অনন্ত, ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানও তেমনই অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর সম্বন্ধে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞানরাশিই বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ। এই অপরিসীম জ্ঞানরাশির কিছু অংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পাইয়াছিলেন। তাহাই লিপিবদ্ধ হইয়া বেদ নামে প্রচলিত হইয়াছে।” বেদের আরও দুটি নাম হল ‘আগম’ ও ‘নিগম’। ‘আগম’ শব্দের অর্থ ‘যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে’ এবং ‘নিগম’ শব্দের অর্থ হল ‘যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘আগম’ ও ‘নিগম’ তন্ত্রশাস্ত্রের দুটি বিভাগেরও নাম
বেদকে "ত্রয়ী বিদ্যা" বা কেবল "ত্রয়ী" ও বলা হয়। ঋগ্বেদ,সামবেদ,যজুর্বেদ এই তিনবেদকে একত্রে ত্রয়ী বলা হয়- পূর্বমীমাংসা দর্শনে জৈমিনি ঋক্,সাম্ ও যজুঃ এই তিন প্রকার মন্ত্রের লক্ষণ কে ত্রয়ী বলেছেন "তেষাম্ ঋক্ যত্র অথর্বশেন পাদব্যবস্থা","গৌতিষুসামাখ্যা", "শেষে যজুঃ শব্দঃ "।
অর্থাৎঃ বেদের যে মন্ত্রগুলিতে অর্থানুসারে ছন্দঃ ও পাদব্যবস্থা আছে সেই মন্ত্ররাশিকে "ঋক" বলা হয়। এই "ঋক্" মন্ত্র সকলের মধ্যে যে মন্ত্রগুলি গান করা যায়, যেগুলি গীতযুক্ত তাদের সামবলে। এই ঋক্ ও সাম লক্ষণযুক্ত মন্ত্ররাজি ব্যতীত আর যে সকল মন্ত্র ও গদ্য আছে সেই অবশিষ্ট মন্ত্র সকলকে যজুঃ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে পদ্য ও গদ্য উভয়রূপ মন্ত্র দৃষ্ট হয়। অথর্ববেদের মধ্যে যেসকল মন্ত্র আছে তাদের লক্ষণ ঋক্ ও যজুঃ মন্ত্রের লক্ষণের অন্তর্ভুক্ত; পৃথক কোন বিশিষ্ট লক্ষণ নাই। তজ্জন্যই অর্থাৎ অথর্ব বেদের মন্ত্রলক্ষণের চতুর্থ প্রকারের প্রয়োজন নাই।
"ব্রহ্ম এব প্রথমমসৃজতে ত্রয়ীমেব বিদ্যাং" শতপথ ব্রাহ্মণ ৬।১।১।৪
অর্থাৎ-ঋগ্বেদ, যজুঃ, সাম ত্রয়ী বিদ্যা ব্রহ্ম সৃজন করেন।
তৈত্তিরীয় ব্রাঃ২।৩।১০।১ এও এরূপ বচন আছে "অগ্নেঃ ঋচঃ বায়োর্য়জুংষি সাম আদিত্যাং"-অর্থাৎ প্রজাপতি অগ্নি হইতে ঋগ্বেদ, বায়ু হইতে যজুর্ব্বেদ এবং আদিত্য হইতে সামবেদ নিঃসৃত করেন।
-[পৃথিবীর ইতিহাস - চতুর্থ খণ্ড (দুর্গাদাস লাহিড়ী) পৃষ্ঠাঃ৩২]
সৃষ্টির আদি কাল থেকেই বেদের বিদ্যমানতা-সকল শাস্ত্রই এক বাক্যে ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন। বেদার্থ স্মরণ করিয়া যে সকল শাস্ত্র-গ্রন্থ মহর্ষিগণ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাই স্মৃতি নামে অভিহিত। স্মৃতি বেদের অনুসারী। বেদের অনুসারী বলিয়াই স্মৃতি ধর্ম্মশাস্ত্র। মনুস্মৃতি সম্যকরূপে বেদের অনুসরণ করিয়াছেন বলিয়া, সকল স্মৃতির মধ্যে মনু-স্মৃতি প্রাধান্য। মহর্ষি বৃহস্পতির ভাষায় সে কতা স্পষ্টঃ
-"বেদার্থোপনিবন্ধিত্বাং প্রাধান্যং হি মনোস্মৃতং। মন্বর্থ বিপরীতা ভূষো স্মৃতি সা ন শস্যতে।।"
"ত্রয়ী বৈ বিদ্যা"-(শতপথব্রাহ্মণ : ৪/৬/৭/১)
বেদ যে চারটিই ছিলো তার বহু প্রমাণ সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় -
তত্রাপরা ঋগ্বেদোযজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং।
নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।।
(মুন্ডকোপনিষদ ১।১।৫)
#অপরাবিদ্যা - ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যকরন, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। পরা বিদ্যা - যা দ্বারা অক্ষর ব্রহ্মকে জানা যায়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে চারটি বেদ কে পরমাত্মার নিঃশ্বাসস্বরূপ বলা হয়েছে -
"ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্বাঙ্গিরসঃ"- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ: ২/৪/১০)
শুধুমাত্র উপনিষদ নয়। এমনকি বেদেও চতুর্বেদের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে -
তস্মাৎ যজ্ঞাত্ সর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাৎ যজুস্তস্মাদজায়ত।।
(ঋঃ ১০।৯০।৯, যজুঃ ৩১।৭, অথর্বঃ ১৯।৬।১৩)
সেই পূজনীয় এবং সবার গ্রহনযোগ্য পরমেশ্বর হতে ঋগবেদ (পদার্থের গুণ প্রকাশক বিদ্যা) সামবেদ (মোক্ষ বিদ্যা) উৎপন্ন হয়েছে। তাহা থেকেই অথর্ববেদ (আনন্দদায়ক বিদ্যা) উৎপন্ন হয়েছে এবং তাহা থেকেই যজুর্বেদ (সৎকর্মের জ্ঞান) উৎপন্ন হয়েছে।
বেদের অন্যান্য মন্ত্রেও ঋক, সাম, যজুর সাথে অথর্ববেদের নাম এসেছে -
যস্মাদৃচো অপাতক্ষ্যন্যজুর্যস্মাদপাকষন্।
সামানি যস্য লোমান্যথর্বাঙ্গিরসো মুখং স্কম্ভং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
(অথর্ববেদ ১০।৭।২০)
=>>সরলার্থঃ যাহা থেকে ঋকমন্ত্র তৈরী হয়েছে যাহা থেকে যজুমন্ত্র নির্মিত হয়েছে। সামমন্ত্র যাহার লোমতূল্য অথর্বমন্ত্র যাহার মুখ, তিনি কে নিশ্চরূপে? তাহাকে সর্বাধার পরমেশ্বর বলো।। ২০।।
উপরে স্পষ্ট হয়েছে যে, ঈশ্বরকৃত চার বেদের মধ্যে অথর্ব এক বেদ। তাহার নাম ছন্দ (ছন্দাংসি), অথর্বাঙ্গিরা (অথর্বাঙ্গিরসঃ)। এই শব্দগুলোর অর্থ এই প্রকার যে,
(i) অথর্ববেদ - ইহা অথর্ব [অথর্বন্] এবং বেদ এই দুই শব্দের সমুদায়ে গঠিত। থর্ব ধাতুর অর্থ চলা এবং অথর্বের অর্থ নিশ্চল, এবং বেদের অর্থ জ্ঞান, অর্থাৎ অথর্ব, নিশ্চল, যিনি একরস সর্বব্যাপক পরমব্রহ্ম, তাহার জ্ঞান অথর্ববেদ। (অথর্বাণোথনবন্তস্থর্বনিশ্চরতিকর্মা তৎপ্রতিষেধঃ, নিরুক্ত ১১।১৮)
(ii) ছন্দ - ইহার অর্থ আনন্দদায়ক, অর্থাৎ তাহার মধ্যে আনন্দদায়ক পদার্থের বর্ণনা রয়েছে। (চান্দেরাদেশ্চ ছঃ। উঃ৪।২১৯। ইতি চদু আহ্লাদে- অসুন, চস্য ছঃ। চন্দয়তি আহ্লাদয়তীতি ছন্দঃ।।
(iii) অথর্বাঙ্গিরা - এই পদের অর্থ এই যে, তাহার মধ্যে অথর্ব, নিশ্চল পরমব্রহ্ম বোধক অঙ্গিরা অর্থাৎ জ্ঞানের মন্ত্র রয়েছে। (অঙ্গঃতেরসিরিরুঙাগমশ্চ। উঃ ৪।২২৬। ইতি অহি গতৌ- অসি, ইরুট আগম্। অঙ্গতি গচ্ছতি প্রাপ্নোতি জাতগ্নি বা পরব্রহ্ম যেনেতি অঙ্গিরা, বেদঃ। অথর্বণোহঙ্গিরসোহথর্বাঙ্গিরসঃ।।)
এখন তবে প্রশ্ন এই যে, বেদ যখন চারটিই তবে তাকে ত্রয়ী কেন বলা হয়? মূলত ত্রয়ী শব্দ বেদ চারটি বা তিনটির কারণে হয় নি। মূলত চার বেদের মধ্যে তিন প্রকার মন্ত্রের কারণেই বেদকে ত্রয়ী বলা হয়েছে।
পূর্ব মীমাংসায় স্পষ্ট হয়েছে যে,
তেষাং ঋগ যত্রার্থবশেন পাদ ব্যবস্থা।
গীতিষু সামাখ্যা শেষে যজুঃ শব্দ।
(পূর্বমীমাংসা ২।১।৩৫-৩৭)
যাহার মধ্যে অর্থবশ পাদ ব্যবস্থা তাকে ঋক বলা হয়। যে মন্ত্র গায়ন করা হয় তাকে সাম এবং বাকী মন্ত্র যজুর্বেদের অন্তর্গত। এই তিন প্রকারের মন্ত্র চার বেদের মধ্যে রয়েছে।
এই কথা সর্বানুক্রমনীবৃত্তির ভূমিকায় "ষড়্গুরুশিষ্য" বলেছেন -
"বিনিয়োক্তঞ্চরূপশ্চ ত্রিবিধঃ সম্প্রদর্শ্যতে।
ঋগ যজুঃ সামরূপেন মন্ত্রোবেদচুতষ্টয়ে।।"
অর্থাৎ যজ্ঞে তিন প্রকারের মন্ত্র বিনির্যুক্ত হয়ে করতে হয়। চার বেদে তাহা ঋগ যজু সাম রূপে রয়েছে।
তিন প্রকারের মন্ত্র, অথবা বেদে জ্ঞান, কর্ম এবং উপাসনা তিন প্রকারের কর্তব্যের বর্ণনা করার কারনেও বেদত্রয়ী বলা হয়। এই বেদত্রয়ী শব্দে চার বেদের সমাবেশ রয়েছে। কেউ যদি এ কুতর্ক করে যে, অথর্ববেদ অত্যন্ত নবীন তবে সে বেদকেই উলঙ্ঘন করার দুঃসাহস করলো। কারণ অথর্বেদের বেদত্ব স্বয়ং বেদ এবং উপনিষদ্ স্বীকার করেছে।
[তথ্য সূত্রঃ অথর্ববেদ ভূমিকা (ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী), বেদ রহস্য (মহাত্মা নারায়ন স্বামী]
বেদ ছন্দের রূপ। ছন্দ মানে কম্পণ,বেদ অনুসারে কম্পণ সাত প্রকারের। যাহা ছন্দ তাহা কম্পণ বা ফ্লাকচুয়েশন। প্রতিটি মলিকূলের চূড়ান্ত সূক্ষতম ভাগ স্টিং ও গ্লুয়োন। ইহা সূক্ষ রশ্মির গাঢ়ো কম্পণশীল অবস্থা মাত্র। প্রাণরশ্মি ও মরুত রশ্মি আদির গাঢ়ো কন্ডেন্স রূপই স্টিং বা গ্লুয়োন। ইহা থেকে আরো সূক্ষ স্টেট আছে। যাহা রশ্মিরূপী।
বেদ অনুসারে এই ছন্দই প্রজাপতি।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থের অনুসারে সকল ছন্দই প্রজাপতিস্বরূপ।
প্রজাপতির স্বভাবই নির্মান করা। অর্থাৎ ছন্দের স্বভাব নির্মান করা।
।। সর্বানি ছন্দাংসি বৈ প্রজাপতি।।
।।প্রাণ বৈ কম্পনাৎ।। প্রাণ কম্পনের আরেক অবস্থা।
মহর্ষি য়জ্ঞবাল্য মহারাজ শতপথ ব্রাহ্মণে লিখেছেন-
বাক্ মই মতির বাচম্ হিদম্ সর্বম্ মনুতে।। ইহা বাক্ ওঙ্কার রূপী বাক্, ওঙ্কার রূপী বাক্ ইহাই মহৎ তত্ত্ব। ইহা থেকে সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে প্রকাশিত করে রেখেছে, দীপ্তিযুক্ত করে রেখেছে, কান্তিযুক্ত করে রেখেছে। যেখানে এই কথার প্রকাশের সম্বন্ধ আছে, প্রকাশ যেখানে-যেখানে আছে ওই-ওই মূলের সবথেকে মূল তো ঈশ্বরই ওম্ যখন সৃষ্টি ছিল না তখন এক অব্যক্ত প্রকৃতি ছিল। তখন।পরামাত্মা প্রকৃতির মাঝে পরা ওম্ রশ্মি সক্রিয় করলেন তখন প্রকৃতির মাঝে সূক্ষ মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হল। সমগ্র প্রকৃতি জুড়ে চিত্রে বর্নিত কম্পনের ন্যায় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকল। এই।ভাবে ক্রমে মহৎ, অহঙ্কার, মনস্তত্ব আদি সৃষ্টি হল। মনস্তত্বের মাঝে আরো গাঢ়ো কম্পনের নির্মান হল। উক্ত কম্পনগুলো আর কিছুই নয় উহা সব বেদ মন্ত্রই। সৃষ্টির প্রথম এইভাবেই বৈদিক রশ্মির স্থাপনা হয়ে থাকে।
প্রকৃতিকে ডিষ্টার্ব করবার জন্য পরমাত্মা হতে কোন শক্তি বা বল প্রয়োগের দরকার হয় না। পরমাত্মার স্বাভাবিক গুণ ঈক্ষণ অর্থাৎ জ্ঞান ইশারা করা মাত্রই প্রকৃতির সাম্য অবস্থা ভঙ্গ হয়ে সৃষ্টির নির্মান অারম্ব হয়ে যায়। এই ক্ষেত্র প্রকৃতি উপাদানকারণ এবং পরমাত্মা নিমিত্ত কারণ।
যেমন কোন মানুষ তার মুখ-আয়ব দ্বারা ইশারা করে কোন বালকে উত্তেজিত করে থাকে তদ্রুপ পরমাত্মার ইশারা অতিসূক্ষাতিসূক্ষ। পরমাত্মার সাথে প্রকৃতির মধ্যে এই সম্বন্ধ খুব সূক্ষ। পরমাত্মার ইশারা পেলেই প্রকৃতি প্রজাপতী হতে আরম্ব করেন। সৃষ্টির সকল বস্তুই প্রকৃতির দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে এবং পরমাত্মা জ্ঞান তথা ঈক্ষণ কর্ম দ্বারা সব কিছুর তূল্যতার নিয়ামক হয়ে থাকেন।
সর্ব প্রথম পরমাত্মা পরা ওম্ রশ্মিকে মুক্ত করেন। পরা ওম্ অনাদি সত্বা কিন্তু তাহার গুণ সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয়। সৃষ্টিতে সক্রিয় এবং প্রলয়ে নিষ্ক্রিয় থাকে। পরমাত্মা যে সব কার্য সম্পন্ন করেন তাহা ওম্ রশ্মি দ্বারাই করে থাকেন।
।। যজ্ঞেন বাচঃ পদবীয মাযন্তা মন্ববিন্দ ত্রিৃষিষু প্রবিষ্টাম্।
তামা ভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাং সপ্ত রেভা অভি সং নবন্তে।। -(ঋক ১০/৭১/৩)
বাক বৈ বৃহস্পতি।। জ্ঞানম্ বৈ মনস্তত্ব।।
পদার্থঃ- ( যজ্ঞেন) পরম্ত্মার ( বাচঃ) পরা, পশ্যন্তি বানী রূপ সূক্ষ রশ্মি মনস্তাতিক ফ্লাকচুয়েশন ( পদবীযম্) আকাশ মার্গে ভাসমান এবং গতি যুক্ত তরঙ্গ রূপে বিরাজ করে (আযন্) সর্বত্র সদা ব্যাপ্ত তথা প্রাপ্ত (ঋষিষু প্রবিষ্টাম্) সেই বেদ রূপি ছন্দ রশ্মি আদি চার ঋষির হৃদয় মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় স্বাভাবিক ভাবে প্রবেশ করে ( তাম্) সেই ছন্দ রশ্মি রূপি বেদ বানীকে ( অন্ববিন্দন) সকল ঋষির মধ্যে অনায়াসে প্রবেশ করিবার শক্তি পরমাত্মাই প্রদান করে ( তাং আমৃত্যা) সেই বেদ বানীকে উত্তমতায় ধারন করে তাহাকে ( পুরুত্রা) পৃথিবী পৃষ্ঠের বহু স্থানে ( মে ব্যদধুঃ) প্রচার করে ( তাম্) সেই বেদ বানীকে ( সপ্ত রেভাঃ) ঋষিরা সাত ছন্দ রূপ তরঙ্গে বেদ রূপি অক্ষর রশ্মি এবং ছন্দরশ্মি আকারে (অভিসংনবন্তে) ধারন করে ।।
ভাবার্থঃ-পশ্যন্তি ওম্ রশ্মির দ্বারা মমনস্তত্বের মধ্য ঘটা প্রাণ রশ্মি এবং ছন্দ রশ্মির কম্পনই বেদ রূপি ঋচা। পরমাত্মার কৃপায় অগ্নি ঋষি,বায়ূ ঋষি,অঙ্গিরা ঋষি এবং আদিত্য ঋষি পরমাত্মার পরা, পশ্যন্তি বেদ বানী তরঙ্গকে তথা সাত ছন্দযুক্ত অক্ষর রশ্মি তরঙ্গকে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহনের ন্যায় আকাশ থেকে গ্রহন করে নেয়। সমগ্র অাকাশেই বেদ মন্ত্র ভরা আছে। পরে সেই বানীকে মানব সমাজে বৈখরী বানীর আকার দিয়ে অন্য ঋষিদের মাঝে প্রচার করেন।।
বেদ রূপি ঋচা তথা অক্ষর রশ্মি এবং ছন্দ রশ্মি এবং প্রাণরশ্মি। সূর্যাদি সৃষ্টির পূর্বেই পরমাত্মা কতৃক বেদ বানী সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গরূপি বেদ বানীর প্রভাবে সূর্যাদি সকল দৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়।।
বৈখরী, মধ্যমা, প্রশ্যন্তি, পরা এই হলো জ্ঞানের 4 অধ্যায়।
বৈখরী - আমি অন্য জায়গা বা অন্যের কাছ থেকে জেনে যেই জ্ঞানটা অর্জন করি সেটাই বৈখরীবাক|
মধমা - অনেক ব্যাক্তি দূরদৃষ্টি সম্পর্ন হয়, যেমন ধরো তাঁরা আজ যা বলছে 10, 20, 50, 100, 150 বছর পরে সেটাই ঘটছে !
উদাহরণ -রবিন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ | রবিন্দ্রনাথের অনেক লেখা পড়লে মনে হয় না সে এটা 150 বছর আগে লিখেছে ! এই জ্ঞানটাকেই বলে মধ্যমাবাক |
প্রশ্যন্তি - ধ্যানের একটা পর্যায়ে সাধকের সামনে সব ছবির মতো ফুটে উঠে !এই কারণে তাকে দ্রষ্টা বলা হয় !
ঋষি সংজ্ঞা -- যার কাছে বেদবানী স্বয়ং আগমন করে | এই দেখা বাকটাই হলো বেদ !
পরা -- সাধক যখন ধ্যানস্থ থাকে তখন সে পরমশান্তি এবং ঈশ্বর উপলব্ধি করে \| কিন্তু সে কোনোদিন ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না ! সাধক তখন পরমাত্মায় লীন থাকে ! ধ্যানের এই চরম পর্যায়ে যেই জ্ঞানটা উপলব্ধি করে সেটাই পরাবাক |
প্রথমে এই জ্ঞান গুরু শিষ্য পরম্পরায় চললেও একটা সময় খরার ফলে অনেকে তাঁদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তখন এই ঋষিদের থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত করে বেদ সম্পাদন করেন এবং লিপিবদ্ধ করেন এক ব্যাক্তি, তাঁর নাম কৃষ্ণ ! কারণ নাহলে বেদজ্ঞান বিলুপ্তি হয়ে যাবে !
তিনি এক দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন তাই তাঁর নামে যুক্ত হয় দৈপায়ন !
তিনি জেলে বর্মাছত্রপতির পুত্র ! তিনি বেদকে সম্পাদন করেন বলে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয় বেদব্যাস!
রশ্মি
সমগ্র আকাশে পশ্যন্তি মধ্যমা বেদ বানী ভরা আছে। মনস্তাত্ত্বিক এই ফ্লাকচুয়েশন বানী কম্পন্নরত অবস্থায় আকাশে নৃত্যের ন্যায় ছন্দায়িত হচ্ছে। আমাদের ঋতম্বরা প্রজ্ঞা লাভকারী সমাধিস্থ ঋষি তা শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় সহজে গ্রহন করে নিয়েছিলেন। সংস্কৃত ব্রহ্মান্ডের ভাষা যা দ্বারা বেদ মন্ত্র লিখিত হয়েছে, অন্য কোন মনুষ্যকৃত ভাষা ব্যবহার করে লেখা হয়নি। কোরআনের ভাষা আরবি[সুরা : হুদ, আয়াত : ২], বাইবেল হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় রচিত,সংস্কৃত ভাষা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত ভাষার একটা সিমাবদ্ধতা আছে। একটা গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে এই সকল ভাষা ব্যবহার করে জন সংযোগ স্থাপনে বিপত্তি আসে। তাই বর্তমান সময়ে নাসা তে সকল বৈজ্ঞানীদের সংস্কৃত ভাষার একটি ক্যাপসুল ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নিরুক্তকারের মতে রশ্মি, যাহা অনাদি সত্বা।
[Shatpatha Brahmana 11/5/2/3]
অর্থাৎ। যাহা কোন কিছুকে উৎপন্ন করে ধারণ পালন পোষণ নিয়ামন,নির্মান করতে থাকেন তাহাই রশ্মি। সৃষ্টির বহু রশ্মি আছে।বেদে যত মন্ত্র আছে ততই রশ্মি সৃষ্টিতে আছে। একেকটি বেদ মন্ত্রই রশ্মি। তাই নিরুক্তকার বলেছেন রশ্মির যমুনাম। বেদ অনন্ত।তাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থের ঋষিরা বলছেন। অনন্ত বৈ বেদা। সৃষ্টিতে বেদ অনন্ত। মানবীয় ঋষিগণ তাদের মানবীয় সামর্থ দ্বারা যতটুকু বৈদিক রশ্মিকে শোষণ করে নিতে পেরেছেন ততটুকুই মনুষ্যের জন্য বিদিত হয়েছেন।
সৃষ্টির আদিতে অমৈথুনি মনুষ্য সৃষ্টি হইলে পাঁচ বৎর পরে অগ্নি,বায়ু,অঙ্গিরা,আদিত্য নাম্মী উপাধি প্রাপ্ত চার ঋষি শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহনের ন্যায় বেদ ঋচা সমুহ মনস্তত্ব হতে শোষন করে নেন। মনস্তত্ব বিশ্বজগতের পূর্ব অবস্থা যেটা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত আছে।
বেদ মন্ত্র সমুহ বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির ছন্দ যদ্বারা বিশ্ব সংসারের সকল স্থূল সূক্ষ পদার্থের নির্মান হয়েছে। বেদ মন্ত্র সকলই প্রজাপতি।
বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান যা সৃষ্টির প্রারম্ভে মানবের কল্যাণের জন্য দেওয়া হয়েছে।বেদ হলো বৈদিক সংস্কৃতির মূলাধার। এই সংসার রুপ সাগর পারের জন্য বেদ হলো নৌকারুপ।বেদে মনুষ্য জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে।অজ্ঞানান্ধাকারে পতিত মানুষের জন্য বেদ প্রকাশস্তম্ভ। ভুল পথে গমনকারী লোকের জন্য বেদ সত্য মার্গ দেখায়। পথভ্রষ্টকে কর্তব্য জ্ঞান প্রদান করে। আধ্যাত্ম পথের পথিক এর জন্য প্রভু প্রাপ্তির সাধনার উপদেশ দেয়। সংক্ষেপে বেদ অমূল্য রত্ন ভান্ডার।
বেদ মানবজাতির সর্বস্ব।
মহর্ষি অত্রি বলেছেন→
“নাস্তি বেদাত্ পরং শাস্ত্রম্।”(অত্রিস্মৃতি ১৫১)
অর্থাৎ বেদের চেয়ে বড়ো কোনো শাস্ত্র নেই।
মহর্ষি মনু লিখেছেন→
“য়োনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রমম্।
স জীবনত্রেব শুদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ।।”(মনুসংহিতা ২/১৬৮)
.
অর্থাৎ যে দ্বিজ(ব্রহ্মচারী/ব্রাহ্মণ) বেদ না পড়ে অন্যান্য শাস্ত্র পড়ে পরিশ্রম করে,সে জীবনাবস্থাতেই নিজের কুলসহিত শুদ্রে পরিনত হয়।
বেদের মহত্ব মহর্ষি মনু,মনুসংহিতাতে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন
“সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।।”(মনুসংহিতা ২/৭)
অর্থাৎ বেদ সকল জ্ঞানের ভান্ডার।
তিনি এটাও লিখেছেন যে➨
“কোনো ব্রাহ্মণ যদি তপস্যা করতে চায় তাহলে সেই ব্রাহ্মণ যেন বেদ অভ্যাস করে,বেদ অভ্যাসই হলো ব্রাহ্মণের পরম তপস্যা।”(মনুসংহিতা ৬/৩৭)
মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন
“যজ্ঞানাং তপসাঞ্চৈব শুভানাং চৈব কর্মণাম্।
বেদ এব দ্বিজাতীনাং নিঃশ্রেয়সকরঃ পরঃ।।”(যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ১/৪০)
অর্থাৎ যজ্ঞের বিষয়ে,তপস্যার বিষয়ে,শুভ কর্মের জ্ঞানার্থ দ্বিজের জন্য বেদ পরম কল্যাণের সাধন।
অত্রি স্মৃতি শ্লোক ৩৫১→
“শ্রুতিঃ স্মৃতিশ্চ বিপ্রাণাং নয়নে দ্বে প্রকীর্তীতে।
কাণঃ স্যাদেকহীনোপি দ্বাভ্যামন্ধঃ প্রকীর্তীতঃ।।
অর্থাৎ→ শ্রুতি=বেদ এবং স্মৃতি- এই দুটিকে ব্রাহ্মণের চোখ বলা হয়েছে। যদি এই দুটির মধ্যে যে কোনো একটি না থাকে তবে সেই ব্রাহ্মণ কাণা বলে বিবেচিত হবে এবং দুটোই যদি না থাকে তবে সে অন্ধ বলে বিবেচিত হবে।
বৃহস্পতি স্মৃতিতে ৭৯তে বেদের প্রশংসা করা হয়েছে,যা নিম্নরূপ➨
“অধীত্য সর্ববেদান্বৈ সদ্দো দুঃখাত প্রমুচ্যতে।
পাবনং চরতে ধর্ম স্বর্গলোকে মহীয়তে।”
অর্থাৎ বেদের অধ্যায়ন করে মানুষ শীঘ্রই দুঃখ থেকে মুক্তি পায়,সে পবিত্র ধর্মের আচরন করে এবং স্বর্গলোকের মহিমা প্রাপ্ত হয়।
প্রাচীন সমস্ত স্মৃতিকার, দর্শন শাস্ত্রকার, উপনিষদকার তথা রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির লেখকেরা এমনকি এমনকি পুরানকার রাও বেদকে ঈশ্বরীয় তথা স্বতঃ প্রমাণ এবং অন্য সমস্ত গ্রন্থকে পরতঃ প্রমাণ বলেছেন।
উদাহরণস্বরূপ মনু বলেছেন➨
“বেদোখিলো ধর্মমূলম্।”(মনুসংহিতা ২/৬)
অর্থাৎ বেদ হল হল ধর্মের মূল। ধর্মের বিষয়ে বেদ স্বতঃ প্রমাণ।
মনুসংহিতা ২/১৩ এ লেখা আছে➨
“ধর্ম জিজ্ঞাসমানানাং, প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।।”
অর্থাৎ যে ধর্মের জ্ঞান প্রাপ্ত করতে চায় তাঁর জন্য পরম প্রমাণ বেদ।
এছাড়াও বলেছেন
“পিতৃদেবমনুষ্যাণাং বেদশ্বক্ষুঃ সনাতনম্। অশক্যং চাপ্রমেয়ং চ, বেদশাস্ত্রং ইতি স্থিতিঃ।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৪)
“চাতুর্বণ্যং ত্রয়ো লোকা শ্চত্বারশ্চাশ্রমাঃ পৃথক্। ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ, সর্বং বেদাত্প্রসিধ্যতি।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৭)
“বিভর্তি সর্বভূতানি,বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।তস্মাদেতত্পরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৯)
সারাংশ এটাই যে, বেদ পিতৃ, দেব, মনুষ্য সকলের জন্য সনাতন মার্গদর্শক চোখের সমান। বেদের মহিমা পূর্ণভাবে প্রতিপাদন করা খুবই কঠিন। চার বর্ণ, তিন লোক, চার আশ্রম, ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান বিষয়ক জ্ঞান বেদ থেকেই প্রসিদ্ধ হয়। সনাতন (নিত্য) বেদ শাস্ত্র সকল প্রাণীকে ধারণ করে এটাই সকল মানুষের জন্য ভবসাগর পারের সাধন।
শতপথ ব্রাহ্মণ তথা তদন্তর্গত বৃহদারণ্যক উপনিষদে স্পষ্ট বলা হয়েছে➨
“এতস্য বা মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতত্।
য়ত্ ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোথর্ববেদঃ।।”(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৫/১১)
অর্থাৎ ঋকবেদ যজুর্বেদ সামবেদ এবং অথর্ববেদ সেই মহান পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ।
সমগ্র আকাশে পশ্যন্তি মধ্যমা বেদ বানী ভরা আছে। মনস্তাত্ত্বিক এই ফ্লাকচুয়েশন বানী কম্পন্নরত অবস্থায় আকাশে নৃত্যের ন্যায় ছন্দায়িত হচ্ছে। আমাদের ঋতম্বরা প্রজ্ঞা লাভকারী সমাধিস্থ ঋষি তা শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় সহজে গ্রহন করে নিয়েছিলেন। আজ আমাদের নিকট তাহা চারবেদ হিসাবে খ্যাত।
শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে
“স (প্রজাপতিঃ) শ্রান্তস্তেপানো ব্রহ্মৈব প্রথমমসৃজত ত্রয়ীমেব বিদ্দ্যাম্।।
অর্থাৎ প্রজাপতি পরমেশ্বর নিজের তপস্যা বা পূর্ব জ্ঞান দ্বারা বেদের নির্মাণ করেছেন যা ওই ত্রয়ীবিদ্যা নামে পরিচিত কেননা তাতে জ্ঞান কর্ম এবং উপাসনার প্রতিপাদন রয়েছে।
মুন্ডক উপনিষদে বেদ কে ঈশ্বরীয় জ্ঞান মানার স্পষ্ট প্রতিপাদন রয়েছে
“অগ্নির্মুর্ধা চক্ষুষী চন্দ্রসূর্যো দিশঃ শ্রোত্রে বাগ্বিবৃতাশ্চ বেদাঃ।।”(মুন্ডক উপনিষদ ২/১/৪)
অর্থাৎ সেই ঈশ্বরের মস্তক অগ্নি'র সমান, সূর্য এবং চন্দ্র যার চোখের সমান, দিক যার কানের তুল্য, বেদ যার বানী অর্থাৎ এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে বেদ ঈশ্বরীয়।
তণ্ড্যয় ব্রাহ্মণ তথা তদন্তর্গত ছান্দোগ্য উপনিষদে ছন্দের দ্বারা বেদের মহিমা উপস্থাপন করা হয়েছে→
“দেবা বৈ মৃত্যোর্বিভ্যতস্ত্রয়ীং বিদ্যাং প্রাবিশন্ তে ছন্দোভিরচ্ছাদয়ন,য়দেভিরচ্ছাদয়ন,তচ্ছান্দসাং ছন্দস্ত্বম্।”(ছান্দোগ্য উপনিষদ ১/৪/২)
অনুবাদ→ দেবতারা (সত্যনিষ্ঠ বিদ্বানেরা) মৃত্যুর দ্বারা ভয়ে ভীত হয়ে ত্রয়ীবিদ্যা (জ্ঞান,কর্ম, উপাসনার প্রতিপাদনকারী বেদ) এর আশ্রয় নেয়। তাঁরা বেদ মন্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং এইজন্য ইহাকে ছন্দও বলা হয়।
মহাভারতে বেদের মহত্ব
মহাভারতে মহর্ষি বেদব্যাস বেদ কে নিত্য এবং ঈশ্বর কৃত বলেছেন এবং বেদ কে অর্থ শহিত অধ্যয়ন করার জন্যও বলেছেন।
“অনাদিনিধনা নিত্যা বাগূত্সৃষ্টা স্বয়ম্ভূবা।
আদৌ বেদময়ী দিব্যা য়তঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ।।” (মহাভারত শান্তি পর্ব ১২/২৩২/২৪)
অনুবাদ→ সৃষ্টির আদিতে স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা এই বেদ বাণী প্রকাশিত হয়েছিল যার না আদি আছে,না অন্ত,যা নিত্যনাশরহিত এবং দিব্য।যা থেকে জগতের সমস্ত প্রবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে।
এই অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে
“নানারুপং চ ভূতানাং, কর্মণাং চ প্রবর্তনম্।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ,নির্মিতীনে স ঈশ্বরঃ।।
নামধেয়ানি চর্ষীণাং,য়াশ্চ বেদেষু দৃষ্টয়ঃ।
শর্বর্য়ন্তে সুজাতানাং,তান্যেবৈভ্যো দদাত্যজঃ।।”
(মহাভারত শান্তিপর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ২৩২/২৫/২৭)
অনুবাদ→ ঈশ্বর বস্তুর নাম এবং কর্ম বেদের শব্দের দ্বারা নির্মাণ করেছেন।ঋষিদের নাম এবং জ্ঞান প্রলয়ের শেষে অর্থাৎ সৃষ্টির প্রারম্ভে বেদের দ্বারা করছেন। বেদের অর্থ সহিত অধ্যায়নের উপর জোর দিয়ে,
ব্যাসদেব বলেছেন→
“য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্ৰন্থধারণতত্পরঃ।
ন চ গ্ৰন্থার্য়তত্বজ্ঞঃ,তস্য তদ্ধারণং বৃথা।।
ভারং স বহতে তস্য গ্ৰন্থস্যার্থ ন বেত্তি য়ঃ।
য়স্তু গ্ৰন্থার্থতত্ত্বজ্ঞো নাস্য গ্ৰন্থাগমো বৃথা।।”
(মহাভারত শান্তি পর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ৩০৫/১৩/১৪)
অনুবাদ→ যে কেবল বেদ পড়ে কিন্তু বেদের অর্থ এবং তত্ত্ব জানেনা, তাঁর এই প্রকার অধ্যায়ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। অতএব সকলের উচিত বেদের অধ্যায়ণ অর্থ এবং তত্ত্বের সাথে করা।
এছাড়া মহাভারতে আরো বলা হয়েছে→
ঋষয়স্তপসা বেদানধ্যৈষন্ত দিবানিশম অনাদিনিধনা
বিদ্যা বাগৎসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব ২৩২।২৪)
.
অর্থাৎ মহর্ষিগণ তপোবলেই দিবানিশি বেদ অধ্যয়ন
করিয়া থাকেন। সৃষ্টির প্রথমে জগদীশ্বর আদি অন্ত শূন্য বেদ রূপী বিদ্যার সৃষ্টি করিয়াছেন ।
-
দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে শব্দব্রহ্ম পরং চ যৎ।
শব্দব্রহ্মণি নিষ্পাতঃ পরং ব্রহ্মাধিগচ্ছতি।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব ২৩২।৩০)
.
অর্থাৎ বেদ ও বেদ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন , তিনিই অনায়াসে পরব্রহ্ম লাভে সমর্থ হন ।
-
নাবেদনিষ্ঠস্য জনস্য রাজন প্রদেয়মেতত্ পরমং ত্বয়্
ভবেত্। বিধিত্সমানায় বিবোধকারণং প্রবোধহেতোঃ
প্রণতস্য শাসনম্।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৩০৮। ৩২)
.
যে মনুষ্য বেদে শ্রদ্ধা রাখে না, তাকে এই জ্ঞানের
উপদেশ দেওয়া উচিৎ নয়। যার বোধের জন্য অধিক পিপাসা তথা যে জিজ্ঞাসু শরণে আসে তিনিই শোনার অধিকারী।
-
দর্শন শাস্ত্রে বেদের মহত্ব
ন্যায়, বৈশেষিক,সাংখ্য,যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত এই ছয় দর্শন শাস্ত্র যা গৌতম,কণাদ,কপিল, পতঞ্জলি,জৈমিনি এবং ব্যাসদেব রচিত। এই সমস্ত দর্শন শাস্ত্রে বেদের মহত্বের স্পষ্টততা স্বীকার করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ,
ন্যায় দর্শনে➣
“মন্ত্রায়ুর্বেদ প্রামাণ্যবচ্চ তত্প্রমাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাত্ (২/১/৬৭)
সুত্রে পরম আপ্ত পরমেশ্বরের বাণী এবং অসত্য, পরস্পর বিরোধী এবং পুনরোক্তি দোষরহিত হওয়ায় বেদকে পরম প্রমাণ হিসেবে সিদ্ধ করা হয়েছে।
বৈশেষিক শাস্ত্রকার কণাদ মুনি➣
“তদ্ বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্।”(১০/১/৩)
এই সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরের বাণী হওয়ায় আম্নায় অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলা হয়েছে।
আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে-
“বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদ।”(৬/১/১)
অর্থাৎ বেদ বাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্বক। এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোনো কথা নেই।অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান।
সাংখ্য দর্শনে কপিল মুনি ➣
“শ্রুতি বিরোধাত্র কুতর্কাপসদস্যাত্মলাভঃ।”(৬/৩৪)
শ্রুতি বিরুদ্ধ কুতর্ককারীরা কখনোই আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন না। এই সূত্রের মাধ্যমে সাংখ্যকার বেদের প্রামাণিকতা স্বীকার করেছেন।
এছাড়াও একটি সূত্রে বলা হয়েছে-
“ন পৌরুষেয়ত্বং তত্কর্তুঃ পুরুষস্যাভাবাত্।”(৫/৪৬)
অর্থাৎ-বেদ পৌরুষের নয়,কেনন বেদের রচয়িতা কোনো পুরুষ নয়।জীব অল্পজ্ঞ এবং অল্পশক্তি হওয়ায় সে সমস্ত বিদ্যার ভাণ্ডার বেদ রচনা করতে অসমর্থ।বেদ মনুষ্য রচনা না হওয়ায় বেদ অপৌরুষেয়।
আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে➙
নিজশক্ত্যভিব্যক্তেঃ স্বতঃ প্রমাণ্যংম্।”(৫/৫১)
সূত্রের দ্বারা বেদকে ঈশ্বরীয় শক্তি থেকে অভিব্যক্ত(প্রকট) হওয়ায় স্বতঃ প্রমাণ মানা হয়েছে।
যোগদর্শনকার পতঞ্জলি মুনি➣
“তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞ বীজম্”(যোগ ১/২৫)
সেই (ঈশ্বর)এর সর্বজ্ঞ হওয়া এতটাই নিমিত্ত যে তিনি ছাড়া আর কারোরই সেই ক্ষমতা নাই।
“স এষ পূর্বেমেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাত্।”(যোগ ১/২৬)
ঈশ্বরকে এইভাবে সমস্ত জ্ঞানের স্তোত্র মেনে বলেছেন সেই(ঈশ্বর)যার কাল বিভাগ নেই, তিনি পূর্ব ঋষিদের ও গুরু।
অর্থাৎ তিনি জগতের প্রারম্ভে বেদরুপী জ্ঞান দিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করেছেন। এই দর্শন এটাই সিদ্ধ করে যে,বেদ হলো ঈশ্বরীয় জ্ঞান। বেদজ্ঞান দান করায় পরমেশ্বর কে আদি গুরু মানা হয়েছে।
বেদান্ত শাস্ত্রের কর্তা ব্যাসদেব➣
“শাস্ত্র য়োনিত্বাত্” (১/১/৩) তে তথা “অতএব চ নিত্যত্বম্”(১/৩/২৯) ইত্যাদি সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরকে ঋগ্বেদাদি রুপ সর্ব জ্ঞানের কর্তা মেনে বেদের নিত্যতা প্রতিপাদন করা হয়েছে।“শাস্ত্রয়োনিত্বাত্”(১/১/৩)
উপরিউক্ত সূত্রের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য লিখেছেন➟
“ঋগ্বেদাদেঃ শাস্ত্রস্যানেকবিদ্যা স্থানোপ্বৃংহিতস্য প্রদীপবত্ সর্বার্থাবধোতিনঃ সর্বজ্ঞকল্পস্য য়োনিঃ কারণং ব্রহ্ম। নহীদৃশস্য-র্গ্বেদাদি লক্ষণস্য সর্বজ্ঞগুণাচিতস্য সর্বজ্ঞাদন্যতঃ সংভবোস্তি।”
.
অর্থাৎ ঋগ্বেদাদি যে চার বেদ আছে যা অনেক বিদ্যার দ্বারা যুক্ত, সূর্যের সমান সমস্ত সত্য অর্থের প্রকাশ করে,যা সর্বজ্ঞত্বাদী গুণযুক্ত পরমেশ্বরের বাণী, কেননা সর্বজ্ঞ ব্রহ্ম ছাড়া কোনো জীব সর্বজ্ঞ গুণযুক্ত এই বেদকে তৈরি করতে পারে না।
মীমাংসা শাস্ত্রের কর্তা জৈমিনি ধর্মের লক্ষণ সম্পর্কে বলছেন➣
“চোদনালক্ষণোর্থো ধর্মঃ” অর্থাৎ বেদের আজ্ঞাই হল ধর্ম, এবং যা বেদবিরুদ্ধ তা অধর্ম। এই ভাবে সমস্ত শাস্ত্র একস্বরে বেদের নিত্যতা এবং স্বতঃ প্রমাণতা প্রতিপাদন করে।
বেদের মহত্বের কারণ➽
(১) বেদের মহত্বের কারণ এটাই যে,বেদের মধ্যে জ্ঞান,কর্ম, উপাসনার সুন্দর মেলবন্ধন রয়েছে।কেবলমাত্র জ্ঞান বা কর্মের দ্বারা মুক্তি হয় না। জ্ঞান কর্ম এবং উপাসনার মিলনেই মোক্ষ বা পরমানন্দ প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রদ্ধা এবং মেধা(শুদ্ধ বুদ্ধি বা তর্ক)এর সুন্দর মিলন বৈদিক ধর্ম শেখায়।
শ্রদ্ধাং প্রাতর্হবামহে শ্রদ্ধাং মধ্যংদিনং পরি।শ্রদ্ধাং সূর্যস্য নিম্রুচি শ্রদ্ধে শ্রদ্ধাপয়হে নঃ।” (ঋগ্বেদ ১০/১৫১/৫)
অনুবাদ→মন্ত্রের দ্বারা প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন এবং সূর্যাস্তের সময় শ্রদ্ধার ধারণ করতে এবং জীবনকে শ্রদ্ধাময় বানানোর জন্য উপদেশ করা হয়েছে।সাথে সাথেই আমাদের সর্বদা মেধা বা শুদ্ধ বুদ্ধি ধারনের কথা বলা হয়েছে।
“মেধাং সায়ং মেধাং প্রাতর্মেধাং মধ্যন্দিনং পরি।
মেধা সূর্যস্য রশ্মিভির্বচসা বেশয়ামহে।।”(অথর্ববেদ ৬/১০৮/৫)
অনুবাদ→মন্ত্রে এই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে।প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন,সায়ং সূর্যের কিরণের সাথে সাথে মেধা অথবা শুদ্ধ বুদ্ধি যেন আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করি।
বৈদিক ধর্মের শ্রদ্ধা অন্ধবিশ্বাস নয় শ্রত্+ধা অর্থাৎ "সত্যকে ধারণ করা"। শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা সত্য জ্ঞান প্রাপ্ত করে তার সম্পূর্ণতা নিজের মধ্যে ধারণ করা, কঠিন থেকে কঠিনতর আপত্তি এবং প্রলোভন এলেও সত্যকে অস্বীকার না করাই হচ্ছে শ্রদ্ধা।বেদোক্ত ধর্ম এইভাবেই শ্রদ্ধা এবং মেধা (শুদ্ধ বুদ্ধি) র মিলনের উপদেশ দেয়।
“অগ্নয়ে সমিধামাহার্য় বৃহতে জানবেদসে।
স মে শ্রদ্ধাং মেধাং চ জানবেদাঃ প্রয়চ্ছতু।।”
(অথর্ববেদ ১৯/৬৪/১)
.
“মূর্ধানমস্য সংসীব্যাথর্বা হৃদয়ং চ য়ত্।”(অথর্ববেদ ১০/২/২৬)
তাৎপর্য→ উপরিউক্ত মন্ত্রের দ্বারা জ্ঞানীর জন্য মস্তিষ্ক এবং হৃদয় কে কাজ করার জন্য উপদেশ দেয় যা অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ। ধর্মের বিষয়ে তর্ক করলে তা নাস্তিকতার চিহ্ন বলে মনে করা হয়। কেবলমাত্র বিশ্বাস এর উপর নির্ভর করা হয়,যার ফলে সমাজে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাস। কিন্তু বেদোক্ত ধর্ম কখনোই কোনো অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার বা যুক্তিবিরোধী কথায় বিশ্বাস করে না।ইহার বিশেষতা এটাই, প্রত্যেক মন্ত্রে বুদ্ধি এবং যুক্তিতর্ক এর মাধ্যমে সত্যকে স্বীকার করার কথা বলা হয়েছে।
তর্কের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যে বিভিন্ন কথা পাওয়া যায়-
(I) মহাভারতে লেখা আছে নাস্তিক,সমস্তকিছুতেই শঙ্কা প্রকাশ করে,বেদ নিন্দুক, মূর্খ নিজেকে পন্ডিত মনে করে এবং শেয়ালের যোনি প্রাপ্ত হন।(মহাভারত শান্তি পর্ব ২৮০)
(II) মনু লিখেছেন যে ব্যক্তি তর্কের আশ্রয় নিয়ে বেদের অপমান করে,সে নাস্তিক এবং বেদ নিন্দুক।(২/১১)
যখন মানুষ তর্ক ছেড়ে শ্রদ্ধার আশ্রয় নেয় তখন তা অন্ধবিশ্বাসে পরিনত হয়।এইভাবে যখন শ্রদ্ধা ছেড়ে তর্কের আশ্রয় নেয় তা কুতর্কীতে পরিনত হয়।এজন্য এটাই আবশ্যক তর্ক এবং শ্রদ্ধা এই দুটোকেই নিজেদের সীমার মধ্যে রাখা উচিত।
(২) বেদের মহত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে এখানে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। বেদের অনুসারে এই সমবিকাস হলো উন্নতির মূলমন্ত্র।
“মনস্ত আপ্যায়তাং বাক্ ত আপ্যায়তাং প্রাণস্ত আপ্যায়তাং চক্ষুস্ত আপ্যায়তাং শ্রোত্রং ন আপ্যায়তাম্।।(যজুর্বেদ ৬/১৫)
.
“বাঙ্ ম আসন্ নসোঃ প্রাণশ্চক্ষুরক্ষ্ণোঃ শ্রোত্রং কর্ণয়োঃ।।
অপলিতাঃ কেশা অশোণা দন্তা বহু বাহ্মোর্বলম্।।
ঊর্বারোজা জঙ্ঘয়োর্জবঃ পাদয়োঃ প্রতিষ্ঠা অরিষ্টানি মে সর্বাত্মা নিভৃষ্টঃ।।”
অথর্ববেদ ১৯/৬০/১/২)
ইত্যাদি মন্ত্রে এই শারীরিক মানসিক ও আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশের জন্য প্রতিপাদন এবং সেই অর্থে প্রার্থনাদির উপদেশ আছে এবং একেই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য বলা হয়েছে।
(৩) বেদের মহত্বের তৃতীয় কারণ হলো বেদে মধ্যমার্গের প্রতিপাদন তথা উহার সমন্বয়াত্মক উপদেশ আছে। সমাজে প্রায় দেখা যায় মানুষ মধ্যমার্গের অবলম্বন না করে কোনো না কোনো বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়ে যার জন্য তাঁকে বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ অনেক মানুষ আছে যারা ব্যাক্তিগত উন্নতিতে সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু সামাজিক উন্নতির দিকে একটুও দেখে না।আবার অনেকে আছেন যারা পর্যাপ্ত রুপে নিজেদের শারীরিক মানসিক ও আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশ না করে কেবল অপরের উন্নতির ব্যাপারে তৎপর থাকেন। বাস্তবে যদি দেখি তাহলে এই দুটোই আবশ্যক। যজুর্বেদ ৪০ অধ্যায়ে সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি নিয়ে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত ভাবের বর্ণনা করে বলা হয়েছে➙
“অন্ধংতমঃ প্রবিশন্তি য়ে সংভুতিমুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য় উ সংভূত্যাং রতাঃ।।”(যজুর্বেদ ৪০/৯)
অর্থাৎ যে কেবল অসংভূতি-ব্যাক্তিগত উন্নতির জন্য মগ্ন থাকে সে অন্ধকারে পতিত হয় এতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু যে ব্যাক্তিগত উন্নতিতে মনোযোগ না দিয়ে কেবল সামাজিক উন্নতির জন্য মগ্ন থাকে সেও অন্ধকারে পতিত হয়। এই জন্য বেদ অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি অর্থাৎ ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক এই দুটোরই উন্নতির জন্য মনোযোগ দেওয়ার উপদেশ দেয়।
এছাড়াও পবিত্র গীতা তে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে
পবিত্র বেদ ঈশ্বরের থেকে এসেছে অর্থাৎ পবিত্র বেদ ঈশ্বরের জ্ঞান -: গীতা 3/15
এবং পরের শ্লোকে গীতা ৩/১৬-তে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে -যে ব্যক্তি বেদ মানে না , সেই পাপীর জীবনই বৃথা ।
এছাড়াও পবিত্র গীতার ১৫/১৫:-তে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে সমগ্র বেদ দ্বারা ঈশ্বরকে জানা যায় ।।
এই কারণেই বেদ সনাতন ধর্মের মূল এবং প্রধান ধর্মগ্রন্থ সর্বশ্রেষ্ঠ , যাঁর জয়গান সমস্ত শাস্ত্রে করা হয়েছে ।
পৃথিবীর নানা জাতি নানা ভাষায় ও নানা ভাবে আজও বেদের গবেষণা করিতেছে। বেদের উপর পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধা থাকিলেও সকলে বেদকে একভাবে দেখেন না। যাঁহারা বেদ-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিতে পারি। একদল বেদকে “পৌরুষেয়”, দ্বিতীয় দল “আর্ষ”, তৃতীয় দল “ঈশ্বরীয়” এবং চতুর্থ দল “অপৌরুষেয়” বলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বেদকে পৌরুষেয়’ বলেন। তাঁহাদের মতে বেদ মানবের রচনা মনে করিয়াই তাঁহারা বেদকে পুরুষ বিশেষের রচিত বা “পৌরুষেয়” বলেন। বেদ তাঁহাদের মতে মানব মস্তিষ্কের চরম উৎকর্ষ। ঋষিদিগকেই তাঁহারা বেদ মন্ত্রের রচয়িতা ও উপদেষ্টা মনে করেন। বেদ মানব জাতির গ্রন্থ ভাণ্ডারে প্রাচীনতম গ্রন্থ ইহা তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। বেদকে কেন্দ্র করিয়াই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাঁহারা এই সব সাহিত্য রাজির মধ্য হইতে প্রাচীন আর্য জাতির ইতিহাস উদ্ধার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছেন। প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক বৃত্তান্তও তাঁহারা বেদ হইতেই উদ্ধার করিতে প্রায়াস পাইয়াছে। পৌরুষেয়বাদী এই সব দেশী ও বিদেশী পণ্ডিত বেদকে উপাদেয় গ্রন্থ ও গবেষণার ক্ষেত্র মনে করয়িা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেছেন।
দ্বিতীয় পক্ষ বেদকে “আর্ষ” বলেন। প্রাচীনকাল হইতেই ইহারা ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন যে, বেদ ঋষি প্রণীত। স্বচ্ছ-হৃদয়, সত্যাচারী শুদ্ধাত্মা ঋষিরা পুণ্যবলে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ের যে সাক্ষাৎ জ্ঞান দর্শন করিয়াছিলেন, ইহাই বেদ মন্ত্রের সমষ্টি। ইঁহাদের মতে বেদের বিষয়ীভূত জ্ঞান সর্বদাই একরস থাকে। কল্প কল্পান্তরেও এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয় না। এই জ্ঞান মানব জাতির উন্নতির চির সহায়। এক কথায় আর্ষবাদীরা বেদ মন্ত্রের ভাষাকে ঋষিদের নিজস্ব মনে করেন, কিন্তু বেদমন্ত্রের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নিজস্ব মনে করেন। তাঁহাদের মতে বেদান্তর্গত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তির নিয়ম অপৌরুষেয় বা ঈশ্বরীয়। পরমেশ্বর বেদকে উৎপন্ন করিয়াছেন এবং ইহা ঋষিদের ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। পৌরুষেয় ও আর্ষ পক্ষ উভয়েরই মতেই বেদমন্ত্র একসঙ্গে রচিত হয় নাই। বেদ মন্ত্র রচনা করিতে ঋষিদের কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হইয়াছে। আর্ষবাদী মতে উপনিষদ রচিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিদের যুগ শেষ হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদের মধ্যে কল্পিত উপাখ্যানও আছে। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজের বলিয়াই তাঁহারা ইহাকে ‘আর্ষ’ বলিয়া থাকেন।
তৃতীয় পক্ষ বেদকে “ঈশ্বরীয়” বলেন। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রথমে স্বচ্ছ হৃদয় মানবের হৃদয়ে ঈশ্বর বেদবাণীর প্রেরণা দান করেন। যে সব মানবের আত্মা পূর্ব সৃষ্টিতে শুভকর্ম দ্বারা শুদ্ধ থাকে তাঁহাদের হৃদয়ই বেদবাণীর প্রেরণা লাভ করে। ঈশ্বরীয় পক্ষ বলেন –চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গলোকাদি যেমন পূর্ব কল্পের অনুযায়ী, যেমন এ কল্পে রচিত হইয়াছে তেমন পূর্ব পূর্ব কল্পে বেদ যেভাবে প্রকট হইয়াছিল এ কল্পেও সেই ভাবেই প্রকট হইয়াছে। ইহাদের মতে বেদের মন্ত্র, ভাষ্য ও অর্থ প্রত্যেক কল্পে একরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। আর্ষপক্ষ জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন আর ঈশ্বরীয় পক্ষ ভাষা, শব্দ, মন্ত্র ও জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, - কল্পের প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদ অর্পিত হইয়াছিল এবং ব্রহ্মার নিকট হইতে শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। কাহারও মতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এই চারিজন ঋষির হৃদয়ে চারি বেদ অর্পিত হইয়াছিল। এই চারিজন ঋষি হইতেই শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবজাতির মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদ ‘ঈশ্বরীয়’ ও নিত্য। কল্পের প্রারম্ভে ঋষিরা ইহার প্রকাশ করিয়াছিলেন। বেদ ঋষিদের নিজস্ব বস্তু নয়, তাঁহারা বেদের রচয়িতা নহেন তাঁহারা বেদের দ্রষ্টা। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন এই ঈশ্বরীয় পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। উত্তর মীমাংসার মতে বেদ দিব্যবাক্।
চতুর্থ পক্ষ বেদকে “অপৌরুষেয়” বলেন। ইঁহারা বেদের উৎপত্তি স্বীকার করেন না; অভিব্যাক্তি স্বীকার করেন। মীমাংসা দর্শনকার জৈমিনীর মতে শব্দ নিত্য। নিত্য পদার্থ অপরিণামী ও প্রবাহ ভেদে দ্বিবিধ। যাহার স্বরূপ বা গুণের কোনই পরিবর্তন হয় না তাহা ‘অপরিণামী-নিত্য’ এবং যাহা নানা রূপান্তরের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে তাহা ‘প্রবাহ-নিত্য’। পরমাত্মা অপরিণামী-নিত্য। তিনি সর্বদাই এক রস থাকেন কিন্তু প্রকৃতি প্রবাহ-নিত্য। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের চক্র প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয় কিন্তু কারণ রূপে ইহা নিত্য। বেদ শব্দময়। মহর্ষি জৈমিনি শব্দকে নিত্য বলিয়াছেন। অ-আ-ক-খ প্রভৃতি বর্ণের উৎপত্তি হয় না। ইহার অভিব্যক্তি হয়। স্বর্ণ হইতে অলঙ্কারের উৎপত্তি হয় কারণ অলংকার পূর্বে ছিল না। অন্ধকার গৃহে প্রদীপের সাহায্যে অলঙ্কার দৃষ্ট হয় এখানে অলঙ্কারের অস্তিত্ব পূর্বেই ছিল, তবে তাহার মাত্র অভিব্যক্তি হইল। কোনও বস্তুর অভিব্যক্তির পূর্বে তাহার উৎপত্তি হয়, উৎপত্তির পূর্বে অভিব্যক্তি হয় না। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতিকে অক্ষর বলে, কেননা ইহাদের ক্ষরণ বা ধংস হয় না। অক্ষর জগতের প্রত্যেক স্থানেই বর্ত্তমান রহিয়াছে। কন্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থান অক্ষরকে উৎপাদন করে না, ব্যক্ত করে মাত্র। অক্ষর সমস্টি মিলিত হইয়া পদ ও শব্দসমষ্টি। ইহারা কোন অর্থ প্রকাশ করিতে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে অক্ষর বা বর্ণ কোন পুরুষ বিশেষের রচিত নয় বলিয়া অপৌরুষেয়। বর্ণ অপৌরুষেয় হইলেও বিভিন্ন অর্থের সংকেত অনুসারে ইহার মিলিত হইয়া পদ গঠন করে এবং বিভিন্ন পদও অর্থের সংকেতানুসারে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে। মনুষ্যকৃত গ্রন্থে এই সব বর্ণ ও বাক্যের সাহায্যে অর্থের সংকেত প্রকাশ করা হইয়াছে। বেদ ও মনুষ্যকত গ্রন্থে পার্থক্য এই স্থানে যে মনুষ্যকৃত গ্রন্থের বর্ণ বা অক্ষর অপৌরুষেয় হইলেও পদ বা বাক্য সমষ্টি পৌরুষেয়। কিন্তু বেদের পদ, শব্দার্থ, বাক্য বাক্যার্থ সবই অপৌরুষেয়। বেদমন্ত্রকে কোন পুরুষ বিশেষ রচনা করে নাই। ইহা নির্দিষ্ট আকারে অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ঋষিরা নিজের তপোবলে এই নিত্য বেদকে দর্শন করেন ও তাহাকে অভিব্যক্ত করেন। বেদমন্ত্রের অর্থকেও তাঁহারা দর্শন করেন। বেদ শব্দার্থ সন্বন্ধযুক্ত হইয়াই অনাদিরূপে অবস্থান করে। ঋষিরা যুগে যুগে ইহা প্রকাশ করেন। জৈমিনি শব্দের নিত্যতা প্রমাণ করিয়াই বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন এবং শব্দের অনিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘শব্দ স্বয়ং উৎপন্ন হয় না, কণ্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতির প্রযত্ন দ্বারা ইহা উৎপন্ন হয়; শব্দ এক প্রকারের উচ্চারণ ক্রিয়া। উচ্চারণের সহিত স্বল্প সময়ের জন্য শব্দ প্রত্যক্ষ হয়। ইহা প্রথমে অনুৎপন্ন ছিল, উচ্চারণের সময় স্বল্প সময়ের জন্য ইহার স্থিতি হয় এবং উচ্চারণের পরেই ইহার ধ্বংস হয়। অতএব যাহা উৎপন্ন তাহা নিত্য নহে। শব্দের নিত্যতাবাদীরা ইহার উত্তরে বলেন, উচ্চারণের পূর্বে শব্দের অস্তিত্ব আছে; ইহা নিরাকার, নিত্য ও অব্যক্তরূপে আছে। উচ্চারণ করিলে ইহা উৎপন্ন হয় না, শুধু ব্যক্ত হয় মাত্র। উচ্চারণের পর ইহার ধ্বংস হয় না শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়র অগোচর হয় মাত্র। উচ্চারিত হইলে ইহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় এবং শব্দকারীর সহিত ইহার কোন সন্বন্ধ থাকে না। আজ একটা শব্দ শ্রুতি গোচর হইয়া জ্ঞান প্রকাশ করিল, বহুদিন পরও শব্দটী জ্ঞান প্রকাশ করিবে। ইহাতেই শব্দের নিত্যতা সিদ্ধ হয়।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন-‘রাম শব্দ করিল, যদু শব্দ করিবে’ ইত্যাদি বাক্যে শব্দের কর্তা রাম ও যদুকেই বুঝায়। যখন শব্দ কোন ব্যক্তি কর্তৃক উৎপন্ন কার্য, তখন তাহার নিত্যতা হইতে পারে না’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘রাম ও যদু শব্দের নির্মাতা নহে, শব্দের উচ্চারণ কর্তা মাত্র। কেহই শব্দকে উৎপন্ন করিতে বলে না, উচ্চারণ করিতেই বলে। উৎপন্ন পদার্থের উপাদান কারণের প্রয়োজন হয় কিন্তু শব্দ উৎপাদনের জন্য উপাদান কারণ পাওয়া দুষ্কর। বায়ু শব্দের উপাদান কারণ নয়। বায়ু সাহায্য করে মাত্র। বায়ু শব্দকে বহন করে। ধ্বনি ও শব্দের পার্থক্য সকলেই মানিয়া থাকেন।
শব্দের অনিত্যবাদীরা বলেন –‘এক সঙ্গে বহু লোকে মিলিয়া শব্দ করিলে তাহার বৃদ্ধি হয় এবং অল্প লোক, বালক বা রোগী উচ্চারণ করিলে তাহা হ্রাস হয়, শব্দ নিত্য হইলে তাহাতে হ্রাস বৃদ্ধি হইতে পারে না’। নিত্যতাবাদীরা বলেন- ‘বহুজনে মিলিয়া শব্দ করিলে শুধু ধ্বনি বৃদ্ধি পায়, শব্দ বৃদ্ধি পায় না। ধ্বনির হ্রাস বৃদ্ধিতে শব্দের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে না’।
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর হ্রাস বৃদ্ধি হয় না কিন্তু ব্যাকরণ গ্রন্থে দেখি শব্দের বিকৃতি, রূপান্তর ও হ্রাস বৃদ্ধি হয়।’ শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন-‘ব্যাকরণ গ্রন্থে যে, ‘ই’ স্থানে ‘য’ হয় বা ‘উ’ স্থানে ‘ব’ হয় ইহা আকৃতির বিকৃতি ভাব নহে এখানে দুটী বর্ণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক।’
শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘বহু সময় বহু স্থানে বহু লোক একই শব্দের উচ্চারণ করে। শব্দ নিত্য হইলে এইরূপ ঘটিত না।’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর ইহাও একটি লক্ষণ। একই পরমাত্মাকে বহু স্থানে বহু ব্যক্তি অনুভব করিতে পারে। ইহাতে নিত্যত্ব খণ্ডিত হয় না, সিদ্ধ হয়।’
চারিবেদ
পরমাত্মা যেমন নিত্য তাঁহার জ্ঞান এই বেদও নিত্য। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যা জানিবার জন্য একই বেদ চারিভাগে বিভক্ত হইয়াছে-ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি, বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদের সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’। যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকি ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’। যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থে সচল এবং অথর্ব অর্থে অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।
বেদের আয়তন ও মন্ত্রসংখ্যাবেদ
ঋগ্বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ১০৫৫২। সমস্ত ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডলে, ৮৫ অনুবাকে ও ১০১৮ সূক্তে বিভক্ত। ঋগ্বেদকে অন্য ভাবেও বিভাগ করা হইয়াছে। যেমন-অষ্টক ৮, অধ্যায় ৬৪ ও বর্গ ১০২৪। যজুর্বেদের মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৯৭৫ এবং সাম বেদের মন্ত্রসংখ্যা ১৮৭৫। সামবেদ ৩ ভাগে বিভক্ত, যথা পূর্বার্চিক, মহানাম্নীআর্চিক ও উত্তরার্চিক। মহানাম্নী আর্চিককে পূর্বার্চিকের মধ্যেই ধরা হয়। পূর্বার্চিক ৪ কাণ্ডে বিভক্ত, ৪ কাণ্ড ৬ প্রপাঠক বা ৫ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রপাঠক অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চিক ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক। এই প্রপাঠকগুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে, দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে। অথর্ব্ব বেদের মন্ত্রসংখ্যা ৫৯৭৭। অথর্ববেদে ২০ কাণ্ড। এই কাণ্ডগুলি ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত। ইহাতে ১১১ অনুবাক্, ৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত। সমগ্র বেদে মোট মন্ত্রসংখ্যা ২০৪১৬, পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর মতে বেদ মন্ত্র সংখ্যা প্রায় ২০৪৩৪। প্রধান আলোচ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে- পরমাত্মা, আত্মা ও প্রকৃতি। এখানে বর্ণিত হয়েছে ঈশ্বরের হাজারো গুণাগুণ, বৈশিষ্ঠ্য। ইহলৌকিক ও পরলৌকিক বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান। তাছাড়া আছে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, গ্রহবিজ্ঞান, মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি। আবার বস্তুর (ক্ষেত্রবিশেষে ) ফিজিকাল, মেটাফিজিকাল এবং স্পিরিচ্যুআল ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া নিয়েও আলোচনা করে। ঋগ্বেদের ১০ টি মন্ডল, ১০২৮ টি সূক্ত এবং ১০৫৮৯টি মন্ত্র রয়েছে।
🔗বেদের মন্ত্র সংখ্যা নিয়ে কিছু পুস্তকের মধ্যে মত-পার্থক্য পাওয়া যায়। যেমন ঋগ্বেদের ১০৫৮৯ মন্ত্র। শুক্ল যজুর্বেদের দুটি শাখা যথাক্রমে মধ্যদিন ও কণ্ব, উভয়ের অধ্যায় সংখ্যা ৪০ কিন্তু মধ্যদিন সংহিতায় ১৯৭৫ টি মন্ত্র ও কণ্ব সংহিতায় ২০৮৬টি মন্ত্র রয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের বহুল ব্যবহৃত সংহিতা হল তৈত্রিয় সংহিতা। এতে ৭টি কান্ড, ৪৪টি প্রপাঠক রয়েছে, অনুবাক ৬৩১ মন্ত্র সংখ্যা ২১৯৮টি পাওয়া যায়। কৃষ্ণ যজুর্বেদের দ্বিতীয় সংহিতা হল মৈত্রাযণী সংহিতা। এই সংহিতায় ৪টি কাণ্ড, ৫৪টি প্রপাঠক এবং ২১৪৪টি মন্ত্র রয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৃতীয় সংহিতা হল কঠ সংহিতা [অষ্টাধ্যায়ী ৪।৩।১০১ পতঞ্জলি মহাভাষ্য]। বর্ত্তমানে কঠ লুপ্ত প্রায়।
মন্ত্রের ঋষি, দেবতা, ছন্দ বেদের মন্ত্রগুলি গদ্য, পদ্য ও গানে প্রকাশিত। যজুঃ গদ্যে, ঋক্ পদ্যে, এবং সাম গানে প্রকাশিত – এজন্য বেদের আর এক নাম ‘ত্রয়ী’। প্রত্যেকটি মন্ত্রের সহিত ঋষি, দেবতা, ছন্দ এবং স্বর উল্লেখিত হয়। যে যে ঋষি যে যে মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করিয়া মানব জাতির মহা উপকার সাধন করিয়াছেন, সেই সেই ঋষির নাম, সেই সেই মন্ত্রের সহিত স্মরণ করা হয়। ঋষিগণ মন্ত্রের রচয়িতা ছিলেন না, তাঁহারা ছিলেন মন্ত্রের দ্রষ্টা। মন্ত্রগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, বর্ণিত হইয়াছে। যে মন্ত্রের যেটি মুখ্য বিষয় সে মন্ত্রের সেইটিই দেবতা। মন্ত্রের বর্ণিত বিষয়কে দেবতা বলে। মন্ত্রের সহিত দেবতার উল্লেখ থাকায় দৃষ্টি মাত্রেই মন্ত্রের মূখ্য বিষয়টি উপলদ্ধি হয়। পাঠের সুবিধার জন্য মন্ত্রের সহিত ছন্দেরও উল্লেখ করা হয়। যে যে মন্ত্র, যে যে ছন্দে প্রকাশিত, সেই সেই মন্ত্রে সেই সেই ছন্দ।
ছন্দ তিন প্রকারের – ছন্দ, অতিছন্দ ও বিছন্দ। এই তিনের প্রত্যেকটিতে ৭টি করিয়া ভেদ আছে। ছন্দ সাতটি, যথা- গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী। অতিছন্দও সাতটি। যথা – অতিজগতী, শক্করী, অতিশক্করী, অষ্টি, অত্যষ্টি, ধৃতি ও অতিধৃতি। বিছন্দও সাতটি, যথা- কৃতি, প্রকৃতি, আকৃতি, বিকৃতি, সংকৃতি, অতিকৃতি ও উৎকৃতি। এই ২১টি ছন্দের প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন সংখ্যক অক্ষরযুক্ত থাকে। গায়ত্রীতে ২৪ অক্ষর, উষ্ণিকে ২৭টি, অনুষ্টুপে ৩২টি, বহতীতে ৩৬টি, পংক্তিতে ৪০টি, ত্রিষ্টুপে ৪৪ টি, জগতীতে ৬০টি, অত্যষ্টিতে ৬৮টি, ধৃতিতে ৭২টি, অতিধৃতিতে ৭৬টি, কৃতিতে ৮০টি, প্রকৃতিতে ৮৪টি, আকৃতিতে ৮৮টি, বিকৃতিতে ৯২টি, সংকৃতিতে ৯৬টি, অতিকৃতিতে ১০০টি এবং উৎকৃতিতে ১০৪টি অক্ষর থাকে। এই ২১ ছন্দের মধ্যে কোনটিতে এক অক্ষর কম হইলে তাহাতে নিচৃৎ এবং এক অক্ষর বেশী হইলে ভুরিজ বিশেষণ যুক্ত হয়। এই ২১ ছন্দের আর্ষী, দৈবী, আসুরী, প্রজাপত্যা, যাজুষী সাম্লী, আর্চী ও ব্রাহ্মী ভেদে ৮ ভেদ এবং বিরাট, নিচৃৎ, শুদ্ধা, ভূরিজ্ ও স্বরাট্ ভেদে ৪ ভেদ হয়। অতিছন্দ ও বিছন্দেরও ভেদ হয়। এইভাবে নানা পদ যোজনা ও অক্ষর যোজনা দ্বারা এই সব ছন্দের না না বিভেদ করা হইয়াছে।
বেদাঙ্গ ও স্বর
বেদাঙ্গের অভ্যাস বেদার্থ বোধের সহায়তা করে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ছয়টিকে বেদের ‘ষড়ঙ্গ’ বলে। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সম – ‘শিক্ষা’ এই পাঁচটি বিষয়ের শিক্ষা দান করে। স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দুই প্রকার। অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বর্ণগুলির জ্ঞান অত্যাবশ্যক। প্রধানত: স্বর ত্রিবিধ-উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিৎ। উদাত্ত বিধানে উ্চ্চৈঃস্বরে, অনুদাত্ত বিধানে কোমল স্বরে, এবং স্বরিৎ বিধানে উদাত্ত ও অনুদাত্ত মধ্যবর্তী স্বরে উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরিৎ উদাত্ত ও অনুদাত্তের মিলন স্বর ১৪ প্রকার। উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎস, স্বরিদুদাত্ত ও একশ্রুতি এই সতটি স্বর উদাত্ত ভেদে এবং ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই সাতটি স্বর যড়ঙ্গ ভেদে বিধান করা হইয়াছে। ষড়ঙ্গ বিহিত সাতটি স্বরকে সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। উদাত্ত হইতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হইতে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিৎ হইতে ষডজ, মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পনা করা হইয়াছে।
আমরা সকলেই যাহা কিছু উচ্চারণ করি উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিৎ বিধানে উচ্চারণ করি। আয়াম অর্থাৎ অঙ্গ সকলকে রুদ্ধ করিয়া, দারুণ অর্থাৎ বাণীকে রুক্ষ করিয়া বা উচ্চেঃস্বরে এবং অণুতা অর্থাৎ কণ্ঠকে কিছু রুদ্ধ করিয়া উদাত্ত স্বরের উচ্চারণ করা হয়। ‘অন্বয়’ অর্থাৎ গাত্রকে দোলায়মান করিয়া ‘মার্দব’ অথ্যাৎ স্বরের কোমলতা করিয়া এবং উরুতা অথ্যাৎ কণ্ঠকে বিস্তৃত করিয়া অনুদাত্তের মিলনে উৎপত্তি হয়। উচ্চ, নীচ, হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদেও স্বর উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎ, স্বরিতোদাত্ত ও একশ্রুতি, এই সাত প্রকারের হইয়া থোকে। স্বরিতেরও তিন ভেদ আছে –হ্রস্ব, স্বরিৎ, দীর্ঘ স্বরিৎ ও প্লুত স্বরিৎ! ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ – এই সপ্ত স্বরকেই সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। সঙ্গীতে ও গান্ধার উদাত্তের লক্ষণে, ঋষভ ও ধৈবত অনুদাত্তের লক্ষণে ষড়জ্ মাধ্ম ও পঞ্চম স্বরিতের লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়।
স্বরের চিহ্ন
বেদ মন্ত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিৎ ভেদ বুঝাইবার জন্য বৈদিক গ্রন্থ সমূহে কতগুলি চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়। উদাত্ত স্বরের সহিত কোনও চিহ্ন প্রযুক্ত হয় না। অনুদাত্ত বর্ণের নীচে শায়িত একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। স্বরিতের উপরে লম্বমান একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। মাত্রা তিন প্রকারের হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত। প্লুত স্বর বুঝাইতে ৩ সংখ্যা ব্যবহৃত হয়।
ক, খ, গ ঘ ৩ –এখানে ক উদাত্ত, খ অনুদাত্ত গ স্বরিৎ এবং ঘ প্লুত স্বরিৎ। ‘নি’ হ্রস্ব, ‘নী’ দীর্ঘ এবং নি ই ই’ প্লুত। ক্রন্দনে ও গানে প্লুত স্বর ব্যবহৃত হয়। ইহাকে দীর্ঘ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরের চিহ্ন সন্বন্ধে মতদ্বৈত ও দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ উদাত্ত বুঝাইতে বণেৃর উপরে লম্বমান রেখার, অনুদাত্ত বুঝাইতে বর্ণের নীচে শায়িত রেখার প্রয়োগ করেন এবং স্বরিতের কোনও রেখারই প্রয়োগ করেন না। কেহ কেহ স্বরিত বুঝাইতে বর্ণের নীচে একটি বক্র রেখার ও প্রয়োগ করেন। কণ্ঠ দ্বারাই স্বরের উচ্চারণ করিতে হয় কিন্তু বৈদিক পণ্ডিতেরা কেহ কেহ স্বর পাঠের সংস্কারকে দৃঢ় করিবার জন্য অঙ্গ বিশেষের পরিচালনা করেন। ঋগ্বেদ, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ পাঠ করিতে মস্তককে নীচু করিয়া অনুদাত্ত, উচু করিয়া স্বরিৎ, এবং মস্তককে ঠিক রাখিয়া উদাত্ত। শুক্ল যজুর্বেদ পাঠ করিতে হস্তের অগ্রভাগ সঞ্চালন করা হয়। হস্তের অগ্রভাগ নামাইয়া অনুদাত্ত, উঠাইয়া উদাত্ত এবং দক্ষিণে বামে তির্যক সঞ্চালন করিয়া স্বরিৎ প্রকাশ করা হয়। ঋক, যজু ও অথর্ববেদ সন্বন্ধেও এই ব্যবস্থা। সামবেদ ১, ২ ও ৩ সংখ্যা বর্ণের উপর প্রয়োগ করা হয়। বর্ণের উপরে ১ উদাত্ত, ২ দ্বারা অনুদাত্ত এবং ৩ দ্বারা স্বরিৎ। কেহ, ২ দ্বারা স্বরিৎ এবং ৩ দ্বারা অনুদাত্ত প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে অন্যরূপ ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের মধ্যেই স্বর উচ্চারিত হয়, চিহ্নাদিরও প্রয়োগ করা হয়। ঋক্, সাম ও অথর্ব বেদের ব্রাহ্মণের স্বর উচ্চারিত হয় না, চিহ্নাদিরও পয়োগ করা হয় না। কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্রাহ্মণে সংহিতার ন্যায়ই স্বরের উচ্চারণ হয় এবং চিহ্নাদির প্রয়োগ করা হয়। শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণের নীচে অনুদাত্তবৎ শায়িত রেখা প্রয়োগ করিয়া উদাত্ত প্রকাশ করা হয়।
বর্ণের উচ্চারণেরে মধ্যেও নানা পার্থক্য দৃষ্ট হয়। স্বর বর্ণের মধ্যস্থিত ‘ড’ কে ‘ড়’ এবং ‘ঢ’ কে ‘ঢ়’ উচ্চারণ করা হয়। অনুদাত্তের(ং) উচ্চারণ নানাবিধ। ং স্বরকে কেহ কেহ অনুস্বারের পরে ‘ব’(উয়) সংযোগ করিয়া উচ্চারণ করেন, কেহ কেহ দীর্ঘ অনুস্বারকে ‘’ এইরূপ, হ্রস্ব অনুস্বারকে ং এইরূপ লিখিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা বর্ণের উপর ঁ চন্দ্রবিন্দু দিয়া অনুস্বারের কার্য চালাইয়া থাকেন। দীর্ঘ অনুস্বারের উচ্চারণ গ্বু ‘’ এইভাবেই করিয়া থাকেন। ‘য’ এর উচ্চারণ কেহ কেহ ‘ইঅ’ না করিয়া ‘জ’ বৎ এবং ‘ষ’ এর উচ্চারণ ‘খ’ বৎ করিয়া থাকেন। সামবেদের উদাত্ত উচ্চারণের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে পৃথক্ রাখিয়া অন্য চারি আঙ্গুলিকে মিলিতভাবে খুলিয়া রাখা হয়। অনুদাত্ত উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগ তর্জনীর মধ্যপর্বে সংলগ্ন করা হয়। এবং স্বরিৎ উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে পর্বসংলগ্ন করা হয়। সামবেদে স্বরের সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝাইতে আরও নানারূপ চিহ্ন প্রদত্ত হয়। অক্ষরের উপরে ‘র’ থাকিলে বাম হস্তের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী, অঙ্গুষ্ঠ এক এক করিয়া তালু দেশে মুড়িয়া আনিতে হয়। ‘উ’ অনুদাত্তের সঙ্গেই থাকে। তাহা প্রদর্শনের জন্য মধ্যম অঙ্গুলি মুড়িয়া অঙ্গুষ্ঠের মূলে আনা হয়। ‘ক’ স্বরিতেরই সঙ্গে থাকে, ইহা প্রদর্শনের জন্য অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা মধ্যমার মূল ভাগ হইতে অগ্রভাগ পর্যন্ত স্পর্শ করিয়া লইতে হয়।
উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিতের ভেদ প্রদর্শন না করিয়া একটানা পড়িয়া যাওয়ার নামই ‘একশ্রুতি’। যজ্ঞ কর্মে একশ্রুতি স্বরে বেদ মন্ত্রের উচ্চারণ করিতে হয়। বেদ মন্ত্রের জপ করিতে ‘নূঙ্খ’ নামক বৈদিক স্তুতিতে এবং সামবেদে একশ্রুতি স্বরের ব্যবহার না করিয়া উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিতের ভেদ অনুসারে উচ্চারণ করিতে হয়।
সামগান
সামগানে স্বর সন্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। উর, কণ্ঠ ও শির –এই তিন স্থান হইতে শব্দ উত্থিত হয়। উর স্থানকে প্রাতঃ সবন, কণ্ঠ স্থানকে মাধ্যন্দিন সবন এবং শিরস্থানকে তৃতীয় সবন মনে করিতে হইবে। এই তিন স্থানে সাত সাতটি স্বর বিচরণ করে। আমরা কর্ণ দ্বারা উহা শ্রবণ করিতে পারিনা। ৭ স্বর, ৩ গ্রাম, ২১ মূর্চ্ছনা ও ৪৯ প্রকার স্বর; ইহাকে স্বর মণ্ডল বলে। ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই ৭টি স্বর। ষডজ, মধ্যম ও গান্ধার এই তিনটি গ্রাম। ষডজ গ্রামে তান ১৪টি, মধ্যম গ্রামে ২০টি এবং গান্ধার গ্রামে তান ১৫টি। মুর্চ্চনা তিন প্রকারের – ঋষি, পিতৃ ও দেব। নন্দী, বিশালা, সুমুখী, চিত্রা, চিত্রবতী, সুখা ও বলা- এই সাতটি দেবমূর্চ্ছনা। আপ্যায়নী, বিশ্বভৃতা, চন্দা, হেমা, কপাদিনী, মৈত্রী ও বার্হতী এই সাতটি পিতৃ মূর্চ্ছনা। উত্তর মন্দ্রা, উদ্গাতা, অশ্বক্রান্তা, সৌবীরা হৃষ্যকা, উত্তরায়তা ও রজনী এই ৭টি ঋষি মূর্চ্ছনা। গানের গুণ ১০টি – রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিস্ক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সম, সুকুমার ও মধুর। সঙ্গীত শাস্ত্রানুসারে সামবেদের মন্ত্রকে গানের আকারে রাখিয়া একই মন্ত্রের বিভিন্ন শব্দকে একাধিকবার প্রয়োগ করিয়া বহুদীর্ঘ করা হয়। ইহাকে গান সংহিতা বলে। সামগানে গান সংহিতারই প্রয়োগ হয়। গান সংহিতা মন্ত্র সংহিতা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।
বেদপাঠ প্রণালী
বেদমন্ত্র কোনও রূপেই বিস্মৃত না হয় এবং ইহার মধ্যে কিছুই প্রক্ষিপ্ত না হইতে পারে এ জন্য বেদ পাঠের দুই প্রণালী আছে – ‘নির্ভূজ’ সংহিতা ও ‘প্রতৃণ’ সংহিতা। মন্ত্রটি যেরূপ আছে ঠিক সেইরূপ পাঠ করিলে তাহা ‘নির্ভূজ’ সংহিতা। “অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম” এই মন্ত্রটিকে ‘অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্’ ঠিক এইরূপ অবিকৃতভাবে পাঠ করিলেই তাহাকে ‘নির্ভুজ’ সংহিতা বলে। ‘প্রতৃণ’ সংহিতার বহু ভেদ আছে। যেমন পদপাঠ, ক্রমপাঠ, জটাপাঠ, ধনপাঠ ইত্যাদি। সন্ধি ও বিরাম আদি বিচার করিয়া পাঠ করিলে তাহার নাম ‘পদপাঠ’, যেমন- ‘অগ্নিম, ঈডে, পুরোহিতম, যজ্ঞস্য, দেবম্, ঋত্বিজম্’। ‘ক্রমপাঠ’ এইরূপ, যেমন –‘অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্। ‘জটাপাঠ’ এইরূপ যেমন –অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম্। অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস দেবম্, দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবম্, দেবং ঋত্ত্বিজম্। ‘ধনপাঠ’ এইরূপ যেমন – অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম, অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; পুরোহিতং ঈডে অগ্নিম্; অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পূরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য দেবম্। দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্ ইত্যাদি।
বেদভাষ্য ও ভাষ্যকার
বেদের তত্ব ও রহস্যকে সুস্পষ্ট করিতেই বিভিন্ন ভাষ্যের সৃষ্টি হইয়াছে। স্মরণাতীত কাল হইতে কত জনে, কতভাবে বেদভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রাচীন কালের সায়ণাচার্য এবং বর্তমান যুগের দয়ানন্দ সরস্বতীই উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদ ভাষ্য পড়িলে জানা যায়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধুরন্ধর পণ্ডিত ছিলেন। সায়ণাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয় নগরের মহারাজার মন্ত্রীপদে অসীন ছিলেন। তাঁহার ভাষ্য পড়িলে মনে হয়, তিনি একাকী সমগ্র ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। তাঁহার নেতৃত্বে অন্যান্য পণ্ডিতেরা ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী(১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ) বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। পণ্ডিত রোম্যাঁরলার মতে –“আচার্য শঙ্করের পর বেদের এতবড় পণ্ডিত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন নাই”।
ঋগ্বের ভাষ্যকার
১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।
যজুর্বেদ ভাষ্যকার
১। শৌনক। ২। হরিস্বামী (৫৮১খৃঃ)। ৩। উবট (১১শ শতাব্দী)। ৪। গৌরধর (১২৯৩ খৃঃ)। ৫। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৬। মহীধর (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১১৮৩ খৃষ্টাব্দ)
সামবেদ ভাষ্যকার
১। গুণ বিষ্ণু (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ২। মাধব। ৩। ভরত স্বামী (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৪। সায়ণাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৫। শোভাকর ভট্ট (খৃঃ ১৫শ শতাব্দী)। ৬। মহাস্বামী। ৭। সূর্যদৈবজ্ঞ(খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)।
অথর্বদেব ভাষ্যকার
১। সায়নাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। দয়ানন্দের পরে পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালংকার আজমীড় হইতে চতুর্বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনি এবং পণ্ডিত শিবশংকর কাব্যতীর্থের বেদভাষ্য উচ্চ সম্মান লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর যজুর্বেদ ভাষ্য, তুলসীরাম স্বামীর সামবেদ ভাষ্য এবং পণ্ডিত ক্ষেমকরণের অথর্ববেদ ভাষ্য বর্তমানে আদৃত হইয়াছে।
বেদের অঙ্গ, উপাঙ্গ, উপবেদ
বেদার্থ জানিবার জন্য শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ‘ষড়ঙ্গ’ প্রবর্তিত হইয়াছে। ‘শিক্ষা’ ছয় প্রকারের –শব্দ, শব্দাঘাত, শব্দাবয়ব, শব্দাবয়বাঘাত, স্বর মাধুর্য ও শব্দ সন্ধি। শিক্ষা গ্রন্থে এই সকল শিক্ষা দেওয়া হয়। শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শল্ব এই চারি সূত্রের নাম ‘কল্প’। ইহাতে যজ্ঞ প্রয়োগ বিধি কল্পিত হইয়াছে বলিয়া ইহার নাম কল্প। আপস্তন্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, প্রভৃতি ঋষিরা সূত্রাকারে কল্প গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। শ্রোত সূত্রে ধর্মানুষ্ঠান ও যজ্ঞ সন্বন্ধের বিধান; গৃহ্য সূত্রে গার্হস্থ্য বিধি, গর্ভাধান হইতে অন্ত্যেষ্টি এই ষোড়শ সংস্কার ও পঞ্চ মহাযজ্ঞের বিধান, ধর্মসূত্রে দায়ভাগ, শাসন বিধি কর্মবিধি ও চারিবর্ণের আচার বিচার এবং শূল্ব সূত্রে বেদীরচনা, অগ্নি কুণ্ড রচনাদি বর্ণিত আছে। শূল্ব সূত্রের সন্বন্ধ শ্রৌত্র সূত্রেরই সঙ্গে।
কর্ম কাণ্ডের জন্য সূত্র গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন ও সাংখ্যায়ন শ্রৌত সূত্র এবং ইহাদের উভয়ের গৃহ্য সূত্রও পাওয়া যায়। শৌনকের এক প্রতিশাখ্য সূত্র আছে। যজুর্বেদের কঠ, মানব, লৌগাক্ষি, কাত্যায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশী বাধুল, বৈখানস, মৈত্রা বরুণী ও ছাগল শ্রৌতসূত্র পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্র ও এতগলিই আছে। শুক্ল যজুর্বেদের কাত্যায়ন ও বৈজপায় শ্রোতসূত্র, পারস্কর ও কাতীয় গৃহ্যসূত্র। কাত্যায়নের এক প্রতি শাখায় আছে। সামবেদের পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের এক শ্রৌতসূত্র ও এক গৃহ্যসূত্র আছে। দ্বিতীয় –লাট্যায়ন শ্রোতসূত্র বা মশকসূত্র, তৃতীয় –দ্রাক্ষায়ণ শ্রৌত্রসূত্র, চতুর্থ – অনুপদ সূত্র, পঞ্চম-গোভিল কৃত পুষ্প সূত্র এবং তাণ্ডা, লক্ষণ, উপগ্রন্থ, কল্পানুপদ, অনুস্তোত্র ও ক্ষুদ্র সূত্র আছে। ইহার গৃহ্য সূত্রের মধ্যে গোভিল গৃহ্যসূত্র; কাত্যায়ন কর্মদীপ, খদির গৃহ্যসূত্র ও পিতৃমেধসূত্র আছে। অর্থববেদের কৌশিক, বৈতান, নক্ষত্র কল্প, অঙ্গিরস ও শান্তিকল্প সূত্র আছে।
যাহা দ্বারা ভাষায় সম্যক জ্ঞান লাভ হয় তাহার নাম ‘ব্যাকরণ’। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণই বর্তমানে একমাত্র বৈদিক ব্যাকরণ। মহর্ষি পতঞ্জলি ইহার উপর মাহভাষ্য নামে এক ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন। পাণিনির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন, তন্মধ্যে সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্মন্, ভারদ্বাজ, অপিশালী ও কাশ্যপের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহাদের ব্যাকরণ হইতেই পাণিনি সুত্রাকারে অষ্টাধ্যায়ী প্রণয়ন করিয়াছিলেন।
নিরক্ত গ্রন্থে বৈদিক শব্দ ও বাক্য সমূহের অর্থ সুস্পষ্ট করা হইয়াছে। যাস্কমুনি কৃত অতি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ নিরুক্ত গ্রন্থই বর্তমানে আদৃত হইতেছে। যাস্কের পূর্বেও কৌৎস, শাকপুণি ঔর্ণনাভ ও স্থোলাষ্টীরী প্রভৃতি নিরুক্তকার বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর লোক। নিঘন্টু নিরুক্তের অঙ্গীভূত। নিঘন্টু বেদের অর্থ প্রকাশক শব্দকোষ বা অভিধান মাত্র। দেবরাজ যজ্বা নিঘন্টুর টীকা লিখিয়াছেন এবং দুর্গাচার্য নিরুক্তের বৃত্তি প্রণয়ন করিয়াছেন। ছন্দ সন্বন্ধে পূর্বেই বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘জ্যোতিষ’ গ্রন্থে আকাশস্থ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর গতি বিধি সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। ‘উপাঙ্গ’ ছয়টি। গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, কপিলের সাংখ্য, পতজ্ঞলির যোগ, জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা এবং ব্যাসদেবের ব্রহ্মসূত্র বা উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত)। উপাঙ্গের তীক্ষ্ ন বিচার দ্বারা বেদের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। ‘উপবেদ’ চারি প্রকারের। ধনুর্বেদ বা যুদ্ধবিদ্যা, গন্ধর্ববেদ বা সঙ্গীত বিদ্যা, অর্থবেদ বা শিল্প বিদ্যা, আর্য়ুবেদ বা চিকিৎসা বিদ্যা। আয়ুর্বেদ হলো ঋকবেদের উপবেদ, ইহাতে শরীরের রক্ষা, আরোগ্য এবং সুস্থ থাকার উপায় আছে, ঔষধিগুণ এবং রোগ নিবারণের উপায় বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে আয়ুর্বেদ এর গ্ৰন্থে চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতা প্রসিদ্ধ। ধনুর্বেদ হলো যজুর্বেদ এর উপবেদ, ইহাতে তির ধনুক চালোনোর বিষয় রয়েছে। গান্ধবর্বেদ হলো সামবেদের উপবেদ, ইহাতে সঙ্গীতের বিষয় রয়েছে। অথর্ববেদের উপবেদ হলো অর্থবেদ, ইহাতে শিল্প শাস্ত্রের বিষয় রয়েছে। অনেকের মতে, আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের উপবেদ কেননা ঋকবেদের মতো অথর্ববেদেও ঔষধি বিষয়ক অনেক সুক্ত পাওয়া যায়।
বেদের ছয় উপাঙ্গের নাম ষড়দর্শন ব্ ষট্ শাস্ত্র। জৈমিনি কৃত পূর্ব মীমাংসা সূত্রে কর্মকাণ্ডের বিধান ধর্ম ও ধর্মী সন্বন্ধে বর্ণনা রহিয়াছে। ব্যাসদেব পূর্ব মীমাংসার ভাষ্য রচনা করিয়াছেন। গৌতমমুনি কণাদ কৃত বৈশেষিক সূত্রের প্রশস্ত পাদ ভাষ্য, বাৎসায়ন মুনি গৌতম কৃত ন্যায় সূত্রের ভাষ্য, ব্যাসদেব পতঞ্জলি কৃত।
বেদ পরিচয়ঃ পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর লেখা থেকে
বেদের মন্ত্রগুলি গদ্য, পদ্য ও গানে প্রকাশিত। যজুঃ গদ্যে, ঋক্ পদ্যে, এবং সাম গানে প্রকাশিত – এজন্য বেদের আর এক নাম ‘ত্রয়ী’। প্রত্যেকটি মন্ত্রের সহিত ঋষি, দেবতা, ছন্দ এবং স্বর উল্লেখিত হয়। যে যে ঋষি যে যে মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করিয়া মানব জাতির মহা উপকার সাধন করিয়াছেন, সেই সেই ঋষির নাম, সেই সেই মন্ত্রের সহিত স্মরণ করা হয়। ঋষিগণ মন্ত্রের রচয়িতা ছিলেন না, তাঁহারা ছিলেন মন্ত্রের দ্রষ্টা। মন্ত্রগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, বর্ণিত হইয়াছে। যে মন্ত্রের যেটি মুখ্য বিষয় সে মন্ত্রের সেইটিই দেবতা। মন্ত্রের বর্ণিত বিষয়কে দেবতা বলে। মন্ত্রের সহিত দেবতার উল্লেখ থাকায় দৃষ্টি মাত্রেই মন্ত্রের মূখ্য বিষয়টি উপলদ্ধি হয়। পাঠের সুবিধার জন্য মন্ত্রের সহিত ছন্দেরও উল্লেখ করা হয়। যে যে মন্ত্র, যে যে ছন্দে প্রকাশিত, সেই সেই মন্ত্রে সেই সেই ছন্দ।
ছন্দ তিন প্রকারের – ছন্দ, অতিছন্দ ও বিছন্দ। এই তিনের প্রত্যেকটিতে ৭টি করিয়া ভেদ আছে।
ছন্দ সাতটি, যথা- গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পঙক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী।
অতিছন্দও সাতটি।
যথা – অতিজগতী, শক্করী, অতিশক্করী, অষ্টি, অত্যষ্টি, ধৃতি ও অতিধৃতি।
বিছন্দও সাতটি, যথা- কৃতি, প্রকৃতি, আকৃতি, বিকৃতি, সংকৃতি, অতিকৃতি ও উৎকৃতি।
এই ২১টি ছন্দের প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন সংখ্যক অক্ষরযুক্ত থাকে। গায়ত্রীতে ২৪ অক্ষর, উষ্ণিকে ২৭টি, অনুষ্টুপে ৩২টি, বহতীতে ৩৬টি, পংক্তিতে ৪০টি, ত্রিষ্টুপে ৪৪ টি, জগতীতে ৬০টি, অত্যষ্টিতে ৬৮টি, ধৃতিতে ৭২টি, অতিধৃতিতে ৭৬টি, কৃতিতে ৮০টি, প্রকৃতিতে ৮৪টি, আকৃতিতে ৮৮টি, বিকৃতিতে ৯২টি, সংকৃতিতে ৯৬টি, অতিকৃতিতে ১০০টি এবং উৎকৃতিতে ১০৪টি অক্ষর থাকে। এই ২১ ছন্দের মধ্যে কোনটিতে এক অক্ষর কম হইলে তাহাতে নিচৃৎ এবং এক অক্ষর বেশী হইলে ভুরিজ বিশেষণ যুক্ত হয়। এই ২১ ছন্দের আর্ষী, দৈবী, আসুরী, প্রজাপত্যা, যাজুষী সাম্লী, আর্চী ও ব্রাহ্মী ভেদে ৮ ভেদ এবং বিরাট, নিচৃৎ, শুদ্ধা, ভূরিজ্ ও স্বরাট্ ভেদে ৪ ভেদ হয়। অতিছন্দ ও বিছন্দেরও ভেদ হয়। এইভাবে নানা পদ যোজনা ও অক্ষর যোজনা দ্বারা এই সব ছন্দের না না বিভেদ করা হইয়াছে।
বেদ পাঠঃ
বেদকে বিশুদ্ধ ও মনে রাখার জন্য প্রাচীন কালে ঋষিগণ ১১ প্রকার পাঠ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। এই ১১ প্রকার পাঠ পদ্ধতি বা রীতি গুলো হলো: সংহিতা পাঠ, পদ পাঠ, ক্রম পাঠ, জটা পাঠ, মালা পাঠ, শিখা পাঠ, লেখা পাঠ, ধ্বজ পাঠ, দণ্ড পাঠ, রথ পাঠ এবং ঘন পাঠ।
এদের মধ্যে মৌলিক পাঠ ৩ টি। সংহিতা, পদ ও ক্রম পাঠ এই তিনটি পাঠ হচ্ছে প্রকৃত পাঠ। আর বাকী ৮ টি পাঠ হচ্ছে বিকৃতি পাঠ অর্থাৎ যৌগিক পাঠ৷ এগুলো সব ক্রম পাঠের বর্ধিত রূপ৷ এজন্য এসব পাঠের নামের আগে ক্রম শব্দটি ব্যবহার করা হতো। যেমন: ক্রমজটা পাঠ, ক্রমমালা পাঠ ইত্যাদি। তবে সংক্ষেপে এদের জটা পাঠ, মালা পাঠ ইত্যাদি বলা হতো৷
প্রতিটি প্রনালীকে পাঠ পদ্ধতি বলা হয় এবং এদের আয়ত্তকারীদের পাঠিন বলা হয়।এদের মধ্যে ঘনপাঠ পদ্ধতি সবচেয়ে জটিলতম ও বিজ্ঞানসম্মত এবং আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে এক বিস্ময়।একজনরে দেখে নেয়া যাক কিছু নির্বাচিত পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিবরন।
পদপাঠঃ
বেদ মন্ত্রগুলোর প্রতিটি পদকে সন্ধি বিচ্ছেদ করে বা সমাসবদ্ধ পদকে বিশ্লেষণ করে পড়া হয় যে পাঠে, তাকে পদ পাঠ। পদ পাঠে প্রতিটি পদ স্পষ্ট হয় বলে পদ পাঠ অপেক্ষাকৃত সহজ। ঋষি শাকল্য ঋগ্বেদের শাকল্য শাখার স্রষ্টা এবং তিনিই প্রথম শাকল্য সংহিতায় পদ পাঠ ব্যবহার করেন। পদ পাঠ অনুসারে উক্ত মন্ত্রটি হবে:
অগ্নিম। ঈড়ে। পুরঃSহিতম্।
যজ্ঞস্য। দেবম্। ঋত্বিজম্।
হোতারম্। রত্নSধাতমম্।
এখানে পুরোহিতম্ ও রত্নাধাতমম্ সমাস দুটিকে বিশ্লেষণ করে–পুরঃSহিতম্ ও রত্নSধাতমম্ পাওয়া যায়৷ এই পদ দুটির মাঝখানে যে ব্যাসসূচক ইংরেজি S এর মতো চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে, এটাকে অবগ্রহ বলে।
এ পদ্ধতিতে প্রতিটি পদকে আলাদা করে ক্রমপদ্ধতিতে উচ্চারন করে মুখস্ত করা হয়।ঠিক নিম্নলিখিত রীতিতে
কখ খগ গঘ...
এটি বেদ উচ্চারন এর দুটি মুল নিয়ম এর মধ্যে একটি(অপরটি হল সংহিতা বা বাক্যপাঠ)।
পদপাঠিনদের অধিকাংশ ই দক্ষিন ভারতের অধিবাসী।
সংহিতা বা বাক্যপাঠ পদ্ধতি
একক অর্থের একাধিক পদকে সন্ধির মাধ্যমে উচ্চারন এবং মুখস্ত করা হয়।যেমন যত্ ইদম উপাস্যতে(যাকে লোকউপাসনা করে) এর সংহিতা বা বাক্য রুপ হল যদিদমুপাসতে।এটা বেদ উচ্চারনের দুটি সঠিক নিয়মের একটি।সংহিতা পাঠ হচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত বেদের পাঠ। অর্থাৎ আমরা বর্তমান বেদ মন্ত্রগুলোকে যেভাবে দেখতে পারি সেগুলো সংহিতা পাঠে লিপিবদ্ধ। সংহিতা পাঠে বেদ মন্ত্র যেভাবে লেখা থাকে, তাকে সেভাবেই পাঠ করা হয়৷ যেমন:
অগ্নিমীড়ে পুরোহিতং
যজ্ঞস্য দেবমৃতিজম।
হোতারং রত্নধাতমমS।।
জটাপাঠঃ
জটা পাঠকে তাঁতিদের কাপড় বোনার সাথে তুলনা করা যায়। তাঁতিদের কাপড় বুনতে যেমন টানাপোড়েন ব্যবহার হয়, এই পাঠ অনেকাংশে তেমন। এই পাঠ পদ্ধতিতে মন্ত্রের প্রথম ও শেষ পদটি তিনবার করে এবং মধ্যবর্তী পদগুলো ছয়বার করে পঠিত হয়। যেমন:
অগ্নিম ঈড়ে। ঈড়ে অগ্নিম। অগ্নিম ঈড়ে৷
ঈড়ে পুরোহিতং। পুরোহিতম্ ঈড়ে৷ ঈড়ে পুরোহিতম্।
পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য। যজ্ঞস্য পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য।
যজ্ঞস্য দেবং। দেবং যজ্ঞস্য। যজ্ঞস্য দেবম।
........এভাবে চলতে থাকবে।
এক্ষেত্রে প্রথম পদ পরের পদের সাথে আবার পরের পদ পুনরায় প্রথম পদের সাথে যুক্ত করে মুখস্ত করা হয়।ঠিক এভাবে-
কখ খক কখ খগ গখ খগ।
ক্রম পাঠ: একটি মন্ত্রের বা ঋকের দুটি করে পদ এক একবারে গ্রহণ করা হয়। প্রথম পদ ও শেষের পদ ছাড়া মধ্যের সব পদই এই পাঠে দুবার করে পঠিত হয়। যেমন:
অগ্নিম ঈড়ে। ঈড়ে পুরোহিতম্৷
পুরোহিতং যজ্ঞস্য।
যজ্ঞস্য দেবম। দেবম ঋত্বিজম।
ঋত্বিজং হোতারম্।
হোতারং রত্নাধাতমম্।
এই পাঠে অগ্নিম এবং রত্নাধাতমম্ এই দুটি পদ ছাড়া মধ্যবর্তী সকল পদ দুই বার করে রয়েছে। আক্ষরিক প্রতীকের মাধ্যমে ক্রম পাঠকে এভাবে বুঝানো যায়– ১-২, ২-৩, ৩-৪, ৪-৫, ৫-৬ ইত্যাদি
৷
ধ্বজা পাঠ: ধ্বজ পাঠ ক্রম পাঠের অনুরূপ। ঠিক ক্রম পাঠের মতো এখানেও ছয়টি পদ উচ্চারণ করে তারপর বিপরীত ক্রমের দিক থেকে সেই ছয়টি পদের পাঠ করতে হয়। যেমন:
অগ্নিম্ ঈড়ে৷ ঈড়ে পুরোহিতম্।
পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য।
পুরোহিতং যজ্ঞস্য। ঈড়ে পুরোহিতম্।
অগ্নিম্ ঈড়ে।
যজ্ঞস্য দেবম্। দেবম্ ঋত্বিজম্।
ঋত্বিজং হোতারম্।
ঋত্বিজং হোতারম্।
দেবম্ ঋত্বিজম্। যজ্ঞস্য দেবম্।
এতে প্রথম চরণ ঠিক ক্রম পাঠ অনুযায়ী। দ্বিতীয় চরণ তার ঠিক উল্টো। তৃতীয় চরণ ক্রম পাঠ অনুযায়ী এবং চতুর্থ পাঠ উল্টো ক্রমে।
ধ্বজা পাঠের অক্ষর প্রতীক:
১-২, ২-৩, ৩-৪, ২-৩, ২-১, ৪-৫, ৫-৬, ৬-৭, ৫-৬, ৪-৫ ইত্যাদি।
দণ্ড পাঠ: এর সঙ্গে ক্রম পাঠের আংশিক মিল রয়েছে। ক্রম পাঠের মতো এখানেও দুটো দুটো করে পদ তিন তিনবার করে উচ্চারিত হয়। কেবল দ্বিতীয়বার বিপরীত ক্রমে পাঠ করতে হয়। যেমন:
অগ্নিম্ ঈড়ে। ঈড়ে অগ্নিম্।
অগ্নিম্ ঈড়ে।
ঈড়ে পুরোহিতম্। পুরোহিতম্ ঈড়ে অগ্নিম্৷
এর আক্ষরিক প্রতীক:
১-২, ২-১, ১-২,
২-৩, ৩-২-১
রথ পাঠ: এটি একটি মিশ্র প্রক্রিয়া৷ ক্রম পাঠের ধারা ও এর বিপরীতমুখী ধারাকে একত্রে সংমিশ্রণ করে এই পাঠের সৃষ্টি হয়েছে।
রথ পাঠ আবার দুই প্রকার। এদের মধ্যে এক প্রকার পাঠের উদাহরণ হলো:
অগ্নিম্ ঈড়ে যজ্ঞস্য দেবম্।
ঈড়ে অগ্নিম্ দেবং যজ্ঞস্য।
অগ্নিম্ ঈড়ে ঈড়ে পুরোহিতম্।
যজ্ঞস্য দেবং দেবম্ ঋত্বিজম্।
এর আক্ষরিক প্রতীক হচ্ছে:
১-২-৩-৫।
২-১-৫-৪।
১-২-২-৩।
৪-৫-৫-৬।
মালা পাঠ: এই পাঠ বেশ কঠিন। এই পাঠের ক্ষেত্রে প্রথম এবং দ্বিতীয় পদ পাঠ করার পরে, সেই পদ থেকে ষষ্ঠ ও পঞ্চম পদ পাঠ করতে হয়। এভাবে পদ ক্রম ধীরে ধীরে কমে আসে। যেমন:
অগ্নিম ঈড়ে। ঋত্বিজং দেবম্।
ঈড়ে পুরোহিতং। দেবং যজ্ঞস্য।
পুরোহিতং যজ্ঞস্য। যজ্ঞস্য পুরোহিতম্।
যজ্ঞস্য দেবং। পুরোহিতম্ ঈড়ে। দেবম্ ঋত্বিজম। ঈড়ে অগ্নিম্।
মালা পাঠের আক্ষরিক রূপ: ১-২-৬-৫, ২-৩-৫-৪, ৩-৪-৪-৩, ৪-৫-৩-২, ৫-৬-২-১।
লেখা পাঠ: লেখা পাঠ অনেকটা ক্রম পাঠের মতো৷ এটিকে লেখা পাঠও বলে। এই পদ্ধতিতে পাঠ করার সময় কখনও দুটি পদ, কখনও তিনটি পদ একত্রে পাঠ করা হয়। এটি হয় যথাক্রমে এবং বিপরীত ক্রমে উভয়ভাবে। যেমন:
অগ্নিম ঈড়ে। ঈড়ে অগ্নিম্৷ অগ্নিম্ ঈড়ে।
ঈড়ে পুরোহিতং যজ্ঞস্য।
যজ্ঞস্য পুরোহিতম্ ঈড়ে।
ঈড়ে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য।
..................এভাবে চলতে থাকবে।
এর আক্ষরিক প্রতীক:
১-২, ২-১, ১-২।।
২-৩-৪, ৪-৩-২।।
২-৩, ৩-৪ ইত্যাদি।
শিখা পাঠ: শিখা পাঠ বেশ কঠিন। এর গঠন অনেকটা জটা পাঠের মতো। এই পঠন পদ্ধতিতে তৃতীয়, ষষ্ঠ, নবম চরণে তিনটি করে পদ থাকে৷ বাকী চরণ গুলোতে দুটি করে পদ থাকে। যেমন:।
অগ্নিম্ ঈড়ে৷ ঈড়ে অগ্নিম্।
অগ্নিম্ ঈড়ে পুরোহিতন্।
ঈড়ে পুরোহিতম্৷ পুরোহিতম্ ঈড়ে।
ঈড়ে পুরোহিতং যজ্ঞস্য।
পুরোহিতং যজ্ঞস্য। যজ্ঞস্য পুরোহিতম্।
পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্।
যজ্ঞস্য দেবম্। দেবং যজ্ঞস্য।
যজ্ঞস্য দেবম্ ঋত্বিজম।
.......এভাবে পাঠ চলতে থাকবে৷
এর আক্ষরিক প্রতীক :
১-২, ২-১, ১-২-৩
২-৩, ৩-২, ২-৩-৪
৩-৪, ৪-৩, ৩-৪-৫ ইত্যাদি।
ঘনপাঠঃ
ঘন পাঠের চারটি পদ দুটি দুটি করে ঠিক জটা পাঠ অনুযায়ী পাঠ করতে হয়। তারপর তিনটি করে পদ যথাক্রমে বিপরীতক্রমে এবং বিপর্যস্ত ভাবে উচ্চারণ করতে হয় । যেমন:
অগ্নিম্ ঈড়ে। ঈড়ে অগ্নিম।
অগ্নিম্ ঈড়ে পুরোহিতম্
পুরোহিতম্ ঈড়ে অগ্নিম।
অগ্নিম্ ঈড়ে পুরোহিতম্৷
ঈড়ে পুরোহিতম্। পুরোহিতম্ ঈড়ে।
ঈড়ে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য।
যজ্ঞস্য পুরোহিতম্ ঈড়ে ।
ঈড়ে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য।
..........এভাবে চলবে।
এই পাঠের আক্ষরিক প্রতীক হবে:
১-২, ২-১, ১-২-৩, ৩-২-১, ১-২-৩
২-৩, ৩-২, ২-৩-৪, ৪-৩-২, ২-৩-৪
৩-৪, ৪-৩, ৩-৪-৫, ৫-৪-৩, ৩-৪-৫ ইত্যাদি
ঘনপাঠ হল সবচেয়ে জটিল পাঠ পদ্ধতি।বিশেষজ্ঞদের মতে এইপাঠ পদ্ধতি বেদে পরিবর্তন হওয়া তো দুরের কথাবেদ এর প্রতিটি শব্দের উচ্চারন ও স্বরগ্রাম পর্যন্ত অবিকৃত।এই পদ্ধতিতে একবার মন্ত্রটি পড়লে প্রকারান্তরে সেটি ১৩ বার পড়া হয়ে যেত।তাই একজন ঘনপাঠিন কমপক্ষে ১৩ বার বেদ পড়ে থাকেন!
এই অভুতপূর্ব সংরক্ষন এর কারনেই ২০০৩ সালের ৭ ই নভেম্বর UNESCO বেদ সংরক্ষন এর এই পদ্ধতিকে"Master piece of theoral and intangible heritage of humanity"হিসেবে ঘোষনা করে।
Macdonell এ সম্বন্ধে তার History of sanskrit literature(page no 50) তে বলেন-
"এ রকম পরিবর্তিত হবার ক্ষীনতম সম্ভাবনা পর্যন্ত না থাকাটা পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র উদাহরন"
Keigi তার ঋগ্বেদভাষ্যের (Page 22) তে বলেন
"এই পর্যন্ত বেদ এত যত্নের সাথে সংরক্ষিত হয়েছে যার সাথে আর কোন বইয়ের ই তুলনা দেয়া যায়না।"
আপনারা বেদের ইংরেজি বা হিন্দি Pdf ডাউনলোড করে নিতে পারেন। পাশাপাশি কিছু বাংলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।Pdf গ্রন্থ
বে
(খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। এখানে বেদের ৪০০ টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র বাংলায় দেওয়া আছে)
দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী এখানে বেদসার
ব্যাসদেব ও বেদ
ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ। এই ৪ প্রকার বেদ নিয়ে বহুলপ্রচলিত একটা বিষয় হলো যে, [ বেদ প্রথমে একটাই ছিলো আর পরে "মহর্ষী কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসদেব " তিনি এই বেদকে মানুষের সুবিধার জন্য ৪ ভাগে ভাগ করেছেন, আর সে জন্য উনার নামও ব্যাসদেব হয়েছে।] অবাক করা বিষয় হলো এই তথ্যটাই সম্পুর্ন ভুল। এই লেখাটি আমদের পাঠ্যবই তে লেখা আছে। কিন্তু সত্য কথা এটা যে বেদ কখনোই একটা ছিলো না আর " মহর্ষী কৃষ্ণদৈপায়ন" সেটাকে চার ভাগও করেন নি। বেদ সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর চার ঋষির হৃদয়ে প্রকাশ করেছেন আর সেটা প্রথম থেকেই চার ভাগে বিভক্ত ছিলো। বেদ যে প্রথম থেকেই ৪ ভাগে বিভক্ত ছিলো তার প্রমান বহু যায়গায় আছে, প্রথমত সরাসরিই বেদে বলা হয়েছে ৪ বেদের নাম, তাছাড়াও উপনিষদ, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং রামায়ণেও ৪ টি বেদের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ এবার আসুন আমরা রেফারেন্স গুলো দেখে নেই ---
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুতহ্ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে। ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।। ( যজুর্বেদ - ৩১/৭)
সরলার্থঃ সেই সর্ব পূজ্য পরমাত্মা হইতে ঋগ্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ ও যজুর্বেদ উৎপন্ন হইয়াছে। সমগ্র বেদের মধ্য মহান ঈশ্বরের মহিমার পরম প্রকাশ। বেদের শৈলী অনুযায়ী অনেকে বেদ কে ত্রয়ী বলেন।
এই বেদমন্ত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে যে বেদ শুরু থেকেই ৪ভাগে বিভক্ত ছিলো। বেদ নিজেই বলছে যে পরমাত্মা হইতে ৪ বেদ উৎপন্ন হয়েছে। বেদ যে সৃষ্টুর শুরু হইতেই ৪ টা ছিলো সে বিষয়ে প্রথম প্রমাণ স্বয়ং বেদ।
এছাড়াও এই চার বেদ নিয়ে ঋগ্বেদ -১০/৯০/৯ নং মন্ত্রেও বলা হয়েছে [ নিচে হিন্দিতে ছবি দেওয়া হয়েছে, অনুবাদ উপরেরটাই, একই মন্ত্র যজুর্বেদ ও ঋগ্বেদে রয়েছে। ]
এবার আমরা বেদের ব্যাখ্যা গ্রন্থ- ব্রাহ্মণ গ্রন্থতে দেখি কি বলা হয়েছে --
এবং বা অরেস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বাসতমতদ্ যদৃগ্বেদা যর্জুবেদঃ সামবেদোহথর্বাঙ্গিরসঃ""।।
( শতপথ ১৪/৫/৪/১০)।
ভাবানুবাদ - সেই মহান পরমাত্মা হইতেই, ঋগ্বেদ , সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ উৎপন্ন হইয়াছেন।
এই ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও স্পষ্টই বলা হয়েছে যে বেদ চার প্রকার যা পরমাত্মা হইতেই সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের আরো বিভিন্ন স্থানেও ৪ বেদের বিষয়ে বলা হয়েছে। [ নিচে শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে হিন্দিতে, ]
এবার আসুন আমরা উপনিষদ থেকে কিছু প্রমাণ দেখে নেই --
মুন্ডক উপনিষদ- ১/১/৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে -
তত্রাপরা ঋগবেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে। ( মুন্ডক উপনিষদ - ১/১/৫)
অনুবাদ --- ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ এই গুলো সমস্ত অপরা বিদ্যার অন্তর্গত। যার দ্বারা অবিনাশী পরমব্রহ্ম অধিগম্য হন সেটা পরা বিদ্যা।
এখানেও স্পষ্টই ৪ বেদের আলাদা আলাদা নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আরো একটা বিষয় উক্ত শ্লোকে বেদকে অপরা বিদ্যার ( যার দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায়না) অন্তর্গত বলা হয়েছে, এটা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারেন যে বেদ ঈশ্বরের বানী, তাহলে বেদের মাধ্যমে ঈশ্বরকে জানতে পারবো না, এটা কেমন কথা?? আসলে এটার বিস্তারিত ও গভীর ব্যাখ্যা আছে এটা দেখে চিন্তায় পড়ার কারণ নেই তাছাড়া বেদ শুধু অপরা বিদ্যার নয় পরা বিদ্যারও গ্রন্থ, এই বিষয়য়ে গীতাতে বলা হয়েছে।[ গীতার ১৫ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো" অর্থাৎ সমস্ত বেদ দ্বারা আমি (পরমাত্মাই) জানার যোগ্য।] অর্থাৎ বেদ দ্বার ঈশ্বরকেই জানা যায়। ,এখান থেকেই বুঝা যায় বেদ পরাবিদ্যারও গ্রন্থ । সুতরাং উপনিষদের উক্ত শ্লোক নিয়ে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না, এটার বিস্তারিত সুন্দর ও গভীর ব্যাখ্যা আছে।
এবার আসুন রামায়ণের দিকে। বাল্মিকী রামায়ণেও চার বেদের কথা পাওয়া যায়।
বাল্মীকি রামায়নে যখন শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ কিষ্কিন্ধা পর্বতে ছিলেন, তখন রামচন্দ্র হনুমান জীর কথা শুনে এ কথা বলেন -
ন অন ঋগবেদ বিনীতস্য ন অ যজুর্বেদ- ধারিন।
ন অ সামবেদ বিদুষ শক্যম এবম বিভাষিতু মদম।।
( বাল্মীকি রামায়ন ৪।৩।২৮)
অনুবাদ - ঋগবেদ অধ্যয়নে অনভিজ্ঞ এবং যজুর্বেদে যার বোধ নেই তথা যার সামবেদ অধ্যয়ন নেই , সেই ব্যক্তি এইরূপ পরিস্কৃত বাক্য বলতে পারবে না।
বাল্মীকি রামায়নের এই শ্লোক দ্বারা স্পষ্ট যে, সেই সময় ঋগবেদাদি পৃথক পৃথক ছিলো। তাহলে তার হাজার বছর পর ব্যাসদেবের কালে তার এক হওয়া এবং ব্যাসদেব দ্বারা তার চার বিভাগ এটা কি প্রকারে স্বীকার করা যেতে পারে?। এখানে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে অথর্ববেদের নাম নেই কেনো। মন্ত্র ৩ প্রকারের হয়। ব্যাকরণগত দিক দিয়ে আসলে ৪ বেদের মাঝে ৩ প্রকার আলাদা আলাদা বৈশিষ্টের মন্ত্র পাওয়া যায়। অর্থবশ পাদ ব্যবস্থা তাকে ঋক বলা হয়। যে মন্ত্র গায়ন করা হয় তাকে সাম এবং বাকী মন্ত্র যজুর্বেদের অন্তর্গত। আর এই ৩ প্রকার বিষয় আমাদের সুন্দর ও নির্ভুলভাবে কথা বলতে কাজে লাগে, আর তাই এই ৩ বেদের নাম বলা হয়েছে, যেহেতু অথর্ববেদে এই ৩ প্রকারের মন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত তাই আর আলাদা করে বলা হয় নি,। তাছাড়াও এই বাল্মিকী রামায়ণে অথর্ববেদের কথা আছে। রামায়ণ বালকান্ড (১৫/২)
"" ইষ্টি তেহহং করিষ্যামি পুত্রায়াং পুত্রকারণাৎ অথর্বশিরসি প্রোক্তর্মন্ত্রেঃ সিদ্ধাং বিধানতঃ"।।
অনুবাদ--- এখানে রাজ দশরথের সন্তান প্রাপ্তির জন্য অথর্ববেদের মন্ত্র দ্বারা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার কথা উল্লেখ রয়েছে।।
উপরের রেফারেন্স গুলো থেকেই প্রমাণ হয় যে বেদ প্রথম থেকেই ৪ ভাগে বিভক্ত ছিলো।
এখন প্রশ্ন এই যে, ব্যাসদেব যদি বেদ কে চার ভাগে ভাগ না করে থাকেন তবে তার নাম বেদব্যাস কেন হলো?
বেদব্যাস নাম তার বেদ কে বিভক্ত করার জন্য হয় নি ব্যাসদেব বেদ অধ্যয়ন - অধ্যাপন দ্বারা বেদার্থ বিস্তার করেছিলেন এজন্য তার নাম "বেদব্যাস" হয়েছিলো। পারাপারের মধ্য রেখাকে "ব্যাস" বলা হয়। অর্থাৎ ঋগবেদের আরম্ভ থেকে অথর্ববেদের পার পর্যন্ত চার বেদ পড়েছিলেন। আর শুকদেব এবং জৈমিনি প্রভৃতি শিষ্যদের পড়িয়েছিলেন। বাস্তবিক পক্ষো তার জন্ম নাম ছিলো "কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন"। যদি কেউ বলে যে, ব্যাসদেব বেদ চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেননা ব্যাসদেবের পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, পরাশর, বশিষ্ঠ এবং ব্রহ্মা প্রভৃতিও চারবেদ অধ্যয়ন করেছিলেন।।।
ধন্যবাদ
।।ওম্ শম্।।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ