১. গ্রিক সভ্যতার অভ্যুদয়
পুরো ইতিহাসে গ্রিক সভ্যতার আকস্মিক অভ্যুদয়ের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার মতো কঠিন বিষয় আর নেই। সভ্যতা গঠনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার অধিকাংশই ইতোমধ্যে মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্যমান ছিল হাজার বছর ধরে এবং সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের অভাব তত দিন পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল যত দিন গ্রিকদের কাছ থেকে তা পাওয়া বাকি ছিল। শিল্প ও সাহিত্যে গ্রিকদের অর্জন সম্পর্কে সবাই অবগত, কিন্তু বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তারা যা করেছে তা বেশ ব্যতিক্রমী। গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন তাদেরই আবিষ্কার। নিছক ঘটনাপঞ্জির বদলে ইতিহাস রচনা করে তারাই প্রথম। উত্তরাধিকার-সূত্রে চলে আসা গোঁড়ামির বেড়াজালে আবদ্ধ না থেকে তারা স্বাধীনভাবে বিশ্বজগতের প্রকৃতি ও জীবনের পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করত। গ্রিসে যা কিছু ঘটেছে তা এতই বিস্ময়কর যে খুব সাম্প্রতিককাল আগেও গ্রিক মনীষা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে গিয়ে লোকজনকে বিমূঢ় আর হতবুদ্ধি হতে হয়েছে। কিন্তু গ্রিসের ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব, আর তা করার কাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ উপযোগীও বটে।
থেলিসকে দিয়ে দর্শনের শুরু। একটি ঘটনা থেকে সৌভাগ্যক্রমে থেলিসের সময়কাল নির্দেশ করা যায়। সেটি হচ্ছে, তিনি একটি সূর্য/চন্দ্রগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জ্যোতির্বিদদের মতে তা ঘটেছিল ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাহলে, দর্শন ও বিজ্ঞান-যা শুরুতে পরস্পর থেকে পৃথক ছিল না-তার সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে। কিন্তু সে সময়ের আগে গ্রিসে ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে কী ঘটেছিল? এই প্রশ্নের যেকোনো উত্তর আংশিকভাবে অনুমাননির্ভর হতে বাধ্য। তবে সুখের কথা, বর্তমান শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ব থেকে আমাদের অনেক বেশি জ্ঞান লাভ হয়েছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে মিসরে লেখার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে মেসোপটেমিয়াতেও তা ঘটে। প্রত্যেক দেশেই লেখা শুরু হয় কোনো লক্ষ্যবস্তুর ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। ছবিগুগলো দ্রুত পরিচিত ও রীতিসিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং একটি সময়ে শব্দ বোঝাতে আইডিওগ্রাম ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে, যেটা চীন দেশে এখনো প্রচলিত আছে। হাজার হাজার বছরে এই কষ্টসাধ্য পদ্ধতিটি উন্নীত হয় বর্ণমালার ব্যবহারে লেখার পদ্ধতিতে।
মিসর ও মেসোপটেমিয়ার প্রাথমিক উন্নতি সাধিত হয় নীল, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর বদৌলতে। নদীগুলোর কারণে সেখানে কৃষিকাজ ছিল খুব সহজ ও উৎপাদনশীল। স্পেনীয়, মেক্সিকো এবং পেরুতে যা দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে প্রাচীন মিসরীয় এবং মেসোপটেমীয় সভ্যতার অনেক সাদৃশ্য লক্ষ করা যাবে। ঈশ্বরসুলভ একজন রাজা থাকত, তার ক্ষমতা হতো একচ্ছত্র ও অসীম। মিসরে সেই ছিল সব ভূমির মালিক। বহু-ঈশ্বরবাদী একটি ধর্ম ছিল। সে ধর্মে ছিল একজন সর্বোচ্চ দেবতা অর্থাৎ সর্বেশ্বর। সর্বেশ্বরের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক হতো বেশ ঘনিষ্ঠ। একটি সামরিক আর একটি পুরোহিত সম্প্রদায় থাকত। রাজা যদি দুর্বল হতো বা কোনো কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ত, তাহলে পুরোহিত সম্প্রদায় প্রাইই রাজক্ষমতা দখল করে নিত। যারা ভূমি চাষ করত তারা ছিল রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের অধীনস্ত দাস।
মিসরীয় ধর্মতত্ত্ব ও ব্যাবিলনীয় ধর্মতত্ত্বের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল। মিসরীয়দের মধ্যে মৃত্যুচিন্তাই ছিল প্রধান ও প্রকট। তারা বিশ্বাস করত, মৃত ব্যক্তির আত্মা পাতালপুরীতে নেমে যায়, সেখানে ওসিরিস তাদের ইহজাগতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে বিচার করে। তারা মনে করত আত্মা শেষ পর্যন্ত আবার দেহের মধ্যে ফিরে আসে। এই বিশ্বাস থেকে তারা মৃতদেহকে নষ্ট না করে মমি বানিয়ে সুন্দর সুন্দর কবরের মধ্যে রেখে দিত। বিভিন্ন রাজার উদ্যোগে অনেক পিরামিড তৈরি হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ও তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। ওই সময়ের পর থেকে মিসরীয় সভ্যতা ক্রমশই গাধা হয়ে পড়ে এবং ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ভবিষ্যৎ প্রগতিকে অসম্ভব করে তোলে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালে হিকসোস নামক সেমিটীয়রা মিসর অধিকার করে নেয়। তারা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে মিসর শাসন করে। মিসরে তারা কোনো স্থায়ী চিহ্ন রেখে যায়নি, কিন্তু সেখানে তাদের উপস্থিতি সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে মিসরীয় সভ্যতার প্রসারে নিশ্চয়ই সহায়ক হয়ে থাকবে।
মিসরের চেয়ে ব্যাবিলনিয়া ছিল অধিকতর সামরিকসুলভ। প্রথম দিকে সেখানকার শাসকরা সেমিটীয় ছিল না, ছিল সুমেরীয়। সুমেরীয়দের আদি পরিচয় অজানা। তারা লেখার কীলকাকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। বিজয়ী সেমিটীয়রা সেটা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল। একটি সময় ছিল যখন অনেক স্বাধীন নগরী ছিল, আর তারা সব সময় পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। কিন্তু একটি সময় আসে যখন ব্যাবিলন হয়ে ওঠে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য নগরীর দেবতারা হয়ে পড়ে ব্যাবিলনের দেবতা মারডকের অধীন। মারডক এমন একটি অবস্থান অর্জন করে যা পরবর্তীকালে গ্রিক দেবমণ্ডলীতে জিউসের অবস্থানের মতো। একই ধরনের ব্যাপার ঘটে মিসরেও, তবে তা আরো বেশ কিছু সময় আগে। অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মতো মিসর এবং ব্যাবিলনিয়ার ধর্মগুলোও ছিল মূলত উর্বরতা পূজা।
পৃথিবী ছিল স্ত্রী, সূর্য পুরুষ। ষাঁড় গরুকে সাধারণত পুরুষ উর্বতার মূর্ত প্রকাশ বলে মনে করা হতো; সর্বত্রই ষাঁড়-দেবতার দেখা পাওয়া যেত। ব্যাবিলনে স্ত্রী দেবতাদের মধ্যে মৃত্তিকা দেবী ইশতারের স্থান ও মর্যাদা ছিল সবার উপরে। পশ্চিম এশিয়াজুড়ে এই মহামাতার পূজা করা হত বিভিন্ন নামে। গ্রিক ঔপনিবেশিক শাসকরা এশিয়া মাইনরে যখন ইশতারের মন্দিরগুলো দেখতে পায় তখন তারা তার নাম দেয় আরটেমিস এবং তারা সেখানকার বিদ্যমান ধর্ম গ্রহণ করে। ডায়ানা অব এফেসিয়ানস-এর আদি উৎস ছিল এটাই। খ্রিস্ট ধর্ম তাকে রূপান্তরিত করে কুমারী মেরিতে। এফেসাসে একটি পরিষদ ছিল যারা আমাদের লেডির (যিশুমাতা মেরিকে বোঝানো হচ্ছে) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঈশ্বরমাতা অভিধানটিকে বৈধতা দান করে। যেখানে কোনো সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ধর্ম খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের আদিরূপ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সেখানে দেবতা বা দেবী রাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে উঠেছে এবং তারা যে কেবল প্রচুর পরিমাণে ফসল ফলানোর ব্যবস্থা করত তা-ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা বিজয় নিশ্চিত করত। একটি ধনী পুরাহিত সম্প্রদায় নীতি-আচার ও ধর্মকে বিশদভাবে প্রণয়ন করে সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেগুলোকে একটি দেবতামণ্ডলীর সঙ্গে মিলিয়ে নিত।
রাজ্যশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে দেবতারা নৈতিকতার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হতো। বিধানদাতারা বলত, তারা তাদের বিধানগুলো পেয়েছে দেবতার কাছ থেকে। তাই তারা দাবি করত, সাম্রাজ্যের আইন বা বিধান হচ্ছে ঐশ্বরিক, পবিত্র জিনিস। তাই সে-আইন ভঙ্গ করা পাপ। আজ পর্যন্ত জানা দণ্ডবিধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি (খ্রি.পূ. ২০৬৭-২০২৫)-এর দণ্ডবিধি। রাজা হাম্মুরাবি দাবি করতেন দেবতা মারডক তাকে ওই দণ্ডবিধিটি দান করেছিল। প্রাচীনকালজুড়ে ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে।
মিসরীয় ধর্মে পরকালের চিন্তা প্রধান। কিন্তু ব্যাবিলনিয়ার পরকাল নয়, ইহকালের সুখ-সমৃদ্ধির কথাই বেশি ভাবা হতো। জাদু, তন্ত্রমন্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি উন্নত ছিল ব্যাবিলনিয়াতে এবং প্রধানত ব্যাবিলনের মাধ্যমেই এই জিনিসগুলো পরবর্তী প্রাচীন যুগে প্রাধান্য লাভ করেছিল। ব্যাবিলন থেকে কিছু জিনিস এসেছে যেগুলো বিজ্ঞানের অন্তর্গত। যেমন-দিন-রাত্রিকে ২৪ ঘণ্টায় ভাগ করা, বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা ব্যাবিলনেই আবিষ্কৃত হয়। সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের বেলায় তারা একটি চক্র আবিষ্কার করে, যার ভিত্তিতে নিশ্চয়তার সঙ্গে চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া যেত এবং সূর্যগ্রহণের সম্ভাব্যতা নির্দেশ করা যেত। দেখা যায়, পরবর্তীকালে থেলিস এই ব্যাবিলনীয় জ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন।
মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলো ছিল কৃষিভিত্তিক এবং তার চারপাশের জাতিগুলোর সভ্যতা ছিল মূলত পশুপালনভিত্তিক। বাণিজ্য-প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়, প্রথমে বাণিজ্য ছিল পুরোপুরি সমুদ্রভিত্তিক। খ্রিস্টপূর্ব প্রায়। ১০০০ সাল পর্যন্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। যেসব জাতির নিজ নিজ অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধাতু ছিল না তারা তা সংগ্রহ করত হয় বাণিজ্য, নয় দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। দস্যুবৃত্তি ছিল একটি সাময়িক কূটকৌশল। যেসব স্থানে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল সেখানে বাণিজ্য অধিকতর লাভজনক হয়ে ওঠে। বাণিজ্যক্ষেত্রে ক্রিটি দ্বীপ ছিল অগ্রপথিক। খ্রি.পূ. ২৫০০ থেকে খ্রি.পূ. ১৪০০ সাল পর্যন্ত এগারো শতাব্দী ধরে ক্রিটি দ্বীপে এক উন্নত শিল্পসভ্যতা ছিল, ইতিহাসে তা মিনোয়ান সভ্যতা (Minoan Civilization) নামে খ্যাত। ক্রিটীয় শিল্প-সংস্কৃতির যা কিছু আমাদের কাল অবধি টিকে রয়েছে তার নিদর্শনগুলো থেকে তাদের আনন্দোচ্ছল, এমনকি বেশ বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপনের ইঙ্গিত মেলে, যা মিসরীয় মন্দিরগুলোর ভয়গম্ভীর চেহারা থেকে খুবই আলাদা।
স্যার আর্থার ইভান্স ও অন্যদের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের আগ পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। এটি ছিল একটি সমুদ্র-উপকূলীয় সভ্যতা। হিসোসদের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত এই সভ্যতার সঙ্গে মিসরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মিসরীয় চিত্রাবলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় মিসর ও ক্রিটি দ্বীপের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল, ক্রিটীয় নাবিকদের মাধ্যমে তা চলত। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম বিকাশ ঘটেছিল। মনে হয় ধর্মের দিক থেকে ক্রিটির সাদৃশ্য ছিল সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের সঙ্গে, আর শিল্পকলার দিক থেকে মিসরের সঙ্গে, যদিও ক্রিটির শিল্পকলা ছিল খুব মৌলিক ধরনের, তাতে চমৎকার জীবনবাদিতা ছিল। ক্রিটির সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল তথাকথিত মিনোসের প্রাসাদ বা Palace of Minos। তার অবস্থান ছিল নসস (Knosos) নামক স্থানে। ক্রিটির প্রাসাদগুলো ছিল খুবই মনোমুগ্ধকর। সম্ভবত খ্রি.পূ. ১৪০০ শতাব্দীতে গ্রিক আগ্রাসীদের হাতে সেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ক্রিটির ইতিহাসের কালপঞ্জি পাওয়া যায় মিসরে আবিষ্কৃত ক্রিটির জিনিসপত্র থেকে। এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আগাগোড়াই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর ওপর নির্ভরশীল।
ক্রিটির অধিবাসীরা একজন অথবা সম্ভবত কয়েকজন দেবীর পূজা করত। দেবীদের মধ্যে যিনি ছিলেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাকে বলা হতো প্রাণিকুলের মালকিন। তিনি ছিলেন সম্ভবত একজন শিকারি মহিলা এবং তিনিই সম্ভবত ধ্রুপদী আরটেমিস দেবীর উৎস। দৃশ্যত তিনি একজন মাতাও ছিলেন। প্রাণিকুলের মালিকরা ছাড়া যে একমাত্র পুরুষ দেবতা ছিলেন, তিনি এই দেবীর যুবক পুত্র। মিসরীয়দের মতো ক্রিটির অধিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসেও পরজীবন ছিল এমন প্রমাণ খেয়াল করা যায়। মিসরীয়দের মতো তারাও বিশ্বাস করত যে পৃথিবীতে তাদের কার্যকলাপ মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করবে। তবে সামগ্রিকভাবে তাদের শিল্পকলার নিদর্শনগুলো থেকে মনে হয় তারা মোটের ওপর হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিল। বিষণ্ণ পরকালীন চিন্তার ছাপ তাদের মধ্যে খুব একটি ছিল না। ক্রিটি দ্বীপে ষাঁড়ের লড়াই বেশ জনপ্রিয় ছিল। ষাঁড়-লড়াইয়ে নারী ও পুরুষ লড়য়ারা সমান রকম দৈহিক পারদর্শিতা দেখাত।
স্যার আর্থার ইভান্স মনে করেন, ক্রিটিতে ষাঁড়ের লড়াই ছিল একধরনের ধর্মীয় উৎসব, যারা এ লড়াইয়ে অংশ নিত সমাজে তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হতো। তবে স্যার আর্থার ইভান্সের এই মত সর্বজনস্বীকৃত হয়নি। আমাদের কাল অবধি যেসব চিত্রকলা টিকে রয়েছে সেগুলো গতি আর বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। ক্রিটির অধিবাসীদের একটি রৈখিক হস্তলিপি ছিল, কিন্তু তার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিজেদের মধ্যে তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত, তাদের নগরগুলো প্রাচীরবেষ্টিত ছিল না। এটা নিঃসন্দেহে এ কারণে যে তাদের ভূখণ্ড ছিল সমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত।
ধ্বংসের আগে মিনোয়ান সংস্কৃতি ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের প্রসার লাভ করে। ক্রমবিকাশের বিভিন্ন ধাপে সে সংস্কৃতি সেখানে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে এই সভ্যতা মাইসেনিয়ান সভ্যতা নামে পরিচিত। এটা জানা যায় রাজা-বাদশাদের সমাধি আর পাহাড়-চূড়ায় অবস্থিত দুর্গগুলোর নিদর্শন থেকে, যাতে যুদ্ধের ভয় বেশি করে প্রতিফলিত হয়েছে, যা কিনা ক্রিটি দ্বীপে ছিল না। সমাধি এবং দুর্গগুলো উভয়ই ধ্রুপদী গ্রিসের মানসে ছাপ ফেলেছে। এর আগেকার শিল্পকলার নিদর্শনগুলো-যেগুলো মিনোয়ান প্রাসাদগুলোতে পাওয়া যায়-হয় মূলত ক্রিটির কর্মনৈপুণ্যের লক্ষণ বহন করে, নয়তো সেগুলো ক্রিটি দ্বীপের লোকদেরই কর্মকুশলতার নিদর্শন। আর কাহিনি-উপকথার মধ্য দিয়ে মাইসেনীয় সভ্যতাকে দেখলে তাই পাওয়া যায়, যা আমরা হোমারের মারফতে পাই।
মাইসেনীয়দের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা যায় না। তারাই কি সেই সভ্যতার ধারক ছিল যা ক্রিটির অধিবাসীরা অধিকার করে নিয়েছিল? তারা কি গ্রিক ভাষায় কথা বলত? অথবা তারা কি আরো পূর্ববর্তী প্রাচীন কোনো স্থানীয় জাতি ছিল? এইসব প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। তবে এমন প্রমাণ মিলেছে যা এ ধরনের সম্ভাব্য উত্তর সরবরাহ করে যে, তারা সম্ভবত এক বিজয়ী জাতি ছিল যারা গ্রিক ভাষায় কথা বলত এবং ওই প্রমাণ থেকে অন্ততপক্ষে এমনটা মনে করা যায় যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত শ্রেণিগুলো ছিল উত্তর থেকে আগত সোনালি চুলের আগ্রাসীর দল, যারা তাদের সঙ্গে করে গ্রিক ভাষা নিয়ে এসেছিল। গ্রিকরা গ্রিস দেশে এসেছিল পরপর তিনটি ধারায়। প্রথমে এসেছিল আয়োনিয়ান (lonians) নৃগোষ্ঠী, তারপর আকিয়ান (Achaeans) এবং সবশেষে ডরিয়ান (Dorian) নৃগোষ্ঠী। আয়োনীয়রা যদিও ছিল বিজয়ী আগ্রাসনকারী, তবু তারা বেশ ভালোভাবে ক্রিটির সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল, যেমনটা পরবর্তীকালে রোমানরা গ্রহণ করেছিল গ্রিসের সভ্যতাকে। কিন্তু আয়োনীয়রা বাধাগ্রস্ত হয়, তাদের অধিকাংশকে উৎখাত করে পরবর্তী আগ্রাসী আকিয়ানরা। বোঘাজ-কুই নামক স্থানে প্রাপ্ত হিটাইট ফলক থেকে জানা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে আকিয়ানদের এক বিশাল সংগঠিত সাম্রাজ্য ছিল। আয়োনীয়রা, অর্থাৎ ডরিয়ানরা বস্তুত সেটাকে ধ্বংসই করে ফেলে। যেহেতু পূর্ববর্তী দখলদাররা মিনোয়ান সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল সে জন্য ডরিয়ানরা তাদের পূর্বসূরিদের মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্মকে পরিত্যাগ করেনি, তারা তা সংরক্ষণ করেছিল। মাইসেনীয় ধর্ম টিকে ছিল বিশেষত নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে এবং ধ্রুপদী গ্রিসের ধর্ম ছিল মূলত দুটোর মিশ্রণ। আসলে ধ্রুপদী দেবীদের অনেকেরই উৎস ছিল মাইসেনীয়।
যদিও উপরের বিচারকে সম্ভবপর বলেই মনে হয়, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা জানি না, মাইসেনীয়রা আসলেই গ্রিক ছিল কি না। আমরা যা জানি তা হলো, তাদের সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে। যখন তাদের সভ্যতার পরিসমাপ্তি ঘটে তখন ব্রোঞ্জের জায়গা দখল করে নিয়েছে লোহা এবং আরো জানি যে, কিছুকালের জন্য সমুদ্রের আধিপত্য চলে গিয়েছিল ফিনিসীয়দের হাতে। মাইসেনীয় যুগের শেষের দিকে এবং এ যুগ শেষ হবার পর-উভয় কালে দখলদারদের কিছু অংশ সেখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে এবং কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। আর তাদের কিছু অংশ আরো অগ্রসর হয়ে প্রথমে এশিয়া মাইনরের দ্বীপগুলোতে, তারপর সিসিলি ও দক্ষিণ ইতালি পৌঁছে। সেখানে তারা নগর পত্তন করে এবং সমুদ্র-উপকূলীয় বাণিজ্যকে জীবিকা হিসেবে নেয়। এসব উপকূলীয় নগরীতেই গ্রিকরা তাদের সভ্যতার জন্য নতুন নতুন গুণগত অবদান রাখে। এথেন্সের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় পরবর্তী সময়ে, এ ক্ষেত্রে এথেন্স নৌশক্তির সহযোগিতা লাভ করে।
গ্রিসের মূল ভূখণ্ড পাহাড়ি এবং এর ব্যাপক অঞ্চল অনুর্বর। অবশ্য অনেক উপত্যকা ছিল যেখান থেকে সহজেই সাগরে পৌঁছানো যেত। কিন্তু উপত্যকাগুলো পাহাড়-পর্বত দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাতে করে স্থলপথে যোগাযোগ সহজ ছিল না। এসব উপত্যকায় ছোট ছোট জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি কোনো নগরকে কেন্দ্র করে তারা বসবাস করত। তাদের জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। এ রকম পরিবেশে এটা খুব স্বাভাবিক ছিল যে জনগোষ্ঠীগুলো সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পেতে যখন এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের সম্পদে তাদের চাহিদা আর মেটে না, তখন তাদের অনেকেই সাগরের দিকে অগ্রসর হয়। মূল ভূখণ্ডের নগরগুলো প্রায়ই এমন সব স্থানে তাদের কলোনি স্থাপন করে যেখানে উপজীবিকা ছিল মূল ভূখণ্ডের চেয়ে সহজতর। এইভাবে ইতিহাসের একেবারে শুরুর যুগে এশিয়া মাইনর, সিসিলি ও ইতালির গ্রিকরা মূল ভূখণ্ডের গ্রিকদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল।
গ্রিসের বিভিন্ন অংশের সামাজিক ব্যবস্থাগুলো ছিল খুবই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। স্পার্টায় একটি ক্ষুদ্র অভিজাত সম্প্রদায় ছিল যারা জীবনযাপন করত অন্য জাতির দাসদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষি অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল মূলত চাষী। তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেদের জমি চাষাবাদ করত। কিন্তু যেখানে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল সেসব অঞ্চলে স্বাধীন নাগরিকরা দাসদের কাজে খাঁটিয়ে ধনী হতে থাকে। পুরুষ দাসদের তারা খাটাত খনিতে আর নারী দাসদের খাটাত বস্ত্রশিল্পে। আয়োনিয়াতে এই দাসরা ছিল চারপাশের বর্বর জনগোষ্ঠী, যাদেরকে অধিকার করে নেওয়া হয় যুদ্ধে। সম্পদবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধাভাজন নারীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে গ্রিক সমাজ জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যায়, অবশ্য স্পার্টায় ও লেসবস-এ ছাড়া।
গ্রিসের সব অঞ্চলের বিকাশের মধ্যে একটি বেশ সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বিকাশ ঘটেছিল প্রথমে রাজতন্ত্র থেকে অভিজাততন্ত্রে, তারপর স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্র বদলাবদলি করে। মিসর ও ব্যাবিলনিয়ার রাজাদের মতো গ্রিসের রাজারা নিরঙ্কুশ বা অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে বয়োজ্যেষ্ঠদের একটি পরিষদ থাকত। রাজারা প্রচলিত নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেত না। স্বৈরতন্ত্র বলতে অবধারিতভাবে মন্দ শাসন বোঝত না, তা ছিল কেবল একজন মানুষের শাসন যার ক্ষমতার দাবি উত্তরাধিকারভিত্তিক ছিল না। গণতন্ত্র বলতে বোঝাত সব নাগরিকের শাসন, তবে দাস-দাসী ও নারীদের নাগরিক বলে গণ্য করা হতো না। মেডিসির মতো প্রথম দিকের স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা লাভ করে ধনিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ধনী সদস্য হিসেবে। প্রায়ই তাদের সম্পদের উৎস ছিল সোনা ও রুপার খনির মালিকানা। মুদ্রা প্রস্তুতকরণ শুরু হবার পর থেকে সোনা-রুপা আরো বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে। মুদ্রা তৈরির শিল্প প্রথম আসে আয়োনিয়ার পার্শ্ববর্তী লিডিয়া থেকে। এই শিল্প প্রথম আবিষ্কৃত হয় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সামান্য আগে।
বাণিজ্য আর দস্যুবৃত্তির মধ্যে শুরুতে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। গ্রিকদের কাছে বাণিজ্য বা দস্যুবৃত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলগুলোর একটি ছিল লেখার কৌশল অর্জন। যদিও মিসর ও ব্যাবিলনিয়ায় হাজার বছর ধরে লেখার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল এবং আয়োনিয়ার ক্রিটীয়দেরও একটি হস্তলিপি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল-যা এখন গ্রিক ভাষারই একটি ধরন বলে জানা গেছে-তবু গ্রিকরা সঠিক কোন সময় থেকে বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখার কৌশল অর্জন করেছিল তা জানা যায়নি। বর্ণমালার সাহায্যে লেখার কৌশলটা তারা শিখেছিল ফিনিসীয়দের কাছ থেকে। সিরিয়ার অন্যান্য অধিবাসীদের মতো ফিনিসীয়দের ওপরও মিসর এবং ব্যাবিলনিয়ার প্রভাব ছিল। আয়োনিয়া, ইতালি ও সিসিলিতে গ্রিক নগরীগুলোর উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত উপকূলীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিনিসীয়দেরই প্রাধান্য ছিল সর্বাধিক। চতুর্দশ শতকেও ইখনাতনের (Ikhnaton) চিঠিপত্র লেখার সময় সিরীয়রা ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্মই ব্যবহার করত। কিন্তু টায়ার এর হিরাম (৯৬৯-৯৩৬ খ্রি.পূ.) ব্যবহার করত ফিনিসীয় বর্ণমালা, যার বিকাশ ঘটেছিল সম্ভবত মিসরীয় হস্তলিপি থেকেই। শুরুর দিকে মিসরীয়রা শুধু ছবির মাধ্যমে লিখত। ক্রমান্বয়ে ছবিগুলো সর্বজনীনতা লাভ করতে থাকে এবং সবার দ্বারা ব্যবহৃত হতে হতে রীতি লাভ করে এবং একেকটা ছবি একেকটা শব্দাংশ বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে (অঙ্কিত বস্তুর নামের প্রথম শব্দাংশ)। এভাবে অবশেষে একেকটা বর্ণ বা অক্ষর তৈরি হয়। অক্ষর তৈরির নিয়মটা ছিল এ রকম : A ছিল একজন Archer, যে একটি ব্যাঙ মেরেছিল। গ্রিকরা তাদের ভাষার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো করে বর্ণমালা পরিবর্তন করে নিয়েছিল। শব্দ তৈরিতে শুধু ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহারের বদলে গ্রিকরা তাতে স্বরবর্ণ যোগ করার গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনাটি সাধন করেছিল। লেখার এই সুবিধাজনক পদ্ধতি অর্জনের ফলে গ্রিক সভ্যতা যে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
হেলেনিক সভ্যতার প্রথম উল্লেখযোগ্য ফসল ছিলেন হোমার। হোমার সম্পর্কে সবকিছুই অনুমাননির্ভর। তবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত একটি মত আছে যে, হোমার নামে কোনো একজন ব্যক্তি ছিল না, বরং এ নামে পরিচিত ছিলেন বেশ কয়েকজন কবি, আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। যারা এই ধারণায় বিশ্বাসী তাদের হিসেবে ইলিয়াড এবং অডেসি রচনা সম্পূর্ণ হবার মাঝখানের সময়গত দূরত্ব দুই শত বছর। কেউ কেউ বলেন খ্রি.পূ. ৭৫০ থেকে খ্রি.পূ. ৫৫০ সাল পর্যন্ত আবার অন্য অনেকে মনে করেন, অষ্টম শতকের শেষ নাগাদ হোমার প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল। হোমারীয় কবিতাগুলো বর্তমান রূপে এথেন্সে এনেছিলেন পেইসিস্ট্রাটাস। পেইসিস্ট্রাটাস গ্রিসে রাজত্ব করেন ৫৬০ খ্রি.পূ. থেকে ৫২৭ খ্রি.পূ. পর্যন্ত (মাঝখানে কিছু সময় বিরতিসহ)। তার সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে এথেনীয় যুবসম্প্রদায় হোমারের রচনা মুখস্থ করত এবং তা ছিল তাদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রিসের কিছু কিছু অংশে, বিশেষভাবে স্পার্টায়, আরো কিছুকাল অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত হোমারের মর্যাদা একই রকম ছিল না।
পরবর্তী-মধ্যযুগের প্রণয়-প্রার্থনা ধরনের রোম্যান্সগুলোর মতো হোমারীয় কবিতাগুলোতে একটি সভ্য অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারকে নিচ ও ইতর ভেবে উপেক্ষা করা হয়। এই কুসংস্কারগুলো এখনো জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। অনেককাল পরে এগুলোর কিছু কিছু আবার বেরিয়ে এসেছে। নৃবিজ্ঞানের সহায়তায় অনেক বিজ্ঞানী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হোমার সেকেলে ছিলেন না, ছিলেন একজন সংস্কারক বা সংশোধনকারী, প্রাচীন পুরাণগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যাদানকারী অষ্টাদশ শতকের র্যাশনালাইজারদের মতো। অলিম্পীয় দেবতারা-যারা ছিলেন হোমারের মধ্যে ধর্মের প্রতিফলন-হোমারের যুগে বা তার পরের যুগেও শুধু গ্রিকদের মধ্যেই পূজনীয় ছিলেন না। গণধর্মের মধ্যে অন্য অনেক অন্ধকার ও অসভ্য উপাদান ছিল। সেগুলো গ্রিক মনীষা দ্বারা কোণঠাসা হয়ে থাকত, কিন্তু দুর্বলতা বা আতঙ্কের মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকত। হোমার যেসব বিশ্বাসকে বাতিল করে দিয়েছিলেন, অবক্ষয়ের যুগে সেগুলো টিকে ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে, ধ্রুপদী যুগ জুড়ে সেগুলো আধা বিলুপ্তির অবস্থায় ছিল। এই তথ্য অনেক বিষয়েরই ব্যাখ্যা হাজির করে, অন্যভাবে যা সঙ্গতিহীন বা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। আদি ধর্মগুলো কোথাও ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, ছিল গোত্রীয় ব্যাপার। গোত্র বা উপজাতির মঙ্গলার্থগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য চিত্তাকর্ষক নানা ধরনের জাদুবিদ্যা দ্বারা কিছু বিশেষ কৃত্যানুষ্ঠান চলত। বিশেষভাবে উর্বরতা, গাছপালা, পশু ও মানুষের কল্যাণের জন্য এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হতো। দক্ষিণায়নের দিন সূর্যের শক্তি যাতে ফুরিয়ে না যায় সে জন্য সূর্যকে সাহস যোগানো হতো। বসন্ত আর ফসল কাটার ঋতুতেও যথাযথ অনুষ্ঠান করা হতো। এগুলো প্রায়ই এমন ছিল যাতে ব্যাপক সমষ্টিগত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যে উত্তেজনার মধ্যে ব্যক্তি-মানুষ তার বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্তি পায় এবং নিজেকে তার পুরো গোত্রের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। পৃথিবীজুড়েই ধর্মীয় বিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট ধাপে পৌঁছে পবিত্র পশু আর মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা করা বা বলি দেওয়া হতো এবং তাদের ভক্ষণ করা হতো। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এই ধাপ এসেছিল বিভিন্ন সময়ে। বলি দেওয়া মানুষের মাংস ভক্ষণের চেয়ে বেশি দিন স্থায়ী ছিল নরবলির ধর্মীয় রীতি। ঐতিহাসিক যুগ শুরুর দিকেও গ্রিসে তা বিলুপ্ত হয়নি। এরূপ নির্দিষ্ট দিক বাদ দিয়ে উর্বরতা-প্রার্থনার কৃত্যানুষ্ঠানগুলো গ্রিসে ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। নির্দিষ্টভাবে এলিউসীয় গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলো তাদের প্রতীকধর্মিতার দিক থেকে মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক।
স্বীকার করতেই হবে, হোমারের মধ্যে ধর্ম ব্যাপারটা খুব একটি ধার্মিকতাপূর্ণ নয়। তার রচনায় দেবতারা আগাগোড়াই মানবসুলভ। মানুষের সঙ্গে দেবতাদের পার্থক্য শুধু এই যে, দেবতারা অমর এবং অতিমানবিক নানা ক্ষমতার অধিকারী। নৈতিক দিক থেকে এ ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। তারা যে কীভাবে এতটা সম্ভ্রম বা ভয় উদ্রেক করতে পারত তা বোঝা কঠিন। হোমারের কাব্যগুলোর কোনো কোনো অংশে-যেগুলো মনে হয় পরের দিকে রচিত-দেবতাদেরকে ভলতেরীয় অশ্রদ্ধার সঙ্গে দেখানো হয়েছে। সেই অর্থে খাঁটি ধর্মীয় অনুভূতি হোমারে পাওয়া যায় না। ধর্মীয় অনুভূতি যা তার মধ্যে খেয়াল করা যায়, তা অলিম্পিয়াসের দেবতাদের চেয়ে নিয়তি, প্রয়োজন, পরিণতি-এ রকম সব অস্পষ্ট ছায়াময় বিষয়ের সঙ্গেই বেশি সম্পর্কিত। এমনকি হোমারের রচনায় বর্ণিত জিউসও এই বিষয়গুলোর অধীন ছিলেন। পুরো গ্রিক চিন্তায় নিয়তি বা ভাগ্যের একটি বড় প্রভাব ছিল এবং এটা সম্ভবত বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর প্রতি বিশ্বাসের উৎসগুলোর অন্যতম।
হোমারের দেবতারা ছিল একটি বিজয়ী অভিজাত সম্প্রদায়ের দেবতা। যারা বস্তুত ভূমি চাষ করত। ওইসব দেবতা তাদের উর্বরতার দেবতা ছিল না। গিলবার্ট মুরে যেমনটি বলেন: অধিকাংশ জাতির দেবতারা দাবি করে যে তারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। অলিম্পীয় দেবতারা এ রকম দাবি করে না। তারা যা করেছে তা হলো বিশ্বকে জয় করা…আর যখন তাদের রাজ্যজয় সম্পন্ন হয়ে গেছে তখন তারা কী করে? তারা কি দেশ শাসনে আছে? তারা কি কৃষিকাজ চালাচ্ছে? তারা কি বাণিজ্য ও শিল্প করছে? মোটেই না। কেন তাদেরকে কোনো সৎ কাজ করতে হবে? তারা রাজস্ব আয়ের ওপর জীবনযাপনকেই বেশি সহজ মনে করে, আর যারা রাজস্ব পরিশোধ করে না তাদের ওপর বজ্রপাত ঘটানোই তাদের কাছে অধিকতর সহজ কাজ। তারা একেকজন বিজয়ী গোষ্ঠীপতি, একেকজন রাজকীয় বোম্বেটে। তারা যুদ্ধ করে, আনন্দোৎসব করে, আনন্দ-ফুর্তি আর পানভোজনে দিন কাটায়। তারা ক্রীড়ামোদে গা ভাসায়, সঙ্গীত রচনা করে, তারা আকণ্ঠ পান করে আর সেই খোঁড়া কর্মকারের প্রতি অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে, যে তাদের খেদমতে নিয়োজিত। নিজেদের রাজাকে ছাড়া তারা কখনো আর কাউকে ভয় পায় না। শুধু প্রেমে আর যুদ্ধক্ষেত্রে ছাড়া তারা কখনো মিথ্যা বলে না।
হোমারের মানুষ-বীরদেরও স্বভাব-আচরণ খুব একটি ভালো নয়। তাদের নেতৃস্থানীয় পরিবার হলো হাউস অব পেলোপস। কিন্তু সুখী পারিবারিক জীবনের একটি আদর্শ দাঁড় করাতে এ পরিবার সফল হয়নি।
এ বংশের এশীয় প্রতিষ্ঠাতা তানতাবোস তার কর্মজীবন শুরু করেন দেবতাদের বিরুদ্ধে এক সরাসরি আক্রমণের মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ বলেন তিনি দেবতাদের নরমাংস খাইয়ে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার পুত্র পেলোপসের মাংস দেবতাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। পেলোপস অলৌকিকভাবে প্রাণ ফিরে পেলে নিজের অকর্মটা সম্পন্ন করেন। তিনি পিসার রাজা অনৌমাওসের সঙ্গে রথচালনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন রাজার রথচালক মারটিলিসের পরোক্ষ সহায়তায়। পেলোপস মারটিলিসকে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে রথচালক মারটিলিস যদি তাকে সহায়তা করেন তাহলে তিনি তাকে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু পেলোপস প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবার পর মারটিলিসকে পুরস্কার না দিয়ে বরং সাগরে নিক্ষেপ করেন। এরপর এর অভিশাপ পুরুষান্তরে বর্ষিত হয় তার পুত্র আট্রেয়াস আর থায়েস্টেসের ওপর। গ্রিক ভাষায় সে অভিশাপের নাম ate, যার অর্থ অপরাধের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। থায়েস্টেস তার ভাইয়ের স্ত্রীকে প্ররোচিত করে পরিবারের ভাগ্য চুরি করতে সক্ষম হয়। সেই ভাগ্য হলো সেই বিখ্যাত সোনালি পশমের ভেড়া। আর আট্রেয়াস সে জন্য তার ভাইয়ের নির্বাসনের ব্যবস্থা পাকাঁপোক্ত করে, তারপর তার সঙ্গে মিটমাট করার অজুহাতে ফিরিয়ে আনে এবং তার নিজেরই ছেলেমেয়েদের মাংস তাকে খাওয়ায়। তারপর এই অভিশাপের উত্তরাধিকারী হয় আট্রেয়াসের পুত্র আগামেনন। আগামেনন এক ধর্মের পাঁঠা হরিণ হত্যা করে আরটেমিসকে প্রতারিত করে, দেবীকে তুষ্ট করার জন্য নিজের কন্যা এফিজেনিয়াকে বলি দেয় ও তার নৌবহরের জন্য ট্রয়ে যাওয়ার একটি নিরাপদ রাস্তা পেয়ে যায় এবং পরিশেষে তার অবিশ্বস্ত স্ত্রী ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও তার প্রেমিক আইগিস্থসের হাতে খুন হয়। আইগিস্থস থায়েস্টেসের একজন বেঁচে যাওয়া পুত্র। আগামেননের পুত্র অরেস্টেস পরিণামে পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয় তার মা ও মায়ের প্রেমিক আইগিসকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।
পূর্ণাঙ্গ একটি অর্জন হিসেবে হোমার ছিলেন আয়োনিয়ার ফসল, অর্থাৎ হেলেনিক এশিয়া মাইনর ও তার পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোর। হোমারের কবিতাগুলো বর্তমান রূপে স্থিতি লাভ করে খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে। গ্রিক বিজ্ঞান, দর্শন এবং গণিতও শুরু হয় ওই শতাব্দীতেই। একই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন অনেক ঘটনা ঘটছিল। কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, জরআস্তর (জরথুস্ত্র)-যদি তাদের অস্তিত্ব সত্য হয়ে থাকে-সম্ভবত এই শতাব্দীরই মানুষ ছিলেন। কেউ কেউ বলেন ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সম্রাট সাইরুস পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, আর সে শতাব্দীর শেষের দিকে আয়োনিয়ার গ্রিক নগরীগুলো, যাদেরকে পারসিকরা একটি সীমিত স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দিয়েছিল, তারা একটি অসফল বিদ্রোহ করে। দারিউস সেই বিদ্রোহ দমন করেন আর সেসব গ্রিক নগরীর সেরা সেরা লোকজন নির্বাসিত হয়। এই যুগের কয়েকজন দার্শনিক ছিলেন উদ্বাস্তু। হেলেনিক জগতের তখন পর্যন্ত মুক্ত এক নগরী থেকে অন্য নগরীতে তারা ঘুরে বেড়াতেন। আর তখন পর্যন্ত যে সংস্কৃতি আয়োনিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা তারা অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেন। যেসব জায়গায় তারা ঘুরে বেড়াতেন সেখানে সদয় আচরণ পেতেন। জেনোফেন, যিনি খ্যাতি লাভ করেন ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে, তিনি ছিলেন উদ্বাস্তু দার্শনিকদের অন্যতম। তিনি বলেন, এটা এমন একটি ব্যাপার ছিল যাকে বলতে হয় শীতকালে আগুনের পাশে উত্তম খাদ্য গ্রহণের পর মিষ্টি সুরা পান করতে করতে নরম গদিতে শুয়ে হলুদ মটর দানা চিবানো : কোন দেশ থেকে এসেছেন, কত বয়স আপনার, জনাব? যখন মিডির আবির্ভাব ঘটেছিল, তখনই বা কত বয়স ছিল আপনার…? সালামিস আর প্লটেয়ার যুদ্ধে গ্রিসের অবশিষ্ট অংশ স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ দুই যুদ্ধের পর আয়োনিয়া কিছু সময়ের জন্য মুক্ত হয়েছিল।
অনেক ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল গ্রিস। একটি করে নগরী আর সেটিকে ঘিরে কিছু কৃষি-অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্রগুলো গঠিত ছিল। গ্রিক দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে সভ্যতার স্তর খুবই ভিন্ন ভিন্ন রকমের ছিল। শুধু অল্পসংখ্যক নগরীই পুরো হেলেনিক সিদ্ধিতে অবদান রাখতে পেরেছিল। স্পার্টা, যার সম্পর্কে পরে আমার অনেক কিছু বলার থাকবে, গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়। করিন্থ ছিল ধনী ও সমৃদ্ধিশালী। সেটা ছিল এক বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্র, কিন্তু বড় বড় ব্যক্তিত্বের মানুষ করিন্থে খুব বেশি ছিল না। তারপর ছিল খাঁটি কৃষিজীবী গ্রামীণ সম্প্রদায়, প্রবাদতুল্য আর্কেডিয়ার মতো নগরীর লোকেরা আর্কেডিয়াকে স্বপ্নসুখাচ্ছন্ন, শান্ত সমাহিত একটি স্থান বলে কল্পনা করত। কিন্তু আর্কেডিয়া আসলে ছিল প্রাচীন বর্বরতাপূর্ণ, বিভীষিকায় পরিপূর্ণ একটি জায়গা।
অধিবাসীরা হারমেস এবং পান-এর উপাসনা করত। তাদের মধ্যে উর্বরতা-পূজার অজস্র রকমফের ছিল। এসব উপাসনায় প্রায়ই একটি চৌকোনা খুঁটি দেবতার মূর্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কৃষকরা এত দরিদ্র ছিল যে তারা ষাড়ের মালিক হতে পারত না, তাই ছাগী ছিল তাদের কাছে উর্বরতার প্রতীক। যখন খাদ্যদ্রব্য খুব দুর্লভ হয়ে উঠত তখন পান-এর মূর্তিকে পেটানো হতো। (চীন দেশের কোনো কোনো প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে একই ধরনের রীতি এখনো প্রচলিত আছে।) কথিত ওয়্যার-উলফদের একটি পোত্র ছিল, যারা সম্ভবত নরবলি দিত এবং স্বজাতি মাংস ভক্ষণ করত। মনে করা হতো যে, কেউ যদি বলি-দেওয়া মানুষের মাংসের স্বাদ গ্রহণ করে তাহলে সে ওয়্যার-উলফ বনে যায়। নেকড়ে-জিউসের একটি পবিত্র গুহা ছিল; সে-গুহার ভেতরে কারোর ছায়া সৃষ্টি হতো না। আর যে সেই গুহায় প্রবেশ করত, এক বছরের মধ্যেই তার মৃত্যু হতো। ধ্রুপদী যুগেও এইসব কুসংস্কার সক্রিয়ভাবে প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ বলেন, দেবতা পান-এর প্রকৃত নাম ছিল পাওন (Paon)। শব্দটির অর্থ যে খাওয়ায় বা রাখাল। পারস্য যুদ্ধের পর খ্রি.পূ. পঞ্চম শতকে এথেন্সের লোকেরা যখন পান বা পাওনের উপাসনার রীতি গ্রহণ করে নেয়, তখন তার আরেকটি উপাধি অর্জিত হয়, যা আরো বেশি পরিচিত। সেটার ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় All-God, বাংলায় সর্বেশ্বর।
ধর্ম শব্দটি আমরা যেভাবে বুঝি তার অনেকটাই প্রাচীন গ্রিসে ছিল বলে মনে হয়। এটা অলিম্পীয়দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, ছিল ডায়োনিসাস বা বাক্কাসের সঙ্গে। বাক্কাস বা ডায়োনিসাস সম্পর্কে আমাদের খুব স্বাভাবিক ধারণা যে, তিনি মদ এবং মাতলামির এক কুখ্যাত দেবতা। তার উপাসনা থেকে এক গভীর মরমিবাদের সৃষ্টি হয়েছে, সেই মরমিবাদ অনেক দার্শনিকের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে, এমনকি খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের রূপায়ণের মধ্যেও এর একটি অংশ রয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটেছে তা বেশ লক্ষণীয় এবং যিনি গ্রিক চিন্তার বিকাশ অধ্যয়ন করার ইচ্ছা রাখেন তাকে অবশ্যই তা বুঝতে হবে।
ডায়োনিসাস বা বাক্কাস ছিলেন মূলত একজন গ্রেসীয় দেবতা। থ্রেসীয়রা গ্রিকদের চেয়ে অনেক কম সভ্য ছিল, গ্রিকরা তাদেরকে বর্বর মনে করত। সব আদিম কৃষিজীবীদের মতো গ্রেসীয়দেরও উর্বরতা-পূজা করার ধর্ম ছিল এবং তাদের একজন দেবতা ছিলেন যিনি উর্বরতা যোগাতেন। তার নাম ছিল বাক্কাস। বাক্কাসের আকার মানুষের মতো ছিল, না ষাঁড়ের মতো ছিল তা কখনোই জানা যায়নি। থ্রেসীয়রা যখন বিয়ার তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করে তখন তারা মাদকতাকে স্বর্গীয় ব্যাপার মনে করত এবং বাক্কাসকে ভক্তি করত। পরে, যখন তারা আঙুরলতার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং মদপান শেখে, তখন বাক্কাসের প্রতি তারা আরো ভালো ধারণা পোষণ করতে থাকে। সাধারণভাবে উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যে কাজ বাক্কাস করতেন সেটার চেয়ে আঙুর উৎপাদন আর মদ-সৃষ্ট স্বর্গীয় উন্মাদনা সৃষ্টির কাজ তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব লাভ করে।
বাক্কাস-পূজা কখন থ্রেস থেকে গ্রিসে চলে আসে তা জানা যায়নি। তবে মনে হয়, সেটা ঘটেছিল ঐতিহাসিক যুগ শুরু হবার ঠিক প্রাক্কালে। গ্রিসের গোড়া ধার্মিকরা বাক্কাস-পূজার প্রতি ছিল বিরূপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাক্কাস উপাসনায় অনেক বর্বর উপাদান ছিল। যেমন-বন্য পশুকে টুকরো টুকরো করে কেটে পুরোটাই কাঁচা খাওয়া হতো। বাক্কাস-পূজার মধ্যে নারীবাদের একটি কৌতূহলোদ্দীপক উপাদান ছিল। বয়স্কা মহিলারা এবং অবিবাহিত তরুণীরা বড় বড় দল বেঁধে উন্মুক্ত পাহাড়ে সারা রাত নৃত্য করত, এই নৃত্য তাদের মনে আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভের তীব্র অনুভূতি জাগাত। তাদের এই অনুভূতি ছিল প্রধানত আধ্যাত্মিক এবং অংশত মদপানজনিত। এই রীতি তাদের স্বামীদের অসন্তুষ্ট করত, কিন্তু তাদের স্বামীরা ধর্মের বিরোধিতা করার সাহস পেত না। ধর্মীয় উপাসনার এই রীতির সৌন্দর্য ও বর্বরতা বর্ণিত হয়েছে ইউরিপাইডিসের Bacchae শীর্ষক রচনায়।
গ্রিসে ডায়োনিসাস-পূজার সিদ্ধিতে অবাক হবার কিছু নেই। দ্রুত সভ্যতা অর্জনকারী সব সম্প্রদায়ের মতোই গ্রিকদের বা অন্তত তাদের কিছু অংশের মধ্যে আদিম-এর প্রতি একধরনের অনুরাগ গড়ে উঠেছিল। সমকালীন বা প্রচলিত নৈতিকতা দ্বারা বেঁধে-দেওয়া জীবনের চেয়ে তাদের বেশি ঝোঁক ছিল প্রবৃত্তিতাড়িত, প্রবল আবেগপ্রবণ জীবন-পদ্ধতির প্রতি। যে নারী বা যে পুরুষ অনুভূতির টানে নয়, নেহায়েত প্রচলিত আচার-ব্যবহারের দায়ে সভ্য হতে বাধ্য হয়েছে, তার কাছে যৌক্তিকতা বা বুদ্ধি-বিবেচনা বিরক্তিকর। সদগুণকে সে মনে করত একটি বোঝা, দাসত্ব। এ থেকে তার প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিই আমাদের আলোচনায় বিশেষ স্থান পাবে। তবে প্রথমে অনুভূতি ও আচরণের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবশ্যই কিছু বলে নেওয়া প্রয়োজন।
অসভ্য মানুষ থেকে সভ্য মানুষকে যা পৃথক করে তা হলো মূলত পরিণামদর্শিতা বা দূরদর্শিতা, অথবা আরেকটু বিশদভাবে বললে, পূর্বচিন্তা। ভবিষ্যতের সুখ বা আনন্দের খাতিরে সে বর্তমানের কষ্ট সহ্য করতে রাজি, যদি সেই ভবিষ্যৎ-সুখ অনেক দূরবর্তীও হয়। এই অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে কৃষির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী শীতকালে খাদ্য পাবার জন্য কোনো পশু বা বর্বর মানুষ বসন্তকালে কাজ করে না। শুধু মৌমাছির মধুসগ্রহ আর কাঠবিড়ালীদের বাদাম লুকিয়ে রাখার মতো খাঁটি প্রবৃত্তিগত কাজগুলোই এর ব্যতিক্রম। এসব ক্ষেত্রে কোনো পূর্বচিন্তা কাজ করে না। মানুষের ক্ষেত্রে কেবল সে রকম কাজের প্রতিই একটি প্রত্যক্ষ প্রণোদনা থাকে যে কাজ পরবর্তী সময়ে উপকারী বা ফলদায়ী প্রমাণিত হয়। সত্যিকারের পূর্বচিন্তা কেবল তখনই উদ্রেক হয় যখন একজন মানুষ প্রবৃত্তিগত প্রণোদনা ছাড়াই একটি কিছু করে, কারণ বুদ্ধি তাকে বলে দেয় যে ভবিষ্যতে কোনো একসময়ে এই কাজের কিছু সুফল সে পাবে। শিকারে কোনো পূর্বচিন্তার প্রয়োজন হয় না, কারণ তা আনন্দদায়ক। কিন্তু ভূমিকৰ্ষণ খাটুনির কাজ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনা থেকে তা করা যায় না।
সভ্যতা প্রণোদনাকে নিয়ন্ত্রণ করে কেবল পূর্বচিন্তার দ্বারাই নয়, যে পূর্বচিন্তা একধরনের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ। আইন, সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রণোদনা। সভ্যতা প্রণোদনার নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে বর্বরতা থেকেই, তবে সেই নিয়ন্ত্রণে প্রবৃত্তির ভূমিকা ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে, শৃঙ্খলা ও নিয়মের ভূমিকা বেড়েছে। কিছু কিছু কাজ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং সেগুলো সম্পাদনের দায়ে শাস্তির বিধান হয়েছে। আর কিছু কিছু কাজ আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক না হলেও দুষ্টকর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যারা এসব দুষ্টকর্ম করে সমাজ তাদের ভালো বলে না, প্রত্যাখ্যান করে।
সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আসে নারীদের অধীনস্ত করার রীতি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি দাস শ্রেণির উৎপত্তি ঘটে। একদিকে সম্প্রদায়ের অভীষ্টগুলো ব্যক্তির ওপর আরোপিত হওয়ায়, অন্যদিকে নিজের জীবনকে পুরো সম্প্রদায়ের জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে দেখার অভ্যাস অর্জন করায় সে আরো বেশি করে তার বর্তমানকে ভবিষ্যতের জন্য উৎসর্গ করতে থাকে। এটা বেশ পরিষ্কার যে, এই প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত চলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন কঞ্জুস ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। কিন্তু সে রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে না গিয়েও দূরদর্শিতার কারণে জীবনের অনেক শ্রেষ্ঠ জিনিস হারাতে হতে পারে। ডায়োনিসাসের উপাসক দূরদর্শিতার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে। দূরদর্শিতা মানুষের অনুভূতির যে তীব্রতা নষ্ট করে দেয়, শারীরিক বা আধ্যাত্মিক নেশাগ্রস্ততার মধ্যে তা ফিরে পাওয়া যায়। নেশাগ্রস্ত হয়ে মানুষ জগৎকে আনন্দে আর সৌন্দর্যে ভরপুররূপে দেখতে পায় এবং প্রাত্যহিক চিন্তাকুলতার কারাগার থেকে তার কল্পনা হঠাৎ মুক্তি লাভ করে। যাকে উৎসাহ বা উদ্দীপনা বলা হতো, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পূজারি বা উপাসকের ভেতরে ঈশ্বরের প্রবিষ্ট হওয়া, বাক্কাসের আচার অনুষ্ঠানগুলো সেই উদ্দীপনা সৃষ্টি করত। ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে পেয়ে পূজারি মনে করত সে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। মানবসভ্যতার অর্জনগুলোর মধ্যে যেগুলো শ্রেষ্ঠ তার অধিকাংশের সঙ্গে নেশাগ্রস্ততার কিছু উপাদান জড়িত (আমি বলতে চাই, মানসিক নেশাগ্রস্ততা, অ্যালকোহল-সৃষ্ট নেশাগ্রস্ততা নয়), আবেগ দ্বারা নেশাগ্রস্ততাকে খানিকটা হটিয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। বাক্কাসীয় উপাদান ছাড়া জীবন হয়ে পড়ত নিরানন্দ; আবার এইসব উপাদানপূর্ণ জীবন বিপজ্জনক। দূরদর্শিতা বনাম আবেগ-এমন একটি দ্বন্দ্ব যা ইতিহাসজুড়ে চলে আসছে। তবে এটা এমন কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নয়, যাতে আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে।
চিন্তার জগতে সংযমী বা মিতাচারী সভ্যতা মোটামুটি বিজ্ঞানের সমার্থক। কিন্তু নির্ভেজাল, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান মানুষকে পরিতুষ্ট করতে পারে না। মানুষের আবেগ, শিল্পকলা এবং ধর্মও প্রয়োজন। বিজ্ঞান জ্ঞানের সীমারেখা টেনে দিতে পারে, কিন্তু কল্পনার সীমা টানা বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। পরবর্তীকালের দার্শনিকদের কারো কারো মতো গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন প্রাথমিকভাবে বৈজ্ঞানিক, কেউ কেউ প্রাথমিকভাবে ধার্মিক। পরবর্তীরা, অর্থাৎ ধর্মপ্রবণ দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাক্কাসের ধর্মের কাছে বেশ ঋণী। এটা বিশেষভাবে প্লেটোর ক্ষেত্রে এবং তার মাধ্যমে সংঘটিত পরবর্তী বিকাশগুলো-যা শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে সঞ্চারিত হয়েছে-সেসবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ডায়োনিসাস-পূজার আদি রূপটি ছিল বর্বর এবং নানাভাবে বিকর্ষক ও বীভৎস। সেই আদি রূপ যে দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়, বরং অর্ফিয়ুস কর্তৃক আরোপিত এর আধ্যাত্মিক রূপটির দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল আত্মনিরোধী, কৃচ্ছ্ববাদী এবং শারীরিক নেশাগ্রস্ততার পরিবর্তে মানসিক নেশাগ্রস্ততা। অর্ফিয়ুস একটি অনুজ্জ্বল কিন্তু আগ্রহব্যঞ্জক চরিত্র। কেউ কেউ মনে করেন তিনি একজন বাস্তব মানুষ ছিলেন, আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি ছিলেন একজন দেবতা, বা একজন কাল্পনিক বীর। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, তিনিও বাক্কাসের মতো থ্রেস থেকে আগত। কিন্তু তিনি (বা তার নামের সঙ্গে জড়িত ধারাটি) ক্রিটি দ্বীপের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অর্ফিক মতবাদগুলোর মধ্যে অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর প্রাথমিক উৎস মিসরীয় বলে মনে হয় এবং এটা নিশ্চিত যে, মিসর গ্রিসের ওপর প্রভাব ফেলেছিল প্রধানত ক্রিটির মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে অর্ফিয়ুস ছিলেন একজন সংস্কারক, যাকে টুকরো টুকরো করে কেটেছিল বাক্কাসের গোড়া উপাসক মায়েনাড়রা। পৌরাণিক উপকথার প্রাচীন ভাষ্যগুলোতে সঙ্গীতের প্রতি অর্ফিয়ুসের আসক্তির কথা ততটা সুবিদিত ছিল না, যতটা হয়েছে পরবর্তীকালে। প্রাথমিকভাবে তিনি ছিলেন একজন পুরোহিত ও দার্শনিক। অর্ফিয়ুসের শিক্ষা (যদি আসলেই এ কথা সত্য হয় যে বাস্তবে তার। অস্তিত্ব ছিল) যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, অর্ফিয়ুসবাদীদের শিক্ষা কিন্তু বেশ পরিচিত। তারা ছিলেন আত্মার দেহান্তরে বিশ্বাসী। তারা এই শিক্ষা দিতেন যে, পৃথিবীতে মানুষের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে মৃত্যুর পর তার আত্মার অনাদি আনন্দ লাভ করতে পারে অথবা চিরন্তন বা সাময়িক নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ বা পবিত্র হওয়া। সেটা তারা করার চেষ্টা করতেন অংশত শুদ্ধিকরণ কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে, অংশত দূষণীয় কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করার মাধ্যমে। তাদের মধ্যে যারা ছিলেন সবচেয়ে কট্টর তারা কোনো প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করতেন না। তবে ধর্মীয় আচার ও সংস্কারবশত তারা তা খেতেন শুধু কিছু কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। তারা মনে করতেন মানুষের কিছু অংশ পার্থিব আর কিছু অংশ স্বর্গীয়। শুদ্ধ জীবনযাপনের ফলে স্বর্গীয় অংশটি বৃদ্ধি পায় আর পার্থিব অংশটি লোপ পায়। এভাবে শুদ্ধ জীবনযাপন করতে করতে পরিশেষে একজন মানুষ বাক্কাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং তখন তাকে একজন বাক্কাস বলে অভিহিত করা হয়। একটি বিশদ ধর্মতত্ত্ব ছিল, যা অনুসারে বাক্কাসের জন্ম হয়েছিল দুইবার। একবার তার মাতা সিমিলি থেকে, আরেকবার তার পিতা জিউসের ঊরু থেকে।
ডায়োনিসাস-পুরাণের অনেক রকম ভাষ্য আছে। সেগুলোর একটিতে বলা হয়, ডায়োনিসাস জিউস এবং পারসিফোনির পুত্র। যখন তিনি নিতান্ত বালক, তখন টাইটানরা তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং শুধু তার হৃৎপিণ্ড ছাড়া সব মাংস খেয়ে ফেলেছিল। কেউ কেউ বলে সেই হৃৎপিণ্ড জিউস দিয়েছিলেন সিমিলিকে। অন্যরা বলে জিউস নিজেই তা গলাধঃকরণ করেন। এ দুয়ের যেটাই ঘটে থাকুক না কেন, তা থেকেই ডায়োনিসাসের দ্বিতীয় জন্ম ঘটে। মনে করা হয়, বাক্কাসের উপাসকরা বন্য পশুদের টুকরো টুকরো করে কেটে কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত টাইটানদের হাতে ডায়োনিসাসের টুকরো টুকরো হবার সেই ঘটনা উদযাপনের জন্য। এক অর্থে সেই বন্য পশুকে দেবতার প্রতিমূর্তি মনে করা হতো। টাইটানদের জন্ম পৃথিবীতে, কিন্তু দেবতাকে ভক্ষণ করার ফলে তাদের মধ্যে স্বর্গীয় দ্যুতি আসে। সে জন্যই মনে করা হতো মানুষ অংশত পার্থিব, অংশত স্বর্গীয় এবং বাক্কাসীয় কৃত্যানুষ্ঠানগুলোতে মানুষকে প্রায়-সম্পূর্ণরূপে স্বর্গীয় করে তোলার চেষ্টা চলত।
একজন অর্ফিক পুরোহিতের মুখ দিয়ে ইউরিপাইডিস একটি স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করিয়েছেন, যা এ ব্যাপারে ইঙ্গিতবহ–
টায়ার বংশোদ্ভূত প্রভু ইউরোপার,
জিউস-জাত, পদতলে তোমার।
ক্রিটির শত নগরী,
সেই নিস্প্রভ সমাধি থেকে খুঁজছি তোমাকে।
সমাধির ছাদ বাঁকানো আর খোদাই-করা কড়ির,
শ্যালিব-ইস্পাত আর বুনো ষাঁড়ের শোণিতে
সাইপ্রেস কাঠের নিখুঁত জোড়ে সুদৃঢ়। এক বিশুদ্ধ স্রোতধারায়
আমার দিন গেল। সেবক আমি
ঈদীয় জোভের শাগরেদ,
যেখানে মধ্যরাতে বিহার করে জাগ্রেউস, বিহার করি আমি
আমি সয়েছি তার বজ্রচিৎকার;
পূর্ণ করে লোহিত রক্তাক্ত ভোজ
ধারণ করে মহামাতার পর্বতাগ্নি
আমি হয়েছি মুক্ত, অভিধা পেয়েছি
একজন বাক্কাস বর্মাচ্ছাদিত পুরোহিতদের।
শুভ্র বিশুদ্ধ পোশাকে নিজেকে করেছি অমল
মনুষ্যজন্মের কালিমা আর শবাধারের কাদা থেকে,
আর চিরতরে নির্বাসিত করেছি আমার ওষ্ঠ থেকে
সব মাংসের স্পর্শ, যেখানে জীবন ছিল।
বিভিন্ন সমাধিতে কিছু অফিক ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। পরজীবনে পথ খুঁজে পেতে হলে কী করতে হবে, নিজেকে পরিত্রাণের উপযুক্ত প্রমাণ করার জন্য কী বলতে হবে। ইত্যাদি সম্বন্ধে মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে নির্দেশনা লেখা রয়েছে সেসব ফলকে। ফলকগুলো ভাঙা এবং অসম্পূর্ণ, সেগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সম্পূর্ণ (প্যাটেলিয়া ফলক), তাতে এ রকম কথাবার্তা লেখা রয়েছে–
হাডেস ভবনের বাম পাশে তুমি একটি ঝরনা-কূপ দেখতে পাবে,
তার পার্শ্বে এক শ্বেত সাইপ্রাসবৃক্ষ দণ্ডায়মান।
ঝরনা-কূপটির নিকটবর্তী হয়ো না।
আরো একটি ঝরনা-কূপ দেখতে পাবে স্মৃতি হ্রদের পাশে,
সেখান থেকে শীতল পানি নির্গত হচ্ছে, তার সম্মুখে প্রহরীরা আছে।
তুমি বলো : মর্ত্য ও তারকাময় স্বর্গের এক সন্তান আমি;
কিন্তু আমার বংশ (শুধুই) স্বর্গের। তোমরা নিজেরাই তা জানো।
আর দেখো, তৃষ্ণায় আমি কাতর ও মৃত্যুপথযাত্রী। শিগগির আমাকে স্মৃতি-হ্রদ থেকে প্রবাহিত শীতল পানি এনে দাও।
তখন তারা নিজেরাই তোমাকে সেই পবিত্র ঝরনা-কূপ থেকে পানি পান করতে দেবে,
অতঃপর অপরাপর বীরদের মধ্যে তুমি কর্তৃত্ব লাভ করবে…।
অন্য একটি ফলকে লেখা রয়েছে : স্বাগতম, তোমরা যারা যন্ত্রণা সয়েছ…তোমরা মানুষের উর্ধ্বে উঠে দেবতা হয়েছ। আরো একটি ফুলকে বলা হচ্ছে : সুখী আর আশীর্বাদধন্যরা শোনো, তোমরা নশ্বর না হয়ে দেবতা হবে।
মৃতের আত্মাকে যে ঝরনা-কূপ থেকে পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছে সেটি লিথি (Lethe) বা বিস্মৃতি আনে। অন্য ঝরনা-কূপটি মেমোসাইনি (Mnemosyne), এর অর্থ স্মরণ বা স্মৃতি। পরলোকে আত্মাকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিস্মৃত হওয়া চলবে না, বরং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্মৃতিশক্তি অর্জন করতে হবে।
অর্ফিকরা ছিল এক আত্মনিরোধী, কৃছুবাদী গোষ্ঠী। মদ তাদের কাছে ছিল একটি প্রতীকমাত্র, যেমনটি পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় সংস্কারে হয়েছে। তারা যে মাদকতা কামনা করত তা ছিল উদ্দীপনার মাদকতা, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের মাদকতা। তাদের বিশ্বাস ছিল সাধারণ উপায়ে যে মরমি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়, এই উপায়ে তা লাভ করা সম্ভব। গ্রিক দর্শনে এই মরমিবাদী উপাদান প্রবেশ করেছে পিথাগোরাসের হাত ধরে, যিনি ছিলেন অফিজিমের একজন সংস্কারক, যেমনটি অর্ফিয়ুস ছিলেন ডায়োনিসাসের ধর্মের একজন সংস্কারক। পিথাগোরাস থেকে অর্ফিক উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। প্লেটোর দর্শনে আর প্লেটো থেকে তা প্রবেশ করেছে পরবর্তীকালের যেসব দর্শন কিছু না কিছু মাত্রায় ধর্মীয় ছিল সেসবের অধিকাংশতে।
যেখানেই অফিজিমের প্রভাব ছিল সেখানেই বাক্কাসীয় উপাদানগুলো নিশ্চিতভাবে ছিল। সেগুলোর একটি ছিল নারীবাদ, পিথাগোরাসে নারীবাদের উপাদান ছিল যথেষ্ট পরিমাণে এবং প্লেটোতে নারীবাদ এত পরিমাণে ছিল যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সম্পূর্ণ সম-অধিকার দাবি করেছিলেন। পিথাগোরাস বলেন, লিঙ্গ হিসেবে নারী প্রকৃতিগতভাবে অধিকতর পবিত্র। বাক্কাসীয় উপাদানগুলোর আরেকটি ছিল তীব্র আবেগের প্রতি অনুরাগ। গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর জন্ম হয়েছে ডায়োনিসাসের আচার অনুষ্ঠানাদি থেকে। বিশেষত, ইউরিপাইডিস অর্ফিজিমের দুই প্রধান দেবতাকে ভক্তি করতেন। তারা হলেন ডায়োনিসাস ও এবোস। শীতল, আপনভোলা, শান্ত স্বভাবী, সদাচারী ব্যক্তির জন্য তার কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। তার ট্র্যাজেডিগুলোতে দেখা যায়, এই ধরনের চরিত্রগুলো পাগল হয়ে যায়, অথবা কোনো না কোনোভাবে অধর্মাচারের শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর তাদেরকে দুঃখ-যন্ত্রণায় ফেলেন।
গ্রিকদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, তারা প্রশংসনীয় রকমের সৌম্য-শান্ত, তারা আবেগের বশবর্তী না হয়ে আবেগ সম্পর্কে চিন্তা করতে পারত এবং আবেগের মধ্যকার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারত, কিন্তু নিজেরা ছিল শান্ত ও অলিম্পীয় মেজাজের। এটি খুবই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। সম্ভবত হোমার, সফোক্লিস এবং অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে, কিন্তু এটা সেইসব গ্রিকের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সত্য নয় যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাক্কাসীয় বা অর্ফিক উপাদানগুলো দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এলিউসিসে, যেখানে এথেনীয় রাষ্ট্রধর্মের সবচেয়ে ঐশ্বরিক অংশ গঠিত হয়েছিল এলিউসীয় গুহ্যাচার থেকে, সেখানে একটি স্তোত্র গাওয়া হতো, যার বাণীগুলো এ রকম–
উচ্চে দুলিয়ে সুরাপাত্র তোমার,
উন্মত্ত উল্লাসে
এলিউসিসের পুষ্পময় উপত্যকায়
এসো হে-বাক্কাস, পিয়ান, স্বাগতম।
ইউরিপাইডিসের বাককেতে মায়েনাদের কোরাসে কাব্য ও বর্বরতার সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়, যা কিনা শান্ত স্বভাবের একেবারেই বিপরীত। তারা একটি বন্য পশুকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে সেখানেই, তখনই, একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলে–
যখন পবিত্র ছাগশিশুর চামড়া লেগে থাকে
আর সবকিছুই ভেসে যায় উড়ে যায়
তখন ছোটার ক্লান্তিতে বেহুশ হয়ে পড়া
কী আনন্দ কী আনন্দ তখন পাহাড়ে
স্রোতস্বিনী রক্তপ্রবাহের আনন্দে
ছিঁড়ে ফেলা পাহাড়ি ছাগলের রক্তে
বন্য পশুর ভয়ঙ্কর ক্ষুধার গৌরবে
যেখানে পাহাড়ের চূড়া ধরে ফেলে দিনকে
সেই ফ্রিজিয়ান আর লিডিয়ান পাহাড়ে পাহাড়ে
হে ব্রোমিওস, পথ দেখাও।
পর্বতচূড়ায় মায়েডদের নৃত্য কেবল উন্মত্তই ছিল না, তা ছিল সভ্যতার বোঝা আর দায়িত্ব-কর্তব্য-যত্ন-সতর্কতা থেকে অমানবিক সৌন্দর্যের জগতে, হাওয়া আর তারকাদের মুক্ত জগতে পলায়নস্বরূপ। অপেক্ষাকৃত কম উত্তেজনার মেজাজে তারা একটি গান গাইত–
তারা কি আবার আসবে আমার কাছে, আবার কখনো
সেই সব দীর্ঘ, দীর্ঘ নৃত্য?
যে-সব নৃত্য চলত সারা রাত ধরে, অনুজ্জ্বল তারাগুলো মিলিয়ে না যাওয়া অবধি?
কণ্ঠে কি আমি শিশিরের স্পর্শ পাব? চুলে লাগবে হাওয়ার পরশ?
নিষ্প্রভ প্রান্তরে আমাদের শুভ্র পদরাজি কি দ্যুতিময় দেখাবে?
হরিণশাবকের পাগুলো হারিয়ে গেছে হায়! সবুজ বনে,
একাকী, ঘাসে আর সৌন্দর্যে
শিকারির শিকার হয়ে লাফাবে না আর, কোনো ভয় আর নেই তার।
আর তার ফাঁদে পড়ার ভয় নেই, নেই কোনো মারাত্মক চাপ।
একটি কণ্ঠস্বর তবুও ভেসে আসে,
একটি কণ্ঠস্বর, একটি ভয়, ডালকুত্তাদের ছুট,
ওহ্ জান্তব শ্রম, দুর্ধর্ষ ক্ষিপ্রতা,
নদী আর উপত্যকা বেয়ে ধেয়ে চলা
হে ঝাক্ষিপ্র পদযুগল, এ কি হর্ষ, না আতঙ্ক?
মানুষের উৎপাতহীন, নির্জন, প্রিয় এই দেশে,
যেখানে ধ্বনিত হয় না কোনো কণ্ঠ, ছায়াচ্ছন্ন সবুজের মাঝে
বনভূমির ছোট ছোট জীব বাস করে অলক্ষ্যে।
গ্রিকরা সৌম্য-শান্ত ছিল এই কথাটির পুনরাবৃত্তি করার আগে ইউজিন ওনিলের একটি নাটকে ফিলাডেলফিয়ার ম্যাট্রনদের এ রকম আচরণের কথা ভেবে দেখার চেষ্টা করুন। ডায়োনিসাসের আদি উপাসকদের চেয়ে অর্ফিকরা কোনোভাবেই বেশি শান্তশিষ্ট নয়। একজন অর্ষিকের কাছে এ জগতে জীবন হচ্ছে যন্ত্রণা, ক্লান্তি আর একঘেয়েমি। তাদের মতে, আমরা এমন এক চক্রে বাঁধা যা জন্ম আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীনভাবে ঘুরে চলেছে। আমাদের সত্যিকারের জীবন স্বর্গে, কিন্তু আমরা বাঁধা পড়ে আছি পৃথিবীর মাটির সঙ্গে। শুদ্ধি, ত্যাগ আর কৃচ্ছসাধনাপূর্ণ জীবনযাপনের দ্বারাই কেবল আমরা সেই চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং পরিশেষে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের পরমানন্দ লাভ করতে পারি। যেসব মানুষের কাছে জীবন সহজ ও আনন্দদায়ক এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এটা অনেকটাই সেই নিগ্রো ধর্মসঙ্গীতের মতো, যেখানে বলা হয়–
যখন আমি ঘরে পৌঁছুব
তখন আমার সব সমস্যার কথা ঈশ্বরকে বলব।
গ্রিকদের সবাই নয়, কিন্তু তাদের এক বিরাট অংশ ছিল তীব্র আবেগপ্রবণ, অসুখী। তাদের মধ্যে ছিল যুক্তিবুদ্ধি আর আবেগের লড়াই। তাদের মধ্যে স্বর্গের কল্পনা আর নরক সম্পর্কে সচেতন আত্মপ্রত্যয়ের দ্বন্ধ ছিল। তাদের একটি নীতিবাক্য ছিল, কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি কোরো না। কিন্তু বাস্তবে তাদের সব কিছুতেই ছিল বাড়াবাড়ি-বিশুদ্ধ চিন্তায়, কাব্যকলায়, ধর্মে এবং পাপকর্মে। যখন তাদের মধ্যে আবেগ আর যুক্তিবুদ্ধির মিলন ঘটেছে তখন তারা মহৎ সব কর্ম করাতে পেরেছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে তারা যেভাবে বদলে দিয়েছে, শুধু আবেগ বা শুধু যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তা করা কখনোই সম্ভব ছিল না। পুরাণে তাদের প্রত্নপ্রতিমা অলিম্পীয় জিউস নয়, বরং প্রেমিথিউস, যে স্বর্গ থেকে আগুন এনেছিল এবং তার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল চিরন্ত ন যন্ত্রণা।
সামগ্রিকভাবে গ্রিকদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের ব্যাপারে উপরে যা বলা হলো, অর্থাৎ, গ্রিকদের যে শান্তশিষ্ট বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, তা একটি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তুত গ্রিসে প্রবণতা ছিল দুটি। একটি আবেগ-প্রবণতা : ধর্মীয়, মরমি, পরজাগতিক প্রবণতা। আর অন্যটা হাসি-খুশি, অভিজ্ঞতাবাদী, যুক্তি ও বুদ্ধিবাদী এবং বিচিত্র রকমের ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী প্রবণতা। দ্বিতীয় প্রবণতাটি লক্ষ করা যায় হেরোডটাসের মধ্যে। একেবারে গোড়ার দিকের আয়োনীয় দার্শনিকদের মধ্যেও তা ছিল। একটি পর্যায় পর্যন্ত অ্যারিস্টটলও তাই। অফিজম বর্ণনা করার পর বেলক বলেছেন
ইহজগৎকে অস্বীকার করে বাস্তব জীবনকে পরকালে স্থানান্তরিত করার সর্বজনগ্রাহ্য যে-একটি বিশ্বাস ছিল তাকে অতিক্রম করার মতো যথেষ্ট যৌবনময় প্রাণশক্তির অধিকারী ছিল গ্রিক জাতি। তাই অর্ফিক মতবাদ সীমাবদ্ধ ছিল অজিমে দীক্ষিত একটি সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, রাষ্ট্রধর্মের ওপর তার প্রভাব ছিল না বললেই চলে। এমনকি এথেন্সের মতো স্থানের জনগোষ্ঠী, যারা তাদের রাষ্ট্রীয় ধর্মাচারে গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলো উদ্যাপনের রীতি গ্রহণ করেছিল এবং তাকে আইনগত সুরক্ষা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অর্ফিক মতবাদের প্রভাব ততটা ছিল না। অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের এক ধর্মতাত্ত্বিক পোশাকে তা গ্রিক জগতে বিজয় অর্জন করেছিল, কিন্তু তার জন্য পুরো এক হাজার বছর সময় লেগেছিল।
এই বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত মনে হয়, বিশেষ করে এলিউসীয় গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে, যেগুলো অর্ফিক মতবাদ দ্বারা পরিপূর্ণ। ব্যাপক অর্থে বললে, যাদের মেজাজ ও মনোভঙ্গি ছিল ধর্মীয় তারাই অফিঁজমের দিকে ঝুঁকেছে আর যুক্তিবাদীরা অৰ্কিজমকে ঘৃণা করেছে। ১৮ শতকের শেষ ও ১৯ শতকের শুরুর দিকের ইংল্যান্ডের মেথডিজম। বা পদ্ধতিবাদের সঙ্গে অজিমের মর্যাদার তুলনা করা যেতে পারে।
একজন গ্রিক তার পিতার কাছে কী শিক্ষা লাভ করত তা আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু একেবারে শৈশবের দিনগুলোতে একজন গ্রিক তার মায়ের কাছ থেকে কী ধরনের শিক্ষা লাভ করত তা সম্পর্কে আমরা জানি খুব অল্পই। পুরুষরা যে সভ্যতা থেকে আনন্দ লুটত, নারীরা তার আলো থেকে বেশ বঞ্চিত ছিল। এমন হতে পারে যে, শিক্ষিত এথেন্সবাসিরা, এমনকি তাদের সর্বোত্তম যুগেও, আচরণগত দিকে সচেতন মানসিক প্রক্রিয়ায় যত যুক্তিবাদীই হোক না কেন, ঐতিহ্যগতভাবে একেবারে শৈশব থেকেই চিন্তাপদ্ধতি ও অনুভবের এমন একটি আদিম ধরন তাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল যা সংকটময় মুহূর্তগুলোতে সর্বদাই জয়ী হয়েছে। এই কারণে গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কোনো সরল বিশ্লেষণ যথার্থ হবে বলে মনে হয় না।
সাম্প্রতিককালের আগে পর্যন্ত গ্রিক চিন্তায় ধর্মের, বিশেষ করে অন-অলিম্পীয় ধর্মের প্রভাব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। জন হ্যারিসনের প্রলেগোমেনা টু দি স্টাডি অব গ্রিক রিলিজিয়ন গ্রন্থে সাধারণ গ্রিকদের ধর্মে আদি ও ডায়োনিসাসীয় উপাদান, দুটোর কথাই জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এফএম কর্নফোর্ড-এর ফ্রম রিলিজিয়ন টু ফিলোসফি গ্রন্থে দার্শনিকদের ওপর ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে গ্রিক দর্শনের শিক্ষার্থীদের অবগত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অথবা তার নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলো সম্পূর্ণ আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করা যায় না। আমার জানা মতে, সবচেয়ে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে জন বার্নেটের আরলি গ্রিক স্টাডিজ গ্রন্থটিতে, বিশেষ করে বইটির বিজ্ঞান ও ধর্ম শীর্ষক অধ্যায়টিতে। বার্নেট বলেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে হেলাসজুড়ে যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সৃষ্টি হয় তা থেকে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে একটি বিরোধ দাঁড়িয়ে যায়; আয়োনিয়া থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে হতে পশ্চিমে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা ঘটতে থাকে। তিনি বলেন, উপমহাদেশীয় হেলাসের ধর্ম বিকশিত হয়েছে আর্জেনিয়ার ধর্মবিকাশের ধরন-প্রক্রিয়ার চেয়ে খুবই আলাদাভাবে। নির্দিষ্ট করে প্রেস থেকে আগত ডায়োনিসাস-পূজা, যার কথা হোমারে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত হয়েছে, তাতে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির বীজ ছিল। থ্রেসীয়রা নিজেরা কোনো উচ্চমানের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিল এ কথা বলা নিশ্চিতই ভুল হবে। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, গ্রিকদের আধ্যাত্মিক পরমানন্দের বিষয়টির অর্থ ছিল এই যে, আত্মা কেবল সত্তার একটি ক্ষীণ প্রতিরূপ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু এবং আত্মা যখন দেহের বাইরে যায়, কেবল তখনই তার প্রকৃত স্বরূপ দেখা যায়…।
মনে হয় গ্রিক ধর্ম যেন সেই পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল, প্রাচ্যের ধর্মগুলো ইতমধ্যে যে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের উত্থান ছাড়া আর কিসের দ্বারা সেই প্রবণতা প্রতিহত হয়েছিল তা দেখতে পাওয়া কঠিন। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রাচ্য ধরনের ধর্ম থেকে গ্রিকরা রক্ষা পেয়েছিল এই জন্য যে তাদের কোনো পুরোহিততন্ত্র ছিল না। কিন্তু এ রকম বলার অর্থ দাঁড়ায় কারণকে কার্য হিসেবে ধরে নেওয়া, অর্থাৎ এতে ভুল করা হয়। পুরোহিততন্ত্র অন্ধবিশ্বাস তৈরি করে না, যদিও ইতমধ্যে সৃষ্ট বা বিদ্যমান অন্ধবিশ্বাসকে তা জিইয়ে রাখে। কিন্তু বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে প্রাচ্যের জাতিগুলোর মধ্যে কোনো পুরোহিততন্ত্র সে অর্থে ছিল না। গ্রিসকে রক্ষা করেছে তার বৈজ্ঞানিক ধারাগুলো যতটা, পুরোহিততন্ত্রের অনুপস্থিতি ততটা নয়।
নতুন ধর্ম-যা এক বিবেচনায় নতুন, অন্য বিবেচনায় মানবজাতির মতোই পুরাতন-তার বিকাশের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে অফিক সম্প্রদায়গুলোর গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে। যত দূর দেখতে পাই, সে সম্প্রদায়গুলোর আদি নিবাস ছিল অ্যাটিকা, কিন্তু তারা অসাধারণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলিতে। তারা প্রথমত ছিল ডায়োনিসাসের উপাসক গোষ্ঠী, কিন্তু তারা আলাদা ছিল দুটি দিক থেকে, যা গ্রিক নাগরিকদের মধ্যে ছিল নতুন বিষয়। তাদের কাছে ধর্মীয় কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তারা সংগঠিত হয়েছিল কৃত্রিম সম্প্রদায় রূপে। যেসব কাব্যে তাদের ধর্মতত্ত্ব রয়েছে সেগুলোর উৎস অর্ফিয়ুস, এই অর্ফিয়ুস নিজে থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন হাডেস-এ এবং পরজগতে দেহ থেকে মুক্ত আত্মাকে ঘিরে যেসব ভয়ানক বিপদ-আপদ রয়েছে সেসব অতিক্রম করে যাবার পথে তিনি এক নিরাপদ দিগনির্দেশক।
বার্নেট আরো বলছেন, অর্ফিক ধর্মবিশ্বাসগুলোর সঙ্গে প্রায় একই সময়কার ভারতে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলোর একটি চমৎকার সাদৃশ্য আছে; যদিও তিনি মনে করেন যে, তখন এ দুই দেশের মধ্যে কোনো যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। এরপর তিনি orgy বা উদ্দাম পানভোজনোৎসব শব্দটির মূল অর্থের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। অর্ফিকরা এই শব্দটিকে ধর্মদীক্ষার অনুষ্ঠান বোঝাতে ব্যবহার করত। এই উপায়ে তারা বিশ্বাসীর আত্মাকে শুদ্ধ করত এবং জন্মের চক্র থেকে তাকে মুক্ত করতে চাইত। আমরা যাকে গির্জা বা church বলি, তার প্রতিষ্ঠা করে অর্ফিকরা, অলিম্পীয় ধর্মের পুরোহিতরা তা করেনি। গির্জা মানে ধর্মীয় সম্প্রদায়, লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সে সম্প্রদায়ের সদস্য হতে পারত। তাদেরই প্রভাব থেকে জীবনযাপনের একটি বিধান বা পথ হিসেবে দর্শনের সৃষ্টি।
২. মিলেসীয় ধারা
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে লেখা দর্শনের প্রত্যেকটি বইতে প্রথমেই যে কথাটি উল্লেখ করা হয় তা হলো : দর্শনের শুরু থেলিস থেকে, যিনি বলেছিলেন সবকিছুই পানি থেকে সৃষ্ট। যে নবিস ছেলে বা মেয়েটি দর্শনের প্রতি তার পাঠ্যসূচির প্রত্যাশিত অনুরাগ নিজের মধ্যে সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করছে-প্রাণপণে না হলেও, চেষ্টা করছে-তার কাছে এটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিন্তু তবুও থেলিসের জন্য শ্রদ্ধাবোধ করার প্রচুর কারণ রয়েছে, যদিও তা আধুনিক অর্থে দার্শনিক হিসেবে নয়, বরং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে।
এশিয়া মাইনরের মিলেটাস নামক এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক নগরীর অধিবাসী ছিলেন থেলিস। সেখানে ছিল এক বিশাল দাস জনগোষ্ঠী, আর স্বাধীন জনগণের মধ্যে ছিল ধনী আর গরিবে এক তিক্ত শ্রেণিসংগ্রাম। মিলেটাস প্রথমে সাধারণ মানুষ জয়ী হয়। এবং তাদের প্রতিপক্ষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, এমনভাবেই পুড়িয়ে মারে যে জ্বলন্ত মানবদেহের আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়। থেলিসের যুগে এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ নগরীতেই এ ধরনের সংঘাতময় অবস্থা ছিল।
আয়োনিয়ার অন্যান্য বাণিজ্যিক নগরীগুলোর মতো মিলেটাসেও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে। প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল ভূস্বামী অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে, তবে তা ক্রমশ চলে যায় ধনী বণিকগোষ্ঠীর হাতে। পরে এই ক্ষমতা চলে যায় এক স্বৈরশাসকের হাতে, যে কি না তা লাভ করে সাধারণ জনতার সহযোগিতায় (যেমনটি সেকালে সচরাচর ঘটত)। লিডিয়া রাজ্যের অবস্থান ছিল গ্রিক উপকূলীয় নগরীগুলোর পুব দিকে, কিন্তু নিনেভাহ্ (খ্রি.পূ. ৬০৬)-এর পতনের আগ পর্যন্ত গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে লিডিয়ার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। এর ফলে লিডিয়া তার পশ্চিম দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করার ফুরসত পায়। কিন্তু মিলেটাস বরাবর লিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়, বিশেষ করে শেষ লিডীয় রাজা ক্রোয়েসাসের সঙ্গে, যাকে খ্রি.পূ. ৫৪৬ সালে সাইরুস পরাজিত করেন। মিলেটাসের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল মিসরের সঙ্গেও, সেখানকার রাজা গ্রিক বণিকদের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতিপয় নগরী উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মিসরে প্রথম গ্রিক বসতি ছিল একটি দুর্গ, সেটি দখল করে নিয়েছিল এক মিলেসীয় বাহিনী। তবে ৬১০-৫৬০ খ্রি.পূ. সময়কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডাফনি। সেখানে জেরোমিয়াহ্ ও অন্যান্য ইহুদি ফেরারীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু মিসর যেহেতু সন্দেহাতীতভাবে গ্রিকদের প্রভাবিত করেছিল, সেহেতু আমরা মনে করতে পারি না যে সন্দেহপরায়ণ আয়োনীয়দের প্রতি গ্রিকদের বা জেরোমিয়াহর ভয় ছাড়া অন্য কোনো ভালো অনুভূতি ছিল।
থেলিসের জীবনকাল সম্পর্কে সর্বোত্তম সাক্ষ্য হচ্ছে, যেমনটি আমরা জানি, তিনি এক চন্দ্র/সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জ্যোতির্বিদদের মতে সেই গ্রহণ ঘটেছিল খ্রি.পূ. ৫৮৫ সালে। এ রকম আরেকটি সাক্ষ্য থেকেও তাকে এর কাছাকাছি সময়কালের মানুষ রূপেই পাওয়া যায়। থেলিসের পক্ষে একটি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া কোনো অসাধারণ প্রতিভার বিষয় ছিল না। মিলেটাসের মৈত্রী ছিল লিডিয়ার সঙ্গে, আর লিডিয়ার ছিল ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আর ব্যাবিলনিয়ার জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেছিল যে প্রায় ১৯ বছরের এক চক্রে চন্দ্রগ্রহণ ঘুরে ঘুরে আসে। চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস তারা দিতে পারত বেশ সাফল্যের সঙ্গেই, তবে সূর্যগ্রহণের ব্যাপারে তাদের সমস্যা ছিল এই যে, সূর্যগ্রহণ কোনো একটি জায়গা থেকে দৃশ্যমান হতে পারে আবার অন্য আরেক জায়গা থেকে না-ও হতে পারে। ফলে তারা শুধু জানতে পারত যে সম্ভাব্য অমুক অমুক তারিখে সূর্যগ্রহণের প্রত্যাশায় আকাশে তাকানো যেতে পারে। থেলিস সম্ভবত এ সবকিছুই জানতেন। থেলিস নিজে বা তারা কেউই জানতেন না সঠিক কী মেয়াদে সূর্যগ্রহণের চক্রটা ঘুরে ঘুরে আসে।
বলা হয়ে থাকে, থেলিস মিসর ভ্রমণ করেছিলেন আর সেখান থেকেই গ্রিকদের কাছে এনেছিলেন জ্যামিতির বিজ্ঞান। মিসরীয়রা জ্যামিতিশাস্ত্রের যা জানত তা ছিল অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন দ্বারা স্থিরীকৃত কিছু পরিমাপ-পদ্ধতি (rules of thumb)। তাই এ কথাও মনে করার কোনো কারণ নেই যে থেলিসের জ্যামিতিক জ্ঞান অবরোহমূলক প্রমাণ অবধি পৌঁছেছিল। সেটা ছিল পরবর্তী কালের গ্রিকদের আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, তিনি সমুদ্রতীরে দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রবক্ষের কোনো জাহাজের দূরত্ব কীভাবে পরিমাপ করতে হয় এবং একটি পিরামিডের ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে ওই পিরামিডের উচ্চতা কীভাবে মাপতে হয় তা আবিষ্কার করেন। আরো অনেক জ্যামিতিক উপপাদ্য থেলিসের আবিষ্কার বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সম্ভবত তা ঠিক নয়।
গ্রিসে যে সাতজন মনীষীর প্রত্যেকে একটি করে প্রজ্ঞাময় উক্তি করার জন্য বিশেষভাবে খ্যাতিমান ছিলেন, থেলিস তাদের একজন। থেলিসের উক্তিটি একটি ভ্রান্তি, তিনি মনে করতেন পানিই সর্বোত্তম। অ্যারিস্টটলের মতে : থেলিস মনে করতেন পানি হচ্ছে আদিমৌলিক সারবস্তু, যা থেকে অবশিষ্ট সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করতেন, পৃথিবী পানির ওপর ভাসছে। অ্যারিস্টটল আরো বলেন, থেলিস বলেছিলেন, চুম্বকের মধ্যে একটি আত্মা থাকে, কারণ তা লোহাকে নড়ায়। তিনি আরো বলেছিলেন, সব বস্তুর মধ্যে দেবতারা আছে।
সবকিছুর উৎপত্তি পানি থেকে-এই বক্তব্যকে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর এটি কোনোভাবেই নির্বোধ উক্তি নয়। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে গৃহীত মত ছিল যে সবকিছু হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্ট, যে-হাইড্রোজেন কিনা আবার পানির দুই-তৃতীয়াংশ। গ্রিকরা নিজেদের অনুমানের ব্যাপারে ছিল হঠকারী, কিন্তু মিলেসীয় ধারাটি অন্তত নিজেদের অনুমানগুলো অভিজ্ঞতা দ্বারা পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল। আমরা থেলিস সম্বন্ধে এত অল্প জানি যে, তার সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা সন্তোষজক দিকে পালটানোর সুযোগ তেমন নেই। কিন্তু মিলেটাসে তার উত্তরসূরিদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে, আর এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, তাদের বিশ্ববীক্ষার কিছু কিছু এসেছিল থেলিস থেকেই। থেলিসের বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ই কাঁচা, কিন্তু সেগুলো চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ উদ্দীপ্ত করার পক্ষে সহায়ক ছিল।
থেলিস সম্পর্কে অনেক কাহিনি-উপকথা চালু আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমার উল্লিখিত তথ্যাগুলোর চেয়ে বেশি আর কিছু তার সম্পর্কে জানা যায়নি। তার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনিগুলোর কিছু কিছু শুনতে বেশ প্রীতিকর। যেমন-একটি বলেছেন অ্যারিস্টটল, তার পলিটিক্স গ্রন্থে : লোকেরা তাকে (থেলিসকে) তার দারিদ্র্যের জন্য গালমন্দ করত, যা থেকে মনে করা হতো যে, দার্শনিকরা কোনো কাজের নয়। কাহিনিটি অনুসারে, গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে দক্ষ ধারণা থেকে থেলিস এক শীতকালে টের পেলেন, পরবর্তী বছর জলপাইয়ের ফলন খুব ভালো হবে। তার যে সামান্য অর্থ ছিল তা দিয়ে তিনি কিওস ও মিলেটাসের সব জলপাইয়ের ঘানি ভাড়া করার জন্য অগ্রিম বায়না করে রাখলেন, তা তিনি করতে পারলেন খুব সস্তায়, কারণ সেসব নেওয়ার জন্য ওই মুহূর্তে তার কোনো প্রতিযোগী ছিল না। তারপর যখন ফসল তোলার মৌসুম এলো এবং প্রচুর লোক জলপাইয়ের ঘানির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তখন তিনি সেগুলো ছেড়ে দিলেন নিজের ইচ্ছেমতো দরে এবং এ থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেন। এভাবে তিনি জগৎকে দেখিয়ে দিলেন যে, দার্শনিকরা ইচ্ছে করলে অর্থ উপার্জন করে ধনী হতে পারে। কিন্তু তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো ভিন্ন প্রকৃতির।
মিলেসীয় ধারার দ্বিতীয় দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার। তিনি থেলিসের চেয়ে বেশি আগ্রহোদ্দীপক এক চরিত্র। তার সময়কাল অনিশ্চিত, তবে বলা হয়, তিনি ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কাছাকাছি সময়েই যে তা ঘটেছিল এ ধারণার পেছনে যুক্তি আছে। অ্যানাক্সিমেন্ডার মনে করতেন সব বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে একটিমাত্র আদিবস্তু থেকে, কিন্তু তা থেলিসের দাবিকৃত পানি বা আমাদের পরিচিত কোনো পদার্থই নয়। তা অসীম, শাশ্বত, সময়নিরপেক্ষ এবং তা সব বিশ্বকে বেষ্টন বা আবৃত করে রয়েছে-তিনি মনে করতেন আমাদের জগৎ অনেক জগতের একটি মাত্র। সেই আদিবস্তু আমাদের কাছে পরিচিত বিভিন্ন পদার্থে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেগুলো। আবার একটি থেকে আরেকটাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও লক্ষণীয় মন্তব্য করেছেন :
যে-রূপ থেকে বস্তুগুলোর উদ্ভব ঘটে নিয়তিনির্ধারিতভাবে তারা আবার সেই রূপের মধ্য দিয়ে যায়, কারণ কালের বিন্যাস অনুসারে তারা তাদের পরস্পরের অন্যায্যতার ক্ষতিপূরণ ও সন্তোষ বিধান করে।
মহাজাগতিক এবং মানবিক-উভয় অর্থে ন্যায্যতার ধারণা গ্রিক ধর্ম ও দর্শনে এমন এক ভূমিকা পালন করেছে যা আধুনিক মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সহজ নয়। ন্যায্যতার নিহিতার্থ যা ছিল, আমাদের ব্যবহৃত ন্যায়বিচার বা ন্যায্য আচরণ তা প্রকাশ করে না বললেই চলে। কিন্তু এর চেয়ে জুতসই আর কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অ্যানাক্সিমেন্ডার যে চিন্তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা বোধ করি এই : বিশ্বে আগুন, পানি ও মাটির একটি নির্দিষ্ট অনুপাত আছে। কিন্তু এই তিনটি উপাদানের প্রত্যেকটি (মনে করা হচ্ছে যে তারা প্রত্যেকেই একজন করে দেবতা) অবিরামভাবে তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু একটি অনিবার্যতা বা প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে যা অবিরামভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যেমন-যেখানে আগুন আছে, সেখানে আছে ছাই। আর ছাই হলো মাটি। ন্যায্যতার অর্থ শাশ্বতভাবে নির্ধারিত সীমাগুলো অতিক্রম না করা। এই ধারণা ছিল গ্রিক বিশ্বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গভীর ধারণাগুলোর একটি। দেবতারাও ঠিক মানুষের মতোই এই ন্যায্যতার অধীন ছিল। তবে খোদ চূড়ান্ত শক্তিটি নিজে ছিল নৈর্ব্যক্তিক, তা কোনো সর্বময় ঈশ্বর ছিল না।
পানি বা অন্য কোনো পরিচিত পদার্থ যে আদিবস্তু নয় তা প্রমাণ করার জন্য অ্যানাক্সিমেন্ডার এক তর্ক জুড়েছিলেন। সেটা ছিল এ রকম : উপাদানগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি যদি হয় আদি বা প্রাথমিক, তাহলে তা অন্যগুলোকে আত্মসাৎ করে নিত। অ্যারিস্টটল জানাচ্ছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার বলেছিলেন, আমাদের পরিচিত বা জ্ঞাত পদার্থগুলো পরস্পর বিপরীতধর্মী। বায়ু শীতল, পানি আর্দ্র, আগুন গরম। অতএব, এদের যেকোনো একটি যদি অসীম হতো তাহলে এত দিনে অন্যগুলোর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং এই মহাজাগতিক দ্বন্দ্বে আদি বস্তু অবশ্যই নিরপেক্ষ।
শাশ্বত এক গতি ছিল, জগৎগুলোর সূচনা ঘটেছে তারই ধারায়। জগৎগুলো সৃষ্টি হয়নি-খ্রিস্টীয় বা ইহুদি ধর্মতত্ত্বে যেমনটি বলা হয়েছে-বরং বিকশিত হতে হতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। প্রাণিজগতে একটি বিকাশ প্রক্রিয়া ছিল। আর্দ্র উপাদান যখন সূর্যকিরণে বাষ্পীভূত হয়েছিল তখন তা থেকে প্রাণীগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও সম্ভূত হয়েছে মাছ থেকে। নিশ্চয়ই ভিন্ন প্রকৃতির জীব থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে, কারণ এখন তার শৈশবকাল এত দীর্ঘ যে, আদিতে এ রকম থাকলে সে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারত না।
অ্যানাক্সিমেন্ডারের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ছিল প্রভূত পরিমাণে। বলা হয়, তিনিই সর্বপ্রথম একটি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর আকৃতি একটি চোঙের মতো। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয় যে তিনি মনে করতেন সূর্য পৃথিবীর সমান বা পৃথিবীর চেয়ে ২৭ বা ২৮ গুণ বড়। তার মৌলিকত্ব ছিল তার বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদিতা।
অ্যানাক্সিমেনিস ছিলেন মিলেসীয় ধারার শেষ দার্শনিক। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতো তিনি আগ্রহব্যঞ্জক না হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। তার জন্ম মৃত্যুর সাল-তারিখ খুবই অনিশ্চিত, তবে এটা নিশ্চিত যে তিনি ছিলেন অ্যানাক্সিমেন্ডারের পরবর্তীকালের। আর যেহেতু ৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আয়োনীয়দের বিদ্রোহ দমনের একপর্যায়ে পারসিকদের দ্বারা মিলেটাস বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেহেতু অ্যানাক্সিমেনিস নিশ্চিতভাবেই ওই সময়ের পূর্ববর্তী ছিলেন।
অ্যানাক্সিমেনিস বলেছিলেন মূল পদার্থ হচ্ছে বায়ু। আত্মা বায়ু, আগুন তরলীকৃত বায়ু। ঘনীভূত করা হলে বায়ু প্রথমে হয় পানি, তারপর আরো ঘনীভূত করা হলে হয় মাটি, এভাবে শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় পাথরে। এই তত্ত্বের মধ্যে যে কৃতিত্বটা আছে তা হচ্ছে শুধু বিভিন্ন পদার্থের ঘনীভবনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে তাদের মধ্যকার সব পার্থক্যকে পরিমাণগত রূপ দেওয়ার ক্ষমতা। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর আকৃতি একটি গোলাকার টেবিলের মতো, আর সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে বায়ু। আত্মা যেমন করে আমাদেরকে সংহত করে, একত্রে ধরে রাখে, তেমনি করে নিঃশ্বাস আর বায়ু পুরো বিশ্বকে ধরে রাখে। যেনবা পৃথিবী দম নিচ্ছে, দম ফেলছে।
প্রাচীন যুগে অ্যানাক্সিমেন্ডারের চেয়ে অ্যানাক্সিমেনিস বেশি সমাদৃত ছিলেন। অবশ্য আধুনিক দুনিয়ার যেকোনো মানুষ এখন এর ঠিক উলটো মূল্যায়নটাই করবে। পিথাগোরাস এবং তার পরবর্তী কালের অনেক চিন্তায় অ্যানাক্সিমেনিসের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। পিথাগোরাসবাদীরা আবিষ্কার করে পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু পরমাণুবাদীরা ছিলেন অ্যানাক্সিমেনিসের মতের কাছাকাছি-অর্থাৎ পৃথিবী একটি চাকতির মতো।
মিলেসীয় দার্শনিক ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ তার অর্জনের কারণে নয়, বরং তার উদ্যম ও প্রয়াসের জন্য। মিলেসীয় ধারার উৎপত্তি ঘটেছিল ব্যাবিলনিয়া ও মিসরের সঙ্গে গ্রিক মননের সংযোগের ফলে। মিলেটাস ছিল একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক নগরী, যেখানে আদিম ধারণা ও কুসংস্কারগুলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নমনীয় রূপ লাভ করেছিল। পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে দারিয়ুস কর্তৃক অধিকৃত হবার পূর্ব পর্যন্ত হেলেনিক জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আয়োনিয়া। ডায়োনিসাস এবং অর্ফিয়ুসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের স্পর্শ থেকে আয়োনিয়া প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। আয়োনিয়ার ধর্ম ছিল অলিম্পীয়, তবে হয়তো ততটা কঠিন অর্থে নয়। থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার এবং অ্যানাক্সিমেনিসের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে বিবেচনা করতে হবে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে; সেগুলোতে প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে মনুষ্যত্ব আরোপের আকাক্ষা, বা নৈতিক কোনো ধারণার অন্যায় অনুপ্রবেশ ছিল না। তাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো ছিল উত্তম প্রশ্ন, আর তাদের প্রাণশক্তি অনুপ্রাণিত করেছিল পরবর্তীকালের অনুসন্ধিৎসুদের।
গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপ, যা দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা অধিকতর ধর্মীয় এবং বিশেষ করে, অধিকতর অর্ফিক। কিছু দিক থেকে তা বেশি আগ্রহব্যঞ্জক, অর্জনের দিক থেকে প্রশংসনীয়, কিন্তু মিলেটাসের দার্শনিক ধারার চেয়ে চেতনার দিক থেকে কম বিজ্ঞানভিত্তিক।
৩. পিথাগোরাস
এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় প্রাচীন ও মধ্যযুগে পিথাগোরাসের প্রভাব। পিথাগোরাস ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মানবজাতির এ যাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন। জ্ঞানী লোক হিসেবে তো বটেই, এমনকি যখন তার আচরণে নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেয়েছে তখনো তিনি গুরুত্বপূর্ণ। প্রদর্শনমূলক অবরোহী যুক্তি হিসেবে গণিতের সূচনা ঘটেছে তারই হাতে। অদ্ভুত একধরনের মরমিবাদের সঙ্গে গণিতের সম্পৃক্তি ঘটেছে তারই মধ্যে। দার্শনিকদের ওপর গণিতের যে প্রভাব, তার আংশিক কারণ পিথাগোরাস। এই প্রভাব গভীরতর হয়েছে তার সময় থেকে পরবর্তীকালে এবং তা হয়েছে দর্শনের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
পিথাগোরাসের জীবন সম্পর্কে অল্প যা কিছু জানা গেছে তাই দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। তিনি ছিলেন সামোস দ্বীপের অধিবাসী; তার জন্ম আনুমানিক ৫৩২ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন মেসারকস নামে এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ নাগরিকের পুত্র। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। পাঠকরা এ দুই ভাষ্যের যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। পিথাগোরাসের সময়ে সামেসের শাসক ছিলেন পলিক্রেটিস নামের একজন স্বৈরাচারী। বৃদ্ধ এই লোকটি ছিলেন একজন দস্যু। বিশাল ধন-সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। তার একটি বিশাল নৌবাহিনী ছিল।
সামোস দ্বীপ ছিল মিলেটাসের এক বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী। সামোসের ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল সুদূর স্পেনের টারটেসাস পর্যন্ত। টারটেসাস ছিল খনিশিল্পের জন্য বিখ্যাত। পলিক্রেটিস সামোসের স্বৈরশাসক হন খ্রি.পূ. ৫৩৫ সালের দিকে এবং শাসন করেন ৫১৫ সাল পর্যন্ত। ন্যায়-অন্যায়ের নৈতিক বালাই তার ছিল না। তার দুই ভাই শাসনকার্যে তার সহযোগী ছিলেন, তিনি তাদেরকে হত্যা করেন। তিনি তার বিশাল নৌবাহিনীকে ব্যবহার করতেন প্রধানত জলদস্যুতার কাজে। সে সময় মিলেটাসের কাছে পারস্যের পরাজিত ও অধীনস্ত হবার ঘটনা থেকে পলিক্রেটিস লাভবান হয়েছিলেন। পারসিকরা যাতে আরো পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে না পারে সে লক্ষ্যে পলিক্রেটিস মিসরের রাজা আমাসিস-এর সঙ্গে মৈত্রী করেন। কিন্তু পারস্যের রাজা কামবাইসিস যখন মিসর জয়ের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন তখন পলিক্রেটিস বুঝতে পারেন যে কামবাইসিস জয়ী হতে যাচ্ছেন এবং তিনি পক্ষ পরিবর্তন করেন। মিসর আক্রমণের জন্য তিনি একটি নৌবহর পাঠান, যেটা গঠন করা হয়েছিল তার রাজনৈতিক শত্রুদের নিয়ে। কিন্তু নাবিকরা বিদ্রোহ করে উলটো পলিক্রেটিসকেই আক্রমণ করার জন্য সামোস ফিরে যায়। সে যাত্রা পলিক্রেটিস নাবিকদের বিদ্রোহ দমন করে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা তার হয়নি। অতিশয় লোভের ফলে অবশেষে তার পতন ঘটে। সারদেস-এ পারস্যের প্রাদেশিক প্রশাসক ঘোষণা করেন তিনি মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান, পলিক্রেটিস যদি সে বিদ্রোহে তাকে সাহায্য করেন তাহলে তিনি তাকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেবেন। পলিক্রেটিস সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মূল ভূখণ্ডে গেলে বন্দি হন এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
পলিক্রেটিস শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সামোসকে তিনি অনেক দর্শনীয় জনকর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন। আনাক্রেন ছিলেন তার সভাকবি। কিন্তু পিথাগোরাস পলিক্রেটিসের শাসন পছন্দ করেননি, সে কারণে তিনি সামোস ত্যাগ করে চলে যান। বলা হয়, তিনি মিসর গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি অনেক জ্ঞান আহরণ করেন। এ তথ্য অসম্ভব নয়। সে যাই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত যে তিনি দক্ষিণ ইতালির ক্রোটনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সামোস ও মিলেটাসের মতো দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলো ধনী ও সমৃদ্ধ ছিল। তা ছাড়া পারসিকদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর আক্রমণের ভয় ছিল না। সবচেয়ে বড় দুটি নগরী ছিল সাইবারিস ও ক্রোটন। বিলাসিতার জন্য সাইবারিসের খ্যাতি প্রবাদ হয়ে আছে। ডিওডরাস-এর ভাষ্য অনুযায়ী সাইবারিসের সবচেয়ে সুদিনে সে নগরীর জনসংখ্যা ছিল তিন লাখ। অবশ্য সন্দেহ নেই যে এটা অতিরঞ্জন। আকারের দিক থেকে ক্রোটন সাইবারিসের প্রায় সমান ছিল। উভয় নগরীর জীবিকা ছিল আয়োনীয় পণ্যসামগ্রী ইতালিতে আমদানি করা। এর কিছু অংশ সে দেশে ব্যবহৃত হতো আর কিছু অংশ ফের রপ্তানি করা হত। পশ্চিম উপকূল থেকে গল ও স্পেনে। ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। পিথাগোরাস যখন ক্রোটন পৌঁছেন তখন সে নগরী সদ্য লকরির কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে তার আগমনের অল্প পরেই সাইবারিসের সঙ্গে এক যুদ্ধে ক্রোটন সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করে এবং সাইবারিসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেন (৫১০ খ্রি.পূ.)। মিলেটাসের সঙ্গে সাইবারিসের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রোটন চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ক্রোটনের জনৈক ডেমোসেডিস প্রথমে পলিক্রেটিসের এবং পরে দারিয়ুসের চিকিৎসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
পিথাগোরাস তার শিষ্যদের নিয়ে ক্রোটন নগরীতে একটি সংঘ স্থাপন করেন। সেটি সে নগরীতে কিছুকালের জন্য প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু নগরবাসীরা শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তিনি সেখান থেকে মেটাপন্টিওন চলে যান (এটিও দক্ষিণ ইতালিতেই অবস্থিত ছিল)। সেখানে তার মৃত্যু হয়। অচিরেই তিনি এক পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত হন; গালগল্প ছড়িয়ে পড়ে যে তার নানা রকম অলৌকিক ও জাদুকরী ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তিনি আবার গণিতবিদদের একটি স্কুলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এভাবে পিথাগোরাসের স্মৃতি দুই বিপরীতমুখী বিশ্বাস দ্বারা বিতর্কিত। এই বিতর্কের জট খুলে আসল সত্য বের করে আনা কঠিন।
ইতিহাসের সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ও দুর্বোধ্য ব্যক্তিদের অন্যতম পিথাগোরাস। তার সম্বন্ধে প্রচলিত বিশ্বাসগুলো যে শুধু সত্য ও মিথ্যার একটি প্রায়-অমোচনীয় মিশ্রণ তা-ই নয়, এমনকি তার সম্পর্কে সবচেয়ে সরল ও সবচেয়ে কম বিতর্কিত মতগুলোও আমাদের সামনে এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক মনস্তত্ত্ব হাজির করে। সংক্ষেপে তাকে বর্ণনা করা যেতে পারে আইনস্টাইন ও মিসেস এডির এক সমন্বয় রূপে। তিনি একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন যার মূলনীতি ছিল আত্মার পুনর্জন্ম ও শিমজাতীয় খাদ্য খাওয়ার পাপ। তার ধর্ম মূর্ত রূপ লাভ করে একটি ধর্মীয় জীবন বিধানের মধ্য দিয়ে, সে বিধানটি কোথাও কোথাও রাষ্ট্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল এবং ঋষিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু অদীক্ষিত লোকজন শিম খাওয়ার জন্য লোলুপ থেকে যায় এবং বিদ্রোহ করে।
পিথাগোরীয় জীবন-বিধানের কয়েকটি নিয়ম ছিল এ রকম—
১. শিম ভক্ষণ করবে না।
২. পতিত বস্তু তুলে নেবে না।
৩. সাদা মোরগ স্পর্শ করবে না।
৪. রুটি ভাঙবে না।
৫. দুটি লোহার দত্রে উপরে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত কোনো দণ্ড (ক্রবার) ডিঙাবে না।
৬. লোহার দণ্ডের দ্বারা আগুন উস্কাবে না।
৭. সম্পূর্ণ রুটি থেকে খাবে না।
৮. মালা থেকে পুষ্প ছিঁড়ে নেবে না।
৯. কোয়ার্ট পরিমাপের উপরে বসবে না।
১০. হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করবে না।
১১. মহাসড়কে হাঁটবে না।
১২. গৃহের ছাদে চড়ুই পাখিকে বাসা বাঁধতে দেবে না।
১৩. চুল্লি থেকে পাত্র সরানোর পর ভস্মে পাত্রের চিহ্ন রাখবে না, ভস্ম নেড়ে-চেড়ে পাত্রের দাগ মিশিয়ে দেবে।
১৪. আলোর পাশে যে দর্পণ রয়েছে তার পানে তাকাবে না।
১৫. শয্যাত্যাগের পর বিছানায় দেহের ছাপ রাখবে না, ছাপ মুছেয়া ফেলে বিছানা গুটিয়ে রাখবে।
উল্লিখিত সব উপদেশই আদিম ট্যাবু ধারণার অন্তর্ভুক্ত।
ফ্রম রিলিজিওন টু ফিলোসফি গ্রন্থে কর্নফোর্ড বলেছেন, তার মতে পিথাগোরাসের দার্শনিক ধারাটিতে সেই মরমিবাদের মূল ধারাটি উপস্থাপিত হয়েছে, যেটিকে আমরা বৈজ্ঞানিক প্রবণতার বিপরীতে স্থাপন করেছি। কর্নফোর্ড পারমিনাইডিসকে বলেছেন যুক্তিশাস্ত্রের আবিষ্কর্তা। তিনি মনে করেন পারমিনাইডিস পিথাগোরাসবাদের এক দলছুট শাখা। তিনি আরো মনে করেন, প্লেটো নিজেও তার অনুপ্রেরণার মূল উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন ইতালীয় দর্শনে। কর্নফোর্ড বলছেন, পিথাগোরাসবাদ ছিল অফিঁজমের একটি সংস্কার-আন্দোলন আর অর্ফিজম ছিল ডায়োনিসাস-পূজার একটি সংস্কার-আন্দোলন। পুরো ইতিহাসে বুদ্ধিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যে যে বিরোধ চলে আসছে তা প্রথম পরিলক্ষিত হয় গ্রিকদের মধ্যে। অলিম্পীয় দেবকুল ও স্বল্প সভ্য দেবতাদের মধ্যে সেই বিরোধ ফুটে ওঠে। অন-অলিম্পীয় সেসব স্বল্প সভ্য দেবতাদের সঙ্গে সেই সব আদিম ধর্মবিশ্বাসের মিল ছিল বেশি যেসব ধর্মবিশ্বাস নিয়ে নৃতত্ত্ববিদরা কাজ করেন। বুদ্ধিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যকার এই বিভেদে পিথাগোরাস ছিলেন মরমিবাদের পক্ষে, যদিও তার মরমিবাদের ধরনটি ছিল অদ্ভুত রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক। তিনি নিজেকে এক আধা-ঐশ্বরিক চরিত্ররূপে উপস্থাপন করেছিলেন। মনে হয় এই উক্তিটি তারই : জগতে মানুষ আছে, দেবতারা আছেন, আর আছে পিথাগোরাসের মতো এক প্রকারের জীব। কর্নফোর্ড বলেছেন, পিথাগোরাস যেসব পদ্ধতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তার সবই ঝোঁক পরজাগতিক, সেগুলোতে সব মূল্য পেয়েছে ঈশ্বরের অদৃশ্য ঐক্য। দৃশ্যমান জগৎকে মিথ্যা আর মায়াবী বলে নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছে জগৎ একটি অস্বচ্ছ ঘোলাটে মাধ্যম, যার ভেতর দিয়ে স্বর্গীয় আলোকরশ্মি ভেঙে ভেঙে যায় আর কুয়াশা ও অন্ধকারে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডিকেয়াকোস বলেছেন, পিথাগোরাসের প্রথম শিক্ষা ছিল এই যে, আত্মা অমর এবং তা অন্যান্য ধরনের জীবে রূপান্তরিত হয়। কোনো কিছুই সম্পূর্ণরূপে নতুন নয়, কারণ জীবিত সব কিছুরই চক্রাকারে পুনর্জন্ম ঘটে। প্রাণ নিয়ে যা কিছুর জন্ম হয়েছে তাকেই আত্মীয় জ্ঞান করতে হবে।
পিথাগোরাসের সভ্যসংঘে নারী ও পুরুষকে সদস্য করা হতো সমান শর্তে। সেখানে সম্পত্তির মালিকানা ছিল যৌথ, সবার জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল একই রকম, সাধারণ। এমনকি বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক আবিষ্কারগুলোকেও যৌথকর্মের ফসল বলে বিবেচনা করা হতো। আর একধরনের মরমিবাদী চিন্তা থেকে মনে করা হতো যে সেগুলোর পেছনে আছেন পিথাগোরাস। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও এ-রকম ভাবা হত। হিপ্পাসোস ও মেটাপন্টিওন নামে দুজন সদস্য এ নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, এই পাপের ফলে ঐশ্বরিক অভিশাপে তারা জাহাজডুবির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এসবের সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা একধরনের নৈতিক সম্পর্ক, যে নৈতিকতায় চিন্ত। শীল জীবনকে শ্রেয় মনে করা হতো। বার্নেট এই নৈতিকতার সারসংক্ষেপ করেছেন এ রকম–
আমরা এ জগতে আগন্তুক। আত্মা হচ্ছে দেহের সমাধি। কিন্তু আমাদের উচিত নয় আত্মহত্যার দ্বারা এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করা। কারণ আমরা হলাম পশুপাল আর ঈশ্বর আমাদের রাখাল। তার হুকুম ছাড়া আমরা পালাতে পারি না। এ জীবনে মানুষ আছে তিন প্রকারের। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যেমন তিন ধরনের মানুষ আসে ঠিক তেমনি। সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির মানুষ হচ্ছে তারা, যারা আসে কেনাবেচা করতে। তাদের ঠিক উপরের স্তরটিতে আছে তারা, যারা প্রতিযোগিতা করে। আর সর্বোত্তম স্তরে হচ্ছে তারা যারা কিছুই করে না, শুধু দেখে অর্থাৎ যারা নিরাসক্ত দর্শক। তাই সর্বোত্তম উৎকর্ষ হচ্ছে নিরাসক্ত বিজ্ঞান, আর যে ব্যক্তি নিজেকে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসর্গ করেন তিনি প্রকৃত দার্শনিক, তিনিই সবচেয়ে সফলভাবে নিজেকে মুক্ত করেছেন জন্মের চক্র থেকে।
প্রায়ই শব্দার্থের নানা ধরনের পরিবর্তন ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে থাকে। আমি orgy শব্দটি নিয়ে আগে আলোচনা করেছি। এখন theory শব্দটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এটি মূলত ছিল একটি অফিক শব্দ। কর্নফোর্ড এর অনুবাদ করেছেন আবেগপূর্ণ সহানুভূতি সহযোগে অনুধ্যান। পিথাগোরাস বলছেন, যখন কেউ আবেগপূর্ণ সহানুভূতি-সহযোগে অনুধ্যান করে তখন তার অবস্থা হয় পীড়িত ঈশ্বরের মতো। অর্থাৎ, তার মৃত্যু হয় এবং আবার সে নতুন করে জন্ম নেয়। পিথাগোরাসের কাছে আবেগপূর্ণ সহানুভূতি সহযোগে অনুধ্যান ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, তার সূচনা গাণিতিক জ্ঞানের মধ্য দিয়ে। এইভাবে পিথাগোরাসবাদের মধ্য দিয়ে theory শব্দটি ক্রমে তার আধুনিক অর্থ অর্জন করেছে। কিন্তু পিথাগোরাসের দ্বারা উদ্বুদ্ধ সবার কাছে তা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের একটি উপাদান হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। পাঠশালায় যারা অনিচ্ছুকভাবে হলেও একটু-আধটু গণিত শিখেছে তাদের কাছে এটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু গণিতের আকস্মিক উপলব্ধির গভীর আনন্দলাভের অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, যারা গণিত ভালোবাসে, তাদের কাছে পিথাগোরীয় দৃষ্টিভঙ্গি-যদি সত্য না-ও মনে হয়-পুরোপুরি স্বাভাবিক বলে মনে হবে। মনে হতে পারে, অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক তার অভিজ্ঞতার উপাদান-বস্তুর দাস, কিন্তু খাঁটি গণিতজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞের মতো এক নিজস্ব সুশৃঙ্খল সুন্দর জগতের স্বাধীন স্রষ্টা।
এটা খেয়াল করা বেশ আগ্রহব্যঞ্জক যে, বার্নেট-বর্ণিত পিথাগোরীয় নৈতিকতা আধুনিক মূল্যবোধের সঙ্গে বিরোধাত্মক। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক মানসিকতার লোকজন মনে করে ফুটবল খেলায় দর্শকদের চেয়ে খেলোয়াড়রা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের ব্যাপারেও সে রকম : সাধারণ দর্শকজনতার চেয়ে তারা বেশি পছন্দ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত রাজনীতিবিদদের। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যোদ্ধা, অভিজাত, ধনিক এবং একনায়ক প্রত্যেকের শুভ ও সত্যের নিজ নিজ মানদণ্ড আছে। অভিজাত ব্যক্তি দার্শনিক তত্ত্বের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন, কারণ গ্রিক মনীষার সঙ্গে তার সংসর্গ হয়েছে, কারণ চিন্তাশীলতা একটি সদগুণ হিসেবে ধর্মের অনুমোদন লাভ করেছে এবং নির্মোহ সত্যের আদর্শ শিক্ষাজীবনকে মহিমান্বিত করেছে। অভিজাত হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবেন তিনি, যিনি এমন এক সমাজের একজন, যে সমাজে সবাই সমান, যারা দাসশ্রমের ওপরে নির্ভর করে বা এমন কিছু লোকের শ্রমের ওপরে নির্ভর করে জীবনযাপন করে, যারা প্রশ্নাতীতভাবে অধঃস্তন। এও খেয়াল করা দরকার যে, সাধু-সন্ন্যাসীরাও এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়বেন; তারা কর্মময় জীবনযাপন করেন না, তাদের জীবন চিন্তাশীল, ধ্যানপূর্ণ।
সত্যের আধুনিক সংজ্ঞাগুলো চিন্তামূলক নয়, ব্যবহারিক। যেমন প্রয়োগবাদ বা প্রয়োজনবাদে সত্যের সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞাগুলো সূচিত হয়েছে অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে শিল্পতন্ত্রের দ্বারা। যে সমাজব্যবস্থা দাসপ্রথা সহ্য করে তার সম্বন্ধে যা-ই ভাবা হোক না কেন, উপরে বর্ণিত অর্থে যারা অভিজাত, বিশুদ্ধ গণিতের জন্য আমরা তাদের কাছেই ঋণী। চিন্তাশীলতার আদর্শ থেকে বিশুদ্ধ গণিতের জন্ম হয়েছিল বলে তা ছিল ব্যবহারিক কাজকর্মের উৎস। ফলে চিন্তাশীলতার মর্যাদা বেড়েছে, ধর্মতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র এবং দর্শনে চিন্তাশীলতার আদর্শের জয় হয়েছে। ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডের একটি উৎস না হলে চিন্তাশীলতার আদর্শ হয়তো এতটা মর্যাদা ও সাফল্য পেত না।
এ পর্যন্ত যা ব্যাখ্যা করা গেল তা থেকে পিথাগোরাসের দুটো দিক বেরিয়ে আসে। একদিকে তিনি ধর্মীয় প্রবক্তা, অন্যদিকে বিশুদ্ধ গণিতজ্ঞ। উভয় দিকে তার গুরুত্ব ছিল অপরিমেয়। তবে একজন আধুনিক মানুষের কাছে এই দুটি দিক যতটা আলাদা মনে হতে পারে সে সময় কিন্তু ততটা ছিল না।
অধিকাংশ বিজ্ঞান সূচনালগ্নে কিছু না কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, যা থেকে সেসব বিজ্ঞান একধরনের কাল্পনিক তাৎপর্য লাভ করেছে। জ্যোতির্বিদ্যা জড়িত ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে, রসায়নবিদ্যা আলকেমির সঙ্গে। গণিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আরো বেশি সূক্ষ্ম একধরনের ভ্রান্তির। মনে করা হতো গাণিতিক জ্ঞান নিশ্চিত, নির্ভুল এবং বাস্তব জগতে প্রয়োগযোগ্য। তা ছাড়া, তা অর্জিত হয় শুধু চিন্তার দ্বারা, কোনো পর্যবেক্ষণের দরকার হয় না। ফলে গাণিতিক জ্ঞান থেকে একটি আদর্শ তৈরি হয়, দৈনন্দিন ব্যবহারিক জ্ঞান সে আদর্শের চেয়ে অনেক নিম্নমানের। গণিতের ওপরে ভিত্তি করে মনে করা হতো চিন্তা ইন্দ্রিয়ের চেয়ে এবং সংজ্ঞা পর্যবেক্ষণের চেয়ে শ্রেয়। ইন্দ্রিয়জগতের সঙ্গে গণিতের যদি বনিবনা না হয়, দোষটা গণিতের নয়, ইন্দ্রিয়জগতেরই। গণিতজ্ঞের আদর্শের নিকটবর্তী হবার নানা রকম পথ ও পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, তার ফলে যেসব পরামর্শ পাওয়া গেছে সেগুলো অধিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বে অনেক ভ্রান্তির উৎস হয়েছে। দর্শনের এই ধরনটির শুরু পিথাগোরাস থেকে।
সবাই যেমনটি জানে, পিথাগোরাস বলেছিলেন সব বস্তুই হচ্ছে সংখ্যা। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কথাটি যৌক্তিকভাবে অর্থহীন, কিন্তু তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা ঠিক অর্থহীন নয়। সঙ্গীতে সংখ্যার গুরুত্ব তারই আবিষ্কার আর সঙ্গীত ও পাটিগণিতের মধ্যে তিনি যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন তা আজও হারমোনিক মিন ও হারমোনিক প্রগ্রেশন-এই দুটো গাণিতিক পরিভাষার মধ্যে টিকে আছে। তিনি মনে করতেন সংখ্যাগুলো একেকটা আকৃতি-চাকতি বা খেলার তাসে যেমন থাকে। আমরা এখনো সংখ্যার বর্গ, ঘন ইত্যাদির কথা বলে থাকি। এই শব্দগুলো আমরা পেয়েছি পিথাগোরাসের বদৌলতেই। চতুষ্কোণ সংখ্যা, ত্রিকোণ সংখ্যা, পিরামিডাকৃতি সংখ্যা ইত্যাদির কথাও তিনি বলেছিলেন। একটি প্রশ্নকে আকৃতি দেওয়ার জন্য এই সব সংখ্যার নুড়ির (বা আমরা সাধারণত যেগুলোকে খুঁটি বলি) দরকার হতো। সম্ভবত পিথাগোরাস পৃথিবীকে পারমাণবিক মনে করতেন এবং মনে করতেন যে পৃথিবী বিভিন্ন আকৃতির পরমাণু দ্বারা গঠিত বস্তুকণা বা অণুর তৈরি। নন্দনতত্ত্বে যেমন পাটীগণিত মৌলিক জিনিস, তেমনি তিনি পাটিগণিতকে পদার্থবিদ্যার মূল পাঠ হিসেবে পাওয়ার আশা করেছিলেন।
পিথাগোরাস বা তার প্রত্যক্ষ শিষ্যদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি ছিল সমকোণী ত্রিভুজের উপপাদ্য : সমকোণী ত্রিভুজের সমকোণের সন্নিহিত বাহুদ্বয়ের উপরে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের যোগফল অপর বাহুটির বা অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের সমান। মিসরীয়রা জানত যে ত্রিভুজের বাহুগুলোর মাপ ৩, ৪ ও ৫, সেটি একটি সমকোণী ত্রিভুজ হবে। কিন্তু মনে হয়, গ্রিকরাই সর্বপ্রথম খেয়াল করে যে, ৩^২ + ৪^২ = ৫^২ হয় এবং এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তারাই প্রথম সাধারণ প্রতিজ্ঞার একটি প্রমাণ। আবিষ্কার করে।
পিথাগোরাসের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, তার উপপাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিষম জ্যামিতিক আকারগুলোও আবিষ্কৃত হয়, যার ফলে তার পুরো দর্শনকেই ভুল প্রমাণিত হতে দেখা যায়। সমকোণবিশিষ্ট একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজে অতিভুজের উপরে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্র অন্য দুই বাহুর উপর অঙ্কিত যেকোনো বর্গক্ষেত্রের দ্বিগুণ। ধরা যাক প্রত্যেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১ ইঞ্চি, তাহলে অতিভুজের দৈর্ঘ্য কত হবে? মনে করা যাক অতিভুজের দৈর্ঘ্য m/n ইঞ্চি। তাহলে m^২/n^২ = ২। যদি m ও n-এর একটি উৎপাদক গুণনীয়ক থাকে তাহলে তাকে বের করলে দেখা যাবে m অথবা n-দুটোর একটি অবশ্যই হবে বেজোড়। এখন m^২-২n^২, অতএব m^২ জোড় সংখ্যা, অতএব m জোড় সংখ্যা, অতএব n বেজোড় সংখ্যা। ধরা যাক, m = 2p, তাহলে 4p^২ = ২n^২, অতএব n^২ = ২p^২, অতএব n জোড় সংখ্যা এবং অতএব n হবে একটি জোড় সংখ্যা, যা কিনা পূর্ব সিদ্ধান্তের বিপরীত। সুতরাং m/n-এর কোনো ভগ্নাংশ অতিভুজটির পরিমাপ নির্ণয় করতে পারবে না। এই প্রমাণটির সারমর্ম তাই, যা রয়েছে ইউক্লিডের ১০ম খণ্ডে।
এ যুক্তি থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দৈর্ঘ্যের যে এককই আমরা ধরি না কেন, এমন কিছু দৈর্ঘ্য আছে যেগুলোর সঙ্গে ওই এককের কোনো সুনির্দিষ্ট সাংখ্যিক সম্পর্ক থাকে না। কথাটা বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, m ও n বলে এমন দুটো পূর্ণসংখ্যা থাকতে পারে না যে আলোচ্য দৈর্ঘ্যের m-গুণ তার এককের n-গুণ হবে। এতে করে গ্রিক গণিতবিদদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে জ্যামিতিকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে পাটিগণিতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, স্বাধীনভাবে। প্লেটোর সংলাপগুলোতে এমন কিছু অনুচ্ছেদের দেখা পাওয়া যায় যা থেকে এই প্রমাণ মেলে যে, প্লেটোর যুগের জ্যামিতির স্বতন্ত্র প্রয়োগ প্রক্রিয়াধীন ছিল। ইউক্লিডের সময় তার উৎকর্ষ ঘটে। ইউক্লিড তার দ্বিতীয় পুস্ত কে জ্যামিতির সাহায্যে অনেক কিছু প্রমাণ করেছেন, যেগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবে বীজগণিতের সাহায্যে করে থাকি। যেমন-(a+b)^২ = a^২ + ২ab + b^২। বিষমগুলোর ব্যাপারে অসুবিধার কারণেই তার কাছে এটা অনিবার্য মনে হয়েছিল। একই কথা প্রযোজ্য তার পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুস্তকে বর্ণিত ভগ্নাংশের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। পুরো পদ্ধতিটি আনন্দদায়ক, এবং এ থেকে উনিশ শতকের গণিতবিদদের পরিশ্রমক্ষমতা টের পাওয়া যায়। বিষম-এর ব্যাপারে যত দিন পর্যন্ত কোনো যথার্থ পাটিগাণিতিক তত্ত্ব ছিল না তত দিন ইউক্লিডের পদ্ধতি, যা জ্যামিতিতে যতটা খাটানো সম্ভব ছিল, তা-ই ছিল সর্বোত্তম। দেকার্তে যখন স্থানাঙ্ক জ্যামিতি প্রবর্তন করেন এবং তা করে পাটিগণিতকে আবার সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যান, তখন তিনি বিষম-এর সমস্যাটি সমাধানের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছিলেন। অবশ্য তার কালে সে ধরনের কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর জ্যামিতির প্রভাব গভীর। জ্যামিতি, যেভাবে তা গ্রিকদের হাতে প্রবর্তিত হয়, তা শুরু হয় কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ ধারণা দিয়ে (বা সেগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়) এবং তা থেকে অবরোহমূলক যুক্তির ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হতে কতকগুলো উপপাদ্যে পৌঁছে, যেগুলো মোটেই স্বতঃসিদ্ধ নয়। স্বতঃসিদ্ধ ও উপপাদ্যগুলোকে আমাদের অভিজ্ঞতার আওতাধীন বাস্তব স্থানে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে মনে হয় যে, স্বতঃসিদ্ধ কী, প্রথমে তা খেয়াল করে তারপর অবরোহ-পদ্ধতি ব্যবহার করে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটো ও কান্টকে এবং তাদের মধ্যবর্তী কালের অধিকাংশ দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স-এ বলা হয়েছে : আমরা এই-সব সত্যকে সত্য বলে মনে করি। এটা আসলে ইউক্লিডের অনুকরণ। ১৮ শতকের ন্যাচারাল রাইটস মতবাদ আসলে ছিল রাজনীতিতে ইউক্লিডের স্বতঃসিদ্ধগুলোর সন্ধান।
স্বীকৃত প্রায়োগিক উপাদান থাকা সত্ত্বেও নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার আঙ্গিক আগাগোড়াই ইউক্লিড দ্বারা প্রভাবিত। ধর্মতত্ত্বও-তার নিখুঁত স্কলাস্টিক আঙ্গিকে-একই উৎস থেকে শৈলী গ্রহণ করেছে। ব্যক্তিগত ধর্ম এসেছে আধ্যাত্মিক অনুভূতি থেকে আর ধর্মতত্ত্ব এসেছে গণিত থেকে। পিথাগোরাসের মধ্যে উভয়েরই সাক্ষাৎ মেলে।
আমার বিশ্বাস, শাশ্বত ও নির্ভুল সত্যের প্রতি বিশ্বাসের উৎস গণিত, একটি অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের প্রতি বিশ্বাসের উৎসও তা-ই। জ্যামিতির কারবার, উদাহরণস্বরূপ, বৃত্ত নিয়ে। কিন্তু কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নিখুঁতভাবে বৃত্তাকার নয়। যত যত্নসহকারেই আমরা আমাদের কম্পাস ব্যবহার করি না কেন, অঙ্কিত বৃত্তে কিছু খুঁত, কিছু বিষমতা থেকেই যাবে। তাহলে এ থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, সব নির্ভুল যুক্তি কেবল ভাবনার জগতের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে নয়। এ পথে চিন্তা করলে স্বাভাবিকভাবেই আরো এগোনো যায় এবং দাবি করা যায় যে, ইন্দ্রিয়ের চেয়ে চিন্তা মহত্তর এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর চেয়ে চিন্তার বিষয়গুলো অধিকতর সত্য। শাশ্বতর সঙ্গে সময়ের সম্বন্ধ সম্পর্কিত মরমি মতবাদগুলোও বিশুদ্ধ গণিত থেকে প্রচুর রসদ পেয়েছে। কেননা, গাণিতিক বিষয়গুলো, যথা সংখ্যাগুলো, যদি আদৌ সত্য হয়, তবে সেগুলো শাশ্বত, সময়ের মধ্যে সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। ঈশ্বরের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে এ ধরনের শাশ্বত বিষয় বলে মনে করা যেতে পারে। এখান থেকেই প্লেটোর এই মতবাদ এসেছে যে, ঈশ্বর একজন জ্যামিতিবিদ এবং এখান থেকেই স্যার জেমস জর এই বিশ্বাসের উৎপত্তি যে, ঈশ্বর গণিতের প্রতি আসক্ত। পিথাগোরাসের সময় থেকে এবং বিশেষ করে প্লেটোর সময় থেকে, মহাপ্রলয়বিশ্বাসী ধর্মের বিপরীতে বুদ্ধিবাদী ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে গণিত ও গাণিতিক পদ্ধতি দ্বারা।
পিথাগোরাসের সময় থেকে গণিত ও ধর্মতত্ত্বের যে সংমিশ্রণ শুরু হয়েছে তা-ই গ্রিসের ধর্মীয় দর্শন, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দর্শন এবং আধুনিক যুগে কান্ট পর্যন্ত ধর্মীয় দর্শনের স্বরূপ গঠন করেছে। পিথাগোরাসের আগে অফিজম ছিল এশীয় গুহ্য। ধর্মগুলোর অনুরূপ। কিন্তু প্লেটো, সেন্ট অগাস্টিন, টমাস অ্যাকুইনাস, দেকার্তে, স্পিনোজা এবং লাইবনিজে ধর্মের সঙ্গে চিন্তনের, নৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পিথাগোরাস থেকে আগত সময়নিরপেক্ষ বিষয়ের প্রতি যৌক্তিক মুগ্ধতা-যা এশিয়ার সহজ-সরল মরমিবাদ থেকে ইউরোপের বৌদ্ধিকীকৃত ধর্মতত্ত্বকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে-তার এক ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ ঘটেছে। কেবল অতি সাম্প্রতিককালে এসেই পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব হয়েছে পিথাগোরাসের ভুলটা কী ছিল। চিন্তার জগতে পিথাগোরাসের মতো প্রভাব বিস্তারকারী আর কোনো ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই। এ কথা বলছি এ কারণে যে, প্লেটোবাদে যা দেখা যায় তা বিশ্লেষণ কবলে দেখা যাবে তার সারমর্ম রয়েছে পিথাগোরাসবাদে। ইন্দ্রিয়ের কাছে নয়, বুদ্ধির সামনে উন্মোচিত একটি শাশ্বত জগতের পুরো ধারণাটিই এসেছে পিথাগোরাসের কাছ থেকে। পিথাগোরাস না থাকলে ক্রাইস্ট শব্দটাই ক্রিস্টানদের মাথায় আসত না। তিনি না থাকলে ধর্মতাত্ত্বিকদের ঈশ্বর ও অমরত্বের যৌক্তিক প্রমাণ অন্বেষণের প্রয়াসই জাগত না। যাই হোক, এসব কিছুই এ পর্যন্ত তার মধ্যে নিহিতরূপে ছিল। কীভাবে তা প্রকাশ্য হয়েছে তা আমাদের আলোচনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জানা যাবে।
৪. হেরাক্লিটাস
গ্রিকদের সম্পর্কে বর্তমানকালে দুটি বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে প্রচলিত। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি রেনেসাঁর যুগ থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বস্তুত সর্বজনীন ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল গ্রিকদের প্রতি প্রায়-কুসংস্কারের সমতুল্য একধরনের ভক্তি। ভাবা হতো যে তারা সব সর্বোত্তম কিছুর উদ্ভাবক, তাদের প্রতিভা ছিল এমন অতিমানবিক পর্যায়ের, যার সঙ্গে আধুনিক মানুষের সমতুলনার কথা প্রত্যাশাই করা চলে না। অন্য দৃষ্টিভঙ্গিটি অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিজ্ঞানের বিজয় আর সভ্যতার প্রগতির প্রতি আশাবাদী একধরনের বিশ্বাস দ্বারা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি এ রকম যে, চিন্তার জগতে গ্রিকদের অধিকাংশ অবদানই এখন বিস্মৃতির বিষয়। এ দুই দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটার প্রতিই ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষপাত নেই। আমি বলব, উভয় দৃষ্টিভঙ্গিই অংশত সঠিক এবং অংশত ভুল। বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশ করার আগে আমি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব, গ্রিক চিন্তাজগৎ থেকে আমরা কী ধরনের জ্ঞান এখনো পেতে পারি।
নানা ধরনের প্রকল্পই বিশ্বজগতের প্রকৃতি ও গঠন-কাঠামো সম্পর্কে সম্ভবপর। অধিবিদ্যার বিকাশ যতখানি ঘটেছে তাতে রয়েছে এসব প্রকল্পের এক ক্রমান্বয়িক পরিশীলন, রয়েছে সেসবের তাৎপর্যের বিকাশ এবং সেগুলোর বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তি মোকাবিলা করার জন্য প্রত্যেকটি প্রকল্পের পুনর্গঠন। এসব আনুমানিক তত্ত্ব অনুসারে জগতের ধারণা গঠন করতে পারার মধ্যে একধরনের কল্পনাপ্রবণ আনন্দ পাওয়া যেতে পারে এবং তা অন্ধত্ববাদের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিষেধক হতে পারে। তা ছাড়াও, এসব প্রকল্পের কোনোটাই যদি প্রমাণসাধ্য না-ও হয়, তবুও সেগুলোর মধ্যে যেগুলো স্বয়ংসঙ্গতিপূর্ণ আর জ্ঞাত তথ্যাবলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, সেগুলোর আবিষ্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর মধ্যেই জ্ঞান রয়েছে। আধুনিক দর্শনকে যেসব প্রকল্প প্রভাবিত করেছে তার প্রায় সবই প্রথমে চিন্তা করেছিল গ্রিকরা। বিমূর্ত বিষয়াবলিতে তাদের কল্পনাপ্রবণ উদ্ভাবনী শক্তির অতি-উচ্চপ্রশংসা তেমন একটি করা চলে না। গ্রিকদের সম্পর্কে আমি যা কিছু বলব তা এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলব। আমি মনে করি গ্রিকরা যেসব তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে সেগুলোর অস্তিত্ব ও বিকাশ ছিল স্বনির্ভর এবং সেগুলো-যদিও প্রাথমিক অবস্থায় ছিল বালসুলভ-দুই হাজারের বেশি সময় ধরে টিকে থাকতে ও বিকশিত হতে সক্ষম ছিল।
এ কথা অবশ্য সত্য যে, বিমূর্ত চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রিকদের অন্য আরেক রকম অবদান ছিল, সেটার অধিকতর স্থায়ী মূল্য আছে। গণিত ও অবরোহী যুক্তিমূলক চিন্তার কৌশল গ্রিকদের আবিষ্কার। বিশেষ করে জ্যামিতি এক গ্রিক উদ্ভাবন, যা ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান সম্ভব ছিল না। কিন্তু গ্রিক মনীষায় গণিতের ব্যাপারে একপেশে প্রবণতাটি ছিল এই যে, গ্রিক মনন চিন্তা করত স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রতীয়মান একটি ধারণা থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে, পর্যবেক্ষণলব্ধ কিছু থেকে আরোহী পদ্ধতিতে নয়। তাদের এই পদ্ধতি প্রয়োগের চমৎকার সাফল্য শুধু প্রাচীন জগৎকেই নয়, আধুনিক জগতেরও বৃহত্তর অংশকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। বিশেষ বিশেষ ঘটনার পর্যবেক্ষণ দ্বারা আরোহী পদ্ধতিতে সূত্রের পৌঁছার চেষ্টা করে যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, হেলেনিক জগতের দার্শনিকদের মনোকল্পিত স্বতঃসিদ্ধের প্রতি বিশ্বাসকে দূর করতে পেরেছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। অন্যান্য কারণসহ এই কারণেও গ্রিকদের প্রতি প্রায়-কুসংস্কারতুল্য ভক্তি পোষণ করা ভুল। যদিও গ্রিকদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তির ঝোঁক ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি, তবু সামগ্রিকভাবে এটা ছিল তাদের মেজাজের বিরোধী। তাদের শেষ চার শতাব্দীর বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিকে খাটো করে তাদেরকে মহিমান্বিত করার প্রয়াস আধুনিক চিন্তাজগতের ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে।
গ্রিকদের প্রতি হোক বা অন্য যে কারো প্রতি হোক, ভক্তির বিরুদ্ধে আরো সাধারণ একটি যুক্তি আছে। একজন দার্শনিককে পাঠ করার ক্ষেত্রে যথার্থ প্রবণতাটি হওয়া উচিত না-ভক্তি, না-ঘৃণা। বরং একধরনের তাত্ত্বিক সহানুভূতিসুলভ মন নিয়ে তাকে পাঠ করা শুরু করতে হবে। তারপর যখন মনে হবে যে, এই দার্শনিকের তত্ত্বগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে, কেবল তখনই একটি বিচারী দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যেতে হবে, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। তখন মনের অবস্থাটা যত দূর সম্ভব এমন হওয়া প্রয়োজন যে, এ পর্যন্ত যা কিছু সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল তা ত্যাগ করা হলো। এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটিতে বাধা সৃষ্টি করে ঘৃণা আর দ্বিতীয় ধাপটিকে বাধা দেয় ভক্তি। দুটো ব্যাপার স্মরণ রাখা দরকার : এক. যে ব্যক্তির অভিমত ও তত্ত্ব পাঠ করার যোগ্য, ধরে নিতে হবে যে তার কিছু-না-কিছু প্রতিভা আছে। দুই. কোনো বিষয় সম্পর্কেই সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সত্য ধারণায় পৌঁছে যাওয়া চলবে না। কোনো বুদ্ধিমান মানুষ যখন এমন কোনো মত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যা আমাদের কাছে স্পষ্টতই অর্থহীন বা উদ্ভট মনে হয়, তখন আমাদের উচিত হবে না সেটাকে কোনো না- কোনোভাবে সত্য প্রমাণ করতে চেষ্টা করা, কিন্তু কীভাবে তা সত্য বলে মনে হয় তা বোঝার চেষ্টা করা আমাদের উচিত। ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্পনাশক্তির এই অনুশীলন একই সঙ্গে আমাদের চিন্তার পরিধি বাড়ায় এবং উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে, আমাদের অনেক ধারণা বা সংস্কার অন্য মেজাজের একটি যুগের মানুষের কাছে কতটা নির্বোধ, বোকামিপূর্ণ মনে হতে পারে।
আমরা এ অধ্যায়ে আলোচনা করব পিথাগোরাস ও হেরাক্লিটাস সম্বন্ধে। তবে এ দুজনের মধ্যবর্তী আরো একজন দার্শনিক আছেন। তার গুরুত্ব অবশ্য অপেক্ষাকৃত কম। তিনি জেনোফেনিস। তার জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ খুবই অনিশ্চিত। তার সময়কাল নির্ধারণ করা যায় শুধু এই তথ্য থেকে যে, তার রচনায় পিথাগোরাসের উল্লেখ আছে, আর হেরাক্লিটাস উল্লেখ করেছেন তার কথা। জন্মসূত্রে জেনোফেনিস ছিলেন আয়োনীয়, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি বাস করেছেন দক্ষিণ ইতালিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব বস্তুর সৃষ্টি মাটি ও পানি থেকে। দেবতাদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব শক্তিশালী একজন মুক্তচিন্তার মানুষ। হোমার ও হেসিয়ড দেবতাদের ওপর এমন সব বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন যেগুলো নশ্বর মানবদের কাছে লজ্জাকর ও ঘৃণ্য : চুরি, ব্যভিচার, পরস্পরকে বিপথগামী করা…মানুষেরা মনে করে দেবতারা যে রকম, তাদের জন্মই হয়েছে সেই রূপে। আর মনে করে, দেবতাদেরও মানুষের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ আছে, মানুষের মতোই তাদের কণ্ঠস্বর, আকৃতি…হ্যা! যদি ষাঁড় ও ঘোড়াদের মানুষের মতো হাত থাকত আর সেই হাত দিয়ে তারা ছবি আঁকতে পারত, মানুষের মতো শিল্পকর্ম করতে পারত, তাহলে ঘোড়ারা দেবতাদের ছবি আঁকত ঘোড়ার মতো, আর ষাঁড়েরা আঁকত ষাঁড়ের মতো। আর দেবতাদের দেহগুলো তারা বিভিন্ন রকম ঘোড়া আর বিভিন্ন রকম ষাঁড়ের মতো করে আঁকত…ইথিওপিয়ার দেবতাদের রং কালো, নাক বোঁচা। থ্রেস-এর লোকেরা বলে তাদের দেবতাদের চোখ নীল আর চুল লাল। জেনোফেনিস এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, সে ঈশ্বর আকারে ও চিন্তায় মানুষের মতো নন, তিনি তার মনের শক্তিবলে সবকিছু অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ করেন। জেনোফেনিস পিথাগোরাসের দেদহান্তরবাদকে বিদ্রূপ করতেন। একদিন পথে যেতে যেতে তিনি (পিথাগোরাস) দেখতে পেলেন একটি কুকুরকে পীড়ন করা হচ্ছে। তিনি বললেন, থামো ওকে আঘাত কোরো না। সে একজন বন্ধুর আত্মা। আমি তার কণ্ঠ শুনে তা বুঝতে পেরেছি। জেনোফেনিস মনে করতেন, ধর্মতত্ত্বের বিষয়গুলোর মধ্যকার সত্য অনুধাবন করা অসম্ভব। দেবতাদের সম্বন্ধে আমি যেসব বিষয়ে কথা বলি সেসব সম্পর্কে নিশ্চিত সত্য জানে এমন মানুষ নেই, কখনো থাকবেও না। হ্যাঁ, এমনকি যদি কোনো মানুষ এমন কিছু বলে যা সম্পূর্ণরূপে সত্য, তবুও সে নিজেই সেই সত্যকে জানতে পারে না। একমাত্র অনুমান ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই। পিথাগোরাস ও অন্যদের মরমিবাদী প্রবণতার বিপরীতে যেসব দার্শনিক ছিলেন, জেনোফেনিসের স্থান তাদের ধারায়। তবে স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি প্রথম সারির নন।
আমরা যেমনটি দেখেছি, পিথাগোরাসের মতবাদগুলোকে তার শিষ্যদের মতবাদগুলো থেকে আলাদা করে শনাক্ত করা কঠিন। তা ছাড়া, পিথাগোরাস যদিও খুবই প্রাচীন, তবুও তার ধারার প্রভাব মূলত অন্য অনেক দার্শনিকের প্রভাবের পরবর্তীকালীন। তাদের মধ্যে প্রথম জন হচ্ছে হেরাক্লিটাস। তিনি একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। হেরাক্লিটাসের আবির্ভাব খ্রি.পূ. ৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। তার জীবন সম্পর্কে জানা যায় খুব সামান্যই। শুধু জানা গেছে যে তিনি ছিলেন এফেসাস-এর একজন অভিজাত নাগরিক। প্রাচীনকালে তিনি খ্যাত ছিলেন প্রধানত এই মতবাদের জন্য যে, সবকিছুই একটি নিত্য-পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। কিন্তু দেখা যাবে, এটা তার অধিবিদ্যার অনেকগুলো দিকের একটি মাত্র।
হেরাক্লিটাস ছিলেন একজন আয়োনীয়, কিন্তু মিলেসীয়দের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের অংশীদার তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন মরমিবাদী, তবে খুবই অদ্ভুত একধরনের মরমিবাদী। তিনি মনে করতেন, আদিবস্তু হচ্ছে আগুন; আগুনের মধ্যে যেমন করে অগ্নিশিখার জন্ম হয়, তেমনি প্রত্যেক বস্তু জন্ম হয় অন্য একটি কিছুর মৃত্যুর ফলে। নশ্বররা অবিনশ্বর আর অবিনশ্বরা নশ্বর-নশ্বরের জন্মের মধ্যে আছে অবিনশ্বরের মৃত্যু আর নশ্বরের মৃত্যুর মধ্যে অবিনশ্বরের জন্ম। জগতে ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য গঠিত হয় পরস্পর বিপরীতধর্মী বস্তুগুলোর মিলন থেকে। সব বস্তুর উৎপত্তি এক অভিন্ন বস্তু থেকে, আর সেই একের উৎপত্তি সব বস্তু থেকে। কিন্তু বহুর গুরুত্ব একের চেয়ে কম, এক হলো ঈশ্বর।
হেরাক্লিটাসের রচনার যেটুকু আমাদের কাল পর্যন্ত টিকে আছে, তা থেকে তার চরিত্রের যে পরিচয় মেলে তা সৌহার্দ্যময় নয়। ঘৃণা বা বিরূপ মনোভাবের প্রতি তার বেশ আসক্তি ছিল, আর তিনি ছিলেন একজন গণতন্ত্রমনার বিপরীত। সহ-নাগরিকদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এফেসাস-এর প্রত্যেকটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি গলায় দড়ি দিয়ে মরে গিয়ে নগরটাকে শশ্রুবিহীন নারীদের জন্য রেখে যায় তাহলেই ভালো হয়। কারণ তারা তাদের মধ্যেকার সর্বোত্তম ব্যক্তি হারমোডরাসকে এই বলে বিতাড়িত করেছে, আমরা এমন কাউকে রাখব না যে আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম; যদি সে রকম কেউ থাকে, তাকে অন্য কোনোখানে, অন্য লোকদের মধ্যে গিয়ে সর্বোত্তম হতে বলব। হেরাক্লিটাস তার পূর্বসূরিদের মধ্যে শুধু একজন ছাড়া সব প্রখ্যাত ব্যক্তির সম্বন্ধে মন্দ কথা বলেছেন
তাদের তালিকা থেকে হোমারকে বের করে এনে চাবকানো উচিত।
যাদের আলোচনা আমি শুনেছি তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি বুঝতে পেরেছেন যে প্রজ্ঞা সবকিছুর থেকে আলাদা।
নানা ধরনের বস্তুকে জানার বিদ্যা কোনো কিছু বুঝতে শেখায় না, শেখালে হেসিয়ড, পিথাগোরাস, জেনোফেনিস আর হেকাটিয়াস অনেক কিছু বুঝতে শিখতেন।
পিথাগোরাস দাবি করতেন…তার প্রজ্ঞা আছে। আসলে তার যা ছিল তা নেহায়েত বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান আর দুষ্টামির কলাকৌশল।
একমাত্র যে ব্যক্তিটি হেরাক্লিটাসের নিন্দার ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি টিউটেমাস। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, টিউটেমাস বলেছিলেন অধিকাংশ মানুষ খারাপ।
মানবজাতির প্রতি ঘৃণা পোষণের ফলে হেরাক্লিটাস মনে করতেন, মানুষকে নিজেদের পক্ষে মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় শুধু বল প্রয়োগের দ্বারা। তিনি বলতেন, প্রত্যেকটি পশুকে তৃণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে। তার আরো একটি মন্তব্য ছিল, গর্দভরা সোনা চায় না, খড় চায়।
এসব কারণে যেমনটি প্রত্যাশিত, হেরাক্লিটাস যুদ্ধে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধই সবকিছুর জনক, সবার রাজা। যুদ্ধই কাউকে দেবতা বানিয়েছে, কাউকে বানিয়েছে মানুষ, কাউকে করেছে বন্দি, কাউকে মুক্ত। তিনি আরো বলেন, হোমার বলেছিলেন, ঈশ্বর আর দেবতাদের মধ্যে এই বিরোধের কি অবসান হবে না! ঠিক বলেননি হোমার। তিনি বুঝতেই পারেননি যে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা করছেন। তার প্রার্থনা পূর্ণ হলে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে, আর দ্বন্দ্ব বিরোধই ন্যায়বিচার, সব বস্তুর সৃষ্টি ও বিলয় ঘটে বিরোধের মধ্য দিয়ে।
হেরাক্লিটাসের নৈতিকতা একধরনের গর্বিত কৃচ্ছসাধনা। নিটশের নৈতিকতার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। হেরাক্লিটাস মনে করেন, আত্মা আগুন ও পানির মিশ্রণ, আগুন মহৎ আর পানি হীন। যে আত্মার বেশি অংশ আগুন তাকে তিনি বলেন শুষ্ক। তিনি বলেন, শুষ্ক আত্মা সবচেয়ে প্রজ্ঞাময় ও সর্বোত্তম। আত্মা যখন আর্দ্র হয় তখন সে আনন্দ বোধ করে। একজন পুরুষ যখন মাতাল হয়, দাড়িগোঁফহীন নারীর অঙ্গুলিহেলনে চলে, টলমল করে, বুঝতে পারে না কোথায় সে পা ফেলছে, তখন তার আত্মা আর্দ্র হয়।আত্মা যখন পানি হয়ে যায় তখন তার মৃত্যু ঘটে। কোনো ব্যক্তির মনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। সে যা পেতে চায়, তা ক্রয় করে আত্মার বিনিময়ে। মানুষ যা পেতে চায় তার সবকিছু পাওয়া মানুষের জন্য ভালো নয়। কেউ বলতে পারেন, হেরাক্লিটাস আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ক্ষমতাকে মূল্য দেন, আর সেসব আবেগকে ঘৃণা করেন যেগুলো মানুষকে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে।
নিজের যুগের ধর্মগুলোর প্রতি, অন্তত বাক্কাসীয় ধর্মের প্রতি হেরাক্লিটাসের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিরূপ, কিন্তু সেটা একজন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবাদীর বিরূপতার মতো নয়। হেরাক্লিটাসের নিজের ধর্ম আছে, সমকালীন ধর্মতত্ত্বের কিছু অংশ তিনি নিজের মতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে নিতেন আর কিছু অংশ বেশ ঘৃণাভরে নাকচ করে দিতেন। তাকে বাক্কাসীয় বলা হয়েছে (কর্নফোর্ড), আবার তাকে গুহ্য বিষয়াদির ব্যাখ্যাকারী হিসেবেও মনে করা হয়েছে (ফ্লেইডেরার)। আমার মনে হয় না, এ সম্পর্কিত উদ্ধৃত্তিগুলো এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। লোকজন যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। এ কথা থেকে এমন মনে হয় যে তার মনে এমন গুহ্য বিষয়েরও ধারণা ছিল যেগুলো অপবিত্র নয়, কিন্তু সেগুলো প্রচলিত গুহ্যাচারগুলো থেকে বেশ ভিন্ন ধরনের। তিনি যদি অশ্লীল বিষয়াদির বিরুদ্ধে অত্যধিক নিন্দামুখর প্রচারণায় লিপ্ত না হতেন তাহলে একজন ধর্মসংস্কারক হতে পারতেন।
হেরাক্লিটাস সম্পর্কে নিচে বর্ণিত মতগুলো এখনো প্রচলিত আছে। এগুলো তার যুগের ধর্মতত্ত্বগুলোর ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। ডেলফি নগরীতে বর্ষিত দৈববাণী ঈশ্বরের। তিনি তার অর্থ প্রকাশও করেন না, গোপন রাখেন না, বরং প্রতাঁকের সাহায্যে তা প্রদর্শন করেন। আর সিবিল, যে সুগন্ধি মাখে না, জমকালো পোশাক পরে না, সে উত্তেজিত ঠোঁটে নিরানন্দ কথাবার্তা বলে; তার ভেতরের দেবতার কল্যাণে সে তার কণ্ঠস্বর নিয়ে সহস্রাধিক বছর অতিক্রম করে।
হাডেস-এ আত্মার গন্ধ পাওয়া যায়। মহত্তর মৃত্যু বৃহত্তর ভাগ লাভ করে (যারা এমন মৃত্যুবরণ করে তারা দেবতায় পরিণত হয়)। নিশাচর, জাদুকর, বাক্কাসের পুরোহিত এবং মদ-ভাটির যাজিকারা গুহ্য বিষয়াদির কারবারি। লোকেরা যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। আর তারা এমনভাবে এসব ছবিকে উপাসনা করে, যেন-বা তারা মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে কথা বলছে। তারা জানে না, দেবতা ও বীদের স্বরূপ কী। কারণ তারা ডায়োনিসাসের পানে শোভাযাত্রা করে আর লজ্জাকর লিঙ্গাত্মক স্তোত্ৰগীত গায়, তা যদি তারা নাও করত, তার চেয়েও লজ্জাজনক আচরণ তারা করত নিশ্চয়। কিন্তু ডায়োনিসাস আর হাডেস অভিন্ন, অথচ তারা সেই ডায়োনিসাসের জন্যই পাগল হয়, মদের ভঁটি ঘিরে ভোজনোৎসবে মেতে ওঠে। তারা রক্ত মেখে বৃথাই নিজেদের পবিত্র করার চেষ্টা করে, ঠিক যেন কেউ কাদার মধ্যে পা দিয়ে কাদায় পা ধুয়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে এভাবে কাদায় পা ধুতে দেখলে মানুষ তাকে পাগল ঠাওরায়।
হেরাক্লিটাস মনে করতেন আদি উপাদান হচ্ছে আগুন। আগুন থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। পাঠকের মনে পড়বে, থেলিস মনে করতেন সবকিছুর সৃষ্টি পানি থেকে। অ্যানাক্সিমেনিস মনে করতেন আদি উপাদান বায়ু। আর হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস ছিল আদি উপাদান আগুন। অবশেষে রাষ্ট্রনায়কোচিত একটি সমঝোতা পাওয়া যায় এম্পিডক্লিসের কাছ থেকে। তিনি মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি-এই চার উপাদানকেই স্বীকৃতি দেন। এই পর্যায়ে এসে প্রাচীন রসায়নশাস্ত্র থেমে দাঁড়ায়। যত দিন পর্যন্ত না মুসলমান আলকেমিস্টরা পরশমণি, অমরত্ব-সুধা আর নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার পদ্ধতি অনুসন্ধান আরম্ভ করেছেন, তত দিন পর্যন্ত রসায়নশাস্ত্রের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যা এমন গতিশীল যে তা অত্যুৎসাহী আধুনিক ব্যক্তিদেরও বেশ সন্তুষ্ট করতে পারে : এই জগৎ, যা কিনা সবার কাছে অভিন্ন, তা মানুষ-দেবতা কারোর দ্বারাই সৃষ্ট নয়। বরং তা সদা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে, এ এক চিরজ্বলন্ত আগুন, ক্ষণে জ্বলছে, ক্ষণে নিভছে। আগুন প্রথমে রূপান্তরিত হয় সমুদ্রে, আর সমুদ্রের অর্ধেক মাটি, অর্ধেক ঘূর্ণিবায়ু। এ রকম জগতে নিরন্তর পরিবর্তনই প্রত্যাশিত। হেরাক্লিটাস এই নিরন্তর পরিবর্তনেই বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তার আরো একটি তত্ত্ব ছিল। সেটিকে তিনি পরিবর্তনের তত্ত্বের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। তত্ত্বটি ছিল বিপরীত বস্তুগুলোর মিলনের তত্ত্ব। হেরাক্লিটাস বলেন, মানুষ জানে না বিরোধপূর্ণ ব্যাপারগুলোর মধ্যে সমঝোতা ঘটে কীভাবে। এটা আসলে বিপরীতমুখী চাপগুলোর ঐক্যাবিধান-ধনুক ও বীণার মতো। দ্বন্দ্বের প্রতি হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস এই তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত; দ্বন্দ্বের মধ্যে বিপরীতগুলোর মিলনের ফলে একটি গতির সৃষ্টি হয়, যা কিনা একটি ছন্দ। জগতে একটি ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য বৈচিত্র্যের ফল : জোড় বস্তুগুলো একইসঙ্গে সমগ্র, আবার সমগ্র নয়। একত্রিত, আবার বিচ্ছিন্ন। বৈরিতামুক্ত, আবার বিরোধপূর্ণ। সব বস্তু মিলে একের সৃষ্টি, আবার সব বস্তুর উৎপত্তি এক থেকে।
কখনো কখনো হেরাক্লিটাসের বক্তব্য থেকে মনে হবে ঐক্য বৈচিত্র্যের চেয়ে অধিকতর মৌলিক : শুভ ও অশুভ এক। ঈশ্বরের কাছে সবকিছুই সুন্দর, শুভ ও ন্যায্য। কিন্তু মানুষ কিছু জিনিসকে ন্যায্য আর কিছু জিনিসকে অন্যায্য মনে করে। ঊর্ধ্বমুখী পথ আর নিম্নমুখী পথ এক এবং অভিন্ন। ঈশ্বর হলেন রাত ও দিন, শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল, যুদ্ধ ও শান্তি, অরুচি (অতিপানভোজনের ফলে) ও ক্ষুধা। কিন্তু তিনি বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক আগুনের মতো; আগুনের সঙ্গে মসলা মেশালে সে মসলার স্বাদ-গন্ধ অনুসারে নাম হয় সে আগুনের। তবুও, মিলিত হবার মতো বৈপরীত্য না থাকলে কোনো ঐক্য সম্ভব হতো না : আমাদের জন্য যা ভালো তা হচ্ছে বৈপরীত্য।
হেরাক্লিটাসের এই তত্ত্বে হেগেলের দর্শনের বীজাণু রয়েছে। হেগেলের দর্শন অগ্রসর হয়েছে বিপরীতগুলোর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। অ্যানাক্সিমেন্ডারের অধিবিদ্যার মতো হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যায়ও মহাজাগতিক ন্যায়বিচারের একটি ধারণার প্রাধান্য রয়েছে। মহাবিশ্বে এমন একটি ন্যায়বিচার আছে যার ফলে বিপরীতগুলোর দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষই কখনো চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে না।
সব বস্তুই আগুনের বিনিময় আর আগুন সবকিছুর বিনিময়, যেমনটি সোনার বিনিময়ে সবকিছু পাওয়া যায়, আর সবকিছুর বিনিময়ে সোনা পাওয়া যায়। আগুন জীবন লাভ করে বাতাসের মৃত্যুতে, আর বাতাস বেঁচে থাকে আগুনের মৃত্যুতে। মাটির মৃত্যু হচ্ছে পানির জীবন, আর মাটির জীবন হচ্ছে পানির মৃত্যু। সূর্য অতিক্রম করবে না তার সীমারেখা। যদি করে, তাহলে এরিনাইসরা-ন্যায়ের পরিচারিকারা-ধরে ফেলবে তাকে। আমাদের জানা থাকা দরকার যে সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে। দ্বন্দ্বই ন্যায্য।
হেরাক্লিটাসে বারবার যে ঈশ্বরের কথা পাওয়া যায়, সে ঈশ্বর দেবতাদের থেকে আলাদা। মানুষের পথে কোনো প্রজ্ঞা নেই, কিন্তু ঈশ্বরের পথে প্রজ্ঞা আছে…ঈশ্বর মানুষকে বলেন বাছা, এমনকি মানুষ মানুষকে বলে শিশু…সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটিও ঈশ্বরের তুলনায় উলুক, ঠিক যেমন সবচেয়ে সুন্দর উলুকটিও মানুষের তুলনায় কুৎসিত।
সন্দেহ নেই যে হেরাক্লিটাসের ঈশ্বর তার মহাজাগতিক ন্যায্যতার ধারণাটির মূর্ত প্রকাশ। সবকিছুই পরিবর্তনশীল অবস্থায় বিরাজমান-এই তত্ত্বটি হেরাক্লিটাসের তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। প্লেটোর থিয়াটিটাস-এর বর্ণনা অনুসারে এই তত্ত্বটির ওপরেই হেরাক্লিটাসের অনুসারীগণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। তুমি এক নদীতে দুবার পা ফেলতে পারবে না কারণ তোমার উপর দিয়ে সর্বদাই নতুন জল প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি দিনের সূর্যই নতুন।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, সার্বিক পরিবর্তনে বিশ্বাসের বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে হেরাক্লিটাসের এই বাক্যে : সব বস্তুই বহমান। কিন্তু তিনি যে এই বাক্যটি সত্যই বলেছিলেন তার কোনো প্রমাণ নেই, যেমন প্রমাণ নেই যে ওয়াশিংটন বলেছিলেন, বাবা, আমি তো মিথ্যে বলতে পারি না এবং অয়েলিংটন বলেছিলেন, সৈন্যরা ওঠো এবং আক্রমণ করো।
প্লেটোর পূর্ববর্তী সব দার্শনিকের বক্তব্য সম্পর্কে জানা যায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে। সে উদ্ধৃতিগুলোর বেশিরভাগই প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দেওয়া, দার্শনিকদের বক্তব্যগুলো খণ্ডন করার প্রয়োজনে তারা উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছেন। হেরাক্লিটাসের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। তার বক্তব্য সম্পর্কেও জানা যায় উদ্ধৃতি থেকে। আধুনিক কোনো দার্শনিককে জানার একমাত্র উৎস যদি হতো তার শত্রুদের বাদানুবাদ, তাহলে তার অবস্থাটা কী দাঁড়াত সে কথা ভাবলে দেখা যাবে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দার্শনিকরা কতই না প্রশংসনীয়, তাদের শত্রুদের ছড়ানো সব প্রতিহিংসার পরেও তারা যথেষ্ট মহৎ বলে প্রতিভাত হবেন। সে যাই হোক না কেন, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল একমত যে হেরাক্লিটাসের শিক্ষা ছিল : কোনো কিছুরই অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়নি, সবকিছুই অস্তিত্বলাভের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। (প্লেটো) এবং কোনো কিছুই অপরিবর্তিতরূপে বিরাজমান নয়। (অ্যারিস্টটল)।
এই তত্ত্বের আলোচনায় আবার ফিরে আসা যাবে প্লেটো সম্পর্কিত আলোচনার সময়। প্লেটো এই তত্ত্বটি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। দার্শনিকগণ এই তত্ত্বের ব্যাপার কী বলেছেন সে অনুসন্ধানে আপাতত না গিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব এ সম্পর্কে কবিদের অনুভূতি কী এবং বিজ্ঞানের লোকজন এ ব্যাপারে কী বলেছেন।
যেসব সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর প্রবৃত্তিগুলোর একটি হচ্ছে স্থায়ী একটি-কিছুর আকাঙ্ক্ষা বা অনুসন্ধান। সন্দেহ নেই যে এ প্রবৃত্তির উৎস গৃহের প্রতি ভালোবাসা এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা। তাই দেখা যায়, এই প্রবৃত্তি সেই সব মানুষের মধ্যে বেশি তীব্র, যাদের জীবনযাপন বিপদসঙ্কুল পরিবেশে। ধর্ম স্থায়িত্বের অন্বেষণ করে দুই ভাবে : ঈশ্বরের মধ্যে অমরত্বে। ঈশ্বরে অস্থিরতার বা পরিবর্তনশীলতার ছায়ামাত্র নেই; আর মৃত্যুর পরবর্তী জীবন চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর হাসি-খুশি মনোভাব মানুষকে এসব অনড় ধারণাগুলোর প্রতি বিমুখ করে তোলে। আধুনিক উদারপন্থী ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাস করে যে স্বর্গেও প্রগতি আছে এবং ঈশ্বরের মাথায়ও চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটছে। কিন্তু এসব ধারণার মধ্যেও স্থায়ী কিছু আছে, যথা খোদ প্রগতিকে এবং তার সর্বব্যাপী গন্তব্যকে মনে করা হচ্ছে স্থায়ী। আবার এক নিমেষের বিপর্যয়েই মানুষ ফিরে যায় তার পুরোনো অপার্থিব জগতে, সব আশা-ভরসা ন্যস্ত করে তারই ওপর। সে বলে, এই পৃথিবীতে জীবন যদি হতাশায় ভরে ওঠে তাহলে কেবল স্বর্গেই শান্তির সন্ধান করা যায়। যা কিছু মানুষের প্রিয় তার সবই হরণ করে নিয়ে যায় কাল-এই নিয়ে কতই না অনুশোনা করেছেন কবিরা।
যৌবনের উদ্দামতাকে বিদ্ধ করে কাল
আর সুন্দরের কপালে এঁকে দেয় বলিরেখা
প্রকৃতির দুর্লভ সত্য কালের আহার
কালের কাস্তে কচুকাটা করবে সব-রবে না কিছুই।
তবে সেইসঙ্গে তারা সাধারণত বলেন যে তাদের কাব্যগুলো অমর–
তবুও, কালের কাছে প্রত্যাশা, আমার কবিতা রবে।
থাক না তার নিষ্ঠুর হাত, আমি গাইব তোমার মহিমা।
যা কিছু কালের মধ্যে বিরাজমান তা ক্ষণস্থায়ী–এ কথা প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে দার্শনিকতাপ্রবণ মরমিবাদীগণ শাশ্বতের এক ধারণা উদ্ভাবন করেছেন- শাশ্বত সীমাহীন কালব্যাপী বিরাজমান কিছু নয়, বরং কাল-প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বাইরের একটি অস্তিত্ব। কিছু কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের মতে, উদাহরণস্বরূপ ডিন ইঙ্গের মতে, শাশ্বত জীবন বলতে ভবিষ্যৎকালের প্রতিটি মুহূর্তজুড়ে অস্তিত্ব বোঝায় না, বরং তারা সম্পূর্ণরূপে সময়নিরপেক্ষ সত্তার একটি অবস্থা, যেখানে আগে বা পরে বলে কিছু নেই এবং সে কারণে পরিবর্তনে কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনা নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন ভগান
সে-রাতে আমি শাশ্বতকে দেখেছি
বিশুদ্ধ আর অনিঃশেষ আলোকের এক বলয় যেন
শান্ত আর উজ্জ্বল
আর নিচে তাকে ঘিরে প্রহর, দিবস, বর্ষ
গোলক-তাড়িত
যেন এক বিপুল ছায়া চলমান
তাতে নিক্ষিপ্ত বিশ্ব ও তার সর্বস্ব।
দর্শনের সুবিখ্যাত কয়েকটি তত্ত্বে এই ধারণাটিই পরিমিত গদ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ধৈর্যসহকারে যুক্তি অনুসরণ করলে আমরা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হব।
পরিবর্তনের প্রতি সমুদয় বিশ্বাস সত্ত্বেও হেরাক্লিটাস নিজে মনে করতেন, একটি কিছু আছে যা চিরস্থায়ী। শাশ্বতের ধারণা (অসীম স্থিতিকালের বিপরীত হিসেবে) এসেছে পারমিনাইডিস থেকে; হেরাক্লিটাসে তা দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার দর্শনে কেন্দ্রীয় আগুনটি কখনোই নেভে না : বিশ্ব সর্বদা এক চিরঞ্জীব আগুন ছিল, আছে এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু আগুন অবিরামভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার স্থায়িত্ব কোনো বস্তুর স্থায়িত্ব নয়, বরং একটি প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব-যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গি হেরাক্লিটাসের নয়।
দর্শনের মতো বিজ্ঞানও পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চের মধ্যে কিছু স্থায়ী অধঃস্তর অন্বেষণের মাধ্যমে নিরন্তর পরিবর্তনের তত্ত্বটি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। এই আকাক্ষা রসায়নশাস্ত্রের দ্বারা পূরণ হয়েছিল বলে মনে হয়। দেখা গেছে, আগুন আপাতদৃষ্টিতে নিভে গেলেও বস্তুতপক্ষে ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয় : উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটে, কিন্তু সেই বিন্যাসের আগে যেসব পরমাণু ছিল পুনর্বিন্যাস-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার পরেও সেগুলোর প্রত্যেকটি থেকে যায়। সে অনুসারে ধারণা করা হয়েছিল যে, পরমাণু ধ্বংসযোগ্য নয় এবং বস্তুজগতে সব পরিবর্তন আসলে স্থায়ী উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস মাত্র। তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত এই মত চালু ছিল, কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার পরে জানা গেল, পরমাণু বিভাজিত হতে পারে।
অদম্য পদার্থবিজ্ঞানীরা নতুন নতুন এবং ক্ষুদ্রতর একক আবিষ্কার করলেন, সেগুলোকে বলা হয় ইলেকট্রন ও প্রোটন-এদের সমন্বয়েই পরমাণু গঠিত। কিছুকাল ধরে এমন ধারণা চালু ছিল যে, এই এককগুলো অবিভাজ্য, যেমন আগে পরমাণুর ক্ষেত্রে মনে করা হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেল, প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং তা থেকে নতুন বস্তু উৎপন্ন হয় না, বরং বিশ্বব্যাপী এমন এক শক্তি সঞ্চারিত হয় যার বেগ আলোর বেগের সমান। স্থায়ী একটি কিছু হিসেবে বস্তুর জায়গা দিতে হয়েছে শক্তিকে। কিন্তু শক্তি বস্তুর মতো নয়, একটি জিনিস সম্পর্কে কোনো সাধারণ-জ্ঞানপ্রসূত ধারণা নয়। বরং শক্তি ভৌত প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। ব্যাপারটাকে হেরাক্লিটাসের আগুনের মতো মনে করা যেতে পারে, কিন্তু তা দহনের একটি প্রক্রিয়া, দাহ্য বস্তু নয়। যা দাহ্য তা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতরের দিকে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহাশূন্যের পদার্থগুলোকে চিরস্থায়ী ভাবার কোনো সুযোগ রাখেনি। গ্রহগুলো বেরিয়ে এসেছে সূর্য থেকে, আর সূর্যের উৎপত্তি নীহারিকা থেকে। সূর্য কিছুকাল ধরে আছে, আরো কিছুকাল থাকবে, কিন্তু একদিন না একদিন-হয়তো কোটি কোটি বছর পরে-তা বিস্ফোরিত হবে এবং সেই সঙ্গে সব গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্তত এমনটাই বলেন। সেই চরম লগ্ন এগিয়ে আসতে আসতে একদিন তারা হয়তো দেখতে পাবেন যে তাদের হিসাব-নিকাশে ভুল-ত্রুটি আছে। হেরাক্লিটাসের নিরন্তর পরিবর্তনের মতবাদটি বেদনাদায়ক এবং আমরা দেখেছি, একে খারিজ করে দিতে বিজ্ঞান কিছুই করতে পারে না। বিজ্ঞান যেসব আশাকে হত্যা করেছে সেগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা দার্শনিকদের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা। তাই দার্শনিকরা এমন কিছুর অন্বেষণ করেছেন যা কালের রাজত্বের অধীনে নয়। এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে পারমিনাইডিসের হাতে।
৫. পারমিনাইডিস
গ্রিকদের পরিমিতিবোধের প্রতি আসক্তি ছিল না; তত্ত্বেও নয়, জীবনযাপনেও নয়। হেরাক্লিটাস মনে করতেন সবকিছুই বদলায়। পারমিনাইডিসের পালটা জবাব ছিল, কোনো কিছুই বদলায় না।
দক্ষিণ ইতালির ইলিয়া নগরীর অধিবাসী ছিলেন পারমিনাইডিস, তার জীবনকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক। প্লেটোর ভাষ্য অনুসারে, যুবক সক্রেটিস একবার (আনুমানিক খ্রি.পূ. ৪৫০ সাল) পারমিনাইডিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। পারমিনাইডিস তখন বৃদ্ধ। সক্রেটিস তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। ওই সাক্ষাতের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না তা কেবল অনুমানের বিষয়। তবে অন্যভাবে যা স্পষ্ট তা এই যে, প্লেটো নিজে পারমিনাইডিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আয়োনিয়ার দার্শনিকদের তুলনায় দক্ষিণ ইতালির এবং সিসিলির দার্শনিকরা মরমিবাদ ও ধর্মের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। কিন্তু পিথাগোরাসের প্রভাবে গণিতের বিকাশ আয়োনিয়ার তুলনায় বেশি ঘটেছিল ম্যাগনা গ্রেসিয়ায়। তবে সে যুগে গণিত মরমিবাদের সঙ্গে মিশ্রিত ছিল। পারমিনাইডিস পিথাগোরাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবে সে প্রভাবের মাত্রাটি অনুমাননির্ভর। যে কারণে পারমিনাইডিস ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে, তিনি অধিবিদ্যক যুক্তিশাস্ত্রের এমন একটি রূপ উদ্ভাবন করেন যা হেগেল পর্যন্ত তার পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, হেগেল নিজেও এই তালিকায় পড়েছেন। সাধারণভাবে বলা হয় পারমিনাইডিস যুক্তিশাস্ত্র আবিষ্কার করেছেন; কিন্তু আসলে তিনি যা আবিষ্কার করেছেন তা হলো যুক্তিশাস্ত্রের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো অধিবিদ্যা।
অন ন্যাচার নামের একটি কবিতায় পারমিনাইডিসের মতবাদ উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি ইন্দ্রিয়গুলোকে বিভ্রান্তিকর মনে করতেন এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সমাহারকে নিছক মায়া বলে নিন্দা করতেন। তার মতে, একমাত্র প্রকৃত সত্তা হচ্ছে পরম এক বা অদ্বিতীয়, যা অসীম ও অবিভাজ্য। হেরাক্লিটাসের তত্ত্বে যেমনটি বলা হয়েছে, এখানে প্রকৃত সত্তা সে রকম নয়-বিপরীতগুলোর মিলন নয়, কারণ পারমিনাইডিসের তত্ত্বে বিপরীত বলে কিছু নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তিনি দৃশ্যত মনে করতেন, শীতল মানে কেবল তা-ই যা গরম নয় এবং অন্ধকার অর্থ শুধুই অনালোক। তার এক বা অদ্বিতীয়ের ধারণা আমাদের ঈশ্বরের ধারণার মতো নয়। মনে হয় তিনি সেই সত্তাকে বস্তুগত এবং বিস্তৃত বলে মনে করতেন, কেননা তিনি তাকে বলেছেন একটি গোলকের মতো। কিন্তু তাকে বিভক্ত করা যায় না কারণ তার সমগ্রটাই সর্বত্র বিরাজমান।
পারমিনাইডিস তার তত্ত্বকে ভাগ করেছেন দুই ভাগে। যথা : সত্যের পথ এবং অভিমতের পথ। অভিমতের পথ নিয়ে এখানে আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সত্যের পথ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন-তার যতটুকু আমাদের কাল পর্যন্ত টিকে আছে-তার মূল দিকগুলো এ রকম : যা নেই তাকে তুমি জানতে পারো না-সেটা অসম্ভব-তুমি তা উচ্চারণও করতে পারো না। কারণ কোনো কিছু সম্পর্কে চিন্তা করা মানেই সেটির অস্তিত্ব আছে।
তাহলে এটা কেমন করে হতে পারে যে, যা আছে তা ভবিষ্যতেও থাকবে? কীভাবে তা অস্তিত্ব লাভ করল? যদি তা অস্তিত্ব লাভ করে থাকে তাহলে তা নেই, ভবিষ্যতে যদি তা অস্তিত্ব লাভ করে তাহলেও তা নেই। তাহলে তো হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়া বিলুপ্ত হবে এবং গত হচ্ছে কথাটা শোনা যাবে না।
যে-জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করা যায় আর যে-জিনিসের কারণে চিন্তার অস্তিত্ব আছে তা একই। কারণ অস্তিত্বমান কোনো বস্তু ছাড়া তা সম্পর্কে উচ্চারিত কোনো চিন্তা হতে পারে না।
এই যুক্তির সারকথা হলো : যখন তুমি কিছু সম্পর্কে চিন্তা করো, অবশ্যই কোনো একটা বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করো; যখন তুমি একটা নাম ব্যবহার করো, অবশ্যই তা একটা-কিছুর নাম। সুতরাং চিন্তা ও ভাষা উভয়েরই এমন বিষয় প্রয়োজন যা থাকে চিন্তা ও ভাষার বাইরে। আর, একটি বস্তু সম্পর্কে যেকোনো সময় চিন্তা করা বা কথা বলা যায় মানে যে-বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করা বা কথা বলা যায় তার অস্তিত্ব সর্বদা বিরাজমান থাকে। তাহলে, পরিবর্তন বলে কিছু থাকতে পারে না, কেননা পরিবর্তন ঘটে কেবল সেইসব বস্তুর মধ্যে যা অস্তিত্ব লাভ করে এবং বিলুপ্ত হয়।
দর্শনে একটিই চিন্তা ও ভাষা থেকে সাধারণ জগতের ব্যাপারে যুক্তির প্রথম দৃষ্টান্ত। অবশ্য এই যুক্তিকে ন্যায্য বলে গ্রহণ করা যায় না, কিন্তু এতে সত্যের কী উপাদান রয়েছে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যুক্তিটি আমরা উপস্থাপন করতে পারি এভাবে : ভাষা যদি নিছক অর্থহীন না হয় তাহলে প্রতিটি শব্দের অবশ্যই কিছু অর্থ থাকতে হবে এবং সাধারণভাবে একটি শব্দের অর্থ দ্বারা অন্য একটি শব্দের অর্থ বোঝাবে না, বরং এমন একটা-কিছু বোঝাবে যার অস্তিত্ব আছে; আমরা তা সম্পর্কে কিছু বলি বা না বলি তার ওপরে সেটার অর্থ থাকা-না-থাকা নির্ভর করে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যাক, জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে। এই নামে যদি কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির অস্তিত্ব না থাকত তাহলে নামটি (মনে হবে) অর্থহীন হয়ে যেত এবং যেসব বাক্যে এই নামটি ব্যবহার করা হবে সেগুলোরও কোনো অর্থ দাঁড়াবে না। পারমিনাইডিস মনে করতেন, জর্জ ওয়াশিংটনের অস্তিত্ব কেবল অতীতেই ছিল তাহলে চলবে না, বর্তমানেও তাকে অবশ্যই থাকতে হবে, কেননা আমরা এখনো তার নামটি অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারি। এটাকে স্পষ্টতই অসত্য মনে হয়, কিন্তু যুক্তিটি আমরা এড়িয়ে যাব কীভাবে?
একজন কাল্পনিক ব্যক্তির কথা ধরা যাক, ধরা যাক হ্যামলেট। হ্যামলেট ডেনমার্কের রাজপুত্র ছিলেন-এই বিবৃতিটি বিবেচনা করা যাক। কথাটি কিছু অর্থে সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিক অর্থে সত্য নয়। সত্য বিবৃতিটি হবে, শেক্সপিয়র বলেন যে হ্যামলেট ডেনমার্কের রাজপুত্র ছিলেন। বা আরো পরিষ্কারভাবে বললে, শেক্সপিয়র বলেন যে, ডেনমার্কে হ্যামলেট নামে এক রাজপুত্র ছিলেন। এখানে এখন আর কাল্পনিক কিছুই নেই। শেক্সপিয়র, ডেনমার্ক এবং হ্যামলেট শব্দটি-সবই বাস্তব। কিন্তু হ্যামলেট ধ্বনিটি বাস্তব কোনো নাম নয় কারণ হ্যামলেট বলে বাস্তবে কোনো মানুষকে ডাকা হয় না। যদি বলা হয়, হ্যামলেট একজন কাল্পনিক ব্যক্তির নাম-তাহলেও বাক্যটি কড়া অর্থে সঠিক হয় না। বলতে হবে কল্পনা করা হয় যে, হ্যামলেট একজন বাস্তব মানুষের নাম।
হ্যামলেট একজন কল্পিত মানুষ, একশৃঙ্গ প্রাণী (unicorn) একটি কল্পিত প্রজাতি। যেসব বাক্যে একশৃঙ্গ শব্দটি থাকবে সেগুলোর কিছু সত্য হবে, কিছু ভ্রান্ত হবে-কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষভাবে সত্য বা ভ্রান্ত হবে না। এই দুটি বাক্য বিবেচনা করা যাক: একটি একশৃঙ্গ প্রাণীর একটি শিং থাকে এবং একটি গরুর দুটি শিং থাকে। দ্বিতীয় বাক্যটির সত্যতার জন্য আপনাকে একটি গরুর দিকে তাকাতে হবে, এ ক্ষেত্রে এ কথা বলাই যথেষ্ট হবে না যে, কিছু কিছু বইতে বলা হয়েছে যে, গরুর দুটি শিং থাকে। কিন্তু একশৃঙ্গ প্রাণীর একটি শিং থাকে-এই বিবৃতির সাক্ষ্য শুধু বইতেই পাওয়া যাবে। আসলে এ ক্ষেত্রে সঠিক বিবৃতিটি হবে, কিছু কিছু বইতে বলা হয়েছে যে, এক শিংবিশিষ্ট এক জাতীয় প্রাণী আছে যাদেরকে একশৃঙ্গ প্রাণী বলা হয়। একশৃঙ্গ সম্বন্ধে সব বাক্যই প্রকৃতপক্ষে একশৃঙ্গ শব্দটির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ঠিক একইভাবে হ্যামলেট সম্বন্ধে সব কথাই বস্তুত হ্যামলেট শব্দটির সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কথা বলি শব্দ সম্পর্কে নয়, বরং শব্দটি দ্বারা যা বোঝায় তা সম্পর্কে। এটাই আমাদেরকে পারমিনাইডিসের যুক্তির কাছে নিয়ে যায়। আর তা হলো, যদি কোনো শব্দ অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হতে পারে তাহলে সেই শব্দ দ্বারা অবশ্যই একটা কিছু বোঝায়, কিছুই বোঝায় না। তা হয় না। সুতরাং সেই শব্দ দ্বারা যা বোঝায়, কিছু অর্থে তার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে।
তাহলে জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে আমরা কী বলব? দেখা যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে দুটো বিকল্প; একটি হলো এ কথা বলা যে, এখনো তার অস্তিত্ব আছে। আর অন্যটা হলো এ কথা বলা যে, আমরা যখন জর্জ ওয়াশিংটন শব্দ দুটি ব্যবহার করি তখন আসলে এই নামের কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে বলি না। উভয়ই কূটাভাসা বলে মনে হয়, তবে দ্বিতীয়টি একটু কম। যে-অর্থে দ্বিতীয়টি সত্য আমি তা দেখাবার চেষ্টা করব।
পারমিনাইডিস মনে করেন শব্দের স্থায়ী অর্থ থাকে। এ কথা আসলেই তার যুক্তির ভিত্তি এবং এই ভিত্তিকে তিনি প্রশ্নাতীত মনে করেন। কিন্তু একটি অভিধানে বা কোষগ্রন্থে একটি শব্দের যে-অর্থ থাকে-যাকে একটি শব্দের আনুষ্ঠানিক বা সামাজিকভাবে নির্ধারিত অর্থ বলা যেতে পারে-দুজন ব্যক্তি যখন সেই শব্দটি ব্যবহার করে তখন সেই একই ভাবনা তাদের মনের মধ্যে থাকে না।
জর্জ ওয়াশিংটন নিজে তার নাম ব্যবহার করতে পারতেন এবং তার সমার্থক হিসেবে আমি শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন। তিনি নিজের চিন্তাভাবনা ও দেহের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। সুতরাং অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি অধিকতর পরিপূর্ণ অর্থে নিজের নাম ব্যবহার করতে পারতেন। তার উপস্থিতিতে তার বন্ধুরা তার দেহের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে পারতেন এবং তার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে ধারণা করতে বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। তাদের কাছে জর্জ ওয়াশিংটন নামটির অর্থ তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ছিল। তার মৃত্যুর পরে তার বন্ধুদের প্রত্যক্ষণের বিকল্প হিসেবে স্মৃতির শরণ নিতে হয়েছে, এবার তারা যখন তার নামটি ব্যবহার করেন তখন তাদের মানসিক প্রক্রিয়ায় একটি পরিবর্তন ঘটে। আমরা যারা জর্জ ওয়াশিংটনকে দেখিনি তাদের মানসিক প্রক্রিয়াটি কিন্তু তার বন্ধুদের মানসিক প্রক্রিয়ার চেয়ে ভিন্ন। আমরা তার ছবির কথা ভাবতে পারি এবং নিজেকে বলতে পারি হ্যাঁ, এই লোক। আমরা ভাবতে পারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। যদি আমরা খুবই অজ্ঞ হই তাহলে তার ছবি দেখে আমাদের মনে হবে, এই লোকটিকে জর্জ ওয়াশিংটন বলে ডাকা হতো। এই নামকে ঘিরে যা কিছুই আমরা বলি না কেন, তা এই নামের খোদ মানুষটি সম্পর্কে নয়, কারণ সেই মানুষটিকে আমরা কখনো দেখিনি বা জানি না, বরং তা এমন একটা কিছু যা আমাদের অনুভূতি, স্মৃতি বা চিন্তায় বিরাজমান। এর দ্বারা পারমিনাইডিসের যুক্তির ভ্রান্তিটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
শব্দের অর্থের এই নিরন্তর পরিবর্তন এই সত্য দ্বারা ঢাকা পড়ে যে, যে-বাক্যের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট শব্দ থাকে তার সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে ওই পরিবর্তনে কিছু এসে যায় না। আপনি যদি এমন একটি বাক্য বলেন যার মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটন শব্দটি রয়েছে, এবং ওই বাক্যে জর্জ ওয়াশিংটন-এর জায়গায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা হয়, তাহলেও বাক্যটি একই রকম সত্য থেকে যাবে। এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্য রয়েছে। ওয়াশিংটন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার আগে একজন মানুষ বলতে পারতেন, আমি আশা করছি জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু তিনি বলবেন না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু এ ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিয়ে একটি নিয়ম তৈরি করে নেওয়া যায় এবং অবশিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে শুধু জর্জ ওয়াশিংটনের জন্য প্রযোজ্য যেকোনো বাক্যে জর্জ ওয়াশিংটনের জায়গায় ওই শব্দগুলো ব্যবহার করা যায়। তার সম্বন্ধে আমরা যা জানি তা কেবল এ ধরনের বর্ণনাত্মক বাক্যের মাধ্যমে জানতে পারি।
পারমিনাইডিস মনে করেন, সাধারণভাবে অতীত বলতে যা বোঝানো হয় তা যেহেতু আমরা বর্তমান সময়ে জানতে পারি, তাই তা আসলে অতীত হতে পারে না, বরং কিছু অর্থে তা বর্তমান সময়েও অস্তিত্বমান। তাই তিনি মনে করেন পরিবর্তন বলে কিছু নেই। জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে আমরা যা বলছি তা এই যুক্তিকে সমর্থন করে। এক অর্থে বলা যেতে পারে যে অতীত সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। যখন আমরা কোনো কিছু স্মরণ করি, স্মরণক্রিয়াটি ঘটে বর্তমান মুহূর্তে এবং আমাদের স্মরণ আর যে ঘটনাগুলো আমরা স্মরণ করছি সেগুলো এক জিনিস নয়। কিন্তু স্মরণক্রিয়ায় অতীতের ঘটনাবলির বর্ণনা করা হয়, আর বর্ণনা ও বর্ণিত ঘটনাবলির মধ্যে পার্থক্য করা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। এই পুরো যুক্তিটি থেকে দেখা যাচ্ছে, ভাষা থেকে অধিবিদ্যক সিদ্ধান্তে পৌঁছা কত সহজ। এ থেকে আরো দেখা যায় যে, এ ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তি এড়ানোর একমাত্র উপায় হিসেবে ভাষার যুক্তিশাস্ত্রীয় এবং মনস্ত ত্ত্বিক গবেষণা অগ্রসর হয়েছে, যা অধিকাংশ অধিবিদ্যক পণ্ডিত করেননি।
তবে আমার মনে হয়, পারমিনাইডিস যদি মৃত্যুলোক থেকে ফিরে আসতে পারতেন এবং আমি যেসব কথা বলছিলাম তা পাঠ করতেন, তাহলে তার কাছে এগুলো অত্যন্ত অগভীর, উপরভাষা বলে মনে হতো। তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি কীভাবে জানো যে জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে তোমার বক্তব্য একটি অতীত কাল সম্পর্কিত? তোমার নিজের বক্তব্য অনুসারেই প্রত্যক্ষ উল্লেখগুলো এমন সব বিষয় সম্পর্কে যেগুলো এই মুহূর্তে বর্তমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তোমার স্মৃতিচারণা ঘটছে এই মুহূর্তে তুমি যে সময়ের কথা স্মরণ করছ বলে তোমার মনে হচ্ছে সেই সময়ে নয়। স্মৃতিকে যদি জ্ঞানের একটি উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে মনের সামনে যে অতীত রয়েছে তা আসলে এই মুহূর্ত এবং সে কারণে কিছু অর্থে তা অবশ্যই এখনো অস্তিত্বমান।
এই তর্কের জবাব দেবার চেষ্টা আমি এখন করব না। এ জন্য স্মৃতিসম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। সেটা একটি কঠিন বিষয়। এই তর্কটি আমি এখানে উল্লেখ করছি পাঠকদের এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য যে, দার্শনিক তত্ত্ব, যদি সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়, সেগুলো প্রথমে যেভাবে উপস্থাপিত হয় তা খণ্ডনের পরে আবার নতুন রূপে উপস্থাপিত হতে পারে। খণ্ডন কদাচিৎ চূড়ান্ত ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আরো পরিমার্জনার সূচনা মাত্র।
পারমিনাইডিসের পর থেকে অতি আধুনিককাল পর্যন্ত তার কাছ থেকে যা গ্রহণ করা হয়েছে তা সব ধরনের পরিবর্তনের অসম্ভবপরতা নয়, বরং সারবস্তুর অবিনাশ্যতা। তার অব্যবহিত পরবর্তী উত্তরসূরিদের মধ্যে অবশ্য সারবস্তু শব্দটার দেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু এর ধারণাটি ইতোমধ্যেই তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। একটি সারবস্তুকে বিভিন্ন পরিবর্তনশীল বিধেয়র উদ্দেশ্য বলে বিবেচনা করা হতো। এভাবেই তা দর্শন, মনস্তত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের একটি মৌলিক ধারণা হয়ে উঠেছিল এবং দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে তা টিকে রয়েছে। আপাতত আমি শুধু এটুকু উল্লেখ করতে চাই যে সারবস্তুর ধারণাটি চালু হয়েছিল দৃশ্যমান সত্যগুলো অস্বীকার না করে পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলোর প্রতি সুবিচার করার একটি উপায় রূপে।
Cont...
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ