কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

14 August, 2021

কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই

 কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বারট্রান্ড রাসেল

বার্ট্রান্ড রাসেল আধুনিক যুগের এক আশ্চর্য কর্মঠ চিন্তাবিদ। ১৯১৪ সাল, রাসেল তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেই সময় তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন জ্ঞানতত্ত্ব বিষয়ে। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কোমল মনের এই শান্তিপ্রিয় দার্শনিক সভ্য দেশগুলির বর্বরতায় সব থেকে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। সেইসময় তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এক দূরবর্তী বিষয় সম্পর্কে–বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান’। কেননা তিনি জানতেন এটি এমন একটি বিষয় যা পরিণত হয়েছিল অত্যন্ত কদাকার বস্তুতে, তাই তিনি চাইতেন বিষয়টি যেন বাস্তব থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকে। দশবছর পরে, তখন তিনি বাহান্ন, সেই সময় তাঁর পূর্বতন সহকর্মীরা তাকে আবিষ্কার করে খুশী হয়েছিলেন কেননা পূর্বের রাসেল আর বর্তমান রাসেল সম্পূর্ণ অন্য মানুষ– সবল, হাসিখুশী, সদা প্রফুল্ল এবং একগুঁয়ে। এই দশটি বছর একটি মধ্যবর্তী দশক হলেও তা তাঁর সমস্ত আশা ও বন্ধুত্বকে শেষ করে দিয়েছিল, এবং একদা যে আভিজাত্যপূর্ণ জীবনধারণে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন ধ্বংস করেছিল তাকেও।

কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই


বার্ট্রান্ড ছিলেন রাসেল পরিবারভুক্ত। এই পরিবার ইংল্যান্ডের তথা প্রাচীনতম পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম। ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে বেশ কয়েক পুরুষ ধরে এই পরিবার সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছিল। বাট্রান্ডের ঠাকুর্দা লর্ড জন রাসেল ছিলেন একজন মহান ও উদার প্রধানমন্ত্রী। যিনি মুক্ত বাণিজ্য, সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা, ইহুদীদের বন্ধনমোচন ইত্যাদি যাবতীয় ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য একরোখা লড়াই চালিয়ে এসেছেন। তার বাবা ‘ভাইকাউন্ট অ্যামবারলে’ ছিলেন একজন মুক্ত চিন্তক। তিনি কখনওই চাননি তাঁর পুত্র বংশানুক্রমিক পশ্চিমী ধর্মতত্ত্বের দ্বারা ভারাক্রান্ত হ’ক। বার্ট্রান্ড তখন দ্বিতীয় আর্ল রাসেলের প্রমাণহীন উত্তরাধিকারী–সেইসময় তিনি তার উত্তরাধিকারলব্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করেন এবং সগর্বে নিজস্ব আয় থেকেই নিজস্ব খরচ খরচা নির্বাহ করতে থাকেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বিশ্বজনীন শান্তিবাদের জন্য তাঁকে চাকরী থেকে অব্যাহতি দিলে তিনি সমগ্র বিশ্বকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন এবং নিজে পরিণত হন এক ভ্রাম্যমান কূট তার্কিকে যাকে সমগ্র বিশ্ব সাদরে গ্রহণ করে।


যুদ্ধ-পূর্ব বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন ভিন্ন সত্তার অধিকারী গাণিতিক নৈয়ায়িক । সেই গাণিতিক নৈয়ায়িকের ভস্ম থেকে উঠে আসেন যুদ্ধোত্তর রাসেল–একজন রহস্যময় কমুউনিষ্ট-এর জন্ম হয়। তার মধ্যে হয়তো এক মৃদু অতীন্দ্রিয় চাপ কাজ করত যার প্রথম প্রকাশ ঘটে এক পর্বতপ্রমাণ বীজগাণিতীয় সূত্রের দ্বারা এবং তখন সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে বিকৃত ব্যাখ্যা জন্ম দিল এক নতুন ধর্মের অথবা বলা যায় এক দর্শনের। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে সবচাইতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিরোনাম হল– Mysticism & Logic’ বা ‘অতীন্দ্রিয়বাদ এবং তর্কবিদ্যা’। এটি অতীন্দ্রিয়তার প্রতি এক নির্দয় আক্রমণ। অতীন্দ্রিয়তার বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত প্রশস্তিকে অনুসরণ করে এটা লেখা। রাসেল উত্তরাধিকারসূত্রে ইংরেজ প্রত্যক্ষবাদী ঐতিহ্য লাভ করেছিলেন এবং কৃতসংকল্প ছিলেন শক্ত মানসিকতার জন্য কেননা তিনি জানতেন তিনি তা পারেন না।


সম্ভবত এটি ছিল এক অতিরিক্ত মূল্যায়ন, যে জন্য তিনি জোর দিয়েছিলেন ধর্মের যৌক্তিতার উপর এবং প্রস্তুত করেছিলেন এক গাণিতিক দেবত্বকে। তিনি বলেছিলেন বার্গস’-এর ‘সিনেমাটোগ্রাফিক অ্যানালজি ফর দ্য ইনটেলেক্ট’ বইটি পড়ার আগে অবধি তিনি কোন সিনেমা দেখেননি, আর বইটি পড়ার পর তিনি নিজেকে একটি উপস্থাপনার সাথে যুক্ত করেন যা ছিল মূলত দর্শনের একটি অধ্যায়। বার্গ-এর সময় ও বেগ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর মতে, সমস্ত বস্তুই আবশ্যকীয় তৎপরতা সহ জীবিত।’ কিন্তু এই বোধ রাসেলের মনে কোন দাগ কাটেনি। তাঁর কাছে এটি একটি সুন্দর কবিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা গণিত ভিন্ন তাঁর কাছে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বই নেই। তার কাছে ক্লাসিকেরও কোন স্থান ছিল না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় সতেজ যুক্তিতে তর্ক করতেন শিক্ষায় বিজ্ঞানের আরো প্রবেশ ঘটানোর জন্য, তিনি অনুভব করতেন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখের মূল কারণ অতীন্দ্রিয়তা এবং চিন্তার নিন্দনীয় দুর্বোধ্যতা। তার মতে নৈতিকতার প্রথম সূত্র হওয়া উচিত– ‘সূহজ সরল চিন্তা। একজন মানুষের মিথ্যা বিশ্বাসের চেয়ে বরং ভালো পৃথিবীর অকাল ক্ষয়। এটাই হচ্ছে আমাদের চিন্তার ধর্মীয়তা, যার লেলিহান শিখাই একদিন বিশ্বের সব ময়লাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।


তাঁর ভাবাবেগের নির্মলতাই তাঁকে অনিবার্যভাবে চালিত করে গণিতের দিকে। তিনি প্রায়ই শিহরিত হতেন এই অভিজাত বিজ্ঞানের প্রশান্ত যথার্থতার কথা ভেরে। তাঁর কাছে ‘গণিত শুধুমাত্র সত্য নয়, সর্বশেষ সৌন্দর্য শীতল; কঠোর, সাধাসিধে এক ভাস্কর্যের ন্যায়, যা আমাদের দুর্বল প্রকৃতির উপর কোন সাড়া না ফেলেই, চিত্রকলা অথবা সুরের চোখ ধাঁধানো ফাঁদ অতিক্রম না করেই– তা শুদ্ধ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পের ন্যায় কঠিন যথার্থতা দেখানোর যোগ্য। তাঁর বিশ্বাস ছিল গণিতের উন্নতি ঊনবিংশ শতাব্দীর সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য। গাণিতিক অসীমকে ঘিরে থাকা জটিলতার সমাধান সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যার জন্য আমাদের শতক গর্ব করতে পারে। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে আগলে রাখা পুরাতন জ্যামিতি প্রথম শতাব্দীতে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পৃথিবীর প্রাচীনতম ইউক্লিডীয় পাঠ্যগ্রন্থ অবশেষে অপসারিত হয়। এটা একটা বদনাম ভিন্ন কিছুই নয়।


সম্ভবত আধুনিক গণিতে অধিকাংশ উদ্ভাবনের উৎপত্তিগত স্বতঃসিদ্ধ সত্যকে বাতিল করে। রাসেল সেইসব মানুষদের উপর খুশী হন যারা স্বতঃপ্রত্যক্ষ সত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানান এবং যা অনিবার্য তার সম্পর্কেই নিজেকে প্ররোচিত করেন। তিনি এটা জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন যে দুটি সমান্তরাল রেখা এক জায়গায় মিলিত হতে পারে এবং সময়ের থেকে অংশ কখনই হতে পারে না।


তিনি সরল পাঠকদের স্তম্ভিত করে দিতে ভালবাসতেন, যেমন–যুগ্ম সংখ্যাগুলি হল সমস্ত সংখ্যার অর্ধসংখ্যা এবং সমস্ত সংখ্যাগুলির মতোই এই যুগ্ম সংখ্যাগুলিকেও পাওয়া যায়, যদিও প্রত্যেক সংখ্যার যুগ্ম সংখ্যাটি হচ্ছে তার দ্বিগুণ, বাস্তবিক এটাই হচ্ছে তাঁর সমগ্র বা মূল বিন্দু যে বিন্দু পর্যন্ত বস্তু অমীমাংসিত থাকে।


রাসেল গণিত বলতে পুনরায় প্রমাণ করতে চাইলেন তার কঠোর নৈর্ব্যক্তিকতা এবং বস্তুময়তাকে। সনাতন সত্য, পরম জ্ঞান– যা প্লেটোর ধারণার এক অবরোহী প্রণালী, স্পিনোজার সনাতন ধারা মূলকথা, যা তাঁর কাছে বিম্বের সার কথা। তাঁর মতে দর্শনের লক্ষ্য হওয়া উচিত অভিজ্ঞতার নিরিখে সত্য গঠন করা ও তার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে গণিতের সমতুল্য হওয়া। এই অত্যাশ্চর্য প্রত্যক্ষবাদী আরো মনে করতেন–’দার্শনিক প্রতিজ্ঞাগুলি নিশ্চিতভাবেই পূর্বতসিদ্ধ। এই প্রস্তাব বা প্রতিজ্ঞাগুলি কোন বস্তুর প্রতি দিকনির্দেশ করে না করে সম্পর্কের প্রতি, অথবা বলা চলে বিশ্বজনীন সম্পর্কের প্রতি। এগুলি কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনার অপেক্ষা রাখে না। যদি বিশ্বের সমস্ত নির্দিষ্ট বস্তুগুলি পরিবর্তিত হয়ে যায়, তথাপি এই অনুপাত সত্যই থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি সমস্ত A হয় B এবং X হয় A, তবে X হবে B, A যাই হোক না কেন। মরণশীলতা সম্পর্কে সক্রেটিসের পূর্বতন সার্বিক ন্যায় বা সিদ্ধান্তকে এটা সঙ্কুচিত করে তথাপি এই সিদ্ধান্ত সত্যই হত যদি সেখানে কোন সক্রেটিস, বা কোন মানুষ তা না-ও প্রমাণ করত । প্লেটো এবং স্পিনোজা ছিলেন সঠিক । তাঁদের মতে এই বিশ্ব যা যা দিয়ে তৈরি তা দিয়েই তার সার্বিকতা ব্যাখ্যা করা যায় । এই বিশ্ব যা-কিছু দিয়ে প্রস্তুত সেই সব কিছুই অপরিবর্তনীয়, কঠোর এবং সঠিক, এবং একজন গণিতবিদ নৈয়ায়িক জাতীয় মানুষরা হচ্ছেন সেইসব মানুষ যারা পূর্ণতাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসেন এবং তাঁদের কাছে তা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। পিথাগোরাস-এর উচ্চাশা ছিল দর্শনকে তার সমস্ত বিষয়সহ সঙ্কুচিত করে গণিতের আকারে নিয়ে আসা।


এই বর্ণনা হয়তো গাণিতিক দর্শনের প্রতি কোন মহান অবিচার সূচিত (যদি কেউ নিজস্ব মতামত দিয়ে এই ব্যাখ্যায় অশিষ্ট উপায়ে বাধা দান করে) করবে না। এটা যারা পছন্দ করে তাদের কাছে এক চমৎকার খেলা– দাবার মতন এই খেলায় খুব দ্রুত সময় কেটে যায়। এটি নির্জন বা একক খেলার এক নতুন রূপ এবং এটি খেলা উচিত বস্তুর স্পর্শে কলুষিত হবার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকে। এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর যে Moonshine-এর বহু খণ্ড রচনার পর বাট্রান্ড রাসেল নিজেকে এই পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন এবং অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে যুদ্ধ, সরকার, সমাজতত্ত্ব, বিপ্লব প্রভৃতির কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন– অথচ একবারও নিজের Principia Mathematica-র Pelion, upon Ossa-য় ব্যবহৃত নিখুঁত সূত্রগুলি ব্যবহার করলেন না, অথবা অন্য কেউও তা লক্ষ্য করে ব্যবহার করল না। প্রয়োজনীয়তা বোঝার জন্য বস্তু সম্পর্কে বিচারশক্তি জোয়ারের মতন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে উৎখাত ও একঘরে করা সত্ত্বেও স্তব্ধ হল না, ঠিক যেন লন্ডনের ছোট্ট পরিসরে অন্য এক গ্যালিলিও। যারা তার বিজ্ঞতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করত, তারাও তাঁর আন্তরিকতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিল। কিন্তু তারাও তার এই বিশাল রূপান্তর দেখে অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল এবং কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও এক অত্যন্ত অ-ইংরেজমূলক অসহিষ্ণুতায় ভুল করে ফেলেছিল।


এই প্রত্যক্ষ বিরোধিতার পিছনে সমস্ত নোংরা দ্বন্দ্বের এক তীব্র ঘৃণা ছিল। বার্ট্রান্ড রাসেল, যিনি চেষ্টা করেছিলেন বস্তুনিরপেক্ষ এক বুদ্ধি হতে, সত্যসত্যই ছিলেন বোধের এক ধারাস্বরূপ এবং জওয়ানদের জীবনের মূল্যের বিনিময়ে সাম্রাজ্যের আকাক্ষা কখনই তাঁর মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করত না তিনি দেখতেন জওয়ানরা গর্বিত ভাবে যাচ্ছে এবং নিজেরাই মৃত্যুবরণ করছে। তিনি ঠিক করেছিলেন এই সামগ্রিক হত্যাকাণ্ড বা এই সম্পূর্ণ বিনাশকারী শক্তির উপর আলোকপাত করবেন এবং নিশ্চিত ছিলেন যে সমাজতত্ত্বের মধ্যে এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দ্বারা তিনি তা খুঁজে পাবেন যা অবিলম্বে ব্যাধির। উৎসমুখ খুলে দিয়ে সুস্থতার প্রতি দিকনির্দেশ করবে।


তিনি সূক্ষ্মতার সঙ্গে নির্ধারণ করেছিলেন যে সমস্ত সম্পত্তির উৎস হল উৎপীড়ন নতুবা চুরি। কিম্বারলী-র হীরক-খনি এবং র‍্যান্ড-এর স্বর্ণখনির ডাকাতি থেকে সম্পত্তিতে রূপান্তরের ঘটনাটি ঘটেছিল সমস্ত বিশ্বের নাকের উপর দিয়ে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে প্রাপ্ত ফলাফল, তা যে ধরনেরই হোক না কেন, কখনই ভাল হতে পারে না।


যদিও ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং ডাকাতি যা সম্পত্তি তৈরি করে তা প্রণীত আইনসমূহ দ্বারা অনুমোদিত এবং যুদ্ধ দ্বারা কার্যকরী অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্র এক অন্যায্য সংস্থা। বরঞ্চ যদি অধিকাংশ কার্যপ্রণালী সমবেতভাবে এবং নির্মাতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হত তবে তা হত দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক। আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্র সমাজ কর্তৃক সাদৃশ্যপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে পুনঃপুনঃ নিষ্পেষিত হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং আধুনিক জীবনের নৈমিত্তিকতাই পুনরায় দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করাতে পারে।


স্বাধীনতা হচ্ছে উৎকৃষ্টতম বিষয় আর ব্যক্তিত্ব ব্যতিরেকে তা একেবারেই অসম্ভব। একমাত্র মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে ভুলভ্রান্তি পেরিয়ে, পূর্ব সংস্কার অতিক্রম করেই সেই সম্পূর্ণ সত্যকে পেতে পারি। ধরা যাক, মনুষ্যকুল এবং শিক্ষককুলের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে এবং তারা সেই বিষয়ে বিতর্কেও অংশ নেয়। তাদের এই অসম মতামত থেকেই এক সুবিদিত আপেক্ষিকতা বেরিয়ে আসে, যা অবশ্যই নিরপেক্ষ অবস্থায় নেই, তথাপি এইসব স্থিরীকৃত ধারণা অথবা প্রামাণিক আস্থার মধ্য দিয়েই ঘৃণিত যুদ্ধ আসে।


আমরা যতদূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারি ততদূর পর্যন্ত শিক্ষিত না হওয়ার কারণেই বলা যায় আমরা বিদ্যালয়প্রাপ্ত শিক্ষার বিরাট পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূচনামাত্র। আমরা যন্ত্রপাতি তৈরি করলেও পদ্ধতি বা টেকনিকের ব্যাপারে এখনও প্রাচীনপন্থী। আমাদের ধারণায় শিক্ষা হচ্ছে একটা শরীরের মধ্যে কিছু নির্ধারিত জ্ঞান চালনা করা যখন কিনা এবং প্রতি পদক্ষেপে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা অত্যন্ত জরুরী। বিমূর্ততার ব্যবহার তাদের কাছে সারাংশ রূপে থাকে, কিন্তু যুক্তিপ্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন চলমান অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণী। আমরা যখন পাণ্ডিত্যকে সঙ্গে নিয়ে বিপদের মধ্যে অবস্থান করছি, সেই পরিস্থিতিতে মধ্যযুগীয় দর্শন প্রয়োগিক চিন্তনের মডেল হতে পারে।


এইরকম ভাবে শুরু করে বার্ট্রান্ড রাসেল দৈবনির্দিষ্ট অজ্ঞেয়বাদ অতিক্রম করলেন। তিনি দেখলেন খ্রীষ্টীয়বাদের মধ্যে এমন অনেক কিছু রয়েছে যাকে গণিতের শব্দগুচ্ছ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি বাধ্য হলেন ‘নৈতিক সংকেত’ ব্যতিরেকে সব কিছু পরিত্যাগ করতে। তিনি অত্যন্ত অবজ্ঞার সাথে এটাও জানালেন যে সভ্যতা যা কিনা খ্রীষ্টীয়বাদকেও মানে না তা মানুষকে নির্যাতিতই করছে, তাই যারা এর পৃষ্ঠপোষক তাদের কারারুদ্ধ করার পক্ষে সমর্থন জানালেন তিনি। এই পরস্পর বিরোধী অসংগত বিশ্বে তিনি কোন ঈশ্বর খুঁজে পাননি। তিনি তাঁর দর্শনের মধ্য দিয়ে স্পেনসারকে অনুসরণ করেন এবং ব্যক্তি ও জাতির সর্বশেষে পরাজয় সম্পর্কে স্টোয়িকদের সহিষ্ণুতা বর্ণনা করার জন্য জেগে ওঠেন। আমরা সাধারণত অভিযোজন এবং উন্নতি নিয়ে কথা বলি, এর মধ্যে উন্নতি এক দাম্ভিক শব্দ এবং অভিযোজন যার অর্ধেক হচ্ছে ঘটনাসমূহের এক অনৈতিক চক্র, তার পরিসমাপ্তি ঘটে তরলীকরণ অথবা মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। জৈব জীবন যে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে প্রোটোজোয়া থেকে দার্শনিক–এইভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এবং সন্দেহাতীত ভাবেই এই উন্নতি আমাদের অগ্রিম পাওনা। দুর্ভাগ্যবশত এই আশ্বাস একজন দার্শনিকের, একটি প্রোটোজোয়ার নয়। একজন মুক্ত মানুষ কখনওই শিশুবৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ঈশ্বরে আরোপিত মনুষ্যত্বের মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে না। তাকে নিজেই নিজের প্রেরণাকে ধরে রাখতে হয় এবং সাহসী হতে বাধ্য হতে হয় এটা মেনে নিয়েই যে একদিন তার মৃত্যু ঘটবে, বস্তুত যা সমস্ত কিছুরই নিয়তি। তথাপি সে আত্মসমর্পণ করে না, যদি সে জিততে না-ও পারে তবুও সে অন্তত লড়াইটাকে উপভোগ করতে পারে। আপন জ্ঞানের দ্বারা পূর্বেই সে জানতে পারে অন্ধ শক্তি গুলি অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সেই শক্তিই তাকে ধ্বংস করবে। তাঁর পুজো বা শ্রদ্ধা কখনই এই বর্বর শক্তিগুলোর দিকে যাবে না যদি না লক্ষ্যহীন অধ্যবসায় তাকে জয় করে নেয়, ধ্বংস করে সমস্ত ঘরবাড়ি ও সভ্যতা আর সৃষ্টিশীল শক্তিগুলি সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যায় এবং কয়েক শতাব্দীর জন্য জেগে ওঠে ক্ষোদিত ও চিত্রিত বস্তুগুলির দুর্বল সৌন্দর্য ও পার্থেনন-এর গরিমাময় ধ্বংস বুকে নিয়ে।


এটাই ছিল যুদ্ধের প্রতি বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন।


বার্ট্রান্ড রাসেল যিনি সব কিছু ভুলে ছিলেন তর্কবিদ্যা, গণিত ও জ্ঞানবিদ্যার ভারে, হঠাত্র এক মুক্ত শিখার মতন জেগে উঠলেন এবং সমগ্র বিশ্ব চমকিত হয়ে দেখল এই রোগ-ফ্যাকাশে অধ্যাপক একজন অসীম সাহসী মানুষ এবং প্রগাঢ় মানবতাপ্রেমী। তাঁর নিজের সূত্রের অবকাশের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলেন এই মেধাবী মানুষটি। প্রকাশিত হলেন তার দেশের মর্যাদাপূর্ণ রাজনীতিজ্ঞ গোষ্ঠীর মধ্যে এক বাদানুবাদপূর্ণ আলোচনা তা হওয়া উচিত মনের বিজ্ঞানসম্মত উন্নতিসাধন। অজ্ঞানী লোকের সঙ্গে জ্ঞানী লোকের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যটি হল তার হঠকারিতা এবং নিজের মতামতকে একদম সঠিক ভাবা, অপরপক্ষে একজন বিজ্ঞানী অনেকবার ভাবনাচিন্তার পর তবেই কোন কিছু গ্রহণ (বিশ্বাস) করে এবং পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পরই কোন কিছু সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যক্ত করে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির ব্যাপকতর ব্যবহার আমাদের সেই শিক্ষাসংক্রান্ত বিবেককেই বিস্তৃতি প্রদান করে এবং তা তাকেই বিশ্বোস করে যার প্রমাণ আমাদের নাগালের মধ্যেই রয়েছে এবং সবসময় প্রস্তুত থাকে এটা মেনে নিতে, যে-কোন মুহূর্তে তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। এই পদ্ধতিগুলির মধ্য দিয়েই শিক্ষা প্রমাণ করতে পারে যে তা আমাদের অসুস্থতাগুলি সারাতে সক্ষম এবং আরো পারে আমাদের সন্তানসন্ততিদের পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন মানব মানবীতে পরিণত করে নতুন বিশ্বের সামনে নিয়ে আসতে পারে। আমাদের চরিত্রের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যটি হল অত্যন্ত নমনীয়–এটা বিশ্বাসের দ্বারা, পার্থিব পরিস্থিতি, সামাজিক পরিস্থিতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মতামতকে পরিবর্তিত করে উচ্চ ধারণায়, শিল্পকে স্থান দেয় সম্পদের উপরে, ঠিক রেনেসাঁসের দিনগুলোর মতোই যা কিছু সৃজনশীল তার উন্নতিসাধন এবং আবেগ যা আমাদের অধিকারবোধকে কেন্দ্র করে রয়েছে তাকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে ও সংকল্পের দ্বারা তাকে পরিচালিত করে। এটা হচ্ছে সৃষ্টির সূত্র, যার ভাবী অনুসিদ্ধান্তগুলি একটি নতুন ও প্রাকৃতিক নৈতিকতার দুটি মহান অনুশাসন। যার প্রথমটি হচ্ছে ভক্তি বা মর্যাদার সূত্র–এটা হচ্ছে ‘ব্যক্তি ও সমষ্টির যতদূর সম্ভব উন্নতিসাধন’ এবং দ্বিতীয়টি (পরধর্ম) সহিষ্ণুতার সূত্র ‘একজন ব্যক্তি বা একটি সমষ্টির উন্নতি অন্যের সাপেক্ষে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি বিষয়।’ প্রণীত আইনসমূহ হচ্ছে অর্থনৈতিক লোভ এবং বিশ্বজনীন নির্দয়তা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায়। মানুষ জীবনের অন্য সকল ধারণাগুলির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে সমর্থ হয়েছে। তখনই সে তা ব্যবহার করেছে বুদ্ধিমানের মতন এবং শিখতে পেরেছে কিভাবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ এবং সংরক্ষণ করবে। আমাদের স্কুলগুলি হচ্ছে সুখ-রাজ্য খোলার গুপ্ত মন্ত্র বিশেষ। এই সমস্ত কিছুই নিশ্চিতভাবে আশাব্যঞ্জক এক ধারণা। রাসেল তার সামাজিক দর্শনের মধ্যে অতীন্দ্রিয়তা এবং আবেগকে স্থান দিয়েছিলেন যা সম্পর্কে তিনি দৃঢ় মনোভাব পোষণ করতেন এবং এইভাবেই অধিবিদ্যা এবং ধর্মের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বে গণিত এবং তর্কবিদ্যাকে ব্যবহার করেননি। পূর্বতসিদ্ধ প্রণালীর (A priori) প্রতি তাঁর প্রবণতা, পূর্ণতা জীবনের চেয়ে মূল্যবান এই ধারণার প্রতি ভালবাসা তাকে এক সুন্দর ধারণার দিকে নিয়ে যায় যা এই গদ্যময় পৃথিবীকে তার সমস্যাসঙ্কুল জীবনের সাধ্যমত পথপ্রদর্শনের চেয়ে বরং একটুকরো কবিত্ব প্রদান করে। এটা অত্যন্ত আনন্দজনক বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সমাজ যেখানে শিল্প সম্পদের তুলনায় বেশি মূল্যবান, তার মূল্যায়ন করাটা রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের ন্যায় দীর্ঘ বিষয় । শিল্প হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা সম্পদের মধ্যে থেকে উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু কখনই সম্পদের প্রতিভূ হতে পারে না। যেমন–প্রথমে মেদিচি এবং পরে মাইকেল-অ্যাঞ্জেলো ।


কিন্তু রাসেলের মেধাবী দর্শন থেকে কিছু দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করে আনাটা কোন জরুরী বিষয় নয়, যখন কিনা তার নিজের অভিজ্ঞতাই ছিল তার অন্যতম কঠোর সমালোচক। রাশিয়াতে তিনি অনুভব করেছিলেন একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন করার প্রয়াস। তিনি এটা আবিষ্কার করে অত্যন্ত নিরাশ হয়েছিলেন যে রাশিয়ার সরকার গণতন্ত্রের পরিমাপের ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি নিতে পারবে না, যা তাঁর কাছে ছিল মুক্ত দর্পণের স্বতঃসিদ্ধ সত্য স্বরূপ। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন মানুষের বক্তব্য ও সংবাদমাধ্যমের প্রতি আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একচেটিয়া কারবারের প্রচারের সকল পথগুলির যথাযথ ব্যবহার লক্ষ্য করে । তিনি এটা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন যে নিরক্ষরতার এই তিমিরে, ভর্তুকিপ্রাপ্ত সংবাদপত্রের যুগে, সত্যলাভের প্রতিবন্ধকতার এই ক্ষেত্রে রাশিয়ার জনগণ পড়তে সক্ষম। জমির জাতীয়করণের ফলে ব্যক্তিমালিকদের অধিকার খর্ব হওয়ায় তিনি অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আজকের মানুষও যথাযথ কার্য করছে না কারণ সে সম্পূর্ণ ক্ষেত্রগুলির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারেনি। রাসেলের মতে, রাশিয়া ধীরে ধীরে এক বৃহত্তর ফ্রান্সে পরিবর্তিত হচ্ছে যা ক্ষুদ্র কৃষক সম্বলিত এক বৃহৎ দেশ যেখানে প্রাচীন সামন্তপ্রথা উধাও।


তিনি যখন একবছরের জন্য চীনে গিয়েছিলেন অধ্যাপনা করতে, তখন সম্ভবত অধিকাংশ সময় তিনি ঘরেই কাটাতেন। সেখানে তখন যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার কম, অপেক্ষাকৃত মন্দ ছন্দ। একজন যখন ধীরেসুস্থে কোন কারণ অনুসন্ধানে রত থাকত তখন সেই কার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার জীবন একটা জায়গায় স্থির হয়ে থাকত। তিনি অনুভব করলেন ইউরোপ হচ্ছে এক বৃহত্তর মহাদেশের প্রাচীনতর প্রতিভূ এবং সম্ভবত প্রগাঢ়তর সংস্কৃতি। এইসব তত্ত্ব এবং অনুসিদ্ধান্তগুলি এক বিনীত আপেক্ষিকতায় দ্রবীভূত হয়ে দেশের সম্মুখে আনীত হয় একসময় দেখা গেল তার লেখা থেকে তাঁর System বা ব্যবস্থা পৃথক হয়ে পড়ছে। এটা অবশ্যই কঠিন বিষয়– একজন ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা, সেখান থেকে ভারত হয়ে চীনে গেল অথচ তার সামাজিক দর্শন অপরিবর্তিত থেকে গেল। এই বিশ্ব তাঁকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে বিশ্ব তার সূত্রের পক্ষে বেশ বড় এবং তার হৃদয়ের ইচ্ছানুসারে পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত বৃহৎ এবং ভারী। কেননা এই পৃথিবীতে রয়েছে আরো অনেক অনেক হৃদয় এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন। ইচ্ছাসকল। এখন একজন তাঁকে দেখলে দেখতে পাবে যে রাসেল একজন বয়স্ক জ্ঞানী মানুষ যিনি কালস্রোতে শান্ত, স্নিগ্ধ, মৌন।


রাসেল ছিলেন কোমলীয় মনের মানুষ, সুগভীরতম অধিবিদ্যা এবং অতি সূক্ষ্ম গাণিতিক ব্যাখ্যা নিরূপণে সক্ষম, এতদসত্ত্বেও কথা বলেন অত্যন্ত সহজ সরল স্পষ্ট ভাষায় যা কিনা তাদের ক্ষেত্রেই সম্ভব যারা অকপট। চিন্তার প্রতি তিনি এমন আকৃষ্ট যা স্বাভাবিকভাবেই অনুভবের স্রোতকে শুকিয়ে ফেলে। তিনি উষ্ণতা ও সহানুভূতির দ্বারা আলোকিত এবং মানবতার পক্ষে অতীন্দ্রিয় কোমলতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তিনি কখনই একজন রাজসভাসদ বা তোষামুদে ছিলেন না, ছিলেন একজন জ্ঞানী মেধাবী ভদ্রলোক এবং অন্য অনেকের চেয়ে একজন উন্নততর খ্রীষ্টান যিনি সত্য বলতেন। আনন্দের সাথে এটা বলা যায় তিনি এখনও একজন হৃদয়বান বলিষ্ঠ মানুষ, জীবনের শিখা যার মধ্যে উজ্জ্বলভাবে দীপ্যমান। তিনি জানেন পরবর্তী শতাব্দী তাঁকে দেখবে বিজ্ঞতার রাজ্যে মোহ মুক্তিকরণ থেকে উদ্ভূত একজন মানুষ হিসাবে এবং তাঁর নাম লেখা থাকবে শান্ত নির্মল ভ্রাতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে।

ধার্মিক বুর্জোয়া এবং অধার্মিক সর্বহারা


[১৯২৭ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখে জাতীয় ধর্ম-নিরপেক্ষ সমাজের দক্ষিণ লন্ডন শাখার দ্বারা আয়োজিত বাটেরেসা টাউন হলে উক্ত বিষয়ে এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে বাট্রান্ড রাসেলের দ্বারা প্রদত্ত ভাষণ]


এতক্ষণ আপনাদের সামনে শ্রদ্ধেয় সভাপতি মহাশয় যে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য রাখলেন উক্ত বিষয় প্রসঙ্গে এই মনোজ্ঞ রাতে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে চলেছি। বিষয়টি হল, কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই ভালো করে বুঝতে হবে যে একজন ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী বা খ্রীস্টান বলতে ঠিক কী বোঝে। বর্তমানে বহু মানুষ এই শব্দটিকে খুবই হাল্কা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিছু কিছু মানুষ এই শব্দটির দ্বারা সেই সব মানুষদের বোঝেন যারা তাদের জীবনকে সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে পরিচালিত করতে চায়। যদি খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ এই হয়, তবে আমি বলব সমস্ত জাতি ধর্মে যারাই সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে নিজেদের পরিচালিত করেছেন তারাই খ্রীস্টান। ভাবার্থের দিক থেকে খ্রীস্টান শব্দটিই যে কেবল সৎ সুন্দর মঙ্গলজনক জীবনের অর্থ বহন করে তা আমি মনে করি না, কেননা যারা খ্রীস্টান নন অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, কনফুসীয় ধর্মাবলম্বী কিংবা মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বী বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তারা যেহেতু খ্রীস্টান নন, তাই তারা সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক জীবন অতিবাহিত করবার চেষ্টা করছেন না। আমি খ্রীস্টান অর্থে সেই সব মানুষদের কথাও বলছি না, যারা নিজেদের আলোয় সুন্দরভাবে জীবনকে চালাবার চেষ্টা করেন। আমি কেবল মনে করি, নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে মনে করার অধিকার পেতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশ্বাসের অধিকারী হতে হবে, যে বিশ্বাসের দ্বারা আপনি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে পারবেন। একটা কথা আপনাদের মনে রাখতেই হবে যে খ্রীস্টান শব্দটি সেন্ট অগস্টাইন এবং সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের সময় যে পূর্ণ অর্থ বা প্রাণ-পূর্ণ রক্তিম অর্থে ব্যবহার হত সেই অর্থে শব্দটিকে বর্তমানে ব্যবহার করা হয় না। অর্থাৎ ব্যাপারটি অনেকটা এইরকম, যেমন–আপনি পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করলেন, যে ধর্মমতগুলি যথার্থরূপে নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিকশিত এবং সেইসব ধর্মমতের প্রতিটি অক্ষরকে আপনি বিশ্বাস করেন আপনার দৃঢ় বিশ্বাসের পূর্ণ শক্তিতে।


ঈশ্বর বিশ্বাস বলতে কী বোঝায়?


বর্তমানে ঈশ্বর বিশ্বাস ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ নয়। খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ আমরা ক্রমশই অস্পষ্টরূপে বুঝতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা, আমি মনে করি যে, দুটি স্বতন্ত্র বিষয় সেই ব্যক্তির জন্য একান্ত অপরিহার্য যে ব্যক্তি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে চায়। বিষয়টি হল নিশ্চিতভাবে কথিত কিন্তু প্রমাণহীন– অর্থাৎ আপনাকে অবশ্যই ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ হতে হবে। যদি এই দুটি বিষয়ে আপনি বিশ্বাসী না হন, তবে আমার মনে হয় না যে আপনি নিজেকে একজন যাথার্থ ঈশ্বরবিশ্বাসী বলতে পারেন। এরপরেও, আর কিছুটা এগিয়ে বলা যায়, ধর্মটি যার নামে নামাঙ্কিত, সেই খ্রীস্টের উপর আপনার এক ধরনের বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বীরাও ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ অথচ তারা নিজেদের খ্রীস্টান বলে মনে করে না। আমি মনে করি, কিছু না হলেও খ্রীস্টের উপর আপনার এই বিশ্বাস অবশ্যই আছে যে তিনি যদি স্বর্গীয় না-ও হন, অন্তত তিনি সমস্ত মানুষের চেয়ে উত্তম ও জ্ঞানী মানুষ। যদি আপনি খ্রীস্টের উপর বেশিরভাগ বিশ্বাসটি না করে উঠতে পারেন, তা হলে আমি মনে করি না যে আপনার নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে ডাকার অধিকার আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে হুইটেকারের পঞ্জিকা থেকে আপনারা আর একরকম পথের সন্ধান পেয়েছেন এবং ভূগোলের বইগুলি থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন যে পৃথিবীর সমগ্র জনগণকে খ্রীস্টীয়, মহম্মদীয়, বৌদ্ধ ও কৃতাসম্পন্ন উপাসক সম্প্রদায় এবং আরও বহু ধরনের সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এরকম ভাবে ধরলে আমরা সবাই খ্রীস্টান। ভূগোলের বইগুলিতে আমরা সবাই নিজেদের জাতি সম্প্রদায়ের নামে তালিকাভুক্ত, কিন্তু তা কেবলমাত্র জ্ঞানের দাবিতেই, অন্য কিছু নয়। বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গটিকে আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি। এইজন্য উক্ত বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে যখন আমি আপনাদের বলে থাকি যে আমি কেন খ্রীস্টান নই, তখন আমি আপনাদের দুটি বিভিন্ন বিষয় বলতে বাধ্য হই, প্রথমত, কেন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না এবং বিশ্বাস করি না তার অমরত্বে এবং দ্বিতীয়ত, কেন আমি মনে করি না যে যীশু খ্রীস্ট সমগ্র মানুষের থেকে জ্ঞানী ও উত্তম মানুষ, যদিও আমি তার মঙ্গলময় নৈতিকতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকি।


কিন্তু অতীতে ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঈশ্বরবিশ্বাস সম্পর্কে তাদের মতো স্থিতিস্থাপক কোন ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে নিতে পারিনি। আমি আগেই বলেছি যে প্রাচীন কালে এই শব্দটিকে পূর্ণ রক্তিম চেতনার সঙ্গে ব্যবহার করা হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শব্দটির নিষ্পত্তি ঘটে নরক-বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। শাশ্বত নরকের বিশ্বাসে খ্রীস্টানদের কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আগুন একটি অনিবার্য উপাদান ছিল। আপনারা জানেন, এই দেশে প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের ফলে অনিবার্য উপাদান হিসেবে আগুনকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ ও ইয়র্কের আর্কবিশপের মধ্যে মতভেদও হয়েছে, কিন্তু এই দেশে, আমাদের ধর্ম পার্লামেন্টের অ্যাট বা সংসদীয় আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে প্রিভি কাউন্সিল এই জঘন্য করুণাকে পদদলিত করবার সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছে এবং খ্রীস্টানদের কাছে নরকের প্রয়োজনীয়তা আর বেশি দিন থাকতে পারেনি। ফলস্বরূপ আমিও কোন খ্রীষ্টানকে নরকে বিশ্বাসী হবার জন্য উৎসাহিত করব না।


ঈশ্বরের অস্তিত্ব


ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে আসতে গেলে, প্রশ্নটি যেমন বড় হবে তেমনই তা ভাবগম্ভীর হবে। যদি আমার পক্ষে এই ধরনের প্রশ্ন ঠিক করা সম্ভব হত তবে আমি ঈশ্বরের রাজত্ব আসার আগে পর্যন্ত আপনাদের এখানেই ধরে রাখতাম, যাতে আপনারা আমাকে ক্ষমা করতে পারতেন প্রশ্নটি অপেক্ষাকৃত জোর করে করার জন্য। আপনারা জানেন যে ক্যাথলিক চার্চ ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্পর্কে এই মতো পোষণ করে থাকে যে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচার শক্তি (unaided reason) দ্বারা। এই ধরনের মতবাদ কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক হলেও তাদের অনেকগুলি মতবাদের মধ্যে এটাও একটি। এই ধরনের মতবাদ তারা প্রচার করেছিল এই কারণে যে কোন একটি সময় মুক্তচিন্তাবিদরা প্রায়শই সেইসব বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করে দেখাতেন যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সেইসব মুক্তচিন্তাবিদরা জানতেন যে তাদের বিশ্বাসের দিক থেকে ঈশ্বর অবশ্যই বিদ্যমান। এই বিষয়ে যুক্তিপ্রদর্শন ও তর্কবিতর্ক এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যে, ক্যাথলিক চার্চ অনুভব করল, এগুলোর অবশ্যই থাকার প্রয়োজন আছে। এইজন্যই তারা এই ধরনের মতবাদ প্রচার করল যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচারশক্তির দ্বারা এবং তারা সেই ধরনের তর্কবিতর্কগুলিকেই সামনে রেখেছে যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের স্বপক্ষে যেতে পারে। এই ধরনের অনেকগুলি যুক্তি আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে নিয়েই আমরা আলোচনা করব।


প্রথম-কারণের উপর বিতর্ক


প্রথম কারণের ওপর আলোচনাটি বোঝাবুঝির দিক থেকে সব থেকে সরল ও সোজা [আমাদের আগেই বুঝে রাখা দরকার যে জগতের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবকিছুর একটি কারণ আছে। এই কারণকে প্রশ্ন করতে করতে আপনি পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অবশ্যই প্রথম কারণের (First cause) সম্মুখীন হবেন, এবং এই প্রথম কারণকেই আপনি ঈশ্বর বলে অভিহিত করেন।] আমি মনে করি উক্ত বিতর্কটি বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ, প্রথমত যে কারণটিকে ব্যবহার করা হবে সেটি সম্পূর্ণ নয়। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা উক্ত কারণের উপর কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, যে কারণটি মোটেই তেমন প্রাণবন্ত নয় যেমনভাবে অতীতে তাকে প্রাণবন্ত করে দেখানো হত। কিন্তু এতদ্বতিরিক্ত আপনি একটি যুক্তি দেখাতে পারেন যে প্রথম কারণ বলে একটি কারণ অবশ্যই আছে যার কোন বৈধতা নেই। যখন আমি যুবক ছিলাম তখন এই প্রশ্নগুলি নিয়ে নিজের মনেই ভাবগম্ভীর তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছিলাম। প্রথম কারণের উপর বিতর্ক আমি বহুদিন ধরে গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু একদিন, যখন আমার বয়স আঠারো, আমি জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়লাম, এবং সেখানে এই বাক্যটি দেখলাম : আমার বাবা আমাকে এই প্রশ্নগুলি শেখালেন, ‘কে আমাকে তৈরি করেছে?’ আমার দ্বারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন করার পথে নিয়ে গেল, সেটি হল, ‘কে ঈশ্বরকে তৈরি করেছে?’ আমি এখনও মনে করি এই সরল বাক্যটি প্রথম কারণ সম্পর্কিত যুক্তির দোষটি সেই প্রথম আমাকে দেখালো। যদি প্রতিটি জিনিসের একটি কারণ থাকে তবে ঈশ্বরেরও কারণ আছে (If everything mrust have cause, then god must have a cause)। যদি কারণ ছাড়াই কোন কিছু থাকতে পারে তবে তা ঈশ্বরের জগৎ সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং যুক্তি-তর্কের আর কোন মূল্যই থাকে না। এই ব্যাপারটি অনেকটা হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গির মতো, যেমন জগৎ একটি হাতির উপর অবস্থান করছে এবং হাতিটি একটি কচ্ছপের উপর অবস্থান করছে এবং যখন কেউ প্রশ্ন করে কচ্ছপটি কার উপর অবস্থিত? তখন ভারতীয়রা বলে থাকে মনে হয় আমরা বিষয়টিকে পরিবর্তন করছি। সত্যি করে বলতে গেলে এর থেকে ভালো যুক্তি আর নেই। কোনরকম কারণ ছাড়াই জগৎ বর্তমান অস্তিত্বে আসতে পেরেছে এরকম ভাবার যেমন কোন কারণ নেই, অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এরকম কি কোন কারণ থাকতে পারে যে কেন জগতের সর্বদাই বিদ্যমান থাকা উচিত হয়নি। এরকম ভাবারও কোন কারণ নেই যে পৃথিবীর একটি শুরু ছিলো। আমাদের কল্পনার অভাবেই আমাদের এরকম ভাবতে হয় যে, বস্তুসমূহের অবশ্যই একটি শুরু ছিল। এই জন্য আমি প্রথম কারণের যুক্তির উপর অযথা সময় নষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না।


প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত যুক্তি


প্রাকৃতিক আইন থেকে একটি অতি সাধারণ যুক্তি পাওয়া যেতে পারে, যে যুক্তিটি সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, বিশেষত, স্যার আইজ্যাক নিউটন ও তাঁর বিশ্বতত্ত্বের প্রভাবের ফলে। মাধ্যাকর্ষণের সূত্র অনুযায়ী সাধারণ মানুষ এই সত্যটি জানলে যে সমস্ত গ্রহগুলি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তারা মনে করল যে ঈশ্বর এসমস্ত গ্রহগুলিকে এই বিশেষভাবে ঘোরার আদেশ দিয়েছিলেন বলেই তারা ওই ভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। তাদের এই ভাবনাটি এত সরল ও সোজা ছিলো যে তার ফলে তাদের মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে আরও খতিয়ে দেখার সমস্যাকে গ্রহণ করতে হয়নি। কিন্তু আইনস্টাইনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটির ব্যাখ্যা আমাদের কাছে কিছুটা জটিল হয়ে পড়ল। নিউটনীয় ব্যবস্থায় যে ব্যাখ্যাটি অতি দ্রুত দেওয়া যেত, এখন থেকে তা আর হল না, কেননা যে ভাবেই হোক ব্যাখ্যাটি সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ল। আইনস্টাইন কিভাবে মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছেন সে সম্পর্কে আমি কোন ভাষণ দিতে চাই না, কারণ তা কিছুটা সময় নিয়ে নেবে, তবে সেই নিউটনীয় ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক আইনটিকে আপনারা আর বেশিদিন ধরে থাকতে পারলেন না, যেখানে, কোন কারণবশত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি, কেন প্রকৃতি সমরূপ ধরনের (Uniform fashion) আচরণ করে থাকে। এবার আমরা বুঝতে পারলাম অনেক কিছু, যাদেরকে আমরা প্রাকৃতিক আইন বলে মনে করতাম সেগুলো বাস্তবে বিভিন্ন মানবিক প্রথা (Human connection)। আপনারা জানেন যে বহুদূরবর্তী তারকামণ্ডিত অনন্তেও তিন গজে এক ফুট হয়। এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কিন্তু আপনি এই ব্যাপারটি প্রাকৃতিক আইন বলে ভাবতে পারেন না এবং এইরকম বহু জিনিস যাকে আমরা প্রাকৃতিক আইন ভেবে থাকি, আসলে সেগুলো উক্ত ঘটনাটির মতো। অন্যদিকে, পরমাণুগুলো কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কিত বিষয় যদি আপনি জানেন তবে দেখবেন যে সেগুলো ঠিক তেমনভাবে প্রাকৃতিক আইন মেনে কাজ করে না যেমনভাবে সাধারণ মানুষ ভাবে। আপনি যে-সব প্রাকৃতিক আইনগুলি সম্পর্কে জানেন সেগুলো পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবে আকস্মিক ঘটনা থেকে উদ্ভূত। এরকম একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে যা বলতে গেলে আমরা সবাই জানি। পাশাখেলার ক্ষেত্রে দেখা যায় ছত্রিশবার দান ফেললে আপনি একবার হঠাৎ দুটি ছয়ের দান ফেলতে পারেন, এর জন্য আপনি এরকম মনে করতে পারেন না যে আপনার দানের ক্ষেত্রে এই রকম ঘটনা কোন একটা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় যে প্রতি ছত্রিশবারে যদি একবার দুটো ছক্কা পড়ে তবে বলা যেতে পারে যে ব্যাপারটি একটা নিয়মে চলছে। প্রাকৃতিক আইনগুলি বহু ক্ষেত্রেই অনেকটা এইরকম। পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবের দিক থেকে তারা প্রায় সবাই আকস্মিকতার আইন (Laws of chance) থেকে উদ্ভূত এবং এই ধরনের ঘটনার ফলে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে প্রাকৃতিক আইনগুলিকে অনেক কম মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়। এর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বলা যেতে পারে যে উপযুক্ত আইনগুলি বিজ্ঞানের ক্ষণিক পরিস্থিতির (Momentary state of science) প্রতিনিধিত্ব করলেও কাল সেগুলো বদলে যেতে পারে। প্রাকৃতিক আইনই মূলত আইন প্রণেতা এই ধরনের সমগ্র ধারণাটি প্রাকৃতিক আইন ও মানবিক আইনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির ফলেই ঘটেছে। মানবিক আইনগুলো এমন কতকগুলি আদেশ যা কোন একটি নির্দিষ্ট পথে আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে, যে পথে আপনি আচরণ করতেও পারেন, আবার না-ও করতে পারেন সেটা আপনার পছন্দের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রাকৃতিক আইন হল বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা এবং প্রাকৃতিক আইনগুলো বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা বলেই আপনি কখনও এই ধরনের তর্ক উত্থাপন করতে পারেন না যে, কেউ বস্তুগুলোকে ঠিক ওই ধরনের আচরণ করতে আদেশ দিয়েছে, কেননা যদি আপনি এই ধরনের কথা বলেন তবে প্রশ্ন উঠবে, কেন ঈশ্বর অন্য কিছু না করে ঠিক এমন ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করলেন?’ তখন যদি আপনি বলেন যে তিনি তাঁর আনন্দের জন্যেই এই ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করেছেন এবং যার কোন কারণ নেই, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে এখানে এমন কিছু একটা আছে যা আইনের বিষয়বস্তু নয় এবং সেখানেই আপনার প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত ধারণা বিঘ্নিত হবে। যদি আপনি গোঁড়া ধর্মবেত্তাদের মতো অনুসরণ করে এই কথা বলেন যে ঈশ্বর সর্বোত্তম বিশ্ব সৃষ্টি করবার জন্যেই কেবল এই ধরনের আইনের সৃষ্টি করেছেন, অন্য আর কোন কারণ নেই, তবে যেভাবে ব্যাপারটিকে আপনি কখনই ভেবে দেখেননি, সে ভাবেই বলতে হয়, যে যদি প্রাকৃতিক আইনগুলি ঈশ্বরেরই রচনা এইরূপ কারণ থাকে তবে ঈশ্বর নিজেও উক্ত আইনের বশবর্তী এবং এই কারণেই ঈশ্বরকে মধ্যস্থ কোন সত্তা বলে পরিচিত করানোর মধ্যে কোন লাভ নেই। আপনার স্বর্গীয় আদেশের বাইরে ও সম্মুখে সত্যই একটি আইন আছে এবং ঈশ্বর আপনার উদ্দেশ্যকে কখনই সফল করে তুলতে পারবেন না, কেননা তিনি কখনই কোন আইনপ্রণেতা নন। সংক্ষেপে, প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কে সমগ্র যুক্তি আগে যে শক্তির সঙ্গে ব্যবহৃত হত এখন তা আর রইল না। বিষয়গুলি সম্পর্কে সমালোচনা করার জন্য আমি ঠিক সময়েই এগিয়ে চলেছি। বিষয়টি হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নিয়ে যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। এই বিষয়গুলি প্রথমে ছিল যথেষ্ট কঠিন ও বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু অবশ্যই ভ্রমাত্মক ছিল । আমরা আধুনিক যুগে প্রবেশ করা মাত্রই তারা বুদ্ধিগত দিক দিয়ে কম সম্মানিত হয়ে পড়ল এবং ক্রমশ এক ধরনের নৈতিক অস্পষ্টতার দ্বারা আক্রান্ত হল।


অভিসন্ধিজাত আলোচনা


পরবর্তী পদক্ষেপ আমাদের অভিসন্ধিজাত আলোচনায় (Argument from design) নিয়ে আসে। অভিসন্ধিজাত আলোচনা সম্পর্কে আপনারা সবাই জানেন: জগতের সবকিছুই এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে জগতে আমরা বেঁচে থাকার উপায় পেতে পারি এবং যদি এই জগৎ একটুখানি অন্যরকম হত তবে আমরা এখানে বেঁচে থাকার উপায় পেতাম না। এটাই অভিসন্ধিজাত বিষয়। বিষয়টি কখনও কখনও কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে, উদাহরণস্বরূপ, এই বলে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে গুলি করার সুবিধার জন্যই খরগোসের সাদা লেজ। আমি জানি না কিভাবে একটি খরগোস এই ধরনের ব্যাপারটি দেখবে। এটা একটি ব্যঙ্গ-কাব্যের সহজ বিষয়। আপনারা সবাই ভলতেয়ারের সেই জনপ্রিয় উক্তিটির কথা জানেন যে নাকটি এমনভাবে গঠিত হয়েছে যাতে সেখানে চশমাটি ঠিক মতো বসে। অষ্টাদশ শতকে এই ধরনের ব্যঙ্গোক্তি সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা অসংগতিকর কথা হয়ে উঠতে পারেনি কেননা ডারউইনের সময় থেকে আমরা অনেকটা বুঝে গিয়েছিলাম যে কেন জীবন্ত সৃষ্টি তাদের পরিবেশের সঙ্গে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে নেয়। এটা নয় যে তার পরিবেশটিকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয় যেখানে তারা মানাতে পারবে, বরঞ্চ তারাই পরিবেশটির পক্ষে মানানসই হয়ে ওঠে এবং এটাকেই অভিযোজনের ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে অভিসন্ধির কোন প্রমাণ নেই। আপনি যখন নকসা বা অভিসন্ধিটিকে খতিয়ে দেখতে চাইবেন, তখন একটা আশ্চর্যজনক জিনিস আপনি দেখতে পাবেন যে মানুষ বিশ্বাস করে এই জগৎ ও তার অভ্যন্তরে সমগ্র বস্তু তাদের অপূর্ণতা সত্ত্বেও অবশ্যই এক অসাধারণ সৃষ্টি বা সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। আমি বস্তুতই ব্যাপারটিকে বিশ্বাস করতে পারি না। আপনি কি এটা ভেবে দেখেছেন যে যদি আপনাকে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ করে দেওয়া হয় এবং লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জগৎকে একটা পূর্ণতার সঙ্গে গঠন করার, তবে আপনি কু-ক্লুক্স-ক্ল্যান বা ফ্যাসিস্তদের থেকে ভালো কিছু তৈরি করে উঠতে পারবেন না? এছাড়াও, যদি আপনি বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলি গ্রহণ করেন তবে আপনাকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে এই গ্রহটির উপর মানবজীবন ও সাধারণ জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই শেষ হয়ে যাবে। সৌর-ব্যবস্থার ক্ষয়জাত এটি একটি বিশেষ পর্যায় মাত্র, উক্ত ব্যবস্থার ক্ষয়ের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে আপনি উষ্ণতাকে একটি বিশেষ অবস্থায় পেলেন এবং যে উষ্ণতায় প্রোটোপ্লাজম সৃষ্টি সম্ভব হয়ে উঠল এবং সমগ্র সৌর-ব্যবস্থার আয়ুর উপর নির্ভর করে এখানে কিছুদিনের জন্য জীবনলীলার সূচনা হল (There is life for a short time in the life of the whole solar system) lontanist চাঁদে এমন কিছু দেখেন যা পৃথিবীতে হতে চলেছে, অর্থাৎ কিছুটা মৃত, ঠাণ্ডা এবং জীবনহীন।


আমাকে বলা হল যে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বিষণ্ণতামূলক এবং মানুষ আপনাদের বলবে যে যদি তারা এই ধরনের বিশ্বাস করে তবে তারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সামর্থ্য জোগাড় করে উঠতে পারবে না। এটা বিশ্বাস করবেন না, এটা একেবারেই বাজে কথা। এখন থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পরে কি ঘটবে তা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন নয়। এমনকি যদি তারা ভাবে যে তারা সত্যই ব্যাপারটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তবে তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত করছে। তারা এমন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন যা অনেকটা পরিমাণ পার্থিব অথবা ব্যাপারটি তাদের বদহজম হয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর পরে পৃথিবীতে কি ঘটতে যাচ্ছে তা ভেবে অবশ্যই কেউ দুঃখকে উৎপাদন করবে না। যদিও এটা একটা বিষণ্ণতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি যে পৃথিবীতে জীবনলীলা একদিন শেষ হবে, অন্তত আমরা যেন এই সত্যটা বুঝতে পারি । যদিও কখনও কখনও মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে যে-সব জিনিসগুলি করে থাকে তা নিয়ে আমার অনুশোচনা হয় কেননা এগুলো কেবলমাত্র এক প্রকার সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই নয়, তবে এই সান্ত্বনাগুলো আর যাই হক জীবনলীলাকে অন্তত দুর্বিসহ করে তোলে না।


পরমেশ্বরের স্বপক্ষে নৈতিক যুক্তি


এখন আমরা আর একটা স্তর এগিয়ে এলাম যে স্তরটিকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত অবতরণ (Intellectual descent) বলব, অর্থাৎ যে পথে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা আস্তিকেরা তাদের যুক্তি প্রয়োগ করেছেন এবং আমরা এখন সেই বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করব যাকে বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে তিনটি বিচারবুদ্ধি-সংক্রান্ত যুক্তি ছিল, যার সবগুলোই ইমানুয়েল কান্ট তার “Critioue for Pure Rason” গ্রন্থে গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু যেই তিনি এই তিনটি যুক্তি গ্রহণ করলেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি নতুন যুক্তি আবিষ্কার করে ফেললেন এবং সেই যুক্তিটি ছিল একটি নৈতিক যুক্তি যা তাকে সহজেই প্রভাবিত করে ফেলেছিল। তিনি সাধারণ আর সব মানুষদের মতোই ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধি-সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি ছিলেন সন্দেহবাদী, তবে নৈতিক বিষয় তিনি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন যে তিনি মাতৃচরণে পূর্ণভাবে সমর্পিত। এই ধরনের মনোভাব সম্পর্কে মন বিশ্লেষকরা যা জোর দিয়ে বলে থাকেন তা হল কিশোর বয়সে আমরা যে পরিবেশে (Association) বড় হই তা আমাদের জীবনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে যা পরিণত বয়সের পরিবেশ ফেলতে পারে না।


আমার মতে কান্ট ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি নতুন নৈতিক যুক্তি আবিষ্কার করলেন যেটি বিভিন্নভাবে ঊনবিংশ শতকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই যুক্তিটি বিভিন্ন ধরনের আকারবিশিষ্ট, এদের মধ্যে একটি হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে জগতে ভালো-মন্দ বলে কিছুই থাকত না। জগতে ভালো-মন্দের মধ্যে সত্যই কোন স্বতন্ত্রতা আছে কিনা, সে বিষয়ে এখনই কোন আলোচনা করতে আমি আগ্রহী নই। বর্তমানে আমি যে বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী তা হল, যদি আপনি ভালো-মন্দের স্বতন্ত্রতা স্বীকার করে নিতে চান তবে যে প্রশ্নের সম্মুখীন আপনি হবেন তা হল, ঈশ্বরের আদেশেই কি এই স্বতন্ত্রতা, নাকি তা নয়? যদি এটা ঈশ্বরের আদেশ হয়ে থাকে তবে স্বীকার করে নিতে হয় যে ঈশ্বরের নিজের কাছে ভালো বা মন্দের মধ্যে কোনরকম স্বতন্ত্রতা নেই। তাই ঈশ্বর মঙ্গলময় এই কথাটির আর কোন অর্থই হয় না। এর পরেও যদি ধর্মবেত্তাদের মতো আপনি বলতে চান যে ঈশ্বর মঙ্গলময় তবে আপনি এ কথা বলতে চাইছেন যে ভালো-মন্দের এমন একটি অর্থ আছে যা ঈশ্বরের আদেশের উপর নির্ভর করে না, কেননা ঈশ্বরের আদেশ সর্বদাই ভালো, তা কখনই নিজের থেকে মন্দ হতে পারে না। এরপরে যদি আপনি একথা বলতে চান যে ভালো-মন্দ ব্যাপারটি এই ঈশ্বরের থেকে আসেনি কেননা ভালো-মন্দ ব্যাপারটি ঈশ্বরের পূর্ববর্তী হওয়ায় যুক্তিগত দিক দিয়ে তা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে না। এবার উক্ত যুক্তির উপর নির্ভর করে আপনি অবশ্যই বলতে পারেন যে এই ঈশ্বরের পূর্ববর্তী আর এক পরম ঈশ্বর আছেন যিনি এই জগতে প্রকৃত খ্রীস্টান অথবা এই জায়গায় কোন পরম ঈশ্বরকে না বসিয়ে কোন শয়তানকেও বসাতে পারেন। শেষোক্ত ঘটনাটিকে আমি অনেকটা বেশি বাস্তব বলে মনে করি। বস্তুত আমাদের পরিচিত এই জগৎটি কোন এক মুহূর্তে শয়তানের দ্বারা তৈরি যে মুহূর্তে ঈশ্বর কিছুই দেখছিলেন না। এতক্ষণে এই ব্যাপারটির সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ভালোভাবে বুঝেছি এবং যা বুঝেছি তা অবশ্যই আমার দ্বারা খণ্ডিত হবে না।


অন্যায় প্রতিকারার্থে যুক্তি


শেষমেশ আমরা নৈতিক যুক্তি সম্পর্কে একটি কৌতূহলপূর্ণ দিক খুঁজে পাই, সেটা হল, তারা বলে থাকেন যে জগতে মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব একান্তভাবে প্রয়োজন। আমরা জানি যে বিশ্বের এই অংশে অন্যায়ের রাজত্ব এবং প্রায়শই কঠিন সংগ্রাম ও কখনও শয়তানের অগ্রগতি। কেউ এটা ঠিক বুঝতে পারে না এর মধ্যে কোনটা বেশি বিরক্তিকর। কিন্তু যদি আপনারা এই বিশ্বে ন্যায় বস্তুটিকে লাভ করতে চান তবে ব্যাপারটি এমন দাঁড়াবে যে আপনারা বস্তুত আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবনে পৃথিবীর ভারসাম্যমূলক উপশম চাইছেন। এই জন্যে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলে থাকেন অবশ্যই ঈশ্বর আছেন। ভবিষ্যতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেই পৃথিবীতে স্বর্গ ও নরকের অস্তিত্ব একান্ত প্রয়োজন। এই যুক্তিটি বেশ কৌতূহলপূর্ণ। যদি ব্যাপারটিকে আপনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন তবে আপনি অবশ্যই বলতে বাধ্য হবেন, আমি কেবলমাত্র এই জগৎকেই চিনি, বিশ্বের অন্যান্য অংশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সম্ভাব্যতার তত্ত্বের উপর নির্ভর করে যতটা সম্ভব যুক্তি প্রদর্শন করে একজন একথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন যে এই জগৎটি একটি সুন্দর নিদর্শন, যদি এখানে অন্যায় থাকে তবে বিশ্বের সর্বত্রই অন্যায়কে দেখা যাবে। ব্যাপারটি অনেকটা এইরকম, যেমন ধরুন আপনি একটি কমলালেবুর বাক্স আনলেন, যার ঢাকনাটা খুলে আপনি দেখলেন যে উপরিভাগের কমলালেবুর সবগুলিই খারাপ, তখন আপনি এরকম যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন না যে ভারসাম্যের নিয়মানুযায়ী নীচে অবশ্যই ভালো কমলালেবু আছে। আপনার বলা দরকার, সম্ভবত এই বাক্সের সব লেবুগুলিই খারাপ এবং একজন বৈজ্ঞানিক ব্যক্তি সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে এই ধরনের যুক্তি পোষণ করবেন। তিনি সম্ভবত বলবেন, এই জগতেই আমরা এত বেশি পরিমাণ অন্যায় দেখি যে তা দেখে মনে হয় না বিশ্বের কোন জায়গায় ন্যায় শাসন চলতে পারে এবং এই যুক্তিই যে নৈতিক যুক্তির উত্থাপন করে তা ভগবান বা অন্য ওইরকম কারুর অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। তবে এই ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিগুলি, যেগুলি নিয়ে আমি এতক্ষণ আলোচনা করেছি, সেগুলি জনসাধারণকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। যা মানুষকে ঈশ্বরের বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করে তা অবশ্যই এই সব বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিগুলি নয়। বেশিরভাগ মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে এই জন্য যে তারা শিশু বয়স থেকে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে শেখে এবং এটাই হল প্রধান কারণ।


আমি মনে করি বাঁচবার ইচ্ছাটাই সব থেকে শক্তিশালী কারণ। এটা এমন এক ধরনের অনুভব যা মানুষকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই ধরনের অনুভবই মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে এমন মৌলিকভাবে প্রভাবিত করেছে যাতে সে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে বাধ্য হয়েছে।


খ্রীষ্টের চরিত্র


এখন আমি এমন একটি বিষয়ের উপর কথা বলতে চাই যে বিষয়টিকে নিয়ে যুক্তিবাদীরা ঠিক মতো আলোচনা করেন না বলে আমার প্রায়ই মনে হয় এবং তা হল– খ্ৰীষ্ট মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও জ্ঞানী কিনা। এটা সাধারণত আগেই মেনে নেওয়া হয় যে আমরা ব্যাপারটিকে মেনে নেব কেননা ব্যাপারটা ওইরকম। কিন্তু ব্যাপারটিকে আমি নিজে এরকমভাবে মেনে নিই না। আমি মনে করি এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে আমি খ্রীষ্টের সঙ্গে যতটা একমত হতে পারব ততটা একমত পেশাদার খ্ৰীষ্টানরাও হতে পারবে না। আমি জানি না খ্রীষ্টের সঙ্গে আমি সমগ্র পথটা হাঁটতে পারব কিনা, কিন্তু যে-কোন পেশাদার খ্রীষ্টানের থেকে অনেক বেশি পথ আমি তার সঙ্গে যেতে পারব। আপনারা মনে রাখবেন যে তিনি বলেছিলেন, ‘অশুভকে প্রতিরোধ কোর না, কেউ যদি তোমার গালে আঘাত করে, বা গালটাও পেতে দিও। এটা কোন নতুন আদর্শ বা ধারণা নয়। খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ ছ’শ বছর আগে লাওৎসে এবং বুদ্ধ এই ধরনের আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই ধরণের আদর্শ বস্তুত কোন খ্রীষ্টানই গ্রহণ করেন না। উদাহরণ হিসেবে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর (স্ট্যানলি বালডুইন) কথা বলতে পারি যিনি নিঃসন্দেহে একজন নৈতিক খ্রীষ্টান, কিন্তু তাই বলে আমি আপনাদের কারুকে এই উপদেশ দেব না যে যান, গিয়ে তার একটি গালে আঘাত করে আসুন। আমি মনে করি আপনি দেখতে পারেন যে মন্ত্রীমহাশয় এই ব্যাপারটিকে দৈহিক আঘাতরূপে ধরে নেবেন।


এখানে আর একটি দিক আছে যে দিকটিকে আমি দারুণ বলে মনে করি। আপনি মনে রাখবেন যে খ্ৰীষ্ট বলেছেন নিজেকে বিচার না করে অপরকে বিচার করতে যেও না। আমি মনে করি না এই ধরনের আদর্শ খ্রীষ্টান দেশগুলোর আইন আদালতে জনপ্রিয়রূপে দেখতে পাবেন। আমার সময়ে আমি অনেক বিচারকদের চিনতাম যারা গোঁড়া খ্রীষ্টান ছিলেন এবং তারা এটাই জানেন না যে তারা যে কাজ করতেন তা খ্রীষ্টীয় আদর্শের ঠিক বিপরীত। খ্রীষ্ট আরও বলেন, তাকে তাই দাও যা সে তোমার কাছে চাইছে এবং তাকে যা ধার দিয়েছো তা তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিও না। এটা একটা সুন্দর আদর্শ।


আপনাদের সভাপতি মহাশয় আপনাদের একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এখানে কোনরকমভাবে রাজনৈতিক কথা চলবে না, কিন্তু আমাকে শেষ সাধারণ নির্বাচনের কথা বলতেই হচ্ছে। এই নির্বাচনটি সংঘটিত হয়েছিল এই আশায় যে এই নির্বাচনে আপনারা তাদের যে ধার দিয়েছিলেন তা তারা ফিরিয়ে দেবে। তাহলেই দেখুন আপনাদের সংরক্ষণশীল দল (Conservative party) ও উদারনৈতিক দল (Liberal Party) এমন কিছু মানুষদের নিয়ে তৈরি যারা খ্রীষ্টীয় হয়েও খ্রীষ্টের শিক্ষাকে মানেন না, কেননা নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে দিয়েই তারা যা দিয়েছিল তার সবটাই জোর করেই ফিরিয়ে নিয়েছে।


খ্রীষ্টের আর একটি উপদেশের কথা আমি জানি যেটি আমার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমার কিছু খ্রীষ্টান বন্ধুদের মধ্যে তাকে জনপ্রিয় রূপে দেখেনি। এই উপদেশে তিনি বলেছেন, যদি তুমি সঠিক হতে পার, তবে তোমার যা আছে তা নিয়ে যাও ও বিক্রি কর এবং দরিদ্রকে দাও।’ এটা সত্যই একটা সুন্দর নীতি কিন্তু এই নীতিটিকে খুব একটা অনুসরণ কেউ করে না। আমি মনে করি, এই সব নীতিগুলি নিঃসন্দেহে মঙ্গলজনক, যদিও এগুলি অনুসরণ করে জীবনে বাঁচা ব্যাপারটি খুব কষ্টকর। বেঁচে থাকবার জন্য আমি নিজের জীবনেও এই নীতিগুলি অনুসরণ করি না, কিন্তু এটা অবশ্যই বলব যে আমার ব্যাপারটা ঠিক খ্রীষ্টানদের মতন নয়।


খ্রীষ্টের শিক্ষার ভ্রান্তিসমূহ


এই নীতিগুলোকে অতি উত্তম বলে স্বীকার করে নিলেও, আমি এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না যে একজন মানুষকে চরম জ্ঞানী বলা যেতে পারে কিংবা খ্রীষ্টের ঈশ্বরতত্ত্বকে চরম রূপে দেখানো যেতে পারে, যেরকমভাবে দেখানো হয়েছে। গসপেলে।


যদিও এখানে কে ঐতিহাসিক প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত তা দেখানো আমার কাজ নয়, তবুও এ কথা বলতেই হয় যে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে খ্রীষ্টের অস্তিত্ব কোনদিন ছিল কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং তিনি থেকে থাকলেও তার সম্বন্ধে কোন কিছুই জানি না, অতএব আমি এই ধরনের ঐতিহাসিক প্রশ্নের ধারে-কাছেও যেতে চাই না যা যথেষ্ট দুঃসাধ্য। আমি শুধু সেই খ্রীষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই যাকে গপেলে বর্ণনা করা হয়েছে। গসপেলের বর্ণনাগুলিকে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে কেউ একথা বলতে পারবে না যে সেখানে যা পাওয়া যায় সেগুলো খুব জ্ঞানদীপ্ত। একটা জায়গায় অবশ্য সে ভাববে যে সেই সময় জীবিত সব মানুষদের মরবার আগে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব ওইসব মানুষদের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে এক গৌরবের মেঘমালার সৃষ্টি করেছিল। আমরা প্রচুর গ্রন্থ থেকে এই ঘটনার প্রমাণ পাই। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, “তোমরা ইজরায়েলের নগরীগুলোতে ততদিন পর্যন্ত যেতে পারনি যতদিন মানবের সন্তান না এসেছে। তারপর তিনি আরও বলেন, সেখানে এমন একটি অবস্থা দাঁড়ালো, যে-অবস্থা ততদিন পর্যন্ত মৃত্যুর স্বাদ নিতে পারেনি যতক্ষণ না মানবের সন্তান তার নিজের রাজত্বে ফিরে এসেছেন। এইরকম উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে তিনি বিশ্বাস করতেন যে সেই সময়ের জীবিত মানুষদের জীবদ্দশাতেই তিনি দ্বিতীয়বার ফিরে আসবেন। খ্রীষ্টের তৎকালীন অনুগামীদের এই বিশ্বাসই ছিল এবং তার নৈতিক শিক্ষার এটাই ছিল মূলভিত্তি। যখন তিনি বলেন, “পরের দিনের জন্য কোন চিন্তা রেখো না এইরকম আরও কয়েকটি উদাহরণকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, যে খ্ৰীষ্ট এই ধরনের কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন এই কারণে, যে তিনি জানতেন তাঁর দ্বিতীয় আবির্ভাব খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে চলেছে এবং এই কারণেই পার্থিব সব কারণগুলিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। বস্তুত, আমি কিছু খ্রীষ্টানদের চিনি যারা বিশ্বাস করে যে দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন ছিল। আমি এমন একজন ব্যক্তিকে চিনি যিনি তাঁর ধর্মসভাকে এই বলে শাসিয়ে ছিলেন যে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন, কিন্তু সেই ধর্মসভায় উপস্থিত ব্যক্তিরা তাকে তার বাগানে বৃক্ষরোপণ করতে দেখে যথেষ্ট সান্ত্বনা পেয়েছিল। সেই যুগের খ্রীষ্টানরা এই ব্যাপারটিকে যথার্থই বিশ্বাস করত এবং তার ফলে তারা তাদের বাগানে বৃক্ষেরোপণ থেকে বিরত থাকত, কেননা তারা খ্রীষ্টের থেকে এই বিশ্বাস গ্রহণ করতে পেরেছিল যে তাঁর দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন। উক্ত প্রসঙ্গে এ কথা পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে যে অন্যান্য মানুষদের মতোই তিনি যথেষ্ট জ্ঞানী ছিলেন না এবং তিনি কখনই পরম জ্ঞানী ছিলেন না।


নৈতিক সমস্যা


এবার আপনি নৈতিক প্রশ্নে আসুন। খ্রীষ্টের নৈতিক চরিত্রকে নিয়ে আমার মনে একটি গভীর সন্দেহ আছে এবং সেটি হল যে তিনি নরকে বিশ্বাস করতেন। আমি নিজে এই ব্যাপারটিকে কিছুতেই মেনে উঠতে পারি না যে খ্রীষ্টের মতো একজন পূর্ণমানব এইরকম চিরশাস্তিকে বিশ্বাস করতে পারেন। সুসমাচারগুলোতে খ্রীষ্টের এমন অনেক ছবি আঁকা হয়েছে যেখানে তাকে চিরশাস্তিকে বিশ্বাসীরূপে দেখা যাচ্ছে এবং যে-কেউ এই ব্যাপারটি দেখতে পাবেন যে যারা খ্রীষ্টের বাণী প্রচারে কান দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে তার সমর্থনকারীদের উন্মত্ততা। বাণী প্রচারকদের কাছে এই রকম ঘটনা কোন নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা তাদের গুরুগিরির গুরুত্বকে বেশ কিছুটা হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে আপনি সক্রেটুসের আচরণ লক্ষ্য করেননি। যে-সব মানুষ সক্রেটসের কথা শুনতো না তাদের কাছে তিনি ছিলেন অতিশয় নম্র ও ভদ্র। আমার মত অনুযায়ী এই ধরনের আচরণই একজন সাধু ব্যক্তির পক্ষে অধিকতর উপযুক্ত আচরণ। উপরোক্ত প্রচারক গুরুদের কর্কশ আচরণ কখনই উপযুক্ত আচরণ হতে পারে না। সম্ভবত আপনারা সবাই মনে রেখেছেন সেইসব কথাগুলোকে যা সক্রেটস তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বলেছিলেন এবং সেই কথাগুলোও নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে যে কথাগুলো তিনি তাদের বলতেন যারা তার কথা শুনতে না।


আপনারা দেখতে পাবেন যে তিনি তার সুসমাচারগুলোতে বলেছেন, ‘ওরে শয়তানগ্রস্ত, ওরে বিষধর সর্পের বংশধর, তোরা কি নরকের করাল গ্রাস থেকে কোনভাবে উদ্ধার পাবি?’ এই ধরনের কথা তাদের বিরুদ্ধেই বলা হয়েছে যারা তাঁর প্রচারে কান দেয়নি। এই ধরনের কথাগুলিকে আমার মন কিছুতেই উত্তম বলে মেনে নিতে পারেনি। নরক সম্পর্কে এ ধরনের অনেক উদাহরণ আপনি সুসমাচারগুলোতে দেখতে পাবেন। পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে পাপ সম্পর্কিত জনপ্রিয় একটি গ্রন্থের কথা আমরা জানি, যেখানে বলা হয়েছে, যারা পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কোন কথা বলবে তারা এ-জগতেও যেমন স্থান পাবে না, তেমনি আগত জগতেও কোন স্থান পাবে না। এই জনপ্রিয় গ্রন্থটিতে সেইসব মানুষদের জন্য এই জগতে অব্যক্ত সব নিদারুণ যন্ত্রণার উল্লেখ করা হয়েছে যারা কল্পনাতেও পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কোনরকম পাপ করে ফেলেছে এবং এটা চিন্তা করা হয়ে থাকে যে তারা ইহজগৎ বা পরজগৎ কোন জায়গাতেই ক্ষমা পাবে না। আমি সত্যই একথা চিন্তাও করতে পারি না যে চরিত্রের দিক থেকে খ্রীষ্টের মতো এমন একজন কোমল হৃদয়সম্পন্ন মানুষের পক্ষে জগতে এইরকম ভয় এবং প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার সম্ভব হয়ে থাকতে পারে।


এখানেই খ্রীষ্ট থেমে থাকলেন না। তিনি আরও বললেন, মানবের সন্তান তার দেবদূত পাঠাবেন এবং তারা তাঁর রাজত্বে যা কিছু বিরক্তিকর সেইসব কিছুকে বার করে এক জায়গায় একত্রিত করবে, এবং শুধু তাদেরই নয়, যারা পাপ করেছে। তাদেরও তারা এক জায়গায় করবে। তারপর তাদের জ্বলন্ত আগুনের চুল্লীতে নিক্ষেপ করবে। সেখানে শোনা যাবে দাঁত কিড়মিড় ও আর্তনাদের শব্দ। তিনি সেই আর্তনাদ ও দাঁত কিড়মিড়ের দিকেই এগিয়ে চলেছেন। তাঁর সুসমাচারগুলোতে এই ধরনের কথা বার বারই এসেছে। এটা পাঠকদের কাছে স্পষ্ট যে এই ধরনের দাঁত কিড়মিড় ও আর্তনাদের সম্পর্কে অনুতাপ করে এক ধরনের সুখ লাভ করা যায়। এই ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন আপনাদের অবশ্যই মনে আছে সেই ভেড়া ও ছাগলের উপাখ্যানের কথা। ভেড়া ও ছাগলদের দ্বিতীয়বার ভাগ করতে এসে তিনি ছাগলদের বলেন, ‘ওরে অভিশপ্তর দল, দূর হ আমার সামনে থেকে, এবং অনন্ত আগুনে পুড়ে মর। এরপর তিনি আরও বলেন, যদি তোমার হাত তোমাকে বিরক্ত করে তবে তাকে কেটে ফেল, দু’হাত থেকে যদি সেই নরকে যেতে হয় যে নরকের আগুন কখনও নেভে না, উষ্ণতা কখনও হ্রাস পায় না তপ্ততা কখনও ঠাণ্ডা হয় না, তার থেকে অনেক ভালো দু’হাত কেটে অঙ্গহীনতার জীবন কাটানো, বার বার তিনি এই কথা বলেছেন। আমি অবশ্যই বলব যে এই ধরনের নীতি, যা পাপ করার জন্য নারকীয় আগুনের শাস্তি দেয়, তা নিষ্ঠুর নীতি। এই ধরনের নীতি জগতে নিষ্ঠুরতাকে বৃদ্ধি করেছে এবং যুগের পর যুগ ধরে নিষ্ঠুর অত্যাচারের রাজত্ব চালিয়েছে। সুসমাচারের খ্রীষ্টকে যদি আপনারা তার যুগের সময় থেকে পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেখবেন যে তিনি এরজন্য আংশিক হলেও দায়ী।


এধরনের আরও অন্যরকম গল্প পাওয়া যায় যেগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। গাদারেনের শূকরের উপাখ্যান আর একটি দৃষ্টান্ত। সেখানে ছোট শূকরদের মধ্যে শয়তানকে স্থাপন করে তাদের পাহাড় থেকে ছুটিয়ে নামিয়ে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়াটা মোটেই কোন সহৃদয়তার পরিচয় নয়। আপনারা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে তিনি সর্বশক্তিমান এবং তিনি ইচ্ছে করলে শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে ছোট্ট শূকরদের মধ্যে শয়তানকে পাঠালেন। এছাড়াও ডুমুরগাছ নিয়েও একটি কৌতূহলোদ্দীপক গল্প আছে, যে গল্পটা আমাকে সর্বদাই বিমূঢ় করে রাখে : ‘সে ছিল ক্ষুধার্ত এবং দূরে পাতায় ভরা একটি ডুমুরগাছ দেখে খুশী হয়ে সেখানে এলো এই আশায় যদি সেখানে কিছু পাওয়া যায়। গাছের কাছে এসে সে দেখলো গাছের পাতা ছাড়া আর কিছুই নেই, কেননা সেই সময়টা ডুমুর ফলার সময় ছিল না। এই জন্য যীশু ডুমুরগাছকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, “কোন মানুষ এবার থেকে তোমার ফল খাবে না কখনও।”… পিটার তাঁকে বললেন, “প্রভু দেখুন, ঐ যে ডুমুরগাছ, তোমাদের মধ্যে যারা অভিশপ্ত তারা দূর হও।” এই গল্পটি সত্যই একটি কৌতূহলোদ্দীপক গল্প, কেননা বছরের সেই সময় ডুমুর ফলার সময় ছিল না, এই কারণে কোনভাবেই আপনারা ডুমুরগাছকে দোষারোপ করতে পারেন না। আমি নিজে ভাবতে পারি না যে যীশু ইতিহাসে পরিচিত তিনি কিছু মানুষের থেকে জ্ঞানে অথবা ধর্মে সবচেয়ে বড় ছিলেন। আমি মনে করি বুদ্ধ ও সক্রেটস এই ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন।


আবেগের কারণ


আমি আগেই বলেছি, মানুষ কেন ধর্মকে গ্রহণ করে তার প্রকৃত কোন কারণ না থাকার ফলে যুক্তি-তর্কের দ্বারা কিছু করা যাবে বলে আমি মনে করি না। তারা কেবলমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে ধর্মকে গ্রহণ করে। কোন একজনকে প্রায়ই বলা হত যে ধর্মকে আক্রমণ করাটা একটা বিরাট ভুল, কেননা ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান করে তোলে। এরকমই আমাকে বলা হয়, কেননা আমি ধর্মকে লক্ষ্যই করি না। আপনারা অবশ্যই জানেন, উক্ত বিষয়ের উপর যুক্তিকে নিয়ে ব্যঙ্গকাব্যে রচিত স্যামুয়েল বাটলারের গ্রন্থ এরিউহন রিভিজিটেড-এর কথা। আপনারা মনে রাখবেন যে এরিউহনে (Erewhon) হিগ্‌স নামে একটি চরিত্র আছে যে একটি দূরবর্তী দেশে পৌঁছলো। সেখানে কিছুদিন কাটাবার পর সে সেই দেশ থেকে বেলুনে চড়ে পালালো। কুড়ি বছর পর সে সেই দেশে ফিরে এলো এবং একটি নতুন ধর্মকে দেখলো, যে ধর্মে সেই পূজিত হচ্ছে সূর্যপুত্রের নামে এবং এই প্রবাদবাক্য সেখানে প্রচলিত ছিল যে সে স্বর্গে আরোহণ করেছে। সে দেখলো তার সেই আরোহণের দিনটিকে সেখানে উৎসব হিসাবে পালিত হতে। সে শুনলো দুজন অধ্যাপক হ্যাঁঙ্কি ও প্যাঙ্কি বলছে যে তারা মানুষ হিগসের উপর কখনও তাদের চোখ রাখতে পারে না এবং কোনদিন পারবেও না বলে তারা আশা করে। কিন্তু সূর্যপুত্রের ধর্মে তারাই ছিলেন উচ্চ পুরোহিত। এতে হিগস্ খুব রেগে গেল। সে তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি তোমাদের সমস্ত প্রবঞ্চনার কথা জানাতে যাচ্ছি এবং এরিউহনের সব মানুষদের আমি বলে দেব যে দেখ আমাকে, আমি সেই মানুষ হিগস এবং আমি বেলুনে চড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন তাকে বলা হল, তুমি এরকম কাজ অবশ্যই কোর না। এদেশের সব নৈতিক আদর্শগুলো এই পৌরাণিক গাথার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। একবার যদি তারা জানে যে তুমি স্বর্গে আরোহণ করনি তবে তারা বদমাস হয়ে যাবে।’ সে তাদের সেই কথা শুনলো এবং শান্তভাবে চলে গেল।


এটাই হল ব্যাপার যে আমরা যদি খ্রীষ্টান ধর্মকে আঁকড়ে না ধরি তবে আমরা সবাই খারাপ হয়ে যাবো। আমার কাছে মনে হয়, যে মানুষেরা এই ধর্মটাকে আঁকড়ে ধরেছে তাদের বেশিরভাগই ভীষণ বদমাস। আপনারা একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা দেখতে পাবেন, যে কোন যুগে ধর্ম যত তীব্র হয়েছে এবং ধর্মশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস মানুষের যত দৃঢ় হয়েছে, ততই সেখানে নিষ্ঠুরতা বেড়েছে এবং সামাজিক সম্পর্ক ও দৈনন্দিন জীবনের অবস্থা ততই খারাপ হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসের সেই সব যুগগুলোতে, যখন মানুষ সত্যই খ্রীষ্টধর্মকে উক্ত ধর্মের সব কিছু সমেত বিশ্বাস করত, তখন সেই প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ মতো দমনের জন্য স্থাপিত বিচারালয় যেমন ছিল, তেমন ছিল তার অত্যাচার। সেই সময় বহু হতভাগী মহিলাদের ডাইনি সন্দেহে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল। ধর্মের নামে মানুষের উপর সমস্ত রকমের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হয়েছিল।


জগতের দিকে তাকিয়ে দেখলে আপনারা দেখতে পাবেন, যখনই মানুষের অনুভবে যৎকিঞ্চিত অগ্রগতি ঘটেছে, অপরাধের আইনে যখনই কোন উন্নতি ঘটেছে, যখনই যুদ্ধ হ্রাস করার কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বা যখনই বর্ণ বৈষম্যকে দূর করার কোন চেষ্টা করা হয়েছে, যখনই দাসত্বকে হ্রাস করবার চেষ্টা করা হয়েছে বা জগতে প্রতিটি নৈতিক অগ্রগতি যখনই ঘটেছে, তখনই জগতের সমস্ত সংগঠিত গীর্জা সর্বদা তার বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কথাই বলব যে খ্রীষ্টধর্ম, যা তার গীর্জাগুলোকে ভিত্তি করে সংগঠিত, তা সর্বদা ও এখনো পর্যন্ত জগতের নৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু।


কেমনভাবে গীর্জাগুলো অগ্রগতিকে বাধা দিয়েছে


আপনারা হয়ত ভাবছেন যে এখনো গীর্জাগুলো অগ্রগতিকে বাধা দিয়ে যাচ্ছে বলে আমি খুব বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছি বলে আমি মনে করি না। আচ্ছা, একটা ঘটনার কথা বলা যাক। যদি আমি ঘটনাটার কথা উল্লেখ করি তা হলে আপনারা আমার সঙ্গে অবশ্যই তা সহ্য করবেন, কেননা ঘটনাটা খুব আনন্দদায়ক নয়। গীর্জা কোন একজনকে সত্য বলতে বাধ্য করেছিল যেটা খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। ধরুন আজকের যে জগতে আমরা বাস করছি। সেখানে একটি অভিজ্ঞ মেয়ে একজন সিফিলিটিক (যৌনরোগাক্রান্ত) মানুষকে বিবাহ করেছিল। এই ঘটনায় ক্যাথলিক গীর্জা বলেছিল, এটা খ্রীষ্টধর্মের একটা অচ্ছেদ্য আদর্শ। তোমাদের অবশ্যই সারা জীবনের জন্য একসঙ্গে থাকতে হবে। সেই মহিলাকে একটি সিফিলিটিক শিশুকে জন্ম দেওয়ার থেকে বিরত হবার জন্য কোনরকম ব্যবস্থা নিতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনাটা ঘটেছিল গীর্জার ঐ কথার জেরেই। আমি মনে করি এই ঘটনাটা ছিল জঘন্য নিষ্ঠুরতা এবং যাদের প্রাকৃতিক সহানুভূতি শাস্ত্রের নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ নয়, সমস্ত দুঃখ-কষ্টের প্রতি যাদের নৈতিক চরিত্র একেবারেই মরে যায়নি, তারা এই ধরনের ঘটনাকে সঠিক ও যথার্থ ভেবে চলতে দেওয়া উচিত বলে মনে করবে না।


এটা কেবলমাত্র একটি উদাহরণ। এখনো, বর্তমানে অনেক পথেই গীর্জাগুলো নৈতিক আদর্শের নামে সমস্ত রকমের মানুষকে নানারকম অনুচিত ও অপ্রয়োজনীয় কষ্টের দিকে ঠেলে দেয়। এ বিষয়ে আরও বলতে গেলে, আমাদের পূর্বের আলোচনাকে টেনে এনে আবার বলতে হয়, যে-কোন পথের অগ্রগতি এবং উন্নতির যা জগতের দুঃখ-কষ্টকে হ্রাস করতে পারে, তারই বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে এই গীর্জাগুলো। কারণ এরা তাদের ইচ্ছামত কিছু নৈতিক আদর্শকে গড়ে নিয়েছে। এই আদর্শগুলোকে তারা তাদের সংকীর্ণ শাসনের দ্বারা পরিচালিত করে থাকে, যা কোনভাবেই মানুষকে সুখী করে তুলতে পারে না। যখন আপনারা বলে থাকেন এটা বা ওটা অবশ্যই করা উচিত, কেননা তা মানুষের সুখের জন্যই বলা হয়েছে, তখন তারা মনে করে যে সেগুলো করে কোন লাভই নেই। নীতিকথার সঙ্গে মানুষের সুখের সম্পর্কটা কী? নীতিকথার বিষয়গুলি মানুষকে কখনই সুখী করতে পারে না।


ধর্মের ভিত্তিকে ভয় করুন


আমি মনে করি প্রাথমিকভাবে ধর্ম প্রধানত ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এটা আংশিকভাবে অজানার ভয় এবং আংশিকভাবে আপনার সেই অনুভব প্রবণতা যার দ্বারা আপনি এমন ভাবেন যে আপনার কিছু দরদী ভাই আছে যারা আপনার যে কোন বিপদে ও সমস্যায় আপনার পেছনে দাঁড়াবে। ভয়টাই হল আসল ভিত্তি- রহস্যের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় হল নিষ্ঠুরতার জনক-জননী। এই জন্যেই এটা বললে খুব একটা আশ্চর্য শোনাবে না যে ধর্ম এবং নিষ্ঠুরতা পরস্পরের হাত ধরে চলে। এটার কারণ, ভয়ই হল নিষ্ঠুরতা ও ধর্ম এই দুই বস্তুর আসল ভিত্তি। এই জগতের বস্তুকে বুঝতে আমরা এখন অল্প চেষ্টা করতে পারি, এবং সেই বিজ্ঞানের সাহায্যে উক্ত বস্তুর উপর অল্প-স্বল্প প্রভুত্বও করতে পারি, যে বিজ্ঞান খ্রীষ্টধর্ম, গীর্জা ও সব পুরোনো ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে প্রতি পদক্ষেপে লড়াই করে এগিয়ে এসেছে। বিজ্ঞান এই অতি নীচ ভীতি থেকে মনুষ্যজাতিকে উদ্ধার করে আমাদের সাহায্য করতে পারে যে ভীতির অধীনে সে যুগের পর যুগ ধরে বেঁচে এসেছে। বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দিতে পারে এবং আমি মনে করি, আমাদের হৃদয়ও আমাদের এই শিক্ষা দিতে পারে, যাতে আমরা আর বেশি দিন কাল্পনিক সহযোগিতার আশায় বসে না থাকি, যাতে আর আমরা আকাশে কানাগলি খুঁজে না মরি, ববং আমরা আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে জগৎকে বাসযোগ্য করে তুলবো সেই জায়গার পরিবর্তে যে জায়গায় গীর্জাগুলো শত শত বছর ধরে জগৎকে পৌঁছে দিয়েছে।


আমাদের অবশ্যই কী করা উচিত


আমাদের অবশ্যই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং জগৎকে ভোলা চোখে দেখতে হবে। ভোলা চোখে দেখতে হবে জগতের ভালো দিক, মন্দ দিক, জগতের সৌন্দর্য এবং কুৎসিত দিকসমূহ। জগৎকে জগতের মতোই দেখতে হবে এবং তার জন্য ভয় পেলে চলবে না। বুদ্ধিব দ্বারা জগৎকে জয় করতে হবে। জগৎ থেকে উঠে আসা ভয়গুলোর দৌরাত্মে দাসতুকে মেনে নিলে আর চলবে না। ঈশ্বর সম্পর্কে সমগ্র ধারণাটি জগৎজোড়া প্রাচীন স্বৈরাচারী কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের কল্পনা নিছক বাতুলতা মাত্র। যখন আপনারা শোনেন, যে মানুষ গীর্জায় গিয়ে নিজেদের শোচনীয় পাপী বলে ছোট করে, বা এ ধরনের সব রকমের কাজ শুধু নিন্দনীয়ই নয়, তা মানুষের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষে উপযুক্তও নয়। আমাদের উঠে দাঁড়ানো উচিত এবং সম্মুখ জগৎকে উন্মুক্তভাবে দেখা উচিত। জগতের ভালো সম্পর্কে আমরা যতটা করতে পারি ততটাই আমাদের করা উচিত। যদি যতটা ভালো চাইলাম ততটা ভালো না-ও হয়, তবুও যুগের পর যুগ ধরে ওরা যা করে এসেছে তার থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো হবে বলে আশা করা যায়। একটি মঙ্গলময় জগৎ সৃষ্টি করতে চাই জ্ঞান, দয়া এবং সাহস। ঘৃণ্য অতীতের ধ্বজা আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে আর চলবে না, অথবা বহু যুগ আগের অজ্ঞ মানুষদের মুক্তবুদ্ধি প্রসূত কথার জালে আটকে থাকলেও চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন ভয়হীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুক্তবুদ্ধি। এর জন্য দরকার ভবিষ্যৎ গঠনের আশা, যে অতীত মৃত তার দিকে মুখ করে বসে থাকলে আর চলবে না, যে অতীতকে আমরা বিশ্বাস করি তাকে অতিক্রম করে চলে যাবে ভবিষ্যৎ কেননা আমাদের বুদ্ধি সৃষ্টি করতে পারে।

সভ্যতায় ধর্মের কি কোন কার্যকরী অবদান আছে?


ধর্ম সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি লুক্রেতিউসের মতো। আমি মনে করি এটা এমন একটা রোগ যা ভয় থেকে জন্মগ্রহণ করে থাকে এবং যা মানবজাতির শোচনীয় দুর্দশার উৎস। যদিও, আমি একথা অস্বীকার করতে পারি না যে মানবসভ্যতায় এর কিছু অবদান আছে। প্রাচীন যুগে একটি ক্যালেন্ডার তৈরিতে সাহায্য করেছে। এটি ইজিন্সীয় পুরোহিতকে এমন সযত্নে সূর্যগ্রহণের সময় নির্ধারণ করতে শিখিয়েছিল যাতে তারা তার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়। এর এই দুটি অবদানের কথা জানাতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, কিন্তু অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না।


ধর্ম শব্দটি বর্তমানে খুব হাল্কা অর্থে ব্যবহৃত হয়। চরম প্রোটেস্টান্টবাদের প্রভাবে কিছু মানুষ ধর্ম শব্দটিকে খুব ব্যক্তিগত দৃঢ়বিশ্বাস, যেমন নৈতিক আদর্শ প্রভৃতি অর্থে ব্যবহার করে থাকে অথবা তারা ধর্ম বলতে মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে বোঝে। শব্দটির এই ধরনের ব্যবহার সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। প্রাথমিকভাবে ধর্ম হল একটি সামাজিক ঘটনা। বহু আচার্যের নিজ নিজ দৃঢ়বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই গীর্জাগুলির উদ্ভব ঘটেছে, কিন্তু যে-সব আচার্য এই গীর্জাগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা কদাচিৎ গীর্জাগুলির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। অথচ যে মনুষ্য-গোষ্ঠীগুলোর উপর গীর্জাগুলি বেড়ে ওঠে সেখানে তাদের প্রভাব অপরিসীম। পাশ্চাত্য সভ্যতার সদস্যদের ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলা যাক। সুসমাচারে খ্রীষ্টের যে উপদেশগুলো দেখা যায় তা সেখানকার খ্রীষ্টীয় নীতিশিক্ষার থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই স্বতন্ত্র। খ্রীষ্টীয়বাদের যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি হল, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে খ্ৰীষ্টীয়বাদ খ্রীষ্টের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে গীর্জার উপর এবং যদি আমরা সামাজিক শক্তি হিসাবে খ্রীষ্টীয় শক্তি বা ধর্মকে বিচার করবার চেষ্টা করি তবে তার উপাদান খুঁজতে আমরা কখনই সুসমাচারের দ্বারস্থ হব না। খ্রীষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন যে আপনার উচিত আপনার সম্পদ গরীবকে দেওয়া, এর জন্য আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে না। আপনাকে গীর্জার দ্বারস্থ হতে হবে না এবং ভেজাল বস্তু বিক্রয়ের জন্য কাউকে আপনাকে শাস্তিও দিতে হবে না। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রোটেস্টান্ট বা ক্যাথলিক কোন সম্প্রদায়ই খ্রীষ্টের উপদেশ অনুসরণ করার কোন ইচ্ছাই পোষণ করে না। এটা সত্য যে কিছু ফ্রানসিসকীয় সদস্যরা খ্রীষ্টের বারজন শিষ্যের আদর্শমণ্ডিত ও কষ্টসহিষ্ণু জীবনের নীতি দর্শিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পোপ এই ধরনের নীতি প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ-আদর্শ বলে নিন্দা করেছেন। আমরা যদি খ্রীষ্টের এই উপদেশটিকে নিয়ে পর্যালোচনা করি, যেমন, ‘নিজেকে বিচার না করে অপরকে বিচার করতে যেও না তাহলে আপনারা নিজেদেরকেই জিজ্ঞাসা করুন যে এই উপদেশটি অনুসরণ করলে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ-মতো দমনের জন্য ঐ বিচারালয়ের কি অবস্থা হবে এবং কু কুক্স-ক্ল্যান (Ku-Klux-klan)-এর কি পরিণতি দাঁড়াবে।


খ্রীষ্টধর্মের বেলায় যে ব্যাপারটি সত্য তা বৌদ্ধধর্মের বেলাতেও একইভাবে প্রযোজ্য। বুদ্ধ ছিলেন অমায়িক ও আলোকিত। মৃত্যুশয্যায় বুদ্ধকে শুয়ে থাকতে দেখেও তাঁর শিষ্য তাকে অমর ভাবাতে তিনি তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধ পৌরোহিত্য, এখন যা বিদ্যমান, উদাহরণস্বরূপ তিব্বতের কথাই ধরা যাক সেখানে–অজ্ঞেয়বাদীদের স্বৈরাচার ও নিষ্ঠুরতা এক চরম আকার ধারণ করেছে।


গীর্জা ও তার স্থপতির মধ্যে এই স্বতন্ত্রতা কোন দৈবাৎ ঘটনা নয়। যখন কোন মানুষ পরম সত্য সম্পর্কে কিছু বলে, তখন কিছু পারদর্শী মানুষ তা ব্যাখ্যা করতে বসে এবং অব্যর্থ ভাবে তারা অর্জন করে ক্ষমতা, কেননা তারা সত্যের চাবিকাঠি সম্পর্কে জানে। সমাজের যে-কোন কুলীন জাতের মতোই তারা তাদের স্বার্থে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কুলীন জাতের থেকেও একটি বিষয়ে এগিয়ে থাকে, আর তা হল অপরিবর্তনীয় সত্যের ব্যাখ্যা করার ব্যবসা করা। তারা যা প্রকাশ করে তা সবার ক্ষেত্রে ও সব কিছুর ক্ষেত্রে যথার্থ ধরা হয়। ফলে, অনিবার্যরূপে তা সমস্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও নৈতিক অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। গীর্জা গ্যালিলিও ও ডারউইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, আমাদের যুগে ফ্রয়েডের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে সময়টাতে গীর্জা তার চরম ক্ষমতায় আসীন ছিল সেই সময়টাতে সে সমস্ত বুদ্ধিদীপ্ত জীবনের বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পোপ গ্রেগরী দ্য গ্রেট কোন এক বিশপকে একটি চিঠি লেখেন, যে চিঠিটি তিন শুরু করেন এই ভাবে যে আমাদের কাছে এমন একটি সংবাদ এসে পৌঁছেছে যে সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে হয়। আর তা হল, আপনি আপনার কিছু বন্ধুর কাছে ব্যাকরণের ব্যাখ্যা করেছেন। এই বিশপকে প্রধান ধর্মগুরুর কর্তৃত্বের ফলে ঐ রকম নীচ শ্রম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হতে হয়েছিল, ফলস্বরূপ নবজাগরণের আগে পর্যন্ত ল্যাটিন সাহিত্যের উদ্ধার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র বুদ্ধিগত বিষয়ের জন্যই নয়, দৈনিক বিষয়ের জন্যও ধর্ম অনিষ্টকর (it is not only intellectuallly, but also nor mally, that religion is permicious)। আমি বলতে চাইছি যে, ধর্ম যে নৈতিক শিক্ষার তালিকা প্রদান করে থাকে তাকে অনুসরণ করে মানুষ কখনই সুখী হতে পারে না। কিছু বছর আগে, যখন জার্মানীর রাজপরিবার তাদের ব্যক্তিগত জমিকে আগের মতোই ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেই মতের উপর নির্বাচন করা হয়েছিল, তখন সেখানকার গীর্জা এই মর্মে ঘোষণা করেছিল যে এই ধরনের ব্যবস্থা যার দ্বারা রাজ-পরিবার বঞ্চিত হবে তা খ্রীষ্টীয় শিক্ষার বিরোধী। একথা সবাই জানে যে যখন তারা দাসত্ব প্রথা বিলোপ করতে চেয়েছিল তখন গীর্জাগুলো তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল এবং বর্তমানে কিছু কিছু বহুল বিজ্ঞাপিত ব্যতিক্রম ছাড়া গীর্জাগুলো অর্থনৈতিক সুবিচারের প্রতিটি পদক্ষেপে বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে। পোপ সর্বতোভাবে সমাজতন্ত্রের নিন্দা করেছেন।


খ্রীষ্টীয়বাদ ও যৌনতা


খ্রীষ্টানধর্মের সব থেকে জঘন্য বৈশিষ্ট্যটি হল, যৌনতার প্রতি এর আচরণ এতই ব্যাধিগ্রস্ত ও অপ্রাকৃতিক যে তা একমাত্র রোম সাম্রাজ্যের পতনের সময় সভ্য জগতের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তার সঙ্গে তুলনীয়। সেই সময়ের আঙ্গিকে উক্ত আচরণকে বিচার করলে তবেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। আমরা অনেক সময় শুনে থাকি বা বলে থাকি যে খ্রীষ্টীয়বাদ মহিলাদের মর্যাদাকে উন্নত করেছে। কিন্তু এর থেকে স্কুল ঐতিহাসিক বিকৃতি আর কখনও সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের সমাজে মহিলারা কখনও একটা সহনীয় অবস্থা ভোগ করতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে এটাকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়ে থাকে যে কঠোর নৈতিক আদর্শগুলো কখনই মহিলাদের লজ্জন করা উচিত নয়। মঠের সাধুদের কাছে প্রাথমিকভাবে মহিলারা চিরকালই প্রলোভনের যন্ত্র হিসাবে পরিগণিত। তারা মহিলাদের প্রধানত অশুদ্ধ লালসার প্রেরণা বলে ভাবে। গীর্জার শিক্ষানুযায়ী এখনো কৌমার্য উত্তম বলে বিবেচিত, কিন্তু যারা এই অবস্থাটাকে অসম্ভব বলে মনে করবে তাদের জন্য বিবাহকে অনুমোদন করা হয়েছে। জ্বলে-পুড়ে মরার থেকে বিবাহ করা ভাল, সেন্ট পল নিষ্ঠুরভাবে কথাটি বলেছেন। বিবাহ-নীতিকে তাচ্ছিল্য করে, এবং বেছে বেছে সৌন্দর্য ও কলা বিষয়ক সমস্তরকম জ্ঞানকে বাদ দিয়ে, গীর্জাগুলো যেটুকু যৌনাচারকে বিবাহিত জীবনের জন্য নিশ্চিত করে অনুমোদন দিয়েছে তাতে আনন্দ যৎকিঞ্চিৎ কিন্তু যন্ত্রণা অধিক। এই একই ধরনের অত্যাচার দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতার ক্ষেত্রে। বছরের পর বছর শিশুর জন্ম দিয়ে শুকিয়ে না মরলে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে যে সে তার বিবাহিত জীবনে খুব বেশি আনন্দ লাভ করতে পারেনি। এই কারণেই জন্মনিয়ন্ত্রণকে কোনভাবেই উৎসাহ দেওয়া হয়নি।


খ্রীষ্টীয়বাদের সঙ্গে পাপের যে ধারণা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত তা অস্বাভাবিক ক্ষতি করে থাকে, যেহেতু এই ধারণা অন্য দিক দিয়ে তাকে সেই মর্ষকামী হতে বাধ্য করে যে মর্ষকামকে তারা আইনত, এমনকি মহান বলে মনে করে। উদাহরণস্বরূপ, সিফিলিস প্রতিরোধের প্রশ্নকেই নেওয়া যাক। এই রোগের বিরুদ্ধে আগের থেকে কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে এই ছোঁয়াচে রোগের প্রতিকারকে কোন আমলই দেওয়া হয়নি। যদিও এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে খ্ৰীষ্টীয়রা তাদের ব্যাপ্ত জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে ঘটনাটিকে মঙ্গলময় বলে থাকে এই কারণে যে তারা মনে করে পাপীর শাস্তি পাওয়া উচিত। এই ব্যাপারটিকে মঙ্গলময় মনে করে তারা এই ইচ্ছাও পোষণ করে থাকে যে এই শাস্তিটি পাপীর স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যেও যেন বিস্তৃত হয়। বর্তমান পৃথিবীতে এই মুহূর্তে বহু শিশু এই ছোঁয়াচে মারাত্মক সিফিলিস রোগে জীবনমরণ লড়াই করে চলেছে, কিন্তু তাদের এমনভাবে জন্মানোর কথা ছিল না যদি না খ্রীষ্টীয়রা পাপীদের শাস্তি দিতে চাইত। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না যে শাস্ত্রীয় নীতি এই ধরনের শয়তানি নিষ্ঠুরতার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় তা নৈতিক চরিত্রের উপর কোনরকম শুভ প্রভাব ফেলতে পারে।


এই বিষয়টি কেবলমাত্র যৌন আচরণের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, যৌন বিষয়ের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য। এর ফলে, একথা বলা যেতে পারে যে খ্ৰীষ্টীয়দের আচরণ মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। নিরপেক্ষভাবে যখনই কেউ এই বিষয়টি ভাবতে চায় তখন তাকে এই দেখে কষ্ট পেতে হয় যে যৌন বিষয়ের উপর কৃত্রিম নির্বুদ্ধিতা যা গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের পরিচালিত করে ও যুবক-যুবতীদের শিক্ষার ব্যাপারে তা তাদের শারীরিক ও মানসিক দু-দিকের জন্যই মারাত্মক বিপজ্জনক এবং এই ক্ষতি তাদের উপর বর্তায় যারা উক্ত বিষয়ের উপর তাদের অযথার্থ (Improper) আলোচনা শুনে জ্ঞান অর্জন করে থাকে। যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি প্রায়শই ঘটে, এর ফলে তারা যৌনতাকে কুৎসিত ও হাস্যাস্পদ বলে মনে করে। জ্ঞান চির-অনাকাঙ্ক্ষিত এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি না। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা আমি পছন্দ করি না, তা যে-কোন মানুষের ক্ষেত্রেই হক। বিশেষত যৌন জ্ঞানের বিষয়ের স্বপক্ষে বহু ওজনদার যুক্তি পাওয়া যাবে যা অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রের চেয়েও বেশি। কোন বিষয়ের উপর অনুশীলনকারী ব্যক্তি যতটা বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে ততটা কোন অনুশীলনহীন নির্বোধ ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে পাপের ধারণা গড়ে তোলাটা একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার কেননা যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের স্বতঃস্ফুর্ত কৌতূহল থাকবেই।


প্রত্যেক বালকই ট্রেনের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত। ধরা যাক আমরা তাকে বললাম ট্রেনের ব্যাপারে আগ্রহ থাকাটা একধরনের পাপ। মনে করা যাক, ট্রেনে থাকাকালীন আমরা তার চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলাম, অথবা যখন সে কোন রেল স্টেশনে তখন ঐ একই কাজ করলাম। মনে করা যাক, তার উপস্থিতিতে আমরা কখনও ‘ট্রেন’ শব্দটি তার সামনে উচ্চারণ করলাম না এবং সেটি কিভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয় সে বিষয়ে আমরা তার কাছে এক অভেদ্য রহস্য বজায় রাখলাম। এর ফলে এই দাঁড়াবে না যে সে ট্রেনের ব্যাপারে তার আগ্রহকে কমিয়ে দেবে, উপরন্তু দেখা যাবে ট্রেনের ব্যাপারে আগের তুলনায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে, কিন্তু এক বিষণ্ণ পাপের চেতনায় সে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। কেননা এই ধরনের আগ্রহকে অন্যায় বলে তার কাছে। বর্ণনা করা হয়েছে। সক্রিয়ভাবে বুদ্ধিমান যে-কোন বালক এই কারণেই কমবেশি স্নায়ুরোগের শিকার হয়ে পড়ে। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে, যৌনতা সম্বন্ধে এই ধরনের ঘটনাই ঘটে এবং যেহেতু যৌনতা ট্রেনের থেকেও অনেক বেশি আগ্রহোদ্দীপক তাই ফল আরও অনেক খারাপ হয়। এর ফলেই খ্রীষ্টীয় গোষ্ঠীতে বহু মানুষই স্নায়ুরোগের শিকার। এর কারণ ছোট বয়সে তাদের যৌন জ্ঞানের উপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা। এই পাপবোধ যা কৃত্রিমভাবে তাদের উপর আরোপ করা হয়েছিল তা পরবর্তীকালে তাদের ভীরু, নিষ্ঠুর, নির্বোধ করে তোলে। ছোট বয়সে বালক-বালিকারা যা জানতে চায় তাকে তা না জানানোটা কোন যুক্তিসংগত ব্যাপার নয়– সেটা যৌন সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাও হতে পারে অথবা অন্য কিছু। আমরা যতক্ষণ প্রাথমিক পড়াশুনোর সময়টাতে ছেলেমেয়েদের এই বিষয়ে জানাতে না পারবো ততদিন পর্যন্ত আমরা সুস্থ জনসাধারণ সৃষ্টি করতে পারবো না। যতদিন গীর্জাগুলোর হাতে শিক্ষাগত রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এটা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।


যদি এই সব আপত্তির সঙ্গে তুলনীয় বর্ণনাগুলোকে পাশে সরিয়ে রাখি, তবে এটা পরিষ্কার যে খ্রীষ্টীয়বাদের মৌল শাস্ত্রীয় নীতিগুলিকে মেনে নেওয়ার আগেই তা লোকের মনে এক ধরনের নৈতিক বিকৃতির দাবি করে থাকে। আমাদের বলা হয়ে থাকে যে এই জগৎ সেই ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট যিনি একাধারে মঙ্গলময় ও সর্বশক্তিমান। জগৎ সৃষ্টি করার আগেই তিনি তাঁর দিব্য দৃষ্টিতে সেই সব যন্ত্রণা ও কৃপণতাকে আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যার দ্বারা জগৎ পূর্ণ হবে। তাই এই সমস্ত কিছুর জন্য তিনিই দায়ী। এই তর্ক করাটা একেবারেই অনর্থক, যে পাপের জন্যেই জগতে এত যন্ত্রণা। প্রথমেই বলতে হয় যে এটা সত্য নয়। নদীতে বন্যা আসার ফলে কূল উপচে পড়া বা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ অবশ্যই কোন পাপের ফলে ঘটে না। কিন্তু যদিও তা সত্য হত, তাতে কোন কিছু যেত-আসত না। যদি আমি জেনেশুনে এমন একটি শিশুর জন্ম দিতাম যার মাথায় অবশ্যই ভ্রাতৃহত্যার পাগলামী আছে তবে সেই অপরাধের জন্য আমিই দায়ী হতাম। যদি ঈশ্বর আগেভাগেই সেই পাপের কথা জানতেন যে পাপের ফলে সে দোষী হবে, তবে এই সমস্ত পাপের ঘটনার জন্য তখন থেকে তিনিই পরিষ্কারভাবে দায়ী যখন থেকে তিনি মানুষ সৃষ্টি করবার পরিকল্পনা করেছিলেন। খ্রীষ্টীয়দের যুক্তিতে জগৎকে পাপ থেকে মুক্ত করে তাকে শুদ্ধ করতেই এই ধরনের দুঃখ-কষ্ট। এই জন্য দুঃখ কষ্ট-যাতনা মঙ্গলময়। মর্ষকামকে সংগতিকর করে তোলার জন্য এ এক ভালো যুক্তি, কিন্তু সর্বতোভাবে এই যুক্তি খুবই দুর্বল। আমি যে-কোন খ্রীষ্টীয়কে হাসপাতালের শিশু-বিভাগে আমার সঙ্গে ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানাই তাদের এটি দেখাতে যে সেখানে কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করা হচ্ছে। তা দেখার পর তাদেরকে ভাবতে বলব যে সেই সব শিশুরা নৈতিকভাবে পরিত্যক্ত এবং তারা যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, তারা তার যোগ্য। এই অনুভব জাগাতেই তাকে এই জায়গায় নিয়ে আসা যে, মানুষ তার অন্তরেই সমস্ত দয়া-মায়া-করুণার অনুভূতিকে অবশ্যই ধ্বংস করে। যে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বরের মতোই সে নিজেকে নিষ্ঠুর করে তোলে। যেসব মানুষ বিশ্বাস করে যে এই যন্ত্রণাকাতর জগতের সবকিছুই উত্তম তারা তাদের নৈতিক মূল্যকে অবিকৃত রাখতে পারে না, কেননা তারা সর্বদাই সমস্ত দুঃখ-কষ্টের পেছনে ওজর খুঁজে বার করে।


ধর্ম সম্পর্কে আপত্তি


ধর্ম সম্পর্কে দু’ধরণের আপত্তি দেখা যায়–বৌদ্ধিক এবং নৈতিক। বৌদ্ধিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় যে কোন ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার কোন কারণ নেই এবং নৈতিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় ধর্মের উপদেশগুলি এমন এক সময় থেকে উঠে এসেছিল যখন মানুষ বর্তমান যুগের থেকেও অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে যে এই উপদেশগুলি অমানবিকতাকে চিরন্তন করবার জন্যই তৈরি এবং যদি এমন না হত তবে মানুষের নৈতিক বিবেকবোধ বর্তমানে আরো অনেক উন্নত হত।


প্রথমে বৌদ্ধিক আপত্তির কথাই ধরা যাক। বর্তমান বাস্তব যুগে এই প্রবণতাটি দেখা যায় যে ধর্ম সত্য না অসত্য তা নিয়ে কারুর কোন মাথাব্যথা নেই, কেননা ধর্ম সম্পর্কে যে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ধর্ম কার্যকরী কি না। একটি বিষয়ের উপর প্রশ্ন অন্য বিষয়ের উত্তর হতে পারে না। যদি আমরা খ্রীস্টধর্মকে বিশ্বাস করি তা হলে আমাদের উদ্দেশ্য হবে তার মধ্যে মঙ্গলময় কি আছে তা দেখা। আর যদি আমরা বিশ্বাস করব না এই রকম ভাবি তবে প্রশ্নটা হবে সেই মঙ্গলময় দিকগুলো কতটা মঙ্গলময় হয়ে দাঁড়াবে তার উপর ফলে, এই দু’ক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট অবশ্যই স্বতন্ত্র। খ্ৰীষ্টীয়দের কাছে খ্রীষ্টধর্ম ভালো মনে হতেই পারে, যখন অবিশ্বাসীদের কাছে তা মন্দ বলে বিবেচিত। অধিকন্তু ঐ ব্যাপারে প্রত্যেকের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সব সিদ্ধান্ত থাকে এবং তাদের প্রশ্নগুলি তাদের প্রমাণের স্বপক্ষে তৈরি হয়ে থাকে। এর ফলে প্রকৃত প্রমাণের বিপক্ষে শত্রুতার সৃষ্টি হয় এবং ঘটনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমরা মনকে সেই বিষয়ে আর খাটাতে চাই না। কেননা পক্ষপাতশূন্য অবস্থায় আমাদের মন খাটতে অভ্যস্ত নয়।


একটি সরল বা পক্ষপাতশূন্য বৈজ্ঞানিক ভাবনা আছে যা গুণগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই সরল বৈজ্ঞানিক ভাবনা কদাচিৎ কোন মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যে জগতের সমস্ত বস্তুগুলোকে বিশ্বাস করাটা তার কর্তব্য। এইজন্য ধর্ম প্রকৃতপক্ষে সত্য কিনা সে সম্পর্কে কোন রকম অনুসন্ধান না করে আমরা এই সিদ্ধান্তে বাস্তবপক্ষে পৌঁছাতে পারি না যে ধর্ম যা করে তা মঙ্গলের জন্যই করে। মহম্মদীয় ধর্ম এবং ইহুদি ধর্ম প্রভৃতি প্রতিটি ধর্মের সত্য সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে। সেই সব যুগগুলোতে যখন ধর্ম বলতে যে শব্দটির জয়ঢাক বাজতো তা ঈশ্বর এবং যথার্থভাবে তার একটি নির্দিষ্ট অর্থ থাকত। কিন্তু যুক্তিবাদীদের কঠোর আক্রমণে তা ক্রমশই ম্লান হয়ে এসেছে। এই ব্যাপারটা বোঝা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে সহজ হবে না যতক্ষণ আমরা বুঝতে না পারবো যে বর্তমানে যখন মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এমন কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ঠিক কি বোঝাতে চাইছে, তা না বুঝলে। এ বিষয়ে ম্যাথিউ আর্নল্ড প্রদত্ত সংজ্ঞার যুক্তিপ্রসূত উদ্দেশ্যকে ধরা যাক, আমাদের মধ্যে এমন কোন ক্ষমতা নেই যা আমাদের পুণ্যবান করে তোলে। আমরা এই ব্যাপারটাকে আগের থেকেও অনেক বেশি অস্পষ্ট করে তুলি এবং নিজেদের কাছে বারবার এই প্রশ্ন করি যে এই পৃথিবী নামক গ্রহের পৃষ্ঠে জীবিত সত্তার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য আছে এমন প্রমাণ আমাদের হাতে আছে কি না।


এই বিষয়ে ধার্মিক মানুষদের সচরাচর যে যুক্তি হয় তা মোটামুটি এই রকম, ‘ধরুন, আমি এবং আমার বন্ধু দুজনেই অসাধারণ বুদ্ধি ও নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী। কিন্তু এটা ভেবে নেওয়া খুব কঠিন যে অতি বুদ্ধিমান ও অতি পুণ্যবান হঠাৎই আসতে পারে। এইজন্য বলা যেতে পারে যে এখানে আমাদের মতো জীবন্ত অন্তত এমন একজন কেউ অবশ্যই থাকবে যে অতি বুদ্ধিমান ও নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী এবং যে তার অতি জাগতিক যন্ত্র ঘোরাতে শুরু করেছে আমাদের উৎপাদনের জন্য। আমি এ কথা বলতে দুঃখবোধ করছি যে যারা এই ধরণের যুক্তিকে খুব হৃদয়গ্রাহী বলে মনে করে তাদের মতো করে আমি মানতে পারি না। বিশ্বটা বিরাট, অতএব যদি আমরা এডিংটনকে বিশ্বাস করি, দেখবো যে এই বিরাট বিশ্বের কোন জায়গাতেই মানুষের মতো বুদ্ধিমান কেউ নেই। সেই তুলনায় বুদ্ধিমান প্রাণীর শরীর গঠন করতে কতটা বস্তু খরচ হয়েছে তা যদি মেপে দেখেন তবে বুঝতে পারবেন পূর্বের তুলনার পর। যদি আপনি জগতের সমুদয় বস্তুকে আপনার বিবেচনার অধীনে নিয়ে আসেন এবং সেই তুলনায় বুদ্ধিমান প্রাণীর শরীর গঠনের পরিমাপটি লক্ষ্য করতে চান তবে দেখবেন আগে যা ছিল তার অনন্ত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ, এটাও যদি অসম্ভব বলে মনে হয় যে আকস্মিকতার আইন তৈরি করবে জীবন্ত প্রাণী যারা বহু পরমাণুর সাধারণ নির্বাচনের ফলে বুদ্ধিমান হবে, তবে এটাও সম্ভব নয় যে এই বিশ্বে আমাদের মতো অতি অল্প পরিমাণ বুদ্ধিমান প্রাণী থাকবে যা বাস্তবে আমরা দেখতে পাই। এই ব্যাপারে আমাদের আবার বলতে হয় যে এই বিশদ পদ্ধতিটিকে নাটকের চরম দৃশ্যের মতো বিবেচনা করলে, আমরা দেখতে পাব যে আমরা প্রকৃতপক্ষে কোন অতি অদ্ভুত সুন্দর জিনিস মনে করিনি। যদিও আমি এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ যে এমন বহু স্বর্গীয় জিনিস আছে যা আমার থেকেও অদ্ভুত সুন্দর। এই কারণে আমার যোগ্যতা যত দূরেই সমাধিস্থ হ’ক না কেন আমি তাকে খুব একটা যোগ্য বলে মনে করি না। অধিকন্তু আমার মস্তিষ্ক থেকে সাড়া পেলেও আমি একথা চিন্তা করতে পারি না। সমগ্র অনন্তের সর্বময় ঈশ্বর সর্বত্র এমনভাবে কাজ করতে পারেন যা, অপেক্ষাকৃত উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে। অবশ্য এ সম্পর্কে আমাদেব মস্তিষ্কের হঠাৎ ঝলকে-ওঠা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হবে। পৃথিবী সর্বদাই ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। মানবজাতি অবলুপ্ত হবে। যদি মহাজাগতিক পদ্ধতিটি নিজেকেই নিজে মূল্যায়ন করে থাকে তাহলে তা আমাদের এই গ্রহকে ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় অবশ্যই কিছু কাজ করতে বাধ্য হবে। তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী বিশ্ব ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে এ কথাটা একপ্রকার অসম্ভব এবং বিশ্বের কোন জায়গার পরিপ্রেক্ষিতেই এই ধরনের সামান্য আগ্রহ বজায় রাখাও একেবারেই অসম্ভব। যদিও আমরা এই ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত যে যখন সময় আসবে তখন ঈশ্বর তাঁর চাকা, ঘোরাবেন। কিন্তু যদি আমরা এই ধরণের কথা বলি তাহলে আমাদের নিশ্চয়তাকে কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করাতে হবে, তা কখনই একটুকরো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর নির্ভর করবে না। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে যতদূর বলা যায় তাতে খুব ধীরগতিতে বিশ্ব এমনভাবে এগোচ্ছে যা পৃথিবীর উপর এক করুণ অবস্থার সৃষ্টি করবে, এবং এটি ক্রমশ ধীরগতিতে দৃঢ়ভাবে চিরন্তন মৃত্যুগত কারণের আরও করুণ পর্যায়ে পৌঁছাবে। যদি বিশ্বের গতিপ্রকৃতির প্রমাণ হিসাবে এই ধারণাকে নেওয়া হয়, তাহলে আমি শুধুমাত্র এই বলতে পারি যে বিশ্বের এই ধরনের গতিপ্রকৃতি আমার কাছে কোন আবেদন রাখতে পারে না। এই জন্যে আমি পরিষ্কারভাবে মনে করি যে, ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনরকম কারণ নেই, সেই বিশ্বাস যতই অস্পষ্ট হোক এবং যতই সূক্ষ্ম হোক। আমি পুরোনো অধিবিদ্যাগত যুক্তিগুলিকে একপাশে ফেলে রাখলাম যেহেতু ধর্মীয় আত্মপক্ষ-সমর্থনকারীরা নিজেদেরকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে।


আত্মা এবং অমরত্ব


খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে থাকেন যে, খ্রীষ্টীয় গোষ্ঠীগুলির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আত্মার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বর্তমান। এই ধরণের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা মৌলিকভাবে স্টোয়িকদের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। যা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তাদের কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল এবং তার ফলে গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার প্রাপ্তির আশা একেবারেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। একজন অসাধারণ সুন্দর চরিত্রের মহান ব্যক্তি যে মঙ্গলময় কাজ করবেন সে সম্পর্কে একটি স্বাভাবিক ভাবনা আমাদের মধ্যে কাজ করে, কিন্তু, যদি সেই ব্যক্তিটিকে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সেই ধরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় যে সুযোগগুলি ঘটনাসমূহকে প্রভাবিত করে, তবে অবশ্যই সেই ব্যক্তি তাঁর স্বাভাবিক গতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বেন। ব্যক্তির স্বাভাবিক গতি থেকে এই ধরনের বিচ্যুতিকেই মঙ্গলময় হয়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। পূর্বের খ্ৰীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই ধরণের ঘটনাই ঘটত। এই ধারণা এমন একটি ব্যক্তিগত পবিত্রতার দিকে তাদের চালিত করত যা সম্পূর্ণভাবে তাদের স্বনির্ভর শুভকার্যের উপর নির্ভর করত, যেহেতু পবিত্রতা এমন একটি বস্তু যে বস্তুটি সেই সব মানুষরাই অর্জন করতে পারে যারা যে কোন কাজে একেবারেই নপুংসক (……. holyness had to be something that could be achieved by people who were impotent in action.)। এই কারণেই সামাজিক ধর্মগুলি খ্ৰীষ্টীয় নৈতিক আদশের বহির্ভূত। এমনকি আজকের দিনেও সাধারণ খ্রীষ্টীয় ভক্তরা এই কথা ভাবেন যে, একজন ঘুষখোর রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অনেক বেশি বদমাশ একজন ব্যভিচারী ব্যক্তি। যদিও ঘুষখোর রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্ভবত ব্যভিচারী ব্যক্তির চেয়ে সহস্রগুণে ক্ষতিকারক। ধর্ম ও নৈতিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে মধ্যযুগীয় কল্পনা যা তৎকালীন সাধুসন্তদের ছবিগুলির মধ্যে দেখা যায় তা হল তাদের দেখতে অনেকটা জ্ঞান-ধোয়া মুখসম্পন্ন, দুর্বল এবং অভিমানী। সব থেকে নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী মানুষ সেই ধরণের মানুষ যে জগৎ থেকে অবসর গ্রহণ করেছে। সক্রিয় মানুষ কেবলমাত্র তাদের বলা হয় যারা সাধুসন্ত নামে সাধারণত সম্মানিত। এই ধরণের মানুষ সর্বদাই তাদের জীবনটাকে বাজে খরচা করে এবং সেন্ট লুই-এর তুর্ক-এর বিরুদ্ধে আমরণযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটাকেই তাদের জীবনের সার সত্য মনে করে। গীর্জাগুলো কখনই সাধুসন্তদের সম্মান প্রদর্শন করেনি, কেননা তারা আর্থিক বিষয়গুলিতে অথবা অপরাধীর জন্য নির্মিত আইনকে অথবা বিচার-ব্যবস্থাকে সংস্কার করে থাকেন। এই ধরনের মানবকল্যাণমূলক অবদানকে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা হয়নি। আমি মনে করি না মানব-ইতিহাসে এমন কোন একজন সাধু আছেন যার সাধুত্ব জনগণের উপযযাগিতার জন্য গড়ে উঠেছিল। সামাজিক এবং নৈতিক ব্যক্তির মধ্যে এই ধরণের বিচ্ছেদের ফলেই আত্মা এবং শরীরের মধ্যে বিচ্ছেদ ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই বিচ্ছেদের প্রমাণ আমরা খ্রীষ্টীয় অধিবিদ্যায় দেখতে পাই এবং সেই সমস্ত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে দেখতে পাই যে ব্যবস্থাগুলো দেকার্তের দর্শন থেকে নিঃসৃত। খুব খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে একজন একথা বলতেই পারে যে, মানুষের শরীর মানুষের সামাজিক এবং তার জাতিগত দিকের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে আত্মা তার ব্যক্তিগত দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। আত্মার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে খ্রীষ্টীয় নীতিবিদ্যা নিজেকে পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আমি মনে করি, এটা একেবারেই পরিষ্কার যে শত শত বছরের খ্রীষ্টীয় মতবাদের মোট ফলাফল মানুষকে অধিক অহংকারী করে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং প্রকৃতি তাদের যতটা আবদ্ধ করে থাকে তার তুলনায় তারা নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি আবদ্ধ। যে ধরণের সক্রিয় অনুভূতি মানুষকে তার অহংকারের চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে যেতে পারে তা হল তার যৌনতা, তার পিতৃত্ব, মাতৃত্ব এবং স্বদেশিকতা অথবা তার ইতর প্রবৃত্তি। যৌনতাকে দোষারোপ করতে এবং তাকে পদাবনত করতে গীর্জা সব ধরণের কাজ করেছে। খ্রীষ্ট নিজেই পারিবারিক স্নেহ ভালবাসাকে নিন্দা করেছেন এবং তার বেশিরভাগ অনুগামীরা এমনই মনে করে থাকে এবং রোম সাম্রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাদেশিকতা কোন স্থানই পায়নি। গসপেল-এ বর্ণিত পারিবারিক বিষয়গুলির বিরুদ্ধে পোলেমীয় ধারণা যতটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারত ততটা করতে অক্ষম হয়েছে। গীর্জা খ্রীষ্টের মাতাকে যথেষ্টই সম্মান প্রদর্শন করে কিন্তু যীশু নিজে সে ব্যাপারে খুব সামান্য আচরণই প্রদর্শন করেছেন। নারী, আমি তোমার সঙ্গে কি-ই বা করব?’ (জন, II, ৪) তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলার ধরন এরকমই ছিল। তিনি এ-ও বলেছেন যে, তিনি এসেছেন তার বাবার বিপক্ষে একজন মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মায়ের বিপক্ষে কন্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং শাশুড়ির বিপক্ষে শ্যালিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং যে তার চেয়ে তার নিজের বাবা-মাকে বেশি ভালবাসে তার কাছে সে যোগ্য নয় (ম্যাথু, X, 35-7)। এই সমস্ত কিছুর অর্থ হল শাস্ত্রীয় নীতির জন্য পরিবারগুলির মধ্যে জৈবিক বন্ধনকে নষ্ট করে ফেলা জগতে বেশিরভাগ অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি করছে এবং খ্রীষ্টীয়ধর্মের বৃদ্ধির সঙ্গে তা চারদিকে বিস্তৃতি লাভ করেছে।


ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তার চরমত্ব লাভ করেছে ব্যক্তি আত্মা অমরত্ব প্রসূত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার মধ্যে, যা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনন্ত আনন্দ অথবা অনন্ত দুঃখ ভোগ করে থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ স্বতন্ত্রতা যে ঘটনার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। উদাহরণস্বরূপ, পুরোহিত নিজের মনে বিড়বিড় করে মন্ত্র বলতে বলতে ঠিক যখন আপনার উপর জল ছেটাচ্ছে তখনি যদি আপনি মারা যান তবে আনন্দের উত্তরাধিকারী হবেন, অন্যথায় জুতোর গোড়ালি ভেঙে যাবার জন্য যখন বিরক্তির চোটে আপনি বাজে ভাষা ব্যবহার করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ বজ্রপাতে আপনার মৃত্যু হল, আর সঙ্গে সঙ্গে আপনি অনন্ত নরকের অধিকারী হলেন। আমি এমন কথা বলি না যে, আধুনিক প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টীয়রা বিশ্বাস করেন, অথবা আধুনিক ক্যাথলিক খ্রীষ্টীয়রা এই ঘটনাকে যারা শাস্ত্রীয় তত্ত্বের দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত নয় তারা এ ঘটনা বিশ্বাস করে না, কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে এই ঘটনাটি এমন গোঁড়া শাস্ত্রীয় নীতির মধ্যে পড়ে যা এখনো পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করা হয়। মেসিকো ও পেরুর স্পেনীয়রা ইন্ডিয়ান শিশুদের খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মগজ-ধোলাই করত এবং এইভাবেই তারা এইসব শিশুদের স্বর্গে যাবার পথকে নিশ্চিত করে থাকত। তাদের এই ধরণের কাজকে নিন্দা করবার জন্য গোঁড়া খ্রীষ্টীয়রা কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে বার করতে পারে না, যদিও বর্তমানে সকলেই এরকম করে থাকে। বহু উপায়েই খ্রীষ্টীয় ধরণের ব্যক্তিগত অনৈতিকতাব নীতি নৈতিকতার উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে, এবং আত্মা ও শরীরের উপর অধিবিদ্যাগত বিচ্ছেদ দর্শনের উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলে থাকে।


অসহিষ্ণুতার উৎসসমূহ


খ্রীষ্টীয়ধর্মের এটাই সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য যে এই ধর্মের সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই অসহিষ্ণুতা সারা জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি মনে করি ইহুদিদের ঈশ্বরের ন্যায্যতা এবং অতিবাস্তবতার উপর বিশ্বাসের কারণেই এই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। এই ধরণের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ইহুদিদের মধ্যে কেন গড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। সম্ভবত তাদের এই ধরণের মনোভাব গড়ে উঠেছিল তাদের বন্দীদশার প্রতিক্রিয়ার সময়টাতে যখন ইহুদিদের বিদেশী জনসাধারণের সঙ্গে মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। যদিও এটাও হতে পারে যে, তাদের বহু পয়গম্বররা ব্যক্তিগত নৈতিক উৎকর্ষতার উপর জোর দেওয়ার ব্যাপারটি আবিষ্কার করেছিল এবং সেই ধরনের ধারণা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল যে ধারণার ফলে মনে করা হত যে, একটি ধর্ম ছাড়া অন্যান্য যে কোন ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা এক ধরণের পাপ। এই দুই ধারণা পাশ্চাত্য ইতিহাসে অসাধারণ ধ্বংসাত্মক প্রভাবের সৃষ্টি করেছে। কনষ্টেনটাইনের যুগের আগেই গীর্জা রোমান রাষ্ট্রের দৌলতে খ্রীষ্টীয়দের যথেষ্ট হয়রান করেছিল। যদিও এই হয়রানি ছিল অল্প, এবং অন্তর্বর্তীকালীন এবং সবৈভাবে রাজনৈতিক। কনষ্টেনটাইনের যুগ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষ পর্যন্ত সর্বদা খ্রীষ্টীয়রা অন্যান্য খ্রীষ্টীয়দের দ্বারা মারাত্মকভাবে হয়রান হয়েছিল, যে হয়রানি রোম সম্রাটের দ্বারা তারা কখনও হয়নি। খ্রীষ্টীয়ধর্মের উত্থানের আগে এই ধরণের হয়রানিকর আচরণ কেবলমাত্র ইহুদিদের মধ্যে ছাড়া প্রাচীন জগতে আর কোথাও জ্ঞাত ছিল না। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি হেরোডোটাস পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন যে বিদেশী রাজ্যগুলিতে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, তারা সবাই ছিল স্নিগ্ধ এবং সহিষ্ণু আচরণসম্পন্ন। তবে এটাও সত্য কখনও কখনও তাদের অদ্ভুত বর্বরোচিত প্রথা তার মনে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু সাধারণভাবে তিনি বিদেশী প্রথাগুলি এবং দেবতাদের কাছ থেকে আতিথেয়তাপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছেন। তিনি উদ্বিগ্নতার সঙ্গে এটি প্রমাণ করেননি যে, যে-সব মানুষদের ইহুদি বলে আখ্যায়িত করা হত তারা যদি অন্য কোন জাতির নামে অ্যাখ্যায়িত হত তবে অনন্ত শাস্তি ভোগ করত এবং তাদের শাস্তি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। এই ধরণের আচরণ কেবলমাত্র খ্রীষ্টানদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। এটা সত্য যে আধুনিক খ্ৰীষ্টীয়রা এই ব্যাপারে অনেক কম বলবান, কিন্তু এর জন্য খ্রীষ্টীয় ধর্মকে কোন ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ দিতে হবে সেই সব মুক্ত চিন্তাবিদদের যারা নবজাগরণ থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত খ্রীষ্টীয়দের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসকে যথেষ্ট পরিমাণ লজ্জিত করতে পেরেছে। বর্তমান খ্রীষ্টীয়দের মুখে এই ধরনের কথা শুনে খুব আনন্দ পাবেন যে, খ্রীষ্টীয়ধর্ম বাস্তবে খুব নমনীয় এবং যুক্তিসংগত। কিন্তু যারা একথা বলবেন তারা এই ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই ধর্মের সমগ্র নমনীয়তা ও যৌক্তিকতা সেইসব মানুষদের শিক্ষা প্রদানের ফলে সম্ভব হয়েছিল যারা প্রত্যেকে তাদের নিজেদের সময়ে গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের দ্বারা হয়রান হয়েছিল। বর্তমানে কেউই একথা বিশ্বাস করে না যে, এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল ৪০০৪ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে, কিন্তু খুব। বেশি দিন আগে নয় যখন এই বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করাটা ছিল এক জঘন্য অপরাধ। আমার প্রপিতামহ, এতনা-র (etna) ঢালে লাভার গভীরতা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, গোঁড়া খ্ৰীষ্টীয়রা জগৎকে যতটা পুরোনো বলে মনে করে তার থেকেও জগৎ অনেক বেশি পুরানো এবং তাঁর এই মতামত তিনি একটি বইতে প্রকাশ করেন। এই অপরাধের ফলে তাঁকে সেখানকার কাউন্টির দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়েছিল এবং অবশেষে সমাজ থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। যদি তিনি বাজে পরিস্থিতিসম্পন্ন মানুষ হতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তার শাস্তি আরও গুরুতর হয়ে উঠত। সুতরাং গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের কাছে এটা বলা খুব একটা কৃতিত্বের নয় যে, তারা এখন সেই সমস্ত অসংগতিগুলোকে বিশ্বাস করে না যেগুলোকে তারা ১৫০ বছর আগে বিশ্বাস করত। প্রচণ্ড প্রতিরোধকে প্রতিহত করেই ক্রমশ এই সমস্ত খ্রীষ্টীয় মতবাদগুলিকে দুর্বল করা হচ্ছে এবং তা সম্ভব হয়েছে মুক্ত চিন্তাবিদদের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে।


স্বাধীন–ইচ্ছার মতবাদ


প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর খ্রীষ্টীয়দের আচরণ কৌতূহলোদ্দীপকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত। একদিকে ছিল স্বাধীন-ইচ্ছার মতবাদ, যে মতবাদ বেশিরভাগ খ্ৰীষ্টীয়রা বিশ্বাস করত। এই মতবাদ অনুযায়ী মনে করা হত যে অন্তত মানবজাতির কর্মসমূহ প্রাকৃতিক আইনের বিষয় হওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে, বিশেষত অষ্টাদশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে, এই বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে ঈশ্বর হলেন আইনপ্রণেতা। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ হিসাবে প্রাকৃতিক আইনের প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। অধুনা স্বাধীন-ইচ্ছার খাতিরেই আইনের রাজত্বের বিরুদ্ধে আপত্তি গড়ে উঠেছে। পূর্বের আইনপ্রণেতা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বজ্ঞাপক প্রাকৃতিক আইনকে বিশ্বাস করার চেয়ে সেই আপত্তিকে অনেক দৃঢ়তার সঙ্গে বোঝাবার চেষ্টা শুরু করা হয়েছে। বস্তুবাদীরা পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলির দ্বারা দেখাতে চেয়েছেন, বা দেখাবার চেষ্টা করেছেন, যে মানবশরীরের গতিপ্রকৃতি যান্ত্রিকভাবে নির্ধারিত। ফলস্বরূপ সেই সব বস্তু যাদের সম্পর্কে আমরা আলোচনা করি এবং প্রতিটি অবস্থার পরিবর্তন যাকে আমরা প্রভাবিত করে থাকি, তা সম্ভাব্য স্বাধীন ইচ্ছার পরিধির বাইরেই ঘটে। যদি এরকমই হয়, তবে আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত ইচ্ছার মূল্য নিতান্তই কম। যদি একটি মানুষের কবিতা রচনা ও খুন করার ক্ষেত্রে তার দৈহিক সঞ্চালন তার সেই ধরনের কার্য নিযুক্তি থেকে নিষ্পন্ন হয় যা কেবলমাত্র পদার্থগত কারণনির্ভর, তবে তাকে একদিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়ে আর একদিকে তার মর্মর মূর্তি নির্মাণ করাটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অধিবিদ্যার কোন ব্যবস্থায় মুক্ত চিন্তার রাজত্ব থাকলেও থাকতে পারে যেখানে ইচ্ছাগুলো স্বাধীন হবে। কিন্তু যেহেতু এই সব স্বাধীন ইচ্ছা অন্যান্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে থাকে কেবলমাত্র দৈহিক সঞ্চালনের মাধ্যমে, তাই সেখানকার স্বাধীনতার রাজত্ব ঠিক সেই ধরনের কিছু একটা হয়ে উঠবে যা কখনও সংযোগের বিষয় হয়ে উঠতে পারবে না এবং কখনও সামাজিক গুরুত্ব লাভ করতে পারবে না।


এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে আবার বলতে হয়, যে-সব খ্ৰীষ্টীয়রা এই মতবাদকে গ্রহণ করেছিল তাদের উপর ক্রমবিবর্তন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তারা এটা দেখেছে যে বিবর্তন কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই পরিবর্তন দাবি করেনি, মানুষের থেকে একেবারে স্বতন্ত্র প্রাণীদের গঠনেও সে পরিবর্তন এনেছিল। এই জন্য, মানুষের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা জীবন্ত বস্তুর আচরণ সম্পর্কে পদার্থগত ও রসায়নতগত প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যতবার নতুন নতুনভাবে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা হয়েছে ততবার বাধা দিয়েছে। সমস্তরকম নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হিসাবে মনে করার জন্য দেকার্তের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তা হল তিনি উদার ধর্মশাস্ত্রবিদদের সমর্থন হারিয়েছিলেন। নিরবচ্ছিন্নতার মতবাদ তাদের আরও অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল এবং এখনো তাদের এই ধারণায় ভাবিত করে যে যাকে মৃত বস্তু বলে সেই সব বস্তু অপরিবর্তনীয় আইনের দ্বারা তাদের আচরণগত দিক দিয়ে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত হয় না। তারা ঘটনাটি এড়িয়ে চলে, কেননা, যদি আপনি আইনের শাসনকে বিলুপ্ত করে দেন তবে ভোজবাজির সম্ভাবনাকেও আপনাকে বিলুপ্ত করতে হবে, যেহেতু ভোজবাজি ঈশ্বরের কার্য যা সেই সব আইনের বিপরীত এবং যা সাধারণ ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও আমি জানি যে আধুনিক উদার ধর্মতত্ত্ববিদরা সুগভীরতার ভাব দেখিয়ে প্রমাণ করতে চায় যে সমস্ত সৃষ্টিই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। সুতরাং তারা কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রমাণ বলে প্রচার করতে চায় না।


প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার এই প্রভাবে, কোন কোন খ্রীষ্টীয় আত্মপক্ষ-সমর্থনকারী পরমাণু সম্পর্কিত সাম্প্রতিক মতবাদকে আক্রমণ করে বসেছিল। তারা এটা দেখতে চাইল যে এতদিন পর্যন্ত যে-সব পদার্থগত আইনগুলো আমরা বিশ্বাস করে এসেছি তা বহুসংখ্যক পরমাণু সম্পর্কে গড়ে আপাত সত্য হলেও, প্রতিটি স্বতন্ত্র ইলেকট্রন তার ইচ্ছা অনুসারেই আচরণ করে থাকে। আমার নিজের বিশ্বাস যে এটা একটা অস্থায়ী অবস্থা। পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্যই ঠিক সময়মত মুহূর্ত-ঘটনাগুলি (Minute phenomena) কেমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার সূত্র আবিষ্কার করে ফেলবেন, যদিও সেই সব সূত্রগুলি ঐতিহ্যবাহী পদার্থবিজ্ঞানের থেকে স্বতন্ত্র হতে পারে। যদিও, এটাও ঘটতে পারে যে, দেখা গেল আধুনিক মতবাদগুলি, যেমন মুহূর্ত-ঘটনাগুলির সম্পর্কে যে মতবাদগুলি আছে, সেগুলি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কোন কিছুকে প্রভাবিত করার অসমর্থতার দরুন কোন রকম বাস্তবিক গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠবে না। যে কোন বস্তুর নিজ নিজ গতির ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার মতোই পরমাণুগুলি নিজ নিজ গতির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হওয়ার ফলে খুব সহজেই। তারা পুরানো সূত্রগুলির পরিধির সঙ্গে সংগতিকর হয়ে উঠল। আমাদের পূর্বের আলোচনাকে টেনে এনে আমরা আবার বলতে পারি যে, একটা কবিতা লিখতে বা একটা খুন করতে বেশ কিছু কালির পরমাণুকে অথবা সীসার পরমাণুকে গতিসম্পন্ন করে তুলতে হয়। যে-সব ইলেকট্রনগুলি দিয়ে কালিটা তৈরি সেই ইলেকট্রনগুলি অবশ্যই পেনের ডগায় নিজের খেয়ালে নাচতে পারে এবং এই পেনের ডগাটি পূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী গতিশীল, এবং এটাই একমাত্র সেই গতি যা কবি এবং প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কারণে বলা যায় যে, আধুনিক মতবাদগুলি মানবিক আগ্রহের সেই সমস্ত সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যে সমস্যাগুলির সঙ্গে ধর্মতত্ত্ববিদরা সম্পর্কিত।


ফলস্বরূপ স্বাধীন ইচ্ছা ঠিক যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেল। অধিবিদ্যার চরম বিষয় হিসাবে যা কিছুই এর সম্পর্কে চিন্তা করা হোক না কেন, বাস্তবে কেউই এই মতবাদে বিশ্বাসী নয়। প্রত্যেকেই সর্বদা এটা বিশ্বাস করেছে যে, একটি চরিত্রকে বিশেষরূপে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। প্রত্যেকে এটাও বিশ্বাস করেছে যে, আফিম অথবা মদ আচরণের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। স্বাধীন ইচ্ছার বাণী এই মতামত পোষণ করে থাকে যে, মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে মদের নেশা এড়াতে পারে, কিন্তু তারা এই মতবাদ পোষণ করে না যখন একটি লোক নেশাগ্রস্ত হয় তখন সে ছিচকাঁদুনি কাদার মতোই পরিষ্কার করে ব্রিটিশ সংবিধান’ কেও বলে যেতে পারে। যারা শিশুদের সম্পর্কে এসেছেন তারা প্রত্যেকেই এই কথা জানেন যে দুনিয়ার যে কোন বিরাট বাগ্মিতাপূর্ণ ধর্মপ্রচারের থেকে শিশুকে অনেক বেশি পুণ্যবান করে তোলে সুস্বাস্থ্যকর খাদ্য। স্বাধীন ইচ্ছার মতবাদ গুলিকে অভ্যাস করলে যে ফল লাভ হয় তা হল এই মতবাদ সাধারণ জ্ঞান থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে এসে তাকে যৌক্তিক সিদ্ধান্তের অধিকারী করে না। যখন কোন মানুষ সেই পথে কাজ করে যা আমাদের কাছে বিরক্তিকর তখন তাকে আমরা দুষ্টু বলে ভাবি। কিন্তু এটা করে আমরা আসল ঘটনাকে এড়িয়ে যাই যে, তার বিরক্তিকর আচরণগুলো সেইসব পূর্ববর্তী কারণের ফল, যে কারণগুলিকে আপনি ভাল করে দেখলে দেখতে পাবেন যে, সেগুলি সেই বিরক্তিকর আচরণকারী ব্যক্তির জন্মমুহূর্তের আগে আপনাকে নিয়ে যাবে এবং সেই সব কারণের পিছনে যেসব ঘটনাগুলো আপনাকে দেখাবে, তাতে আপনি দেখতে পাবেন যে, সেইসব ঘটনাগুলির জন্য সেই ব্যক্তি কোনভাবেই দায়ী নয় বা তাকে দায়ী করা কল্পনাতেও সম্ভব নয়।


কোন ব্যক্তি একজন মানুষের সঙ্গে যে রকম আচরণ করে ভুলক্রমেও একটি মোটরগাড়ির সঙ্গে সেরকম আচরণ করবে না। যখন একটি গাড়ি চলে না, তখন সেই গাড়িটির এই বিরক্তিকর আচরণকে সে পাপ বলে ভাবে না, এবং সে বলে না : তুমি একটা দুষ্টু মোটরগাড়ি, যতক্ষণ না তুমি চলবে ততক্ষণ আমি তোমায় পেট্রল দেব না। সে চেষ্টা করবে মোটরগাড়িটা কোন্ জায়গায় খারাপ হয়েছে তা বার করতে এবং তা ঠিক করতে। কিন্তু এই সাদৃশ্যমূলক ঘটনা যখন মানবশিশুর বেলায় ঘটানো হয় তখন তা পবিত্র ধর্মপ্রসূত সূত্রের বিপরীত হয়ে ওঠে এবং এই বিপরীত ধর্ম ছোট শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। অনেক ছোট শিশুরই নানান বাজে অভ্যাস থাকে কিন্তু সেই অভ্যাসগুলিকে চিরন্তন করে তোলা হয় শাস্তির দ্বারা। কিন্তু তাদের বদ অভ্যাসগুলিকে লক্ষ্য না করলে তার মধ্যে ঐ বাজে অভ্যাসকে চিরন্তন করে তোলার ঘটনাটিকে পাশ কাটানো যাবে। যে-সব সেবিকারা শিশুদের সেবা করে তারা কদাচিৎ শাস্তি ব্যাপারটাকে বেঠিক বলে মনে করে। এই রকম শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে তারা শিশুর মানসিক রোগের কারণ সৃষ্টির ঝুঁকি নিয়ে থাকে। যখনই মানসিক রোগ ঘটে যায় বিচারালয়গুলিতে তাকে আচরণগত দিক থেকে ক্ষতিকারক বলে প্রমাণ করা হয়, কিন্তু অতীতের শাস্তির প্রমাণ হিসাবে দেখা হয় না। (আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্যে) মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপর সাম্প্রতিক ফৌজদারী মোকদ্দমা সংক্রান্ত বিষয়ক আলোচনাকে আমি এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছি।


এই সব দুর্বল মানসিকতাসম্পন্ন ও স্নায়ুরোগগ্রস্ত শিশুদের পর্যবেক্ষণ করেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংস্কার সংঘটিত হয়েছে। এর কারণ ছিল এই সব শিশুরা তাদের ব্যর্থতার জন্য নৈতিক ভাবে দায়ী ছিল না। ফলস্বরূপ যে-কোন সুস্থ শিশুর থেকে এই সব শিশুদের জন্য অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রদানের প্রয়োজন ছিল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল যে, যদি কোন শিশু তার পড়া ঠিক মতো করতে না পারে, তবে তার জন্য সঠিক পন্থা ছিল তাকে বেত্রাঘাত করা, কিন্তু এই ধরনের শাস্তি অপরাধমূলক আইনে দেখা যায়। এটা সত্য যে অপরাধ প্রবণতাসম্পন্ন মানুষকে অবশ্যই থামানো উচিত, কিন্তু যে মানুষ জলাতঙ্করোগ হওয়ার ফলে তোক দেখলেই কামড়াতে আসছে, আমার মনে হয় তাকে কেউ নৈতিকভাবে দায়ী মনে করবে না। যে মানুষটি প্লেগ রোগাক্রান্ত তাকে অবশ্যই তার রোগ আরোগ্য পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দী করে রাখতে হবে, কিন্তু এর জন্য তাকে কেউ বদমাস বলে ভাববে না। এই একই রকম আচরণ করা উচিত সেইসব মানুষের সঙ্গে যারা দলিল কিংবা নোট জাল করার অপরাধমূলক রোগে ভুগছে। অপরাধ অপরাধই, তাই কোন অপরাধকে খুব বড় কিংবা ছোট বলে ভাবা উচিত নয়। কিন্তু এই ধরনের সাধারণ জ্ঞানগুলোকে খ্রীষ্টীয় নীতি বিদ্যায় ও অধিবিদ্যায় অস্বীকার করা হয় ।


কোন গোষ্ঠীর উপর যে-কোন প্রতিষ্ঠানের নৈতিক প্রভাবকে বিচার করে দেখতে গেলে, আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে সেই সব ধরনের আবেগ গুলোকে যে আবেগগুলো এই প্রতিষ্ঠানের ভিতর মূর্ততা লাভ করেছে, এবং যে মাত্রায় এই প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেয়েছে এই আবেগ ততটাই ভিত গাড়তে পেরেছে সেই গোষ্ঠীটির বুকে। কখনও কখনও এই ধরনের আবেগগুলিকে স্পষ্ট রূপে বোঝা যায়, আবার কখনও কখনও তা একেবারেই গুপ্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আলপাইন ক্লাবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ধরনের মূর্ত আবেগ তার সদস্যদের দুঃসাহসিক অভিযানের দিকে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে জ্ঞানীগুণী সমাজের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা আবেগ সদস্যদের জ্ঞানের দিকে তাড়িত করে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানরূপে পরিবারগুলোতে যে আবেগ গড়ে ওঠে তা হিংসা ও বাবা মার অনুভবগত। একটি ফুটবল ক্লাব ও একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা আবেগ সর্বদা তার সদস্যদের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু দুটি বৃহৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন গীর্জা ও রাষ্ট্র তাদের মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রকৃতির দিক থেকে অনেক বেশি জটিল। কোন রাষ্ট্রের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল অভ্যন্তরীণ অপরাধী ও বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়তার বন্দোবস্ত করা। শিশুদের মানসিক প্রবণতায় এই ভাব শিকড় গেড়ে থাকে যে যখন তারা কোন কিছুতে ভয় পায় তখন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে এবং একটি বড়োসড়ো মানুষকে খোঁজে যে মানুষটি তাদের ভেতরে নিশ্চয়তার চেতনা সৃষ্টি করবে। গীর্জাগুলোর উৎস অনেক বেশি জটিল। নিঃসন্দে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উৎসটি হ’ল ভয়। বর্তমানেও ব্যাপারটি দেখা যায় যে যখনই মানুষ কোন কিছুকে ভয় পায় তখনই তাদের চিন্তাভাবনা ঈশ্বরের দিকে ঘোরে। যুদ্ধক্ষেত্র, মহামারী, ধ্বংস, এই সমস্ত কিছু মানুষকে ধার্মিক করে তোলে। যদিও ভয়াবহ দিকগুলো ছাড়াও ধর্মের অন্যান্য আবেদন আছে। আমাদের মানবিক আত্ম-মূল্যায়নের দিকে ধর্মের আবেদন উল্লেখযোগ্য। যদি খ্রীষ্টীয়বাদ সত্য হয়, তবে মনুষ্যজাতি নিজেকে যতটা দুর্দশাগ্রস্ত কৃমিকীট মনে করে ততটা তারা নয়। তারা বিশ্ব-স্রষ্টা ঈশ্বরের স্বার্থের বিষয়, যে ঈশ্বর তাদের সাথে আনন্দে থাকতে গিয়ে সমস্যাকে গ্রহণ করেন, যখন তারা তার সাথে ভাল আচরণ করে তখন তিনি আনন্দিত হন কিন্তু যখন তারা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তখন নিরানন্দিত হন। এটা সত্যই একটি মহান প্রশংসাসূচক ঘটনা। একটি পিঁপড়ের বাসা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের এই চিন্তা করা উচিত নয় যে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে সেই ধরনের পিঁপড়েদের যারা নিজেদের ধরনের কর্তব্য গুলো করছে। এছাড়াও আমাদের এই ধরনের চিন্তাও করা উচিত নয় যে পিঁপড়ে গুলো নিজেদের ধরনের কর্ম থেকে বিরত তাদের বেছে বেছে তুলে আগুনে নিক্ষেপ করতে হবে। যদি ঈশ্বর আমাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজ করেন তবে তা আমাদের গুরুত্বের দিক থেকে প্রশংসাসূচক হবে। এটা আরও আনন্দময় প্রশংসাসূচক ব্যাপার হবে যদি ঈশ্বর আমাদের মধ্যে যারা ভাল তাদের চির-স্বর্গের সুখকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এছাড়াও তুলনামূলক আধুনিক একটি ধারণা পেতে পারি যে ধারণা অনুসারে বলা যেতে পারে জাগতিক বিবর্তন এমনভাবে পরিকল্পিত হয়েছে যে তার ফলে যা কিছু ঘটে তাকেই আমরা মঙ্গল বলে থাকি–এর অর্থ হল, বিবর্তনের ফলে যা কিছু ঘটে তা আমাদের মনে এক রকম আনন্দের সৃষ্টি করে থাকে। তাই আবার বলতে হয় যে এটা মনে করাটা একটা বাতুলতায় দাঁড়াবে যে এই বিশ্বটি নিয়ন্ত্রিত হয় এমন একটি সত্তার দ্বারা যিনি আমাদের রুচি এবং সংস্কারের সঙ্গে সমান অংশগ্রহণ করে থাকেন।


ধার্মিকতার ধারণা


তৃতীয়ত, যে মনস্তাত্ত্বিক তাড়নাকে ধর্মের মধ্যে মূর্ত হতে দেখা যায় তা ধার্মিকতার কল্পনা গড়ে তোলে। আমি এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে বহু মুক্ত চিন্তাবিদরা এই কল্পনা বা ধারণাকে মহান শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। গোঁড়া ধর্মের অবক্ষয়ের পরেও তারা মনে করেন এই ধরণের ধারণাকে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু আমি এই বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে একমত নই। ধার্মিকতার ধারণার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে আমার মনে হয় এই ধারণার শিকড় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবাবেগ বা যৌনপ্রেমের মধ্যে নিহিত এবং যাকে যুক্তির অনুমোদন দিয়ে আরও বেশি শক্তিশালী করা উচিত নয়। ধার্মিকতা এবং অধার্মিকতা দুটোকে এক সাথেই আলোচনা করা আবশ্যক এবং একটিকে গুরুত্ব না দিয়ে আর একটিকে গুরুত্ব দেওয়া অসম্ভব। এখন আমাদের বুঝতে হবে, অধার্মিকতা বলতে বাস্তবে কি বোঝায়? বাস্তবে এটি এমন একটি ধরনের আচরণ যা সাধারণ মানুষ অপছন্দ করে থাকে। উক্ত ধরনের আচরণকে অধার্মিকতা বলে উল্লেখ করে এবং এই ধারণার চারপাশে বিশদ নৈতিক ব্যবস্থাকে সাজিয়ে তুলে জনতা তাদের আপন অপছন্দের ব্যাপারগুলোর প্রতিশোধমূলক শাস্তি প্রদান করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। ধারণা অনুযায়ী সাধারণ জনতা ধার্মিক। তারা তাদের আত্ম-মূল্যায়নকে বর্ধিত করে থাকে ঠিক তখন যখন তারা তাড়নার বশে নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছায়। এটা এক ধরনের অনৈতিক হত্যামূলক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং এক অন্য পথের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যে পথের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। এইজন্য ধার্মিকতার ধারণার সারবস্তুটি হল বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার বোরখা পরা ধর্ষকামের বহির্গমন (The essence of the conception of right eousness, therefore, is to afford an outlet for sadism by Cloaking cru elty as justice.) I


কিন্তু, আমরা বলতে পারি, ধার্মিকতার ব্যাপারে আপনারা যে ধারণা পোষণ করে থাকেন তা আপনাদের ধারণা অনুযায়ী সেইসব হিব্রু পয়গম্বরদের আবিষ্কার যা সর্বৈবভাবে তাদের নিজেদের কাছেই অবাস্তব। এই সত্য পরিলক্ষিত। হিব্রু পয়গম্বরদের মুখে ধার্মিকতার অর্থ ছিল তাই যা তাদের ও ইয়াহবে-র দ্বারা অনুমোদিত ছিল। যে-কেউ দেখতে পারেন যে খ্রীষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের দ্বারা রচিত সংহিতায় এই ধরনের আচরণ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে এই শব্দগুলি উচ্চারণ করে তাঁরা ঘোষণা করছেন : কারণ ইহা পবিত্র আত্মা ও আমাদের কাছে মঙ্গলময় বলে মনে করা হয়’ (অ্যাক্ট xv. 28)। ঈশ্বরের রুচি ও মতামতের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা এই ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিশ্চয়তা কখনও কোন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হতে পারে না। এই ধরনের ধারণা সর্বদাই সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে এবং প্রোটেস্টান্টবাদ এই ধরনের সমস্যাজনক ধারণাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। একজন নতুন পয়গম্বর সর্বদাই এই কথা বলে এসেছে যে তার মতবাদ তার পূর্বসূরীদের অপেক্ষা অনেক বেশি প্রমাণসিদ্ধ ও খাঁটি। প্রোটেস্টান্টবাদে এই রকম কাউকে পাওয়া যায় না যে এই দাবিকে অযোগ্য বলে প্রমাণ করতে সাহসী হয়ে উঠবে। ফলস্বরূপ, প্রোটেস্টান্টবাদ বহু সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা পরস্পরকে দুর্বল করে তুলেছে। এই কারণেই মনে করা যেতে পারে যে এখন থেকে একশ বছর পরে ক্যাথলিকবাদ খ্রীষ্টধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে উঠবে। ক্যাথলিক গীর্জাগুলোতে এই অনুপ্রেরণা দেখা যায় যে পয়গম্বররা তাঁদের নিজেদের নিজেদের স্থানকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন। কিন্তু সেখানে তারা খাঁটি স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা বজায় রাখতে গিয়ে যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটায় বা যে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাতে মনে হয় যে, সেইসব অনুপ্রেরণা শয়তানের অনুপ্রেরণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোনটা খাঁটি কোনটা নকল পার্থক্য করাটাই গীর্জার ব্যবসা হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন ভাবে একজন শিল্পকলা-বিক্রেতার মূল ব্যবসা হল লিওনার্দোর ছবিটি খাঁটি না জাল তা ধরা। এইভাবেই একই সময় মতবাদগুলি প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। গীর্জা যাকে ধার্মিকতা বলে অনুমোদন দেয় তা ধার্মিক এবং যাকে অধার্মিকতা বলে অনুমোদন দেয় না তা অধার্মিক। এই জন্য বলা যেতে পারে যে ধার্মিকতার কার্যকরী ধারণাটি হল জনসাধারণের বিতৃষ্ণাপ্রসূত বিচার।


এইজন্য, বলা যেতে পারে যে, মানুষের তিনটি তাড়না বা আবেগ যা আমরা ধর্মের মধ্যে মূর্ত হতে দেখি, সেগুলি হল– ভয়, আত্মশ্লাঘা বা অহমিকা এবং বিদ্বেষ। যে-কেউ এখন এ কথা বলতে পারে যে, ধমেরে উদ্দেশ্য হল এই ধরনের ভাবাবেগের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে এই সব ভাবাবেগগুলো তাদের নির্দিষ্ট পথে চলতে পারে। এর কারণ হল, সব্বেভাবে এই ভাবাবেগগুলো মানুষের দুর্দশার জন্য তৈরি হয়েছে। ধর্ম হল অশুভ শক্তির বল, কেননা তা মানুষের এই ভাবাবেগগুলোকে প্রশ্রয় দেবার অনুমোদন দিয়ে থাকে তাকে রোধ করবার পরিবর্তে। কিন্তু, এটা সত্য, যখন তারা এ ধরণের ভাবাবেগগুলোর অনুমোদন দিতে পেরেছিল, তখন অন্তত কিছুটা পরিমাণে তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত করতেও পারত।


উক্ত বিষয়ে আপত্তির স্বরূপ রিট (writ) সম্পর্কে আমি চিন্তা করতে পারি, যে আপত্তিটির সম্পর্কে গোড়া ধর্মবিশ্বাসীরা সম্ভবত যেমন আগ্রহ বোধ করতে পারেনি, তেমন সেই আপত্তিটিকে পরীক্ষা করার জন্য যোগ্য বলেও ভাবতে পারেনি। বিদ্বেষ এবং ভয়, বলা যেতে পারে এই দুটো মানবজাতির অতিপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। মানব জাতি এ দুটিকে সর্বদাই অনুভব করেছে এবং আহ্বান জানিয়েছে। আমাকে এটা বলা হতেই পারে যে, এই দুটো বিষয় সম্পর্কে আপনি যে কাজ করতে পারেন তা হল তাদের এমন পথে পরিচালনা করা যে পথে গেলে তারা যতটা ক্ষতিকারক হয়ে উঠত তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। একজন খ্রীষ্টীয় ধর্মবেত্তা এ কথা বলতে পারেন যে গীর্জা এই দুটি বিষয়কে এমনভাবে পরিচালিত করে থাকে যা তাদের যৌনতা বিষয়ক আবেগ পরিচালনার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত, অর্থাৎ তাদের বিলাপের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বিবাহের চৌহদ্দির মধ্যে উদগ্র লালসাকে আবদ্ধ করে তারা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সুতরাং একথা বলা যেতে পারে, যদি মানবজাতি অনিবার্যভাবে বিদ্বেষ অনুভব করে, তাহলে এটা ভালো হবে যদি তাদের সেই বিদ্বেষকে তারা তাদেরই বিরুদ্ধে পরিচালিত করে যারা সত্যই ক্ষতিকারক। সংক্ষেপে ধার্মিকতার ধারণার দ্বারা গীর্জা ক্ষতিকারক কার্যই করে থাকে।


এই বিষয়ে দুটি প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় একটি তুলনামূলকভাবে ভাসা-ভাসা এবং অন্যটির ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে সেটি বিষয়ের উৎস সম্পর্কিত। ভাসা-ভাসা প্রত্যুত্তরটি হল, ধার্মিকতার সম্পর্কে গীর্জার ধারণা কখনও পরিষ্কার হয়ে ওঠে না


এবং মৌলিক প্রত্যুত্তরটি হল বিদ্বেষ ও ভয়। আমাদের বর্তমান মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আমাদের বর্তমান শিল্প-প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দ্বারা মনুষ্যজাতির জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।


প্রথমেই আমাদের প্রথম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ধার্মিকতার বিষয়ে গীর্জার ধারণা সামাজিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত–প্রথম ও সর্ব-প্রধান কারণ হল, বিষয়টি বুদ্ধিগত ও বিজ্ঞানগত দিক দিয়ে নিন্দনীয়। এই ধরনের দোষ সুসমাচারগুলোর থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। যীশু আমাদের একটি ছোট শিশুর মতো হতে বলেছেন, কিন্তু ছোট্ট শিশু ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস বুঝতে পারে না, অথবা কারেন্সির আদর্শকে বুঝতে পারে না, কিংবা সে রোগের প্রতিকারার্থে আধুনিক পদার্থগুলিকে বুঝতে পারে না। এই ধরনের জ্ঞান অর্জন করাটা আমাদের কর্তব্যবোধের কোন অংশ নয়, যেরকম গীর্জাগুলো উপদেশ দিয়ে থাকে। গীর্জাগুলো বেশিদিন এই ধরনের মত পোষণ করেনি যে জ্ঞান নিজেই একটি পাপগত বিষয়, কিন্তু পুরোনো যুগে তারা এমনই ধারণা পোষণ করত। জ্ঞান অর্জন ব্যাপারটা পাপগত না হলেও ভয়ঙ্কর অবশ্যই, কেননা এটি বুদ্ধিমানের অহংকারে পরিণত হয়। ফলে, খ্রীষ্টীয় গোঁড়া ধর্মাদর্শ সম্পর্কে সে প্রশ্ন তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুটি মানুষকে নেওয়া যাক, তাদের মধ্যে একজন কোন গ্রীষ্মপ্রধান বিরাট অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ন্যাবারোগে আক্রান্ত রোগীকে খুঁজে বার করল, কিন্তু যখন সে এই কাজটি করছিল তখন তার সঙ্গে ঘটনাক্রমে এক মহিলার সম্পর্ক ঘটেছিল যাকে সে বিয়ে করেনি। অন্য মানুষটি ছিল কুঁড়ে এবং জড় প্রকৃতির। যতদিন পর্যন্ত তার স্ত্রী দেহের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ফুরিয়ে গিয়ে মরে না গেল ততদিন পর্যন্ত বছরের পর বছর তার জন্য সন্তান প্রসব করল। সেই মানুষটি সেই সব শিশুদের এত কম নজর রাখলো যার জন্য তাদের অর্ধেক কেবলমাত্র দেখাশোনার অভাবে মরে গেল। কিন্তু সেই মানুষটি কখনও নিজেকে অবৈধ যৌনসঙ্গমে প্রশ্রয় দেয়নি। প্রতিটি সৎ খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী অবশ্যই এই মত পোষণ করবে যে দ্বিতীয় ধরণের মানুষটি প্রথম ধরণের মানুষটির থেকে অনেক বেশি ধার্মিক। এই ধরনের আচরণ অবশ্যই কুসংস্কার এবং যুক্তির পরিপন্থী। এই ধরণের অসঙ্গতি থেকে অনিবার্যভাবে যে সিদ্ধান্তটি বেরিয়ে আসে তা হল কোন ধনাত্মক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে কেবলমাত্র পাপকে অগ্রাহ্য করা এবং যতদিন পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য জীবনের জন্য জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া না হবে ততদিন পর্যন্ত সেই জ্ঞানকে স্বীকৃতি না দেওয়া।


দ্বিতীয় মৌলিক আপত্তিটি হল বিদ্বেষ ও ভয় যাকে এতদিন পর্যন্ত গীর্জাগুলো ব্যবহার করে এবং বর্তমানে এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে এইসব আবেগগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত সংস্কারের ফলে মানুষের প্রকৃতি থেকে একেবারেই ঘেঁটে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাগত সংস্কারকে ভিত্তিরূপে নেওয়া আবশ্যক। কেননা যে মানুষ ঘৃণা ও ভয় অনুভব করে তারাই আবার তাদের প্রশংসাও করে এবং তাদেরকে চিরন্তন করে তোলবার চেষ্টা করে থাকে। যদিও এই প্রশংসা ও ইচ্ছা সম্ভবত অবচেতন মনের ব্যাপার, যা সাধারণ খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে থাকে। যে ধরণের শিক্ষা ভয় দূর করতে পারে, সেই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করা খুব একটা শক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন শিশুকে ভালোবেসে শিক্ষা দেওয়া। তাকে এমন একটি পরিবেশের মধ্যে রাখা যেখানে সে কোন দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল ছাড়াই পড়াশুনা চালাতে পারবে। তাকে বাঁচাতে হবে সেই পরিণত বয়স্কদের হাত থেকে যারা অযৌক্তিক ভয়ঙ্কর ভীতির দ্বারা ভোগে। সেই ভীতি ইঁদুরে ভীতি, অন্ধকার-ভীতি কিংবা সামাজিক বিপ্লব-ভীতিও হতে পারে। একটি শিশু অবশ্যই কঠিন শাস্তি, চোখ রাঙানি, গাম্ভীর্য প্রদর্শন এবং অসম্ভব নিন্দার বিষয় হতে পারে না। শিশুকে বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করাটা সত্যই একটা বিরাট কাজ। যে অবস্থাগুলো হিংসা, স্পর্শকাতরতার জন্ম দেয় সেগুলোকে অবশ্যই যত্নসহকারে এড়িয়ে যাওয়া দরকার। বিভিন্ন ধরণের শিশুর মানসিকতা বুঝে অতি সূক্ষ্মতা ও সঠিক বিচারের সঙ্গে তা এড়িয়ে যেতে হবে। একটি শিশু নিজেকে উষ্ণ স্নেহের পাত্র বলে অনুভব করবে সেই বয়স্ক মানুষটির কাছে যে মানুষটির সঙ্গে সে থাকবে এবং যার কাছে পড়াশুনো করবে। শিশুটিকে অবশ্যই তার প্রাকৃতিক কাজ ও কৌতূহল থেকে জোর করে সরিয়ে রাখা হবে না, যদি না তা তার স্বাস্থ্য ও জীবনের পক্ষে মারাত্মক হয়। সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যৌন জ্ঞানের ব্যাপারে কোন রকম কুসংস্কার থাকবে না, এবং সেই সব সংরক্ষণশীলতা থাকলে হবে না যেগুলিকে প্রথাগতভাবে সাধারণ মানুষ বেঠিক বলে মনে করে। যদি প্রথম থেকেই এই ধারণা দিয়ে শুরু করা যায় তবে শিশু ভয়হীন ও বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। পূর্ণবয়স্ক জীবনে প্রবেশ করেই, উক্ত ধরণের শিক্ষিত যুবক ও যুবতী নিজেকে হঠাই এমন একটি জগতের মধ্যে দেখতে পাবে যে জগৎটি পূর্ণ অবিচার, নিষ্ঠুরতা ও প্রতিবন্ধকতামূলক দুর্দশায় পর্যবসিত। এই নিষ্ঠুরতা, অবিচার,দুর্দশা যা আধুনিক জগতে বিদ্যমান তা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং তাদের মূল উৎস হল অর্থনীতি। যেহেতু পূর্বের যুগগুলো থেকেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে জীবন-মৃত্যুর প্রতিযোগিতা অনিবার্য। কিন্তু আমাদের যুগে তা অনিবার্য নয়। আমাদের বর্তমান শিল্পগত কৌশলের দ্বারা, যদি আমরা ইচ্ছা করি, তবে আমরা প্রত্যেকের জন্য সহনীয় অস্তিত্বমূলক জীবনের বন্দোবস্ত করতে পারি । আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে যদি আমরা সেই গীর্জার রাজনীতির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হই যে গীর্জা যুদ্ধ, মহামারী বেশি পছন্দ করে এবং গর্ভনিরোধের বিপক্ষে জেহাদ ঘোষণা করে। জ্ঞান হল সেই বস্তু যার দ্বারা চিরন্তন সুখকে নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধক হল ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্ম আমাদের শিশুদের যৌক্তিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। ধর্ম আমাদের বাধা দেয় যুদ্ধের মৌলিক কারণগুলোকে দূর করবার ক্ষেত্রে। ধর্ম আমাদের বাধা দেয় পাপ ও শাস্তি সম্পর্কে পুরোনো হিংসাত্মক মতবাদগুলোকে দূর করে তার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতাকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। এটা সম্ভবত সত্য যে মনুষ্য-জাতি স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায়, কিন্তু যদি এটা সত্যই হয়, তবে প্রথম প্রয়োজন সেই ড্রাগনটিকে কেটে হত্যা করা যে দোরগোড়ায় পাহারা দিয়ে বসে আছে এবং এই ড্রাগনটি হল ধর্ম।

আমি কী বিশ্বাস করি


(‘আমি কী বিশ্বাস করি’ প্রবন্ধটি ১৯২৫ সালে একটি ছোট্ট গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধের ভূমিকায় রাসেল লেখেন, ‘আমি বলবার চেষ্টা করেছি বিশ্বে মানুষের স্থান সম্পর্কে এবং মঙ্গলময় জীবন অর্জনের জন্য তার সম্ভাবনাগুলোর সম্পর্কে আমি কী ভাবি… মানবিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে এমন কিছু শক্তি আছে যেগুলো সুখকে তৈরি করে এবং অন্য আর এক রকম কিছু শক্তি আছে যেগুলো দুর্দশাকে তৈরি করে। আমরা জানি না কোনটা জয়লাভ করবে, কিন্তু ঠিক মতো বিচার করে আমাদের এই দুটি বিষয় সম্পর্কে সজাগ হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৮ সালে নিউইয়র্ক কোর্টের মামলায় বলা হয়, আমি কী বিশ্বাস করি’ প্রবন্ধটি অনেকগুলো প্রবন্ধের মধ্যে একটি যাকে সামনে রেখে এই মত প্রকাশ করা যায় যে রাসেল সিটি কলেজে অধ্যাপনা করার ক্ষেত্রে অযোগ্য। সংবাদপত্রগুলি প্রবন্ধটির থেকে এমন সমস্ত বাক্য বেছে বেছে তুলে প্রকাশ করে যাতে রাসেলের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি হয়।)


(১) প্রকৃতি ও মানুষ


মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ, প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোন কিছু নয়। তার চিন্তা, তার শারীরিক গতিপ্রকৃতি সেই একই আইনের বশবর্তী যে আইনের বশবর্তী হয়ে নক্ষত্র ও পরমাণুগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বস্তুগত পৃথিবী মানুষের সঙ্গে এতটাই তুল্য যে, দান্তের সময় প্রকৃতিকে মানুষের সঙ্গে যতটা তুলনা করা হত তার থেকেও বেশি, কিন্তু এতটাও বেশি ছিল না যা আজ থেকে একশ বছর আগে ভাবা হত। উচ্চের দিকেই হ’ক বা নিম্নের দিকেই হ’ক, কিংবা বৃহৎ বা ক্ষুদ্রের দিকেই হ’ক, উভয় ক্ষেত্রেই মনে হয় বিজ্ঞান কতকগুলি সীমার দিকে পৌঁছেছে। মনে করা হয় বিশ্ব অনন্তের সীমিত বিস্তারিত ফল। এইজন্যই আলো বিশ্বের চারদিকে কয়েক লক্ষ বছর পরিভ্রমণ করতে পারে। বস্তু ইলেকট্রন ও প্রোটনের দ্বারা তৈরি, যেগুলোর একটি সীমিত আকার আছে এবং জগতে তাদের সংখ্যা সীমিত। সাধারণত মনে করা হত যে সম্ভবত তাদের পরিবর্তন নিরবচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু তাদের পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে কতকগুলি ধাক্কার (Jerks) ফলে, যে ধাক্কাগুলো ক্ষুদ্র যে-কোন ধাক্কার থেকে কখনই খুব ক্ষুদ্র নয়। পরিবর্তনের এইসব নিয়মগুলোকে স্পষ্টতই যে-কোন সাধারণ গাণিতিক পদ্ধতির দ্বারা যোগ করে এক জায়গায় করা যেতে পারে এবং যখনই জগতের কোন ক্ষুদ্র অংশের ইতিহাসকে জানা যাবে তখন এই সমস্ত যোগফলের সমষ্টি সামনে রেখে জগতের অতীত ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যাবে।


পদার্থবিজ্ঞান এই ভাবেই সেই স্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে পৌঁছে সে একদিন শেষ হয়ে যাবে। এই কারণেই তা আগ্রহোদ্দীপক নয়। সেই সমস্ত নিয়মগুলো আবিষ্কার করা হল যেগুলো ইলেকট্রন ও প্রোটনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। এবার পড়ে থাকলো ভূগোলের দিকটি যে বিষয়টি বিশেষরূপে সেই সমস্ত ঘটনার সগ্রহ যা জগতেরই ইতিহাসে কিছু কিছু অংশে কিভাবে তারা বন্টিত হল তার কথা বলে। জগতের ইতিহাস জানতে ভূগোলের যে সমগ্র ঘটনাগুলির সংখ্যা সমষ্টির প্রয়োজন তাও সম্ভবত সীমিত। তত্ত্বগতভাবে তাদের সবগুলোকে সমারসেট হাউসের বৃহৎ গ্রন্থে লিখে রাখা যেতে পারে এবং তার সঙ্গে রাখা যেতে পারে একটি গণক যন্ত্র, যার হাতল ঘোরালেই কোন জিজ্ঞাসু সেই সব ঘটনাগুলোর সম্পর্কে জানতে পারবে সেই সময়, যে সময়টা ঘটনা গুলোর ঘটার নথিভুক্ত সময় থেকে অন্য। কোনোকিছু কম আগ্রহোদ্দীপক বস্তু সম্পর্কে কল্পনা করাটা শক্ত ব্যাপার অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে, কোনো অসম্পূর্ণ আবিষ্কারজাত আবেগপ্রবণ আনন্দের থেকে তা স্বতন্ত্র। এটা অনেকটা খুব উচ্চ পাহাড়ে ওঠার মতো, যেখানে গিয়ে দেখা গেল যে, একেবারে শীর্ষদেশে একটা রেস্তোরাঁ ছাড়া কিছুই নেই এবং সেই রেস্তোরাঁয় তারা আদা থেকে তৈরি বীয়ার বিক্রি করছে এবং যে স্থানটি সম্পূর্ণ কুয়াশায় ঘেরা কিন্তু স্থানটি বেতার তরঙ্গের দ্বারা সজ্জিত। অ্যামস-এর (Ahmes) সময়ে ধারাপাতটি ছিল খুব উত্তেজক।


বস্তুগত জগৎ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সে নিজে অনাগ্রহোদ্দীপক এবং মানুষ হল তার একটা অংশ, তার শরীরটা অন্যান্য বস্তুর মতোই ইলেকট্রন ও প্রোটন সমষ্টি দ্বারা তৈরি, যতদূর আমরা জানি, যা একই ধরণের নিয়ম বা আইনকে অনুসরণ করে যেগুলি জীবজন্তু ও গাছপালার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করে না। এমন কিছু ব্যক্তিকে পাওয়া যায় যারা বলে থাকেন শারীরবিদ্যা কখনই পদার্থবিজ্ঞানের স্তরে নেমে আসতে পারে না, কিন্তু তাদের এই ধরণের যুক্তি খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং এটা ভাবাটাও এক ধরনের গর্বের ব্যাপার হয়ে যাবে যে তারা ভুল করে থাকে। যখন আমরা এরকম বলে থাকি যে, সড়কপথ এবং রেলপথের উপর নির্ভর করে আমরা যেমন ভ্রমণ করে থাকি, কিছুটা একই ভাবে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলি মস্তিষ্কের বহু পথ (Tracks) ভ্রমণ করে থাকে। চিন্তা করার জন্য যে শক্তি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর উৎস মূলত রসায়ন এমনই ভাবা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আয়োডিনের অভাবে একটি চালাক মানুষ বোকা মানুষে পরিণত হয়। মানসিক ঘটনাগুলি সম্পর্কে মনে করা হয় যে, এগুলি বস্তুগত কাঠামোর সঙ্গে আবদ্ধ। যদি তাই হয়, আমরা এটা মনে করতে পারি না যে, একটি সঙ্গ-বিবর্জিত ইলেকট্রন অথবা প্রোটন চিন্তা করতে পারে, যেমন ভাবে আমরা চিন্তা করতে পারি না একজন সঙ্গ-বিবর্জিত ব্যক্তি বা সঙ্গহীন ব্যক্তি একটি ফুটবল ম্যাচ খেলতে পারে। আমরা এটাও মনে করতে পারি না যে, দৈহিক মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তির চিন্তা বেঁচে থাকতে পারে, যেহেতু মৃত্যু মস্তিষ্কের সংগঠনকে ধ্বংস করে এবং সেই শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে যে শক্তি মস্তিষ্কের পথগুলিকে ব্যবহার করে থাকে।


ভগবান এবং অমরত্ব, যা খ্রীষ্টীয় ধর্মের কেন্দ্রীয় নীতি, তা বিজ্ঞানের কোনো সমর্থন পায় না। এটা বলা যেতে পারে না যে, যেহেতু বুদ্ধবাদে কিছুই পাওয়া যায় না সেহেতু ধর্মের জন্য অন্য আরেকটি মতবাদ একান্তই প্রয়োজন। (অমরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা মনে রাখতে হবে যে, অনুপযুক্ত আকারে এই ধরণের বিবৃতি ভুলপথে চালিত করতে পারে, কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে সেটার সার্থকতা বোঝা যাবে।) কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমা দেশের লোক তারা প্রাচ্য দেশের লোকেদের সম্পর্কে ভাবি যে তারা অটুট ঈশ্বরীয় বিদ্যার অধিকারী। নিঃসন্দেহে সেখানকার লোকেরা এই ধরণের বিশ্বাসকে বজায় রাখবে, কারণ এতে তারা আনন্দিত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম যেমন আমরা নিজেদেরকে প্রফুল্ল এবং শত্রুকে বদমাস ভাবতে ভালোবাসি। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি উভয় দিকেই কোন ভিত্তি দেখতে পাই না। আমি এই রকম কোনো ভান করতে চাই না যার দ্বারা বোঝাবে যে আমার প্রমাণ করবার সামর্থ্য আছে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একই ভাবে আমি এটাও প্রমাণ করতে পারব না যে শয়তান মানেই হল কল্পিত কাহিনী। খ্রীষ্টীয় ঈশ্বর থাকতেই পারে এবং ঠিক একইভাবে অলিম্পাসের ঈশ্বর, অথবা প্রাচীন ইজিপ্টের ঈশ্বর অথবা ব্যাবিলনের ঈশ্বর থাকতেই পারে। কিন্তু এদের মধ্যে কোন প্রকল্পই (hypothesis) একে অন্যের চেয়ে অধিক সম্ভাব্য নয় এমন কি এই সমস্ত প্রকল্পগুলি বা অনুমানগুলি সম্ভাব্য জ্ঞানের অঞ্চলের বাইরে অবস্থান করে থাকে। এই জন্যেই তাদের কোনটাকেই বিবেচনা করে দেখার কোন কারণ নেই। এই প্রশ্নের উপর আমার বক্তব্যকে আমি আর বিস্তৃত করতে চাই না, কেননা এই প্রশ্নের উপর আলোচনা আমি অন্য জায়গায় করেছি (আমার ‘লাইনিজের দর্শন’ গ্রন্থটি দেখুন, পরিচ্ছেদ ১৫)।


ব্যক্তিগত অমরত্বের প্রশ্নটি যার উপর দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তি কিছুটা অন্যরকম। দুভাবেই এর প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। ব্যক্তিসকল প্রতিদিনের জগতের একটি অংশ এবং যে জগতের সঙ্গে বিজ্ঞান অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, এবং যে অবস্থা তাদের অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে থাকে তা আবিষ্কারযোগ্য। একটি জলের বিন্দু অমর নয়, কেননা এটিকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে ভাগ করা যেতে পারে এইজন্য একবিন্দু জলের ক্ষেত্রে এইরকম ধারণা করা হয় যে এইরূপ বিভক্ত করার পরও যদি তার জলত্বের গুণটি বজায় থাকে তাহলে আমরা অবশ্য সন্দেহ করব একই ভাবে আমরা জানি যে মস্তিষ্ক অমর নয় এবং জীবিত শরীরের সংগঠিত শক্তি মৃত্যুতে নিঃসাড় হয়ে পরে, এইজন্য সে আর সমষ্টিগত ক্রিয়ায় যোগদান করতে পারে না। এই সমস্ত প্রমাণগুলি আমাদের এই সত্য প্রদর্শন করে থাকে যে যেটাকে আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবন বলে থাকি তা আসলে মস্তিষ্কের কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত এবং তা সংগঠিত শারীরিক শক্তি। এইজন্য এটা মনে করা যুক্তিযুক্ত যে মানসিক জীবন বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক জীবনও বন্ধ হয়ে যায় । যুক্তিটি কেবলমাত্র সম্ভাবতা সম্পর্কিত, কিন্তু এটি এতটাই জোরালো যে যার উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলো গড়ে উঠেছে।


এখানে এমন অনেক পথ আছে যে পথে এই সিদ্ধান্তটিকে আক্রমণ করা যেতে পারে। মানসিক গবেষণা এই রকম শিক্ষা দিয়ে থাকে যার দ্বারা বেঁচে থাকার প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে এবং নিঃসন্দেহে এর পদ্ধতিটি আদর্শগত দিক দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক। এই ধরনের প্রমাণগুলিই এমন প্রচণ্ড হয়ে থাকে যে কোন বৈজ্ঞানিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষই তাকে পরিহার করতে পারে না। প্রমাণের উপর যে ওজনটি যোগ করতে হবে তা অবশ্যই বেঁচে থাকার পূর্ববর্তী সম্ভাব্য অনুমানের উপর নির্ভরশীল হবে। যে-কোন ঘটনাগুচ্ছকে সর্বদা বিভিন্ন পথে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করা যায় এবং এদের মধ্যে আমরা একটিকে পছন্দ করে নিতে পারি যা পূর্ববর্তীমূলক ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে খুব কম অসম্ভাব্য। যারা ঠিক এইরকম ভাবেই ভেবে নিয়েছে যে মৃত্যুর পরেও আমরা বেঁচে থাকতে পারি তারা অবশ্যই প্রস্তুত থাকবে এইরকম ভাবে দেখতে যে এই তত্ত্বটি মানস সম্বন্ধীয় ঘটনার সম্পর্কে সব থেকে উত্তম ব্যাখ্যা প্রদান করে। অন্যদিকে যারা এই তত্ত্বটিকে অসত্য বলে ভাবে তারা অন্য ধরণের ব্যাখ্যা খুঁজবে। আমার দিক থেকে বলতে গেলে আমি মনে করি যে মানস সম্বন্ধীয় গবেষণা যতটা প্রমাণ উদাহরণস্বরূপ দিতে পারে তার থেকে অনেক বেশি প্রমাণ দিতে পারে শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গবেষণা। কিন্তু আমি এ কথা হলফ করে বলতে পারি যে কোন সময় এই তত্ত্বটি জোরালো হয়ে উঠতে পারে এবং যদি এরকম ঘটে তখন বেঁচে থাকার ব্যাপারটিকে অবিশ্বাস করাটা অবৈজ্ঞানিক হয়ে দাঁড়াবে।


শারীরিক মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার ঘটনাটি যদিও অমরত্বের থেকে একটি স্বতন্ত্র ঘটনা। এই ধরণের ঘটনা কেবল এই অর্থ বহন করে যে মানসিক মৃত্যু হয়নি বা তা রহিত হয়ে গেছে। আর এটাকেই লোকে অমরত্ব বলে ভাবতে চায়। অমরত্বে বিশ্বাসী লোক কেবলমাত্র শারীরবিদ্যামূলক যুক্তির উপর নির্ভর করে এগোয়। আমি এ বিষয়ে আগেই বলেছি, যে আত্মা এবং শরীর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্য দিয়ে আত্মার বিকাশের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে তার থেকে সে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। আমি বিশ্বাস করি যে এটা একটা অধিবিদ্যাগত কুসংস্কার। কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মন এবং বস্তু অনেকটা একই অর্থ বহন করে থাকে, কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রগুলো চরম বাস্তব নয়। আত্মার মতোই ইলেকট্রন ও প্রোটন কণার সমষ্টি, এক ধরণের যৌক্তিক কল্পকাহিনী, প্রত্যেকটিই একটি বাস্তব ইতিহাস ও একগুচ্ছ ঘটনাবলী কিন্তু কোনটারই শক্তিশালী কোন অস্তিত্ব নেই। আত্মার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়, তা হল বৃদ্ধির ঘটনাবলী থেকে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট। এমন কে আছে যে ভাবতে পারে যে, কল্পনায় হক ‘গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় হক’ কিংবা শৈশবেই হক, কেউ এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারে না যে আত্মা অবিভক্ত কিছু একটা, যা উক্ত অবস্থাগুলোর মধ্যে দিয়ে চলার সময় যথার্থ ও সম্পূর্ণ থাকে। এটা প্রমাণ করা যায় যে আত্মা শরীরের মতোই বেড়ে ওঠে, এর উদ্ভব শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে, এর ফলে এটি বিভক্ত হতে পারে না। এটা কোন বস্তুবাদ নয়, এটা কেবলমাত্র একটা স্বীকৃতি যে প্রতিটি আগ্রহোদ্দীপক বস্তু মাত্রই সংগঠনমূলক সত্ত্বার বিষয়, কখনই প্রাথমিক সারসত্ত্বামূলক বিষয় নয়।


অধিবিদ্যাবিদরা আত্মা যে অবশ্যই অমর তা প্রমাণ করতে বহু যুক্তি প্রদান করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একটি সরল পরীক্ষার দ্বারা এই সমস্ত যুক্তি গুলোকে নস্যাৎ করা যেতে পারে। সমস্ত অধিবিদ্যাবিদরা সমানভাবে প্রমাণ করেছেন যে আত্মা সমগ্র অনন্ত জুড়ে ব্যাপ্ত রয়েছে। অনেক দিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন মোটা হতে হবে এমন কোন আগ্রহ থাকে না, সেই রকমই কোন অধিবিদ্যাবিদরা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তাদের যুক্তিগুলোকে প্রয়োগ করার দিকে লক্ষ্য করেন। এটা অন্ধ হয়ে থাকার আকাক্ষার এক আশ্চর্য ক্ষমতা যা অতি সমর্থ মানুষকেও ভুল যুক্তির পথে পরিচালিত করে থাকে যেটা না হলে সবকিছুই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যেতো। যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় না পেতাম, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে কখনও অমরত্বের ধারণা গড়ে উঠতে পারত।


ধর্মীয় মতের ভিত্তি হল ভয়, যা মানবজীবনে রাজত্ব করে চলেছে। মানব জাতির মধ্যে ভয় বস্তুটি, সে ব্যক্তিগত হ’ক কিংবা সমষ্টিগত হক, আমাদের সামাজিক জীবনের উপর বেশি প্রভুত্ব করে থাকে। মন ও জড় বস্তুর মধ্যে বৈষম্য বা দ্বন্দ্ব (antithesis) কম বা বেশি ভ্রমাত্মক। কিন্তু আর একটি বৈষমন্ত দেখা যায় যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা হল বস্তুদ্বয়ের মধ্যে যে অন্য ধরণের বৈষম্য আমরা দেখি তা আমাদের আকাক্ষার দ্বারা প্রভাবিত এবং কিছু বস্তুর ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আমাদের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা ততটা প্রভাবিত নয়। এই দুই বস্তুর মধ্যে যে রেখাচিত্রটি আঁকা যায় তা যেমন স্পষ্টও নয় তেমনি অপরিবর্তনীয়ও নয়। বিজ্ঞান যত এগিয়েছে, ততই বহু বহু বস্তু মানুষের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অধিকন্তু এখনো অনেক বস্তুই অনিবার্যভাবে অন্যদিকে রয়ে গেছে। এই বস্তুগুলোর মধ্যে আমাদের জগতের সব থেকে বড় বড় ঘটনাগুলো রয়ে গেছে। এই ধরণের বড় বড় ঘটনাগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের দ্বারাই ঘটেছে। পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে বা পৃথিবীর নিকটে ঘটে যাওয়া এই সব ঘটনাগুলো, অন্তত কিছুটা দূর অবধি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে দমিয়ে মানানসই করে তুলতে পারে। আমরা জানি যে পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে আমাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। সর্বোপরি, আমরা মৃত্যুকে থামাতে পারি না, যদিও মৃত হওয়ার দিক থেকে কিছুটা বিলম্ব ঘটাতে পারি।


ধর্ম এই ধরণের বৈষম্যকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করছে। যদি জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ঈশ্বরকে যদি প্রার্থনা দ্বারা চালিত করতে পারা যায়, তাহলে আমরা সর্বময়তা অর্জন করব। পূর্বের দিনগুলোতে, প্রার্থনার উত্তরে দৈব ঘটনা ঘটে যেত। ক্যাথলিক চার্চে এখনো এই ধরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রোটেস্টান্ট চার্চগুলো এই ধরণের ক্ষমতা হারিয়েছে। যদিও, দৈব ঘটনাগুলোকে ত্যাগ করে কাজ চালান সম্ভব, যেহেতু বিধাতা এই বিধান জারি করেছেন যে প্রাকৃতিক নিয়মসমূহের কার্য সম্ভাব্য উত্তম ফল উৎপাদন করতে পারে। যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাস এখনও পর্যন্ত প্রাকৃতিক জগৎকে মানবীয় করে রাখে, এবং মানুষকে এই অনুভব করায় যে পদার্থগত শক্তি বাস্তবে তাদের বন্ধু। একইভাবে অমরত্ব মৃত্যু থেকে মৃত্যুর ভয়াবহতাকে মুছে দেয়। যে-সব লোক এই বিশ্বাস করে যে যখন তারা মরবে তখন তারা উত্তরাধিকারসূত্রে অনন্ত আশীর্বাদের বা আনন্দের ধারক হবে, তারা এটাও আশা করতে পারে যে, তাদের মৃত্যু হবে মৃত্যুর ভয়াবহতার অনুভব ছাড়াই, যদিও, সৌভাগ্যক্রমে চিকিৎসাবিদরা এই ধরণের ঘটনা কখনই ঘটতে পারে না বলে মনে করেন। যদিও, এটা মানুষের ভয়কে কিছুটা পরিমাণ কমিয়ে দেয়, কিন্তু এত করেও মানুষের ভেতরে উক্ত ভয়কে একেবারে উপশম করতে পারে না।


ভয়াবহতাই ধর্মের মূল উৎস। সে কিছু কিছু ধরণের ভীতিকে মর্যাদা প্রদান করেছে এবং মানুষকে তাদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা করতে কখনও শেখায়নি। এই পথেই সে মানুষের জন্য সব থেকে বড় অকাজটি করেছে। সমস্ত রকম ভীতিই খারাপ (all fear is bad)। আমি বিশ্বাস করি, যখন আমি মরব তখন আমি পচব এবং আমার কোন রকম অহঙ্কারই বেঁচে থাকবে না। আমি যুবক নই, এবং আমি জীবনকে ভালবাসি। কিন্তু মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপাটাকে আমার অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। সুখ বস্তুটি কোন সত্য সুখের থেকে কম সত্য নয়। কারণ তার অবশ্যই একটা শেষ আছে। কিন্তু এরকম ভাবে ভাবা হয় না। প্রেম তার মূল্য হারাচ্ছে, কারণ তাও চিরস্থায়ী নয়। অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদেরকে মাচার উপর বহন করতে ভালবাসে। অবশ্য এই একই ধরণের গর্ব জগতে মানুষের স্থান সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করতে শেখায়। প্রথমে আরামদায়ক অন্দরমহলের ঐতিহ্যবাহী উষ্ণ মানবীয় পুরাণের পরিবেশে বিজ্ঞানের জানালা খুলে দিলে ঠান্ডা বাতাস আমাদের কাঁপিয়ে দেয়, কিন্তু পরিশেষে সেই বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসে উৎসাহ এবং জানালা দিয়ে দেখা যায় অসীম অনন্তকে যা আপন মহিমায় দীপ্ত।


প্রকৃতির দর্শন এক, বস্তুমূল্যের দর্শন একেবারেই ভিন্ন। এই দুই দর্শনের মধ্যে বিলতার সৃষ্টি করাটা একটা বিরাট ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যা ভাল ভাবি, আমরা যা পছন্দ করি, তা সেই বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপের উপর নির্ভর করে না, যে স্বরূপটি প্রকৃতির দর্শনের প্রশ্ন। অন্যদিকে, অমানবিক জগৎ কোনটাকে মূল্য দেয়নি তার উপর নির্ভর করে মূল্য প্রদানের ক্ষেত্রে এটা না ওটা করে কোন ভুল করতে পারি না আমরা, না আমরা বাধ্য কোন কিছুকে প্রশংসা করতে এই ভিত্তির উপর যে সেটি প্রাকৃতিক নিয়ম। নিঃসন্দেহে আমরা প্রকৃতির অংশ, যা আমাদের মধ্যে বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষা উৎপাদন করেছে। উৎপাদন করেছে আশা ও ভীতিসমূহ এবং সেই সব নিয়মসমূহ অনুযায়ী নিয়মগুলোকে পদার্থবিদরা সবে মাত্র আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন। এই অর্থে আমরা প্রকৃতির বশবর্তী, প্রাকৃতিক নিয়মজাত ফলস্বরূপ এবং অনেক পরে এই সব নিয়মের কাছেই বলি স্বরূপ (…….. we are part of nature, we are subordinated to nature, the outcome of natural laws, and their victims in the long run.)


প্রকৃতির দর্শন অবশ্য অনুচিতভাবে পার্থিব নয়, কেননা, পৃথিবী ছায়াপথের একটি ক্ষুদ্র নক্ষত্রমালার মধ্যে একটি ছোট্ট গ্রহ। তাই এই অকিঞ্চিত্বর গ্রহের ক্ষুদ্র পরজীবীদের আনন্দের খাতিরে প্রকৃতির দর্শনকে মুছে ফেলাটা একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার হবে। প্রাণবাদ (vitalism) এবং বিবর্তনবাদ এই প্রসঙ্গে যে সত্যটা আমাদের কাছে তুলে ধরে তা হল, এগুলো সামঞ্জস্যমূলক চেতনাহীন এবং যৌক্তিক সঙ্গতিহীন। এইসব মতবাদগুলি সেই সমস্ত ঘটনাগুলোকে সমাদর করে থাকে, যে ঘটনাগুলি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাছে আগ্রহোদ্দীপক, কেননা তাদের একটা জাগতিক তাৎপর্য আছে বলে, তাদের পার্থিব তাৎপর্যের জন্য নয়। জাগতিক দর্শন হিসাবে, আশাবাদ ও দুঃখবাদ সেই একই সরল মানবতাবাদকে প্রদর্শন করে থাকে। এই জগৎ বিশাল, প্রকৃতির দর্শন থেকে যতদূর পর্যন্ত আমরা এই বিশাল জগৎ জেনেছি তা না মঙ্গলময় না অমঙ্গলময়, এবং তা আমাদের সুখী বা অসুখী করবার সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। এই ধরণের সমস্ত দর্শনগুলো আত্ম গুরুত্ব থেকে নির্গত এবং তাদের আরও শুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে নক্ষত্র বিজ্ঞানের উপর এক ছটাক জ্ঞানের দ্বারা।


কিন্তু মূল্যের দশনের ক্ষেত্রে অবস্থাটা একেবারেই উল্টো। আমরা যতটা কল্পনা করতে পারি প্রকৃতি তারই একটা অংশ। বাস্তব বা কল্পিত প্রতিটি বস্ততুই আমাদের দ্বারা প্রশংসিত হতে পারে, এবং এখানে এমন কোন বহির্মূল্যায়ন (out side standard) নেই যার দ্বারা দেখানো যেতে পারে যে আমাদের মূল্যায়ন ভুল। আমরা নিজেরাই সেখনে চরম এবং মূল্য প্রদানের ক্ষেত্রে অখণ্ডনীয় মধ্যস্থতাকারী এবং মূল্যের জগতে প্রকৃতি একটি অংশ মাত্র। এইভাবেই এই জগতে আমরা প্রকৃতির থেকে অনেক বড়। মূল্যের জগতে প্রকৃতি নিজেই নিরপেক্ষ। সে ভালও নয়, খারাপও নয়, সে প্রশংসারও যোগ্য নয়, নিন্দারও যোগ্য নয়। আমরাই মূল্য সৃষ্টি করি এবং সেই ধরণের আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করি যা মূল্য প্রদান করে থেকে। এই রাজত্বে আমরা রাজা এবং আমরা তখন আমাদের রাজত্বকে নিকৃষ্ট করে তুলি যখন আমরা প্রকৃতির কাছে অবনত হই। আমাদের জন্যই মঙ্গলময় জীবনকে নির্ধারণ করতে হবে, প্রকৃতির জন্য নয়– এমনকি সেই প্রকৃতির জন্যও নয় যাকে আমরা ঈশ্বরে পরিণত করেছি।


(২) মঙ্গলময় জীবন


বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষদের মধ্যে মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে ধারণা বিভিন্ন রকম। এই বিভিন্নতাই বিভিন্ন যুক্তির জন্য কিছুটা পরিমাণে দায়ী। এই ঘটনা তখনই ঘটেছে যখন মানুষ তাদের নিজের নিজের ধারণা অনুযায়ী উক্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। কেউ কেউ মনে করেছে কারাগার হল সেই মঙ্গলময় পথ যে পথে অপরাধকে আটকানো যেতে পারে। অন্যজনে এই ধারণা পোষণ করে থাকে যে শিক্ষাই উক্ত পথের থেকে অনেক বেশি মঙ্গলময়। এই ধরণের বিভিন্নতাগুলোকে যথেষ্ট প্রমাণ দর্শিয়ে সিদ্ধান্তের আঙিনায় নিয়ে আসা যায়। তলস্তয় সমস্ত রকম যুদ্ধকেই নিন্দা করেছেন। অন্যরা যোদ্ধার জীবনকে গ্রহণ করে সঠিককে মহান করবার জন্য যুদ্ধ করে। এক্ষেত্রে বাস্তব পার্থক্য জড়িত এবং লক্ষ্যগুলির মধ্যে পাথক্য দ্রষ্টব্য। যারা যোদ্ধাকে প্রশংসা করে থাকে তারা সাধারণত পাপীর শাস্তিকে মঙ্গলজনক পথ বলে মনে করে। তলস্তয় কিন্তু এরকম চিন্তা করেননি। এ ব্যাপারে কোনরকম যুক্তি প্রদর্শন অসম্ভব। এইজন্যই, আমি প্রমাণ করে বলতে পারি না যে মঙ্গলজনক জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক। আমি কেবলমাত্র আমার দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলতে পারি এবং আশা করতে পারি যে যতদূর সম্ভব তা সমর্থিত হবে। এই ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হল :


‘মঙ্গলময় জীবন হল সেই জীবন যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত’ (The good life is one inspired by love and guided by knowledge)


জ্ঞান এবং প্রেম উভয়ই অর্নিদিষ্টভাবে প্রসারণক্ষম। এইজন্য একটি জীবন যতই মঙ্গলময় হ’ক না কেন, তার থেকেও অনেক বেশি উন্নত জীবন কল্পনা করা যায়। জ্ঞান ব্যতীত প্রেম, বা প্রেম ব্যতীত জ্ঞান, কোনটাই মঙ্গলময় জীবন সৃষ্টি করতে পারে না। মধ্য যুগগুলোতে, যখন কোন দেশে মহামারী উপস্থিত হত তখন সাধু মানুষেরা জনগণকে গীর্জায় সমবেত হয়ে উদ্ধার পাবার জন্য প্রার্থনা করতে উপদেশ দিতেন। এর ফল দাঁড়াত এই যে বিনীতভাবে প্রার্থনাকারী মানুষের ভিড়ে অতি দ্রুত রোগটি ছড়িয়ে পড়ত। জ্ঞানহীন প্রেমের নজির এই ধরণের ঘটনা এবং পরেরটি প্রেমহীন জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই, ফল হত বিরাট আকারে মৃত্যু।


যদিও প্রেম এবং জ্ঞান উভয়ই প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রেম হল সব থেকে মৌলিক, যেহেতু এটি বুদ্ধিমান মানুষকে জ্ঞান অন্বেষণে প্রবৃত্ত করে সে যাদের ভালবাসে তাদের কিসে ভাল হয় তার জন্য। কিন্তু যদি জনগণ বুদ্ধিমান না হয়, তবে তাদের যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা শুনেই তারা সন্তুষ্ট থাকে, ভালো করার থেকে ক্ষতি করে বেশি। আমি যা বলতে চাইছি সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিদ্যা খুব ভালো উদাহরণ। একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু অপেক্ষা একজন দক্ষ চিকিৎসাবিদ অনেক বেশি কার্যকরী। চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানের অগ্রগতি মনুষ্যগোষ্ঠীর সাধারণ স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য একজন অজ্ঞানী মানবদরদী অপেক্ষা অনেক বেশি কাজ করতে পারে। অধিকন্তু, যদি ধনিক শ্রেণী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করিয়ে তার থেকেও লাভ সগ্রহ করতে চায় তা হলেও ভালো, কেননা যে-কোন রকম ভাবে উপকারের ইচ্ছাটাই প্রয়োজনীয়।


প্রেম এমন একটি শব্দ যা বহু বিচিত্র অনুভবকে ঢেকে রাখে। আমি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই এই শব্দটি ব্যবহার করেছি সেই সব বিচিত্র অনুভবগুলো ধরতে চাওয়ার জন্য। আবেগ হিসেবে প্রেম– আমি যা বলতে চাইছি তা হল, প্রেমের জন্য কোন আদর্শ আমার কাছে খাঁটি মনে হয় না এটি দুটি মেরুর মধ্যে চলাচল করে থাকে। একটি দিকে প্রশান্তিমূলক শুদ্ধ আনন্দ এবং অন্যদিকে শুদ্ধ বদান্যতা বা উপকার করবার ইচ্ছা। যেখানে প্রাণহীন বস্তু সম্পর্কিত, সেখানে কেবল আনন্দ প্রবেশ করতে পারে। আমরা ছবিতে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখে বা সোনাটা (SONATA) শুনে বদান্যতা অনুভব করতে পারি না। স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে যে এই ধরণের আনন্দই শিল্পকলার উৎস। নিয়ম অনুযায়ী এই ধরণের আনন্দ পূর্ণবয়স্ক শিশু অপেক্ষা কমবয়সের শিশুর মধ্যে বেশি থাকে, যারা উপযোগিতামূলক অনুপ্রেরণায় কোন বস্তুকে দেখতে সমর্থ। মানব জাতির অভিমুখে আমাদের এই ধরনের অনুভব খুব বড় কাজ করে। কেউ কেউ মুগ্ধতা অনুভব করে, আবার কেউ কেউ যখন কেবলমাত্র সৌন্দর্যতত্ত্বমূলক সন্তুষ্টির বস্তু হিসেবে তাকে দেখে তখন সে উল্টো অনুভব করে।


প্রেমের বিপরীত মেরুটি হল শুদ্ধ বদান্যতা। কুষ্ঠরোগীদের সাহায্য করতে গিয়ে বহু মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। এই ধরণের ঘটনায় যে ধরনের প্রেম তারা অনুভব করেছে তা সৌন্দর্যতত্ত্বমূলক কোন আনন্দ থেকে নয়। বাৎসল্য, নিয়ম অনুযায়ী, শিশুর উপস্থিতিজাত আনন্দ থেকে উদ্ভূত। কিন্তু এই স্নেহ আরও বেড়ে যায় যখন উপকরণটি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। অসুস্থ শিশু সন্তানের প্রতি মায়ের আগ্রহকেই বদান্যতা বলাটা বিষম হয়ে দাঁড়াবে, কারণ নয় ছয় পনের মার্কা প্রবঞ্চনাকর ধূসর আবেগকে আমরা এই ধরণের শব্দে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। কিন্তু অন্য ব্যক্তির মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষাকে অন্য কোন শব্দে বর্ণনা করা দুরূহ। বাস্তবে পিতৃমাতৃ অনুভবের ক্ষেত্রে এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা শক্তির যে-কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটা অনেক কম তীব্র, বরঞ্চ এটা মনে করাটা অনেক সহজসাধ্য হবে যে, সব ধরণের পরোপকারের ধারণা মূলত পিতৃমাতৃমূলক অনুভবের প্রবাহ, অথবা কখনও তা এই ধরণের অনুভবের মঙ্গলজনক পথে পরিচালন বোঝায়। অপেক্ষাকৃত ভাল শব্দের চাহিদায়, আমি এই আবেগকে বদান্যতা বলে অভিহিত করব। কিন্তু এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আমি একটি আবেগ সম্পর্কে কথা বলছি, কোন আদর্শ সম্পর্কে নয়, এবং তার ফলে আমি এই শব্দের সঙ্গে জড়িত কোন মহানতার অনুভবকে অন্তর্ভুক্ত করিনি। সমবেদনা (sympathy) শব্দটিকে আমি যা বুঝি তা তার কিছুটা অংশ। শব্দটির থেকে যে-সব কার্যকরী অংশ বাদ দেওয়া হয় আমি সেই অংশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।


প্রেম (Love) শব্দটি চরম অর্থে দুটি উপকরণের অদ্রবীভূত মিশ্রণ, আনন্দ এবং শুভ-ইচ্ছা। সুন্দর ও সার্থক শিশুর পিতামাতার আনন্দের ক্ষেত্রে এই দুই ধরণের উপকরণ কাজ করে। যৌন প্রেমের ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব ঐ একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু যৌন প্রেমের ক্ষেত্রে বদান্যতা ব্যাপারটি তখনি দেখা যায় যখন অধিকারের নিশ্চয়তা দেখা যায়, তা না হলে হিংসা তাকে ধ্বংস করে থাকে, যখন সম্ভবত প্রশান্তিজাত আনন্দ বাড়তে থাকে। শুভ-ইচ্ছা ব্যতীত আনন্দ নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হতে পারে। আনন্দ ব্যতীত শুভ-ইচ্ছা শীতল ও একটু বেশি শ্ৰেষ্ঠতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। একজন ব্যক্তি যে প্রেম চায় সে আসলে প্রেমের সেই বিষয় হতে চায় যেখানে এই দুটি উপকরণই থাকবে, একমাত্র প্রবল দুর্বলতা ছাড়া, যেমন শৈশব এবং মারাত্মক অসুস্থতার বেলায় বদান্যতাকেই বেশি করে আকাঙ্ক্ষা করা হয়। বিপরীতভাবে, প্রবল শক্তির ক্ষেত্রে, বদান্যতার চেয়ে প্রশংসা অনেক বেশি আকাক্ষিত। এই ধরণের মানসিক অবস্থা দেখা যায় প্রসিদ্ধ রাজা বা সম্রাট ও বিখ্যাত সুন্দরীদের ক্ষেত্রে। এই অনুভব করে আমরা মানুষের মঙ্গলময়-ইচ্ছা ততটা পরিমাণেই চেয়ে থাকি যতটা পরিমাণ সাহায্যের প্রয়োজনে ও বিপদের সময় আমরা নিজেরা তাদের কাছে চাই। ব্যাপারটিকে অন্তত অবস্থার (Situation) জীববিদ্যাগত যুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমরা স্নেহ আকাক্ষা করে থাকি একাকিত্বের অনুভব থেকে মুক্তি পেতে, যে ব্যাপারটি আমাদের কাছে উহ্য থাকে। সমবেদনার (sympathy) এটাই হল বিষয় যে তা কেবলমাত্র বদান্যতা নয়। যে ব্যক্তির স্নেহ আমাদের কাছে সন্তুষ্টিমূলক জায়গায় পৌঁছতে পারে, সেই স্নেহ কেবলমাত্র আমাদের মঙ্গল কামনাই করে না সে জানে ঠিক কোথায় আমাদের সুখ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই ধরণের অনুভব মঙ্গলময় জীবনের অন্য আর একটি অনুভব, যাকে আমরা জ্ঞান বলতে পারি।


একটি সঠিক জগতে প্রতিটি সচেতন সত্ত্বা প্রতিটি সত্ত্বার জন্য পূর্ণ প্রেমের বিষয়, যে প্রেম আনন্দ, বদান্যতা ও বোঝাঁপড়ার সমাধানযোগ্য মিশ্রণ। তা বলে এটা এরকম বোঝায় না যে, এই বাস্তব জগতে, যে সব মানুষের সঙ্গে লড়াই করে চলেছি তাদের প্রতি আমাদের এই ধরণের অনুভব অর্জন করা উচিত। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ব্যাপারে আমরা আনন্দ অনুভব করি না, কারণ তারা বিরক্তজনক। যদি আমরা এই ধরণের মানুষের ভেতরে সৌন্দর্য দেখবার চেষ্টা করতে গিয়ে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাতাম তবে আমরা স্বাভাবিকভাবে যেসব বস্তুকে সুন্দর দেখি তাদের সেইভাবে দেখবার সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা করে ফেলতাম। এই ধরণের মানুষের প্রসঙ্গে মানবজাতির কথা উল্লেখ করবেন না, কেননা তারা মাছি, ছারপোকা এবং উকুনের মতো। এই ধরণের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে আনন্দবোধ করবার আগে আমাদের এসিয়েন্ট মেরিনার মতো দৃঢ়ভাবে রস নিঙড়ানোর ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। এটা সত্য যে কিছু সাধু মানুষ এদেরকে ঈশ্বরের মুক্তো বলে ডেকে থাকেন, কিন্তু এই কথা বলে সেই সাধু মানুষরা যে আনন্দ পেয়ে থাকেন তা তাঁদের নিজেদের গুণের প্রদর্শন মাত্র।


পরোপকারকে সহজেই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা যায়, কিন্তু তার একটি সীমা আছে। যদি কোন ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক হয় এবং সে যদি দেখে যে অন্য আর একজন ব্যক্তিও সেই মহিলাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তবে আমাদের এইরকম ভাবা উচিত হবে না যে তার পক্ষে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়াটাই ভালো হবে। এই ব্যাপারটিকে আমরা তখন ধরে নেব প্রতিযোগিতার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে। এক্ষেত্রে বিরুদ্ধ পক্ষের উপর তার অনুভব পূর্ণরূপে পরোপকারমূলক হতে পারে না। আমি মনে করি যে পৃথিবীর উপর মঙ্গলময় জীবনের সব রকমের বর্ণনাতে কোন-না-কোন জান্তব প্রাণবন্ততা ও প্রবৃত্তিকে ভিত্তিরূপে আমরা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারি। এ ছাড়া, জীবন অবদমিত ও অনাগ্রহোদ্দীপক হয়ে ওঠে। সভ্যতা অবশ্যই এর সঙ্গে সংযুক্ত কিছু একটা, অবশ্যই তা এই ব্যাপারটির উল্টো কিছু নয়। এই জন্যেই কৃচ্ছ্বতাসম্পন্ন সন্ন্যাসী ও বিচ্ছিন্ন সাধু পূর্ণ মানব হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। মুষ্টিমেয় সংখ্যায় তারা কোন গোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে, কিন্তু যে জগৎ তাদের নিয়েই রচিত সেই জগৎ অবশ্যই নৈরাশ্যে মরবে।


এই সমস্ত বিবেচনাগুলি উত্তম প্রেমের উপাদান হিসেবে আনন্দের উপকরণের উপর বিশেষ জোর দেওয়ার দিকে পরিচালিত হয়। আনন্দ, এই বাস্তব জগতে, অবশ্যম্ভাবী রূপে নির্যাতনমূলক এবং যা আমাদের বাধা দিয়ে থাকে সমগ্র মনুষ্য জাতির প্রতি একই রকম অনুভব পোষণ করার ক্ষেত্রে। যখন আনন্দ ও বদান্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, নিয়ম অনুযায়ী, তখন বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে একটা সিদ্ধান্তে অবশ্যই আসতে হয়, কিন্তু কখনই যে-কোন দুটির একটিকে পূর্ণ সমর্পণ করার দ্বারা তা হয় না। প্রবৃত্তির নিজস্ব কিছু অধিকার আছে কিন্তু সীমার বাইরে গিয়ে যদি আমরা তার প্রতি হিংসা প্রদর্শন করে থাকি তবে তা সূক্ষ্ম পথে তার প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। এইজন্য মঙ্গলময় জীবনের লক্ষ্যে মানবিক সম্ভাব্যতার সীমা মনে অবশ্যই জন্ম নেবে। আবার বলতে হয়, যদিও, জ্ঞানের প্রয়োজনে আমাদের ফিরে আসতে হয়।


যখন আমি মঙ্গলময় জীবনের উপাদান হিসেবে জ্ঞানের কথা বলে থাকি, তখন আমি নৈতিক জ্ঞানের কথা ভাবি না, বরং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও বিশেষ ঘটনাগুলি সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা ভাবি। সত্য করে বলতে গেলে আমি মনে করি না যে নৈতিক জ্ঞান বলে কোন কিছু আছে। আমরা যদি কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, জ্ঞান আমাদের দেখাতে পারে তার উপায়গুলি এবং এই জ্ঞান হাল্কাভাবে নৈতিক জ্ঞান হিসেবে আমাদের সামনে দিয়ে বয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে সেই নৈতিক জ্ঞানগুলির সম্ভাব্য ফল প্রদর্শন ছাড়াই আমরা তাদের মধ্যে কোনটা ঠিক বা ভুল তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। একটি লক্ষ্যকে অর্জন করবার জন্য দেওয়া হ’ক, দেখা যাবে যে কিভাবে তা অর্জন করা যায় তা আবিষ্কারের জন্য সেটি বিজ্ঞানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের কামনাপ্রসূত লক্ষ্যগুলিকে ঠিক মতো অনুধাবন করবার ক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার মাধ্যমে আমরা সমস্ত নৈতিক সূত্রগুলির যোগ্যতা প্রমাণ করে নিতে পারি। আমি সেই লক্ষ্যগুলির প্রসঙ্গে বলেছি যেগুলি আমরা কামনা করে থাকি, কিন্তু সেই সব লক্ষ্যগুলির কথা বলিনি যেগুলি আমাদের কামনা করা উচিত। কামনা করার ক্ষেত্রে যা আমাদের উচিত বলে বিবেচিত সেই সব কামনাগুলি অপর কারুর ইচ্ছাপ্রসূত। সাধারণত এগুলি এরকমই যা কর্তৃপক্ষ আমাদের কামনা করতে শেখান। বাবা-মা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ এবং বিচার করা। যদি আপনি আমাকে বলেন, আপনার উচিত এটা কি সেটা করা’, তবে আপনার মন্তব্যের চালক-শক্তি আপনার অনুমোদনের দিকে আমার কামনাকে চালিত করবে তা উভয় প্রকার সম্ভাব্য অনুমোদনের দিকে চালিত হতে পারে এবং তা আপনার অনুমোদন ও অননুমোদন সাপেক্ষে পুরস্কারমূলক বা শাস্তিমূলক হতে পারে। যেহেতু সমস্ত রকমের আচরণ কামনা থেকেই উত্থিত, সুতরাং এটা পরিষ্কার যে নৈতিক মতো কখনই কোন গুরুত্ব নিতে পারে না যতক্ষণ না তারা কামনাকে প্রভাবিত করতে পারে। অনুমোদনের কামনা এবং অননুমোদনের ভীতির মাধ্যমেই তারা তাদের এই কাজ করতে পারে। এইগুলি ক্ষমতাসম্পন্ন সামাজিক বল। আমাদের সাপেক্ষে আমরা সেগুলি সাধারণভাবে জয় করবার চেষ্টা করি তখনই, যখন আমরা কোন সামাজিক উদ্দেশ্যকে মেটাতে ইচ্ছা করে থাকি। যখন আমি বলে থাকি যে নির্দেশিত আচরণের নৈতিকতাকে বিচার করে নিতে হবে তার। সম্ভাব্য ফলের দ্বারা, তখন আমি এই বলতে চাই যে সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণার্থে করণীয় আচরণগুলির অনুমোদন আমি দেখার কামনা করি এবং বিপরীত আচরণের ক্ষেত্রে অননুমোদন দেখার কামনা করে থাকি। বর্তমানে এটি ঘটে না। এখানে এমন কিছু ঐতিহ্যবাহী নিয়ম আছে যে নিয়মগুলি অনুযায়ী ফলসমূহকে অগ্রাহ্য করেই অনুমোদন এবং অননুমোদন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই বিষয়টির উপর আলোচনা আমরা পরবর্তী ভাগে করব।


সাধারণ ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক নৈতিকতার আধিক্য স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ মনে করা যাক, আপনার শিশুটি অসুস্থ। আপনার প্রেম আপনাকে শিশুটিকে সারিয়ে তুলতে ইচ্ছা করাবে এবং বিজ্ঞান বলবে কেমন ভাবে আপনি শিশুটিকে সারিয়ে তুলতে পারেন। নৈতিক তত্ত্বের মধ্যে এমন কোন মধ্যবর্তী স্থান নেই যেখানে দাঁড়িয়ে একথা বলা যেতে পারে যে আপনার শিশুটিকে আরও ভালোভাবে সারিয়ে তোলা যেত। একটি লক্ষ্য পূরণের আকাক্ষা থেকে আপনার কার্যটি সরাসরি উঠে আসে বিভিন্ন রকম উপায়ের জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে। সব কার্যের ক্ষেত্রেই এটা সমান সত্য, সে কার্য ভালো মন্দ যাই হক না কেন। লক্ষ্যগুলি পরস্পর স্বতন্ত্র এবং কিছু কিছু লক্ষ্যের ক্ষেত্রে জ্ঞান অপর্যাপ্ত হতে পারে আবার কিছুর ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। কিন্তু মানুষ যে কাজ করতে ইচ্ছুক নয় তাকে সেই কাজ করাবার জন্য কোন বোধগম উপায় নেই। যেটা সম্ভব সেটা হল পুরস্কার এবং শাস্তির ব্যবস্থার দ্বারা তাদের কামনাকে পরিবর্তিত করা। এক্ষেত্রে সামাজিক অনুমোদন এবং অননুমোদন খুব একটা কম বলশালী নয়। এই কারণেই বিধান সম্বন্ধীয় নীতিবিদদের জন্য যে প্রশ্নটি জাগে তা হল, কিভাবে এই পুরস্কার ও শাস্তিসমূহের ব্যবস্থাকে সাজালে বিধান সম্বন্ধীয় কর্তৃত্বদের কামনার সব থেকে বেশি সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা যায়? যদি আমি এমন বলি যে, বিধান সম্বন্ধীয় কর্তৃত্বদের কামনাগুলি ভালো নয়, তখন আমি কেবলমাত্র এই কথাই বলতে চাই যে তাদের কামনা বা ইচ্ছাগুলি গোষ্ঠীর কিছু কিছু অংশের সঙ্গে দ্বন্দরত থাকে যে অংশগুলিতে আমি বা আমার মতো লোকজন জড়িত থাকে। মানবিক কামনা বাসনার বাইরে কোনরকম নৈতিক মান নেই (outside hauman desire there is no moral standard.)


তাই বলা যেতে পারে যা নীতিবিদ্যার থেকে বিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র করেছে তা কোন বিশেষ ধরণের জ্ঞান নয়, তা হল কামনা বা আকাঙ্ক্ষা। যে-কোন ক্ষেত্রে যেভাবে জ্ঞান অর্জন করা হয়ে থাকে সেরকমই নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে ঘটে। যে ঘটনাটা অদ্ভুত তা হল কিছু লক্ষ্যকে কামনা করা হয়ে থাকে এবং সেইসব লক্ষ্যের সহায়ক আচরণকে যথার্থ বলে ধরা হয়। সুতরাং বলা যায়, যদি ব্যাখ্যাটি যথার্থ আচরণ সম্পৰ্কীয় হয়ে থাকে তা হলে তার আবেদনের পরিধিও ব্যাপক। মনুষ্যজাতির বেশিরভাগ অংশের কামনা বাসনার উপরই লক্ষ্যগুলি গড়ে ওঠে। যথার্থ আচরণগুলিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করলে আমার অর্থ উপার্জন ভালো হবে, পাঠক তা কোনভাবেই মেনে নেবে না। যে কোন কার্যকরী নৈতিক যুক্তি তার বৈজ্ঞানিক অংশে নিহিত থাকে, তা হল, অন্যান্য কিছু আচরণের চেয়ে বিশেষ এক ধরণের আচরণ যা সেই লক্ষ্য পূরণের উপায় যে লক্ষ্য ব্যাপকভাবে আকাক্ষিত। যদিও আমি নৈতিক যুক্তি এবং নৈতিক শিক্ষাকে স্বতন্ত্রভাবে দেখি। নৈতিক শিক্ষা কিছু আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং তা করতে গিয়ে সে কিছু আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে তোলে। এটা সম্পূর্ণভাবে একটি ভিন্ন ধরণের পদ্ধতি, যা শেষের দিকে স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হবে।


এখন আমরা সেই মঙ্গলময় জীবনের সংজ্ঞার তাৎপর্য আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে বিষয়টি নিয়ে এই পরিচ্ছেদটি শুরু হয়েছিল। যখন আমি বলেছিলাম যে মঙ্গলময় জীবন প্রেমের দ্বারা গঠিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত, তখন যে কামনা আমাকে এই কথা বলতে তৎপর করেছিল তা ছিল যতদূর সম্ভব এমন একটা জীবন বাঁচার কামনা এবং অন্যকে তার জীবনে এই রকম ভাবে বাঁচতে দেখার কামনা। এই বিবৃতির অন্তর্নিহিত যুক্তিটি হল যে, একটি গোষ্ঠীতে যেখানে মানুষ এইভাবে বসবাস করে, সেখানে কামনাগুলির অনেক বেশি সন্তুষ্টি সাধন হয়ে থাকে তাদের চেয়ে যারা অপেক্ষাকৃত কম প্রেম ও জ্ঞানের পরিবেশে বসবাস করে। আমি এই অর্থ করছি না যে এই ধরনের জীবন ‘পুণ্যবান’ অথবা এর বিপরীতটি হল ‘পাপময়’, কেননা এই রকম কল্পনা আমার কাছে কোন বৈজ্ঞানিক গ্রাহ্যতা রাখে না।


(৩) নৈতিক নিয়মসমূহ


নৈতিক উপদেশগুলির বাস্তব প্রয়োজনীয়তা কামনার দ্বন্দ্ব থেকে উঠে আসে এবং সে দ্বন্দ্ব ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যে হতে পারে অথবা ভিন্ন সময়ে একই মানুষের মধ্যে হতে পারে, এমনকি একই সময়ে একই মানুষের মধ্যেও হতে পারে। একজন মানুষ মদ্যপানের আকাক্ষা করতে পারে এবং পরের দিন সকালে তার কাজ করবার জন্য সে সুস্থ থাকার আকাক্ষাও করতে পারে। আমরা তখনই তাকে অনৈতিক বলব যদি সে বেছে নেয় সেই রাস্তা যে পথ তার সমগ্র আকাক্ষার অতি সামান্যই পূরণ করতে পারে। আমরা সেইসব মানুষ সম্পর্কে বাজে ভাবি যারা অতিরঞ্জিত ও বেপরোয়া। এমনকি যারা নিজের ক্ষতি ছাড়া অন্যের ক্ষতি করে না তাদের সম্বন্ধেও ওই একই কথা ভাবা হয়। বেন্থাম মনে করতেন যে ‘আলোকিত আত্ম-স্বার্থ’ থেকেই নৈতিকতার সবকিছুর জন্ম এবং একজন ব্যক্তি যে সর্বদা তার নিজের সর্বাধিক সন্তুষ্টির দিকে নজর রেখে কাজ করে, পরবর্তীকালে সে যা কাজ করে তাই সর্বদা সঠিক হয়। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি না। স্বৈরাচারীরা তাদের মধ্যেই বিদ্যমান যারা শাস্তিপ্রসূত অত্যাচার পর্যবেক্ষণ করে তীব্র আনন্দ পেয়ে থাকে। আমি সেই ধরণের মানুষকে কখনই প্রশংসা করতে পারি না যারা মিতব্যয়িতার সঙ্গে তাদের কাছে বলিস্বরূপ প্রদত্ত মানুষদের জীবনকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে তারা অন্য কোন দিন আরও অত্যাচারিত হবে। অন্যান্য বস্তু বা দিকগুলি সমান হলে, মিতব্যয়িতা মঙ্গলময় জীবনের একটি অংশ। এমনকি রবিনসন ক্রুশোকেও প্রাসঙ্গিক কারণে পরিশ্রম, আত্ম-সংযম এবং দূরদর্শিতার সাধনাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল যাকে অবশ্যই নৈতিক গুণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, কেননা তারা বিপরীত ভারসাম্যকে বজায় রাখতে গিয়ে অপরকে কোনরকম আঘাত না করে তাদের সমষ্টিগত পরিতৃপ্তিকে বাড়াতে পেরেছিল। নৈতিক গাথাগুলির এই অংশ সেই সব কিশোর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে খুব বড় ভূমিকা পালন করে, যাদের ভবিষ্যতের চিন্তার দিকে ঝোঁক আছে। যদি পরবর্তীকালে জীবনে এগুলোকে খুব বেশি সাধনা করা যেত তবে জগৎটা খুব তাড়াতাড়ি স্বর্গ হয়ে যেত, কারণ তা সেই যুদ্ধগুলিকে বন্ধ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হত, যে যুদ্ধগুলি ভাবাবেগ জাতীয় কার্য নয়। তথাপি, মিতব্যয়িতার গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও নৈতিক গাথাগুলিতে এটি খুব আগ্রহোদ্দীপক অংশ নয়। এটি এমনও কোন অংশ হয়ে উঠতে পারেনি যা বৌদ্ধিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, সেহেতু এটি আত্মকেন্দ্রিক উদ্দেশ্যের বাইরে কোন আবেদন রাখতে পারে না।


নৈতিকতার যে অংশ পরিণাম দর্শিতা বা মিতব্যয়িতার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা, প্রকৃতপক্ষে আইনসদৃশ অথবা মুগুরের শাসন। একটি গোষ্ঠীতে একসঙ্গে থাকতে সমর্থ করে তোলে এই সম্ভাবনা সত্ত্বেও যে সেখানে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা গুলি পরস্পর-বিবাদী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখানে দুটি ভিন্ন ধরণের পদ্ধতি সম্ভব। একটি হল অপরাধমূলক আইনের পদ্ধতি, যে আইনের লক্ষ্য সেই সমস্ত কার্যরত বিরক্তিকর ঘটনা গুলিকে যোগ করে কেবলমাত্র বাহ্যিক সংগতি রক্ষা করা যে ঘটনাগুলি অন্যান্য মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কোন-না-কোন ভাবে আঘাত করে। এটাকে সামাজিক নিন্দার পদ্ধতিও বলা যায়। কেউ তার নিজের সমাজের দ্বারা বাজে ভাবে চিহ্নিত বা ভাবিত হলেও তা এক ধরণের শাস্তি। নিজেদের সংবিধান লঙ্ঘন করছে জেনেও বেশির ভাগ মানুষ এই ধরণের শাস্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু এখানে আরও একটি পদ্ধতি আছে, যা আরও বেশি মৌলিক এবং অনেক বেশি সন্তুষ্টিজনক যখন এটি সফল হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিটি হল মানুষের চরিত্র ও কামনা গুলিকে সেই পথে পরিবর্তিত করা যে পথে একটি মানুষের কামনা গুলিকে অন্যান্য মানুষের কামনার সঙ্গে সঙ্গতিকর করে তুলে বিবাদের উপলক্ষ গুলিকে কমিয়ে দেওয়া যায়। এই জন্য ঘৃণার থেকে প্রেম ভালো, কেননা উল্লেখিত ব্যক্তির কামনাগুলিতে প্রেম বিবাদের পরিবর্তে সঙ্গতি fara opcy (That is why, love is better than hate, because it brings har mony instead of conflict into the desire of the person concerned) i to মানুষ, যাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম আছে, তারা উভয়ে সমানভাবে সফল বা ব্যর্থ হয়। কিন্তু যখন দুটি মানুষ পরস্পরকে ঘৃণা করে, তখন সফল একজন হয় আর অন্যজন বিফল হয়।


যদি আমরা এ কথা বলে ঠিক কাজ করি যে মঙ্গলময় জীবন প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এটা পরিষ্কার যে, কোন গোষ্ঠীর সংহিতা কখনই চরম এবং যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাকে এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরীক্ষা করে অবশ্যই দেখতে হবে যে সেখানে কোন প্রজ্ঞা এবং বদান্যতাকে রায় হিসেবে জারি করা হয়েছে কিনা। নৈতিক সংহিতা সর্বদা দোষমুক্ত নয়। সূর্যের আলো কমে যাবে এই ভয়ে মানুষের মাংস খেয়ে অ্যাটেক জাতিরা মনে করে যে এটা তাদের একটা যন্ত্রণাদায়ক কর্তব্য। তারা ভুল করে থাকে তাদের বিজ্ঞান বোধে এবং সম্ভত যদি তারা প্রদত্ত বলিকে ভালবাসতে পারত তবে তারা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক ভুলটিকে অনুভব করতে পারত। কোন কোন উপজাতি ১০ থেকে ১৭ বছর বয়স্ক মেয়েদের অন্ধকারে কয়েদ করে রাখে। তারা এই কাজ করে এই ভয়ে যে, সূর্যরশ্মির দ্বারা তারা গর্ভবতী হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অবশ্যই আমাদের আধুনিক নৈতিক সংহিতায় এইরকম আইনের সদৃশ কোন আইন পাওয়া যাবে না যে আইনগুলি অসভ্য জাতিরা ব্যবহার করে থাকে। নিশ্চয়ই আমরা শুধুমাত্র সেই সব আইনকে নিষিদ্ধ করব যারা সত্যই ক্ষতিকারক, অথবা এতটাই জঘন্য যা কোন সুন্দর মানুষ সমর্থন করতে পারে না? আমি অবশ্য এ ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত নই।


বর্তমান নৈতিকতা উপযোগবাদ ও কুসংস্কারের অদ্ভুত মিশ্রণ কিন্তু কুসংস্কারের অংশটি শক্তিশালী। এটাই স্বাভাবিক, যেহেতু কুসংস্কার নৈতিক শাসনের উৎস (….. superstition is the origin of moral rules.)। প্রকৃতপক্ষে কোন কোন কার্যকে এমন কার্যরূপে ভাবা হয়েছিল যা ভগবানের কাছে নিরানন্দজনক এবং সেইসব কাজকে আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করা হল কারণ স্বর্গীয় ক্রোধ কেবলমাত্র অপরাধী ব্যক্তিদের জন্যই নামবে না, তা সমগ্র গোষ্ঠীর উপরই নেমে আসবে। এখান থেকেই পাপের ধারণার উন্মেষ এবং পাপ ভগবানের কাছে নিরানন্দজনক। কোনরকম যুক্তিকে স্থির করা যায়নি যে কেন কোন কোন বিশেষ কার্য এরকম নিরানন্দজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, এটা বলা খুব সত্যি যে কেন ছাগল-মায়ের দুধে ছাগলছানাকে ফোঁটানোটা নিরানন্দজনক। কিন্তু বাইবেলের শেষ গ্রন্থে এরকম ধরণের ঘটনার কথাই বলা হয়েছে। কখনও কখনও স্বর্গীয় আদেশসমূহকে অদ্ভুতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শনিবার আমাদের কাজ না করতে বলা হয়েছে এবং প্রোটেস্টান্টরা তার অর্থ করে নিলো যে রবিবারগুলোতে আমাদের খেলা করা উচিত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও পুরোনো নিষেধাজ্ঞার মতোই সেই একই মহান কর্তৃত্ব নব্য নিষেধাজ্ঞায় অর্পিত হল।


প্রমাণ করা যায় যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন একজন ব্যক্তি শাস্ত্রের উপদেশ অথবা চার্চের শিক্ষাকে ভয় পেয়ে চলবার অনুমতি নিজেকে প্রদান করে না। সে এ ধরণের কথা বলে প্রশান্তি লাভ করে না যে, ‘এই-এই ধরণের কাজ পাপমূলক এবং তা মৃত্যুকে ডেকে আনবে।’ সে খোঁজ করবে আদৌ এই ধরণের কাজ কোন ক্ষতি করবে কিনা অথবা, একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে বলা যায়, সে খোঁজ চালাবে যেটিকে পাপ বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে সেটি আদৌই ক্ষতিকারক কিনা। সে দেখায় যে, বিশেষত যে-সব বিশ্বাসগুলি যৌনতার সঙ্গে জড়িত, সেগুলি আমাদের বর্তমান নৈতিকতার বেশিরভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে এবং তার বেশিরভাগ অংশের উৎসই হল পুরোপুরি ভাবে কুসংস্কার। সে এ-ও দেখতে পাবে যে অ্যাজটেকদের কুসংস্কারের মতো যে-সব কুসংস্কার অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হয় সেগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করা যায় যদি জনসাধারণ তাদের প্রতিবেশীদের প্রতি দয়ার্দ্র অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু ঐতিহ্যমূলক নৈতিকতা রক্ষা করা। কদাচিৎ উষ্ণ হৃদয়সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়, যার প্রমাণ গীর্জার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সৈন্যবাদের প্রদর্শনের প্রতি ভালোবাসা। একজন এটা ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে যে তারা নৈতিক নিয়মগুলোকে মূল্য দেয় এই কারণে যে তা যন্ত্রণাকে আরোপ করার জন্য তাদের আকাক্ষার বাইরে বেরিয়ে আসার বৈধ উপায়। পাপী-পাপী খেলাটা বড় সুন্দর যাকে সহ্যশক্তির দ্বারা ধরে রাখা যায়।


আসুন কবরের কল্পনা থেকে সাধারণ মানুষের জীবনকে আমরা বোঝায় চেষ্টা করি। আমরা লক্ষ্য রাখবো সেইসব দিকগুলোতে যেখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নৈতিক নিয়মগুলো প্রতিকারমূলক যন্ত্রণাকে আরো করে। যে কারণে আমি কল্পনা দিয়ে শুরু করেছি তা হল, এখানে কুসংস্কারের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদি বাবা-মা বিবাহিত না হয় তবে তা শিশুর কলঙ্ক, এ ধরণের মনোভাব সম্পূর্ণ অমূলক। যদি বাবা বা মায়ের যে-কোন কারুর যৌন রোগ থাকে, তাহলে শিশুর মধ্যেও সেই রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি তাদের বহু সন্তান থাকে তবে সেখানে অনাহার, দারিদ্র্য, অতিজনসংখ্যাজাত ভার এবং সেই অনুযায়ী অজাচার থাকবে। অতএব বেশির ভাগ নীতিবাদীরাই এই মত সমর্থন করে থাকেন যে বাবা-মায়েদের যা জানাই ভালো কিভাবে প্রতিকারমূলক কল্পনার দ্বারা এই শোচনীয় অবস্থাকে প্রতিরোধ করা যায় (এটা সৌভাগ্যক্রমে বেশিদিন সত্য থাকেনি। প্রোটেস্টান্ট এবং ইহুদিদের বেশিরভাগ নেতারা এখন জন্মনিয়ন্ত্রণে। আপত্তি করে না। ১৯২৫ সালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাসেলের বিবৃতি যথার্থভাবে নিখুঁত বর্ণনা। এটা অবশ্যই তাৎপর্যমূলক যে, একটি কিংবা দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া, জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ প্রধান প্রচারকরা, যেমন– ফ্রান্সিস প্লেস, রিচার্ড কারলাইল, চালর্স নলটোন, চালর্স ব্র্যাডলাফ এবং মারগারেট স্যাঙ্গার– এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বাধীন চিন্তাবিদ–সম্পাদকীয় টীকা)। এইসব নীতিবিদদের খুশী করতে গিয়ে অত্যাচারিত জীবনে সংগ্রাম লক্ষ লক্ষ মানবের উপর আরোপিত হয়েছে যাদের কখনও বেঁচে থাকা উচিত নয়, শুধুমাত্র এই কারণে যে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া যে-কোন রকম যৌন সঙ্গম একটা পাপ। কিন্তু সেই সব সন্তানদের হতভাগ্য বানাবার জন্য যে যৌন আকাঙ্ক্ষা বর্তমানে নির্বিচারে চলছে তা পাপের নয়। কারুকে হঠাৎ খুন করো এবং তারপর খাও, যা অ্যাজটেকদের বলি-প্রদত্ত ব্যক্তির ভাগ্য ঘটে, তা সেই শিশুর উপর আরোপিত অত্যাচারের থেকে অনেক কম যে শিশুটি এই শোচনীয় পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যৌন রোগের দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। অতএব নৈতিকতার নামে রাজনীতিবিদ ও বিশপদের দ্বারা আরোপিত অনবরত অত্যাচার আরও ভয়ঙ্কর। যদি শিশুদের জন্য তাদের ভেতরে এতটুকুও প্রেমের বিচ্ছুরণ থাকত, থাকত করুণা, তবে তারা সেইসব নৈতিক আইনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারতেন না, যে আইনগুলো জঘন্য নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যুক্ত।


জন্মের সময় এবং শৈশবে, গড়ে সব শিশুই কুসংস্কারের চেয়ে অর্থনৈতিক কষ্টে বেশি ভোগে। যখন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাদের সন্তান হয়, তখন থেকে তাদের জন্য থাকে অনেক ভালো ডাক্তার, ভালো নার্স, ভালো পথ্য, ভালো বিশ্রাম এবং ভালো ব্যায়াম। কিন্তু শ্রমজীবী মহিলারা এই ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায় না এবং তাদের শিশুরা মারা যায় ওই সব সুযোগ-সুবিধার অভাবে। জনগণের কর্তৃপক্ষ মায়েদের যত্ন নেবার ক্ষেত্রে খুবই কম কাজ করে এবং যাও বা করে তা নিতান্তই ক্রোধান্বিত হয়েই করে। একই সময়ে খরচ কমাতে যখন তারা মায়েদের সেবার জন্য বরাদ্দ্য দুধের যোগান বন্ধ করে দেয়, তখন কম গাড়ি ঘোড়ার ভীড়সম্পন্ন স্থানে বিলাসবহুল বাড়িতে থাকবার জন্য তারা বিরাট পরিমাণ টাকা খরচ করে থাকে। এটা তারা অবশ্যই জানে যে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা শ্রমজীবী শ্রেণীর বেশকিছু সংখ্যক শিশুকে দারিদ্রের অপরাধের নামে মৃত্যুদণ্ডে অভিযুক্ত করে থাকে। এই জন্যেই আমরা দেখি শাসক দল প্রচুর পরিমাণ ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের দ্বারা সমর্থিত হয়ে থাকে, যারা তাদের মাথার উপর পোপকে রেখে সামাজিক অবিচারকে সমর্থন করতে জগতের সমস্ত কুসংস্কারের বিরাট ক্ষমতার পক্ষে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে।


শিক্ষার সমস্ত স্তরেই কুসংস্কারের প্রভাব ধ্বংসাত্মক। কিছু শতাংশ শিশুর স্বভাব চিন্তা করা। শিক্ষার অনেকগুলি লক্ষ্যের মধ্যে একটি লক্ষ্য হল তাদেরকে এই ধরণের চিন্তার রোগ থেকে সারিয়ে তোলা। অসুবিধাজনক প্রশ্ন তাদের চুপ চুপ করে কিংবা শাস্তি পেয়ে করতে হয়। সমষ্টিগত আবেগকে ধীরে ধীরে এক বিশেষ ধরণের বিশ্বাসে পরিণত করার কাজে লাগানো হয়, বেশি কাজে লাগানো হয় জাতীয়তা ধরণের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রের পুঁজিপতি, সেনাবাদী ও গীর্জার পুরোহিতরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে সমবায় গড়ে তুলেছে। কেননা ক্ষমতার জন্য এদের সবাই আবেগবাদের ব্যাপকতা ও চুলচেরা বিচারের অপ্রতুলতার উপর নির্ভর করে থাকে। মানবিক প্রকৃতির সাহায্যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরণের প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলা ও তাদেরকে তীব্র করে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা সফলতা পেয়ে থাকে।


অন্য যে পথে কুসংস্কার শিক্ষার ক্ষতি করে থাকে সেটা হল শিক্ষক নির্বাচনের– উপর এদের প্রভাব। অর্থনৈতিক কারণের জন্য একজন মহিলা-শিক্ষক অবশ্যই বিবাহিত হবেন না এবং নৈতিক কারণের জন্য তাঁর বিবাহিত জীবনের বাইরে কোন অতিরিক্ত যৌন সম্পর্ক গড়ে অবশ্যই উঠবে না। এইজন্য যারা বিষণ্ণ তার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করার কষ্ট স্বীকার করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, নিয়ম হিসেবে একটি দীর্ঘকুমারীত্ব একজন মহিলার পক্ষে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর এবং এটা এতটাই ক্ষতিকর যে কোন সুস্থ সমাজে শিক্ষকদের এই ব্যাপারে বারবার নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ যত বেশি হয়ে ওঠে ততই উদ্যোগী ও প্রাণবন্ত মহিলারা শিক্ষকের পেশায় ঢুকতে অস্বীকার করে। এটা ঘটে থাকে কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৃতাবাদের বিরক্তিজনক প্রভাবে।


মধ্য এবং উচ্চ শ্রেণীর বিদ্যালয়গুলিতে ব্যাপারটি আরও বাজে আকার ধারণ করে। সেখানে দেখা যায় ভজনালয়ের কার্য এবং যাজক শ্রেণীর হাতে নৈতিক চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি রাখার ক্ষমতা। নৈতিকতার শিক্ষকদের মতোই যাজক শ্ৰেণীও প্রায় অবশ্যম্ভাবীরূপে এই দুই দিক থেকেই ব্যর্থ হয়ে থাকে। তারা সেইসব কাজকে নিন্দা করে যে কাজগুলো কোন ক্ষতি করে না এবং তারা সেইসব কাজকে ক্ষমা করে থাকে, যে কাজগুলো বিরাট ক্ষতি করে। তারা সবাই সেইসব, অবিবাহিত মানুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে নিন্দা করে থাকে যারা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত কিন্তু এমন নিশ্চিত নয় যে তারা সারা জীবন পরস্পর একসঙ্গে থাকতে চাইবে। তাদের বেশিরভাগ অংশই জন্মনিয়ন্ত্রণকে নিন্দা করে থাকে। কিন্তু তাদের কেউই সেই স্বামীর পশুত্বকে নিন্দা করে না যে তার স্ত্রীকে বারবার গর্ভবতী করে তার মৃত্যুর কারণ হয়। আমি বাতিকগ্রস্ত একজন যাজককে চিনতাম যার স্ত্রীর ন’বছরে নটি সন্তান হয়েছিল। ডাক্তাররা তাকে বলেছিল যদি তার আর একটি সন্তান হয় তবে সে মারা যাবে। পরের বছর তার আর একটি সন্তান হল এবং সে মারা গেল। কারুর কোন নিন্দা হল না, এবং সেই যাজক তার বৃত্তিতে রয়ে গেল এবং আবার বিয়ে করল। যতদিন এই ধরণের যাজকরা নিষ্ঠুরতাকে ক্ষমা প্রদর্শন করবে এবং নিষ্পাপ আনন্দকে করবে নিন্দা, ততদিন তারা যুবজনতার নৈতিকতার অভিভাবক হিসেবে কেবল ক্ষতিই করতে পারবে।


শিক্ষার উপর কুসংস্কারের অন্য আর একটি মন্দ প্রভাব হল যৌন ঘটনা সম্পর্কে নির্দেশের অনুপস্থিতি। বয়ঃসন্ধি আসার আগে যখন তারা উত্তেজিত অবস্থায় থাকে না তখন এ বিষয়ে তাদের সহজ ও স্বাভাবিকভাবে প্রধান মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাগুলোকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। বয়ঃসন্ধিকালে, কুসংস্কারমুক্ত যৌন নৈতিকতার উপকরণ গুলিকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। ছেলেমেয়েদের এই বলে শিক্ষা দেওয়া উচিত যে যদি পরস্পরের বন্ধুত্বমূলক আগ্রহ না থাকে তবে কোনরকম যৌন সঙ্গমকে সুবিচার বলা যেতে পারে না। এই ধরণের চিন্তা গীর্জাগুলোর শিক্ষার বিপরীত। তারা এই মত পোষণ করে যে, যদি দুজন বিবাহিত হয় এবং পুরুষমানুষটি যদি অন্য আরও একটি সন্তান চায়, তবে স্ত্রীর শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌন সঙ্গম বৈধ। ছেলেমেয়েদের অবশ্যই পরস্পরের স্বাধীনতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া উচিত। তাদের অবশ্য এই অনুভব করতে সমর্থ করে তোলা উচিত যে হিংসা ও সংকীর্ণ অধিকারবোধ প্রেমকে হত্যা করে। শিক্ষা দেওয়া উচিত যে, অপর একটি মানুষকে পৃথিবীতে নিয়ে আসাটা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং তখনি তাকে নিয়ে আসার কথা ভাবা যেতে পারে যখন শিশুটির জন্য যৌক্তিক ভবিষ্যৎ, সুস্থ পরিবেশ এবং বাবা-মায়ের তাকে যত্ন করার ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া উচিত এটা নিশ্চিত করতে যে শিশু কেবলমাত্র তখনি আসবে যখন তারা কাক্ষিত হবে। পরিশেষে, তাদেরকে যৌন রোগ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে তার প্রতিকার ও আরোগ্যের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত। এইভাবে যৌন শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানবিক সুখকে বাড়িয়ে তোলার সম্ভাবনা প্রচুর।


যেখানে শিশু জন্ম নেবে না এই রকম বিষয়ে বা পরিস্থিতিতে যৌন সম্পর্ককে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, যা রাষ্ট্র কিংবা প্রতিবেশী কারুরই ভাববার বিষয় নয়। এমন কিছু যৌন ক্রিয়াকলাপ আছে যেগুলো কখনই শিশুর জন্ম দেয় না, সেগুলো বর্তমানে অপরাধের আইনের দ্বারা দণ্ডিত। এই ধরণের ঘটনা সম্পূর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কেননা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দু’জন মানুষ ছাড়া ব্যাপারটা কারুকেই প্রভাবিত করে না। যে ক্ষেত্রে শিশুরা থাকে, সেখানে এটা মনে করাটা ভুল হবে যে তাদেরই প্রয়োজনে বিবাহ-বিচ্ছেদ করাটাকে প্রয়োজনীয় ভাবা খুবই কষ্টকর। আচরণগত অন্ধকার, নিষ্ঠুরতা, পাগলামি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে শিশুদের জন্যেই স্বামী কিংবা স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এব্যাপারে ব্যভিচারের উপর যে অদ্ভুত ধরণের গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটা পরিষ্কার যে বিবাহিত জীবনের সুখ সম্পর্কে যে-কোন ধরণের অন্যায় আচরণ সাধারণ ছোটখাট ব্যভিচারের থেকে বিরাটভাবে ক্ষতিকর। বছরে একটি করে শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য পুরুষের জোর খাটানো প্রথাগত ভাবে অন্যায় আচরণ নয় কিংবা নিষ্ঠুরতা নয়, কিন্তু সব থেকে বড় ক্ষতিকারক।


নৈতিক নিয়মগুলো এমন হওয়া উচিত নয় যেখানে প্রবৃত্তিমূলক সুখ অসম্ভব হয়ে ওঠে। যেমন–যে গোষ্ঠীতে একবিবাহ নীতির প্রভোব দৃঢ়ভাবে আছে সেখানে দুটি যৌন সম্পর্ক খুবই অসমানুপাতিক। যদিও এই পরিবেশের অধীনেই নৈতিক নিয়মগুলো লজ্জিত হয়ে থাকে। কিন্তু নিয়মগুলি এমনি যে তারা কেবল মান্যতা লাভ করতে পারে গোষ্ঠীর অবনতিসম্পন্ন সুখের থেকে এবং যখন তাদেরকে মেনে চলার থেকে লঙ্ন করাটাই শুভ হয়ে থাকে তখন বুঝে নিতে হবে যে এটাই নিশ্চিতভাবে সেই সময় যখন নিয়মগুলোর পরিবর্তন ঘটে গেছে। যদি এটা না ঘটে, তবে এটা বুঝতে হবে বহু মানুষ যারা জনগণের আগ্রহের বিপরীত পথে তাদের কাজ চালাচ্ছেন তারা ভণ্ডামি বা তেরছা পথের বিকল্প স্বরূপ অযৌক্তিক পথের সম্মুখীন হচ্ছেন। ভণ্ডামিকে গীর্জা কিছু মনে করে না, কেননা তা গীর্জার ক্ষমতার সমীপে ছিনাল অঞ্জলি। কিন্তু অন্যান্য জায়গায় এটাকে অশুভ বলে প্রতিপন্ন করা হয় যাকে হাল্কাভাবে ধরা উচিত নয়।


ঈশ্বরভিত্তিক কুসংস্কারগুলির চাইতেও জাতীয়তা ভিত্তিক কুসংস্কারগুলি আরও বেশি ক্ষতিকর। এই কুসংস্কারগুলি এরকম কথা বলে থাকে, যে কর্তব্য কেবল নিজের দেশের জন্যই কর, অন্য কোন দেশের জন্য কর না। কিন্তু একজনের স্বাদেশিকতার সীমার বাইরে আঙুল তুলে আমি এই আলোচনা করার প্রস্তাব করব না যে স্বাদেশিকতা প্রেমের আদর্শের ঠিক বিপরীত, যে আদর্শকে আমরা মঙ্গলময় জীবন গঠনের জন্য স্বীকার করে নিয়েছি। যদিও এটা আলোকিত আত্ম-স্বার্থের বিপরীত, যেহেতু একটিও গোঁড়া জাতীয়তাবাদ বিজয়ী জাতিগুলিকেও ছাড়ে না।


অন্য আর একটি দিকে যেখানে আমাদের সমাজ ‘পাপ’-এর শাস্ত্রীয় ধারণার দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে থাকে সেটি হল অপরাধীর প্রতি আচরণ। অপরাধীরা দুষ্ট এবং শাস্তির যোগ্য। এটা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না যাকে যৌক্তিক নৈতিকতা সমর্থন করতে পারে। নিঃসন্দেহে কিছু পরিমাণ মানুষ সেই সমস্ত কাজ করে থাকে যে কাজগুলোকে সমাজ বাধা দিতে চায় এবং সমাজ তাদের যতদূর সম্ভব বাধা দিয়ে সঠিক কাজই করে। সহজ উদাহরণস্বরূপ আমরা কোন খুনের ঘটনাকে নিতে পারি। স্পষ্টতই যদি একটি গোষ্ঠী পরস্পরের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং যদি সেই বন্ধনযুক্ত আবদ্ধিত গোষ্ঠী থেকে আমাদের আনন্দ ও সুযোগ সুবিধা। নিতে হয় তবে আমরা পরস্পরকে খুন করার অনুমতি জনগণকে দিতে পারি না, কিন্তু তারা এই ধরণের কাজ করবার তাড়নাই অনুভব করে থাকে। কিন্তু এই ধরণের সমস্যাকে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক চেতনার দ্বারা দেখা উচিত। সহজভাবে আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত : খুন বন্ধ করবার সব থেকে উত্তম পদ্ধতিটি কী? দুটি পদ্ধতির মধ্যে দুটিই খুন বন্ধ করার ক্ষেত্রে সমান ফলপ্রসূ। এদের মধ্যে যেটি খুনীর জন্য খুব কম ক্ষতিকারক সেটিকে বেছে নিতে হবে। খুনীর ক্ষতি করাটা শল্যচিকিৎসা প্রসূত যন্ত্রণার মতোই সম্পূর্ণভাবে দুঃখজনক। তা দু’ক্ষেত্রেই সম্ভবত সমানভাবে প্রয়োজনীয় হলেও এটা কোন আনন্দের বিষয় নয়। যে নিষ্ঠুর অনুভূতিকে ‘নৈতিক অবিচারজনিত রাগ বলা হয় তা শুধুমাত্র এক প্রকার নিষ্ঠুরতা কেবলমাত্র নিষ্ঠুর শাস্তির দ্বারাই অপরাধীকে কষ্ট দেওয়াটা কখনও কোন সুবিচার হতে পারে না। যদি শিক্ষা কোমলতার সঙ্গে মেশে তবে তা সমানভাবে কার্যকরী এবং এটাকেই বাঞ্ছনীয় বলা যায়। এটা যদি আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে তবে তা আরও বেশি বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠবে। যদিও অপরাধের প্রতিকার ও অপরাধের শাস্তি দুটি ভিন্ন ধরণের প্রশ্ন। অপরাধীকে যন্ত্রণা প্রদানের কারণ অনুমান সাপেক্ষে প্রতিকারমূলক। যদি কয়েদখানাকে এতটাই মানবিকীকরণ করে তোলা যেত যে সেখানে কয়েদিরা শুধুই শুভ শিক্ষা পেত তবে মানুষ সেই কয়েদখানায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্যই কেবল অন্যায় করত। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার চেয়ে কয়েদখানা অবশ্যই নিরানন্দজনক। কিন্তু ফলাফলকে নিশ্চিত করবার জন্য সব থেকে উত্তম পথটি হল স্বাধীনতাকে আরও বেশি আনন্দজনক করে তোলা সেই স্বাধীনতার চেয়ে যে স্বাধীনতা বর্তমানে কখনও কখনও মেলে। দণ্ডমূলক আইনের সংস্কার সাধন বিষয়ে আমি আমার জাহাজ ভেড়াতে চাই না। আমি শুধু এই উপদেশ দিতে চাই যে আমরা প্লেগ রোগে আক্রান্ত রুগিকে যেমন ভাবে দেখি তেমন ভাবেই একজন অপরাধীকে আমাদের দেখা উচিত। এরা দুজনেই জনগণের পক্ষে বিপজ্জনক এবং যতদিন পর্যন্ত বিপজ্জনক থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাদের স্বাধীনতাকে অবশ্যই খর্ব করে রাখা দরকার। কিন্তু যে মানুষটি প্লেগ রোগে আক্রান্ত সে সহানুভূতি ও অনুকম্পার বিষয় এবং সেখানে। অপরাধী অভিশাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এটা হয়ে থাকে আচরণগত বিভেদের জন্য। যেখানে আমাদের কয়েদখানা গুলো অপরাধীদের প্রবণতাকে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ সেখানে আমাদের হাসপাতাল রোগকে সারিয়ে তুলছে।


(৪) মুক্তি : ব্যক্তিগত ও সামাজিক


ঐতিহ্যবাহী ধর্মের অনেকগুলি ত্রুটির মধ্যে একটি হল তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নৈতিকতার সঙ্গে এই ক্রটি যুক্ত। ঐতিহ্যবাহিকতার দিক দিয়ে, ধার্মিক জীবন পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী, আত্মা ও ঈশ্বরের কথোপকথন ছিল। ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে চলাটাই ছিল পুণ্যের এবং গোষ্ঠীর অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ব্যক্তির পক্ষেই এটা সম্ভবপর ছিল। প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠী মুক্তির উপায়-এর ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছিল কিন্তু খ্রীষ্টীয় শিক্ষায় এই ব্যাপারটি সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। স্বতন্ত্র আত্মার এই ধরণের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ইতিহাসের বিশেষ স্তবগুলোতে মূল্য পেয়েছিল কিন্তু আধুনিক জগতে আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মঙ্গলের ধারণার থেকে সামাজিক মঙ্গলের ধারণা করা অনেক বেশি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমি এই বিবেচনা করে দেখাতে চাই যে কিভাবে এই বিষয়টি মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রভাবিত করে থাকে।


রোম সাম্রাজ্যে সেই সমস্ত জনগণের মধ্যে খ্রীষ্টীয়বাদ জেগে ওঠে যারা তাদের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে বসেছিল, যাদের জাতীয় রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং এক বিরাট ব্যক্তিত্বহীন সমষ্টিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। খ্রীষ্টীয় যুগে প্রথম তিন শতাব্দী ধরে যে-সব ব্যক্তি খ্রীষ্টীয়বাদকে গ্রহণ করেছিল তারা তৎকালীন যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বাস করত, সেইসব রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ফুটোফাটাগুলোকে পরিবর্তন করতে পারেনি, যদিও তারা তাদের বাজে দিকটির সম্পর্কে মৌলিকভাবে স্বীকার করে গেছে। এই পরিবেশ গুলোতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে তারা এই ধরণের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে ছিল যে একটি অযথার্থ জগতে একজন ব্যক্তি যথার্থ হয়ে উঠতে পারে এবং এই জন্যেই একটি মঙ্গলময় জীবনের এই জগতের সঙ্গে কোন কাজ থাকতে পারে না। যা আমি বলতে চাইছি তা প্লেটোর ‘রিপাব্লিক’ গ্রন্থের তুলনায় সরল। যখন প্লেটো মঙ্গলময় জীবনের বর্ণনা করতে চেয়েছেন, তখন তিনি সমগ্র গোষ্ঠীকে বর্ণনা করেছেন, কখনই একজন ব্যক্তিকে বর্ণনা করেননি। তিনি এটা করেছিলেন ন্যায় বিচারকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তিনি প্রজাতন্ত্রের নাগরিকত্বে অভ্যস্ত ছিলেন এবং নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণকে সমর্থেন করেছিলেন গ্রীস স্বাধীনতা হারাবার সঙ্গে সঙ্গে স্টোয়িকবাদের উন্মেষ হয় যেটা অনেকটা খ্ৰীষ্টীয়বাদের মতোই এবং প্লেটোর আদর্শের সঙ্গে যার মিল নেই, কেননা তারা মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতামূলক ধারণা গ্রহণ করেছিল।


আমরা যারা বিরাট গণতন্ত্রগুলোতে বসবাস করি তাদের দেখা উচিত যে স্বেচ্ছাচারী সাম্রাজ্যবাদী রোমের তুলনায় স্বাধীন এথেন্সে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত নৈতিকতা ছিল। ভারতবর্ষে, যেখানে রাজনৈতিক পরিবেশ খ্রীষ্টের সময় জুডিয়ার দেশগুলোর মতো সমানুপাতিক ছিল, সেখানে আমরা দেখবো গান্ধী খ্রীষ্টের নৈতিকতার মতোই সমনৈতিকতা প্রচার করছেন এবং এইজন্য তাঁকে পন্টিয়াস পাইলেটের খ্ৰীষ্টধর্মে দীক্ষিত উত্তরাধিকারদের হাতে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ব্যক্তির মুক্তিতেই সন্তুষ্ট ছিল না, তারা চেয়েছিল জাতীয় মুক্তি, এর জন্য তারা পাশ্চাত্যের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি এই পরামর্শ দিতে চাই যে এইসব ক্ষেত্রগুলোতে এই দৃষ্টিভঙ্গী খ্রীষ্টীয়বাদের প্রভাবে এখনো আত্ম-সচেতন ও সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি, এবং এখনো তা ব্যক্তির মুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য বিঘ্নিত হচ্ছে।


মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে আমরা যেমন ধারণা করি, তা বহু সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এবং এগুলো ছাড়া এই ধারণাকে বুঝে ওঠা যায় না। আমরা আগেই বলেছি যে মঙ্গলময় জীবন প্রেম ও জ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অর্জিত জ্ঞান সেখানেই বিদ্যমান থাকতে পারে যেখানে সরকার ও কোটিপতিরা এই ধারণার আবিষ্কার ও তার সম্প্রসারণের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সারের প্রসারণ আশঙ্কাজনক আমাদের এ সম্পর্কে কি করা দরকার? এক মুহূর্তে কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না কেবলমাত্র জ্ঞানের অভাবে। বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে গবেষণা ছাড়া এই জ্ঞানের উন্মেষ সম্ভব নয়। আবার, সেইসব মানুষ যারা এর উত্তর চাইছে তাদের বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য এবং কলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন। এরজন্য জনগণের কর্তৃপক্ষসমূহের বিশদ বিন্যাসের প্রয়োজন। কেবলমাত্র ধর্মীয় কথোপকথনের দ্বারা অর্জনের বিষয় এটি নয়। এছাড়াও বিদেশ ব্যবসা আছে যেটা ছাড়া গ্রেট ব্রিটেনের অর্ধসংখ্যক অধিবাসী অনাহারে থাকবে এবং যদি আমরা অনাহারে থাকি তবে আমাদের মধ্যে কতিপয় মানুষ মঙ্গলময় জীবন কাটাতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে আরও অনেক দৃষ্টান্ত অপ্রয়োজনীয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যে, সমস্ত ক্ষেত্রে যা মঙ্গলময় জীবনের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করে, সেখানে সমগ্র জগৎ একটি ঐক্যরূপ লাভ করে। কিন্তু সেই মানুষ যে স্বাধীন জীবনের ভান করে ঘুরে বেড়ায় সে সচেতন অথবা অসচেতন পরজীবী ছাড়া আর কিছুই নয়।


ব্যক্তিমুক্তির ধারণা, যাকে সঙ্গে নিয়ে পুরাতন খ্রীষ্টীয়বাদীরা তাদের রাজনৈতিক পরাধীনতার জন্য নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে রাখতো, তা সত্বর অসম্ভব হয়ে উঠলো যেই আমরা মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে খুব সংকীর্ণ ধারণা থেকে উঠে আসতে পারলাম। গোঁড়া খ্রীষ্টীয় ধারণা অনুযায়ী মঙ্গলময় জীবন হল পুণ্যবান জীবন। পুণ্য নির্ভর করে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে মেনে চলার উপর এবং প্রতিটি ব্যক্তির কাছে ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যক্ত হয়ে থাকে তাদের বিবেকের কণ্ঠস্বরের দ্বারা। মানুষ সম্পর্কে এই ধরণের ধারণা একটি বিদেশী স্বৈরাচারবাদের বিষয়ে। একটি মঙ্গলময় জীবন ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে বেশি যুক্ত উদাহরণস্বরূপ, বুদ্ধি। বিবেক সব থেকে বেশি ভ্রান্ত পথনির্দেশক, যেহেতু এটি অতি যুবক বয়সের শোনা উপদেশগুলির অস্পষ্ট স্মরণ, অতএব বিবেক কখনই পালনকারিণী মা বা ধাত্রীর জ্ঞানের থেকে বড় নয়। সঠিকভাবে একটি মঙ্গলময় জীবন কাটাতে গেলে মানুষের অবশ্যই ভালো শিক্ষা থাকা আবশ্যক, বন্ধুবান্ধব, প্রেম, সন্তানাদি (যদি সে তাদের আকাঙ্ক্ষা করে) আবশ্যক। চাহিদা ও গভীর উদ্বেগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চাই যথেষ্ট উপার্জন, উন্নত স্বাস্থ্য এবং কর্ম। এই সমস্ত জিনিস, বিভিন্ন মাত্রায় গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে এবং রাজনৈতিক ঘটনার দ্বারা বাধা পায় কিংবা সাহায্য পায়। একটি মঙ্গলময় জীবন একটি মঙ্গলময় সমাজেই কাটানো যায়, অন্যথায় আর অন্য কোন জায়গায় সম্ভব নয়।


সম্ভ্রান্তশ্রেণীর আদর্শে এটাই একটা মৌলিক ক্রটি। কিছু কিছু মঙ্গলময় বস্তু, যেমন কলা বিজ্ঞান এবং বন্ধুত্ব সম্ভ্রান্ত সমাজে খুব ভালোভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে । দাসত্বের উপর ভিত্তি করে সম্ভ্রান্ত শ্রেণী গ্রীসে বিদ্যমান ছিল, শোষণের উপর নির্ভর করে তারা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আছে। কিন্তু প্রেম, সহানুভূতির আকারে, অথবা বদান্যতার আকারে, সম্ভ্রান্ত সমাজে বেঁচে থাকতে পারে না। সম্ভ্রান্তরা নিজেদেরকে এই বলে প্ররোচিত করে যে দাস অথবা সর্বহারা অথবা কালা আদমিরা কাদামাটির দ্বারা তৈরি, তাদের দুঃখ-কষ্ট কোন ব্যাপারই নয়। বর্তমান মুহূর্তে, সম্ভ্রান্ত ইংরেজ ভদ্রলোকরা আফ্রিকানদের এতবার চাবুক মারে যে তারা অব্যক্ত মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় কয়েক ঘন্টার পরেই মারা যায়। এমনকি যদি এই ভদ্রলোকেরা উচ্চশিক্ষিতও হয়ে থাকে, কিংবা তারা শিল্পীসুলভ এবং প্রশংসনীয় বাগ্মীও হয়, তা হলেও আমি এটা স্বীকার করে নিতে পারি না যে তারা কোন মঙ্গলময় জীবন অতিবাহিত করছে। মানবিক প্রকৃতি সহানুভূতির ক্ষেত্রে কিছু সীমা আরোপ করেছে, কিন্তু সংকুচিত করেনি। গণতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন সমাজে, কেবলমাত্র পাগলই এইভাবে আচরণ করতে পারে। সম্ভ্রান্তদের আদর্শে সহানুভূতির যে সীমাটি দেখা যায় সেটি হল দণ্ড। মুক্তি সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর একটি আদর্শ, কেননা এটি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা। এই কারণে ব্যক্তিগত মুক্তির ধারণা, যাকে যতই ব্যাখ্যা করা হ’ক কিংবা প্রসারিত করা হ’ক না কেন, কখনও মঙ্গলময় জীবনের কোন ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে না।


মুক্তির অন্য বৈশিষ্ট্যটি হল যে এটি সাধু পলের কথোপকথনের মতোই মহা আকস্মিক পরিবর্তনে পর্যবসিত হয়। শেলীর কবিতাগুলোতে সমাজের উপর আরোপিত এই রকম ধারণার ছবি পাওয়া যায়–সময় যখন এসেছিল তখন প্রত্যেকেই পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল ও নৈরাশ্য ছেয়ে ফেলেছিল চারদিক এবং ‘জগতের সেই বিরাট যুগ নতুন হতে শুরু করেছিল। বলা যেতেই পারে যে একজন কবি গুরুত্বহীন মানুষ এবং যার ধারণাগুলো কোন ঘটনাই নয়। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বৈপ্লবিক নেতাদের একটি বিরাট অংশ শেলীর মতোই ধারণা পোষণ করতেন। তারা মনে করতেন যে স্বৈরাচারী, পুরোহিত অথবা পুঁজিপতি অথবা জার্মানরা যতরকম নিষ্ঠুরতা, যাতনা এবং হীনতা প্রাপ্তির জন্য দায়ী ছিল। এই কারণে এইসব দুষ্ট প্রভাবের উৎসগুলোকে যদি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় তবে হৃদয়ের একটি সাধারণ পরিবর্তন হবে এবং আমরা সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারব। এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে তাঁরা যুদ্ধের দ্বারা যুদ্ধকে শেষ করার ইচ্ছা পোষণ করে এসেছিলেন। তুলনামূলকভাবে তারাই সৌভাগ্যবান যারা পরাজয় বা মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন এবং তারাই দুর্ভাগা ছিলেন যারা জয়ের তিলক কপালে পরার পর বৈরাগী হয়ে পড়েছিলেন। এবং তাদের সমস্ত উজ্জ্বল আশাকে হারিয়ে হতাশার শিকার হয়েছিলেন। এই সমস্ত আশা গুলির উৎস ছিল খ্রীষ্টীয় মুক্তির পথ হিসেবে আকস্মিক মহা পরিবর্তনের তত্ত্ব।


আমি এই পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করি না যে বিপ্লব গুলি আর কখনই প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু আমি অবশ্যই এই পরামর্শ দেব যে সহস্রাব্দের মধ্যে বিপ্লবগুলি ঘটানো সোজা হবে না। মঙ্গলময় জীবন কোন সোজা পথ নয়, তা ব্যক্তিগত বা সামাজিক যাই হক না কেন। মঙ্গলময় জীবন গড়তে গেলে, আমাদের অবশ্যই বুদ্ধিকে গড়ে তুলতে হবে, গড়ে তুলতে হবে আত্ম-সংযম ও সহানুভূতিকে। এটা একটা পরিমাণগত বিষয় এবং একটি ক্রম-উন্নতির বিষয়, শৈশব শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়। কেবলমাত্র অধৈর্যই হঠাৎ উন্নতির সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাসকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলে। ক্রম-উন্নতি সম্ভব এবং যে পদ্ধতির দ্বারা এটি অর্জন করা সম্ভব তা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের বিষয়। এ সম্পর্কে যা বলা যেতে পারে তা আমি একদম শেষে আলোচনা করবার চেষ্টা করব।


(৫) বিজ্ঞান এবং সুখ


নীতিবিদদের উদ্দেশ্য হল মানুষের স্বভাবের উন্নতি ঘটানো। এটা একটি প্রশংসনীয় উচ্চাশা, যেহেতু তাদের স্বভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোচনীয়। কিন্তু আমি নীতিবিদদের কোন দিক থেকেই প্রশংসা করতে পারি না, সে তিনি একটি বিশেষ উন্নতিই চান কিংবা সেই বিশেষ উন্নতি অর্জন করবার জন্য যেসব পদ্ধতি তিনি গ্রহণ করেছেন তার জন্য। তাঁদের কৃত্রিম পদ্ধতি হল নৈতিক উপদেশ। তাদের বাস্তব পদ্ধতি (যদি তিনি গোঁড়া ধর্মাবলম্বী হন) একটি অর্থনৈতিক পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা। পূর্বেরটি স্থায়ী বা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে না। সাভোনারোলা থেকে আজ পর্যন্ত পুনরুত্থানবাদীদের প্রভাব সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী হয়ে এসেছে। কিন্তু পরেরটি অর্থাৎ পুরস্কার ও শাস্তি–উল্লেখযোগ্য প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, এই ব্যবস্থা একটি মানুষকে অস্থায়ী গৃহকত্রী অপেক্ষা পতিতাকে বেশি পছন্দ করতে বাধ্য করেছে, কারণ এমন একটি পদ্ধতিকে গ্রহণ করাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে যে পদ্ধতিকে অতি সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়। এইভাবেই তারা বহুসংখ্যক সাংঘাতিক পেশা গ্রহণ করেছে এবং যৌন রোগের ব্যাপকতাকে নিশ্চিত করেছে। নীতিবিদরা অবশ্যই এই ধরণের ঘটনা ঘটুক তা আশা করেননি। কিন্তু তারা ঘটনাটিকে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ অবৈজ্ঞানিক, কেননা উক্ত ঘটনাগুলি হল তাই যা সে বাস্তবে অর্জন করেছে।


ধর্ম প্রচার ও উৎকোচ গ্রহণের বৈজ্ঞানিক মিশ্রণের কোন প্রতিভূ আছে কি? আমি মনে করি আছে।


অজ্ঞতা বা মন্দ কামনাগুলি থেকেই মানুষের কর্মগুলি মন্দ হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যখন আমরা মন্দ’ কামনাগুলির কথা বলি, তখন সেই কামনাগুলিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে সেগুলো অপরের কামনাগুলোকে বাধা দিতে চায় অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, মন্দ কামনা বলতে সেই কামনাগুলিকে বোঝায় যেগুলো অনেক কামনাকে সাহায্য করার পরিবর্তে বাধা দিয়ে থাকে। অজ্ঞতা থেকে যে অনিষ্টকারী প্রভাবের সৃষ্টি হয় তাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। এখন একথা বলতে হয় যে জ্ঞানের সমৃদ্ধিই হল একমাত্র প্রয়োজনীয়। অতএব আরও বেশি শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যেই উন্নতির রাস্তা নিহিত আছে। কিন্তু অনিষ্টকারী প্রভাব যা মন্দ কামনাগুলির থেকে উত্থিত হয় তা বেশ দুরবগাহ বিষয়।


সাধারণ নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছু পরিমাণ সক্রিয় অপকার করবার ইচ্ছা থাকে। উভয়ের বিশেষ ধরণের অশুভ ইচ্ছা নির্দিষ্ট শত্রুদের দিকে পরিচালিত হয় এবং অপরের দুর্ভাগ্যকে দেখে তাদের সাধারণ নৈর্ব্যক্তিক আনন্দ বোধ হয়। সুন্দর সুন্দর শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে এই ঘটনাগুলিকে ঢেকে রাখাটা প্রচলিত প্রথা। প্রথাগত নৈতিকতার অর্ধেকটাই উক্ত ঘটনাগুলিকে ঢেকে রাখার বোরখা। যদি নীতিবিদদের লক্ষ্য অনুযায়ী আমাদের আচরণকে উন্নত করে তাকে বাস্তবায়িক করতে চাই তবে আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতেই হবে। এগুলোকে ছোট এবং বড় হাজার পথে দেখানো যেতে পারে। মানুষ বারবার কুৎসা রটাতে কিংবা তাকে বিশ্বাস করতে এক রকম আনন্দ পায়। অপরাধীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে তাকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায় এটা জানা সত্ত্বেও তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। সাদা চামড়ার জাতেরা নিগ্রোদের প্রতি অবিশ্বাস্য বর্বরতা সুলভ আচরণ করে থাকে। যেমন মহান আনন্দের সঙ্গে প্রজা, বৃদ্ধ, মহিলা এবং পুরোহিতরা যুদ্ধের সময় যুব জনতার সামরিক কর্তব্য কি হবে তা নির্দেশ করে। এমনকি শিশুরাও স্বৈরাচারী নিষ্ঠুরতার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ডেভিড কপারফিল্ড এবং অলিভার টুইস্ট কোনভাবেই কাল্পনিক নয়। এরকম সক্রিয় অনিষ্ট করার ইচ্ছা মানবিক চরিত্রের জঘন্য বৈশিষ্ট্য এবং জগৎকে যদি সত্যই সুখী করে তুলতে হয় তবে মানুষের এই জঘন্য বৈশিষ্ট্যকে অবশ্যই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সম্ভবত যুদ্ধের এটাই বড় কারণ। সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোকে এক সঙ্গে করলেও এত বড় কারণ হবে না।


অনিষ্ট করবার ইচ্ছাকে বাধা দেওয়ার সমস্যা তো দেখানো গেল এখন আমরা কিভাবে এর সঙ্গে আচরণ করব? প্রথমে এর কারণগুলিকে আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে। আমি মনে করি এগুলি হল আংশিকভাবে সামাজিক ও আংশিকভাবে শারীরবিদ্যা সম্বন্ধীয়। জগৎ আগের মতো এখনও জীবন-রণ। প্রতিযোগিতার উপর নির্ভর করে আছে। যুদ্ধের সময় যে প্রশ্নটি উঠেছিল সেটি হল অভাব ও উপবাসের হাতে মরবার জন্য কোন শিশুদের ছেড়ে দেওয়া উচিত জার্মান শিশুদের না মিত্রপক্ষের শিশুদের? (অনিষ্টের পেছনে দুপক্ষই সমান অথচ জীবিত থাকার সময় দুপক্ষের সমান অধিকার থাকবে না কেন তার কোন যুক্তি নেই।) বেশিরভাগ মানুষের মনের পেছনে ধ্বংসের ভীষণ ভীতি তাড়া করে ফেরে এবং এই ভয় সেই সব মানুষদের সব থেকে বেশি হয় যাদের বাচ্চাকাচ্চা থাকে। ধনীরা ভয় পায় যে বলশেভিকরা তাদের বিনিয়োগকে বাজেয়াপ্ত করে নেবে। দরিদ্র মানুষের ভয় যে তারা তাদের কর্ম হারাবে অথবা তাদের স্বাস্থ্য যাবে । প্রত্যেকেই নিশ্চয়তার পেছনে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়ে ভেবে নেয় যে প্রচ্ছন্ন শত্রুকে পদানত করে রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়। আতঙ্কের মুহূর্তগুলোতে নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা সব থেকে বেশি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। যে-কোন জায়গায় প্রগতি বিরোধী ব্যক্তিরা ভীতিকে উস্কে দেয়। ইংল্যান্ডে বলশেভিকবাদকে ভয় করা, ফ্রান্সে জার্মানিকে ভয় করা, জার্মানিতে ফ্রান্সকে ভয় করা। তাদের এই ধরণের ভীতির ফলে তারা যার বিরুদ্ধে নিজেদেরকে রক্ষা করতে চায় সেই বিপদটাই আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।


এই জন্য বৈজ্ঞানিক নীতিবিদদের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত, কিভাবে এই ভীতিকে রোধ করা যায়। এটি দুটো পথে সম্ভব। একটি হল নিশ্চয়তাকে ক্রমশ বাড়িয়ে এবং অপরটি হল সাহসকে বাড়িয়ে তুলে। আমি সেই ভীতির কথা বলছি যেটি একটি অযৌক্তিক ভাবাবেগ, কিন্তু কখনো একটি সম্ভাব্য দুর্ভাগ্যের যুক্তিপূর্ণ জ্ঞান সম্পর্কে কথা বলছি না। যখন কোন থিয়েটারে আগুন লাগে তখন একজন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মতো এক পূর্ণ যৌক্তিক মানুষ ধ্বংসকে আরো বেশি খুঁচিয়ে দেয়, কিন্তু সে একই সঙ্গে ধ্বংসলীলাকে কমিয়ে আনার পদ্ধতিগুলি আয়ত্ত করে। কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র একজন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৪ সালে ইউরোপে একটি নাট্যমঞ্চে আগুন ধরলে দর্শকমণ্ডলী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে কিন্তু তখন প্রয়োজন ছিল শান্ত থাকার। কর্তৃপক্ষের চেষ্টা ছিল কিভাবে দর্শকমণ্ডলী একে অপরকে পদদলিত করে পিষে না দিয়ে পরস্পর উদ্ধার পেতে পারে। ভিক্টোরিয়ার যুগে, হাজার বঞ্চনা সত্ত্বেও, মানুষ খুব দ্রুত অগ্রগতির দিকে পৌঁছেছিল। এর কারণ ছিল মানুষ তখন ভীতির থেকে আশার দ্বারা বেশি পরিচালিত হয়েছিল। যদি আমরা আবার সেই ধরণের অগ্রগতি ফিরে পেতে চাই তবে আবার আমাদের আশার দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।


যুদ্ধ প্রতিরোধের বেলাতেও ওই একই কথা খাটে, সে সম্মিলিত জাতিসংঘের মধ্যস্থতার দ্বারাই হক, অথবা অভাব-দারিদ্র মুছে ফেলার চেষ্টার মধ্য দিয়েই হ’ক। ওষুধপত্রের উন্নতির মধ্য দিয়ে সুপরিবেশের সৃষ্টি করে,স্বাস্থ্যকর স্থান সৃষ্টির দ্বারা আরও সুস্থ স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা তৈরি করার মধ্যে দিয়েও তা হতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য সেই সব ধরণের পদ্ধতির দ্বারাও মানুষের মনের অতল গভীরে লুকিয়ে থাকা ভীতি, যা যখন তারা ঘুমোতে যায় তখন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদের কাছে উঠে আসে, তা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু মনুষ্যজাতির একটি অংশ অপর অংশকে শোষণ করে যেভাবে নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে তার থেকে বড় নিশ্চয়তা পাবার চেষ্টা আর কিছুই হতে পারে না। যেমন–জার্মানদের খরচে ফরাসী মানুষের চলে। মজদুরদের খরচে পুঁজিপতিরা চলে। হলুদ’ মানুষদের খরচের উপর সাদা মানুষেরা চলে। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। পদদলিত গোষ্ঠীর কাছে এই রকম পদ্ধতি কেবল আতঙ্কের সৃষ্টি করে। পাছে পদদলিত গোষ্ঠী বিদ্রোহ করে উঠতে না পারে তার জন্য তাদেরকে আতঙ্কের মধ্যে রাখতেই হয়। কেবলমাত্র ন্যায়বিচার নিশ্চয়তা দিতে পারে। কেবল ন্যায়বিচার দ্বারাই, আমি মনে করি, মানবজাতির জন্য সমদাবী স্বীকৃত হতে পারে।


আরও বলা যেতে পারে, যে সামাজিক পরিবর্তনগুলিতে নিশ্চয়তা আনার চেষ্টা করা হয় সেখানে ভীতিকে সরাসরি হ্রাস করার জন্য সাহসকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যুদ্ধে সাহসের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে পেরে, প্রাচীন যুগে মানুষ শিক্ষা ও ভালো খাদ্যের বন্দোবস্তের মাধ্যমে সাহসকে বাড়িয়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ মানুষের মাংস খাওয়াকে এই ব্যাপারে কার্যকরী ভাবা হত। সামরিক সাহসকে শাসক শ্রেণীর এক বিশেষ অধিকার বলে ভাবা হয়ে থাকে। হেলদের থেকে স্পার্টানরা বেশি সাহসী ছিল। ভারতীয় রাজাদের সেনাদের থেকে ব্রিটিশ অফিসাররা বেশি সাহসী ছিল। নারীর থেকে পুরুষেরা বেশি সাহসী এবং এরকম আরও অনেক আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহসকে অভিজাতদের বিশেষ অধিকার বলে ভাবা হত। শাসক শ্রেণীর সাহসের প্রতিটি বৃদ্ধি প্রধানত পদদলিত জাতির উপর বোঝার বৃদ্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই জন্যই শাসক শ্রেণীর ব্যবহারের জন্য আতঙ্কের পরিবেশের সৃষ্টি হল এবং একই কারণে সেখানে নিষ্ঠুরতার কারণগুলিকে না দমিয়ে সেগুলোকে উস্কে দেওয়া হল। মানুষকে মানবিক করে তুলতে পারার আগেই সাহসের গণতন্ত্রীকরণ করে তোলা আবশ্যক।


বিশদ করে বলতে গেলে, সাহস এখনি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দ্বারা গণতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। ভোটাধিকারের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে তারা অতি বীর মানুষদের মতো সাহসী হয়ে উঠেছে। ভোটে জেতার জন্য তাদের এই ধরণের সাহসের প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধে একজন সাধারণ যোদ্ধার ক্যাপটেন বা লেফটেন্যান্টের মতোই সাহসের প্রয়োজন হয়। জেনারেলের থেকে অনেক বেশি সাহসের প্রয়োজন হয় সাধারণ যোদ্ধাদের। সৈন্যদল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাদের দাসত্বহীন মনোভাব অনেক কিছুই করতে পারে। বলশেভিক, যারা নিজেদেরকে সর্বহারাদের চ্যাম্পিয়ন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাহসের অভাব নেই, সে তাদের সম্বন্ধে যা খুশি বলা হ’ক না কেন। কেননা বিপ্লব-পূর্ব সময়ের নথিপত্রের দ্বারাই তাদের সাহসের প্রমাণ মেলে। জাপানে সামুরাইরা সামরিক উদ্দীপনার একচেটিয়া অধিকারী ছিল কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে স্থল- সন্য বা নৌ সেনাদলে নাম লেখানোর জন্য সেখানে সমগ্র পুরুষ জনতার মধ্যে সাহসের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এই ভাবেই সব শক্তিশালী দেশগুলোতে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে সাহসকে অভিজাত শ্রেণীর একচেটিয়া অধিকারে আর বেশি দিন রাখা হয়নি। যদি এটা না ঘটত তবে গণতন্ত্রের পক্ষে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। যুদ্ধে সাহস একমাত্র বিষয় নয়। কিন্তু যুদ্ধে সাহস সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়। দারিদ্র্যের মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। বিদ্রুপের মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। নিজের সম্প্রদায়ের শত্রুতার মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। এই সব ব্যাপারে কখনও কখনও অতি বীর যোদ্ধাও শোচনীয় ভাবে অসমর্থ হয়। সর্বোপরি বিপদের মোকাবিলা করার জন্য শান্তভাবে ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মধ্যেও একটা সাহস লুকিয়ে থাকে। উৎকণ্ঠাজনিত ভয় বা রাগের ভাবাবেগকে সংযত করার মধ্যেও সাহস থাকে। এগুলো নিশ্চিতভাবে সেইসব বিষয় যে বিষয়গুলোর উপর শিক্ষা মানুষকে কিছু দিতে সাহায্য করতে পারে। সুন্দর স্বাস্থ্য, সুগঠিত দেহ, পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি এবং মৌলিক প্রাণোচ্ছল ভাবাবেগের স্বাধীন প্রবাহের দ্বারা যে-কোন ধরনের সাহসের শিক্ষা ভালোভাবে সম্পাদিত হতে পারে। সম্ভবত সাহসের শারীরবিদ্যামূলক উৎস আবিষ্কার করা যেতে পারে ইঁদুরের রক্তের সঙ্গে বিড়ালের রক্তের তুলনা করলে। সব কিছুর মতোই সাহসকে বাড়িয়ে তুলতে বিজ্ঞান যা কিছু করতে পারে তা অসীম। উদাহরণস্বরূপ, বিপদের অভিজ্ঞতা, একটি বলিষ্ঠ জীবন এবং পুষ্টিজনক খাদ্য। এই সমস্ত জিনিসগুলো আমাদের উচ্চ শ্রেণীর বালকেরা সাধারণভাবে ভোগ করে থাকে। তার কারণ, তারা সম্পদের বিশেষ অধিকারী। মনুষ্য গোষ্ঠীর গরীব মানুষের মধ্যে সাহস উৎসাহিত করে শৃঙ্খলার অধীনস্থ সাহসকে। কিন্তু সেই ধরণের সাহসকে কখনই উৎসাহিত করে না যা নেতৃত্ব ও প্রথম প্রয়াসের বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে। যখন সেই সব গুণসমূহ যা সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে তা সার্বজনীন হয়ে উঠবে, তখন আর কোন নেতা বা অনুসরণকারীর প্রয়োজন হবে না এবং তখনই গণতন্ত্রকে উপলব্ধি করা যাবে।


ভীতিই অনিষ্টের একমাত্র উৎস নয়। হিংসা এবং অসন্তোষও তার উৎসের অংশ হিসেবে গণ্য। অনিষ্টের মহা উৎস হিসেবে প্রবাদ বাক্যের রূপ নিয়েছে। তাদের চেয়ে অন্যান্যদের দুর্ভাগ্য একই ফল প্রদান করে। একজন পুরুষ বা নারী, যে যৌনতার ক্ষেত্রে আঘাত পেয়েছে, সে হিংসায় পূর্ণ হবার যোগ্য। এই ব্যাপারে অতি সৌভাগ্য বানদের কপালেই নৈতিক দোষারোপ জোটে। বিপ্লবের সময় থেকে বেশি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ধনিক শ্রেণীর হিংসা। ঈর্ষা হিংসার একটি বিশেষ ধরন–প্রেমের হিংসা। বৃদ্ধরা যুবকদের প্রায়শই হিংসা করে থাকে। যখন তারা সুযোগ পায়, তখন তারা তাদের উপর নিষ্ঠুর ব্যবহার করার যোগ্যতা দেখিয়ে ছাড়ে।


যতদূর আমি জানি হিংসুটে মানুষকে সুখী ও পূর্ণ করে তোলা ছাড়া হিংসার সঙ্গে এঁটে ওঠার আর কোন পদ্ধতি নেই। যুবকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার চেয়ে সম্মিলিত উদ্যোগের ধারণা গড়ে তোলার থেকে ভালো কোন পদ্ধতি নেই। হিংসার সব থেকে বাজে প্রকাশ দেখা যায় তাদের মধ্যে যারা তাদের বিবাহিত জীবনে, বা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিংবা তাদের কর্মজীবনে পূর্ণ হতে পারেনি। এই ধরণের দুর্ভাগ্যকে বেশিরভাগ সব ক্ষেত্রে ভালোভাবে দূর করা যেতে পারে অপেক্ষাকৃত উত্তম সামাজিক প্রথাসমূহের মধ্য দিয়ে। এটা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে যে হিংসার আবেশটি প্রায়শই থেকে যায়। ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যেখানে দেখা যায় যে কোন সর্বাধিনায়ক অপর কোন সর্বাধিনায়ককে এতটাই হিংসা করত যে তারা একে অপরের খ্যাতির বৃদ্ধি যাতে না হয় তার জন্য ইচ্ছে করে হেরে যাওয়াটাই পছন্দ করত। একই দলের দুজন রাজনীতিবিদ, কিংবা একই ঘরানার দুজন শিল্পী অবশ্যই একে অপরের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে প্রতিটি প্রতিযোগী একে অপরের ক্ষতি করতে সক্ষম না হয়। তারা যেন কেবলমাত্র তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী জয়লাভ করে। সাধারণত একজন শিল্পীর তার শত্রুর প্রতি ঈর্ষা খুব কমই ক্ষতি করতে পারে। কারণ সেই শিল্পী তার ঈর্ষাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এই কারণে যে সে তার শত্রুর অপেক্ষা আরও ভালো ছবি আঁকবে বলে। কেননা তার শত্রুর ছবিগুলোকে ধ্বংস করে ফেলার পথ তার কাছে উন্মুক্ত নয়। যেখানে হিংসাকে কোন ভাবে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় সেখানে তাকে একে অপরের জন্য উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করা চলে, কিন্তু কখনই শক্রর প্রচেষ্টাকে আঘাত করে নয়।


মানুষের সুখকে বৃদ্ধি করার জন্য বিজ্ঞানের সম্ভাবনাগুলি মানুষের প্রকৃতির সেইসব দিকগুলোকে কিছুতেই হ্রাস করতে পারে না যে প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা পরস্পর বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় হারে এবং যে প্রকৃতিটিকে আমরা অবশ্যই মন্দ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। ধনাত্মক যোগ্যতা বৃদ্ধিতে বিজ্ঞান যা করতে পারে তার কোন সীমা নেই। স্বাস্থ্য এখনই অনেক উন্নত হতে পেরেছে। অতীতের আদেশ গ্রহণকারীদের বিলোপ সত্ত্বেও আমরা আজ আগের থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচি। অষ্টাদশ শতকের যে-কোন শ্রেণী বা জাতির থেকে আমরা অনেক কম অসুস্থতায় ভুগি। আমরা যে জ্ঞান এখনই অর্জন করেছি সেই জ্ঞানের একটু বেশি প্রয়োগ করলে এখন আমরা যেমন আছি তার থেকেও অনেক বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকতে পারবো এবং ভবিষ্যতে যে আবিষ্কারগুলো হবে তা দিয়ে উন্নতির পদ্ধতি আরও বেশি দ্রুত হয়ে উঠবে।


পদার্থবিজ্ঞান আমাদের জীবনে উপর যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে মনস্তত্ত্ব এবং শারীরবিদ্যা আরও বেশি ফলদায়ক হয়ে উঠবে। যখন এখনি আমরা আবিষ্কার করতে পেরেছি কিভাবে চরিত্র শারীরবিদ্যার উপর নির্ভর করে, তখন আমরা যদি চাই তবে আমরা ভবিষ্যতে সেই রকম অনেক মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হব যে মানুষদের আমরা প্রশংসা করে থাকি। বুদ্ধি, শৈল্পিক পারদর্শিতা, বদান্যতা –এই সমস্ত জিনিসগুলি বিজ্ঞানের দ্বারা আরও বৃদ্ধি করা যাবে। যদি আমরা বিজ্ঞানকে বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহার করি তবে মঙ্গলময় জগৎ তৈরি করতে যা করা যাবে তার কোন সীমা পরিসীমা থাকবে না। কিন্তু আমি কোন এক জায়গায় এই অভিমত প্রকাশ করেছিলাম যে মানুষ সম্ভবত সেই ক্ষমতাকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারবে না যে ক্ষমতা সে বিজ্ঞান থেকে অর্জন করতে পেরেছে (ইকারুস দেখুন)। বর্তমানে আমি সেই মঙ্গলের সম্পর্কে কথা বলছি যে মঙ্গল মানুষই করতে পারে যদি তারা চায়, আমি কোন বিষয় সম্পর্কে কথা বলছি না যেখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে তারা মঙ্গল অপেক্ষা অমঙ্গল করাটা বেশি পছন্দ করবে কিনা।


মানবজীবনের উপর বিজ্ঞানের একটি বিশেষ আচরণ দেখা যায় যে সম্পর্কে আমার একটা সহানুভূতি আছে, যদিও শেষ বিশ্লেষণে আমি তার সঙ্গে একমত হইনি। এই আচরণটি তাদের যারা যা কিছু ‘অপ্রাকৃতিক’ তাকেই ভয় পায়। রুশো, ইউরোপে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান নায়ক। এশিয়াতে, লাওৎসে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে তা বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৪০০ বছর খুব তাড়াতাড়ি গড়িয়ে গেছে। আমি মনে করি ‘প্রকৃতি’কে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে সত্য এবং মিথ্যা মিশ্রভাবে মিশে আছে, যার জট খোলাটা গুরুত্বপূর্ণ। শুরু করতে হবে প্রাকৃতিক’ বলতে কি বোঝায় সেই প্রশ্ন দিয়েই। মোটামুটিভাবে বলা যায় প্রাকৃতিক বলতে সেই সমস্ত বস্তুকে বোঝায় যে বস্তুগুলির সঙ্গে বক্তা শিশুর মতোই যুক্ত হতে অভ্যস্ত। লাওৎসে রাজপথ এবং যানবাহন ও নৌকার সম্পর্কে আপত্তি করেছেন যেগুলো সম্ভবত তিনি যে গ্রামে জন্মান সেখানে অপরিচিত ছিল। রুশো এই সমস্ত জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি সেগুলোকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলেননি। কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি বেঁচে থাকতে যদি রেলপথ দেখতেন তবে কেটে পড়তেন। পোশাক পরা এবং রান্না করাটা বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রকৃতির ধর্মপ্রচারকদের বেশির ভাগের দ্বারা প্রকাশ্যে নিন্দিত হয়ে এসেছে, যদিও তারা সবাই যে-কোন নতুন ধরনকে নিন্দা করতে অভ্যস্ত। যারা কৌমার্যের যন্ত্রণা সহ্য করেছিল তারা জন্মনিয়ন্ত্রণকে শয়তানের ইচ্ছা বলে মনে করত, কারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রকৃতিকে নতুনভাবে এক অস্বীকার ছিল এবং সৌন্দর্যের যন্ত্রণা সহ্য করাটা ছিল প্রকৃতিকে অস্বীকার করার প্রাচীনতম প্রথা। এইসব পথ দিয়ে যারা প্রকৃতিকে প্রচার করেছে তারা অসঙ্গতিকর ছিল এবং কেউ কেউ যারা তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে উগ্র হয়ে উঠেছিল তারা ছিল রক্ষণশীল।


অধিকন্তু, তাদের পক্ষে কিছু বলা যেতে পারে। ভিটামিনের উদাহরণটি নেওয়া যাক, যার আবিষ্কার প্রাকৃতিক খাদ্যের সমর্থনে একটি বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। তবে মনে করা হয়েছিল যে ভিটামিনগুলি সরবরাহ করা যেতে পারে কডলিভার অয়েল এবং বৈদ্যুতিক আলোর দ্বারা, যা নিশ্চিতভাবেই মানুষের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই ঘটনা এই ব্যাখ্যাই করে যে, জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে, প্রকৃতি থেকে কোন নতুনভাবে অপসরণ আশাতীত ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু যখন ক্ষতিটিকে বুঝতে পারা যায় তখন নতুন কোন কৃত্রিমতা দিয়ে তাকে সাধারণত সারাবার চেষ্টা হয়ে থাকে। আমাদের ভৌতিক পরিবেশ ও আমাদের আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির জন্য ভৌতিক উপাদানগুলি সম্পর্কে বলতে গেলে, আমি মনে করি না যে প্রকৃতি’ মতবাদটি নতুন কোন সুবিধা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গবেষণামূলক সাবধানতা নেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ জামা কাপড়ের কথাই ধরা যাক, যেটি প্রকৃতি বিরোধী এবং যেটাকে পূরণ করবার চেষ্টা হয়েছে অপ্রাকৃতিক কার্যাবলীর দ্বারা, অর্থাৎ জামাকাপড় ধোয়ার মাধ্যমে, কেন না নোংরা জামাকাপড় রোগ ডেকে আনবে। কিন্তু দুটি কাজ যা বর্বর মানুষদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছিল তা আজ মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান করে তুলেছে।


মানুষের আকাক্ষার রাজত্বে ‘প্রকৃতি’ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যাবে। পুরুষ নারী ও শিশুর শক্তিশালী ভাবাবেগকে ধাক্কা মেরে তার উপর কোন জীবনকে বলপূর্বক চাপিয়ে দিলে তা যেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে তেমনি ভয়ঙ্করও হবে। এই অর্থে ‘প্রকৃতি অনুযায়ী একটি জীবন কোন স্থিরীকৃত শর্তসমূহের প্রতি সমর্পিত। ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক রেলপথের চেয়ে আর কোন কিছুই ততটা কৃত্রিম নয়, কিন্তু সে যখন কোন শিশুকে নিয়ে যাত্রা করে তখন সে শিশুটির প্রকৃতিকে মোটেই লঙ্ঘন করে না। বিপরীতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে এই অভিজ্ঞতাটি সব শিশুই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। অন্যান্য জিনিসগুলি সমানুপাতিক হলে যে কৃত্রিমতা সাধারণ মানুষের কামনাকে পরিতৃপ্ত করে তা মঙ্গলজনক। কিন্তু জীবনের যে পথসমূহকে কৃত্রিম বলা যায় তা অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কর্তৃত্বের দ্বারা নির্মিত, তাই সেই সব পথ সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। জীবনের এই ধরণের পথ, নিঃসন্দেহে, কিছুদূর পর্যন্ত এখন প্রয়োজনীয়। সাগরে যাত্রা করাটা একটা দুরবগাহ ব্যাপার হয়ে উঠবে যদি স্টিমারের অগ্নিকুণ্ডে কয়লা ঠেলে দেওয়ার কেউ না থাকে। এই ধরণের প্রয়োজনীয়তাগুলো দুঃখজনক এবং তাদের এড়িয়ে চলবার পথ আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্ম করা অভিযোগের বিষয় নয়, বরঞ্চ দশের মধ্যে নটি ঘটনাতেই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় জীবন কাটানোর থেকে কর্মই মানুষকে বেশি সুখী করে। বর্তমানে মানুষ যে ধরণের কার্য যে পরিমাণ করতে বাধ্য হয় তা গভীরভাবে অশুভ। বিশেষত নিত্যকর্মের দাসত্বের বাঁধা জীবন মন্দ। জীবন কখনই কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয় অথবা তা অতিরিক্ত প্রণালীসংগত হওয়া উচিত নয়। আমাদের ভাবাবেগগুলো যদি ধনাত্মকভাবে ধ্বংসাত্মক না হয়, কিংবা তা অপরের ক্ষতিকারক না হয়, তবে সম্ভব হলে তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত এবং দুঃসাহসিক কাজের জন্য সুযোগ দেওয়া উচিত। মানবিক প্রকৃতিকে আমাদের সম্মান করা উচিত, কারণ আমাদের ভাবাবেগগুলো এবং কামনাগুলো সেই মোড়কের ভেতর থেকে বার হয়ে আসে যেখানে আমাদের সুখ তৈরি করা যায়। মানুষকে এমন কিছু দেওয়া অনর্থক যাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে মঙ্গলময় ধরে নিতে হবে। আমাদের মানুষকে আকাক্ষিত এবং প্রয়োজনীয় এমন কিছু দেওয়া অবশ্য দরকার যা মানুষের সুখের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। বিজ্ঞান এই শিক্ষা ঠিক সময় মতো অর্জন করে আমাদের কামনাগুলোকে সেই পথে ঘোরাতে পারে যাতে আজকের মতো তা অপর মানুষের সাথে বিবাদের কারণ হয়ে উঠবে না এবং তখনই আমরা আমাদের কামনাগুলোর বেশিরভাগ অংশটিকে আজকের চেয়ে অনেক বেশি পরিতৃপ্ত করতে পারব। কেবলমাত্র সেই অর্থেই, তখন আমাদের কামনাগুলো মঙ্গলতর হয়ে উঠবে। একটি কামনার না থাকে মঙ্গলময় দিক, না থাকে মন্দের দিক। তাকে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছন্ন একাকী হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু একটি কামনাপুঞ্জ অন্য পুঞ্জটির থেকে মঙ্গলদায়ক যদি প্রথম পুঞ্জটির সবাই একই সঙ্গে পরিতৃপ্ত হতে পারে তখন দ্বিতীয় পুঞ্জটির অনেকেই অন্যান্যদের থেকে অসঙ্গতিকর হয়ে থাকে। এই জন্যই প্রেম বিদ্বেষের চেয়ে মঙ্গলজনক।


ভৌতিক প্রকৃতিকে সম্মান করাটা বোকামি। ভৌতিক প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করা ভাল বা মন্দ কোনটাই নেই। যখন ভৌত প্রকৃতি ও মানবিক প্রকৃতি পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে, বিশেষত জনসংখ্যার প্রশ্নের দিক দিয়ে, তখন পূজার ভঙ্গিতে দু’হাত জোড় করে বসে বুদ্ধকে মেনে নিলে চলবে না। মহামারী ও দুর্ভিক্ষের একটি সম্ভাব্য যোগসূত্র আছে। স্বর্গ বলে : এটা মহা পাপ। যদি তাই হয় তবে সমস্যার কেবল ভৌতিক দিকটিতেই বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করা হ’ক। আমরা অবশ্যই (তারা বলে থাকে) মানবিক দিকে নৈতিকতাগুলো প্রয়োগ করব এবং সংযম পালন করব। ঘটনা স্বরূপ প্রত্যেকেই, এমনকি স্বর্গের অনুগামীরাও জানে যে তাদের উপদেশগুলোকে মেনে নেওয়া হবে না। গর্ভধারণের প্রতিকার স্বরূপ ভৌত উপায়কে গ্রহণ করে জনসংখ্যার প্রশ্নটিকে সমাধান করাটা কেন পাপের হবে? একমাত্র সেকেলে ধর্মমত ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে কোন উত্তর সামনে উঠে আসবে না। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে প্রকৃতিকে খণ্ডন করার ব্যাপারে স্বর্গের যে উপদেশগুলি আছে তা অন্তত জন্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত উপদেশগুলির মতোই মহান। স্বর্গ মানবিক প্রকৃতির লঙ্ঘনকেই পছন্দ করে। সেই লঙ্ঘনকে সফলভাবে সান করার ক্ষেত্রে অসুখ, হিংসা, নির্যাতন প্রবণতা এবং প্রায়শই পাগলামি জড়িত। আমি ভৌত প্রকৃতির লঙ্ন’ পছন্দ করি যা একইভাবে স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে অথবা ছাতা ব্যবহারের সঙ্গেও জড়িত। এই উদাহরণে দেখা যায় যে সেই আদর্শের প্রয়োগ কতটা দ্ব্যর্থক ও অনিশ্চিত যাকে আমরা ‘প্রকৃতি’ বলে অনুসরণ করে থাকি।


প্রকৃতি ও মানবিক প্রকৃতি পরম স্বীকৃত বিষয়সমূহ থেকে ক্রমশই বেশি করে ক্ষান্ত হয়ে আসছে। বৈজ্ঞানিক বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে তাকে যত সুবিধাজনক জায়গায় আনা হচ্ছে ততই সে বেশি করে ক্ষান্ত হয়ে পড়ছে। যদি বিজ্ঞান চায়, তবে আমাদের প্রপৌত্রদের মঙ্গলময় জীবন কাটাতে সমর্থ করে তুলবে, তাদেরকে জ্ঞান প্রদান করে, আত্ম-সংযমী করে এবং বিবাদ উৎপাদনকারী চরিত্রের বদলে সংগতি উৎপাদনকারী চরিত্র প্রদান করে। বর্তমানে আমাদের শিশুদের পরস্পরকে হত্যা করবার শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কেননা বিজ্ঞানের বহু মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎকে তাদের নিজেদের মুহূর্তের সমৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলি দিতে ইচ্ছুক কিন্তু এই সময় অতিক্রান্ত হবে তখন যখন মানুষ যে ভাবে বাহ্যিক জগতের ভৌত বলের উপর প্রভুত্ব করতে পেরেছে ঠিক তেমনি সে তার নিজের ভাবাবেগের উপর প্রভুত্ব করতে পারবে। আর তখনই শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।

আমরা কি মৃত্যুর পরেও জীবিত থাকি?


(এই প্রবন্ধটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত জীবন ও মৃত্যুর রহস্য,’ নামক গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। বিশপ ব্যারেন্সের দ্বারা রচিত একটি প্রবন্ধ যেটির কথা রাসেল উল্লেখ করেন তা এই একই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।)


মৃত্যুর পর আমরা জীবিত থাকবো কিনা তার আলোচনা ভালোভাবে করার আগে আমাদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভালো যে আজকের মানুষটি কাল যেমন ছিল সে আজও সেই একই মানুষ আছে কিনা। দার্শনিকরা চিন্তা করতে অভ্যস্ত ছিলেন যে নির্দিষ্ট সারসত্ত্বাগুলো আছে। আত্মা এবং শরীর এমন কিছু যা দিনের পর দিন থেকে যায়। একবার যে আত্মা সৃষ্টি হয়েছে তা সমগ্র ভবিষ্যৎ সময় ধরে থেকে যায় এবং সাময়িকভাবে শরীর মৃত্যুর পর নষ্ট হয়ে যায় ততদিন পর্যন্ত যতদিন না শরীরের আবার পুনর্জাগরণ হয়।


বর্তমান জীবন সম্পর্কে ধর্মমতের যে অংশ যুক্ত তা নিশ্চিতভাবে অসত্য। শরীরের সাধন ও অপচয়ের পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবর্তিত পদার্থবিজ্ঞানের পরমাণু নিরবচ্ছিন্নভাবে কখনই বিদ্যমান থাকতে পারত না বলেই মনে হয়। তাই কোন অর্থেই বলা যায় না যে এই পরমাণুটি সেই পরমাণুর মতো একই যা কিছু মিনিট আগে বিদ্যমান ছিল। মানবশরীরের নিরবচ্ছিন্নতা অভ্যাস ও আচরণের বিষয়, কখনও সারসত্ত্বার বিষয় নয়।


এই একই জিনিস মনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। আমরা চিন্তা করি, অনুভব করি এবং কাজ করি। কিন্তু চিন্তা অনুভব এবং কার্য ব্যতিরিক্ত কোন অনাবৃত অস্তিত্ব নেই। মন অথবা আত্মা সেই বস্তু, যাকে এই ঘটনাগুলোকে বহন করতেই হয়। একজন ব্যক্তির মানসিক ধারাবাহিকতা তার অভ্যাস ও স্মৃতির ধারাবাহিকতা। কাল একজন মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যার অনুভব আমি মনে করতে পারি, কিন্তু বস্তুত কালকে আমি নিজেই কতকগুলি মানসিক ঘটনা যেগুলো বর্তমানে স্মরণ করা হয় এবং যে ঘটনাগুলো সেই ব্যক্তির অংশরূপে গণ্য করা হয়ে থাকে যে ব্যক্তি ঘটনাগুলো স্মরণ করে। এই সমস্ত জিনিসগুলো একজন মানুষকে একটি ধারাবাহিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন করে গঠন করে যে অভিজ্ঞতাগুলি স্মৃতির দ্বারা যুক্ত এবং ওই একই ধরণের বস্তুর দ্বারা যুক্ত যাকে আমরা অভ্যাস বা আচরণ বলে থাকি।


এই জন্য যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় যে একজন ব্যক্তি মৃত্যুর পরও জীবিত থাকে, তবে আমাদের এই বিশ্বাস করতে হবে যে সমস্ত স্মৃতি ও অভ্যাসসমূহ ব্যক্তিকে গঠন করে তাকে একটি নতুন ঘটনাসমূহের প্রস্থে প্রদর্শিত হতে হবে।


কেউ এটা প্রমাণ করতে পারে না যে এমনটা ঘটবে না। কিন্তু এটা দেখা খুবই সোজা যে এই ব্যাপারটি খুবই অসঙ্গতিকর। মস্তিষ্কের কাঠামোর সাথে আমাদের স্মৃতিসমূহ ও অভ্যাসসমূহ জড়িত। জড়িত এমন ভাবে যেমন ভাবে একটি নদী নদীগর্ভের সাথে জড়িত থাকে। একটি নদীর জল সর্বদাই পরিবর্তনশীল। কিন্তু সে তার ধারা সর্বদাই বজায় রাখে কারণ পূর্বের বৃষ্টিধারা জলনালীকে ক্ষয় করে দিয়েছে। এই একইভাবে, পূর্ব ঘটনাসমূহ মস্তিষ্কের নালীকে ক্ষয় করে এবং আমাদের চিন্তা সেই নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটাই হল স্মৃতিশক্তি ও মানসিক অভ্যাসসমূহের কারণ। কিন্তু কাঠামো হিসেবে মস্তিষ্ক মৃত্যুর পর ধ্বংস হয়ে যায়। এইজন্য আশা করা যায় মস্তিষ্কও মৃত্যুর পর ধ্বংস হয়ে যাবে। এই আশা করা ছাড়া অন্য কোনভাবে চিন্তা করার উপায় নেই যে একটি নদী ভূমিকম্প হবার পর তার পুরানো ধারায় টিকে থাকবে কারণ ভূমিকম্প উপত্যকা ছিল এমন একটি জায়গায় একটি পর্বতমালা সৃষ্টি করে দেয়।


এইজন্য একজন বলতেই পারে যে সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত মনসমূহ একটি সম্পদের উপরে নির্ভর করে এবং যা যে-কোন বিশেষ ধরণের বস্তুগত কাঠামোসমূহে লক্ষ্য করা যায়। তবে অন্যান্য ধরণের বস্তুসমূহে অতি অল্প পরিমাণই বিদ্যমান থাকে। এই সম্পদটি হল অভ্যাস সমূহ বা একই ধরণের ঘটনা সমূহ বারবার ঘটার ফলে যা গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, উজ্জ্বল আলো চোখের তারাকে সংকুচিত করে এবং যদি আপনি কোন মানুষের চোখে বারবার আলোর ঝলক ফেলেন এবং একই সঙ্গে তার কানের সামনে পেটাঘড়ি বাজান, তাহলে দেখা যাবে শেষে কেবলমাত্র পেটাঘড়ির শব্দেই তার চোখটি সংকুচিত হচ্ছে। মস্তিষ্ক ও স্নায়ু ব্যবস্থা সম্পর্কেও ওই একই ঘটনা ঘটে। বিয়বস্তুগত কাঠামো সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলতে হয়। এটা দেখা যাবে যে একদম একই ধরণের ঘটনা সমূহ যা ব্যাখ্যা করতে পারে ভাষার প্রতি আমাদের সাড়া দেওয়াটাকে এবং তাকে আমাদের ব্যবহার করাটাকে, তারা কি ভাবে আমাদের স্মৃতিসমূহ ও আবেগসমূহকে জাগিয়ে তোলে তাকে এবং আমাদের অভ্যাসের ফলে গড়ে ওঠা নৈতিক ও অনৈতিক আচরণসমূহকে, বলতে গেলে সেই সব কিছুকে যা আমাদের মানসিক ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে, একমাত্র সেই অংশটি ছাড়া যেটি আমাদের বংশধর দ্বারা গড়ে ওঠে। যে অংশটি বংশগতির দ্বারা নির্ধারিত হয় তাকে আমরা আমাদের পরবর্তী বংশধরদের দিয়ে যেতে পারি কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তিতে, কিন্তু তা কখনও জীবিত থাকতে পারে না যার শরীরটি মৃত্যুর পর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছে। তাই আমাদের অভিজ্ঞতা যতদূর পৌঁছেছে তার উপর নির্ভর করে বলতে গেলে বলতে হয় যে ব্যক্তিত্বের অর্জিত অংশ এবং বংশগতির দ্বারা নির্মিত অংশ উভয়ই বিশেষ শারীরিক কাঠামোসমূহের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আবদ্ধ। আমরা সবাই জানি যে মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। একজন ধার্মিক মানুষ এনসেফালাইটিস লেথারজিকার কবলে পড়ে লম্পট মানুষে পরিনত হতে পারে এবং আয়োডিনের অভাবে একটি বুদ্ধিমান বালক বোকায় পরিণত হতে পারে। এই ধরণের অতিপরিচিত ঘটনাগুলির উপর চোখ রেখে এটা অসম্ভব বলে মনে হয় যে মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক কাঠামোর সম্পূর্ণ ধ্বংসের পরও মন জীবিত থাকে।


এটা কোন যৌক্তিক বির্তক নয়, কিন্তু সেই আবেগসমূহ, যা ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসকে ডেকে আনবে।


এইসব আবেগসমূহের মধ্যে মৃত্যুভীতিটাই গুরুত্বপূর্ণ, যা প্রবৃত্তিগত এবং প্রাণীতত্ত্ববিদ্যার দিক দিয়ে কার্যকর। যদি আমরা মৃত্যুর পর জীবনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসপরায়ণ হয়ে থাকি তবে আমাদের মৃত্যুভীতিপরায়ণতাকে একেবারে মুছে ফেলা উচিত। তখন ব্যাপারটি কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠবে এবং সেটা এমন হয়ে দাঁড়াবে যে আমরা অনুশোচনা করতে বাধ্য হব। কিন্তু আমাদের মানবজাতি এবং উপমানবজাতির পূর্বপুরুষরা ভূবিদ্যাগত যুগগুলোতে আমাদের শত্রুদের সঙ্গে লড়েছে ও তাদের নির্মূল করে ছেড়েছে এবং তারা তাদের সাহসের দ্বারা লাভবান হয়েছে। এইজন্য ঘটনাচক্রে স্বাভাবিক মৃত্যু-ভীতিকে অতিক্রম করতে সামর্থলাভ করবার জন্য জীবনযুদ্ধে বিজয়ীদের কাছে এটা ছিল একটা বড় সুবিধা। জন্তু এবং বর্বরদের মধ্যে এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাদের যুদ্ধপ্রিয়তাই যথেষ্ট। কিন্তু উন্নতির একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে, মহম্মদীয়রা প্রথম প্রমাণ করতে পেরেছিল যে স্বর্গে বিশ্বাস ব্যাপারটাতে যথেষ্ট পরিমাণ সামরিক মূল্য আছে যা প্রাকৃতিক যুদ্ধপ্রিয়তাকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই সম্ভব। এইজন্য আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে অমরত্বে বিশ্বাসপরায়ণ হতে উৎসাহী করার জন্য সমরতত্ত্ববিদরা যথেষ্ট জ্ঞানী এবং সর্বদা তারা মনে করায় যে এই জগৎ সম্পর্কে উদাসীনতাকে তৈরি করতে না পারলে এই বিশ্বাস কখনই গম্ভীর হয়ে উঠবে না।


অন্য যে আবেগ মানুষের মৃত্যুর পর জীবিত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকে তা মানুষের মহানত্বকে প্রশংসা করার মধ্যে দিয়ে করে। যেমন বারমিংহামের বিশপ বলেছেন, তার মন অন্য যে-কোন কিছুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি সূক্ষ্ম যন্ত্র যা সবার আগে তার মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিল সে জানে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। সে ওয়েস্টমিনিষ্টার অ্যাবে নির্মাণ করতে পারে। সে পারে উড়োজাহাজ তৈরি করতে। সে সূর্যের দূরত্বকে হিসেবে করে বার করতে পারে…। তাই মানুষ কি মৃত্যুর পর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হবে? সেই অতুলনীয় যন্ত্র, তার মন, যখন জীবন স্তব্ধ হয়ে যাবে, তখন উধাও হয়ে যেতে পারে কি?


বিশপ তার যুক্তি প্রদর্শনে এই ভাবে এগিয়েছেন যে একটি বৌদ্ধিক উদ্দেশ্যের দ্বারা এই বিশ্ব আকৃতিসম্পন্ন হয়েছে এবং শাসিত হচ্ছে। তাই মানুষকে তৈরি করে তাকে ধ্বংস হতে দেওয়াটা খুবই বুদ্ধিহীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।


এই বিতর্কে অনেকগুলি উত্তর দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, প্রকৃতির সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দেখা যায় নীতিবিদ্যা অথবা সৌন্দর্যবিজ্ঞানমূলক মূল্যবোধের অনুপ্রবেশে আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আগে মনে করা হত যে স্বর্গীয় শরীরগুলো একটি বৃত্তে অবশ্যই ঘোরে। বৃত্তই একমাত্র যথার্থ বক্ররেখা (Curve) এবং ঐ প্রজাতিগুলি অবশ্যই অপরিবর্তনীয়। কেননা ঈশ্বর কেবলমাত্র তাই সৃষ্টি করেন যা যথার্থ এবং যাদের কোন রকম উন্নয়নের প্রয়োজন নেই। এই কারণে কেবলমাত্র অনুশোচনা ছাড়া মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করাটা একটা অনর্থক ব্যাপার। কারণ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাদের পাঠানো হয়েছে এবং এই রকম আরও অনেক কিছু। যদিও এটা দেখা গেছে যে যতদূর পর্যন্ত আমরা আবিস্কার করতে পারি ততদূর পর্যন্ত আমরা দেখি যে প্রকৃতি আমাদের দ্বারা প্রদেয় মূল্যগুলির প্রতি উদাসীন থাকে। প্রকৃতিকে কেবলমাত্র জানা যেতে পারে আমাদের ভালো-মন্দ বিচারকে অবজ্ঞার দ্বারা। বিশ্বের একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কিন্তু তা আমাদের জানার মধ্যে কখনই পড়ে না, যদি তাই হত তবে সেই উদ্দেশ্য আমাদের মতোই সমগোত্রীয় হত।


এখানে চমৎকৃত হবার মতো কিছুই নেই। ড. বারনেস আমাদের বলেছেন যে মানুষ কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা জানে। কিন্তু, বস্তুত নৃতত্ত্ববিদ্যা অনুযায়ী, ভালো-মন্দের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এতই পরিবর্তনশীল যে তার মধ্যে কোন একটাও কখনও স্থায়ী হয়নি। এইজন্য আমরা বলতে পারি না যে মানুষ জানে কোনটা ভালো এবং কোনটা মন্দ, তবে কেবলমাত্র কিছু মানুষ তা পারে। সেইসব মানুষগুলি কেমন? নিৎসে একটি নীতিশাস্ত্রের স্বপক্ষে তার যুক্তি দেখিয়েছেন যা মৌলিকভাবে খ্ৰীষ্টীয়দের নীতিশাস্ত্রের থেকে স্বতন্ত্র এবং কিছু শক্তিশালী সরকার তার সেই শিক্ষাকে গ্রহণও করেছে। যদি ভালো-মন্দের জ্ঞানটাই অমরত্বের একটি যুক্তি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে আমরা নিৎসে না খ্রীষ্টকে বিশ্বাস করব। তারপর আমরা দেখাবো যে খ্রীষ্টরা অমর কিন্তু হিটলার এবং মুসোলিনি অমর নয় অথবা উল্টোটা। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই যুদ্ধক্ষেত্রে নিতে হবে, কেবলমাত্র করে নিলে হবে না। যাদের হাতে সব থেকে বিষাক্ত গ্যাস আছে তাদের হাতে নীতি শাস্ত্র আছে, এইজন্য তারাই হবে অমর।


আমাদের চারপাশের সব কিছুর মতোই অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলির মতোই ভালো ও মন্দের বিষয়ের উপর আমাদের অনুভব এবং বিশ্বাস বেড়ে উঠেছে আমাদের অস্তিত্বের জন্য সগ্রামের মধ্যে দিয়ে। এছাড়া তাদের কোন স্বর্গীয় অথবা অতিপ্রাকৃতিক উৎস নেই। ঈশপের একটি গল্পে আছে, একটি সিংহকে একটি ছবি দেখানো হল যে ছবিটিতে অনেকগুলি শিকারী অনেকগুলি সিংহকে ধরছে এবং তাই বলে মন্তব্য করা হল যে, যদি সিংহটি এই ছবিগুলি আঁকত তবে দেখা যেত যে সিংহরা শিকারীদের ধরছে। ড. বারনেস বলেছেন, মানুষ একটি অতি উত্তম প্রাণী কেননা সে উড়োজাহাজ বানাতে পারে। কিছুক্ষণ আগেই যে। মাছিগুলি সিলিংয়ের উপর ঘুরে বেড়ায় তাদের চালাকি নিয়ে একটি সম্মিলিত সংগীত গাওয়া হচ্ছিল : ‘এটা কি লয়েড জর্জ করতে পারেন? এটা কি. মিঃ বালডুইন করতে পারেন? এটা কি রামসে ম্যাক করতে পারেন? না’ এর উপর ভিত্তি করে একমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাসী মানসিকতাসম্পন্ন মাছিই এই সশব্দ যুক্তি প্রদর্শন করতে পারে এবং নিঃসন্দেহে অন্যান্য মাছিগুলি তাতে বিশ্বাস করার মতো অনেক কিছুই খুঁজে পাবে।


অধিকন্তু, এটা তখনি ঘটে থাকে যখন আমরা অবাস্তবভাবে মানুষের সম্পর্কে এই ধরণের উচ্চ মতামত পোষণ করে থাকি। খুব সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ খুবই মন্দ চিন্তা পোষণ করে থাকে। সভ্য দেশগুলি তাদের বেশির ভাগ শুল্ক ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত অর্থ পরস্পরের নাগরিকদের হত্যা করবার জন্য ব্যয় করে থাকে। নৈতিক সমর্থনে যে সমস্ত কার্যকলাপ ঘটেছে তার দীর্ঘ ইতিহাসকে বিবেচনা করা যাক। নরবলি, প্রচলিত ধর্মমত অনুযায়ী বিরোধীদের হত্যা, ডাইনি শিকার, সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড ও লুঠ, বিষাক্ত গ্যাসের দ্বারা হাজার হাজার মানুষের হত্যাকাণ্ড নির্বিচারে পরিচালনা, এসবের অন্তত একটাকেও ড. বারনেসের বিশপ-সম্প্রদায় সমর্থন করার দরকার মনে হয়, যেহেতু তিনি একজন অ-খ্রীষ্টীয় হতে নারাজ কিংবা বিরোধের বেলায় তিনি শান্তিকামী। এই সমস্ত অমঙ্গল এবং শাস্ত্রীয় মতবাদ যাদের দ্বারা ওই অমঙ্গলজনক কার্য ত্বরান্বিত হয়েছে সেগুলো কি সত্যই একজন বুদ্ধিমান স্রষ্টার প্রমাণ? এবং আমরা কি সত্যই এই ইচ্ছা করতে পারি যে মানুষগুলি এইসব কাজ তাদের চিরদিনের জন্য বেঁচে থাকা উচিত? যে জগতে আমরা বাস করি তাকে বিশৃঙ্খল ও দুর্ঘটনার ফলরূপে আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু যদি এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিপ্রায়ের ফলরূপে নির্গত হত, তবে সেই অভিপ্রায়টি শয়তানের অভিপ্রায়ই হত। আমার দিক দিয়ে বলতে গেলে, আমি মনে করি দুর্ঘটনা অনেক কম যন্ত্রণাদায়ক এবং অনেক সত্যবৎ প্রতীয়মান কল্পনা।

শ্ৰীমতী, আপনি কি এটাই মনে করেন? না, এটা তা নয়


(এই প্রবন্ধটি ১৮৯৯ সালে লিখিত হলেও তা পূর্বে ছাপা হয়নি। এই প্রবন্ধটির ঐতিহাসিক মূল্যের জন্যই প্রধানত এটি ছাপা হয়েছে। যেহেতু এই প্রবন্ধটির মধ্য দিয়েই হেগেলের দর্শনের বিরুদ্ধে রাসেলের প্রথম বিদ্রোহ যার প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন কেমব্রিজে পড়াশুনোর সময় থেকে। যদিও সেই সময় তিনি ধর্মের প্রতি ততটা বিরুদ্ধ ছিলেন না যতটা তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হয়েছিলেন। তাঁর কিছু সমালোচনা এই একই ঘটনার উপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল।)


দর্শন তার সমৃদ্ধির সময়গুলোতে, তার কাজ করার শপথ অনুযায়ী, বহু বিচিত্র পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেছিল বলে দাবী করেছিল। বহু বাধার মধ্যেও দর্শন তাদের স্বস্তিকর আশ্রয় দিতে পেরেছিল। বৌদ্ধিক সংকটে সে ব্যাখ্যা প্রদান করে সেই সংকটকে দূর করত এবং নৈতিক বিহ্বলতায় পথ প্রদর্শনের কাজ করত।


যখন দর্শনের ব্যবহারের দৃষ্টান্ত একজন যুবককে বোঝানো হত তখন সেই কনিষ্ঠ ভ্রাতার যুবোচিত উচ্ছ্বাসে আশ্চর্য হবার কিছু নেই;


স্বর্গীয় দর্শন সুন্দর কত!

নয় সে কটু নয় সে কড়া

ভাবে যেমন বোকার মরা

সে যে অ্যাপোলোর বাঁশির মতো

সঙ্গীতময় মনোহরা।


কিন্তু সেই সব সুন্দর দিনগুলো আজ আর নেই। একের পর এক চরম ভন্ডামীগুলোকে দর্শন তার নিজের উত্তরাধিকারীদের ধীরগতিতে বিজয়ের ফলে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায়, বৌদ্ধিক সংকটগুলো সমাধিত হয়েছে বিজ্ঞানের দ্বারা বিশেষ কিছু অসাধারণ প্রশ্নের উপর দর্শনের ব্যগ্র দাবী, যে প্রশ্নগুলির উত্তর আজও দেবার প্রচেষ্টা হচ্ছে। যে প্রশ্নগুলি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে সেগুলি অন্ধকার যুগগুলির অবশিষ্ট এবং যেগুলো তাদের সমস্ত দ্রুতি নিয়ে মি. এফ ডব্লু মেয়ারের কঠিন বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। নৈতিক বিহ্বলতাগুলি– যেগুলিকে আজও পর্যন্ত দার্শনিকরা দ্বিধাহীনভাবে তাঁদের রাজত্ব মনে করে থাকেন এবং যেগুলিকে ম্যাক ট্যাগার্ট এবং মি. ব্র্যাডলে পরিত্যাগ করেছেন সংখ্যাতত্ত্ব ও সাধারণ জ্ঞানের খামখেয়ালীপনা হিসেবে। কিন্তু আশ্বাস এবং সান্তনা দেবার ক্ষমতা যা ক্ষমতাহীনের কাছে শেষ ক্ষমতা–ম্যাক ট্যাগার্ট মনে করেন তা হল দর্শন। আজকের রাত্রে এটাই হল সেই শেষ অধিকার যার বলে আমি আমাদের আধুনিক দেবতাদের জীর্ণশীর্ণ জনক-জননীকে ডাকাতি করে নিতে ইচ্ছুক।


কেবলমাত্র দর্শনের ক্ষেত্রে এটা মনে হতে পারে যে, প্রশ্নটি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে স্থির করা যেতে পারে। আমি জানি যে দর্শন আরাম দিতে পারে, ম্যাক ট্যাগার্ট বলতেই পারেন, কারণ এটা অবশ্যই আমাদের আরাম দেয়। যদিও, আমি প্রমাণ করবার চেষ্টা করব যে যে-সব সিদ্ধান্ত তাকে আশ্বাস দেয়, সেই সিদ্ধান্তগুলো হল তাই যা তার সাধারণ অবস্থান থেকে তাকে অনুসরণ করে না বরং সেগুলো। স্বীকৃত ভাবে তাকে অনুসরণ না করে কেবল পড়ে থাকে। এটা হয় কেবল সেগুলো তাকে আশ্বাস দেয় বলেই। দর্শনের আবেগী মূল্য ছাড়া তার সত্য সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আমি এটা ধরে নেব অধিবিদ্যা অবভাস (Appear ances) ও সত্তার (Reality) মধ্যে যে স্বতন্ত্রতা আছে তার উপর নির্ভর করে ও তাকে যথার্থ বলে মেনে নেয়। এই ধরণের যে-কোন অধিবিদ্যাগত আদর্শকে খুব ছোট্ট করে বলা যায়। ‘ঈশ্বরীয় যা কিছু সবই তাঁর স্বর্গের, সবার যা কিছু মন্দ তা জগতের’–এটাই এর শেষ কথা। কিন্তু এটা মেনে নিতে গেলে মনে হয় যে, যেহেতু তিনি তাঁর স্বর্গেই বিরাজ করেন এবং সর্বদাই তিনি সেখানে থাকেন, তাই আমরা এটা আশা করেও নিতে পারি যে তিনি কোন-না-কোন দিন পৃথিবীতে নেমে আসবেন– সজীব ও মৃতকে বিচার করতে না আসলেও, অন্তত দার্শনিকদের বিশ্বাসকে পুরস্কৃত করতে তিনি আসবেনই। যদিও বিশুদ্ধ স্বর্গীয় সত্ত্বার কাছে তার দীর্ঘদিনের আত্মসমর্পণ পার্থিব ব্যাপারগুলোকে বিবেচনা করে স্টোয়িকবাদকে গ্রহণ করবার প্রস্তাব দেয়, যার উপর নির্ভর করে যদি আমরা আমাদের আশাগুলোকে পূরণ করতে চাই, তবে তা একপ্রকার হঠকারিতা হয়ে যাবে।


কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে গেলে, বৈচিত্র্যের মধ্যে সান্ত্বনা হিসেবে শাস্ত্রীয় মতবাদগুলির আবেগী মূল্য তার ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী করার উপর নির্ভর করে আবির্ভূত হয়। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আবেগী কথাবার্তা একটি অতীত যা বর্তমানের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার শেষ ভালো, তার সব ভালো এই সূত্রটি সর্বসম্মত সাধারণ জ্ঞান সঞ্জাত। অনেকগুলি বিষণ্ণ সকাল একটি সুন্দর দিনে পরিণত হয়। যেখানে দুঃখবাদ বলে :


অনেক দেখেছি আমি উজ্জ্বল দিন।

সার্বভৌম চোখের সাথে

দেখেছি গিরিচূড়াদের–

ছিনাল মেলামেশা।

দেখেছি আমি সবুজ তৃণভূমি আছে যত,

তারা স্বর্ণ-মুখে চুম্বনরত।

দেখেছি ধূসর ছোট নদীদের সেই উজ্জ্বলতা

স্বর্গ-মদিরা পান করে তারা পেয়েছে মাদকতা।

শীঘ্র কর, অনুমতি দাও

উড়ুক হীন মেঘমালা,

তার স্বর্গ-মুখে ঢেলে দিক তার

পুঞ্জীভূত কালো জ্বালা।

লুকিয়ে সে নেবে মুখ

জগতের থেকে,

অদৃশ্যকে রাখবে সে

পশ্চিমে ঢেকে

এই অপমান মেখে,

ভাই, এই অপমান মেখে।


এই জন্যই বলতে হয়, বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আবেগমূলক দিক থেকে ভালো বা মন্দ যে দৃষ্টিভঙ্গিই থাকুক না কেন তা নির্ভর করে ভবিষ্যতের উপর, যার উপর এটা থাকবে। আমরা সর্বদাই কালের পরিপ্রেক্ষিতে অবভাসসমূহকে (Appearances) বিবেচনা করে থাকি এবং যতক্ষণ না আমরা এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের বর্তমানের চেয়ে উত্তম হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোথায় আমরা সান্ত্বনা পাব তা দেখাটা সত্যই শক্ত।


ভবিষ্যৎ এত বিপুল পরিমাণে আশাবাদের সঙ্গে আবদ্ধ যে ম্যাক ট্যাগার্টের সমস্ত আশাবাদ কালকে অস্বীকার করার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠলেও তিনি বাধ্য হন। বস্তুসমূহের ভবিষ্যৎ অবস্থাস্বরূপ সেই কালকে প্রতিনিধিত্ব করতে যা পরম ‘একটি সঙ্গতি যে অবশ্য কোন-না-কোন দিন প্রকাশিত হবে।‘ এই স্ববিরোধকে উত্তেজিত করে তোলাটা নির্দয়তা হবে। ম্যাক ট্যাগার্ট নিজেই আমাকে এ সম্পর্কে সজাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে ধারণাটিকে উত্তেজিত করে তুলতে ইচ্ছুক তা হল, যে-কোন আশ্বাস যা ধর্মীয়শাস্ত্র থেকে উৎসারিত হতে পারে এবং যে সত্তা হল কালহীন ও চিরন্তনভাবে মঙ্গ তা এই স্ববিরোধ থেকে একমাত্র এবং সম্পূর্ণরূপে উৎসারিত হয়েছে। একটি কালহীন সত্তা অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের সঙ্গে কখনও অন্তরঙ্গ যোগ রাখতে পারে না। যদি এটার যথার্থতা এখনো এসে উপস্থিত না হয় তা হলে কোন কারণে মনে করা ঠিক হবে না যে এটা কোনদিন উপস্থিত হবে– এরকম প্রতিটি জায়গায় বলা হয় যে ঈশ্বর তাঁর স্বর্গে থাকবেন। আমরা সমানুপাতিক ন্যায্যতার সঙ্গে একটি সঙ্গতি সম্পর্কে বলতে পারি যা অবশ্যই কোন-না-কোন দিন প্রকাশিত হয়েছে। এটা হতে পারে যে, ‘আমার দুঃখ রয়েছে পেছনে’ এবং এটা একেবারেই স্পষ্ট যে কত কম আশ্বাস এটা আমাদের দিতে পারে।


আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা কালের সঙ্গে বাঁধা এবং কালহীন অভিজ্ঞতাকে কল্পনা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু যদি তা সম্ভবও হত, স্ববিরোধিতা ছাড়া আমরা কখনই মনে করতে পারতাম না যে আমরা কখনও এ ধরণের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারব। এইজন্য, সমস্ত অভিজ্ঞতা যতটা দর্শনের দেখানো উচিত তা আমাদের জানা অভিজ্ঞতার অনুরূপ– যদি আমাদের কাছে এটাকে মন্দ ভাবা হয় তবে অবভাস থেকে স্বতন্ত্র সত্তা সম্পর্কে কোন মতবাদ আমাদের কোন আশাই জোগাতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা একটি দ্বৈতবাদের মধ্যে পড়েছি। একদিকে আমাদের জানা জগৎ যা তার সমস্ত রকম ঘটনাসমূহ, আনন্দদায়ক বা নিরানন্দদায়ক, মৃত্যু, ব্যর্থতা, বিপর্যয় প্রভৃতি নিয়ে আছে, অন্যদিকে কাল্পনিক জগৎ যে-জগৎটিকে আমরা সত্তার জগৎ বলে নাম দিয়েছি। সত্তার বৃহত্বের দ্বারা এবং এইরকম জগৎ সত্যই আছে কিনা তার কোন চিহ্ন না দেখতে পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি। এখন সত্তার জগতের জন্য আমাদের একটাই জায়গা আছে, তা হল, সত্তাকে তাই হতে হবে যাতে আমরা তাকে বুঝতে পারি। কিন্তু যদি আমাদের শুদ্ধ আদর্শ নির্মাণের ফল হিসেবে আমরা যে জগৎকে জানি তার উল্টো হয়ে দেখা দেয় অর্থাৎ বাস্তব জগৎ থেকে তা ভিন্ন হয়, তবে সেই বিশেষ নির্মাণের থেকে যে ফল বেরিয়ে আসবে তা দিয়ে আমরা তথাকথিত সত্তার জগৎ (World of reality) সম্পর্কে কখনই কোন অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারব না। তবে একমাত্র সেই বিষয়ের কথাই বলছি যে বিষয়ে আমরা কোন অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে পারিনি। তাই আমি এমন কোন কিছুকে দেখতে পাই না যেটাকে বর্তমান জটিলতার থেকে মুক্তি পাবার সেই আশ্বাস বলা যেতে পারে যা আমরা আমাদের সমস্ত অধিবিদ্যার মধ্যে দিয়ে লাভ করেছি। অমরত্বের প্রশ্নটিকে উদাহরণস্বরূপ নেওয়া যাক। মানুষ অমরত্ব কামনা করেছে এই জগতের অবিচারের প্রতিকার করবার জন্য, অথবা সেই উদ্দেশ্যে যে উদ্দেশ্যটিকে আমরা শ্রদ্ধেয় বলতে পারি, তা হল মৃত্যুর পর মিলনের একটা সম্ভাবনা তৈরি করা যাতে তারা যাদের ভালোবাসত তাদের সঙ্গে মিলতে পারে। দ্বিতীয় কামনাটি এমন যা আমরা সবাই অনুভব করতে পারি এবং যাদের সন্তুষ্টির জন্য দর্শন যদি কিছু করতে পারে তবে তার কাছে আমাদের প্রচুর পরিমাণে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু দর্শন, তার ক্ষমতা অনুযায়ী, আমাদের কেবল নিশ্চিত করতে পারে যে আত্মা হল কালহীন সত্তা। যদি এমন কোন কাল থাকে তবে তার উপস্থিতি একদিন ঘটবেই, এবং তা এই কালহীন কালের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে অসঙ্গতিকর। মৃত্যুর পর অস্তিত্বের মতবাদ থেকে কোনরকম আইনসিদ্ধ অনুমান পাওয়া যায় না। কীটস এখনও সখেদে বলতে পারেন :


তবে আমি চাইবো না গো তোমার পানে

অনেক বেশি করে,

চাইনে কখনও সুখী হতে সেই প্রেম ধনে

ভীতির ক্ষমতা ধরে–

যে অবাস্তব ভালোবাসা

বাঁধে তার বাসা।


এটা তাঁকে কুব একটা সান্ত্বনা দিতে পারেনি এই বলে যে এক ঘন্টার সুন্দর সৃষ্টি, অধিবিদ্যাগত সঠিক শব্দগুচ্ছ (Phrase) নয়। এটা এখনও সত্য যে ‘কাল এসে নিয়ে যাবে মোর সকল ভালোবাসা’ ‘এই চিন্তা মৃতের মতো, যাকে বেছে নেওয়া যেতে পারে না’ তাই শুধু হারাবার ভয়ে বসে বসে কাঁদতে হয়। তাই কালহীনভাবে যথার্থ সত্তার মতবাদসমূহের প্রতিটি অংশই এরকমই। যা কিছু এখন অমঙ্গলকর মনে হয় এবং এটা অমঙ্গলের পক্ষে দুঃখজনক বিশেষ অধিকার যে এরকম ভাবলে এরকমই হবে যা কিছু অমঙ্গল বলে মনে হয় তা সব থাকতে পারে এবং আমরা জানি যেগুলোকে সম্বল করে সমগ্র কাল ধরে আমরা আমাদের সাম্প্রতিক উত্তরাধিকারীদের তীব্র যন্ত্রণা দেব। আমার মনের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে এই ধরনের মতবাদে আশ্বাস অথবা সান্ত্বনার কোন চিহ্নই নেই।


এটা সত্য যে খ্রীষ্টীয় মতবাদ এবং পূর্বের সমস্ত আশাবাদসমূহ, জগৎকে দয়ালু বিধাতার চিরন্তন শাসিত স্থান হিসেবে দেখিয়েছে এবং তা অধিবিদ্যাগতভাবে মঙ্গলজনক বলে আখ্যায়িত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটা কেবলমাত্র একটা কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে যার দ্বারা জগতের ভবিষ্যতের মহানত্ব প্রমাণ করা যাবে– উদাহরণস্বরূপ, এই প্রমাণ করতে, যে ভালো মানুষেরা মৃত্যুর পর সুখী হবে। এটা সর্বদাই এই রকম সিদ্ধান্তই হয়ে এসেছে যদিও সিদ্ধান্তটি অবৈধভাবে গঠিত তবুও তা আমাদের আশ্বাস দিতে পেরেছে। ‘সে ভালো মানুষ এবং সবটাই ভালো হবে।’


প্রকৃতপক্ষে বলা যেতে পারে যে কেবলমাত্র বস্তু-নিরপেক্ষ মতবাদেই এই আশ্বাস থাকতে পারে যে সত্তা মঙ্গলজনক। আমি নিজে এই মতবাদের প্রমাণকে স্বীকার করি না। এমনকি এটা যদি সত্যিও হয় তবু আমি এটা দেখতে পাব না যে কেন এটা আশ্বাসমূলক হওয়া উচিত। কেননা আমার তর্কের উপাদান সেই সত্তা, যা অধিবিদ্যার দ্বারা নির্মিত এবং অভিজ্ঞতার জগতের সঙ্গে যার কোন রকম সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এটা একটা সারগর্ভহীন বস্তু-নিরপেক্ষ বিষয়, যার থেকে অবভার্সের জগতে কোন একটা মাত্র বৈধ অনুমানও গঠন করা যাবে না, তথাপি, যে জগতে আমাদের সব স্বার্থসমূহ নিহিত। এমনকি সেই বিশুদ্ধ আত্মিক স্বার্থ যার থেকে অধিবিদ্যার উত্থান। সেই স্বার্থ আসলে অবভাসের জগৎকে ব্যাখ্যা করার স্বার্থ। কিন্তু এই বাস্তব স্পষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে ব্যাখ্যা করার বদলে অধিবিদ্যা নির্মাণ করেছে অন্য আর একটি মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র জগৎ এবং তা এতটাই স্বতন্ত্র, এতটাই বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অসংযুক্ত যে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের জগৎ সম্পূর্ণভাবে এর দ্বারা অপ্রভাবিত রয়ে গেছে এবং এমনভাবে তার নিজের পথে চলেছে যেন সত্তার জগৎ বলে কোনরকম জগই নেই। এমনকি যদি কেউ সত্তার জগৎকে অন্য জগৎ’ হিসেবে, বা আকাশে বিরাজিত স্বর্গীয় নগররূপে বিবেচনা করার অনুমতিও পেত, তাহলে নিঃসন্দেহে অন্তত চিন্তার এই আশ্বাস পাওয়া যেত যে অন্যদের একটি যথার্থ অভিজ্ঞতা আছে যা আমাদের নেই। কিন্তু বলতে গেলে, আমাদের অভিজ্ঞতা, যেমনভাবে আমরা তাকে জানি, তা একটি যথার্থ অভিজ্ঞতা এবং তা অবশ্যই আমাদের ঠান্ডা করে ছাড়ে, যেহেতু এটা প্রমাণ করতে পারে না যে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য রকম অভিজ্ঞতার চেয়ে উত্তম হতে পারে। অন্যদিকে, একথা বলতে হয় যে আমাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা দর্শনের দ্বারা নির্মিত যথার্থ অভিজ্ঞতার মতো নয়। আমাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা সেই ধরণের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে যে অস্তিত্ব দার্শনিক বাস্তবতার থাকতে পারে যেহেতু ঈশ্বর তার স্বর্গে একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে কখনই নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারেন না। হয় আমাদের অভিজ্ঞতা যথার্থ যা একটি সারগর্ভহীন শব্দগুচ্ছ মাত্র, যে শব্দগুচ্ছটি আগেরগুলোর থেকে কোন অংশে উত্তম না হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো– অথবা যথার্থ অভিজ্ঞতা বলেই কিছু নেই এবং আমাদের সত্তার জগৎ সম্পর্কে কারুর কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় সেই জগৎ কেবলমাত্র অধিবিদ্যার বইগুলোতেই রয়ে গেছে। এই উভয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয় যে ধর্মের সান্ত্বনাসমূহকে আমরা দর্শনে দেখতে পাই না। যদিও এমন কতকগুলি বোধ আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে এটা অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে যে দর্শন আমাদের আশ্বাস দিলেও দিতে পারে। আমাদের সকালগুলোকে সুন্দর করে কাটাবার উপায়কে আমরা দার্শনিকীকরণ করতেই পারি এই অর্থে। আমাদের সন্ধ্যাগুলোকে সুন্দর করে কাটাবার উপায় হিসেবে মদ্যপানকে আশ্বাসের উৎসরূপে তুলনা করা যেতে পারে। আবার আমরা দর্শনকে সৌন্দর্যবিদ্যাগতভাবে নিতে পারি। সম্ভবত আমাদের মধ্যে অনেকেই স্পিনোজাকে নিতে পারি। আমরা অধিবিদ্যাকে ব্যবহার করতে পারি মেজাজ তৈরি করবার সেই উপায় হিসেবে, যখন কবিতা ও সঙ্গীত, যা বিশ্ব সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন সম্পর্কে বিশেষ আচরণ প্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করে মনের পরিমাণবাচক অবস্থা ঠিক সেই অনুপাতে মূল্য পায় যে অনুপাতে কাব্যিক আবেগের মাত্রা উন্মোষিত হয়। কিন্তু তা বিশ্বাসসমূহের সভ্যতার উপর নির্ভর করে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের পরিতৃপ্তি, এই ধরণের ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, মনে হয় অধিবিদ্যাবিদদের পেশার ঠিক বিপরীত। এটা বাস্তব জগৎ ও তার অমঙ্গলজনক দিকগুলোকে ভুলে যাবার একটা সন্তুষ্টি। কয়েক মুহূর্তের জন্য, আমরা নিজেরা যে বাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছি তাকে ভুলে যাবার জন্য আমরা নিজেরাই নিজেদের প্ররোচিত করে থাকি। মনে হয় এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাডলে অধিবিদ্যাসমূহকে বিচার করেছেন। তিনি বলেন, যখন কাব্য, কলা এবং ধর্ম কোনরকম উৎসাহ জাগাতে পারে না, অথবা যখন চরম সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করবার কোন প্রবণতা তারা আর দেখায় না এবং সেইসব সমস্যাগুলোর সাথে একটা বোঝাঁপড়ায় আসে, যখন রহস্য-চেতনা ও জাদুমন্ত্র উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবার জন্য মনকে আর আকর্ষণ করে না এবং প্রেম জানে না কাকে সে ভালোবাসবে, সংক্ষেপে, যখন গোধূলির মুগ্ধ করার ক্ষমতা থাকে না তখন অধিবিদ্যাসমূহ নিরর্থক হয়ে পড়ে। এইভাবে অধিবিদ্যা আমাদের জন্য যে কাজ করে সেই একই প্রয়োজনে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ আমাদের জন্য সেই কাজ করে–কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তার মূল্য তার সত্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রসপেরোর জাদু আমাদের প্রেত আত্মাদের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে আমরা দ্য টেম্পেস্ট’-কে মূল্য দিই তা নয়, সৌন্দর্যবিদ্যাগত ভাবে আমরা তাকে মূল্য দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা অধিবিদ্যাসমূহকে মূল্য দিই না এই কারণে যে তা আমাদের প্রেত আত্মাদের জগতের সম্পর্কে খোঁজ দেয়। এর ফলে ধার্মিক আশ্বাস ও সৌন্দর্য-বিজ্ঞানগত সন্তুষ্টির মধ্যে একটা অনিবার্য স্বতন্ত্রতার সৃষ্টি হয়, যে ব্যাপারটাকে আমি স্বীকার করে নিই, কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে তাকে আমি অস্বীকার করি। সৌন্দর্য-বিজ্ঞানজাত সন্তুষ্টির জন্য বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন দৃঢ়বিশ্বাস থাকা একান্ত প্রয়োজন। যখন আমরা এই সন্তুষ্টি খুঁজে থাকি তখন অধিবিদ্যাকে বেছে নিতে পারি যা এই বিষয়ে আমাদের অনেকটা সন্তুষ্টি দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, ধর্মীয় আশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ব্যাপারটি একান্ত প্রয়োজন। আমি এই ব্যাপারে তর্কের অবতারণা করছি যে আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আমরা অধিবিদ্যা থেকে কখনই ধর্মীয় আশ্বাস পাই না।


যদিও সৌন্দর্য-বিজ্ঞানগত আবেগের রহস্যময় তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে বিতর্ককে পরিশুদ্ধ করে নেওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে তর্কে অবতীর্ণ হওয়া যায় যে যদিও আমরা অভিজ্ঞতা পুরোপুরি লাভ করি না, তবুও কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এর খুব কাছাকাছি যায় এবং এই ধরণের অভিজ্ঞতাগুলি, বলা যেতে পারে, কলা ও দর্শনের থেকে পাওয়া যায়। এই অভিজ্ঞতাজাত প্রভাব যা দর্শন ও কলা মাঝেমধ্যে আমাদের দিয়ে থাকে, তা গ্রহণ করা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অধিবিদ্যাগত তীব্র ভাবাবেগ সম্ভবত মানুষকে আবেগের দিক থেকে এতটাই সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে তোলে যা সম্পূর্ণভাবে তাদের কাছে আকাক্ষিত এবং মঙ্গলময় সুন্দর দৃষ্টির দ্বারা পরিবর্তিত জগৎ সম্পর্কে রহস্যময় এই চেতনা দর্শন কখনও কখনও দিয়ে থাকে। ব্র্যাডলে যেমন বলেছেন, কেউ কেউ এই পথে, তো কেউ কেউ অন্য আর এক পথে, কিন্তু দৃষ্ট জগতের ওপারে আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে থাকি। বিভিন্ন ভাবে আমরা উচ্চ কিছুকে দেখে থাকি, যা আমাদের সমথনেও করে আবার ছোট করেও রেখে দেয়, যা আমাদের নির্দোষ করে তোলে আবার আমাদের সেই নির্দোষিতাকে সমর্থনও করে। কিছু বিশেষ মানুষদের ক্ষেত্রে বিশ্বকে বোঝবার জন্য পরমেশ্বর সম্পর্কে এইরকম অভিজ্ঞতা অর্জন একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়…… এবং এইভাবে পরম সত্যকে জানবার জন্য এই ঘটনাটি আর একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


কিন্তু সমভাবে এই আশা করবার কোন কারণ নেই যে এইসব মানুষগুলো পরম সত্যকে দেখতে পাবে কিনা? যদি পরম সত্যে অবভাস ও সত্তার মতবাদের কোন সাদৃশ্য থাকে তবে তা থাকুক। আমি আবেগের মূল্য অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এটা অস্বীকার করি যে, এটা কোন অদ্ভুত ধরণের কৃপামূলক দৃষ্টি, অথবা দেবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এক অর্থে, সমস্ত অভিজ্ঞতা পরমেশ্বর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, কিন্তু অন্য আর একটি অর্থে, যেহেতু সব অভিজ্ঞতা সমভাবে একই কালে অবস্থিত, তাই তা পরমেশ্বর সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা নয়–যেমনভাবে’ পাণ্ডিত্যের অভিমান আমাকে কথা বলালো। অবভাস ও সত্তার মধ্যে অনতিক্ৰমণীয় ব্যবধান এতটাই সুগভীর যে, যতদূর আমি দেখতে পাই, কোন অভিজ্ঞতাকেই সত্তার অভিজ্ঞতার কাছাকাছি ভাবার কোন রকম উপায় নেই। এইজন্যই প্রশ্নের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাগুলির মূল্য সম্পূর্ণভাবে আবেগের গুণের উপর হওয়া আবশ্যক। কিন্তু ব্র্যাডলের নির্দেশ অনুযায়ী সত্যের কোনচরম মানকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করে নয়। যদি তাই হয়, সেগুলো কেবলমাত্র দার্শনিকীকরণের সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে, দর্শনের সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে না। তারা পরম সত্যকে প্রবর্তন করবার যুক্তি নির্মাণ করবে। কেননা সমস্ত ধরনের ফুল যারা যাবার পথে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে কিন্তু তারা তাদের এই প্রাপ্তির জন্য কোন পুরস্কার নির্মাণ করে না, যেহেতু এই সমস্ত ফুল রাজপথের প্রথমেই কেবলমাত্র বেড়ে ওঠে এবং আমরা আমাদের যাত্রা শেষ করার অনেক আগেই তারা মিলিয়ে যায় ঠিক তেমনভাবে যেমনভাবে আবির্ভূত সব কিছু আমাদের যাত্রা শেষে পৌঁছবার আগেই মিলিয়ে যায় ।


যে দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে আমি বললাম তা নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক কিছু নয়। যদি সাধারণভাবে তা গ্রহণীয়ও হয়ে থাকে তবু তা দর্শন অধ্যয়নে কোন রকম উন্নতি ঘটাবে না বলেই মনে হয়। আমি আমার গবেষণাকে বিচার করে দেখতে পারি এবং যদি সত্যই আমি তাই করি তবে এই নীতি অনুযায়ী করব যে, সেখানে সব কিছুই পচে গেছে, যেখানে মানুষের কাজ দুর্গন্ধময় মাছের জন্য কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমি এই বিষয়ে নির্দেশ দিতে আগ্রহী যে অধিবিদ্যা যখন ধর্মের স্থানকে যোগান দেবার রাস্তা খোঁজে তখনি সব থেকে বড় ভুলটি করে। আমি স্বীকার করি যে অধিবিদ্যা তা যোগান দিতে পারে। শুধু তাই নয় সে যোগান দিয়েও থাকে, কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে, তা সে করে থাকে নিজেকে অধিবিদ্যায় পরিবর্তিত করে। কোন অধিবিদ্যাকে বিজ্ঞানের মতো করে স্বীকার করে নেওয়া হয় না যা বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের দ্বারা বিচার্য এবং যার একমাত্র বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের দ্বারাই পরিচালিত হওয়া উচিত। আমাদের সবাইকে একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে অধিবিদ্যার মধ্যে আশ্বাসকে পাওয়ার কামনা প্রচুর পরিমাণে ভ্রমপূর্ণ যুক্তি এবং বুদ্ধিবিদ্যাগত অসততা তৈরি করেছে। যে-কোন ভাবেই হক, ধর্ম পরিত্যাগ এর থেকে আমাদের উদ্ধার করে থাকে। যেহেতু বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের কিছু কিছু মানুষের বিদ্যমান থাকে, সেহেতু এখনও বিশেষভাবে বিভ্রান্তিগুলির হাত থেকে তাদের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্র্যাডলেকে উদ্ধৃত করে আরও একবার বলা যেতে পারে, মানুষের প্রকৃতি এমন ধরণের যে একমাত্র একটি পথে তার প্রধান কামনা পূর্ণতায় পৌঁছাবে এবং সেই পথেই তাকে পাবার চেষ্টা করবে, সে যাই হক এবং জগৎ সে সম্পর্কে যা খুশীই ভাবুক না কেন। যদি সে তা না করে, তাহলে সে অতি নীচ।

ক্যাথলিক ও প্রোটেষ্ট্যান্ট সন্দেহবাদ প্রসঙ্গে


(১৯২৮ সালে লিখিত)


যদি কোন ব্যক্তি বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জাতির মুক্তচিন্তাসম্পন্ন মানুষের সাথে বেশি যোগাযোগ রাখে তবে সে ক্যাথলিক ও প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্মের উৎস দুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করবে। যদিও তারা অনেকটা কল্পনা করে নিতে পারে যে তারা সেই ধর্মতত্ত্বকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে যা যুবক বয়সে তাদের শেখানো হয়েছিল। প্রোটেষ্ট্যান্টও ক্যাথলিকদের মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক সেই রকম যে রকম পার্থক্য মুক্ত-চিন্তাবিদ ও বিশ্বাসীদের মধ্যে হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, প্রয়োজনীয় পার্থক্যটি আবিষ্কার করা হয়ত সোজা, যেহেতু ধর্মমত থেকে সরে যাবার সুস্পষ্ট প্রবণতার পেছনে তাদের লুকিয়ে রাখা হয় না। এ’সম্পর্কে একটা অসুবিধা আছে, আর তা হল, বেশিরভাগ প্রোটেষ্ট্যান্ট নাস্তিক ইংরেজ অথবা জার্মান, যখন বেশির ভাগ ক্যাথলিক হল ফরাসী। গিবনের মতো যে-সব ইংরেজ ব্যক্তি আছেন তারা ফরাসী চিন্তাভাবনার সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগের ফলে প্রোটেষ্ট্যান্ট ধরণের রীতির বদলে ক্যাথলিক মুক্ত-চিন্তাবিদদের চারিত্রিক গুণাগুণ অর্জন করেন। অধিকন্তু যে বড় ধরণের পার্থক্যটি পড়ে থাকে তা ঠিক কোথায় থাকে তা খুঁজে বার করবার প্রচেষ্টাটি আনন্দজনক হতে পারে।


যে-কেউ সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্যমূলক প্রোটেষ্ট্যান্ট চিন্তাবিদ হিসেবে জেমস মিলকে নিতে পারে । যিনি তাঁর পুত্রের দ্বারা রচিত “আমার পিতা’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে যেভাবে আবির্ভূত হয়েছেন, সে সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, আমার পিতা স্কচ প্রেসবাইটারিয়ানবাদ (একটি বিশেষ ধরণের গীর্জা যা প্রেসবাইটারদের শাসনে পরিচালিত হত এবং যে গীর্জাগুলো স্কটল্যান্ড গীর্জাগুলোর থেকে স্বাধীন ছিল। যেখানে স্বাধীন-চিন্তাকে কোনরকম বাধা দেওয়া হত না–অনুবাদক) প্রসূত কর্মকাণ্ডের দ্বারা শিক্ষিত ছিলেন। তিনি তাঁর নিজের অধ্যয়নপ্রসূত মননের দ্বারা আগেই যে বাইবেলের শেষ গ্রন্থে বা প্রত্যাদেশে বর্ণিত বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা নয়, যাকে সাধারণভাবে প্রাকৃতিক ধর্ম বলা হয়ে থাকে তাকেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমার পিতা সেই সমস্ত কিছুকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সবাই যা মনে করতে পারে এটা সেরকম ছিল না। এই প্রত্যাখ্যান প্রাথমিকভাবে যুক্তি-তর্ক-প্রমাণ প্রভৃতির উপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠেনি। তার ভিত্তি ছিল নৈতিকতা, যা এখনও বিদ্যাবুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। তিনি এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করা অসম্ভব বলে মনে করেছেন, যে জগৎ এত অশুভ শক্তিতে পূর্ণ সেই জগৎ একজন অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মঙ্গলময় ও ন্যায়পরায়ণ স্রষ্টার দ্বারা রচিত… ধর্মের প্রতি তার এই অনীহা, অর্থাৎ ধর্ম বলতে সাধারণত যা বোঝান হয়ে থাকে তার প্রতি অনীহা, লুক্ৰেতিউসের মতোই ছিল। তিনি এই অনুভব নিয়ে ব্যাপারটিকে দেখতেন যে এটা শুধু মানসিকভাবে প্রবঞ্চনাকরই নয়, এটা বিরাট ধরণের নৈতিক বিপদ। আমার পিতার কর্তব্যের আদর্শের সঙ্গে ধর্ম ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অসঙ্গতিকর ছিল। তিনি আমাকে ধর্ম সম্পর্কে তার বিশ্বাস সমূহ ও অনুভূতির বিরোধ মতো পোষণ করার অনুমতি দিতেন। প্রথম থেকেই এই বলে আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিলেন যে, কিভাবে জগতের আবির্ভাব হয়েছিল সে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তথাপি জেমস্ মিল নিঃসন্দেহে একজন প্রোটেষ্ট্যান্ট হয়েই রয়ে গিয়ে ছিলেন। তিনি আমাদের সংস্কারের প্রতি শক্তিশালী ভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠার শিক্ষা দিয়েছেন। স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে পুরোহিতদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য তিনি আমাকে সংস্কারের প্রতি শক্তিশালীভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠারও শিক্ষা দিয়েছিলেন।


এই সমস্ত ক্ষেত্রে জেমস্ মিল কেবলমাত্র জন নক্সের প্রেরণাকেই বহন করে চলেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। জন নক্স একটি চরমপন্থী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হয়েও সেই নৈতিক আগ্রহ এবং ধর্মতত্ত্বে উৎসাহকে ধরে রেখেছিলেন যা তাঁর পূর্বপুরুষদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করে তুলেছিল। প্রথম থেকে প্রোটেস্ট্যান্টরা তাদের বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের থেকে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের মতগুলোকে বিশ্বাস না করে। এইজন্য আরও একটি মতকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াটা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার নৈতিক উৎসাহ হিসেবে সমস্ত বিষয়ের সার।


এটাই প্রোটেষ্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের নৈতিকতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। প্রোটেষ্ট্যান্টদের কাছে সেই মানুষই অসাধারণ ভালো মানুষ যে কর্তৃত্বদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং ওয়রসের (Worms) ভোজন উৎসবে লুথারের মতো করে মতবাদসমূহকে গ্রহণ করে। প্রোটেষ্ট্যান্টদের মঙ্গলময়তা সম্পর্কে ধারণা কিছুটা ব্যক্তিতান্ত্রিক এবং বিচ্ছিন্ন। আমি নিজেই একজন প্রোটেষ্ট্যান্ট হিসেবে শিক্ষিত হয়েছি এবং সেই সময় অনেকগুলি বাক্য আমার যুব মনে যথেষ্ট পরিমাণ দাগ কেটে গেছে। সেটি হল, অনেক পথ অনুসরণ কর না, তাহলেই অনিষ্ট করবে। আমি সচেতনতার সঙ্গে বলতে পারি আজকের দিনটাতেও এই বাক্যটি আমার সুগভীর কাজগুলোতে প্রভাব সৃষ্টি করে। ধার্মিকতা সম্পর্কে ক্যাথলিকদের ধারণা একেবারেই আলাদা তাদের কাছে সমস্ত রকম ধার্মিকতাই এমন বস্তু যার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। কেবলমাত্র ঈশ্বরের কণ্ঠ হিসেবে বিবেকের কথা মেনে নিলেই চলবে না। প্রত্যাদেশ বা বাইবেলের শেষ গ্রন্থের শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র গীর্জার কর্তৃত্বকেও মেনে নিতে হবে। এই ব্যবস্থা ক্যাথলিকদের ধার্মিকতার ধারণাকে প্রোটেষ্ট্যান্টদের থেকে অনেক বেশি সামাজিক করে তুলেছে এবং তাদের প্যাঁচকলকে আরও বেশি বড় করে তোলে যখন সে গীর্জার হয়ে কাজ করে। প্রোটেষ্ট্যান্টরা তাদের সেই বিশেষ প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়কে পরিত্যাগ করে যেখানে তারা লালিত-পালিত হয়েছিল এবং তা করে এই কারণে যে বহু আগে এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতারা বর্তমান যুগ অনুযায়ী কাজগুলো করে যেতে পারেনি বলে। এইজন্য নতুন সম্প্রদায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলাটাই এখন প্রোটেষ্ট্যান্টদের মানসিকতা। অন্যদিকে ক্যাথলিকরা চার্চের সমর্থন ব্যতীত নিজেদেরকে অসহায় অনুভব করে। যদিও সে যুক্ত হতে পারে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে, যেমন পরস্পর সহযোগিতা ও ভ্রাতৃপ্রেমের আদর্শে স্থাপিত কোন গুপ্ত সমিতিতে। কিন্তু সে হতাশাপ্রসূত বিদ্রোহ সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ থাকে। সে সাধারণত তার অবচেতন মনের যে-কোন মাত্রায় এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখে যে নৈতিক জীবন গীর্জার সভ্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতএব স্বাধীন-চিন্তাবিদদের ক্ষেত্রে উচ্চ ধরণের ধার্মিকতা পোষণ করাটা অসম্ভব হয়ে যায়। এই ধরণের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে তার মেজাজ অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র পথে নিয়ে যায়। যদি সে আনন্দময় ও সহজ ধরণের ব্যক্তি হয় তবে সে উইলিয়াম জেমসের মতে সেই ছুটির দিনকে ভোগ করতে পারবে যাকে তিনি মরাল হলিডে (Moral holiday) বলে উল্লেখ করেছেন। এই ধরণের ব্যক্তির ক্ষেত্রে যথার্থ উদাহরণ হল মতে, যিনি ব্যবস্থাসমূহ ও সিদ্ধান্তসমূহের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শন করে তার বিদ্যাবুদ্ধিগত হলিডে (Holiday) পালন করতেন। আধুনিক মানুষেরা এটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে নবজাগরণ ঠিক কতটা বুদ্ধিবিদ্যাগত মনোভাবের বিরুদ্ধ আন্দোলন ছিল। মধ্য যুগে বস্তুকে প্রমাণ করাটাই ছিল একটা প্রথা। নবজাগরণ এই প্রথাসমূহকে পর্যবেক্ষণ করার অভ্যাস আবিষ্কার করেছিল। যে ন্যায়-এর সঙ্গে মতে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন সেই ন্যায়গুলি হল তাই যা বিশেষ নঞর্থক ধারণাকে প্রমাণ করত, উদাহরণস্বরূপ, তিনি যখন তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতেন এই সত্য প্রতিপন্ন। করার জন্য যে যারাই অরিউসের মতো মারা গেছে তারা সবাই অরিউসের মতো প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী ছিল না। বিভিন্ন মন্দ লোক যারা ওই একইভাবে মারা গেছে তাদের সংখ্যা গণনা করার পর, তিনি এই বলে এগিয়েছেন, কিন্তু কি আশ্চর্য! অরিউসকেও দেখা গেল একই সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবান হতে। ঈশ্বরের উদ্দেশ্য, জগতের ভালো ও মন্দ ভাগ্যের চেয়ে আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে ভালোদের এমন কিছু আছে যার কাছ থেকে আশা করা যায় এবং মন্দেরা এমন কিছু যাকে ভয় করতে হয়। প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন-চিন্তাবিদদের বিপক্ষে ব্যবস্থা সম্পর্কীয় অপছন্দকর কিছু বৈশিষ্ট্য ক্যালিকদের রয়ে গেছে। কারণ হিসেবে আবার বলতে হয় যে ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বের ব্যবস্থা এতটাই ভয়ঙ্কর যে কোন ব্যক্তির পক্ষেই এটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না যে (যদি সে প্রবল বীরত্বের অধিকারী না হয়) সে অন্যান্যদের এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য তৈরি করবে।


ক্যাথলিক স্বাধীন চিন্তাবিদ তদনুযায়ী নৈতিক ও বিদ্যাবুদ্ধিগত ধর্মকর্মকে পরিত্যাগ করতে আগ্রহী, যখন প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীনচিন্তাবিদ উভয়কে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। জেমস মিল তাঁর পুত্রকে শিক্ষা দিয়েছিলেন এই প্রশ্ন করতে, কে আমাকে তৈরি করেছে? আমাদের মন এর কোন উত্তর দিতে পারে না। কারণ আমাদের এমন কোন অভিজ্ঞতা নেই অথবা এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান নেই যার থেকে এর উত্তর দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে যে-কোন উত্তরই সেই অসুবিধার সৃষ্টি করে যা আমাদের এক ধাপ পিছিয়ে নিয়ে যায় । যেহেতু এই প্রশ্নটি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে যে প্রশ্নে পরিবর্তিত করে তা হল ‘কে ঈশ্বরকে তৈরি করেছেন? এর সঙ্গে তুলনীয় ভলতেয়ারের সেই উক্তি যা তিনি তাঁর দর্শনের অভিধানে (Dictionaire philosophique) করতে বাধ্য হয়েছেন। ঈশ্বর’ (Dieu) নামক প্রবন্ধটি নিম্নলিখিতভাবে শুরু হয়েছে; আরকাদিউসের রাজত্বের সময়, লোগোম্যাকোস, কনস্টানটিনোপোলের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক স্কাইথিয়ায় যান এবং কলচিলস্ সীমান্তে জেফিরিন নামক উর্বর সমভূমিতে ককেসাসের পাদপৃষ্ঠে অবস্থান করেন। প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ মানুষ ডডিডাক তখন বিরাট ভেড়ার খোয়াড় ও বিশাল খামারের মধ্যবর্তী একটি বড় লম্বা চওড়া ঘরে ছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী, পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা, পিতা-মাতা ও ভৃত্যদের সঙ্গে অল্প পরিমাণ আহার করে সবার সঙ্গে ঈশ্বরের স্কৃতিবাচক সঙ্গীত গাইছিলেন।


প্রবন্ধটি একই পথে এগিয়ে গেছে এবং এই সিদ্ধান্তে এসে শেষ হয়েছে, সেই সময় থেকে আমি এই সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম যে আর কখনও তর্ক করব না। কেউ সেই সময়টাকে কল্পনাও করতে পারবে না যখন থেকে জেমস্ মিল কোন বিষয়ে, সে যতই কম মহান হক, আর তর্ক না করার সংকল্প নিয়েছিলেন এবং যে ঘটনাকে তিনি একটি উপকথার দ্বারা বর্ণনা করেছেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসঙ্গতির শিল্পকে অভ্যাস করেননি, যেমন ভলতেয়ার লাইবনিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে করেছেন : ‘তিনি উত্তর জার্মানিতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন যে ঈশ্বর কেবল একটা জগঞ্জ তৈরি করতে পেরেছিল।’ যে নৈতিক আগ্রহের সঙ্গে জেমস মিল জগতে অশুভ শক্তির অস্তিত্বকে জোরালো করে দেখিয়েছেন তার সঙ্গে পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে ভলতেয়ারের উক্তির তুলনা করলে দেখা যাবে যে তিনিও সেই একই কথা বলেছেন : ‘অশুভ শক্তির অস্তিত্ব আছে ‘এ’কথা মজার ছলে লুকুলুস অস্বীকার করে বলতে পেরেছিলেন, যিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং যিনি তাঁর স্ত্রী ও বন্ধুদের সাথে অ্যাপোলোর বৈঠকখানায় বসে সুখাদ্য খাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেওয়া হ’ক, তিনি দেখবেন কিছু শোচনীয় অবস্থাসম্পন্ন মনুষ্যজাতিকে এবং তাঁকে জ্বরে ভুগতে দেওয়া হ’ক, তিনি নিজের কাছেই নিজে শোচনীয় হয়ে যাবেন।


মঁতে এবং ভলতেয়ার আনন্দময় সন্দেহবাদের চরম উদাহরণ। বহু ক্যাথলিক স্বাধীন চিন্তাবিদ আনন্দময়তার থেকে অনেক দূরে থাকেন এবং তারা সর্বদাই কঠোর বিশ্বাস ও গীর্জার পরিচালনার প্রয়োজনীয়তাকে মনে মনে অনুভব করেন। এই ধরণের মানুষেরা কখনও কখনও কমুনিষ্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ বিষয়ে লেনিন ছিলেন চরম উদাহরণ। লেনিন একজন প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন চিন্তাবিদের থেকে তার বিশ্বাসকে গ্রহণ করেছিলেন (ইহুদি ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মানসিকতাকে আলাদা করে পৃথক করা যায় না, কিন্তু তার পূর্ববর্তী বাইজেনটাইনরা তাকে বাধ্য করেছিল গীর্জা সৃষ্টি করতে যে গীর্জা বিশ্বাসের মূর্তরূপ। এর থেকে কম সফলতা প্রাপ্ত উদাহরণ হল অগাষ্ট কোঁৎ-এর প্রচেষ্টা। মানুষ তার মর্জি অনুযায়ী, যদি তার মর্জি অস্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বা ব্যাধিগ্রস্ত না হয়, আগে বা পরে গীর্জার কোরকে স্থানান্তরিত হয়। দর্শনের রাজ্যে একটি উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত মি. সানটাইয়ানা, যিনি সর্বদা গোড়ামী ব্যাপারটাকে ভালোবেসেছেন, কিন্তু যে ঘৃণাজনক ব্যাপারস্যাপার ক্যাথলিক গীর্জা আয়োজন করে থাকে তার চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিগত ভাবে কম ঘৃণাজনক ব্যাপারের জন্য তিনি লালায়িত। তিনি সর্বদা ক্যাথলিক গীর্জার প্রথা হিসেবে ক্যাথলিকবাদকে পছন্দ করতেন এবং পছন্দ করতেন তার রাজনৈতিক প্রভাবকে। কিন্তু উদারভাবে বলতে গেলে তিনি পছন্দ করতেন সেই আদর্শকে যা গীর্জা গ্রীস ও রোম থেকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইহুদিদের কাছ থেকে গীর্জা যা গ্রহণ করেছে তাকে তিনি পছন্দ করতেন না। এর সঙ্গে অবশ্য এই কথাও বলা যায়, যে প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে ক্যাথলিকবাদ ঋণী ছিল তাদের তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি এই ইচ্ছাও পোষণ করতে পারতেন যে লুক্রেতিউস দিমোক্রেতিউসের মানসিকতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা গীর্জার উপর নিজের আদর্শের গীর্জা প্রতিষ্ঠার কাজে সফলতা পেলে ভালোই হত। কেননা তার বিদ্যাবুদ্ধিতে বস্তুবাদ সর্বদা একটা আবেদন রাখতে পেরেছে এবং তার আগের কাজগুলোতে ক্যাথলিকবাদ ও বস্তুপুজোর স্বাতন্ত্রকে অন্যকিছুতে নিয়ে গিয়ে পুরস্কৃত করার চেয়ে তিনি বস্তুপুজোকেই আপন করে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্ভবত এই অনুভব করতে পেরেছিলেন, যে গীর্জাগুলোকে যারা পছন্দ করে তারা সত্তার রাজ্যের দ্বারা আবদ্ধ। মি. সানটাইয়ানা যদিও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং তিনি আমাদের কোন আধুনিক শ্রেণীর সঙ্গে মানানসই নন। তিনি বাস্তবে নবজাগরণপূর্ব ব্যক্তি, যার সঙ্গে ঘিবেলিসের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে যে ঘিবেলিসকে দান্তে নরকে শাস্তি ভোগ করতে দেখেছিলেন এপিকিউরাসের মতবাদের সঙ্গে লেগে থাকার জন্য। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে জোর করে ডেকে আনা অতীতের স্মৃতিচারণজনিত বিষণ্ণতা, যে বিষণ্ণতা আমেরিকার সঙ্গে অনিচ্ছুক ও দীর্ঘ সম্পর্ক রাখতে গিয়ে স্পেনীয়দের মেজাজে ঘটেছিল।


সবাই জানে কিভাবে জর্জ এলিয়ট এফ-ডব্লু-এইচ মেয়ারকে শিখিয়েছিলেন যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তবুও আমাদের ভালো হওয়া আবশ্যক। এই ধরণের বিশেষ আচরণের দিক থেকে জর্জ এলিয়ট একজন প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন-চিন্তাবিদ। খুব পরিষ্কার করে বলতে গেলে একজন বলতেই পারে যে প্রোটেষ্ট্যান্টরা ভালো হওয়াটাকে পছন্দ করে এবং নিজেদের ভালো রাখার জন্য সেই অনুযায়ী ধর্মতত্ত্বের আবিষ্কার করে থাকে, যেখানে ক্যাথলিকরা খারাপভাবে থাকাটাকে পছন্দ করে অথচ তারা তাদের প্রতিবেশীদের ভালো রাখার জন্য ধর্মতত্ত্বের আবিষ্কার করে থাকে। এখানেই ক্যাথলিকদের সামাজিক চরিত্র এবং প্রোটেষ্ট্যান্টদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিহিত । একজন মৌলিক প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন-চিন্তাবিদ হিসেবে জেরমি বেন্থাম এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে সব সুখের মধ্যে সব থেকে বড় সুখ আত্ম-অনুমোদনের সুখ। এইজন্য তিনি কখনও খুব বেশি আহার কিংবা মদ্যপান করতেন না। কেননা তাতে বেসামাল জীবনের অপরাধবোধ কাজ করে, অথবা একই কারণে তিনি তার প্রতিবেশীর অর্থ কোন ভাবে চুরি করাটাও পছন্দ করতেন না, কেননা এইসব কোন জিনিসই তাকে এমন কোন দারুণ রোমাঞ্চ দিত না যা তিনি জ্যা হরনারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন। কিন্তু এই বিষয়টি খুব সহজ কথা নয়। তিনি বড়দিনের মটরদানা ত্যাগ করতেন তাকে ফিরে পাবার জন্য। অন্যদিকে ফ্রান্সে কঠোর আত্ম-সংযম নির্ভর নৈতিকতাকে প্রথমে ভেঙে ফেলা হল, তারপর, ফলস্বরূপ ধর্মতত্ত্বগত সন্দেহ পরে এলো। এই ধরণের বিভেদ সম্ভবত জাতিগত কিন্তু কোনরকম শাস্ত্রীয় বিভেদ নয়।


ধর্ম ও নৈতিকতার সঙ্গে যোগটা এমন যার সম্পর্কে জানতে গেলে নিরপেক্ষভাবে ভৌগোলিক অধ্যয়নের প্রয়োজন। আমার মনে আছে বৌদ্ধ সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হবার পর জাপানে পৌরোহিত্য ব্যাপারটি বংশনুক্রমিক হয়ে ওঠে। আমি এই বিষয়ে অনুসন্ধান করেছি যে কিভাবে এটা সম্ভব হত যখন কারুকে পুরোহিত হতে হবে আবিবাহিত হতে হত। কেউই আমাকে এই বিষয়ে সন্ধান দিতে পারেনি। কিন্তু শেষ এই ঘটনাটি সম্পর্কে একটি গ্রন্থ থেকে নিশ্চিত হই। এই ধরণের সম্প্রদায় শুরু হয়েছিল বিশ্বাসজাত ন্যায়বিচারমূলক মতবাদের দ্বারা এবং সেখানে এই ধরণের সিদ্ধান্ত ছিল যে যতদিন বিশ্বাস শুদ্ধ থাকবে ততদিন কোন পাপই কিছু করতে পারবে না। ফলস্বরূপ, সমস্ত পৌরোহিত্য পাপে পর্যবসিত হল। কিন্তু একমাত্র যে পাপ তাদের উত্তেজিত করে তুলেছিল তা হল বিবাহ। সেইদিন থেকে আজ আমাদের যুগ পর্যন্ত এই সম্প্রদায়ের পুরোহিতরা বিবাহ করে চলেছে। কিন্তু এছাড়া অন্যদিক থেকে তারা দোষমুক্ত জীবনযাপন করে। সম্ভবত যদি আমেরিকাকে বিবাহ একটি পাপ বলে বিশ্বাস করানো যেতে পারত তবে তারা আর কোনদিন বিবাহ-বিচ্ছেদের তাগিদ অনুভব করত না। হয়ত ‘পাপ’-এর বহুসংখ্যক তকমা লাগানো ব্যাপারটা জ্ঞানী সমাজব্যবস্থার সারসত্তাজাত অক্ষতিকর কার্য ছিল, কিন্তু সেই পাপ যারা সম্পাদন করত তাদেরই সহ্য করতে হত। এইভাবেই কারুর ক্ষতি না করে শয়তানের আনন্দ অর্জিত হতে পারত। শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে এই ধরণের ঘটনাই আমার উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি শিশুরই দুষ্টু হতে ইচ্ছে করে এবং তাকে যদি যুক্তিসঙ্গত ভাবে শেখানো হয়, তাহলে সে তার দুষ্টুমি করার ভাবাবেগটিকে চরিতার্থ করবে প্রকৃত কোন ক্ষতিকারক কার্য করার মধ্যে দিয়ে। যদি তাকে এই শিক্ষা দেওয়া হয় যে রবিবারে তাস খেলাটা একটা বাজে ব্যাপার অথবা একইভাবে যদি তাকে বলা হয় শুক্রবারে মাংস খেতে তাহলে সে তার পাপমূলক ভাবাবেগটিকে চরিতার্থ করতে পারে কারও কোন ক্ষতি না করে। কিন্তু আমি কার্যের এই রকম কোন আদর্শের উপর বিশ্বাস রাখি না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রকম ঘটনা, যার সম্বন্ধে আমি একটু আগেই বলেছি, তা নির্দেশ করে যে এই ধরণের ব্যাপারকে অনেক বেশি গ্রাহ্য বলা যেতে পারে।


সেই পার্থক্যের উপর খুব বেশি জোর দেওয়ার দরকার নেই যে পার্থক্যটিকে আমরা প্রোটেষ্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক স্বাধীন চিন্তাবিদদের মধ্যে বেশি করে দেখাতে চেস্টা করি। উদাহরণস্বরূপ, অষ্টাদশ শতকের বিশ্বকোষবিদ এবং দার্শনিকরা প্রোটেষ্ট্যান্ট ধরণের ছিলেন কিন্তু কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েও আমি একথা বলবো যে স্যামুয়েল বাটুলার ছিলেন ক্যাথলিক ধরণের। যদি কেউ লক্ষ্য করতে চায় তবে যে মূল পার্থক্যটি ধরা পড়বে সেটি হল যে ঐতিহ্যের থেকে প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন চিন্তাবিদদের বেরিয়ে আসাটা প্রাথমিকভাবে বিদ্যাবুদ্ধিগত ব্যাপার ছিল, সেখানে ক্যাথলিক স্বাধীন চিন্তাবিদের কাছে ছিল তা বাস্তব। মৌলিক প্রোটেষ্টান্ট স্বাধীন চিন্তাবিদরা এমন কিছু করার সামান্য আকাক্ষাও করতে না যা তার প্রতিবেশী নাকচ করে দেয় তাদের বংশপরম্পরাগত মতবাদের সমর্থনে। দুই খণ্ডে হার্বার্ট স্পেনসারের সঙ্গে ঘরোয়া জীবন’ নামক গ্রন্থটি (বহু গ্রন্থের মধ্যে একটি আনন্দজনক গ্রন্থ) সেই দার্শনিকের সম্পর্কে একটি সাধারণ মতো দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করেছে যেখানে বলা হয়েছে তার উন্নত নৈতিক চরিত্র ছাড়া আর কিছুই তাঁর সম্পর্কে বলার নেই। হার্বার্ট স্পেনসার, বেনথাম, মিল অথবা যে-কোন স্বাধীন চিন্তাবিদ যে উদ্দেশ্যে তাদের কাজগুলো করে গেছেন এবং যে উদ্দেশ্যটা ছিল আনন্দই জীবনের শেষ লক্ষ্য তা তাঁদের বেলায় ঘটেনি। আমার মতে তারা নিজেরা যে আনন্দের খোঁজ করেছিলেন তা কখনও ঘটেনি, অন্যদিকে ক্যাথলিকরাও তাদের মতো করে ওই একই সিদ্ধান্তে বাঁচার তাগিদে নিজেদের কাজ চালিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা যেতে পারে যে জগৎটা ক্রমশ্যই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন চিন্তাবিদ তার চিন্তা ও কার্যের ক্ষেত্রে সবরকম যোগ্য কিন্তু এই ব্যাপারটি প্রোটেষ্ট্যান্টবাদের সাধারণ অবক্ষয়ের লক্ষণ। পুরানো যুগগুলিতে প্রোটেষ্ট্যান্ট স্বাধীন চিন্তাবিদরা স্বাধীন প্রেমের সমর্থনে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্য ছিল এবং তারা একটি দিনও কঠোর অবিবাহিত জীবনযাপন করত না। আমি মনে করি তার পরিবর্তনটা সত্যিই দুঃখজনক। যে-কোন মহান যুগ এবং মহান ব্যক্তি কঠোর ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার মধ্যে দিয়েই উখিত হয়েছেন। কঠোর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় নিয়মানুবর্তিতা ও তার প্রতি লেগে থাকার নিষ্ঠা। অন্যদিকে এই ব্যবস্থার ভাঙন প্রচুর পরিমাণ শক্তিকে নির্গত করে। তবে এটা ভাবা ভুল হবে যে ভাঙনের প্রথমেই যে প্রশংসনীয় ফলসমূহ অর্জিত হয় তা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ বলতে একটি নির্দিষ্ট কঠোর কার্যকে বোঝায়, এর সঙ্গে থাকে চিন্তাভাবনার নমনীয়তা, কিন্তু একমাত্র পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত সন্ধিক্ষণগুলির সময় ছাড়া এই ধরণের সাধনা অর্জন করাটা দুরবগাহ হয়ে ওঠে। একইভাবে পুরানো ভাবাদর্শগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তখন যখন বিবাদের প্রয়োজনীয়তার মধ্য দিয়েই নতুন অনমনীয় ধর্মমতসমূহ বেড়ে ওঠে। রাশিয়ায় বলশেভিক ঈশ্বর বিশ্বাসীরা লেনিনের দেবত্বের উপর সন্দেহ ছুঁড়ে দিয়েছিল এবং তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে অন্য কারও সন্তানকে ভালবাসাটা অন্যায় নয়। চীনদেশের কুয়োমিতাঙ ঈশ্বর বিশ্বাসীরা সান-ইয়াৎ-সেনকে অবশ্যই সংরক্ষণ করবে এবং কুনফুসিয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য কদাচিৎ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। আমার এটাই ভয় যে মুক্তির অবক্ষয় মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে এত জটিল করে যে তারা কিছু কিছু বিবাদীয় ধর্মমতের সঙ্গে লেগে থাকার থেকে সম্পূর্ণ বিরত হবে। সম্ভবত বিভিন্ন ধরণের ঈশ্বর বিশ্বাসীরা একটি গোপন সমাজে সম্মিলিত হবে এবং তারা সেইসব পদ্ধতিসমূহে ফিরে যাবে যেগুলো বেল তার শব্দকোষে আবিষ্কার করেছে। সেখানে এটাই সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে যে সাহিত্যবিষয়ক শৈলীর উপর মতামতের নির্যাতন যে-কোন মাত্রায় প্রশংসনীয় প্রভাব সৃষ্টি করবে।

মধ্যযুগে জীবন যেমন


আমাদের নিজেদের পক্ষপাতিত্বকে মানিয়ে নেবার ক্ষেত্রে মধ্যযুগে আমাদের ছবি অন্যান্য যুগগুলোর চাইতে অনেক বেশি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সেইসব ছবিগুলো কখনও অতি কালো হয়ে পড়েছে আবার কখনও অতি গোলাপী হয়ে পড়েছে। অষ্টাদশ শতক নিজেই নিঃসন্ধিগ্ধভাবে মধ্যযুগগুলোকে কেবলমাত্র বর্বর বলে চিহ্নিত করেছে। গীবনের কাছে সেই সময়কার মানুষগুলি আমাদের ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার অসঙ্গতি রচনা করেছিল এবং তা সেই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল। যে অভিজ্ঞতাপ্রসূত যুক্তি গিলোটিনের দিকে পরিচালিত হয়েছিল তা বীরসম্প্রদায়ের যুগ’-এর গৌরবকে আরও গৌরবান্বিত করে তুলেছিল এবং ইংরাজী ভাষাভাষীদের কাছে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল স্যার ওয়াল্টার স্কটের দ্বারা। গড়ে প্রায় সকল ছেলে ও মেয়ে এখনো মধ্যযুগগুলোর রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত। এইসব ছেলেমেয়েরা মনে মনে কল্পনা করে সেই যুগটাকে যখন নাইটরা বর্ম পরিধান করে হাতে বল্লম নিয়ে বলত ‘সত্য বটে’ এবং আমার পবিত্রভূমির নামে শপথ করে বলছি, অবশ্যই তারা একদিকে ছিল যেমন বিনীত অন্যদিকে ছিল রাগান্বিত। যখন সব মহিলারাই ছিল সুন্দরী ও বিষণ্ণ কিন্তু গল্পের শেষে তারা নিশ্চয়ই উদ্ধার পেত। আর এক রকম দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পেতে পারি যেটাকে আমরা তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বলব, যেটা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও কিছুটা দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির মতো যা মধ্যযুগগুলোকে প্রশংসা করে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি হল যাজকীয় দৃষ্টিভঙ্গি যা সংস্কারকরণকে ঘৃণা করে জন্ম নিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জোর দেওয়া হয়েছে ভক্তি, ধর্মীয় গোঁড়ামী, পাণ্ডিত্যপূর্ণ দর্শন এবং গীর্জার দ্বারা খ্রীষ্টীয় সাম্রাজ্যের একত্রীকরণের উপর। রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির মতোই এই দৃষ্টিভঙ্গিও যুক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াটা অপেক্ষাকৃত কম ঋণাত্মক, যুক্তির ছদ্মবেশে যা চিন্তাভাবনার একটি বড় ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে এবং যা একসময় জগৎকে দমিয়ে রেখেছিল ও ভবিষ্যতে আবার দমিয়ে রাখতে পারে।


এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গিগুলোতেই সত্যের উপকরণ আছে। মধ্যযুগগুলো ছিল কর্কশ, তারা ছিল বীরত্বব্যঞ্জক ও পবিত্র। কিন্তু আমরা যদি একটি সময়কে সত্য করে দেখতে চাই তবে তাকে আমাদের নিজেদের সময়টার বিপরীত সময় হিসেবে দেখলে চলবে না– তা সেই সময়ের সুবিধা বা অসুবিধা যার পরিপ্রেক্ষিত্রেই হক না কেন। সেই সময়টাকে আমাদের দেখতে চেষ্টা করতে হবে ঠিক সেইভাবে যেরকম তা ছিল সেই সব মানুষগুলোর কাছে যে মানুষগুলো তার মধ্যে বসবাস করত। সর্বোপরি, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মহাযুগে বেশিরভাগ মানুষই ছিল সাধারণ যারা ঐতিহাসিকদের বড় বড় বিষয়ের চেয়ে তাদের প্রতিদিনের রুটির চিন্তায় ব্যস্ত থাকত। এইসব সাধারণ মরণশীল মানুষদের ছবি আঁকা হয়েছিল ‘মেডিয়াভেল পিপল’ নামকমিস্ এলিন পাওয়ারের একটি মনোরম গ্রন্থে। সে গ্রন্থে শারলেমা থেকে সপ্তম হেনরী পর্যন্ত সময়টিকে ধরে রাখা হয়েছিল। তাঁর গ্যালারীতে একমাত্র যে বিখ্যাত মানুষটির ছবি রাখা ছিল তার নাম মার্কোপোলো। এছাড়াও পাঁচটা কি তার বেশি যেসব ব্যক্তিদের ছিল তাদের পরিচয় ছিল অস্পষ্ট কিন্তু পরে তাদের পরিচয় খুঁজে পাওয়ার ফলে তাদের জীবন পরিচয়কে নতুন করে তৈরি করা গেছে। বীরত্ব যা অভিজাত সম্প্রদায়গত বিষয় ছিল তা এই গণতান্ত্রিক ইতিবৃত্তে স্থান পায়নি। সেখানে ভক্তি প্রদর্শিত হয়েছে চাষা ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের দ্বারা। কিন্তু যাজকীয় সম্প্রদায়ের দ্বারা ভক্তির প্রদর্শন দেখানো হয়নি এবং অষ্টাদশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে যে রকম বর্বর মানুষদের দেখার আশা করা হয়েছিল সেখানে তা ঘটেনি, সেখানে প্রতিটি মানুষই ছিল কম বর্বরোচিত। যদিও গ্রন্থটিতে বর্বরোচিত দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে একটি আশ্চর্যরকমের বৈপরীত্য দেখানো হয়েছে। এই বৈপরীত্যটি ছিল নবজাগণের আগে ভেনিশিয়ান শিল্পকলা ও চতুর্দশ শতকে চৈনিক শিল্পকলার মধ্যে। এখানে দুটি ছবিকে দেখানো হয়েছে। একটি ভেনেশিয়ান শিল্পরীতিতে আঁকা মার্কোপোলোর জাহাজে ওঠার দৃশ্য এবং আর একটি চতুর্দশ শতকে চৈনিক শিল্পরীতিতে আঁকা চাও মেঙ্গ-ফু-এর স্থল দৃশ্য। মিস্ পাওয়ার বলেছেন, একটি (যেটি চাও মেঙ্গ-ফু-এর দ্বারা নির্মিত) স্পষ্টতই উন্নত শিল্পের নিদর্শন এবং অন্যটি শিশুসুলভ সভ্যতা ও প্রায় গেঁয়ো শিল্পের নমুনা। ছবি দুটোর মধ্যে তুলনা করতে গেলে লেখিকার কথাকে কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।


লেডেনের অধ্যাপক হুইজিঙ্গার দ্বারা লিখিত ‘দ্য ওয়েনিং অব দ্য মিড়ল এজেস’ নামক সাম্প্রতিক গ্রন্থটি ফ্রান্স ও ফ্ল্যান্ডারস্-এ চতুর্থ দশম ও পঞ্চদশ শতক সম্পর্কে অসাধারণ সব উৎসাহহাদ্দীপক ছবি দিয়েছে। এই গ্রন্থে বীরত্বকে এমন পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে যে তা মনোযোগ আকর্ষণ করে। বীরত্বকে এখানে রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখানো হয়নি। তাকে দেখানো হল এমন একটা পরিশ্রমসিদ্ধ খেলা হিসেবে যা উচ্চবিত্ত শ্রেণী আবিষ্কার করেছিল তাদের অসহ্য বিরক্তিকর জীবনে আনন্দ পাবার জন্য। বীরত্বের প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল প্রেম সম্পর্কে অদ্ভুত ধরণের ভাবুক কল্পনা, যে প্রেমে অতৃপ্ত হওয়াটাকেই আনন্দকর বিষয় হিসেবে ধরা হত। দ্বাদশ শতকে যখন প্রেমের কাব্যিক কল্পনার অন্তঃস্থলে অতৃপ্ত কামনার স্থান troubadours of Provence (প্রভেন্সের সেইসব কবি যারা বীরত্বব্যঞ্জক প্রেমের উপর কাব্য রচনা করেছিল এবং একাদশ শতক থেকে এয়োদশ শতক পর্যন্ত তারা তাদের রচনা ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিল অনুবাদক) দখল করল, তখন সভ্যতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। প্রণয়গত কাব্য…নিজেই মূল বিষয় হিসেবে কামনার সৃষ্টি করত এবং ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরে করে প্রেমের কল্পনার সৃষ্টি করত।’


উপরোক্ত গ্রন্থে একথাও পাওয়া যায় যে উচ্চবিত্ত শ্ৰেণীদের অস্তিত্ব তাদের বিদ্যাবুদ্ধিগত ও নীতিগত মতো হিসেবে সাহিত্য কলা মন্দিরে সুরক্ষিত আছে যা ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য যুগগুলোতে সভ্যতার আদর্শ এতটা পরিমাণে প্রেমের কল্পনার সঙ্গে মিশতে পারেনি। ঠিক যেরকম ভাবে পাণ্ডিত্যবাদ মধ্যযুগে সমস্ত রকম দর্শনের একটিমাত্র কেন্দ্রকে খুঁজে নেবার জন্য বৃহৎ প্রচেষ্টায় প্রতিনিধিত্ব করেছিল, তেমনি প্রণয়গত প্রেমের তত্ত্ব অপেক্ষাকৃত ছোট পরিধির মধ্যে সেই সমস্তকিছুকে নিজের কাছে ধরে রেখেছিল যা মহৎ জীবনের অন্তর্ভুক্ত।


মধ্যযুগের অনেক কিছুকেই রোমান ও জার্মান ঐতিহ্যের মধ্যে বিবাদরূপে বর্ণনা করা হয়। একদিকে ছিল গীর্জা আর একদিকে ছিল রাষ্ট্র। একদিকে ছিল ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন আর একদিকে ছিল বীরত্ব ও কাব্য। একদিকে ছিল আইন আর একদিকে ইন্দ্রিয়-আনন্দ, আসক্তিগত ভাবাবেগ এবং সব রকম নৈরাশ্যজনক অবস্থা ও জড়বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের উন্মাদনা। রোমের অবস্থা সেই আগের মতো ছিল না যে সময়টা কনষ্টানটিন ও জাষ্টিনিয়ানের সময় ছিল, এতদসত্ত্বেও সেখানে তখনও এমন কিছু ছিল যা অশান্ত জিনিসগুলোর জন্য প্রয়োজন ছিল এবং যাকে ছাড়া অন্ধকার যুগের থেকে সভ্যতার পুনরুত্থান সম্ভব ছিল না। কেননা মানুষ ছিল উন্মত্ত এবং তাদের দমানো যেতে পারত কেবলমাত্র শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভীতিজনক কঠোর আচরণের দ্বারা। ত্রাসের সঙ্গে ঘর করে নিজের প্রভাব না হারানো পর্যন্ত সন্ত্রাস তার কাজ চালিয়ে যেত। বিগত মধ্যযুগীয় শিল্পকলার একটি প্রিয় বিষয় মৃত্যুর নৃত্য, যেখানে দেখা যায় নরকঙ্কাল মানুষের সঙ্গে নৃত্যরত। ড. হুইজিঙ্গা আরও কিছুটা এগিয়ে বলেছেন প্যারিসে নিরীহদের সেই গীর্জা-প্রাঙ্গণের কথা যেখানে ভিলিয়নের সমসাময়িকেরা আনন্দের জন্য বেড়াতে যেতেন। তিনি বলেছেন :


মঠের তিন দিক ঘিরে গোরস্তানগুলোতে খুলি ও হাড় স্থূপাকৃতি করে রাখা হত এবং সেগুলো উন্মুক্ত করে রাখা হত যাতে হাজার হাজার মানুষ সেগুলো দেখে সাম্যের ধারণা লাভ করে…. মঠের নীচে মৃত্যুর নৃত্য বিভিন্ন মূর্তি ও কবিতার মধ্য দিয়ে প্রদর্শিত হত। পোপ, সম্রাট, সাধু ও বোকাদের নিয়ে মৃত্যুর অপক্ক মূর্তিগুলি রাখবার জন্য এমন বাদরামীর আর কোন ভালো জায়গা ছিল না। বেরীর ডিউক যিনি সেখানে কবরস্থ হবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তার ইতিহাস সম্পর্কে তিনজন জীবিত মানুষ ও তিনজন মৃত মানুষের মূর্তি গীর্জার প্রবেশপথে খোদিত করা হয়েছে। এক শতাব্দী পর, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রতীক হিসেবে মৃত্যুর একটি বিরাট মূর্তি সেখানে তৈরি করা হয়, যা এখন লুভ্যরে স্থান পেয়েছে। এটাই সেই মঠের একমাত্র ভগ্নাংশ হিসেবে টিকে রয়েছে সেখানে। পনেরো শতকের প্যারিসের লোকেদের এরকম শোকাবহ আচরণকে নকল করে গড়ে উঠেছিল ১৭৮৯ সালের পালাই রয়াল। দিনের পর দিন, হাজার হাজার মানুষ মঠগুলোতে গিয়ে এইসব মূর্তি এবং সরল কবিতাগুলো দেখতে ও পড়তে লাগলো, যেগুলো তাদের মনে করিয়ে দিত যে তারা শেষের দিকে চলেছে। মুহুর্মুহু কবরস্থ করা এবং তাদের খুঁড়ে বার করে নিয়ে আসার পরিবর্তে সেই স্থানটি জনগণের জন্য একটি সুন্দর বেড়াবার ও ধ্যান করবার স্থানে পরিণত হল। সেইসব গোরস্থানের সামনেই তৈরি হল বিভিন্ন দোকান, মঠের সামনে ঘুরে বেড়াতে লাগলো পতিতারা। গীর্জার একটি দিকে একজন সন্ন্যাসিনীকে কবরস্থ করে রাখা হল। সেখানে মঠবাসীরা তাদের ধর্ম প্রচার করতে আসত এবং ধর্মীয় মিছিল সেখানে এসেই শেষ হত…. এমনকি সেখানে ভোজেরও আয়োজন করা হত। এইভাবেই ভয়ঙ্কর এতদূর পর্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।’


মৃত্যুর নৃত্যজাত বিষণ্ণতা (Macabre) থেকে যে প্রেম আশা করা যেত তা ছিল এমন নিষ্ঠুরতা যা সাধারণ মানুষের কাছে মূল্যবান উপহারজাত আনন্দের মতো ছিল। মনস্ একজন দস্যুকে কিনেছিল শুধুমাত্র তাকে অত্যাচারিত দেখবার জন্য, যে অত্যাচার সাধারণ মানুষ খুব আনন্দের সঙ্গে নিয়ে ছিল এই কৌতূহলে যে তার মৃতদেহের ভেতর থেকে একটি নতুন পবিত্র শরীর নির্গত হবে। ১৪৮৮ তে বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহে বার্জেসের কিছু ম্যাজিসট্রেটদের বাজার এলাকায় নিয়ে গিয়ে প্রবল অত্যাচার করা হয়েছিল জনগণের আনন্দের জন্য। ড. হুইজিঙ্গা বলেছেন যে তারা এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষে মৃত্যুভিক্ষা চেয়েছিল, কিন্তু তাদের জন্য সেইটুকু দানও অস্বীকার করা হয়েছিল যাতে জনগণ আবার তাদের উপর প্রবল অত্যাচার দেখে আনন্দ করতে পারে।


হয়ত অষ্টাদশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও কিছু বলা যেতে পারে।


ড. হুইজিঙ্গারের গ্রন্থটিতে মধ্যযুগের শেষের দিকের যুগগুলোর শিল্পকলা সম্পর্কে উৎসাহহাদ্দীপক আলোচনা রয়েছে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সঙ্গে আঁকা ছবির সৌন্দর্যকে সমান করে দেখা হয়নি। আঁকা ছবি মহানত্বজাত প্রেমের রক্তিম অবদান ছিল বা যুক্ত ছিল সামন্ততান্ত্রিক আড়ম্বরের সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সেই ঘটনাটির কথা, যেখানে বার্গান্ডির ডিউক শিল্পী সুটারকে ক্যাম্পমলের অশ্বারোহী সৈন্যদলের একটি ছবি আঁকতে বললেন, তাতে স্লটার যে ছবিটি আঁকলেন তা ছিল বার্গান্ডি ও ফ্লান্ডারের অশ্বারোহী সৈন্যদল ক্রসের দুটি বাহুতে পরস্পরের সম্মুখীন। সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি হল এই ছবিটিতে জেরোমিয়ার যে ছবিটি অংশ হিসেবে আঁকা হয়েছে সেই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে যে তার নাকে দুটি চশমা আঁটা। লেখক ফিলিষ্টাইন পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই মহান শিল্পীর করুণ অবস্থার কথা জানিয়ে বলেছেন যে উক্ত ছবিটি আঁকার পর তারা ছবিটিকে নষ্ট করে দিলো এই বলে যে স্লটার নিজেই জেরোমিয়ার নাকে চশমা এঁটে দিয়ে হয়ত ছবিটিকে নান্দনিক করতে চেয়েছেন। শ্রীমতী পাওয়ার এই একই ধরণের আর একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে ত্রয়োদশ শতকের এবং ইতালির এক পুস্তক-বিশোধক (BOWDLER- যে পুস্তকের আপত্তিজনক অংশকে কেটে বাদ দেয়) টেনিশনের রচনাগুলিকে বিশোধন করেন ভিক্টোরীয় পরিশোধনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং আর্থারীয় গাথার উপর যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন সেখানে ল্যান্সেলট ও গুয়েনিভারের প্রেমের সমস্ত ঘটনাগুলোকে কেটেছেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস বহু কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনায় পূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, যোড়শ শতকে মস্কোতে একজন জাপানী জেসুইট শহীদ হয়েছিলেন। আমার ইচ্ছা কোন পণ্ডিত ঐতিহাসিক এমন একটি গ্রন্থ রচনা করুন যে গ্রন্থটিকে চিহ্নিত করা হবে যে ঘটনাসমূহ আমাকে বিস্মিত করে এই নামে। এই ধরণের গ্রন্থে জেরোমিয়ার চশমা ও ইতালির বিশোধকের স্থান অবশ্যই থাকবে।

টমাস পেনের নিয়তি


(১৯৩৪ সালে রচিত)


দু’ দুটো বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অংশগ্রহণ করে তৃতীয় এক বিপ্লবের প্রচেষ্টা করার ফলে যাঁকে ফাঁসির মঞ্চে প্রায় উঠতে হয়েছিল সেই টমাস পেন আমাদের সময়টাতে কিছুটা ফিকে হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের প্রপিতামহদের কাছে তিনি ছিলেন এক পার্থিব শয়তান এবং তাঁর ঈশ্বর ও তাঁর রাজার কাছে তিনি ছিলেন ধ্বংসাত্মক নাস্তিক বিদ্রোহী। পরস্পর কখনই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না এমন তিনটি মানুষকে ভীষণভাবে বিপদে ফেলে তিনি তিক্ত শত্রুতা কুড়িয়েছিলেন। এই তিনজন মানুষ হলেন পিট, রোবসপিয়ের এবং ওয়াশিংটন। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন তাঁর মৃত্যু চেয়েছিলেন এবং তৃতীয়জন সযত্নে নিজের জীবন বাঁচাতে চিৎকার চেঁচামেচি না করে নানা রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পিট ও ওয়াশিংটন তাঁকে ঘৃণা করতেন এইজন্য যে তিনি একজন ডেমোক্র্যাট ছিলেন, অন্যদিকে রোবসপিয়ের তাকে ঘৃণা করতেন কেননা তিনি রাজার মৃত্যুদণ্ড ও সন্ত্রাসের রাজত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। সর্বদাই তার ভাগ্যে বিরোধী পক্ষের প্রশংসা ও সরকারের ঘৃণা জুটেছে। যখন তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন তখন এই ওয়াশিংটন তাঁর সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ফরাসী জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে স্তূপাকৃতি সম্মানে ভূষিত করেছে যতক্ষণ না জ্যাকোবিনরা ক্ষমতায় এসেছে। এমনকি ইংল্যান্ডেও প্রসিদ্ধ হুইগ রাষ্ট্রনেতারা তাঁকে বন্ধুর মতো সাহায্য করেছেন এবং তাদের ইস্তাহার তৈরি করবার ব্যাপারে তাকে কাজে লাগিয়েছেন। অন্যান্য মানুষদের মতোই তারও কিছু ভুল ছিল, কিন্তু এটা ছিল তাঁর গুণ যার জন্য তিনি ঘৃণিত হয়েছিলেন এবং সফলতার সঙ্গে উচ্চ শিখরে উঠতে পেরেছিলেন।


ইতিহাসে পেনের গুরুত্ব এই কারণে যে তিনি গণতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রচার করেন। তিনি সেই সব গণতান্ত্রিকদের কথা বলেছিলেন যারা অষ্টাদশ শতকে ফরাসী ও ইংরেজ সম্ভ্রান্ত শ্ৰেণীদের মধ্যে ছিল, ছিল দার্শনিকদের মধ্যে ও আস্থাহীন মন্ত্রীদের মধ্যে, কিন্তু এদের সবাই তাদের নিজের নিজের ধারণাগুলোকে এমনভাবে গঠন করতে যা কেবলমাত্র শিক্ষিতদেরই দেওয়া যেত। পেন তাঁর মতবাদকে কোন রকম কাব্য না করে এমন এক শৈলীতে উপস্থাপিত করতেন যা সহজ সরল এবং সরাসরি হত, যার ফলে প্রতিটি বুদ্ধিমান কর্মী মানুষ সেই মতবাদকে প্রশংসা করতে পারত। এই ব্যাপারটাই তাঁকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল এবং যখন তিনি তাঁর অন্যান্য অপরাধে ধর্মীয় শিথিলতা প্রদর্শন করেন তখন ধর্মরক্ষকরা তাঁর সমস্ত সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়ে তাঁকে তিরস্কারের ভারে ভারাক্রান্ত করে তোলে।


তাঁর জীবনের প্রথম ছত্রিশটা বছরে তেমন কোন প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়নি যা তাঁর পরবর্তী জীবনে পাওয়া যায়। তিনি ১৭৩৯ সালে থেটফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এক দরিদ্র পরিবারে। তের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি আঞ্চলিক একটি ব্যাকরণ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মেয়েদের জামার পাড় তৈরি করে জীবিকা অর্জন করতে থাকেন। এই ধরণের পরিত্যক্ত জীবন তার অভিপ্রেত ছিল না। সতেরো বছর বয়সে তিনি ‘দ্য টেরিবল’ নামক একটি জাহাজ রক্ষার জন্য বে-সরকারী সৈন্যদলে তালিকাভুক্ত হবার চেষ্টা করেছিলেন, যার সৈন্যাধ্যক্ষের নাম ছিল ডেথ (Death)। কিন্তু পেনের পিতামাতা তাঁকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সম্ভবত তার জীবন রক্ষা করেছিলেন কেননা এর কিছুদিন পরেই একটি ঘটনায় সেই জাহাজ রক্ষাকারী নাবিক সৈন্যদলটির ২০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৫ জন সদস্যই নিহত হয়। কিছুদিন বাদেই সপ্তবর্ষের যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপরোক্ত ধরণের আর একটি বেসরকারী সৈন্যদলে যোগদান করেন। সেই সময় সমুদ্রবক্ষে তাঁর সংক্ষিপ্ত রোমাঞ্চকর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। ১৭৫৪ সালে তিনি লন্ডনে মেয়েদের অন্তর্বাস তৈরি করবার কাজে আবার যোগ দেন এবং ওই একই বছরে তিনি বিবাহ করেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী কয়েক মাস পরেই মারা যান। ১৭৬৩ সালে তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে কাজে লাগেন কিন্তু দু’বছর পরেই বরখাস্ত হন এই অভিযোগে যে তিনি তার অনুসন্ধানমূলক কাজের সময় কাজ না করে ঘরে বসে পড়াশুনো করছিলেন। প্রচণ্ড দারিদ্রের সময় তিনি সপ্তাহে দশ শিলিংয়ের বিনিময়ে একটি স্কুলে চাকরি পেয়ে যান এবং ইংল্যান্ডের গীর্জার ধর্ম গ্রহণের চেষ্টা করেন। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই রকম দুঃসাহসিক পদক্ষেপের ফলে লিউইসের মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী পদে পূর্ণ বহাল হয়ে বেঁচে যান। সেখানে তিনি বিবাহ করেন কোয়েকার সমাজের একটি মেয়েকে (কোয়েকার সমাজ বলতে ষোড়শ শতকে জর্জ কক্সের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষ ধরনের ধর্মীয় সম্প্রদায়), কিন্তু ১৭৭৪ সালে সাধারণভাবে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তবে এর পেছনে কারণ কি ছিল তা জানা যায়নি। এই বছরেই তিনি আবার তাঁর চাকরিটি হারান। এর কারণ ছিল তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে উচ্চ বেতনের জন্য সম্মিলিত ভাবে আবেদন সংগঠিত করেছিলেন। এরপর তিনি তার যা কিছু ছিল তা বিক্রী করে দেন ঋণশোধ করবার জন্য এবং যা কিছু বাঁচে তা দেন সেই স্ত্রীকে, কিন্তু নিজে আবার চরম দারিদ্র্যে পড়েন।


লন্ডনে তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে উচ্চ বেতনের জন্য সংসদে সম্মিলিত আবেদন করতে গিয়ে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে পরিচিত হন। বেঞ্জামিন তার সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতেন। এর ফলস্বরূপ তিনি ১৭৭৪ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকায় যাত্রা করেন ফ্র্যাঙ্কলিনের একটি চিঠি হাতে নিয়ে। সেখানে তাঁর সম্পর্কে লেখা ছিল ‘একজন সরল ও উপযুক্ত যুবক। যেই তিনি ফিলাডেলফিয়ায় পৌঁছলেন তখনি একজন লেখক হিসেবে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করতে শুরু করলেন এবং খুব অল্প দিনের মধ্যে একটি জার্নালের সম্পাদক হয়ে গেলেন।


তাঁর প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৫ সালে যেখানে তিনি দাসত্ব ও দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় লেখেন। তাঁর বন্ধুরা বলতে পারেন যে তিনি এইসব করে তার বিরুদ্ধে কিছু গোঁড়া শত্রুর সৃষ্টি করেছিলেন। এর কারণ ছিল তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে জেফারসন স্বাধীনতার সনদের খসড়ায় উক্ত বিষয়ের সন্নিবেশ করেন যা পরবর্তীকালে বাতিল করে দেওয়া হয়। দাসত্ব ব্যবস্থাটি পেনসিলভেনিয়াতে ১৭৭৫ সালেও টিকে ছিল। এই ব্যবস্থা সেখান থেকে দূরীভূত হয় ১৭৮০ সালের একটি আইন অনুযায়ী। সাধারণত সেখানে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে পেন সেই আইনের প্রস্তাবনাটি রচনা করেন।


একদম প্রথম না হলেও পেনই প্রথম মানুষ যিনি ইউনাইটেড স্টেটের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। ১৭৭৫ সালে অক্টোবরে স্বাধীনতার সনদে যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মানিয়ে চলার আশা করেছিলেন। এ বিষয়ে পেন লিখলেন,


‘আমি বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নই যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে ব্রিটেনের থেকে আলাদা করে দেবেন। তোমরা একে স্বাধীনতা বলেও ডাকতে পার আবার তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যা খুশী বলে ডাকতে পার, যদি তা ঈশ্বর ও মানবিকতার কারণে ঘটে তবে অবশ্যই তা চলতে থাকবে। যখন ঈশ্বর আমাদের আশীর্বাদ করবেন এবং আমাদেরকে এমন জনগণ রূপে তৈরি করবেন যারা তার উপর নির্ভরশীল, তখন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য আমাদের উচিত একটি উপমহাদেশীয় আইন প্রণয়ন করা যা নিগ্রোদের বিক্রি করার জন্য আমদানিকে বন্ধ করবে। তাদের নীতিকে কেউ তখন আর নরম বা কঠিন করে তুলতে পারবে না যা এখানে এখন বর্তমান এবং তাদের স্বাধীনতা যথাসময়ে অর্জিত হবে।’


কেবলমাত্র স্বাধীনতার খাতিরে– রাজতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা অভিজাততন্ত্র থেকে, দাসত্ব থেকে এবং সবরকম স্বৈরাচারিতা থেকে যা পেন আমেরিকা গঠনের জন্য চেয়েছিলেন।


স্বাধীনতার যুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে তিনি সারাটা দিন প্রচার করে বেড়াতেন এবং রাতটা কাটাতেন ইস্তাহার রচনা করে যা common sense’ নামে প্রকাশিত হত। তাঁর রাতটা কাটাতেন ইস্তাহার সফলতা পেয়েছিল এবং বাস্তবিক পক্ষে এই জন্যই যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। ব্রিটিশরা মেনের ফলমাইথ ও ভার্জিনিয়ার নরফোক শহর পড়িয়ে দেবার পর, ৩১ শে জানুয়ারী ১৭৭৬ সালে ওয়াশিংটন তার এক বন্ধুকে লেখেন:


‘ফলমাউথ ও নরফোকের জ্বলন্ত দৃষ্টান্তজাত প্রশ্ন যা ‘common sense’ প্রকাশিত হবার পর কোন উত্তর পাওয়া যায়নি, সেই সব প্রশ্নের উপর ভিত্তি করেই স্বতন্ত্রতার যথার্থতা নিধারিত হবে।’


কাজটা ছিল সময়সাপেক্ষে বিষয়োপযোগী ও বর্তমানে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেখানে এমন কিছু শব্দগুচ্ছ আছে যেগুলো আজও বলা হচ্ছে। বিবাদ কেবল রাজার সঙ্গে নয়, বিবাদ সংসদের সঙ্গেও তা দেখবার পর, পেন বললেন, তাদের অধিকারসমূহ নিয়ে সংসদের নিম্নকক্ষ যতটা ঈর্ষান্বিত আর কেউ নয়, কারণ তারা তাদের বিক্রি করে দিয়েছে। সেই সময় এই ধরণের বিদ্রুপাত্মক বিচারকে অস্বীকার করাটা ছিল অসম্ভব।


প্রজাতন্ত্রের স্বপক্ষে জোরালো সমর্থন উত্থিত হয় এবং কেবলমাত্র রাজতন্ত্রই গৃহযুদ্ধকে রোধ করতে পারে এইরকম ধারণাকে নিদারুণভাবে খণ্ডন করা হয়। তিনি ইংরেজের ইতিহাসকে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করে বলেন, রাজতন্ত্র ও উত্তরাধিকার সমস্ত জগৎটাকে রক্ত ও ছাইতে শুইয়ে দিয়েছে। এটা এমন এক ধরণের সরকার যেখানে ঈশ্বরে বাণীকে বিরুদ্ধ সমালোচনা করা হয় এবং তাকে রক্তাক্ত করে তোলা হয়। ১৭৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন যুদ্ধের ভাগ্য বিরূপ আকার ধারণ করেছে। তখন পেন ‘The Crisis’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রথমে এই কথা লিখলেন,


‘এটা এমন একটা সময় যখন মানব-আত্মাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এই সংকটে কষ্টসহিষ্ণু দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও সূর্যস্নাত স্বদেশপ্রেমিক সবাই একে একে দেশের কাজের থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু সব প্রতিকূলতা সহ্য করেও পিতৃভূমি যে ভাবে আজও দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য এখন তিনি নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রেম ও ধন্যবাদের যোগ্য।


ওয়াশিংটন এই প্রবন্ধটি তার সৈন্যবাহিনীর সম্মুখে পাঠ করে পেনকে এই কথা বলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যে এটা আপনার কাজের গুরুত্বের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।’ আমেরিকা পেনের মতো এত জনপ্রিয় লেখক কেউ ছিলেন না। তিনি যদি চাইতেন তবে কলমের জোরে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন কিন্তু লেখা থেকে যে অর্থ তিনি পেতেন তা নিতে অস্বীকার করতেন। স্বাধীনতার যুদ্ধের শেষে সংযুক্ত রাষ্ট্রে তিনি চিরকালের জন্য শ্রদ্ধার আসনে বসলেন কিন্তু তখনও তিনি গরীব রইলেন। যদিও রাষ্ট্রের একটি আইন-সভা তাঁকে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এবং পরে আর একটি নতুন আইন-সভা তাকে একটি জমিদারী প্রদান করল। এইভাবে তাঁর বাকি জীবনে আরাম ও অবসরের সুযোগ মিললো। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সফল বিপ্লবীদের গুণাগুণ নিয়ে সম্মানিত হয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু তিনি তা থাকলেন না। তিনি রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পথে এলেন। কিভাবে বড় বড় লোহার পাত দিয়ে ব্রিজ তৈরি করা যায় তা দেখালেন যা আগে অসম্ভব বলে ভাবা হত। লোহার ব্রিজ তৈরির সূত্র ধরে তিনি আবার ইংল্যান্ডে গেলেন এবং সেখানে ব্রুক, পোর্টল্যান্ডের ডিউক ও স্বনামধন্য হুইগরা তাকে বন্ধুর মতো স্বাগত জানালেন। প্যাডিংটনে তিনি তার বিরাট আকারের লোহার ব্রিজটি মডেল স্বরূপ তৈরি করলেন এবং প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়াররা তাকে প্রশংসা করলেন এবং এরপর তিনি তাঁর বাদবাকি জীবনটা একজন আবিষ্কারক হিসেবে কাটালেন।


ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সও লৌহ ব্রিজের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল। ১৭৮৮ সালে তিনি এই ব্যাপারে প্যারিসে গেলেন ও লাফায়েতসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনাটি অ্যাকাডেমি দ্য সায়েন্সে পেশ করলেন। এই ব্যাপারে অ্যাকাডেমি তার রায় জানাতে একটু দেরি করলেও পরে রায়টি তার অনুকূলেই গিয়েছিল। বাস্তিল দুর্গের পতনের পর লাফায়েত কারাগারের চাবিকাঠি ওয়াশিংটনকে উপহার দেবেন বলে মনস্থ করলেন, এবং আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে তার উপহারটি ওয়াশিংটনের হাতে পৌঁছে দেবার জন্য তিনি টমাস পেনকে একমাত্র বিশ্বস্ত মনে করলেন। কিন্তু পেন তখন ইংল্যান্ডে ব্রিজ তৈরি করবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তিনি ওয়াশিংটনকে এই জানিয়ে চিঠি লিখলেন যে তার পরিবর্তে এমন একজন বিশ্বস্ত মানুষকে প্রয়োজন যিনি নিরাপদে তাঁর হাতে সেই উপহারটি পৌঁছে দেবেন যে উপহারটি স্বৈরাচার অবসানের প্রথম স্মৃতিবিজড়িত চিহ্নস্বরূপ আমেরিকার আদর্শের প্রথম পাকা ফল হিসেবে ইউরোপে রোপিত হয়েছিল। এর পরে তিনি আরো লিখেছিলেন যে ফ্রান্সের বিপ্লবের সম্পূর্ণ সফলতা সম্পর্কে আমার আর কোন সন্দেহ নেই, এবং আরও লিখলেন যে আমি একটা ব্রিজ তৈরি করেছি (একটা খিলানের উপর) যেটি একশ দশ ফিট লম্বা এবং খিলানের উপর লোহার দড়ি থেকে সেটি পাঁচ ফুট উঁচু।


একটা সময় ব্রিজ নির্মাণ ও বিপ্লব তাঁর কাছে সমান ভাবে উৎসাহের বিষয় ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কাছে বিপ্লবটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ইংল্যান্ডে সচেতনমূলক আন্দোলন গড়ে তোলার খাতিরে তিনি তাঁর ‘মানুষের অধিকার’ (Rights of man) প্রবন্ধটি রচনা করেন এবং যার ফলস্বরূপ গণতন্ত্রী হিসেবে তার খ্যাতি লাভ হয়।


এই কাজটি যা জ্যাকোবিন-বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার সময়টাতে একটা ভয়ঙ্কর সাহসিক বিপর্যয়রূপে চিহ্নিত তা আধুনিক পাঠককে বিস্মিত করবে তার সাধারণ জ্ঞান ও কোমলতার পরিচয়ে। এ প্রবন্ধটি প্রাথমিকভাবে ব্রুকের প্রশ্নের উত্তররূপে লেখা হয়েছিল এবং লেখাটির মধ্যে তৎকালীন ফ্রান্সের ঘটনাগুলির সম্যক বিচরণ ও তার উপর যথার্থ আলোচনা ছিল। এই গ্রন্থটির প্রথম অংশটি প্রকাশিত হয় ১৭৯১ সালে, দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয় ১৭৯২ সালে। সুতরাং বিপ্লবের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দায়ে তার ক্ষমা চাইবার কোন জায়গা নেই। এই গ্রন্থটির একটি ছোট্ট জায়গায় প্রাকৃতিক অধিকার সম্পর্কে অল্প মর্মস্পর্শী লেখা তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু সেখানে ব্রিটিশ সরকার সম্পর্কে তাঁর পরিচ্ছন্ন গভীর বোধের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ব্রুক এইভেবে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন যে ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের ফলে অ্যাক্ট অব সেটলমেন্টের দ্বারা চিরকালের জন্য ব্রিটিশরা সার্বভৌম শক্তির বশ্যতা মানতে বাধ্য হল। পেন কিন্তু ব্রুকের মতো ভেবে প্রশান্তি লাভ করলেন না, তিনি এই ভেবে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন যে সমৃদ্ধিকে কখনও আর বাধা যাবে না এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন অবশ্যই ঘটবে।


তিনি লিখলেন, সরকারগুলোকে তিনটি মূল বিষয়ের অন্তর্গতরূপে ভাবা যেতে পারে। প্রথম, কুসংস্কার, দ্বিতীয়, ক্ষমতা, তৃতীয়, সমাজের সাধারণ স্বার্থ ও মানুষের সাধারণ অধিকার হিসেবে। প্রথমটি হল পুরোহিতদের সরকার, দ্বিতীয়টি হল বিজিতদের সরকার এবং তৃতীয়টি হল বুদ্ধির দ্বারা নির্মিত সরকার। প্রথম দুটি এক জায়গায় মিলেমিশে গেল এবং তা ‘সেন্ট পিটারের চাবিকাঠি ও ধনভাণ্ডারের চাবিকাঠিতে পরিণত হল, এবং পরবর্তীকালে তা আরও কয়েকটি টুকরো হয়ে নানা রকম ভণ্ড ও জোচ্চোর ধরণের পূজারী সরকারের সৃষ্টি করল। এই ধরণের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ সত্যই অপ্রতুল। তার বেশিরভাগ কাজ প্রথমে ১৭৮৯ সাল থেকে ১৭৯১ সালের শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের ইতিহাস সম্পর্কে এবং দ্বিতীয়টি ব্রিটিশ সংবিধানের সঙ্গে ১৭৯১ সালের ফ্রান্সের রায়ের তুলনা সম্পর্কীয়, তবে এই কাজে ফ্রান্স, তার কাছ থেকে বেশি উপকার পেয়েছে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ছিল। পেন ছিলেন প্রজাতান্ত্রিক এবং তা তিনি কখনই গোপন করেননি, কিন্তু তিনি ‘মানবের অধিকারসমূহ’ নামক গ্রন্থে সে সম্পর্কে খুব একটা জোরও দেননি।


কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনার ক্ষেত্র ছাড়া পেন সর্বদা সাধারণ চেতনার কাছে তাঁর আবেদন করেছেন। পিসের অর্থনীতির বিরুদ্ধে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন এমন কারণের, যে কারণের উপর ভিত্তি করে রাজস্ববিভাগের সভাপতির কাছে আবেদন করা একান্ত উচিত। পেনের পথ অনুসরণ করে পরে কবেটও একই কাজ করেন। তিনি সেই ডুবে যাওয়া অর্থভাণ্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে বিরাট অঙ্কের টাকা ধার করাটাকে তুলনা করলেন খরগোশ ধরবার জন্য একটা মানুষকে হাতে লাঠি ধরিয়ে বসিয়ে রাখার সঙ্গে যত দূর খরগোশরা ছোটে, ততদূর বসে থাকা মানুষটা সরে যায়। তিনি কবেটের পথ অনুসরণ করে রাজস্ববিভাগকে কাগজের টাকা বানাবার কুমোরের কারখানা এই শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করে তার উপর আলোচনা করলেন। বস্তুত অর্থভাণ্ডারের উপর তাঁর লেখা কবেটের সঙ্গে তার পূর্বের শত্রুতাকে মুছিয়ে দিয়ে সে জায়গায় তার প্রতি কবেটের প্রশংসা এনে দিল। তাঁর বংশানুক্রমিক আদর্শের প্রতি আপত্তি যা ব্রুক এবং পিটকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল তা আস্তে আস্তে হিটলার ও মুসোলিনি সমেত সমস্ত রাজনীতিবিদদের কাছে সাধারণভাবে গ্রাহ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তার লেখার শৈলী কখনই উদ্ধত ধরণের ছিল না। তার লেখা ছিল পরিষ্কার, অকপট, প্রাণবন্ত, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষের লেখার মতো কখনই গালাগালিপূর্ণ ছিল না।


শুধু তাই নয়, পিট মনস্থ করেছিলেন যে পেনের বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেও তার মানব অধিকারসমূহ’ নামক গ্রন্থটি বাতিল করে তিনি তাঁর সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করবেন। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রী লেডি হেসটার স্ট্যানহোপের মতে তিনি রোজই বলতেন টম পেন সর্বদাই সত্যের পক্ষে, কিন্তু তার পর আবার বলতেন, আমাকে আর যে কি করতে হবে? আসল কথাটা হল যদি আমরা টম পেনের মতামতকে মেনে নিই তবে আমাদের বিশ্রী ধরণের বিপ্লবে জড়িয়ে পড়তে হবে। পেন এই মকদ্দমার প্রত্যুত্তর হিসেবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের গণহত্যার পর ইংরেজ টোরিরা বর্ধিত আগুনে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ল। জাগতিক প্রজ্ঞায় অনেক বড় হয়েও কবি ব্লেক পেনকে প্ররোচিত করে বলেন যে তিনি যদি ইংল্যান্ডে থাকেন তার ফাঁসি হবে। কর্মরত যে পুলিশ অফিসাররা তাকে ধরতে এসেছিল তাদের ফাঁকি দিয়ে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যান। যাবার আগে কিছু ঘন্টা তিনি লন্ডনে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ডোভারে আসেন এবং সেখানে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফ্রান্সে যাবার অনুমতি পান, কেননা সেই কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি পান যেখানে তিনি টমাস পেনকে সুযোগ সুবিধা দেবার কথা বলেছিলেন।


তখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জড়িয়ে পরেনি, ফলে ডোভার ও কালেই একটি স্বতন্ত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পেন ফ্রান্সের সাম্মানিক নাগরিকতা পেলেন, যার ফলে তিনি তিনটি নির্বাচন এলাকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন, যার মধ্যে কালেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিজের এলাকায় অভ্যর্থনা জানায়। তাকে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতে তারা তোপ দাগলো এবং সেই সঙ্গে তীরে দাঁড়ানো হাজারো মানুষ তাঁর জয়ধ্বনি করে উঠলো। কালেই-এর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যখন ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখলেন তখন সৈনিকরা তাঁকে রাস্তা করে নিয়ে গেল, বড় বড় অফিসাররা তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁকে জাতীয় ফুল উপহারস্বরূপ দেওয়া হল। তার পরে ফরাসী কায়দায় আরো অনেক রকম সাম্মানিক আচরণ তার সঙ্গে করা হল, বহু সুন্দরী মহিলা ও মেয়র তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।


প্যারিসে পৌঁছে তিনি অহঙ্কারের জায়গায় অনেক বেশি জনতা-হৃদয় সম্পন্নতা দেখালেন। তিনি আশা করেছিলেন ফ্রান্সে গণহত্যার জায়গায় একটি নিয়মানুবর্তী বিপ্লবের উত্থান হবে যা তিনি আমেরিকায় গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি গিরাডিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, লাফায়েৎ সম্পর্কে বাজে চিন্তা ছেড়ে দেন (যা এখন লজ্জাজনক), এবং একজন আমেরিকানের মতো তিনি চতুর্দশ লুইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেন, কেননা তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধে সংযুক্ত রাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজার শিরোচ্ছেদের বিরোধিতা করে জ্যাকোবিনদের রোষে পড়েন। তাঁকে প্রথমে সাম্মানিক অতিথির সম্মান থেকে বরখাস্ত করা হয়, পরে একজন বিদেশী হিসেবে তাকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। রোবসপীয়ের যতদিন ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তার কিছু মাস পরে পর্যন্ত পেন কারাগারে বন্দী ছিলেন। যদিও তাঁর এই অপমানের দায় ফ্রান্সের ছিল তবে তা ছিল আংশিক। এর পেছনে আমেরিকান মন্ত্রী গুর্ভারনিয়ার ছিলেন সমানভাবে দায়ী। গুর্ভারনিয়ার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র মতবাদী এবং তিনি ফ্রান্সের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের পক্ষ নিয়েছিলেন। আসলে গুর্ভারনিয়ার এই কাজ করেছিলেন পুরোনো প্রতিহিংসা মেটাবার জন্য। কেননা তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় গুর্ভারনিয়ারের কোন বন্ধুর বাজে কাজ ফাঁস করে দিয়েছিলেন। এরই জের টেনে তিনি পেন সম্পর্কে বলেছিলেন যে তাঁকে কোনরকম সাহায্য তিনি করতে পারবেন না। ওয়াশিংটন গোপনে ইংল্যান্ডের সঙ্গে জের চুক্তিতে আবদ্ধ হন, তিনি পেনকে এই অবস্থায় দেখেও কোনরকম সহানুভূতি প্রদর্শন করলেন না পাছে পেন ফরাসী সরকারকে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলেন। আকস্মিকভাবে তিনি গিলোটিন থেকে রেহাই পান, কিন্তু মারাত্মক শরীর খারাপের ফলে তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। শেষে মরিসের বদলে মনরো আসেন যিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন এবং তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আঠারো মাস ধরে আন্তরিকতা ও যত্নের সঙ্গে সারিয়ে তোলেন।


পেন জানেননি মরিস তার দুর্ভাগ্যের জন্য কি পরিমাণ দায়ী ছিলেন, কিন্তু তিনি ওয়াশিংটনকে কখনও ক্ষমা করতে পারেননি। ওয়াশিংটনের মৃত্যুর পর মানুষ হিসেবে তাঁর মর্মরমূর্তি নির্মাণের খবর শুনে, তিনি ভাস্করকে নীচের পঙক্তিগুলি শুনিয়েছিলেন,


খনি থেকে তোল শিল্পী

যে ঠান্ডা কঠিন পাথর

তাই যে ওয়াশিংটন,

আবার মূর্তির কি প্রয়োজন!

তবুও যদি চাও,

তোমার কঠিন হাতে আঘাত হেনে

তার বুকেতে গভীর করে

‘অকৃতজ্ঞ’ লিখে দাও।


তিনি ওয়াশিংটনকে একটি দীর্ঘ ও তিক্ত পত্র লেখেন যেটি বহুদিন অপ্রকাশিত থাকার পর ১৭৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং যে পত্রটি শেষ হয় এই বলে :


‘এবং আপনার সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে মহাশয়, আপনি ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একজন বিশ্বাসঘাতক মানুষ (কেননা বিপদের সময় আপনি এরকমই আচরণ আমার সঙ্গে করেছেন), এবং জনগণের জীবনের ক্ষেত্রে একজন ভণ্ড মানুষ, এবং আপনি একজন স্বধর্মত্যাগী না প্রতারক তা নিয়ে জগৎ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বিহ্বল হয়ে পড়বে এই সিদ্ধান্ত নিতে যে আপনি মঙ্গলজনক আদর্শ পরিত্যাগ করেছিলেন না কোনদিনই তেমন কোন আদর্শ আপনার ছিল না।’


যারা কেবল ইতিহাসের ঐতিহ্যময় ওয়াশিংটনকে চেনেন তারা এই ধরণের পত্রকে বর্বরোচিত বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু ১৭৯৫ সালে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে জেফারসন ও অ্যাডামসের মধ্যে নির্বাচনের লড়াইতে ওয়াশিংটন অ্যাডামসকে সমর্থন করলেন একথা জেনেও যে অ্যাডামস রাজতন্ত্র ও সম্ভ্রান্ত শ্ৰেণীর সমর্থক। শুধু তাই নয়, তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষ নিলেন এবং যে প্রজাতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে তিনি আমেরিকার উচ্চ স্থানে এসেছিলেন সেই আদর্শের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জনগণের পক্ষ নিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাজাত পত্রটি প্রমাণ করে যে পেনের কথাগুলো বেঠিক ছিল না।


পেনকে বন্দীদশার করুণ অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়াটা ওয়াশিংটনের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠত যদি না এই জেদি মানুষটি তার শেষে মুক্ত জীবনগুলিতে ধর্মতত্ত্বের উপর সেই সব মতামত প্রকাশ করে দিন কাটাতেন, যে মতামতকে ভিত্তি করে তিনি ও জেফারসন মেনে নিতে পেরেছিলেন ওয়াশিংটন ও অ্যাডাম্‌সকে যারা ধর্ম বিষয়ে জনগণের যে-কোন রকম শিথিলতাকে যত্নসহকারে এড়িয়ে যেতেন। নিজের দূরদৃষ্টির ফলে নিজের বন্দীদশাকে আগে থেকে জানতে পেরে যুক্তির যুগ’ (The age of reason) প্রবন্ধটি লিখতে শুরু করেন, এবং গ্রন্থটির প্রথম ভাগটি লেখা শেষ করার ছয় ঘণ্টার পর তিনি গ্রেফতার হন। এই গ্রন্থ তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের আহত করে এবং তাদেরকেও আহত করে যারা তাঁর রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমানে এই গ্রন্থটির কিছু বাজে লেখা ছেড়ে দিলে বাদবাকি যে লেখাগুলি পড়ে থাকবে তা খুব কম যাজকই অস্বীকার করে উঠতে পারবেন। প্রথম অধ্যায়ে তিনি লেখেন,


‘আমি একটিমাত্র ভগবানে বিশ্বাসী এবং আমি এজীবনের পরেও সুখ-আশা করি।


‘আমি মানুষের সমতায় বিশ্বাসী, এবং আমি বিশ্বাস করি যে ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ নির্ভর করে ন্যায়বিচার, প্রেমময় করুণা এবং মনুষ্যজাতিকে সুখী করার প্রচেষ্টার মধ্যে।’


এই সমস্ত কথাগুলো মোটেই ফাঁকা বুলি ছিল না। জনগণের সেবায় ব্রতী হবার প্রথম দিন থেকেই তিনি যে-কোন রকম নিষ্ঠুরতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। ১৭৭৫ সালে তিনি দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নিজের সমর্থিত দলের কিংবা বিরুদ্ধ দলের কোনরকম নিষ্ঠুরতাকে বরদাস্ত করেননি। সেই সময় ইংল্যান্ডে কতিপয় ব্যক্তির নিষ্ঠুর শাসন চলছিল। তারা সংসদকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে গরীব শ্রেণীকে আরও গরীব করে তুলেছিল। পেন এই ধরণের জঘন্য শাসনের রাজনৈতিক সংস্কার চাইলেন। ফলস্বরূপ তাকে সে দেশ ছাড়তে হল নিজের জীবন বাঁচাতে। ফ্রান্সে গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন এবং অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেন। আমেরিকার দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং স্বাধীনতা ঘোষণার আদর্শকে সমর্থন করে তিনি সেখানকার সরকারের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেন ঠিক তখন যখন তাঁর ওই সরকারের সমর্থন খুব দরকার ছিল। তাঁর ধর্মমতকে এখন অনেকেই মেনে থাকেন। তিনি যে ধর্মমত পোষণ করতেন এবং সারাটা জীবন মেনে চলতেন তা হল সত্য ধর্ম বলতে বোঝায় ন্যায়বিচার, প্রেমময় করুণা প্রদর্শন এবং মানবজাতিকে সুখী করবার প্রচেষ্টা। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না যিনি নিজেকে এই বিচারে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ বলতে পারেন।


‘যুক্তির যুগ’ নামক গ্রন্থটির বেশিরভাগ অংশ নৈতিক দিক থেকে ওল্ড টেষ্টামেন্টের সমালোচনা। বর্তমান যুগে খুব কম মানুষই Pentateuch এবং Book of Joshua-তে ধর্মের নামে নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যার যে ঘটনার কথা নথিভুক্ত আছে তা মানতে পারবেন। কিন্তু পেনের সময়ে ইজরায়েলীয় ধর্মকে নিন্দা করাটা অপবিত্র বলে মনে করা হত কেননা তারা ওল্ড টেষ্টামেন্টের দ্বারা মনোনীত ছিল। এর ফলে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে চিঠি লিখে তাদের উত্তর জানিয়েছিল। এদের মধ্যে উদারপন্থী ল্যান্ডফের বিশপ Pentateuch-এর ঘটনা মমাজেসের দ্বারা লিখিত নয় বলে প্রচার করেন এবং জালমা-র (Psalma) নয় বলে দাবী করেন। এইজন্য তিনি তৃতীয় জর্জের শত্রুতাকে দায়ী করেন যার জন্য ডেভিডের রচনাকে ঠিক মতো অনুবাদ করা যায়নি। কিছু কিছু বিশপ প্রত্যুত্তরে বলেন যে পেন একজন কৌতূহলী মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন। উদাহরণস্বরূপ ‘যুক্তির যুগ’ গ্রন্থটি এই সন্দেহ করে এগিয়েছে যে সত্যই ঈশ্বর মিডিয়ানটিয়দের মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন না দেননি। কেননা অল্পবয়স্ক মেয়েদের রক্ষা করাটাই তখন ধর্ম ছিল। বিশপ রেগে গিয়ে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন যে অল্পবয়স্ক মেয়েদের কখনই অবৈধ কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে রক্ষণ করার নিয়ম ছিল না যে রকম পেন বিশ্রীভাবে বলতে চেয়েছেন, তবে দাসী হিসেবে তাদের রক্ষণ করাটাকে নৈতিক দিক থেকে আপত্তি করার কিছু নেই বলে জানান বিশপ। আমাদের সময়ে গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা হয়ত ভুলে গেছেন আজ থেকে একশচল্লিশ বছর আগে গোঁড়া ধর্মাবলম্বী বলতে ঠিক কি বোঝাত। ধর্মমতকে নরম করতে গিয়ে কি ধরণের অত্যাচার পেনকে সেই সময় সহ্য করতে হয়েছিল যার ফলস্বরূপ আজকে আমাদের যুগটা লাভবান। কবরের ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরাও পেনের মৃত্যুর পর তাদের কবরভূমিতে তাঁর দেহ কবরস্থ করার অনুমতি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ঐরকম একজন কৃষক পুরোহিত (যারাও সংখ্যায় খুব কমই আছে) পেনের নশ্বর দেহকে কবরস্থ করে।


‘যুক্তির যুগ’ প্রকাশিত হবার পর পেনের রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবাটা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক দিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আরোগ্য লাভ করলেন তখন তিনি দেখলেন ফ্রান্সের জ্ঞাতব্য বিষয়ক পুস্তকে তার কোন জায়গা নেই, এমন কি প্রথম কনসালেও তার কোন জায়গা নেই। নেপোলিয়ন যদিও তাঁর সঙ্গে কোনরকম খারাপ ব্যবহার করেননি, তবুও তার তাকে তেমন কোন দরকার হয়নি কেবলমাত্র ইংল্যান্ডে তাকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আন্দোলনের একজন সম্ভাব্য এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া। এরপর তিনি আমেরিকায় থাকবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং যুক্তরাষ্ট্রবাদীদের বিরুদ্ধ পক্ষ জেফারসন অনুরাগীদের কাছে এ বিষয়ে সাহায্য চান। কিন্তু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তার ফাঁসি অবধারিত ছিল। এরপরে ১৮০২ সালে তিনি বালতিমোরে এসে নামেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জেফারসনকে একটি চিঠি লেখেন (জেফারসন তখন রাষ্ট্রপতি) :


ষাট দিন ধরে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে হ্যাঁভার থেকে আমি শনিবার এখানে এসে পৌঁছলাম। আমার অনেক রকম মডেল ও চাকা প্রভৃতি অনেক কিছু নিয়েছিলাম এবং জর্জটাউনের জন্য নেওয়া জিনিসের মোড়কগুলো জাহাজে তোলা মাত্রই আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা আপনার প্রতি জ্ঞাপন করলাম। আপনার বাধিত অনুরাগী নাগরিক, টমাস পেন।


কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রবাদী ছাড়া তাঁর বাদবাকি পুরোনো বন্ধুরা যে তাকে স্বাগত জানাবেন এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু একটা অসুবিধা ছিল। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য জেফারসন মরণপণ লড়ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারে তার বিরুদ্ধে সব থেকে বড় যে-অস্ত্রটি তার বিরোধী সমস্ত দলের মন্ত্রীরা ব্যবহার করে আসছিল তা হল তার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ। তার বিরোধী দল তাঁর সঙ্গে পেনের অন্তরঙ্গতাকে বড় করে দেখিয়ে দুজনকে একজোড়া ব্যভিচারী বলে প্রচার করছিল। কুড়ি বছর পরেও স্বদেশবাসীর এই ধর্মীয় গোঁড়ামী দেখে তিনি এতটাই আশ্চর্য হয়েছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের ত্রিমূর্তিবাদে অবিশ্বাসী একজন মন্ত্রী যিনি তাঁর একটি চিঠি প্রকাশ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁকে প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন, না, শ্রদ্ধেয় মহাশয়, সমস্ত জগতের জন্য নয়। … আমার খুব তাড়াতাড়ি বেড় লামের পাগল খুলিটাকে নিয়ে আসা উচিত যে বকবক করে আথানাসীয়দের মনে যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করবে…তাই ক্যালভিনের কাঠ ও আগুন এবং তার বলি সারভেটাসের থেকে আমাকে বাঁচান। এই কারণে এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয় যে যখন সারভেটাসের নিয়তি তাদের হুমকি দিচ্ছিল তখন জেফারসন ও তার রাজনৈতিক অনুরাগীরা পেনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রাখার লজ্জাকে ঢাকার চেষ্টা করবে এবং অস্বীকার করবে। পেনের সঙ্গে দ্র ব্যবহার করা হয়েছিল ফলে অভিযোগ করার কোন উপায়ই নেই, কিন্তু পুরোনো সেই সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।


তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের কাছে তাকে আরও খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। আমেরিকায় তাঁর প্রথম বন্ধুদের মধ্যে একজন ফিলাডেলফিয়ার ডাক্তার রুশ তার জন্য কিছুই করেননি। রুশ লেখেন, তাঁর যে আদর্শের কথা তিনি যুক্তির যুগ নামক গ্রন্থটিকে অকপটে বলতে পেরেছেন তা আমাকে এতটাই অসন্তুষ্ট করেছে যে আমি তার সঙ্গে আর নতুন করে কোন সম্পর্ক তৈরি করতে ইচ্ছুক নই। তিনি নিজের প্রতিবেশীদের কাছে ছিলেন অত্যাচারিত এবং স্ট্যাগ কোচে (বগা-হরিণ বাহিত গাড়ি) তাকে কোন বসবার জায়গা দেওয়া হত না। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে থেকে তাকে ভোট দিতে দেওয়া হত না এই অভিযোগে যে তিনি একজন বিদেশী। তাঁকে অনৈতিক ও অমিতাচারী বলে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোতে তাঁকে একাকিত্ব ও দারিদ্রে কাটাতে হয়। তিনি মারা যান ১৮০৯ সালে। যে সময় তিনি মারা যাচ্ছেন তখন দুজন পাদ্রী তাঁর ঘরে জোর করে ঢুকে তাঁকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে চান, তখন তিনি অনেক কষ্টে একবার বলেন, আমাকে একা থাকতে দিন, সুপ্রভাত। এতদসত্ত্বেও গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা বলে বেড়ালেন মৃত্যুশয্যায় তার ভুল স্বীকারোক্তির কথা যা সবাই বিশ্বাস করে থাকে।


মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতি আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে বেশি। তাঁর রচনাগুলো প্রকাশ করা বেআইনী ছিল, কিন্তু তা বারবার প্রকাশিত হতে লাগলো। যদিও বেআইনীভাবে প্রকাশ করার জন্য বহু মানুষ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ১৮১৯ সালে পেনের রচনা প্রকাশ করার জন্য সর্বশেষ অভিযুক্ত করা হয়েছিল রিচার্ড কারলাইল ও তার স্ত্রীকে। তাঁকে তিন বছরের জন্য দণ্ড দেওয়া হয়েছিল ও তার উপর পনেরোশো পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। তার স্ত্রীকে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল এক বছরের জন্য ও পাঁচশো পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। এই বছরেই কবেট পেনের অস্থি ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন এবং ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বীরযোদ্ধাদের অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে তার খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তাঁর অস্থিকে চিরস্থায়ী বিশ্রামের জায়গা দিতে পারেননি। মনকিয়োর কনওয়ে (পেনের জীবনী ও তাঁর রচনাগুলি লেখা ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যিনি যথেষ্ট নিষ্ঠা ও যত্নের পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন, যে স্মৃতিস্তম্ভের চিন্তা কবেট করেছেন তা কোনদিনই গড়ে উঠবে না। এই ঘটনাটিকে নিয়ে ইংল্যান্ডের সংসদে ও পৌরসভায় যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বোলটনের শহর-ঘোষক পেনের অস্থি পৌঁছনোয় খবর ঘোষণা করার জন্য তিন সপ্তাহের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। ১৮৩৬ সালে পেনের অস্থি কবেটের হাত থেকে পশ্চিমের এক গ্রহীতার কাছে যায়। লর্ড চ্যান্সেলার পেনের অস্থিকে সম্পদ হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন। ফলে সেই অস্থি ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত একজন দিনমজুরের দ্বারা রক্ষিত হয়, তারপর তা ১৩ নম্বর বেডফোর্ড স্কোয়ারে, লন্ডনের এক ফার্নিচার ব্যবসায়ী বি. টিলির হাতে যায়…১৪৫৪ সালে রেভারেন্ড আর এইনস্নি (ইউনিটারিয়ান) ই, ট্রলাভকে বলেন যে তিনি টমাস পেনের খুলি ও ডান হাতের হাড়টি কিনেছেন, কিন্তু তার এই কথা সত্য কিনা তা যথেষ্ট অনুসন্ধান সাপেক্ষ। তাঁর নশ্বর দেহের কোন কিছুই আর পড়ে নেই, এমনকি তার খুলি বা ডান হাতটিও কোথাও পাওয়া যায় না।


পৃথিবীতে পেনের প্রভাব দু’ধরনের। আমেরিকার বিপ্লবের সময় তিনি উৎসাহ ও দৃঢ়তার জন্য প্রেরণা জুগিয়েছেন এবং বিপ্লবে জয়লাভের জন্য বহু কিছুই করেছেন।


ফ্রান্সে তার জনপ্রিয়তা ছিল ক্ষণস্থায়ী ও কৃত্রিম, কিন্তু ইংল্যান্ডে তিনি পিট ও লিভারপুলের দীর্ঘ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ শ্রেণীর হয়ে কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। বাইবেলের উপর তার মতামতসমূহ তার ঈশ্বরের ত্রিমূর্তিবাদে অবিশ্বাসের থেকে অনেক বেশি তার সমসাময়িকদের অসন্তুষ্ট করেছিল, অথচ আজ কোন এক আর্চবিশপ ওই মতবাদই পোষণ করছেন। কিন্তু যারা সত্যিই তাঁর অনুরাগী ছিল তারা ছিল সেই সব মানুষ যারা তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করে আন্দোলন করে পিটের নির্দেশে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেইসব মানুষদের কেউ ছিল Owenites, Chartists, Trade unionist ও Socialist যারা Sixth Acts-এর দ্বারা ক্লেশ ভোগ করেছিল। এই সমস্ত অবদমিত বীরদের কাছে সাহস, মানবিকতা ও সম-মনোভাবাপন্নতার উদাহরণ তিনি নিজেকে দিয়েই রেখে গেছেন। যখনই জনসাধারণের কোন ব্যাপার তার কাছে এসেছে তখনই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অহঙ্কারের কথা ভুলে গেছেন। তাঁর নিজের প্রতি এই অনীহার জন্য জগৎ তাকে শাস্তি দিয়েছে। যদি তিনি একটু কম দয়ালু হতেন, একটু কঠোর হতে পারতেন, তবে বোধহয় আজ তিনি খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পারতেন। প্রশংসাকে ধরে রাখতে গেলেও কিছুটা জাগতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়।

সুন্দর মানুষ


(প্রথম প্রকাশ ১৯৩১)


সুন্দর মানুষ যারা তাদের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা হল। কিন্তু পাঠক একথা জানতে চাইতেই পারে ঠিক কেমন ধরণের মানুষকে আমি সুন্দর মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি। তাদের প্রয়োজনীয় গুণের উপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচন করাটা কিছুটা জটিল হয়ে যাবে। তাই আমি নির্দিষ্ট ধরণের কিছু মানুষের কথা আলোচনা করব যারা সুন্দর মানুষের আয়তায় পড়ে। সুন্দরী অল্পবয়স্কা অবিবাহিতা মাসি বা পিসি অবশ্যই সুন্দর মানুষ, বিশেষত যদি তারা ধনী হয়। ধর্মযাজকরা খুব সুন্দর, একমাত্র সেই ধরণের ঘটনা ছাড়া যে ঘটনার ফলে তারা আত্মহত্যার ভান করে কীর্তন দলে ভিড়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় পালায়। আমার বলতে দুঃখ হচ্ছে যে, যুবতী মেয়েরা বর্তমানে কদাচিৎ সুন্দর হয়। যখন আমি যুবক ছিলাম, তখন যুবতী মেয়েরা খুব সুন্দর ছিল– অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি তখন যে-কোন বিষয় শুধু নয়, যে-কোন ব্যক্তি, এমন কি যুবকদের কোন উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে মায়েদের মতামতকে তারা মূল্য দিত। তারা ঠিক সময় মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলত “হ্যাঁ মা’ এবং না মা। তারা তাদের বাবাকে ভালোবাসত কেননা সেটাকে কর্তব্য বলে মনে করত, এবং মাকে ভালোবাসত এই কারণে যে তাদের সামান্য ভুল কাজ করা থেকে রক্ষা করত। যখন তারা বাগদত্তা হত তখন তারা নিজেদের আধুনিকা করে সাজাতে ভালোবাসত এবং বিবাহের পর তারা নিজেদের সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাটাকে স্বামীকে ভালোবাসা জনিত কর্তব্য বলে মনে করত, কিন্তু অন্যান্য মহিলাদের তারা বোঝাত যে এটা এমন একটা কর্তব্য যা তারা অতিকষ্টে সম্পাদন করে। তারা তাদের শ্বশুর ও শাশুড়ীর সঙ্গে খুব সুন্দর ব্যবহার করত, কিন্তু কোন কর্তব্যহীন ব্যক্তি যে এরকম ব্যবহার করতে পারে না তা যদি আমরা আগে বুঝে নিতে পারি তবে এই মেয়েদের আমরা ভালো করে বুঝতে পারব। তারা অন্যান্য মহিলা সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণভাবে কথা বলত না, কিন্তু যখন তারা মুখ খুলত এবং কথা খরচ করত তখন তা একজন দেবদূতীর মহানুভবতার সঙ্গেই করত। এই ধরণের মহিলাদের শুদ্ধ ও মহান মহিলা বলা যায়। কিন্তু হায়, এই ধরনের মহিলা কেবলমাত্র বৃদ্ধাদের মধ্যে ছাড়া এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।


কৃপাবশত আজও যারা বেঁচে আছেন তাঁদের প্রবল ক্ষমতা। তারা শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করেন। তাঁরা ভিক্টোরীয় ধরণের ভণ্ডামিকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা যেখানে করেছেন সেখানে খুব অসফলতা পাননি। তাঁরা আইনসভাকে ‘নৈতিক প্রেক্ষাপটে’ আজও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এবং পায়ে তেল মাখানো ধরণের জীবিকার সৃষ্টি করেন। তারা কাগজের হয়ে লেখে এমন সব যুবকদের বৃদ্ধা রমণীদের সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করবার জন্য উৎসাহিত করেন যাতে তারা যুব মানসের বিচিত্র ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কল্পনা ও শৈলীকে ধরতে পারেন। তারা বহু আনন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে, না হলে অন্যান্যরা তা বুভুক্ষুর মতো খেয়ে শেষ করে ফেলত। উদাহরণস্বরূপ, মঞ্চে উঠে আজেবাজে কথা শোনার আনন্দ কিংবা প্রথাগত রীতির বাইরে একটু বেশি খালি গা দেখার আনন্দ। সর্বোপরি তারা এখনও পর্যন্ত শিকার করার আনন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ডের শায়ার বা জেলাগুলোতে শেয়াল শিকারের জন্য লোকদের অভিযুক্ত করা হয়। এই ধরণের শিকার যেমন খরচ সাপেক্ষ, অন্যদিকে কিছু কিছু সময় তেমন ভয়ঙ্কর। এছাড়াও একটা শেয়াল কোনভাবেই পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে না যে শিকার হওয়াটাকে সে কতটা অপছন্দ করে। এই সমস্ত ব্যাপারে মানুষ-শিকার করাটা বেশ মজার খেলা হতে পারত। যদি খেলাটা সুন্দর মানুষদের জন্য না হত তবে বিবেকবান মানুষদের জন্য খেলাটা মুস্কিলের হত। যে খেলাগুলোকে এইসব সুন্দর মানুষগুলো দোষারোপ করে সেই খেলাগুলো মানবিক, কিন্তু যখন তারা খেলবে এসো’ বলে ডাক ছাড়ে তখন শিকারীরা একত্র হয় এবং শিকারের পেছনে ছুটে তারা শিকারকে বন্দী করে অথবা তাকে মেরে ফেলে। বিশেষত খেলাটা তখন বেশি করে জমে ওঠে যখন শিকার হিসেবে কোন মহিলাকে ধরা হয়। এই খেলাটা মহিলাদের হিংসা বা পুরুষদের ধর্ষকাম থেকে ঘটে। এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে থাকেন এমন এক বিদেশিনী মহিলাকে আমি জানি যিনি তার স্বামী ছাড়াও আরও একজন পুরুষের সঙ্গে সুখে শান্তিতেই আছেন যাকে তিনি ভালোবাসেন, আবার সেই পুরুষটিও তাকে ভালোবাসে। দুর্ভাগ্যক্রমে তার রাজনৈতিক মতামত যতটা রক্ষণশীল হওয়া দরকার ছিল ততটা রক্ষণশীল হয়নি। যদিও সেই মতামতগুলো কেবল মতামতই, তবুও বলা যায় যে তিনি সেই মতামতগুলোকে মানতে কিছুই করেননি। সুন্দর মানুষেরা এই ঘটনার সত্যাসত্য জানবার জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে কাজে লাগালো এবং সেই মহিলাকে তার নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল যাতে তিনি না খেতে পেয়ে মরেন। ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় বিদেশীরা নৈতিকভাবে অপমানজনক কাজকর্ম করে বেড়ায়। এইজন্য আমরা পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা বিদেশীদের এই মর্যাদাহানিকর কাজকে সামলে বেড়ায় এবং যাতে আমাদের মধ্যে কেবলমাত্র ধার্মিক বিদেশীরাই থাকতে পারে তার দিকে চোখ রাখে।


এটা মনে করা আমাদের অবশ্যই উচিত নয় যেসব সুন্দর মানুষই মহিলা। যদিও বলা যায় যে পুরুষের থেকে মহিলারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুন্দর মানুষ হয়ে থাকে। ধর্মের সেবিকারা ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় আরও অনেক সুন্দর মানুষ আছে। এইসব মানুষ হল তারা যারা নিজেদের জন্য বিরাট সৌভাগ্যকে তৈরি করেছে এবং যারা এখন তাদের ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে তাদের সৌভাগ্যকে দানশীলতার পেছনে খরচ করছে। ম্যাজিষ্ট্রেটরাও প্রায় অনিবার্যভাবে সুন্দর মানুষ। যদিও এটা বলা যেতে পারে না যে তারা আইন আদালতকে সমর্থন করে তারাই সুন্দর মানুষ। মনে আছে যখন আমি যুবক ছিলাম যখন চরম শাস্তি সম্পর্কে আগে থেকেই একজন সুন্দর মহিলা আমাকে শুনিয়ে রেখেছিলেন যে এধরনের শাস্তি ভালো নয় এবং একজন ফাঁসুড়ে কখনই একজন ভালো মানুষ হতে পারে না। কোন ফাঁসুড়েকে ব্যক্তিগতভাবে কখনও জানিনি তাই তার সম্পর্কে সেই মহিলার যুক্তিকে পরীক্ষা করে দেখে নেবার সুযোগ কখনও পাইনি। আমি একজন মহিলাকে জানি যিনি একদিন ট্রেনের মধ্যে একজন ফাঁসুড়ের সাক্ষাৎ পান একথা না জেনে যে সেই লোকটি একজন ফাঁসুড়ে। আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা থাকার জন্য সেই ভদ্রমহিলা যখন তাকে একটি কম্বল দিতে যান তখন সেই লোকটি বলে ওঠে, ‘ম্যাডাম, যদি জানতেন আমি কে তা হলে আপনি একাজ করতেন না, ফাঁসুড়ে ব্যক্তিটির এই ধরণের আচরণ ও কথাবার্তা প্রমাণ করে যে সেও একজন সুন্দর মানুষ। যদিও এধরণের ঘটনা একটি ব্যতিক্রম। ডিকেন্সের বারনাবি রাজ’ গ্রন্থে যে ফাঁসুড়েটির কথা বলা হয়েছে, জোর দিয়ে বলা যায় যে সে কখনই সুন্দর মানুষ নয়, সম্ভবত এক অদ্ভুত ধরণের মানুষ।


যেহেতু ফাঁসুড়েরা সুন্দর মানুষ নয় সেহেতু চরম শাস্তি (ফসি) ভালো নয়, এই ধরণের যে যুক্তি সেই মহিলার কাছ থেকে আমরা পাই, আমি মনে করি তার সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। কেননা একজন সুন্দর মানুষ হতে গেলে যে কোন রকম নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বাস্তবে রক্ষিত হতে হয় এবং যারা রক্ষা করবার কাজটি করে তারা কখনও সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন, সমুদ্রতীরবর্তী একটি ডুবন্ত জাহাজ, যে জাহাজটিতে করে অনেক বর্ণের শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মহিলা যাত্রীও ছিল। যাদের মধ্যে ধরেই নেওয়া যায় যে সবাই সুন্দরী মহিলা ছিল। তাই তাদের আগে বাঁচানো হল। যে-সব মানুষ এই বহু বর্ণের শ্রমিকদের নিয়ে যাচ্ছিল তাদের বড় সুন্দর পদ্ধতিতে বাঁচবার সুযোগ মিলল সেইসব শ্রমিকদের দ্বারাই। সেই সুন্দর মহিলারা যখনই বুঝল যে তারা রক্ষিত তখনই তারা সেইসব ডুবে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু তাদের কোমল হৃদয় কার্যকরী হয়ে উঠলো সেইসব শ্রমিকদের দ্বারা রক্ষিত হবার পর।


সাধারণত সুন্দর মানুষেরা সমগ্র জগতের খবরদারি করার ভারটি বেতনভুক কর্মচারীদের হাতে দিয়ে রেখেছে। কারণ তারা বুঝেছে যে যারা সত্যই সুন্দর মানুষ তাদের পক্ষে এই খবরদারি করা সম্ভব নয়। তবে একটা জায়গা আছে যেখানে তারা কোন রকম অংশগ্রহণ করে না আর তা হল পেছনে কামড়ানো বা কোনরকম কেলেঙ্কারীজনিত ঘটনায়। কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতার দ্বারা মানুষ সৌন্দর্যের যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। যদি ক খ-এর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং খ ক-এর বিরুদ্ধে বলে তবে যে সমাজে তারা বাস করে সেই সমাজ অনুযায়ী একজন তার কর্তব্য করছে আর একজন ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি জনগণের হয়ে কর্তব্য করছে সে ওই দুই ব্যক্তির থেকে অনেক বেশি সুন্দর। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্কুলের অন্যান্য শিক্ষিকাদের চেয়ে সুন্দর কিন্তু যে মহিলাটি স্কুল পরিচালনার বোর্ডে আছেন তিনি প্রধান শিক্ষিকা ও অন্যান্য শিক্ষিকাদের চেয়ে অনেক সুন্দর। নামী দামী পদবী-টদবিগুলোর বলি নারী বা পুরুষ প্রথমেই তাদের জীবনের অস্তিত্বকে হারায়। আবার যারা এই পদবীগুলোতে পৌঁছতে পারে না, তারা অধৈর্য ছোটলোকেও পরিণত হতে পারে। এইজন্য আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয় যে মঙ্গলের খাতিরে এই বিষয়টি বেশ শক্তিশালী এবং আমাদের অবশ্যই সেইসব সুন্দর মানুষদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা উচিত যারা এই ধরণের ব্যবস্থা প্রদান করেছেন।


সুন্দর মানুষদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিজ সত্তা নির্ভর উন্নতির সশব্দ সাধনা। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সুন্দর মানুষেরা মনে করেন যে তারা এই কাজটি আরও ভালোভাবে করতে পারতেন, কিন্তু স্বর্গীয় হস্তকর্মের অধীনে বহু বিষয় ও কাজ আছে, তাই সেই ধরণের কোন কাজ করবার ইচ্ছা অবশ্যই ঈশ্বর নিন্দাজনক। এবং তার উল্লেখ করাও কোন রকমভাবে সুন্দর নয়। স্বর্গীয় মানুষেরা বলে থাকেন যে যদি আমাদের প্রথম জনক জননী আপেলটি না খেতেন তবে মানবজাতি অন্যান্য নিষ্পাপ ধরণের ফলে পূর্ণ হয়ে যেত–গিবন এরকম ধরণের কথাই বলেছেন। এই বিষয়ে স্বর্গীয় পরিকল্পনা সত্যই রহস্যজনক। স্বর্গীয় মানুষদের মতে পাপের শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যথার্থ, অর্থাৎ আপেল খেয়েছে তার ফল ভোগ কর। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যে সমস্যাটা দাঁড়ায় তা হল সুন্দর মানুষের ক্ষেত্রে যেটা শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়, দুঃখজনকভাবে সেই একই শাস্তি অন্যান্য মানুষদের ক্ষেত্রে আনন্দজনক হয়ে ওঠে। মনে হয় যে, শাস্তি ব্যাপারটি তৈরি হয়েছে কিছু ভুল লোকদের ঘাড়ে পড়বার জন্য। সুন্দর মানুষদের বহু উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য হল নিঃসন্দেহে এই অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের প্রতিকার করা। তারা এটাই নিশ্চিত করতে সর্বদা প্রচেষ্টা করতে থাকে যে জীববিদ্যা অনুযায়ী ফল প্রদানের সাধন উর্বর অথবা শীতল এই দুভাবে করা যায়, এবং যারা উর্বরভাবে সাধন করে, দেখা যায় তারাই সুন্দর মানুষদের মধ্যে ক্ষমতায় আসীন হয় এবং তারা এই ক্ষমতায় আসীন হয় কেলেঙ্কারীর দ্বারা তাদের চরিত্র কলঙ্কিত হবার পর। তারা কেলেঙ্কারীর ব্যাপারটিকেও খুব সুন্দর করে আড়াল করে রাখার প্রচেষ্টা করে থাকে। তারা সেন্সরকে নিজেদের হাতে পাবার চেষ্টা করে যাতে গোপনে ঘটে যাওয়া কুৎসিত নোংরামীর চেয়ে সেইসব গ্রন্থ ও নাটককে বাতিল করে দিতে পারে যেখানে কেলেঙ্কারীর কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারে তারা সব জায়গায় প্রায় সরল হয় এবং আইন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ঈশ্বর কেন যে মানবশরীরটি তৈরি করেছেন তা জানা যায় না, কিন্তু যে কোন ব্যক্তি এটা মনে করে নিতে পারে যে সর্বময় ঈশ্বর মানবশরীরকে এইভাবে তৈরি করেছেন এই জন্য যাতে সুন্দর মানুষেরা কোনরকম আঘাত না পায়। সম্ভবত এর পেছনে সঠিক কোন কারণ আছে। ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারে যতদিন বয়নশিল্প গড়ে উঠেছে ততদিন ধরে দেখা যাচ্ছে যে বয়ন-শিল্পের সঙ্গে মিশনারীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মিশনারীরা বর্বরদের শেখাচ্ছে কিভাবে মানব শরীরকে আচ্ছাদিত করতে হয় এবং তার ফলে বস্ত্রশিল্পের চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে। যদি মানব শরীর সম্পর্কে লজ্জার কোন কিছু না থাকত, তবে বয়নশিল্প তার লাভের উৎসমুখ হারাত। এই দৃষ্টান্ত আমাদের যে ঘটনাটি দেখায় তা হল, পাছে পুণ্যের প্রচার আমাদের লাভ কমিয়ে দেয় তাতে আমাদের ভীত হবার কোন প্রয়োজন নেই।


‘নগ্ন সত্য’ এই শব্দগুচ্ছটি যিনিই আবিষ্কার করে থাকুন না কেন তিনি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নগ্নতা যে-কোন সঠিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের কাছে একরম ধাক্কা এবং ঠিক এই কারণেই তা সত্য। কি ধরণের বিভাগে আপনি যুক্ত আছেন তাতে কিছু আসে যায় না, আপনি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন যে সত্য এমন একটি বস্তু যা সুন্দর মানুষ তাদের চেতনায় স্বীকার করেন না। এটাই আমার দুর্ভাগ্য যে এমন একটি মামলার শুনানীর জন্য আদালতে উপস্থিত থাকতে হয় যে ঘটনাটি সম্পর্কে আমার প্রথম শারীরজ্ঞান ছিল, কিন্তু আমি দেখে আঘাত পেয়েছিলাম যে সেইসব শ্রদ্ধার বেড়াজালে আবদ্ধ প্রবেশদ্বার ভেদ করবার জন্য কোন সত্যই সেখানে অনুমোদন পায় না। যে সত্য আইন আদালতে প্রবেশের সুযোগ পায় তা নগ্ন নয়, কিন্তু আদালতের পোশাকের অপেক্ষাকৃত কম সুন্দর অংশে যে সত্য লুকিয়ে থাকে তা নগ্ন সত্য। সরাসরি খুন, চুরিমূলক অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে তা সত্য সে কথা আমি বলিনি, আমি বলেছি সেই সব মামলা মোকদ্দমার কথা যেখানে সংস্কারের উপাদান থাকে, যেমন–রাজনৈতিক মামলা, বা অশ্লীলতার মামলা। আমি বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে আমেরিকার থেকে ইংল্যান্ড অনেক বেশি হীন পর্যায় পড়ে। কেননা ইংল্যান্ড তার সৌন্দর্যের অনুভবের দ্বারা সব অসুন্দর বস্তুর অদৃশ্যে ও আধা-সচেতন নিয়ন্ত্রণকে একটা উৎকর্ষে নিয়ে যেতে পারছে। যদি আপনি আইন আদালতে কোন অপরিপক্ক ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চান তবে আপনি দেখবেন যে সেরকম কাজ করতে চাওয়াটা সাক্ষ্যপ্রমাণজাত আইনের বিরুদ্ধ এবং কেবলমাত্র বিচারক ও বিরুদ্ধ আইনজীবীই নয়, আপনার পক্ষে যিনি আইনজীবী হবেন তিনিও ওই ধরণের ঘটনার কথা বলতে বাধা দেবেন।


এই একই ধরণের অবাস্তবতা রাজনীতিতে প্রবেশ করে থাকে সুন্দর মানুষদের অনুভবের ফলস্বরূপ। যদি আপনি কোন সুন্দর মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করেন তিনি যে দলের সমর্থক সেই দলের কোন রাজনীতিবিদ সাধারণ একজন মরণশীল ব্যক্তি এবং যিনি রাশি রাশি মানুষের থেকে কোন অংশে বড় নন তবে দেখবেন সেই সুন্দর মানুষটি রুষ্ট হয়ে আপনার উপদেশটি অস্বীকার করবেন। ফলস্বরূপ রাজনীতিবিদদের নিষ্কলঙ্ক হয়ে সামনে আসাটা একান্ত প্রয়োজন। বেশিরভাগ সময় সমস্ত দলের রাজনীতিবিদরা তাদের পরিচিত হয়ে ওঠবার পেশায় কোনরকম ক্ষতির আশঙ্কা দেখলে মৌনভাবে একত্র হন তাকে বাধা দেবার জন্য। রাজনীতিবিদদের পেশাগত অভিন্নতা যতটা তাদের একত্র করে তার চেয়ে দলের স্বতন্ত্রতা অনেক কম তাদের বিভক্ত করে থাকে। এইভাবে সুন্দর মানুষেরা জাতীয় মহান মানুষদের সম্পর্কে কল্পনাময় ছবি সংরক্ষণে সমর্থ হন। বিদ্যালয়ের শিশুদের ভাবতে বাধ্য করানো যে, খ্যাতি কেবলমাত্র উচ্চ-ধর্ম বা গুণের দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। এটা সত্য যে কিছু কিছু অসাধারণ সময়ে রাজনীতিবিদরা বাস্তবে অসহ্য হয়ে উঠেছে এবং সর্বদা সেইসব রাজনীতিবিদরা যথার্থ সম্মানের জন্য বিবেচিত হন না যারা শিষ্টাচারবর্জিত ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, পারনেল প্রথমে খুনীদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রাখার জন্য সফলতার সঙ্গে অভিযুক্ত হন এবং তারপর তাকে এমন অনৈতিকতার অভিযোগে সফলতার সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয় যে অভিযোগের কথা কোন অভিযোগকারী স্বপ্নেও ভাবতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের কালে ইউরোপের ক্যুনিস্ট এবং আমেরিকার চরমপন্থী দল ও শ্রমিক আন্দোলনকারীরা সীমার বাইরে অবস্থান করত। কোন সুন্দর মানুষদের বিরাট দল তাদের প্রশংসা করত না এবং যদি তাদের মধ্যে কেউ প্রথাগত আইনের বিপক্ষে যেত তবে তার কপালে কোনরকম ক্ষমা জুটত না। এইভাবে সুন্দর মানুষদের গতিহীন নৈতিক প্রথাসমূহ তাদের সম্পত্তির প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এইভাবেই তাদের অপরিমেয় যোগ্যতা আর একবার প্রমাণ করা যায়।


সুন্দর মানুষ যখনই কোন আনন্দ দেখে তখনই খুব সঠিকভাবে তাকে সন্দেহ করতে পারে। তারা জানে যে, সে যতটা প্রজ্ঞা (Wisdom) বাড়ায় ততটা দুঃখও বাড়ে এবং তারা অনুমান করে যে, সে যতটা দুঃখকে বাড়ায় ততটাই প্রজ্ঞাকে বাড়াতে পারে। এই কারণে তারা অনুভব করে যে দুঃখের প্রসারণে প্রজ্ঞার প্রসারণ হচ্ছে। কেননা প্রজ্ঞা চুনীর থেকেও বেশি মূল্যবান। তারা মনে করে যে এইরকম কাজ করে তারা সুবিচার করছে কেননা তা আখেরে লাভজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, তারা শিশুদের খেলার জন্য মাঠ তৈরি করে দেয় এই কারণে যাতে তারা নিজেদেরকে মানবপ্রেমিক মনে করতে পারে। তারপর সেখানে খেলবার জন্য এত শর্ত চাপায় যে কোন শিশুই সেখানে খেলে সুখী হয় না যতটা তারা সুখী হয় রাস্তায় খেলে। শিশুরা সেই খেলার মাঠ ও রঙ্গালয় কেবলমাত্র রবিবার দিনটি ছাড়া বাদবাকি দিনে পরিহার করে চলে, কেননা সেই দিনে সেগুলো সবার জন্য খোলা থাকে বলে তারা সেখানে আনন্দ করতে পারে। কর্মস্থলে যুবতী মহিলাদের যতদূর সম্ভব বাধা দেওয়া হয়ে থাকে যুবক পুরুষদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে। যতজন সুন্দর মানুষকে আমি চিনি তারা তাদের পরিবারের প্রিয়জন সম্পর্কে এই ধরণের আচরণই করে থাকে এবং তাদের শিশুদের তারা কেবলমাত্র নির্দেশিত কিছু খেলা খেলতে বাধ্য করে। যদিও আমি একথা বলতে দুঃখবোধ করছি যে সৌন্দর্যের এই ধরণের মাত্রা আগে যতটা ছিল এখন তা খুবই কম। পুরোনো যুগে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হত :


ঈশ্বরের দণ্ডের একটি আঘাত হলে, ছোট্ট পাপী নরকে শীঘ্র যায় চলে। এর থেকে এটা বোঝা যায় যে শিশুরা খুব গোলমাল করলে বা যে কাজ তাদের জন্য মন্ত্রকেরা নির্দিষ্ট করে দেয়নি সেই রকম কাজে অতি প্রশ্রয় পেলে তাদের কপালে ওইরকম ঘটবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর শিক্ষা যা ‘দ্য ফেয়ারী চাইল্ড ফ্যামিলি’তে দেওয়া হচ্ছে তা সুন্দর মানুষ তৈরির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। আমি কতিপয় পিতামাতাকে জানি যারা বর্তমানে এই ধরণের উচ্চ মাপের জীবনযাপন করে থাকেন। এটা খুব সাধারণ ধারণা হয়ে গেছে যে শিশুরা নিজেরাই আনন্দ করতে পারে এবং এটা খুব ভয়ের ব্যাপার যে যেসব শিশুরা এই ধরণের কোমল আদর্শের উপর শিক্ষিত হচ্ছে তারা যখন বড় হবে তখন আনন্দ পাবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভয়ঙ্কর ব্যাপার যে ঘটাবে না এমন নয়।


এটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার যে সুন্দর মানুষদের সময়টা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। দুটো বিষয় এই সময়টাকে শেষ করছে। প্রথম বিষয় হল এই ধরণের বিশ্বাস পোষণ করা যে সুখী হবার জন্য কোন কষ্ট বা ক্ষতিকে স্বীকার করতে হয় না এবং সুখী হবার ক্ষেত্রে কেউ কম যোগ্য নয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হল বড় বড় কথা বলাকে অপছন্দ করা। এই অপছন্দটি নীতির মতোই সুন্দর। যুদ্ধের দ্বারা এই দুই ধরণের বিদ্রোহকে উৎসাহিত করা হয়েছিল তখন যখন সমস্ত দেশের সুন্দর মানুষেরা নিয়ন্ত্রিত নিশ্চয়তার মধ্যে ছিল এবং উচ্চ নৈতিকতার নামে তারা যুবক মানুষদের একে অন্যকে হত্যা করতে প্ররোচিত করেছিল। এসব মিটে গেলে পরে যারা বেঁচে রইল তারা এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেল যে, উচ্চ-ধর্ম তৈরি করে সেই ধরণের বিদ্বেষ যা মিথ্যা ও দুর্দশাকে প্রেরণা দেয়। আমি এই ভেবে ভীত হই যে এইসব যুবক মানুষেরা সময় আসার আগেই না তাদের এই ধরণের বাস্তব ও উচ্চ ধরণের নীতিজনিত মৌলিক মতাদর্শকে গ্রহণ করতে প্রবৃত্ত হয়ে ওঠে।


সুন্দর মানুষদের মূল বিষয়টি হল যে তারা সহযোগিতা মূলক ভাবে জীবনকে গড়ে তোলার প্রবণতা সম্পন্ন জীবনকে ঘৃণা করে। শিশুর গোলমাল এবং সর্বোপরি যৌনতা প্রভৃতি নিয়ে তাদের চিন্তা তাদের মর্যাদা আবিষ্ট করে রাখে। সংক্ষেপে সুন্দর মানুষ সর্বদাই সেই ধরণের মানুষ যাদের মন নোংরা।

নতুন প্রজন্ম


[বর্তমান প্রবন্ধটি রাসেল The new generation নামক একটি গ্রন্থের ভূমিকা রূপে লেখেন, যে গ্রন্থে বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদরা ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররাও লেখেন। রাশিয়া একমাত্র ‘রাষ্ট্র যা পুরোনো নীতি ও ধর্মীয় সংস্কারের অধীনে নেই’- রাসেলের এই ধরণের মন্তব্য লক্ষ করে বলা যায় এই প্রবন্ধটি অবশ্যই ১৯৩০ সালের দিকে রচিত। পরবর্তীকালে স্ট্যালিনের রাজত্বে যৌনতা সম্পর্কীয় নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠার সমস্ত চেষ্টাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় এবং এই বিষয়ে যে-সব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে সেখানে বেশি গোঁড়া বা অবদানমূলক ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। ১৯২০ সালে রাসেল নিজেই সেখানকার এই উন্নতির সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।]


এই গ্রন্থের পরবর্তী পাতাগুলোতে শিশুদের মঙ্গল করা ও তাদের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ লেখকেরা তাদের মতো প্রদান করেছেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমি সেই পথ সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রস্তাব করি যে পথে নব্য জ্ঞান রূপান্তরিত হয়েছে এবং এখনও রূপান্তরিত হয়ে চলেছে অর্থাৎ ঐতিহ্যময় জীববিদ্যাগত সম্পর্কের পথ। আমি কখনই জ্ঞানের অভিপ্রায়মূলক ও উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করছি না। আমি সেই ধরণের জ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করছি প্রাকৃতিক শক্তি হিসেবে যে জ্ঞান ভীষণভাবে কৌতূহলোদ্দীপক ও আশাতীত ধরণের ফল প্রদান করতে পারে। আমি নিশ্চিত যে জেমস ওয়াটের কখনই মাতৃতান্ত্রিক ধরণের পরিবার প্রতিষ্ঠা করবার ইচ্ছা ছিল না। যদিও এই বিষয়টিকে সম্ভবপর করে তুলে পুরুষ নিজের কাজের জায়গা থেকে বহু দূরে গিয়ে ঘুমোতে ভালোবাসে। গ্রামের জনসাধারণের মধ্যে এই রকম ঘটনাই দেখা যায়। শহরতলির পরিবারগুলোতে পিতার স্থান খুবই কম–বিশেষত তিনি যদি গলফ খেলেন যা তারা সাধারণত খেলে থাকেন তার শিশুর জন্য মূল্য প্রদান করে তিনি শিশুর জন্য কি কিনছেন তা দেখা কিছুটা কষ্টকর এবং কেবলমাত্র ঐতিহ্যের দিক থেকে তিনি তার শিশুকে দর-কষাকষির বস্তু ভাবছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ করা যায়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার তার স্বর্ণযুগে পুরুষ মানুষকে প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। এই পরিবার তাকে পুত্র দিয়েছে যে পুত্র তাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখাশুনা করবে এবং তাকে বহু শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এখন যে শ্রেণীর অন্তর্গত হয়ে মানুষ বসবাস করে সেখানে তারা বিনিয়োগ করে অথবা তাদের উপার্জিত সঞ্চয়ের উপর নির্ভর করে বাঁচে, তাই এখন পিতা-পুত্র যতদিনই এক সঙ্গে থাকুক না কেন পুত্র এখন আর পিতার পক্ষে লাভজনক বা সুবিধাজনক নয়।


অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে যে নব্য জ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের যুগটিকে হঠাত্র যেমন জটিল করে তুলেছে অন্যদিকে তেমন কৌতূহলজনকও করে তুলেছে। পুরোনো যুগগুলোতে মানুষ প্রকৃতির অধীনে ছিল। সে দু’ধরনের প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল আবহাওয়া ও ফসলের উর্বরতা ইত্যাদি জড় প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল। আবহাওয়া ও ফসলের উর্বরতা ইত্যাদি জড় প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল, অন্যদিকে সে অন্ধ উত্তেজনাকর মানবিক প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল যা তাকে জন্ম দিত ও যুদ্ধ করাত। পুরুষত্বহীনতা বা অক্ষমতার ফলজনিত বোধ ধর্মের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। কর্তব্যের মধ্যে ভয়কে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এবং নৈতিক উল্কর্ষ বা ধর্মের (Virtue) মধ্যে বিতৃষ্ণাকে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ধর্ম তার কাজ করত। কতিপয় নমুনা হিসেবে এখনো যারা বিদ্যমান সেইসব আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র। বস্তুজগৎ তাদের কাছে এখন কোন স্বীকৃত বিষয় নয় যা ধন্যবাদের সঙ্গে ও প্রার্থনাপূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে তাদের গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত জগৎ তাদের কাছে বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের জন্য একপ্রকার কাঁচামালের মতো। মরুভূমি এমন একটি স্থান যেখানে জলকে অবশ্যই আনতে হয়, কিন্তু ম্যালেরিয়া জলাভূমি এমন একটা জায়গা যেখান থেকে জলকে সরাতে হয়। মানুষ এমন কিছুকে অনুমোদন করে না যা তার সঙ্গে প্রাকৃতিক শক্রতা চালিয়ে যেতে পারে। সুতরাং পদার্থগত প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের লড়াইতে শয়তানের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করবার জন্য ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন নেই। যে বিষয়টি সম্ভবত এখনও পর্যন্ত কম প্রশংসিত হয়েছে তা হল একই ধরণের অনিবার্য পরিবর্তন যা মানবপ্রকৃতির মধ্যে হতে শুরু করেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে যখন ব্যক্তি তার চরিত্র উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাল্টাতে অসুবিধা বোধ করতে পারে, তখন যদি বৈজ্ঞানিক মনস্তাত্ত্বিকদের শিশুদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয় তবে তারা ঠিক সেইরকম ভাবে শিশুদের সুবিধাজনক অবস্থায় আনবার কার্যকলাপ করতে পারে যেরকম ভাবে ক্যালিফোর্নিয়রা মরুভূমিকে সুবিধাজনক অবস্থায় আনবার জন্য কাজ করে থাকে। যে শয়তান কেবল পাপ করে সেই শয়তানের খেলা আর রইল না, বিষয়টি আজ (শরীরের) দূষিত গ্রন্থিসমূহ ও অজ্ঞাতমূলক অবস্থাজাত হয়ে পড়েছে।


সম্ভবত পাঠক এই প্রসঙ্গে পাপের ব্যাখ্যা শোনবার আশা করবেন। যদিও এতে কোনরকম অসুবিধা নেই। পাপ হল তাই যা সেই সব মানুষদের অপছন্দের যারা শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে (Sin is what is disliked by those control education)।


এটা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে এই অবস্থা বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার ধারকদের অর্পণ করা হয় যা এক নতুন ও গভীর দায়িত্ব। এখনো মনুষ্যজাতি বেঁচে আছে এই কারণে যে সে তার উদ্দেশ্যসমূহকে অর্জন করবার জন্য যতই বোকার মতো ছুটুক না কেন তাদের এমন কোন অর্জিত জ্ঞান নেই যা দিয়ে সে উদ্দেশ্যসমূহকে অর্জন করতে পারে। এখন, যখন এই জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তখন জীবনের লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে প্রজ্ঞার একটি বিরাট মাত্রা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের বিল যুগে এই প্রজ্ঞা কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে?


উপরোক্ত প্রতিফলনগুলি এই নির্দেশ করে যে আমাদের সমস্ত প্রথা, এমনকি যেগুলো আমাদের প্রবৃত্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সেগুলো আগে যেমন ছিল বা এখন যেমন আছে তার চেয়ে নিকট ভবিষ্যতে অনেক বেশি সুচিন্তিত ও সজাগ হয়ে উঠবে এবং তার বিশেষ প্রয়োগে শিশুদের ফিরে পাওয়া যাবে ও লালনপালন করা যাবে। নতুন পথ পুরোনো পথের থেকে অনেক বেশি ভালো হবে; আবার তা খুব সহজে খারাপও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের যুগের নব্য জ্ঞান ঐতিহ্যমূলক আচরণের যান্ত্রিকতাকে এমন কঠিন আঘাত দিয়েছে যে পুরোনো ধরণের প্যাটার্ন বা আদল আর টিকে থাকতে পারেনি এবং ফলে নতুন ধরণের আদল ভালো বা মন্দ যে-কোন কিছুর জন্য অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।


মানুষ তার অবিশেষজ্ঞ অতীতেও বেঁচে ছিল, যখন একটি মানুষ তার নিজের জুতো নিজে তৈরি করত আবার তাকেই নিজের কেকটি বানাতে হত। পুরুষ মানুষের কার্যকারিতা এর বাইরে চলে গেল, কিন্তু নৈতিকতার জের টেনে মহিলাদের কার্যকারিতায় অনুরূপ পরিবর্তন এলো না। শিশুদের লালনপালন করা একটা বিশেষজ্ঞতার কাজ যা করতে গেলে দরকার বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান ও মানানসই পরিবেশ। ঘরে শিশুদের মানুষ করাটা যেন একটা ঘুরন্ত চাকার কাজ এবং তা কোনভাবেই অর্থনৈতিক নয়। জ্ঞান বিকাশের সাথে সাথে শিশু-প্রকৃতির বেশিরভাগ দিকগুলোকে ঘরের থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। এমনকি ঘরে শিশুর জন্ম হওয়ার প্রথাটিও আর রইল না। শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে আর সেই প্রাচীন ধারায় টোটকা চিকিৎসার ব্যবস্থা টিকে থাকল না যা আমাদের পূর্বপুরুষদের বহু শিশুকেই হত্যা করেছে। নিজের মায়ের হাঁটুর সামনে বসে আর প্রার্থনা করার প্রথা রইল না, সে জায়গায় এলো সানডে স্কুলে গিয়ে প্রার্থনার রেওয়াজ। জোর করে দাঁত তুলে ফেলার অথবা দাঁতে তার বাঁধার রেওয়াজ আর রইল না যা আমার যুবক বয়স পর্যন্ত টিকে ছিল। কিংবা দরজায় হাতল লাগানো বা দরজায় খিল লাগানো ব্যাপারটাও আর থাকল না। শিশুর জীবন সম্পর্কে প্রথম অংশটি চিকিৎসাবিদ্যাজনিত জ্ঞানের আওতায় পড়ে, দ্বিতীয়টি পড়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানজনিত জ্ঞানের আওতায় এবং তৃতীয়টি পড়ে শিশু-মনস্তত্ত্বের আওতায়। কিন্তু শেষে বিভ্রান্ত মা এসব কিছু বাজে কাজ ভেবে পরিত্যাগ করে এবং ইডিপাস কমপ্লেক্সের শাসানি শুনে তার প্রাকৃতিক স্নেহটি পাপের গন্ধে ভরে যায়।


এই পরিবর্তনের প্রধান কারণটি হল জন্ম ও মৃত্যুর হ্রাসপ্রাপ্তি। সৌভাগ্যবশত এই দুটি একই সঙ্গে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ যদি একটির পরিবর্তনে আর একটির হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটত তবে ফল হত মারাত্মক। জগতের সব সরকার সেই গীর্জাগুলোর সঙ্গে মিলে এই ধ্বংসাত্মক কার্য করতে তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে যে গীর্জাগুলোর প্রভাব মানুষের দুর্দশা ও কাপুরুষতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। তারা উভয়ে মিলে জন্মের হার হ্রাসকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যা মৃত্যুর হার হ্রাসের সঙ্গে সমানভাবে যুক্ত। এই বিষয়ে মানবজাতির জন্য সৌভাগ্যবশত ব্যক্তির স্বার্থপরতা তাদের সম্মিলিত নির্বুদ্ধিতার চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণিত হতে পেরেছে। আধুনিক পরিবারের ছোট্ট আকার পিতামাতাকে তাদের শিশুর সম্পর্কে এক নতুন মূল্য চেতনা দিয়েছে। যেসব পিতামাতার দুটি শিশু আছে তারা চায় না তাদের শিশুদের মধ্যে যে-কোন একটি শিশু মারা যাক, কিন্তু পুরোনো ধাচের পরিবারে যেখানে দশটা পনেরোটা ছেলেমেয়ে জন্মাতো সেখানে যত্নের অভাবে অর্ধেক সংখ্যক ছেলেমেয়েকে বলি চড়ানোটা কোন ব্যাপারই ছিল না। শিশুদের উপর আধুনিক বৈজ্ঞানিক যত্নের বিষয়টি আধুনিক ছোট আকারসম্পন্ন পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।


একই সঙ্গে এই পরিবর্তন পরিবারকে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের দিক থেকে কম মানানসই করে তুলেছে এবং মহিলাদের কর্মে ডুবে থাকার দিক থেকে কম সুবিধাজনক করে তুলেছে। পরিবারের পনেরোটা শিশুর মধ্যে অর্ধেক করে মরে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি নিরানন্দজনক জীবনকার্য। কিন্তু যে কোনভাবেই হোক সেখানে নিজেকে জানবার জন্য কিছুটা অবসর মিলত, অন্যদিকে দুটো কি তিনটে ছেলেমেয়ের পরিবারে জীবন-কার্যকে যথেষ্ট বলে ভাবা যাচ্ছে না, কিন্তু যতদিন পুরোনো ধরণের পরিবারকে ধরে রাখা হবে ততদিন জীবনের অন্যান্য দিকগুলোতে তা গভীরভাবে হস্তক্ষেপ করবে। অন্যদিকে, কতিপয় শিশুর পরিবারে মানুষ শিশুকে আরও বেশি বোঝা মনে করবে।


বর্তমানে যখন মানুষ উচ্চ-ভাড়ার দরুন নগরগুলো ঘিঞ্জি পরিবেশের বাস করে তখন দৈহিক নিয়ম অনুযায়ী গৃহটি শিশুদের পরিবেশের জন্য একেবারেই বাজে। যে মানুষ নার্সারির বাগানে চারাগাছকে লালনপালন করে সে সেই গাছদের জন্য ঠিক মাটি, ঠিক পরিমাণ আলো ও বাতাস, ঠিক পরিমাণ জায়গা ও ঠিক প্রতিবেশীদের বন্দোবস্ত করে থাকে। সে গাছগুলোকে আলাদা আলাদা টবে রেখে একের পর এক করে লালনপালন করার চেষ্টা করে না। শহরতলীয় গৃহগুলোতে শিশুরা যতদিন থাকবে ততদিন এইরকমভাবেই শিশুদের লালনপালন করবার চেষ্টা করা হবে। শিশুরা চারাগাছের মতো। তাদের ঠিক ভাবে বেড়ে ওঠবার জন্য চাই ঠিক পরিমাণ জমি, আলো, বাতাস এবং তাদের নিজেদের মতো প্রতিবেশী। শিশুদের সেই জায়গাতেই বড় হওয়া উচিত যেখানে কোনরকম উত্তেজনা ছাড়াই তারা পাবে স্বাধীনতা। গৃহগুলির মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সেখানকার দৈহিক পরিবেশের মতোই বাজে। চিৎকার চেঁচামেচিকেও একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে মনে করা যেতে পারে। বড় হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের চারপাশে নিরবচ্ছিন্ন টেসি খেলার শব্দকে সহ্য করবে এরকম আশা তাদের কাছ থেকে করা যেতে পারে না, কিন্তু একটি শিশুকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে না দেওয়াটা এমন একটা নিষ্ঠুরতা যা তার মধ্যে ক্রোধের জন্ম দেয় যা তাকে গভীর নৈতিক দোষে দুষ্ট করে তোলে। এই একই রকম ঘটনা ঘটে যদি তাদের কোন জিনিস ভাঙতে বাধা দেওয়া হয়। যখন একটি বালক রান্নাঘরের তাকে উঠে কাঁচের কাপ-ডিস ভেঙে ফেলে তখন তার পিতামাতা কদাচিৎ আনন্দিত হতে পারে। অথচ তার এই ধরণের কার্যকলাপ তার দৈহিক বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। যে পরিবেশ শিশুর জন্য তৈরি সেখানে এই রকম প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর ভাবাবেগকে করাবার কোন প্রয়োজন নেই।


পিতামাতার দৃষ্টিকোণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন অনিবার্যভাবে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনেতিক বিবর্তনের জন্য ঘটেছে যা পরিবারকে প্রভাবিত করে। নিশ্চয়তার চেতনার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য প্রমাণিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার দক্ষতা বারবার সংগঠিত ও হিংস্র যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে তুলবে বাড়তি জনসংখ্যাকে কমিয়ে আনবার উপায় হিসেবে।


এই কারণে, যদি রাষ্ট্রকে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হতে হয় তবে রাষ্ট্রের আলোকিত হওয়াটা একান্তভাবে প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র একা এই কাজটি করতে পারবে না, তবে বেশিরভাগ মানুষ যখন পুরোনো কুসংস্কারগুলোকে সংরক্ষণ করা জোর করে বন্ধ করে তখন ব্যাপারটি সম্ভব হবে। সব থেকে বেশি আলোকিত মানুষেরা একটি অবাস্তব জগতে বাস করে এবং সেই জগৎ তাদের সীমিত বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আবদ্ধ। তারা কল্পনা করে নেয় যে জগতের সবটাই প্রায় আলোকিত তবে কতিপয় অবাস্তব মানুষ এখনও অনালোকিত রয়ে গেছে। যেখানে তথাকথিত নৈতিক বিষয়গুলো যুক্ত সেখানে বাস্তব রাজনীতি ও আইন পরিচালনা সম্পর্কে অল্প অভিজ্ঞতা সেইসব মানুষের জন্য যথেষ্ট লাভজনক হতে পারে যেসব মানুষ শিশুপ্রকৃতি সম্পর্কে বা অন্যান্য বিষয়ে যৌক্তিক মতামত পোষণ করে থাকেন। আমি সাহসের সঙ্গে বলতে পারি যে রাশিয়ার বেশিরভাগ যুক্তিবাদীদের চেয়ে যুক্তিবাদের বিস্তৃত জনপ্রিয় প্রচারকার্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


ধরে নেওয়া যাক পরিবারপ্রথা এবং শিশুদের জন্য যুক্তিগতভাবে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ভেঙে গেছে, তাহলে তখনও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য অন্য কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়বে। যেসব মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অভ্যস্ত এবং যারা নিজেদের জন্য কোন সন্তান ধারণ করতে চান না তারা গর্ভধারণ কালের অস্বস্তি এবং শিশুর জন্ম দেওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করার ইচ্ছা খুবই কম রাখেন। ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে জনসাধারণকে ধরে রাখতে গর্ভধারণের বিষয়টি একটি খরচসাপেক্ষ পেশায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনিবার্যভাবেই এসে যাবে। যদিও এই পেশাটি সব মহিলা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলারা গ্রহণ করবে না, কেবলমাত্র নির্দিষ্ট শতাংশ মহিলারা জন্ম দেওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ উপযুক্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ উক্ত পেশা গ্রহণ করবে। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের কাছে কি ধরণের উপযুক্ততার পরীক্ষায় পিতাকে উত্তীর্ণ হতে হবে এবং তারা কত শতাংশ পুরুষ জনতা গঠন করতে চাইবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের এখন ডাকা হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি উপযুক্ত পরিমাণ জন্ম নিশ্চিত করাটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে, যেহেতু জন্মের হার হ্রাসের দিকে এগোলে, জনসংখ্যার বাড়ও কমবে। অন্যদিকে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনগণ মনুষ্যগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সমস্যাকর হয়ে উঠবে। যদি চিকিৎসাবিদ্যা ও ওষুধপত্র মানুষকে একশত বছর বাঁচিয়ে রাখতে সফল হত তবে গোষ্ঠীগুলি লাভের বদলে সমস্যাকাতর হয়ে উঠত।


শিশুদের গড়ে তোলার বিষয়ে যৌক্তিক মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে মনুষ্যজাতির যে লাভ আশা করা যেতে পারে তা অসীম। যৌনতার বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের শরীরের বিশেষ কিছু অংশ সম্পর্কে তাদের শিশুদের কুসংস্কারগত আচরণ শেখানো হয়ে থাকে এবং বিশেষ কিছু কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে তাদের এই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে এবং ওই একই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয় কিছু বিশেষ খেলা সম্পর্কে যা প্রকৃতি তাদের খেলতে উৎসাহিত করে থাকে। এর ফলে যে কারণটি ঘটে তা হল যখন শিশুটি বড় হয় তখন সে প্রমের কোন ব্যাপারে কঠিন ও কদর্য হয়ে দাঁড়ায়। সমগ্র ইংরেজি ভাষাভাষী লোকেরা তাদের নার্সারি থেকেই সুখী বিবাহে অসমর্থ হতে শেখে। সেখানে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের অন্য কোন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করবার সুযোগ পায় না বা পর্যবেক্ষণ করে তারা সেই রকম কার্যকলাপ করবার চেষ্টা করবে এবং তা করবার ক্ষেত্রে বাধা পাবে। এর ফলে পরবর্তীকালে তারা পরম ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার থেকে যথার্থ প্রতিযোগিতায় যে হঠাত্র স্থানান্তরিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।


পাপের ধারণা বহু শিশু ও যুবক-যুবতাঁকে আঁকড়ে বসে থাকে এবং প্রায়শই পরবর্তী জীবনে তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে এবং সেইসব বিকৃতির উৎস হয়ে ওঠে যা তাদের জীবনে কোন ধরণের কার্যকরী উদ্দেশ্যকে সংঘটিত করে না। এই ধরণের ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণভাবে যৌনতার বিষয়ে প্রথাগত নৈতিক শিক্ষার জন্যে। যৌনতা একটি খারাপবস্তু যা সুখী প্রেমকে অসম্ভব করে তোলে এই ধরণের মনোভাবসম্পন্ন পুরুষ যে-সব মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে সেইসব মহিলাদের ঘৃণা করতে শেখায় এবং কখনও কখনও তাদের সঙ্গে তারা নিষ্ঠুর আচরণও করে ফেলে। অধিকন্তু যখন যৌনতাকে রোধ করা হয় তখন সে জটিলতা যৌনভাবাবেগেরে উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় তা মানুষকে ভাবপ্রবণ বন্ধুত্ব, ধর্মীয় উদ্দীপনা, উচিত অনুচিত প্রভৃতির দিকে ঠেলে দেয় যা বুদ্ধিগত আন্তরিকতার অভাব ঘটায় এবং যা বাস্তব বোধও বুদ্ধির দিক থেকে অনিষ্টকর। শৈশবে যে নৈতিক শিক্ষার অত্যাচার সহ্য করতে হয় তার থেকেই পরবর্তীকালে নিষ্ঠুরতা, বোকামি, অসমর্থতা প্রভৃতির জন্ম হয় যা সংগতিকর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিষ্টকর। এছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক ধরণের গোলমাল এর থেকে জন্ম নেয় খুব সহজ সরল ভাষায় বলা যেতে পারে যে যৌনতায় কোনরকম নোংরামি নেই এবং এই বিষয়ে প্রথাগত আচরণ কোন অর্থই রাখে না। আমি বিশ্বাস করি যে আর কোন বিষয় মানুষের দুর্দশা ঘটাবার ক্ষেত্রে এতটা বেশি শক্তিশালী নয়, এই বিষয়টি সরাসরি নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক অনিষ্টসাধন করে। শুধু তাই নয়, এটি মানুষের মমতাবোধ, স্নেহ প্রভৃতির পথকে রুদ্ধ করে দাঁড়ায় যার দ্বারা সে মানুষের উপর বিভিন্ন প্রতিকারযোগ্য অশুভ কর্মের প্রভাব অর্থাৎ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতিভিত্তিক অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারে যেগুলোর দ্বারা মানবতা অত্যাচারিত। এইসব কারণে শিশু-মনস্তত্ত্ব বিষয়ক সেইসব গ্রন্থসমূহের খুবই প্রয়োজন যা উক্ত জ্ঞানের প্রসার ঘটাবে এবং উক্ত বিষয়ে যৌক্তিক আচরণের শিক্ষা দিতে পারবে। আমাদের এই সময়টাতে এক ধরণের দৌড়-প্রতিযোগিতা চলছে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান শক্তির বৃদ্ধি ও কুসংস্কারের শক্তির ক্রমবর্ধমান হ্রাসের মধ্যে। শিশুর সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসমূহ যে বেড়েছে তা অনিবার্য ছিল। কিন্তু যদি এই ক্ষমতা সীমার বাইরে চলে যায় তবে কুসংস্কার সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কুসংস্কারহীন সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রচারকার্যের দ্বারা চুপসে যাবে, ফলে যে-কোন গণতান্ত্রিক দেশে নতুন করে কোন প্রতিবাদ গড়ে উঠবে না। আমাদের সমাজ ক্রমশই সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে, ফলে যে-কোন দিকে কোনরকম সংস্কার অন্যান্য দিকেও পরিবর্তন আনতে বাধ্য এবং কোন সংস্কারই আর বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমি মনে করি যে কোন যুগের থেকে আমাদের যুগটা শিশুকে নিয়ে অনেক বেশি কাজ করতে সহৃদয়ভাবে ইচ্ছুক এবং আমরা যদি বুঝতে পারি যে প্রথাগত নৈতিক শিক্ষা যুব মানসের পক্ষে যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে আমরা সেইরকম চাহিদার আশা করতে পারি যে চাহিদার ফলে খুব তাড়াতাড়ি যন্ত্রণাদায়ক কারণের স্থানে বৈজ্ঞানিক ও সহৃদয়কর কোন প্রতিকার করা যাবে।

আমাদের যৌনতামূলক নীতিসমূহ


(প্রথম প্রকাশ ১৯৩৯ সালে) মানবজীবনের অন্যান্য যে-কোন উপাদানের চেয়ে যৌনতাকে বেশির ভাগ মানুষ অযৌক্তিকভাবে দেখে থাকে। গণহত্যা, মহামারী, উন্মত্ততা, সোনা, মূল্যবান রত্ন– এইসব বস্তু, বস্তুত যৌনভাবাবেগমূলক আশা ও ভয়ের বিষয়–যা এখনও চলছে। অতীতেও চলেছিল পৌরাণিক কাহিনী বা ঘটনার মধ্য দিয়ে অথবা কোন কুয়াশাচ্ছন্ন যাদুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু এখানে সেখানে কিছু জায়গা ছাড়া সব জায়গায় যুক্তির সূর্য উঠে সেই কুয়াশাকে দূর করে দিল। যৌনতার অঞ্চলে যে ঘন মেঘ জমে ছিল তা স্বাভাবিক ছিল কেননা যৌনতা মানবজীবনের সব চেয়ে ভাব-বিহ্বল অংশ।


যদিও বর্তমানে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে আসছে যে আধুনিক জগতের অবস্থা এমন ভাবে কাজ করছে যাতে যৌনতার প্রতি আচরণ ও মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি ধরণের পরিবর্তন বা পরিবর্তনসমূহ সে ঘটাবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু এটা লক্ষ্য করা সম্ভব যে এখন কিছু শক্তি বা বল এই বিষয়ে কাজ করছে এবং এর ফলে সামাজিক কাঠামোতে কি ধরণের ঘটনা ঘটবে তা নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব।


মানব-প্রকৃতি যতদূর জানা যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় এমন কোন সমাজ গঠন একেবারে অসম্ভব যেখানে বিবাহের বাইরে যৌন মিলন ঘটবে না। এর জন্য যে-সব শর্ত একান্ত প্রয়োজন তা বর্তমান জীবনে কোনভাবেই মেনে চলা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় এবং সেই শর্তসমূহই বা কি–আসুন সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করি।


যে অঞ্চলে কতিপয় প্রতিবেশী বসবাস করে সেখানে একবিবাহ প্রথা কার্যকরী করে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করা গেলেও তা অচলতার সৃষ্টি করে। যদি কোন এক ব্যক্তি কখনও বাড়ি থেকে না বেরোয় এবং নিজের স্ত্রী ছাড়া কখনও অন্য কোন মহিলাকে দেখতে না পায়, তাহলে তার পক্ষে বিশ্বস্ত হওয়াটা অনেক সোজা। কিন্তু যদি সে তার স্ত্রী ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে অথবা জনবহুল কোন শহরতলীতে বসবাস করে তা হলে সমস্যাটি সমানুপাতিকভাবে সমস্যাসঙ্কুল হয়ে দাঁড়াবে। একবিবাহের পক্ষে সব থেকে সাহায্যকারী বিষয়টি হল কুসংস্কার। যারা বিশ্বাস করে যে ‘পাপ’ অনন্ত শাস্তির পথ সৃষ্টি করে, আশা করা যায় যে তারা পাপকে এড়িয়ে চলবে এবং কিছুদূর পর্যন্ত তা এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করবে, কিন্তু যতটা আশা করা যেতে পারে ততটা এড়িয়ে চলতে পারবে না। জনতার সমর্থন মানেই পুণ্য। যেমন কৃষিজীবী সমাজ, যেখানে একজন মানুষ যা যা করে তা সবই তার প্রতিবেশীরা জানতে পারে, সেক্ষেত্রে যা-কিছু প্রথার দিক থেকে নিন্দনীয় তাকে এড়িয়ে চলার শক্তিশালী কারণসমূহ তার থাকে। কিন্তু সঠিক আচরণের জন্য সমস্ত কারণসমূহ আগে যতটা প্রভাবশালী ছিল ততটা প্রভাবশালী আর রইল না। বিচ্ছিন্নভাবে অতি অল্প মানুষের মধ্যে ছাড়া সমস্ত মানুষের মধ্যে থেকে নরকের আগুনের প্রতি বিশ্বাস চলে গেল এবং একটা বড় শহরে কেউই জানে না তার প্রতিবেশী কি করে। এইজন্য আধুনিক শিল্পবাদের উত্থানের আগে তারা একবিবাহের প্রতি যতটা অনুরাগী ছিল আর যে তা রইল না তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।


যদিও বলা যেতে পারে নৈতিক নীতিসমূহের প্রতি সজাগ থাকার ক্ষেত্রে ব্যর্থ জনতার সংখ্যা বাড়তে থাকল বলেই আমাদের জীবনের নৈতিক মানসমূহ বদলে গেল। আমাদের বলা হয়ে থাকে যে যারা পাপ করে তাদের জানা উচিত বা ভাবা উচিত যে তারা পাপ করে এবং আমাদের এও বলা হয়ে থাকে যে নৈতিক উপদেশ বা আইনসমূহ মেনে জীবনে চলাটা খুবই দুষ্কর। উত্তরে আমি বলব যে ভালো বা মন্দের প্রশ্নটা নির্ভর করবে মানুষ সুখী হতে পারছে কি পারছে না তার উপর। বহু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সেই সমস্ত জিনিস বিশ্বাস করে থাকে যা তাদের শৈশবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল এবং যখনই তাদের জীবন রবিবারের প্রার্থনা-সভায় যাবার সময় করে উঠতে পারে না বা তার সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন হতে পারে না তখনই তারা তাদের হৃদয়ে নিজেদেরকে পাপী বলে অনুভব করে থাকে। ক্ষতিটা কেবল আত্মজ্ঞান ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও আত্মজ্ঞানবিহীন ও শিশুসুলভ ব্যক্তিত্বের মধ্যেই একটা ব্যবধান সৃষ্টি করে না, উপরন্তু প্রথাগত নৈতিকতার ভালো দিকগুলো অচল দিকগুলোর জন্য দুর্নাম কুড়োয় এবং এর ফলে মনে করা হয় যে যদি ব্যাভিচারিতা ক্ষমার যোগ্য হয় তবে আলস্য, অসততা, দয়ামায়াহীনতাও ক্ষমার যোগ্য। এই ভয়ঙ্কর দিকটি সেই ব্যবস্থা থেকে অবিচ্ছেদ্য যে ব্যবস্থা যুবকদের শিক্ষা দিয়ে থাকে এবং সেই সব যুবককে পরিণত বয়সে বহুসংখ্যক বিশ্বাসকে নিশ্চিতভাবে পরিত্যাগ করতে হয়। তাই সামাজিক অর্থনৈতিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় তারা ভালোগুলোকেও মন্দের সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।


ঈর্ষামূলক ভাবাবেগ ও বহুবিবাহের প্রতি আগ্রহমূলক ভাবাবেগের দ্বন্দ্ব থেকে কাজ চালানো যায় এমন যৌনমূলক নীতিতে পৌঁছনোর বিষয়ে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। প্রবৃত্তিগত দিক থেকে দেখতে গেলে ঈর্ষা নিঃসন্দেহে খুবই মামুলী ব্যাপার। যার স্ত্রী অবিশ্বাসিনী, সমাজে সেই মানুষটিকে হাস্যাস্পদ হবার যোগ্য বিষয় হিসেবে ভেবে নেওয়া হয়। এর ফলে যেখানেই তার স্ত্রী সম্পর্কিত সেখানেই সে ঈর্ষান্বিত, এমনকি স্ত্রী সম্পর্কে কোন আকর্ষণ না থাকলেও সে এইরকম ঈর্ষা বোধ করে থাকে। ঈর্ষা সম্পত্তি সম্পর্কীয় জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত, তাই যেখানে এই সম্পত্তির বিষয়টি যত কম সেখানে ঈর্ষা ব্যাপারটিও তত কম। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিশ্বস্ততাকে যেভাবে আশা করা হয়ে থাকে তা যদি না করা হয় তবে ঈর্ষা ব্যাপারটিও হ্রাস পাবে, যদিও মানুষ যতটা মনে করে তার থেকেও ঈর্ষাকে অনেক কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। যতদিন পিতাদের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ বজায় থাকে ততদিন ঈর্ষার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। যতদিন এই ব্যাপারটি বজায় থাকবে ততদিন পুরুষমানুষ এই বিষয়ে অবশ্যই নিশ্চয়তা চাইবে যে তারা তাদের স্ত্রীদের সন্তানের পিতা। যদি মহিলাদের যৌন-স্বাধীনতা পালনের অধিকার দেওয়া হয়, তাহলে পিতাদের গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায়, ফলে স্ত্রী আর বেশি দিন তার স্বামীর সমর্থন আশা করতে পারে না। যথাসময়ে এই ধরণের ঘটনাই ঘটবে। কিন্তু সেটা এক মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের ফলেই ঘটবে এবং ভালো বা মন্দ যে-কোন কারণেই হক এর ফল অনিশ্চিত।


ইতিমধ্যে, যদি বিবাহ ও পিতৃত্বকে সামাজিক প্রথা হিসেবে টিকে থাকতে হয় তবে বিশৃঙ্খলতা ও সারা জীবন ধরে একবিবাহের মধ্যে একটি বোঝাঁপড়ামূলক স্থান একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব থেকে সঠিক বোঝাঁপড়াটা কি হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়, কেননা সময় ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিসমূহের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়টি নির্ভর করে। স্পষ্টতার উপর নির্ভর করেই কিছু বলা যেতে পারে।


সর্বপ্রথমে শারীরবিদ্যাগত ও শিক্ষাগত উভয় দিক দিয়েই এটি কখনই কাম্য নয় যে কুড়ি বছরের আগেই মহিলাদের বাচ্চা-কাচ্চা হবে। এইজন্য আমাদের নীতিসমূহ এমন হওয়া উচিত যাতে এই ধরণের ঘটনা একদম না ঘটে।


দ্বিতীয়ত, পূর্ব যৌন অভিজ্ঞতা ছাড়া, পুরুষ কি মহিলার দৈহিক আকর্ষণ ও বিবাহকে সফল করে তোলবার জন্য যে সহানুভূতির একান্ত প্রয়োজন তা বুঝতে সমর্থন হবে এরকম আশা করা যায় না। অধিকন্তু নিয়ম অনুযায়ী অর্থনৈতিক কারণসমূহ পুরুষকে বিবাহ রোধ করতে বাধ্য করে এবং এটাও আশা করা যায় না যে তারা কুড়ি থেকে তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত কুমার থেকে যাবে। শারীরবিদ্যাগত দিক থেকেও তারা এরকম করবে তা আশা করা যায় না, এর থেকে এটা ভালো যদি তাদের নিজেদের ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে তাদের অস্থায়ী সম্পর্ক থাকে এবং সেই সম্পর্ক কোনভাবেই পেশাগত হওয়া উচিত নয়, কেননা সেই সম্পর্কের উদ্দেশ্য টাকা নয় স্নেহ। এই উভয় কারণে যুবক অবিবাহিত মানুষের এই বিষয়ে যথাযোগ্য স্বাধীনতা থাকা উচিত যা শিশুদের বেলায় এড়িয়ে চলা দরকার।


তৃতীয়ত, বিবাহ-বিচ্ছেদ কোন পক্ষকেই দোষারোপ না করে করা সম্ভব এবং কোনভাবেই বিষয়টিকে ঘৃণার চোখে দেখা উচিত নয়। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের যে কোন কারুর ইচ্ছায় একটি বন্ধ্যা বা শিশুহীন বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি টানা যায় এবং পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মধ্যে দিয়ে যে-কোন বিবাহের সমাপ্তি টানা যায় এবং পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মধ্যে দিয়ে যে-কোন বিবাহের সমাপ্তি হওয়া দরকার– যদি প্রয়োজন হয় তবে এর জন্য এক বছরের নোটিশ উভয় পক্ষ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। যদিও বিবাহ-বিচ্ছেদ ব্যাপারটি অন্যান্য কারণেও ঘটা সম্ভব যেমন পাগলামি, মানসিক বিষণ্ণতা, নিষ্ঠুরতা এবং এরকম আরও কারণে, কিন্তু পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে করাটাই স্বাভাবিক কারণ।


অর্থনৈতিক দোষ থেকে যৌনতাকে মুক্ত করতে সম্ভবপর সব কাজই করা উচিত। বর্তমানে স্ত্রীরা পতিতাদের মতোই তাদের যৌন সৌন্দর্যকে বিকিয়ে বাঁচে, এমনকি অস্থায়ী স্বাধীন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পুরুষ উভয়পক্ষের খরচ চালাবে এটাই আশা করা হয়ে থাকে। এর ফলে যে ঘটনাটি ঘটে তা হল টাকা ও যৌনতার মধ্যে একটি হীন। সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এইরকম ক্ষেত্রে মহিলাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনরকম দয়ামায়ামূলক জায়গা থাকে না। যৌনতা চার্চের দ্বারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলেও কখনও তা পেশা হওয়া উচিত নয়। ছেলেমেয়ে দেখাশুনো করা, ঘরদোর সামলানো, রান্নাবান্না করা ইত্যাদির জন্য মহিলাদের বেতন দেওয়াটা উচিত, কিন্তু কেবলমাত্র পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখার জন্য টাকা নেওয়াটা ঠিক নয়। কোন মহিলা একবার যখন ভালোবেসেছে বা কোন পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছে তখন দুজনের কারুর দিক থেকে তা থেমে গেলে কেবলমাত্র টাকার অনুদানের উপর নির্ভর করে তার জীবন চিরদিন চলতে পারে না। একজন মহিলা অবশ্যই পুরুষের মতোই তার জীবিকা অর্জনের জন্য কর্ম করবে এবং একজন অলস স্ত্রী আবশ্যিকভাবে আর সম্মানের যোগ্য থেকে না।


(২)


বর্তমান যৌন আচরণের গৃহীত নীতির উদ্ভবের মধ্যে খুবই স্বতন্ত্রভাবে দুটি আদিম ভাবাবেগ অংশগ্রহণ করে থাকে। এদের মধ্যে একটি হল বিনয় আর অপরটি হল ঈর্ষা। যে-কোন আকারে ও যে-কোন মাত্রায় বিনয় মানবজাতির মধ্যে প্রায় একটি চিরন্তন বিষয় এবং এটি এমন একটি ধর্মীয় মানা-না-মানার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে যাকে নির্দিষ্ট কিছু আকার ও শিষ্টাচারবিধি অনুযায়ী অবশ্যই ভাঙতে হবে অথবা কিছু স্বীকৃত ভদ্র-আদব কায়দার সঙ্গে সঙ্গতি সম্পন্ন হতে হবে। না সব কিছু দেখা যায়, না সব ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়। এটি ভিক্টোরীয় যুগের আবিষ্কার বলে কিছু আধুনিক মানুষ মনে করেন বটে, তবে তা নয়। বিপরীতভাবে বলতে গেলে, নৃতত্ত্ববিদরা প্রাচীন বর্বরদের মধ্যে বিনয়ের পরাকাষ্ঠাকে বিশদ আকারে লক্ষ্য করেছেন। মানব-চরিত্রের গভীর মূলে অশ্লীলতার কল্পনা আছে। আমরা এর বিরুদ্ধে যেতে পারি বিপ্লব-প্রীতির মধ্য দিয়ে অথবা বৈজ্ঞানিক উৎসাহের দ্বারা, কিংবা বায়রনের মতো এটাকে খারাপ বা বাজে বলে ভাবার ইচ্ছার দ্বারা, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও আমরা আমাদের স্বাভাবিক ভাবাবেগ থেকে তাকে কখনই মুছে ফেলতে পারি না। কোন একটি গোষ্ঠীতে নিঃসন্দেহে কোনটি কুৎসিত বলে নির্ধারণ করা হবে তা নির্ণয় করে সেই গোষ্ঠীর রীতির উপর। কিন্তু এমন কিছু রীতিনীতি থাকে যেগুলো মানব-প্রকৃতির উৎসের সঙ্গে চরমভাবে জড়িত, তাই সেগুলোকে শুধুমাত্র রীতি বলে ছেড়ে দিলেই হবে না। প্রায় সমস্ত সমাজেই যৌনতা উদ্রেককারী অশ্লীল গ্রন্থ ও যৌন আবেদনের জন্য শরীর প্রদর্শন ব্যাপারটিকে এক ধরণের অপরাধ বলে মনে করা হয়, কিন্তু একমাত্র তখনই ব্যাপারটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় যখন তা ধর্মীয় উৎসবের আকার ধারণ করে, যা প্রায়শই সমস্ত সমাজে ঘটে থাকে।


কৃচ্ছ্রতাবাদ– বিনয়ের সঙ্গে যার মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ থাকলে থাকতেও পারে আবার না-ও পারে– এমন একটি ভাবাবেগ যা সভ্যতার একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছবার পরেই হয়তো উখিত হয়েছে এবং তার পরে তা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ওল্ড টেষ্টামেন্ট বা পুরোনো বাইবেলের গ্রন্থগুলোতে এই বিষয়টিকে দেখা যায়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে অ্যাপোক্রিফা ও নব্য বাইবেল প্রভৃতি গ্রন্থে তা দেখা যায়। একইভাবে গ্রীসেও পুরোনো যুগে বিষয়টিকে খুব কমই দেখা গেছে, কিন্তু যত দিন গেছে তত তা বেড়ে উঠেছে। ভারতবর্ষে খুব প্রাচীন যুগে বিষয়টি গড়ে উঠেছিল এবং তা খুবই তীব্রতা অর্জন করেছিল। আমি বিষয়টির উৎস সম্পর্কে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী নই কিন্তু বিষয়টি যে বেশিরভাগ সভ্য জাতির মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ রূপে কিছুটা জায়গা দখল করে নিতে পেরেছে সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। বিনয় ব্যাপারটির ধরন বোঝা যায় যখন আমরা কোন সম্মানিত ব্যক্তি, বিশেষ করে যে ব্যক্তি ধার্মিক পবিত্রতার গুণে গুণান্বিত, তাকে কোন প্রেমের খেলার সঙ্গে যুক্ত ভাবতে অনিচ্ছুক হই, কেননা যে-কোন মর্যাদার উচ্চতম মাত্রার ক্ষেত্রে বিষয়টি কখনই সুসংগত নয়। রক্তমাংসের দাসত্বের থেকে আত্মাকে মুক্ত করার ইচ্ছা জগতের বহু মহান ধর্মকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো তা একটা শক্তিশালী জায়গা দখল করে রেখেছে।


কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে ঈর্ষা বিষয়টি যৌনতামূলক নৈতিকতার সম্পর্কে একমাত্র প্রভাবশালী কারণ। ঈর্ষা প্রবৃত্তিগত ভাবেই ক্রোধের উদ্রেক করে এবং ক্রোধ যুক্তিসংগত কারণেই নৈতিক অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করে। সভ্যতার বিবর্তনের কোন একটি প্রাচীন স্তরে পুরুষ জাতির মধ্যে পিতৃত্বকে নিশ্চিত করবার আকাক্ষার মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে প্রবৃত্তিগত এই উদ্দেশ্যে বা গতি সঞ্চারক বিষয়টি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই বিষয়ে নিশ্চয়তা ছাড়া পিতৃতান্ত্রিক পরিবার গড়ে ওঠা অসম্ভব ছিল এবং পিতৃত্ব তার সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব পালন করেও কখনও সামাজিক প্রথাসমূহের ভিত্তিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারত না। তদনুযায়ী কোন মানুষের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তা সামান্যও দূষণীয় নয়। ব্যভিচারীকে নিন্দা করার জন্য সব থেকে বড় বাস্তব কারণটি হল যে সে বিহ্বলতা বা গোলমালের সৃষ্টি করে এবং রক্তপাতও ঘটায়। স্বামীর অধিকারসমূহকে অসম্মমান করার জন্য বিরাট যুদ্ধের উদাহরণ আমরা দেখেছি ট্রয়কে দখল করার মধ্যে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অপমানও এ ধরণের ঘটনা ঘটাত, তবে তা নিতান্তই অল্প। সেই সময় স্ত্রীদের অধিকার বলতে কোন কিছুই ছিল না এবং স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের কোন কর্তব্যই থাকত না, যদিও এক স্বামী অপর স্বামীর সম্পত্তিকে সম্মান করার কর্তব্য পালন করত।


যে নৈতিক আদর্শের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা মনোভাব সম্পর্কে আমরা এতক্ষণ ধরে আলোচনা করছি তার উপর ভিত্তি করে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের পুরোনো ব্যবস্থা বলতে গেলে সাফল্যই পেয়েছিল। সেখানে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা পুরুষ মানুষের হাতেই ছিল তাই তাদের হাতে ছিল অপর্যাপ্ত স্বাধীনতা। অন্যদিকে নারী, যারা ছিল নির্যাতিত, তারা এমন দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল যে তাদের অসুখী মনোভাব কোনরকম আমলই পেত না। বর্তমান জগতে পুরুষের সঙ্গে সমতার যে দাবি নারী করেছে তা এক প্রয়োজনীয় নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। এই সমতা দু’ভাবে নিশ্চিত করা যায় হয়– পুরুষমানুষ একবিবাহ প্রথায় কঠোরভাবে আবদ্ধ হ’ক যা তারা অতীতে নারীর উপর জোর করে চাপিয়ে দিত অথবা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে নারীকেও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহ্যময় নৈতিক আদর্শের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেওয়া হ’ক। মহিলাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগ অগ্রদূতরা প্রথম পথটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। গীর্জাও এই পথটিকে সঠিক পথ হিসেবে ধরে নিয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় পথটি অনেক বেশি মানুষ কার্যকর পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে, যদিও তত্ত্বগত দিক থেকে তাদের বেশিরভাগ অংশ নিজেদের আচরণ ন্যায়সংগত কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান এবং যারা এটা বুঝতে পেরেছে যে কিছু নতুন নৈতিক নীতির প্রয়োজন তারা সেই নীতির উপদেশ বা পথ কি হওয়া উচিত তা নিয়ে মুস্কিলে পড়েছে।


অভিনবত্বের অন্য আর একটি উৎস আছে এবং তা হল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবের ফলে দুর্বল হয়ে যাওয়া যৌন জ্ঞান সম্পর্কে ধর্মীয় নিষেধসমূহ। এটা বুঝতেই হয়েছে যে রোগের মতো বিভিন্ন ধরণের অনিষ্টকর ঘটনার সঙ্গে ততদিন কার্যকরভাবে এঁটে ওঠা যাবে না যতদিন না এ বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলাখুলিভাবে বলা যাবে এবং এটা দেখা যাবে যে যৌনভাব ও অজ্ঞতা ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে অনেক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করবে। সমাজবিদ্যা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মনোযোগী ছাত্রদের যৌন ব্যাপারে নীরব না থাকার পরামর্শদান করে। অনেক বাস্তববাদী শিক্ষাবিদ বাচ্চাদের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে ওই একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। মানব-আচরণ সম্পর্কে যাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তাদের পক্ষে কোন কার্যকে ‘পাপ’ বলে চিহ্নিত করাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা মনে করেন যা আমরা করি তার উৎস আমাদের বংশধারা, আমাদের শিক্ষা ও আমাদের পরিবেশের মধ্যে নিহিত, তাই তার পেছনের কারণগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে বন্ধ করতে হবে, তাকে দোষারোপ বা নিন্দা করে নয়। এইভাবেই সমাজের ক্ষতিসাধন করাটাকে রোধ করা যেতে পারে।


এই কারণে, যৌন আচরণ সম্পর্কে নতুন জ্ঞানের খোঁজ করতে গিয়ে আমরা যেন প্রাচীন কালের অযৌক্তিক সেইসব ভাবাবেগের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পড়ি যে ভাবাবেগের দ্বারা পুরোনো নৈতিক নিয়ম গড়ে উঠেছিল। যদিও কোন দৈবাৎ কারণে আমরা এটা মনে করতেই পারি যে এইসব নীতিসমূহের মধ্যে এমন মঙ্গলময় কিছু ছিল যার জন্য সম্ভবত দুর্বল হয়ে গেলেও সেগুলো সমস্যার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়ে গেছে। ধনাত্মকভাবে যে কাজটা আমরা করতে পারি তা হল আমরা নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে পারি কোন্ নৈতিক নিয়মসমূহ মানবিক সুখসমূহকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু একটা কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে যে নিয়ম যাই হোক না কেন তা কখনও চিরন্তন বা সার্বজনীন হয়ে উঠবে না। নিয়মগুলির মধ্যে বাস্তবে যে কার্যকর প্রভাব থাকবে সেগুলোর সম্পর্কে আমাদের বিবেচনা করে দেখতেই হবে, কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ কার্যকর প্রভাবটি দেখার পর তাদের বিবেচনা করে দেখার কোন প্রশ্নই ওঠে না।


(৩)


এবার সেই যৌন বিষয়ের জ্ঞানের প্রশ্নে আসা যাক যা সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে এবং আমাদের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত সেই প্রশ্নগুলি নিতান্তই সরল ও এমন যা সন্দেহপূর্ণ নয়। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কোনভাবে সত্যকে গোপন করে যাওয়ার পেছনে কোন সঠিক যুক্তি নেই। তাদের কৌতূহলপ্রসূত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সরাসরিভাবে দেওয়া দরকার। যা তাদের ভালো লাগে তাদের মনকে আকর্ষণ করে, যেমন মাছ ধরার অভ্যাসের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতোই যৌনতা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর সরাসরিই বলা দরকার। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে যেন কোন রকম ভাবাবেগ না থাকে, কেননা ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষমতা থাকে না। মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়া উচ্চ কথাবার্তা বোঝার মতো কোন ঘটনা তারা দেখে উঠতে পারে না। মৌমাছি ও ফুলের মধ্যে ভালোবাসার কথা বলে শুরু করাটা ভুল হয়ে যাবে। জীবনের বাইরে থেকে জীবনের ঘটনাসমূহকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার কোন কারণ নেই। শিশু যা জানতে চায় সর্বদাই এ বিষয়ে কথাবার্তা শোনে ও জানতে পারে তারা এ বিষয়ের উপর এত কথাও বলে না এবং এত চিন্তাও করে না। প্রথাগত অজ্ঞতা ও বাস্তবজ্ঞান তাদেরকে তাদের বড়দের কাছে ভণ্ডামী ও কপটতা করতে শেখায়। অন্যদিকে জীবনে যদি সত্য করে কোন অজ্ঞতা থাকে তবে তা কঠিন আঘাত ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ও বাস্তব জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলার ব্যাপারে মুস্কিল হয়ে যায়। সমস্ত ধরণের অজ্ঞতাই দুঃখজনক, কিন্তু যৌনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে অজ্ঞতা ভীষণভাবে বিপজ্জনক।


যখন আমি বলি যে শিশুদের যৌনতার বিষয়ে বলা দরকার, তখন আমি এটা বলতে চাই না যে তাদের এ বিষয়ে কেবলমাত্র মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাসমূহ বলা হোক। তাদের সেইটুকুই বলা হোক যেটুকু তারা জানতে চায়। প্রাপ্তবয়স্কদের সাত্ত্বিক করে তোলার কোন চেষ্টার দরকার নেই। অন্যদিকে, তাদের এ কথা বলাও উচিত নয় যে যৌনতা কেবলমাত্র বিবাহিত জীবনের জন্য। শিশুদের বঞ্চনা করার কোনরকম অজুহাত করা উচিত নয়। যখন কোন শিশু তার পিতামাতাকে মিথ্যা কথা বলতে দেখে তখন তারা নিজেদের মধ্যে দৃঢ়তা হারায় এবং পরে পিতামাতার কাছে মিথ্যা কথা বলাটাকে ন্যায়সংগত বলে ধরে নেয়। জোর করে শিশুদের মনে কোন কিছু ঢোকাবার কথা আমি বলছি না। কোন্টা সত্য নয় এ ধরণের কথা তাকে বলার চেয়ে যে-কোন বিষয়ে যে-কোন কথা তাকে দ্রুত বলে দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। মিথ্যা ঘটনার বা সাত্তিত্বকতার যে ধারণা গড়ে ওঠে তা সঠিক পুণ্য নয়। কেবলমাত্র তত্ত্বের উপর নির্ভর করেই কথা বলা উচিত নয়, কথা বলা দরকার বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আমি মনে করি যৌনতা বিষয়ে খোলাখুলি মনোভাব শিশুকে সেই বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা, নোংরা ও অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা থেকে বিরত করতে পারে। একমাত্র এই পথটিই আলোকিত যৌন নৈতিকতার দিকে নিয়ে যাবার জন্য অনিবার্যভাবে একটি প্রাথমিক পথ।


যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের যৌন আচরণের বিষয় যুক্ত সেখানে যৌন বিষয় সম্পর্কে একটি আপোসমূলক জায়গায় আসাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়, কেননা সেখানে পরস্পর-বিরোধী দুটি শিবির ক্রিয়াশীল যারা নিজের নিজের জায়গায় যথেষ্ট শক্তিশালী। মৌলিক সমস্যাটা হল ঈর্ষান্বিত ভাবাবেগ ও যৌন বৈচিত্র্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব। কিন্তু এটা সত্য যে দুটি ভাবাবেগের মধ্যে কোনটা চিরন্তন নয়। এমন কিছু মানুষ দেখা যায় (যদিও তা খুবই অল্প) যারা কখনই ঈর্ষান্বিত হয় না। এমন কিছু মানুষও থাকে (পুরুষের মতো মহিলাদের মধ্যেও) যারা তাদের পছন্দ করা পাত্র বা পাত্রীর উপর থেকে তাদের স্নেহ বা আসক্তি কখনও মুছতে পারে না। যদি এই দুই ধরণের মানুষের আচরণকে চিরন্তন করে তোলা সম্ভব হত তবে এ বিষয়ে সন্তোষজনক নৈতিক আইন তৈরি করা সহজ হত। এটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রথাসমূহের দ্বারা এই দুই ধরণের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে গড়ে তোলা যেতে পারে।


অনেক কিছুর ভিত্তি যৌনতার নৈতিকতার দ্বারা আচ্ছাদিত আছে। কিন্তু আমি মনে করি না যে ততক্ষণ আমরা কোন কিছুর সম্পর্কেই খুব একটা ধনাত্মকভাবে বলতে পারি যতক্ষণ বিভিন্ন ব্যবস্থাজাত কার্য ও যৌন বিষয়ে যৌক্তিক শিক্ষাজাত অভিজ্ঞতা অনেক পরিমাণে অর্জন করতে পারি। এটা পুরোপুরি পরিষ্কার যে প্রথা হিসেবে বিবাহ ব্যবস্থা কেবলমাত্র শিশুদের জন্যই রাষ্ট্রকে উৎসাহিত করে। কিছু শিশু ছাড়া এই ব্যবস্থাটিকে একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখা দরকার। এটাও পরিষ্কার যেখানে শিশুরা যুক্ত সেখানে রাষ্ট্র পিতার দ্বারা তাদের প্রতি কর্তব্য করিয়ে নেবার জন্য উৎসাহিত হয় এবং যে কর্তব্যটি প্রধানত আর্থিক হয়ে থাকে। স্ক্যানডিনেভিয়ার মতো দেশে যেখানে বিবাহবিচ্ছেদ বিষয়টি খুব সহজ সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের পর শিশু মায়ের সঙ্গে চলে যায়, যার ফলে সেখানে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার-ব্যবস্থা একেবারে মুছে যেতে বসেছে। যেখানে মজদুরীনির্ভর শ্রমজীবীদের প্রশ্ন যুক্ত সেখানে এই বিষয়টি বেড়ে গেলে রাষ্ট্র পিতার উপর ন্যস্ত কর্তব্যকে অধিগ্রহণ করবে, ফলে যুক্তিসংগত অবস্থা ও সামর্থ্য না থাকার জন্য সেখানে বিবাহ করবার রেওয়াজটি রোধ হবে এবং সম্ভবত ধনিক শ্রেণী ও ধার্মিকদের মধ্যে ব্যবস্থাটি কেবলমাত্র প্রচলিত রীতি হিসেবে থেকে যাবে। এর আগে পুরুষ ও নারী উভয়ে যদি যৌন সম্পর্ক, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে সহ্যগুণ, দয়া-মায়া, সত্যবাদিতা ও সুবিচারকে অভ্যাস করে তবে ভালো হয়। প্রথাগত ধারণা অনুযায়ী যারা যৌন পবিত্রতার অধিকারী তারা প্রায়শই মনে করে থাকে যে তারা সুন্দর মানুষের মতো আচরণ করার হাত থেকে মুক্ত। বেশিরভাগ নৈতিক মানুষ যৌন বিষয়টির দ্বারা এতটাই আবিষ্ট থাকেন যে তারা নৈতিকভাবে নিন্দনীয় কিন্তু সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর অতি সামান্যই জোর দিয়ে থাকেন।

স্বাধীনতা ও মহাবিদ্যালয়সমূহ


[এই প্রবন্ধটি ১৯৪০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের সিটি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে বিচারক ম্যাগিহান রাসেলকে অনুপযুক্ত সাব্যস্ত করার কিছুদিন পরেই এই প্রবন্ধটি রচিত হয়।]


(১)


বর্তমান বিদ্যালয় সম্পর্কিত স্বাধীনতার মান সম্পর্কে আলোচনা করার আগে শব্দটির দ্বারা আমরা কি বোঝাতে চাই সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করে নিতে পারি। বিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা হল সেই রকম শিক্ষককে নির্বাচিত করা যে শিক্ষকের দক্ষতার বিচারক হবে অন্যান্য দক্ষ শিক্ষকেরা। একজন দক্ষ অঙ্কবিদ, পদার্থবিজ্ঞানবিদ ও রসায়নবিদ্যাবিদ অবশ্যই অন্য অঙ্কবিদ, পদার্থবিজ্ঞানবিদ ও রসায়নবিদ্যাবিদদের দ্বারা বিবেচিত হবেন। একমাত্র তাদের দ্বারাই ঐক্যসম্মতভাবে এই বিচার করা যেতে পারে।


কলেজ বা মহাবিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা তারা মনে করেন শিক্ষকদের নিজস্ব বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়াও অন্যান্য গুণ থাকাও প্রয়োজন। তারা মনে করেন যে একজন শিক্ষক কখনই তাদের মতের বিরুদ্ধাচরণ করবে না যারা ক্ষমতা ধারণ করে আছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নীতি অগ্রাহ্যকারী রাষ্ট্রসমূহ এই বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কঠিন পথ অবলম্বন করে থাকে। কেরেনস্কির সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের বাইরে রাশিয়া কোনদিনও মহাবিদ্যালয় সংক্রান্ত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু আমি মনে করি জারদের রাজত্বকালের থেকেও এই বিষয়ে অনেক কম স্বাধীনতা বর্তমানে সেখানে দেওয়া হয়ে থাকে। যুদ্ধের আগে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অনেক অভাব থাকলেও জার্মানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিষয়ে মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার আদর্শকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও কিছুজন ছাড়া প্রায় সব দক্ষ পণ্ডিত মানুষকে নির্বাসনে পাঠাবার ফল হিসেবে সবই বদলে গেছে। কিছুটা কম আকারে হলেও ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই একই ধরণের স্বৈরাচারিতা চলে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাধারণত এই ধরণের প্রবণতা খুবই দুঃখজনক। তাই এই বিষয়টিকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে এই ধরণের প্রবণতা সেখানেও এই একই ধরনের অশুভ ঘটনার জন্ম দেবে।


বিপদ এমনই বস্তু যা গণতন্ত্র হাজার চেষ্টা করেও দূর করতে পারে না। গণতন্ত্র হল তাই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একজন একনায়কের মতোই স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে যদি তারা তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবহার করে। একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠদের জন্য সহনশীল মনোভাব একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান, কিন্তু বাস্তবে এই উপাদানটি যথেষ্টভাবে মনে রাখা হয় না।


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে সেইসব বিচক্ষণতাকে অনুসরণ করা দরকার যা বিশেষভাবে তাদের জন্যই প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অবশ্যই বিশেষভাবে জ্ঞানী ও বিশেষভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হবেন যার দ্বারা তারা বিতর্কিত প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে যেমন সমর্থ হবেন, অন্যদিকে সেইসব প্রশ্নের উপর আলোকপাত করতে পারবেন। বিতর্কিত বিষয়ের উপর আলোচনা করবার বিষয় তারা যদি নীরব ভূমিকা পালন করেন তবে যতটা পরিমাণ নীরবতা তারা পালন করবেন, ধরে নেওয়া হবে, ততটা পরিমাণে পক্ষপাতিত্ব করে তারা জনসাধারণের মঙ্গলকে বঞ্চনা করছেন। বহু বছর আগে চীনের সম্রাট সরকারের সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এই জন্য তিনি একটি বিশেষ পরীক্ষকমণ্ডলী নির্মাণ করেন যে মণ্ডলী সেইসব প্রখ্যাত ও জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে তৈরি হত যারা সম্রাট ও তার সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে সমর্থ হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সব কিছুর মতোই এই প্রথাটিও সেখানে প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে পড় গেল। পরবর্তীকালে বিশেষ কিছু বিষয় নির্ধারিত হল যার উপর তারা সমালোচনা করতে পারত। এক্ষেত্রে নৃপুংসকদের ক্ষমতা ছিলো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কিন্তু যদি তারা তাদের উপর প্রদত্ত অধিকারের বাইরে গিয়ে সমালোচনার প্রচলিত রীতি লঙ্ন করে কিছু করবার চেষ্টা করত তবে সম্রাট তাদেরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারটি ভুলে যাবার অধিকারী ছিলেন। অনেকটা একই রকম ঘটনা আমাদের মধ্যে ঘটে। একটি বিরাট ক্ষেত্রে সমালোচনা অনুমোদনীয়। কিন্তু যেখানে সমালোচনা সত্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সেখানে সমালোচনাকারী বা লেখকের ভাগ্যে শাস্তি জুটবেই।


এই দেশে মহাবিদ্যালয়ের স্বাধীনতা দুদিক থেকে বিপদগ্রস্ত। এদের মধ্যে একটি হল ধনিক শ্রেণীর সরকার আর অন্যটি হল গীর্জাগুলি। যারা এইসব মহাবিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক ও ধর্মতত্ত্বমূলক বিবাচন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকে। সাম্যবাদের অভিযোগের খোঁচায় এই দুজন সহজেই মিলে গেছে এবং যাদেরই মতামতকে তারা অপছন্দ করছে তাদের বিরুদ্ধেই তারা অন্ধভাবে সাম্যবাদের অভিযোগ ছুঁড়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আমি এটা খুব ভালো করে দেখেছি যে ১৯২০ সাল থেকে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বারবার সমালোচনা করে এসেছি এবং বলেছি যে সেখানকার সরকার নাৎসী সরকারের মতোই মন্দ কিন্তু আমার সমালোচক সেইসব কথা উল্লেখ


করে কেবলমাত্র আমি আমার লেখাতে যে দু’একটি আশাব্যঞ্জক কথা সেই সরকারের সম্পর্কে বলেছি সেগুলোরই উল্লেখ করেছেন।


যাদের মতামতকে অপছন্দ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার কৌশল কিছু বিশেষ শক্তিশালী ব্যক্তি সম্প্রদায়ের দ্বারা ক্রমশই এমন নিপুণ হয়ে উঠছে যে শৃঙ্খলিত অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা বিপজ্জনক। যদি কোন যুবক এ বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে তবে যে-কোন সময় তার অফিসের বড়বাবু তাকে পেশাগত দিক দিয়ে অযোগ্য ভাবতে পারেন এবং তার চাকরিটি চলেও যেতে পারে। বৃদ্ধ মানুষেরা এই পদ্ধতিটিকে না করে উঠতে পারার ফলে তাদের সঙ্গে জনগণের বিরোধ বাড়তে থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই এই ধরণের বিপদ নিজের জন্য কখনই ডেকে আনার চেষ্টা করেন না, এইজন্য তারা জনসমক্ষে অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাব কখনই প্রকাশ করেন না। এটা একটা বিপজ্জনক বিষয়, এইজন্যই নিরপেক্ষ বুদ্ধি পক্ষপাতদুষ্ট নীরবতা পালন করে থাকে এবং তারা যাতে তাদের নিজেদের জায়গাটাতে ঠিকঠাক থাকতে পারেন তার জন্য সংরক্ষণশীলতা ও প্রচ্ছন্নতার শক্তিকে মেনে নিতেই হয়।


(২)


আমেরিকার সংবিধান রচয়িতাদের অনুপ্রাণিত করেছিল যে উদার গণতন্ত্রের আদর্শ, সে সম্পর্কে উখিত প্রশ্নসমূহের সমাধান গায়ের জোরে সমাধান না করে যুক্তির মধ্য দিয়ে করতে হবে। উদারপন্থীরা সর্বদাই মনে করে থাকেন যে মতামত সমূহকে অবশ্যই বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে হেঁকে নিতে হবে, শুধুমাত্র এক পক্ষের কথা শুনেই তা গ্রহণ করলে চলবে না। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগে স্বৈরাচারী সরকার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আমার দিক থেকে বলতে গেলে এই ব্যাপারে ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করার কোন কারণ আমি দেখতে পাই না। যদি আমার ক্ষমতা থাকত তবে আমি আমার বিরুদ্ধ পক্ষের মতামতকে দমাতে কখনই সুযোগ খুঁজতাম না। আমি সব ধরণের মতামতকে সমানভাবে সুযোগ দিতাম এবং বিতর্ক ও আলোচনার থেকে বেরিয়ে আসা ফলাফলকে ত্যাগ করতাম। আমি যতদূর জানি পোল্যান্ডে জার্মান নির্যাতনের বলি যে ক’জন শিক্ষক ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু প্রাচীন যুক্তিবিদ ছিলেন যারা গোড়া ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্তু আমি তাদের সহযোগী ধর্মবিদরা কোন রকম অভিনন্দন আমাকে জানাবে না তা জেনেও আমার ক্ষমতায় তাদের মহাবিদ্যালয়গত অবস্থাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতাম।


উদার ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটির হল যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সব প্রশ্ন আলোচনাযোগ্য এবং সব মতামত কম বা বেশি সন্দেহযোগ্য। কিন্তু অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশেষ কিছু মতামতা এমনই চরম যে তা উত্তরযোগ্য নয় এবং সেইসব প্রশ্নের বিরুদ্ধে কোন মতামতকে অবশ্যই অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে যেটা সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক তা হল সেই বিশ্বাস, যে যদি এ সম্পর্কে কোন নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের অনুমোদন দেওয়া হয় তবে তা মানুষকে ভুল সিদ্ধান্তে নিয়ে যাবে, এইজন্য ভুলের বিরুদ্ধে বাঁচার অস্ত্র অজ্ঞতা। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি কখন সেই ধরণের মানুষ গ্রহণ করতে পারে না যারা মানুষের কার্যকে সংস্কারের থেকে মুক্তি দিয়ে বিচার করতে চায়।


ধর্মযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডে উদার দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ঘটে। ১৩০ বছর ধরে প্রচণ্ড হিংস্রতা ও ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ ঘটলেও তা কোন পক্ষকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করতে পারেনি। প্রতিটি পক্ষই মনে করেছিল যে তারা নিজের ক্ষেত্রে সঠিক এবং মানবজাতির জন্য তাদের বিজয় একান্তই গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে সচেতন মানুষ বহুদিন ধরে এই যুদ্ধের অশেষ দুঃখ-কষ্টকে সহ্য করে বুঝতে পেরেছিল যে উভয় পক্ষই তাদের গোঁড়া মনোভাবের দিক থেকে ভুল ছিল। জন লক এই নতুন যুগের শুরুতেই নতুন ধরণের দর্শন ও রাজনীতি সম্পর্কে লিখতে শুরু করলেন। মানুষের বিচার কখনও যে সঠিক হতে পারে না সে সম্পর্কে তিনি জোর দিয়েই বললেন এবং অগ্রগতির যুগের সূচনা করলেন যা ১৯১৪ সাল পর্যন্ত টিকে রইল। লক ও তাঁর অনুগামীদের জন্য ক্যাথলিকেরা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর প্রতি সহ্যশক্তি প্রদর্শন করতে পেরেছিল। যেখানে সপ্তদশ শতকে দেখা যায় যে তখন মানুষ কম বা বেশি সহনশীলতার পাঠ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু মহাযুদ্ধের (The Great War) শেষে উদারনীতিবাদের দার্শনিকদের উচ্চ আদর্শগুলোকে সবাই ভুলে গেল। দ্বিতীয় চার্লসের বিচার-সভার খ্রীষ্টীয়দের সময় কোয়েকারদের আমরা যেমন ভয় করে চলতাম সেরকম আর বেশিদিন ভয় করে চলতে হল না আমাদের। কিন্তু সপ্তদশ শতকে কোয়েকার-রা তৎকালীন যুগে সমস্যা সমূহকে যে আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতেন সেই একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শে যখন কিছু মানুষ বর্তমান সমস্যা সমূহকে অমান্য করেছি যেগুলো প্রাচীনতার দোষে দুষ্টু, কিন্তু এটা দুঃখজনক এবং অনিবার্যভাবে একটা ধাক্কা যে আমরা নতুন মতবাদ গুলোকেও মেনে নিতে পারছি না।


গণতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতায় সম্ভবত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সমস্ত ক্ষেত্রেই চরমভাবে জয়লাভ করতে পারে। আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যেখানে সাধারণ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই সেখানে যতদূর সম্ভব অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের মতামতের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত সংখ্যাগত হার অনুযায়ী। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যখন কোন মত সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সমর্থিত হয় তখন অন্যান্যদের মতামত প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া আবশ্যিকভাবেই উচিত নয়। যদিও তা প্রকাশ করতে দেওয়াও হয় তবে তা অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। অন্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ মতোই সংখ্যালঘিষ্ঠদের মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত, তবে তা সংক্ষিপ্ত ছোট্ট আকারে।


শিক্ষা ক্ষেত্রে এই একই বিষয়ের প্রয়োগ হয়। রাষ্ট্রের অধীনে যে-সব পুরুষ ও মহিলা শিক্ষকের পদে আসীন আছেন তাদের মতামতকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বলে প্রকাশ করা উচিত নয়। যদিও স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ শিক্ষকই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকেই নিজের মত হিসেবে প্রকাশ করে থাকেন। শিক্ষকদের মতামতের মধ্যে একরূপতা কখনও চাওয়া যেতে পারে না কেননা তাদের মতামতের মধ্যে বিচিত্রতাই উত্তম শিক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন। এমন প্রশ্নসমূহ যাকে কেন্দ্র করে জনগণ দ্বিধাবিভক্ত সেই প্রশ্নটির একপেশে উত্তর দিয়ে কোন মানুষই পাশ করে শিক্ষিত হতে পারে না। গণতন্ত্রের শিক্ষা সম্পর্কীয় কোন প্রতিষ্ঠানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যুক্তি সমূহকে ওজন করে দেখে নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ও মনকে মুক্ত করার শিক্ষা দেওয়া যাতে যে পক্ষটি বা দিকটি সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত তাকে আগেভাগেই গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি আসে। শিক্ষকদের অকপটে মতামত প্রকাশ করার উপর যখন নিয়ন্ত্রণ আসে তখন শিক্ষা তার সেবামূলক কাজ বন্ধ করে দিয়ে মানুষের দ্বারা গঠিত জাতি (Nation of men) গঠনের পরিবর্তে এক দল উন্মাদগ্রস্ত ধর্মান্ধকে তৈরি করে। মহাযুদ্ধের (Great War) অবসানের পর থেকে উন্মাদগ্রস্ত ধর্মান্ধতা জগতের বেশিরভাগ অংশ ছেয়ে ফেলল তার তীব্র বিষে যা ধর্মযুদ্ধের সময়গুলোতে ঘটেছিল। যারা স্বাধীন আলোচনার বিরোধিতা করে এবং যে মতামতের উপর নির্ভর করে যুবকেরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারে তার উপর যারা নিয়ন্ত্রণ চাপায় তারাই ধর্মান্ধতার বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে এবং জন লক ও তার অনুগামীরা অতলস্পর্শী গভীর বিবাদ ও অসহনশীলতার হাত থেকে যে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল সেই পৃথিবীকে তারা সেখানেই ঠেলে দেয়।


এমন দুটি প্রশ্ন দেখা যায় যে দুটির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। এদের মধ্যে একটি হল উত্তম ধরণের সরকারের কাঠামো নিয়ে এবং অন্যটি সরকারের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে। গণতন্ত্রই সরকারের উত্তম কাঠামো সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার কার্যের সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথা বলতে হয় যে তা অন্য যে-কোন সরকারের কার্যের মতোই বাজে। এমন কিছু বিশেষ বিষয় আছে যার উপর সাধারণ ক্রিয়ার প্রয়োজন। এই কারণেই সাধারণ সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজনও নেই আবার, তা আকাক্ষিতও নয়। এই অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে মত প্রকাশের পরিধিটিও পড়ে। কিন্তু মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা যাঁদেরই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে তাদেরই থাকে, তাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার যাতে একটা সীমা থাকে তার জন্য সেখানে অবশ্যই সেই সব রীতিনীতিকে কার্যকরী করে তোলার জন্য সংগঠিত পরিচালকমণ্ডলী থাকার প্রয়োজন যারা হয় বাস্তবে অথবা তত্ত্বগত দিক থেকে তা করতে পারবে। মধ্যযুগে ইউরোপে গীর্জা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদের মধ্য দিয়ে সেখানে যে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল সেই সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিলো যেসব দেশ সেখানে এই ধরনের স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে সেই স্বাধীনতার উৎসকে প্রমাণও করা যায়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে গীর্জা রাষ্টের দ্বারা অবদমিত হয়েছিল এইভাবেই সেই রাশিয়াতে স্বাধীনতার যে-কোন ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির কারণটিকেও আমরা সম্ভবত চিহ্নিত করতে পারব যে রাশিয়া কনস্টান্টিনোপলের সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমা দেশগুলোতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথমে ক্যাথলিক গীর্জা এবং পরে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় ক্রমশ বিশেষ কিছু স্বাধীনতা অর্জন করে।


শিক্ষাগত স্বাধীনতা গীর্জার স্বাধীনতার একটি অংশ ছিলো এবং এর ফলে অষ্টম হেনরীর সময় তা জ্ঞানের আলো থেকে বিচ্যুত ছিলো। আমি আবারও বলতে চাই প্রতিটি রাষ্ট্রে সরকারের কাঠামো যাই হোক, স্বাধীনতার সংরক্ষণের বিষয়ে এমন একটি পরিচালক বর্গের অস্তিত্ব থাকবে যাদের হাতে রাষ্ট্রের সীমিত স্বাধীনতার অধিকার থাকবে এবং এইসব পরিচালক বর্গের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমেরিকায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে শিক্ষাগত স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায় সেই স্বাধীনতা গণতন্ত্রের কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লক্ষ্য করা যায় না এবং এর কারণ হল সরকারের যথার্থ কার্যসমূহের সম্পর্কে বিস্তৃত ভুল ধারণা।


(৩)


খাজনা প্রদানকারীরা ভেবে থাকেন যেহেতু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দিয়ে থাকেন সেইহেতু কিভাবে তারা শিক্ষা দেবেন তা ঠিক করার অধিকার তাদের। এই আদর্শকে যদি যুক্তিগতভাবে বিচার করা যায় তবে যে অর্থটি দাঁড়াবে তা হল উচ্চ বিদ্যার জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা পেয়ে থাকেন সেগুলো নিষ্ফল এবং তাদের শিক্ষার বিষয়েও ওই একই কথা বলা যেতে পারে। তাদের বিশেষ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা তা ব্যবহার করতে পারেন না। ‘নির্বুদ্ধিতা, চিকিৎসকদের মতো নিয়ন্ত্রণের কৌশল’ (‘Folly, Doctor-like, Controlling skill’) এমন এক বস্তু যা সেক্সপীয়রকে শান্ত-মৃত্যুর জন্য কাঁদিয়েছে। তাই বেশিরভাগ আমেরিকান গণতন্ত্র বলতে যা বোঝে তা হল সমস্ত রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর এই ধরণের নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতি থাকা একান্ত দরকার। ক্ষমতার ব্যবহার অবশ্যই দরকার তবে জ্ঞানী ব্যক্তির উপর অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে প্রয়োজন। যে রোমান সেনা আর্কিমিডিসকে হত্যা করেছিল সে যদি তার যুবক বয়সে জ্যামিতি শিখতে বাধ্য হত তবে সে এই সুপ্রসিদ্ধ অপরাধীর জীবনের অবসান করবার সময় দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর আনন্দ উপভোগ করতে পারত। কোন মূর্খ আমেরিকান ধর্মান্ধ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার গণতান্ত্রিক শক্তিকে ব্যবহার করে একই ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করে যে ব্যক্তি অশিক্ষিত ব্যক্তি সম্পর্কে ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে।


সম্ভবত ক্ষমতার গণতান্ত্রিক অপব্যবহারের মধ্যেই বিশেষ বিপদ নিহিত থাকে, বিশেষ করে তখন যখন সম্মিলিতভাবে সেগুেলো উন্মত্ত জনতার দ্বারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জনতার ডাইনি শিকারের প্রবৃত্তিকে উস্কে দেবার কৌশল যে মানুষের জানা আছে সে গণতন্ত্রের অশুভ দিকটিকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতাও ধারণ করে। গণতন্ত্র হল সেই জায়গা যেখানে ক্ষমতার ব্যবহার সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা হয়ে থাকে। ফলে স্বৈরাচারের দিকে যাবার ভাবাবেগ ও মাদকতা সেখানে খুব সহজেই তৈরি হয় যা অনিবার্যভাবে তাড়াতাড়ি বা ধীরগতিতে কর্তৃত্বের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এই বিপদের বিরুদ্ধে প্রধান রক্ষাকবচটি হল সঠিক শিক্ষা। সম্মিলিত ঘৃণার অযৌক্তিক উদ্রেকের প্রবণতার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষেত্রে যাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকই এই ধরণের শিক্ষা প্রদান করতে আগ্রহী। কিন্তু অভিজাততন্ত্র ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রভুরা এই কর্তব্যকে সঠিকভাবে পালন করার ক্ষেত্রে তাদের যতদূর সম্ভব বাধা দিয়ে থাকেন। কেননা এইসব মানুষদের ক্ষমতা আসে জনতার অযৌক্তিক ভাবাবেগের থেকে। তারা জানে যে যদি যৌক্তিক চিন্তার ক্ষমতা তাদের মধ্যে আসে তবে তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। তাই নীচে মূর্খতার পরস্পর-সংযুক্ত ক্ষমতা এবং উপরে ক্ষমতার প্রতি ভালোবাসা যুক্তিবান মানুষদের প্রচেষ্টাকে পঙ্গু করে দেয়। এই দেশে আজ পর্যন্ত জনগণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি শিক্ষাগত স্বাধীনতা এই অশুভ দিকটিকে নিবৃত্ত করতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তির অ-জনপ্রিয় আকারের নির্যাতন যে-কোন দেশের পক্ষে গভীরভাবে বিপজ্জনক এবং জাতীয় ধ্বংসের কারণ হিসেবে যা প্রায়শই ঘটে থাকে। চোখের সামনে আমরা স্পেনকে উদাহরণস্বরূপ দেখাতে পারি যেখানে ইহুদি ও মুরদের নির্বাসনের ফলে কৃষি-ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে গেছে এবং সেখানে সম্পূর্ণ পাগলের মতো অর্থ-ব্যবস্থার পরিচালনা গ্রহণ করা হয়েছে। স্পেন এই দুটি কারণের জন্যই ইউরোপে তার শক্তিশালী অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছিলো যদিও পঞ্চম চার্লস সর্বপ্রথম এই দুটি কারণপ্রসূত কার্যকে ঢাকা দেবার চেষ্টা করেন। খুব সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই একই কারণ জার্মানীতে একই কার্যকে উৎপাদন করবে, যদি তা নিকট ভবিষ্যতে না-ও হয় অদূর ভবিষ্যতে তা ঘটবেই। এই একই ঘটনা রাশিয়াতেও অনেক দিন ধরে চলছে এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থায় তাদের অযোগ্যতা থাকলেও, ভবিষ্যতে সেখানে যে কার্য ঘটতে চলেছে তা সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য।


এই মুহূর্তে রাশিয়া একটি দেশ হিসেবে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। সেখানে মূর্খ ধর্মান্ধদের উপর যথেষ্ট পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত থাকায় তারা নিউইয়র্কে চলে যাবার চেষ্টা করছে। অধ্যাপক এ.ভি. ছিল ১৯৩৮ সালের অ্যাট্রোনমিক্যাল জার্নাল অব সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর থেকে যে কথাগুলির উল্লেখ করেছেন সেগুলো হল :


১) প্রকৃত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অর্থাৎ সময় ও স্থানের (Time and space) পরিপ্রেক্ষিতে অসীমকে বিচার করার ধারণা গ্রহণ না করার ফলে আধুনিক বুর্জোয়াদের বিশ্বতত্ত্বের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা এক গভীর বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়েছে।


২) ফ্যাসিবাদের দালালরা একটা সময় মহাকাশবিদ্যা থেকে অন্যান্য বিষয় ও সংবাদমাধ্যম (Press) সবাইকে নিজের অধীনে আনতে পেরেছিলো, কিন্তু তাদের শত্রুভাবাপন্ন এই সব কাজের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সাহিত্যে এখন প্রতি বৈপ্লবিক বুর্জোয়া আদর্শের বৈপ্লবিক প্রচার চলছে।


৩) বিশ্বতত্ত্বের সমস্যার উপর বর্তমান সোভিয়েতের বস্তুবাদমূলক কার্যসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে এবং জনগণের শত্রুদের দ্বারা এখনো পর্যন্ত অবদমিত।


৪) বিজ্ঞান অনুরাগীদের একটি বিরাট অংশ বুর্জোয়াদের সাম্প্রতিক বিশ্বতত্ত্বের তত্ত্বসমূহের আদর্শগত দিকের প্রতি উদাসীন থাকার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে।


৫) সোভিয়েতের জনসাধারণের শত্রুদের অনাবৃত করতে নব্য সোভিয়েত বস্তুবাদমূলক বিশ্বতত্ত্বের উন্নতি একান্ত প্রয়োজন।


৬) দর্শনগত পদ্ধতিবিদ্যার (Philosophic methodolgy) উপর ভিত্তি করে বিশ্বতত্ত্বের তত্ত্বসমূহ গঠনের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের রণাঙ্গণে সোভিয়েত বিজ্ঞানের প্রবেশ করাটা বর্তমানে বিশেষ প্রয়োজন।


কেননা আমেরিকার স্থানে ‘সোভিয়েত’কে বসতে হবে। সাম্যবাদকে ‘ফ্যাসীবাদের স্থানে বসতে হবে। ক্যাথলিক সত্যের স্থানে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’কে বসতে হবে। আপনাদের শুধু সেই তথ্যকে খুঁজে বের করতে হবে যার উপর এদেশের শিক্ষাগত স্বাধীনতার শত্রুরা তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছে।


(8)


এদিকে একটি উৎসাহব্যঞ্জক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার নতুনভাবে বেড়ে না উঠে আজ থেকে একশ বছর আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে। যে কেউ ডি. টকিউভেলির ‘ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ নামক গ্রন্থে উপসংহারটি পড়ে দেখতে পারেন। সেই গ্রন্থে তিনি যা বলেছেন তার বেশিরভাগ অংশ এখনো প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ আর সত্য হিসেবে টিকে থাকতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, আমি তার এ ধরণের কথাকে মেনে নিতে পারি না যে, সভ্য জগতে আর কোন দেশেই দর্শনের প্রতি এত কম মনোযোগ দেওয়া হয় না যতটা আমেরিকায় দেওয়া হয়। কিন্তু আমি মনে করি এখনো সেখানে ন্যায়বিচারের কিছু অস্তিত্ব আছে যদিও তা হয়ত ডি. টকিউভেলির সময়ের চেয়ে কম। তিনি লিখেছেন।


মতামতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা এক মারাত্মক বেড়াজাল সৃষ্টি করে। এই বেড়াজালের ভেতরেই একজন লেখক যা খুশী তাই লিখতে পারেন, কিন্তু যদি তিনি এই বেড়াজাল অতিক্রম করতে চান তাহলে তাকে অনুশোচনা করতে হয়। তাকে শুধু জনগণের সন্ত্রাসই সহ্য করতে হয় না, প্রতিদিন গালাগালের নির্যাতন ও অবজ্ঞাও সহ্য করতে হয়। তার রাজনৈতিক জীবন চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু তিনি সেই একমাত্র কর্তৃত্বকে অসন্তুষ্ট করেছেন যে তার জীবনে সফলতাকে আনাতে পারত। সব ধরণের ক্ষতিপূরণ তার ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হয়। এমনকি তার খ্যাতির দিকটিও কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি তার মতামত প্রকাশের আগে কল্পনা করতে পারেন যে তার মতামতটি তিনি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরবেন এবং অন্যান্য অনেকেই তাকে সমর্থন করবে কিন্তু যেই না তিনি তা প্রকাশ করেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে সশব্দে দমিয়ে দেয় এবং যারা তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে চান না, বুঝতে হবে তারা তাঁকে পছন্দ করে এবং নীরবতায় তাকে পরিত্যাগ করেন। শেষে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন। প্রতিদিন তিনি যা চেষ্টা করেছেন তার জন্যই উৎপীড়িত হয়েছেন, তারপর একসময় নীরবতায় তাকে থিতিয়ে যেতে হয়। এ যেন সত্য বলার অপরাধে তীব্র মনস্তাপে জ্বলে-পুড়ে মরার অবস্থা।


গণতন্ত্রে একজন ব্যক্তির উপর সমাজের ক্ষমতা সম্পর্কে ডি. টকিউভেলি যা বলেছেন আমি মনে করি তা অবশ্যই মেনে নিতে হয়। তিনি বলছেন, যখন একটি গণতান্ত্রিক দেশের একজন প্রতিবেশী ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে দেশের অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে তুলনা করে তখন সে এই ভেবে গর্ব বোধ করে থাকে যে সে তাদের যে-কোন কারুর সঙ্গে এক ও সমান। কিন্তু যখন সে তার দেশের জনসাধারণের সমগ্রতাকে জরিপ করে এবং সেই বিরাট অংশকে নিজের বিপরীতে তুলনা করতে চায় তখন সে নিজের তুচ্ছতা ও দুর্বলতাকে মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পেরে অভিভূত হয়ে যায়। এই একই বোধ তাকে বুঝতে শেখায় যে সে তার প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে স্বাধীন (আলাদাভাবে নয়) এবং তখন সে বুঝতে পারে এই বিরাট সংখ্যক জনসাধারণের প্রভাবের কাছে সে অরক্ষিত ও একা। গণতান্ত্রিক জনসাধারণের মধ্যে জনগণই একটি অদ্বিতীয় ক্ষমতা, যার সম্পর্কে কোন অভিজাততান্ত্রিক জাতি ঠিকমতো করে কোন ধারণা করে উঠতে পারে না, কেননা এরকম দেশ কোন বিশেষ মতামতকে প্ররোচিত করে না। সে ওই মতামতসমূহকে জোর করে কার্যক্ষম করে তোলে এবং পারস্পরিক যুক্তির উপর নির্ভর করে সর্বজনের মনের বিরাট চাপে সেই মতামতসমূহ কার্যকরী মতামতে পরিণত হয়ে ওঠে।


ডি. টকিউভেলির সময় থেকে লেভিয়াথানের (Leviathan) বিরাটত্ব ব্যক্তি সত্তাকে গিলে ফেলে বহু গণতান্ত্রিক দেশেই নিজের বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা পশ্চিমা সভ্য জগতের পক্ষে আসন্ন একটি মারাত্মক বিপদের সংকেত। যদি এটিকে এখনি রোধ করা না হয় তবে বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির সমাপ্তি ঘটবে। কেননা সব বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির জন্য দরকার এমন এক বিশেষ স্বাধীনতা যা বাইরের মতামতের দ্বারা বিঘ্ন হবে না। কিন্তু যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে বিশেষ ধর্মীয় সম্মানে দেখা হয় সেখানে এই ধরণের স্বাধীনতা থাকতে পারে না, কেননা সেখানে গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা উক্ত ইচ্ছাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মনে করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি সম্মানের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার প্রতি সম্মান আরও বেশি ক্ষতিকর, কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে নিরূপণ করা যায়। সম্ভবত চল্লিশ বছর আগে ডারবান শহরে Flat Earth Society-র একজন সদস্য সমগ্র জগৎকে বিতর্কে আহ্বান করেছিলেন। এই আহ্বানে জগতের সপক্ষে সাড়া দিয়েছিলেন একজন জাহাজের ক্যাপটেন। তাঁর একটি মাত্রই যুক্তি ছিল যে পৃথিবীটি গোলাকার কেননা সমগ্র পৃথিবীটি ঘোরবার পর তিনি তাকে গোলাকারই দেখেছেন। তাঁর এই যুক্তিটি খুব সহজেই দমিত হল এবং Flat Earth সংঘের প্রচারকরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল। জনগণের কণ্ঠ এইভাবে ঘোষিত হয়ে আসছে। একজন সত্যনিষ্ঠ গণতন্ত্রবাদী অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত নেবেন যে ডারবানে পৃথিবীটা সমতল। আমি আশা করি সেদিন থেকে ডারবানের সাধারণ বিদ্যালয়ে আর কেউ শিক্ষা দিতে পারেনি (আমার বিশ্বাস যে সেখানে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই) যতক্ষণ না সে এই সম্মতি জ্ঞাপন করেছে যে পৃথিবী গোল বিষয়টি এমন একটি নাস্তিক মতো যা সাম্যবাদের দিকে মানুষকে নিয়ে যাবার একটা কৌশল হিসেবে তৈরি হয়েছে এবং পরিবার প্রথাকে ধ্বংস করবার জন্য তৈরি। এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার তথ্য ত্রুটিপূর্ণ।


দুঃখের বিষয় সমবেত প্রজ্ঞা (Wisdom) বা সমষ্টিগত জ্ঞান ব্যক্তিদের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতিভূ নয়। যে-সব ব্যক্তি গৃহীত মতামতসমূহের বিরোধিতা করে তারাই সমস্ত ধরণের অগ্রগতির উৎস হয়ে আসছে আজ পর্যন্ত। তারা নৈতিক ও বিদ্যাবুদ্ধিগত অগ্রগতির উৎস। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা জনপ্রিয় নয়। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের নিন্দায় সক্রেটিস, ক্রাইস্ট এবং গ্যালিলিও সমানভাবে বিপদে পড়েছেন। আগেকার দিনে দমন করার জন্য যে পন্থা ব্যবহার করা হত তা আজকে আমাদের দিনের থেকে যথেষ্ট দুর্বল ছিলো এবং সে সময় প্রচলিত ধর্মমতের যারা বিরোধিতা করত তারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলেও যথেষ্ট প্রচার পেতেন। শহীদের রক্তই গীর্জার বীজ। কিন্তু জার্মানীর মতো দেশে এই ব্যাপারটি সত্য রইল না। সেখানে শহীদের দুঃখ-যন্ত্রণাকে গোপন রাখা হয় এবং প্রচারিত শহীদের মতবাদের কোন চিহ্নই রাখা হয় না। শিক্ষাগত স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা আছেন তারা যদি কোন পথ পান তবে এই দেশকে তারা জার্মানের নীচেও নামাতে পারেন যাতে তারা যে মতবাদসমূহকে অমনোনীত করেছে তা প্রচার না পায়। ব্যক্তিচিন্তার প্রতিভূ হিসেবে তারা সংগঠিত স্বৈরাচারের সৃষ্টি করে। যা-কিছু নতুন তাকেই তারা বে আইনী বলে ঘোষণা করে। তারা মনুষ্যসমাজকে ফোপরা করে ছাড়ে এবং পরিশেষে এমন এক মনুষ্যধারার সৃষ্টি করে যারা মানব-ইতিহাসের কোন রকম চিহ্ন না রেখে জীবন-মৃত্যুর তরঙ্গের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। কারুর কারুর মনে হতে পারে যে তারা এই মুহূর্তে যেটা দাবি করছে সেটা খুব একটা গভীর বিষয় নয়। এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে, যে জগৎ যুদ্ধের দ্বারা নির্যাতনের নিদারুণ যন্ত্রণায় জর্জরিত এবং তাদের জন্য বহুসংখ্যক নির্যাতন-শিবির বা বন্দী-শিবিরে (Con-centration camp) পূর্ণ, যারা কোন পাপকর্ম করতে নারাজ, সে জগতে শিক্ষাগত স্বাধীনতার গুরুত্ব কতখানি? আমি স্বীকার করি এইসব কিছুর তুলনায় শিক্ষাগত স্বাধীনতা গুরুত্বের দিক দিয়ে কখনই প্রথম শ্রেণীভুক্ত নয়। কিন্তু এটি একই যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এ কথা যেন স্মরণ রাখি যে বিষয়টি এখন সংকটে। যাকে বড় বড় সমস্যার সামনে খুব ছোট বলে মনে হতে পারে তা হল মনুষ্যজাতির ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও আশা প্রকাশ করবার জন্য ব্যক্তি-মানব-আত্মার স্বাধীনতা, সেই আশা ও বিশ্বাস বহুজনের দ্বারা সমর্থিত হোক, কিংবা কতিপয় জনের দ্বারাই হোক অথবা কারুর দ্বারা নাই বা হোক। নতুন আশা, নতুন বিশ্বাস এবং নতুন চিন্তা মনুষ্যজাতির জন্য সর্বদাই প্রয়োজনীয় এবং সৃষ্টিশীলতাহীন সমভাব থেকেই যে তা উখিত হবে তা আশা করা যেতে পারে না।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব


(বার্ট্রান্ড রাসেল ও ফাদার এফ. সি. কলেস্টোন-এর মধ্যে একটি বিতর্ক। এই বিতর্কটি মূলত ১৯৪৮ সালে বিবিসির থাউ প্রোগ্রামে সম্প্রচারিত হয়। ১৯৪৮ সালের হিউম্যানটিয়াস’ পত্রিকার শরৎকালীন সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং বর্তমান গ্রন্থে ফাদার কলেস্টোনের সহৃদয় অনুমতিতে পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছে।)


কপলেস্টোন : যখন আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি, তখন আমাদের সম্ভবত এমন একটি অস্থায়ী চুক্তিতে আসার দরকার যার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে ঈশ্বর বলতে ঠিক কি বোঝায়। আমি মনে করি, ঈশ্বর বলতে বোঝায় একটি চরম ব্যক্তিগত সত্তা যিনি জগৎ এবং জগতের স্রষ্টার থেকে স্বতন্ত্র। অন্তত সাময়িকভাবে কি আপনি ঈশ্বর বলতে আমি যা বোঝাতে চাইলাম তা গ্রহণ করবেন?


রাসেল : হ্যাঁ, আমি এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলাম।


কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার মতামত ধনাত্মক এবং আমি মনে করি তার অস্তিত্ব দার্শনিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে। সম্ভবত আপনি অবশ্যই আমায় জানাবেন যে আপনি এ বিষয়ে একজন নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী মনোভাব রাখেন কি না। আমি বলতে চাই যে আপনি কি এটি বলতে পারবেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে কি না?


রাসেল : না, আমি বলতে পারি যে আমি অজ্ঞেয়বাদকে সমর্থন করি।


কপলেস্টোন : আপনি কি এটি আমার সঙ্গে মেনে নেবেন যে ঈশ্বরের সমস্যা হল একটি মহৎ গুরুত্বের সমস্যা? উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি মেনে নেবেন, যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকত তবে মানবজাতি এবং মানবের ইতিহাস অন্য কোন উদ্দেশ্যে না চলে কেবলমাত্র নিজেদের পছন্দ মতো উদে. ই চলত। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি সেই উদ্দেশ্যের কথা, কার্যকরীভাবে যে উদ্দেশ্য কেবলমাত্র তারাই অন্য লোকের উপর চাপাবে যাদের অন্যদের উপর উদ্দেশ্য চাপিয়ে দেবার মতো ক্ষমতা আছে।


রাসেল : মোটামুটিভাবে বলতে গেলে আমি হ্যাঁ বলব, যদিও আপনার শেষ বাক্যটির উপর আমার কিছু সীমা (Limitation) রাখা প্রয়োজন।


কপলেস্টোন : আপনি কি এটি মেনে নেবেন যদি ঈশ্বর বলে কিছু না থাকে অর্থাৎ পরম সত্তা বলে যদি কিছু না থাকে তবে কোন পরম মূল্য থাকতে পারে না? আমি বোঝাতে চাইছি যে আপনি কি এটি মেনে নেবেন যে যদি কোন পরম মঙ্গল না থাকে তবুও মূল্যসমূহের আপেক্ষিকতা ফল প্রয়োগ করতে পারে?


রাসেল : না, আমি মনে করি এইসব প্রশ্নগুলি যুক্তিগতভাবে স্বতন্ত্র । উদাহরণস্বরূপ, ধরুন জি. ই. মুর-এর প্রিন্সিপিয়া এথিকা (Principia Ethica) গ্রন্থটির কথা। সেখানে তিনি দেখিছেন যে, অমঙ্গলের একটা স্বতন্ত্রতা আছে এবং এই দুটোই একটি নির্দিষ্ট কল্পনা, কিন্তু এই ধারণাটিকে সমর্থন করার জন্য তিনি ঈশ্বরের ধারণার অবতারণা করেননি।


কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। মনে করা যাক আমরা মঙ্গল বিষয়ক প্রশ্নটিকে ততক্ষণ সরিয়ে রাখব যতক্ষণ না আমরা কোন নৈতিক বিষয়বস্তুতে আসছি। আমি প্রথমে অধিবিদ্যাগত যুক্তি দেব। আমি লাইবনিজের অনিশ্চয়তা’ (Contingency) সম্পর্কিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে যে অধিবিদ্যাগত যুক্তি গড়ে ওঠে তাকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু বলব এবং তারপর আমরা নৈতিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। ধরুন আমি অধিবিদ্যাগত বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেব, তারপর আমরা ঐ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা চালাতে পারি কি?


রাসেল : আমার মনে হয় এটাই ঠিক পরিকল্পনা।


.


অনিশ্চয়তাজাত বিষয়ে


কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে আমি বিষয়টিকে কয়েকটি স্তরে ভেঙে নেব। সবার আগে আমার জানা দরকার যে এই জগতে অন্তত এমন কিছু সত্তা আছে যাদের বেঁচে থাকার কোন কারণই নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার পিতামাতার উপর নির্ভর করে থাকি, বাতাসের উপর, খাদ্যের উপর ও এরকম আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে থাকি। দ্বিতীয়ত, জগৎ সহজভাবে বাস্তব অথবা সামগ্রিকভাবে কল্পিত অথবা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর (Individual objects) সমষ্টি এবং তাদের মধ্যে কোন একটি বস্তুও নিজের অস্তিত্বের কোন কারণ প্রকাশ করতে পারে না। এমন কোন জগৎ নেই যে-জগৎ যে-বস্তু (object) থেকে গঠিত হয়েছে তার থেকে স্বতন্ত্র। জগতের এইসব সদস্য-বস্তুদের চেয়ে মানুষ কিছুটা স্বতন্ত্র হলেও সেও তাই। এইজন্য, আমার বলা উচিত, যেহেতু বস্তুসমূহ বা ঘটনাসমূহ বিদ্যমান এবং যেহেতু অভিজ্ঞতালব্ধ কোন বস্তুই তার অস্তিত্বের কোন কারণ নিজের মধ্যে দর্শাতে পারে না, তাই সমগ্র বস্তুর পেছনে যে- কারণ আছে তা অবশ্যই বস্তুর বাইরে অবস্থিত এবং সেই কারণটি অবশ্যই এক বিদ্যমান সত্তা। তাই বলা যায় এই সত্তাটি হয় নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারণ অথবা তা নয়। যদি তাই হয় তবে তা শুভ এবং মঙ্গলময়। যদি তা না হয় তা হলে আমরা আরও কিছুটা দূর এগোতে পারি। কিন্তু ওই অর্থে যদি আমরা অসীমের দিকে এগোই তাহলে অস্তিত্বের ব্যাখ্যা করবার জন্য আর কিছুই পড়ে থাকে না। সুতরাং আমার বলা উচিত, অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবার জন্য আমাদের অবশ্যই এমন একটি সত্তার নিকট আসার দরকার যে সত্তাটি তার নিজের অস্তিত্বের কারণটি নিজেই ধারণ করে রাখে। অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে যেটি কখনও অবিদ্যমান (not exist) হতে পারে না।


রাসেল : এই প্রশ্নের উত্তর বহুদিক থেকে দেওয়া যেতে পারে এবং ঠিক কোন দিক থেকে এর উত্তর শুরু করা যাবে তা বার করা সামগ্রিকভাবে খুব সোজা কাজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি যে, আপনার যুক্তির উত্তরে সম্ভবত যে উত্তম দিকটিকে নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায় সেটি হল প্রয়োজনীয় সত্তা। প্রয়োজনীয় (necessary) এই শব্দটি বচনের (propositions) উপর তাৎপর্যমূলক ভাবে কেবলমাত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। বস্তুত এই ধরণের বিষয় বিশ্লেষণমূলক অর্থাৎ বলা যেতে পারে এই ধরণের বিষয় অস্বীকার করার ক্ষেত্রে স্ববিরোধমূলক। যদি এমন কোন সত্তা থাকে যার অস্তিত্ব অস্বীকার করার ক্ষেত্রে স্ববিরোধমূলক, তবে আমি কেবল প্রয়োজনীয় সত্তাকেই স্বীকার করে নেব। এখন আমি জানতে চাই লাইনিজ বচনসমূহকে কারণের সত্যসমূহ এবং ঘটনার সত্যসমূহ এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন তা আপনি গ্রহণ করবেন কিনা। পূর্বেরটি অর্থাৎ কারণের সত্যসমূহ (truth of reason) প্রয়োজনীয় সত্তা।


কপলেস্টোন : যদি তাই হয় তবে আমার এই বিষয়ে সম্মতি দেওয়া উচিত নয় যে বিষয়টিকে লাইবৃনিজের ধারণাপ্রসূত কারণের সত্যকে ঘটনার সত্য (truth of fact) বলা হেয়ে থাকে। যেহেতু লাইবৃনিজের জন্যই বিষয়টি পরবর্তী সময় কেবলমাত্র বিশ্লেষণমূলক বচনে (analytical proposition) পর্যবসিত হয়। মনে হত পারে যে লাইবনিজের ঘটনার সত্যসমূহ শেষে কারণের সত্যসমূহের আকারে এসে ঠেকে, অর্থাৎ বিশ্লেষণমূলক বচনে (analytical proposition) উপনীত হয়, অন্তত একজন সর্বজ্ঞ মনের (omnis-cient mind) কাছে। অতএব, তার সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। কেবলমাত্র একটি বিষয়ের জন্যই এটি স্বাধীনতার (freedom) অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আমি লাইনিজের সমগ্র দর্শনটিকে সমর্থন করতে চাই না। তবে অনিশ্চয়তা থেকে প্রয়োজনীয় সত্তা পর্যন্ত তার সেইসব যুক্তি আমি ব্যবহার করে থাকি যেগুলি যথার্থ কারণের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কারণ, আমার মনে হয় এইসব যুক্তি এমন একটি সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার সাধারণ সূত্রাকারে প্রকাশ যা আমার মতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সমর্থনে একটি মৌলিক অধিবিদ্যাগত বিষয়।


রাসেল : কিন্তু আমার মনের কাছে একটি প্রয়োজনীয় বচন’ অবশ্যই বিশ্লেষণমূলক হবে। এটা অবশ্যই অন্য কোন অর্থ বোঝাবে বলে আমার মনে হয় না। বিশ্লেষণমূলক বচন সর্বদাই জটিল হয়ে থাকে এবং কিছুটা পরে যুক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিচারশক্তিশূন্য পশুও পশু’ বচনটি একটি বিশ্লেষণমূলক বচন, কিন্তু এটি হয় একটি পশু এমন বচন কখনই বিশ্লেষণমূলক হতে পারে না। বস্তুত, সমস্ত বচন যেগুলি বিশ্লেষণমূলক হতে পারে সেগুলো গঠিত হতে কিছুটা সময় নেয়।


কপলেস্টোন : এ-রকম একটি বচনকে নেওয়া যাক যদি অনিশ্চিত কোন সত্তা থাকে তবে প্রয়োজনীয় সত্তা আছে। আমি মনে করি, যে-বচনটিকে অনুমানসিদ্ধ ভাবে প্রকাশ করা হল তা একটি প্রয়োজনীয় বচন। যদি আপনি প্রতিটি প্রয়োজনীয় বচনকে একটি বিশ্লেষণমূলক বচন বলতে যান, তবে পরিভাষাগত বিবাদ এড়াতে আমি বচনটিকে বিশ্লেষণমূলক বচন হিসেবে মেনে নেব, যদিও আমি বচনটিকে পুনরুক্তিগত বচন (tautolgical proposition) হিসেবে বিবেচনা করব না। কিন্তু অনিশ্চিত একটি সত্তা আছে এই অনুমানের উপর বচনটি একটি প্রয়োজনীয় বচন। যে-অনিশ্চিত সত্তাটি কার্যত বিদ্যমান তাকে অভিজ্ঞতার দ্বারা অবশ্যই আবিষ্কৃত হতে হবে। একটি অনিশ্চিত সত্তা আছে, এইরকম বচন কখনই বিশ্লেষণমূলক বচন হতে পারে না। যদিও আপনি জানেন, আমার এ কথা বলা উচিত যে একটি অনিশ্চিত সত্তা আছে এবং যা অনুসরণ করে এমন এক প্রয়োজনীয়তাকে যাকে অনুসরণ করে ধরে নিতে হয় একটি প্রয়োজনীয় সত্তা আছে।


রাসেল : এই বিষয়ে যে বাধাটি আছে তা হল যে আমি প্রয়োজনীয় সত্তার ধারণাটিকে স্বীকার করি না। আমি স্বীকার করি না অন্য সত্তাকে ‘অনিশ্চিত বলে ভাবার মধ্যে কোন বিশেষ অর্থ আছে। এইসব শব্দগুচ্ছগুলি আমার কাছে কোন তাৎপর্যমূলক বিষয় নয় একমাত্র সেই যুক্তির মধ্যে ছাড়া যে যুক্তিটিকে আমি বাতিল করেছি।


কপলেস্টোন : আপনি কি এই বোঝাতে চাইছেন যে আপনি এই পদগুলিকে বাতিল করেন এই কারণে যে সেগুলো সেই তর্কবিদ্যার সঙ্গে মানানসই হবে না যাকে ‘আধুনিক তর্কবিদ্যা’ বলা হয়ে থাকে?


রাসেল : পদগুলোর ঠিক কি অর্থ তা আমি বুঝতে পারি না। যেমন ‘প্রয়োজনীয় এ পদটি আমার মনে হয় একটি অনর্থক শব্দ। একমাত্র যখন শব্দটি বিশ্লেষণমূলক বচনে প্রয়োগ হয় তখন মানতে পারি, কিন্তু যখন বস্তুসমূহের (things) প্রতি প্রয়োগ হয় তখন আমার কাছে তা অনর্থক বলে মনে হয়।


কপলেস্টোন : প্রথমেই আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করব আধুনিক তর্কবিদ্যা’ বলতে আপনি কি বোঝেন? যতদূর আমি জানি পৃথক ব্যবস্থাসমূহ (differing system) বলতে কিছু আছে। দ্বিতীয়ত, কখনই সমস্ত আধুনিক তর্কবিদ অধিবিদ্যার অর্থহীনতাকে নিশ্চিতভাবে স্বীকার করে নেবেন না। যে-কোনভাবেই হোক আমরা উভয়ই জানি যে এমন একজন বিখ্যাত আধুনিক চিন্তাবিদ আছেন যার আধুনিক তর্কবিদ্যার উপর জ্ঞান সুগভীর কিন্তু যিনি অবশ্যই অধিবিদ্যাকে অর্থহীন বলে ভাবেননি অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তিনি ঈশ্বরের সমস্যাকে (problem of God) অনর্থক এমন ভাবেননি। আবার বলা যায় যদি সমস্ত আধুনিক তর্কবিদরা অধিবিদ্যাকে অর্থহীন মনে করেন তাহলেও এটা মনে করার কোন মানে নেই যে তারা সবাই সঠিক। অধিবিদ্যাগত পদসমূহ অর্থহীন এই বচনটি আমার কাছে এমন একটি বচন যা নির্ভর করে আছে অনুমিত বা কাল্পনিক দর্শনের উপর। এর পেছনে যে গোঁড়ামিটা কাজ করে তা হল যা আমার মস্তিষ্কে ঢোকে না তাই অ-বিদ্যমান (non-existent), অথবা তা অর্থহীন কিংবা এটি একটি আবেগমূলক ভাবে প্রকাশ। আমি সহজভাবে এটাই বলতে চাইছি যে, যারা বলেন আধুনিক তর্কবিদ্যার একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা যে কোন অর্থ (mean ing) বোঝাবার একমাত্র মানদণ্ড তারা আরও বেশি গোঁয়ার। তারা গোঁয়ার্তুমি করে দর্শনের একটি অংশকে দর্শনের সমগ্র অংশ রূপে চালাতে চাইছে। সর্বোপরি, একটি ‘অনিশ্চিত’ (Contingent) সত্তা এমন একটি সত্তা যার নিজের মধ্যেই নিজের সত্তার কোন কারণ নেই, অনিশ্চিত সত্তা বলতে আমি এ রকমই বোঝাতে চাই। আমার মতো আপনিও জানেন যে আমাদের বাইরে অবস্থিত কোন কিছু বা কারুর স্বীকৃতির দ্বারা আমাদের অস্তিত্বের কোন ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা পিতামাতার কথা বলতে পারি। অন্যদিকে একটি প্রয়োজনীয় সত্তা বলতে বোঝায় এমন একটি সত্তা যা কখনই অ-বিদ্যমান’ (not-exist) হতে পারে না। আপনি বলতেই পারেন যে এ রকম কোন সত্তা নেই, কিন্তু এ বিষয়ে আপনি আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে পদসমূহ আমি ব্যবহার করছি তা আপনি বোঝেন না। যদি আপনি সেইসব পদসমূহকে না বোঝেন, তা হলে কেমনভাবে আপনি বলতে পারেন যে এ রকম কোন সত্তা নেই, যদি এই হয় তবে আপনি কি বলবেন?


রাসেল : দেখুন, অনেকগুলো দিক থেকেই এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় কিন্তু আমি সেগুলোর ভেতর ঢোকার কোন প্রস্তাব করছি না। সাধারণভাবে কখনই আমি অধিবিদ্যার অর্থহীন ব্যাপার সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাব না। আমি আলোচনা করব বিশেষ বিশেষ কিছু পদসমূহের অর্থহীনতার সম্পর্কে, কেননা সেই সমস্ত পদসমূহের কোন ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কোন সাধারণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সেগুলোকে আলোচনা করব না। এটা কোন সাধারণ মতো নয়– এটা একটা বিশেষ বস্তু (thing), কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য সেইসব দিকগুলোর সম্পর্কে আমি আলোচনা বন্ধ রাখবো এবং আমি বলবো যে যা এতক্ষণ ধরে আপনি বলেছেন আমার মনে হয় তা আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো সেই তাত্ত্বিক (ontological) বিষয়ের দিকে যে, এমন একটি সত্তা আছে যার সারসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব, তাই তার অস্তিত্ব বিশ্লেষণমূলক। কিন্তু আমার মনে হয় এটা অসম্ভব, কারণ এর ফলে যে প্রশ্নটা সামনে আসে তা হল অস্তিত্ব বলতে একজন কি বোঝে এবং এই বিষয়ে আমি মনে করি একটি নামাঙ্কিত কর্তাকে (subject) কখনই তাৎপর্যমূলকভাবে বিদ্যমান বলা যেতে পারে না কিন্তু বর্ণিত (described) কর্তাকে বিদ্যমান বলা যেতে পারে এবং সেই অস্তিত্ব কখনই বিধেয় (predicate) নয়।


কপলেস্টোন : আমি মনে করি আপনি বলতে চাইছেন যে এটি একটি ভুল ব্যাকরণ অথবা বলার ক্ষেত্রে একটি বাজে পদ-বিন্যাস, উদাহরণস্বরূপ, টি. এস. এলিয়ট বিদ্যমান আছেন’, উদাহরণরূপে, একজন বলতে পারেন মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রাল-এর লেখক, বিদ্যমান আছেন। আপনি কি বলতে চাইছেন জগতের কারণের অস্তিত্ব আছে এই ধরণের বচন অর্থহীন? আপনি বলতে পারেন যে জগতের কোন কারণ নেই, কিন্তু আমি এটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কেমনভাবে আপনি বলতে পারেন যে ‘জগতের কারণ আছে’ এই রকম বচন অর্থহীন? বচনটিকে প্রশ্নাকারে রাখুন যেমন, ‘জগতের কি কোন কারণ আছে, অথবা জগতের অস্তিত্বের কোন কারণ কাজ করে কি? বেশিরভাগ মানুষই এ ধরণের প্রশ্নকে অবশ্যই বুঝবে, যদি তারা উত্তর সম্পর্কে একমত না-ও হয়।


রাসেল : জগতের অস্তিত্বের কোন কারণ কাজ করে কি?’ এই ধরণের প্রশ্নের অর্থ আছে বই কি। কিন্তু যদি আপনি বলেন হ্যাঁ, ঈশ্বরই জগতের কারণ’ তাহলে আপনি ঈশ্বরকে নামবাচক বিশেষ্য বা একটি নির্দিষ্ট নামে (proper name) ব্যবহার করছেন। তাই ‘ঈশ্বর বিদ্যমান আছেন এই ধরণের বাক্য কখনই এমন একটি বিবৃতি হয়ে উঠতে পারে না যার একটি মানে আছে– ঠিক এই কথাটিই আমি বলতে চাইছি। কারণ এইজন্যই বলা যেতে পারে যে এ ধরণের বাক্য কখনই বিশ্লেষণমূলক বচন হতে পারে না যদি আমরা বলি যে এটা বা ওটা বিদ্যমান আছে। উদাহরণরূপে মনে করুন যে আপনি একটি কর্তাকে নিতে পারেন যেমন বিদ্যমান গোলাকার-চৌকোণ,’ এটাকে একটি বিশ্লেষণমূলক বচনের মতো লাগলেও তা বিদ্যমান নয়।


কলেস্টোন :না, তা নয়। অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা আপনার না থাকলে আপনি কখনই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না যে এটি বিদ্যমান নয়। যেমন ধরুন ‘গোলাকার-চৌকোণের অস্তিত্ব’, আমি অবশ্যই বলব এর কোন মানে নেই।


রাসেল : আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। প্রয়োজনীয় সত্তা’ প্রসঙ্গে আমি ওই একই কথা বলব।


কপলেস্টোন : আমার মনে হয় আমরা একটা কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। প্রয়োজনীয় সত্তা এমন একটি সত্তা যে অবশ্যই বিদ্যমান আছে অথবা বিদ্যমান। থাকতে পারে না– এই ধরণের বচন আমার কাছে একটি নির্দিষ্ট মানে রাখে। কিন্তু আপনার কাছে এর কোন অর্থ নেই।


রাসেল : আমরা বিষয়টির উপর একটু চাপ দিতে পারি। আপনার মত অনুযায়ী একটি সত্তা যা অবশ্যই বিদ্যমান এবং বিদ্যমান থাকতে পারে না, অবশ্যই এমন একটি সত্তা হবে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, এটি এমন একটি সত্তা যার সারসত্তাকে অবশ্যই বিদ্যমান থাকতে হবে। কিন্তু কেবলমাত্র ঈশ্বরের সারসত্তার (essence) ধারণা থেকে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ইচ্ছুক নই। কারণ এখনো পর্যন্ত ঈশ্বর সম্পর্কে কোন পরিষ্কার সজ্ঞা (intuition) আমাদের আছে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি অভিজ্ঞতার জগতের দ্বারাই আমাদের ঈশ্বরের বিষয়ে তর্ক চালাতে হবে।


রাসেল : হ্যাঁ, পার্থক্যটি আমি পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারছি। কিন্তু একই সঙ্গে একটি সত্তা সম্পর্কে যার যথেষ্ট জ্ঞান আছে তার পক্ষেই এটা বলা সত্য হবে ‘এখানে এই সত্তাটি আছে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব!


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, যদি কেউ ঈশ্বরকে দেখত তবে অবশ্যই সে বুঝতে পারত যে ঈশ্বর অবশ্যই বিদ্যমান।


রাসেল : অতএব আমি বলতে চাই যে এমন একটি সত্তা আছে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব, যদিও আমরা সেই সারসত্তাকেই জানি না।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, আমি এর সঙ্গে আরও যোগ করব যে আমরা পূর্বকল্পিত ধারণা হিসেবে সারসত্তাকে জানি না। আমাদের অভিজ্ঞতায় কেবলমাত্র একটি পশ্চাদ্বতী কল্পনা যার দ্বারা আমরা সত্তার অস্তিত্ব বিষয়ক জ্ঞানে আসতে পারব এবং তারপর কেউ প্রমাণ করতেই পারে যে সারসত্তা এবং অস্তিত্ব অভিন্ন। কারণ ঈশ্বরের সারসত্তা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি অভিন্ন না হত তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যেই ঈশ্বরের বাইরে অন্য কোন যথার্থ কারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ত।


রাসেল : এবার যথেষ্ট কারণের দিকে সমগ্র বিষয়টি ঘুরে গেল এবং আমি অবশ্যই বলব যে যথেষ্ট কারণ সম্পর্কে আপনি এমনভাবে ব্যাখ্যা করেননি যাতে আমি বুঝতে পারি আপনি যথেষ্ট কারণ বলতে ঠিক কি বোঝেন? আপনি কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি বোধহয়?


কপলেস্টোন : কখনই নয়। কারণ (cause) হল এক ধরনের যথেষ্ট কারণ (sufficient reason)। একমাত্র অনিশ্চিত সত্তার একটি কারণ থাকতে পারে। ঈশ্বর তাঁর নিজের জন্য যথেষ্ট কারণ এবং তিনি নিজেই তার কারণ (cause) নন। যথেষ্ট কারণ বলতে আমি বোঝাতে চাই কোন বিশেষ সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুরূপ বা পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার কথা।


রাসেল : কিন্তু ঠিক কখন একটি ব্যাখ্যা অনুরূপ বা পর্যাপ্ত হতে পারবে? ধরুন আমি একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন ধরাতে উদ্যোগী। আপনি বলতে পারেন যে এর জন্য অনুরূপ যে ব্যাখ্যাটি হবে তা হল আমি দেশলাই কাঠিটিকে দেশলাই বাক্সের উপরে ঘষবো।


কপলেস্টোন : বাস্তব উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে এটি ভালো কথা কিন্তু তত্ত্বগত দিক দিয়ে এটা একটি আংশিক ব্যাখ্যা। একটি অনুরূপ বা পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হল সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা। যার সঙ্গে আর কোন কিছুই নতুন করে যোগ করা সম্ভব নয়।


রাসেল : তা হলে আমি বলতে পারি যে আপনি তাকিয়ে আছেন এমন কিছুর দিকে যেটি কখনই পাওয়া যেতে পারে না এবং যাকে কারুর পাবার আশা করাও উচিত নয়।


কপলেস্টোন : একজন এটা দেখেনি বলতে এক জিনিস বোঝায়, কিন্তু একজনের এটা দেখা উচিত নয় বলাটা আমার কাছে গোঁড়ামি মনে হয়।


রাসেল : হতে পারে, তবে আমি জানি না। আমি বলতে চাই একটি বস্তুর ব্যাখ্যা হল একটি অন্য বস্তু যা দ্বিতীয় বস্তুর উপর নির্ভরশীল করে তোলে। আপনি যা করতে চাইছেন তার জন্য আপনাকে একটি দুঃখজনক পথ অবলম্বন করতে হবে যা আমরা করতে পারি না।


কপলেস্টোন : আমাদের বস্তুসকলের দুঃখজনক নকশা (Scheme) সম্পর্কে কিংবা সমগ্র বিশ্বের দুঃখজনক নকশা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই কি আমাদের তোলা উচিত নয়?


রাসেল : হ্যাঁ, আমি মনে করি না এধরণের প্রশ্ন করার মধ্যে কোন রকম অর্থ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ব’ (universe) শব্দটিকে আমার সুবিধাজনক শব্দ হিসেবে মনে হয়, কিন্তু আমি মনে করি না কোন কিছুর স্বপক্ষে এই শব্দটি বসালেই তার একটি অর্থ হয়ে যাবে।


কপলেস্টোন : যদি শব্দটি অর্থহীন হয় তা হলে সেটিকে ব্যবহার করাটা খুব সুবিধাজনক হতে পারে না। কোন ক্ষেত্রেই আমি বলি না যে বিশ্বটি সেই বস্তুসমূহের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র যে বস্তুসমূহ তাকে গঠন করেছে। (প্রমাণের সংক্ষিপ্ত সারাংশে আমি যার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম) যা কিছু আমি করছি তা কারণকে খোঁজার জন্যই করছি। এই ব্যাপারে বস্তুসকলের কারণ একটি বাস্তব বা কল্পিত সমগ্রতা (totality) যা গঠন করেছে তাকে যাকে আমরা বিশ্ব বলে ডেকে থাকি। এই বিশ্ব অথবা যদি আপনি পছন্দ করেন তবে বলব আমার অস্তিত্ব, কিংবা অন্য যে-কোন অস্তিত্বকে আপনি কি অবোধগম্য বলে মনে করেন?


রাসেল : আমি কি এই প্রশ্ন করতে পারি যে যদি একটি শব্দ অর্থহীন হয় তবে কি তা সুবিধার্থে ব্যবহারযোগ্য (Handy) হতে পারে না? যে শব্দটি শুনতে ভালো কিন্তু বাস্তবে বেঠিক। যেমন ‘The’ অথবা ‘Then’-এর মতো শব্দকেই ধরুন। এই শব্দ দুটি কোন বস্তুকে নির্দেশ করে না, কিন্তু এই শব্দ দুটি যথেষ্ট দরকারি শব্দ। আমি মনে করি ‘বিশ্ব’ (Unvierse) শব্দটিও তাই। কিন্তু এই বিষয়টিকে ছেড়ে যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন বিশ্ব’ শব্দটিকে আমি অবোধগম্য ভাবি কি না, তবে আমি বলব যে আমি মনে করি ‘বিশ্ব’টি অবোধগম্য। –আমি এটাও মনে করি যে এর কোন ব্যাখ্যা হয় না। আমার মতে বোধগম্য শব্দটি একটি অন্য জিনিস। বোধগম্যতা নিজেই বস্তুর সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে কাজ করতে বাধ্য থাকে কিন্তু তার সম্পর্কসমূহের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য থাকে না ।


কপলেস্টোন : আমি যা বলতে চাই তা হল ঈশ্বরের থেকে বিচ্ছিন্ন জগৎ অত্যাবশ্যকভাবে অবোধগম্য। আপনি জানেন আমি বিশ্বাস করি না অনন্তবাচক ধারাবাহিক ঘটনাসমূহ বা তার অনুভূমিক ধারাবাহিকতাকে যদি এই ধরণের ধরাবাহিকতাকে অনন্ত ঘটনাসমূহে প্রমাণ করা যেত তবে তা অবস্থার (situation) সঙ্গে কিছুটা হলেও সঙ্গতিকর হত। যদি আপনি চকোলেটকে যুক্ত করেন তবে আপন চকোলেটকেই পাবেন, কখনই ভেড়াকে পাবেন না। যদি আপনি অনন্তের সঙ্গে চকোলেটকে যুক্ত করতেন তবে আপনি আনুমানিকভাবে অনন্ত সংখ্যা চকোলেট পেতেন। তাই যদি আপনি অনিশ্চিত সত্তার সঙ্গে অনন্তকে যুক্ত করেন তবুও অনিশ্চিত সত্তাকেই পাবেন কখনও প্রয়োজনীয় সত্তাকে পাবেন না। আমার ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী অনিশ্চিত সত্তাসমূহের অনন্ত ধারাবাহিকতা একটি অনিশ্চিত সত্তার মতোই নিজেই নিজেকে ঘটাতে অসমর্থ (বা নিজেই নিজের কারণ হতে অসমর্থ অনুবাদক) যদিও আমি মনে করি যে আপনি বলবেন কোন বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবে কে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাটা অবৈধ?


রাসেল : যদি এটিকে ব্যাখ্যা করে আপনি এটাই বোঝান তবে তা সর্বৈব সঠিক, কেননা আপনি এর একটি কারণ অনুসন্ধান করেছেন।


কপলেস্টোন : যদি তাই হয় তবে একটি বিশেষ বস্তুর বেলায় থামব কেন? কেন সমস্ত বিশেষ বস্তুসমূহের অস্তিত্বের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়?


রাসেল : কারণ আমার মনে হয় চিন্তা করবার মতো কোন যুক্তি (reason) নেই। কারণের (cause) সমগ্র ধারণাটি এমন একটি ধারণা যা আমরা বিশেষ বস্তুসমূহের পর্যবেক্ষণ থেকে পেয়ে থাকি। সমগ্র বস্তুসমূহের কোন রকম কারণ আছে, এরকম যুক্তি কোন রকম ভাবে সঙ্গতিকর বলে আমি মনে করি না।


কপলেস্টোন : যদি তাই হয়, তাহলে বলা যায় যে কারণ বলে কিছু নেই বিবৃতিটি আমাদের কোন কারণ অনুসন্ধান করা উচিত নয় বিবৃতিটির মতো একরকম নয়। কারণ বলে কিছু নেই তখনই বলা যাবে (যদি কখনও বলা যায়) যখন অনুসন্ধান শেষ হবে, কিন্তু অনুসন্ধান শুরুর সময় এ ধরনের বিবৃতি দেওয়া যায় না। যে-কোন ক্ষেত্রে, যদি সমগ্রের কোন কারণ না থাকে, তাহলে আমার চিন্তাধারা অনুযায়ী তার অবশ্যই নিজের একটি কারণ আছে। যা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়। অধিকন্তু যদি একটি প্রশ্নের উত্তরে এটা বলা যায় যে জগৎ বলে কিছু একটা আছে তবে স্বীকার করে নেওয়া যায় যে প্রশ্নটির অর্থ আছে।


রাসেল : না, এর নিজের কোন কারণের প্রয়োজন নেই। আমি যা বলছি তা হল কারণের কল্পনাকে সমগ্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না।


কপলেস্টোন : তাহলে সারত্রের সঙ্গে আপনি একমত হবেন যে, বিশ্ব হল তাই যাকে তিনি ‘অকারণ’ (gratuitous) বলেছেন?


রাসেল : ‘অকারণ’ (gratuitous) যে ধরণের অর্থ বহন করে তা বোধহয় অন্য কোন অর্থ। আমি বলি যে বিশ্বটা বিশ্বই এবং এটাই সব।


কপলেস্টোন : আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে সমগ্র (total) অথবা যে-কোন কিছু যা এখানে আছে সে সম্পর্কে কোন বৈধতা মেনেই আপনি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। কেন কিছুই না থাকার থেকে কিছু থাকা ভালো–এটা প্রশ্ন? ঘটনাটি হল যে বিশেষ কারণ থেকে আমরা যে আকস্মিকতার জ্ঞান (Knowledge of casuality) অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবে পেয়ে থাকি তা ধারাবাহিকতার কারণ কি এই জিজ্ঞাসার সম্ভাবনাকে অবৈধ করে তোলে না। যদি কারণ’ (Cause) শব্দটি অর্থহীন হয় অথবা জড়বস্তু (Matter) সম্পর্কে কারেন্টর দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক বলে দেখানো যেতে পারত তবে আমি মেনে নিতাম যে প্রশ্ন করাটি অবৈধ হবে, কিন্তু আপনি কারণ’ শব্দটিকে অর্থহীন বলে ধরতে চান না এবং আমি এ-ও মনে করি না যে আপনি একজন কান্টীয় (Kantian)।


রাসেল : আপনার হেত্বাভাস বা দোষ (Fallacy) আমার কাছে কিরকম মনে হয় তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। বিদ্যমান প্রতিটি মানুষের একটি মা আছে এবং আপনার যুক্তিটি আমার কাছে এরকম মনে হয় যে এইজন্যই মানবজাতির একটি মা আছে, কিন্তু মানবজাতির অবশ্যই কোন মা নেই– এটা তর্কবিদ্যার ভিন্ন। ক্ষেত্র।


কপলেস্টোন : এর মধ্যে কোন সমতা দেখতে পাচ্ছি না। যদি আমি বলতাম ‘প্রতিটি বস্তুর একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ (Phenomenal cause) আছে, তাই সমগ্র শ্রেণীর (Whole series) একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ আছে, তবে সেখানে একটি সমতা থাকত, কিন্তু আমি তা বলছি না। আমি বলছি, প্রতিটি বস্তুর একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ আছে, যদি আপনি অনন্ত ধারাবাহিকতার (Infinit series) উপর জোর দেন কিন্তু বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণসমূহের ধারাবাহিকতা, ধারাবাহিকতার সম্পর্কে একটি অপর্যাপ্ত ব্যাখ্যা। এইজন্য ধারাবাহিকতার কোন বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ নেই কিন্তু তার অজ্ঞেয় কারণ (Transcendent cause) আছে।


রাসেল : এটাই সর্বদা ধরে নেওয়া হয় যে কেবলমাত্র প্রতিটি বস্তুই নয়, সামগ্রিকভাবে সমগ্র জগতেরও একটি কারণ আছে। কিন্তু এই ধারনার কোন ভিত্তি আমি দেখতে পাই না। তবে যদি আপনি এই ভিত্তির উপর আমাকে কিছু বলেন তবে আমি শুনবো।


কপলেস্টোন : ঘটনাসমূহের শ্রেণী হয় কারণগত অথবা কারণগত নয়। যদি এটি কারণগত হয়, তবে শ্রেণীর বাইরে কোন কারণ অবশ্যই থাকবে। যদি এটি কারণগত না হয় তবে তা নিজেই নিজের পর্যাপ্ত কারণ যাকে আমি প্রয়োজনীয় বলে থাকি। কিন্তু এটি কখনও প্রয়োজনীয় হতে পারে না যেহেতু প্রতিটি সদস্যই অনিশ্চিত এবং আমরা এ বিষয়টি মেনেই নিয়েছি যে সমগ্রের কোন বাস্তবতা নেই। এইজন্যই এটি কখনই প্রয়োজনীয় হতে পারে না অথবা অকারণগতও হতে পারে না তাই এর অবশ্যই কোন কারণ আছে। আমি বলতে চাই, বিশ্বটা কেবল আছেই এবং তা ‘অনির্বচনীয়’–এই ধরণের বিবৃতি কখনও যুক্তিগত বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায় না।


রাসেল : এই বিষয়ে আমি উদ্ধত হতে চাই না, কিন্তু আমি বলতে পারি যে আমি সেইসব বস্তুসমূহকে কল্পনা করতে পারি যে বস্তুসমূহ আপনার মতে মানবমন কল্পনা করতে পারে না। বস্তুসমূহের কোন কারণ নেই তা পদার্থবিদরা আমাদের নিশ্চিত করে দেখিয়েছেন এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে পরমাণুর মধ্যে প্রতিটি কোয়ান্টামের স্থানান্তরণের (Individual quantum transition in atom) কোন কারণ নেই।


কপলেস্টোন : এই বিষয়টি একটি অস্থায়ী অনুমান কিনা সে বিষয়ে আমি বিস্ময় বোধ করছি।


রাসেল : তা হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি এই সত্য প্রদর্শন করছে যে পদার্থবিদদের মন একে কল্পনা করতে পারে।


কপলেস্টোন : আমি স্বীকার করি কিছু বিজ্ঞানী পদার্থবিদরা একটি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যে প্রত্যয়হীনতার (Indetermination) বিষয়টি বাদ দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীরা এরকম করতে ইচ্ছুক নন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডিঙ্গল এই মত পোষণ করেন যে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব আপেক্ষিক পর্যবেক্ষণ (Correalting observation) বর্তমান পারমাণবিক তত্ত্বের সফলতা (অথবা অসফলতা) সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাতে পেরেছে কিন্তু প্রকৃতির সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি। অনেক বৈজ্ঞানিক এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। আমি এটাই বুঝে উঠতে পারি না কিভাবে যে-কোন ব্যাপারে পদার্থবিদরা তত্ত্বকে বাস্তব ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন অথচ তারা তত্ত্ব গঠনের ক্ষেত্রে এরকম করেন না। আমি বুঝতে পারি না প্রকৃতিতে যে বোধগম্যতা (Intelligibility) এবং শৃঙ্খল (Order) আছে তার চেয়ে অন্য অনুমানের উপর কিভাবে বিজ্ঞানকে পরিচালিত করা যেতে পারে। পদার্থবিদরা নীরবতার সঙ্গে পূর্বেই মেনে নেন যে অনুসন্ধানমূলক প্রকৃতির মধ্যে এবং ঘটনাসমূহের কারণসমূহকে খোঁজার মধ্যে কিছু অর্থ আছে, ঠিক যে-রকমভাবে একজন গোয়েন্দা পূর্বে মেনে নেয় যে খুনীকে খুঁজে বার করাটার মধ্যে একটা অর্থ আছে। অধিবিদ্যাবিদরা ধরে নেন যে সরাসরি ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু বা বিষয়ের কারণ অথবা যুক্তিকে খোঁজার মধ্যে একটা অর্থ আছে। একজন কান্টীয় না হয়ে আমি মনে করি যে একজন অধিবিদ্যাবিদ অনুমানের ক্ষেত্রে একজন পদার্থবিদের মতোই ন্যায় সংগত। উদাহরণস্বরূপ, যখন সারত্রে বলেন যে জগৎটি অকারণ তখন আমি মনে করি তিনি অকারণ’ বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন সে বিষয়ে পর্যাপ্ত বিবেচনা করেননি।


রাসেল : এখানে একটি বিশেষ অনধিকার চর্চা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। একজন পদার্থবিদ কারণের অনুসন্ধান করেন, এবং তা অনিবার্যভাবে এই অর্থ প্রকাশ করে যে সর্বত্রই কারণ সমূহের অস্তিত্ব আছে। যে-মানুষটি সোনার খোঁজ করছে সে এই ভেবে সোনার খোঁজ করছে না যে সোনা সর্বত্রই আছে। এই একই কথা পদার্থবিদের ক্ষেত্রেও সত্য যখন তিনি কারণসমূহের অনুসন্ধান করেন। সারত্রের কথাই ধরুন। তিনি কি বলতে চেয়েছেন তা আমি জানি বলে স্বীকার করি না, কিন্তু আমার এরকম মনোভাব রাখা উচিত নয় যে তাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। আমার দিক থেকে আমি মনে করি যে জগতের খেয়ালের (Otion of the world) একটি ব্যাখ্যা আছে এরকম মনে করাটা একটা ভুল। আমি বুঝি না কেন একজন এইরকম ব্যাখ্যা পাবার আশা করে থাকে এবং আমি মনে করি আপনি বিজ্ঞানীদের অনুমানকে কেন্দ্র করে যা বললেন তা একটি অতিবিবৃতি।


কপলেস্টোন : আমার মনে হয় বিজ্ঞানীরা এই ধরণের অনুমান গঠন করেন। যখন একটি বিশেষ সত্তাকে বার করতে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান, তখন সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার পেছনে একটি অনুমান নিহিত থাকে যে বিশ্বটি কোন অবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে একটি সত্যকে আবিষ্কার করার সম্ভাবনা আছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা মন্দও হতে পারে, অথবা তারা যে-ফল চান সেই অনুযায়ী না-ও হতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে একটি সত্য আবিষ্কার করার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই কারণেই আমার মনে হয় একটি শৃঙ্খলিত ও বোধগম্য বিশ্বকে অনুমান করা যায়।


রাসেল : আমার মনে হয় আপনি যতটা প্রয়োজনীয় তার থেকে বিষয়টিকে বেশি সাধারণ করে তুলেছেন। নিঃসন্দেহে একজন বিজ্ঞানী অনুমান করতে পারেন যে কোন বস্তুকে বা সত্যকে হয়ত বার করা যাবে এবং প্রায় সে-রকমই বার হবে। কিন্তু তিনি এইরকম অনুমান করেন না যে সেটাই বার হবে। এটাই আধুনিক পদার্থবিদ্যার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


কপলেস্টোন : আমি মনে করি বিজ্ঞানী তার কাজ করতে করতে অনুমান করেন অথবা অনুমান করতে বাধ্য থাকেন। অধ্যাপক হালডেনকে উদ্ধৃত করে এটাও বলা যায়, যখন আমি কেটলীর নীচে গ্যাস জ্বালালাম তখন জলের কিছু অণু বাষ্প হয়ে উড়ে গেল, কিন্তু কে এই কাজটা করছে তা দেখবার কোন পথ নেই। তা বলে সম্ভাবনার ধারণাকে (Idea of change) সর্বত্র ব্যবহার করা যাবে কেবলমাত্র আমাদের যেখানে জ্ঞান আছে সেখানে ছাড়া এই ধরণের ধারণাকে কখনই তিনি অনুসরণ করতে বলেননি।


রাসেল : না, তা অবশ্যই নয় অন্তত তিনি যা বলেছেন তা যদি আমি করতে পারি। তিনি বহু বস্তুকেই খুঁজে বার করেছেন। বিজ্ঞানীরা জগতে যা কিছু ঘটছে তার অনেক কিছুই খুঁজে বার করছেন, সর্বপ্রথমে যেগুলো সাময়িক শৃঙ্খলসমূহকে (Casual chains) শুরু করেছে। প্রথম কারণগুলি এমন যে কারণসমূহের নিজেদেরই কোন কারণ নেই। তিনি মনে করেন না যে প্রতিটি বস্তুর একটি কারণ আছে।


কপলেস্টোন : নিশ্চয়ই সেগুলো বিশেষ নির্বাচিত ক্ষেত্রের মধ্যে স্থিত প্রথম কারণ (First cause), কিন্তু আপেক্ষিকভাবে প্রথম কারণ।


রাসেল : আমি মনে করি না যে তিনি এ ধরণের কথা বলবেন। যদি এটি এমন একট জগৎ হয় যেখানে সব ঘটনা না হলেও বেশিরভাগ ঘটনার কারণ আছে, তাহলে তিনি অনুমানের দ্বারা সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তাকে বর্ণনা করতে সক্ষম হবেন যে আপনি যে বিশেষ ঘটনাটির সম্পর্কে উৎসাহিত তার সম্ভবত একটি কারণ আছে। যে-কোন ব্যাপারেই আপনি সম্ভাবনার চেয়ে বেশি কিছু পাবেন না। এবং সেটাই যথেষ্ট।


কপলেস্টোন : এটাও হতে পারে বিজ্ঞানী সম্ভাবনার (Probability) চেয়ে বেশি কিছু অর্জন আশা করতে পারে না, কিন্তু প্রশ্নের অবতারণা করে তিনি অনুমান করেন যে ব্যাখ্যা সম্পর্কিত প্রশ্নের একটি অর্থ আছে। কিন্তু মহানুভব রাসেল, আপনার বিষয়টি কি তাই যে জগৎ সম্পর্কে কোন রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাটাও একটা অবৈধ ব্যাপার?


রাসেল : হ্যাঁ, আমি এমন মতই পোষণ করে থাকি।


কপলেস্টোন : যদি এটা এমন একটি প্রশ্ন হয় যার কোন অর্থ আপনার কাছে নেই, তাহলে তার সম্পর্কে আলোচনা করাটাও দুষ্কর হয়ে উঠবে, তাই নয় কি?


রাসেল : হ্যাঁ, এটা খুবই দুষ্কর। আপনি কি বলেন আমরা কি অন্য কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করতে পারি?


ধর্মীয় অভিজ্ঞতা


কপলেস্টোন : আসুন আলোচনা করা যাক। সম্ভবত আমি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি কথা বলতে পারি এবং তারপর আমরা নৈতিক অভিজ্ঞতার উপর আলোচনা চালাতে পারি। আমি মনে করি না ধর্মীয় অভিজ্ঞতার অর্থ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত দৃঢ় প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং আলোচনার চরিত্রটির কিছুটা পরিবর্তন হল। আমার মতে এ বলাটা সত্য হবে যে এর সব থেকে উত্তম ব্যাখ্যাটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বলতে আমি কেবল মঙ্গলজনক অনুভবকে বোঝাতে চাইছি না। আমি বোঝাতে চাইছি বস্তু সম্পর্কে একটি প্রেমময় অথচ অপরিচ্ছন্ন সচেতনতাকে যা অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর কাছে নিজ আত্মার এক ধরণের তুরীয় ভাব। এটি এমন এক ভাব যাকে চিত্রিত করা যায় না অথবা কল্পনা করা যায় না, কিন্তু যার বাস্তবতা সম্পর্কেও কোন সন্দেহ করা অসম্ভব অন্তত অভিজ্ঞতা অর্জন করার সময় কোন রকম সন্দেহ করাটা অসম্ভব। আমি দাবি করতে পারি যে তা যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব এবং মানসিকভাবে নিজের মনেই নিজে জানা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যে কোন মাত্রায় যে প্রকৃত প্রাথমিক অভিজ্ঞতা এই প্রকল্পের বা অনুমানের উপর সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় সে অভিজ্ঞতার কিছু বস্তুগত কারণ আছে।


রাসেল : এই যুক্তির উত্তরে আমি যা বলব তা হল, এই সমগ্র বিষয়টি আমাদের নিজেদের মানসিক অবস্থা থেকে জাত হয়ে আমাদের বাইরে কোন কিছুকে নির্দেশ করে। যা আমার মতে অতি চালাকির বিষয়। এমনকি যখন আমরা সবাই তার ন্যায্যতাকে স্বীকার করে নিই, এবং এইরকম করাটাকে আমরা যখন ন্যায়সংগত বলে অনুভব করি, তখনও বিষয়টিকে আমার এক ধরণের চালাকি মনে হয়। আমরা এরকম করি তার কারণ এটি মানবজাতির একরকম সংস্কার। যদি একটি ঘরে ভীড় থাকে এবং যদি সে ঘরে একটা ঘড়ি থাকে, তবে সবাই ওই ঘড়িটিকেই দেখতে পাবে। ঘটনাটি হল যে তারা সবাই ঘড়িটিকে দেখতে পাবে। এই ঘটনাটি তাদের এই চিন্তা করাবে যে এই ঘটনাটি কোন মতিভ্রম বা মায়া নয়। কিন্তু সেখানে এইসব ধর্মীয় অভিজ্ঞতাসমূহ অতি ব্যক্তিগত হবার প্রবণতাসম্পন্ন হয়।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এই রকম ঘটে। আমি যথার্থ অতীদ্রিয় অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমি কোন ভাবে এই ব্যাপারে দর্শনসমূহকে (Visions) অন্তর্ভুক্ত করছি না। আমি কেবল বোঝাতে চাইছি তুরীয় বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতাকে বা যাকে তুরীয় বস্তু (Transcendent object) বলা হয়ে থাকে তাকে। আমি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করি যে তা অবর্ণনীয়। আমার মনে আছে জুলিয়ান হাক্সলে তাঁর কোন একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন যে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, অথবা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, প্রেমে পড়া, কলা ও কাব্যকে প্রশংসা করার অভিজ্ঞতার মতোই অনেকটা। তাই আমি বিশ্বাস করি, যখন আমরা কাব্য ও কলাকে প্রশংসা করি তখন আমরা নির্দিষ্ট কোন কবিতাসমূহ ও কলা সম্পর্কীয় কর্মকে প্রশংসা করে থাকি। যদি আমরা প্রেমে পড়ি তাহলে আমরা কারুর সঙ্গে প্রেমে পড়ি, কখনই এমন প্রেমে পড়ি না যেখানে কেউ নেই।


রাসেল : কিছুক্ষণের জন্য আমি ধারাবাহিকতাকে ভাঙছি। এই বিষয়টিই যে সর্বদাই ঘটবে এরকম কোন কারণ নেই। যতক্ষণ কিছু জলজ্যান্ত মানুষ কাল্পনিক নায়িকার প্রেমে আত্মহত্যা না করছে ততক্ষণ জাপানী ঔপন্যাসিকরা মনে করেন যে তাদের সফলতা আসেনি।


কপলেস্টোন : জাপানের এই ধরণের ঘটনার পক্ষে আপনার বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমি আত্মহত্যা করিনি, কিন্তু দটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পড়ার পর আমি আমার জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। যদিও আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে আমার উপর ওই গ্রন্থ দুটির বাস্তব প্রভাব ও যথার্থ অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মধ্যে আমি কোন সাদৃশ্য দেখতে পাইনি, কেননা একজন বহিরাগত হিসেবে সেই অভিজ্ঞতার ধারণা যটা অর্জন করা যেতে পারে ততটাই আমার ছিলো।


রাসেল : আমরা অবশ্যই ঈশ্বরকে উপন্যাসের চরিত্রসমূহের কোন সত্তা হিসেবে দেখবো না। আপনি অবশ্যই স্বীকার করবেন যে এই দুটির মধ্যে একটি স্বতন্ত্রতা আছে।


কপলেস্টোন : আমি অবশ্যই তা স্বীকার করব। কিন্তু আমি একথা অবশ্য বলব যে উত্তম ব্যাখ্যা সম্ভবত হয় কোন শুদ্ধ অধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা (Subjectivisit explanation) নয়। যদিও অধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা কিছু বিশেষ মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব, যাদের ভেতর অভিজ্ঞতা ও জীবনের মধ্যে খুব কম সম্পর্কই আছে। মোহগ্রস্ত, প্রবঞ্চিত ও এমন ধরণের মানুষদের এরকমভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের মতানুযায়ী যাকে শুদ্ধ ধরনের অধ্যাত্মবাদ বলে আমরা মনে করতে পারি, তার অভিজ্ঞতা যখন আপনি পাবেন তখন তার ফল হবে গতিশীল ও সৃষ্টিশীল প্রেমের প্রবাহ। আমার মনে হয় অভিজ্ঞতার বিষয়গত কারণের (Objective cause) প্রকৃত অস্তিত্বই তার একমাত্র উত্তম ব্যাখ্যা।


রাসেল : ঈশ্বর বলে কিছু নেই এরকম কিছু নিয়ে আমি গোঁয়ারের মতো লড়াই করতে চাইছি না। যে ভাবে আমি অন্য নথিসমূহকে (Records) নিয়ে থাকি সেরকম ভাবে যা নথিভুক্ত তাকেই কেবল গ্রহণ করতে পারি। আমি জানি সেখানে অনেক কিছু সম্পর্কেই বলা হয়েছে। আমি এ বিষয়েও নিশ্চিত যে আপনি মঙ্গলকর উপদেবতা এবং অমূলক বস্তু ও শয়তান বিষয়ক বহু জিনিস সেখান থেকে গ্রহণ করবেন না যেখানে এই সমস্ত জিনিস সম্পর্কেও ওই একই প্রত্যয় ও বিশ্বাসের সঙ্গে বলা হয়েছে। একজন অতীন্দ্রিয়বাদীর দর্শন (Vision) যদি সত্যই হয় তবে শয়তান আছে এই বিষয়টিও সত্য। কিন্তু আমি শয়তান আছে বলে কিছু জানি না।


কপলেস্টোন : কিন্তু শয়তানের বিষয়ে বলতে গিয়ে মানুষ দর্শন, ভূত, দেবদূত, মঙ্গলকর উপদেবতা এবং আরও অনেক কিছুর কথা বলে থাকে। আমি কাল্পনিক ভূত ইত্যাদিকে অবশ্যই বাতিল করব, কারণ আমি মনে করি বস্তুর অস্তিত্ব ছাড়াই সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এবং যেগুলোকে দেখা যেতে পারে বলে মনে হয়।


রাসেল : কিন্তু আপনি কি জানেন না এমন প্রচুর পরিমাণ নথিভূক্ত ঘটনা আছে যেখানে মানুষ তাদের নিজেদের হৃদয়ের ভেতর থেকে শয়তানের কথা শুনেছে ঠিক সেই রকম ভাবে, যেরকম ভাবে ঈশ্বর তাদের হৃদয় থেকে নিজের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত করেছেন। কোন বাহ্যিক দর্শনের কথা এখন বলছি না, আমি সম্পূর্ণভাবে মানসিক অভিজ্ঞতার কথা বলছি। ঈশ্বরের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মতোই এও সেই একই ধরণের অভিজ্ঞতা এবং আমি এটাই বুঝতে পারি না যে কিভাবে অতীন্দ্রিয়বাদীরা আমাদের বলে থাকেন যে ঈশ্বর বিষয়ক যে কোন আলোচনা শয়তান বিষয়ক আলোচনার সমানুপাতিক নয়।


কপলেস্টোন : এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। যদিও সেইসব মানুষ কল্পনা করেছিল বা চিন্তা করেছিল যে তারা শয়তানকে বলতে শুনেছিল বা তাকে দেখেছিল। শয়তানকে অস্বীকার করে সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। কিন্তু আমি মনে করি যে মানুষ এই দাবি করেছে যে তারা ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। অ-খ্রীষ্টীয় পুটনিয়ামের ঘটনার কথাই ধরা যাক তিনি স্বীকার করেছেন যে এই ধরণের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। বস্তুটি কেবল প্রেমময় এবং এইজন্য তা এমন কোন বস্তু নয় যা ভয় বা ঘৃণার কারণ হয়ে থাকে। এবং সেই অভিজ্ঞতার প্রভাবকেই সেখানে বহন করা হয়েছে, অথবা আমি বলতে চাই সেই অভিজ্ঞতার বৈধতাকেই পুটনিয়ামের জীবনের নথিপত্রে বহন করা হয়েছে। যে-কোন ভাবেই হ’ক এটি মনে করা খুবই যুক্তিযুক্ত হবে যে তার এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যদি আমরা পুটনিয়ামের দয়া ও বদান্যতা সম্পর্কে প্রফিরির তথ্যসমূহকে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হই তবে তা আমরা অবশ্যই মেনে নেব বলে আশা করি।


রাসেল : একটি বিশ্বাস মানুষকে খুব নৈতিক করে তোলে এরকম কোন প্রমাণ নেই, তা সেই বিশ্বাসের স্বপক্ষে যতই বলা হ’ক না কেন।


কপলেস্টোন : কিন্তু যদি প্রকৃতই প্রমাণ করা যেতে পারে যে বিশ্বাসই মানুষের জীবনের উপর শুভ কার্য করতে পারে তবে তাকে আমি একটি সত্যের সাপেক্ষে অনুমান বলে ধরে নেব, এবং সেই সত্যের সম্পূর্ণ বৈধতাকে মেনে না নিলেও তার যে কোন পরিমাণের ধনাত্মক দিকটিকে মেনে নেব। যে-কোন ঘটনাতেই অতীন্দ্রিয় সত্যবাদিতা ও পবিত্র জীবনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে আমি চরিত্রগুলো ব্যবহার করেছি। কিন্তু তার বিশ্বাসসমূহের পক্ষে কোন প্রমাণ হিসেবে আমি তা দেখাইনি।


রাসেল : কিন্তু আমিও তাকে প্রমাণ হিসেবে মনে করি না। আমি নিজেও একটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম যা আমার চরিত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং সেই সময় আমি ভেবেছিলাম মঙ্গলের জন্যই আমার চরিত্রটি পরিবর্তিত হয়েছে। সেইসব অভিজ্ঞতাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু তারা আমার বাইরে কোন অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমি মনে করি না যে যদি আমি মনে করতাম যে তারা আমার বাইরে কোন অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, তবে ঘটনাটি দাঁড়াত এই যে, সেই অভিজ্ঞতাগুলির এমন একটি কার্যকরী প্রভাব থাকত, যার ফলে আমি যে ঠিক, এই রকম কোন-না-কোন প্রমাণ রাখত।


কপলেস্টোন : না, তা নয়, আমি মনে করি যে আপনার মঙ্গলজনক অভিজ্ঞতার বর্ণনার মধ্যে দিয়েই যে সত্যের প্রমাণ হচ্ছে সেটাই মঙ্গলজনক কার্য। দয়া করে মনে রাখবেন, আমি একথা বলছি না যে একজন অতীন্দ্রিয়বাদী তার নিজের অভিজ্ঞতা বা মধ্যস্থতার ব্যাপারে আলোচনা ও সমালোচনা থেকে মুক্ত হবেন।


রাসেল : স্পষ্টতই একটি যুবক ছেলের চরিত্র ইতিহাসের কোন মহান মানুষের সম্পর্কে পড়ার পর চিরকালের জন্য দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং এইরকম প্রায়শই হয়। এটাও ঘটতে পারে যে সেই মহান মানুষটি পৌরাণিক হয়ে গেছেন এবং বিদ্যমান নন, কিন্তু সেই যুবক চিরকালের জন্য এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছে যেন সেই মহান মানুষটি নিজেই তাকে এরকম প্রভাবিত করেছেন। এইরকম মানুষ এখানে অনেক আছেন। উদাহরণস্বরূপ, পুটার্কের জীবন যে লাইকারগুসকে গ্রহণ করেছিল তিনি কোন কালেও বিদ্যমান ছিলেন না, কিন্তু যদি লাইকারগুসকে পড়েন তবে আপনার এমন মনে হবে যে তিনি আগে বিদ্যমান ছিলেন। তখন আপনি এমন একটি বস্তুর দ্বারা প্রভাবিত হবেন যাকে আপনি ভালোবাসেন কিন্তু তা কোন বিদ্যমান বস্তু নয়।


কপলেস্টোন : এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একমত যে একটি মানুষ উপন্যাসের কোন চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যা তাকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে কোন প্রশ্নে না গিয়ে (আমি অবশ্যই বাস্তব মূল্যের কথা বলব) আমি বলব যে সেই মানুষটির অবস্থা (Situation) এবং একজন অতীন্দ্রিয় মানুষের অবস্থা স্বতন্ত্র। সর্বোপরি যে মানুষটি লাইকারগুসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সে এমন কোন দুর্দমনীয় ধারণা অর্জন করতে পারেনি যে সে যে-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা চরম বাস্তব।


রাসেল : আমি মনে করি না যে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি এবং ইতিহাসে এইসব অনৈতিহাসিক চরিত্রগুলির সম্পর্কে আমার যুক্তিটি আপনি ধরতে পেরেছেন। আমি অনুমান করতে পারছি না সেই বিষয়টিকে যাকে আপনি কারণ-নির্ভর কার্য বলে অভিহিত করেছেন। আমি অনুমান করছি, যুবক ছেলেটি এই ব্যক্তির সম্পর্কে পড়ে এবং তাকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করে, তাকে ভালোবাসে– যা ঘটা খুবই সহজ এবং তার এই ভালোবাসাটা একটা ভূতকে ভালোবাসার মতো।


কপলেস্টোন : একটি অর্থে সে একটি ভূতকে ভালোবাসছে বিষয়টি যথার্থভাবে সত্য। আমি এই অর্থেই কথাটি বলছি যে সে এক্স বা ওয়াই-কে ভালোবাসছে যে বিদ্যমান নয়। কিন্তু ওই একই সময়ে আমার মনে হয়, সে যাকে ভালোবাসছে সে ভূত নয়। সে অনুভব করে একটি বাস্তব মূল্যকে, এবং এমন একটি ধারণাকে সে স্বীকার করে নেয় যা বস্তুগতভাবে ন্যায্য এবং এই কারণেই তা তার প্রেমকে উত্তেজিত করে তোলে।


রাসেল : এই একই অর্থ আমরা উপন্যাসের চরিত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পূর্বেই পেয়েছিলাম।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, একটি অর্থে মানুষের অশরীরী বা ভূতকে ভালোবাসা যথার্থভাবে সত্য। কিন্তু আর একটি অর্থে সে তাকেই ভালোবাসছে যাকে সে একটি মূল্য হিসেবে অনুভব করে।


নৈতিক বিষয়


রাসেল : কিন্তু আপনি কি এখন সেই কার্যের কথা বলছেন না, আমি বলতে চাইছি যা কিছু ভালো তাই ঈশ্বর অথবা যা কিছু ভালো তার সমষ্টি ঈশ্বর– এমন একটি ব্যবস্থা যা মঙ্গলময় এবং এই কারণে যখন একটি যুবক কোন কিছুকে ভালোবাসে তখন সেটাই ভালো যেটাকে যে ভালোবাসছে। আপনি কি এগুলেই বলতে চাইছেন? যদি তাই হয় তবে বিষয়টি একটু তর্ক সাপেক্ষ।


কপলেস্টোন : সর্বেশ্বরবাদকে সামনে রেখে ঈশ্বর সমগ্র মঙ্গলের সমষ্টি বা এমন কিছু একটা ব্যবস্থা (System) যা মঙ্গলময়–এরকম আমি বলি না। আমি সর্বেশ্বরবাদী নই, কিন্তু আমি মনে করি যে সমস্ত মঙ্গলময়তা যে-কোন পথেই ঈশ্বরে প্রতিফলিত হয় এবং তাঁর কাছ থেকেই অগ্রসর হয়, এই অর্থে একটি মানুষ যে সত্যই মঙ্গলজনক কোন কিছুকে ভালোবাসে সেই ঈশ্বরকে ভালোবাসে, এমনকি যদি সে ঈশ্বরের প্রতি মনোযোগ নাও রাখে তাহলেও। কিন্তু এখনও আমি মেনে নেব যে মানুষের এই ধরণের আচরণের ন্যায্যতা নির্ভর করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার উপর।


রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু তা প্রমাণ করবার একটি বিষয়।


কপলেস্টোন : একেবারেই ঠিক, কিন্তু আমি অধিবিদ্যাগত বিষয়টিকে প্রমাণপত্র হিসেবে ভাবি, তবে এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে পার্থক্য ঘটবে।


রাসেল : আমি অনুভব করি যে কিছু বস্তু মঙ্গলময় এবং অন্য বস্তুগুলো মন্দ। আমি সেইসব বস্তুকে ভালোবাসি যেগুলো মঙ্গলময়, কেননা সেগুলোকে আমি মঙ্গলময় ভাবি এবং আমি সেই সমস্ত বস্তুকে ঘৃণা করি যেগুলোকে আমি ঘৃণা করি। আমি এরকম বলি না যে এই বস্তুগুলো ভালো কেননা তারা স্বর্গীয় মঙ্গলময়তার সঙ্গে যুক্ত।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, কিন্তু ভালো ও মন্দের মধ্যে বিচারটি আপনার কি-রকম অথবা এই দুটির মধ্যে পার্থক্য আপনি কিভাবে করেন?


রাসেল : যখন নীল ও হলুদের মধ্যে পার্থক্য করতে যাই তখন আমার বিচারের কোন প্রয়োজন হয় না। নীল ও হলুদের মধ্যে পার্থক্য করতে গেলে আমার কি বিচারের প্রয়োজন? আমি দেখতেই পাই যে তারা স্বতন্ত্র।


কপলেস্টোন : এটি একটি সুন্দর বিচার বলে আমাকে মানতেই হবে। আপনি নীল ও হলুদ রঙকে দেখেই তাদের পার্থক্য করেন, কিন্তু ভালো ও মন্দকে পার্থক্য করেন কোন ক্ষমতা বলে?


রাসেল : আমার অনুভবের দ্বারা।


কপলেস্টোন : আপনার অনুভবের দ্বারা আপনি তা করেন। ঠিক আমি এটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি কি মনে করেন শুভ এবং অশুভ বিষয়টি কেবল অনুভবের বিষয়?


রাসেল : কেন এক ধরণের বস্তুকে নীল মনে হয়, এবং অন্য ধরণের বস্তুকে হলুদ মনে হয়? পদার্থবিদদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমি একটু বেশি বা কম উত্তর দিতে পারি এবং ওই একইভাবে একটি জিনিস মঙ্গলময় ও আর একটি জিনিস অশুভ কি করে হয় তার উত্তরও দেওয়া সম্ভব, কিন্তু উত্তরটি বিষয় সাপেক্ষে যাচ্ছে না, তাই আপনাকে আমি উত্তরটি দিতে পারব না।


কপলেস্টোন : বেলসেনের সেনানায়কের আচরণের কথা আলোচনা করা যাক। যা আপনার অনাকাক্ষিত ও অশুভ মনে হবে আমার কাছেও তাই হবে, কিন্তু অ্যাডলফ হিটলারের কাছে তা মঙ্গলময় ও আকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হবে। আমি মনে করি যে আপনি অবশ্যই স্বীকার করে নিয়েছেন যে-বিষয়টি হিটলারের জন্য মঙ্গলজনক আপনার কাছে তা অমঙ্গলজনক।


রাসেল : না, বিষয়টিকে আমি এমন ভাবে নেব না। আমি মনে করি মানুষ এ বিষয়ে ভুল করতেই পারে যেমন সে অন্য বিষয়ে ভুল করতে পারে। যদি আপনার ন্যাবা রোগ হয় তবে আপনি সব কিছুতেই হলুদ দেখবেন কিন্তু সেগুলো হলুদ নয়। আপনি একটি ভুল করছেন।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, একজন ভুল করতে পারে, কিন্তু প্রশ্নটি যদি কেবলমাত্র অনুভব বা আবেগ সম্পর্কিত হয় তবে কি আপনি ভুল করবেন? কি তার আবেগসমূহে আবেদন রাখতে পেরেছিল সে সম্পর্কে হিটলারই সম্ভবত একমাত্র বিচারক।


রাসেল : এটা বলা একদম ঠিক হত যে এটি তার আবেগসমূহে আবেদন রেখেছিল, কিন্তু আপনি সে সম্পর্কে অনেক কিছুই বলতে পারেন, অন্যান্য এতগুলো বিষয়ের মধ্যে কেবলমাত্র ওই একই ধরণের বস্তু যদি হিটলারের আবেগসমূহে আবেদন রাখে তাহলে হিটলার আমার আবেগসমূহে স্বতন্ত্র আবেদন রাখবে।


কপলেস্টোন : বিষয়টি আমি মেনে নিলাম। অনুভবের বাইরে কোন বস্তুগত প্রমাণ নেই, তাহলে বেলসেনের সেনানায়কের আচরণকে আপনি কিভাবে নিন্দা করবেন?


রাসেল : ঠিক সেই ভাবে যেভাবে একজন বর্ণান্ধ মানুষকে করা যায়, তার থেকে বেশি কিছু নয়। আমরা বিদ্যাবুদ্ধিগতভাবে একজন বর্ণান্ধ মানুষকে নিন্দা করি ও আমরা এরকম করি ব্যক্তি সংখ্যালঘিষ্ঠদের মধ্যে পড়ে বলেই না?


কপলেস্টোন : এর কারণ হিসেবে আমি বলব সেই মানুষটির যা অভাব তা সাধারণত মানব প্রকৃতির অন্তর্গত।


রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু সে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে পড়ে তবে তার সম্পর্ক আমরা ও কথা বলব না।


কপলেস্টোন : তাহলে আপনি বলবেন যে অনুভবের বাইরে এমন কোন বিষয় নেই। যা দিয়ে কেউ বেলসেনের সেনানায়ক, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস অথবা ক্যান্টারবেরির আর্ক বিশপের আচরণকে আলাদা করে দেখতে পারবে।


রাসেল : অনুভব বিষয়টি অতি সাধারণীকরণ। আপনাকে কার্যসমূহের প্রভাবসমূহকে এবং সেই প্রভাবসমূহ অনুযায়ী আপনার অনুভবকে নিতে হবে। আপনি দেখবেন, এই বিষয়ে আপনি একটি যুক্তি দিতে পারেন যদি আপনি বলেন যে কিছু বিশেষ ধরণের ঘটনা আছে যেগুলো আপনার পছন্দ অনুযায়ী নয়। তারপর, আপনি কার্যসমূহের প্রভাবসমূহকে অবশ্যই কারণ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হবেন। তখন আপনি খুব ভালো ভাবে বলতে পারবেন যে বেলসেনের সেনানায়কের কার্যসমূহের প্রভাব খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং নিরানন্দজনক ছিল।


কপলেস্টোন : শিবিরে থাকা মানুষের কাছে তা সত্যই নিরানন্দজনক ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল বলে আমি স্বীকার করি।


রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু তা শুধু শিবিরে থাকা মানুষদের কাছেই নিরানন্দজনক ছিল না, বাইরের মানুষদের কাছেও তা চিন্তার বিষয় ছিল।


কপলেস্টোন : হ্যাঁ, কল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে পুরোপুরি সত্য। এটাই আমার যুক্তি। আমি তাদের অনুমোদন করি না এবং আমি জানি যে আপনিও তাদের অনুমোদন করেন না। আমি বুঝতে পারছি না কি সেই কারণ যে-কারণে আপনি তাদের অনুমোদন করেন না, কারণ সর্বোপরি সেইসব কার্যসমূহ বেলসেনের সেনানায়কের কাছে আনন্দজনক।


রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানেন যে ওই ব্যাপারে আর বেশি কোন দরকার নেই যতটা দরকার আমার বর্ণ (Colour) উপলব্ধি করবার জন্য আছে। এমন। কিছু মানুষ আছে যা মনে করে সব কিছুই হলুদ, এমন কিছু মানুষ আছে যারা ন্যাবা রোগে ভুগছে এবং আমি এটা প্রমাণ করতে পারব না যে বস্তুগুলো হলুদ নয় এবং তার কোন প্রমাণও নেই, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন যে সেগুলো হলুদ নয়, এবং অনেক মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন যে বেলসেনের সেনানায়ক ভুল করেছিলেন।


কপলেস্টোন : আপনি কি কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করবেন?


রাসেল : এ সম্পর্কে উত্তর দিতে গেলে একটা বড়োসড়ো উত্তর দিতে হয়। বাস্তব ভাবে বলতে গেলে বলব– হ্যাঁ। তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে বরং যত্ন সহকারে আমার দরকার নৈতিক বাধ্যবাধকতা ব্যাখ্যা করা।


কপলেস্টোন : আপনি কি মনে করেন যে ‘উচিত’ (ought) শব্দটির একটি ভাবাবেগগত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে।


রাসেল : না, আমি তা মনে করি না, কারণ আপনি জানেন, কিছুক্ষণ আগেই আমি বলেছিলাম, কারুকে কার্যের হিসেবে নিতেই হয়, এবং আমি মনে করি যে। সঠিক আচরণ হল তাই যা ঘটনাসমূহের (circumstances) মধ্যে নিহিত সম্ভাব্য সকল রকমের কার্যসমূহের (Acts) অন্তনিহিত মূল্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারসাম্য তৈরি করে এবং আপনি যাকে সঠিক কাজ বলে ভাবেন সেই কার্যের সম্ভাব্য প্রভাবসমূহের (effects) হিসেবটা আপনাকে নিতেই হয়েছে।


কপলেস্টোন : নৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আমি নিয়ে এসেছি কারণ আমি মনে করি যে এই পথেই কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভুল ও ঠিকের মধ্যে একটি পার্থক্য টেনে এনেছিল এবং ভবিষ্যতেও আনবে। আমি মনে করি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নৈতিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার একটি চেতনা আছে। আমার মত হল এই যে, বাধ্যবাধকতা, নৈতিক আইনের চেতনা এবং মূল্যের অনুভবের ব্যাখ্যা সব চেয়ে ভালো হয়ে থাকে মূল্যের তুরীয় ভিত্তি (Transcendent Ground Of Value) এবং নৈতিক আইনের রচনাকারের কল্পনার মধ্য দিয়ে। নৈতিক আইনের রচনাকার’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি নৈতিক আইনের একজন খামখেয়ালী রচনাকারের কথা। বাস্তবে আমি মনে করি যে আধুনিক নাস্তিকেরা উল্টো পথে গিয়ে এই যুক্তি দেখান যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, সুতরাং কোন পরম মূল্য বা পরম আইন বলে কিছু নেই’ বিষয়টি পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত।


রাসেল : আমি ‘পরম’ শব্দটি পছন্দ করি না। আমি মনে করি না পরম বলে কোন কিছু থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নৈতিক আইন সর্বদাই পরিবর্তিত হচ্ছে। মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের কোন একটি সময় সবাই মনে করত যে নরখাদকতা একটি কর্তব্য।


কপলেস্টোন : আমি মনে করি না যে কোন বিশেষ নৈতিক’ বিচারসমূহের মধ্যে স্বতন্ত্রতা নৈতিক আইনের চিরন্তনতার বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্তমূলক যুক্তি খাড়া করতে পারে। কিছুক্ষণের জন্য আসুন আমরা মনে করি যে পরম নৈতিক মূল্যসমূহ বলে কিছু আছে। এমনকি এই কল্পনার উপর নির্ভর করে আশা করা যেতে পারে যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসমূহ এবং স্বতন্ত্র সম্প্রদায়সমূহ সেইসব মূল্যসমূহের অন্তরে বিভিন্ন মাত্রায় অন্তদৃষ্টিকে ভোগ করে থাকে।


রাসেল : একজনের উচিত’ (ought) বলতে ধরণের অনুভব কাজ করে আমি ঠিক সেই অনুভবের সঙ্গে ‘উচিত’ কথাটিকে নিতে উৎসাহী এবং অনুভবের সেই অনুরণনের সঙ্গে নিতে চাই যেভাবে একের পর এক মানুষের পিতামাতারা ও তাদের ধাত্রীরা এখনও পর্যন্ত নিয়ে আসছে।


কপলেস্টোন : আমি বিস্মিত হব যদি আপনি কেবল পিতামাতা ও ধাত্রীদের সাপেক্ষে ‘উচিত’ শব্দটির ধারণাকে বাজে অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যান। আমি প্রকৃতপক্ষে জানি না কিভাবে এই শব্দটি নিজের অর্থের চেয়ে অন্যভাবে কোন কারুর কাছে প্রকাশিত হতে পারে। আমার মনে হয় যে যদি মানুষের বিবেক বাহিত একটি নৈতিক শৃঙ্খলা থাকত তাহলে সেই নৈতিক শৃঙ্খলা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছাড়া অবোধগম্য হত।


রাসেল : তাহলে আপনাকে দুটি বস্তুর মধ্যে একটি বা অন্যটির সম্পর্কে বলতে হবে। ঈশ্বর খুব কম শতাংশ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন– যাদের মধ্যে আপনিও পড়েন– অথবা তিনি বর্বরদের বিবেকের মধ্যে যা বলে থাকেন তা সত্য নয়।


কপলেস্টোন : আপনি জানেন, আমি এ-রকম কোন প্রস্তাব করছি না যে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর বিবেককে নৈতিক উপদেশ প্রদান করেন। নৈতিক আইনের বিষয়বস্তু বা আধেয় সম্পর্কে মানবজাতির ধারণা পরিবেশ ও শিক্ষার বিশাল বিস্তৃতির উপর নিশ্চিতভাবে নির্ভর করে এবং একটি মানুষ তার সামাজিক সম্প্রদায়ের প্রকৃত নৈতিক ধারণাসমূহের বৈধতা নির্ধারণের যুক্তিকে অবশ্যই ব্যবহার করবে। কিন্তু গৃহীত নৈতিক সংহিতার সমালোচনার সম্ভাবনাকে সামনে। রেখে আগেই মনে করে নেওয়া হয় যে একটি বস্তুগত মান বিদ্যমান, ফলস্বরূপ একটি আদর্শ নৈতিক শৃঙ্খলা আছে যা নিজেই নিজেকে স্থাপন করে (আমি বোঝাতে চাই যার বাধ্যবাধকতামূলক চরিত্রকে স্বীকার করে নেওয়া যায়)। আমি মনে করি যে এই আদর্শ নৈতিক শৃঙ্খলার স্বীকৃতি অনিশ্চয়তার স্বীকৃতির একটি অংশ যা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তব ভিত্তির অর্থ প্রকাশ করে।


রাসেল : কিন্তু আমার মনে হয় যে আইনপ্রণেতা সর্বদা কারুর পিতামাতা বা ওই রকম কিছু হয়ে আসছে। এই হিসেবে বহু পার্থিব আইনপ্রণেতা আছেন এবং এই কারণেই বলা যায় কেন ভিন্ন কাল ও দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের বিবেক আশ্চর্যরকম স্বতন্ত্র ।


কপলেস্টোন : বিশেষ নৈতিক মূল্যসমূহে যে-ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় তাকে ব্যাখ্যা করতে এটি সাহায্য করে, যদি না হত, তবে তা ব্যাখ্যাতী হয়ে যেত। বাণীর বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সেই নৈতিক আইনের বিষয়ে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে-নৈতিক আইন তা এই জাতি (nation)অথবা ওই জাতি, অথবা এই ব্যক্তি অথবা ওই ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত। কিন্তু কান্টের ভাষা যার আকারকে (Form) নিরপেক্ষ অনুজ্ঞা বা পরম আদেশ (Categorical imperative) বলা যায় সেই ‘উচিত’ (Ought) শব্দটি কিভাবে পিতামাতা ও ধাত্রীর দ্বারা বাহিত হয়ে অন্যের কাছে পৌঁছচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না। যতদূর আমি জানি, এমন কোন পদ নেই যার দ্বারা এই শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই শব্দটিকে কেবল এই শব্দের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়, অন্য কোন পদের দ্বারা একে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ একবার এই শব্দটিকে কেবল এই শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা না করে অন্য পদের দ্বারা ব্যাখ্যা করে আপনি বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন। ‘উচিত’ শব্দটি আর বেশি দিন নৈতিক ‘উচিত’ (Moral ought) রইল না। শব্দটি অন্য আরও কিছু অর্থ বহন করে।


রাসেল : আমি মনে করি ‘উচিত’ শব্দের অথটি কোন কল্পিত অসম্মতির প্রভাব যা ঈশ্বরের কোন কল্পিত অসম্মতিও হতে পারে। অবশ্য এটি কারুর কল্পিত অসম্মতি এবং আমার মতে এটিই ‘উচিত’ শব্দটির অর্থ।


কপলেস্টোন : আমার মনে হয় শব্দটি বাহ্যিক প্রথা ও ধর্মীয় নিষেধ এবং এরকম এমন কিছুর অর্থ বহন করবে যাকে পরিবেশ এবং শিক্ষার মধ্য দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু সবকিছু যার অন্তর্ভুক্ত তাকেই আমি আইনের বিষয় বা বিষয়ের আধেয় (Content) বলে থাকি। ‘উচিত’ (Ought) এমনই একটি শব্দ যা যে-কোন মানুষের দ্বারা কখনই আর একটি মানুষের কাছে বাহিত হতে পারে না, কারণ এমন অন্য কোন পদসমূহ নেই যার দ্বারা এই শব্দটি বাহিত হতে পারে। এই শব্দটি আমার কাছে পুরোপুরি (রাসেল কপলেস্টোনকে কথাটি শেষ করতে না দিয়ে বললেন)–


রাসেল : আমি এরকম কথা বলবার কোন যুক্তি দেখি না আমি বোঝাতে চাইছি যে আমরা সবাই জানি অবস্থাসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াসমূহকে (Conditioned re-flexes)। আমরা জানি যে একটি জন্তু যদি কোন একটি কাজ করার জন্য বারবার এক ধরণের শাস্তি পেয়ে থাকে তবে কিছুকাল পরে সে ক্ষান্ত হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে জন্তুটি এই যুক্তি নিজের মধ্যে তুলে নিজেকে ক্ষান্ত করবে যে আমি যদি এই কাজটি করি তবে প্রভু রাগ করবেন। তার এই অনুভবটি কাজ করবে, যে ওই কাজটি করবার মতো কাজ নয়। এটাই একমাত্র আমরা আমাদের সঙ্গে করতে পারি, আর কিছু নয়।


কপলেস্টোন : একটি জন্তুর কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে বলে মনে করার কোন যুক্তি আমি দেখি না। একটি জন্তু তার অমান্যতাধর্মী কার্যসমূহ করবার জন্য নৈতিকভাবে দায়ী হবে এরকমভাবে একটি জন্তুকে আমরা অবশ্যই দেখি না। কিন্তু একটি মানুষের নৈতিক মূল্যসমূহ ও বাধ্যবাধকতার চেতনা আছে। একটি মানুষকে মানুষ যে মর্যাদা দেবে তা একটি জন্তুকেও দেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি না যদি কেউ এমন করেও তবুও আপনি সত্যই এরকম করতে চাইবেন। যদি আচরণবাদ’ সত্য হত তাহলে সম্রাট নিরো এবং আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের নৈতিক উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন স্বতন্ত্রতা থাকত না। মহানুভব রাসেল, আপনি জানেন যে আপনি বেলসেনের সেনানায়কের আচরণকে নৈতিকভাবে দূষণীয় বলে মনে করেন, কিন্তু আপনি নিজে এ ধরণের কার্যের কোন পরিবেশে কখনই থাকেননি, অথচ আপনি কি এরকম মনোভাব পোষণ করেন যে সম্ভবত মানবজাতির সুখের ভারসাম্য কিছু মানুষের উপর এই রকম জঘন্য আচরণ চালিয়ে বাড়ানো যেতে পারে?


রাসেল : আমি একটি পাগলা কুকুরের আচরণকে কখনই অনুকরণ করব না। ঘটনাটি হল এই যে আমি এটা করব না বললেই তা বাস্তবে এই প্রশ্নের জবাব হয়ে যাবে না।


কপলেস্টোন : না, যদি আপনি ঘটনার ফল হিসেবে ঠিক ও ভুলের উপযোগিতামূলক ব্যাখ্যায় যেতেন তবে হয়ত এই রকমই হত। আমি মনে করি কিছু উন্নত ধরণের নাৎসি এরকমই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যদিও এই ধরণের ব্যাখ্যা দেওয়াটা অনুশোচনামূলক, তবে অনেক পরে যে ভারসাম্য আমরা দেখতে পাব তা মানুষকে আরও বেশি করে সুখি করবে। আমি মনে করি না যে আপনি এরকম কথা বলবেন, আপনি কি এরকম বলবেন? আমার ধারণা অনুযায়ী আপনি বলে দেন যে এই ধরণের কাজ ঠিক নয়– তা সত্ত্বেও যদি আপনি একথা বলতে প্রস্তুত থাকেন তবে আমি মনে করব যে আপনার অবশ্যই ভুল বা ঠিকের একটি মানদণ্ড আছে যে-মানদণ্ড যে-কোন ভাবেই হ’ক অনুভবের বাইরে। আমার কাছে মনে হবে অনুভবের বাইরে কোন মানদণ্ডকে মেনে নিলে শেষে ফলস্বরূপ তা মূল্যের পরম ভিত্তি ঈশ্বরে গিয়ে দাঁড়াবে।


রাসেল : আমার মনে হচ্ছে সম্ভবত আমরা সব গুলিয়ে ফেলছি। এটি কার্য সম্পর্কে এমন একটি সরাসরি অনুভব নয় যার দ্বারা আমি বিচার করব, কিন্তু বিষয়টি কার্যসমূহ অনুযায়ী বরং একটি অনুভব। আমি এমন কোন পরিস্থিতিকে স্বীকার করি না যেখানে বিশেষ ধরণের কিছু আচরণ মঙ্গলজনক কার্য করবে। আমি এমন কোন পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে পারি না যেখানে এই ধরণের কার্যসমূহ কোন লাভজনক কার্য করতে পেরেছে। যদিও আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হচ্ছি ‘আমি এইগুলি পছন্দ করি না, কিন্তু আমি এগুলির বিষয় একমত হচ্ছি ঠিক যেভাবে আমি অপরাধমূলক আইনের সম্পর্কে একমত হয়ে থাকি, যদিও আমি শাস্তিকে গভীরভাবে অপছন্দ করি।


কপলেস্টোন : সম্ভবত এইবার আমি আমার অবস্থান গুছিয়ে নেব। আমি দুটি বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেছি। প্রথম, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অধিবিদ্যার যুক্তির দ্বারা দার্শনিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে, দ্বিতীয়, একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বই এমন একটি ঘটনা যা মানুষের নৈতিক অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার চেতনা তৈরি করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি যে মানুষের নৈতিক বিচারকে পরিমাপ করবার জন্য আপনার পথ অনিবার্যভাবে এমন একটি স্ববিরোধের দিকে নিয়ে যায় যেখানে আপনার তত্ত্ব যা বোঝাতে চায় এবং আপনার নিজের স্বতঃস্ফূর্ত বিচার দুটি একে অপরের থেকে ভিন্ন। অধিকন্তু আপনার তত্ত্ব নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে বাতিল করে দেয় এবং বাতিল করে দেওয়া বিষয়টির কোন ব্যাখ্যা হতে পারে না। অধিবিদ্যাগত বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এই ঐকমত্যে আসতে পেরেছিলাম যে জগৎটি অনিশ্চিত সত্তার দ্বারা গঠিত। অর্থাৎ তা এমন একটি সত্তা যার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউই কোন কিছু নির্ণয় করতে পারে না। আপনি বলেন ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতার (Series of events) কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আমি বলি যে যদি কোন প্রয়োজনীয় সত্তা না থাকে, তাহলে কোন সত্তা অবশ্যই বিদ্যমান থাকবে না এবং বিদ্যমান থাকতে পারে না এবং কিছু বিদ্যমান থাকবে না। অনিশ্চিত সত্তাসমূহের ধারবাহিকতার অসীমতা যদি প্রমাণিতও হয় তবুও তা অসঙ্গত প্রমাণিত হবে। কিছু অবশ্যই বিদ্যমান, এইজন্য এমন কিছু অবশ্যই থাকবে যা এই ঘটনার কারণ, আর তা হল এমন একটি সত্তা যা অনিশ্চিত সত্তাসমূহের ধারাবাহিকতার বাইরে অবস্থিত। যদি আপনি এটি স্বীকার করেন তাহলে আমরা এই আলোচনা করতে পারব যে সত্তাটি ব্যক্তিগত, মঙ্গলময় এবং এরকম আরও অন্য কিছু কি না। প্রকৃত যে বিষয়টির উপর আলোচনা হয়েছে তা হল প্রয়াজনীয় সত্তা আছে কি নেই তার উপর। এ বিষয়ে আমি ধ্রুপদী দার্শনিকের সঙ্গে আমার নিজে মিল খুঁজে পেয়েছি।


আমি মনে করি যে আপনি এই মত পোষণ করেছেন যে বিদ্যমান সত্তাসমূহ কেবলমাত্র এখানে আছে বলেই আছে, তাই তাদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার কোন ওজর আমার নেই। কিন্তু আমি এই বিষয় অবশ্যই নির্দেশ করব যে এই অবস্থাকে কোন যুক্তিগত বিশ্লেষণের দ্বারা সত্য বলে প্রমাণ করা যাবে না, এটি এমন এক দর্শনকে (Philosophy) প্রকাশ করে থাকে যা নিজেই নিজের প্রমাণ রূপে দাঁড়ায়। আমি মনে করি আমরা একটি কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি কারণ আমাদের দর্শনের ধারণাসমূহ মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র। আমার মনে হয় যে যাকে আমি দর্শনের একটি অংশ বলে ভাবি তাকে আপনি সমগ্র দর্শন বলে ভাবেন, অন্তত যতদূর পর্যন্ত আপনি দর্শনকে যুক্তিযুক্ত বলে ভাবেন ততটা পর্যন্তই আপনি তাকে দর্শন বলে ভাবেন। যদি আপনি আমায় ক্ষমা করেন তবে বলব যে আপনার নিজের যৌক্তির ব্যবস্থা যাকে আপনি সেকেলে যুক্তির (উদ্দেশ্যপূর্ণ বিশ্লেষণ) বিপরীতে ‘আধুনিক’ বলে আখ্যায়িত করেন, তা করতে গিয়ে আপনি এমন এক দর্শন পোষণ করে থাকেন যাকে যৌক্তিক বিশ্লেষণের দ্বারা কখনই সত্য বলে প্রমাণ করা যাবে না। সর্বোপরি, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সমস্যা একটি অস্তিত্ববাচক সমস্যা যেখানে যৌক্তিক বিশ্লেষণ অস্তিত্বের সমস্যার সঙ্গে সরাসরি কোন সম্পর্ক ঘটায় না। সুতরাং আমার মনে হয় যে পদসমূহ কেবল একটি সমস্যাসমূহের গুচ্ছের সঙ্গে জড়িত এরকম ঘোষণা করাটা অর্থহীন কেননা তা অন্য সমস্যাসমূহের গুচ্ছের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রকৃতির শুরুর সময় থেকে স্থাপন করতে হবে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যই দর্শনের বিস্তৃতি ঘটে। এটি নিজেই একটি দার্শনিক কার্য যা ন্যায্যতা বা সত্যতা প্রতিপাদনের প্রয়োজনে নিজেই নিজের পক্ষে দাঁড়ায়।


রাসেল : আমার বক্তব্যের সারাংশ হিসেবে আমি অল্প কিছু বলতে চাই। প্রথমত, অধিবিদ্যাগত বিষয়ের দিক থেকে আমি অনিশ্চিত জাতীয় কোন পদকে স্বীকার করি না অথবা ফাদার কপলেস্টোনের মতানুযায়ী এরকম ধরণের ব্যাখ্যার সম্ভাবনাকেও আমি স্বীকার করি না। আমি মনে করি ‘অনিশ্চিত’ শব্দটি অনিবার্যভাবে কোন কিছুর সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে যা আপনার মতানুযায়ী এক ধরনের দৈবাৎ চরিত্রসম্পন্ন এবং আমি একমাত্র কারণগত অর্থ ছাড়া সত্য বলে কোন কিছুকে চিন্তা করি না। আপনি কখনও কখনও কোন বস্তু সম্পর্কে কারণগত ব্যাখ্যা দিতে পারেন যাকে আপনি কোন কিছুর প্রভাব বা কার্য ভাবেন, কিন্তু তা একটি জিনিসের পরিবর্তে আর একটি জিনিস বোঝাচ্ছে এবং আমার মতে যে কোন কিছুর সম্পর্কে ফাদার কপলেস্টোনের ধারণা অনুযায়ী কোন ব্যাখ্যা নেই এবং যে-সব বস্তুসমূহকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে তার কোন অর্থই নেই কারণ তারা যেমন হতে পারে সেরকম বস্তু বলে কিছুই নেই। এই কারণেই ফাদার কপলেস্টোনের অভিযোগ সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলব। তাঁর অভিযোগ সমস্ত দর্শনের মতোই আমি তর্কবিদ্যাকে সম্মান করি তবে সেটা কোন ঘটনাই হতে পারে না। আমি দর্শনের মতো তর্কবিদ্যাকে কোন মতেই মেনে নিই না। আমি মনে করি তর্কবিদ্যা দর্শনের একটি অতিপ্রয়োজনীয় অংশ এবং দর্শনে তর্কবিদ্যাকে অবশ্যই ব্যবহৃত হতে হয় এবং তার ফলে আমি মনে করি তিনি এবং আমি একই জায়গায় অবস্থিত। তিনি যে-তর্কবিদ্যা ব্যবহার করেন তা অ্যারিস্টটলের সময় নতুন ছিল এবং সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল এক ধরনের গুজব বা হট্টগোল এবং অ্যারিস্টটল সেই তর্কবিদ্যা সম্পর্কে নিজেও হট্টগোল তৈরি করেন। বর্তমানে এটি পুরোনো ও সম্মানীয় হয়ে পড়েছে এবং আপনি অবশ্যই এই নিয়ে বেশি হইচই করবেন না। যে-তর্কবিদ্যায় আমি বিশ্বাসী তা তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এই কারণে আমি একে নিয়ে হইচই করবার জন্যই অ্যারিস্টটলকে অনুকরণ করতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু তা বলে আমি এর সব কিছুই যে দর্শন বলে মনে করি না তা নয়। আমি মনে করি এটি দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং যখন আমি তা বলি তখন সেই বা সেই শব্দের কোন অর্থও আমি দেখতে পাই না এবং যেভাবে একটি বিশেষ শব্দকে আমি খুঁজে বার করেছি তার ভিত্তির এটাই পুঙ্খানুপুঙ্খ কারণ যে আমি তা পেরেছি কারণ আমি সেইসব শব্দগুলোকে নিয়ে চিন্তা করেছি। তবে অধিবিদ্যায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দগুলোই যে অর্থহীন তা ভাবার কোন কারণ নেই, অথবা এইরকম যে-কোন কিছু সম্পর্কে আমার সত্যই কোন ধারণা নেই।


নৈতিক বিষয় সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে আমি দেখি নৃতত্ত্ব বা ইতিহাস পড়বার সময় কিছু মানুষ কার্যটিকে জঘণ্য বলে মনে করে এবং এই কারণেই আমি নৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে স্বর্গীয় উৎসকে স্বীকার করতে পারি না, অবশ্য ফাদার কপলেস্টোন আমাকে তার উত্তর দেবার জন্য অনুরোধ করেননি। নিজের বাবাকে খেয়ে আনন্দ কর এবং এরকম আরও অনেক কিছু, যাকে নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে ভাবা হয় সেইরকম নৈতিক বাধ্যতাকে আমি কখনও খুব সুন্দর ও মহৎ বস্তু বলে ভাবতে পারি না। এজন্যেই নৈতিক বাধ্যবাধকতা অর্থে আমি কোন স্বর্গীয় উৎসকে আরোপ করি না, আমি মনে করি বিষয়টিকে সহজ ভাবে একেবারে অন্য পথ দিয়েও নির্ণয় করা যায়।

ধর্ম কি আমাদের অসুখ সারাতে পারে?


(এই প্রবন্ধটির দুটি অংশ স্টকহোমের সংবাদ পত্রিকা Dagens Nyheter-এ প্রকাশিত হয় ৯ই নভেম্বর ও ১১ই নভেম্বর ১৯৫৪ সালে।)


মনুষ্যজাতি আজ ভয়ঙ্কর বিপদ ও ভীতির সম্মুখীন। ভীতি মানুষকে আজ ঈশ্বরের আশ্রয় খোঁজার প্রবণতাসম্পন্ন করে তুলেছে। সমগ্র পশ্চিমে ধর্মের সাধারণ পুনরভ্যুত্থান ঘটে গেছে। নাৎসি ও কমুনিষ্টরা খ্রীষ্টান ধর্মকে পরিত্যাগ করেছে এবং আমাদের অনুশোচনাকর সব কাজগুলোই তারা করেছে। এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া খুব সহজ হবে যে হিটলার এবং সোভিয়েত সরকারের দ্বারা খ্রীষ্টানধর্মকে অস্বীকার আমাদের অসুখের কারণের জন্য অন্তত আংশিকভাবেও দায়ী, কেননা যদি জগৎ খ্রীষ্টীয়ধর্মে আবার ফিরে আসত তবে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হত। আমার বিশ্বাস যে সন্ত্রাস থেকেই এই ধরণের সম্পূর্ণ ভ্রমের জন্ম হয়ে থাকে এবং আমি মনে করি যে এটা একটা বিপজ্জনক ভ্ৰম কারণ এটা সেইসব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে যাদের চিন্তাভাবনা হয় ফলপ্রসূ হতে পারত অথবা ন্যায্য সমাধানের পথে পরিচালিত হত।


এর সঙ্গে জড়িত প্রশ্নটি কেবলমাত্র বর্তমান জগতের অবস্থার সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। এটা খুবই সাধারণ প্রশ্ন এবং তাকে নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু বিতর্কই ঘটে গেছে। প্রশ্নটি হল এই যে গোঁড়া ধর্মের সাহায্য না পেলে সমাজগুলো সামান্য নৈতিকতাকেও যথার্থভাবে পালন করতে পারত না। আমি নিজেই মনে করি না যে ধর্মের উপর নীতিগুলোর নির্ভর ততটাই। যতটা ধার্মিক মানুষেরা তাদেরকে মনে করে। এমন কি আমি এও মনে করি যে যারা ধর্মীয় গোঁড়ামীকে অস্বীকার করে তারা বরঞ্চ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক উৎকর্ষতাকে পালন করে থাকে তাদের চেয়ে বেশি যারা ধর্মের গোঁড়ামীকে গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে সত্যের ধর্ম এবং বিদ্যাবুদ্ধিগত অখণ্ডতার ক্ষেত্রে এই সত্যকে মেনে নিতে হবে বলে আমি মনে করি। বিদ্যাবুদ্ধিগত অখণ্ডতা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি প্রমাণ সাপেক্ষে কষ্টকর প্রশ্নসমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার অভ্যাসকে অথবা সেইসব প্রশ্নসমূহকে সিদ্ধান্তহীন ভাবে পরিত্যাগ করার অত্যধিক অভ্যাসকে যেখানে প্রমাণ অমীমাংসিত। যদিও এই ধরনের নৈতিক উৎকর্ষতা গোড়া ধর্মব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত মানুষের দ্বারা অবহেলিত, কিন্তু আমার মতে এই ধরণের ধর্মের বিরাট সামাজিক গুরুত্ব আছে এবং খ্রীষ্টধর্ম বা যে-কোন সংগঠিত বিশ্বাসের ব্যবস্থার চেয়ে এই ধর্ম জগতের কাছে লাভজনক।


আসুন আমরা কিছুক্ষণের জন্য বিবেচনা করে দেখি কি নৈতিক নিয়মগুলি গৃহীত হয়েছে। নৈতিক নিয়মগুলি বিশদভাবে দু’প্রকার, ধর্মীয় শাস্ত্রে যে নৈতিক নিয়মগুলি দেখা যায় সেগুলির শাস্ত্রীয় ভিত্তি ছাড়া আর কোন ভিত্তি নেই এবং এমন কিছু নৈতিক নিয়ম আছে যা স্পষ্টতই সামাজিক উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। গ্রীসের গোঁড়া (orthodox) গীর্জার নিয়ম অনুযায়ী একই বাচ্চার দু’জন ধর্মপিতামাতা (Godparents) অবশ্যই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে না। স্পষ্টতই এই নৈতিক নিয়মের শাস্ত্রীয় ভিত্তি ছাড়া আর কিছুই নেই এবং যদি আপনি মনে করেন যে নিয়মটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলে একথা বলে আপনি ঠিক করবেন যে ধর্মের ক্ষয় ব্যাপারটিকে পরিহার করে চলতে হবে কারণ তা না হলে তা লজ্জিত নৈতিক নিয়মের দিকে পরিচালিত হবে। কিন্তু এই নৈতিক নিয়মগুলি এমন কোন নিয়ম নয় যাকে ঘিরে প্রশ্ন উখিত হবে। যে-সমস্ত নৈতিক নিয়মগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন, বুঝতে হবে সেগুলির শাস্ত্রীয় নিয়মের বাইরে সামাজিক গুরুত্ব আছে।


উদাহরণস্বরূপ, আমরা চৌর্যবৃত্তিকে নিতে পারি। যে সম্প্রদায়ে প্রত্যেকেই চুরি করে সেখানে তা প্রত্যেকের পক্ষে অসুবিধাজনক, কিন্তু যেখানে চৌর্যবৃত্তি নেই বললেই চলে সেখানে মানুষ তাদের ইচ্ছামত জীবন চালাতে পারে। কিন্তু আইন, নৈতিক নিয়ম ও ধর্মের অনুপস্থিতিতে মুশকিল হতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তির কাছে একটি আদর্শ সম্প্রদায় সেই জায়গা যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি সৎ এবং সে একমাত্র চোর, এর ফলে বলা যায় যে ব্যক্তির উৎসাহকে সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুনর্মিলিত করতে গেলে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে এবং এই অপরাধমূলক আইন ও পুলিশ এই বিষয়ে সকল ভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু অপরাধীরা সর্বদাই ধরা পড়ে না, এবং পুলিশ শক্তিমানের পক্ষে অনৈতিকভাবে প্রবণতাসম্পন্নও হয়ে উঠতে পারে। যদি মানুষ এই বিষয়ে প্ররোচিত হতে পারে যে এখানে ঈশ্বর আছেন যিনি পুলিশ ব্যর্থ হলেও চৌর্যবৃত্তিকে শাস্তি দেবেন, তবে মনে করা যায় যে এই বিশ্বাস সতোকে বৃদ্ধি করবে। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখে তারা আগেভাগেই বিশ্বাস করে নেবে যে ঈশ্বর চৌর্যবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এই বিষয়ে ধর্মের উপযোগিতা সম্পর্কে নাবোথার আঙুর বাগানের গল্পে চিত্রিত আছে যে সেখানে রাজাই চোর যিনি যে-কোন পার্থিব বিচারের উর্ধ্বে।


আমি অস্বীকার করব না যে অতীতের অর্ধ-সভ্য সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এই ধরণের বিচার সামাজিকভাবে আকাক্ষিত আচরণকে বর্ধিত করত। কিন্তু বর্তমান দিনে নৈতিক নিয়মগুলোর উপর ধর্মতত্ত্বের উৎসকে (Theological origin) আরোপ করে এই ধরণের মঙ্গল করা যেতে পারে যা এমন গভীর অমঙ্গলের সঙ্গে জড়িত যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এর ফলে মঙ্গল বিষয়টি তুলনামূলকভাবে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। সভ্যতা যত এগিয়েছে, পাথির্ব অনুমোদন বা সমর্থন ততই নিশ্চিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে স্বর্গীয় সমর্থন অনিশ্চিত হয়েছে। মানুষ চিন্তা করবার মতো অনেক যুক্তি খুঁজে পেল, যেমন– যদি তারা চুরি করে তাহলে তাদের ধরা হবে এবং এই ধারণা ক্রমশ কমে যেতে থাকল যে যদি তারা ধরা না-ও পড়ে তবুও ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেবেন। এমনকি বর্তমানে উচ্চ ধার্মিক মানুষেরাও আশা করতে পারে না যে চুরি করার জন্য তাদের নরকে যেতে হবে। তারা মনে করে ঠিক সময় মতো অনুতপ্ত হলেই হল এবং যে-কোন ঘটনাতেই নরক আর আগের মতো নিশ্চিত বা খুব ভয়ঙ্কর নেই। কোন সভ্যসমাজে বেশিরভাগ মানুষই চুরি করে না। আমি মনে করি সাধারণ উদ্দেশ্য পৃথিবীতে শাস্তির মতো একই বস্তু। এই ঘটনার প্রমাণ মেলে খনি থেকে সোনা-উত্তোলনকারীদের শিবিরে ও যে-কোন বিশৃঙ্খল সমাজে যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই চুরি করে।


কিন্তু আপনি একথা বলতে পারেন, যদিও চুরি করার বিষয়ে শাস্ত্রীয়নিষিদ্ধ করণ বেশি দিন প্রয়োজনীয় হয়ে থাকেনি, তবুও তা কোনভাবে আমাদের ক্ষতি করেনি যেহেতু আমরা সবাই চাই মানুষ যাতে চুরি না করে। যদিও সমস্যাটা দাঁড়ালো এই যে, শাস্ত্রীয়বিধি গ্রহণের বিষয়ে মানুষ যখন সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে, তখন তার সেই সন্দেহ প্রবণতা ক্ষতিকর ও অপ্রীতিকর পথে সমর্থিত হয়। যদি নৈতিক উৎকর্ষতার জন্য ধর্মতত্ত্ব প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় এবং যদি নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীরা ধর্মতত্ত্বকে সত্য বলে ভাবার কোন যুক্তি না দেখে, তবে দেখা যায় যে কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীদের ভগ্নোৎসাহ করবার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। পূর্বের শতকগুলোতে তারা যে-কোনভাবে এই সব নাছোড়বান্দা অনুসন্ধানকারীদের পুড়িয়ে মেরে তাদের ক্ষান্ত করত। রাশিয়াতে তারা যে পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে তা কিছুটা উন্নত, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্তৃপক্ষ জনগণকে মৃদুভাবে প্ররোচিত করবার পদ্ধতিটিকে যথার্থ করে তুলেছে। এদের মধ্যে বোধহয় বিদ্যালয়গুলির ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কর্তৃপক্ষ যা অপছন্দ করে সে বিষয়ে কোন রকম যুক্তিতর্ক শোনার থেকে যুবকদের সরিয়ে রাখা হয়, তবুও যারা অনুসন্ধানকারী মনোভাব দেখাতে আগ্রহী হয়ে পড়ে তারা সামাজিক বিপদের সম্মুখীন হয় এবং যদি সম্ভব হয় তাদের ভাবতে বাধ্য করা হয় যে তারা নৈতিকভাবে দূষণীয় হয়ে পড়েছে। এইভাবে নৈতিক নিয়মসমূহের যে-কোন ব্যবস্থা যা ধর্মতত্ত্বের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে তা এমন সব যন্ত্র যার দ্বারা ক্ষমতার ধার করা তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে এবং যুবকদের বিদ্যাবুদ্ধিগত উৎসাহকে ধ্বংস করে।


বর্তমানে বহু মানুষের মধ্যে আমি সভ্যতা সম্পর্কে উদাসীনতা দেখি যাকে আমি ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, খ্রীষ্টীয়ধর্মের পক্ষ নিয়ে যখন মানুষ তর্ক করে তখন তারা থমাস অ্যাকুইনাসের মতো এই যুক্তি তোলে না যে ঈশ্বর আছেন এবং তিনি বাইবেলে তার ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন। এর পরিবর্তে তারা এই বিষয়ে তর্ক করে যে যদি মানুষ এই ধরণের চিন্তা করে তবে সে যতটা ভালো কাজ করতে পারবে, সে যদি না ভাবে তবে ততটা পারবে না। এই কারণে ঈশ্বর বিদ্যমান কিনা সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবার অনুমতি আমাদের নিজেদেরকে দেওয়া উচিত নয়– সাধারণ মানুষ তর্ক করে এইরকম সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায়। যদি কোন অসতর্ক মুহূর্তে সন্দেহ মাথা তোলে তাহলে আমরা তাকে জোর করে দমন করব। যদি নাছোড়বান্দা চিন্তাভাবনা সন্দেহের কারণ ঘটায় তবে সেই নাছোড়বান্দা চিন্তাভাবনাকে আমরা অবশ্যই চিবিয়ে ফেলবো। যদি গোঁড়া ধর্মের সরকারী ব্যাখ্যাকাররা আপনাকে বলে যে মৃত স্ত্রীর ভগ্নীকে বিবাহ করা মন্দ কাজ তবে আপনি পাছে নৈতিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাই তাদের অবশ্যই বিশ্বাস করবেন। যদি তারা আপনাকে বলে যে জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি পাপ তাহলে আপনি তাদের মতামত গ্রহণ করবেন, যদিও স্পষ্টভাবে আপনি জানেন জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিপর্যয় নিশ্চিত। যদি কোন বিশ্বাস, সে যাই হক না কেন, সত্যের চেয়ে অন্য কোন কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে সমস্ত ধরণের অশুভ বা অমঙ্গলজনক বিষয়গুলি লাফিয়ে উপরে উঠে আসবার জন্য প্রস্তুত থাকে। অনুসন্ধান সম্পর্কে অনুৎসাহ, যার সম্পর্কে আগেই আমি বলেছি, তা উঠে আসা অমঙ্গলজনক বিষয়গুলির মধ্যে প্রথম, কিন্তু বাদবাকি অন্য বিষয়গুলি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের কাছে কর্তৃত্বের স্থানটি ভোলা থোকবে। ঐতিহাসিক নথি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে যদি তারা গৃহীত মতামতসমূহ সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে। আগে বা পরে উদারতাকে একটি অপরাধ বলে মনে করে নিয়ে তাকে কোন খুঁটিতে বেঁধে রাখা হবে, কিংবা তাকে বাজে বস্তু বলে পরিত্যাগ করা হবে অথবা বন্দী শিবিরে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আমি সেই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করি যে যুক্তি দেয় যে ধর্ম সত্য এবং এইজন্যই তাকে বিশ্বাস করা উচিত, কিন্তু আমি তাদের জন্য প্রগাঢ় নৈতিক দোষ অনুভব করি যারা বলে থাকেন যে ধর্মকে অবশ্যই বিশ্বাস করা উচিত কারণ ধর্ম কার্যকরী এবং ধর্ম সত্য কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করে যারা সময় কাটান তাদের সম্পর্কেও আমি ওই একই দোষ অনুভব করি।


খ্রীষ্টীয় আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের (Christian apologist) মধ্যে সাম্যবাদকে খ্রীষ্টধর্মের থেকে খুব স্বতন্ত্র বলে মনে করাটা একটা প্রচলিত ব্যাপার এবং খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী জাতিগুলি সাম্যবাদের অমঙ্গলজনক দিকগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে তার তুলনায় তারা কত সুন্দর আছে, আনন্দে আছে তা দেখাতে সর্বদা ব্যস্ত। আমার কাছে একটা বিরাট ভুল। সাম্যবাদের অমঙ্গলজনক দিকগুলো বিশ্বাসের যুগগুলিতে (Ages of Faith) খ্রীষ্টধর্মের যে অমঙ্গলজনক দিকগুলো ছিল তারই মতো। অগপু (The Ogpu) প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধমত দমনের জন্য স্থাপিত বিচারালয়ের বিপক্ষে গিয়েছিল কেবলমাত্র আকারগত দিক থেকে। নিষ্ঠুরতাও ওই একই রকম। এই ধরণের বিচারালয় যেখানেই সুযোগ পেয়েছে সেখানেই ধ্বংস করেছে। যেমন–সে বর্তমানে রুশিয়দের বিদ্যাবুদ্ধিগত ও নৈতিক জীবনকে ধ্বংস করে। সাম্যবাদীরা ইতিহাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে এবং গীর্জাগুলো নবজাগরণের আগে পর্যন্ত ওই একই কাজ করেছিল। যদি গীর্জা সোভিয়েত সরকারের মতো এখন বাজে না-ও হয় তবে তার কারণ, যারা গীর্জা আক্রমণ করেছিল তাদের প্রভাব ট্রেটের কাউন্সিলের (Council of Trent) থেকে আজ পর্যন্ত গীর্জার যা কিছু উন্নতি হয়েছে তা তার শত্রুদের জন্যই হয়েছে। এমন অনেকে আছে যারা সোভিয়েত সরকারকে আপত্তিজনক বলে ভাবেন কারণ তারা সাম্যবাদের অর্থনৈতিক মতবাদকে অপছন্দ করেন, কিন্তু এই বিষয়ে ক্রেমলিন প্রাচীন খ্ৰীষ্টীয়ধর্ম, ফ্রানসিসকান ও প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী মধ্যযুগীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্ৰীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে তুলনীয়। প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী মানুষের মধ্যে যদিও সাম্যবাদ আবদ্ধ নয়। একজন গোড়া ধর্মের শহীদ স্যার টমাস মুর সাম্যবাদীদের সুরেই বলেছিলেন খ্রীষ্টধর্মের এটাই বৈশিষ্ট্য যে এটি একমাত্র কল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এটি কোন সোভিয়েত মতবাদ নয় যাকে বিপজ্জনক বলে ভাবা যেতে পারে। এটি একটি পথ মাত্র যে পথে মতবাদটি গড়ে উঠেছে। যে পবিত্র ও অলঙ্নীয় সত্যটি উঠে এসেছে তা হল সেই পাপকে সন্দেহ করা যে পাপের ফলে কঠোরতম শাস্তি জোটে। খ্রীষ্টানদের মতো কমুনিষ্টরাও বিশ্বাস করে যে মুক্তির জন্য মতবাদটিই একান্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি সেই ধরণের বিশ্বাস যা তার জন্য মুক্তির পথকে সম্ভাবনায় করে তোলে। খ্রীষ্টধর্ম ও সাম্যবাদের মধ্যে এটাই এমন একটি সাদৃশ্য যেখানেই তারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে ওঠে। যখন বিজ্ঞানের দুটি মানুষের মধ্যে এত বিরোধ হয় তখন তারা ধর্মনিরপেক্ষ কোন হস্তের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে না। যে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দিয়েছিল সেই বিষয়টির উপর সিদ্ধান্ত নেবার জন্য বিষয়টির পরবর্তী উন্নয়নের জন্য তারা অপেক্ষা করে, কারণ বিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে তারা জানেন যে, কোন কিছুই অভ্রান্ত নয়। কিন্তু দুজন শাস্ত্রজ্ঞ যখন পরস্পর মতবিরোধী হয়ে ওঠেন তখন যেহেতু প্রমাণ করবার মতো এমন কিছু সামনে থাকে না যা দিয়ে দুজনের মধ্যে কেউ তার আবেদন রাখতে পারে, তাই দুজনের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও জোর যার মুলুক তার ধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি স্বীকার করব যে খ্রীষ্টধর্ম আগে যা ক্ষতি করত এখন তার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর। এর কারণ এখন তা আগের মতো আগ্রহপূর্ণ বিশ্বাসের বিষয় নয়। সম্ভবত ঠিক সময়ে এই একই ধরণের পরিবর্তন সাম্যবাদেও ঘটবে এবং যদি তা ঘটে তবে আজ যে ধর্মমতকে নিন্দনীয় করে তোলা হচ্ছে সেই ধর্মমত অনেক কম নিন্দনীয় হবে। কিন্তু যদি পশ্চিমা দেশগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি জয়লাভ করে যে ন্যায় ও সামাজিক স্থায়িত্বের জন্য খ্রীষ্টধর্ম একান্ত প্রয়োজনীয় তবে খ্রষ্টধর্ম আবার একবার অমঙ্গলজনক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে উঠবে যা সে হয়ে উঠেছিল মধ্য যুগগুলোতে এবং ক্রমশ বর্তমান সাম্যবাদের মতো হয়ে উঠে সে এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যেখানে দুজনের মধ্যে কোন মীমাংসা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠবে। এটি সেই পথ নয় যে পথ দিয়ে জগৎকে ধ্বংসের হাত থেকে মুক্ত করা যেতে পারে।


(২)


আমার প্রথম প্রবন্ধে যে-কোন গৃহীত ধর্মমতের ব্যবস্থাজাত অমঙ্গলসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম সত্যের উপর ভিত্তি করে নয়, কেবল সামাজিক উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে। খ্রীষ্টধর্ম, সাম্যবাদ, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং সব ধর্মমত ব্যবস্থার উপর সমানভাবে প্রযোজ্য কিন্তু একমাত্র সেই ব্যবস্থা ছাড়া যে ব্যবস্থা বিজ্ঞানের মানুষের দ্বারা গঠিত এক চিরন্তন আবেদনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যদিও খ্রীষ্টধর্মের স্বপক্ষে একটি বিশেষ বিতর্ক গড়ে উঠে আজ সম্মুখে অগ্রসর যা উক্ত ধর্মে বিশেষ যোগ্যতার উপর নির্ভর করেই হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক হারবার্ট বাটারফিল্ড তাঁর বাগ্মিতা ও পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে এইসব যোগ্যতাসমূহকে আমাদের সামনে রেখেছেন (গ্রন্থটির নাম Christianity and History, লন্ডন, ১৯৫০) এবং তাকে আমি গ্রহণ করব একটি বিশাল জনসমর্থনের মুখপাত্র হিসেবে যে জনসমর্থনের সঙ্গে তিনি নিজেও সংযুক্ত।


অধ্যাপক বাটারফিল্ড বিশেষ কিছু বিষয়কে নিজের কোলে টেনে নিয়ে সেইসব যুক্তিতর্ক-সাপেক্ষ বিষয়ের সুবিধাজাত সুযোগ নিয়েছেন যাতে মনে হবে তিনি বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি মুক্ত-মনের মানুষ। তিনি স্বীকার করেন যে খ্ৰীষ্টীয় গীর্জা নির্যাতনে বিশ্বাসী ছিল এবং চাপের ফলেই এই ধরণের কার্যকে পরিত্যাগ করেছে এবং করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে বর্তমানে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চাপা উত্তেজনা ক্ষমতার রাজনীতির ফল যা রাশিয়ার সরকার যদি গ্রীসের গোঁড়া গীর্জার সঙ্গে সংযুক্ত থাকত তা হলেও ঘটত। তিনি মনে করেন কিছু কিছু নৈতিক উৎকর্ষতা কিছু স্বাধীন চিন্তাবিদদের দ্বারাও প্রদর্শিত হয়েছে যা অনেক খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আচরণে দেখা যায়নি। কিন্তু এইরকম স্বীকৃতি সত্ত্বেও তিনি এই ধরণের মনোভাব ধরে রেখেছেন, যে-সব অমঙ্গলজনক অবস্থার জন্য জগৎ এখনো ভুগছে তা দূর হতে পারে যদি জগৎ খ্ৰীষ্টীয়ধর্মমতের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং তার মতে কিঞ্চিত পরিমাণ খ্রীষ্টীয় ধর্মমতকে মানতে গেলে কেবলমাত্র ঈশ্বর ও তার অমরত্বকে মানলেই চলবে না, তার সঙ্গে অবতারত্বেরও বিশ্বাস রাখা একান্ত প্রয়োজন। তিনি বিশেষ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে খ্রীষ্টধর্মের সংযোগের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসেবে এইসব ঘটনাসমূহকে গ্রহণ করেছেন যে ঘটনাগুলি তার ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত না হলে কোনভাবেই তাঁর কাছে বিশ্বাসজনক হয়ে উঠত না। আমি মনে করি না যে কুমারী জননী বিষয়টি এমন একটি প্রমাণ যাকে ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস রাখায় অভ্যস্ত ব্যক্তি ছাড়া কোন নিরপেক্ষ অনুসন্ধানকারী বিশ্বাসজনক বলে মেনে নেবেন। পৌত্তলিক পুরাণে (Pagan mythology) এমন অনেক গল্প আছে যেখানে এ-ধরণের কাহিনী পাওয়া যায়, কিন্তু কেউই এধরণের কাহিনীকে স্বপ্নেও সত্য বলে ধরে নিতে পারে না। একজন ঐতিহাসিক হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক বাটারফিল্ড যেখানে খ্রীষ্টধর্মের বিষয় জড়িত সেখানে সঠিক ইতিহাসমূলক প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়ে অনাগ্রহোদ্দীপক। তাঁর ভদ্রতা ও প্রতারণাপূর্ণ যুক্তি তার নিজের ভদ্রতা প্রতারণাপূর্ণ আবহাওয়ার মুখোশের তলায় অপরিণত হলেও তা অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে বিবৃত হতে পারে যেমন ‘খ্রীষ্ট সত্যই কুমারী মায়ের সন্তান কিনা, কিংবা কুমারী মা সত্যই পবিত্র আত্মাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা উচিত নয়, এই ঘটনাটি সত্য কিনা তা জানা না গেলেও এই ঘটনাটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নিলে বর্তমান জগৎ সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাবে।’ অধ্যাপক বাটারফিল্ডের কাজের কোন জায়গাতেই খ্রীষ্টধর্মের মতাদর্শকে সত্য বলে প্রমাণ করবার কোন চেষ্টাই নেই। সেখানে প্রচলিত একটি ধারণা দেখা যায় যে খ্রীষ্টধর্মে বিশ্বাস রাখাটা কার্যত্র। অধ্যাপক বাটারফিল্ডের যুক্তিতে এমন অনেক স্তর আছে যা একজনের বোঝার পক্ষে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও যথার্থ নয়, কেননা যদি সেখানে পরিচ্ছন্নতা ও যথার্থতা থাকত তবে তা ওইসব যুক্তিগুলিকে বেঠিক বা অসত্য বলে প্রতীয়মান করে ছাড়ত। আমার মনে হয় বাটারফিল্ডের বিতর্কটি কতকগুলি অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় পূর্ণ, যেমন– যদি মানুষ তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসে তবে তা ভালো হবে, কিন্তু তা করবার জন্য তাদের মধ্যে বেশি প্রবণতা নেই। খ্রীষ্ট বলেছেন এই কাজটা তাদের করা উচিত এবং যারা খ্রীষ্টকে একজন ভগবানের মর্যাদা প্রদান করে না তাদের চেয়ে যারা তাকে সেই মর্যাদা দিয়ে থাকে তাদের খ্রীষ্টের শিক্ষার উপর অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এইজন্য যারা চায় যে মানুষ তার প্রতিবেশীকে ভালোবাসুক তারা তাদের এই বুঝিয়ে প্ররোচিত করবার চেষ্টা করেন যে খ্রীষ্ট একজন ভগবান ছিলেন।


এই ধরণের যুক্তির ক্ষেত্রে এত আপত্তি রয়ে যায় যে কোন আপত্তিটি দিয়ে শুরু করা যাবে সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, অধ্যাপক বাটারফিল্ড এবং তাঁর মতো যারা অপরকে প্ররোচিত করে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে প্রতিবেশীকে ভালোবাসা মঙ্গলজনক বিষয় এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা বলে থাকেন যে তারা উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি খ্রীষ্টের শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে, ঠিক উল্টোভাবে তারা বলে থাকেন যে তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন এই কারণে যে তারা খ্রীষ্টের শিক্ষাকে তার স্বর্গীয়ত্বের প্রমাণ হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। বলতে গেলে ধর্মতত্ত্ব-নির্ভর কোন নীতিবিদ্যা তাদের নেই, কিন্তু তাঁদের নিজেদের নীতিবিদ্যা নির্ভর একটি ধর্মতত্ত্ব আছে। তাঁরা এইরকম ভাব দেখাতে চাইছেন যেন অ ধর্মতত্ত্বগত ভিত্তি দেখালেই প্রতিবেশীকে ভালোবাসার বিষয়টি জমে উঠবে এবং তা একটি বড় আবেদন রাখতে পারবে এবং এইভাবেই তারা অন্য যুক্তিগুলোকে দেখিয়েছেন এই মনে করে যে সেগুলোকে ধর্মতত্ত্বের চৌহদ্দির বাইরে রাখলে তা অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। এটি একটি বিপজ্জনক পদ্ধতি। অনেক প্রোটেস্টান্ট এই মনোভাব পোষণ করত যে সাব্বাথকে (ছুটির দিন) ভঙ্গ করাটা খুন করার অপরাধের সামিল। যদি আপনি তাদের এই বলে প্ররোচিত করেন যে সাব্বাথকে ভঙ্গ করাটা কোন দোষের নয় তাহলে তারা এটাও মনে করে নেবে যে খুন করাটাও কোন অপরাধ নয়। প্রতিটি ধর্মতত্ত্বগত নীতিবিদ্যাকে এইরকম যৌক্তিকভাবে সমর্থনও যেমন করা যেতে পারে, আবার অন্যদিকে তাকে কেবলমাত্র কুসংস্কারমূলক নিষেধের সমাহার বলেও মনে করা যেতে পারে। ধর্মতত্ত্বের যে অংশটিকে যৌক্তিকভাবে সমর্থন করা যেতে পারে তাকে সমর্থন করাই দরকার এই কারণে যে যারা তার অযৌক্তিক অংশটিকে আবিষ্কার করে, সুযোগ পেলে তারা হঠকারিতার সঙ্গে সমস্ত নীতিগুলোকেই বাতিল করে দেবে।


কিন্তু বাস্তবে খ্রীষ্টধর্ম তার বিরোধী পক্ষ ও শত্রুদের চেয়ে উত্তম নৈতিকতার জন্য দাঁড়িয়ে আছে? আমি মনে করি না যে ইতিহাসে কোন সৎ ছাত্র বিষয়টিকে একটি ঘটনা বলে মেনে নেন। অন্যান্য ধর্ম থেকে খ্রীষ্টধর্ম যেখানটায় স্বতন্ত্র তা হল এই ধর্ম নির্যাতনের বিষয়ে সর্বদাই দারুণভাবে প্রস্তুত থাকে। বৌদ্ধধর্ম কখনই একটি নির্যাতনমূলক ধর্ম হয়ে দেখা দেয়নি। খলিফার সাম্রাজ্য ইহুদি ও খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেক বেশি উদার কিন্তু খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রগুলি ইহুদি ও মুসলমানদের কাছে অতটা উদার নয়। তাদেরকে কর প্রদান করেই ইহুদি ও খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা অনুৎপীড়িত অবস্থায় থাকতে পেরেছে। যখন রোম সাম্রাজ্য খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী হল ঠিক সেই মুহূর্তে ইহুদি-খেদানো আন্দোলন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল। ধর্মযুদ্ধের ধর্মীয় আগ্রহ পশ্চিম ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরাই অন্যায়ভাবে দ্ৰেইফুসকে ও স্বাধীন চিন্তাবিদদের অভিযোগ করেছিল যারা তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিল। আধুনিক যুগে কেবলমাত্র ইহুদিদের বেলাতেই নয়, অন্যান্যরাও যখন বলি হয়েছে তখন অতিশয় ঘৃণার বিষয়টি খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই রক্ষিত হয়েছে। কঙ্গোর রাজা লিওপোল্ডের সরকারের অতিশয় ঘৃণা গীর্জার দ্বারাই গোপন ছিল এবং তার দ্বারাই তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং তা শেষ হয় কেবলমাত্র স্বাধীন পরিচালনার দ্বারা। সমগ্র তর্কটি যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তা হল খ্রীষ্টীয়ধর্ম এমন একটি নৈতিক প্রভাব উত্তোলন করেছে যা সমগ্র ঐতিহাসিক প্রমাণকে অবজ্ঞা করে এবং তাদের মিথ্যা প্রমাণিত করার দ্বারা রক্ষিত হতে পারে।


প্রথাগত উত্তরটি হল, যে-খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা আমাদের অনুশোচনাকর কোন কিছু করে তারা প্রকৃত খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী নয় এই অর্থে যে তারা খ্রীষ্টের শিক্ষাকে অনুসরণ করে না। যে-কেউ ওই একইভাবে বলতে পারে যে সোভিয়েত সরকার প্রকৃত মার্কসবাদের দ্বারা গঠিত নয়, কেননা মাকর্স এই শিক্ষা দিয়েছেন যে স্লাভরা জার্মানদের থেকে নিম্ন মানের এবং এই মতবাদ ক্রেমলিনের দ্বারা গৃহীত হয়নি। কোন শিক্ষকের অনুসরণকারীরা সর্বদা তার মতবাদকে কিছু কিছু জায়গা থেকে পরিত্যাগ করে। যাদের লক্ষ্য গীর্জার প্রতিষ্ঠা করা কথাটি তাদের মনে রাখা উচিত। প্রতিটি গীর্জাই আত্ম-সংরক্ষণের একটি প্রবৃত্তিকে গড়ে তোলে এবং সেই প্রবৃত্তিগত আত্ম-সংরক্ষণের পক্ষে প্রতিষ্ঠাতার মতবাদের যে যে অংশ সাহায্য করতে পারে না সেই অংশসমূহ ক্রমশ হ্রাস পায়। কিন্তু যে-কোন ঘটনা যাকে আধুনিক আত্ম-পক্ষ সমর্থনকারীরা সত্য’ খ্রীষ্টধর্ম বলে থাকে, তা স্বযত্নে নির্বাচিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। সুসমাচারগুলিতে যা দেখতে পাওয়া যায় তাকে এই ‘সত্য ধর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভেড়া ও ছাগলের নীতিকথা এবং সেই মতবাদ যেখানে বলা হয়েছে যে বদমাইসরা অনন্ত নরকের আগুনে ঝরে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করবে। এই ধর্ম গিরিচূড়ার উপর ধর্মোপদেশের থেকে বিশেষ কিছু অংশ তুলে নেয়, যদিও সেই অংশগুলোকেও তারা কার্যক্ষেত্রে বাতিল করে দেয়। তারা প্রত্যাহার বা নিরোধের মতবাদকে ত্যাগ করে, উদাহরণস্বরূপ, যা গান্ধীর মতো অ-খ্রীষ্টীয়রা করে থাকেন। তারা যে-বিশেষ উপদেশগুলিকে সমর্থন করে থাকেন সেই উপদেশগুলি এমন সব উচ্চ নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত যাতে মনে হয় যে সেগুলি অবশ্যই একটি স্বর্গীয় উৎস থেকে নিঃসৃত। অধ্যাপক বাটারফিল্ড অবশ্যই জানেন যে এই সব উপদেশগুলো খ্রীষ্টের সময়ের আগে ইহুদিদের দ্বারাই উচ্চারিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তাদের দেখা যায় হিল্লেলের (Hillel) শিক্ষা ও বারোজন কুলপতির টেষ্টামেন্ট (Tes-taments of the Twelve Patriarcs), এই বিষয়ে বর্তমানে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত রেভারেণ্ড ড. আর. এইচ. চার্লস বলেন, গিরিচূড়ার ধর্মোপদেশে আত্ম (Spirit) সম্পর্কে বহুরকম উদাহরণ পাওয়া যায় এবং তা আমাদের পাঠ্যগ্রন্থের প্রধান শব্দগুচ্ছসমূহের জন্ম দেয়। যেমন সুসমাচারগুলি উক্ত বিষয়ের চিহ্নগুলিকে প্রদর্শন করে থাকে এবং মনে হয় সেন্ট পল গ্রন্থটিকে নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী হিসেবে (Vade mecum) ব্যবহার করতেন। ড. চার্লস মত পোষণ করেন যে খ্রীষ্ট উক্ত গ্রন্থের সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত ছিলেন। আমাদের যেমন বলা হয়ে থাকে যে যদি নৈতিক শিক্ষা উৎকর্ষতা উক্ত গ্রন্থের রচয়িতার স্বর্গীয়ত্বকে প্রমাণ করে, তবে টেষ্টামেন্টের অজ্ঞাত লেখক অবশ্যই স্বর্গীয় ছিলেন। জগৎটি যে একটি বাজে আকারে সজ্জিত ছিল তা অস্বীকার করা যায় না এবং সেখান থেকে বেরোবার একটি রাস্তা হিসেবে খ্রীষ্টধর্ম কোন কাজ করেছে এই রকম মনে করার সামান্য কারণও ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের সমস্যাগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে গ্রীক ট্র্যাজেডির অপ্রতিরোধ্যতার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে এসেছে এবং সাম্যবাদী ও নাৎসিরা যার ফল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধটি উৎসের দিক থেকে সমগ্রভাবে খ্ৰীষ্টীয়। তিনজন ম্রাট যেমন ভক্তিনিষ্ঠ ছিলেন অন্যদিকে ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের মতো যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন। জার্মান ও রাশিয়ার যে-সব সমাজবাদীদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ সম্পর্কে বিরোধিতা এসেছিল তারা খ্রীষ্টবিরোধী ছিল। ফ্রান্সে জোরের গুপ্তহত্যা আন্তরিক খ্ৰীষ্টীয়দের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধিতা এসেছিল ইংল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য নাস্তিক জনি মর্লের কাছ থেকে। সাম্যবাদের সব থেকে বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্যটি হল যে এটি মধ্যযুগীয় গীর্জার বৈশিষ্ট্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা তাদের সেইসব গৃহীত মতবাদ- সমূহের সঙ্গে উন্মত্তভাবে যুক্ত যে-মতবাদগুলি তাদের পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ। তারা এইসব মতবাদগুলিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে অনিচ্ছুক এবং যারা সেই মতবাদ-গুলিকে বাতিল করে তাদের তারা বর্বরদের মতো শিরচ্ছেদ করে। আমরা পশ্চিমে সেই ধর্মোন্মত্তা ও গোড়ামীর উত্থানের কথা বলছি না যা আমাদের কাছে অবশ্যই একটি সুখের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, বরঞ্চ সেই মনোভাবের উত্থানের কথা বলা হচ্ছে যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে সাম্রাজ্যবাদী রাজত্বের ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলো চিরন্তন বলে প্রমাণিত হয়েছে। জগতের যা প্রয়োজন তা হল মানব পরিবারের পরস্পর নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা ও অনুভব। এই পরস্পর নির্ভরশীলতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে আধুনিক আবিষ্কারগুলির মধ্য দিয়ে এবং শুদ্ধ পার্থিব যুক্তি তাদের প্রতিবেশীর উপর তাদের দয়ালু আচরণকে যতটা শক্তিশালী করে গড়ে তোলে ততটা পূর্বে কোন যুগেই তারা হতে পারেননি। এইরকম বিবেচনার দিকে আমাদের অবশ্যই তাকাতে হবে, এবং কোন মতেই অপরিষ্কার পুরাণগুলির দিকে আমাদের ঘুরে দাঁড়ালে চলবে না। বলা যেতে পারে যে, বিদ্যাবুদ্ধি আমাদের রোগের কারণ হয়েছে, কিন্তু অবিদ্যাবুদ্ধি সেই রোগকে কখনই সারিয়ে তুলবে না। কেবলমাত্র জ্ঞানদীপ্ত বুদ্ধিই জগৎকে সুখী করে তুলতে পারে।

ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্র


(১৯৫২ সালে লিখিত)


অনেক মানুষ আমাদের বলে থাকেন যে ঈশ্বর বিশ্বাস ছাড়া একটি মানুষ কখনও যেমন সুখীও হতে পারে না তেমনি নৈতিকভাবে উত্তৰ্ষসম্পন্নও হতে পারে না। আমি বলতে পারি নৈতিক উৎকর্ষতা কেবলমাত্র পর্যবেক্ষণ থেকেই আসতে পারে, কখনই তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আসে না। সুখের কথা বলতে গেলে অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ কোনটাই আমাকে এই চিন্তা করায়নি যে গড় হিসেবে বিশ্বাসীদের থেকে অবিশ্বাসীরা সুখী অথবা অসুখী হয়ে থাকে। এটি অ-সুখী হবার সব থেকে বড় কারণটিকে খুঁজে বার করবার একটি প্রচলিত রীতি, কারণ দুর্দশাকে যকৃতের গোলযোগের কারণ হিসেবে না দেখে তাকে বিশ্বাসের অভাব হিসেবে দেখে গর্বিত হওয়া অনেক সোজা। নৈতিকতার বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে তা নির্ভর করে কিভাবে একজন ওই পদটিকে বোঝে তার উপর। আমার ক্ষেত্রে আমি মনে করি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক উৎকর্ষতা হল দয়া এবং বিদ্যাবুদ্ধি। বিদ্যাবুদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় যে-কোন শাস্ত্রের দ্বারা, সেই শাস্ত্র যাই হ’ক না কেন। দয়া অনুভবটি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে পাপ ও শাস্তির উপর বিশ্বাসের দ্বারা (কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় যে সোভিয়েত সরকার এই একটিমাত্র বিশ্বাসকে গোড়া খ্রীষ্টধর্ম থেকে গ্রহণ করেছে)।


বহু বিচিত্র বাস্তব পথ আছে যেখানে ঐতিহ্যময় নৈতিকতা হস্তক্ষেপ করে থাকে সেই সব বিষয়ে যেগুলো সামাজিকভাবে আকাক্ষিত। এর মধ্যে একটি হল যৌনরোগের প্রতিরোধ। জনসংখ্যার সীমাটাই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ওষুধের উন্নতির এই বিষয়টিকে আগের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলল। যদি কোন জাতি (Ation) এবং কুল একশ বছর আগের ব্রিটিশদের মতো এখনো উর্বর থাকে এবং যারা এই বিষয়ে তাদের অভ্যাস বদলাতে চায় না, তাদের যুদ্ধ ও দারিদ্র্য ছাড়া আর কোন পরিণাম থাকে না। যে-কোন বুদ্ধিমান ছাত্রের কাছেই এই বিষয়টি পরিচিত হলেও ধর্মতত্ত্বের ধ্বজাধারীদের কাছে এটা খুব পরিচিত নয়।


আমি বিশ্বাস করি না যে ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসের ক্ষয় মঙ্গল ছাড়া আর কিছু করতে পারে। আমি এক মুহূর্তে স্বীকার করতে রাজি আছি যে নাৎসি ও সাম্যবাদীদের মতাদর্শের নতুন ব্যবস্থা পুরোনো ব্যবস্থাগুলোর চাইতেও খারাপ, কিন্তু যুবকদের মনের মধ্যে গোঁড়া মতাদর্শগত অভ্যাস যদি ধীরে ধীরে তার জায়গা গ্রহণ করা বন্ধ না করত তবে ওই নতুন ব্যবস্থা কখনই মানুষের মনে স্থান অর্জন করতে পারত না। স্ট্যালিনের ভাষা সেই ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষাস্থল সম্পর্কে স্মৃতিপূর্ণ যেখানে তিনি তার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। জগতে আজ যা চাই তা কোন উপদেশ-বাক্য নয়, চাই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানমূলক আচরণ যা এই বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিত হবে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর অত্যাচার আকাঙ্ক্ষিত নয়– সে স্ট্যালিনের দ্বারাই আরোপিত হ’ক অথবা বিশ্বাসীদের কল্পিত পরমেশ্বরের দ্বারাই হক।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ