‘সেল (Cell)’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২,০০০ বছর বা তার আগেই পশুশিকারী মানুষের একটা দল ভাগ হয়ে চলে যায় মধ্য এশিয়ার ইরানের দিকে, দ্বিতীয়টি চলে আসে প্রাচীন ভারতের সিন্ধু নদের অববাহিকায়। আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ থেকে ৭,৫০০ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০-৫,৫০০) সময়কালের মধ্যে, আজকের উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাপ্ত সিন্ধু তথা হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তোলে এরাই। আজকের শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর তটে (ঘগ্গর-হাকরা বেসিন) অবস্থিত ‘ভিরানা’ শহর রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী প্রায় ৮,০০০ থেকে ৯,৫০০ বছরের পুরনো এবং হরপ্পা সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন। সেল (Cell) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, হরপ্পা সভ্যতার বৃহত্তম শহর, রাখিগড়িতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে প্রাপ্ত ৪,০০০ বছর পুরনো এক কঙ্কালের ডিএনএ (আই৬১১৩)-এর অ্যানালিসিস করে জানা যাচ্ছে যে এর সাথে সেই বহুহাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভারতে আসা মানুষের জীনগত সাদৃশ্য রয়েছে। মিল রয়েছে ইরানের দিকে যাওয়া দলটির ডিএনএ-এর সাথেও; কিন্তু, ইরানে চলে গিয়ে যে দলটি পশুশিকার ও প্রতিপালন ছেড়ে পরবর্তীকালে কৃষি কাজ শুরু করেছিল, তাদের সাথে এই সিন্ধু সভ্যতার মানুষের বংশানুক্রমিক কোন যোগ নেই। অর্থাৎ, হরপ্পা সভ্যতার বিকাশের সময়ে এখানকার ভূমিপুত্রেরাই কৃষিকাজ এর পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার রূপায়ণ করে।
অথচ, এতদিন ভাবা হত যে ইরান থেকে আসা মানুষেরাই ভারতবর্ষে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। অবশ্য ইরানের সাথে সেসময়ে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল কিনা বা তা’ এই হরপ্পা সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল কিনা, এই গবেষণা থেকে তা জানা যায় না। সাথে সাথেই, এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে সেই যুগে দাহ করার রীতিও চালু ছিল, সবাইকে গোর দেওয়া হত না। কাজেই গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনাটি হরপ্পা সভ্যতার অংশীদার শতশত গোষ্ঠীর মানুষের কারোর একটি। ভবিষ্যতে আরও এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
আর্য ঈশ্বরপুত্রঃ।।[নিরুক্ত ৬।২৬]
আর্য আক্রমণ তত্ত্বের পটভূমিঃ
Max Muller, যিনি আর্যবাদের মূল প্রবক্তা, তিনি ১৮৭২ সালে স্ট্রেসবার্গ বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক বক্ত্তায় বলেন, আর্যভাষা-র অস্তিত্ব থাকলে -ও আর্যজাতি বা আর্য রক্তের কথা বলা অবৈজ্ঞনিক। [There are Arya and semitic languages but it is unscientific.. to speak of Aryan race, Aryan blood and Aryan skulls..]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে [১৭০০-] তিন শ্রেণীর ইউরোপীয় মানুষ ভাগ্যন্বেষণে ভারতে আসেন। প্রথম শ্রেণীর মানুষেরা এলেন বারতের মাটিতে বানিজ্যিক কারনে। ইংরেজ, ফরাসী,ডাচ এবং পর্তুগীজরা তাদের দেশে এক একটি East India Company স্থাপন করলেন এবং সমৃদ্ধশালী (তেমনটাই প্রচারিত ছিল ইউরোপের মাটিতে) ভারতের সাথে বানিজ্য করতে বেরিয়ে পড়লেন। জলপথে ভারতে পৌঁছাবার তাগিদ থেকেই অতীতে কলম্বাস, ভাস্কো-ডা-গামা-দের মতন লুটেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, তাদের নিজ নিজ দেশের রাজানুগ্রহ পেয়ে। এসব East India Company গুলো ভারত ও অন্যন্য দেশে বানিজ্যিক ঘাটি গেড়ে বসল এবং পারস্পরিক লড়াই চালিয়ে গেল, যাদের মধ্যে British Est India Company ভারতের বুকে রাজনৈতিক তথা শাসন ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হল।
দ্বিতীয় দল এলেন খ্রীষ্টান মিশনারী-রা যারা ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়লেন খ্রীষ্ট-মত প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং এদেশের সাধারণ মানুষ ও তাদের শিক্ষা-সৃস্কৃতির সাথে এই মিশনারীদের যোগাযোগ হতে লাগল।
তৃতীয় একদল মানুষ এলেন ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে, কোন-ও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ার বাইরে। তারা বিলাতে নিযুক্ত East India Company বা মিশনারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী নন। এদেশে এসে কোন-ও না কোন-ও কাজে যুক্ত হয়ে অর্থোপার্জন করা তাদের মূল উদ্দেশ্য হলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ এদেশের সাথে সাংস্কৃতিগত ভাবে জরিয়ে পড়লেন। সেময় ইউরোপ নবজাগরণের মধ্যে দিয়ে এসেছে এবং সাহিত্য , বিজ্ঞান, শিল্প সর্বক্ষেত্রে-ই পারদর্শিতার চূড়ান্ত শিখরে বসে থেকে তারা পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের অশিক্ষিত, বর্বর বলে মনে করছেন। সর্ববিষয়ে ভারতের মানুষদের তারা অনুন্নত জাতি হিসাবে-ই দেখছিলেন। কিন্তু গোল বাধল এদেশের মাটিতে খুঁজে পাওয়া বৈদিক সাহিত্যিক নিদর্শনগুলি -যা রচনা ও অভ্যাস করার জন্য যে উন্নত, সভ্য ও শিক্ষিত মানুষদের প্রয়োজন তা সেইসময় ভারতের মাটিতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঐসব বৈদিক সাহিত্যগুলিতে "আর্য" শব্দটি পাওয়া যাচ্ছিল যা একশ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে প্রয়োগ করা ছিল।
১৬০০ সাল তেকে ভারতে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করেছিল। মিশনারীরা তার একটু আগে থেকেই ভারতে আসছিল। Robert De Noboli, যিনি ১৬০৬ সালে এদেশে আসেন, তার লেখা থেকে জানা যায় ১৫৫৯ সালে গোয়ার মিশনারীগণ এক খৃষ্টমত গ্রহণকারী ব্রাহ্মণের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্র তথা দর্শন গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন। উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ব্রাহ্মণদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান করা।
১৬৯৭ সালে একদল ফরাসী জেসুইট মিসনারী এলেন। তাদের মধ্যে Father pons ১৭৪০ সালে ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থগুলির এক তালিকা প্রস্তুত করেন। এরপর ১৭৯০ সালে Johann Philip Wesdin নামক এক জার্মান পন্ডিত একটি সংস্কৃত ব্যকরণ পুস্তক রচনা করেন।
Abbe Dubois নামক এক ফরাসী মিশনারী সর্বপ্রথম "আর্য জাতি" শব্দটি প্রয়োগ করলেন। পরবর্ত্তীকালে British Est India Company এই মতবাদটি লুফে নিল এবং দৃঢ়ভাবে এই মতটি প্রচার করতে লাগল যে যেমন ভাবে ইউরোপ থেকে তারা আধুনিক উন্নত শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এদেশে এসেছেন সেরকম-ই "আর্য জাতি"-র লোকেরা এদেশে এসেছিল এবং এসব বৈদিক সাহিত্য তাদের-ই উন্নত শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ।
প্রথমদিকে ভারতীয় সাহিত্য সম্ভারের বিস্তর জ্ঞান যত-ই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছিল, ইউরোপীয় পান্ডিতদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক উচ্চকিত ধারণার জন্ম দিচ্ছিল। দুই বিখ্যাত ইউরোপীয়ান পন্ডিত ভলতেয়ার ও স্লেগেল-----এর দুটি বক্তব্য
[Source:" The Invasion That never was": Michel Danino & Sujata Nahar;page 12-13 & 90-91] এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
১৫/১২/১৭৭৫ তারিখে লেখা এক চিঠিতে , যা ১৭৭৭ সালে প্যারিস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল, ভলতেয়ার জানলেন-
"I am convinced that everything has come down to us from the bank of the Ganges-astronomy,astrology, metepsychosos etc" [জ্যোতিরবিদ্যা, জ্যোতিষ এর মতন সবকিছু-ই গঙ্গা নদীর তীর থেকেই এসেছে বলে আমি বিশ্বাস করি]।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক ভন স্নেগেল ১৮০৩ সালে বলেন-"Everything without exception is of India origin whether directly or indirectly, all nations are originally nothing but India colonies" [সবকিছু-ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারত থেকেই উদ্ভূত এবং সব দেশগুলো ভারতের উপনিবেশ]
কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় পন্ডিতদের এমনধারা মতামত ভারতে ক্রমবিস্তারশীল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক শক্তি রূপে পরিগনিত হচ্ছিল না। East india Co.-এর "Divide and Rule" এবং মিশনারী-দের "Divide and convert' পরিকল্পনার আকারে ভারতে প্রযুক্ত হচ্ছিল। ফলে ভারতের অতীত সম্পর্কিত এমন একটি মতবাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল যা বৃটিশ শাসনের পথকে প্রশস্ত করবে।
১৮৩১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিকরা হল "বোডেন প্রফেসরশিপ" নামক একটি পদ, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য-ই ছিল ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং শাস্ত্রগুলির এমন ব্যাখ্যা প্রদান যা ভারতবর্ষে খ্রীষ্টমত প্রচারের সহায়ক হবে। ঠিক এই সময় থেকেই ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিদেশী রাজনীতি ও অর্থের অশুভ প্রভাব শুরু হয়ে গেল। আমেরিকান ঐতিহাসিক Thoman R.Traumann জানিয়েছেন, ইভাঞ্জেলিষ্টদের প্রভাবে ভারতীয় সভ্যতাকে ছোট করার কাজ শুরু হল ["Evangelical influence drove British policy down a path that tended to minimize and denigrate the accomplishment of Indian Civilization"-Aryans and British India, 1997]
"জ্যাকালয়ট্" নামক ফরাসী দেশীয় জনৈক সাহেব, তাঁর "বাইবেল্ ইন ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন য, আর্য্যাবর্ত্ত সমস্ত বিদ্যা ও কল্যানের ভান্ডার। সমস্ত বিদ্যা ও সমস্ত মত এই দেশ হইতেই বিস্তৃত হইয়াছে। তিনি পরমেশ্বরের কাথে পার্থনা করেছিলেন, "হে পরমেশ্বর ! পূর্ব্বকালে আর্য্যাবর্ত্ত যেরূপ উন্নত ছিল, আমাদের দেশকেও সেইরূপ করুন"।[সত্যার্থ প্রকাশ পৃঃ৩০১]
১৮৩৩ সালে টমাস ব্যারিংটন মেকলে নিযুক্ত হলেন ভারতে East India Co.র শিক্ষাবিষয়ক কিমটির অধিকর্তা পদে। তিনি ভারতে রইলেন মাত্র ছয় বছর কিন্তু তার গৃহীত নীতি-কেই আদর্শ করে বৃটিশ শাসন চলতে লাগল ভারতের মাটিতে, বর্তমান সময় পর্যন্ত ওনার নীতি অনুসরন করেই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা চলছে।
তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভারতীয়দের, বিশেষতঃ ব্রাহ্মন পন্ডিতদের ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তাঁরা বেদভিত্তিক হিন্দুদের অসারতা বুঝতে পারবে এবং সহজেই খ্রীষ্টমতের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ভারতীয় সংস্কৃতি, ও শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর মত ছিল-
"a literature admitted to be of small intrinsic value...(one) that inculcates the most serious erosion of the most important subject"[এ সাহিত্যের অতি নগণ্য মূল্য আছে এবং বহু বিষয়ে ভুল তথ্যে ভরা][Source:India:A world in transition -By B.P.Lamb;page-194]
ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে----ও তার পরিস্কার মতামত ছিল। তিনি এদেশেই ইংরেজী শিক্ষিত একদল মানুষ তেরী করতে চাইলেন যারা সর্ববিষয়ে বৃটিশরাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। "১৮৩৫ Minute" -এ তিনি বললেন যে তিনি চান, পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতিতে একদল শিক্ষিত ভারতীয় শ্রেনী সৃষ্টি করতে যারা রক্তে ও গাত্রবর্ণে ভারতীয় হলেও নীতি, মত ও রুচিতে হবে ইংরেজ [to create India elite through western style of education.... India in blood and colour, but English in taste, in opinion, in morals, in intellect"]
এই মেকলে সাহেব-ই পরবর্তীকালে ১৮৫৪ সালে জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমূলারকে খুঁজে পেলেন। মণিকাঞ্চন যোগাযোগ হল। কেহ কেহ বলে যে, জার্ম্মানীতে সংস্কৃতের বহুল প্রচার আছে এবং ম্যাক্সমূলর সাহেব যত সংস্কৃত অধ্যান করিয়াছেম, অন্য কেহ তত করেন নাই। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষায় ইহা কেবল কথার কথা। করাণ "যস্মিন্ দেশে দ্রুমো নাস্তি তত্রৈরন্ডোহপি দ্রুমায়তে" অর্থাৎ যে দেশে কোন বৃক্ষ নাই, সে দেশে এরন্ডকেই বৃহৎ বৃক্ষ বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়। সেই রূপ ইউরোপে সংস্কৃত প্রচার না থাকতে জার্ম্মানগণ
এবং ম্যাক্সমূলর সাহেব যৎসামান্য যাহা পাঠ করিয়াছেন তাহাই সে দেশের পক্ষে অধিক। কিন্তু আর্য্যাবর্ত্তের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে সংস্কৃতে তাঁহার পান্ডিত্য নগন্য মনে হইবে।[সত্যার্থ প্রকাশ পৃঃ৩০০] যাই হোক তথ্য বলছে তিনি (ম্যাক্সমূলর) দশ হাজার পাউন্ড পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঋগ্বেদের অনুবাদ কার্যে নিযুক্ত হন এই শর্তে যে বেদ এর ব্যাখ্যা ভারতের মাটিতে ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের সহায়ক হবে। ম্যাক্সমূলর ১৮৮৬ সালে তাঁর স্ত্রীকে চিঠিতে জানান-
"বেদের অনুবাদ অনেকাংশে ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ওদেশের লক্ষ লক্ষ লোক মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। বেদই তাঁদের ধর্ম্মের মুলে। এই মুলটা কি দেখানো গেলে, আমি নিশ্চিৎ, ৩০০০ বছর ধরে যা কিছু উদ্ভূত হয়েছে তা মূলোৎপাটিত হবে"[Life and letters of Friedrish Maxmuller from "Maxmuller Exposed"-by Brahma Dutt Bharati]
ইতিপূর্বে ওয়ারেন হেস্টি- এর আমলে (১৭৭৩)ইউরোপীয়ান দের সংস্কৃত চর্চা শুরু হয়। হেস্টিং নিজ উদ্যোগ নিয়ে আনলেন চার্লস উইলসকিন্সকে। ইনি বেনারস-এ গিয়ে সংস্কৃত চর্চা করলেন এবং ১৭৮৫ সালে "ভাগবতগীতা"-র ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করলেন।
ইতিমধ্যে ১৭৮৬ সালে উইলিয়ম জোন্স(যিনি এশিয়াটিক সোসাইটি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠা ও সভাপতি) সংস্কৃত,গ্রীক,ল্যাটিন, জার্মান ভাষাগুলি একটি বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীবূক্ত একথা ঘোষণা করলেন। জোন্স কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে থমাস ইয়ং (পদার্থবিজ্ঞানী তথা মিশরতত্ত্ববিদ) "ইন্দো-ইউরোপীয়ান" এই পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার [the Quarterly Revies;1813] করলেন। এই শব্দটির সাহায্যে তিনি উপরোক্ত ভাষাসমূহের একটি সাধারণ উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। খুব অল্পদিনে এই ধারনার উৎপত্তি হল যে ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি-ই হল এসব ভাষাসমূহের স্রষ্টা। (১৮১৮) সালে জার্মান ভাষাবিদ Klaproth "ইন্দো-জার্মানীয়" পরিভাষাটি ব্যবহার করলেন) একাথাও বলা হল যে তারা আদিতে ---একটি জায়গায় বাস করত। সে জায়গা কোথায় ?
১৮২০ সালে, জ জি রোড (Rhode) এই আদিস্তল-কে নির্দ্ধারণ করলেন মধ্য এশিয়ায়। ১৮৪০ সালে এফ আ পট (Pott) হিন্দুকুশ এবং ওক্সাস উপত্যকা-কে আদি স্থান বললেন। জ ভন কালেপ্রাথ (Caleprath) আবার বললেন "ইন্দো-ইউরোপীয়" শব্দটির বদলে "ইন্দো-জার্মানিক" শব্দটি বেশী যুক্তি যুক্ত।
১৮৩৫ সালে ফ্রাঞ্জ বপ (Franz Bopp) তুলণামূলক ভাষাতত্ত্বে-র এক বই লিখে ফেললেন। সংস্কৃত শব্দমন্ডলীর সাথে ইউরোপীয় ভাষার শব্দের সাদৃশ্য ইউরোপীয় পন্ডিতদের এই ধারণার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল যে ইউরোপ-ই আদি বৈদিক ভাষার জন্মস্থান এবং পরবর্তীকালে এই ভাষা (বৈদিক-সংস্কৃত) ও ভাষাবাহক জনগষ্ঠী ইউরোপ থেকে ভারতে চলে আসেন। বপ-এর কাছে জার্মান পন্ডিতদ্বয় স্লেগেল এবং ম্যাক্সমূলার সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন।
ম্যাক্সমূলর ছয় খন্ডে ঋগ্বেদ অনুবাদ করা ছাড়াও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও ভারতীয় দর্শন-এর উপর আরো গ্রন্থ রচনা করলেন। তিনি ১৮৫৭ সালে লিখলেন "A History of Ancient Sanskrit Literature"। এতে তিনি "ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের উৎস যারা তাদের "ইন্দো-ইউপরোপীয়" বা "ইন্দো-জার্মানিক" না বলে বলা উচিত "আর্য"। কারণ যারা ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল তাদের ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং তারা নিজেদের "আর্য" হিসেবে চিহ্নিত করত। এরাই হলেন হিন্দু, পারশিক,গ্রীক, রোমান, শ্লাভ,কেল্ট ও জার্মানদের পূর্বপুরুষ।
এই আর্যজাতি ইউরোপে উদ্ভূত এবং নানা দলে দক্ষিণে , দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পশ্চিমে সভ্যতা বিস্তার করতে করতে আরমেনিয়া, পারস্য হয়ে ভারতবর্ষে এসে পড়েন।
এর মধ্যে জার্মান ভাষাতত্ত্ব ও জাতিতত্ত্ববিদ Kerl Penka প্রাচীণ আর্যদের "doicho-cephalic (দীর্ঘকপালি) leptorhine type" বলে বর্ণনা করেছেন, আবার পরবর্তীকালে (১৯০১) ভারতের জাতিতত্ত্ব সংকলন বিভাগের অধ্যক্ষ হার্ভার্ট রিসলে জাঠ ও রাজপুতানা-র লোকেদের মধ্যে পেঙ্কা বর্ণিত আর্য লক্ষণ খুঁজে পেলেন।
ম্যাক্সমূলর আর্যজাতিরতত্ত্বের প্রচারের পাশাপাশি দ্বিতীয় এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন- সেটি হল ঋগ্বেদাদি গ্রন্থের কাল নির্ণয়। তিনি এক অবোধ্য কারনে একাদশ শতকের কাশ্মীরী পন্ডিত সোমদেব ভট্ট রচিত "কথাসরিতসাগর" নামক এক গ্রন্থ থেকে এক ভৌতিক কাহিনী থেকে নন্দ রাজার এক মন্ত্রী "বররূচি" সম্পর্কিত বর্ণনাটি গ্রহন করলেন, যে বররূচি পূর্ব জন্মে কাত্যায়ণ নামে পরিচিত ছিল।
এদিকে বৈদিক গ্রন্থগুলির যে সকল সূত্রগ্রন্থাবলি পাওয়া যায় তাদের একটির সূত্রকার হলেন কাত্যায়ণ নামক এক ঋষিপন্ডিত। ম্যাক্সমূলার ঐ কাত্যাযণকে নন্দ রাজার সমসাময়িক (অথচ কাত্যায়ণ নন্দ-মন্ত্রি নন) ধরে নিয়ে সূত্রগ্রন্থগুলির কালনির্ণয় করলেন খ্রীঃপূঃ চতুর্থ শতক (নন্দ রাজা আলেকজান্ডারের সমসাময়িক)। কত বড় মূর্খামী অথবা প্রতারনা, তিনি সর্বসাকুল্যে যা যা কল্পনা করলেন, তা হল-
১)আর্যরা ভারতে এসেছিল ১৫০০BC নাগাদ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে
২) ঋগ্বেদ হল প্রাচীনতম গ্রন্থ;
৩) সমগ্র বেদিক সাহিত্যের চারটি স্তর বা কালপর্যায়, যথা-ছন্দ,মন্ত্র, ব্রাহ্মণ ও সূত্র;
৪) প্রাচীণ সাহিত্যের প্রতিটির কালপর্যায় ছিল আনুমানিক দুশ বছর;
৫)সোমদেবের গ্রন্থের ব্যাখ্যা অনুসারে সূত্র রচনার কাল মৌর্যযুগের সমসাময়িক;
৬) বেদের চারটি স্তর পার হতে লেগেছিল ২০০x৪=৪০০ বছর। সূত্রযুগকে ৪০০বিসি ধরে নিয়ে ঋগ্বেদ রচনাকাল হল ৪০০+৮০০=১২০০ বিসি
সোমদেব রচিত "কথাসরিতসাগর" নামক গ্রন্থের কাণভূতি নামক এক ভূত বা অশরীরি প্রকৃতপক্ষে বররূচি-কাত্যায়ণের কাহিনী শুনিয়েছিল। অতএব কানভূতি নামক ভূতের সাক্ষে ভারতবর্যের প্রাচীণ ইতিহাস রচিত হল।
ম্যাক্সমূলরের এই গল্পগাথা সকলে একবাক্যে মেনে নিল না। উইলিয়াম হুইটনী (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতভাষার অধ্যাপক), থিওডোর গোল্ডষ্টুকার (লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক)-দের মতন সমসাময়িক পন্ডিতেরা ঐ তত্ত্বের বিরোধিতা করতে লাগলেন লিখিতভাবে। আইজ্যাক টেলর নামক এক পাদ্রী ১৮৯০ সালে লিখলেন (Orifin of the Aryans;page-39) "আর্য়দের আতুরঘর হল সেই দেশ যেখানে সংস্কৃত ও জেন্দ উচ্চারিত হয়েছিল [The cradle of Aryans must have been in the region where Sanskrit and Zend were spoken]"।
অবশেষ চাপের মুখে ম্যক্সমূলার তার দুই মতবাদ থেকে-ই পিছু হটলেন। ১৮৯০ সালে জানালেনঃ-
১) বেদের যে কাল তিনি নির্নয় করেছেন তা হল ন্যুনতম;
২) বেদের সঠিক কাল নিরর্ণয় করা অসম্ভব এবং সর্বশেষ
৩) আর্যজাতি বলে আসলে কিছু হয় না।
1. [ "I have repeatedly dwell on the merely hypothetical character of dates, which I have ventured to assign to the first period of vedic Literature. All I have claimed for them has been that they are minimum dates and that the literary productions of each period which still exist or which formerly existed could hardly be accounted for wihin shorter limits of time than those suggested"]
2. ["whether the vedic hymns were composed (in) 1000 or 1500 or 2000 or 3000BC, no power on earth will ever determine"]
3. ["To me an ethnologist who speaks of an Aryan race, Aryan blood, Aryan eyes and hair, is as great a sinner as a linguist who speaks of a dolicho-cephalic dictionary.."]
বিঃদ্রঃ ১৮৭৫ সালে খ্রীষ্টীয় বিশপ রবার্ট কল্ডওয়েল কাল্পনিক দ্রাবিড় তত্ত্বের সৃষ্টি করেন
দ্ৰাবিড় তত্ত্ব
1875 সালে খ্রীষ্টীয় বিশপ রবার্ট কন্ডওয়েল সৃষ্টি করলেন দ্রাবিড় তত্ত্বের। তিনি বললেন আর্যদের মত দ্রাবিড়-রাও ভারতে বহিরাগত। তারা এসেছিল আর্যদের আগে। আর-ও বলা হল আর্য ও দ্রাবিড় দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষাগোষ্ঠী। আর্যরা ভারতে আসার পরে দ্রাবিড় ভাষা সংস্কৃত দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর্য-পূর্ব সেই কাল্পনিক ভাষার নাম প্রোটো দ্রাবিড়ীয় (আজ পর্যন্ত যে ভাষার অস্তিত্ব কোথাও পাওয়া যায় নি)। David MeAlpin একটি Proto-Elamo-Dravidian Theory উদ্ভাবন করলেন, আর বললেন যে এদের আদি বাসস্থান মেসোপটেমিয়া।
বারো (Burrow) ঋক বেদ-এর প্রায় ৫০০ শব্দ এবং কুইপার (Kuiper) প্রায় ৩৮৩ শব্দ-কে প্রাচীন ভ্রাবিড় শব্দসম্ভূত মনে করলেন। থিম (Thieme) আবার এ সম্ভাবনাকে বাতিল করে বললেন এগুলো ইন্দো-আর্য শব্দ। থিম এও বললেন যে বারো এবং কুইপার অতিউৎসাহী ['zeal for hunting up Dravidian loans in Sanskrit']!
দাস বললেন ঋক বেদ-এ একটিও বিদেশী শব্দ পাওয়া যায় নি। যা কিছু যুক্তির কথা বলা হয় তা সব-ই বিশ্বাস থেকে বলা হয় [ Not a single case in which a communis opinio has been found confirming the foreign origin of a RgVedic (and probably Vedic in nature) words... any of the arguments for such foreign origin are often statement of faith'- "Hunt of foreign words in RV'-R .P. Das] 1
ঋক বেদ-এ দ্রাবিড় শব্দ ধার নেওয়া সম্ভব নয় মূলতঃ দুটি কারনে
১। দ্রাবিড় ভাষার মধ্যে প্রাচীনতম হল তামিল, যার সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায় সবচেয়ে পুরানো 300 BC-তে। যত-ই মতভেদ থাকুক সবাই এটা মানবেন যে ঋক বেদ এর চেয়ে অনেক প্রাচীন।
২। তামিল-এ প্রাচীণতম নিদর্শ হল সঙ্গম তামিল। এতে অনেক সংস্কৃত প্রভাব দেখা যায় ['Influence of Sanskrit or Prakrit on Sangam Tamil can be seen
in some particular terms-Elst; 1999]। যেমন Tamil Akkam > সংস্কৃত আকাশ
Tamil- Ayutham (= weapon) > সংস্কৃত – আয়ূধ
দেখা যাচ্ছে যে, 'আর্য আক্রমণ’-বাদীরা যতগুলি তথাকথিত প্রোটো ভাষার সৃষ্টি করেছেন, যেমন প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়, প্রোটো-ইন্দো-ইরানীয়, প্রোটো-ব্রাবিড়ীয় তার সবগুলিই সম্পূর্ণ কাল্পনিক। পর্যবেক্ষণ ও সমীক্ষায় এদের একটির ও অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় নি। অথচ দাবী করা হয় ভাষাতত্ত্ব একটি বিজ্ঞান।
প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনা
৬০-এর দশক থেকে প্রত্নতাত্বিক তথ্যপ্রমাণ 'আর্য আক্রমণ তত্ত্ব'-এর বিরুদ্ধে যেতে লাগল।
কাজানাস জানাচ্ছেন যে খৃঃ পূঃ সপ্ত সহস্রাব্দ থেকে পাঁচ শত পর্যন্ত বেলুচিস্থান থেকে গঙ্গা-যমুনা এবং সোয়াত-কাশ্মীর থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত ধারাবাহিক সভ্যতা র নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। অন্ততঃ 2000 BC – এর পর থেকে এ অঞ্চলে কোন-ও আক্রমণ হয়নি [Shaffer, Lichtenstein; 1995, 1999]।
আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক কেনোয়ার জানাচ্ছেন যে, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হলেও অন্যান্য তথ্য প্রমাণ জানাচ্ছে যে কোন-ও 'আর্য আক্রমণ' হয় নি ['Although the overall socio-economic organization changed, continuities in technology, subsistence practices, settlement organization and some regional symbols show that the indigenous population was not displaced by invading hordes of Indo-Aryan speaking people.'- "The Indus Valley tradition of Pakistan and western India'; - J.M.Kenoyer; 1991] 1
অপর প্রত্নবিদ ডেলস অনেক আগেই বলেছিলেন, মহেঞ্জোদাড়ো-তে ৯ বছর ধরে খোঁড়াখুড়ি করে মাত্র ৩৭টি কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অধিকাংশ কঙ্কাল নিম্ন বাসভূমি অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মূল দুর্গ অঞ্চলে, যেখানে চূড়ান্ত লড়াই-টি হওয়া উচিত, একটিও নয় [“what of these skeletal remains that have taken on such undeserved importance? Nine years of extensive excavations at Mohenjo-daro (1922-31)- a city of three miles in circuit- yielded the total of some 37 skeletons or parts thereof that can be attributed with some certainty to the period of Indus civilization... They were all found in the area of lower town - probably the residential district. Not a single body was found within the area of the fortified citadel where one could reasonably expect the final defence of this thriving capital city to have made']।
তিনি আরও বললেন অস্ত্র, রথ, পোড়া দুর্গ, আক্রমণকারীদের দেহাবশেষ কোথায় গেল? অন্যান্য হরপ্পা ক্ষেত্রগুলো-তেও অনেক খুঁড়েও আক্রমণের হদিশ মিলল না ['where are the burned fortresses, the arrow heads, weapons, pieces of armour, the smashed chariots and bodies of invaders and defenders? Despite the extensive excavations at the largest Harappan sites, there is not a single bit of evidence that can be brought forth as unconditional proof of an armed conquest and the destruction on the supposed scope of the Aryan invasion'- 'The mythical massacre at Mohenjo-daro'- Expedition Vol-VI 3, 1964- by G. F. Dales] |
শ্যাফার ও লিচটেন্সটেন জানালেন হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের অভিসকা প্রথম সহস্রান্স-এর প্রথমার্ধে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের একমাত্র ঘটনা (The shift by Harappan groups and perhaps other Indus Valley cultural mosaic groups is the only archaeologically documented west-to-cast movement of human population in South Asia before 1" half of the 1" millennium
BC-Shaffer & Lichtenstein; 1995] কাজানাস (2006) জানাচ্ছেন 1984 সালের পর থেকে সমস্ত প্রত্নবিদরা (Lal & Gupta-1984; Allchin-1997; Kenoyer-1999; Shaffer & Lichtenstein 1991; Posschl-2002; MeIntosh-2002) একমত হতে লাগলেন যে সিন্ধু
অঞ্চলের সভ্যতা একটি ধারাবাহিক সভ্যতা।
কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নবিদদ্বয় আর এবং বি অলচিন স্বীকার করেছেন সিন্ধু-সরস্বতী সংস্কৃতি-তে বৈদিক নিদর্শ পাওয়া যাচ্ছে [Aryans lived in close proximity to the Indus Sarasvati Civilization natives, acquired their material culture and lifestyle (i.e. clothing, tools, weapons, means of transport etc' - 1982] 1
অবশ্য ফরাসী প্রশ্নবিদ সলোমন রিনাথ অনেক আগেই (1892) আর্য জাতিতত্ত্বের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গেছেন [to speak of an Aryan race of 3000 years ago is to put forward a gratuitous hypothesis; but to speak of it as if it still existed today is quite simply absurd' - quoted by Leon Poliakov in 'The Aryan Myth page 344]।
আধুনিক প্রত্নবিদ, কেনোয়ার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সিন্ধু প্রত্ন অঞ্চলে কাজ করছেন, বললেন যে ঐ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটলেও একদল আর্যভাষী মানুষের দ্বারা ওই অঞ্চলের মানুষেরা বিতাড়িত হয়েছিল। একথা বলা যায় না [ Although the overall socio-economic organization changed, continuities in technology, subsistence practices, settlement organization and some regional symbols show that the indigenous population was not displaced by invading hordes of Indo-Aryan speaking people - The Indus valley tradition of Pakistan and western India'; 1991]। তিনি পরিস্কারভাবে জানালেন যে 1900 BC থেকে 600 BC পর্যন্ত আর্য বা অন্য আগমনের কোন প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ নেই ['But there is no archaeological or biological evidence for invasion or mass migrations into Valley between the end of the Harappan Phase, about 1900 BC and the beginning of the Early Historic period around 600BC' - Kenoyer, 1998]
কি দাড়াল?
আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’এর সপক্ষে বলার মতন বিশেষ কিছুই আর নেই। আমরা এখানে আর এক বার দেখে নেব আর্য আক্রমণতত্ত্বের বিপক্ষ যুক্তিগুলো
১ম বর্তমানে AIT Model সম্পুর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে ভাষাতাত্ত্বিক থিওরী-র উপরে, যা কিনা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমানের উপর নির্ভরশীল। বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ কলিন রেনফ্লু বলেছেন যে, ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্বিকেরা পরস্পরের মুখের কথার উপর নির্ভরশীল, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় নি। [In the Indo-European field, linguists have been willing to follow the archaeological orthodoxy of nearly a century ago, while archaeologists have taken the conclusions of historical linguists at their face value, failing to realize that they were themselves based upon archaeological assumption which had not been questioned, yet which were not in some cases justifiable] |
২য় – লকউড [W.B.Lockwood] -এর মতন অনেকেই মনে করেন যে অসংগঠিত ও ভ্রাম্যমান জাতিগুলির মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলি বেশি মাত্রায় হয়। সেক্ষেত্রে আর্যরা বহিরাগত হলে সংস্কৃত ভাষা এত সুগঠিত হত না। বারো বলেছেন বৈদিক ভাষা অন্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার তুলনায় অনেক কম পরিবর্তিত হয়েছে [Vedic is a language which in most respects is more archaic and less altered from the original Indo-European than any other member of the family'- T. Burrow]
৩য়- জাতিগত অভিসরণের ক্ষেত্রে এক পূর্বস্মৃতি অধ্যায় থাকে। অর্থাৎ অঞ্চল থেকে সে চলে আসে, তার কাহিনী রয়ে যায় আগত মানুষদের স্মৃতিতে। বৈদিক আর্য সাহিত্যগুলিতে যার কোনও নিদর্শন নেই। কাজানাস তাই বলছেন, বৈদিক আর্যদের শিকড় তাই তাদের মূলভূমিতেই আছে ['strong sense of being rooted in their land'] i সিন্ধু-সরস্বতী নদীখাত বরাবর যে সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্রগুলি পাওয়া
৪র্থ-
যাচ্ছে, তার অনেকগুলিতেই সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা পাওয়া যাচ্ছে। যজ্ঞবেদী, ভুর শিল্পসামগ্রী, মাপন পদ্ধতি ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে এই মিলগুলি দেখা যাচ্ছে। আর্যরা বহিরাগত হলে এই ধারাবাহিকতা থাকার কথা নয়। ৫ম- সিন্ধু-সরস্বতী ক্ষেত্রগুলিতে ঘোড়া-র নানা নিদর্শ আবিস্কার আর্যরা
বহিরাগত'– এই তত্ত্ব-কে শেষ করে দিয়েছে।
৬ষ্ঠ- সরস্বতী নদী 1900 BC নাগাদ প্রায় লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। ঋক বেন এ সরস্বতী নদীর যে বর্ণময় বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে বলা যায় যে ভারতের মাটিতে আর্য সভ্যতার কাল অন্ততঃ 2000 BC-এর পরবর্তী নয়। ৭ম প্রাচীণ ভারতীয় সভ্যতার সাথে জড়িয়ে আর একটি বিষয় নিয়ে
আলোচনা করা হয় এবং এর সাহায্যে সভ্যতার কাল নির্ণয় করা হয় সেটি হল মৃতব্য এবং তাতে রং-এর ব্যবহার। এদের শ্রেণীবিভাগগুলি হল PGW (Painted Gray Ware) culture, Northern Black Polished Ware Culture, Black and Red Ware Culture ইত্যাদি। এই culture বা সংস্কৃতিগুলিকে বিভিন্ন সময়ের হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ধরা হয় যে এগুলি বিভিন্ন সময়ে উন্নত ও ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ দেখা গেছে। দেখা যাচ্ছে যে সিন্ধু-সরস্বতী অঞ্চলে সবকটি কালচার-এর নিদর্শ পাওয়া যাচ্ছে। PGW কে গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য আগমণের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছিল এবং এর কাল নির্ণয় করা হয়েছিল 1100 BC। আগমবাদীরা এর সাহায্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে আর্যরা 1500 BC নাগাদ ভারতে প্রবেশ করে এবং 1100 BC নাগাদ গাঙ্গেয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। এখন সিন্ধু- সরস্বতী অঞ্চলে PGW পাওয়া যাওয়ায় এই তত্ত্ব ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। প্রত্নবিদ শ্যাফার তাই এই বিচার পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে বলেছেন [all these labels based on pottery styles are ill-defined and are rather unfusing and therefore best be abandoned - J.G. Shaffer, "The
Indo-Aryan Invasions: Cultural Myth and Archaeological Reality | ৮ম - উইটজেল (Michel Witzel; Harvard University) নামক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ঋকবেদের ২য় মন্ডল আফগানিস্থানে এবং ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম মন্ডলগুলি সিন্ধুর পশ্চিমতীরস্থ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত বলে বলতে চেয়েছেন ঋকবেদ ভারতের বাইরে রচিত। কিন্তু আমাদের আলোচনায় তৎকালীন ভারত বলতে এসব অঞ্চলকে ধরে-ই নির্ণয় করা হয়েছে। উইটজেল ঋকবেদের কোন-ও অংশ ইউরোপে বা পশ্চিম এশিয়ায় রচিত হয়েছে বলেন নি।
‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব' প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে কিছু পন্ডিত (থাপার, শর্মা, হাবিব, উইটজেল প্রমূখ) 'আর্য' অভিসরণ/পরিযান তত্ত্ব (Aryan Migration Theory)' প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। আমরা এখানে জানাতে চাই সমস্ত রকম প্রমাণই একথা বলে যে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার সম্পূর্নভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে হয়েছিল। অর্থাৎ আর্য সংস্কৃতির বিস্তার ভারত থেকে পশ্চিমে হয়েছিল। একথার প্রমাণে আমরা কিছু তথ্য তুলে ধরব। [যদিও আর্যজাতি বলে কিছু না, আমরা আলোচনার সুবিধার জন্য আর্য সংস্কৃতির মানুষদের 'আর্য' বলেই উল্লেখ করব]।
আর্য অভিসরণ তত্ত্ব (Aryan Migration Theory)'-এর বিরুদ্ধ প্রমাণ ১। উইটজেল 'বৌধায়ন শৌতসূত্র থেকে পুরুরৰা-উবশী কথোপকথনকে
উল্লেখ করেছেন। এই শৌতসূত্রটি তৈত্তিরীয় সংহিতার অন্তর্গত। সেখানে উবশীর দুই পুত্র – অয়ু এবং অমাবসু। মা এদের বাইরে যেতে বলছেন। অযুকে মা বলছেন পূর্বে যেতে। অয়ু পূর্বে গিয়ে বসতি স্থাপন করলে, তার সন্তান-সন্ততিরা হয় কুরু-পাঞ্চাল এবং কাশী-বিদেহ গোষ্ঠী। এরা হল আয়ভ গোষ্ঠী। অমাবসু পশ্চিমে চলে যান। তার বংশধররা হল গান্ধার, পার্শব এবং অরট্টগণ। এরা হল অমাবসব গোষ্ঠী। রাম শরণ শর্মা-র মতে অমাবসব-রা ধূসর মৃৎপাত্র এবং আয়ভ-রা ধূসর এবং উত্তরের কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র ব্যবহার করত।
উইটজেল জানালেন এভাবেই আর্য গোষ্ঠীর বিস্তার হল ভারতে। একই তথ্য নিয়ে আমরা বলব যে উত্তর পশ্চিম হিমালয় অঞ্চল থেকে আর্যদের দুই গোষ্ঠী পূবে ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে অঞ্চলের পশ্চিমে গান্ধার (অমাবসবর গেল যে দিকে) এবং পূর্বে কুরু-পাঞ্চাল ও কাশী (অয়ু যে দিকে গেল), সেটি নিশ্চয়ই ভারতের বাইরে নয়। বরং সেটি সপ্ত সিন্ধু অঞ্চল।
২। জেন্দ আবেস্তা-র সাথে ঋগ্বেদের মিল এখন সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন। একথাও স্বীকৃত যে উভয় গোষ্ঠীর লোকেরা একসময় একত্রে বসবাস করত। তাহলে কারা অভিসরন ঘটিয়েছিল?
I. আলবেরুনী তার 'তহকিক-ই-হিন্দ' গ্রন্থে বলেছেন জেন্দ-এর উপাস্য দেবতা আহুর মাজদা বা প্রধান অসুর ভারত থেকে মধ্য প্রাচ্যে যান। II. জেন্দ আবেস্তা-র গাথাগুলিতে এদের মূল ভূমি পরিত্যাগের বেদনার কথা বলা আছে ('আমি কোথায় যাব, কোথায় লুকাব, কোন দেশ আমাদের স্থান দেবে ইত্যাদি)। তুলনামূলক ভাবে বলা যায় ঋকবেদের কোথাও দেশ ত্যাগ করে আসার
কথা নেই। III. জরাথ্রষ্ট পন্থীরা যেখানে তাদের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটায় সেখানে তারা কখনই সংখ্যাগুরু ছিলেন না। তারা বহিরাগত হিসাবেই ইরানে বসবাস করত।
IV. ম্যাক্সমূলার পর্যন্ত মনে করতেন যে এরা উত্তর ভারত থেকে এসেছিল ["The Zoroastrians were a colony from Northern India..(they) migrated west ward to Archosia and Persia' - Science and Language, vol-III, page 279]
জেন্দ-এ 'হারখাওয়াতি' নামক নদীর বিবরণ আছে। এটি অবশ্যই ভারতের সরস্বতী নদী। এরা 'স'-কে 'হ' উচ্চারণ করেছে। তাই 'অসুর' হয়েছে 'আহুর মাজদা'। আবেস্তাপন্থীদের বসবাসের স্থানে এই নামে কোন নদী নেই। ৩। শর্মা ঋকবেদের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন
মরুৎ-এর উপাসকগণ সরযু, সিন্ধু এবং সিন্ধুর চারটি শাখানদী পার হয়ে সিন্ধুর পূর্ব পারে আবির্ভূত হয়েছিল। অর্থাৎ তারা ভারতে বহিরাগত। আমরা আর্যদের প্রাথমিক বসতিক্ষেত্র হিসাবে উত্তর-পশ্চিম হিমালয়কেই চিহ্নিত করেছি। সেসব অঞ্চল ছেড়ে সমতল অঞ্চলে আসতে হলে ঐসব নদীগুলিকেই (রসা, কুভা, ক্রুমু, সিন্ধু ও সরযূ) পার হতে হয়। ঐ নদীগুলি পার্বত্য অঞ্চলে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত। এই উদাহরণটি আর্যদের বাইরে থেকে ভারতে আসার কথা না বলে পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে সমতলে আসার কথা বলে।
৪। গ্রান্টোভস্কি ও বনগার্ড লাভিন তাদের ‘The Origin of Aryans from Scythia to India' নামক গ্রন্থে আর্যদের বহিরাগমণের পক্ষে জানিয়েছেন ব্যাসদেবপুত্র শুকদেব মর্ত্যে আসার সময় নদী, হ্রদ, পর্বত ডিঙ্গিয়ে আর্যাবর্তে
আসেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব-এর আমলে আর্যাবর্ত বলতে হরিয়ানা-দিল্লী পাঞ্জাবকে ধরতে হবে। এ সময়ে আর্যরা সমতল অঞ্চলে বেশ গুছিয়ে বসেছে। সেসময় ব্রাহ্মণ ঋষিদের সাথে তদানীন্তন 'স্বর্গ'-এর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মহাভারতে দেখা যায় রাজা পাণ্ডু বনবাসকালে লোমশ ঋষিদের পায়ে হেঁটে মর্ত্য থেকে স্বর্গে যেতে দেখেছেন। তাই শুকদেবের ‘মর্ত্যে আসা' বিদেশ থেকে ভারতে আসা নয়। ৫। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বৈদিক ও পৌরাণিক নানা দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেছেন (Political History of Ancient India) যদুগণ, তুর্বসুগণ, কুরুগণ ও উত্তর মদ্রগণ পর্বতমালা বা The Great Himalayan Mountain বলা হয়, তা প্রাচীন বৈদিক ভারতে হিমালয়, হেমকূট, নিষধ ইত্যাদি নানা পর্বত নামে বিভক্ত ছিল। বর্তমান ভারতে সমতলভূমির কাছাকাছি সর্বনিম্ন হিমালয়ের অংশকে শিবালিক রেঞ্জ বলা হয়, যা প্রাচীনকালে শুধুমাত্র হিমালয় নামে পরিচিত ছিল। হেমকূট, নিষধ ইত্যাদি হল বর্তমান ম্যাপ অনুযায়ী কৈলাস রেঞ্জ, লাদাখ রেঞ্জ ইত্যাদি। রায়চৌধুরী জানিয়েছেন “যারা ছিলেন ঐলদের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখা সেই কুরুগণ হিমালয়ের ওপারে উত্তরকুরু নামক অঞ্চল থেকে আগত অধিবাসী।
"হিমালয়ের ওপারে উত্তরকুরু' বলতে সমগ্র হিমালয় পর্বতমালা-র ওপারে নয়। উত্তরকুরু অঞ্চলটি তিব্বতের পশ্চিম পার্শ্বস্থ অঞ্চল যেখানে আর্যদের বসতি ছিল ৬। শিবসাধন ভট্টাচার্য (প্রাচীণ ভারতের বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস) ইংল্যান্ডের ফ্লুইড ধর্মের [মতের] বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জুলিয়াস সিজার খৃঃ পূঃ ৫৫ সালে যখন ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন তখন ব্রিটেনে ফ্লুইড ধর্ম বা Druidical Religion-এর হদিশ পান। সেই ধর্মের সর্বোচ্চ স্তরে যারা ছিলেন তারা হলেন ব্রাহ্মণ বা Druids যারা ক্ষত্রিয় তাদের বলা হত Equites। বৈশ্যদের বলা হত Plebes। অবিকল ভারতীয় বৈদিক জনভাগ। ধর্মগুরুরা মন্দিরে না থেকে জঙ্গলে থাকতেন। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয় গুরুকুল পদ্ধতি। চার্চিল তার Birth of Britain গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন 'ব্রিটেন ছিল ফ্লুইড ধর্মের প্রধান কেন্দ্র, যা নানাভাবে গল ও জার্মানদের প্রভাবিত করেছিল' [Britannia was the prime centre of the Druidical religion, which, in various forms and degrees, influenced profoundly the life of Gaul and Germany]। চার্চিল সিজারের 'কমেন্টরী' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, যারা ঐ বিষয়ে অধিক জানতে চাইত তারা
ব্রিটেনে যেত। সিজার খোঁজ নিয়ে দেখেন ফ্লুইড ধর্ম পূর্ব দিক থেকে এসেছে, ভূমধ্যসাগরের তীরে কার্থেজ হয়ে এবং ব্রিটেনে এর কেন্দ্র বানিয়েছে।
ঋকবেদ মতে চন্দ্রবংশীয় যযাতির পুত্র অনু এবং দ্রুহু ভারত থেকে বেরিয়ে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে যায়। বিষ্ণুপুরাণ (৪/১০, ১৭) অনুসারে দ্রুহু পিতার রাজত্বের পশ্চিম দিকে চলে যায়। তার বংশধরেরা উদীচ্যাদী ম্লেচ্ছগণের উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রবৃত্ত হয়। উদীচ্য মানে পশ্চিম দুনিয়া। এই দ্রুহু-রাই ফ্লুইড ধর্মের আদি পুরুষ বলে অনেকেই মনে করেন।
৭। বহুদিন ধরে সিন্ধুসভ্যতাকে অনার্য সভ্যতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে অনেকেই একে আর্য সভ্যতারই অংশ বলতে চাইছেন (বিস্তারিত আলোচনা পরে)। বি বি লাল তার The Earliest Civilization of South Asia' নামক গ্রন্থে ‘হরপ্পা যুগের প্রাপ্ত পুরাবস্তুগুলির সাথে বৈদিক সংস্কৃতির বিশেষ পার্থক্য আছে' -এ তত্ত্ব অস্বীকার করেছেন। এস পি গুপ্তা তার The Lost Saraswti and the Indus Civilization' গ্রন্থে বলেছেন, 'সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা পূর্ণ বিকশিত বৈদিক সভ্যতারই এক গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। এক্ষেত্রে সরস্বতী বলতে ঘগর-হাকরা নদীকে ধরা হয়েছে। পাঞ্জাব-হরিয়ানা রাজস্থানে এটি ঘাগর এবং পাকিস্তানে এটি হাকরা নামে চিহ্নিত। শর্মা-র মত বিরুদ্ধবাদী লোক-ও স্বীকার করেছেন (Advent of Aryans – R.C.Sharma), হাকরা শুষ্ক এলাকার ক্ষেত্রগুলিতে আর্য উপাদানও যথেষ্ট লক্ষ্যনীয়। এখন ৩০০০-৪০০০ খৃঃ পুঃ -এর সিন্ধু এলাকায় যদি আর্য সংস্কৃতিকে স্বীকার করা
হয় তাহলে মানতেই হবে যে আর্য সংস্কৃতি ভারতে বহিরাগত নয়। কারণ ঐ সময়ে পৃথিবীর আর কোথাও আর্য নিদর্শ পাওয়া যায় না। ৮। হারমাট্টা দেখিয়েছেন (The emergence of the Indo-Iranian The Indo-Iranian language) -
1. 2300-2100 BC কালীন ইরাকের আগাদে বংশের এক ক্ষুদ্র ফলকে-র লেখায় 'অরিসেনা' এবং 'সোমসেনা (অরিসেন ও সোমসেন) নামক দুটি শব্দ যা আর্যদের শব্দ।
II. আনাতোলিয়া (তুরস্ক) অঞ্চলে প্রাপ্ত হিটাইট লেখগুলি 1900-1700 BC সময়কার। হিটাইট ভাষায় 'ইনর' শব্দটি ম্যালরি মতে ‘ইন্দ্র'। III. 1600 BC-র ব্যবিলনিয়া অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে প্রাপ্ত ক্যাসাইট লেখতে প্রাপ্ত 'সূর্যাস্', 'মরুতস্', 'বুরিয়স' নামক শব্দগুলি ঋকবেদোক্ত সূর্য, মরুৎ এবং বায়ু-কে মনে করায়। হোমার-এর রচনায় (900 BC) বায়ু অর্থে বোরিয়াস শব্দের ব্যবহার আছে। কয়েকজন ক্যাসাইট রাজার নামের শেষে 'বুরিয়স' কথাটি দেখা যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ইন্দস্’ শব্দটি ব্যবহার করতেন যা ইন্দ্র শব্দের সদৃশ।
IV. 1400 BC-এর উত্তর সিরিয়া-তে বা মিতান্নি-দের দেশে মিতান্নি লেখতে মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র, নাসত্য প্রভৃতিদের উল্লেখ আছে। এশিয়া মাইনরের বোঘাজকোই অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালেখ (1400 BC) এবং সম সময়ে মধ্য মিশরের তেল-এ-অমরনা তে বেশ কয়েকটি পত্র বা চিঠি পাওয়া গেছে। বোঘাজকোই লেখতে হিটাইট রাজাদের সাথে এবং তেল-এ-অমরনায় মিতান্নি রাজাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের ইঙ্গিত আছে। এই চুক্তির রক্ষাকর্তা হিসাবে ঋক দেবতাদের উল্লেখ আছে, সংস্কৃত ঘেষা (দেবনাগরী –র পূর্বসুরী) কোন লিপিতে। তবে মূল চুক্তিতে এ ধরনের শব্দ নেই।
V. 1200 BC-র আসিরিয় সাম্রাজ্যের এক লেখ পাওয়া যায়। এতে বলা আছে "মুসকি' নামক জাতি আসিরিয়া আক্রমণ করেছিল। 'মুসকি' শব্দের উৎপত্তি ঋকবেদের 'মুষক' থেকে যার অর্থ 'ইঁদুর'। অর্থাৎ ইঁদুর' এদের টোটেম ছিল।
তাহলে আর্য কারা?
যদি ভাষাতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জিনগতভাবে আর্যজাতি বলে কিছু-র অস্তিত্ব না থাকে তাহলে এই প্রশ্ন আসবে যে 'আর্য' বলতে তাহলে কি বোঝায়। ঋকবেদ ও জেন্দ আবেত্তা, উভয় গ্রন্থেই ‘আর্য' শব্দের প্রচুর প্রয়োগ পাওয়া যায়। ইরান দেশের নামটি আর্য Arya বা Aryan শব্দসম্ভূত। 600 BC নাগাদ পারস্যের রাজা দারিয়াস নিজেকে ‘আর্য বলে অভিহিত করেছেন। বেদ ও আবেস্তার রচনাকার ও অনুসরণকারীরা নিজেদের 'আর্য' বলে অভিহিত করেছেন। হিটাইট ভাষায় 'আর্য' শব্দ এবং জার্মান ভাষায় আর্য-সগোত্র শব্দ পাওয়া যায়।
তাহলে আর্য কারা ? Encyclopedia Britannica - 14th Edition পর্যন্ত 'আর্য' শব্দটির অর্থ ছিল 'মহৎ ব্যাক্তি'। কিন্তু 1993-এর 15th Edition –এ এর অর্থ বদলে বলা হল ভারতে অনুপ্রবেশকারী নরগোষ্ঠী।
ম্যাক্সমূলার 'আর্য' শব্দের উৎপত্তি হিসাবে অর' ধাতুরূপকে গ্রহণ করেছিলেন। 'অর' ধাতুরূপের অর্থ 'লাঙল বা চাষ করা'। সেখান থেকে তিনি 'আর্য' কথার অর্থ করেন কৃষক বা চাষবাসকারী In ar or ara, I recognize one of the oldest names of the earth, as the ploughed land, lost in Sanskrit but preserved in Greek as (era) so that Aryan would have conveyed originally the meaning of landholder, cultivator of the land] অভিধানে এর মূল ধাতুরূপ দেখিয়েছেন 'র' বা 'ঋ'
কিন্তু ভি এস আপ্তে তার এবং তার আগে 'আ' যুক্ত হয়ে বিপরীতার্থক শব্দরূপে আর্য শব্দের অর্থ হল ভদ্র ও সন্মানীয় ব্যক্তি। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র দত্ত তার 'হিন্দুশাস্ত্র নামক গ্রন্থে বলেছিলেন, আর্য শব্দের
সংজ্ঞা হল
‘কর্তব্যম আচরণ অকর্তব্যম অনাচারম্।
তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে সঃ যঃ আর্য ইতি স্মৃতি ৷৷
- অর্থাৎ যিনি কর্তব্য পালন করেন, অকর্তব্য করেন না, সদাচারে থাকেন, তিনি ই আর্য। বৌদ্ধরা অরিয়ো', 'অয়ির, অয্য' এই তিনরূপে আর্য শব্দ ব্যবহার করত, যার অর্থ ছিল – right, good, ideal, noble আর্যের' বলতে অনরিয়' শব্দ প্রয়োগ করা হত। যার অর্থ ছিলundignified, uncultured
আর্যাবর্ত কাকে বলে
পতঞ্জলি আর্যাবর্ত বলতে বুঝিয়েছেন –
'এই দেশটা আদর্শ-এর পূর্ব দিকে, কলকবনের পশ্চিমদিকে, হিমালয়ের দক্ষিণে এবং পারিযাত্রা-র উত্তরদিকে'।
বশিষ্ঠ এবং বোধায়ণের মতে, সিন্ধুনদী এবং আসামের মধ্যবর্তী অঞ্চল-ই আর্যভূমি। সাধারণতঃ ধর্মসূত্রের লোকেরা বলেন গঙ্গা-যমুনা দোয়ার অঞ্চল-ই আর্যভূমি [Indian Historical Quarterly, Vol. IV, 1928; essay by H.C.Chakladar]
মনু সংহিতা –য় দ্বিতীয় অধ্যায়ে আর্যাবত সম্পর্কে বলা আছে
आ समुद्रात्तु वै पूर्वादा समुद्राच्च पश्चिमात् ।तयोरेवान्तरं गिर्योरार्यावर्तं विदुर्बुधाः । 2/22
पूर्व समुद्र से लेकर पश्चिम समुद्र तक उन्हीं हिमालय और विन्ध्य पर्वतों के अन्तवर्ती उसी ब्रह्मावर्त को विद्वान् लोग आर्यावर्त समझते हैं।
टिप्पणी :
१. आर्यावर्त की अवधि उत्तर में हिमालय, दक्षिण में विन्ध्याचल, पूर्व और पश्चिम में समुद्र; तथा पश्चिम में सरस्वती, अटक नदी (सिन्धु) जो उत्तर के पहाड़ों से निकल कर पश्चिम के समुद्र की खाड़ी में मिली है, और पूर्व में द्षद्वती, जो नेपाल के पूर्वभाग पहाड़ से निकल के बंगाल और आसाम के पूर्व और ब्रह्मा के पश्चिम ओर होकर दक्षिण के समुद्र में मिली है जिसको ब्रह्मपुत्रा कहते हैं, है। हिमालय की मध्यरेखा से दक्षिण ओर और पहाड़ों के भीतर और रामेश्वर पर्यन्त विन्ध्याचल के भीतर जितने देश हैं, उन सब को आर्यावर्त इसलिए कहते हैं कि यह आर्यावर्त देव अर्थात् विद्वानों ने बसाया और आर्यजनों के निवास करने से ‘आर्यावर्त’ कहाया है। (स० स० ८) आर्या आवर्तन्ते पुनः पुनः वर्तन्तेऽत्रेति आर्यावर्त्तः। हिमालय, विन्ध्याचल, सिन्धु नदी और ब्रह्मपुत्रा नदी, इन चारों के बीच, और जहाँ तक उनका विस्तार है, उनके मध्य में जो देश है, उसका नाम आर्यावर्त है। (आर्योदेश्यरत्नमाला)
[ पण्डित चन्द्रमणि विद्यालंकार]
translate-[poorv samudr se lekar pashchim samudr tak unheen himaalay aur vindhy parvaton ke antavartee usee brahmaavart ko vidvaan log aaryaavart samajhate hain.1 tippanee : 1. aaryaavart kee avadhi uttar mein himaalay, dakshin mein vindhyaachal, poorv aur pashchim mein samudr; tatha pashchim mein sarasvatee, atak nadee (sindhu) jo uttar ke pahaadon se nikal kar pashchim ke samudr kee khaadee mein milee hai, aur poorv mein dshadvatee, jo nepaal ke poorvabhaag pahaad se nikal ke bangaal aur aasaam ke poorv aur brahma ke pashchim or hokar dakshin ke samudr mein milee hai jisako brahmaputra kahate hain, hai. himaalay kee madhyarekha se dakshin or aur pahaadon ke bheetar aur raameshvar paryant vindhyaachal ke bheetar jitane desh hain, un sab ko aaryaavart isalie kahate hain ki yah aaryaavart dev arthaat vidvaanon ne basaaya aur aaryajanon ke nivaas karane se ‘aaryaavart’ kahaaya hai. (satyartha prakasth 8) aarya aavartante punah punah vartantetreti aaryaavarttah. himaalay, vindhyaachal, sindhu nadee aur brahmaputra nadee, in chaaron ke beech, aur jahaan tak unaka vistaar hai, unake madhy mein jo desh hai, usaka naam aaryaavart hai. (aaryodeshyaratnamaala)]
‘আসমুদ্ৰাত্তু বৈ পূর্বাৎ আসমুদ্ৰাত্তু পশ্চিমাৎ।
তয়োরেবান্তরং গির্যোরার্যাবর্ভং বিদুবুর্ধাঃ ।। ২/২২
অর্থাৎ পূর্ব পশ্চিমে সমুদ্রদ্বয় ও উত্তর দক্ষিণে পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানকে আর্যাবর্ত বলে। এখন উত্তরকুরু-র স্বর্গভূমি ছেড়ে আর্যবিতে আসতে হলে পাহাড়, পর্বত, নদী, হ্রদ তো অতিক্রম করতেই হবে। অর্থাৎ আর্যাবর্ত-এর উত্তরে পর্বত, নদী ও হ্রদ আছে কিন্তু সমুদ্র নেই।
অমরকোষ মতে বিন্ধ্য ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে আর্যবর্ত বলে। (বিন্ধ্যহিমালয়োমধ্যম আৰ্য্যাবর্ভঃ পূণ্যভূমিশ্চোচয়তে অধ্যায়)। অমরকোষ, ভূমিবর্গ ১৬ অধ্যায়।
বিঃদ্রঃ আর্যোদেশ্য রত্নমালা গ্রন্থে বিস্তৃত বর্ননা আছে।
চলবে....>>
পুরানো পোষ্ট সমূহঃ
২) আর্য কারা
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ