ব্রহ্মযজ্ঞ-(অধ্যাপনং ব্রহ্ময়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) বেদ শাস্ত্রের স্বাধ্যায় অন্যকে স্বাধ্যায় করানো, সন্ধ্যোপসনা করা ব্রহ্মযজ্ঞ বলে।
মিমীহি শ্লোকমাস্যে পর্জন্য ইব ততনঃ।
গায় গায়ত্রমুক্থ্যম্।। (ঋ০ ১।৩৮।১৪)
পদার্থঃ হে বিদ্বান! (শ্লোকম্) বেদবাণীকে (আস্যে) নিজের মুখে (মিমীহি) ভরে নাও, আবার ওই বেদবাণীকে (পর্য়ন্যঃ ইব ততনঃ) মেঘ-বাদলের সমান গর্জন করে দূর-দূর পর্যন্ত গম্ভীর স্বর দ্বারা প্রচার করো, তাহার উপদেশ সর্বত্র করো। (গায়ত্রম্) প্রাণের রক্ষাকারী (উক্থ্যম্) বেদ মন্ত্রকে (গায়) স্বয়ং গান করো, স্বয়ং পড় আর অন্যকে পড়াও।।১৪।।
ভাবার্থঃ প্রস্তুত মন্ত্রে মনুষ্য মাত্রের জন্য কি সুন্দর শিক্ষার সমাবেশ দিয়েছে।
১.প্রত্যেক মনুষ্যের বেদ-মন্ত্রের দ্বারা নিজের মুখে ভরে নেওয়া উচিত, মন্ত্রকে পড়া-পড়ে তাহার কন্ঠস্থ করা উচিত।
২.বেদ পড়ে যে জ্ঞানামৃত প্রাপ্ত হয় তাহাকে নিজের কাছেই সীমিত রাখা উচিত নয়, পরন্তু যে প্রকার বাদল সমূদ্র থেকে জল নিয়ে তাহাকে গম্ভীর গর্জনের সাথে সর্বত্র বর্ষণ করেন ওই প্রকার মনুষ্যেরও বেদরূপী সমূদ্র থেকে রত্ন আর জ্ঞানের সঞ্চয় করে তাহার লেখন আর বাণী দ্বারা প্রচার করা উচিত।
৩.বেদে আয়ুবৃদ্ধির, স্বাস্থ্যরক্ষার আর প্রাণশক্তিকে বলিষ্ঠ বানানোর সহস্র মন্ত্র আছে। শরীর রক্ষার জন্য এই প্রকারের মন্ত্রকে স্বয়ং পড়া উচিত আর অন্যকে পড়ানো উচিত।।১৪।।
ভাষ্যঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী
মিমীহি শ্লোকমাস্যে পর্জন্য ইব ততনঃ।
সায়ংসায়ং গৃহপতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা।
বসোর্বসোর্বসুদান এনি বয়ং ত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম।।৩।। (অথর্ব০ ১৯।৫৫।৩)
পদার্থঃ (সায়ংসায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলা (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (সৌম্যনসস্য) সুখ (দাতা) প্রদাতা (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে প্রকাশিত করিয়ে (বয়ম্) আমরা মনুষ্য (তন্বম্) শরীরকে (পুষেম) পুষ্ট করি।।৩।।
ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৩।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
সায়ংসায়ং গৃহপতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা।
বসোর্বসোর্বসুদান এনি বয়ং ত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম।।৩।।
প্রাতঃপ্রাতর্গৃহপতির্নো অগ্নিঃ সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা।বসোর্বসোর্বসুদান এধীন্ধানাস্ত্বা শতংহিমা ঋধেম।।৪।।পদার্থঃ (সায়ংসায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলা (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (সৌম্যনসস্য) সুখ (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে প্রকাশিত করে (বয়ম্) আমরা মনুষ্য (তন্বম্) শরীরকে (পুষেম) পুষ্ট করি।।৩।।(প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (সায়ং সায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলাতে (সৌমনসস্য) সুখের (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে (ইন্ধানাঃ) প্রকাশিত করিয়ে (শতংহিমাঃ) শত শীতল ঋতুতে আমরা মনুষ্য (ঋন্ধানাঃ) উন্নতি করি।।৪।।ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৩-৪।।গৃহপতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা।বসোর্বসোর্বসুদান এনি বয়ং ত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম।।৩।।প্রাতঃপ্রাতর্গৃহপতির্নো অগ্নিঃ সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা।বসোর্বসোর্বসুদান এধীন্ধানাস্ত্বা শতংহিমা ঋধেম।।৪।।পদার্থঃ (সায়ংসায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলা (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (সৌম্যনসস্য) সুখ (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে প্রকাশিত করে (বয়ম্) আমরা মনুষ্য (তন্বম্) শরীরকে (পুষেম) পুষ্ট করি।।৩।।(প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (সায়ং সায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলাতে (সৌমনসস্য) সুখের (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে (ইন্ধানাঃ) প্রকাশিত করিয়ে (শতংহিমাঃ) শত শীতল ঋতুতে আমরা মনুষ্য (ঋন্ধানাঃ) উন্নতি করি।।৪।।ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৩-৪।।সায়ংসায়ং গৃহপতির্নো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা।বসোর্বসোর্বসুদান এনি বয়ং ত্বেন্ধানাস্তন্বং পুষেম।।প্রাতঃপ্রাতর্গৃহপতির্নো অগ্নিঃ সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা।বসোর্বসোর্বসুদান এধীন্ধানাস্ত্বা শতংহিমা ঋধেম।।৪।।পদার্থঃ (সায়ংসায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলা (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (সৌম্যনসস্য) সুখ (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন দানকারী (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে প্রকাশিত করে (বয়ম্) আমরা মনুষ্য (তন্বম্) শরীরকে (পুষেম) পুষ্ট করি।।৩।।দেবযজ্ঞ-(হোমঃ দৈবঃ। মনু০ ৩/৭০) সায়ং-প্রাতঃ হবন করা দেবযজ্ঞ বলে।
দেবযজ্ঞ-(হোমঃ বেঃ। মনু০ ৩/৭০) সায়ং-প্রভাতে হবন করা দেবযজ্ঞ বলে।
প্রাতঃপ্রাতর্গৃহপতির্নো অগ্নিঃ সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা।
বসোর্বসোর্বসুদান এধীন্ধানাস্ত্বা শতংহিমা ঋধেম।।৪।। (অথর্ব০ ১৯/৫৫/৪)
পদার্থঃ (প্রাতঃ প্রাতঃ) প্রাতঃ-প্রভাতে (নঃ) আমাদের (গৃহপতিঃ) ঘরের রক্ষক আর (সায়ং সায়ম্) সায়ং-সন্ধ্যাবেলাতে (সৌমনসস্য) সুখের (দাতা) দানকারী (অগ্নিঃ) অগ্নি [জ্ঞানবান পরমেশ্বর বা বিদ্বান পুরুষ ও ভৌতিক অগ্নি] তুমি (বসোর্বসোঃ) উত্তম-উত্তম প্রকারে (বসুদানঃ) ধন প্রদাতা (এধি) হও। (ত্বা) তোমাকে (ইন্ধানাঃ) প্রকাশিত করিয়ে (শতংহিমাঃ) শত শীতল ঋতুতে আমরা মনুষ্য (ঋন্ধানাঃ) বিস্তার হতে থাকি।।৪।।
ভাবার্থঃ মনুষ্যের পরমেশ্বরের উপাসনা, বিদ্বানের সৎসঙ্গ আর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা স্বাস্থ্য উন্নতি করে ধনবৃদ্ধি করা উচিত।।৪।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
সমিধাগ্নিং দুবস্যত ঘৃতৈর্বোধয়াতিথিম্।
সমিধাগ্নিং দুবস্যত ঘৃতৈর্বোধয়াতিথিম্।
অস্মিন্ হব্য জুহোতন।।১।। (যজুর্বেদ ৩/১)
পদার্থঃ হে বিদ্বানগণ! তোমরা (সমিধা) যে জ্বালানি দ্বারা উত্তম প্রকার প্রকাশ হয়, ওই কাঠ-ঘী আদির দ্বারা (অগ্নিম্) ভৌতিক অগ্নিকে (বোধয়ত) উদ্দীপন অর্থাৎ প্রকাশিত করো তথা যেরূপ (অতিথিম্) অতিথিকে অর্থাৎ যাহার আসা-যাওয়া বা নিবাসের কোন দিন-সময় নেই, ওই সন্ন্যাসীর সেবন করায়, ঐরূপ অগ্নির (দুবস্যত) সেবন করাও আর (অস্মিন্) এই অগ্নিতে (হব্যা) সুগন্ধ কস্তুরী, কেসর আদি, মিষ্টি, গুড়, চিনি আদি পুষ্ট ঘী, দুধ আদি, রোগ নাশক সোমলতা আদি ওষধি, এই চার-প্রকারের সমগ্রতাকে (আজুহোতন) উত্তম প্রকার হবন করো।।১।।
ভাবার্থঃ এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালংকার আছে। যেরূপ গৃহস্থ মনুষ্য আসন, অন্ন, জল, বস্ত্র আর প্রিয় বচন আদি দ্বারা উত্তম গুণবান সন্ন্যাসী আদির সেবন করায়, ঐরূপই বিদ্বান গণের যজ্ঞ, বেদী, কলাযন্ত্র আর যানে স্থাপন করো যথাযোগ্য জ্বালানী, ঘী, জলাদি দ্বারা অগ্নিকে প্রজ্বলিত করে বায়ু, বর্ষা জলের শুদ্ধি বা যানের রচনা নিত্য করা উচিত।।১।।
ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
পিতৃযজ্ঞ- (তর্পণং পিতৃয়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) মাতা-পিতা আদির সেবা-সুশ্রূষা তথা ভোজন আদি দ্বারা তৃপ্তি করা পিতৃযজ্ঞ বলে।
উর্জং বহন্তীরমৃতং ঘৃতং পয়ঃ কীলালং পরিশ্রুতম্।
স্বধাস্থ তর্পয়ত মে পিতৃন্য।। (যুজুর্বেদ ২/৩৪)
পদার্থঃ হে পুত্রাদি! তোমরা (মে) আমার (পিতৃন্) পূর্বোক্ত গুণযুক্ত পিতা-মাতার (ঊর্জম্) অনেক প্রকারের উত্তম-উত্তম রস (বহন্তীঃ) সুখ প্রাপ্তকারী স্বাদিষ্ট জল (অমৃতম্) সব রোগের দূর প্রদানকারী ওষধি মিষ্টাদি পদার্থ (পয়ঃ) দুধ (ঘৃতম্) ঘী (কীলালম্) উত্তম-উত্তম রীতি দ্বারা রন্ধন করা অন্ন তথা (পরিস্রুতম্) রসে রসালো ফল দিয়ে (তর্পয়ত) তৃপ্ত করো। এই প্রকার তুমি তাহাদিগের সেবন দ্বারা বিদ্যার প্রাপ্ত হয়ে (স্বধাঃ) পরধনকে ত্যাগ করে নিজের ধনের সেবনকারী (স্থ) হও।।
ভাবার্থঃ ঈশ্বর আজ্ঞা দেন যে সব মনুষ্যের পুত্র আর চাকর আদির আজ্ঞা দিয়ে বলতে চায় যে তোমাদের আ পিতাদি অর্থাৎ পিতা-মাতা আদি বা বিদ্যা প্রদানকারীর প্রীতি দ্বারা সেবা করার যোগ্য। যেরূপ তোমাদিগের বাল্যাবস্থা বা বিদ্যাদানের সময় তোমাদের পালন করেছ, ঐরূপ তোমরাও তাহাদের সব সময়ে সৎকার করার যোগ্য, যাহা দিয়ে আমরা লোকের মধ্যে বিদ্যার নাশ আর কৃতজ্ঞতা আদি দোষ কখনো প্রাপ্ত না হই।।৩৪।। ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
অতিথিযজ্ঞ-(অতিথিপূজনম্ নুয়জ্ঞঃ। মনু০ ৩/৭০) অতিথিদের ভোজন দেওয়া আর সেবা করে সৎকার করা নৃযজ্ঞ অথবা অতিথিযজ্ঞ বলে।
অশিতাবত্যতি থাবশ্নীয়াদ্যজ্ঞস্য সাkত্মত্বায়।
য়জ্ঞস্যাবিচ্ছেদায় তদ্ব্রতম্।।৮।।
এতদ্বা উ স্বাদীয়ো য়দধিগবং ক্ষীরং।
বা মাংসং বা তদেব নাশ্নীয়াত্।।৯।। (অথর্ব০ ৯/৬/৮-৯)
পদার্থঃ (অতিথৌ অশিতবতি) অতিথির ভোজন করার পরে (অশ্নীয়াত্) সে [গৃহস্থ] আহার করবে, (য়জ্ঞস্য) যজ্ঞ [দেব পূজা, সঙ্গতিjরণ আর দান] এর (সাত্মত্বায়) অনুভূতির জন্য আর (য়জ্ঞস্য) যজ্ঞের (অবিচ্ছেদায়) নিরন্তর প্রবৃত্তির জন্য (তত্) সে (ব্রতম্) নিয়ম।।৮।।
ভাবার্থঃ অতিথির সৎকার করাতে গৃহস্থর শুভকর্ম নির্বিঘ্ন হয়ে সদা চলতে থাকে।।৮।।
পদার্থঃ (এতদ্ বৈ) ইহা (উ) নিশ্চয় করে (স্বাদীয়ঃ) অধিক উত্তম-স্বাদযুক্ত, (য়ত্) যে (তত্ এব) তাহাকেই (অধিগবম্) অধিকৃত জল, (বা) আর (ক্ষীরম্) দুধ (বা) আর (মাংসম্) মনন সাধক [বুদ্ধিবর্ধক] বস্তুকে (ন) এখন [অতিথির ভোজন করানোর পরে-ম০৮] (অশ্নীয়াত্) সে [গৃহস্থ] আহার করবে।।৯।।
ভাবার্থঃ গৃহস্থের ইহাই সুখদায়ী হয় যে তিথির উত্তম-উত্তম রুচিকারক বুদ্ধিবর্ধক পদার্থ ফল, বাদাম, অক্ষোট আদি ভোজন করিয়ে আপনি ভোজন করবেন, যাহা থেকে সে সৎকৃত বিদ্বাস যথাবত উপদেশ করেন।।৯।। ভাষ্যঃ পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী
বলিবৈশ্বশ্বদেব যজ্ঞের বিধান-
বৈশ্বদেবস্য সিন্ধস্য গৃহ্যেহগ্নৌ বিধিপূর্বকম্।
আভ্যঃ কুর্য়াদ্দেতাভ্যো ব্রাহ্মনো হোমমন্বহম্।। (মনু০ ৩/৮৪)
ব্রাহ্মণ অর্থাৎ প্রত্যেক দ্বিজ ব্যক্তি পাকশালার অগ্নিতে বিধিপূর্বক সিদ্ধ=তৈরী হয়ে বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞের ভাগের ভোজনকে প্রতিদিন। এই দেবতাদের=ঈশ্বরীয় দিব্যগুণের চিন্তন পূর্বক আহুতি দিয়ে হবন করেন।
অহরহর্বলিমিত্তে হরন্তোহশ্বায়েব তিষ্ঠতে ঘাসমগ্নে।১। (অথর্ব০ (১৯/৫৫/৬)
রায়স্পোষেণ সমিষা মদন্তো মা তে অগ্নে প্রতিবেশা রিষাম।২। (অথর্ব০ (১৯/৫৫/১)
পদার্থঃ (অহরহর্বলি) হে পরমেশ্বর! আপনার আজ্ঞায় যাহারা প্রতিদিন বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাহারা (রায়ষ্পোষেণ) চক্রবর্ত্তী রাজ্যলক্ষ্মী ও ঘৃত, দুগ্ধাদি পুষ্টিকর পদার্থ প্রাপ্তি ও সম্যক শুভেচ্ছা দ্বারা, (মদন্তঃ) নিত্যানন্দ প্রাপ্ত হন, এবং মাতা, পিতা ও আচার্যদিগের প্রীতিপূর্বক উত্তমোত্তম পদার্থ দ্বারা নিত্য সেবা করেন। (অশ্বায়েব তিষ্ঠন্তে ঘাসম্) যেরূপ অশ্বের সম্মুখে তাহার ভক্ষ্য তৃণ, লতাদি এবং পানার্থ জলাদি প্রচুর পরিমাণে সংস্থাপিত হয়, সেই রূপ পিতা, মাতা ও আচার্যর সেবার জন্য বহুবিধ উত্তমোত্তম পদার্থ প্রদান পূর্বক তাহাদিগের প্রসন্নতা সম্পাদন করিবে। ।১।।
(মা তে অগ্নে প্রতিবেশরিসাম) হে পরম গুরু ঈশ্বর! আপনার আজ্ঞার বিরুদ্ধ ব্যবহারে আমরা যেন কদাপি প্রবৃত্ত না হই। অন্যায় পূর্বক আমরা যেন কদাচিৎ কোন প্রাণীকে পীড়া না দেই, পরন্তু সমস্ত জীবনমাত্রকে নিজ মিত্রবৎ ও আপনাকে সকলের মিত্রজ্ঞান করিয়া পরস্পরের উপকার সাধনে রত থাকি। ইহাই ঈশ্বর আজ্ঞা।।২।। ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
।।বেদানুকূল পঞ্চমহাযজ্ঞ সমাপ্ত হল।।
‘যজ’ ধাতু, ‘ঞ’ প্রত্যয় করে যজ্ঞ শব্দ নিষ্পন্ন হয় এর অর্থ হল কর্ম। মানুষ যা কিছু কর্ম করে তাকে আমরা যজ্ঞ বলতে পারি। অগ্নির এরূপ সামর্থ্য আছে যে উহাতে আহুতি দিলে বায়ু এবং দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ সকলকে ছিন্ন ভিন্ন ও লঘু করিয়া উহাদিগকে বহির্গত করাইয়া, পবিত্র বায়ুর প্রবেশ করায়। প্রত্যেক মনুষ্যের ১৬ আহুতি ও অন্যুন ৬ মাসা পরিমাণে ঘৃত এক এক আহুতিতে থাকা উচিৎ, ইহাপেক্ষা অধিক ও দিলে উত্তম হয়। আম কাষ্ঠ, গুড়, ঘি কালো তিল দ্বারা যজ্ঞ আহুতি দিলে বায়ুতে cfc মাত্রা যদি ১০০% থাকে তবে তার মাত্রা কমে ১৫% এর মধ্যে হয় যা প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত ২৭ দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে, ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে o3 গ্যাস(Ozone is a natural gas composed of three atoms of oxygen. Its chemical symbol is O3) উৎপন্ন হয় এবং ethylene oxide gass তৈরী হয়। prof. Om Prakash pandey এর ভাষায় ওজোন হচ্ছে অক্সিজেনের একটি সক্রিয় রূপভেদ। এর সংকেত O3।
ড. হাফকিন বলেছেন, “ঘি এবং চিনি মিশ্রণ করে যজ্ঞে পোড়ালে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় তা বিভিন্ন রোগজীবাণু ধ্বংস করে।” প্রফেসর টিলওয়ার্ড বলেন, “চিনি মিশ্রিত হবিষ্যের পরিবেশ শোধনের শক্তি রয়েছে। এটি যক্ষ্মা, মিলস, বসন্ত প্রভৃতি জীবাণুনাশক।”
গায়ত্রী পরিবার আয়োজিত গোরখপুরে অশ্বমেধ যজ্ঞ চলাকালীন সময়ে “উত্তর প্রদেশ দূষণ রক্ষা বোর্ড” এর ডিরেক্টর ড. মনোজ গর্গ একদল বিজ্ঞানী নিয়ে বেশকিছু পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষার ফল “অখণ্ড জ্যোতি” সাময়ীকির সেপ্টেম্বর ’৯৭ সংখ্যাতে প্রকাশ পায়। যা যজ্ঞের ব্যাপক উপযোগিতা ফুটিয়ে তুলে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যজ্ঞ সম্পাদনের পূর্বে সে স্থানে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩.৩৬ ও ১.১৬ ইউনিট এবং যজ্ঞ সম্পাদনের শেষে বিষাক্ত গ্যাস দুটির পরিমাণ কমে দাড়ায় যথাক্রমে ০.৮০ ও ১.০২ ইউনিট। বিজ্ঞানীর দল যজ্ঞকুণ্ডের কিছু দূরে অবস্থিত জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করেও অভূতপূর্ব ফল লাভ করেন। তাঁরা দেখতে পান সংগৃহীত নমুনায় যজ্ঞের পূর্বে ব্যাকটেরিয়া ছিল ৪৫০০ এবং যজ্ঞের শেষে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে দাড়ায় ১২৫০। যজ্ঞাবশিষ্ট যে ছাই ছিল তাতে মিনারেল পদার্থের পরিমাণ পরীক্ষা করে উত্তর প্রদেশ কৃষির ডেপুটি ডিরেক্টর একে উত্তর মৃত্তিকা উর্বরকারক বলে মত দেন। ১৯৯৩-১৯৯৫ পর্যন্ত ২৭টি যজ্ঞভিত্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রত্যেকটিই বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে যজ্ঞের উপযোগিতা ব্যাপকহারে সমর্থন করে।
আপনারা অনেকেই ভূপাল ট্র্যাজেডির কথা শুনেছেন, যেখানে বিষাক্ত এমআইসি গ্যাস নির্গমনের ফলে শতশত মানুষ মারা যায় এবং সহস্র মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এই গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছিল মাইলের পর মাইল। ৪মে ১৯৮৫ এর দৈনিক “দ্যা হিন্দি” এর একটি প্রতিবেদন সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “দূষণ প্রতিরোধে বৈদিক উপায়।” যেখানে বলা হয় ওই গ্যাস প্ল্যান্টের খুব নিকটবর্তী সোহান লাল খুশওয়া এর পরিবারের কোনো সদস্যই ওই ঘটনার ফলে মৃত্যু তো দূরে থাক অসুস্থই হয় নি। কারণ কি? অগ্নিহোত্র। হ্যাঁ একমাত্র এই পরিবারটিই সেখানে নিয়মিত বৈদিক অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করত। যার ফল স্বরূপ এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পায় পরিবারটি। আর এই ঘটনা পরিবেশ দূষণ রোধে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কার্যকারিতা পুনরায় প্রতিপাদন করল।
তাই তো বৈদিক ধর্ম ঘোষণা দিয়েছে “য়জ্ঞো বৈ শ্রেষ্ঠতম কর্মম্”। ভগবানও বলেছেন যজ্ঞের মাধ্যমে মনীষিরা কেবল নিজের চিত্ত শুদ্ধিই ঘটায় না, সেই সাথে ভূত অর্থাৎ পরিবেশের শুদ্ধতাও বজায় রাখে। আর কলির এ দুঃসময়ে আমরা যজ্ঞবিমুখী হয়ে কেবল অন্ধকারেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। তাই আমাদের উচিত পুনরায় অগ্নিহোত্র আদি যজ্ঞ আয়োজনের মাধ্যমে সনাতনের স্বর্ণযুগে ফিরে যাওয়া। যেদিন ঘরে ঘরে সুবাসিত অগ্নিহোত্রের গন্ধ ছেয়ে যাবে এবং মুখে মুখে গায়ত্রীর পবিত্র ধ্বনি উচ্চারিত হবে সেদিনই কলি হবে পরাহত এবং ফিরে আসবে সনাতনের স্বর্ণযুগ।
যজ্ঞের মহত্বতার গুনগান করে বেদ বলছে যে, সত্যনিষ্ঠ বিদ্বান লোক যজ্ঞ দ্বারাই পূজনীয় পরমেশ্বরের পূজা করে। "যজ্ঞ বৈ শ্রেষ্ঠতম কর্ম " আদি বচন অনুসারে যজ্ঞ কর্মেই সব শ্রেষ্ঠ ধর্মের সমাবেশ হয়ে থাকে। যাহাতে হিংসার কোন স্খান নেই, এজন্যই যজ্ঞে "অধ্বর" শব্দটি এসেছে। নিরুক্ত ১।৮ এ অধ্বর শব্দের অর্থ হিংসরহিত করা হয়েছে। এ জন্য ঋগবেদে বলা হয়েছে যে, এই হিংসারহিত যজ্ঞেই বিদ্বানরা সুখ প্রাপ্ত করে থাকে (ঋগ্বেদ ১।১।৪)।
অতএব বৈদিক যজ্ঞে পশুবলির বিধান শুধু একটি ভ্রান্ত ধারনা মাত্র। যজ্ঞে পশুবলির প্রথা মধ্য কালে এসেছে। প্রাচীন কালে যজ্ঞে পশুবলির প্রথা ছিলো না। ধর্ম পথ হতে বিচ্যুত লোক নিজ মাংসলোলুপতার বশীভূত হয়ে যজ্ঞে পশুবলির প্রথা প্রচলন করেছে। যার প্রমাণ আমরা মহাভারতে পাই -
সুরা মৎসা মধু মাংসমাসবং কৃসরোদনম্।
ধুর্তেঃ প্রবর্তিতং হোতন্নৈবদ্ বেদেষু কল্পিতম।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ ২৬৫,শ্লোক ৯)
---সুরা, মৎস, মাংস, তালরস, এইসব বস্তুকে ধুর্তেরাই যজ্ঞে প্রচলিত করেছে। বেদে এসব উপযোগের বিধান নেই।
অব্যবস্থিতমর্যদৈবিমূঢর্নাস্তিকৈর্তবৈ।
সংশয়াত্মাভিরব্যক্তৈহিংসা সমনুবর্তিত।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ অঃ ২৬৫, শ্লোক ৪)
--- যে ধর্মের মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে মূর্খ, নাস্তিক তথা যার আত্মা সংশয়যুক্ত এবং যার কোন প্রসিদ্ধি নেই এইরূপ লোকই হিংসাকে সমর্থন করে।
মানান্মোহাচ্চ লোভাচ্চ লৌল্যমেত্যপ্রকল্পিতম্।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৬৫, শ্লোক ১০)
-- সেই ধূর্তেরা অভিমান, মোহ এবং লোভের বশীভূত হয়ে সেই সব বস্তুর প্রতি লোলুপতা প্রকট করে থাকে।
অর্থাৎ মহাভারত থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, যজ্ঞে পশুবলি ধূর্তদের কাজ। কিন্তু পাশ্চাত্য বিদ্বান মাক্সমুলার , গ্রিফিথ আদি বেদে মাংসাহারের প্রচার করে কেবল মাত্র পবিত্র বেদ কেই কলঙ্কিত করেছে। মধ্য কালে বাম মার্গ নামে একটি দলের প্রসার খুব হয়েছিলো। যারা মাংস, মদিরা, মৎস, মৈথুন আদিকে মোক্ষের মার্গ বলে মানতো। সায়ন,মহিধর আদি বিদ্বান যারা ছিলো তারা বাম মার্গ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারনেই বেদে বলিপ্রথা তথা মাংসাহারের কথা উল্লেখ করেন। বেদে মাংস ভক্ষন এবং বলি প্রথার মিথ্যা প্রচারের কারনে ধর্মের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা অবর্ণনীয়। আজ কাল তো আমাদের সামনে এই শঙ্কা উপস্থিত হয়ে যে, বেদে গো আহুতি এবং গো মাংস ভক্ষনের নির্দেশ রয়েছে। অথচ আমরা গাভীকে মাতৃতূল্য জ্ঞান করে এসেছি এবং গাভীকে হত্যার চিন্তাও করতে পারি না। এবং বেদেও গাভীকে "অঘ্না" "অদিতি" ইত্যাদি শব্দে ভূষিত করা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে গাভীগুলো হত্যার অযোগ্য। এবং বেদের অসংখ্য জায়গায় গো হত্যার নিষেধ এবং গো হত্যাকারীকে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। যেমন-
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায় মা গামনাগা মদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগবেদ ৮।১০১।১৫)
--- হে জ্ঞানবান পুরুষের নিকট আমি বলিতেছি নিরপরাধ অহিংস পৃথিবী সদৃশ গাভীকে হত্যা করিও না।
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পুরুষম।তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা।। (অথর্বেদ ১।১৬।৪)
--- যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।
"অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী"
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
--- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না।
"গোঘাতম্ ক্ষেধে যঃ গাম্ বিকৃন্তন্তম" (যজুর্বেদ ৩০।১৮)
- গাভীর ঘাতক অর্থাৎ হত্যাকারী যে, ক্ষুধার জন্য গাভীকে হত্যা করে। তাকে ছেদন করি।
" অদিতিম মা হিংসী" (যজুর্বেদ ১৩। ৪৯)
- হত্যার অযোগ্য গাভীকে কখনো মেরো না।
" মা গাম অনাগাম অদিতিম বধিষ্ট" (ঋগবেদ ৮।১০১।১৫)
--- নিরপরাধ গাভী এবং ভূমিতূল্য গাভীকে কখনো বধ করো না।
"অঘ্না ইব" গাভী সমূহ বধের অযোগ্য। সর্বদা পশুন ত্রায়েথাম,(যজুঃ৬/১১)
--- পশুদের রক্ষা করো তাদের পালন করো (অঃ ৩।৩০।১)।
অথচ এসব পৌরাণিক সায়ন, মহিধর, রমেশ আদি বেদ ভাষ্যকারদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাদের ভাষ্যে এতটাই সুস্পষ্টভাবে গো আহুতি এবং মাংস ভক্ষনের নির্দেশনা পাওয়া যায় যে সেটা অস্ত্রস্বরূপ বেদ বিদ্বেষীরা ব্যবহার করে বেদকে কলুষিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। এ পর্যায়ে এরকমই কিছু মন্ত্র শঙ্কাস্বরূপ তুলে ধরবো এবং সেগুলোর বাস্তবিক অর্থ জানার প্রয়াস করবো -
যজ্ঞে কি পশু বলি শঙ্কা সমাধানঃ
শঙ্কা - ০১
হে ভারত অগ্নি! তুমি আমাদিগের! তুমি বন্ধ্যাগাভী ও বৃষ ও গর্ভিনী গাভী সকলের দ্বারা আহুত হইয়াছো।
(ঋঃ ২।৭।৫)
সমাধানঃ
মন্ত্রটিতে যথাক্রমে তিনটি শব্দ এসেছে যথা - বশা, উক্ষ এবং অষ্টাপদী।
★ বশাঃ এ শব্দের অর্থ রমেশ বন্ধ্যাগাভী করেছে। কিন্তু বশা শব্দের আরো অনেক অর্থ হয়। শতপথ ব্রাহ্মণ ২।৮।৩।১৫ অনুসারে বশা অর্থ পৃথিবী -(ইয়ং [পৃথিবী] বৈ বশা পৃশ্নি)। অথর্ববেদ ১।১০।১ অনুসারে ঈশ্বরীয় নিয়ম বা নিয়ামক শক্তি। এবং অথর্ববেদ ১০।১০।৪ এ বশা অর্থে সংসারকে বশকারী পরমাত্মা শক্তি। বেদের বহুস্থলে বশা শব্দটি এসেছে যেগুলোতে এর অর্থ বশকারী, ঈশ্বরীয় শক্তি, পৃথিবী ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
★ উক্ষঃ এই শব্দটি সেচনার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। "উক্ষেথাং মিত্রা বরুনা ঘৃতেন ; ঋঃ ৭।৬৪।৪"। নিরুক্ত ১৩।৯ অনুসারে "উক্ষঃ বৃদ্ধিকারক অথবা জল সেচন অর্থে। কিন্তু রমেশ এখানে বৃষ অর্থ করায় এমন অনর্থ ঘটেছে।
★ অষ্টাপদীঃ সরল অর্থে আমরা বুঝি আট পা। এ অর্থেই বোধ হয় রমেশ "অষ্টাপদী" = গর্ভবতী গাভী করেছে। অর্থাৎ গাভীর চার পা এবং গর্ভস্থ গাভীর চার পা এই আট পা। কিন্তু বেদের অর্থ আধ্যাত্মিক এবং গূঢ তাৎপর্য সম্পন্ন। এখানে অষ্টাপদী অর্থে যোগাঙ্গের আট চরন অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার,ধারনা, ধ্যান, সমাধি। সম্পূর্ণ মন্ত্রের ভাবার্থ এই যে প্রভূকে লাভের জন্য আমাদের তিন কার্য আবশ্যক। (ক) ইন্দ্রীয় কে বশ রাখা (খ) উৎপন্ন সোম শক্তি শরীরের মধ্যে সিঞ্চন করা এবং (গ) অষ্টাঙ্গ যোগ।
মন্ত্রটি নিম্নরূপ -
ত্বং নো অসি ভারতাগ্নে বশাভিরুক্ষভিঃ। অষ্টাপদীভিরাহুত।।
(ঋগবেদ ২।৭।৫)
সরলার্থঃ হে অগ্রনি প্রভূ! আপনি [ইন্দ্রীয়] বশীকরন দ্বারা নিজ ভিতর প্রাপ্ত করে আমাদের হও, এই প্রকার শরীরের মধ্যে শক্তি সেচন দ্বারা আপনি আট যোগাঙ্গরূপ চরন দ্বারা আহুত হয়ে [আমাদের হও]
(অনুবাদঃ হরিশরন সিদ্ধান্তলংকার)
শঙ্কা - ০২
হে অগ্নি! আমরা তোমাকে হৃদয় দ্বারা সংস্কৃত ঋকরূপ হব্য প্রদান করছি। বলশালী বৃষভ ও ধেনুসকল তোমার নিকট পূর্বক্তরূপ হব্য হউক
(ঋগবেদ ৬।১৬।৪৭)
সমাধানঃ
এ মন্ত্রটিতেও তিনটি শব্দ এসেছে - বশা, উক্ষন এবং ঋষভ। যার অর্থ রমেশ বলশালী বৃষ এবং ধেনুসকল করে সেগুলোকে অগ্নির হব্য দ্রব্য তৈরী করেছে। বশা এবং উক্ষণ শব্দের অর্থ পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে - উক্ষ (সেচনার্থে) + কনন্= উক্ষন। বাকী রয়েছে " বৃষভ" শব্দটি যার অর্থ শুধু বৃষ নয়। শতপথ ব্রাহ্মণ ৫।৩।১।৩ এ ইন্দ্র কে বৃষভ বলা হয়েছে "ইন্দ্র যদৃষভ"। ইন্দ্র শব্দে ঐশ্বর্যবান পুরুষ তথা একজন শ্রেষ্ঠ রাজা বুঝায়। অতএব মন্ত্রটির যথার্থ অর্থ নিম্নরূপ দাড়ায় -
আ তে অগ্নে হবির্হৃদা তষ্টং ভরামসি।
তে তে ভবন্তুক্ষণ ঋষভাসো বশা উত।।
(ঋগবেদ ৬।১৭।৪৭)
সরলার্থঃ হে তেজস্বিন! তোমার জন্য আমরা উত্তম মন্ত্র দ্বার হৃদয় দ্বারা সুসংস্কৃত গ্রাহ্য, অন্ন প্রস্তত করি তোমার কার্যের জন্য ঐ সব কার্যভার উঠানকারী তথা বীর্যসেচনে সামর্থ সত্য ন্যায় দ্বারা কান্তিমান, নরশ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং রাষ্ট্রকে বশকারী অধিকারী তোমার অধিনে হোক।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
শঙ্কা -০৩
হে ইন্দ্র! তোমার নিমিত্তে পুরোহিতদিগের সহিত একত্রে বৃষকে পাক করি এবং পঞ্চদশ তিথীর প্রত্যেক তিথীতে সোমরস প্রস্তুত করিয়া থাকি।
( ঋঃ ১০।২৭।২)
সমাধানঃ
মন্ত্রটিতে "বৃষভং পচানি" শব্দগুলো এসেছে। যার অর্থ রমেশ এখানে বৃষভ (ষাড়) কে পচানি (রান্না) করার কথা উল্লেখ করেছে। বৃষভ = বৃষ (সেচনার্থক) +অভচ (ঋষি বৃষিভ্যাং কিত) = বৃষভ। অথবা বৃহ (উদ যমন অর্থে) + অভচ = বৃষভ (বাহুলক নিয়ম দ্বারা "হ" কে "ষ") যাস্ক "বৃহ" ধাতুকে বর্ষণ অর্থ মেনেছেন। তাছাড়া নিরুক্তে বৃষভ এর অনেক প্রকার অর্থ রয়েছে। নিরুক্ত ৭।২৩ এ বৃষভ অর্থ বর্ষা বর্ষনকারী রয়েছে, "প্র নু মহিত্বং বৃষভস্য বোচম"। আবার নিরুক্ত ৬।২৩ এ "বৃষভ" অর্থ " বেদজ্ঞ বিদ্বান" রয়েছে - "অনর্বাণং বৃষভং মন্ত্রজিহ্লম" অর্থাৎ সুন্দর বাণীসম্পন্ন বেদজ্ঞ বিদ্বান কে অন্ন দ্বারা পোষন করো। ঋগবেদ ১০।১০।১০ এবং নিরুক্ত ৪।২০ এ "বৃষভ" অর্থ বীর্য সেচনে সামর্থ পুরুষ বলা হয়েছে। বাকী থাকলো "পচানি শব্দটি। বৈদিক কোষে "পচন" শব্দের অর্থ হচ্ছে বিদ্যা অথবা বল কে পরিপক্ক করা। ঋগবেদ ২।১২।১৪ এবং অঃ ২০।৩৪।১৫ এ একই কথা বলা হয়েছে, "যঃ সুনন্তম অবতি যঃ পচন্তম"। অর্থাৎ মন্ত্রটিতে মেঘের তূল্য পুরুষকে পরিপক্ক করার কথা বলা হয়েছে। কোন ষাড় কে রান্নার করার কথা বলা হয় নি। মন্ত্রটি নিম্নরূপ -
যদীদহং যুধয়ে সংয়ান্যদেবয়ুন্তন্বা শুশুজানান।
তে তুম্রেং বৃষভং পচানি তীব্রং সুতং পঞ্চদশং নিষিঞ্চম।।
(ঋগবেদ ১০।২৭।২)
সরলার্থঃযখনই আমি যুদ্ধ করবার নিমিত্তে দেহ বা বিস্তৃত সেনা দ্বারা বর্ধিত হয়ে, দেব বা বিদ্বান কে না দানকারী দুষ্ট জনকে লক্ষ্য করে নিজ সৈন্য বল কে একত্রিত করবো। হে প্রভু! আমার সাথে তোমার অতি বলশালী বৃষ্টিকারক মেঘের তূল্য শর বর্ষনকারীকে পরিপক্ক করবো এবং অতি তীক্ষ্ণ অভিষেক যোগ্য পূর্ণচন্দ্রবত বিরাজমান পুরুষকে মুখ্য পদের উপর অভিষিক্ত করবো।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
শঙ্কা - ০৪
হে বৃষাকপি নিতে! তুমি ধনশালিনী ও উৎকৃষ্ট পুত্রযুক্তা আমার সুন্দরী পুত্রবধু! তোমার বৃষদিগকে (ষাড় কে) ইন্দ্র ভক্ষন করুন। তোমার অতি চমৎকার অতি সুখকর হোমদ্রব্য তিনি ভক্ষন করুন। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।
(ঋঃ ১০।৮৬।১৩)
সমাধানঃ
মন্ত্রটিতে "উক্ষণ" শব্দে বৃষ করায় এমন অনর্থ ঘটেছে। উক্ষন শব্দের অর্থ আমরা পূর্বেই ব্যাখ্যা করেছি। তবুও এস্থলে পুনরায় কিঞ্চিত তুলে ধরছি। উক্ষ (সেচন অর্থে) + কনিন্ = উক্ষন। এবং বৃদ্ধিকরন অর্থেও উক্ষ ধাতু এসেছে। নিরুক্ত সংহিতা ১৩।৯ এ উক্ষণ শব্দের অর্থটি পরিষ্কার হযেছে। "উক্ষণ উ- ক্ষেতের্বৃদ্ধিকর্মণ উক্ষনত্যুদকেনোতিবা ; নিরুঃ ১৩।৯ " অর্থাৎ বৃদ্ধি অর্থে উক্ষ অথবা জল সেচন কারী অর্থে। অতএব মন্ত্রটির সত্যার্থ এরূপ দাড়ায় - ইন্দ্র (পরমঐশ্বর্যবান প্রভূ) "উক্ষণ"সেচনকারী মেঘ দ্বারা উৎপন্ন "তে হবি" অন্নের তূল্য (জগত) কে "ঘসত" ভক্ষন করেন। অর্থাৎ প্রলয় কালে সমস্ত জগৎ কে লীন করে নেয়।
মন্ত্রটির সরলার্থ নিম্নরূপ -
বৃষকপায়ি রেবতি সুপুত্র আহু সুস্নুষে।
ঘসত্ত ইন্দ্র উক্ষণঃ প্রিয়ং কাচিৎকরং হবির্বিশ্বস্মাদিন্দ্র উত্তর।।
(ঋগবেদ ১০।৮৬।১৩)
সরলার্থঃ সমস্ত সুখ কে মেঘের তূল্য বর্ষনকারী প্রভূর অপার শক্তি! হে অনেক ঐশ্বর্যের স্বামিনি! হে উত্তম পুত্র, জীবধারী! হে উত্তম সুখপূর্বক বিরাজমান, সুখদায়িনি! পরমঐশ্বর্যবান প্রভূ সেচনকারী মেঘ দ্বারা উৎপন্ন প্রীতিকারক অনেক সুখ দান কারী তোমার উত্তম অন্ন সদৃশ [জগত কে] ভক্ষন করেন [প্রলয়কালে লীন করে নেয় ] পরমঐশ্বর্যবান প্রভূ সবার থেকে উপরে।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
শঙ্কা - ০৫
আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষকে (ষাড়) পাক করিয়া দেয়। আমি খাইয়া শরীরের স্থুলতা সম্পাদন করি। আমার উদরের দুইপার্শ পূর্ন হয়। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।
(ঋঃ ১০।৮৬।১৪)
সমাধানঃ
একই "উক্ষণ" শব্দের ব্যবহার এ মন্ত্রেও হয়েছে তাই এখানে এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। মন্ত্রটিতে পনেরো ষাড় নয় বরং সেচন সামর্থ পনেরো - দশ ইন্দ্রীয় এবং পঞ্চ প্রাণকে এবং শরীরস্থ বিশ অঙ্গকে পরিপক্ক করার বলা হয়েছে। বেদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাই সর্বাপেক্ষা গ্রহনযোগ্য কারন আক্ষরিক অর্থে সর্বদাই অনর্থ ঘটিয়া থাকে।
উক্ষ্ণো হি মে পঞ্চদশ সাকং পচন্তি বিংশতিম্।
উতাহমদ্মি পীব ইদুভা কুক্ষো পৃণন্তি মে বিশ্বস্মাদিন্দ্র উত্তর।।
(ঋগবেদ ১০।৮৬।১৪)
সরলার্থঃ আমার সেচনকারী পনেরো - দশ ইন্দ্রীয় এবং পঞ্চ প্রাণ হাত এবং পায়ের বিশ আঙ্গুলির সমান শরীরের ভিতর বিশ অঙ্গকে এক সাথে পরিপাক করে এবং পরিপুষ্ট হয়ে পুষ্টিদায়ক ভোগ্য দেহ এবং নানা প্রকার ভোগ কে বা সেই প্রাণকে ভোগ করি, ঐ সমস্ত প্রাণ নিশ্চয়রূপে আমার দুই পার্শ পূর্ণ করে, শক্তিশালী প্রভূ সবার থেকে উপরে।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
অতএব ইহা স্পষ্ট যে বেদ যজ্ঞে গো আহুতি দেবার মিথা প্রচার নিতান্তই ভ্রান্ত।অধ্বর রূপ যজ্ঞকে বেদ কখনো নির্দোষ প্রাণীর রক্ত দিয়ে অপবিত্র করতে বলে নি। বরং পবিত্র বেদের নির্দেশ এই যে আমরা সর্বদা যেন জগতের সমস্ত প্রাণীর জন্য সুখকর হই -
"স্বস্তি মাত্রে উত পিত্রে নো অস্তু স্বস্তি গোভ্যো জগতে পুরুষেভ্যঃ।(অথর্ববেদ ১।৩১।৪)"
--- আমাদের মাতার জন্য এবং পিতার জন্য সুখদায়ক হও এবং গাভীর জন্য পুরুষের জন্য জগতের জন্য সুখদায়ক হও।
রেফারেন্স সমূহ:
১. ‘The Integrated Science Of Yagya’ by Dr. Rajani R. Joshi, Yug Nirman Yojana, Gayatri Tapobhumi, Mathura
২. ‘Agnihotra Vyakhya’, Arya Pratinidhi Sabha, Ajmer
৩. ‘Fumigating Substances used in Yagna’- Procedings of Ashwamedha Yagna held in Montreal, Canada
৪. ‘Does Yagna Add to the Prevalent Pollution’- Procedings of Ashwamedha Yagna held in Montreal, Canada
৫. Selected Articles from Akhand Jyoti. Publisher Akhand Jyoti Sansthan, Mathura
৬. ‘Agnihotra: The Message of Time’ by Dr. Madhukar P. Giak-wad, National Symposium on Unification of Modern and Ancient Sciences held in Andheri, Mumbai on April 30, 1995
৭. ‘The New Age Force of Gayatri’ by Ashok N. Raval, Bhartiya Vidya Bhavan, Mumbai
ওম্ শম্
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ