মহাভারত কালের প্রাচীনত্ব প্রমাণের প্রত্নতাত্ত্বিক নানা অসুবিধা আছে।
যেমনঃ-
১। যমুনা নদী বহুবার গতিপরিবর্তন করার ফলে সেকালের প্রত্ন উপাদান অন্বেষণে নানা অসুবিধা আছে।
২। গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে পরবর্তী কয়েক হাজার বছরে নানা মানব বসতি প্রাচীন নিদর্শনগুলিকে নষ্ট করেছে। হরপ্পা সভ্যতার প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মতন পরিত্যক্ত ও রুক্ষ অঞ্চলে খনন কার্যে সফলতা অধিক। কিন্তু মহাভারতের কাহিনীগুলি মূলতঃ গঙ্গা-যমুনা দোয়াব ১৩। ৪। হরপ্পা সভ্যতার নব্য আবিষ্কৃত নানা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকেরা আর্য নিদর্শনের অঞ্চলের। প্রাচ্য লক্ষ্য করছেন। এগুলোকে মহাভারতের আলোকে বিশ্লেষণ করা দরকার। ৫। Mesolithic বা মধ্যপ্রস্তরযুগ এবং Neolithic বা নব্যপ্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত নানা নমুনাগুলিকে (যেমন – রাজস্থানের ভিলওয়ারা জেলার বাগোর 6000 BC) আদি মহাভারতের কালের সাথে মিলিয়ে বিচার করা দরকার। মহাভারতের কালনির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা নানাভাবে যেসকল তথ্য পাচ্ছি সেগুলি আলোচনা করছি।
১। কোটা ভেঙ্কটাচলন পুরাণবিদ ও সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরা পৌরাণিক নানা ঘটনা ও বংশলতিকা রূপায়ণ করে পৌরাণিক কাল নির্ণয় করতে চেয়েছেন। “প্রখ্যাত পন্ডিত কোটা ভেঙ্কটাচলন নানা বিচার বিশ্লেষণ করে বলতে চেয়েছেন 3138 BC-তে কুরুক্ষেত্রে কুরু-পান্ডব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পুরানবিদরা বলেন 3101 BC-তে কলিযুগ শুরু হয়। কল্যাব্দ শুরু হয় সে সময় থেকে।
২। মকরন্দকার প্রখ্যাত জ্যোতিষবিদ মকরন্দকার (হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়ের উদ্ধৃতি থেকে) বলেছেন কলিযুগের 3179 বছর অতীত হলে শকাব্দ শুরু হয় – শাকো নবাগেন্দু কৃশানুযুক্তঃ কলেভর্বত্যব্দগণোযুগস্য 78 AD থেকে শকাব্দ শুরু হয় বলে ঐতিহাসিকরা একমত। তাহলে 3179-78 = 3101 BC [3101 খ্রিস্টপূর্বাব্দ] থেকে কল্যাব্দ শুরু হয়।
৩। ভাস্করাচার্য প্রখ্যাত পন্ডিত ভাস্করাচার্য প্রণীত ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থ মতে শকাব্দ আরম্ভ হবার পূর্বে কলিযুগের 3179 বছর হয়েছিল। যাতা যনবো যুগানি ভমিতান্য ন্যদযুগানগুথ্রিত্ৰয়ং নন্দাদ্রীন্দুগুণাস্ততা শকনূপস্যান্তে কলেবৎসরাঃ ।
৪। কালিদাস মহাকবি কালিদাস বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার এক রত্ন। কালিদাস কেবলমাত্র মহাকবি ছিলেন না। তিনি ‘জ্যোতির্বিদাভরণ’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাতে তিনি জানিয়েছেন –‘যুধিষ্ঠিরাব্দেদ যুগান্বরাময়ঃ কলম্ববিশ্বেহদ্ৰ-খ- খাষ্টভূময়ঃ ততোহযুক্তং লক্ষচতুষতয়ং ক্রমাদ্ধরা- দৃগাষ্টাবিতি শকবৎসরা ইত্যাদি।
সম্পূর্ণ শ্লোকটি পাঠ করলে জানা যায়ঃ- যুধিষ্ঠির, বলি, বিজয়াভিনন্দন, বিক্রমাদিত্য, শালিবাহন, নাগার্জুন – এই ছজন নৃপতি (কালানুক্রমিক নয়) লৌকিক গণনাব্দের প্রবর্তক। এই জোতির্বিদাভরণ এবং এর সুখবোধিকা নামক টীকা অনুসারে জানা যায় বলি থেকে ৮২১ বছর, যুধিষ্ঠির থেকে ৩০৪৪ বছর, বিক্রমাদিত্য থেকে ১৩৫ বছর, শালিবাহন থেকে ১৮,০০০ বছর, বিজয়াভিনন্দন থেকে ১০,০০০ বছর এবং নাগার্জুন থেকে ৪,০০,০০০ বছর এভাবে গণনাব্দ চলেছিল, চলছে এবং চলবে।
শালিবাহনাব্দ বা শকাব্দ, বিজয়াভিনন্দনাব্দ এবং নাগার্জুনাব্দ কত বছর স্থায়ী হবে সে বিষয়ে মন্তব্য করা যায় না, কারণ তা জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোচনায় ভবিষ্যতের বিষয়। তবে কালিদাসের গণনা থেকে অতীত কালের যে কালানুক্রম পাওয়া যাচ্ছে তা এরকম--যুধিষ্ঠিরাব্দ ৩০৪৪ বছর চালু থাকার পর বিক্রমাব্দ চালু হয় এবং সেটি ১৩৫ বছর চালু থাকার পর শালিবাহনাব্দ বা শকাব্দ চালু হয়। যেহেতু শকাব্দ 78 AD-তে চালু হয়, তাই যুধিষ্ঠিরাব্দ থেকে খৃঃ চালু হওয়া পর্যন্ত সময় হয় -
৩০৪৪ + ১৩৫ – ৭৮ = ৩১০১
অন্যভাবে বিচার করলে পাই যদি 2012 AD = 1934 শকাব্দ হয়। তাহলে, 2012 AD 3044 + 135 + 1934 5113 তাহলে যুধিষ্ঠিরাব্দ শুরু হয় = 5113 AD 2012 AD - 3101 BC
বর্তমানে কালিদাসের কালনির্ণয় নিয়ে বিতর্ক চালু আছে। একমতে বলা হয় বিক্রমাদিত্য নয়, তার বংশধর গুপ্তযুগের অন্য নৃপতির আমল কালিদাসের সময়। এইমত গ্রহণ করলে 'বিক্রমাব্দ ১৩৫ বছর হলে শকাব্দের সূচণা'- এটি কালিদাসের একটি প্রত্যক্ষগোচর ঘটনা হতে পারে। কালিদাসের কাল হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় কালিদাসের 'জ্যোতির্বিদাভরণ? থেকে দেখিয়েছেন ৩০৬৮ কল্যব্দ বা 33 BC। সেখানে আছে -
বর্ষে সিন্ধুর-দর্শনাম্বর-গুণৈর্যাতে কলৌ সম্মিতে মাসে মাধবসংজ্ঞিতে চ বিহিতো গ্রন্থক্রিয়োপক্রমঃ।
নানাকালবিধানশাস্ত্রগদিত জ্ঞানং বিলোক্যাদরাৎ উর্দ্ধে গ্রন্থসমপ্তি রত্র বিহিতাং জ্যোতির্বিদাং প্রীতয়ে।।-জ্যোতির্বিদাভরণ, ২২ অধ্যায়, ২১ শ্লোক
এক্ষেত্রে সিন্ধুর = ৮; দর্শন = ৬; অম্বর = ০; গুণ – ৩; ‘অন্ধস্য বামাগতি। তাই সময় = ৩০৬৮ কল্যব্দ।একটি অল্প প্রচলিত ঐতিহাসিক মত আছে, যাতে বলা হয় আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় ভারতের সম্রাট ছিলেন গুপ্তযুগের হয় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত না হয় সমুদ্রগুপ্ত; কিন্তু কোন ভাবেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নয়। এই মতানুসারে গুপ্তযুগের শুরু চতুর্থ খৃষ্টপূর্বাব্দে। জ্যোতির্বিদাভরণ’-এর মতে কালিদাসের জন্মকাল এই ঐতিহাসিক মতের সাথে মিলযুক্ত।
৫। আইহোল শিলালিপি গুজরাটের চালুক্যবংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী, রবিকীর্তি নামক কবি দ্বারা কিছু শ্লোক রচনা করিয়ে শিলাফলকে উৎকীর্ণ করেন। ওই শিলাফলকটি আইহোল শিলালিপি নামে পরিচিত। ওই লিপি পাঠে জানা যায় ‘কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হতে ৩৭৩৫ বছর এবং শকাব্দ ৫৫৬ বছর অতীত হলে এই শিলাফলকটি উৎকীর্ণ হল এখন, ‘শকাব্দ ৫৫৬ বছর অতীত হলে’ মানে 556+78AD = 634 AD অর্থাৎ 634 AD তে ওই শিলালিপি লেখা হয়। আবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হতে 3735 বছর = 634 AD তাহলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ = 3735634AD = 3101 BC অর্থাৎ যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করলে পরে যুধিষ্ঠিরাব্দ চালু হয় ধরে নিলে 3101 BC [5200 Before years] –কে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এবং যুধিষ্ঠিরাব্দ –এর শুরু বলে ধরে নিতে হবে।
৬। বরাহমিহির প্রখ্যাত জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ বরাহমিহির তার 'বৃহৎসংহিতা' গ্রন্থে লিখেছেন
‘আসন্যঘাসু মুনয়ঃ শাসতি পৃথ্বীং যুধিষ্ঠিরে নৃপতৌ। ষড়ছিপঞ্চষিযুতঃ শককাল স্তস্য রাজন্চ।।
(১৩৩) কলহন ‘রাজতরঙ্গিনী’-তে এই উদাহরণ টেনে জানিয়েছেন যুধিষ্ঠির নৃপতি হবার ২৫২৬ বছর পরে শকাব্দ শুরু হয়। অর্থাৎ 2526-78 = 2448BC –তে যুধিষ্ঠির রাজা হন।
এই গণনার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অবকাশ আছে- যার পরিণতিতে বোঝা যায় কলহনের বিচারে এক ভ্রান্তি আছে। প্রকৃতপক্ষে অধুনালুপ্ত কিন্তু অতীতে প্রচলিত দ্বিতীয় একটি শকাব্দের হদিশ পাওয়া যায়। উজ্জয়িনীর শক রজা চাসনা-র সিংহাসনে আরোহণের সময়ে ঐ শকাব্দটি চালু হয়েছিল। বর্তমানে প্রচলিত শকাব্দটি চালু হবার ৬৫০-৭০০ বছর আগে ঐ শকাব্দটি চালু হয়। বরাহমিহির-এর জীবনকালে ওই পুরাতন শকাব্দটি চালু ছিল এবং দ্বিতীয় শকাব্দটি তার মৃত্যুর পরে প্রচলিত হয়(78 AD)। বর্তমান অনেক ঐতিহাসিকদের মতে কালিদাস বরাহমিহির পরবর্তী অন্য গুপ্ত বংশের আমলে জীবিত ছিলেন। কালিদাস শালিবাহনাব্দের কথা বলেছেন, যেটি দ্বিতীয় শকাব্দ। বরাহমিহির যে শকাব্দটি জানতেন তার সাথে আনুমানিক ৬৫৩ বছর পরে দ্বিতীয়টি চালু হয় ধরে নিলে আমরা হিসাব পাই –২৫২৬ + ৬৫৩ = ৩১৭৯ বছর।
সেক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির নৃগতি হওয়া এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কাল 3101 BC – কে সমর্থন করে।
কলিযুগের বা কল্যাব্দের সাথে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কালের কিছু পার্থক্য আছে।
৭। আর্যট্ট
প্রখ্যাত ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট গ্রীকদের কাছে 'অন্দুবেরিয়স' বা ‘অদুর্বেরিয়স’ নামে এবং আরবীয়দের কাছে অর্জভর’ নামে বিখ্যাত ছিলেন। তার বাসস্থান ছিল কুসুমপুর, যা পূর্ববর্তীকালে পাটলিপুত্র এবং বর্তমানে পাটনা নামে পরিচিত।
আর্যভট্ট নামে দুজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তবে প্রথম আর্যভট্ট-ই অধিক বিখ্যাত ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থের নাম 'আর্যভটীয়'- এটি 'আর্যসিদ্ধান্ত' নামে অধিক পরিচিত। দ্বিতীয় আর্যভট্টের লেখা গ্রন্থকে 'দ্বিতীয় আর্যসিদ্ধান্ত' বলে। প্রথম আর্যভট্টের জন্মকাল নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা না গেলেও এটি ধরা হয় যে তিনি চতুর্থ – পঞ্চম শতাব্দীর মানুষ ছিলেন। প্রথম আর্যভট্ট তার 'আর্যভটীয়' গ্রন্থের কালক্রিয়াপদের দশম শ্লোকে বলেছেন
ষষ্ট্যদানাং ষষ্টিযর্দা ব্যতীতান্ত্রয়শ্চ যুগপাদাঃ
এ্যাধিকাবিংশতিরদাস্তদেহমম জন্মনোহতীতাঃ।।
অর্থাৎ কলিযুগের ৩৬০০ বছর অতিক্রমের সময়ে আর্যভট্টের বয়স ছিল ২৩ বছর।
আর্যভট্টের আনুমানিক জন্ম বৎসর 476 AD ধরে নিলে, কল্যব্দের হিসাব হয় 3600-234763101 BC ৮। সপ্তর্ষিকাল [পন্ডিত শিবসাধন ভট্টাচার্য প্রণীত ‘প্রাচীণ ভারতের বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস গ্রন্থের সহায়তায়]
প্রাচীন ভারতীয়রা পল, ক্ষণ, মুহুর্ত ইত্যাদি নানা সময় পরিমাপের একক আবিস্কার করেছিলেন। এছাড়া সময়ের বৃহৎ একক হিসাবে তারা মাস, বৎসর ও আবিস্কার করেছিলেন। তবে সময়ের এক অন্যতম বৃহৎ একক তারা অবিস্কার করেন যা দিন, মাস, বছরের তুলনায় অনেক বড়ো। এটি হল সপ্তর্ষিকাল।পৃথিবীর সাধারণত দুটি গতি। আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতি।
এক্ষেত্রে দেখানো লাটিমের মত-ই পৃথিবীর আসলে তিনটি গতি। একটি সে নিজের চারিদিকে ঘোরে – সেটি তার আহ্নিক গতি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে পাক খায়। সেটি তার বার্ষিক গতি। পৃথিবী লাটিমের মতই তার নিজ অক্ষকে খানিকটা কাত হয়ে (সাড়ে ২৩ ডিগ্রি) পাক খায়। পৃথিবীর এই তৃতীয় ঘূর্ননের জন্য মহাকাশের তারামন্ডলী ধীর গতিতে স্থান পরিবর্তন করে।
ভারতীয় প্রাচীণ ঋষি তথা পন্ডিতরা উত্তর আকাশে সাতটি তারা বা নক্ষত্র নিয়ে গঠিত এক নক্ষত্র মন্ডলীকে সপ্তর্ষি মণ্ডল বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এছাড়াও তারা অশ্বিনী, কৃত্তিকা, মঘা,পূর্ব ফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী, হস্তা, স্বাতী ইত্যাদি ২৭ টি (মতান্তরে অভিজিত সহ ২৮ টি) বিশিষ্ট নক্ষত্রকে চিহ্নিত করেন।
প্রধানত ওই ২৭ টি নক্ষত্রকে নিয়ে ১২ টি রাশিচক্র কল্পনা করা হয়েছিল। কয়েকটি নক্ষত্র আবার রাশিচক্রের বাইরে অবস্থান করে। যেমন
নক্ষত্র রাশিচক্র
১। অশ্বিনী, ভরনী [Arietis, Musca] মেষ [Aries]
২। কৃত্তিকা, রোহিনী [Aleyoni, Aldabaran] বৃষ [Taurus]
৩। মৃগশিরা, আর্দ্রা [Orionis, betelgues] কালপুরুষ [রাশিচক্র বহির্ভূত]
৪। পুনর্বসু [Pollux] মিথুন [Gemini]
ইত্যাদি
পরাশরমুনি পৃথিবীর এই তৃতীয় আবর্তনের ফলে (কারনটি সম্পর্কে নিশ্চিতভা না জানলেও পর্যবেক্ষণ দ্বারা লক্ষ্য করেন) তারামন্ডলীর এই স্থানপরিবর্তনের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেন এবং এক বৃহৎ সময়ের একক উদ্ভাবন করেন।
পরাশর সম্পাদিত বিষ্ণুপুরাণে লিপিবদ্ধ আছে -
সপ্তর্ষিনাঞ্চ যৌ পূৰ্ব্বেী দৃশ্যেতে উদিতৌ দিবি।
তয়োন্ত মধ্যনক্ষত্রং দৃশ্যতে যৎ সমগ নিশি।
তেন সপ্তঘয়োযুক্ততিষ্ঠন্ত্যব্দশতং নৃনাং।। বিষ্ণুপুরাণ ৪/২৪/৩৩
এর অর্থ হল, সপ্তর্ষিমন্ডলে যে দুটি তারা প্রথমে উদিত হয়, তাদের মধ্য দিয়ে ধ্রুবতারাকে সংযোগ করে একটি সরলরেখা কল্পনা করে দেখলে সে রেখা যে নক্ষত্রকে ছেদ করে সেই বিন্দুতে সপ্তর্ষি অধিষ্ঠিত আছে ধরা হয়। রাশিচক্রসহ ওই ২৭ টি নক্ষত্রের সাথে সপ্তর্ষিমন্ডল ও ধ্রুবতারার সংযোজক রেখা ১০০ বছরে এক এক নক্ষত্র অতিক্রম করে যায়। সপ্তর্ষির এই সরণ বা চলনকে ‘সপ্তর্ষির চলন' বলে উল্লেখ করা হয়। ২৭০০ বছরে সপ্তর্ষি ২৭ টি নক্ষত্র অতিক্রম করে আবার প্রথম নক্ষত্রে ফিরে আসে। সুতরাং ২৭০০ বছরে একটি সপ্তর্ষি যুগ’ বা সপ্তর্ষি কাল শেষ হয়।
বৃহৎ সংহিতা-তে সপ্তর্ষি মন্ডলের সাতটি নক্ষত্রের নাম (সাতজন পৌরাণিক ঋষির নামে ঐ নামকরণ) ও তাদের অবস্থান নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। সপ্তর্ষির ভ্রুতু ও পুলহ নক্ষত্রদুটি বরাবর ধ্রুবতারাকে যুক্ত করে রেখা কল্পনা করা হয়ে থাকে। আবার বরাহমিহির মতে সপ্তর্ষিমন্ডলের যে দুটি তারকা (মরীচী এবং বশিষ্ঠ) সর্বাপেক্ষা পূর্ব দিকে থাকে, তাদের মধ্যবিন্দুর সঙ্গে যে চান্দ্র নক্ষত্রটি সম-অবস্থানে
যেখা যায়, অনুমান করা হয় সপ্তর্ষি সেই নক্ষত্রে অবস্থান করছে। এই অবস্থাটি ১০০ বছর স্থায়ী। এটিকে বলা হয় সপ্তর্ষির নক্ষত্র ভোগকাল। ২৭ টি নক্ষত্র ভোগকালে একটি যুগ, অর্থাৎ ২৭০০ বছর।
সাধারণত একটি বিশেষ ঘটনাকে স্মরণ করে অব্দ প্রচলন হয়। শকাব্দ, খৃষ্টাব্দ ইত্যাদির বৃদ্ধি সরলরৈখিক। কিন্তু সপ্তর্ষিকাল চক্রাকার, অর্থাৎ একই নাক্ষত্রকাল বার বার ফিরে ফিরে আসে। এই সপ্তর্ষি কাল কাশ্মীরে লোককাল বা লৌকিক কাল নামে এবং কেরালাতে কোপ্লম কাল নামে পরিচিত। আল-বেরুনি একে বলেছেন পাণ্ডু কাল। বোঝা যায় যে এই কালটি সারা ভারতে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ এটির প্রচলন ছিল সারা ভারতে।
ছবিটি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব ধ্রুবতারা থেকে কাল্পনিক রেখা ত্রুতু-পুলহ স্পর্শ করে বর্তমানে কন্যারাশির হস্তা নক্ষত্রকে ছুয়েছে। এটি মাঘ ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যার দিকে আকাশে দেখা যায়। ঐ কাল্পনিক রেখটি প্রায় উত্তর ফাল্গুণী নক্ষত্রকে স্পর্শ করতে চলেছে। ক্রমে অন্যান্য নক্ষত্রকে স্পর্শ করে আবার ২৭০০ বছর পরে ওই রেখাটি আবার হস্তা নক্ষত্রে ফিরে আসবে। আর্য হিন্দুদের নানা পৌরাণিক সাহিত্যে সপ্তর্ষি নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেওয়া আছে। ঐ তথ্যাদি লক্ষ্য করে Back Calculation করে আমরা ঐসকল ঘটনার কাল নির্ণয় করতে পারি। বর্তমানে সপ্তর্ষি হস্তা/উত্তর ফাল্গুনীতে অবস্থান করছে। সপ্তর্ষির আবর্তনের ক্রম হল
হস্তা- উত্তর ফাল্গুণী – পূর্ব ফাল্গুণী মঘা ইত্যাদি।
অতীতের কাল নির্ণয়ের জন্য বিপরীত ক্রম গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ হস্তা – চিত্রা স্বাতী বিশাখা অনুরাধা – জ্যেষ্ঠা মূলা পূর্ব আষাঢ়া উত্তর আষাঢ়া শ্রবণা – ধনিষ্ঠা শতভিষা – পূর্ব ভাদ্রপাদ – উত্তর ভাদ্রপাদ
রেবতী –অশ্বিণী – ভরনী – কৃত্তিকা – রোহিণী – মৃগশিরা আর্দ্রা পুনবসু – পৃষ্যা - - অশ্লেষা – মঘা পূর্ব ফাল্গুনী – উত্তর ফাল্গুনী হস্তা।। বায়ুপুরাণে দেখা যাচ্ছে
সপ্তবর্ষো মঘাযুক্তাঃ কালে পরিক্ষিতে শতম্। অন্ধ্রান্তে তু চতুর্ধ্বিংশে ভবিষ্যক্তি মতে মম ।। ৯৯/৪২৩ অর্থাৎ পরিক্ষিতের কালে সপ্তর্ফিাণ ১০০ বছরের জন্য মঘাযুক্ত থাকবেন। ইত্যাদি। বর্তমানে সপ্তর্ষি হস্তা নক্ষত্রে অবস্থিত। হস্তা থেকে মঘা নক্ষত্র ২৪০০ বছরের তফাৎ। অতীত গণনা করলে দেখা যায় সপ্তর্ষি মঘা নক্ষত্রে ছিল একবার 400 BC তে, আর একবার ২৭০০ বছর আগে 3100 BC -তে।
400 BC –তে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল একথা কেউই বিশ্বাস করবেন না। সেক্ষেত্রে 3100 BC কে গ্রহণ করতে হবে। ওই সময়-ই যুধিষ্ঠির তাদের নাতি পরিক্ষিৎকে রাজত্ব সম্প্রদান করেন। যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ৩৬ বছর রাজত্ব করেন। তারপর পরিক্ষিৎ রাজা হন। মঘা যে ১০০ বছর সপ্তর্ষির সাথে যুক্ত ছিল সেই সময়ের মধ্যেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, যুধিষ্ঠির রাজা হওয়া এবং পরিক্ষিৎ রজা হওয়া সবগুলি-ই ঘটেছিল।
সপ্তর্ষিকাল গণনার প্রাচীণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় মান্ডি জেলায় বৈজনাথ মন্দিরের শিলালিপিতে। বুলার জানিয়েছেন যে ঊনবিংশ শতকে কাশ্মীরে ব্রাহ্মণদের পরম্পরাগত ইতিহাস অনুসারে 3075 BC তে সপ্তর্ষিকাল গণনা শুরু। মিচিনার আবার বলেছেন যে সপ্তর্ষিকাল শুরু হয়েছিল 6676 BC-তে।
৯। মহাকাশ গবেষণা
কলকাতা থেকে প্রকাশিত The Telegraph পত্রিকার 03.11.2003 এর Knowhow নামক অংশে মেমফিস বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নরহরি আচার -এর একটি গবেষণার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি সদ্য আবিষ্কৃত কমপিউটার সফটওয়ার, যার সাহায্যে ৬০০০ বছর আগে এবং পরের মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায় তার সাহায্যে তিনি মহাভারতে বর্ণিত গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, ধুমকেতু এবং সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের অবস্থা বিচার করে মহাভারতের যুদ্ধের কালনির্ণয় করেছেন 3067 BC [ Narahari Achar, Professor of Physics at the University of Memphis, Tennessee, who has used sky simulation software (computer software available today allows scientists to recreate the look of the night sky at any time and place on earth by simulating the position of stars and planets upto 6000 years both in the past and future) to analyse astronomical observations in the Mahabharata and arrives at 3067 BC as the date of the battle. He has simulated the Lunar and Solar eclipses, planetary positions, comets and meteors, showers to show that they could have occurred exactly as they are depicted in the epic] !
আচার বলেছেন যে, মহাকাশের ঘটনাবলীগুলি কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঐসব গ্রহ-নক্ষত্র সন্নিবেশ এমন জটিল বিষয় যে সেগুলিকে নিখুতভাবে কল্পনা করে অতীত সময়কে নির্ধারন করে কোন কাব্যগ্রন্থ লেখা সম্ভব নয় [The celestial events in the epic can not be dismissed as fictions. The complexity of the events are such that nobody could have back calculated and inserted them into the text as a later date'] I একই প্রতিবেদনে শ্রী আয়েঙ্গার (R. N. Iyengar, Indian Institute of Science) এর একটি সমতুল্য কাজ নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি মহাভারত যুদ্ধের কাল নির্ণয় করেছেন 1478 BC। তবে তিনি শুধুমাত্র সূর্যগ্রহণ নিয়ে কাজ করেছেন এবং কালের সীমা ধরেছেন 500-3000 BC। তার মতে মহাভারতে তিনটি বিশেষ সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। একটি পাশা খেলার সময়, দ্বিতীয়টি যুদ্ধের সময় এবং তৃতীয়টি কৃষ্ণের মৃত্যুর সময়। আয়েঙ্গারের কাজের দুর্বলতা দুটি। এক তিনি কেবল মাত্র সূর্যগ্রহণ নিয়ে কাজ করেছেন, অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র, ধুমকেতু নিয়ে মাথা ঘামাননি। দ্বিতীয়তঃ তিনি কালের সীমা ধরেছেন 3000 BC পাশা খেলার ১৩ বছর পরে যুদ্ধ এবং তার ৩৫ বছর পরে কৃষ্ণের মৃত্যু হয়। একটি সূর্যগ্রহণের ১৩ বছর এবং তার ৩৫ বছর পর আর-ও একটি মোট তিনটি সূর্যগ্রহণের ঘটনা কয়েক হাজার বছরে কয়েক বার ঘটতে পারে। এটি 1500 BC নাগাদ যেমন হয়েছে তেমনি 3000 BC-র পূর্বেও হয়েছে।
এছাড়া আচার এক-ই প্রতিবেদনে জানিয়েছেন আর-ও একটি তথ্য। বলা হয়। সরস্বতী নদী 1900 BC নাগাদ শুকিয়ে যায়। অথচ বলরাম, কৃষ্ণের বড়ভাই মহাভারত যুদ্ধের সময় ৪২ দিন সরস্বতী নদী পরিক্রমা করেন। শুকিয়ে যাওয়া নদী পরিক্রমা ৪২ দিন ধরে করা যায় না [ If it had happened anytime later than 1900 BC, the river could not have figured in the text' - Achar]
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ