শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ (গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ –
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়।।১
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়।।১
অর্থঃ-(১) ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন – হে সঞ্জয়, পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ এবং পাণ্ডুপুত্রগণ যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া কি করিলেন?
সঞ্জয় উবাচ –
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২
অর্থঃ-(২) সঞ্জয় কহিলেন – তৎকালে রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডব-সৈন্যদিগকে ব্যুহাকারে সজ্জিত দেখিয়া দ্রোণাচার্য্য সমীপে যাইয়া এই কথা বলিলেন।
পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য্য মহতীং চমূম্।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩
অর্থঃ-(৩) গুরুদেব, আপনার ধীমান্ শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্ত্তৃক ব্যুহবদ্ধ পাণ্ডবদিগের এই বিশাল সৈন্যদল দেখুন।
অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জ্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ।।৪
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।।৫
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ।।৬
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ।।৪
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।।৫
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ।।৬
অর্থঃ-(৪-৬) এই সেনার মধ্যে ভীমার্জ্জুনের সমকক্ষ, মহাধনুর্দ্ধারী বহু বীর পুরুষ রহিয়াছেন। সাত্যকি, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশীরাজ, কুন্তীভোজ পুরুজিৎ, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্য্যবান্ উত্তমৌজা, সুভদ্রা-পুত্র (অভিমন্যু), দ্রৌপদীর পুত্রগণ (প্রতিবিন্ধ্যাদি) ইহারা সকলেই মহারথী।
অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭
অর্থঃ-(৭) দে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ! আমার সৈন্যমধ্যেও যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন তাহাদিগকে অবগত হউন। আপনার সম্যক্ অবগতির জন্য তাহাদিগের নাম বলিতেছি।
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ।।৮
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ।।৮
অর্থঃ-(৮) আপনি, ভীস্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র এবং জয়দ্রথঃ।
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্র প্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধ-বিশারদাঃ।।৯
নানাশস্ত্র প্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধ-বিশারদাঃ।।৯
অর্থঃ-(৯) আমার জন্য জীবন ত্যাগে প্রস্তুত আরও অনেক নানাশস্ত্রধারী বীরপুরুষ আছেন। তাঁহার সকলেই যুদ্ধ বিশারদ।
অপর্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্।
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্।১০
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্।১০
অর্থঃ-(১০) ভীস্মকর্ত্তৃক সম্যক্ রক্ষিত আমাদের সেনা অপরিমিত। আর ভীমকর্ত্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প)।
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি।।১১
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি।।১১
অর্থঃ-(১১) আপনারা সকলেই স্ব স্ব বিভাগানুসারে সমস্ত বূহ্যদ্বারে অবস্থিত থাকিয়া ভীস্মকেই সকল দিক্ হইতে রক্ষা করিতে থাকুন।
তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্।।১২
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্।।১২
অর্থঃ-(১২) তখন প্রতাপশালী কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীস্ম তাঁহার (দুর্য্যোধনের) আনন্দ উৎপাদন করিয়া উচ্চ সিংহনাদ করত শঙ্খধ্বনি করিলেন।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখঃ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩
অর্থঃ-(১৩) তখন শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, গোমুখ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহসা বাদিত হইলে সেই শব্দ তুমুল হইয়া উঠিল।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ।
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ।।১৪
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ।।১৪
অর্থঃ-(১৪) অনন্তর শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুন দিব্য শঙ্খধ্বনি করিলেন।
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ।
পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ।।১৫
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬
পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ।।১৫
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬
অর্থঃ-(১৫-১৬) শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, অর্জ্জুন দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজাইলেন। কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ, নকুল সুঘোষ নামক শঙ্খ এবং সহদেব মণিপুস্পক নামক শঙ্খ বাজাইলেন।
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মু পৃথক্ পৃথক্।।১৮
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মু পৃথক্ পৃথক্।।১৮
অর্থঃ-(১৭-১৮) হে রাজন্, মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট রাজা, অজেয় সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রা-পুত্র – ইহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ বাজাইলেন।
স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্।।১৯
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্।।১৯
অর্থঃ-(১৯) সেই তুমুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ও তৎপক্ষীয়গণের হৃদয় বিদীর্ণ করিল।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০
অর্থঃ-(২০) হে রাজন্, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয়দিগকে যুদ্ধোদ্ যোগে অবস্থিত দেখিয়া শস্ত্রনিক্ষেপে প্রবৃত্ত কপিধ্বজ অর্জ্জুন ধনু উত্তোলন করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিলেন।
অর্জ্জুন উবাচ –
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।।২১
যাবদেতান্ নিরীক্ষেহহং যোদ্ধু কামানবস্থিতান্।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।।২১
যাবদেতান্ নিরীক্ষেহহং যোদ্ধু কামানবস্থিতান্।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩
অর্থঃ-(২১, ২২, ২৩) অর্জ্জুন বলিলেন – হে অচ্যুত, যুদ্ধকামনায় অবস্থিত ইহাদিগকে যাবৎ আমি দর্শন করি, তাবৎ (তুমি) উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর; এই যুদ্ধব্যাপারে কাহাদিগের সহিত আমার যুদ্ধ করিতে হইবে তাহা আমি দেখি; দুর্ব্বুদ্ধি দুর্য্যোধনের হিতকামনায় যাহারা এখানে উপস্থিত হইয়াছেন, সেই সকল যুদ্ধার্থিগণকে আমি দেখি।
সঞ্জয় উবাচ –
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪
ভীষ্মদ্রণপ্রমুখতঃ সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।।২৫
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪
ভীষ্মদ্রণপ্রমুখতঃ সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।।২৫
অর্থঃ-(২৪-২৫) সঞ্জয় কহিলেন – হে ভারত ! অর্জ্জুন কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে ভীস্ম দ্রোণ এবং সমস্ত রাজগণের সম্মুখে উৎকৃষ্ট রথ স্থাপন করিয়া কহিলেন – “হে অর্জ্জুন, সমবেত কুরুগণকে দেখ।”
তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৄনথ পিতামহান্।
আচার্য্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৄ্ন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।।২৬
আচার্য্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৄ্ন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।।২৬
অর্থঃ-(২৬) তখন অর্জ্জুন উভয় সেনার মধ্যেই অবস্থিত পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ ও সুহৃদ্ গণকে দেখিলেন।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীত্।।২৭
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীত্।।২৭
অর্থঃ-(২৭) সেই কুন্তীপুত্র অর্জ্জুন বন্ধুবান্ধবদিগকে যুদ্ধার্থে অবস্থিত দেখিয়া নিতান্ত করুণার্দ্র হইয়া বিষাদপূর্ব্বক এই কথা কহিলেন।
অর্জ্জুন উবাচ –
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূ্ন্ সমবস্থিতান্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি।।২৮
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূ্ন্ সমবস্থিতান্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি।।২৮
অর্থঃ-(২৮) অর্জ্জুন কহিলেন – হে কৃষ্ণ, যুদ্ধেচ্ছু এই সকল স্বজনদিগকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুস্ক হইতেছে।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিধ্যতে।।২৯
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিধ্যতে।।২৯
অর্থঃ-(২৯) আমার শরীরে কম্প ও রোমাঞ্চ হইতেছে; হাত হইতে গাণ্ডীবখসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম জ্বালা করিতেছে।
ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০
অর্থঃ-(৩০) হে কেশব, আমি স্থির থাকিতে পারিতেছি না; আমার মন যেন ঘুরিতেছে, আমি দুর্লক্ষণ সকল দেখিতেছি।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১
অর্থঃ-(৩১) যুদ্ধে স্বজনদিগকে নিহত করিয়া আমি মঙ্গল দেখিতেছি না। হে কৃষ্ণ, আমি জয়লাভ করিতে চাহি না, রাজ্যও চাহি না, সুখভোগ চাহি না।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সন্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন।।৩৪
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সন্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন।।৩৪
অর্থঃ-(৩২, ৩৩, ৩৪) হে গোবিন্দ, যাহাদিগের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখাদি কামনা করা যায় সেই আচার্য্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও কুটুম্বগণ যখন ধনপ্রাণ ত্যাগ স্বীকার করিয়াও যুদ্ধার্থে উপস্থিত, তখন আমাদের রাজ্যেই বা কি কাজ আর সুখভোগ বা জীবনেই বা কি কাজ? হে মধুসূদন, যদি ইহারা আমাকে মারিয়াও ফেলে তথাপি আমি ইগাদিগকে মারিতে ইচ্ছা করি না।
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং ন্য মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন।।৩৫
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন।।৩৫
অর্থঃ-(৩৫) হে কৃষ্ণ, পৃথিবীর রাজত্বের কথা দূরে থাক, ত্রৈলোক্যরাজ্যের জন্যই বা দুর্য্যোধনাদিগকে বধ করলে আমাদের কি সুখ হইবে?
পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬
অর্থঃ-(৩৬) যদিও ইহারা আততায়ী (এবং আততায়ী শাস্ত্রমতে বধ্য), তথাপি এই আচার্য্যাদি গুরুজনকে বধ করিলা আমরা পাপভাগীই হইব। অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে বধ করিতে পারি না; হে মাধব, স্বজন বধ করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব?
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন।।৩৮
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন।।৩৮
অর্থঃ-(৩৭-৩৮) যদিও ইহারা লোভে হতজ্ঞান হইয়া কুলক্ষয়জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহজনিত পাতক দেখিতেছে না, কিন্তু হে জনার্দ্দন, আমরা কূলক্ষয়জনিত দোষ দেখিয়াও সে পাপ হইতে নিবৃত্ত কেন না হইব?
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মা সনাতনাঃ
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোহভিভবত্যুত।।৩৯
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোহভিভবত্যুত।।৩৯
অর্থঃ-(৩৯) কূলক্ষয় হইলে সনাতন কূলধর্ম্ম নষ্ট হয় এবং ধর্ম্ম নষ্ট হইলে সমগ্র কূল অধর্ম্মে অভিভূত হয়।
অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০
অর্থঃ-(৪০) হে কৃষ্ণ, কূল অধর্ম্মে অভিভূত হইলে কূলস্ত্রীওগণ ব্যভিচারিণী হয়। হে বার্ষ্ণেয়, কূলনারীগণ ব্যভিচারিণী হইলে বর্ণসঙ্কর জন্মে।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১
অর্থঃ-(৪১) বর্ণসঙ্কর, কূলনাশকারীদিগের এবং কূলের নরকের কারণ হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয় (সদ্গতিপ্রাপ্ত হয় না)।
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২
অর্থঃ-(৪২) কূলনাশকারীদগের বর্ণসঙ্করকারক ঐ দোষে সনাতন জাতিধর্ম্ম, কূলধর্ম ও আশ্রমধর্ম্মাদি উৎসন্ন যায়।
উৎসন্নকুলধর্ম্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দ্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩
অর্থঃ-(৪৩) হে জনার্দ্ধন, যে মনুষ্যদিগের কূলধর্ম্ম উৎসন্ন যায়, তাহাদের নিয়ত নরকে বাস হয়, ইহা আমরা শুনিয়াছি।
অহোবত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ম্।
যদ্রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪
যদ্রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪
অর্থঃ-(৪৪) হায় ! আমরা রাজ্যসুখলোভে স্বজনগণকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়া মহাপাপে প্রবৃত্ত হইয়াছি।
যদি মামপ্রতিকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেত।।৪৫
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেত।।৪৫
অর্থঃ-(৪৫) আমি শস্ত্রত্যাগ করিয়া প্রতিকারে বিরত হইলে যদি অস্ত্রধারী দুর্য্যোধনাদি আমাকে যুদ্ধে বধ করে তাহাও আমার পক্ষে অধিকতর মঙ্গলকর হইবে।
সঞ্জয় উবাচ –
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬
অর্থঃ-(৪৬) সঞ্জয় কহিলেন – শোকাকুলিত অর্জ্জুন এইরূপ বলিয়া যুদ্ধমধ্যে ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ করিয়া রথোপরি উপবেশন করিলেন।
১) সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি
যুদ্ধারম্ভের পূর্বে ব্যাসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন । ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন – আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন । তখন ব্যাসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন । সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বাক্যাদি-শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন । গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য [মভাঃ|ভীঃ|১|২৪] । ‘পরম যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য চক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না’ – শ্রীঅরবিন্দ ।
যুদ্ধারম্ভের পূর্বে ব্যাসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন । ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন – আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন । তখন ব্যাসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন । সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বাক্যাদি-শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন । গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য [মভাঃ|ভীঃ|১|২৪] । ‘পরম যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য চক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না’ – শ্রীঅরবিন্দ ।
ধর্মক্ষেত্র – যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র
কুরুক্ষেত্র চিরকালই পরম পুণ্যভূমি বলিয়া পরিচিত । জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবযজন অর্থাৎ দেবতাদের ‘যজ্ঞস্থান’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । ইহার প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক । পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং ‘ধর্মক্ষেত্র’ এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।
কুরুক্ষেত্র চিরকালই পরম পুণ্যভূমি বলিয়া পরিচিত । জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবযজন অর্থাৎ দেবতাদের ‘যজ্ঞস্থান’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । ইহার প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক । পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং ‘ধর্মক্ষেত্র’ এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।
৩) ‘আপনার ধীমান শিষ্য’ – এ-কথাটি দুর্যোধন শ্লেষাত্মক ভাবেই ব্যবহার করিয়াছেন । আবার ‘ধৃষ্টদ্যুম্ন’ না বলিয়া ‘দ্রুপদপুত্র’ বলিয়া দ্রোণাচার্যের পূর্বশত্রুতা স্মরণ করাইয়া দিতেছেন ।
৫) কুন্তিভোজঃ পুরুজিৎ – একই ব্যক্তি, ইনি ভীমসেনাদির মাতুল । কুন্তিভোজ কৌলিক নাম ।
৬) মহারথ = যিনি একাকী দশ-সহস্র ধনুর্ধারীর সহিত যুদ্ধ করেন এবং যিনি শস্ত্রশাস্ত্রে প্রবীণ, তিনিই মহারথ ।
৮) সমিতিঞ্জয়ঃ = সমিতি(সংগ্রামে) জয় লাভ করে যে অর্থাৎ যুদ্ধজয়ী ।
সৌমদত্তিঃ = সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রবা ।
সৌমদত্তিঃ = সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রবা ।
১০) পর্যাপ্ত = যাহা আয়ত্ত করা যায়, পরিমাণ করা যায় অর্থাৎ পরিমিত, সীমাবদ্ধ । অর্থান্তরে যথেষ্ট, সমর্থ ।
অপর্যাপ্ত = অপরিমিত, অসংখ্য । অর্থান্তরে অপ্রচুর, অসমর্থ ।
এই অনুবাদে প্রথম অর্থই গ্রহণ করে তাৎপর্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে – ‘আমাদের সৈন্য অপরিমিত অর্থাৎ বৃহৎ, তাহাতে বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আমাদের সেনাপতি; আর উহাদের সৈন্য পরিমিত অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, আর নগন্য ভীম উহাদের সেনাপতি – সুতরাং আমাদের জয় হইবে না কেন ?’
অপর্যাপ্ত = অপরিমিত, অসংখ্য । অর্থান্তরে অপ্রচুর, অসমর্থ ।
এই অনুবাদে প্রথম অর্থই গ্রহণ করে তাৎপর্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে – ‘আমাদের সৈন্য অপরিমিত অর্থাৎ বৃহৎ, তাহাতে বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আমাদের সেনাপতি; আর উহাদের সৈন্য পরিমিত অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, আর নগন্য ভীম উহাদের সেনাপতি – সুতরাং আমাদের জয় হইবে না কেন ?’
শ্রীধর স্বামীর টীকায় শেষোক্ত ব্যাখ্যাই আছে । এঁনার মতে, পরের শ্লোকে ‘সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন’ এ-কথায় বুঝা যায় যে, দুর্যোধনের মনে কিছু ভয়ের উদ্রেক হইয়াছিল এবং তিনি নিজের সৈন্যবল অপ্রচুর বা অসমর্থ মনে করিতেছেন । কিন্তু দুর্যোধনের ভয় পাওয়ার কথা মহাভারতে কোথাও নাই । বরং ঠিক ইহার বিপরীত কথাই আছে [মভাঃ|উঃ|১-৬৯, মভাঃ|ভীঃ|৫১|৬|৯] যাহা হইতে বুঝা যায় যে সকলকে উৎসাহ-দানার্থই এ-সকল কথা বলা হইয়াছিল । এই কারণে লোকমান্য তিলক প্রমুখ অনেকে পূর্বোক্ত প্রথম অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।
১১) ‘সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন’ – দুর্যোধনের এই আশঙ্কার তাৎপর্য
ভীষ্ম সমরে অপরাজেয়, তথাপি তাঁহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন ? দুর্যোধন পূর্বেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন – ‘ভীষ্ম একাই সসৈন্য পাণ্ডবকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখণ্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখণ্ডী দ্বারা অতর্কিতভাবে ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই’ [মভাঃ|ভীঃ|১৫|১৪-২০] ।
ভীষ্ম সমরে অপরাজেয়, তথাপি তাঁহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন ? দুর্যোধন পূর্বেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন – ‘ভীষ্ম একাই সসৈন্য পাণ্ডবকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখণ্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখণ্ডী দ্বারা অতর্কিতভাবে ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই’ [মভাঃ|ভীঃ|১৫|১৪-২০] ।
১৩) পণব = মৃদঙ্গ, আনক = ঢাক, গোমুখ = রণশঙ্খ; সেকালের বিউগ্ল্ (bugle) ছিল শঙ্খ ।
২৪) ভারত = দুষ্মন্ত-রাজার পুত্র ভরতের বংশধর, এখানে ধৃতরাষ্ট্র ।
গুড়াকেশেন = গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য), তাহার ঈশ, অর্থাৎ নিদ্রালস্যজয়ী, এখানে অর্জুন ।
হৃষীকেশঃ = হৃষীক ইন্দ্রিয়, তাহার ঈশ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ।
গুড়াকেশেন = গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য), তাহার ঈশ, অর্থাৎ নিদ্রালস্যজয়ী, এখানে অর্জুন ।
হৃষীকেশঃ = হৃষীক ইন্দ্রিয়, তাহার ঈশ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ।
৩৬) আততায়ী (assassin)
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ । ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ।।
ছয়জন আততায়ী – (i)অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), (ii)গরদ (যে বিষ দেয়), (iii)বধার্থ অস্ত্রধারী, (iv)ধনাপহারী, (v)ভূমি-অপহারী ও (vi)দারা-হরণকারী ।
দুর্যোধনাদি প্রায় এ-সমস্ত কর্মই করিয়াছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী ।
Six types of assassin (who can be killed as per law) : one who (i) commits arson, (ii) gives poison, (iii) wields weapon to kill, (iv) steals wealth, (v) steals land, (vi) steals wife.
অর্থশাস্ত্রমতে (law) আততায়ী বধ্য [মনু|৮|৩৫০-৫১] । কিন্তু ধর্মশাস্ত্রমতে (morality) “অহিংসা পরমো ধর্মঃ’, ‘গুরুজনাদিরবধ্যঃ’, ‘ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ’ ইত্যাদি । অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্র বলবৎ । সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাদি-বধে পাপভাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম ।
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ । ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ।।
ছয়জন আততায়ী – (i)অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), (ii)গরদ (যে বিষ দেয়), (iii)বধার্থ অস্ত্রধারী, (iv)ধনাপহারী, (v)ভূমি-অপহারী ও (vi)দারা-হরণকারী ।
দুর্যোধনাদি প্রায় এ-সমস্ত কর্মই করিয়াছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী ।
Six types of assassin (who can be killed as per law)
অর্থশাস্ত্রমতে (law) আততায়ী বধ্য [মনু|৮|৩৫০-৫১] । কিন্তু ধর্মশাস্ত্রমতে (morality) “অহিংসা পরমো ধর্মঃ’, ‘গুরুজনাদিরবধ্যঃ’, ‘ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ’ ইত্যাদি । অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্র বলবৎ । সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাদি-বধে পাপভাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম ।
৪২) বর্ণধর্ম = ব্রাহ্মণের অধ্যাপনাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষাদি, বৈশ্যের কৃষি-বাণিজ্যাদি, শূদ্রের পরিচর্যাদি । (অর্জুন এস্থলে জাতিধর্ম ও বর্ণধর্ম সমার্থক রূপে ব্যবহার করিয়াছেন কিন্তু মানুষের জাতি তার জন্মের সহিত সম্পর্কিত আর শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ মানুষের গুণের ও কর্মের সহিত সম্পর্কিত [গীতা|৪|১৩], uploader’s comment ।) বর্ণ বনাম জাতি
কুলধর্ম = কৌলিক উপাসনা-পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি ।
আশ্রমধর্ম = ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস ।
কুলধর্ম = কৌলিক উপাসনা-পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি ।
আশ্রমধর্ম = ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ