শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা: দ্বিতীয় অধ্যায় - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 August, 2021

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা: দ্বিতীয় অধ্যায়

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা: দ্বিতীয় অধ্যায় – সাংখ্যযোগ

(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা দ্বিতীয় অধ্যায়


সঞ্জয় উবাচ –

তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ।।১
অর্থঃ-(১) সঞ্জয় কহিলেন – তখন মধূসুদন কৃপাবিষ্ট অশ্রুপূর্ণলোচন বিষন্ন অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন।
শ্রীভগবানুবাচ –
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্য্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্ত্তিকরমর্জ্জুন।।২
অর্থঃ-(২) শ্রীভগবান্ উবাচ – হে অর্জ্জুন ! এই সঙ্কটসময়ে অনার্য্য-জনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্ত্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল?
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্ব্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।৩
অর্থঃ-(৩) হে পার্থ, কাতর হইও না। এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাকে শোভা পায় না। হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্ব্বলতা ত্যাগ করিয়া (যুদ্ধার্থে) উত্থিত হও।
অর্জ্জুন উবাচ –
কথং ভীস্মমহং সংখ্যে দ্রোণঞ্চ মধুসূদন।
ইযুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পুজার্হাবরিসূদন।।৪
অর্থঃ-(৪) অর্জ্জুন বলিলেন – হে শত্রুমর্দ্দন মধুসূদন, আমি যুদ্ধকালে পূজনীয় ভীস্ম ও দ্রোণের সহিত কিরূপে বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব ? (অর্থাৎ) তাঁহারা আমার শরীরে বাণ নিক্ষেপ করিলেও আমি গুরুজনের অঙ্গে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারিব না।
গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্ শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্।।৫
অর্থঃ-(৫) মহাবুভব গুরুদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন-ভোজন করাও শ্রেয়ঃ। কেননা গুরুদিগকে বধ করিয়া ইহলোকে যে অর্থকাম ভোগ করিব তাহা ত (গুরুজনের) রুধির-লিপ্ত।
ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো যদ্বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্তেহবস্থিতাঃ প্রজুখে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ।।৬
অর্থঃ-(৬) আমরা জয়ী হই অথবা আমাদিগকে ইহারা জয় করুক, এই উভয়ের মধ্যে কোন্ টি শ্রেয়স্কর তাহা বুঝিতে পারিতেছি না, – যাহাদিগকে বধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত।
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।।৭
অর্থঃ-(৭) (গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কিরূপে প্রাণ ধারণ করিব এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত) চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইয়াছি; প্রকৃত ধর্ম কি এ সন্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে; যাহা আমার ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও। (আমাকে আর তুমি সখা বলিয়া মনে করিও না, আমি তোমার শিষ্য)।
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাৎ যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভুমাবসপত্নমৃদ্ধং রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্।।৮
অর্থঃ-(৮) পৃথিবীতে নিস্কন্টক সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না।
সঞ্জয় উবাচ –
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভুব হ।।৯
অর্থঃ-(৯) সঞ্জয় কহিলেন – শত্রুতাপন অর্জ্জুন হৃষীকেশ গোবিন্দকে এইরূপ বলিয়া ‘আমি যুদ্ধ করিব না’ এই কথা কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন (নীরব রহিলেন)।
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষিদন্তমিদং বচঃ।।১০
অর্থঃ-(১০) হে ভারত (ধৃতরাষ্ট্র) ! হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপ্রাপ্ত অর্জ্জুনকে হাসিয়া এই কথা বলিলেন।
শ্রীভগবানুবাচ –
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ।।১১
অর্থঃ-(১১) শ্রীভগবান্ বলিলেন- যাহাদিগের জন্য শোক করার কোন কারণ নাই, তুমি তাহাদিগের জন্য শোক করিতেছ, আবার পণ্ডিতের ন্যায় কথা বলিতেছ। কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী তাঁহারা কি মৃত কি জীবিত, কাহারো জন্য শোক করেন না।
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিশ্যামঃ সর্ব্বে বয়মতঃপরম্।।১২
অর্থঃ-(১২) আমি পূর্ব্বে ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিগণ ছিলেন না, আমন নহে (অর্থাৎ সকলেই ছিলাম)। আর, পরে আমরা সকলে থাকিব না তাহাও নহে (অর্থাৎ পরেও সকলে থাকিব)।
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩
অর্থঃ-(১৩) জীবের এই দেহে বাল্য, যৌবন ও বার্দ্ধক্য, কালের গতিতে উপস্থিত হয়। তেমনি কালের গতিতে দেহান্ত্র প্রাপ্তি হয়। জ্ঞানিগণ তাহাতে মুগ্ধ হন না।
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।১৪
অর্থঃ-(১৪) হে কৈন্তেয়, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়াদির সংযোগই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখ প্রদান করে। সেগুলির একবার উৎপত্তি হয়, আবার বিনাশ হয়, সুতরাং ওগুলি অনিত্য। অতএব সে সকল সহ্য কর।
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।।১৫
অর্থঃ-(১৫) হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, যে স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি এই সকল বিষয়স্পর্শ-জনিত সুখদুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, উহাতে বিচলিত হন না, তিনি অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হন।
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।১৬
অর্থঃ-(১৬) অসৎ বস্তুর ভাব (সত্তা, স্থায়িত্ব) নাই, সৎবস্তুর অভাব (নাশ) নাই; তত্ত্বদর্শিগণ এই সদসৎ উভয়েরই চরম দর্শন করিয়াছেন (স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন)।
অবিনাশিতু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুমর্হতি।১৭
অর্থঃ-(১৭) যিনি এই সকল (দৃশ্য জগৎ) ব্যাপিয়া আছেন তাঁহাকে অবিনাশী জানিও। কেহই এই অব্যয় স্বরূপের বিনাশ করিতে পারে না।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত।।১৮
অর্থঃ-(১৮) দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছে। কিন্তু আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রমেয় (স্বপ্রকাশ)। অতএব, হে অর্জুন, যুদ্ধ কর (আত্মার অবিনাশিতা ও দেহাদির নশ্বরত্ব স্মরণ করিয়া কাতরতা ত্যাগ কর। স্বধর্ম পালন কর)।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্ত ন হন্যতে।।১৯
অর্থঃ-(১৯) যে আত্মাকে হন্তা বলিয়া জানে এবং যে উহাকে হত বলিয়া মনে করে, তাহারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না। ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।২০
অর্থঃ-(২০) এই আত্মা কখনো জন্মেন না বা মরেন না। ইনি অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ব লাভ করেন না অর্থাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান। ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ; শরীর হত হইলেও ইনি হত হয়েন না।২০
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্।।২১
অর্থঃ-(২১) যিনি আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয় বলিয়া জানেন, হে পার্থ, সে পুরুষ কি প্রকারে কাহাকে হত্যা করেন বা করান?
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।২২
অর্থঃ-(২২) যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন শরীর পরিগ্রহ করে।
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।২৩
অর্থঃ-(২৩) শস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না, বায়ুতে শুস্ক করিতে পারে না।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্য্যোহয়মুচ্যতে।।২৪
অর্থঃ-(২৪) এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য। ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অবিকার্য্য বলিয়া কথিত হন।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি।।২৫
অর্থঃ-(২৫) অতএব আত্মাকে এই প্রকার জানিয়া তোমার শোক করে উচিত নয়।
অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি।।২৬
অর্থঃ-(২৬) আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মা সর্ব্বদা দেহের সঙ্গে জন্মে এবং দেহের সঙ্গেই বিনষ্ট হয়, তথাপি, হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয়। (দেহনাশে আত্মারও নাশ হয় ইহা স্বীকার করিয়া লইলেও শোক করা উচিত নয়। কেননা, জন্মমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।)
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।২৭
অর্থঃ-(২৭) যে জন্মে তার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়।
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।২৮
অর্থঃ-(২৮) হে ভারত (অর্জ্জুন) ! জীবগণ আদিতে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত এবং বিনাশান্তে অব্যক্ত থাকে। তাহাতে শোক বিলাপ কি?
আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনমাশ্চর্য্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।।২৯
অর্থঃ-(২৯) কেহ আত্মাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা ইনি আশ্চর্য্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন। কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না।
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।৩০
অর্থঃ-(৩০) হে ভারত, জীবসকলের দেহে আত্মা সর্বদাই অবধ্য, অতএব কোন প্রাণীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নহে।
স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।৩১
অর্থঃ-(৩১) স্বধর্ম্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার ভীত-কম্পিত হয়া উচিত নহে। ধর্মাযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নাই।
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্।।৩২
অর্থঃ-(৩২) হে পার্থ, এই যুদ্ধ আপনা হইতেই উপস্থিত হইয়াছে, ইহা মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ। ভাগ্যবান্ ক্ষত্রিয়েরাই ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করিয়া থাকেন।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্ম্মং কীর্ত্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি।।৩৩
অর্থঃ-(৩৩) আর যদি তুমি ধর্ম্ম্য যুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম্ম ও কীর্ত্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে।
অকীর্ত্তিঞ্চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্ত্তির্মরণাদতিরিচ্যতে।।৩৪
অর্থঃ-(৩৪) আরও দেখ, সকল লোকে চিরকাল তোমার অকীর্ত্তি ঘোষণা করিবে। সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্ত্তি মরণ অপেক্ষা অধিক, অর্থাৎ অকীর্ত্তি অপেক্ষা মরণও শ্রেয়ঃ।
ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ।
যেষাষ্ণ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্।।৩৫
অর্থঃ-(৩৫) মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশতঃ নহে। সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে।
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্।।৩৬
অর্থঃ-(৩৬) তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে; তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কি আছে?
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ।।৩৭
অর্থঃ-(৩৭) যুদ্ধে হত হইলে স্বর্গ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে, সুতরাং হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর।
সুখেদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।৩৮
অর্থঃ-(৩৮) অতএব, সুখদুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় তুল্যজ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্ যুক্ত হও। এইরূপ করিলে পাপভাগী হইবে না।
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্যসি।।৩৯
অর্থঃ-(৩৯) হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য নিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান উপদেশ দিলাম, এক্ষণ যোগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ কর (যাহা এক্ষণ বলিতেছি) এই জ্ঞান লাভ করিলে কর্ম্মবন্ধন ত্যাগ করিতে পারিবে।
এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিয়োগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা য়ুক্তো য়য়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি।। গীতা - ২।৩৯

পদচ্ছেদঃ এষা। তে। অভিহিতা। সাংখ্যে। বুদ্ধিঃ। য়োগে। তু।
ইমাং। শৃণু। বুদ্ধ্যা। যুক্তঃ । য়য়া। পার্থ। কর্মবন্ধং। প্রহাস্যসি।।

পদার্থঃ (পার্থ) হে পার্থ! (তে) তােমার জন্য (এষা) এই (সাংখ্যে) শঙ্কা=সদসদ্ধি বিষয়ে (বুদ্ধিঃ) জ্ঞানযােগের উপদেশ করে আর এখন (য়ােগে, তু, ইমাং, শ্রৃণু) ক. বিষয়ক এই উপদেশকে শ্রবণ করাে (য়য়া, বুদ্ধ্যা) যে বুদ্ধি থেকে (যুক্তঃ) যুক্ত হয়ে তুমি (কর্মবন্ধং) কর্মবন্ধন থেকে (প্রহাস্যসি) মুক্ত হতে পারবে।।

ভাবার্থঃ হে অর্জুন! তােমার এই বুদ্ধি শঙ্কার বিষয়ে কেন হয়? এখন যােগ-বিষয়ক বুদ্ধিকে
শ্রবণ করাে, যাহা থেকে যুক্ত হয়ে তুমি কর্মের বন্ধনকে নষ্ট করতে পারবে।
এইজন্য
"য়োহর্থজ্ঞ ইত্ সকলম্ ভ্রদ্রমশ্লুতে” (নিরুক্ত ১।৬।১৮)
কেননা সেই অর্থজ্ঞানের বল হইতে বিকলের সকলকে বানিয়ে নেয়। কিন্তু এই বেদবাদিদের তব সারা পুণ্য-পাপ যজ্ঞ-ক্রিয়ার মন্ত্রোচ্চারণ তথা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া-ক্রমেই রেখে দেয়। এই জন্য শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছে যে হে অর্জুন! ধর্ম-মার্গ অতি সরল হয়।
মহাে অর্ণঃ সরস্বতী প্র চেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বি রাজতি। (ঋগ্বেদ ১।৩।১২)
ভাবার্থঃ জ্ঞানের প্রকাশ করার জন্য এই বিদ্যার দেবী কর্মের মহাসাগরকে জ্ঞানের সামনে খুলে দিতে হয় অর্থাৎ এই বিদ্বার কারণ মনুষ্য, কর্মকে নানা মার্গের জ্ঞাতা হয়ে যায় আর এই প্রকার নিজের বুদ্ধিকে জ্ঞানযুক্ত করে।।-(আর্যমুনি গীতা ভাষ্য)
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।৪০
অর্থঃ-(৪০) ইহাতে (এই নিস্কাম কর্ম্মযোগে) আরব্ধ কর্ম্ম নিস্ফল হয় না এবং (ত্রুতিবিদ্যুতি-জনিত) পাপ বা বিঘ্ন হয় না, ধর্ম্মের অল্প আচরণও মহাভয় হইতে ত্রাণ করে।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।
বহুশাখা হ্যনস্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্।।৪১
অর্থঃ-(৪১) ইহাতে (এই নিস্কাম কর্ম্মযোগে) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি (নিস্কাম ভাবে কর্ম্ম করিয়াই আমি ত্রাণ পাইব এইরূপ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) একই হয় অর্থাৎ একনিষ্ঠই থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না। কিন্তু অব্যবসায়ীদিগের (অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অনন্ত (সুতরাং নানাদিকে ধাবিত হয়)।
যামিমাং পুস্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ।।৪২
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্ম্মফলপ্রদাম্
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈর্শ্বয্যগতিং প্রতি।।৪৩
ভোগৈর্শ্বয্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪
অর্থঃ-(৪২, ৪৩, ৪৪) হে পার্থ, অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ বেদের কর্ম্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে বেদোক্ত কাম্যকর্ম্মাত্মক ধর্ম্ম ভিন্ন আর কিছু ধর্ম্ম নাই, তাহাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বর্গই তাহাদের পরম পুরুষার্থ, তাহারা ভোগৈশ্বর্য্য লাভের উপায়স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশংসাসূচক আপাতোমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে; এই সকল শ্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বর্য্যে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্য্যাকার্য্য নির্ণায়ক বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না (ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না)।
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জ্জুন।
নির্দ্বন্ধো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।।৪৫
অর্থঃ-(৪৫) হে অর্জ্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও – তুমি নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্ত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মবান্ হও।
যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ।।৪৬
অর্থঃ-(৪৬) বাপীকূপতপাগাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, এক বিস্তীর্ণ মহাজলাশয়ে সেই সমস্তই সিদ্ধ হয়; সেইরূপ বেদোক্ত কাম্যকর্ম্মসমূহে যে ফল লাভ হয়, ব্রহ্মবেত্তা ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সেই সমস্তই লাভ হয়।
কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।৪৭
অর্থঃ-(৪৭) কর্ম্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই। কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয় কর্ম্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।৪৮
অর্থঃ-(৪৮) হে ধনঞ্জয়, যোগস্থঃ হইয়া, ফলাসক্তি বর্জ্জন করিয়া, সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্যজ্ঞান করিয়া তুমি কর্ম্ম কর। এইরূপ সমত্য-বুদ্ধিকেই যোগ কহে।
দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ।।৪৯
অর্থঃ-(৪৯) হে ধনঞ্জয়, কেবল বাহ্য কর্ম্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট; অতএব তুমি সমত্ববুদ্ধির আশ্রয় লও; যাহারা ফলের উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করে, তাহার দীন, কৃপার পাত্র।
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম্।।৫০
অর্থঃ-(৫০) সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিস্কাম কর্ম্মী ইহলোকেই সুকৃত দুস্কৃত উভয়ই ত্যাগ করেন। সুতরাং তুমি যোগের অনুষ্ঠান কর; কর্ম্মে কৌশলই যোগ।
কর্ম্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্।।৫১
অর্থঃ-(৫১) সমত্ববুদ্ধিযুক্ত জ্ঞানিগণ কর্ম্মকরিলেও কর্ম্মজনিত ফলে আবদ্ধ হয়েন না, সুতরাং তাঁহারা জন্মরূপ বন্ধন অর্থাৎ সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্ব্বপ্রকার উপদ্রবরহিত বিষ্ণুপদ বাঁ মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন।
যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্ব্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।৫২
অর্থঃ-(৫২) যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকানন অতিক্রমকরিবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে।
শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্স্যসি।।৫৩
অর্জ্জুন উবাচ –
স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্।।৫৪
অর্থঃ-(৫৩) লৌকিক ও বৈদিক নানাবিধ ফলকথা শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে নিশ্চল হইয়া থাকিবে তখন তুমি(সাম্যবুদ্ধিরূপ) যোগ প্রাপ্ত হইবে।
শ্রীভগবানুবাচ –
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্ব্বান্ পার্থ মণগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।৫৫
অর্থঃ-(৫৫) শ্রীভগবান্ বলিলেন – হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জ্জন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন।
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।৫৬
অর্থঃ-(৫৬) যিনি দুঃখে উদ্বেগশূন্য, সুখে স্পৃহাশূন্য, যাঁহার অনুরাগ, ভয় এবং ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনি বলা যায়।
যঃ সর্ব্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৭
অর্থঃ-(৫৭) যিনি দেহ-জীবনাদি সকল বিষয়েই শুভ প্রাপ্তিতে সন্তোষ বাঁ অশুভ প্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
যদা সংহরতে চায়ং কুর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৮
অর্থঃ-(৫৮) কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গসকল সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, তেমনি যিনি রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সকল সংহরণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্টা নিবর্ত্ততে।।৫৯
অর্থঃ-(৫৯) ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়োপভোগ নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু বিষয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না। কিন্তু সেই পরম পুরুষকে দেখিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির বিষয়-বাসনাও নিবৃত্ত হয়।
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।।৬০
অর্থঃ-(৬০) হে কৌন্তেয়, প্রমাথী ইন্দ্রিয়গণ সংযমে যত্নশীল, বিবেকী পুরুষেরও চিত্তকে বলপূর্ব্বক হরণ করে (বিষয়াসক্ত করে)।
তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬১
অর্থঃ-(৬১) যিনি আমার অনন্যভক্ত তিনি সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করিয়া আমাকে চিত্ত সমাহিত করিয়া অবস্থান করেন। তাদৃশ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিরই ইন্দ্রিয়-সকল বশীভূত হয়, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপুজায়তে।
সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।৬২
ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩
অর্থঃ-(৬২-৬৩) বিষয়-চিন্তা করিতে করিতে মনুষ্যের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা অর্থাৎ সেই বিষয় লাভের অভিলাষ জন্মে, সেই কামনা কোন কারণে প্রতিহত বা বাধা প্রাপ্ত হইলে প্রতিবোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ ঘটে।
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।৬৪
অর্থঃ-(৬৪) কিন্তু যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যাহার মন নিজের বশবর্ত্তী, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিষয় উপভোগ করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।
প্রসাদে সর্ব্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্য্যবতিষ্ঠতে।।৬৫
অর্থঃ-(৬৫) চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে এই পুরুষের সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি হয়, যেহেতু প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্র উপাস্য বস্তুতে স্থিতি লাভ করে।
নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।৬৬
অর্থঃ-(৬৬) যিনি অযুক্ত অর্থাৎ যাঁহার চিত্ত অসমাহিত ও ইন্দ্রিয় অবশীকৃত, তাঁহার আত্ম-বিষয়া বুদ্ধিও হয় না, চিন্তাও হয় না। (যাঁহার আত্ম-বিষয়া) চিন্তা নাই, তাঁহার শান্তি নাই, যাঁহার শান্তি নাই, তাঁহার সুখ কোথায়?
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি।।৬৭
অর্থঃ-(৬৭) মন বিষয়ে প্রবর্ত্তমান ইন্দ্রিয়গণের যেটীকে অনুবর্ত্তন করে, সেই একটী ইন্দ্রিয়ই, যেমন বায়ু জলের উপরিস্থিত নৌকাকে বিচলিত করে, তদ্রূপ উহার প্রজ্ঞা হরণ করে।
তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্ব্বশঃ
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬৮
অর্থঃ-(৬৮) হে মহাবাহু ! (যখন ইন্দ্রয়াধীন মন এবং মনের অধীন প্রজ্ঞা) সেই হেতু, যাহার ইন্দ্রিয় সর্ব্বপ্রকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারই প্রজ্ঞা স্থির হইয়াছে।
যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।৬৯
অর্থঃ-(৬৯) সাধারণ প্রাণিগণের পক্ষে যাহা (আত্মনিষ্ঠা) নিশাস্বরূপ, তাহাতে (আত্মনিষ্ঠাতে) সংযমী ব্যক্তি জাগ্রত থাকেন; যাহাতে (বিষয়নিষ্ঠাতে) অজ্ঞ প্রাণিসাধারণ জাগরিত থাকে, আত্মদর্শী মুনিদিগের তাহা (বিষয়নিষ্ঠা) রাত্রিস্বরূপ।
আপূর্য্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদবৎ।
তদবৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্ব্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।৭০
অর্থঃ-(৭০) যেমন নদ-নদীর জলে পরিপূরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশি আসিয়া প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, সেইরূপ যে মহাত্মাতে বিষয় সকল প্রবেশ করিয়াও কোনরূপ চিত্তবিক্ষেপ উৎপন্ন করে না, তিনি শান্তিলাভ করেন; যিনি ভোগ কামনা করেন, তিনি শান্তি পান না।
বিহায় কামান্ যঃ সর্ব্বান্ পুমাংশ্চরতি নিস্পৃহঃ।
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।৭১
অর্থঃ-(৭১) যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করিয়া নিস্পৃহ হইয়া বিচরণ করেন, যিনি মমতাশূন্য ও অহঙ্কারশূন্য, তিনিই শান্তিপ্রাপ্ত হন।
এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃচ্ছতি।।৭২
অর্থঃ-(৭২) হে পার্থ, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান)। এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে জীবের আর মোহ হয় না। মৃত্যুকালে এই অবস্থায় থাকিয়া তিনি ব্রহ্মনির্ব্বাণ বা ব্রহ্মে মিলনরূপ মোক্ষ লাভ করেন।

১) দয়া ও কৃপা স্বতন্ত্র ভাব :
দয়া = লোকের দুঃখে দুঃখিত হইয়া দুঃখমোচনের প্রবল প্রবৃত্তি ।
কৃপা = পরের দুঃখচিন্তায় বা দুঃখদর্শনে কাতর হওয়া ।
‘কাতরতা দয়া নহে, কৃপা । দয়া বলবানের ধর্ম, কৃপা দুর্বলের ধর্ম ।’ – শ্রীঅরবিন্দ ।
৩) ‘যে কৃপার বশে (কাতর হইয়া) অস্ত্র পরিত্যাগ করে, ধর্মে পরানঙ্মুখ হয়, কাঁদিতে বসিয়া ভাবে আমার কর্তব্য করিতেছি, আমি পুণ্যবান – সে ক্লীব ।’ … “শ্রীকৃষ্ণ দেখিলেন, অর্জুন কৃপায় আবিষ্ট হইয়াছেন, বিষাদ তাঁহাকে গ্রাস করিয়াছে । এই তামসিক ভাব অপনোদন করিবার জন্য অন্তর্যামী তাঁহার প্রিয়সখাকে ক্ষত্রিয়োচিত তিরস্কার করিলেন, তাহাতে যদি রাজসিক ভাব জাগরিত হইয়া তমঃকে দূর করে ।’ – শ্রীঅরবিন্দ ।
৭) পুত্র বা শিষ্যরূপে জিজ্ঞাসু না হইলে গুরু তত্ত্বোপদেশ দেন না, কাজেই তত্ত্বজিজ্ঞাসু-অর্জুন লৌকিক ‘সখ্য’-ভাব ত্যাগ করিয়া ভগবানের ‘শিষ্যত্ব’ স্বীকার করিলেন । একান্ত শ্রদ্ধার বশে সম্পূর্ণভাবে ভগবানের শরণাগত হওয়াই গীতার প্রধান শিক্ষা । ইহাই আত্মসমর্পণ । এই শ্রদ্ধাবলেই অর্জুন গীতোক্ত-শিক্ষার শ্রেষ্ঠপাত্র বলিয়া গৃহীত ।
১১) অর্জুনের মোহ :
এই স্থলেই প্রকৃতপক্ষে গীতা আরম্ভ । গীতোক্ত ধর্ম কি তাহা বুঝিতে হইলে, কি উপলক্ষে এই ধর্মের প্রচার হইয়াছিল তাহা স্মরণ রাখা প্রয়োজন । পাঠক মনে রাখিবেন, অর্জুন পূর্বাপরই যুদ্ধার্থে উদ্যোগী ছিলেন, যুদ্ধের কর্তব্যতা সম্বন্ধে কখনও তাঁহার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় নাই । বরং শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ অনিবার্য জানিয়াও যুদ্ধ নিবারণার্থ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন – এমন কি স্বয়ং দৌত্যকার্য্যে ব্রতী হইয়াছিলেন । সেই যুদ্ধ যখন আসন্ন, শস্ত্র-সম্পাত যখন আরম্ভ হইয়াছে, তখন অর্জুনের বিষম নির্বেদ উপস্থিত, তিনি যত ধর্মশাস্ত্র খুঁজিয়া-খুঁজিয়া যুদ্ধের অকর্তব্যতা প্রতিপাদ্য করিতে উন্মুখ । অর্জুনের মনোরম বাক্যগুলি শুনিয়া আমাদের মনে হয়, কি উচ্চ অন্তঃকরণের কথা । কি উদার নিঃস্বার্থ ভাব ! কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কি বলিতেছেন ? ভগবান একটু হাসিয়া বলিলেন, এগুলি জ্ঞানীর ভাষায় মূর্খের কথা । তোমার এ-মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল ?
অর্জুনের এই মোহ দূরীকরণের চেষ্টাতেই গীতাশাস্ত্রের উদ্ভব । অর্জুনের মোহ উপলক্ষ্য করিয়া ভগবান সমগ্র মানব-জাতির অশেষ কল্যাণকর এই অপূর্ব ধর্মতত্ত্ব জগতে প্রচার করিলেন ।
১৩) জন্মান্তরবাদ : খ্রীষ্টীয় বনাম হিন্দু মত
বাল্যাবস্থার পরে যৌবনাবস্থা উপস্থিত হয়, উহা অবস্থান্তরমাত্র । সেইরূপ এক দেহ ত্যাগ করিয়া অন্য দেহ গ্রহণও জীবাত্মার একটি অবস্থান্তর মাত্র । এখানে ‘মৃত্যু’ না বলিয়া বলা হইয়াছে, ‘দেহান্তর-প্রাপ্তি’, সুতরাং মানিয়া লওয়া হইল মরিলেই জন্ম হয় । ইহাই জন্মান্তরবাদ । আত্মার অবিনাশিতা ও পুনর্জন্ম হিন্দুধর্মের এই দুইটি প্রধান তত্ত্ব । বৌদ্ধধর্মেরও ইহাই মূলতত্ত্ব । খ্রীষ্টীয় ধর্ম আত্মার অবিনাশিতা স্বীকার করেন, কিন্তু পুনর্জন্ম স্বীকার করেন না । এখন প্রশ্ন এই – আত্মা যদি অবিনাশী, তবে দেহনাশের পরে ইহার কি গতি হয় ?
এ-সম্বন্ধে খ্রীষ্টীয় ধর্মের মত এই যে – পরমেশ্বর বিচার করিয়া জীবের সুকৃতি ও দুষ্কৃতি-অনুসারে দেহান্তে পুণ্যবানকে অনন্ত স্বর্গে ও পাপীকে অনন্ত নরকে প্রেরণ করেন । এই ধর্মমতের অনুকূলে যুক্তি বেশী কিছু নাই । বিশ্বাসই ইহার মূল ভিত্তি । কিন্তু ইহার প্রতিকূলে প্রধান আপত্তি এই যে, ঈশ্বরের এই যে বিচার, ইহা অবিচার বলিয়াই বোধ হয়; কেননা এই সংসারে কেহই কেবল পুণ্য বা কেবল পাপ করে না । সকলে কিছু-না-কিছু পুণ্যকর্মও করে, পাপকর্মও করে । সুতরাং যাহার জন্য অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থা হইল, তাহার পাপের শাস্তি হইল না; পক্ষান্তরে যাহার পক্ষে অনন্ত নরকবাস লখিত হইল, তাহার পুণ্যের পুরস্কার হইল না । বলিতে পার, প্রত্যেক জীবের পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশ করিয়া পাপ ও পুণ্যের আধিক্য-অনুসারে অনন্ত নরকবাস বা স্বর্গবাসের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু অনন্তকালের তুলনায় মানুষের এই জীবনকাল কতটুকু ? ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের পাপাধিক্য বা পুণ্যাধিক্যের জন্য অনন্তকাল ব্যাপিয়া নরকবাস বা স্বর্গবাসের ব্যবস্থা, ইহাতে কি একপক্ষে অতি-নিষ্ঠুরতা, অপর পক্ষে অতি-উদারতা প্রকাশ পায় না ?
এ-সম্বন্ধে হিন্দুমত এই যে – স্বর্গ বা নরকভোগ জীবের চরম গতি নয় । যাহা হইতে জীবের উদ্ভব, সেই পরব্রহ্মে লীন হওয়া বা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়াই জীবের পরম লক্ষ্য ও চরম গতি । যে-পর্যন্ত জীব তাহার উপযোগী না হয়, সে পর্যন্ত তাহাকে কৃতকর্মানুসারে পুনঃপুনঃ দেহ ধারণ করিয়া কর্মফল ভোগ করিতে হয় । ভোগ ভিন্ন প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয় না । জীবের এই যে জন্মমৃত্যু-চক্রে পরিভ্রমণ, ইহারই নাম সংসার (সং-সৃ=গমন করা) । এই সংসার ক্ষয় হইয়া কিরূপে জীবের ব্রহ্মনির্বাণ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি হইতে পারে, তাহাই সমগ্র হিন্দুদর্শন ও হিন্দুশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় । অবশ্য হিন্দুশাস্ত্রে, জীবের কৃতকর্মানুসারে স্বর্গাদি-ভোগের ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু তাহা অনন্তকালের জন্য নহে । যে-কর্মবিশেষের ফলে স্বর্গাদি লাভ হয়, সেই কর্মের ফলভোগ শেষ হইলে তাহাকে আবার জন্মগ্রহণ করিতে হয় । মোক্ষ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জন্মকর্মের নিবৃত্তি নাই ।
১৪) তিতিক্ষা = শীতোষ্ণ, সুখদুঃখ, মান-অপমানাদি দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা । ইহা মহাফলপ্রদ, ইহা জীবনকে মধুময় করে, মানবকে অমৃতত্ত্ব প্রদান করে ।
১৫) অমৃতত্ত্ব :
এই স্থূল শরীর লইয়া চিরকাল বর্তমান থাকাকে অমৃতত্ত্ব বা অমরত্ব বলে না; তাহা কেহ থাকিতে পারে না; কারণ ভৌতিক দেহ বিনাশশীল, মৃত্যুর অধীন [গী|২|২৭] । মৃত্যুর পর সূক্ষ্ম শরীরে বিদ্যমান থাকাকেও অমৃতত্ত্ব বলে না, উহা সকলেই থাকে [গী|১৫|৮-৯] এবং পুনরায় দেহ গ্রহণ করে । এই জন্মমৃত্যুর চক্র হইতে নিষ্কৃতি লাভই অমৃতত্ত্ব লাভ,ইহাকেই মোক্ষ বলা হয় ।
দেহাত্মবোধ : দেহটাকেই ‘আমি’-বোধ করা । আমরা এই অনিত্য দেহটা লইয়াই ‘আমি’ ‘আমি’ করি, কিন্তু দেহের মধ্যে যে দেহী (আত্মা) আছেন, তাঁহার খোঁজ লই না ।
দেহাত্মবিবেক : আত্মা দেহ হইতে পৃথক বস্তু – এই জ্ঞান । এই জ্ঞানলাভের নামই অমৃতত্ত্ব (আত্মানন্দ, নিত্যানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, প্রেমানন্দ) লাভ ।
এক তত্ত্বই ব্রহ্মআত্মাভগবান, এই ত্রিবিধ নামে অভিহিত হন এবং সাধকের ভাব-বৈশিষ্ট্যহেতু ত্রিবিধ ভাবে প্রকাশিত হন । সাধক যখন এই দেহচৈতন্যের ঊর্ধ্বে উঠিয়া ব্রহ্মচৈতন্যে [গী|৬|২৮] অথবা আত্মচৈতন্যে [গী|৬|২৯] অথবা ভাগবত-চৈতন্যে [গী|৬|৩০] অবস্থান করেন, তখন তিনিই অমৃতত্ত্ব লাভ করেন ।
এই শ্লোকে বলা হইল, যাঁহার সুখদুঃখে সমভাব, তিনি অমৃতত্ত্ব লাভ করেন । এই সমতা বা সাম্যবুদ্ধির কথা পরেও আমরা পাইব, শ্রীগীতায় ইহাকেই যোগ বলা হইয়াছে [গী|২|৪৮,৫০; ৬|৩৩] । সুখদুঃখে সাম্যভাব সমতাযোগের একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত মাত্র ।
ত্যাগ : গীতাশাস্ত্র বলেন ত্যাগ অর্থ আসক্তি ত্যাগ, কামনা-বাসনা ত্যাগ । আসক্তিই সুখদুঃখাদি-চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ । সংসার-আসক্তি ত্যাগ করিয়াও সংসার করা যায়, বিষয়-কামনা না করিয়াও বিষয় ভোগ করা যায়, ফল কামনা না করিয়াও কর্ম করা যায় এবং শ্রীগীতার উপদেশ, তাহাই কর্তব্য ।
হৃদয়গ্রন্থি : শাস্ত্রমতে কামনাই হৃদয়গ্রন্থি, যাহা ছিন্ন করিতে পারিলেই মরণশীল মানুষ অমর হইতে পারে । ‘জীবিতাবস্থায়ই (ইহ) যখন হৃদয়ের গ্রন্থিসকল (কামনাসমূহ) বিনষ্ট হয়, তখন মরণশীল মানুষ অমর হয়, এইটুকুই সমগ্র বেদান্তশাস্ত্রের সারকথা [কঠোপনিষদ |২|৩|১৫] । একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের শরণ লইলে, তাঁহার কৃপায় হৃদয়গ্রন্থি ক্রমে শিথিল হয় ।
পরাভক্তি : ভক্তিশাস্ত্রে ইহাই অমৃতস্বরূপ, উহা পাইলেই সাধক সিদ্ধ হন, অমর হন, তৃপ্ত হন – আর কিছু পাইবার আকাঙ্ক্ষা থাকে না, মোক্ষেরও না । [ভক্তিসূত্র]
১৬) অস্‌ (থাকা) + শতৃ = সৎ, যাহা থাকে, নিত্য তাহাই সৎ । যাহা থাকে না, আসে যায়, তাহা অসৎ, অনিত্য । আত্মাই সৎ; জগৎপ্রপঞ্চ, দেহাদি ও তৎসংসৃষ্ট-সুখদুঃখাদি অসৎ । সুতরাং অর্থ হইল – ‘আত্মার বিনাশ নাই, দেহাদি ও সুখদুঃখাদির স্থায়িত্ব বা অস্তিত্ব নাই ।’ এখন দেহাদির স্থায়িত্ব নাই, একথা বুঝা গেল, কিন্তু ‘দেহাদির অস্তিত্ব নাই’, এ-কথার অর্থ কি ?
যাঁহারা মায়াবাদী, তাঁহারা বলেন, এক আত্মাই (ব্রহ্মই) সত্য, জগৎ মিথ্যা – মায়া-বিজৃম্ভিত । ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়, ব্রহ্ম ভিন্ন আর-কিছুর পারমার্থিক সত্তা নাই । কিন্তু জগৎ যে মিথ্যা, এই মতবাদ অনেকেই স্বীকার করেন না এবং গীতাও এ-মত সমর্থন করেন বলিয়া বোধ হয় না । সুতরাং তাঁহারা ‘নাসতো বিদ্যতে ভাবো’ এই শ্লোকাংশের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।
শ্রীমৎ শ্রীধরস্বামী বলেন – এই শ্লোকের সদসৎ-বস্তুর স্বরূপ-বর্ণনায় আত্মার নিত্যতা এবং সুখ-দুঃখাদির অনিত্যতা ও অনাত্মধর্মিতাই লক্ষ্য করা হইয়াছে, ইহাই টীকাকারের অভিপ্রায় ।
সুখদুঃখের অনাত্মধর্মিতা :
সুখদুঃখ আত্মার ধর্ম নহে, উহা অন্তঃকরণের ধর্ম । অন্তঃকরণ = মন + বুদ্ধি + চিত্ত + অহঙ্কার । হিন্দু-দার্শনিকগণ মনস্তত্ত্বের যে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহার সম্যক আলোচনা এ-স্থলে সম্ভবপর নহে । স্থূলত এইটুকু স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এ-সকলই প্রকৃতির বিকৃতি বা পরিণাম; পুরুষ বা আত্মার সহিত উহাদের কোনো নিত্য সম্বন্ধ নাই ।
জ্ঞানান্মুক্তি/ত্রিগুণাতীত অবস্থা : প্রকৃতির সংযোগবশত আত্মা সুখদুঃখের ভোক্তা বলিয়া প্রতীয়মান হন । সৃষ্টিকালে পুরুষ ও প্রকৃতি পরস্পর-সংযুক্ত থাকাতে পুরুষের ধর্ম প্রকৃতিতে ও প্রকৃতির ধর্ম পুরুষে উপচরিত হয় । এই কারণেই বস্তুত অচেতন হইলেও প্রকৃতিকে চেতন বলিয়া মনে হয় এবং বস্তুত অকর্তা হইলেও আত্মাকে কর্তা-ভোক্তা বলিয়া বোধ হয় । পুরুষ (আত্মা) ও প্রকৃতির পার্থক্য যখন উপলব্ধি হয়, তখন আর এ-অজ্ঞান থাকে না । এই প্রকৃতি ও পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞান’ই সাংখ্যদর্শনের ‘জ্ঞানান্মুক্তি’ – জ্ঞান হইতে মুক্তি । গীতাতে ইহাই ত্রিগুণাতীত অবস্থা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে । এই অবস্থায় সুখদুঃখের পরানিবৃত্তি । বিশদ
সৎকার্যবাদ : ‘নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ’ – এ-কথায় এই বুঝায় যে, যাহা নাই তাহা হইতে পারে না এবং যাহা আছে তাহার অভাব হয় না অর্থাৎ কোনো পদার্থই নূতন উৎপন্ন হয় না এবং কোনো কিছুই বিনষ্ট হয় না, পরিবর্তন হয় মাত্র । ইহা সাংখ্যদর্শনের একটি প্রধান সিদ্ধান্ত যাহার উপরেই সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত । ইহাকে বলে সৎকার্যবাদ ।
১৭) অব্যয় = যাহার উপচয় (বৃদ্ধি) ও অপচয় (ক্ষয়) নাই, যাহা সর্বদাই একরূপ ।
মূলতত্ত্ব : সাধন-ভেদে একেরই তিন রূপ বা বিভাব । যে তাঁহাকে যে-ভাবে চিন্তা করে তাহার নিকট তিনি তাহাই । জ্ঞানীর নিকট তিনি জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম, যোগীর নিকট তিনি চিদাত্মস্বরূপ পরমাত্মা, ভক্তের নিকট তিনি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ ভগবান । বিশদ
অদ্বয় জ্ঞান তত্ত্ব কৃষ্ণের স্বরূপ । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান তিন তাঁর রূপ ।।
জ্ঞান, যোগ, ভক্তি তিন সাধনার বশে । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান ত্রিবিধ প্রকাশে ।। [শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত]
অদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা । জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন, যেমন ঘটাকাশ ও মহাকাশ । পাঁচটি শূন্য ঘটে যে-আকাশ আছে, উহা আধারভেদে বিভিন্ন বোধ হইলেও মূলত একই । ঘট পাঁচটি ভাঙিয়া দিলে আর ভেদ থাকে না, তখন সকলেই এক মহাকাশ । এইরূপ বিভিন্ন দেহাধিষ্ঠিত আত্মা দেহভেদে ভিন্ন বোধ হইলেও স্বরূপত অভিন্ন । দেহবন্ধন-বিমুক্ত হইলেই উহার স্ব-স্বরূপ পরমাত্মরূপ প্রতিভাত হয় । এই যে দৃশ্য জগৎ প্রত্যক্ষ হইতেছে, উহা ভ্রমমাত্র; যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজতভ্রম, সূর্য-রশ্মিতে মরীচিকাভ্রম । মায়াবাদীর মতে এই ভ্রম হয় ব্রহ্মের ‘অঘটন-ঘটন-পটীয়সী’ মায়াশক্তির প্রভাবে । তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে এই মায়া কাটিয়া যায়, তখনই ‘সোহহম্‌’ ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’এইরূপ আত্মস্বরূপ অধিগত হয় । অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্বিশেষ, নির্বিকল্প, নিরুপাধি, নির্গুণ; সুতরাং অজ্ঞেয়, অচিন্ত্য, অমেয় – মনোবুদ্ধির অগোচর ।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম ও জীব স্বতন্ত্র বস্তু । জগৎ মিথ্যা নহে, উহা ব্রহ্মের মায়াশক্তি-প্রসূত । জগৎ ব্রহ্মেরই শরীর । ব্রহ্ম সগুণ, তিনি জগতের কর্তা ও উপাদান । এই মতকে অনেকে দ্বৈতবাদও বলেন ।
শুদ্ধদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ তিনই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক তত্ত্ব ।
২০) ষড়বিধ বিকার : (i)জন্ম, (ii)অস্তিত্ব, (iii)বৃদ্ধি, (iv)বিপরিণাম, (v)অপক্ষয়, (vi)বিনাশ – লৌকিক বস্তুর বিকার । জন্মের পর যে বিদ্যমানতা তাহার নাম অস্তিত্ব-বিকার ।
পুরাণ = সনাতন ।
অহং অর্থাৎ আত্মা অকর্তা হইলেও অহঙ্কার (আমি করিতেছি এই বুদ্ধি) যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ কর্মের বন্ধন যায় না । সুতরাং আত্মা অকর্তা বলিয়া যে অর্জুনের হত্যাজনিত পাপ হইবে না তাহা নহে । যদি অর্জুনের এই জ্ঞান জন্মে যে, আমি অকর্তা, আমি কিছুই করিতেছি না, প্রকৃতিই প্রকৃতির কাজ করিতেছে; আমি নিঃসঙ্গ, নির্লিপ্ত, তবেই তাহার ফলভোগ নিবারিত হইবে । এইরূপ জ্ঞানই, এই কর্তৃত্বাভিমান-ত্যাগই গীতায় পুনঃপুনঃ উপদিষ্ট হইয়াছে ।
৩৯) সংখ্যা = বস্তুতত্ত্ব সম্যক প্রকাশিত হয় যাহা দ্বারা অর্থাৎ সম্যক জ্ঞান ।
সাংখ্য = সংখ্যায় প্রকাশমান আত্মতত্ত্ব অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞান ।
‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’-শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার :
সনাতন ধর্মে অতি প্রাচীন কাল হইতেই দুইটি সাধনমার্গ বা মোক্ষপথ প্রচলিত আছে – (i)সাংখ্য বা জ্ঞানমার্গ, (ii)কর্মমার্গ । জ্ঞানমার্গ-অবলম্বিগণ প্রায় সকলেই কর্মত্যাগী, কর্ম হইতে নিবৃত্ত, এইজন্য ইহাকে সন্ন্যাসমার্গ বা নিবৃত্তিমার্গও বলে । কর্মমার্গ-অবলম্বীরা জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্মের যোগ ছেদন করেন না, কর্মে প্রবৃত্ত থাকেন, এইজন্য ইহাকেপ্রবৃত্তিমার্গ বলে (‘প্রবৃত্তিলক্ষণো যোগো জ্ঞানং সন্ন্যাসলক্ষণম্‌’ – অনুগীতা) ।
কর্ম দ্বিবিধ – (i)সকাম, (ii)নিষ্কাম । বৈদিক কর্মযোগ = যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্ম; বৈদান্তিক কর্মযোগ = নিষ্কাম কর্মযোগ ।
গীতায় জ্ঞানমার্গ বুঝাইতে ‘সাংখ্য’ শব্দ ও নিষ্কাম কর্মযোগ বুঝাইতে ‘যোগ’ শব্দ পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে ।
জ্ঞানমার্গেরই একটি বিশিষ্ট প্রাচীন স্বরূপ মহর্ষি কপিলদেব-প্রণীত পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক বা সাংখ্যদর্শনে বিবৃত হইয়াছে । কিন্তু এ-স্থলে সাংখ্য-শব্দে সাংখ্যদর্শন বুঝায় না ।
যোগ বলিতে সাধারণত আসন-প্রাণায়ামাদি, পাতঞ্জল দর্শনোক্ত অষ্টাঙ্গযোগ বা সমাধিযোগ বুঝায় । এ-স্থলে যোগ-শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই । গীতায় সমাধিযোগ ও সাংখ্যদর্শনেরও অনেক তত্ত্ব সন্নিবিষ্ট আছে । সুতরাং ‘যোগ’ ও ‘সাংখ্য’-শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহা স্মর্তব্য ।
৪০) কর্মবন্ধ : শত কোটি-কল্পেও ভোগ ভিন্ন কর্মক্ষয় হয় না, কৃতকর্মের শুভাশুভ ফল অবশ্যই ভোগ করিতে হইবে । এই কর্মফল ভোগের জন্য আমাদিগকে পুনঃপুনঃ জন্মমৃত্যু-জরাব্যাধি-সঙ্কুল সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ হইতে হয় । ইহাই কর্মবন্ধন । আমরা যদি ফল ত্যাগ করিয়া সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সমজ্ঞান করিয়া কর্তৃত্বাভিমান বর্জন করিয়া কর্ম করিতে পারি তবে সেই নিষ্কাম কর্মে বন্ধন হয় না ।
৪১) বুদ্ধি (intelligent will), মন (mind), বাসনা (desire)
গীতার ‘বুদ্ধি’ শব্দের যথাযথ ইংরেজী অনুবাদ করিতে গেলে বলিতে হয়, ‘intelligent will’ (Sri Aurobindo) । সাধারণভাবে ‘বোধ’, ‘জ্ঞান’ অর্থে বুদ্ধি-শব্দের প্রয়োগ হয় । দার্শনিক পরিভাষায় বুদ্ধিকে বলে ব্যবসায়াত্মিকা বা নিশ্চয়াত্মিকা মনোবৃত্তি বা অন্তরিন্দ্রিয় । বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়-সংযোগে মনে নানারূপ জ্ঞান বা সংস্কার জন্মে এবং ইহার কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ, কোনটি গ্রাহ্য, কোনটি ত্যাজ্য, ইহা এই প্রকার, না ঐ প্রকার, মনে এইরূপ সঙ্কল্প-বিকল্প উপস্থিত হয় । তখন বুদ্ধি, বিচার করিয়া কোনটি গ্রাহ্য বা কর্তব্য তাহা নির্ণয় করিয়া দেয় । এই হেতু মনকে সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক এবং বুদ্ধিকে ব্যবসায়াত্মিকা ইন্দ্রিয় বলে । সংস্কৃতভাষায় এইরূপ কার্যাকার্য-নির্ণয় করার ব্যাপারকেই ‘ব্যবসায়’ কহে ।
‘বুদ্ধি’ কিছু স্থির নিশ্চয় করিয়া দিলে মন আবার সেই দিকে ধাবিত হয়, সেই কার্যে আসক্ত হয় । ইহাকেই ‘বাসনা’ বলে, ইহাকে অনেক সময় ‘বাসনাত্মিকা বুদ্ধি’ বলা হয় । এই শ্লোকে প্রথম পংক্তিতে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, কিন্তু দ্বিতীয় পংক্তিতে ‘বুদ্ধয়ঃ’ শব্দে বুঝায় বাসনাত্মিকা বুদ্ধি বা বাসনাতরঙ্গ । বস্তুত জ্ঞান, বিচার, ব্যবসায় (perceptive choice), বাসনা (will), উদ্দেশ্য (motive) – এই সকলই গীতায় স্থলবিশেষে এক ‘বুদ্ধি’-শব্দদ্বারাই প্রকাশিত হয়, ইহা মনে রাখা কর্তব্য ।
৪২-৪৪) বেদের কর্মকাণ্ড :
বেদের চারি ভাগ – (i)সংহিতা, (ii)ব্রাহ্মণ, (iii)আরণ্যক ও (iv)উপনিষদ । সংহিতা ও ব্রাহ্মণ-ভাগ লইয়া কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ-ভাগ লইয়া জ্ঞানকাণ্ড । কর্মকাণ্ডে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির ব্যবস্থা আছে এবং বিহিত প্রণালীতে ঐ সমস্ত কর্ম সম্পন্ন হইলে স্বর্গাদি লাভ হয়, এইরূপ ফলশ্রুতিও আছে । সাধারণত ‘ধর্মকর্ম’ বলিতে লোকে এই সকল কর্মকেই বুঝিয়া থাকে । শ্রীভগবান বলিতেছেন, ঐ সকল কাম্যকর্মে ভোগ-বাসনা বিদূরিত হয় না, বরং আরো বর্ধিত হয় ।
৪৫) নির্যোগক্ষেম = যোগ-ক্ষেম-রহিত; যোগ = অলব্ধ বস্তুর উপার্জন; ক্ষেম = লব্ধ বস্তুর রক্ষণ । অর্থ এই – তুমি উপার্জন ও রক্ষা এই উভয় বিষয়েই চিন্তা ত্যাগ কর ।
৪৬) লোকমান্য তিলক, বঙ্কিমচন্দ্র-প্রমুখ আধুনিক ব্যাখ্যাকর্তৃগণের অনেকেই এই শ্লোকের নিম্নোক্তরূপ ব্যাখ্যা করেন । –
সকল স্থান জলে প্লাবিত হইলে কূপাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ের যে প্রয়োজন, তত্ত্বজ্ঞ ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সমস্ত বেদেও সেই প্রয়োজন । অর্থাৎ সকল স্থান জলে প্লাবিত হইলে যেমন কূপাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ে কোনো প্রয়োজন হয় না, তদ্রূপ ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের বেদে কোনো প্রয়োজন নাই । কেননা যিনি ব্রহ্মজ্ঞ, যিনি ঈশ্বরকে জানিয়াছেন, তাঁহার আর বেদে কি প্রয়োজন ?
ইহা স্পষ্টই বেদ-নিন্দার মত শুনায় । ব্রহ্মজ্ঞই হউন আর যাহাই হউন বেদে কাহারও প্রয়োজন নাই, এরূপ কথা যাহাতে না বলা হয়, প্রাচীন ব্যাখ্যাকর্তৃগণ কষ্টকল্পনা করিয়া সেরূপ ব্যাখ্যারই অন্বেষণ করিয়াছেন ।
রহস্য – গীতা ও বেদের আপাতবিরোধ
সনাতন ধর্ম = যাহা বেদমূলক তাহাই ধর্ম; কিন্তু বেদের ‘জন্মকর্মফলপ্রদ’ কাম্যকর্মাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরোধী বলেই গীতাশাস্ত্রকে মনে হয় ।
বেদের প্রকৃত তাৎপর্য কি তাহা আমরা বুঝি না । অতি প্রাচীনকালে বেদের গূঢ়ার্থ গুরু-শিষ্য-পরম্পরাক্রমে অধিগত হইত, উহা লিপিবদ্ধ হইত না । উহা বহু পূর্বেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল । পরে বেদার্থ যিনি যেরূপ বুঝিয়াছেন তিনি সেইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং তদনুসারে নানা মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে । দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রাদি বেদ শিরোধার্য করিয়াও পরস্পর বিরুদ্ধ-মতাবলম্বী ।
বেদবাদ : দ্বাপরযুগের শেষকালে একটি কাম্যকর্মবাদী ধর্মমত (বা অধর্মমত) বড় প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল । ইহাকেই বেদবাদ বলা হইয়াছে । কাম্যকর্মবাদী বলেন, বেদের কর্মকাণ্ডই সার্থক, যাগযজ্ঞাদিই একমাত্র ধর্ম, স্বর্গই একমাত্র পুরুষার্থ, উহাতেই সমস্ত দুঃখনিবৃত্তি, এতদ্ব্যতীত ঈশ্বরতত্ত্ব বলিয়া আর-কিছুই নাই । এই আপাত-মনোরম কর্মমার্গ, যাহা ইহকালে ধনৈশ্বর্য, পরকালে উর্বশী-পারিজাতাদির আশাপ্রদ, তাহা যে লোকপ্রিয় হইবে তাহা বলাই বাহুল্য । ফলে যাগযজ্ঞাদির ঘটা বাড়িয়া গেল । অশ্বমেধ, গো-মেধ, নরমেধাদি ‘মেধে’র মাত্রা বৃদ্ধি পাইল, প্রাণি-বধই ধর্মে পরিণত হইল ।
এইরূপে যখন বিষম ধর্মবিপ্লব উপস্থিত হইল – ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অভ্যুত্থান, তখনই ধর্ম-সংস্থাপনার্থ শ্রীভগবানের গীতা-প্রচার । তাই শ্রীভগবান বলিতেছেন – ‘এই বেদবাদী, মূঢ়গণের কথায় মুগ্ধ হইও না, ও-পথে যাইও না, উহাতে বুদ্ধি ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না । ইহা বেদ-নিন্দা নহে, বেদের অপব্যাখ্যাকারী কাম্যকর্মবাদিগণের নিন্দা ।
তবে ত্রিগুণাত্মক কর্মকাণ্ডের কি প্রয়োজন ?
ব্রহ্মজ্ঞের ইহাতে কোনো প্রয়োজন নাই । কিন্তু জগৎ ত্রিগুণাত্মক, সংসার ত্রিগুণাত্মক, দেহাভিমানী জীব ত্রিগুণে অভিভূত – সে ত্রিগুণ ত্যাগ করিতে না পারিলে, নিবৃত্তি-মার্গ অবলম্বন করিতে না পারিলে – কোন ধর্ম লইয়া থাকিবে ? তাহার উচ্ছৃঙ্খল কামনা বিধিবদ্ধ না করিলে সংসার রক্ষা পাইবে কিরূপে ? কামনা-পূরণার্থ যাগযজ্ঞ ও দেবার্চনাদির ব্যবস্থা, স্বর্গের প্রলোভন, প্রবৃত্তির প্রতিরোধার্থ নরকাদির ভয়, প্রায়শ্চিত্তাদির বিধান, এই সকল না থাকিলে কামনাকুল জীব স্বেচ্ছাচারী হইয়া আত্মঘাতী হইয়া উঠিত । তাই লোকবৎসল বেদ – অজ্ঞ ও নিম্ন অধিকারীর জন্য এই সকল ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং উহাতে রুচি জন্মাইবার জন্য স্বর্গফলাদির বর্ণনা করিয়াছেন । উচ্চাধিকারী ব্যক্তি ঐ সকল কর্ম ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া করিবেন, উহাতেই কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সিদ্ধিলাভ করিবেন ।
৪৭) রহস্য – নিষ্কাম কর্ম কি সম্ভবপর ?
ফলাকাঙ্ক্ষা না থাকিলে কর্ম করিবে কেন ? উদ্দেশ্য (motive) ভিন্ন কর্ম হয় না । কিন্তু ফলাফলে উদাসীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা এক কথা নহে । নিষ্কাম কর্মও উদ্দেশ্যহীন নহে; ‘লোক-সংগ্রহ’, ভগবানের সৃষ্টিরক্ষাই উহার উদ্দেশ্য; উহা ভগবানের কর্ম । বস্তুত, ইহা ভগবানের অর্চনা । যখন ভাগবত ইচ্ছা ও কর্মীর ইচ্ছা এক হয়, তখনই প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম সম্ভবপর; তখন কর্তার ব্যক্তিত্ব থাকে না । এরূপ অবস্থায় ফলাফলে সমত্ব-বুদ্ধি অসম্ভব ব্যাপার তো নহেই, ফলত উহা স্বাভাবিকই হইয়া উঠে ।
প্রশ্ন – এইরূপ যন্ত্রচালিত পুতুলের (mechanical) ন্যায় কর্মের কোনো নৈতিক মূল্য (moral value) কি আছে ?
উত্তর – গীতার অধ্যাত্ম-তত্ত্ব ঐ নৈতিক মূল্যের অনেক উপরে । ঐ নৈতিক মূল্যটিকে অর্থাৎ ঐ কর্মফলের দায়িত্বটা ত্যাগ করাই নিষ্কাম কর্মীর লক্ষ্য । উহাই কর্মবন্ধ । উহার ফল স্বর্গ বা নরক বা পুনর্জন্ম । হিন্দু-সাধক ইহার কোনোটিই চাহেন না । তিনি জানিতে চাহেন তাঁহাকে, যাঁহা হইতে তাঁহার উদ্ভব, যাঁহা হইতে তাঁহার কর্ম-প্রবৃত্তি । সুতরাং তিনি নিজেকে যন্ত্রস্বরূপ মনে করিয়া সেই যন্ত্রীর নিকটই আত্মসমর্পণ করেন ।
৬১) ভগবচ্চিন্তাই ইন্দ্রিয়-সংযমের মহৌষধ । ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করিলে যেরূপ আত্যন্তিক চিত্তশুদ্ধি হয়, দেবতা-উপাসনা, তপ, বায়ুনিরোধ-যোগ, মৈত্রী, তীর্থস্থান, ব্রত, দান, বিদ্যা ও জপের দ্বারা তাহা হয় না ।
৬৪) নির্লিপ্ত সংসারী :
‘তুমি সংসারে থাক তাহাতে দোষ নাই, সংসার তোমাতে না থাকিলেই হয় । জলের উপর নৌকা থাকিতে পারে, কিন্তু নৌকায় জল উঠিলেই ডুবিয়া যায় ।’ – শ্রীরামকৃষ্ণ ।
‘যেমন গৃহস্তের বাটীর দাসীরা সংসারের যাবতীয় কার্য করিয়া থাকে, সন্তানদিগকে লালন-পালন করে, উহারা মরিয়া গেলে রোদনও করে, কিন্তু মনে জানে যে, ইহারা তাহাদের কেহই নহে ।’ – শ্রীরামকৃষ্ণ

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

तैत्तिरीय ब्राह्मणम्

  Conti..... Conti........ Conti..........

Post Top Ad

ধন্যবাদ