ঈশ্বর ও জীবের প্রভেদ
ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বব্যাপক। কিন্তু তিনি জীব হতে পৃথক।এই বিষয়ে বেদ ও উপনিষদ এর প্রমাণ-
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখাযা সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তযোরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভি চাকশীতি।। ঋকবেদ-১/১৬৪/২০ শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্-৪/৬
অর্থ-(দ্বা) ব্রহ্ম বা ঈশ্বর উভয়ে, (সুপর্ণা) চেতনা ইত্যাদি একইরকম গুণবিশিষ্ট, (সযুজা) ঈশ্বর সর্বব্যাপক বলে জীবের সাথে সবসময় সংযুক্ত,(সখাযা) ঈশ্বর ও জীব পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ,(সমানং) ঈশ্বর ও জীব উভয়ে সনাতন ও অনাদি,(বৃক্ষম) অনাদি প্রকৃতিরূপ বৃক্ষ বা গাছ অর্থাৎ এই জগৎ- সংসারে, ঈশ্বর ও জীব উভয়ে বসবাস করে, (তযোরন্যঃ)এই জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে, জীব এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পুণ্যরূপ ফলসমূহ (স্বাদ্বত্তি) উত্তমরূপে ভোগ করে,আর ঈশ্বর,কর্মফল (অনশ্নন্) ভোগ না করে চারদিকে অর্থাৎ অন্তর ও বাইরে সর্বত্র প্রকাশিত হয়ে আছেন। ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি ভিন্নধর্মী ও অনাদি।
শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ- যজুর্বেদ-40/8
অর্থ-জীব হল অনাদি ও সনাতন।
অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং,বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং স্বরূপা।
আজো হ্যেকো জুযমাণোহনুশেতে, জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ।। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/5
অর্থ-প্রকৃতি,জীবাত্না এবং পরমাত্মা এই তিন অজ অর্থাৎ ইহাদের জন্ম হয় না ও চিরকাল বর্তমান।অনাদি জীব এই অনাদি প্রকৃতিকে,ভোগ করতে আসক্ত হয়।কিন্তু পরমাত্মা ইহাতে আসক্ত হন না এবং ভোগও করেন না।
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্ আত্নাস্য জন্তোরনিহিতো গুহায়াম।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্ননঃ।। কঠ উপনিষদ-1/2/20
অর্থ-পরমাত্না ও জীবাত্মা উভয়েই জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত।যিনি সব রকম জড় বাসনা ও শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন,তিনিই কেবল ভগবৎ কৃপায় আত্নার মহিমা বুঝতে পারেন।
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
মুন্ডক উপনিষদ-3/1/2
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/7
অর্থ-দুটি পাখি(জীবাত্মা ও পরমাত্মা)একই গাছে(প্রকৃতি বা সংসাররূপ বৃক্ষ) বসে আছে,কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত,সে,গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা দুঃখ ভোগ করছে। কিন্তু সে যদি (জীবাত্মা) একবার তার নিত্যকালের বন্ধু,অপর পাখিটির(পরমাত্মা)দিকে ফিরে তাকায়(যোগযুক্ত হয়)তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়।
সুতরাং ইহাতে প্রমাণিত হয় যে,জীবাত্মা, পরমাত্মা ও প্রকৃতি হল অনাদি বা নিত্য।পরমাত্মা জীবাত্মা কে পাপ-পুণ্যের ফল হেতু শরীর ধারণ করিয়ে স্বয়ং সেই শরীরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকেন,কারণ তিনি সর্বব্যাপক। তাই জীব ব্রহ্ম হতে পারে না এবং মুক্তিতেও জীব ব্রহ্মতে লীন হয় না।
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।।
গীতা অধ্যায়-৯ শ্লোক-১১
অনুবাদ- আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে।তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বা পরম ঈশ্বর বলে জানে না।
শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বাণী বলেছেন। এই বিষয়ে, মহাভারতের প্রমাণ দেখুন-
ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনজ্ঞয়।
স হি ধর্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্মষা ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।
পরং হি ব্রহ্মা কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
মহাভারত- অশ্বমেধিক পর্ব-অধ্যায়-১৭, শ্লোক-১১-১২ ও ১৩
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন)হে, ধনজ্ঞয়(অর্জুন),সেই সমস্ত কথা(গীতার বাণী) আমার পক্ষে বলা আর সম্ভব নয়।সেই ধর্মটি পরমাত্নার স্বরূপ জানবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।আমি এখন সেই সমস্ত কথা,পুনরায় বলতে পারব না।সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে,পরব্রহ্মের বিষয় বলেছিলাম।এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলছি।
এখানে, শ্রীকৃষ্ণ পরিস্কার ভাষায় বলছেন,তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বিষয়ে বলেছেন।শ্রীকৃষ্ণ একবারও বলেননি যে,ঈশ্বর তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) মাধ্যমে,বাণী দিয়েছেন।
সুতরাং,গীতার এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।
বেদ হল,ঈশ্বরীয় বাণী।তাই বেদের বাণীকে মন্ত্র বলে। গীতা হল, মানুষের বাণী। তাই গীতার বাণীকে শ্লোক বলে।
ঈশ্বর মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করেন, এই বেদ বিরোধী মিথ্যা ধারণা।
এইবার বেদের সিদ্ধান্ত দেখুন------
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ-
র্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।[ঈশোপনিষদ:৮]
শংকর-ভাষ্যম্ঃ
যোহয়মতীতৈর্মন্ত্রৈরুক্ত আত্না, স স্বেন রূপেণ কিংলক্ষণ ইত্যাহ অয়ং মন্ত্রঃ। স পর্য্যগাৎ, স যথোক্ত আত্না পর্য্যগাৎপরি সমন্তাৎ অগাৎ গতবান্ আকাশবদ্ব্যাপীতর্থ্যঃ। শুক্রং শুদ্ধং জ্যোতিষ্মৎ দীপ্তিমানিত্যর্থঃ।অকায়মশরীরঃ-- লিঙ্গশরীরবর্জিত ইত্যর্থঃ।অব্রণমক্ষতম্।অস্নাবিরং--স্নাবাঃ শিরা যস্মিষ্ ন বিদ্যন্ত ইত্যস্নাবিরম্।অব্রণমস্নাবিরমিত্যেতাভ্যাং স্থুলশরীরপ্রতিষেধঃ। শুদ্ধং নির্মলমবিদ্যামলরহিতমিতি কারণ শরীর প্রতিষেধঃ।অপাপবিদ্ধং ধর্মাধর্মাদিপাপবর্জিতম্।শুক্রমিত্যাদীনি বচাংসি পুংলিঙ্গত্বেন পরিণেয়ানি। 'স পর্য্যগাৎ' ইত্যুপক্রম্য 'কবির্মনীষী' ইত্যাদিনা পুংলিঙ্গত্বেনোপসংহারাৎ।কবিঃ ক্রান্তদর্শী---সর্বদৃক্। 'নান্যোহতোহস্তি দ্রষ্টা'(বৃ.আ. 3/7/23) ইত্যাদিশ্রুতেঃ। মনীষী মনস ঈষিতা-----সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ইত্যর্থঃ।পরিভূঃ সর্বেষাং পরি উপরি ভবতীতি পরিভূঃ।স্বয়ম্ভূঃ স্বয়মেব ভবতীতি,যেষামুপরি ভবতি,যশ্চোপরি ভবতি,সঃ সর্ব স্বয়মেব ভবতীতি স্বয়ম্ভূঃ।স নিত্যমুক্ত ঈশ্বরো যাথাতথ্যতঃ, সর্বজ্ঞত্বাদ্,যথাতথাভাবো যাথাতথ্যং তস্মাদ্ যথাভূতকর্মফলসাধনতোহ-র্থান্ কর্তব্যপদার্থান্ ব্যদধাদ্বিহিতবান্ যথানুরূপং ব্যভজদিত্যর্থঃ শাশ্বতীভ্যো নিত্যাভ্যঃ সমাভ্যঃ সংবৎসরাখ্যেভ্যঃ প্রজাপতিভ্য ইত্যর্থঃ।।
শুক্ল যজুর্বেদেও দেখুনঃ
स पर्य॑गाच्छु॒क्रम॑का॒यम॑व्र॒णम॑स्नावि॒रꣳ शु॒द्धमपा॑पविद्धम्।
क॒विर्म॑नी॒षी प॑रि॒भूः स्व॑य॒म्भूर्या॑थातथ्य॒तोऽर्था॒न् व्य᳖दधाच्छाश्व॒तीभ्यः॒ समा॑भ्यः ॥
যর্জুবেদ: অধ্যায় ৪০,মন্ত্র ৮
ব্যাখ্যা:
(অন্বয়)------সঃ (সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্(শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ(ক্রান্তদর্শী), মনীষী(সর্বজ্ঞ),পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান),স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ),[সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ(লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
অনুবাদ-----তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা, সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময় ও অশরীরী (অশরীর শব্দে পরমাত্মার লিঙ্গ শরীরের নিষেধ) ক্ষতরহিত, শিরাহীন, স্নায়ুহীন, (ক্ষতরহিত ও শিরাহীন শব্দে, স্থূল শরীরের নিষেধ), নির্মল (নির্মল শব্দে,কারণ শরীরের নিষেধ করা হল) ও অপাপবিদ্ধ।তিনি, সর্বদর্শী,সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান ও স্বয়ম্ভূ।পরমাত্না, চিরকাল ধরে, লোকের যথাযথ কর্মফল অনুসারে কর্তব্য বিধান করছেন।
'স পর্যগাৎ' এই শ্রুতিবাক্য অনুসারে ঈশ্বরের অবতার প্রমাণ করা কোন প্রকারেই সম্ভব হয় না।
বেদে পাষাণাদি মূর্ত্তি পূজা এবং পরমেশ্বরের আবাহন বিসর্জ্জনের জন্য কোন অক্ষর বা মন্ত্র নাই। এ পর্য্যন্ত নাই যে পাষাণের মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়া মন্দিরে স্থাপন করে চন্দন ও অক্ষতাদি দ্বারা পূজা করিবে-ইহার লেশমাত্র নাই।
ঈশ্বরের স্থানে অন্য কোন পদার্থ কে পূজনীয় মানিবে না এবং সর্বদা নিষেধও করা হয়েছে।[যজুর্বেদ ৪০।৯, যজুর্বেদ ৩২।৩] কেনোপনিষদে পরিস্কার বলা হয়েছে যিনি প্রাণ সমূহ দ্বারা চালিত হয়েন না এবং যাঁহার নিমিত্ত প্রাণ গতিশীল হয় তুমি,তাহাকেই ব্রহ্ম বলে জান এবং উপাসনা কর; তদ্ভিন্ন উপাসনা করিও না ইত্যাদি অনেক নিষেধ আছে.. নিষেধ যখন আছে তখন মূর্ত্তি পূজোর কথা বলাও নেই- যেমন অপ্রাপ্তের নিষেধ।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর যজুর্বেদ ৪০।৮ এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ-
যিনি (পরমেশ্বর) সর্বব্যাপক অর্থাৎ সমস্ত জগতে অবস্থিত, এরূপ ব্রহ্ম(শুক্রং) সমস্ত জগতের রচয়িতা,(অকায়ং) যিনি স্থূল,সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর রোহিত অর্থাৎ পরমাত্মা কখনো শরীর ধারণ বা জন্মগ্রহণ করেন না। (অব্রণং) যিনি সদা ছিদ্র রোহিত, (অস্নাবিরং) যিনি নাড়ী সকলের বন্ধন হতে মুক্ত,(শুদ্ধ) যিনি অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ,দ্বেষরূপ অজ্ঞান ও দোষ হইতে মুক্ত, (অপাপবিদ্ধ) যিনি কখনো পাপকারী নন অর্থাৎ সদা পবিত্র,(কবিঃ) যিনি সকলের জ্ঞাতা, (মনীষী) যিনি সকলের অন্তর্যামীরূপে বর্তমান থেকে, ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই তিন কালের বিষয়ে যথাবৎ জানেন, (পরিভূঃ)যিনি সবসময়ই বিরাজমান, (স্বয়ম্ভূঃ) যিনি কখনো উৎপন্ন না অর্থাৎ অর্থাৎ তিনি নিজ সামর্থের সহিত সদা বর্তমান থাকেন, (শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ) এরূপ সচ্চিদানন্দ স্বরূপ পরমাত্মা সৃষ্টির আদিকালে নিজের নিত্য প্রজাদেরকে,সুখ প্রাপ্তির জন্য বেদ শাস্ত্রের উপদেশ করেছেন।
শংকারাচার্য ও দয়ানন্দ সরস্বতী, উভয়েই ভাষ্য করেছেন, ঈশ্বরের স্থুল, সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর হয় না বা পরমাত্না, স্থূল সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর ধারণ করেন না। সুতরাং, অবতারবাদ বেদ বিরোধী।
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যে ঈশ্বর না,এই বেদের বাণী দিয়ে তা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া, শ্রীকৃষ্ণ বেদজ্ঞ ছিলেন।এই ধরনের বেদ বিরোধী বক্তব্য তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।গীতা ৯।৩২।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী, বৈশ্য, শুদ্র আদি নীচকুলে জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে।[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]এখানে শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে স্ত্রী কে নীচকুল জাত বলা হয়েছে।
যথেমাং বাচল কল্যানীমাবদানি জনেভ্যঃ।
বহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।
প্রিয় দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ।
ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।[যজু ২৬।২]
ভাবার্থ-(ঈশ্বর বলছেন) আমি সব মানুষের সুখের জন্য এই কল্যাদায়ক চার বেদের বাণী উপদেশ করছি।অর্থাৎ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, নারী ও পুরুষের বিভেদ নেই। উচ্চ-নীচ বিভেদ নেই। গীতাতে কেন ভেদ সৃষ্টি হলো।
ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।গীতা ১৫।৬।।
অনুবাদঃ সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।
এইবার মুক্তি বিষয়ে বেদের প্রমাণ দেখুনঃ
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কোনো মহ্যা অদিতযে পুনর্দাৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।১।।
অগ্নের্বযং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স নো মহ্যা অদিতযে পুনর্দা্ৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।২।।
ঋগ্বেদ-১।২৪।১-২
অর্থ- আমরা কার নাম পবিত্র বলে জানব? অবিনাশী পদার্থ সমূহের মধ্যে বিদ্যমান, চির প্রকাশ রূপ কোন্ দেব আমাদের সকলকে মুক্তি সুখ ভোগ করিয়ে পুনরায় এই সংসারে জন্মদান করান এবং পিতা-মাতা'কে দর্শন করান?।।১।।
আমরা এই স্বপ্রকাশরূপ, অনাদি এবং সদামুক্ত পরমাত্মার নাম পবিত্র বলে জানব।পরমাত্না আমাদের মুক্তিতে আনন্দ ভোগ করিয়ে পুনরায় মাতা-পিতার সংযোগে জন্মদান করিয়ে তাঁহাদের দর্শন করান।। ২।।
গীতার কিছু পরস্পর বিরোধী শ্লোক আছে উদাহরণঃ
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।গীতা ৪।১৩।।
অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
অর্থ-"গুণ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ) ও কর্মের বিভাগ অনুসারে বাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি।"
এই শ্লোকটা থেকে বোঝা যায়,বংশানুসারে নয়,গুনানুসারেই বর্ণের বিভাগ।অর্থাৎ,ব্রাহ্মণের পুত্রের মধ্যে যদি তমোগুণের আধিক্য ঘটে তাহলে সে শূদ্র এবং শূদ্রের পুত্রের মধ্যে যদি সত্ত্বগুণের আধিক্য ঘটে তাহলে সে শূদ্র বংশে জন্মেও ব্রাহ্মণ হবে। (এই বিষয়ে, মহাভারত ও মনুস্মৃতির প্রমাণ আছে)
উপরের শ্লোকের বিরোধী শ্লোক দেখুন-
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।গীতা ৩।৩৫।।
অনুবাদঃ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
অর্থ বিশ্লেষণ- ধরা যাক, শূদ্রকে উদ্দেশ্য করে এই শ্লোকটি বলা হয়েছে। তাহলে এই শ্লোকটির অর্থ হবে,হে শূদ্র,তোমার কর্ম হলো ব্রাহ্মণদের সেবা করা।এটাই তোমার স্বধর্ম। এতে যদি তোমার মৃত্যু হয় তাহলে তুমি স্বর্গলোকে যাবে।কিন্তু ব্রাহ্মণের কর্ম গ্রহণ করলে,তোমার পরধর্ম গ্রহন করা হবে। পরধর্ম ভয়ংকর,কেননা, উহা নরকে যাবার কারণ।
মহাভারতে আছে দ্রোণ, তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য এবং তার পুত্র অশ্বথামা এরা সকলেই ব্রাহ্মণ কিন্তু এরা তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করতেন তাছাড়া পরশুরাম ছিলেন ব্রাহ্মণ,অথচ তিনি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতেন।তাহলে এঁরা কি পরধর্ম আচরণ করে,ভয়ংকর অশাস্ত্রীয় আচরণ করেছেন? বিশেষতঃ,পরশুরাম তো আবার হিন্দুদের অবতার!!!অবতার হয়ে, পরশুরাম গীতার এই শ্লোক অনুযায়ী,নরকগামী হবেন!!ঋষি বিশ্বামিত্র ছিলেন বেদ মন্ত্রের দ্রষ্টা। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয়, তাহলে গীতার বচন অনুযায়ী,তিনিও নরকগামী হবেন!!! (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো,গীতায় স্বর্গ ও নরকের উল্লেখ আছে তাই এই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বর্গ ও নরক বলতে বিশেষ কোন স্থান নেই!)
ধর্ম বলতে,তখন কর্মকেও বোঝাতো। যেমন, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল,যুদ্ধ করা। গীতাতেও, তাই বলা আছে।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যাং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাস্প্যসি।। গীতা২।৩৩।।
অনুবাদঃ কিন্তু, তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে।-[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ] ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্মামনুস্মরন্।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্।।গীতা ৮।১৩।।
অনুবাদঃ যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হয়ে পবিত্র ওঙ্কার উচ্চারণ করতে করতে কেউ যদি পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই পরমা গতি লাভ করবেন।-[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ] অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ বলছেন) যিনি,"ওম্"এই ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর নামটি মনে মনে উচ্চারণ করে দেহত্যাগ করেন,তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন।
বৈষ্ণবরা যদি সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের বানী মানতো,তাহলে 'ওম্' নাম জপ করতো!!কিন্তু বৈষ্ণবদের মতে,হরেকৃষ্ণ নাকি মহামন্ত্র।
প্রথমতঃ,বেদের বাণীকে মন্ত্র বলে।হরেকৃষ্ণ বলে, বেদে কোন মন্ত্র নেই। সুতরাং,হরেকৃষ্ণ কোন মন্ত্র নয়।
দ্বিতীয়তঃ,মহামন্ত্র বলা হয়, বেদের বাণী গায়ত্রী মন্ত্রকে।
তৃতীয়তঃ,অনেক অতিজ্ঞানী বৈষ্ণব যুক্তি দেখায় যে,কলিযুগের জন্য,শ্রীকৃষ্ণ,চৈতন্য মহাপ্রভুর রূপ ধারণ করে এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জীবকে উপদেশ করেছেন।
কিন্তু,বৈষ্ণবরা,শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করেন।তাহলে,ঈশ্বর দ্বাপরে ভুল করলেন।সেই ভুল সংশোধন করার জন্য পুনরায় কলিতে জন্ম নিলেন!!ঈশ্বর মানুষের মতো ভুল করেন!!বাঃ বাঃ।ইহাতে তো, শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডন হয়ে যায়।
দ্যূতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।
জয়োহস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্।।গীতা ১০।৩৬।।
অনুবাদঃ সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।-[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
অর্থ বিশ্লেষনঃ- ছলনাকারীদের মধ্যে,আমি (শ্রীকৃষ্ণ) দ্যুতক্রীড়া অর্থাৎ,জুয়ারী!!!!
এই শ্লোকাংশ ঈশ্বর পক্ষে ব্যাখ্যা সম্ভব কি?(কারণ গীতা হল যোগযুক্ত অবস্থায় বলা শ্রীকৃষ্ণের বানী,তাই অনেকেই গীতার ঈশ্বরপক্ষে ব্যাখ্যা করেন)।যদি সম্ভব হয়,তাহলে ঈশ্বর নিম্নস্তরের,পশুতুল্য মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত হন!!!আর, শ্রীকৃষ্ণ যোগী ও বেদজ্ঞানী ছিলেন, সুতরাং তিনি, জুয়ার বিষয়ে বেদের নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই জানতেন। সুতরাং, যোগীপক্ষেও এই শ্লোকাংশের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
এবার আসুন দেখি, শ্রুতি বা বেদ এবং মনুস্মৃতি জুয়ার বিষয়ে কি বলছেন~
অক্ষৈর্মা দীব্যঃ কৃষিমিত্ কৃষস্ব
বিত্তে রমস্ব বহু মন্যমানঃ।
তত্র গাবঃ কিতব তত্র জায়া
ঋগ্বেদ-মন্ডল 10 সুক্ত 34 মন্ত্র 13
অর্থ-হে জুয়ারী,পাশা কখনো খেল না,বরং কৃষিকাজ কর।তাহাতে, স্ত্রী ও অনেক গাভী পাবে।
এইবার মনুস্মৃতির প্রমাণ দেখুন~
মনুস্মৃতি, ৭/৪৭ এ পাশা খেলাকে বা জুয়াকে কামজ ব্যসন বলে নিন্দা করা হয়েছে।
মনুস্মৃতি , ৭/৫০ এ,দশটি কামজ দোষের মধ্যে,পাশাখেলা বা জুয়াখেলা,মদপান, স্ত্রীসম্ভোগ এবং মৃগয়া -এই চারটি দোষকে অত্যন্ত দূষণীয় ও কষ্টতম বলা হয়েছে।
মনুস্মৃতি, ৭/৫২তে পুনরায় পাশা বা জুয়া খেলাকে পরিত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে।
সুতরাং,এ ই শ্লোকাংশ বেদ বা শ্রুতি এবং স্মৃতি বিরোধী।
মহাভারতে মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণকে আপ্ত পুরুষ বলেছেন
ন্যায় দর্শনের প্রনেতা গৌতমাচার্য় সত্যবাদী সাক্ষাৎকৃতধর্মা, বিদ্যান্ ব্যক্তির উপদেশকেই শব্দ প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন এবং যাহা শব্দপ্রমানযুক্ত, তাহাকেই ঐতিহ্য বা ঐতিহাসিকপ্রমাণ বলা যায়।
বাৎসায়ন মুনি ন্যায়ভাষ্যে আপ্তের লক্ষণ লিখিয়াছেন যে, যিনি সাক্ষাৎ সমস্ত পদার্থ বিদ্যার জ্ঞাতা, কপটতাদি রহিত ও ধর্মাত্মা, যিনি সত্যবাদী, সত্যমানী ও সত্যকারী এবং যিনি পূর্ণ বিদ্যাযুক্ত ও দয়াপরবশ হইয়া স্বেচ্ছায় পরোপকার্থে ও সকলের সুখ বৃদ্ধদির জন্য নিজ নিভ্রান্ত জ্ঞান অপরকে প্রদান করেন এবং যিনি পৃথিবী হইতে পরমাত্মা পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের যথাবৎ করিয়াছেন ও যিনি তদনুযায়ী নিজ আচরণের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, এরূপ শুভ গুনকেই আপ্তি বলা হয়। এইরূপ আপ্তি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠগুণ যুক্ত মনুষ্যকেই "আপ্ত" বলা হয়। এইরূপে আপ্তের বচন বা উপদেশই শব্দপ্রমাণ বলা হইয়া থাকে।
অর্থকামেষবসক্তানাং ধর্মজ্ঞানং বিধীয়তে।
ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ
মনুস্মৃতি ২।১৩
অর্থ- যাঁরা অর্থ ও কামে আসক্ত নন, ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান তাঁদেরই হয়। আর, ধর্মজিজ্ঞাসু ব্যক্তিগনের কাছে বেদই সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। (যেখানে শ্রুতি বা বেদ ও স্মৃতির মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হবে, সেখানে শ্রুতি বা বেদের মতই গ্ৰাহ্য।এই কারণে,শ্রুতি বা বেদকে, সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে)
সুতরাং,ধর্ম জানার একমাত্র উপায় হল বেদ। গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, এগুলো কোন ধর্ম গ্ৰন্থ নয় আর ধর্ম জানার উপায় নয়।
গীতা হল শ্রীকৃষ্ণের বানী। যা কিনা, পরবর্তী সময়ে অনেক বৈষ্ণব দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। গীতা কোন ঈশ্বরের বাণী নয়। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে কোন বাণী দেননি। ঈশ্বরের বাণী হলো বেদ। ঈশ্বরকে সাধারণ মরণশীল মানুষের (শ্রীকৃষ্ণ) পর্যায়ে নামিয়ে এনে,বেদ বিরোধী মতবাদ প্রচারকারীদের নাম হল বৈষ্ণব।শ্রীকৃষ্ণের মতো শুদ্ধ চরিত্রের মানুষের চরিত্র কালিমালিপ্ত করে,তাঁকে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী মানুষদের কাছে তাচ্ছিল্যের পাত্র করে তুলেছেন এই বৈষ্ণব সম্প্রদায়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ