‘সুশ্রুত সংহিতা’ দুটি মূল অংশে বিভক্ত। প্রথম পাঁচটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘পূর্বতন্ত্র’ এবং পরের অংশটি ‘উত্তরতন্ত্র’। ছয়টি কাণ্ডে বিভক্ত ১৮৪ টি অধ্যায়ে বিধৃত এই মহাগ্রন্থ। এতে প্রায় ১,১২০টি মেডিকেল কন্ডিশন বা অসুস্থতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক আঘাতের ফলে সৃষ্ট বৈকল্য, বয়স বাড়ার ফলে সৃষ্ট অসুস্থতা, প্রসূতিদের সাথে সম্পর্কিত নানাবিধ রোগ, এমনকি মানসিক রোগের বিভিন্ন দিক এবং তার প্রতিকার। পাশাপাশি রয়েছে ৭০০টি ওষধি গাছের বর্ণনা এবং তাদের ব্যবহার। খনিজ পদার্থজাত ৬৪টি এবং প্রাণীজ উৎসজাত ৫৭টি ওষধি দ্রব্যের বর্ণনা পাওয়া যায় তার গ্রন্থে।
পাঠ্যটিতে শল্য চিকিৎসা, পরীক্ষা করা, বিদেশী সংস্থাগুলি নিষ্কাশন, ক্ষার এবং তাপ কৌতুককরণ, দাঁত নিষ্কাশন, ক্ষরণ, এবং ফোলা নিকাশী জন্য ট্রোকার, হাইড্রোসিল এবং অ্যাসিডিক তরল প্রসেট, প্রোস্টেট গ্রন্থি অপসারণ, মূত্রনালী স্ট্রাকচার বিচ্ছিন্নতা, ভ্যাসিকোলিথোটোমি, হার্নিয়া সার্জারি, সিজারিয়ান বিভাগ, রক্তক্ষরণ, ফিস্টুলি, ল্যাপারোটমি পরিচালনা এবং অন্ত্রের বাধা পরিচালনা, ছিদ্রযুক্ত অন্ত্র এবং পেটের দুর্ঘটনাক্রমে ছত্রাকের প্রসারণ এবং ফ্র্যাকচার ম্যানেজমেন্টের নীতিগুলি, যেমন, ট্র্যাকশন, ম্যানিপুলেশন, প্রয়োগ এবং স্থিতিশীলতা সহ কিছু পুনর্বাসন এবং সিন্থেটিক ফিটিং ব্যবস্থা। এটি ছয় প্রকার বিশৃঙ্খলা, বারো প্রকারের ভাঙ্গন এবং হাড়ের শ্রেণিবিন্যাস এবং আঘাতের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়ার গণনা করে এবং ছানি শল্য চিকিৎসা সহ চোখের রোগগুলির শ্রেণিবিন্যাস দেয়।
তিনি তার গ্রন্থের বড় অংশই বরাদ্দ রেখেছেন শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির জন্য। এই গ্রন্থে শল্য চিকিৎসার ১২০ রকমের যন্ত্রপাতির উল্লেখ রয়েছে। অস্ত্রোপচারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোকে তিনি সূক্ষ্ম এবং স্থূল, এই দু’ভাগে ভাগ করেন। কামারের কাছ থেকে কীভাবে এই যন্ত্রগুলো তৈরি করা যাবে, তারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তার ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্রের নাম মণ্ডলাগ্র সূচিকা, কুশপত্র, উৎপল পত্র, শবরিমুখ কাঁচি, অন্তর্মুখ কাঁচি প্রভৃতি। আনুমানিক ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বা ৫৫০০ বছর পূ্র্বে সুশ্রুত জন্মগ্রহন করেন। তিনি বারাণসীতে দেবদাস ধন্বন্তরির কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন, পরে পরে তিনি শল্যবিদ্যার সাথে সাথে চিকিৎসাবিদ্যার অন্যান্য শাখার ওপর পারদর্শিতা লাভ করেন।
তিনি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করেন। এগুলো হচ্ছে,
১)ছেদন (excision)- কেটে বাদ দেওয়া। যেমন মারাত্মক ক্ষত হয়ে যাওয়া আঙুল বা নিরাময়ের অযোগ্য পা।
২)লেখন (sacrification)- কোনো একটি অংশকে দাগ কেটে আলতোভাবে চিরে ফেলা কিংবা কোনো ক্ষতের বাড়তি মাংস বা ময়লা ছেঁচে তুলে ফেলা।
৩) ভেদন (puncturing)- কোনো অঙ্গে বিশেষ যন্ত্র দিয়ে ছিদ্র করে পেটের গহ্বরে বা অণ্ডকোষে কিংবা মাংসপেশির মাঝে জমা হওয়া অস্বাভাবিক তরল ফেলে দেওয়া।
৪) এষণা (exploration)- আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না, এমন সব জায়গা যেমন দেহ গহ্বর কিংবা অসুখের ফলে সৃষ্ট সাইনাস সমূহ উন্মুক্ত করে পর্যবেক্ষণ করা।
৫) আর্য্যন (extraction)- উৎপাটন বা শরীরে ঢুকে যাওয়া কিছু (যেমন তীরের অগ্রভাগ) টেনে বের করা।
৬) সিবন(suturing)- অস্ত্রোপচারের পর উন্মুক্ত স্থান সেলাই করে দেওয়া।
সুশ্রুত সংহিতার ছয়টি স্থান ও বেশ কিছু অধ্যায় আছে। যেমনঃ
সূত্রস্থান
এই স্থানে ৪৬টি অধ্যায় আছে। এখানে শল্যচিকিৎসা বিষয়ক শব্দাবলির অর্থ এবং ভেষজের শ্রেণিবিভাগ আছে।
নিদানস্থান
এই স্থানে ১৬টি অধ্যায় আছে। এই অধ্যায়গুলিতে রোগের কারণ ও লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে।
শারীর স্থানঃ
এই স্থানে ১০টি অধ্যায় আছে। এই স্থানে মানবদেহের বিবরণ ও ভ্রূণতত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
চিকিৎসাস্থান
সুশ্রুত সংহিতার এই স্থানে ৪০টি অধ্যায় আছে। এই স্থানে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
কল্পস্থান
এই স্থানে ৮টি অধ্যায় আছে। এখানে বিভিন্ন বিষয় ও তাদের প্রতিক্রিয়া এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
উত্তরতন্ত্র
উত্তরতন্ত্রে আছে ৬৬ টি অধ্যায়। শল্য চিকিৎসার সাতটি প্রক্রিয়ার কথা এই তন্ত্র থেকে জানা যায়। সেগুলিহল-(১) ছেদন, (২) ভেদন, (৩) লেখন, (৪)এয্যন, (৫) আহরন, (৬)বিস্রবণ এবং (৭) সীবন।
সুশ্রুত সংহিতার মূল্যায়ন
সুশ্রুতসংহিতা’র বিষয়সন্নিবেশ ব্যবস্থা সুসমৃদ্ধ এবং রচনারীতি অপেক্ষাকৃত প্রাঞ্জল। এমনকি এই সংহিতার সমসাময়িক কালে শাস্ত্রচিকিৎসা উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিল। ভাষার সহজবোধ্যতা ও বিষয়স্থাপন পদ্ধতি গ্রন্থটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
সুশ্রুত সংহিতার টীকাকার
সুশ্রুতসংহিতার টীকাকারগণের মধ্যে শ্রীমাধর, চক্রপাণি, উত্থন প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
[PDF] সুশ্রুত সংহিতা pdf download করুন
আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় ঠিক এই কাজগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নাকের অস্ত্রোপচার যা এখন রাইনোপ্লাস্টি নামে পরিচিত, তখনকার সময় থেকেই চলে আসছে। এখানেই শেষ নয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সত্যি যে, সুশ্রুত সংহিতার ষোড়শ অধায়ে অটোপ্লাস্টি এবং ল্যারিংগোপ্লাস্টি’র মতো অপারেশনের বর্ণনা পাওয়া যায়। সুশ্রুত ই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম চিকিৎসক, যিনি পেট কেটে সন্তান প্রসব করানোর (caesarean delivery) পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকি চোখের ছানি অপারেশন করতেন সুশ্রুত।
এমনকি জীবাণুমুক্তকরণের উপরও তার নজর ছিলো। অস্ত্রোপচারের সময় ব্যথানাশক হিসেবে রোগীকে তিনি আঙুর থেকে তৈরি সুরা পান করতে দিতেন এবং ক্যানাবিস জাতীয় হিপ্নোটিক ড্রাগের ধোঁয়া শোঁকাতেন, যাকে আধুনিক 'anesthesia' বা চেতনানাশক এর আদি পূর্বসূরি বলা যায়। ফলে রোগী অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রণা ভোগ করতো। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে একজন মানুষ তাঁর চিন্তাধারায় এতটা অগ্রগতি লাভ করেছিলেন।
মহর্ষি সুশ্রুত ও তার সুশ্রুত সংহিতা এতই বিখ্যাত ছিলো যে এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। অষ্টম শতকে ‘কিতাব-ই-সুশ্রুত’ নামে আরবিতে অনূদিত হয় এটি। আরবির এই অনুবাদ মধ্যযুগের শেষমেশ ইউরোপে পৌছায়। ইতালিতে যে রাইনোপ্লাস্টি চালু হয়েছিলো, ধারণা করা হয়, তারা সুশ্রুত সংহিতা থেকে প্রভাবান্বিত ছিলো। ১৮৩৫ সালে কলকাতায় মধুসূদন দত্ত কর্তৃক ‘এডিটিও প্রিন্সেপ্স’ নামক সংস্করণ বের হয়। কবিরাজ কুঞ্জলাল ভিষকরত্ন ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১৬ সালের ভেতরে তিন খণ্ডে সুশ্রুত সংহিতার সম্পূর্ণ ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন।
মহর্ষি সুশ্রুতের ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্র
প্রাচীন ভারতে সুশ্রুত পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। মৃতদেহ নিয়ে গবেষণা বা কাটাছেঁড়া নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে আস্তে আস্তে শল্যবিদদের দক্ষতা হ্রাস পেতে থাকে। জাতিভেদ প্রথাসহ সামাজিক শ্রেণিবিভাগ আরোপিত হওয়ার পর উঁচু শ্রেণির মানুষেরা ‘শল্যবিদ’ ব্যাপারকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে এই জ্ঞান হারিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। হয়ত আমরা কখনোই জানতে পারতাম না আমাদের অতীতের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে, যদি না মহর্ষি সুশ্রুত আমাদের জন্য রেখে যেতেন তার অমর গ্রন্থ ‘সুশ্রুত সংহিতা’। সুশ্রুত, একজন প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন যা সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থটির মূল লেখক হিসাবে পরিচিত। তিনি " অস্ত্রোপচারের জনক " এবং "প্লাস্টিক সার্জারির জনক" হিসাবে পরিচিত।[Champaneria, Manish C.; Workman, Adrienne D. (জুলাই ২০১৪)। "Sushruta: father of plastic surgery": 2–7] ।
খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই ভারতআইসোলেশন, কোয়ারান্টাইন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং সম্পর্কে অবগত। এমনকি অষ্টাঙ্গ হৃদয় যা চরক ও সুশ্রুত সংহিতা অবলম্বনে লেখা, তাতে মহামারী রোধে ২১ দিন লকডাউনের কথাও স্পষ্ট করে বলা আছে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ