হিন্দু ধর্ম - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 January, 2022

হিন্দু ধর্ম

হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্ম (রিলিজিয়ন)

 হিন্দু ধর্ম্ম কাহাকে বলে, ইহার সূত্র করিতে হইলে অগ্রে ধর্ম্ম পদার্থের লক্ষণ নির্দ্দেশ আবশ্যক হইয়া উঠে। ধর্ম্ম কাহাকে বলে ? যিনিই হীনতা ত্যাগ করতে পারবেন তিনিই হিন্দু। 

হীনতা বর্জনকারী মানব নিচয়।

হিন্দু বলে আপনার দের পরিচয়।

প্রাচীন মেরুতত্ত্বানুসারে এর ধাতুগত অর্থই হল। | হীনঞ্চ দৃষয়তোর হিন্দুবিতাচতো প্রিয়ে। ব্যাকরণের নিয়মানুসারে হীন + দুষ-ডু-যে- নিপাতনে।  নিপাতনে সিদ্ধ এই পদ পূর্বোদরদিত্বাৎ সাধুর। রামকোষ নামক প্রাচীন অভিধানেও হিন্দু শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, হিন্দুদুষ্টমূহঃ প্রোক্তোহনার্যনীতি বিদষবঃ। সদ্ধর্ম-পালকো বিদ্বান শ্রৌতধর্মপরায়ণ । অর্থাৎ দুষ্টের দণ্ডদাতা, অনার্য নীতির বিরোধী সদ্ধর্মের পালক ব্যক্তিই হিন্দু।

"হিন্দু" এই শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে ভাষাতত্ত্ববিৎ পন্ডিত গণের ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। ফলতঃ ভারতবর্ষবাসী আর্য্যের নামান্তর হিন্দু এ বিষয়ে মত-ভেদ তেমন দেখা যায় না প্রকৃতপক্ষে হিন্দু কোন ধর্ম্মের নাম না। ধর্ম্ম একটি সম্পূর্ন বাক্য, আমাদের ধর্ম্মে নাম "ধর্ম্ম"-এই ধর্ম্ম সনাতন ইহার পূর্বে ব্যবহৃত শব্দ বৈশিষ্ট বাচক। ইহা সময় বিশেষে কখনো ব্রাহ্মন্য ধর্ম্ম, চিরাচরিত ধর্ম্ম, সনাতন ধর্ম্ম। সনাতন বা Sanatana একটি সংস্কৃত শব্দ। যদি এক কথায় এর অর্থ প্রকাশ করা যায় তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে “Eternal” বা “চিরস্থায়ী”। সনাতন শব্দের অর্থ চিরন্তন, শাশ্বত, নিত্য, চিরস্থায়ী; অপরিবর্তনীয়, সার্বজনীন, যার শুরু নেই শেষ নেই।।

জিজিয়া কর আদায় কালে মুসলিমরা ভারতীয়দের হিন্দু নামে চিহ্নিতকরণ করতো, আরবী, ফার্সি, ও উর্দু শব্দকোষ এমন কি বিশ্বকোষেও লেখা আছে হিন্দু মানে চোর, লুচ্চা, লাফাঙ্গা, দাগাবাজ,  শরাবি, বদমাশ,কাফের, কালা আদমি। হিন্দু শব্দটি এসেছে পার্সিয়ান থেকেহিন্দু শব্দটি হচ্ছে পার্শি শব্দ । যার অর্থ হীন্ বা নীচতা । যদি হিন্দু শব্দের লম্বা উচ্চারণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে হিন্-ন্-ন্ –ন্ –দু । এখানে হিন্ শব্দটি প্রধান । আর হীন্ মানে নীচ্ বোঝায় । গেবিন ফ্লাডের মতে, "আসল পরিভাষা হিন্দু প্রথম দেওয়া হয় পার্সিয়ান ভৌগোলিক পরিভাষা থেকে যা দ্বারা সিন্ধু নদীর পাশে বসবাসকারী লোকেদের বোঝানো হত[ Flood, Gavin D. (১৯৯৬)। An Introduction to Hinduism। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 6। আইএসবিএন 0521438780।। হিন্দু শব্দটি পরবর্তীতে মাঝে মাঝে ব্যবহার করা হয়েছিল কিছু সংস্কৃত লেখায় যেমন কাশ্মীরের বিখ্যাত লেখক কলহনের লেখা রাজতরঙ্গিনীতে (হিন্দুকা সি. ১৪৫০)। আর্য নাম বেদাদী শাস্ত্রে অসংখ্য জায়গায় পাবেন । কিন্তু কেউ কি আমায় হিন্দু শব্দটি একবার কোনো বেদ ,উপনিষদ, বেদান্ত,দর্শন , মনুস্মৃতি ব্রাহ্মণ শাস্ত্র থেকে দেখাতে পারবেন না।
জিজিয়া কর সম্পর্কে অনেকেই ইতিহাসে পড়েছ। অমুসলিম দের কে যদি মুসলিম শাসন করে তাহলে সেই অমুসলিম কে জিজিয়া কর দিতে হবে এইটা কুরআন এর বাণী ৯) সূরা আত তাওবাহ.. আয়াত ২৯ । তাই আমাদের কে চিহ্নিত করার জন্য আমাদের নাম দেওয়া হয় 'হিন্দু' , হিন্দু বলে ডাকতো ।যেহেতু মুসলিমদের দেওয়া নাম এই হিন্দু সেহেতু তাদের হিসেব মতোই এইনামের অর্থ তারা দিয়েছে ।

        অনেকে তর্ক দেন যে সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দের উৎপত্তি, যদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তবে সেটা শুধু সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের   ক্ষেত্রে হিন্দু শব্দ প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল । সম্পুর্ন ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে হিন্দু নামাঙ্কণ হওয়ার দরকার পড়ে না । ।সম্পুর্ন ভারতবর্ষের লোকদের ক্ষেত্রে হিন্দু নামে চিহ্নিত হওয়ার কারণ,সারা ভারতে মুসলমান শাসন কায়েম ছিল । তাই হিন্দু শব্দের প্রসার সারা ভারতব্যাপী হয়েছিল । আর একটা কথা সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকলে শুধুমাত্র সিন্ধু অঞ্চলে এই নাম সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল ।এতে প্রমান হয় সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়নি । আরও একটা কথা ‘স’ কে যদি ‘হ’ বলত তাহলে‘স’ দিয়ে আরও যে সব শব্দ আছে সেগুলোরও পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা তো হয়নি । যেমন মুসলমান উচ্চারণ "মুহলমানহয়নি পার্সি "পার্হিশিয়া "হিয়াসুন্নি "হুন্নিবা সুলেমান "হুলেমানহয়নিযদি সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে থাকে তাহলে হিন্দুধর্ম অনুসারে‘গঙ্গা’নদীর পরিবর্তে সিন্ধু নদীকে পবিত্র হিসাবে মানা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা মানা হয় না। অতএব সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে একথাটি মিথ্যা প্রমানিত হল। 

আমরা সকলে আর্য, ঋষিদের বংশধর। আমাদের দেশের নাম আর্য্যবর্ত্ত। শাস্ত্রে আর্যের অর্থে বলা হয়েছে আর্য অর্থাৎ ঈশ্বরঃ পুত্রঃ। আমাদের সমস্ত শাস্ত্র বলছে আমাদের গুনগত নাম 'আর্য " এটি জাতিগত নয় বারবার বলা হয়েছে কিন্তু আমরা আজ নিজেকে হিন্দু বলতেই ব্যস্ত , হিন্দু নাম হওয়ার পর থেকে আমরা বেদাদী শাস্ত্র চর্চা কেও বাদ দিয়ে দিয়েছি , আজ হিন্দু সমাজ সনাতন বৈদিক ধর্মের শাস্ত্র থেকে অনেক টা দূরে আজ আমরা শাস্ত্র কে ভুলে কুসংস্কার ,অন্ধবিশ্বাস এখন আমাদের ধর্মের স্থান পেয়েছে ।  মুসলমানরা ফার্সি ভাষায় কথা বলত । ফারসিতে ‘স’ ‘হ’ –এর মত উচ্চারিত হয়  বা তারা ‘স’ কে ‘হ’ বলত, তাই সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়েছে ।  কিন্তু এদের কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও ,সেটাতো মুসলমানদের দেওয়া নাম । তা নিয়ে হিন্দুদের  গর্ব করা কিকরে সম্ভব । কারন হিন্দুত্ববাদীরাতো সব সময় মুসলমানদের বিরোধীতা করছে । 

Encyclopedia Britannica - 14th Edition পর্যন্ত 'আর্য' শব্দটির অর্থ ছিল "মহৎ ব্যাক্তি'। কিন্তু 1993-এর 15th Edition –এ এর অর্থ বদলে বলা হল 'ভারতে অনুপ্রবেশকারী নরগোষ্ঠী" ।

ম্যাক্সমূলার 'আর্য' শব্দের উৎপত্তি হিসাবে অর' ধাতুরূপকে গ্রহণ করেছিলেন। 'অর' ধাতুরূপের অর্থ 'লাঙল বা চাষ করা'। সেখান থেকে তিনি 'আর্য' কথার অর্থ করেন 'কৃষক বা চাষবাসকারী' [ In ar or ara, I recognize one of the oldest names of the earth, as the ploughed land, lost in Sanskrit but preserved in Greek as (era) so that Aryan would have conveyed originally the meaning of landholder, cultivator of the land]

কিন্তু ভি এস আপ্তে তার অভিধানে এর মূল ধাতুরূপ দেখিয়েছেন 'র' বা 'ঋ' এবং তার আগে 'আ' যুক্ত হয়ে বিপরীতার্থক শব্দরূপে 'আর্য' শব্দের অর্থ হল ভদ্র ও সম্মানীয় ব্যক্তি। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র দত্ত তার 'হিন্দুশাস্ত্র' নামক গ্রন্থে বলেছিলেন, 'আর্য' শব্দের সংজ্ঞা হল – 

কর্তব্যম আচরণ অকর্তব্যম অনাচারম্।
তিষ্টতি প্রকৃতাচারে সঃ যঃ আর্য ইতি স্মৃতি।।

 অর্থাৎ যিনি কর্তব্য পালন করেন, অকর্তব্য করেন না, সদাচারে থাকেন, তিনি ই 'আর্য'। ঋগ্বেদে "আর্য" শব্দের ব্যবহার ৩২ বার হয়েছে। বেদ ভাষ্যকার সায়ণাচার্য (চতুর্দশ শতাব্দীতে তুঙ্গভদ্রা নদীতীরে হাপ্পিন নগরের কাছে জন্ম। বেদ-এর টীকাকার হিসাবে ইনি অপরিহার্য) এই আর্য শব্দটির নয়-টি অর্থ করেছেন। যথা

১। বিজ্ঞ যজ্ঞানুষ্ঠাতা

২। বিজ্ঞ স্রোতা

৩। বিজ্ঞ

৪। সর্বান্তব্য

৫। উত্তমবর্ণ

৬। ত্ৰৈবণিক

৭। মনু

৮। কর্মযুক্ত, দেবোপাসক

৯। কর্মানুষ্ঠানের নিমিত্ত শ্ৰেষ্ঠ

আবেস্তাতে 'আর্য' শব্দের অর্থ প্রভু বা অভিজাতকুলের ব্যক্তি। ঋক বেদ-এ এই অর্থে (উত্তমবণ) প্রয়োগ দেখা গেলেও তা বাইরেও অন্যান্য অর্থে এর প্রয়োগ দেখা যায়।
আর্য আগমনবাদীরা বলেন বহিরাগত আর্যরা হল 'প্রভু' এবং বিজিত আদিবাসীরা হল 'দাস' বা 'দাস্যু'। কারণ ঋক বেদ-এ 'দাস' কথাটা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে 'দাস' কারা? তারা কি অনার্য? ঋক বেদ-এ দাসদের ভাষা বলা আছে 'মৃদ্ধাভাষঃ[ঋক বেদ ১/১৭৪/২; ৫/৩২/৮, ৭/৬/৩ ইত্যাদি] এই শব্দটির প্রয়োগ দেখিয়ে আগমনবাদীরা বলেন যে দাসদের ভাষা পৃথক। কিন্তু 'মৃদ্ধাভাষঃ' কথাটির অর্থ অনার্য ভাষা নয়। 'মৃদ্ধাভাষ' অর্থ 'অপরিশিলীত ভাষ; 'মৃদ্ধাভাক' হল এ ভাষা যে ব্যবহার করে। যে কোন ভাষাতেই শ্লীল – অশ্লীল ব্যবহার থাকে। অশ্লীল ভাষা যেমন অন্য কোন ভাষা নয়, তেমনই 'মৃদ্ধাভাষ' মানে অন্য ভাষা নয় ।

আর একটি শব্দ প্রয়োগ করে 'আর্যদের' সাথে দাস বা দাস্যুদের পৃথক করা হয়েছিল। শব্দটি হল 'অনাস'। ঋক বেদ ৫/২৯। ১০ –এ দাস বা দস্যুদের প্রসঙ্গে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। ম্যাক্সমূলার এটিকে 'অ-নাস' এভাবে ভাগ করেছিলেন। অর্থাৎ ‘যার নাক নেই বা যার নাক চাঁপা'। অর্থাৎ ভারতের নাকচাঁপা মানুষেরা হয়ে গেলেন অনার্য বা দস্যু বা দাস্যু। কিন্তু সায়নাচার্য এর অর্থ করেছেন 'ভাষাহীন বা ভদ্রভাষাহীন’। তিনি 'অনাস' শব্দটিকে ভেঙ্গেছেন ‘অন-অস'। সায়নাচার্যের ব্যখ্যাটি গ্রহণ করলে আমরা বলতে পারি যে 'মৃদ্ধাভাষ' এবং 'অনাস' শব্দদুটি প্রতিরূপ। দুটি শব্দই প্রয়োগ হয়েছে অপরিশিলীত ভাষা ব্যবহার করা বিষয়ে। অর্থাৎ দাস বা দস্যুরা অবিনীত বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করত। তাই বলে তারা অনার্য নন। তারা আর্য সংস্কৃতি বহন করছেন না বলে তারা আর্যেতর। জাতিগতভাবে তারা পৃথক নন।

এই দাস বা দাস্যুরা অশিক্ষিত, বর্বর ছিলেন এমন মনে করার নেই। কারণ ঋকবেদ জানাচ্ছে যে এরা (দাস বা দাস্যু) -

১। শহরে বাস করে [১/৫৩/৮; ১/১০৩/৩]

২। এরা সম্পদশালী [৮/৪০/৬; ১/৩৩/৪]

৩। এরা গরু, ঘোড়া ও রথ ব্যবহারকারী [২/১৫/৪]

৪। সমতল ও পাহাড় উভয় জায়গায় বাস করে [১০/৬৯/৬]

৫। এরা সোনা ও মণিমাণিক্য ব্যবহার করে [১/৩৩/৮]

৬। রথ, এরা যুদ্ধে ব্যবহার করে [৮/২৪/২৭] ঘোড়া ও রথ ব্যবহারকারী হিসাবে আর্যদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দাস বা দাস্যুরা-ও একই সংস্কৃতিকে বহন করছে।

মনু সংহিতায় (শ্লোক ৪৫) বলা আছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র- এই চারবর্ণের আর্যরা ছাড়া অন্যদের বলা হত দাস বা দাস্যু। এক্ষেত্রে ভাষার কোন সম্পর্ক নেই। দাস্যু কথার অর্থ হল পতিত। পতিত কারণ তারা পবিত্র অনুশাসন বা অনুষ্ঠান মানেন নি। বেদ টীকাকার কুল্লুক বলেছেন 'আর্য বা ম্লেচ্ছ যে কোন ভাষাতেই কথা বলুক না কেন যে সব আর্য পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান বিরোধী তারাই দাস্যু বা দাস।

অধ্যাপক বন্ধ বিহারী চক্রবর্তী তার 'আর্য-দ্রাবিড় তত্ত্ব' বইতে 'আর্য' শব্দের পৃথিবীব্যপী সমরূপ শব্দের ব্যবহারকে উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি জরাথ্রুস্ট্রিয়রা জেন্দ আবেস্তাতে 'আর্য' সম্পর্কিত শব্দকে রক্ষণ করেছেন। মনে করা হয় যে এরা ভারত থেকে উত্তর-পশ্চিমে পর্যটন করেন। আবেস্তার একটি অংশ ভেন্দিদাদে বলা আছে, আহুর মাজদা জরাথ্রুস্ট্রের কাছে যে ষোলটি দেশের নাম বলেন, তার মধ্যে একটি দেশের নাম (প্রথমটি) ‘Airyamen Vaejo'। এর অবস্থান অতিদূর প্রাচ্যে। এই দেশ থেকে তারা দক্ষিণ ও পশ্চিমে যায়। জেন্দ আবেস্তা অনুসারে আর্য-অধিকৃত ভূভাগের নাম হল 'আইরিয়া'। Strabo আবার Ariana বলতে বুঝতেন – দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে সিন্ধু, উত্তরে হিন্দুকুশ এবং পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের অন্তর্ভুক্ত ভূভাগ। ব্যাকট্রিয়াকে বলা হত Ariana – এর ভূষণ। একসময় পারস্যকে Aria বলা হত। জরাথ্রুস্ত্র-এর ধর্ম যখন পারস্য, এলামেইজ এবং মিডিয়াতে প্রচলিত হল, তখন সেই সেই দেশীয়গণ সকলে 'আর্য' পদবী দাবী করল। মিডিয়াবাসীগণ নিজেদের বলত Arii, মিডিয়ার উত্তরাংশের নাম হল Arianai এলামেইজ নামটি এসেছে Ailama শব্দ থেকে, যা হল 'ঐরিয়াম' শব্দের বিকৃত রূপ।

- দারিয়ুসের কিউনিফর্ম লিপিতে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে পরিস্কার দেখান হয়েছে যে পারস্য সাম্রাজ্যে Arian শব্দটি সন্মান্ সূচক পদবীরূপে ব্যবহৃত হত। বিহিস্তান শিলালিপিতে আহুর মাজদা-কে Arian –এর ঈশ্বর ভাবা হত। দারিয়ুসের প্রপিতামহকে Ariaramna ('Ariaramnes' in Greek) বলা হত। এরিষ্টটলের শিষ্য Eudemos, Arian-দের কথা উল্লেখ করেছেন। জেন্দ আবেস্তা-তে যে অর্থে Arian শব্দটি ব্যবহার করা হত ইউডেমস সম্ভবত সেই অর্থেই এটি ব্যবহার করেন। আধুনিক ইরাণ শব্দটি প্রাচীন আরিয়ান তাৎপর্য বহন করে। আমের্নিয়া শব্দটিতে একই তাৎপর্য আছে।

এভাবে দেখা যায় ভারত থেকে পশ্চিমদেশ এবং আর্যাবর্ত থেকে আরিয়ানা, পারস্য, মিডিয়া, সন্দিগ্ধভাবে আর্মেনিয়া এবং অক্সাসের পরপার পর্যন্ত 'আরিয়া' নামের সূত্র পাওয়া যায়। সম্ভবত দুটি পথ দিয়ে এশিয় আরিয়ানরা অগ্রসর হয়েছিল। একটি উত্তরে খোরাসান হয়ে রাশিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসাগর এবং থ্রেসের দিকে। অন্যটি আমের্নিয়া হয়ে ককেশাস অথবা কৃষ্ণসাগর পার হয়ে উত্তর গ্রীসে এবং জার্মানীর দানিয়ুবের ধারে। প্রথম পথটিতে আরিয়ানরা পর্যটনের চিহ্নস্বরূপ রেখে যায় আরিয়া নামক দেশ- যার পরবর্তী নাম থ্রেস। দ্বিতীয় পথের চিহ্নটি পাওয়া যাবে জার্মানীর পূর্বাংশে Arii ট্রাইব-এ।

হেরাট (Herat) নামক স্থান যার অন্য নাম হেরি (Heri) –এটি হরিয়ুদ নদীর তীরে অবস্থিত। টলেমি হেরি-কে বলতেন Areias; অন্যান্য লেখকেরা বলতেন Arius। এটিই হল আরিয়া – যার পশ্চিমে পার্থিয়া, উত্তরে মারজিয়ানা, পূর্বে ব্যাকট্রিয়া ও আরাকোশিয়া এবং দক্ষিণে ড্রানজিয়ানা। এই আরিয়া দেশটি সমগ্র আরিয়ানা নয়, আরিয়ানার অংশ মাত্র।

যাহোক, আমরা দেখতে পাচ্ছি 'আর্য' শব্দের অর্থ আর যাই হোক, এর মাধ্যমে কোনও বিশেষ জনজাতির কথা বলা যায় না। এই শব্দটি একটি বিশেষ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মানুষদের কথা জানায় যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে পৃথক পৃথক জাতিগোষ্ঠীর হতে পারে।

বৌদ্ধরা ‘অরিয়ো’, ‘অয়ির', 'অয্য' – এই তিনরূপে 'আর্য' শব্দ ব্যবহার করত, যার অর্থ ছিল – right, good, ideal, noble। 'আতের' বলতে 'অনরিয়' শব্দ প্রয়োগ করা হত। যার অর্থ ছিল – undignified, uncultured
ধম্মপদ-এ গৌতম বুদ্ধ বলছেন –

ন তে অরিয়ো হোতি যেন পাণানি হিংসতি।
 অহিংসা সবপানামং অরিয়োতি পবুচ্চতি।।-(15)

অর্থাৎ কেহ যদি প্রাণীহিংসা করে তবে সে তদ্বারা আর্য হয় না, সর্বপ্রাণীতে অহিংসাহেতুই লোকে 'আর্য' বলে কথিত হয়। অমরকোষ জানাচ্ছে, মহাকুল, কুলীন, সভ্য, সজ্জন ও সাধু ব্যক্তি হল 'আর্য'।

('মহাকুল কুলীনাৰ্য্য সভ্য সজ্জন সাধব – ব্রহ্মবর্গ, ৫ম অধ্যায়। 

আবেস্তা-তে 'অইর্য' (Airya) শব্দটি আর্য শব্দের অর্থদ্যোতক। এর অর্থ সম্ভ্রান্ত বংশীয় বা সম্ভ্রান্ত। এদের ভাষায় 'অইরান' এবং 'অনইরান’ নামক দুটি বিপরীতার্থক শব্দ ব্যবহৃত হত। তারা নিজেদের 'অইরান' এবং অন্যদের ‘অনইরান' বলত।

হিটাইট ভাষায় প্রাপ্ত 'আর্য' শব্দটির অর্থ 'আত্মীয় বা বন্ধু'। বিপরীত অর্থেও 'আর্য' শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। ফিনিসীয় ভাষায় ‘ওরজ' শব্দের অর্থ 'দাস' এবং এটি আর্য-শব্দ প্রসূত। মনে করা হয়, ফিনল্যান্ডবাসীরা তাদের প্রতিবেশী আর্য-সংস্কৃতির মানুষদের পদানত করার সময় ওই শব্দটির উৎপত্তি। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, এক বিশেষ সাংস্কৃতিক মানবগোষ্ঠী, যারা নিয়েদের ‘আর্য' বলে অভিহিত করত, যাদের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় ভারতবর্ষের মাটিতে এবং পরবর্তীকালে যারা এশিয়া ও ইউরোপের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, তারা-ই হল 'আর্য'। 

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর অমর গ্রন্থ সাতার্থ প্রকাশে আমরা জানতে পারি মানুষ্যের আদি সৃষ্টি ত্রিবিষ্টপ অর্থাৎ যাহাকে তিব্বত বলে সেই দেশে হয়েছে। ঋগ্বেদ ১।৫১।৮ "বিজানীহ্যর্য্যান্ যে চ দস্যবঃ"-শ্রেষ্ঠ দিগকে আর্য্য, বিদ্যান এবং দেব এবং দুষ্টদের দস্যু অর্থাৎ ডাকাইত ও মূর্খ নাম ছিল। পরে পরে যখন আর্য্য ও দস্যু অর্থাৎ বিদ্বান দেব ও অবিদ্বান অসুরের মধ্যে কলহ বিবাদ বশতঃ নানা উপদ্রব শুরু হয় তখন আর্য্যগণ সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এই ভূখন্ডকে সর্ব্বোৎকৃষ্ট জানিয়া এখানেই বাস করিতে লাগিলো। এই জন্য এদেশের নাম 'আর্য্যবর্ত্ত" হয়। 

আর্যগন ভিন্নদেশ থেকে এসেছিলো কিনা প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি দয়ানন্দ তাঁর পুস্তকে লিখেন আর্য্যদিগের পূর্ব্বে এদেশে কেহ বাস করিত না। কারণ আর্য্যগণ সৃষ্টির আদিতে কিছুকাল পরে একেবারে তিব্বত হইতে এদেশে আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।
মনুস্মৃতি ২।২২ ও ২।১৭ 

আসমুদ্ৰাত বৈ পূৰ্ব্বাদাসমুদ্রাত্ত পশ্চিমাৎ।
তয়োরেবান্তরং গির্ষ্যোরাৰ্যাবর্ভং বিদুৰ্ব্ব ধাঃ ॥১॥
সরস্বতীদৃষদ্বত্যো দেবনজ্যোর্যদস্তরম্।
                                     তং দেবনিৰ্ম্মিতং দেশমাৰ্য্যাবর্ভং প্রচক্ষতে ॥২॥-মনু ( ২। ২২। ১৭) ॥

উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল, পূর্বের ও পশ্চিমে সমুদ্র ॥১॥ পশ্চিমে সরস্বতী অর্থাৎ অটক নদী এবং পূর্ববদিকে দৃষন্বতী নদী। উহা নেপালের পূর্ববভাগের পর্ববতশ্রেণী হইতে উৎপন্ন হইয়া বঙ্গ ও আসামের পূর্ব্ব এবং ব্রহ্মদেশের পশ্চিম দিয়া দক্ষিণের সমুদ্রে পতিত হইয়াছে। ইহার নাম ব্রহ্মপুত্র। অটক উত্তরস্থ পর্বতশ্রেণী হইতে বহির্গত হইয়া দক্ষিণের উপসাগরে মিলিত হইয়াছে। উত্তরে হিমালয়ের মধ্যরেখা, দক্ষিণে পর্ববত পর্যান্ত ও বিন্ধ্যাচল হইতে রামেশ্বর পর্যান্ত – এইসব অঞ্চলের অন্তবর্তী দেশগুলিকে আর্য্যাবর্ষ বলে। কারণ দেব অর্থাৎ বিদ্বান এবং আৰ্বাগণ এই সকল দেশে বসতি স্থাপন করিয়া বাস করিয়াছিলেন।

বিজ্ঞানীহ্যাৰ্যানযে চ দস্যবো বর্হিম্মতে রন্ধয়। শাসদব্রতান ॥ঋ০১।৫১।৮
উত শূদ্রে উতাৰ্য্যে ৷৷ অথর্ব ১৯। ৬২ ) |

ইহা লিখিত হইয়াছে যে, ধাৰ্ম্মিক, বিদ্বান এবং আপ্ত-পুরুষদিগের নাম আৰ্য্য । তদ্বিপরীত লোকদিগের নাম দস্যু অর্থাৎ ডাকাইত, দুর্বৃত্ত, অধাম্মিক এবং মূর্খ। সেইরূপ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য দ্বিজদিগের নাম আর্য্য এবং শুদ্রের নাম অনাৰ্য্য অর্থাৎ অনাড়ী। যখন বেদে এইরূপ উক্তি আছে, তখন কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিদেশীয়দিগের কপোল-কল্পনা কখনও বিশ্বাস করিতে পারেন না। আর্য্যাবর্ত দেশীয় অর্জুন ও মহারাজা দশরথ প্রভৃতি হিমালয় পর্ববতে আর্য্যদিগের সহিত দস্থ্যু, সেচ্ছ, এবং অসুরদিগের যে যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে দেব অর্থাৎ আর্য্যদিগের রক্ষা এবং অনুরদিগের পরাজয় করিতে সহায়ক হইয়াছিলেন।

এতদ্বারা ইহাই সিদ্ধ হইতেছে যে, আর্যাবর্ভের বাহিরে চতুৰ্দ্দিকে অর্থাৎ হিমালয়ের পূর্ব্বে, অগ্নিকোণে, দক্ষিণে, নৈব্ব কোণে, পশ্চিমে, বায়ুকোণে, উত্তরে এবং ঈশানকোণের দেশ সমূহে যে সকল মনুষ্য বাস করিত, তাহাদেরই নাম অসুর। কারণ যখনই হিমালয় প্রদেশ মার্যাদিগের উপর যুদ্ধার্থ আক্রমণ হইত, তখনই রাজা মহারাজা ঐ সকল উত্তরাঞ্চল প্রভৃতি স্থানে আর্য্যদিগের সহায়তা করিতেন। শ্রীরামচন্দ্রের সহিত দক্ষিণদেশে যে যুদ্ধ হইয়াছিল রাম-রাবণ অথবা আর্য্য-রাক্ষস সংগ্রাম। তাহার নাম দেবাসুর সংগ্রাম নহে, কিন্তু কোন সংস্কৃতগ্রন্থে বা ইতিহাসে এইরূপ লিখিত নাই যে, আর্য্যগণ ইরান হইতে আসিয়াছিলেন এদেশীর বন্য মনুষ্যদিগকে পরাজিত করিয়া এদেশের রাজা হইয়াছিলেন। তাহা হইলে বিদেশীদিগের লেখা কিরূপে গ্রাহ্য হইতে পারে ? আর-

মেচ্ছবাচশ্চাৰ্যবাচ: সর্ব্বে  তে দস্যবঃ স্মৃতাঃ ॥১॥ মনু• ১০।৪৫
ম্লেচ্ছ দেশস্ত্বতঃ পরঃ || | মনু ( ২ ॥ ২৩) ॥

আর্য্যাবর্ত্ত ভিন্ন অন্য দেশকে দস্যুদেশ এবং ম্লেচ্ছদেশ বলে, এর দ্বারা সিদ্ধ হয় যে, আর্য্যাবর্ত্তের বাহিরে পুর্ব্বদেশ, ঈশান, উত্তর, বায়ব্য এবং পশ্চিম দেশবাসীদিগের দস্যু, ম্লেচ্ছ ও অসুর এবং নৈর্ঋত্য, দক্ষিণ এবং অগ্নের দিকে
আয্যাবর্তবহির্ভূত দেশবাসীদিগের নাম রাক্ষস ছিল। এখনও নিগ্রোদিগের যেরূপ রাক্ষসদের আছে, তদ্রূপ ভয়ঙ্কর দেখায়।

আর্য্যাবর্ত্তের ঠিক নিম্নদেশের অধিবাসীদিগের নাগ। আৰ্য্যাবর্ষবাসী পদতলে অবস্থিত সেই দেশের নাম পাতাল ছিল। নাগবংশীয় নাগনামা লোকদিগের লোকেরা দেশে রাজত্ব করিতেন। এখানেরই নাগরাজকন্যা সহিত অর্জুনের হইয়াছিল। ইক্ষাকু কৌরব-পাণ্ডবের পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীতে আর্য্যদিগের ছিল আর্য্যাবর্ত্ত অন্যান্য দেশেও বেদের অল্পবিস্তর ছিল।
 বিষয়ে এই যে, ব্রহ্মার পুত্র বিরাট, বিরাটের মনু, মনুর মরীচি প্রভৃতি পুত্রের স্বায়ত্তব প্রমুখ সাতজন রাজা ছিলেন। তাঁহাদিগের সন্তান ইক্ষাকু আর্যাবর্ষের রাজা ছিলেন। তিনি আৰ্য্যাবর্তে স্থাপন করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ আর্য্যদিগের আলস্ত, প্রমাদ পারস্পরিক বিরোধ এখন অন্যান্য দেশে রাজত্ব করা ত দূরে থাকুক, আর্যাবর্ষেও তাহাদিগের অখও, স্বতন্ত্র, এবং নির্ভয় রাজ্য নাই। মহর্ষি জী আমাদের দেশ নিয়ে আরো বলেন যে  যাহা কিছু আছে, তাহাও বিদেশীয়দিগের পদানত হইতেছে। অল্প কয়েকজন মাত্র রাজা স্বতন্ত্র আছেন। দুর্দিন উপস্থিত হইলে দেশবাসীদিগকে অনেক প্রকার দুঃখ ভোগ করিতে হয়। যিনি যতই করুন না কেন স্বদেশীয় রাজাই সর্বশ্রেষ্ঠ। বিদেশীয় শাসন মতমতান্তরে আগ্রহরহিত, নিঙ্গের ও পরের প্রতি পক্ষপাতশূক্ত এবং প্রহাদিগের প্রতি মাতাপিতার হ্যায় দয়ালু, কৃপালু ও ন্যায়পরায়ণ হইলেও সম্পূর্ণ সুখকর হয় না। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, পৃথক পৃথক শিক্ষা ও আচারব্যবহার সম্বন্ধীয় বিরোধ দূর হওয়া অতীব দুস্কর। তাহা দূর না হইলে পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ উপকার ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়া কঠিন। সুতরাং বেদাদি শাস্ত্রে এবং ইতিহাসে যে সকল ব্যবস্থার উল্লেখ আছে, সেই সকল মান্য করা সৎপুরুষ দিগের কর্ত্তব্য।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে হিমালয় হল ভঙ্গিল পর্বত। হাজার হাজার বছরে এতে নানা ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও বিপর্যয় ঘটেছে। তাই প্রাচীণ বর্ণনা অনুসারে বর্তমানের স্থান চিহ্নিত করা কঠিন কাজ।

আর্য্যাবর্ত্ত

ভূমন্ডল এক বিশাল পদ্মের মতন। তার সাতটি দ্বীপের ১মটি জম্মু দ্বীপ। এই দ্বীপে ৯টি বর্ষ আছে। ইলাবৃতবর্ষ আছে মাঝের দিকে। তার মাঝে কুলপর্বতের রাজা সুমেরু পর্বত। ইলাবৃতের উত্তরদিক থেকে ক্রমে নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান এই তিন পর্বত রম্যক, হিরন্ময় ও সীমা। ইলাবৃতের দক্ষিণে নিষধ, হেমকূট ও হিমালয় এই তিন পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত পর্বত যথাক্রমে হরিবর্ষ, কিম্পুরুষবর্ষ ও ভারতবর্ষের সীমা। ইলাবৃতের পূর্বে ও পশ্চিমে মাল্যবান ও গন্ধমাদন পর্বত। এরা হল কেতুমাল ও ভদ্রাশ্ব বর্ষের সীমান্ত পর্বত। -ভাগবত পঞ্চম স্কন্ধ, ১৬তম অধ্যায়।

মহাভারতে বর্ণনানুযায়ীঃ

হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত ও সর্বধাতুসম্পন্ন শৃঙ্গবান এই ছয় পর্বত একাকার। এসকল পর্বত পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। তন্মধ্যে নানা জনপদ প্রতিষ্ঠিত।

হিমালয়ের উত্তরে হৈমববর্ষ এবং হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। নীল পর্বতের দক্ষিণে এবং নিষধ গিরির উত্তরে মাল্যবান পর্বত। সুমেরু গিরি নীল ও নিষধ পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। লোকসমূদয় উহার উর্দ্ধ, অধঃ ও পার্শ্বপ্রদেশে অবস্থান করে। ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্মু ও উত্তরকুরু; এই চারটি দ্বীপ এর পার্শ্বদেশে অবস্থিত। হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে হৈমববর্ষ। হেমকূট পর্বতের উত্তরে হরিবর্ষ, নিষধ পর্বতের উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ, নীল পর্বতের উত্তরে শ্বেতবর্ষ, শ্বেত পর্বতের উত্তরে হৈরণ্যক বর্ষ। তারপর ঐরাববর্ষ। এই সাতটি বর্ষ ধনুকাকারে অবস্থিত। - ভীষ্ম পর্ব

ভাগবত ও মহাভারতের উপরে বর্ণিত তথ্য এবং সেখানে উল্লিখিত আরও তথ্য থেকে জানা যায়:-

* হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান পর্বত একাকার। অর্থাৎ এরা আসলে বৃহত্তর হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত। এইবর্ষগুলি ভারত, চীন ও আফগানিস্তানের অন্তর্গত। কখনই মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া বা সাইবেরিয়া নয়। বলা আছে এই সাতটি বর্ষ ধনুকাকারে অবস্থিত পর্বতগুলির মধ্যে মধ্যে নানা জনপদ অবস্থিত।

*সুমেরু-র শিখর থেকে ভাগিরথী নিপতিত হচ্ছে। অর্থাৎ গঙ্গোত্রী হিমবাহ হল সুমেরু পর্বতে। এই সুমেরু বর্তমানের সুমেরু (north pole) নয়।

*সুমেরুর দক্ষিণে অবস্থিত কৈলাস।

* সুমেরুর চূড়ায় আছে ব্রহ্মাপুরী। অলকানন্দা ব্রহ্মার পুরী থেকে দক্ষিণ দিকে গিয়ে হেমকূট এবং হেমকূট ভেদ করে ভারতবর্ষে পতিত হচ্ছে।

* শৃঙ্গবানের উত্তরদিকে আছে সাগরপাড়ে ঐরাবতবর্ষ। এখানে দিবাকর উত্তাপ প্রদান করে না। এই সাগর পারে ঐরাববর্ষ বহুদুরে রাশিয়াতে হতে পারে। তবে ভারতের পৌরাণিক কাহিনীতে কোথাও ঐরাববর্ষ নিয়ে বিশেষ কাহিনী নেই। e

* বিষ্ণুপুরাণ বলছে সুমেরুর উত্তরদিকের পর্বতগুলি (নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান) বরফ পর্বত নামে খ্যাত। বোঝা যাচ্ছে সুমেরুর দক্ষিণের পর্বতগুলিতে সারা বছর বরফ থাকে না। অর্থাৎ এগুলি শিবালিক রেঞ্জ এর অন্তর্গত।

* সুমেরুর চারিদিকে মানস ইত্যাদি চার সরোবর আছে। বর্তমানে মানস সরোবরের অবস্থান থেকে আমরা সুমেরুর অবস্থান টের পাচ্ছি।

গঙ্গোত্রী হিমবাহকে ঘিরে ছিল ব্রহ্মা এবং রুদ্র, শিব বা মহেশ্বর তিন দেবতার আবাসস্থল। ব্রহ্মাতীর্থের উত্তরে গঙ্গোত্রী। গঙ্গোত্রী হিমবাহের দক্ষিণে সুমেরু ও আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে কেদারনাথ বা মহেশ্বর তীর্থ। আর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বিষ্ণুস্থান, বদ্রীনাথ বা বদরিকাস্থান। কিন্তু এরূপ বিস্তার পরবর্তীকালে হয়। প্রথমে সুমেরু অঞ্চলের নিকটে অবস্থান করলেও বিষ্ণুলোক পরবর্তীকালে চলে যায় শ্বেত বর্ষে। শিব চলে যান তিব্বত অঞ্চলে।হিমালয়ের শৈলশ্রেণীতে শুধু দেবতারা নন, একই ভূখন্ডে বাস করত যক্ষ, রক্ষ, দৈত্য-দানবরাও। 

বিষ্ণুপুরাণে বলা আছে –

‘গন্ধর্ব- যক্ষ – রক্ষাংসি তথা দৈতেয় দানবাঃ। 

ক্রীড়ন্তি তাসু রম্যাসু শৈলদ্ৰোণীষ্বহর্ণিশম্ ।।    

বিষ্ণুপুরাণ মতে এসকল স্থান ভৌম স্বর্গ বা পৃথিবীর স্বর্গ বলে চিহ্নিত।

‘ভৌমা হোতে স্মৃতাঃ স্বৰ্গী ধর্মিণামালয়া মুনে'। 

উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তার ‘পঞ্চকেদার' গ্রন্থে বলেছেন –

‘হিমালয়ের স্থাণীয় অধিবাসীরা বদ্রীনাথ চৌখাম্বাকেই সুমেরু পর্বত বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। চৌখাম্বা ও সুমেরু উত্তর কাশী জেলার অন্তর্ভুক্ত। মানচিত্রে সুমেরুপবত কেদারনাথের উত্তর-পূর্বে এবং গঙ্গোত্রী হিমবাহের দক্ষিণ দিকে চিহ্নিত। কেদারনাথের পূর্বে বদ্রীনাথ ও তারই সামান্য উত্তর-পূর্বে নন্দনকানন'।

মন্দাকিনী বিধৌত কেদার মন্দিরের পশ্চাৎবর্তী তুষার প্রাচীরটিকে অনেকে সুমেরু পর্বত বলে মনে করেন। কেদার ও বদ্রী অঞ্চলটি অনেক কাল আগে সংযুক্ত ও নিকটবর্তী ছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এদুটি স্থান পৃথক ও দূর হয়ে যায়। সুমেরু অঞ্চল বলতে তাই চৌখাম্বা চত্বরসহ এই দুই অঞ্চলকে বোঝায়।

“হিমালয়ের স্থাণীয় অধিবাসীরা বদ্রীনাথ চৌখাম্বাকেই সুমেরু পর্বত বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। চৌখাম্বা ও সুমেরু উত্তর কাশী জেলার অন্তর্ভুক্ত। মানচিত্রে সুমেরু পর্বত কেদারনাথের উত্তর-পূর্বে এবং গঙ্গোত্রী হিমবাহের দক্ষিণ দিকে চিহ্নিত। কেদারনাথের পূর্বে বদ্রীনাথ ও তারই সামান্য উত্তর-পূর্বে নন্দনকানন’ ।

বর্তমানে যোশীমঠ ( ৬২০০ ফুট) থেকে ঘুরে ঘুরে নামতে হয় বিষ্ণুপ্রয়াগে (৪৫০০ ফুট)। অলকাপুরী থেকে অলকানন্দা নেমে এসে মিলিত হয়েছে ধৌলিগঙ্গার সাথে। বিষ্ণুপ্রয়াগ থেকে গোবিন্দঘাট পুরো পথটাই পার্বত্য ধ্বস বহুল। - গোবিন্দঘাট থেকে মাইল দু এক চড়াই উঠলে পান্ডব পিতা পান্ডুরাজার নামাঙ্কিত স্থান পান্ডুকেশ্বর (৬৪৫০ ফুট)। এখান থেকে বদ্রীনাথ ১৫ মাইল। পান্ডুকেশ্বর থেকে সন্নিকটাঞ্চল ( বর্তমানে মোটরে যাওয়া যায়) হনুমানচটী – ভীম দ্রৌপদীর জন্য পারিজাত আনতে এলে এখানে হনুমানের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হন। হনুমান ভীমকে এর পরবর্তী অঞ্চল ‘দেবলোক’ বলে চিহ্নিত করে যেতে নিষেধ করেন।

হনুমানচটীর পর বদ্রীনাথ ধাম। তার পরে মানাগ্রাম। এরপর লক্ষীবন, চক্ৰতীৰ্থ, অলকাপুরী ইত্যাদি ।

মানাগ্রাম---------১২ কিমি-----লক্ষীবন-----দেড় কিমি---বানধার---৮ কিমি--চক্রতীর্থ---৫ কিমি--সতোপস্থতাল

১। চৌখাম্বা পর্বতশৃঙ্গ, ২। ভাগিরথী-খরাক হিমবাহ, ৩। সতোপন্থ তাল, ৪। সতোপন্থ হিমবাহ, ৫। শস্ত্রধারা, ৬। বানধারা, ৭। লক্ষীবন, ৮। চক্ৰতীৰ্থ, ৯। অলকানন্দা, ১০। অলকাপুরী, ১১। বসুধারা, ১২। পশ্চিমী কামেট হিমবাহ, ১৩। সরস্বতী নদী, ১৪। মানাগ্রাম, ১৫। অলকানন্দা, ১৬। যোশীমঠ, ১৭। বদ্রীনাথ, ১৮। কুবের পর্বত শৃঙ্গ, ১৯। নীলকন্ঠ পর্বত শৃঙ্গ

পান্ডবদের স্বর্গারোহণের কাহিনী এ অঞ্চলে প্রচলিত। ‘সতোপন্থ’ কথার অর্থ ‘স্বর্গের রাস্তা’ । এটি বদ্রীনাথ থেকে ৩০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে। লক্ষীবন = দ্রৌপদীর পতন হয়। বানধারা = অর্জুনের বানে জলের উৎসমুখ খুলে যায় ভীমবার = ভীমের পতন হয়। অলকানন্দ পেরিয়ে দেড় কিমি দূরে। শস্ত্রধারা = অর্জুন কর্তৃক পাশুপাত অস্ত্র ত্যাগ ও পোষাক ত্যাগ এবং নিকটেই পতন।

পুরাণানুযায়ী যদি আর্য ও আর্য্যবর্ত্ত বিষয়ে দেখি তাহলে মৎস পুরাণ অনুযায়ী সূর্য্যবংশীয় ইক্ষ্বাকু রাজার পুত্রগণ মেরু পর্ব্বতের উত্তরে ও দক্ষিণে রাজ্যত্ব করেতেন। বিষ্ণুপুরাণের বর্ণনানুসারে প্রতিপন্ন হয় যে, আধুনিক বোখারা দেশস্থ উন্নত পর্ব্বতই পৌরাণিক "সুমেরু পর্ব্বত"। ভূগ্রভ হইতে প্রাপ্ত তাম্রফলক দ্বারা প্রতিপন্ন হইয়াছে, যে জেনিসি নদীর তীরস্থ কৃষ্ণজর্স্কনগরে ইক্ষ্বাকুবংশের রাজধানী ছিল। পুরাণ পুরী নামক সন্নাসী আসিয়া ব্রহ্মদেশ হইতে ইউরোপীয় রুসিয়ার মস্কো নগর পর্য্যন্ত ভ্রমণ করেন। তিনি লিখিয়াছেন যে, "তুরস্ক" দেশের বসোরা নগরে "কল্যাণ রাও" ও গোবিন্দ রাও" নামক দুই দেবমূর্ত্তি আছে। "পারস্য" দেশের হিঙ্গুলাজ নগরে, "তাতার" দেশের বাখ নগরে, আসিরিক রুসিয়ার আষ্ট্রাকান নগরে, এবং জাবা-দ্বীপ, বালিদ্বীপ ও খরক উপদ্বীপে বহুতর আর্যগণ বাস করিতেন। 

রোম দেশীয় পণ্ডিত স্ত্রাবো ও ডাইরো লেখেন, যে খ্রীষ্টাব্দের ২০ বৎসর পূর্ব্বে পণ্ডিয়ন রাজা রোমীয় সম্রাট আগষ্টস সীজরের নিকট যে দূত প্রেরণ করেন, তাহার মধ্যে এক জনের নাম “খড়্গ শম্মা” ।

১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডের কোন স্থানে মৃত্তিকা মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত যে তাম্রফলক পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে প্রতিপন্ন হয় যে, খ্রীষ্টাব্দের ২২০০ বাইশ শত বৎসর পূর্ব্বে হিন্দুজাতি ইউরোপে বাণিজ্য করিতে যাইতেন। ঐ তাম্রফলক এক্ষণে ইংলণ্ডের চিত্রশালিকায় আছে । বিশ্ব-ইতিহাস-লেখক টাইটেলার এবং প্রসিদ্ধ ফরাসি পণ্ডিত মনসেয়ার বেলী লেখেন যে, আফরিকা মহাদেশস্থ ঈজিপ্ট ও কালডিয়া দেশে যে যে বিদ্যা প্রচলিত আছে, ভারতবর্ষই তাহার বিদ্যালয়স্বরূপ।

পুরানে বর্ণিত আছে যে, বলিরাজা ও পুরুবংশীয় কোন কোন রাজা পাতালে বাস করিতেন। মহাভারতের বর্ণনা এই যে, ভীমসেন পাতালে গমন করেন। বর্তমান সময়ের প্রচলিত ভূগোল-শাস্ত্রে নির্দিষ্ট হইতেছে যে, আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণ অংশে দুইটী প্রদেশের নাম পুরুভিয়া ও বলিভিয়া। তথাকার অধিবাসীরা আচার ব্যবহারাদি বিষয়ে অনেকাংশে হিন্দু সম্প্রদায় সদৃশ। তাহারা অদ্যাপি রাম-সীতার পূজা করিয়া থাকে ।

সংস্কৃত ভাষায় “পাত” শব্দের একটী অর্থ- উর্দ্ধাধভাবে অবস্থিত। ব্যাকরণের যে সূত্রানুসারে বাচ্ শব্দ হইতে “বাচাল” শব্দ সিদ্ধ হয়, সেই সূত্র অনুসারে “পাত” শব্দ ( হইতে “পাতাল” শব্দ সিদ্ধ হইতে পারে।

পৌরাণিক বর্ণনা, পাতাল শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং আমেরিকার প্রচলিত ভুগোল বৃত্তান্ত একত্র অনুধাবন করিতে গেলে, ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে আধুনিক আমেরিকা নামক স্থানই পূৰ্ব্বকালে “পাতাল” শব্দে নির্দিষ্ট হইয়াছিল; এবং সংস্কৃত “পুরুভূমি” শব্দের অপভ্রংশে পুরুভিয়া ও “বলিভূমি” শব্দের অপভ্রংশে বলিভিয়া শব্দ উৎ পন্ন হইয়াছে। ফলতঃ যে হিন্দু গোষ্টি জ্যোতিঃশাস্ত্রে পৃথিবীকে কদম্বকুসুমাকার পদার্থ বলিয়া নির্ণয় করিয়াছেন, আমেরিকাই যে তাঁহাদিগের পাতাল, তদ্বিষয়ে সন্দেহের কারণই নাই।

আদিম কালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা চরম জ্ঞানী, চরম 'ধার্ম্মিক এবং প্রায় চরম সভ্য হইয়াছিলেন। অদ্বিতীয় তীক্ষ্নবুদ্ধি ও অদ্বিতীয় আধ্যাত্মিক তত্ত্বালোচনার পরিচায়ক বেদশাস্ত্র, উপনিষৎ শাস্ত্র এবং দর্শন শাস্ত্র সকল তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ ।

মানববুদ্ধির অদ্বিতীয় গৌরবের সামগ্রী, সারবান্ প্রকৃত “ব্রাহ্মধর্ম্ম” হিন্দু সভ্যতার জ্ঞানচর্চ্চা হইতে সমদ্ভূত। হিন্দু (আর্য) কেবল ব্রাহ্মধর্ম্মের সৃষ্টি করিয়াই ক্ষান্ত হয়েন নাই। তাঁহারা অপরিত্যজ্যবৎ, সংসারের মায়া পরিত্যাগ করিয়া সহাস্যবদনে কৌপীন ধারণ পূর্ব্বক বনবাস-আশ্রয় করিতেন ; সমুদ্রবৎ বিস্তৃত হিন্দুশাস্ত্র (বৈদিকশাস্ত্র) সকল তাহা উচ্চৈঃস্বরে ব্যক্ত করিতেছে।

শাস্ত্রে প্রমাণিত হইতেছে যে, সভ্যতাসাধনের উপকরণ স্বরূপ ব্যোমযান, দূরবীক্ষণ, গ্লোব, ঘটিকা, তাপমান, বায়ুমান এবং দিদর্শন যন্ত্র প্রথমে হিন্দরা (আর্য) সৃষ্টি করিয়া ছিলেন। তীক্ষ্ণ, বুদ্ধি, কুসংস্কার-রহিত জ্ঞান, মাজ্জিত ধর্ম্ম এবং পরিশুদ্ধরূপ কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প কাৰ্য্যই প্রকৃত সভ্যতা নামক পদার্থের উপাদান। জ্ঞানচক্ষে অবলোকন করিলে আদিম হিন্দু (arya) দের সকলেরই বিদ্যমানতা দেখা যায়। কালে সকল পদার্থেরই লয় হয়। তদনুসারে আর্য্যদের উল্লিখিত উচ্চতম অবস্থা যুগে যুগে হ্রাস প্রাপ্ত হইয়া পরিশেষে বর্ত্তমান কলিযুগে যবনাদি জাতির অত্যাচারে হিন্দু নামে অভিহিত হয়ে লোপ প্রাপ্ত হয়।

পদার্থ সাত প্রকার। যথা দ্রব্য, গুণ, কর্ম্ম, সামান্য, সমবায় ও অভাব। "সামান্য" পদার্থেরই নামান্তর "জাতি" পদার্থ। জাতির লক্ষণ এই,---------

"নিত্য অনেক-সমবেতা জাতিঃ।"-যে পদার্থ নিত্য অর্থাৎ মহাপ্রলয় পর্যন্ত্য স্থায়ী, এবং যাহা-অনেক সংখ্যক পদার্থে সমবেত অর্থাৎ- যাহা এক কালে একাধিক পদার্থকে বুঝায়, তাহার নাম "জাতি"

"দ্রব্যং গুণাস্তথা কর্ম্ম সামন্যাং সবিশেষকং।

সমবায়স্তথাভাবঃ পরার্থাঃ সপ্ত কীর্ত্তিতাঃ।।[বৈশেষিক দর্শন]


• সংস্কৃত ভাষায় উল্লিখিত “শিল্প সংহিতা” এবং “সূর্য্য সিদ্ধান্ত গ্রন্থে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এখন দেখাযাক ধর্ম্ম কি

"লোকে প্রেত্য বা বিহিতো ধর্ম্মঃ।।"
(বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ১/৪)ভাবার্থঃ-- বেদ বিহিত কর্মই ধর্ম্ম।

সাধারণ অর্থে আমরা ইংরেজি শব্দ Religion-কে ধর্ম মনে করি, কিন্তু আসলেই কি তাই?
না। ইংরেজি শব্দের Religion-এর অর্থ বিশ্বাস , সম্প্রদায় কিন্তু ধর্ম শুধু বিশ্বাসের উপর আধারিত নয়।রিলিজিয়ন শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি religion থেকে । বিশ্বাস ধর্মের সামান্য একটি অংশ মাত্র। আসলে ধর্ম মানে কি?
বৈশেষিক দর্শনে মহর্ষি কণাদের ভাষায়ঃ
‘য়তো অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্ম’
বৈশেষিক দর্শন ১ম অধ্যায়, ১ম আহ্নিক, ২য় সূত্র
অর্থাৎ যা দ্বারা যথার্থ উন্নতি এবং পরম কল্যাণ লাভ হয় তাই ধর্ম।

আহারনিদ্রাভয়মৈথুনঞ্চ

সামান্যমেতৎ পশুভির্নরানাম্ ।

ধর্ম্মোহি তেষামধিকো বিশেষো

ধর্ম্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ ॥

অর্থাৎ, ধর্ম্মহীন ব্যক্তি পশুর সমান


"যা বেদবিহিত তাই ধর্ম আর যা বেদনিষিদ্ধ তাই অধর্ম ।
বেদ স্বয়ং ভগবানের স্বরূপ..................."- শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ৬/১/৪০ শ্লোক (গীতাপ্রেস ভাষ্য)

धारणात् धर्म इत्याहुः धर्मों धारयति प्रजाः।
यः स्यात् धारणसंयुक्तः स धर्म इति निश्चयः।।
ধারণাত্ ধর্ম ইত্যাহুঃ ধর্মো ধারয়তি প্রজাঃ।
যঃ স্যাত্ ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চযঃ।।
কর্ণপর্ব ৬৯।৫৮, মহাভারত  ১২.১১০.১১

অর্থাৎঃ সমাজকে, প্রজা সাধারণকে ধারণ করে রাখে যা তাই ধর্ম্ম, ইহা এমন এক সদাচার যা ধারণ করলে আত্মার উন্নতি ও মোক্ষ প্রাপ্তির পথ সুগম হয় ও সমাজ ব্যবস্থা ঠিক থাকে। সমাজের সমৃদ্ধি, কল্যাণ হয়, তাই বিচার করে সেটিই ধর্ম্ম, তাই স্থির করতে হয়। ধর্ম প্রজাদিগকে ধারন করে, যা প্রজাকে ধারনকরে একসূত্রে বেঁধে রাখে তা অবশ্যই ধর্ম্ম...অর্থাৎ যা থেকে জাগতিক কল্যাণ ও মোক্ষলাভ হয় তাহাই ধর্ম।অর্থাৎ যে যে ব্যবহারে নিজের ও অন্যের হানি হয় তাহাকে অধর্ম এবং যে যে ব্যবহারে নিজের ও অন্যের উপকার হয় তাহাকে ধর্ম বলে।
ধর্ম শব্দটি আসে সংস্কৃত √ধৃ হতে। এই √ধৃ -এর অর্থ 'ধারণ'। 'একজন ব্যক্তি তার জীবনে তার যত প্রকার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে সব মিলিয়ে হয় তার ধর্ম।' তার বিশ্বাস, তার পরম্পরাগত শিক্ষা, তারা আচার ব্যবহার ইত্যাদি এই সবই তার ধর্ম। যেভাবে আগুনের ধর্ম দহন করা, জলের ধর্ম শীতলতা, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম হয় মনুষত্ব। কিন্তু শাস্ত্র বলে মানুষ উচ্চমার্গীয় একটি জীব এবং এই উচ্চমার্গীয় জীবকে নির্ণয়ের জন্য মনুস্মৃতি বা (মনুষ্যের বিধি বিধান সম্বলিত গ্রন্থ)লেখা হয়েছে। স্মৃতিশাস্ত্রে ধর্ম্ম বলতে সদ্ গুণাবলীকে বোঝানো হয়েছে, মহর্ষি মনু বলেছেন।
এই গ্রন্থ অনুসারে মনুষ্য ধর্ম বিবেচিত হবে দশটি গুণ এর মাধ্যমে, যে দশটি গুণের উপস্থিতি তাদেরকে মনুষ্য প্রমাণ করবে। যথা-
धृति: क्षमा दमोऽस्तेयं शौचमिन्द्रियनिग्रह:। 
धीर्विद्या सत्यमक्रोधो दशकं धर्मलक्षणम् ॥ मनु स्मृति 6/92
ধৃতিঃ ক্ষমা দমোSস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্।।-[মনুস্মৃতি ৬/৯২]

পদার্থ-( ধৃতি) কষ্ট অথবা বিপত্তিতে খুব ধৌর্য ধারণ রাখা আর দুঃখে এবং বিচলিত না হয়ে তথা ধর্ম পালনে কষ্ট আসার পরও ধৌর্য রেখে পালন করে দেখান,দুঃখি অথবা বিচলিত হয়েও ধর্মকে ত্যাগ না করা,( ক্ষমা) ধর্ম পালনের জন্য নিন্দা-স্তুতি,মান-অপমানকে সহন করা ( দমঃ) ঈর্ষা,লোভ মোহ,শত্রুতা আদি অধর্ম রূপ সংকল্প অথবা বিচার হইতে মনকে বশ করে রাথা, ( অস্তেযম্) চুরি, ডাকাতি মিথ্যা,ছল-কপট ভ্রষ্টারচার,অন্যায় অধর্মাচরণ হইতে কারো বস্তু ধন আদি না নিতে,( শোচম্) দেহ আর মনকে পবিত্রতা রাখা,( ইন্দ্রিয়নিগ্রহঃ) ইন্দ্রিয়কে নিজ-নিজ বিষয়ে অধর্ম আর পতন হইতে থামিয়ে রাখা, (ধীঃ) বুদ্ধিকে উন্নতি করে,মননশীল হয়ে বুদ্ধিবর্ধক উপায় করা আর বুদ্ধিনাশক নেশা আদি না করা,( বিদ্যা) সত্যবিদ্যা কে ব্যায় করে অধিকাধিক যত্ন করে বিদ্যা আর জ্ঞানকে উন্নতি করা,(সত্যম্) মন,বচন,কর্ম হতে সত্য মেনে সত্যভাষণ ও সত্যাচরণ করা,আত্মবিরুদ্ধ মিথ্যাচরণ না করা, ( অক্রোধঃ) ক্রধের ব্যবহার আর বিনিময় এর ভাবনাকে ত্যাগ করে শান্তি আদি গুণকে ধারণ করা, (দশক ধর্মলক্ষণম্) এই দশ ধর্মের লক্ষণ। ওই গুণ হতে ধর্মপালন এর শনাক্তকরণ হয় আর ওই মনুষ্যগণ ধার্মিক হয় এর লক্ষিত-সিদ্ধ কর। এই ধর্মের সর্বসামান্য লক্ষণ হয়।।
অর্থাৎ, ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ- এই দশটি ধর্ম্মের লক্ষণ।
১। ধৃতি- সর্বদা ধৈর্য অবলম্বন করা;(ধারণা করা স্মরণ রাখিবার শক্তি।)

২। ক্ষমা- নিন্দা-স্তুতি, মান-অপমান এবং হানি-লাভাদি দুঃখের মধ্যেও সহিষ্ণু থাকা;(কেহ অপকার করিলে যে তাহার প্রত্যপকারে প্রবৃত্তি হয়,সেই প্রবৃত্তিকে যে শক্তি দ্বারা নিরোধ করা যায়।)

৩। দম- মনকে সর্বদা ধর্মে রত এবং অধর্ম হইতে বিরত রাখা;(শোক,তাপাদি দ্বারা কোন প্রকার চিত্তবিকৃতি উপস্থিতি হইলে,যে শক্তি দ্বারা ঐ প্রবৃত্তির নিরোধ করা যায়।)

৪। অস্তেয়- চৌর্য পরিত্যাগ করা অর্থাৎ অনুমতি ব্যতীত ছল, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা বা বেদবিরুদ্ধ উপদেশ দ্বারা পরপদার্থ গ্রহণ না করা;(অবিধি পূর্ব্বক পরস্ব গ্রহণের প্রবৃত্তিকে যে শক্তি দ্বারা নিরূদ্ধ করা যায়।)

৫। শৌচ- রাগ, দ্বেষ ও পক্ষপাত পরিত্যাগ করিয়া জল, মৃত্তিকা মার্জনাদি দ্বারা শরীর ও মনের পবিত্রতা রক্ষা করা;(শরীর ও চিত্তের নির্ম্মলভাব।)

৬। ইন্দ্রিয়নিগ্রহ- ইন্দ্রিয়সমূহকে অধর্মাচরণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া সর্বদা ধর্মপথে পরিচালনা করা;(যে শক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে বিষয় হইতে নিরুদ্ধ করা যায়।)

৭। ধী- মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য বুদ্ধিনাশক পদার্থ, কুসংসর্গ, আলস্য এবং প্রমাদ প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট পদার্থ সেবন এবং সৎসঙ্গ ও যোগাভ্যাস দ্বারা বুদ্ধির উন্নতি সাধন;(শাস্ত্রাদি দ্বারা বস্তুর তত্ত্ব নিশ্চয় শক্তি-ধীশক্তি)।

৮। বিদ্যা- পৃথিবী হইতে পরমেশ্বর পর্যন্ত(যাবতীয় পদার্থের) যথার্থ জ্ঞান অর্জন ও পদার্থসমূহের দ্বারা যথোচিত প্রয়োজনের সিদ্ধি এবং মন, বাক্য ও কর্ম দ্বারা আত্মানুরূপ আচরণ করা;(
যে শক্তি দ্বারা অন্তরস্থ চৈতন্য স্বরূপ পরমাত্মার আন্তরিক প্রত্যক্ষ করা যায়,শরীরাদি হইতে আপনাকে পৃথকরূপে জানা যায়, যে শক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়,মন,বুদ্ধি অভিমান প্রভৃতি অন্তরস্থ পদার্থ সকল আম্র ও কাঁঠালের রসাস্বাদের ন্যায় পৃথক্ পৃথক্ রূপে জাজ্জল্যমান মানসিক প্রত্যক্ষ করিতে পারে।)
৯। সত্য- কায়, মন ও বাক্য দ্বারা যথার্থ আচরণ করা অর্থাৎ যে পদার্থ যেরূপ তাহাকে সেইরূপ মনে করা, সেইরূপ বলা এবং সেইরূপ করা;
১০। অক্রোধ- ক্রোধাদি দোষ পরিত্যাগ করিয়া শান্তি প্রভৃতি গুণ গ্রহণ করা।
অতএব, ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বাণপ্রস্থী এবং সন্ন্যাসী সকলের উচিত যত্নসহকারে উপরোল্লিখিত দশ লক্ষণান্বিত ধর্ম পালন করা।(
যে শক্তি দ্বারা ক্রোধকে নিরুদ্ধ করা যায়
এই দশটি এবং বৈরাগ্য,ঔদাসীন্য,ভক্তি,শ্রদ্ধা,প্রেম,সন্তোষ প্রভৃতি কতকগুলি সৎগুণ। এতৎ সমস্তের মধ্যে আত্মবোধের ক্ষমাতাটিই সর্ব্বোচ্চ পরম ধর্ম্ম )
*কেহ কেহ ধৈর্য্যকেই ধৃতি বলিতে চাহেন, কিন্তু তাহা নিতান্ত ভ্রম। যে ধৈর্য্যকে তাঁহারা ধৃতি বলিতে চাহেন,সেই ধৈর্য্য পরোক্ত দম শক্তি ও ইন্দ্রিয় নিগ্রহাদি শক্তির মধ্যে অন্তর্নিহিত সুতরাং এখানে আবার ধৈর্য্য অর্থ করিলে মনুর পুনরুক্তি দোষ ঘটে।
এর মধ্যেই একজন ব্যক্তির মনুষত্ব প্রমাণিত হয়। এই ১০ লক্ষণ একটি পশুকেও মানুষ হিসেবে বিবেচিত করাতে পারে। যে ধর্মের অনুষ্ঠানে কুকার্য ও কলুষতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং সংসারে যেটি স্থিতির কারণ, তাই হিন্দুধর্ম। আমাদের যজুর্বেদের উপদেশ হল - মিত্রস্য চক্ষুয়া সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষাস্তাম্। মিত্রের চোখে সকলকে দেখবে, নিজের কল্যাণকে বড় করে দেখো না, ব্যষ্টির কল্যাণে সমষ্টির কল্যাণ, আবার সমষ্টির কল্যাণেই ব্যাষ্টির কল্যাণ। এ জগতে প্রত্যেকেই প্রিয়ব্যক্তি বা আপনজনের কল্যাণ চান, কিন্তু যশ্চ মাং ছেটি লোকেহস্মিন্ সোহপি ডানি পশ্যত্ব- -যে আমাকে হিংসা করে সেও তোমার মঙ্গলপদ দর্শন করুক, তার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হোক শত্রুর জন্যও এই যে মঙ্গল কামনা, এমন কোন ধর্ম শিক্ষা দিয়েছে আমার জানা নাই। ঐ বিশ্বমৈত্রী ও বিশ্বোদর ভাব ভাবনাই হিন্দু শব্দে ব্যঞ্জিত আছে। অন্যান্য ধর্ম মতবাদ, কিন্তু সনাতন হিন্দু ধর্ম হল জীবন, একে উপলব্ধি করতে হয় এবং সেই উপলব্ধি অনুসারে সমগ্র জীবনকে পরিচালিত করতে হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে- হিন্দু ধর্মের উপদেশ এবং উপলনি বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সারকথা হল, যারাই বস্তুর উপাসনা না করে চৈতন্যের উপাসনা করেন এবং প্রাত্যহিক দিনচর্যায় সর্বপ্রকার হীনতা, এবং হিংসাকে বর্জন করে চলেন, সেইসব সদ্ধর্মপালক ব্যক্তিরাই হিন্দুপদ বাচা। এই মহন অর্থেই আমরা হিন্দুনাম ব্যবহার করে আসছি।



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ