পুরুষ দুই প্রকার ঈশ্বর এবং জীব [সাংখ্য দর্শন ১।২৬]
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখাযা সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তযোরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যো অভি চাকশীতি।। [ঋগ্বেদ০১।১৬৪।২০]
ভাবার্থঃ-(দ্বা) ব্রহ্ম বা ঈশ্বর উভয়ে,(সুপর্ণা)চেতনা ইত্যাদি একইরকম গুণবিশিষ্ট,(সযুজা) ঈশ্বর সর্বব্যাপক বলে জীবের সাথে সবসময় সংযুক্ত,(সখাযা) ঈশ্বর ও জীব পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ,(সমানং) ঈশ্বর ও জীব উভয়ে সনাতন ও অনাদি,(বৃক্ষম) অনাদি প্রকৃতিরূপ বৃক্ষ বা গাছ অর্থাৎ এই জগৎ- সংসারে, ঈশ্বর ও জীব উভয়ে বসবাস করে,(তযোরন্যঃ)এই জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে, জীব এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পুণ্যরূপ ফলসমূহ(স্বাদ্বত্তি) উত্তমরূপে ভোগ করে,আর ঈশ্বর,কর্মফল (অনশ্নন্)ভোগ না করে চারদিকে অর্থাৎ অন্তর ও বাইরে সর্বত্র প্রকাশিত হয়ে আছেন। ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি ভিন্নধর্মী ও অনাদি।
শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ- যজুর্বেদ-40/8
অর্থ-জীব হল অনাদি ও সনাতন।
স পর্য়্যগাচ্ছুকমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবির্মণীষী পরিভুঃ স্বয়ম্ভূর্য়াথাতথ্যতোহথান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
যজু০-৪০।৮, ঈশোপনিষদ- ৮
ভাবার্থঃ- হে মনুষ্য! যে ব্রহ্ম ( শুক্রম্) শীঘ্রগামী, সর্বশক্তিমান (অকায়ম্) স্হূল, সূক্ষ্ম আর কারণ শরীর থেকে রহিত, (অব্রণম্) ছিদ্র রহিত এবং যাহা ছেদন যোগ্য নয় ( অস্নাবিরম্) নারী আদির বন্ধন থেকে রহিত, ( শুদ্ধম্) অবিদ্যা আদির দোষের হইতে রহিত হয়ে সদা পবিত্র,( অপাপবিদ্ধম্) যে কখনো পাপ হইতে যুক্ত, পাপকারী আর পাপ দ্বারা প্রেমকারী জয় না, সে ( পরি+অগাত্) সর্বত্র ব্যাপক; যে ( কবিঃ) সর্বজ্ঞ, ( মণীষী) সকল জীবের মনোবৃত্তিকে জানে, (পরিভূঃ) দুষ্ট পাপীদের তিরস্কারকারী, (স্বয়ম্ভূঃ) অনাদিস্বরূপ,যাহার সংযোগ থেকে উৎপত্তি আর বিয়োগ হইতে বিনাশ হয় না, যাহার মাতা-পিতা কেউ নেই আর যাহার গর্ভাবাস,জন্ম, বৃদ্ধি আর ক্ষয় হয় না,সে পরমাত্মা (শাশ্বতীভ্যঃ) সনাতন,অনাদি স্বরূপ, নিজের স্বররূপের দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি আর বিনাশ হইতে রহিত (সমাভ্যঃ) প্রজার জন্য ( য়াথাতভ্যতঃ) যথার্থ হইতে ( অর্থান্) বেদের দ্বারা সকল পদার্থের ( ব্যদধাত্) উত্তম প্রকারের উপদেশ করে। ( সঃ) সেই পরমাত্মাই তোমাদের জন্য উপাসনা করার যোগ্য।।
#ভাষ্যসার-পরমেশ্বর-কোথায়-যে ব্রহ্ম শীঘ্রগামী,সর্বশক্তিমান,স্হূল, সূক্ষ্ম, আর কারণ শরীর হইতে রহিত,ছিদ্র রহিত এবং অখণ্ড,নাড়ী আদির বন্ধন থেকে রহিত,অবিদ্যাদি দোষ হইতে রহিত হয়ে সদা পবিত্র অথবা যে কখনো পাপযুক্ত,পাপকারী আর পাপপ্রিয় হয় না। সে জন্ম,বৃদ্ধি আর ক্ষয় হইতে রহিত হয়। অনন্ত বলবান্, অজ,নিরন্তর, সদা মুক্ত, ন্যায়কারী, নির্মল,সর্বজ্ঞ,সবার সাক্ষী,নিয়ন্তা, অনাদি স্বরূপ ব্রহ্ম-সৃষ্টির আদিতে সনাতন, অনাদি স্বরূপ,নিজের স্বরূপ হইতে উৎপত্তি আর বিনাশ হইতে রহিত জীবের জন্য যথার্থ স্বরূপে বেদের দ্বারা সকল পদার্থের উপদেশ করে। যদি ব্রহ্ম স্বয়ং প্রোক্ত বেদের দ্বারা শব্দ, অর্থ সম্বন্ধর বিজ্ঞাপন বিদ্যার উপদেশ না করে তো কোনো মনুষ্য বিদ্বান্ হইতে পারে না আর না কোনো ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ স্বরূপ ফলক প্রাপ্ত করে। অতঃ সকল মনুষ্য মন্ত্রোক্ত ব্রহ্মকেই উপাসনা করা উচিত।।
অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং,বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং স্বরূপা।
আজো হ্যেকো জুযমাণোহনুশেতে, জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ।। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/5
অর্থ-প্রকৃতি,জীবাত্না এবং পরমাত্মা এই তিন অজ অর্থাৎ ইহাদের জন্ম হয় না ও চিরকাল বর্তমান।অনাদি জীব এই অনাদি প্রকৃতিকে,ভোগ করতে আসক্ত হয়।কিন্তু পরমাত্মা ইহাতে আসক্ত হন না এবং ভোগও করেন না।
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্ আত্নাস্য জন্তোরনিহিতো গুহায়াম।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্ননঃ।। কঠ উপনিষদ-1/2/20
অর্থ-পরমাত্না ও জীবাত্মা উভয়েই জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত।যিনি সব রকম জড় বাসনা ও শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন,তিনিই কেবল ভগবৎ কৃপায় আত্নার মহিমা বুঝতে পারেন।
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
মুন্ডক উপনিষদ-3/1/2
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ-4/7
অর্থ-দুটি পাখি (জীবাত্মা ও পরমাত্মা) একই গাছে (প্রকৃতি বা সংসাররূপ বৃক্ষ) বসে আছে,কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত,সে,গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা দুঃখ ভোগ করছে। কিন্তু সে যদি (জীবাত্মা) একবার তার নিত্যকালের বন্ধু,অপর পাখিটির (পরমাত্মা) দিকে ফিরে তাকায় (যোগযুক্ত হয়) তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়।
সুতরাং ইহাতে প্রমাণিত হয় যে,জীবাত্মা, পরমাত্মা ও প্রকৃতি হল অনাদি বা নিত্য।পরমাত্মা জীবাত্মা কে পাপ-পুণ্যের ফল হেতু শরীর ধারণ করিয়ে স্বয়ং সেই শরীরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকেন,কারণ তিনি সর্বব্যাপক। তাই জীব ব্রহ্ম হতে পারে না এবং মুক্তিতেও জীব ব্রহ্মতে লীন হয় না।
বৈশেষিক দর্শনে স্বীকৃত সাতটি পদার্থের মধ্যে দ্রব্য হলো প্রথম ভাবপদার্থ। সূত্রকার মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে দ্রব্যের লক্ষণ বর্ণনা করেছেন এভাবে-"ক্রিয়াগুণবৎ সমবায়িকারণমিতি দ্রব্যলক্ষণম্"[বৈশেষিক সূত্রঃ১।১।১৫]- অর্থাৎঃ যে পদার্থ ক্রিয়া বা গুণের আশ্রয় অথবা যা সমবায়ী কারণ হয় তাই দ্রব্য।
বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয় প্রকার। যথাঃ- ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি),মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিক, কাল, আত্মা এবং মন। এই নয়টি দ্রব্যের মধ্যে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম-কে ভূতদ্রব্য বা পঞ্চভূত এবং ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও মনকে মূর্তদ্রব্য বলা হয়। অর্থাৎ ন্যায়-বৈশেষিক মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারটি ভূতদ্রব্য ও বটে আবার মূর্তদ্রব্য ও বটে।
ৰালাগ্ৰশতভাগস্য শতধা কল্পিতত্স্য চ ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ সঃ চানন্ত্যায় কল্পতে ॥
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদঃ ৫/৯
পদার্থ : [ জীবের উপাধিবশতঃ অণুত্ব এবং স্বরূপতঃ বিভুত্ব প্রদর্শিত হইতেছে ] — ৰাল - অগ্র - শতভাগস্য ( একটি কেশাগ্রকে শতধা বিভক্ত করিয়া প্রতিখণ্ডকে ) শতধা কল্পিতস্য চ ( শতখণ্ডে বিভক্ত করিলে , [ তাহার যে ] ) ভাগঃ ( একটি অংশ [ হয় ] ) সঃ জীবঃ ( জীব সেই পরিমাণ বলিয়া ) বিজ্ঞেয়ঃ ( জানিবে ) ; সঃ চ ( সেই জীবই আবার ) আনন্ত্যায় ( অনন্ত পদের বাচ্য হইবার ) কল্পতে ( যোগ্য হয় ) ।
অনুবাদ : একটি কেশাগ্রকে শতভাগে বিভক্ত করিয়া তাহার প্রতি ভাগকে পুনরায় শতধা বিদীর্ণ করিলে যে এক-একটি ভাগ হয় , জীব তাহারই ন্যায় অণুপরিমাণ বিশিষ্ট তিনিই আবার স্বরূপতঃ অনন্ত ।
অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ।
অনাদ্যনত্তং মহতঃ পরংধ্রুবং নিচায্য তন্মৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে।।-কঠ-১/৩/১৫
পদার্থ-(যত্) যে ব্রহ্ম ( অশ্বদম্) শব্দরহিত ( অস্পর্শম্) স্পর্শহীন ( অরুপম্) রুপরহিত ( অরসম্) রসরহিত ( তথা) এবং ( অব্যয়ম্) বিকাররহিত=অবিনাশী ( নিত্যম্) অনাদি ( অগন্ধবত্) গন্ধরহিত ( অনন্তম্) অনন্ত ( মহতঃ,পরম) মহত্তত্ত্ব দ্বারা খুব সূক্ষ্ম ( চ) এবং ( ধ্রুবম্) স্থাবর ( তত্) সেই ব্রহ্মকে ( নিচায্য) জেনে ( মৃত্যুমুখাত্) জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহরূপ দুঃখের বন্ধন থেকে ( প্রমুচ্যতে) জীবাত্মা মুক্ত হয়। মহর্ষি দয়ানন্দ বিভিন্ন স্থানে এই শ্লোকের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ-(ক) সেই ( ব্রহ্ম) ধ্বনি,স্পর্শ,রূপ,রস,স্বাদ ও নাশরহিত, নিত্য, অনাদি,অনন্ত, মহত্তত্ত্ব হতে উর্ধ্বে নিশ্চল। এই ভাবে সত্য জেনে মৃত্যুরূপ গ্রহের মুখ হতে মুক্তি পান। বেদবিরুদ্ধমতখণ্ডনম, ল. ২৯ পৃ.) (খ) “কোন শব্দ, স্পর্শ কোন রূপ বিহীন, এর দ্বারা পরমাত্মার নাম নির্গুণ। 'যে গুণোঃ সহ বর্ততে সহ সগুণঃ', যিনি সমস্ত সুখ, পবিত্রতা, জ্ঞানের অসীম গুণাবলীতে সমৃদ্ধ, তাই পরমাত্মার নাম সগুণ।
সত্যার্থ প্রথম ০ ২৪ পৃষ্ঠা) (গ) "অতো দেহধারণেশ্বরঃ সগুণো ভবতি, দেহত্যাগেন নির্গুণশ্চেতি বা মুধানাম্ কল্পনাস্তি সা বেদাধিশাস্ত্রপ্রমাণবিরুদ্ধা বিদ্ধানুভবিরুদ্ধা চাস্তি। তস্মাত্ সজ্জনৈর্ব্যর্থেয়ম্ রীতিঃ সদা ত্যজ্যেতি শিবম্।" অর্থ- যারা অজ্ঞ লোকেরা বলে যে তারা দেহ ত্যাগ করে ভগবান ও নির্গুণ পূজা করে পুণ্যবান, তাই ভদ্রলোকদের কখনোই এটা বিশ্বাস করা উচিত নয় কারণ তাদের এই কল্পনা সমস্ত বেদের প্রমাণের বিপরীত। (ঋ০ ভা০ মুক্তিবিষয়) ( ঘ) আর্যরা পার্থিব মূল দেবতাদের পূজা করত।'এই ধরনের পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ 'অশব্দমস্পর্শম' প্রভৃতি বহু প্রমাণ সহ প্রমাণ করেছেন (ঋ০ ভূ০ ৭৩ পৃ০ আর্যরা একই ঈশ্বরের উপাসক। অর্থঃ এই শ্লোকে ঈশ্বরের স্বভাব সম্পর্কে অত্যন্ত ভ্রান্ত ও সত্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যার ফলে ভগবানের দৈহিকতা ও অদ্বৈতবাদ সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। কিভাবে সেই সর্বব্যাপী ঈশ্বর? এখানে স্পষ্ট উত্তর দেওয়া হয়েছে যে
তিনি রূপ বর্জিত কারণ তিনি এই ইন্দ্রিয়ের বস্তু নন। নিরাকার হয়ে তিনি 'অব্যয়'। এই শাশ্বত কারণ এর কোনো কারণ নেই এবং এই শাশ্বত কারণ এর কোনো ক্রিয়া নেই। যারা ঈশ্বরের দৈহিক রূপে বিশ্বাসী, তারা কখনই ঈশ্বরের উপরোক্ত বিশেষণের সাথে যুক্ত হতে পারে না।
উপনিষদেও 'স পর্যাগচ্ছুক্রমকায়মব্রণম্০' (যজুর্বেদ) এই বেদ-মন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এবং এই শ্লোকে বলা হয়েছে, (নিচায্য) তম মৃত্যুমুখত্ প্রমুচ্যতেম্, অর্থাৎ বন্ধ জীব আত্মা, ঈশ্বরকে জেনে, মৃত্যু = জন্ম ও মৃত্যুর দুঃখ থেকে মুক্ত। এখানে জীব-ব্রহ্মের জ্ঞাত-জ্ঞেয় বন্ধ-মুক্ত এবং উপাস্য-উপাসকের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এখানে আচার্য শঙ্করও একই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। ঈশ্বর কখনই মৃত্যুর মতো দুঃখের বন্ধনে আসতে পারেন না, কারণ তিনি চির মুক্ত, সত্য এবং নিরাকার এবং অপরিবর্তনীয়। অতএব, নতুন বেদান্তীদের অদ্বৈতবাদের স্বীকৃতি কখনই সম্মানজনক হতে পারে না কারণ তা উপনিষদেরও বিরোধী। এই তিনটি বল্লীতে উল্লিখিত গুরু-শিষ্য কথোপকথনের উপাখ্যানের প্রশংসা করে উপনিষত্কার বলেছেন-.. ( ভাষ্যকার আচার্য রাজবীর শাস্ত্রী)
কেনউপনিষদ ১/৩
न तत्र चक्षुर्गच्छति न वाग्गच्छति नो मनो
न विद्मो न विजानीमो यथैतदनुशिष्यात्।
अन्यदेव तद्विदितादथो अविदितादधि।
इति शुश्रुम पूर्वेषां ये नस्तद्व्याचचक्षिरे ॥
চ তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগগচ্ছতি নো মনো ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুষিয্যাদন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি। ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং যে নস্তদব্যাচচক্ষিরে।।
পদার্থ- (তত্র) সেই ব্রহ্মের ( চক্ষুঃ)গ্রহণ যোগ্য চোখ ( ন,গচ্ছতি) অর্থাৎ চোখ ব্রহ্মকে গ্রহণ করতে অক্ষম কারণ তিনি নিরাকার,(বাক্) বাণী ( ন,গচ্ছতি) তাঁহার মূল্য জানে না = বলতে পারে না,( মন, ন) মন গ্রহণ করতে পারে না। এখানে চক্ষু আদি উপলক্ষণার্থক শুধু মাত্র। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলিও ব্রহ্মকে জানতে অক্ষম।এই কারণে ( ন,বিদম্) আমরা ব্রহ্মকে না জানি এবং ( ন,বিজানীমঃ) বিশেষ করে আমরা ব্রহ্মকে জানতে পারি না (যথা) পছন্দ ( এতত্) এই উক্ত ব্রহ্মের ( অনুশিষ্যাত্) শিষ্যকে শিক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ বাস্তবে যা জানা যায় তা প্রচার করা হয়, কিন্তু ব্রহ্ম বোধগম্য, তা প্রচার করা যায় কীভাবে?(তত্)সেই ব্রহ্ম ( বিদিতাত্) জ্ঞান বিষয় থেকে ইন্দ্রিয় পর্যন্ত ( অন্যত্,এব) তিনি ভিন্ন হয় ( অথো) আর ( অবিদিতাত্)অজ্ঞাত বস্তু থেকে ( অভি) উপরে = ভিন্ন, বা ব্রহ্ম প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্ম পরমাণু থেকে ভিন্ন। সেই ব্রহ্ম জ্ঞাত ও অজ্ঞাত উভয় দিক থেকেই অদ্বিতীয়। (ইতি) এইভাবে ( পূর্বেষাম্) পূর্বপুরুষের ব্রহ্ম-সম্পর্কিত বচন ( শুশ্রুম্) আমরা শুনেছি,( যে) যে আচার্য গুরুজনেরা ( নঃ) আমাদের জন্য ( তত্) সেই ব্রহ্মের বিষয়ে ( ব্যাচচক্ষিরে) উপদেশ রূপে বলেন।।
অর্থ: সেই ব্রহ্ম নিরাকার, নিরাকার এবং অসীম হয়েও অতীন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা তার ইন্দ্রিয় জানা যায় না। এখানে 'বিদ্মঃ বিজনীমঃ' এই দুটি ক্রিয়াপদ থেকে ব্রহ্ম সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, দূরের কোনো বস্তুর দিকে তাকালে উপাদান-বিভাগের জ্ঞানের অভাবে সাধারণ জ্ঞান হবে এবং কাছাকাছি গেলে সেখানে একটি সাধারণ জ্ঞান হবে। উপাদান ১ হতে.. শ্রী শঙ্করাচার্য জী এই মন্ত্রটি দুটি ধারায় ব্যাখ্যা করেছেন (৩, ৪)। বিভাগীয় পর্যায় থেকে যে জ্ঞান আসে তা বিশেষ জ্ঞান। আমরা সাধারণ এবং বিশেষ উভয় উপায়ে ব্রহ্মকে জানতে পারি না, কারণ আমরা অতীন্দ্রিয়। তাহলে সেই অসীম ও অসীম ঈশ্বরকে অন্যের কাছে প্রচার করবেন কীভাবে? সেই ব্রহ্ম জ্ঞাত ও অবিদ্যার ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ জ্ঞাত ও অজ্ঞাতদেরও ঊর্ধ্বে। এটাকে জ্ঞাত (জানা) বলা মানে সীমাবদ্ধ করা, আর অজ্ঞাত (অজানা) বলাকে অ-বস্তু বলা। অতএব সেই ব্রহ্ম জ্ঞাতও নয়, অজ্ঞাতও নয়। যে পরিচিত (জানা) এই ধরনের অতীত ব্যবহারের একটি বিষয় নয়, বা এটি ভবিষ্যতের কালের একটি বিষয় নয় যা জানা যাবে। তার জন্য শুধু বর্তমানের ব্যবহারই সার্থক হতে পারে, তাকে জানার চেষ্টা করছি। কারণ সেই ব্রহ্ম অসীম, যতটুকু জানা যায়, ততই কম হবে। প্রাচীন ঋষিরা অহংকার হীন এবং ক্রমাগত ব্রহ্মকে জানার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। সম্পূর্ণরূপে না জানা তার গুরুত্বের লক্ষণ। ব্রহ্ম বাণীর বিষয় নয় কেন? এবং কাদের পূজা করা উচিত? এই বিবৃতি করা।। -( ভাষ্যকার আচার্য রাজবীর শাস্ত্রী)
ঈশ্বরের অবতার হয় না
রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব তদন্য রূপম্ পতিচক্ষণায়।
ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে যুক্তাহ্যস্য হরয়ঃ শতাদশঃ।। ঋগ্বেদ ৬/৪৭/১৮
পদার্থঃ- (রূপং রূপং) (প্রতিরূপঃ) দতাকার বর্ত্তমানঃ (বভূব) বভতি (তৎ) (অস্য) জীবাক্মানঃ (রূপম্) (প্রতিচক্ষণাম্)প্রত্যক্ষ কথনায় (ইন্দ্র) জীবঃ (মায়াভিঃ) প্রজ্ঞাভিঃ (পুরুরূপঃ) বহুশরীরধারণের বিবিধরূপ (ঈয়তে) (যুক্তাঃ) (হি) খলু (অস্য) দেহিনঃ (হরয়ঃ) অশ্বা ইবোন্দ্রিয়ানবন্তঃ করণপ্রাণাঃ (শতা) শতানি (দশ)।।
ভাবার্থ- হে মনুষ্য! যথা বিদ্যুৎ পদার্থং পদার্থং প্রতি তদ্রূপা বভতি, তথৈব জীবঃ শরীরং শরীরং প্রতিতৎস্বভাবো জায়তে যদা বাহ্য বিষয়ং দুষ্ঠুমিচ্ছতি তদাতদ্দৃষ্টা তদাকারং জ্ঞানমস্য জায়তে যা অস্য শরীরে বিদ্যুৎসহিতা অসংখ্যা নাড্যঃ সস্তি তাভিরয়ং সর্বস্য শরীরস্য সমাচারং জানতি। (মহর্ষি দয়ানন্দ)।। যেমন বৈদ্যুতিক শক্তি যে বস্তুতে যায় তারই রূপ গ্রহন করে সেইরূপ জীবাত্মা কর্মের প্রবাহে জন্মজন্মান্তরে যেমন শরীর গ্রহন করুক না কেন, তখন তদাকার বৃত্তি লাভ করে,যেমন যেমন বাহ্যবস্তুর সংস্পর্শে যায় তার থেকে তদাকার জ্ঞানলাভ হয়। বিজলীশক্তি যেমন অসংখ্য তারের মধ্যে দিয়ে পবাহিত হয়, তেমনি আমাদের শরীরস্হ অংসখ্য নাড়ীতে যে চিৎশক্তি প্রবাহিত হচ্ছে তার কেন্দ্রস্হুল অন্তঃকরণ। জীবাত্মা ঐ কেন্দ্রে বসেই শরীরস্হ নাড়ীর মধ্য দিয়ে যেমন চিৎশক্তির প্রবাহে জীবনশক্তি ক্রয়াশীল থাকে, তেমনি চিদ্প্রবাহের যে অসংখ্যধারা বা রশ্মি আছে, তারই সহায়তায় সমস্ত জ্ঞানলাভ করে। জীবাত্মা চিদবিন্দুর যে কেন্দ্রে থাকে সেইখান থেকেই উৎক্রমণের পথ। জীবাত্মা যতক্ষণ না ঐ উৎক্রমণের পথে গিয়ে পরমাত্মারসঙ্গে মিলিত হয়, সেই সেই শরীরের অন্তঃকরণের ঘাটে বসেই জীবাত্মা দেশকালপাত্রানুযায়ী তদাকার বৃত্তি, সংস্কার ও জ্ঞানলাভ করে সেই সেই শরীরের কার্য নির্বাহ করে থাকে।
সংক্ষেপে এই হ'ল ঐ ঋক্ মন্ত্রের মর্মবাণী। জীবাত্মার জন্মজন্মান্তরে শরীর গ্রহনকে অনেকে অবতার গ্রহন ধরে নিয়ে বকবক শুরু করেন! এই মন্ত্রে "পুনরয়ং জীবাত্মা কীদৃশো ভবতীত্যাহ"-সেই প্রসঙ্গই আলোচিত হয়েছে। এই মন্ত্রে অবতারবাদের গন্ধও নেই।
ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা নান্যৈর্দ্দেবৈস্তপসা কর্ম্মণা বা।
জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্ব স্ততস্ত্ত তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মানঃ।।
মুণ্ডক-৩/১/৮
न चक्षुषा गृह्यते नापि वाचा नान्यैर्देवैस्तपसा कर्मणा वा ।
ज्ञानप्रसादेन विशुद्धसत्त्वस्ततस्तु तं पश्यते निष्कलं ध्यायमानः ॥
পদার্থ-( ন) না ( চক্ষুষা) চোখ দিয়ে ( গৃহ্যতে) কেউ তাঁকে দেখতে পারে, কারণ তিনি অসীম, বাস্তব, সূক্ষ্ম ( ন) না ( অন্যঃ,দেবোঃ) অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ( অপি) অনেক( বাচা) বাণী দ্বারা ( তপসা) তপ দ্বারা ( কর্মণা বা) না কর্মের দ্বারা ( জ্ঞানপ্রসাদেন) জ্ঞান দ্বারা, ভিতরে উপস্থিত রাগ এবং ঘৃণা, যখন এই ত্রুটি দূর হয় ( ততঃ) তাদের নিকটে থাকে ( তু) তাই ( তম্) সেই পরমাত্মাকে নিকটে ( পশ্যতে) দেখা যায় (নিষ্কলম্) নিরাকার এবং অসীম ( ধ্যায়মানঃ) ধ্যান করার সময়।
ভাবার্থ-পরমাত্মা নিরাকার, তাই চোখ তাঁকে দেখতে পায় না এবং তিনি অতি নিকটে, তাই চোখ দেখতে পায় না। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠেও মহান, তাই চোখ দেখতে পারে না বা কথা বলতে পারে না তার গুণের পরিধি। বা অন্য কোন ইন্দ্রিয় তা অনুভব করতে পারে না। এবং তপস্যা অর্থাৎ তুষারপাত সহ্য করেও তা জানা যায় না, কর্ম দ্বারাও জানা যায় না। কিন্তু যখন অজ্ঞানতার দোষ থেকে মুক্ত হয়ে বুদ্ধি শুদ্ধ হয়, অর্থাৎ মনের দোষ, অশুচিতা, যা আছে, এই সব দোষ-ত্রুটি সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়, তখন সেই শুদ্ধ চিত্তে ধ্যান করার সময় তা দেখতে পাওয়া যায়। প্রশ্ন: ইন্দ্রিয় বাইরের জিনিস দেখার জন্য, ভিতরে দেখা যায় না। এইজন্য যে ভিতরে তাকায় তাকে কোন বস্তুগত ইন্দ্রিয় বা মন দ্বারা দেখা যায় না। বুদ্ধি, যা আত্মার স্বাভাবিক শক্তি, তা থেকে দেখা যায়।
[#পরমাত্মা আর জীবাত্মার মিলন]
ঋষিঃ-অসিতঃ কাশ্যপো দেবলো বা।। দেবতা-পবমানঃ সোমঃ।। ছন্দঃ-গায়ত্রী।। স্বরঃ-ষড়জঃ।।
য়ঃ সোমঃ কলশেষ্বা অন্তঃ পবিত্র আহিতঃ।
তমিন্দুঃ পরি ষস্বজে।।সাম-১২০০
#পদার্থ- (য়ঃ সোমঃ) যে জগতের রচনাকারী, সর্বান্তর্যামী,রসের ভাণ্ডার,পরম আহ্লাদক পরমেশ্বর ( কলশেষু) অনেকই কৌশলের দ্বারা যুক্ত শরীরের মধ্যে [কলশাঃ কস্মাত? কলা অস্মিঞ্ছরতে মাত্রাঃ। নিরু০ ১১.১০] (আ) নিহিত আছে,আর ( অন্তঃ পবিত্রে) পবিত্র হৃদয়ের অন্তরও ( আহিতঃ) বিদ্যমান আছে ( তম্) ওই পরমেশ্বরের (ইন্দুঃ) তেজস্বী জীবাত্মা (পরিষস্বজে) আলিঙ্গন করে।।
#ভাবার্থ- পরমাত্মার শরণের সাহায়্য নেওয়া জীবাত্মার পরমানন্দায়ক হয়।।
আত্মা স্ত্রী কিংবা পুরুষও নয় আবার নপুংসকও নয়। কর্ম অনুসারে যে দেহ প্রাপ্ত হয় সেই দেহ দ্বারাই লিঙ্গ পরিচিত হয়।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ বলা হয়েছে,,
নৈব স্ত্রী ন পুমানেষ ন চৈবায়ং নপুংসক ।
যদ্ যচ্ছরীরমাদক্তে তেন তেন স রক্ষ্যতে।।( ৫/১০)
পদার্থঃ- (এষঃ) এই জীবাত্মা (ন) না (এব) তো (স্ত্রী) স্ত্রী (ন) না (পুমান্) পুরুষ (চ) আর (ন) না (এব) তো (অয়ম্) এই আত্মা (নপুংসকঃ) নপুংসক (যৎ যৎ) যে যে (শরীরম্) শরীর কে (আদক্তে) গ্রহণ করে (তেন তেন) সেই সেই শরীর দ্বারা (সঃ) সে (রক্ষ্যতে) রক্ষিত হয় অর্থাৎ সেই শরীরে যুক্ত হয়ে যায়।
অনুবাদঃ- জীবাত্মা না তো স্ত্রী, না পুরুষ, না ইনি নপুংসক, তিনি যে শরীর গ্রহন করেন সেই সেই শরীর দ্বারা সমন্ধযুক্ত হন।
জীব ও ঈশ্বরের স্বরূপ, গুণ-কর্ম এবং স্বভাব
- (জীব ও ঈশ্বর) উভয়েই চৈত্যন্যস্বরূপ। উভয়েরই স্বভাব পবিত্র। উভয়ই অবিনাশী এবং ধার্মিকতা প্রভৃতি গুণযুক্ত কিন্তু সৃষ্টিস্হিতি প্রলয়ও সকলকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং জীবদিগের পাপপূণ্যের ফলদান প্রভৃতি ধর্মযুক্ত কর্ম পরমেশ্বরের।আর সন্তান উৎপত্তি,সন্তান পালন এবং শিল্পবিদ্যা প্রভৃতি উত্তম-অধম কর্ম জীবের। নিত্যজ্ঞান, আনন্দ এবং অনন্ত বল প্রভৃতি ঈশ্বরের গুণ। আর জীবের-
ইচ্ছাদ্বেষ প্রয়ত্নসুখদুঃখজ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গামিতি। ন্যায়সূত্র-১।১।১০
প্রাণাপাননিমেষোন্মেষ জীবন মনোগতীন্দ্রিয়ান্তর্বিকারাঃঃ
সুখদুঃখেচ্ছাদ্বেষপ্রয়ত্নাশ্চাত্মনো লিঙ্গানি।।-বৈ০ অ০ ৩
(ইচ্ছা) পদার্থ সমূহের পাইবার অভিলাষা, (দ্বেষ) দুঃখাদি প্রাপ্তির অনিচ্ছা অর্থাৎ বৈরভাব, (প্রয়ত্ন) পুরুষার্থ,বল;( সুখ) আনন্দ, (দুঃখ) বিলাপ,অপ্রসন্নতা; ( জ্ঞান) বিবেক,চিনিতে পারা- এইগুলি সমান; [ন্যায় ও বৈশেষিকের একরূপ ] কিন্তু বৈশেষিকে; (প্রাণ) প্রাণ বায়ুকে বহির্গত করা;(অপান) প্রাণকে বাহির হইতে ভিতরে আনা; (নিমেষ) পলকগতি; (উন্মেষ) চক্ষু উন্মীলন করা,( জীবন) প্রাণ ধারণ করা ; (মন) নিশ্চয়,স্বরণ ও অহঙ্কার করা; (গতি) চলন, ( ইন্দ্রয়) সমস্ত ইন্দ্রয়ের পরিচালনা,( অন্তর্বিকার) ছিন্ন-ভিন্ন রূপে ক্ষুধা,তৃষ্ণা,হর্ষশোকাদি যুক্ত হওয়া; জীবাত্মার এই সকল গুণ পরমাত্মার হইতে পৃথক্। ইহাদের দ্বারাই প্রতীত করিবে কারণ আত্মা স্হূল পদার্থ নহে। আত্মা যতকাল দেহে থাকে ততকাল পর্যন্ত এই সকল গুণ প্রকাশিত থাকে। কিন্তু আত্মা দেহত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে এই সকল গুণও দেহে থাকে না। যাহা থাকিলে যাহা থাকে, এবং যাহা না থাকিলে যাহা থাকে না তাহাই তাহার গুণ। যেমন প্রদীপ, সূর্যাদি না থাকিলে আলোক থাকে না কিন্তু থাকিলে থাকে। সেইরূপ গুণ দ্বারাই জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান হইয়া থাকে।
ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্যশঃ।
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেব মা মা হিংসীদিত্যেবা য়স্মান্ন জাত ইত্যের্ষঃ।। (যজু০ ৩২/৩)
পদার্থঃ (য়স্য) যাহার (মহত্) মহান (নাম) প্রসিদ্ধ (য়শঃ) যশ আছে, (তস্য) ওই পরমাত্মার কোন (প্রতি-মা) প্রতিমা অথবা উপমা (ন অস্তি) নেই। (হিরণ্য-গর্ভ ইতি এবঃ) 'হিরণ্যগর্ভ' আদি মন্ত্রের দ্বারা তথা, (মা মা হিংসীত্ ইতি এষা)
'মা মা হিসীত্' এই মন্ত্রদ্বারা, আর
(য়স্মাত্ ন জাতঃ ইতি এষঃ) 'য়স্মান্ন জাত' এই মন্ত্রদ্বারা তাহার বর্ণন হয়।।৩।।
ভাবার্থঃ উক্ত মন্ত্রের দ্বারা যাহার মহান প্রসিদ্ধ যশের গায়ন হয় ওই আত্মার কোন প্রতিমা অথবা উপমা হয় না।।৩।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত দামোদর সাতবলেকর
আসুন অমরকোষ আর বৈদিককোষ প্রতিমা শব্দ নিয়ে কি বলে-
তাই আসুন (প্রতিমা) শব্দের অর্থ
(অমরকোষে ২/১০/৩৫)
প্রতিমানং প্রতিবিম্বং প্রতিমাপ্রতিয়াতনা প্রতিচ্ছায়া।।৩৫।।
প্রতিকৃতিরর্চা পুংসি প্রতিনিধি-
প্রতিমা অর্থাৎ ছবির নাম।।৮।।
১. প্রতিমান। ২. প্রতিবিম্ব। ৩. প্রতিমা। ৪. প্রতিছবি। ৫. প্রতিছায়া।।৩৫।।
৬. প্রতিকৃতি। ৭. অর্চা। ৮. প্রতিনিধি।
.................................................................................
আর ( বৈদিককোষ; পৃষ্টাঃ ৬৪১) দেখে আসি-
প্রতিমা প্রতিমীয়নোত পরিমীয়ন্তে সর্ব পদার্থা য়য়া সা
ভা০-পরিমাণসাধন পদার্থতোলনার্থম্ (বস্তু) ১৫ ৬৫
প্রতিমীয়তে য়য়া তৎপরিমাপক সদৃশ তোলনসাধন প্রতিকৃতিরাকৃতির্বা ৩২ ৩
প্রতিগোয়তে য়য়া ক্রিয়ায়া সা ১৪ ১৮
পরিমাণ, সাদৃস্য বা মূর্তি স০ প্র০ ৪৩২, ৩২ ৩
প্রতিনিধি প্রতিকৃতি, প্রতিমান তোলনসাধন, পরিমাণ, মূর্ত্যাদিকল্পনম্
ঋ০ ভূ০ ৩০০, ৩২ ৩, প্রতিমীয়তেহনয়া সা (য়য়া পরিমাণ ক্রিয়তো)
ঋ০ ভূ০ ১৪৭, ঋ০ ৮ ৭ ১৮০ ৩
................................................................................
অনেক নামের দ্বারা এক ঈশ্বরের বোধ হয়-
ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং য়মং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।
(ঋ০ ১।১৬৪।৪৬; অথর্ব০ ৯।১০।২৮; নিরু০ ৭।১৮, ১৪।১; ঋগ্বেধা০ ১।২৫।৭; বৃহদেবতা ৪।৪২)
'একই সৎ স্বরূপ পরমাত্মাকে জ্ঞানীলোক অনেক প্রকারে ডেকে থাকেন। ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, উরুত্মান, সৎ, যম, মাতরিশ্বা আদি নামের দ্বারা একই পরমাত্মার বর্ণন করেন।'
অথর্ববেদে ঈশ্বরের একত্বার নিশ্চয়তা-
'সে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চাম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম আদি অনন্ত সংখ্যা দ্বারা বলা হয়নি। এই সম্পূর্ণ জগত তাহাতে নিঃশেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ তাহার মধ্যে। সে সহন শক্তিদ্বারা যুক্ত অর্থাৎ অত্যন্ত বলবান। সে একই। কেবল একই। নিশ্চয়ই একই। সব তেজস্বী পদার্থ ইহাতে কেবল এক বানিয়ে রাখে।' (অথর্ব০ ১৩।৪।১৬-২১)
বৈ-মানরস্য প্রতিমোপরি দ্যোর্য়াবদ্রোদসী বিবাদে অগ্নিঃ।
(অথর্বঃ ৮।৯।৬)
' (বৈশ্বা-নরস্য) বিশ্বের নেতা ঈশ্বরের
(প্রতিমা) প্রতিমা এমনই হয়, যে (য়াবত্ দ্যোঃ) তেমন দ্যুলোকে উপরে থাকে, যেমন (রোদসী) উপরে নিয়ে আর নিম্নস্থ আকাশে (অগ্নিঃ) অগ্নিই (বি-ববাধে) অন্তর বানায়।' যথা-
য়স্মান্ন ঋতে বিজয়ন্তে জনাসো য়ং য়ুদ্ধয়মানা অবসে হবন্তে।।
য়ো বিশ্বস্য প্রতিমানং বভূব য়ো অচ্যুতচ্যুত্ স জনাস ইন্দ্রঃ।।
(ঋ০ ২।১২।৯; অথর্ব০ ২০।৩৪।৯)
'হে (জনাসঃ) মনুষ্য ! (য়স্মাত্ ঋতে) যাহাকে ছেড়ে (জনাসঃ) মনুষ্য (ন বিজয়ন্তে) বিজয়কে প্রাপ্ত হতে পারে না, আর (য়ুদ্ধমানাঃ) লড়াইকারী (অবসে)
রক্ষণের জন্য (য়ং হবন্তে) যাহার প্রার্থনা করতে হয়। আর যে (প্রতিমানম্) বিশ্বের প্রতিমা (বভূব) হয় আর যে (অচ্যুত-চ্যুত্) স্বয়ং না নড়াচড়া করে আর অন্যকে নাড়ায় (স ইন্দ্রঃ) সে ইন্দ্র অর্থাৎ সব জগতের এক রাজা।' ভাষ্যঃ পণ্ডিত দামোদর সাতবলেকর
এই দুই মন্ত্রে জগতের বরাবর ওই পরমাত্মার প্রতিমা, এরূপ বলেছে।
এই আকাশ অনন্ত। যে প্রকার আকাশের কোন সীমা নেই ওই প্রকার পরমেশ্বরেরও কোন অন্ত নেই। এই কথা উক্ত দুই মন্ত্রে বলা হয়েছে।
এখন আসি যজুর্বেদের নিম্ন মন্ত্র-
ও৩ম্ খং ব্রহ্ম।। (যজু০ ৪০। ১৭)
' (ও৩ম্ ব্রহ্ম) সবার রক্ষাকারী ব্রহ্ম (খং) আকাশের সমান ব্যাপ্ত।'
এই মন্ত্রের ভাব উক্ত অর্থের দুই মন্ত্রের সমান।
তাই আরো দেখুন-
ত্বং ভুবঃ প্রতিমানং পৃথিব্যাঃ।। (ঋ০ ১।৫২।১৩)
'তুমি পৃথিবী থেকে উল্টো প্রমাণ রাখেন।' অর্থাৎ পৃথিবী ছোট আর তুমি মহান। যথা-
সূ ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাহত্যতিষ্ঠদ্দশাংগুলম্।
( ঋ০ ১০।৯০।১; আরণ্য স০ ৪।২; অথর্ব০ ১৯।৬।১; যজু০ ৩১।১; তৈ০ আরণ্য০ ৩।১২।১)
'সে পরমাত্মা পৃথিবীকে (বিশ্বতঃ) চারিদিক থেকে (বৃত্বা) ঘিরে
(দশাংগুলং) দশ আঙ্গুলের সমান ছোট বিশ্বকে (অতি অতিষ্ঠত্) বিশ্বের বাহিরেও আছে অথবা বিশ্বের উপর শাসন করেন।'
এই মন্ত্রে উক্ত আশায় অনেক স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তথা আরো মন্ত্র দেখুন-
ন হীন্বমস্য প্রতিমানস্যত্যন্তর্জাতেষূত য়ে জনিত্বাঃ। (ঋ০ ৪।১৮।৪)
' (অস্য ন) নিশ্চয়ই ইহার (জাতেষু অন্তঃ) বানানো পদার্থের অন্তর (উত) আর (য়ে জনিত্বাঃ) যে বানানোকারী হয় তাহার মধ্যে কোন (প্রতিমানম্) তুলনা, প্রতিমা
(ন অস্তি) হয় না।, যথা-
এই প্রকার প্রতিমা আর প্রতিমান শব্দের প্রয়োগ বেদ মন্ত্রে এসেছে, ইহার নিম্ন লিখিত অর্থ-'প্রতি-মা' র অর্থ-বানানোকারী প্রতিমা, সাদৃশ্য, উপমা, প্রতিবিম্ব, মাপ, তোলা, বিস্তার, বরাবর, 'প্রতি-মান' এর অর্থ-নমুনা সাদৃশ্য, তোলা, ওজন, মাপ, প্রতিবিম্ব, বিপরীত, শত্রু এই বিবিধ অর্থ দেখে তথা মন্ত্রের সংবন্ধ দেখে, উক্ত মন্ত্রের অর্থ বিচার করা উচিত।
কিং সময় ঋধক্ কৃণবদ্ য়ংসহপ্রে মাসো জভার শরদশ্চ পূর্বীঃ।
নহী ধ্বস্ত প্রতিমানমত্ত্য ন্তর্জাতেষূতে য়ে জনিত্বা।।৪।।
প্র তুবিদ্যুম্নস্য স্থবিরস্য ঘৃষ্বের্দিবো ররপ্শে মহিমা পৃথিব্যাঃ।
নাস্য শত্রুর্ন প্রতিমাননস্তি ন প্রতিষ্ঠিঃ পুরুমায়স্য সহ্যোঃ।।১২।।
(ঋ০ ৪/১৮/৪; ৬।১৮।১২)
পদার্থঃ (য়) যাহার (সহস্রং মাসঃ পূর্বী শরদঃ চ) হাজার মাসের আর অনেক বর্ষ পর্যন্ত (জভার) ভরণপোষণ করেন, (সঃ) সে
(ঋধক্ কিং কৃণবত্) বিরুদ্ধ কর্ম কে করবে?
(য়ে জনিত্বাঃ) যে উৎপন্নকারী তাহার আর (গাতেষু) উৎপন্ন হওয়ার (অন্তঃ) মাধ্যমে (অস্য প্রতিমানম্ নহি) এই ইন্দ্রের কোন উপমা নেই।।৪।।
ভাবার্থঃ যাহার অনেক মাসের আর বর্ষ পর্যন্ত ভরণপোষণ করেন, সে নিজের পোষণকরীর কোন কার্য কে করবে? অর্থাৎ কেউ করবে না। উৎপন্নকারী আর উৎপন্ন হওয়ার মধ্যে এই ইন্দ্রের সমান কেউ নেই।।৪।।
পদার্থঃ (তুবি-দ্যু-ম্নস্য) অত্যন্ত তেজস্বী (স্থবিরস্যা) স্থির আর (ঘৃষ্বেঃ) দুষ্টতাকে চূর্ণকারী ঈশ্বরের (মহিমা)
মহত্তা দ্যুলোক আর পৃথিবীর মর্যাদার থেকেও বাহিরে (ররশ্পে) বিস্তার। (ন অস্য শত্রুঃ) এই ঈশ্বরের কোন শত্রু নেই (ন অস্য প্রতিমানম্) না ইহার কোন প্রতিমা আছে। (পুরু-মায়স্য) অনন্ত জ্ঞানবান
(সহ্যোঃ) আর সহন শক্তিবান বলবান ঈশ্বরকে ছেড়ে আর (প্রতিষ্ঠিঃ) আশ্রয় হয় না। অর্থাৎ সেই এক সবার আশ্রয়।।১২।।
ভাবার্থঃ তেজস্বী শ্রেষ্ঠ শত্রুনাশক বীরের মহিমা পৃথিবী থেকে আর দ্যুলোক থেকেও মহান। অনেক প্রজ্ঞাবান আর শত্রুনাশক বীরের কোন শত্রু হয় না। অধিক কুশল আর শান্তি, সুখ, দানকারী বীরের জন্য তুলনা হয় না।।১২।।
ভাষ্যঃ পণ্ডিত দামোদর সাতবলেকর
এখন আসি প্রতিমানম্ শব্দের কি অর্থ করেছেন বৈদিককোষ
বৈদিককোষ প্রতিমানম্; পৃষ্টা ৬৪১।
পরিমাণসাধনানম্ ৪ ১৮ ৪ সাদৃশ্য পরিগান বা ১ ৩২ ৩ রামন্তাত্ প্রতিমীয়তে
পরিণীয়তে প্রতিক্রিয়তে গেন তত্ (স্ব-সুখমন্তরিক্ষ বা) ১ ৫২ ১২
প্রতিমীয়তে য়ত্ (জগত্) ১ ১০২ ৮ অতিসমর্থানামুপমা ১ ১০২ ৬
পরিমাণসাধক (ইন্দ্র=পরমেশ্বরী বিদ্যুদ্বা) ২ ১২.৯
পরিমাণসাধকম্ (জ্ঞানম্) ৩ ৩১ ৮ প্রতিমান অর্থাৎ পরিমাণের কর্তা (ঈশ্বর) আর্যাভি০ ১ ১৩,
ঋ০ ১ ৪.১৪ ১২, [প্রতি+মাঙ্মানে (জু০) ধাতো করণে ল্যুট্]
তাই সামবেদও ঘোষণা করছেন-
মা চিদন্যদ্ বি শংসত সখায়ো মা রিষণ্যত।
ইন্দ্রমিত্স্তোতা বৃষণং সাচ সুতে মুহুরুক্থা চ শংসত।।১০।।
সামবেদ ২৪২
পদার্থঃ হে (সখায়ঃ) মিত্র! তুমি (অন্যত্) দ্বিতীয় কোন বস্তু পাথরের মূর্তি, নদী, পর্বত ইদিকে (মা চিত্) না কখনো (বি শংসত) উপাস্য রূপে পূজা করো, (মা রিষণ্যত) যে উপাসনীয় নয় তাহার উপাসনা করে হানি প্রাপ্ত করো না। (সুতে) জ্ঞান, কর্ম আর ভক্তির রস নিষ্পাদিত হয়ে (সচা) সাথে মিলে (বৃষণম্) সুখবর্ধক (ইন্দ্রম্ ইত্) পরমেশ্বরেরই (স্তোত) স্তুতি-উপাসনা করো আর (শংসত) গান করো।।১০।।
ভাবার্থঃ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আর জগতে যে সম্মানের যোগ্য তাহাকে সম্মান তো করাই উচিত, কিন্তু তাহাদের মধ্য থেকে কাউকে পরমেশ্বরের রূপে পূজা করা উচিত নয়, না নদী, বৃক্ষ, পর্বত আদি জড় পদার্থকে পূজা করা উচিত নয়। ইন্দ্র আদি নামের দ্বারা বেদের মধ্যে প্রসিদ্ধ সুখবর্ষী এক জগদীশ্বরই পুনঃ-পুনঃ স্তুতি, প্রার্থনা, অর্চনা আর উপাসনা করার যোগ্য।।১০।। ভাষ্যঃ আচার্য ড. রামনাথ বেদালঙ্কার বিদ্যামার্তণ্ড
জীব বা আত্মা :
জীবাত্মা এক নয় বহু চিরন্তন ও শুদ্ধ, আত্মা লিঙ্গহীন [অথর্ব্ববেদ ১০।৮।২৬, ঋগ্বেদ ৬।৯।৪, ৬।৯।৫]
.
বাদরায়ণের মতে ব্রহ্ম থেইে জগৎ সৃষ্ট। জগতের মতো আত্মাও ব্রহ্মের শরীর, ব্রহ্ম উভয়েরই অন্তর্যামী আত্মা- এটিই বাদরায়ণের ব্রহ্মবাদের ভিত্তি বলে মনে করা হয়। ব্রহ্ম ও জগতের অতিরিক্ত তৃতীয় আর একটি বস্তু আছে, বাদরায়ণ যার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, তা হলো জীবাত্মা। এই জীবাত্মা বহুসংখ্যক। জীবাত্মাতে ব্রহ্ম স্বরূপেই কূটস্থ এবং নিত্য। আর জগৎ স্বরূপে নয়, প্রবাহে অনাদি। একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সূত্রকার বলেন-
‘নাত্মা, অশ্রুতের্নিত্যত্বাচ্চ তাভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭)।।
ভাবার্থ : জীবাত্মা উৎপন্ন হন একথা শ্রুতি বলেননি। বরং আত্মার নিত্যত্ব ও অজত্ব বিষয়ে শ্রুতি বলেছেন (ব্রঃ-২/৩/১৭)।
যেমন, শ্রুতিতে রয়েছে- ‘এই জন্মরহিত মহান আত্মা’ (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২৫)। কিংবা কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’।। (কঠোপনিষদ-১/২/১৮)।।
অর্থাৎ : আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী (কঠ-১/২/১৮)।
এখানে আত্মা অর্থে জীবাত্মাকেই বোঝানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, এই জন্মরহিত আত্মা নিত্য বা অবিনাশী হলে তার সাথে জগতের আদি-কারণ পরমাত্মা ব্রহ্মের সম্বন্ধ বা পার্থক্য কীরূপ ? কেননা, শ্রুতিশাস্ত্র জুড়ে উপনিষদগুলিতে আত্মাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সার্বিক অর্থে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে করে পরমাত্মা ও জীবাত্মাকে বোঝাতে গিয়ে যে দ্ব্যর্থবোধক বিভ্রান্তি বা বিরোধ তৈরি হয়েছে তা নিষ্পত্তিকল্পে সূত্রকার বাদরায়ণকে সেগুলির জন্য বহু ব্যাখ্যাও হাজির করতে হয়েছে। এবং আত্মা বা জীবাত্মার সঙ্গে সর্বব্যাপী ব্রহ্ম বা পরমাত্মার ভেদ ও অভেদও চিহ্নিত করতে হয়েছে। যেমন একটি শ্রুতিতে আছে-
‘নিত্যঃ অনিত্যানাং চেতনশ্চেতনানামেকো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্ ।
তমাত্মস্থং যঃ অনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্’।। (কঠোপনিষদ-২/২/১৩)।।
অর্থাৎ : সকল অনিত্যের মধ্যে যিনি নিত্য, সকল চেতন বস্তুর মধ্যে যিনি স্বয়ং চৈতন্য এবং যিনি একমাত্র সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণে সক্ষম, তিনিই পরমাত্মা। যে সব প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এই পরমাত্মাকে নিজ আত্মারূপে দর্শন করেন, কেবল তাঁরাই মনে অপার শান্তি লাভ করেন। অন্যেরা এই শান্তি থেকে বঞ্চিত হন (কঠ-২/২/১৩)।
পরমাত্মা স্বয়ং চৈতন্যস্বরূপ। সকল অনিত্য বস্তুর মধ্যে নিত্যবস্তু পরমাত্মাই নাম-রূপ আরোপিত হয়ে জীবাত্মারূপে প্রতিভাত হন। জীবাত্মার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। তাই পরমাত্মা ও জীবাত্মা যে অভিন্ন, এই সত্য উপলব্ধির কথাই আরো বিভিন্ন শ্রুতিতে বলা হয়েছে। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এই অভেদাত্মক সম্বন্ধ নিশ্চয়ই বেদান্তের কাশকৃৎস্ন শাখায়ও বেদান্ত শ্রুতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাই সূত্রকার বলেন-
‘অবস্থিতেরিতি কাশকৃৎস্নঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।।
ভাবার্থ : কাশকৃৎস্ন মুনি বলেন, পরমাত্মাই দেহ মধ্যে জীবাত্মারূপে অবস্থিত। সুতরাং জীব শব্দে এই স্থলে পরমাত্মাকেই বুঝতে হবে (ব্রঃ-১/৪/২২)।
কিন্তু জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই উপলব্ধিগত অভেদ সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে যে যথেষ্ট ভেদ বা পার্থক্যও রয়েছে তা স্বীকার করেই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অধিকং তু, ভেদনির্দেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/২২)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি যেমন জীব-ব্রহ্মের অভেদ নির্দেশ করেছেন সেরূপ ভেদের কথাও বলেছেন। তাই ব্রহ্ম জীব থেকে অধিকতর কিছুই (ব্রঃ-২/১/২২)।
যেসব ভেদ বা পার্থক্য জীবাত্মাকে পরমাত্মা থেকে পৃথক করে, সূত্রকার তাও চিহ্নিত করেছেন। সেগুলি নিম্নরূপ-
বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা অণু-স্বরূপ
(ক) আত্মা অণু-স্বরূপ :
শ্রুতিতে পরমাত্মা ব্রক্ষকে অদ্বিতীয় সর্বব্যাপী ঘোষণা করে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে তাঁর যে স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে তা হলো-
‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।
কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৬/১১)।।
অর্থাৎ : তিনি অদ্বিতীয়, তবু তিনি সর্বভূতে নিহিত। তিনি সর্বব্যাপী, সকলের অন্তরাত্মা। তিনিই সকল কর্মের ফলদাতা, তিনিই সকলকে পালন করছেন, তিনিই চৈতন্যদায়ক, নিরুপাধিক এবং নির্গুণ ও মুক্ত (শ্বেতাশ্বতর-৬/১১)।
আবার দেহত্যাগ করে জীবাত্মার লোকান্তরে গমন বিষয়ে অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘তে যে এবমেতদ্ বিদুর্ষে চামী অরণ্যে শ্রদ্ধাং সত্যমুপাসতে তেহর্চিরভিসংভবন্তি অর্চিষোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্যান ষণ্মাসানূদঙ্ঙাদিত্য এতি মাসেভ্যো দেবলোকং দেবলোকদাদিত্যম্ আদিত্যাৎ বৈদ্যুতং, তান্ বৈদ্যুতান্ পুরুষো মানস এত্য ব্রহ্মলোকান্ গময়তি। তে তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতো বসন্তি। তেষাং ন পুনরাবৃত্তি’।। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।।
অর্থাৎ : পঞ্চাগ্নিবিদ্যায় যাঁরা বিদ্বান এবং এই জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর পূত হয়ে প্রথমে অর্চিলোকে যান। ক্রমে অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয়মাসে। তারপর সেখান থেকে দেবলোকে, দেবলোক থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে বিদ্যুৎলোকে যান। সেখানে আসেন এক মনোময় পুরুষ, তাঁকে নিয়ে যান ব্রহ্মলোকে। পরমলোক সেই ব্রহ্মলোকে তিনি থেকেই যান। আর শুক্র-শোণিতে ফিরে আসতে হয় না (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৫)।
এটিকে বলা হয় দেবযান পথ। প্রায় অনুরূপ শ্রুতি ছান্দোগ্য (ছাঃ-৫/১০/১-২) উপনিষদেও রয়েছে। জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে অভেদ মানলে এই দুটি শ্রুতির মধ্যে একটা বিরোধ দৃষ্ট হয়। কেননা, আত্মা অখণ্ড ও সর্বব্যাপী হলে জীবাত্মা একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমনের বিষয়টাই বিভ্রান্তিকর হয়। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে গিয়ে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘উৎক্রান্তিগত্যাগতীনাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)।।
‘স্বাত্মনা চোত্তরয়োঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।।
ভাবার্থ :
জীবাত্মার উৎক্রান্তি-গতি, এবং পুনরাগমনের কথা শ্রুতিতে থাকায়- তা ব্রহ্মের ন্যায় বিভু বা সর্বব্যাপী হতে পারে না (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৯)। গতি এবং অগতি কর্তার সাথেই সম্বন্ধবিশিষ্ট। আত্মার সম্পর্কে-ই জীবের গতি-অগতি বিচার করা যায়। তাই জীবাত্মা সীমিত পরিমাণ (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২০)।
এই সীমিত পরিমাণ মানে কতটুকু ? এক্ষেত্রেও শ্রুতির প্রমাণই সাক্ষ্য। যেমন-
‘এষঃ অণুঃ আত্মা চেতসা বেদিতব্যো যস্মিন্ প্রাণঃ পঞ্চধা সংবিবেশ।
প্রাণৈশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং যস্মিন্ বিশুদ্ধে বিভবত্যেষ আত্মা’।। (মুণ্ডকোপনিষদ-৩/১/৯)।।
অর্থাৎ : প্রাণবায়ু পাঁচভাগে ভাগ হয়ে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একই দেহে অণু পরিমাণ আত্মাও রয়েছেন যা শুদ্ধ জ্ঞান বা বুদ্ধির গোচর। সকল বস্তু ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও চৈতন্যরূপ শুদ্ধ আত্মা বিরাজ করেন। চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মা তখন নিজেকে প্রকাশ করেন (মুণ্ডক-৩/১/৯)।
‘বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায়কল্পতে’।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/৯)।।
অর্থাৎ : একটি কেশাগ্রকে শতভাগে বিভক্ত করে তার প্রতি ভাগকে আবার শতভাগে ভাগ করলে যে এক একটি ভাগ হয়, জীবাত্মা তারই ন্যায় অতি ক্ষুদ্র অণুপরিমাণবিশিষ্ট। আবার এই জীবাত্মাই অনন্ত (শ্বেতাশ্বতর-৫/৯)।
এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, জীবাত্মা আকারে ক্ষুদ্রতম থেকেও ক্ষুদ্র অণুপরিমাণ-ই। তাই সূত্রকার সিদ্ধান্ত করেন-
‘স্বশব্দোন্মানাভ্যাং চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২২)।।
ভাবার্থ : অণুবোধক এবং অণুপরিমাণবাচক স্পষ্ট শ্রুতিবাক্য থাকাতে বুঝতে পারা যায় যে, জীব অণুপরিমাণই (ব্রঃ-২/৩/২২)।
এখানে আপত্তি আসে যে, জীবাত্মা অণুপরিমাণ হওয়ায় দেহের অতিক্ষুদ্র একাংশে তার অবস্থিতি, ফলে সম্পূর্ণ দেহের উপর বিস্তীর্ণ সুখ-দুঃখাদি উপভোগ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন-
‘গুণাদ্বা লোকবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৫)।।
‘ব্যতিরেকো গন্ধবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৬)।।
‘তথা চ দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৭)।।
ভাবার্থ :
নিজ গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র একটি দীপ যেমন বৃহৎ একটি ঘরকে আলোকিত করে, সেইভাবে বিজ্ঞানাদি গুণের দ্বারা ক্ষুদ্র আত্মা একস্থানে অবস্থান করেও সমগ্র দেহে কার্য করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৫)। পুষ্পের গন্ধ যেমন পুষ্পে অবস্থিত হয়েও তাকে অতিক্রম করে দূরবর্তী স্থানকেও আমোদিত করে, জীবাত্মাও তেমনি একাংশে থেকেও সর্বদেহে কার্যকর হতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৬)। শ্রুতিশাস্ত্রেও তার সমর্থন রয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৭)।
যেমন, শ্রুতিশাস্ত্রে এর সমর্থন দেখা যায় কৌষীতকি উপনিষদে-
‘তদ্ যথা ক্ষুরঃ ক্ষুরধানে অবহিতঃ স্যাৎ। বিশ্বম্ভরো বা বিশ্বম্ভরকুলায় এবমেবৈষ প্রাজ্ঞ আত্মেদং শরীরমাত্মানম্ অনুপ্রবিষ্টঃ। আ লোমভ্য আ নখেভ্যঃ’।। (কৌষীতকি-৪/১৯)।।
অর্থাৎ : যেমন ক্ষুর থাকে ক্ষুরের খাপের মধ্যে অথবা আগুন থাকে কাঠের মধ্যে তেমনি ঐ বিজ্ঞানময় বা প্রাজ্ঞ চেতন আত্মা এই দেহে প্রবিষ্ট হয়ে কেশ থেকে নখাগ্র পর্যন্ত সর্বত্র সঞ্চারিত হয়ে অবস্থান করছেন (কৌষীতকি-৪/১৯)।
গন্ধ যেমন নিজের দ্রব্য পৃথিবীর গুণ হয়েও তা থেকে ভিন্ন, জ্ঞানও তেমনি আত্মা থেকে ভিন্ন। যদিও কোথাও কোথাও আত্মাকে জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলা হয়েছে, কিন্তু তা এজন্যেই বলা হয়েছে যে জ্ঞান আত্মার সার থেকে জাত গুণ, এবং সেইজন্যও যেখানে যেখানে আত্মা আছে, সেখানে সেখানে জ্ঞান অবশ্যই থাকবে। যেমন, কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন বাচং বিজিজ্ঞাসীত। বক্তারং বিদ্যাৎ। ন গন্ধং বিজিজ্ঞাসীত। ঘ্রাতারং বিদ্যাৎ। ন রূপং বিজিজ্ঞাসীত। রূপবিদ্যং বিদ্যাৎ। ন শব্দং বিজিজ্ঞাসীত। শ্রোতারং বিদ্যাৎ। নান্নারসং বিজিজ্ঞাসীত। অন্নরসস্য বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। ন কর্ম বিজিজ্ঞাসীত। কর্তারং বিদ্যাৎ। ন সুখ-দুঃখে বিজিজ্ঞাসীত। সুখদুঃখয়োর্বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। নানন্দং ন রতিং ন প্রজাপতিং বিজিজ্ঞাসীত। আনন্দস্য রতেঃ প্রজাতের্বিজ্ঞাতারং বিদ্যাৎ। নেত্যাং বিজিজ্ঞাসীত এতারং বিদ্যাৎ। ন মনো বিজিজ্ঞাসীত। মন্তারং বিদ্যাৎ’।। (কৌষীতকি-৩/৬)।।
অর্থাৎ : বাক্ বা বক্তব্যকে জানার চেষ্টা করবে না। বক্তাকে জানবে। গন্ধ বা গন্ধবস্তুকে জানার চেষ্টা করবে না। যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়ে আঘ্রাণ দিচ্ছেন তাঁকে জানবে। রূপকে জানতে চেষ্টা করবে না, দ্রষ্টাকে জানবে। শব্দকে জানতে চেষ্টা করবে না, শ্রোতাকে জানবে। অন্নরসকে জানতে চেষ্টা করবে না। তাকে যিনি জানেন, তাঁকে জানবে। কর্মকে জানতে ইচ্ছুক হবে না, কর্তাকে জানবে। সুখ-দুঃখকে জানতে চেষ্টা না করে, তার যে বিজ্ঞাতা, তাঁকে জানতে আগ্রহী হবে। আনন্দ, রতি, সন্তান-সন্ততির উপভোগ জানতে উৎসুক না হয়ে, এসবের বিজ্ঞাতাকে জানবে। গতিকে জানার জন্য আগ্রহী না হয়ে, গমনকারীকে জানবে। মনকে জানতে উদ্গ্রীব না হয়ে যিনি মনন করছেন তাঁকে জানার চেষ্টা করবে। কে সেই বক্তা, দ্রষ্টা, শ্রোতা, কর্তা, বিজ্ঞাতা ? তিনি হলে প্রজ্ঞা, চৈতন্যময় আনন্দস্বরূপ, অমৃতময় আত্মা।
তাই বলে প্রতর্দন, এমন কথা কখনো ভেবো না যে দুটি ভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে দুটি পৃথক হলেও আসলে কিন্তু পৃথক নয়। যেমন গাছের সঙ্গে ফুল-ফলের সম্পর্ক, এখানেও তাই (কৌষীতকি-৩/৬)।
.
‘তা বা এতা দশৈব ভূতমাত্রা অধিপ্রজ্ঞম্, দশ প্রজ্ঞামাত্রা অধিভূতম্ । যদা ভূতমাত্রা ন স্যুর্ন প্রজ্ঞামাত্রাঃ স্যুঃ। ন হি অন্যতরো তো রূপং কিঞ্চন সিধ্যেৎ। নো এতন্নানা। তদ্ যথা রথস্যারেষু নেমিরর্পিতো নাভাবরা অর্পিতাঃ। এবমেবৈতা ভূতমাত্রাঃ প্রজ্ঞামাত্রাসু অর্পিতাঃ, প্রজ্ঞামাত্রাঃ প্রাণে অর্পিতাঃ স এষ প্রাণ এব প্রজাত্মানন্দোজরোহমৃতঃ’।। (কৌষীতকি-৩/৭)।।
অর্থাৎ : দশটি ভূতমাত্রা, নাম থেকে মন পর্যন্ত প্রজ্ঞাকে আশ্রয় করে আছে। তাই এদের বলা হয় ‘অধিপ্রজ্ঞ’। আবার দশটি প্রজ্ঞামাত্রা ঐ ভূতমাত্রাকে অবলম্বন করে আছে। তাই তারা হলো ‘অধিভূত’। স্বতন্ত্র হয়েও কেউ নিরপেক্ষ নয়। যদি নাম, দৃশ্য, গন্ধ ইত্যাদি ভূতমাত্রা অর্থাৎ বিষয় জগতের উপাদান না থাকতো, তাহলে মুখ, চোখ, ঘ্রাণ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা অর্থাৎ বিষয়ীরাও থাকতো না। আবার বাক্, চোখ ইত্যাদি প্রজ্ঞামাত্রা ইন্দ্রিয়রা যদি না থাকতো তাহলে কথা, রূপ, গন্ধ এসব ভূতমাত্রা বিষয়ও থাকতো না। ইন্দ্রিয় আর বিষয় কেউ কারো সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত নয়। ইন্দ্রিয় না থাকলে বিষয়কে জানা যেতো না। আবার বিষয় না থাকলে ইন্দ্রিয়ও অর্থহীন হতো। তাই- আলাদা হলেও আসলে কিন্তু এক।
যেমন রথের চাকা। গোলাকার কাঠের বেড় বা পরিধি। মাঝে একটা ‘অর’ নাভি, চলতি কথায় যাকে বলে ‘মাদল’। এই মাদলে আছে বেশ কয়েকটা গর্ত। সেই গর্ত থেকে এক-একটা কাঠের শলাকা বেরিয়ে পরিধি বা নেমির শরীর ফুটো করে তাকে ধরে রেখেছে এমনভাবে যে, নেমির সাধ্য নেই খসে আলাদা হয়ে যায়। কাঠের শলাকাগুলো হলো ইন্দ্রিয় আর নেমি হলো নামাদি বিষয়। এই প্রাণই হলো প্রজ্ঞা বা চেতন-আত্মা। আনন্দস্বরূপ, অৎর, অমৃত (কৌষীতকি-৩/৭)।
এইসব শ্রুতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রজ্ঞা (বিজ্ঞান) দেহ থেকে পৃথক- এদের মধ্যে করণ-কর্তা সম্পর্ক বর্তমান এবং এই বিশেষ গুণ সহায়েই আত্মা সর্বদেহব্যাপী হয়ে বর্তমান। তাই সূত্রকার বলেন-
‘পৃথগুপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৮)।।
‘ত˜গুণসারত্বাৎ তু তদ্ব্যপদেশঃ প্রাজ্ঞবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৯)।।
‘যাবদাত্মভাবিত্বাচ্চ ন দোষঃ, তদ্দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩০)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতিতে জ্ঞান হতে জীবাত্মার পৃথকত্ব উপদেশ করা হয়েছে। অতএব বিজ্ঞানময়তায় জীব মহৎ হলেও জীব আসলে অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৮)। প্রাজ্ঞ পরমাত্মার বৃহৎগুণ থাকায় যেমন তাঁকে ব্রহ্ম বলা হয়, তেমনি জীবাত্মার গুণেও বিভুত্ব থাকায় কোন কোন শ্রুতি জীবকেও বিভু বলেছেন। কিন্তু জীবাত্মা অণুই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৯)। গুণে জীবাত্মাকে বিভু বলা দোষযুক্ত নয়। কারণ আত্মা যতদিন থাকবে তার গুণও ততদিন থাকবে। আত্মা নিত্যহেতু তার গুণও নিত্য (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩০)।
তদুপরি বাদরায়ণ বলেন, এই জ্ঞান যদি দৃষ্টিগোচর না হয় তবে তাকে তুলনা করতে হবে বাল্যাবস্থায় শিশুর অপ্রকটিত পৌরুষের সঙ্গে। জ্ঞান শরীরের মধ্যেই অবস্থিত, এতেও প্রমাণিত হয় যে জীবাত্মা অণু। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘পুংস্ত্বাদিবৎ ত্বস্য সতোহভিব্যক্তিযোগাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩১)।।
ভাবার্থ : পুরুষের ধর্ম যেমন বাল্যে প্রকাশিত হয় না, তেমনি জীবের জ্ঞানও সুষুপ্তি অথবা প্রলয়ে অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু জাগ্রৎ-কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায় (ব্রঃ-২/৩/৩১)।
কারণ, সুষুপ্তি অবস্থায় জ্ঞান যে অপ্রকাশিত থাকে তা শ্রুতিতেই বলা হয়েছে-
‘…যত্রৈতং পুরুষঃ স্বপিতি নাম সতা সোম্য তদা সম্পন্নো ভবতি স্বমপীতো ভবতি তস্মাদেনং স্বপিতীত্যাচক্ষতে স্বং হ্যপীতো ভবতি’।। (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।।
অর্থাৎ : …যখন কাউকে বলা হয় ‘ইনি ঘুমোচ্ছেন’, তখন হে সোম্য, তিনি সৎ-এর সঙ্গে একীভূত হন এবং স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হন। সেইজন্য লোকে একে ‘সুষুপ্ত’ (স্বপিতি) বলেন, কারণ তখন তিনি স্ব-স্বরূপে থাকেন (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)।
অর্থাৎ সুষুপ্তিকালে বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার এই সংযোগ খুব সূক্ষ্ম এবং সম্ভাবনাপূর্ণ অবস্থায় বর্তমান থাকে। তা না হলে জাগ্রৎ অবস্থায় তা বিকশিত হয়ে উঠতে পারতো না। পুরুষত্ব শক্তিটি যৌবনে বিকশিত হয়, যদিও মাত্র তা সম্ভাবনাময় অবস্থায় শৈশবে বর্তমান থাকে। সুতরাং এই সংযোগটি বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকে যে-পর্যন্ত ব্যাষ্টি সত্তার (জীবরূপে) অবস্থাটি বর্তমান থাকে।
বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা কর্তা
(খ) আত্মা কর্তা :
আত্মা কর্তা, শ্রুতিতে এর প্রচুর প্রমাণ আছে। কেননা, আত্মা কর্তা না হলে তাকে ভোক্তা বলে মানা ভুল। বেদশাস্ত্রে বা উপনিষদের শ্রুতিতে স্বর্গাদিলাভের উদ্দেশ্যে কিছু যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের কথা জীবের দ্বারা করণীয় বলে ব্যবস্থাপিত হয়েছে। যদি জীবাত্মা কর্তাই না হন, তাহলে শ্রুতির এজাতীয় উপদেশগুলি নিরর্থক প্রতিপন্ন হবে। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘কর্তা, শাস্ত্রার্থবত্ত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৩)।।
ভাবার্থ : শাস্ত্র স্বর্গাদিলাভের জন্য যে যজ্ঞাদির কথা উপদেশ করেছেন তা সার্থক হয় তখনই যখন জীবকে এইসবের কর্তা বলে মান্য করা হয় (ব্রঃ-২/৩/৩৩)।
আবার শ্রুতিবচন থেকে জানা যায়, যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘স যত্রৈতৎ স্বপ্নায়া চরতি, তে হাস্য লোকাঃ। তদুতেব মহারাজো ভবত্যুতেব মহাব্রাহ্মণ উতেব উচ্চাবচং নিগচ্ছতি। স যথা মহারাজো জানপদান্ গৃহীত্বা স্বে জনপদে যথাকামং পরিবর্তেতৈবম্ এবৈষ এতৎ প্রাণাম্ গৃহীত্বা স্বে শরীরে যথাকামং পরিবর্ততে’।। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮)।।
‘অথ যথা সুষুপ্তো ভবতি যদা ন কস্যচন বেদ…’।। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।।
অর্থাৎ :
মানুষ যখন ঘুমোতে যায়, তখনো তার দুটো অবস্থা। একটা হলো স্বপ্নাবস্থা। মানুষটি শুয়ে ঘুমোচ্ছে, সাধারণ চোখ দিয়ে যেমন দেখে সেরকম দেখছে না, সাধারণ কান দিয়ে যেমন শুনতে পাচ্ছিলো সেভাবে আর শুনতে পাচ্ছে না, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস যেভাবে সে অনুভব করছিলো সেভাবে করতে পাচ্ছে না, অথচ সে সবকিছুই করে চলেছে। মহারাজ, মহাব্রাহ্মণের মতো ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু ভেতরে রীতিমতো সক্রিয়। একজন মহারাজ যেমন তার অধীন প্রজাদের নিয়ে খেয়াল-খুশিমতো ঘুরে বেড়ায়। সেই বিজ্ঞানময় পুরুষ বা বলতে পারেন, স্বপ্নপুরুষ ইন্দ্রিয়দের নিজের অধীনে রেখে নিজের দেহের ভেতরে থেকেই ইচ্ছামতো ঘোরে-ফেরে, কাজ-কর্ম করে (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮)।
এরপর সুষুপ্তি অবস্থা। জেগে থাকার সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে ঐ বিজ্ঞানময় পুরুষ যেসব বিষয় উপভোগ করে, ঘুমোতে যাবার সময় স্বপ্নের মধ্যে সে যার আস্বাদ নেয়, সুষুপ্তির মধ্যে কোন বিষয়ই সে উপভোগ করে না। ঘুমের অতল সাগরে সে তখন তলিয়ে থাকে। কোন তরঙ্গই সে সময় তাকে স্পর্শ করে না… (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।
শ্রুতি অনুযায়ী, এই যে স্বপ্নাবস্থায় জীবাত্মা ইন্দ্রিয়গুলিকে সাথে নিয়ে বিচরণ করে থাকেন, এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, জীব কর্তা। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘বিহারোপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৪)।।
‘উপাদানাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৫)।।
ভাবার্থ : বিহার বা বিচরণাদির উপদেশ থেকেও বুঝা যায় যে, জীব কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৪)। শ্রুতিতে ইন্দ্রিয়াদিকে গ্রহণরূপ কার্যের উপদেশ থাকায় জীব কর্তা-ই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৫)।
এখানে একটি আপত্তি উঠে যে, বুদ্ধি না হয়ে জীব বা আত্মা যদি কর্তাই হয়, তাহলে যা তার পক্ষে কল্যাণকর শুধু সেসব কর্মেরই অনুষ্ঠান করতো- শুভ-অশুভ উভয় কর্ম করতো না। এই আপত্তি খণ্ডন করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, বুদ্ধি আসলে করণ। যদি বুদ্ধিকে কর্তা বলা হয় তাহলে তা করণ হিসাবে কার্য সহায়ক হতে পারে না- ফলে আমাদের অন্য কিছুকে করণরূপে কল্পনা করতে হয়। আর জীব যেমন স্বাধীন হলেও প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়কেই অনুভব করে, ঠিক তেমনি শুভ ও অশুভ উভয় প্রকার কার্যই করতে পারে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘উপলব্ধিবদনিয়মঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৭)।।
‘শক্তিবিপর্যয়াৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৮)।।
ভাবার্থ : জীব কর্তা হলেও শুভাশুভ কার্য সম্পাদনে তার কোন নিয়মিত কর্তৃত্ব বা নিয়ম নেই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৭)। বুদ্ধিকে কর্তা বললে বুদ্ধির করণত্বও লোপ হয়- তা কর্তা হয়ে যায়। আসলে জীবেরই কর্তৃত্ব (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৮)।
তাছাড়া যদি আত্মা কর্তা না হন, তাহলে সাংখ্য-যোগ-সম্মত সমাধিরই বা কী প্রয়োজন ? এছাড়া শ্রুতিশাস্ত্রে যে আছে সমাধির দ্বারা ‘আত্মাকে জানতে হবে’ (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫), তা অর্থহীন হয়ে যায়। সুতরাং আত্মার পক্ষে শাস্ত্রানুযায়ী ‘শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন’ ইত্যাদি সহায়ে সাধনা করে জ্ঞান উৎপাদন এবং সমাধিলাভ করাও সম্ভব হবে না। ফলে জীবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ করাও হবে না। বরং আত্মাকে কর্তা বলে মেনে নিলে তাকে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে দেখলে দোষ হবে না। তাই বেদান্তসূত্রানুসারে-
‘সমাধ্যভাবাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।।
‘যথা চ তক্ষোভয়থা’।। (২/৩/৪০)।।
ভাবার্থ : আত্মার কর্তৃত্ব স্বীকার না করলে আত্মজ্ঞানলাভের জন্য যে সমাধির উপদেশ আছে তা বৃথা হয়ে পড়ে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)। সূত্রধর (কাষ্ঠশিল্পী) ইচ্ছানুসারে কর্তা এবং অকর্তা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু অচেতন বুদ্ধি তা পারে না। সুতরাং জীবই কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪০)।
অর্থাৎ উপাধিযুক্ত জীবই কর্তা। কেননা, শাস্ত্রেও সকল উপদেশই হলো আত্মার বিশেষ গুণযুক্ত অবস্থা বিষয়ে। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘স বা অয়ং পুরুষো জায়মানঃ শরীরং অভিসম্পদ্যমানঃ পাপমভিঃ সংসৃজ্যতে। স উৎক্রামন্ ম্রিয়মাণঃ পাপমনো বিজহাতি’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৮)।।
অর্থাৎ : এই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় পুরুষ (=আত্মা) জন্মগ্রহণ করে যখন শরীর ধারণ করে তখন জাগতিক ধর্ম-অধর্মের নিয়মাধীন হয়ে পাপের সঙ্গে যুক্ত হন। আবার দেহান্তে অর্থাৎ এই শরীর ত্যাগ করার সময়, যাবতীয় পাপকেও পরিত্যাগ করে যান (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৮)।
আত্মা স্বভাবত নিষ্ক্রিয়- যখনই মন বুদ্ধি ইত্যাদি উপাধির সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই আত্মা সক্রিয় হয়। যদি জীবাত্মা স্বভাবতই কর্তা না হন, তাহলে শাস্ত্রের উপদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়। কর্তার মধ্যে কর্তৃত্ব ক্ষমতা থাকেই, সে তাকে কখনো ব্যবহার করে, কখনো করে না। শ্রুতিতে সিদ্ধ করা হয়েছে যে জীবাত্মার এই কর্তৃত্বশক্তি পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত। যেমন কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন সাধুনা কর্মণ্য ভুয়ান্নো, এব অসাধুনা কনীয়ান্ । এষ হ্যেবৈনং সাধু কর্ম কারয়তি তৎ যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষত, এষ উ এবৈনম্ অসাধু কর্ম কারয়তি তং যং অধঃ নিনীষতে। এষ লোকপালঃ। এষ লোকাধিপতিঃ। এষ সর্বেশঃ। স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ, স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ’।। (কৌষীতকি-৩/৮)।।
অর্থাৎ : এই যে আত্মা, শাস্ত্রবিহিত সাধু কাজ করলে যে তাঁর লাভ হলো, বৃদ্ধি হলো- তা যেমন হয় না; আবার অশাস্ত্রীয় অসাধু কাজ করলে যে ক্ষতি হলো, হীন হলো, তাও হয় না। এই মহাপ্রাণ চেতন আত্মা চলেন নিজের ইচ্ছায়। তিনি যদি মনে করেন এ জগতে কাউকে মহান করে তুলবেন, তখন তিনিই তাকে দিয়ে সাধু কাজ করিয়ে নেন। আবার যদি মনে করেন, কারো অধঃপতন ঘটাবেন, তাহলে রাজ্যের অসাধু কাজ তিনিই তাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। ইনি লোকপাল- জীবের প্রভু। ইনি সর্বেশ- সমস্ত গুণসম্পন্ন। জানবে- সেই আত্মাই আমার আত্মা, আমার স্বরূপ। ‘তিনিই আমার আত্মা’- তাঁকে এইভাবে জানবে। ঐ আত্মাই আমার স্বরূপ (কৌষীতকি-৩/৮)।
অতএব, বাদরায়ণও বেদান্তসূত্রে এই সিদ্ধান্ত করেন-
‘পরাত্তু তচ্ছ্রুতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি বাক্যানুসারে জীবের কর্তৃত্ব পরমাত্মা পরমেশ্বরের অধীন (ব্রঃ-২/৩/৪১)।
কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী জীবের ক্রিয়া পরমেশ্বরের অধীন হলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, যেহেতু ঈশ্বর কোন কোন ব্যক্তিকে সৎকার্যে এবং কাউকে আবার মন্দ কার্যে প্রবৃত্ত করেন সেকারণে তাঁকে নিষ্ঠুর এবং অবিবেকী মনে হতে পারে। এই আপত্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন-
‘কৃতপ্রযত্নাপেক্ষস্তু বিহিতপ্রতিষিদ্ধাবৈয়র্থ্যাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪২)।।
ভাবার্থ : জীবের ধর্ম-অধর্ম কার্যানুসারেই ঈশ্বর তাকে শুভ-অশুভ কর্মে প্রবৃত্তি দিয়ে থাকেন। অতএব শাস্ত্রোক্ত বিধি-নিষেধের সার্থকতা আছে (ব্রঃ-২/৩/৪২)।
অর্থাৎ, শাস্ত্রানুসারে, ঈশ্বর জীবের পূর্ব পূর্ব জন্মের সুকৃতি বা দৃষ্কৃতি অনুসারেই শুভাশুভ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এবং সংসার যেহেতু অনাদি, নিশ্চয়ই পুনঃপুনঃ পূর্ব জন্মগুলির কর্মফল তাতে থাকবেই- এবং ঈশ্বরই এসব কর্মফলানুসারে জীবের নিয়ন্তা। সুতরাং ঈশ্বরকে নিষ্ঠুর বা স্বৈরাচারী বলে দোষারোপ করা যায় না। এভাবে বুঝলেই শাস্ত্রের কর্তব্য-অকর্তব্যের বিধিনিষেধের সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। তা নাহলে জীব এসব শাস্ত্র উপদেশ পালন করে কোন লাভবান হতো না। এতে কিন্তু ঈশ্বরের স্বাধীনতার কোন হানি হয় না। যদিও বলা যেতে পারে যে, তিনি তো জীবের শুভাশুভ ক্রিয়ার উপরই ফলদান ব্যাপারে নির্ভরশীল- তিনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন না। এর উত্তরে বলা হয়, একজন রাজা যেমন তাঁর প্রজাকে তাদের কর্মানুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দিয়ে থাকেন- কিন্তু এর দ্বারা রাজার সার্বভৌমত্বেও কোন হানি হয় না।
বাদরায়ণের মতে জীবের স্বপ্ন, সুষুপ্তি, জাগৃতি, মূর্চ্ছা প্রভৃতি হলো আত্মার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা। এক্ষেত্রেও তিনি বিভিন্ন শ্রুতিবাক্যকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে সিদ্ধান্ত করেছেন।
(১) স্বপ্নাবস্থা : সুপ্তিতে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তু মায়ামাত্র। তবে স্বপ্নে যে বস্তু দৃষ্ট হয়, স্বপ্নদ্রষ্টা জীবই এই স্বগ্নজগতের সৃষ্টিকার্যের কর্তা। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থা হলো আত্মারই এক ভিন্ন অবস্থা। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘তস্য বা এতস্য পুরুষস্য দ্বে এব স্থানে ভবত- ইদং চ পরলোকস্থানঞ্চ। সন্ধ্যং তৃতীয় স্বপ্নস্থানং; তস্মিন্ সন্ধ্যে স্থানে তিষ্ঠন্নেতে উভে স্থানে পশ্যতি ইদং চ পরলোকস্থানঞ্চ। অথ যথাক্রমোহয়ং পরলোকস্থানে ভবতি তমাক্রমং আক্রম্য উভয়ান্ পাপমন আনন্দাংশ্চ পশ্যতি। স যত্র প্রস্বপিতি লোকস্য সর্বাবতো মাত্রামপাদায় স্বয়ং বিহত্য স্বয়ং নির্মায় স্বেন ভাসা স্বেন জ্যোতিষা প্রস্বপিতি। অত্রায়ং পুরুষঃ স্বয়ংজ্যোতির্ভবতি’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৯)।।
‘ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্ রথযোগান্ পথঃ সৃজতে। ন তত্রানন্দা মুদঃ প্রমুদো ভবন্ত্যথানন্দা মুদঃ প্রমুদঃ সৃজতে। ন তত্র বেশান্তাঃ পুষ্করিণ্যঃ স্রবন্ত্যে ভবন্ত্যথ বেশান্তান্ পুষ্করিণীঃ স্রবন্তীঃ সৃজতে; স হি কর্তা’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১০)।।
অর্থাৎ :
সেই পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মার স্থান হলো দুটি- ইহলোক আর পরলোক। এই দুটি জগতের সন্ধি হয়েছে স্বপ্নস্থানে। এটি তৃতীয় স্থান। এই স্থানে অবস্থান করেই জীবাত্মা ইহলোক এবং পরলোক- এই দুটি জগৎকেই দেখেন। মানুষ যা আশ্রয় করে অর্থাৎ যে সাধনাকে অবলম্বন করে পরলোকে যায়, জীবাত্মাও তাকে অবলম্বন করেই পাপ (দুঃখ) এবং আনন্দ- এই দুটিকেই দেখেন। আবার যখন প্রসুপ্ত হন, তখন জীবাত্মার জন্ম-গ্রহণ; শরীর ধারণ থেকে শুরু করে ইহজগতের যতগুলি উপাদান সবগুলি আত্মসাৎ করে, তাকে ভেঙে-গুঁড়িয়ে আবার নতুনভাবে তৈরি করে এক অভিনব স্বপ্নরাজ্য গড়ে তোলেন- আপনার জ্যোতি দিয়ে নিজের মতো করে। এই অবস্থায় পুরুষ হন স্বয়ংজ্যোতি (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৯)।
দুস্তর পথ পাড়ি দেবার রথ নেই, রথ টানার অশ্ব নেই, এই আত্মাই আপন ইচ্ছায় নির্মাণ করে নেন রথ, অশ্ব। যেখানে আমোদ নেই, প্রমোদ নেই, হর্ষ নেই, আনন্দ নেইইে স্বয়ংজ্যোতি আত্মা আপন লীলাবিলাসে সেখানে সে-সবও সৃজন করে নেন। যেখানে নেই জলাশয় বা ডোবা, নেই পুকুর, ইনিই সেখানে তা তৈরি করে নেন আপন ইচ্ছায়। তিনিই কর্তা। তাঁর যা কিছু প্রয়োজন স্বয়ংজ্যোতি আত্মা ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তা সবই পূরণ করে নেন (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১০)।
এই শ্রুতিবচনই প্রমাণ করে যে, জীবই স্বপ্ন-জগতের সৃষ্টি-কার্য করে- পরমেশ্বর নন। এবং তারই অনুসরণে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘সন্ধ্যে সৃষ্টিরাহ হি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১)।।
‘মায়ামাত্রং তু, কার্ৎস্ন্যেনানভিব্যক্তস্বরূপত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩)।।
ভাবার্থ : শ্রুতিতে স্বপ্নাবস্থায় যে রথ প্রভৃতি সৃষ্টির উল্লেখ আছে, স্বপ্নদ্রষ্টা জীবই তার কর্তা, কারণ শ্রুতিতে অনুরূপ বাক্য আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১)। কিন্তু স্বপ্নে যে রথ ইত্যাদি কাম্যবস্তু সৃষ্ট হয়, তা মায়ামাত্র- কারণ তাতে জাগ্রত অবস্থার সকল লক্ষণ থাকে না (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩)।
স্বপ্নে সৃষ্টবস্তু মায়া হলেও স্বপ্নকে ব্রহ্মের সংকল্প হিসেবেই মনে করা হয়। তাই ভালোমন্দ নানা ঘটনার পূর্বসূচনা স্বপ্নেই হয়ে থাকে বলে শ্রুতিতেও স্বীকার করা হয়। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে একটি শ্রুতি আছে-
‘তদেষ শ্লোকঃ, যদা কর্মসু কামোষু স্ত্রিয়ং স্বপ্নেষু পশ্যতি সমৃদ্ধিং তত্র জানীয়াৎ তস্মিন্ স্বপ্ননিদর্শনে, তস্মিন্ স্বপ্ননিদর্শনে’।। (ছান্দোগ্য-৫/২/৮)।।
অর্থাৎ : এ বিষয়ে একটি শ্লোক আছে- কাম্যকর্মের অনুষ্ঠানকালে যদি স্বপ্নে স্ত্রীলোক দর্শন হয়, তবে জানবে কর্মে তোমার সিদ্ধিলাভ নিশ্চিত। এটিই হলো স্বপ্ন-নিদর্শনে; স্বপ্ন নিদর্শনে (ছান্দোগ্য-৫/২/৮)।
এবং এই শ্রুতিকে প্রামাণ্য ধরে বাদরায়ণও সিদ্ধান্ত করেন-
‘সূচকশ্চ হি শ্রুতেঃ, আচক্ষতে চ তদ্বিদঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৪)।।
ভাবার্থ : স্বপ্ন ভাবী শুভাশুভের সূচনা করে, শ্রুতির এবং স্বপ্ন রহস্যবেত্তা পণ্ডিতদেরও এমন অভিমত (ব্রঃ-৩/২/৪)।
(২) জাগ্রৎ অবস্থা : জাগ্রৎ অবস্থা হলো জীবাত্মার বোধির জগত। আর স্বপ্নাবস্থা হলো স্বসৃষ্ট মায়ার জগৎ। কেননা, জাগ্রৎ অবস্থায় মানুষ যা দেখে, যা অনুভব করে, স্বপ্নে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে পার্থক্য হলো জীব তখন থাকে ‘অবিদ্যা’ বা মায়া-কবলিত। তাই স্বপ্ন ও জাগ্রৎ অবস্থা প্রসঙ্গে শ্রুতির ঋষিরা বলেন- এটি জীবের অবস্থান্তর। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘স বা এষ এতস্মিন্ স্বপ্নে রত্বা চরিত্বা দৃষ্টৈবব পুণ্যঞ্চ পাপঞ্চ পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি বুদ্ধান্তায়ৈব। স যত্তত্র কিঞ্চিৎ পশ্যতি অনন্বাগতস্তেন ভবত্যসঙ্গো হি অয়ং পুরুষ ইতি…’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৬)।।
‘স বা এষ এতস্মিন্ বুদ্ধান্তে রত্বা চরিত্বা দৃষ্টৈবব পুণ্যং চ পাপং চ পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি স্বপ্নান্তায়ৈব’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৭)।।
‘তদ্ যথা মহামৎস্য উভে কুলে অনুসঞ্চরতি পূর্বং চাপরং চৈবমেবায়ং পুরুষ এতাবুভাবন্তৌ অনুসঞ্চরতি স্বপ্নান্তং চ বুদ্ধান্তং চ’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৮)।।
অর্থাৎ :
সেই পুরুষ স্বেচ্ছাবিহার, স্বপ্নানন্দ উপভোগের পর, যে পথ ধরে গিয়েছিলেন নিদ্রাজগতে, সেই পথ ধরেই আবার ফিরে আসেন বোধের জগতে বা জাগ্রৎ অবস্থায়। স্বপ্নে তিনি যা কিছুই দেখুন না কেন, তাতে তার কোন আসক্তি থাকে না। তিনি নির্লিপ্ত, অসঙ্গ- স্বয়ংজ্যোতি… (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৬)। বোধির জগতে অর্থাৎ জাগ্রৎ অবস্থায় এই দৃশ্যমান জগতে বিহার করে, পাপ-পুণ্য দেখে স্বপ্ন দেখার জন্য আবার সেই পুরুষ একই পথ ধরে স্বপ্নস্থানে ফিরে যান (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৭)। নদীর জলে এক মহামৎস্য অর্থাৎ বিশালাকায় মাছ যেমন এপাড় থেকে ওপাড়ে আবার এপাড়ে বিচরণ করে, এই পুরুষও ঠিক সেভাবেই বিহার করেন স্বপ্ন থেকে জাগরিত স্থানে- স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝে (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৮)।
স্বপ্নে বাহ্যবস্তু থাকে না, তবুও স্বপ্নে যা দেখা যায় তা যে মিথ্যা তা স্বপ্নাবস্থায় বুঝা যায় না। কিন্তু কিভাবে বুঝা যায় যে স্বপ্নাবস্থা ছিলো অবিদ্যায় মায়া কবলিত ? কারণ স্বপ্নে যা দেখা যায়, তা জাগ্রৎ হয়ে জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞতার দ্বারা বাধিত হয়- দেখা যায় তা মিথ্যা ছিলো। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থা একপ্রকার স্মৃতি, আর জাগ্রত অবস্থা হলো বাস্তব অনুভব। সুতরাং তাকে মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। ফলে দুই অবস্থার অভিজ্ঞা একরূপ নয়। তাই বাদরায়ণ বলেন-
‘বৈধর্ম্যাচ্চ ন স্বপ্নাদিবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৯)।।
ভাবার্থ : জাগ্রৎ ও স্বপ্নাবস্থার চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে বলে, জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞা স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞার অনুরূপ নয় (ব্রঃ-২/২/২৯)।
(৩) সুষুপ্তি : এই স্বপ্নাবস্থা ও জাগৃতি ছাড়াও জীবাত্মার আরেকটি অবস্থা হলো সুষুপ্তি। এটা কী ? শাস্ত্রে (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮-১৯) আছে, সুপ্তি বা নিদ্রা দু’রকমের হয়। একটিতে মানুষ স্বপ্ন দেখে, অন্যটিতে দেখে না। স্বপ্নহীন এই নিদ্রাকেই ‘সুষুপ্তি’ বলে। এই সুষুপ্তির লক্ষণ ব্যাখ্যাকল্পে ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘তদাত্রৈতৎ সুপ্তঃ সমস্তঃ সম্প্রসন্নঃ স্বপ্নং ন বিজানাত্যাসু তদা নাড়ীষু সৃপ্তো ভবতি তং ন কশ্চন পাপ্মা স্পৃশতি তেজসা হি তদা সম্পন্নো ভবতি’।। (ছান্দোগ্য-৮/৬/৩)।।
অর্থাৎ : সুতরাং কোন মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয় তখন তার সমস্ত ইন্দ্রিয় শান্ত হয়ে যায়, তারা কোন কাজ করে না। সেই ব্যক্তির আর কোন দুঃশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা থাকে না। তখন সে স্বপ্নও দেখে না। ইন্দ্রিয়গুলি তখন তার নাড়ীতে প্রবেশ করে। তখন সূর্যরশ্মি তাকে ঘিরে থাকায় কোন পাপই তাকে স্পর্শ করতে পারে না (ছান্দোগ্য-৮/৬/৩)।
এবং বৃহদারণ্যকে জীবাত্মার পূর্বোল্লিখিত জাগৃতি ও স্বপ্নাবস্থার পরপরই সুষুপ্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে-
‘তদ্ যথা অস্মিন্নাকাশে শ্যেনো বা সুপর্ণো বা বিপরিপত্য শ্রান্তঃ সংহৃত্য পক্ষৌ সল্লয়ায়ৈব ধ্রিয়ত, এবমেবায়ং পুরুষ এতস্মা অন্তায় ধাবতি, যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৯)।।
‘তদ্বা অস্যৈতৎ অতিচ্ছন্দাঃ অপহত পাপ্মা অভয়ং রূপম্ । তদ্ যথা প্রিয়য়া স্ত্রিয়া সম্পরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিঞ্চন বেদ নান্তরং, এবায়ং পুরুষঃ প্রাজ্ঞেনাত্মনা সম্পরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিঞ্চন বেদ, নান্তরম্ । তদ্ বা অস্যৈতৎ আপ্তকামং আত্মকামং অকামং রূপং শোকান্তরম্’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/২১)।।
অর্থাৎ :
আকাশপথে উড়তে-উড়তে, বিহারে-বিহারে শ্রান্ত শ্যেন বা বিচিত্রপক্ষ পাখি এক সময় ডানা গুটিয়ে যায় নিজের নীড়ের দিকে, তেমনি এই পুরুষও বিশ্রামের আশায় ছুটে চলে সুষুপ্তির দিকে। সেখানে কোন কামনা নেই, কোন স্বপ্নও নেই (বৃহদারণ্যক-৪/৩/১৯)। আত্মার এই রূপটি হলো অতিচ্ছন্দা অর্থাৎ কামনারহিত, যাবতীয় পাপরহিত; এটি হলো অন্তরঙ্গ অভয় রূপ। প্রেমিক-প্রেমিকার যখন নিবিড় আলিঙ্গন হয়, তখন যেমন তার স্থান-কালের জ্ঞান থাকে না, দেখেও দেখে না সেখানে আছে ঘরের মানুষ কি বাইরের মানুষ, পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে শারীর-পুরুষেরও তখন সেই অবস্থা। তখন সে বাহ্যজ্ঞান রহিত। এটি হলো আত্মার আপ্তকাম, আত্মকাম, কামনাহীন, শোকাতীত রূপ (বৃহদারণ্যক-৪/৩/২১)।
এই যে সুপ্তিতে জীবের বাহ্যজ্ঞান রহিত স্বপ্নহীন সুষুপ্তি অবস্থা, প্রশ্ন আসতে পারে, তখন জীবাত্মার অবস্থান কোথায় থাকে ? শ্রুতিতে বলা হচ্ছে- ‘সুষুপ্তিকালে তিনি সতের সাথে একীভূত হন এবং নিজ স্বরূপে গমন করেন’ (ছান্দোগ্য-৬/৮/১)। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার এই একীভূত অবস্থার সাথে তাহলে দেহত্যাগী মুক্ত আত্মার ভিন্নতা কোথায় ? এই সংশয় দূর করতেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘তদভাবো নাড়ীষু, তচ্ছ্রতেঃ, আত্মনি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৭)।।
ভাবার্থ : সুষুপ্তি অবস্থায় জীবাত্মা নাড়ী, পুরীতৎ এবং ব্রহ্ম এই তিনটি পৃথক বস্তুর সাথেই মিলিত হয়ে থাকে। তা শ্রুতি থেকে জানা যায় (ব্রঃ-৩/২/৭)।
কেননা, শ্রুতিতেই রয়েছে যে-
‘অথ যথা সুষুপ্তো ভবতি যদা ন কস্যচন বেদ হিতা নাম নাড্যো দ্বাসপ্ততিঃ সহস্রাণি হৃদয়াৎ পুরীততম্ অভিপ্রতিষ্ঠন্তে, তাভিঃ প্রত্যবসৃপ্য পুরীততি শেতে স যথা কুমারো বা মহারাজো বা মহাব্রাহ্মণ্যে বাতিঘ্নীমানন্দস্য গত্বা শয়ীত এবমেবৈষ এতচ্ছেতে’।। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।।
অর্থাৎ : জেগে থাকার সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ঐ বিজ্ঞানময় পুরুষ যেসব বিষয় উপভোগ করে, ঘুমোতে যাবার সময় স্বপ্নের মধ্যে সে যার আস্বাদ নেয়, সুষুপ্তির মধ্যে কোন বিষয়ই সে উপভোগ করে না। ঘুমের অতল সাগরে সে তখন তলিয়ে থাকে। কোন তরঙ্গই সে সময় তাকে স্পর্শ করে না। -রাজা বললেন, ব্রহ্মন্ এই সময় সেই পুরুষ কোথায় থাকে জানো ? মানুষের হৃদপিণ্ড থেকে বাহাত্তর হাজার নাড়ী বেরিয়ে সারা শরীরকে হৃদয়ের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। প্রতিটি নাড়ীই হিতকর। তাই এই নাড়ীগুলিকে বলে ‘হিতা’ নাড়ী। সুষুপ্তিকালে সেই বিজ্ঞানময় পুরুষ এই নাড়ীগুলির সঙ্গে হৃদয়ে শুয়ে থাকে। তখন কারো কোন বোধশক্তিই তাকে সেখানে বিব্রত করতে পারে না। সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটন কোন কিছুই সে সময় সে বোধ করে না। মহারাজ, মহাব্রাহ্মণের মহা আনন্দ তখন তার মধ্যে। সেই আনন্দ তার কিসের ? পরমাত্মার মধ্যে নিশ্চিন্তে থাকতে পারার আনন্দ (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।
সুষুপ্তিতে জীবাত্মা যেভাবে ব্রহ্মে লীন হয়, সুষুপ্তি অবস্থা থেকে যখন জাগ্রৎ অবস্থায় ফিরে আসে তখন সে সৎ বা ব্রহ্ম থেকেই ফিরে আসে। সুষুপ্তি থেকে জীবাত্মার জাগ্রৎ অবস্থায় ফিরে আসা বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের (বৃহদারণ্যক-২/১/২০) মতোই কৌষীতকি উপনিষদের শ্রুতিতেও বলা হয়েছে-
‘যদা সুপ্তঃ স্বপ্নং ন কঞ্চন পশ্যতি অথাস্মিন্ প্রাণ এবৈকধা ভবতি। তদৈনং বাক্ সর্বৈর্নামভিঃ সহাপ্যেতি। চক্ষুঃ সর্বৈ রূপৈঃ সহাপ্যেতি। শ্রোত্রং সর্বং শব্দৈঃ সহাপ্যেতি। মনঃ সর্বৈর্ধ্যানৈঃ সহাপ্যেতি। স যদা প্রতিবুধ্যতে যথাহগ্নের্জ্বলতঃ সর্বা দিশো বিস্ফুলিঙ্গা বিপ্রতিষ্ঠেরণ্ এবমেব এতস্মাদাত্মনঃ প্রাণা যথায়তনং বিপ্রতিষ্ঠন্তে। প্রাণেভ্যো দেবা দেবেভ্যো লোকাঃ’।। (কৌষীতকি-৪/১৯)।।
অর্থাৎ :
ঘুমন্ত মানুষ যখন কোন স্বপ্নই দেখে না, সুষুপ্তিতে মগ্ন, তখন সে এইসব হিতা নাড়ীর মধ্যে থেকে প্রাণের (ব্রহ্মের) সঙ্গে এক হয়ে যায়। জীবাত্মা তখন প্রাণের (ব্রহ্মের) মাঝে বিলীন। তখন তার যতো ইন্দ্রিয় আর ইন্দ্রিয়ের বিষয় আছে যেমন বাক্-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে নাম, চক্ষু-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে রূপ, কর্ণ-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে শব্দ, মন-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে চিন্তা- সব, সব তারই মাঝে বিলীন হয়ে যায়। যখন ঘুম ভাঙে, জেগে ওঠে, তখন জ্বলন্ত আগুন থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছিটকে যায়, সেইভাবে ঐ মহাপ্রাণ আত্মা থেকে জীবাত্মার প্রাণশক্তি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়শক্তিগুলো ছিটকে বেরিয়ে এসে যে যার বিষয়ের দিকে ছুটে যায়। প্রাণসমূহ থেকে দেবতারা অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দেবতারা আর ঐ দেবতাদের থেকে লোকালোকের প্রকাশ (কৌষীতকি-৪/১৯)।
তাই বেদান্তসূত্রে সূত্রকার বাদরায়ণ যদিও বলেন-
‘অতঃ প্রবোধোহস্মাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৮)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্ম বা আত্মাই যখন জীবের সুষুপ্তিস্থান, তখন এই আত্মা থেকেই জীবের জাগরণও হয়ে থাকে (ব্রঃ-৩/২/৮)।
তবুও প্রশ্ন উঠে, সৎ হতে বা ব্রহ্ম হতে এসেও বা জাগরিত হয়েও জীব কেন জানতে পারে না যে সে ব্রহ্ম থেকেই এসেছে ? কিংবা তার স্মৃতিতেই বা কেন তা থাকে না ? এ বিষয়ে শ্রুতিতেও উক্ত হয়েছে যে-
‘ইমাঃ সোম্য নদ্যঃ পুরস্তাৎ প্রাচ্যঃ স্যন্দন্তে পশ্চাৎ প্রতীচ্যন্তাঃ সমুদ্রাৎ সমুদ্রমেবাপিযন্তি স সমুদ্র এব ভবতি তা যথা তত্র ন বিদুরিয়মহমস্মীয়মহমস্মি-ইতি’।। (ছান্দোগ্য-৬/১০/১)।।
‘এবমেব খলু সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সত আগম্য ন বিদুঃ সত আগচ্ছামহ ইতি ত ইহ ব্যাঘ্রো বা সিংহো বা বৃকো বা বরাহো বা কীটো বা পতঙ্গো বা দংশো বা মশকো বা যদ্যদ্ভবন্তি তদাভবন্তি’।। (ছান্দোগ্য-৬/১০/২)।।
অর্থাৎ :
হে সোম্য, এই পূর্ববাহিনী নদীসমূহ পূর্বদিকে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চিমবাহিনী নদীসমূহ পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়। সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে তারা আবার সমুদ্রেই লীন হয় এবং সমুদ্রই হয়ে যায়। ঠিক যেমন এই সব নদী সমুদ্রে মিশে গিয়ে ‘আমি অমুক নদী, আমি অমুক নদী’ এরূপ পৃথক অস্তিত্ব আর জানতে পারে না-’ (ছান্দোগ্য-৬/১০/১)। একইভাবে হে সোম্য, এইসব জীব সৎ থেকে আসে, কিন্তু তা তারা জানে না। তারা কখনো ভাবে না, ‘আমরা সৎ থেকে এসেছি।’ পূর্বজন্মে (বা সুষুপ্তির আগে) পৃথিবীতে তারা বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ, শূয়োর, কীট-পতঙ্গ, মাছি বা মশা ইত্যাদি যে রূপেই থাকুক না কেন, তাদের প্রত্যেককেই আবার (কর্মফল অনুযায়ী) ফিরে আসতে হয় (ছান্দোগ্য-৬/১০/২)।
এখানে আপত্তিটি হলো, জীবের বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত সুষুপ্তিকালে ব্রহ্মের সাথে মিলিত বা আত্মার স্বরূপে ফিরে যাওয়ার সাথে দেহত্যাগী মুক্ত আত্মার ব্রহ্মে লীন হওয়ার মধ্যে যেহেতু পার্থক্য থাকে না, তাই সুষুপ্তির পর জাগৃতি অবস্থায় ফিরে আসার ক্ষেত্রেও একই জীব যে সুষুপ্তি হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়, তার নিশ্চয়তা কোথায় ? কেননা জীব পুনর্জন্ম নিয়ে পুর্বজন্মের কোন স্মৃতি যেমন মনে করতে পারে না, তেমনি সুষুপ্তিকালীন কোন বিষয়ও জীবের স্মৃতিতে থাকে না। তাই এমন কোন নিশ্চিত নিয়ম থাকতে পারে না যে, একই জীব ব্রহ্ম থেকে ফিরে আসে। এই আপত্তি নিষ্পত্তিকল্পেই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, যেহেতু জীব মায়াদ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, সেজন্য সুষুপ্তিকালে জীব ব্রহ্মের সাথে নিজের একত্বকে অনুভব করতে পারে না। এবং এ প্রসঙ্গে বেদান্তসূত্রের সিদ্ধান্ত হলো-
‘স এব তু, কর্মানুস্মৃতিশব্দবিধিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৯)।।
ভাবার্থ : সুষুপ্ত জীবই পুনরায় জাগ্রত হয়। তা তার কর্ম, স্মৃতি, শাস্ত্রীয় প্রমাণ এবং নৈতিক শিক্ষা থেকে জানা যায় (ব্রঃ-৩/২/৯)।
অর্থাৎ, এই সূত্রটি বলতে চায় যে, একই জীব সুষুপ্তির পর ব্রহ্ম হতে প্রত্যাগমন করে যেসব কারণে- (১) কোন ব্যক্তি নিদ্রার পূর্বে কোন অসমাপ্ত কাজকে নিদ্রা ভঙ্গের পর পুনরায় সম্পন্ন করে থাকে- তা আমরা দেখতে পাই। যদি সে একই জীব না হতো তা হলে অন্য জীবের কৃত অর্ধসমাপ্ত কাজকে সম্পন্ন করার জন্য তার কোন আগ্রহ থাকতো না। (২) নিদ্রার পূর্বে এবং পরে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের একত্বের অভিজ্ঞতা। (৩) আমাদের পূর্ববর্তী ঘটনার স্মৃতি। (৪) শ্রুতি প্রমাণ; যেমন এই শ্রুতিটি-
‘ত ইহ ব্যাঘ্রো বা সিংহো বা বৃকো বা বরাহো বা কীটো বা পতঙ্গো বা দংশো বা মশকো বা যদ্ যদ্ ভবন্তি তদাভবন্তি’।। (ছান্দোগ্য-৬/৯/৩)।।
অর্থাৎ : জীবগণ (নিদ্রার পূর্বে) এই পৃথিবীতে যে যা ছিলো- বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, শূয়োর, কীট-পতঙ্গ, মশা, মাছি ইত্যাদি (নিদ্রার পরে) তারা সেভাবেই ফিরে আসে। (তারা কিন্তু জানে না তারা সৎ থেকে এসেছে) (ছান্দোগ্য-৬/৯/৩)।
এখানে এই শ্রুতিতে দেখতে পাই যে, একই জীব সুষুপ্তির পর ব্রহ্ম হতে ফিরে আসে। এবং অন্য কারণটি হলো, (৫) যদি সুষুপ্তির পথে গতিশীল ব্যক্তিটি ব্যুত্থিত ব্যক্তিটি থেকে পৃথক হতো, তাহলে কর্ম বা জ্ঞান সম্পর্কে শাস্ত্রীয় উপদেশগুলি নিরর্থক হয়ে যেতো। কারণ, যদি কোন ব্যক্তি নিদ্রিত হওয়া মাত্র ব্রহ্মের সাথে চিরন্তনভাবে একীভূত হয়ে যেতে পারতো, তাহলে মুক্তিলাভের জন্য শাস্ত্রীয় উপদেশের কোন মূল্যই থাকতো না।
(৪) মূর্চ্ছা : জীবের অন্য আরেকটি অবস্থা রয়েছে, তা হলো মূর্চ্ছা। বাদরায়ণের মতে, মূর্চ্ছা হলো অর্ধ-মরণ। শরীরে অবস্থান কালে জীবের তিনটি মাত্র অবস্থা থাকে- জাগ্রৎ, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি। আর চতুর্থ অবস্থাটি হলো মৃত্যু। কিন্তু মূর্চ্ছা অবস্থাকে জীবের পঞ্চম অবস্থারূপে গণ্য করা যায় না- যেহেতু এরূপ কোন অবস্থার কথা আমাদের জানা নেই। তাহলে মূর্চ্ছা অবস্থার স্বরূপটি কী ? তা কি জীবের একটি পৃথক অবস্থা, অথবা এই তিন অবস্থারই অন্যতম অবস্থা ? তা জাগ্রৎ বা স্বপ্ন অবস্থা হতে পারে না, কারণ তাতে কোন চেতনা বা কোন কিছুর অনুভূতি থাকে না। তা সুষুপ্তিও নয়, কারণ সুষুপ্তি আনন্দ দেয়, মূর্চ্ছা আনন্দ দেয় না। তা মৃত্যুও নয়, কারণ জীব মূর্চ্ছার পর আবার প্রাণময় হয়ে ওঠে। সুতরাং একমাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকে এই যে, মূর্চ্ছাবস্থায় জীব আংশিকভাবে সুষুপ্তির অবস্থাই প্রাপ্ত হয়। এর কারণ হলো, সে অবস্থায় জীবের কোন সংজ্ঞা থাকে না এবং পরবর্তীকালে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ অবস্থাটি আংশিকভাবে মৃত অবস্থাও বটে, কারণ সে অবস্থায় জীব দুঃখ এবং বেদনা অনুভব করে যার প্রতিক্রিয়া তার বিকৃত মুখে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রকট হয়ে থাকে। ফলে এ অবস্থাটি একটি পৃথক অবস্থাই বটে, যদিও তা সাময়িকভাবে ঘটে। কিন্তু তা যে একটি পঞ্চম অবস্থা নয় তার কারণ হলো, মূর্চ্ছাবস্থা অপর দুটি অবস্থারই সংমিশ্রণ বিশেষ। তাই মূর্চ্ছা সম্পর্কে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘মুগ্ধেহর্ধসংপত্তিঃ, পরিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১০)।।
ভাবার্থ : মূর্চ্ছা জীবের অর্ধেক মরণাবস্থা, এবং তা জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও মরণাবস্থার অতিরিক্ত একটি অবস্থা (ব্রঃ-৩/২/১০)।
কর্মফল ও পুনর্জন্ম
.
বেদান্তসূত্রে সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, জগৎকে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মকেও জীবের কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেননা, এই সৃষ্টিজগৎ আপ্তকাম ব্রহ্মের লীলা (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) হলেও, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মর পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ঠুরতার আপত্তি উত্থাপিত হয়। বস্তুত জগতে- মানব সমাজে- যে বৈষম্য দেখা যায়, অনেকেই শ্রম করতে করতে অনাহারে মৃতপ্রায় হলেও কেউ কেউ বিনা পরিশ্রমেই অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে বিলাসী জীবন কাটায়। তাদের দেখেই পুরোহিতবর্গ দেবলোকের কল্পনা করেছেন। আবার মনুষ্য থেকে ক্ষুদ্রতম কীট পর্যন্ত প্রাণিজগতে যে ভীষণ সংহার দেখা যায় যায় তা জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্মকে বড়ই হৃদয়হীন বলে প্রমাণ করে, এবং তার থেকে আত্মরক্ষার জন্যই উপনিষদে পূর্বজন্মকৃত কর্মসিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে-
‘তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোনিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চণ্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’- (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।
একই বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে এভাবে-
‘…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান।’- (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।
অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মফলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে এজন্মে কিভাবে এই ফল ভোগ করতে হবে, এই জন্মে সুখ ভোগ করবে, না কি দুঃখ ভোগ করবে। তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা- শোষক-শোষিত, প্রভু-ভৃত্য প্রথার- দৃঢ় সমর্থক বাদরায়ণও একে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেছেন-
(বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি), ‘জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।
এবং জীবের এই কর্মফল দাতা যে ঈশ্বরই, তা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করেই তিনি বলেন-
‘ফলমতঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৮)।।
ভাবার্থ : জীবের কর্মফলদাতা যে ঈশ্বর তাই যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত (ব্রঃ-৩/২/২৮)।
এখানে হয়তো একটি আপত্তি উঠতে পারে যে, কর্ম তো একটা সময়ে করা হয়ে থাকে, তার আবার আগের জগতের কথা কী করে আসে ? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও হতে পারে যে, যেহেতু প্রথম সৃষ্টির পূর্বে জীবাত্মার পক্ষে তার পূর্বে কোন অবস্থান সম্ভব নয়, তাই কর্মফল থাকাও সম্ভব নয়, তাহলে প্রথম সৃষ্টির সময়েই জীবের মধ্যে অবস্থার পার্থক্য আসবে কোত্থেকে- যদি না ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে এই ভেদ সৃষ্টি করে থাকেন ? এই আপত্তির উত্তরে বাদরায়ণ বলেন যে, সৃষ্টি অনাদি, অতএব কর্মও অনাদি-
(ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ), ‘সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মের কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে এর উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।
পুনর্জন্মের বিষয়ে বাদরায়ণ উপনিষদের সিদ্ধান্তকে সু-ব্যবস্থিতরূপে একত্রিত করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের (ছাঃ-৫/১০/৭) শ্রুতিতে সুকৃতি-দুষ্কৃতির মাধ্যমে পুনর্জন্মের যে ধারণা অভিপ্রেত হয়েছে, তার থেকেই পরবর্তী উপনিষদগুলিতে জীবের পুনর্জন্মচক্রের একটা দার্শনিক রূপরেখাও তৈরি হয়ে গেছে। যেমন, প্রশ্ন-উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘তেজো হ বা উদানঃ তস্মাৎ উপশানততেজাঃ। পুনর্ভবম্ ইন্দ্রিয়ৈঃ মনসি সম্পদ্যমানৈঃ’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/৯)।। ‘যৎ চিত্তন্তেনঃ এষঃ প্রাণম্ আয়াতি। প্রাণঃ তেজসা যুক্তঃ সহাত্মনা যথাসঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/১০)।।
অর্থাৎ :
অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার শরীর শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয় (প্রশ্ন-৩/৯)। মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত সংস্কার বা চিন্তা ও বাসনা সমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয় (কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়)। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্ম গ্রহণ করে (প্রশ্ন-৩/১০)।
এই ধারণারই আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে-
‘স যত্র অয়মাত্মাহ্বল্যং ন্যেত্য সংমোহমিব ন্যেতি অথৈনমেতে প্রাণা অভিসমায়ন্তি স এতাস্তেজোমাত্রাঃ সমভ্যাদদানো হৃদয়মেব অন্ববক্রামতি ষ যত্রৈষ চাক্ষুষঃ পুরুষঃ পরাঙ্ পর্যাবর্ততে, অথ অরূপজ্ঞ ভবতি’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/১)।। ‘একীভবতি ন পশ্যতীতি আহুঃ, একীভবতি ন জিয়তীতি আহুঃ, একীভবতি ন রসয়ত ইতি আহুঃ, একীভবতি ন বদতীতি আহুঃ, একীভবতি ন শৃণোতীতি আহুঃ, একীভবতি ন মনুতে ইত্যাহুঃ, একীভবতি ন স্পৃশতীতি আহুঃ একীভবতি ন বিজানাতীত্যাহুঃ। তস্য হি এতস্য হৃদয়স্যাগ্রং প্রদ্যোততে, তেন প্রদ্যোতেন এষ আত্মা নিষ্ক্রামতি চক্ষুষ্টো বা মূর্ধ্নো বা অন্যেভ্যো বা শরীরদেশেভ্যঃ। তং উৎক্রমন্তং প্রাণোহনুৎক্রামতি, প্রাণমনুৎক্রামন্তং সর্বে প্রাণা অনুৎক্রামন্তি, সবিজ্ঞানো ভবতি, সবিজ্ঞানমেব অন্ববক্রামতি। তং বিদ্যাকর্মণী সমন্বারভেতে পূর্বপ্রজ্ঞা চ’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২)।। তদ্ যথা তৃণজলায়ুকা তৃণস্যান্তং গত্বাহন্যমাক্রমম্ আক্রম্যাত্মানম্ উপসংহরত্যেবং এবায়মাত্মা ইদং শরীরং নিহত্যাহবিদ্যাং গময়িত্বাহন্যমাক্রমং আক্রম্যাত্মানং উপসংহরতি’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।।
অর্থাৎ :
এই শারীর-পুরষ আত্মা দুর্বলতার কারণে যখন সংজ্ঞালোপ পাবার মতো অবস্থায় আসে তখন সবকটি প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এসে জড়ো হয় আত্মার কাছে। যে তেজশক্তি নিয়ে ইন্দ্রিয়রা ছিলো প্রকাশমান, করছিলো আপন-আপন নির্দিষ্ট কাজ, তাদের সেই তেজকে নিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে। সঙ্গত কারণেই চাক্ষুষ-পুরুষ আদিত্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে, চোখ আর কেমন করে রূপ দেখবে ? তাই মুমূর্ষুর চোখে কোন রূপই ধরা পড়ে না (বৃঃ-৪/৪/১)। আত্মার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে কি আর স্বাতন্ত্র্য থাকে ? একীভূত হয়ে থাকার ফলে, লোকে বলে শুনতে, চিন্তা করতে, স্পর্শ করতে পারছে না, কিছু জানতেও পারছে না। সেই সময় তার হৃদয়ের অগ্রভাব দীপ্তিযুক্ত হয়ে ওঠে, প্রকাশিত হয় হৃদয়পথে নির্গমন দ্বার। দেহকে ছেড়ে জ্যোতির সাহায্যে সেই আত্মা জীবের কামনা অনুযায়ী অনুরূপ পথ দিয়ে বেরিয়ে যান। যদি তার সাধনা থাকে আদিত্যলোকের তবে আত্মা নিষ্ক্রান্ত হন চক্ষুপথে, ব্রহ্মলোকের জন্য ব্রহ্মতালু পথে, আবার নানা-বাসনা, নানা কর্মানুসারে অনুরূপ অপরাপর ইন্দ্রিয়পথে। আত্মা নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যপ্রাণ তাঁর অনুগমন করে, সেই সঙ্গে অপরাপর প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ও তাঁর অনুগমন করে। আত্মা তখন বিজ্ঞানময়। এই বিজ্ঞানময় আত্মার অনুগমন করে বিদ্যা, কর্ম আর সংস্কার (বৃঃ-৪/৪/২)। জলায়ুক বা জলৌকা অর্থাৎ জোঁক যেমন ঘাসের এক ডগা ছেড়ে আর এক ডগায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, আত্মাও তেমনি দেহত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে, স্থূল শরীরটাকে পরিত্যাগ করে আশ্রয়রূপ অন্য দেহকে অবলম্বন করে (বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।
এই শ্রুতিকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে তাই বাদরায়ণও বলেন-
‘তদন্তরপ্রতিপত্তৌ রংহতি সম্পরিষ্বক্তঃ, প্রশ্ননিরূপণাভ্যাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)।।
‘প্রাণগতেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।।
অর্থাৎ :
জীব সূক্ষ্মভূত-সমন্বিত হয়ে দেহত্যাগান্তে অন্যদেহ প্রাপ্তির জন্য গমন করে- তা শ্রুতি বর্ণিত প্রশ্নোত্তর থেকে অবগত হওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেন যে, জীব উৎক্রান্ত হলে জীবের সাথে ইন্দ্রিয়সকলও গমন করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।
এই প্রাণসকল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়সহ উৎক্রান্ত জীব কোথায় গমন করে ? এর একটা বিবরণ ছান্দোগ্য উপনিষদেই পাওয়া যায়। যেমন-
‘স জাতো যাবৎ-আয়ুষম্ জীবতি তং প্রেতং দিষ্টমিতম্ অগ্নয়ঃ এব হরন্তি যত এবেতো যতঃ সম্ভূতো ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/৯/২)।। ‘তদ্ য ইত্থং বিদুর্যে চ ইমে অরণ্যে শ্রদ্ধা তপ ইত্যুপাসতে তে অর্চিষম্ অভিসংভবন্তি অর্চিষঃ অহঃ অহ্নঃ আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্ যান্ ষট্ উদঙ্ এতি মাসাংস্তান্’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/১)।। ‘মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাৎ আদিত্যম্ আদিত্যাৎ চন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষঃ অমানবঃ স এনান্ ব্রহ্ম গময়তি এষঃ দেবযানঃ পন্থাঃ ইতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/২)।। ‘অথ য ইমে গ্রাম ইষ্টাপূর্তে দত্তম্ ইতি উপাসতে তে ধূমম্ অভিসম্ভবন্তি ধূমাৎ রাত্রিম্ রাত্রেঃ অপরপক্ষম্ অপরপক্ষাৎ যান্ ষট্ দক্ষিণা এতি মাসাংস্তান্নৈতে সংবৎসরম্ ন অভি প্রাপ্নুবন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৩)।। ‘মাসেভ্যঃ পিতৃলোকং পিতৃলোকাৎ আকাশম্ আকাশাৎ চন্দ্রমসম্ এষঃ সোমো রাজা তৎ দেবানাম্ অন্নম্ তং দেবা ভক্ষয়ন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৪)।। ‘তস্মিন্ যাবৎ সম্পাতম্ উষিত্বা অথ এতম্ অধ্বানম্ এব পুনঃ নিবর্তন্তে যথা ইতম্ আকাশম্ আকাশাৎ বায়ুম্ বায়ুঃ ভূত্বা ধূমঃ ভবতি ধূমঃ ভূত্বা অভ্রং ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।।
অর্থাৎ :
(সন্তান) জন্মগ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু ততদিন জীবিত থাকে। (তারপর যখন) যথানির্দিষ্ট রূপে (অর্থাৎ কর্মফল অনুযায়ী লোক লাভের জন্য) দেহত্যাগ করে, তখন (তার পুত্র ও শিষ্যরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য) তাকে ঘর থেকে সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়- যে অগ্নি থেকে সে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে (ছাঃ-৫/৯/২)। যাঁরা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর অর্চিলোক অর্থাৎ জ্যোতির্লোক প্রাপ্ত হন। (অতঃপর) অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মাসে- (ছাঃ-৫/১০/১)। সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রলোকে এবং চন্দ্রলোক থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে (ব্রহ্মলোক থেকে) এক অমানব অর্থাৎ জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ (ছাঃ-৫/১০/২)। আর যে সকল গৃহস্থ যজ্ঞ, সমাজসেবামূলক কর্ম এবং দান ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন তাঁরা (মৃত্যুর পর) ধূমকে প্রাপ্ত হন। (তারপর তাঁরা) ধূম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়ণের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা (দেবযানপথে গমনকারীদের মতো) সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না (ছাঃ-৫/১০/৩)। দক্ষিণায়ণের ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। ইনিই (অর্থাৎ উজ্জ্বল চন্দ্রই) রাজা সোম। ইনি দেবতাদের অন্ন, দেবতারা এঁকে ভোগ করেন (ছাঃ-৫/১০/৪)। কর্মফল ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রলোকে বাস করে তারপর যে পথে তাঁরা গিয়েছিলেন সেই পথেই পুনরায় (পৃথিবীতে) ফিরে আসেন। তাঁরা প্রথমে আকাশ ও পরে বায়ুকে প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধূম, ধূম হয়ে কুয়াশা হন (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।
শ্রুতিতে এই যে জীবের উৎক্রমণের পর আবার কর্মফল ভোগের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়, তাই বাদরায়ণও বলেন-
‘কৃতাত্যয়ে অনুশয়বান্, দৃষ্টস্মৃতিভ্যাম্ যথেতমনেবং চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৮)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জীব যে-পথে চন্দ্রলোকে গিয়েছিলো, কর্মফল ভোগের পর আবার সেই পথেই এবং অন্যভাবেও ভুক্তাবশিষ্ট কর্মসহ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে (ব্রঃ-৩/১/৮)।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে যে, এ সকল ব্যক্তির আত্মা কি বাস্তবিকপক্ষে আকাশ, ধূম ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়, অথবা এরা কি একটি প্রকৃতিগত সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয় ? বিষয়টি স্পষ্ট করতে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘তৎসাভাব্যাপত্তিঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২২)।।
ভাবার্থ : চন্দ্রমণ্ডল হতে অবতরণকালে জীব আকাশাদির সদৃশ হয়। আকাশস্বরূপ হয় না- কারণ সদৃশ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত (ব্রঃ-৩/১/২২)।
অর্থাৎ, শ্রুতিটিতে আকাশ ইত্যাদির সাথে অভিন্নত্বের কথা বলা হয়নি। শ্রুতিটির অর্থ হলো, এরা আকাশ ইত্যাদির প্রকৃতিগত একটি সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়- আকাশ, বায়ু প্রভৃতির মতো হয়ে যায়। তার মানে, জীব আকাশের মতো একটি সূক্ষ্ম আকার ধারণ করে বায়ুর অধীনে আসে এবং ধূম ইত্যাদির সাথে সংযুক্ত হয়। এই পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ায় তারপরে ছান্দোগ্য উপনিষদে আরো বলা হয়েছে-
‘অভ্রং ভূত্বা মেঘো ভবতি মেঘো ভূত্বা প্রবর্ষতি ত ইহ ব্রীহি-যবাঃ ওষধি-বনস্পতয়ঃ তিলমাষাঃ ইতি জায়ন্তে অতঃ বৈ খলু দুর্নিষ্প্রপতরং যঃ যঃ হি অন্নম্ অত্তি যঃ রেতঃ সিঞ্চতি তৎ ভূয়ঃ এব ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।।
অর্থাৎ :
কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। (সন্তান উৎপাদনে সমর্থ) যে যে প্রাণী ওই (ব্রীহি প্রভৃতি) অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠে যে, চন্দ্রলোক হতে প্রত্যাবর্তনকারী জীবাত্মা যখন আকাশ, বায়ু প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্যপ্রাপ্ত হয় তখন কি তা বেশ দীর্ঘকালই ঐ অবস্থায় থাকে, না কি শীঘ্রই এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয় ? এবং অন্য প্রশ্নটি হলো, জীবাত্মা কি ব্রীহি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জরূপে জাত হয় ? এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ বলেন-
‘নাতিচিরেণ, বিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)।।
‘অন্যাধিষ্ঠিতে পূর্ববৎ, অভিলাপাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)।।
‘রেতঃ-সিক্-যোগঃ অথ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)।।
‘যোনেঃ শরীরম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতি বলেন জীবের চন্দ্রলোক হতে নানা অবস্থার (ব্রীহি, যব ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে বেশি বিলম্ব হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ শ্রুতি তাই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)। জীব ব্রীহি ইত্যাদি রূপ প্রাপ্ত হয় বলা হয়েছে; তার অর্থ হলো সেই সেই ব্রীহিতে অবস্থান হয় মাত্র, কারণ শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে আকাশাদি সম্বন্ধে যেরূপ উল্লেখ আছে, ব্রীহির সম্বন্ধেও সেরূপই উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)। চন্দ্রলোক-প্রত্যাগত জীব ধান ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পর যারা শুক্রনিষেক করে জন্মদান করতে সমর্থ তাদের দেহে প্রবিষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)। যোনিকে (গর্ভকে) আশ্রয় করেই জীব স্বীয় ভোগায়তনদেহ লাভ করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।
অতএব, সংক্ষিপ্ত করে বললে, দেহত্যাগান্তে পরলোক ভ্রমণ করে প্রত্যাগত জীব কর্মফল অনুযায়ী ইহলোকে পুনরায় জীবন শুরু করে। পুণ্যবানগণ চন্দ্রলোকে যান। নবকলেবর ধারণের জন্য চন্দ্রমা থেকে মেঘ, জল, অন্নাদির যে রাস্তার কথা উপনিষদে বলা হয়েছে তাতে ফিরে আসতে দেরি হয় না। যে ধান্যশস্যাদির সঙ্গে জীব মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট তাতে সে নিজে নয়, অন্যজীবের অধিষ্ঠাতা হওয়ার সময় এরূপ করে। সুতরাং অবতরণকারী জীবাত্মা অন্য জীবাত্মার দ্বারা (সঞ্জীবিত) প্রাণবন্ত বৃক্ষাদির মধ্যে অবস্থান মাত্র করে- যে পর্যন্ত না নতুন কোন জন্মের সুযোগ পায়। সেই শস্য ভক্ষণের পর আবার রক্ত-বীর্য-যোনির সংযোগ হয়, যার ফলে হয় নতুন শরীর সৃষ্টি। অর্থাৎ পরিশেষে জীবাত্মা একজন সন্তান-উৎপাদনসক্ষম (রেতঃসিঞ্চনকারী) পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেখানে একটি নতুন দেহ লাভ করে, যে দেহ (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭ অনুযায়ী) পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য সমর্থ।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যে, ইহলোক থেকে যারা উৎক্রমণ করে তাদের সকলেই কি চন্দ্রলোকে গমন করে থাকে ? যে-সকল জীবের কর্মফল চন্দ্রলোক গমনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ যারা যজ্ঞাদি বা কোন ধর্মানুষ্ঠান করে না, কিংবা অনিষ্টকারী ব্যক্তি, মৃত্যুর পর তাদের কী গতি হয় ? এ বিষয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘অথ এতয়োঃ পথোর্ন কতরেণচন তানীমানি ক্ষুদ্রাণি অসকৃৎ আবর্তীনি ভূতানি ভবন্তি জায়স্ব ম্রিয়স্ব ইতি এতৎ তৃতীয়ং স্থানম্ তেন অসৌ লোকঃ ন সম্পূর্যতে তস্মাৎ জুগুপ্সেত’।। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।।
অর্থাৎ :
যারা (অর্থাৎ যে জীবগণ উপাসনা বা ইষ্টপূর্তাদি কর্ম করে না) উভয় পথের কোন পথ দিয়েই যায় না, তারা পুনঃ পুনঃ (জন্ম-মৃত্যু চক্রে) আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে। (এদের বিষয়ে বলা যায়)- জন্মাও আর মরো (অর্থাৎ এরা এতো ক্ষণস্থায়ী যে জন্মগ্রহণ করেই মরে যায়। জন্ম-মৃত্যু ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোন ঘটনা নেই)। এই হলো তৃতীয় স্থান। এজন্যেই এই লোক (অর্থাৎ স্বর্গ বা চন্দ্রলোক) পূর্ণ হয় না। সুতরাং (এই গতিলাভকে) ঘৃণা করবে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।
অর্থাৎ অনিষ্টকারী ব্যক্তি স্বর্গে গমন করে না। তাহলে কোথায় যায় ? সংশয় দূর করতে বাদরায়ণ বলেন-
‘সংযমনে তু অনুভূয় ইতরেষাম্ আরোহাবরোহৌ, তদ্গতিদর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৩)।।
ভাবার্থ : অনিষ্টকারী ব্যক্তি যমলোকে গমন করে; কারণ অনিষ্টকারীর সংযমী নামক যমপুরে যাওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রঃ-৩/১/১৩)।
কারণ, কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্ ।
অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি মানী পুনঃ পুনর্বশম্ আপদ্যতে মে’।। (কঠোপনিষদ-১/২/৬)।।
অর্থাৎ :
যম বলছেন, সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে, পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠ-১/২/৬)।
চন্দ্রলোকে আরোহণ শুধুমাত্র শুভকর্মের ফল ভোগেরই জন্য- অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। সুতরাং অনিষ্টকারিরা চন্দ্রলোকে যায় না। তাদের গন্তব্য হয় নরকে। কৃতকর্মের কষ্টভোগের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়ে পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জীব দেহধারী হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন-
‘স্মরন্তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)।।
‘অপি চ সপ্ত’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)।।
‘বিদ্যাকর্মণোঃ ইতি তু প্রকৃতত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।।
ভাবার্থ :
স্মৃতিশাস্ত্রেও (যথা মনুস্মৃতি) পাপীদের নরক গমনের কথা দৃষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)। অধিকন্তু পাপীদের ভোগের জন্য সাতটি নরক আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)। পাপীদের চন্দ্রলোকে গমন হয় না, কারণ, বিদ্যাদ্বারা দেবযান এবং কর্মের দ্বারা পিতৃযান প্রাপ্তির কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।
কেন-উপনিষদের ১/১ প্রশ্নের উত্তরঃ-
কার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিক্ষিপ্ত মন তার লক্ষে পতিত হয় ? কার দ্বারা যুগে যুগে বদ্ধ হয়ে প্রথম প্রাণ তার পথে এগিয়ে চলে ? কার দ্বারা প্রণোদিত হয়ে লোকে এই সব বাক্য বলে? কোন দেবতা চক্ষু কর্ণকে তাদের কাজে নিযুক্ত করেন ?
পদার্থ-( কেন) যার থেকে ( প্রেষিতম্) অনুপ্রাণিত ( মনঃ) মন ( ইষিতম্) অভিষ্ট বিষয়কে ( পততি) প্রাপ্ত হয় এবং ( কেন) যার থেকে ( প্রথমঃ) সকল ইন্দ্রিয় হতে প্রথম ( যুক্ত) তার কর্মে নিয়ত স্হির ( প্রাণঃ) প্রাণ-বায়ু ( প্রেতি) নিজে ব্যাকহার করে এবং ( কেন) যার থেকে ( ইষিতাম্) প্রেরিত ( ইমাম্,বাচম্) এই বাণীর ( বদন্তি) মানুষের দ্বারা, এবং ( চক্ষুঃ)নেত্রেন্দ্রিয় তথা ( শ্রোত্রম্) কর্ণ ইন্দ্রিয়ে ( কঃ) যিনি ( উ) প্রসিদ্ধ ( দেবঃ) প্রকাশক দেব ( যুনক্তি) নিজ-নিজ বিষয়ে গ্রহণ করে প্রথম উৎপত্তি হতে নিযুক্ত।।
ভাবার্থ-বেদে বলা হয়েছে-'সপ্ত ঋষয়ঃ প্রতিহিতাঃ শরীরে"( যজু০ ৩৪/৫৫)
অর্থাৎ শরীরে নেত্রাদি পঞ্চ জ্ঞান-ইন্ত্রিয় মন বা প্রাণ যে সপ্ত ঋষি প্রত্যেক শরীরে কার্য করছেন। বেদে অন্যত্র লেখা আছে-(অথর্ব০) এই শরীর দেবতাদের অষ্টচক্র এবং নব দ্বার সহ আজেয় নগরী। ইহা উপযুক্ত ঋষিদেরই দেবতা বলা হয়েছে। যদিও ব্যাবহার অবস্হায় শরীরে যে জীবাত্মার অধীন থেকে কার্য করে,কিন্তু ওই সকলের সামর্থ্য পরমব্রহ্মই এই দাতা হয়। চক্ষু রূপকে গ্রহণ করতে পারে, রস কে নয়,শ্রোতা কেবল শব্দকেই গ্রহণ করতে পারে,রূপকে নয়। এই নিজ-নিজ বিষয়ে যে নিয়তভাব ব্যবস্থায় দেখতে আসে,তা কেনো জীবকৃত ব্যবস্হা নয়, তার নিয়ন্ত্রক পরব্রহ্মই। এবং উত্তর প্রশ্নারূপই দিতে হবে। পরবর্তী উত্তর থেকে ইহা স্পষ্ট যে এই প্রশ্নটি ব্রহ্ম বিষয় সম্পর্কিত।অতঃ এই প্রশ্নকে জীববিষয়ক লাগানো সর্বথা অসঙ্গত তথা প্রকরণ বিরুদ্ধ হয়। সমীক্ষা-শ্রী শঙ্করাচার্য জী এই শ্লোকের প্ররম্ভতে লিখেন-তস্মাদ দৃষ্টাদৃষ্টভ্যো বাহ্যসাধসাভ্যেভ্যো বিরক্তস্য প্রত্যগাত্মবিষয়া ব্রহ্মজিজ্ঞাসেয়ম্ কেনেষিতমিত্যাদিশ্রুত্যা প্রদর্র্যতে।" অর্থাৎ সংসারের দৃষ্ট বা অদৃষ্ট বাহ্য সাধনে তথা সাধ্যতে বিরক্ত পুরুষকে প্রত্যগাত্মবিষয়ক ( প্রতি শরীরে বিদ্ধমান আত্মবিষয়ক) ব্রহ্ম জিজ্ঞাসার "কেনষিতম্" ইত্যাদি শ্রুতি থেকে দেখিয়া জানা হয়। ইহা উপনিষদকারের প্রশ্ন প্রত্যগাত্মবিষয়ক ( জীবাত্মা) নয়। কারণ প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর দিতে হবে 'শ্রোত্রস্য শ্রোত্রম' প্রভৃতি উত্তরের সংসর্গ কখনোই জীবাত্মার সাথে বলে মনে হয় না। এই সমস্ত শারীরিক প্রভাবের স্রষ্টা ব্রহ্মা, জীবাত্মা নয়। কিন্তু শ্রী শঙ্করাচার্য জী, এই প্রশ্নগুলি না বুঝে, ভুলবশত, জীবাত্মার উপর প্রয়োগ করে লিখেছেন -কেনেষিতম্ কস্যেষ্টম্ কাস্যেচ্ছামাত্রেণ মনঃ পততি=গচ্ছতি,স্ববিষয়ে নিয়মেন ব্যাপ্রিয়তে।"অর্থাৎ কার ইচ্ছায় মন স্ববিষয়ে নিয়ম থেকে প্রবৃত্ত হয়। এখানে "ইচ্ছা" তথা "প্রেরিত"অর্থে মহান্ বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কামনাই জীবাত্মার ধর্ম, ব্রহ্মের নয়। মন তথা অন্যান্য ইন্দ্রিয় জীবাত্মার ইচ্ছায় স্ববিষয়ে প্রবৃত্ত থাকে। এইজন্য তাদের কর্মের ফলের ভোক্তা জীবাত্মাই হয়। এবং মন হল জ্ঞানাদিকে উপলব্ধির সাধন হয়-চক্ষু রূপের, শ্রোত্র শব্দের গ্রহণ করা হয় অন্য বিষয়ের নয়,এই নিয়তব্যবস্হা পরমব্রহ্মের। এই রহস্য বুঝতে না পেরে শ্রী শঙ্করাচার্যজীর এই উক্তিটি কতটা ভ্রান্ত –সর্বস্যৈব করণকলাপস্য যদর্থপ্রক্তা
প্রবৃত্তিস্তদব্রহ্মেতি প্রকরণার্থো বিবক্ষিতঃ।"(কেন০ ১।২ শা০ ভা০)
অর্থাৎ যার উদ্দেশ্যে ইন্দ্রিয়ের প্রবণতা আছে তাকে ব্রহ্মা বলেন। ইহাএই পুরো বিষয়ের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। যে ব্রহ্ম সম্পর্কে উপনিষদে লেখা আছে- ন তস্য কার্য করণস্চ বিদ্যাতে। অর্থাৎ সেই ব্রহ্মের কোনো কার্য বা কারণ নেই, সেইজন্য মানাদিকে করণ মনে করাটাই ভ্রান্ত বিশ্বাস।
মুক্ত আত্মার স্হূল শরীর থাকে কিনা? সুখ ও আনন্দ কীরূপে ভোগ করে?
স্হূল শরীর থাকে না। মুক্ত জীবের সত্যসঙ্কল্প প্রভৃতি স্বাভাবিক গুণ ও সামর্থ্য থাকে, ভৌতিক সঙ্গ থাকে না। যথা-
'শৃণ্বন্ স্রোত্রং ভবতি, স্পর্শয়ন্ ত্বগ্ভবতি, চক্ষুর্ভবতি, পশ্যন্, রসয়ন্ রসনা ভবতি জিঘ্রন্ ঘ্রাণং ভবতি, তর্জানো মনো ভবতি, বোধয়ন্ বুদ্ধির্খবতি, চেতয়ঁশ্চিত্তস্ভবত্যহঙকুর্বোণোহঙ্কারো ভবতি।। শতপথ০ কাং ১৪।।
মোক্ষে জীবাত্মার সঙ্গে ভৌতিক শরীর অথবা ইন্দ্রিয় গোলক থাকে না কিন্তু তাহার স্বাভাবিক শুদ্ধ গুণ থাকে। মুক্তি অবস্হায় জীবাত্মা শুনিতে ইচ্ছা করিলে স্বশক্তি দ্বারাই শ্রোত্র, স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করিলে ত্বক্, দেখিবার সংকল্প হইলে চক্ষু, স্বাদ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণ, সংকল্প বিকল্প করিবার জন্য মন, নিশ্চয় করিবার জন্য বুদ্ধি, স্মরণ করিবার জন্য চিত্ত, অহংবুদ্ধির জন্য অহঙ্কার এবং সংকল্পমাত্র শরীর হইয়া থাকে। শরীরের আধারে থাকিয়া জীব যেমন ইন্দ্রিগোলকের দ্বারা স্বকার্য্য সিদ্ধ করে সেইরূপ মুক্তি অবস্হায় স্বশক্তি দ্বারা সমস্ত আনন্দ ভোগ করে।।
কঠ উপনিষদে জীবাত্মা কে শরীর রূপী রথের স্বামী, বুদ্ধি কে সারথি এবং মন কে সেই রথের রশি বলা হয়েছে (কঠ উপনিষদ/১/৩/৩)। জীবাত্মা হলো আমাদের দেহের কর্তা..
ঐতরেয় উপনিষদ-১/৩/১২ জীবাত্মা শরীরে তিন অংশে বিচরণ করে।
স এতমেব সীমানং বিদার্যেতয়া দ্বারা প্রাপদ্যত।
সৈষা বিদৃতির্ণাম দ্বাঃ; তদেতন্নন্দনম্।
তস্য ত্রয় আবসথাস্ত্রয়ঃ স্বপ্নাঃ।
অয়মাবসথোহয়মাবসাথো হয়মাবসথ ইতি।।[ঐতরেয়োপনিষদ ১।৩।১২]
জীবাত্মার (জীবভূত আত্মা) মস্তিস্ক, হৃদয়াকাশে ও শরীরে আবাস স্থান।
रू॒पंरू॑पं॒ प्रति॑रूपो बभूव॒ तद॑स्य रू॒पं प्र॑ति॒चक्ष॑णाय। इन्द्रो॑ मा॒याभिः॑ पुरु॒रूप॑ ईयते यु॒क्ता ह्य॑स्य॒ हर॑यः श॒ता दश॑ ॥
ঋগ্বেদ-৬/৪৭/১৮
বিষয়- তাহলে এই জীবাত্মা কেমন, এই বিষয়ে বলেন।
পদার্থ-হে মনুষ্য!যে ( ইন্দ্রঃ) জীব ( মায়াভিঃ) বুদ্ধিতে ( প্রতিক্ষণায়) প্রত্যক্ষ বিবৃতির জন্য ( রূপরূপম্) রূপ-রূপকে ( প্রতিরূপঃ) প্রতিরূপ অর্থাৎ তার স্বরূপে বর্তমান ( বভূব) এবং ( পুরুরূপঃ) বহু শরীর ধারণ করে অনেক প্রকারে ( ঈয়তে) পাওয়া যায় ( তত্) সে ( অস্য) এই শরীরের ( রূপম্) রূপ এবং যা ( অস্য) এই জীবাত্মাকে ( হি) সংকল্প করে ( দশ) দশ সংখ্যাতে বিশিষ্ট এবং ( শতা) শত সংখ্যার জন্য বিশিষ্ট (হরযঃ) অশ্বের ন্যায় ইন্দ্রিয়,অন্ত-করণ এবং প্রাণ ( যুক্তাঃ) যুক্ত হয়ে শরীরে ধারণ করে,এই তার সামর্থ্য।
ভাবার্থ-এই মন্ত্রে বাচকলুপ্তোপমালঙ্কার আছে। হে মনুষ্য! বজ্র পদার্থের অনুরূপ, একইভাবে জীব দেহের সাথে তত্ত্বভাব এবং যখন সে বাহ্যিক বস্তুকে দেখতে চায়, তখন তা দেখে এই জীব তথ্যরূপ জ্ঞান লাভ করে এবং জীবের দেহে যা অগণিত। বজ্রপাত সহ. নাড়ী আছে, সেই নাড়ীগুলি.এসব থেকে বিস্তারিত জানে।।-( ভাষ্যম্-মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী)
শরীর নির্মাণ ও শরীরে আত্মার প্রবেশ
[অথর্ব্ববেদঃ ১০।৮।২৮, ঋগ্বেদ ৬।৪৭।১৮]
সৃষ্টির সময় উপস্থিত হলে পরমাত্মা পরমসূক্ষ্ম পদার্থ সমূহকে সন্মিলিত করেন। ঐ সকলের প্রথম অবস্থায় পরমসূক্ষ্ম প্রকৃতিরূপ কারণ অপেক্ষা যাহা কিঞ্চিত স্থূল হয় তার নাম মহত্তত্ত্ব। যাহা মহত্তত্ত্ব অপেক্ষা কিঞ্চিত স্থূল হয়, তহার নাম অহঙ্কার। অহঙ্কার হতে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ সূক্ষ্মভূত শ্রোত্র, ত্বক, নেত্র, জিহ্বা এবং ঘ্রাণ-এই জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং বাক, হস্ত,পদা,উপস্থ ও মলদ্বার-এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় এবং একাদশ মন, অপেক্ষাকৃত স্তূলরূপে উৎপন্ন হয়। উক্ত পঞ্চতন্মাত্রা হইতে অনেক স্থূলবস্থা প্রাপ্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে যে পঞ্চভূত উ(পন্ন হয়, আমরা ঐ সকল প্রত্যক্ষ করি। স্থূলভূত হতে নানাবিধ ওষধি এবং বৃক্ষাদি উৎপন্ন হয়। ওষধি এবং বৃক্ষাদি হইতে অন্ন, অন্ন হতে বীর্ষ্য এবং বীর্য্য হতে শরীর উৎপন্ন হয়। সর্ব্বপেক্ষা সূক্ষ্ম খন্ড অর্থাৎ যাহা বিভক্ত করা য়ায় না, তার নাম পরমাণু। ষাইট পরমাণু মিলে এক অনু হয়। দুই অণু মিলে এক দ্ব্যণুক হয়। তিন দ্ব্যণুক হতে অগ্নি, চার দ্ব্যণুক হতে জল এবং পাঁচ দ্ব্যণুক হতে পৃথিবী আদি দৃশ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়। পরমাত্মা এইরূপ ক্রমানুসারে পরমাণু মিলিত করে পৃথিবী ইত্যাদি নির্মান করেছেন।
জীবাত্মার মুখ্য শক্তি এক প্রকার। কিন্তু বল, পরাক্রম, আকর্ষণ, প্রেরণা, গতি, ভীষণ, বিবেচন ক্রিয়া, উৎসাহ, স্মরণ, নিশ্চয়, ইচ্ছা, প্রেম, দ্বেষ, সংযােগ,বিভাগ, সংযােজক, বিভাজক, শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন, আস্বাদন, গন্ধ গ্রহণ তথা জ্ঞান—এই (২৪) চতুর্বিংশ প্রকার সামর্থযুক্ত জীব। জীব ইহার দ্বারা মুক্তি অবস্থাতেও আনন্দ ভােগ করিয়া থাকে। | মুক্তির সঙ্গে জীবের লয় হইলে, মুক্তিসুখ কে ভােগ করিত? জীবের নাশকেই যে মুক্তি মনে করে সে মহামূখ। কারণ জীবের পক্ষে দুঃখ বিমুক্ত হইয়া আনন্দস্বরূপ, সর্বব্যাপক এবং অনন্ত পরমেশ্বরের সানন্দে অবস্থান করাই মুক্তি।
জীব শরীর অর্থাৎ জীবের পঞ্চকোষ সম্বন্ধে বিচার ।।
পঞ্চকোষ প্রথম – ‘অন্নময়। উহা ত্বক হইতে অস্থি পৰ্য্যন্ত সমুদায় পৃথিবীময় বিস্তৃত। দ্বিতীয় প্রাণময় কোষ’ যাহাতে ‘প্রাণ’ অর্থাৎ যাহা ভিতর হইতে বাহিরে যায়; ‘অপান যাহা বাহির হইতে ভিতরে আসে; ‘সমান’ যাহা নাভিস্থ হইয়া সর্বত্র শরীরে রস সঞ্চারিত করে; ‘উদান, যাহা দ্বারা কণ্ঠস্থ অন্নজল আকৃষ্ট হয় ও বল পরাক্রম বৃদ্ধি পায় এবং ব্যান’ যদ্বারা জীব সমস্ত শারীরিক চেষ্টাদি কর্ম করে। তৃতীয় মনােময় কোষ। যাহাতে মনের সহিত অহঙ্কার ও পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু এবং উপস্থ থাকে। চতুর্থ—‘বিজ্ঞানময় কোষ’ যাহাতে বুদ্ধি, চিত্ত এবং শ্রোত্র, ত্ব, নেত্র, জিহ্বা ও নাসিকা—এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় থাকে, যদ্বারা জীব জ্ঞানাদি কাৰ্য্য সম্পাদন করে। পঞ্চম – ‘আনন্দময় কোষ’ যাহাতে প্রীতি, প্রসন্নতা অল্পবিস্তর আনন্দ এবং আধার কারণরূপ প্রকৃতি থাকে। এই পঞ্চকোষ দ্বারা জীব সর্ববিধ জ্ঞান,কর্ম উপাসনা প্রভৃতি জ্ঞানাদি ব্যবহার সম্পাদন করিয়া থাকে।
| ‘অবস্থা’ ত্রিবিধ—প্রথম ‘জাগ্রত’, দ্বিতীয়–স্বপ্ন’ এবং তৃতীয় –‘সুষুপ্তি'।
ত্রিবিধ শরীর-—প্রথম ‘স্থুল’ শরীর যাহা দৃষ্ট হয়, দ্বিতীয় পঞ্চ প্রাণ,পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চসূক্ষ্মভূত বা পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) ও মন তথা বুদ্ধি – এই সপ্তদশ তত্ত্বের সমষ্টিকে সূক্ষ্ম শরীর’ বলে।
এই সূক্ষ্ম শরীর জীবনে মরণেও জীবের সঙ্গে থাকে। ইহা দ্বিবিধ—প্রথম ভৌতিক অর্থাৎ সূক্ষ্ম ভূতের অংশ দ্বারা নির্মিত। দ্বিতীয়, স্বাভাবিক’ ইহা জীবের স্বাভাবিক গুণস্বরূপ।
এই দ্বিতীয় সূক্ষ্ম এবং‘ভৌতিক’ শরীর মুক্তি অবস্থায় থাকে। ইহা দ্বারাই জীব মুক্তিতে সুখ ভোগ করে। তৃতীয়—কারণ যাহাতে সুষুপ্তি অর্থাৎ গাঢ় নিদ্রা হয়। উহা প্রাকৃতিকরূপ হওয়ায় সর্বত্র ব্যাপক এবং সকল জীবের পক্ষে একই প্রকার। চতুর্থ -তুরীয় শরীর, যাহাতে জীব সমাধি দ্বারা পরমাত্মার আনন্দস্বরূপে মগ্ন থাকে। এই সমাধি সংস্কারজন্য শুদ্ধ শরীরের পরাক্রম মুক্তিতেও যথাবৎ সহায়করূপে থাকে। যেরূপ জীব শরীরের আধারে সাংসারিক সুখ ভোগ করে সেইরূপ পরমেশ্বরর আধারে জীব মুক্তি আনন্দ ভোগ করে। বল, পরাক্রম, আকর্ষণ, প্রেরণা, গতি, ভীষণ, বিবেচনা ক্রিয়া, উৎসাহ, স্মরণ, নিশ্চয়, ইচ্ছা, প্রেম, দ্বেষ, সংযোজক, বিভাজক, শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন, আস্বাদন, গন্ধ গ্রহন তথা জ্ঞান - এই (২৪) চতুর্বিংশ প্রকার সামর্থ্যযুক্ত জীব। জীব ইহার দ্বারা মুক্তি অবস্থাতেও আনন্দ ভোগ করিয়া থাকে। জীবের নাশকেই যে মুক্তি মনে করে সে মহামূর্খ। কারন জীবের পক্ষে দুঃখ বিমুক্ত হইয়া আনন্দস্বরূপ, সর্বব্যাপক এবং অনন্ত পরমেশ্বরের সানন্দে অবস্থান করাই মুক্তি।
জীব এই সকল কোষ এবং অবস্থা হতে পৃথক। কারণ মৃত্যু হলে জীব বহির্গত হয়, এই জীবকেই সকল বিষয়ের প্রেরয়িতা,ধর্ত্তা,সাক্ষী,কর্ত্তা এবং ভোক্তা বলা হয়। যদি কেউ বলে জীব কর্ত্তা, ভোক্তা নয় তবে তিনি অজ্ঞ ও বিচারহীন। কারণ জীব ব্যতীত জড়পদার্থ সমূহের সুখ-দুঃখ ভোগ অথবা পাপ পুণ্যের কর্ত্তৃত্ব অন্য কাহারও কখনও হতে পারে না।
অবশ্য এই সকলের সম্বন্ধ বশতঃ জীব পাপ-পুণ্যের কর্ত্তা ও সুখ-দুঃখের ভোক্তা হয়ে থাকে। যখন ইন্দ্রিয় অর্থের সাথে মন ইন্দ্রিয়ের সাথে এবং আত্মা মনের সাথে সংযুক্ত হয়ে প্রেরণাদ্বারা প্রাণকে উত্তম অথবা অধম কর্মে নিয়োজিত করে, তখনই বহির্মুখ হয়ে যা। তখন ভিতর হতে আনন্দ, উৎসাহ, অভয়, এবং কুকর্মে ভয়, শঙ্কা এবং লজ্জা উৎপন্ন হয়। এটাই অন্তর্য্যামী পরমাত্মার শিক্ষা। যিনি এই শিক্ষানুসারে আচরণ করেন, তিনিই মুক্তিজন্য সুখ প্রাপ্ত হন। যিনি বিপরীত আচরণ করেন, তিনি বন্ধনজন্য দুঃখ ভোগ করেন।
শ্রুতিতে(ব্রহ্মসূত্র) ব্রহ্মকে চৈতন্যমাত্র বলেন[চৈতন্যমাত্রমিতি শ্রুতিরাহ]। চৈতচ্য ভিন্ন আত্মার অন্তর্বাহ অন্যরূপ নাই। চৈতন্যই তাঁহার সার্ব্বকালিক রূপ। লবণের যেমন অন্তরে ও বাহিরে লবণ রস, আত্মারও সেইরূপ অন্তরে ও বাহিরে চৈতন্যরূপী।
ব্রহ্ম অব্যক্ত ও সাক্ষিস্বরূপ, শ্রুতিস্মৃতি উপদেশে জানা যায় আরাধনা দ্বারা সাধক, ব্রহ্মে লীন হন ! তিনি ইন্দ্রিয়গম্য নন, ধ্যান ও প্রণিধানাদি দ্বারা নির্ম্মল চিত্ত যোগীদিগের হৃদয়ে তিনি স্বয়ং প্রকাশিত। পরমাত্মা ও জীবাত্মা উপাস্য উপাসক আবিদ্যক। অবিদ্যা নাশ হলে ব্রহ্ম যোগীদের হৃদগম্য হন[যোহবৈতৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি]বেদান্ত সূত্র পৃঃ৩৭২।
জীব মাত্রেই ইষ্টানিষ্ট কর্ম্মফল ভোগ করে-ঈশ্বর সর্ব্বাধ্যক্ষ তিনি সকলের দেশকাল ও কর্ম্ম বিদিত আছেন। তাঁহা হইতেই কর্ম্মগণের কর্ম্মফল উৎপন্ন হয়, "কর্ম্ম হইতে কর্ম্মফলোদয় নয়। কর্ম্ম নিজে অভাব পদার্থ, সুতরাং ভাব পদার্থের উৎপাদক হতে পারে না। ঈশ্বর জীবের কর্মফল দাতা।
জীব কর্ম্মদ্বারা ঈশ্বরের আরাধনা করিয়া তাহা দ্বারাই কর্ম্মফল লাভ করে। ঈশ্বরই কর্ম্মিগণকে কর্ম্মানুসারে বা কর্ম্মজন্য অপূর্ব্ব অনুসারে কর্ম্মের ফল দান করিয়া থাকেন। এ বিষয়ে শ্রুতিতে প্রমান আছে, যথা-
"এষ হ্যেবসাধু কর্ম্ম কারয়তি তংযন্তুন্নিনীয়তে, এষহ্যেবাসাধু কর্ম্ম কারয়তি তং যমধোনিনীয়তে"। কেবল শ্রুতি প্রমাণ নয়, এ বিষয়ে স্মৃতি প্রমাণও আছে (বেদান্ত সূত্রের সাধনাখ্য তৃতীয়ধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদ দ্রষ্টব্য).. ঈশ্বর প্রাণিগনের প্রযত্নানুযায়ী কর্ম্মফল বিধান করিয়া থাকেন।
|
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী |
সাংখ্য দর্শনের পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব বা পঁচিশ প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- (১) জ্ঞ বা পুরুষ, (২) অব্যক্ত বা মূলপ্রকৃতি বা প্রধান, (৩) মহৎ বা বুদ্ধি, (৪) অহংকার, (৫) মনস্ বা মন (৬) পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- এই পাঁচটি), (৭) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ- এই পাঁচটি), (৮) পঞ্চতন্মাত্র বা পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ- এই পাঁচটি), (৯) পঞ্চস্থূলভূত বা পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ্ বা জল, তেজ বা অগ্নি, মরুৎ বা বায়ু, আকাশ বা ব্যোম্- এই পাঁচটি)। অন্যদিকে পতঞ্জলির যোগ দর্শনে সাংখ্যের পঁচিশটি তত্ত্বের সাথে অতিরিক্ত একটি তত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্ব যুক্ত করে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়েছে বলে নিরীশ্বর-সাংখ্যের বিপরীতে যোগ দর্শনকে ‘সেশ্বর-সাংখ্য’ও বলা হয়ে থাকে।ইহা সকলেই জানে যে, জীব এই সকল কোষ এবং অবস্থা হইতে পৃথক্। কেননা, মৃত্যু হইলে সকলেই বলে যে জীব বাহির হইয়া গেল। এই জীবকেই সকল বিষয়ের প্রেরয়িতা, ধৰ্ত্তা, সাক্ষী এবং ভােক্তা বলা হয়। যদি কেহ বলে যে, জীব কৰ্ত্তা, ভােক্তা নহে, তবে জানিবে যে, সে অজ্ঞ ও বিচার বিবেচনা হীন। কারণ, জীব ব্যতীত জড়পদার্থ সমূহের সুখ দুঃখ ভাগ অথবা পাপ পূণ্যের কর্তৃত্ব অন্য কাহারও হইতে পারে না। অবশ্য এই সকলের সম্বন্ধ বশতঃ জীব পাপ-পুণ্যের কর্তা ও সুখ-দুঃখের ভােক্তা হইয়া থাকে।
যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞামামি মনসা সহ।
ব্রহ্মা -- এর মূল শব্দ ব্রহ্মন্ । যা পুংলিঙ্গ এবং নপুংশকলিঙ্গ ( ব্রহ্মা-ব্রহ্ম ) ভেদে দুই প্রকার । দুই প্রকারের ব্রহ্মণ শব্দই আধ্যাত্মে জীব এবং ঈশ্বর এই দুটির জন্যই প্রযুক্ত হয়ে থাকে [[ বস্তুতঃ, যক্ষ, পুরুষ, ব্রহ্ম, ব্রহ্মা, আত্মা আদি যত পদ (শব্দ) জীব আর ঈশ্বর বাচক রয়েছে, সেসব আধ্যাত্ম- তে শরীরের আর আধিদৈবিক -এ ব্রহ্মাণ্ডের ও বাচক। ]] ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতে তমাহুঃ পরমাং গতিম্।। [কঠঃ ২।৬।১০]
-যখন জীবের সহিত শুদ্ধ মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় বিদ্যমান থাকে এবং বুদ্ধি স্থিরনিশ্চয় হয়, সেই অবস্থাকে পরমাগতি অর্থাৎ মোক্ষ বলে।
_ অবিদ্যা জাত প্রকৃতি হতে বন্ধন থেকে তথা দুঃখ থেকে মুক্তি তথা ব্রহ্মে অব্যাহত গতিতে বিচরণ করা হলো মোক্ষ । (কঠ: ১/২/১৭)
জীবাত্মার কর্ম স্বার্থ অত: জীবাত্মার ফলও স্বার্থ লাভ করে ।
অর্থাৎ মোক্ষে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার পর জীবাত্মার পুনরাবৃত্তি হয় ।
অর্থাৎ মূলকারণ থেকে আত্মা পুনরায় কার্যে নিযুক্ত হয়।
__ তং বিদ্যাকৰ্মণী সমম্বারভেতে পূর্ব প্রজ্ঞা চ । ( বৃঃ উঃ ৪।৪।২ )
__ জীবাত্মা শরীর ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় তাহার বিদ্যা, কর্ম এবং পূর্ব প্রজ্ঞা তাহার সহিত অনুগমন করে।
আত্মা গর্ভাশয়ে যে সমস্ত গুণ নিয়ে প্রবেশ করে
__ ও৩ম্ অসুণীতে পুনরস্মাসু চক্ষু পুনঃ প্রাণমিহ নাে ধেহি ভােগ । জ্যোক্ পশ্যেম সূর্যমুচ্চরন্তমনুমতে মৃড়য়া ন স্বস্তি ।।
" ও৩ম্ পুনর্ন অংসু পৃথিবী দদাতূপুনদৌর্দেরী পুনরন্তরিক্ষ ।
পুনর্নঃ সােমস্তন্বং দদাতু পুনঃ পুষা পথ্যাং যা স্বস্তিঃ । "
( ঋঃ বেঃ ৮।১।২৩ / ৬-৭ )
__ অর্থাৎ হে সুখদায়ক পরমেশ্বর ! আপনি কৃপা পূর্বক আমাদের পূনর্জন্মে । আমাদের মধ্যে উত্তম নেত্রাদি সমগ্র ইন্দ্রিয় স্থাপন করিবেন । আমরা পুনর্জন্মে উত্তম প্রাণ - শক্তি , মন , বুদ্ধি , চিত্ত , অহঙ্কার , বল ও পরাক্রমযুক্ত শরীর যেন প্রাপ্ত হই । হে জগদীশ্বর এই জন্মে এবং পরজন্মে আমরা যেন নিরন্তর উত্তম উত্তম ভােগ প্রাপ্ত হই । হে ভগবান ! আপনার কৃপায় আমরা যেন সূৰ্য্যাদি লােক , আপনার বিজ্ঞান ও প্রেম সদা দর্শন ও উপলব্ধি করতে পারি । হে প্রভাে ! আমাদের সমস্ত জন্মে আপনি আমাদের সুখে রাখুন , যাহাতে আমাদের কল্যান হয় । হে সর্বশক্তিমান ! আমরা যেন পুনঃ পুনঃ পৃথিবী , প্রাণ চক্ষু এবং অন্তরীক্ষ আদি সমস্ত উত্তম পদার্থ এবং পুষ্টিকারক উত্তম শরীরের অনুকুল সােম অর্থাৎ ঔষুধি প্রাপ্ত হই ।
_ অপানতি প্রাণতি পুরুষো গর্ভে অন্তরা।
যদাত্বং প্রাণ জিন্বস্যথ স জায়তে পুনঃ।
[অর্থববেদ-১১|৪|৬]
মানুষ গর্ভের মধ্যে শ্বাস গ্রহণ করে ও প্রশ্বাস ত্যাগ করে। হে প্রাণ! যখন তুমি প্রেরণা দান কর তখনই সে পুর্নজন্ম গ্রহণ করে।
প্রাণাপান নিমেষোন্মেষজীবন মনোগতীন্দ্রিয়ান্তরবিকারাঃ সুখদুঃখেচ্ছাদ্বেষপ্রযত্নাশ্চাত্মনো লিঙ্গানি।। [বৈশেষিক দর্শন ৩।২।৪]
অস্যার্থঃ- প্রাণ ও অপান ক্রিয়া, নিমেষ ও উন্মেষ, জীবন, মনের গতি, অপর ইন্দ্রিয়ের কার্য্য, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ ও প্রযত্ন এই সকল আত্মার লিঙ্গ, অর্থাৎ এই সকল হেতু হইতে আত্মার অনুমান প্রমান সিদ্ধ হয়।
অহমিতি শব্দস্য ব্যতিরেকান্নাগমিকম্।।[বৈশেষিক ৩।২।৯]
-অহং ইত্যাকার যে স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যয় সকলের আছে, তাহা শরীরে প্রযুক্ত হিতে পারে না; অতএব আত্মার অস্তিত্ব এই অহং প্রত্যয় দ্বারা সিদ্ধ হয়; সুতরাং আত্মা কেবল আগমোক্ত বলিয়াই যে গ্রহণীয় তাহা নহে। অহংপ্রত্যাই আত্মার অনুমাপক লিঙ্গ।
অহং প্রত্যের সহিত আত্মার সম্বন্ধ এমন অকাট্য যে, শরীরে অহং প্রত্যয়ের উপচার (আরোপ) বশতঃ, আগমনকারী দেবদত্ত প্রভৃতির শরীর দর্শন করিয়াই, আমরা মনে করি যেন প্রকৃত দেবদত্ত প্রভৃতিকেই (যাঁহারা আত্মাময় তাঁহাদিকেই) দর্শন করিতেছি; শরীরকেই আত্মা বলিয়া অভেদ জ্ঞান হয়[-বৈশেষিক ৩।২।১৩ সূত্র]।
[উপচার (আরোপ)বশতঃ শরীরে যে অহংবুদ্ধি হয়, তাহাও এত দৃঢ় যে, সন্দেহ হয় আমি বুঝি যথার্থ শরীরই; শরীরেতে যে অহংবুদ্ধি আরোপিত হইয়াছে মাত্র, তহার বোধও অনেক সময় হয় না; অতএব শরীরে যে অহংবুদ্ধি, তহা উপচার কিনা তদ্বিষয়েই সন্দেহ হয়[বৈঃদঃ ৩।২।১৩]।
লিঙ্গশরীরনিমিত্তক ইতি সনন্দনাচাৰ্য্যঃ। ।সাংখ্য ৬।৬৯
পদঃ—লিঙ্গশরীরনিমিত্তকঃ। ইতি। সনন্দনাচাৰ্য্যঃ।।
সরলার্থ – সনন্দনাচার্য্য বলিয়াছেন লিঙ্গ শরীররূপ নিমিত্ত হইতেই এই সংযোগ সম্বন্ধ উৎপন্ন হইয়া থাকে। এই তিন আচার্য্যের (কপিলাচাৰ্য, পঞ্চশিখাচার্য্য ও সনন্দনাচার্য) মতের কোন বিরোধ নাই। জীবাত্মার কর্ম ও অবিদ্যা অনাদি বলিয়া এই সংসার চক্র প্রবাহরূপে অনাদি। জীবাত্মা নির্গুণ বলিয়া বন্ধন ও মোক্ষ কোনটিই তাহার স্বরূপ নহে। জীবাত্মা চিৎস্বরূপ বলিয়া জ্ঞান গ্রহণের শক্তিস্বরূপ এবং তাহার কর্মের সংস্থার অনাদি বলিয়া সম্বন্ধ উৎপাদনের দ্বারা কর্ম করিবার যোগ্য। অবিদ্যাগ্রস্ত জীব অস্মিতাজনিত প্রাকৃতিক বিষয়ের সহিত সম্বন্ধ উৎপাদন করিবার কারণ বন্ধনপ্রাপ্ত হইয়া থাকে এবং পুরুষার্থের দ্বারা বিবেকজ্ঞান লাভ করিতে পারিলেই বন্ধন হইতে মুক্ত হয়। এইভাবে অনাদি কাল হইতে বন্ধন ও মোক্ষ জীব ভোগ করিয়া আসিতেছে। লিঙ্গ শরীরই এই সম্বন্ধের কারণ অনাদি জীবের অবিদ্যাজনিত কর্ম ও সংস্কারই এই লিঙ্গ শরীরের কারণ। এইভাবে বীজাঙ্কুরের ন্যায় অনাদি চক্র চলিয়া আসিতেছে ও অনন্তকালই চলিবে।
অহংপ্রত্যয় কেবল জীবাত্মারই আছে, শরীরাদিতে তাহা নাই; অতএব শরীরাদি হইতে পৃথক যে আত্মা তিনিই অহংপ্রত্যায় গম্য। ভাবার্থ এই যে, মৃত শরীরে অহংবুদ্ধি দৃষ্ট হয় না; এবং ছিন্ন দেহাবয়বে অহংবুদ্ধি দৃষ্ট হয় না, অতএব শরীরাতিরিক্ত পদার্থ আত্মাই এই অহংপ্রত্যয়গম্য-[বৈশেষিক ৩।২।১৪ অহমিতি প্রত্যগাত্মনি ভাবাৎ পরত্রাভাবাদর্থান্তর প্রত্যক্ষঃ]।
আত্মার শরীরে অবস্থান বিষয়ে তিনটি মত প্রচলিত । কেউ আত্মার নিবাস মস্তিষ্কে মানে, কেউ হৃদয়ে মানে এবং কেউ সুষুম্ণা নাড়ীতে মেনে থাকে । কিন্তু শ্রুতি মতে শরীর আত্মার বাসস্থান, আমরা যেমন বাড়ীর মধ্যে বিচরন করি আত্মাও তেমন.. শ্রুতি অনুযায়ী আত্মা শরীরের তিন অংশে থাকে..হৃদয়ে, মস্তিস্কে ও সমস্ত শরীরে বিচরন করে।
১. অনেক প্রাচীন বিদ্বান আত্মার নিবাসস্থান মস্তিষ্ক মেনে থাকে । তাদের মন্তব্য এই যে, শরীরে অবস্থিত ব্যাপ্ত সমস্ত সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক জ্ঞান-তন্তুসমূহের কেন্দ্র মস্তিষ্ক, এটাই বুদ্ধির নিবাসস্থান এবং এটা দ্বারাই সমস্ত শারীরিক চেষ্টার নিয়মত হয়ে থাকে ।
অতএব চেতন অর্থাৎ সংবেদক আত্মার নিবাসস্থান মস্তিষ্কে হওয়া উচিত ।
২. যে ব্যক্তি আত্মার নিবাস হৃদয়ে মেনে থাকে, সে তার মত পুষ্টি করতে উপনিষদ এবং আয়ুর্বেদ এর কিছু প্রমাণ উপস্থিত করে, যেখানে আত্মার নিবাসস্থান হৃদয় বলা হয়েছে । যথা --
" অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষোন্তরাত্মা সদা জনানা হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।" (কঠ. ২/৬/১৭)
" আত্মনঃ শ্রেষ্ঠতমমায়তনং হৃদয়ম্।।"
৩. কতিপয় ব্যক্তি, সুষুম্ণায় জীবের নিবাস মেনে থাকে। তাদের মন্তব্য এই যে এই উর্ধ্বমূল অধঃশাখ শরীররূপী বৃক্ষের মূল আধারভূত হলো মেরুদণ্ড এবং তার মধ্যে অবস্থান করছে সুষুম্ণা নাড়ী, যার থেকে সহস্র তন্তু বের হয়ে এই সমস্ত শরীররূপী বৃক্ষকে কার্যক্ষম বলা হয়েছে । অতএব আত্মার নিবাস স্থানও সুষুম্ণারুপী কেন্দ্রস্থানেই হওয়া উচিত ।
বেদ এবং আত্মার নিবাস স্থান
অথর্ববেদ এর দশম কাণ্ডের দ্বিতীয় সূক্ত
" কেনপাষ্ণী " নামে প্রসিদ্ধ । এই সূক্তের ঋষি নারায়ণ, দেবতা - প্রতিপাদ্য বিষয় পুরুষ - ব্রহ্মপ্রকাশন । এখানে ৩১ নং এবং ৩২ নং মন্ত্রকে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম প্রকাশক বলা হয়ে থাকে । [ অথর্ববেদীয় বৃহৎসর্বানুক্রমণী, তথা তদনুসার মুদ্রিত অথর্ববেদীয় ঋষি নির্দেশ ] কেন উপনিষদের মূল আধার এই সূক্ত । কেন উপনিষদের প্রবচন শৈলীতে এই সূক্তের অনুকরণ করা হয়েছে । অতএব বেদের এই কেনপাষ্ণী সূক্ত এই প্রকারের প্রতিপাদন শৈলীর সবচেয়ে প্রাচীনতম উদাহরণ ।
এই সূক্ত থেকে কতিপয় সেই মন্ত্রসমূহের উদ্ধৃত করা হচ্ছে, যেখানে আত্মাকে শরীরগত বিশিষ্ট নিবাসস্থানের বিষয়ে কিছু নির্দেশ করা হয়েছে --
তদ্বা অথর্বণঃ শিরো দেবকোশঃ সমুঞ্জিতঃ। তত্ প্রাণী অভি রক্ষতি শিরো অন্নমথোঃ মনঃ।।২৭।।
অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পূরযোষ্যা। তস্যাং হিরণ্যয়ঃ কোশঃ স্বর্গো জ্যোতিষাবতঃ।। ৩১।।
তস্মিন্ হিরণ্যয়ে কোশে ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে। তস্মিন্ যদ্ যক্ষমাত্মন্বত্ তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ।।৩২।।
প্রভ্রাজমানাং হরিণীং যশসা সংপরীবৃতাম্। পুরং হিরণ্যয়ী ব্রহ্মা বিবেশাপরাজিতাম্।।৩৩।।
অন্তে ৩২নং এবং ৩৩নং মন্ত্রে প্রতিপাদিত বিষয়কে সংক্ষেপে এবং সমানরূপে প্রতিপাদনকারী অন্য একটি অথর্ববেদীয় মন্ত্র --
পুণ্ডরীকং নবদ্বারং ত্রিভির্নুণেভিরাক্তম। তস্মিন্ যদ্ যক্ষমাত্নন্বদ্ তদৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ।।
এই মন্ত্রসমূহের শব্দার্থ করার পূর্বে নিম্ন
পদসমূহের অর্থোদ্ধার করা আবশ্যক ।
মন্ত্রসমূহে প্রযুক্ত বিশিষ্ট পদ এবং তার বিবরণ
১. দেব ২. দেবকোশ, ৩. প্রাণ ৪. অন্ন ৫. মন ৬. হিরণ্ময়কোশ, ৭. হিরণ্যয়ী পুরী ৮. স্বর্গ ৯. জ্যোতিষাবৃত ১০. ত্র্যর ১১. ত্রিপ্রতিষ্ঠিত ১২. যক্ষ ১৩. আত্মন্বৎ ১৪. ব্রহ্মা
ক্রমশ এক এক পদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
১. দেব - দ্বিতীয় মন্ত্রে শরীরকে দেবতাদের পুরী বলা হয়েছে । এই দেব হলো পুরুষের জ্ঞানেন্দ্রিয় । এর দ্বারাই আত্মা সাংসারিক পদার্থসমূহের জ্ঞান উপলব্ধ করে থাকে তথা এর দ্বারা সমস্ত সাংসারিক ব্যবহারসমূহকে সিদ্ধ করতে সমর্থ হয়ে থাকে ।
ইন্দ্রিয়কে দেব বলা হয় --
দেবো দানাদ্বা, দ্যোতনাদ্বা, দ্যস্থানী ভবতীতি বা ( নিরুক্ত ৭/১৫)
দিবু ক্রীডাবিজিগীষাব্যবহারদ্যুতি....(ধাতুপাঠ)
চক্ষুর্দেবঃ। গোপথ পূ০ ২/১০ (১১)
বাগ্ দেবঃ। গোপথ পূ০ ২/১০ (১১)
শরীরে দেবাধিদেব ইন্দ্র ( আত্মা ) দ্বারা সম্বন্ধ [[ দ্রষ্টব্য-- " ঊধ্ব প্রাণমুন্নয়ত্যপানং প্রত্যগস্যতি। মধ্যে বামনমাসীনং বিশ্বেদেবা উপাসতে "।। কঠোপনিষদ ২/৫/৩।। প্রাণাপানক্রিয়া কারী বামন ( বামঃ শ্রেষ্ঠঃ, বামং রূপময় স বামনঃ। অষ্টাধ্যায়ী ৫/২/১০০ হতে মত্বর্থীয় ' ন ' প্রত্যয়)আত্মার বিশ্ব দেব = সমস্ত ইন্দ্রিয়ের উপাসনা করে থাকে । দেবগণ = ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে অবস্থানকারী বামন = আত্মা মস্তিষ্কেই অবস্থান করে, অন্যত্র নয় । ]] ইন্দ্রিয়রূপী দেবতাগণের বাস হওয়ার কারণে এই শরীরকে " দেবতাগণের পুরী " বলা হয় ।
২. দেবকোশ - প্রথম মন্ত্রে মাথাকে দেবকোশ বলা হয়েছে । দেব এর অর্থ জ্ঞানেন্দ্রিয় যা পূর্বে প্রমাণিত হয়েছে । সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বাহ্য স্থুলরূপ শিরোভাগে বিদ্যমান ( ত্বক্ ইন্দ্রিয় শরীরব্যাপী ) । পরন্তু এই ইন্দ্রিয়সমূহের সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক শক্তির কেন্দ্র মস্তিষ্কেই অবস্থিত । ইন্দ্রিয়সমূহের বাস্তবিক স্বরূপ শকত্যাত্মকই [[ দ্রষ্টব্য. ইন্দ্রিয়মিন্দ্রলিঙ্গমিন্দ্রদৃষ্টমিন্দ্রসৃষ্টমিন্দ্রজুষ্টমিন্দ্রদত্তমিতি বা । অষ্টাধ্যায়ী ৫/২/৯৩ ।। ]] , কেননা বাহ্য স্বরূপসমূহ সর্বদা নীরোগ হওয়ার পরও শক্তির হ্রাস অথবা উৎসন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে শ্রবণ দর্শন আদি ক্রিয়া সংঘটিত হয় না । অতএব এখানে দেবকোশ শব্দ দ্বারা মস্তিষ্ক বাচকই বুঝিয়েছে [[ অতএব সাংখ্যে ইন্দ্রিয়সমূহের উৎপত্তি অহংকার দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে - অহংকারাৎ পঞ্চতন্মাত্রাণি উভয়মিন্দ্রিয়ং চ । বিনা ভৌতিক উপষ্টম্ভের ইন্দ্রিয় কার্যে সমর্থ হয় না, এজন্য নৈয়ায়িক একে ভৌতিক মেনেছেন । দ্র. ন্যায়দর্শন. অ. ৩/১, ইন্দ্রিয় পরীক্ষা প্রকরণ ]] । এই দেবকোশকে অথর্ববেদ ৬/৯৫/১-এ দেবসদন বলা হয়েছে । দেবকোশের অর্থ মস্তিষ্ক করার ফলেই তৃতীয় মন্ত্রে উল্লেখিত " হিরণ্যকোশ " এর বিশেষণ সঠিকভাবে বুঝতে পারা যায় ।
একারণে তদেকদেশ-ন্যায়ানুসার এই মন্ত্রে নির্দিষ্ট মাথা শব্দ দ্বারা মাথার একটি অংশ মস্তিষ্কই বুঝিয়ে থাকে ।
৩. প্রাণ - বৈদিক বাঙময়ে প্রাণ শব্দ অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । পরন্তু প্রথম মন্ত্রে প্রাণকে মাথা, দেবকোশ, মস্তিষ্ক তথা অন্ন এবং মনের রক্ষক নির্দেশ করেছে । এই প্রাণ ভৌতিক বায়ু নয়, বরং জীব বাচক । " প্রাণো হি প্রিয়ঃ প্রজানাম্ " ( তৈ. ব্রা. ২/৩/৯/৫ ) -এ প্রাণ শব্দের অর্থ আত্মাই নির্দেশ করছে । এটাই এই ভৌতিক শরীরে অমৃতস্বরূপ । এজন্য ব্রাহ্মণগ্রন্থ গুলোতে বিভিন্ন স্থানে প্রাণকে অমৃত বলা হয়েছে - " অমৃতং বৈ প্রাণঃ " ( কৌ. ব্রা. ১১/৪/১৪/৪ ইত্যাদি ) ।
ভৌতিক প্রাণবায়ু হলো নাশবান, অতএব একে অমৃত শব্দ সম্বোধন করা উপযুক্ত নয় । মহাভারত শান্তিপর্ব ১৮৭/৩১-এ এই মানস অগ্নিকেই জীব ( আত্মা ) বলা হয়েছে --
" মানসোগ্নিঃ শরীরেষু জীব ইত্যভিধীয়তে " ।
অথর্ববেদ এর " প্রাণসূক্ত " ( ১০/৪ )-এ প্রাণ শব্দ দ্বারা জীবেরই মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে ।
জগতে জীবযুক্ত সচেতন শরীরকেই প্রাণী বলা হয়ে থাকে । অতএব এটা স্পষ্ট যে, প্রাণ শব্দের মুখ্যতয়া জীব বাচকই । প্রাণ অপান আদি ভৌতিক বায়ু সমূহের জন্য প্রাণ শব্দের ব্যবহার " প্রাণ = জীব " এর সাহচর্যের কারণে লক্ষণাবৃত্তিতে হয়ে থাকে ।
৪,৫ - অন্ন, মন -- এখানে অন্ন এবং মন দ্বারা " পদেষু পদৈকদেশান্ " ( = পদসমূহের স্থানে পদের একদেশ এর প্রয়োগ হয়ে থাকে ) ন্যায় দ্বারা অন্নময় এবং মনোময় কোশসমূহের নির্দেশ করে ।
৬. হিরণ্ময়কোশ -- দ্বিতীয় মন্ত্রে অষ্টচক্রা নবদ্বারা দেবগণের ( ইন্দ্রিয়সমূহ ) পুরীতে হিরণ্ময়কোশের উল্লেখ রয়েছে । একে স্বর্গ এবং জ্যোতিষাবৃত ( জ্যোতি দ্বারা আবৃত ) বলা হয়েছে । পরবর্তী মন্ত্রে এই হিরণ্ময়কোশের " ত্রিপ্রতিষ্ঠিত ত্র্যর " এর স্থানে " আত্মন্বৎ যক্ষ " এর স্থিতি বলা হয়েছে । একারণে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করা উচিত যে, মন্ত্রোক্ত হিরণ্ময়কোশের স্থিতি শরীরের কোথায় অবস্থান করছে ?
বৈয়াকরণগণের মতানুসারে হিরণ্ময় শব্দ হলো ময়ট্প্রত্যয়ান্ত [[ দ্রষ্টব্য -- ঋত্ব্যবাস্ত্ব্যবাস্ত্বমাধ্বীহিরণ্যয়ানি ছন্দসি। ( অষ্টাধ্যায়ী ৬/৪/১৭৫) সূত্র দ্বারা " হিরণ্ময় " এর 'ময়ট্' এর মকারের লোপ বেদে দর্শিত করা হয়েছে । কিছু বৈদিক গ্রন্থে হিরণ্ময় শব্দেরও প্রয়োগ রয়েছে, সেখানে হিরণ্ময় এর য়কার এর লোপের উল্লেখ রয়েছে, অথবা হিরণ্যার্থক " হিরণ্ " প্রকৃত্যন্তর হয়েছে ]] । এই পদে ময়ট্
" আনন্দময় " এর সমান প্রকৃত অর্থ্যাৎ প্রাচুর্য দ্বারা প্রস্তুত [[ তৎপ্রকৃতবচনে ময়ট্ (অষ্টা. ৫/৪/২১)-- প্রাচুর্যেণ প্রস্তুতং প্রকৃতম্ ( কাশিকা) ]] অর্থে হয়েছে । তদনুসার
" হিরণ্ময় " শব্দের অর্থ - হিরণ্য এর প্রাচুর্য - প্রাধান্য দ্বারা নির্মিত বস্তু । এই দেবপুরী শরীরে এমন কোন অবয়ব রয়েছে, যা হিরণ্য এর প্রাচুর্য দ্বারা তৈরি হয়েছে । এই বিষয়ে শরীর-শাস্ত্র-নিষ্ণাতসমূহের কথন হলো মস্তিষ্কে এমন একটি অবয়ব রয়েছে, যা হাল্কা হলুদ ( ধুসর ) বর্ণের পদার্থের বাহুল্য দ্বারা তৈরি হয়েছে [[ আজ্ঞাকন্দৌ নাম------- ধূসরবস্তুভূয়িষ্ঠৌকন্দৌ ব্রহ্মগুহামুভয়তো বর্তেতে। ( গণনাথসেন কৃত প্রত্যক্ষশারীর ভাগ. ৩, অ. ৬, পৃষ্ঠা ৭৯) ]] । যোগীগণ একে " আজ্ঞাচক্র বলে থাকে । যা বাম এবং দক্ষিণ ভেদের মাধ্যমে দুই বিভাগে বিভক্ত [[ দ্র.--- প্রত্যক্ষশারীরের পূর্বোক্ত উদাহরণ ]]। এই দুটির আকৃতি মনুষ্যের অঙ্গুষ্ঠ-পর্ব থেকে পাওয়া যায় [[ দেখুন-- প্রত্যক্ষশারীর ভাগ ৩, পৃষ্ঠা ৮৫, তে সংখ্যা ২২১ - এর চিত্র ]] । এটাই সমস্ত জ্ঞান তথা চেষ্টাতন্তুসমূহের কেন্দ্র ।এই অবয়বের অতিরিক্ত শরীরে আর কোনো এমন অবয়ব নাই যা, হাল্কা হলুদ বর্ণ বহুল পদার্থ দ্বারা তৈরি । অতএব বেদ এর
" হিরণ্ময়কোশ " এই আজ্ঞাচক্রই হতে পারে । এই হিরণ্ময় কোশকে ঋগ্বেদ ৪/৫৮/৫-এ
" হিরণ্ময় বেতস " বলা হয়েছে ।
শুধু এইটুকু নয়, বেদ-এ এই হিরণ্ময়কোশকে স্বর্গও বলা হয়েছে । ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে স্বর্গকে উর্ধ্বলোক বলা হয়েছে -- " ঊর্ধ্বমু বৈ স্বর্গো লোকঃ, উপরীব স্বর্গো লোকঃ " ( তৈ. ব্রা. ৩/২/১/১৫ )। এই ব্রহ্মাণ্ডে স্বর্গ আদিত্যলোক, পৃথিবীতে স্বর্গ ত্রিবিষ্টপ ( তিব্বত ) এবং এই শরীরের স্বর্গ মস্তিষ্কের অবয়বভূত হিরণ্ময়কোশই । তিনটি ঊর্ধ্বভাগে নিহিত । আদিত্যে অজর অমর দেবগণ = কিরণে বাস করে, ত্রিবিষ্টপে মানুষ দেবজাতির নিবাসস্থান এবং এই হিরণ্ময়কোশে দেবগণ = ইন্দ্রিয়সমূহ সূক্ষ্ম সংবেদনাত্মক শক্তির সংনিবাস । এজন্য বলা হয় " যদ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে " অর্থাৎ, যেমনভাবে ব্রহ্মাণ্ডের রচনা হয়েছে তেমনভাবে শরীরের হয়েছে ।
৭. স্বর্গ - মন্ত্রে হিরণ্ময়কোশকে স্বর্গ বলা হয়েছে । এর ব্যাখ্যা পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে ।
৮. জ্যোতিষাবৃত - মন্ত্রে হিরণ্ময়কোশকে
" জ্যোতি দ্বারা আবৃত " বলা হয়েছে । পূর্বোক্ত আজ্ঞাকেন্দ্রসমূহ ( ধূসরবর্ণ ) হওয়ার কারণে বেদ দ্বারা একে জ্যোতিষাবৃত হিসেবে বর্ণনা করা সর্বথা উপযুক্ত । কঠোপনিষদ অ. ২, বল্লী. ৪, কং. ১৩ -তেও অঙ্গুষ্ঠ-পর্বমাত্র পুরুষকে ধুমরহিত জ্যোতি দ্বারা চমকাতে থাকা অলঙ্কার দ্বারা উপাধি দেওয়া হয়েছে । [[ অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো জ্যোতিরিবাবধুমকঃ ]]
উপনিষদের অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ বেদের এই হিরণ্ময় কোশই, কেননা এই হিরণ্ময় কোশের আকারও অঙ্গুষ্ঠপর্ব সদৃশ । যা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে ।
৯. ত্র্যর - ত্র্যর শব্দের অর্থ -- ত্রিকোণ । মন্ত্রকে সামান্য দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের পর ত্র্যর এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত পদকে হিরণ্ময়কোশ এর বিশেষণ প্রতীত হয় । পরন্তু একই মন্ত্রে দুইবার ' তস্মিন্ ' পদের উল্লেখ থাকার কারণে এই মন্ত্রের দুইটি বাক্য তৈরি করতে হবে । এটুকু নয়, হিরণ্ময়কোশের আকৃতি যে অঙ্গুষ্ঠপর্ব সদৃশ তা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে । এজন্য ত্র্যর এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত পদ হিরণ্ময়কোশের বিশেষণ হতে পারে না । এসব কারণে ' ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে ' পদের সম্বন্ধ উত্তর ' তস্মিন্ ' পদের সাথে মিলিত করতে হবে । তদনুসার যেই স্থানে ' আত্মন্বৎ যক্ষ ' এর স্থিতি উক্ত মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই স্থান হলো ত্র্যর এবং ত্রিপ্রতিষ্ঠিত এবং তা হিরণ্ময়কোশের মধ্যে অবস্থান করছে । দুই আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে ' ব্রহ্মগুহা ' নামক এক ত্রিকোণ পরিখাকার স্থান রয়েছে [[ ব্রহ্মগুহা ব্রহ্মযোনির্বা নাম আজ্ঞাকন্দয়োরন্তরালে মধ্যরেখায়াং দৃশ্যা গুহা তনুত্রিকোণপরিখাকার । তদেব ক্বচিদ্ ব্রহ্মহৃদয়মিতি হৃদয়মিতি মা ব্যবহরন্তি প্রাঞ্চঃ ।। প্রত্যক্ষশারীর ভাগ ৩, অ. ৬, পৃষ্ঠা. ৮২ ]] ।
একেই বেদে ত্র্যর পদে উল্লেখ করা হয়েছে ।
১০. ত্রিপ্রতিষ্ঠিত - ত্রিপ্রতিষ্ঠিত শব্দের অর্থ - তিনটি স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা, অথবা তিনটি আধারের ওপর আধৃত । উপযুক্ত হিরণ্ময়কোশের ( আজ্ঞাকেন্দ্র ) মধ্যে বর্তমান যে ত্র্যর ( ব্রহ্মগুহা ) স্থান রয়েছে, তা গুহান্তরালিকবিবরদ্ধার মাধ্যম দিয়ে এবং দুইটি ত্রিপথগুহা দ্বারা সম্বন্ধ রয়েছে । এবং তৃতীয়টি ব্রহ্মদার সুরঙ্গের মাধ্যমে প্রাণগুহার মাধ্যমে সম্বন্ধ রয়েছে । [[ সা চ গুহায়াঃ পুরস্তাদুর্ধ্ব ত্রিপথগুহাম্যাং সম্বন্ধবতী গুহান্তরালিক বিবরদ্বারেণ, পশ্চিমতশ্চ প্রাণগুহয়া ব্রহ্মদ্বারসুরঙ্গ মার্গেণ ।। প্রত্যক্ষশারীর ভাগ ৩, অ. ৬, পৃষ্ঠা ৮২ ]] এজন্য বেদেও ত্র্যরকে ত্রিপ্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে ।
১১. যক্ষ - " যক্ষ পূজায়াম্ " ধাতু থেকে তৈরি এই শব্দ । আধ্যাত্মে যক্ষ শব্দ জীব এবং ঈশ্বর বাচক । অথর্ববেদ এর তিনটি আধ্যাত্ম প্রকরণে বার বার যক্ষ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় । এই প্রকরণে যেখানে যেখানে জ্যেষ্ঠ ব্রহ্মের ( পরমাত্মা ) বর্ণনা রয়েছে, সেখানে সেখানে যক্ষের বিশেষণ " মহৎ " এর উল্লেখ রয়েছে । দেখুন - অথর্ববেদ ১০/৭/৩৮, ১০/৮/৮৫ ।। এবং যেখানে যেখানে জীবের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে সেখানে যক্ষের বিশেষণ " আত্মন্বৎ " এর উল্লেখ রয়েছে । দেখুন - অথর্ববেদ ১০/২/৩২, ১০/৮/৪৩ ।।
প্রকৃত মন্ত্র সমূহে যক্ষ নবদ্বারযুক্ত [[ কঠোপনিষদ ২/২/১-এ একাদশদ্বার যুক্ত পুরের উল্লেখ রয়েছে -- " পুরমেকাদশদ্বারমজস্যাবক্রচেতসঃ "]] দেবপুরীর অন্তর্গত ত্র্যর ( ব্রহ্মগুহা ) এর স্থানে বিদ্যমান বর্ণনা করা হয়েছে । অতএব এই যক্ষ শব্দ নিশ্চয়ই জীব বাচক ।
১২. আত্মন্বৎ - আত্মা শব্দ জীব এবং ঈশ্বরবাচক । যা লোকপ্রসিদ্ধ । পরন্তু আত্মা শরীর বাচক শব্দও, যা কেবল বিদ্বানই জানেন । " হন্ত্যাত্মা আত্মানম্ " ( মহাভাষ্য ১/৩/৬৭ ) ইত্যাদি বাক্যে প্রথম আত্মা শব্দ জীব এবং দ্বিতীয়টি শরীর বাচক । অথর্ববেদে যেখানে যেখানে আত্মন্বৎ বিশেষণের সাথে যক্ষের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে সেখানে নবদ্বার পুরী অথবা পুণ্ডরীক ( গৃহ ) এরও উল্লেখ রয়েছে ( অথর্ববেদ ১০/৮/৪৩ ) । আত্মন্বৎ শব্দের অর্থ -- আত্মা দ্বারা যুক্ত ( আত্মাস্যাস্তীতি ) ।
এর দ্বারা স্পষ্ট যে তৃতীয় মন্ত্রে প্রযুক্ত আত্মন্বৎ শব্দে আত্মা শব্দ শরীর বাচক । এজন্য ব্রাহ্মণগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে - " আত্মা বৈ তনুঃ " ( শত. ব্রা. ৬/৭/২/৬, ৭/৩/১/২৩, ৩/৫/২/৩২ ) ; পাংক্ত ইতর আত্মা লোমত্বঙমাংসমস্থিমজ্জা ( তাণ্ডব্য ব্রা. ৫/১/৪ ); আত্মা বৈ পুঃ ( শতপথ ব্রা. ৭/৫/১/২১ )
এজন্য প্রকৃত মন্ত্রে প্রযুক্ত আত্মন্বৎ শব্দের অর্থ শরীর দ্বারা যুক্ত ।
১৩. ব্রহ্মা -- এর মূল শব্দ ব্রহ্মন্ । যা পুংলিঙ্গ এবং নপুংশকলিঙ্গ ( ব্রহ্মা-ব্রহ্ম ) ভেদে দুই প্রকার । দুই প্রকারের ব্রহ্মণ শব্দই আধ্যাত্মে জীব এবং ঈশ্বর এই দুটির জন্যই প্রযুক্ত হয়ে থাকে [[ বস্তুতঃ, যক্ষ, পুরুষ, ব্রহ্ম, ব্রহ্মা, আত্মা আদি যত পদ (শব্দ) জীব আর ঈশ্বর বাচক রয়েছে, সেসব আধ্যাত্ম- তে শরীরের আর আধিদৈবিক -এ ব্রহ্মাণ্ডের ও বাচক। ]] ।
এখানে ব্রহ্মণ শব্দের সাথে " জ্যেষ্ঠ " [[ তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ। (অথর্ববেদ: ১০/৮/১) ]] অথবা " মহৎ " আদি বিশেষণ প্রযুক্ত হয়, যা নিশ্চিতরূপে ঈশ্বর বোধকই বুঝিয়েছে । অন্যত্র প্রকরণ আদি অনুসারে এর বাচ্যকে নিশ্চয় করা হয়ে থাকে । প্রকৃত চতুর্থ মন্ত্রে হিরণ্ময়ী পুরীতে ব্রহ্মের প্রবেশ করার উল্লেখ রয়েছে । অতএব প্রকরণানুসারে এই মন্ত্রে প্রযুক্ত ব্রহ্মা পদ নিশ্চিতরূপে জীব বাচকই [[ অথর্ববেদ: ১০/২ এর অনেক মন্ত্রে এর উল্লেখ আছে-- " পুরং যো ব্রহ্মণো বেদ যস্যাঃ পুরুষ উচ্যতে"। ( অথর্ববেদ: ১০/২/৩০) ]], ঈশ্বর বাচক নয় ।
উক্ত মন্ত্রসমূহের সামূহিক অর্থ
এখন সামূহিক রূপে এই চারটি মন্ত্রের অধ্যয়নের দ্বারা এই মন্ত্রসমূহের অভিপ্রায় স্পষ্ট হয় --
" আট চক্র এবং নবদ্বার দ্বারা যুক্ত দেবগণের অযোধ্যা তথা অথর্বা নাম্নী নগরীর শিরস্থানে হিরণ্ময় দেবকোশ রয়েছে । এর মধ্যে আরও তিনটি সম্বদ্ধ ত্রিকোণ স্থানে আত্মন্বৎ যক্ষ ব্রহ্মা ( জীব ) বসবাস করে থাকে "
এই বর্ণন দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, মস্তিষ্কান্তর্গত পীতাভ বর্ণের দুটি আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে যে ত্রিকোণ পরিখাকার স্থান রয়েছে, সেখানে জীবাত্মার নিবাস । এজন্য যোগীগণ এই ত্রিকোণ পরিখাকার স্থানকে ব্রহ্মগুহা নাম দ্বারা সম্বোধন করে থাকে । এটাকেই সপ্তম সত্যনামক সপ্তম লোক স্বর্গ বলা হয় [[ দ্রষ্টব্য--- " সপ্তমে উ লোকে ব্রহ্ম। ( জৈ. ব্রা. ১/৩৩৩)। এই সাতটি লোক-কেই বৈদিক গ্রন্থগুলোতে ভূঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম্ রূপ সপ্ত ব্যাহ্যতিয় রূপে স্মরণ করা হয়। পুরাণে যে সাত স্বর্গের কথা বলা হয়েছে, তা এই পিন্ড= শরীরের নাভি হইতে উপর পর্যন্ত বর্তমান সাতটি স্থান। এতে দেবগণ নিবাস করেন। সত্য নামক স্বর্গতে দেবরাজ ইন্দ্র= আত্মা নিবাস করে । ]] । এর মধ্যে ব্রহ্ম -- জীব বসবাস করে ।
এই ভাবকে মাধ্যন্দিন সংহিতার অন্তিম মন্ত্রে এইভাবে ব্যক্ত করেছে -- " হিরণ্ময় পাত্র দ্বারা সত্যের মুখ ঢাকা রয়েছে, সেই সত্যরূপী আদিত্যে বর্তমান যে পুরুষ রয়েছে, তা আমি [[ হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্ । যোসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোসাবহম্ ।। যজু: ৪০/১৭ ]] । এখানে হিরণ্ময় পাত্র দ্বারা অভিপ্রায় উক্ত পীতাভ আজ্ঞাকেন্দ্রসমূহের দ্বারা । পাত্র শব্দের প্রয়োগ এর জন্য সর্বথা যুক্ত । কেননা পাত্র যেমন কোনো বস্তুর আধার হয়ে থাকে, সেই প্রকার সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত জ্ঞানবাহক তথা চেষ্টাবাহক তন্তুসমূহের কেন্দ্র আজ্ঞাকেন্দ্রই । ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে সত্যকে আদিত্য বলা হয়েছে । " তদ্ যৎসত্যমসৌ স আদিত্যঃ " ( শতপথ ব্রা. ৬/৪/১/১২ ) ;
" অসৌ বা আদিত্যঃ সত্যম্ " ( তৈ. ব্রা. ২/১/১১/১ ) । ব্রহ্মাণ্ডে যে আদিত্য রয়েছে, তা শির পিণ্ডে । এজন্য মন্ত্রের স্পষ্ট অর্থ - সেই সত্যরূপী আদিত্যলোকে যা বর্তমান, সেখানেই জীবাত্মা বিদ্যমান ।
খং ব্রহ্ম
' ও৩ম্ ক্রতো স্মর ' ( যজু: ৪০/১৫ ) এই মন্ত্রে মৃত্যুর সময় জীবাত্মার জন্য যে ও৩ম্-কে স্মরণ করার বিধান দেওয়া হয়েছে, সেই ও৩ম্ এর লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে -- " ও৩ম্ খং ব্রহ্ম " । অর্থাৎ ও৩ম্ নাম " খ " ব্রহ্মের ।
পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, বৈদিক গ্রন্থগুলোতে ব্রহ্ম পদ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা দুটির জন্যই প্রযুক্ত হয়ে থাকে [[ ব্রহ্ম পদ শরীরের বাচক ও, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড শব্দে ব্রহ্ম পদ জগৎ বাচক। তা অন্ড অর্থাৎ অন্ডাকার বা গোল। এই ব্রহ্মান্ড ব্রহ্মের শরীর। অতঃ আত্মার সমান ব্রহ্ম পদ ও শরীর, জীব আর ঈশ্বর এই তিন-এর বাচক। ]] ।
পরন্তু এখানে কেবল " পরমব্রহ্মের " নির্দেশ অভিপ্রেত হয়ে থাকে, স্পষ্টতার জন্য ' মহৎ ' ' বৃহৎ '
" খং " আদি শব্দ কোথাও না কোথাও বিশেষণ অবশ্যই প্রযুক্ত হয়ে থাকে । খং নাম দ্বারা আকাশকে সম্বোধন করা হয়, অতএব,
' খং ব্রহ্ম ' এর অর্থ, খ = আকাশ সমান সর্বব্যাপক ব্রহ্ম । তদনুসার সর্বব্যাপক ব্রহ্মের নাম ও৩ম্ । আদিত্য ( সত্য ) অর্থাৎ, ব্রহ্মগুহায় বর্তমান যে পুরুষ বিদ্যমান, তা ক্রতু = ক্রয়কারী জীব । সন্ধ্যার ভোজন মন্ত্রেও এই ভাবকে ব্যক্ত করা হয়েছে । সেখানে মহাব্যাহত্মাত্মক সপ্ত স্বর্গলোকের নির্দেশ করে অন্তে " খং ব্রহ্ম পুনাতু সর্বত্র " মন্ত্রে ব্রহ্মকে সর্বব্যাপক অর্থাৎ কোনো লোক বিশেষ দ্বারা অসম্বদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ।
কং ব্রহ্ম
খ এর পূর্বের বর্ণ ক । যা মস্তকের জন্য প্রযুক্ত হয়ে থাকে [[ দ্রষ্টব্য--- "কং সমারভ্য মেঘাবী ততো হ্যঙ্গানি বিন্যসেত্। ভবিষ্যপুরাণের নামে বীরমিত্রোদয় পূজাপ্রকাশ পৃষ্ঠা০ ২০২- এ উদঘৃত। সেখানে " কং শিরঃ" এরকম ব্যাখা করা হয়েছে। " কং মস্তকে" দ্র.-- হৈমলঘুন্যাস্, পৃষ্ঠা ২২ খ, অব্যয়ার্থতে। ]] । কেশকে মাথার চুল বলা হয় --
" কে শেরতে কেশাঃ " মাথায় হওয়া
[ ক্ষীরস্বামী, অমর টীকা ২/৬/৯৫ ] । ক এর সাথেই কায় শব্দের সম্বোধন রয়েছে । কপাট শব্দে বর্তমান ক ই মস্তককে বুঝিয়ে থাকে -- ক শিরঃ পাটয়তীতি কপাট [ ক্ষীরস্বামী, অমরটীকা ] । এ কারণে " কং ব্রহ্ম খং ব্রহ্ম " ( ছা.উপনিষদ. ৪/১০/৫ ) -এ ক ব্রহ্ম মস্তক স্থানীয় জীবাত্মা এবং খ ব্রহ্ম আকাশবৎ সর্বব্যাপক ব্রহ্ম পরমাত্মা ।
এই প্রকারে অথর্ববেদ এর মন্ত্রসমূহ স্পষ্ট নির্দেশ করে যে, শরীরে জীবের নিবাসস্থান মস্তিষ্কন্তর্গত দুই আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যবর্তী বর্তমান ব্রহ্মগুহাই ।
শরীরে উক্ত অবয়বাতিরিক্ত অন্য কোনো আর এরকম অবয়ব নাই, যা বেদ-এ স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে -
তস্মিন্ হিরণ্ময়ে কোশো ত্র্যরে ত্রিপ্রতিষ্ঠিতে ।
তস্মিন্ যদ্ যক্ষমাত্মন্বদ্ তদ্বৈ ব্রহ্মবিদো বিদুঃ ।।
এখন কেবল একটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টিপাত বাকি রয়েছে যেসব বচন দ্বারা আত্মার নিবাস " হৃদয় " -এ বলা হয়ে থাকে, সেখানে হৃদয় শব্দের বাচ্য বক্ষস্থানে লোকপ্রসিদ্ধ শরীরাবয়বই নির্দেশ করছে নাকি অন্য কিছু ?
হৃদয় শব্দের মীমাংসা
হৃদয় শব্দের অর্থ — লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, বৈদিক বাঙময়ে কোনো প্রকার শব্দ প্রকরণ বিশেষ বিনা সম্প্রতি লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ নেওয়া বা গ্রহণ করা অন্যায় । যদি এমন অপচেষ্টা করা হয় তাহলে মহর্ষি যাস্ক কৃত সমুদ্র শব্দের অন্তরিক্ষ [[ নিঘণ্টু: ১/৩ ; নিরুক্ত ২/১০ ]]
অর্থ অযৌক্তিক হবে , কেননা লৌকিক অর্থে সমুদ্র পদকে পার্থিব সমুদ্রই বলা হয়ে থাকে । সেই অবস্থায় " স উত্তরস্মাদধরং সমুদ্রম্ " ( ঋগ্বেদ. ১০/৯৮/৫ ) মন্ত্রের ব্যাখ্যাই হতে পারে না । এই প্রকার ' বৃত্র ' শব্দ লৌকিক অর্থে ত্বষ্টা নামক অসুরের পুত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ, পরন্তু নৈরক্ত বৃত্র শব্দের অর্থ "মেঘ" করেছেন [[ নিঘন্টু ১/২০ ; নিরুক্ত ২/১৬ ]] । বেদে
" বৃত্র " শব্দ ত্বাষ্ট্র অসুর শব্দ বাচক নয়, বরং মেঘ বাচক । এর সিদ্ধি যাস্ক অত্যন্ত প্রবল প্রমাণ দ্বারা করেছেন । এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যার দ্বারা স্পষ্ট হওয়া যায় যে, বেদার্থে কোনো প্রকার লৌকিক অর্থই নেওয়া যাবে না । এখানে এটাও বিচারণীয় যে, উপনিষদের সেই বচন দ্বারা যেখানে আত্মার নিবাস স্থান হৃদয় বর্ণনা হয়েছে, সেই বচনসমূহের হৃদয় শব্দের লৌকিক অর্থ বক্ষস্থানীয় শরীরাবয়বই হবে নাকি এর অন্য কোনো বাচ্য পদার্থ হবে ?
পূর্বোক্ত অথর্ববেদ এর মন্ত্রগুলোতে জীবের নিবাস স্থান সম্পর্কে এতো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জীবের নিবাস স্থান লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় শরীরাবয়বে নয়, মস্তিষ্কে অবস্থান করে । এমন পরিস্থিতিতে উপনিষদের বচন কি বেদবিরুদ্ধ মানতে হবে, নাকি উল্লেখিত হৃদয় শব্দের অন্যার্থ অনুসন্ধান করতে হবে ?
এর উপর দৃষ্টিপাত করার পূর্বে যেটা পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক যে, হৃদয় শব্দের মূল অর্থ কি ? শতপথ ব্রাহ্মণে ( ১৪/৮/৪/১ ) হৃদয় শব্দের নিরুক্তি ' হৃ দ য়ম্ ' এই তিন শব্দ দ্বারা মানা হয়েছে ।
হৃ — হৃন্ হরণে = হরণ করা, করে নেওয়া
দ — ডুদাঅ্র্ দানে = দেওয়া
য়ম্ — য়মু উপরমে = আটকিয়ে রাখা
অর্থাৎ, যে শরীরাবয়বে এই তিনটি ক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে, তাকে হৃদয় বলা হয় ।
ভারতীয় আধ্যাত্মবিদ্যার সামান্য একটি সুত্র — " য়দ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে " এই তত্ত্বের মূলভূত যজুর মন্ত্রে এই প্রকার বর্ণনা করা রয়েছে --
অন্তস্তে দ্যাবাপৃথিবী দধাম্যন্তর্দধাম্যুর্বন্তরিক্ষম্ ।
সজুর্দেবেভিরবরৈঃ পরৈশ্চান্তর্য়ামে মঘবন্ মাদয়স্ব ।।
যজুর্বেদ: ৭/৫
অর্থাৎ — হে মধবন্= ইন্দ্র= জীব ! তোমার শরীরের ভিতরই দ্যুলোক, পৃথিবীলোক এবং বিস্তীর্ণ অন্তরীক্ষলোকের স্থাপিত করে থাকি ।তুমি অবর এবং দেবগণের সহিত ( কর্মেন্দ্রিয়সমূহ এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহ ) অন্তর্য়াম ( সব ইন্দ্রিয়ের নিয়মনকারী ) স্থানে বর্তমানই মুদ্রিত রয়েছে ।
এই আধ্যাত্মবিদ্যা দ্বারা জানা তত্ত্ব আধ্যাত্ম জ্ঞানের বাস্তবিক দৃষ্টান্ত । এর মাধ্যমে আধ্যাত্মসম্বন্ধী অনেক রহস্যের উন্মোচন হয় ।
হৃদয় শব্দের অর্থের সমস্যাও উক্ত তত্ত্বকে স্বীকার করা ফলে বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে থাকে ।
হৃদয় এবং সমুদ্রের সাম্য
এই শরীরে বক্ষস্থানীয় হৃদয়ের যে কার্য এবং মহত্ত্ব রয়েছে, তা এই ব্রহ্মাণ্ডের সমুদ্রকে নির্দেশ করে । মহর্ষি যাস্ক সমুদ্র শব্দের ব্যখ্যা করেছেন - " সমুদ্রবন্ত্যস্মাদাপঃ, সমুদ্রবন্ত্যেনমাপঃ ( নিরুক্ত ২/১০ ), অর্থাৎ, যেখান থেকে আপঃ ( জল ) গমন করে থাকে, এবং যার প্রতি আপঃ গমন করতে থাকে, তাই সমুদ্র । পার্থিব সমুদ্রের প্রতি সমস্ত আপঃ গমন করতে থাকে এবং এর দ্বারা বাষ্পরূপ হয়ে আপঃ [ উপরে ] গমন করতে থাকে । এবং গমনাগমনের সাথে তার মধ্যে জল স্থিরও থাকে । উপরে শতপথ অনুসারে হৃদয় শব্দের যে অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে, তা পূর্ণরূপে সমুদ্রে ঘটিত হয়ে থাকে । " অতঃ লোকসম্মিতোয়ং পুরুষঃ " ( চরক. শরীরস্থান. অ. ৪/১৩ তথা ৫/২-৪ ) অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডে যে সমুদ্র রয়েছে, তা শরীরে লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় ।
অতএব সামুদ্রিক মুক্তা প্রবাল আদি হৃদয়ের জন্য পরম ঔষধ মানা হয়েছে ।
সমুদ্র এবং হৃদয়ের অনেকতা -- ব্রহ্মাণ্ডে তিনটি সমুদ্র বিদ্যমান -
" ত্রীন্তসমুদ্রান্তসমসৃপৎ স্বর্গান্ " ( যজু: ১৩/৩১ ) । তিনটি সমুদ্র - এক পার্থিব ( পৃথিবীস্থানীয় ) , দ্বিতীয় অন্তরিক্ষস্থ, তৃতীয় দ্যুস্থ ( নিঘন্টু. অ. ৬ -এ সমুদ্র দ্যুস্থানীয় দেবতাসমূহেরও অন্তর্গত ) । প্রথমটিতে জল স্থূলরূপে এবং দ্বিতীয়টিতে বাষ্পরূপে । দ্যুতে আপঃ সোম - " আপো বৈ সোমঃ " ( তুলনা - শতপথ ব্রা. ৭/১/১/২২ ) । প্রথম এবং দ্বিতীয় সমুদ্রের বর্ণন " স উত্তরস্মাদধরং সমুদ্রম্ " ( ঋগ্বেদ. ১০/৯৮/৫ ) -এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে । যাস্কীয় নির্বচন এই দুটি সমুদ্রকে কেন্দ্র করেই বর্ণনা করা হয়েছে । দ্যুলোকস্থ আদিত্যই তৃতীয় সমুদ্র । এর কিরণও পার্থিব জলকে হরণ করে এবং তাকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্মতর সূক্ষ্মতম করে অর্থাৎ সোমরূপে পরিণত করে সূর্য পর্যন্ত পৌঁছিয়ে থাকে এবং অগ্নিতে প্রজ্বলিত হয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মরূপে সেই সোম কিরণের দ্বারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, যার মাধ্যমে প্রাণী এবং ঔষধি বনস্পতি জীবন ধারণ করে থাকে ।
বেদে সোমের স্থিতি সূর্যেই বর্ণনা করা হয়েছে -
" সোমো গৌরী অধিশ্রিতঃ " ( ঋগ্বেদ: ৯/১২/৩ ) । গৌর আদিত্যের নাম, তারই স্ত্রী লিঙ্গ গৌরী । যথা সূর্যের সূর্যারূপ । শতপথ ব্রাহ্মণে ৯/৪/২/৫-এ বর্ণনা করা হয়েছে — অসৌ বৈ ( দ্যুঃ ) লোকঃ সমুদ্রো নভস্বান্ ।
' নভ ' এর নির্বচন যাস্ক ( নিরুক্ত ২/১৪ ) ভনকে ( ভা দীপ্তৌ + ক্যুন্ ) আদ্যন্তবিপর্যয় দ্বারা বর্ণনা করেছেন । অতএব নভস্বান্ এর অর্থ — দীপ্তিমান্ ।
" য়দ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎপিণ্ডে " অথবা
" লোকসম্মিতোয়ং পুরুষঃ " অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডে আদান-প্রদানকারী তিনটি সমুদ্র রয়েছে, সুতরাং এই শরীরেও আদান-প্রদানকারী তিনটি হৃদয় অবশ্যই থাকবে । তদনুসার শরীরে দ্যু স্থানীয় সমুদ্র মস্তিষ্কে অবস্থান করে থাকে । এটাই সম্পূর্ণ শরীরে ব্যাপ্ত জ্ঞানতন্তু এবং কর্মতন্তু হিসেবে অবস্থান করে, যা আদান-প্রদান করতে থাকে । পায়ের ওপর কাঠ অথবা ভারী কোনো বস্তুর পতিত হলে তার সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং তাৎক্ষণিক মস্তিষ্ক সংকেত দেয় পায়ের উপরের ভারী বস্তুটিকে সরাতে বা পা সেখান থেকে সরিয়ে নিতে ; সেই সংকেত অনুসারে পা সেই স্থান থেকে সরে যায় । এর সাথেই মস্তিষ্কে হিরণ্যবর্ণ = হালকা পীত বর্ণের দ্রব দ্রব্য রয়েছে [[ দ্রষ্টব্য-- পূর্বে বর্ণিত হিরণ্ময়কোষের ব্যাখা। ]], যাকে আর্য়ুবেদে "ওজ" সম্বোধন করা হয়েছে [[ হৃদি তিষ্ঠতি যঞ্চুদ্ধ রক্তমীষত্সপীতকম্। ওজঃ শরীরে সমারূযাতং তন্নাশাত্ না বিনশ্যতি। ( চরক সূত্রস্থান ১৭/৭৫)।। কোথাও-কোথাও র্সাপবর্ণম পাঠ রয়েছে। এর তাৎপর্য গো-ঘৃতের বর্ণের সাথে। তাই-ই পীতাভ হয়। ওজ --এর বিষয়ে চরক সূত্রস্থান. ৩০/১-১৪ তেও দ্রষ্টব্য রয়েছে। ]] এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে একেই সোমরূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । [[ এতদ্বৈ দেবানাং পরমমন্নং যৎসোমঃ। ( তৈ. ব্রা. ১/৩/২/২) ব্রহ্মাণ্ডে এই সোম দেব= রশ্নিদের অন্ন। এর প্রজ্বলনের মাধ্যমেই সূর্যতে প্রকাশ বা তাপের উৎপত্তি হয়। আর শরীরে এই সোমই ওজঃ। ইন্দ্রিয় গুলোর ভক্ষ ও এই সোমই। এর কারণেই ইন্দ্রিয় সকল বলবান হয়। এই কথাও " সোমঃ সর্বাভ্যো দেবতাভ্যো জুহ্বতি" ( শত. ব্রা.১/৬/৩/২১) --তেও বলা হয়েছে। ]]
যা বীর্যরূপ আপঃ এর সূক্ষ্মতমরূপ হয়ে থাকে, তা সুষুম্না নাড়ী দ্বারা মস্তিষ্কে ক্ষরিত হয়ে থাকে । তাই-ই ঋগ্বেদ এর নবম মণ্ডলে পঠিত পবমান সোম হিসেবে খ্যাত, যার মহিমা সম্পূর্ণ মণ্ডলে বর্ণিত হয়েছে । সেই ওজ বা সোম মস্তিষ্ক থেকে ক্ষরিত হয়ে সম্পূর্ণ শরীরে ব্যাপ্ত তন্তুজাল দ্বারা শরীরে সর্বত্র পৌঁছিয়ে শরীরকে ওজস্বী করে থাকে । " মরণ বিন্দুপাতেন " এর নির্দেশ এই ওজরূপ অষ্টম ধাতুর জন্য ।
লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয়েরও এই কার্য যে, হৃদয় শরীর থেকে দূষিত রক্ত গ্রহণ করে এবং সেই শুদ্ধ করে শরীরে ছড়িয়ে দেয় । এই প্রকারে শরীর এবং সমুদ্রের কার্য একই [[ ঋগ্বেদ: ৪/৫৮/৫ তথা যজুর্বেদ: ১৭/৯৩ তে হৃদ্য সমুদ্র, শত মার্গ গমনকারী নাড়ীসমূহ, সোমরূপী ঘৃতের প্রবাহ এবং তার মধ্যে হিরণ্যয় চেতনের উল্লেখ রয়েছে ]] ।
ব্রহ্মাণ্ডে তিনটি সমুদ্র বিদ্যমান, সেই প্রকারে পিণ্ড = শরীরেও তিনটি সমুদ্র বিদ্যমান — নাভি, হৃদয় এবং মস্তিষ্ক
নাভির কার্য — পাকস্থলীসংক্রান্ত অঙ্গ থেকে নিষ্পন্ন রস গ্রহণ করা এবং ২৪ মুখ্য ধমণীর দ্বারা সম্পূর্ণ শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া ।
হৃদয়ের কার্য — পূর্বে বর্ণিত হয়েছে
মস্তিষ্কের কার্য — শরীরে ব্যাপ্ত ব্যাপ্ত জ্ঞানতন্তুসমূহ দ্বারা শরীরের প্রত্যেক স্থান থেকে জ্ঞান আহরণ করে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া, চেষ্টাবাহক তন্তুসমূহ দ্বারা শরীরায়বকে যথাযোগ্য পরিচালন করা ।
পূর্বে উদ্ধৃত অথর্ববেদ এর মন্ত্রগুলোতে এই দেবপুরী অযোধ্যাকে অষ্টচক্রা বলা হয়েছে । চক্রের অভিপ্রায় হলো, এক স্থান থেকে গমন করে আবার সেই স্থানে ফিরে যাওয়া । এই ক্রিয়া সাধন সেই আটটি শরীরাবয়ব চক্রকে হৃদয়পদবাচ্যও বলা হয় । এজন্য শতপথ ৯/১/২/৪০-এ বর্ণনা করা হয়েছে — " নিকক্ষে নিকক্ষে হৃদয়ম্ " অর্থাৎ, প্রত্যেক কক্ষ = শরীরবিভাগে হৃদয় অবস্থিত । এই আট চক্ররূপী হৃদয়ে পূর্বোক্ত নাভি হৃদয় এবং মস্তিষ্করূপী সমুদ্র বা হৃদয় প্রধান অবস্থান করছে ।
হৃদয় শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে । তাকে ব্রহ্মাণ্ডস্থ সমুদ্র দ্বারা তুলনা দেওয়ার বর্ণনা করা হয়েছে । এর দ্বারাই স্পষ্ট হয় যে, পিণ্ডেও ব্রহ্মাণ্ডের সমান তিনটি সমুদ্র বিদ্যমান, যাকে শারীরিক পরিভাষায় হৃদয় বলা হয় ।
পরন্তু যে ব্যক্তি পূর্বের নির্দেশনানুযায়ীও নাভি এবং মস্তিষ্ককে হৃদয় শব্দে বাচ্য মানতে নারাজ, তার জন্য প্রাচীন শাস্ত্র থেকে প্রমাণ তুলে ধরা হবে । যার মাধ্যমে নাভি এবং মস্তিষ্কের হৃদয়পদবাচ্যতা স্পষ্ট হয়ে যাবে ।
নাভির জন্য হৃদয় শব্দের ব্যবহার — সুশ্রুত সূত্রস্থান অধ্যায় ১৪তে বর্ণনা রয়েছে —
" উপযুক্তস্যাহারস্য সম্যক্ পরিণতস্য য়ঃ তেজোভূতঃ সারঃ স রস ইতি উব্যতে ।
তস্য চ হৃদয়ং স্থানম্ । স হৃদয়াত্ চতুবিংশতিধমনীরনুপ্রবিশ্য.... কৃ্ৎস্নং শরীরমহরহস্তর্পয়তি । "
অর্থাৎ — ভক্ষণ করা খাবার ভাল ভাবে পরিপাক হবার পর যে তেজরুপ সার হয়,তাকে ব্রহ্মরস বলে । তার স্থান হলো হৃদয় । সেই ব্রহ্মরস হৃদয় থেকে ২৪টি ধমনীতে প্রবিষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ শরীরকে প্রতিদিন পুষ্ট করে থাকে ।
হজম হওয়া খাবার থেকে নিষ্পন্ন ব্রহ্মরসের স্থান নাভি । লোকপ্রসিদ্ধ বক্ষস্থানীয় হৃদয় নয়, যা সাধারণ অর্থে প্রচলিত । অতএব এখানে হৃদয় শব্দ নাভি বাচকই বুঝিয়েছে ।
এর পুষ্টি সুশ্রুত শরীরস্থান অধ্যায় ৯ তেও বর্ণনা করা হয়েছে ।
" চতুর্বিংশত্যো ধমনয়ো নাভিপ্রভবা অভিহিতাঃ তাসাং তু নাভিপ্রভবাণাং ধমনীনাং ঊর্ধ্বগা দশ, দশ চাঘোগামিন্যঃ । চতস্রশ্চ নির্য়গাঃ "
অর্থাৎ — নাভি থেকে গমনকারী ২৪টি ধমনী বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকে ....... সেই নাভী থেকে গমনকারী ধমনীসমূহের মধ্যে দশটি উপরে গমন করে থাকে, দশটি নিচে এবং চারটি বিভিন্ন স্থানে ।
সুশ্রুতকারের বর্ণন, নাভি থেকে গমনকারী ২৪টি ধমনীর সংকেত পূর্বোক্ত উল্লেখিত হৃদয় থেকে গমনকারী ২৪টি ধমনীর বর্ণনা একই তত্ত্ব নির্দেশ করছে । সুশ্রুতে সূত্রস্থান অধ্যায় ১৪তে ব্যতীত আর কোথাও নাভি থেকে গমনকারী ২৪টি ধমনীর বর্ণনা নাই ।
অতএব " অভিহিতাঃ " শব্দের সংকেত উক্ত হৃদয় পদ ঘটিত বর্ণনাকেই স্পষ্ট নির্দেশ করছে । ভিষক্প্রবর গণনাথ সেন হৃদয় শব্দের লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ বাচক না মেনে এর অর্থ মস্তিষ্ক করেছেন । পরন্তু তিনি সুশ্রুত ( সূত্রস্থান অ. ১৪ ) এর প্রথম উদ্ধৃত বচনে হৃদয় শব্দের লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ বক্ষস্থানীয় অবয়ব বাচক মেনে সুশ্রুতের দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দর্শায়িত করেছেন ।
" শ্বোক্তিবিরোধশ্চ সংজ্ঞার্থব্যাকুলীভাবনিমিত্তঃ সুশ্রুতে । য়থা সূত্রস্থানে হৃদয়াচ্চতুতিধমনীরনুপ্রবিশ্ব ইত্যমিধায় পুনঃ শারীরে চতুর্বিংশতির্ধমন্যো নাভিপ্রভবা অভিহিতাঃ ইতি সূচনম্ " প্রত্যক্ষশারীর ভাগ ১, উপোদ্ঘাত পৃষ্ঠা ৬৬, সংস্করণ. ২
যদি গণনাথ সেন ঐ সুশ্রুত পাঠসমূহের সূক্ষ্মতা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং বিচার করতেন, তাহলে সেই দুটি পাঠের মধ্যে বিরোধ দর্শাতেন না ।
মস্তিষ্কের জন্য হৃদয় শব্দের ব্যবহার — আধ্যাত্মিক পরিভাষায় আদিত্য পদ মাথা = মস্তিষ্ক বাচক হয়ে থাকে । যজুর্বেদ ৪০/১৭তে উল্লেখ রয়েছে -- " যোসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোমাবহম্ " এটি আত্মা প্রকরণ হওয়ার জন্য " অহং " পদবাচ্য আত্মাকেই নির্দেশ করছে ।
এই আত্মারূপী ব্রহ্ম থেকে পরমব্রহ্মকে পৃথক করার জন্য পরমুহূর্তে বলা হয়েছে — ' ও৩ম্ খং ব্রহ্ম ' ; ও৩ম্ খং = আকাশের সমান সর্বব্যাপক ব্রহ্ম । যজুর উক্ত মন্ত্রে উক্ত আধ্যাত্মিক আদিত্যকে শতপথ ৯/১/৩/৩৪-এ হৃদয় বলা হয়েছে — " অসৌ বা আদিত্যো হৃদয়ম্ " । মৈত্রায়ণী আরণ্যক ৬/৩৪-এ হিরণ্যবর্ণ শকুন= পক্ষী [[ আত্মার জন্য পক্ষী শব্দের প্রয়োগ সাধুদের বাণীতে প্রায়ই পাওয়া যায় । জনসাধারণেও এই অর্থটি প্রসিদ্ধ। ]] = আত্মাকে আদিত্যরূপ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত বর্ণনা করা হয়েছে — " হিরণ্যবর্ণঃ শকুনঃ হৃদি আদিত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ " । এই বচন দ্বারা হৃদ্ ( হৃদয় ) এবং আদিত্য দুইটি পদকেই নির্দেশ করে সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হয়েছে ।
অথর্ববেদ ১৯/৯/৫ নং মন্ত্র ——
" ইমানি য়ানি পঞ্চেন্দ্রিয়াণি মনঃষষ্ঠানি মে হৃদি ব্রহ্মণা সংশ্রিতানি..... " । [[ দ্রষ্টব্য-- চরক সূত্র. ৩০/৪]]
এই মন্ত্রে মনের সাথে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়কে ব্রহ্ম = আত্মার সাথে হৃদ-এ ( হৃদয় ) স্থিত বর্ণনা করা হয়েছে । [[ তুলনা করুন -- ষড়ঙ্গমঙ্গং বিজ্ঞানমিন্দ্রিয়াণ্যর্থপঞ্চকম্। আত্মা চ সগুণশ্চেতঃ চিন্ত্যং চ হৃদি স্থিতম্।। চরকসূত্র স্থান ৩০/৪।। বিজ্ঞান, ইন্দ্রিয়াং, পঞ্চইন্দ্রিয় ( রূপাদি) আত্মা, চেতঃ (মন), চিন্ত্য য়ে ছঃ, হৃদয় স্থিত রয়েছে। এরজন্যে হৃদয়াঙ্গ ষড়ঙ্গ বলা হয়ে থাকে। ]] ইন্দ্রিয়সমূহের স্থান মস্তক । এর সাথে তন্তুসমূহের সমন্ধ মস্তিষ্ক = ব্রহ্মরন্ধ্র বা ব্রহ্মগুহার সাথে সর্ববাদীসম্মত । সেই ইন্দ্রিয়সমূহের স্থানকে এই বচনে হৃদ ( হৃদয় ) সম্বোধন করা হয়েছে এবং সেখানেই আত্মার বাস বা অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে ।
নিরুক্ত ৪/১৩-তে ইন্দ্রিয়সমূহকে মস্তক সমাশ্রিত বলা হয়েছে — " ইদমপি ইতরচ্ছির এতস্মাদেব । সমাশ্রিতান্যেতদিন্দ্রিয়াণি ভবন্তি " ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/২১ নং-এ উল্লেখিত
" য়ত্রা সুপর্ণাঃ " মন্ত্রের ব্যাখ্যান যাস্ক অধিদৈবত এবং আধ্যাত্ম দুই পক্ষেই করেছেন । অধিদৈবত পক্ষে সুপর্ণ এর অর্থ আদিত্যের রশ্মি, তার গোপা= রক্ষক আদিত্য । আধ্যাত্ম পক্ষে সুপর্ণ এর অর্থ ইন্দ্রিয়, তার গোপা আত্মা ( দ্র. নিরুক্ত: ৩/১২ ) । এর ব্যাখ্যা দুর্গাচার্য করেন — " অধ্যাত্মেপি হৃদ্যাকাশাত্ য়ানি ইন্দ্রয়াণি প্রসর্পন্তি, ত এব রশ্ময়ঃ " অর্থাৎ, আধ্যাত্ম অর্থে হৃদ্ ( হৃদয় ) হলো আকাশ দ্বারা যে ইন্দ্রিয়সমূহ গতিপ্রাপ্ত হয়, তাই-ই রশ্মি । অধিদৈবত অর্থে রশ্মিসমূহের প্রসরণের স্থান আদিত্য ।
অতএব আধাত্ম্য অর্থে ইন্দ্রিয়সমূহের প্রসরণস্থান হৃদয়রূপী আদিত্য = মস্তিষ্কই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত , যা স্পষ্ট ।
আয়ুর্বেদোক্ত চেতনাস্থানীয় হৃদয়
চরক সুত্রস্থান অ. ১৭তে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে -
প্রাণাঃ প্রাণমৃতাং য়ত্র শ্রিতাঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ ।
য়দুত্তমমঙ্গমঙ্গানাং শিররস্তদভিঘোয়তে ।।
অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়সমূহের স্থিতি হলো মস্তক । একেই আধ্যাত্মবিদ " হৃদয় " সম্বোধন করে থাকে ।
চরক সুত্রস্থান ৩০/৭-এ উল্লেখ রয়েছে --
" তৎপরমমৌজসঃ স্থানং য়ত্র চৈতন্যসং গ্রহঃ "
এখানে যে স্থানে চৈতন্যের স্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে, তাকে পরম ওজ এর স্থান বলা হয়েছে । এই পরম ওজ-ই সেই গোঘৃতবর্ণ ঈষৎপীতক দ্রব দ্রব্য, যা ব্রহ্মগুহায় বিদ্যমান ।অতএবঃ উক্ত বচন অনুসারে ওটাই চেতন আত্মার নিবাস স্থান । " হৃদয়ে চিত্তসংবিৎ " ( ৩/৩৪ ) এই যোগ সূত্রানুসারে তথা
" তদ্ ( হৃদয়ং ) বিশেষেণ চেতনাস্থানম্ " এই সুশ্রুতের ( শারীর. ৪/৩১ ) বচন অনুসারে ওজ-কে স্থানরূপ হৃদয়ে চেতনার স্থিতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ।
চরক নিদান স্থান ৮/৩-এ বর্ণনা করা হয়েছে — " আত্মনঃ শ্রেষ্ঠমায়তনং হৃদয়ম্ "
এই প্রকারে চরক কৃত সুশ্রুত হতে পর্যাপ্ত প্রমাণসমূহের দ্বারা বিদিত হওয়া যায় যে, আত্মার আয়তনরূপী হৃদয় লোকপ্রসিদ্ধ অর্থ হৃদয় নয় ।
সুশ্রুতে ( শারীরস্থান. অ. ৪ ) স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে —
পুণ্ডরীকেণ সদৃশং হৃদয়ং স্যাদধোমুখ্যম্ ।
জাগ্রতস্তদ্বিকসতি স্বপতশ্চ নিমোলতি ।।
অর্থাৎ, হৃদয় কমলের সমান অধোমুখ ।জাগ্রত অবস্থায় তা বিকশিত হয় এবং নিদ্রাবস্থায় সংকুচিত হয়ে থাকে ।
সুশ্রুতের এই বচন দ্বারা হৃদয়কে যে অবস্থাভেদে সংকোচ-প্রসারণ এর ধর্ম বলা হয়েছে, তা লৌকিক অর্থ বক্ষস্থানীয় অবয়ব নয় । কেননা, এটা তো জাগ্রত বা স্বপ্ন দুই অবস্থাতেই কার্য সম্পাদন করে থাকে ।
এই দুটি ধর্ম মস্তিষ্কের হয়ে থাকে । স্বপ্নে কোমলভাবে সংকুচিত হওয়ার ফলে ইন্দ্রিয়সমূহ বাহ্যমুখী থাকে না, তা অভ্যন্তরে থাকে ।
এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে এখানে হৃদয় শব্দ মস্তিষ্ক বাচকই বুঝিয়েছে ।
এখন এই বিষয়ে আয়ুর্বেদীয় শল্যতন্ত্রের পুনরূদ্ধারক ভিষকপ্রবর গণনাথ সেন এর বর্ণনা উদ্ধৃত করা হলো ।
গণনাথ সেন স্ববিরচিত প্রত্যক্ষ শারীর গ্রন্থের নাড়ীখণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় উল্লেখিত " তন্ত্র সাঙ্গোপাঙ্গো মস্তিষ্কং সহস্রদলপদমসদশাত্বাৎ সহস্রাকারমিতি মন্যন্তে য়োগিনঃ " এর পাদ-টিপ্পণীতে লিখেন ——
" যত্তু বৈদ্যকে-- ' বুদ্ধ নিবাসং হৃদয়ং প্রদুষ্য ' (চরক) ইত্যাদি -- বিরুদ্ধপ্রায়বচনম্। তন্মস্তিষ্কমূলস্থিতাজ্ঞাচক্রাশমূতস্রহ্মহৃদর্য়ামিপ্রায়েণ। যোগিনো হিষটচক্রমুপক্রম্য এতৎপদমান্তরালে নিবসতি চ মনঃ সূক্ষ্মমরূপ প্রসিদ্ধম্ ইতি স্পষ্টমাহুঃ ; ন চ মনোবিরহিতা বুদ্ধিরস্তি। শ্রুতিশ্চ-- ' হৃদয়ং চেতনাস্থানম্' [[ সুশ্রুত: শারীর. ৪/৩১ ]] ইত্যাদি প্রাচীন বচনম্। ' তদপি নবভিপ্রায় কমেব। " জাগ্রতস্তদ্বিকসতি " [[ সুশ্রুত: শারীর. অধ্যায়: ৪ ]] ইত্যাদি নির্দেশাত্ ইতি বিক্। ন চ মাংসময়মেব হৃদয়যন্ত্রং তদিতি বাচ্যম্? তদ্ধি ন কয়মাপি তাদগ্লুক্ষণাভিষেয়ং মবিতুমহতি, অসম্ভবাত্। তবেতদখিলমস্মদীয়ে শারীরমীমাংসাখ্যে গ্রন্থে বিস্তরেম স্ফুটীকৃতং দ্রষ্টব্যম্। "
অর্থাৎ — সব প্রকার জ্ঞানের স্থান মস্তিষ্ক । যা বৈদ্যকের বুদ্ধির নিবাসস্থান হৃদয়কে দূষিত করে এই বচনের বিরুদ্ধ নয় । বৈদ্যক বচনে হৃদয় শব্দ দ্বারা মস্তিষ্কের মূলে স্থিত আজ্ঞাচক্রের ( আজ্ঞাকেন্দ্র ) অংশরূপ ব্রহ্মহৃদয় অভিপ্রেত হয়েছে । যোগীগণ ষটচক্র নিরুপণের প্রসঙ্গে মস্তিষ্কের মূলে অবস্থিত আজ্ঞাচক্রের বর্ণনা করে এই পদম এর মধ্যে সূক্ষ্মরূপ মন অবস্থান করে এটা স্পষ্ট বুঝিয়েছেন । মন বিহীন বুদ্ধি অবস্থান করতে পারে না ।
উপনিষদেও — ' হৃদয়ের মধ্যে আকাশ রয়েছে, সেখানে মনোময় পুরুষ অবস্থান করে ' এমনটা বর্ণিত রয়েছে । সুশ্রুতাচার্য " যা হৃদয় চেতনার স্থান " ইত্যাদি যে প্রাচীন আচার্যগণের মত উদ্ধৃত করেছেন, সেটাও এটাকে নির্দেশ করছে ( অর্থাৎ, সেখানেও হৃদয় দ্বারা মস্তিষ্কাবয়বভূত ব্রহ্ম হৃদয়ই বুঝিয়েছে ) । কেননা, এর জন্য সুশ্রুতে
" জাগ্রত অবস্থায় বিকশিত হয় এবং স্বপ্নাবস্থায় সংকুচিত হয় " এটা বর্ণিত রয়েছে ।
হৃদপিণ্ডকেই এখানে বোঝানো হয়েছে, এমনটা বলা সম্ভব নয় । কেননা এই হৃদপিণ্ডে উক্ত লক্ষণ সম্ভব নয় ( অর্থাৎ, হৃদপিণ্ডে জাগ্রত অবস্থায় বিকশিত হওয়া এবং নিদ্রায় সংকুচিত হওয়ার লক্ষণ পাওয়া যায় না ।
এই অঙ্গটি দুই অবস্থাতেই সমানরূপে কার্য করে থাকে ) ।
উপনিষদ বচনের মীমাংসা
এখন বাকি রয়েছে তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি বচন, যেখানে বক্ষস্থানীয় হৃদয়রূপী অবয়বে আত্মার নিবাস স্থান মান্যকারীগণ দর্শিত করে থাকে ।
" স য় এষোন্তহৃদয় আকাশঃ তস্মিন্নয়ং পুরুষো মনোময় অমৃতো হিরণ্ময়ঃ । অন্তরেণ তালুক য় স্তন ইবাবলম্বতে, স ইন্দ্রয়োনিঃ । য়ত্রাসৌ কেশান্তো বিবর্ততে ব্যপোহ্য শীর্ষকপালে " । —— তৈ.উপনিষদ. ১/৬/১
অর্থাৎ — হৃদয়পথ মধ্যে যে প্রসিদ্ধ আকাশ তাহাতে এই বিজ্ঞানময়, অমৃতস্বরূপ, জ্যোর্তিময় পুরুষ অবস্থিত আছেন । তালুদ্বয়ের মধ্যে স্তনের ন্যায় লম্বমান যে মাংসখণ্ড রহিয়াছে এবং যেখানে কেশগুলির মূল বিভক্ত হইয়াছে সেখানে মস্তকস্থ কপালম্বয় ভেদ করিয়া নির্গত সুষুম্না নাড়ীই ইন্দ্রযোনি । ঐ পথে নিষ্ক্রান্ত হইয়া উপাসক 'ভূঃ' এই ব্যাহৃতিরূপী অগ্নিতে এবং ‘ভুবঃ’ এই ব্যাহৃতরূপী বায়ুতে প্রতিষ্ঠিত হন। [[ তৈ. উপ. শঙ্করভাষ্য ( দশোপনিষদ শঙ্করভাষ্য) বেনারস হিতচিন্তক মুদ্রালয় থেকে মুদ্রিত, পৃষ্ঠা ২৬৭-- তে উপনিষদের " কেশান্তঃ " পদের ওপর টিপ্পনী আছে--- " কেশান্তঃ " মূর্ধানমারভ্যোপরিষ্টাদ্ দশাঙ্গুলপরিমিত দেশঃ।
তুলনা কর---" অত্যতিষ্ঠদ্ দশাঙ্গলম্"।। (যজু. ৩১/১)।। ]]
এই বচনে " হৃদয়ে পুরুষের নিবাস " বর্ণনা করে পরবর্তী বাক্যেই তালু থেকে শুরু করে কপালের শীর্ষপর্যন্ত ভাগকে ইন্দ্রের ঘর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । এই ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, এখানে হৃদয় শব্দ বক্ষস্থানীয় অবয়ব বাচক নয় । ইন্দ্র হলো জীববাচক, যা পাণিনি " ইন্দ্রিয়মিন্দ্রদৃষ্টম্ " ( ৫/২/৯৩ ) সূত্রে স্পষ্ট বর্ণনা করে দিয়েছেন ।
[[ ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা--- উপাসনা বিষয়ের অন্তে " অথ য়দিদমস্মিন্ ব্রহ্মপুরে দহরম্" -- এর হিন্দি ব্যাখাতে পাওয়া যায় --- " কন্ঠের নিচে দুই স্তনের মাঝে আর উদরের উপর যে হৃদয়দেশ রয়েছে-- সেটাকে ব্রহ্মপুর বলা হয়। এই ভাষাগত লেখা বেদাদি সকল বৈদিক বাঙময় এর বিরুদ্ধ হওয়ায় অপ্রমাণ। এটি মূল সংস্কৃত তে নেই। ]]
এই সব প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, হৃদয় শব্দ মস্তিষ্ক বাচকই, কেবল বক্ষস্থানীয় মাংসময় অবয়বই নয় । ' অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ ' ( কঠো. উপ. ৬/১৭ ) ইত্যাদি প্রমাণ দ্বারা লোকপ্রসিদ্ধ হৃদপিণ্ডই আত্মার নিবাসস্থান, এমনটা মানা কেবল অনুচিত নয় বরং বেদ এবং শরীরবিজ্ঞান বিরুদ্ধও এটা ।
এজন্য উক্ত কঠাদি শ্রুতিসমূহেও হৃদয়ের অর্থ মস্তিষ্কান্তর্গত আজ্ঞাকেন্দ্রের মধ্যে বর্তমান ব্রহ্মগুহা [[ আজ্ঞাকেন্দ্রসমূহের নির্দেশ মনুষ্যের অঙ্গুষ্ঠ থেকে প্রাপ্ত হয়ে থাকে । দ্র. প্রত্যক্ষশারীর ভাগ ৩ ]] অর্থই যথোপযুক্ত ।
বাকি রয়েছে তৃতীয় মত — " জীবাত্মা সুষুম্নায় অবস্থান করে " । এই মতের মূল কারণ এটাই যে, সুষুম্নার শীর্ষভাগ ব্রহ্মগুহা দ্বারা সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকে । এজন্য ব্রহ্মগুহায় অবস্থিত যে ব্রহ্মজল রয়েছে, তাকে শরীর পরিভাষায় " মস্তিষ্কসুষুম্নান্তরীয় জল " [[ দ্র. প্রত্যক্ষ শরীর ভাগ. ৩ ]] সংজ্ঞায়িত করা হয় । তাই-ই ওজরূপী অষ্টম ধাতু, যার দ্বারা শরীর ওজস্বী হয়ে থাকে । এই জলেই আত্মার নিবাসস্থান । অতএব সুষুম্নার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার ফলে আত্মার নিবাস স্থান সুষুম্না মানা হয়ে থাকে ।
এই প্রকারে বৈদিক বচনসমূহকে পর্যবেক্ষণ করার ফলে স্পষ্ট হয় যে, লোকপ্রসিদ্ধ হৃদয় অথবা সুষুম্না দুটোই মূলতঃ আত্মার নিবাসস্থান নয় । " আত্মার নিবাস বস্তুতঃ মস্তিষ্কান্তর্গত দুটি আজ্ঞাচক্রের = ( কেন্দ্রসমূহ ) মধ্যে ব্রহ্মগুহাতেই অবস্থিত " ।
বেদ-এ আত্মার নিবাসস্থান সম্পর্কে যা বর্ণিত রয়েছে, তা শরীরের অন্য কোনো অংশে সংঘটিত হতে পারে না । অতএব বেদানুযায়ী আত্মার নিবাসস্থান ব্রহ্মগুহাই । উপনিষদের বচনসমূহে হৃদয় শব্দের অভিপ্রায়ও সেই স্থানই নির্দেশ করছে । বৈদিক বাঙময়ে মস্তিষ্ককে হৃদয় শব্দ দ্বারা সম্বোধন করা হয়ে থাকে । শ্রুতি অনুযায়ী আত্মা শরীরের তিন অংশে থাকে..হৃদয়ে, মস্তিস্কে ও সমস্ত শরীরে বিচরন করে। যেমন আমরা নিজ গৃহে থাকা কালিন ঘরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিচরন করি ও নির্দিষ্ট স্থানেও থাকি ঠিক তেমন জীবাত্মা শরীর রূপ গৃহে থাকে।।
জীবাত্মার মুক্তির সাধন ও সিদ্ধির উপায় কি ?
পারস্পর্য্যোণ তৎসিদ্ধৌ বিমুক্তিশ্রুতিঃ।। সাংখ্য দর্শন ষষ্ঠ অধ্যায় ৫৮ নং সাংখ্য সূত্র পদঃ-পারস্পর্যোগ। তৎসিদ্ধৌ। বিমুক্তিশ্রুতিঃ।।
সরলার্থ — পরম্পরা হিসাবে যম নিয়মাদির সাধন এবং শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন দ্বারা বিবেকজ্ঞান সিদ্ধ হইলে জীবের মুক্তি হইয়া থাকে। বেদাদি শাস্ত্রে সর্বত্র এইরূপই দেখিতে পাওয়া যায়।
সং— পূর্বপক্ষ সন্দেহ করিতেছেন কি ? গতিশ্রুতেশ্চব্যাপক ত্বে হপ্যুপাধিযোগাভোগদেশ
কাললাভোব্যোমবৎ।।সাংখ্য ৬।৫৯
পদঃ—গতিশ্রুতেঃ। চ। ব্যাপকত্বে। অপি। উপাধিযোগাৎ। ভোগদেশকাললাভঃ। ব্যোমবৎ ।।
সরলার্থ—যেমন আকাশ বিভু হইলেও ঘটরূপ উপাধি দ্বারা তাহার গতি পাওয়া যায় সেইরূপ জীবাত্মাকে বিভু ধরিয়া লিঙ্গ শরীর রূপ উপাধি দ্বারা তাহার দেশদেশান্তরে গমনাগমন ও ভোগ শরীর লাভ করা সম্ভব হইতে পারে। এইরূপ ধরিলে দোষ কি?
সং-উক্ত আশঙ্কার সমাধান করিতেছেন।
অনধিষ্ঠিতত্স্যপুতিভাবপ্রসঙ্গান্নতৎসিদ্ধিঃ।। সাংখ্য ৬।৬০ পদঃ—অনধিষ্ঠিতস্য। পূতিভাবপ্রসঙ্গাৎ। ন। তৎসিদ্ধিঃ।।
সরলার্থ—জীবাত্মা বিভু বা ব্যাপক হইতে পারে না। কারণ ব্যাপক হইলে জীবের অবর্তমানে তাহার শরীর পচিয়া নষ্ট হইয়া দুর্গন্ধ যুক্ত হইত না। শরীরের অধিষ্ঠাতা কেহ না থাকিলে শরীর পচিয়া নষ্ট হইয়া দূর্গন্ধ সৃষ্ট হয়, ইহা প্রত্যক্ষ সিদ্ধ। ভিন্ন-ভিন্ন শরীরে পৃথক জীবাত্মা অবস্থিত আছে। সেই কারণ জীবাত্মা বিভু সিদ্ধ হইতে পারে না।
সং—আত্মা এক ও বিভু ধরিয়া অদৃষ্ট দ্বারা উপাধি ভেদজনিত সুখ দুঃখের অনুভূতি যদি মানা যায় তাহাতে কি দোষ হয় ?
অদৃষ্টদ্বারাচেদসম্বন্ধস্যতদসংভবাজ্জলাদিবদঙ্কুরে।।সাংখ্য ৬। ৬১
পদঃ—অদৃষ্টদ্বারা। চেৎ। অসম্বন্ধস্য। তৎ। অসম্ভবাৎ। জলাদিবং। অঙ্কুরে।।
সরলার্থ—অদৃষ্ট দ্বারা উপাধি ভেদজনিত একই বিভু আত্মায় যদি সুখ
দুঃখের অনুভূতি ধর তাহা হইলে অনেক দোষ উপস্থিত হয় এবং প্রত্যক্ষের বাধ উপস্থিত হইয়া যায়। অদৃষ্ট পৃথক ধরিলেও অনুভব কৰ্ত্তা আত্মা সমস্ত উপাধির মধ্যে যদি একই হয় তখন সুখ দুঃখের অনুভূতি সকলের একই রকম হওয়া উচিৎ কিন্তু জীবাত্মা এক এবং বিভু নহে বলিয়া প্রত্যেক জীবের পৃথক পৃথক সুখ দুঃখের অনুভূতি হইয়া থাকে যেমন বীজ নানা প্রকারের বলিয়া যে বীজে জল সেচন করা হয় তাহারই অঙ্কুর উৎপন্ন হইয়া থাকে অন্য বীজের অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না সেইরূপ জীব বহু বলিয়া সংসারে এই বিচিত্র কর্ম ও বিচিত্র ভোগ ও সুখ দুঃখের পৃথক পৃথক অনুভূতি সর্বত্র দেখা যাইতেছে। সং-নিশুণ আত্মায় অদৃষ্টের সম্বন্ধ কি করিয়া হইয়া থাকে ?
পুনর্জন্মঃ
অথর্ব্ববেদ০ ১০।৮।২৭, ১০।৮।২৮, ১১।৪।৬
ঋগ্বেদ০ ৬।৪৭।১৮
যজুর্বেদ০ ৪।১৫
ও৩ম্ শম্
পুনর্জন্ম ধারণে কতটা সময় লাগে বা আত্মা দেহ ত্যাগের কতদিন পর নতুন দেহ ধারণ করে ?
কেউ কেউ বলেন আত্মা পুরাতন দেহ ছেড়ে ১২ দিন ভ্রমণ করে সূর্য, জল বায়ু, আদি পদার্থ হতে শক্তি প্রাপ্ত করে নতুন দেহে গমন করে। এটার সত্যতার উপরই আজ আলোকপাত করবো৷ মূলত শাস্ত্রে নির্দিষ্ট করে সময় বা দিন বলে দেওয়া হয় নি। তবে এ সম্পর্কে মুটামুটি ধারণা লাভের জন্য কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেই সকল তথ্যকে একত্রিত করে তর্ক দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌছতে হবে।
আত্মার পুনর্জন্ম ধারণে কতটা সময় লাগে এটা জানার পূর্বে
পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা আবশ্যক। পুনর্জন্মের সময় ও প্রক্রিয়া এই দুই বিষয় সম্পর্কে প্রারম্ভে কিছু শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেখে নেই।
সবিতা প্রথমেऽইনগ্নিন্ত্রিতীয়ে বায়ুতীয়ऽআদিত্যশ্চতুর্থে। চন্দ্ৰমাঃ
পঞ্চমऽঋতুঃ ষষ্ঠে মরুতঃ সপ্তমে বৃহস্পতিরষ্টমে মিত্রো নবমে বরুণো দশমऽইন্দ্ৰऽএকাদশে বিশ্বে দেবা দ্বাদশে।
[যজুর্বেদ ৩৯/৬]
পদার্থ :- হে মনুষ্যগণ ! এই জীব [প্রথমে] শরীর ত্যাগ করার প্রথম [অহন্] দিন [সবিতা] সূৰ্য [দ্বিতীয়ে] দ্বিতীয় দিন [অগ্নিঃ] অগ্নি [তৃতীয়ে] তৃতীয় দিন [বায়ু] বায়ু [ চতুর্থে ] চতুর্থ দিন [আদিত্য] মাস [পঞ্চমে] পঞ্চম দিন (চন্দ্রমাঃ) চন্দ্র [ ষষ্ঠ ] ষষ্ঠ দিন [ ঋতুঃ] বসন্তাদি ঋতু [সপ্তমে] সপ্তম দিন [ মরুতঃ] মনুষ্যাদি প্রাণী [অষ্টমে] অষ্টম দিন [বৃহস্পতিঃ] সূত্রাত্মা বায়ু [নবমে] নবম দিনে [ মিত্রঃ] প্রাণ [দশম] দশম দিনে [বরুণঃ] উদান [একাদশে] একাদশ দিনে [ইন্দ্রঃ] বিদ্যুৎ এবং [দ্বাদশে] দ্বাদশতম দিন [বিশ্বে] সমস্ত (দেবাঃ) উত্তম গুণ প্ৰাপ্ত করে।
ভাবার্থ - যখন আত্মা দেহ ত্যাগ করে পৃথিবী আদি সহ সকল পদার্থে ভ্রমণ করে, স্বীয় কর্মানুসারে পরমাত্মার বিধিঅনুসারে জন্ম লাভ করে, সুপ্রসিদ্ধ হয়।
মূলত এই মন্ত্রের দ্বারা অনেকেই ভাবেন যে আত্মা শরীর ত্যাগ করার পর সূর্য, জল, বায়ু আদি পদার্থ হতে শক্তি প্রাপ্ত করে তারপর নতুন দেহ ধারণ করে। যদিও উক্ত মন্ত্রে বলা হয় নি শক্তি গ্রহণের পর আত্মা গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে । আত্মা যখন পুরাতন দেহ ত্যাগ করে বাইরে আসে, তখন তার পক্ষে প্রকৃতির কোন কিছু ভোগ করা সম্ভব নয়, কারণ তখন আত্মার নিকট স্থুল দেহ থাকে না। এই সম্পর্কে সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে -
ন বুদ্ধ্যাদিনিত্যত্বমাশ্রয়বিশেষেহপিবিহ্নিবৎ। ( সাংখ্য - ৫/১২৬)
আশ্রয়াসিদ্ধেশ্চ।
( সাংখ্য - ৫/১২৭)
অর্থাৎ - যে আত্মা পূর্বতন শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর ধারণ হেতু যাত্রা করে তাকে অনুশয়ী আত্মা বলে। এই অনুশয়ী আত্মার কোন প্রকার চৈতন্য তথা সুখ দুখঃ ইত্যাদির জ্ঞান থাকে না । তাই আত্মা এই সম্পর্কে সম্পুর্ন অজ্ঞ থাকে যে সে কোথায় যাচ্ছে, কি হেতু গমন করছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা স্থুল শরীরকে প্রাপ্ত না করে ততক্ষন পর্যন্ত আত্মার চৈতন্য হয় না। সুক্ষ্ম শরীরে আত্মা সুখ দুখঃ আদির জ্ঞান লাভ করতে পারে না।
এ সম্পর্কে গীতার একটা শ্লোক উদাহরণ হিসাবে দেওয়া যেতে পারে -
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ॥
( গীতা -২/২৩)
অনুবাদঃ আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পুড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানো যায় না।
অর্থাৎ আত্মার উপর জল, বায়ু, তাপ আদি কোন কিছুর প্রভাব পড়ে না। যখন আত্মা স্থুল শরীরে অবস্থান করে তখন তাপ, জল, বায়ু ইত্যাদির প্রভাব মূলত স্থুল শরীর ভোগ করে। আত্মা মূলত দেহের মাধ্যমেই শক্তি প্রাপ্ত করে, সুখ ভোগ করে, কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং গীতার শ্লোকানুসারেও আমরা দেখতে পাচ্ছি আত্মার স্থুল শরীর ব্যাতিত শক্তি প্রাপ্ত করা অসম্ভব।
তদ্যথা তৃণজলায় কা তৃণস্যান্তং গত্বাহন মারুনমারুন্যাত্মানম,পসংহর তার মেবায়মাত্মেদং শরীরং নিহ ত্যাঽবিদ্যাং গময়িত্বাহ নামারুমমারুম্যাত্মানম,প সংহরতি
[বৃহদারণ্যক ৪/৪/৩ ]
অর্থাৎ - যেরূপে জোঁক একটি তৃণের শেষ প্রান্তে গিয়ে অপর তৃণকে আশ্রয় করে নিজেকে তার উপর উঠিয়ে নেয় তেমনি আত্মাও দেহত্যাগ করিয়া অবিদ্যা দূর করে অন্য একটি দেহকে আশ্রয় করে ও সেখানে গমন করে।
উপনিষদের উক্ত শ্লোকের উদাহরণকে একটু গভীর ভাবে দেখলে বুঝা যায় যে আত্মা দেহ ত্যাগের করে সাথে সাথেই অন্য দেহ ধারণ করে ফেলে। জোঁক যেরকম একটা তৃণের শেষ প্রান্তে এসে আবার অন্য তৃণকেই আশ্রয় করে তার উপর গমন করে সেভাবে আত্মাও । এখানে জোঁক হচ্ছে আত্মা আর তৃণ হচ্ছে আত্মার সেই স্থুল দেহ৷ অর্থাৎ দ্বাদশতম দিন পর্যন্ত আত্মার ভ্রমণের উল্লেখ এখানেও নেই।
মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে আত্মাকে সেই পরমাত্মাই তার নিয়মানুসারে ও আত্মার কর্মানুসারে বিভিন্ন যোনি বা লোকে নিয়ে যান। এই সম্পর্কে উপনিষদের বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়, কিন্তু কোথাও আত্মা পুরাতন দেহ ত্যাগ করার পর নতুন দেহ ধারণের আগে ১২ দিন ভ্রমণ করে এরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না।
শতং চৈকা চ হৃদয়স্য নাড্যস্তাসাং মূর্ধানমভিনিঃসৃতৈকা। তয়োমায়ন্নমৃতত্বমেতি বিষন্যা উৎক্রমণে ভবন্তি৷৷
পদার্থ - [ হৃদয়স্য ] হৃদয়ের [শতম্ চ একা চ] একশ এক [নাড়্যঃ] নাড়ি আছে [ তাসাম্] তাদের মধ্যে [একা ] একটি [মূর্ধানম্] মস্তকের দিকে [অভিনিঃসৃতা ] বেরিয়েছে (একে সুষুম্না বলে) [ তথা ] তার দ্বারা [ ঊর্ধ্বম্ ] ঊর্ধ্বলোকে [আয়ন্] গিয়ে (মানুষ) [অমৃতত্বম্] মোক্ষ [এতি] প্রাপ্ত হয় [অন্যাঃ] অপর একশত নাড়ি দ্বারা [উৎক্রমণে] মৃত্যুকালে জীবকে [ বিষন্যা] নানাবিধ যোনিতে নিয়ে যাওয়া [ভবন্তি] হয়।
অথৈকয়োর্ধ্ব উদানঃ পুণ্যেন পুণ্যং লোকং নয়তি পাপেন পাপমুভাভ্যামেব মনুষ্যলোকম্॥
পদার্থ - [অথ] তথা [একয়া] আর একটি নাড়ি আছে, তার দ্বারা [ উদানঃ ঊর্ধ্বঃ ] উদানবায়ু উপরের দিকে গমন করেন [ সঃ পুণ্যেন] তিনি পুণ্যকর্মের দ্বারা (মনুষ্যম) মানুষকে [পুণ্যম্ লোকম্] পুণ্য লোকে [নয়তি] নিয়ে যান [পাপেন] পাপকর্মহেতু [পাপম্ (নয়তি) ] পাপযোনিতে নিয়ে যান।[উভাভ্যাম্ এব] পাপ এবং পুণ্য উভয়বিধ কর্ম দ্বারা (জীবকে) [ মনুষ্যলোকম্] মনুষ্য শরীরে নিয়ে যান৷
যচ্চিত্তস্তেনৈষ প্রাণমায়াতি প্রাণস্তেজসা যুক্তঃ সহায়না যথাসংকল্পিতং লোকং নয়তি।
পদার্থ - [এষঃ] এই জীবাত্মা [যচ্চিত্তঃ] যে সংকল্পবান হন [তেন ] সেই সংকল্পের সাথে [ প্রাণম্] মুখ্য প্রাণে [আয়াতি] স্থিত হয়ে যান [প্রাণঃ] মুখ্য প্রাণ [ তেজসা যুক্তঃ] তেজ যুক্ত [আত্মনা সহ ] জীবাত্মাকে [যথাসঙ্কল্পিত] সংকল্পানুসারে [লোকম্] ভিন্ন ভিন্ন লোক অথবা যোনিতে [ নয়তি ] নিয়ে যায়।
উপনিষদের উক্ত শ্লোকগুলোতে মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে জীবাত্মার অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। উক্ত শ্লোক সমূহ হতে স্পষ্ট যে জীবাত্মা পুরাতন দেহ ত্যাগ করার পর ঈশ্বর সেই আত্মাকে আর কর্মানুসারে দেহ প্রাপ্ত করান, এখানে আত্মার ভ্রমণের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে আত্মার গতি সম্পর্কে সেকল শ্লোক আছে সেগুলোর মাঝে উক্ত শ্লোকগুলোরই ভাবার্থের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, উক্ত শ্লোক সহ কোথাও আত্মার ১২ দিনের ভ্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
উক্ত প্রমাণ অনুসারে ঋষিগণ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার সারাংশ এই যে - আত্মা শরীর ত্যাগ করে, পৃথিবী আদি পদার্থে ভ্রমণ পূর্বক পরমাত্মার ব্যাবস্থা অনুযায়ী স্বীয় কর্মানুসারে দেহ প্রাপ্ত করে। এবং দেহ পরিত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ নতুন দেহে গমন করে।
এখানে অনেকে ভাবেন আত্মা যেহেতু ক্ষণকাল ভ্রমণ করে সেহেতু সেই সময়টাই হচ্ছে ১২ দিন কিন্তু -
পাঠকবৃন্দ লক্ষ করুন - যখন আত্মা পূর্বের শরীর ত্যাগ করে তখন পরমাত্মাই তাকে নতুন দেহ ধারণের জন্য নিয়ে যান, সেই ক্ষণে আত্মার নিকট কেবল সুক্ষ্ম শরীর থাকে। স্থুলশরীর থাকে না। এখন যদি আত্মার ১২ দিন ভ্রমনের বিষয় স্বীকার করা হয় তবে প্রশ্ন আসে, কে তাকে ভ্রমণ করাবেন? এখন যদি এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় ঈশ্বর, তবে আবার প্রশ্ন আসবে কেন ঈশ্বর এই কার্য করবেন? যেখানে কোন উদ্দেশ্যই থাকে না, কারণ পূর্বেই দর্শন শাস্ত্র তথা গীতার শ্লোক হতে প্রমাণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে আত্মা তখন সুক্ষ্ম শরীরে অবস্থান করে যার ফলে তার জ্ঞান থাকে না, আর আত্মার সুক্ষ্মশরীরের উপর সূর্য, জল, বায়ু আদি পদার্থের কোন প্রভাবই পড়ে না, সুতরাং ১২ দিনের ভ্রমণ করে কি লাভ? কি উদ্দেশ্য ১২ দিন আত্মাকে ভ্রমণ করানো হবে?। যেহেতু সুক্ষ্ম আত্মার উপর প্রকৃতির কোন প্রভাব পড়ে না সেহেতু ১২ দিন ভ্রমণ করানো অর্থহীন কর্ম হয়ে যায়। আর পরমাত্মা কখনোই অর্থহীন কর্ম করেন না। সুতরাং পরমাত্মা কদাপি আত্মাকে ১২ দিন সূর্য, বায়ু, জল আদি পদার্থে ভ্রমণ করান না।
তাহলে আত্মা কি করে পুরাতন দেহ ত্যাগের পর ১২ দিন অগ্নি, জল, বায়ু, সূর্য আদি পদার্থ হতে শক্তি লাভ করে? বা ১২ দিনে তাৎপর্য কি?
এই কথা সত্য যে আত্মা ১২ দিন পর্যন্ত অগ্নি, জল, বায়ু, সূর্য আদি পদার্থ হতে শক্তি প্রাপ্ত করে, কিন্তু সেটা ১২ দিন ভ্রমনের মাধ্যমে নয়। যখন মাতৃগর্ভে ভ্রুণের সৃষ্টি হয় ও আত্মার জন্য স্থুল শরীরের জন্ম হয়, তখন সেই স্থুল শরীরের মাধ্যমেই আত্মা গর্ভাবস্থায়, অগ্নি, বায়ু, জল, সূর্য আদি পদার্থের হতে শক্তি গ্রহণ করে। কারণ তখন সেই শক্তি গ্রহণ করার মত তথা ভোগ করার উপযোগী স্থুল শরীর সৃষ্টি হয়।
সুতরাং তর্ক তথা শাস্ত্রীয় প্রমাণাদি হতে আমরা এই সিন্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , আত্মা ১২ দিন ভ্রমণ করে না। বরং এক দেহ ত্যাগ করে তৎক্ষনাৎ নতুন দেহে গমন করে, এবং গর্ভাবস্থায় স্থুলশরীরের মাধ্যমে ১২ দিন পর্যন্ত সূর্য, জল, বায়ু আদি পদার্থ হতে শক্তি গ্রহন করে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ