অজানা মহাযোগী বাবা লোকনাথ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

22 September, 2021

অজানা মহাযোগী বাবা লোকনাথ

 অজানা মহাযোগী বাবা লোকনাথ – ডঃ অসীমবরণ দে

এই পুস্তক বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তপোজীবনের উপর আমার দীর্ঘ ১৭ বৎসরের গবেষণালব্ধ ফল। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী নামক বিরলতম মহাপুরুষের সিদ্ধজীবনী লিখতে ব্রহ্মচারী বাবা স্বয়ং আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং নিজ দিব্য উপস্থিতির মাধ্যমে এই পুস্তক রচনায় সহায়তা করেছেন। সেইজন্য আমি সর্বপ্রথম মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পুণ্য চরণে আমার বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁর দিব্য সাহায্য ভিন্ন আমি এই পুস্তক রচনা করতে সক্ষম হতাম না। এরপর আমি কৃতজ্ঞতা জানাই অধুনা জার্মান নিবাসী শ্ৰীশঙ্কর দাস মহাশয়কে। তার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সূত্রে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং বারদী থেকে বাবার সম্বন্ধে অমূল্য তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হই এবং বারদী আশ্রমের বর্তমান অবস্থানের আলোকচিত্রগুলি আমার হাতে আসে। কৃতজ্ঞতা জানাই অধুনা দঃ ২৪ পরগণা নিবাসী শ্রীবিপ্লব চক্রবর্তী মহাশয়কে। তাঁর পূর্বপুরুষ সোনারগাঁ নিবাসী ছিলেন এবং বাবার অনেক লীলা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি তাঁর পারিবারিক তথ্যভাণ্ডার থেকে এবং সোনারগাঁ অঞ্চল ও বারদী আশ্রম থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে এই কাজে আমাকে সহায়তা করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই বারদী আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত সেইসব ভক্তদের যাঁদের দেওয়া তথ্য আমার এই গবেষণার কাজে সহায়তা করেছে। কৃতজ্ঞতা জানাই বাবার সেইসব পুণ্যবান ভক্তদের যাঁরা ইতিপূর্বে বাবার সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য ভক্তদের জ্ঞাতার্থে পরিবেশন করেছেন, যে তথ্যাবলী বর্তমান গ্রন্থকারকে অনেকভাবেই সহায়তা করেছে এই গ্রন্থ রচনাতে।

বাবা লোকনাথ

সর্বশেষে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই গিরিজা লাইব্রেরীর কর্ণধার শ্রীপ্রশান্ত চক্রবর্তী মহাশয়কে যাঁর উদ্যোগে এই গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হল এবং মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দিব্যস্বরূপের অজানা কাহিনী ও দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র সম্বলিত গবেষণালব্ধ এই জীবনীগ্রন্থ তার অগণিত ভক্তদের সামনে পরিবেশন করা সম্ভব হল।


—অসীমবরণ দে

প্রথম অধ্যায় – পটকথা


ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় দ্বিতীয় জন্মলাভ


ঈশ্বর হি কেবলম–শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অপার করুণার কথা নানাভাবে আমরা নানাজনের কাছে শুনে এসেছি। তার অপার মহিমা ইতিমধ্যে বিভিন্ন গল্প-কথা, চলচ্চিত্র এমনকি টি.ভি. সিরিয়ালের মাধ্যমে আমরা জ্ঞাত হয়েছি। কিন্তু আমার এই নিবন্ধে আমি আমার নিজের জীবনে তার অপার করুণাময় কৃপার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তার জীবনবৃত্তান্ত শুরু করছি।


২০০০ সালের ২৮ নভেম্বরের সকাল। আমি ঢাকুরিয়া বাসস্টপে অফিস যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একটি বাস ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার ব্যস্ত চোখ খুঁজছে ওই বাসের পিছনের দিকের মিনিবাস। হঠাৎ বাঁদিক থেকে একটা সাইকেল তীব্র গতিতে এসে আমাকে ধাক্কা মারলো। আমি বাঁদিকে কাৎ হয়ে দুই পা সহ ঢুকে গেলাম বাসের তলায়। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম—’বাবা লোকনাথ বাঁচাও’। বাবা লোকনাথ আমার প্রথম দিব্যগুরু। আমার চিৎকারে বাসযাত্রীরা ও ব্যস্ত পথচারীরা সচকিত হয়ে চিৎকার করতে লাগলো। বাসের কন্ডাক্টর ততক্ষণে বাস ছাড়ার ঘন্টা বাজিয়েছে। বাসের পিছনের দুটি চাকা ধীরে ধীরে আমার পায়ের উপর উঠে আবার পিছনে নেমে গেল। সকলেই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছে। কিছু পথচারী আমার দেহটা টেনে বাসের নিচ থেকে বার করলো। আমাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোমর থেকে সম্পূর্ণ নিচে আমার কোনো জোড় নেই। আমাকে সোজা করে তারা ধরে রেখেছে। আমি বাবা লোকনাথের নাম নিয়ে কেঁদে চলেছি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করতেই আমি বললাম–


আমার বাড়ি খুব কাছেই। আমাকে আগে বাড়ি নিয়ে চলুন। তারপর বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ততক্ষণে আমার পা-দুটি ফুলে কলাগাছ। আমাকে তারা বাড়িতে ঢোকালেন। আমার ওই অবস্থা দেখে বাড়ির সকলের কান্নার রোল পড়ে গেল। আমার নিম্নাঙ্গে কোনো বোধশক্তি নেই। একজন ডাক্তারকে সঙ্গে সঙ্গে আনা হল। তিনি সব দেখেশুনে অবাক। Pain killer ওষুধ দিলেন এবং বললেন আমাকে কোনো অস্থিবিশারদের কাছে তখনই নিয়ে যেতে। আমার শরীর ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগলো। কলকাতার একজন বিশিষ্ট অস্থিবিশারদ আমার পরিচিত ছিলেন। তাকে ফোন করে সব জানানো হল। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার বাড়িতে এসে আমাকে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তক্ষুনি কোনো ভালো নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।


তিনি এও জানালেন যে, যদি আমাকে কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো তবে তক্ষুনি আমার পা দুটো কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তার এখুনি কোনো প্রয়োজন নেই। উনি আমার পা বাদ দিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেন না। ওনার প্রথম লক্ষ্য হল আমার জীবন বাঁচানো। উনি কিছু injection আমাকে দিলেন এবং বললেন, তখনও আমার জীবন সংশয় আছে। সেজন্য উনি আমাকে কয়েকদিনের জন্য একটি নার্সিংহোমে দিতে চান। আমার নিশ্চল দেহ নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হল। তিনদিন পর্যন্ত চললো যমে-মানুষে টানাটানি। বাড়ির লোক সারাদিন নার্সিংহোমে বসে থাকতো। কখন খারাপ খবর হয়! এইভাবে বেশ কয়েকদিন যাবার পর আমার স্ত্রী অস্থিবিশারদকে অনুরোধ করলো যে, আমাকে যদি বাড়িতে রেখে উনি চিকিৎসা করেন, তবে খুব ভালো হয়। বাড়িতে বাবা লোকনাথ আছেন। তার উপর আমাদের বিশ্বাসের কথা ওনাকে জানানো হল। ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের মর্যাদা দিয়ে অস্থিবিশারদ আমাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতে রাজি হলেন। আমার নিশ্চল দেহ আবার বাড়িতে ফিরে এলো। আমার শোবার ঘর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নার্সিংহোমের মতো তৈরি রাখা হলো। ডাক্তারবাবু প্রতিদিন আমার বাড়ি এসে চিকিৎসা করতে লাগলেন। ১৮দিন পর্যন্ত চললো জীবন ও মরণের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ। প্রতিদিন রাতে মেয়েরা ও স্ত্রী এসে দেখতে আমি বেঁচে আছি কিনা। আর বাবা লোকনাথের কাছে চোখের জল ফেলতো। অমায়িক ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং বাবা লোকনাথের দয়ায় ১৮ দিন পর আমার জীবন বিপদমুক্ত হল। তখন ডাক্তার বললেন, এখন আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবার জন্য আমার পা দুটিকে সচল করতে হবে। আমার দু-পায়ের সমস্ত Soft-tissue গুলি smashed হয়ে গিয়েছিল। কলাগাছের মতো ফোলা এক-একটি পা। কোনো sense নেই। একজন দেবদূত অস্থিবিশারদ ও আমার স্ত্রী ও কন্যাদের অক্লান্ত সেবায় এবং বাবা লোকনাথের অসীম কৃপায় দীর্ঘ চিকিৎসার পর আমি হাঁটতে সক্ষম হলাম। যদিও আমার বাঁ পায়ে এখনও দুটি fracture আছে। ডাক্তার বললেন, ওই fracture দুটি সারাতে অপারেশন করলে ভবিষ্যতে আমার পা দুর্বল হয়ে যাবে। আমি যখন হাঁটতে পারছি, তখন আর অপারেশনের দরকার নেই। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম। পরবর্তী সময়ে এই পা নিয়ে আমি সারা ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণ করেছি। এমনকি নর্মদা পরিক্রমাও করেছি।


ডাক্তার যখন আমার পায়ের scan report দেখলেন, বললেন এই scan report অনুযায়ী এইভাবে আপনার হাঁটতে পারার কথা নয়, কিন্তু আপনি আমার সামনে হাঁটছেন। আপনার মাটিতে বসতে পারার কথা নয়, কিন্তু আপনি বসছেন। আপনার এত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা নয়, কিন্তু আপনি ফিরেছেন। আমি কোষ্টাকে বিশ্বাস করবো! scan report যা দেখছি সেটা, না আমার চোখে যা দেখছি, সেটা! আমি নিজেই জানি না আপনি কীভাবে এত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠলেন। It’s a miracle. আমি জানি, আমার এই দ্বিতীয় জীবনদাতার নাম মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। বিশিষ্ট অস্থিবিশারদের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র ছোট না করে বলছি, বাবা লোকনাথের অসীম কৃপায় আজ আমি জীবিত। অস্থিবিশারদ তার দূত রূপে আমার চিকিৎসা করে গেছেন।


পরবর্তীকালে একজন অন্য বিশিষ্ট অস্থিবিশারদ আমাকে ও আমার চিকিৎসাপত্র দেখে বলেছিলেন যে, আমি জানিনা কিভাবে আপনি এইরকম হাঁটতে পারছেন। আপনাকে এই অবস্থায় দাঁড় করাতে কেবল সেই চিকিৎসকই পারেন যে ভগবান। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, আমি বাবা লোকনাথের চরণাশ্রিত। তিনি শুনে বলেছিলেন, তার কৃপা যেখানে থাকে, সেখানে সবই সম্ভব। আমার কিছু বলার নেই।


আমি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি ১৯৯৫ সালে। তখন জীবনের এক কঠিনতম বিপদের মধ্যে আমি বাবা লোকনাথের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। সেই বছরই ১৯শে জৈষ্ঠ্য বাবা লোকনাথের ফটো আমার ঘরের ঠাকুরের আসনে প্রতিষ্ঠা করে তাকে আমার প্রথম দিব্যগুরুরূপে বরণ করি এবং এখনও নিত্য তার পূজারাধনা করে আসছি। এবং তার কৃপাধন্য হয়ে বেঁচে আছি।


.


ব্রহ্মচারী বাবার দিব্যশক্তির মূল্যায়ণ প্রেক্ষাপট


সেই ১৯৯৫ সাল থেকে আমি একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করছি যে, বাবা লোকনাথ ইহলোকে নিজ শরীরে না থেকেও কিভাবে আমাদের এইভাবে রক্ষা করেন! নর্মদা পরিক্রমা করার সময় আমি সেইসব স্থান দর্শন করেছি যেখানে বাবা লোকনাথ তপস্যা করেছিলেন। এবং নর্মদা তটে তার তপস্যার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। হিমালয়ের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র দর্শন করে তার তপোজীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার ও তার স্বরূপ জানার প্রয়াস করেছি। বদ্রীনাথ মন্দিরে তাঁর প্রতিকৃতি সামনে রেখে পূজা করে তার কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়েছি আমাকে তাঁর দিব্য স্বরূপের সন্ধান দেবার জন্য। সেখানে এক জ্যোতিরাশির মধ্যে অজস্র ওঁকার আমার মুখমণ্ডলকে ঘিরে রেখেছিল।


এইভাবে মহাযোগী বাবা লোকনাথ সম্বন্ধে বিভিন্ন তীর্থে যেসব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে যে, আমরা তার ভক্তরা বোধহয় সেই মহাযোগীর যোগপ্রভাবের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। আজ ঘরে ঘরে বাবা লোকনাথ পূজিত। যখন কাউকে জিজ্ঞাসা করি কেন তারা বাবা লোকনাথকে পূজা করেন? তখন নিম্নরূপ উত্তর পাই :


(ক) যে কোনো বিপদে বাবাকে ডাকলে, বাবা রক্ষা করেন।


(খ) বিপদের সময় বাবাকে স্মরণ করলে মনে জোর পাই।


(গ) বাবা অনেকের ব্যাধি সারিয়ে দিয়েছেন।


(ঘ) কোনো মামলা-মোকদ্দমায় বাবাকে স্মরণ করে সাহায্য চাইলে, বাবা রক্ষা করেন।


(ঙ) বাবার আশীর্বাদ থাকলে, কোনো বিপদ হয় না। ইত্যাদি।


এই উত্তরগুলি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যে, আমরা বাবাকে পূজা করি তার যোগ-বিভূতির জন্য। অর্থাৎ আমরা বাবা লোকনাথের যোগ-বিভূতিকে পূজা করি।


আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে যে, কোনো সাধক যোগ-বিভূতি প্রাপ্ত হন অষ্টাঙ্গ অথবা অষ্টাদশ যোগসিদ্ধ হলে। এই যোগ-বিভূতি তার একটি লীলাখেলা’–এটা কোনো সাধকের আসল পরিচয় নয়। বাবা লোকনাথ যে যোগ-বিভূতির দ্বারা নানা মানবকল্যাণ ও সমাজকল্যাণের কাজ করতেন, সেটা তার কাছে অতি সামান্য কাজ ছিল। তাঁর যোগৈশ্চর্য ছিল অতি উচ্চ মার্গের। এইসব বিভূতি প্রদর্শন ছিল তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তিনি ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে যোগের যে স্তরে উপনীত হয়েছিলেন, সেখানে তিনি দেব স্বারূপ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর আত্মা-পরমাত্মার সঙ্গে লীন হয়ে দেহাভ্যন্তরে বিরাজ করতো। যাঁর সর্বদেহের লোমকূপে দেবতারা বিরাজ করতেন, তার কাছে কি এই যোগ-বিভূতি প্রদর্শন করা অতি সামান্য ব্যাপার নয়! আসলে আমরা এই সামান্য বিভূতি পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছি এবং যে মহা ঐশ্বর্য তার কাছে ছিল, তার আর সন্ধান করিনি। যখন কোনো ভক্ত আরাধ্যের যোগ-বিভূতি পাবার জন্য তার পূজা করে, তখন তার মধ্যে একটি স্বার্থ নিহিত থাকে। স্বার্থযুক্ত পূজা দেবতার চরণে পৌঁছয় না। দেবতা তার কৃপা-বিভূতি প্রদানেই সীমাবদ্ধ রাখেন। যেমন কথিত আছে, একজন পরম দেবভক্ত ইহলোকে অবস্থানকালে অনেক মন্দির নির্মাণ করেছেন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দান করেছেন। পরলোকে তার স্থান হয়েছিল তৃতীয় নরকে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এত ভালো ভালো কাজ করে তিনি নিশ্চয়ই স্বর্গে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন। তৃতীয় নরকে পড়ে তিনি চেঁচামেচি করতে লাগলেন। উচ্চস্বরে সেখানে সকলকে বলতে লাগলেন যে, তিনি ইহলোকে কি কি দেবকার্য করেছেন। এত দেবকার্য করার পর কারও যদি নরকে স্থান হয়, তবে আর কেউ দেবকার্য করবে না। তার চেঁচামেচিতে নরকে শান্তি ভঙ্গ হওয়ায় স্বর্গ থেকে একজন দেবদূত তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন সে এখানে অশান্তির সৃষ্টি করছে। সে দেবদূতকে গালাগালি দিয়ে বলতে লাগলো যে, ভগবান তার প্রতি অবিচার করেছেন। তখন দেবদূত তাকে বললেন, আপনি ইহলোকে অনেক দেবকার্য করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু সব দেবকার্যের পিছনেই আপনার নিজের স্বার্থ ছিল। স্বার্থ সম্বলিত দেবপূজা বা ফল কামনা করে যে পূজা, সেই পূজা ইহালোকের ফল প্রদানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। কেবলমাত্র নিঃস্বার্থ দেবপূজা বা ফল কামনা রহিত দেবকার্যই দেবতার চরণে পৌঁছয়। আপনার স্বার্থ সম্বলিত পূজার ফল আপনি ইহলোকেই প্রাপ্ত হয়েছেন; পরলোকের জন্য আপনার কোনো সুফল সঞ্চিত নেই। সেইজন্য আপনার নরক প্রাপ্তি।


গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, আমার উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল হও। আমাতে মনপ্রাণ সমর্পণ করে ভক্তি ভরে ভজনা করে যাও। তুমি যখন কোনো কর্মের অনুষ্ঠান করবে, আমিই তার উপলক্ষ এই জ্ঞানে আমাতে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করো। তাতে যেন কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা না থাকে। এইরূপ কর্মের জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, আমিই তোমাকে রক্ষা করবো। তুমি আমার শরণাগত হও, আমার উপর নির্ভরশীল হও। আমি তোমাদের সমস্ত পাপ হতে রক্ষা করবো।


বাবা লোকনাথও তেমনি ভক্তদের বলতেন, আমি সচ্চিদানন্দ পুরুষ, আমি সেই পরমাত্মা। তোরা তোদের সব কিছু আমাকে সমর্পণ করে নিষ্কামভাবে কাজ করে যাবি। মনে ভাববি, তোদের সব কিছু আমার। কোনো ফলের প্রত্যাশা করবি না। বিপদে পড়লে আমাকে স্মরণ করবি। আমি তোদের রক্ষা করবো। ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথের কাছে আমরা কেবল যোগ-বিভূতিই চেয়ে এসেছি। কিন্তু তিনি তো আমাদের ভবরোগ থেকেই মুক্ত করে দিতে সক্ষম ছিলেন! এইজন্য মহাপ্রয়াণের আগে বারদীতে বাবা দর্শনার্থী এক পরমভক্ত বিধবা মহিলাকে বলেছিলেন–এ দেহটা একটা পাখির খাঁচা। জানিস মা, ওরা আমাকে মানুষ ভাবে। কোনো ভবরোগী পেলাম না।–এই কথার গূঢ় অর্থ তখন কেউ বিশ্লেষণ করেনি।


সাধারণ মানুষ কোনো মহাপুরুষের জীবন আলোচনাকালে তাঁর অলৌকিক বিভূতির মানদণ্ডে আধ্যাত্মিক সিদ্ধির মূল্যায়ণ করে থাকে। বলা বাহুল্য, আমাদের এই মূল্যায়ণ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। একজন প্রকৃত মহাপুরুষের বা মহাযোগীর কাছে অষ্টসিদ্ধি বা অষ্টাদশসিদ্ধির মূল্য কম। এগুলি মূল সিদ্ধিপ্রাপ্তির সোপান স্বরূপ। সিদ্ধ যোগীর কাছে যোগের ফল জ্যোতিস্মতী ও মধুমতী প্রজ্ঞা, ব্রহ্মলোকের সন্ধান। মহাযোগী যে ব্রহ্মজ্ঞানের ও ব্রহ্মলোকের অধিকারী হন, তা যোগ্যশিষ্য বা ভক্তের মধ্যে সঞ্চারিত করে তার আত্মা বা লিঙ্গ-শরীরকে ব্রহ্মজ্ঞানের ও ব্রহ্মলোকে বিচ্ছুরিত করে দেন। অষ্ট বা অষ্টাদশসিদ্ধির অলৌকিক শক্তি থেকে এই ব্রহ্মজ্ঞ শক্তি অনেক অনেক উচ্চস্তরের। আমরা যদি এই ব্রহ্মজ্ঞানের মানদণ্ডে বাবা লোকনাথকে দেখি বা ব্রহ্মবিদ্ ঋষিরূপে তার যোগেশ্বর্যের মূল্যায়ণ করি, তবে দেখতে পাবো যে, তিনি স্বয়ং ভগবানরূপে সর্বদা আমাদের মধ্যেই বিরাজ করছেন এবং তাকে একবার মাত্র ভক্তিভরে স্মরণ করলেই তিনি তার জ্যোতি বিচ্ছুরণের মাধ্যমে আমাদের মঙ্গল বিধান করতে পারেন।


আমি নর্মদা পরিক্রমা করে মা নর্মদার দৈবীশক্তির পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশ করার পরে অন্তরে এক তীব্র আকুলতা অনুভব করেছি মহাযোগী বাবা লোকনাথের অপার যোগৈশ্বর্যের স্বরূপ জনসমক্ষে উন্মোচন করতে। এগারো বছরের বালক লোকনাথ কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী লোকনাথে পরিণত হয়ে দেবসাযুজ্য লাভ করেছিলেন, সেই বিস্তৃত যোগ-সিদ্ধির কাহিনী এখনও অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। বাবার যোগবিভূতির মায়ায় সেই অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত যোগসিদ্ধির কাহিনী আবৃত হয়ে আছে। এই কাহিনী উন্মোচিত হলে যেমন ভারতের যোগসাধনার এক অত্যুচ্চ দিক আলোকিত হবে, তেমনই বাবার ভক্তগণ তার সত্যস্বরূপ জেনে তাঁকে পূজা করতে সমর্থ হবেন ও ভবরোগ থেকে স্বীয় আত্মাকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হতে পারবেন।


কিন্তু আমার মতো ক্ষুদ্র যোগশক্তিবিহীন ব্যক্তির পক্ষে মহাযোগী বাবা লোকনাথের যোগজীবন আলোচনা করা কি সম্ভব! বারদীতে বাবা লোকনাথ নিজ মুখে বলেছিলেন–আমি ধরা না দিলে, কার বাপের সাধ্য আমাকে ধরতে পারে! সত্যিই তো। তিনি নিজে না বলে দিলে, তার কঠোর ও মহাযোগশক্তির সন্ধান কে পেতে পারে। তাই আমি বাবার পুণ্যচরণ কমলে কোটি কোটি প্রণাম। নিবেদন করে বলছি, বাবা, আমি জ্ঞানহীন, শক্তিহীন, সাধনহীন, ভক্তিহীন। আমি তোমার সত্যস্বরূপ জগতের সামনে উন্মোচন করতে ব্ৰতী হয়েছি। তুমি নিজে কৃপা করে আমার কলমে অধিষ্ঠান করে তোমার পরিচয় ব্যক্ত করো। তুমি নিত্য আমার আত্মায় বিরাজ করো। আমি তোমারই চরণাশ্রিত। হে পরম করুণাময়, তোমার অত্যাশ্চর্য কঠোর তপোময় জীবনচরিত অধিকাংশ জনমানসের দৃশ্যপট বহির্ভূত। সেই অলৌকিক গাথা যেমন লোকাতীত তেমন কল্পনাতীত। আমি সমগ্র নর্মদা তট ও হিমালয়ের বদরিকা আশ্রম পরিভ্রমণ করে তোমার মতো এমন ত্রিকালদর্শী এবং এত যোগৈশ্বর্যপূর্ণ ব্যক্তির সন্ধান পাইনি। তোমার উপমা, তুমি নিজেই। কেবল নর্মদা উত্তরতটের ওঁকারেশ্বরে প্রলয়দাসজি নামে এমন একজন ব্রহ্মজ্ঞের সন্ধান পেয়েছিলাম যিনি এখন দেহে নেই, যে অলৌকিক তপোবলে তিনি সর্ববিদ্যা বিশারদ হয়েছিলেন ও ব্রহ্মদর্শন করেছিলেন, তা আপামর জনমানসের নয়নের অগোচরে রয়ে গেছে। তুমি যেমন অনধিগম্য, তোমার অলৌকিক জীবনলীলাও তেমনি দুয়ে ও জনমানসের জ্ঞানাতীত। তোমার অমৃতময় ও সুমধুর জীবনকথা লোকসমাজের মঙ্গলকার্যে প্রচারে আমি ব্রতী হয়েছি। আমি তোমার, আমার আত্মায় তুমি অধিষ্ঠিত। সে জন্য আমার এ কাজও তোমার। আমাকে নিমিত্ত করে তুমি নিজেই এ কাজ সম্পাদিত করো। তুমি আমাকে যেমন লেখাবে আমি তেমনই লিখব। এ যেন এক অমর কথা হয়ে থাকে।


জয় বাবা লোকনাথ। জয় শিব লোকনাথ।

 জয় গুরু লোকনাথ। জয় ব্রহ্ম লোকনাথ।।


গুরুপ্রণাম


যোগীন্দ্রায় নমস্তুভ্যাং ত্যাগীশ্বরায় বৈ নমঃ।

ভূমানন্দ স্বরূপায় লোকনাথায় নমো নমঃ।।

 শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং বদামি

 শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং ভজামি।

শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং স্মরামি

শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং নমামি।।

নিত্যং শুদ্ধং নিরাভাসং নির্বিকারং নিরঞ্জন।

নিত্য বোধং চিদানন্দং গুরুং ব্রহ্ম নমাম্যহম্।

অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।

তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।

গুরুব্রহ্মা গুরুবিষ্ণু গুরুদেবো মহেশ্বরঃ।

গুরুরেব পরংব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।

চিন্ময়ং ব্যাপিতং সৰ্ব্বং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্।

তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।

 চৈতন্যং শাশ্বতং শান্তং ব্যোমাতীতং নিরঞ্জন।

 বিন্দুনাদ কলাতীতং তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।

যস্যস্মরণ মাত্রেণ জ্ঞানমুৎপদ্যতে স্বয়ম্।।

 স এব সর্বসম্পন্নঃ তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।।

 ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব, ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব।

 ত্বমবে বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব, ত্বমেব সর্বং মম দেবদেব।।

ওঁ নমঃ শ্রী গুরবে বাবা লোকনাথায় নমো নমঃ।।

দ্বিতীয় অধ্যায়-  জন্ম ও বাল্যকাল


জন্মস্থান বিবাদ


বাবা লোকনাথের জন্মস্থান নিয়ে অনেকদিন থেকেই বিবাদ চলছে। চাকলার মন্দির কর্তৃপক্ষ বলেন জন্মস্থান চাকলায়। কচুয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ বলেন জন্মস্থান কচুয়াতে। এই বিষয়ে কোনো বিবাদে অংশগ্রহণ না করে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে আমি বাবার জন্মস্থান চিহ্নিত করার প্রয়াস করছি।


বাবা লোকনাথের জন্ম হয়েছিল ইংরাজি ১৭৩০ সালে। ওই সময়ের নবাবী আমলে অখণ্ড বঙ্গদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য বঙ্গদেশকে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল। চাক’ শব্দের একটি অর্থ হল ‘বিভাগ’। তখন বারাসত নামে কোনো জেলা ছিল না। বারাসত জেলার সৃষ্টি হয় ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে। অখণ্ড বাংলাকে যে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি চাকলা অর্থাৎ বিভাগের নাম ছিল যশোহর। বারাসত, বসিরহাট এবং বনগ্রাম অঞ্চলগুলি এই চাকলার অন্তর্গত ছিল। বাবা লোকনাথের জন্মস্থান রূপে যে চাকলা নামের উল্লেখ করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো গ্রামের নাম নয়। এখানে চাকলা অর্থ বিভাগ। সেই অর্থে মনে করা যেতে পারে যে, বাবার জন্ম তৎকালীন যশোহর চাকলায় হয়েছিল। সেই যশোহর চাকলারই অন্তর্গত কাকড়া কচুয়া নামে এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে লোকনাথ বাবার জন্ম হয়। বর্তমানে এই কচুয়া গ্রাম বসিরহাটের অন্তর্গত দেগঙ্গা থানার অধীন স্বরূপনগরের নিকট অবস্থিত। বর্তমান জেলা বিভাগ অনুযায়ী এই স্থান উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত। পরবর্তীকালে দেগঙ্গা থানার কাছে চাকলা নামে একটি গ্রামেরও পত্তন হয়।


বাবার ভক্ত গবেষকদের জন্য এই সম্পর্কে আরও কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। লোকনাথ বাবার জীবনী গ্রন্থের মধ্যে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থটির নাম। সিদ্ধজীবনী। এই গ্রন্থের লেখক বাবার অতি প্রিয় শিষ্য ব্রহ্মানন্দ ভারতী। লোকনাথ বাবা নিজ মুখে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর জন্ম কচুয়া গ্রামে হয়েছে। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার কাছে জেনে নিজে কাকড়া কচুয়া গ্রাম পরিদর্শনে ১২৯৬ মতান্তরে, ১২৯৭ সালের বৈশাখ মাসে এসেছিলেন। এবং সেখানে বিস্তর খোঁজের পর রামকানাই ঘোষালের বাস্তুভিটার সন্ধান পেয়েছিলেন। সেখানে তখন লোকনাথ বাবার ভাইয়েদের বংশধরদেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। যদিও তারা পরবর্তীকালে জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। ওই সময় ব্রহ্মানন্দ ভারতী লক্ষ্য করেছিলেন যে, ওই গ্রামের লোকেরা তখন বাবা লোকনাথের বারদীতে অবস্থান সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন না। ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই কাঁকড়া কচুয়া গ্রামেই সন্ধান পেয়েছিলেন বাবার সতীর্থ বাল্যবন্ধু বেনীমাধবের ভাই হরিমাধব ও নীলমাধবের বংশধরদের। কথিত আছে যে বেণীমাধবের ভিটায় তাঁর ঘরখানির এখনও অস্তিত্ব আছে এবং ভক্তগণ সেখানে গেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।


এই গ্রামেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন বাবার গুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির বংশধরদের, যাঁরা অনেক পরে সেখানে বসতি করেন। ভগবান গাঙ্গুলির পুত্র ও পরবর্তী বংশধরেরা জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। পরে আবার সেখানে এসে কেউ কেউ বসতি করেন।


এই সমস্ত তথ্য-প্রমাণ ভক্তদের মনে এই বিশ্বাসের উদ্রেক করে যে বাবা লোকনাথের প্রকৃত জন্মস্থান ছিল কাকড়া কচুয়া গ্রাম।


বাবা লোকনাথ কোথায় জন্মেছিলেন সেটা ঐতিহাসিক ও গবেষকদের গবেষণার বিষয়। ভক্তদের কাছে জানার বিষয় হল বাবা লোকনাথ কোন্ শক্তিবলে ব্রহ্মজ্ঞানী ও ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ হয়েছিলেন এবং কিভাবে তিনি সমস্ত ভক্তের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। তিনি কচুয়াতে যে রকম বিরাজ করছেন, চাকলা, বারদী এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র একইভাবে বিরাজ করছেন। সেজন্য জন্মস্থান বিবাদে না গিয়ে আমরা সেই মহান ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষকে আমাদের হৃদয়ে কিভাবে খুঁজবো, সেই প্রয়াসে ব্রতী হই।


.


লোকনাথের জন্ম


কাঁকড়া কচুয়া গ্রাম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত একটি কৃষিপ্রধান গ্রাম ছিল। চাষবাস করাই ছিল এই গ্রামের প্রজাদের পেশা। এই গ্রামে রামকানাই ঘোষাল নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল কমলাদেবী। যে সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, সেই সময়টা ছিল নবাবী আমল। সেই সময় রাজস্ব আদায়ের জন্য নবাবের লোকজন এবং জমিদারগণ প্রজাদের উপর প্রভূত অত্যাচার করতো। রামকানাই ঘোষাল ছিলেন একজন সরল প্রকৃতির ব্রাহ্মণ। যার বিষয়বুদ্ধি ছিল কাঁচা। তিনি শাস্ত্রপাঠ ও পূজার্চনাতেই দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন। বিষয় আলোচনার থেকে ধর্মালোচনায় তার নিষ্ঠা ছিল বেশি। বলাবাহুল্য এই জন্যই সংসারের অভাব অনটনের প্রতি তার ভ্রূক্ষেপ ছিল কম। তাঁর স্ত্রী কমলাদেবীও ছিলেন ধর্মপ্রাণা। তাঁরও বিষয় সম্পত্তির উপর টান ছিল না। এইভাবে অস্বচ্ছল সংসারে দেবার্চনাতেই স্বামী-স্ত্রী বিভোর থাকতেন। রামকানাই ঘোষালের কোনো পুত্র ছিল না। তিনি চিন্তা করতেন কিভাবে তার পিতৃকূল উদ্ধার হবে। তিনি মনে মনে ভাবতেন, যে একজন বৈদিক সন্ন্যাসী অতীত ষাটকুল ও ভবিষ্যতের ষাটকুল উদ্ধার করতে পারেন। যদি তাঁর এক পুত্র সন্তান হতো এবং সে বৈদিক সন্ন্যাসী হতো, তবে ঘোষাল পরিবারের অতীত ষাটকুল এবং ভবিষ্যৎ ষাটকুল উদ্ধার হয়ে যেত। এই চিন্তাকে তিনি মনের মধ্যে গোপনে পোষণ করতেন কেননা তখনও তার কোনো পুত্রসন্তান হয়নি।


কিছুকাল পরে কমলাদেবী প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। রামকানাইয়ের মন আনন্দে নেচে উঠলো। এতদিনে বোধহয় তার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। তিনি যথাসময়ে কমলাদেবীকে তার ইচ্ছাপূরণের কথা বলতে কমলাদেবীর চোখ জলে ভরে এলো। বিষণ্ণ মুখে ছলছল চোখে তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রামকানাই বুঝলেন, প্রথম পুত্র সন্তানের মায়া ত্যাগ করতে তাঁর স্ত্রী সমর্থ নয়। তিনি আর পীড়াপীড়ি করলেন না।


কিছুকাল পর কমলাদেবী ‘দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হলেন। রামকানাই এবার আশান্বিত হলেন যে, এখন তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। যথাসময়ে কমলাদেবী দ্বিতীয় পুত্র প্রসব করলেন। রামকানাই স্ত্রীর কাছে তার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে স্ত্রী এবারও কেঁদে আকুল হলেন এবং স্বামীর প্রস্তাবে ঘোরতর আপত্তি করলেন। রামকানাই এবারও ব্যর্থ হলেন কিন্তু মন থেকে তার আকাঙ্ক্ষা মুছে ফেললেন না। দুই পুত্র নিয়ে রামকানাই সংসার জীবনে এগিয়ে চলেছেন কিন্তু তার মন অতৃপ্ত থেকে গেছে। আশায় আছেন কবে তার তৃতীয় সন্তান জন্ম নেবে। কিছু সময় গত হলে কমলাদেবী তার তৃতীয় পুত্রের জন্ম দিলেন। রামকানাই এগিয়ে এলেন তার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে। কিন্তু মায়ের মন এবারও সায় দিল না। চোখের জলে স্বামীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। রামকানাই আবারও আশাহত হলেন। আর বুঝি তার বংশ উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল না। কিন্তু ধর্মনিষ্ঠ রামকানাই মন থেকে তার আকাঙ্ক্ষাকে মুছে ফেললেন না বরং নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।


এরপর ঘটল এক অলৌকিক কাণ্ড। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যেই রামকানাই স্বপ্নে দেখলেন এক দিব্যকান্তি জ্যোতির্ময় পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অঙ্গ-বিচ্ছুরিত জ্যোতিতে রামকানাইয়ের অন্ধকার ঘর আলোকিত। রামকানাই ঘুমের মধ্যে তার বন্দনা করতে লাগলেন। সেই দিব্যপুরুষ রামকানাইকে বললেন, তোমার ভক্তিতে আমি তুষ্ট। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। আমি তোমার পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবো। এই কথা বলে সেই দিব্যপুরুষ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। রামকানাইয়ের নিদ্রাভঙ্গ হল। তিনি জেগে উঠে আর সেই দিব্যজ্যোতি পুরুষকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তার মন এক অপার আনন্দে ভরে গেল। এবার নিশ্চয়ই তার মনের বাসনা পূর্ণ হবে। এই স্বপ্নের কথা তিনি সবার কাছে গোপন রাখলেন।


এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই আর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো কমলাদেবীর জীবনে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় কমলাদেবী গৃহদেবতা শিবলিঙ্গের স্বায়ংকালীন ভোগারতির জোগাড় করছিলেন। অন্য কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না। হঠাৎ তার সামনে শিবলিঙ্গ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বার হয়ে তার শরীরে প্রবেশ করলো। কমলাদেবী সেই দিব্যজ্যোতির তাপে জ্ঞান হারিয়ে শিবলিঙ্গের সামনে লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি দেখেন তিনি স্বামীর কাছে শুয়ে আছেন। তখন তিনি স্বামীকে সেই দিব্যজ্যোতির কথা বলেন। রামকানাইও তখন তার স্ত্রীকে স্বপ্নে সেই দিব্যপুরুষ দর্শনের কথা বলেন। দুজনেই এবার প্রসন্ন হন এই ভেবে যে তাদের মনোবাসনা এবার পরমেশ্বরের আশীর্বাদে পূর্ণ হতে চলেছে।


এই ঘটনার পর কমলাদেবী আবার সন্তান সম্ভবা হলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বুঝতে পারলেন যে, এবার তাঁদের ঘরে স্বয়ং মহেশ্বর পুত্ররূপে অবতীর্ণ হচ্ছেন। তারা সব সময় এক অনাবিল আনন্দ-সাগরে ভাসতে লাগলেন। কালে কালে কমলাদেবীর শরীরে এক দিব্য দীপ্তি ফুটে উঠলো। তাঁর শরীরে দেখা যেতে লাগলো বিভিন্ন দিব্য লক্ষণ। চোখ বন্ধ করলেই কমলাদেবীর দিব্যদর্শন হয়। একদিন রাতে ঘরের মেঝেতে শুয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে দর্শন করলেন কমলাদেবী। তাঁর পরিধানে ছিল ব্যাঘ্রচর্ম, সর্বাঙ্গে বিভূতি, কণ্ঠে নাগরাজ, ত্রিলোচন, জটাজুটমণ্ডিত মস্তক ও পঞ্চমুখ। এই পঞ্চমুখ পঞ্চবর্ণের ছিল–ধূম্র, পীত, শ্বেত, রক্ত ও অরুণ। তার শিরে ছিল গঙ্গা আর ললাটে অর্ধচন্দ্র। দেবাদিদেব বৃষপৃষ্ঠে আরোহন করেছিলেন। এই দিব্যদর্শনের কিছুদিন পরেই এলো সেই শুভদিন। বাংলা ১১৩৭ সালের ১৮ই ভাদ্র, ইংরাজি ১৭৩০ সালের ২৯শে আগস্ট, মঙ্গলবার রোহিণী নক্ষত্রে শুভ জন্মাষ্টমীর দিন কমলাদেবী প্রসব করলেন এক দিব্যকান্তি দেবশিশু। শিশুর দেহে এক অপূর্ব দিব্যভাব। রামকানাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন সেই দিব্যকান্তি শিশুকে আর ভক্তিভরে স্মরণ করতে লাগলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। যে দিব্যজ্যোতি নিয়ে এই অনিন্দ্যসুন্দর শিশু শোভা পাচ্ছে কমলাদেবীর কোলে, তাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বুঝলেন যে, এই সন্তান শিবঅংশ সম্ভুত। দেবাদিদেব মহাদেবের কৃপায় এই শিশু ধরায় তাদের ঘরে অবতীর্ণ হয়েছেন এই জগৎ সংসারকে আলোকিত করতে।


.


শিশু লোকনাথ


দিব্যলক্ষণ সমন্বিত শিশু লোকনাথ মাতৃক্রোড়ে বড় হতে লাগল। শিশুর যখন ৬ মাস বয়স হল তখন রামকানাই তার অন্নপ্রাশন দেবার কথা চিন্তা করলেন। তখনও শিশুর নামকরণ হয়নি। অন্নপ্রাশনে নামকরণ অনুষ্ঠান হয়। শিশুর জন্মপূর্ব অলৌকিক ঘটনাবলী এবং নিজের ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা স্মরণ করে রামকানাই শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠানের জন্য একজন বেদজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে যাওয়া মনস্থ করলেন। সেই সময় ওই অঞ্চলে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি নামে এক শাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত বাস করতেন।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী যে সময় কাঁকড়া কচুয়া গ্রাম দর্শনে এসেছিলেন, তার থেকে কিঞ্চিৎ সহস্র বছর পূর্বে কান্যকুজ থেকে ভট্টনারায়ণ, দক্ষ, বেদগর্ভ, ছান্দর ও শ্রীহর্ষ নামে পাঁচজন পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ বিপ্র মহারাজ আদিশূরের যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য বাংলায় এসেছিলেন। সেই পঞ্চ বিপ্রের মধ্যে বেদগর্ভের বংশধর ছিলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি। তিনি ওই অঞ্চলেই বসতি করেছিলেন। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির হিন্দুশাস্ত্রে তথা বেদ-পুরাণে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। লোকনাথের জন্মের পর তিনি দেবনির্দেশ পেয়েছিলেন যে রামকানাই-এর ঘরে যে দেবশিশুর জন্ম হয়েছে তাকে যোগসাধনার পথে পরিচালনা করে ব্রহ্মজ্ঞ করার গুরুদায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।


রামকানাইয়ের সঙ্গেও তার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল এবং রামকানাই তাকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন। একদিন রামকানাই আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির সমক্ষে উপস্থিত হয়ে তার চতুর্থ সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত ও নিজকুল উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করলেন। তিনি পণ্ডিত মহাশয়কে এও জানালেন যে, তাঁর স্ত্রীর এই ব্যাপারে সম্মতি আছে। রামকানাইয়ের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির ইচ্ছা হল নবজাতককে দর্শন করার। তিনি রামকানাইয়ের সঙ্গে শিশু দর্শনে এলেন। রামকানাইয়ের ঘরে সেই দিব্যশিশুকে দর্শন করেই আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অভিভূত হয়ে গেলেন। শিশুর শরীরের কিছু দিব্যলক্ষণ তার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করলো। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এই শিশুর মধ্যে নানাবিধ মহাপুরুষের লক্ষণ বিদ্যমান। তিনি স্বেচ্ছায় এই শিশুর কোষ্ঠি বিচার করতে বসলেন। কোষ্ঠিবিচার করে তিনি জানতে পারলেন যে, এই শিশু ত্রিলোকের নামের অংশ হতে সমুদ্ভূত। ভবিষ্যতে এই শিশু এক মহাপুরুষরূপে আবির্ভূত হবেন। তিনি মনে করলেন লোকেশ্বরের কৃপায় যার জন্ম এবং ইহলোকের সন্তাপ দূর করার নিমিত্ত যার জন্ম হয়েছে, তার নাম লোকনাথ হওয়াই উচিত। শিশুর নামকরণ হল লোকনাথ ঘোষাল। রামকানাই মহানন্দে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান করলেন ও সারা গ্রামের লোককে আপ্যায়িত করলেন। সারা গ্রামের লোক এই দেবশিশু দর্শন করে ধন্য হলেন।


এরপর দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, শিশু লোকনাথ হাঁটতে শেখে। অন্য ভাইদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে শেখে। এইভাবে চার বছর পার হয়ে যায়। শিশু চার বছর অতিক্রম করলে রামকানাই শিশুর বিদ্যারম্ভের জন্য হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাংলায় এখনও এই প্রথা প্রচলিত যে, শিশুর হাতেখড়ি অনুষ্ঠান হবার পরই বিদ্যারম্ভ করা হয়। রামকানাই গেলেন শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলির কাছে একটি শুভদিন নির্ণয় করার জন্য। ভগবান গাঙ্গুলি শুভদিন নির্ণয় করে দিলেন। শিশু লোকনাথের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করা হল। রামকানাইয়ের মনোবাসনা এই শিশু বেদজ্ঞ মস্ত পণ্ডিত হবেন। কিন্তু শিশুর বিদ্যাশিক্ষার থেকে খেলাধূলায় মতি বেশি। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু লোকনাথের লেখাপড়ায় কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। রামকানাই কত চেষ্টা করেন লোকনাথের আকর্ষণ খেলাধূলা থেকে বিদ্যাভ্যাসে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু সব বৃথা। নয় বৎসর বয়স পর্যন্ত লোকনাথের অক্ষর জ্ঞান হয় না। রামকানাই পুত্রকে নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি একদিন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাছে গিয়ে সব নিবেদন করেন। তিনি বলেন যে, যখনই তিনি লোকনাথকে নিয়ে বিদ্যাভ্যাস করাতে যান, শিশুর মন কিছুতেই বিদ্যায় আকৃষ্ট হয় না। পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন ভবিষ্যদ্রষ্ট। তিনি শিশুকে দর্শন করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই শিশু একদিন মহাপুরুষ হবে। তিনি রামকানাইকে বললেন, তুমি যাকে মূর্খ হবে ভাবছে, সে একদিন ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করে মহাযোগী রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। এই জগতে একদিন সে মহাযোগী, সর্বশাস্ত্র বিশারদ, মহাজ্ঞানী রূপে পূজিত হবে। তোমরা ওকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পীড়াপীড়ি কোরো না। সময় হলেই ওর দিব্য প্রকাশ ঘটবে এবং ওর মধ্যে দিব্যজ্ঞান স্কুরিত হবে। রামকানাইয়ের চিন্তিত মন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কথায় আশ্বস্ত হল এবং তিনি গৃহে ফিরে এলেন। লোকনাথ প্রকৃতির খেয়ালে নিজের ইচ্ছায় বড় হতে লাগল।


.


বালক লোকনাথ


লোকনাথ শিশু অবস্থা থেকে বাল্যাবস্থায় পা দিয়েছেন। কিছু সঙ্গী-সাথীও হয়েছে। তাদের নিয়েই তিনি গ্রামে খেলা করে বেড়ান। তাঁদের খেলার একটি প্রিয় স্থল ছিল গ্রামের একটি প্রাচীন বটগাছতলা। সেখানে গ্রামের লোকেরা বটেশ্বর পূজা করতো। লোকনাথ ও তার সাথীরা সেই বটগাছতলায় বসে ধ্যান ধ্যান খেলা করতেন। সাথীরা লক্ষ্য করতো, যখন লোকনাথ সেই বটগাছের নিচে ধ্যান করতেন, তখন তার আর কোনোদিকে খেয়াল থাকতো না। এই ধ্যান ধ্যান খেলা তার কাছে অতি প্রিয় ছিল। লোকনাথ বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতীর কাছে বলেছিলেন তাঁর আর একটি প্রিয় খেলা ছিল সাথীদের নিয়ে গ্রামে ঘুরে যেখানে বৃদ্ধরা ঘন্টাকর্ণ পূজা (ঘেটুপূজা) করতো, সেখানে গিয়ে পূজা সমাধা হবার আগেই তা লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া। এই খেলায় তিনি ও তাঁর সাথীরা খুব আনন্দ পেতেন। গ্রামের বৃদ্ধরা সেই নিয়ে বাড়িতে নালিশ জানায়। তখন বাড়ি ফিরলে মায়ের কাছে খেতে হতো বকুনি আর বাবা শোনাতেন অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরাও তাদের বাগে পেলেই জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাতেন। তার আর একটি বাল্যকালের টান ছিল সাধু-সন্ন্যাসীদের উপর। গ্রামের প্রান্তে ছিল এক প্রাচীন শিবমন্দির। বিভিন্ন স্থান থেকে সাধু-সন্ন্যাসীরা ওই মন্দিরে এসে আশ্রয় নিত। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি লোকনাথের ছিল এক তীব্র আকর্ষণ। তাঁর সাথীদের নিয়ে প্রায়ই ওই মন্দিরে যেতেন সাধু দর্শন করার জন্য। এই প্রবণতা তার মধ্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। সাধুসন্তরা যখন ওই গ্রামে দীর্ঘদিনের জন্য উপস্থাপন করতেন, লোকনাথ প্রায় সারাদিন তাঁদের সঙ্গেই কাটাতেন। তাদের আচার-আচরণ, দিনযাপন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি রালক লোকনাথ তীক্ষ্ণ দর্শনে অবলোকন করতেন। তিনি দেখতেন যে, সাধুরা একটি কাপড় ছিঁড়ে একখণ্ড কাপড়ে ল্যাঙ্গুটির মতো করে ব্যবহার করতেন। যাকে বলা হয় কৌপিন।


একদিন কমলাদেবী একটি নতুন বস্ত্র লোকনাথকে পড়তে দিলেন। লোকনাথ সেই বস্ত্র ছিঁড়ে একটি কৌপিন বানিয়ে পড়ে নিজের ঘরে ধ্যানে বসেন।


এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে কমলাদেবী হাসতে হাসতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কার ধ্যান করছিস? মার কথার উত্তরে চোখ মেলে লোকনাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, শিবের ধ্যান করছি। এই কথা শুনে কমলাদেবীর হাসি আর থামে না। সে হাসতে হাসতে স্বামীর কাছে গিয়ে লোকনাথের কথা বলায় রামকানাই মনে মনে আশ্বস্ত হন যে এই লোকনাথই একদিন তার মনস্কামনা পূর্ণ করবে।


একদিন লোকনাথ গ্রামের শিবমন্দিরে গিয়ে সাধুদের সঙ্গেই ধ্যানে বসে যান। তাঁর নিষ্ঠা দেখে সাধুরা প্রীত হন। সারারাত লোকনাথ সেই সাধুদের নিয়ে নাম-গান করে ঘুমিয়ে পড়েন। এদিকে বাবা-মা রাতে লোকনাথ না ফেরায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারা জানতে পারেন যে, লোকনাথ শিবমন্দিরে সাধুসঙ্গ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্ন্যাসী দেখলেই লোকনাথ তার পিছনে ছুটে যান এবং তার সঙ্গে নানারকম বার্তালাপ জুড়ে দেন। একটি বালকের মধ্যে এত সন্ন্যাস প্রেম দেখতে পেয়ে সন্ন্যাসীরাও তাকে আপন করে নেন।


একবার চড়কের মেলায় গ্রামে অনেক সন্ন্যাসী এসেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা গ্রামের একটি বড় আকর্ষণ। সেই সময় গ্রামে যেমন সন্ন্যাসী আসে তেমন গ্রামের লোকেরাও শিব-পার্বতী সঙ সেজে গ্রামে ঘোরে। অনেকে শিব সেজেছে। তাদের দেখে লোকনাথও বাঘের ছাল পড়ে, গায়ে ভস্ম মেখে, হাতে একটা ত্রিশূল নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু গ্রামের সকলে লক্ষ্য করল যে অন্যান্য সঙের থেকে লোকনাথের শরীরে এক অন্য বিভা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক দিব্যজ্যোতিতে সে মানুষকে মুগ্ধ করে তুললো। ত্রিশূল হাতে তিনি সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনেক দূরে চলে গেলেন। রাত হয়ে গেছে। চারিদিক অন্ধকার। এবার তিনি আর বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পান না। অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে আর কেউ নেই। তিনি একটা বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। তারপর একমনে শিবকে স্মরণ করে বলতে থাকেন–হে বাবা ভোলানাথ, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি, আমাকে পথ দেখাও। এমন সময় কোথা থেকে এক জটাজুটধারী সাধু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেই সাধুর শরীর থেকে এক অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠেছে। মাথার পিছনে চক্রাকার দিব্যজ্যোতি। কপালে অর্ধচন্দ্রাকার। তিনি ইশারা করে লোকনাথকে চলতে বললেন। লোকনাথও বিমূঢ় চিত্তে তাকে অনুসরণ করে যখন নিজের বাড়ির সামনে পৌঁছলেন, দেখলেন, সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ আর নেই।


এরপর একদিন পাশের গ্রামে পালা গান শুনতে যাবার জন্য লোকনাথ বায়না ধরলেন। মা কিছুতেই তাকে একা যেতে দেবেন না। তার শঙ্কা লোকনাথ কোথাও হারিয়ে যেতে পারে। তিনি লোকনাথকে বলেন, তুই এতদূরে যাবি, তোর ভয় করে না? লোকনাথ মাকে বললেন ভয় করবে কেন? কোথাও রাস্তা হারালে তো তুমি আলো হাতে লোক পাঠিয়ে দাও। সেই লোকই আমায় বাড়ি পৌঁছে দেয়। সেই লোকটাকে দেখতে ঠিক শিবের মতো। ছেলের কথা শুনে মা ভয় পেয়ে গেলেন! ভাবলেন, কোনো ব্রহ্মদৈত্য ছেলের কাছে আসে না তো। তিনি আরো ভাবলেন, সাধু-সন্ন্যাসীরা ছেলের মাথা বিগড়ে দিয়েছে। মায়ের মন সবসময় সন্তানের বিপদের দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু এ তো যে-সে সন্তান নয়। এ যে স্বয়ং লোকের নাথ।


একবার জ্যৈষ্ঠ মাসে ভীষণ খরা। বৃষ্টির চিহ্নও নেই। কৃষিপ্রধান গ্রামে চাষীরা হাহাকার করছে। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা বৃষ্টির জন্য শুভ যজ্ঞানুষ্ঠান করছেন, কিন্তু মেঘ-বৃষ্টির দেখা নেই। দেবতারা কৃষকের ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। গ্রামের সকলের মতো রামকানাইও চিন্তিত ছিলেন। বাবাকে চিন্তিত দেখে লোকনাথ বললেন, এতো ভাবছো কেন বাবা? আমাদের ঠাকুরঘরে যে জলেশ্বর শিবলিঙ্গ আছে, তাকে মহাস্নান করালেই বৃষ্টি হবে। খরা দূর হয়ে যাবে। লোকনাথ তখন সঙ্গীসাথী নিয়ে গ্রামের সমস্ত বাড়িতে এই খবর পৌঁছে দিতে লাগলেন যে, তাদের বাড়ির জলেশ্বর শিবলিঙ্গকে স্নান করালে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। গ্রামের মানুষ আবার কৃষিকাজ শুরু করতে পারবে।


পূর্বস্মৃতি মেনে গ্রামের সমস্ত পরিবার লোকনাথের বাড়ির শিবলিঙ্গের মাথায় পূণ্য জল ঢালতেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। লোকনাথের এই দৈববাণীতে গোটা গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। রামকানাই ও কমলাদেবীও তাদের পুত্রের দৈবসত্তার পরিচয় পেয়ে মানসিকভাবে তৃপ্ত হলেন।


এরপর একদিন লোকনাথ তার বন্ধুদের সঙ্গে গ্রামের প্রাচীন বটগাছতলায় বসে আছেন। সহসা তিনি এক বন্ধুর হাত টেনে নিয়ে ভাগ্যবিচার করতে বসেন। এক-একজনের হাত দেখে তিনি বলেন–তোর ভাগ্যে সন্ন্যাসী হওয়া নেই, তোর কপাল খারাপ। বন্ধুরা এই নতুন খেলায় মজা পায় এবং এক একজন করে সকলেই তার কাছে হাত দেখাতে থাকে। কিন্তু লোকনাথের কথা শুনে তারা বুঝতে পারে না, সন্ন্যাসী হতে না পারলে কেন কপাল খারাপ হবে? তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে থাকে। এমন সময় তার এক সাথী বেণীমাধব সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দেয়। লোকনাথ খুব ভাল করে তার হাত দেখে বলেন, তোর সন্ন্যাসী হবার যোগ আছে। শিবদর্শনও হতে পারে। তখন বন্ধু বেণীমাধব বলে, তুই যেদিন ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে বেরোবি, সেদিন আমি তোর সঙ্গী হব। সেদিন যেন তাড়িয়ে দিসনে আমায়। লোকনাথ বন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-ঠিক আছে, তাই হবে।


লোকনাথের মন আরও বেশি করে ধ্যানে আকৃষ্ট হয়। আগে বটগাছতলায় বা শিবমন্দিরে বসে ধ্যানাভ্যাস করতেন, এখন ঘরে বসেই ধ্যান করেন। কেউ তাকে এভাবে ধ্যান করতে শেখায়নি। ঘরে ধ্যান করলে মা যখন জিজ্ঞাসা করতেন, কি রে তুই ওভাবে বসে কি করছিস? লোকনাথ উত্তর দিতেন–দিলে তো আমার ধ্যানটা ভঙ্গ করে। চোখ বুজে এভাবে ধ্যান করলেই মাথায় জটা গজাবে। ছেলের এই কথা শুনে কমলাদেবীর হাসিও পেত আবার মন শঙ্কিতও হয়ে উঠতো এই ভেবে যে, এই বুঝি সেই সময় এগিয়ে আসছে। যখন এই পুত্রকে তিনি আর ধরে রাখতে পারবেন না। পুত্রের বাল্যকালের সংসারলীলা আর তার চক্ষুগোচর হবে না। নীরবে তিনি অশ্রু বিসর্জন করতেন।


.


দ্বিজ লোকনাথ


কোনো ব্রাহ্মণ সন্তানের উপনয়ন সংস্কার হলে তাকে ‘দ্বিজ’ বলে। বালক লোকনাথের দশ বছর বয়স পার হয়ে গেছে বাল্যলীলা করতে করতে। কমলাদেবী তার স্বামীকে বলেন লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করতে। রামকানাইও চিন্তা করেন যে, লোকনাথ এগারোয় দিয়েছে, এটাই তার উপনয়নের যথার্থ সময়। রামকানাই লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করার জন্য পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলির কাছে গেলেন। পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথের উপনয়নের কথা শুনে বুঝলেন যে এবার তাঁকেও সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এক মহা তপস্যার অভিযানে। তিনি লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের দিন ঠিক করে দিলেন।


এদিকে গ্রামেরই বলরাম বাড়ুজ্যের পুত্র বেণীমাধব, যার জন্ম হয়েছিল ১১৩৭ সনের ২০শে ভাদ্র, সেও এগারোয় দিয়েছে। যখন সে জানতে পারলো লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার হবে, সেও উপনয়নের জন্য বায়না ধরলো যে সেও লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচারী হতে চায়। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে একটি পূর্বনির্ধারিত আত্মিক যোগ ছিল। লোকনাথের জন্মের দুইদিন পরেই বেণীমাধবের একই গ্রামে জন্ম হয়। বেণীমাধবের লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচারী হবার বাসনায় প্রাথমিকভাবে বাড়ির লোকের আপত্তি ছিল না। সেজন্য তারও উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করা হল।


নির্দিষ্ট দিনে পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি রামকানাইয়ের বাড়ি উপস্থিত হলেন লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার করতে। তিনি নিজ হস্তে লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার কার্য সমাধা করলেন। উপনয়ন সংস্কার কার্য সমাপ্ত হবার পর ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথকে নিয়ে দণ্ডীঘরে প্রবেশ করলেন। দণ্ডীঘরে দণ্ডীবেশী লোকনাথকে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বললেন, লোকনাথ এবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। লোকনাথ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যেতে হবে? আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাকে বললেন, আমাদের তপস্যা করার জন্য গৃহত্যাগ করতে হবে। এখন থেকে তোমায় সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করতে হবে। ঈশ্বরের সাধনা করতে হবে। পরমেশ্বরকে লাভ করতে হবে।


আচার্যদেব এবার রামকানাই ও কমলাদেবীর কাছে ঈশ্বরের সেই অমোঘ আদেশ প্রকাশ করে বললেন, বাবা রামকানাই, মা কমলা, ঈশ্বরের যে আদেশ আমার উপর আছে, তা এবার আমায় পালন করতে হবে। এই জগতের মঙ্গলের জন্য ও ত্রিতাপজ্বালা জর্জরিত অসংখ্য মানুষকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য এবং তোমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করার নিমিত্ত লোকনাথকে সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করতে হবে। আমি এই দিনটির অপেক্ষাতেই বসে আছি।


রামকানাই বুঝলেন যে এতদিনে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। তাঁর চতুর্থ পুত্র ব্রহ্মচারী হয়ে তার ষাট কুল উদ্ধার করবে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, এবার আমাদের লোকনাথকে বিদায় দিতে হবে। মা-ও বোঝেন যে, দেবাদিদেব মহাদেবের অংশে লোকনাথের জন্ম হয়েছে জগতের মঙ্গল বিধানের জন্য। তার শক্তি নেই এর বিরুদ্ধে যাবার। কিন্তু তাও মনে মনে তিনি কেঁদে আকুল হন। রামকানাই তাকে বোঝাতে থাকেন যে, তাদের পুত্র মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেছে কোনো দেবকার্য সাধনের জন্য। দেবতার কার্যে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। এবার ভিক্ষা গ্রহণের পালা। উপনয়ন সংস্কারের পর শাস্ত্রানুসারে দণ্ডী সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দিতে হয়। মা কমলাদেবী দণ্ডীঘরে প্রবেশ করলে লোকনাথ সামনে এসে বলেন–ভগবতী ভিক্ষাং দেহী। এইভাবে তিনবার উচ্চারণ করে লোকনাথ মার কাছে ভিক্ষা চাইলেন। মা কমলাদেবী তার সন্তানকে আঁচল ভরে ভিক্ষা দিলেন ও অনেক আশীর্বাদ করলেন। এরপর মা স্বয়ং লোকনাথের কাছে ভিক্ষা চাইলেন–আগামী জন্মে আবার যেন তোমায় সন্তান রূপে পাই। লোকনাথ বললেন–তাই হবে। মা কমলাদেবী অশ্রুসজল চোখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো দেখতে থাকেন তাঁর প্রিয় পুত্রকে। রামকানাই শোক ও আনন্দ মিশ্রিত মনে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে দু চোখ ভরে দেখতে থাকেন দ্বিজ লোকনাথকে। বিদায়ের কাল সমাগত। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাঁর শিষ্য লোকনাথকে নিয়ে প্রস্তুত। রামকানাই তাঁর পুত্রের সমস্ত ভার সঁপে দিলেন আচার্যদেবের হস্তে।


এদিকে গ্রামেরই অন্যপ্রান্তে ঘটছে এক অন্য ঘটনা। বেণীমাধবের ইচ্ছা অনুযায়ী তার পরিবার প্রাথমিকভাবে তাকে উপনয়ন সংস্কারের পর লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালনে সন্ন্যাস নেবার কোনো আপত্তি না দেখালেও শেষ পর্যন্ত তারা বেঁকে বসেন। কিন্তু বেণীমাধব নাছোড়–সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি জুড়ে দিলে সেই সময় উপস্থিত পণ্ডিতগণের সঙ্গে বাড়ির লোকেরা আলোচনা করলেন এবং বেণীমাধবের কথা শুনে পণ্ডিতবর্গ তার কথায় সায় দিলেন। লোকনাথের খেলার সাথী বেণীমাধব গৈরিক বসন পড়ে মুণ্ডিত মস্তকে কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে লোকনাথের কাছে পৌঁছল। সেখানে পৌঁছে আচার্যদেবকে দেখতে পেয়ে সে বলল, আমার নাম বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকনাথ আমার হাত দেখে বলেছিল, আমার হাতে সন্ন্যাস যোগ আছে। আমার শিবদর্শন হবে। ও যখন সন্ন্যাসী হবে, তখন ও আমাকে সঙ্গে নেবে। আমার উপনয়ন সংস্কার হয়েছে। দণ্ডীঘরে মার কাছে ভিক্ষা নিয়েই আমি লোকনাথের ডাক শুনতে পেলাম। ও বলল, বেণী, আমি তোকে কথা দিয়েছিলাম, যাবার সময় ডেকে নেব। এখনই আমি বেরিয়ে পরছি। যাবি তো এখনি আমার বাড়ি চলে আয়। সন্ন্যাসী হতে চাস তো দেরি করিসনে। দেখবি, সন্ন্যাসী হবার কি মজা! বালকের কথা শুনে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অবাক বিস্ময়ে দুই দ্বিজ বালককে দেখতে লাগলেন। কি সরল মন ওদের। কি পবিত্র চিত্ত! কি প্রবল বাসনা সন্ন্যাসী হবার। কি ব্যাকুলতা শিব দর্শনের। দুজনেরই বয়স প্রায় এক। তিনি চোখ বুজে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন, এই জন্মে এমন শিষ্য দেবার জন্য। তিনি অন্তরে অনুভব করলেন, একদিন এই দুই বালক শিষ্যের মহিমার মাধ্যমে তাঁর জীবন সার্থক হয়ে উঠবে। এদের মাধ্যমেই হয়তো বা হতে পারে তার দেবদর্শন। আর দেরি নয়। আর কোনো মায়ার বন্ধনে জড়াতে চান না আচার্যদেব। দুই পরিবারের লোকেদের কাছে বিদায় নিয়ে এবার তাঁর এগিয়ে যেতে হবে এক মহতি অভিযানে। সেই অভিযান যেমন দুষ্কর তেমনি কঠিন। এই অভিযানের নেতৃত্ব তিনি ঈশ্বরের আদেশে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। দুই বালকের হাত ধরে নিঃশব্দে পরমেশ্বরকে স্মরণ করে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কচুয়া গ্রামের পথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন। একবারও পিছনে না তাকিয়ে সম্মুখে স্থির দৃষ্টি রেখে দুই দ্বিজ বালক সন্ন্যাসীর বেশে আচার্যদেবের হাত ধরে এগিয়ে চলে এক অজানার সন্ধানে। সারা গ্রামের লোক সানয়নে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল।

তৃতীয় অধ্যায় – কালীঘাটে দ্বিজ লোকনাথ


কালীঘাটের পথে বনে অবস্থান


কচুয়া গ্রাম ছেড়ে ধীরে ধীরে দুই বালক সন্ন্যাসী ও আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এগিয়ে চলেছেন জঙ্গলের পথ ধরে কালীঘাটের দিকে। কচুয়ার পরে বসিরহাট, বারাসতের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তবে কলকাতায় কালীঘাট। ওই সময় এই বিস্তীর্ণ পথ ছিল ঘন জঙ্গল ও জলাশয়ে আবৃত। সাধারণ পথচারীদের জন্য কোনো পথের ব্যবস্থা ছিল না। নিতান্ত প্রয়োজনে যারা চলাচল করতো, তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে পথ করে পদব্রজে কিংবা গোরুর গাড়িতে করে যাতায়াত করতো। বালক দুজনের বয়স সবে দশ অতিক্রম করে এগারোয় এবং তাদের গুরুর বয়স তখন ৭০ পার হয়ে ৭১-এ পড়েছে। এই প্রথম এত দীর্ঘ পদযাত্রা করছে দুই বালক। পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা আগত। কিন্তু কোথাও জনবসতি দেখা যায় না। কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। আচার্যদেব বোঝেন যে এখন রাত্রি কাটাবার জন্য একটি আশ্রয়স্থল প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পান না। তিনি নিজে এবং বালকেরাও সারাদিন পদযাত্রায় ক্লান্ত। আরও কিছুদূর এগিয়ে বনের ধারে এক পর্ণকুটির দেখা গেল, আচার্যদেব এগিয়ে দেখলেন, কুটির শূন্য। কুটিরের অবস্থা দেখে সহজেই অনুমান করলেন যে, এই কুটিরে অবশ্যই কোনো সাধু বা সন্ত বাস করেন অথবা কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলেন। এই পর্ণকুটিরেই আচার্যদেব রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করে এই প্রথম দুই বালক সন্ন্যাসীর বনাঞ্চলে পর্ণকুটিরে বাস। পথশ্রমে ক্লান্ত হলেও তাদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা কাজ করছিল। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে স্বায়ংকালীন সন্ধ্যাকাজ সম্পন্ন করে বসলেন গায়ত্রী আলোচনা করতে। বালক শিষ্যদের সন্ন্যাস আশ্রমের শিক্ষা তিনি গায়ত্রীর অর্থ দিয়েই শুরু করতে চান। আরম্ভ হল দ্বিজ লোকনাথ ও বেণীমাধবের শিক্ষা।


গায়ত্রীর অর্থ দিয়ে কেন আচার্যদেব তাঁর শিক্ষা শুরু করেছিলেন, সেটা জানতে হলে আমাদের একবার সৃষ্টির আদি তত্ত্বে ভ্রমণে যেতে হবে। একবার বিশ্বেশ্বর স্বয়ং পার্বতী দেবীকে সেই তত্ত্ব সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, এখানে তার উল্লেখ করছি। বিশ্বেশ্বর মাতা পার্বতাঁকে বলছেন


আমি পূর্বে প্রাকৃত কল্পে মুখ হতে এক কপিলাকৃতি পুরুষ সৃষ্টি করি। তাকে বলি–তুমি নিজের আত্মাকে বিভক্ত কর। কিভাবে আত্মাকে বিভক্ত করি–সেই চিন্তায় যখন আমি ধ্যানাবিষ্ট, সেই সময় আমার প্রসাদে তার দেহ ভেদ করে ত্রিবর্ণস্তররূপী চতুর্বর্গ ফলপ্রদ ঋক্‌-যজুঃ-সাম নামক ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবাত্মক ওঁকার স্বীয় প্রভাবে অখিললোক পরিব্যাপ্ত করে আবির্ভূত হলেন। ওই সময় আমার উদার বাণী দ্বারা সমলস্কৃত হয়ে ওঁকারের হৃদয় হতে ধটুকার ধ্বনি উত্থিত হল। আর ছন্দঃশ্রেষ্ঠা চতুর্বিংশতি অক্ষরবিশিষ্ট পঞ্চশীর্ষা মধুরভাষিণী দেবী গায়ত্রীও তাঁর পাশে প্রকট হলেন। হে পার্বতী! আমি গায়ত্রী ও ওঁকারকে বললাম–তোমরা উভয়ে বিচিত্র সৃষ্টির প্রবর্তন কর। আমার কথা শুনে হিরন্ময় ত্ৰিশিখ ওঁকার স্বীয় জ্যোতি থেকে বিবিধ সৃষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন। সর্বপ্রথমে বেদ প্রকট হলেন। ক্রমে ক্রমে তেত্রিশ জন বৈদিক দেবতা, কয়েকজন ঋষি ও মানুষ সৃষ্টি হল সেই ওঁকার থেকে। গায়ত্রী সহ এই ওঁকারই সর্বজগতের স্রষ্টা। স্কন্দপুরাণে এই তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং অথর্ব বেদেও এই তেত্রিশ বৈদিক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমি নর্মদা পরিক্রমার সময় কারেশ্বরের মন্দিরে এই তত্ত্বকথা অবগত হই। সৃষ্টির আদি এই তেত্রিশ বৈদিক দেবতা ও গায়ত্রী সহ ওঁকার সৃষ্টি প্রারম্ভ করে ওঁকারেশ্বরের ওঁকারে লীণ হয়ে যায়।


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তার শিষ্যদের শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তরে মানবের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকেই শুরু করেছিলেন। কেননা যে সাধন অভিযানে তিনি বেরিয়েছেন তার মূল লক্ষ্য আত্মদর্শনের মাধ্যমে ব্রহ্মদর্শন। এবং সেই লক্ষ্যে। পৌঁছোতে হলে, এই মানব সৃষ্টির বীজ কোথায় তা জানা দরকার। গায়ত্রীর মধ্যেই সকল বৈদিক দেবতার বাস। এই সকল বৈদিক দেবতারাই মানব শরীরে বাস করেন। গায়ত্রী মন্ত্র দেহের মধ্যের সকল দেব দেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই মন্ত্রের দ্বারাই সাধক সেই ধী শক্তিকে আহ্বান করেন, যিনি তাকে সর্বত্র রক্ষা করে প্রাপ্য পদে পৌঁছে দেবেন।


গায়ত্রী মন্ত্র : তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি।

ধ্যেয় যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ।।


 অর্থ : যিনি আমাদের ধী শক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সেই সবিতাদেবের সে বরণীয় তেজ ধ্যান করি। ঋগ্বেদে সবিতাদেব বলতে সূর্যকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম রাতেই আচার্যদেব তার দুই বালক শিষ্যকে সেই জ্ঞান প্রদান করেন, যার দ্বারা তারা সবিতাদেবের ধীশক্তির অধিকারী হতে পারেন এবং তাঁর তেজকে ধারণ করার শক্তির অধিকারী হন। এই প্রথম শিক্ষাই ছিল এক অনন্য শিক্ষা। যখন আচার্যদেব তার শিষ্যদের সঙ্গে গায়ত্রীর আলোচনা করছিলেন, সেই সময় এক বিরাট সৰ্প এসে বিশাল ফনা বিস্তার করে প্রথমে স্থির হয়ে রইল। তারপর একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরে দুই বালক ব্রহ্মচারীকে নিরীক্ষণ করে তাদের তিনবার প্রদক্ষিণ করে কুটির থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আচার্য বুঝতে পারলেন যে, এই নাগরাজ কোনো সর্পদেহধারী দিব্যপুরুষ। নাগরাজের আকস্মিক আবির্ভাব, আচরণ ও অন্তর্ধানের ঘটনায় তিনজনের দেহ রোমাঞ্চিত এবং অন্তর পুলকিত হয়ে উঠল।


নর্মদা পরিক্রমার শেষ পর্যায়ে আমি যখন ওঁকারেশ্বরের পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে গিয়েছিলাম, তখন আমিও অনুরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আমি ওঁকারেশ্বরের উত্তর তটে পাহাড়ের গায়ে এক কুটিরে অবস্থিত শুকদেব মুনিকে দর্শন করতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের খাঁজের শেষ ধাপে পৌঁছতেই একজন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। আমি বললাম আমি একজন নর্মদা পরিক্রমাকারী। পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে এসেছি। শুকদেব মুনির দর্শনপ্রার্থী। তিনি তখন আমাকে সামনে পাহাড়ের খাঁজ দেখিয়ে বলেন–আপনি আগে এই নাগরাজকে দর্শন করুন। এই নাগরাজকে সবসময় দেখা যায় না। কোনো পরিক্রমাকারী বা মুনি এলে তখনই তিনি আবির্ভূত হন। আপনি অতীব ভাগ্যবান। আমি নাগরাজের থেকে ৫ ফুট দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে। হাত জোড় করে তাঁকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইলাম। নাগরাজ প্রথমে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একবার আমার বাঁদিকে, আবার ডানদিকে এইভাবে কয়েকবার মস্তক আন্দোলন করে তাকালেন। তারপর আমার শুকদেব মুনির দর্শন হল। ওঁকারেশ্বরেই শুনেছিলাম, অনেক সময় সিদ্ধযোগী পুরুষরাও নাগরূপে দর্শন দেন।


এখানে পর্ণকুটিরে নাগরাজের দর্শন নিশ্চিতভাবে একটি শুভলক্ষণ। আর এইজন্যই আচার্যদেব ঠিক করলেন এই স্থানেই বারোদিন অবস্থান করে ব্রহ্মচর্য শিক্ষা শুরু করবেন। এই বারোদিনে যখনই আচার্যদেব গায়ত্ৰীমন্ত্র আলোচনা করেছেন, তখনই প্রত্যহ সেই নাগরাজ তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার বনে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। বারোদিন পর আচার্যদেব মনস্থ করলেন আরও এগিয়ে যাওয়ার। যেদিন সকলে কুটির ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, তখন এক সাধু এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, এই পর্ণকুটির তার। তখন আচার্যদেব তাকে তাদের বারোদিন বসবাসের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলেন।


তিনি আচার্যদেব ও দুই বালকের পরিচয় বৃত্তান্ত শুনে বললেন যে, শুধুমাত্র ওই নাগরাজ দর্শনের আশায় তিনি বিগত বারো বছর ওইখানে কুটির বেঁধে বসবাস করছেন। কিন্তু ওই নাগরাজের দর্শন পাননি। তিনি বলেন, আপনার বালক শিষ্যরা খুবই ভাগ্যবান যে প্রথম দিনেই তাঁর দর্শন পেয়েছেন এবং প্রত্যহ তার দর্শন পেয়েছেন। ওই নাগরাজ একজন দিব্যজ্ঞানী মহাপুরুষ। স্বেচ্ছায় সর্পদেহ ধারণ করে সাধকদের কৃপা করেন। আপনাদের অনেক সুকৃতি আছে।


সাধু মহারাজের কাছে বিদায় নিয়ে আবার শুরু হল পথচলা। এবার বনাঞ্চল পেরিয়ে তারা গঙ্গার তীর ধরে হাঁটতে লাগলেন। গন্তব্যস্থল মহাতীর্থ কালীঘাট। অক্লান্তভাবে পথ চলে একদিন তারা পৌঁছলেন কালীঘাট।


কালীঘাট সেই সময় ছিল এক মহাজাগ্রত সাধনপীঠ। এই পীঠস্থান একটি প্রধান শক্তিপীঠ নামে কথিত ছিল। দেবীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। এইখানে সতীর ডান পায়ের চারটি আঙ্গুল পতিত হয়েছিল। দেবী সতীর অঙ্গ যেখানেই পতিত হয়েছে সেখানেই মহাপীঠের সৃষ্টি হয়েছে। কালীঘাট মহাপীঠে দেবী বিরাজ করছেন দক্ষিণা কালিকা ও শিব নকুলেশ্বর ভৈরব রূপে। এই দক্ষিণা কালিকা সর্বসিদ্ধিদাত্রী। ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ এসমা সাহেবের বাংলার নক্সা থেকে জানতে পারা যায় যে দক্ষিণ বাংলার সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল জঙ্গলময় ভূভাগের সমতটের মধ্যেই কালীঘাট অবস্থিত ছিল। ওই জঙ্গলের মধ্যে একটি কালীকুণ্ড নামে হ্রদ ছিল। এই হ্রদের পাশে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের মধ্যে পর্ণকুটিরে দক্ষিণা কালিকা ও নকুলেশ্বর শিব বিরাজমান ছিলেন। জনৈক কালীসাধক এই দেবদেবীর সেবায়েত ছিলেন। পরবর্তীকালে যশোরের জমিদার বসন্তরায় মহাশয় সেই পর্ণকুটিরের জায়গায় একটি ছোট মন্দির তৈরি করে দেন। এরপরে কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ১৮০৯ সালে বড়িশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরি ও তার পুত্র রামলোচন রায়চৌধুরি এবং ভাইপো রাজীবলোচন রায়চৌধুরি বর্তমান মন্দির নির্মাণ করান। ১৯৮২ সালে শিল্পপতি বিড়লা ট্রাষ্ট কালীকুণ্ডের সংস্কার করিয়ে বর্তমান রূপ দেয়।


বাবা লোকনাথ যে সময় এসেছিলেন, সেই সময় এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। অনেক সাধুসন্ন্যাসী এখানে আসতেন শক্তির আরাধনা করার জন্য। মন্দিরের অদূরে ছিল কালীঘাটের বিখ্যাত মহাশ্মশান। ওই নির্জন শ্মশান তান্ত্রিকদের সাধনক্ষেত্র ছিল। তন্ত্র সাধনার জন্য সেইসময় কালীঘাট বিখ্যাত ছিল। তখন নিবিড় জঙ্গলে বন্যকুকুর ও শেয়াল ঘুরে বেড়াত। আস্তানা ছিল কিছু ডাকাতেরও। প্রতি অমাবস্যার রাতের অন্ধকারে তান্ত্রিকেরা উন্মাদের মতো সাধনা করতেন। তাদের ঘিরে থাকতো জঙ্গলের পশুরা। আচার্যদেব এই মহাতীর্থে পদার্পণ করে বালক সন্ন্যাসীদের নিয়ে মন্দিরের সন্নিকটে জঙ্গল পরিস্কার করে একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করলেন। সেটাই তাদের বাসস্থান হল। বাবা লোকনাথ তাঁর কালীঘাট অবস্থান সম্বন্ধে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বেশ মজা করে যা বলেছিলেন, সে কথার এখানে উল্লেখ করছি।


তৎকালে কলিকাতা জঙ্গলময়, কালীঘাটও নিবিড় বনে আচ্ছাদিত ছিল। ইংরেজরা কালীঘাটের নিকট সওদাগিরি ব্যবসা করছিলেন। আমরা যখন কালীঘাটে এসেছিলাম, তখন বহু সংখ্যক দীর্ঘ জটাজুটধারী সাধুসন্ন্যাসী তথায় অবস্থান করছিলেন। আমি ও বেণী এই অভিনব জীবদের পেয়ে বিলক্ষণ তুষ্ট হলাম। কয়েকদিন থেকে আমরা কালীঘাটকে বাড়িঘরের মতো বানিয়ে নিলাম। সাধুরা যখন চুপ করে স্থিরভাবে উপবিষ্ট থাকতেন, তখন বালক স্বভাবসুলভ চপলতাবশতঃ আমরা কাহারও জটায় হস্তাপণ, কাহারও বা লেংটি স্পর্শ করতাম। তাহারা কিছু বলতেন না। আমরা প্রশ্রয় পেয়ে তাদের জটা ও লেংটি ধরে টান দিয়ে পালিয়ে যেতাম। সাধুরা আমাদের উপদ্রব কয়েকদিন সহ্য করে অবশেষে গুরুদেবকে জানালেন। গুরুদেব উত্তর করলেন–আমাকে বলেন কেন? আমি তো গৃহী। এরা আপনাদের লোক। আপনারা এদেরকে প্রস্তুত করে নিন। আমি গৃহ থেকে দুইটি বালককে সঙ্গে করে এনে আপনাদের নিকট উপস্থিত করেছি। এই উত্তর শুনে সাধুরা আর গুরুদেবকে অনুযোগ করতে পারলেন না। তারপরে গুরুদেব আমাদের একান্তে ডেকে বললেন–তোমরা যে তাদের জটা খসিয়ে ফেল ও লেংটি ধরে টানো, বড় হলে যখন অন্যেরা তোমাদের জটা ও লেংটি ধরে টানাটানি করবে, তখন কি করবে? আমি তখন বললাম, সে কি! আমরা তো পৈতার দিনের চেলি কাপড় পড়েছি। আমাদের জটা ও লেংটি হবে কেন? গুরু বললেন–তোমরা এই সংসার ছেড়ে আসলে ওদের মতোই জীবনযাপন করতে এসেছ। তখন আমি বললাম–আমরা যদি ওঁদের মতো হতে এসে থাকি, তবে ওরা ভিক্ষা করে খান, আর আমাদের ঘর থেকে খরচ আসে কেন? গুরু বললেন–তাও আমাদের ভিক্ষা স্বরূপ। সেই সময় লোকনাথের গ্রাম থেকে তাদের জন্য সিধে আসতো। তাদের ভিক্ষা করতে হতো না।


সাধুদের এই ঘটনা তাদের অন্তরে এক পরিবর্তন এনে দিল। তারা এরপর থেকে তান্ত্রিকদের সেবা করতে লাগলো। তাদের মধ্যে কৌতূহল হল তান্ত্রিকদের সাধন রহস্য জানার। এক-একদিন সারারাত তাদের সঙ্গে থেকে দুই বালক তান্ত্রিকদের সাধন প্রক্রিয়া দেখতো ও তাদের ধর্মালোচনা শুনতো। বুঝতে চেষ্টা করতো সাধন জগতের রহস্য। কোনো নতুন সন্ন্যাসী এলে দুই বালক সন্ন্যাসী তাদের সেবায় লেগে যেতেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তাদের অনুরাগ বাড়ে। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে এই ভাবান্তর দেখে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি খুশি হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর দুই বালক শিষ্য বালকসুলভ চপলতা ত্যাগ করে ধীরে ধীরে সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন। আর যত তাড়াতাড়ি তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায়, তত তাদের মধ্যে বৈরাগ্য আসবে। মহাতীর্থে এসে বালকেরা সন্ন্যাসে আসক্তি বাড়িয়েছে। এবার আবার এগিয়ে যেতে হবে। পথে পথে শিষ্যদের শিক্ষা দিতে হবে সাধনার গুহ্য পথের।


একদিন আচার্যদেব দুই শিষ্যকে ডেকে বললেন, এই মহাতীর্থে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। এবার আবার পথে বেরোতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে উচ্চতম সাধনপীঠের দিকে আর পথে পথে তোমাদের শিখতে হবে সাধন জগতের সব গুহ্য রহস্য। চলো, আবার আমরা পথ চলা শুরু করি। দুই বালক শিষ্য তখনই তৈরি গুরু নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলার জন্য। কালীঘাটের জঙ্গলের লতাপাতা নির্মিত কুটির ত্যাগ করে তিন সাধনপথের যাত্রী আবার আপন করে নিলেন অজানা অরণ্যপথকে।

চতুর্থ অধ্যায় – বনে বনে অষ্টাঙ্গ যোগসাধনা


অরণ্যপথে ক্ষুধা–তৃষ্ণা জয়


যোগসাধনা কল্পে কালীঘাটের থেকে এগিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে পশ্চিমদিকে বর্তমান হাওড়া জেলার তৎকালীন অরণ্যপথে এগিয়ে যেতে লাগলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি, লোকনাথ ও বেণীমাধব। পথে কোনো বসতি নেই, দেখা গেল না কোনো লোকালয়, যেখান থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। অবিরাম পথ চলা। চারিদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। কেবল শোনা যায় কখনো কখনো পশুর ডাক। পথশ্রমে ক্লান্ত দুই বালক সন্ন্যাসী ক্রমেই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন। এই গহন বনে খাদ্য ও পানীয় জল পাবার কোনো সম্ভাবনা নজরে এলো না। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বালক শিষ্যদের কাতর অবস্থা দেখে ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাতে লাগলেন বালকদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করার জন্য। বনে চলতে চলতে হঠাৎ এক সন্ন্যাসী আবির্ভূত হয়ে আচার্যদেবকে বললেন, তোমরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। আমি তোমাদের এই দানা দিচ্ছি। এই দানা গ্রহণ করলে তোমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর হয়ে যাবে। আচার্যদেব ওই গহন বনে আকস্মিক সন্ন্যাসী দর্শনে ও তাঁর দানা প্রদানে হতচকিত হয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী দানা প্রদান করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আচার্যদেব তাঁর বালক শিষ্যদের নিয়ে দুটি করে দানা মুখে দিলেন। কি আশ্চর্য! দানা মুখে দিতেই মুহূর্ত মধ্যে তাদের ক্লান্তি-ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব দূর হয়ে গেল। কি আশ্চর্য ক্ষমতা সেই দানার! বলাবাহুল্য যে সন্ন্যাসী এই দানা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো উচ্চমার্গের যোগী অথবা দিব্যপুরুষ। এই দানা নিশ্চিতভাবে কোনো দিব্যবস্তু যার সেবনে মুহূর্ত মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-পথশ্রম সব দূর হয়ে গিয়ে শরীরে নতুন উদ্যমের সৃষ্টি করে। দানা সেবনঅন্তে তিনজন নতুন করে শক্তি পায় এবং আবার এগিয়ে যেতে থাকে গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে সাধনার অনুকূল কোনো স্থানের সন্ধানে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটে গেলেই তাদের কার্যসিদ্ধি হল না, কেননা তারা বেরিয়েছেন ঈশ্বরের সন্ধানে। কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে জয় করা নিশ্চয়ই সাধনার পথে এক বড় পদক্ষেপ। এখন তাদের আকুলতা কেবলই ঈশ্বরের জন্য, দেহের প্রয়োজন মেটাবার জন্য নয়।


.


আচার্য কর্তৃক ঈশ্বরকে খোঁজার ব্যাকুলতার পরামর্শ


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অরণ্যপথে চলতে চলতে শিষ্যদের বোঝালেন যে, তারা ঈশ্বর দর্শনের অভিযানে বেরিয়েছেন। সাধনার মাধ্যমেই ঈশ্বর দর্শন হতে পারে। আর সাধনা তখনই সফল হয় যখন সাধকের ঈশ্বর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায়। দেহের প্রয়োজনের থেকে মন যখন ঈশ্বর প্রয়োজনের দিকে ধাবিত হয়, তখনই ঈশ্বর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরকে দর্শন করতে গেলে আগে নিজেকে দর্শন করতে শিখতে হবে। গুরুদেব শিষ্যদের বললেন, যে দেহটা নিয়ে তোমরা চলছে, সেটা তোমাদের আসল পরিচয় নয়। তোমাদের এই দেহের ভিতরে যে আত্মা বিরাজ করছে, সেটাই তোমাদের সত্য রূপ। যতক্ষণ সেই আত্মার দর্শন না হয়, পরমাত্মার দর্শন হয় না। সেই জন্য সাধনার মাধ্যমে তোমাদের আগে আত্মদর্শন করতে হবে। আত্মদর্শন হলে অর্থাৎ নিজের আত্মাকে চিনতে পারলে, তবেই তোমরা পরমাত্মার দর্শন পাবে এবং তাকে চিনতে পারবে। কিন্তু নিজের আত্মাকে চেনার জন্য দরকার আত্মজ্ঞান। প্রকৃত আমি কে’–এই তত্ত্ব জানাকে বলে আত্মজ্ঞান। ‘আমি’ বলতে আমরা আমাদের এই স্থূল দেহ এবং মন ও বুদ্ধির মিলিত রূপ বা সূক্ষ্ম দেহকে বুঝি। এই দুই রূপ দেহের মধ্যেই আছে ব্রহ্মের অংশ, যখন কোনো সাধকের এই জ্ঞান হয় যে এই স্থূল ও সূক্ষ্মদেহ প্রকৃত ‘আমি’ নই, আমি এই দুইরূপ দেহের কারণ বিশেষ, তখনই তার আত্মজ্ঞান হয়। সাধকের মধ্যে আত্মজ্ঞান সাধনার মাধ্যমে হয়। সেইজন্য এখন তোমাদের যোগসাধনায় ব্রতী হতে হবে।


যোগসাধনার তিনটি পথ আছে–জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ। এর মধ্যে যে কোনো একটি পথ অবলম্বন করেই সাধনা করতে হবে। এখন আচার্যদেবকেই ঠিক করতে হবে কোন্ পথে তিনি শিষ্যদের সাধনপথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আচার্য গাঙ্গুলি নিজেই এবার আত্মপর্যালোচনা করতে থাকেন যে, তার নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে কোন্ পথ এই বালক শিষ্যদের জন্য সঠিক পথ হবে।


.


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আত্মপর্যালোচনা


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একাধারে এক মহান দার্শনিক এবং একজন মহান শাস্ত্রজ্ঞ। বেদ-প্রাণ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি ছিলেন জ্ঞানমার্গের সাধক। কিন্তু এত গভীর শাস্ত্র ও দার্শনিক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তখনও তিনি সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। শিষ্যদের সাধনমার্গ দর্শনের ভার নিয়ে তিনি এটা। বুঝতে পেরেছিলেন যে, জটিল দার্শনিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করা যায় বটে, কিন্তু তাতে ঈশ্বর দর্শন হয় না। ঈশ্বর দর্শনের জন্য যে ব্যাকুলতা প্রয়োজন, প্রেম-ভক্তি হল তার প্রধান ভিত্তি। প্রেম-ভক্তিবিহীন জ্ঞানযোগ নিরস এবং তা সাধকের আত্মাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে না। ঈশ্বর প্রেম-ভক্তি বিহীন যোগসমাধি ক্ষণস্থায়ী। সমাধি থেকে বিচ্যুত হলেই সাধকের চিত্ত বৈকল্য হতে পারে ও তার পতন হতে পারে। ভক্তিমার্গে যোগসাধনা সাধককে মোক্ষপথে নিয়ে যায়। কিন্তু ভক্তিযোগ সহজ পন্থা নয়। সাধকের ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভগবানকৃপা ভিন্ন ঈশ্বরশক্তি লাভ হয় না। ভক্তিমার্গের সাধক প্রবল ঈশ্বরানুরাগী না হলে ভক্তিমার্গে সিদ্ধিলাভ সহজ নয়। অনেক যোগী যোগাভ্যাসে পটুতা লাভ করেন কিন্তু ঈশ্বর দর্শনের বা তাকে পাবার জন্য যে প্রবল ব্যাকুলতা, নিজের হৃদয়ে সেই অবস্থার সৃষ্টি না করতে পারাতে ভগবৎকৃপা থেকে বঞ্চিত হন। আচার্যদেব অনুভব করেন যে, তিনি জ্ঞানযোগের উচ্চমার্গে বিচরণ করলেও হৃদয়ে ভক্তির অপ্রতুলতায় এখনও সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি।


আচার্য গাঙ্গুলি এও অনুভব করেন যে, কেবল প্রেম-ভক্তি থাকলেও ভক্তিমার্গে সাধক সফল নাও হতে পারেন। ভক্তিযোগ সমৃদ্ধ কর্মর্মার্গ তাঁর শিষ্যদের জন্য সঠিক হতে পারে। বালকদ্বয়ের মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের প্রবল ব্যাকুলতা আছে। লোকনাথের মধ্যে তিনি পূর্বেই দিব্যলক্ষণের সন্ধান পেয়েছিলেন। তারা যদি ভক্তিযুক্ত মনে কর্মযোগের সাধনায় ব্রতী হন, তবে সফলতা আসবেই। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে স্থিরমতি হন যে, বিশুদ্ধ ভক্তি সহকারে ঈশ্বর দর্শনের প্রবল ব্যাকুলতা নিয়ে যদি তার এই দুই বালক শিষ্য কর্মযোগ সাধনা করে, তবে এই পথেই তারা একদিন সিদ্ধিলাভ করবে। এই পথই তিনি তার শিষ্যদের সাধনপন্থার জন্য নিশ্চিত করলেন। তিনি শিষ্যদ্বয়কে বললেন, এবার আমি তোমাদের যোগ সাধনার বিভিন্ন মার্গের শিক্ষা দান করবো।


.


যোগসাধনার তিন প্রধান মার্গের ব্যাখ্যা


আচার্য নিজে যখন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন যোগ সাধনার এই পথেই তার দুই শিষ্যকে প্রাথমিক স্তরে শুরু করাবেন, তখন তিনি তাদের নিয়ে বসে শুরু করলেন তার জ্ঞানগর্ভ পাঠ। তিনি শুরু করলেন যোগ সাধনার তিনটি প্রধান মার্গ নিয়ে আলোচনা। এই তিনটি মার্গ হলো–জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ


জ্ঞান যোগ : জ্ঞানযোগ শিখতে হলে আগে জ্ঞানের অর্থ জানা প্রয়োজন। কোনো সাধকের কাছে যার দ্বারা সবর্ভূত এবং স্বীয় আত্মাকে অভিন্ন বোধ হয় এবং স্বীয় আত্মা ও পরমাত্মাও অভিন্ন বোধ হয়–অর্থাৎ যাতে জীব, জগৎ ও ব্রহ্মের একাত্ম দর্শন হয়, তাই জ্ঞান। যে যোগ সাধনার মাধ্যমে সাধক এই জ্ঞান লাভ করেন তাকে জ্ঞানযোগ বলে। কিন্তু জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয় বিনা জ্ঞানযোগ সম্পূর্ণ হয় না। জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের সমন্বয় প্রয়োজন। জ্ঞানীর কর্মের বন্ধন হয় না। জ্ঞানী যখন প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করেন, তখন তার সব কর্মই নিষ্কাম কর্ম হয়। নিষ্কাম কর্মের অর্থ হল ফলকামনা ত্যাগ করে সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত হয়ে কর্ম করা। তাহলে দেখা যায় যে, যদিও সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন, কিন্তু কেবল জ্ঞান ও যুক্তি-তর্ক দ্বারা ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ করা যায় না।


ভক্তিযোগ : শ্রীগীতায় উল্লেখ আছে যে ভক্তিমার্গেই প্রত্যক্ষ ও ব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা হয় এবং সেটাই অপেক্ষাকৃত সুখসাধ্য। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অর্জুনকে বলেছিলেন–ভক্তিমার্গে নিত্যযুক্ত হয়ে যাঁহারা আমার সগুণ স্বরূপের উপাসনা করেন, তাহারাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কেবল ভক্তিমার্গেও ব্রহ্মদর্শন দুর্লভ।


কর্মযোগ : তপস্যা, ওঁকার মন্ত্র জপ ও ঈশ্বরে সব কিছু অর্পন করে কর্ম করাই কর্মযোগ। কর্মযোগীর তিনটে প্রধান লক্ষণ দেখা যায়?


(১) কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ (2) ফলাকাঙ্খ বর্জন এবং (৩) সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ। কর্মযোগীর মধ্যে এই তিন লক্ষণ থাকতে হবে। যেমন–যিনি ‘আমি’ করছি, এই বুদ্ধি ত্যাগ করতে পেরেছেন, তিনি পরম ভক্ত। সেই সাধকের ভক্তিযোগ হয়েছে। ভাবতে হবে। যিনি সর্বকর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে কর্ম করেন, তিনি পরম জ্ঞানী–সেই সাধকের মধ্যে জ্ঞানযোগের গুণ যুক্ত হয়েছে বলে মনে করতে হবে। যিনি সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করে মনে করেন আমি ঈশ্বরেরই কর্ম করছি, তিনিই প্রকৃত কর্মী। এই তিন লক্ষণ যার মধ্যে থাকে, তিনিই প্রকৃত কর্মযোগী। অর্থাৎ, কর্মযোগে ভক্তি, জ্ঞান ও কর্ম–এই তিনেরই সমন্বয় থাকে। এই কর্মযোগ পথে সাধনায় ব্রতী হলে সাধক যেমন প্রকৃত জ্ঞানলাভ করেন, তেমনি শুদ্ধভক্তিতে ঈশ্বরের প্রতি ব্যাকুল হতে পারেন এবং কর্মের মাধ্যমে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। সেইজন্য এই তিন সাধনার যোগপন্থার মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ। আচার্য বালকশিষ্যদ্বয়কে বলেন, তোমাদের আমি ঈশ্বরের প্রতি প্রেমভক্তি সমৃদ্ধ কর্মযোগেরই শিক্ষা দান করবো।


.


লোকনাথের বিদ্যাশিক্ষার আগ্রহ প্রকাশ


গুরুর কথা শুনে লোকনাথ বললেন, গুরুদেব, আমি নিরক্ষর মূর্খ। আমার কোনো অক্ষর জ্ঞানই হয়নি। কোনো শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান নেই। এমতাবস্থায় যে কর্মযোগের কথা আপনি বললেন, সেটা শুরু করার আগে বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন বললেন, বাবা লোকনাথ, বিদ্যাশিক্ষার জন্য তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তোমরা গুরুর কাছে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছে। আমি তোমাদের সাধনমার্গে এগিয়ে নিয়ে যাবার ভার নিয়েছি। আমার প্রতি তোমাদের যে অপরিসীম ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, তাতে বিনা অধ্যয়নেই আমার মধ্যে সঞ্চিত বিদ্যা আমি তোমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবো। তোমরা হবে অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী।


শ্রীগীতায় আছে–শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ। (৪/৩৯)


অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয়, সাধনপরায়ণ, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি জ্ঞানলাভ করেন। লোকনাথ ও বেণীমাধবের গুরুভক্তি ছিল প্রশ্নাতীত। গুরুচরণে সমর্পিত মন ছিল তাদের। এই দুজনের সদ্গুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন একজন শ্রোত্রিয় এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ উপাসক। যে উপাসক সমস্ত বেদ, শাস্ত্র ও সমগ্র পুরাণ বিশারদ হন, তাকে শ্রোত্রিয় বলা হয়। এবং যে উপাসক সদ্গুরু ব্রহ্মকে জানেন, তাকে বলা হয় ব্রহ্মনিষ্ঠ। যে সদ্গুরুর মধ্যে এই দুই গুণ বর্তমান, তাঁর মধ্যে এক ভগবৎশক্তি বিরাজ করে। সদ্গুরুর সেই শক্তিই শিষ্যে সঞ্চারিত হয়ে তার অন্তরের মায়ার গ্রন্থি শিথিল করে দিয়ে প্রকৃত দিব্যজ্ঞানের সঞ্চার করে। সদ্গুরুর থেকে শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের ক্রিয়া নিয়ত অবাধে চলতে থাকে এবং একসময়ে তা প্রবল আকার ধারণ করে শিষ্যের মধ্যে মহাজ্ঞান ও মহাশক্তির সৃষ্টি করে। সদ্গুরুর শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের প্রক্রিয়া সাধারণতঃ তিন প্রকারে সাধিত হয়।


(১) শিষ্যের অন্তরে সদ্গুরুর মহাশক্তি তার দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত হয়।


(২) শিষ্যের মধ্যে সদ্গুরু-স্মরণ-মননের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চার করেন।


(৩) শিষ্যের হৃদয়ে সদ্গুরুর যোগস্পর্শের মধ্য দিয়ে শক্তি ও জ্ঞানের সঞ্চার হয়।


সদ্গুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের লীলা এক সদগুরুর শক্তির অলৌকিক লীলা। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি পূর্ব থেকেই অবগত ছিলেন যে, তার জ্ঞানমার্গের সঞ্চিত জ্ঞান তাঁকে এই দুই শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করে এদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। তারপর সেই সঞ্চারিত জ্ঞানের সঙ্গে লোকনাথ ও বেণীমাধবের অদম্য ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা ও কর্মযোগের সাধনের সমন্বয় ঘটিয়ে পোঁছে দিতে হবে সাধনমার্গের অত্যুচ্চ শিখরে। সেই লক্ষ্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখন একাধারে তিনি তার দুই শিষ্যের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান সঞ্চারিত করবেন এবং কর্মমার্গের যোগসাধনার শিক্ষা দান করবেন। ঈশ্বর দর্শনের যে প্রবল ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা আছে এই দুজনের মধ্যে, কর্মযোগের পথে তা প্রবলতর হবে এবং একদিন তারা সফল হবেই।


.


ঋষি পতঞ্জলের কর্মযোগ শিক্ষা


এরপর একদিন আচার্যদেব তাঁর দুই শিষ্যকে বললেন, আজ আমি তোমাদের ঋষি পতঞ্জলের কর্মযোগ শিক্ষা দেবো–সাধকের কাছে ঋষি পতঞ্জল প্রদর্শিত কর্মযোগ প্রক্রিয়াই সাধনায় সিদ্ধিলাভের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি রূপে গণ্য হয়। ঋষি পতঞ্জলের মতে তপস্যা, ওঁকার মন্ত্র জপ ও ঈশ্বরে সমস্ত সত্তা অর্পণ করাকেই কর্মযোগ বলে।


এক্ষেত্রে সুখ-দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্মজনিত দ্বন্দ্ব সহ্য করার প্রক্রিয়ার নাম তপস্যা। কর্মযোগীকে তপস্যার মাধ্যমেই সাধনপথে এগিয়ে যেতে হয়।


ওঁকার তিন অক্ষরের মিলিত এক মহামন্ত্র।–অ, উ, ম। ওঁ মন্ত্রে ‘অ’-কারের অর্থ জগৎপিতা বা জগতের পালনকর্তা। উ’ কারের অর্থ জগতের সংহারকর্তা। ‘ম’ কারের অর্থ জগতের সৃষ্টি কর্তা। ওঁকার মন্ত্র জপ করার অর্থ জগতের পালনকর্তা, সংহারকর্তা ও সৃষ্টি কর্তার ধ্যান করা। এই সম্বন্ধে আমি তোমাদের পরে আরও বিস্তারিত জ্ঞান দান করবো।


ধ্যান করার অর্থ হল ভ্রূমধ্যে ধ্যেয়রূপ পরমেশ্বরের আনন্দময় ও জ্যোতির্ময় স্বরূপে মগ্ন হয়ে যাওয়া। এই ধ্যানই হচ্ছে প্রধান যৌগিক প্রক্রিয়া। ধ্যান করার সময় সাধকের মন ও ইন্দ্রিয়কে অন্তর্মুখী করে তার সমস্ত সত্তা ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হয় এবং মনে করতে হয় আমি এই শরীরের পঞ্চক্লেশ রহিত আনন্দময় অমৃতপুত্র ব্রহ্মের অংশ। কর্মযোগীর এই মনোভাব তার শরীরের পঞ্চক্লেশকে শক্তিহীন করে তাকে সমাধির পথে নিয়ে যায়।


.


মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ তত্ত্ব


লোকনাথ তাঁর গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন–শরীরের পঞ্চক্লেশ কি?


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন শিষ্যদের মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ হল–অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ। এই পঞ্চক্লেশের মধ্যে অবিদ্যাই প্রধান। যার শরীরে অবিদ্যা ক্লেশ বিদ্যমান, অন্য চারটি ক্লেশ সেখানে অবস্থান করবেই। সাধক যদি অবিদ্যা ক্লেশকে ক্ষয় করতে পারেন তবে অন্য ক্লেশগুলি সহজেই ক্ষয় হয়। সেজন্য সাধকের প্রয়োজন প্রথমে শরীরের অবিদ্যাজনিত ক্লেশকে ক্ষয় করা।


লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন–অবিদ্যা কি?


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন শিষ্যদের বলেন–অনিত্যবস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুচিতে শুচিজ্ঞান, দুঃখে সুখজ্ঞান আর অনাত্মায় আত্মজ্ঞানকে অবিদ্যা বলে। আত্মজ্ঞান দ্বারা অবিদ্যার বিনাশ হলে চিত্ত বিমুক্ত হয় এবং যোগী তখন আত্ম চৈতন্যরূপে নির্মলভাবে অবস্থান করেন এবং তার ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ হয়।


মানবশরীরের দ্বিতীয় ক্লেশের নাম অস্মিতা। পুরুষচেতন ভোজা আর বুদ্ধি অচেতন ভোগ্য, এই উভয়ের অভেদ জ্ঞানকে অস্মিতা ক্লেশ বলে। বুদ্ধিই প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনকেই জীবভাব বলা হয়। জীবের সকল কর্তৃত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্তা। প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতই জীবের পুনঃ পুনঃ যোনীতে জন্ম ও সংসার সুখ-দুঃখ ভোগ।


তৃতীয় ক্লেশের নাম রাগ। সুখ ও সুখের জন্য উপায়সাধনে আসক্তি বা কামনাকে রাগ বলে। সাধককে সর্বদা সুখ বা সুখজনিত উপায়সাধন ত্যাগ করে চলতে হয়। তবেই এই ক্লেশের ক্ষয় হয়।


চতুর্থ ক্লেশের নাম দ্বেষ। দুঃখ বা দুঃখের কারণে শরীরে যে ক্রোধ উৎপন্ন হয়, তাকে দ্বেষ বলে। সুখ-দুঃখের ভিন্ন জ্ঞান অবিদ্যাজনিত ক্লেশ। এই ক্লেশ থেকেই দ্বেষের উৎপত্তি। সুখ-দুঃখকে অভিন্ন জ্ঞান করলে যেমন অবিদ্যাজনিত ক্লেশ ক্ষয় হয়, তেমনই দ্বেষজনিত ক্লেশও ক্ষয় হয়।


মানব শরীরের পঞ্চম ক্লেশটি হল অভিনিবেশ। পূর্বজন্মের মরণদুঃখ অনুভব করে লোকের মনে যে মৃত্যুভয় আসে, তাকে বলা হয় অভিনিবেশ। এটি হল জন্মান্তরের সংস্কার। সাধক যখন তপস্যাবলে আত্মজ্ঞানের পথে অগ্রসর হন, তখন তার মধ্যে জন্মান্তরবাদের উদয় হয়। তিনি তখন পূর্বজন্মকে স্মরণ করতে পারেন। সেই স্থিতিতে তিনি যদি পূর্বজন্মের মরণদুঃখে দুঃখিত হয়ে পড়েন, তবে এই ক্লেশ সাধককে সাধনার পথে বিচ্যুত করবে। সেজন্য জন্মান্তরবাদজনিত এই অভিনিবেশ ক্লেশকে ক্ষয় করেই সাধককে অগ্রসর হতে হয়।


লোকনাথ একদিন গুরুদেবকে প্রশ্ন করলেন–সংস্কাররূপ ক্লেশগুলিকে কি উচ্ছেদ করা যায়?


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন বললেন, পঞ্চক্লেশের সুখ-দুঃখ, মোহ ইত্যাদি স্থূলরূপ বৃত্তিগুলি সংসারীদের ভোগ করতে হয়। কর্মযোগী তপস্যার দ্বারা এইসব বৃত্তিগুলি ক্ষয় করতে সমর্থ হয় এবং এই বৃত্তিগুলিকে তখন সাধক ত্যাগ করেন। যতদিন এই ত্যাগ সব সাধকের মধ্যে না আসে, ততদিন তাকে সাধনা করে যেতে হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ বৃত্তিগুলি থেকেই পুণ্যকর্মাশয় এবং অপুণ্যকর্মাশয় উৎপন্ন হয়। এই কর্মাশয়গুলির মধ্যে কতকগুলি বর্তমান জন্মেই অনুষ্ঠিত হয় এবং এই জন্মেই ভোগ সম্পন্ন করতে হয়। একে ক্রিয়াকরণ কর্ম বলে। কতকগুলি বৃত্তি আবার মরণের পরে জন্মান্তর ফল উৎপন্ন করে। একে মানব সঞ্চিতকর্ম বলে। পরবর্তীকালে জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী সেই আত্মার পুনর্জন্ম হলে তখন এই সঞ্চিত কর্ম প্রারব্ধকৰ্ম রূপে তাকে সেই জন্মে ভোগ করতে হয়। পঞ্চক্লেশ থাকলেই পুণ্য ও অপুণ্য কৰ্মাশয়ের বিপাক হয়। ক্লেশরূপ মূলের উচ্ছেদ হলে আর তা হয় না। আত্মজ্ঞান দ্বারা সাধকের অবিদ্যার নাশ হলে কর্মাশয়ের নাশ হয় অর্থাৎ কার্যবিমুক্তি হয়। এই বিমুক্তি হলে সাধকের চিত্ত বিমুক্তি হয়। তখন সাধক সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনের গুণাতীত হয়ে চৈতন্যরূপে নির্মলভাবে অবস্থান করে।


এক্ষেত্রে তোমাদের জীবদেহে তিন গুণের অস্তিত্বের কথা বলা প্রয়োজন। শ্রীগীতায় বলা আছে–সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃজাত প্রবৃত্তিগুলি প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন এবং এই তিনগুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে শরীরে আবদ্ধ করে। এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বঃগুণ নির্মল হওয়ায় প্রকাশশীল এবং বিকাররহিত। সত্ত্বঃগুণ নির্মল হওয়ায় জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞান কিন্তু আত্মজ্ঞান নয়। সত্ত্বঃগুণের অধিকারীর মধ্যে আমি সুখী, আমি জ্ঞানী, আমি ভক্ত এইরূপ অভিমানের ভাব থাকে। যতক্ষণ সত্ত্বগুণাধিকারীর মনে এই অভিমান ভাব বিরাজ করে, ততক্ষণ তিনি বন্ধনমুক্ত হতে পারেন না। এই সাত্ত্বিক অভিমান বা আসক্তি সাধনার প্রাথমিক স্তরে সাধকের মুক্তিপথের সহায়ক হয়। সাধক যখন মনে করেন আমি দীন-হীন নই, আমি পরমাত্মারই অংশ, আমি জ্ঞানী ও ভক্ত, তখন এই ভাব তাঁকে আত্মোন্নতির পক্ষে সহায়তা করে। তবে সাধনার উচ্চতম স্তরে এই সাত্ত্বিক অভিমান ত্যাগ করতে হয়। জীবাত্মার সত্ত্বঃগুণকে এইজন্য বলা হয় একাধারে বন্ধনের কারণ ও মুক্তির সহায়ক। সাধক যখন দেখেন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পেলেই সাধকের মনে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সত্ত্বগুণের কাজ হল চিত্ত ও ইন্দ্রিয়াদিতে আলস্য দূরীভূত করে একপ্রকার চেতনার উন্মেষ ঘটানো। সাধকের মধ্যে যখন এই চেতনার বিকাশ ঘটে, তখন তিনি ধীরে ধীরে সাত্ত্বিক অভিমান ত্যাগ করে স্বত্তগুণাতীত হবার পথে অগ্রসর হন।


রজঃগুণের ধর্ম রাগাত্মক। এই গুণ জীবাত্মার মধ্যে কামনা এবং আসক্তি উৎপন্ন করে। রজঃগুণ কর্মকে আচ্ছাদিত করে রাখে। রজঃগুণ সমন্বিত ব্যক্তি ভোগপ্রবণ হয় এবং কদাচ স্বল্পে সন্তুষ্ট হয় না। ভোগপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এই গুণ সমন্বিত ব্যক্তি গর্হিত আচরণশীল হয়। এইজন্য এইরূপ জীবাত্মা বিবিধ কর্মে আবদ্ধ হয়ে দুঃখ ভোগ করে।


তমোগুণ সমন্বিত জীবাত্মার অন্তঃকরণে মোহিনীবৃত্তি, কর্তব্যকর্মে অপ্রবৃত্তি ও ব্যর্থ চেষ্টার উৎপন্ন হয়। তমোঃগুণ জীবাত্মার অধোগতি উৎপন্ন করে। তমোঃগুণ সমন্বিত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়। তামসিক গুণ সমন্বিত ব্যক্তি পশু, নীচযযানি বা নরকপ্রাপ্ত হয়।


জন্মলগ্নে কোনো জীবাত্মার মধ্যে এই তিন সত্ত্বগুণ স্বতন্ত্র বা অবিমিশ্রতভাবে অবস্থান করে না। প্রতি জীবাত্মাতেই এই তিন গুণের সমন্বয় থাকে। কারও মধ্যে সত্বগুণ প্রবল থাকে, কারও মধ্যে রজঃগুণ প্রবল থাকে বা কারও মধ্যে তমঃগুণ প্রবল থাকে। যে মানবের মধ্যে যে গুণ প্রবল থাকে, সে সেই গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তদনুরূপ কার্য করে। মোক্ষার্থী সাধকের এই গুণত্রয়ের সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। কেননা, এই গুণগুলিকে জয় করতে না পারলে সাধকের পঞ্চক্লেশের ক্ষয় হয় না এবং চিত্ত কদাপি শুদ্ধ, সংস্কারমুক্ত ও মোক্ষমুখী হয় না। যে সাধক ভক্তিযোগ সহকারে এই গুণত্রয় অতিক্রম করে ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন, তিনিই মোক্ষলাভের অধিকারী হন। যে সাধক দেহের গুণত্রয় ধর্ম অনুযায়ী কার্য চলতে থাকলেও উদাসীনের ন্যায় অবস্থান করেন, সত্ত্বাদি গুণকর্ম কর্তৃক বিচলিত হন না, যাঁহার সর্ববিষয়ে সমত্ত্ব বুদ্ধি জন্মায়, যাঁহার নিকট সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা, শত্রু-মিত্র সকলই সমান তিনিই ত্রিগুণাতীত হন। আর এইরূপ ত্রিগুণাতীত সাধকই ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হয়। সাধক স্বীয় জীবাত্মাকে সাধনার মাধ্যমেই ত্রিগুণাতীত অবস্থায় নিতে পারেন। আজ তোমাদের এই পর্যন্তই শিক্ষা দিলাম।


আচার্যের কাছ থেকে লোকনাথ সাধনমার্গের গুহ্যতম বিদ্যাগুলি শিক্ষালাভ করছেন। সেদিনের শিক্ষা সারারাত তার মনকে আলোড়িত করে। তিনি চিন্তা করতে থাকেন, সাধনাই মোক্ষলাভের একমাত্র পথ কি না? পরদিন আবার গুরুদেব আলোচনা শুরু করলেন।


প্রথমেই লোকনাথ আচার্যকে জিজ্ঞাসা করেন–সাধনা ছাড়া কি মোক্ষলাভের অন্য কোনো উপায় নেই? আচার্য বলেন, না, সাধনা ছাড়া সিদ্ধিলাভ হয় না। আর সিদ্ধিলাভ ভিন্ন মোক্ষলাভও হয় না। মোক্ষলাভের জন্য এই সাধনা হল অষ্টাঙ্গ যোগের অনুষ্ঠান। আমি আজ তোমাদের সাধনার অষ্টাঙ্গযোগ সম্বন্ধে শিক্ষাদান করবো।


.


লোকনাথের অষ্টাঙ্গ যোগশিক্ষা


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এরপর অষ্টাঙ্গ সাধনা সম্পর্কে তার শিষ্যদ্বয়কে বিস্তারিত জ্ঞানদান করেন। অষ্টাঙ্গযোগ যোগীর কাছে এক প্রকৃষ্ট সাধনমার্গ। এই সাধনমার্গে অগ্রসর হয়েই একজন যোগী সিদ্ধিলাভ করেন। কিন্তু সাধনা আর সিদ্ধিলাভের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সব যোগীই সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন না। একজন প্রকৃত সাধকই কেবলমাত্র এই সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। সব যোগী অবিদ্যা আদিজনিত কারণে প্রকৃত সাধক হতে পারেন না।


প্রকৃত সাধক কে? : প্রকৃত সাধক হল একজন যোগীর ভাবশরীর। মানুষের এই স্থূলশরীর প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হয়। পরমাত্মার দুটি প্রকৃতি–অপরা এবং পরা। স্থূলশরীর হল অপরা প্রকৃতি এবং জীব হল পরা প্রকৃতি। এই স্থূলশরীর হল প্রথমে অব্যক্ত পরে ব্যক্ত ও পরিশেষে অব্যক্ত। যে প্রকৃতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল, সে সাধক কি করে হতে পারে? পরা প্রকৃতি অর্থাৎ জীবাত্মা সর্বদাই অব্যক্ত। এই অব্যক্তই সাধক, কেননা এটা পরিবর্তনশীল নয়। মানব শরীরের ব্যক্তরূপ সাধক হয় না। সাধন মার্গে সাধকের যখন সিদ্ধিলাভ হয়, তার স্কুলশরীরের সিদ্ধিলাভ হয় না। প্রকৃত সাধক সাধন প্রক্রিয়ার দ্বারা তার সমস্ত সত্তাকে অব্যক্তে লীণ করে দেন অর্থাৎ জীবভাবে পরিণত করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। সাধনার এই প্রক্রিয়ার জন্য ঋষি পতঞ্জল কথিত অষ্টাঙ্গ যোগসাধনাই সর্বশ্রেষ্ঠরূপে গণ্য হয়।


এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে অষ্টাঙ্গ যোগের বিভিন্ন অঙ্গগুলি ব্যাখ্যা করেন। অষ্টাঙ্গ যোগের আটটি অঙ্গ হল–যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি।


.


অষ্টাঙ্গ যোগের প্রথম অঙ্গ যম


অষ্টাঙ্গ যোগসাধনের প্রথম অঙ্গ হচ্ছে যম। যে অনুষ্ঠান দ্বারা দেহের ইন্দ্রিয়গুলিকে এবং মনকে হিংসা ইত্যাদি অশুভ ভাব থেকে সরিয়ে আত্মকেন্দ্রিক করা যায়, তাকে যম বলে। ঋষি পতঞ্জল যমের পাঁচটি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল–অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে এই পাঁচটি অনুষ্ঠান সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলেন।


অহিংসা : অহিংসার অনুষ্ঠানের অর্থ হচ্ছে কোনো প্রাণীকে কথা, মন অথবা কর্মদ্বারা কোনো কষ্ট না দেওয়া। মনে মনেও কারও অনিষ্ট চিন্তা না করা, কটু বাক্য দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়া এবং কর্ম দ্বারা কোনোস্থানে, কোনো অবস্থাতে কোনোদিন কোনো প্রাণীর প্রতি হিংসাভাব প্রদর্শন না করা–এই অভ্যাসগুলিই হচ্ছে অহিংসা। মানুষের দ্বারা তিন প্রকারের হিংসা অনুষ্ঠিত হতে পারে–


(১) নিজের মন, বাক্য বা কর্মদ্বারা হিংসা করা;


(২) নিজে প্রত্যক্ষরূপে হিংসা না করে, অন্যদের দিয়ে হিংসা কার্য করানো; এবং


(৩) হিংসা কার্য সমাধা করার জন্য অন্য কাউকে পাঠানোর অনুমোদন করা।


যমের অহিংসা অনুষ্ঠানে সাধককে এইসব কার্য থেকে বিরত থাকা উচিত। সাধকের মনে দৃঢ় নিশ্চয় থাকা উচিত যে, হিংসাজনিত কোনো কার্যই আমি কোনোদিন, কোনো অবস্থাতে, কোনোভাবে গ্রহণ করবো না। হিংসাজনিত দোষগুলিকে আমি সদাই পরিত্যাগ করে চলবো। তবেই অহিংসা অনুষ্ঠান পালিত হবে।


সাধকের ভিতর অহিংসা প্রতিষ্ঠা হলে, সে তখন সব জীবের প্রতি নিজের হৃদয়ে নিঃস্বার্থ স্নেহ-প্রেম বৃদ্ধি ও ধারণ করতে পারে এবং তা তার কর্মের মধ্য দিয়ে প্রদর্শন করতে পারে। সাধকের মধ্যে যখন অহিংসাভাব প্রবল হয়, তখন হিংস্র জীবজন্তুও সেই সাধকের প্রতি হিংসাভাব ত্যাগ করে।


সত্যঃ সত্য অনুষ্ঠানের অর্থ হল যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা জেনেছি, তেমনটাই শুদ্ধভাবে মনে ধারণ করা এবং সেইভাবে কাজ করা। সাধকের কথার মধ্যে ছল-কপটতা, ভ্রান্তি, মিথ্যা থাকা উচিত নয়। সাধকের যা সত্য নয়, সেই কথা বা সেই ভাবকে মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়।


কোনো সাধক যখন এই সত্য অনুষ্ঠান সফলভাবে করেন, তখন সেই সাধকের মুখনিঃসৃত বাক্য সত্য ও অমোঘ হয়ে ওঠে। মহাযোগীদের জীবনী অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, সেই মহাযোগিরা মুখে যে কথা বলেছেন, সে কথা অবশ্যই সত্য হয়েছে। প্রকৃত যোগীপুরুষ সর্বদা সত্য আচরণ করে থাকেন। সত্যবাদী মহাযোগিদের মধ্যে এক মহাশক্তির জন্ম নেয় যা তাদের বাক্যকে অমোঘ করে।


অস্তেয়ঃ অস্তেয় শব্দের অর্থ হচ্ছে চুরি না করা। কোনো শাস্ত্রবিরুদ্ধ পদ্ধতিতে সাধক কোনো দ্রব্য গ্রহণ করলে, তাকে চুরি অর্থাৎ স্তেয় বলা হয়। সাধকের মনে অপরের বস্তু প্রাপ্ত করার বাসনা বা লালসাকেও চুরি করা বলে। একজন সাধকের না অপরের দ্রব্য চুরি করা বা দ্রব্য প্রাপ্তির উপর লালসা করা উচিত, না অন্যের দ্বারা সেই দ্রব্য প্রাপ্তির চেষ্টা করা উচিত।


সাধকের মনে সবসময় এই ভাব বিরাজ করা উচিত যে, আমার এই স্থূলশরীরের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, ভগবান স্বয়ং আমায় সেইসব প্রদান করেন, তাহলে আমার অন্যের দ্রব্য প্রাপ্তির কি প্রয়োজন। এই ভাবের সাধক কখনো অন্যের নিকট হতে কোনো দ্রব্য গ্রহণ করেন না। যদি কেউ তাকে কোনো দ্রব্য দেন, তবে সাধক সেই দ্রব্য মানব কল্যাণে দান করে দেন। অস্তেয় ব্রত সিদ্ধি হলে যোগীর সংকল্প মাত্রই তার হাতের কাছে সমস্ত রত্ন উপস্থিত হয়।


এই বিষয়ে আচার্যদেব শিষ্যদের একটি চমৎকার ঘটনার কথা বলেন। একবার গুরু মীননাথ শিষ্য গোরক্ষনাথকে নিয়ে পদব্রজে চলেছেন। গুরু মীননাথের মধ্যে বিষয়াসক্তি ছিল। তাঁর সঙ্গে বহু ধনরত্ন ছিল। কিছুদূর চলার পর গোরক্ষনাথ বললেন, প্রভু, আপনার ওই ধনরত্নের বোঝাটি আমায় দিন, আমি এটা বহন করে নিয়ে যাবো। মীননাথ বোঝাটি গোরক্ষনাথের হাতে দিলে তিনি সেটাকে বনের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। মীননাথ তা দেখে রোষাবিষ্ট হয়ে শিষ্যকে তিরস্কার করতে লাগলেন। গোরক্ষনাথ তখন গুরুকে বললেন, গুরুদেব এই সামান্য ধনরত্নের জন্য আপনি বিচলিত হচ্ছেন কেন? এইসব রত্নের এমন কি মূল্য? প্রস্রাব করলেও তার থেকে এমন রত্ন পাওয়া যায়। এ কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য মীননাথ শিষ্য গোরক্ষনাথকে তাই করে দেখাতে আদেশ করলেন। গেরাক্ষনাথ তৎক্ষণাত সেখানে প্রসাব করলেন এবং গুরু দেখলেন, আশ্চর্যজনকভাবে সেই প্রস্রব থেকে ভুরি ভুরি রত্ন উৎপন্ন হল। এই দৃশ্য দেখে মীননাথ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং শিষ্যকে বললেন, আমি বুঝলাম, বিষয়-বৈভবই অনর্থের মূল। একজন যোগীর কাছে তার কোনো প্রকৃত মূল্য নেই। বলাবাহুল্য, গোরক্ষনাথ ছিলেন এক উচ্চকোটির মহাযোগী।


আমি যখন নর্মদা পরিক্রমা করি, তখন হোসেঙ্গাবাদের এক পূর্বতন মহাযোগী ও মা নর্মদার বরপুত্র মহাযোগী গৌরীশঙ্কর মহারাজের সম্বন্ধে অনুরূপ একটি ঘটনার কথা জেনেছিলাম। এই ঘটনা পাঠককে জানতে সাহায্য করবে যে, ভারতের সাধকদের কি উচ্চ আধ্যাত্ম ক্ষমতা ছিল!


গৌরীশঙ্কর মহারাজ হাজার হাজার সাধু-সন্ন্যাসীর জমায়েত নিয়ে নর্মদা পরিক্রমা করতেন। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে ঝাঁসির রানী, বাদশা জাফর, তাতিয়া তোপির মতো ব্যক্তিরা পরাজিত হবার পর, ইংরেজরা ভারতের সাধুদের জমায়েতের উপর অত্যাচার শুরু করে। সেইসময় গৌরীশঙ্কর মহারাজ নর্মদা তটে ৬-৭ হাজার সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিক্রমা করছিলেন। ইংরেজ অফিসাররা গৌরীশঙ্কর মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেন, এত সাধুদের রোজ ভোজন খরচ কোথা থেকে পাও? এই কথার উত্তরে গৌরীশঙ্কর মহারাজ ‘হর নর্মদে’ ধ্বনি দিয়ে যেই নর্মদার জলে হাত ডুবিয়েছেন অমনি তার হাতে উঠে আসে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলি। উনি ইংরেজদের বলেন, এটা মা নর্মদার কৃপা।


একচ্ছত্র শাসন ক্ষমতার অধিকারী দাম্ভিক ইংরেজরা তাঁর এই মহামানবীয় কাণ্ডকে সহজে মেনে নেয়নি। তাদের সন্দেহ হয় অন্য কেউ নর্মদার জলে হাত ডোবালে কোনো স্বর্ণমুদ্রার থলি উঠে আসে না কেন? নিশ্চয় এই সাধুরা কোনো ডাকাতির ধনরত্ন নর্মদার কূলবর্তী জলে লুকিয়ে রেখেছে। মহারাজকে তারা মাঝনদী থেকে রত্ন তোলার আদেশ করে। নৌকা করে মহারাজকে মাঝনদীতে নিয়ে গেলে তিনি সেই একই কাণ্ড করে দেখালেন। ইংরেজ অফিসারেরা মোহিত হয়ে পড়ে।


এরপর তারা মহারাজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এক আদেশনামা জারী করে যে, গৌরীশঙ্কর মহারাজ একজন সত্যই সিদ্ধ পুরুষ।


গুরু ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদ্বয়ের কাছে গোরক্ষনাথের ঘটনার উল্লেখ করে এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন সিদ্ধপুরুষের যোগৈশ্বর্য পৃথিবীর ধনরত্নের থেকে বেশি মূল্যবান।


ব্রহ্মচর্যঃ ব্রহ্মচর্য কথার প্রকৃত অর্থ হল ব্রহ্মে বিচরণ অর্থাৎ ভগবানে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। মানবশরীর সপ্তধাতুতে গঠিত–যেমন, রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র। এই সপ্তধাতুর মধ্যে শুক্রকে বীর্য বলে। তপস্যার দ্বারা এই বীর্যকে পতন না ঘটিয়ে শরীরের মধ্যে রক্ষা করাই হল ব্রহ্মচর্যের উদ্দেশ্য। বীর্যের প্রতি বিন্দুতে কোটি বজ্রের শক্তি নিহিত আছে। ব্রহ্মচর্য ব্রত ও তপস্যার মাধ্যমে বীর্য রক্ষা করলে সাধকের দেহে ওজঃ অর্থাৎ ব্রহ্মতেজ উৎপন্ন হয়। এই ওজঃ সাধকের মস্তিষ্কে অবস্থান করে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। স্বয়ং মহাদেব বলেছেন, যে ব্যক্তি ধৃত বীর্য, উৰ্দ্ধরেতাঃ, সে মানুষ নয়, সে দেবতা। এই অনুষ্ঠান পালন করলে, যোগী পুরুষের তেজ, কান্তি, শক্তি ও পরাক্রম বেড়ে ওঠে।


অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহের প্রকৃত অর্থ হল বৈরাগ্যসিদ্ধি। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনে সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর আরাধনা করাই হচ্ছে অপরিগ্রহ। ঐশ্বরীয় প্রনিধান অনুযায়ী জীবনে যে বাহ্যসাধন প্রাপ্ত হয়, তাতে অহঙ্কারের বশীভূত না হয়ে সেই জাগতিক বা বাহ্যসুখের সাধনগুলি পরিত্যাগ করাই প্রকৃত যোগীর কর্তব্য। যোগীর বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত থেকে বৈরাগ্যভাব নিয়ে অপরিগ্রহের পালন করা উচিত। কোনো সাধক যখন বৈরাগ্য ভাব নিয়ে বিষয়াসক্তি থেকে সম্পূর্ণ রহিত হয়ে সাধনা করেন, তখন তিনি জিতেন্দ্রিয় হন। সাধক যখন এইরূপ জিতেন্দ্রিয় হন, তখন তার কাছে জন্ম-মৃত্যুর স্বরূপ উদ্বাটন হয় এবং তিনি আত্মদর্শনের পথে এগিয়ে যান। অর্থাৎ নিজের মধ্যে আত্মাকে অন্তদৃষ্টিতে দর্শন করেন। এই স্থিতিতে সাধকের মনে আপনা থেকেই জ্ঞানলাভ করে। যমের সমস্ত পরিগণনাগুলি শিষ্যদ্বয়ের কাছে ব্যাখ্যা করে গুরুদেব বললেন, এরপর আমি তোমাদের অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় অঙ্গ নিয়মের কথা বলবো। নির্জন ঘন। বনের মধ্যে দিয়ে নিরন্তর পথচলা এবং কোথাও কোথাও লতাপাতার কুটির বানিয়ে রাত্রিবাস এবং গুরুদেবের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে লোকনাথ কিন্তু থেমে থাকেন না। গুরুদেবের থেকে যে শিক্ষা পেয়েছেন, নিয়ত তার অভ্যাস করে চলেন।


কোনো প্রশ্ন তার মনে জাগলে, পরদিন সেই প্রশ্নের উত্তর চেয়ে নেন গুরুদেবের কাছে। অষ্টাঙ্গ যোগের একটি অঙ্গের শিক্ষা পেয়েছেন, দ্বিতীয় অঙ্গশিক্ষা শুরুর পূর্বে লোকনাথ তার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে নেন। পরদিন আবার শুরু হয় দ্বিতীয় অঙ্গ ‘নিয়মের শিক্ষা।


.


অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় অঙ্গ ‘নিয়ম’


অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় আধার নিয়ম। মহর্ষি পতঞ্জল পাঁচটি নিয়মের উল্লেখ করেছেন। যেগুলি পালনের মাধ্যমে যোগী নিজের স্থূলশরীর ও লিঙ্গশরীরকে যোগক্ষম করতে পারেন। এই নিয়মগুলি হলো–শৌচ, সন্তুষ্টি, তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর প্রণিধান।


এই নিয়মগুলি হল–


শৌচ : শৌচ সাধারণভাবে দুই প্রকার–বাহ্যশৌচ ও অন্তঃশৌচ। পবিত্র সলিলে স্থলশরীরকে ধৌত করার নাম বাহ্যশৌচ। চিত্ত থেকে রাগ-দ্বেষ ক্লেশাদি দূর করার নাম অন্তঃশৌচ। কিন্তু একজন সাধকের কাছে শৌচের অর্থ আরও বড়। প্রকৃত সাধককে প্রতিদিন পবিত্র সলিলে অবগাহন করে স্থূলশরীরের শুদ্ধি, সত্যাচরণ দ্বারা মনের শুদ্ধি, বিদ্যা আর তপদ্বারা আত্মার শুদ্ধি এবং জ্ঞানদ্বারা বুদ্ধির শুদ্ধি করতে হয়।


একজন সাধক যখন শৌচের অনুষ্ঠানে সিদ্ধ হন, তখন তাঁর বাহ্যশরীরের প্রতি নিরাসক্তি দেখা দেয়। সাধকের তখন তার স্কুলশরীরের প্রতি কোনো মোহ থাকে না। তিনি তখন জীবপ্রেম স্থূলশরীর দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে করেন। আর সাধক যখন আভ্যন্তরীণ শৌচ অনুষ্ঠানের দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধি করেন, তখন তার মনে একাগ্রতা বৃদ্ধি হয় এবং তিনি ইন্দ্রিয়গুলির উপর বিজয়প্রাপ্ত হন। তখনই তিনি তাঁর আত্মাকে জানার যোগ্যতা অর্জন করেন। বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ শৌচসিদ্ধ সাধকই নিজ আত্মাকে আপনাতে অন্তদৃষ্টিতে দেখার জন্য সক্ষম হন। এই সক্ষমতার ফল আত্মদর্শন।


সন্তুষ্টিঃ বিষয়ভোগ থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিবৃত্ত রাখার নামই হল সন্তুষ্টি। সাধকের মধ্যে কোনো অপ্রাপ্তের তৃষ্ণা রাখতে নেই। ঈশ্বর কৃপায় যা প্রাপ্ত হয়েছে তাতেই মনকে সন্তোষ রাখার নামই হল সন্তুষ্টি। বৈভবের পিছনে না ছুটে সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সিদ্ধ হলে সাধক আত্মিক ও আন্তরিক সুখ লাভ করেন। সাধকের মনে রাখা উচিত যে, সন্তুষ্টি অনুষ্ঠানের ফলে প্রাপ্ত সুখ সর্বোত্তম সুখ।


সংসারে কামরূপ এবং দিব্যস্বর্গের কল্পনাযুক্ত যে মহান সুখ আছে, এই দুই প্রকারের জাগতিক সুখ-তৃষ্ণা নাশ হলে প্রাপ্ত হওয়া সুখের বোল ভাগের এক ভাগের সমানও জাগতিক সুখ হতে পারে না। সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সাধককে স্বর্গীয় সুখ এনে দেয়।


সেই জন্য সাধককে সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সাধনের দ্বারা স্বর্গীয় সুখের সন্ধান করতে হয় এবং তার জন্য তাঁর দৃঢ়ভাবে জাগতিক সুখকে ত্যাগ করতে হয়। সত্ত্বগুণ প্রবল হলে সাধক এইরূপ করতে পারেন।


তপ : যোগীর সাধনকর্মে যা কিছু বাধা-বিঘ্ন ও দ্বন্দ্ব আসবে, সেগুলিকে সহ্য ও অতিক্রম করে নিরন্তর সাধনা করে যাওয়াই হচ্ছে তপ। সাধকের সাধনকালে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা ইত্যাদি দ্বন্দ্ব ও প্রতিকূলতায় সম থাকার অর্থই হচ্ছে তপ। তপের অনুষ্ঠান দ্বারা সাধকের শরীর, মন শুদ্ধ হয় এবং তিনি তখন ত্রিগুণাতীত হয়ে ধর্মপথে শুভকর্মের আচরণ করেন।


স্বাধ্যায় : মহর্ষি ব্যাসদেব বলেছেন, সাধককে মোক্ষের পথে এগিয়ে নিয়ে চলা বেদ-উপনিষদ, যোগদর্শন, গীতা ইত্যাদি শাস্ত্রের শ্রদ্ধাপূর্বক অধ্যয়ন ও ওঁ-কার মন্ত্র জপ করাকে স্বাধ্যায় বলে। যে সাধক স্বাধ্যায়ের অনুষ্ঠান করেন, তিনি সিদ্ধ পুরুষ, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, দেব বা বিদ্বান যোগীর দর্শন পান-যাঁরা সাধককে সাধনায় সহায়তা করেন। ওঁকার মন্ত্র সঠিক জ্ঞানে জপ করলে, সাধক সাধন পথে যখনই কোনো বাধার সম্মুখীন হন, তখনই কোনো যোগসিদ্ধ পুরুষ তার পথ প্রদর্শন করেন।


স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান সাধকের ভিতরে আলোকের সন্ধান দেয়। সাধক স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও চর্চা পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য করেন না। সাধকের ততটাই স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান করা উচিত, যতটা করলে তার মধ্যে পাণ্ডিত্যাভিমান জন্মায় না। যে মুহূর্তে সাধকের মনে পাণ্ডিত্যের অভিমান জন্ম নেয়, তখন তিনি যোগ বিভূতির দিকে ধাবিত হন এবং সাধনার থেকে দূরে সরে যান। স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হল সাধকের মধ্যে জ্ঞানালোকের বিকাশ ঘটিয়ে তাকে ঈশ্বর প্রণিধানে সহায়তা করা ও জপের মাধ্যমে সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছানো। স্বাধ্যায় হচ্ছে সাধনার এমন একটি অনুষ্ঠান যা সাধকের কাছে সাধনাকে সহজ করে তোলে। স্বাধ্যায় দ্বারা সাধক তার সাধনার মূল লক্ষ্যকে স্থির করতে পারেন।


ঈশ্বর প্রণিধানঃ পরমাত্মার নিকট নিজের সমস্ত কর্ম অর্পণ করার নাম ঈশ্বর প্রণিধান। পরমাত্মা বা পরমেশ্বরকে সাধক সেই জিনিসই অর্পণ করতে পারে যেটা পবিত্র ও দিব্য। সেইজন্য সাধক অন্যান্য নিয়মানুষ্ঠানগুলি দ্বারা নিজেকে সম্পূর্ণ দিব্যভাবে উন্নীত করে নিজের অস্তিত্ব ও সমস্ত সত্তা ঈশ্বরকে অর্পণ করেন। সাধক যখন এই অনুষ্ঠানে সফল হন, তখন তাঁর সমাধি ও সিদ্ধি প্রাপ্তির সময় হয়। সমাধিকালে সাধক নিজের মধ্যে ও সর্বত্র পরমেশ্বরকেই দর্শন করেন এবং এই বোধ প্রাপ্ত হন যে পরমেশ্বর ও তার আত্মার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।


লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবের কাছ থেকে অষ্টাঙ্গযোগের নিয়মানুষ্ঠানগুলি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকেন। গুরুদেব তাঁদের কাছে নিজজ্ঞান উজার করে দিচ্ছেন। এখন তাঁদের এই নিয়মানুষ্ঠানগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে প্রকৃত সাধক হবার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। লোকনাথ নিরলসভাবে যোগের বিভিন্ন অঙ্গের অনুষ্ঠান নিয়ত দৃঢ়ভাবে অভ্যাস করতে থাকেন।


.


অষ্টাঙ্গযোগের তৃতীয় অঙ্গ আসন


যোগী যে প্রকারে স্থিরভাবে বিনা কষ্টে দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে যোগসাধনা করেন, তাকে আসন বলে। যোগীর সাধনার জন্য কোনো একান্ত স্থানে সমতল ভূমিতে কুশ অথবা কম্বলের উপর মেরুদণ্ড সোজা রেখে আসনে বসা উচিত। এই আসন নানাপ্রকার হয়–যেমন, পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, গোমুখাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন, পর্যাসন ইত্যাদি। যোগী তার সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো আসন গ্রহণ করতে পারেন। এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে সবগুলি আসনের বিধি প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দেন এবং বলেন যে, যোগী যখন আসনে সিদ্ধি লাভ করেন, তখন তার শীত-গ্রীষ্ম, ঠাণ্ডা-গরমজনিত কষ্ট থাকে না।


গুরুদেবের থেকে আসন বিধির শিক্ষা পেয়ে দুই শিষ্য বিভিন্ন আসন অভ্যাস শুরু করেন এবং বুঝতে চেষ্টা করেন, কোন্ আসনে তাদের মনোযোগ বেশি দৃঢ় হচ্ছে এবং কোন্ আসনে তারা বেশিক্ষণ ধ্যানে থাকতে সক্ষম হচ্ছেন। গুরুদেব তাদের প্রচেষ্টা দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।


.


অষ্টাঙ্গযোগের চতুর্থ অঙ্গ প্রাণায়াম


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদ্বয়কে বলেন, আজ আমি তোমাদের প্রাণায়াম শেখাব। তোমাদের আগে আসনসিদ্ধি লাভ করার জন্য যে আসনগুলি শিখিয়েছি, সেই আসনসিদ্ধ হলেই তবে প্রাণায়াম করতে তোমরা সক্ষম হবে। প্রাণায়াম হচ্ছে প্রাণের সাধনা। আসনসিদ্ধ হয়ে দেহের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরমেশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার প্রক্রিয়ার নাম প্রাণায়াম। প্রাণায়ামের তিনটি স্তর আছে–যথা, পূরক, কুম্ভক এবং রেচক। গুরুদেব লোকনাথ ও বেণীমাধবকে প্রাণায়মের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন–ডানহাতের অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে দক্ষিণ নাসা ধারণ করে বায়ু রোধ করে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে বাম নাসা দিয়ে যতটা সম্ভব বায়ু গ্রহণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে পূরক।


তারপর কনিষ্ঠা ও অনামিকা অঙ্গুলিদ্বয় দিয়ে উভয় নাসা ধারণ করে বায়ুরোধ করে ওঁ মন্ত্র জপ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে কুম্ভক বলে। তৎপর অঙ্গুষ্ঠ ডান নাসা থেকে তুলে নিয়ে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে দক্ষিণ নাসা দিয়ে ভিতরের বায়ু বাইরে ত্যাগ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে রেচক।


এইভাবে পুনশ্চ বিপরীত ক্রমে প্রথমে ডান নাসা দিয়ে পূরক, তৎপর উভয় নাসা বন্ধ করে কুম্ভক এবং অন্তে বাম নাসা দিয়ে রেচক করতে হবে। পূরক, কুম্ভক ও রেচক করবার সময় ওঁ মন্ত্র নিরন্তর জপ করে যেতে হবে।


সাধারণতঃ পূরকের সময় যতবার:ওঁ মন্ত্র জপ করবে, কুম্ভকের সময় তার চতুগুণ জপ করবে এবং রেচকের সময় পুরকের দ্বিগুণ জপ করবে। প্রাণায়ামের সময় একবার বামহাতের কর রেখায় এবং আরেকবার দক্ষিণহাতের কর রেখায় জপসংখ্যা রাখতে হয়।


লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, যোগ সাধনায় প্রাণায়মের গুরুত্ব কি? আচার্যদেব তখন শিষ্যদ্বয়কে যোগসাধনায় প্রাণায়ামের বিশেষ গুরুত্বের ব্যাখ্যা করেন।


গুরুদেব শিষ্যদের বলেন, প্রাণায়াম যোগ সাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। প্রাণায়ামের সঠিক অভ্যাসে দেহের পঞ্চক্লেশগুলি শিথিল হয়ে সাধকের মনে একাগ্রতা বৃদ্ধি করে এবং তার ধ্যানাবস্থার উন্নতি সাধন করে তাকে সমাধির পথে নিয়ে যায়। প্রাণায়ামের অভ্যাসে যোগী তার দেহে স্থিত পঞ্চপ্রাণকে দৃঢ় করতে সক্ষম হন এবং তার ফল হিসেবে যোগীপুরুষ দীর্ঘ আয়ু প্রাপ্ত হন। আচার্য তাদের আরও বলেন, এই পঞ্চপ্রাণ সম্বন্ধে আমি তোমাদের আরও কথা বলব। এখন তোমরা নিজ নিজ আসনে প্রাণায়াম অভ্যাসে রত হও।


লোকনাথ ও বেণীমাধব বনমধ্যে পথ চলতে চলতে যেখানেই অবস্থান করেন, যম-নিয়মের অনুষ্ঠানগুলি করতে থাকেন এবং আসন অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণায়ামের অভ্যাস নিরলসভাবে করতে থাকেন। লোকনাথ পর্যঙ্কাসন এবং গোমুখাসন বেশি করে অভ্যাস করেন কেননা তিনি এই দুই আসনেই চিত্তের একাগ্রতা বেশি করে বৃদ্ধি করতে পারেন, বেণীমাধব পদ্মাসনে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।


.


অষ্টাঙ্গযোগের পঞ্চম অঙ্গ প্রত্যাহার


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এই দেখে তৃপ্ত হন যে, তার শিষ্যদ্বয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রুত তার দেওয়া শিক্ষা আয়ত্ত করছেন। লোকনাথের যোগাসন অভ্যাসে তার মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় হয় যে, যোগের পরবর্তী ধাপগুলি গ্রহণ করতে এখন তাঁর শিষ্যদ্বয় সক্ষম হয়েছেন। সেইজন্য একদিন তিনি শিষ্যদ্বয়কে অষ্টাঙ্গ যোগের পঞ্চম অঙ্গ প্রত্যাহার সম্বন্ধে শিক্ষাদান করার জন্য ডাকেন।


গুরুদেব শিষ্যদের বলেন, আসনে বসে যোগাভ্যাস করার সময় প্রধান বাধারূপে দেহের ইন্দ্রিয়গুলি উপস্থিত হয়। দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় যোগীর চিত্তকে একাগ্রতা থেকে সরিয়ে বৈকল্যের পথে টেনে নিয়ে যায়। যোগীকে দেহের এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপর বিজয় প্রাপ্ত হতে হয়। দেহের এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের চালক হচ্ছে মন। সাধক যখন বৈরাগ্য ও প্রাণায়াম দ্বারা নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন, তখন তিনি দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে সক্ষম হন। প্রাণায়াম ও বৈরাগ্যের দ্বারা দেহের ইন্দ্রিয়গুলিকে অন্তর্মুখী করার প্রক্রিয়ার নাম প্রত্যাহার। মহর্ষি পতঞ্জল বলেছেন, প্রত্যাহার অনুষ্ঠান দ্বারা সাধক তার ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ অধিকার কায়েম করতে পারে। দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল–শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এর প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের প্রতি আসক্তি মনকে বিচলিত করে তোলে। সাধক প্রত্যাহার সিদ্ধ হলে এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে সমর্থ হন এবং তিনি পরম ভগবতসুখের সন্ধান পান।


প্রত্যাহারের ব্যাখ্যা দিয়ে আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে বলেন, এতদিন পর্যন্ত আমি তোমাদের অষ্টাঙ্গ যোগের যে পাঁচটি অঙ্গ অর্থাৎ–যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহারের শিক্ষাদান করলাম, এগুলি হল অষ্টাঙ্গযোগের বহিরঙ্গ সাধন। অষ্টাঙ্গযোগের আর তিনটি অঙ্গ, অর্থাৎ–ধ্যান, ধারণা ও সমাধি হল অন্তরঙ্গ সাধন। তোমাদের বহিরঙ্গ সাধন সিদ্ধ হলে তবেই তোমরা অন্তরঙ্গ যোগসাধনে সক্ষম হবে। সুতরাং এইগুলি সম্বন্ধে আমি তোমাদের পরে শিক্ষাদান করবো। এখন আমি তোমাদের এই বহিরঙ্গ সাধনে সিদ্ধিলাভ করার উপায় ও পথ নির্দেশ করবো। তোমাদের দৃঢ় মনে আমার নির্দেশিত পথে এই বহিরঙ্গ যোগসাধনা করতে হবে। এরপর তারা আবার দুর্গম বনপথে এগিয়ে যেতে থাকেন ও প্রতি রাত্রিবাসে লোকনাথ ও বেণীমাধব বহিরঙ্গ যোগাভ্যাসে ডুবে যান। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে তাদের যোগশিক্ষা ও সাধনা যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার।


.


গুরুতত্ত্ব আলোচনা


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি নিজে চিন্তা করতে থাকেন যে, তাঁর শিষ্যদ্বয় নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলতে প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু অষ্টাঙ্গ যোগে। নিয়মের অন্তর্গত স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান করার মতো অক্ষর বা শাস্ত্রজ্ঞান এদের নেই। স্বাধ্যায়ের যথোচিত অনুষ্ঠান করলেই একজন সাধক উপলব্ধি করতে পারেন–সে কে? কে তার সৃষ্টিকর্তা? কেন তার সৃষ্টি হয়েছে? তার জীবনের লক্ষ্য কি? এই উপলব্ধির দ্বারাই সাধক পরমেশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে যান। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে এই উপলব্ধির সঞ্চার করতে হবে। তারা এখন মায়ার অন্ধকারে ডুবে আছেন। গুরুরূপে তাকে এখন শিষ্যদ্বয়ের এই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোর সন্ধান দিতে হবে।


শাস্ত্রে আছে–গুকারঃ প্রথমো বর্ণো মায়াদি গুণভাসক। রুকার্যোস্ত পরং– ব্রহ্ম মায়াভ্রান্তিবিমোচকম্।। অর্থাৎ, গুরু শব্দের ‘গু’ অক্ষরটি মায়ান্ধকারের প্রতীক। এবং রু অক্ষরটি সেই পরব্রহ্মের প্রতীক যে সেই মায়ার অন্ধকার থেকে শিষ্যকে মুক্ত করতে পারেন।


কিন্তু গুরু তখনই শিষ্যের মধ্যে জ্ঞানের সঞ্চার করতে সক্ষম হন যখন শিষ্য গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সেই তত্ত্বসাগরে ডুব দিতে পারেন। সেইজন্য এখন প্রথমে তাকে শিষ্যদের গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে।


তিনি শিষ্যদের বলেন, দেখো, তোমরা নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে আমার থেকে যোগদর্শনের শিক্ষা গ্রহণ করছো। তোমরা আমার নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে। সেজন্য এখন আমি গুরুরূপে তোমাদের স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানের উপযুক্ত করে তুলবো। আমার মধ্যে সঞ্চিত জ্ঞান তোমাদের মধ্যে সঞ্চারের দ্বারা আমি তোমাদের মধ্যে মায়ার অন্ধকারকে ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে দেবো। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব মায়া কি? আমাদের মধ্যে মায়া কোথা থেকে এলো? গুরুদেব বললেন, মায়া শব্দ মী ধাতু থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। মী ধাতুর অর্থ হল বোধ করা। যে শক্তির দ্বারা ঈশ্বরের সৃজন, পালন হরণাদি বোধ হয় তাকে মায়া বলে। দেহতত্ত্বের নিয়মানুযায়ী ঈশ্বর যখন এই দেহ সৃষ্টি করেন, তখন এই দেহস্থিত আত্মার নিজ স্বরূপকে এক মায়ার আবরণ দ্বারা ঢেকে রাখেন। এই মায়ার জাল ছিন্ন না হলে আত্মার স্বরূপ জানা যায় না এবং তপস্যায়ও সফল হওয়া যায় না। গুরুর কৃপাই তোমাদের এই মায়াজাল ছিন্ন করে সত্যের সন্ধান দেবে। কিন্তু গুরুর সেই কৃপা একমাত্র একজন উপযুক্ত শিষ্যই পেতে পারেন। এই উপযুক্ত শিষ্য হবার জন্য তোমাদের গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু অবহিত হতে হবে। এই প্রকারে তিনি প্রথমে শিষ্যদের গুরু শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। তারপর বলেন, শাস্ত্রে আছে


গুরুবক্রে স্থিতা বিদ্যা গুরুভক্ত্যা চ লভ্যতে।।


অর্থাৎ জগতের প্রকৃত বিদ্যা অর্থাৎ জ্ঞান একজন সদ্গুরুর মুখে অবস্থান করে এবং তা একজন প্রকৃত গুরুভক্তই লাভ করতে পারেন। শাস্ত্রে এও বলেছে


গুরুবক্রে স্থিতং ব্রহ্ম প্রাপ্যতে তৎপ্রসাদতঃ।


অর্থাৎ গুরুর বচনে স্বয়ং ব্রহ্মা অধিষ্ঠান করেন। পরমেশ্বরই স্বয়ং সদ্গুরুর মাধ্যমে সাধকের ভিতরের সব অন্ধকারের নিরসন করে তাকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন। যোগ্যশিষ্য সদ্গুরুর থেকে সত্যতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করেন। সদগুরু কেবল একজন শিষ্য তৈরি করেন না, তিনি শিষ্যকে একজন তত্ত্বজ্ঞ জীবন্মুক্ত পুরুষে পরিণত করেন, যিনি মানব উদ্ধারকর্তা রূপে পৃথিবীর ক্লেশ লাঘব করেন। তোমরা এই গুরুতত্ত্ব সর্বদা মনে রাখবে। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবান শিষ্য সদাই জ্ঞানলাভ করে। শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞান। আমি তোমাদের মধ্যে স্বাধ্যায়ের অনুষ্ঠান নিমিত্ত সেই জ্ঞানের সঞ্চার করবো যার দ্বারা তোমরা তোমাদের মধ্যের মায়ার আবরণকে ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোর সন্ধান পাবে এবং একদিন সেই আলোয় জগৎকে আলোকিত করবে।


আচার্যদেব শিষ্যদের গুরুতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে গহন বনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে এক নির্জন পাহাড়ের গুপ্ত মুখ দেখতে পেলেন। সেই গুহার পাশেই ছিল এক গভীর খাদ। তার মধ্যে দিয়ে বহমানা এক খরস্রোতা নদী। আচার্যদেব ভাবলেন যমের অনুষ্ঠানে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের জন্য এটাই উপযুক্ত স্থান। শিষ্যদের নিয়ে তিনি ওই গুহাতেই প্রবেশ করলেন এবং বললেন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের জন্য এটাই উত্তম স্থান। কাল থেকে আমি তোমাদের এই গুহাতে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের শিক্ষা দান করব।


.


ব্রহ্মচর্য ব্ৰতানুষ্ঠান পর্ব


আচার্যদেব সকালে শিষ্যদের নিয়ে নদীতে স্নান করে এসে বললেন, আজ আমি তোমাদের ব্রহ্মচর্য ব্রত আচরণ সম্বন্ধে বলবো। আজ থেকে শুরু হবে তোমাদের কঠোর কৃচ্ছুব্রত। ব্রহ্মচর্য পালন সাধনায় মোক্ষলাভের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। ধূমের দ্বারা যেমন অগ্নি, ময়লার দ্বারা দর্পণ এবং জরায়ুর দ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে, তেমন কাম দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে। ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি এইগুলি কামের বাসস্থান। ইন্দ্রিয়াদিকে বশীভূত করতে ব্রহ্মচর্য পালন করা কর্তব্য। ইন্দ্রিয়াদিকে জয় করতে হলে মনে করতে হবে ইন্দ্রিয় থেকে মন শ্রেষ্ঠ, মন · থেকে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ এবং বুদ্ধি থেকে অতিশয় শ্রেষ্ঠ হল আত্মা। ব্রহ্মচর্য পালন করলে যোগী সেই আত্মাকে দর্শন করতে সমর্থ হয়। ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য তোমাদের নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হতে হবে। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী কঠোর যোগসাধনার সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের ব্রতগুলি পালন করে। যোগীকে ব্রহ্মচর্যে সফলতা লাভ করার জন্য ৮টি ব্ৰতানুষ্ঠান করতে হয়। সেগুলি হল-নক্তব্ৰত, একান্তরা, ত্রিরাত্র, পঞ্চাহ, নবরাত্র, দ্বাদশাহ পক্ষাহ ও মাসাহ। এখন আমি তোমাদের এই ব্রতগুলি পালনের নিয়মগুলি বলবো।


নক্তব্ৰত : নক্ততে সারাদিন উপবাসে থেকে যোগানুশীলন করতে হয়। সূৰ্য্য অস্ত গেলে নক্ষত্র দর্শন করে হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যে উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


একান্তরা ব্রত : একান্তরা ব্রত পালনের সময় একদিন ও একরাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগ সাধনা করতে হয়। তারপরদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


ত্রিরাত্র ব্রত : ত্রিরাত্র ব্রতে যোগীকে ক্রমান্বয়ে তিনদিন-তিনরাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগসাধনা করতে হয়। তারপর চতুর্থদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের অনুকূল খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


পঞ্চাহ ব্রত : পঞ্চাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি উপবাস করে যোগানুশীলনের পর ষষ্ঠ দিবসে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্ৰহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


নবরাত্র ব্রত : নবরাত্র ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে নয় দিন নয় রাত্রি উপবাস করে যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর দশম দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


নবরাত্রির ব্রত লোকনাথ ও বেণীমাধবের কাছে খুব কঠিন ছিল। ব্রহ্মচর্যাবস্থায় এত দীর্ঘদিন উপবাস থেকে যোগসাধনা করা বেশ কঠিন কাজ। লোকনাথ বাবা এই নবরাত্রিব্রত কিরূপে সমাধা করেছিলেন, সেই কথা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–উপবাসের কালে যাতে আমাদের কোনোরূপ অঙ্গ সঞ্চালন করতে না হয়, সেদিকে গুরুদেব সদা সতর্ক থাকতেন। এমনকি মল, মূত্র ত্যাগের জন্যও শরীর নড়াচড়া করতে গুরুদেবের নিষেধ ছিল। মল, মূত্র ত্যাগ করতে হলে গুরুদেব এসে জলশৌচাদি সমাধা করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ধরে তুলে পরিষ্কার স্থানে বসিয়ে দিতেন। তৎপর বিষ্ঠা দূরে ফেলে দিয়ে স্থান পরিষ্কার করতেন। এইসব কথা যখন তিনি বলেছিলেন, সেইসময় লোকনাথ বাবার নয়ন হতে অশ্রু বিগলিত হয়ে তার বক্ষ ভেসে যেত। এমন গুরু না পেলে কি এমন লোকনাথ ব্রহ্মচারী হওয়া সম্ভব হতো! একবার হিতলাল মিশ্র লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বলেছিলেন–আমরা জীবনে এমন গুরু পাই নাই।


দ্বাদশাহ ব্রত : দ্বাদশাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে বারো দিন বারো রাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর ত্রয়োদশ দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্যগ্রহণ করতে হয়।


পক্ষাহ ব্রত : পক্ষাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে এক পক্ষ অর্থাৎ পনেরো দিন পনেরো রাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর ষোড়শ দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


মাসাহ ব্রত : মাসাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে এক মাস দিবারাত্রি উপবাস করে একনিষ্ঠভাবে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর একমাস কাল অতিক্রান্তের পরদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।


আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে আরও উপদেশ দিলেন যে, তোমাদের ক্রমান্বয়ে এই ব্ৰতগুলি পালন করতে হবে। এই ব্রতানুষ্ঠানের নামই সাধনায় কৃচ্ছ্বসাধন। তোমরা ব্রতানুষ্ঠানকালে অষ্টাঙ্গ যোগের যে পাঁচটি অঙ্গ আমি তোমাদের শিখিয়েছি, সেগুলির পালন করবে। পূর্ণ একনিষ্ঠতার সঙ্গে অষ্টাঙ্গ যোগের অনুষ্ঠান এবং এই আটটি ব্রতের পালন করতে পারলে, তোমরা সাধনার পথে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। নক্তব্ৰত দিয়ে শুরু করে এক একটি ব্রত পালনে সিদ্ধ হয়ে, তবেই পরের ব্রত পালনে অগ্রসর হবে। আগামীকাল থেকেই শুরু হবে তোমাদের এই কৃছুব্রত। তোমরা তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করো।


লোকনাথ ও বেণীমাধব নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত উদ্যাপন শুরু করলেন। যোগানুশীলনের প্রতি পদে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি তাদের পথ নির্দেশ করতেন। শিষ্যদের প্রতি কাজে তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি। শিষ্যদের ব্রতানুষ্ঠানের পর খাদ্যগ্রহণ ও বিশ্রামের প্রতিও তিনি ছিলেন সর্বদাই সজাগ। ব্রত পালনের পর তাঁদের খাদ্য ছিল তিল ও দুধ দিয়ে তৈরি এক প্রকার অন্ন। পরবর্তীকালে লোকনাথ বাবা বলেছিলেন যে, এই খাদ্য খেতে তার বড়ই কষ্ট হতো।


এইভাবে তিন দশকের অধিক কাল ধরে চললো লোকনাথ ও বেণীমাধবের কঠোর কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে যোগসাধনা। লোকনাথ নক্তব্রত থেকে মাসাহ পর্যন্ত সব পর্যায়ের ব্রত পালনের পর আবার দ্বিতীয়বার মাসাহ করলেন। কিন্তু বেণীমাধব একবারই মাসাহ ব্রত পালন করেছিলেন। কঠোর তপস্যা আর কৃচ্ছ্বসাধনের মাধ্যমে ব্রহ্মচর্য ব্রতানুষ্ঠানের পর লোকনাথের শরীরে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। যোগলীণ লোকনাথের শরীর স্থির নিস্পন্দ এবং তার চক্ষু দুটি স্থির উজ্জ্বল রক্তবর্ণ। শরীর থেকে বের হচ্ছে এক উজ্জ্বল আভা। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথের এই তপোদীপ্ত শরীর দর্শন করে বুঝলেন, লোকনাথ তার স্থির লক্ষ্যের প্রতি এগিয়ে চলেছে।


একদিন লোকনাথ গুরুকে বললেন, গুরুদেব, দ্বিতীয়বার মাসাহ ব্রত করার সময় একদিন আমার মানসনেত্রে পূর্বজন্মের এক অদ্ভুত ছবি ভেসে উঠেছিল। আচার্যদেব জানতে চাইলেন, কি সেই ছবি?


লোকনাথ তখন বললেন, আমি যোগে লীণ ছিলাম। স্বপ্নের মতো দেখতে পেলাম, বর্ধমান জেলার পাশ দিয়ে দামোদর নদ বয়ে চলেছে। ওই নদের তীরে বেড়ুগাঁ নামে এক গ্রাম। সেই গ্রামে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে আমি সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে বিচরণ করছি। পরিবারে আমি সব থেকে ছোট ছেলে। অবিবাহিত। আমি কারও সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা বা কারও সঙ্গে বেশি কথা বলি না। কারও সঙ্গে কোথাও যাইও না। একা একা নির্জনে থাকতে ভালোবাসি। আমি গতজন্মে এই প্রকৃতির একজন মানুষ ছিলাম।


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি কাগজ এনে লোকনাথের বর্ণিত বৃত্তান্ত লিখে রাখলেন। তিনি বুঝলেন, লোকনাথের অভিনিবেশ অনুষ্ঠানকালে পূর্বজন্মের স্মৃতি তার মানসচক্ষে জাগরিত করতে পেরেছিল। একেই সাধনার ভাষায় বলে, জাতিস্মরতা লাভ।


গুরুদেব বুঝলেন, এই স্থানে সাধনার কাজ শেষ হয়েছে। এখন তাদের আবার এগিয়ে যেতে হবে। তাদের গন্তব্যস্থল এখনও অনেক দূর। সাধনপথে অগ্রগতির মধ্য দিয়েই সেই পথ অতিক্রম করতে হবে। তিনি লোকনাথকে বললেন, বাবা লোকনাথ, আমরা আগামীকাল এই স্থান ত্যাগ করবো। আবার শুরু হয় পথচলা এবং পথে পথে যোগসাধনা। এরপর থেকে তপস্যায় লোকনাথ তার মধ্যে দর্শন করেন তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। চলমান ছবির মতো সেই দৃশ্য তার মানসচক্ষে ফুটে ওঠে। এইভাবে যম, নিয়ম, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অঙ্গে তিনি সিদ্ধ হতে থাকেন।


.


যোগী লোকনাথের প্রতি হিংস্র জন্তুর অহিংসা প্রদর্শন


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথ ও বেণীমাধবকে নিয়ে এরপর এক বন। থেকে অন্য বনে ঘুরে যোগসাধনার উপযুক্ত একটি আস্তানার খোঁজ করতে থাকেন। একসময় তারা গভীর বনের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত কুটির দেখতে পান। আচার্যদেব ভাবলেন গভীর নির্জন বনের মধ্যে এই কুটিরে কিছুদিন অবস্থান। করে শিষ্যদের যোগসাধনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তারা কুটিরকে অবস্থানের উপযুক্ত করে কিছু ফলমূল আহার করে শয়নের ব্যবস্থা করলেন। লোকনাথ গুরুদেবকে বললেন, আপনি বেণীমাধবকে নিয়ে কুটিরের ভিতরে শয়ন করুন। আমি আজকের রাতে কুটিরের বারান্দায় শয়ন করি। আচার্যদেব লোকনাথের কথায় সম্মতি প্রদান করলেন। তিনি কুটিরের বারান্দায় একা শয়ন করলেন। গভীর রাতে সহসা কোথা থেকে একদল ডাকাত কুটিরের সামনে এসে উপস্থিত হল। তারা কুটিরের বারান্দায় লোকনাথকে অন্ধকারে দেখতে পায়নি। ডাকাতরা এই পরিত্যক্ত কুটিরটি ব্যবহার করতে নিজেদের ডাকাতি করা সম্পত্তি ভাগ করার জন্য। কুটিরের ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে তারা দেখতে পায় গৈরিকবসন পরিহিত এক সন্ন্যাসী দরজার সামনে শুয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, এখানে আবার কে শুয়ে আছে? ভাগ এখান থেকে। কিন্তু তাদের কথার কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। তখন ডাকাতেরা লোকনাথের খুব নিকটে এসে দেখতে পেল, এক তরুণ সন্ন্যাসী হাঁটুর উপর দুই বাহু প্রসারিত করে (পর্যঙ্কাসনে) শুয়ে আছে। সন্ন্যাসীর শরীর থেকে এক জ্যোতি বের হচ্ছে। তখন তারা যুক্তি করলো যে, এই তরুণ সন্ন্যাসীকে তারা হত্যা করবে। কিন্তু ডাকাত সর্দার সন্ন্যাসীকে দেখে তার সঙ্গীদের সেই ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত করলো। সে সঙ্গীদের বললো যে, এই সন্ন্যাসীকে হত্যা করলে আমাদের বিপদ হতে পারে। এ কোনো সাধারণ সন্ন্যাসী নয়। অন্য ডাকাতরা সর্দারের কথা না মেনে বললো, যদি আমরা এই সন্ন্যাসীকে ছেড়ে দিই, তবে সে অন্যদের আমাদের কথা বলে দিতে পারে। তাতে আমাদের বিপদ বাড়বে। সেজন্য একে শেষ করে দেওয়াই ভালো। এই কথা বলে একজন ডাকাত খোলা তরোয়াল নিয়ে যেই লোকনাথকে হত্যা করতে যাবে, তার হাত আর উপরে উঠলো না। সে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এবং অন্যরা সেই দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে গেল। এই সময় হঠাৎ কোথা থেকে দুটো বাঘ গর্জন করতে করতে ছুটে এলো। সর্ব ডাকাতরা ভয়ে মালপত্র ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। কেবল ডাকাত সর্দার উঠানের একপাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে দেখলো, বাঘ দুটি লোকনাথের কাছে এসে তাকে দেখে আবার বনের মধ্যে চলে গেল। ডাকাত সর্দার এই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। যোগাসনে লোকনাথ এই ঘটনার কথা জানতে পারলেন না এবং কুটিরের অভ্যন্তরে নিদ্রামগ্ন আচার্যদেব ও বেণীমাধবও এই ঘটনার কথা কিছু টের পেলেন না।


পরদিন সকালে তারা একটি লোককে কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সেই লোকটি হল ডাকাত সর্দার। লোকনাথের চরণে মাথা রেখে বললো, তুমি মানুষ নও, দেবতা। আমি ডাকাত সর্দার। গতরাতে আমার সঙ্গীদের। নিয়ে যখন এই কুটিরে আসি, তখন তোমাকে দ্বারে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আমার সঙ্গীরা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আমার এক সঙ্গী যেইমাত্র তার তরোয়াল দিয়ে তোমাকে হত্যা করতে যাবে, তার হাত আটকে গেল। আমরা সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তখন কোথা থেকে দুটো বাঘ গর্জন করতে করতে এখানে এলো। আমার সঙ্গীরা মালপত্র ফেলে বনে পালিয়ে গেল। আমি উঠানের পাশে একটি গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বাঘ দুটো তোমার কাছে এসে, তোমাকে দেখে চারিদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বনে চলে গেল। তোমার শরীর থেকে তখন এক অপূর্ব জ্যোতি বেরোচ্ছিল। তুমি সাধারণ সন্ন্যাসী নও বাবা। তুমি নিশ্চয়ই কোনো মহাযোগী। তোমার অলৌকিক শক্তির জন্যই বাঘ দুটো তোমার রক্ষায় এসেছিল।


লোকনাথ গতরাতের সব ঘটনা শুনে বিনীতভাবে আচার্যদেবকে দেখিয়ে বললেন, আমার কোনো শক্তি নেই। আমার এই গুরুদেবই আমার সকল শক্তির উৎস। তিনি যা শিখিয়েছেন, আমি তাই শিখেছি। ডাকাত সর্দার তখন আচার্যদেবকে বলল, আমার অনেক ভাগ্যে আমি আপনাদের মতো পুণ্যবান লোকেদের দেখা পেলাম। আমি আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। আচার্যদেব তাকে আশীর্বাদ করে বললেন, আর কখনও ডাকাতি কোরো না। সত্তাবে সংসার প্রতিপালন করো। আচার্যদেব এই ঘটনায় বুঝতে পারলেন যে, লোকনাথ বহিরঙ্গ যোগে সিদ্ধিপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। হিংস্র বাঘের তাঁর প্রতি অহিংস আচরণ করা লোকনাথের যোগবিভূতির পরিচয়।


এরপর একদিন লোকনাথ আচার্যদেবকে বললেন, গুরুদেব, আজ আমি সারারাত যোগাসনে থাকবো। আপনি ও বেণীমাধব আমার পাশে শুয়ে ঘুমোবেন। রাতে গহন বনে হিংস্র জীবজন্তুর নানাবিধ আওয়াজ কুটিরের পরিবেশকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। চারিদিকে অন্ধকার। লোকনাথ কুটিরের ভিতর যোগাসনে ধ্যানমগ্ন। আচার্যদেব ও বেণীমাধব তার পাশে শুয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। ব্রাহ্মমুহূর্তে আচার্যদেব গাত্রোত্থান করলেন ও বেণীমাধবকে জাগ্রত করলেন। ঘুম থেকে উঠে তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন একটা প্রকাণ্ড বিষধর সাপ লোকনাথের গলা জড়িয়ে আছে। লোকনাথ নিশ্চলভাবে গভীর ধ্যানে মগ্ন। তাদের বাক্যস্ফুট হল না। কিছুক্ষণ এই দৃশ্য অবলোকন করার পর সাপটি ধীরে ধীরে লোকনাথের কণ্ঠ থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পরে লোকনাথের বুক্ষণ হল এবং তিনি এই ঘটনার কথা গুরুদেবের কাছে শুনলেন। আচার্যদেব বুঝতে পারেন যে, লোকনাথ অষ্টাঙ্গ যোগের যম-এর অনুষ্ঠান সফলভাবে করতে পারার জন্য অষ্টাদশ সিদ্ধির এক সিদ্ধি, যথা প্রাপ্তিসিদ্ধি লাভ করেছেন। সিদ্ধিলাভের পথে তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। যোগের অষ্টাদশ সিদ্ধিই প্রাপ্ত হতে হবে লোকনাথকে। আচার্যদেব মনে করলেন, গভীর বনে হিংস্র জন্তুর মাঝে যোগাসনে সফল হয়েছেন লোকনাথ। এখন আবার এগিয়ে যেতে হবে। তার পরবর্তী লক্ষ্য এটা পরীক্ষা করে দেখা যে, মাসাহ ব্রতের সময় লোকনাথ তাঁর পূর্বজন্মের যে কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন, সেটা সত্য কিনা। যদি সত্য হয়, তবে বোঝা যাবে, সে দেহের পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে সমর্থ হয়েছে।


.


লোকনাথের পূর্বজন্মের সত্যতা যাচাই


বনের কুটির ছেড়ে আবার শিষ্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি। বেশ কিছুদূর চলার পর তাদের সামনে একটি নদী দৃশ্যমান হল। আচার্যদেব লোকনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, কখনও যোগাসনে তুমি এইরকম কোনো জায়গা দেখেছ কি? লোকনাথ ভালো করে চারিদিক অবলোকন করে গুরুদেবকে বললেন, মনে হয় দ্বিতীয় মাসাহব্রতের সময় তিনি এইরকম জায়গাই দেখেছিলেন। তার মনে হয়, যোগাসনে দেখা সেই নদীই এই দামোদর নদ। এরপর তারা তিনজন লোকালয়ে প্রবেশ করে বেড়ুগাঁর সন্ধান করতে লাগলেন। কিছুদূর লোকালয়ে এগিয়ে লোকনাথ নিজেই বেডুগাঁ চিনতে পারলেন। আচার্যদেব সেই গ্রামের কতিপয় বৃদ্ধদের জিজ্ঞাসা করতে তারা সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতে পারলেন। সেই বৃদ্ধেরা সীতানাথের পরিবারের সম্বন্ধে যখন বলতে লাগলেন, তখন লোকনাথের তাঁর পূর্বজন্মের সব কথা মনে পড়তে লাগলো। এই গ্রামে জন্মের পর থেকে দেহপাত পর্যন্ত তিনি যা যা করেছিলেন, সব তার স্মরণ হতে লাগলো। এই ঘটনা থেকে আচার্যদেব নিশ্চিত হলেন যে, লোকনাথ দ্বিতীয় মাসাহ ব্রতের সময় তাঁর পূর্বজন্মের যে কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন, সে কোনো স্বপ্ন নয়, সেটা হল তার অভিনিবেশ ক্লেশকে ক্ষয় করার উদাহরণ। দেহের পঞ্চক্লেশ যতক্ষণ ক্ষয় না হয়, সাধক সাধনার উচ্চমার্গে প্রবেশ করতে পারে না। এই পঞ্চক্লেশের মধ্যে অভিনিবেশ ক্লেশ ক্ষয় হলেই সাধক তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। বেডুগার ঘটনা প্রমাণ করে যে, লোকনাথ পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে পারায় তার মধ্যে পূর্বজন্মের স্মৃতি উন্মোচিত হয়েছে। এখন অষ্টাঙ্গ যোগের বহিরঙ্গ যোগসাধনের অন্য অনুষ্ঠান গুলিতে সফল হলে তবেই সে অষ্টাদশ সিদ্ধির পথে এগোতে পারবে। তাদের যোগসাধনার যাত্রা যে সঠিক পথে হচ্ছে, বেডুগাঁয়ে আচার্যদেব সেই সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন।


.


বনের মন্দিরে কালীসাধকের সঙ্গে সাক্ষাৎ


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আবার শুরু হয় পথ চলা। লোকালয় ছেড়ে শিষ্যদের নিয়ে আবার তিনি বনপথ ধরেন। গহন অরণ্যে পথ চলতে চলতে একটি আশ্রমের সন্ধান পাওয়া যায়। আচার্যদেব সেই আশ্রমেই কিছুদিন থাকার সংকল্প করেন। জনকোলাহলশূন্য বনের মধ্যেই এখন যোগসাধনার উপযুক্ত স্থান বলে গুরুদেব মনে করেন। চতুর্দিকে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের মাঝে নানারকম কীটপতঙ্গের শব্দের মধ্যে বসে একনিষ্ঠ যোগসাধনায় শিষ্যদের তিনি মগ্ন হতে বলেন।


এইসময় একদিন বনের মধ্যে বিচরণ করতে করতে লোকনাথ একটি কালীমন্দিরের দর্শন পান। তিনি জানতে পারেন যে, সেই মন্দিরের সেবক একজন কালীসাধক। ওই সাধক কালীসাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি কোনো আচার মানেন না। মা কালী তার সঙ্গে কথা বলেন। একদিন তিনি সেই কালীসাধককে দেখতে পান। তিনি সেই সাধককে জিজ্ঞাসা করেন, মা কি তোমার সঙ্গে কথা বলেন? সেই সাধক লোকনাথের কথা শুনে পাগলবৎ উচ্চহাস্য করে বলেন, মা আমার সঙ্গে কথা বলে বৈকি! মা তার ছেলের সঙ্গে কথা কইবে না? লোকনাথ তখন তার কাছে আবদার করেন, তার হয়ে একটি কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতে। সেই সাধক লোকনাথকে দেখে বুঝতে পারেন যে সেও একজন যোগী। সাধক রাজি হন। লোকনাথ বলেন, তুমি মার কাছে জিজ্ঞাসা কোরো আমি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করতে পারবো কি না? সেখানকার দারুণ শীত আমার সহ্য হবে কি না? সাধক মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। লোকনাথ শুনতে পান, মা বলছেন, তুমি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করতে পারবে। শীত সহ্য হবে। লোকনাথ অবাক হয়ে সাধককে বলেন, আমি মাকে একটা প্রশ্ন করবো? সাধক বলেন, করে দেখ। লোকনাথ এইবার নিজে প্রশ্ন করেন, আমি কি হিমালয়ে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করতে পারবো? মার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। লোকনাথ ভাবতে থাকেন, সাধক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তখন মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, কিন্তু মা তার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝলেন, এই সাধক সিদ্ধিপ্রাপ্ত। তিনি নিজে এখনও সেই স্তরে উন্নীত হতে পারেন নি। তিনি তখন সেই সাধককেই অনুরোধ করেন, তার হয়ে প্রশ্নটা মাকে করতে। সাধক হেসে লোকনাথের প্রশ্নটা মাকে নিবেদন করেন। এবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, হ্যাঁ, হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ ঘটবে। এই ঘটনা লোকনাথের মনে প্রবল বল সঞ্চার করে। তিনি পূর্ণ উদ্যমে গভীর সাধনায় মগ্ন হন। তাঁর সাধনার প্রতি সদা জাগ্রত দৃষ্টি রাখেন আচার্যদেব।


.


প্রণবরূপী শব্দব্রহ্ম সাধনা


একদিন লোকনাথ গুরুদেবের কাছে প্রণবরূপী শব্দব্রহ্ম সাধনা সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আচার্যদেব তাকে বলেন, মানুষ জন্মসময়ে শুদ্ৰজাতি থাকে, উপনয়ন সংস্কারান্তে দ্বিজ হয় এবং যখন সে বেদপাঠ করে তখন তাকে বিপ্ৰ বলে। বিপ্র যখন ব্রহ্ম অর্থাৎ প্রণবকে জানতে পারে, তখন তাকে ব্রাহ্মণ বলে। একজন বিপ্র তখনই ব্রাহ্মণ হন, যখন তিনি প্রণবরূপী ওঁকারকে জানতে সমর্থ হন। এই প্রণবরূপী ওঁকারই ব্রহ্ম। ওঁকার ব্রহ্মের শব্দপ্রতীক। ব্রহ্মের ধ্যেয়মূর্তি। ওঁকার সহায়ে ব্রহ্মের ধ্যান করলে জীবের ক্রমমুক্তি হয় এবং ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হয়।


ব্ৰহ্ম দুই প্রকার–পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্ম।


 ব্ৰহ্ম যখন নিষ্ক্রিয় থাকেন অর্থাৎ যখন তিনি প্রকৃতিতে আরোপিত হন না, তখন তাকে পরব্রহ্ম বলা হয়। ব্ৰহ্ম যখন প্রকৃতি স্বরূপ হয়ে সৃষ্টি করতে থাকেন, তখন তাকে অপরব্রহ্ম বলা হয়। এই পরব্রহ্ম ও অপর ব্রহ্মের সমষ্টিকে মহাপ্রণব বলা হয়। তোমাদের এই মহাপ্রণবের জ্ঞান আত্মস্থ করে প্রণব জপের মাধ্যমে ব্রহ্মের ধ্যান করতে হবে।


আচার্যদেব শিষ্যদের বলেন, এতদিন তোমরা প্রাণায়ামকালে প্রণবের প্রকৃত অর্থ না জেনে প্রণবমন্ত্র জপ করেছ। প্রাণায়াম অভ্যাসের প্রাথমিক অবস্থায় এইরূপ করে তোমরা প্রাণায়াম পদ্ধতিতে উৎকর্ষ লাভ করেছ। আমি তোমাদের পূর্বে কেবলওঁকার মন্ত্রের তিন বর্ণের অর্থ বলেছিলাম। কিন্তু ওঁকারের প্রকৃত অর্থ আরও ব্যাপক। আমি তোমাদের এখন ‘ওঁ’ কার মন্ত্রের সেই প্রকৃত অর্থ বলবো।


তোমরা জেনেছ ‘ওঁ মন্ত্র তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত-অ-উ-ম। এই মন্ত্রে অ-কারের অর্থ জগতের পালনকর্তা, উ-কারের অর্থ জগতের সংহারকর্তা এবং ম-কারের অর্থ জগতের সৃষ্টিকর্তা। এই তিনবর্ণের মিলিত শব্দ ওঁ-কে মহাপ্রণব বলা হয়। সুতরাং ওঁ শব্দ হল পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্মের সমষ্টি।


এই ওঁ-কারের সাতটি অঙ্গ, চতুষ্পদ, ত্রিস্থান এবং পঞ্চদেবতা আছে। ওঁ-কারের সাতটি অঙ্গ হলো–অ-কার, উ-কার, ম-কার, নাদ, বিন্ত, মূল, প্রকৃতি এবং কলাতীত। ওঁ-কারের চতুস্পদ হলোস্থূল, সূক্ষ্ম, বীজ এবং সাক্ষী। ওঁ-কারের ত্রিস্থান হলো-জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা এবং সুষুপ্তি অবস্থা। ওঁ-কারের পঞ্চদেবতা হলন–ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ঈশ্বর ও মহেশ্বর।


ওঁকারের এই প্রকৃত ও বহু ব্যাপক অর্থ জেনে যিনি ওঁকারের অর্থাৎ প্রণবের ধ্যান করেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানতে পারেন। এই প্রণব ধ্যান বা জপ কেবল ওঁ শব্দ উচ্চারণ নয়। ওঁ মন্ত্র যখন সাধকের যচক্র ভেদ করে দেহের সত্যলোকে পৌঁছায়, তখন তার ব্রহ্মদর্শন হয়। মানবদেহের মস্তকে সত্যলোক অবস্থিত।


এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মানবদেহের বিভিন্ন অংশে পরলোকের বিভিন্ন ভাগের অবস্থান আছে। ব্রহ্মাণ্ডের চতুর্দশভূবন এই মানবদেহে অবস্থান করে। তার মধ্যে নাভিদেশে ভূলোক, হৃদয়ে ভূবলোক, কণ্ঠদেশে স্বর্গলোক, চক্ষুদ্বয়ে মহর্লোক, চক্ষুদ্বয় ও ললাটের মাঝে জনলোক, ললাটে তপলোক এবং মস্তকে সত্যলোকের অবস্থান। কোনো সাধক যখন ওঁ মন্ত্রের অর্থাৎ প্রণবের উপাসনা করেন তখন তার উচ্চারিত ওঁ মন্ত্রের ধ্বনি দেহস্থিত ব্রহ্মাণ্ডের এই সকল ভবনে ধ্বনিত হয়ে ষট্‌চক্র ভেদ করে সত্যলোকে পৌঁছায় এবং সেখানে ব্রহ্মলোক স্ফুটিত হয়। সেইজন্য সাধকের দেহতত্ত্ব জ্ঞান বিনা মহাপ্রণবের উপাসনা সফল হয় না।


লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবের এই ওঁ-কারতত্ত্ব আলোচনায় খুবই উৎসাহিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এই সম্বন্ধে আরও জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ বেড়েছে। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, মানবদেহ সৃষ্টির গুঢ় তত্ত্ব না জেনে ব্রহ্মের সাধনায় সফল হওয়া যায় না। সাধনার গুঢ়তম তত্ত্ব এই মানবদেহের মধ্যেই নিহিত আছে। তারা ঠিক করলেন, পরের দিন গুরুদেবের কাছে ষট্‌চক্রতত্ত্ব রহস্য সম্বন্ধে আরও জানতে চাইবেন।


.


মানবদেহের ষটচক্র তত্ত্বশিক্ষা


পরদিন আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে আলোচনায় বসতেই লোকনাথ ও বেণীমাধব তার কাছে মানবদেহের ষট্‌চক্রতত্ত্ব ও ষট্‌চক্র ভেদের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়ের আগ্রহে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে মানবদেহের ষট্‌চক্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন।


মানবদেহের মেরুদণ্ডের মধ্যস্থলে একটি সুষুম্ননাড়ী আছে। এই নাড়ী দেহের গুহ্যমূল থেকে মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত প্রসারিত। মেরুদণ্ডের মজ্জার সঙ্গে যে স্থানে মস্তিষ্কের মজ্জার সংযোগ ঘটেছে, সেই স্থানের নাম আজ্ঞাচক্র। সুষুম্না নাড়ী এই স্থান থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়েছে। আজ্ঞাচক্র থেকে ললাটের সম্মুখদিকের অভ্যন্তরপথে অর্ধবৃত্তাকারে ব্রহ্মরন্ধের কাছে নাড়ীর একটি মুখ এবং আজ্ঞাচক্রের পিছন দিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে অপর পাশে গিয়েছে নাড়ীর আর একটি মুখ। ব্রহ্মতালুদেশে এই দুই মুখের মধ্যস্থলে ব্রহ্মরন্ধ্র অবস্থিত। ব্রহ্মর কথার অর্থ যে রন্ধ্র অর্থাৎ ছিদ্রপথে পরমাত্মা শরীরের মধ্যে জীবাত্মারূপে প্রকট হন বা যেখান দিয়ে জীবাত্মার উক্ৰমণ ঘটে। সুষুম্না নাড়ীর এই দুই ভাগের নাম উত্তরা সুষুম্না ও অপরা সুষুম্না। আজ্ঞাচক্রের নিচের যে ষট্‌চক্রের অংশগুলি অবস্থিত, সেগুলি দক্ষিণায়নের পর্ব। এইজন্য ষট্‌চক্রের পঞ্চচক্র পর্যন্ত ভেদ করে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত যোগী উঠতে পারলেও যোগীকে দক্ষিণায়নের পথে এই মরদেহ ত্যাগ করতে হয় এবং সেক্ষেত্রে যতই সিদ্ধি সে আয়ত্তে আনতে পারুক না কেন, তাকে আবার কিছুকাল পরে পুনর্জন্ম লাভ করতে হয়। যোগী যদি আজ্ঞাচক্রের উপরে উঠতে সমর্থ হয় অর্থাৎ উত্তরা সুষুম্না পথে সহস্ররে উঠতে সমর্থ হয়, তবে সে উত্তরায়ণের পথে তার জীবাত্মাকে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উক্ৰমণ করতে সমর্থ হয় এবং সেই পথে সে ব্রহ্মলোকে পৌঁছতে সমর্থ হয়। উত্তরা সুষুম্না হল ব্রহ্মমার্গ। নর্মদা পরিক্রমাকালে গুজরাটের নর্মদাতটে উত্তরেশ্বর লিঙ্গের কাহিনী যখন জেনেছিলাম, তখন বুঝেছিলাম উত্তরেশ্বর লিঙ্গের উৎপত্তি হয়েছিল ব্রহ্মবিদ্যার মূর্ত বিগ্রহ ভগবান সনকুমারের তপস্যাবলে এবং নর্মদা পরিক্রমাকারী উত্তরেশ্বরের তপস্যা করলে ব্রহ্মবিদ্যার এই পথের সন্ধান পাওয়া যায় এবং সাধক উত্তর সুষুম্না পথেরও সন্ধান পান। বাবা লোকনাথ এই উত্তর সুষুম্না পথেই উক্রমণ করেছিলেন।


যোগীকে নিজের শরীরাভ্যন্তরের ব্রহ্মমার্গের সন্ধান পেতে গেলে এই সুষুম্ন নাড়ীর মাধ্যমে কিভাবে ষট্‌চক্র ভেদ করে ব্রহ্মজ্যোতি আজ্ঞাচক্রে ভোলা যায়, সেই প্রক্রিয়া শিখতে হয়।


সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে একটি নাড়ী আছে যার নাম চিত্ৰাণী এবং সেই চিত্রাণী নাড়ীর অভ্যন্তরে আর একটি সুক্ষ্ম নাড়ী আছে যার নাম ব্রহ্মনাড়ী। এই সুষুম্ন নাড়ী একটি শুক্লবর্ণ নাড়ী যার ছয়টি গ্রন্থি আছে। এই ছয়টি গ্রন্থিকে ছয়টি চক্র বা ষট্‌চক্র বলে। মেরুদণ্ডের নিচে গুহ্যমূল থেকে মস্তক পর্যন্ত বিস্তৃত সুষুম্না। নাড়ীর ক্রমান্বয়ে গ্রন্থিগুলি হল—


(১) মূলাধার–এখানে দেহের ক্ষিতিতত্ত্ব নিহিত আছে। এই মূলাধার চক্রে কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত অবস্থায় বা সুপ্তাবস্থায় চতুর্দল পদ্মমধ্যে থাকে।


 (২) স্বাধিষ্ঠান–এখানে দেহের জলতত্ত্ব নিহিত আছে। মানবের যৌনসম্ভোগজনিত বৃত্তিগুলি এখানে ষড়দল পদ্মমধ্যে অবস্থিত।


(৩) মণিপুর–এখানে দেহের তেজতত্ত্ব নিহিত আছে। এটি মানবদেহের নাভীমূল। এখানে খাদ্য ও পানীয়জনিত বৃত্তিগুলি দশদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।


(৪) অনাহত–এখানে দেহের বায়ুজনিত তত্ত্বগুলি নিহিত আছে। এখানে মানবের দর্প, দম্ভ, অহঙ্কার, সন্দিগ্ধতা, মান-অভিমানজনিত বৃত্তিগুলি দ্বাদশদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।


(৫) বিশুদ্ধ–এখানে দেহের আকাশতত্ত্ব নিহিত আছে। এটি মানবদেহের ঘাড়ের কাছে অবস্থিত। এখানে মানবের পূজা-পাঠ, তীর্থভ্রমণ, তীর্থস্থান, উপবাসাদি জনিত বৃত্তিগুলি সোড়শদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।


(৬) আজ্ঞাচক্র–ইহা ভগবদ্ভুমি। ললাটে দ্বিদল পদ্মমধ্যে অবস্থিত।


 (৭) মস্তক–যচক্রের উপরে মস্তকে ব্রহ্মাণ্ডের সত্যলোক অবস্থিত। এখানে অধোমুখ সহস্রদল পদ্মকর্ণিকা মধ্যে পরমাত্মার নিবাস। ঈশ্বর যখন দেহসৃষ্টি করেন, তখন এই সহস্রদল পদ্মকর্ণিকা মধ্যে নিজের অর্থাৎ নিজ অংশের প্রবেশ ঘটান।


কোনো আত্মা যখন পরলোক থেকে ইহলোকে একটি শরীরকে আধার করে অবতীর্ণ হয়, তখন সেই আত্মার মধ্যে যে জীবাত্মা থাকে তাকে নিবাত দ্বীপশিখার মতো চিন্তা করে সুষুম্না পথে হৃদয় থেকে এনে মূলাধারে কুলকুন্তলিনীর সঙ্গে একীভূত করতে হয়। যোগীগণ গুরুর নিকট যোগশিক্ষা করে এই কাজে সমর্থ হয়। তারপর যোগবলে সেই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে এক একটি চক্রে নিহিত প্রবৃত্তি গুলিকে জয় করে চক্র ভেদ করে উপরে উঠতে হয়। এইভাবে ছয়টি চক্র ভেদ করে যখন কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে পৌঁছায়, তখন ভগবৎদর্শন লাভ হয়। আজ্ঞাচক্রে পৌঁছবার আগে বিশুদ্ধচক্রে মানবকে ধর্মের মায়ার আবরণে এমন ভাবে ভুলিয়ে রাখে যে সে কেবল পূজা-পাঠ ও তীর্থভ্রমণ করে সন্তুষ্টিতে ভোগে। যোগীরা অনেক সময় এইভাবে স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানেই আটকে যান। তাহলে আর আজ্ঞাচক্রে পৌঁছে ভগবৎ দর্শন লাভ হয় না। যিনি নিজের সাধনার দ্বারা এই মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে বিশুদ্ধচক্র ভেদ করে আজ্ঞাচক্রে পৌঁছতে পারেন, তিনিই ভগবৎ দর্শনের অধিকারী হন।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতীর কাছে যোগশিক্ষা প্রদানকালে প্রকাশ করেছিলেন যে, কুলকুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে মেরুদণ্ডের অভ্যন্তরদেশে ক্রমে ক্রমে ছয়চক্র ভেদ করে অতিক্রম করে সহস্রাধারে অর্থাৎ মস্তিষ্কমধ্যে প্রবেশ করালে যোগী বিশেষ আনন্দ অর্থাৎ পরমানন্দ অনুভব করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় যোগী তাঁর আত্মাকে সুষুম্না নাড়ীর মস্তিষ্কস্থিত মুখ থেকে অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে দেহ থেকে সূক্ষ্মভাবে বর্হিবিশ্বে নিয়ে যেতে পারেন আবার সেই পথে তার নিজের দেহে ফিরিয়ে আনতে পারেন। বাবা লোকনাথ অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে এই কাজ সুচারুরূপে করতে সক্ষম হতেন। অনেক যোগী হয়তো ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আত্মাকে বহির্গত করতে সক্ষম হন কিন্তু আবার সেটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন না। তখন সেই আত্মা ব্রহ্মলীণ হয়।


যোগী যখন ষট্‌চক্র ভেদ করতে করতে উপরের দিকে উঠতে থাকেন তখন সুষুম্না নাড়ীর অভ্যন্তরে ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে এক প্রকার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হতে থাকে। একে আধ্যাত্মিক ভাষায় ব্রহ্মতেজের জাগরণ বলে। যখন ষট্‌চক্র ভেদ প্রক্রিয়ায় যোগী আজ্ঞাচক্রে পৌঁছতে সমর্থ হন, তখন ব্রহ্মনাড়ীর সেই স্ফুলিঙ্গ দুই ভ্রু-র মধ্যস্থলে আজ্ঞাচক্রে দিব্যজ্যোতির আকারে দর্শন হয়। এরপর যোগীর জীবাত্মা মস্তকস্থিত সহস্ৰারে পরমাত্মাকে দর্শন করে পরম আনন্দ অনুভব করেন।


তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে সহস্রধারে পরমাত্মা দর্শনের জন্য আর একটি বিদ্যার কথা জেনেছিলাম। তার নাম শাম্ভবী বিদ্যা বা শাম্ভবী মূদ্রা। শাম্ভবী মূদ্রা প্রকৃতপক্ষে শিব সাধনা। এই বিদ্যায় চিন্তা করা হয় যে সদাশিব সকল মানবের ইষ্টদাতা এবং মুক্তির জনক। তিনিই একমাত্র মানবের মুক্তিদাতা। কোনো মানব যদি ইহজীবনে পরমেশ্বরের পরমতত্ত্বের অনুভূতি পেতে চান বা নিজের মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করতে চান বা দর্শনের পরম আনন্দসাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চান, তবে তাকে জন্মমল, কর্মর্মল ও আণবমলের করালগ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে অমৃতপদে স্থান পাবার জন্য শাম্ভবী বিদ্যার প্রয়োগ করতে হবে। এই শাম্ভবী মুদ্রার প্রয়োগে সকলের অধিকার জন্মায় না। যে যোগীর খেচরী মুদ্রা আয়ত্তে আছে, সেই কেবল শাম্ভবী মুদ্রা প্রয়োগের অধিকারী। খেচরী মুদ্রা সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য যে, নর্মদা পরিক্রমাকালে জানা যায় যে খেচরী মুদ্রা হল এক বিশেষ প্রকার যৌগিক ক্রিয়া যার প্রয়োগে শিবদর্শন হয়। প্রক্রিয়াটি হল জিহ্বাকে লম্বা করে উল্টোদিকে আলজিহ্বার উপর দিয়ে তালুমধ্যে প্রবেশ করিয়ে সহস্রাধার মণ্ডলের দিকে ঊর্ধদিকে রেখে অবস্থান করা। এই ক্রিয়ায় সাধকের শিবদর্শন হয়। নর্মদাতটে যোগীগণ এই ক্রিয়ার প্রয়োগ করে থাকেন।


শাম্ভবী মুদ্রায় জিহ্বাকে অবলীলাক্রমে দুই ভ্র-মধ্যস্থ স্থানে স্পর্শ করাতে হয়। যোগাসনে বসে যোগী জিহ্বাকে তালুর অভ্যন্তর দিয়ে উপরদিকে কপালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে স্থির দৃষ্টিতে অবস্থান করবেন। তারপর দুই ভ্র-মধ্যস্থ স্থান পলকহীন ভাবে স্থির দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে একাগ্রভাবে নিজ জীবাত্মাতে এক জ্যোতি অবলোকন করবে। এর নাম শাম্ভবী মুদ্রা। এটা জানা যায় যে, এই মুদ্রা প্রয়োগের সময় যোগীর দুই চোখের মণিদ্বয় একপাশে এনে ঊর্ধ্বনেত্রে জ্ব-দ্বয়ের মধ্যবিন্দুকে লক্ষ্য করতে হয় (আজ্ঞাচক্র)। যোগী প্রথমে বাঁ চোখের মণি ডানপাশে এবং ডান চোখের মণি বাঁ পাশে এনে মধ্যস্থ স্থলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তারপর প্রাণায়ামের নিয়ম অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যোগী তাঁর আজ্ঞাচক্রে জ্যোতির প্রকাশ ঘটান। একজন সিদ্ধ যোগী এই জ্যোতির মধ্যে পরমেশ্বরের চিদানন্দরূপ দর্শনে সমর্থ হন এবং তার চৈতন্য সত্তায় মন ডুবে গিয়ে সমস্ত জগৎ একাকার হয়ে যায়। তখন তার হৃদয়ে কেবলই পরমানন্দ। সাধক এই অবস্থায় নিজ জীবাত্মাকে এক জ্যোতিস্বরূপ দেখতে সমর্থ হন এবং সেই জ্যোতির মধ্যে পরমাত্মা দর্শন করে সদানন্দভাবে বিভোর হয়ে থাকেন।


এই বিদ্যা জেনেছি, কিন্তু নিজে প্রয়োগ করার চেষ্টা করিনি। শাম্ভবী বিদ্যার উল্লেখ এইখানে এইজন্য করলাম যে, যারা বাবা লোকনাথের ছবিকে অন্তর দিয়ে দেখবেন, তারা লক্ষ্য করবেন বাবার চোখের মণি প্রায়শই শাম্ভবী মুদ্রায় অবস্থান করতো এবং তার চক্ষু পলকহীন স্থির থাকতো। মনে হতো যেন তিনি কোনো দূরঅন্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। তিনি অনেক সময় শাম্ভবী মুদ্রায় পরমেশ্বরের সঙ্গে ব্রহ্মজ্যোতিতে পরমানন্দে অবস্থান করতেন। যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যোগশিক্ষা দেবার কালে এই শাম্ভবী মুদ্রার উল্লেখ করেছিলেন। নিজ পঞ্চভূত দেহ মধ্যে ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করার এটিও একটি পথ।


যচক্র ভেদ ক্রিয়া মানবদেহের ভূতশুদ্ধির একটি অঙ্গ বচ্চক্রভেদক্রিয়ার জ্ঞান লাভ করে লোকনাথ আচার্যদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব, ভূতশুদ্ধি কি?


.


ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা


আচার্যদেব বললেন, আমাদের শরীরের ভিতর পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি দ্বারা গঠিত আর একটি শরীর আছে যাকে সূক্ষ্মশরীর বা লিঙ্গশরীর বলা হয়। চক্ষুদ্বারা একে দেখা যায় না। যোগীরা যোগবলে এই লিঙ্গশরীর দর্শন করতে সমর্থ হন। এই লিঙ্গশরীরকে শোধন করার প্রক্রিয়ার নাম ভূতশুদ্ধি। আমি প্রথমে তোমাদের মানবদেহস্থিত পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চপ্রাণের পরিচয় দিচ্ছি।


লিঙ্গশরীর গঠন উপাদানের পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় হল–চক্ষু, কর্ণ, নাসিক, জিহ্বা ও ত্বক। এগুলির দ্বারা আমরা পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ভোগ ও অনুভব করি।


পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় হল–বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ। এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় সংযত করে যোগীরা কর্মযোগে রত হন।


মানব শরীরে পঞ্চপ্রাণ অবস্থিত। এই পঞ্চপ্রাণগুলি কি এবং মানব শরীরে এরা কি কি কাজ করে, আমি তোমাদের সে কথা বলছি।


(১) প্রাণ–শরীরের কণ্ঠ থেকে হৃদয় পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে তাকে প্রথম প্রাণ বলা হয়। এই প্রাণ নাসিকাপথ, স্বরযন্ত্র, বাক-ইন্দ্রিয়, অন্ননালী, শ্বাস-তন্ত্র, ফুসফুস এবং হৃদয়কে ক্রিয়াশীল রাখে এবং শক্তি প্রদান করে।


(২) অপান–নাভির নিচ থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে, তাকে অপান বলে। এই অপান বায়ু তলপেট থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্রিয়াশীল রাখে।


(৩) উদানকণ্ঠের উপর থেকে মস্তক পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে, তাকে উদান বলে।


কণ্ঠের উপরের অঙ্গ যথা-নেত্র, নাসিকা এবং মুখমণ্ডলকে তেজ ও আভা প্রদান করা এই বায়ুর কাজ। এছাড়া উদান বায়ু মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীলতা প্রদান করে।


(৪) সমান-হৃদয়ের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত শরীরে যে বায়ু কাজ করে, তাকে সমান বলে। হৃদয়ের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত যকৃৎ, অন্ত্র, প্লীহা এবং অগ্নাশয় সমেত সম্পূর্ণ পাঁচন তন্ত্রের আভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালীকে এই বায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।


(৫) ব্যান–ব্যান প্রাণ সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত থেকে শরীরের সব গতিবিধিকে নিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রিত করে। শরীরের সব অঙ্গ, মাংসপেশী, তন্তু, সন্ধি এবং নাড়ীর ক্রিয়াশীলতা রক্ষা করা এবং শক্তি প্রদান করাই ব্যান বায়ুর কাজ।


এই পঞ্চপ্রাণের অতিরিক্ত শরীরে পঞ্চউপপ্রাণও থাকে। যেমন–দেবদত্ত, নাগ, কৃংকল, কৃর্ম এবং ধনঞ্জয়। এই উপপ্রাণগুলি যথাক্রমে হাঁচি, চোখের পলক ফেলা, হাই তোলা, চুলকানো, হেঁচকি তোলা ইত্যাদি ক্রিয়াগুলিকে সঞ্চালিত করে।


যে পঞ্চপ্রাণ ও উপপ্রাণের কথা বলা হল, এদের কাজগুলি শরীরের কোষের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রাণায়াম অভ্যাস এইসব প্রাণেদের এবং প্রাণময় কোষগুলির শুদ্ধতা, সুস্থতা এবং নীরোগ রাখার কাজ করে। যে যোগী প্রাণের এই কাজগুলি সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হয়ে প্রাণায়ামাভ্যাস করে, সে দেহের সমস্ত কোষগুলিকে সাধনার উপযুক্ত শুদ্ধ ও সুস্থ রাখতে সমর্থ হয়। যোগীগণ ভূতশুদ্ধি যোগের দ্বারা লিঙ্গশরীর শোধন করে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বাবা লোকনাথ নাগ উপপ্রাণ নিয়ন্ত্রণে উৎকর্ষতা লাভ করে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারতেন।


ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগী তার দেহের লিঙ্গশরীর এবং নিজ পঞ্চভূত দ্বারা নির্মিত দেহকে শুদ্ধ করে থাকেন। এটি একটি অনন্য যৌগিক ক্রিয়া। মানবদেহ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূতের দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এখানে


ক্ষিতি অর্থ–মাটি, পৃথিবী।


অপ অর্থ–জল


তেজ অর্থ-শক্তি, আলোক, শুক্র, রেতঃ


মরুৎ অর্থ–দেবতা,


বায়ু ব্যোম অর্থ–আকাশ, জল, নভোমণ্ডল


ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় মানবদেহের উপাদান এই পঞ্চভূতকে মস্তকস্থিত পরমাত্মার সঙ্গে সংযোগ করা হয়।


.


শাস্ত্রসম্মত ভূতশুদ্ধি পদ্ধতি


যোগী প্রথমে রং মন্ত্র উচ্চারণের দ্বারা তার চারিদিকে জলের ধারা দিয়ে এক বহ্নি প্রকার তৈরি করবে যেন মনে হয় সে চতুর্দিকে বহ্নিদ্বারা বেষ্টিত হয়ে বসে আছে। তারপর সে দুই হাত চিৎ করে উপর্যুপরি কোলের উপর রেখে সোহহং মন্ত্রে হৃৎপ্রদেশস্থ জীবাত্মাকে মূলাধারস্থিত কুলকুণ্ডলিনীর সঙ্গে সুষুম্নাপথে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞা নামক ষট্‌চক্র ভেদ করে শিরোস্থিত অধোমুখ সহস্রদল কমলের কর্ণিকামধ্যস্থ পরমাত্মাতে সংযোগ করবে। অতঃপর সেখানে দৈহিক পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ, শব্দ, নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, ত্বক, কর্ণ, বাক্, হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ, প্রকৃতি, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার–এই চতুর্বিংশতিতত্ত্বকে বিলীন ভাবনা করে অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা বাম নাসা রোধ করে যং নামক বীজ চিন্তা করে ১৬ বার বাম নাসা দিয়ে বায়ু গ্রহণ করে সমস্ত দেহ আপূরণ করতে হবে। তৎপর উভয় নাসা বন্ধ করে কুম্ভক অবস্থায় ওই যং মন্ত্রটি ৬৪বার জপ করতে করতে পাপ পুরুষের সঙ্গে নিজদেহ শোষণ হচ্ছে চিন্তা করতে হবে। তারপর ওই যং মন্ত্র ৩২ বার জপ করতে করতে দক্ষিণ নাসা দিয়ে বায়ু ত্যাগ করতে হবে। পরে রং বীজ মন্ত্র। চিন্তা করে ১১ বার জপের সঙ্গে বায়ু গ্রহণ করে দেহ আপূরণ করতে হবে এবং ৬৪ বার জপের সঙ্গে কুম্ভক মূলাধারোথিত বহ্নিদ্বারা পাপপুরুষ দগ্ধ হচ্ছে চিন্তা করে ৩২ বার জপের সঙ্গে বাম নাসা দিয়ে দগ্ধীভূত পাপপুরুষের ভস্মের সঙ্গে বায়ু পরিত্যাগ করতে হবে। এরপর ঠং চন্দ্ৰবীজ মন্ত্র চিন্তা করে ১৬ বার জপ করতে করতে বায়ুতে দেহ আপূরণ করতে এবং বং বীজমন্ত্র ৬৪ বার জপ করতে করতে কুম্ভকাবস্থায় ললাটে চন্দ্রানয়ন করতে হবে।


এরপর লং পৃথ্বীবীজ চিন্তা করে ৩২ বার জপের মাধ্যমে দেহকে সুদৃঢ় করে দক্ষিণ নাসা দিয়ে বায়ু ত্যাগ করতে হবে। অনন্তর হংসঃ এই মন্ত্রে জীবাত্মাকে বিলীন কুলকুণ্ডলিনী সহ চতুর্বিংশতি তত্ত্বকে সস্থানে স্থাপন করে নিজ শরীরকে অভীষ্ঠ দেবের সদৃশ চিন্তা করতে হবে। এই হল ভূতশুদ্ধি পদ্ধতি।


আচার্যদেব বলেন, ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় সফল হলে যোগীর দেহ দেবসদৃশ হয়। ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগী মন্ত্রসিদ্ধ হয় ও বিভিন্ন প্রকার বিভূতি ও যোগৈশ্বর্য লাভ করে। এই ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছু অন্য ক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যোগী ব্রহ্মদর্শনের উপযুক্ত হয়।


.


ব্ৰহ্মদর্শনের উপায় বর্ণন


গুরু ভগবান গাঙ্গুলির কাছে ষটচক্র ভেদ ও ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার কথা জেনে লোকনাথ ও বেণীমাধব চমৎকৃত হন। তারা বুঝতে পারেন মানব দেহের এই গুঢ় তত্ত্ব না জেনে প্রণবমন্ত্রে সিদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তাদের এখন ষট্‌চক্র ভেদ করে মহাপ্রণবমন্ত্রে সিদ্ধ হতে হবে। কিন্তু ষট্‌চক্র ভেদ করতে হলে নিজের লিঙ্গশরীর ও তার পঞ্চভূত শরীরাধারকে শুদ্ধ করার জন্য ভূতশুদ্ধি যৌগিক ক্রিয়ার উৎকর্ষতা লাভ করতে হবে। এর জন্য এখানে তাদের আরো কঠোর যোগাভ্যাস করতে হবে। গুরুদেবের থেকে জেনে নিতে হবে যোগাভ্যাসের আরো কিছু গূঢ় তত্ত্ব যার দ্বারা তারা মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হতে পারেন। লোকনাথ গুরুদেবের কাছে যৌগিক ক্রিয়ার আরও কিছু গূঢ় তত্ত্ব জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন যাতে তারা মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হয়ে আত্মদর্শনে তথা ব্রহ্মদর্শনে সমর্থ হন।


আচার্যদেব তখন তাদের মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হবার জন্য যোগাভ্যাসের কিছু প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন।


আচার্যদেব বলেন, তোমরা যোগাসনে বসে দুই অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে দুটি কান, দুই তর্জনী দিয়ে দুই চোখ, দুই মধ্যমা দিয়ে দুই নাসারন্ধ্র আর বাকি আঙ্গুলগুলি দিয়ে মুখদ্বার দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করবে। তারপর আত্মা, প্রাণ ও মন এক এই চিন্তা করতে করতে একাগ্র মনে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে নাসিকাদ্বয় দিয়ে বায়ুধারণ করবে এবং পরে নাসিকাদ্বয় বন্ধ করবে। তখন দেখবে তোমাদের মুখবিবর থেকে ক্রমে প্রথমে ভ্রমরের গুঞ্জনধ্বনি, পরে বংশীধ্বনি, তারপর ক্রমে বীণার ঝঙ্কার ধ্বনি, ঘন্টার ধ্বনি এবং সবশেষে জলপূর্ণ ঘন মেঘের গর্জন ধ্বনি বের হবে। অতঃপর দেহস্থিত বায়ু বার করে পুনরায় পূর্বরূপ অভ্যাস করবে। ভূতশুদ্ধির সঙ্গে এইরূপ যোগাভ্যাস করবে। তোমাদের আত্মদর্শন লাভ হবে এবং সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন হবে। যোগের এই অবস্থায় যোগী ঈশ্বরের স্বারূপ্য লাভ করে, তখন পরমেশ্বর ও সাধকের মধ্যে নিত্যমধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সে দেবতাগণের সঙ্গে ক্রীড়া করতে সমর্থ হয়। তোমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে যোগাভ্যাস করে এই অবস্থায় পৌঁছতে হবে। এটাই এখন তোমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। এই আলোচনা ও শিক্ষাদানের পর, শুরুদেব তার দুই শিষ্যকে নিয়ে বনমধ্যে আবার পথ চলা শুরু করেন। এরইসঙ্গে স্থলে স্থলে বিশ্রাম ও নিরন্তর যোগসাধনা চলতে থাকে।


একদিন লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব যোগীরা কত প্রকার সিদ্ধি লাভ করতে পারে?


আচার্যদেব লোকনাথের প্রশ্নের উদ্দেশ্য অনুধাবন করে বলেন, যোগীরা মুখ্য ও গৌণভেদে অষ্টাদশসিদ্ধি লাভ করতে পারেন।


.


অষ্টাদশসিদ্ধির ব্যাখ্যা


আচার্যদেব বললেন, যোগের অষ্টাদশসিদ্ধির মধ্যে আট প্রকার সিদ্ধি মুখ্য সিদ্ধি এবং দশ প্রকার সিদ্ধি গৌণ সিদ্ধি। মুখ্য আটপ্রকার সিদ্ধি লাভ করলে যোগী সিদ্ধ হন কিন্তু দেবস্বারূপ্য বা দেবসাযুজ্য লাভ করেন না। অষ্টাদশ সিদ্ধিলাভ করলে তবেই যোগী দেবসাযুজ্য লাভ করেন।


.


অষ্ট মুখ্য সিদ্ধি


(১) অনিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী পঞ্চভূত দেহকে অতিমাত্রায় সূক্ষ্ম করে বিচরণ করতে পারেন, তাকে অনিমাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী নিজেকে সূক্ষ্মাবস্থায় নিয়ে যে কোনো দেবস্থানে বা যে কোনো কাজে যেতে সমর্থ হন।


আমি যখন নর্মদা পরিক্রমা করেছি, তখন জেনেছিলাম যে ওঁকারেশ্বর মন্দিরে এবং অমরকন্টকের পাতালেশ্বর মন্দিরে অনেক সিদ্ধ যোগী ও দেবতাগণ ওঁকারেশ্বর-এর আরতী দর্শন করতে সূক্ষ্মরূপে আসেন এবং পাতালেশ্বরেও সূক্ষ্ম রূপে এসে পাতালেশ্বরের পূজা করে যান। আমি উভয় জায়গায় এইরূপ সূক্ষ্ম রূপে যোগীদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলাম।


(২) লঘিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের পঞ্চভূত দেহকে অতিমাত্রায় লঘু করে বিচরণ করতে পারেন, তাকে লঘিমাসিদ্ধি বলে।


(৩) মহিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের দেহকে অতিমাত্রায় বৃহৎ করতে পারেন, তাকে মহিমাসিদ্ধি বলে।


শ্রীহনুমান লঙ্কা দহনকালে রাবনের সামনে এই সিদ্ধিবলে নিজেকে অতিবৃহৎ করেছিলেন।


 (৪) প্রাপ্তিসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের ইন্দ্রিয় শক্তির সঙ্গে সমস্ত প্রাণীদের ইন্দ্রিয় শক্তির সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারেন, তাকে প্রাপ্তিসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগীরা যে কোনো হিংস্র জন্তুকে বশীভূত করতে পারেন এবং যে কোনো কীটপতঙ্গের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারেন।


 (৫) প্রাকামসিদ্ধি–যে সিদ্ধি দ্বারা যোগী ঐহিক ও পারত্রিক সকল তত্ত্ব অবগত হতে পারেন, তাকে প্রাকামসিদ্ধি বলে।


(৬) ঈশিতাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য ও মায়ার তত্ত্ব জানা যায়, তাকে ঈশিতাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী ঈশ্বরের সৃষ্টির সকল গূঢ় তত্ত্ব অবগত হন।


(৭) বশিসিদ্ধি–যে সিদ্ধিদ্বারা যোগী সত্ত্বাদি গুণযুক্ত সকল প্রকার বিষয়ভোগকে বশীভূত করে তাকে জয় করতে পারেন, তাকে বশিসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে যোগী কোনো ভোগে লিপ্ত হন না।


(৮) কামবসায়িত্বসিদ্ধি–যোগী যে সিদ্ধিবলে সকল প্রকার সুখ ও কামনা পূরণ করতে পারেন তাকে কামবসায়িত্ব সিদ্ধি বলে। এই অষ্টমুখ্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে যোগী কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী হন এবং কিছু বিভূতি লাভ করেন। কিন্তু তার ব্রহ্মদর্শন হয় না। এই সিদ্ধিগুলির বলে যোগী কখনও দেবস্বারূপ্য লাভ করতে পারেন না। তার জন্য যোগীকে গৌণদশটি সিদ্ধিও প্রাপ্ত হতে হয়।


.


দশ প্রকার গৌণসিদ্ধি


(১) অনুৰ্মিমত্ত্বা–যোগীর দেহের যে ছয়টি দেহতরঙ্গ আছে, যথা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শোক, মোহ, জরা ও মৃত্যু এই তরঙ্গগুলিকে জয় করাকে অনুমিত্ত্বা সিদ্ধি বলে। এর মধ্যে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা প্রাণের তরঙ্গ, শোক ও মোহ মনের তরঙ্গ এবং জরা ও মৃত্যু বাহ্যদেহের তরঙ্গ। এই তরঙ্গগুলিই যোগীর দেহকে ক্ষীণ করে।


(২) দূরশ্রবণ ও দর্শন–যে সিদ্ধির বলে যোগীর ত্রিভূবনের সকল শব্দ শ্রবণ এবং অদৃশ্যকেও দর্শন হয়, তাকে দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী বহুদূরের যে কোনো শব্দ ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুও দর্শন করতে পারেন।


(৩) মনোজবসিদ্ধি–যে সিদ্ধির বলে যোগী মন দ্বারা কামনামাত্র যেখানে খুশি গমন করতে সমর্থ হন, তাকে মনোজবসিদ্ধি বলে।


নর্মদা পরিক্রমাকালে আমি শাণ্ডিল্যমুনির তপস্থলী গুহায় এমন একজন মুনির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, যিনি রাত্রিকালে বিভিন্ন দেবস্থানে ভ্রমণ করতেন যদিও তার দেহ গুহাতেই অবস্থান করতো।


(৪) কামরূপসিদ্ধি–যে সিদ্ধির বলে যোগী যে কোন প্রাণী বা দেবমূর্তি ধারণ করতে পারেন, তাকে কামরূপ সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী যে দেবতার ধ্যান অন্তরে করেন, তারই স্বারূপ্য লাভ করতে পারেন।


(৫) পরকায় প্রবেশন–যে সিদ্ধির বলে যোগী নিজ ইচ্ছামতো অন্যের দেহে সূক্ষ্মরূপে প্রবেশ করতে পারেন, তাকে পরকায় প্রবেশন বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী নিজ ভক্তের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে চালনা করতে পারেন।


(৬) ইচ্ছামৃত্যু–যে সিদ্ধির বলে যোগী নিজের ইচ্ছায় ব্রহ্মলীণ হতে পারেন বা নিজের মৃত্যুর সময় নিজেই ঠিক করতে পারেন, তাকেই ইচ্ছামৃত্যুসিদ্ধি বলে।


নর্মদা পরিক্রমাকালে নর্মদার দক্ষিণ তটে ব্রহ্মাণ ঘাট তীর্থস্থানে আমি বিমলা বাঈ নামক এক মহাযোগিনীর সমাধিস্থলে যাই, যিনি ৭ এপ্রিল ২০০৬ সালে কালেক্টর এবং সকল ভক্তের সামনে মা নর্মদা মন্দিরে ব্রহ্মলীণ হয়েছিলেন। তাঁর এই ইচ্ছামৃত্যুর কথা তিনি সবাইকে অনেক আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।


(৭) যথাসংকল্পসিদ্ধি-যে সিদ্ধির বলে যোগী কিছু সংকল্প করা মাত্রই তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তাকে যথাসংকল্পসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী মনে যা কিছু সংকল্প করেন, তাই ঘটে।


 (৮) দেবগণের সঙ্গে ক্রীড়াকরণ সিদ্ধি–এই সিদ্ধির বলে যোগী নিত্য নিজ ইচ্ছানুযায়ী দেবগণের সঙ্গে ক্রীড়া করতে সমর্থ হন। এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে যোগী দেবসাযুজ্য লাভ করেন।


(৯) অপ্রতিহতা আজ্ঞা–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগীর কোনো আজ্ঞাকে কারও, এমনকি প্রকৃতিরও লঙ্ঘন করার ক্ষমতা থাকে না, তাকে অপ্রতিহতা আজ্ঞা সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী প্রকৃতিকে বশ করতে সমর্থ হন।


(১০) অপ্রতিহতা গতি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী এমন গতি প্রাপ্ত হন, যা কেউ রোধ করতে পারে না, তাকে অপ্রতিহতা গতি সিদ্ধি বলে।


এই অষ্টাদশ সিদ্ধি যোগীর অন্তরঙ্গ সাধনের ধারণা স্তরে বা অবস্থাতে উদয় হয় ও সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়। যোগী সাধনার বিভিন্ন স্তরে ও অবস্থায় প্রথমে আটটি মুখ্য সিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং পরে সাধনার অত্যুচ্চ স্তরে ক্রমে ক্রমে দশটি গৌণসিদ্ধি প্রাপ্ত হন। যোগীগণ সাধনার উচ্চমার্গে যখন ঈশ্বরকে অন্তরে ধারণ করেন, তখন এই অষ্টাদশ সিদ্ধি ভিন্ন আরও পাঁচটি অনন্য সিদ্ধি লাভ করে থাকেন। সেগুলি হল


(১) ত্রিকালজ্ঞতা–যে সিদ্ধিবলে যোগী নিজের ও যে কোনো ব্যক্তির ভূত বর্তমান-ভবিষ্যৎ –এই তিনকাল সম্বন্ধে অবহিত হতে পারেন, তাঁকে ত্রিকালজ্ঞতা বলে।


(২) অদ্বন্দ্বত্ব–যে সিদ্ধিবলে যোগী শীত-গ্রীষ্ম আদি ঋতুজনিত সব অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম হন, তাকে অদ্বন্দ্বত্ব বলে।


(৩) পরচিত্তাভিজ্ঞতা–যে সিদ্ধিবলে যোগী অন্যের মনের কথা জানতে পারেন, তাকে পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধি বলে।


(৪) স্তম্ভনকরণ–যে সিদ্ধিবলে যোগী অগ্নি, জল, সূর্য ও বিষাদিকে নিষ্ক্রিয় বা শক্তিহীন করে দিতে পারেন, তাকে স্তম্ভনকরণ সিদ্ধি বলে।


(৫) অপরাজেয়–যে সিদ্ধির বলে যোগীকে কেউ অভীভূত করতে সমর্থ হয় না, তাকে অপরাজেয় সিদ্ধি বলে।


যে যোগী এই অষ্টাদশ এবং বিশেষ অন্য পাঁচটি সিদ্ধি সাধনায় লাভ করেন, তার বহ্মদর্শন হয় এবং তিনি দেবস্বারূপ্য লাভ করেন।


আচার্যদেব বলেন, লোকনাথ ও বেণীমাধব তোমরা ৪০ বৎসর ধরে তপস্যা করে যোগসাধনার অনেক গূঢ় রহস্য করায়ত্ত করেছ। নিজেদের ইন্দ্রিয়সকল জয় করতে পেরেছ, আসক্তি ও ভোগ বাসনাকে জয় করেছ এবং নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছ। এখন তোমাদের অষ্টাঙ্গ যোগের অন্তরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়াগুলি শিখতে হবে। আমি তোমাদের যে ২৩টি সিদ্ধির কথা বললাম, তা একমাত্র অন্তরঙ্গ সাধনস্তরেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। তোমরা বহিরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়ায় উৎকর্ষ লাভ করে এখন অন্তরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়ার অভ্যাস করবে। হিমালয়ে পৌঁছে তোমাদের অন্তরঙ্গ সাধনে ডুবে যেতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই ২৩টি সিদ্ধি দুর্লভ হলেও, তোমরা তা প্রাপ্ত করতে পারবে। এইভাবে বনপথে এগোতে এগোতে চলতে থাকে যোগশিক্ষা এবং যোগাভ্যাস। বনের মধ্যে কোনো কোনো জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করেন, কঠোর যোগ সাধনায় শিষ্যদের নিয়োজিত করেন, আবার এগিয়ে চলেন হিমালয়ের পথে। আচার্যদেব মনে করেন, এখন শিষ্যদের অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠানের তিনটি অঙ্গ শেখানো প্রয়োজন। কেননা অন্তরঙ্গ যোগ সাধনাই তাদের সাধনার আরও উচ্চমার্গে নিয়ে যাবে। সেজন্য তিনি শিষ্যদের কাছে অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠান প্রক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করেন।


.


অষ্টাঙ্গ যোগের অন্তরঙ্গ যোগসাধনা


আচার্যদেব বলেন, অষ্টাঙ্গ যোগের পাঁচটি অঙ্গের কথা তোমাদের আগে বলেছি। এখন তোমাদের শিখতে হবে অষ্টাঙ্গ যোগের তিনটি অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠান যা তোমাদের পৌঁছে দেবে সাধনার আরও উচ্চস্তরে। এই তিনটি যোগানুষ্ঠান হল -ধারণা, ধ্যান ও সমাধি।


ধারণা–দেহের নাভিচক্র, হৃদয়পুণ্ডরীক, মূর্ধা, মধ্য, নাসিকা, ব্রহ্মরন্ধ্র ইত্যাদির মধ্যে যে কোনো একস্থানে মনকে একাগ্র করাকে ধারণা বলে। প্রত্যাহার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যখন যোগীর ইন্দ্রিয়সকল ও মন দেহের এইসকল স্থানের কোনো এক স্থানে স্থির হয়, তখন যোগীর সেই অবস্থার নাম ধারণা। এইসময় যোগী মনকে স্থূল বিষয় থেকে সরিয়ে আত্মা বা পরমাত্মাতে কেন্দ্রীভূত করেন। যোগীর মধ্যে যখন ধারণার উদয় হয়, তখনই যোগী ধ্যানাবস্থা প্রাপ্ত হন। সেজন্য ধারণাকে ধ্যানের প্রথমাবস্থা বলা হয়।


ধ্যান-ধ্যান অর্থ হল ধারণাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে নাভিচক্র, হৃদয়পুণ্ডরীক, নাসিকাগ্র, মধ্য, মূর্ধা অথবা ব্ৰহ্মরন্ধ্রে পরমেশ্বরের ধ্যেয়রূপে মগ্ন হয়ে থাকা। প্রথমে ভ্রমধ্য এবং পরে ব্রহ্মরন্ধ্রে ধ্যেয় রূপে মগ্ন থাকাই শ্রেয়। এই ধ্যানাভ্যাসের সময় দেহের সকল ইন্দ্রিয় ও মনকে অবশ্যই অন্তর্মুখী করতে হবে এবং বহিরঙ্গ যোগানুষ্ঠানের পালনপূর্বক ওঁ-কার মন্ত্র জপ করতে হবে।


সমাধি-সমাধি হল সাধকের সেই অবস্থা যখন সাধক ধ্যানাবস্থায় পরমেশ্বরের ধ্যেয় রূপের সঙ্গে নিজের স্বরূপকে একাত্ম করে নিজেকে তার মধ্যে লীন করে দিতে পারেন। এই অবস্থায় সাধক নিজের অস্তিত্ব ভুলে যান এবং এক দিব্য আনন্দে ভাসতে থাকেন।


সমাধিবস্থায় সাধকের জীবাত্মার সঙ্গে মস্তকস্থিত পরমাত্মার মিলন ঘটে এবং তাঁর আজ্ঞাচক্র হতে সহস্রার পর্যন্ত এক ব্রহ্মতেজরাশি বিরাজ করে। সেই অবস্থায় সাধকের দিন-রাত্রি কিছুরই জ্ঞান থাকে না কেননা তিনি বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন। সমাধিবস্থায় সাধকের দেহ এইসব জগতে থাকলেও তার আত্মা ঈশ্বর জগতে ভ্রমণ করে। তাকে ঘিরে রাখে এক পরম আনন্দবিভূতি।


অন্তরঙ্গ সাধনের অঙ্গগুলি ও সাধন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে আচার্যদেব শিষ্যদের বললেন, তোমরা এখন থেকে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ সাধন পদ্ধতিগুলি কঠোরভাবে অভ্যাস করো। আমরা এখন বিন্ধ্যপর্বত হয়ে হিমালয়ের পথে যাত্রা করবো।


বিন্ধ্যপর্বত হয়ে হিমালয়ে যাবার পথে মেকল পর্বতশ্রেণীর নিচে ছিল সিদ্ধিদাত্রী নর্মদা। এই নর্মদার জন্মস্থল অমরকন্টক সমস্ত ঋষি ও দেবতাদের প্রিয় তপস্যাস্থল। অমরকন্টকে নর্মদা তটেই আবার কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন লোকনাথ।


.


সিদ্ধিদাত্রী নর্মদা তটে তপস্যা


গহন বনের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে কত পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে লোকনাথ এসে পৌঁছোন অমরকন্টকের উপকণ্ঠে নর্মদার দক্ষিণতটে। এই পর্বতকে বলা হতো মেকল পর্বতশ্রেণী। অমরকন্টক পরিবেষ্টিত হয়ে আছে সবুজ ঘন বন ও হিংস্র জন্তু জানোয়ার দ্বারা, তথাপি এই পর্বত ঋষি সংঘ সেবিত। অমরকন্টক মা নর্মদার জন্মস্থান। অমরকন্টকের রেবাকুণ্ড তার উৎসস্থল। হরপার্বতী সমেত সমস্ত দেবতাদের প্রিয় তপস্থলী এই অমরকন্টক। মহামুনি মার্কন্ডেয় এইখানে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করে শিবের থেকে সপ্তকল্পান্ত জীবী থাকার বর পেয়েছিলেন। ভৃগু আদি সব ঋষি এবং তৈলঙ্গস্বামীও এখানে তপস্যা করেছেন।


পুরাণে কথিত আছে মাতা নর্মদা পিতা দেবাদিদেব মহাদেবের থেকে এই বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, নর্মদার উভয়তটে যে সকল মুনি-ঋষি তপস্যা করবেন, তারা অবশ্যই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবেন। পুরাণে বর্ণিত সমস্ত মুনি-ঋষিরা এমনকি দেবতারা পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় নর্মদার কোনো তটে তপস্যা করেছেন। বাবা লোকনাথ নর্মদার দক্ষিণ তটে পাহাড়ের উত্রাইয়ে এসে পৌঁছেছেন। চারিদিকে পাহাড়, সবুজ বনানীতে ঘেরা। সামনে মাতা নর্মদা বহমান। তিনি এখানে একটি শিবলিঙ্গ দেখে সেখানেই তপস্যায় বসলেন। একদিন তিনি দেখেন, একটি কালো গাভী নর্মদার জলে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন সেই গাভীটি জল থেকে উঠে এল, তার গায়ের রং সাদা। তাঁর কাছে এটি বেশ রহস্যজনক মনে হল। তিনি ধ্যানে বসে জানতে পারলেন যে, মা গঙ্গা রোজ এখানে এসে কালো গাভীর রূপ নিয়ে নমর্দায় স্নান করে যান। যে পথে ওই গাভীটি নর্মদায় নামে, সেখানে একটি জলধারা বয়ে গিয়ে নর্মদায় মিশেছে। এই জলধারাকে গঙ্গা বলে। যে স্থানে সেই গাভীটি স্নান করে, তাকে কপিলা সঙ্গম বলা হয়।


আমি তপস্যারূপে যখন নর্মদা পরিক্রমা করি, কপিলা সঙ্গমে পৌঁছে এই স্থানটি দর্শন করি ও এই কথা লোকমুখে শুনতে পাই। বাবা লোকনাথ পূজিত সেই শিবলিঙ্গ এখনও জঙ্গলের মধ্যে আছে। সেই জঙ্গলে এখন আদিবাসীদের বাস। তারাই এই স্থানকে পরিষ্কার করে রাখে ও শিবলিঙ্গের পূজা করে। স্থানটি বন আধিকারিকের আওতায় থাকায় এখানে কোনো মন্দির গড়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু বাবা লোকনাথের তপস্যাস্থলের চিহ্নরূপে আদিবাসীরা সেটি সংরক্ষণ করে রেখেছে। সেই স্থল থেকে এখনও একটি স্থূল জলধারা নমর্দায় এসে নিয়ত মিশছে। আমি ও আমার স্ত্রীর সৌভাগ্য হয়েছিল এই কপিলা সঙ্গম স্পর্শ করার।


নর্মদা পরিক্রমার সময় উত্তর তটে ডিনডোরির কাছে আর একটি ঘাটের সন্ধান পেয়েছিলাম যেখানে বাবা লোকনাথ তপস্যা করেছিলেন। তার নাম গঙ্গাবাহ ঘাট। পুরাণে রেবাখণ্ডে মার্কন্ডেয় মুনির কথা থেকে জানা যায় যে, আদিকালে মহাপুণ্যা গঙ্গাদেবী নর্মদার উত্তর তটে এইস্থানে নারায়ণের উদ্দেশ্যে কঠিন তপস্যা করেছিলেন। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে নারায়ণ গঙ্গাদেবীকে দর্শন দিয়ে বলেছিলেন, তুমি আমার পাদপদ্ম হতে উদ্ভূতা। তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট। বলল, তোমার জন্য আমি কি করতে পারি? গঙ্গাদেবী তার উত্তরে বলেন–ভগীরথের তপস্যার প্রভাবে আমি আপনার এবং গঙ্গাধরের কথায় এই মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হয়েছি, আমাকে আপনার পাদোদ্ভূতা জেনে আমার জলে ব্রহ্মঘাতী, গুরু নিন্দুক, পিতৃমাতৃত্যাগী, অগম্যাগামী, মিথ্যাচারী, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন, ব্যাভিচারী প্রভৃতি সকল রকমের পাপিষ্ঠগণ নিত্য অবগাহন করে পাপমুক্ত হচ্ছে। আমি তাদের পাপরূপ ক্ষারে নিত্য দগ্ধ হচ্ছি। যাতে আমি তাদের পাপের জ্বালা এবং স্পর্শ থেকে রক্ষা পাই তার উপায় বলুন। নারায়ণ তখন বললেন–তুমি এই স্থানে নিত্য নর্মদা জলে প্রবেশ করবে। আমি এবং মহেশ্বর সতত এখানে বিরাজ করবো। লোককৃত দুঃসহ পাপের জ্বালা এইখানে স্নান করলে দূর হবে। আজ হতে এই তীর্থ গঙ্গাবাহ তীর্থ নামে প্রসিদ্ধ হল। ব্রহ্মাদি দেবগণ এবং ঋষিগণ এই তীর্থের সেবা করবেন। তদবধি নর্মদার উত্তর তটের এই ঘাট গঙ্গাবাহ ঘাট নামে পরিচিত।


বাবা লোকনাথ নর্মদার দক্ষিণতট থেকে উত্তরতটে এসে এই গঙ্গাবাহ ঘাটে তপস্যা করেছিলেন। একদিন ধ্যানদৃষ্টিতে তিনি দেখেছিলেন, মা গঙ্গা এই ঘাটে এসে এক কৃষ্ণগাভীর রূপ ধারণ করে নর্মদার জলে স্নান করলেন এবং অতঃপর শ্বেতবর্ণ ধারণ করে জল হতে নির্গত হয়ে মহারণ্যের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন। এই ঘাট সংলগ্ন বনে বাবা লোকনাথ কিছুদিন তপস্যা করেছিলেন।


কপিলা সঙ্গম স্থানে নর্মদা তটে তপস্যা করার পর গঙ্গাবাহ তীর্থে যাবার পূর্বে মেকল পর্বতশ্রেণী দিয়ে বাবা লোকনাথ নর্মদা তটের দুধধারায় পৌঁছান। দুধধারার জলপ্রপাতের পাশে দুর্বাসা মুনির গুহা অবস্থিত, যেখানে দুর্বাসা মুনি দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন। নর্মদা পরিক্রমার সময় জানতে পেরেছিলাম এই গুহায় সাধারণ ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে না। এখনও এই গুহায় সূক্ষ্মরূপে এসে মুনি-ঋষিরা তপস্যা করেন। জনশ্রুতি এই যে বাবা লোকনাথ এই গুহায় এসে দুর্বাসা মুনি পূজিত শিবলিঙ্গের সামনে বসে তপস্যা করেছিলেন। এই গুহাকে অতি পবিত্র তপোস্থলী বলে মানা হয়। জনশ্রুতি আছে যে কোনো পরিক্রমাকারী এই দুধধারায় স্নান করে দুর্বাসা মুনির গুহায় ধ্যান জপ করে আবার দুধধারার জলে মা নর্মদার স্মরণ করলে, জলে শিবলিঙ্গ ভেসে আসে। কোনো কোনো পরিক্রমাকারী এইরূপ শিবলিঙ্গ প্রাপ্ত হয়েছেন এবং কোনো কোনো যোগী এই দুর্বাসা মুনির গুহায় ধ্যান করতে যেয়ে সূক্ষ্ম আত্মার উপস্থিতি টের পেয়েছেন। এই স্থান এক অতি জাগ্রত তপোস্থলী। দুধধারা স্থানটি কপিলধারা থেকে ১ কিঃমিঃ বনপথে এগিয়ে গেলে বাঁ হাতে পড়ে। ডানদিকে ও বাঁদিকে সবুজ মেকল পর্বতশ্রেণী এবং তার মধ্য দিয়ে নর্মদা প্রবাহিত।


এইভাবে সিদ্ধিদাত্রী নর্মদার উভয় তটে তপস্যা করে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের নিয়ে এগিয়ে চলেন হিমালয়ের পথে। এই দীর্ঘ পথে চলতে থাকে শিষ্যদের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ যোগসাধনায় উৎকর্ষ বৃদ্ধির প্রয়াস, যে প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন। আচার্যদেব জানতেন যে হঠযোগের সাধনায় পূর্ণ উৎকর্ষ লাভ না করতে পারলে ব্রহ্মদর্শনের জন্য সাধনার অন্তিম চরণে পৌঁছানো যাবে না। হিমালয়ে পৌঁছবার পূর্বেই শিষ্যদের হঠযোগের উৎকর্ষতায় পূর্ণ হতে হবে।


একদিন লোকনাথ গুরু ভগবান গাঙ্গুলিকে বলেন, গুরুদেব আমি হঠযোগের সাধনায় কি এখনও সফল হইনি? গুরুদেব তখন বলেন, তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে। লোকনাথ রাজি হয়ে যান।


আচার্যদেব তখন লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বলেন জঙ্গল থেকে কিছু শুকনো কাঠ নিয়ে আসতে। দুই শিষ্য বনের থেকে শুকনো ডালপালা নিয়ে এসে গুরুদেবের সামনে বসেন। গুরুদেব তখন লোকনাথকে বলেন হাঁটুদ্বয় সোজা করে সামনের দিকে রেখে তার নিচে কাঠগুলি রাখতে। তারপর তিনি লোকনাথের দুই হাঁটুর মধ্যখানে একটি মাটির হাঁড়িতে দুধ ও চাল দিয়ে বসিয়ে দেন। তারপর বলেন, তুমি যদি হঠযোগসিদ্ধ হয়ে থাক, তবে এই কাঠে আগুন জ্বেলে হাঁড়িতে মিষ্টান্ন রান্না করে আমাকে খাওয়াও। একজন হটযোগসিদ্ধ যোগীকে অগ্নি স্পর্শ বা দহন করতে পারে না। লোকনাথ গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে একমনে ধ্যানাবিষ্ট হলেন এবং তার দুই হাঁটুর মাঝের পাত্রে মিষ্টান্ন রান্না হতে থাকল। তার হাঁটুর নিচে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত থাকা সত্ত্বেও সেই অগ্নি তার দেহকে দহন করতে পারল না। লোকনাথের এই সিদ্ধি অবস্থায় আচার্যদেব অতিশয় প্রীত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর শিষ্যদ্বয় হিমালয়ে গিয়ে ব্রহ্মেপসনায় নিজেদের নিয়োগ করতে সক্ষম হবে। তিনি তো শিষ্যদের যোগবিভূতি অর্জন করার জন্য এই পথে আসেন নি। পরমেশ্বরের নির্দেশে তাকে এই দুই শিষ্যকে যোগের এমন স্তরে উন্নীত করতে হবে যাতে তারা দেসাজুয্য লাভ করে মানব কল্যাণে ব্রতী হতে পারেন। তাঁর শিষ্যদের ঈশ্বরকোটির যযাগী হতে হবে। লোকনাথ ও বেণীমাধবের যোগারাধনার প্রগতিতে আচার্যদেব তুষ্ট। তার অভিষ্ট সফলের জন্য এখন বনপথে পাড়ি দিয়ে তাকে হিমালয়ের উচ্চশিখরে পৌঁছতে হবে। যেখানে পার হতে হবে তাঁর শিষ্যদের সাধনার চরম ও অন্তিম লগ্ন। সাধনার চরম লক্ষ্য ব্রহ্মদর্শন ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। নিরন্তর যোগসাধনা করতে করতে গুরু-শিষ্য দীর্ঘ বনপথ অতিক্রম করেন সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছবার আশায়।

পঞ্চম অধ্যায় – হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ, ব্ৰহ্মদর্শন ও বিশ্বপর্যটন


হিমালয়ে আগমন


বহুদিন ধরে ক্রমাগত পথ চলতে চলতে অনেক পাহাড়-পর্বত-বনাঞ্চল পেরিয়ে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের নিয়ে পৌঁছলেন হিমালয়ে অবস্থিত বদ্রীনাথে। এখান থেকে দেখা যায় তুষারাবৃত হিমালয়ের শিখরদেশ। তাদের পৌঁছতে হবে হিমালয়ের সেই বরফাবৃত শিখরদেশে। প্রথমে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করলেন। তারপর আবার হিমালয়ের চড়াই বেয়ে বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। যখন এই তিন সাধনত্রী হিমালয়ে আরোহণ করছেন, তখন তাদের মনে হচ্ছে তারা এখন সেই পবিত্র ভূমি অতিক্রম করছেন যেখানে পূর্বে কত যোগী সিদ্ধিলাভ করে মহর্ষি হয়েছেন। হিমালয় সিদ্ধযোগীদের পীঠস্থান। পথ চলতে চলতে সূর্যদেব যখন অস্তাচলে যাচ্ছেন, তখন তার অস্তরাগে হিমালয়ের বরফাবৃত শিখরদেশ এক অপূর্বরূপ ধারণ করেছে। অবাক বিস্ময়ে আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে সেই রূপ দেখেন আর এগিয়ে চলেন। হিমালয়ের বরফাবৃত অঞ্চলে পৌঁছে লোকনাথ ও বেণীমাধব মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অপরূপ হিমালয় শৃঙ্গের দিকে। চতুর্দিকে বরফ। তার মধ্যে কোথাও কোথাও পর্বতগাত্রে গুহা দেখা যায়। নির্জন নিস্তব্ধ বরফাঞ্চল। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–বাবা লোকনাথ, বাবা বেণীমাধব! এই নির্জন তুষারাবৃত পর্বতাঞ্চলে তাদের নাম শুনে অবাক হয়ে যান লোকনাথ ও বেণীমাধব। চারিদিকে নিরীক্ষণ করে তারা দেখতে পেলেন অদূরে এক গুহার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন জটাজুটমণ্ডিত দুই যোগী। তাদের শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে দীপ্ত আভা। সেই দীপ্তিতেই সেই গুহাদ্বার আলোকিত হয়ে আছে। আচার্যদেব বুঝলেন যে, এই দুই সিদ্ধযোগী লোকনাথ ও বেণীমাধবকে কৃপা করার জন্যই তাদের ডেকেছেন। তিনি শিষ্যদের ইঙ্গিত করলেন সেই সিদ্ধযোগীদের নিকট যেতে। লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবকে প্রণাম করে সেই দুই সিদ্ধযোগীর কাছে এগিয়ে গিয়ে ভক্তিভরে তাঁদের প্রণাম করলেন। সেই দুই সিদ্ধযোগী ক্ষণকাল তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং তারপর লোকনাথ ও বেণীমাধবকে নিয়ে গুহার অভ্যন্তরে গেলেন। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলিও তাদের সঙ্গে গুহায় প্রবেশ করলেন।


.


হিমালয় গুহায় বিরামহীন যোগসাধনা ও সিদ্ধিলাভ


সেই দু’জন সিদ্ধযোগী লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বললেন, আমরা এবার তোমাদের ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য যোগের বিভিন্ন ক্রিয়া শেখাবো। এরপর চললো বরফাবৃত হিমালয় গুহাতে বিরামহীন যোগানুষ্ঠান শিক্ষা। লোকনাথ ও বেণীমাধব সিদ্ধযোগীদের একজনকে বড়ঠাকুর এবং অন্যজনকে ছোট ঠাকুর সম্বোধন করতেন। গুরু ভগবান গাঙ্গুলির আন্তরিক শিক্ষায় লোকনাথ ও বেণীমাধব অষ্টাঙ্গ যোগসাধনে পারদর্শিতা লাভ করেছেন এবং অষ্টাদশ সিদ্ধির মধ্যে অনেকগুলি প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ বা ব্রহ্মদর্শনের জন্য প্রয়োজন অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনায় আরও উত্তম উৎকর্ষতা। সেই উৎকর্ষতা লাভের জন্য প্রয়োজন তুষারাবৃত হিমালয়ে বসে বিরামহীন যোগসাধনা করার শক্তি সঞ্চয়ন এবং সুকঠোর কৃচ্ছুব্রত পালন। দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয় এবং সমস্ত সত্তাকে জয় করে আত্মার মিলন ঘটাতে হবে পরমাত্মার সঙ্গে। সিদ্ধযোগীদ্বয় লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উচ্চমার্গের সর্বযোগানুষ্ঠান শিখিয়ে দিলেন যাতে তারা সিদ্ধিলাভে সমর্থ হন। তারা এও বললেন, তোমাদের শরীরে কোনো রক্তকণিকা থাকবে না। দেহের রক্ত সাদা রসে পরিণত হবে। কিন্তু তোমরা ভয় পেও না। শরীরের পঞ্চভূতের প্রতি তোমাদের যেন কোনো আসক্তি না থাকে। ক্লান্তিহীন, বিরামহীন যোগসাধনাই তোমাদের একমাত্র অবলম্বন। যতদিন তোমাদের ব্রহ্মদর্শন না হয়, ততদিন তোমরা সুকঠোর কৃচ্ছুব্রত পালন করে যোগাসনে নিয়োজিত থাকবে। একদিন তোমরা সিদ্ধিলাভ করবে। লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উপদেশ ও শিক্ষা দিয়ে দুই সিদ্ধযোগী বিদায় নিলেন।


যোগীদ্বয় বিদায় নিলে লোকনাথ ও বেণীমাধব কঠোর যোগসাধনা শুরু করলেন। তুষারাবৃত হিমালয়ের কোলে সম্পূর্ণ দিগম্বর রূপে চলতে থাকে যোগসাধনা। কোনোদিন একবার ফলমূল গ্রহণ করেন, কোনোদিন বা কন্দমূল আহার করেন। বেশিরভাগ দিন অনাহারেই চলতে থাকে কঠিন যোগসাধনা। দুই সাধকের শরীর হিমালয়ের মতো তুষারাবৃত হয়ে যায় আবার সেই বরফ গলে জল হয়ে যায়; কিন্তু সমাধির বুখান হয় না। গুরুদেব প্রত্যক্ষ করতে থাকেন শিষ্যদের সেই বিরামহীন যোগসাধনা। ক্রমে যোগীদ্বয়ের শরীরে দেখা যায় এক উজ্জ্বল আভা। গুরুদেব বুঝতে পারেন তার শিষ্যদ্বয় সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে চলেছেন। পুলকিত হয়ে ওঠে তার মন। সর্বক্ষণ চেয়ে থাকেন তিনি তার প্রিয় শিষ্যদের দিকে। এইভাবে প্রায় ৫০ বছর কঠোর যোগ সাধনার পর লোকনাথ ও বেণীমাধব ব্রহ্মদর্শন লাভ করেন। তারা তখন নিজেদের অস্তিত্ব দেখতে পান না। নিজেদের মধ্যে ব্রহ্মদর্শন করেন অর্থাৎ নিজেতে আর পরমাত্মাতে কোনো ভেদ দেখতে পান না। নিজের ও পরমাত্মার রূপ এক বোধ হয়। তাদের অঙ্গ থেকে বের হতে থাকে এক অপূর্ব জ্যোতিরাশি। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেই জীব মুক্ত হয়। যে ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তার মরদেহ মর্তলোক ত্যাগ করলেই নির্বাণ মুক্তি হয়ে থাকে। তার জীবাত্মা সূর্যমণ্ডল ভেদ করে ব্রহ্মলোকে স্থান পায়।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, এই কথার অর্থ কি?–এই তত্ত্ব জানবার জন্য ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই প্রশ্নটি বাবাকে করেছিলেন। তার উত্তরে বাবা বলেন–আমি ও আমার দেহ এবং আমার কর্ম আছে, আর কিছু চাই না। এই কর্মক্ষয় হইলেই আমি একক থাকিব-তাহাই আমি চাই। এরপর ব্রহ্মানন্দ ভারতী প্রশ্ন করেন–তোমার শরীরের সঙ্গে বাহ্যজগতের যতদূর সংশ্রব ঘটে, ততদূর পর্যন্ত জগৎকে তোমার কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে পারি, যাহা তোমার অগোচর অর্থাৎ জগতের যে ভাগের সহিত তোমার সংশ্রব আদপে ঘটে না, তাহাকে তোমার কর্ম বুঝিব কিরূপে? বাবা তার উত্তরে বলেছিলেন–যাহা আমার গোচর নহে তাহা আছে বলিয়া, তোমাদের মতো ধারণা আমার নাই। বাবা লোকনাথ প্রবৃত্তি দ্বারা আপনার কর্ম অনুভব করতেন। তিনি বলেছিলেন-যখন কোনো বিষয়েই আমাকে প্রবৃত্ত হইতে হইবে না; তখন কর্মক্ষয় হইয়াছে বুঝা যাইবে। তাহার পর হইতে আমি একক থাকিব। তাহা হইলেই আমি মুক্ত থাকিব। তাহাই একমেবাদ্বিতীয়ম।


ব্রহ্মজ্ঞান বলতে বোঝা যায় যে, যখন যোগী নিজ আত্মাকে পরমাত্মারই অংশ এইরূপ জ্ঞান লাভ করেন এবং নিজ আত্মার মধ্যে পরমাত্মার দর্শন পান, তার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে সে পরমাত্মার সঙ্গেই সমস্ত জগৎব্যাপী অবস্থান করছেন, তাতে ও পরমাত্মাতে কোনো প্রভেদ নেই এবং এই জ্ঞানের আলোকে যখন তার দেহ দিব্যজ্যোতি প্রাপ্ত হয়, সেই অবস্থাকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ বলা হয়। তখনই তিনি হন একমেবাদ্বিতীয়। সেই সময় যোগীর আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে লীণ হয়ে যায়।


বেণীমাধব ও বাবা লোকনাথের সেই অবস্থা প্রাপ্তি হয়েছিল। তাদের অঙ্গ হতে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক অপূর্ব জ্যোতিরাশি। আচার্যদেব শিষ্যদের এই রূপ দেখে মোহিত হয়ে যান। বুঝতে পারেন, তার এতো দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হয়েছে। লোকনাথ ও বেণীমাধব সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। পরমেশ্বর তাঁর প্রতি যে দায়িত্ব সঁপেছিলেন ৯০ বছর আগে, এখন তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন। সেই সময় লোকনাথের বয়স প্রায় ৯০ বছর এবং গুরু ভগবান গাঙ্গুলির বয়স প্রায় ১৫০ বছর। দীর্ঘ সমাধির পরে যখন লোকনাথের বুত্থান হল তখন তিনি সামনে গুরুদেবকে দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হল, যে গুরু তাকে এই সিদ্ধিলাভের জন্য তিল তিল করে তৈরি করেছেন, তিনি এখনও সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি। দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে গুরুদেব নিজে কত কষ্ট সহ্য করে তাদের শিক্ষা দিয়ে তৈরি করেছেন সাধনমার্গের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিতে। গুরুর অপত্য স্নেহ এবং কৃপায় তিনি ব্রহ্মদর্শন লাভ করলেন, সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলেন, কিন্তু সর্বদা জ্ঞানমার্গে বিচরণকারী গুরু আজও সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি। এই কথা ভেবে লোকনাথ গুরুর সামনে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন ও বললেন, গুরুদেব, আপনার অক্লান্ত চেষ্টায়, শিক্ষায় আমি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলাম। আপনি আমায় পরিত্রাণ করলেন, কিন্তু আপনি নিজে যে সাধন মার্গের একই অবস্থায় রয়ে গেলেন, তা দেখে আমি ধৈর্যধারণ করতে পারছি না। এমন কেন হল গুরুদেব!


আচার্যদেব সদ্যসিদ্ধিপ্রাপ্ত উজ্জ্বল দেহধারী তার শিষ্যের কথা শুনে বললেন, লোকনাথ আমি জ্ঞানমার্গাবলম্বী। আমি নিজে সর্বদা জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করে চলেছি কিন্তু তোমাদের আমি কর্মমার্গের শিক্ষা দিয়ে কর্মযোগে রত করিয়েছি। আমি নিজে কর্মমার্গ অবলম্বন করে সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করিনি। কর্মমার্গের সাধনায় তুমি ও বেণীমাধব যেভাবে সিদ্ধিলাভ করেছে, আমি তা দর্শন করে পুলকিত ও বিস্মিত হচ্ছি। আমার উপর প্রদত্ত পরমেশ্বরের কাজ শেষ হয়েছে। আমি শীঘ্রই দেহত্যাগ করে আবার জন্মগ্রহণ করবো। তখন তুমি আমাকে কর্মর্মর্গে পরিচালিত করে আমার উদ্ধারের বিধান করবে। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে বললেন– গুরুদেব, এত বড় কঠিন কাজের ভার আমাকে দিও না। আজ পর্যন্ত তুমি আমাকে এমনভাবে প্রস্তুত করোনি যে তোমার মতো অদ্বিতীয় পণ্ডিত ব্যক্তির মত পরিবর্তন করতে আমি সমর্থ হতে পারবো। তুমি এই সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাবুদ্ধিসহ জন্মগ্রহণ করার পর যখন আমার শিষ্য হয়ে আসবে, তখন আমি কিভাবে তোমার মত ফিরিয়ে তোমাকে কর্মর্মর্গে প্রবৃত্ত করাবো?


আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন–এ বিষয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি নিজেই এ ভার গ্রহণ করবো। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে বলেন, তাই হবে। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। এই কথা বলে লোকনাথ গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে যুক্তকরে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। গুরু-শিষ্যের এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে, গুরু যদি সিদ্ধিপ্রাপ্ত নাও হয় এবং একনিষ্ঠভাবে শিষ্যের মঙ্গল চিন্তা করে তাকে সাধন মার্গের পথ প্রদর্শন করে ব্রহ্মলাভের উপযুক্ত করে তুলতে পারেন, তবে সেই শিষ্য ব্ৰহ্মদর্শন করতে পারেন। এই গুরু ঋণ অপরিশোধ্য। লোকনাথ গুরুর অসীম কৃপা স্মরণ করে তার জন্মান্তরে উদ্ধারের ভার নিয়েছেন। ভারতের অধ্যাত্ম ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধহয় দেখা যায় না।


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এরপর তার অবশিষ্ট কার্যগুলি শেষ করতে চান। তিনি লোকনাথকে বললেন, এবার তোমাকে সন্ন্যাস নিতে হবে। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তবে কি তিনি সন্ন্যাসী না হয়েই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন! কিন্তু গুরুকে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না।


আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন, তোমার পিতা রামকানাইয়ের ইচ্ছা ছিল, তার বংশের কেউ বৈদিক সন্ন্যাসী হলে, তার ষাটকুল উদ্ধার হবে। তিনি আমাকে সেই কথা বলেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যেই তোমার উপনয়ন সংস্কারের সময় দণ্ডীঘরেই তোমায় বিদায় দিয়ে আমার হাতে সঁপেছিলেন। তুমি এতদিন যোগসাধনা করে যোগসাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছ। এখন সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হয়ে তোমাকে পরিভ্রমণ করে লোকশিক্ষা দিতে হবে। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন প্রকার সন্ন্যাসের বিধান আছে–যেমন, বৈদিক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, উদাসী। এর মধ্যে বৈদিক সন্ন্যাস সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ এবং তোমার পিতারও এই ইচ্ছাই ছিল। আমি আগামীকাল তোমাকে সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষা দেব। আগামীকাল দীক্ষান্তে তুমি হবে একজন সিদ্ধিপ্রাপ্ত বৈদিক সন্ন্যাসী।


.


লোকনাথের সন্ন্যাসদীক্ষা


পরদিন এক শুভমূহূর্তে আচার্য লোকনাথকে সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষা দিলেন এবং তাঁর নুতন নামকরণ হল–লোকনাথ ব্রহ্মচারী। লোকনাথ নামের পরে যে ব্রহ্মচারী উপাধি যোগ করা হল সেটি কেবলমাত্র একটি উপাধি নয়। ব্রহ্মচারী শব্দের ব্যাপক অর্থকে অনুধাবন করে এবং লোকনাথের যোগৈশ্বর্যকে ভিত্তি করেই তার নাম লোকনাথ ব্রহ্মচারী রাখা হয়েছিল। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি একজন বেদজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। অথর্ববেদে কথিত ব্রহ্মচারী কথার মাহাত্ম তিনি জানতেন এবং লোকনাথের যোগৈশ্বর্য সম্বন্ধেও তার পূর্ণ জ্ঞান ছিল। এই দুইয়ের সমন্বয়েই তিনি লোকনাথ ব্রহ্মচারী নামকরণ করেছিলেন।


অথর্ববেদে কথিত আছে যে, ব্রহ্মচারী হচ্ছেন তিনি, যিনি সর্বদা বেদাত্মক ব্রহ্মে বিচরণশীল এবং যিনি নিজ তপস্যা দ্বারা পৃথিবীব্যাপ্ত করতে করতে স্বনিয়মে প্রবর্তিত হচ্ছেন। ব্রহ্মচারীতে ইন্দ্রাদি সকল দেবগণ অনুগ্রহ বুদ্ধিযুক্ত হয়। ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যায় পৃথিবী ও দ্যুলোক পোষণ করেন। পিতৃগণ, দেবগণ ও ইন্দ্রাদি সকল দেবতা এবং অন্তরিক্ষচারী বসুগণ ও গন্ধর্বগণ ব্রহ্মচারীর রক্ষার জন্য পৃথক পৃথকভাবে অনুগমন করে। সৃষ্টির আদি তেত্রিশ দেবতা–যথা, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি ও বষট্‌কার–এবং তাদের বিভূতি স্বরূপ তিনশত তেত্রিশ দেবতা ও ষট্‌সহ সকল দেবতাকে অর্থাৎ দেব-মনুষ্যাদি সকল জগৎ ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্যের দ্বারা ধারণ করেন। ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্য মহিমার দ্বারা ব্রাহ্মণ জাতি, গঙ্গাদি নদী, স্বর্গাদিশোক, প্রজাপতি, সত্যলোকে অবস্থানকারী আদিব্রহ্মা পরমেষ্ঠী ও মূল প্রপঞ্চ শরীরাভিমানী বিরাট পুরুষকে ধারণ করেন। ব্রহ্মচারী তার তপোমহিমায় সূর্য ও অগ্নিযুক্ত ভূমিতে অধিষ্ঠান করেন অর্থাৎ অগ্নিরূপে তার অধিদেবতা হন।


কেলমাত্র সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করলেই ব্রহ্মচারী হয় না। ব্রহ্মচারী শব্দের এই ব্যাপক অর্থ অনুযায়ী সন্ন্যাস দীক্ষান্তে লোকনাথ ব্রহ্মচারী নাম হয়। এই নামকরণের মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হয় যে, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগৈশ্বর্য কত উচ্চ ছিল, তিনি কত বড় মহাযোগী ছিলেন এবং তার পূর্ণ প্রকাশ কি ছিল!


আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন, তুমি একজন মহান যোগীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে কিন্তু তোমার প্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে তোমায় জগৎকে আলোকিত করতে হবে। লোকশিক্ষার মাধ্যমে তুমি এই কাজ করবে। যোগসাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে সাধকের নিজের উন্নতি হয়। কিন্তু প্রকৃত সাধক কখনও নিজের উন্নতির জন্য সাধনা করেন না। জগতের সব জীবকে মুক্তির আলো প্রদর্শনের জন্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ। একজন কর্মযোগী সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে কর্মের মাধ্যমে সাধনায় প্রাপ্ত আলোয় জগৎকে আলোকিত করে।


সাধক দুই প্রকারের হয়–জীবকোটি ও ঈশ্বরকোটি। জীবকোটির সাধকেরা সিদ্ধি লাভের পর আর সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকটিত হন না। ঈশ্বরকোটির সাধকেরা সিদ্ধিলাভের পর স্বেচ্ছায় অথবা ঈশ্বরের আদেশে লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মাঝে প্রকটিত হন। শুকদেব নির্বিকল্প সমাধিতে মগ্ন ছিলেন। ঈশ্বর শুকদেবকে দিয়ে লোকশিক্ষা দেওয়াবার জন্য দেবর্ষি নারদকে তার কাছে পাঠালেন। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল শুকদেব মুনি রাজা পরীক্ষিৎকে ভাগবত শোনাবেন যার থেকে মর্ত্যে লোকশিক্ষা হবে। নারদমুনি শুকদেবের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় সমাধি মগ্ন। তিনি তখন বীণা বাজিয়ে শ্রীহরির রূপটি চারটি শ্লোকে শুকদেবের সামনে বর্ণনা করলেন। শ্রীহরির রূপ কানে প্রবেশ করা মাত্র শুকদেবের সমাধি থেকে বুত্থান হল। তিনি হৃদয়মধ্যে শ্রীহরির মনোহর রূপ দর্শন করলেন। দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে পরমেশ্বরের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। শুকদেব তারপর রাজা পরীক্ষিতের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ভাগবত পাঠ করে শোনালেন। তার থেকে লোকশিক্ষার প্রসার হলো। আচার্যদেব আরও বললেন, আদি শঙ্করাচার্যও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর অধ্যাত্মলোকের উচ্চমার্গ থেকে লোকশিক্ষা ও ধর্মসংস্থাপনা হেতু সাধারণের মাঝে নেমে এসেছিলেন।


বাবা লোকনাথ, তোমাকে এখন লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মাঝে বাস করতে হবে। নিজেকে জাতির ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে। যে ব্রহ্মজ্ঞানের সন্ধান তুমি পেয়েছ, সেই আলোয় জগৎ ও সমাজকে আলোকিত করতে হবে। পতিত মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। এই ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমানের দেশ। কেবল হিন্দুধর্ম জ্ঞানে তুমি এ দেশের আপামর জনগণের কল্যাণ সাধনে সমর্থ হবে না। তোমাকে হিন্দুধর্মের বিষয়গুলির সঙ্গে মুসলমান ধর্মের বিষয়গুলিও জানতে হবে। এইজন্য তোমাকে কোরাণ শরিফ শিখতে হবে।


.


কাবুলে কোরাণ শিক্ষা


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তার প্রিয় শিষ্যদ্বয়দের কোরাণ শরিফ শিক্ষার জন্য কাবুল যেতে মনস্থ করলেন। আফগানিস্থানের কাবুলে তৎকালীন বিখ্যাত পারসিক কবি মোল্লাসাদীর বাস। আচার্যদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হিমালয় থেকে পদব্রজে কাবুলের মিরাজনগরে মোল্লাসাদীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। মোল্লাসাদী কেবলমাত্র একজন কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞানমার্গের একজন সাধক। গুরু ভগবান গাঙ্গুলির সঙ্গে তাঁর দুই শিষ্যকে দর্শন করে মোল্লাসাদী অত্যন্ত প্রীত হলেন। আচার্যদেব তাকে বললেন যে, তিনি তার দুই শিষ্যকে নিয়ে এসেছেন ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য। তার এই দুই শিষ্য দীর্ঘ ৮০ বছর যোগানুষ্ঠানে ব্রতী হয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। এখন দেশে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হবার জন্য এদের ইসলাম ধর্ম শিক্ষারও প্রয়োজন। জীবনের প্রকৃত সত্যকে লোকসমক্ষে উদঘাটন করতে হলে সব ধর্মকে জানতে হবে। সব ধর্মের মূল সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। তবেই প্রকৃত লোকশিক্ষা সম্ভব। লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুর ঐকান্তিক ইচ্ছায় মোল্লাসাদীর কাছে এক বছর অবস্থান করে ইসলাম ধর্মের মূলতত্ত্ব ও কোরাণ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন। মোল্লাসাদীর কাছে জ্ঞান লাভের পর আচার্যদেব আবার হিমালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন এবং নিঃসংশয় হন যে এখন তাঁর শিষ্যদ্বয় লোকশিক্ষা দেবার উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তার আগে শিষ্যদের ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে এবং সেই পথ উক্রমণের জন্য দরকার যোগমার্গের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছানো। শিষ্যদের সেই মার্গে নিয়ে যাবার জন্য দরকার আরও শক্তিধর মহাযোগীর সাহচর্য। তার জন্য তাঁকে যেতে হবে কাশীধামে। তিনি একদিন লোকনাথকে বললেন, বাবা লোকনাথ এবার আমার দেহত্যাগ করার সময় হয়েছে। আমি কাশীধামে দেহত্যাগ করবো। সেখানে শুরু হবে তোমাদের আর এক মহা যোগানুষ্ঠান। সেই যোগানুষ্ঠানে সফল হলেই তোমরা হবে মহাযোগী।


.


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাশীধামের মাহাত্ম্য বর্ণন


আচার্যদেবের কথা শুনে লোকনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব আপনি কাশীতে কেন দেহত্যাগ করবেন? আচার্যদেব লোকনাথের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ভাগীরথী তীরে এক মহাপুণ্যভূমি বারাণসী ভগবান শঙ্করের রাজধানী রূপে খ্যাত। আমি সেখানেই দেহত্যাগ করবো এবং সেখানেই মহাযোগানুষ্ঠানের পর তোমরা ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগীরূপে আত্মপ্রকাশ করবে।


ব্রহ্মচারী লোকনাথ বললেন, গুরুদেব পুণ্যভূমি বারাণসী ধাম সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন। বারাণসী ধাম কেনই বা শঙ্করের রাজধানী রূপে পরিচিত?


আচার্যদেব বললেন, অসি ও বরুণা নদীর সঙ্গম হওয়ায় কাশীধাম বারাণসী নামে খ্যাত। এই কাশীতে চক্রসরোবরে, মণিকর্ণিকা ও সুরধুনী মিলিত হয়েছে। অসি, বরুণা ও জাহ্নবীর মিলনে এই স্থান সর্বদুঃখবিনাশিনী মোক্ষপ্রদ এক অবিমুক্তধাম। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব, কাশীধামের এত মহিমা কিসের জন্য? কেনই বা একে মোক্ষপ্রদ ও অবিমুক্ত ধাম বলা হয়?


আচার্যদেব তখন বললেন, প্রলয়কালে সমস্ত জগৎ সংসার যখন জলপ্লাবিত হয়, তখন দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের উপর কাশীধাম ছিল। মহাপ্রলয় সমাপ্ত হলে মহাদেব তার পদতল দ্বারা এই কাশীক্ষেত্রকে নির্মাণ করেন। পঞ্চক্রোশ বিস্তৃত এই কাশীধামে দেবাদিদেব মহাদেব ও মাতা পার্বতী সদা বিহার করেন। প্রলয়কালেও তারা কাশীধাম ত্যাগ করেন না। এইজন্য পণ্ডিতগণ কাশীধামকে অবিমুক্তধাম বলেছেন। এই কাশীধামে একদা বিষ্ণুদেব তাঁর চক্র দিয়ে এক পুষ্করিণী খনন করে তার তীরে বসে কঠোর তপস্যা করেন। তপস্যায় তার প্রদীপ্ত তেজ দেখে দেব মহেশ্বর বিষ্ণুকে বৰু প্রার্থনা করতে বলেন। তখন বিষ্ণুদেব বলেন, আমি ভবানীর সঙ্গে আপনাকে সর্বদা দর্শন করতে অভিলাষ করি। মহেশ্বর বিষ্ণুদেবকে এই বরদান করে বললেন, তোমার কঠোর তপস্যায় আমার দেহ কম্পিত হয়েছিল এবং সেইসময় আমার কর্ণ থেকে মণিকুণ্ডল এইস্থানে পতিত হয়। সেইজন্য এই রমণীয় স্থানের নাম দিলাম মণিকর্ণিকা। তদবধি কাশীর এই মণিকর্ণিকা ঘাট এক শ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র এবং মোক্ষপ্রদ বলে বিখ্যাত হয়েছে। এখানে বিশ্বেশ্বর নামে যে শিবলিঙ্গ আছেন, তিনিই জ্যোতির্লিঙ্গ। এই কাশীধামকে সদা রুদ্রগণ রক্ষা করেন। এই কাশীধামে আছেন এক শিবকল্প মহাযোগী। তার নাম হিতলাল মিশ্র। আমি সেই মহাযোগীর হাতে তোমাদের সমর্পণ করে মণিকর্ণিকা ঘাটে যোগাসনে দেহত্যাগ করবো। লোকনাথ তখন গুরুদেবকে বললেন, গুরুদেব, এই মহাযোগী হিতলাল মিশ্র কে? আপনি কেনই বা আমাদের তার হাতে সমর্পণ করবেন?


আচার্য তখন বললেন, এই মহাযোগী হিতলাল মিশ্র প্রায় ৮০ বছর যাবৎ কাশীধামে বাস করছেন। লোকে তাকে সচল বিশ্বনাথ বলে জানে। তিনি জগতে মানব বিগ্রহ তৈলঙ্গস্বামী নামে খ্যাত। প্রতিদিন কাশীর গঙ্গায় অজস্র ভক্ত ও তীর্থযাত্রীগণ স্নান করে ঘাটের উপর এসে শিবজ্ঞানে মহাযোগীর চরণ বন্দনা করেন। সুদীর্ঘকাল কঠোর তপস্যা করে অসামান্য যোগবিভূতির অধিকারী হয়েছেন এই পরম পূজ্য হিতলাল মিশ্র। মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণে তিনি সর্বদা তাঁর অমূল্য যোগসম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছেন। তার স্পর্শে কত মুমূর্য মানুষ জীবন পেয়েছেন, কত মৃত মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। এই মহাযোগীর কাছে যোগের যে গুহ্যতত্ত্ব আছে, তা অন্য কারও কাছে নেই। তোমাদের এখন ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে। ব্রহ্মজ্ঞ হবার জন্য যোগের যে গুহ্যতত্ত্ব শিখতে হবে, তার জন্য হিতলাল মিশ্র ভিন্ন অন্য কেহ নাই। আমার ইচ্ছা তোমরা দুজনে এই চলমান শিবের সান্নিধ্যে থেকে যোগমার্গের সব নিগুঢ় তত্ত্বগুলি শিখে এমন এক উচ্চস্তরে পৌঁছে যাও, যেখানে যোগী সর্বদা ভগবানের নিত্যসঙ্গ লাভ করেন এবং এক পরমানন্দে অবস্থান করেন। যোগের সেই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছলে তোমরা ভগবানের অবতারত্ব লাভ করবে এবং সর্বভূতের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবে। তোমরা জগতে ব্রহ্মজ্ঞ বলে পরিচিত হবে। তোমাদের শরীর পূর্ণ ব্রহ্মে রূপান্তরিত হবে।


.


লোকনাথের কাশীধাম যাত্রা


লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব গুরুদেবের কাছে আশ্চর্য চলমান শিবের কথা শুনে ভাবতে থাকেন কত বড় মহাযোগী হলে তবে এই দেহকে চলমান শিবে পরিণত করা যায়! আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে কাশীধামে পৌঁছে হিতলাল মিশ্রর খোঁজ করতে থাকেন। হিতলাল মিশ্র তখন মণিকর্ণিকার ঘাটে অবস্থান করছিলেন। তথায় পৌঁছে আচার্যদেব বললেন, যোগেশ্বর হিতলাল, আমার এই বালকদুটির ভার আপনার হাতে সমর্পণ করে আমি এবার দেহত্যাগ করতে চাই। আপনি এদের ভার নিন। যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বালকদের প্রতি নিরীক্ষণ করে এঁদের ভার গ্রহণ করতে সম্মত হলেন। এবার আচার্য নিশ্চিত হলেন। দীর্ঘ আট দশকের অধিক কাল ধরে যে আশা তিনি মনে পোষণ করে এসেছেন এবং ঈশ্বরের আদেশবলে যে কার্যভার তিনি বহন করে এসেছেন, আজ তার সমাপ্তিক্ষণ এসেছে। তার প্রিয় শিষ্যদ্বয় হিমালয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন। এখন দেবতুল্য তৈলঙ্গস্বামীর তত্ত্বাবধানে তারা ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে দেব সাযুজ্য লাভ করবে এবং জগতের কল্যাণে ব্রতী হবে। কর্মযোগী না হয়েও তিনি কর্মযোগে এইরূপ মহাসিদ্ধি লাভ প্রত্যক্ষ করেছেন। এবার তাকে এই দেহ ত্যাগ করে আবার দেহধারণ করতে হবে কর্মযোগে আত্মার মুক্তির জন্য। সেই সময় আগত। আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে বলেন, লোকনাথ, বেণীমাধব আমি এইবার মণিকর্ণিকার ঘাটে দেহত্যাগ করবো। এই কথা বলে গঙ্গায় স্নান করে মহান আচার্যদেব মণিকর্ণিকার ঘাটে যোগাসনে বসলেন। যোগাসনেই আচার্যদেব দেহত্যাগ করে নিত্যধামে গমন করলেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব আচার্যদেবের দেহ স্পর্শ করেই বুঝলেন, তার আত্মা ইহজগতের লীলা সাঙ্গ করে পরমধামে চলে গেছে। তারা গুরুদেবের দেহের যথাবিধি সৎকার করলেন।


আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির দেহত্যাগের পর লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব যোগীবর ত্রৈলঙ্গস্বামীর আশ্রমে বাস করে তার কাছে যোগমার্গের সকল গুহ্যতত্ত্বের শিক্ষা লাভ করতে লাগলেন। কিছু সময়ের মধ্যে তৈলঙ্গস্বামীর উচ্চ আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত হল তাদের মধ্যে। ক্রমে ক্রমে তাদের যোগৈশ্বর্য অত্যুচ্চ শিখরে পৌঁছতে লাগলো। দীর্ঘ অক্লান্ত যোগ সাধনার পর লোকনাথের উপর ঐশ্বরিক করুণা বর্ষিত হল। তার মন এক অপূর্ব পরমানন্দ সাগরে ভাসতে লাগলো। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক অপূর্ব জ্যোতিমধ্যে। তিনি দেখলেন, তিনি নিজেই ব্রহ্মের অংশ। ব্ৰহ্ম এবং তার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তিনিই সর্ব চরাচরে বিরাজিত। সর্বপ্রাণীর মধ্যেই তিনি বিরাজমান। তিনি নিজেকে এক ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষরূপে জানতে পারলেন। তার মধ্যেই দৃষ্ট হতে লাগলো সব দেব-দেবীর বাস। তার শরীরে প্রতিভাত হল এক অপূর্ব জ্যোতি। তার চোখ পলকহীন। সেই চোখের দৃষ্টি অতি প্রখর। তৈলঙ্গস্বামী বুঝতে পারলেন, শিষ্যরা ব্ৰহ্মলাভে সমর্থ হয়েছে। এবার তাদের পরিব্রাজনে বেরোনো প্রয়োজন।


.


লোকনাথের মক্কা যাত্রা


লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে তাঁদের গুরুদেবকে স্মরণ করেন। গুরুদেবের ইচ্ছা ছিল তারা যেন ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারেন। গুরুদেবের সেই ইচ্ছা তারা পূরণ করেছেন। মর্তলোক থেকে গুরুদেব আজ বহুদূরে। তাঁর সকল বাসনা তাদেরই পূরণ করতে হবে। কাশীধামে আসার আগে গুরুদেব বলেছিলেন, তাদের পরিব্রাজন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে হবে, আর ধর্মালোচনার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞান বিতরণ করতে হবে। এখন গুরুর এই দ্বিতীয় ইচ্ছাপূরণে ব্রতী হতে হবে। লোকনাথ ও বেণীমাধব যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর কাছে তাদের পরিব্রাজনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যোগীবর মহানন্দে দুই ব্ৰহ্মজ্ঞানীর ইচ্ছায় সম্মতি জানান এবং তাদের সঙ্গে নিজের সঙ্গদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যোগীবরের এই ইচ্ছায় লোকনাথ ও বেণীমাধব অত্যন্ত আনন্দিত হন। কিন্তু যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বলেন, আমি এখন তোমাদের সঙ্গে যাব না। তোমরা যাত্রা করো। আমি সময়মতো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। যোগীবরের আদেশ পেয়ে কমণ্ডলু ও কম্বল মাত্র সম্বল করে দুই মহান ব্রহ্মজ্ঞানী যোগী আরব দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কাশীধাম থেকে রওনা হয়ে হিমালয় হয়ে তারা প্রথমে আফগানিস্থানে এলেন। সেখানে কিছুদিন ইসলাম ধর্মচর্চা করে কঠোর পরিশ্রম শেষে মক্কায় পৌঁছলেন। মক্কা হজরত মহম্মদের জন্মস্থান হিসাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র। সেখানে এই দুই হিন্দু মহাযোগী পৌঁছলে সেখানকার বিশিষ্ট ধর্মানুরাগীগণ তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব মক্কায় ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হন। মক্কায় কিছুদিন অবস্থান করে তারা মদিনায় যান। মদিনায় হজরত মহম্মদ দেহরক্ষা করেছিলেন। এখানেও দুই ভারতীয় মহাযোগী বিশিষ্ট ধর্মানুরাগীদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করেন। এখানে তারা জানতে পারেন, মদিনা থেকে কিছুদূরে মক্কেশ্বরে আব্দুল গফুর নামে এক সাধক থাকেন। কয়েক দিনের হাঁটা পথে লোকনাথ ও বেণীমাধব মক্কেশ্বরে পৌঁছান। মক্কেশ্বরে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে, আব্দুল গফুর খান মৌন ব্রত ধারণ করে গভীর সাধনায় মগ্ন। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। লোকনাথ তার সাধনার সঙ্গী বেণীমাধব ও অন্যকিছু সাধকের সঙ্গে আব্দুল গফুর খানের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। কিন্তু আবদুল গফুর খান তাদের দিকে কোনো দৃষ্টিপাত করলেন না। লোকনাথ ভাবলেন, এত মরুপ্রান্তর পেরিয়ে আসা কি তবে বৃথা যাবে? তিনি সমাধিরত আব্দুল গফুর খানের সম্মুখে ধ্যানাবিষ্ট হলেন। সাধক জানেন সাধকের মনের কথা। বৃদ্ধ সাধক বুঝলেন, সামনের বাঙালি সাধক একজন ব্রহ্মজ্ঞ। সহজে এখান থেকে যাবেন না। তাও তিনি তার পরীক্ষা নিলেন। কয়েকদিন ধরে চললো ধৈর্য্যের পরীক্ষা। তারপর একদিন চক্ষু মেলে তাঁর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন লোকনাথের উপর। সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বাবা লোকনাথকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। তারপর বাবা লোকনাথ তাঁর দিকে চক্ষু মেলে তাকালে তিনি ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তুমি কয়দিনের লোক, বল তো? আচমকা এইরকম হেঁয়ালি প্রশ্ন শুনে বাবা লোকনাথ হকচকিয়ে গেলেন। তাঁর বুঝতে দেরি হল না যে, এই প্রশ্নের মধ্যে কোনো জটিল ইঙ্গিত আছে, যা একমাত্র মহাযোগিরাই বুঝতে পারেন। সাধক আব্দুল গফুর আবার প্রশ্ন করলেন–তুমি কয়দিনের লোক? অকস্মাৎ এই প্রশ্নের গূঢ় সত্যটি লোকনাথের মনে উদয় হল। তিনি বুঝতে পারলেন, সাধক জানতে চাইছেন তার গত জীবনের কথা স্মরণ আছে কি না? আর দেরি না করে বাবা লোকনাথ উত্তর দিলেন, আমি দুই দিনের নোক। আপনি কয়দিনের দয়া করে বলুন। লোকনাথের কথা শেষ হবার পূর্বেই সাধক হেসে বললেন, আমি চারিদিনের। লোকনাথ ব্রহ্মচারী আমি দুই দিনের এই কথার মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি দুই জন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। সাধক আব্দুল গফুর আমি চারিদিনের এই কথা বলে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি চারজন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। এই বার্তালাপের মাধ্যমেই সাধক আবদুল গফুরের সঙ্গে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবের পরিচয় হল। এরপর এই সিদ্ধযোগী বাবা লোকনাথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে?’ লোকনাথ ব্রহ্মচারী খুব বিনীতভাবে উত্তর দিলেন–আমি কে তা জানার জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। সিদ্ধ যোগীর বয়স ৪০০ বছর। লোকনাথের এই উত্তর শুনে তিনি খুশির আবেগে তাঁকে বুকে টেনে নিলেন। যোগী আবদুল গফুর খান ছিলেন অনন্ত যোগৈশ্বর্যের অধিকারী এবং সর্বজন সমাদৃত। মক্কেশ্বরের মুসলমানরা যোগীরাজের এইরূপ ব্যবহারে চমৎকৃত হলেন এবং বুঝলেন যে, এই দুই ভারতীয় যোগী অত্যন্ত উচ্চমার্গের যোগীপুরুষ। তারা বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে খুব আদর যত্ন করতে লাগলো। তারা দুই ভারতীয় যোগীকে বললো, বাবা, আপনারা যদি নিজের হাতে রসুই করে খেতে চান তো বলুন। আমাদের থেকে তাহলে আপনারা চাল, ডাল, সজি গ্রহণ করুন। আর যদি আপনারা আদেশ করেন তবে আমরাই রসুই করে দিচ্ছি। বাবা লোকনাথ তাদের কথার উত্তরে বলেন, তোমাদের হাতের রান্না খেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বাবা লোকনাথের এইরূপ উত্তরে সমবেত মুসলমান ভক্তগণ বিস্মিত হলেন। তখন আবদুল গফুর তাদের বললেন, এই ভারতীয় যোগী একজন খাঁটি মুসলমান। তোমরা সকল হিন্দুকে বিধর্মী মনে করে ভুল করো। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের মধ্যেও মুছলম ইমান অর্থাৎ ষোলআনা ইমান বা ধর্ম আছে এমন অনেক মহাপুরুষ আছেন। এই লোকনাথ ব্রহ্মচারী এমনই একজন মহাপুরুষ। আবদুল গফুরের কথা শুনে সমবেত মুসলমানেরা মুখে কাপড় বেঁধে অতি পবিত্র ভাবে রসুই করে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে ভোজন করাতে লাগলেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব কিছুদিন সেই মহান সিদ্ধ যোগীর সান্নিধ্যে পরমানন্দে ঐশ্বরিক আলোচনা করে কাটালেন। উভয়ের অলৌকিক যোগশক্তি উভয়কে মুগ্ধ করলো। কিছুদিন একসঙ্গে যোগানুষ্ঠানের পর বাবা লোকনাথ সতীর্থ বেণীমাধবকে নিয়ে মক্কেশ্বর ত্যাগ করার সময় বললেন, আমি এত পাহাড় পর্বত ভ্রমণ করেছি, কিন্তু মাত্র তিনজন ছাড়া ব্রাহ্মণ দেখিনি। এই তিনজন হলেন, কাশীতে তৈলঙ্গস্বামী, মক্কেশ্বরে আবদুল গফুর আর …। এই কথা শুনে উপস্থিত মুসলমানেরা বিস্মিত হলেন। তারা বললেন, আর একজন ব্রাহ্মণ কি স্বয়ং আপনি? তাই কি নাম করলেন না? তারা আরও বললেন যে, আমরা বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে, একজন মুসলমান ফকির কি ভাবে ব্রাহ্মণ হলেন? লোকনাথ তখন তাদের সন্দেহ নিরসন করে বললেন, ব্রাহ্মণ কে? ব্রাহ্মণ হলেন ব্রহ্মের অবিকৃত রূপ। দেশকালাতীত ব্রহ্মই পরমার্থিক নিত্যসত্তা। এই নিত্যসত্তাই দেশ কালে প্রকাশিত হন। যিনি ব্রহ্মজ্ঞ, তিনি নিজের আত্মাতে ব্রহ্মের উপাসনা করতে করতে ব্রহ্মরূপ হয়ে যান। তিনি তখন সর্বত্রই ব্রহ্মকে দর্শন করেন। তার মধ্যে কোনো ভেদজ্ঞান থাকে না। ব্রহ্মা ব্রাহ্মণের হৃৎপদ্মে সর্বদাই চৈতন্যরূপে অভিব্যক্ত থাকেন। মুসলমান কথার অর্থ বাবাজী তোমাদের বলেছেন–ষোলআনা ইমান। অর্থাৎ ষোলআনা ধর্ম যার মধ্যে আছে সেই মুসলমান। আমি লক্ষ্য করেছি, প্রকৃত মুসলমানের মধ্যেও ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মহাপুরুষ আছেন। আবদুল গফুর একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ। তার হৃদয়মধ্যে সর্বত্র ব্রহ্ম আনন্দরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। ব্রহ্মকে তিনি আত্মরূপে দর্শন করছেন। সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ভেদাভেদ জ্ঞান মুক্ত হয়েছেন। তাই তাঁর সাম্য প্রাপ্ত হয়েছে। ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ। ব্রহ্মকে পেতে হলে সত্যের পথে চলতে হয়। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ সত্যের পথেই সত্যস্বরূপ ব্রহ্মকে লাভ করেন। তাই তো বলা হয়, পরমাত্মাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ পথ সত্যের মধ্যেই নিহিত আছে। এই সত্যই হল ধর্ম। আর এই ষোলআনা ধর্ম যার মধ্যে আছে, তিনিই ব্রাহ্মণ। তিনিই মুসলমান।


বাবা লোকনাথের এই সত্য তথা ধর্ম বিশ্লেষণ আবদুল গফুর ও সমবেত মুসলমানদের চকিত করলো। লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার ধর্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই লোকশিক্ষাই দিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান ধর্মে কোনো পার্থক্য নেই। দুই ধর্মই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সত্যকে জানলে আর উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। মক্কেশ্বরে দাঁড়িয়ে এই লোকশিক্ষা প্রচার করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বেণীমাধবকে নিয়ে হিমালয়ে ফিরে আসেন। শোনা যায়, হিমালয়ের অত্যুচ্চ শিখরে কিছুদিন বসবাস করে তারা আবার মক্কায় গিয়ে আবদুল গফুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।


.


লোকনাথের ইওরোপ পর্যটন


মক্কেশ্বর থেকে প্রস্থান করে দুই ভারতীয় মহাযোগী কেবলমাত্র কম্বল ও কমন্ডলু সম্বল করে তুরস্কে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে তারা গ্রিস দেশে যান। গ্রিস দেশ প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র। সেখানে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির বাস। এই দুই ভারতীয় মহাযোগীকে তারা সাদরে গ্রহণ করলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধবের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে বহুদূর থেকে অনেক সাধু, সন্ন্যাসী ও গুণীজনের সমাবেশ ঘটলো। আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক আলোচনা হল। ভারতীয় মহাযোগিগণ তাদের অর্জিত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে গ্রিস দেশের সাধু, সন্ন্যাসী ও গুণীজনদের মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটালেন। সকলেই তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য সাধুবাদ জানালেন।


গ্রিস থেকে দুই মহাযোগী গেলেন ইতালি। গুরুদেবের ইচ্ছা তাদের প্রেরণা। তাদের অধ্যাত্ম জ্ঞান বিতরণ করতে হবে দেশ-বিদেশে। অর্জন করতে হবে বিভিন্ন দেশের জ্ঞান। ইতালিতে দুই মহাযোগী ধর্মানুরাগীদের থেকে পেলেন অনেক উষ্ণ সম্বর্ধনা। এখানেও ধর্মানুরাগিদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাব-ভাবনার আদান-প্রদান হল। সর্বত্রই ধর্মপ্রাণ মানুষের মন জয় করে চলেছেন দুই ভারতীয় মহাযোগী।


ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে দুই মহাযোগী চললেন ফরাসি দেশের পথে। পদব্রজে আরব দেশ থেকে এতগুলি ইওরোপ দেশ ভ্রমণ করা যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা সকলেই অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু দুই ভারতীয় মহাযোগীর কাছে কোনো বাধাই বাধা নয়। যত ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে, তত তাদের জ্ঞানপিপাসা বেড়ে চলেছে। তারা বুঝতে পারলেন, কেন গুরুদেব তাদের পরিব্রাজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফরাসি দেশ পর্যটন করে লোকনাথের ইচ্ছা হল স্বদেশে ফিরে আসার। সাধনার ছায়াসঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে লোকনাথ পদব্রজে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। স্বদেশে ফিরে দুজনের বাসনা হল উত্তর মেরু অভিযান করার।


.


বাবা লোকনাথের উত্তরমেরু অভিযান


 ইওরোপ পর্যটন থেকে হিমালয়ে ফিরে প্রথমে বাবা লোকনাথ মনে করলেন, গঙ্গার উৎস থেকে হিমালয়ের কোলে গঙ্গার তটে অনেক মুনি-ঋষির বাস। তারা নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন পরমেশ্বরকে পাবার ইচ্ছায়। তিনি অভিন্নসঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে গঙ্গার তটে সেইসব স্থান দর্শন করে মুনি-ঋষিদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় করতে মনস্থ করলেন।


প্রথমে তারা এলেন বদরিকা আশ্রম অর্থাৎ বদ্রীনাথে। বদ্রীনাথে বদ্রীনারায়ণ নামে বিষ্ণুমূর্তি স্থাপিত। হিন্দুদের এক অতি পবিত্র তীর্থস্থান। সারাদেশ থেকে পুণ্যার্থীরা অনেক দুর্গম পাহাড়িপথ অতিক্রম করে এখানে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করতে আসেন। বিভিন্ন মুনি-ঋষি, এমনকি তোরাও সূক্ষ্মরূপে বদ্রীনারায়ণ দর্শনে আসেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব বদ্রীনাথে এসে স্বামী বদ্রীনারায়ণ দর্শন করলেন এবং কিছুদিন সেখানে বাস করে সাধন-ভজন করলেন। সেখানকার সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাদের আধ্যাত্মিক আলোচনারও অবকাশ হল। তারপর তারা কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ইত্যাদি ভারতের সনাতন তীর্থস্থানগুলি দর্শন করে হরিদ্বারে এসে কিছুদিন সাধুসঙ্গ করলেন। এরপর হরিদ্বার থেকে তারা আবার ফিরে গেলেন হিমালয়ের বরফাবৃত শিখরে। এরপই বাবা লোকনাথের মনে এলো পৃথিবীর উত্তরমেরুর কথা। তিনি জ্ঞানার্জনকালে জেনেছেন যে এই উত্তরমেরুই হল ‘স্বর্গদ্বার’। মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব এই স্বর্গদ্বার দিয়েই স্বর্গে পৌঁছেছিলেন। তাই তাঁরও বাসনা জাগলো উত্তরমেরু পরিভ্রমণের। তিনি তার সঙ্গী বেণীমাধবের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে যাওয়া স্থির করলেন।


কিন্তু বরফাবৃত উত্তরমেরুর হাড় কাঁপানো তাপাঙ্ক উপেক্ষা করা মানুষের পক্ষে অসাধ্য আর তাই নিজেদের দেহকে ওইরূপ উপযুক্ত করে তুলতে তাঁরা হিমালয়ের বরফাবৃত পর্বতে বসবাস করতে শুরু করলেন।


এইসময় বাবা লোকনাথের সিদ্ধযোগী তৈলঙ্গস্বামীর কথা মনে পড়লো। তিনি বলেছিলেন, পর্যটনের মাঝে তিনি যোগদান করবেন। মণিকর্ণিকা ঘাটে ছাড়াছাড়ি হবার পর আর দেখা হয়নি। এদিকে যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, লোকনাথ ও বেণীমাধব উত্তরমেরু অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এবং তাকে স্মরণ করছেন। তিনি বাবা লোকনাথের ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। একদিন যোগীবর তাঁর শিষ্যদের সামনে উপস্থিত হলেন। আশ্চর্যজনকভাবে বাবা লোকনাথ দেখলেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হতে সেখানে সাধক আবদুল গফুরও হাজির। অতি আনন্দে চারজন সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়ে বরফের উপর চলা অভ্যাস করতে লাগলেন। বাবা লোকনাথ তিনবছর এই সুমেরু অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর এক শুভ মুহূর্তে চার মহাপুরুষ মহাযোগী বরফাবৃত সুমেরু প্রদেশের পথে অগ্রসর হলেন।


হিমালয়ে দুর্গম পার্বতশৃঙ্গ অতিক্রম করতে করতে একসময় তারা উত্তরমেরুর সেই পথে এসে পৌঁছলেন যেখান দিয়ে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাগণ ও দ্রৌপদীকে নিয়ে স্বর্গাভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। সেই পথ বরফাবৃত। কোথাও মানুষ জনের চিহ্ন নেই। শৈত্যের প্রভাবে নদীর জল বরফ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা মেটাবার কোনো সংস্থান নেই। ক্ষুধা মেটাবার একমাত্র সহায়ক কন্দমূল।


তারা জানতে পারেন এই পথেই স্বর্গের খোঁজে বেরিয়ে প্রথমে দ্রৌপদীর দেহপাত হয়। পরে আরও কিছুদূর এগিয়ে সহদেবের শরীর পাত হয়। এইভাবে মহাপ্রস্থানের পথে একে একে নকুল, অর্জুন ও ভীম সহ চার পাণ্ডবের দেহ বরফের উপর পড়ে থাকে। পরে বরফগলিত জলে সেই সব দেহ ভেসে আসে কেদারতীর্থে। যে পথ দিয়ে দ্রৌপদী ও চার পাণ্ডবের দেহ কেদারতীর্থে ভেসে এসেছিল তার নাম ভৃগুপন্থা। যে পথ দিয়ে পাণ্ডবেরা মহাপ্রস্থানে এগিয়েছিলেন, ভৃগুপন্থা তার পশ্চিমদিকে অবস্থিত। এখনও কেদারতীর্থে গেলে সেখানকার পাণ্ডাগণ এই ভৃগুপন্থা তীর্থযাত্রীদের দর্শন করান। এইখানে উল্লেখযোগ্য যে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের দেহ এখানে পাওয়া যায় না। সেজন্য যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে পৌঁছেছিলেন বলে কথিত আছে। বাবা লোকনাথসহ চারজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ এই পথে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। কারণ তারা এরজন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, যা পাণ্ডবদের ছিল না।


এখানে জনমানসের চিহ্নও নেই। চারজন স্বর্গসন্ধানী যোগী বরফের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন স্বর্গদ্বারের সন্ধানে। এইসময় বরফের উপর দিয়ে চলতে চলতে তারা শ্বেতবর্ণ ধারণ করলেন। তারা একসময় উত্তরমেরুর সেই অঞ্চলে এসে পৌঁছলেন যেখানে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি হয়। দিনের আলো এখানে খুবই মৃদু। কিছু চোখে দেখা যায় না। দীর্ঘদিন এই পথে চলতে চলতে তারা অন্ধকারে দৃষ্টিশক্তি লাভ করেন। অন্ধকারের মধ্যেও তারা সব কিছু দেখতে পান। এইভাবে প্রায় দশবছর সুমেরু পর্বতের দিকে তারা অগ্রসর হতে হতে এমন এক স্থানে এসে পৌঁছলেন, যেখান থেকে আর উপরের দিকে যাবার পথ নেই। তারা উত্রাই-এ নিচের দিকে নামতে থাকলেন। কিছুদূর নিচে নেমে তাদের খেয়াল হল যে, এই পথ বোধহয় পাতালের দিকে গেছে। তাই তারা সেই পথে অগ্রসর না হয়ে আবার পিছনে এসে পথ খুঁজতে লাগলেন। সুমেরুর পথ খুঁজতে খুঁজতে তারা এক জায়গায় কয়েকটি বরফের টিলা দেখতে পেলেন। বহু কষ্টে তারা পর্বতারোহণের কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ভিন্ন একটি বরফের টিলায় উঠতে সক্ষম হলেন। সেই টিলার উপরে কোনো বায়ুস্তরের চিহ্ন দেখতে পেলেন না। সেখানে অদ্ভুত এক নিস্তরঙ্গ ভাব তারা অনুভব করলেন। কিন্তু এটিই তাঁদের বাঞ্ছিত সুমেরু শৃঙ্গ কি না, সে সম্বন্ধে তারা নিশ্চিত হতে পারলেন না। চার ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী পুরুষ এরপর সুমেরু অভিযান শেষ করে আবার প্রায় দশ বছর পদব্রজে হিমালয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকে আবদুল গফুর স্বস্থানে ফিরে যান।


.


বাবা লোকনাথের চীনদেশ যাত্রা


সুমেরু অভিযান সম্পন্ন করে যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উদয়াচলের পথে যাবার কথা ব্যক্ত করলেন। উদয়াচলের কথা শুনে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব যোগীবরের উদয়াচল অভিযানের সাথী হতে চাইলেন। এবার তিন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাযোগী আবার পথে নামলেন। তাঁদের প্রথম গন্তব্যস্থল চীনদেশ। তারা পথে নেমে প্রথমে পৌঁছলেন সাইবেরিয়া। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে তারা উপস্থিত হলেন মঙ্গোলিয়ায়। এখানে কিছুদিন অবস্থান করে তারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবের আদান-প্রদান করেছিলেন। তারপর শুরু হয় আবার পথচলা। অনেক পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল অতিক্রম করে তিন মহাযোগী একদিন চীনদেশে পদার্পণ করেন। তাদের মাথায় জটাজুটো, মুখের একরাশ দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে, গায়ে ভস্ম মাখা। এইরূপ দেহসজ্জায় তিন যোগীকে দেখে চীনবাসীদের খুব কৌতূহল হল। তাদের উপস্থিতির কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সে দেশে এক আলোড়ন সৃষ্টি করলো। হাজার হাজার চীনবাসী তাদের দর্শন করতে এলেন। তারা চীনাভাষায় যোগীদের অনেক প্রশ্ন করেন, কিন্তু ভাষা সমস্যায় যোগীগণ তাদের কথা বুঝতে পারেন না। কেবল আকারে ইঙ্গিতে জবাব দেন। তিনজন ভারতীয় যোগীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা রাজার গোচরে এলো। রাজার রক্ষীরা তিন যোগীকে নিয়ে রাজার সম্মুখে হাজির করলো। রাজা যা প্রশ্ন করেন, যোগীরা তা বুঝতে পারেন না। আবার যোগীরা যা বলেন, রাজা তা বুঝতে পারেন না। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ইঙ্গিতে রাজাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, তারা ভারতীয় বোগী। আধ্যাত্মিক ভাবের আদান-প্রদান করতে এসেছেন। তাদের দ্বারা রাজার বা চীনবাসীদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু রাজা তাঁদের কথা বুঝতে না পেরে তিন ভারতীয় যোগীকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন এবং তাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। কিছুদিন কারাবাসের পর যোগীদের আচার-আচরণে রাজা বুঝতে পারলেন যে, এঁদের দ্বারা অহিতকর কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। এঁরা নিছকই অধ্যাত্ম জগতের মানুষ। তারপর রাজা যযাগীদের সসম্মানে কারামুক্ত করে দিলেন এবং তখন তাদের জনসমক্ষে আসার আর কোনো বাধা রইলো না। কারাবাসের পর তিন ভারতীয় মহাযোগী যখন বাইরে এলেন, তখন চীনবাসীগণ তাদের যথেষ্ট সমাদর করলেন এবং তাদের কথা শুনলেন। এই সময় একদিন যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, বাবা লোকনাথের নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত হবার সময় উপস্থিত হয়েছে। তিনি বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বললেন, তোমাদের এবার স্বদেশে ফিরে নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত হতে হবে। দেশে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করতে হবে। তোমাদের অর্জিত অধ্যাত্ম জ্ঞানের প্রভাবে সমাজকে আলোকিত করতে হবে। তোমরা এবার সে পথে অগ্রসর হও। আমি উদয়াচলের পথে অগ্রসর হব।


বাবা লোকনাথ বুঝলেন, সাধনায় সিদ্ধিলাভের ফল দেশবাসীকে বিতরণ করার সময় আগত। এখন তাদের স্বদেশের মাটিতে ফিরে দেশ ও সমাজের কাজে ব্রতী হতে হবে। তারা যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর থেকে বিদায় নিয়ে দেশের পথে অগ্রসর হলেন।

ষষ্ঠ অধ্যায় – বাবা লোকনাথের বারদী আগমন


ভারত-চীন–ব্ৰহ্মদেশ বর্ডারে কারাবাস


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর থেকে বিদায় নিয়ে হিমালয়ের তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করলেন। বাবা লোকনাথ স্মরণ করলেন যে, তাকে সেই পথেই যেতে হবে যেখানে আবির্ভূত হবেন তার গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি। তাকে পরজন্মে কর্মযোগে প্রবৃত্ত করে মুক্ত করার ভার তিনি নিয়েছেন। আবার উপনয়নে দণ্ডীঘরে মা কমলা দেবীকে কথা দিয়েছিলেন, তার পরজন্মে পুত্ররূপেই দেখা দেবেন। এই দুই অঙ্গীকার রক্ষার্থে এবং গুরুদেব নির্দেশিত লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হতে তাকে এমন স্থানে যেতে হবে যেখানে তিনি তার কার্য সমাধা করতে পারবেন। এই দায়িত্ব স্মরণ করে তিনি অভিন্ন হৃদয়সঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে চীন-তিব্বত সীমান্ত অতিক্রম করে নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন।


এইভাবে যখন তারা ভারতের নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন, তাঁদের এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। দুই ভারতীয় মহাযোগী তখন ছিলেন নগ্নদেহ, দীর্ঘজটাজুটো শত্রুধারী, বড় বড় নখযুক্ত এবং বাক্যরহিত। দীর্ঘদিন তরল পদার্থ ও কন্দমূল ভক্ষণে তারা বাশক্তি রহিত ছিলেন। বাবা লোকনাথের ছিল পলকহীন চক্ষুদ্বয়। সেইসময় চীন-ব্রহ্মদেশ-ভারত বর্ডারে ইংরেজ আধিকারিকরা ছিলেন। তারা এই ভারতীয় মহাযোগীদের পরিচয় জানতেন না, এমনকি, তখন ভারতীয়রাও তাদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতো না। ইংরেজ আধিকারিকেরা তাঁদের চোরাকারবারী সন্দেহে আটক করলেন। চীন-ভারত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে তখন চোরাকারবারী সাধু-সন্ত সেজে জটার মধ্যে ও থলিতে সোনা-মোহর, গাঁজা-আফিম ইত্যাদি পাচার করতো। শুল্ক বিভাগের লোক মহাযোগীদের সেইরকম কোনো চোরাকারবারী ভেবেছিলেন। তারা যোগীদের জটা-শ্মশ্রু ধরে অনেক টানাটানি করে কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য পেলো না এবং জটা ও শ্মশ্রু আসল বলে বুঝতে পারলেন। তা সত্তেও তারা তাদের আটক করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চালান করলেন। এই যোগীদ্বয় বাকশক্তি রহিত হবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো কথা ব্যক্ত করতে সমর্থ হলেন না। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বাবা লোকনাথ স্থির, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তাঁর চোখ থেকে এক দিব্যজ্যোতি ঠিকরে বের হচ্ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট তার চোখের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেলেন। বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব মুখে কোনো কথা ব্যক্ত করতে না পারলেও, তাঁদের চোখের দৃষ্টি যেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সব ব্যক্ত করলো। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারলেন, এই দুই ভারতীয় সাধু সাধারণ যোগী নন। এঁদের মধ্যে উচ্চ অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তিনি দুই মহাযোগীকে তৎক্ষণাৎ সসম্মানে মুক্তির আদেশ দিলেন। বাবা লোকনাথ তখন ইঙ্গিতে অন্য সকল সাধুদেরও মুক্তি প্রার্থনা করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট বাবা লোকনাথের তুষ্টির জন্য আটক অন্যান্য সাধুদেরও মুক্তির আদেশ দিলেন। এরপর বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব নিম্নভূমিতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠলেন।


.


চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বাবা লোকনাথ


চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব একটু বিশ্রামের জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন। শুল্ক বিভাগের আধিকারিকদের হয়রানি, হাজতবাস এবং দীর্ঘ পার্বত্যপথ অতিক্রমের ধাক্কায় তারা তখন খুবই ক্লান্ত। অবশেষে ওই পাহাড়ের উপরে বনাঞ্চল বেষ্টিত নির্জন একটি গুহার খোঁজ পান। সেখানেই তারা বিশ্রাম নেবার মনস্থ করলেন।


চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গুহায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই ঘটে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। যে গুহায় তারা অবস্থান করছিলেন, তার অল্পদূরে এক বাঘিনী হঠাৎ তীব্র গর্জন করতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে বাঘিনী গর্জন করতে থাকলে বাবা লোকনাথ ধ্যানস্থ হয়ে জানতে পারলেন যে, একটি বাঘিনী কিছু সময় পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে সন্তান প্রসব করেছে। সামনে দুজন মনুষ্য দেখতে পেয়ে ভীত হয়ে সে সন্তানদের আগলে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে। ধ্যানে বাঘিনীর মনোভাব জানতে পেরে বাবা লোকনাথ বাঘিনীকে বলেন, তোমার কোনো ভয় নেই মা। তুমি শিশুসন্তান নিয়ে সুখে নিদ্রা যাও। আমরা ব্রহ্মচারী, আমাদের কাছ থেকে তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি আর চিৎকার কোরো না, শান্ত হও। এই কথা শুনে বাঘিনী আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যায় ও তার সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।


পরের দিন সকালবেলায় বাঘিনী আবার গর্জন শুরু করে। বাবা লোকনাথ আবার ধ্যানস্থ হয়ে জানতে পারেন যে, নবপ্রসূত বাঘিনী সন্তানদের একা রেখে কিভাবে শিকারে যাবে বুঝতে না পেরে গর্জন করছে। বাঘিনীর মনের ভাব বুঝতে পেরে বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, তুমি সন্তানদের এখানে রেখে শিকার করতে যাও, তাদের জন্য চিন্তা কোরো না। আমি এদের রক্ষা করবো। বাবার এই কথা শুনে বাঘিনী নিশ্চিন্ত মনে একা শিকারে বের হয়। শিকারে গেলে বাবা বাঘিনীর সন্তানদের রক্ষা করতেন। বাঘিনী শিকার থেকে ফিরে দু-তিনবার আওয়াজ করে বলে দিত যে সে ফিরে এসেছে। এরপর বাঘিনী যখনই শিকারে যেত, বাবাকে তার মনোভাবে জানিয়ে যেত। আবার যখন ফিরে আসতো, তখনও আওয়াজ করে জানিয়ে দিত। এইভাবে কিছুদিন অবস্থান করার পর বাবা লোকনাথ ও বেনীমাধব ওই স্থান ত্যাগ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল সেই বাঘিনীর প্রচণ্ড গর্জন। তারা যত এগোতে লাগলেন, গর্জন বাড়তে লাগলো। তখন বাবা লোকনাথ বেণীমাধবকে বললেন, বেণী, আজ আর যাওয়া হল না, বাঘিনীর বড় কষ্ট হচ্ছে। আর কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে হবে। দুজনে ফিরে এসে বাঘিনীকে বললেন–যতদিন তোমার ছেলেরা তোমার সঙ্গে যেতে না পারবে, ততদিন আমরা এখানে থেকে গেলাম। আর দুঃখ কোরো না। এখন চুপ করো। বাবার এই কথা শুনে বাঘিনী চুপ করে গেল। এরপর মাসখানেক সময় অতিবাহিত হবার পর বাঘিনী তার সন্তানদের নিয়ে শিকারে চলে যায়। এই ঘটনার কথা বাবা লোকনাথ তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীযুক্ত যামিনীকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে বলেছিলেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওই স্থানে বাবা লোকনাথের ভব্য মন্দির বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের চিত্ত আকর্ষণ করে। বারদী থেকে চট্টগ্রাম হয়ে এই মন্দিরে যেতে হয়।


যখন দুই ব্ৰহ্মজ্ঞানী মহাযোগী চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান করছেন, তখন সেই পাহাড়ের কোলে বনের মধ্যে সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তপস্যারত ছিলেন। সাধক বিজয়কৃষ্ণ প্রথম জীবনে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে নিরাকার ব্রহ্মোপসনায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে তার মন ভরছিল না। এরপর তিনি সাকার দেব-দেবীর উপাসনায় আকর্ষণ অনুভব করলেন। একবার সাকার, একবার নিরাকার–এইরূপ দুই সাধনার দোলাচলে তিনি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। অশান্ত মনে সাধনায় তার তখনও ঈশ্বর দর্শন সম্ভব হয়নি। হতাশায় জর্জরিত হয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে সাধনা করতে করতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে পাহাড়ের নিচে তিনি ঈশ্বর দর্শন উদ্দেশ্যে ধ্যানমগ্ন।


একদিন সেই বনাঞ্চলে দাবানলের সৃষ্টি হল। চোখের পলকে সেই দাবানল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। যে জায়গায় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ধ্যানরত, সেই জায়গার চারিদিক দাবানল বেষ্টিত। পাহাড়ের উপরে গুহায় বাবা লোকনাথ তখন যোগ সাধনায় মগ্ন। তিনি যোগবলে জানতে পারলেন যে, নিচে পাহাড়ে গায়ে সাধক বিজয়কৃষ্ণ দাবানল বেষ্টিত হয়ে আছেন। তিনি যোগবলে সেখানে পৌঁছে দাবানলের ভিতর থেকে বিজয়কৃষ্ণকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় একটি পাথরের উপর বসিয়ে নিজের গুহায় প্রত্যাবর্তন করেন। সাধুক বিজয়কৃষ্ণের যখন বুত্থান হল তিনি চারিদিকে তাকিয়ে সেই দাবানলের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করলেন। কিন্তু তিনি কি করে সেই দাবানল থেকে রক্ষা পেয়ে এই পাথরের উপর এলেন, তা বুঝতে পারলেন না। চতুর্দিক অবলোকন করেও তিনি কারো সন্ধান পেলেন না। তার চোখের সমানে দাবানল তখনও জ্বলছে; তার ধ্যানস্থান তখনও দাবানল বেষ্টিত। কিন্তু তিনি কিভাবে এখানে এলেন, তা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। জানতে পারলেন না, এক ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী তাকে উদ্ধার করে এখানে রেখে গেছেন। তিনি বিমূঢ়ভাবে চতুর্দিকেতার উদ্ধারকর্তাকে অনুসন্ধান করতে থাকলেন।


এই ঘটনার পর আরও কিছুদিন বাবা লোকনাথ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ধ্যানযোগে অতিবাহিত করলেন। তারপর তার স্মরণ হল যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ও গুরু ভগবান গাঙ্গুলির কথা। কেবল পাহাড়-পর্বতে যোগানুষ্ঠান করলেই হবে না, তাদের এখন নিম্নভূমিতে গিয়ে নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়ে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করতে হবে। তাই বাবা লোকনাথ বেণীমাধবকে সেই কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং দুজনে চন্দ্রনাথ পাহাড় ত্যাগ করতে মনস্থ করলেন।


চন্দ্রনাথ পাহাড় ত্যাগ করা দুই মহাযোগীর কাছে কেবল স্থান ত্যাগ করা নয়। নিম্নভূমিতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দুজনের নিষ্কামকর্মে ব্ৰতী হতে হবে। তার জন্য এই দুই মহাযোগীর দীর্ঘজীবনের অভিন্নসঙ্গও ত্যাগ করতে হবে। জন্মের পর থেকেই দুজন অভিন্ন সঙ্গী হয়েছিলেন। একইদিনে উপনয়ন হয়ে এগারো বছর বয়সে দুজনে একসঙ্গে গুরুর হাত ধরে সন্ন্যাসী হবার বাসনায় ঘর ছেড়েছিলেন। দুজনে একসঙ্গে সাধনযাত্রার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সিদ্ধিলাভ করেছেন, বিশ্বপর্যটন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছরের সঙ্গ চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এখন তাদের ভিন্ন স্থানে নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হতে হবে। এ বড় কঠিন কাজ। কিন্তু এই দুই মহাযোগী জীবনে অনেক কঠিন, অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছেন। আজও তারা এই কঠিন কাজকে সহজ করে নিয়ে নিজ নিজ বাসনা ব্যক্ত করলেন। ব্রহ্মচারী বেণীমাধব তার হৃদয়ের অভিন্ন সঙ্গী বাবা লোকনাথকে বললেন, তিনি দেবীর একান্নপীঠের অন্যতম কামরূপ তীর্থে গিয়ে কামাখ্যাধামে কর্মে রত হবেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী বেণীমাধব ব্রহ্মচারীকে বললেন, তিনি তার নিম্নভূমির কর্মস্থলের পথে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। দুই মহাযোগীর এই কথোপকথন কোনো বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে হল না, কারণ, দুজনেই বাকরহিত। উচ্চমার্গের যোগীগণ যোগের মাধ্যমেই তাদের ভাবের আদানপ্রদান করেন। একজনের ইচ্ছা অন্যজন বুঝতে পারেন। মহাযোগীদের এই এক অপূর্ব যোগলীলা। নর্মদা পরিক্রমাকালে উচ্চমার্গের মুনিদের এইরূপ যোগলীলার কথা আমি শুনেছি। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যে স্থানে দাঁড়িয়ে দুই মহাযোগী তারা তাদের বাসনা প্রকাশ করলেন, সেখান থেকে এই দুই যোগীর যাত্রাপথ ভিন্ন হল বেণীমাধব এগিয়ে চলেন কামাখ্যা ধামের পথে আর বাবা লোকনাথ এগিয়ে চলেন ত্রিপুরার পথে। চন্দ্রনাথ পাহাড় হয়ে ওঠে এক প্রসিদ্ধ শিবতীর্থ (বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত)।


.


ত্রিপুরার দাউদকান্তি (কাঁদি) গ্রামে বাবা লোকনাথ


অনেক পথ ঘুরতে ঘুরতে বাবা লোকনাথ ত্রিপুরার দাউদকান্তি গ্রামে পৌঁছে একটি বৃক্ষের নিচে বিশ্রামের জন্য বসলেন। এই গ্রামটিতে হিন্দু-মুসলমান চাষীদের বাস ছিল। বাবা লোকনাথ এইখানেই নগ্নদেহে অনাহারে কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। মুখ দিয়ে তাঁর কোনো বাক্য বের হয় না, সেজন্য তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথাও বলতে পারেন না। একদিন একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে চাষের ক্ষেতে আব্বার জন্য খাবার নিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করলো, গাছতলায় একটি সন্ন্যাসী বসে আছেন। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না এবং কিছু খানও না। সন্ন্যাসীকে দেখে মেয়েটির মনে দয়া হল এবং সে তার কাছে গিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। বাবা লোকনাথ কেবল তারদিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো বাক্য বের হল না। মেয়েটি তখন বাড়ি থেকে কিছু খাবার এনে তাকে খেতে দিলেন। কিন্তু দীর্ঘসময় কোনো শক্ত খাবার গ্রহণ না করার জন্য তিনি জিহ্বাতে কোনো খাবার নিতে পারলেন না। তার খাদ্য গ্রহণের অক্ষমতা দেখে মেয়েটির মনে করুণা হল। সে তখনই বাড়ি গিয়ে গরম দুধ এনে চামচে করে নিজেই বাবা লোকনাথকে খাইয়ে দিলো। এইভাবে মেয়েটি রোজ বাবার কাছে এসে তাকে সযত্নে দুধ খাইয়ে যায়। একদিন সে সুজির পায়েস (মোহন ভোগের মতো) এনে বাবাকে খাইয়ে দিলো। এইভাবে কয়েকদিন খাওয়াবার পর তিনি একটু করে খাদ্যগ্রহণে সমর্থ হলেন এবং দুই-একটি কথা উচ্চারণ করতে সমর্থ হলেন। মেয়েটি তখন বুঝলো যে সন্ন্যাসী বাবা অনেকদিন অনাহারে থাকার জন্যই কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। সে রোজ খাবার এনে বাবাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। এইভাবে বাবা শরীরে কিছু শক্তি সঞ্চয় করলেন এবং বাকশক্তি ফিরে পেলেন। কিছুদিন খাদ্যগ্রহণ করার পর তিনি দেখলেন, তার রক্তের রঙ, যা সাধনার সময় রসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার লাল হচ্ছে। তিনি সেই মেয়েটিকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সেই নিম্নভূমিতে প্রথম ব্যক্তি যে বাবার কৃপালাভ করেছিল।


কিছুদিন একই স্থানে কাটাবার পর বাবা লোকনাথ স্মরণ করলেন যে, তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। সেই গ্রাম ছেড়ে তিনি আবার পথ চলা শুরু করলেন। একদিন তিনি পথে একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। এই জায়গাটি অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কাছাকাছি ছিল। কুমিল্লা জেলা ত্রিপুরার লাগোয়া। তিনি যখন বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন, সেইসময় ডেঙ্গু কর্মকার নামক এক ব্যক্তি তাকে দেখতে পান। ডেঙ্গু কর্মকার একজন উলঙ্গ জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে বৃক্ষের নিচে বসে থাকতে দেখে তাঁর কাছে যান। ডেঙ্গু কর্মকার ছিলেন এক ফৌজদারী মামলার আসামী। প্রতিদিন ওই পথে তিনি উকিলের কাছে যাতায়াত করতেন। বাবা লোকনাথের উজ্জ্বল অঙ্গকান্তি ও অপলক চক্ষু দেখে তার মনে ভক্তিভাব হয় এবং তিনি তার আশীর্বাদ নেবার জন্য তার কাছে যান। তিনি বলেন আমি ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বারদী গ্রাম নিবাসী। দাউদকান্তি গ্রামে বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য আমাকে প্রায়শঃই আসতে হয়। আমি বর্তমানে একজন ফৌজদারী মামলার আসামী। কিছু ব্যক্তি শত্রুতা করে আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন যেন আমি এই মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পাই। বাবা ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, ওই ব্যক্তি নির্দোষ। তিনি তাকে অভয় দিয়ে বললেন, তুই বাড়ি যা। তোর কোনো ভয় নেই। আদালতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তুই দেখবি, তুই খালাস পেয়েছিস। এই অভয়বাণী শুনে ডেঙ্গু কর্মকার সেদিন বাড়ি ফিরে গেলো। এরপর আদালতে রায়দানের নির্দিষ্ট দিনে অত্যন্ত আশঙ্কা নিয়ে ডেঙ্গু কর্মকার এজলাসে উপস্থিত হন। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে শেষপর্যন্ত তিনি বুঝি হেরেই যাবেন এবং তার ফল নিশ্চিত জেল। কিন্তু প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিচার শেষে বিচারক ডেঙ্গু কর্মকারকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে রায় দেওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে যান।


ডেঙ্গু কর্মকার আনন্দে আত্মহারা হলেও তার মনে পড়ে যায় গাছতলায় বসে থাকা সেই নাগাসন্ন্যাসীর কথা। তিনি আদালত থেকে বেরিয়েই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করেন ওই গাছতলার দিকে। বাবা লোকনাথ তখন ধ্যানস্থ। তাঁর পা জড়িয়ে ধরে ডেঙ্গু কর্মকার হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। বাবাকে কিছু জানাতে হয় না, কারণ তিনি নিজেই তো সূক্ষ্মরূপ নিয়ে আদালতে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করেছেন। ডেঙ্গু বলেন, এই খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় আপনাকে রেখে আমি যাবো না। আপনি দেবতা, মহাপুরুষ। আপনি বারদীতে আমার বাড়িতে চলুন। সেখানে আমার সেবায় আপনি থাকবেন। তা না হলে আমি আপনার এই শ্রীচরণেই পড়ে থাকবো।


বাবা লোকনাথ তাঁকে পা ছাড়তে বলে ধ্যানাবিষ্ট হলেন। ধ্যানযোগেই তিনি জানতে পারলেন, যে কর্মের জন্য তিনি পাহাড় থেকে নিম্নভূমিতে এসেছেন, সেই কর্মস্থল বারদী। সেখানেই তিনি দেখা পাবেন তার পরমগুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির বর্তমান জন্মের শরীর। মা কমলাদেবীও বর্তমান জন্মে সেখানে আছেন। আজ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় এসেছে। গুরু নির্দেশিত লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজও সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। এইসব ভেবে ঈশ্বরের ঐকান্তিক ইচ্ছায় তিনি ডেঙ্গু কর্মকারের প্রস্তাবে সম্মত হলেন।


.


বাবা লোকনাথের বারদী আগমন


ঢাকা জেলার মেঘনা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় বারদী ছিল এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই অঞ্চলটি ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বতীরে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদের এই পূর্বতীর সোনারগাঁ নামে প্রসিদ্ধ। সেইসময় সোনারগাঁ হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। জলযান এই অঞ্চলের মুখ্য যাতায়াতের মাধ্যম ছিল।


আনুমানিক বাংলা ১২৭০ সনে বাবা লোকনাথ বারদী গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। ওইসময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ১৩৩ বছর। প্রথম যখন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদী পদার্পণ করেছিলেন, তখন বারদীবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল এক দীর্ঘদেহী, আজানুলম্বিত বাহু, ভূতলস্পর্শী বিশাল জটা ও শ্বেত-শুভ্র শ্মশ্রু সমন্বিত এক মহাপুরুষকে। যার দুই হাত ও পায়ে বড় বড় নখ। যাঁর দৃষ্টি ছিল পলকহীন। দীর্ঘ কয়েক দশক বরফের দেশে অবস্থানের জন্য তার গাত্রচর্ম ছিল শ্বেতশুভ্র। তখনকার দিনে গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সমাজ ছিল ভীষণরকম রক্ষণশীল। ডেঙ্গু কর্মকার এই মহাপুরুষের অলৌকিক শক্তির পরিচয় পেলেও গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু-মুসলমান সমাজ নগ্নদেহী সাধুকে প্রথমে সুনজরে দেখেনি। ডেঙ্গু কর্মকারের পরিবারের লোকেরাও এই নগ্ন সন্ন্যাসী দর্শনে খুশি হয়নি। সেজন্য প্রথমে বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়িতে রক্ষিত একটি জীর্ণ নৌকার ছৈয়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ জ্ঞান ছিল না। তার কাছে বস্ত্র ও বিবস্ত্রর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়ির লোকেরা ও গ্রামের লোকেরা এই উলঙ্গ সাধু দেখে খুব বিরক্ত হতেন। গ্রামের রাস্তায় দেখতে পেলে তার প্রতি সকলে কটুক্তি করতে এবং ছোটো ছেলেমেয়েরা তাকে পাগল মনে করে ঢিল ছুঁড়তো। বাবা কেবল তাদের প্রতি নীরবে করুণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। যখন গ্রামের ছেলেরা তাকে পাগল বলে তাড়া করতে তিনি স্মিত হাস্যে তাদের প্রতি করুণাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ডেঙ্গু কর্মকারের সন্তানরা বাবা লোকনাথের আগমনে খুশি হতে পারেননি। ডেঙ্গু কর্মকার একজন নগ্ন পাগলপ্রায় সাধুকে বাড়িতে এনেছেন দেখে তার পরিবারও আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গু কর্মকার যখন তাঁর স্ত্রীর কাছে মামলায় খালাস পাওয়ার কথা বলেন, তখন তিনি আর আপত্তি করেননি। তিনি বুঝেছিলেন, নিশ্চয়ই এই সাধুর কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু গ্রামবাসী ও গ্রামের অন্য ব্রাহ্মণদের মনে এই সাধুকে নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। তারা প্রশ্ন করলো, যদি এই সাধু ব্রাহ্মণ হবেন, তবে তার যজ্ঞোপবীত নেই কেন? তিনি যে সত্যই ব্রাহ্মণ, তার প্রমাণ কি? একরাশ জটাজুট ও দাড়ি নিয়ে বিবস্ত্র হয়ে যোগাসনে বসে থাকলেই তো আর সাধু হওয়া যায় না! এই লোকটি কোনো ভণ্ড তপস্বীও হতে পারে। অনেকে তাকে বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বলে মনে করলো। গ্রামবাসী ও ব্রাহ্মণদের এইরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করা সত্তেও ডেঙ্গু কর্মকার নির্বিকার এবং বাবা লোকনাথকে গৃহে স্থান দেবার ব্যাপারে অটল রইলেন। গ্রামবাসীরা বাবা লোকনাথকে পাগল বলে উপেক্ষা করতে লাগলো।


এরপর একদিন ঘটলো এক চমৎকার ব্যাপার। একটি বাড়ির বাইরের বারান্দায় বসে তিনজন প্রবীণ ব্রাহ্মণ সকালে স্নানান্তে পৈতা গ্রন্থি দিচ্ছিলেন। কিন্তু পৈতার সুতো এমনভাবে জট পাকিয়ে গিয়েছিল যে, তারা কিছুতেই তা খুলতে পারছিলেন না। বাবা লোকনাথ সেইসময় ব্রহ্মপুত্র নদীতে স্নান সেরে সেই পথে ফিরছিলেন। তিন ব্রাহ্মণের গলদঘর্ম অবস্থা দেখে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ধীর পায়ে তাদের কাছে গিয়ে বললেন, কি, খুব সমস্যায় পড়েছে, তাই না? প্রবীণ ব্রাহ্মণত্রয় হৈ হৈ করে বললেন, তোর এখানে কি চাই? দূরে সরে দাঁড়া। আমরা স্নান সেরে এসেছি। তুই ছুঁয়ে দিলে আবার ডুব দিতে হবে। যা, নিজের কাজে যা। বাবা লোকনাথ স্মিত হেসে বললেন, কেন? ছুঁয়ে দিলে কি হবে? আমি ছুঁলে তোমাদের কি জাত যাবে? ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে একজন তখন খেঁকিয়ে বলে উঠলেন, জাত তো যাবেই; জাত যাবে কিনা নিজে বুঝিস না হতচ্ছারা! তোর কি জাতের ঠিক আছে? মাথায় জটা রেখে গায়ে ভষ্ম মাখলেই যদি সাধু হওয়া যেত, তবে সাধু সন্ন্যাসীতে দেশ ছেয়ে যেত! বাবা লোকনাথ ব্রাহ্মণের কথায় বিন্দুমাত্র উম্মা প্রকাশ না করে স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি গোত্র গা? প্রবীণ ব্রাহ্মণটি বললেন, কাশ্যপ গোত্র। বাবা লোকনাথ উচ্চারণ করলেন-কাশ্যপ গোত্র? ‘কাশ্যপ–অবসর-নৈ ধ্রুব প্রবর’ বাবা লোকনাথের মুখে এই কথা শুনে তিন অহঙ্কারী ব্রাহ্মণ কেবল হতচকিতই হলেন না, বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে মহাযোগী বাবা লোকনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহূর্ত আগে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে যাদের মধ্যে আত্মম্ভরী ভাব প্রকট হয়েছিল, তারা এক পাগলপ্রায় বিবস্ত্র সাধুর মুখে কাশ্যপ গোত্রের গোত্ৰপবিতের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। মহাযোগী বাবা লোকনাথ তাদের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। প্রবীণ ব্রাহ্মণটি বিস্ময়াবিষ্ট থেকেই নীরবে হাতের জট পাকানো পৈতেটি যন্ত্রের মতো বাবা লোকনাথের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু তিনি বাবা লোকনাথকে স্পর্শ করলেন না। বাবা লোকনাথ মুচকি হেসে বললেন, পাক লেগে যাওয়া পৈতে খুলতে হলে গায়ত্রী জপ করতে হয় গা। তবে গায়ত্রী জপে উচ্চারণ পরিষ্কার হওয়া দরকার। তারপর তিনি অস্ফুট স্বরে গায়ত্রী জপ করতে করতে জট পাকানো পৈতেটির দুই প্রান্ত ধরে সজোরে টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৈতের পাঁচ খুলে গেল। ব্রাহ্মণত্রয় একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। তাদের চোখের ভাষা প্রকাশ করছিল–এ কোনো ছদ্মবেশী মহাপুরুষ নয় তো? মহাযোগী বাবা লোকনাথ পৈতের জট খুলে দিয়ে কাঠের খরম পায়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন। অহঙ্কারী ব্রাহ্মণত্রয় সেই পথের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলেন। এই ঘটনা মুখে মুখে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। গ্রামের সমাজপতিগণ ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় যারা এতদিন সেই মহাযোগীর অপযশ কীর্তন করে বেড়াতেন তারা এখন তাকে ছদ্মবেশী কোনো মহাপুরুষ মনে করলেন এবং তাঁর চরণে আশ্রয় নিলেন। গ্রামবাসীরাও তাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে আরম্ভ করলেন।


এদিকে মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ বারদী গ্রামে আগমনের পর গ্রামের প্রভুত উন্নতি হতে থাকে। তার আগমনের পূর্বে এই গ্রামে বসন্ত, কলেরা মহামারীতে প্রতি বছর অনেক লোক মারা যেত। কিন্তু এই মহাপুরুষের আগমনে সেই মড়ক বন্ধ হয়ে যায়। চাষীরা ক্ষেতে ভালো ফসল পেতে আরম্ভ করে। অনাবৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। মৎসজীবীরা নদীতে প্রচুর মাছ পেতে থাকে। গ্রামের সর্বদিক থেকে উন্নতি লক্ষিত হয়। গ্রামের লোকেরা তাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে এবং তার কাছে যা মানত করে, তা সিদ্ধ হয়। সমস্ত গ্রামবাসীরা এই মহাযোগীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।


এইসময় ইংরেজ নীলকর ওয়াইজ সাহেবের সঙ্গে নীলের কুঠি নিয়ে জমিদার নাগবাবুদের সঙ্গে জোর দাঙ্গা বাঁধে। ইংরেজদের অস্ত্রবলে জমিদার ভীত হয়ে পড়েন। তখন তার কানে তারই গ্রামের বসবাসকারী এক মহাযোগীর কথা যায়। তিনি জানতে পারেন, এই যোগী একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ। জমিদার নাগবাবু তখন সেই মহাপুরুষের শরণাপন্ন হলেন। মহাযোগেশ্বর তাকে অভয় দেন। বাবা লোকনাথের আশীর্বাদে জমিদারের জয় হয় এবং ওয়াইজ সাহেবের নীলকুঠি উঠে যায়। এই ঘটনার পর বারদীর জমিদার নাগবাবুদের বাবা লোকনাথের উপর ভক্তিশ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। তারা নিয়মিত বাবার কাছে যাতায়াত শুরু করেন।


এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ডেঙ্গু কর্মকারের মৃত্যু হয়। তার ছেলেরা কোনোদিনই বাবা লোকনাথের বাড়িতে অবস্থান ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল যে যদি এই সন্ন্যাসী এখানে কোনো আশ্রম গড়ে তোলে তবে তাদের ভাগের অনেকটা জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে, তাই তারা বাবার অনুপস্থিতিতে বাড়ির মেয়েদের অসুবিধার কারণ জানিয়ে তাকে অন্যত্র চলে যেতে বলে। বাবা তাদের বলেন, আমি সন্ন্যাসী। এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে তোমাদের কিসে ভালো হয়, কিসে মঙ্গল হয়, তোমরা বোঝ নি।


বাবা লোকনাথ কর্মকার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন, এই কথা গ্রামে প্রচার হয়ে যায়। সে কথা ক্রমে জমিদার নাগবাবুর কানে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ মহাযোগীর দর্শনে এসে তার কাছে নিবেদন করেন যে, তাদের জায়গায় বাবার জন্য তিনি একটি আশ্রম গড়ে দিতে আগ্রহী। তিনি বাবার কাছে প্রার্থনা করেন তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হবার জন্য। কিন্তু বাবা বলেন, আমি সন্ন্যাসী। তোমাকে খাজনা কোথা থেকে দেবো? যদি তোমরা আমাকে এমন কোনো জায়গা দিতে পারো, যেখানে কোনো খাজনা দিতে হবে না, তবে আমি সেখানে আশ্রম করতে পারি। তখন জমিদার নাগবাবু বললেন, গ্রামের পূর্বদিকে শ্মশানের কাছে একটি পতিত জমি আছে। সেখানে শবদাহ হয় বলে কোনো খাজনা দিতে হয় না। আমি সে জায়গায় আপনাকে আশ্রম বানিয়ে দেবো। বাবা লোকনাথ জমিদারের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বারদীর নাগবাবু শ্মশান সংলগ্ন জমিতে বাবা লোকনাথের জন্য আশ্রম বানিয়ে বাবার আসনঘর তিনি নিজের হাতে ছনের চাল দিয়ে তৈরি করেন।


এই আশ্রমে বাবার আসন ঘরের বাইরে বড় উঠান ছিল এবং সোজাসুজি একটি বেলগাছ ছিল। বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়ি ত্যাগ করে এই আশ্রমেই তার বারদী লীলা করেছিলেন। ঈশ্বরকোটির মহাপুরুষ বলেই মহাযোগী বাবা লোকনাথ লোকালয়ে আবির্ভূত হয়ে লোকশিক্ষার ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। জীবকোটির সিদ্ধ মহাপুরুষগণ ব্রহ্মদর্শনের পর ব্রহ্মলীন থাকেন, তারা নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন না। ঈশ্বরকোটির মহাপুরুষরূপে মহাযোগী বাবা লোকনাথের প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটে বারদীর এই আশ্রমে। এইরূপ মহাপুরুষ নিজেরা স্বয়ংই আত্মপ্রকাশ ঘটান। তারা স্বেচ্ছায় প্রকাশ না করলে, কেউ তাঁদের নাগাল পায় না। বাবা নিজেও বলেছেন, আমি ধরা না দিলে, আমায় ধরতে পারে কার বাপের সাধ্যি! এতদিনে বাবা কোটিতে বস্ত্র ধারণ শুরু করেছেন। একই বস্ত্রে শরীর আবৃত থাকত।


বারদীর এই আশ্রম যেদিন প্রতিষ্ঠা হল সেদিন উঠানে উপস্থিত গ্রামবাসীদের বাবা সেবা করিয়েছিলেন। সেদিন জমিদার নাগবাবুদের পরিবারবর্গও উপস্থিত ছিল। উঠানে যখন কলাপাতায় ভোগ পরিবেশন হচ্ছে, তখন বাবা দেখতে পেলেন এক কোণে একজন সাদা থান পরিহিতা মহিলা বসেছেন। তাকে খাদ্য পরিবেশন করা হয়েছে। বাবা স্মিতহাস্যে তাঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মা তুমি কোথা থেকে এসেছো? সেই মহিলা বললেন, আমি গোয়ালিনী, আমার গরু আছে, কাছেই থাকি। দুধ বিক্রি করেই আমার দিন চলে। বাবা দিব্যদৃষ্টিতে এই গোয়ালিনী মায়ের মধ্যে তাঁর মা কমলাদেবীকে চিনতে পারলেন। পূর্বজন্মে এই গোয়ালিনী ছিলেন তাঁর জন্মদাত্রী। উপনয়নের সময় দণ্ডীঘরে তিনি মাকে কথা দিয়েছিলেন, পরজন্মে আবার তাকে পুত্ররূপে দেখা দেবেন। এখন সেই সময় সমাগত। তিনি গোয়ালিনী মাকে বললেন, রোজ তাকে দুধ খাওয়াতে। বারদীর এই আশ্রম থেকেই মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ধরাধামের লীলা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আশ্রমের ঠিকানা–শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, বারদী, সোনারগাঁ, মহকুমা? নারায়ণগঞ্জ, জেলা-ঢাকা, বাংলাদেশ।


ডেঙ্গু কর্মকারের পরিবারের যারা একদিন বাবাকে চরম অসম্মান ও অবজ্ঞা করে বিতাড়িত করেছিল, অল্প কিছুকালের মধ্যেই সেই পরিবারে চরম সংকট ও বিপর্যয় নেমে আসে। গোটা সংসারটাই ধনেমানে বিনষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে মাত্র দু’জন মানুষ জীবিত থাকে। যে বাড়ি থেকে একজন ঈশ্বরকোটি ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগীকে বিতাড়িত হতে হয় সেখানে কি ঈশ্বর অবস্থান করতে পারেন! অবশেষে যখন বাকি দুজন তাদের ভুল বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।


কিন্তু এই বারদী আগমনও তার কাছে নিষ্কন্টক হল না। বারদী জমিদারদের অনেক শরিক ছিল। কোনো কোনো শরিক বলতে লাগলো, পৈতে নেই একজন ল্যাংটা সাধু আবার মহাপুরুষ হয় কি করে? একজন ল্যাংটা সাধুকে এখানে ঠাই দিলে মেয়েরা কি মনে করবে। সেই জন্য বাবা যখন বারদী আশ্রমে পদার্পণ করেন, তিনি নাগবাবুদের কাছ থেকে একটি পৈতা ও একটি শ্বেতবস্ত্র গ্রহণ করেন। তাও কোনো কোনো শরিকদের বৈরী ভাব যায় না। একজন শরিক বলেন, বাবা যদি এতই বড় মহাপুরুষ, এক সের দুধের মিষ্টান্ন রান্না কইরা সারা বারদী গ্রামের লোকরে খাওয়াউক তো দেখি! সেই কথা বাবা জানতে পারলেন। বাবা আশ্রমের ভোগশালায় এক সের দুধের পায়েস বানাতে বললেন। পায়েসকে বাংলাদেশে মিষ্টান্ন বলা হয়। সেই পায়েস তৈরি হলে বাবা সেই হাঁড়ি স্পর্শ করে সারা বারদী গ্রামের লোককে প্রসাদ দিতে বলেন। সেদিন সেই এক সের দুধের পায়েস প্রসাদ একহাতা করে সারা বারদী গ্রামের লোক পেয়ে ধন্য হয়েছিল। যতক্ষণ একজন লোকও বাকি ছিল, হাঁড়ির পায়েস শেষ হয়নি। এমনকি জমিদারদের বৈরী শরিকও সেই প্রসাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন এবং বাবার কৃপা ভিক্ষা করেছিলেন।


বারদী গ্রামে এইভাবেই বাবা নিজের লীলা শুরু করেন।

সপ্তম অধ্যায় – বারদীতে মহাযোগেশ্বরের যোগসিদ্ধি প্রকাশ ও মানবকল্যাণ


মহাযোগী বাবালোকনাথ ব্রহ্মচারী শতাধিক বৎসর যোগসাধনা করে যে অনন্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং দেবস্বারূপ্য লাভ করেছিলেন, তার তুলনা কলিযুগে যোগসাধনার ইতিহাসে বিরল। পঞ্চভূতে তৈরি এক মানবদেহকে কঠোর যোগসাধনার মাধ্যমে কিরূপে দেবদেহে উন্নীত করা যায়, এই যোগেশ্বরের সিদ্ধজীবনী তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার একনিষ্ঠ যোগসাধনার মাধ্যমে এ কথা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন যে, মানবদেহেই বৈদিক দেবতাগণ অবস্থান করেন এবং একাগ্র যোগসাধনার মাধ্যমে তাদের জাগ্রত করে মানবদেহকে দেবদেহে রূপান্তরিত করা সম্ভব। অথর্ববেদে মানবদেহে তেত্রিশ বৈদিক দেবতার অবস্থানের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই দেবতাদের জাগ্রত করে মানবদেহকে দেবস্বারূপ্য করার প্রক্রিয়া মহাযোগী বাবালোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগজীবন থেকেই জানা যায়। এইরূপ ঈশ্বরকোটির যোগী তাঁর সাধনালব্ধ সিদ্ধি কেবল নিজ মুক্তির কাজে প্রয়োগ করেননা। বাবাসোকনাথ তাঁর সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়ে বারদীতে প্রায় ২৬ বছর বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করে গেছেন এবং দেবলোক হতে এখনও তার অনন্য সিদ্ধির বলে ভক্তদের কৃপা করে চলেছেন। বারদীতে সিদ্ধির প্রকাশ ছিল যোগীদের জন্য প্রথম লোকশিক্ষা যে, মানবদেহকে সুকঠোর যোগসাধনার মাধ্যমে দেবদেহে উন্নীত করা যায়। এখন এমন অনেক সাধু-সন্ত দেখতে পাওয়া যায়, যারা একটি-দুটি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলেই নিজেদের মহাযোগী বলে প্রচার করেন। এইরকম সাধকগণ নিজেদের যোগবিভূতিতেই আটকে রাখেন। ঈশ্বরের সান্নিধ্য তাদের লাভ হয় না। বাবালোকনাথ তার অর্জিত বিভিন্ন সিদ্ধিকে কিভাবে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে প্রয়োগ করেছিলেন, এই অধ্যায়ে আমরা সেই কথা জানবো।


.


প্রাপ্তি সিদ্ধিদ্বারা জীবের প্রতি অহিংসা শিক্ষা


প্রাপ্তি সিদ্ধির অধিকারী নিজের ইন্দ্রিয়শক্তির সঙ্গে সমস্ত প্রাণীদের ইন্দ্রিয়শক্তির সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এজন্য এই সিদ্ধির অধিকারী সাধক বিনা বাক্যব্যয়ে অন্য প্রাণীদের মনের ভাব বুঝতে পারেন এবং বাক্যদ্বারা ও ব্যবহারে নিজের মনের ভাব অন্য প্রাণীদের মনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। অষ্টাঙ্গ যোগাসনে যম-এর অনুষ্ঠানে অহিংসাব্রতে সিদ্ধ হলেই যোগী এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হন। এই সিদ্ধিবলে বাবা লোকনাথ যে কোনো কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী অথবা সরীসৃপের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনে সক্ষম ছিলেন। যোগসাধন কালে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে হিংস্ৰপ্ৰাণীগণ জঙ্গলে বাবার নিকটে এসে তার বশ্যতা স্বীকার করে চলে গেছে। তার প্রতি কোনো হিংস্রভাব প্রদর্শন করেনি। বারদীতে বিভিন্ন সময়ে এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়ে বাবা জনমানসকে এই শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন যে, অহিংসার মাধ্যমে যে-কোনো হিংস্র প্রাণীকে বশ করা যায়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বাঘিনীর ঘটনা এ কথা প্রমাণ করে যে, বনের হিংস্র জন্তুরাও বাবার কথা বুঝতে পারে। অর্থাৎ বাবার ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তারা নিজেদের ইন্দ্রিয়ের যোগস্থাপনা করতে পারতো। এই সিদ্ধির প্রকাশ আবার বারদীতে দেখতে পাওয়া যায়।


লোকনাথবাবার বারদীতে আগমনে সেখানকার সমাজপতিরা অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে, এই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যোগী যদি এই গ্রামে বাস করেন, তবে উত্তরোত্তর তার ভক্তসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রামে সমাজপতি ও তথাকথিত ব্রাহ্মণদের গুরুত্ব কমবে। এজন্য তারা ভাবতেন, কিভাবে এই যোগীকে বারদী থেকে বিতাড়িত করা যায়। এই সমাজপতিদের কারও এমন সামর্থ ছিল যে তারা মুখোমুখি শাস্ত্রালোচনার মাধ্যমে তাকে পরাজিত করতে পারেন। তারপর গ্রামের জমিদার স্বয়ং যেখানে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েছেন, তখন জমিদারের কাছে গেলেও তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবার আশা নেই। প্রথমদিকে তারা চেষ্টা করেছিলেন গ্রামের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে বাবার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন বাবার দ্বারা উপকৃত হতে লাগলেন, তখন ক্রমশঃ বিভিন্ন জেলা থেকে লোক এসে বারদী আশ্রমে বাবার কৃপা লাভ করতে লাগলো। বাবার নাম বারদী থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কাজেই সমাজপতিরা এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতলব ছেড়ে এবার বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোককে ক্ষেপিয়ে তোলা শুরু করলেন। ঢাকা জেলায় সেই সময় ব্রাহ্মসমাজের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রভাব ঢাকা জেলায় যত বাড়তে থাকে, ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব তত কমতে থাকে। ব্রাহ্মসমাজের সভ্যরা ব্রহ্মের উপাসনা করলেও বাবালোকনাথের মতো কোনো ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তাদের তৎকালীন সমাজে ছিলেন না। সেজন্য লোকনাথ বাবার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে শক্তিহীন করার মতো কোনো শক্তি সেই সমাজের ছিল না। কিন্তু লোকনাথ বাবার প্রভাবে তাঁদের সমাজের ক্রমহ্রাসমান প্রতিপত্তিতে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অমিত যোগশক্তির অধিকারী এই ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে বিরুদ্ধ প্রচারের মাধ্যাম বারদী থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হবে না। এর উপর তখন বারদী ও তার আশেপাশের সমস্ত গ্রামের সকল সম্প্রদায়ের লোকই লোকনাথ বাবার পরম ভক্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্য তাঁরা ও বারদী সমাজপতিরা মিলে এক ষড়যন্ত্র রচনা করলেন। তাঁরা দুজন হীন প্রকৃতির ব্রাহ্ম যুবককে নিয়োগ করলেন লোকনাথ বাবাকে রাতের অন্ধকারে মেরে বারদী থেকে তাড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র পার করে দিয়ে আসতে। ব্রাহ্ম যুবক দু’জন ঠিক করলো রাতের অন্ধকারে বারদী আশ্রমে গিয়ে তারা এই কাজ সারবে। একদিন গভীর রাতে যখন চারিদিক অন্ধকারে ডুবে আছে এবং আশ্রমের সবাই নিদ্রায় মগ্ন, সেইসময় দু’জন আশ্রমে হাজির হলো। নিশুতি রাত। আশ্রম নিস্তব্ধ। তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যুবক দু’জন লাঠি নিয়ে আশ্রমের উঠোনে বাবার ঘরের বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে একটি হিংস্র বাঘিনী গর্জন করতে করতে আশ্রমের দ্বারের দিকে ছুটে এলো। যুবক দুজন ভয় পেয়ে চিৎকার করে আশ্রমের একটি ঘরে ঢুকে লুকিয়ে রইলো। বাঘিনী প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে উঠোন পার হয়ে লোকনাথবাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। যুবক দুজন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল যে, লোকনাথবাবা তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসছেন। তারা মনে মনে আনন্দিত হল যে, এবার তাদের কাজটা বাঘিনী করে দেবে। তাদের আর মারতে হবে না। বাঘিনীর সেই নরহত্যালীলা দেখবার আশায় তারা বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা ভাবছিল, এইবার বাঘিনী বাবার উপর লাফিয়ে পড়ে দেহটাকে ছিঁড়ে খাবে আর ঘাড়ে করে নিয়ে চলে যাবে। তাদের আর বাবার দেহ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার করতে হবে না। কিন্তু এ কী! হিংস্র বাঘিনীটা গর্জন থামিয়ে চুপ করে পোষা বিড়ালের মতো বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লো। লোকনাথবাবা তখন তার মাথায়-গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, মাগো, তোমার এ-সময়ে আশ্রমে আশা ঠিক হয়নি। দেখছো না, তোমার ভয়ে দুজন যুবক আমার কাছে আসতে পারছে না। তাদের ঘরে লুকিয়ে কত কষ্ট হচ্ছে। লোকনাথবাবার কথা শুনে বাঘিনী শান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে তার মুখপানে একবার তাকিয়ে এক লাফে আশ্রম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। লোকনাথবাবা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। বনের হিংস্র বাঘিনী যে মানুষের কথা বুঝতে পারে, এ সেই যুবকদের কল্পনার অতীত ছিল। তারা যা চোখে দেখলো তা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। এইরকম বিস্ময়কর ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তারা কল্পনায়ও ভাবতে পারে না। লাঠি থেকে তাদের হাতের মুঠি আলগা হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে দুজন ঘামতে থাকে। তারা বুঝতে পারে, যাঁকে তারা মারতে এসেছিল, তিনি কোনো সামান্য সাধু নন, তিনি একজন অসাধারণ অলৌকিক যোগশক্তির অধিকারী। এক মহাপুরুষ, যাঁর সামনে বনের হিংস্র প্রাণীও মাথা নত করে বশ্যতা স্বীকার করে। এইরকম মহাপুরুষকে আঘাত করার জন্য তারা এসেছে, এই মনে করে তাদের মনে অনুশোচনা হলো। তারা গভীরভাবে অনুতপ্ত হয়ে ও লজ্জায় অধোবদন হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকনাথ বাবার চরণে লুটিয়ে পড়লো। বাবার কাছে তারা তাদের আশ্রমে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলো এবং নিজেদের দোষ স্বীকার করে কৃপা ভিক্ষা করলো।


দোষী যত বড় দোষই করুক, যদি সে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে বাবার চিত্ত বিগলিত হয়ে যেত। তিনি সব সময় অপরাধীকে ক্ষমা করতেন। তিনি বলতেন, অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। অনুতপ্ত যুবকদের স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা প্রার্থনায় বাবালোকনাথ তাদের ক্ষমা করে বললেন, যা তোরা বাড়ি যা, এমন কাজ আর করিসনা, তোদের চৈতন্য হোক।


এই লীলা প্রদর্শনের দ্বারা বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে, হিংসা থেকেই হিংসার বৃদ্ধি হয়। ব্রাহ্ম যুবকদের মনে হিংসাবৃত্তি ছিল বলেই বাঘিনী গর্জন করতে করতে তাদের দিকে ছুটে এসেছিল। কিন্তু অহিংসাসিদ্ধ বাবালোকনাথ সামনে দাঁড়াতেই সে গর্জন থামিয়ে তার পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। আবার বাবা চলে যেতে বলতে সে আশ্রম ছেড়ে চলেও গিয়েছিল। মহাযোগীর অহিংসাবৃত্তির প্রভাবে বনের হিংস্র বাঘিনীও হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করেছিল। এই লীলা প্রকাশের মাধ্যমে বাবা তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সমাজে ক্রমবর্ধমান হিংসাবৃত্তি রোধের জন্য এই শিক্ষা প্রচার করতে চেয়েছিলেন যে, বনের এক হিংস্র প্রাণীও অহিংসাবৃত্তি অবলম্বনকারীদের সামনে হিংসাবৃত্তি পরিত্যাগ করে। সেজন্য একই সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক কেন হিংসা বৃত্তি ত্যাগ করে অহিংসভাবে সহাবস্থান করতে পারবে না! এ এক ঈশ্বরকোটি সাধক মহাপুরুষের অমিত যোগৈশ্বর্য প্রকাশের লীলা। মহাশক্তিধর যোগীদের জীবনে এইরকম লীলার বিরল প্রকাশ দেখা যায়। কলিযুগে এই প্রকাশ ছিল বিরলতম।


বাবা লোকনাথের ছিল দয়ার শরীর। কোনো প্রাণীর দুঃখ-কষ্ট দেখলেই তাঁর করুণা হতো। তার কাছের মানুষ ও অন্য জীবের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। একদিন রাতে একজন শিষ্য বাবার ঘরের দক্ষিণদিকের বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে জপের আসন করছেন। তিনি জপ করতে শুরু করবেন, এমন সময় একটি ঘেয়ো কুকুর এসে তার কাছে বসে গা চুলকাতে লাগলো। কুকুরটির গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। শিষ্যটি তখন আসন তুলে নিয়ে পূর্বদিকের বারান্দায় বসলেন। সেখানে জপ শুরু করতে যাবেন এমন সময় সেই কুকুরটি আবারও তার কাছে বসে গা চুলকাতে লাগলো। শিষ্যটি কুকুরটিকে তাড়ালেও সে যায় না। তখন শিষ্যটি সেই জায়গা ছেড়ে আবার অন্য এক জায়গায় গিয়ে আসন পাতলেন। কুকুরটিও সেখানে গিয়ে তার কাছে বসলো। যেহেতু বাবা ঘরে আছেন, সেইজন্য শিষ্যটি চেঁচামেচি করতে পারছেন না, কিন্তু কুকুরের এই আগমনে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন। সে রাগ করে মনে মনে বলছে, বাবা এভাবে আমায় একটা কুকুর দিয়ে বিরক্ত করছেন, জপ করতে দিচ্ছেন না! যেই তিনি এই কথা মনে মনে বললেন, অমনি কুকুরটা সে স্থান ছেড়ে চলে গেল। শিষ্যটি তারপর শান্ত হয়ে জপ করতে বসলেন। কিন্তু কিছুতেই জপে একাগ্র হতে পারলেন না। সারাটা রাত তার অস্থিরতার মধ্যে কাটলো।


পরদিন ভোরবেলায় বাবা দরজা খুলে শিষ্যটিকে বললেন, রাতে তোকে মশা কামড়াচ্ছিল নাকি রে? শিষ্যটি উত্তর দিলেন, না বাবা, মশা নয়। একটা ঘেয়ো কুকুর আমাকে বড় জ্বালাতন করেছে। আমি যেখানে জপ করতে বসি, সেখানেই আমার কাছে বসে গা চুলকোয়। কুকুরটার শরীরের দুর্গন্ধে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।


একথা শুনে বাবা শিষ্যকে বললেন, তুই ওকে ঘৃণা করছিস কেন? ওকে ঘৃণা করার কোনো অধিকার তোর নেই। তোর অসুবিধা হলে, তাড়িয়ে দিবি। যদি সে না যায়, তবে তোকেই সরে যেতে হবে। আমার কথাটা মনে রাখিস।


সামান্য একটা ঘেয়ো কুকুরের প্রতি বাবার এমন অসীম করুণা দেখে শিষ্যটি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই কথা বা লীলা থেকে বাবা দুটি শিক্ষা দিলেন—


(১) কুকুরটি আশ্রয়হীন। সে আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে। তুমি যদি তাতে বিরক্ত হও, তবে তুমি অন্য যে-কোনো জায়গায় যেতে পারো। কিন্তু ঘেয়ো নিরাশ্রয় কুকুরটি যেখানে যাবে, সেখানেই লোকে তাকে তাড়িয়ে দেবে। আশ্রম সকল প্রাণীর। এখানে সে নিরাপদ ভেবেই আশ্রয় নিয়েছে। যদি সে অন্য জায়গায় আশ্রয় পায়, তবে সে নিজেই চলে যাবে, কিন্তু যদি না পায়, তবে তোমার উচিত তাকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া, নতুবা অন্যত্র চলে যাওয়া।


(২) জীবের সেবা করার নামই ধর্ম। জীবকে ঘৃণা করে জপ সাধনা করলে জপসিদ্ধ হওয়া যায় না। সব জীবের প্রতি সমভাবে প্রেম করলেই ঈশ্বর তুষ্ট হন।


এইভাবে বাবা বারদীতে এক একটি লীলার মাধ্যমে লোকশিক্ষার প্রবর্তন করে গেছেন। বাবা বলতেন, ঈশ্বর সর্বভূতাত্মা। ঈশ্বরকে সর্বভূতাত্মারূপে উপাসনা করলে সর্বত্র সমদর্শনরূপ আত্মজ্ঞানের উদয় হয়। সাধক সমদর্শী হয়। সমদর্শী মহাযোগেশ্বর লোকনাথের অন্তরে ছিল অসীম করুণা। এই অন্তহীণ করুণার অমৃত ধারার অধিকারী ছিল মানুষ, হিংস্র প্রাণী, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি সকলে। তিনি তার করুণার বিগলিত ধারায় সকলকে কৃতার্থ করতেন।


বারদী আশ্রমে প্রতিদিন আহারের সময় বাবা উঠোনে এসে ‘আয়, আয়’ বলে ডাক দিতেন। তখন কত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এসে উঠোনে হাজির হতো। আশ্রমের গাছের ডালে ডালে পাখিরা বসে কলরব করতো। কখনও কখনও পাখিরা বাবার জটায়, কাঁধে বসে বিচিত্র সুরে কলরব করতো। বাবা তাদের ভাষা বুঝতেন। আনন্দের সঙ্গে নিজের হাতে তাদের খাইয়ে দিতেন। ছোটে ছোটো পিঁপড়ের সারিতে মিছরির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতেন। তখন তার মুখে এক প্রশান্তি বিরাজ করতো। যতক্ষণ পর্যন্ত না পাখি, কীটপতঙ্গ খেয়ে নিরাপদে আশ্রম ছেড়ে চলে যেত, বাবা সেখানে বসে থাকতেন। তাঁর কাছে শিষ্যদের আহার ও পশুপাখি, কীটপতঙ্গের আহার সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো মানুষ না খেতে পেয়ে মরে গেলেও বর্তমান সমাজপতিদের মনে দাগ কাটে না। কিন্তু একটি পাখি বা কীটও যদি আশ্রম থেকে না খেয়ে যেত, বাবার মন তার জন্য কাঁদতো। যোগসাধনায় সমদর্শী বলতে কি বোঝায়, বাবার এই আচরণ থেকে তা শিক্ষণীয়। এই সমদর্শন ভিন্ন আত্মদর্শন হয় না। আর আত্মদর্শন না হলে সিদ্ধিলাভ কি করে হবে!


একদিন জমিদারবাবু আশ্রমে এসে হাজির হলেন। সাধারণতঃ তিনি এলে সোজা বাবার ঘরে গিয়েই বসেন। তিনি বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই ভিতর থেকে অন্তর্যামী বাবা বলে উঠলেন, বাবা অরুণ, এখন ঘরে আসবি নে। আমার পরিবার খাচ্ছে। খাওয়া হয়ে গেলে ঢুকবি।


বাবার এই কথায় নাগ মহাশয় আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন যে, বাবার পরিবার এখানে কোথা থেকে এলো? পরে ভাবলেন, বোধহয় কোনো কূলবধূ বাবাকে দর্শন করতে এসেছেন। এখন বাবার প্রসাদ পাচ্ছেন। তিনি বাবার আদেশমতো বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। দেখতে দেখতে দু-ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু তখনও বাবা দরজা খুলে বাইরে এলেন না। ঘরের মধ্য থেকে কোনো কথাও শোনা যাচ্ছে না। নাগ মহাশয় ভিতর থেকে কোনো কথা শুনতে না পেয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখলেন। কিন্তু ঘরে কোনো লোক তার গোচরে এলো না। এমন সময় বাবা ঘরের দরজা খুলে বললেন, বাবা অরুণ, এবার তুই ঘরের ভিতরে আসতে পারিস।


নাগবাবু ঘরে ঢুকে বাবাকে প্রণাম করলেন কিন্তু অন্য কোনো ব্যক্তি দেখতে পেলেন না। নিজের ঔৎসুক্য চেপে না রাখতে পেরে তিনি বাবার কাছে নিবেদন করলেন, ব্রহ্মচারী বাবা, আপনি তখন আমায় বললেন, আপনার পরিবার খাচ্ছে। কিন্তু কই, ঘরে তো কাউকে দেখছি না! নাগ মহাশয়ের এই কথা শুনে হাসতে হাসতে বাবা বললেন, ওই দেখ, আমার পরিবার কেমন খেয়ে খুশি মনে চলে যাচ্ছে। বাবার কথা শুনে নাগমহাশয় দেখলেন, একদল পিঁপড়ে সার বেঁধে ঘরের ভিতর থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। নাগবাবু এতক্ষণে বুঝলেন, করুণাময় বাবা নির্জনে ঘরের মধ্যে বসে নিজের হাতে পিঁপড়েদের মিছরির গুড়ো খাওয়াচ্ছিলেন এবং যতক্ষণপর্যন্ত তাদের খাওয়া শেষ না হয়, তিনি নিজে তাদের পাহারা দিচ্ছিলেন। পিঁপড়েদের খাবার সময় যদি কেউ ঘরে ঢোকে, তবে তাদের পদদলিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য বাবা সেই সময় কাউকে ঘরে ঢুকতে দেন না।


জমিদার নাগমহাশয় ভাবতে লাগলেন, পিঁপড়ের মতো এত ক্ষুদ্র জীবের প্রতিও বাবার কত ভালোবাসা, কত করুণা, কত মমতা। মানুষ পিঁপড়ে দেখলেই তাদের মেরে ফেলার ঔষধ খোঁজে। কিন্তু হিংসা ত্যাগ করে কেবল মমতা ভরা ভালোবাসা দিয়ে পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকেও আপন করে নেওয়া যায়। তিনি আরও শিক্ষা গ্রহণ করলেন যে, পিঁপড়ের মতো এত ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্যও বাবা জমিদারকে বাইরে বসে থাকতে আদেশ করেছিলেন। এই আচরণ দ্বারা বাবা এই শিক্ষা প্রবর্তিত করেছিলেন যে, কোনো বড় মানুষ দেখলেই, ছোটোকে দূরে সরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। আদর্শ মানুষের কাছে বড়ো-ছোটো সমান হওয়া উচিত। বর্তমানের কর্তাভজা সমাজে বাবা লোকনাথের এই শিক্ষা কেবলমাত্র প্রাসঙ্গিকই নয়, বোধহয় দুঃস্থ ও পঙ্গু সমাজকে সবল করার জন্য অপরিহার্য্যও বটে।


নর্মদা পরিক্রমার প্রাক্কালে একজন মুনির পরামর্শে অম্বামাতার আশীর্বাদ প্রার্থনার জন্য গুজরাটের অম্বা পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে অম্বা মন্দিরে হোমযজ্ঞ করে আমি নর্মদা পরিক্রমার জন্য সফলতা প্রার্থনা করি। সেই যজ্ঞের সময় মহন্তজী একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার দ্বারা কীট-পতঙ্গাদির যে অনিচ্ছাকৃত হত্যা হয়েছে, তার পাপ স্খলনের জন্য মাতার কাছে প্রার্থনা করেন। আমি এই সময় জানতে পারি যে নর্মদা পরিক্রমা একটি তপস্যা। সাধকের মধ্যে সমদর্শন


এলে তপস্যায় সফল হওয়া যায় না। সমদর্শন থেকেই আত্মদর্শন হয়। আমার তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমা যাতে সফল হয়, সেজন্য আমার পায়ে পদদলিত হয়ে এ যাবৎ যে সব কীটপতঙ্গের মৃত্যু হয়েছে, তার পাপ থেকে আমার মুক্তি কামনাকল্পে এই প্রক্রিয়া করা হলো। তখন বিষয়টা এত গভীরে বুঝিনি। পরে পূর্ণ নর্মদা পরিক্রমাগালে এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। অনিচ্ছাকৃত হিংসা সংঘটিত হলেও সাধকের তপস্যায় সফলতা আসেনা। সাধকের কাছে অহিংসা একটি বড়ো মন্ত্র। সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী সকলের প্রতি সমান করুণা করেন।


একসময় বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার চাষ করার ইচ্ছা হয়। তিনি মনে করেন আশ্রমে ভক্তদের সেবা করানোর দ্রব্য যদি নিজেরা চাষ করে ফলানো যায়, তবে বাইরে থেকে কিনতে হয় না। তিনি জমিদার মহাশয়কে তার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, নাগমহাশয় চাষের ক্ষেত, চাষের দ্রব্য ও লোকজনের সব ব্যবস্থা করে দেন। এক বর্ষাকালে ধান রোপন শুরু করা হলো। শীতকালে যখন ধান পেকে উঠেছে, রোজ রাতে শুয়োরের পাল ক্ষেতে এসে ধান নষ্ট করে দিতে লাগলো। ধান কারা নষ্ট করে দিচ্ছে আশ্রমবাসীরা বুঝতে না পেরে রাতে পাহারার ব্যবস্থা করলো। পাহারাদাররা দ্যাখে রাতে শূয়োরের পাল এসে ধান নষ্ট করছে। তারা লাঠি নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছবার আগেই শূয়োরের পাল দৌড়ে পালিয়ে যায়। এইভাবে প্রতি রাতেই শুয়োরের পাল এসে ধান খেয়ে যায়, কিন্তু কোনোদিন পাহারাদাররা একটিও শূয়োরকে ধরতে পারেনা। তারা ভাবতে থাকে, শূয়োরেরা কি করে জানতে পারে যে তারা লাঠি নিয়ে আসছে, আর তারা পৌঁছনোর আগেই পালিয়ে যায়!


একদিন এক ভক্ত সেই রহস্য ভেদ করলেন। তিনি বললেন, বাবা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে যোগবলে দেখতে পান, রাতে ক্ষেতে কে এসে ধান খাচ্ছে। একদিন আমি শুনলাম, বাবা ঘরের থেকে শূয়োরগুলোকে বলছেন, ওরে তোরা কাজ সেরে তাড়াতাড়ি সরে পড়, লাঠি নিয়ে ওরা তোদের মারতে আসছে। বাবা ঘরের থেকে বলামাত্র শূয়োরগুলো ক্ষেত থেকে দৌড়ে পালায়। বাবার অলৌকিক শক্তিতে অহিংসা সিদ্ধি দ্বারা শূয়োরগুলোর ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন, তাদের নিরাপদ করেন। সব জীবের প্রতি তার এমনই করুণা ছিল। আশ্রমবাসীরা বাবার কাছে গিয়ে এই রহস্যের কথা ব্যক্ত করেন ও তাঁর শ্রীমুখ থেকে আসল ব্যাপারটা জানতে চান। বাবা তখন সকলের কাছে স্বীকার করেন যে, তিনি প্রতি রাতে শুয়োরগুলোকে সতর্ক করে দেন, যাতে তারা নিরাপদে ক্ষেত ত্যাগ করতে পারে। ক্ষেতের যে ফসল তাতে যেমন আশ্রমিকদের অধিকার, তেমনই ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য প্রাণীদেরও অধিকার। এই কথার মাধ্যমে বাবা আশ্রমিকদের এই শিক্ষা দিলেন যে, জগতের সব বস্তু ঈশ্বরের। এই জমি যেমন ঈশ্বরের সৃষ্টি, তেমন প্রাণীরাও তারই সৃষ্টি। সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্ট সব বস্তুতেই সব জীবের সমান অধিকার। মানুষ নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য প্রাণীর অধিকার হরণ করতে পারে না।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই বার্তা যদি সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে প্রচারিত হতো, তবে দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে এত ভেদাভেদ সৃষ্টি হতো না। প্রত্যেক মানুষ নিজেকে অন্যের থেকে বড় মনে করে এবং সেখান থেকেই ভেদাভেদের সৃষ্টি। আরও একটি ঘটনার মাধ্যমে বাবা ভক্তদের এই সম্বন্ধে শিক্ষা দান করেন।


একদিন বারদী স্কুলের পণ্ডিত বিপিনবিহারী সরকার মহাশয় ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। তিনি বাবার ঘরের বাইরে তার সঙ্গে বার্তালাপ করতে থাকেন। এমন সময় আশ্রমের এক গাছের ডালে বসে একটি কাক কর্কশ স্বরে কা-কা করে ডাকতে থাকে। কাকের কর্কশ ডাকে বার্তালাপে ব্যাঘাত ঘটায় বিপিন বিহারী বাবু একটি ঢিল ছুঁড়ে কাকটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আবার বার্তালাপ করতে থাকেন। কিন্তু কাকটা আবার ফিরে এসে একইভাবে কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকে। বিপিনবিহারীবাবু আবার ঢিল ছুঁড়ে কাককে তাড়িয়ে দেন। তখন বাবা লোকনাথ পণ্ডিত বিপিনবিহারীবাবুকে বললেন, কাকের ডাক তোর কাছে কর্কশ লাগছে, তাই তুই ওকে বারবার ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিস। কিন্তু দ্যাখ, তোর কথাও আমার কানে তেমন কর্কশ লাগছে, কিন্তু আমি তোকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না। এই কথা শুনে পণ্ডিত মহাশয় খুব লজ্জিত হয়ে গেলেন। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথ এই কথার মাধ্যমে পণ্ডিত মহাশয়কে এই শিক্ষা দিলেন যে, জগৎ সংসারে সব প্রাণীই ঈশ্বরের সৃষ্টি। তাদের কাউকে ঘৃণা করার অধিকার আমাদের কারও নেই। ঈশ্বরের সৃষ্ট কোনো জীব বা বস্তু যদি কারও কাছে কুৎসিত বা অপ্রিয় মনে হয়, তাহলেও ঈশ্বরের সৃষ্টিকে অনাদর করা মহাপাপ হবে। সংসারী লোকেদের কথাবার্তায় কামনা-বাসনার প্রলেপ থাকে। যোগসিদ্ধ মহাপুরুষগণের সেইসকল কামনা-বাসনাপূর্ণ কথা ভালো লাগে না। তবুও মহাপুরুষরা তাদের তাড়িয়ে না দিয়ে কামনা-বাসনা ত্যাগ করে কি করে সংসারে সুখী হওয়া যায় তার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ ও অহঙ্কার–এই পঞ্চতত্ত্বকে যে জয় করতে পারে, সেই ঈশ্বরমুখী হতে পারে। যতক্ষণ মানুষের মধ্যে এই পঞ্চতত্ত্ব বিরাজিত থাকে, ততক্ষণ সে প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের চরণে কিছু দিতে সমর্থ হয় না।


বারদীর আশ্রমে প্রতিদিন একটি ষাঁড় এসে বাবাকে দর্শন করে যেত। বাবা তার নাম রেখেছিলেন কালাচাঁদ। একদিন বারদীর এক ভক্ত চাষী এসে এক কাঁদি মর্তমান কলা এনে বাবার ঘরের সামনে রেখে তার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে চলে গেল। বাবার ঘর বন্ধ ছিল। ঘরের বারান্দায় আশ্রম-ভৃত্য ভজলেরাম বসেছিল। এমন সময়ে কালাচাঁদ এসে সামনে মর্তমান কলা দেখতে পেয়ে খেতে আরম্ভ করলো। ভজলেরাম এই কাণ্ড দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। তার চেঁচামেচি শুনে চাষী ভক্তটি ফিরে দ্যাখে তার দেওয়া কলার কাদি থেকে ষাঁড়টি সব কলা খেয়ে ফেলছে। সে দৌড়ে এসে ওর মুখের সামনে থেকে কিছু কলা বাঁচিয়ে সরিয়ে রাখলো। এমন সময় বাবা দরজা খুলে বেরিয়ে সেই ভক্তটিকে বললেন, তুই ওর গ্রাসের কলা সরিয়ে নিলি কেন? সেইসময় কালাচাঁদ বাবার মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভক্তটি বললো, বাবা, আমি ওর গ্রাসের কলা নিইনি। কাঁদিতে যে কটা কলা পড়েছিল, সেগুলি সরিয়ে দিয়েছি। বাবা বললেন, যে কলা তুই আমাকে নিবেদন করেছিস, তাতে আর তোর কি অধিকার? কালাচাঁদ আমার কলা খেয়েছে। তুই ওর সামনে থেকে কলা নিলি কেন? ভক্তটি তখন তার ভুল বুঝতে পারলো এবং সেই কলাগুলি এনে কালাচাঁদকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো। বাবা এবার শান্ত হলেন। যখন ভক্তটি কালাৰ্চাদের সামনে থেকে কলাগুলি সরিয়ে নেয়, তখন সে করুণভাবে বাবার ঘরের দিকে তাকিয়েছিল। বাবার ইন্দ্রিয় কালাচাঁদের দুঃখ বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন। আর এই ঘটনার মাধ্যমে বাবা সব ভক্তকে এই শিক্ষা দিলেন যে, আশ্রমের প্রতিটি জিনিসের উপর সবার সমান অধিকার। বাবা এখানে ভক্তদের আরও একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, দেবতার সামনে কিছু নিবেদন করে দিলে, সেটা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে দিতে হয়। নিবেদিত দ্রব্য যখন দেবতার হয়, তখন নিবেদনান্তে সেই দ্রব্য কে গ্রহণ করলো, তা নিয়ে নিবেদনকারীর মাথা ঘামানো উচিত নয়। যখন নিবেদনকারী দেবতাকে নিবেদন করার পরেও সেই দ্রব্যের প্রতি মোহ রাখে, তখন বোঝা যায় যে, সে সেই দ্রব্যের প্রতি সম্পূর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করতে পারেনি। এমন দ্রব্য দেবতার পূজায় লাগেনা।


নর্মদা পরিক্রমার সময় ওঁকারেশ্বরের দক্ষিণতটে মামলেশ্বর মন্দিরে জ্যোতির্লিঙ্গের বিশেষ অভিষেক পূজা করে আমি যখন গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে পণ্ডিত মহাশয় ও স্ত্রীকে নিয়ে নাটমন্দিরে বসেছি, ঠিক সেই সময় একটি হনুমান এসে আমাদের সামনে থেকে কেবল প্রসাদটি নিয়ে এক লাফে চলে গেল। একদানা প্রসাদও কারও জন্য রাখলো না। পণ্ডিত মহাশয় আমাদের বললেন, ওকে নিতে দাও। এটা খুব শুভ লক্ষণ। আমরা আনন্দিত মনে সেই হনুমানকে প্রণাম করেছিলাম।


জ্যোতির্লিঙ্গকে নিবেদন করা প্রসাদ যদি হনুমান নিয়ে থাকে, তবে আমি কেন তাকে বাধা দেবো? নর্মদা পরিক্রমা একটি তপস্যা। সমদর্শী না হলে তো সেই তপস্যায় সফলতা পাওয়া যায় না। মা নর্মদা এইভাবেই পরিক্রমায় ভক্তদের পরীক্ষা করেন।


ভক্তদেরকে অহিংসার শিক্ষা দিতে ব্রহ্মচারী বাবার আর একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে নয়। একদিন বাবা ভক্তদের বিভিন্ন উপদেশ দান করছিলেন। সেইসময় একজন গ্রামের মহিলা এক বাটি গরম দুধ বাবার সেবার জন্য এনে তার সামনে নিবেদন করে প্রণাম জানিয়ে বাইরে গেলেন। দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। একজন ভক্ত বাবাকে দুধের কথা মনে করিয়ে দিতে তিনি আয় আয় বলে ডাকতে লাগলেন। উপস্থিত কেউ বুঝতে পারলো না যে বাবা কাকে ডাকছেন। কিছুক্ষণ পর সকলে আশ্চর্য হয়ে দেখে প্রকাণ্ড এক কেউটে সাপ বাইরে থেকে বাবার দুধের বাটির দিকে আসছে। সকলে ভীত হয়ে সরে বসলো। কয়েকজন চিৎকার করে কাষ্ঠবৎ জড়সড় হয়ে বাবার গা ঘেঁসে গিয়ে বসলেন। সাপটি ব্রহ্মচারী বাবার সামনে গিয়ে তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো। বাবা আদর করে ফণাটি ধরে দুধের বাটির মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন। বাটির দুধ পান করা হয়ে গেলে সে আবার বাবার সামনে ফণা বিস্তার করলো। তখন বাবা তাকে বললেন, এখন চলে যা। বাবা বলমাত্র সাপটি ফনা নামিয়ে যে পথে এসেছিল, সেইপথে চলে গেল। নিঃশব্দে এতক্ষণ উপস্থিত ভক্তগণ এই শ্বাসরুদ্ধকারী ঘটনা দেখছিলেন। সাপটি চলে গেলে বাবা দুধের বাটি থেকে একটু সর নিয়ে নিজের মুখে দিলেন। তারপর বর্ধমানের এক ভক্তকে বললেন, নে প্রসাদ নে। সেই ভক্তের নাম ছিল গৌরগোপাল রায়। গৌরগোপাল রায় মহাশয় পেশায় দারোগা ছিলেন এবং ভোলাগিরি বাবার শিষ্য ছিলেন। গৌরবাবু বিষাপ্ত সাপের মুখ দেওয়া দুধ নিতে ইতস্ততঃ করছিলেন। বাবা তখন বললেন, ইতস্ততঃ করছিস কেন? নে না, কোনো ভয় নেই। গৌরবাবু তখন মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মহাপুরুষের প্রসাদ মনে করে ভক্তিভরে তা গ্রহণ করলেন। সকল ভক্তের সামনে এইরকম বিষধর সাপের সঙ্গে অহিংসাভাব প্রদর্শন করে বাবা সকলকে এই শিক্ষা দিলেন যে, কেউটের মতো বিষধর সাপও অহিংসার ভাব প্রদর্শনে তার স্বভাবজাত হিংস্রতা ভুলে বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু মানুষ হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের মধ্যে বিভেদের রেখা সৃষ্টি করে।


.


দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি দ্বারা লোকশিক্ষা


দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি দশটি গৌণসিদ্ধির অন্তর্গত। যে সিদ্ধির বলে যোগী ত্রিভূবনের সকল শব্দশ্রবণ ও সকল অদৃশ্যও দর্শন করতে পারেন, তাকে দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি বলে। অষ্টাঙ্গ যোগে আটটি মুখ্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর যোগী এই গৌণসিদ্ধি প্রাপ্ত হন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যে এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত ছিলেন অর্থাৎ তিনি যে সাধারণ মানুষের কাছে অদৃশ্য জিনিসও দর্শন করতে পারতেন বা ত্রিভূবনের সকল শব্দই শ্রবণ করতে পারতেন, সেটা তিনি একটি ঘটনার মাধ্যমে জনসমক্ষে এনেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে অষ্টাঙ্গ যোগ শিক্ষার সময় বাবা শব্দব্রহ্মের তপস্যা করেছিলেন।


একবার নারায়ণগঞ্জ যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বারদীর কিছু গরীব চাষিদের নামে কিছু বিত্তবান ব্যক্তি ফৌজদারি মামলা করে। সেই গরীব চাষীরা লোকনাথ বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। তারা একদিন বাবার কাছে এসে মামলার সত্য ঘটনা নিবেদন করে তাকে চাষীদের হয়ে আদালতে সাক্ষী দিতে অনুরোধ করে। বাবা তাদের বলেন, আমি সন্ন্যাসী মানুষ, কখন কোথায় থাকি, তার ঠিক নেই। আমায় মামলা-মোকদ্দমায় জড়াচ্ছিস কেন? আমার দ্বারা ওসব হবে না। তখন ভক্তরা অনুনয় করে বলে যে, তুমি সাক্ষী না দিলে, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে সাজা দেওয়াবে। প্রকৃত সত্য আদালতের সামনে আসবে না। ভক্তদের এই একান্ত অনুরোধে আদালতে প্রকৃত সত্য প্রমাণ করার জন্য বাবা শেষপর্যন্ত সাক্ষী দিতে রাজী হলেন।


মামলার দিন আদালত কক্ষ লোকে লোকারণ্য। সবার মধ্যে প্রচার হয়ে গেছে যে, সেইদিন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আদালতে সাক্ষী দিতে আসছেন। নারায়ণগঞ্জে তাঁর অগণিত ভক্ত ছিল। তারা ছাড়াও অন্য অনেকে যারা কোনোদিন তাঁর দর্শন পাননি, সেইসব লোকও আদালতে কেবলমাত্র ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনাকাঙ্খায় এসেছে। আদালতের কাঠগড়ায় সাক্ষীর নাম ধরে ডাক পড়াতেই বাবা সাক্ষীর কাঠগড়ায় উপস্থিত হলেন। গুঞ্জনমুখর আদালতকক্ষ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। সকলে উগ্রীব হলেন ব্রহ্মচারী বাবা কি বলেন, সে কথা শোনার জন্য।


যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেট বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দীর্ঘ জটাজুটমণ্ডিত দেহের দিকে তাকিয়ে নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পর প্রশ্ন করলেন, আপনার বয়স কত?


ব্রহ্মচারী বাবা সহজভাবে উত্তর দিলেন, দেড়শো বছরের বেশি হবে।


কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি প্রথমে ভাবলেন, কোনো মানুষ দেড়শো বছর বেঁচে থাকতে পারেনা। পরে আবার ভাবলেন, যোগী পুরুষদের পক্ষে এত দীর্ঘসময় বেঁচে থাকা সম্ভব হতেও পারে।


কিন্তু বিপক্ষের আইনজীবী বাবার কথায় বিশ্বাস করলেন না। তিনি বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, আদালতে সাক্ষী দিতে এসে এইরকম অবান্তর কথা বললে, তা অপরাধ বলে গণ্য হয়।


বাবা তখন সহজ-সরলভাবে আইনজীবীকে বললেন, বেশ, আমার কথা যদি তোমাদের অবিশ্বাস্য মনে হয়, তবে তোমাদের খুশিমতো বয়সটা লিখে নাও।


বিপক্ষের উকিল তখন ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন, হুজুর, সাক্ষী বয়সে অতি বৃদ্ধ এবং স্বাভাবিকভাবেই তার দৃষ্টি ক্ষীণ। যে ঘটনার সাক্ষী দিতে উনি এসেছেন, তা তার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। এরপর তিনি তার বক্তব্যকে প্রমাণ করার জন্য লোকনাথ বাবাকে বিভিন্নভাবে জেরা করতে লাগলেন। ব্রহ্মচারী বাবা উকিলের জেরার সব ঠিক ঠিক উত্তর দিলেন। তাঁকে জেরায় অপ্রতিভ করা গেল না। শেষে উকিল বললেন, আপনি আপনার যে বয়সের কথা আদালতে বললেন, তাতে আপনার পক্ষে কোনো দূরের জিনিস বা ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আপনি যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এই কথা কি করে মেনে নেওয়া যায়?


ব্রহ্মচারী বাবা এই কথা শুনে উকিলবাবুকে কাছে ডাকলেন। উকিল ভাবলেন, সাক্ষী হয়তো তার কাছে কোনো গোপন কথা ফাঁস করবেন। তিনি অতি আগ্রহে তড়িৎ গতিতে সাক্ষীর সামনে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা তখন আদালতকক্ষের দরজা দিয়ে দূরে একটি আমগাছ দেখিয়ে তাকে বললেন, ওই গাছটাতে কোনো প্রাণী উঠছে দেখতে পাচ্ছো?


উকিলবাবু এটিকে একটি অবান্তর প্রশ্ন মনে করে অতীব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, না কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।


এইসময় আদালতকক্ষে উপস্থিত বাবার ভক্তগণ বুঝতে পারলেন যে, এটি বাবার একটি লীলা। বাবা যে কোনো দূরের জিনিসই দেখতে সক্ষম হন। অন্য অনেক উপস্থিত ব্যক্তিরা গাছের দিকে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করে যে, কিছু দেখা যাচ্ছে কি না! আদালতকক্ষে অতঃপর একটি গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, কই, কিছুই তো দেখছি না!


ব্রহ্মচারী বাবা তখন হেসে বলেন, আশ্চর্যের কথা। তোমরা সব বয়সে যুবক, তোমাদের দৃষ্টিশক্তিও প্রখর। অথচ এত কাছের জিনিসও তোমরা দেখতে পাচ্ছো না!


উকিলবাবু তখন কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলেন, বেশ, আপনিই বলুন, ওই আমগাছে কোন্ প্রাণী উঠছে?


ব্রহ্মচারী বাবা সহজভাবে বললেন, ওই গাছে একদল লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে উপরের দিকে উঠছে।


বাবার কথা শুনে আদালত কক্ষে সকলে বিস্মিত হলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও বিস্মিত হলেন। তিনি উকিলবাবুকে বললেন, নিজে সেই গাছের কাছে গিয়ে দেখে আসতে যে, এই সন্ন্যাসী যা বলছেন, সেটা সত্য কি না! উকিলবাবু তখন আদালতকক্ষ থেকে দূরে অবস্থিত সেই গাছের কাছে গেলেন। কৌতূহলী কিছু লোকও উকিলবাবুর সঙ্গী হলেন। গাছের কাছে গিয়ে তারা দেখলেন যে, সত্যিই একদল লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে উপরের দিকে উঠছে। তারা সকলে বিস্মিত হয়ে এসে ম্যাজিস্ট্রেটকে সেই কথা জানালে তিনিও হতভম্ভ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই ব্রহ্মচারী একজন সাধারণ মানুষ নন। ইনি নিশ্চয়ই একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ। যোগবলে সব অদৃশ্য বস্তুই ওনার দৃশ্যমান হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট লোকনাথবাবার সাক্ষী গ্রহণ করেন এবং তার সাক্ষ্যবলে বাবার ভক্তরা ফৌজদারী মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হয়।


শব্দব্রহ্মের তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে বাবা বহুদূরের কোনো মানুষ, জন্তু, কীট-পতঙ্গ ও পাখির গুঞ্জন অথবা গর্জন শব্দ শুনে তাদের ভাব বুঝতে সক্ষম ছিলেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের শরণপথে সমস্ত জগৎ সংসার থাকে। এই জগতের কে, কোথায় কি করছেন, সেটা তাঁর কাছে দৃশ্যমান হয় এবং তিনি সে কথা বলে দিতে পারেন। আদালতের এই লীলার মাধ্যমে বাবা কেবল এই প্রদর্শন করতে চাননি যে, তিনি বহুদূরের জিনিস দেখতে সক্ষম। এইভাব তর লীলার অতি সরলীকরণ। এই লীলার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, জগৎসংসারের সব কিছু তার শরণপথে থাকে। তার কাছে সারা জগৎসংসার দৃশ্যমান। এ জগতের কোনো কিছুই তার অগোচর নয়।


মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী দুর্লভ ঈশিতাসিদ্ধির দ্বারা এই মননধারণা করতে পারতেন যে, ঈশ্বর সারা আকাশব্যাপী সূক্ষ্মাত্মারূপে বিরাজমান। ঈশ্বরের সেই আকাশমূর্তির ধ্যানমন্ত্র হচ্ছে ‘ওঁ আকাশমূর্তয়ে নমঃ’। ঈশ্বরের সেই আকাশমূর্তির মধ্যে নিয়ত যে হংসশব্দ ধ্বনিত হচ্ছে, তা ব্রহ্মচারী বাবা শুনতে পেতেন। সেজন্য তিনি সমস্ত জীবের হৃদয়াকাশে হংসনাদ ও দূরবর্তী অসংখ্য প্রাণীর স্কুট-অস্ফুট সমস্ত ধ্বনি শুনে তাদের ব্যক্ত ও অব্যক্ত সব কথা বুঝতে পারতেন। এইজন্য বিপদে পড়ে কোনো লোক বাবার শরণাপন্ন হয়ে প্রার্থনা করলে, সে প্রার্থনার ধ্বনি তিনি শুনতে পেতেন ও ভক্তকে কৃপা করতেন এবং এখনও করেন। এই বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি কোনো সামান্য সিদ্ধি নয়। এটি একটি বিরল সিদ্ধি, যার ফল আজও তার অগণিত ভক্ত পেয়ে চলেছেন।


লোকনাথ বাবার এই বিরল সিদ্ধির অর্থ আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমার তপস্যা স্বরূপ নর্মদা পরিক্রমার সময়। নর্মদার উত্তর তটে শূলপানিঝাড়ির অদূরে এমন স্থান আছে যেখানে পরমেশ্বর শিবকে আকাশরূপে কল্পনা করে ওঁ আকাশমূর্তয়ে নমঃ মন্ত্রে ধ্যান করতে হয়। সেখানে হংসমন্ত্রে যোগীগণ আত্মশুদ্ধির জন্য তপস্যা করেন এবং হংসঋক্ মন্ত্রে পরমেশ্বরের কৃপা লাভ করেন। আত্মশুদ্ধির জন্য হংসমন্ত্র চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।


লোকনাথবাবার এই বিরল সিদ্ধির যদি আমরা সঠিক অনুধাবন করতে পারি তবে দেখবো যে, আমাদের মনের অভ্যন্তরে কোনো বাক্য অব্যক্ত থেকেও যদি সেটা মনের মধ্যে অনুরণিত হয়, সেটাও তার দৃষ্টির বা শরণের অগোচরে থাকে না। আমাদের মধ্যে অব্যক্ত ভাব সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে করুণার উদয় হয় এবং তাঁর বিগলিত করুণার ধারায় তিনি ভক্তকে নিত্য স্নাত করান। বারদীর আদালতে এই লীলার প্রকাশ থেকে কি আমরা বাবার এই সিদ্ধির সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি? বা এই লীলার মাধ্যমে তিনি যে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, সেটা কি আমরা সঠিক অনুধাবন করতে পেরেছি?


এই প্রসঙ্গে বারদী আশ্রমের আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। একদিন ঢাকার একজন পুলিশ ইনসপেক্টর কালীকান্ত নন্দী এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজের সুপারিটেডেন্ট অনাথবন্ধু মল্লিক মহাশয় বাবাকে দর্শনের জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। তারা ঢাকায় ব্রহ্মচারী বাবা সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন। তাদের মনে ইচ্ছা হল একবার স্বচক্ষে দর্শন করে যাচাই করতে যে ব্রহ্মচারী বাবা কত বড়ো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ। যেদিন তারা বারদী আশ্রমে এলেন, তখন আশ্রম ভক্তসমাগমে পরিপূর্ণ। অনেক লোক তাদের রোগ সারাবার জন্য ব্রহ্মচারী বাবার শরণাপন্ন হয়েছেন। এই দুই ব্যক্তিও বাবাকে দূরে বসে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর যখন প্রসাদ বিতরণের সময় হলো, এই দুইজন আশ্রমের উঠানে একসঙ্গে প্রসাদ নিতে বসলেন। প্রসাদ খেতে খেতে একজন আর একজনকে বললেন, ব্রহ্মচারী বাবার যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তা বোঝার জন্য একটা পরীক্ষা করে দেখলে হয়।


তারা শহরের শিক্ষিত ব্যক্তি। গ্রামের লোকেদের কথায় কাউকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী মহাপুরুষ বলে কি করে মেনে নেওয়া যায়। তাদের একজন অন্যজনকে বললেন-দেখ, এখন কঁঠালের সময় নয়। এই অকালে বাবা যদি আমাদের পাকা কাঁঠাল খাওয়াতে পারেন, তবে বুঝবো প্রকৃতই তাঁর অলৌকিক শক্তি আছে। তাদের এই কথা নিজেদের মধ্যেই হচ্ছিল, অন্য কেউ এই কথা শুনতে পায়নি বা তারাও বাবার কাছে গিয়ে এই ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কিন্তু বাবা ঘরের ভিতর নিজ আসনে বসে আশ্রমের চারিদিকের সব কিছু দেখতে পেতেন এবং সবার ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথাও শুনতে পেতেন। এই দুই শহুরে ব্যক্তি তাঁদের গোপন ইচ্ছা মনে নিয়ে বসেছিলেন। এই কথোপকথনের প্রায় দুই ঘন্টা বাদে দেখা গেল এক ব্যক্তি একটা বড় পাকা কাঁঠাল মাথায় নিয়ে আশ্রমে এসে বাবার ঘরের সামনে রাখলো। ওই ব্যক্তি কাঁঠালটি রেখে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে বাবাকে প্রণাম করে চলে গেল। লোকটি চলে যাবার পর বাবা একজনকে ডেকে বললেন, এই কাঁঠালটা এখনই ভেঙ্গে ওই দুজন ভদ্রলোককে খেতে দাও। এরা যথেষ্ট খাবার পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে আশ্রমের সকলকে বেঁটে দিও। আশ্রম সেবক কাঁঠালটি ভেঙ্গে ঢাকার দুই ভদ্রলোককে খেতে দিলো। সামনে পাকা কাঁঠাল দেখে ওই দুই শহুরে ভদ্রলোকের অবস্থা তখন খুবই করুণ। তারা ভাবতে লাগলেন, যে-কথা তাদের নিজেদের মধ্যে গোপনে হয়েছিল, বাবা কি করে সে কথা শুনতে পেলেন এবং এই অকালে এমন পাকা রসালো কাঁঠাল কোথা থেকে তিনি নিয়ে এলেন! বিস্ময়ে তাদের মুখে কথা ফোটে না। এতক্ষণে তারা বুঝতে পারলেন যে তাদের সামনের এই ব্যক্তি কেবল অসামান্য অলৌকিক শক্তির অধিকারীই নন, তিনি একজন অদ্বিতীয় মহাপুরুষও বটে। শ্রদ্ধায় ও সন্ত্ৰমে তাঁদের মাথা বাবার সামনে নত হল এবং তারা তখন বাবার কাছে কৃপা ভিক্ষা করলেন। বারদীতে বাবাকে নিত্য এই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হয়তো আজও ভক্তদের কাছে তার স্বরূপ চেনাবার জন্য এই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে! কবে তার ভক্তরা বুঝবেন, তিনি আছেন কেবল ভক্তদের কৃপা করার জন্য।


.


ঈশিতাসিদ্ধি দ্বারা লোকশিক্ষা


যে সিদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য ও মায়ার তত্ত্ব জানা যায়, তাকে ঈশিতাসিদ্ধি বলে। এটি অষ্টাঙ্গ যোগের একটি মুখ্য সিদ্ধি। এই সিদ্ধিবলে যোগী ঈশ্বরের সৃষ্টিরহস্য জানতে পারেন এবং যে মায়ার বলে ঈশ্বর সেই সৃষ্টিরহস্য মানবের অগোচরে রাখেন, তার তত্ত্ব জানতে সক্ষম হন। লোকনাথবাবা বারদীতে তার কিছু লীলার মাধ্যমে এই অমূল্য ও দুর্লভ তত্ত্ব মানুষের কাছে কিঞ্চিৎ উন্মোচন করেন। তিনি জনসমক্ষে এই তত্ত্বের ততটুকুই উন্মোচন করেন, যতটুকু জানলে বা অনুধাবন করলে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পায়।


শ্রীগীতার দশম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি। আমি সর্বভূতের আদি, অন্ত ও মধ্য। আবার নবম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, আমি অব্যক্ত মূর্তিতে জগৎব্যাপিয়া আছি, আমি প্রকৃতি দ্বারাই জগৎ সৃষ্টি করি, আমি সর্বভূত মহেশ্বর, আমিই জীবের গতি, ভর্তা, প্রভু ও শরণ সুহৃৎ। কিন্তু অবিবেকী ব্যক্তিগণ আমার পরম ভাবনা না জানিতে পারিয়া আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবৎ মনে করেন। আমি সর্বতোমুখ, সর্বাত্মা, সর্বম্বরূপ। লোকনাথ বাবাও বলতেন, আমাকে আশ্রয় করে যারা থাকে, তাদের মধ্যেই যে আমি আছি, সেটা তারা ধারণা করতে পারে না। আমার দেহাতিরিক্ত আত্মাকে তারা পরমাত্মা বলে গ্রহণ করতে পারে না। তাই আমি তাদের মধ্যে থাকলেও তারা আমায় চিনতে পারে না।


ঈশিতাসিদ্ধি যোগীর মধ্যে আত্মদর্শন ঘটায় এবং ব্রহ্মজ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ এই সিদ্ধির বলে নিজের পঞ্চভূত দেহের মধ্যে পরমাত্মাকে চিনতে পারেন এবং এই জ্ঞান প্রাপ্ত হন যে, তিনি পরমাত্মারূপে সর্বভূতে বিরাজ করছেন। এই আত্মোপলব্ধি যোগীর তখনই হয়, যখন যোগীর দেহ এক দেবদেহে রূপান্তরিত হয়। মহাযোগী বাবা লোকনাথ তাঁর জীবদেহকে সিদ্ধির দ্বারা দেবদেহে রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু যে সমস্ত ভক্তগণ তার সমক্ষে যেতেন, তারা তাকে একজন যোগবিভূতি সম্পন্ন মহাপুরুষ বলে ভাবতেন। তারা আন্তরিকভাবে ভাবতে পারতেন না যে, লোকনাথ বাবার আত্মা অমর, তিনি সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন এবং পঞ্চভূতে দেহ বিলীন হয়ে গেলেও তিনি চিরকাল এই চরাচরে ব্যাপ্ত থাকবেন। তিনি পূর্ণব্রহ্ম। তিনি অনেক ভক্তকেই বলেছেন, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। লোকনাথবাবা যেহেতু ঈশিতাসিদ্ধি শক্তির দ্বারা ভক্তদের জন্ম-জন্মান্তরের রহস্য জানতে পারতেন, তিনি কোনো কোনো ভক্তকে তাদের পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত ও পার্থিব ভোগের কথা বলে দিতেন। তাতে ভক্তবৃন্দ কেবল এটুকু বুঝতেন যে, বাবা একজন মহাপুরুষ এবং সেজন্য ওনাদের পূর্বজন্মের কথা বলে দিচ্ছেন। বাবার বলার উদ্দেশ্য কিন্তু ভক্তদের মনে শুধুমাত্র এই ধারণা উৎপত্তির কারণই ছিল না। কথাপ্রসঙ্গে একদিন তিনি এক ভক্তকে বলেছিলেন, ইচ্ছে করেই আমি আমার অনুভূতির কথা সবাইকে শুনিয়ে দিই। আমি তো সব কিছুর মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব দেখতে পাই। নিজের মধ্যেই বিশ্বের সবকিছু দেখতে পাই। জগৎ সংসারে যা সব কিছু যেখানে আছে, সবই আমার মধ্যে আছে। আমিই সব কিছুর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে এক অসীম অব্যক্তরূপে বিরাজ করছি। সে এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় ভাব। সে ভাব প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। সেই ভাবের কথা ভাবলেই আমার আত্মা দেহ থেকে আলগা হয়ে যায়। তাই আমি সময়ে চুপ করে থাকি। আমি সব সময়ে তোদের সঙ্গে থাকি, কথা বলি, তাই লোকে ভাবে আমি তাদেরই মতো একজন। তোরা আমায় চিনতে পারলি না রে!


বাবার এই ভাব প্রকাশের মাধ্যমে বাবা এটাই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, তাদের সামনে স্বয়ং দেবতা বসে থাকলেও, ভক্তবৃন্দ তাকে একজন মনুষ্যদেহী যোগীরূপেই ভেবেছে। জন্ম-মৃত্যু রহস্যজ্ঞানী পুরুষ সমর্থ ছিলেন মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত ভোগ থেকে মুক্তির উপায় বলে দেবার। তিনি মানুষকে মুক্তি দিতে প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু মানুষ সেই দেবদেহের কাছে কেবল সংসারের দেহ ও মনোরোগের চিকিৎসার জন্য উপস্থিত হয়েছে। তাইতো তিনি প্রয়াণের পূর্বে একজনকে বলেছিলেন–অনেক সংসাররোগীর সন্ধান পেলাম, কিন্তু ভবরোগী পেলাম না। ঈশিতাসিদ্ধিপ্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞ সিদ্ধ ব্রহ্মচারী যাহা বলেন, তা স্বয়ং পরমেশ্বরও খণ্ডন করতে পারেন না। জগৎসংসারে প্রারব্ধকৰ্মভোগে যারা ভুগছেন এবং অনন্ত কষ্ট ভোগ করছেন, তাদের প্রারব্ধ ক্ষয়ের উপায় তিনিই বলে দিতে পারতেন এবং ভক্তের কষ্টের লাঘব করতে পারতেন।


সর্বজ্ঞ বাবা লোকনাথ বলতেন, মানুষ ভালো-মন্দ যা কিছু করে, তা সব আমার করানো। মানুষ তার আমিত্বের বশে মনে করে, সে করছে। আমি যাকে যেমন করাই, সে তেমন করে। সে জানে না যে তার নিজের ইচ্ছায় কিছু হয় না। সবার অন্তরে বসে আমি নিত্য এই খেলা খেলে চলেছি। আমিই তাদের দিয়ে সব কিছু করাই, আমিই সেই কাজের ফল চাওয়াই, আমিই তাদের ফল দিই। যে ফল পায় সে আনন্দ করে। তার সেই আনন্দ আমি ভোগ করি। আর যে পায় না, সে বেদনা অনুভব করে। তার সেই বেদনাও আমিই ভোগ করি। যে যেমনভাবে আমার ভজনা করে, আমিও তাদের তেমনভাবে তৃপ্ত করার চেষ্টা করি।


ঈশিতাসিদ্ধির অধিকারী বাবার সামনে কেউ উপস্থিত হলেই, কেবলমাত্র দর্শনে বাবার কাছে তার জন্ম-মৃত্যু বৃত্তান্ত উন্মোচিত হতো।


এক ব্রাহ্মণ বহু গণৎকারকে কোষ্ঠী বিচার করিয়ে জানতে পারেন, তার ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু হবে। তিনি ঠিক করেন, ৬২ বছর বয়স হলেই তিনি কোনো তীর্থে গিয়ে বাস করবেন যাতে তিনি তীর্থস্থানে মরতে পারেন। পরে ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে তিনি বারদী আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে আসেন। তিনি বাবার সামনে গিয়ে বসলে বাবা জিজ্ঞাসা করেন–কেন এসেছো? ব্রাহ্মণ বলেন–গণকেরা বলেছে ৬২ বছর বয়সে আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু গণকের কথায় আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চিত মৃত্যু ৬২ বছর বয়সে হবে কি না তাই জানতে আপনার কাছে এসেছি।


ব্রহ্মচারী বাবা সেই ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে কুষ্ঠরোগে ধরেছে। বাড়ি ফিরে যাও। সম্প্রতি কোথাও যেতে হবে না। দশ-পনেরো বৎসর পরে পারলে একবার এসে সাক্ষাৎ করে যেও। তুমি ভাল হয়ে যাবে। ব্রহ্মচারী বাবা সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের শরীরের উপর যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন, তাতেই তিনি কুমুক্ত হয়ে যান এবং ৮৩ বছরের কিছু বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন বলে জানা গেছে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর ঈশিতাসিদ্ধিবলে যে কেবল ব্রাহ্মণকে মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত করেছিলেন তাই নয়, তার চোখ থেকে যে আলোর বিকীরণ ব্রাহ্মণের শরীরে প্রবেশ করেছিল, তাতে তার কুষ্ঠরোগ মুক্তিও ঘটে। এইভাবেই বাবার অযাচিত করুণা তাঁর ভক্তগণ পেয়ে এসেছেন।


.


যথাসংকল্প সিদ্ধি দ্বারা ভক্তদের কৃপা


যথাসংকল্প সিদ্ধি অষ্টাদশ সিদ্ধির অন্তর্গত একটি সিদ্ধি। যে সিদ্ধির বলে সিদ্ধযোগী কিছু সংকল্প করা মাত্রই তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় তাকে যথাসংকল্প সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী ভক্তদের কোনো কৃপা করার কথা মনে মনে সংকল্প করা মাত্রই ভক্তগণ সেই কৃপা লাভ করে। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ভক্তদের কিভাবে এই সিদ্ধিবলে কৃপা করতেন, সেই সম্বন্ধে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলো।


শ্রীব্রজেন্দ্রকুমার বসু বাবার একজন ভক্ত ছিলেন। তিনি উকিল। একসময় তিনি পেটে শূলরোগে আক্রান্ত হন। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও রোগের তত কোনো উপশম হলোই না, বরং পেটের ব্যথা আরও বেড়ে গেল। যখন তিনি রোগে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন এবং কোনোভাবেই এই রোগ থেকে নিস্তার পাচ্ছিলেন না, সেইসময় বাবার অন্য এক ভক্ত তাকে বারদীতে গিয়ে লোকনাথ বাবাকে সব জানাতে বলেন। ব্রজেন্দ্রবাবু তখন মনে মনে বাবার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রোগ নিরাময়ের আশায় আশ্রমে উপস্থিত হন। বাবা লোকনাথ তখন ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে উপদেশ প্রদান করছিলেন। ব্রজেন্দ্রবাবুও তাদের মাঝে গিয়ে বসলেন। এমন সময় তার প্রচণ্ড শূল বেদনা শুরু হলো। তিনি তখন বাবার দিব্যদেহ স্মরণ করে মনে করতে লাগলেন যে, একবার যদি বাবা তার পা আমার ব্যথার জায়গায় স্পর্শ করান, তাহলে আমার ব্যথার এখনই উপশম হতে পারে। কিন্তু কি করে তা সম্ভব! তিনি মনে মনে কাতরভাবে বাবার কাছে নির্বাক হয়ে সেই আকুতি করতে লাগলেন। আশ্চর্যভাবে সেই সময় বাবা বললেন, আমার পায়ে ঝি ঝি ধরেছে। তোদের কেউ এসে আমার পা-টা একটু টিপে দে তো। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজেন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি সবাইকে ডিঙ্গিয়ে বাবার সামনে বসে তার পা-খানি ভক্তিভরে নিয়ে নিজের পেটের ব্যথার জায়গায় স্পর্শ করালেন। তারপর দু-হাতে তার পা টিপে দিতে লাগলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মহাপুরুষের দিব্যদেহের স্পর্শে এবং তার করুণায় ব্রজেন্দ্রবাবুর শূলব্যথা কমে গেল এবং তা চিরতরে তার শরীর হতে বিদায় নিলো।


বাবা লোকনাথ ছিলেন অন্তর্যামী। তিনি ব্রজেন্দ্রবাবুর কাতর প্রার্থনা দূরশ্রবণ সিদ্ধিবলে শুনতে পেয়েছিলেন এবং তখন মনে মনে সংকল্প করেছিলেন তাঁকে কৃপা করার। তাই তিনি পা টেপানোর ছলে তাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন তার পা-টি ব্রজেন্দ্রবাবুর ব্যথাস্থলে স্পর্শ করাবার জন্য। বাবার যথাসংকল্প সিদ্ধির বলে ব্রজেন্দ্রবাবু শূলরোগ থেকে চিরতরে অব্যাহতি পেলেন।


এরপর ব্রজেন্দ্রবাবু সবার কাছে তার রোগ নিরাময়কল্পে আশ্রমে আগমনের কথা ও তার অস্ফুট প্রার্থনার কথা বলেন। ভক্তগণ পরম বিস্ময়ে উপলব্ধি করল যে, বাবাকে মুখে কিছু না বললেও, ভক্তের মনের আকুতি ও প্রার্থনা শুনে বাবা কিভাবে এইরকম একটা রোগ থেকে একস্পর্শে ব্রজেন্দ্রবাবুকে মুক্ত করে দিলেন।


ব্রজেন্দ্রবাবু তখন ভেবেছিলেন, বাবার অহৈতুকী কৃপায় তার ব্যথা সেরে গেল। তিনি কি এটা ভাবতে পেরেছিলেন যে, বাবা তাকে ব্রহ্মপদ লাভের সুযোগটাও করে দিয়েছিলেন!


এই সম্পর্কে একদিন বাবার এক ভক্ত তাঁকে বললেন, বাবা, শুনেছি ঐশী শক্তি বলে যদি কোনো রোগীর রোগ সারিয়ে দেন, তবে সেই রোগ তাকে গ্রহণ করতে হয়। আপনি তো কত রোগীর রোগ সারিয়ে দেন, আপনি সেই রোগগুলি গ্রহণ করেন না তো?


করুণাময় বাবা লোকনাথ বলেন, কোনো রোগীর উপর আমার মনে দয়া হলেই আমার ঐশী শক্তিতে তার রোগ সেরে যায়। কোনো রোগী আমার শরণাপন্ন হলে আমি সুস্থির থাকতে পারি না। আমার থেকে দয়ার ধারা বয়ে গিয়ে রোগীকে সুস্থ করে দেয়। কোনো ভক্তের জন্য আমার হৃদয় বিগলিত হলেই সেই ভক্তের উপর আমার কৃপা বর্ষিত হয়।


ভক্তটি তখন জিজ্ঞাসা করে, বাবা, কি করলে আপনার দয়া পাওয়া যায়?


বাবা লোকনাথ বলেন, আমায় তুষ্ট করলেই আমার দয়া পাওয়া যায়।


 ভক্তটি তখন জিজ্ঞাসা করে, আপনি কিসে তুষ্ট হন বাবা?


তখন বাবা লোকনাথ বলেন, তাতে আমি জানি না। তবে কোনো ভক্ত আমাকে নিজের মনে কোরে, আপন কোরে ডাকলেই তার জন্য আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে, আমার হৃদয় বিগলিত হয় এবং আমার করুণার ধারা তার উপর বর্ষিত হয়।


অনেক সময় বাবার এই অযাচিত করুণার অমর্যাদাও ভক্তরা করেছে। এইবার সেইরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করবো।


একদিন বারদীর আশ্রমে কয়েকজন লোক নানাপ্রকার পূজাসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হলো। জানকীনাথ ব্রহ্মচারী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কীসের পূজা দিতে এসেছো? লোকগুলি বললো, আমরা মানসিক শোধ করতে এসেছি। এই মানসিক শোধ না হলে আমাদের রোগী সুস্থ হবে না। জানকীনাথ তখন জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার মানসিক শোধ করতে এসেছো? তখন সেই লোকগুলির মধ্যে একজন বললো, বছরখানেক আগে আমাদের এক আত্মীয়কে সাপে কামড়ায়। সাপের তীব্র বিষ তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং সে মৃতবৎ হয়ে যায়। আমরা প্রথমে বৈদ্য ডাকি, কিন্তু সে কিছু করতে পারলো না। তখন আমরা ওঝা ডাকি, সে শতচেষ্টা করেও দেহ থেকে বিষ নামাতে পারলো না। অবশেষে আমাদের গাঁয়ের কিছু লোকের পরামর্শে আমরা বাবা লোকনাথের নামে মানত করলাম। সাপে কামড়ানো লোকটির মা-বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে বললেন, হে ব্রহ্মচারী বাবা, আপনি আমাদের ছেলেকে বিষমুক্ত করে দিন। আমরা আপনার নামে পূজা মানত করছি। এই মানত করার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শরীর থেকে বিষ নামতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো। যখন ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলো, তখন বাড়ির কেউ কেউ বলতে লাগলো, ওঝা ও বৈদ্যের চিকিৎসাতেই ছেলে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় কিছু হয়নি। সবাই মিলে ছেলের মাকে বোঝালেন যে, ওঝা-বৈদ্যের চিকিৎসায় যখন ছেলে ভালো হয়ে উঠেছে, তখন আবার ব্রহ্মচারী বাবার নামে পূজা দিতে যাবার দরকার কি? পাঁচজনের কথায় ছেলের মা বশীভূত হয়ে নিজের সত্যরক্ষা করলেন না। পূজা দেবার সময় চলে গেল, কেউ আর সেই আশ্রমের নামে মানসিকের কথা মনে রাখলোনা, সকলেই মন থেকে সেটা মুছে ফেললো।


এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর এখন সেই সপর্দষ্ট লোকটি দংশনের জায়গায় বেদনা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন সেই সাপের বিষ আবার তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলে বাড়িতে শুয়ে ছটফট করছে। কেউ তার যন্ত্রণার উপশম করতে পারছে না। এখন বাড়ির লোকেদের চোখ খুলেছে। তারা বুঝেছে যে ব্রহ্মচারী বাবা যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ। তিনি সাক্ষাৎ দেবতা। তার উদ্দেশ্যে করা মানত পূজা না দিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হয়েছে। সেইজন্য একবছর বাদে এখন কোনো সাপ না কামড়ালেও, সেই পুরোনো বিষের জ্বালা শুরু হয়েছে। আমরা তাই বাবার শরণাপন্ন হয়েছি তার কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করে মানত পূজা দেবো বলে।


জানকি ব্রহ্মচারী তাদের বাবার কাছে নিয়ে গেলেন। সেই লোকেরা সবাই বাবার চরণ স্পর্শ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। বাবাকে কিছু বলার আগেই বাবা সব বুঝতে পারলেন। লোকগুলি অনুতপ্ত হয়ে দোষ স্বীকার করায়, বাবা পূজা গ্রহণ করলেন। তার হৃদয় করুণায় বিগলিত হলো। পূজা শেষ হলে বাবা তাদের আশীর্বাদ করলেন। লোকগুলি বাবার কাছে আর কোনো কথা বলল না, বাবাও তাদেরকে আর কোনো কথা বললেন না। তারা বাড়ি ফিরে দেখলেন ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় সেই ছেলেটির বিষক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রোগীর দেহে আর কোনো বিষক্রিয়ার লক্ষণ নেই। সে সম্পূর্ণ সুস্থ।


একবছর আগে সর্পদংশন এবং বৈদ্য-ওঝার ব্যর্থতার পর প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী ওই ছেলেটির আকুল মা বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন, বাবা তার দূরশ্রবণ সিদ্ধির বলে সেই প্রার্থনা শুনতে পেয়েছিলেন। তাঁর অন্তদৃষ্টিজনিত আশীর্বাদেই সাপের বিষ তার শরীর থেকে অন্তর্হিত হয় এবং সে সুস্থ হয়ে ওঠে।


এই ঘটনা থেকে সব সাধুসমাজ ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন যে, দোষী যদি তার দোষ স্বীকার করে, তবে তাকে ক্ষমা করে আপন করে নেওয়া উচিত।


একসময় চাঁদপুরের কয়েকজন ভক্ত উকিল বারদী আসেন বাবাকে দর্শন ও কয়েকদিন তাঁর সান্নিধ্যে কাটাবার জন্যে। কয়েকদিন আশ্রমে থেকে তারা যাবার অনুমতি চাইতে বাবার কাছে যান। বাবা তাদের বলেন, আজ তোদের না গেলে হয় না? তারা বললেন, আগামীকাল কাছারী খুলবে, না গেলে ক্ষতি হবে। তখন ব্রহ্মচারী বাবা একজনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন–যদি তোদের যাওয়াই প্রয়োজন হয়, তবে ওকে রেখে যা। মহাপুরুষের কথা উপেক্ষা করা উচিত নয় মনে করে তাঁরা সেই ব্যক্তিকে রেখে চলে গেলেন। সঙ্গীরা চলে যাবার পর সেই লোকটি অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং পরে সেইদিনই তার কলেরা দেখা দিলো। বাবা তাকে সুস্থ করে দেবার সংকল্প করলেন এবং তার মহিমায় ও সিদ্ধিবলে সেই উকিল মহাশয় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলো। তখনকারদিনে কলেরা হলেই মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল একশোভাগ। তখন উকিলবাবু বুঝলেন, কেন বাবা তাকে থাকতে বলেছিলেন।


পণ্ডিত শ্রীহরি বিদ্যালঙ্কার মহাশয় সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাবার কাছে আসতেন কিন্তু পণ্ডিত বলে তার মধ্যে এক দম্ভ সবসময় বিরাজ করতো। তিনি কখনও আশ্রমের প্রসাদ গ্রহণ করতেন না। একদিন ব্রহ্মচারী বাবা পণ্ডিত বিদ্যালঙ্কার মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করেন–তোমার কোনো দ্রব্যে পিপাসা আছে? পণ্ডিত মহাশয় উত্তর দেন–পাতক্ষীর খাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। ঢাকার পাতক্ষীর বিখ্যাত। আশ্রমে পাতক্ষীর পাওয়া যাবে না মনে করেই পণ্ডিত মহাশয় তা খেতে চেয়েছেন। ব্রহ্মচারী বাবা মনে মনে পাতক্ষীরের সংকল্প করায় সেদিন বিকেলেই এক ভক্ত সের চারেক পাতক্ষীর নিয়ে আশ্রমে হাজির হয়। ব্রহ্মচারী বাবা তার থেকে দেড়সের মতো পাতক্ষীর নিজের হাতে পণ্ডিত মহাশয়কে খাইয়েছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় বাবার এই অচিন্ত্যনীয় মহিমায় তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন এবং বাবার সামনে তার দম্ভ ত্যাগ করেছিলেন। যিনি অন্তরে সংকল্প করলে স্বয়ং দেবতার রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন, তার কাছে পাতক্ষীর জোগার করা কী এমন কঠিন কাজ! আসলে বাবার সেই প্রকৃত রূপকে তিনি চিনতে পারেননি।


ঢাকা পশ্চিমদীর রাধিকামোহন রায় শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন। বাত ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তার অর্ধাঙ্গ অবশ হয়ে গিয়েছিল। প্রভুপাদ গোস্বামী মহাশয় তাকে একটি নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে বারদী আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন করতে বলেন। রাধিকামোহন রায় মহাশয় তার কথানুসারে একটি নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে এসে বারদীর ঘাটে নৌকা বাঁধেন। প্রতিদিন সেখান থেকে তিনি বারদী আশ্রমে গিয়ে আশ্রমের মাটি সারা গায়ে মেখে ব্রহ্মচারী বাবার সামনে বসে থাকতেন। ওনার সঙ্গে কথা বলার সময়েও উনি আশ্রমঘরের মাটিতে হাত দিয়ে গায়ে ঘষতেন। কিন্তু রোগ নিরাময় করার জন্য বাবাকে কিছু বলতেন না। এইভাবে একমাসকাল চলার পরে তিনি প্রায় ভালো হয়ে যান। কেবল একটা হাত তিনি ওঠাতে পারতেন না। একদিন রাধিকাবাবুর স্ত্রী বাবার সামনে বসে আছেন আর রাধিকাবাবু নৌকাতে আছেন। রাধিকাবাবুর স্ত্রীর ম্লান মুখ দেখে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন–এমন করে বসে আছো কেন? স্ত্রী বললেন, তার স্বামীর অসুখ প্রায় সেরে গেছে। কিন্তু হাতখানা এখনও অবশ হয়ে আছে। তখন বাবা নিজের হাতটি তিনবার উঠিয়ে বললেন-যাও, হাত উঠেছে। এই কথা শুনে রাধিকাবাবুর স্ত্রী বাবাকে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে দেখেন, রাধিকাবাবু তার হাত তুলতে পারছেন–নিজের হাত তুলে ব্রহ্মচারী বাবা যেইমাত্র সংকল্প করলেন, রাধিকাবাবুর হাত সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। এ ছিল বাবার যথাসংকল্প সিদ্ধি প্রয়োগের এক অনন্ত উদাহরণ।


বাবা লোকনাথ যথাসংকল্প সিদ্ধি প্রয়োগ করে আর একজনকে এমন অদ্ভুতভাবে রোগমুক্ত করে দিয়েছিলেন। চিকন্দীর অধিবাসী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী পিঠের ব্যথায় খুব কষ্ট পেতেন। তিনি আশ্রমে গিয়ে বাবাকে সেবা করে কষ্টমুক্ত হতে চেয়েছিলেন। একদিন গোয়ালিনী মায়ের কাছ থেকে বাবার জন্য খাবার এনে নিজের হাতে তাঁকে খাওয়াতে গেলেন। তিনি যখনই বাবাকে খাওয়াতে যান, বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এর আগে একবার তিনি বাবাকে নিজের হাতে খাইয়েছিলেন। সে কারণে তিনি বুঝতে পারলেননা, বাবা কেন আজ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি আবার খাবার গ্রাস নিয়ে বাবার মুখে দিতে গেলেন। বাবা আরও ঘুরে মুখ সরিয়ে নিলেন। শরৎচন্দ্রবাবু না বুঝে আবার যেই বাবার মুখে গ্রাস দিতে গেছেন, বাবা তার খড়ম নিয়ে তার পিঠে তিনবার সজোরে আঘাত করলেন। শরৎচন্দ্রবাবু তখন কেঁদে সেখান থেকে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ কান্নার পর বাবা তাকে আবার ডাকলেন ও তাঁর হাতে খৈ-দুধ খেলেন।


শরৎচন্দ্রবাবু বুঝতে পারলেন না বাবা প্রথমে কেন তার হাতে খাবার খেলেন না, তাকে খড়ম পেটা করলেন, আবার ডেকে তার হাতেই খৈ-দুধ খেলেন। পরেরদিন তিনি আবিষ্কার করেন যে তার পিঠের ব্যথা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেছে। বাবা তার প্রিয় ভক্তকে রোগমুক্ত করার সংকল্প করেই পিঠে খড়মের আঘাত করেছিলেন। এই কথা বুঝতে পেরে শরৎচন্দ্রবাবু তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন।


.


অপ্রতিহতা আজ্ঞাসিদ্ধির দ্বারা প্রকৃতিকে বশ


অষ্টাঙ্গ যোগ সিদ্ধির দশটি গৌণসিদ্ধির মধ্যে একটি অন্যতম সিদ্ধি হল অপ্রতিহতা আজ্ঞা। যে সিদ্ধির দ্বারা যোগীর কোনো আজ্ঞা কারও, এমন কি প্রকৃতিরও লঙ্ঘন করার ক্ষমতা থাকে না, তাকে অপ্রতিহতা আজ্ঞাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির অধিকারী যিনি হন, দেব-দেবীকেও তার কথা মানতে হয়। বারদীতে বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে বাবার এই অনন্য সিদ্ধি প্রকটিত হয়েছিল। এখানে তার কিছু ঘটনার উল্লেখ করছি।


একবার ঢাকার একটি কলেজের কিছু ছাত্র বাবা ব্রহ্মচারীর কথা শুনে তার মাহাত্ম্য দেখার জন্য বারদীর আশ্রমের পথে রওনা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বারদীর সাধুবাবা কত বড় মহাপুরুষ। তা স্বচক্ষে দেখতে হবে এবং সততা যাচাই করতে হবে।


তারা ঠিক করলো যে নারায়ণগঞ্জ হয়ে প্রথমে বারদী যাবে। তারপর তারা দয়াগঞ্জ যাবে। কিন্তু এক ছাত্র বললো যে, আশ্রমে তো নিরামিষ খাবার, বরং বাইরের হোটেলে কিছু খেয়ে নিয়ে বারদীর আশ্রমে গেলেই হবে। কিন্তু অন্য ছাত্ররা বেঁকে বসে। এই ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রাজেন্দ্রচন্দ্র। যিনি পরবর্তীকালে বিদ্যাভূষণ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তার অন্যতম পৌত্র বিপ্লব ভট্টাচার্য বর্তমানে সোনারপুর নিবাসী। তার মুখে শোনা ঘটনার কথাই এখানে উল্লেখ করছি।


এই ছাত্রের দল যখন বারদী আশ্রমে আসে, তার কিছুক্ষণ পর একটি লোক একটি বড় রুই মাছ নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হয়। ছেলেরা বাবার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রণাম জানিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে। তাদের কারও কারও উদ্দেশ্য ছিল বাবাকে বিব্রত করা। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ছেলেরা বলে যে তাদের এক্ষুনি দয়াগঞ্জ হয়ে ঢাকায় তাদের হস্টেলে ফিরতে হবে। কারণ দয়াগঞ্জের হোটেলে তাদের খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। বাবা তাদের বাধা দিয়ে বলেন, এখানেই তোমরা তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে যাও। রুইমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে তবে তোমরা রওনা হও। ছাত্ররা এই কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়।


এরপর তারা ওই কাঠফাটা রোদে দীর্ঘ মাঠ পেরিয়ে যেতে হবে ভেবে বাবাকে বলতে যেতেই তিনি বলে ওঠেন, তোমরা রওনা হও। মাথায় রোদ লাগবে না। তখন একখণ্ড মেঘ হঠাৎ কোথা থেকে এসে সূর্যকে আড়াল করে দিলো। ছাত্রদের গায়ে কোনো রোদের তাপ লাগলো না। ছাত্ররা মাঠ পার হতেই সেই মেঘ আবার সূর্যের উপর থেকে সরে গেল এবং মাঠটি রৌদ্রময় হয়ে উঠলো। ছাত্রেরা এই ব্যাপার দেখে বুঝতে পারলো যে, ব্রহ্মচারী বাবা একজন সাধারণ সাধু নন। তিনি একজন মহাপুরুষ। তখন তাদের মন অনুতপ্ত হল বাবার প্রতি অবজ্ঞা ভাব দেখানো এবং এমন একজন মহাপুরুষের কথার সত্যতা যাচাই করার কথা মনে ভাবার জন্য। তারা সকলে আবার আশ্রমে ফিরে এসে বাবাকে বললো, আপনার দয়ায় মাঠ পার হতে আমাদের কোনো কষ্ট হয়নি। কিন্তু আমরা মাঠ পার হতেই আবার প্রচণ্ড রোদের তাপ আমাদের উপর এসে পড়লো। আপনি কৃপা করে আমাদের দয়াগঞ্জ পর্যন্ত ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাবার ব্যবস্থা করে দিন। এবার তাদের কথার মধ্যে অবজ্ঞার জায়গায় মিনতির সুর ছিল। অন্তর্যামী বাবা তাদের বললেন, দয়াগঞ্জ পর্যন্ত তোরা কোনো রোদের তাপ পাবি না। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ঢাকায় যাবি। একথা শুনে ছাত্রের দল খুশি হয়ে বাবাকে প্রণাম করে বিদায় নিলো। যতক্ষণ ছাত্রেরা দয়াগঞ্জ না পৌঁছলো, ততক্ষণ একখণ্ড মেঘ সূর্যকে আড়াল করে রইল।


এইভাবে বাবা লোকনাথ তাঁর যোগশক্তিবলে প্রকৃতিকে যে আজ্ঞা করেছেন, প্রকৃতি তা মানতে বাধ্য হয়েছে। এক ব্রহ্মজ্ঞ সিদ্ধযোগীর আজ্ঞা অপ্রতিহত। প্রকৃতিরও সাধ্য নেই সেই আজ্ঞার অবমাননা করার।


এইরকমই একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে।


রাজাসাহেব একদিন পাত্র-মিত্র ও অন্যান্য লোকজন সমেত হাতির পিঠে চড়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। বাবাকে দর্শন করে চরণবন্দনার পর সকলে প্রসাদ পেলেন। তারপর রাজা বাবার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য অনুমতি চাইলেন। তিনি বাবাকে বললেন, বাবা, আজ আমাকে যাবার জন্য অনুমতি দিন। আমার বিশেষ কাজ আছে। আর থাকা চলবে না। বাবা তখন তাঁকে বললেন-না না, এখন যাসনি। যদি একান্তই যেতে হয়, কিছুক্ষণ পরে যাবি। কিন্তু ভাওয়ালের রাজা যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি আর অপেক্ষা না করে বাবাকে প্রণাম করে হাতির পিঠে চড়ে পাত্রমিত্রসহ রওনা হলেন।


আশ্রম থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তারপর শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। রাজা বুঝতে পারলেন যে, এমতাবস্থায় এতগুলি লোক নিয়ে ভাওয়াল যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি তখন আশ্রমে ফিরে এলেন। রাজাকে ফিরে আসতে দেখে অন্তর্যামী বাবা মনে মনে হাসলেন। কিন্তু মুখে কোনো ভাব প্রকাশ না করে বললেন-কিরে, ফিরে এলি কেন? রাজা বিনীতভাবে বললেন, ঝড়বৃষ্টির জন্য ফিরে এলাম। এই ঝড় না থামলে যাবার উপায় নেই। বাবা হেসে বললেন-’বেশ বেশ, ভালই করেছিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল। রাজা হাতির পিঠে লোকজন নিয়ে আবার রওনা হলেন। এবারও কিছুদূর যাবার পর আবার ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। রাজা আবার আশ্রমে ফিরে এলেন। বাবা চুপচাপ বসে ছিলেন। রাজাকে কিছু বললেন না। রাজার এবার মনে হলো, যখনই রওনা হচ্ছেন, তখনই ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, আবার ফিরে এলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ তো অদ্ভুত ব্যাপার। এবার তার চৈতন্য হল যে ব্রহ্মচারী বাবা তাকে তখন যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাবার কথা অগ্রাহ্য করে রওনা হয়েছিলেন। লোকনাথ বাবা সাক্ষাৎ শিব। তার দেহে সব দেবতা বিরাজ করেন। তিনিই সেই পরমপুরুষ, আবার তিনিই প্রকৃতি। তাঁর ইচ্ছায় প্রকৃতির খেলা চলে। তার নিষেধ অমান্য করে রওনা হবার জন্যই প্রকৃতির রোষে বারবার পড়তে হচ্ছে। রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি তখন বাবার চরণ ধরে বলেন, বাবা, আমায় ক্ষমা করুন। আপনার নিষেধ অমান্য করে যাবার জন্যই আমাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আপনার আদেশ না পেলে আমার কী সাধ্য যে আমি আশ্রম ত্যাগ করতে পারি? আমার খুব অপরাধ হয়েছে। আপনি কৃপা করে এবার আমায় যাবার অনুমতি দিন। বাবার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছাড়া যে কেউ বাবার কাছে আসতে পারে না বা তার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারে না–এই কথা রাজা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে বাবা সন্তুষ্ট হলেন। তিনি এবার বললেন–আচ্ছা যা, আর কোনো চিন্তা নেই। পথে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবি। রাজা ও পাত্র-মিত্রগণ বাবার চরণে প্রণাম করে বাইরে এসে দেখলেন, আকাশ একেবারে পরিষ্কার। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ দেখে মনেই হবে না যে একটু আগে আকাশ সম্পূর্ণ মেঘাচ্ছন্ন ছিল এবং প্রবল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজা হাতিতে চড়ে পাত্রমিত্রসহ নির্বিঘ্নে ভাওয়াল গিয়ে পৌঁছলেন। এরপর থেকে ভাওয়ালের রাজা কখনও বাবার আদেশ অমান্য করেননি।


এই লীলার মাধ্যমে লোকনাথ বাবা ভাওয়ালের রাজাকে এই বার্তা স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন যে, তিনি নিজেই প্রকৃতি পুরুষ। বিশ্বচরাচরের সব কিছুই তার দ্বারা সংঘটিত হয়।


কেউ কেউ আবার তার অস্তিত্বের স্বরূপ বুঝতে না পারলেও, তার কথা অন্ধের মতো মেনে চলতেন। কিন্তু সঠিক মূল্যায়ণ করে এই ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিকে খুব অল্প ভক্তই চিনতে পেরেছিলেন।


বারদী আশ্রম ছিল পুরাকালের মুনি-ঋষিদের মতো। আশ্রমের চারিদিকে অনেক ফল-ফুলের গাছ শোভা পেত। বাবার ঘর বরাবর উঠানে একটি বেলগাছ ছিল যেটি ভূমি থেকে চার হাত পরিমাণ এক কাণ্ডে উঠে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে এবং তার শাখা-প্রশাখাগুলি উপরে চতুর্দিকে গোলাকারে বিস্তৃত হয়েছে। ওই বেলগাছের গোড়া গোলাকারে বাঁধানো আছে। বাবার অনেক ভক্ত এই বেলগাছতলার মাটি মেখে নীরোগ হয়েছে। বাবা নিজে এই বেলগাছতলায় এসে বসতেন। অনেক সময় ঘরে লোক হয়ে গেলে, ভক্তগণ এসে এই বেলগাছতলায় বসতেন।


একদিন শ্রীযুক্ত রাধাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মদনমোহন চক্রবর্তী (বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত) বাবার ঘরে জায়গা না পেয়ে এই বেলগাছের তলায় বসেছিলেন। দিনের বেলায় তাদের সঙ্গে আরও অনেক ভক্তও বসে আছেন। এমন সময় হঠাৎ মেঘ কালো করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। সকলে একমনে বাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন। কিন্তু সেখান থেকে সরলেন না। আশ্রমের সব ঘরেই ভিড় ছিল। ভক্তের ডাক বাবার কানে পৌঁছতেই তার অসীম কৃপায় দেখা গেল বেল গাছের তলায় কোনো বৃষ্টির জলের ফোঁটা পড়ছে না, কিন্তু আশ্রমের অন্য অংশে বৃষ্টি হচ্ছে। যে ভক্তগণ বেলগাছ তলায় ছিলেন, তাদের গায়ে বৃষ্টির জল পড়লো না। তারা সকলে বাবার উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই প্রণাম জানালেন। ভক্তের ডাক শুনে বাবা আজ্ঞা করেছিলেন, তাঁর ভক্তদের বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে। প্রকৃতির কি সাধ্য তার আজ্ঞার অবমাননা করে? ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা যে অপ্রতিহত।


এবার একটি ঘটনার উল্লেখ করবো যার থেকে বোঝা যাবে যে, ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা যে কেবল প্রকৃতি মানতেন, তা নয়, তার আজ্ঞা অবমাননা করা দেব-দেবীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না।


একদিন লোকনাথ বাবা তার ঘরের বাইরে আশ্রমের এক পাশে বসে আছেন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন রক্তবস্ত্র পরিহিতা এক রমণী তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। তাঁর মুখ বিবর আচ্ছাদিত কিন্তু তাতে বসন্তদাগ স্পষ্ট। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে? সেই রমণী উত্তর দিলেন–আমি মা শীতলা। আমি এই পথ দিয়ে যাব। তুমি পথ ছেড়ে বসো। লোকনাথ বাবা বললেন, তোমার এ পথ দিয়ে যাওয়া হবে না। বাবার কথা শুনে প্রথমে দেবী নীরব রইলেন। তারপর তার একটি পা এগিয়ে দিলেন। বাবা তখন হাত তুলে বললেন–আমি কি কেউ নই? আমি বারণ করা সত্তেও তুমি কি করে অগ্রসর হও? তৎক্ষণাৎ দেবী তার পা পিছনে নিয়ে নিলেন। এবার দেবী বললেন আমি কি যাবার পথ পাবো না? আমাকে কি এখানে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে? বাবা বললেন–তুমি বন্দিনী হবে কেন? ছাগলবাঘিনীর নদীর নিচু এলাকায় যে চর আছে, তুমি সেখান দিয়ে গমন করো। খবরদার, উঁচু ভূমিতে যেন অগ্রসর হয়ো না। এরপর মা শীতলা বাবার নির্দেশিত পথে সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন। আশ্রমের পিছনদিকে ছাগলবাঘিনী নদী।


এই ঘটনার কিছুদিন পর ছাগলবাঘিনীর চর এলাকায় বসন্ত দেখা দিলো। সেখানকার ভূইমালী বাড়ির বেশ কিছু লোক বসন্তে মারা গেল। পরিবারের কর্তা তখন বাবার কাছে আশ্রমে এসে তাদের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। বাবা তাদের সেই জায়গা ছেড়ে অবিলম্বে চলে যেতে বললেন। সেই পরিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ি ত্যাগ করলো এবং অনেকের জীবন তাতে রক্ষা পেল।


এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য হল যে, ব্রহ্মচারী ঋষির আজ্ঞা এতটাই অপ্রতিহত যে, তা লঙ্ন করার শক্তি কারও নেই। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যে পথ দিয়ে চলেন, স্বয়ং দেবতাগণ তাঁর পথ ছেড়ে দাঁড়ান। তপস্যায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর তাকে ব্রহ্মচারী উপাধিতে ভূষিত করার তাৎপর্য হল তিনি এক হস্তে ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করার ক্ষমতা ধরেন। বাবা লোকনাথ সেই উচ্চতায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন। এই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।


.


অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগে মানবকল্যাণ


কোনো সাধক সাধনার অতি উচ্চতম পর্যায়ে অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধিপ্রাপ্ত হন। এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে যোগী এমন গতিপ্রাপ্ত হন, যা কেউ রোধ করতে সমর্থ নয়। এই গতির দ্বারা যোগী ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো স্থানে যখন ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারেন। এই সিদ্ধি বাবা লোকনাথ বিভিন্ন মানবকল্যাণকার্যে প্রয়োগ করেছিলেন এবং নিজ আত্মাকে মহাপ্রয়াণের সময় উক্রমণের জন্য প্রয়োগ করেছিলেন। এখানে আমরা কিছু ঘটনার কথা আলোচনা করবো যখন বাবা মানবকল্যাণের জন্য অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন।


রজনীকান্ত ব্রহ্মচারী ছিলেন বাবা লোকনাথের একজন অতিপ্রিয় শিষ্য। তার কাছে বাবার একটি তৈলচিত্র ছিল। সেই চিত্রটি অতি প্রাচীন হয়ে যাওয়াতে এর কিছু অংশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। রজনীকান্তের ইচ্ছা হয় চিত্রটি সংস্কার করার। তৈলচিত্রটি সংস্কার করার জন্য তিনি কেদারেশ্বর সেনের কাছে দিয়েছিলেন।


কেদারেশ্বরবাবু তখন বি.এ. ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু চিত্র অঙ্কনে তার পারদর্শিতা ছিল। তিনি রজনী ব্রহ্মচারীর একজন অনুগত শিষ্য ছিলেন। শিল্পী প্রাচীন তৈলচিত্রটি পেয়ে তার সংস্কারের কার্য করার সময় ধারণা করতে পারছিলেন না যে চিত্রটির বিকৃত জায়গায় কি হওয়া উচিত। তিনি নিজে লোকনাথবাবাকে দর্শন করেননি। সেইজন্য তার মানসপটে লোকনাথ বাবার শারীরিক ভাব বিরজিত অংশ সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল না। তিনি সে কথা রজনী ব্রহ্মচারীকে জানিয়েছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে এমন কোনো লোকের যোগ স্থাপন করিয়ে দিতে যিনি শিল্পীকে বাবার চিত্রের বিকৃত স্থানগুলির সঠিকভাব ব্যাখ্যা করতে পারেন। রজনী ব্রহ্মচারী সেইরকম একজন লোকের খোঁজ করতে থাকেন, কিন্তু এমন কোনো লোকের সন্ধান পান না। যিনি বাবার চিত্রের সঠিক শারীরিক অবস্থান ও ভাবভঙ্গির ব্যাখ্যা দিয়ে চিত্রটি ত্রুটিমুক্তভাবে অঙ্কনে সাহায্য করতে পারেন।


এদিকে কেদারবাবু রজনীকান্তের থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে ভাবতে থাকেন কিভাবে তৈলচিত্রটি নিখুঁতভাবে গড়ে তুলবেন। এমন অবস্থায় একদিন একজন ব্রহ্মচারী তাঁর কাছে এসে, তার সামনে বসে চিত্রটির দোষ, ত্রুটি সব বলে দিলেন। চিত্রটির বিকৃত অংশ কেমন হবে তাও বলে দিলেন। তার কথানুযায়ী শিল্পী সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গা সংস্কার করলেন। তৈলচিত্রটি সম্পূর্ণ হলো। ঠিক সেইসময় কেদারবাবুকে বাইরে থেকে রজনীকান্ত ডাকলেন এবং তাঁকে বললেন যে, তিনি এমন কোনো লোক জোগাড় করতে পারেননি যিনি বাবার চিত্রটি সংস্কার করতে সাহায্য করতে পারেন। কেদারবাবু তখন তার গুরুদেবকে বলেন, একজন ব্রহ্মচারী বাবা তাঁর কাছে এসেছেন এবং চিত্রটির দোষ, ত্রুটিগুলি সংশোধন করে দিয়েছেন। চিত্রটি এখন সম্পূর্ণ। সেই ব্রহ্মচারী এখন তার ঘরেই আছেন। রজনীকান্ত তড়িৎগতিতে কেদারবাবুর সঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করে দেখেন সেখানে কেউ নেই। কেদারবাবু বলেন, এইমাত্র তো ব্রহ্মচারী বাবা আমার সঙ্গে বসেছিলেন, সকলের অজ্ঞাতে তিনি কোথায় গেলেন! লোকনাথবাবা স্বয়ং দেবলোক থেকে অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির বলে কেদারবাবুর কাছে দর্শন দিয়ে তার প্রিয় শিষ্যের ইচ্ছাপূরণ করে গিয়েছিলেন। এখনও তার অপ্রতিহত গতিতে তিনি ভক্তদের কৃপা করে থাকেন। কেদারেশ্বর সেন মহাশয় লোকনাথ মাহাত্ম নামে একটি পুস্তক রচনা করে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।


অন্নদাচরণ চাকলাদার লোকনাথবাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি একদিন বারদী আশ্রমে এসে বাবার ঘরে তার থেকে উপদেশ শুনছেন। এমন সময় তাঁর শ্যালক এসে খবর দেয়, বাড়িতে তার মায়ের বুকে-পিঠে খুব ব্যথা শুরু হয়েছে। অন্নদাচরণ বাবার কাছে বাড়ি যাবার জন্য অনুমতি চাইলেন। বাবা তাঁকে বললেন–যা, বাড়ি গিয়েই মাকে বেড়াতে দেখবি। অন্নদাচরণ অনেক চিন্তাযুক্ত মনে বাড়ির পথে রওনা হলেন। ইত্যবসরে বাবার দেহ স্থির হয়ে গেল। উপস্থিত সকলে দেখলেন, বাবা কোনো কথা বলছেন না। তার দেহ ও চক্ষু স্থির। অন্নদাচরণ বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, তার মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তার মা বললেন, তিনি ক্ষীর ও খৈ দিয়ে পথ্য করে রোগমুক্ত হয়ে গেছেন। এখন তাঁর কোনো রোগ নেই। মাকে এইভাবে রোগমুক্ত হতে দেখে অন্নদাচরণ আবার বারদীর পথ ধরলেন। আশ্রমে পৌঁছে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করতেই তিনি বললেন–আমি তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম, তোর মাকে ক্ষীর-খৈ খাইয়ে এসেছি। তোর মা ভালো হয়েছে বটে, কিন্তু দুই বৎসরের মধ্যে বৈশাখ মাসে তাঁর মৃত্যু হবে। ব্রহ্মচারী বাবার এই কথা সত্য হয়েছিল।


এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই কীভাবে বাবা লোকনাথ তাঁর অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগে ভক্তের মনের ব্যথা দূর করতে তার মাকে কষ্টমুক্ত করেন। আবার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির দ্বারা একথাও বলে দেন, কতদিন তার মা ইহজগতে থাকবেন।


কুমিল্লাবাসী নিবারণ রায় নামে এক ব্যক্তি একটি ফৌজদারী মামলার আসামী হয়ে আদালতে অভিযুক্ত হন। কুমিল্লার জেলা কোর্টে সেই মামলা চলতে থাকে। নিবারণের পক্ষে খুব ভালো উকিল নিয়োগ করা হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্তেও তার ফাঁসির হুকুম হয়।


এরপর কলকাতা হাইকোর্টে আসামীর পক্ষে আপিল করা হয়। সেখানে অনেক বড়ো আইনজীবী নিবারণের ফাঁসির হুকুম র করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। কিন্তু কোনো আশার আলো দেখা যায় না। হাইকোর্টে ওই কেসের রায়দানের আগের দিন কারাকক্ষে নিবারণ অস্থির চিত্তে পায়চারি করছেন আর ভাবছেন তার ভবিতব্যের কথা। কীভাবে ওই মামলায় তার শাস্তি রদ হবে এই চিন্তায় তখন তিনি পাগল।


ইতিপূর্বে তিনি বারদীর বাবা লোকনাথের কথা শুনেছেন। কিন্তু কখনও তাকে চোখে দেখেননি। হঠাই কে যেন অন্তর থেকে ডেকে বললো, তুই বাবা লোকনাথকে স্মরণ কর। অন্তরাত্মার এই কথা শুনে নিবারণবাবু অন্তিমলগ্নে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বাবার কৃপা প্রার্থনা করতে লাগলেন। কারাগারের অন্ধকার কুঠিতে তিনি বাবা লোকনাথের স্মরণে তন্ময় হয়ে গেলেন। হঠাৎ সেই অন্ধকার কুঠুরি এক জ্যোতির্ময় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। নিবারণবাবু দেখলেন কারাগারের লোহার গারদ ভেদ করে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন এক জটাজুটোধারী দিব্যকান্তি মহাপুরুষ। নিবারণবাবু তার পদতলে লুটিয়ে পড়ে বললেন, আপনি কে আমি জানি না। কিন্তু আমি বড় বিপদের মধ্যে আছি। আমায় উদ্ধার করুন।


সেই জটাজুটধারী জ্যোতির্ময় পুরুষ বললেন, তুই আমাকে স্মরণ করে আমার শরণাপন্ন হয়েছিস, সেইজন্য আমি তোর মামলার রায় লিখে দিতে এখানে এসেছি। শুনে রাখ, এতক্ষণ তুই যার নাম করছিলি, আমিই সেই বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারী। এই কথা বলেই বাবা অন্তর্হিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই দিব্যজ্যোতিও কারাকক্ষ থেকে অন্তর্হিত হয়ে আবার ঘরখানি অন্ধকার করে দিল।


বিস্মিত, অভিভূত নিবারণবাবুর গোটা রাত কাটে নিদ্রাহীনভাবে। কিছুটা সংশয়, কিছুটা আশঙ্কায় গোটা রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। আদালতে রায়দান পর্বের সময় আগত। নির্দিষ্ট সময়ে বিচারক রায় দিয়ে ঘোষণা করলেন যে ওই মামলায় নিবারণবাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন।


অবাক বিস্ময়ে নিবারণবাবু ভাবলেন, এত খরচ করে এত বড়ো বড়ো উকিল মোক্তার লাগিয়েও যে মামলায় তার হার প্রায় নিশ্চিত ছিল তা কেবলমাত্র বাবা লোকনাহের কৃপায় উল্টে গেল।


কারামুক্ত হয়েই নিবারণবাবু ছুটে গেলেন বারদীর আশ্রমে। আশ্রমে বাবার একটি তৈলচিত্র দেখেই তিনি চিনতে পারলেন কারাকক্ষের সেই দিব্যকান্তি পুরুষকে।


এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাবা কেবল তার অপ্রতিহত গতিসিদ্ধি দিয়ে কারাকক্ষে সকলের অজ্ঞাতে প্রবেশ করেছিলেন, তাই নয়, তিনি তার পরকায় প্রবেশন সিদ্ধি প্রয়োগ করে অতি সূক্ষ্মরূপে বিচারকের মধ্যে প্রবেশ করে অভিযুক্তের হয়ে রায়ও লিখে দিয়েছিলেন। অনেকে হয়তো এই ব্যাপারে আশ্চর্য হবেন, কিন্তু এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বাবা কেমন ঈশ্বরকোটির সাধক ছিলেন!


ডাঃ আশুতোষ বণিক ও তার পরিবার ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একবার সেই পরিবারের অরবিন্দ বণিক চন্দ্রনাথ তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর পৌঁছে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যান এবং অস্ফুটে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার শরীরের উত্তাপ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি মৃতবৎ হয়ে পড়েন। হঠাৎ কোথা থেকে সাধু সাধু শব্দ শোনা গেল। আর তখনই কেউ যেন তার চোখে জলের ঝাঁপটা দিলেন এবং তিনি চেতনা ফিরে পেলেন। অচেতন অবস্থা থেকে চৈতন্য ফিরে পেয়ে তিনি অন্য তীর্থযাত্রীদের কাছে শুনলেন, এক সাধু আবির্ভূত হয়ে তার কমন্ডলু থেকে পবিত্র জল মন্ত্রপুত করে তীর্থযাত্রীর চোখে ঝাঁপটা দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অরবিন্দ বাবু বুঝলেন যে, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে স্মরণ করেছিলেন বলে তিনি নিজে সাধুবেশে এসে মন্ত্রপুত জল সিঞ্চন করে তার প্রাণরক্ষা করে গেলেন। সার্থক করে গেলেন তার কথা–


রণে বনে জলে জঙ্গলে

যেখানে বিপদে পড়িবে

আমাকে স্মরণ করিও

আমিই রক্ষা করিবো।


পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য। একবার রাজা বাবাকে ভাওয়ালে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বাবাকে বলেন–ভাওয়ালে তিনি বাবার জন্য আশ্রম ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবেন। ভক্তের এই আগ্রহ দেখে বাবা তাঁকে বলেন, আমাকে ভাওয়ালে নিয়ে যাবার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমাকে যেখান থেকে ডাকবি, সেখানেই পাবি।


এই কথার মাধ্যমে বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভক্ত যেখান থেকেই তাকে ডাকুক না কেন, সেই ডাক তার অন্তরে সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করে এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানে তাকে দেখা দিয়ে কৃপা করেন। তিনি যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই বিরাজ করছেন, অনেক সময় ভক্তগণ সেই কথা বুঝতেন না।


বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা জজ কোর্টের একজন আইনজীবী। ঢাকায় তার খুব প্রতিপত্তি ছিল। তিনি ছিলেন ব্রহ্মচারী বাবার চরণাশ্রিত একজন অনুগত ভক্ত। একবার তিনি ঢাকা থেকে স্টিমারযোগে মেঘনা নদীপথে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। মেঘনা নদী দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। প্রচণ্ড ঝড়ে মেঘনা নদীর বুকে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠতে থাকে। শুরু হয়ে যায় এক প্রলয়কাণ্ড। যাত্রীদের বুক অজানা শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। এমনসময় যাত্রীদের বিপদ সংকেত জানাতে স্টিমারের সাইরেন বেজে ওঠে। এই সাইরেনের শব্দে স্টিমারের সব যাত্রী প্রমাদ গুণতে থাকে এবং চারিদিক থেকে আর্তনাদ ভেসে ওঠে। নিশ্চিত শমণকে সামনে দেখতে পেয়ে বিহারীলাবাবু একমনে আকূল হয়ে বাবা লোকনাথকে ডাকতে থাকেন।


সেইসময় বারদী আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের সুপারিনটেনডেন্ট শ্রী অনাথবন্ধু মল্লিক মহাশয়। হঠাৎ বাবা লোকনাথ সমবেত ভক্তগণকে বলেন, বিহারী এখন ভীষণ বিপদে পড়ে আমার সাহায্য প্রার্থনা করছে। আমি তার জীবনরক্ষার জন্য চললাম। এই কথা বলে বাবা গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। তার দেহ স্থির হয়ে গেল।


ওদিকে মেঘনা নদীর উপর স্টিমারে জল ঢুকতে শুরু করেছে। নাবিকরা বুঝতে পারে যে, যে-কোনো মুহূর্তেই ঢেউয়ের আঘাতে স্টিমার উল্টে সকলের সলিল সমাধি হবে। প্রাণরক্ষার আর কোনো উপায় কারও চোখে পড়ে না। সবাই যখন মেঘনার বুকে প্রকৃতির তাণ্ডবের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর প্রহর গুণতে শুরু করেছে, তখনও বিহারীলালবাবু ‘হে বাবা রক্ষা কর’ বলে কাতর কণ্ঠে বাবাকে ডাকতে থাকেন। জল ঢুকে যখন স্টিমারটি ডুবতে বসেছে তখন হঠাৎ সেই তাণ্ডবলীলা স্তব্ধ হয়ে গেল। বিহারীলালবাবু ও অন্যান্য যাত্রীরা দেখলেন দুটি অলৌকিক হাত স্টিমারটিকে শক্ত করে ধরে উপরে তুলছে। বিহারীলাল বাবু সেই দুটি অলৌকিক হাত দেখতে পেয়েই বুঝলেন, এই দুই হাত স্বয়ং বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার। তার ডাক শুনে বাবা লোকনাথ তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে এসেছেন। তিনি পুনঃ পুনঃ তার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন।


এদিকে বারদী আশ্রমে সকল ভক্তগণ দেখছেন বাবার শরীর নিস্পন্দ। কিছুক্ষণ পর তার বুখান হলো। সমাধি ভঙ্গ হলে তিনি বললেন, বিহারীলাল চট্টগ্রামের পথে মেঘনা নদীতে খুব বিপদে পড়ে আমাকে স্মরণ করেছিল। ওর প্রাণ সংশয় হয়েছিল। ওকে রক্ষা করে এলাম। সঙ্গে সব যাত্রীরাও রক্ষা পেয়ে গেল। অনাথবন্ধু বাবু এবং অন্যান্য ভক্তগণ বাবার এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বাবা তাদের সামনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তবে কি বাবা বারদী থেকে ঢাকার পথে গিয়ে মেঘনার উপর ডুবন্ত স্টিমারসহ বিহারীলালবাবুকে রক্ষা করলেন!


অপ্রতিহতাগতি এমন এক আশ্চর্য সিদ্ধি যে যোগীর আত্মা মুহূর্তের মধ্যে তাঁর অভিলষিত স্থানে পৌঁছে যেতে পারে, যদিও তার শরীর স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকে।


এই ঘটনার কিছুদিন পরে বিহারীলাল বাবু বারদী আশ্রমে আসেন বাবার দর্শনাকাঙ্ক্ষায়। বাবা লোকনাথ তখন তাকে বলেন–তুমি কি কখনও অসহায় অবস্থায় জলপথে আমাকে স্মরণ করেছিলে? বিহারীলালবাবু তখন মেঘনা নদীর ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সমবেত ভক্তগণের সামনে পেশ করেন এবং ব্রহ্মচারী বাবার শ্রীপাদপদ্মে তার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।


যোগীর অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগ সম্বন্ধে জানতে পারা যায় যে, যোগী তার আধ্যাত্মিক শক্তিবলে আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে অন্যান্য সমস্তরের যোগীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে যান এবং আবার আত্মাকে স্বদেহে ফিরিয়ে এনে সচল করেন।


বাবা লোকনাথের অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধি প্রয়োগের আর একটি চমকপ্রদ ঘটনা সাধু সমাজে বহুল প্রচারিত।


একবার শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী উত্তর ভারত ভ্রমণের সময় ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছিলেন। এই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে বাবা একবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে দাবানল থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে ঢাকায় গোঁসাই বলে ডাকা হতো। ঢাকায় তার আশ্রম ছিল। ঢাকার আশ্রমে একটি টেলিগ্রাম মারফৎ খবর আসে যে গোঁসাই বাবা মৃত্যুমুখে পতিত। গোঁসাই বাবার একজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন শ্যামাচরণ। তিনি বাবা লোকনাথের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তার বারদী আশ্রমেও যাতায়াত ছিল। শ্যামাচরণবাবু গোঁসাই বাবার খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে বারদী আশ্রমে গিয়ে তার গুরুদেবের প্রাণরক্ষার জন্য বাবার চরণে নিবেদন করেন। কিন্তু বাবা তাকে বলেন, তুমি আমার কাছে পূর্বে এলে না কেন?


তখন শ্যামাচরণবাবু বাবা লোকনাথের কাছে আকুল প্রার্থনা করেন যে, বাবা যেন তার আয়ু কমিয়ে গুরুর জীবনদান করেন। গুরুর প্রতি শ্যামাচরণবাবুর এমন ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে বাবা খুশি হয়ে তাকে বলেন, তুমি ঢাকায় ফিরে যাও, আমি বিজয়কৃষ্ণের কাছে যাবো। আগামী পরশু খবর পাবে।


এরপর দেখা যায় বাবার দেহটি বারদী আশ্রমে অবস্থান করছে আবার তাকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর রোগ শয্যাতেও দেখা যাচ্ছে। গোঁসাই বাবার সেবিকা বাবাকে রোগশয্যায় বসে রোগীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখেছেন। গোঁসাই বাবার একজন প্রিয় শিষ্য, যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেছেন, গোঁসাই বাবার বাঁচার কোনো আশা ছিল না বলে ডাক্তারেরা তাকে মৃত ভেবে দেহটি বাইরে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা লোকনাথ সেই দেহের পাশে বসার পরেই ডাক্তাররা দেখেন যে দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এখানে বাবা তার অমিত যোগশক্তিবলে দেহের কাছে উপস্থিত হয়ে গোঁসাই বাবার জীবন দান করেছিলেন।


.


মনোজব সিদ্ধি প্রয়োগে মানবকল্যাণ


এই সিদ্ধির বলে যোগী মনের কামনামাত্র তাঁর অভিষ্ট স্থানে পৌঁছতে সমর্থ হন।


দার্জিলিং-এর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন পার্বতীচরণ রায়। তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একদিন বারদীতে বাবার নামে পার্বতীবাবুর কাছ থেকে একটি পত্র আসে। পত্রখানি রজনী ব্রহ্মচারীর হাতে পড়ে। রজনীকান্ত খাম নিয়ে বাবাকে দিতে গেলে বাবা বলেন, দ্যাখ তো পার্বতী চরণের চিঠি কি না? রজনীকান্ত চিঠিটি বার করে বলেন, পার্বতীচরণ রায়ের চিঠি। বাবা। বললেন–পড় দেখি, কি লিখেছে? রজনীকান্ত চিঠি পড়ে বললেন, পার্বতীবাবু লিখেছেন–আমার শরীর নিতান্ত অসুস্থ হইয়াছিল গতকল্য। যেন কৃপাদৃষ্টি থাকে।


সুস্থ হয়ে পার্বতীবাবু বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন? উত্তরে বাবা লোকনাথ বলেন–আমি কি বারদী ছেড়ে কোথাও যাই? তখন পার্বতীবাবু অবাক হয়ে বললেন-আমি আপনাকে। দর্শন করেছি। এই কথা শুনে বাবা বলেন–আমি তোমার বিষয়ে চিন্তা করেছিলাম।


মনোজব সিদ্ধি প্রয়োগ করে ভক্তকে কৃপা করা-শরণাগতকে কৃপা করার এটি ছিল একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


.


পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগে ভক্তকে রক্ষা


যে সিদ্ধির বলে সিদ্ধ যোগী নিজের ইচ্ছামতো অন্যের দেহে সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে তার আদেশমতো কাজ করাতে পারেন, তাকে পরকায় প্রবেশন সিদ্ধি বলে। অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির সঙ্গে পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগ করে দেহান্তরে ব্রহ্মচারী বাবা কীভাবে এক ভক্তকে রক্ষা করেছিলেন, সেই ঘটনা আগে উল্লেখ করেছি। একবার বাবা লোকনাথ বারদীর জমিদার নাগবাবুদের রক্ষা করার জন্য কিভাবে এই সিদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন, এখানে সেই ঘটনার উল্লেখ করছি।


একবছর জমিদার নাগবাবুদের এজমালি মহলে প্রজারা বিদ্রোহ করেছিল। প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিলো। তখন জমিদারির কোনো কোনো শরিক কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করতে নির্দেশ দিলেন। তাদের মধ্যে একজন বয়ঃবৃদ্ধ শরিক বলেছিলেন, কিছু করার আগে একবার বাবা লোকনাথের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই কথা শুনে শরিকদের কেউ কেউ বললো, নিজেদের জমিদারি নিজেরা রক্ষা করবো, এ ব্যাপারে বাবার পরামর্শ নেবার দরকার কি? কিন্তু অন্য শরিকরা বাবার পরামর্শ নেবার পক্ষে মত দিলে তারা সকলে বারদী আশ্রমে বাবার কাছে গিয়ে তাঁর মত চাইলে তিনি বললেন


হ্যাঁরে, নিজেদের জমিদারি নিজেরা রক্ষা করবি, তাতে আবার বাবার পরামর্শ নেবার দরকার কি? তিনি একথা এইজন্য বলেছিলেন কেননা সর্বজ্ঞ ব্রহ্মচারী বাবা বাড়িতে তাদের কথোপকথন সব যোগবলে জানতে পেরেছিলেন। নাগবাবুরা বাবার এই কথায় বুঝতে পারলেন যে, বাবা তাঁদের কথোপকথন সব জেনে গেছেন। বাবার কথা শুনে তারা অত্যন্ত ভীত, বিস্মিত এবং লজ্জিত হলেন। তারা তখন বাবাকে বললেন, আমাদের অন্যায় হয়ে গেছে, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনার শরণাপন্ন। এরপর নাগবাবুদের কাছে কোনো ঘটনা না শুনেই বাবা নিজে থেকে বলে দিলেন, তোদের প্রজারা বিদ্রোহী হয়েছে, এই তো? ঠিক আছে, তোদের কিছু করতে হবে না। তারা এই আশ্রম থেকে বিদ্রোহী প্রজাদের খাজনা ও কবুলতি বুঝে পাবি। নাগবাবুরা ভাবলেন, বিদ্রোহী প্রজারা এসে খাজনা ও কবুলতী দিয়ে যাবে, এটা একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বাবার কথায় তাদের বিশ্বাস হল না কিন্তু তারা কিছু না বলে বাড়ি চলে এলেন।


বাড়ি ফিরে তারা লোকনাথবাবার কথা অমান্য করে লেঠেল পাঠিয়ে খাজনা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু লেঠেলদের হুকুম দেবার আগে তারা আবার বারদী আশ্রমে গিয়ে লোকনাথবাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলেন।


এবারও তারা বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার সামনে যেতেই তিনি বললেন, ‘তোরা এ কাজ করিস না। আমি তো বলছি, ভয় নেই। আশ্রম থেকেই তোরা খাজনা ও কবুলতী পাবি।


কিন্তু জমিদারপক্ষের শরিকরা তাদের জমিদারিত্বের সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে লেঠেল পাঠিয়ে অনাদায়ী খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের ক্ষেত থেকে পাট কেটে আনতে হুকুম করলো। রুখে দাঁড়ালো সেইসব প্রজারা। বেঁধে গেল তুমুল সংঘর্ষ। লেঠেলদের লাঠির আঘাতে বেশ কিছু প্রজা আহত হলো। তাদের মধ্যে একজন গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো।


প্রজাদের পক্ষ থেকে আদালতে লেঠেলদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হলে জমিদারপক্ষ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তারা ফের বাবার শরণাপন্ন হবার কথা ভেবে গেলেন বারদী আশ্রমে। দু’দুবার বাবার কথা অমান্য করে তখন তারা যথেষ্ট লজ্জিত। তাঁরা বাবার কাছে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বাবার আশীর্বাদ চাইলেন। তিনি তাদের শুধু বললেন–ওরা যা করেছে করুক। তোরা দারোগা, পুলিশ, আমলা, উকিল, মোক্তার কাউকেই কোনো টাকা পয়সা দিবিনা। তোরা বাড়ি ফিরে যা। আমি দেখবো।


বাবার অভয়বাণী শুনে তারা বাড়ি ফিরে গেলেও মনে তাদের অনেক সংশয় রয়ে গেল। তারা ভাবলেন, লেঠেলদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় আসামীপক্ষ সমর্থন না করলে, লেঠেলরা জমিদারদের কথা বলে দিতে পারে এবং তাদের শাস্তি অনিবার্য। এছাড়াও লেঠেলদের কাছে জমিদারদের অপমানিত হতে হবে। তাদের হেয় হতে হবে। এইসব ভেবে তারা মামলা চালানোর পক্ষে যুক্তি করলেন। মামলায় লেঠেলদের শাস্তি আটকানো গেল না। আসামীদের প্রত্যেকের ছয় মাস করে জেল হয়ে গেল। নাগবাবুদের মুখ পুড়লো। লোকনাথবাবার সামনে দাঁড়ানোর আর মুখ রইলো না। তাই তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলেন। আপিল চলাকালে নাগবাবুদের বিপদ আরও বেড়ে গেল, কেননা যে বিদ্রোহী প্রজাটি গুরুতর আহত হয়েছিল, সে মারা গেল। তাই আপিল চলাকালীন ফরিয়াদি পক্ষ থেকে এটাকে খুনের মামলা হিসেবে বিচার করার জন্য প্রার্থনা জানানো হলো। এই অবস্থায় জমিদার পরিবার রীতিমতো আতান্তরে পড়ে গেল। বাবা লোকনাথের আদেশ অমান্য করেই যে আজ তাদের এই অবস্থা তা বুঝতে পেরে শেষরক্ষার জন্য তারা ফের বাবারই শরণাপন্ন হলেন।


বাবা তাদের বললেন, তোরা বারবার আমার কথা অমান্য করেছিস। তার ফলস্বরূপ এখন আগে তোদের একশত টাকা জরিমানা দিতে হবে। তোরা জানিস না, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। তোরা নাস্তিক, তোদের তাই বিশ্বাস নেই। ত্রিকালজ্ঞ বাবা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে আহত প্রজা মৃত্যুমুখে পতিত হবে, সেইজন্য তিনি নাগবাবুদের মামলায় যেতে নিষেধ করেছিলেন। ভক্তরা কীভাবে তার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির মূল্যায়ণ করতে সমর্থ হবেন? সেইজন্যই অনেক সময় ভক্তের আন্তরিক বিশ্বাসের স্তর নিচের দিকে থাকে। যদিও বাহ্যিকভাবে তারা প্রকাশ করেন তাদের অবিচল বিশ্বাস আছে। এক্ষেত্রে নাগবাবুরা আশ্বস্ত হলেন যে, বাবা তাদের ক্ষমা করেছেন। তারা একশত টাকা জরিমানা দিতে সম্মত হলেন।


বাবা লোকনাথ তাঁদের বললেন, যেদিন তোদের মামলার শুনানি হবে, সেদিন বিকেলবেলা তোরা আমার কাছে আসবি। নাগবাবুরা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।


এরপর আপিলের শুনানির দিন বিকেলে নাগবাবুরা দুরুদুরু বুকে বাবার কাছে। হাজির হলেন। বাবার সামনে উপস্থিত হওয়ামাত্র তিনি বললেন, তোদের জজ অসুস্থ। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি তাঁকে উঠিয়ে রায় লিখিয়ে দিয়ে এসেছি। আগামীকাল তোরা আসামীদের খালাস করার টেলিগ্রাম পাবি। আর শোন, আসামীদের তোরা আমার আশ্রমেই পাবি। যা, এখন বাড়ি যা।


করুণাময় বাবার এইরকম অভয়বাণী শুনে নাগবাবুরা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে এলেন। পরের দিন তারা টেলিগ্রাম পেলেন যে, আসামিরা খালাস পেয়েছে, আরও আশ্চর্যের বিষয় হল যে, আসামীরা খালাস পেয়ে জমিদারবাড়ি না গিয়ে বারদীর আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে এলো। নাগবাবুরা খবর পেয়ে বারদী আশ্রমে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করলেন।


এই ঘটনাটি বড়ই অদ্ভুত। নাগবাবুরা যেভাবে বাবার আদেশ অমান্য করেছেন, কোনো দেবতাও তাদের ক্ষমা করতেন না। কিন্তু করুণাময় বাবা লোকনাথ নাগবাবুদের এই অপরাধের জন্য কেবল ক্ষমাই করেননি, তাদেরকে নিশ্চিত শাস্তির হাত থেকে রক্ষাও করেছেন। তারপর তিনি মনোজবসিদ্ধি বলে জজের কাছে পৌঁছে পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগ করে তার হাতে নাগবাবুদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় রায়ও লিখিয়ে দিয়েছেন। এইজন্যই তিনি তাঁর শাশ্বতবাণীতে বলেছেন, তিনি ইচ্ছা করলেই সব করতে পারেন। ব্রহ্মচারী বাবার পথ রোধ করে এমন ক্ষমতা কারও নেই। ভক্তের মনে কেবল অবিচল বিশ্বাস চাই।


.


পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধির বলে লীলা


এটি এমন এক চমকপ্রদ সিদ্ধি যার বলে যোগী পরের মনের কথা জানতে পারেন। তার সামনে কেউ কোনো কথা বা ভাবনা গোপন রাখতে পারে না। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী এমনই এক সিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন যে, তাকে কেউ স্মরণ করলে বা তার সম্বন্ধে কোনো কথা বা ভাব মনে মনে পোষণ করলে, তিনি সেটা বুঝতে পারতেন। তার হৃদয়তন্ত্রীতে সেই স্মরণকারী বা ভক্তের মনের কথা অনুরণিত হতো এবং তার মানসপটে সেই ভক্তের ছবি ভেসে উঠতো। সেই স্মরণকারী বা ভক্ত যদি বিপদগ্রস্ত হতো, তবে তিনি সূক্ষ্ম শরীরে তার কাছে পৌঁছে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। তিনি অপ্রতিহতা গতি বা মনোজবসিদ্ধিবলে এই রকমভাবে ভক্তদের কাছে চোখের পলকে পৌঁছতে পারতেন। এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি। দেহান্তরে এখনও মহাযোগেশ্বরবাবা লোকনাথ ভক্তদের একইভাবে কৃপা করে চলেছেন। এখানে পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধি বলে বারদী আশ্রমে বাবার আরও কিছু লীলার উল্লেখ করছি।


একদিন আশ্রমে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। বাবা তাদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করছেন। নানা বিষয়ে ভক্তদের উপদেশ দান করছেন। হঠাৎ দ্বারের দিকে চেয়ে একজনকে উদ্দেশ্য করে তিনি খুব কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। ভক্তরা বুঝতে পারলেন না যে, কাকে উদ্দেশ্য করে বাবা সহসা এত কটুক্তি করছেন। বাবা হঠাৎ বললেন–তোর সালা আজ আমি মাথা ভেঙ্গে দেবো। কিছুক্ষণ পর এক অপরিচিত ব্রাহ্মণ আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। বারদী আশ্রমে তাকে আগে কখনও দেখা যায়নি। তাঁকে দর্শন মাত্রই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা। নানা কটুকথা বলে তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন।


এই ব্রাহ্মণ অনেক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়ে আশ্রমে প্রবেশ করেই বাবার কাছে এইরকম কটুক্তি ও তিরস্কার পেয়ে খুবই বিস্মিত এবং দুঃখিত হলেন। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন যে, ব্রহ্মচারী বাবা তাঁকে আগে কখনও দেখেননি, তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানেনও না, তবে কেন তিনি এমন ভর্ৎসনা করছেন? এই ভৎর্সনার কোনো কারণ কারও জানা নেই। বাবাও কাউকে এর কোনো কারণ বলছেন না, কেবল তিরস্কার করে যাচ্ছেন। ব্রাহ্মণ এইরকম কঠোর কটুক্তি আর সহ্য করতে না পেরে অবশেষে আশ্রম ত্যাগ করলেন।


এই ঘটনায় সমবেত ভক্তগণ যথেষ্ট আশ্চর্য হলেও এটা বুঝলেন যে, এই ঘটনার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মহাযোগী বাবা তার যোগদৃষ্টিতে ব্রাহ্মণের মধ্যে এমন কোনো অপরাধ দেখেছেন যার জন্য তিনি তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কেউ সে কথা রাগত বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলো না। ব্রাহ্মণ আশ্রম ত্যাগ করলে বাবা নিজেই তার রাগের কারণ ভক্তদের বললেন। তিনি বললেন, তোরা আমার এরকম কটুক্তি শুনে নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পেলি। কিন্তু আমার এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ওই ব্রাহ্মণ একজন নরমাংস বিক্রেতা, একটা কশাই। ওর এক বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। বেটা বরপক্ষের কাছ থেকে মোটা পণ নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছে। ও মেয়েকে দেবার জন্য কেবল পণের অঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে। যে বেশি পণ দেবে, ও তাকেই মেয়ে দেবে, মেয়ে সুপাত্রে পড়লো না অপাত্রে পড়লো, সেদিকে ওর নজর নেই। তাই আমি গালি দিয়ে ওকে অমন করে তাড়িয়ে দিলুম।


একজন ভক্ত বাবার কথা শুনে কৌতূহলবশতঃ সেই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বাবার কথা জানালেন। তার কথা শুনে ব্রাহ্মণ মুক্তকণ্ঠে সব স্বীকার করে বললেন, তার একটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। একাধিক বরপক্ষের কাছে পণের দাবি বাড়াতে বাড়াতে এখন কয়েকশো টাকায় উঠেছে। এই পণের টাকা আর বাড়বে কি না, সেই কথা জানতে তিনি আশ্রমে বাবার কাছে গিয়েছিলেন।


ব্রাহ্মণ তখন সেদিন বাবার দ্বারা তিরস্কৃত হবার কারণ বুঝতে পারলেন। করুণাময় বাবা তার মেয়ের মঙ্গল কামনা করে তাকে এমন কঠোরভাবে তিরস্কার করেছেন। পিতা হিসাবে তার মেয়ের মঙ্গল কামনা করা উচিত ছিল। কিন্তু অর্থোপার্জনের নেশায় সে মেয়ের মঙ্গল চিন্তা না করে পণের দাবি বৃদ্ধি করে গিয়েছেন। তখন তার মন অনুশোচনায় ভরে উঠলো। তিনি আশ্রমে ফিরে এসে সকলের সামনে দোষ স্বীকার করে বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যারা পণ দিতে চেয়েছে, তাদের সঙ্গে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তিনি অন্যত্র মেয়ের পাত্রের সন্ধান করবেন। বাবা তার সিদ্ধিবলে ব্রাহ্মণের মনের কথা ও ভাব বুঝতে পেরেই তাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়েছিলেন।


একদা কলকাতার এক ধনী পরিবার থেকে এক ব্যক্তি বাবা লোকনাথকে দর্শনের জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। তিনি প্রথমে বাবার প্রিয় শিষ্য ব্রহ্মানন্দ ভারতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর কাছে নিজেকে এক ধনী পরিবারের সন্তানরূপে পরিচয় দেন। তিনি তাকে অনুরোধ করেন বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্য। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার কাছে তাকে নিয়ে গিয়ে বলেন যে, ইনি কলকাতার এক প্রভূত ধনী পরিবারের ছেলে। এদের অগাধ সম্পত্তি আছে এবং এদের পরিবার কলকাতায় বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। যখন ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই কথা বলছেন, তখন বাবা ধ্যানস্থ হয়ে পড়েন। ধ্যানাবস্থা থেকে বুত্থান হলে বাবা আগন্তুককে বলেন, তুমি এখন ভাড়া বাড়িতে থাকো। ভদ্রলোক এই কথা শুনে অবাক হয়ে যান। বাবা বলতে থাকেন, এ বড় ধনী পরিবারের সন্তান। কিন্তু পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে বাধ্য হয়ে পৈত্রিক বাড়ি ত্যাগ করে এরা এখন ভাড়াটে বাড়িতে আছেন। আগন্তুক আশ্রমে আসার সময় এই কথা ভেবে এসেছিলেন যে, তিনি নিজেকে ধনী পরিবারের সন্তান রূপে পরিচয় দেবেন এবং ভাড়া বাড়িতে থাকেন এই কথা বলবেন না। এখন তিনি না বললেও বাবা কীভাবে সেই কথা জেনে ফেললেন, তা ভেবে উনি আশ্চর্য হলেন। বাবার অলৌকিক ক্ষমতায় বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা বাধ্য হয়ে বর্তমানে ভাড়াটে বাড়িতে আছি।


যিনি নিজেকে পরমব্রহ্মে উন্নীত করেছেন, তিনি সকলের আত্মাতে বিরাজ করেন। তার কাছে কি কিছু গোপন করা সম্ভব? বরং তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে কৃপা পাওয়া যেতে পারে।


একদিন বাবা আশ্রমে তার আসনঘরে গোমুখাসনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তার দেহে কোনো কম্পন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তার মুখমণ্ডলে এক উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠেছে। তার চোখের অপলক দৃষ্টি যে কোথায় কার উপর নিবদ্ধ আছে, তা কারও জানা নেই। এইসময় সমবেত ভক্তগণের মনে হচ্ছিল যে, এই দেহটা বারদীর আশ্রমে উপস্থিত থাকলেও, বাবা সূক্ষ্মরূপে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও হয়তো বিচরণ করছেন।


সেই অবস্থা থেকে বুত্থান হয়েই তিনি আগন্তুকদের মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর অবস্থা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। সংসার ছাড়বো মনে করলেই কি আর তা করা যায়রে পাগল। কাজকর্মে ঢিলে দিয়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘোরাফেরা করছিস। ভাবছিস বুঝি, এমনি করেই পালিয়ে যাবার পথ খুঁজে পাবি। আমার কথা যদি শুনিস, আবার একটা বিয়ে করে নতুন সংসার পাত। আর মন দিয়ে সংসারসেবায় লেগে যা। মনেও ভাবিসনি যে, সংসার ছাড়লেই সংসার তোকে ছাড়বে। সেটি হবার যো নেই। আমার কথা মেনে সংসারকে আঁকড়ে ধরলেই দেখবি তারই মাঝখান দিয়ে তোর পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে।


আগন্তুক তখন বললো, আমি তো মরেই গিয়েছিলাম। কবিরাজ আমাকে জবাব দিয়ে গিয়েছিল। তারপর এ প্রাণ তো তোমারই দেওয়া। সেজন্য তোমার আদেশ আমি মাথা পেতে নেবো। তবু তোমাকে নিবেদন করতে চাই যে, বিয়েতে আমার রুচি নেই। আর সংসারে জড়িয়ে পড়তে ভালো লাগেনা।


বাবা তখন তাকে ধমক দিয়ে বললেন, বাজে কথা রাখ। মাগ-ছেলেকে যে ভালোবাসতে পারে না, সে আমাকে ভালোবাসবে কি করে? সারা মনপ্রাণ দিয়ে সংসারকে জড়িয়ে ধরলে দেখবি আমিও ধরা পড়ে গেছি সেই ফাঁকে। ভালোবাসাও একটা শ্রেষ্ঠ সাধনা। নিজেকে ভুলে গিয়ে যতই বিলিয়ে দিবি ততই দেখবি বাঁধা পড়ে গেছি তোর কাছে। এখন যে আমাকে ভালোবাসিস, এটা মেকি ভালোবাসা। আসল বস্তু পেতে হলে ভালোবাসার তপস্যা করতে হয়। আমি বলছি আবার বিয়ে কর। তোর যা কিছু অভাব সব মিটে যাবে।


আগন্তুক মনে কি বাসনা নিয়ে এসেছিলেন, বাবা তা বুঝতে পেরে তাঁকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়েছিলেন। এই লীলার মাধ্যমে বাবা এই কথাও বুঝিয়েছিলেন যে, কারও মনে কোনো সুপ্ত কামনা-বাসনা থাকলেও সেটা বাবার গোচরে আসে। যদিও আগন্তুক সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবার বাসনায় এসেছিলেন, কিন্তু তার মনের গভীরে তখনও কামনা সুপ্ত অবস্থায় ছিল। সেই কামনার পূরণ না হলে সংসার ত্যাগ করে তো কোনো লাভ নেই। বাবার হৃদয়-দর্পণে সকলের মন ধরা পড়ে যায়। বাবা এই লীলার মাধ্যমে আরও একটি লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, সংসারের সকলকে ভালোবাসতে পারলে, বাবা নিজেই সেই ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে যান। বাবার কৃপা পেতে হলে সংসার ত্যাগ করার প্রয়োজন হয় না। অনেকে সংসার ত্যাগ করে সাধু হয়েছেন, কিন্তু ঈশ্বর দর্শন হয়নি বা সিদ্ধি প্রাপ্তিও হয়নি। কারণ, তাদের মনে তখনও প্রকৃত সংসার বৈরাগ্য বাসা বাঁধেনি। সংসারধর্ম পূর্ণ পালন না করলে সংসার বৈরাগ্য সকলের আসে না।


ঢাকা বিক্রমপুরের এক নিবাসী তার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার জন্য তিনি অনেক চিকিৎসা করেন কিন্তু সবই নিষ্ফল হয়। বাবার কথা লোকমুখে শুনে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আশায় বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে আসেন। ঢাকা থেকে বারদী দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময় তিনি একমনে বাবাকে স্মরণ করতে থাকেন এবং মনে দৃঢ় ধারণা পোষণ করেন যে, অমিত যোগশক্তির অধিকারী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিশ্চয়ই তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবেন। তিনি আশ্রমে পৌঁছে বাবার সামনে বসে আকুলভাবে তার প্রার্থনা নিবেদন করেন। তার কষ্ট দেখে করুণাময় বাবা তার দিকে তার শ্রীপাদপদ্ম এগিয়ে দিয়ে আদেশ করেন খুব শক্ত করে ধরে রাখতে। ব্রহ্মচারী বাবার আদেশমতো সেই ব্যক্তি তার শ্রীপাদপদ্ম খুব শক্ত করে ধরে রাখেন। বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? উত্তরে তিনি বললেন, আমি একটু দেখতে পাচ্ছি। ঠিক সেই সময় বিক্রমপুরের কয়েলী পাড়ার এক ব্যক্তি বাবার সামনে বসে সেখানকার জমিদারের এক করুণ ইতিহাস বাবার কাছে বর্ণনা করতে শুরু করলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তির মনঃসংযোগে তাতে ব্যাঘাত ঘটালো এবং তিনি মনে মনে যে বাবার করুণার চিন্তা করছিলেন, সেখান থেকে মনকে সরিয়ে জমিদারের কাহিনীতে নিবিষ্ট করলেন। যেইমাত্র তিনি অমনোযোগী হয়েছেন, বাবা তাকে তার পদযুগল ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন। তাঁর আর পূর্ণদৃষ্টি পাওয়া হল না। তিনি ব্রহ্মচারী বাবার যে অসীম কৃপাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন, তার থেকে বিচ্যুত হলেন।


এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বাবা সেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তির মনের আকুলতার জন্য তার কাছে ধরা দিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই ব্যক্তির চিত্তবৈকল্য ঘটলো, তিনি তৎক্ষণাৎ তার চিত্তের কথা বুঝতে পারলেন এবং নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিলেন। ভক্তগণ অকপট অন্তর্দর্শন করলে নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে, তারা যখন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে স্মরণ করেন বা তার কাছে কোনো কাতর প্রার্থনা জানান, তখন সত্যই কি পূর্ণ শতাংশ মন ব্রহ্মচারী বাবার শ্রীপদযুগলে নিবিষ্ট থাকে, না তার বিভাজন হয়ে থাকে! যদি ভক্তের মন পূর্ণ শতাংশে ব্রহ্মচারী বাবার উপর নিবিষ্ট থাকে, তবে ভক্তের ডাক তৎক্ষণাৎ তার হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে ওঠে এবং তিনি ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। আমি নিজের জীবনে এর অনেক প্রমাণ পেয়েছি। ভক্তের ডাক যদি একনিষ্ঠ হয়, ভগবান সাড়া দেবেনই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। ভক্তের মন কদাচিই একনিষ্ঠভাবে ঈশ্বরের চরণে নিবিষ্ট হতে পারে।


এই সম্বন্ধে দক্ষিণেশ্বরের একটি কাহিনীর এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।


একদিন সকালে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরে রানী রাসমণি আহ্নিক করতে বসার সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে বলেন মায়ের গান গাইতে। রানীর অনুরোধে যথারীতি ঠাকুর মায়ের নামগান শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ গান গাইবার পর তিনি হঠাৎ গান থামিয়ে রানীর গালে সজোরে এক থাপ্পর মেরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন–সর্বক্ষণ কেবল বিষয় ভাবনা! এখানে এসেও ওই এক চিন্তা! ঠাকুরের কাণ্ড দেখে মন্দিরের সেবক ও অন্যান্য কর্মচারীরা হতবাক। রানী রাসমনি কিন্তু ক্ষুব্ধ হলেন না। বিনীতভাবে বললেন, তিনি জমিদারীর একটি বিশেষ মোকদ্দমার কথা চিন্তা করছিলেন। আহিকের সময় ঈশ্বরে আত্মমগ্ন না হয়ে তিনি বিষয়। চিন্তায় আত্মস্থ ছিলেন। তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং সকলকে সতর্ক করে দিলেন, যেন এই ব্যাপারে ঠাকুরকে কেউ কিছু না বলে।


এই ঘটনাও এ কথা প্রমাণ করে যে ঈশ্বরের সামনে হাতজোড় করে বসে থাকলেই ঈশ্বরের চরণে মন নিবিষ্ট থাকে না। আমি লোকনাথবাবার মন্দিরে বারংবার গিয়ে খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেছি যে বাবার মর্মরমূর্তির সামনে উপবিষ্ট ভক্তের মনে অনেক সময়েই একটা পর্যটনের তৃপ্তি ফুটে উঠছে। লোকনাথবাবার কৃপা ভিক্ষার তৃপ্তি নয়। প্রভুর চরণে যদি এক মুহূর্তও মন একনিষ্ঠভাবে নিবিষ্ট করা যায়, মুহূর্ত মধ্যেই তার কৃপা বর্ষিত হতে পারে।


উপরিল্লিখিত অন্ধ ব্যক্তির ঘটনায় সাধারণ ভক্তগণ এই কথাই মনে করবেন যে, আহা! বাবা তাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু তার মনোসংযোগ নষ্ট হওয়ায় তিনি সেই কৃপা থেকে বঞ্চিত হলেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে বাবা কেবল তাকে দৃষ্টিশক্তি ফেরাবার কৃপাই করছিলেন না, একজন পূর্ণব্রহ্ম রূপে ব্ৰহ্মপদ তাকে দিয়েছিলেন। এমন সুযোগ কজনের ভাগ্যে ঘটে! অন্ধ ব্যক্তি যদি সেই ব্রহ্মপদ আঁকড়ে থাকতে পারতেন তার আত্মার ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হতো। সঙ্গতি হতো। তিনি তার মনোযোগ নষ্ট করে কেবল দৃষ্টিশক্তি থেকেই বঞ্চিত রইলেন না, যে ব্রহ্মপদ পাবার জন্য মুনি-ঋষিরা যুগ যুগ ধরে তপস্যা করেন, মানুষ কত সহস্রবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রের আবর্তনে আবর্তিত হতে থাকে, সেই অতি মূল্যবান ব্রহ্মপদ হাতে পেয়েও হেলায় হারালেন। সে জন্যই তো বাবা অতীব দুঃখের সঙ্গে বারবার বলেছেন, আমি তোদের যা দিতে চাই, যা দিতে পারি, তোরা তা নিতে পারিস কই!


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পরচিত্তাভিজ্ঞতার সিদ্ধি প্রকাশের আর একটি মজার ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।


সেই সময় ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুরের খুব নামডাক ছিল। বংশমর্যাদায় এবং রাজরক্ত ও অর্থকৌলিন্যে সমাজে তার বিশেষ মর্যাদা ছিল। তার নামডাক সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছিল। বারদীর আশ্রম এবং মহর্ষি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কথা তিনি অনেক লোকমুখে শুনে তাকে একবার চাক্ষুষ দর্শন করার অভিলাষ হলো। তিনি তার মন্ত্রী ও অন্যান্য পারিষদবর্গকে নিয়ে বারদী আশ্রমে হাতির পিঠে চড়ে রওনা হলেন। পথে আসতে আসতে মন্ত্রী ও পারিষদগণ আলোচনা করতে লাগলেন যে, রাজাবাহাদুরের লোকনাথবাবাকে প্রণাম করা উচিত হবে কিনা? কোনো কোনো পারিষদ এই মতো ব্যক্ত করলেন যে, ব্রহ্মচারী বাবার জাতির কোনো ঠিক নেই। এমন লোককে উচ্চ কৌলিন্যবংশের রাজার ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করা ঠিক হবে না। পারিষদদের আলোচনার পরে রাজা বললেন–জাতির যখন কোনো নিশ্চয়তা নেই বলছে, তখন ভূমিষ্ঠ হয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা বা পদধূলি নেওয়া ঠিক হবে না। রাজা এরপর সপারিষদ আশ্রমে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এ কী বিস্ময়কর কাণ্ড! রাজা আশ্রমে প্রবেশ করেই সর্বাগ্রে ভূমিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করে পায়ের ধূলা নিলেন। বাবা তখন হেসে বললেন–কেন বাবা, প্রণাম করবেনা বলে তো মনস্থির করে এসেছিলে। কি হলো? বাবা তখন স্থির দৃষ্টিতে রাজার দিকে চেয়ে আছেন। রাজা ভাবলেন তারা তো পথে আসতে আসতে এ কথা আলোচনা করেছিলেন। ব্রহ্মচারী বাবা কি করে তাদের কথা জেনে ফেললেন? অতঃপর তিনি ও তার পারিষদগণ লজ্জায় মাথা অবনত করেন। তারা যারপর নাই অপ্রস্তুতও হন। এরপর থেকে ভাওয়ালের রাজা বাবা লোকনাথের খুব প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, বাবার অগণিত ভক্তগণ আজ বাবার যে ছবি দেখতে পান, সেটা প্রকৃতপক্ষে ভাওয়ালের রাজা বারদী আশ্রমে ক্যামেরা নিয়ে তোলেন। বাবা একমাত্র ভাওয়ালের রাজাকেই তার ছবি তুলতে দিয়েছিলেন, যখন রাজা তাকে বলেছিলেন যে, এই ছবির মাধ্যমেই আগামীদিনে ভক্তগণ তার পূজা করতে পারবেন।


.


বারদী আশ্রমে লঘিমাসিদ্ধির প্রকাশ


অষ্টাঙ্গ যোগের একটি মুখ্য সিদ্ধির নাম লঘিমাসিদ্ধি। এই সিদ্ধিবলে যোগী নিজের দেহকে অতি মাত্রায় লঘু করতে পারেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী একবার বারদী আশ্রমে এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।


ঢাকার পশ্চিমদি গ্রামের বাসিন্দা অন্নদাসুন্দরী প্রায়শঃই বারদী আশ্রমে বাবার দর্শনার্থে আসতেন।


তিনি অতি ভক্তিমতি এবং বাবার প্রতি তার মনে এক বাৎসল্যভাব বিরাজ করতো। একদিন তিনি আশ্রমে এসে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করে প্রসাদ গ্রহণ করেন। তাঁর অবিচল নিষ্ঠা ভক্তি দেখে বাবা তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন।


অন্নদাসুন্দরী বাবাকে প্রণাম করে তার পাশে আসন গ্রহণ করেন। বাবা তখন তাকে বললেন, তুই তো আমার মা হয়েছিস? তোর ছেলেকে একটিবার কোলে নিয়ে বসতে ইচ্ছা করে না?


এইকথা শুনে অন্নদাসুন্দরী বলেন, তা কেন হবে না বাবা? তবে তুমি এখন এত বড়ো হয়েছে। তাই কেমন করে আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বসবো? তোমার যদি কৃপা হয়, তবেই আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বসতে পারি।


বাবা তখন বললেন, আচ্ছা একবার চেষ্টা করেই দেখ না, কোলে নিতে পারো কিনা?


তখন অন্নদাসুন্দরী এগিয়ে এসে সকলের সামনে সন্তানরূপী লোকনাথকে কোলে তুলে নিলেন। কোলে নিয়েই তিনি ঘোর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কি! এ যে দেখছি শোলার চেয়েও হালকা ও নরম। লোকনাথ বাবা তখন ছোট শিশুর মতো অন্নদাসুন্দরীর কোলে শুয়ে মিটমিট করে তাকাচ্ছেন। মুখে তার স্নিগ্ধ মধুর হাসি।


অন্নদাসুন্দরী তখন মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই অযাচিত করুণা দেখে কৃতার্থ হয়ে করজোড়ে সজল নয়নে ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বললেন, বাবা আমি তোমার এক সামান্য মেয়ে। কোনো জ্ঞান নেই। তাই ও কথা বলেছিলাম। বুঝতে পারিনি তোমার কৃপা হলে এ জগতে সবই সম্ভব।


ঈশ্বর তার পরম ঐশী শক্তির প্রভাবে পরমাণুর মতো সূক্ষ্ম মূর্তিতে সারা জগৎব্যাপী বিরাজ করেন। তার সেই পরমাণুমূর্তিতে মনকে যুক্ত করে মহাযোগী বাবা লোকনাথ দেহকে অতি মাত্রায় লঘু করে লঘিমাসিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সেজন্যই অন্নদাসুন্দরী বাবার দেহকে শোলার মতো হালকা বলেছিলেন। অন্নদা সুন্দরীর এই মনুষ্য জনম ধন্য করে দিয়ে বাবা পূর্ণব্রহ্ম রূপে তার কোলে শুয়েছিলেন। অন্নদাসুন্দরী ব্রহ্মকে তার কোলে পেয়েছিলেন। এই কথা কি তখন অন্নদাসুন্দরী বুঝতে পেরেছিলেন? তিনি কি বুঝেছিলেন যে ভগবান স্বয়ং তার কোলে শোভা পাচ্ছেন!


তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমা অন্তে আমি যখন নর্মদার উত্তর তটে অমরকন্টকের অনতিদূরে বড়ে গণেশজির মন্দিরে গিয়ে পরিক্রমা সমাপন আরতি করছিলাম (আমার সঙ্গে সেখানকার একজন মুনি আরতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন), তখন গণেশজির পা মানবদেহের পায়ের মতো নরম হয়েছিল। স্পর্শ করে বোঝা গেছে গণেশরূপে এক সজীব দেহ আমাদের সামনে বিরাজমান। ঈশ্বরের লঘিমাশক্তির এই চমৎকার আমার নিজ চক্ষে দর্শন করার সৌভাগ্য হয়েছিল।


.


বারদীতে কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ


অষ্টাঙ্গ যোগে সফল হয়ে যোগী যে অষ্টাদশসিদ্ধি লাভ করেন, তার মধ্যে একটি হল কামরূপসিদ্ধি। এই সিদ্ধি দশটি গৌণ সিদ্ধির অন্তর্ভুক্ত। এই সিদ্ধিবলে যোগী যোগবলে যে কোনো প্রাণী বা দেবমূর্তি ধারণ করতে পারেন। বারদীতে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী কয়েকবার এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।


একদা বাবার এক ভক্ত তার মেয়ের বিয়েতে বাবাকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি বাবাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন অনুষ্ঠান দিবসে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে। বাবা বলেন, তিনি আশ্রম থেকেই মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু নাছোরবান্দা সেই ভক্ত। বারবার বাবার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন বিবাহ দিবসে তাঁর বাড়িতে দর্শন দিয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে। অগত্যা বাবা রাজি হন। অনুষ্ঠান দিবসে সন্ধ্যাবেলা সেই বাড়িতে সকলেই গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন ব্রহ্মচারী বাবা আসবেন। গৃহকর্তা একবার সদর একবার ভিতর করতে থাকেন। হঠাৎ তিনি দেখেন একটি কালো কুকুর প্রবেশ করে সোজা ঘরে চলে যাচ্ছে। তিনি তখন এক লম্বা কাঠ এনে কুকুরটিকে মারতে মারতে বাইরে বার করে দেন। সেই কাঠের আঘাতে কুকুরটির দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। সে চিৎকার করতে করতে গৃহস্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করে। সকলে বাবার জন্য অপেক্ষা করেও বাবার দর্শন না পেয়ে আশাহত হন। বিবাহকার্য সম্পূর্ণ হয়ে যায়।


কিছুদিন পর সেই ভক্ত বাবার কাছে গিয়ে ব্যক্ত করেন যে, বাবা নিজের মুখে নিমন্ত্রণ স্বীকার করে কথা দিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে আসবেন, কিন্তু তিনি তো গেলেন না।


বাবা তখন সেই ভক্তকে বললেন, আমি তখন তোকে কত করে বললাম যে, আমি আশ্রম থেকে তোর মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করবো। সে কথা তোর মনে ধরলো না। তাই বাধ্য হয়ে কথা দিলাম, যাব। মিছে কথা আমি বলতে পারিনা। তাই আমার কথা আমি রেখেছি। তুই যদি আমাকে চিনতে না পারিস তো আমার দোষ কি? তুই বিনা কারনে কালো কুকুরটাকে অমন করে কাঠ দিয়ে মারলি কেন? শুভকর্মে তোর এমন আচরণ করা কি ভালো হয়েছে? এই দেখ, আমার ডান হাতটা এখনও ভালো করে নাড়তে পারছি না। নাই বা চিনতে পারলি। কিন্তু অমন করে মারবি কেন? এই কথা বলে বাবা তার শরীরের ক্ষত দেখায়। বাবা সেই ভক্তকে আরও বলেন, আমি ছাড়া তো আর কেউ কোথাও নেই। তারা যে ভগবানের নাম করিস, সেও তো আমি ছাড়া আর কেউ নয়। একশো বছর ধরে কত অরণ্যে পর্বতে ঘুরেছি, এ শরীরে কতবার বরফের স্তূপ জমে গেছে, আবার তা গলে জল হয়ে গেছে। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। আমি দেখেছি কেবল আমাকে, আর বুঝেছি যেখানে যা আছে, তা সব আমারই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। সেই ভক্ত তখন লজ্জায় ও অনুশোচনায় অশ্রু বিসর্জন করতে করতে বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। দয়ালু বাবা নিজে তার দ্বারা প্রহৃত হয়েও তাকে ক্ষমা করলেন।


এইরকম আর একটি ঘটনা ঘটেছিল আর একজন ভক্তের সঙ্গে। একজন ভক্তের পিতৃবিয়োগ হয়। তার পিতৃশ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত থাকার জন্য সেই ভক্ত বাবাকে খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ব্রহ্মচারী বাবা সেই সময় আশ্রম ছেড়ে কোথাও যেতেন না। তিনি বলতেন, তোমরা আমায় কোথাও যাবার জন্য পীড়াপীড়ি কোর না। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে ভক্তের জোর বেশি। কথায় বলে ভক্তের ভগবান। অনেক ভক্ত মিলে বাবাকে ধরে বসলেন যে, তাকে শ্রাদ্ধবাসরে যেতেই হবে। শেষে অনেক মিনতির পর বাবা বললেন, বেশ আমি যাব বটে, কিন্তু একলা যাব। যে কোনো সময়েই যাব, তোমরা কেউ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না। ভক্তরা তাতেই রাজি।


শ্রাদ্ধের দিন সকলেই জানতে পেরেছেন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আসবেন। সকলে অধীর আগ্রহে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। যখন শ্রাদ্ধের বেদিতে শ্রাদ্ধকাৰ্য আরম্ভ হল ঠিক সেই সময় একটি কালো কুকুর দৌড়ে এসে সেখানে দাঁড়াল। সকলেই মার মার করে চেঁচিয়ে উঠল। সকলেই বলতে লাগল, কুকুর প্রবেশ করে শ্রাদ্ধবাসর অপবিত্র করে দিয়েছে। একজন একটা চ্যালা কাঠ এনে সজোরে কুকুরের গায়ে কয়েক ঘা কষিয়ে দিলো। কুকুরটা মার খেয়ে প্রথমে শ্রাদ্ধবেদিতে বসা গৃহস্বামীর দিকে করুণভাবে চাইল, তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশদ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেল।


এদিকে শ্রাদ্ধকাৰ্য শেষ হয়ে গেলেও সারাদিনে বাবা লোকনাথের দর্শন কেউ পেলেন না। গৃহস্বামী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, ব্রহ্মচারী বাবা তো কখনও মিছে কথা কননা। নিশ্চয়ই বাবার শরীর খারাপ হয়ে থাকবে। তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। রাতে সব কাজকর্ম মিটে গেলে তিনি বারদী আশ্রমে এলেন ব্রহ্মচারী বাবার খোঁজ নিতে। আশ্রমে এসে তিনি দেখেন, বাবা শুয়ে আছেন। তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, বাবা কেন তার শ্রাদ্ধবাসরে যেতে পারলেন না? বাবা তখন তাকে বললেন, এত আদর করে নিমন্ত্রণ করে শেষকালে এমন প্রহার! বাবার মুখে এই কথা শুনে ভক্ত তো আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা তখন বললেন, বাবা কালো কুকুরটি কি অপরাধ করেছিল যে তাকে এত কঠিন অভ্যর্থনা করে তাড়ালে? সকলে এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কারও মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। সেই ভক্তটি অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন।


অন্যান্য ভক্তগণ তখন তাকে বললেন, বেলা দ্বিপ্রহরের পর ব্রহ্মচারী বাবার ঘর থেকে একটা কালো কুকুর বার হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে বাবাকে আর দেখা গেল না। কিছুক্ষণ পরে সেই কালো কুকুরটি আবার এসে বাবার ঘরে ঢুকল। তখন ঘরে এসে দেখা গেল ব্রহ্মচারী বাবা যেন বাইরে থেকে এসেছেন। দেখা হওয়ামাত্র বললেন–শ্রাদ্ধ বাড়িতে বেশ কিছু খেয়ে এলাম। এই কথা শুনে সেই ভক্তের লজ্জার সীমা রইলনা। তিনি অনুশোচনায় কেবল অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। তার পিতার শ্রাদ্ধবাসরে ব্রহ্মচারী বাবা প্রহৃত হয়েছেন জেনে দুঃখে তিনি ম্লান হলেন। বারংবার ব্রহ্মচারী বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপরিউক্ত দুটি ক্ষেত্রেই কামরূপ সিদ্ধি প্রয়োগ করে দেহান্তরে ভক্তের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এই পরীক্ষাও করছিলেন যে, তাঁর ভক্তগণ কত নিবিড়ভাবে তাকে ভালোবাসে। তারা কত আগ্রহে তার আদর্শ গ্রহণ করেছে। দুটি ক্ষেত্রেই ভক্তরা সেই পরীক্ষায় অসফল হয়েছে। লোকনাথ বাবা ভক্তদের বলতেন সকল জীবে সমবুদ্ধি না হলে সাধনা হয় না। সাধনজ্ঞান লাভ হলে সাধকের মনে এই বুদ্ধি আসে যে সর্বজীবে একই সত্তা রয়েছেন। তিনি সকল ভক্তকে বলতেন, সকল জীবের মধ্যে তোমার সত্তা, তোমার আত্মা, আর সকল প্রাণীর আত্মার উপাদান একই। এই ভাবটি সকলের মধ্যে তিনি বধ্যমূল করতে চেয়েছিলেন যে, ঈশ্বরকে আপন আত্মা ও এই বিশ্বচরাচর থেকে পৃথক করে দেখলে ও খুঁজলে কখনই তাঁকে পাওয়া যাবে না। ঈশ্বরকে আপন আত্মার মধ্যে এবং সেই আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে বিচিত্ররূপে দেখাই হল প্রকৃত ঈশ্বরদর্শন। নিজের আত্মাকে যদি নিজের মধ্যে দর্শন করতে সমর্থ হও, তবে নিজের মধ্যেই ঈশ্বরকে দর্শন করতে সমর্থ হবে। বাবা লোকনাথ সকলের আত্মায় বিরাজমান। আমরা তাকে চিনতে পারিনা। তার বিভিন্ন লীলা দিয়ে তিনি এই কথাই ভক্তদের বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা কি তা বুঝতে পেরেছি?


বাবা লোকনাথের মতো এইরূপ লীলা ও কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ সিরডির সাঁইবাবার জীবনীতেও পাওয়া যায়। তিনিও একই প্রকারে ভক্তদের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনের প্রয়াস করেছিলেন। নমর্দা পরিক্রমার সমাপণ পূজা দেবার সময় ওঁকারেশ্বর উত্তর তটে পাহাড়ের উপরস্থিত ভৈরব গুহা দর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ প্রলয়দাসজির আরাধনা করার পর আমাকে অবিশ্বাস্যরূপে দক্ষিণ তটে গজানন আশ্রমে সেই মহান ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কালো কুকুররূপে দেখা দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাকে সেইরূপে দর্শন করে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাবার। মহাযোগী বাবা লোকনাথের শিক্ষা আমার তপস্যার পথ সুগম করেছিল।


নবদ্বীপের শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে তার ভক্তবৃন্দকে বলেছিলেন–


নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ।

এই বাক্যে বিকাইনু তার বংশের হাত।।

তোমার কা কথা তোমার গ্রামের কুক্কুর

সে হো মোর প্রিয় অন্যজন বহু দূর।


এইবার উল্লেখ করছি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কামরূপ সিদ্ধি প্রকাশের আর এক অনন্য চমকপ্রদ ঘটনা।


একদিন বারদী আশ্রমের গোয়ালিনী ব্রহ্মচারী বাবার কাছে গিয়ে বললেন, বাবা, আমার এক আত্মীয় কালীঘাটের কালীর নামে মানত করে ফল পেয়েছে। সে এখন ওই মানতের টাকা ও পূজাসামগ্রী কালীঘাটে পাঠাতে চাইছে। আপনার কাছে তো কলকাতার কত লোক আসে। তাদের কারও সঙ্গে যদি ওই টাকা আর পূজার সামগ্রী পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন তো ভালো হয়।


গোয়ালিনী মার কাছে এই কথা শুনে বাবা বললেন, ওই টাকা ও পূজা-সামগ্রী আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমিই কালীঘাটের কালী।


বাবা লোকনাথকে ভগবান জ্ঞানে ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন গোয়ালিনী মা। বাবার কত ভগবৎ লীলা চাক্ষুষ করেছেন তিনি। বাবার কথায় তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি তার আত্মীয়কে বললেন মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী আশ্রমে বাবার কাছে দিয়ে যেতে। পরের দিন সকালবেলায় গোয়ালিনীমার আত্মীয় এসে মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী আশ্রমে দিয়ে গেল। সে মনে ভাবলো ব্রহ্মচারী বাবা একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ, তিনি কৃপা করলে সকল দেবদেবীরাও কৃপা করবেন। তার কাছে পূজা দেওয়া মানেই কালীঘাটের কালীর কাছে পূজা দেওয়া। তারা গোয়ালিনী মার জিম্মায় মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী দিয়ে দিলেন।


বাবা লোকনাথ সেই সময় তাঁর আসন ঘরে ধ্যানাবিষ্ট। গোয়ালিনী মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী নিয়ে বাবার আসন ঘরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এ কি! সামনে উনি কী দেখছেন! বাবার আসনে বাবা নেই। তার স্থানে আসনে উপবিষ্টা করালবদনা কালীমাতা। তিনি তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি একজন নিরক্ষর মহিলা। জপ, তপ, সাধন, ভজন কিছুই তার জানা নেই। তিনি কেবল অবিচলিত ভক্তিদ্বারা একনিষ্ঠভাবে আশ্রমে বাবার সেবা করেন। বাবার অনেক ঈশ্বরীয় লীলা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেজন্য সামনে এমন অবিশ্বাস্য লীলা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন, কিন্তু ভীত হননি। তার আত্মীয়ের মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী সেই করালবদনা কালীমূর্তির সামনে রেখে সাষ্টাঙ্গে পরম ভক্তিভরে কালীরূপী বাবা লোকনাথকে প্রণাম করে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। বাবা লোকনাথের এইরূপ মাতৃরূপ গ্রহণ করা প্রত্যক্ষ করেছিলেন একমাত্র তার একান্ত সেবিকা গোয়ালিনী মা। তারপর থেকেই বাবার নাম জয়গান করতে বলা হতো–জয় বাবা লোকনাথ, জয় মাতা লোকনাথ।


গোয়ালিনী যেহেতু বাবার গর্ভধারিণী মা কমলা ছিলেন, একমাত্র তাকেই বাবা কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ দেখিয়েছেন।


একদিন গোয়ালিনী বাবার কাছে পুরীর জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন ব্রহ্মচারী বাবা আমিই সেই জগন্নাথ এই কথা বলে তাকে নিজ দেহে জগন্নাথমূর্তি দর্শন করিয়েছিলেন। এই কথা গোয়ালিনী পরবর্তীকালে বাবার প্রিয় শিষ্য যামিনীকুমারকে বলেছিলেন এবং তিনি এই অপূর্ব দর্শনের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। বারদীতে যামিনীকুমারের নিজ লেখা থেকে এই তথ্য জানতে পারা গেছে।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন মহাযোগী। অষ্টাঙ্গ যোগশিক্ষার সময় তিনি আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাছে ত্রিগুণাত্মক হবার যে শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং কঠোর যোগসাধনার দ্বারা নিজের মধ্যে সেই শিক্ষাবলে স্বত্ত্বগুণের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে তিনি যে ধারণা অনুষ্ঠানে সফল সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাতে কামরূপ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে তার মনে যে ধারণার উদয় হতো, তিনি সেই রূপ পরিগ্রহ করতে পারতেন। কামরূপসিদ্ধযোগী নিজের মনে যে দেবতার ধারণা করেন, তার দেহ সেই দেবতার রূপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে কামরূপসিদ্ধি প্রয়োগ করে বাবা গোয়ালিনী মার কথায় কালীরূপ ধারণ করেছিলেন। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সুদীর্ঘকাল অতি কঠোর যোগসাধনা দ্বারা যে অষ্টমুখ্য, দশটি গৌণ ও পাঁচটি অন্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, অতি উচ্চ ঈশ্বরকোটির যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ ভিন্ন অন্য কেউ এইরকম সিদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারেন না। অনেক সাধক হয়তো কঠোর সাধনা বা একনিষ্ঠ ভগবৎ প্রেমের দ্বারা ভগবৎ কৃপা বা ভগবৎ দর্শন লাভ করতে পারেন বা কিছু সিদ্ধি বা তার ফলস্বরূপ কিছু বিভূতি লাভ করতে পারেন, কিন্তু সেই দেহে কোনো দেবতা ধারণ করতে পারেন না। যোগসাধনায় অতি উচ্চ স্তরে কোনো ঈশ্বর কোটির যোগী যখন নিজের মধ্যে পূর্ণব্রহ্ম রূপ দর্শন করতে সমর্থ হন, তখন তার পঞ্চভূত দেহ দেবদেহে রূপান্তরিত হয়। এইরূপ অবস্থায় যোগীর দেহে সব সিদ্ধির প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই যোগীর দেহে এই দেবরূপ দর্শন করতে সমর্থ হননা যদি না যোগী স্বেচ্ছায় কারোকে তার দেবদেহ দর্শন করান। একমাত্র কোনো সিদ্ধ যোগীই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো মহাপুরুষের দেবদেহ দর্শন করতে সমর্থ হন। শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একজন সিদ্ধ বৈষ্ণব যোগী হিসাবে বাবা লোকনাথের দেহে সকল দেবতার অবস্থান দর্শন করেছিলেন। আর বাবা স্বেচ্ছায় তার জন্মদাত্রী মা কমলাকে (যিনি পরজন্মে গোয়ালিনী হয়ে বাবাকে পুত্রবৎ সেবা করতেন) কালীরূপে দর্শন দিয়েছিলেন।


.


ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির প্রকাশ


অষ্টাঙ্গ যোগসিদ্ধ যোগীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ সাধনার বিভিন্ন স্তরে প্রথম আটটি মুখ্যসিদ্ধি ও ক্রমে ক্রমে দশটি গৌণসিদ্ধির প্রকাশ ঘটে। ঈশ্বরকোটির অথবা জীবকোটির অষ্টাদশ সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী এই অষ্টাদশসিদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও যখন ব্রহ্মদর্শনের পথে অগ্রসর হন, তখন যোগের বিভিন্ন স্তরে তিনি আরও যে পাঁচটি বিশেষ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তার মধ্যে প্রথম সিদ্ধি হল ত্রিকালজ্ঞতা। এই সিদ্ধিবলে সিদ্ধযোগী যে কোনো ব্যক্তির বা ব্রহ্মাণ্ডের ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এই তিনকাল সম্বন্ধে অবহিত হতে পারেন। ত্রিকালজ্ঞ যোগী এক অতি উচ্চস্তরের যোগী। বর্তমানে ত্রিকালজ্ঞ এই শব্দটির ব্যবহার জ্যোতিষ ও সাধারণ সাধু সমাজে যথেচ্ছভাবে হয়ে থাকে। যখন এই শব্দটি এইরূপ সাধারণ মানে ব্যবহৃত হয়, তখন তার মধ্যে ত্রিকালজ্ঞতাসিদ্ধির কোনো সম্পর্ক থাকে না। যিনি এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত তিনি অবশ্যই অষ্টাদশ সিদ্ধিপ্রাপ্ত এবং তিনি কেবল কোনো ব্যক্তির নয়, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ব্যক্ত করতে পারেন। বাবা লোকনাথের যে বিভিন্ন লীলার উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্য সিদ্ধির সঙ্গে তার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির প্রকাশও ঘটেছে। একবার বাবা লোকনাথ বারদীর জমিদারদের কাছে তার এক বিচিত্র লীলার মাধ্যমে এই সিদ্ধির প্রকাশ করেছিলেন, এখানে সেই ঘটনার উল্লেখ করছি।


একদিন সন্ধ্যাবেলায় বারদীর জমিদার পরিবারের অরুণকান্তি নাগ ও কুঞ্জলাল নাগ মহাশয় হঠাৎ আশ্রমে উপস্থিত হন। বাবাকে এসে যখন তারা প্রণাম করেন, তখন বাবা তাদের বলেন, তোরা না খেয়ে যাসনি। এখুনি খিচুড়ি ভোগ রান্না করে দিতে বলছি।


এই বলে বাবা গোয়ালিনী মাকে ডেকে খিচুড়ি রান্না করার জন্য বললেন ও সেই সঙ্গে নিজেই চাল ও ডালের পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দিলেন। তিনি চাল ডালের যে পরিমাণ বললেন, তাতে অন্ততঃ পঞ্চাশজন লোক ভোগ গ্রহণ করতে পারবে। যথাসময়ে খিচুড়ি ভোগ রান্না সম্পন্ন হলো। এত ব্যাপক পরিমাণ খিচুড়ি দেখে কুঞ্জবাবু অরুণকান্তি বাবুকে বললেন, কি ব্যাপার বলতো? আমরা এখন আশ্রমে মাত্র দশজন লোক আছি অথচ বাবা পঞ্চাশজনেরও বেশি লোকের ভোগ রান্না করালেন। এত খিচুড়ি খাবে কে? কুঞ্জবাবু ও অরুণকান্তি বাবুর মধ্যে কথোপকথন অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ সব জানতে পারলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।


রাত তখন দশটা। কুঞ্জবাবু ও অরুণকান্তি বাবু পেট ভরে ভোগ সেবা করে বাবাকে প্রণাম করে বাড়ি যাবার জন্য রওনা হলেন। তারা আশ্রমের উঠোন পার হতেই পিছন থেকে বাবা পরিহাস করে বললেন, এত খিচুড়ি খাবে কে রে? বাবার এই পরিহাস শুনে নাগবাবুরা একবার থমকে গেলেন, তারপর এর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে আবার এগোতে লাগলেন। যেই তারা আশ্রমের উঠোন পার করেছেন, দেখলেন হঠাৎ কোথা থেকে ৪০-৫০ জন লোক এসে হাজির। এতক্ষণে নাগবাবুরা বুঝলেন বাবা কেন তাদের পিছনে পরিহাস করেছিলেন এবং কেনই বা বাবা এত চাল-ডাল দিয়ে রাতে ভোগ রান্না করালেন। বাবার লীলা কে বুঝতে পারে!


ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথ জানতেন যে তার ৪০-৫০ জন ভক্ত বহু পথ অতিক্রম করে আসছেন। তারা যাতে আশ্রমে এসে ভোগ সেবা করতে পারেন, সেজন্যই তিনি আগে থাকতে খিচুড়ি রান্না করতে বলেছিলেন। ভক্তের কুশল চিন্তা ভক্তের আগে বাবার মনে আসত। তিনি যে ভক্তের ভগবান ছিলেন।


যিনি ত্রিকালজ্ঞ ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ হন, তাঁর বাক্য হয় অমোঘ। তিনি মুখে যা বলেন, সে কথা সত্য হবেই। এমন একটি ঘটনা ঘটে কেউটেখালির মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রী ছিলেন মৃতবৎসা। যতবার তিনি সন্তান সম্ভবা হন, সেই সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। অনেক চিকিৎসায়ও কোনো ফল হয় না। অতঃপর রজনী ব্রহ্মচারীর পরামর্শে মহেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে নিয়ে একদিন বারদী আশ্রমে বাবার কাছে আসেন। সেইসময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাবাকে দর্শন করে প্রথমে তারা প্রসাদ গ্রহণ করেন। তারপর কিছুক্ষণ আশ্রমে বিশ্রাম করে আবার বাবার দর্শনে যান। বাবার পায়ের ধূলা মাথায় নেবার পর বাবা মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রীকে বলেন, শোন মা, আর ভয় নেই। তোর গর্ভস্থ সন্তান আর নষ্ট হবে না। আগামীকাল থেকে তোর গর্ভস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে শয্যা ত্যাগের পর আমার আশ্রমের সেবার জন্যে একটি করে পয়সা সরিয়ে রাখবি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর ওই পয়সা এখানে পাঠিয়ে দিবি। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রী যথাসময়ে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। প্রসবান্তে তিনি বাবার নির্দেশমতো পয়সা আশ্রমের সেবার নিমিত্ত পাঠিয়ে দেন। মহেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে দেওয়া ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথের বাক্য অমোঘ প্রমাণিত হয়েছিল।


.


দেবগণ সহিত ক্রিড়াকরণসিদ্ধির প্রকাশ


দেবগণ সহিত ক্রিড়াকরণসিদ্ধি সাধক তপস্যার এমন এক স্তরে প্রাপ্ত হন যখন তার দেহে অবস্থিত সমস্ত বৈদিক দেবতা জাগ্রত হয়ে সাধকের পঞ্চভূত দেহ এক দেবদেহে উন্নীত হয়। এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে সাধক ইচ্ছামতো দেবতাদের সঙ্গে ক্রিড়া করতে সমর্থ হন। সাধকের দেবগণের সঙ্গে এই ক্রিড়াকরণ দুইভাবে হয়ে থাকে। এক হয়, সাধকের পঞ্চভূত দেহ থেকে তার আত্মা সূক্ষ্মরূপ গ্রহণ করে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হন। আবার দেখা যায়, পঞ্চভূত দেহের মধ্যে থেকেই সাধকের আত্মা বিভিন্ন মুদ্রার মাধ্যমে দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়া করেন।


আমার সাধন জীবনে দু-বার এমন উচ্চমার্গের সাধকদের সামনে একান্তে বসে তাদের দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়াকরণ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। একজন ছিলেন হৃষিকেশের গীতা ভবনের অধ্যক্ষ স্বামী রামসুখ দাসজি। (বর্তমানে তার পুণ্যাত্মা দেবলোকে উক্রমণ করেছে)।


গীতাভবনে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই উচ্চ ঈশ্বরকোটির সাধকের সঙ্গে একান্তে মুখোমুখি বসে তার আশীর্বাদ গ্রহণ করার। তাঁকে দেখেছিলাম কথার মাঝে হঠাৎ করে প্রথমে সমাধিস্থ হয়ে যেতে, তারপর সমাধি অবস্থার মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হতে। সেইসময় তার ডান হাত এক বিচিত্র মুদ্রায় থাকত এবং তার মুখে এক অতি উজ্জ্বল আভা প্রকটিত হতো। কিছুক্ষণ পরে বুখান হলে তিনি আবার কথা বলতেন।


আর এক এইরকম উচ্চমার্গের সাধকের দেখা পেয়েছিলাম ওঁকারেশ্বরের উত্তর তটে। তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমার সফল পরিসমাপ্তিতে যখন আমি পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে ওঁকারেশ্বরে গিয়েছিলাম, তখন উত্তর তটে পাহাড়ের গায়ে একটি কুঠিতে শুকদেব মুনির সন্ধান পেয়েছিলাম। পরিক্রমাকারীরূপে তার সামনে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি মুখে কোনো কথা বলতে পারেন না। তার শরীরে কোনো রক্ত চলাচল করছে কি না বোঝা দায়। সামনে থেকে দেখলে মনে হয় হাড়ের উপর চামড়া লাগানো। জটাজুটধারী মুনি বেশিরভাগ সময় শয়ন করে দুহাত দিয়ে বিচিত্র মুদ্রা করে চলেছেন। তিনি দাঁড়াতে পারেন না। কখনও তার মুখে স্মিত হাসি লক্ষ্য করা যায়। হাত কখনও থামে না। অনেক পর্যবেক্ষণ করার পর তার সেবককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম, মুনিজি সবসময় দেবতাদের সঙ্গে এই মুদ্রার মাধ্যমে কথা বলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। শুনেছি এক বিরাট সর্পরাজ সারারাত তার পাহারায় থাকেন। কেউ তখন তার কাছে থাকতে পারেন না, এমনকি সেবকও নয়। নর্মদা পরিক্রমা অন্তে তার আশীর্বাদ পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।


বাবা লোকনাথের জীবনীতেও পাওয়া যায় যে তিনি তার পঞ্চভূত দেহকে দেবদেহে উন্নীত করেছিলেন। তার পুণ্যদেহে সর্বদা দেবতাগণ বিরাজ করতেন। শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নিজ সাধন ক্ষমতায় বাবার দেহে এইরূপ দেবতাদের অবস্থান দর্শন করেছিলেন। কোনো উচ্চকোটির সাধকই একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের দেহের এই অবস্থান বুঝতে সমর্থ হন। সাধারণ মানুষের চোখে এই দৃশ্য ধরা পড়ে না। ব্রহ্মচর্য তপস্যা দ্বারা বাবা লোকনাথ নিজ দেহে যে ওজঃ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার তেজে তিনি ভূলোক, দ্যুলোক অনায়াসে বিচরণ করতে পারতেন। অনেক উচ্চকোটির মুনি-ঋষিরাও তার কাছে সাধন মার্গের রহস্য জানতে সূক্ষ্মদেহে বারদীতে আসতেন। একজন উর্ধরতা ব্রহ্মচারী এক স্বতন্ত্র পরম ঐশ্বর্যযুক্ত বিরাট পুরুষরূপে জগতের স্রষ্টা পরমাত্মা হন। সমস্ত দেবতারা তখন তাকে দেখার জন্য তাঁর অভিমুখে আসেন। ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যায় পৃথিবী ও দ্যুলোক পোষণ করেন এবং তিনিই দ্যাবা পৃথিবী ব্যাপ্ত করতে করতে স্বনিয়মে প্রবর্তিত হচ্ছেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন ব্রহ্মে বিচরণশীল একজন প্রকৃত আচরণশীল ব্রহ্মচারী। তার দেহে সর্বদা ওজঃ নিঃসৃত ব্ৰহ্মতেজপুঞ্জ বিরাজ করতো। এইরকম আচরণশীল ব্রহ্মচারী সাধক জগতে বিরল। মুনি-ঋষিগণও এইরকম আচরণশীল ব্রহ্মচারীর পূজা করতেন। বাবা লোকনাথ নিজেই বলতেন, আমি নিত্য, আমার নাশ নেই, আমার শ্রদ্ধও নেই। বাবার যে দেহ সর্বদা দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়ায় লিপ্ত থাকত, তা কি সাধারণ মানুষ তার চক্ষে দেখতে সক্ষম? সেই ক্রিড়া একমাত্র সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীই দেখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি নিজে কৃপা করে যদি কাউকে তার দেবদেহ দর্শন দেন, তবেই সে দর্শন করতে পারে। সাধারণ মানুষ যে তার দেবদেহ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না, তা কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়।


একদিন বারদী আশ্রমে পুরীর এক পাণ্ডা এসে উপস্থিত হন। তিনি বাবাকে জগন্নাথদেবের প্রসাদ দিয়ে বলেন, এটা পুরীর জগন্নাথদেবের প্রসাদ। আপনি গ্রহণ করুন। বাবা সে প্রসাদ গ্রহণ না করে পাণ্ডাকে কটু কথা বলে তাড়িয়ে দিলেন। আশ্রমভৃত্য ভজলেরাম এই ঘটনায় দুঃখ পেয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি পুরীর জগন্নাথদেবের প্রসাদ কেন নিলে না? সর্বদা ব্রহ্মে বিচরণশীল ও প্রকৃত আচরণশীল ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন ঈশ্বরের সঙ্গে নিত্য যুক্ত, তার দেহেই যখন ঈশ্বর বিরাজ করছেন, তখন জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদন করলে তো তাকেও সেই ভোগ নিবেদন করা হয়। তার নিজের প্রসাদ নিজে গ্রহণ করবেন কি করে?


আর একটি ঘটনার মাধ্যমেও বাবা তার স্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন, যা কেউ ধরতে পারেনি, স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীও নন।


একদিন কিছু লোক হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে আশ্রমে আসেন এবং সেখানে হরির লুট দিতে চান। বাবা তাদের বলেন, আশ্রমে হরির লুট হবে না। যখন সেই ভক্তবৃন্দ জিজ্ঞাসা করেন, কেন হরির লুট হবে না। তখন বাবা বলেন, তোদের হরির মুখে আমি হাগি, মুতি। বাবার মুখে এই প্রকার কথা শুনে ভক্তেরা খুব দুঃখিত মনে সেখান থেকে প্রস্থান করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে এই কথা বলেছিল। বৈষ্ণব বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই কথা শুনে খুব ব্যথিত হয়েছিলেন এবং বাবার উপর রাগ করেছিলেন। এই কথা যখন বাবার প্রয়াণপূর্বে তিনি বলেন, তখন বাবা তাঁকে বলেন–হরি তো সারা ব্রহ্মাণ্ড জুড়েই আছে। তবে আমি মল-মূত্র যখন ত্যাগ করি, সেটা কি ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে করি? সেটা তো সকলে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই করি। তবে আমি এই কথা বলে কি দোষ করেছি? আসলে বাবা নিজেকে সর্বজগব্যাপী বিরাট পুরুষরূপে দেখতেন। একজন ব্রহ্মচারীরূপে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই তার উপস্থিতি আছে। তিনি নিজেই হরি, নিজেই শিব, নিজেই ব্রহ্মা। বাবার এই স্বরূপের প্রকাশ তো তখন হয়নি তার ভক্তদের কাছে। আজও তা হয়েছে কি না জানি না। সেজন্যই তো বাবা প্রয়াণপূর্বে বলেছেন- আমাকে তোরা চিনলি না রে। আমাকে সবাই রক্তমাংসের মানুষরূপে ভাবে।


.


সমাজসংস্কারক বাবা লোকনাথ


বাবা লোকনাথ নিম্নভূমিতে এসে তার বর্ণময় লীলা বিভূতির মাধ্যমে কেবল যে লোকশিক্ষায় ব্রতী হয়েছিলেন তা নয়। তিনি সমাজসংস্কারের কাজেও অগ্রণী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এক সুস্থ সবল সমাজই এক শক্তিশালী জাতির গঠন করতে পারে। সেজন্য তার চেষ্টা ছিল কি করে সমাজের মঙ্গল করা যায়। এখানে বাবার বিভিন্ন সমাজমঙ্গল কার্যের উল্লেখ করছি।


একদিন বারদী গ্রামের কয়েকজন কর্মকার বাবার কাছে এসে নিবেদন করল যে তারা তাদের ছেলের বিয়ে দিতে চায়। এজন্য তারা বাবার কাছে বিবাহের একটি ফর্দ করে দেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো।


লোকনাথ বাবার কাছে গ্রামের সাধারণ লোকেরা অনেক রকম আবদার নিয়ে আসতো এবং বাবা কখনও তাদের নিরাশ করতেন না। এক্ষেত্রেও বাবা তাদের জন্য একটি বিবাহের ফর্দ করে দিলেন।


সেই ফর্দ পড়ে আগন্তুকদের একজন বললো, বাবা আপনি ফর্দে আতসবাজীর কথা লিখেছেন। কিন্তু আমাদের বিয়েতে বাজির দরকার নেই। একবার আমাদের শরিকের এক ছেলের বিয়েতে বাজি পোড়ানোর সময় আগুন লেগে গাঁয়ের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তার কথা শুনে বাবা বললেন, বেশ তো, বিয়ের দিন বাজিগুলো এনে এই আশ্রমের সামনে পোড়াবি। তাহলে তো গাঁয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। বিয়ের ফর্দতে বাজি ধরার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, গ্রামে যারা বাজি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের জন্য বাজি ব্যবহার করা দরকার। বিয়েতে কিছু লোক আনন্দ করবে আর সমাজের অন্য শ্রেণির তাতে কোনো কাজ হবে না, সেটা ঠিক নয়।


ঠিক একই কারণে বিয়েতে বাজনার ফদও তিনি করেছিলেন। এতে এক কর্মকার বাবাকে ইংরেজি বাজনা আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বাবার তাতে সম্মতি ছিল না। তিনি বলেন, একান্তই যদি তাই করতে হয়, তবে বারদী গ্রামে যত গরীব দুঃখী মানুষ আছে তাদের ঘরে চাল, ডাল, মাছ, দই, পান পাঠিয়ে ভোজনের ব্যবস্থা করতে হবে।


বাবা লোকনাথের এই কথা বলার অর্থ, তিনি মনে করেছিলেন ইংরাজি বাজনার জন্য খরচ না করে গ্রামের গরীব ব্রাহ্মণ-দুঃখীদের ভোজন করানো অনেক বেশি মঙ্গলজনক কাজ। গরীব ব্রাহ্মণদের ভোজন করালে স্বয়ং ভগবান দাতাকে আশীর্বাদ করবেন। তার এই কথা বলার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, সমাজে সকল শ্রেণির মানুষই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই কোনো উৎসবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোক যোগদান করলে শ্রেণিগত ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি পায়, সমাজ শক্তিশালী হয়।


একদিন এক ছুতোর মিস্ত্রি বাবা লোকনাথের কাছে এসে বলল, বাবা আমি বড় বিপদে পড়েছি। আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন।


তার কথা শুনে বাবা বললেন–তোমার বিপদটা কি, সেটা না বললে, কী করে রক্ষা করব?


তখন ছুতোর মিস্ত্রি বলল, আমি আমার ছেলেকে সার্ভে স্কুলে ভর্তি করেছি। কিন্তু এখন সেই স্কুলের খরচ চালাতে পারছি না।


লোকনাথবাবা তখন সেই ছুতোর মিস্ত্রির আর্থিক অবস্থার কথা জেনে তাকে বললেন, তোর ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে কোনো জমিদারি সেরেস্তায় কাজ শেখানোর ব্যবস্থা কর। মিস্ত্রিটি সেই কথা মেনে নিয়ে বলল, বাবা তাই হবে।


লোকনাথবাবা মিস্ত্রির আর্থিক অবস্থা জেনে বুঝেছিলেন যে, তার মতো দিন আনি দিন খাই অবস্থার সংসারের ছেলেকে সার্ভে স্কুলে ভর্তি করে লেখাপড়া শেখানো সম্ভব নয়। তাতে সংসার অচল হয়ে পড়বে এবং আখেরে ছেলেরও তাতে ভালো হবে না। কিন্তু সে যদি কোনো হাতের কাজ শেখে, তবে ভবিষ্যতে সংসারের অবলম্বন হতে পারবে।


একদিন এক ব্যক্তি বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে বলে–বাবা, আমি আপনার কৃপাপ্রার্থী। আমাকে আশ্রয় দিয়ে আমার মনের অভিলাষ পূর্ণ করুন।


অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ খুব গম্ভীরভাবে তাকে বললেন, তুই নিজের স্ত্রীকেই ভালোবাসতে পারিস না তো আমাকে ভালোবাসবি কি করে? তুই এখান থেকে এখনি চলে যা। যেদিন তোর ওই লক্ষ্মী স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারবি, সেদিন আমার কাছে আসবি। লোকটি আশ্রমে আশ্রয়ের জন্য অনেক অনুনয় করলো, কিন্তু বাবা তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন।


লোকটি চলে গেলে কিছু ভক্ত বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্ত্রীর সঙ্গে অসদ্ব্যবহার কি আধ্যাত্ম পথের অন্তরায়?


এই কথার উত্তরে বাবা বললেন–যে লোক তার নিজের সংসারের লোকদের ভালোবাসতে পারে না, সে কখনও ভগবানকে ভালোবাসতে পারে না। অন্তরে সত্ত্বগুণ না জন্মালে ভগবদ্ভক্তি হয় না। অর্থাৎ, যার হৃদয়ে স্বত্ত্বগুণের অভাব থাকে, সে রজঃ ও তমোঃগুণ প্রভাবে অত্যাচারী স্বভাবের হয় এবং তার মধ্যে কখনও ভগবানের প্রতি ভক্তির উদয় হয় না। সমাজে তখন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে কপট সন্ন্যাস নেবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যেত। সেই প্রবণতা রুখতে বাবা লোকটিকে ওইরূপ আদেশ করেছিলেন।


একবার রজনীকান্তবাবু বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে বলেন যে, তার কুলগুরুদের মধ্যে শিষ্য নিয়ে শরিকী গোলযোগ বাধায় তারা কেউ এখন দীক্ষা দিতে চাইছেন না। এখন তিনি কি করবেন?


বাবা লোকনাথ সেই কথা শুনে বললেন, তুই তোর গুরুদের বলগে যা, আপনারা শিষ্যসম্বন্ধীয় গোলমাল মীমাংসা করে আমাকে দীক্ষা দিন। যদি আপনারা গোলমাল মেটাতে না পরেন এবং আমাকে দীক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে আমি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কাছে দীক্ষা নেব।


কুলগুরুগণ অনেক সময় মনে করেন, শিষ্যগণ তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তারা শিষ্যগণকে দীক্ষা দিক না দিক, শিষ্যগণ কখনও তাদের ত্যাগ করবে না। গুরুগণ যদি শিষ্যদের মঙ্গল চিন্তা না করেন, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহে লিপ্ত থাকেন, তবে তা অনেক সময় শিষ্যদের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। সমাজের এই কুপ্রথা দূর করার জন্য বাবা রজনীকান্তবাবুকে এইরকম উপদেশ দিয়েছিলেন। গুরু যখন শিষ্যের মঙ্গল কামনা ছেড়ে আত্মবিষয়ে মগ্ন হন, তখন গুরু শিষ্যের। বন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং তা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হয় না। বাবা লোকনাথ সমাজের এই ব্যাধির কথা চিন্তা করেই রজনীকান্তবাবুকে যথোপযুক্ত উপদেশ দিয়েছিলেন।


বাবার কাছে যখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যধি থেকে মুক্তিলাভ হেতু আসতে থাকেন, তখন বাবা আশ্রমে এক অন্নসত্ৰ খোলেন। বাবা লোকনাথের বারদী আশ্রমের মহাপ্রসাদ খেয়ে ও বাবার অসীম করুণায় বহু মানুষ দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। এইভাবে বাবা সমাজ থেকে রোগমুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।


.


দেহরোগের ডাক্তার সিদ্ধযোগী বাবা লোকনাথ


একদিন বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথ সমাধিস্থ। তার দেহ নিস্পন্দ, স্থানুর মতো। চোখ পলকহীন। দেহে প্রাণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সমগ্র পঞ্চভূত দেহটিতে এক দীপ্ত আভা বিরাজ করছে। সমবেত ভক্তগণ আশ্চর্যভাবে একদৃষ্টে বাবার দেহ অবলোকন করছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সহসা দেহটি কেঁপে উঠলো। সমবেত ভক্তগণের উৎকণ্ঠা বিজড়িত মুখগুলি দেখে স্মিত হেসে বাবা বললেন, একশো সওয়াশো বছর পরে হিমালয়ের নির্জন গুহা ছেড়ে তোদের এই হট্টগোলের মাঝে শ্মশানভূমিতে কোন্ দুঃখে আমি পড়ে আছি রে! তোদের জন্য যে আমার প্রাণটা কেমন করে ওঠে। ইচ্ছা করে তোরা যে যেখানে আছিস, সবাইকে এই বুকের মধ্যে ধরে রাখি। তোরা তো আমার অন্তরের ভাব বুঝতে পারিস না। তাই এখানে পরের মতো আসিস। বাবার কাছে ছেলে যেমন দ্বিধাহীন হয়ে আসে, তেমন করে তোরা আসতে পারিস কই?


ভক্তদের মধ্যে থেকে তখন একজন বললো, তুমি তো আমাদের তোমার মনের মতো করে নিতে পারো বাবা। বাবা বললেন, সে তোদের মনের ভুল। যা কিছু হয়, সব তোদের ইচ্ছায়। তোদের ইচ্ছা হলেই, আমার ইচ্ছা হয়। তোদের ইচ্ছা যখন আমার উপর ক্রিয়া করে, তখন আমার ভিতরে কি যেন একটা আলগা হয়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কিছু একটা হয়ে যায়। দোষ তোদের নয়, দোষ আমার।


প্রথম প্রথম সাধ হয়েছিল, সত্যি আমি প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয়েছি কি না পরখ করে দেখবো। ব্রহ্মকে জানলে সে নিজেই নাকি ব্রহ্ম হয়ে যায়। তার বাক্য অমোঘ হয়, তাঁর কথায় মৃতও জীবন ফিরে পায়। নিজের সম্বন্ধে সেটা যাচাই করতে গিয়ে একটা ঝোঁক পেয়ে বসেছিল। নিজেই পরখ করে দেখতে গেলাম আমি দুরারোগ্য রোগীর রোগ সারাতে পারি কি না! নিজের সেই দোষে এখন আমায় সবাই ছিঁড়ে খায়। কেউ বলে পরমায়ু দাও, সুখ দাও, ঐশ্বর্য দাও, দেহের রোগ সারিয়ে দাও, গাছে ফল ফলিয়ে দাও, এ দাও, ও দাও। কিন্তু যা পেলে সব চাওয়া মিটে যায় সেই আসল ধনটি বিলিয়ে দেবার জন্য পথ চেয়ে এত বছর বসে আছি। কেউ সেই ধনটি চায় না রে, কেউ চায় না।


মহাযোগী বাবা লোকনাথের কাছে ভক্তদের চাওয়ার কোনো শেষ ছিল না। ভক্তদের এইসব চাওয়া ছিল পার্থিব জগতের চাওয়া। তাদের দেহ সুখ, ঐশ্বর্যের জন্য চাওয়া। কেউ তার কাছে নিত্যবস্তু চাইত না, যা পেলে এই দেহটাই মুক্ত হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু বারদীর আশ্ৰম ভক্ত সমাগমে মুখরিত থাকত প্রধানতঃ রোগ নিরাময়ের আশায়। বারদী আশ্রমের মাটি, পরিবেশ, প্রসাদ, বাবার স্পর্শ, বাবার কৃপাদৃষ্টির মাধ্যমে অগণিত ভক্ত দেহরোগ মুক্ত হয়েছে। এখানে সেইরকম কিছু ঘটনার উল্লেখ করা হলো–


ঢাকা, বিক্রমপুর নিবাসী শ্ৰীমদনমোহন চক্রবর্তী একদিন তার মাকে নিয়ে বারদী আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তিনি বাবাকে দর্শন করে বললেন, বাবা, আমি প্রতিদিন ফুল, বেলপাতা ও পবিত্র জল দিয়ে আমার মায়ের চরণ পূজা করি। তার পায়ের যে জায়গায় আমি ফুল, বেলপাতা দিই সেই জায়গাটা কিছুদিন হল কালো হয়ে গেছে। সেখানে পচন ধরেছে। তাঁর জ্বরও হয়েছে। কেন তার এমন হল বুঝতে পারছি না। কিভাবে মা সেরে উঠবে তা জানতেই আপনার কাছে এসেছি।


মদনবাবুর মায়ের পায়ে চর্মরোগ দেখা দিয়েছিল। বাবা তার কথা শুনে বললেন, আশ্রমের আঙিনায় ওই যে একটা বেলগাছ আছে, তার তলায় তোর মার থাকার জন্য একটা চালা করে দে। তোর মা কে বলবি, তার যখন যা খেতে ইচ্ছা হয়, কোনো দ্বিধা না করে যেন সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানায়। তুই তোর মার কাছে কাছে থেকে নজর রাখবি।


এই নির্দেশ মতো মদনমোহনবাবু বেলতলাতে মা’র থাকার জায়গা করে দিলেন। তার মা যখন যা খেতে চাইতেন, তিনি সে কথা বাবাকে নিবেদন করতেন এবং বাবা তার যথাযথ ব্যবস্থা করতেন। এইভাবে কিছুদিন যাবার পর দেখা গেল তার মায়ের পায়ের ঘা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। পায়ের উপর কালো দাগ আর নেই। তার জ্বরও নেই। মদনমোহনবাবু এই দেখে বাবাকে সব জানালেন। বাবা বললেন, তোর মাকে এখন বাড়ি নিয়ে যা। যথাসাধ্য মার ইচ্ছা পূরণ করবি। তাহলেই মার পূজা করা হবে।


যে বেলগাছতলার কথা এখানে বলা হয়েছে, বাবা নিত্য এই বেলগাছতলায় এসে বসতেন। তার মতো মহাপুরুষের স্পর্শে এই স্থানে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চিকণা সর্বদা বিরাজ করত। সেই চিকণার স্পর্শে ও প্রভাবে মদনমোহন বাবুর মা আরোগ্য লাভ করেছিলেন।


শ্রী সীতানাথ দাস কলকাতার হাটখোলা নিবাসী একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন। সংসারের সুখ, ঐশ্বর্য, অর্থ কোনোকিছুরই তার অভাব ছিল না। কিন্তু তার জীবনে এক বিরাট দুঃখ নেমে এলো। দীর্ঘকাল বাত রোগে ভুগে তিনি পঙ্গু হয়ে গেলেন। আর তার চলৎশক্তি রইল না। কলকাতায় অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে চিকিৎসা করালেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। লোকমুখে তিনি বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম শুনেছিলেন। তিনি শুনেছিলেন যে, বারদীর ব্রহ্মচারী একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ এবং তাঁর সংস্পর্শে এসে তার কৃপায় অনেকে রোগমুক্ত হয়েছেন। তাঁর অলৌকিক শক্তি আছে। যখন সব প্রচেষ্টায় বিফল হয়ে তিনি শয্যা নিলেন, তখন আত্মীয়স্বজন-দাসদাসী নিয়ে একটা বজরায় বারদীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।


একদিন সীতানাথবাবুর বজরা বারদীর ঘাটে উপস্থিত হলেন। আত্মীয়রা তাকে ধরাধরি করে বারদীর আশ্রমে নিয়ে হাজির করলো। তাকে একটা দড়ির খাট পেতে শুইয়ে দেওয়া হলে তিনি বাকি লোকজনকে বজরায় চলে যেতে বললেন। সীতানাথবাবু মনে মনে ভাবলেন, যখন মহাপুরুষের শরণাপন্ন হয়েছি, তখন এই আশ্রমের আঙিনাতেই পড়ে থাকবো। হয় তাঁর কৃপায় রোগমুক্ত হবে নতুবা তার সামনেই মরবো।


দু-দিন দু-রাত সীতানাথবাবু এইভাবেই কাটালেন। বৃষ্টির জল, রোদের তাপ সব সহ্য করে একইভাবে পড়ে রইলেন। এই দু-দিনের মধ্যে কেউ তার কথা বাবাকে বলেনি এবং বাবাও তার সম্বন্ধে কোনো খোঁজ করেননি। কিন্তু তাতে সীতানাথ বাবুর মনোবল দুর্বল হয়নি। তিনি তার সংকল্পে দৃঢ় রইলেন।


দুদিন পর সীতানাথবাবুর আত্মীয়স্বজন ও দাসদাসীরা এসে তাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে খুব দুঃখ পেল এবং তাঁকে বজরায় ফিরে যেতে অনুরোধ করলো। সীতানাথবাবু তাদের বললেন, এখানে আশ্রমে আমার প্রাণ যায় সেও ভালো, তবু আমি বজরায় ফিরে যাব না। তার দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনে আত্মীয়স্বজন ও অনুচরেরা বজরায় ফিরে গেল।


তৃতীয়দিন ভোরবেলায় সহসা বাবার প্রাণ সীতানাথবাবুর জন্য কেঁদে উঠলো। সূর্যোদয়ের পরে বাবা তার ঘর থেকে বেরিয়ে সীতানাথবাবুর কাছে গিয়ে বললেন, সীতানাথ তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। নে, এবার উঠে দাঁড়া। এই বলে বাবা যেমনি সীতানাথ বাবুকে স্পর্শ করলেন, অমনি তার শরীরে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হল এবং দীর্ঘকালের বাতপঙ্গু সীতানাথবাবু শরীরে শক্তি ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অমিত যোগশক্তির অধিকারী বাবা লোকনাথ তাঁর এক স্পর্শে চলৎশক্তিহীন এক পঙ্গুকে মুহূর্তে সব ব্যাধি মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিলেন।


সীতানাথবাবুর দু চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হল তার অন্তর। বাক্যরহিত হয়ে তিনি বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা তাকে বললেন, সীতানাথ, তুই তোর দেহ, মন-প্রাণ, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী এমনকি তোর সব বিষয়সম্পত্তি পর্যন্ত আমাকে অর্পণ করে আমারই উঠানে বৃষ্টিতে ভিজেছিস ও রোদে পুড়েছিস। তাই তোর জন্য আমার প্রাণ কেঁদেছে। এখন তুই সুস্থ সবল হয়েছিস। এবার বাড়ি ফিরে যা। (সীতানাথবাবু সর্বস্ব বাবার চরণে অর্পণ করে দিয়েছিলেন।)।


এই ঘটনা বাবা লোকনাথের ভক্তদের বিদিত করে যে, তার কেবলমাত্র একটু স্পর্শে এই পঞ্চভূত দেহের সমস্ত রোগ নিরাময় হয়ে রোগী শক্তিলাভ করতে পারে। এমন ভবরোগী তিনি পাননি যাকে এক স্পর্শে ভবরোগ মুক্ত করে ব্রহ্মলোকের সন্ধান দিতে পারেন। তিনি বলতেন, ভবরোগের বৈদ্য আমি, সে রোগ নিয়ে কেউ আসে না।


সেই সময় বিভূপদ কীর্তি নামে এক ব্যক্তি অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের পার্বতীপুর স্টেশনে রেলকর্মচারী ছিলেন। এক দুর্যোগপূর্ণ সন্ধ্যায় তিনি রেলের বিশ্রামাগারে ঢুকতেই দেখেন একজন স্ট্রেচার বাহিত সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধের পাশে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি চিন্তান্বিত মুখে বসে আছেন। বিভূপদবাবু ভিতরে ঢুকে বসতেই সেই ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি এইখানে থাকেন?


বিভুপদবাবু তাঁকে জানালেন যে, তিনি এই স্টেশনেরই রেলকর্মচারী। সেই ভদ্রলোক তখন তাকে বললেন, আমরা বড়ো মুশকিলে পড়েছি। আমার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ, অক্ষম। গরম জলের ব্যাগ ছাড়া তাঁর এক দণ্ড চলে না। হঠাৎ দেখছি, গরম জলের ব্যাগটা ফুটো হয়ে গেছে। আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। বারদী যাব। সঙ্গে তোকজন আছে, কিন্তু তারা এখানকার কিছু চেনে না। এখানে গরম জলের ব্যাগ কোথায় পাবো?


তার কথা শুনে বিভূপদবাবু বললেন যে, তাঁর বাবা সেখানে হাসপাতালের চার্জে আছেন। স্টেশন থেকে লোক পাঠিয়ে তিনি গরম জলের ব্যাগ আনিয়ে দেবেন। তিনি একজন কর্মচারীকে হাসপাতালে ব্যাগ আনতে পাঠালেন।


পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তির পুত্র তখন বলেন, আমরা ঢাকা হয়ে বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যাবো। বিভূপদবাবু বললেন, তার নাম শুনেছি, কিন্তু তিনি কি এখনও দেহে আছেন? একথা শুনে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে বললেন, তিনি দেহে থাকুন বা না থাকুন, তাঁকে দেখা যায়, তার সঙ্গে কথাও বলা যায়। এইমাত্র তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এইমাত্র তোমরা যখন কথা বলছিলে, তিনি আমাকে দেখা দিয়ে বলে গেলেন, তোমরা যাকে ব্যাগ আনতে পাঠিয়েছ, সে শূন্য হাতে ফিরে আসছে। আমি ব্যাগের ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকা পৌঁছনো পর্যন্ত ওতেই কাজ চলে যাবে।


বৃদ্ধের কথায় বিভূপদবাবু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বৃদ্ধের পুত্র তাদের ব্যাগটি এনে দেখলেন সেখানে কোনো ছিদ্র নেই। এই অলৌকিক কাণ্ড দেখে বিভূপদবাবু বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাদের সামনেই ব্রহ্মচারী বাবা এসে বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে ব্যাগের ছিদ্র বন্ধ করে দিয়ে গেলেন, অথচ সেই বৃদ্ধ ভিন্ন কেউ তাকে দেখতে পেলেন না। এরপর হাসপাতাল থেকে লোকটি এসে বলল যে, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে ব্যাগ আনতে পারেনি। তখন বিভূপদবাবু বৃদ্ধের পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন, কি করে তার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলেন এবং কেন তারা এই পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুমূর্ষ ব্যক্তিকে নিয়ে এতদূর বারদী আশ্রমে যাচ্ছেন।


বৃদ্ধের পুত্র তখন বললো, আমার পিতা বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য। তিনি অনেকবার ব্রহ্মচারী বাবার কৃপালাভ করেছেন। একদিন রাতে আমাদের কাছারি ঘরে ডাকাত পড়লো। অন্ধকারের মধ্যে বাবা ঘরের দরজা খুলে যেই বেরিয়েছে, তার মাথার উপর জোর লাঠির আঘাত পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে তিনি নিচে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালেন। এরপর জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এইভাবে উনিশ দিন উনি শয্যাশায়ী ছিলেন। এই সময় প্রতিদিন লক্ষ্য করতাম ছায়ার মতো ব্রহ্মচারী বাবা বাবার কাছে আসেন, আবার ছায়ার মতোই সরে যান। আমি তাকে দেখতে পেলেই ঘর ছেড়ে চলে যেতাম। উনিশ দিন পর হঠাৎ একদিন বাবার আচ্ছন্নভাব কেটে গেল। তার গলা দিয়ে স্বাভাবিক স্বর বেরোলো। আমি তাকে জানালাম যে, ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় তিনি ভালো হয়ে উঠেছেন। তাকে এও জানালাম যে, প্রতিদিন ছায়ার মতো ব্রহ্মচারী বাবা তার কাছে আসতেন। বাবা আমার কথা শুনে তখনই বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যেতে চাইলেন। বাবার ইচ্ছানুযায়ী আমি বাবার ভগ্নদেহ নিয়ে বারদী যেতে রাজি হলাম না। তিনি তখন একজন ভৃত্যকে নিয়ে বারদী আশ্রমে চলে গেলেন।


আশ্রমে যখন বাবা পৌঁছলেন, ব্রহ্মচারী বাবা তখন ছিলেন না। তিনি আগের দিন কোথায় গেছেন, কেউ জানে না। পালকির মধ্যে শুয়ে অসহ্য গরমে বাবা দিনপাত করতে লাগলেন। আমি লোকজন, ডাক্তার, ঔষধ নিয়ে বারদী পৌঁছোলাম, তাকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন না করে বাড়ি ফিরবেন না। আশ্রমবাসীরা তাকে আশ্রমের ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করলেও বাবা গাছতলাতে থাকতে চাইলেন। তখন আমার লোকেরা গাছতলায় তাকে মশারি টানিয়ে বিছানা করে দিলো। বাবা আমায় লোকজন নিয়ে চলে যেতে বললেন, আমি চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে গেলাম। তিনি আমার আনা। কোনো ঔষধ খেলেন না এবং সঙ্গেও রাখলেন না। এইভাবে তিন দিন কেটে গেল। এই তিন দিনে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগ ও ভাঙ্গা হাড়ের বেদনা সব ভুলে গেলেন। তিনি এক পরম আত্মিক তৃপ্তি লাভ করলেন। তার সমস্ত কামনা বাসনা মন থেকে অন্তর্হিত হলো।


চতুর্থদিনে ব্রহ্মচারী বাবা আশ্রমে এলেন। আমি তার কাছে সব নিবেদন করে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন একটি বার বাবার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি না দর্শন দেওয়া পর্যন্ত বাবা জলস্পর্শও করতে রাজি নন। ব্রহ্মচারী বাবা আমার কোনো কথা গ্রাহ্য তো করলেনই না, উল্টে আমাকে কড়া ভাষায় বললেন, দেশ-দেশান্তর থেকে কত রোগী আসে, আমি কি তাদের ডেকে আনি? তোর বাবা জমিদার বলে কি তাকে খাতির করে ডেকে আনতে হবে? খাওয়া না খাওয়া, এখানে আসা না আসা তার ইচ্ছা। আমি কেন বলতে যাব? আমি এই কথা বাবাকে জানিয়ে তাকে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু বাবা বললেন, ফিরে যাব বলে তো আসিনি। সমাদর পাবার আশা নিয়েও আসিনি। যে জন্য এসেছি, তা আমি পেয়ে গেছি। প্রতি মুহূর্তে নুতন করে পাচ্ছি। গতকাল রাতে আমার মশারির গা ঘেঁষে একটা কালো ঘেয়ো কুকুর এসে শুলো। আমার তাকে তাড়িয়ে দেবার ইচ্ছা হল না। আমি মশারির বাইরে হাত বাড়িয়ে আমার কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে দিলাম। এক অব্যক্ত আনন্দে আমার মন ভরে উঠলো। তখন কুকুরের গা থেকে এক সুন্দর চন্দনের গন্ধ আসতে লাগলো। আমার কম্বলে এখনও সেই গন্ধ আছে। আমি সেই কুকুরটার স্পর্শে দয়াল ব্রহ্মচারী বাবার স্পর্শই পেয়েছি। তিনি বাড়ি ফিরলেন না।


এরপর একদিন আমি তাকে বললাম যে, ডাক্তার বলেছে, আর দেরি করলে তোমার বুকের হাড় জোড়া লাগবে না। মাথার ক্ষতস্থান বিষিয়ে প্রাণসংশয় হবে। ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন পেলেই তুমি ফিরে চলো। তিনি যদি তোমার কাছে না আসতে চান, আমি লোক দিয়ে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। বাবা বললেন, আমাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না। সময় হলে আমি নিজেই বাড়ি ফিরে যাব। আপাততঃ আমি এখানেই থাকব। দর্শন দেবার হয় তিনি দেবেন, না দেবার হয় দেবেন না। আমি তখন বাবাকে বললাম, তবে তোমার রোগ আর সারবে না।


ইতিমধ্যে আমার বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন আমার সমালোচনা শুরু করলেন এই বলে যে আমাদের বিপুল অর্থ থাকা সত্তেও আমি বাবার ভাল চিকিৎসা করছি না। রীতিমতো বিরক্ত হয়ে আমি আবার বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে গেলাম। তাকে আমার বাবার সঙ্গে একটি বারের জন্য দর্শন দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা লোকনাথ বললেন–জানি এ রোগ সারবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার আনলেও এ রোগ সারবে না। এ রোগ সারানো শিবের অসাধ্য। এ কথা শুনে আমি বললাম, তবে আমি এখন কি করবো বলুন। তখন বাবা বললেন, তুই কিছুই করবি না। এই কথা বলে তিনি আমার সঙ্গে বাবার কাছে এলেন। তিনি যখন আসন ঘর থেকে উঠে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে আসছেন, তখন আমার মনে হচ্ছে তার পা মাটি স্পর্শ করছে না, অথচ তিনি হাঁটছেন। ব্রহ্মচারী বাবা বাবার বিছানার পাশে এসে প্রথমে নীরবে দাঁড়ালেন। তারপর তার ডান হাতটি বাড়িয়ে বাবার মাথা স্পর্শ করে বললেন, আর তোকে শুয়ে থাকতে হবে না। উঠে বস। তোর সমস্ত ব্যাধি সেরে গেছে। কোনো ওষুধপত্রের দরকার হবে না। উঠে দাঁড়াতে একটু কষ্ট হবে। আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার সঙ্গে বেলতলা পর্যন্ত আয়। বাবা, ব্রহ্মচারী বাবার কথায় যন্ত্রচালিতের মতো উঠে বসলেন। কে বলবে, তিনি একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী, কতদিন অনাহারে এখানে পড়ে রয়েছেন। প্রথমে বাবা ব্রহ্মচারী বাবার চরণে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর তার হাত ধরে হেঁটে বেলতলায় এলেন। এই ঘটনার পরে মাত্র কয়েকদিন ব্রহ্মচারী বাবা এ জগতে নিজ দেহে ছিলেন। এরই মধ্যে একদিন বাবাকে ডেকে বলেছিলেন, তোর প্রারব্ধ কেটে গেছে। তবে এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘদিন পরে এই রোগ আবার হবে। তখন বিচলিত না হয়ে এইখানে এসে এমনি করে দিনকতক অবস্থান করবি। তাতেই তোর সব সঞ্চিত কর্মের ভোগ কেটে যাবে। আমার দেড়শো বছরের দেহটাকে আমি এবার ত্যাগ করবো। কিন্তু আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। যখনই ডাকবি, তখনই আমার সাড়া পাবি। আমি যে নেই, এ কথাটা মনে আমল দিবি না। আশ্রমের ভূমি শয্যায় তোকে যে ভাবটি দিয়েছিলাম, সেটি তখন স্মরণ করবি। দেহমন যখন আমাকে সমর্পণ করেছিস, তখন পাপ-পুণ্যের কোনো বোধ মনে আসতে দিবি না।


এখন বাবার আবার সেই রোগ দেখা দিয়েছে। আমরা সেজন্য বারদী যাচ্ছি ব্রহ্মচারী বাবার নির্দেশানুসারে কাজ করতে। আমাদের মনে পূর্ণ বিশ্বাস ব্রহ্মচারী বাবা বর্তমানে দেহে না থাকলেও আমার বাবা সেখানে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।


পার্বতীপুর স্টেশনে বিভূপদবাবু বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যে অপূর্ব অলৌকিক কীর্তির কথা শুনলেন, তাতে তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে গেলেন। এই লীলার মাধ্যমে বাবা ভক্তদের অনেক বার্তা দিয়ে গেছেন।


 (১) ভক্তদের একাগ্র ডাক বাবার মনে ভক্তের জন্য কৃপাবর্ষণ করে। সেই কৃপায় ভক্ত ধন্য হয়। রোগমুক্ত হয়।


(2) বাবা নিত্য, সর্বাবস্থায়, সর্বস্থানে তিনি বিরাজিত। যে স্থান থেকেই তাকে ডাকা হোক না কেন, ভক্তের ডাকে যদি আকুলতা থাকে, তিনি সবার অলক্ষ্যে সাড়া দেবেন।


(৩) ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ যে স্থানে অবস্থান করেন, সে স্থান উচ্চ চিৎকণা সমৃদ্ধ হয় এবং তার স্পর্শে যে আসে, সেই উপকৃত হয়।


(৪) বাবার কৃপা ভক্তের প্রারব্ধভোগ ও সঞ্চিত কর্মভোগ কাটাতে সাহায্য করে। তিনি সেই পথের সন্ধান দিতে পারেন যাতে ভক্ত প্রারব্ধভোগ মুক্ত হতে পারেন।


(৫) তার স্পর্শে ভক্তের শরীরে এমন শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটে যে সেখানে কোনো রোগ আর থাকতে পারে না।


বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের ১২৭ বছর পরেও এই সব তত্ত্ব ধ্রুবসত্য। তার অগণিত ভক্ত আজও তার কৃপা লাভ করে। মহাপ্রয়াণের পরেও বাবা ভক্তকে রোগমুক্ত করেছেন, এমন একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একজন অকৃত্রিম একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ডাঃ নিশিকান্ত বসু। তার একান্ত কাতর প্রার্থনায় তার অনেক রোগীকে বাবা সুস্থ করে দিয়েছেন।


একবার নাগ পরিবারের শ্রীচৈতন্য নাগের স্ত্রী অনেকদিন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগতে থাকেন। তখনকার দিনে ম্যালেরিয়া ভয়ানক রোগ ছিল। নিশিকান্তবাবু অনেক চিকিৎসা করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। একদিন রাতে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল, হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলো। নিশিকান্তবাবু তখন একমনে লোকনাথবাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন।


সেই রাতে রোগিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন দেখলেন, লোকনাথবাবা আশ্রম থেকে এসে তার মাথার কাছে খাটে বসে বললেন, এই যে আমি এসেছি। তুই ভয় করিস কেন? এরপর রোগিনী সব রোগ সেরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। চলৎশক্তিহীনা রোগিনী বিছানায় বসে সবাইকে তার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। এও বললেন যে, সেই সময় সারাটা ঘর এক মিষ্টি চন্দনের গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। পরদিন সেই রোগিনী বারদী আশ্রমে গিয়ে প্রসাদ খেয়েছিলেন।


বারদীর জমিদার আনন্দকান্তি নাগ ছিলেন বাবালোকনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত ও কৃপাধন্য। তাঁর পৌত্র প্রেমরঞ্জন নাগের স্ত্রী রেণুকণাদেবী ছিলেন লোকনাথগতপ্রাণা। বাবা লোকনাথের প্রতি তার অগাধ ভক্তি বিশ্বাস ছিল। সারাজীবন তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার সেবা, পূজা, ধ্যানে অতিবাহিত করেন। তার মনে একটি দুঃখ ছিল যে তিনি কখনও বাবার দর্শন পাননি। রেণুকণাদেবীর গুরুদেব ছিলেন ডাঃ নিশিকান্ত বসু। তার কাছ থেকেই তিনি বাবার লোকমাহাত্ম্য শুনেছেন।


১৯৮৮ সালের শেষের দিকে হঠাৎ রেণুকণাদেবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন তিনি অচেতন হয়ে পড়লে তার শরীর নীলবর্ণ হয়ে যায়। তখন তার কন্যা ও জামাতা লোকনাথবাবা ও ডঃ নিশিকান্ত বসুর দুখানি ফটো তার মার কাছে রেখে দেন। বাড়ির সকলে লোকনাথ বাবাকে ব্যাকুলভাবে স্মরণ করে রেণুকণাদেবীর আরোগ্য কামনা করতে থাকেন। এইভাবে কয়েকদিন গত হয়।


হঠাৎ একদিন রেণুকণাদেবী চেতনা ফিরে পেয়ে বিছানায় উঠে বসে বাবা বাবা বলে কাঁদতে থাকেন। আবার পরমুহূর্তেই অচেতন হয়ে পড়েন ও তার দেহটি বিছানায় ঢলে পড়ে। বাড়ির লোকেরা ডাক্তার ডেকে আনেন।


ডাক্তার এসে রোগিণীকে পরীক্ষা করে বলেন, এ হচ্ছে ডিপ কোমা। অক্সিজেন ও প্রাণরক্ষার ঔষধ দেওয়া হলো। কিন্তু রোগিণীর চেতনা ফিরে এলো না। ডাক্তার জানালেন এই কোমা অবস্থার মধ্যেই রোগিণী প্রাণত্যাগ করতে পারেন।


ডাক্তারের এই বার্তা শুনে রেণুকণাদেবীর কন্যা প্রতিমা শোকে মূহ্যমান হয়ে লোকনাথবাবার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে আর্তি জানাতে থাকেন, তাঁর মা-কে চৈতন্য ফিরিয়ে দেবার জন্য। আত্মীয়স্বজনেরা একে একে এসে অচৈতন্য রেণুকণাদেবীকে দেখে বাবা লোকনাথের কাছে তার প্রাণভিক্ষা করতে থাকেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় দিনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেণুকণাদেবী কন্যা প্রতিমাকে ডাকতে ডাকতে সুস্থ অবস্থায় বিছানায় উঠে বসেন। কন্যাকে তার পাশে কাগজ কলম নিয়ে এসে বসতে বলেন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের তিনি কাছে ডেকে নেন।


এরপর তিনি বলতে থাকেন, আমি দেহে এসেছি কেবল তোমাদের এই কথা বলতে যে বাবা আছেন। তিনি সর্বদাই আমাদের সাথে সাথে আছেন। মেয়েকে তিনি বলেন, জানিস আমি কেন তোদের কাছে নেমে এলাম? তুই বাবার কাছে কেঁদে বলেছিলি, আমি বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছি। বাবা তাই আমাকে একদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন চিকিৎসা করাবার জন্য। তবে চিকিৎসায় আমি কয়েকদিন মাত্র থাকব।


প্রতিমাদেবী মা-র কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। মায়ের অচেতন অবস্থায় তিনি যথার্থই বাবার ফটোর সামনে কাঁদতে কাঁদতে আকুলভাবে প্রার্থনা


জানিয়েছিলেন, মা যেন এভাবে বিনাচিকিৎসায় প্রাণ না হারান। মার অজ্ঞান অবস্থার যে কথা তিনি বাবা লোকনাথকে জানিয়েছিলেন, সে কথা মা কি করে জানলেন? এ সবই বাবা লোকনাথের অলৌকিক লীলা। এমন সময় রেণুকণাদেবীর অতি স্নেহের পৌত্র বাদশা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা দিদু, তুমি কি বাবা লোকনাথকে দর্শন করেছ? রেণুকণাদেবী তখন তাদের বলতে আরম্ভ করলেন তার পারত্রিক ভ্রমণের অলৌকিক কাহিনী। তিনি বললেন, আমি দেখলাম আমার দেহ থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর আমার আমি ঊর্ধদিকে উঠতে লাগলাম। তখন আমার এ দেহ ভেঙ্গে দু-খণ্ড হয়ে গেছে। আমি ঊর্ধ্বে উঠতে উঠতে নীল আকাশ ভেদ করে আরও উপরে উঠলাম। যেখান থেকে এই পৃথিবীটাকে একটা ছোট বস্তুর মতো মনে হলো। নিচের পৃথিবীটাকে তখন মনে হল কি নোংরা ও দুঃখে ভরা। আমি আরও উর্ধে উঠে এক জায়গায় দেখলাম ভগবান শিব বসে আছেন ধ্যানাসনে আর তার পাশেই বসে আছেন বাবা লোকনাথ। আমাকে দেখে বাবা আসন ছেড়ে উঠে এলেন এবং অসীম করুণায় তার বক্ষের মধ্যে আমাকে টেনে নিলেন। আমার মাথা ও মুখে তার কৃপাহস্ত বুলিয়ে দিলেন। যখন রেণুকণাদেবী এই আশ্চর্য অলৌকিক কাহিনী বিবৃত করছেন, তখন তার দেহ এক অপূর্ব আভায় দীপ্তমান হয়ে উঠেছে। তিনি তার ডান হাত প্রসারিত করে তালুর মধ্যে এক গোলাপী রঙের বৃত্ত দেখালেন। এমন রক্তিম আভা কেউ কখনও তার অঙ্গে দেখেনি। তিনি বললেন, এটা আমার হাত নয়। এ হাত বাবার। এসো, এই হাত তোমরা স্পর্শ করো। তাঁর আশীর্বাদ মাথায় নাও। আমি বাবার কাছ থেকে তোমাদের সকলের জন্য এক দিব্যবাণী নিয়ে এসেছি। আমার নিম্ন অঙ্গের কোনো অনুভূতি নেই। আমার শক্তি কেবল উর্ধাঙ্গে এবং এই হাতের মধ্যে আছে। এই হাতটি বাবার কৃপাহস্ত। বাবা আমাকে তোদের কাছে পাঠিয়েছে এই অভয়বাণী শোনাবার জন্য যে, তিনি আছেন, আজও জীবন্ত হয়ে আছেন। রেণুকণাদেবীর এই কথা শোনামাত্র আশেপাশের লোকজন তাকে দর্শন করার জন্য আসতে লাগলো। তিনি সকলকে ডান হাত প্রসারিত করে আশীর্বাদ করলেন। তিনি সকলকে বলতে লাগলেন, সংসারে থেকে সংসার জীবনযাপন করেও কেমন করে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। তার কথা শুনে সকলের মনে হচ্ছিল, এই কথা তিনি বলছেন না। তার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মচারী বাবা বলছেন।


ডাক্তারেরা এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে খেই হারিয়ে ফেলে যে, এইরকম ডিপ কোমা অবস্থা থেকে একজন কীভাবে এই অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। বিজ্ঞানকে মিথ্যা করে দিয়ে লোকনাথবাবার মহিমা দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়েন। লৌকিক বস্তুজগতের উপরে যে একটা অলৌকিক আধ্যাত্ম জগৎ আছে, তার কথা অনেকেই মানেন না। কোনো বিজ্ঞান এখনও তার রহস্য ভেদ করতে সমর্থ হয়নি। ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কিভাবে রেণুকণাদেবীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। রেণুকণাদেবী তাদের বলেন, বাবা আমাকে যতদিন এখানে রাখবেন, ততদিনই আমি থাকব। তার বেশি তোমরা আমাকে রাখতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি বাবার সান্নিধ্যবিহনে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এইসব লৌকিক চিকিৎসা তার ভালো লাগেনা। এই জগৎটাকে এখন তার নোংরা মনে হয়। অবশেষে তিনি ১৯৮৮ সালের ১১ই মার্চ বাবা লোকনাথকে স্মরণ করতে করতে জ্যোতির্ময় দেবলোকের পথে গমন করেন।


পুস্তকের পটকথায় আমার উপর বাবার এইরূপ কৃপা বর্ষণের কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এখনও করুণাময় বাবা ও মাতা নর্মদার কৃপায় আমি জীবনধারণ করে আছি। তাদের দেওয়া জীবন এইজন্য তাদের নামেই উৎসর্গ করে দিয়েছি।


পারত্রিক জগতে এই ভ্রমণ কাহিনী সূক্ষ্মদেহে বাবা লোকনাথের ভক্তদের প্রতি কৃপার এক অমূল্য নিদর্শন। অনেক ভক্ত পূজা করেন, বাবাকে স্মরণ করেন, কিন্তু মনের গভীরে এক প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন থাকে, বাবা কি আমায় দর্শন দেবেন? কৃপা করবেন? অনেক সময় এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন সম্বন্ধে তারা নিজেরাও অবগত থাকেন না। পরম করুণাময় বাবা ভক্তের মনের সব ভাবের খোঁজ রাখেন। তাঁকে অটল বিশ্বাসে ভক্তি সহকারে আকুল হয়ে ডাকলে, তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া দেবেনই। কিন্তু ভক্ত সেভাবে ডাকতে পারে কই? সেজন্যেই তিনি জীবিতকালে বলেছেন, বাবা বলে ডাকিস, কিন্তু সন্তানের মতো আসতে পারিস কই? সত্যিই তো আমরা তার কাছে কেবলই ভক্ত থাকি। কিন্তু সন্তানের আবদারে সন্তানের মতো তার সামনে যেতে পারি কি?

অষ্টম অধ্যায় – বাবার কৃপাধন্য কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা


গোয়ালিনী মা


বারদী আশ্রম থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে একটি মাটির ঘরে গোয়ালিনী মা-র নিবাস ছিল। তিনি ছিলেন বাল্যবিধবা এবং নিঃসন্তান। তিন কুলে তাঁর কেউ ছিল না। তার নিজের বলতে ছিল একটি ছোট মাটির কুটির এবং একটি গরু। এই গরুটিকেই তিনি সন্তান স্নেহে লালন-পালন করতেন এবং দুধ বিক্রি করে তার গ্রাসাচ্ছাদন চলতো। গোয়ালিনী মা নামেই তিনি গ্রামে পরিচিতা ছিলেন।


গোয়ালিনী একদিন লোকমুখে শুনতে পেলেন বারদী গ্রামে শ্মশানের কাছে এক মহাপুরুষ আসছেন। শ্মশান সংলগ্ন জমিতে তার কুটির তৈরি হয়েছে। মহাপুরুষের কথা শুনেই তার মনটা কেমন বিচলিত হয়ে ওঠে। মনটা ছুটে চলে যেতে চায় সেই মহাপুরুষকে দেখতে। বারদী আশ্রমে যেদিন প্রথম ভক্তদের সেবা করানো হয়, সেদিন তিনিও আশ্রমে যান খিচুরি প্রসাদ নিতে ও মহাপুরুষকে দেখতে। আশ্রমে এসে তিনি এককোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে মহাপুরুষকে দেখতে থাকেন। আশ্রমের আঙিনায় যখন সব ভক্তদের খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা হয়, তখন তিনি এক কোণে প্রসাদ নিতে বসে পড়েন। তার সামনে শালপাতায় খিচুড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রসাদ গ্রহণে তার মন নেই। তিনি আশ্রমের বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী জটাজুটমণ্ডিত মহাপুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার অন্তর ও চোখ যেন কিছু খুঁজে বেড়ায়।


বাবা লোকনাথের নিম্নভূমিতে অবতরণের পর বারদীতে আসার একটি বড়ো কারণ হল তার জন্মদাত্রীকে তিনি যে কথা দিয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে বেরিয়েছিলেন, সেই কথা রাখতে। উপনয়নের পর দণ্ডী ঘরে লোকনাথকে ভিক্ষা দেবার পর মা কমলা স্বয়ং লোকনাথের কাছে ভিক্ষা চান যেন পরজন্মে তাকেই পুত্ররূপে পান। বাবা লোকনাথ মা-কে কথা দিয়েছিলেন যে, মা-র পরজন্মে তার সঙ্গে আবার পুত্ররূপে দেখা হবে। ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথ জানতেন যে তার গর্ভধারিণী মা সেইসময় বারদী গ্রামেই অবস্থান করছেন। সেইজন্য তিনি নিম্নভূমিতে অবতরণের সময় বেণীমাধবকে বলেন যে, তিনি বারদী যাবেন। বারদী এসে তার চোখও গর্ভধারিণী মাকে খুঁজতে থাকে। আসন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভক্তদের প্রসাদ গ্রহণ দেখতে দেখতে তার চোখ পড়ে এক কোণায় বসে থাকা ওই গোয়ালিনী মার দিকে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলেন, মা, তুমি প্রসাদ গ্রহণ করো। তার কথা যেন গোয়ালিনী মা-র অন্তরে পৌঁছায়। ভেতর থেকে উঠে আসতে থাকে কান্নার রোল। তিনি কেবল দুচোখ ভরে মহাপুরুষকে দেখতে থাকেন। বাবা লোকনাথ চিনতে পারেন তার জন্মদাত্রী মা-কে। তিনি গোয়ালিনী মা-র থেকে তার নিবাস জেনে নেন।


পরদিন বাবা গোয়ালিনী মা-র নিবাসে উপস্থিত হয়ে তার বর্তমান অবস্থা জানতে পারেন। তিনি গিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে গোয়ালিনী মা-র সঙ্গে কথা বলেন। তিনি গোয়ালিনী–কে বলেন আশ্রমের সব ভার নিতে আর তার গরুর দুধ আশ্রমে দিতে। তিনি গোয়ালিনী মা-কে বলেন যে তিনি যেন বাবাকে পুত্রবৎ দেখেন। মহাপুরুষ না ভাবেন। সেই থেকে আশ্রমের ভক্তদের সেবা, রুগীদের শুশ্রূষা ও আশ্রমের সব দেখাশোনার ভার বর্তায় গোয়ালিনী মা-র উপর। বাবার কৃপায় গোয়ালিনী মা-র অন্তরে এক বাৎসল্যভাবের উদয় হয় এবং তিনি পুত্রবৎ বাবা লোকনাথের সেবা করতে থাকেন। বিশেষ করে আহারকালে তিনি বাবার আহার তার সামনে নিজে এনে দিতেন। বাবার কৃপায় তিনি এক আশ্চর্য কর্মশক্তির অধিকারিণী হলেন যার বলে সারাদিন তিনি আশ্রমের সেবা করতে পারতেন।


বারদী আশ্রমে যখন শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম বাবা লোকনাথের দর্শনে আসেন, তখন বাবা গোয়ালিনী–কে বলেন, এটি তোমার আর এক ছেলে বিজয়কৃষ্ণ। গোয়ালিনী তখন বাবার সামনে বসে বিজয়কৃষ্ণের বিশাল বপুকে নিজের কোলে শুইয়ে স্তন্যপান করান। তিনি নিজে নিঃসন্তান। কোনোদিন তার বুকে দুধ আসেনি। কিন্তু বাবার কৃপায় ও গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর যোগবলে সেই বিশাল বপুলঘু হয়ে গোয়ালিনী মার কোলে শুয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করেছিলেন। এই ঘটনা উপস্থিত সমস্ত ভক্ত প্রত্যক্ষ করে ধন্য হয়েছিল। সবার মনে এই প্রশ্ন জেগে উঠেছিল যে গোঁসাইয়ের এত বিশাল বপু অশীতিপর বৃদ্ধা কী করে কোলে নিলেন এবং যার কোন সন্তানই কোনোদিন হয়নি, এই বয়সে তাঁর স্তনে মাতৃদুগ্ধ কি করে এলো। গোয়ালিনী নিঃস্বার্থভাবে অন্তর থেকে বাবা লোকনাথের সেবা করতেন। তাঁর কোনো ধর্মবিষয়ে জ্ঞান ছিলনা এবং সাধন জ্ঞানও ছিলনা। তিনি নিজেকে বাবার চরণে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে বাবার সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। সেইজন্য বাবাই তাকে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী করেছেন। বাবা ভক্তদের কাছে বলতেন যে, গোয়ালিনী–ই পূর্বজন্মে তার জন্মদাত্রী মাতা ছিলেন। বাবা লোকনাথের অনেক অলৌকিক লীলা গোয়ালিনী দেখেছেন। বাবার সামনে যে কোনো সময়ে উপস্থিত হবার অধিকার একমাত্র তাঁরই ছিল। গোয়ালিনী–ই হচ্ছেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি যিনি বাবা লোকনাথকে কালীরূপে দর্শন করেছিলেন। বাবা লোকনাথের কামরূপসিদ্ধির এই প্রকাশ কেবলমাত্র গোয়ালিনী–ই প্রত্যক্ষ করেছেন। গোয়ালিনী তার জন্মদাত্রী মা জেনেই বাবা তাঁর সমক্ষে দক্ষিণাকালীকা রূপে প্রকট হয়েছিলেন। গোয়ালিনী মা-র চক্ষু সেদিন সার্থক হয়েছিল তাঁর পূর্বজন্মের লোকনাথের সাধন ক্ষমতা দেখে। দণ্ডীঘরে তার চোখের জল বৃথা যায়নি।


বারদী আশ্রমের অনতিদূরে গোয়ালিনী মার সেই মাটিরবাড়ি আজও রক্ষিত আছে। বারদী আশ্রম থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারা গেল যে একজন গোয়ালিনী মা-র ভিটা জোর করে দখল করে নিয়েছিলেন। তখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে এই কাজ করতে নিষেধ করে। কিন্তু তিনি গায়ের জোরে সেই ভিটা দখল করে বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর তাঁর একটি সন্তান মারা যায় এবং সংসারে ভীষণ অশান্তি ও উপদ্রব নেমে আসে। তারপর তিনি সেই ভিটা ত্যাগ করেন। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সকলেই বলে যে এই ভিটায় বাবা লোকনাথ নিজে এসে বসেছেন। সেই ভিটাকে আমরা রক্ষা করবো। বাবা লোকনাথের কৃপা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পেয়েছিলেন। বারদী গ্রামেরতো কথাই নেই, সারা বাংলা থেকে লোক তার কৃপা পাবার জন্য বারদী যায়। বর্তমানে গোয়ালিনী মা ও বাবা লোকনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে এই ভিটার রক্ষণাবেক্ষণে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে।


যেসব ভক্ত বারদী আশ্রম পরিদর্শন করেন, তারা গোয়ালিন মা-র ভিটাও দর্শন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।


.


নারিশা বাবা


নারিশা নিজের জীবনধারণের কোনো সদুপায় করতে না পেরে প্রথম জীবনে মাকে ছেড়ে এক অসৎ সাধুর চেলা হয়েছিলেন। জীবনধারণের কোনো নিজস্ব উপায় না থাকলেও সঙ্গদোষে সে গাঁজা খাওয়া, নারী ভোগকরা ইত্যাদি কাজে বেশ হাত পাকিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে এক সাধুর চেলা হয়ে বিনামূল্যে গাঁজা সেবন করার সুযোগ পেল এবং সাধুগিরি কী করে করতে হয় তাও শিখলো। সন্ত সাধুরা কিভাবে লোক ঠকিয়ে পয়সা উপার্জন করে এবং রাতের অন্ধকারে সুখী জীবন ভোগ করে সেগুলি সে সাধুবাবার চেলাগিরি করে বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে নিল। যখন তাঁর সাধু ব্যবসাটা বেশ বোঝা হয়ে গেছে এবং নিজেরও বেশ বড় জটা হয়ে গেছে, তখন সে ভাবল সে নিজেই সাধু হয়ে যাবে। এখন চেলাগিরী করে যা উপার্জন করে, তার বেশিরভাগই সাধুকে দিয়ে দিতে হয়। আর রাতের সুখীজীবন ভোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। এইসব ভেবে সে চেলাগিরী ছেড়ে অন্যগ্রামে গিয়ে নিজেই সাধুরূপে আত্মপ্রকাশ করলো। সঙ্গে কয়েকজন চেলাও রাখলো। গেরুয়াবসনে ও লম্বা জটায় তাকে সাধুর মতো দেখায় বটে। গ্রামের গাছতলায় একটি ধূনী জ্বালিয়ে ত্রিশূল পুঁতে সে ব্যোম ভোলানাথ ধ্বনি দিতে থাকে। ধর্মভীরু গ্রামের সাধারণ মানুষ ক্রমেই আকৃষ্ট হয় ওই সাধুর প্রতি। তারা দেখে যে এক জটাধারী সাধু চোখ বুজে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে মাঝে মাঝেই ‘ব্যোম ভোলানাথ’ ধ্বনি দিচ্ছে। গ্রামের অসহায় দুঃখী মানুষেরা তাদের সংসার জীবনের হাজারো সমস্যা সেই সাধুর কাছে ব্যক্ত করতে থাকে। সাধুও তাদের অভয় আশীর্বাদ দিয়ে আশ্বস্ত করতে থাকে এই বলে যে সব সমস্যা সে দূর করে দেবে।


তার চেলারা মানুষজনকে বোঝাতে থাকে যে শুধু অর্থপ্রণামী দিয়ে ‘সিধা দিলেই হবে না। বাবার চরণে গাঁজাও নিবেদন করতে হবে। সকলে তাদের অর্পিত ‘সিধায় গাঁজাও দিতে শুরু করে। অতিরিক্ত গাঁজা সে এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনও শুরু করে। কোনো মহিলার সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ হতো রাতে, যাতে নারীভোগের বিলাসিতাটুকুও নির্বিঘ্নে মেটানো যেত।


কিন্তু চতুর এই নারিশা বাবা এক গ্রামে বেশিদিন অবস্থান করতো না। কারণ সে জানতো অচিরেই স্থানীয় মানুষরা তার ভণ্ডামী ধরে ফেলবে। ক্রমেই তার পসার এমনই জমে উঠেছিল যে নিজস্ব বড়ো তাবু, তিনটি ঘোড়া ও ব্যাপক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও গাঁজা-আফিমের ভাণ্ডার নিয়ে সে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ঘুরে বেড়াত। এভাবেই একবার ত্রিপুরার একটি গ্রামে গিয়ে গোল বাঁধলো নারিশার সাজানো সংসারে।


প্রতিদিনের অভ্যাসমতো গ্রামের একটি গাছতলায় ধূনী জ্বালিয়ে ব্যোম ভোলানাথ শব্দে সবে সে আসর জমাবার চেষ্টা করছে আর ফাঁকে ফাঁকে মিটমিট করে দেখছে কতজন ভক্ত আকৃষ্ট হলো। ঠিক সেই সময় একটি পদধ্বনি তার সামনে এসে থামলো এবং তার সংসার জীবনের নাম ধরে ডাকলো। নারিশাবাবা সেই নাম প্রায় ভুলেই গিয়েছে। এতদিনপর এই নামে তাকে কে ডাকলো! সেই আগন্তুক তারপর বললেন–কিরে বেশ তো ব্যবসা কেঁদে জমিয়ে বসেছিস দেখছি। এইজন্যই বুঝি বাবা-মাকে কাঁদিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলি? বাবা মরে বেঁচেছে আর বুড়ি মা অন্ধ হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। মানুষের চামড়া যে তোর গায়ে আছে তাও তত মনে হয়না। এত বয়সে তুই নির্লজ্জের মতো কী করে বেড়াচ্ছিস, তা আর কেউ না জানুক, আমি ভালো করেই জানি। বেশ করে ভেবে বলতো দেখি, কি শাস্তি হলে তোর ঠিক উপযুক্ত হয়। গুরুগম্ভীর শব্দে এই কথা শুনে নারিশাবাবা চোখ খুলে আগন্তুকের দিকে তাকালো। তার সামনে দণ্ডায়মান দীর্ঘদেহী জটাজুটধারী দেহে দীপ্ত আভা সমন্বিত এক যোগীপুরুষ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না নারিশাবাবা। তার দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বুকের গভীর থেকে এক উদত্ত কান্নার রোল এসে তার চক্ষুকে প্লাবিত করতে লাগলো। তার মনে হল সেই আগন্তুকের সামনে যেন সে নিজের সব সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। সে সেই যোগীপুরুষের চরণে লুটিয়ে পড়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলো। সেদিনের সেই আগন্তুক যোগীপুরুষ ছিলেন মহাযোগী ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।


বাবা লোকনাথ নারিশাবাবার প্রায় অবসন্ন দেহটিকে তুলে পরম স্নেহে তার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, তোর কোনো ভাবনা নেই। এখন থেকে তোর সব ভার আমার। এখান থেকে আমি বারদী গ্রামে যাব। ছাগলবাঘিনী ঘাটের কাছে মেঘনা নদীর তীরে শ্মশানভূমিতে আমার স্থান নির্দিষ্ট আছে। সেইখানে সন্ধান করলে আমাকে পাবি। আগে জননীর প্রতি তোর শেষ কর্তব্যটা করে আয়। আগামী পূর্ণিমার দিন তোর মা দেহ রাখবেন। তার সেবা করার জন্য আর দিন দশেক সময় পাবি। নানাভাবে এতদিন ধরে যা জমিয়েছিস, এই সুযোগে তা সমস্ত ব্যয় করে হালকা হয়ে তুই আমার কাছে ফিরে যাবি। এই কথাগুলি বলে বাবা লোকনাথ অন্তর্হিত হলেন।


সেইদিনই বাবা লোকনাথের উপদেশ শিরোধার্য করে নারিশাবাবা সাধুব্যবসা গুটিয়ে ফেলে ট্রেনে চেপে তার নিজের গ্রামে রওনা হলেন। গ্রামে পৌঁছে মাকে খুঁজে বার করে অক্লান্ত পরিশ্রমে তার সেবা করলেন। তারপর তার মা দেহত্যাগ করলে মায়ের শ্রাদ্ধ করে তার পাপপথে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করলেন। তার কাছে সম্বল রইল কেবল বারদী পৌঁছবার পথের খরচ।


নারিশাবাবা বারদী পৌঁছলে বাবা লোকনাথ তাঁকে সত্যকারের সাধুরূপে নিজের হাতে গড়ে তোলেন। নারিশা বাবা তার পূর্বের সাধুজীবনের সব অসৎ কাজ পরিত্যাগ করেছিলেন, কেবল গাঁজা সেবন ছাড়া। আশ্রমে তিনি লুকিয়ে গাঁজা সেবন করতেন। বাবা লোকনাথ সেই কথা জানতেন। একদিন বাবা নারিশাবাবাকে ডেকে বলেন, হারে নারিশা, গাঁজার নেশাটাও তুই ছেড়ে দিলি! বাবার এই কথায় হতচকিত হয়ে নারিশাবাব বলেন, বাবা অপরাধ নিবেন না। আপনার কৃপায় গাঁজা সেবন ছাড়া বাকি সবই আমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন যদি বলেন তো গাঁজা খাওয়াও ছেড়ে দেবো। বাবা তখন স্মিত হেসে বলেন, তোর মতো অনেকেরই সবকিছু আমি গ্রহণ করেছি। কোনো চিন্তার কারণ নেই। তোকে গাঁজা খাওয়া ছাড়তে হবে না। যত খুশি গাঁজা খা। তবে তা লক্ষ্য করার জন্য আমি সর্বদা পাহাড়ায় থাকব। গাঁজা যেন তোকে না খায় তা দেখার দায়দায়িত্ব আমারই থাকবে।


এই নারিশাবাবা বারদী আশ্রমের এক প্রধান সেবক ছিলেন যাকে বাবা লোকনাথ নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন। যতদিন বাবা ধরাধামে ছিলেন, একদিনের জন্যেও নারিশাবাবা তার কাছ ছাড়া হননি এবং তাঁর দেহত্যাগের পরও তার সুখস্পর্শ স্মৃতিকে বুকে নিয়েই তিনি আশ্রমের সেবা করে গেছেন। বাবা যে তার সমস্ত পাপকার্য নিজে গ্রহণ করে তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। তার মতো ভাগ্যবান কজন আছে?


.


চন্দ্রকিশোর চক্রবর্তী


ঢাকা, বিক্রমপুর নিবাসী চন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীর ইচ্ছা ছিল তিনি সিদ্ধিলাভ করে একজন মহাপুরুষ হবেন। তার মনের ঐকান্তিক বাসনা ছিল যে তিনি লোকসমাজে একজন মহাপুরুষ রূপে আদৃত হবেন। সেই ইচ্ছা পূরণের আশায় তিনি অনেক সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গে সঙ্গত করেছেন। কিন্তু তার আকাঙ্খিত সিদ্ধি হস্তগত হয়নি। মনে গভীর অতৃপ্তি নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। একদিন লোকমুখে তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার অমিত যোগশক্তির কথা শুনতে পান। তিনি বিভিন্ন লোকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে ওই ব্রহ্মচারীর যোগবিভূতির কোনো সীমা নেই। লোকমুখে বারদী ব্রহ্মচারীর কথা শুনে তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং মনে বল পেলেন যে, এই মহাযোগীর কৃপা লাভ করতে পারলেই তিনি যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন। তাই কালবিলম্ব না করে তিনি বাবা লোকনাথের কৃপালাভের জন্য বারদীর আশ্রমে উপস্থিত হলেন। আশ্রমে এসে তিনি বাবাকে দর্শন করে প্রণাম করলেন। তারপর কোনো কথা না বলে আসন ঘরের বারান্দার এক কোণে উপবাস করে নীরবে হত্যে দিয়ে পড়ে রইলেন। তিনি কেন এসেছেন সে কথা বাবাকে বললেন না এবং তিনি যে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন সে সম্বন্ধে বাবাও কারোকে কিছু বললেন না। উভয়েই নীরব রইলেন। এইভাবে আটদিন উপবাসে কাটলো। চন্দ্রকিশোর জলও স্পর্শ করলেন না। বাবাও তাকে কিছু বললেন না। তিনি কেবল নীরবে চন্দ্রকিশোরের ভক্তি, সংযম ও তিতিক্ষার পরীক্ষা করতে লাগলেন। নয়দিনের দিন চন্দ্রকিশোর পিপাশায় যন্ত্রণাকাতর হলেন কিন্তু জল গ্রহণ করলেন না। চন্দ্রকিশোরের যন্ত্রণা বাবা অনুভব করলেন এবং ভক্তের যন্ত্রণায় তিনি অতিশয় কাতর হয়ে এক ভক্তকে ডেকে তার খাবারের ব্যবস্থা করলেন।


চন্দ্রকিশোর খাদ্য-পাণীয় গ্রহণ করে বাবার সম্মুখে গেলে বাবা তাকে বসতে বললেন। চন্দ্রকিশোর বাবার চরণবন্দনা করে বসলেন। বাবা তাঁর মধ্যে আশীর্বাদ সঞ্চারিত করলেন। সেই আশীর্বাদের সঙ্গে বাবা কিছু যোগশক্তি চন্দ্রকিশোরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন। বিনা আয়াসে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাযোগীর থেকে চন্দ্রকিশোরের মধ্যে কিছু যোগশক্তি সঞ্চারিত হলো। সবই হল নীরবে। কেউ কোনো কথা বললেন না। এরপর চন্দ্রকিশোর বাবাকে প্রণাম করে তার অনুমতি নিয়ে বিক্রমপুর ফিরে গেলেন।


বিক্রমপুরে ফিরে গিয়ে চন্দ্রকিশোর প্রচার করলেন যে, তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার যোগশক্তির অধিকারী হয়েছেন। বাবা লোকনাথের নাম করে তিনি বহু লোকের দূরারোগ্য ব্যাধি সারাতে থাকেন। সেইসব রোগমুক্ত ব্যক্তিরাই চন্দ্রকিশোরের নাম সারা ঢাকায় প্রচার করে। চন্দ্রকিশোরের যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।


এই যশ ও প্রচার চন্দ্রকিশোরের মধ্যে অহংভাবের সৃষ্টি করে। তিনি ভুলে যান যে বাবা লোকনাথ তাঁর মধ্যে সামান্য যোগশক্তি সঞ্চারিত করেছেন। মূল শক্তির অধিকারী মহাযোগী বাবা লোকনাথ। তিনি নিজেকে একজন বড়ো যোগীপুরুষরূপে ভাবতে থাকেন এবং সেইভাবে প্রচারে উৎসাহ দিতে থাকেন। এই অহঙ্কার বোধ ও যশের মোহই তার কাল হয়। অল্পদিনের মধ্যেই বারদীর ব্রহ্মচারীর দেওয়া যোগশক্তির ক্ষয় হতে থাকে এবং একদিন তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। চন্দ্রকিশোর ভুলে গিয়েছিলেন যে, তিনি বিধিবদ্ধ কোনও তপস্যার দ্বারা এই যোগসিদ্ধি অর্জন করেননি। বাবা লোকনাথ লোককল্যাণ হেতু তার মধ্যে কিছু যোগশক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন। কিন্তু চন্দ্রকিশোর সেই যোগশক্তিকে নিজের যশলাভ হেতু ব্যবহার করেছেন এবং সেই শক্তিদাতাকেই অবজ্ঞা করেছেন। যখন তার মধ্যে সমস্ত শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল, তখন তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চন্দ্রকিশোরের কীর্তি লোকমুখে বারদীতে পৌঁছেছিল। বাবা লোকনাথ তখন বুঝলেন যে চন্দ্রকিশোর তার কাছে যোগশক্তি সঞ্চয়ের জন্য এসেছিলেন কেবল নিজের নাম-যশ অর্জন করার জন্য, মানবকল্যাণের জন্য নয়। চন্দ্রকিশোরের সিদ্ধিলাভের বাসনার পিছনে আধ্যাত্মিক গভীরতা ছিল না। ছিল কেবল নাম-যশ লাভের উচ্চাকাঙ্খা। তিনি চন্দ্রকিশোরের মনের এই অবস্থা সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। এবং সেইজন্যই তাকে আটদিন উপবাসে রেখে তার শরীরকে ক্লীষ্ট করে মনকে সিদ্ধিলাভের উপযোগী করার চেষ্টা করেছিলেন। বাবা লোকনাথ চন্দ্রকিশোরকে যৎসামান্য যোগশক্তি দান করেছিলেন। কিন্তু এই যৎসামান্য শক্তির প্রভাবেই চন্দ্রকিশোর নিজেকে একজন বড়ড়া যোগী ভাবতে থাকেন ও যশলাভের জন্য প্রচার করতে থাকেন। তার মধ্যে এই যৎসামান্য শক্তি ধারণ করার ও রক্ষা করার শক্তি ছিল না। আসলে তার মধ্যে সাধনার জমিই প্রস্তুত ছিল না। কঠোর তপস্যা ও যোগসাধনা ভিন্ন যোগশক্তি ধারণ করা যায় না। যৎসামান্য শক্তি সঞ্চারিত করে চন্দ্রকিশোরকে বাবা লোকনাথ সেই শিক্ষাই দান করেছিলেন।


আজকের ভঙ্গুর সমাজে আমরা এইরূপ ঘটনার অজস্র উদাহরণ দেখতে পাই। যদি কেউ সামান্য সাধনায় সামান্য কিছু সিদ্ধি অর্জন করে থাকেন, তবে তিনি নিজেকে একজন মহাশক্তিধর সিদ্ধযোগী বলে প্রচার করতে থাকেন। যিনি কঠোর তপস্যা ও যোগসাধনার মাধ্যমে যোগসিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনি সর্বদা প্রচার বিমুখ হবেন। তপস্যার শিক্ষাই হল যোগী কখনও তার সিদ্ধির প্রচার প্রকাশ্যে করবেন না। বাবা লোকনাথের মতো উচ্চকোটির অমিত যোগশক্তির অধিকারী কোনো যোগী আমি সমগ্র নর্মদা পরিক্রমা করে এবং হিমালয় ভ্রমণ করে মাত্র দুজনকে জেনেছিলাম। যাঁদের আসন-গুহায় প্রবেশ করে তাদের শ্রদ্ধা জানাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।


এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় নর্মদা তটের একটি ঘটনার। মায়ুর কল্পে অমরকন্টকের নর্মদা তটে মহামুণি মার্কণ্ডেয় বাল্যাবস্থা থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত মহাদেবের সাধনায় রত ছিলেন। তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে শিব-পার্বতী যখন তাকে দর্শন দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন, তখন মুণি মার্কণ্ডেয় বলেন, প্রভু যদি আপনি আমার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আমাকে অমর করে দিন। যাতে আমি যুগ যুগ ধরে মানবকল্যাণতরে যোগসাধনা করে যেতে পারি। তার আকাঙ্ক্ষায় তুষ্ট হয়ে শিব মহামুনিকে সপ্তকল্প অমর থাকার বরদান করেন। মহামুনি সপ্তকল্প জীবিত থেকে মানবকল্যাণের জন্য যোগসাধনা করেন।


যোগসাধনা এবং তার ফলশ্রুতি রূপে প্রাপ্য যোগবিভূতি মানবকল্যাণের জন্য হয়। ব্যক্তিগত নাম-যশ-মুনাফা অর্জনের জন্য নয়। যারা যোগসাধনালব্ধ ফল ব্যবসায়িক কারণে অথবা ব্যক্তিগত হিতে ব্যবহার করেন, যোগশক্তি বা ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি সে স্থানে বাস করে না। বাবা লোকনাথ তাঁর অমিত যোগশক্তি কেবল মানবকল্যাণের জন্যই ব্যবহার করেছেন। কখনও সেই যোগশক্তি ব্যবহার করার জন্য কোনো মূল্য গ্রহণ করেননি। বা নিজের নাম-যশ প্রচারও করেননি। তার কাছে ধনী-দরিদ্র-জমিদার-রাজা সব সমান ছিল। আর্থিক মাপকাঠিতে তিনি ভক্তদের বিচার করতেন না। ভক্তদের তিনি সর্বদা সদুপদেশ দিতেন যাতে তাদের কল্যাণ হয়। এরূপ দৃষ্টান্ত বর্তমান সমাজে মেলা কঠিন। এখন প্রচারের যুগ। সবাই কেবল প্রচার চায় আর যোগবিভূতিকে অর্থের তরাজুতে মূল্যায়ণ করে। এরূপ ব্যক্তিদের মধ্যে তো ব্রহ্মজ্ঞান আশা করা যায় না। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথ তো তার ভক্তদের জন্য হৃদয়াসন পেতেই বসে আছেন। তবে কেন আমরা মেকিদের পিছনে ঘুরি!


.


কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন


তৎকালীন পূর্ববাংলার একজন সুপণ্ডিতরূপে পরিচিত ছিলেন কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয়। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ ব্রাহ্মণ বংশীয় এবং তপস্বী। গুরুকূলে বাস করে বিধিবদ্ধভাবে ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠান করে তিনি বেদ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র বিশারদ হয়েছিলেন। তিনি গুরুকুলে নিত্যব্রত অনুষ্ঠান দ্বারা তপস্যা ও যোগসাধনায় ব্রতী হয়ে একজন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ হয়েছিলেন। যোগসাধনার মাধ্যমে তিনি তাঁর পঞ্চভূত দেহের সব রিপুগুলিকে জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার মধ্যে কোনো বিষয়ভোগের’ বাসনা ছিল না। গুরুকুলে শিক্ষান্তে তিনি গৃহাশ্রম ধর্মে প্রবৃত্ত হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কারও থেকে কখনও তিনি দান বা প্রতিগ্রহ গ্রহণ করতেন না। তাঁর মনে বিষয় ভাবনার পরিবর্তে ছিল আধ্যাত্মিক বাসনা। তার মধ্যে আধ্যাত্মিক পিপাসা প্রবল ছিল। পূর্ববাংলায় তার অনেক শিষ্য ছিল।


বিদ্যারত্ন মহাশয় বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার নাম শুনে দর্শন করতে আসেন এবং প্রথম দর্শনেই তার নজরে পড়েন। তিনি এরপর প্রায়ই তার আধ্যাত্ম পিপাসা নিবারণার্থে বাবা লোকনাথের কাছে আসতেন এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করতেন।


একদিন বিদ্যারত্ন মহাশয় আশ্রমে এসে আসন-ঘরের বাইরে থেকে বাবাকে প্রণাম নিবেদন করতেই ভিতর থেকে বাবা পরম স্নেহে বলে ওঠেন কালীপ্রসন্ন, নিদারুণ অর্থাভাবে তোর এখন দিন কাটছে, না রে? হাতে টাকা পয়সা কিছু নেই। তুই ভাবিস না। আমার কাছে অনেক টাকা রয়েছে। তুই সেগুলো নিয়ে যা।


বিদ্যারত্ন মহাশয় আসন-ঘরে ঢুকে বাবার চরণ স্পর্শ করে বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর আপনি অষ্টাদশসিদ্ধি এবং পাঁচটি সামান্য সিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই আপনার তো টাকা পয়সার অভাব থাকতে পারে না। কিন্তু আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। দারিদ্র্য আমার সহচর। তবু আমার টাকা পয়সার দরকার নেই।


এই কথা শুনে বাবা অত্যন্ত খুশি হলেন। তবু নিজের কম্বলাসন উঠিয়ে তাকে দেখালেন। বিদ্যারত্ন মহাশয় দেখেন আসনের নিচে অনেক টাকা। তিনি বুঝলেন, যিনি আজন্ম ব্রহ্মচারী, টাকা পয়সায় কোনোদিন হাত দেননি, তাঁর আসনের নিচে এত টাকা কোথা থেকে আসবে। এটা বাবার এক অলৌকিক লীলাখেলা। তিনি বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর, আপনার যোগৈশ্বর্য আপনারই থাকুক। ওতে আমার দরকার নেই। আশীর্বাদ করুন যেন আমার ভগবৎ ঐশ্বর্য লাভ হয়।


বাবা বিদ্যারত্ন মহাশয়কে পরীক্ষা করছিলেন। তার মুখে এই কথা শুনে তিনি খুব খুশি ও তৃপ্ত হলেন। তাঁর কাছে ভক্তরা কেবল বিষয়ভোগ বাসনার আর্জি নিয়ে আসে। কেউ ভগবৎ-ঐশ্বর্য পাবার বাসনায় আসে না। কিন্তু কালীপ্রসন্ন ভগবৎ-ঐশ্বর্য পেতে এসেছেন। তিনি এতে খুব খুশি। যার অন্তর তপস্যাবলে শুদ্ধ হয়, তার বাসনাও ক্রিয়াহীন হয়। যার মধ্যে ঈশ্বরবাসনা থাকে, তার মধ্যে যোগ বাসনা থাকে না। তিনি আসনের নিচে অনেক অর্থ দেখিয়ে তা দান করতে চাইলেও কালীপ্রসন্ন কোনো আগ্রহ দেখালেন না, বরং বললেন, আপনার যোগৈশ্বর্য আপনারই থাক। অর্থাৎ অর্থ দেখেও কালীপ্রসন্ন বুঝতে পেরেছে যে সেটা বাবার যোগৈশ্বর্য। সাধারণ লোক এইরকম দেখলে মনে করবে বাবা লোকনাথ ভক্তদের কৃপা বিতরণ করে অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন। তারা বাবার যোগৈশ্বর্যের নাগাল পাবে না। সেজন্য বাবা লোকনাথের মতো এমন উচ্চ ঈশ্বরকোটির ব্রহ্মচারীর কৃপালাভ করার জন্য ভক্তের অন্তরের জমি তৈরি করা প্রয়োজন। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের ওইদিনের ঘটনার মাধ্যমে বাবা এই লোকশিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ভক্তগণ তা বুঝতে পেরেছে কি?


নর্মদা পরিক্রমার সময় আমি দুটি জায়গায় দুজন সিদ্ধ যোগীর সম্মুখীন হয়েছিলাম। যাঁরা আমাদের মনের ইচ্ছামতো বর প্রার্থনা করতে বলেন। কিন্তু আমরা কেবল মা নর্মদা ও শিবশঙ্করের আশীর্বাদ ভিন্ন অন্য কোনো বর কারও কাছে চাইনি। যদিও আমাদের বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। গুরুদেবের থেকে যে সামান্য জ্ঞান সঞ্চয় করে পরিক্রমায় বেরিয়েছিলাম, তাতে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প ছিল যে ঈশ্বরের কৃপা ভিন্ন অন্য কোনোকিছু আমরা গ্রহণ করবো না। তপস্যার এটি মূল মন্ত্র। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয় যেহেতু একজন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ ছিলেন, সেইজন্য তিনি তপস্যার মূল মন্ত্রটি ভালোভাবে জানতেন এবং বাবা লোকনাথের কাছে কেবল ভগবৎ ঐশ্বর্য প্রার্থনা করেছিলেন। বাবার এমন ভক্ত খুব কমই ছিল।


এরপরে আর একদিনের কথা। বিদ্যারত্ন মহাশয় বারদীর আশ্রমে এসেছেন বাবার কাছে বিদায় নিয়ে কাশী চলে যাবেন বলে। তিনি যখনই বাবার ঘরের দরজায় পৌঁছলেন, ভিতর থেকে বাবা বলে উঠলেন, কীরে কালীপ্রসন্ন, শেষে মনের দুঃখে কাশীবাসী হতে চলেছিস?


বিদ্যারত্ন মহাশয় আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এই অন্তর্যামী মহাপুরুষের অজ্ঞাত কিছুই নেই। যে কথা তিনি বলবার জন্য এসেছেন, কিন্তু এখনও কারোকে বলেননি, সে কথা বাবা তাকে দেখা মাত্রই কী করে জেনে গেলেন? বিদ্যারত্ন মহাশয় বাবাকে বললেন, আগামী মাসেই চলে যাব ঠিক করেছি। আপনার কি অভিমতো তাই জানতে এসেছি।


বাবা লোকনাথ তখন বললেন, এ মাসে তোর মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসছে মাসে চলে যাবি–এই তত তোর ইচ্ছে? হারে তোর পুত্র সন্তান নেই বলেই কি এই অভিলাষ? তোর মনে দুঃখ, তাই বৈরাগ্য। তোর কাশী যাওয়া হবে না। তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাকবি। আমি তোর ঘরে ছেলে হয়ে জন্মাব। বাবার কথা শুনে বিদ্যারত্ন মহাশয় যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তার মনের গভীরে যে দুঃখ-ব্যথা লুকিয়ে আছে, বাবা সেকথা জানতে পেরেছেন। পরম করুণাময় বাবা তাঁর অলৌকিক শক্তির দ্বারা সেই দুঃখের অবসান করবেন বলেছেন। এজন্যই বলে ভক্তের জন্যই ভগবান। ভক্তের দুঃখে ভগবানের প্রাণ কাঁদে। বাবার এই অযাচিত কৃপালাভ করে বিদ্যারত্ন মহাশয় কাশী যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু তারপরও বাবাকে বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর, আপনি আমায় আবার কেন সংসারে আবদ্ধ করছেন?


 বাবা লোকনাথ তখন বললেন, কালীপ্রসন্ন, তুই তো ব্রহ্মনিষ্ঠ। ব্রহ্মচর্য ব্রতানুষ্ঠানের পর গৃহাশ্রমী হয়েছিস। ব্রহ্মচর্য ও ধর্মজ্ঞান শিক্ষা করলে চিত্ত বিশুদ্ধ হয়। চিত্ত বিশুদ্ধ হলে যদি কেউ সংসার ধর্ম পালন করে, তাহলে সংসার বন্ধন হয় না। আমি জানি তোর গৃহে ভোগাসক্তি নেই। মনে রাখিস, কর্তব্যের খাতিরে সংসারধর্ম প্রতিপালন ও সন্তান প্রজনন করেও সেই পরম পদে ভক্তি স্থির রাখলে ভোগের মধ্যে গৃহীর চিত্ত আকৃষ্ট বা আবদ্ধ হয় না। আমি শুনেছি তোর স্ত্রীও ভক্তি পরায়ণা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভক্ত হলে তাতে কখনও বিষয়াশক্তি পাপ উপস্থিত হতে পারে না।


বাবা লোকনাথের বিদ্যারত্ন মহাশয়কে এই কথা বলার এক নিগূঢ় অর্থ আছে। পরমাত্মা ও জীবাত্মা একই বস্তু। ব্রহ্মচর্য অনুষ্ঠানের দ্বারা বিশুদ্ধ চিত্ত হলে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সাক্ষাৎ হয়। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন ব্রহ্মচর্য পালন করে গুরুগৃহে ব্রতানুষ্ঠানের দ্বারা নিজের চিত্তকে বিশুদ্ধ করেছেন। তিনি অবিদ্যাজনিত ক্লেশগুলিকে বিনাশ করে নিজের জীবাত্মায় পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হয়েছেন। সেইজন্য তিনি ব্রহ্মজ্ঞ যোগীশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই পরমতত্ত্ব বুঝতে পারলেন। বুঝলেন, বাবা লোকনাথ কিভাবে তাকে সংসারী করেও মনে অনন্ত সুখের সন্ধান দিলেন। কৃতজ্ঞতায় তার মস্তক অবনত হলো। তিনি বাবার আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ির পথে অগ্রসর হলেন।


বাড়ি যেতে যেতে তিনি ভাবলেন, যতক্ষণ জীবাত্মা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, ততক্ষণ সে জীবনের আসল সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না। সংসারের মায়ার বন্ধনেই সে আবদ্ধ থাকে। যখন ঈশ্বরের করুণাময় জীবাত্মা সেই মায়ার বন্ধন হতে মুক্ত হয়, তখন সংসারে থেকেও সে বন্ধনহীন থাকে। ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট মহামায়ার এই বন্ধন কেবল একজন পরমব্রহ্ম মহাপুরুষই ছিন্ন করতে বা করাতে পারেন। আজ বাবা লোকনাথকে তিনি সেই পরমব্রহ্ম মহাপুরুষরূপেই দর্শন করলেন। বাবার কৃপায় আজ তাঁর জীবাত্মার সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন হলো। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয়ের ব্যক্তিগত জীবনে তপশ্চারণ ও ব্রতানুষ্ঠানের মাধ্যমে যে জমি প্রস্তুত করেছিলেন, আজ বাবা তাতে সুরভিত ফুলের বীজ বপন করে দিলেন। তার মধ্যে এই জমি প্রস্তুত ছিল বলেই তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী পরমপুরুষরূপে দেখতে সমর্থ হলেন। এ তার অতীব সৌভাগ্য। তাঁর মন আজ আনন্দময় হয়ে উঠেছে এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কৃপায়। তিনি পুনঃ পুনঃ প্রণাম জানাতে থাকেন তার পরমপুরুষকে।


.


অভয় ব্রহ্মচারী


অভয়াচরণ চক্রবর্তী তৎকালীন বাংলার ময়মনসিংহ জেলার সদর রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করতেন। তার নিবাস ছিল ওই শহর সংলগ্ন হরিশচন্দ্রপট্টি গ্রামে।


স্ত্রী-পুত্র ও এক বড়ো ভাই নিয়ে তার পরিবার। ধর্মে মতি ছিল। ঈশ্বর দর্শনের বাসনা তার মধ্যে ক্রমে ক্রমে তীব্র হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন তিনি কারোকে কিছু না বলে গৃহত্যাগ করলেন। তারপর থেকে দীর্ঘদিন তার কোনো খবরই ছিল না।


১৭ বছর পরে অনেক পাহাড়-পর্বত ভ্রমণ করে একদিন তিনি ব্রহ্মচারীরূপে ঘরে ফিরে এলেন। সংসারে তার মন ছিল না। সর্বদাই তিনি যেন কীসের চিন্তায় মগ্ন থাকেন। শিব চতুর্দশীর কয়েকদিন আগে তিনি ময়মনসিংহ জজকোর্টের এক পরিচিত উকিলের বাড়িতে এসে বলেন যে, তাঁর শিবরাত্রির দিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তীর্থে যাবার খুব বাসনা হয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে যেতে পারছে না। চন্দ্রনাথ তীর্থ (বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে পড়ে)। সেখানে শিবরাত্রিতে বহুভক্তের সমাগম হয়। অভয়াচরণের মনের বাসনা ছিল সেখানে শিবদর্শনে যাবার। তাঁর কথা শুনে উকিলবাবু তাঁকে বললেন, অভয়াচরণ, আপনি তো চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পাষাণ শিবের পূজা করতে যেতে চাইছেন। এক কাজ করুন না। ঢাকা জেলায় বারদী গ্রামে এক অলৌকিক যোগশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ এসেছেন, যাঁকে সকলে সচল শিব বলেন। তাকে দর্শন করে আসুন। আপনার চিত্ত আনন্দিত হবে। তিনি অভয়চরণকে পাথেয় হিসাবে কিছু অর্থও প্রদান করলেন। উকিলবাবুর কথামতো অভয়াচরণ পথে বেরিয়ে পড়লেন এবং শিব চতুর্দশীর দিন সচল শিব দর্শনের জন্য নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে বারদী গ্রামের পথে অগ্রসর হলেন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছতে তাঁর অনেক ধকল গেছে। গঞ্জিকা সেবন করা তাঁর একটি অভ্যাস ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ উপবাসে থেকে সচল শিবের পূজা করবেন বলে তিনি পথে একবারও গাঁজা সেবন করেননি। বারদী গ্রামে যাবার পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়েও তার গাঁজা সেবন করার প্রবল ইচ্ছা জাগলেও তিনি মনের দৃঢ়তায় সেই ইচ্ছাকে দমন করে রাখেন। অবশেষে তিনি বারদী আশ্রমদ্বার দেখতে পান।


বাবা লোকনাথ তখন ভক্তপরিবৃত হয়ে আসন ঘরে বসেছিলেন। হঠাৎ তিনি ভক্তদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়েন। ভক্তেরা এর কোনো কারণ অনুধাবণ করতে পারলেন না। একটু পরে আবার বাবা হাত নেড়ে ভক্তদের ঘরের প্রবেশ দ্বার থেকে সরে যেতে ঈশারা করেন। ভক্তরা তখন বুঝতে পারেন, বোধহয় বাইরে থেকে কোনো সাধুজন বাবার সাক্ষাতের জন্য আসছেন। তারা প্রবেশদ্বার থেকে সরে বসেন। এরপর বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেন একজন সাধু দ্রুতগতিতে বাবার ঘরের দিকে আসছেন। তখন তারা বুঝতে পারেন যে অন্তর্যামী বাবা এই সাধুর প্রবেশের পথের জন্য তাদের দ্বারের প্রবেশপথ থেকে সরে বসতে ইশারা করছিলেন।


অভয়াচরণ ঘরে প্রবেশ করে বাবার সম্মুখে গিয়ে প্রণাম নিবেদন করে আসন গ্রহণ করতে যাবেন, এমন সময় ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, হ্যাঁরে অভয়াচরণ, আজ তোর এখানে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে তো?


অভয়াচরণ মনে করলেন, ব্রহ্মচারী বাবা বোধহয় তার পথশ্রমের কথা বলছেন। কিন্তু পরক্ষণেই বাবা বললেন, অভয়াচরণ একটু গাঁজা সেজে নিয়ে আয় তো। এবার তার মনের ভুল ভাঙ্গলো। অবাক হয়ে তিনি ভাবতে থাকেন যে, ব্রহ্মচারী বাবা তার নাম কি করে জানলেন? তিনি তো আগে কখনও এখানে আসেননি বা তার পরিচিত কেউও এখানে নেই। তাছাড়া তিনি যে গাঁজা সেবন না করে এতটা পথ এত কষ্ট করে এসেছেন, সে কথাই বা বাবা কি করে জানলেন? বাবা কি করে জানলেন যে তিনি গাঁজা সেবন না করে থাকতে পারেন না? বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গাঁজা নিয়ে আসতে যান। বাবা লোকনাথ তখন গীতা নিয়ে বারান্দার এক কোণায় এসে বসেন।


ব্রহ্মচারী বাবার আদেশ পেয়ে অভয়াচরণ ভালো করে গাঁজা সেজে নিয়ে এসে দেখেন যে বাবা বারান্দায় বসে গীতাপাঠ করছেন। তিনি বাবার সামনে এসে বসেন। সেইসময় এক দমকা হাওয়ায় গাঁজার কলকের ধোঁয়া গিয়ে বাবার নাকে প্রবেশ করে। বাবা তখন অভয়াচরণকে বলেন, নে তুই এবার গাঁজা সেবন কর। অভয়াচরণ অবাক বিস্ময়ে দেখেন হাওয়ায় গাঁজার ধোঁয়া কেবল বাবার নাকেই প্রবেশ করছে, অন্য কোনোদিকে যাচ্ছে না। তিনি বাবাকে বলেন, বাবা, আপনি প্রসাদ করে দেবেন না? বাবা বললেন, প্রসাদ করা হয়েছে। অভয়াচরণ তখন বুঝলেন, বাবার ইচ্ছাশক্তিতে গাঁজার কলকের ধোঁয়া হাওয়ায় বাবার নাকে প্রবেশ করে প্রসাদহয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন, বাবা লোকনাথ কে কেন লোকে সচল শিব বলেন। বাবার আজ্ঞায় তিনি আনন্দিত হয়ে গাঁজা সেবন করতে থাকেন। গাঁজা সেবন করতে করতে অভয়াচরণ ভাবতে থাকেন, তার চন্দ্রনাথ তীর্থে শিবচতুর্দশীর দিন যাবার বাসনা ছিল। অর্থভাবে যাওয়া হল না। যদি তিনি চন্দ্রনাথ তীর্থে যেতেন, তবে এমন শিবযোগী মহাপুরুষ দর্শন করতে পারতেন না। বারদী আশ্রমে এসে যেন তার সাক্ষাৎ ব্রহ্মদর্শন হলো। এত বছর পাহাড়-পর্বতে ভ্রমণ করে যে শক্তির সন্ধান করেছেন, আজ বারদী গ্রামে এসে তার সাক্ষাৎ হলো। আর তার পাহাড়-পর্বতে যাবার প্রয়োজন নেই। তার মনে হল এখানে আসার পর যা ঘটছে, তাতে মনে হয় তিনি এই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের শরণ পথেই আছেন। তিনি নিজে এক আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন এবং আশ্রমে রাত্রিবাস করলেন। রাতে তিনি মনে মনে ভাবলেন, কাল প্রত্যূষে এই সচল শিবের কৃপা ভিক্ষা করবেন।


পরদিন সকালে বাবাকে দর্শন করে, প্রণাম করে তিনি বাবার কৃপা ভিক্ষা করলেন। বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, তুই নিজেই তো একজন ব্রহ্মচারী, তুই আবার আমার কাছে কৃপা ভিক্ষা করছিস কেন? অভয়াচরণ নিজেকে অভয় ব্রহ্মচারী রূপে পরিচয় দেন। ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী’ শব্দের প্রকৃত অর্থ অবহিত আছেন। বেদ অর্থে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী সারা জগৎকে ধারণ করেন। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যে পথে চলেন, স্বয়ং দেবতারাও তাকে পথ করে দেন। কেবলমাত্র গেরুয়া বসন ধারণ করে সন্ন্যাসী হলে ব্রহ্মচারী হওয়া যায় না। জগৎ ধারণ ও পালন করার কর্তব্যও তাকে পালন করতে হয়। সেইজন্যই বাবা অনেককে বলতেন, আমি যেদিকে তাকাই কেবল আমাকেই দেখি। একজন ব্রহ্মচারী সারা জগৎ পরিব্যাপ্ত করে থাকেন। অভয় ব্রহ্মচারী সেই অর্থে এখনও ব্রহ্মচারী হননি। পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ালেও তিনি কর্মযোগে প্রবৃত্ত নন। তাই বাবা তাকে বলেছেন, তুই তো নিজেই ব্রহ্মচারী, তবে আমার কৃপা চাইছিস কেন? একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী নিজেই ব্রহ্ম। তিনি অন্যদের কৃপা করেন, কিন্তু তার কারও কৃপার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অভয় ব্রহ্মচারী কি বাবার কথার এই গূঢ় অর্থ বুঝতে সক্ষম হবেন! অভয় ব্রহ্মচারী মনে মনে ভাবলেন, বুঝেছি ঠাকুর, আপনি ধরা দিতে চান না। তা তো হবে না। যাঁকে দেখবার জন্য আহার, নিদ্রা, পিপাসা সব ত্যাগ করে ছুটে এসেছি, মহাতীর্থ চন্দ্রনাথে না গিয়ে সচল শিবের দর্শন ও কৃপালাভের আশায় উন্মত্ত হয়েছি, সেই পরম শিবময় পুরুষ আমায় প্রত্যাখ্যান করবেন, এটা হতে পারে না। যে জীবন্ত শিবের কৃপালাভের আশায় আমি ক-দিন ধরে উপবাস করে আছি, আজ দেখি কি করে তিনি আমায় প্রত্যাখ্যান করেন। যদি আমার ভক্তি একনিষ্ঠ হয়, তবে তার সাধ্য কি ধরা না দিয়ে যান।


অভয়াচরণের কৃপা ভিক্ষার আর্জিতে বাবা আর কোনো সাড়া দিলেন না। অভয়াচরণ তখন বাবার দুয়ারে তিনবার মাথা ঠুকে আশ্রম ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। মনে গভীর বেদনা নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে আশ্রমের দ্বারের দিকে চলেছেন। এমন সময় উপস্থিত ভক্তগণের মধ্যে একজন উকিল বাবাকে বললেন, বাবা উনি তো গতকাল থেকে এখানে উপোস করে আছেন। শিবচতুর্দশীর উপোস করে প্রসাদ না খেয়ে উনি আশ্রম ছেড়ে যাচ্ছেন কেন? তখন বাবা লোকনাথ বললেন, ওকে বসতে বল। ওর আহারের জন্য এখনি আহার মিলবে।


বাবার এই কথা অভয়াচরণকে বললে তিনি ব্যথিত হয়ে চড়া গলায় বাবাকে শুনিয়ে বলেন, আমি বামুনের ছেলে। দু-একদিন না খেলে মরবো না। খুব ক্ষিদে পেলে তিন বাড়ি ঘুরে তিন মুঠো চাল পেলে নিজে রান্না করে খাব। আমি এখানে খেতে আসিনি। যে জন্যে আমার এখানে আসা, তাই যদি না পেলাম, তবে কি জন্যে এখানে থাকবো? অভয়াচরণ প্রচণ্ড গাঁজাসক্ত ছিলেন। গাঁজা সেবন না করে থাকতে পারতেন না। তবুও তিনি বাবার আজ্ঞায় একবার ভিন্ন সেই ঘর হতে বার হওয়া থেকে এখন অবধি আর গাঁজা সেবন করেননি। শরীরের সব কষ্ট সহ্য করেছেন কেবল এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কৃপা লাভের আশায়। বাবা যখন তাঁকে নিজে গাঁজা সেজে আনতে বলেছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন, এখানে তার অভিষ্ট অবশ্যই পূরণ হবে। কিন্তু পরদিনই কেন তিনি কৃপাভিক্ষা মঞ্জুর করলেন না, সেটাই অভয়াচরণ বুঝতে পারছেন না। তাঁর মনের মধ্যে সব গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।


এদিকে বাবা অভয়াচরণকে কঠিন পরীক্ষা করছেন। ১৭ বছর পাহাড়-পর্বতে সে যে ব্রহ্মচর্য পালন করে এসেছেন, তা কতটা খাঁটি তিনি পরখ করে দেখতে চাইছেন। অভয়াচরণ যখন বলেন, তিনি ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করতে পারেন, বাবা তাতে খুশি হন। বুঝতে পারেন যে অভয়াচরণের ব্রহ্মচর্য পালনে নিষ্ঠা ছিল। কিন্তু কর্মযোগে প্রবৃত্ত হবার মতো গুরুর অভাব ছিল। ভক্তকে ভগবান সর্বদা পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে পারলে তবেই তার কৃপা পাওয়া যায়।


বাবার মনের ভাব বুঝতে না পেরে অভয়াচরণ আবার আশ্রমদ্বারের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক সেই সময় একজন রমণী নানাবিধ অন্নব্যঞ্জন ও মিষ্টান্ন ভোগ সাজিয়ে উপবাসের পর বাবা লোকনাথকে নিবেদন করার জন্য নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সারারাত্রি উপবাস করে বাবার কাছে নিবেদন করে উপবাস ভঙ্গ করার জন্য সে নানাবিধ উপচারে ভোগ নিয়ে এসেছে। বাবা লোকনাথ তার সিদ্ধিবলে জানতেন যে তার জন্য ভোগ আগতপ্রায়। সেইজন্যই তিনি অভয়চরণকে এতক্ষণ পরীক্ষা করছিলেন। এবার ভোগের থালা দেখে স্নেহভরা কণ্ঠে তাকে ডেকে বললেন, অভয়াচরণ, তোর খাবার এসেছে। এবার খেয়ে উদরপূর্তি কর।


সেই স্নেহভরা কণ্ঠস্বরকে আর উপেক্ষা করতে পারলেন না অভয়াচরণ। তিনি অশ্রুপূর্ণ নয়নে উপবাস ভঙ্গ করার জন্য বাবার সামনে এসে বসতেই, বাবা সেই রমণীকে বললেন, তুই সরে যা এখান থেকে। রমণী বাবাকে প্রণাম করে শশব্যস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেই অভয়াচরণ সেই প্রসাদ খেতে আরম্ভ করলেন।


রমণী বাইরে বেরিয়ে এসে ভাবলেন, তিনি বাবার উপবাস ভঙ্গের জন্য সারারাত্রি একনিষ্ঠভাবে এই ভোগ রান্না করে এনেছেন। বাবা তার ভোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্য একজন সাধুকে তা খাইয়ে দিলেন। তিনি এর কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না।


ভগবান কোনো কাজ কেন করেন, তা ভক্তের বোধগম্য হয় না। কিন্তু তাঁর কাজ সর্বদা ভক্তের মঙ্গলের জন্যই হয়। নর্মদা পরিক্রমার সময় উপবাসে থেকে মামলেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের অভিষেক পূজা করে সস্ত্রীক যেই আমরা গর্ভগৃহ থেকে নাটমন্দিরে বেরিয়েছি, একটি হনুমান এসে অনেক দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রসাদটি নিয়ে চলে গেল। আমি তার দিকে তাকাতেই, মহন্তজি বলেছিলেন, এ অতি শুভ লক্ষণ। মামলেশ্বরের প্রসাদ হনুমানজিকেই খেতে দিন। এতে ভক্তের মঙ্গল হয়। রমণীর অনেক আকাঙ্ক্ষা করে বাবার জন্য নিয়ে আসা ভোগ বাবা অভয়াচরণকে খাইয়ে দিলেন, তাতে রমণীর কল্যাণই সাধিত হবে।


এদিকে অভয়াচরণ পরমতৃপ্তি সহকারে বাবার সামনে বসে প্রসাদ খেতে থাকলেন। প্রায় অর্ধেক খাওয়া হয়ে যাবার পর বাবা তাকে বললেন, এ যে কায়েতের মেয়ের হাতের রান্না খাচ্ছিস, অভয়চরণ।


এ কথা শুনে অভয়াচরণ বললেন, আমি তো ঠাকুরের প্রসাদ খাচ্ছি। চণ্ডালের মেয়ের হাতের রান্না হলেই বা দোষ কি?


বাবা লোকনাথ অভয়াচরণের এই উক্তিতে অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং তার সত্য জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে খুশি হলেন। অভয়াচরণ ভোগ খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে সেদিন আশ্রমেই থেকে গেলেন। তার মনের মধ্যে আলোড়ন চলতে থাকল যে বাবা তাকে অভিষ্ট কৃপা দিচ্ছেন না, অথচ তার প্রতি স্নেহপূর্ণ মনোভাবও দেখাচ্ছেন। তাকে নিবেদন করা ভোগ তিনি অভয়চরণকে সামনে বসিয়ে খাওয়ালেন। তিনি বুঝতে পারেন, বাবা নিশ্চয়ই তাকে পরীক্ষা করছেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষের কৃপা পেতে গেলে তাকে পরীক্ষা তো দিতেই হবে। তিনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন যে বাবার যে কোনো পরীক্ষাতে তাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে এবং এজন্য তিনি কিছুদিন আশ্রমেই অবস্থান করলেন। তারপর একদিন সকালে বাবার দর্শন করে অভয়াচরণ বিদায় চাইলেন। বাবা তখন তাকে বললেন, হারে অভয়াচরণ, যার জন্য তুই ১৭ বছর পাহাড়-পর্বত ঘুরে বেড়িয়েছিস, তা কি তুই পেয়েছিস? অভয়াচরণ বাবাকে বললেন, না পাইনি।


বাবা তখন অভয়াচরণের ডান হাতের কব্জিটা নিজের ডান হাতে ধরে বললেন, যার জন্য ঘুরেছিস, তা তোর ডান হাতে বেঁধে দিলাম। আর তোকে ঘুরতে হবে। না! শুধু ঘুরে বেড়ালে কি হবে রে? জানবি কর্মই ব্ৰহ্ম। কর্মের মধ্যে দিয়েই ব্রহ্মকে জানতে হবে, তাকে পেতে হবে। এরপর তিনি রজনী ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন, রজনী তুই অভয়াচরণকে সঙ্গে নিয়ে যা। বুঝিয়ে দে, তুই এখন কি কর্ম করছিস। আর ওকে বেশ করে খাইয়ে দিস। তারপর অভয়াচরণকে বললেন, শোন অভয়াচরণ, রজনী যা, আমিও তা। রজনী আমার সীলমোহর।


ওদিকে বাবা লোকনাথ যখন অভয়াচরণের ডানহাত স্পর্শ করলেন, তিনি সর্বাঙ্গে এক অপূর্ব শিহরণ অনুভব করলেন। তাঁর সমস্ত শরীরে যেন কোনো বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবেশ করল। তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। তার মুখ দিয়ে কেবল অস্ফুট শব্দ বেরোতে লাগলো’কর্মই ব্রহ্ম’! কর্মই ব্ৰহ্ম! আজ থেকে আমি কর্মযোগী। এখন থেকে আমাকে কর্মযোগে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। বাবা লোকনাথ তাঁর হাত ছেড়ে নাম দিলেন অভয় ব্রহ্মচারী। এবার ব্রহ্মশক্তির অংশ পেয়ে অভয় ব্রহ্মচারী নামে সে পরিচিত হবে। প্রবৃত্ত হবে বাবা লোকনাথ প্রদর্শিত পথে। তার মনের ঐকান্তিক কামনা এতদিনে পূর্ণ হলো। সচল শিব দর্শন তার সফল হলো।


বাবা লোকনাথ অভয়াচরণকে কৃপা করলেন, কিন্তু তার কর্মগুরু ও পথপ্রদর্শক করলেন রজনী ব্রহ্মচারীকে। বাবা বুঝেছিলেন যে, অভয়াচরণের মধ্যে ব্রহ্মচর্যের শক্তি আছে, কিন্তু কর্মযোগ ভিন্ন তার প্রকাশ সম্ভব নয়। তিনি তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করে দিলেন যাতে অভয়াচরণ কর্মযোগে সফল হতে পারেন। এ তার অহৈতুকি কৃপা। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের থেকে যখন যোগশক্তি কোনো ভক্তের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তখন তার মনের জমি সহজে উর্বর হয় এবং তার অন্তরস্থিত জীবাত্মা সহজে মহামায়া সৃষ্ট মায়ার বন্ধন কাটিয়ে মস্তকে স্থিত পরমাত্মাকে দর্শন করতে সমর্থ হয়। বাবার এই কৃপা অভয়াচরণকে সাধনপথে একধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে দিলো। বাবার থেকে যে কতিপয় ভাগ্যবান ব্যক্তি এইভাবে বাবার যোগশক্তির কিছু কণা পেয়েছিলেন, অভয়াচরণ তাদের মধ্যে একজন।


রজনী ব্রহ্মচারী বাবা লোকনাথের আদেশানুসারে অভয়াচরণকে সঙ্গে নিয়ে তার ঢাকা আশ্রমে এলেন। অভয়াচরণ সেখানে তিনদিন বাস করার পর আবার অজানা পথে বেরিয়ে পড়লেন। বাবা লোকনাথ তাঁকে রজনী ব্রহ্মচারী নির্দেশিত কর্মযোগের পথে অগ্রসর হতে উপদেশ দিয়েছিলেন। জানা যায় যে অভয় ব্রহ্মচারী তার নিজ গ্রামে এসে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরপট্টি গ্রাম ছিল একটি অখ্যাত পল্লী। যেখানে প্রচুর গরীব মানুষের বাস। অভয় ব্রহ্মচারী এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে থেকে তাঁর কর্মযোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনস্থ করেছিলেন। তিনি তার গ্রামে এতদিন এক ভবঘুরে সন্ন্যাসীরূপেই পরিচিত ছিলেন। তার উপর তার নিত্য গাঁজা সেবন করার অভ্যাসকে নাগরিক সমাজ খুব ভালো চোখে দেখতো না। কিন্তু তাদের সেই অভয়াচরণ যখন অভয় ব্রহ্মচারী হয়ে গ্রামে ফিরলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বাবা লোকনাথ তাকে যে কর্মযোগের পথে এগোতে বলেছিলেন, তিনি গ্রামে আশ্রম স্থাপন করে সেই কাজেই বেশ কিছুদিন প্রবৃত্ত রইলেন। তারপর বাবা ধরাধামে থাকাকালীন তিনি একবার মাত্র বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বারদী আশ্রমে এসেছিলেন। তখন বাবার সঙ্গে তার কি কথোপকথন হয় সেটা জানা যায়নি। তবে এরপর আর তার কোনো খবর পাওয়া যায় না। ব্রহ্মচারী বাবার ব্রহ্মশক্তির সামান্য অংশ নিয়ে তিনি সাধনমার্গের কোন স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিলেন, বাবার ভক্তগণ তা জানতে সক্ষম হল না। বাবার উপদেশ মতো আশ্রম স্থাপন করে তিনি কর্মযোগে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে হয়তো বাবার দ্বারা সঞ্চারিত ব্রহ্মশক্তির বলে তিনি নিজ মুক্তির পথের সন্ধান পেয়ে যান। তাই সাধক সমাজ আর তার সন্ধান পান না। ব্রহ্মশক্তির বলে জীবাত্মায় যে জ্ঞানের আলোয় উদ্দীপিত হয় তাতে সাধক নিজমুক্তি কামনায় প্রবুদ্ধ হতেই পারেন। সেই জ্ঞানের আলোয় যে-সব সাধক সমাজকে আলোকিত করতে চান, মানবকল্যাণ সাধন করতে চান, তারাই ঈশ্বরকোটির সাধক হন। এমন উচ্চমার্গের সাধক জগতে কমই এসেছেন।


.


রজনী ব্রহ্মচারী


রজনীকান্ত চক্রবর্তী ঢাকা সাব জজ আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। ঢাকা শহরে তাঁর বেশ পরিচিতি ছিল। সুখী স্বচ্ছল সংসার। রজনীবাবু ও তার স্ত্রী উভয়েরই আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল। সংসারধর্ম পালন করতে থাকলেও তাদের উভয়ের মধ্যেই এক বিষয় বৈরাগ্যের সঞ্চার ঘটে। নিত্য সংসারধর্ম পালনে ক্রমে তাদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক অতৃপ্তি জেগে ওঠে এবং মন অশান্ত হয়ে ওঠে। উভয়ের উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় কোনো রকমে সংসার বন্ধন টিকে থাকে। রজনীবাবুর বুদ্ধিমতি স্ত্রী বুঝতে পারেন যে তার স্বামীর ধর্মপথে অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক সংসারবন্ধন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই স্বামীকে সংসার ত্যাগ করতে দিতে চান না। সংসারে থেকেই সংসারবন্ধনকে কাটাবার জন্য রজনীবাবুর ভক্তিমতি স্ত্রী একটি উপায় বার করেন। একসময় তিনি এক ব্রত পালন উপলক্ষে তার স্বামীকে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসার অনুরোধ জানান। রজনীবাবু আদালত থেকে বাড়ি এলে সারাদিন স্ত্রীর ব্রতপালন অনুষ্ঠান চলে। রাত্রিতে শয়নকালে রজনীবাবুর স্ত্রী তাঁর কাছে একটি বর প্রার্থনা করেন। রজনীবাবু খুবই আশ্চর্য হয়ে বর দিতে রাজি হলে তাঁর স্ত্রী বলেন, আজ হতে তোমার আমার মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক অর্থাৎ সহবাসের সম্পর্ক থাকবে না। রজনীবাবু তখন তাঁর স্ত্রীকে বলেন, বেশ তাই হবে। আজ থেকে তুমি আমার মা হলে। তোমার উপর আমার মাতৃভাব থাকবে। রজনীবাবুর স্ত্রী তখন বললেন–হ্যাঁ, আমি তাই হলাম।


রজনীবাবু ও তার স্ত্রী উভয়েরই ধর্মপথে যে সংসারবন্ধন কাঁটাস্বরূপ ছিল, তা দূরীভূত হলো। ধর্মপথে উভয়ের অগ্রসর হওয়া নিষ্কন্টক হলো। এরপর উভয়েই নিজ নিজ মতে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হতে থাকেন। রজনীবাবুর স্ত্রী ব্রহ্মচারিণী রূপে জীবনযাপন করতে থাকেন এবং একদিন ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে দেবলোকের পথে যাত্রা করেন।


স্ত্রী গত হবার পর রজনীবাবু ইতস্ততঃ বিভিন্ন জায়গায় সাধুদর্শনে যেতে থাকেন মনের শান্তি ও আধ্যাত্মিক পথ নির্দেশের আশায়। কিন্তু কোথাও তার অশান্ত মন শান্তি খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়ায় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন। মনে কিছুতেই শান্তি আসে না। এক আধ্যাত্মিক অতৃপ্তি তার সারা মন জুড়ে বিরাজ করতে থাকে। একদিন গোঁসাইজি তাকে বলেন, শোন রজনী, তুমি একবার বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করে এসো। এমন উঁচুদরের মহাপুরুষ আমি কোথাও দেখিনি। রজনীবাবু গোঁসাইজির কথা শোনেন, কিন্তু তার অশান্ত মনে সে কথা কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। তিনি অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর আখড়া ঘুরেছেন, কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাননি যাঁকে দর্শন করে তাঁর অশান্ত মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা নিয়ে অতৃপ্ত মনে তিনি জীবনযাপন করতে থাকেন।


এরপর একদিন সাব জজ কোর্টের এক উকিল মহাশয় রজনীবাবুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার পরামর্শ দেন। যে উপদেশ গোঁসাইজি দিয়েছিলেন সেই একই পরামর্শ উকিলবাবুর কাছে শুনে রজনীবাবুর মনে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শনের ইচ্ছা হয়। তিনি তখন আর দেরি না করে তার আদালতের বৃন্দাবন নামক একজন পিওন ও ঢাকা মুন্সেফ আদালতের উকিল বিষ্ণুচরণ চক্রবর্তীকে নিয়ে বারদী আশ্রমে যাওয়া ঠিক করেন।


সেই সময়টা ছিল ১২৯৪ সালের শ্রাবণ মাস। যাবার দিন নদীর ঘাটে বৃন্দাবন ও রজনীবাবু এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু বিষ্ণুবাবুর দেখা নেই। তারপর হঠাৎ বিষ্ণুবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দিলেন যে একটি বিশেষ পারিবারিক কারণে তিনি সেদিন যেতে সমর্থ হচ্ছেন না। অতঃপর রজনীবাবু বৃন্দাবনকে সঙ্গে নিয়েই নৌকাযোগে বারদীর পথে পাড়ি দিলেন।


রজনীবাবুর নৌকা সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে যখন বারদী বাজারের পশ্চিমদিকের আখড়ার কাছে পৌঁছলো, তখন পাড়ে দাঁড়ানো একটা নৌকা থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলো, এই নৌকা কোথা থেকে আসছে? বৃন্দাবন তখন নৌকা থেকে উত্তর দিলো, ঢাকা থেকে। পাড়ের নৌকা থেকে আবার প্রশ্ন হলো, এই নৌকায় রজনীবাবু এসেছেন নাকি? তখন বৃন্দাবন পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি জানলেন কি করে? এবার পাড়ের নৌকা থেকে উত্তর এলো, ঢাকা থেকে বিষ্ণুবাবু এসে বলে গেছেন।


এই কথা শুনে রজনীবাবু ও বৃন্দাবন দুজনেই যারপরনাই বিস্মিত ও হতবাক হলেন। তারা ভাবতে লাগলেন, এ কি করে সম্ভব? বিষ্ণুবাবু তো নিজেই তাদের রওনা হবার সময় নদীর ঘাটে এসে জানিয়ে গেলেন যে কিছু পারিবারিক কাজের জন্য তিনি তাদের সঙ্গে বারদী আসতে পারবেন না। তাই তো তারা দুজনে রওনা হয়ে এলেন। এখন তাদের নৌকা সবে ঘাটে এসেছে। এর মধ্যে বিষ্ণুবাবু তাঁদের আগে পৌঁছে কি করে তাদের আগমন সংবাদ দিয়ে গেলেন। রজনীবাবু চমৎকৃত হলেন এই ভেবে যে, এটা নিশ্চয়ই সেই বারদী ব্রহ্মচারী বাবার এক লীলা। বৃন্দাবনের কাছে গোটা ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। সে নিঃশব্দে রজনীবাবুকে অনুসরণ করে বারদী আশ্রমের পথে এগুতে থাকলো।


বারদীর আশ্রমে প্রবেশ করেই রজনীবাবুর মনে হল তিনি যেন কোন পুরাকালের মুনি-ঋষির আশ্রমে এলেন। আশ্রমের ভূমিতে পা রেখেই তিনি এক পবিত্রতার স্পর্শ পান। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আশ্রম। চারিদিকে নানা সুরভিত ফুল ও ফলের গাছ শোভিত। উঠোনের মাঝে একটি বেলগাছ। চারহাত উঁচু। গাছটি উপরে উঠে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। শাখাগুলি উপরে উঠে এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যেন তার ছায়ায় আশ্রমে আগমনকারীরা সুশীতল হন। সেই বৃক্ষের নিচে কিছু ভক্ত উপবেশন করেছিলেন। আশ্রমের ডানদিকে লোকনাথ বাবার আসন-ঘর। ঘরের বাইরে একটি বিস্তৃত বারান্দা। রজনীবাবু আশ্রমে আসার সময় একটি মিছরির পুঁটলি সঙ্গে করে এনেছিলেন। তিনি বৃন্দাবনকে সঙ্গে নিয়ে লোকনাথ বাবার ঘরে প্রবেশ করে মিছরির পুঁটলিটা তার পায়ের সামনে রেখে তাঁর চরণে মাথা ঠেকিয়ে যেই প্রণাম করেছেন, অমনি তার নাকে এক অতি সুমিষ্ট দিব্য গন্ধ প্রবেশ করলো এবং বাবার চরণ স্পর্শে তার সমস্ত শরীর শিহরিত হলো। তিনি পাগলপ্রায় হয়ে দুহাত তুলে লাফাতে লাগলেন। এ গন্ধ তো যে সে গন্ধ নয়! এ যে এক অপার্থিব দিব্য গন্ধ, যা কেবল দেবতাদের শরীর থেকেই নির্গত হতে পারে। বাবা লোকনাথ স্থির হয়ে আসনে উপবিষ্ট। রজনীবাবু পাগল হয়ে আবার বাবার চরণে মাথা স্পর্শ করলেন এবং প্রায় ১৫ মিনিট সেইভাবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় রইলেন। ১৫ মিনিট পর যখন তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলে তিনি বাবার ডানদিকে মাটির উপর ধপ করে বসে পড়ে বাবার পলকহীন দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বাবার চোখের সঙ্গে তার যখন দৃষ্টি বিনিময় হলো, তখন তিনি কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। চলে গেছেন অন্য এক জগতে। কিছুক্ষণ এইভাবে নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের পর বারান্দায় পাতা একটি কুশাসন দেখিয়ে বাবা তাকে সেখানে গিয়ে বসতে বললেন। রজনীবাবু বাবাকে করজোড়ে বললেন, আপনার চরণপদ্ম ছাড়া আর কোথাও বসবার বাসনা আমার নেই। রজনীবাবুর মধ্যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি তো ছিলই। সংসারী হয়েও তিনি বৈরাগ্য জীবনযাপন করেছেন, ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। বাবার চরণস্পর্শে তিনি যে দিব্য অনুভূতি পেয়েছেন, সেটা ছেড়ে আর কোথাও তিনি যেতে চান না। বাবা তখন একটু কঠোরস্বরে রজনীবাবুকে বললেন, ওই বাসনাতেই তো সব মাটি করলি।


রজনীবাবু বাবার কথার অর্থ বুঝতে পারেন না। ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের সব কথার অর্থ বোঝা সহজ কাজ নয়। রজনীবাবু ভাবতে লাগলেন, আমি তো কোনো বিষয় বাসনা নিয়ে এখানে আসিনি। বাবার চরণদর্শনই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল। বাবার কৃপায় সেই চরণের আত্মিক দর্শন হয়েছে। আর তার কি বাসনা থাকতে পারে। এমন ভাবতে ভাবতে দেখেন লোকনাথ বাবার দুই চোখ একেবারে স্থির। তার দৃষ্টি যেন বহুদূরে কোথাও নিক্ষেপিত হচ্ছে। তার দেহে কোনো শ্বাস প্রশ্বাসের লক্ষণ নেই। দেহ কাষ্ঠবৎ স্থির। যেন পটে আঁকা কোনও ছবি। তার দেহটি আশ্রমের এই ঘরে উপবিষ্ট থাকলেও তিনি যেন এই দেহে নেই। চলে গেছেন কোথাও কোন্ অজানা দেশে। এমনভাবে প্রায় আরও ১৫ মিনিট কাটল। তারপর তাঁর দেহে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল। তিনি রজনীকান্তের দিকে স্থির কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন।


রজনীকান্তের দিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে গম্ভীরস্বরে তিনি তাকে অনেক প্রশ্ন করতে থাকলেন। রজনীকান্ত তার উত্তর দিতে থাকলেন। এরপর হঠাৎ বাবা রজনীকান্তকে বললেন, অনেকদিন হল তোর স্ত্রী গত হয়েছেন। তুই আবার বিয়ে করলি না কেন? তুই ভাবলি বিয়ে করলে তোর ব্রহ্মজ্ঞান হবে না! তুই একটা কাপুরুষ।


রজনীকান্ত নিজে থেকে তার সম্বন্ধে কোনো কথাই এ যাবৎ বাবাকে বলেননি। তিনি ভাবলেন, বাবা কি করে স্ত্রীর কথা জানলেন। তিনি বাবার কথা শুনে চমকে উঠলেন। এতদিন যে সমস্ত সাধুসন্ন্যাসী তিনি দর্শন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি এইরূপ দিব্যপ্রকাশ ও ক্ষমতা দেখেননি। সেজন্যই তিনি বাবার কথায়, চমকে গিয়েছেন। বিস্ময় ভাঙলে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বাবাকে বললেন, কাপুরুষ না হলে এখানে আসব কেন? বাবা লোকনাথ তখন করুণামাখা স্বরে বললেন, কিরে, তুই আমার কথায় চলি না যে? রজনীকান্ত তখন বললেন, চট্র কেন? চার কি আছে? কাপুরুষকে কাপুরুষ বলেছেন। আমাকে যদি দুটো চড় কিংবা জুতোর বাড়িও দেন, তাহলেও চট্র না। আমি আপনাকে চিনেছি, বুঝেছি। আমি বুঝেছি, নিতান্ত পাষণ্ডও যদি আপনার সাক্ষাতে আসে, সেও চটতে পারে না।


একজন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি ও তার ভক্তের মধ্যে এই আলাপন এক গভীর ইঙ্গিত বহন করে। কোনো সিদ্ধ মহাযোগী সহজে কারোকে তার কাছে ঘেঁষতে দেন না। যে তার কাছে আসার চেষ্টা করে, তার প্রতি সে এমন দুর্ব্যবহার করে, ভয় দেখায় যেন সে বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যায়। কিন্তু আগন্তুক যদি সেই রূদ্ররূপকে সহ্য করে মহাযোগীর সান্নিধ্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে না ছাড়েন, তবে অন্তে তার কোমল হৃদয়ে জায়গা অবশ্যই পায়। আমি নর্মদা পরিক্রমা করার সময় দক্ষিণ তটে এইভাবে দুবার এইরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে আমি খুবই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই ঋষিদের চরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসিনি। যা থাকে কপালে মনে করে তাদের চরণ ছাড়িনি। অন্তে দুজনেই আমাকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন এবং আমাকে সস্ত্রীক আশীর্বাদ ও বর প্রদান করেছিলেন।


রজনীকান্ত আজ কোনভাবেই এই মহর্ষির কৃপাদৃষ্টি থেকে নড়বেন না স্থির করেছেন। তাই বাবার কোনো কথায় তার প্রতি রজনীকান্তের রাগ, বিরূপতা কিছুরই উদ্রেক হচ্ছে না।


এবার বাবা তাকে বললেন, রজনী, তুই আবার বিয়ে কর। এই আমার আদেশ। বাবা এবার আদেশ করে রজনীকান্তকে পরীক্ষা করছেন। রজনীকান্ত উত্তর দিলেন, আপনার এ আদেশ আমি পালন করতে পারবো না। একথা শুনে বাবা রাগত স্বরে বললেন, কেন পারবি না? রজনীকান্ত উত্তর করলেন, স্ত্রীলোকে আমার মাতৃভাব হয়েছে। অবশ্য এর পিছনে আমার বিগতা স্ত্রীর ভূমিকা ছিল। এরপর রজনীকান্ত তিনবছর পূর্বের সেই ব্রতের দিনের কথা বাবাকে বলেন, যেদিন সারাদিন ব্রত পালন করে তার স্ত্রী তাকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর স্ত্রীকে মাতৃরূপে দেখার শপথ নিয়েছিলেন। এখন জগতের সব স্ত্রীলোকের প্রতিই তার মাতৃভাব।


বাবা লোকনাথ রজনীকান্তর মুখে এই কথা শুনে বললেন, সত্যযুগ ফিরে এল না কি রে? তাহলে তুই আমার কাছে এসেছিস কেন? আমারই তো উচিত ছিল তোর কাছে যাওয়া। সংসারবদ্ধ জীবের পক্ষে সহধর্মিণীর প্রতি মাতৃভাব স্থাপন করা তো সোজা কাজ নয়। এরূপ সংসার বৈরাগ্য একমাত্র তখনই হতে পারে যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সংসারের মধ্যে থেকেও ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারেন। এই ঘটনার প্রায় ১১ বছর পূর্বে এমন কাণ্ড ঘটেছিল দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সারদামাকে জগদম্বারূপে পূজা করে তাঁর প্রতি মাতৃভাব জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরকোটির ভগবৎ প্রেমে উন্মত্ত সাধক এবং সারদা মাতার মধ্যে ছিল মাতৃশক্তি।


বাবা লোকনাথ রজনীকান্তের ইন্দ্রিয়সংযম ক্ষমতার পরীক্ষা করছিলেন। ইন্দ্রিয়সংযম না করতে পারলে অবিদ্যাজনিত ক্লেশ দূর হয় না। সাধক পঞ্চভূতের দেহের পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়কে সংযত করে কর্মযোগে ব্রতী হন। এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়র মধ্যে একটি হল উপস্থ। উপস্থ সংযমের দ্বারাই ব্রহ্মচর্য পালিত হয়। যোগী পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়কে সংযত করতে পারলে পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে পারে। সেজন্য ইন্দ্রিয়সংযমবিনা অন্তরে ধর্মভাব স্থায়ী হতে পারে না। ইন্দ্রিয়সংযম যোগীকে স্থিতপ্রজ্ঞ করে। স্থিতপ্রজ্ঞ যোগীই জিতেন্দ্রিয় হতে পারেন। বাবা লোকনাথ ভাবেন, বিষয় উপভোগ না করলেই মানুষ জিতেন্দ্রিয় হতে পারে না। সেজন্য তিনি রজনীকান্তকে কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে থাকেন। অনেকে বিকলাঙ্গ হলে বা লোকনিন্দার ভয়েও বিষয় ভোগে বিরত থাকে। কিন্তু তাতে তারা জিতেন্দ্রিয় হয় না। এদের মনে বাসনা থাকে। এই বাসনার যতক্ষণ নিবৃত্তি না হয়, ততক্ষণ প্রজ্ঞা স্থির হয় না। যে মানব ইন্দ্রিয়সংযমের দ্বারা বাসনার নিবৃত্তি করতে পারেন, তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরানুরাগ জন্ম নেয়। ঈশ্বরানুরাগ জন্মালে চিত্ত বিশুদ্ধ হয়। তখন আর কোনো সংসারের ভোগ বাসনা থাকে না। যোগীরা অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনের মাধ্যমে এই পর্যায় পেরিয়ে আসেন, কিন্তু সংসারবদ্ধ জীবের পক্ষে এই পর্যায় পেরোনো অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেজন্যই বাবা বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে রজনীকান্তের চিত্তশুচিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইছেন।


রজনীকান্ত যখন বললেন, ‘কাপুরুষ না হলে আপনার কাছে আসব কেন? এই কথা শুনে বাবা অতীব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। যতক্ষণ মানুষের মনে অহংভাব থাকে, ততক্ষণ সে আত্মসামর্থকে বড়ো বলে মনে করে। সাধুসঙ্গের প্রতি আকুলতা তখন মনে স্থান পায় না। সাধুসঙ্গে প্রবৃত্তি দুই প্রকার ব্যক্তির হতে পারে। কেউ সাধুসঙ্গ করে ক্ষমতা-যশ লাভ করতে চায়। কেউ সাধুসঙ্গ করে ব্রহ্মলোকের সন্ধান চায়। বাবা লোকনাথ পরীক্ষা করে দেখছিলেন, রজনীকান্ত আসলে কি চায়। রজনীকান্তের অন্তরের ঈশ্বরলাভের আকুলতা ও তার পথের সন্ধানের আকুলতা বাবা লোকনাথকে চমৎকৃত করেছিল। তিনি রজনীকান্তকে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে বসতে বললেন।


রজনীকান্ত ঘর থেকে উঠে আশ্রমের উঠানে একটি আমগাছের নিচে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ জোড় ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। রজনীকান্ত কোনো হৃক্ষেপ না করে গাছের নিচে বৃষ্টির মধ্যে বসে রইলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এতদিন জ্ঞানে অজ্ঞানে যা পাপ করেছি, তা এই মুক্ত মহাপুরুষের সামনে সব ধুয়ে যাক। আজ এই জলঝড়ে আমার দেহের যদি কোনো ক্ষতি হয় তবে এই মহাপুরুষই তার প্রতিকার করবেন। এই মনে করে যখন তিনি বৃষ্টিতে ভিজে একসা, তখন বাবা তাকে ডেকে বললেন, রজনী তুই উঠে আয়। আমার কাছে আয়। ওরে, তুই এখনও ছায়ার কচু। রোদ বৃষ্টি সইবি কি করে? একথা শুনে রজনীকান্ত বুঝলেন যে বারদী আসা তার সফল হয়েছে। তিনি গাছতলা থেকে উঠে কাকভেজা অবস্থায় বাবার সামনে এসে বসলেন।


বাবা তার সঙ্গে আবার ধর্মালোচনা করতে লাগলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে হয়ে গিয়ে তাঁর খুব তামাক খাবার ইচ্ছা হলো। রজনীবাবুর একটু তামাকে আসক্তি ছিল। অন্তর্যামী বাবা রজনীকান্তের মনের কথা জানতে পেরে তাঁকে বললেন, তুই কেমন ভক্ত রে, আমাকে একটু তামাক খাওয়াতে পারলি না? রজনীকান্ত তখন মনে মনে আনন্দিত হয়ে তামাক সাজতে গেলেন। রজনীকান্ত তামাক সেজে নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন। বাবা তারপর নিজে প্রসাদ করে রজনীকান্তকে খেতে দিলেন। রজনীকান্ত বাবার আড়ালে নিয়ে খাবার চেষ্টা করতেই বাবা বলে উঠলেন, তা হবে না। আমার সামনে বসে খেতে হবে। রজনীবাবু তখন তামাক নিয়ে বাবার সামনে বসে টান দেন। কি আশ্চর্য! দুবার তামাকে টান দিয়ে তৃতীয়বার টান দিতে হুঁকোতে মুখ ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর চিরদিনের মতো তামাক খাবার ইচ্ছা চলে গেল। এরপর রজনীকান্ত আর কোনোদিন তামাক স্পর্শ করেননি।


তামাক খাওয়া হলে রজনীবাবু ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। বারদী আশ্রমে পৌঁছবার পর থেকে বাবা তাকে কত পরীক্ষা করছেন আর সঙ্গে সঙ্গে কত কৃপাও করছেন। তিনি ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর ভোগ গ্রহণ করতে যান। ভোগ গ্রহণ করে তিনি বাবার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাবা তখন তাঁকে বলেন, আয়, একবার আমার বুকে আয়। রজনীবাবু বাবার কাছে যেতেই বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে বাবার হৃদয় থেকে রজনীকান্তের মধ্যে সঞ্চারিত হল এক অনির্বচনীয় শক্তির ধারা। রজনীকান্ত তার অন্তরে এমন এক শান্তি অনুধাবন করলেন যার প্রভাবে তাঁর চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারায় আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। তিনি পেলেন এক অপার শান্তি। তার এতদিনের অশান্ত মন বাবা লোকনাথের শান্তিচ্ছায়ায় স্থান পেল। তার হৃদয়াসনে স্থান হল রজনীকান্তের।


মহাযোগী বাবা লোকনাথের স্নেহবাৎসল্য ছিল অপরিসীম। তিনি তাই তো বলতেন, সন্তানের মতো নিজের মনে করে একবার ডেকে দ্যাখ, আমি তোদের আমার বুকে রেখে দেবো। কিন্তু রজনীকান্তের মতো সবাই তা পারে কই?


এরপর থেকে রজনীকান্ত লোকনাথ বাবাকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারতেন না। প্রায়শঃই ব্যাকুলভাবে ছুটে আসতেন বারদীর আশ্রমে। সবসময় তার মন ছটফট করতো বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার চরণ দর্শনের জন্য। যিনি ব্রহ্মচারী বাবার হৃদয়ে আসনলাভ করেছেন, তিনি কি আর তাকে দর্শন না করে থাকতে পারেন!


একদিন বাবা লোকনাথের রজনীকান্তকে খুব দেখতে ইচ্ছা হলো। বাবা যখন কোনো বিশেষ ভক্তকে দেখতে ইচ্ছা করতেন, তখন তার কাছে তিনি সূক্ষ্ম নির্দেশ পাঠাতেন। তার নির্দেশ পেলেই সেই ভক্তের অন্তরে তাকে দর্শনের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হতো এবং সে ছুটে আসত বারদীর আশ্রমে। রজনীকান্ত বাবা লোকনাথের এক সূক্ষ্ম নির্দেশ পেলেন বিনা ছাতিতে খালি পায়ে আগামী ছুটির দিন বাবার কাছে আসতে। আদেশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে রজনীকান্তর মনে বাবাকে দর্শনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাবা আগামী ছুটিতে যেতে বলেছেন। কোনোরকমে অনন্ত মনের কষ্টে তিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাটান। কবে ছুটির দিন আসবে। অবশেষে ছুটির দিন বিনা ছাতিতে বিনা জুতোয় কাঠফাটা রোদ্দুরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বারদী আশ্রমে রজনীকান্ত এসে পৌঁছান। ঢাকা থেকে বারদীর দীর্ঘপথ প্রখর রৌদ্রতেজ মাথায় নিয়ে তপ্ত কাকুড়ে মাটিতে পা ক্ষত-বিক্ষত করে আশ্রমে এসে রজনীকান্ত বাবার চরণে মাথা রাখেন। বাবার চরণে মাথা স্পর্শ করা মাত্র এক অপার্থিব আনন্দের ধারা তার সারা শরীরে প্রবাহিত হতে লাগলো এবং তার সমস্ত পথশ্রান্তি মুহূর্তে অন্তর্হিত হলো। বাবা রজনীকান্তকে তখন আশ্রমে থাকার নির্দেশ দিলেন। রজনীকান্তের উপর আশ্রম দেখাশুনা করার ভার পড়লো। আশ্রম পরিচালনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রজনীকান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বাবার ও ভক্তদের সেবা করতে লাগলেন। আশ্রমের সেবায় কোনো ত্রুটি হলে বাবা খুব রেগে যেতেন। আশ্রমের প্রতিটি কাজের প্রতি তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। আশ্রমের সেবা করা ছিল কর্মযোগের একটি অঙ্গ। রজনীকান্তকে বাবা কর্মযোগী করতে চেয়েছিলেন। কর্ম ছেড়ে কেবল সাধু-সন্ন্যাসীদের আখড়ায় ঘুরে বেড়ালে কর্ম সাধনা হয় না। কর্ম করতে হবে নিষ্কামভাবে। তবেই নৈষ্কর্মসিদ্ধি হবে। কর্মের মধ্যেই ব্রহ্মের সন্ধান করতে হবে। কর্মযোগীর কাছে কর্মই ব্রহ্ম।


রজনীকান্তের কর্মযোগের প্রতি নিষ্ঠা ও বাবা লোকনাথের প্রতি একনিষ্ঠ এবং অকৃত্রিম ভক্তি দেখে বাবা সন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে জানতে পারেন যে রজনীকান্তের পার্থিব ভোগ্যবস্তুর উপর কোনো আসক্তি নেই এবং ঈশ্বরলাভের জন্য তাঁর অন্তর হয়ে উঠেছে ব্যাকুল। এমতাবস্থায় একদিন বাবা রজনীকান্তকে ডেকে আদেশ করেন কৌপীন পরার জন্য। তিনি আরও বলেন, বাড়িতে যখন থাকবি নেংটি পরবি আর বাইরে বেরোলে শাল দোশালা করে পরবি। এখন থেকে তুই হলি রজনী ব্রহ্মচারী।


রজনী ব্রহ্মচারী এরপর ঢাকায় ফিরে গিয়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার কর্মের উপর বাবার আশীর্বাদ আছে এবং তিনি রজনী ব্রহ্মচারীর কর্মযোগের উপর বারদী থেকে প্রখর দৃষ্টি রাখেন।


আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার পর রজনী ব্রহ্মচারীর কাছে অনেক লোক আসে তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে। রজনী ব্রহ্মচারীর স্পর্শে অনেকের রোগ সেরে যায়। তাঁর নাম ঢাকা শহরে ছড়াতে থাকে। এতে তার মনে ধীরে ধীরে এক মোহের জন্ম নেয়। নামের মোহ। একদিন তিনি লোকনাথ বাবার কাছে বারদী আশ্রমে আসেন। তখন তিনি একান্তে কথোপকথনের সময় বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, মোহ কেন আসে?


বাবা লোকনাথ তাঁকে বলেন, মোহ কেন আসে, তা জানা আছে। আসতে না দিলেই হয়।


তখন রজনী ব্রহ্মচারী সরলভাবে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, মোহ জয়ের সহজ পন্থা কি?


বাবা তখন উত্তর দেন, বাক্যবাণ, বন্ধু-বিচ্ছেদ বাণ ও চিত্ত-বিচ্ছেদ বাণ সহ্য করতে পারলে মৃত্যুকেও জয় করা যায়। অর্থাৎ বাবা রজনী ব্রহ্মচারীকে এই শিক্ষা দিলেন যে, একজন কর্মযোগী কখনও নিজ বাক্যদ্বারা কাউকে আঘাত করেনা বা কেউ যদি তাকে বাক্যদ্বারা আঘাত করতে চায়, তবে সেই আঘাত তাকে স্পর্শ করেনা, কারণ তিনি নিত্য, তার কর্মই ব্রহ্ম, ব্রহ্মকে কেউ কখনও আঘাত করতে পারে না। একজন যোগী যখন ব্রহ্মরূপে কর্মে রত, তখন সে সর্ব কর্মে থেকেও নেই। সেজন্য বন্ধু-বিচ্ছেদ জ্বালা তাকে স্পর্শ করে না। আর ব্রহ্মের চিত্ত সর্ব চিত্তে ব্যাপৃত। সেজন্য চিত্ত-বিচ্ছেদে সে ব্যাকুল হয় না। একজন কর্মযোগীর মধ্যে যখন এই ভাব আসে, তখন সে কোনোকিছুর মোহে আবৃত হয় না। কোনো মোহই তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। রজনী ব্রহ্মচারীকে বাবা নিজের সীলমোহর দিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন এবং তাঁর যোগসাধনার অগ্রগতি নিজে পরীক্ষা করতেন।


বাবা লোকনাথ রজনী ব্রহ্মচারীকে যে শিক্ষা দিলেন তাতে তিনি হতে পারছেন কি না, সেটা তিনি একবার পরীক্ষা করতে চাইলেন। ঢাকা থেকে যখন রজনী ব্রহ্মচারীর কোনো ভক্ত বারদী আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে আসত, তখন বাবা তাদের বলতেন, রজনী একটা ভণ্ড। তোরা আর রজনীর কাছে যাস না। সে কৌপীন পড়ে ঘুরে বেড়ায় আর বলে আমি তাকে কৌপীন পড়তে বলেছি। কিন্তু আমি তাকে একথা বলিনি। (যদিও বাবা নিজেই তাঁকে কৌপীন পড়তে আদেশ দিয়েছিলেন। বাবা বলেন, ও নিজেকে জাহির করবার জন্য, লোকেদের কাছ থেকে নাম, সম্মান পাবার লোভে আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলে।


যে-সমস্ত ভক্তগণ রজনী ব্রহ্মচারীর কাছে প্রভূত উপকার পেয়েছেন তারা বাবা লোকনাথের মুখে এইসব কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। তারা ভাবতে থাকেন যে মহাপুরুষের সান্নিধ্যে এসে এবং তার কৃপায় রজনী ব্রহ্মচারী এত অল্পদিনের মধ্যে, এত অল্প আয়াসে এত সিদ্ধাই অর্জন করেছেন, সেই মহাপুরুষ যখন নিজের মুখে এইসব কথা বলছেন, তখন তা মিথ্যা হতে পারে না। যে মহাপুরুষের এক কথায় কত অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়, তিনি মিথ্যা বলছেন, এ কথা ভাবাও পাপ। তাই বাবা লোকনাথের কথা রজনী ব্রহ্মচারীর ভক্তগণ ঢাকা শহরে প্রচার করতে থাকে। এই প্রচারের কিছুদিনের মধ্যেই ভক্তদের মধ্যে রজনী ব্রহ্মচারী সম্বন্ধে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং তারা রজনী ব্রহ্মচারীর আশ্রমে যাওয়া বন্ধ করে দেন।


গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন বাবা লোকনাথের একজন অনুগত ও একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি জানতেন যে রজনী ব্রহ্মচারীকে কর্মযোগ ও সাধনপথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাবা লোকনাথ নিজেই। এমনকি তিনি নিজে সকলকে বলতেন, রজনী হল আমার সীলমোহর। রজনী ব্রহ্মচারীর গুরুভক্তিতে তিনি কখনও কোনো খুঁত দেখেননি। রজনী ব্রহ্মচারী ছিলেন গুরু অন্ত প্রাণ। সেই রজনী সম্বন্ধে বাবা লোকনাথ কেন এসব কথা বলছেন সেই কথা জানার জন্য তিনি একদিন রজনী ব্রহ্মচারীর আশ্রমে গিয়ে বাবার সব কথা তাকে বলেন।


রজনী ব্রহ্মচারী গিরিশবাবুর মুখে সব কথা শুনে অবিচলিতভাবে বলেন, বাবা লোকনাথের মঙ্গলময় স্বরূপ তিনি দর্শন করেছেন। গুরুতর হৃদয়াসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ব্রহ্মচারী বাবার লীলা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাঁর প্রতিটি আচরণই আমার জন্য মঙ্গলময়। তিনি আমার সম্বন্ধে যাই বলুন, আমি জানি তিনি আমার মঙ্গলের জন্যই বলবেন।


এমন গুরু ও এমন ভক্তযোগী এ জগতে এমন সময় মেলা ভার। এখন যদি কোনো সিদ্ধ যোগী জানতে পারেন, তার কোনো ভক্ত তাকে অবজ্ঞা করেছেন, তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের যোগবিভূতি ব্যবহার করে সেই ভক্তের ক্ষতি সাধন করে দেবেন।


গিরিশবাবু রজনী ব্রহ্মচারীর কথায় অবাক হয়ে যান। তার প্রতি গিরিশবাবুর ভক্তিশ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, গুরুর প্রতি রজনী ব্রহ্মচারীর ভক্তিশ্রদ্ধা কত গভীর ও কত অবিচল। এইরকম গুরুভক্তি আছে বলেই তো তিনি লোকনাথ বাবার দ্বারা সঞ্চারিত যোগশক্তি নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছেন।


এইভাবে এক বছর ধরে বাবা লোকনাথের লীলা চলতে থাকে। রজনী ব্রহ্মচারী বাবার উক্তিকে আশীর্বাদ মনে করে অন্তরে ধারণ করেন আর ভক্তেরা যখন এই সব কথা তাকে বলেন, তখন তিনি তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ভক্তদের কথা তার মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না বা তার গুরুর প্রতি কোনো রকম ক্ষোভের সৃষ্টি করে না। একবছর পরে একদিন রজনী ব্রহ্মচারী বারদী আশ্রমে আসেন ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনের জন্য। আশ্রমে এসে বাবাকে প্রণাম করে তিনি নির্বিকারভাবে আশ্রমের সেবায় লেগে যান। কোনো রকম মান-অপমান বোধ তার ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। তার মনের মধ্যে কেবল একটি আগ্রহ বাবার নিজের মুখ থেকে শোনার যে, বাবার এইরূপ আচরণ করার প্রকৃত কারণ কি?


রজনী ব্রহ্মচারী যখন আশ্রমে থাকতেন, তখন গোয়ালিনী মা-র থেকে খাবার নিয়ে তিনি নিজে হাতে বাবাকে খাইয়ে দিতেন। এদিনও তেমন খাবার নিয়ে তিনি বাবাকে খাওয়াতে এলেন। তার ব্যবহারে কোনো রকম মানসিক বিরূপতা প্রকাশ পেল না। খাওয়াতে খাওয়াতে এক সময় তিনি বাবাকে প্রশ্ন করলেন, বাবা, একথা কি সত্য যে, আপনি বহু লোকের কাছে বলেছেন, রজনী নিজের ইচ্ছায় সম্মান আর যশের মোহে কৌপীন পড়েছে, আমি তাকে পড়তে বলিনি! আপনি জানেন, একথা মিথ্যা। তবুও আপনি কেন এই মিথ্যার অবতারণা করেছেন আমার জানতে ইচ্ছা হয়।


রজনীকান্তের কথা শুনে বাবা সোজা তাকে উত্তর দেন–হ্যাঁ, বলেছি তো। তোকে কৌপীন নিতে বলেছি বলে তুই আমার দুর্নাম করে বেড়াস। আর তার ফলে বহু লোক এসে আমায় বিরক্ত করে।


বাবার কথা শুনে রজনীকান্তের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বাবা লোকনাথের মাহাত্মকীর্তন তার জীবনের ব্রত। তিনি যে কাজ করেন, সব বাবা লোকনাথের নাম নিয়েই করেন এবং তার যোগশক্তির ক্ষমতাতেই করেন। অথচ বাবা বলছেন কিনা সে বাবার দুর্নাম করে বেড়ায়! বিস্ফারিত চোখে তিনি বাবার মুখে দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হয় না।


বাবা লোকনাথ রজনী ব্রহ্মচারীর চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর সপ্রশ্ন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারেন। শিষ্যের অন্তরের বেদনা নিরসনের জন্য তিনি তখন সস্নেহে বলেন–’দূর’ শব্দের অর্থ ব্যবধান আর ‘নাম’ শব্দের অর্থ যশ। দূর থেকে যশকীর্তন করার নাম দূর্নাম। তুই দূর থেকে আমার যশকীর্তন করলে, লোকে আমার কাছে এসে ভিড় করে। যোগীর কাছে যত বেশি সংসারী লোকের ভিড় হয়, তাঁর যোগসাধনায় তত বিঘ্ন ঘটে। লোকের ভিড়, তাদের নামকীর্তন সাধকের মনে মোহ বা অহঙ্কারের সৃষ্টি করতে পারে। আর যোগী যদি একবার সেই মোহজ্বালে জড়িয়ে পড়ে, তবে আর সাধন মার্গের উচ্চস্তরে উঠতে পারে না। পরম করুণাময় বাবা তার প্রিয় শিষ্যকে আধ্যাত্ম পথের বাধাগুলি থেকে সচেতন করার জন্যই তার নিন্দার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্যকে সর্বদা মোহমুক্ত ও অহংমুক্ত রাখতে চান যাতে সে সাধন মার্গের আরও উচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারেন।


রজনী ব্রহ্মচারী বাবার এই উদ্দেশ্য জানতে পেরে তার চরণে লুটিয়ে পড়েন। তার প্রতি বাবার যে কি অসীম কৃপা তা অনুধাবন করে তাঁর মস্তক বাবার চরণে লুটিয়ে পড়ে। এদিকে ভক্তগণ ধীরে ধীরে বাবার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন এবং রজনী ব্রহ্মচারীর প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব ত্যাগ করে তার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হন।


রজনী ব্রহ্মচারী বুঝতে পারেন যে বাবার শরণপথে তিনি সর্বদা রয়েছেন এবং বাবা তাকে নিত্য পরীক্ষা করে চলেছেন। এবারের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন কেননা তার প্রতি বাবার বিরূপ মন্তব্য সকল শুনেও তাঁর মন বিচলিত হয়নি। বাবার পূণ্যচরণ থেকে তার মন সরে যায়নি বা তিনিও কোনো মন্তব্য করেন নি। বাবার সামনে এসেও তিনি বাবাকে কোনো কথা বলেন নি। কেবল এইরূপ আচরণের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে লোকহিতের জন্য হলেও কোনো সাধক যখন তার যোগবিভূতি ব্যবহার করেন, তখন তার মধ্যে একটি অহংবোধ জন্ম নেবার অবকাশ থাকে। সেই অহংবোধ থেকেই মোহের সৃষ্টি হয়। আর এই মোহই আধ্যাত্মিক উন্নতির সব থেকে বড় বাধা। বাবা লোকনাথ তাঁকে এই মোহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই ওই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর মনের জিজ্ঞাসা প্রশমিত হয়ে গেছে। তিনি ঢাকা ফিরে গিয়ে আবার তার কর্মযোগে প্রবৃত্ত হলেন। বাবার প্রতি রজনী ব্রহ্মচারীর যে অটল বিশ্বাস আর অবিচল ভক্তি ছিল তার জোরে রজনী ব্রহ্মচারী ক্রমে সাধনার উচ্চস্তরে উন্নীত হতে থাকেন।


বেশ কিছু সময় পর একদিন বাবা লোকনাথ তাঁর শিষ্যকে বারদীতে তার কাছে ডেকে পাঠান। রজনী ব্রহ্মচারী তার কাছে এলে তিনি তাকে বলেন, রজনী সংসার আশ্রমের মধ্যে থেকে কর্তব্যকর্ম করে যতটা সাধনা করার, তোর তা করা হয়েছে। এবার তোকে নিরালায় গিয়ে যোগসাধনা করতে হবে। বাবা তার স্নেহের শিষ্যকে আরও বলেন, তুই যোগী হয়েছিস ঠিক, কিন্তু আমি চাই তুই মহাযোগী হ। আর তার জন্য তোর সংসারের সমস্ত সম্বন্ধ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ হয়ে যোগসাধনা করতে হবে। তা না হলে প্রকৃত জীবন্মুক্তির অবস্থা লাভ করা সম্ভব নয়। তাই আমি চাই তুই আলাদা কোথাও আমার মতো একটা ঘর করে বসে সাধনার গভীরে ডুবে যা।


মহাশক্তিধর গুরুর আদেশ মাথা পেতে নেন রজনী ব্রহ্মচারী। বাবার আদেশ তার মধ্যে জীবন্মুক্তির এক পরোক্ষ দিব্য ভাবের আবেশ জাগায়। তার অন্তর এক অজানা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। হাতে ধরে বাবা লোকনাথ তাকে যোগসাধনার উচ্চমার্গে উন্নীত করে দিচ্ছেন। জীবন্মুক্তির পথের সন্ধান দিয়ে নিজে তার পথ প্রদর্শন করছেন। কত ভাগ্যবান তিনি, যে এই ব্রহ্মজ্ঞ দেবসুলভ মহাপুরুষের কৃপা পেতে সক্ষম হয়েছেন। পরম ভক্তিতে ও শ্রদ্ধায় তার মস্তক এই দেবপুরুষের চরণে আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি ভক্তিভাবে বিভোর হয়ে বাবার চরণে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকেন আর ব্রহ্মপুরুষ বাবার শরীর থেকে এক দিব্য জ্যোতি তার শরীরে প্রবেশ করে।


এরপর রজনী ব্রহ্মচারী যোগসাধনায় লীণ হয়ে যান। সংসার জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে গভীর যোগ সাধনায় তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেন এবং একদিন সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছে বহু সিদ্ধিলাভ করেন। অতঃপর লোকনাথ বাবার নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে তার মতাদর্শ সাধারণের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন এবং নিজের যোগসাধনার সিদ্ধাই মানবহিতে ব্যবহার করতে থাকেন। তাঁর সমস্ত কর্মই তিনি লোকনাথ বাবার নামে উৎসর্গ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।


.


সুরথনাথ ব্রহ্মচারী


দীর্ঘ ৯০ বছর ধরে পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল এবং হিমালয়ের উচ্চশিখরে তপস্যা করে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তারপর আরও ৩০ বছর কঠোরভাবে যোগসাধনার প্রয়োগ করে বিস্তীর্ণ বরফাঞ্চল ও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় করেছেন ও নিজের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছেন। এরপর তিনি নিম্নভূমিতে অবতরণ করেছিলেন এবং বসবাস করেছিলেন মানবকল্যাণে তার অনন্য যোগসাধনাকে ব্যবহার করার জন্য। মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবার জন্য। এছাড়াও তার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল তার গুরুদেব আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করা এবং তার গর্ভধারিণী মাতাকে বর্তমান জন্মে দর্শন দেবার। সেই কার্য সম্পন্ন করার নিমিত্তই তার বারদীতে অবস্থান। কিন্তু এত উচ্চমার্গের একজন ঈশ্বরকোটির যোগীর সন্ধান পাওয়ামাত্র তখন নিপীড়িত সমাজের মানুষ সংসারের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ও দেহের রোগ নিবারণের জন্য তার কাছে ভিড় করে। বারদীর আশ্রম হয়ে ওঠে হাসপাতাল। করুণাময় বাবা তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে তাদের দুঃখ-দুর্দশার নিরসন করেন। কিন্তু এইটি তার আসল কাজ ছিল না। কেননা এইসব কাজের জন্য যোগীকে তাঁর যোগবিভূতির ব্যবহার করতে হয়। একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হিসাবে তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে। কিন্তু মানুষ তার কাছে কেবল রোগমুক্তি ও সংসারের দুর্দশার থেকে মুক্তি পেতে আসে। এটা তাঁর ভালো লাগে না। এজন্য তিনি কিছু ব্যক্তির মধ্যে যোগশক্তি সঞ্চারিত করে তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কর্মযোগের মাধ্যমে সাধনা করতে। রজনী ব্রহ্মচারী ছিলেন এঁদের মধ্যে অন্যতম। সেইজন্য বাবা তাকে নিজের সীলমোহর বলতেন। কিছু কিছু সাধারণ ব্যক্তির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে বাবা লোকনাথ তাদের কর্মযোগে নিয়োজিত করেছিলেন। একসময় সেই কর্মযোগীরাই বড়ো যোগী হয়ে মানব কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। সেইরকম আর এক ব্যক্তিত্ব ছিল সুরথ ব্রহ্মচারী।


শ্রী অখিলচন্দ্র সেন ঢাকা জেলার অন্তর্গত সোনার গাঁ অঞ্চলে এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেইসময় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সোনার গাঁ’র খুব নাম ছিল এবং সেখানে অনেক ধনী পরিবারের বসতি ছিল। অখিলচন্দ্র সুদর্শন যুবক ছিলেন এবং খুব সৌখীন ছিলেন। তার জীবনযাত্রা যৌবনে ভোগবিলাসে পরিপূর্ণ ছিল। প্রতিদিন ধনী বন্ধুদের সংসর্গে মদ্যপান ও নারী বিলাসিতায় তাঁর দিন খুব ভালোই কাটছিল। একদিন সান্ধ্য আসরে একজন বারদীর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কথা বলে। তার সারা বঙ্গে খুব নামডাক আছে। শুনে অখিলচন্দ্রের ইচ্ছা হয় বারদীতে গিয়ে তাকে দর্শন করার।


একদিন সকালে কোঁচানো বাবু ধুতি, শার্ট, কোট, মোজা, জুতো, গলায় সোনার চেন ও রুদ্রাক্ষ মালা পড়ে তিনি বারদী আশ্রমে উপস্থিত হলেন। দেখতে তাকে তখনকার দিনের ফুলবাবুর মতো লাগছিল। আশ্রমে পৌঁছে বাবার সামনে উপস্থিত হতেই বাবা তাকে দেখে হেসে বললেন, বড়ো যে সাজ-সজ্জা করে এসেছিস দেখছি। অখিলচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে উত্তর দেন, সাজবো না কেন? এই দেহ তো দেবতার মন্দির। এ দেহকে সাজাবো না তো কাকে সাজাবো?


অখিলচন্দ্রের উত্তর শুনে বাবা প্রসন্ন হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন অখিলচন্দ্র বিলাসী ও ব্যভিচারী হলেও তাঁর অশুদ্ধ দেহের আধারে এক শুদ্ধভাব আছে। ভোগের মধ্যে সহসা তাঁর মধ্যে এক ত্যাগের ভাব জাগ্রত হওয়ায় এক অধ্যাত্ম চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। অখিলচন্দ্রের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা বললেন, ঠিকই বলেছিস। এ দেহ তো দেবতারই মন্দির। বাবার এই স্নেহময় উক্তি শুনে অখিলচন্দ্রের মনে এক আলোড়ন শুরু হলো। বাবার দিকে তাকিয়ে যেন তিনি আর চোখ ফেরাতে পারছেন না। বাবা তার মস্তক স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন। বাবার দর্শনে এবং তার সস্নেহ স্পর্শে অখিলচন্দ্রের মন এক দিব্য আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেল। মনের মধ্যে তার এমন এক আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল যে আনন্দ, যে তৃপ্তি তিনি চরম ভোগবিলাসেও পাননি; জগতে অর্থের বিনিময়ে যা কিছু কাম্যবস্তু, তিনি এই বয়সে সবই ভোগ করেছেন। কিন্তু যত ভোগ করেছেন, ভোগের বাসনা তত বেড়ে গেছে। ভোগের বাসনার নিবৃত্তি তাতে কখনই হয় নি। কিন্তু আজ এ কি হলো! এই মহাপুরুষের এক স্পর্শে এবং তাঁর প্রতি তাঁর দিব্য দৃষ্টি নিক্ষেপণে তার মনে এক তুমুল আলোড়ন এনে দিয়েছে। এই মহাপুরুষের সামনে বসে তাঁর মনে হচ্ছে ভোগবাসনায় যে পার্থিব সুখ পাওয়া যায়, তা ক্ষণস্থায়ী। সে সুখ অন্তরের এত গভীরে পৌঁছয় না। একজন মহাপুরুষের স্পর্শে যে সুখ পাওয়া যায়, যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটা অন্তরের গভীরে স্পর্শ করে এবং অন্তরকে সেই সুখে আবৃত করে রাখে। সুরা ও নারীসঙ্গ লাভ করে তিনি যে সুখ এতদিন ভোগ করে এসেছেন, সেই সুখ তো অন্তরের এত গভীরে কখনও প্রবেশ করতে পারেনি। যে অখিলচন্দ্র ফুলবাবু সেজে বাবাকে দর্শন করতে এসেছিলেন, তিনি বাবার চরণে নিজেকে সমর্পণ করলেন। বাবার কৃপা প্রার্থনা করলেন। তারপর এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ রূপে সোনার গাঁ ফিরে এলেন।


সোনার গাঁ ফিরে এসে তার আর ভোগবিলাসের জীবন ভালো লাগে না। সুরা ও নারীসঙ্গ, যা ভিন্ন তিনি একদিনও থাকতে পারতেন না, তা তার বিষময় মনে হতে লাগলো। তার অন্তরে কেবল বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার মুখ ও স্নেহময় আশীর্বাদ ভেসে ওঠে। কিছুদিন পরপর তিনি বারদী আশ্রমে আসেন বাবাকে দর্শন করতে। বাবা লোকনাথও তাকে সন্তানবৎ স্নেহ করেন এবং তার প্রতি নিজের কৃপা বর্ষণ করতে থাকেন। প্রতি দর্শনেই বাবা তাকে আধ্যাত্মপথের বিভিন্ন শিক্ষা দান করতে থাকেন এবং কর্মের মাধ্যমে তার প্রারব্ধকে ক্ষয় করাতে থাকেন। বাবা জানতেন প্রারক্কের ভোগের জন্য অখিলচন্দ্র ওইরূপ ভোগবিলাসী স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করছিলেন। অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ নিজের দেবসত্তায় জানতে পেরেছিলেন অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ভোগের কথা। তিনি নিজেই ছিলেন পূর্ণব্রহ্ম। তাঁর মধ্যে সমস্ত দেবসত্তা বিরাজমান ছিল। তিনি বলতেন কোনো ভক্তের অন্তরে যখন তার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়, তখন তার অন্তরের সব ভজ তার সামনে খুলে যায়। তিনি সেই ভক্তের জন্ম-জন্মান্তরের সব কর্মভোগ সম্বন্ধে অবহিত হয়ে যান। সেইজন্য তিনি যখন জানতে পারলেন যে অখিলচন্দ্র ভোগবিলাসী স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করছেন তার প্রারব্ধ কারণে কিন্তু তার অন্তঃকরণে একটি শুদ্ধ আধার আছে, তিনি নিজে অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ভোগকে কর্মের মাধ্যমে ক্ষয় করিয়ে তার অন্তঃকরণে স্থিত শুদ্ধ আধারকে জাগ্রত করে দিয়েছিলেন। কেমন করে গুরু তাঁর শিষ্যের প্রারব্ধকে ক্ষয় করে তার মধ্যে স্থিত শুদ্ধ আধারকে জাগ্রত করে তাকে আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারে, লোকনাথ বাবার অখিলচন্দ্রের উপর কৃপার এ এক অনন্য উদাহরণ যা আজকের যুগে অতি বিরল।


বর্তমান কালে কোনো শিষ্য ও ব্যক্তি সমস্যা জর্জরিত হয়ে গুরু বা কোনো সাধক বা জ্যোতিষের কাছে গেলে তারা বলেন, এটা আপনার প্রারন্ধের ভোগ। প্রারন্ধের ভোগ কেউ কাটাতে পারে না। ব্যক্তিকে স্বয়ং সেই ভোগ সম্পন্ন করতে হয়।


আমি হৃষিকেশে এক মহাযোগী ও শক্তিধর মহাপুরুষের দর্শন ও কৃপালাভ করেছিলাম, যিনি প্রারব্ধ ভোগ সম্পর্কে আমায় বলেছিলেন, যিনি প্রারব্ধ তোমার এই জীবনে লিখে দিয়েছেন, তার কাছেই আকূল আর্তি জানাও তাকে ক্ষয় করে দেবার। তিনিই সামান্য উপায়ে সেই প্রারক্কের ক্ষয় করে দেবেন। যেটা অনেক বড়ো কিছু হতে পারত, সেটা সামান্য কষ্ট ভোগের মাধ্যমে তিনি ক্ষয় করে দেবেন। বাবা লোকনাথ যেভাবে নিজে থেকে অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ভোগ ক্ষয় করে দিয়েছিলেন, তাতে সেই মহাযোগীর কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু এ কাজ একমাত্র প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষের দ্বারাই করা সম্ভব। এবং প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ তখনই এই কাজ করেন যখন যে ব্যক্তির প্রারব্ধ তিনি ক্ষয় করছেন, সে নিজেকে নিঃশর্তভাবে অবিচল ভক্তির দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষের চরণে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করতে পারেন। অখিলচন্দ্র সেইভাবে নিজেকে বাবা লোকনাথের চরণে সমর্পণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে বাবা তাঁর প্রারব্ধ ভোগগুলিকে ক্ষয় করিয়ে তাকে দেহবাদী জৈব চেতনার অন্ধকার স্তর থেকে টেনে আধ্যাত্ম চেতনার আলোকের স্তরে তুলে আনেন। এর জন্য চাই গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি, অকৃত্রিম বিশ্বাস এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এ কাজ সেই শিষ্যই করতে পারে, যে নিজের গুরুর বাক্যকেই ব্রহ্ম বলে মনে করে তা পালন করতে পারে। সেই শিষ্যকে গুরু ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে তোলেন, যে ভাগ্য অখিলচন্দ্রের হয়েছিল।


এ সম্বন্ধে আমার সাধন পথে শোনা একটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন গুরুর কাছে দুই শিষ্য আসে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য। গুরুগৃহে তারা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। গুরু তাদের বলেন, গুরুবাক্যই ব্রহ্ম। পঞ্চভূত দেহের মধ্যে যে মনের অবস্থান সেটা ঠিক জলের মতো। যে রঙে তুমি তাকে রাঙাতে চাও, সে সেই রঙেই রেঙে উঠবে। যে শিষ্য গুরুবাক্য শুনে সেই রঙে মনকে রাঙাতে পারে, সে-ই ব্রহ্মলোকের সন্ধান পায় এবং সে-ই আলোকে তার জীবাত্মা পরমাত্মাকে দর্শন করে।


শিষ্যরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপযোগী হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য গুরুদেব তাদের নিয়ে একটি নদীর পাড়ে আসেন। সেখানে দুই শিষ্যকে নদীর ঘাটে সিঁড়িতে নেমে দাঁড়াতে বলেন। তিনি শিষ্যদের বলেন, তোমরা জল দেখবে। তারপর এক শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জল দেখছি। গুরু আবার জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জলে নদীপাড়ের গাছের ছায়া দেখছি। গুরু বলেন, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার নিচে জলের তলায় আরও সিঁড়ি দেখছি। গুরু আবার জিজ্ঞাসা করে, ভালো করে জল দেখে বলল, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে জলের তলায় কিছু মাছ খেলা করছে, আমি তাও দেখতে পাচ্ছি।


এবার গুরুদেব দ্বিতীয় শিষ্যকে বলেন, তুমি কি দেখছ? সে বলে, আমি জল দেখছি। গুরু আবার একই প্রশ্ন করলেন। সে বলে আমি জল দেখছি। গুরু বলেন, ভালো করে দেখে বলো তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জল দেখছি। গুরু তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, তুমি ভালো করে দেখে বল তুমি কি জল ছাড়া সেখানে আর কিছু দেখতে পাচ্ছ না? শিষ্য তখন হাউহাউ করে কেঁদে বলে, গুরুদেব আমার দু-নয়নে জল ছাড়া যে আর কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমি কি করব? গুরুদেব তখন উঠে এসে শিষ্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমিই ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী। আমি তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করবো।


এক্ষেত্রে দ্বিতীয় শিষ্যটি তার গুরুর বাক্যকে ব্রহ্মরূপ জ্ঞান করে তা পালন করেছিল। গুরু বলেছিলেন জল দেখতে। সেইজন্য সে তার মনে কেবল জল দেখার কথাকেই স্থান দিয়েছিল। গুরুর বাক্যকে সে ব্রহ্ম মনে করেছিল। অর্থাৎ জলে ব্রহ্মরূপ দর্শন করেছিল সে। তার মনকে সে সেই ব্রহ্মলোকের আলোয় রাঙিয়েছিল। সেজন্য জল ভিন্ন আর কিছুই তার দৃশ্যগোচর হয়নি। যে এই কাজ করতে পেরেছিল তার জীবাত্মাতো তখনই ব্রহ্মলোকে আলোকিত হয়ে পরমাত্মার দর্শন করে নিয়েছে। এ কাজ সম্ভব হয়েছিল গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি, অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে গুরু চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য। রজনী ব্রহ্মচারী এ কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অখিলচন্দ্রও এত ভোগবিলাসী হওয়া সত্ত্বেও বাবার চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেজন্যই তো তারা রজনী ব্রহ্মচারী ও সুরথ ব্রহ্মচারী হতে পেরেছিলেন। আমাদের আত্মপর্যালোচনা করে দেখা দরকার আমরা যখন বাবাকে ডাকি, সত্যিই কি সেই ডাক এই তিনগুণ সমন্বিত হয়।


আমি নিজে একবার নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, বাবা লোকনাথ আমাকে বাঁচাও। আমার অর্ধেক শরীর বাসের নিচে। আমার দুই পায়ের উপর বাসের চাকা উঠছে। আমার সামনে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু শমন ও আমার মাঝে বাবা লোকনাথ ছিলেন। শমণকে ফিরে যেতে হয়েছিল। যে পায়ের উপর বাসের চাকা উঠে আমার সমস্ত নিম্নাঙ্গ নিশ্চল করে দিয়েছিল, আমি সেই দুই পায়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছি এবং এই দুই পা নিয়েই পূর্ণ নর্মদা পরিক্রমা করেছি। সেজন্য পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি–ডাকার মতো ডাকলে বাবা ভক্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন না।


এক্ষেত্রে অখিলচন্দ্রের মধ্যে এমন পরিবর্তন বাবা এনে দিয়েছিলেন যে, তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। যখন বাবা বুঝতে পারলেন যে, অখিলচন্দ্রর ভিতরের আধার এখন আধ্যাত্ম কর্মে এগিয়ে যাবার জন্য তৈরি, তখন তিনি এক শুভলগ্নে অখিলচন্দ্রকে গৈরিক বস্ত্র দান করে দীক্ষা দিলেন এবং তার নাম হল সুরথনাথ ব্রহ্মচারী। কত ভাগ্য ছিল সেই অখিলচন্দ্রের যার সমস্ত প্রারব্ধ নিজে ক্ষয় করিয়ে দিয়ে এক চরম ভোগবিলাসী জীবন থেকে তাকে আধ্যাত্ম লোকের আলোয় আলোকিত করে নিজে দীক্ষা দান করে সুরথ ব্রহ্মচারীরূপে প্রতিষ্ঠা করলেন। দীক্ষা দান করে বাবা লোকনাথ সুরথ ব্রহ্মচারীকে যোগসাধনার কিছু তত্ত্ব শিক্ষা দিলেন এবং ব্রহ্মচর্য পালন করে গৃহে অবস্থান করে তাকে যোগসাধনায় রত হতে নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশের মাধ্যমে বাবা মানবসমাজের কাছে এবং তার ভক্তদের কাছে একটি বার্তা দিলেন।


সংসারী মানুষরা সাধারণতঃ মনে করেন সংসারে থেকে গৃহী জীবনযাপন করে সাধনা হয় না। সাধনা করতে হলে বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ে বা কোনো নির্জন স্থানে যেতে হয়। সাধনার একটি স্তরে হয়তো সে রকম যেতেও হয়। যেমন যেতে হয়েছিল রজনী ব্রহ্মচারীর। বাবা নিজে সুরথ ব্রহ্মচারীকে গৃহে অবস্থান করে যোগ সাধনায় রত হতে বললেন। বাবা যখন বলেছেন তখন গৃহে যোগ সাধনা করলেও সুরথ ব্রহ্মচারী নিশ্চয়ই ঈশ্বরকৃপা লাভ করবেন।


সদ্গুরুর কৃপা থাকলে শিষ্য যেখানেই সাধনা করুন সিদ্ধিলাভ করবেন। সুরথ ব্রহ্মচারীও বাবা লোকনাথের কৃপায় যোগসাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর যোগশক্তির পরিচয় পেয়ে অনেকে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সুরথ ব্রহ্মচারী বাবার আদেশে নিজেকে কর্মযোগে নিয়োজিত করেন। এরপর বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালনের মধ্যে দিয়েও তিনি কর্মযোগ থেকে বিচ্যুত হননি। অবশেষে ৪ঠা পৌষ, ১৩২৯ সনে তিনি স্ত্রী ও মাতাকে এই জগত সংসারে রেখে তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করে দেবলোকের পথে গমন করেন। তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করলেও তার ধনী ভোগবিলাসের জীবন থেকে সুরথ ব্রহ্মচারী হয়ে আধ্যাত্ম পথের উচ্চমার্গে বাবার কৃপায় উক্রমণের কথা লোককথা হয়ে আজও প্রচলিত আছে।


.


যামিনীকুমার মুখোপাধ্যায়


ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে বেজগাঁ নামক স্থানে এক সাধক বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যামিনী মুখোপাধ্যায়। ব্রিটিশ আমলে বেজগাঁর মুনসী বাড়ির খুব নাম ও প্রতিপত্তি ছিল। সেই বাড়ির এক বংশধর ছিলেন যামিনীবাবু। বংশানুক্রমিক যামিনীবাবুর পূর্বপুরুষেরা ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দান-ধ্যান করে তাঁরা বিক্রমপুরে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যামিনীবাবুর পিতা গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তার মাতা ঠাকুরানী সাধন ভজনে জীবন অতিবাহিত করতেন এবং সেই ভাবধারা যামিনীবাবুকে বাল্যবয়স থেকেই প্রভাবিত করেছিল। পিতার দেহত্যাগের পর যামিনীবাবু সাধুসঙ্গ করার দিকে ঝোঁকেন। তাঁর মনে অনেক ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যা নিরসন করার জন্য তিনি সাধুসঙ্গ করতেন। কোথাও তিনি তার মনের প্রশ্নের এমন উত্তর পেতেন না যা তাঁর মনকে শান্ত করতে পারে। যামিনীবাবু ঢাকা জেলার গেণ্ডারিয়া গ্রামে অবস্থিত শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন গোঁসাইজির সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতে। তার অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হয় না। একদিন গোঁসাইজি তার আশ্রমে রজনী ব্রহ্মচারীকে বলেন যামিনীবাবুকে একবার বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কাছে নিয়ে যেতে। যামিনীবাবু এক শুভদিনে রজনীকান্তের সঙ্গে বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। বারদী আশ্রমে এসে লোকনাথ বাবার সামনে দাঁড়াতেই তিনি বুঝতে পারেন যে যামিনীবাবুর মনে অসংখ্য আধ্যাত্মিক প্রশ্ন তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। প্রথম দর্শনেই যামিনীবাবুর মনে হয় যেন তিনি মূর্তিমান গীতার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আর স্থির থাকতে না পেরে বাবার সঙ্গে কিছু ধর্মীয় আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথম দিনের ধর্মীয় আলোচনা তার মধ্যে আরও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে এবং তিনি এরপর ঘন ঘন বাবার দর্শনে এসে ধর্মীয় আলোচনা করেন। এই ধর্মীয় আলোচনার মধ্যে তার সঙ্গে বাবা লোকনাথের অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি বাবার বিশেষ কৃপার পাত্র হয়ে ওঠেন। যামিনীকুমারের সঙ্গে বাবা লোকনাথের যে ধর্মীয় আলোচনা হয়েছিল সেগুলি আধ্যাত্ম সাধনার এক অমূল্য সম্পদ বলে পরিগণিত হয়। সেজন্য এইখানে যামিনী কুমারের আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা এবং বাবা লোকনাথের সেইসব জিজ্ঞাসার উত্তর উপস্থাপনা করা হল যাতে বাবার অগণিত ভক্ত সেই বার্তালাপের আধ্যাত্ম রসাস্বাদন করতে পারেন।


যামিনীকুমার : তাপ শব্দের অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : সুখে অথবা দুঃখে, জয় অথবা পরাজয়ে মনের যে অবস্থা হয়, তাই তাপ। যে কাজ করে তুই তাপগ্রস্ত হচ্ছিস বা সমাজকে তাপগ্রস্ত করছিস, তাই হল তাপ।


যামিনীকুমার: বাবা, তাহলে তো তাপশূন্য কোনো কাজই দেখতে পাচ্ছি না?


 বাবা লোকনাথ : ঠিকই বলেছিস। যে কোনো কাজ করতে গেলে কিছুটা তাপ তো তাতে থাকবেই। যে এই কথা জেনে কাজ করে সেই তো মুক্ত। ওরে, অজ্ঞানতা হল তাপের কারণ। ঈশ্বরের সৃষ্টির সঙ্গেই এই অজ্ঞানতা জড়িয়ে রয়েছে। এই অজ্ঞানতাই হল অবিদ্যা।


যামিনীকুমার : এই অবিদ্যা অজ্ঞানতা বলতে কি বোঝায়?


বাবা লোকনাথ : অনিত্য বস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুচিতে শুচিজ্ঞান, দুঃখে সুখ জ্ঞান, আর অনাত্মায় আত্মজ্ঞানকে অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতা বলে।


যামিনীকুমার : তাপের কারণ কি?


 বাবা লোকনাথ : বাসনাই হল তাপের কারণ। যার বাসনা নাই, তার তাপও নাই। যে লোক গন্ধ রসাদি ভোগে অনুরাগ বা তার প্রতি রাগ-দ্বেষ প্রকাশ না করে, যার কীর্তি ও সম্মান লাভে বিন্দুমাত্র বাসনা নেই, সেই লোকই যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞ। ব্রহ্মজ্ঞ লোকের সকল কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। শোক-সন্তাপ ও বিষয়-বাসনা মনকে কষ্ট দেয়।


যামিনীকুমার : পাপ কাকে বলে?


বাবা লোকনাথ : যাতে তাপ লাগে, তাই পাপ। সে তাপ তোমার নিজেরও হতে পারে, সমাজেরও হতে পারে। যে কাজ দ্বারা তুমি নিজেকে ও সমাজকে তাপগ্রস্ত করো, তাই পাপ কাজ।


যামিনীকুমার : আমার মাথা ব্যথায় আমি তাপগ্রস্ত হলাম। তাহলে মাথাব্যথায়ও কি পাপ হলো?


বাবা লোকনাথ : মাথা কি? কার মাথা? বেদনা কি? কে বেদনা বোধ করে? এই সব বিষয়ে আলোচনা করলে দেখবে মনেতেই বেদনার উৎপত্তি, স্থিতি, লয় মনের এই অবস্থান হয় অবিদ্যা থেকে। তখন বুঝতে পারবে, যেখানে অবিদ্যা, সেখানেই পাপ, সেখানেই তাপ। বিদ্যায় পাপ বা তাপ কিছুই থাকে না।


যামিনীকুমার : আচ্ছা বাবা, তাহলে তাপশূন্য তো কিছুই দেখি না।


বাবা লোকনাথ : ঠিক কথা। একথা জেনে যে কাজ করে সেই ব্যক্তিই মুক্ত। কিছু পরিমাণ তাপ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। কিছু পরিমাণ তাপ ছাড়া ঈশ্বরও সৃষ্টি করেন না।


যামিনীকুমার : ঈশ্বর তাপ ছাড়া সৃষ্টি করেন না, এই কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না।


বাবা লোকনাথ : অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই তাপের কারণ। আবার অবিদ্যা ছাড়া কোনো কাজই হয় না। সুতরাং ঈশ্বরও অবিদ্যার সাহায্য ছাড়া কোনো সৃষ্টিকাৰ্যই করতে পারেন না। কিছু পরিমাণ তাপ সব কাজের মধ্যেই আছে।


যামিনীকুমার : গুরু কে?


বাবা লোকনাথ : মানুষ যেখানে ঠেকে, সেখানেই শেখে। যার আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষা পাও, তিনিই গুরু।


যামিনীকুমার : গুরুকে সর্বদা স্মরণ করবে–এর অর্থ কি? বাবা লোকনাথ ও গুরুকে সর্বদা স্মরণ করবে মানে গুরুর আদেশ স্মরণ করবে। গুরুর আদেশই গুরু।  


যামিনীকুমার : গুরুর আদেশ যদি গুরু হয়, তবে তার দেহকে অনাদর করতে পারি?


বাবা লোকনাথ : না, গঙ্গাজলের পাত্রকে লোকে আদর করে।


যামিনীকুমার : গুরুর চরণ ধরবে। এর অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : গুরুর আচরণ করবে। অর্থাৎ গুরু যে আচরণ দ্বারা শিবত্ব লাভ করেছেন, তার অনুরূপ আচরণ করবে।


যামিনীকুমার :গুরুকে আসন-বসন দেবে। এই কথার অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : গুরুকে আসন দেওয়ার অর্থ হল তার আদেশ হৃদয়ে ধারণ করবে। বসন দেওয়ার অর্থ হলো, তার আদেশকে আচ্ছাদন দান করবে। অর্থাৎ অভক্ত নাস্তিকদের কাছে তার আদেশ প্রকাশ করবে না।


যামিনীকুমার : গুরুবৎ গুরুপুত্রেযু–এই কথার অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : গুরুর মতো যোগ্য যে গুরুর পুত্র, পৌত্রাদি, তাদের গুরুর মতো ভক্তি করবে।


যামিনীকুমার : গুরুর পুত্র কে? গুরুপুত্র মূর্খ হলে যদি তাকে ভক্তি করতে না পারি তাহলে কি দোষ হয়?


বাবা লোকনাথ : গুরুর ঔরসজাত পুত্র অথবা গুরুর উপদেশে পরিচালিত হয়ে যার জ্ঞান জন্মেছে, সেই গুরুর পুত্র। যদি শব্দ সংশয়াত্মক। গুরু পুত্রকে তুমি ভক্তি করতে পার কি না দেখ। না পারলে লোক দেখানো ভক্তি করলে লাভ না হয়ে ক্ষতি হবে।


 যামিনীকুমার : গুরু শিষ্যের কি করেন?


বাবা লোকনাথ : গুরু জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকাদ্বারা অজ্ঞানান্ধ শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন। আমি কে? আমার কর্ম কি? আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? সৃষ্টি কৌশল কি? এই সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে গুরু শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন।


যামিনীকুমার : গুরু গীতাতে ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান লেখার কারণ কি?


বাবা লোকনাথ : গুরু অনন্ত, ধ্যানও অনন্ত।


যামিনীকুমার : জীবের বন্ধন এবং মুক্তির কারণ কি? বাবা লোকনাথ : একই কারণ-মায়া। যামিনীকুমার ও বাবা, আমি বদ্ধ না মুক্ত, বুঝব কি করে?


বাবা লোকনাথ : ওরে, তাপই হল পরীক্ষার মূল। যখন সুখে-দুঃখে, মান-অপমানে, শীত-গ্রীষ্মে তুই একই অবস্থায় থাকবি, তোর চিত্তের কোনো চাঞ্চল্য দেখা যাবে না, তখনই বুঝবি তুই মুক্ত।


যামিনীকুমার : তাপ লাগবার কারণ কি?


বাবা লোকনাথ : কামনাই তাপের কারণ। যার কামনা নেই, তার তাপও নেই।


যামিনীকুমার : সন্ন্যাস ভালো অবস্থা কি না?


বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, ভালো অবস্থা।


যামিনীকুমার : সন্ন্যাস কাকে বলে?


বাবা লোকনাথ : শোন যামিনী, কর্ম পরিত্যাগ করা ও কর্ম করা এই দুইকেই যে একই অবস্থা মনে করে, সেই সন্ন্যাসী। সনাতন হিন্দু ধর্মে সন্ন্যাস অনেক রকম–বৈদিক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, উদাসী ইত্যাদি। এদের মধ্যে বৈদিক সন্ন্যাসী সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। সন্ন্যাস শব্দের অর্থ হলো-কামনা, বাসনা ও বিষয়াসক্তির ত্যাগ। বাহ্যিক ত্যাগ নয়, আন্তরিক ত্যাগই সন্ন্যাস। তাই সন্ন্যাসী কর্মত্যাগী নন, তিনি কাম্য কর্ম ত্যাগ করে নিষ্কামভাবে সমস্ত কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি দেহত্যাগের পর ব্রহ্মভূত হয়ে অর্থাৎ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মেই স্থিতি লাভ করেন। জীবস্মৃতি লাভই সন্ন্যাস আশ্রমের উদ্দেশ্য। বৈদিক সন্ন্যাসের চরম আদর্শ হল নির্বিকল্প সমাধিতে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে স্থিতি লাভ করানো। গীতায় বলা হয়েছে– ফলত্যাগী কর্মযোগীই নিত্যসন্ন্যাসী। কর্মযোগ ও সন্ন্যাস একই। অলসতা হেতু কার্য পরিত্যাগকে সন্ন্যাস বলে না।


যামিনীকুমার : এই সংসারে ত্রিবিধ তাপ কি?


বাবা লোকনাথ : এই সংসার ত্রিবিধ তাপে পূর্ণ। বাক্যবাণ, বিত্তবিচ্ছেদ বাণ, বন্ধুবিচ্ছেদ বাণ–এই তিনটি বাণ ত্রিবিধ তাপ। এই ত্রিবিধ তাপ যিনি সহ্য করতে পারেন, তিনি মৃত্যুকে জয় করতে পারেন।


যামিনীকুমার : তবে কি আপনি এই সমস্ত তাপের মধ্যে থাকাই শ্রেয় মনে করেন?


বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, তাই মনে করি। কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। যামিনীকুমার ও তাপের কি কোনো উপকারিতা আছে? বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, প্রচুর উপকারিতা আছে। প্রহ্লাদ ও সীতাকে দেখ। যামিনীকুমার ও প্রহ্লাদ ও সীতার কথা কি বললেন, বুঝলাম না। বাবা লোকনাথ : অবতার কেন, কী উদ্দেশ্যে হয়, বোঝ। ভগবান ধর্ম রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন এবং নিজে সেই ধর্ম আচরণ করে জীবকে শিক্ষা দেন।


যামিনীকুমার : প্রহ্লাদকে তো ভগবানকে পাবার জন্য কত উৎকট বিপদই না সহ্য করতে হয়েছিল।


বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, তা সত্য। কিন্তু শত তাপের মধ্যেও তারা কখনও নষ্ট হয়নি। এত উৎকট তাপেও অগ্নি পরীক্ষার সময় অগ্নি অণুমাত্রও প্রবেশ করতে পারল না সীতার দেহে। স্বয়ং হরি এসে সীতা এবং প্রহ্লাদকে কোলে তুলে নিয়ে রক্ষা করলেন।


যামিনীকুমার : বাবা, জীবের কি কি অবস্থা হয়?


বাবা লোকনাথ : ওরে, জীবের তিন অবস্থামুক্তাবস্থা, বদ্ধাবস্থা ও তৃতীয় মুক্তাবস্থা। প্রথম মুক্তাবস্থায় জীবের সামাজিক কোনো বন্ধন থাকে না। যেমন, পশুজীবন। বদ্ধাবস্থা হল সাংসারিক বা সামাজিক জীবের অবস্থা, যেমন তোর অবস্থা যামিনী। তৃতীয় মুক্তাবস্থা হল বন্ধনের ঊর্ধ্বের অবস্থা। যেমন আমার ও হিতলাল মিশ্রের অবস্থা।


যামিনীকুমার : আচ্ছা বাবা, আপনি আমাকে দ্বিতীয় অবস্থার আর আপনাকে তৃতীয় অবস্থার জীব বললেন কেন? আপনার ও আমার কর্মের মধ্যে তফাৎ কি?


বাবা লোকনাথ: দেখ যামিনী, আমার আশ্রমে প্রতিদিনই কিছু লোক প্রসাদ পায়। তেমনি তোর বাড়িতেও তোর পরিবারের লোকেরা প্রতিদিনই আহার করে। আমার আশ্রমে যারা প্রসাদ পাবে তাদের খাদ্যবস্তু কোথা থেকে আসবে আর তারা কি প্রসাদ পাবে, সে বিষয়ে আমার কোনো চেষ্টা বা ভাবনা নাই। কিন্তু তোর? তোর পরিবারের লোকেরা কি খাবে সে বিষয়ে তোর চেষ্টা-ভাবনা দুটোই আছে। যেমন, তুই মনে করিস তুই এদের খেতে দিস। আমি মনে করি আমি কাউকে খেতে দিই না। যার এখানে আহার আছে, সে আহার করবে। যার তা নাই, সে আহার করবে না। এতে আমার কোনো তাপ নেই। আমার জ্ঞান আছে, তাই আমি এরকম মনে করি। কিন্তু তুই তো অজ্ঞান, তাই তোর মনে ভয় আছে যে তুই তোর পরিবারের লোকেদের ভালো খেতে না দিলে সমাজের লোক তোর নিন্দে করবে। পরিবারের লোকেরা চেঁচামেচি করবে। দেখ, আমার কিন্তু ওই সব ভয় নেই।


যামিনীকুমার : ধর্ম কি? বাবা লোকনাথ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ–এই তিনগুণের যে কর্ম, তাই ধর্ম। যামিনীকুমার ও সত্ত্ব গুণের লক্ষণ কি?


বাবা লোকনাথ : প্রকৃত ব্রাহ্মণের লক্ষণই সত্ত্বগুণের লক্ষণ, অর্থাৎ সম, দম, তপঃ শৌচ ইত্যাদি। রজঃ গুণের লক্ষণ হল দান, ঐশ্বর্য, বীরত্ব ইত্যাদি। আর তমঃ গুণের লক্ষণ হল হিংসা, নিদ্রা, তন্দ্রা, দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি।


যামিনীকুমার : এইসব গুণ চিন্তা করলে আমাদের কি উপকার হবে?


বাবা লোকনাথ : সূর্যোদয়ে যেমন অন্ধকার দূর হয়ে যায়, গৃহস্থ জাগলে যেমন চোর পালায়, তেমনি এইসব গুণের চিন্তা বারবার করলে নিকৃষ্ট কর্মগুলি পালিয়ে যাবে। তখন এই দেহ দেবমন্দির হয়ে উঠবে।


যামিনীকুমার : দেহ ও মনকে পবিত্র রাখার কি কোনো উপায় আছে?


বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ আছে। সাত্ত্বিক আহারে দেহ পবিত্র হয় আর বাসনা ত্যাগে মন পবিত্র হয়। এইভাবে যখন তোমার দেহ ও মন পবিত্র হবে, তখন বুঝবে ‘হরি’ কেমন। তখন জানবে ‘হরি’ তোমার কে?


যামিনীকুমার : ব্রহ্মশক্তি অসার হৃদয় অধিকার করবে–এর অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : কালীই ব্রহ্মশক্তি। শবের হৃদয় অধিকার করে রয়েছেন।


যামিনীকুমার : শব কে?


বাবা লোকনাথ : তুমি যাকে শিব বলে জানো।


যামিনীকুমার : শব তো মৃতদেহকে বলে। বাবা লোকনাথ ও তাই শিবকে শব বলে। যামিনীকুমার ও শিব তো মৃত্যুঞ্জয়। তবে তাকে শব বলে কেন?


বাবা লোকনাথ : যে কারণে শিব মৃত্যুঞ্জয়, সেই কারণেই শব। যামিনীকুমার ও সেই কারণটা কি, তা তো বুঝলাম না। বাবা লোকনাথ? সেই কারণ হচ্ছে বাসনা ত্যাগ। বাসনা ত্যাগ হলেই জীবের অমরত্ব লাভ হয়। তার আর তখন মৃত্যু থাকে না। কামনা-বাসনা না থাকলে অহংবোধ থাকে না। তখন কোনো কার্য তার কর্তৃত্বে হচ্ছে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় জীব সব কাজ করে যান, অথচ আসলে তিনি কিছুই করেন না। ভোগ বাসনার অভাবে জীব তখন মৃতবৎ সংসারে বিচরণ করেন। বাসনাশূন্য হলেই জীবের জীবত্ব শেষ হয়ে যায়, এবং জীব শিবত্ব লাভ করে। সেই অবস্থায় ইচ্ছাময়ী ব্রহ্মশক্তি কালীরূপে শবদেহ অধিকার করেন।


যামিনীকুমার : তবে কি আমার বাসনা ত্যাগ হলে হৃদয়ে কালীমূর্তির আবির্ভাব হবে?


বাবা লোকনাথ : সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মনো রূপকল্পনম অর্থাৎ সাধকের হিতের জন্যই ব্রহ্মরূপ পরিগ্রহ করেন। তোমার হিতের জন্য তোমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্যই ওই কালীমূর্তির আবির্ভাব।


যামিনীকুমার :সাধক কয় শ্রেণিতে বিভক্ত?


বাবা লোকনাথ : সাধক চার শ্রেণিতে বিভক্ত; জ্ঞানী, যোগী, ভক্ত ও কর্মী।


যামিনীকুমার : এই চার শ্রেণির সাধকের সাধন প্রণালীর মধ্যে কি কোনো প্রভেদ আছে?


বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, আছে। জ্ঞানীর সাধন হল সৎসঙ্গ, দান, বিচার ও সন্তোষ। যোগীর সাধন হল জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যোগ করা। ভক্তের সাধন হল সম্পূর্ণ নিষ্কামভাবে ভগবানের আত্মবৎ পূজা ও সেবা করা। কর্মী বা কর্মযোগের সাধনা হল দান, যজ্ঞ ইত্যাদি সাংসারিক কাজকর্ম অনাসক্তভাবে করা। সব সাধকই বিচার করে কর্ম করতে করতে বাসনশূন্য হয়ে মুক্ত হয়ে যায়।


যামিনীকুমার : সৎসঙ্গের ফল কি?


বাবা লোকনাথ : গঙ্গাস্নান ও বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণে যে ফল হয়, সৎসঙ্গে বা সাধুসঙ্গে সেই ফল হয়। সাধু দর্শনমাত্রেই জীবের সকল পাপ ও তাপ হরণ করেন। তাই সাধুসঙ্গের গুণ ও মহিমা অনন্ত।


যামিনীকুমার : দানের উপকারিতা কি? বাবা লোকনাথ : সাত্ত্বিক দান উদারতা ও বৈরাগ্য এনে দেয়। যামিনীকুমার ও বিচারে লাভ কি?


বাবা লোকনাথ : বিচারে আত্ম-অনাত্ম বোধ হয়, নিত্য-অনিত্য বিবেক জন্মায়। নিত্যনিত্য বিবেক জন্মালে অশুদ্ধ আরোগ্যের উৎপত্তি হয় এবং জীব শিব হয়।


যামিনীকুমার : সন্তোষ কিভাবে সাধন করতে হয়?


বাবা লোকনাথ : সংসারের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যেও চেষ্টা করে মনকে তুষ্ট রাখাই হল সন্তোষ সাধনের উপায়।


যামিনীকুমার : ভগবান ধর্ম রক্ষার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। এখানে যুগ কথার অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : কোনো কার্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক যুগ বলা হয়। বাল্য, যৌবন, বার্ধক্যও এক একটি যুগ। যুগ মানে সময় জানবে।


যামিনীকুমার : আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভগবান ধর্ম রক্ষার জন্য রাম, কৃষ্ণ ইত্যাদি রূপে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর কলিতে জন্মগ্রহণ করেন–এটা বুঝলাম। কিন্তু কোনো মানুষের জীবনে বাল্যে, যৌবনে, বার্ধক্যে ভগবান তিন-চার রূপে অবতীর্ণ হন–এর অর্থ বুঝলাম না।


বাবা লোকনাথ : অবতারের অন্যতম উদ্দেশ্য হল অসুর নিপাত করা। তোমার হৃদয়ে জ্ঞানরূপ ভগবান অবতীর্ণ হয়ে তোমার অজ্ঞানরূপ অসুরকে যুগে যুগে বিনষ্ট করেন। যখন যে কালে তোমার মধ্যে অধর্মরূপ অসুর প্রবল হয়ে ওঠে, জ্ঞানের আবির্ভাবেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়। তা সে বাল্যে, যৌবনে বা বার্ধক্যে, যখনই হোক না কেন। এইভাবে ভগবান তিন, চার কি পাঁচ, সাত বারও এক জীবনে অবতীর্ণ হতে পারেন। আবার একজনের পাঁচ-সাত জন্মের পরও জ্ঞানব্যাপী ভগবান অবতীর্ণ হতে পারেন।


যামিনীকুমার : একবার যার জীবনে ভগবান অবতীর্ণ হন, সে চিরকালের জন্য মুক্ত হয়ে যায় না কেন?


বাবা লোকনাথ : ভোগ পূর্ণ না হলে প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় হয় না। আর প্রারব্ধ ক্ষয় না হলে জীব সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয় না। তাছাড়া জীবকে একেবারেই মুক্ত করে দিলে ভগবানের সৃষ্টি কৌশলও থাকে না।


যামিনীকুমার : প্রারব্ধ কর্ম কাকে বলে?


 বাবা লোকনাথ : শাস্ত্রকারেরা বাণের সঙ্গে প্রারব্ধ কর্মের তুলনা করেছেন। বাণ যেমন একবার ধনুক থেকে ছেড়ে দিলে কর্তার আর কোনো কর্তৃত্ব থাকে না, তা আপন গতিবেগে যেখানে সেখানে গিয়ে পতিত হয়, জীবের প্রারব্ধ কর্মও তেমনি। কর্ম একবার করা হয়ে গেলে তার ফলের উপর কর্তার কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। তার ফল ভোগ করতেই হবে। একজন্মে তা ভোগ না হলে জন্মান্তরে তা ভোগ করতে হবে। ভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মুক্তি নেই।


যামিনীকুমার : বিষয়টা পরিষ্কার বুঝলাম না।


বাবা লোকনাথ : ছোট বেলায় জেনেছিস তো, জন্মকালে ষষ্ঠী যার ললাটে যা লিখে দিয়েছেন, তা হরি, হর, ব্রহ্মাণ্ড খণ্ডাতে পারেন না। অর্থাৎ যার যা কর্ম নির্দিষ্ট হয়েছে, তাকে তা করতেই হবে। একেই বলে ভাগ্য বা প্রারব্ধ। এই কারণেই কারো জীবনে ভগবান জ্ঞানরূপে কয়েকবার আবির্ভূত হলেও প্রারব্ধ ভোগ শেষ না হলে জীব মুক্ত হয় না। আবার এই ভোগ শেষ হলে জীব একবারেও মুক্ত হয়ে যেতে পারে।


এই প্রারব্ধ সম্বন্ধে আর এক ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ স্বামী রামসুখদাসজি বলেছেন। ভগবাম জপ ও কীর্তন দ্বারা প্রারব্ধ বদলানো যায়। ভগবাম জপ ও কীর্তনে চিত্ত বিশুদ্ধ হলে অলভ্য বস্তু লভ্য হয়, অসম্ভব সম্ভব হয়। যিনি কর্মফলের বিধান করেছেন, তাকে যদি কেউ ডাকে, তার নাম জপ করে তাহলে তার নাম জপকারীর প্রারব্ধ যে বদলাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? প্রসিদ্ধ ঈশ্বরের মায়ার সৃষ্টি। তাকে ক্ষয় করার জন্য তিনিই গুহ্য পথের সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানবের প্রয়োজন তার সন্ধান আবার ও কর্ম ভক্তি যোগের মাধ্যমে তার নিবৃত্তি করা।


বাবা লোকনাথ নিজে সুরথ ব্রহ্মচারীর প্রারব্ধ ক্ষয় করিয়েছিলেন বিভিন্ন কর্মের দ্বারা। কিন্তু আজ সেইরূপ পথপ্রদর্শক গুরু খুবই দুর্লভ। বাবা লোকনাথ নিজে যামিনীকুমারকে বলেছিলেন, শিষ্যের অর্থনাশকারী গুরু অনেক পাওয়া যায় কিন্তু শিষ্যের ভবদুঃখ নাশকারী গুরু অতীব দুর্লভ।


ব্রহ্মচারী বাবার সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে যামিনীকুমারের মনে ধর্ম সংক্রান্ত এতদিন যে সব প্রশ্ন ছিল, সেগুলি পরিষ্কার হয়ে গেল। যে সব সংশয়ের জন্য তার মন এতদিন অশান্ত ছিল, সেই সংশয়গুলি মন থেকে দূরীভূত হয়ে মন শান্ত হলো। তার মধ্যে এক নতুন বিবেক বোধ জাগ্রত হলো। এক নতুন জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হল তার মন। যামিনীকুমার এরপর ব্রহ্মচারী বাবার চরণেই নিজেকে সমর্পণ করলেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। এরপর বাবা লোকনাথ যামিনীকুমারকে দীক্ষা দিলেন এবং উপদেশ দিলেন যে, মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ করতে হলে মৌমাছি সরিয়ে মধুকুণ্ড লাভ করতে হয়। তেমনই আমার সূক্ষ্ম আদেশ গ্রহণ করতে হলে প্রথমে আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান, ধারণা প্রভৃতির ভিতর দিয়ে হিংসা, দ্বেষ, কামনা, বাসনারূপী মৌমাছিগুলিকে সরাতে পারলেই তোমরা আমার আদেশ ধরার অধিকারী হবে।


বাবা যামিনীকুমারকে আরও উপদেশ দিলেন যে, মানুষের ধর্মপথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল অহঙ্কার। অহঙ্কার ক্ষয় হলে মোহ নাশ হবে। মোহ নাশ হলে চিত্তশুদ্ধি হবে। চিত্তশুদ্ধি হলেই আত্মজ্ঞান লাভ হবে। আর তাহলেই ঘটবে জীবন্মুক্তি।


ব্রহ্মচারী বাবার কাছে দীক্ষিত হয়ে এবং অমূল্য উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে শান্ত শুদ্ধ মনে যামিনীকুমার বাড়ি ফিরে গেলেন। বাড়ি ফিরে যামিনীকুমার মাকে বলেন, মূর্তিমান গীতা দেখে এলাম। সব বেদ বেদান্ত সহ সর্বভাব মূর্ত হয়ে রয়েছে এই মহাপুরুষের মধ্যে। কিন্তু তাঁর কৃপা ভিন্ন তাকে বোঝা সম্ভব নয়।


যামিনীকুমার বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য ছিলেন। তিনি সেই কতিপয় ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অতীব ভাগ্যবান ছিলেন যার মধ্যে ব্রহ্মচারী বাবা তার আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন। দীক্ষা দান করার পর বাবা যামিনীকুমারকে কর্মযোগে নিয়োজিত করার জন্য তাঁর মধ্যে তাঁর নিজের কৃপা ও আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন। এরপর একদিন যামিনীকুমারকে বাবা তার সঙ্গে আহার করতে বললেন। এক পাত্রে গুরু-শিষ্য আহার করছেন। হঠাৎ বাবা যামিনীকুমারের মুখে গ্রাস তুলে দিলেন। যামিনীকুমার খেতে লাগলেন। বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কি করছিস? যামিনীকুমার বললেন, আপনি আমার মুখে যে অন্ন তুলে দিয়েছেন, আমি তা চিবিয়ে খাচ্ছি। তখন বাবা বলেন, গুরু শিষ্যের এতটাই করতে পারেন। গুরু শিষ্যের মুখে খাবার উঠিয়ে দেন, কিন্তু শিষ্যকে তা চিবিয়ে উদরস্থ করতে হবে। বাবার এই কথা বলার অর্থ হল যে, বাবা যামিনীকুমারকে যে ধর্মতত্ত্বের শিক্ষা দিলেন, এইগুলি তাকে অন্তঃকরণে স্থান দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। তবেই তার মধ্যে জ্ঞানের উদয় হবে। যামিনীকুমার পূর্ণব্রহ্ম ব্রহ্মচারী বাবার থেকে কেবল দীক্ষাই পেলেন না, পেলেন উচ্চ আধ্যাত্মতত্ত্ব এবং সেই আধ্যাত্মতত্ত্বকে হৃদয়ে ধারণ করার মতো যৌগিক ক্ষমতা, যা বাবা তার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। তিনি ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যা পেয়েছেন, সে অতি দুলর্ভ।


সাধন জগতের যারা যাত্রী, তাদের কাছে যামিনীকুমার ও বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রশ্নোত্তর অধিবেশন জ্ঞানের সঞ্চার করবে এবং শিষ্যকে আধ্যাত্ম জগতে এগিয়ে দিতে গুরুর কর্তব্যেরও পথ প্রদর্শন করবে। কেবল মন্ত্র প্রদানই গুরুর কর্তব্যের শেষ নয়। বাবার প্রিয়ভক্ত যামিনী কুমারের সঙ্গে তার কথপোকথন যামিনীকুমার তার ধর্মসার সংগ্রহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।


.


কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী


কুলদানন্দ ছিলেন গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য। গোঁসাইজির ঢাকার আশ্রমের আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা লাভ করে তিনি সাধন জগতে প্রবেশ করেন। তারা চার ভাই। হরকান্ত, বরদাকান্ত, কুলদানন্দ (কুলদাকান্ত) ও তারাকান্ত। সকলেই গোঁসাইজির আশ্রমে যাতায়াত করতেন তাদের নিজ নিজ আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারণের জন্য। কুলদানন্দর তখন বোধহয় ২১/২২ বছর হবে। গোঁসাইজির পরামর্শে তিনি যতই মনকে আধ্যাত্ম পথে আনার চেষ্টা করেন, যৌবনের কামের জ্বালা তাঁর চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। কিছুতেই তিনি তার প্রতিকারের কোনো উপায় খুঁজে পান না। তিনি গোঁসাইজির কাছে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কথা অনেকবার শুনেছেন। একদিন গোঁসাইজিকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি একবার বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করতে যাব? গোঁসাইজি তাকে তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিলে তিনি সে-কথা তার ভাইদের বলেন। অতঃপর সব ভাই পরামর্শ করে এক রবিবার সকালে বারদীর পথে রওনা হলেন। চারভাই নৌকাযোগে সন্ধ্যাবেলা বারদী বাজারের ঘাটে এসে পৌঁছলেন। তারা নৌকায় বসে ভাবতে লাগলেন, গোঁসাইজি একবার তাদের বলেছিলেন সন্ধ্যার পর ব্রহ্মচারী বাবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রাতে আর খোলেন না। হিমালয় ও অন্য পাহাড়-পর্বত থেকে সূক্ষ্মরূপে যোগীগণ তাঁর কাছে সেইসময় যোগসাধনা সংক্রান্ত আধ্যাত্মিক আলোচনা করতে আসেন। সুতরাং সন্ধ্যাবেলা ঘর বন্ধ হয়ে গেলে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন সেইদিন হবে না। কুলদানন্দ বলেন যে, পরদিন সকালবেলা ব্রহ্মচারী বাবার সাক্ষাতে গেলেই ভালো। কিন্তু তাঁর বড় ভাই হরকান্ত সেদিনই ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। কুলদানন্দ রাজি না হওয়ায় অন্য তিন ভাই নৌকা থেকে নেমে বাজার দিয়ে আশ্রমে গিয়ে পৌঁছলেন। কিন্তু আশ্রমে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। আশ্রমে পৌঁছে তারা দেখেন বাবা তখনও ঘরে যাননি। তিনি তাঁর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আশ্রমে প্রবেশ করে বাবার সম্মুখে যেতেই বাবা বললেন, হরকান্ত, আমি তোমাদের জন্য এত রাত পর্যন্ত আমার ঘরের দরজা বন্ধ করিনি। এখন তোমরা যাও। নৌকায় বিশ্রাম করো গে। কাল সকালে এসো। এই কথাগুলি বলে বাবা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। হরকান্তবাবু ও তার ভাইয়েরা নৌকায় ফিরে কুলদানন্দকে সব কথা জানালেন।


পরদিন ভোরবেলা চারভাই ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন উথাল-পাথাল করছে যে আগের দিন তারা কোনো পরিচয় প্রদান করার পূর্বেই বাবা কি করে হরকান্তর নাম ধরে ডাকলেন! তারা তো ব্রহ্মচারী বাবাকে কোনো খবর দিয়ে আসেননি। তারা যেই বাবার ঘরের বারান্দার সামনে হাজির হয়েছেন, অমনি ব্রহ্মচারী বাবা আসন থেকে উঠে এসে হরকান্তবাবুর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে তার পাশে বসালেন। অন্য ভাইয়েরা বারান্দায় গিয়ে বসলেন।


হরকান্তবাবুকে বাবা বললেন, তুমি তো মহাপুরুষ হে, ছদ্মবেশে কেন বাবু সেজে এসেছ?


হরকান্তবাবু উত্তর দিলেন, আমি তো সবসময়েই এই বেশে থাকি।


 এরপর হরকান্তবাবুর সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবা নানা আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপর তাকে বললেন, হরকান্ত, তোমার কর্ম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আজ তুমি এসেছ আমায় দর্শন করতে। দশ বছর পর শত শত লোক তোমাকে দর্শন করে কৃতার্থ হবে।


পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে হরকান্তবাবুর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব জাগ্রত হলেও কর্মভোগের ফেরে অর্থাৎ প্রারন্ধের ফেরে এখনও তিনি সংসারকর্ম করে চলেছেন। তবে তার প্রারব্ধ শেষ প্রায়। এরপর তার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তির স্ফুরণ ঘটবে এবং তিনি একজন আধ্যাত্মিক জগতের পথপ্রদর্শনকারীরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন।


হরকান্তবাবু ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে তাকে প্রশ্ন করলেন, আমার যথার্থ কল্যাণ কেমন করে হবে, তা আমায় বলে দিন।


ব্রহ্মচারী বাবা তখন বললেন, তুমি গোঁসাইজির কাছে দীক্ষা নাও। তার কাছে সত্যবস্তু আছে। তিনি তোমায় আশ্রয় দিলে তোমার কল্যাণ খুব শীঘ্রই হবে।


লোকনাথ বাবার এইরূপ বলার কারণ হল তার তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তিনি হরকান্তবাবুর মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা জানতে পেরেছিলেন। হরকান্তবাবু মনে করতেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য কেশব সেন গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর থেকে বড়ো। সেইজন্য গোঁসাইজির আশ্রমে গেলেও তিনি তাঁর কাছে এখনও দীক্ষা নেননি। তিনি মনে মনে এই যুক্তিও করতেন যে কেশব সেন যদি বিনা দীক্ষায় ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য হতে পারেন, তবে তিনিও তো বিনা দীক্ষায় কেবল নিজের পুরুষকার বলে ধর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন।


বাবা লোকনাথ তার মনের এই ভাবের কথা বুঝতে পেরে বলেন, ধর্মলাভের জন্য যা থাকা দরকার তোমার মধ্যে সবই আছে। তবে সদ্গুরুর কাছে দীক্ষিত না হলে ঈশ্বর দর্শনে অধিকার হয় না। বাবা তাকে আরও বললেন, শিশু ধ্রুব পাঁচ বছর বয়স থেকেই পদ্মপলাশলোচন হরিকে কত ডাকলো, পথে পথে কত কাদলো, তবু যতক্ষণ তার গুরুকরণ হল না, হরির দর্শন পেল না। গুরুকরণ ছাড়া ব্ৰহ্মদর্শন হয় না। মৌনী হবে, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করবে, কত লোকে সাধু বলে ভক্তি করবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত বস্তু লাভ হবে না। যদি ব্ৰহ্মদর্শন করতে চাও, তবে অন্তরের সমস্ত পূর্ব-সংস্কার দূর করে ফেলতে হবে। গুরুকরণে সমস্ত অন্তরের বাসনা দূরীভূত হয় এবং তখনই ব্রহ্মদর্শন সম্ভব হয়। এখন তোমার যা অবস্থা তাতে অন্তরে যে বাসনা আছে তা পাবে কিন্তু ব্রহ্মদর্শন হবে না।


বাবা লোকনাথ হরকান্তবাবুকে সঠিক আধ্যাত্ম পথের সন্ধান দিয়ে দিলেন। হরকান্তবাবু সঠিক পথের দিশা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন।


কুলদানন্দর মেজদা বরদাকান্তর মন জুড়ে ছিল কি করে আরও অর্থ উপার্জন করা যায়। তার মধ্যেও বংশানুক্রমিক ধারায় ধর্মভাব আছে, কিন্তু ওই বয়সে তার নজর অর্থোপার্জনের দিকে। হরকান্তবাবুর পরে বাবা বরদাকান্তকে কাছে ডাকলেন। বাবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে বরদাকান্তর মনের ভাজ খুলে গেল। তিনি জানতে পারলেন যে বড়দাকান্তর মনে ধর্মভাব থাকলেও তার মন অর্থোপার্জনের দিকে ঝুঁকে আছে। তিনি বরদাকান্তকে বললেন, তুই এখন অর্থ উপার্জন কর আর সেই অর্থ নির্লিপ্তভাবে লোকের সেবায় ব্যয় কর।


বাবা মনে করলেন এতে বরদাকান্তর অর্থোপার্জনের প্রতি আসক্তির নিবৃত্তি ঘটবে। আবার সেই অর্থে মানবসেবা করলে তার মনের ধর্মভাবেরও রক্ষা হবে। এখন ওঁর মধ্যে অর্থোপার্জনের বাসনা ওঁকে ধর্মকাজে প্রবৃত্ত হতে দেবে না। যেমন- রোগ, তার তেমনি দাওয়াই। বরদাকান্তবাবু বাবার এই কথায় সন্তুষ্ট হলেন এবং বাবার আশীর্বাদ নিলেন।


ব্রহ্মচারী বাবা কুলদানন্দর ভাইদের পর্যায়ক্রমে ডেকে কথা বলছেন। কুলদানন্দ ভেবেছিলেন মেজদার পরে তাঁর ডাক আসবে। কিন্তু বাবা বরদাকান্তবাবুর পর অন্য লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কুলদানন্দ বা তারাকান্ত কারোকে ডাকলেন না। যখন ঘরের অন্য লোকেদের সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবা কথা বলছেন, তখন কুলদানন্দ চুপ করে বারান্দায় বসে বাবাকে নিরীক্ষণ করছেন। গোঁসাইজি তাকে বলে দিয়েছেন, নিজে থেকে কোনো কথা না বলতে। বাবা সবার সঙ্গে কথা বলে কুলদানন্দকে ডেকে বললেন, তুই এখানে এসেছিস কেন? দেবতা দেখতে এসেছিস?


বাবার এই কথা বলার উদ্দেশ্য হল গোঁসাইজি কুলদানন্দকে বলেছিলেন, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার দেহে সকল দেবদেবীর বাস তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। নিম্নভূমিতে এমন মহাপুরুষ তিনি আর দেখেননি।


কুলদানন্দ গোঁসাইজির পরামর্শ অনুযায়ী মৌন থেকে কেবল মাথা নেড়ে জানান–’না’।


বাবা তখন তাঁকে ঘুষি দেখিয়ে রাগত স্বরে বলেন, কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ছিস কেন? কথা বল। কুলদানন্দ চুপ করে বসে থাকেন। বাবা লোকনাথ তার তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারেন যে কুলদানন্দর মধ্যে যৌবনের কামের জ্বালা মনে বিক্ষোভের সৃষ্টি করছে। সে কামের নিবৃত্তি চায় না, কামভাবের প্রতিকার চায়। কিন্তু তিনি কুলদানন্দকে পরীক্ষা করার জন্য হঠাৎ বললেন, শোন কুলদা, তুই রমন করবি। আচ্ছা, তোর কি স্ত্রীলোক জোটে না? কুলদানন্দ তখন বাবাকে বলেন যে তিনি এই কামভাবের প্রতিকারের আশায় বাবার কাছে এসেছেন। ধর্মপথে থেকে এইভাবে রমন কাজ তাঁর কাছে নিন্দনীয়। বাবা তখন তাঁকে বললেন, ওরে, জ্ঞানীরা নিন্দা করবে না। মূর্খরাই করবে। মূখের নিন্দায় কি হয়?


বাবা কুলদানন্দকে বোঝালেন যে প্রত্যেকে কিছু কর্মভোগ নিয়ে এই জগতে আসে। কর্মের মাধ্যমেই সেই ভোগ ক্ষয় করতে হয়। কর্মভোগ যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ ধর্ম ধর্ম করে দৌড়লে কিছু হবে না। কর্মভোগ ক্ষয় হলে ধর্মলাভ হবে।


তারপর বাবা কুলদানন্দকে বলেন, হারে কুলদা, তুই তো রোজ ডায়েরি লিখিস। তাতে আমার দুটো কথা লিখে রাখিস। (১) বিলাসিতা ত্যাগ কর। (২) আর বিদ্যা হবে না। আচ্ছা আমার এই দুটো কথার মানে কি বুঝলি বল তো?


ব্রহ্মচারী বাবার প্রশ্নের উত্তরে কুলদানন্দ বললেন, সমস্ত রকম সুখভোগ ত্যাগ করাই বিলাসিতা ত্যাগ। বিলাসিতা ত্যাগ করলে ধর্মে মতি হবে। আর তা হলে লেখাপড়া হবে না।


কুলদানন্দের কথা শুনে বাবা রাগতস্বরে বললেন–তুই একটা গণ্ডমূর্খ। আমি কি তাই বলেছি? অবিদ্যা কাকে বলে আর বিদ্যা কাকে বলে জানিস না? তুই তো সে-কথা গোঁসাইয়ের কাছে জেনেছিস। লেখাপড়া করবি না কেন? বেশ ভালোভাবে লেখাপড়া করবি। লেখাপড়া করলেই পরীক্ষায় পাশ করবি। তবে বিলাসিতা করিস না। একখানা কাপড় আর একখানা চাদরই হবে তোর পরিচ্ছদ। নেহাৎ যদি পড়তে চাস এক জোড়া চটিজুতো পড়তে পারিস। মন যখন খারাপ হবে আমার কাছে আসবি। আমাকে চিঠি লিখবি। তোর ধর্মকর্ম সব হবে। অস্থির হোস না। কোনো ভয় নেই। তারপর বাবা বলেন, হ্যাঁরে কুলদা তুই একটা ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিস, তাই না? আমার আরও কাছে আয়। আমি বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। এখনই সেরে যাবে।


কুলদানন্দ শূল ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিন্তু এতবড়ো একজন মহাপুরুষের কাছ থেকে তিনি কেবল একটি ব্যথা নিরাময় করতে আসে নি। তাঁর কাছ থেকে তাকে অনেক মূল্যবান আধ্যাত্মিক সম্পদ পেতে হবে। সেইজন্য কুলদানন্দ বাবাকে বললেন, ব্যথা সারাবার জন্য আমি এখানে আসিনি। বারদী আশ্রম তখন একটা হাসপাতালের রূপ নিত, কেননা বেশিরভাগ দর্শনার্থীই বাবার কাছে আসতেন কোনো না কোনো দেহের রোগ সারাতে। কিন্তু কুলদানন্দর কথায় বাবা চমৎকৃত হলেন। কুলদানন্দ বললেন, আমি এসেছি শুধু আপনাকে দর্শন করতে। আমি দুদিন আগে স্বপ্নে আপনাকে ঠিক এমনটিই দেখেছিলাম।


কুলদানন্দর মনে সাত্ত্বিক ভাব ছিল। মাঝে মাঝে রজঃভাব তাকে তাপিত করে। তিনি সেই রজঃভাবকে কি করে প্রশমিত করতে পারেন সেই উপদেশের জন্য এসেছেন। তার মনের সাত্ত্বিক ভাব তাকে ব্রহ্মচারী বাবার থেকে কিছু চাওয়া থেকে বিরত করেছে। বাবার একস্পর্শে তার শূল রোগ চিরতরে নিরাময় হতে পারে জেনেও তিনি তা করতে রাজি হননি। বাবা বুঝতে পারেন যে কুলদানন্দ তার মনের সাত্ত্বিক ভাবের দ্বারা রজঃভাবকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম। সে এসেছে কেবল দর্শনের জন্য। কুলদানন্দ গোঁসাইজির কাছে পূর্ণব্রহ্ম লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দেবদেহের পরিচয় পেয়ে ভেবেছেন, যে দেহে সব দেবদেবী বাস করেন, সেই দেহের দর্শনেই তো সব দেবদেবীর দর্শন হয়ে যায়, তবেই তো কর্মক্ষয়, তবেই তো ব্রহ্মদর্শন। তবে মুখে কিছু চাইতে যাব কেন? কুলদানন্দর মতো ক’জন ভক্ত এইরকম ভাবতে পারে! ব্রহ্মদর্শনের পরে আর কি কারও কিছু চাওয়ার থাকতে পারে? কিন্তু এরূপ মনের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র তারাই করতে পারেন যাদের মনে সাত্ত্বিক ভাবের প্রবলতা বেশি। কুলদানন্দ পেরেছিলেন। কিন্তু সব ভক্ত পারবে না। তাদের মনের রজঃ ও তমঃগুণের প্রভাবে তারা সংসারের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চাইবে এক দর্শনে। এক সাত্ত্বিক দর্শনে যে রজঃ ও তমঃগুণ প্রভাবিত সব সমস্যার সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যেতে পারে, সে কথা ভক্তের মনে উদয়ই হয় না। কুলদানন্দ তার সাত্ত্বিক গুণের প্রভাবে জীবনের এই সত্যকে বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন।


কুলদানন্দ যখন বাবাকে বললেন, তিনি একটি স্বপ্নে বাবাকে দেখেছেন, তখন বাবা তার কাছে সেই স্বপ্নের কথা জানতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কুলদানন্দ বলেন–


স্বপ্নে দেখলাম, গোঁসাইজি হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন, আর সময় নেই, চলো এখনই বেরিয়ে পড়ি। গোঁসাইজির পিছনে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। তারাকান্ত দাদাও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর আমাদের পথ চলা শুরু হলো। সকলের আগে আপনি, আপনার পিছনে গোঁসাইজি, তারপর তারাকান্ত দাদা আর সকলের পিছনে আমি। চলতে চলতে বেশ কিছুদূর গিয়ে ভীষণ ঘন একটা অরণ্য দেখতে পেলাম। দূর থেকে সেই অরণ্য দেখেই ভয় হতে লাগল। কিন্তু যতই এগোতে লাগলাম, অরণ্যের সবুজ ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের শোভায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। অরণ্যের কাছাকাছি এসে দেখলাম তা শুধু বনভূমি নয়, সেখানে রয়েছে প্রকাণ্ড একটা পাহাড়। আমরা সেই পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। আপনি নিজের মনে পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। গোঁসাইজি তার হাতের লাঠি দিয়ে কাটা সরিয়ে পথ পরিষ্কার করতে করতে চলেছেন। তারাকান্তদাদা এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে চলেছেন। আমি গোঁসাইজির দিকে দৃষ্টি রেখে চলেছি। ক্রমে আমরা বহু উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে সেই পর্বতের শিখরদেশে একটা সমতল জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সেখানে গোঁসাইজি এক জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়ে তিনটি আসন দেখালেন। আসনগুলির চারিদিকে বহু পুরনো বড়ো বড়ো ঝাঁপড়া গাছ। জায়গাটি ছায়ায় ঢাকা। গাঢ় অন্ধকার। আসন তিনটিই গৈরিক লাল রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। আসনগুলি চতুষ্কোণ এবং পূর্বমুখে পাতা রয়েছে। আসন তিনখানি ১, ২, ৩ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত। ৩’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটি আমাকে দেখিয়ে গোঁসাইজি বললেন, এইটে তোমার আসন। এই আসনে বসে তোমাকে কিছুক্ষণ সাধনা করতে হবে। এইখানে বসো। তারপর ২’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটিতে গোঁসাইজি বসলেন। ১’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটি শূন্য রইল। গোঁসাইজির নির্দেশ মতো আমি সেই আসনে বসে কিছুক্ষণ সাধনা করলাম। পরে গোঁসাইজি তাঁর আসন থেকে উঠে বললেন, আমার পিছু পিছু চলো। তখন আমরা চারজনেই আবার পথচলা শুরু করলাম। উঁচু-নিচু কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গলময় পথ। সেই পথ চলতে চলতে কাটায় আমার পদতল ক্ষত-বিক্ষত হলো। বার কয়েক হোঁচট খেলাম। দু-তিনবার পড়ে গেলাম। এরপর গোঁসাইজি দুর্গম সঙ্কীর্ণ গিরিপথের বিপদের কথা ঈশারা করে জানিয়ে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি এগোতে লাগলেন। আমায় বারবার বলতে লাগলেন, খুব সাবধানে ধীরে ধীরে আমার পিছু পিছু এসো।


এইভাবে অতি কষ্ট করে অনেক দূর চলার পর শেষে এক বিশাল রাজ্যের খুব কাছে এসে পড়েছি বলে বুঝতে পারলাম। ঘন সন্নিবিষ্ট সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির মতো সেই রাজ্যের তেজ বেরিয়ে আসছে দেখলাম। সেই তেজরশ্মি ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। গোঁসাইজি এক-একবার মুখ ফিরিয়ে আমার মুখপানে তাকিয়ে আমায় সাহস দিতে লাগলেন। তাতে আমার মনে হলো, সামনে কোনো বিপদ আছে। আমরা যে অরণ্যপথে চলছিলাম তা থেকে সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যে প্রবেশ করার একটিমাত্র দ্বার ছিল। তা ছাড়া গোটা রাজ্যটাই বেড়ায় পরিবেষ্টিত। খুব উৎসুক হয়ে প্রবেশদ্বারের দিকে এগোতে লাগলাম। দ্বারের কাছে গিয়ে দেখি কৃষ্ণবর্ণ এক ভয়ঙ্কর লম্বা সাপ ফোঁস ফোঁস করছে আমাদের দেখে। সাপটি ফণা বিস্তার করে তেজের সঙ্গে আমাদের দংশন করতে এলো। প্রথমে আপনার সামনে ফণা উঁচিয়ে দাঁড়াল, কেননা আপনি সকলের সামনে ছিলেন। কিন্তু আপনি তাকে গ্রাহ্য করলেন না। এগিয়ে গেলেন। সাপটি এবার ফণা নামিয়ে গোঁসাইজির দিকে ছুটল। কিন্তু গোঁসাইজিও তাকে গ্রাহ্য করলেন না, এগিয়ে গেলেন। তিনি তখন আমার পানে তাকিয়ে ভয় নেই, ভয়, নেই বলে আমাকে আশ্বাস দিতে লাগলেন। আমিও ভয় পেলাম না। সাপটি তখন ফণা নামিয়ে তারাকান্ত দাদার দিকে এগিয়ে চললো। তারাকান্ত দাদার হাতে একটি লাঠি ছিল। সাপটি তার কাছে যেতে তিনি তার লাঠি দিয়ে সাপটিকে প্রহার করতে লাগলেন। সাপটি তখন তাঁর দু-পা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গোঁসাইজি চিৎকার করে উঠলেন, ওকে মেরো না। মেরে ওকে ছাড়াতে পারবে না। ওকে না মারলে ও কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু তারাকান্তদাদা ভয়ে ক্রমাগত লাঠি দিয়ে সাপটিকে আঘাত করতে লাগলেন। সাপটিও তার পা-দুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।


এমন সময় সামনে তাকিয়ে দেখি উলঙ্গ, দীর্ঘাকৃতি, গৌরবর্ণ এক জটা-ব্রহ্মচারী বাবা। আপনি অবলীলাক্রমে প্রবেশদ্বার দিয়ে সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন। গোঁসাইজি সেই দ্বারপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। তার দেহের অর্ধেকটা সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যের মধ্যে আর বাকি অর্ধেকটা এদিকে। গোঁসাইজি তখন আমাকে হাত নেড়ে সঙ্কেত করে বললেন, তুমি সাপটিকে ডিঙ্গিয়ে তার উপর দিয়ে আমার দিকে লাফ দাও। সাপটি তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। আমি যেমনি একটা জোড় লাফ দিয়ে তার কাছে গিয়ে পড়লাম, আমি সেই ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে আমি যেমনটি আপনাকে দেখেছি, আজ এখানে এসে আপনাকে দেখলাম সেই একই রূপ ও আকৃতিতে।


কুলদানন্দের মুখ থেকে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তোর ডায়েরিতে এই স্বপ্নের কথা লিখে রাখিস (কুলদানন্দ বাবার কথা শুনে তার স্বপ্নকথা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন বলে আজ বাবার অগণিত ভক্তবৃন্দ সেই কথা জানতে পারছে)। ব্রহ্মচারী বাবা তাকে আরও বললেন, তোর পথ তো স্বপ্নেই তোকে দেখিয়েছে। আচ্ছা, তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিলি না কেন?


কুলদানন্দ তখন বললেন, গোঁসাইজি আমাকে বলে দিয়েছেন, আমার ভবিষ্যতে যা যা দরকার, সে-সব বিষয় আপনি নিজে থেকেই ডেকে বলবেন। আমাকে নিজে থেকে কোনো কথা বলতে তিনিই নিষেধ করেছিলেন।


তখন ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তোর সব কথার উত্তর, তোর যা যা দরকার, তা সব পেয়েছিস তো? কুলদানন্দ বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। এরপর ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তবে যা। স্বপ্নে যা দেখেছিস, তোর ডায়েরিতে লিখে রাখবি। তোর যত কিছু ব্যথা বেদনা তা সব প্রারক্কের। আমি হাত বুলিয়ে দিলে এখনকার মতো সারবে বটে, কিন্তু পরে আবার হবে। কর্মফল শেষ হলে আপনা থেকেই সেরে যাবে। অসহ্য বোধ হলে বেলগাছ তলার তাজামাটি লেপে দিস। কমে যাবে। কিন্তু তাতে তোর ভোগ শেষ হবে না। ভোগ শেষ করার জন্য আবার তোকে দেহ ধারণ করে এই পৃথিবীতে আসতে হবে। এখন ভেবে দেখ, কি করবি। তোকেই ঠিক করতে হবে, এই দেহেই ব্যথা সহ্য করে সাধনার দ্বারা মুক্ত হবি, না এ জীবনে রোগমুক্ত হয়ে ভোগ শেষ করার জন্য আবার দেহ ধারণ করে আসবি। এখান থেকে বোঝা যায় যে প্রারন্ধের ভোগ পূণ্য কর্মের মাধ্যমেই ক্ষয় করতে হয়।


ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে কুলদানন্দ গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগলেন রোগমুক্তি কী জীবন্মুক্তি–কোনটা শ্রেয়। তার মধ্যে এখন জীবন্মুক্তির বাসনাই প্রবল। সাময়িক কষ্ট থেকে মুক্ত হবার জন্য জীবন্মুক্তির পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া তার উচিত হবে না। কিন্তু তিনি ব্রহ্মচারী বাবাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। তিনি তো বলেই দিয়েছেন রোগ থেকে মুক্তি চাস, না জীবন্মুক্তি চাস? কিন্তু তার মনে এখনও একটু দ্বন্দ্ব আছে। তিনি কিছুই বলতে পারছেন না।


কুলদানন্দকে মৌন দেখে বাবা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে, চুপ করে রইলি কেন? বল, তোর কি ইচ্ছা।


এবার কুলদানন্দ মনকে শক্ত করে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বললেন, রোগমুক্তির চেয়ে জীবন্মুক্তিই আমার বেশি কাম্য। এখন রোগমুক্ত হয়ে ভোগ শেষ করার জন্য আবার জীবনে বদ্ধ হতে চাই না। সাধনজীবনে যাতে আমি চরম উন্নতি লাভ করতে পারি, রোগ যন্ত্রণা যাতে আমার সাধনপথে বিশেষ কোনো বিঘ্ন না ঘটাতে পারে, আপনি আমাকে সেই করুণা করুন। আমি রোগমুক্তি চাই না।


কুলদানন্দের কথা শুনে বাবা খুব সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর কাছে সবাই রোগমুক্তির জন্য আসে, সেজন্য তার মনে এক খেদ জমে আছে। তিনি হচ্ছেন জীবন্মুক্তি প্রদানকারী ব্রহ্মপুরুষ। কিন্তু সেই অমূল্য ধন কেউ তার কাছে চায় না। কুলদানন্দের অভিপ্রায় জেনে তাই বাবা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। এরপর কিছুদিন বারদী আশ্রমে বাবার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে কুলদানন্দ বাবার থেকে অসীম, করুণা লাভ করলেন, তারপর একদিন বাবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা নিজের আশীর্বাদ দিয়ে তাকে গোঁসাইজির আশ্রয়েই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা গোঁসাইজি ছিলেন বাবার পরম স্নেহের ব্যক্তি। এরপর কুলদানন্দ একদিন কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।


.


ব্রহ্মানন্দ ভারতী (তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়)


শ্রীতারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন নারায়ণগঞ্জের একজন প্রথিতযশা উকিল। বেদ, বেদান্ত ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল এবং সেজন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। শাস্ত্রালোচনার জন্য তিনি ঢাকায় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন। তাঁরা চার ভাই ছিলেন–হরকান্ত, বরদাকান্ত, তারাকান্ত ও কুলদানন্দ। এই ভাইয়েদেরও গোঁসাইজির আশ্রমে যাতায়াত ছিল। ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কুলদানন্দ ধর্মালোচনার জন্য গোঁসাইজির কাছে নিয়মিত যেতেন কিন্তু তার মনের পিপাসা তাতে মিটছিল না। তারাকান্তের মনেও অনেক ধর্মসংক্রান্ত জিজ্ঞাসা ছিল, যার সদুত্তর তিনি কোথাও পাচ্ছিলেন না। অবশেষে এই চার ভাই একসঙ্গে গোঁসাইজির পরামর্শে ১২৯৫ সনের ১লা জ্যৈষ্ঠ বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। এরপরে ব্রহ্মচারী বাবা দু’বছরের কিছু বেশিদিন বেঁচে ছিলেন। কুলদানন্দ ও তারাকান্তের সঙ্গে বাবার ঘনিষ্ঠতা স্বল্পকালের হলেও তাদের সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবার বার্তালাপ আধ্যাত্মিক জগতের এক অমূল্য সম্পদ। কুলদাকান্ত বাবার আশীর্বাদ পেয়ে পরবর্তীকালে কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। যেদিন চারভাই একসঙ্গে বারদী আশ্রমে এসেছিলেন, সেদিন অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেও বাবা তারাকান্তের সঙ্গে কথা বলেননি। হরকান্ত অন্য ভাইদের নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করার পর বাবা তারাকান্তর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তার সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবার যে ধর্মালোচনা হয়েছিল এবং সেই সংক্রান্ত কিছু গুহ্য আধ্যাত্মিক তত্ত্ব-কথার এখানে উল্লেখ করছি।


সবাই চলে গেলে বাবা তারাকান্তাকে জিজ্ঞাসা করেন—


 ব্রহ্মচারী বাবা : তুই কি জন্য এসেছিস?


তারাকান্ত : আজ্ঞে রামপ্রসাদ বলেছেন, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মলেম শ্যামা। আমারও হয়েছে ঠিক তাই। আমি নিজের ইচ্ছায় সংসারে এসে ঠেকে পড়েছি। সেই মায়াকে পেরোতে পারছি না। আপনি মহাযোগী, এই মায়াকে বশ করেছেন। আচ্ছা এই মায়া কি? এর থেকে উদ্ধারের উপায় কি?


ব্রহ্মচারী বাবা : ‘মায়া’ শব্দটি ‘মী’ ধাতু থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। মী’ ধাতুর অর্থ হল বোধ করা। যে শক্তি দ্বারা ঈশ্বরের সৃজন, পালন, হরণাদি বোধ হয়, তাকে মায়া বলে। যে মায়া সমস্ত দেবতাগণকেও বিমোহিত করে, সে মায়াতে মজীবেরাও যে বিমুগ্ধ হবে, তাতে আর সন্দেহ কি? মায়া সুখ-দুঃখ, আশা-দুরাশায় জীবকে মুগ্ধ রেখেছে। কর্মফল সমূহের দ্বারা জীব জগতে সৃজন, পালন, হরণ ঘটাচ্ছে। এই মায়ার তত্ত্ব বুঝলে সংসারে আবদ্ধ জীব পরমতত্ত্ব বুঝতে পারে।


ব্রহ্মচারী বাবা! তারাকান্ত, সন্দেহ করতে পারিস, যদি মুক্তির জন্য মানুষের জন্ম হয়, তবে ভগবান মায়া দিয়ে কেন তাদের আবদ্ধ করেছেন? এর উত্তরে বলা যায়, বিষয় ভোগে আসক্ত জীবদের মোক্ষের আশা জোড়ালো করবার জন্যই ভগবান মায়ার সৃজন করেছেন। ভোগ ও মুক্তি এই উভয় অবস্থা বোঝাতেই ভগবান সমস্ত পশুজগৎকে আহার, নিদ্রা, ভয়, ক্রোধ, মৈথুনাদির দ্বারা ভারাক্রান্ত করে শুধু বিষয়ভোগেই মত্ত রেখেছেন। বিষয়ভোগে দুঃখলাভ হয় এই জ্ঞান অন্তরে অনুভব করার ক্ষমতা ভগবান মানুষকেই দিয়েছেন। এই মোহ ও জ্ঞান উভয়ই অধিকারভেদে একা মায়া থেকেই মানুষ সংসারে লাভ করে। যদি এই মোহজ্ঞানের বোধ স্বভাবতঃ না হতো, তাহলে একদিনও সংসার চলতো না। মায়াদ্বারা অবস্থা ভেদে জীব জ্ঞান ও অজ্ঞান দুই-ই লাভ করে। যে সকল জীব মায়াঘটিত বিষয়ভোগে উন্মত্ত হয়, তারাই বিষয় আসক্ত হয় এবং অজ্ঞান বা মোহ লাভ করে। আর যাঁরা মায়াঘটিত বিষয়ভোগকে চিত্তের আবরণকারী বুঝে তা থেকে চিত্তকে বিশুদ্ধ রাখতে ইচ্ছা করেন, তাঁরাই জ্ঞান লাভ করেন। এখন প্রশ্ন, যারা অকৃতাত্মা ও স্থূলবুদ্ধি, তারা ঈশ্বর মায়া থেকে কেমন করে উদ্ধারলাভ করে?


অকৃতাত্মা হল তারা, যাদের ইন্দ্রিয় ও মন বিষয়ে আসক্ত, কিছুতেই যারা জ্ঞানের বশীভূত হয় না। আর স্থূল বুদ্ধি হল তারা, যাদের দেহ, গৃহ, ধন ও মনে নিত্যবুদ্ধি। চৈতন্যস্বরূপ ভগবানে তাদের বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা জন্মায় না। এই উভয়বিধ মানুষই মানবজন্মের উপযুক্ত অবস্থা লাভ করে না। মায়া থেকে তাদের উদ্ধারের উপায় বলছি, শোন।


বৈরাগ্য বিনা ওই সব দোষ দূর হয় না। মায়ার তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্ব এই উভয় বিষয়ই উপযুক্ত গুরুর কাছে শুনতে শুনতে যখন মায়াঘটিত ভোগকে দুঃখ বলে বোধ হবে, তখনই বৈরাগ্যের উদয় হবে। এই বৈরাগ্য যত জোরালো হবে ততই মন বিশুদ্ধ ও চিত্ত উজ্জ্বল হবে। এই তত্ত্বকথা শুনতে শুনতে মনের মালিন্য দূর হয়ে যায়। এই অবস্থায় কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় যোগে এমন কিছু কর্ম করা চাই, যে কর্মের গুণে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মন বিশুদ্ধ হবে। ভগবৎ সেবারূপ কর্ম আর আত্মতত্ত্বের অনুভব–এই উভয় বিষয় অভ্যাসে পরিপক্ক হতে হতে অন্তর যত নির্মল হবে, ততই শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেমের সঞ্চার হবে। আর তখনই মায়ার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যাবে।


তবে প্রশ্ন করতে পারিস, সু-শিক্ষার জন্য না হয় তত্ত্বজ্ঞান শুনেই অভ্যাস করলাম, তাতে আবার কর্মের দরকার কি? এর উত্তরে বলা যায়, যে উপদেশ শেখার উপযুক্ত, তার কর্তব্য ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা অনুষ্ঠিত না হলে কখনও সেই বিষয়ে অন্তরের পরিণতি ঘটতে পারে না। যেমন কেউ অহিংসা পরম ধর্ম এক মুখে বলে, উপদেশ শোনে, কিন্তু কাজে তা দেখায় না। যদি সে প্রতিদিনই নিজের হাতে জীবহত্যা করে, তার মাংস খায়, তাহলে তাতে অহিংসার জন্য চিত্তের যে বিশুদ্ধ ভাব দরকার, তা কখনও হতে পারে না। যেমন ওষুধের নাম, চিকিৎসকের নাম, রোগের নাম বারবার শুনলে বা ওষুধ শিখলে রোগ দূর হয় না। নিজে ওষুধ খেতে হবে। তেমনি মায়াভোগে ইন্দ্রিয়াদির সঙ্গে অন্তরের প্রবৃত্তি ও স্থূলদেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আসক্তিরূপ যে রোগে আক্রান্ত হয়েছে, কর্মের দ্বারা তা শোধন করতে হবে। তাতে ওষুধ ব্যবহারে রোগক্ষয়ের মতো জীবের পক্ষে মায়ারও ক্ষয় হতে পারে। যাক এসব কথা। তারাকান্ত, তুই মায়ার উপাসনা করে মায়াকে বশ করিস না কেন?


তারাকান্ত : মায়া বা প্রকৃতি জড়স্বভাবা। তাই তার উপাসনা করতে প্রবৃত্তি হয় না।


ব্রহ্মচারী বাবা : গুটিপোকা তার লালা থেকে রেশম বার করে তা দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে। তখন সেই আচ্ছাদন কেটে তার আর বার হবার সামর্থ্য থাকে না। অন্য কেউ তাকে বার করে দিলেও তাকে বাঁচাতে পারে না। কিন্তু কালক্রমে যখন সে আগের রূপ পরিবর্তন করে অর্থাৎ গুটিপোকা প্রজাপতির আকারে পরিণত হয়, তখন সে নিজেই তার সেই বাসা কেটে বার হয়ে যায়।


তারাকান্ত এই কথার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারলেন না। ব্রহ্মচারী বাবা মায়াকে বশীভূত করার যে তত্ত্বের কথা বললেন, তা তারাকান্তর বোধশক্তির আয়ত্তের বাইরে। যদিও বাবা মানবশরীরে মায়ার ক্রিয়া থেকে মানুষ নিজেকে কিভাবে মুক্ত করতে পারে, সে বিষয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারাকান্তর ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য থাকলেও, সে অনুভব করলো যে মানুষের শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃজন রহস্য সম্বন্ধে তার জ্ঞান সীমিত। সেজন্য ব্রহ্মচারী বাবার কথার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হলেন না। এই তত্ত্ব তার কাছে খুব কঠিন কৰ্মমার্গের তত্ত্ব বলে মনে হলো। তিনি ঠিক করলেন সেইদিন তিনি ফিরে যাবেন। তারপর বাবাকে প্রণাম করে সেদিন বাড়ি ফিরে গেলেন।


তারাকান্তের কাছে বাবা লোকনাথের মায়া ক্ষয় করার প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা কঠিন ও দুর্গম মনে হয়েছিল কারণ ঈশ্বরের সৃজন রহস্য তার অজানা ছিল। সৃজন রহস্য না জানা থাকলে মানবশরীরে মায়ার ক্রিয়া বোঝা যায় না। অথর্ববেদে মানবের সৃজন ক্রিয়ার উল্লেখ আছে। অথর্ববেদের একাদশ কান্ডের তৃতীয় অনুবাকের অন্তর্গত পঞ্চম ও ষষ্ঠ সূক্ত অনুযায়ী মানবদেহের ঈশ্বরের সৃজন ক্রিয়ার উল্লেখ এখানে করা হলো। এই সৃজন ক্রিয়া ও ঈশ্বর দ্বারা মায়ার ব্যবহার জানা থাকলে, বাবা লোকনাথের উপদেশানুসারে মায়া ক্ষয় করার ক্রিয়া করতে সাধনেচ্ছু মানুষ প্রবৃত্ত হতে পারে।


ঈশ্বর সৃষ্টিকালে কেশ, অস্থি, স্নায়ু, মাংস, মজ্জা একত্র করে হস্তপাদাদি অঙ্গ উপাঙ্গের সাথে শরীর নির্মাণ করে আত্মরূপে সে শরীরে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁরই নির্দেশে মহামায়া শরীর-মধ্যে পরমাত্মাকে ও স্বত্ত্ব গুণাবলীকে আবরণ দ্বারা বদ্ধ করে রেখেছেন। এই মানবদেহের মধ্যেই তিনি সমস্ত প্রবৃত্তিগুলি মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত ষট্‌চক্রের প্রতিটি চক্রে স্ব-স্ব স্থানে প্রতিস্থাপিত করেছেন। এবং তিনি স্বয়ং মানবদেহের মস্তকে সহস্রাধারে অবস্থান করছেন। এইজন্য বিদ্বান ব্যক্তি মানবদেহের শরীরকে ব্রহ্মের অংশ বলে জানেন।


ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বত্বগুণাদির প্রকাশ করে বিদ্যার বা জ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যাদি ক্লেশের ক্ষয় করে কর্মের দ্বারা মায়ার আবরণ থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে নিজ দেহে পরমাত্মার দর্শন করতে পারে। প্রতি মানব শরীরে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চবায়ু, বুদ্ধি ও মন–এই সপ্তদশ ইন্দ্রিয়যুক্ত লিঙ্গশরীর দেবতাদের অবস্থানে সমৃদ্ধ জীবাত্মারূপে কথিত হয়। এই লিঙ্গশরীর অর্থাৎ জীবাত্মাকে মায়ামুক্ত করে ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্রহ্মতেজ সম্বল করে (সুষুম্না নাড়ির মধ্যে ব্রহ্ম নাড়ি) জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। সেটাই হল আত্মমুক্তি।


এখন প্রশ্ন হল সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির মধ্যে সঞ্চিত ব্রহ্মতেজকে সম্বল করে এই নাড়ির ব্রহ্মরন্ধ্রস্থ মুখে নিজের অন্তদৃষ্টিকে স্থিত করতে পারলে জীবাত্মা পরমাত্মার দর্শন করতে পারে, সেই কথা বোঝা গেল (সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির অবস্থান পূর্বে বর্ণিত হয়েছে)। কিন্তু গৃহাশ্রম যোগীদের কাছে সমস্যা হল ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে রক্ষিত ব্রহ্মতেজ অগ্নিকে কিভাবে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে ব্রহ্মরন্ধ্রে অর্থাৎ মেরুদণ্ড থেকে মস্তকে প্রেরণ করা যাবে?


এই ব্যাপারে নর্মদা পরিক্রমাকালে যে ক্ষুদ্র জ্ঞান আমি আহরণ করতে পেরেছি, এবং বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যে জ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত করেছিলেন, এখানে তার উল্লেখ করছি।


সুষুম্না নাড়িকে প্রথমে দর্শন ও পরে সেই নাড়ির সাহায্যে নিজ দেহে পরমপদ দর্শন করা যায়। যোগীগণ ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহকে ও চিত্তকে বিশুদ্ধ করে ষট্‌চক্র ক্রিয়ার মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির মধ্যে যে অগ্নিরূপ ব্ৰহ্মতেজ সঞ্চিত আছে, তাকে প্রথমে আজ্ঞাচক্রে প্রেরণ করে সেখানে সেই জ্যোতির দর্শন করেন এবং তৎপর সেই জ্যোতিকে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে মস্তকে প্রেরণ করে পরমপদ দর্শন করেন। গৃহাশ্রমের সাধকগণ অর্থাৎ যারা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী নন, তারা বা অন্য গৃহাশ্রমী ভগবৎপ্রেমীগণ অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সুষুম্ন থেকে অগ্নিরূপ ব্রহ্মতেজ রশ্মিকে মস্তকে প্রেরণ করে নিজের জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটাতে পারেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা যায় যে, যখন উপনয়নের পর কোনো ব্রহ্মচারী গুরু গৃহে শাস্ত্র বা যোগ শিক্ষার্থে যান এবং গুরুগৃহ থেকে আর গৃহাশ্রমে প্রত্যাবর্তন করেন না, তাকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী বলে। যেমন বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব। আর যখন উপনয়নান্তে ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে শাস্ত্র ও যোগ শিক্ষার্থে গিয়ে শিক্ষান্তে গৃহাশ্রমে ফিরে আসেন, তাকে উপকূর্বান ব্রহ্মচারী বলে। তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনকে সমাবর্তন বলা হয়। এখানে আমি গৃহাশমীদের উপযুক্ত পদ্ধতির কথাই উল্লেখ করছি যা আমি নর্মদা পরিক্রমাকালে ও তারপরেও শিখেছি।


গৃহাশ্রমী সাধকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়া আছে। সেই ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় নিজশরীর ও চিত্তকে বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। তারপর রাত্রিকালে অথবা ব্রাহ্মমুহূর্তে ফুসফুসের মাধ্যমে সুষুম্না নাড়িতে অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা যোগ স্থাপন করতে হয়। ওই সময়কালে অন্তদৃষ্টি দেহাভ্যন্তরে প্রসারিত করা সহজ হয়। ওইসময় ফুসফুস কর্ম স্নায়ু বিশেষ দ্বারা মেরুদণ্ডের সঙ্গে বাহিত হয়। সেই মেরুদণ্ডের মধ্যে ব্রহ্মতেজ সম্বলিত জ্বলন্ত শক্তি নিহিত আছে। ফুসফুস ক্রিয়ার সময় বায়ু গমনকালে ওই স্নায়ুর মধ্যে যে চাপ দেয়, তার দ্বারা ফুসফুস প্রসারিত হয় এবং নাসিকা পথে বাইরের বায়ু শরীরে প্রবেশ করে। আবার ওই শক্তি ঊর্ধ্বগমনকালে কম্পনরহিত হয় এবং ফুসফুস সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এই সময় শরীরে গৃহীত বায়ু নাসিকাপথে প্রশ্বাসক্ৰমে বাইরে বেরিয়ে যায়। মস্তক-মধ্যস্থ মস্তিষ্করাশি থেকে নির্গত কঠিন মজ্জাগুলি রজ্জ্বর ন্যায় মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ যে ছিদ্রগুলি আছে সেগুলি পূর্ণ করে অবস্থান করে। তার মধ্য দিয়ে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ির মধ্যস্থ অগ্নিরূপ জ্বলন্ত শক্তি সঞ্চারণ করে সেই সঞ্চারণ স্থানকে সুষুম্নার অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ি বলে চিহ্নিত করতে হয়। এবার সাধক দুই ভ্রুর মধ্যে ললাট মধ্যস্থলে অন্তদৃষ্টিকে ক্রমে ক্রমে মজ্জাশ্রেণির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের মধ্যে সঞ্চারণ করবেন। এইরূপ অভ্যাস করলে সাধক বুঝতে পারবেন যে মজ্জাগুলি অভ্যন্তরদেশে এক অতি জীবন্ত শক্তি বিদ্যুল্লতার রূপ ধারণ করে আজ্ঞাচক্র থেকে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থল পর্যন্ত যাতায়াত করছে। সেই সময় সাধক নিজ অন্তদৃষ্টি দ্বারা আজ্ঞাচক্রে সেই ব্ৰহ্মতেজের জ্যোতিও দর্শন করবেন। সেই জ্যোতি খুব উজ্জ্বল এক চক্রের ন্যায় দর্শিত হয়। এরপর ওই জ্যোতি অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা আজ্ঞাচক্রের ঊর্ধ্বপথে প্রবেশ করিয়ে মস্তিষ্ক মধ্যে সহস্রর দর্শন পাবেন। সেই সহস্রার মধ্যে ব্রহ্মরন্ধ্রে নিজের জীবাত্মাকে প্রেরণ করলে সেখানে পরমাত্মার অর্থাৎ পরমপদের দর্শন পাবেন। তখন সাধকের মধ্যে জ্ঞান হবে যে তাঁর জীবাত্মা বা লিঙ্গশরীর পরমাত্মারই অংশ। তিনি দেখবেন নিজেকে। এই অবস্থার নামই আত্মমুক্তি।


বাবা লোকনাথ এই আত্মমুক্তির পথই তারাকান্তকে বলেছিলেন। তিনি নিজে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ বলেই এত সহজ করে সরলভাবে মায়াক্ষয় করার প্রক্রিয়া বলতে পেরেছিলেন। গৃহাশ্রমে সাধকদের ক্ষেত্রে বাবার এই সরলীকৃত পথ খুবই কার্যকর।


তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে ঈশ্বরের এই সৃজন রহস্য সম্বন্ধে আমি যৎসামান্য জ্ঞান লাভ করি এবং সারা পরিক্রমায় এই মায়াক্ষয় করার প্রক্রিয়ায় রত থাকি। উত্তরতটে উজ্জয়িনীতে মহামায়া মন্দিরে সারাদিন উপবাসে থেকে সান্ধ্য আরতিকালে মহামায়ার কাছেই আমাদের মধ্যে তিনি যে আবরণ সৃষ্টি করেছেন, তা ক্ষয় করে দেবার আকুল প্রার্থনা জানাই এবং সারা পরিক্রমায় অজপা (এইভাগেই পূর্ণ বিশ্লেষণ করা আছে) সাধনের মাধ্যমে জীবাত্মাকে ঈশ্বরমুখী করার প্রয়াস করি। খুবই আশ্চর্যের কথা, সেদিনই মধ্যরাত্রে এক দিব্যজ্যোতি পুরুষ আমার স্ত্রীকে দর্শন দিয়ে অভয় দান করেন। বাবা লোকনাথের দর্শিত মায়াক্ষয় করার পথের কার্যকারিতা আমি ও আমার স্ত্রী নিজ জীবনে উপলব্ধি করেছি।


অন্তর দিয়ে অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, বাবা লোকনাথ গুটিপোকার উদাহরণ দিয়ে মায়া ক্ষয় করার যে প্রক্রিয়া বলেছেন, তা কর্মমার্গের পথ। গুটিপোকা যেমন স্বনির্মিত গুটিতে আবদ্ধ হয়ে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত ওই আবদ্ধ দশা থেকে মুক্তিলাভ করে না, তেমনই জীবও মায়াকে ক্ষয় না করা পর্যন্ত নিজের স্বরূপ চৈতন্যে অবস্থিত হতে পারে না। জ্ঞানমার্গে এই অবস্থায় পৌঁছানো যেতে পারে, কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ভক্তি ও কর্মমার্গ সাধকের কাছে এই কাজ সহজ করে দিতে পারে। যারা গৃহাশ্রমে থেকে আত্মমুক্তির উপায় সন্ধান করেন, তাদের কাছে এই কর্মমার্গের পথই শ্রেষ্ঠ পথ। তবে এই পথে জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানের নাশ করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বাবা তারাকান্তকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা আত্মমুক্তির উপায় সন্ধানকারী সকল ভক্তগণের কাছেই এক অতি মূল্যবান উপদেশ। ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাদৃষ্টি সব সময় সকল ভক্তের উপর থাকে।


তারাকান্তবাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার ‘মায়া’ শব্দের বিশ্লেষণের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য বোঝায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ব্রহ্মচারী বাবার দৃষ্টি ও তাঁর বাৎসল্যপূর্ণ ব্যবহার তারাকান্তবাবুকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি অনেক সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে সৎসঙ্গ করেছেন, কিন্তু এই রকম ভাব কারও মধ্যে দেখেননি। এমন যত্ন করে প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি কাউকে দেখেননি। তার মনে এক প্রশ্ন বারবার ঘুরে-ফিরে আসছিল যে ব্রহ্মচারী বাবা কে? তার মন বারবার বারদী পৌঁছে যেতে চায়, অশান্ত হয়ে ওঠে। তিনি আবার বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। তারাকান্তবাবু বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি ব্রহ্মচারীবাবাকে পরে ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন। ব্রহ্মচারী বাবার কাছে এসে তিনি তাঁর জ্ঞানের পিপাসার নিরসন করতে থাকেন। একদিন এসে তিনি প্রশ্ন করেন


তারাকান্ত : তুমি কে? বুঝিয়ে বলো।


বাবা লোকনাথ : আমাকে আমি জানতে পারি না, অতএব বলতেও পারি না।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন যে এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করা তাঁর পক্ষে খুব কঠিন ছিল। এই কথার মধ্যে এক গঢ় আধ্যাত্ম বিজ্ঞান নিহিত আছে– আমি কে এই কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় কতকগুলি অনুভূতির সমষ্টিই আমার আমিত্ব। এই আমিত্বকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, অনুভূতি বিষয়গুলি অর্থাৎ কর্ম, অনুভব ব্যাপারটি অর্থাৎ ক্রিয়া, অনুভবের সম্পাদক অর্থাৎ কর্তা। এর মধ্যে যে অনুভব করল, অর্থাৎ যার সত্তা দ্বারা অনুভব ক্রিয়া নিষ্পন্ন হলো, সেই চেতন বস্তুই যথার্থ আমি অর্থাৎ বিজ্ঞাতা। সেই আমি বা চেতন বস্তু অথবা বিজ্ঞাতা ভিন্ন যা কিছু অনুভব করা যায়, তৎসমুদয় চেতন নয়, অর্থাৎ অচেতন বা জড়। এই কথা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে সকল দেহে এক-একটি ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাতা নাই–একই বিজ্ঞাতা অর্থাৎ আমি। ব্রহ্মচারী বাবা আপনাকে সেই একমাত্র বিজ্ঞাতা বলে টের পেয়েছিলেন এবং সেইজন্যই বলেছিলেন–আমাকে আমিজানতে পারিনা।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী ব্রহ্মচারী বাবার স্বরূপ জানতে ইচ্ছুক ছিলেন। সেইজন্য তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে বাবার স্বরূপ উদঘাটনে সমর্থ হন। বিভিন্ন প্রশ্নের ছোট ছোট উত্তর জেনে তিনি ব্রহ্মচারী বাবার স্বরূপ সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, এখানে তাঁর সেই উপলব্ধির কথা উল্লেখ করছি


সাধারণ জ্ঞানে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার ঐক্য করার নাম যোগ। পঞ্চভূত দেহের মালিককে চোখে দেখা যায়, এজন্য তাকে জীব বলে বুঝি কিন্তু পরমাত্মাকে চোখে দেখা যায় না, তার কথা আমরা কিছু জানি না। বাবা লোকনাথ চরম সিদ্ধি প্রাপ্তির পূর্বে যাকে জীবাত্মা বলে জানতেন, চরম সিদ্ধি প্রাপ্তির পর আর তাকে খুঁজে পেলেন না। কারণ তখন আর তিনি সেই দেহের মালিক রইলেন না, তিনি হয়ে উঠলেন সেই বিজ্ঞাতা অর্থাৎ পরমাত্মা। সেইজন্য তিনি বলেছেন, আমাকে আমি জানতে পারি না। লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেয়ে মুক্ত হয়ে গেলেন, তখন তাঁর জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন পরমাত্মা অর্থাৎ পূর্ণব্রহ্ম। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিজে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন যে, যখন আমি আমার দেহ থেকে আলগা হয়ে যাই, তখন সাধারণের অগোচর বিষয়সমূহ জানতে পাই। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ জানতে পেরেছিলেন বলে তিনি বাবাকে কেবল একজন মহাযোগী ভাবতেন না। তার কথার মধ্যে ঈশ্বরভাব প্রকাশ পেত। তাই তারাকান্তবাবু তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঘন ঘন বারদী আসতে থাকেন এবং একসময় ওকালতি পেশা ছেড়ে দিয়ে বারদী আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন। বাবা লোকনাথ তার জন্য একটি ঘর বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। তারাকান্তবাবু চাইতেন ব্রহ্মচারী বাবার সান্নিধ্যে থেকে আরও কিছু সাধনার মূল বিষয় জেনে নিতে। তিনি আশ্রমে থেকে বাবার সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আরও অনেক সাধনতত্ত্ব বিষয় জেনে নেন। তাঁর কিছু এখানে উল্লেখ করছি


তারাকান্ত : আচ্ছা, মানব জীবনের লক্ষ্য কি?


বাবা লোকনাথ : ইহজীবনে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে অমৃতত্ত্ব লাভ করা। তারাকান্ত ও ওই লক্ষ্যে সকলে পৌঁছতে পারেনা কেন? বাবা লোকনাথ ও ওই লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে যে বাধা রয়েছে তা দূর করতে পারলে অভীষ্ট লাভ করা অসম্ভব। তাই পারে না।


 তারাকান্ত : ওই বাধার স্বরূপ কি? আর কিভাবেই বা দূর করা যায়?


বাবা লোকনাথ : বিষয়ের উপর আসক্তি, আর আসক্তিজনিত কামনা বাসনাই আত্মজ্ঞান লাভের প্রধান বাধা। কেননা, ওই সব কামনাবাসনাই মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে তাকে ব্ৰহ্মবিমুখ করে তোলে। ওইসব কামনাবাসনার ফলে মানুষের মনে বিক্ষোভ ও মলিনতা জন্মায়। অমন বিক্ষিপ্ত ও মলিন মনে আত্মজ্ঞানের উদ্দীপক হয় না। সে তখন কামনা বাসনার বশ হয়ে বিষয় ভোগেই মত্ত হয়। ব্রহ্মকে-ভোগ করতে পারে না। ব্রহ্মকে ভোগ করতে হলে মন থেকে কামনা বাসনা রূপ বাধা দূর করতে হয়, তাদের উচ্ছেদ সাধন করতে হয়।


তারাকান্ত : আচ্ছা, ‘অমৃতত্ত্ব লাভ’ বলতে কি বোঝায়?


বাবা লোকনাথ : অমৃতত্ত্ব লাভ করার অর্থ হল সুখ-দুঃখ, দ্বন্দ্ব-বিরোধ, অজ্ঞান-মোহময় জীবন অতিক্রম করে আনন্দময়, অমৃতময় মুক্ত জীবন লাভ করা। জন্ম-মৃত্যুর অতীত হওয়া।


তারাকান্ত : বাবা, শাস্ত্রে পড়েছি জীবাত্মা ও পরমাত্মা মাত্রই একত্র যুক্ত হয়ে থাকেন। কেউই কাউকে ছেড়ে থাকেন না। জীব সর্বদাই ঈশ্বরের আশ্রয়ে থাকেন। ঈশ্বরও সর্বদা জীবের সাথে যুক্ত হয়ে আছেন। যদি তাই হয়, তাহলে জীব কেন সুখ-দুঃখ ভোগ করে?


বাবা লোকনাথ : শোন্ জীবের দেহ যেন একটি বৃক্ষ। বৃক্ষ যেমন অল্পদিনেই বিনষ্ট হয়, তেমনই দেহেরও অচিরেই বিনাশ ঘটে। সাধারণতঃ বৃক্ষে পাখিরাই বাস করে। জীবের দেহবৃক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মা দুটি পক্ষী বাস করছেন। জীব ও ঈশ্বর দুজনেই দুজনের সখা। দুইজনেই এক দেহে বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে বাস করছেন।


তারাকান্ত : বাবা ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যিনি তার স্বরূপ বলল।


 বাবা লোকনাথ : যিনি নীতিবাদী, আত্মক্রীড়, আত্মরতি, ক্রিয়াবান ও ব্রহ্মনিষ্ঠ, তিনিই সকল ব্রহ্মজ্ঞানীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।


তারাকান্ত : বাবা, হৃদয় শ্বেতপদ্মে প্রকাশমান শুদ্ধ জ্যোতির্ময় সেই আত্মাকে কি উপায়ে লাভ করা যায়?


বাবা লোকনাথ : সেই আত্মাকে সত্যনিষ্ঠ, তপস্যা, নিত্য ব্রহ্মচর্য ও সম্যক জ্ঞান দ্বারা লাভ করা যায়।


তারাকান্ত : সত্যনিষ্ঠ বলতে কি বোঝায়?


 বাবা লোকনাথ : সত্যনিষ্ঠ কথাটির অর্থ ধরতে হবে সত্যের উপলব্ধি ও অনুষ্ঠান। মিথ্যাজ্ঞানী ও মিথ্যাচারী ব্যক্তি আত্মাকে লাভ করতে পারে না। সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যা কখনও জয়লাভ করতে পারে না।


তারাকান্ত : তপস্যা বলতে কি বোঝাচ্ছে?


বাবা লোকনাথ : এখানে তপস্যা বলতে বোঝাচ্ছে ইন্দ্রিয় সংযম করে একাগ্রমনে পরমাত্মার ধ্যান। পরমাত্মাকে মনন, চিন্তন ও আরাধনা। তপস্যাই সবকিছুর মূল। তপোনুষ্ঠান না করলে কখনও উৎকৃষ্ট ফল ভোগ করা যায় না।


প্রজাপতি ব্রহ্মা তপস্যার প্রভাবেই এইসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মহর্ষিগণ তপোবলে বেদ সকল অধিকার করেন। পৃথিবীর মধ্যে যে বস্তু নিতান্ত দুর্লভ, তপোবলে তাও অধিকার করা যায়। প্রাচীনকালে মহর্ষিগণ যে সকল দুর্লভ ঐশ্বর্য লাভ করেছিলেন, তপস্যাই তার কারণ। ঋষিগণ, পিতৃগণ, দেবগণ ও মানুষ তপস্যার প্রভাবেই সিদ্ধিলাভ করে থাকেন। তপস্যার প্রভাবেই দেবগণ মহত্ব লাভ করেছেন। তপস্যার প্রভাবে অন্যান্য আকাঙ্ক্ষিত ফলের কথা দূরে থাক, দেবত্ব পর্যন্ত অধিকার করা যেতে পারে। তপস্যার প্রভাবে নানা পাপ থেকে বিমুক্ত হওয়া যায়। কঠিন সাধনা দ্বারা আত্মজ্ঞান বা স্বর্গাদিলাভের প্রচেষ্টায় তপস্যা। তপস্যার মূল অর্থ হলো-ইন্দ্রিয় সংযত করে একাগ্রচিত্তে পরমাত্মার মনন, চিন্তন, ধ্যান আরাধনা করা। ইহলোকে অনশনের মতো উৎকৃষ্ট তপস্যা আর কিছু নেই। মহাত্মা ভগীরথ দেহান্তে দেবলোক, গোলক ও ঋষিলোক অতিক্রম করে ব্রহ্মলোক লাভ করেছিলেন ওই অনশন তপস্যায়। তপোনুষ্ঠানের মধ্যে অনশন অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সংযত করে উপবাসই শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মচর্য পালনকালে গুরুদেবের নির্দেশে আমাকে নক্তব্ৰত, একান্তরা, ত্রিরাত্র, পঞ্চাহ, নবরাত্র, দ্বাদশাহ, মাসাহ, উপবাসব্রত পালন করতে হয়েছিল। মাসাহ ব্রত পালন সাধারণ লোকের কাছে সত্যিই অবাস্তব ও কাল্পনিক কাহিনী বলেই মনে হবে। কেননা, একজন মানুষ কি করে এক বিন্দু জলগ্রহণ না করে একমাস জীবিত থাকতে পারেন! জানিস, আমি দুবার মাসাহ ব্রত পালন করে সিদ্ধ হয়েছি।


তারাকান্ত : নিত্য ব্রহ্মচর্য–এই কথার অর্থ কি?


বাবা লোকনাথ : সকল সময়ে ব্রহ্মচর্য পালন অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয় সংযমই হল নিত্য ব্রহ্মচর্য।


তারাকান্ত : সম্যক জ্ঞান কি?


বাবা লোকনাথ :সম্যক জ্ঞান হল পরমাত্মার যথার্থ জ্ঞান। সে জ্ঞান পরমাত্মার সাক্ষাৎ দর্শন থেকেই লাভ করা যায়।


তারাকান্ত : বাবা, তুমি তো ব্রহ্মভূত। তুমি তো পূর্ণব্রহ্ম। তুমি তো আপ্তকাম। তোমার এই দেহ অবসানে তুমি কি আর জগতে ফিরে আসবে না?


বাবা লোকনাথ : আমি কি, তা আমি জানি না। এই দেহ অবসানের পর তোমাদের জন্য, আমার ভক্তদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমায় তো আসতেই হবে।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের স্বরূপ জানতে পেরেছিলেন বলে তিনি বাবাকে কেবল একজন মহাযোগী ভাবতেন না। তিনি তার ব্রহ্মস্বরূপ জানার পর চমৎকৃত হয়ে বাবার সামনে বসে ভাবতে থাকেন যে তার সামনে স্বয়ং পরমেশ্বর অবস্থান করছেন। ব্রহ্মচারী বাবা বুঝতে পেরেছেন যে তারাকান্ত তার স্বরূপ ধরে ফেলেছেন। দুজনে একান্তে আশ্রমে উপবিষ্ট। হঠাৎ বাবা তারাকান্তকে বলেন–দীক্ষা গ্রহণ করবি?


তারাকান্ত : একথা আমার চেয়ে তুমিই বোঝ। অতএব আমাকে জিজ্ঞাসা করা অনাবশ্যক।


বাবা লোকনাথ : গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ স্থাপনের গুরুত্ব বোধহয় জান না; এ সম্বন্ধ চিরস্থায়ী। আমি যদি মোক্ষলাভে সম্পূর্ণ যোগ্য হই, আর তুমি যদি তখন ততদূর প্রস্তুত না থাক, তবে যতদিন না তুমি আমার মতো যোগ্য হবে, ততকাল তোমার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এইরূপ তুমি যদি আমার আগে মোক্ষদ্বারে উপনীত হও, আর আমি অন্যদিকে নিবিষ্ট থাকি, তবে তোমাকেও আমার আগমনের অপেক্ষায় তথায় বসে থাকতে হবে।


তারাকান্ত : না, তবে আমার দীক্ষাগ্রহণ করা উচিত নয়। তুমি বাল্যকাল থেকে কঠোর ব্রহ্মচর্য করেছ, এত কষ্ট স্বীকার করে, কত শীত সহ্য করে, কত সাধন ভজন করে কামরিপুকে জয় করেছ, মহাসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছ। আর আমি কি প্রকৃতির লোক, তা বিলক্ষণ দেখছি। তোমার বিরক্তির ভয়ে জামা, জুতো ছেড়েছি। কিন্তু এখনও বাবু রয়েছি। আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করলে ক্ষতি, তুমি প্রস্তুত হয়েও কতকাল যে আমার অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য হবে তার ইয়ত্তা নেই।


তারাকান্তের এই সরল উক্তির পরেই ব্রহ্মচারী বাবা তাকে দীক্ষা দিলেন এবং তারাকান্তর নতুন নাম হল ব্রহ্মানন্দ ভারতী। ব্রহ্মচারী বাবার দীক্ষাপ্রদান সম্পর্কে ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন- ব্রহ্মচারী বাবা যে আমাকে দীক্ষা দিয়েছেন তা আর কিছুই নয়, গুরুমুখ নির্গত বিশেষ প্রকারের শ্রুতিবাক্য দ্বারা আত্মাকে শ্রবণ করা। আমাকে সেই দীক্ষা দিয়ে বললেন, গুরুবাক্য পেলে, এখন বেদান্ত বাক্যের সঙ্গে মিলাও। এর দ্বারা নিদিধ্যাসন পর্যন্ত করতে পারবে।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী দীক্ষান্তে ব্রহ্মচারী বাবাকে বলেছিলেন–তুমি যে আমাকে এই অদ্ভুত দীক্ষাতে দীক্ষিত করলে, এটা পেলে কোথায়?


তার উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বলেছিলেন–গুরু আমার উপনয়ন করেই এই দীক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গেই মনন করতে আদেশ করেছিলেন। এবং এর বলেই আমার দীর্ঘজীবন লাভ ঘটেছে। তিনি ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকেও প্রথমে মনন ও তারপরে নিদিধ্যাসন করার উপদেশ দেন। এখানে নিদিধ্যাসন কথার অর্থ হল সমাধিস্থ অবস্থায় আত্মাভিমুখ হয়ে স্থিরচিত্ত থাকা। বাবা এইসঙ্গে তাকে বিভিন্ন সাধন ক্রিয়ারও শিক্ষা দেন।


দীক্ষান্তে ব্রহ্মচারী বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বিভিন্ন যোগক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত করেন যার মধ্যে ছিল হঠযোগ, ষট্‌চক্রভেদ ক্রিয়া, শাম্ভবী বিদ্যা, সুষুম্ননাড়ীতে আত্মদর্শন পদ্ধতি, অজপা বিদ্যা ইত্যাদি।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন যে অজপা বিদ্যা শেখার ও অভ্যাস করার পর তিনি সুষুম্না নাড়িতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এর সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, তিনি ব্রহ্মচারী বাবার থেকে পেয়েছিলেন অন্তদৃষ্টি। তিনি আরও বলেছেন, ব্রহ্মচারী বাবা যখন অন্তদৃষ্টি অবলম্বন করতেন, তখন বাইরে তার নিশ্চল ভাব দেখা যেত। তিনি যখন আলগ হতেন অর্থাৎ আপনার দেহাতীত সত্তা অনুভব করতেন তখন সাধারণের দৃষ্টির অগোচর অনেক বিষয় দর্শন করে আসতেন।


অন্তদৃষ্টি শিক্ষালাভ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন–আমি তাহার নিকট হতে অন্তদৃষ্টিতে প্রবেশ করার বিষয় শিক্ষালাভ করেছি ও কিয়ৎ পরিমাণে কৃতকার্য হয়েছি বলতে পারি। তাঁহার অন্তদৃষ্টি যাহা আমার অন্তদৃষ্টি যে তাহাই, এমন মনে করতে হবে না। এই অন্তদৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে তিনি বলেছেন–হৃদয় নামক দেহমধ্যস্থিত জংশন বিশেষে একশত একটি চলন পথের সন্ধি আছে। ওই এক-একটি পথের নাম এক-একটি নাড়ি। ওই সকল নাড়ির অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নাড়ি রয়েছে। যারা উহার কোনো একটি নাড়িতে অন্তঃকরণ প্রবেশ করাতে পারেন, তাদের অন্তদৃষ্টি লাভ হয়েছে বলা যায়। যে নাড়িগুলি হৃদয়াঞ্চল থেকে মেরুদণ্ডে বাহিত হয়েছে তার মধ্যে একটি নাড়ির মাহাত্ম্য সর্বাপেক্ষা অধিক। সেই নাড়ি যোগশাস্ত্রে সুষুম্না নাড়ি নামে কীর্তিত। তা আমাদের দেহ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সূর্য পর্যন্ত প্রসারিত আছে। পরে উনি বলেছেন যে অজপা বিদ্যার সঙ্গে উনি অন্তদৃষ্টি প্রয়োগ করে সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত তেজ জ্যোতি দর্শন করেছেন। এই সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, গুরুদেব আমাকে দীক্ষা দেওয়ার সময় অজপা বিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে দিলেন। এরপর আমার সাধন চলতে থাকল এবং গুরুর আদেশমতো লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। কালে আমি ওই জংশনে পৌঁছতে পারলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, বিদ্যুন্ময়ী কোনো জ্বলন্তশক্তি উদ্ধোভাবে আমার দেহাভ্যন্তরে সতত সঞ্চারমানা থেকে দেহ রক্ষা করছেন। তার যাতায়াত দ্বারা শরীরের অভ্যন্তরস্থ যন্ত্রগুলি আপনা আপনি পরিচালিত হচ্ছে। এটাকেই শ্রম আদি বায়ুকর্তৃক দেহপোষণ ব্যাপার সাধিত হচ্ছে বলা যায়। ওই শক্তির যাতায়াত রেখাপথকে আমি স্নায়ু বুঝে থাকি এবং তাই আমার অন্তদৃষ্টির স্থল। অজপা দ্বারা অন্তঃকরণকে বহিব্যাপার থেকে প্রত্যাহৃত করে কেন্দ্রীভূত করা যায়। তখন মন নিজের করায়ত্ত রয়েছে বুঝতে হয়। গুরুদেবের বিশেষ উপদেশ দ্বারা কেন্দ্রীভূত অন্তঃকরণকে এমনভাবে নিয়োগ করতে হয়েছিল যে, পরিণামে দেখলাম, আমি সেই উপদেশ পালনে বিদ্যুন্ময়ী সেই জ্বলন্তশক্তির নিকট উপস্থিত হতে পেরেছি। গুরুর এই বিশেষ উপদেশ আমার চালক না হলে আমার সেই আয়ত্ত অন্তঃকরণকে আমি কোনদিকে যে চালাতাম বলা যায় না। হৃদয়স্থ নাড়িতে প্রবেশ করা বিশেষ দৈবানুগ্রহ ভিন্ন সম্ভব হয় না। যে-সকল সাধকের হৃদয়ে এই বিদ্যা সাধনের বীজ নিহিত রয়েছে, তারা অন্যান্য সাধকের কৃতকার্যতার বিষয় অবগত হলে স্বতঃই অজপা সাধনের জন্য ব্যাকুল না হয়ে পারবেন না। সেরূপ উত্তেজনা জন্মিলে গুরুভক্তির প্রভাবে সাধকের অন্তঃকরণ বিশেষভাবে সংস্কৃত হতে থাকে এবং গুরুর কৃপায় সাধকের উপযুক্ত পথপ্রদর্শক আপনা থেকে জুটে যায়।


বাবা লোকনাথের ব্রহ্মানন্দ ভারতীর উপর কি পরিমাণ স্নেহবাৎসল্য ছিল, এই ঘটনার থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁকে কেবল দীক্ষাই দেননি, মোক্ষের এক অতি উত্তম ও গুহ্য পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর শিষ্য অতি কম আয়াসে মোক্ষ লাভের পথে যেতে পারেন। এই বিদ্যা একটি বিরল বিদ্যা। এবং অন্তদৃষ্টি প্রদান গুরুর সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। অন্তদৃষ্টি না থাকলে অজপা সাধনায় সফল হওয়া যায় না।


অজপা সাধনা সম্বন্ধে নমর্দা পরিক্রমাকালে আমার একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা এখানে উল্লেখযোগ্য। নর্মদা পরিক্রমার আগের দিন অমরকন্টকের মার্কণ্ডেয় আশ্রমের পীঠাধীশ ব্রহ্মর্ষি শ্রীমৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজি মহারাজ আমাদের দীক্ষা প্রদান করেন। খুব হঠাৎ করেই তিনি দীক্ষা দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করে বলেন, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় আশ্রমের যে বৃক্ষের নিচে তপস্যা করতেন, সেখানে গিয়ে জপ করতে। আমি সেখানে গিয়ে সদ্য প্রাপ্ত ইষ্ট মন্ত্রের জপ করতে থাকি। জপে যখন আমি নিবিষ্ট, হঠাৎ আমার আজ্ঞাচক্রে এক জ্বলন্ত সূর্যের ন্যায় চক্রদর্শন করি এবং পরে ধীরে ধীরে সেই উজ্জ্বল চক্ৰমধ্যে একটি বড় চক্ষু দর্শন করি যেটা আমার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ। আমি যখন এইরূপ স্পষ্ট দর্শন করছি, তখন কিন্তু আমার চক্ষু বন্ধ। আমি যদিও খুব আশ্চর্য হয়ে যাই কিন্তু জপ করে যেতে থাকি। চক্ষুও আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অবস্থান করে। এইভাবে কিছু সময় গত হলে আমার মনে হঠাৎ খুব ভয় হয়। আমি চক্ষু উন্মোচন করে ফেলি। তখন প্রথমে আমার সামনে কেবল অন্ধকার দৃষ্ট হয় এবং পরে স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমি গুরুদেবের কাছে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করি। গুরুদেব বলেন, তুমি মার্কণ্ডেয় মুনির আশীর্বাদ পেয়ে গেছ, আমি তোমায় অন্তঃকরণ থেকে আশীর্বাদ করছি, তুমি এবার পরিক্রমায় বেরিয়ে যাও, তুমি সফল হবে। এখন থেকেই তোমার তপস্যা শুরু হলো।


এরপর পরিক্রমায় রাত্রিবেলা আমি একটি মন্ত্রকে, অজপা সাধনায় আমার লিঙ্গ শরীরের কাছে (জীবাত্মা) প্রেরণ করি এবং সেই মন্ত্র সারারাত্রি আমার মধ্যে হতে থাকে। আমার formally অজপা বিদ্যা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না। পরমেশ্বরের কৃপায় আমি রাত্রিকালে ও নর্মদা আরতীর স, দৃষ্টিকে ভিতরে প্রেরণ করে অজপা সাধনা করেছি এবং অনেক সময় আজ্ঞাচক্রে এক জ্বলন্ত চক্রের দর্শন পেয়েছি। এটা যে একটি গুহ্য সাধন প্রক্রিয়া, সেটা বুঝতে পেরেছি। দৈব অনুগ্রহ ভিন্ন যে এই সাধন প্রক্রিয়া আয়ত্ত করা যায় না এবং এর ফল পাওয়া যায় না, এ কথা ধ্রুব সত্য। নর্মদা পরিক্রমাকালে গুরুদেবের আশীর্বাদ, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় ও বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ এবং নর্মদা মাতা ও শিবশম্ভুর কৃপা আমি পদে পদে পেয়েছি। সেজন্য ব্রহ্মানন্দ ভারতীর এই অনুভূতি যে ঈশ্বরানুগ্রহ ব্যতীত অজপা সাধনায় সফল হওয়া যায় না, এ কথার যথার্থতা আমি স্বীকার করি। আমাকে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।


ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের বিশেষ কৃপালাভে সমর্থ হয়েছিলেন কেননা তিনি তাঁর পূর্ণব্রহ্মরূপ ও সত্ত্ব জানতে পেরেছিলেন। বাবা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপায়ও ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলে দিয়েছিলেন এবং তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মজ্ঞানের নিদর্শনও পেয়েছিলেন। বাবা লোকনাথ মরদেহ ত্যাগ করার পর ব্রহ্মানন্দ ভারতী লোকনাথ মাহাত্ম্য প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। দয়াগঞ্জে লোকনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠায় তার প্রত্যক্ষ মদত ছিল। ব্রহ্মানন্দ ভারতীর সঙ্গে বাবা লোকনাথের প্রশ্নোত্তর ও ভাব বিনিময়ে সাধকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এমনকি গৃহাশ্রমে থেকে যারা সাধনকর্মে রত আছেন, তারাও এই কথোপকথনের দ্বারা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। বাবা লোকনাথের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সাধকদের কাছে এক অমূল্য আধ্যাত্মিক সম্পদ। বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যে সব যোগানুষ্ঠানের কথা বলেছেন, তার থেকে বোঝা যায় যে যোগসাধনার সকল গুহ্য অঙ্গগুলি অতিক্রম করেই তিনি ব্রহ্মজ্ঞ হতে পেরেছিলেন। আর একথাও বোঝা যায় যে, যারা এত দীর্ঘ যোগপথ অতিক্রম করতে পারেন, তারাও ঈশ্বরানুগ্রহে বা বাবা লোকনাথের কৃপায় সাধন পথে সফল হতে পারেন। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার সঙ্গে তার বার্তালাপ ডায়েরিতে সযত্নে লিখে রেখেছিলেন বলে, আজ বাবার ভক্তগণ সেইসব কথা জানতে পারছেন। অনেক কথা যা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বারদী আশ্রম থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।


.


ডাক্তার নিশিকান্ত বসু


ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর জন্ম হয় আসামের তেজপুর শহরে ১৮৮০ সনে। তার পিতা শ্রীরজনীকান্ত বসু তেজপুরের ডেপুটি কমিশনার অফিসে চাকরি করতেন। তাঁরা আট ভাইবোন ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষদের আদি বসতি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। পরে তারা স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা জেলার অন্তর্গত বারদী গ্রামে বসবাস করতে থাকেন বলে জানা যায়। নিশিকান্ত বসু ছাত্র হিসাবে খুবই মেধাবী ছিলেন। যখন তার বয়স ১৪ বছর, তখন তাঁর পিতা তেজপুর থেকে ধুবড়িতে ডেপুটি কমিশনার অফিসের সেরেস্তাদার রূপে বদলি হন। সেই অফিসের এক কর্মচারীর নাম ছিল শ্রীবসন্তকুমার মজুমদার। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বারদীর শশীভূষণ নাগের ভগিনী। নিশিকান্তবাবু বালক বয়সে তাদের কাছে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কথা শোনেন এবং তার মনে লোকনাথ বাবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়। তিনি তখনও বাবাকে দর্শন করেননি।


প্রাথমিক শিক্ষার পরে নিশিকান্ত বসু ডাক্তারি পাশ করেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যান। সেখানে তিনি এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকায় এম.ডি. পাশ করার পর তিনি একটি স্যানেটোরিয়ামে চাকরি জীবন শুরু করেন। একদিন সেখানে এক অলৌকিক ঘটনায় তিনি প্রথম তার উপর লোকনাথ বাবার আশীর্বাদ উপলব্ধি করেন।


স্যানেটোরিয়ামে একজন ৩০ বছর বয়স্ক মহিলা পেটের টিউমারের চিকিৎসার জন্য আসেন। সেখানে চিকিৎসায় তাঁর কোনো উন্নতি না হওয়ায় একদিন নিশিকান্ত বসুকে একা পেয়ে সেই মহিলা তার কাছে এসে বলেন, ডাক্তার বোস, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। এতদিন তোমাদের এখানে চিকিৎসা করেও আমার কোনো উপকার হল না। এখন বলো, আমি কি করবো! নিশিকান্ত বাবু রোগিনীকে কিছু বলতে যাবেন এমন সময়ে সেই রোগিনী বলে উঠলেন, ডাক্তার বোস, আমি তোমার মাথার পিছনে একজনকে দেখতে পাচ্ছি। তার চুলগুলি মাথার উপর জড়ানো, তার মুখমণ্ডল দাড়ি-গোঁফে আচ্ছাদিত। তার মুখ আমার দিকে, কিন্তু চক্ষু অন্যদিকে। তার পরনে একখানি সাদা কাপড় ডান হাতের নিচ দিয়ে শরীর আবৃত করে বাম কাঁধের উপর দেওয়া আছে। তুমি জানো ইনি কে? ইনি নিশ্চয়ই তোমার Spiritual guide. নিশিকান্তবাবু মহিলার মুখের কথা শুনে চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যে বিবরণ তিনি শুনলেন, সেই বিবরণই তিনি শুনেছিলেন বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রীর কাছে। এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বারদীর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। সূক্ষ্মদেহে এখানে তার কাছে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন যে যাঁকে তিনি এখনও দর্শন করেননি, কেবল তার কথা শুনে অন্তরে তার জন্য গভীর ভক্তি, শ্রদ্ধা নিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে বারদী গিয়ে তাঁর দর্শন করবেন, তিনি এত করুণাময় যে ভক্তের অন্তরের কথা জেনে সুদূর আমেরিকাতে সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করছেন। বাবার এই অযাচিত কৃপায় তিনি নিজেকে ধন্য মনে করলেন। তিনি একটি কাগজে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম লিখে সেই মহিলাকে দিয়ে বললেন, তুমি সর্বদা এই নাম স্মরণ করবে আর কোনো হাসপাতালে গিয়ে তোমার টিউমার অপারেশন করাবে। তুমি ভালো হয়ে যাবে। এই কথা বলে তিনি স্যানেটোরিয়ামের একজন নার্সকে দিয়ে রোগিনীকে অন্য একটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে সেই রোগিনীর অপারেশন হল এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।


এই ঘটনার কিছু পরে নিশিকান্ত বসুর শিকাগো শহরের চেম্বারে ঘটলো অনুরূপ একটি অলৌকিক ঘটনা। একদিন একজন সম্ভ্রান্ত মার্কিন মহিলা শূলরোগে আক্রান্ত হয়ে তার চেম্বারে এলেন। তিনি এসে বললেন, আমি অনেকদিন ধরে শূল রোগে আক্রান্ত। পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে এতদিন আমি অনেক চিকিৎসা করেছি, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। আমি ভারতীয় প্রাচীন পদ্ধতিতে আমার রোগের চিকিৎসা করাতে চাই। সেইজন্য আপনার কাছে এসেছি। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির উপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে। ভারতবর্ষ অলৌকিক যোগশক্তির দেশ। আপনি সেই যোগশক্তি সম্বলিত চিকিৎসা আমার জন্য করুন।


নিশিকান্তবাবু মার্কিন মহিলার কথা শুনে অবাক। তিনি তাকে বললেন, আমি ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকায় এসে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি। আমি এখানে সেই পাশ্চাত্য চিকিৎসার পেশায় যুক্ত আছি। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য। আর ভারতীয় যোগশক্তি সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। আমি কি করে যোগশক্তি দ্বারা আপনার চিকিৎসা করব? এইভাবে যখন নিশিকান্ত বসু ও তার রোগিণীর মধ্যে বার্তালাপ চলছে, সেই সময় হঠাৎ সেই মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলেন, well doc tor, who is there? who is behind you? আপনার পিছনে একজন দীর্ঘকায় জটাধারী মহাযোগী দাঁড়িয়ে আছেন। তার দেহে কোনো মাংস নেই। কিন্তু তার দেহের চর্মাবৃত অস্থিরাশি অপূর্ব প্রদীপ্ত। তাঁর শরীরে লোহিতবর্ণ তিলচিহ্ন আছে। তার পলকহীন নয়নযুগল স্থির হয়ে আছে। মহিলার এই কথা শুনে নিশিকান্তবাবু বললেন, আপনি শান্ত হোন। এমন পাগলামি করছেন কেন? আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।


তখন মহিলা বললেন, আমি পাগল নই। এই দেখুন আমি তার থেকে ওষুধ পেয়ে গেছি। এই যোগী আমার হাতে এই ওষুধ দিয়ে বললেন, এটা খেয়ে নে। তোর রোগ সেরে যাবে। মহিলা রোগিনী তার হাত খুলে যে ওষুধটি দেখালেন, সেটা একটি ফুলের পাপড়ি। সেই পাপড়ি এক অতীব মধুর গন্ধবিশিষ্ট। মহিলা রোগিনী সেই ওষুধ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চলে গেলেন। তারপর বাড়ি গিয়ে অতি ভক্তির সঙ্গে সেই দিব্যগন্ধযুক্ত ফুলের পাপড়ি খেলেন ও কিছুদিনের মধ্যে চিরতরে শূলরোগ মুক্ত হয়ে গেলেন। এরপর সেই মার্কিন মহিলা ভারতবর্ষ থেকে লোকনাথ বাবার একটি ছবি সংগ্রহ করেন এবং তার ঘরে টাঙিয়ে রাখেন। নিত্য তিনি সেই চিত্রে ভক্তিশ্রদ্ধা অর্পণ করতেন। ব্রহ্মচারী বাবার এই অযাচিত কৃপা নিশিকান্ত বসুর মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল। তার মন অশান্ত হয়ে উঠল বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য। তিনি আমেরিকা থেকে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে এসে বারদীর পূর্বপুরুষের ভিটায় গেলেন।


নিশিকান্ত বসু ছিলেন বারদীর অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের আত্মীয়। তিনি জানতেন যে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার অশেষ কৃপা আছে এই অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের উপর। তিনি বারদী পৌঁছে নাগবাড়িতে গিয়ে অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জমিদার অরুণকান্তি নাগ নিশিকান্ত বসুকে নিয়ে আশ্রমে গেলেন। আশ্রমে এসে বাবার আসন ঘরে বাবাকে দর্শন করেই চমকে উঠলেন নিশিকান্তবাবু। মহিলা বর্ণিত সেই দীর্ঘদেহী জটাজুটধারী, মুখে শ্বেত শ্মশ্রু, দেহে লোহিতবর্ণ তিল, চক্ষু পলকহীন মহাযোগী এখন তার সামনে গোমুখাসনে উপবিষ্ট। তার দেহে কোনো মাংস আছে বলে বোঝা যায় না। চর্মাবৃত অস্থিরাশি উজ্জ্বল প্রদীপ্ত। এই তো সেই মহাপুরুষ যাঁকে দর্শন করে ধন্য হয়েছেন তার দুই রোগিনী সুদূর আমেরিকায়। সত্যই ধন্য সেই দুই রমণী। তারা যাঁর দর্শন সেই সুদূর আমেরিকায় পেয়েছেন, তিনি ভারতীয় হয়ে আজ তার দর্শন পেলেন। নিশিকান্ত বাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে তার আমেরিকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করছিলেন। জমিদার মহাশয় তাঁকে ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করতে দেখে বললেন, ‘কি বলছ? কি হয়েছে?’ তখন নিশিকান্ত বাবু আমেরিকায় ঘটা ঘটনার বিবরণ তাকে শোনান। তখন জমিদার অরুণকান্তি নাগ তাঁকে বললেন, ব্রহ্মচারী বাবার মনের গতি সর্বত্র। তাঁর মন যেখানে যায়, তার সূক্ষ্মশরীরও সেখানে পৌঁছে যায়। ব্রহ্মচারী বাবা হচ্ছেন একজন মহা অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ। নিশিকান্তবাবু বুঝতে পারলেন যে, কোনো কারণে তিনি বাবার অহৈতুকী কৃপা লাভ করছেন। তার রোগীদের চিকিৎসাক্ষেত্রে তিনি বাবার আশীর্বাদ পাচ্ছেন। কিন্তু কেন তিনি এই আশীর্বাদ বা কৃপালাভ করছেন, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।


নিশিকান্ত বসুর মাতা ছিলেন বারদীর বড় জমিদার কালীকিশোর নাগ মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা। লোকনাথ বাবার পরমভক্ত জমিদার অরুণকান্তি নাগ সেই সূত্রে তার আত্মীয়। বাবা লোকনাথের এই জমিদার বাড়ির উপরে বিশেষ কৃপা আছে। নিশিকান্ত বসুর মনে ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে বালক বয়সেই ভক্তিশ্রদ্ধা জাগ্রত হয়েছিল। যদিও তার দর্শন লাভের সুযোগ পূর্বে হয়নি। কিন্তু তিনি মনে মনে বাবাকে পূজা করতেন ও তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। নিশিকান্ত বসুর উপর বাবার এই অহৈতুকী কৃপা আবার প্রমাণ করে যে ভক্তিযুক্ত মনে যে বাবাকে স্মরণ করে বা মনে মনে পূজা করে, সে বাবার কৃপালাভ করে। বাবাকে দর্শন করার পর নিশিকান্ত বসুর মনে বাসনা জাগে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু সেদিন তিনি এই কথা বাবাকে নিজমুখে বলতে পারেননি।


এরপর আবার আমেরিকাতে ফিরে গেলেও তার মন পড়ে থাকে বারদীতে। তিন বছর আমেরিকায় ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত থাকার পর তিনি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ও তার ডাক্তারি বিদ্যার দ্বারা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাবা লোকনাথের এক পরমভক্ত এবং অতি বিশ্বস্ত কৃপাধন্য সন্তান।


ভারতবর্ষে ফিরে তিনি একবার ধানবাদে তার ভাইয়ের বাড়ি যান। সেখানে কিছুদিন বসবাসকালে তার আলাপ হয় পণ্ডিত রামচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে। শাস্ত্রী মহাশয় বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। নিশিকান্ত বসু তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আলোচনা করে তার কাছেই দীক্ষা নিতে মনস্থ করেন। রামচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় তাকে দুই অক্ষরের মন্ত্র দান করে দিনে তিনবার সেই মন্ত্র জপ করতে বলেন। নিশিকান্ত বাবু গুরুদেবের নির্দেশমতো প্রতিদিন ভোর চারটে, দুপুরে স্নানের পর এবং রাত্রে শোবার সময় জপ ধ্যান করতে থাকেন। জপ করার সময় তিনি গুরুদেব প্রদত্ত মন্ত্রের সঙ্গে লোকনাথ বাবার নাম জুড়ে দেন। এইভাবে নিরন্তর জপ করতে করতে ইষ্টদেবের সঙ্গে লোকনাথ বাবার নাম যুক্ত হয়ে তার মনে ঈষ্টদেব ও লোকনাথ বাবা অভিন্ন হয়ে যান। নিয়মিত তিনবার ভিন্নও তিনি সারাদিন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই জপ অভ্যাস করতে থাকেন এবং এক বছর অনুরূপ অভ্যাস করার পর তিনি তার শরীরাভ্যন্তরে এক অনাহত নাদ শুনতে পান।


আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বারদীর জমিদার নিশিকান্ত বসুকে একটি চিকিৎসালয় করে দেন। তিনি চিকিৎসালয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে কোনো পয়সা নিতেন না। গরিব দুঃস্থদের সেবাকাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার কাছে চিকিৎসা করে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে রোগী মুক্ত হয়ে যেত।


একবার এক রোগী তার দূষিত রোগের চিকিৎসার জন্য নিশিকান্ত বাবুর কাছে আসে। সে পুলিশে চাকরি করত। কিছুদিন চিকিৎসা করার পর সে ডাক্তারকে বলে যে তার চিকিৎসায় কিছু ভুল হচ্ছে। সে তার নামে মামলা করবে। তরে যদি তার চিকিৎসা নির্ভুল প্রমাণিত হয়, তবে সে ডাক্তারকে টাকা দেবে। মামলার কথা শুনে নিশিকান্তবাবু একটু ভীত হয়ে গেলেন। তিনি লোকনাথ বাবাকে ডাকতে লাগলেন। সারারাত্রি তিনি একনিষ্ঠ চিত্তে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন। একসময় এক অপার্থিব দিব্যগন্ধে তার ঘর ভরে উঠল। তিনি চমকে উঠলেন। তার মনে হল বাবা লোকনাথ সূক্ষ্মদেহে তার কাছে এসেছেন। তিনি তার উপস্থিতি সেই দিব্যগন্ধের মধ্যে দিয়ে টের পাচ্ছেন কিন্তু তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।


পরের দিন সেই পুলিশ রোগী একজন সাহেব ডাক্তারের কাছে নিজের রোগ পরীক্ষা করে এসে জানিয়ে গেল যে নিশিকান্ত বসুর চিকিৎসা সঠিক। সে নিশিকান্ত বসুর চিকিৎসাতেই পরে আরোগ্য লাভ করেছিল। যদিও সে তাকে প্রতিশ্রুতিমতো কোনো টাকা দেয়নি।


নিশিকান্তবাবুর বড়দার জামাতা প্রফুল্লচন্দ্র দে ছিলেন একজন ইনকামট্যাক্স অফিসার। তিনি ফুসফুসের একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতার অনেক বড়ো ডাক্তারেরা তাকে যক্ষার চিকিৎসা করেন কিন্তু তিনি ক্রমে দুর্বল হয়ে হাড়চামড়া সার হয়ে ওঠেন। সেই সময় কলকাতার একজন ডাক্তার তাকে টিবির চিকিৎসার জন্য একটি স্যানেটোরিয়ামে পাঠিয়ে দিলেন। স্যানেটোরিয়ামের ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে বলেন যে রোগী ফুসফুসে একটি ফেঁড়ায় আক্রান্ত। সে টি.বি. রোগী নয়। তখন রোগীকে আবার কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হলো। কলকাতার ডাক্তারেরা রোগীর চিকিৎসা নতুন করে শুরু করলেন কিন্তু রোগ উপশমের কিছু লক্ষ্মণ দেখা গেল না। এমন সময় নিশিকান্ত বসু বারদী থেকে কলকাতায় এলেন এবং রোগী দেখলেন। রোগীকে দেখে তিনি একটি ওষুধের নাম লিখে দিলেন ও বাড়ির লোকদের বললেন, চিকিৎসকদের ওই ওষুধের নামটি দিয়ে দিতে। কিন্তু বাড়ির লোক ভাবলো কলকাতার এত বড়ো বড়ো ডাক্তারের ওষুধে কিছু ফল হচ্ছে না, নিশিকান্তবাবুর ওষুধে কি ফল হবে? তারা ডাক্তারকে ওষুধের নামটি ইচ্ছা করে দিলেন না। এদিকে রোগীর অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগল। যখন রোগীর অন্তিম সময় উপস্থিত হলো, তখন প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী ও তার কাকা নিশিকান্তবাবুকে অনুরোধ করলেন একবার শেষ চেষ্টা করতে। জামাতার অকালমৃত্যুর কথা চিন্তা করে নিশিকান্তবাবু লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করে একটি ওষুধের প্রেসক্রিপশন করে দিলেন। এরপর সেইমতো ওষুধ চলতে লাগল। অচিরেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। তখন কলকাতার ডাক্তার বললেন, এইটিই এই রোগের সঠিক ওষুধ। রোগী কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তার কর্মস্থলে যোগ দিলেন। নিশিকান্তবাবুকে পরিবারের লোকেরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গেলে তিনি বলেন যে বাবা লোকনাথের কৃপাতেই তিনি শেষ সময়ে ওই ওষুধটি প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এটা তাঁর কৃতিত্ব নয়, এটা লোকনাথ বাবার কৃপা। এইভাবে অনেক ক্ষেত্রে নিশিকান্তবাবু দেখেছেন যে, কোনো কঠিন রোগের চিকিৎসাকালে তিনি বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ অযাচিতভাবে পেয়েছেন।


বারদীর চৈতন্যনাগ মহাশয়ের স্ত্রী অনেক দিন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগছিলেন। সেইসময় ম্যালেরিয়া জ্বরকে ভয়াবহ বলে গণ্য করা হতো। নিশিকান্তবাবু অনেক চিকিৎসা করেও রোগীকে সুস্থ করতে পারছিলেন না। একদিন রাতে রোগীর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলো। নিশিকান্তবাবু তখন অনন্যোপায় হয়ে একমনে বাবা লোকনাথকে স্মরণ করতে থাকেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকেন রোগিনীকে কৃপা করার জন্য। সেইদিন রাতে রোগিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন সহসা লোকনাথ বাবা আশ্রম থেকে নেমে এসে তার মাথার কাছে খাটের উপর বসে বলেন, এই যে আমি এসেছি। তুই ভয় করিস কেন? লোকনাথ বাবার দিব্যস্পর্শে একজন নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী রোগী সকালে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। অবাক কাণ্ড এই যে, পরদিন সেই চলৎশক্তিহীনা রোগী বিছানা থেকে নেমে হেঁটে বাবার আশ্রমে গিয়ে বাবাকে দর্শন করে পেট ভরে খিচুড়ি প্রসাদ খেলেন।


সেই রোগী এই ঘটনার কথা নিশিকান্তবাবুকে জানান। নিশিকান্তবাবু তাঁর ঘরে বসে যখন এই ঘটনার কথা তার ডায়েরিতে লিখছিলেন, তার ঘরটি একটি মিষ্ট দিব্যগন্ধে ভরে ওঠে। নিশিকান্ত বসু তাঁর প্রতি বাবার কৃপার প্রতিটি কথা তার ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন। বাবার সঙ্গে তার বার্তালাপের অংশও তিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। পরবর্তীকালে তার ডায়েরি থেকে নাগ পরিবারের লোকেরা এবং বারদীর আশ্রমের অন্যেরা সেইসব কথা জানতে পারেন। বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর এইসব অমর কথা বারদী আশ্রম, নাগ পরিবার ও অন্য ভক্তদের মাধ্যমে আপামর মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে।


একদিন কয়েকমাসের একটি শিশুকে চিকিৎসার জন্য নিশিকান্তবাবুর কাছে আনা হলো। শিশুটি জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত ছিল। তাকে ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও সে তারস্বরে কাঁদতে লাগল। ওষুধে কোনো ফল হচ্ছে না দেখে নিশিকান্তবাবু শিশুটিকে কোলে নিয়ে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করে হাঁটতে লাগলেন। শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি একমনে লোকনাথ বাবার নাম জপ করছেন আর শিশুটি তার কোলে তারস্বরে চিৎকার করছে। নিশিকান্তবাবু লোকনাথ বাবার কাছে শিশুটির জন্য দয়া ভিক্ষা করলেন। এভাবে অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে তিনি এক জায়গায় বসে লোকনাথ বাবাকে ডেকে যেতে লাগলেন। হঠাৎ দেখা গেল শিশুটি কান্না থামিয়ে হাসছে, তার কাশিও আর নেই। জ্বরের উপশম হয়েছে। নিশিকান্ত বাবু লোকনাথ বাবার কৃপা নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারলেন।


নিশিকান্ত বসু লোকনাথ বাবার এত প্রত্যক্ষ কৃপা নিরন্তর পেয়েছেন যে লোকনাথ বাবাই তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল। লোকনাথ বাবার সঙ্গে তিনি নিজেকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। তাঁর মনে একবার বাসনা জাগে যে বাবার মন্দিরে (ধ্যানঘরে) তিনি একা যদি বাবার পূজা করতে পারতেন! এই বাসনা মনে নিয়ে একদিন ভোরবেলায় তিনি স্নান করে বারদী আশ্রমে গেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন সঙ্গে পূজা করার জন্য কিছু ফুল নিয়ে যাবেন, কিন্তু যাবার সময় আর ফুল নেওয়া হল না। আশ্রমে গিয়ে তিনি দেখেন বাবার পূজা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার সামনে অনেক ফুল এখনও আছে। বাবা তার ঘরে একা আছেন। যদিও কোনোদিন বাবাকে পূজা করার পর কোনো ফুল অবশিষ্ট থাকে না, কেননা যিনি সর্বশেষ পূজা করেন, তিনিই সব ফুল তার চরণে অর্পণ করে দেন। কিন্তু আজ অবশিষ্ট ফুল পড়ে থাকতে দেখে নিশিকান্তবাবু একটু অবাকই হলেন। তিনি মনে করলেন, এও তার উপর বাবার এক অহৈতুকী কৃপা। তিনি ঘরে ঢুকে মনের আনন্দে ফুল বেলপাতা দিয়ে ইচ্ছেমতো তাঁর পূজা করলেন ও অন্তরে এক পরম তৃপ্তি অনুভব করলেন। এরপর থেকে তিনি যখনই বারদীতে থাকতেন, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আশ্রমে গিয়ে বাবাকে দর্শন ও প্রণাম করে সচল শিব দর্শনের আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করতেন। বাবা লোকনাথ নিশিকান্তবাবুকে অনেক কথা বলতেন এবং বলতেন তার কথাগুলি সব ডায়েরিতে লিখে রাখতে। বোধহয় বাবার ইচ্ছা ছিল তার এইসব কথা ভবিষ্যতে যাতে ভক্তরা এই ডায়েরি মারফত জানতে পারেন। নিশিকান্তবাবু এই কথাও তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন যে, বাবা সচ্চিদানন্দ, সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ। তিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্ম, মহান থেকেও মহান এবং বিরাট থেকেও বিরাট। তিনি পরম মঙ্গলময়। তিনি সর্বদা ভক্তকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনি বাবা লোকনাথের প্রচুর কৃপার নিদর্শন পেয়েছেন। অনেকগুলি ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, আবার এমন অসংখ্য কৃপাকথা লেখা হয়ে ওঠেনি। সেইসব কথা আর কোনো ভক্ত কোনোদিন জানতে পারবে না। নিশিকান্ত বসু তার সুদীর্ঘ জীবনে বাবার কৃপাকে ভগবৎ কৃপারূপেই গণ্য করেছেন। তাঁর শেষজীবনে দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যয় করতেন নিরন্তর জপ-ধ্যান ও বাবার স্মরণে মগ্ন থাকার জন্য। তিনি বৈষয়িক কর্ম ও চিন্তা ত্যাগ করে পরমেশ্বরে চিত্ত সমাহিত করে থাকতেন যাতে মৃত্যুকালে তার ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ হয়। বাবার চিন্তায় মগ্ন থাকতে থাকতে তার ভ্রুযুগলের মধ্যে উজ্জ্বল ওঁকার দৃষ্ট হতো। তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে পরমেশ্বর জ্ঞানে পূজা করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী হচ্ছেন ওঁ-কারের অংশভূত। সেই পরমপুরুষ যিনি বিশ্বের নিয়ন্তা, সৃজনকারী, পালনকারী ও সংহারকারী। অনন্য যোগ সাধনায় তিনি এই পার্থিব দেহকে ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা দিব্যদেহে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি হয়েছেন এমন একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যাঁর দেহে সর্ব দেবদেবীর নিবাস প্রত্যক্ষ করা যায়। নিশিকান্ত বসু নিজেকে ধন্য মনে করেছেন যে তিনি এই পরমপুরুষের সান্নিধ্যে আসতে এবং তার অসীম কৃপা লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, নিশিকান্ত বসু পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শ্রীজ্যোতি বসুর পিতা।


.


জানকী ব্রহ্মচারী


বারদীতে রামরতন চক্রবর্তী নামে একজন কবিরাজের বাস ছিল। একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হিসাবে তিনি ওই গ্রামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম ছিল জানকীনাথ চক্রবর্তী। একমাত্র পুত্র হিসাবে অতিশয় স্নেহ ভালোবাসায় জানকীনাথ তার শৈশব, বাল্যকাল ও কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেন। এইসময় একবার জানকীনাথ কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়। সেইসময় বঙ্গদেশে কালাজ্বর মারাত্মক আকার নিয়েছিল। অনেক ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসা সত্ত্বেও জানকীনাথের রোগের কোনো উপশম হয় না, বরং ক্রমে তা বেড়ে যায়। সে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে শীর্ণকায় হয়ে প্রায় মৃতবৎ হয়ে যায়। রামরতন ও তার স্ত্রী একমাত্র সন্তানের এই করুণ দশায় পাগলপ্রায় হয়ে যান। হাজারো ডাক্তার ও চিকিৎসা যখন তার রোগ সারাতে ব্যর্থ, তখন রামরতন বাবা লোকনাথের কৃপার উপর ভরসা করে তাঁর কাছে ছেলেকে নিয়ে যান।


রামরতন ব্রহ্মচারী বাবার সামনে সন্তানের দেহ রেখে বলেন, বাবা, আমার একমাত্র প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আপনিই রক্ষা করতে পারেন। আপনার কৃপা ভিন্ন আমার সন্তানের প্রাণরক্ষা সম্ভব নয়। তাই আপনার চরণে আমার সন্তানের প্রাণভিক্ষা চাই। আপনি আমার সন্তানকে রক্ষা করুন।


শরণাগত ভক্তবৎসল বাবা লোকনাথ রামরতন কবিরাজের সব কথা শুনে তাঁকে বললেন, ওকে আশ্রমে রেখে যা। রামরতন জানকীনাথকে বাবার চরণে রেখে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁর মনে এটুকু আশা হল যে ব্রহ্মচারী বাবা যখন তাঁর সন্তানকে তাঁর চরণে আশ্রয় দিয়েছেন, তখন যম তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সেদিন জানকীনাথ আশ্রমে পড়ে রইল। বাবা তাকে কিছু বললেন না।


পরদিন সকালে বাবা জানকীনাথকে ডেকে আদেশ করলেন, আশ্রমের পূর্বদিকের পুকুরঘাট থেকে জল তুলে এনে আশ্রমের সেবায় লেগে পড়তে। কিন্তু জানকীনাথ উত্থানশক্তিরহিত। তার অস্থিচর্মসার দেহে উঠে দাঁড়াবার মতোই বল নেই, সে পুকুরঘাট থেকে কি করে জল আনবে! কিন্তু বাবার আদেশ অমোঘ। তার খণ্ডন কেউ করতে পারে না। জানকীনাথ বাবার আদেশ শুনে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই, সহজে উঠে দাঁড়াল। তারপর এক অলৌকিক শক্তিবলে পূর্বদিকের পুকুরঘাট থেকে জল এনে আশ্রমের সেবা করতে আরম্ভ করল। যে সব আশ্রমবাসীগণ জানকীনাথকে মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখেছিল, তারা তার হঠাৎ এইরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে পড়াতে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। ব্রহ্মচারী বাবা যখন জানকীনাথকে আদেশ করলেন, তখনই আশ্রমের সেবার জন্য জানকীনাথের মধ্যে এক অলৌকিক শক্তির সঞ্চার হয়ে তার মধ্যের সমস্ত অসুস্থতা ও জড়তাকে দূর করে দিয়েছে। জানকীনাথ বাবার আদেশ মত নিঃশব্দে প্রতিদিন পুকুর থেকে জল তুলে এনে আশ্রমের পরিচর্যা করতে লাগল। এই সেবার ফলে প্রতিদিনই বাবার আশীর্বাদ তার উপর বর্ষিত হতে থাকল।


বাবা লোকনাথ জানকীনাথকে আশ্রম সেবার মধ্য দিয়ে কর্মযোগে প্রবৃত্ত করেছিলেন এবং নিজে তার মধ্যে আধ্যাত্ম শক্তির সঞ্চার করেছিলেন। আশ্রমের নিত্য সেবা করাই জানকীনাথ তার একমাত্র কাজ বলে মনে করে। সে মনে করে যে এই আশ্রম সেবার মধ্য দিয়েই সে ব্রহ্মচারী বাবার সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগকে সে হারাতে চায় না। সেজন্য অতি নিষ্ঠার সঙ্গে মনোযোগ সহকারে সে নিজেকে আশ্রম সেবায় নিয়োজিত করে। আর সে যত নিজেকে সেবায় নিয়োজিত করে, তত সে আশীর্বাদ পায় বাবার থেকে। এইভাবে ক্রমে মৃতপ্রায় জানকীনাথ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে কেবল বাবার আশীর্বাদে কর্মযোগের মাধ্যমে। যখন সব চিকিৎসা ব্যর্থ, তখন রামরতন চক্রবর্তী বাবার কৃপার উপর ভরসা করেই সন্তানকে আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন। জানকীনাথ সুস্থ হয়েছে লোকমুখে শুনে তিনি সস্ত্রীক আশ্রমে ছুটে আসেন সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। জানকীর মা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। বাবা লোকনাথ তাকে মাতৃআদেশ পালন করতে বলেন। কিন্তু জানকীনাথ বলে যে মাতৃআদেশ পালন করতে এখন সে অক্ষম।


জানকীনাথকে বাবা লোকনাথ ভালোবেসে স্নেহের ব্লসে জানকী বলে ডাকতেন। জানকী বাবা লোকনাথকে বলেন, আমার তো বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। আমি কেবল আপনার কৃপায় বেঁচেছি। তাই এখন এই দেহের উপর আর কারও অধিকার নেই। এই দেহ কেবল আপনার সেবা, পূজা ও সাধনভজনের জন্য উৎসর্গ করেছি। সংসারে আর আমি ফিরে যাব না।


জানকীর এই কথায় তার মা-র প্রাণ কেঁদে ওঠে। একমাত্র পুত্র সন্তানের মায়া তিনি কিছুতেই কাটাতে পারবেন না। তাকে ছেড়ে জীবনধারণ করতে পারবেন না। সেইজন্য তিনি অনেক করে জানকীকে অনুনয় করতে থাকেন তাঁর সঙ্গে গৃহে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু জানকী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আশ্রমের সেবা করে ব্রহ্মচারী বাবার সেবা করে ও তার সান্নিধ্যে এসে সংসার জীবনের মায়া ত্যাগ করতে সে সমর্থ হয়েছে। আর সে সেই পথে পা বাড়াতে চায় না। ব্রহ্মচারী বাবার সান্নিধ্য ছেড়ে সে পিতামাতার সান্নিধ্যে যেতে অপারগ। অবশেষে ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি ভক্তি ও বৈরাগ্যের কাছে হার মেনে জানকীর পিতামাতা চিরদিনের জন্য তাদের পুত্রকে ব্রহ্মচারী বাবার চরণে সমর্পণ করে চোখের জলে একাকী ঘরে ফিরে যান।


এতদিনে জানকী গৃহস্থ জীবনের বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্ত হয়ে সন্ন্যাস জীবনে প্রবেশাধিকার লাভ করে নিজেকে ধন্য মনে করেন। জানকীকে দীক্ষা দেন বাবা লোকনাথ। করে নেন তার একান্ত মন্ত্রশিষ্য। দীক্ষান্তে লোকনাথ বাবা জানকীকে যোগসাধনের বিভিন্ন ক্রিয়া শেখাতে থাকেন। গুরুঅন্ত প্রাণ জানকী অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে গুরুর থেকে প্রাপ্ত বিদ্যা আত্মস্থ করতে থাকেন। তার নাম হয় জানকী ব্রহ্মচারী।


লোকনাথ বাবা সাধনমার্গে জানকীর নিষ্ঠায় ও তার গুরুভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে অষ্টাঙ্গ যোগের প্রতিটি ক্রিয়া নিজে শিখিয়ে দেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী দেবসদৃশ মহাপুরুষের কাছে জানকী ব্রহ্মচারী যোগ সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করতে থাকেন। কত ভাগ্যবান তিনি। সাধনার প্রথম কর্তব্যরূপে জানকী ব্রহ্মচারী সর্বক্ষণ বাবা লোকনাথের দিব্যদেহ স্মরণ, মনন ও অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজের দেহকে লোকনাথ স্বরূপ করে তুলতে থাকেন। জানকী ব্রহ্মচারী ছিলেন এমন একজন অতীব সৌভাগ্যবান যে, বাবা লোকনাথ নিজে তাকে একই সঙ্গে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মমার্গের শিক্ষা দিয়ে সাধনার এক অতি উচ্চস্তরে পৌঁছে দেন। জানকীর যাতে সিদ্ধি সহজলভ্য হয়, সেজন্য বাবা লোকনাথ নিজের যোগশক্তি তার মধ্যে সঞ্চারিত করেন এবং তার নিজের যোগৈশ্বর্য তাকে দান করেন। জানকী ব্রহ্মচারী ক্রমে বাবা লোকনাথের কৃপায় সাধনার অতি উচ্চস্তরে উন্নীত হন এবং বাবা লোকনাথকে সর্বক্ষণ স্মরণ, মনন করতে করতে বাবার কৃপায় তার দেহটিও লোকনাথ সদৃশ্য হয়। সাধনস্তরে এই রূপ উক্রমণ দেখে বারদীবাসী চমৎকৃত হয়।


জানকী ব্রহ্মচারীকে এইরূপ বিশেষ কৃপা করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বাবা লোকনাথের। যখন বারদীর শ্মশানভূমিতে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানকার মাটি হাতে নিয়ে বাবা লোকনাথ তার ব্রহ্মরূপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বারদীর এই মাটি এক মহাতীর্থ স্থান হবে। এই মাটি থেকে ঘটবে মানুষের সর্বকষ্ট থেকে মুক্তি। বাবা ভাবতেন, তার ভবলীলা যখন সাঙ্গ হয়ে যাবে, তারপর এই আশ্রমের ভার তিনি কাকে দিয়ে যাবেন? তার অতি সাধের বারদী আশ্রমকে মানবমুক্তির জন্য তার পরে কে পরিচালনা করবে? কে পথ দেখাবে মুক্তিকামী মানুষকে? জানকীকে সেইজন্য বাবা নিজের হাতে নিজের মনের মতো করে তৈরি করেছিলেন। নিজের যোগৈশ্বর্য তার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন যাতে আগামী দিনে জানকী ব্রহ্মচারী মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাতে পারেন।


বাবা লোকনাথ যখন দেখলেন, জানকীর শরীরে সেই দিব্য আভা যা প্রমাণ করে যে তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উন্নীত হয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন, তখন তাকে ডেকে আদেশ করলেন, জানকী, আমার নলীলা অপ্রকট হলে বারদী আশ্রমের গুরুদায়িত্ব তোকেই বহন করতে হবে।


বাবা লোকনাথের এইরূপ আদেশ শুনে জানকী ব্রহ্মচারী মহাচিন্তায় পড়লেন। এত বড় দায়িত্বভার কেমন করে তিনি বহন করবেন। গুরুদেবের এই কঠোর আজ্ঞা পালন করা কি তার পক্ষে সম্ভব? যে বারদীর মাটিতে সর্ব দেব-দেবীর বাস, যে আশ্রমের মাটি সর্বরোগ ক্ষয় করে, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষের চিত্ত নিজে থেকে শীতল ও নির্মল হয়ে যায়, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষ হিংসা-দ্বেষ রহিত হয়, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষ দিব্যভাব অনুভব করে, যে আশ্রম ও তার সকল দিব্যভাবের রক্ষক স্বয়ং ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী, সেই আশ্রমের সব দায়িত্বভার তিনি কি করে নেবেন? তিনি কি সেই উপযুক্ত হয়েছেন? আবার তার মনে এও প্রশ্ন জাগে যে গুরুদেব তাঁর কাছে নরলীলা সাঙ্গ করার কথা বললেন কেন? তবে কি গুরুদেব আর বেশিদিন তার বর্তমান লীলায় থাকবেন না? এইসব কথা মনে করে তিনি অতিশয় বিচলিত হয়ে পড়েন। নানা সংশয়াত্মক প্রশ্ন তার মনকে তোলপাড় করে তোলে। নিজের যোগ সামর্থ তিনি কিছুই জানেন না। তিনি লোকনাথঅন্ত প্রাণ। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, যেই আসনে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপবেশন করেন, এরপরে সেই আসন তাকে রক্ষা করতে হবে। তিনি অতি বিনীতভাবে গুরুদেবের চরণে তার মনের কথা, অক্ষমতার কথা প্রতিদিন নিবেদন করতে থাকেন ও প্রতীক্ষা করেন বাবার পরবর্তী নির্দেশের।


জানকীকে চিন্তিত দেখে বাবা লোকনাথ একদিন তাকে বলেন, কিরে এত বড়ো আশ্ৰম কি করে চালাবি, তাই ভাবছিস তো? ওরে, আমার কি বিনাশ আছে? তবুও তোকে বলি, প্রত্যহ আসনঘর পরিষ্কার করার সময় আমার আসনের তলায় দুটি করে টাকা পাবি। তাতেই তোদের সব খরচ চলে যাবে। বাবার এই কথা অক্ষরে অক্ষরে পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়। বাবা লোকনাথের দেবলোকে উক্রমণের পর প্রতিদিন জানকী ব্রহ্মচারী বাবার আসনের তলায় দুটি করে টাকা পেতেন বাবার আশীর্বাদস্বরূপ এবং সেই আশীর্বাদকে পাথেয় করেই জানকী ব্রহ্মচারী আজীবন আশ্রমের সেবা করে গেছেন।


জানকী ব্রহ্মচারী যখন বাবার কৃপায় সাধনার অত্যুচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছেন এবং তার মধ্যে বাবার যোগেশ্বর্য সঞ্চারিত হবার ফলে বিভিন্ন সিদ্ধির স্ফুরণ হতে থাকে, বাবা লোকনাথ তখন নিশ্চিত হয়ে যান যে, তাঁর উত্তরকালে তাঁর জায়গায় জানকী মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাতে প্রস্তুত। এইসময় তিনি ভবলীলা সাঙ্গ করে ইহলোক ত্যাগ করার কথা ভাবতে থাকেন। জানকী ছিলেন বাবার শেষ সময়ের নিত্য সেবক। বাবার অন্তিমকালে তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল যে তার যোগৈশ্বচর্য দ্বারা তিনি এই বারদী আশ্রমের পবিত্রতা রক্ষা করবেন এবং সকল মুক্তিকামী মানুষকে পথ প্রদর্শন করবেন। বাবার অন্তিম প্রণয়কালে জানকী ব্রহ্মচারী উপস্থিত ছিলেন।


বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর বারদী আশ্রমের সমস্ত দায়িত্বভার জানকী ব্রহ্মচারীর উপর ন্যস্ত হয়। বাবার আশীর্বাদ সর্বদা তার উপরে ছিল। জানকী ব্রহ্মচারী নিত্য নিজ হস্তে ভোগ রান্না করতেন এবং সেই ভোগ বাবাকে নিবেদন করতেন। বারদী ও সোনার গাঁ-র প্রাচীন ব্যক্তিদের বর্তমান বংশধরদের কাছে শোনা যায় যে, যখন জানকী ব্রহ্মচারী ভোগ রান্না করতেন, পাকশালাটি এক দিব্যগন্ধে ভরে উঠত এবং সেই দিব্যগন্ধ সারা আশ্রম ছেয়ে যেত। ভোগ রান্না করে প্রথমে বাবা লোকনাথকে নিবেদন করা হতো। তারপর জানকী ব্রহ্মচারী প্রসাদ নিয়ে আশ্রমের উঠানে আয় আয় বলে ডাকলে আশ্রমের পাশ থেকে দুটি শেয়াল এবং অন্যান্য প্রাণী ও পক্ষীরা এসে প্রসাদ গ্রহণ করত।


যোগসাধনার উচ্চতর অবস্থায় ক্রমাগত বাবা লোকনাথকে স্মরণ, মনন করার জন্য জানকী ব্রহ্মচারী লোকনাথসদৃশ দেখতে হয়ে গিয়েছিলেন। বাবার মহাপ্রয়াণের পর তার যোগশক্তির বহিঃপ্রকাশ হতে থাকে। তার যোগেশ্বর্যের কথা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তিকামী মানুষ তার দর্শনে ও বাবা লোকনাথের পবিত্র আশ্রম স্পর্শ করার জন্য তার কাছে আসতে থাকেন। অনেক ভক্ত তখন জানকী ব্রহ্মচারীকে গুরুরূপে বরণ করে ধন্য হন।


জানকী ব্রহ্মচারীর অন্যতম শিষ্য ছিলেন গুরুদয়াল দাস। তিনি প্রথমে নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি গুরুর কাছে একটি পুত্রসন্তানের কামনা করেন। গুরুর কৃপায় যথাসময়ে তিনি একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। কিন্তু সেই পুত্র ছিল জন্মান্ধ। একদিন গুরুদয়াল আশ্রমে এসে জানকী ব্রহ্মচারীর চরণে তার শীর্ণকায় জন্মান্ধ পুত্রকে রেখে তার আরোগ্য কামনা করেন।


জানকীনাথ তাকে বলেন, বাবা লোকনাথের শ্রীচরণের ধূলি সর্বরোগের মহৌষধ। সেই পুণ্যধূলি আশ্রমের মাটিতে মিশে আছে। সে যেন এই আশ্রমের মাটি শিশুটির সর্বাঙ্গে ও চোখ দুটিতে প্রত্যহ মাখিয়ে দেন আর বাবা লোকনাথকে স্মরণ করেন। তাহলে বাবার আশীর্বাদে তার পুত্র নিশ্চয়ই আরোগ্য লাভ করবে। গুরুদয়াল গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যহ একমনে বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে আশ্রমের মাটি সন্তানের সর্বাঙ্গে ও দুটি চোখে মাখাতে থাকেন। তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে গুরু যখন বলেছেন, এই মাটি লেপলে তার পুত্র সুস্থ হয়ে যাবে, তখন বাবার কৃপায় নিশ্চয়ই তার পুত্র একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে। তার এই ঐকান্তিক বিশ্বাসের ফল গুরুদয়াল পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর পুত্র সুস্থ সবল হয়ে ওঠে এবং একদিন তার জন্মান্ধ পুত্র দৃষ্টিশক্তি পায়। একদিন সেই পবিত্র আশ্রম তার দৃশ্যগোচর হয়, তারপর ধীরে ধীরে প্রকৃতির সব সৃষ্টি ও সৌন্দর্যকে সে নয়নভরে দেখতে পারে। এই অলৌকিক কাণ্ডে আনন্দে গুরুদয়াল আত্মহারা হয়ে যান, তিনি জয়ধ্বনি করতে থাকেন বাবা লোকনাথ ও জানকী ব্রহ্মচারীর। এই শিশুর তখন নামকরণ হয় ভগবান দাস। সে পরে দীর্ঘজীবন লাভ করে।


এই ঘটনা বারদীতে ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১১৯-২০ বছর আগে বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর। আমি এমনও প্রমাণ পেয়েছি যে, বারদী আশ্রমে বাবার ঘরের বাইরে বারান্দার পাশে একটি জায়গায় বাবা প্রত্যহ আচমন করতেন ও হস্ত-পদ প্রক্ষালন করতেন। সেই জায়গার মাটি লেপন করে আজও অনেক রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আমি নিজে কলকাতা থেকে এক বিশেষ ব্যক্তি মারফৎ সেই জায়গার কিঞ্চিৎ মাটি সংগ্রহ করেছিলাম ও এক মারণরোগ থেকে মুক্তির জন্য ব্যবহার করেছিলাম। সেইজন্য নিজ অভিজ্ঞতার থেকে জোরের সঙ্গে এই কথা বলতে পারি। আমি এও জানি যে অনেক ভক্তই আশ্রমে গিয়ে সেই জায়গার মাটি সংগ্রহ করে নিত্য উপকার পান। বর্তমানে বাংলাদেশে যাদের বারদী যাতায়াত আছে, তারা এই মাটিকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করে।


গুরুদয়ালের পুত্রের এই অলৌকিক ঘটনার বার্তা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে যে, ব্রহ্মচারী বাবার মহাপ্রয়াণের পরেও বারদীর মাটি ততটাই পবিত্র আছে, যা আগে ছিল। বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথের যোগ্যশিষ্য জানকী ব্রহ্মচারী একইভাবে বাবার কৃপা ভক্তের মধ্যে বিতরণ করেছেন।


বারদীর দীঘির পাড়ে হরিচরণ নামে এক মৎস্যজীবী বাস করতো। ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি তার অগাধ ভক্তি বিশ্বাস ছিল। প্রত্যহ সূর্যোদয়ের পূর্বে সে স্নান করে শুদ্ধ মতো বাবার আসন ঘরের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সর্বাঙ্গে সেখানকার মাটি লেপন করতো। তারপর সে তার কাজে যেত। তার মনে দীক্ষা নেবার প্রবল আগ্রহ জাগে কিন্তু সে কথা সে ব্রহ্মচারী বাবাকে কোনোদিন বলতে পারে নি। বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর সে জানকী ব্রহ্মচারীকে সদ্গুরু রূপে পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাবা লোকনাথের প্রতি হরিচরণের ভক্তি বিশ্বাসের কথা জানকী ব্রহ্মচারী অনেকদিন ধরেই জানেন। বাবার ইহলোকে অবস্থানকালে প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁকে প্রণাম না করে সে কোনো কাজ করতো না এবং আশ্রমের পবিত্র মাটিতে দেহ লেপন না করে সে কাজে বেরোত না। এ কথা জানকীনাথের জানা। তবুও তিনি তাকে বলেন সময় হলে দীক্ষা দেবো। অধীর আগ্রহে সেই শুভ সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে হরিচরণ। অবশেষে একদিন তিনি হরিচরণকে দীক্ষা দিয়ে সংসারে থেকেও নিরাসক্ত নির্লিপ্ত হয়ে সাধনা করে যাবার উপদেশ দেন। গুরুর কৃপায় অতি সাধারণ হরিচরণের মধ্যে অল্পদিনেই ত্যাগ ও বৈরাগ্যের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হতে থাকে। সে ক্রমে বারদীতে একজন আদর্শ গৃহস্থ সাধুরূপে পরিচিত হয়ে ওঠে। অবশেষে দেহত্যাগের সময় বাবা লোকনাথ ও জানকী ব্রহ্মচারীর নাম স্মরণ করতে করতে এই ধরাধাম ত্যাগ করে।


বারদী আশ্রমে সেই সময় হরিচরণের দীক্ষান্তে জীবনের পরিবর্তনের কথা লোকমুখে প্রচারিত হয়। সঠিক সদ্গুরু পেলে যে শিষ্যকে সাধন ভজনের জন্য পাহাড় জঙ্গলে যেতে হয় না, হরিচরণের জীবন তার প্রমাণ। সদ্গুরুর প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি শ্রদ্ধা থাকলে এবং সদ্গুরু যদি শিষ্যকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন তবে গৃহে থেকে সংসারী জীবনযাপন করেও ত্যাগ ও বৈরাগ্য মনে আনা সম্ভব এবং তার ফলশ্রুতিতে মুক্তির পথের সন্ধান পাওয়াও সম্ভব। জানকী ব্রহ্মচারী হরিচরণের মতো একজন অতি সাধারণ ভক্তকে দীক্ষা দিয়েও সঠিক পথে পরিচালনা করে তার মধ্যে সংসারের প্রতি নিরাসক্ত ভাব ও বৈরাগ্য সৃষ্টি করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যে, সঠিক সদ্গুরুর সন্ধান পেলে শিষ্যের মুক্তির পথের সন্ধান গৃহাশ্রমে থেকেও পাওয়া যায়। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী মরদেহে না থাকলেও, তার আশ্রমগুরু ভক্তদের সেই পথের সন্ধান দিতে পারেন।


বাবা লোকনাথ অনেক গৃহস্থ ভক্তদের দীক্ষা দিয়ে ও সাধন জীবনে শিক্ষা দিয়ে সিদ্ধযোগী করে তুলেছিলেন। তিনি জগতের কাছে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরদর্শন কেবল গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের একচেটিয়া অধিকারের বস্তু নয়, সদ্গুরুর কৃপা হলে অতি সাধারণ গৃহী ব্যক্তিও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর থেকে উদ্ধৃতর যোগশক্তি ও আধ্যাত্মশক্তি গৃহাশ্রমে সাধনা করেই লাভ করতে পারেন। গৃহাশ্রমে সংসারে যুক্ত কত জীব যে ব্রহ্মচারী বাবার সংস্পর্শে এসে সংসারে নিরাসক্ত হয়ে ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মধ্য দিয়ে সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন, আধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। আবার, তার পরবর্তীকালে যাতে বারদী আশ্রমের এই ধারা বজায় থাকে, তার জন্য তিনি সকল যোগৈশ্বর্য দিয়ে জানকী ব্রহ্মচারীকে তৈরি করে গিয়েছিলেন। জানকী ব্রহ্মচারী, রজনী ব্রহ্মচারী, ব্রহ্মানন্দ ভারতী ইত্যাদি যোগীগণ বাবার সেই ইচ্ছাপূরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। বাবার দিব্যলোকে উক্রমণের পর জানকী ব্রহ্মচারীর যোগশক্তি, ভক্তি, ত্যাগ ও আদর্শের কথা লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং বহু লোক বারদীর আশ্রমে এসে তার কৃপাধন্য হয়।


অবশেষে ১৩১৮ সনের ২৯শে চৈত্র জানকী ব্রহ্মচারী তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করে ব্রহ্মলীন হন। যখন জানকী ব্রহ্মচারী ব্রহ্মলীন হন, তখন বাবা লোকনাথের এক সূক্ষ্ম নির্দেশে তার সমাধির পাশেই জানকী ব্রহ্মচারীর সমাধি নির্মিত হয়। এরপর থেকে একসঙ্গেই গুরু ও শিষ্যের নিত্যসেবা বারদী আশ্রমে হতে থাকে। প্রতিবছর ১৯শে জ্যৈষ্ঠ যখন বাবা লোকনাথের তিরোধান উৎসব হয়, তখন একইসঙ্গে তার সঙ্গে জানকী ব্রহ্মচারী ও মা গোয়ালিনীরও ভোগ নিবেদন হয়। বাবা লোকনাথের মতো জানকী ব্রহ্মচারীও বারদী আশ্রমে অমর হয়ে থাকেন। তার সূক্ষ্মাত্মা নিত্য ভক্তদের আজও কৃপা করে থাকে।


.


গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী


গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সম্পর্ক নিয়ে বাবার ভক্তদের মধ্যে বিশেষ কৌতূহল আছে। বাবার বারদী অবস্থানকালে গোঁসাইজি ছিলেন বোধহয় একমাত্র অতীব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দিব্যদেহের প্রতি লোমকূপে দেবদেবীর অবস্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সে কথা তিনি সারা দেশে পরিভ্রমণকালে তার ভক্তদের অবগত করিয়েছিলেন। কেন গোঁসাইজি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দিব্যদেহ প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেকথা প্রকৃতভাবে জানতে হলে আমাদের গোঁসাইজির জন্ম থেকে সাধনজীবন সম্পর্কে কিছু কথা জানতে হবে।


গোঁসাইজির জন্ম হয়েছিল শান্তিপুরে ১৮৪১ সনের ঝুলন পূর্ণিমার দিন। তার পিতার নাম ছিল শ্রী আনন্দচন্দ্র গোস্বামী ও মাতার নাম শ্রীমতি স্বর্ণময়ীদেবী। তাঁর পিতা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। তাদের কূলদেবতা ছিলেন শ্যামসুন্দর। তৎকালীন বৈষ্ণব সমাজে তার পিতার একজন ধার্মিক ও ন্যায়নিষ্ঠ গুরুরূপে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। বাল্যকালে বিজয়কৃষ্ণ গ্রামের পাঠশালায় বিদ্যা শিক্ষার্থে ভর্তি হন। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার্জনে তার কোনো ঝোঁক ছিল না। পাঠশালায় গিয়ে তিনি একদিন পণ্ডিত মশাইকে জিজ্ঞাসা করেন, ঈশ্বরকে কেমন দেখতে? তিনি মাতা নাকি পিতা? পণ্ডিত মশাই বিজয়ের এইরকম প্রশ্নকে বাঁচালতা মনে করেন ও বলেন, কৌপীন পড়ে, ভস্ম মেখে হিমালয়ের গুহায় গিয়ে ভগবানের খোঁজ করতে। বিজয়কৃষ্ণ তার মনের প্রশ্নের জবাব পাননা এবং সেইজন্য পাঠশালার পুঁথিগত বিদ্যার্জনে তিনি নিরাশ হয়ে পড়েন এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে তার মনের কৌতূহল ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আনন্দচন্দ্র বুঝতে পারেন যে বিজয়ের মন ক্রমেই আধ্যাত্ম পথে ধাবিত হচ্ছে। তিনি পুত্রকে তবুও পাঠশালার পড়ায় মনোনিবেশ করতে বলেন। বিজয় তখন পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? পিতা তখন তাকে বলেন, বিদ্যার্জনের মধ্য দিয়েই তিনি এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। এরপর বিজয়কৃষ্ণ পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করলে আনন্দচন্দ্র তাঁকে টোলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু টোলে ভর্তি হবার কিছুদিন পরে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। মাতা স্বর্ণময়ীদেবী তার স্বামীর ইচ্ছানুসারে পুত্রের টোল পাঠ সমাপ্ত করাতে সচেষ্ট হন এবং বিজয়কৃষ্ণ টোল পাঠ সমাপ্ত করেন। আনন্দচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়াবার। তার অবর্তমানে স্বর্ণময়ীদেবী কলকাতায় তাদের এক অবস্থাপন্ন শিষ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দচন্দ্রের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। সেই শিষ্য তখন বিজয়কৃষ্ণকে শান্তিপুর থেকে এনে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়ার সব ব্যবস্থা করে দেন।


সংস্কৃত কলেজে সেইসময় বিভিন্ন পণ্ডিত ও বিদ্বজনদের যোগাযোগ ছিল। সেইসময় ধর্মসংস্কার আন্দোলনে এই কলেজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে যোগ দিয়েছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ কলেজে বিভিন্ন পণ্ডিত সমাজের ব্যক্তিদের কাছে। ঈশ্বর সম্বন্ধে বিভিন্ন আলোচনা শুনতেন। একবার তিনি শান্তিপুরে মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, মা কেবলমাত্র আমাদের এই কৃষ্ণ বিগ্রহের মধ্যেই কি ভগবান আবদ্ধ আছেন? মা ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। বিজয়কৃষ্ণ মাকে বলেন, ভগবান কোনো সম্প্রদায়ের একার সম্পত্তি নন। স্বর্ণময়ীদেবী বুঝতে চেষ্টা করেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান হয়ে তার পুত্র এসব কি কথা বলছে। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন।


সমগ্র বাংলার বুকে তখন চলছে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভরা জোয়ার। কলকাতার সংস্কৃত কলেজ সেই আন্দোলনের এক কেন্দ্রবিন্দু। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তখন চলছে ভাঙনের জোয়ার। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন তখন ব্রাহ্ম সমাজের প্রাণপুরুষ। তাঁরা তাঁদের অনুগামীদের নিয়ে ভারতের তথা বাংলার বুকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ধ্বজা বয়ে নিয়ে চলেছেন। তারা একটা বড়ো প্রশ্ন সকল ধর্মানুরাগীদের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ সকলেই চায়, কিন্তু কোন পথে? সাকার ঈশ্বর আরাধনায় না নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায়? যে প্রশ্ন বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে সেই পাঠশালা জীবন থেকে তোলপাড় করছিল, সংস্কৃত কলেজে এসে তিনি সেই প্রশ্ন ব্রাহ্ম সমাজের মুখে শুনতে পেলেন। এই প্রশ্ন তাকে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি আকৃষ্ট করল। একদিন তিনি এক সহপাঠীর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজে গিয়ে তাদের কথা শুনলেন। নিরাকারবাদ তার ভালো লাগল। ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে তিনি প্রভাবিত হলেন। কিন্তু বাল্যকালের মনের সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তিনি কোথাও পাননা। ঈশ্বর সাকার না নিরাকার, এক-একজন এক-এক ভাবে ব্যাখ্যা করেন। কেউ কেউ বলেন, ঈশ্বর সাকার আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি নিরাকার। যত তিনি তাদের কথা শোনেন, তার মনের মধ্যে প্রশ্নের জাল বিস্তৃত হতে থাকে। মন হয়ে ওঠে অশান্ত। মনে এক চরম অতৃপ্তি নিয়ে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর সংস্কৃত কলেজে খুঁজতে থাকেন।


এই সময় তিনি কলেজে সহপাঠীদের কাছে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা জানতে পারেন। তিনি শুনতে পান, শ্রীরামকৃষ্ণ নিত্য ঈশ্বর দর্শন করেন। তার মনে হয়, এঁর কাছে গেলে তিনি হয়তো বা তার মনের প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। মনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন নিয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন। সেখানে ঠাকুরের সামনে বসে তিনি একনিষ্ঠভাবে তার উপদেশ শোনেন। ঠাকুরের কাছে তিনি জানতে পারেন, জীবন্মুক্তির উপায়। এ আবার ঈশ্বরের এক অন্য তত্ত্ব।


ঠাকুরের উপদেশ শুনে তিনি উপলব্ধি করেন যে, জীবের দুই অবস্থা–বন্ধন ও মুক্তি। ঈশ্বর উভয়েরই কর্তা। জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ থাকে বলে জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। জীব যদি নিজেকে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত করে আনন্দময় পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, তবেই দেখতে পায় মুক্তির পথ। সাধুসঙ্গ করলে সংসারে আবদ্ধ থেকেও মনকে ঈশ্বরাভিমুখী করা সম্ভব। মনকে দৃঢ় করে কেঁদে আকুল হলে সেই জীব নিজেকে বন্ধন মুক্ত করে মুক্তির আস্বাদ পেতে পারে। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা আর ব্রাহ্ম সমাজের কথা, সব তার মনকে বিচলিত করে তোলে। কোন পথে গেলে তিনি ঈশ্বরের সন্ধান পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। মনের মধ্যে সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি কিছুদিনের ছুটিতে শান্তিপুরে বাড়িতে চলে যান।


বাড়ি গিয়ে বিজয়কৃষ্ণ দেখেন সংসারে প্রচণ্ড অর্থাভাব। মা অতি কষ্টে আছেন। মা তাকে তখন কিছু শিষ্যের বাড়ি যেতে বলেন। শিষ্যের বাড়ি গেলে অর্থাভাব কিছুটা মেটার সম্ভাবনা থাকে। বাড়িতে শ্যামসুন্দরের সেবারও ব্যবস্থা হয়। কিন্তু গুরুর কর্তব্য সম্বন্ধে বিজয়কৃষ্ণের কিছুই জানা নেই। তাও মার কথায় তিনি কিছু শিষ্যের বাড়ি যান। কিন্তু সেখানে তাঁকে লজ্জাকর পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়। তিনি নিজেই অখণ্ড মণ্ডলাকার পুরুষের মাহাত্ম্য এবং তাঁকে দর্শনের উপায় জানেন না, তবে শিষ্যদের সেই পরমপুরুষের দর্শন ও মোক্ষ লাভের উপায় বলে দেওয়া কি করে সম্ভব? তিনি নিজেই তো এই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে শান্তিপুর এসেছেন। বাড়ি ফিরে বিজয়কৃষ্ণ ভাবলেন যে, তার দ্বারা গুরুগিরি করা হবে না। প্রথমে তাকে এখন আধ্যাত্ম জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ঈশ্বর লাভের উপায় অন্বেষণ করতে হবে এবং মোক্ষ লাভের জন্য মন প্রাণ ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হবে।


মা স্বর্ণময়ী এবং অন্যান্য আত্মীয়গণ বিজয়কৃষ্ণের এ হেন মনের অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হলেন এবং তার বিবাহ দিতে মনস্থ করলেন। তার মা দেখলেন পুত্র সংসার বিদ্বেষী। সর্বদা উরু-উরু মন। একটা বিবাগী ভাগ। সংসারে আয়ের প্রধান উৎসই ছিল যজন-যাজন এবং শিষ্যদের দান। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ এইসব থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়ায় মা ঠিক করলেন ছেলেকে বিবাহ দিয়ে সংসারী করবেন, তবে যদি মতি ফেরে। বিজয়কৃষ্ণের বিবাহ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুদিন শান্তিপুরে থাকার পর তিনি আবার কলকাতায় পাড়ি দিলেন।


কলকাতায় গিয়ে তিনি আবার সংস্কৃত কলেজে যাতায়াত শুরু করলেন। কিন্তু পাঠে তার আর মন বসল না। একদিন তিনি তার মনের সকল জিজ্ঞাসা নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সেনের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি শুনলেন, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্মই অখণ্ড মণ্ডলাকার। বিশুদ্ধ বুদ্ধি ও জ্ঞানের দ্বারাই একমাত্র তাঁকে জানা সম্ভব। ব্ৰহ্ম সর্বভূতে বিরাজমান। এই জগৎ তারই সৃষ্টি। ব্রাহ্ম সমাজ সেই ব্রহ্মের উপাসনারই পথ প্রদর্শন করে। এই ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে মনোনিবেশ করলেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। গৃহে কুলদেবতা শ্যামসুন্দর। এ হেন বৈষ্ণবগৃহের সন্তান হলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে তিনি তখন পাগল। কিন্তু সেই ধর্ম প্রচারে তার মনের প্রধান বাধাস্বরূপ এলো গলার উপবীত। তিনি তখন এতটাই ব্রাহ্ম ধর্মে প্রভাবিত হয়েছেন যে একদিন তিনি উপবীত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেমন সিদ্ধান্ত, তেমন কাজ। হঠাৎ একদিন তিনি উপবীত ত্যাগ করে বসলেন এবং নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে খুব তিরস্কৃত হলেন। এই ঘটনায় তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন হলো।


এরপর তিনি মনযোগ সহকারে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করছিলেন। কিন্তু এক নতুন বিপত্তি সামনে এলো। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে ফাটল ধরল। কেশবচন্দ্র সেন আদি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সংস্কারমুক্ত ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে তুললেন। ব্রাহ্ম সমাজের এই বিভাজন বিজয়কৃষ্ণের মনেও চিড় ধরাল। তিনি কলকাতা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য শান্তিপুরে ফিরে গেলেন। বাড়ি ফিরে বিজয়কৃষ্ণ উদ্ভ্রান্তের মতো দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর হাসিমুখে তার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করলেন। এই দর্শন তার মধ্যে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করলো। ঈশ্বর যদি নিরাকার হন, তবে তিনি স্বচক্ষে কি করে দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করলেন! তার একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী জ্ঞানমার্গী মন আবার পৌত্তলিকতার প্রতি ধীরে ধীরে আস্থাশীল হয়ে পড়তে লাগল। এমন সময় একদিন মধ্যাহ্নভোজের পর যখন তিনি বিশ্রাম করছেন, সেইসময় তামধ্যে শ্যামসুন্দর তাঁকে দর্শন দিলেন। তিনি দেখলেন, গম্ভীর মুখে শ্যামসুন্দর তার শিয়রে দাঁড়িয়ে বলছেন, বিজয়, আমি তোর কাছে ছুটে এসেছি। বড়ো কষ্ট আমার। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে। ওরা আমায় এক মুঠো খেতে দেয় বটে, কিন্তু পানীয় জল দেয় না। তুই আমায় জল দে। আমাকে ছেড়ে তুই দূরে চলে যাস না। আমার কাছেই থাক। তামধ্যে শ্যামসুন্দরের এই বাণী শুনে বিজয়কৃষ্ণের তন্দ্রা ছুটে গেল। তিনি ছুটে গিয়ে মন্দিরে দেখেন, ভোগের থালা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জল নেই। এই ঘটনায় তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। এরপরেও শ্যামসুন্দর তাকে কয়েকবার দর্শন দেন। একদিন মন্দিরে গিয়ে তিনি দেখলেন বিগ্রহের সর্বাঙ্গ থেকে এক অত্যুজ্জ্বল আলোচ্ছটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সেই অনন্যসুন্দর দিব্যপুরুষকে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে যখন তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে পড়লেন, মনে হল সেই দিব্যোজ্জ্বল মূর্তি যেন তাঁকে বলছেন, আমি ভাবের কাঙাল। ভক্তির কাঙাল। বিত্ত সম্পদের কাঙাল নই। আমার ভক্তরা যা কিছু করে তা যেন সমস্তই আমাকে অর্পন করে। ভক্তি ও নিষ্ঠা সম্বল করে অনন্যভাবে আমাতে মন-প্রাণ অর্পণ করে আমার ভজনা যে করে, সে অচিরেই ধর্মাত্মায় পরিণত হয়ে যায়। এই কথা বিজয়কৃষ্ণের মনে এক নতুন ভক্তিরসের সঞ্চার করে এবং তার থেকে জন্ম নেয় এক নতুন অস্থিরতার। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি তিনি ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁদের পৌত্তলিকতা বিরোধিতা তার মনকে অশান্ত করে তোলে। তিনি নিজের চক্ষুকে কি করে অবিশ্বাস করবেন যে চক্ষু সার্থক করেছে দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করে। তিনি আবার ছুটে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশামৃতে তিনি এবার ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়লেন এবং সাধন পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন।


বর্ধমান জেলার কালনায় এসে তার সাক্ষাৎ হল ভগবানদাস বাবাজির সঙ্গে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে ভক্তিরসের সন্ধান পেয়ে তিনি অতীব মুগ্ধ হলেন। সাধুসঙ্গ করার জন্য তার মন ব্যাকুল হলো। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন সাধুসঙ্গ করলে মন ঈশ্বরাভিমুখী হয়। সেইজন্য তিনি বনজঙ্গলে ভ্রমণ করতে শুরু করেন এবং সাধু দেখলেই তার সঙ্গে আধ্যাত্মতত্ত্ব আলোচনায় বসে যান। কিন্তু তখনও তিনি দীক্ষা নিয়ে সদ্গুরুর স্থানে কাউকে বসাতে পারেননি যে তাঁকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারেন। সেজন্য উদ্ভ্রান্তের মতো তিনি যেখানে সাধু দেখেন সেখানেই ছুটে যান, গুরুর খোঁজ করেন। কিন্তু সদ্গুরু কোথাও জোটে না। এরপর তিনি গেলেন কাশীতে। সেখানে মণিকর্ণিকার ঘাটে যখন তিনি উদাস মনে বসে আছেন, তখন গঙ্গাস্নান সেরে কমণ্ডলু হাতে তৈলঙ্গস্বামী তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, বেটা ভাবছিস কেন? আজ এখনই তোর দীক্ষা হবে। যা, গঙ্গা থেকে স্নান করে আয়। বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন তার সামনে শীকার সচল শিব দাঁড়িয়ে আছেন। সেই মহাত্মা যার এক দর্শনে শিব দর্শন হয়। তিনি নিজে বলছেন, তাকে দীক্ষা দেবেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিজয়কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে তার বিশাল বপু নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। গঙ্গায় স্নান করে উপরে এলে তৈলঙ্গস্বামী তাকে দীক্ষা দিয়ে বললেন, আজ তোর অর্ধেক দীক্ষা হলো। পূর্ণদীক্ষা আমি দেবো না। আমি তোর শরীরটা কেবল শুদ্ধ করে দিলাম। তোর গুরু আপনা থেকেই আসবে। ব্রাহ্মধর্ম থেকে আবার পৌত্তলিকতায় আস্থা ফিরিয়ে এনে কাশীর সচল শিব নামে পরিচিত ব্রহ্মপুরুষ তৈলঙ্গস্বামীর কাছে তার অর্ধেক দীক্ষা হলো। তিনি বলেছেন, গুরু পূর্ণদীক্ষা দেবার জন্য নিজে থেকেই আসবেন। সেজন্য বিজয়কৃষ্ণের মন এখন আরও বেশি সাধনমুখী হয়ে উঠেছে। তিনি কাশী থেকে গয়ায় গেলেন সেই অজানা গুরুর সন্ধানে। গয়ায় আকাশগঙ্গা পাহাড়ে তিনি দর্শন পান পুণ্যাত্মা ব্রহ্মানন্দ স্বামীর। ভাবাবেশে আপ্লুত হয়ে তিনি তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। এবার ব্রহ্মানন্দ স্বামীর কাছে তার পূর্ণদীক্ষা লাভ হলো। সেখানে দীক্ষামন্ত্র জপ করতে করতে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। যখন তার চোখ খুললো, দেখেন তার গুরু সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত। কেঁদে সেখানে তিনি আকুল হলেন। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি উদভ্রান্তের মতো গুরুদেবের খোঁজ করতে থাকেন। সন্ধান করতে করতে যখন তিনি গয়ার রামশীলা পাহাড়ে যান, সেখানে তাঁর দর্শন হয় গুরুদেবের। গুরুদেব তাকে বললেন, তোর মনের আকুলতাই তোর সিদ্ধিলাভের সহায়ক হবে। উতলা হোস না। তুই সিদ্ধিলাভ করবি। এরপর বিজয়কৃষ্ণ গুরুদেবের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গুরুদেব তখন তাকে আবার কাশী যেতে বলেন। কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটে তার সাক্ষাৎ হয় যোগীবর হরিহরানন্দ সরস্বতীজির সঙ্গে। তিনি তাঁকে সন্ন্যাসদীক্ষা দান করেন। সাধক সমাজে তার নাম হল স্বামী অচ্যুতানন্দ সরস্বতী। এই সময় ব্রহ্মানন্দ স্বামী তাকে দর্শন দিয়ে জীবের হিতসাধনের জন্য সংসার ত্যাগ না করতে পরামর্শ দিলেন। সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেও সন্ন্যাসী হওয়ার সাধ বিজয়কৃষ্ণের পূর্ণ হল না। গুরুর আদেশে গৃহাশ্রম ধর্মের মধ্যেই তিনি গয়ায় গিয়ে তপস্যা করতে থাকলেন। গয়ার নৃসিংহ মন্দিরে তপস্যাকালে প্রথম তার মধ্যে পূর্বজন্মের স্মৃতি উদয় হল এবং তিনি জীবের পঞ্চক্রেশ ক্ষয়ের পথে এগোতে থাকলেন। তপস্যার মাধ্যমে ঈশ্বর দর্শনের হেতু তিনি এরপর হিমালয় ও অন্যান্য স্থানে সাধনা করতে করতে কলকাতায় এসে পৌঁছান। তখনও তার ব্রহ্মদর্শন বা সিদ্ধিলাভ হয়নি।


সাধনায় তখনও ব্রহ্মদর্শন ও সিদ্ধিলাভ না হওয়ায়, বিজয়কৃষ্ণ কলকাতায় এসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারেন যে, বিজয়কৃষ্ণ এখন একজন সাধনপথের যাত্রী এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ তিনি করতে সমর্থ। তিনি তাকে বলেন, ‘বিজয়, এবার পূর্ববঙ্গে গিয়ে তোমাকে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে মন দিতে হবে।’ বিজয়কৃষ্ণ মহর্ষির কথায় পূর্ববঙ্গে যাওয়া মনস্থ করেন। পূর্ববঙ্গে এসে আবার তার গুরু ব্রহ্মানন্দ স্বামীর কথা মনে পড়ে। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকার্য শুরু করার আগে প্রসিদ্ধ শিব তীর্থ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তপস্যায় যেতে মনস্থ করেন।


চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন তপস্যারত, সেইসময় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং বেণীমাধব ওই পর্বত শৃঙ্গেরই একটি গুহায় সাধনারত। একদিন সেই পাহাড়ে দাবানল জ্বলে উঠে সারা অরণ্যভূমিকে গ্রাস করতে থাকে। যোগবলে বাবা লোকনাথ জানতে পারেন যে সেই দাবানলের মধ্যে একজন তপস্বী সাধনারত যাকে যে কোনো সময় দাবানল গ্রাস করতে পারে। তিনি যোগে এও জানতে পারেন যে ওই তপস্বী তার গুরু হিতলাল মিশ্র তথা তৈলঙ্গস্বামীর শিষ্য অর্থাৎ এই যোগী তার গুরুভ্রাতা এবং এই সাধকের সঙ্গে তিনি পারিবারিক সূত্রে আবদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে সেই তপস্বীর রক্ষার্থে তিনি সূক্ষ্মদেহে দাবানলে প্রবেশ করে দুই হাতে সেই বিরাট বপু তপস্বী বিজয়কৃষ্ণকে তুলে দাবানলের বাইরে এনে একটি পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে স্ব-স্থানে ফিরে যান। সেই তপস্বী জানতেও পারেনা যে কে তাঁকে ওই পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে গেলেন।


যখন বিজয়কৃষ্ণের ধ্যান ভঙ্গ হলো, তিনি দেখলেন তিনি যেখানে ধ্যানে বসেছিলেন, এটা সে জায়গা নয়। সেই জায়গা দাবানলে ভস্মীভূত, কিন্তু তিনি সুরক্ষিত। তিনি ভাবতে লাগলেন, দাবানলে যখন সমগ্র অরণ্যাঞ্চল ভস্মীভূত হয়ে গেছে, তখন তিনি দাবানল থেকে রক্ষা পেয়ে কিভাবে এখানে এলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি তখন পেলেন না। মনে সেই প্রশ্ন নিয়েই তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান। ঢাকা শহর ছিল তখন পূর্ববাংলার প্রধান সাংস্কৃতিক শহর। বিজয়কৃষ্ণ এখানে এসে গেণ্ডারিয়া গ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন এবং সেখান থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার শুরু করলেন। কিন্তু তার মন থেকে তিনি ঈশ্বর দর্শনের বাসনাকে মুছে ফেলতে পারলেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারের ফাঁকে এই আশ্রমে তিনি একান্তভাবে চতুর্ভূজ নারায়ণের ধ্যানে মগ্ন হলেন। শান্তিপুরে শ্যামসুন্দরের দিব্যকান্তি দর্শনের অভিজ্ঞতাকে তিনি ভুলতে পারেন নি। শ্যামসুন্দর তাদের কুলদেবতা। সেইজন্য ব্রহ্মদর্শনের জন্য তিনি নারায়ণের ধ্যান করার পথই অবশেষে বেছে নিয়েছিলেন। যখন তিনি পরমপুরুষ স্বরূপ নারায়ণকে ধ্যান করতে লাগলেন, তখন একসময় তার মধ্যে এক অলৌকিক শক্তি সঞ্চারিত হল এবং এতদিনে তিনি দিব্যজ্যোতি সম্বলিত নারায়ণকে তার সম্মুখে দেখতে পেলেন। তার ঈশ্বর দর্শনের আশা পূর্ণ হলো। কিন্তু নারায়ণের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিপ্ৰভার তেজ তিনি সহ্য করতে পারলেন না। সংজ্ঞা লোপ পেয়ে তার নিঃসার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এর থেকে বোঝা যায় যে, বিজয়কৃষ্ণের দেহকে তৈলঙ্গস্বামী শুদ্ধ করে দেবার পর ব্রহ্মানন্দ স্বামীর গুরুমন্ত্রের জোরে তার ঈশ্বরদর্শন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার দেহ যেহেতু যোগসাধনার মাধ্যমে দেবতেজ ধারণ করার মতো পটু তখনও হয়নি, সেজন্য তিনি সেই তেজে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। এরপর সেখানে তার গুরুর আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁর পুণ্যস্পর্শে বিজয়কৃষ্ণ সংজ্ঞা ফিরে পান। এইসময় গুরুদেব তাকে বলেন, বিজয়, তুমি নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছ। অর্জন করেছ দীক্ষাদানের ক্ষমতা। এবার থেকে তুমি ঈশ্বর সন্ধানীদের দীক্ষা দিতে পারো। এইসময় থেকেই তিনি গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামে পরিচিত হন। এই আশ্রমে তিনি তার সহধর্মিনী যোগমায়াদেবী ও শশ্রুমাতা মুক্তকেশী দেবীর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। গুরুদেবের কথা মতো এরপর তিনি গৃহাশ্রমে থেকেই সাধনমার্গে বিচরণ করতে থাকেন। এই আশ্রমেই তিনি অষ্টসিদ্ধি লাভ করেন।


শ্রীগীতার একাদশ অধ্যায়ে পাওয়া যায় যে অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, তুমি নিজ চর্মচক্ষুর দ্বারা আমার বিশ্বরূপ দেখতে সমর্থ হবে না। আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। সেই চক্ষুদ্বারা তুমি আমার ঈশ্বরীয় যোগশক্তি দর্শন করো (একাদশ অধ্যায়, ৮ম শ্লোক)। অর্থাৎ ঈশ্বরের দেহে যে অমিত তেজসম্পন্ন দিব্যজ্যোতি বিরাজমান থাকে, তা মানুষের চর্মচক্ষু সহ্য করতে পারে না। সেই তেজ সহ্য করার জন্য মানব দেহকে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে যোগসাধনার দ্বারা দিব্য দেহে পরিণত করতে হয়। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বা তৈলঙ্গস্বামী এই কাজ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ধর্মপথের বহুদিনের যাত্রী হলেও, অনেকটা সময় তার ব্যয় হয়েছিল সাকার আর নিরাকার উপাসনার দোলাচলে। বাবা লোকনাথ যখন তার পঞ্চভূত দেহকে দেবদেহে পরিণত করেছিলেন তখন অষ্টাদশ সিদ্ধি তাঁর করায়ত্ত এবং তিনি নিজ দেহে জীবাত্মাকে পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলিত করে পূর্ণব্রহ্ম হয়েছেন। গোঁসাইজি যখন চতুর্ভূজ নারায়ণের দর্শন পান, তখন তিনি অষ্টসিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং তখনও তিনি ব্রহ্ম দর্শন করেননি। অর্থাৎ তার দেহ ব্ৰহ্মস্বরূপ হয়নি। সেইজন্য তার দেহ নিঃসার হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছিল। অনেক সাধক এইরূপ অবস্থায় প্রাণও ত্যাগ করতে পারেন। কেননা দিব্যতেজ পঞ্চভূত শরীরের আধার ধারণ করতে সমর্থ নয়। এক্ষেত্রে ঠিক সেই সময় গোঁসাইজির গুরুদেব উপস্থিত হয়ে তাকে রক্ষা করেন। একবার বৃন্দাবনে আমি যখন শ্রীকৃষ্ণের দর্শনাভিলাষি হয়ে তার সব লীলাক্ষেত্র বিচরণ করছিলাম, তখন জানতে পারি যে নিধুবনে একজন কৃষ্ণভক্ত রাতে লুকিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলা দেখতে চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে রাতে ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ভিতরে কেউ থাকতে পারে না। পরদিন সকালে যখন নিধুবনের প্রধান ফটক খোলা হয়, ভিতর থেকে অন্ধ এক পাগল ভক্ত প্রায় চিৎকার করতে করতে বলে, ‘সব উজালা হ্যায়, সব উজালা হ্যায়’। আর রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। পরে তার বাড়ির লোক সেখানে এসে বলে যে সে কৃষ্ণকে দেখার অভিলাষে নিধুবনে আগের দিন লুকিয়ে ছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণলীলা দেখার সেই অভিলাষ পূর্ণ করতে গিয়েই সে চিরতরে অন্ধ ও পাগল হয়ে যায়। পথে পথে সে কেবল পাগলপ্রায় হয়ে রাধাকৃষ্ণের উজ্জ্বল আবির্ভাবকে সব উজালা হ্যায় বলেই ব্যক্ত করতে থাকে। কোনোদিন সে আর ভালো হয়নি। এই ঘটনাও প্রমাণ করে যে ঈশ্বরকে এই পঞ্চভূত দেহের চক্ষু দর্শন করতে সমর্থ নয়। একমাত্র উচ্চমার্গের যোগীরাই তার সরাসরি দর্শন করতে পারেন। ঈশ্বর সেইজন্য যখন কোনো ভক্তকে দেখা দেন, হয় তিনি রূপ পরিগ্রহ করে দেখা দেন, অথবা তন্দ্রায় বা স্বপ্নে দেখা দেন। যোগী বা সাধকরা আজ্ঞাচক্রে মানসচক্ষে উজ্জ্বল আলোয় পরমেশ্বরকে দেখতে সক্ষম হন। ধ্যানাবস্থায় বা সমাধিকালে এইরকম দর্শন হয়ে থাকে। যোগশক্তি মানবদেহের সুপ্ত অবস্থায় যে দেবতাদের বাসস্থান আছে, তাকে জাগ্রত করে তোলে এবং সুষুম্না নাড়ির অভ্যন্তরস্থ ব্রহ্মনাড়িতে সঞ্চিত ওজঃকৈ আজ্ঞাচক্রে এবং মস্তকস্থিত সহস্রাধারে প্রেরণ করে দেহকে দিব্যতেজ ধারণক্ষম করে তোলে।


অষ্টসিদ্ধি লাভ করার পরে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ যোগবলে জানতে পারেন যে এইরূপ এক ঈশ্বরকোটির মহাযোগী বারদী গ্রামে আত্মগোপন করে আছেন। সেই যোগীর বয়স তখন ১৫১ বৎসর। গোঁসাইজির খুব সাধ হল বারদী গিয়ে সেই মহাপুরুষকে দর্শন করার।


একদিন তিনি সহধর্মিনী যোগমায়াদেবী, শশ্রুমাতা মুক্তকেশীদেবী ও কয়েকজন অন্তরঙ্গ ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ব্ৰহ্মপুত্ৰ বেয়ে বারদীর পথে রওনা হলেন। গোঁসাইজি সাধন জীবনে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্য দিয়ে অবশেষে সাকার-এর আরাধনা করেই মুক্তির পথের সন্ধান পেয়েছেন। জন্ম হয়েছিল তার বৈষ্ণব পরিবারে, তারপর হলেন ব্রাহ্ম, ব্রাহ্ম থেকে সন্ন্যাসী, আবার ব্রাহ্ম এবং তারপর আবার সেই জন্মকালীন বৈষ্ণব। গুরু তাঁকে জীবের কল্যাণের জন্য সংসারে থাকতে বলেছেন এবং ঈশ্বর দর্শনের পর মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাবার জন্য দীক্ষা দান করবার অধিকার দিয়েছেন। তখন তিনি এক কৃষ্ণপ্রেমী বৈষ্ণবাচার্যরূপে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলেছেন। ভক্তিরসের আধাররূপে তিনি সদাই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁর মাথায় বিরাট জটা, হাতে কমণ্ডলু এবং পরনে গৈরিক বসন। তার গলায় সর্বদা থাকে তুলসী ও রুদ্রাক্ষের মালা এবং কপালে বৈষ্ণবধর্মী তিলক। ঢাকায় গেন্ডারিয়া আশ্রম থেকে পরিব্রাজনকালে তিনি হাজার হাজার ভক্তকে দীক্ষা দিয়েছেন এবং প্রেমভক্তির রস বিতরণ করেছেন। ভারতের উচ্চকোটির সাধক সমাজে এখন তিনি একজন শক্তিধর সাধক রূপে সমাদৃত। রামদাস কাঠিয়া বাবা তার সম্বন্ধে বলেছেন, গোঁসাইজি একজন মহাসমর্থ পুরুষ, সাক্ষাৎ মহেশ্বর। তিনি যেমন তেজস্বী, তেমনই প্রেমিক। আজ তিনি চলেছেন এক পরম পুরুষের সাক্ষাৎ করতে।


পৌষ মাস শীতের সকাল। সেদিন বাবা লোকনাথ খুব ভোরে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। সেখানে তখন গোঁসাইজির ভক্তশিষ্য কামিনীকুমার নাগ বসেছিলেন। কামিনীবাবু ব্রহ্মচারী বাবার কৃপালাভের জন্য প্রায়ই আসেন। কিন্তু এত ভোরে বাবাকে কখনও আসন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। বাবাকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। কামিনীবাবুকে বারান্দায় দেখে বাবা বললেন, ওরে কামিনী আজ আমার বড়ো আনন্দের দিন। আজ আমার জীবনকৃষ্ণ আসছে। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণকে বাবা লোকনাথ জীবনকৃষ্ণ বলে ডাকতেন। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন কামিনীবাবুর গুরুদেব। গুরুদেব বারদী আশ্রমে আসছেন, এই কথা বাবার মুখে শুনে কামিনীবাবু একটু অবাক হলেন। কেননা, গুরুদেব তাকে কখনও এখানে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কামিনীবাবু তখন বাবা লোকনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা, গুরুদেব মেঘনার পথে আসছেন না ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছেন? বাবা লোকনাথ তখন শিশুর মতো উল্লাসে বলে উঠলেন, ওরে ঘাটে তার নৌকা ভিড়েছে। ওর সঙ্গে আসছে আমার মা ও দিদিমা। জীবনকৃষ্ণ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে। চামার বাড়ির কাছে চড়ে তার নৌকা আটকে গেছে। এখুনি তোরা যা, তাঁকে নিয়ে আয়।


বাবার কথা শুনে কামিনীবাবু, হরিশচন্দ্র রায় এবং আরও কিছু ভক্ত ঘাটের পথে রওনা হলেন। চামার বাড়ির কাছে পৌঁছে তারা দেখেন সত্যিই একটি নৌকা চড়ায় আটকে গেছে। তারা সবাই মিলে তখন ঠেলে নৌকাটি জলে নামিয়ে দিলেন। নৌকাটি এবার ধীরে ধীরে ঘাটে এসে ভিড়ল। ইতিমধ্যে গোঁসাইজির আগমনের খবরে তার অনেক ভক্ত সেখানে পৌঁছে গেছে। কামিনীবাবু গোঁসাইজিকে পথ দেখিয়ে বারদীর আশ্রমে নিয়ে গেলেন।


লোকনাথ বাবা ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। গোঁসাইজি ঘরের বারান্দায় উঠে বিস্ময়বাক্যে বলতে লাগলেন, ‘এ কি স্বর্গীয় দৃশ্য দেখছি কামিনী! চারিদিকেই দেবদেবী! ঘরের সব জায়গায় দেবদেবী। আমার সম্মুখে এই মহাপুরুষের দেহে ও বস্ত্রেও সব দেবদেবীর অবস্থান। আমি দেখছি, তার দেহের প্রতি রোমকূপে এবং কোষমধ্যে দেবদেবী অবস্থান করছেন, তার প্রতি রোমকূপ থেকে অগ্নিশিখা বেরোচ্ছে। এ আমি কি দেখছি!’ কামিনীবাবু গুরুদেবের এইসব কথার কোনো মর্ম বুঝতে না পেরে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহাযোগী মহাপুরুষের যে মহিমা অচিন্ত্যনীয় ও অলৌকিক যা সাধারণ মানুষের বোধের অতীত, সেই মহিমা তাঁর গুরুদেব স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছেন। যে মহাযোগীকে তারা নিত্য দেখে আসছেন একজন মহাযোগীরূপে, তার গুরুদেব তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন সব দেবদেবীর অবস্থান, প্রত্যক্ষ করছেন তার ঘরের সর্বত্র দেবদেবীর অবস্থান, তার শরীরে প্রত্যক্ষ করছেন অগ্নিশিখা, এ-কি আশ্চর্য ব্যাপার (মানব দেহের অধিকাংশস্থান অগ্নিদেব অধিকার করে থাকেন)! আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন কামিনীবাবু ও অন্যরা। তাদের দু-চোখ অশ্রুপ্লাবিত হতে লাগল। সেইসময় কামিনীবাবু প্রত্যক্ষ করলেন, বাবা লোকনাথের নয়নযুগল হতে এক দিব্য জ্যোতিপ্রবাহ বেরিয়ে এসে গোঁসাইজির শরীরে প্রবেশ করছে এবং সেই সঞ্চারিত জ্যোতিপ্রবাহে গোঁসাইজির শরীর দীপ্ত হয়ে উঠেছে। এরপর বাবা লোকনাথ দুই বাহু প্রসারিত করে গোঁসাইজিকে তার বুকে চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোঁসাইজি বাবার চরণতলে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা তাকে দু-হাতে তুলে পুত্রবৎসল পিতার মতো আবার তাকে বুকে টেনে নিলেন।


এইসময় কামিনীবাবু দেখলেন, লোকনাথ বাবার দেহ থেকে নির্গত হওয়া তড়িৎশিখার দিব্যস্পর্শে গোঁসাইজির বিরাট বপু লতার মতো কাঁপছে। এক অদ্ভুত অস্পষ্ট হু-হু ধ্বনি তার মুখবিবর থেকে বার হয়ে ঘরের ভিতসুদ্ধ প্রবলভাবে কাঁপিয়ে তুলছে। এমনভাবে বজ্রপাতের মতো সমস্ত ঘর কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন সব এক্ষুনি ভেঙ্গে পড়বে। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় গোঁসাইজিকে ধরে রেখে বাবা ছেড়ে দিলেন। যেই বাবা তাকে ছেড়েছেন, কাঁপতে কাঁপতে গোঁসাইজি পড়ে যাচ্ছিলেন। মহাপুরুষের দেহ থেকে নির্গত যোগশক্তি যখন গোঁসাইজির দেহে সঞ্চারিত হয়, তখন তার শরীরে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়, গোঁসাইজি তা ধারণ করতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলেন। গোঁসাইজিকে ভাবাবস্থায় পড়ে যেতে দেখে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভক্ত তাঁকে ধরে একটি কম্বলের আসনে বসিয়ে দিলেন। বাবা লোকনাথ গোঁসাইজির দেহে ব্রহ্মশক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। এ তার এক বিশেষ কৃপা, যে কৃপা কেবল গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণই পেয়েছিলেন। অন্যান্য ভক্তদের মধ্যে বাবা লোকনাথ যে শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন, এই ব্রহ্মশক্তি ছিল তার থেকে অনেক উচ্চ পর্যায়ের। ব্রহ্মশক্তির প্রবাহে গোঁসাইজির দেহে এক অনন্য দিব্যভাবের সৃষ্টি হলো।


বাবা লোকনাথ তখন কানাই কবিরাজকে ডেকে বললেন, একটা ছেলে আমার জন্য একটা পাকা বেল নিয়ে আসছে। দৌড়ে গিয়ে বেলটা নিয়ে আয়। আমি খাব।


এই কথা শুনে কানাই কবিরাজ খুব বিস্মিত হলেন কেননা লোকনাথ বাবা দিনের শেষে একবার আহার করেন। আর আজ এই সকালবেলায় বাবা বেল খেতে চাইছেন! বাবার কথামতো কানাইবাবু দৌড়ে আশ্রমের বাইরে গিয়ে দেখে একজন ছেলে একটি বেল নিয়ে আশ্রমের দিকে আসছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির হাত থেকে বেলটা নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন। লোকনাথ বাবা বেলটা নিয়ে নিজে ভেঙ্গে কিছুটা নিজের জিভে ঠেকিয়ে গোটা বেলটা নিজের হাতে গোঁসাইজিকে খাইয়ে দিলেন। বেলটা খাবার পর গোঁসাইজির দেহ স্থির হলো।


কিছুক্ষণ পরে গোয়ালিনী স্নান সেরে এসে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করলেন। গোঁসাইজিকে সেখানে উপবিষ্ট দেখে তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কে বাবা?


গোয়ালিনী মা-র জিজ্ঞাসা শুনে বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাসিমুখে তিনি মা-কে বললেন, এটি ঘরের ছেলে। তোমার শিশু সন্তান। আমি ওর পিতামহের খুড়ো।


গোয়ালিনী মা আশ্রম জননীরূপে বারদীতে পরিচিত। তাঁর বয়স আশির অধিক, কিন্তু বাবার কৃপায় তাকে বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি। গোয়ালিনী মা যখন বাবার মুখে শুনলেন এটি ঘরের শিশু সন্তান, তিনি তখন বিরাট বপু গোঁসাইজিকে আপন শিশুর মতো কোলে তুলে নিয়ে স্তন্যপান করাতে লাগলেন। সিদ্ধিবলে গোঁসাইজির দেহ অত্যন্ত হাল্কা শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিল। উপস্থিত ভক্তগণ বিরাট বপু গোঁসাইজিকে দেখলো, মায়ের কোলে তিনি এমন শিশুবৎ অবস্থান করছিলেন। বাবা লোকনাথের কৃপায় ৮০ বছর উত্তীর্ণ এক বৃদ্ধার স্তনে দুধ এসেছিল, যদিও তাঁর কোনোদিন কোনো সন্তান হয়নি এবং পূর্বে কখনও তার স্তন ক্ষরণ হয়নি। শিশু বিজয়কৃষ্ণ গোয়ালিনী মা-র কোলে শুয়ে স্তনামৃত পান করছিলেন। এই দৃশ্য সেদিন সমবেত ভক্তগণ প্রত্যক্ষ করে জীবন ধন্য করেছিল। এই অলৌকিক ঘটনার কথা বারদী ছাড়িয়ে দ্রুত সারা বাংলাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। উপস্থিত ভক্তগণ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ, বাবা লোকনাথ ও গোয়ালিনী মা-র জয়ধ্বনি করতে লাগল।


গোয়ালিনী মার স্তনামৃত পান করে গোঁসাইজি যখন মায়ের কোল থেকে উঠে বসেছেন, তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ঘরের চারিপাশে অঙ্গজ্যোতি বিচ্ছুরিত করে হাসিমুখে বসে আছেন বাবা লোকনাথ। তাঁর অঙ্গের দিব্যজ্যোতিতে চারিদিক উদ্ভাসিত। এ তো কোনো মানবের হতে পারে না। গোঁসাইজি চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কি দৃশ্য দেখছি আমি! ব্রহ্মজ্যোতি সমন্বিত এক দিব্যপরমপুরুষ বসে আছেন। তাঁর দিব্যদেহে অসংখ্য দেবদেবী তাদের আভা সমন্বিত হয়ে বিরাজ করছেন। ব্ৰহ্মজ্যোতি সমন্বিত পরমপুরুষ কখনও চতুর্ভুজ মূর্তি, কখনও মহেশ্বর, আবার কখনও করাল বদনা কালী। একই দেহে এত দেবদেবীর উপস্থিতি কি করে সম্ভব! ইনি কি স্বয়ং নারায়ণ, না কি স্বয়ং মহেশ্বর। অথবা ব্রহ্মময়ী আদিশক্তি মহাকালী। একই দেহে শিব ও শিবার অবস্থান কি করে সম্ভব! এই দিব্য দর্শন অর্থাৎ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর স্বরূপ দর্শন, অর্থাৎ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মধ্যেই যে সৃষ্টির পালনকারী দেবতা চতুর্ভূজ নারায়ণ, সৃষ্টি সংহারকারী দেবতা শিব এবং ব্রহ্মশক্তি আদ্যামাতার অবস্থান, সেইরূপ গুরু ভগবান গাঙ্গুলি, তৈলঙ্গ স্বামী, আব্দুল গফফর এবং গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভিন্ন আর কেউ এমন প্রত্যক্ষ দর্শন করেননি। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর স্বরূপ কী, এই কথা জানতে গেলে ভক্তদের এই দৃশ্য স্মরণ করতে হবে এবং তা নিজের মধ্যে মনন করে নিদিধ্যাসন করতে হবে। তবেই দর্শন হবে সেই পূর্ণজ্যোতি পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর।


বাবা লোকনাথের এইরকম দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন ঈশ্বরীয় রূপের কথা যখন গোঁসাইজি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ব্যক্ত করছেন, তখন বাবা তাকে বলেন, ওরে তুই চুপ কর। তুই আজ হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিলি। কিছুই গোপন থাকতে দিলিনা। সবার সামনে সব প্রকাশ করে ফেললি। এতদিন শান্তিতে ছিলাম। বারদীর মাটি বাবার এই দিব্যরূপ প্রকাশে ধন্য হয়ে গিয়েছিল। সেই মাটি ব্রহ্মপুরুষের স্পর্শে আজও পবিত্র হয়ে আছে।


গোঁসাইজি দিব্যদর্শনে একটু ধাতস্থ হয়ে কিছুটা অভিমানের সুরে বাবাকে বললেন, এতদিন আমার উপর দয়া করেননি কেন?


বাবা লোকনাথও সমান অভিমানের সুরে বললেন, তুইও তো সমান পাষাণ। বাবা লোকনাথের এইরূপ বলার তাৎপর্য ছিল যে ঈশ্বর দর্শনের জন্য পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল, বৈষ্ণব সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ অনেক তো ঘুরে বেরিয়েছিস, কই আমার কথা তো তোর মনে হয়নি। এরপর দুজনে অন্তরঙ্গভাবে অনেক আধ্যাত্ম আলোচনা করলেন।


গোঁসাইজির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবা লোকনাথ তাঁকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, চন্দ্রশেখর পাহাড়ের দাবানলের কথা তোর মনে পড়ে কি?


গোঁসাইজি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কথা শুনে চমকে উঠলেন। তার স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে উঠল সেই ভয়ানক দাবানলের কথা। তিনি চন্দ্রশেখর পাহাড়ে ধ্যানাবিষ্ট। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এক ভয়ানক দাবানলের সৃষ্টি হয়ে সমস্ত বনাঞ্চল তার গ্রাসে যেতে লাগল। চারিদিকের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে তিনি উপবিষ্ট। তার পক্ষে কোনোদিকে যাবার উপায় ছিল না। হঠাৎ কোন মহাশক্তিধর পুরুষ বায়ুর গতিতে সেই গগণভেদী অগ্নিশিখার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার দেহকে শূন্যে তুলে নিয়ে এক নিরাপদ স্থানে রেখে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যখন এই ঘটনা ঘটল তখন তিনি এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। বাহ্যজ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন যে তার দেহ দাবানলের অগ্নিশিখা থেকে উদ্ধার করে কে যেন এই নিরাপদ স্থানে রেখে গেছেন। কে সেই মহাশক্তিধর পুরুষ তিনি আজও তা জানতে পারেননি। বাহ্যজ্ঞান ফিরলে চারিদিকে ধ্বংসাবশেষে তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সেই মহাশক্তিধরের অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন কিন্তু কারও দর্শন পাননি। তখন বাবা লোকনাথ সেই রহস্যের ভাজ তার কাছে উন্মোচন করে বললেন, সেদিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আমিই তোকে রক্ষা করেছিলাম। গোঁসাইজি কৃতজ্ঞনেত্রে অবাক বিস্ময়ে এই পরম পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই পূর্ণব্রহ্ম পরমপুরুষকে দেখতে দেখতে তার স্মৃতিপটে আর একটি কথা ভেসে ওঠে।


তিনি সিদ্ধিলাভের পর ঈশ্বর দর্শনাভিলাষে হিমালয়ে ভ্রমণ করতে করতে একবার প্রায় মানস সরোবরের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি কতিপয় মহাশক্তিমান সাধককে ধ্যানস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাদের কাছে গেলেন। তিনি যখন ভক্তিযুক্ত চিত্তে তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন হঠাৎ একজন সাধক চোখ খুলে গোঁসাইজিকে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন, তারপর বললেন, তুই এখানে এসেছিস কেন? ঢাকায় তোর আশ্রমের কাছেই আমাদের চেয়েও বড়ো এক মহাযোগী আছেন। তুই তার কাছে যা। তাহলেই তোর অভিলাষ পূরণ হবে। গোঁসাইজি তখনও বারদীর ব্রহ্মচারীর কথা জানতেন না। সেখান থেকে ফেরার পর তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগৈশ্বর্যের কথা জানতে পেরে বারদী আসার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। বারদী আশ্রমে পদার্পণ করেই তিনি যে-সব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন তাতেই তার মনে হয় যে হিমালয়ের সেই সাধক তাকে সঠিক পথই দেখিয়েছিলেন। এখানে না এলে একজন পূর্ণব্রহ্ম ব্রহ্মচারীর ব্যতিক্রমী রূপ তিনি কোনোদিনই দর্শন করতে পারতেন না। একই দেহে তার সর্ব দেবদেবীর দর্শন হয়ে গেল। এই সময়ে তার এই কথাও স্মরণ হল যে একবার দ্বারভাঙ্গায় যখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন তিনি শুনেছিলেন কোনো এক মহাপুরুষ এসে তার বিছানার পাশে বসে তাকে স্পর্শ করেছিলেন এবং তারপরই তার স্পন্দনহীন দেহে জীবনের স্পন্দন ফিরে আসে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এই মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ তাকে রক্ষা করেছিলেন। গোঁসাইজি এক মৌনকৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই মহাপুরুষের কাছে দুবার তাঁর জীবন রক্ষার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।


গোঁসাইজির সহধর্মিনী যোগমায়া দেবীও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চিত্তে এই ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষকে দর্শন করে নিজের চোখকে সার্থক করেছিলেন। তিনি বাবাকে দেবার জন্য একখানি গরদের কাপড় সঙ্গে এনেছিলেন। সেই গরদের কাপড়খানি বাবার পায়ে রেখে প্রণাম করে তার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, যদি বাবা কৃপা করে এই কাপড়খানি পরেন।


বাবা লোকনাথ বললেন, এ কি, এটা পড়তে হবে না কি? এই কথা বলে তিনি গরদের কাপড়খানি চার টুকরো করে এক খণ্ড মাথায় বাঁধলেন, আর একখণ্ড কৌপীন করলেন। বাকি দুই খণ্ড উপস্থিত ভক্তদের দান করে দিলেন। বাবার এই আচরণ বর্তমান সাধু সমাজে এই বার্তা বহন করে যে, যিনি প্রকৃত সাধক হন, তার কোনো বস্তুর উপর মায়া বা মোহ থাকতে নেই। বাবা নিঃসঙ্কোচে মুহূর্তের মধ্যে একটি দামি গরদের কাপড়কে চারফালা করে ফেললেন। এমন দৃশ্য দেখার ভাগ্য বর্তমানে ভক্তদের খুব কমই ঘটে।


এরপর বাবা গোঁসাইজির শ্বমাতা মুক্তকেশীদেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের কি নাম রেখেছ গো?


মুক্তকেশীদেবী বাবাকে বললেন, যোগমায়া।


বাবা নাম শুনে বললেন, বাঃ চমঙ্কার। যোগমায়া শব্দের অর্থ জানো? যে অপ্রাকৃত মায়াকে আশ্রয় করে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ লীলা করেছিলেন, তাই হচ্ছে যোগমায়া। ঠিক নামই রেখেছ।


এরপর হঠাৎ বাবা যোগমায়াদেবীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, মা, আজ তুই আমায় নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারবি?


যোগমায়া দেবী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, কেন পারবনা? দিচ্ছি রান্না করে।


এই কথা বলে যোগমায়া দেবী পাকশালায় যান বাবার জন্য ভোগ রান্না করতে। গোয়ালিনী তাকে সেই কাজে সহায়তা করেন।


ভোগ রান্না শেষ হলে থালায় করে ভোগ নিয়ে যোগমায়াদেবী বাবা লোকনাথের সামনে নিবেদন করেন।


বাবা লোকনাথ তখন বলেন, মা, আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবি?


একথা শুনে যোগমায়া দেবী ইতস্ততঃ করতে থাকেন। সেই দেখে গোঁসাইজি তাকে বলেন, দাও না খাইয়ে।


যোগমায়া দেবী তখন থালার পাশে বসলেন। লোকনাথ বাবা তাকে বললেন, মা বাঁ হাতে আমার ঘাড় ধরে ডান হাত দিয়ে আমায় খাইয়ে দে। যেমন ছোট ছেলেকে তার মা খাইয়ে দেয়। আর বলবি, বাছা খেয়ে নে, নইলে মারবো। তবেই তোর হাতে খাব।


লোকনাথ বাবা যেমনভাবে বললেন, যোগমায়াদেবী ঠিক তেমন করেই বাবাকে খাইয়ে দিলেন। খেতে খেতে বাবা বললেন, আমিও খাই, তুইও খা।


যোগমায়া দেবী তখন বাবার কথামতো দু-এক গ্রাস থালা থেকে নিয়ে নিজের মুখে দিলেন। এরপর বাবা বললেন, এখন আমি নিজেই খাব। এই বলে তিনি নিজে খেতে লাগলেন। খেতে খেতে তিনি যোগমায়াদেবীকে বললেন, মা তুই এবার আমার হাত চেপে ধরে বলবি, বাবা আর খাসনে, অসুখ করবে। বাবা যখন আর একটু খেয়েছেন যোগমায়া দেবী তার হাত চেপে ধরে বললেন, বাবা, আর খাস নে, অসুখ করবে। এইভাবে বাবার বিচিত্র ভোগগ্রহণ পর্ব শেষ হলো।


বাবা যদিও যোগমায়া দেবীকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁকে কি করতে ও বলতে হবে, কিন্তু যোগমায়া দেবী একেবারে অকৃত্রিমভাবে বাবার শেখানো কথা এত মধুর কণ্ঠে বললেন যে বাবার স্মৃতিপটে তার মা কমলাদেবী যেমনভাবে তাকে খাওয়াবার সময় আচরণ করতেন, সেই কথা ভেসে উঠল। তিনি মুগ্ধ হয়ে ‘অহো’ ‘অহো’, এই বলে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।


কিছুক্ষণ পর বাবার সমাধি থেকে বুত্থান হলে ভক্তদের বললেন, বলতে পারিস তোরা, যযাগমায়াকে এত ভালোবাসি কেন?


বাবার এই কথা বলার অর্থ হলো, আজ বাবার ভোগগ্রহণ পর্ব যেভাবে সমাধা হল এমনটা কখনও ভক্তরা দেখেনি। তাদের মনে জন্ম নিয়েছে অনেক প্রশ্ন। অন্তর্যামী বাবা সেই ভক্তদের মনের ভাব বুঝতে পেরে নিজেই এই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন।


একজন ভক্ত বলে ওঠে, জগৎ শুদ্ধ লোকে যে তাকে ভালোবাসে, তাই।


তখন বাবা বললেন, ঠিক বলেছিস। সবাই যাকে ভালোবাসে, সেই তো জগতের মা। যেন রাধা ঠাকুরানী। শ্রীরাধা জগজ্জননী আহ্লাদিনী শক্তি। তিনি কৃষ্ণ কর্তৃক সংস্কৃয়মানা।


বাবা এখানে এইজন্য এই কথার অবতারণা করলেন যে, শ্রীরাধা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের শক্তির উৎস। যখন তিনি এই কথা বলছেন, তখন গোঁসাইজি দেখলেন, লোকনাথ বাবার চোখ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বার হচ্ছে, তার মুখে মিষ্ট হাসি, তার দৃষ্টি যেন শূন্যে নিহিত রয়েছে। গোঁসাইজি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ব্রহ্মচারী বাবার সেই শাশ্বত অবস্থার রসাস্বাদন গ্রহণ করছেন।


বাবার যখন সমাধি থেকে বুত্থান হলো, তিনি গোঁসাইজির জিজ্ঞাসু নেত্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোকে দেখার জন্য বারদীর অনেক লোক উগ্রীব হয়ে আছে। তুই তো আমার একার নোস। যা, তুই তাদের কাছে যা। তখন গোঁসাইজি সেখান থেকে উঠে কামিনী নাগ মহাশয়কে সঙ্গে নিয়ে অন্য ভক্তদের বাড়ি গেলেন। পথে যেতে যেতে কামিনীবাবু গোঁসাইজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুর, ব্রহ্মচারী বাবার মধ্যে কি দেখতে পেলেন?


গোঁসাইজি তাঁকে বললেন, আমার কথা কি তুমি বিশ্বাস করবে কামিনী?


কামিনীবাবু তার গুরুদেবকে বললেন, আপনার কথা বিশ্বাস করবো না কেন?


তখন গোঁসাইজি বললেন, দেখো কামিনী, আমি বহু সাধুসন্ন্যাসীর আশ্রমে গিয়েছি। কোনো আশ্রমে কিছুই দেখিনি। কোনো কোনো আশ্রমে কিছু কিছু দেখেছি। আবার এমনও হয়েছে যে, যতক্ষণ আমি সেই আশ্রমে থেকেছি, ততক্ষণই সেই সাধুর প্রভাব বুঝেছি। কিন্তু আশ্রম থেকে বার হয়েই সব ফাঁকা মনে হয়েছে। কিন্তু যে কথা শুনে আমি বারদীর আশ্রমে এসেছি, তার চেয়েও অনেক বেশি এখানে দেখতে পেয়েছি।


ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানার জন্য আমি বহু দেশে পর্যটন করেছি। বহু পাহাড় পর্বত ও তীর্থ ভ্রমণ করেছি। বহু সাধু-মহাত্মা দর্শন করেছি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অসংখ্য সাধু মহাপুরুষদের সঙ্গ ও কৃপা লাভ করেছি, কিন্তু বারদীর ব্রহ্মচারীর মতো এমন মহাশক্তিধর মহাপুরুষের দর্শন কোথাও পাইনি। সমস্ত ভারতবর্ষে এখন এমন উঁচু অবস্থার মহাপুরুষ আর নেই।


ব্রহ্মচারী বাবার সর্বাঙ্গ দেবদেবীময়। গাত্রবস্ত্র দেবময়। তার গৃহ পর্যন্ত দেবদেবীময়। তাঁর প্রতি রোমকূপেই দেবতা বিদ্যমান।


কামিনী, ব্রহ্মচারী বাবার দেহকান্তি, ললাট, ভ্রুযুগল, দৃষ্টি সবই অনন্য সাধারণ। তাঁর শরীরে মাংস নেই কিন্তু তার চর্মাবৃত অস্থিরাশি অপরূপ প্রভাদীপ্ত। তার হাত পায়ের কোমলতা ও স্নিগ্ধতা পদ্মরাগকেও হার মানায়। তার শরীরের তিলচিহ্ন গুলিও লোহিতবর্ণ। সবচেয়ে অলৌকিকত্ব তার অপার্থিব দৃষ্টিতে। তার দৃষ্টি সর্বদাই স্থির। তার ওই অপার্থিব দৃষ্টি বৈশিষ্ট্য হল সামনে শত শত ভক্ত বসে থাকলেও প্রত্যেকেরই মনে হবে তিনি যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।


ব্রহ্মচারী বাবার দিব্যদেহে কোনো শারীরিক ধর্ম কিছুই দেখা যায় না। নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, হাই প্রভৃতি দেহধর্মগুলিকে তিনি জয় করেছেন। অগ্নিতে এই দেহ দগ্ধ হবার নয়। বরফেও এই দেহ বিকৃত হয়নি। যে সমস্ত প্রাকৃতিক কারণে আমাদের পঞ্চভৌতিক দেহ গলিত বা বিকৃত হয়, এই সিদ্ধপুরুষ মহাযোগবলে সেই সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে জয় করেছেন। তার শরীরের দিব্যভাব দেখে আমার মনে হলো, ব্রহ্মচারী বাবা ইচ্ছা করলে এখনই দেহত্যাগ করতে পারেন, আবার অনন্তকাল তিনি দেহধারণ করেও থাকতে পারেন।


তিনি আরও বললেন, ব্রহ্মচারী বাবা নিত্য যোগস্থ মহাপুরুষ। তার নয়নে কোনো লৌকিক দৃষ্টির আবির্ভাব হয় না। তার নয়নযুগল সর্বদাই সমাধিমগ্ন। তাঁর দেহ সর্বদাই অসার ও নিস্পন্দ বলে মনে হলো। কোনো কোনো সময়ে বোধ হল তার শরীর প্রাণহীন। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আসনের উপর দেহটির মধ্যে মনে হচ্ছিল, তিনি তখন নেই, তখন কিন্তু তার চোখদুটি নিমীলিত হয়নি।


যিনি অখণ্ড চৈতন্যস্বরূপ, নিত্যস্বরূপ, যিনি অবিদ্যাদি সমস্ত ক্লেশ থেকে মুক্ত, যিনি জ্যোতিস্বরূপ আনন্দময় ব্রহ্ম, এমন শিবতুল্য যোগেশ্বর ব্রহ্মচারী বাবা এখন লোকাঁচারের আশ্রয় গ্রহণ করে লোকশিক্ষার জন্য ধর্মকর্ম করছেন।


ব্রহ্মচারী বাবার জ্ঞান অনন্ত, যোগবল অনন্ত এবং ভক্তি অনন্ত। এমন পূর্ণ পুরুষ আমার চোখে আগে কখনও পড়েনি। যিনি যেই মার্গের সাধক হোন না কেন, তিনি ব্রহ্মচারী বাবাকে সেই পথেরই দিশারী রূপে দেখবেন। আমি দেখেছি তার প্রতি রোমকূপে দেবতা। তাছাড়া, আমি তাকে চতুর্ভূজ, কালী, মহেশ্বর প্রভৃতি বিভিন্ন মূর্তিতে দেখেছি।


এই কথা হতে হতে গোঁসাইজি কামিনীবাবুর বাড়ি এসে গেছেন। কামিনীবাবু তাকে বললেন, ঠাকুর, আপনি যথার্থজ্ঞানী। তাই ব্রহ্মচারী বাবার ওইসব অপার্থিব অলৌকিকত্ব আপনার জ্ঞান চোখে ধরা পড়েছে। আমি যথার্থই ভাগ্যবান। এই পুণ্য মুহূর্তে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আমার কুটিরে পদার্পণ করছেন।


কামিনী নাগের বাড়িতে তখন গোঁসাইজির দর্শনের আশায় বহু লোকের সমাগম হয়েছে। গোঁসাইজি সকলকে দর্শন দিয়ে কীর্তনের আখড়ায় গিয়ে নাম সংকীর্তন করলেন, তারপর কয়েকজন শিষ্যের বাড়ি ঘুরে আখড়ার মহন্তকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে ফিরে এলেন। তাঁর মন ও দেহ জুড়ে যে আজ ব্রহ্মচারী বাবা বিরাজ করছেন। তারই ভাবের আবেশে তিনি আবৃত।


ব্রহ্মচারী বাবা গোঁসাইজির সঙ্গে মহন্তজিকে দেখে গৌরাঙ্গ ভজন গাইতে শুরু করলেন। আর মাঝে মাঝে জীবনকৃষ্ণ, জীবনকৃষ্ণ বলে ভাবে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। গোঁসাইজি স্থির দৃষ্টিতে দেখছেন আনন্দে আত্মহারা এই পরমপুরুষকে। তিনি দেখছেন তাঁর সামনে এক অমর্ত্য মহাপুরুষ যাঁর প্রতি রোমকূপে দেবদেবীর অত্যুজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এমন দৃশ্য না কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে। পূর্ণব্রহ্ম নিত্য সদানন্দ পুরুষ কেমন হয়, তা তিনি বারদী এসে প্রত্যক্ষ করে গেলেন এবং এই পূর্ণব্রহ্ম রূপের সঙ্গে জগতকে পরিচিত করিয়ে গেলেন। জগতের লোক এতদিন ব্রহ্মচারী বাবার যোগীরূপ দেখেছেন কিন্তু তার মতো সেই মহাপুরুষের পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ কেউ দেখতে সমর্থ হয়নি। আজও নিত্যস্বরূপ চিদানন্দময় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ তার ভক্তদের কাছে চাপা পড়ে আছে।


ব্রহ্মচারী বাবা কীর্তনের আবেশে ভাবে তন্ময় হয়ে গোঁসাইজিকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, তুই বারদী আশ্রমে না এলে আমাকেই তোর কাছে যেতে হতো। জানিস, আমি তোর পিতামহের আপন খুড়ো। পূর্বপুরুষের চিহ্ন হিসাবে আমি তোকে এই খড়ম জোড়া আর এই কম্বলখানা দিচ্ছি। এগুলো যত্ন করে রেখে দিস।


গোঁসাইজি শ্রদ্ধাযুক্ত মনে সেই খড়মজোড়া আর কম্বলটি গ্রহণ করলেন। তারপর আবার দুজনের মধ্যে ধর্মালোচনা শুরু হলো।


গোঁসাইজি বাবা লোকনাথকে বললেন, ভগবানের সৃষ্ট জীব হয়ে মানবদের মধ্যে কেউ তাকে ভজনা করে, আবার কেউ বা সে বিষয়ে বিমুখ হয়। এর কারণ কি? ভগবান আনন্দময়। কেউ তাকে প্রিয় ভাবে আবার কেউ তাকে স্বীকার করে না। কিন্তু সকল অবস্থার লোকেরাই আনন্দকে স্বীকার করে, আনন্দ চায়। এই আনন্দশক্তি সম্পন্ন ভগবানকে তবে কেউ কেউ অনাদর করে কেন? আর সেই অনাদরকারীদের অন্তিম গতি কি হয়?


গোঁসাইজির প্রশ্নের উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, গুণভেদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারবর্ণ সেই আদিপুরুষ ভগবানের মুখ, বাহু, ঊরু ও পা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আপন আপন উৎপত্তিক্ষেত্র স্বরূপ ঈশ্বরকে লব্ধ গুণানুসারে ভজনা না করে অথবা অবজ্ঞা করে, তারা স্থানচ্যুত হয়ে অধঃপতিত হয়ে থাকে। শোন জীবনকৃষ্ণ, হরিকথা বলতে বা হরিলীলা কীর্তন করতে যাদের রুচি হয় না, তারা সাধু ব্যক্তির অনুকম্পার পাত্র। যেসব অন্ধবুদ্ধি ব্যক্তিরা বিষয়াসক্তিযুক্ত রজোগুণের প্রভাবে কাম, ক্রোধ, অহঙ্কারের বশীভূত হয়, সেই পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরাই নিষ্ঠাবান সাধুদের পরিহাস করে ও ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে।


ঈশ্বররূপী আত্মা যে-সকল দেহধারীর মধ্যেই অবস্থান করছেন, সকল মূর্খেরা তা বিশ্বাস করতে চায় না। বেদের তাৎপর্য না বুঝে অর্থাৎ আসল অর্থ না বুঝে ওইসব মূর্খেরা ইচ্ছানুসারে ধর্মাচরণ করে। ঈশ্বর সর্বজীবে জীবাত্মারূপে অবস্থান করেন। যে লোক অজ্ঞানবশে তা না বুঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে সংসারবন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। সংসারের মমতপাশে আবদ্ধ হলে কখনও বৈরাগ্য অভ্যাস করা যায় না। বৈরাগ্যে অভ্যস্ত না হলে ভগবৎ ভাব প্রকাশ হয় না।


আবার এ সংসারে এক শ্রেণির লোক আছে যারা পুরোপুরি মূর্খ নয়, আবার তত্ত্বজ্ঞানও লাভ করেনি। এমন সব মধ্যবর্তী লোক ধর্ম, অর্থ, কামকে প্রধান এবং দেহাদিকে নিত্য বলে মনে করে। আর যারা আত্মাকে অসৎ ভাবে তাদের সবাইকে আত্মঘাতী বলা হয়। এরা অজ্ঞানুকে জ্ঞান বলে বিবেচনা করে। ভবিষ্যতে এদের মনোরথ বিফল হলে এরা দারুণ দুঃখ পায়। ঈশ্বরপরান্মুখ এইসব লোকেরা ইচ্ছা না থাকলেও জীবন শেষে আত্মমায়া বিরচিত গৃহ, পুত্র, সুহৃদ্ ত্যাগ করে নরকে নিপাতিত হয়।


ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে গোঁসাইজি বাবাকে বললেন, আজ্ঞে, আপনার বিশ্লেষণ শুনলাম। কিন্তু আরো সহজ করে যদি বলেন তো ভালো হয়। এখানে যে সব ভক্ত রয়েছে তাদের এ সব কথা শুনে চৈতন্যোদয় হতে পারে বলে আমার ধারণা।


ব্রহ্মচারী বাবা তখন বলেন, তুই তো বুঝেছিস। তুই-ই ওদের একটু গুছিয়ে বল না।


ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা শিরোধার্য করে গোঁসাইজি তখন উপস্থিত ভক্তদের বলতে লাগলেন, তোমরা শোন গো-শাস্ত্রে বলেছে, ভগবান জগন্ময়। বিশেষভাবে তিনি আনন্দময়। তবু লোকে তাকে ভুলে যায় কেন? ভগবান থেকেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও অনুলোম-প্রতিলোমজাত সব মানুষই উৎপন্ন হয়েছে। সব মানুষই ভগবানের সন্তান ও শিষ্য। তাহলে সকলেরই পরম পিতা ও পরম গুরুরূপী আনন্দময় হরিকে ভজনা করা উচিত। তবে সংসারে কাউকে ভক্তিমান, কাউকে অভক্তিমান দেখার কারণ কি? ব্রাহ্মণাদির জন্ম ও কর্ম সত্ত্ব গুণময়, ক্ষত্রিয়দের সত্ত্ব রজোময়, বৈশ্যদের রজো তমোময় আর শূদ্রদের কেবলই তমোময়। ব্রাহ্মণাদি যদি নিম্নশ্রেণির ধর্ম ও কর্ম আচরণ করে, তবে তাদের অধোগতি হয়। শূদ্রাদি যদি উচ্চ অবস্থার ধর্মাচরণ করে, তবে তাদের উচ্চগতি হয়। স্থান, সহবাস, আচার-ব্যবহার যে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়, মানুষ সেই অনুষ্ঠান অনুযায়ী স্বভাব পেয়ে থাকে। যেমন, কোনো সাধু লোকের হিতাহিত বিবেক উদয় হবার আগে তাকে যদি কোনো কদাচারীর সহবাসে রাখা যায়, তাহলে তার আচার-ব্যবহার ওই কদাচারীর মতোই হয়ে থাকে। আবার কোনো কদাচারীকে পবিত্রতার শিক্ষা বা অনুষ্ঠান করলে তাকে উন্নত করা যায়। এই উপায় শিক্ষার জন্যই ভগবান বর্ণাশ্রমের সৃষ্টি করেছেন। সত্ত্ব গুণাদির অনুষ্ঠানে যতদূর ভগবদ্ভক্তি ও আনন্দানুভূতি হয়, রজোঃ গুণাদির অনুষ্ঠানে ততদূর হয় না। ব্রাহ্মণাদির মনোবৃত্তি যদি জন্ম থেকে নিম্নগুণ সম্পন্ন হয়, তাহলে তাতে চিত্তের বিশুদ্ধি হ্রাস পায়। চিত্তের বিশুদ্ধতা কমে গেলে চিত্ত আপনা থেকে অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়। এই অজ্ঞানতার জন্য লোকে আত্মহিতাহিতবোধ শূন্য হয়। এই ধরনের লোক ভগবানকে আদর করে না। এর মানে হল এই যে, বর্ণাশ্রমের নিয়মানুযায়ী মানুষ যদি আপন হিত চিন্তা করে উন্নতির পথে ছুটে যায়, তাহলে চিত্তের বিশুদ্ধি লাভ হয়। আর চিত্তের বিশুদ্ধি লাভ হলে ভগবদ্ভক্তি হয়। যারা শাস্ত্র মতো না চলে যথেচ্ছ আচরণ করে চিত্তকে মলিন করে, তারা অজ্ঞান আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেই অজ্ঞান রোগে ভগবদ্ বিষয়ে তাদের অরুচি জন্মায়। এইসব অজ্ঞানী ব্যক্তি সংসারকেই সার করে আসক্তিতে ডুবে যায়। আসক্তি কেন হয় এবং অভক্তদের অধোগতিই বা কেন হয়, তাই এতক্ষণ তোমাদের বোঝালাম। বাবা লোকনাথের কথায় গোঁসাইজির উপদেশামৃত পান করে সমবেত ভক্তগণ ধন্য হলেন। তারা একদিকে যেমন ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথের জ্ঞান ও অজ্ঞানের ব্যাখ্যা শুনলেন আবার গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর থেকে বর্ণাশ্রম অনুযায়ী কর্ম করে কিভাবে ভগবদ চরণাশ্রয় পাওয়া যায় তারও ব্যাখ্যা শুনলেন। এই ধর্মালোচনা করতে করতে সন্ধ্যা সমাগত, এবার গোঁসাইজির বিদায় নেবার পালা। গোঁসাইজি, যোগমায়া দেবী ও মুক্তকেশীদেবী ভূমিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রনাম করে বিদায় প্রার্থনা করলেন।


ব্রহ্মচারী বাবা তখন মুক্তকেশীদেবীকে বললেন, ব্রাহ্মসমাজের শুকনো বাঁশের মুড়ো আর না চিবিয়ে এবার ভক্তির আশ্রয় নাও। জ্ঞান ভক্তি ছাড়া দাঁড়াবে কোথায়? যাকে তুমি জামাই করেছ, তার কাছেই সত্যবস্তু আছে। আর সময় নষ্ট না করে, তার কাছেই দীক্ষা নাও।


এরপর ব্রহ্মচারী বাবা গোঁসাইজিকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, আজ তোকে পেয়ে যে আনন্দ পেলাম তা বলবার নয়। তুই যথার্থ ধর্মপিপাসু, প্রেম-ভক্তির ভাণ্ডারী ও সত্যনিষ্ঠ। এবার তুই আমার ভার নে, আমি চলে যাই।


পরক্ষণেই গোঁসাইজির শরীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, না রে তা হবার নয়। তোর শরীর এখনও তেমন পটু নয়। আমার ভার বইতে গেলে তোকে। আরও কিছুদিন সাধনা করতে হবে।


গোঁসাইজি ব্রহ্মচারী বাবাকে বললেন, আজ্ঞে আজ আপনি আমাকে যে অনুগ্রহ করলেন তাতেই আমি ধর্মজীবনে আরও উঁচু অবস্থায় পৌঁছতে পারবো। আজ আপনার সঙ্গ ও কৃপালাভ করে ধন্য মনে করছি নিজেকে। এবার অনুমতি চাইছি বিদায় নেবার। এরপর গোঁসাইজি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকায় গেন্ডারিয়া আশ্রমের পথে পা বাড়ালেন।


ঢাকায় আশ্রমে পৌঁছে গোঁসাইজি সকল ভক্তকে ব্রহ্মচারী বাবার অলৌকিক যোগৈশ্বর্যের কথা বলতে লাগলেন। সেই সময় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সারা দেশের ধর্মজগতে খুব নাম ডাক ছিল। গোঁসাইজির কাছে ব্রহ্মচারী বাবার কথা জানতে পেরে দলে দলে লোক বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করতে ও তার কৃপা লাভ করতে আসতে লাগলেন। গোঁসাইজি তার ভক্তদের বলেছেন, বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করে আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত পরম সত্যের খনির সন্ধান পেয়েছি। এই ব্রহ্মচারী ঈশ্বরের স্বরূপ।


এরপর বাবা লোকনাথের সঙ্গে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সূক্ষ্মরূপে দেখা হয়েছিল। ১২৯৭ সনের জৈষ্ঠ্য মাসে। বাবা ঠিক করে নিয়েছিলেন যে তিনি এবার ইহলোক ত্যাগ করবেন। এই দেহ ত্যাগ করার আগে ১৮ই জ্যৈষ্ঠ বাবা সূক্ষ্মরূপে শেষবারের মতো গোঁসাইজির সঙ্গে দেখা করেন।


সেদিন সন্ধ্যাবেলায় গোঁসাইজি বৃন্দাবনে তার আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন এক পরিচিত কণ্ঠস্বর–জীবনকৃষ্ণ, আমি এসেছি তোর কাছে। একথা শুনে বিস্ময়ে চমকে উঠলেন গোঁসাইজি। একমাত্র বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা ছাড়া তাকে এই নামে তো কেউ ডাকে না। সামনে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, তাঁর সামনে দণ্ডায়মান বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা। গোঁসাইজি বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে তার চরণ স্পর্শ করে বললেন, কোনো খবর না দিয়ে এভাবে এখানে এলেন?


বাবা লোকনাথ তাঁকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, আগামীকালই আমি দেহত্যাগ করব। তুই আমার বারদী আশ্রমে গিয়ে বোস। ওই আসনে বসবার মতো তোকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।


এ কথা শুনে গোঁসাইজি বললেন, আমার এখন বৃন্দাবন ছেড়ে যাবার যে নেই। এখানে একবছর থাকব বলে সঙ্কল্প করে আসন পেতেছি।


 বাবা লোকনাথ তখন বললেন, তবে আমি দেহ ছেড়ে দিই?


গোঁসাইজি তখন বললেন, আপনার যা ইচ্ছা করুন। আপনার দেহের জন্য আমার এতটুকু মায়া নেই।


বাবা লোকনাথ বললেন, একথা বলছিস কেন?


গোঁসাইজি বললেন, আপনি এর মধ্যে অনেক ক্ষতি করেছেন।


লোকনাথ বাবা তখন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী ক্ষতি করেছি বল।


গোঁসাইজি তখন তাকে বলতে লাগলেন, আপনি অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দিয়ে অনেককেই অদৃষ্ট প্রারব্ধ বলে তাদের মন বিগড়ে দিয়েছেন। তারা সব সাধন ভজন ছেড়ে ভুল পথে যাচ্ছে।


একদিন বারদীর একদল লোক খোল, করতাল, বাতাসা নিয়ে আপনার কাছে। গিয়ে বলে, বাবা, আমরা আশ্রমে হরিলুট দিতে এসেছি। কিন্তু আপনি তাদের কথা শুনে বলেন, এখানে হরি নেই। যেখানে তাদের হরি আছে, সেখানে গিয়ে তোরা লুট দে। আপনার কথায় তারা অসন্তুষ্ট হলে আপনি তাদের বলেন, আমি তোদের হরির মুখে প্রস্রাব করি। এই কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা চলে যায়।


কিছুদিন আগে আমার এক শিষ্য শ্রীধরচন্দ্র ঘোষ আপনার কাছে গেলে আপনি তাকে বলেন, তুই এতদিন গোঁসাইজির কাছ থেকে কি পেয়েছিস? যে নিজে অন্ধ, সে কি করে অন্ধকে পথ দেখাবে? অন্ধ গুরুর সঙ্গ ছেড়ে দে। ছ মাস তুই আমার কাছে থাক। তোকে আমি ব্ৰহ্মজ্ঞান দিয়ে উৰ্দ্ধরেতা করে দেবো।


আর একদিন একটি লোক আপনার কাছে গিয়ে বলে, আপনি আমাকে শাস্ত্রবিধি মেনে স্ত্রীসঙ্গ করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তা পারবো না। আমার কাম বড় বেশি। বলুন, এখন আমি কি করবো?


সেই লোকটির কথা শুনে আপনি তাকে বলেন, বেশ তো, যদি তা নাই পারিস, বেশ্যাগমন কর। ব্যাভিচার কর গে। পরে লোকটি আমার কাছে এসে বলে, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আমাকে বেশ্যাগমন করতে বলেছেন। মহাপুরুষের কথামতো তা করলে আমার কখনও পাপ হবে না।


তাহলে বলুন, এসব আপনি কি করছেন? আপনার উপদেশে যে সাধারণ লোকের সর্বনাশ হবে, সমাজ উচ্ছন্নে যাবে।


মাসকয়েক আগে এক ব্রাহ্ম যুবক আপনার কাছে গিয়ে জানতে চায়, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? তাকে আপনি বলেন, তোর ঈশ্বরের মুখে আমি হাগি, তার মুখে মুতি। এ কথা শুনে যুবকটি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে চলে যায় ও সবার কাছে বলতে থাকে বারদীর ব্রহ্মচারি একজন নাস্তিক।


এইরকম বহু ঘটনা আপনার আশ্রমে ঘটেছে যা সমাজের উপকার না করে, অপকার করছে, বিপন্ন করছে। যেভাবে বললে সাধারণ লোক বুঝতে পারে, তেমনটি করে আপনি বলেন না কেন?


গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণের অভিযোগ শুনে বাবা তাকে বললেন, বটে, এখন কি আমি তোদের ভাষা শিখতে যাব নাকি? ও সব লোক আমার কাছে আসে কেন? আমি তো তাদের ডেকে আনি না। ঠিক আছে, এবার তোর অভিযোগগুলি খণ্ডন করছি, শোন।


বারদীর যেসব লোক খোল করতাল নিয়ে হরির লুট দিতে এসেছিল, আমার কথা অমান্য করায় আমি তাদের বলি, তোদের হরির মুখে আমি প্রস্রাব করি। একথা শুনে তারা রেগে চলে গিয়েছিল। আমি তাদের কোনো অশাস্ত্রীয় কথা বলি নি। শাস্ত্রে আছে হরি হাঁ করে যশোদাকে নিজের মুখের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখিয়েছিলেন। আমি যখন ব্রহ্মাণ্ডের একজন এবং ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই প্রস্রাব করে থাকি, তখন হরির মুখে প্রস্রাব করি বলতে দোষের কি হয়েছে?


ব্রহ্মচারী বাবার ব্যাখ্যা শোনার পর গোঁসাইজি এই সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। আসলে যে লোকগুলি হরির লুঠ দিতে এসেছিল, তাদের মধ্যে ভক্তিভাব ছিল না। কপট হরিভক্তি দেখাতে তারা আশ্রমে এসেছিল।


অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ তাদের অন্তরের ভাব বুঝতে পেরে বলেছিলেন, এই আশ্রমে তোদের হরি নেই, যেখানে তোদের হরি আছে, সেখানে গিয়ে লুট দে। হরির জন্য যদি অন্তরে ব্যাকুলতা না থাকে, বিশুদ্ধ ভক্তি না থাকে, কপট ভক্তি দিয়ে হরির লুট দিলে, হরি তা গ্রহণ করেন না।


এরপর শ্রীধর সম্পর্কে বাবা বললেন, আমি শ্রীধরের গুরুভক্তি পরীক্ষা করার জন্যই ওই কথা বলেছিলাম। আমার কথা শুনে সে চেঁচামেচি করতে করতে তার লেংটিটা খুলে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারে। আমি তখন আসন থেকে উঠে দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, শ্রীধর তুই ঠিক বলেছিস। তোর গুরুভক্তি দেখে আমি খুব আনন্দ পেলাম। তবে আমার দোষটা হল কোথায়?


তোকে অন্ধ বলেছি, মূর্খ বলেছি, বেশ করেছি। তুই তো দেশ-বিদেশে আমায় মহাপুরুষ বলে সর্বনাশ করেছিস। বারদীতে এসে প্রথম পাঁচ বছর বেশ ছিলাম। আর এখন রোগীদের চেঁচামেচি আর মামলা-মোকদ্দমার কথা উদয়াস্ত শুনতে হচ্ছে। এইজন্যই কি আমার বারদীতে থাকা? কচি কচি ছেলেগুলোকে যোগশিক্ষা দিচ্ছিস আর মুখে গুরু গুরু বলছিস। শালা, অন্ধ, মূর্খ।


এখানে বাবা লোকনাথের গোঁসাইজিকে অন্ধ ও মূর্খ বলার উদ্দেশ্য হল যে, গোঁসাইজি কোনো বিচার না করে যাকে-তাকে যোগশিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু যোগসাধনা সব দেহে সম্ভব নয়। যোগসাধনার জন্য দেহকে প্রস্তুত করতে হয়। আর সেই কাজের জন্য যেমন দক্ষ গুরু চাই, তেমনি সত্যনিষ্ঠ উপযুক্ত শিষ্যও চাই। যোগশিক্ষার জন্য কঠোর কৃচ্ছুব্রত অনুষ্ঠান করতে হয়। অপরিপক্ক দেহে যোগশিক্ষা করতে গেলে দেহের অনিষ্ট হয়। তাতে শিষ্যের যেমন সাধনায় সফলতা আসে না, গুরুরও বদনাম হয়।


লোকনাথ বাবা গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি চাইতেন তার প্রাণের জীবনকৃষ্ণ সাধনার আরও উচ্চস্তরে উন্নীত হোক। তাঁর কাছে অনেক লোক ভিড় করলে, তার সাধনার ব্যাঘ্যাত হবে। ভিড় সাধনার অন্তরায়। সেইজন্য বাবা লোকনাথ এমন পথ অবলম্বন করলেন যেন বেশি লোক তার জীবনকৃষ্ণের কাছে ভিড় না করে। জীবনকৃষ্ণ যেন ভিড়ে মিশে না গিয়ে সাধনায় মন দেন। এমন কাজ উনি রজনী ব্রহ্মচারীর জন্যও করেছিলেন। তবে রজনী ব্রহ্মচারী বুঝেছিলেন যে বাবা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই কাজ করছেন এবং সেইজন্য তিনি বাবার এই কাজে বিরাগভাজন হননি। কিন্তু গোঁসাইজি সেভাবে ভাবেন নি। তিনি ভেবেছিলেন বাবা গোঁসাইজির বদনাম করছেন নিজের শ্রেষ্ঠতা জাহির করার জন্য। এটা তার ভুল মূল্যায়ণ ছিল, বিশেষ করে বাবার পূর্ণব্রহ্মরূপ দর্শন করার পর।


এরপর বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, বিধিমতো যারা স্ত্রীসঙ্গ করতে পারে না, তাদেরই বলেছি বেশ্যাগমন করগে, ব্যাভিচার করগে। এতে দোষের কি আছে? শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচারই তো ব্যাভিচার। শাস্ত্রবিধি না মেনে স্ত্রীগমনও তো বেশ্যাগমন। ও শালারা যখন আমার কথার মানে বোঝে না, তখন আমার কাছে আসে কেন?


গোঁসাইজি শিষ্যের কাছে শুনেই বাবার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু গভীরভাবে বিষয়টি ভেবে দেখেননি। জোর করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে রমণ করাও তো এখন অপরাধ বলে গণ্য হয়। স্ত্রীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় মতে স্বামী তো মেলামেশা করতেই পারে। কিন্তু অশাস্ত্রীয় মতে নিজের কাম-বাসনাকে পূরণ করার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করাকে অপরাধ বলে গণ্য হয়। এবং বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে সেইরূপ ভাবে স্ত্রীকে ব্যবহার করা আর বেশ্যাগমণ করা সমান। গোঁসাইজি আধ্যাত্মতত্ত্ব অনুসারে বিষয়টি ভেবে দেখেননি।


বাবা লোকনাথ কঠোর বাক্যদ্বারা ভক্তদের পরীক্ষা করতেন। সেইরকম পরীক্ষায় ত্যাগী ও যযাগী ভিন্ন সাধারণ মানুষের উত্তীর্ণ হওয়া খুব কঠিন। এইরকম পরীক্ষার মধ্য দিয়েই উচ্চ মার্গের যোগীগণ ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্ম সাধনায় নিবিড়তা যাচাই করতেন। এই পরীক্ষায় রজনী ব্রহ্মচারী বাবার কাছে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে বাবা প্রায় ১১৩ বছর মুখে কোনো কথা বলেননি, বা ভাষার ব্যবহার করেননি। নিম্নভূমিতে অবতরণের পরই তিনি নতুন করে ভাষার ব্যবহার করতে শেখেন। ১১৩ বছর তিনি সমস্ত লোকাঁচারের বাইরে ছিলেন। সেইজন্য তার ভাষার ব্যবহার অনেক সময় সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকত। বাবা নিজেই তার ভাষা সম্পর্কে বলেছেন, দেখ বাপু, ভাষায় ভাসে, ভাবে ডোবে। তাই ভাষা ও ভাব পরস্পর বিরোধী বলেই ভাবকে সকল সময় ভাষায় সম্যক প্রকাশ করা যায় না। ওই ভাবের ভাবুক না হলে ওই ভাষার অর্থ বোঝা যায় না। আধ্যাত্মিক ভাব অনেক সময় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা অনুভূতির দ্বারা বুঝতে হয়। যখন তোর মন ওই ভাবে পূর্ণ হবে তখন তোর মন ওই ভাষার অভিমুখী হবে। তাই মনের অনুকূল অবস্থা হেতু তুই বুঝতে পারবি যে ওই ভাব প্রকাশ করতে ওই ভাষার চেয়ে স্পষ্টতর ভাষা আর কিছুই সম্ভব নয়। তখন ওই ভাষা অসম্পূর্ণ হলে কিংবা আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল মনে হলেও তোর ভাবের সঙ্গে মিলে যাবে।


উচ্চমার্গের যোগীদের এইরূপ ভাব আমিও প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেইজন্য এই ভাবের অনুধাবন করতে পারি। নর্মদা পরিক্রমার সময় দক্ষিণ তটে আমাকে দুবার এইরকম কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। দু-জায়গায় দুজন উচ্চমার্গের যোগীর সামনে তাদের কঠোর বাক্যবাণ ও রূদ্ররূপের সামনে আমি প্রথমাবস্থায় থরহরি কম্পমান ছিলাম। কিন্তু গুরুর আশীর্বাদে ও মহামুনি মার্কন্ডেয় এবং মাতা নর্মদার কৃপায় আমি সেই অবস্থায় নিজেকে সামলে সেই যোগীদের কৃপা পেতে সমর্থ হয়েছিলাম। যোগীদের এইরূপ প্রক্রিয়া থেকে আমি পরিক্রমার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম যে, তারা যখন কিছু বলেন তখন সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বার করতে হবে। যোগীগণ অনেক সময় গুঢ় শাস্ত্রীয় তত্ত্ব হেঁয়ালির মাধ্যমে ভক্তের সামনে পেশ করেন। সেজন্য তাদের কথার চটজলদি উত্তর দিতে নেই এবং সেই কথাতে মনে ব্যথাও পেতে নেই। এটা মনে করতে হবে যে কোনো উচ্চমার্গের যোগী কঠিন পরীক্ষা ভিন্ন তাঁর কাছে কোনো ভক্তকে আসতে দেবেন না। উচ্চমার্গী যোগীদের কৃপা পেতে হলে তাদের কঠিন বাক্য, ভৎর্সনাকে আশীর্বাদ মনে করতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে যোগী যখন মনে মনে ঠিক করলেন কাউকে কৃপা করবেন, তখনই তাকে পরীক্ষা করেন; নতুবা তাকে এড়িয়ে যান। বাবা লোকনাথ আধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক কথাই বলেছিলেন কিন্তু সমআধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে তার কথার সঠিক অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে গোঁসাইজি সেটা করতে পারেননি। গোঁসাইজি যখন বারদী আশ্রমে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখনই বাবা তাকে বলেছিলেন যে, গোঁসাইজির দেহ তখনও অপটু। তাঁকে সাধনার মাধ্যমে আরও উচ্চমার্গে পৌঁছতে হবে এবং সেজন্য তিনি তাকে আশীর্বাদও করেছিলেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বাবা লোকনাথ ছিলেন ২৩টি সিদ্ধি ও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী পূর্ণব্রহ্ম এবং গোঁসাইজি ছিলেন ৮টি সিদ্ধির অধিকারী। সেজন্য সাধনমার্গের এই তফাৎ তো ছিলই। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন গোঁসাইজি তার উত্তরাধিকারী হয়ে আরও সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সাধনমার্গের উচ্চতম স্তরে উন্নীত হোক। গোঁসাইজির বিগত ধর্মজীবন থেকে দেখা যায় যে তিনি বরাবরই একটা দোলাচলের মধ্যে দিয়ে ধর্মজীবনে এগিয়েছেন। বর্তমান স্তরে এসেও তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও পৌত্তলিকতা উভয়কেই একসঙ্গে নিয়ে চলেছেন। সাধনার প্রথম জীবন থেকে যেভাবে গুরু নির্দেশিত পথে সাধক নিজেকে তৈরি করে সাধনপথে এগিয়ে যেতে থাকেন, তেমনভাবে সাধন জগতের বর্তমান স্তরে গোঁসাইজির উত্তরণ হয়নি। তার মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের ব্যাকুলতা ছিল। এই ব্যাকুলতাই তাকে উচ্চমার্গের গুরু পেতে সাহায্য করে। তারপর গুরুর আশীর্বাদে ও কৃপায় গুরুশক্তির জোরে সেই ব্যাকুলতা আরও বৃদ্ধি পায় ও সাধনপথের দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হয়। অষ্টসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি ঢাকার গেণ্ডারিয়া আশ্রমে তপস্যা করে। এখনও তাকে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। সেই উচ্চতর সাধনার উদ্দেশ্যেই তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে আসন পেতেছিলেন। বাবা লোকনাথ যখন তাকে তার বারদীর আসন গ্রহণ করতে বললেন, তখন তিনি সেজন্য মনস্থির করতে পারেননি। বৃন্দাবনে শ্যামসুন্দরের তপস্যা করার প্রবল বাসনা সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার উপর উপরিউক্ত কারণে তিনি বাবার উপর রুষ্টও ছিলেন।


সেইজন্য বাবা যখন তাকে বললেন, আমি দেহ ছেড়ে যাচ্ছি, তখন তিনি তাকে কিছু বললেন না। বাবা তখন তাকে বললেন, যাঁদের জন্য থাকা, তারাই যখন আমাকে চিনলেন না, আমার দ্বারা তাদের যখন কোন উপকারই হবে না, তখন আর থেকে লাভ কি? আমি দেহ ছেড়ে যাচ্ছি।


বাবার এই কথা শুনেও গোঁসাইজি তাঁকে দেহ ছেড়ে যেতে নিষেধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন, আমার কিছু বলার নেই।


পরমুহূর্তেই এক দমকা হাওয়া ঢুকে ঘরে সব ওলটপালট করে দিল। ব্রহ্মচারী বাবার সূক্ষ্ম দেহ সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলো। গোঁসাইজি তখন ব্রহ্মচারী বাবা, ব্রহ্মচারী বাবা বলে ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু ব্রহ্মচারী বাবার আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।


গোঁসাইজির শেষ কথাটি ব্রহ্মচারী বাবার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তার অন্তর সেই কথায় ব্যথিত হয়ে উঠেছিল কেননা সেই কথাটি বলেছিলেন তাঁর প্রাণের জীবনকৃষ্ণ যাঁকে তিনি অন্তর থেকে সবকিছু দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো বা দুর্লভ ব্রহ্মবিদ্যাও তিনি গোঁসাইজিকে দান করে যেতেন যে বিদ্যা তাঁর কাছ থেকে অন্য কেউ আয়ত্ত করতে পারেনি। সেই বিদ্যা ধারণ করার আধার সেইসময় আশ্রমের অন্য কারও ছিল না। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আধার ছিল এবং তার সঙ্গে বাবা লোকনাথের পারিবারিক সম্পর্ক থাকায় তিনি তাঁকে তার উত্তরাধিকারী রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এক অতিদুর্লভ বিদ্যা বারদী হতে এরপর অন্তর্হিত হলো। বাবা লোকনাথ এই ঘটনার পরদিনই তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করেছিলেন।


গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এরপর সাধনভজনে মগ্ন হয়ে পড়েন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ধ্যানযোগে লাভ করার তাঁর অত্যুগ্র বাসনা ছিল। একদিন ধ্যানযোগে তার সামনে এক দিব্যজ্যোতি ভেসে উঠল। সেই জ্যোতির অমিত তেজ সহ্য করতে না পেরে তিনি জয় গৌর, জয় গৌর বলে সংজ্ঞা হারালেন। এরপর শিষ্যদের সেবায় তার সংজ্ঞা ফেরে। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে বৃন্দাবনে অবস্থানকালে সেখানকার অনেক সাধক মর্মাহত হন। কিন্তু রামদাস কাঠিয়াবাবা ধ্যানযোগে জানতে পারেন যে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ একজন মহাসাধক এবং তিনি অন্যদের বুঝিয়ে বলেন এবং তখন তারা শান্ত হন।


১৩০২ সনের ২২শে জৈষ্ঠ্য তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। শেষ জীবনেও তিনি ভক্তদের সংসারে অবস্থান করে ঈশ্বরের নাম গানের মাধ্যমে ঈশ্বর সেবার পরামর্শ দেন।


.


শ্রীরামকুমার চক্রবর্তী


রামকুমার চক্রবর্তী বারদী গ্রামে এক অতি পরিচিত পুরোহিতের পুত্র ছিলেন। জন্ম থেকে তিনি ছিলেন ধীর, স্থির ও শান্ত স্বভাবের। বাল্যকাল থেকেই তাঁর শাস্ত্রবিষয়ে জ্ঞানার্জনের প্রতি স্পৃহা লক্ষ্য করা যায়। গৃহাশ্রমে থেকেই তিনি বাল্যকাল ও কৈশোরে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করেন এবং সদাচারব্রতের মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে বিভিন্ন সত্ত্বগুণের বিকাশ ঘটতে থাকে। ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করেও প্রায় মধ্যবয়স পর্যন্ত তিনি কোনো সদ্গুরু করেননি। গুরুকরণ করার জন্য তার মধ্যে কোনো চাপও লক্ষিত হয়নি। তিনি গৃহাশ্রমে নিজের মতো করে বড়ো হতে থাকেন।


বাবা লোকনাথ যখন প্রথম বারদী গ্রামে এসে আশ্রমের সূচনা করেন, তখন রামকুমারের কৈশোর উত্তীর্ণ। সারা গ্রামের লোক সেইসময় এই ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শনার্থে গেলেও, রামকুমার সেই ভিড়ে যাননি। বারদী গ্রামে বাবার আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর একদিন একাকী তিনি বারদী আশ্রমে এসে বাবার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। আসনঘরে রামকুমারকে সম্মুখে দেখে বাবা লোকনাথ তাঁর গুরু ভগবান গাঙ্গুলির বর্তমান দেহকে চিনতে কষ্ট হয় না। রামকুমারের মধ্যেও জেগে ওঠে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার। রামকুমারকে দর্শন করেই ব্রহ্মচারী বাবা মনে মনে বলতে থাকেন, তিনি তো গুরু ভগবান গাঙ্গুলির আশাতেই সুদূর হিমালয় থেকে নিম্নভূমিতে এসে বারদীতে অপেক্ষা করছেন। তাঁর গুরু মণিকর্ণিকার ঘাটে শেষবার বলেছিলেন, পরজন্মে বাবা লোকনাথকেই গুরুকে কর্মমার্গের মধ্য দিয়ে ভক্তিরস সৃষ্টি করে মোক্ষলাভের পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তিনি গুরুকে দেহত্যাগের সময় কাশীতে সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এতদিনে সেই সময় সমাগত। রামকুমারের মধ্যেও বাবা লোকনাথকে দর্শন করে এক ত্যাগ ও বৈরাগ্যের বাসনা জেগে ওঠে। জন্মান্তরের সংস্কারের কারণে তখন তার গৃহস্থ জীবন অতি সংকীর্ণ মনে হয়। তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেন বাবা লোকনাথের কাছে।


বাবা লোকনাথ তখন রামকুমারের মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তিমার্গের আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চার করলেন। তাঁকে নির্দেশ দিলেন বারদী আশ্রমে তার কাছে আসতে। রামকুমার এরপর বাবার কাছে প্রায়শঃই আসতেন। বাবা তাকে গোপনে যোগসাধনার অনেক গুহ্য পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলে রামকুমার সেইসব যোগশিক্ষা অতি দ্রুত আয়ত্ত করতে থাকেন। তারপর একদিন গোপনে বাবা রামকুমারকে কাছে ডেকে দীক্ষা দেন। দীক্ষা দান করার পর তাকে আদেশ করেন গৃহত্যাগ করে পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করতে। দেহধারণের প্রারব্ধ সংস্কার ও পূর্বজীবনের সাধনার ভুলত্রুটিগুলিকে সংশোধন করার জন্য বাবা রামকুমারকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে পরিব্রাজনের মাধ্যমে কর্মযোগে নিয়োজিত হতে বলেন। রামকুমার বাবার সেই আদেশ শিরোধার্য করে পরিব্রাজনে বেরিয়ে পড়েন। সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে পরিব্রাজনে বের হবার সময় যখন রামকুমার বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথের কাছে বিদায় নিতে আসেন, তখন বাবা তাকে বলেন, রাম সময় হলেই আমি তোমায় কাছে ডেকে নেব। তুমি যখনই আমায় স্মরণ করবে, আমাকে কাছে পাবে। রামকুমারকে দীক্ষা দান করা, যোগসাধনার সব গুহ্য তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়া এবং সন্ন্যাসী করার কথা বাবা তখন গোপন রেখেছিলেন। বারদী আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে রামকুমার কাশী চলে যান। বারদী গ্রামের সকলে জানতে পারে যে রামকুমার চক্রবর্তী হঠাৎ সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হয়েছেন।


এরপর রামকুমার চক্রবর্তীকে বারদী আশ্রমে দেখা যায় ১২৯৭ সনের ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, খুব সকালে। ওই সনের জ্যৈষ্ঠ মাসেই পরিব্রাজনকালে রামকুমার বাবা লোকনাথের সূক্ষ্ম নির্দেশ পান অবিলম্বে বারদী আশ্রমে আসার জন্য। বাবার নির্দেশ পেয়ে রামকুমার বারদীর পথে রওনা হন এবং ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ব্রাহ্ম মুহূর্তে আশ্রমে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করেন। রামকুমারকে সামনে পেয়েই বাবা তাকে সস্নেহে বুকে টেনে নিলেন। বাবার বুকে রামকুমারের স্পর্শ হতেই বাবা তার যোগদৃষ্টিতে বুঝতে পারেন দীর্ঘ পরিব্রাজনের মধ্য দিয়ে কঠোর তপশ্চর‍্যা করে আধ্যাত্ম সাধনার অনেক উচ্চভূমিতে রামকুমারের উত্তরণ হয়েছে। রামকুমারও বুঝতে পারেন কিভাবে গুরু তাকে নিজের যোগশিক্ষা দিয়ে ও তার মধ্যে আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চার করে দিয়ে তাঁকে সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। জ্ঞান-ভক্তি ও কর্মযোগের পথে প্রতিনিয়ত সূক্ষ্ম নির্দেশের মাধ্যমে তাকে পরিব্রাজনের সময় সাধনপথে পরিচালিত করেছেন। বাবার অসীম করুণার কথা স্মরণ করে তার চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এমন সময় বাবা তাকে বলেন, রাম, আমি আগামীকাল দেহত্যাগ করব। তোমার প্রতি আমার নির্দেশ আমার দেহ সংস্কারকালে তুমি আমার মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করবে। বাবার এই নির্দেশ সম্বন্ধে জানকী ব্রহ্মচারী ও গোয়ালিনী অবগত ছিলেন।


১২৯৭ সনের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ বাবা ব্রহ্মলীণ হবার পর তার নির্দেশানুযায়ী রামকুমার বাবার মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পাদন করেন। বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদনের পর তিনি আবার কাশী চলে যান এবং সেখানে মণিকর্ণিকার ঘাটে ধ্যানাবস্থায় দেহত্যাগ করেন।


রামকুমারের জন্ম হয়েছিল বাবা লোকনাথের প্রদর্শিত আধ্যাত্ম সাধনার পথে পরিচালিত হয়ে মোক্ষ লাভ করার জন্য। বাবা লোকনাথ গুরুর কাছে তার প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্যই বারদীতে এসে আশ্রম করেছিলেন। যদি রামকুমারের জন্ম বারদীতে না হয়ে অন্য কোনো স্থানে হতো, তবে বাবা নিম্নভূমিতে অবতরণ করে সেখানেই অবস্থান করতেন। বাবা লোকনাথ তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে ব্রহ্মলীণ হবার পরই রামকুমারও তার মরদেহ ত্যাগ করে দেবলোকে যাত্রা করেন।


রামকুমারই যে বাবার সাধনপথের গুরু ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন এবং তার উদ্ধারকল্পেই যে তিনি বারদীতে অবস্থান করছেন সেই কথা বাবা কয়েকজন বিশেষ ভক্তকে জানিয়েছিলেন। এখানে সেইরূপ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।


যে ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি, সেটা বাবার একনিষ্ঠ বিশিষ্ট ভক্ত ডঃ নিশিকান্ত বসুর ডায়েরি থেকে পাওয়া যায়।


নিশিকান্ত বসু যখন বারদীতে ডাক্তারি করতেন, তখন তিনি নারিন্দাবাসী শীরমণী দাসের সঙ্গে পরিচিত হন। রমণীমোহন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বাবার এক দৈবলীলার কথা নিশিকান্ত বসুকে বলেন।


রমণীমোহনের ৯ বছরের পুত্র এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। যখন সে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, এমন সময় একদিন সে অচৈতন্য অবস্থায় দেখে বাবা লোকনাথ, ভগবান গাঙ্গুলি ও বেণীমাধব তার কাছে এসেছিলেন। যখন চেতনা ফিরে পেয়ে এই কথা সে সকলকে বলে, তখন সকলে বলে বাবা লোকনাথ, ভগবান গাঙ্গুলি তো দেহত্যাগ করেছেন। তিনি তোমার কাছে কি করে আসবেন? পরে বাবা লোকনাথকে এই প্রশ্ন করা হয়। সূক্ষ্মদেহে বাবা লোকনাথ উপস্থিত হয়ে বলেন, তার পূর্বজন্মের গুরু ভগবান গাঙ্গুলি এ জন্মে বারদীর রামকুমার চক্রবর্তী ছিলেন। তাঁর উদ্ধারের জন্যই তিনি বারদীতে এসেছিলেন এবং এতদিন অবস্থান করেছিলেন।


সমস্ত ঘটনাক্রম, সময় এবং তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করে ডঃ নিশিকান্ত বসুর ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী রামকুমার চক্রবর্তীকেই বাবা লোকনাথের সাধনগুরু ভগবান গাঙ্গুলি রূপে এখানে চিহ্নিত করা হলো। এই পুস্তক লেখার সময় বাবা লোকনাথের সূক্ষ্ম নির্দেশও সেই ইঙ্গিতই বহন করে।

নবম অধ্যায় – মহাপ্রয়াণ


১১৩৭ সনের পুণ্যলগ্নে বাবা লোকনাথ এই জগতে আগমন করেছিলেন। ১১৪৭ সনে গৃহত্যাগ করে গুরু ভগবান গাঙ্গুলির সঙ্গে সাধন পথের যাত্রা শুরু করেছিলেন। তারপর দীর্ঘ ১২৩ বছর বহু পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল ও হিমালয়ে তপস্যা করে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ১২৭০ সনে লোককল্যাণহেতু নিম্নভূমিতে অবতরণ করে বারদী আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর গুরুদেবের আদেশ ছিল নিম্নভূমিতে অবস্থান করে লোকশিক্ষাহেতু তাকে কিছুদিন কর্ম করতে হবে। সিদ্ধিতে প্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে জগতের মানুষকে জীবন্মুক্তির আলোর সন্ধান দিতে হবে। তার সঙ্গে তার দুটি আরও কাজ ছিল। প্রথম কাজ উপনয়নের দিন গর্ভধারিণী মা কমলার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা পালন করা ও দ্বিতীয় কাজ গুরু ভগবান গাঙ্গুলিকে পরজন্মে ভক্তি ও কর্মযোগের শিক্ষার মাধ্যমে মোক্ষ প্রাপ্তিতে উপযুক্ত করা। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে তিনি গুরুর আদেশ পালন করছেন। মা কমলা পরজন্মে গোয়ালিনী রূপে বারদীতে লোকনাথ বাবাকে কাছে পেয়েছেন। রামকুমাররূপী ভগবান গাঙ্গুলিকে গোপনে তিনি ভক্তি ও কর্মযোগের শিক্ষার মাধ্যমে ও তার ব্রহ্মশক্তি রামকুমারের মধ্যে সঞ্চারের মাধ্যমে তাকে তিনি মোক্ষলাভের উপযুক্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে তিনি নানাবিধ লোককল্যাণ কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং লোকশিক্ষা হেতু আরও কিছু যোগীপুরুষ তৈরি করেছেন। যখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তার গুরুদেবের সাধনা মোক্ষলাভের স্তরে পৌঁছে গেছে, তখন তার মন আর এই জগতে থাকতে চাইছিল না। তার পঞ্চভূত দেহ থেকে তার পূর্ণব্রহ্ম রূপ ঘনঘন তখন বেরিয়ে যেত। প্রতিদিন রাতে তাঁর কাছে হিমালয় থেকে মহাযোগীরা সূক্ষ্ম দেহে আসতেন যোগ সাধনার বিভিন্ন গুহ্য প্রক্রিয়ার শিক্ষা লাভের জন্য। তার যোগজীবনী ছিল যোগ শিক্ষা বা যোগ সাধনার এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত যা সেইসময় বা আজও অতি বিরল। বারদীতে এই কথা শোনা যায় যে একদিন রাতে চতুর্যগ অমর অশ্বত্থামা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। ঋষি অরবিন্দের অবনী নামে এক ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন যে বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে গভীর রাতে হিমালয়ের অনেক মহান যোগীগণ যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব আলোচনা করতে আসেন। একজন পূর্ণব্রহ্ম মহাপুরুষরূপে তার অবস্থানের যথার্থতা তিনি সেই সময় উপভোগ করতেন। কিন্তু বারদী আশ্রমে সারাদিন অগণিত ভক্ত আসত কেবল সংসারের দুঃখ কষ্ট, রোগ নিবারণের আর্জি নিয়ে। জীবন্মুক্তির সন্ধান পেতে খুব কম লোকই তার কাছে আসত। এই সমস্ত স্বার্থান্বেষী ভক্তের আর্জি শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার মন আর এই জগতে থাকতে চাইছিল না। তিনি এই সময় কোনো কোনো ভক্তকে বলতেন, আমি ইচ্ছা করলে আমার এই দেহে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু দেহটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে, এ দেহ এখন ত্যাগ করতে হবে। একদিন তিনি সমবেত ভক্তগণকে বলেন, আমি যোগবলে দেহত্যাগ করব। সেই সময় গ্রামের এক ব্যক্তি তার পুত্রকে কোলে নিয়ে বাবা লোকনাথ বলে চিৎকার করতে করতে আশ্রমে ঢোকে। সেই আশ্রমের উঠানে পুত্রকে কোলে নিয়ে বসে কাঁদতে থাকে। বাবা তার আসন ঘর থেকে বাইরে এসে তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। সেই ব্যক্তি বলে তার পুত্র যক্ষারোগে আক্রান্ত এবং তার শেষ সময় উপস্থিত। সে বাবার কাছে মিনতি করে পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য। বাবা সেখানে দাঁড়িয়েই ধ্যানস্থ হয়ে যান। যে-কোনো মরদেহ ত্যাগ করতে হলে একটি হেতুর প্রয়োজন। হয়। বাবা মনে করেন এই পুত্রটির জীবনদানের মাধ্যমে তিনি মরদেহ ত্যাগ করার হেতু পাবেন। সেজন্য তিনি বলেন, তোমার পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দাও। আমি ওকে জীবনদান করব। এরপর বাবা সেই ছেলেটির কপালে বাঁ হাত ও বুকে ডান হাত রাখেন। তার শরীর থেকে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ বের হয়ে সেই ছেলেটির শরীরে প্রবেশ করে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে যায়। বাবা নিজে তার রোগ গ্রহণ করে ছেলেটিকে সুস্থ করে দেন। এরপর বাবার শরীরে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ভক্তদের অনেক অনুনয় সত্ত্বেও তিনি নিজে রোগমুক্ত হতে চান না। তিনি তো স্ব-ইচ্ছাতেই এই রোগ গ্রহণ করেছেন।


এরপর বাবা একদিন সমবেত ভক্তগণকে বলেন, আমার দেহত্যাগের সময় যদি আকাশ মেঘমুক্ত হয় ও সূর্য উজ্জ্বল কিরণ দান করতে থাকে, তবে বুঝতে হবে আমি সূর্যরশ্মি ভেদ করে ব্রহ্মলোকে গিয়ে জ্যোতির্ময়ে প্রবেশ করছি, আমার আর পৃথিবীতে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আমি উত্তরায়ণে দিনের বেলায়ই দেহত্যাগ করবো। বাবার এই কথা শুনে উপস্থিত ভক্তগণ ও গোয়ালিনী এবং আপামর আশ্রমবাসীগণ চোখের জলে ভাসতে থাকেন। তারা বাবার চরণে অশ্রুজলে আকুতি জানাতে থাকেন যেন বাবা তাঁদের ছেড়ে না যান। কিন্তু বাবা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।


বাবা লোকনাথ উত্তরায়ণের সময় কেন দেহত্যাগ করার জন্য বেছেছিলেন, সেই সম্বন্ধে কিছু কথা বলার দরকার।


মনুসংহিতা অনুযায়ী পৃথিবীর ৬ মাসে দেবতাদের একদিন এবং ৬ মাসে এক রাত্রি। দেবতাদের দিনকে বলা হয় উত্তরায়ণ এবং রাত্রিকে বলা হয় দক্ষিণায়ন। দেবতাদের একটি দিন হয় তিনটি ঋতুকে নিয়ে বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত। অর্থাৎ এই তিন ঋতু উত্তরায়ণ। দেবতাদের একটি রাত্রি হয় বাকি তিনটি ঋতুকে নিয়ে গ্রীষ্ম, শীত ও বসন্ত অর্থাৎ এই তিন ঋতু দক্ষিণায়ন। আমাদের যেমন ১২ মাসে এক বছর হয়, দেবতাদের তেমন একদিন ও এক রাতকে সৌরবর্ষ বলে। দেবতাদের এক বছর মানে ৩৬০ সৌরবর্ষ। এইরকম ৬৩০ সৌরবর্ষে এক দিব্যবৰ্ষ হয়, আর ১২ হাজার দিব্যবর্ষে চতুর্যুগ।


বাবা লোকনাথ উত্তরায়ণে দেহত্যাগ করতে চেয়েছিলেন অর্থ এই যে, তিনি দেবতাদের দিনের বেলায় ব্রহ্মলোকে পদার্পণ করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু জ্যৈষ্ঠ মাসে বর্ষা ঋতুর আগমন ঘটে, সেইজন্য তিনি উত্তরায়ণের প্রথম ঋতুতেই এই ধরাধাম ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।


বাবা লোকনাথ যে সূর্যরশ্মি ভেদ করে ব্রহ্মলোকে চলে যাবেন বলে ভক্তদের জানিয়েছিলেন, সেই কথারও বিশেষ অর্থ আছে। সূর্যরশ্মি ভেদ করে কোনো পুণ্যাত্মার ব্রহ্মলোকে যাবার প্রক্রিয়াকে আত্মার উক্ৰমণ বলা হয়।


কোনো পুণ্যাত্মা যখন ব্রহ্মলীণ হন, তখন তার আত্মা যে পথে ব্রহ্মলোকে গমন করে তার একটি রূপরেখা এখানে উল্লেখ করছি।


প্রথম ধাপ : ব্ৰহ্মবিদদের ইহলোক ত্যাগ করার পর তাদের পুণ্যাত্মা প্রথমে অর্চি অর্থাৎ জ্যোতিতে গমন করে। মরদেহের অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার আগেই এই আত্মার গমন হয়। যখন কোনো ব্রহ্মবি যোগবলে তার আত্মার উক্রমণ ঘটান, তখন তার ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে একটি অগ্নিশিখারূপ আত্মা জ্যোতিতে গমন করে।


দ্বিতীয় ধাপ : দ্বিতীয় ধাপে সেই আত্মা অর্চি থেকে দিবসে গমন করে।


তৃতীয় ধাপ : তৃতীয় ধাপে আত্মারূপ জ্যোতি দিবস থেকে শুক্লপক্ষে গমন করে।


চতুর্থ ধাপ : চতুর্থ ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের পথে ৬ মাস থাকে।


পঞ্চম ধাপ : পঞ্চম ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি উত্তরায়ণ থেকে সম্বৎসরে গমন করে।


ষষ্ঠ ধাপ : ষষ্ঠধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি সম্বৎসর থেকে আদিত্যে গমন করে।


সপ্তম ধাপ : সপ্তম ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি আদিত্য থেকে চন্দ্রমাতে গমন করে।


অষ্টম ধাপ : অষ্টম ধাপে সেই জ্যোতি চন্দ্রমা থেকে বিদ্যুল্লোকে গমন করে। বিদ্যুল্লোকে এক দিব্যপুরুষ এসে সেই জ্যোতিকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যান। এই হল দেবপথ। কোনো পুণ্যাত্মার এই দেবপথ গমনের নাম উক্রান্তি। যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানী, তাদের প্রাণ অর্থাৎ আত্মা ব্রহ্মলোকে উক্রান্তি হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মেতে লয় হয়। এই হল আত্মার চরম মুক্তি বা নির্বাণ। যিনি ব্রহ্মচর্যে সিদ্ধ হয়ে স্বল্পদ্মস্থিত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তিনি মরদেহ ত্যাগ করলে মূর্ধাভিমুখে প্রসারিত সুষুম্না নাড়ি অবলম্বন করে উৰ্দ্ধদিকে গমন করেন। মহাযোগীগণ যোগবলে ব্রহ্মরস্থিত সুষুম্না নাড়ির দ্বারা উক্ৰমণ পদ্ধতি অবলম্বন করে সূর্যরশ্মি ভেদ করে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করেন। তারপর ক্রমে ব্রহ্মলোকে গমন করে ভগবৎসাযুজ্য লাভ করেন।


তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে আমি নর্মদা তটে এমনভাবে যোগীদের ব্ৰহ্মলীণ হবার ঘটনা শুনেছি। নর্মদার দক্ষিণ তটে ব্রহ্মাণ ঘাটে মা নর্মদার কৃপাধন্যা এমন এক যযাগিনীর সমাধিস্থলে বসেছিলাম যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং অগণিত ভক্তদের চোখের সামনে এইভাবে ব্রহ্মলীণ হয়েছিলেন। তাঁর আত্মস্বরূপ জ্যোতি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সকলের সামনে উপরে আকাশে সূর্যরশ্মির সঙ্গে মিলে যায়।


বাবা লোকনাথও উত্তরায়ণে দিনের বেলায় সকলের সামনে সূর্যরশ্মি অবলম্বন করে ব্রহ্মলোকে উক্রমণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসার আগে একদিন বাবা তার ভক্তদের বলেন, আমার মৃত্যুর পর এই দেহটি আগুনে পোড়ায়ে দিস। যখন তিনি দেহত্যাগের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেন, তখনই পরিব্রাজনে থাকা রামকুমার চক্রবর্তী বাবার সূক্ষ্ম নির্দেশ পান অবিলম্বে বারদীতে বাবার কাছে আসার জন্য। দেহত্যাগের সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে গেছে।


তারপর এলো সেই দিন। ১২৯৭ সনের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ। খুব সকালে উঠে বাবা আদেশ করলেন সমস্ত আশ্রমবাসীদের ভোজন বেলা ৯ টার মধ্যে শেষ করতে হবে। বাবা তার আসন ঘরে সকাল থেকে রয়েছেন। বেলা ১০টার সময় তিনি নিজে খোঁজ নিয়ে জানলেন সকল আশ্রমবাসীর ভোজন সমাধা হয়েছে কি না। তারপর তিনি আত্মস্থ হলেন। পরিষ্কার উজ্জ্বল দিন। সূর্য অতি উজ্জ্বলভাবে তার কিরণ জাল বিস্তৃত করেছেন। ব্রহ্মচারী বাবা সকল ভক্তের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থির হয়ে গোমুখাসনে বসলেন। তাঁর পিঠ পিছনে একটি কাঠের তক্তায় ঠেস দেওয়া ছিল। যোগবলে তাঁর আত্মা আলাদা হয়ে গেল। দেহ স্থির। চক্ষু পলকহীন। সকল ভক্তের উৎকণ্ঠিত চক্ষু বাবার দিকে প্রসারিত। যখন তিনি সমাধি অবস্থায় থাকেন, তখনও তার দেহ এইপ্রকার স্থির থাকে, চক্ষু পলকহীন থাকে, কিন্তু কিছু সময় পরে আবার সেই দেহ নড়ে ওঠে, বাবা কথা বলেন। কিন্তু আজ প্রায় ২ ঘন্টা হতে চললো সেই দেহ নড়ে উঠলো না। কেউ সাহস পাননা সেই দেহকে স্পর্শ করতে পাছে বাবার ধ্যানভঙ্গ হয়। ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেন এই বলে যে বাবা বোধহয় আর নাই। কেউ কেউ অধীর আগ্রহে দেহের দিকে তাকিয়ে থাকেন যদি অন্যদিনের মতো এই দেহটি আবার নড়ে ওঠে। বাবা বুঝি এইবার কথা বলবেন।


কিন্তু না, ওই দেহ নড়ে ওঠার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। অবশেষে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটের সময় ভক্তগণ মিলে পরামর্শ করলেন যে একবার দেহটি স্পর্শ করে দেখলে হয়। তখন জানকী ব্রহ্মচারী (যিনি বাবার নিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং বাবার পরে তাঁকেই আশ্রমের গুরুরূপে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন। বাবার দেহ স্পর্শ করতেই বুঝলেন যে এই পুণ্যদেহ থেকে বাবার পুণ্যাত্মা চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে দেবলোকের পথে উক্রমণ করেছে। এই কথা প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে বারদী আশ্রম জনারণ্যে পরিণত হলো। বাবার অগণিত ভক্ত সেই পুণ্য দেহটি একবার শেষ দর্শনের জন্য আশ্রমে এসে উপস্থিত হতে লাগলেন। প্রত্যেকেরই চোখে জল। প্রত্যেক ভক্তের মনই আজ বাবার বিরহ ব্যথায় কাতর, বিষণ্ণ।


এরপর শুরু হল অন্ত্যষ্টিক্রিয়া। বাবার পুণ্যদেহকে ধৃত ও চন্দনে চর্চিত করা হলো। অনেক ভক্ত সেই কার্যে অংশগ্রহণ করে পুণ্য অর্জন করলেন। তারপর আশ্রমেই এক চন্দন কাঠের মহাচিতা সজ্জিত হলো। কয়েকজন ভক্ত মিলে বাবার পুণ্যদেহকে শেষবারের মতো স্পর্শ করে চিতায় স্থাপন করলেন। তারপর বাবার নির্দেশ অনুযায়ী রামকুমার চক্রবর্তী বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা বাবার মুখাগ্নি করে চিতায় অগ্নি সংযোগ করলেন। যে দেহে নিত্য অগ্নি বাস করতেন সেই দেহকে তিনিই গ্রহণ করলেন। বাবার দাহক্রিয়া সকল ভক্তের সামনে সমাধা হল। বাবার মরদেহকে অগ্নিদেব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে যোগসাধনার এক জীবন্ত অনন্য মূর্তি এই জগৎ সংসার থেকে বিলীন হয়ে গেল। রয়ে গেল কেবল তার কীর্তিকথা। বাবার নির্দেশ পালনের পর রামকুমার কাশী গিয়ে মণিকর্ণিকার ঘাটে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে মরদেহ ত্যাগ করলেন এবং তিনিও উত্তরায়ণের পথে দেবলোকে যাত্রা করলেন।


বাবা লোকনাথ ইচ্ছামৃত্যুসিদ্ধি লাভ করেছিলেন যা ছিল তার অষ্টাদশসিদ্ধির অন্তর্গত। যখন ইচ্ছা তখনই তিনি দেহত্যাগ করার অধিকারী ছিলেন। তাঁর স্তরের ঈশ্বরকোটির যোগী নিম্নভূমিতে সাধারণতঃ দৃশ্যমান হননা। কেবল গুরুর আজ্ঞায় ও গুরুকার্যে লোকশিক্ষা ও লোককল্যাণ হেতু তিনি প্রায় ২৭ বছর নিম্নভূমিতে ছিলেন। ইচ্ছা হলে তিনি হয়তো আরও অনেক বছর থাকতে পারতেন। তার সমসাময়িক ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ তৈলঙ্গস্বামী, আব্দুল গফুর আরও অনেক বেশিদিনই এই ধরাধামে অবস্থান করেছিলেন। নর্মদা তটে একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কথা জানি যিনি প্রায় ৪৫০ বছর দেহধারণ করে ছিলেন। কিন্তু বাবা লোকনাথের অগণিত ভক্তদের মিলিত ইচ্ছাশক্তি তাকে এই ধরাধামে আটকে রাখতে পারেনি। বাবা ছিলেন প্রেমভক্তির কাঙাল। ভক্তিরসে সিঞ্চিত হয়ে শিশুর মতো বাবা ডাক তিনি কখনও উপেক্ষা করতে পারতেন না।


 এই কথার সব থেকে বড়ো প্রমাণ ছিল, যখন বাবা নিম্নভূমিতে অবতরণ করে ত্রিপুরার দাউদকান্তি গ্রামে এসে একটি গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন, সেইসময় একটি চাষীর মেয়ে তাঁকে দেখতে পেয়ে প্রথম বাবা সম্বোধন করে। সে রোজ বাবার জন্য খাবার বানিয়ে তার কাছে নিবেদন করে যেত। কিন্তু বাবা তখন না কথা বলতে পারতেন, না কোনো শক্ত খাবার খেতে পারতেন। মেয়েটি বাবার এই অবস্থা অবগত হয়ে নিজের হাতে সুজির পায়েস বানিয়ে এনে বাবাকে পিতৃস্নেহে খাইয়ে দিতেন। এই মেয়ের সেবায়েই বাবা নিম্নভূমিতে এসে প্রথমে খাদ্যগ্রহণ ও কথা বলার শক্তি পান। সেজন্য বাবা বারদী চলে গেলেও এই মেয়েটি যেখান থেকে বাবাকে বাবা বলে ডাকতেন, তিনি সূক্ষ্ম রূপে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করতেন। মেয়েটির মমতা ভরা বাবা ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারতেন না।


বাবা লোকনাথ অনেক সময় বলতেন–একবার বাবা বলে ডেকে দেখ না–বাবা বলে সন্তান যেভাবে বাবার কাছে আসে, সেভাবে আমার কাছে এসে দেখ না। কিন্তু অন্তরে শিশুর আবেদন নিয়ে ভক্তি ও পিতৃস্নেহরসে পূর্ণ বাবা ডাক, যা তিনি সেই চাষীর মেয়ের ডাকে পেতেন, সেই মধুর অন্তরের ডাক তিনি ইদানিং কমই শুনতে পাচ্ছিলেন। বাবা বলে ডেকে যারা তাঁর কাছে আসতেন, সেটা তাঁর কাছে আনুষ্ঠানিক সম্বোধন ঠেকতো আবার অনেকের ডাকে ছিল স্বার্থসিদ্ধির প্রলেপ। পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সামনে সেইসব সম্বোধনকারীর মনের প্রতিটি ভাজ খুলে যেত। তিনি তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারতেন এবং একথা তিনি কিছু ভক্তকে জানিয়েও ছিলেন। তিনি মনে অনেক বেদনা নিয়ে ভাবতেন, সন্তান কি বাবার কাছে কেবল স্বার্থের জন্য আসে! তিনি কি এই দেহ কেবল জগতের লোকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধারণ করে আছেন? যদি এই দেহ জগতের লোককে মুক্তির আলো না দেখাতে পারে, তবে এই দেহ থেকে কি লাভ? এই ভাবনা থেকেই তিনি তার মরদেহ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে সন্তানদের প্রতি যে অকৃত্রিম স্নেহ ও করুণা তার হৃদয়ে সঞ্চিত আছে, তিনি এই মরদেহে না থেকেও সেই স্নেহ ও করুণার ধারা তাঁর সন্তানদের উপর বর্ষণ করতে পারেন। তবে কেন এই পঞ্চভূত জরাজীর্ণ দেহটিকে কষ্ট দেওয়া! সেইজন্য তাঁর পূর্ণব্রহ্ম রূপের প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি লোকনাথ রূপের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।


মহাপ্রয়াণের পরেও তিনি সূক্ষ্মরূপে দর্শন দিয়ে অথবা তার সূক্ষ্ম প্রকাশের মাধ্যমে ভক্তের ডাকে প্রতিনিয়ত সাড়া দিয়ে চলেছেন। তিনি যে ভক্তের কাছে, তার সন্তানদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।


রণে বনে জলে জঙ্গলে, যেখানেই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও। আমিই রক্ষা করিব।


এত বড়ো প্রতিজ্ঞা আজ পর্যন্ত কোনো মহাপুরুষের থেকে এই জগতের মানুষ শোনেনি। আজও বাবা লোকনাথ দেবলোকে থেকে সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছেন। আর আজও তিনি অধীর আগ্রহে তার অগণিত ভক্তদের দিকে তাকিয়ে আছেন কেবল একটিবার সেই শিশুসুলভ বাবা ডাক শোনার জন্য। যে ডাকে থাকবে না কোন স্বার্থ, থাকবে না কিছু পাবার আশা। বাবার কাছে যে অগাধ অমূল্যধন সঞ্চিত আছে, তা তো তিনি ভক্তদের দেবার জন্য ভাণ্ডার খুলেই রেখেছেন, তবে সন্তানদের চাইবার দরকার কি! সন্তানের কী দরকার, পিতার থেকে ভালো আর কে জানে? কেবল বাবা বলে তার চরণে স্মরণ নিলে আর ভয় কি? আমাদের বাবা যে স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সংহারকর্তা, তিনিই পালনকর্তা। কেবল একটি শিশুসুলভ নিঃস্বার্থ বাবা ডাক পেলেই তিনি কোলে তুলে নেবেন। আসুন আমরা সকলে সেই পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ বাবাকে স্মরণ করি।


বাবা গো, আমি পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রীগুরুর কথা কীর্তন করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রী গুরুর ভজনা করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রীগুরুকে স্মরণ করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রী গুরুকে নমস্কার করি।


আমি নিত্য, শুদ্ধ, নিরাভাস, নির্বিকার, নিরঞ্জন, নিত্যবোধস্বরূপ চিদানন্দময় গুরুব্রহ্ম শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে নমস্কার করি। একাধারে পিতা ও মাতা স্বরূপ বাবা লোকনাথ অখণ্ড মণ্ডলাকারে এই বিশ্বচরাচরের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে তার যে স্বরূপ আমাকে দর্শন করিয়েছেন, আমি তাঁর সেই পুণ্যপদে আমার বিনম্র প্রণাম নিবেদন করি।


হে বাবা লোকনাথ, তুমি পূর্ণব্রহ্মরূপে ওঁকারে বিরাজ করছে। তুমি দেবাদিদেব মহাদেব, তুমি চতুর্ভূজ নারায়ণ, তুমি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, আবার তুমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি স্বরূপিনী মাতা কালিকা। যে ওঁকারের মধ্যে তোমার এই অত্যুজ্জ্বল ব্রহ্মরূপ বিরাজ করছে, আমি সেই ওঁকার চরণে কোটি কোটি প্রণাম নিবেদন করি। তোমার ব্রহ্মজ্ঞানের আঁধারে আমায় অমরত্ব প্রদান কর–আমার দেহ যেন সুকর্মে উপযুক্তভাবে নিয়োজিত হয়, আমার জিহ্বা যেন অতিশয় মধুরভাষী হয়ে তোমার জয়গান করতে পারে, আমার কর্ণদ্বয় যেন সর্বদা তোমারই নাম শুনতে পায়, আমার চক্ষুদ্বয় যেন পরমেশ্বরকে দর্শনের জন্য উজ্জ্বল অন্তদৃষ্টি লাভ করে, আমার মন যেন সর্বদা ঈশ্বরাভিমুখী হয়ে তোমার নাম জপ করে। তুমি ব্রহ্মের কোষস্বরূপ বিরাজিত এবং প্রজ্ঞা দ্বারা আবৃত আছো। তুমি কৃপা করে আমার সমস্ত শরীর কোষ ও দিব্যনাড়ীকে জাগ্রত করে অজ্ঞানতা নাশ করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে ঈশ্বর সাধনার উপযুক্ত করে দাও এবং তোমার দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞানকে রক্ষা করো।


অজ্ঞানতায় পাশবদ্ধ এই মন যদি কোনো অন্যায় করে থাকে, তুমি তোমার শিশুসন্তানকে নিজগুণে ক্ষমা করে তোমার চরণে ঠাই দিও।


হে সচ্চিদানন্দস্বরূপ বাবা লোকনাথ, আমার প্রতি প্রসন্ন হও। তোমাকে ভালোবেসে, তোমার চরণে যে পূজা নিবেদন করছি, তা গ্রহণ করে তোমার ওই রাঙা চরণে, তোমার ওই অভয় চরণে, তোমার ওই যুগল চরণে তোমার সন্তানকে স্থান দাও। তুমি আমার কাছে সঙ্গোপনে রয়েছ, সেই গোপনের আস্তরণে থেকেও তুমি আমার রক্ষাকর্তা। হে পিতা, তোমার স্নেহের সন্তানের কাতর ডাক শোন, আকুল প্রার্থনা শোন। তোমার স্নেহের সন্তানের সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করো।


তুমি আমায় দেখ বাবা, আমি দেখি তোমায়

পিতা-পুত্রের এই আলাপন রেখ তুমি সঙ্গোপন।


.


প্রার্থনা


ও দয়াল প্রভু হে, আমি যেন তোমায় আপন করতে পারি। (৩)

আমি সাধনশূন্য, ভজনশূন্য, শক্তিশূন্য ভক্তিও শূন্য

কোন গুণে বল আমি তোমায় পাব হে (২)

 তুমি নিজ গুণে দয়া করে দেখা দিও গো মোরে।

ও দয়াল প্রভু হে ….।

ওই রাঙাচরণ দাও গো আমায় (২)

ওই যুগলচরণ দাও গো আমায় (২)

ওই অভয় চরণ দাও গো আমায় (২)

প্রভু আমি যখন যেভাবে থাকি

 দয়া করে দেখা দিও গো মোরে (২)

ও দয়াল প্রভু হে, আমি যেন তোমায়

আপন করতে পারি

 আমি সাধনশূন্য, ভজনশূন্য, আমি শক্তিশূন্য, ভক্তিশূন্য

 কোন গুণে বলল আমি তোমায় পাব হে

 তুমি নিজ গুণে দয়া করে দেখা দিও গো মোরে।

 ও দয়াল প্রভু হে…।


ভিড় সাধন পথের অন্তরায়–বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।


দশম অধ্যায়ন – ভক্তদের উদ্দেশ্যে শ্রীমুখ নিঃসৃত জীবন্মুক্তির উপায়


মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বিভিন্ন সময়ে বারদী আশ্রমে ভক্তদের উদ্দেশ্যে জীবন্মুক্তির উপায় নির্দেশ করে উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই উপদেশামৃত বাবার বিশিষ্ট ভক্তগণ, যথা-যামিনীকুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রীহরি বিদ্যালঙ্কার, কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন, ব্রহ্মানন্দ ভারতী, কুলদা ব্রহ্মচারী প্রমুখ লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। সেই অমূল্য উপদেশের কিছু সংগৃহীত অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো—


ওঁ


 (১) স্মরণ রাখিস–হিন্দুধর্মের প্রকৃত মর্ম হলো, ধর্মই ইহলোক ও পরলোকে একমাত্র সুখের উপায়। হিন্দু মাত্রেরই জীবনের সব কিছুই ধর্মদ্বারা শাসিত হয়ে থাকে। ইহকাল, পরকাল, ঈশ্বর, সমস্ত জীব, সমস্ত জগৎ–এ সব কিছু নিয়েই হিন্দুধর্ম। হিন্দুধর্মই সম্পূর্ণ ধর্ম। এমন সর্বব্যাপী, সর্বসুখময় ও পবিত্র ধর্ম আর নেই। মনে রাখিস–হিন্দুর ঈশ্বর সর্বভূতময়। তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা। সব জীবেই ঈশ্বর বিরাজ করছেন। জাগতিক প্রেম হিন্দুধর্মের মূল। অচ্ছেদ্য, অভিন্ন জাগতিক প্রেমেই হিন্দুত্বের প্রকাশ। অন্য কোনো ধর্মে এমনটি দেখা যায় না।


(২) তোরা যদি দীর্ঘায়ু হতে চাস্ তাহলে তোদের সদাচারী, শ্রদ্ধাশীল, ঈর্ষাহীন, সত্যবাদী, ক্রোধহীন ও সরল স্বভাব হতে হবে।


(৩) যে লোক নাস্তিক, ক্রিয়া-কর্মহীন, বেদ-বিরোধী, শাস্ত্র-বিদ্বেষী, অধার্মিক, দূরাচার ও নিয়মনীতি অমান্যকারী, সে ইহলোকে অল্পায়ু আর পরলোকে নরকগামী হবেই।


মনে রাখিস–সদাচার দ্বারাই লোকের কীর্তি ও আয়ু বেড়ে যায়। সদাচার থেকে ধর্ম উদ্ভূত হয়, আর ধর্মের প্রভাবেই আয়ু বেড়ে যায়। সৎকর্মের অনুষ্ঠান করে যদি দুঃখ ভোগ করতে হয়, তবুও কায়মনোবাক্যে ওই সৎকর্মেরই অনুষ্ঠান করবি।


(৪) তোরা যদি তোদের মঙ্গল কামনা করিস, তাহলে সর্বোপায়ে তোদের সদাচারী হতে হবে।


(৫) মনে রাখিস-মানব দেহই পরমাত্মার বাসস্থান। বারবার এই কথা স্মরণ করে তোদের দেহকে সর্বদা পবিত্র ও শুচি-শুভ্র রাখতে চেষ্টা করবি।


 (৬) কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহাদি উৎকট পাপের ফল ইহলোকেই মানুষ ভোগ করে। তাই কামে কি কুফল, ক্রোধে কি কুফল, লোভে ও মোহাদিতে কি কুফল তা আলোচনা ও স্থিরভাবে চিন্তা করবি।


(৭) ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু। ক্রোধ মনুষ্যত্ব নষ্ট করে। ক্রোধের অধীন হলে মানুষ যে কোনও পাপের কাজ করতে পারে। তাই ক্রোধকে দমন করতে সদাসর্বদা চেষ্টা করবি। ক্রোধ করবি কিন্তু ক্রোধান্ধ হবি না।


মনে রাখিস-ক্রোধ উপস্থিত হলে তপস্যা বিনষ্ট হয়, ঈর্ষার উদয় হলে ধর্মলাভ হয় না, মান-অপমানের ভয় থাকলে বিদ্যালাভ হয় না, আর এমন হলে আত্মজ্ঞান লাভ হয় না।


(৮) খলতা, হঠকারিতা, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা, অন্যের গুণ সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা, প্রদত্ত বস্তু অপহরণ করা, কঠোর ও কটুকথা বলা, আর নিষ্ঠুর আচরণ করা থেকে নিবৃত থাকতে চেষ্টা করবি।


(৯) অসৎ সংসর্গ সর্বপ্রকারে বর্জন করে চলবি। অসৎ সঙ্গ বলতে শুধু অসৎ চরিত্রের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা, আলাপ-আলোচনাই বুঝবি না। অশ্লীল পুস্তক পড়া, অশ্লীল কথা শোনা, কুরুচীপূর্ণ সঙ্গীত শোনা সব কিছুকেই অসৎসঙ্গ বলে বুঝবি।


(১০) মনে রাখিস–জরা সৌন্দর্য নাশ করে, মৃত্যু প্রাণ নাশ করে, ঈর্ষা-দ্বেষ ধর্মাচরণ নাশ করে, ক্রোধ সম্পত্তি নাশ করে, অসাধু ও অশিষ্ট লোকের সেবা শীল নাশ করে, কাম লজ্জানাশ করে আর অভিমান সবকিছুই নাশ করে।


(১১) এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই–এমন শুধু চাই-চাই করবি না। অতি অল্পতেই সন্তুষ্ট হতে চেষ্টা করবি। তোদের কল্পিত অভাব যেন তোদের সর্বনাশ ডেকে না আনে–এদিকটা খেয়াল রাখবি।


(১২) যখন যে অবস্থাতেই থাকিস না কেন, দুঃখজনক মানসিক সন্তাপ পরিত্যাগ করে সন্তোষ অবলম্বন করতে চেষ্টা করবি।


(১৩) কখনও সন্তাপ করবি না। সন্তাপ থেকে রূপ নষ্ট হয়, সন্তাপ থেকে শক্তি নষ্ট হয়; সন্তাপ থেকে জ্ঞান নষ্ট হয়, আর সন্তাপ থেকে ব্যাধি উৎপন্ন হয়।


(১৪) প্রতিদিন রাতে শোবার আগে তোর সারাদিনের কাজের হিসেব-নিকেশ করবি অর্থাৎ ভালো কাজ কী কী করেছিস, আর মন্দ কাজ কী কী করেছিস? যে-সব কাজ মন্দ বলে মনে হবে সে-সব কাজ আর যাতে না করতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি। সূর্য উঠলে যেমন আঁধার পালিয়ে যায়, গৃহস্থের ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চোর পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি বারবার বিচার করলে মন্দ কাজ করবার প্রবৃত্তি পালিয়ে যাবেই।


(১৫) নিষ্কাম নিরলস কর্মীই যথার্থ সন্ন্যাসী। অলসতার বশবর্তী হয়ে কর্ম পরিত্যাগ করাকে সন্ন্যাস বলা যায় না।


তাই বলছি, শোন্ তোরা-কর্মত্যাগ করলে তোদের কখনও সিদ্ধিলাভ হবে না। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে না। মনে রাখিস–কর্মানুষ্ঠানের প্রধান উপায় গৃহাশ্রম অবলম্বন করা। গৃহাশ্রম সত্যিই অতি পবিত্র আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ।


ওরে তোরা শোন–তোদের সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে হবে না। তোরা যদি গৃহাশ্রম অবলম্বন করে নানা পুণ্য অনুষ্ঠান করিস, তাহলেই তোদের যথার্থ তপোনুষ্ঠান করা হবে। প্রতিদিন যথা নিয়মে দেব-দেবীর পূজার্চনা, পিতৃতর্পণ, ঈশ্বর উপাসনা আর দীক্ষা গুরুর সেবা ও আদেশ পালন করা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু তোরা যদি গৃহাম অবলম্বন করে সেসব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারিস, তাহলেই তোদের সিদ্ধিলাভ হবে। শোন, দেবতারা এইসব তপোনুষ্ঠান করেই পরম ঐশ্বর্য পেয়েছেন।


শোন–সকল আশ্রমের মধ্যে গৃহাশ্রমকেই আমি শ্রেষ্ঠ মনে করি। কেন জানিস? অন্য অন্য আশ্রমে, সে ব্রহ্মচর্যাশ্রম কিংবা বাণপ্রস্থাশ্রম অথবা সন্ন্যাসাশ্রমই হোক না কেন, শুধু স্বর্গলাভ হয়। একমাত্র গৃহাশ্রমে কাম ও স্বর্গ দুই-ই লাভ হয়ে থাকে।


যে লোক অহংকার ও মমতা ত্যাগ করতে পারে, সেই লোকই যথার্থ ত্যাগী। শুধু গৃহত্যাগ করলে ত্যাগী হওয়া যায় না। যে লোক গৃহাশ্রমে থেকে শম-দম-ধৈর্য-সত্য, শৌচ, সরলতা, যজ্ঞ, ধর্মাদিকর্ম আর দেবতা-অতিথি-পিতৃগণের অর্চনা অনায়াসে সম্পাদন করতে পারে, সেই লোক ধর্ম-অর্থ-কাম–এই ত্রিবর্গ ফল লাভ করতে পারবে।


শোন–গৃহাশ্রম হল কেল্লা। যখন যুদ্ধই করতে হবে, তখন কেল্লা থেকে যুদ্ধ করাই ভালো। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, ক্ষুধা-তৃষ্ণার সঙ্গে যুদ্ধ গৃহে থেকে করাই ভালো। আবার এই কলিকালে তোদের অন্নগত প্রাণ, হয়তো কোনোদিন খেতেই পেলি না, তখন বনে বাস করে ঈশ্বর-টিশ্বর সব ঘুচে যাবে। জনক ঋষি, মহর্ষি বেদব্যাস, মহর্ষি বশিষ্ঠ গৃহাশ্রম ত্যাগ করেননি।


(১৬) যে ব্যক্তি অহংকার ও মমতা পরিত্যাগ করতে পারে, সেই যথার্থ ত্যাগশীল। শুধু গৃহত্যাগ করলেই ত্যাগশীল হওয়া যায় না। অতিমান, অতিবাদ, অতি অপরাধ, ক্রোধ, আত্মম্ভরিতা আর মিত্রদ্রোহ–এই ছয়টি দোষ তীক্ষ্ণ বাণস্বরূপ হয়ে মানুষের আয়ু কর্তন করে ও প্রাণ হরণ করে।


মনে রাখিস–যতক্ষণ তোর অহংভাব থাকবে, ততক্ষণই তুই মূর্খ ও বদ্ধ। গুরুকৃপায় যখন তোর ওই অহংভাব ক্ষয় হবে তখন তোর চিত্তশুদ্ধি ঘটবে। চিত্তশুদ্ধি ঘটলেই তোর আত্মতত্ত্ব বোধ হবে। আর তখনই হবি জ্ঞানী ও মুক্ত। শোন–যিনি বাক্য, মন, ক্রোধ, প্রতিচিকীর্ষা (প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা), উদর ও উপস্থের বেগ সহ্য করতে পারেন, আমি তাকে যথার্থ ব্রাহ্মণ ও সাধু মনে করি।


বাচালের মতো অকারণ কথা বলার চেয়ে বা সংযমী হওয়া, মৌনী হয়ে থাকার চেয়ে শুধু সত্য কথা বলা, আর সত্য কথার বলার চেয়ে ধর্ম বিষয়ে সত্য কথা বলা শ্রেয়। আবার ওই ধর্মবিষয়ে সত্যবাক্য যদি লোকের প্রিয় হয়, তার চেয়ে শ্রেয় আর কিছুই নেই।


শোন–অশ্রদ্ধার চেয়ে গুরুতর পাপ, আর শ্রদ্ধার চেয়ে পাপ নাশের প্রধান উপায় আর কিছুই নেই। শ্রদ্ধাবান হতে চেষ্টা করবি, তাহলেই ধর্মলাভ করতে পারবি।


(১৭) দেখ–যেখানে ত্যাগ নেই, আছে মোহ ও আসক্তি, সেখানেই যত দুঃখ, দৈন্য ও অশান্তি। মনে রাখিস–চিন্তা ত্যাগ করাই দুঃখ নিবারণের মহৌষধ। দুঃখ চিন্তা করলে কখনও দুঃখ দূর হয় না, তা ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলে। জ্ঞানের দ্বারা মানসিক দুঃখ আর ওষুধের দ্বারা শারীরিক দুঃখ দূর করতে হয়।


কখনও কুতর্ক করবি না। কুতর্কে হৃদয় শুষ্ক হয়ে যায়। আর বুদ্ধি বিচলিত হয়। তর্ক করে কখনও ব্রহ্মকে/ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায় না। ব্রহ্ম-ঈশ্বর মানুষের বুদ্ধির অতীত বস্তু।


শোন–উপাসনা হল ভক্তিমার্গের সাধনা, শ্রবণ-মননাদি হল জ্ঞানমার্গের সাধনা, আর প্রাণায়ামাদি হল যোগমার্গের সাধনা। কিন্তু ত্যাগ হল সকল মার্গের সাধনা। ত্যাগ ছাড়া জ্ঞান-ভক্তি-যোগ-কর্ম কোনো মার্গেই সিদ্ধিলাভ হয় না। কেননা ত্যাগই হল সকল সাধনার মূল।


(১৮) শোন তোরা–রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়বি, আমায় স্মরণ করিস। আমিই সকল বিপদ-আপদ থেকে তোদের রক্ষা করব। জানিস জীবের কল্যাণে আমার অর্জিত বিভূতিগুলি আমার অলক্ষিতে প্রকাশিত হয়। তাই আমার কাছ থেকে ধর্মার্থী পাচ্ছে ধর্ম, জ্ঞানার্থী পাচ্ছে জ্ঞান, কর্মার্থী পাচ্ছে কর্ম, ধনার্থী পাচ্ছে ধনসম্পদ, ক্ষুধার্ত পাচ্ছে অন্ন, নিরাশ্রয় পাচ্ছে আশ্রয় আর ব্যাধিগ্রস্থ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাচ্ছে।


(১৯) শোন তোরা–আমি শতাধিক বছর ধরে বহু পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে বড়ো একটা সম্পদ রোজগার করে এনেছি। তোরা সকলে এখন ওই সম্পদ বসে বসে খাবি। শোন তোরা–আমার দয়া ছড়ানো রয়েছে, কুড়িয়ে নিতে পারলেই হলো। তোরা আর দেরি না করে তা কুড়িয়ে নে।


শোন তোরা–আমি তোদের জন্য ভবের বাজারে অক্ষয় দোকান খুলেছি। তোরা যে যেখানে আছিস, আর দেরি না করে ছুটে আয়। যার যত খুশি নিয়ে যা।


(২০) শোন তোরা–আমি এখানে উপদেশ দিতে আসিনি। আমি এসেছি আদেশ করতে। আমার উপরে আদেশকর্তা আর কে আছে রে?


এতকাল কতশত রুগী পেলাম, এখনও পাচ্ছি, আর পরেও পাব। কিন্তু কই ভবরুগীর দেখা তো পেলাম না। আমি কি শুধুই ধন্বন্তরি? শোন তোরা–আমায় সারাদিন এত কাছে পেয়েও কেউ চিনলো না। তোরা সব আমাকে মানুষ ভেবেই মাটি করে ফেললি।


শোন–আমি ধরা দিই বলেই না তোরা ধরতে পারিস। নইলে কার বাপের সাধ্যি যে আমার কাছে ঘেঁসে?


শোন তোরা–উত্তরায়ণে দিনের বেলায় যখন নির্মল আকাশে কিরণ দেবে, তখনই আমি সূর্যরশ্মি অবলম্বন করে ব্রহ্মলোকে চলে যাব। প্রলয়কাল পর্যন্ত সেখানে থেকে প্রলয়ের সময় ব্রহ্মেতে লীণ হব।


শোন–এ দেহটা যেন একটা পাখির খাঁচা। ওরা সব আমায় মানুষ ভাবে। আমার ভুল হয়ে যায়। এ দেহটা যে আছে তা স্মরণে থাকে না।


শোন তোরা–খাঁচা ছাড়লেই কি আমি হারিয়ে যাব? আমি নিত্য, আমার মৃত্যু নেই, বিনাশ নেই, পরিবর্তন নেই, আমার শ্রাদ্ধও নেই।


খাঁচা ছাড়ার পরেও ঠিক এমনি করেই আমি তোদের মধ্যে থাকব। ঠিক এমনি করেই সাড়া দেবো তোদের আকুল ডাকে। খাঁচাটা যে বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। এ খাঁচা গেলেই বা কি? আমি তো আছি। আমি আছি সর্বভূতে, সব কিছুতে। আমার বিনাশ কোথায় বল্?


দেখ–আজকাল প্রায়ই যখন দেহ থেকে আগা হয়ে যাই তখন আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না। এরপর আমি কোন্ দেহ আশ্রয় করব, তা ভাবছি।


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন পূর্ণব্রহ্ম। ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মলোকে অবস্থান করেও সর্বলোকেই যাতায়াত করতে পারেন। বাবা লোকনাথ উক্রমণের পরেও ব্রহ্মলোক থেকে সূক্ষ্মদেহে সর্বত্র বিচরণ করেন এবং তার ভক্তদের রক্ষা করেন এবং জীবন্মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে প্রবুদ্ধ করেন। ভক্তদের কাজ কেবল তাঁর অমূল্য উপদেশামৃত পান করে এগিয়ে চলা। তাঁর কথিত অক্ষয় ভাবের বাজার থেকে বাবা ডেকে একটু শুদ্ধভক্তির বিনিময়ে জীবন্মুক্তির অমূল্য সম্পদ কুড়িয়ে নিতে বাবার ভক্তরা এগিয়ে আসুন।


ওঁ

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

বৈদিক বিবাহে সিঁদুর দান

'বিবাহ' শব্দটি 'বি' উপসর্গপূর্বক 'বহ প্রাপণে' ধাতুতে 'ঘঅ্' প্রত্যয় যোগ করে গঠিত এবং 'উদ' উপসর্গ হতে...

Post Top Ad

ধন্যবাদ