পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘অবিদ্যাস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃ ক্লেশাঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩)
অর্থাৎ : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম..এই পঞ্চক্লেশ যে বৃত্তিগুলির মধ্যে থাকে, তাদেরকেই বলা হয় ক্লিষ্টবৃত্তি। ক্লেশগুলি দুঃখদায়ক। এবং যোগমতে সব ক্লেশের মূলেই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা বর্তমান(পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)।
#পাঁচ প্রকার ক্লেশ অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশঃ-
অবিদ্যাঃ অনিত্য বস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুদ্ধিতে শুচি জ্ঞান, দুঃখে সুখ জ্ঞান, অনাত্মায় (জড় পদার্থে) আত্মজ্ঞান কে অবিদ্যা বলা হয়; অর্থাৎ যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা।‘অবিদ্যা ক্ষেত্রমুক্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারানাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)
অবিদ্যা নিজে ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশের প্রসবভূমি। অর্থাৎ : অবিদ্যা থেকেই অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ উৎপন্ন হয়। এগুলি সকল সময় একভাবে থেকে কখনো প্রসুপ্ত, কখনো সূক্ষ্ম, কখনো বিচ্ছিন্ন এবং কখনো বা উদারভাবে চিত্তে বিরাজিত থাকে।
অস্মিতাঃ পুরুষ চেতন ভোক্তা আর বুদ্ধি অচেতন ভোগ্য এই উভয়ের অভেদ জ্ঞান কে অস্মিতা ক্লেশ বলা হয়। ‘দৃক্দর্শনশক্তিঃ একাত্মতৈব অস্মিতা।’- (যোগসূত্র : ২/৬)
অর্থাৎ : দৃক্শক্তি ও দর্শনশক্তি অভেদ নয়, তবু অভেদ বা একাত্মতার জ্ঞানই হলো অস্মিতা।পুরুষ বা আত্মা দৃক্শক্তি, বুদ্ধি দর্শনশক্তি। সুতরাং আত্মাকে বুদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করাই হলো অস্মিতা। অস্মিতা ক্লেশের ফলে প্রকৃতির গুণবশত যা ঘটে, অহঙ্কারের বশে নিঃসঙ্গ ও উদাসীন পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
রাগঃ সুখ বা সুখের উপায়ে আসক্তি বা কামনাকে রাগ বলা হয়।
রাগের ব্যাখ্যায় যোগসূত্রে বলা হয়-
‘সুখানুশয়ী রাগঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৭) অর্থাৎ : সুখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো রাগ। পূর্বানুভূত সুখস্মৃতি অনুসারে সেইরূপ সুখভোগের পুনরেচ্ছাই রাগ। নির্লিপ্ত আত্মাকে অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের প্রতি আরোপ করে ইন্দ্রিয়সুখকেই আত্মার সুখ মনে করে লুব্ধ হওয়া এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া হলো রাগ। অস্মিতা থেকে উৎপন্ন হয় রাগ ক্লেশ। রাগকে তৃষ্ণাও বলা হয়।
দ্বেষঃ দুখঃ বা দুঃখের করাণে যে ক্রোধ হয় তাকে দ্বেষ বলে, অজ্ঞানতাই দুঃখের কারণ।
‘দুঃখানুশয়ী দ্বেষঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৮)
অর্থাৎ : দুঃখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো দ্বেষ। অনুভূত দুঃখ স্মরণপূর্বক পুনর্বার আর তা ভোগ করতে হয়, এরূপ বীতরাগের সাথে তা নিবারণের যে আন্তরিক চেষ্টা, তারই নাম দ্বেষ। দ্বেষ হলো দুঃখের সাধনগুলির প্রতি প্রতিঘাত ও হননের ইচ্ছা এবং ক্রোধের অনুভূতি। এখানেও রাগের মতো অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার ভ্রান্ত একীকরণ এবং অকর্তা আত্মাকে কর্তাজ্ঞান করার জন্য এই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
অভিনিবেশঃ পূর্ব পূর্ব জন্মের মরণদুঃখ অনুভব করে বিজ্ঞ বা অজ্ঞ লোকের যে মৃত্যুভয় হয় তাকেই বলা হয় অভিনিবেশ। পঞ্চম ক্লেশ অভিনিবেশ হলো একপ্রকার সহজাত ক্লেশ। অভিনিবেশ অর্থ মৃত্যুভয়। যোগসূত্রে অভিনিবেশের পরিচয় দিতে গিয়ে
যোগসূত্রকার বলেন-‘স্বরসবাহী বিদুষোহপি তথারূঢ়ো অভিনিবেশঃ।’- (যোগসূত্র : ২/৯)
অর্থাৎ : অবিদ্বানের ন্যায় বিদ্বানেরও যে সহজাত ও প্রসিদ্ধক্লেশ, তাই অভিনিবেশ।
মরণের প্রতি আমাদের যে ভীতি তাকেই বলে অভিনিবেশ। চিত্তে দ্বেষ বদ্ধমূল থাকায় অভিনিবেশ নামক পঞ্চম ক্লেশ উৎপন্ন হয়। জগতে সকল প্রকার দুঃখের মধ্যে মৃত্যু-ভীতিজনক যে দুঃখ, তা-ই সব থেকে তীব্র। বার বার মরণদুঃখ ভোগ করায় চিত্তে একপ্রকার সংস্কার বা বাসনা বদ্ধমূল হয়। ঐ সংস্কারকে বলে স্বরস। এই স্বরসের জন্য জ্ঞানী ও অ-জ্ঞানী সকলেরই মরণের প্রতি একটি ভীতি জন্মায়। এই ভীতিহেতু মরণের প্রতি যে বিতৃষ্ণা-বৃত্তির উদয় হয়, তাকেই অভিনিবেশ বলে। বস্তুত জীবের ‘মরণ-অভিজ্ঞতা’ জীবনকালে হয় না। কিন্তু যোগমতে, জন্মান্তরের মরণ-অভিজ্ঞতার সংস্কার জীবের চিত্তে থাকে বলেই মরণ-দুঃখের প্রতি অভিনিবেশ ক্লেশ থাকে।
যোগশাস্ত্র মতে, এই অস্মিতাদি পঞ্চক্লেশের চারটি অবস্থা- প্রসুপ্ত, তনু, বিচ্ছিন্ন ও উদর।
যখন ক্লেশ বীজ বা শক্তিরূপে চিত্তে অবস্থান, আলম্বন বা বিষয় পেলেই পুনরায় উজ্জীবিত হয়, তাকে বলে ক্লেশের প্রসুপ্ত অবস্থা। বিদেহলয় ও প্রকৃতিলয় যোগীদের চিত্তে যে ক্লেশ থাকে, তা বীজের মধ্যে বৃক্ষশক্তি যেভাবে প্রসুপ্ত থাকে সেইভাবে প্রসুপ্ত থাকে। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের উদ্গম হয়, তেমনি প্রসুপ্ত ক্লেশ নিজে নিজে বিষয় লাভ করলে পুনরায় অভিব্যক্ত হয়। পাতঞ্জলসূত্রে এভাবে বলা হয়েছে-
‘দ্রষ্টৃদৃশ্যয়োঃ সংযোগোহেয়হেতুঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-২/১৭)
অর্থাৎ : আত্মার সাথে বুদ্ধির সংযোগই দুঃখের কারণ (পাতঞ্জল-২/১৭)।
যখন ক্লেশ ক্রিয়াযোগের দ্বারা ক্ষীণ হয়, তখন তা সংস্কাররূপে চিত্তে অবস্থান করে, তাকে বলে ক্লেশের ‘তনু’ অবস্থা। দগ্ধ বীজের যেমন কোন শক্তি থাকে না, তেমনি তনুক্লেশেরও কোন শক্তি থাকে না।
আবার অন্য ক্লেশের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলে অন্তরালে যে ক্লেশ থাকে, তাকে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ক্লেশ। আর ব্যাপারযুক্ত ক্লেশ অর্থাৎ যে ক্লেশ পরিপূর্ণ অবস্থায় থাকে, বলা হয় উদার ক্লেশ। যেমন ক্রোধের সময় দ্বেষ উদার হয় এবং রাগ বিচ্ছিন্ন হয়। আবার রাগ তনু হয়ে যায় যদি বৈরাগ্য অভ্যাস করা হয়। যতক্ষণ সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কাররূপ সকল ক্লেশই প্রসুপ্ত অবস্থায় থাকে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ