"শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্ৰাহ্মণশ্চৈতি শূদ্ৰতাম্ ।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবস্তু বিদ্যাৎ বৈশ্যাওথৈব চ।।"
অর্থাৎ শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়, ব্রাহ্মণ শূদ্র হয়। ক্ষত্রিয় থেকে বৈশ্য এবং বৈশ্য থেকেও শূদ্র হয়।
"য়স্ত শূদ্রো দমে সত্যে ধর্ম্মে চ মততোখিতাঃ ।
তং ব্রাহ্মণমহং মন্যে বৃত্তেণ হি ভবদ্ দ্বিজঃ।।"
অর্থাৎ - যে শূদ্র দম, সত্য ও ধর্মে সর্বদা উন্নতি করে তাকে আমি ব্রাহ্মণ মানি কেননা আচার থেকে দ্বিজ হয়।
জন্ম থেকে সকলেই শূদ্র, সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিজ-আখ্যা লাভ করে,বেদপাঠীকে বিপ্র এবং ব্রহ্মকে যে জানে তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়।
হরিচাঁদ জন্ম ১১ মার্চ ১৮১২
ওড়াকান্দি ইউনিয়ন, কাশিয়ানী উপজেলা, গোপালগঞ্জ জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি , ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যুঃ৫ মার্চ ১৮৭৮ (বয়স ৬৫)
অবিভক্ত বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার অন্তর্গত ওড়াকাঁন্দির পার্শ্ববর্তী সাফলাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মাতা-পিতার নাম অন্নপূর্ণা বৈরাগী ও যশোমন্ত বৈরাগী। তার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে হয়নি, কিন্তু প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন। বৈষ্ণব বাড়িতে জন্ম হওয়ার কারণে শাস্ত্র আলোচনার মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করার সুযোগে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি।তার প্রচলিত সাধন পদ্ধতিকে বলা হতো মতুয়াবাদ। তার দুই ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর ও উমাচরণ।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের পিতা শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর মতুয়া ধর্মের উন্নতিসাধন, শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন। হরিচাঁদের জীবনী নিয়ে কবি রসরাজ তারক চন্দ্র সরকার শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। [ বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।]
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ কলি যুগের শ্রীবিষ্ণু'র একজন বিশেষ অবতার যা তার অনুসারিরা(ভক্তরা) সকলে বিশ্বাস করেন এবং তাকে বলা হয় পতিতপাবন।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথীতে ঠাকুর বাড়িতে মহাবারুনি স্নান ও মতুয়া মহামেলা হয়। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ি ও মতুয়া ধাম বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মতুয়া ধাম ঠাকুরনগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। প্রতিবছর চৈত্র মাসে মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ও তার কনিষ্ঠপুত্র শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শে মতুয়া ধামে মতুয়া মহামেলা বসে।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতে শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরকে #পূর্ণব্রহ্ম বলা হয়েছে কী?
চৈতন্য চরিতামৃত অনুযায়ী অবতার পডুন👉 link
ব্রহ্ম আসলে কি দেখাযাক ঃ-ব্রহ্ম বা ব্রহ্মন্ বলতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণাকে বোঝায়। এর অর্থ হল সৃষ্টির বস্তুগত, গুণগত, প্রামাণ্য ও অন্তিম কারণ। ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, চিরসত্য ও পরমানন্দ যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ। পরাবিদ্যায় ব্রহ্মের সংজ্ঞা হল চরাচরে অবস্থিত যাবতীয় বিচিত্র উপাদানের ধাত্রস্বরূপ একক মহাচৈতন্য।
ব্রহ্ম নির্গুণ [নিরুপাধিক], অদ্বয়, নির্বিশেষ, নিরাকার [নিরবয়ব] অপরিণামী, স্বপ্রকাশ, সর্বভূতান্তরাত্মা, অসীম এবং সচ্চিদানন্দ। বাক্য, মন এবং বুদ্ধির অতীত ব্রহ্ম একটি অনির্বচনীয় তত্ত্ব। ব্রহ্ম বুদ্ধিগত সকল প্রমাণের অগম্য। দেশ, কাল, জাতি, গুণ, কর্ম কার্য-কারণ সম্বন্ধগত ধারণা বা বুদ্ধিগত প্রকার, ব্যাপক কোন বিধেয় বা বিধেয়ক দ্বারা সাকার বিশেষ বস্তুকে জানা যায়। ব্রহ্ম নিরাকার বলিয়া বুদ্ধিগত সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
ব্রহ্মে সজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগতভেদ নাই। অবয়বী বস্তুর ইতর বিশেষ আছে, নানা স্বগত ভেদ আছে। ব্যক্তি এবং বস্তু নানা ভেদসমন্বিত। বিষয়ী এবং বিষয় জ্ঞানবিদ্যাগত অর্থে [Epistemologically] দ্বৈতভাবযুক্ত, তত্ত্ববিদ্যাগত অর্থে [Ontologically] এই দুইয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। এই অর্থে অদ্বয় বা অদ্বৈত। আত্মা কিংবা ব্রহ্ম অজ [জন্মহীন]। ব্রহ্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠজাতীয় কিংবা, সমজাতীয় ভিন্নতর কোন সত্তা নাই। সুতরাং ব্রহ্মে সজাতীয় কিংবা বিজাতীয় ভেদ নাই। যেমন, বৃহ্মের সঙ্গে বৃক্ষের কিংবা বৃক্ষের সঙ্গে প্রাণীর সজাতীয় এবং বিজাতীয় ভেদ আছে। বৃক্ষের নিজের অবয়বের মধ্যেও স্বগত ভেদ আছে। অঙ্গ-প্রতঙ্গ, পরিণাহ, শাখা-প্রশাখা, ফুল-ফল, মূল-পাতা প্রভৃতির মধ্যে বৃক্ষের নানা প্রকার স্বগত ভেদ থাকে। ব্রহ্মের দেহ নাই। ব্রহ্ম নিরাকার এবং নির্গুণ। ব্রহ্মে কোন প্রকার ভেদ নাই।
বৃহদাণ্যক, ছান্দোগ্য প্রভৃতি উপনিষদ সমূহে ব্রহ্ম সম্পর্কে নেতি নেতি বলা হইয়াছে। মাণ্ডুক্য উপনিষদে বলা হইয়াছে, ব্রহ্ম অন্তর্মুখী ও নয়, বহির্মুখী-ও নয়, ব্রহ্ম সমস্ত জ্ঞানের অতীত।
ব্রহ্ম শব্দটি বৈদিক সংস্কৃত। বেদে প্রাপ্ত বিভিন্ন দার্শনিক ধারণার অন্যতম হল ব্রহ্ম, এবং বিভিন্ন প্রারম্ভিক উপনিষদে এর বিস্তারিত আলোচনা আছে। উপনিষদের বিভিন্ন জায়গায় একে বলা হয়েছে সচ্চিদানন্দ, এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে অব্যয়, শাশ্বত ও পরম সত্য হিসেবে। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির শব্দশূল ‘বৃহ’। ‘বৃহ’ অর্থ ‘বৃধ’- বাড়িয়া চলা, বৃহৎ হওয়া। বৃহ+মন্=ব্রহ্ম। আদ্যোদাত্ত ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ক্লীবলিঙ্গ ‘ব্রহ্মন’ শব্দ হইতে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থঃ বৃহতের চেতনা বা শক্তি। ব্রহ্ম মূলত চেতনার বিষ্ফারণ। ব্রহ্মের চেতনায় স্ফুরিত হয় বাক্। ব্রহ্ম এবং বাক্ অভিন্ন। অন্তোদাত্ত ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি পুংলিঙ্গবাচক, অর্থ-‘ব্রহ্মবিৎ’ লাতিন ‘Verbum’ শব্দটির সঙ্গে শব্দমূলের বিচারে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের সাদৃশ্য আছে। ‘Verbum’ শব্দটির ইংরেজি রূপান্তর ‘Word’, সৃজনশীল শব্দ বা Logos। যে অর্থে ‘বাক’ অথবা শব্দ হইতে সৃষ্টি সম্ভব হইয়াছে। পরব্রহ্মের জীব এবং জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের প্রতি কোন প্রকার আকর্ষণ কিংবা অনুরাগ নাই। হরিচাঁদ বাবু কি অর্থে পূর্ণব্রহ্ম পাঠকগণ বিচার করুন।
হরিচাঁদ বাবু না জন্মগ্রহণ করলে, বাংলার বিশাল অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী সনাতন ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্মে চলে যেত। তখন পূর্ব বঙ্গে বড় লাট এসে চাইলেন গরীব, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করাতে। তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর কৌশলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করালেন এবং অস্পৃশ্য বাঙ্গালিদের লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিলেন। তা না হলে পূর্ব বঙ্গের নিপীড়িত হিন্দু জনগোষ্ঠীর লেখাপড়া শেখা হত না।
সাধনা সম্পর্কে মতুয়াদের প্রতি শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ১২ টি উপদেশ আছে, যা ‘দ্বাদশ আজ্ঞা’ নামে পরিচিত। সেগুলি হলো:
১. সদা সত্য কথা বলবে
২. পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে
৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে
৪. জগৎকে ভালোবাসবে
৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে
৬. জাতিভেদ করবে না
৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে
৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে
৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে
১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না
১১. ষড়রিপু বশে রাখবে
১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, হরিচাঁদ ঠাকুর কর্মমুখী একেশ্ববাদ প্রচার করেছেন। পথভ্রষ্টদের দুহাতের সমস্ত অর্থসম্পদ ফেলে, দুবাহু উপরে তুলে ঈশ্বর ভজনার তত্ত্ব – জাতির দীর্ঘ পরাধীনতার অন্যতম কারণ। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাস্তববাদী আধ্যাত্মিক দর্শন,সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতি স্থাপনে অন্যতম দিকনির্দেশনা।
হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র মহাত্মা গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বর্ণহিন্দুরা স্কুলে ভর্তি হতে দেয় নি। প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছিল। তিনি উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিতে পরিনত হয়ে, গ্রাম বাংলায় ১৮১২ টি বিদ্যালয় স্থাপন করে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে – অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত তে একটি খণ্ড আছে যার নাম মধ্যখণ্ড, এই মধ্য খণ্ডের প্রথম তরঙ্গে একটি বিষয় আছে যার নাম "প্রভু শ্রীরামের মূর্তি ধারণ"
এখানে বলা আছে একসময় হরিচাঁদের শিষ্য হীরামন দেখলো যে হরিচাঁদ দশরথের পুত্র শ্রীরামের রূপ ধারণ করেছে, শ্রীরামের মতোই মাথায় জটা ছিল হুবহু, তা দেখে হীরামন রাম রাম বললো।
এই কাহিনী টি পড়ে যে কেউ বুঝতে পারবে যে হরিচাঁদ হলো শ্রীরামের অবতার এবং এর দ্বারা এটাও বোঝা যাচ্ছে যে হিন্দুরা যেমন শ্রীরাম কে ঈশ্বরের অবতার মনে করে ঠিক তেমনি হরিচাঁদও শ্রীরামের অবতার অর্থাৎ হরিচাঁদ ঈশ্বর বা পূর্ণব্রহ্ম।
এক মানুষ আর এক মানুষের রূপ কিভাবে ধারণ করতে পারে ? কোন বিজ্ঞান দ্বারা সম্ভব এই ছাগলামী কাহিনী ? মতুয়ারা যদি পদার্থ বিজ্ঞান কে ধর্ষণও করে ফেলে তবুও এমন হওয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বর সম্পর্কে আবাল মতুয়াদের কোনো ধারণাই নেই কাজেই এমন অবাস্তব মিথ্যা কাহিনী কে বিশ্বাস করে!
রামায়ণ পড়লে জানা যায় শ্রীরাম একজন মনুষ্য ছিলেন কিন্তু মূর্খ মতুয়াগণ শ্রীরাম কে তাদের গুরু হরিচাঁদের অবতার বানিয়ে দিয়েছে, যা হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কি ? আসুন এইবার দেখে নেওয়া যাক রামায়ণে শ্রীরামের কিরূপ গুণের মহা পুরুষ ছিলেন__
রামায়ণের শুরুতে বলা হয়েছে - এক সময় মহর্ষি নারদ কে মহর্ষি বাল্মীকি জিজ্ঞাসা করলেন যে 'এই বর্তমান সময়ে এই পৃথিবীতে এমন কোনো মহাত্মা আছেন যিনি মহাবীর, ধর্মজ্ঞ, সত্যভাষী, প্রিয়দর্শন, বিদ্বান। আমি এমন বীর পুরুষের সমন্ধে জানতে ইচ্ছা করি' তখন মহর্ষি নারদ বলতে শুরু করলেন শ্রীরামের ইতিহাস। নারদ জি বলেন 'ঈক্ষ্বাকু বংশীয়, সকলে যাকে রাম নামে জানেন, যিনি আর্য়, জিতেন্দ্রিয়, ধৈর্যশীল, মহাবলবান, সমাধিমান্, ধর্মের রক্ষক, শত্রুনাশক, বেদ- বেদঙ্গ- ধনুর্বেদের মহান জ্ঞানী, প্রিয়দর্শন, খ্যাতিমান।
(রামায়ণ, বালকাণ্ড, প্রথম সর্গের ১-১৮ শ্লোক পর্যন্ত এরূপ বিষয়ে আলোচনা আছে)
গোস্বামী গোলক চরিত (১ম অংশ)
সাহাপুর পরগণা মধ্যস্থিত নারিকেল বাড়ী গ্রাম। সেই গ্রামে সাধু কেনাই মণ্ডলের বিশাল একান্নবর্তী সংসার। পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূগণ, নাতি-নাতনি, ভাই-ভ্রাতৃবধূ তাদের পুত্র কন্যাগণ আত্মীয় পরিজন আশ্রিত অতিথি স্বজন মিলে সে এক বিরাট পরিবার। কেনাই মণ্ডল অত্যন্ত সৎ ও সাধু ব্যক্তি। তার কৃষ্ণভক্তির তুলনা নাই। হরি বলতে তার দুই নয়নে প্রেমাশ্রুর ধারা বইতে থাকে। কেনাইর চার পুত্র। জ্যেষ্ঠ অযোধ্যারাম, ধার্মিক ও হরিভক্ত, দ্বিতীয় পুত্র হরেকৃষ্ণ- সাধু শিরোমণি, তৃতীয় পুত্র সৃষ্টিধর, অনুপম রূপবান ও মহাসাধু, কনিষ্ঠ পুত্র নয়ন, তাকে দর্শন করলেও নয়ন সার্থক হয়। তিনি ধার্মিক ও অতিথি বৎসল, হরিনামে ক্লান্তিহীন। কেনাইর বংশে সকলেই হরিভক্তি পরায়ণ ও অতিথি বৎসল। অযোধ্যারামের তিন পুত্র, জ্যেষ্ঠ ঠাকুর দাস, অতীব সুন্দর ও সুলক্ষণযুক্ত। মধ্যম জয়কৃষ্ণ সর্বদা হরিনানে মত্ত হয়ে নামগান ও কীর্তনাদিতে মগ্ন থাকে, কনিষ্ঠ চন্দ্রকান্ত- সুদর্শন ও পরম ধার্মিক। হরেকৃষ্ণের দুইটি নন্দন, জ্যেষ্ঠ রামনিধি, কনিষ্ঠ বদন, বদনের হরিভক্তি বর্ণনাতীত। ঠাকুর দাসের তিন পুত্র তারা সকলেই গুণের আধার, জ্যেষ্ঠ রামকুমার, মধ্যম বংশীধর ও সর্বকনিষ্ঠ ভক্তচূড়ামণি গোলক চন্দ্র, যার হরিনামের হুংকারে মেদিনী কম্পমান হয়। জ্যেষ্ঠ রামকুমার, সংসারের কর্তা, তিনি সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় মিষ্টভাষী ও সদা হরিনাম গুণগান করেন। তিনি নৌকায় চালান দিয়ে সৎভাবে ব্যবসা করে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি করেন। বংশীধর অত্যন্ত শিষ্টাচারী ধার্মিক সত্যবাদী ও পরোপকারী, তার সৎ ও দরদী ব্যবহারে সংসারে কোথাও কোন অনাচারের চিহ্নমাত্র নাই। সংসারের সকলে তাকে মান্য করে, ভালবাসে। তিনি পরের দুঃখে কাতর তাই গ্রামের লোকেও তাকে ভালবাসে, সাধু বলে সম্ভ্রম দেখায়। সৎ সত্যবাদী বলে রাজদরবারে অর্থাৎ জমিদারের কাছারীতেও তার যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিপত্তি, তিনি এতই বিশ্বস্ত যে, অনেক সময় রাত্রেও তাকে কাছারী থেকে ডেকে পাঠায় আর তিনি নিয়ে রাত্রে কাছারিতে যান। সর্বকনিষ্ঠ মহাভাগ গোলকচন্দ্র হরিচাঁদের স্মরণ মনন ও ধ্যানে এতই মগ্ন থাকেন যে, সাধারণ মানুষ তাকে পাগল বলে আখ্যা দেয়। এইভাবে সেই ভ্রাতৃত্রয় সুখে সংসার যাত্রা নির্বাহ করে চলেছেন।
গোলকচন্দ্র কৃষিকার্যে বড়ই পারগ। হয় ত সমস্ত দিন জমিতে কৃষাণদের সঙ্গে নিয়ে চাষের কাজ দেখাশোনা করেছেন, দ্বি-প্রহরে বাড়ী গিয়ে স্নানাহার বিশ্রাম করে বিকালবেলা একা একা নির্জনে আবার তিনি এলেন জমিতে। দেখতে এলেন চাষ ঠিক মত হয়েছে কিনা, জমির কোথাও উঁচুনিচু আছে কি না। আলে বসে নিবিষ্ট ভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখে জমির যে স্থান উঁচু সে স্থান থেকে মাটি নিয়ে নিচু স্থান ভরাট করেন। তারপর যখন সেই জমি সবুজ কচি চারা ধানে ভরে ওঠে, চোখ জুড়ানো ধানের শীষে ঝলমল করে তখন পরম তৃপ্তিতে তিনি সেই দৃশ্য দেখে আনন্দ লাভ করেন। গোলকচন্দ্র এমনি স্বাস্থ্যবান ও কর্মঠ যে, যে জমির ধান কাটতে আঠারো কৃষাণ লাগে তিনি সেই জমির ধান কাটেন একা এক দিনে। এমন যে বিষয়ী ও কর্মঠ গোলকচন্দ্র তিনি কিভাবে ঠাকুর হরিচাঁদের ভক্ত হলেন আমরা এখন সেই পুণ্য কাহিনী শ্রবণ করবো।
শক্তিধর কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান গোলকচন্দ্র হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তার কণ্ঠদেশ ফুলে উঠতে লাগলো আর যন্ত্রণায় তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। শেষে এমন অবস্থা হল যে, কোন কিছু আহার বা পান করাও তার পক্ষে একেবারে অসাধ্য হড়ে পড়ল। রোগগ্রস্ত গোলকের নাসারন্ধ্রে ঘনশ্বাস বইতে লাগল। কথা বলার ক্ষমতাও তার থাকল না। তখন বাড়ীর সকলে তাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নানা ওঝা, কবিরাজ দেখিয়েও কোন ফল হল না। সেই প্রাচীনকালে গ্রাম অঞ্চলে বিশেষত পূর্ববাংলার অধিবাসীগণ চলাচলের খুবই অসুবিধা ভোগ করতেন। অসুখ বিসুখ হলে যেমন চিকিৎসকের অভাব তেমনি দুর্গম জল জঙ্গলের পথ ঘাট পেরিয়ে কবিরাজ মশাইয়ের বাড়ীতে পৌঁছান দুষ্কর ব্যাপার। যদিও বা পৌঁছান গেল সেই সব অজ্ঞ ওঝা বৈদ্যের কবলে পড়ে বহু রোগী অকালে প্রাণ হারান। যখন ওঝা বৈদ্য কোনকিছুতে গোলকের রোগ নিরাময় হল না বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হয়ে চললো তখন গোলকের সংকটপূর্ণ অবস্থা দেখে আত্মীয় স্বজন হতাশ হয়ে ভাবলেন, গোলকের বুঝি আর প্রাণের আশা নাই। পরিস্থিতি যখন এমন তখন খবর পাওয়া গেল শ্রীহরিচাঁদের একজন নিষ্ঠাবান ভক্ত রাউৎখামার গ্রামে বাস করেন, তার নাম রামচাঁদ। সাধু রামচাঁদ হরিচাঁদের কাছে যাতায়াত করেন ও তার নির্দেশ মত ব্যাধিযুক্ত লোকেরা তার কাছে এলে তিনি হরিচাঁদের দোহাই দিয়ে তাদের নিরোগ করেন। চিন্তিত গোলকের জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকুমার দশরথের কাছে গেলেন। রামকুমারের খুল্লতাত জয়কৃষ্ণ তার পুত্র সহস্রলোচন, তিনি সদানন্দময় পুরুষ, সর্বদা তার সাধু সঙ্গে মতি, তার পুত্র দশরথ, মহানন্দ। রামকুমার দশরথের নিকটে গিয়ে দুঃখ করে বলেন, বাবা দশরথ, গোলকের অবস্থা দেখে আমার মন খুব অস্থির হয়ে পড়েছে, মনে হয় গোলকের মৃত্যু নিকট। শুনেছি হরিচাঁদ ঠাকুরের পরমভক্ত রামচাঁদের অপার মহিমা, বড় বড় রোগী তার কাছে যাওয়া মাত্র তার দয়ায় মুহূর্তে রোগমুক্ত হয়। বাবা দশরথ চলো যাই আমরা গোলকের রোগ মুক্তির প্রার্থনা নিয়ে তার কাছে যাই। দশরথ আর রামকুমার আশান্বিত ও ত্বরান্বিত হয়ে রামচাঁদ ঠাকুরকে আনতে রাউৎখামার গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে বালাবাড়ীতে যাওয়া মাত্র সব কিছু শুনে সকলে বলতে লাগলেন, আপনারা কষ্ট করে আবার যাবেন কেন, এখানেই বসুন।
গিরিধারী বালা জ্বরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, আমরা রামচাঁদ ঠাকুরকে আনতে যাচ্ছি, তিনি এখানে এলে আপনারা এখানে বসেই তাকে পাবেন। বলতে বলতে সেই বাড়ী থেকে লোক গেল রামচাঁদকে আনতে এবং তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। তখন রামকুমার ভক্তিপূর্ণ ভাবে চোখের জলে ভেসে রামচাঁদের কাছে নিবেদন করলেন আমার ভাই গোলক খুবই অসুস্থ, এতক্ষণ সে বেঁচে আছে কি নেই। রোগের কথা আনুপার্বিক বলে কাতরভাবে বলেন, আমরা বড় দায় ঠেকে বড় ছুটাছুটি করে আপনার কাছে এসেছি, দয়া করে আপনি নারিকেল বাড়ী গ্রামে চলুন। রামকুমারের কাতরোক্তি শুনেও রামচাঁদ কোন কথা বললেন না। শুধুমাত্র বাবা হরিচাঁদ বলে এক ডাক ছাড়লেন। তারপর তিনি হুংকার ছেড়ে গিরিধরবালাকে ধরে হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলে ঝাড়তে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে গিরির পৃষ্ঠে সজোরে এক থাপ্পর দিলেন। অমনি উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে রোগশূন্য সুস্থ গিরিধর উঠে বসলেন। গিরিধর সুস্থ হওয়া মাত্র বিনাবাক্যে রামচাঁদ রামকুমারের গলা ঝাড়তে আরম্ভ করলেন। মুখে তার এক ঝুলি দোহাই ওড়াকান্দির বাবা হরিচাঁদ, গলা ঝাড়েন আর মাঝে মাঝে হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলে এমন ডাক ছাড়েন তাতে মনে হয় যেন উচ্চগ্রামে সিংহনাদ শোনা যাচ্ছে। দণ্ডমাত্র রামকুমারের গলা ঝেড়ে তিনি বলেন, আমি নারিকেলবাড়ী যাবো না, তোমরা গৃহে ফিরে যাও, দেখ গিয়ে গোলকের গলা ফোলা নাই। যথার্থই তারা গৃহে ফিরে এসে দেখেন রামচাঁদ যা যা বলে দিয়েছিল তাই ঘটেছে।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামী গোলোকের লীলা সম্বরণ (১ম অংশ)
এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করে শোষিত পীড়িত আর্তজনের দুঃখে দুঃখিত হয়ে তাদের দুঃখ মোচনে সদাসর্বদা রত ছিলেন তিনি। ব্যথিত পীড়িত আর্তজনের ক্রন্দনে বিগলিত হয়ে তিনি তার অমৃতময় বাণী দিয়ে তাদের রোগমুক্ত করেছেন, তাদের শান্তির পথ দেখিয়েছেন। সেই তিনি দয়াময় হরিচাঁদ কালের নিয়মে বার’শ চুরাশির মধুময় ফাল্গুন মাসে মানুষের কল্যাণের নিমিত্ত নেওয়া দায়িত্বভার তাঁর সুযোগ্যপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রতি ন্যস্ত করে স্ব-ইচ্ছায় নশ্বর নরদেহ ত্যাগ করলেন।
গোস্বামী গোলোকচন্দ্র প্রথম জীবনে ছিলেন ঘোরতর বিষয়ী। সাংসারিক কাজকর্ম বিশেষকরে কৃষিকার্য, হল কর্ষণ বীজ বপন ইত্যাদি নানাবিধ কর্মে তিনি বড়ই দক্ষ ছিলেন। হঠাৎ তিনি গলদেশে কঠিন অসুখে ভুগে মরণাপন্ন হন। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমার লোক মাধ্যমে জানতে পারলেন রাউৎখামারবাসী হরিচাঁদের ভক্ত রামচাঁদ হরিচাঁদের দোহাই দিয়ে মানুষকে ব্যাধিমুক্ত করেন। রামচাঁদ হরিচাঁদের দোহাই দিয়ে রামকুমারের গলা ঝেড়ে দিলে গৃহে বসেই গোলোক সুস্থ হন। সেই অবধি গোলোক উন্মনা হলেন, তিনি ভেবে পান না কে সে হরিচাঁদ যার নামের গুণে দূরে বসেই তিনি রোগমুক্ত হলেন। ভাবাবেগে আপ্লুত গোলোক ওড়াকান্দী গিয়ে হরিচাঁদের চরণে লুটিয়ে পড়লেন, চোখের জলে ভেসে তিনি দিব্য দর্শন লাভ করলেন। দিব্য দৃষ্টি লাভ করে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চতুর্ভুজ মূর্তিতে হরিচাঁদকে দর্শন করে সেই যে তিনি হরিচাঁদের একান্ত অনুগত ভক্ত ও সেবক হলেন, আজীবন তাই থাকলেন।
এমন যার বিষয়ে আসক্তি সেই তিনি সব তুচ্ছ জ্ঞানে ত্যাগ করে হরি হরি গৌর হরি বলে মহানন্দে পাগলামী করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। মানুষের অনাগত বিপদ তিনি দিব্য দৃষ্টি দ্বারা দেখতে পান ও পাগলামীর ছলে সেই সব বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করেন, সর্বোপরি হরিচাঁদকে তিনি প্রাণতুল্য ভালবাসেন। তাঁকে দর্শনের জন্য তিনি কেমন ব্যাকুল তার প্রমাণ আমরা শ্রী শ্রী হরি লীলামৃতে হরিচাঁদের সাথে পাগলের করণ যুদ্ধ এই নিবন্ধে দেখতে পাই। কিভাবে তিনি ভাঙ্গা নৌকা বেয়ে হরিচাঁদকে এক্ষুনি না দেখতে পেলে প্রাণে বাঁচবো না বলে আহা উহু করতে করতে ছুটে আসেন তা বর্ণনাতীত। হরিচাঁদ তার প্রাণের প্রাণ তার ইহকাল পরকাল। যাকে ঘিরে এত আনন্দ এত পাগলামী সেই তিনি ধরাধাম ত্যাগ করলে গোস্বামী গোলোক শোকে এতই মুহ্যমান হয়ে পড়লেন যে, তিনি বাক্যহারা স্তব্ধ হয়ে পড়লেন। অন্যান্য ভক্তবৃন্দ কেদে আকুল হলেও তিনি নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। হৃদয়ের দুঃসহ ব্যথায় ক্রমে তার উদরে এক ব্যথার সৃষ্টি হল। আমরা গৌরাঙ্গ প্রভুর লীলা কাহিনীতে দেখতে পাই যখন গৌরাঙ্গ প্রভু লীলা সম্বরণ করেন তখন সনাতন গোস্বামী শোকে মূক ও স্তব্ধ হয়ে পড়লেন। সকলে দুঃখে কেঁদে ভাসালেও তিনি নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। অন্যান্য ভক্তগণ তার ভাব দেখে মনে মনে ভাবেন এর নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। একদা দ্বিপ্রহরে তিনি বৃক্ষ তলে বসে লীলাগীতি পাঠ করছিলেন এমন সময় বাতাসে একটি শুষ্কপত্র তার পৃষ্ঠে পড়েই দপ্ করে জ্বলে ওঠে। তাই দেখেই ভক্তগণ অনুধাবন করলেন সনাতনের অন্তরে বিরহের অনল কিরূপ প্রজ্বলিত আছে।
গোস্বামী গোলোক তদ্রুপ বিরহ ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পাগলামী করে হৃদয়ের জালা জুড়ানোর চেষ্টায় অহরহ জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু হায়! হৃদয়ের ব্যথা তো জুড়ায় না, কোথাও তো তার প্রাণানন্দ হরিচাঁদের চন্দ্র বদনের দর্শন পান না। সেই মিষ্টি মধুর হাঁসি তো কোথাও দেখতে পান না, সেই উদাক্ত কণ্ঠে গোলোক কোথায় গেলা বাপ বলে তো কেউ ডাকে না, গোলোকের প্রাণ হুহু করে।
যখন তিনি উদরে বেদনা অনুভব করেন তখন যন্ত্রণায় ছট ফট করেন আর নিকটে যারা থাকে তাদের বলেন, আমার প্রাণবন্ধু হরিচাঁদ আমার মন-প্রাণ হরণ করে নিয়ে গেছে, আমি প্রভুর কাছে গিয়ে আমার তাপিত প্রাণ শীতল করব। বিরহানলে তার দেহ মন প্রাণ সর্বদা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে, তদুপরি উদরের বেদনায় অস্থির হয়ে পড়েন, সময় সময় বেদনা অসহ্য আকার ধারণ করতে লাগল। ফুকুরার ঈশ্বর অধিকারীর গৃহে পাগলের সর্বদা যাতায়াত ছিল। পাগলের প্রতি অধিকারীর বড় আর্তি জন্মায় এবং তিনি নিজের পরিবারসহ মতুয়া হয়ে নামে প্রেমে মত্ত হলেন। অধিকারী বংশ বড় মহৎ বংশ, তারা ওড়াকান্দীর দিকে মুখ করে করজোড়ে প্রণাম না জানিয়ে কোন কর্ম করেন না। চৈত্র মাসে একদিন পাগল অধিকারীর গৃহে আগমন করে সেইদিন সেই গৃহেই অবস্থান করলেন।
অধিকারীর গৃহিণী বড় ভক্তিমতি রমণী। তিনি পাগলকে শ্রী হরিতুল্য মান্য করেন, ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র রাইচরণ ও কন্যা দেবরাণী। স্ত্রী পুত্র নিয়ে অধিকারী হরিনামে উন্মত্ত প্রায় হলেন। প্রেমোম্মত্ত অধিকারী মুখে সর্বদা হরি হরি উচ্চারণ করেন, আর পাগলের প্রতি তাঁর এমনি আর্তি জন্মাল যে, পাগলের জন্য যেন পাগল হলেন।
হরিচাঁদের তিরোধানের পর একদিন পাগল ঠাকুরাণীর সঙ্গে নদীর ঘাটে বসে হরিচাঁদের মধুর মধুর লীলাকাহিনী আলোচনা করত লাগলেন আর মাঝে মাঝেই উচ্চৈঃস্বরে হরি হরি বলতে লাগলেন। তিনি বলেন, মাগো একেক সময় মনে হয় এই ঘাটেই যেন লয় হয়ে যাই। অন্য একদিন অধিকারীর সঙ্গে নদীর তীরে সেই ঘাটে বসে হরি বিরহে ব্যাকুল পাগল বলেন, আমার মনের ইচ্ছা এই ঘাটে এই দেহ লয় করে দেই, এখন মা গঙ্গার কি ইচ্ছা কি জানে। তিনি বলেন, আর এ দেশে মন টেকে না, আমার প্রাণারাম হরিচন্দ্রের কাছে চলে যাব আমি। সময় সময় উদরে এমন বেদনা অনুভব হয় যে, সহ্য করা যায় না, মনে হয় তখনি প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। ঈশ্বর অধিকারীর সঙ্গে এইসব আলোচনা করে সেই রাত্রি তিনি হরি হরি বলে সেই গৃহে অতিবাহিত করলেন। পর দিন নারিকেল বাড়ীতে নিজ গৃহে ফিরে সকলকে বলেন, আমি পশ্চিমে যাবো বলে মনস্থ করেছি, নবগঙ্গা নদী আমাকে বড় আকর্ষণ করে চলেছে, এবার গেলে আর ফিরে আসি কিনা ঠিক নাই। এইরূপ ভাবে মধুমতী নদীর পূর্ব পাড়ে যারা তাকে ভালোবাসে সকলার নিকটে প্রকারান্তরে বিদায় নিলেন। বৈশাখ মাসের সাত তারিখে তিনি ফুকুরা এসে ঈশ্বরচন্দ্র অধিকারীর গৃহে উপস্থিত হলেন। অধিকারী গৃহে ছিলেন না, তার গৃহিণীও পাগলকে অত্যন্ত ভক্তি করেন, তিনি সযত্নে তাকে গৃহে ঠাই দিয়ে পুত্র কন্যা নিয়ে তার সেবা শুশ্রুষা করতে লাগলেন। সেই রজনী পাগল সেই গৃহেই তাদের সকলকে নিয়ে হরি হরি বলে অতিবাহিত করলেন।
এদিকে কবি রসরাজ তারক চন্দ্র সদলবলে তাড়াইল বাজারে কবিগান করতে গেছেন। গোলোক মাঝির বাড়ীতে ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থেকে তার দলবল নিয়ে বাজারে গান করেন। সেদিন সকালের দিকে একটু বেলায় তারক উত্তরের ঘরে বসে গুণগুণ হরিগুণ গান করছেন আর অশ্রু সজল নয়নে ওড়াকান্দীর কথা হরিচাঁদের কথা চিন্তা করে চলেছেন।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামী গোলক চরিত (২য় অংশ)
গোলকের গলাফোলা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে। কোনরকম উপসর্গ কিছুই অবশিষ্ট নাই। এমন অসম্ভব ঘটনা দেখে শুনে সেই বিশাল বাড়ীতে ও গ্রামে আলোড়নের সৃষ্টি হল, সকলের মুখেই গোলকের অলৌকিক ভাবে সুস্থ হওয়ার ঘটনা আলোচিত হতে লাগল। এও কি সম্ভব! দূরে বসে শুধুমাত্র তার নাম করে অন্যের গলা ঝেড়ে কেমন করে রোগ আরোগ্য হয়। শয্যাশায়ী মৃত্যুপথযাত্রী গোলক এমন অভাবিতভাবে আরোগ্য হয়ে তারও মনের গতি সম্পূর্ণ অন্যপথে ধাবিত হোল। আগে তিনি নির্জন ধান্যক্ষেত্রের আলে বসে খুটিয়ে জমি দেখতেন কিংবা শষ্য চারায় ভরভরন্ত কৃষিক্ষেত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতেন। আর এখন সেই তিনি নির্জন কৃষিজমির আলে বসে মগ্ন হয়ে চিন্তা করেন, কে সে হরিচাঁদ যার দোহাই দিলে মুহূর্তে কালব্যাধি পালাতে পথ পায় না। গোলক ব্যাকুল হয়ে চিন্তা করেন, আমি সেই বিপদত্তারণ হরিচাঁদকে দর্শন করে ধন্য হবো। তখন একদিন ভাবোন্মত্ত গোলক হরি হরি বলে ওড়াকান্দি হরি দর্শনে যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে গোলক ভাবেন, আমি তো মরেই যেতাম যদি না ওড়াকান্দির বাবা হরিচাঁদ আমাকে দয়া করতেন। যে কাল ব্যাধি আমার জীবন নাশ করতে উদ্যত হয়েছিল, বহুদূর থেকে শুধুমাত্র হরিচাঁদের দোহাই শুনে সে সভয়ে পলায়ন করেছে, হরিচাঁদ সে কি স্বয়ং ভগবান? হরিচাঁদ হরিচাঁদ এই নাম সর্বদা গোলকের হৃদয়ে আলোড়িত হতে লাগল। চলতে চলতে গোলক ভাবেন, কই এতদিন তো এই সুধাভরা নাম কখনো শুনি নাই। বিষয়ে ঘোর আসক্ত হয়ে কেবল ধান্য ক্ষেত্রের পারিপাট্ট ধান লাগানো, ধান কাটা আরো কত বিষয় কর্মে লিপ্ত হয়ে কাল হরণ করেছি। কই বাবা হরিচাদ তোমাকে কখন স্মরণ করি নাই।
হরিচাঁদ নামে দুর্নিবার টনে ভাবোন্মত্ত গোলক ওড়াকান্দি ধামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। গিয়ে দেখেন, ভুবনমোহন রূপ নিয়ে ছিন্ন কন্থা গলায় দিয়ে কাঙাল বেশে দয়াল প্রভু বসে আছেন। দর্শন মাত্র গোস্বামী গোলক হরিচাঁদের শ্রীচরণে লুটিয়ে পড়লেন। যেন কতদিনের চেনাশোনা আপন জন সেইভাবে হরিচাঁদ হেসে বলেন, এতদিন কেন আসিস নাই, রোগে-ভুগে কত কষ্ট পেলি বল তো। হরিচাঁদ বলেন, যদি এতদিন পর এসেছিস তবে আর কোন ভয় নাই, যা বাড়ী ফিরে যা।
ঠাকুর হরিচাঁদের এই কথা শুনে গোলক গোস্বামী মুখ তুলে অনিমেষ নেত্রে প্রভুকে দর্শন করতে লাগলেন। মুনি ঋষিগণ বহু সাধনায় ধ্যান যোগে যে রূপ দর্শন করেন মহাভাগ গোলক দৃষ্টি মাত্রে সেই রূপের দর্শন পেলেন। জন্ম জন্মান্তরের সাধনায় গোলক দেখলেন শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী, পীতাম্বর পরিধানে মুকুন্দ মুরারি শ্রীহরি ত্রিভুবন আলোকিত করে বসে আছেন। সেই ভুবনমোহন রূপ দর্শন করে ছিন্ন পত্রের ন্যায় গোলক আবার হরিচাঁদের চরণ প্রান্তে লুটিয়ে পড়লেন। নয়ন জলে ভেসে রোদন রুদ্ধস্বরে বলতে লাগলেন, আর ত আমি গৃহে ফিরে যাবো না। আমি কার বাড়ী যাবো, হে প্রভু? কিসের ঘর কিসের সংসার, এই অসার সংসারে তুমি আমাকে আর ফিরে যেতে বলো না। তখন মধুর হেসে হরিচাঁদ বলেন, বাছাধন আমার, ঘরে যাও চিরদিন আমাকে ভেবে আমার হয়ে থাকো। এতদিন সংসারে আবদ্ধ হয়ে ছিলি এখন সংসারে থাকিস কিন্তু সংসারী হোসনে। চোখের জলে ভেসে গোলক বলেন, হরি হে, এতদিনে তোমাকে চিনেছি। হে হরি, আমি তোমার চরণে বিক্রিত হলাম। হে প্রভু, আমি তোমার দাস হয়ে থাকতে চাই। হরিচাঁদ হেসে বলেন, বেশ তো তুই নিজেকে বিকিয়েছিস আমিও তোকে পেয়েছি, এখন বাছাধন আমার কথায় গৃহে ফিরে গৃহকার্য কর গিয়ে। কিন্তু মনটি রেখ আমার প্রতি। আমিও তোমার টানে মাঝে মাঝে তোমার গৃহে যাবো। এই কথা শুনে গোলক শান্ত হয়ে গৃহে গমন করলেন।
যখন তার মন ঠাকুরকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তখনি সব কিছু ফেলে ছুটে যান ওড়াকান্দি। তার প্রাণারাম হরিচাঁদের চরণ সেবা করে কিছুদিন ওড়াকান্দি ধামে শান্তিতে অবস্থানের পর প্রাণ শীতল করে আবার গৃহে ফিরে গৃহকার্য করেন। মাসান্তর পক্ষান্তর কখনো বা সপ্তাহান্তর পরেই আবার ছুটে যান হরিচাঁদকে দর্শন করতে। ঠাকুর হরিচাঁদের প্রতি তার একান্ত আত্মসমর্পণ ও প্রেমভাব দেখে শ্রীহরিচাঁদ মাঝে মাঝে তার গৃহে যাওয়া আসা করেন। ভ্রমে গোলকের ভ্রাতুষ্পুত্র দশরথ, মহানন্দ তারাও হরিচাঁদের নামে প্রেমে মত্ত হলেন। সেই সব দেখে শুনে গ্রামবাসীগণও হরিচাঁদের ভাবধারায় প্রমত্ত হলেন, তখন নারিকেলবাড়ী গ্রাম বর্ষার জল ধারার ন্যায় হরিনাম প্রবাহে রসস্থ ও নিমগ্ন হয়ে পড়ল।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
ঋমণীদেবীকে গোলকের দর্শনদান
গোস্বামী গোলক ঊনত্রিশে বৈশাখ লীলাসাঙ্গ করলেন। জ্যৈষ্ঠমাসের প্রথম দিনে তারক তাঁর আত্মার ঊর্দ্ধগতি মানসে মতুয়া ভক্তগণ নিয়ে মহোৎসব করলেন। বাসুড়িয়া গ্রামের দশরথ বহুদিন হয় মতুয়া মত গ্রহণ করে হরিচাঁদের ভক্ত হয়েছেন। স্বপরিবারে তিনি গোস্বামী গোলোকের বড় প্রিয় ভক্ত। গোস্বামী গোলোক মাঝে মাঝেই তার গৃহে গিয়ে পাগলামী করতেন। দশরথের বাড়ীর দক্ষিণ দিকের পালানে বড় সুন্দর বেগুনের ক্ষেত করেছেন তিনি। জ্যৈষ্ঠ মাসেও ক্ষেতে যথেষ্ট বেগুন ফলে আছে। দশরথের স্ত্রী ঋমণী দেবীর ক’দিন থেকেই পাগলের জন্য বড় মন কেমন করছে। গোঁসাইয়ের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, বড়ই কৃশ হয়ে পড়েছেন তিনি। ঋমণী ভাবেন, কতদিন হয় বাবা আসেনও না, কেমন আছে কে জানে? জ্যৈষ্ঠমাসের দুই তারিখে তিনি সকালের দিকে একটু বেলায় বেগুন ক্ষেতে বেগুন তুলতে গিয়েছেন। বেগুন তুলছেন আর পাগলের কথা চিন্তা করে চলেছেন, কতদিন পাগলকে দেখি না, তার প্রাণটা পাগলকে দেখার জন্য বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। যাই হোক দেবী ঋমণী বেগুন তুলছেন আর গুণগুণ হরিগুণ গাইছেন। এমন সময় জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে প্রকাণ্ড হুংকার ছেড়ে গোস্বামী গোলোক সেখানে হাজির হলেন। এইরূপ অভাবিত ভাবে পাগলের দর্শন পেয়ে ঋমণীদেবী ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে সেই বার্তাকুর ক্ষেত্রেই ভূলুণ্ঠিত হয়ে তাকে প্রণাম করলেন। বাবা তোমার শরীর কেমন আছে? কত দিন তোমাকে দেখি না, খুব চিন্তা করছিলাম গৃহে চলো। গোস্বামী বলেন, মাগো, গত শনিবার আমি ওড়াকান্দীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছি। ঠাকুর যেদিন লীলাসাঙ্গ করলেন সেই দিন হতে আমি তার অন্বেষণে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মা’রে ঠাকুরের অদর্শনে বড় পরাণ পোড়ে, তাই তো আমি তাঁর তালাশে বেরিয়ে পড়েছি। এই দেশে বাবার যত ভক্ত আছে সবার গৃহে একবার যাওয়ার ইচ্ছা আছে, তাই আজ আর তোমার গৃহে দেরী করবো না। পাগল হরি হরি বলে যাত্রা করলে ঋমণী তার যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি দেখলেন, পাগল যেন পূর্বের ন্যায় সবল সুস্থ ভাবে হরি হরি গৌর হরি বলে দ্রুত হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিন্দু থেকে এসে বিন্দুতেই মিলিয়ে গেলেন তিনি। সেই ভক্তিমতী মেয়ে জানল না কি বিরল সৌভাগ্যের অধিকারিণী হলেন তিনি। ঋমণী ব্যাপারটাকে এত গুরুত্ব দিলেন না, তিনি ভাবলেন, গোঁসাই তো অমন কতই আসেন যান আবার নিশ্চয়ই শিগ্গির একদিন আসবেন। দুই দিন পর লোক মাধ্যমে সংবাদ পেলেন পাগল নরলীলা সাঙ্গ করেছেন। সংবাদ পাওয়া মাত্র ঋমণী মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেলেন। চেতনা ফিরে পেয়ে তার মুখে শুধু এক কথা, দুই দিন আগে বেগুন ক্ষেতে আমি কাকে দেখলাম বলে পাগলের ন্যায় করতে লাগলেন।
অতঃপর পাগল গঙ্গাচর্ণা গ্রামে গঙ্গাধর বাড়ইকে দর্শন দিয়ে বলেন, শিগ্গির আমার জন্য তামাক সেজে আন। বলতে বলতেই তিনি কার্তিকের গৃহে উপস্থিত হয়ে কার্তিকের সদ্য রেখে খাওয়া হুঁকায় তামাক সেবন করে রাইচরণের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই সময় গঙ্গাধর হুঁকা সেজে নিয়ে কার্তিকের গৃহে এসে বলেন, তামাক সেজে দিতে বলে পাগল কোথায় গেলেন বলো তো? কার্তিক তার গৃহিণীকে বলেন, পাগল এসেছে না কি? অম্বিকা বলেন, হা এসেছে তো, তোমার হুঁকায় তামাক খেয়ে এইমাত্র মণ্ডল বাড়ীর দিঝে গেলেন। এমন সময় একজন এসে সংবাদ জানাল, পাগল নরদেহ ত্যাগ করেছেন। শোনামাত্র কার্তিক, গঙ্গাধর, রামমোহন অম্বিকা ইত্যাদি যারা যারা উপস্থিত ছিলেন সকলে হাহাকার করে ধূলায় লুটিয়ে পড়লেন।
সেই কার্তিক, অম্বিকা যাদের নিয়ে পাগল সারানিশি হরি কথায় যাপন করেছিলেন। ঝাড়ে গ্রামের সকলার বাড়ীঘর তছনছ হলেও কার্তিকের গৃহে তার আচড়টুকুও লাগে নাই। তাদের সন্তানাদি ছিল না, পাগলের বরে তারা পুত্র সন্তান লাভ করে। দিব্যদৃষ্টিতে দয়াময় হরিচাঁদের চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি দর্শন করে গোলোকের বিষয় বাসনা ত্যাগ হয়। তিনি হরি হরি বলে ঘরে ঘরে পাগলামীর ছলে হরিনাম বিতরণ করে ফেরেন। আজ তিনি ধরা ছোওয়ার বাইরে নিত্যধামে গমন করেছেন, আর তার প্রিয় অনুগামীগণ তার বিরহ ব্যথায় আকুল হয়ে আকাশ বাতাস মথিত করে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামী গোলোকের লীলা সম্বরণ (২য় অংশ)
এমন সময় জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে গোস্বামী গোলোক এসে উপস্থিত হলেন, আজ তিনি একা এসেছেন অন্য কেহ সঙ্গে আসে নাই। পাগলের হুহুংকারে ও উচ্চঃ হরিধ্বনি শ্রবণ করে প্রতিবেশীরা সব পাগলকে দেখতে ছুটে আসতে লাগল। সূর্যনারায়ণ ও রামধন কীর্তনীয়া উত্তরের ঘরের পাশে বসে আছে, তারা পাগলকে দেখে নিজেরা বলতে লাগল, পাগলকে যেরূপ কৃশকায় দেখছি তাতে উনি আর বেশীদিন বাঁচেন বলে মনে হয় না। তারক সেই কথা শুনতে পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, বড়ই বেদনাদায়ক কথা বললে হে তোমরা। ততক্ষণে গোলোকচন্দ্র এসে উত্তরের ঘরে তারকের শয্যায় গিয়ে বসলেন। মাঝির বাড়ীতে তিনখানা ঘর, উত্তরের ঘর তারককে ছেড়ে দিয়ে তারা স্বপরিবারে এক ঘরে থাকে, আর দক্ষিণের ঘরের শুধুমাত্র পোঁতাটাই পড়ে আছে তার বেড়া চাল কিছুই নাই। পোঁতায় বনবাঙ্গি, আসলীর গাছ ও নানাপ্রকার বুনোঘাসে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে আছে। পোঁতার লাগোয়া আম কাঠালের গাছের শাখা পল্লবে একাকার হয়ে সেই পোঁতা ও বৃক্ষতলের পরিস্কার মৃত্তিকায় সিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছে। সেই পরিস্কার বৃক্ষতলে কয়েক জন দোহার বসে আছে। পাগল জয় হরি বল মন গৌর হরিবল বলে উল্লসিত হয়ে তদের নিকটে এসে হরি হরি বলতে লাগলেন। মেলা দেখতে যত মানুষ মাঝির বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তারা পাগলের হরিধ্বনি শুনে তাকে দেখতে ছুটে আসতে লাগল, মাঝি ও তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে পাগলকে ঘিরে পাগলের সঙ্গে হরি বলতে লাগল। গোস্বামী গোলোক মাঝিকে আলিঙ্গন করে বলেন, তুমি আমার মিতা। মাঝি পাগলের চরণে গড়িয়ে পড়ে গদ্গদ্ ভাষে গোঁসাই তুমি ঈশ্বর তুল্য ব্যক্তি তুমি কেন আমার মত তুচ্ছ মানুষকে মিতা বল? আমি আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা ঘর গরু সবকিছু তোমাকে সমর্পণ করলাম, তুমি আমাদের সকলার গুরু হও, আমরা তোমার শিষ্য। মাঝির শাশুড়ি পাগলের পদে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল। পাগল যাকে দেখেন তাকে ধরেই হরি হরি বলে ধুলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। এইরূপে কিছু সময় পাগলামী করে তিনি হঠাৎ হরি হরি গৌর হরি বলে ভিটার উপরে লম্ফ দিয়ে পড়ে ভিটার জঙ্গল পরিস্কার করতে লাগলেন। তাই দেখে দোহারেরা এসে ঘাস তুলতে লাগলে পাগল তাদের বলেন, ওরে তোরা হরি হরি বল, এইটুকু জায়গার সামান্য ঘাস আমিই তুলে ফেলতে পারব। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘাস পরিষ্কার করে ফেললে মেয়েরা জলঝাঁটা নিয়ে এসে সেই স্থান সুন্দর করে ঝাঁট দিয়ে লেপে দিলে পাগল যাকে সম্মুখে পান ধরে এনে ভিটায় বসিয়ে দিয়ে বলেন তোরা হরি হরি বল। সকলে মিলে হরিবোল হরিবোল বলতে লাগলে পাগল তার মধ্যে ঘুরে ফিরে জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে নৃত্য করে ফিরতে লাগলেন। অপরাহ্ন বেলায় তার উদরে বেদনার উদ্রেক হল আর তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। সকলে মিলে তার সেবা শুশ্রুষা করতে লাগলেন কিন্তু তাতে কোন উপশম হোল না, বরং উত্তরোত্তর বেদনা বৃদ্ধি হয়ে চলল। এদিকে কবিগানের আসর থেকে তারকের ডাক এসে পৌছাল।
তিনি পাগলের নিকট একজনকে শুশ্রুষার্থে রেখে গানের আসরে গেলেন কিন্তু তার মন পড়ে রইল গোস্বামীর নিকটে। পালা করে তারা একেক জন এসে সমস্ত রজনী গোস্বামীর পাশে সজাগ থেকে তার সেবা করলেন। মাঝে মাঝে গানের বিরতির ফাঁকে তারক এসে গোস্বামীকে দেখে যেতে লাগলেন ও বেদনায় গোস্বামীর অসহনীয় কষ্ট দেখে তারা সকলে কেঁদে ভাসাতে লাগলেন। এমন সময় গোস্বামী হরি বলে হুংকার ছেড়ে এক দৌড়ে গোবিন্দ মাঝির গৃহে গিয়েই বেদনায় অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনখানা গামছা জলে ভিজিয়ে তার উদরের উপরে রাখলে মুহূর্তে গামছার জল শুকিয়ে গেল এবং বেদনায় কাতর হয়ে গোস্বামী তারককে বলেন, থালায় জল রেখে আমার উদরের উপরে ধর। সেইমত তারক গোস্বামীর উদরের উপরে থালা রেখে তাতে জল ঢালতে লাগলেন। স্বহস্তে চার ঘটি জল ঢাললেন কিন্তু তাতে বেদনার উপশম হোল না। চার ঘটিতে দশ সের পরিমাণ জল ধরে, সেই সমুদয় জল পাগলের উদরের তাপে অল্প সময়ের মধ্যেই শুকিয়ে গেল, তখন তারক মৃতপ্রায় পাগলকে বক্ষে সাপটে ধরে শয্যায় শয়ন করিয়ে দিলেন। পাগলের এরূপ মৃতপ্রায় দশা দেখে অর্বাচীন গোবিন্দ মাঝি চিন্তান্বিত হয়ে বলতে থাকে তাই তো গোঁসাইয়ের দেখছি না বাঁচার অবস্থা, যদি এখনে মারা যায় তবে উপায় কি হবে, মরা ফেলবে কে? এমন বেদনাদায়ক মুহূর্তে অর্বাচীনের এমন উক্তিতে ক্রোধান্বিত তারক বলেন, ওরে পাপীষ্ঠ জেলে, গোস্বামী মরলে কি তোর বাড়ীতে ফেলে যাব? নাকি তোকে ছুঁতে দেব? ওরে তোর এই বাড়ীতে কে প্রস্বাব করে? অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও গোস্বামী লম্ফ দিয়ে উঠে বলেন, তারক তোর ঐরূপ বাক্যে মহাপাপ হয়েছে, এই বলে তিনি দৌড়ে গোলোক মাঝির গৃহে গিয়ে শুয়ে পড়লে মাঝি ভক্তিযুক্ত ভাবে তার সেবা শুশ্রুষা করে আর বলে গোঁসাই এখানেই থাকুন। এই ভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে রজনী প্রভাত হল, তখন গোস্বামী বলেন, আমি তারকের সঙ্গে যাবো, জয়পুরের ঘাট আমি বড় ভালবাসি, নবগঙ্গা নদীর জলে লয় হওয়ার বাসনা আমার। তারকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তিনি বলেন, তারক, তুমি যদি আমার পুত্রধন হতে তবে আমার অনেক কার্য সমাধা হত, তারক আমি তোমাকে আর দাদা বলব না, তারক বলে ডাকবো। পাগল বলেন তারক আর কি চাও তোমার মনোবাঞ্ছাপূর্ণ হোক তুমি আমার পুত্র হও। তিনি বার বার ডাকেন, তারক তুমি কোথায়? এরিই মধ্যে ভুলবশতঃ দাদা বলে ফেলে উঁহু উঁহু করে বলে ওঠেন ভুল হয়ে গেছে আমি তোমাকে পুত্র ভাবলেও পুরাতন অভ্যাস বশে দাদা বলে ফেলেছি, ওতে কোন দোষ নাই, তুমি আমার পুত্রই। এইসব বাক্যালাপ শুনে সূর্যনারায়ণ চোখের জলে ভেসে বলেন, মহাশয় যদি তুমি মনে কর তোমার মৃত্যুকাল আসন্ন তবে নারিকেল বাড়ীতে তো তোমার পুত্র নিবারণ আছেই। তোমার ভ্রাতুস্পুত্র দশরথ মহানন্দ এরা থাকতে কেন এমন সময় তাদের ছেড়ে এসেছ? মহানন্দ তোমাকে পিতার অধিক মান্য দেয়, তাছাড়া সেখানে তোমার আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব সকলেই আছে সেসব ফেলে কেন তুমি তারক গোস্বামীর সঙ্গে জয়পুরে যেতে চাও? পাগল বলেন, ওরে আমার আত্মীয় পরিজন কেউ নাই, যে আমার মনের মানুষ আমি তার সঙ্গে যাবো। তিনি বলেন, গৃহিণী থাকলে লোকে তাকে গৃহস্থ বলে, তাছাড়া তুমি বল তো বাপু কে কার দারা-পুত্র? নিবারণ আমার পুত্র, তাকে আমি ভালও বাসি কিন্তু সে আমার পুত্র এ কথা আমি বলি কিভাবে, সবই তো ঠাকুর হরিচাঁদের দান। মহানন্দ, দশরথ আমাকে ভালবাসে ঠিকই কিন্তু একা মহানন্দ আমার এত অত্যাচার কেমন করে সহ্য করবে? তাই আমি মনস্থ করেছি আমি জয়পুর যাবো, আমার মনের ভাব সকলে বুঝবে না, আমার মন বলে এই ভাবে দয়াময় হরিচাঁদ আমাকে এই ভবসিন্ধু থেকে ত্রাণ করবে। আমার এই অন্তিম সময়ে মায়িক জগতের জ্ঞাতিবন্ধু আমার কিছু করতে পারবে না, একমাত্র হরিচাঁদই পারেন আমাকে ত্বরাতে, তিনিই আমার মাতা পিতা ভ্রাতা বন্ধু, সে বিনে আর বান্ধব নাই। আমার মনে সর্বদা তারককে দেখতে ইচ্ছা জাগে তাই জয়পুর গেলেই আমি শান্তি পাবো। এই কথা বলে গোস্বামী গোলোক প্রদীপ যেমন নিভে যাওয়ার আগে দপদপ করে জ্বলে ওঠে তেমনি ভাবে তার যেন কিছু হয় নাই যেন তিনি পূর্বের ন্যায় বলশালী আছেন সেই ভাবে লম্ফ প্রদান করে উঠে দৌড়ে খেয়াঘাটে গেলেন। সেখানেও তিনি একলম্ফে নৌকায় উঠে লাফে লাফে একগুড়া থেকে অন্য গুড়ায় যান আর বলেন, তোরা কে কে আমার সঙ্গে যাবি, আয়, আমি ভবপারে যাবো। নদী পার হয়ে কিছু সময় দ্রুত গতিতে চলার পর আর চলতে পারেন না, তখন অতি মন্থর গতিতে চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে তাও আর পারে না তখন হোগলা বনের মধ্যে বসে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। হায়রে হায় একদিন যার সিংহ বিক্রমে দুর্বৃত্তের মনে ত্রাসের সঞ্চার হোত, যার হরি হরি গৌর হরিবল বলে উচ্চলম্ফে ভূমিকম্পের ন্যায় চতুর্দিক কম্পমান হোত আজ সেই তিনি দুর্বল অসহায় অবস্থায় হোগলা বনে ঘুমিয়ে পড়লেন।
---শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামী গোলোকের লীলা সম্বরণ (৩য় অংশ)
হায়রে হায়! জগৎপতি শ্রীকৃষ্ণ যখন প্রভাসের তীরে বৃক্ষশাখায় জরা ব্যাধের নিক্ষিপ্ত শরে প্রাণ ত্যাগ করেন তখন দারুকের আহ্বানে অর্জুন প্রভাসের তীরে গিয়ে ভূমিশয্যায় প্রাণহীন শ্রীকৃষ্ণকে দেখে বিলাপ করে ক্রন্দন করতে থাকেন। দারুকের প্রবোধ বাক্যে নিজেকে সম্বরণ করে তিনি সকলার অগ্নিকার্য তর্পণাদি সম্পন্ন করে যদুকুলের স্ত্রীগণকে নিয়ে হস্তিনার অভিমুখে যাত্রা করলে দৈত্যগণ কৃষ্ণের রমণীদিগকে কেড়ে নিয়ে গেল। এমন যে ত্রিলোকজয়ী অর্জুন তিনি সেদিন তার অক্ষয় গাণ্ডীব ধনুকে গুণ দিতে কষ্টবোধ করতে লাগলেন। যে গাণ্ডীব ধনুকে তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় মুহূর্তে শতবার আকর্ণ টেনে অগ্নিতুল্য শর সকল নিক্ষেপ করেছেন সেই তিনি অতি কষ্টে অল্প টেনেই শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন এবং দৈত্যগণের তাতে কিছুই হল না। তারা শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীগণকে হাত ধরে টানা টানি করতে গেলে সেই সাধ্বী স্ত্রীগণ প্রস্তরিভূত হলেন।
ঠাকুরের মনের ইচ্ছা প্রকাশ
ঠাকুর বলেছিলেন, দেখ নবকুমার। নিমগাছে মাহিত্য আছে। কৃষ্ণ দেহত্যাগে অর্জুনকে আনতে দারুক সারথী পাঠায়। পরে তার সঙ্গে সুভদ্রা এসে একসঙ্গে দেহত্যাগ করেন। অর্জুন এসে দেখেন কৃষ্ণের দেহ হতে একটা কেউটে সাপ, বলরামের দেহ হ’তে একটা গোক্ষুর সাপ বাহির হইতে। পরে তাদের দেহ দাহন করিয়া যে অবশিষ্ট নাভিস্থলী থাকে তাহা নিমগাছে পুরিয়া ভাসাইয়া দেয়। এই গাছেই জগন্নাথ হয়। দারুব্রহ্ম অবতার হয় শ্রীক্ষেত্র।
একদিন বলেছিলেন আমি নিম গাছ দিয়া, গোপালসাধু, হীরামন, গোলক, তারক, মৃত্যুঞ্জয় এইসব সাধু বানাবো। আমি বলেছিলাম তোমাকেও বানাইব। ভাগ্যে নাই আমার। পাথুরে বিচি দিয়া পর্বত ও দন্ত মন্দির করিয়া দেখা আমার ভাগ্যে হল না। সে বড় দুঃখের কথা এই ছিল কপালে। বাবা! তোমার সাথে আর দেখা হ’ল না। মন্দির সামনে একটা গড়ুল, বানাইব তাহাও হইল না। এসব আপনি বলেছিলেন অপনার মনের ইচ্ছা তাহা করে গেলেন কই?
রাউৎখামার, মল্লকান্দির বেপারীদের দিয়া ঢাকা, পদ্মা হইতে পাথুরে বিচি আনিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন নব, ইহা দিয়া কি করিব জান? আমি বলিতাম জানি না। বাবা বলিতেন পর্বত বানাইব। যাহা এ দেশে নাই। লোকে দেখিবে। আর যত লোকে কামনা সাগরে ডুবায়ে পর্বতে কোল দিবে, তাতে যার যা কামনা তাহা পূর্ণ হবে। নিঃপুত্রে পুত্র পাবে। রুগী ভূগীর পন্থা জগতের উপকারে।
মহাবীর পার্থ মুহূর্তেই দুর্বল হয়ে পড়লেন, কিভাবে?
প্রাণসখা জগৎবল্লভ শ্রীকৃষ্ণের অদর্শনে তিনি সর্বশক্তি হারা হয়েছেন। এই জগতে ঐরূপই হয়। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে যে জগৎ মধুময় মনে হয়, যেদিকে তাকাই আকাশ বাতাস সব কত মধুর লাগে, সর্বকর্মে কত উৎসাহ হয়, তারপর সেই প্রিয়জন জগৎ ছেড়ে চোখের আড়ালে চলে গেলে সবকিছু শূন্যময় মনে হয়, কিছু ভাল লাগে না। আকাশের দিকে তাকালে প্রাণ হু হু করে, বাতাস মনে হয় অগ্নিতুল্য, শয্যায় শয়ন করলে মনে হয় শত শত বৃশ্চিক দংশন করে চলেছে, শুধু মনে হয় বিলাপ করে কাঁদি। এতো আমাদের সাধারণ মানুষের ঘটনা কিন্তু যখন অবতারের অন্তর্ধান ঘটে তখন তাঁর পার্ষদগণের হাদয়ে আরো কত গভীর বেদনা না জানি সৃষ্টি হয়, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের ন্যায় বাইরে শোকের প্রকাশ করেন না। তাই তো সাধক গোলোকচন্দ্র অন্তরের বেদনা বাইরে প্রকাশ না করে অন্তরেই রেখে দিলেন। ক্রমে সেই বেদনায় দগ্ধ হতে হতে তার উদরে বেদনার সৃষ্টি হল। তিনি দিনে দিনে ক্ষীণ হতে লাগলেন। মহাবলীর বল বিক্রম তাঁর প্রাণানন্দ হরিচাঁদের সঙ্গেই চলে গেছে, তাই আজ বলহীন শক্তিহীন অতি জীর্ণশীর্ণ দেহে তিনি সেই হোগলা বনে ঘুমিয়ে পড়লেন। পশ্চাতে ধাবমান গোস্বামী তারক এসে তার ঘুমন্ত মস্তক কোলে তুলে নিয়ে হোগলা বনে বসে রোদন করতে লাগলেন। অল্প সময় পরেই ঘুম ভেঙ্গে তিনি দৌড়ে ইতিনা গ্রামের মধ্যে চলে গেলেন এবং সেখানে এক বৃক্ষ তলে বসে কাতরভাবে বলতে লাগলেন আর চলতে পারছি না। গোস্বামী অন্তিম কালে যাকে পুত্র জ্ঞানে তারক তারক বলে ডেকেছেন, সেই মহান হৃদয় তারক কোনরূপ বিরক্ত না হয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে চলতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়েই গোস্বামী বলেন, তারক বাপধন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তখন তারক তাকে স্কন্ধে তুলে নিয়ে বলেন, তুমি আমার মস্তক ধরে বসে থাক, দু’চার পা চলতেই গোঁসাই বলেন, ওরে আমার মনে হচ্ছে শূন্য হয়ে যাচ্ছি। সেই কথা শুনে তারক তাকে ভূমিতে নামিয়ে তার সঙ্গে যত বস্ত্র ছিল সব নিজ কটিদেশে উঁচু করে বেঁধে নিজে হেলে দাঁড়িয়ে সেই বন্ত্রের উপরে গোস্বামীকে বসিয়ে তার মস্তকে ছাতা ধরে হরি হরি বলে দ্রুত গতিতে চলতে লাগলেন।
ইতিনার গ্রাম ছাড়িয়ে করফার মাঠ পার হয়ে মল্লিকপুর গ্রামের কাছাকাছি এলে পাগল লম্ফ দিয়ে ভূমিতে পড়ে জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে পুনর্বার বিশাল এক লম্ফ দিলেন, সেই লম্ফে সেখানকার মাটি এমন কেঁপে উঠল যে, মনে হতে লাগল ভূমিকম্প হয়ে চলেছে। এমন অভাবনীয় কাণ্ডে পথিকেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মুহূর্তে তাদের সম্মুখ দিয়ে ঘূর্ণি বাতাসের ন্যায় পাগল দৌড়ে গেলেন। তারক পিছনে ছুটে গিয়ে তাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বিষণ্ন ও হতাশভাবে হেঁটে চলেছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে এসে বলেন, মহাশয় এক ব্যক্তি এই পথে ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন, তিনি আমাকে বলে গেলেন, আমার পিছনেই তারক আসছে, তাকে বোলো যে, আমার জন্য যেন তিনটা আম কিনে নিয়ে বাড়ী যায়। তারক অমনি আম কিনে বাড়ী গিয়ে দেখেন গোস্বামী বসে আছেন, সেই আম তার সম্মুখে দিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভক্ষণ করলেন। তারক গেলেন পাড়া প্রতিবেশীদিগের বাড়ীতে, গিয়ে পাড়ার যত মেয়েদের ডেকে নিয়ে এসে নয়ন জলে ভেসে বলতে থাকেন, তোমরা গোস্বামীর শারীরিক পরিস্থিতি তো দেখলে এখন তোমাদের কাছে আমার এই মিনতি, তোমরা যে যখন সময় পাবে এসে তার সেবাযত্ন করবে। তিনি কাতর কণ্ঠে অশ্রুসজল চোখে বলেন, তোমাদের চরণ ধরে মিনতি জানাই, তোমরা এখানে থেকে গোস্বামীর যখন যা প্রয়োজন হবে তাই যুগিয়ে দিও, দেখো, আমার গোঁসাই যেন কষ্ট না পায়। তারকের গৃহিণীর নাম চিন্তামণি, পিসতুতো ভ্রাতৃবধূ সরস্বতীও তার সংসারভুক্তা হয়ে আছেন। নয়ন মণ্ডলের কন্যা সাধনা হরিচাঁদের পরমা ভক্তা ও অতীব সেবা পরায়ণা। ধর্ম নারায়ণের স্ত্রী, সতীনাথের মাতা-- এইসব ভক্তিমতি সেবা পরায়ণা মেয়েদের তিনি গোস্বামীর সেবা পরিচর্যার জন্য নিযুক্ত করলেন। গ্রামের আরো অনেক মেয়েরা স্ব-ইচ্ছায় সাধুর সেবার নিমিত্ত এসে উপস্থিত হন। তারক বলেন, গোঁসাইয়ের যখন যে প্রয়োজন তোমরা তার মন বুঝে সেই কর্ম করবে, তোমরা হয়ত বলবে মন কেমন করে বুঝবো? তবে বলি শোন, গোঁসাইয়ের প্রতি একান্ত ভক্তি রেখে একাগ্র মনে তার চরণ চিন্তা করলে অবশ্যই মন বুঝতে পারবে। যদি মন নাই জানতে পার তবে গোঁসাই যখন যা চায় এনে দিও, ‘জ’ বললে জল এনে দিও ‘হু’ বললে হুঁকা সেজে দিও ‘ত’ বললে তেল এনে মালিশ করে দিও। তোমরা কেউ না কেউ সর্বক্ষণ গোঁসাইয়ের নিকটে থেকে তার প্রতি সযত্ন লক্ষ্য রেখ। এইরূপভাবে সর্বক্ষণ সকলে কাছে থেকে তার সেবা যত করে চলেছেন। তারক, তার স্ত্রী চিন্তামণি, ভ্রাতৃবধূ সরস্বতী ও সাধনা এই চারজনে দিবারাত্রি পাগলের নিকটে থেকে তার সেবা যত্ন করতে লাগলেন।
অন্যান্য মেয়েরাও সময় পেলেই এসে দেখাশোনা যত্নাদি করেন। বার’শ ছিয়াশী সালের উনত্রিশে বৈশাখে গোস্বামী সকলকে কাছে ডেকে বলেন, শোন তোরা, যদি আমাকে ভালবাসিস তবে আজ তোরা আমার কাছে কেউ থাকিস না। অপরাহ্নে সকলার সঙ্গে মিষ্টি মধুর বাক্যালাপে সকলকে আশ্বাস প্রদান ও আশির্বাদ করলেন। তারকের বাড়ীতে দক্ষিণ দিকের ঘরে গোস্বামীজী আছেন, প্রথম দিনে এসেই তিনি ওই ঘর পছন্দ করেন। তারককে বলেন, তোমার বড় ঘরে আমি থাকব না, এই ঘরে থেকেই আমি হরিচাঁদের দর্শন লাভ করব। ঘরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বেড়া দেওয়া থাকলেও পুর্ব ও উত্তর দিক খোলা ছিল, গোঁসাই আসাতে উত্তরদিক চাটাই দিয়ে ঘিরে দিলেন শুধু পূর্ব দিক খোলা থাকল, সেই খোলামেলা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘরে গোস্বামীকে সকলে ঘিরে থাকে। আজ তার আদেশে সকলে ঘর ছেড়ে ঘরের আশেপাশে কাছে নিকটে ঘোরাঘুরি করতে লাগল ও আসন্ন বিয়োগ ব্যথায় ভারাক্রান্ত মনে সকলে গুগুণগুণ রবে হরিনাম করতে লাগল, এমন সময় উত্তরের চাটাইয়ের বেড়ার গায়ে গোঁসাই ঢলে পড়লেন। সীতানাথ সর্বপ্রথম দেখতে পেয়ে সকলকে ডাকতে লাগলে তারক দৌড়ে এসে অচৈতন্য পাগলকে প্রাঙ্গণে এনে কোলে নিয়ে বসলেন। অবিরল অশ্রুজলে তার বক্ষ ভেসে যেতে লাগল, তিনি ব্যস্ত হয়ে সকলকে বলতে থাকেন জল আন, হাওয়া কর। তখন অভিজ্ঞ সীতানাথের মাতা বলেন, গোঁসাই বুঝি এবার সত্যিই আমাদের ছেড়ে চললেন। তারককে বলেন, শিগ্গির তুমি গোঁসাইকে হরিনাম শ্রবণ করাও, অন্য সকলকে বলেন, তোমরা তোমাদের যার যা করণীয় কর্ম কর। সকলে উচ্চৈঃস্বরে হরিবোল হরিবোল বলতে লাগল, এমন সময় ও বদন হতে এক জ্যোতি নির্গত হয়ে তারকের বুকে মুখে এসে লাগল এবং কিছু জ্যোতি ঊর্দ্ধগামী হয়ে নারিকেল বাড়ীতে মহানন্দের দেহে লয় হল।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামী গোলোকের লীলা সম্বরণ (৪র্থ অংশ)
শোকে সকলে মুহ্যমান হয়ে পড়লে গোপাল নামে একজন রাশি রাশি কাষ্ঠ কেটে জড়ো করল। তাই দেখে সাধনা বলেন, কাষ্ঠ কেন জোগাড় করেছ? গোঁসাইয়ের পবিত্র দেহ দাহ করায় আমার মনে শঙ্কা জাগে। জীবিত থাকতে বেদনায় তিনি যেরূপ দগ্ধ হয়েছেন তাকে আবার দাহ করায় আমার মন সায় দেয় না বরং নবগঙ্গার জলে তার পূত দেহ বিসর্জন দাও। আমার মন বলে এর অন্যথা করলে আমাদের বিপদ হবে। এ কথা শুনে অনেকেই বলতে লাগল থানা থেকে পরোয়না এসেছে নদীর জলে কোনরূপ কদাচার করা চলবে না, এমন কি মলমূত্র পরিত্যাগ করলেও থানায় ধরে নিয়ে যাবে। যদি নদীর তীরে মৃতদেহ দাহ করে কেউ তবে তাকে ছ’মাস ফাটকে আটকে রাখবে। সব কথা শুনে তারক বলেন, আমিও খেয়াঘাটে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি তাতে লিখেছে মৃতদেহ জলে দিলে দুই মাস জেল অনিবার্য, তাছাড়া পঞ্চায়েত থেকেও টাকা জরিমানা নেবে। যাই হোক গোস্বামীর আত্মার যাতে শান্তি হয় এমন কার্যে আমার যদি জেল হয় হোক তথাপি আমি যদি তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারি তবে আমার জীবন সার্থক হবে। খুন ডাকাতি পরদারি চুরি ইত্যাদি কর্মে জেল হলে তাতে কলংকের ভয় থাকে, কিন্তু গোস্বামীকে জলে দিয়ে যদি আমার জেল হয় তবে আমি স্বর্গসুখ অনুভব করব। যদি এই কর্মে আমাকে জরিমানা দিতে হয় তাও দেবো, যদি পুলিশে আমার প্রতি অত্যাচার করে আমি তাও সহ্য করতে রাজী আছি। সাধনা দেবী বলেন, যদি তাই করতে চাও তবে প্রভাতেই টাকা লাগবে তার কি যোগার করেছ? তারক বলেন, যদি যোগার না থাকে তবে ঘর বেঁচে টাকা দেব নতুবা লোকের চাকর খেটে টাকা দেব। তিনি বলেন, নগদ চল্লিশ টাকা আমার নিকট আছে আরো যদি লাগে তবে নৌকা বেঁচে দেব। সে কথা শুনে সাধনা বলেন, তবে আর চিন্তা নাই, গোস্বামীকে নিয়ে ঘাটে চল। তারক পিতৃজ্ঞানে শেষ বিদায়ের বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয়ে গোস্বামীকে কোলে তুলে নিলেন। গোস্বামীর চরণদ্বয় ঝুলে পড়েছে দেখে সাধনা সেই পবিত্র চরণদ্বয় কোলে তুলে নিয়ে অশ্রুজলে ধৌত করতে লাগলেন। গোস্বামীর দেহ নৌকায় তুলে তারক ঘৃতমাখা সলতে দিয়ে তাঁর মুখাগ্নি করলেন। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা, শনিবার, আকাশে পূর্ণচন্দ্র চরাচর আলোকিত করে ঝলমল করছে। একদণ্ড রজনী গত হলে আকাশে হাল্কা মেঘের সমাগম হল এবং নৌকায় গোস্বামীর পূত দেহ নিয়ে সকলে মাঝ গঙ্গায় গেলে একখণ্ড মেঘ এসে চাঁদকে ঢেকে ফেলল। তাতে চতুর্দিক আলোকিত হলেও গঙ্গাগর্ভে ঘোর অন্ধকারের সৃষ্টি হল। তারক চন্দ্র গোস্বামীর দেহ কোলে নিয়ে বসে আছেন আর গোপাল বৈঠা বেয়ে চলেছে, যখন চন্দ্রমাকে মেঘে গ্রাস করল সেই সময় তারা গোস্বামীর সিদ্ধদেহ জলে বিসর্জন দিলেন। দেহ জলে দেওয়া মাত্র বুড়বুড় শব্দ উঠে জল তোলপাড় করে উথালপাতাল ঘূর্ণনের সৃষ্টি হল। জল হাতে নিয়ে নিজেদের মস্তকে ছিটিয়ে দিয়ে তারা করতালি দিয়ে হরিবোল হলিবোল বলতে লাগলেন। ইতিমধ্যে এড়েন্দার দুই হাটুরে নৌকায় প্রায় নব্বইজন হাটুরে সেই হরিধ্বনি শুনতে পেয়ে সমস্বরে হরিবোল হরিবোল বলতে লাগল। মহাসাধু মহাযাত্রায় চললেন, তাই জলে স্থলে হরিবোল হরিবোল ধ্বনি উত্থিত হতে লাগল।
সাধুকে দাহন করার জন্য নদীর তীরে কাষ্ঠের স্তুপ করা ছিল, সাধনা দেবী বললেন, শ্মশানে কাষ্ঠ থাকা ভাল নয়, তোমরা ঐ কাষ্ঠে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দাও। তারক, গোপাল, সাধনা ও গ্রন্থ এই চারজনে কাষ্ঠের স্তূপে আগুন দিয়ে করতালি দিয়ে হরিবোল হরিবোল ধ্বনি দিতে লাগলেন।
মেঘমুক্ত চন্দ্রালোকে দেখা গেল শ্মশানে কাষ্ঠের স্তূপে আগুন দিয়ে দু’জন পুরুষ ও দু’জন নারী মিলে করতালি দিয়ে হরিবোল হরিবোল বলে চলেছে, তাই দেখে নদীর দুই তীরে বহু মানুষ করতালি দিয়ে হরিনাম করতে লাগল। তখন চতুর্দিকে হরি হরি ময় ধ্বনি উত্থিত হয়ে আকাশ বাতাস মথিত করে যেন ক্রন্দনের ধ্বনি উঠতে লাগল এই কলুষপূর্ণ ধরণীতে একজন সাধু বাস করলে তার দেহের স্নিগ্ধ বাতাসে অগণিত তাপিত প্রাণ শীতল হয়। মহাসাধু গোলোক চন্দ্রের তিরোধানে তাই অগণিত মানুষ অশ্রুসজল চক্ষে হরিবোল হরিবোল বলে তার শেষ বিদায় কালে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে লাগল।
এইরূপ ভাবে চারজনে হরি হরি বলে গৃহে ফিরে এলেন। গোস্বামী গোলোকচন্দ্র অন্তিমে তারককে পুত্রধন বলে সম্বোধন করেছেন- এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী তারক অশ্রুজলে ভেসে গোপালের নিকটে বলেন, তিনি গোলোক গোস্বামীর আত্মার ঊর্দ্ধগতি কামনায় মতুয়াদের নিয়ে মহোৎসব করবেন। সেই মত জয়পুর, কৃষ্ণপুর, নারায়ণদিয়া, কুন্দসী ইত্যাদি গ্রামের নমঃশূদ্র স্বজাতিগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মহোৎসব করলেন। সূর্যোদয়ের প্রাক্কাল হতে সমস্ত দিন মতুয়া ভক্তগণ হরিবোল হরিবোল বলে সংকীর্তন করলেন এবং সন্ধ্যাগ্রে হরি হরি বলে সকলে ভোজনাদি সম্পন্ন করলেন। দুইশত লোকের আহারের আয়োজন সেখানে চারিশত লোক সমাগম হয় এবং সেই চারিশত লোক পরিতোষ সহকারে ভোজন করেও অবশিষ্ট যে খাদ্যদ্রব্য উদ্বৃত্ত হয় তাতে আরো শতাধিক দীন দুঃখীকে প্রসাদ বিলি করেন। দুই মণ তণ্ডুলের অন্ন ও সুস্বাদু ব্যঞ্জনাদি সহযোগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ভোজন করে সকলে জয় জয় হরিচাঁদের জয়, জয় জয় গোলোক চন্দ্রের জয় বলে ধ্বনি দিতে লাগল। এইভাবে গোস্বামী তারক পুত্ররূপে গোলোক চন্দ্রের শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন।
আত্মনিবেদন-
হে হরিচাঁদ, জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না লাভ হল। জীবন পথের বাঁকে বাঁকে কত দুঃখরাশি আমাকে হাসিয়ে কাঁদিয়ে প্রিয়জনের বিরহ ব্যথায় কাতর করল তবু আমার চেতনা হল না প্রভু। আমি পথ চলেছি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায়, আশেপাশে কাছে দূরে ছড়িয়ে আছে আমার সঙ্গী বন্ধু বান্ধব প্রিয়জনেরা, পিছনেই যে কালরূপী ব্যাঘ্র নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে আমরা তা ভুলে গেছি। হঠাৎ দেখি আমার পথের সঙ্গী কাউকে কাল আক্রমণ করে গ্রাস করে ফেলল। আমি কেঁদে আকুল হলাম, কিন্তু জীবন ত দাঁড়িয়ে থাকে না তাই আবার আমি চক্ষু মুখে অগ্রসর হই। ক্রমে বন্ধুর ব্যথা প্রশমিত হয়, সে ব্যথা বিস্মৃতির তলে ডুবে যায়, আমি নতুন নতুন বন্ধু বান্ধব সঙ্গে নিয়ে কল কোলাহলে পথ চলি। পিছনেই কালরূপী শমনের কথা ভুলে যাই, অতি তুচ্ছ ধন জনের বড়াই করি, তুচ্ছ দেহের বড়াই করি, রূপ যৌবনের বড়াই করি কিন্তু সবই যে মুহূর্তে কালের গ্রাসে লয় হতে পারে সে কথা ভুলে যাই। বকরূপী ধর্মের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠিরের কালগ্রাহী সেই নির্মম সত্য ভুলে যাই। সংসার কটাহে রাত্রি দিবা মাস ঋতু ও সবিতার তেজে আমরা অহরহ জীর্ণ হয়ে চলেছি, কাল আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রাস করতে পারে জেনেও মোহান্ধ আমি ভাবি, আমি বহুদিন বেঁচে থাকব, অমুকে মরেছে মরুক না আমি এখনো বহুদিন বেঁচে থেকে সংসারের সুখ ভোগ করবো। হে প্রভু, এই তো মায়া! দুঃখে জারা জারা আমি ভাবি সামনেই সুখ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে-- এই তো মোহ! হে দয়াল বান্ধব, তুমি আমার মনের অন্ধকার দূর কর, আমার মায়া মোহ দূর করে তোমার দেশের পথ দেখিয়ে নিয়ে চল প্রভু।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
বাণীনাথ কহে বাণী মৃদু মৃদু হাসি।
মোহিনী হইতে চাহে বৈষ্ণবের দাসী।।
হরিবলা সাধুদের ভক্তি আকামনা।
তন্ত্র মন্ত্র নাহি মানে ব্রজ উপাসনা।।
বিশুদ্ধ চরিত্রে প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্রমন্ত্র এরা বামপদে ঠেলে।।
শুদ্ধাচার কৃষ্ণ মন্ত্র ভক্তে জপ করে।
অন্য মন্ত্র জপ তপ পাপ গণ্য করে।।
মোহিনী গণিকা কাম বিলাসী-পিশাচী।
তার মন্ত্র হরি ভক্তে স্পর্শিলে অশুচী।।
ঠাকুর গুরুচাঁদ বলিতেন একটা জীবের মৃত্যুকালে জীবন বাইর হ’তে দ্বাদশ দণ্ড লাগে। দ্বাদশ দণ্ডের মধ্যে স্পর্শ করিতে নাই। ঠাকুর মহানিদ্রা আসিলে শ্রীপতি জিজ্ঞাসা করেন ঠাকুরদাদা কেমন লাগে? তিনি কহেন ভাল লাগে। বার বার তাই বলেন। ঘুমায়ে পড়েন। পরে বর্ষা নামে। আর স্পর্শ হল না। আমি সুশ্রুষা করিতে নারিলাম। মনের বেগ সান্তনা করিতে পারি না। শ্রীপতি নিষেধ করিলেন।
ঠাকুর গুরুচাঁদ বলিতেন স্বনামে পুরুষ ধন্য পিতৃ নামে পুরুষ মধ্যম। শ্বশুর নামে পুরুষ অধম। বংশেতে সৎপুত্র জন্মে যদি একজন? সে বংশ উজ্জ্বল হয় তার কারণ। পুংসক নরক হ’তে পুত্র উদ্ধার করে। আর সৎপুত্র-সমকন্যা যদি পাত্র বুঝে দেয়। কন্যাদান উৎকৃষ্ট দান হয়। মাঘে প্রাগে করিলে স্নান; কোটি কন্যা করিলে সম্প্রদান। তবু না হয় প্রাতঃ স্নান সমান। ব্রহ্ম মুহূর্ত সময় স্নান করিবে। হরিনাম করিবে। ব্রহ্ম মুহূর্ত রাত্র এক প্রহর থাকিতে।
সৎসতী স্থান ক’রে হরিনাম করিবে। শান্তি পাবে। দেহ পবিত্র হবে। নব তুমিও কর। বাবা গুরুচাঁদ রাত্র ভরি কি যেন কি করিতেন। যেদিন বাবাকে ডাকলে ডাক শুনিতেন, সেদিন বলে যেতাম, আর যেদিন ডাক শুনিতেন না সেদিন, বা’র তালা দিয়ে যেতাম। একদিন বিপাকে পড়িলাম। আমি দূরে পুকুরপাড়ে পায়খানায় গেছি। এমন সময় বাধা পায়খানায় যাবেন; তাই আমাকে ডাকিলেন। শ্রীপতিবাবু এসে দেখেন বাবার দরজা দেওয়া। নীলরতনকে ডাকেন। সে আমাকে বাইর বাড়ী এসে ডাকে। আমি ভয়ে বেদিক হয়ে যাই। যাইয়া দেখি বাবা দরজায় বসা। আমি দরজা খুলে দালানে ঢুকতে যাই, বাবা ধরে আমাকে মারেন। বাবা পায়খানা করেছেন। বাবাকে ধোয়ায়ে খাটের উপর রেখে, পায়খানা ফেলে, বসে ভাবি কি করেছি। পরে স্নান করি। শ্রীতারক গোস্বামীর বাড়ীতে গোলক গোস্বামী লীলাসাঙ্গ কালে; শ্রীতারক বলেন, গোস্বামী যখন যাহা চাবেন, তোমরা সকলে তাহা মন জেনে দিবা। মন চরণে নিপুণ রেখে বুঝিতে পারিবা, না বুঝিলে, জ-বলিতে জল, ত-বলিতে তেল, হ-বলিতে হুঁকা দিবা। কিন্তু আমি তাহা বুঝিতে পারি নাই। বাবা বলিতেন তিনি ধন যোগাইতেন। অত্রে অন্য বলিলে তিনি গালি দিতেন। বাবার কাছে শুই। ভাবি না ডাকে ঠেলা দিলে উঠিব। একদিন রাত্রে গুরুচাঁদ অসুখ ভান দিরা আমাকে বলিলেন নবকুমার ভাল ঠেকে না। যাহা করি তাহা ভাল ঠেকে না। তখন বিপিন গোস্বামীকে উঠাই। তিনি জিজ্ঞাসা করিলে বাবা বলেন নব বলতে পারে। আমি আর দুঃখে কি করি; ভেবে পাই না। অন্যদিন আমার হাত হাতে নিয়া দেখাইতেন কোথায় বেদনা। আমি সেখানে টিপিতাম। আজ তাই মনে করে হাতে হাত দিলে আঙ্গুল উল্টাইয়া ভাঙ্গিতে লাগিলেন। বিপিন গোস্বামী তাহা দেখে বলিলেন সন্ধ্যার সময় তুমি কাছে ছিলে না। তাই দীনবন্ধু ওরা বাবা কি বলেন বুঝে নাই। সেই জন্য তোমার উপর রাগ করিয়াছেন। আমি ভাবি এখন আঙ্গুল ভাঙ্গলে যদি রাগ সারে তবে ভাঙ্গেন। পরে হাত হাতড়াইতেছেন দেখে মনে করিলাম আমাকে মারিবেন বলিয়া ওরূপ করিতেছেন। তখন আমি বাবার কোলের কাছে আগাইলাম। তিনি আমাকে কিলাইতে লাগিলেন। কিলের পর পিঠ যে কিরূপ ভাল ঠেকে তাহা আর বলিতে পারি না। তখন বিপিন গোঁসাই বলিলেন নব এত রাগ না, এ যেন আর কি। পরে জিজ্ঞাসা করি বিপিন গোস্বামীর কাছে, শ্রীপতিবাবুকে ডাকা উচিত? তিনি ডাকিতে বলিলেন। অন্য কোঠায় ঘুম দীনবন্ধু। সে শ্রীপতিবাবুকে ডাকে। তিনি বাবাকে এসে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন লাগে আপনার? বাবা বলিলেন নব জানে। আমি দুঃখে কি করি। মনে ভাবি হে দয়াময় তোমাকে কিছুই দিতে বাকী রাখি নাই। কালিবুয়া (কলিজা) চাইলেও দিতে পারি বুক চিরে। তখন বাবাকে খুব শুশ্রুষা করিতে লাগিলাম। অনেক পরে তিনি সুস্থ্য হলেন। শ্রীপতিবাবু চেয়ারে ঘুমাইতেছেন। আমি তাহাকে (শ্রীপতি) ডেকে বলিলাম বাব সুস্থ্য হয়েছেন। আপনি বিছানায় যাইয়া ঘুমান। তিনি বলিলেন আবার অন্যরূপ ঠেকিলে বলিও। এই বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
হরিচাঁদের সাথে পাগলের করণযুদ্ধ (১ম অংশ)
গোস্বামী গোলোকচন্দ্র হরিচাঁদের নাম নিয়ে দেশের মানুষকে মাতিয়ে তুললেন। তিনি সদা সর্বদা হরিভক্তদিগের গৃহে যেতে ভালবাসেন ও পাগলামীর ছলে লোকের হিতসাধন করেন। সে দিন তিনি সুরগ্ৰামে গিয়ে আড়ঙ্গ বৈরাগীর গৃহে বসে হরিনামে মত্ত হয়ে আছেন। পাগল এসেছে সংবাদ পেয়ে, গ্রামের বহু মানুষ তাকে দেখার জন্য ছুটে আসে এবং গ্রামের সকল মেয়েরা মিলে পাগলের জন্য অন্নব্যঞ্জন রন্ধন করে। রন্ধন অন্তে তারা পাগলের সম্মুখে এসে করজোড়ে নিবেদন করে, গোঁসাই অন্নপাক হয়ে গেছে, আপনি এখন দয়া করে ভোজনে বসুন। এই বলে তারা যত্ন করে আসন পেতে গোস্বামীর সম্মুখে অন্নপাত্র ধরে দিলেন। এমন সময় একজন এসে সংবাদ জানায় শিঙাসাতপাড়ে যুধিষ্ঠির রঙ্গের গৃহে ঠাকুর হরিচাঁদ এসেছেন। শোনামাত্র পাগল হরি হরি বলে লম্ফ দিয়ে উঠলেন, তিনি আড়ঙ্গ বৈরাগীকে বলেন, আমি ঠাকুরের দর্শনে যাব, তুমি শীঘ্র নৌকাযোগে আমাকে সেখানে নিয়ে চল। ঘাটে কোন নৌকা না থাকায় আড়ঙ্গ বৈরাগী সেই সংবাদ পাগলকে জানালে তিনি মহাক্রোধে বলেন ওসব কোন কথা আমি শুনব না, তুমি কোথা থেকে নৌকা আনবে তার আমি কিছু জানি না। অতিসত্বর তুমি নৌকা সংগ্রহ করে আমাকে ঠাকুরের কাছে পৌঁছে দাও। ঠাকুরকে না দেখে আমি এক মুহূর্ত প্রাণে বাঁচব না। তুমি যদি অতি সত্বর নৌকা যোগাড় করে আন তো ভাল নতুবা আমি এখনি জলে ঝাপ দেব, তাতে যদি আমি জলে ডুবে মরি তাহলে আমি শ্রীহরিকে লাভ করব আর তুমি মহাপাপে ডুববে। নৌকা খুঁজে না পেয়ে আড়ঙ্গ পাগলকে বলেন, গোঁসাই একখানা বড় নৌকা জলে ডুবান আছে সেই নৌকার তলা একটুখানি ভাঙ্গা, তুমি যদি সেই নৌকায় যেতে চাও তো জল থেকে তুলে দিতে পারি। দু’জন হলে একজনে জোরে বেয়ে গেলে অন্যজন যদি জল সেচতে থাকে তবে যাওয়া হবে। এইসব বাক্যালাপের মধ্যেই মেয়েরা এসে চোখের জলে ভেসে বলে, গোঁসাই রাঁধা অন্ন ফেলে যেও না। পাগল বলেন, বাছা, তোদের অন্ন কে খাবে, ঠাকুরকে না দেখা পর্যন্ত আমার ক্ষুধা নাই। তবু মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে অন্নের থালা এনে পাগলের সম্মুখে দিলে তিনি গ্রাস দুই অন্ন ভোজন করলেন। নিকটে বসা রায়চাঁদকে তিনি বলেন, ওরে যদি ঠাকুরকে দর্শন করতে চাস তো আমার সঙ্গে চল। আড়ঙ্গ বৈরাগীকে বলেন, যদি আমাকে ভালবাসিস তবে নৌকা জল থেকে তুলে দে, আর নৌকা বাইবার জন্য কাউকে সঙ্গে দে। আড়ঙ্গ ও রায়চাঁদ দু’জনে জলে ডোবান ভাঙ্গা নৌকা তুলে জল সেচে ধুয়ে পরিস্কার করে দিলে পাগল বৈঠা হাতে লম্ফ দিয়ে নৌকায় উঠলেন। হরিচাঁদকে দর্শনের আশায় রায়চাঁদ সঙ্গে চললেন। নৌকায় উঠে রায়চাঁদ বেগে নৌকা বাইতে লাগলো, পাগল জল সেচতে লাগলেন। হরিচাঁদের দর্শনের আশায় ব্যাকুল গোলোক রায়চাঁদকে বেগে বাইতে বলে নিজে জল সেচে চলেছেন। হরিচাঁদকে এক্ষুনি দেখতে না পেলে যেন তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে- এইরূপ অধৈর্য ভাবে তিনি বলতে থাকেন, ওরে, জোরে জোরে বেয়ে চল। ওরে জোরে খোচ দে, আরো জোরে বেয়ে চল, যদি দেখি কম জোর দিয়েছিস তবে মুণ্ডু ছিড়ে নেব। ওরে মরা-বাঁচার চিন্তা না করে হরিচাঁদের নাম নিয়ে এই ভাঙ্গা নাও বেয়ে তার কাছে যেতেই হবে। রায়চাঁদ অতীব বলশালী ব্যক্তি আর তিনি বাইছেনও জোরে তথাপি পাগলের মনে ওঠে না। তিনি আরো জোরে আরো জোরে বলে নৌকার ডালির উপরে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে ডান হাতে জল সেচতে থাকেন ও বাম হাতে বৈঠার ন্যায় জল টানতে থাকেন। রায়চাঁদ যত জোরে বৈঠা টানে, পাগল ততই বলেন, আরো জোরে আরো জোরে, কাজেই এক মুহূর্ত বিরাম, বিশ্রাম না দিয়ে জোরে জোরে বৈঠা টানতে গিয়ে রায়চাঁদের সর্বঅঙ্গ ঘামে ভিজে গেল ও তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। পাগলও ডালির উপর উপুর হয়ে শুয়ে প্রাণপণে একহাতে জল টেনে অন্য হাতে জল সেচে চলেছেন। এমনিভাবে অর্ধেক পথ গিয়ে পাগল একেবারে শুয়ে পড়লেন। তখন তিনি রায়চাঁদকে আদেশ করেন একা একা বেয়ে চল, এমনভাবে নৌকা চালাবি, এমন জোরে বাইবি যেন নৌকায় জল না ওঠে। রায়চাঁদ অতি বেগে বেয়ে চললে নৌকায় এতটুকু জল উঠল না এবং বহু পরিশ্রমের পর নৌকা শিঙাসাতপাড়ে এসে পৌঁছাল। তরণী ঘাটে লাগা মাত্র হরিপ্রেমে উন্মত্ত পাগল লম্ফ দিয়ে নেমে দৌড়ে ঠাকুরকে দর্শন করতে ছুটলেন। হরিচাঁদ যুধিষ্ঠির রঙ্গ’র গৃহে বসে আছেন, পাগল দৌড়ে তার নিকটে গিয়ে একদৃষ্টে তাঁকে দর্শন করে তাঁর শ্রীচরণে লুটিয়ে পড়লেন এবং ক্ষণ পরে উঠে বসে একদৃষ্টে ঠাকুরকে দর্শন করতে লাগলেন। হরিচাঁদ বলেন, কিরে আমাকে দেখতে শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের বাড়ীতে এলি কিনা বল। হরিচাঁদের দর্শনে পুলকিত গোলোক বলতে থাকেন, হে প্রভু, সকলার ঘরেই তোমার আসন পাতা, তুমি সকল জীবের প্রাণ তাই সর্বত্র তোমার আগমন ঘটে। তোমার কোন মানামান নাই তাই যে তোমাকে অন্তর দিয়ে ডাকে তুমি অমনি তার গৃহে গিয়ে বস। তোমাকে দেখার জন্য আমার প্রাণ বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল, তাই হে প্রভু, তোমাকে দর্শন করতে ছুটে এসেছি। প্রভু এ বাড়ীতে আসি নাই। গোলোকের এরূপ বচন শুনে হরিচাঁদ রুষ্ট হয়ে বলেন, কি তুই এ বাড়ীতে আসিস নাই, তোর এত বড় কথা? এই বলে ক্রোধান্বিত হরিচাঁদ গোলোকের গণ্ডে চপেটাঘাত করলেন। সেই আঘাতে অন্তরে পুলকিত গোলোক বহিরঙ্গে ক্রোধে ফেটে পড়লেন, এক লম্ফে ঘরের বাইরে এসে দৌড়ে ঘাটে গিয়ে দ্রুত নৌকা বেয়ে কুবের বিশ্বাসের গৃহে এসে উঠলেন।
হরিচাঁদ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে রায়চাঁদকে বলেন, এত বড় ঠাকুর কোথায় পেয়েছিস? শুনতে পাই আমি যেখানে যাই ও না কি সেখানে আসে না, ও আমাকে কেমন মান্য দেয় বুঝে দ্যাখ। তিনি বলেন, ওরে এত বড় ঠাকুর ও কবে হল? এই সেদিনও যার পোঁতায় ঘর ছিল না যার বাড়ীর মেয়েরা মাঠে গরু চরায় তার এত বাড় কিসে বাড়ল?
--- শ্রীশী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
হরিচাঁদের সাথে পাগলের করণযুদ্ধ (২য় অংশ)
হরিচাঁদ গোলোককে উদ্দেশ্য করে যেসব গালি দিতে থাকেন সেই সব গোলোকের বংশে কদাপিও দেখা যায় নাই বরং যুধিষ্ঠির রঙ্গের বংশে সেই সব আছে। জগৎজীবন প্রভু হরিচাঁদের রঙ্গ বোঝে কার সাধ্য? এদিকে পাগল অতিদ্রুত নৌকা বেয়ে কুবেরের বাড়ীতে এলেন। কিছু সময় পর রায়চাঁদ এসে উপস্থিত হলে কুবের তার গৃহিণীকে বলেন, রায়চাঁদকে কিছু খেতে দাও। রায়চাঁদ তখন পাগলকে বলতে থাকেন, অনেক পরিশ্রম করে শিঙাসাতপাড়ে এনে তো খুব ভাল খাওয়ালে। সেই কথা শুনে পাগল জয় হরি বল মন গৌর হরিবল বলে উল্কাবৎ ছুটে বেড়াতে লাগলেন। কুবের তার গৃহে হরিচাঁদকে আনার নিমিত্ত ষুধিষ্ঠিরের বাড়ীতে গিয়ে ঠাকুর হরিচাঁদের কাছে তার কাতর আবেদন জানালেন।
ঠাকুর আসবেন তাই তার বাড়ীর মেয়েরা নানাবিধ সুখাদ্য রন্ধন করতে লেগেছেন। পিঠা পায়েস নানাবিধ ব্যঞ্জন লাবড়া শাক ডাল ভাজা বড়া টক ইত্যাদি রন্ধন করে চলেছেন তারা। কুবেরের আন্তরিক আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রভু হরিচাঁদ তার নৌকায় উঠে বসলেন। পাগল যখনি শুনলেন যে, ঠাকুর কুবেরের গৃহে আসছেন অমনি তিনি রোষভরে ঘাটে দাঁড়িয়ে অতি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন এখন বোঝ কে কেমন দয়াময়। আমাকে ঠাকুর কে বলে? ঠাকুর আমাকে বানাল কে? তুই ঠাকুর তাই আমি ঠাকুরের বেটা ঠাকুর। আজ কোন কিছু মানব না, তোমার মত শত ঠাকুর এলেও মানব না, ঠাকুরকে আজ জলে ডুবিয়ে ছাড়ব। তুই যেখানে যাস সেখানে আমি যাই না এ কথা কি করে ভাবলি? যাই কি না যাই আজ জানতে পারবি। বুক চিরে দেখাব তেমন বোকা আমাকে পাও নাই, পরের দেওয়া দেহ ধারণ করে আছি সে দেহ চিরি কোন অধিকারে? পবন নন্দন হনুমান বাহাদুরি দেখিয়ে বুক চিরে লক্ষ্মণকে দেখিয়েছিল, তখন সকলে দেখল তার অস্থিতে রাম রাম লেখা। আমি কেন তার মত বুক চিরে দেখাব? আমি কি পশুশিশু হনুমানের মত বোকা? তুমি অন্তর্যামী অন্তরের সব খবর জান তবে কেন আমি বুক চিরে জহুরি দেখাব? এইরূপ বলতে বলতে ক্ষণে ক্ষণে তিনি সুউচ্চ চিৎকারে চতুর্দিক কম্পমান করে তুলতে লাগলেন। তুই অন্তর্যামী হয়ে না বোঝার ভান করে আমাকে মেরেছিস, এখন ভক্তবৃন্দ দেখুক কার কত ক্ষমতা। ক্রোধে পাগলের অধরোষ্ঠ থর থর করে কেঁপে চলেছে, তার উচ্চলম্ফে চারিধার কেঁপে কেঁপে উঠছে। একেক বার তিনি সাররে সারে বলে ভীষণ চিৎকার করছেন। দূর থেকে পাগলের এহেন আচরণ দেখে হরিচাঁদ ভীত হয়ে কুবেরকে বলেন, তাকিয়ে দেখ, পাগলার আড়ি দেখ। যেমন পাগলামীর বহর দেখছি তাতে আজ একটা কাণ্ড ঘটাবেই মনে হচ্ছে, কাজেই বাপু আজ আর তোর গৃহে গিয়ে কাজ নাই। হরিচাঁদ যুধিষ্ঠির রঙ্গ’র গৃহে ফিরে গেলেন, আশা ভঙ্গে মনের দুঃখে কুবের এসে পাগলের নিকটে দুঃখ করে বলেন, ঠাকুর এলেন না। অশ্রুজলে ভেসে সে বলতে থাকে আমার মত দুর্ভাগা আর কেহ নাই, এখন আমি কি করি, কোথায় যাই, কোথায় গিয়ে প্রাণ জুড়াই? পাগল তখন কোমল স্বরে বলেন, ওরে এত দুঃখ করছিস কেন পিতা কি কখনো পুত্রকে ত্যাগ করতে পারে? আসে নাই তো কি হয়েছে? দয়া না করে সে পারবে না। খাদ্যদ্রব্য যা প্রস্তুত করেছ সব কিছু মস্তকে করে যুধিষ্ঠিরের বাড়ীতে নিয়ে বাবাকে ভোজন করিয়ে এসো। কুবের নৌকায় করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যখন যুধিষ্ঠিরের গৃহে যায় তখন পুলকিত অন্তরে গোলোকও তার সঙ্গে গেলেন। যখন তারা যুধিষ্ঠিরের ঘাটে গিয়ে পৌঁছেছেন তখন অন্তর্যামী হরিচাঁদ ঘাটে এসে উপস্থিত হয়েছেন। অশ্রুজলে ভেসে কুবের ঠাকুরের কাছে তার মনোবাসনা জানিয়ে বলেন, পাগলের আদেশেই তিনি এই আয়োজন করেছেন। সবকিছু শুনে হরিচাঁদ যুধিষ্ঠিরকে বলেন, আমি কুবেরের নৌকায় গৃহে ফিরে যাব এই বলে তিনি কুবেরের নৌকায় চেপে গৃহে ফিরে চললেন।
প্রেমময় হরিচাঁদের সেই তরণীতে তাঁর সঙ্গে যুধিষ্ঠির, কুবের, গোলোক ও রায়চাঁদ এলেন। হরিচাঁদ গৃহে ফিরে ভক্তবৃন্দ নিয়ে বসে নানারূপ মধুর মধুর হরিকথা, পুরাণ কথা আলাপন করছেন। এদিকে কুবের নানারপ সুখাদ্য পূর্ণ পাত্র মস্তকে নিয়ে শান্তিমাতার হস্তে দিতে লাগলেন। শান্তিমাতা কুবেরকে বলেন, এত খাদ্যদ্রব্য কে দিয়েছে? নয়ন জলে ভেসে কুবের আদ্যপান্ত সব ঘটনা জননীর কাছে খুলে বলেন। সব কথা শুনে শান্তিমাতা যুধিষ্ঠিরকে বলেন, বাছা তুমি কি ভেবেছ? গোলোক তোমার ভাই নয়? ঠাকুর যখন গোলোককে করাঘাত করলেন, কি দোষে তাকে করাঘাত করলেন তা কি তুমি জেনেছ? তুমি কেন তার হয়ে ঠাকুরকে বললে না? এই সব কথা হরিচাঁদের কর্ণগোচর হলে তিনি বললেন, যুধিষ্ঠির এই আমার পরীক্ষা। আমার করাঘাতে গোলোক কুবেরের গৃহে গিয়ে ঈশ্বর ভেবে তোমার কি উপকার করেছে জান? কুবেরের গৃহে যেতে সে আমাকে মানা করেছে, তার মনের ইচ্ছা আমি তোমার বাড়ীতেই থাকি সেই কারণেই সে নানাপ্রকার সুখাদ্য আমাকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তোমার গৃহে প্রেরণ করে। গোলোক তোমার উপকারই করেছে কিন্তু তুমি তার জন্য কি করেছ? ঠাকুরকে গৃহে নিয়ে কি তুমি নিজেকে ঠাকুর মনে করেছ? গোলোকের জন্য কেন তুমি আমার কাছে মাথা কুটলে না? কেন তুমি তার হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে না? এই জগতে ঈশ্বরের কর্ম বোঝা বড় ভার, তিনি কন্যাকে মেরে বধূমাতাকে শিক্ষা দেন। তাই বলি যুধিষ্ঠির ধর্মপথে চলতে গেলে খুব সাবধানে চলতে হয়। পরের দুঃখে যে জন দুঃখী হয় পরের সুখ দেখলে যার আনন্দ হয় সেই তো প্রকৃত হরিভক্ত। তুমি একজন হরিভক্ত হয়েছ, লোকে তোমাকে ঠাকুর বলে, তাতে মনে মনে নিজেকে খুব গৌরবান্বিত ভেবে বসে আছ। তুমি কি মনে কর আমি সেসব বুঝি না? শোন যুধিষ্ঠির, হরিভক্তের চরণে অতিক্ষুদ্র অপরাধের জন্যেও বড় বড় সাধক মহাজনগণ কল্পভরি সাধনা করেও শ্রীহরিকে লাভ করতে পারে না। হরিভক্তের চরণ বন্দনা না করে কোনো সাধক হরিকে লাভ করতে পারে না। যে জন সাধন ভজন করে সে সর্বদা ভক্তের চরণ বন্দনা করে থাকে। তাই বলি, বাছা মনের মালিন্য দূরে সরিয়ে রেখে খোলা মনে হরি হরি বলে সুখে কাল যাপন কর।
“যে ব্যক্তি সাধু সঙ্গগুণে বিষয়রূপ কুসঙ্গ পরিত্যাগ করিয়াছেন তিনি সাধুমুখে গীয়মান হরিরুচিকর কীর্তিকথা একবার মাত্র শুনিলেই আর সৎসঙ্গ ত্যাগ করিতে সমর্থ হন না। সুতরাং তাহাদিগের (পাণ্ডব দিগের) হরি বিরহ অসহনীয় হওয়া বিচিত্র নহে”
--- শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত, পৃ-৩৩৬
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
জলে স্থলে হরিনাম সংকীর্তন
পাগলচন্দ্র তীর বেগে ওড়াকান্দী অভিমুখে চলেছেন। ভক্তগণ সংকীর্তনরত অবস্থায় সঙ্গে চলেছেন, এমন সময় সম্মুখে মধুমতি নদী পড়ল। পাঁচহাত মুখে এক নৌকায় উত্তর দেশীয়রা দেশে চলেছেন। পাগল চন্দ্রকে দেখে তারা করজোড়ে আহ্বান জানাল, গোঁসাই দয়া করে আমাদের নৌকায় আসুন। পাগল সেই নৌকারোহনে ভক্তবৃন্দ নিয়ে উত্তরাভিমুখে যাত্রা করলেন। ভক্তগণ নৌকায় বসে খোল করতাল ডংকা কাশী ইত্যাদি নিয়ে সংকীর্তনে মত্ত হলেন। নৌকায় ত্রিশজন মানুষ চাপতে পারে সেখানে মানুষ হয়েছে বিয়াল্লিশ জন এবং সকলেই সংকীর্তনে মত্ত। দু’খানা নৌকা পাশাপাশি চলেছে। কীর্তনানন্দে মত্ত হয়ে মতুয়ারা এ নৌকা থেকে ও নৌকায় লম্ফ প্রদান করেন আর তাতে নদীর জলে উথালপাতাল ঢেউ উঠে কল কল ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হতে থাকে। গোস্বামী গোলোকচন্দ্র মহানন্দে নৃত্য করেন আর জয় হরিবল বলে ছোটাছুটি করে একবার নৌকার এ মাথায় তো পরমুহূর্তে ও মাথায় ছুটে যান। নৌকার অল্প পরিসর স্থানে মানুষ গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে হরিনাম করে চলেছেন। কেহ কেহ ভাবাবেগে পরস্পরে জড়াজড়ি ধড়াধড়ি পড়াপড়ি করে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। তারই মধ্যে গোলোকচন্দ্র ঐরূপ ছোটাছুটি করে চলেছেন। নৌকার আরোহী সমুদয় মানুষ হাতে হাতে ধরাধরি করে গোস্বামীর পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু পাগলের পথরোধ করে সাধ্য কার? তিনি অনায়াসে সেই হস্ত শৃঙ্খলের তলা দিয়ে দৌড়ে নৌকার অপর মাথায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। যখন সব ভক্তগণ বসে বসে নাম গান করে চলেছেন, সেই ভাবময় মুহূর্তে তিনি লম্ফ দিয়ে তাদের মস্তকের উপর দিয়ে অপর মাথায় গিয়ে উপস্থিত হলেন, নদীতে যত নৌকা ছিল তার আরোহীরা আশ্চর্য হয়ে সকলেই পাগলের নৌকার নিকটে এসে পাগলের সেই অলৌকিক নৃত্য ও উল্লম্ফন দর্শন করে করতালি দিয়ে হরিবোল হরিবোল বলতে লাগল। ঈশ্বর অধিকারী গান ধরলেন। শ্রীহরির প্রতি তার আকুল আবেদনে, গানের করুণ বিরহের সুরে মধুমতি নদী পর্যন্ত টলমল করতে লাগল। আশেপাশের নৌকার আরোহীরা জল কি স্থল ভুলে নর্তন কীর্তন করে হরিনাম করতে লাগল। অক্রুর বিশ্বাস আগা নৌকার চরাটে দাঁড়িয়ে বৈঠা হাতে নেচে নেচে কীর্তন করতে লাগলেন।
গোস্বামী গোলোক লম্ফ দিয়ে তার নিকটে গিয়ে একেবারে শুয়ে পড়লেন। তিনি উচ্চেঃস্বরে হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলে অক্রুরের দুই পদের মাঝখানে লম্বমান হয়ে গলুইয়ের দুই দিকে দুই হস্তে জল টানতে লাগলেন। তাতে নৌকা এত বেগে চলতে লাগল যে মনে হতে লাগল নৌকার দুই দিকে দুই দাঁড় বেয়ে চলেছে। চার কিংবা ছয় দাঁড়ে নৌকা যেমন বেগে চলে পাগলের দুই হস্তের টানে তদ্রুপ বেগে চলতে লাগল। পাগলের নৌকার সঙ্গ ধরে যত নৌকা বেয়ে চলছিল কোন অলৌকিক শক্তিতে সেই সব নৌকাও একভাবে তর তর করে বয়ে যেতে লাগল। যত নৌকা পাগলের নৌকার সঙ্গ ধরেছে সেই সব নৌকার সকলেই যেন প্রেমানন্দের ছোঁয়ায় প্রেমের বাতাসে প্রেমোন্মত্ত হয়ে হরিনামে বাহ্যস্মৃতি হারা হয়েছে। যদিও বা কারো একটু বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসে, পাগলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা মাত্র সে বাহ্যস্মৃতি হারা হয়। এমন সময় জয়পুরবাসী সীতারাম, ভোলানাথ, রাইচরণ, হৃদয় এই চার জন ষোলো হাত দীর্ঘ নয় পোয়া প্রস্থ এক নৌকায় মধুমতি নদী বেয়ে আসছিলেন। হরি সংকীর্তনের ধ্বনি ও পাগলের জয় হরিবল মন গৌর হরিবল ধ্বনি শ্রবণ করে শব্দ লক্ষ্যে বেগে তরী বাইতে লাগলেন। বহু পরিশ্রমের পর তারা এসে পাগলের নৌকার গলুইয়ের তলা দিয়ে নিজেদের নৌকার গলুই চালিয়ে দিয়ে স্থির হলেন। তখন মহা সোরগোল তুলে পাগলের নৌকার আরোহীরা বলতে লাগলেন, আরে আরে অর্বাচীনের দল তোদের কি মরার বাসনা হয়েছে? ভোলানাথ আবেগ মথিত কণ্ঠে বলেন, আমরা মরতেই এসেছি। সেই আবেগ ভরা কণ্ঠস্বরে মরতেই এসেছি শুনে বাহ্য চেতনা ফিরে পেয়ে পাগল বলেন, কে তুমি বাছা মরতে এসেছ? ভক্তি গদ্গদ্ কণ্ঠে অক্রুর বিশ্বাস বলেন, গোঁসাই এ জয়পুরের নৌকা। সেই কথা শুনে পাগলচন্দ্র লম্ফ দিয়ে ওঠেন এবং বলেন জয়পুরের নৌকা হলে এ তো তারকের নৌকা। তিনি বলেন, ওরে তারকের গণ না হলে কি মরার বাসনা করে! তখন নৌকায় যত লোক ছিল সকলের মুখে শুধু এক বুলি শোনা যেতে লাগল ‘তারক’ ‘তারক’। অন্যান্য নৌকা সরে গিয়ে জয়পুরের নৌকাকে পথ করে দিলে নৌকা এসে পাগলের নৌকার গায় লাগল। লম্ফ দিয়ে পাগল বলেন, এই যদি তারকের নৌকা তবে আমি তারকের নৌকা বাইব। এই বলে লম্ফ দিয়ে জয়পুরের নৌকার উপরে এসে পড়লেন। রাইচাঁদ, নিবারণ, বদন গোঁসাই, গোলাকের পুত্র গিরি, মথুর, ঈশ্বর অধিকারী সকলে এক স্থানে বসে হরিকথা বলে ক্ষণে ক্ষণে প্রেমাবেশে নৃত্য ও কীর্তনানন্দে মেতে উঠলেন। বড় নৌকা হতে সিংহনাদ তুল্য হরিধ্বনি শোনা যেতে লাগল। তাদের সেই নাম সংকীর্তনের সিংহনাদ তুল্য ধ্বনি নদীর দুই তীরে প্রতিধ্বনিত হয়ে দুই তীরের গ্রামসমূহে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তখন গ্রামের যত আবালবৃদ্ধবনিতা দলে দলে দুই তীরে দণ্ডায়মান হয়ে সেই নয়ন মনোহর দৃশ্য দর্শন ও শ্রুতি সুখকর সংগীত শ্রবণ করতে লাগলেন। এইরূপভাবে নৌকা সকল বর্ণির খালে প্রবেশ করল। যেসব নৌকা দূর দূর গ্রাম হতে এসেছিল তারা অনেকেই সাধুসংগ ছেড়ে নয়ন জলে ভেসে বড় নদীতে চলে গেল। কেহ বা পাগলের প্রেমে মেতে সঙ্গেই থেকে গেল। জয়পুরের নৌকায় লোক ধরে না, গায় গায় লোক দাঁড়িয়ে কীর্তন করে চলেছেন। খালের মধ্যে নৌকায় নৌকায় গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে চলেছে। সময় সময় কোন নৌকা জলের কিনারে গিয়ে লাগলে কিনারায় দাঁড়ানো মানুষ লম্ফ দিয়ে নৌকায় উঠতে লাগল। গোস্বামী গোলক এমন সময় মানুষের মস্তকের উপর দিয়ে প্রকাণ্ড এক লম্ফ দিয়ে কিনারায় গিয়ে পড়লেন। মুহূর্ত মধ্যে পুনর্বার লম্ফ দিয়ে নৌকায় এসে পড়লেন। এমনিভাবে তিনি বার বার লম্ফ প্রদান করতে লাগলেন। দুইবার সকলে তার পশ্চাৎদেশে দীর্ঘ প্রায় বারো তেরো হাত পরিমাণ লম্বা লাঙ্গুল দেখতে পেলেন। তার শরীরও প্রকাণ্ড আকার দেখা যেতে লাগল। গোলোক কীর্তনিয়া, ঈশ্বর অধিকারী এরা ভয় ভক্তি সহযোগে দুইবার পাগলের লাঙ্গুল দর্শন করলেন। তালুকের মহেশচন্দ্র, শ্রী হরি পোদ্দার, আড়ঙ্গ বৈরাগী, মহানন্দ, কোটীশ্বর এমন অনেক ভক্তগণ ধূমকেতুর ন্যায় লাঙ্গুল দর্শন করে চমৎকৃত হলেন। এমন অলৌকিক দৃশ্য দেখে সমবেত মানুষ উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি দিতে লাগল। পুনর্বার গোস্বামী গোলক লম্ফ দিয়ে কূলে এসে নদী তীরের রাখাল বালকগণের সঙ্গে মিশে হরি হরি বলে নৃত্য করতে লাগলেন।
শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
যে করে হরিচিন্তা হরি করেন তার চিন্তা
গুরুচাঁদ বলিতেন না দিলে পাওয়া যায় না। যে যেটুকু সে সেইটুক। আত্ম সমর্পিয়া মনপ্রাণ না দিলে কি পাওয়া যায়। ইহা বলিয়া বাবা বলিতেন শুন নবকুমার, ঐ যে কত লোক বারুণী উৎসবেতে আসে। দুই তিন দিনের পথ বাড়ী। আমি বলিলাম জানি বাবা। গোপালসাধু আসেন চার পাঁচ দিনের পথ থেকে। জগত চাঁদের জগবন্ধু আসেন বার তের দিনের পথ থেকে। নদীয়া থেকে এক বুড়ি আসে কত দিন বসে। ঠাকুর বলেন তবে শোন। মনে যেই পড়ে স্ত্রীপুত্র-গরুবাছুর্ টাকাকড়ি, ঘর-দুয়ার সব পাছে রেখে আমাকে দেখিতে চলে আসে। আমাকে দেখে ঘুরে ফিরে সেই বাড়ীর কথা মনে পড়ে। আমাকে বলে আমি বাড়ী যাই আমাকে দেখবেন। আমি বলি আমাকে দেখিস, কেমন তাই বলি। ঐ দেখ আগে ওর সব পাছে ফেলে আমাকে দেখিতে আসে। এখন আমাকে পাছে থুয়ে ওর সব দেখতে যাইতেছে। কই আমি ত দেখি ওতো আমার দিক চায় না। আমি দেখলে কি হবে। আমি বলি ঠাকুর দেখেন জগৎ জীবে। ঠাকুরকে তো দেখি না। কি করিবেন হরি। ঠাকুর বলিতেন গুরু কি করিতে পারেন পাপ যার কাণ্ডারী। নতুন পাপী তরে পূরণ পাপী তরে না। দেখ সারা কাল পাপ করে যার তাপ উঠে সেই নূতন। আর ভান করে সাধু হওয়া সেই পূরণ পাপী। ঠাকুর বলিতেন পাতকী তরাব না তরাব ভণ্ড। নূতন পাপীর উদ্ধার আছে, পূরণ পাপীর উদ্ধার নাই।
রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর। গ্রামখানি নীরব নিঝুম হয়ে আছে। অন্ধকার গ্রামের ঘরে ঘরে সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। গোস্বামী গোলোক নিজ গৃহে নিদ্রা মগ্ন ছিলেন, হঠাৎই তার নিদ্রাভঙ্গ হল। নিদ্রাভঙ্গে তিনি অভ্যাস বশে হরিবোল হরিবোল বলতে লাগলেন প্রাণারাম হরিচন্দ্রের কথা স্মরণ করে তার প্রাণ বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়ল, তাই শয্যায় বসে বসেই তিনি তার প্রাণারামের রূপ চিন্তা করে চলেছেন। মন চলে গেছে তার প্রিয় ধাম ওড়াকান্দীতে, সেখানে গিয়ে তিনি ঝাড়ু নিয়ে চললেন প্রাঙ্গাণাদি ঝাঁট দিতে। সমস্ত প্রাঙ্গণ ঝাঁট দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বসে তার মনে বড়ই তামাক সেবনের ইচ্ছা জাগল। এদিকে বহুদূর ওড়াকান্দীতে দয়াময় শ্রী হরিচাঁদের নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেল, অন্তর্যামী প্রভু তার প্রিয় ভক্তের মনোবাঞ্ছা জানতে পেরে হুঁকায় জল ভরে তামাক সেজে গোস্বামীর হস্তে দিয়ে এলেন। গোস্বামী দেখলেন, যেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র মহানন্দ এসে তাকে হুঁকা ধরে দিয়ে গেল। তিনি পরমসুখে তামাক সেবন করতে লাগলেন। তামাক সেবন অন্তে তার মনে চিন্তা জাগল এত রাত্রে মহানন্দ নিজ থেকে আমাকে তামাক সেজে দিয়ে গেল, যাই মহানন্দের সঙ্গে দু’টো কথা বলে আসি। তিনি হুঁকা হাতে মহানন্দের গৃহদ্ধারে এসে ডাক দেন, মহানন্দ ওঠো, হুঁকা রাখ। বহু ডাকাডাকির পর মহানন্দ উঠে দ্বার খুলে ডিজ্ঞাসা করেন, এত রাত্রে ডাকছ কেন, কি হয়েছে? গোস্বামী বলেন, বাছা এইমাত্র আমাকে তামাক সেজে দিয়ে এসেই এত গভীর নিদ্রা গেলে কেমন করে। মহানন্দ বলেন, তোমাকে তামাক সেজে দেওয়া তো দূরের কথা রাত্রের মধ্যে আমি গৃহের বাইরে যাই নাই। তিনি নাগরকে জিজ্ঞাসা করেন তুমি হুঁকা সেজে দিয়েছ? সে বলে আমি কবে আবার হুঁকা দিয়ে থাকি যে আজ এত রাত্রে হুঁকা দিতে যাবো? গোস্বামী গোলোক ভেবে পান না কে তাকে হুঁকা সেজে দিল। মহাকবি তারকচন্দ্র সরকার পদ্য ছন্দে বলেন-
“কহিছে তারক এতো ঠাকুরের কার্য।”
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
গোস্বামীর হনুমান মূর্তিধারণ ও গঙ্গাদর্শন
অন্য একদিন পাগল পাগলামী করতে করতে গঙ্গাচর্ণা অভিমুখে চলেছেন। পাগল আসছেন বার্তা পেয়ে অক্রুর বিশ্বাস, রামকুমার বিশ্বাস দু’জনে মিলে পাগলের নিকটে ছুটে এলেন। অক্রুর ও রামকুমারের পাগলের প্রতি ভক্তি বিশ্বাসের তুলনা নাই, পাগলকে তারা ঈশ্বরতুল্য ভক্তি করেন তেমনি তিনিও তাদের পুত্রাধিক স্নেহ করেন তাই পরস্পরে দেখা হলে অক্রুর, রামকুমার পাগলের পদে ভূলুণ্ঠিত প্রণাম করলে তিনি তাদের তুলে ধরে পরম সমাদরে প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। অতঃপর তিনজনে পাটগাতি খেয়াঘাটে এসে নৌকায় পরপারে চললেন। নৌকা প্রায় পরপারে পৌঁছে গেছে এমন সময় দশ বার হাত আগেই পাগল প্রকাণ্ড এক লম্ফে তীরে গিয়ে পড়লেন। যেখানে তিনি লম্ফ প্রদান করলেন সেই স্থান নদীর ভাঙ্গনের স্থান এবং জল হতে পাড়ি চার হাত পরিমাণ উচ্চ হবে। জলও সেখানে তীব্র বেগে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। পাগলের পদভারে নৌকা এমন দুলে উঠল যে নদীর জলেও প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হল। তার অমন অমানুষী লম্ফ দেখে নদী পারের সকলে হতবাক হয়ে গেল, সকলে বলতে লাগল, পাগল যেন বায়ু ভরে এসে তীরে পড়ল। নৌকার মাঝিও এমন অপ্রাকৃত লম্ফ দেখে বলতে লাগল, ইনি তো সাধারণ মানুষ নন। পাগল নদী তীরে পড়েই গঙ্গাচর্ণা অভিমুখে ছুটলেন। অক্রুর, রাম কুমারের সাধ্য কি পাগলের সঙ্গে দৌড়ে পারে। পাগল মানুষ এক দৌড়ে কার্তিকের গৃহে এসে হরিনামে মত্ত হলেন। বহু পরে অক্রুর, রামকুমার এসে শম্ভুনাথের গৃহে তার খোজ করতে থাকেন। এদিকে পাগল কার্তিকের গৃহে বসে ভাবেন, কার্তিক যদি অক্রুর রামকুমারকে গিয়ে নিয়ে আসত তবে বড় ভাল হত। পাগলের আজ্ঞায় কার্তিক দু’জনাকে ডেকে আনতে গেলে তারা এসে রাইচরণের গৃহে প্রেমানন্দে, হরিনামে মত্ত হলেন। অক্রুর, রামকুমার না আসাতে তিনি নিজে রাইচরণের গৃহে ছুটে গিয়ে তাদের দু’জনকে ধরে এনে মদনের গৃহে এসে উঠলেন। মদন ও তর পুত্র পৌত্র সকলেই হরিচাঁদের পরম ভক্ত, পাগল এসেছে খবর পেয়ে তার গৃহে বহুলোকের সমাগম হল এবং সকলেই নামেগানে মত্ত হয়ে পড়লেন। এমন সময় পাগল বায়ুবেগে মদনের গৃহ ও রাইচরণের গৃহকে ঘিরে চক্রাকারে কুম্ভকারের চাকের ন্যায় ঘুরতে লাগলেন তিনি মহাবেগে ছুটে ছুটে ঘরবাড়ী ঘিরে ঘিরে নর্তন কীর্তন উল্লম্ফন করে উচ্চৈঃস্বরে জয় হরিবল মন গৌর হরিবল বলে ফিরতে লাগলেন। তার ভীষণ গর্জনে লোক সমূহের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হল। কার্তিক, রাইচরণ ও মদনের গৃহ পাশাপাশি, এই তিন গৃহে যত নরনারী ছিল সকলে একযোগে নামে প্রেমে মাতোয়ারা হলেন। পাগলের ভীষণ গর্জনে তার উচ্চলম্ফ প্রদানে ও তীর বেগে ছুটে ছুটে বাড়ী পরিক্রমায় সকলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তারা কখনো দেখেন পাগল কার্তিকের গৃহ প্রাঙ্গণে উচ্চলম্ফ প্রদান করছেন আর হরি হরি গৌর হরি বলছেন, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখেন রাইচরণের গৃহ প্রাঙ্গণে হরি হরি বলে নৃত্য করে ফিরছেন। ভয়ে বিস্ময়ে সকল নরনারী সমস্বরে হরিবোল হরিবোল হরিবোল বলতে লাগলেন। পাগল উম্মত্তবৎ বেড়াপাক কীর্তন ও উচ্চঃলম্ফ প্রদান করে একেকবার এমন লম্ফ প্রদান করেন যে বাড়ী ঘর থর থর করে কেঁপে ওঠে। কার্তিক পাগলের বড় অনুরাগী ভক্ত, তিনি কখনো পাগলের সঙ্গ ছাড়েন না, প্রেমাশ্রুতে ভেসে ভাবাবেগে উন্মত্ত প্রায় হয়ে পাগলের পিছে পিছে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তিনি দেখেন পাগল বিশাল এক লম্ফ প্রদান করে দশ-বারো হাত ঊর্দ্ধে উঠে বিরাট আকৃতির হনুমান মূর্তি ধারণ করে রামরাম রামরাম ধ্বনি করে চলেছেন। জল ভরা নয়নে সেই বিরাট মূর্তি দেখে তার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হল এবং এই সময় তার বৃহৎ পুচ্ছ কার্তিকের দেহে গিয়ে স্পর্শ করল। অক্রুর রামকুমার ঘরে বসে হরিনাম করছিলেন, কার্তিক ভয়ার্ত স্বরে তাদের ডাকতে থাকেন তোমরা অতি সত্বর বাইরে এসো। ভাবে গদ্গদ্ কার্তিক অক্রুর বিশ্বাসকে বলেন, ভাই রে আমি কি দেখলাম কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমরা বাইরে এসে দেখে আমাকে বল আমি কি দেখলাম। অক্রুর, রামকুমার বাইরে এসে গোলোকের ঐরূপ ভীষণ হনুমান মূর্তি দেখে মূর্ছাপ্রাপ্ত হলেন। তখন পাগল এসে তাদের ধরে ধরে তোলেন আর বলেন, তোরা হরি হরি বল। মূর্ছা ভঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন কিরে তোরা কি দেখে জ্ঞান হারালি? সকলে বলে, তোমার বিরাট হনুমান মূর্তি দেখলাম, দশ-বারো হাত লম্বা লাঙ্গুল দেখলাম। তিনি বলেন, ওরে আমি তো বানরই, গ্রামের যে যেখানে আছে সবাইকে ডাক কাউকে ফাঁকি দেব না, সকলে দেখুক আমি বানর প্রধান। অনেকে বলে, হয়েছে এখন চল সকলে মিলে স্নান করে আসি। চূড়ামণি ও তোলাবতীর পুত্র রামমোহন হরিচাঁদের প্রিয় ভক্ত, পাগল চন্দ্রের প্রতিও তার অসীম ভক্তি, এই সকল মতুয়া ভক্তগণ কীর্তনরত অবস্থায় স্নানের ঘাটের দিকে চললেন। পাগল পিছনের লোকজনের সঙ্গে পাগলামী করে চলেছেন, মুহূর্তে সকলে দেখে তিনি সর্বাগ্রে পাগলামী ও নৃত্য করে ফিরছেন। ঘাটে এসে পাগল বলেন, তোরা সকলে এই ঘাটে স্নান কর আমি আঘাটে যাবো এই বলে তিনি ঘাট ছেড়ে পশ্চিমদিকে দৌড়ে গেলেন। শম্ভুনাথ পাগলের পিছে পিছে ছুটলেন, অক্রুর রামকুমার কার্তিক তারাও ছুটলেন সেই দিকে। পাগল যখন লম্ফ দিয়ে জলে পড়েন তারা সকলে তার লাঙ্গুল দেখতে পেলেন। পাগল পাগলামী করে জলে নেমে জল ফেলাফেলি করতে লাগলেন, অন্য ঘাটের লোকেরা দূর থেকে দেখেন যেন পাগলের ঘাটে বৃষ্টি হচ্ছে। শম্ভুনাথ, অক্রুর, কার্তিক, রামকুমার এই চারজনে দৌড়াদৌড়ি করে পাগলের ঘাটে এসে জলধারার মধ্যে নিরীক্ষণ করে দেখেন পাগল জলের উপর যোগাসনে বসে আছেন। তার মস্তকে একটি মকর আর জলের ভিতর থেকে বৃষ্টির ধারার ন্যায় জল উঠে তার উপরে বর্ষণ হয়ে চলেছে। মস্তকের মকর লাফ দিয়ে জলে পড়ল অমনি পাগল তার পৃষ্ঠে গিয়ে বসলে চোখের পলকে তারা দেখেন মকরের পৃষ্ঠে পাগল নাই, পরিবর্তে শ্বেতবর্ণা দেবী বসে আছেন। জলের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টি ধারার ন্যায় জলধারায় মকর ডুবে গেলে স্বয়ং মা গঙ্গা মকর পৃষ্ঠে ভাসমান হলেন। পাগল গঙ্গা মাতার নিকটে গিয়ে তার চরণ মস্তকে ধারণ করে বলেন, মা তোমার চরণতলে আমি জল নিয়ে খেলা করেছি, মাগো তোমার অবোধ সম্তানের অপরাধ ক্ষমা কর। মাতা গঙ্গে পাগলকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন, বাছা, তুমি হরিচাঁদের বড় প্রিয়পাত্র তাই তোমার অঙ্গস্পর্শে আমি পবিত্র হলাম। তখন পাগল নির্ভয়ে সিংহ গর্জনে মা মা বলে ডাকতে লাগলেন। পূর্বদিকের ঘাটের যত লোক তারা দেখল পাগলের ঘাটে বৃষ্টি হয়ে গেল। তিনি সাঁতার কেটে তীরে এলে ভয়ে বিহ্বল চারজন তাকে ধরে তুলে আনলেন। পাগল যে ঘাটে স্নান ও জলকেলি করলেন পূর্বে সেই স্থান ছিল নদীর স্রোতহারা বদ্ধ জলা। পাগলের স্নানে সেই স্থান গঙ্গা ধারার ন্যায় শুদ্ধ হল সেই থেকে সেই ঘাটের নাম হল বেলেঘাট। অদ্যাপি সেই স্থানের মাহাত্ম্য লোকমুখে ফেরে এবং ভক্তি সহকারে স্নান করলে লোকের সর্বসিদ্ধি লাভ হয়।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
একদিন শ্রীপতি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন ঠাকুরদাদা আপনি চলিয়া গেলে আমরা কি করিব। ঠাকুর বলিলেন জ্ঞাতি রোষে শরিক মোষে তারে পায় নানা দোষে। জড়ের বাঁশ পড়ে না, জড়ায়ে কড়ায়ে থাকে। যথা ধর্ম তথা জয়। শ্রীপতিকে ঠাকুরের শেষবাণী।
শ্রীহরিগুরুচাঁদের সেবা শুশ্রূষায় ছিলাম চারিজন নেপাল, নীলরতন, দীনবন্ধু। ইহাদের পূর্বে ছিল আদিত্য ও জলধর। তারপর ছিল ঐ চারিজন। দোকানে তাদের ডেকে বলি, তোমরা যখন বাবাকে লইয়া বেড়াও, তখন বাবা তোমাদের সঙ্গে কি বলেন? তাহারা ও দীনবন্ধু বলেন, আমাদের দেশের সেনেদের, বৌদ্ধদের লক্ষ্মীকান্ত পোদ্দারদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমার কাছে নীলরতন বলে আমার দাদা হরিনাথ রায়ের কথা বলেন। তাকে কত গা’লন এই সব কত কি বলেন। নেপাল গোঁসাই বলেন আমার সাথে ত এই বাড়ীর কোথায় কি হচ্ছে, আছে, এসব বলেন। এই কথায় আমি দেখি, আমার সঙ্গে যাহা বলেন তা ত এদের সাথে বলেন না। আমাকে এইভাবে বলেন, দেখ নবকুমার কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ হয় কার্তিক মাসে। আঠার দিনে আঠার অক্ষৌয়নী সৈন্য মরে। ভীষ্ম কার্তিক মাসে শরশয্যায় থাকেন। মাঘ মাসে দেহত্যাগ করেন। কেননা তিনি দক্ষিণায়ন না গেলে দেহত্যাগ করিবেন না। উত্তরায়নে দেহত্যাগ করেন। দক্ষিণায়নের চেয়ে উত্তরায়ন শুভ এজন্য মাঘ মাসে দেহ ত্যাগ করেন।
ভীষ্ম একদিন ডাকেন হে বৈকুষ্ঠের হরি একবার এস, এই কথা বলে ভাবেন। হায় যে হরি বৈকুন্ঠে থাকেন, লক্ষ্মী যার পদসেবা করেন, রত্ন সিংহাসনে আছেন। তিনি এখানে এলে কোথায় বসতে দিব। তাঁকে কি দিয়ে বা সেবা করিব। এই বলে বলেন হরি তোমায় আমি ডাকি না। তুমি ত ডাক নিশ্চয় শুনেছ, তবে হরি তুমি এস না। তোমায় আমি ডাকি না। এভাবে বিনয় করেন। হরি তাতে ভীষ্মের ডাকে থাকিতে পারিলেন না। লক্ষ্মীকে কন, লক্ষ্মী আমাকে যে ভীষ্ম ডাকেন। লক্ষ্মী বলেন ভীষ্মের মত চরিত্রবান লোকে ডাকেন, তাতে তুমি এখনও যাও না? হরি তখন ভীষ্মের কাছে গিয়া বলেন, কেন ডাকলে ভীষ্ম? ভীষ্ম বলিলেন, আমি তোমায় ডাকি না। তুমি এখান থেকে যাও। হরি কহিলেন কেন ডাকলে যে। ভীষ্ম বলিলেন, না তুমি এখান থেকে যাও। তোমায় ডাকি না। তোমায় দেখলে আমার ভাল লাগে না। এখান থেকে তুমি যাও। হরি কতদূরে যাইয়া ভাবেন, বৈকুণ্ঠে গেলে লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিবে যে, ভীষ্মকে কি বর দিয়াছেন? তখন তাকে কি বলিব? এত ভাবি হরি পুনরায় ভীষ্মের কাছে গিয়া বলেন, ভীষ্ম তুমি একটা বর লও। ভীষ্ম বলিলেন ঠাকুর আবার এলেন কেন? আমি যে বলিলাম এখানে আর আসিবেন না। তবে আবার এলেন কেন? আমি কোন বর চাহি না। হরি বলিলেন তোমায় আমি ‘ইচ্ছামৃত্যু’ এই বর দিলাম। ভীষ্ম বলিলেন প্রভু একটা ফাঁকি দিলেন। হরি বলিলেন, না ফাঁকি দেই নাই। আমার কথা মিথ্যা হবে না। তোমার ইচ্ছায়ে মৃত্যু হবে। ফাঁকি দিব কেন। ভীষ্ম বলিলেন তুমি ফাঁকি ছাড়া কি দিবে? তুমি ইচ্ছাময়, তোমার ইচ্ছায় সব হয়।
তুমি যখন ইচ্ছা করিবা যে ভীষ্মকে মারিব, তখন এ ভীষ্মের অনিচ্ছায় কি আর ইচ্ছা হবে না? আজ বর দিলেন কালই আমার ইচ্ছা হতে পারে মরিব। এই বলিয়া ভীষ্ম হাসেন। হরি দেখেন ভীষ্মও সত্য কথা বলেন। তখন হরি কহিলেন। তুমি ত আমায় জর জর করিলা। আমি এখন কি বলিব? ভীষ্ম বলিলেন, তোমায় আমি যেমন জর জর করিলাম, তবে আমি যাহা চাই তাই দিবে কি? হরি কহিলেন দিব। ভুমি যাহা চাও না দেওয়ার হলেও তাই দিব। তখন ভীষ্ম বলিলেন, “তোমায় আমি যেমন জ্বর জ্বর করিলাম, তেমন আমারও যেন শরশয্যায় জর জর হয়। এই বর চাই।” হরি কহিলেন এ কি চাহিলা? ভীষ্ম বলিলেন, আমি যাহা চাই, তাই দিবার স্বীকার করেছেন। এইজন্য ভীষ্মের শরশয্যা হয়। এই প্রকার ভাবের ইঙ্গিতের কথা বাবা আমার সঙ্গে বলিতেন। তাহা তাদের না বলে, বলিলাম, বাবা আমার সাথে যাহা কন্ তাতে বুঝি বাবা এবার দেহে থাকবেন না। এই কথায় নীলরতন গোঁসাই বলেন-- কও কি? ঠাকুর যেরকম খেতে পারেন, গায় যে রকম রক্ত বল আছে, রাধা পাগলার কথা কয়ে যে বক্মী নাচনা দেন, হাতে ধরে রাখতে পারি না। তাতে আরও দশ বৎসরে কিছুই হবে না। আমি বলিলাম তা ত আমিও দেখি। তবে যা আমার মনে এসেছে তাহা বলিলাম। পরে আশ্বিন মাস হতে ঠাকুরের একটু সর্দি জ্বরের ভান দেখান। ফাল্গুন মাসে দেহ রাখেন। ১৪ই ফাল্গুন ৪৩ (চৌদ্দই ফাল্গুন ১৩৪৩ সাল) ওরে কাল বাঘিনী সন তোর মনে এই ছিল। জগৎকে আঁধার করিলি। এখন কোথায় দাঁড়াই? কার কাছে যাই? উপায় কি? কে জগৎ রক্ষা করে? এ জাতিকে কে কোল দেয়, কার কোলে দাড়ায় সবে?
কত যে কি তোমার মনের আশা বলেছিলে, তাহা অসীম। ভেবেছিলেম গোপালসাধুকে দিয়া তোমার সেই সব পুরাব। তুমি বলেছিলে, গোপাল তোমার একগাছ চুল থাকিতে, একখানা হাড় থাকিতে তোমায় ছাড়িব না। তাইতে ভেবেছিলাম ওনাকে দিয়ে মনের আশা পুরাইবা হল না তাহা কালের স্রোতে।
গোলক চন্দ্রের স্পর্শে শাপগ্রস্ত আত্মার মুক্তি
মহাপ্রভু হরিচাঁদ একদিন ওড়াকান্দীর বহির্বাটীর প্রাঙ্গণে বসে আছেন। কিছদূরে গোস্বামী গোলোকচন্দ্র নীরবে বসে মনে মনে হরিনাম করে চলেছেন। কিছু সময় পর হরিচাঁদ মৃদু্স্বরে বলেন, গোলোক কত জায়গা তো ছুটাছুটি করে বেড়াও আজ একবার গজারিয়ায় লক্ষ্মণের বাড়ীতে যাও। হরিচাঁদের শ্রীমুখের আদেশ পেয়ে আনন্দিত গোলোক জয় হরি বল মন গৌর হরি বল বলে নামধ্বনি করে বেগে যাত্রা করলেন। পাগল গোলোক নামধ্বনি সহযোগে ক্ষণে লম্ফ প্রদান করে ক্ষণে অতিবেগে ছুটাছুটি করে চলেছেন। এইভাবে চলতে চলতে সম্মুখে একবিল পড়ল। সুক্ষ্ম বিলের মধ্যে একখাল দেখা গেল, খাল দুইনল পরিমাণ প্রস্থ হবে। গোলকচন্দ্র হরি হরি বলে খালে নেমে পার হতে গিয়ে দেখেন জল তার উরু পর্যন্ত উঠেছে। দু’চারপা অগ্রসর হতেই দেখেন এক বিরাট অজগর সেই জলের মধ্যে ভেসে উঠেছে, অজগরের দুই চক্ষু রক্তবর্ণ, নাসারন্ধ্রে হস্ত মুঠো করে ধরা যায়। তার রক্তবর্ণ মুখ ও ভয়ংঙ্কর রক্তবর্ণ চক্ষু দেখে যে কারো প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। সর্প নাসারন্ধ্রে কলকল করে জল টেনে চলেছে। যখন সে শ্বাস ছাড়ে তখন স্বাহা স্বাহা শব্দ শোনা যেতে লাগল।
অজগরের সর্ব অঙ্গ কালকূটের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ, মস্তকে বিষ্ণুপদচিহ্ন। যখন সে নিশ্বাসের সঙ্গে জল টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয় তখন নর্দমার জল যেমন কলকল করে পড়ে তেমনি বেগে জল পড়তে থাকে। সেই জল গোস্বামীর গাত্রের কন্থা ভিজে গেল। সর্প বিরাট হা করে গোস্বামীকে গ্রাস করতে অগ্রসর হলে তার মুক্তার মতো দন্তের সারি দেখে সাধু বিস্মিত হলেন। লক্ষ প্রদান করে তিনি জল হতে তীরে উঠে একদৃষ্টে অজগরের প্রতি তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবেন এই সর্প কখনো সত্যকার সর্প নয়। এই সময় সেই সর্প প্রকাণ্ড হা করে গোস্বামীকে ভক্ষণ করতে ছুটে আসতে লাগল, তাই দেখে পাগল ত্রাসে ছুটে পালাতে লাগলেন। একছুটে কিছুদূর গিয়ে তিনি ভাবেন হরিনাম মহামন্ত্র জপ করে আমি কাকে ভয় করি? শাস্ত্রে বলে সাধুর জীবন মৃত্যু উভয় সমান। তবে আমি কেন সামান্য সর্পের ভয়ে ছুটে পালাচ্ছি? বাবা হরিচাঁদের নামে ডংকা মেরে বেড়াই, চৌদ্দ ভুবনের মাঝে তবে আমি কাকে শঙ্কা করি? সর্প আমাকে খেতে আসছে আমি ওকে ধরব, ধরে নিয়ে হরিচাঁদকে দেখাব। হনুমান বিশল্যকরণীর খোঁজে গিয়ে গন্ধমাদন পর্বতকে মস্তকে নিয়ে সূর্যকে কক্ষে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। শাপগ্রস্থ কুম্ভীরিণীকে উদ্ধার করে কালনেমী রাক্ষসকে সংহার করেছিলেন। হনুমান এসব করেছিলেন রামনাম মহামন্ত্রের জোরে। তবে আমি কেন হরিনাম মহামন্ত্রের উপর ভরসা রেখে সামান্য সর্পকে ধরতে পারব না? আমার এ ছার জীবনের কি প্রয়োজন আছে যদি ঠাকুরের কোন কর্ম করতে না পারলাম? আমার মনে হয় এই কারণেই প্রভু আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি অবশ্যই ওই সর্পকে ধরব তাতে আমার এ ছার জীবন থাকে থাক যায় যাক।
বদন ব্যাদান করে সর্প ধেয়ে আসছে, সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখেও গোস্বামী ফিরে দাঁড়ালেন। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে হরিনাম মহামন্ত্রের প্রতি অটল বিশ্বাসে তিনি জয় হরি বলরে মন গৌর হরিবল বলে হুঙ্কার ছেড়ে প্রকাণ্ড লম্ফ প্রদান করে সর্পের উপরে গিয়ে পড়লেন। সর্পকে তুলে ধরে তিনি বলতে থাকেন ওরে ফণী তোর মণি নিয়ে আমি প্রভু হরিচাঁদের শ্রীচরণে অর্ঘ দেব। সাধুর স্পর্শ মাত্র অজগর থমকে দাঁড়াল আর মুহুর্তে এক সুন্দর বালকের মূর্তি ধারণ করে ছুটে পালাতে লাগল। অজগর যখন বালক হয়ে জুটে পালাচ্ছে তাই দেখে সাধুও তার পিছে পিছে ছুটলেন।
বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে কৃষকেরা হালচাষ করছে, কেউ বা জমির ঘাস পরিস্কার করছে, এইরূপ নানা কাজে একাদশ জন কৃষক একই জায়গায় কাজ করছে। অপূর্ব সুন্দর বালকটি ছুটে তাদের কাছে গিয়ে বলে তোমরা আমাকে বাঁচাও, ওই ব্যক্তি আমাকে মারতে আসছে। কৃষকেরা এহেন অন্যায় কর্মদেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে তুমি নির্ভয়ে আমাদের কাছে থাক দেখি কে তোমাকে মারে। দূর থেকে ওই দৃশ্য দেখে গোস্বামী ফিরে এলেন। দ্বিপ্রহরে লক্ষ্মণের গৃহে আহারাদি সম্পন্ন করলেন।
হরিনামের পাগল লক্ষ্মণের গৃহে কিছু সময় বীরভাবে পাগলামী করে অপার আনন্দ সাগরে সন্তরণ করলেন। পাগলামী করতে করতেই তিনি ওড়াকান্দী এসে উপস্থিত হলেন। অপরাহ্নে হরিচাঁদ পুষ্করিণীর তীরে গিয়ে দূর্বাসনে বসলেন। নিরালা বুঝে গোলোকও ঠাকুরের নিকটে গিয়ে বসলেন। হরিচাঁদ জিজ্ঞাসা করেন, গোলক, লক্ষ্মণ কেমন আছে, আর তুমি কি দেখে এসেছ? হরিচাঁদ বলেন, গোলোক খনার বচন আছে “সাপ স্বপ্ন পোনা এই দেখে যে না বলে সাধু সেই জনা”। অসম্ভব কিছু দর্শন করলে যারা জ্ঞানী তারা সেই কথা প্রকাশ করে না। তোমার মনের কথা মনেই থাক তুমি আমাকে কি শোনাবে আর কি বা জানব আমি, শুধু এইটুকু তোমাকে বলি, আজ কোন মহাভাগ্যবান উদ্ধার হয়ে গেল। রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি পুরাণ গ্রন্থে শুনেছ কত মহাপুরুষের শাপে কত দেব দেবী কত মনুষ্য শাপগ্রস্ত হয়ে কতরূপ ভাবে এসে শাপ ভোগ করে। পরে কোন মহাপুরুষের স্পর্শে তারা শাপমুক্ত হয়।
দেব কন্যা গন্ধকালী দেবতাদের নৃত্য গীত প্রদর্শন করতো। একদা সে কুবেরের নিবাসে নৃত্য প্রদর্শনের নিমিত্ত গমন করে, পথে দক্ষমুণি তপস্যা করছিলেন, নৃত্য গীতাদি রঙ্গ রসে পথ চলতে গিয়ে মুনির অঙ্গে গন্ধকালীর পদস্পর্শ হয়। মহাক্রোধে মুনিবর তাকে অভিশাপ দেন গন্ধকালী তোর এত অহংকার হয়েছে যে তুই আমার অঙ্গে পদম্পর্শ করিস? এই অপরাধে তুই গন্ধমাদন পর্বতের সরোবরে কুম্ভীরিণী হয়ে থাক গিয়ে। গন্ধকালী নিজের অপরাধ বুঝতে পেরে মুনির চরণ ধরে কাতর ভাবে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। গন্ধকালীর কাতর অনুরোধে কৃপা পরবশ হয়ে মুনি বলেন, রাম অবতারে হনুমানের স্পর্শে তুমি মুক্তি পাবে। অতঃপর রামাবতারে হনুমান বিশল্যকরণী ঔষধ আনতে গন্ধমাদনে গেলে কালনেমীর চক্রান্তে সরোবরে স্নান করতে নেমে গন্ধকালীকে উদ্ধার করেন। হনুমানের স্পর্শে যেমন গন্ধকালী উদ্ধার হয় তেমনি আজ তোমার স্পর্শে কোন মহাভাগ উদ্ধার হল। হরিচাঁদ বলেন, গোলোক বহিরঙ্গ লোক সমক্ষে এইসব কথা আলোচনা কোরো না। তিনি বলেন, গোলোক শোন, যখন কালীদহে কালীয়নাগ ক্রোধে শ্রীকৃষ্ণকে দংশন করে তখন কৃষ্ণ কালীয়ের মস্তকে চরণ রেখে নৃত্য করতে থাকেন। আজও তাই জাতি সর্পের মস্তকে শ্রীকৃষ্ণের চরণচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। কালীয় নাগ শ্রীকৃষ্ণের চরণ ধরে কাতরভাবে অনুনয় করে বলে, হে নাথ, তোমার রাতুল চরণের ধ্যান করেন স্বয়ং ব্রহ্মা। দেবাদিদেব মহেশ্বর তোমার ধ্যানে তোমার শ্রীপদের চিন্তায় শ্মশানে ভ্রমণ করে ফেরেন। তোমার সেই জগৎমান্য চরণে আমি বিষদন্তে দংশন করেছি। এ হেন পাপের ফলে বিষ্ঠাকুণ্ডের কৃমি হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না। হে প্রভু, তবু আমায় দয়া করে তোমার অভয় চরণ আমার মস্তকে রেখে আমার জন্ম জন্মান্তরের পাপভার মুক্ত করেছ। হে প্রভু যদি নিজ গুণে এত দয়া করলে তবে তোমার চরণে আমার এই প্রার্থনা, প্রভু হে, দয়া করে তুমি আমাকে নর বপু দাও। শুনেছি নরবপু ভজনের মূল, তাই হে প্রভু, নরবপু পেলে মনের সাধ মিটিয়ে তব পদ সেবা করতাম। হে দয়াময় হরি, তুমি দয়া করে আমাকে নরবপু দাও। তখন নর দেহধারী হরি তাকে বলেন, তুমি খল সর্প হয়ে আমাকে দংশন করে যে পাপ করেছ সেই পাপে তোমাকে পুনর্বার সর্প হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হবে। এর পরে নরদেহে আমার যে শ্রেষ্ঠ লীলা হবে সেই সময় তুমি সর্পরূপে জন্মগ্রহণ করে পদ্মবনে গুপ্তভাবে থাকবে। রুদ্র অংশে জন্ম আমার পরম ভক্ত গোলোকের স্পর্শে তুমি মুক্তি পেয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করে সালক্যমুক্তি লাভ করবে। আজ সেই কালীয়ানাগ মুক্তি পেয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করেছে। বাপ রে গোলোক তুমি এই কাহিনী অন্য কারো কাছে ব্যক্ত কোরো না। মহাভাগ দশরথ ভাগ্যক্রমে সেইদিন সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গোস্বামী তারকচন্দ্রকে সেই কথা লিখে পাঠান এবং তারক সেই লেখা “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে লিখে প্রকাশ করেন।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
মহাভক্ত জয়চাঁদের উপাখ্যান (১ম অংশ)
মধুমতী নদীতীরে ভূষাইলী গ্রামে হরিচাঁদের প্রিয়ভক্ত জয়চাঁদ ঢালীর বাস। মকিমপুর কাছারীতে তিনি চাকরী করেন। তার বুদ্ধিমত্তা, সত্যবাদীতা ও অপরের প্রতি সহানুভূতিশীলতা দেখে কাছারীর সকলেই তাকে ভালবাসে। নায়েব, মুহুরি, আমিন, পেষ্কার সকলেই তাকে ভালবাসে ও তার বাক্যকে মান্য দেয়। জমিদার মহাশয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গেলে তার নিকটে পরামর্শ চান। দক্ষিণেশ্ববর কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রাণী রাসমণির অধীন মকিমপুর পরগণা। তার সদর কাছারী ও থানা মকিমপুর। কাছারীর যত পাইক সকলের বেতন আট টাকা কিন্তু জয়চাঁদের বেতন দশ টাকা। আমলারা গ্রামে প্রজা মহলে গেলে নজরাণা পায়, যদি সেই সঙ্গে জয়চাঁদ থাকেন তবে তিনিও নজরাণা পান। অন্যায় অধর্ম কার্য তার দ্বারা কখনোই সম্পন্ন হয় না, কাজেই কাছারীতে তার সম্মান প্রচুর।
নড়াইলের রামকুমার বিশ্বাসের মধ্যমা ভগীনী ভবানী হরিচাঁদের পরমা ভক্তা। তিনি ভূষাইলী গ্রামের হরিভক্তদিগের গৃহে মাঝে মধ্যে আগমন করেন ও হরিচাঁদের নাম গুণগানে মত্ত থাকেন। সেই পরমা ভক্তা ভবানীর নিকটে জয়চাঁদ হরিচাঁদের গুণের কথা শ্রবণ করলেন। জয়চাঁদ ভবানীকে দিদি বলে ডাকেন, ভবানী জয়চাঁদকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। পরমা ভক্তা ভবানী অশ্রু বিগলিত চক্ষে গদ্গদ্ ভাষে হরিচাঁদের মহিমা ব্যক্ত করতে থাকেন ও জয়চাঁদ সেই হরিকথারূপ অমৃত ধারায় সিক্ত হয়ে হরিচাঁদের নামেপ্রেমে উন্মত্ত প্রায় হলেন। ভাবাবেগে আপ্লুত জয়চাঁদ ভবানীর চরণ ধরে বলেন, দিদি গো হরিচাঁদকে না দেখে আমি প্রাণে বাঁচবো না, তুমি বল, আমি কেমন করে হরিচাঁদের দেখা পাব? আমার এই দেহ মন প্রাণ সবই হরিচাঁদ হরণ করে নিয়েছে এখন কেবলমাত্র চর্মচক্ষে দেখা বাকী। আমার দেহ পিঞ্জর মাত্র এখানে পড়ে আছে মন পাখী সব বাধা ছাড়িয়ে খাঁচা ফেলে উড়ে চলে গেছে আমার পরাণবন্ধু হরিচাঁদের শ্রীচরণের উদ্দেশ্যে। দিদি গো আমার দিবারাত্রি পরাণ পোড়ে, দিদি তুমি আমার গুরু সেজে আমাকে পথ দেখিয়ে পরাণবন্ধুর কাছে নিয়ে চল। আমি তাকে দর্শন করে আমার চর্মচক্ষু সার্থক করি। জয়চাঁদের কাতর ভাব দেখে ভবানী স্বীকার করলেন তাকে জগৎ জীবন হরিচাঁদের চরণ দর্শনে নিয়ে যাবেন। দিন ধার্য করে সেই দিন এসে ভবানী জয়চাঁদের গৃহে সেই নিশি অবস্থান করলেন। জগৎ জীবন হরিচাঁদের দর্শনে করে তাঁর আনন্দধারার অবগাহন করে আমার এই দুঃখময় জীবনের সব দুঃখের অবসান হবে। জীবন আমার আনন্দময় হয়ে উঠবে- সেই আশায় সেই মহাভাগ্যের উন্মাদনায় ভ্রাতা ও ভগিনী প্রাণারামের কথা আলোচনায় ও চিন্তা জাগরণে নিশি পোহালেন।
হে প্রাণ নাথ, তোমাকে দেখি নাই, তোমার কথা জানি নাই, শুনি নাই, তাই আমি আমার অন্ধকার গৃহকোণে এই আমার ভবিতব্য ভেবে বসেছিলাম। যখন শুনলাম, হে আমার প্রাণানন্দ তুমি আমার পথ চেয়ে বসে আছ তাই শুনে আমার আর ধৈর্য মানছে না। হে প্রাণারাম, আমি কখন যাবো তোমার কাছে, কখন তোমার চন্দ্রবদন দর্শন করে আমার কাঙাল জীবন ধন্য করব প্রভু? এইরূপ যখন জয়চাঁদের মনের অবস্থা, তখন তার ধৈর্য আর ধরে না, রাত্রির বিরহটুকুও তার কাছে অনন্তকাল বলে বোধ হতে লাগল। আর ভবানী? সেতো হরিচাঁদের কৃপাধন্যা, তাঁর অলৌকিক লীলা তাঁর গুণগান করে অশ্রুজলে স্নাত হতে লাগলেন। এইরূপ ভাবাবেগে জারিত হয়ে ব্রাহ্ম মুহুর্তের কালে ভ্রাতা ও ভগিনী ওড়াকান্দীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যখন তারা রাধানগরের বাজারে এলেন তখন সবে সকাল হয়েছে এবং একটি দুটি করে দোকানের ঝাঁপ খুলতে শুরু করেছে। বাজারে জয়চাঁদ এক হাঁড়ি মণ্ডা কিনে মণ্ডার হাঁড়ি মস্তকে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন।
জয়চাঁদ মস্তকে মণ্ডার হাঁড়ি ও হস্তে যষ্টি নিয়ে বাবা হরিচাঁদ বলে অশ্রুমোচন করতে করতে পথ চলেছেন। বিস্তীর্ণ ধান্য ভূমির মধ্য দিয়ে আলপথে বহুদূর চলার পর দেখেন এক দুর্বৃত্ত ধান্য ক্ষেতের নাড়া টেনে আল বাঁধছে। তাদের দু’জনকে দেখে দস্যু আলে বসে কড়া সুরে জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাচ্ছিস? তোর তো বড় সাহস দেখছি, এই পথ দিয়ে একমাত্র মেয়েলোক সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাবি বল। ভাবাশ্রয়ী জয়চাঁদ বলেন, আমরা ওড়াকান্দী বাবা হরিচাঁদের নিকটে চলেছি। আমার সঙ্গে যিনি চলেছেন উনি আমার বড় দিদি, আমি দিদির ছোট ভাই। একই পিতার সন্তান আমরা তাই ভাই বোনে নির্বিকার চিত্তে দেশে চলেছি। এই কথা শুনে দস্যু বলে, তোর মস্তকের হাঁড়িতে কি নিয়ে চলেছিস? জয়চাঁদ উত্তর দেন হাঁড়িতে সন্দেশ আছে। দস্যু বলে এত কষ্ট করে ওসব আবার কেন নিয়ে যাস? যতসব কুষ্মাণ্ডের দল, ওড়াকান্দীতে তোরা কি এমন ঠাকুর পেয়েছিস বল। জমিদার যার বাড়ীঘর কেড়ে নিয়েছে সফলাডাঙ্গা ছেড়ে যে ওড়াকান্দীতে এসে বাস করতে বাধ্য হয়েছে সে আবার ঠাকুর হল কিসে? জাতিতে নমঃশূদ্র সে ব্যাটা ঠাকুর হয় কেমন করে? সে ব্যাটা নমঃশূদ্র তুইও নমঃশূদ্র তবে তুই তাঁর মধ্যে কিসের ঠাকুর দেখে সেখানে যাবি? সে তো তোর সন্দেশের হাঁড়ি নামিয়ে রেখে তোদের না খেতে দিয়ে তাড়িয়ে দেবে। জয়চাঁদ বলেন, খেতে দিক বা না দিক তাতে তোর কোন দায় নাই, খেতে পাই বা না পাই তাতে কোন দুঃখ নাই, শুধু দয়া করে সন্দেশের হাঁড়ি রাখলেই আমার মানব জন্ম ধন্য হবে কিন্তু তাই বলে তোমার বাড়ীতে খেতে যাব ভেবো না। দুর্বৃত্ত বলে, আমার বাড়ীতে চল সেখানে অতিথির ভাত নাই ঠিকই তবে তোর সন্দেশের হাঁড়ি নামালে আমিও খাবো তোকেও খাওয়াবো। জয়চাঁদের নির্লিপ্ত উত্তর আগে আমি ওড়াকান্দী বাবা হরিচাঁদের কাছে যাই সেখানে যদি খেতে নাই দেন তবে না হয় তোমার বাড়ীতে খেতে যাওয়া যাবো। দুর্বৃত্ত ক্রোধে হুঙ্কার ছেড়ে বলে যাচ্ছিস তোর ঠাকুরের বাড়ীতে ত্বে লাঠি নিয়ে যাচ্ছিস যাচ্ছিস কীসের জন্য? সন্দেশ নিচ্ছিস সেবার জন্য লাঠি নিচ্ছিস কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে? এই বলে দুর্বৃত্ত জয়চাঁদের হস্তের যষ্টিটি কেড়ে নিয়ে আলের নিচে পুঁতে রাখল। জয়চাঁদ রুখে দাঁড়িয়ে বলেন, ওই লাঠি আমি মাটি থেকে তুলে নেবই। দুর্বৃত্ত দ্বিগুণ তেজে গর্জন করে বলে বেশি তেজ দেখাবি তো তোর সন্দেশের হাঁড়িও কেড়ে রাখব, ভাল চাস তো সন্দেশের হাঁড়ি নিয়ে চলে যা, তোর ঠাকুরকে গিয়ে বলিস পথে একজন যষ্টি কেড়ে রেখেছে। মহা শক্তিশালী পাইক জয়চাঁদ হরিপ্রেমে জর জর, তাই সে তার পূর্বের বল বিক্রম প্রকাশের মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে। মনের দম্ভ সব হরিপ্রেমের বন্যায় ভেসে গেছে।
--- শ্রীশ্রী হরিলীলা কথামৃত (শ্রীমতী মীরা হালদার)
পূর্নব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর কেন অবতার?
উত্তরঃ আপনি যদি সনাতন ধর্মের লোক হয়ে থাকেন তাহলে শ্রীমৎভাগবত, গৌরাঙ্গ লীলা, সনাতনের শাস্ত্রাদি অবশ্যই মেনে থাকবেন নিশ্চয়। যদি মানেন অথবা মেনে থাকেন তবে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরকে দ্বিধা দ্বন্দ ছাড়া অবতার বলে মেনে নিতে হবে।
হরিচাঁদ ঠাকুরও বলেছেন-
“দেহমন সর্বক্ষণ রাখিবে পবিত্র।
শিখাইতে হবে জীবে এই মূল সূত্র”।।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ধর্ম বলতে মানব ধর্মকেই বুঝিয়েছেন,কোন আচার-বিচার ছুৎমার্গকে নয়।
তিনি বলেছেন-
“নাহি চিনি দেবদেবী।
ঘট পট কিবা ছবি”।।
বরং তিনি ঘরসংসার-পরিবারকে শান্তিতে, সুন্দর ক’রে গড়ে তোলার কথা বলেছেন,পারিবারিক উন্নতির জন্য গৃহধর্ম পালনের কথা বলেছেন-
“গৃহধর্ম গৃহকর্ম করিবে সকল।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল”।।
“কোথায় ব্রাক্ষ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভন্ড সব।।
স্বার্থশূন্য নামে মত্ত মতুয়ার গণ।
ভিন্ন সম্প্রদায়রূপে হইবে কীর্তন”।।
“নরাকারে ভূমন্ডলে যতজন আছে।
এক জাতি বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।“ — গুরুচাঁদ ঠাকুর।
- “বিদ্যাহীন নাহি পায় তত্ত্বের সন্ধান।
জ্ঞানবলে তারে পাবে কহে মতিমান”।।
ঈশ্বর বলতে আকাশে বসে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছেন,এমন কোন মহাপিতার কথা বোঝেননি। ঈশ্বর বলতে তিনি বুঝেছেন-
“বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যাহারে উদ্ধার করে সে তাহার ঈশ্বর”।।
দেখুন বেদ কি বলেছেন:-
পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন। এক ঈশ্বর চিন্তন জ্ঞানীর, বহু ঈশ্বরের ধারণা মুর্খের ।[অথর্ববেদ ১৩/৪/২]
ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ (ঋগ্বেদ ৬।৯।৫)
মতুয়া সম্প্রদায়ের ব্যখ্যা
কারন ১ গীতা যদি মেনে থাকেন তবে -১১-৫-৩২"শ্লোকে বলা হয়েছে"কলৌ কৃষ্ণ বর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণঃসাঙ্গোপাঙ্গোস্ত্রপার্ষদা, যজ্ঞে সংকীত্তর্ণ পায়ৈর্যজান্তি হিসুমেধ সঃ।
অর্থাৎ কলিকালে যিনি কৃষ্ণ বর্ণ পরিত্যাগ করিয়া পীত বর্ণ ধারনপূর্বক সাঙ্গপাঙ্গ রূপ অস্ত্র নিয়ে স্বপার্ষদে অবতীর্ণ হবেন, সুবুদ্ধি পরায়ন ব্যক্তিগন হরিনাম সংকীর্ত্তণ দ্বারা তাঁহার অর্চনা করিবেন।
গীতা-৪র্থ অধ্যায়-জ্ঞান যোগ শ্লোক ৭-৮#যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।৭।।পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮।।-হে ভারত (অর্জুন), যদা যদা হি (যে যে সময়ে) ধর্মস্য গ্লানিঃ (ধর্মের হানি, ক্ষীণতা), অধর্মস্য অভ্যুত্থানম্ (অধর্মের উদ্ভব) ভবতি (হয়), তদা (তখন) অহম্ (আমি, অর্থাৎ পুন্য-আত্মা / জীবাত্মা) আত্মানং সৃজামি (আপনাকে সৃজন করি, অর্থাৎ শরীর ধারণ পূর্বক অবতীর্ণ হই)।[৭]সাধুনাং পরিত্রাণায় (সাধুদিগের রক্ষার জন্য), দুস্কৃতাং বিনাশায় (দুষ্টদিগের বিনাশের জন্য) ধর্মসংস্থাপনার্তায় চ (এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য) [আমি / জীবাত্মা] যুগে যুগে সম্ভবামি (যুগে যুগে অবতীর্ণ হই)।[৮]সরলার্থঃ হে ভারত (অর্জুন), যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি (জীবাত্মা) সেই সময়ে দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই। তে ব্রহ্মলোকে হ পরান্তকালে পরামৃতাৎ পরিমুচ্যন্তি সর্ব্বে।।
-[মুন্ডক ৩।২।৬]
মুক্ত জীবগন মুক্তি অবস্থায় ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া বহ্মে আনন্দ ভোগ করিয়া, পুনরায় মহাকল্পের (৩৬০০০ বার সৃষ্টি ও প্রলয়) পর মুক্তিসুখের অবসানে সংসারে প্রত্যাগমন করে। মহাকল্পের গনণা এইরূপঃ- তেতাল্লিশ লক্ষ, বিশ সহস্র বৎসরে এক চতুর্যগী; দুই সহস্র চতুর্যুগীতে এক অহোরাত্র; এইরূপ ত্রিশ অহোরাত্রিতে এক মাস; এই রূপ বার মাসে এক বৎসর এবং এইরূপ শত বৎসরে এক পরান্ত কাল হইয়া তাকে। মুক্তিসুখ ভোগের এই পরিমাণ কাল। মুক্তি জন্ম-মরণ সদৃশ নহে। কারণ (৩৬০০০) ছত্রিশ সহস্রবার সৃষ্টি ও প্রলয় হইতে যে পরিমাণ কালের প্রয়োজন হয়, ততকাল পর্য্যন্ত জীবদিগের মুক্তির আনন্দে তাকা এবং দুঃখ না থাকা কি সামান্য কথা..?
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হওয়া সত্ত্বেও য়েমন জীবনধারণের উপায় অবলল্বন করা হয়, সেরূপ মুক্তি হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া জন্মগ্রহণ করিতে হইলেও মুক্তির উপায় অবলল্বন করা নিতান্ত প্রয়োজনীয়।
বেদার্থ না জানিয়া সাম্পরদায়িক লোকদিগের দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া নিজের মূর্কতাবশতঃ ভ্রমজালে আবদ্ধ হইয়া অবতারবাদ সৃষ্টি করিয়াছেন। অনেক মনে প্রশ্ন আসিতে পারে যদি ঈশ্বরের অবতার না হয়, তবে কংস, রাবণ, দূর্য়োধন প্রভৃতি দুর্বত্তগণের বিনাশ কীরূপে হইতে পারে..? উত্তর- প্রথমতঃ যে জন্মগ্রহণ করে, সে অবশ্যই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। যদি ঈশ্বর অবতার দেহ ধারণ ব্যতীত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, তাঁহার নিকট কংস, রাবণ, দর্য়োধনাদি একটা কীট তুল্যও নহে।
তিনি সর্বব্যাপক [ঋগ্বেদ ১।২।৭।১৬] বলিয়া ইহাদের শরীরেও পরিপূর্ণ হইয়া আছেন। যখনই ইচ্ছা তখনই মর্মচ্ছেদন করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিতে পারেন। যাহারা এই অনন্ত গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট পরমাত্মাকে একটি ক্ষুদ্র জীবের বধের জন্য জন্ম-মরণশীল বলে, তাহারা মূর্খ ভিন্ন অন্য কি বা হতে পারে।
গীতা অনুযায়ীই জানা যায় যে শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী ছিল গীতা ১১/৪,৯ শ্লোক এবং গীতার শেষের দিকে অর্থাৎ ১৮ অধ্যায়ের ৭৫ এবং ৭৮ শ্লোক দেখুন সেখানে সঞ্জয় কৃষ্ণ কে 'যোগেশ্বর' বলে কথন করেছে, আর যোগেশ্বর এর অর্থ যোগেন্দ্র, মহাযোগী, শ্রেষ্ঠযোগী।
গীতা ৪ অধ্যায়, ৫-৬ শ্লোক
ভগবান বললেন -হে পরন্তপ অর্জুন আমার এবং তোমার বহুজনম অতিত হয়েছে, আমি সে সমস্ত জন্মের কথা মনে করতে পারি তুমি তা পার না।৫।
যদিও আমি জন্ম রহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্ব ভূতের ঈশ্বর তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি স্বীয় মায়ার দ্বারা অবতির্ন হই।৬।
ওপরের দুটি শ্লোক স্ববিরোধী কারণ ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলেছে তার অনেক বার জন্ম হয়েছে , কিন্তু দেখুন পরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলছে যে আমি জন্ম রহিত অর্থাৎ তার জন্ম হয়না।
গীতা ৯ অধ্যায়, ২৯ শ্লোক
আমি সর্বভূতে সমান ভাবে বিরাজ করি, কেউ আমার প্রিয় নয় ও অপ্রিয়ও নয়।২৯।
গীতা ১৮ অধ্যায়, ৬৫-৬৯ শ্লোক
তুমি আমাতে চিত্ত স্থির কর এবং আমার ভক্ত হও। আমার পুজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে এই ভাবে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হবে।৬৫।
পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তার থেকে অধিক প্রিয়কারি এবং আমার প্রিয় আর কেউ নেই এবং ভবিষ্যতে কখন হবেও না।৬৯।
ওপরের শ্লোকে কৃষ্ণ বলছে তার কাছে কেও প্রিয়ও নয় এবং অপ্রিয়ও নয়। কিন্তু নিম্নের শ্লোকে কৃষ্ণজী অর্জুন কে প্রিয় বলছে এমন কেন ?
ওঁ তৎসাদিতি নির্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ।
ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরা।।গীতা-সপ্তদশ অধ্যায় ২৩।।
অনুবাদঃ ওঁ তৎ সৎ- এই তিন প্রকার ব্রহ্ম-নির্দেশক নাম শস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাহ্মণগণ, বেদসমূহ ও যজ্ঞসমূহ বিহিত হয়েছে।
তস্মাদ্ ওঁ ইত্যুদাহৃত্য যজ্ঞদানতপঃক্রিয়াঃ।
প্রবর্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততং ব্রক্ষবাদিনাম্।।গীতা-সপ্তদশ অধ্যায় ২৪।।
অনুবাদঃ সেই হেতু ব্রহ্মবাদীদের যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও ক্রিয়াসমূহ সর্বদাই ওঁ এই শব্দ উচ্চারণ করে শাস্ত্রের বিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
তদিত্যনভিসন্ধায় ফলং যজ্ঞতপঃক্রিয়াঃ।
দানক্রিয়াশ্চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ।।গীতা-সপ্তদশ অধ্যায় ২৫।।
অনুবাদঃ মুক্তিকামীরা ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে ‘তৎ’ এই শব্দ উচ্চারণ-পূর্বক নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা, দান আদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন।
সম্ভাবে সাধুভাবে চ সদিত্যেতৎ প্রযুজ্যতে।
প্রশন্তে কর্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে।।গীতা-সপ্তদশ অধ্যায় ২৬।।
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সদিতি চোচ্যতে।
কর্ম চৈব তদর্থীয়ং সদিত্যেবাভিধীয়তে।।গীতা-সপ্তদশ অধ্যায় ২৭।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! সৎভাবে ও সাধুভাবে ‘সৎ’ এই শব্দটি প্রযুক্ত হয়। তেমনই শুভ কর্মসমূহে ‘সৎ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞে, তপস্যায় ও দানে ‘সৎ’ শব্দ উচ্চারিত হয়। যেহেতু ঐ সকল কর্ম ব্রহ্মোদ্দেশক হলেই ‘সৎ’ শব্দে অভিহিত হয়।
গীতা ৩ অধ্যায়, ১৫ শ্লোক
এখানে বলা হয়েছে কর্ম উৎপন্ন হয় বেদ হইতে আর বেদ উৎপন্ন হয় অক্ষর ব্রহ্ম হইতে।
এই একটা শ্লোক দ্বারাই প্রমাণ হয় যে কৃষ্ণ বেদ কে মানতেন কিনা !
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্।।১৫।।
অনুবাদঃ যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
৪ অধ্যায় , শ্লোক ৩১, ৩২
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্।।
নায়ং লোকোহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম।।৩১।।
অনুবাদঃ হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যজ্ঞ অনুষ্ঠান না করে কেউই এই জগতে সুখে থাকতে পারে না, তা হলে পরলোকে সুখপ্রাপ্তি কি করে সম্ভব?
এবম্ বহুবিধাঃ যজ্ঞাঃ বিততাঃ ব্রাহ্মন মুখে ।
কর্মজান বিদ্ধি তান সর্বান এবম্ জ্ঞাত্বা বিমক্ষ্যসে ।।৩২
অনুবাদঃ এই সমস্ত যজ্ঞই বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়েছে এবং এই সমস্ত মুক্তি বিভিন্ন প্রকার কর্মজাত। সেগুলিকে যথাযথভাবে জানার মাধ্যমে তুমি মুক্তি লাভ করতে পারবে।
অর্থঃ এখানে কৃষ্ণ বলেছে যে - একমাত্র যজ্ঞ দ্বারাই সেই সনাতন ব্রহ্ম কে লাভ করা যায়, যারা যজ্ঞ করেনা তারা এই লোকেও সুখদায়ক তো হয়না, পরলোকে তো দূরের কথা। এই সমস্ত যজ্ঞের কথা (ব্রহ্মণো মুখে) বেদে কথন করা আছে। এই সমস্ত যজ্ঞ করলেই একমাত্র কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়
মা চিদন্যৎ বি শংসত সখায়ো মা রিষণ্যত।
ইন্দ্রমিৎ স্তোতা বৃষণং সচা সুতে মুহুরুক্থা চ শংসত।।
সামবেদ ৩.১.১০
পদার্থঃ হে (সখায়ঃ) মিত্র ! তুমি (অন্যৎ) অন্য কোন পদার্থ পাথরের মূর্তি, পর্বত আদিকে (মা চিৎ) না কখনো (বি শংসত) উপাস্যরূপে পূজা করো, (মা রিষণ্যৎ) যা উপাসনার অযোগ্য তার উপাসনা করে অশান্তি ভোগ করোনা। (সুতে) জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির রস নিষ্পাদিত হলে (সচা) একত্রিত হয়ে (বৃষণম্) সুখদাতা (ইন্দ্রম্ ইৎ) পরমেশ্বরেরই (স্তোতা) স্তুতি-উপাসনা করো এবং তার উদ্দেশ্যে (মুহুঃ) বারংবার (উক্থা চ) স্তোত্রেরও (শংসত) গান করো।।
ভাবার্থঃ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সংসারে যিনি সন্মানের যোগ্য, তার সন্মান অবশ্যই করা উচিত, কিন্তু এদের মধ্যে কাউকে পরমেশ্বর ভেবে পূজো করা উচিত নয়, আর না নদী, বৃক্ষ, পর্বত আদি জড় পদার্থের পূজো করা উচিত। ইন্দ্র আদি নামে বেদ মধ্যে প্রসিদ্ধ সুখপ্রদাতা এক জগদীশ্বরই বারংবার স্তুতি, প্রার্থনা, অর্চনা ও উপাসনা করার যোগ্য।।
গীতা ২/৪২-৪৪ শ্লোক গুলোতে কি বলেছে----
গীতা ২/৪২
যামিমাম্ পুষ্পিতাম্ বাচম্ প্রবদন্তি অবিপশ্চিতঃ ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ ন অন্যত্ অস্তি ইতি বাদিনঃ ॥৪২
পদার্থঃ ( অবিপশ্চিতঃ) {বিপশ্চিত্ বলা হয় পন্ডিতদের আর যিনি বিপশ্চিত্ নয় তাকে বলা হয় 'অবিপশ্চিতঃ'} সেই অবিপশ্চিত ব্যক্তিগণ (বেদবাদরতাঃ) বেদ কে না বুঝে (যামিমাম্) এই বাণী কে (পুষ্পিতাম্) অর্থপাদরূপ কথন করে (ন,অন্যত্, অস্তি) বেদে অন্য কোনো পরমার্থের উপদেশ নেই (ইতি বাদিনঃ) এই প্রকার মানেন অর্থ্যাৎ বেদ কে না বুঝে অবিপশ্চিত পুরুষ রা অনেক প্রকারের অর্থাভাস করে ।।-বৈদিক গীতা আর্যমুনি ভাষ্য
অর্থঃ এখানে সেই ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে সে সমস্ত মূর্খ অবিবেকী ব্যক্তিগণ বেদ কে না বুঝে উল্টো পাল্টা অর্থাভাস করে । এই অধ্যায়ের ৪৩,৪৪ শ্লোকে এই সমস্ত অবিপশ্চিত কর্মের কথা বলেছে । এখানে কোথায় বলা হয়েছে বেদ কে মানা যাবেনা ??
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ
বেদবাদরাতাঃ পার্থ নান্যদন্তীতি বাদিনঃ।।৪২।।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।৪৩।।
অনুবাদঃ বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ,উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদিসকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই।
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪।।
অনুবাদঃ যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মুঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না।
গীতা অধ্যায় ১৮ , শ্লোক সংখ্যা ৪৬
যতঃ প্রবৃত্তিঃ ভূতানাম্ যেন সর্বম্ ইদম্ ততম্ ।
স্বকর্মনা তম্ অভ্যর্চ্য সিদ্ধিম্ বিন্দতি মানবঃ ।।৪৬
অর্থ-যে পরমেশ্বর ভগবান থেকে সমস্ত জীবের উত্পত্তি, যিনি এই সমগ্র বিশ্ব ব্যপ্ত আছেন, তাকে মানুষ তার কর্মের দ্বারা অর্চনা করে সিদ্ধি লাভ করে।
কৃষ্ণ ভক্ত পৌরানিকদের মতে গীতা তো তাদের ঈশ্বর
কৃষ্ণের বাণী তাহলে এখানে কৃষ্ণ বলছে :- ' যে পরমেশ্বর ভগবান থেকে সমস্ত জীবের উত্পত্তি, যিনি এই সমগ্র বিশ্ব ব্যপ্ত আছেন , তাকে মানুষ কর্মর দ্বারা সিদ্ধিলাভ করে ' । ওদের মতে কৃষ্ণ তো নিজেই ঈশ্বর তো এখানে কৃষ্ণ কোন ঈশ্বর এই কথা বলছে ? এখানে 'যিনি' টি কে ? কৃষ্ণ নিজেই নিজেকে 'যিনি তিনি' বলতেন নাকি ? আরো দেখুন--
অধ্যায় ১৮ , শ্লোক ৬২
তম এব শরনম্ গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তত্ প্রসাদাত্ পরাম্ শান্তিম্ স্থানম্ প্রপ্সসি শাশ্বতম্ ।।৬২
অর্থ-হে ভারত সর্বত ভাবে তুমি সেই পরমেশ্বর শরনাগত হও। তার কৃপায় তুমি পরাশক্তি লাভ করবে এবং তার নিত্যধাম প্রাপ্ত হবে।
আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে অবতারবাদ বলে কোনো অযুক্তিক মত নেই ,শুধুমাত্র যজুর্বেদ এর ৪০ অধ্যায়ের ৮ নং মন্ত্র টি অবতারবাদ , সাকারবাদ , দ্বৈতবাদ ইত্যাদি অনেক মতবাদ কে খণ্ডন করে ।
ভাগবত পুরান ইত্যাদি ১৮ পুরান কোনোটিও মহর্ষি ব্যাসদেব এর লিখা নয়
দেখুন পৌরাণিক ভাইদের অবতার রূপকথার কাহানি...
হিন্দু ভাইয়েরা সবাই জানে যে বিষ্ণু দশ অবতার আছে (গডুর পুরাণ)। এর প্রমাণ ১৮ কথিত পুরান এর মধ্যে শুধু মাত্র গড়ুর পুরানে পাওয়া যায় গড়ুর পুরাণ(১।৮৬।১০-১১) দেখে নেবেন ।
কিন্তু এই দিকে ভাগবত পুরানে মাত্র ২২ টি অবতার কে মানা হয়েছে ! ভাগবত পুরান প্রথম স্কন্দ , তৃতীয় অধ্যায় এর ৬ - ২৫ শ্লোকের মধ্যে বিষ্ণুর ২২ অবতারের বর্ণনা দেওয়া আছে । এইবার বলুন তো ভাগবত হরে কৃষ্ণ ভাইয়েরা এবং পৌরাণিক ভায়েরা আপনারা কোনটা মানেন ? ২২ অবতার নাকি ১০ অবতার ?
আমি জানি ৯০ % হিন্দু ভায়েরাই ১০ অবতার কেই মানে, তাহলে এই সমস্ত ভায়েরা কিন্তু ভাগবত পুরাণ কে মানেনা কারণ এরা ভাগবতের ২২ অবতার কে মানেই না ।
ব্যাসদেব এমন গাঁজাখুরি কাহানি কখনোই লেখেনি কারণ তার লেখা মহাভারত,বেদান্ত দর্শন,এবং যোগদর্শন ভাষ্য দেখলে বোঝাযায় তিনি একজন মহা জ্ঞানী ,সত্যবাদী ছিলেন । পুরান এর মত অবৈজ্ঞানিক অবাস্তব মিথ্যা রূপকথার কাহানি কখনোই লেখেনি এই ধরনের পুরান গুলো লিখছে কিছু স্বার্থ লোভী ব্যক্তিরা । ভাগবত পুরাণ ১/৩/২২ শ্লোক অনুযায়ী ১৯ নং বলরাম এবং কৃষ্ণ হলো ২০ নং অবতার , আর ১৭ নং অবতার হলো ব্যাসদেব অর্থাৎ ঈশ্বর বিষ্ণুর এর তিন অবতার একসাথে একই সময় ছিল ।
১৮ পুরান কখনোই এক জনের রচিত নয় কারণ ১৮ পুরান একে অপর পুরানের স্ববিরোধী ,এক এক পুরানে এক এক ধরনের কাহিনী বিষ্ণু পুরানে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ শিব ওর দাস আবার শিব পুরানে শিব শ্রেষ্ঠ ,বিষ্ণু ওর দাস সব ধরনের পুরান গুলো এমনই স্ববিরোধী , এই ১৮ পুরানের লেখক রা ভালো করেই জানত যে তারা যদি নিজের নামে পুরান লেখে তাহলে কেউ বিস্বাস করবে না তাই তারা মহির্ষী ব্যাসদেব এর নামে এক একটা পুরান লেখেন , ঠিক এমনই শঙ্করাচার্য এর সাথে হয়েছে, শঙ্করাচার্য অনেক বড়ো বিদ্বান ছিলেন যার মাধ্যমে জৈন মতবাদ এর পরাজয় ঘটে ,শঙ্করাচার্য এর নামেও এমন অনেক ভণ্ডামি চালিয়েছে ,তার নামেও অনেক গ্রন্থ লিখেছে ভণ্ড রা যাতে সাধারণ মানুষে বিস্বাস করে ! প্রকৃত অর্থে পুরান কি শাস্ত্র অনুযায়ী পুরান কাকে বলে দেখুন
বর্তমান সময়ে বেদ এবং পুরান এর সম্পর্ক এবং এদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিকতার বিষয়টা নিয়ে একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।বেদ এর সাথে পুরানসমূহের সাংঘর্ষিকতা এবং পুরানসমূহের প্রচলন বৈদিক সভ্যতার পতন ও বৈদিক ধর্মের অবক্ষয় এর মূল কারন।পুরান বলতেই আমরা ৩৬টি প্রচলিত পুরান
(১৮টি প্রধান পুরান ও ১৮টি উপপুরান) কে বুঝি। কিন্তু আসলেই
কি তাই?
আমাদের ১৮টি পুরান এবং ১৮টি উপপুরান আছে যেগুলো ব্যসদেব কর্তৃক লিখিত বলে কথিত।এই পোষ্টে পুরানসমূহের প্রকৃত পরিচয় সম্বন্ধে আলোকপাত করা হবে। পুরানসমূহকে পঞ্চম বেদ এর ন্যয় মর্যাদা দেয়া হত।এটা বৈদিক যুগে পুরানসমূহের গুরুত্বপূর্ন অবস্থান নির্দেশ করে।
শ্রুতিশাস্ত্রে পুরান এর উল্লেখ-
"রিচা সামানি ছন্দমসি পুরানাম যজুসা সহ উচ্ছিস্টজ্জানি
রে সর্বে দিবি দেবা দিবি স্মৃতহ"
(অথর্ববেদ ১১.৭.২৪)
এবং
ইতিহাসাং চ পুরানাং চ গাথা চ ইতিহাসস্য চ স বায়
পুরানস্য চ গাথানাম চ নরসংসাম চ প্রিয়ম ধামা ভবতি য ইবম
বেদ
(অথর্ববেদ ১৫.৬.১১-১২)
অর্থাত্ ঋগ,সাম,যজু ও অথর্ব ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত,ঠিক তেমন
পুরান,ইতিহাস,গাথা,কল্প ও সকল দেবসমূহও তাঁর থেকে সৃষ্ট।
ছান্দেগ্য উপনিষদ বলেছে-
"ইতিহাসপুরানাম পঞ্চম বেদানাহ বেদহ"
(ছান্দেগ্য উপনিষদ ৭.১.২,৭.১.৪)
অর্থাত্ ইতিহাস পুরানসমূহ যেন পঞ্চম বেদরুপ। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে পুরানসমূহ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং এগুলো বেদ বুঝতে সহায়ক। বেদদ্রষ্টা এবং উপনিষদ রচয়িতা মুনিগন (যেমন ছান্দেগ্য উপনিষদ রচয়িত ঋষি উদ্দালক ,সনত্কুমার,সান্দিল্য মুনি কর্তৃক) সত্য এবং ত্রেতা যুগে জন্মগ্রহন করেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যসদেব দ্বাপর যুগে জন্মগ্রহন করেন। উপরের পয়েন্টগুলো থেকে এটা পরিস্কার যে পুরানসমূহের রচয়িতা এবং পুরানসমূহ বেদদ্রষ্টা ঋষিদের এবং বেদ এর
অনেক পরে এসেছে। সুতরাং বেদ এবং উপনিষদ এ উল্লেখিত পুরানসমূহ বর্তমান এ
প্রচলিত ৩৬টি পুরান নয় কেননা তখন ওই গ্রন্থগুলোই ছিলনা
এবং তাদের গ্রন্থকারদের জন্ম ই হয়নি।
সুতরাং পুরানসমূহ যার কথা বেদ এবং উপনিষদ এ উল্লেখিত
তা বর্তমানে প্রচলিত ৩৬টি পুরাণ নয়।তাহলে এখন প্রশ্ন হল
পুরান কোনগুলো যার কথা বেদ ও উপনিষদ এ এত গুরুত্বের সাথে
বলা হয়েছে?
মহাভারত এ ব্যসদের বলেছেন বেদ বোঝার জন্য পুরানসমূহ
প্রয়োজন-
"তথা হি মহাভারতে মানবিয়ে চ ইতিহাস পুরানাব হ্যম
বেদম সমুপব্রহ্ময়েত বিভেয়ি অল্পশ্রুতদ বেদো মম অয়ম
প্রহরীস্যতি ইতি
পুরানাম পুরানাম ইতি চন্যয়ত্র্য
ন চ বেদেন বেদেস্য ব্রহ্মনম সম্ভবতি ন
য অপরিপুর্নস্য কনক
বলয়সি অ ত্রপুনা পূর্নম যুজ্যতে"
(মহাভারত আদি পর্ব,১.২৬৭,২৬৮)
বর্তমানে প্রচলিত পুরানসমূহের মতে ব্যসদেব মহাভারত
লেখার ও বহুকাল পরে পুরানসমূহ রচনা করেন।যদি তাই হয়ে
থাকে তবে মহাভারত এ পুরান শব্দটি এলো কি করে?কেননা
তখন পর্যন্ত তো পুরান বলে তো কিছু ছিলই না!এর মাধ্যমে
মহাভারত এ উল্লেখিত পুরান মহাভারত এর আগে থেকেই
বিদ্যমান ছিল।
অর্থাত্ বর্তমানে প্রচলিত ৩৬টি পুরান মহাভারত এ
উল্লেখিত পুরানসমূহ নয়।
*ঐতরেয়, শতপথ, গোপথ ও সাম-এই চারটি ব্রাহ্মন গ্রন্থ ই হল
বেদ,উপনিষদ ও মহাভারত এ উল্লেখিত অতীব গুরুত্বপূর্ন পুরান! এই চার ব্রাহ্মন গ্রন্থের অপর নামগুলো হল
ইতিহাস,পুরান,কল্প,গাথা এবং নরসংশি। যখন ব্রাহ্মন গ্রন্থে বিভিন্ন পুর্বাপর ঘটনা বর্ণিত থাকে
তখন তার নাম হয় ইতিহাস(যেমন ঐতেরিয় ব্রাহ্মন এ যাজ্ঞবল্ক্যসহ বিভিন্ন ঋষির ইতিহাস)
¤ব্রাহ্মন গ্রন্থসমূহে যখন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন তার নাম হয় পুরান(শতপথ ব্রাহ্মন এর সৃষ্টিতত্ত্ব) যখন বৈদিক শব্দের ব্যকরন ও অর্থ এবং তার ব্যুত্পত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন এদের নাম হয় কল্প যেহেতু বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেহেতু আরেক নাম গাথা। অনেক স্থানে বিভিন্ন কাহিনীর মাধ্যমে ভাল-মন্দের নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাই আরেক নাম নরশংশি।
পুরান এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সায়নাচার্য বলেছেন-
"ইদম নৈব কিমছনসিন্নদ রসিতিত্যদিবম।
জগতঃ প্রগনবস্থাম উপক্রম্য স্বর্গপ্রতিপদ একম বাক্যথতম
পুরানাম"
(Aiterya Aranyaka,shayana bhumika)
অর্থাত্ সৃষ্টির পূর্বে শুধু সেই এক ও অদ্বিতীয় ই বিরাজমান ছিলেন।সৃষ্টির পর তাঁর সৃষ্টির তত্ত্ব নিয়ে যেগুলো আলোচনা করল সেগুলো পুরান। আরো স্পষ্ট করে দিতে এবং মানুষ যাতে দ্বিধায় না ভুগে
সেজন্য বলেছেন,
"ন ব্রহ্ম যজ্ঞ প্রকারনেমন্ত্র ব্রাহ্মনব্যতিরেকে ত
ইতিহাস্যেভাগ অম্লয়ন্তে"
অর্থাত্, ব্রহ্ম যজ্ঞে মন্ত্র উচ্চারন করা হয় যে ব্রাহ্মনসমূহথেকে সেগুলো ব্যতিরেক অন্য কোন গ্রন্থ ই পুরান
নয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বৈদিক যুগে যজ্ঞের পরে যজমানরা
ব্রাহ্মন গ্রন্থসমূহ থেকে সৃষ্টিসুক্ত সমূহ উচ্চারন করত যে কারনে এসব গ্রন্থকে পুরান বলা হত।
তৈত্তিরীয় আরন্যক এর ২.৯ এ স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে-
"য়দ ব্রাহ্মনি ইতিহাস পুরানানি কল্পন গাথা নরসংশি"
অর্থাত্ মন্ত্রের বিষয় ভিত্তিতে ব্রাহ্মন গ্রন্থসমূহই
পুরান,ইতিহাস,কল্প,গাথা ও নরসংশি নামে পরিচিত।
সুতরাং এটা পরিস্কার যে বেদ,উপনিষদ ও মহাভারতে
উল্লেখিত পুরান হল ব্রাহ্মনগ্রন্থসমূহ এবং প্রচলিত ৩৬টি
পুরানসমূহ(বিষ্ণু পুরান,নারদিয় পুরান,অগ্নি পুরান,পদ্ম
পুরান,গঢ়ুড় পুরান,মার্কন্ডেয় পুরান,শিব পুরান,লিঙ্গ
পুরান,স্কন্দ পুরান ইত্যাদি) প্রকৃত পুরান নয়।আরো খেয়াল করে
এই পুরানসমূহ পড়লে বোঝা যায় যে নানারকম
ভূল,অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব কাহিনীতে
পরিপূর্ন,অশ্লীলতায় ভরা এই বিকৃত পুস্তকসমূহ মোটেও মহর্ষি
ব্যসদেব এর লেখা নয়। মহির্ষী রা হয় এক একজন বেদজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞ মহা বিদ্ধান , তারা কখনোই এই ধরণের মিথ্যা কাহানি লেখেনি । কিছু ধর্মব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রের
ফসল।
সুতরাং সনাতন এর ঐক্যের স্বার্থে এবং বৈদিক ধর্মের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এইসব মিথ্যা গ্রন্থ আমাদের বর্জন করা উচিত
শ্রীজীব গোস্বামী কৃত চৈতন্য চরিতামৃতে মহাপ্রভু শচীমাতাকে
বলেছিলেন
"তোমাকে এড়াতে শক্তি নাইকো আমার,
তব গর্ভে জন্ম নিব আরো দুইবার। শেষ জন্ম নিব মাগো ঐশাণ্য কোণে,
হরিনামে মাতাইব সর্ব্বজীব গণে।
বৃন্দাবন দাসের রচিত চৈতন্য ভাগবতের মধ্য খন্ডের ২৬ অধ্যায় ব্রাহ্মণ কূলের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে মহাপ্রভু বলেছেন- ব্রাহ্মণকূলের গর্ব খর্ব করিবার,
নীচকূলে জন্মলাভ করিব আবার।
শচীমাতা ও ভক্তবৃন্দের নিকট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে শ্রী গৌরাঙ্গ প্রথমে ক্ষেতরে শ্রীনিবাস রূপে এবং শেষে পুরীধাম থেকে ঐশাণ্য কোণে অবস্থিত শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে লীলা প্রকাশ করেছেন।
বিষ্ণুপুরাণে গৌতমবুদ্ধকে বর প্রদান কালে মহাবিষ্ণু বলেছিলেন-
প্রভু বলে তব নামে অবতার হব,
প্রণব ত্রিগুন নাম শূদ্রকে বিলাব।
এক হরিনাম মধ্যে গুন দিয়া সব,
নীচ জনে করাইব পরম বৈষ্ণব।
বুদ্ধ বলে যদি প্রভু হও অবতার,
এদেশে থাকেনা যেন জাতির বিচার।
এই প্রতিশ্রূতি অনুসারে মহাবিষ্ণু নীচ জাতিকে, নীচ জাতির অধিকার আদায়ের জন্য নমঃশূদ্র কূলে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
স্বার্থান্বেষী মানুষের মনগড়া কৃত্রিম জাতিভেদ প্রথার বিলোপ্ত করে "মতুয়া" নামে একটা মহা জাতির সৃষ্টি করেছেন।
“শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” মহাগ্রন্থের নিম্নলিখিত দুইখানি লাইন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ । হরিচাঁদ ঠাকুরের মুখনিঃশৃত এই বাণী তাঁর অনুগামী ভক্তদের প্রতি এক ‘দৃঢ় বার্তা’ ।
‘পাগলের নামে বিদ্বেষ’ অংশে হরিচাঁদ ঠাকুর ভক্তদের বলেছেন -----
“রাগাত্মিকা রাগ ধর্ম ওড়াকান্দী গণ ।
এর পরে নাহি কোন সাধন ভজন ।।” (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, পৃঃ ১৪৩)
ব্যাখ্যাঃ- বিশুদ্ধ ও একনিষ্ঠ প্রেম-ভক্তির সাথে মন-প্রাণ উজার করে আত্মদান-ই হল “রাগাত্মিকা” প্রেম-ভক্তি । মতুয়ারা হরিচাঁদের প্রতি যা সর্বক্ষণ বজায় রেখে চলবে । ‘রাগাত্মিকা’ ভক্তি তথাকথিত সাধন ভজন বা *বেদ-বিধির ঊর্দ্ধে* । সময় বা অর্থের অপচয় করে বাহ্যিক উপাচার বা তথাকথিত শাস্ত্রের অনুশাষণ মেনে চলার অন্তরায় ----- যাকে ‘রাগ-ধর্ম’ বলা হয়েছে । এখানে বেশ কিছু জিনিস স্পষ্টত বলা যায় ------ তা হলঃ-
ক) কিছু চাওয়া-পাওয়ার শর্ত থাকে না ।
খ) কাল্পনিক পাপ-পুণ্যের কোন ভয় থাকে না ।
গ) বিশেষ সাজ বা পোষাকের প্রয়োজন হয় না ।
ঘ) ছোট-বড়, নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ থাকে না ।
ঙ) বিশেষ ধরণের কোন মন্দির/ঠাকুর ঘরের প্রয়োজন হয় না ।
চ) বিশেষ নিয়মে পূজার্চণার প্রয়োজন হয় না ।
ছ) বিশেষ নিয়মে বিশেষ কিছু নৈবিদ্যি সাজানোর প্রয়োজন হয় না ।
জ) প্রাণের ঠাকুরকে ডাকার নির্দিষ্ট কোন স্থান-কাল নাই ।
ঝ) নাম-গান-মাতাম এর মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না ----- এ যেন অন্তরের অন্তস্থল হতে প্রাণের ঠাকুরের প্রতি সবকিছু উজার করে দেওয়া !
অর্থাৎ, মতুয়ারা রাগাত্মিকা রাগ-ধর্ম অনুযায়ী জীবন ধারণ করবে । হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র “ওড়াকান্দী” । মতুয়াদের কাছে প্রধান পুণ্যক্ষেত্র, পুণ্যভূমি । “ওড়াকান্দী গণ” বলতে মতুয়াদের বোঝানো হয়েছে । সুতরাং, রাগাত্মিকা রাগ ধর্মে মাতোয়ারা মতুয়ারা তথাকথিত সাধন ভজনের ঊর্দ্ধে ।
সুতরাং, একথা বলা যায় কোন বিশেষ ধর্মমতের সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে ধর্ম-পথে নিজেকে ধরে রাখার সমস্ত দুয়ার খুলে দিয়েছেন দয়াল হরিচাঁদ । যা মানবতাবাদের পথকে সুনিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করে ।
ভবিষ্যপুরাণ ও মুহাম্মদ পডুন লিঙ্ক
মতুয়া সম্প্রদায়ের অপব্যাখ্যা
আমরা লক্ষ করেছি বিভিন্ন স্হানে অনেক মতুয়া গোঁসাইরা “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে বর্ণিত হরিচাঁদের বাণী, উপদেশ, তারকচন্দ্র সরকারের মন্তব্য ইত্যাদির বিকৃত ব্যাখ্যা করে মতুয়া বৈদিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়ে বৈদিক আচার পালনের জন্য ভক্তমহলে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা মতুয়াধর্ম যে একটি আলাদা অবৈদিক ধর্ম তা প্রচার করেন না এবং স্বীকারও করেন না। সেইসব গোঁসাইরা দু’রকমের হয়ে থাকেন। একদল না বুঝে পূর্ববর্তী অজ্ঞ গোঁসাইদের উপদেশ অনুসরণ করে নিজেরাও ভুল পথে পরিচালিত হয়ে ভুল ব্যাখ্যা করেন। যাঁরা মতুয়াধর্মের প্রকৃত মর্ম না বুঝে এসব করে থাকেন, তাঁদের সম্পর্কে এইটুকুই বলা যায় যে, তাঁরা যেন জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত মতুয়াদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য ও তত্ত্ব জানার চেষ্টা করেন এবং মতুয়াধর্ম যে বৈদিক হিন্দুধর্ম থেকে একটি আলাদা অবৈদিক ধর্ম তা বুঝে সে সম্পর্কে সঠিক উপদেশ ভক্তমহলে প্রচার করেন। দ্বিতীয় যে সব গোঁসাইরা বিকৃত ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা কিন্তু জেনেবুঝেই এসব করে থাকেন। তাঁরা চতুরালি করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই এসব করে থাকেন। তাঁরা আসলে ছদ্মবেশধারী ব্রাহ্মণ্যবাদী মতুয়া অর্থাৎ ভণ্ড মতুয়া। তাঁরা গোঁসাই বেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী কায়দায় গুরুগিরি করে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্য এবং বিনাশ্রমে দুধ-সর-ননি-মাখন খেয়ে শরীর পালন ও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকল্পে মতুয়াদের ব্রাহ্মণ্যবাদী করে তোলার জন্য সব সময়ই সচেষ্ট। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এমন ধূর্ত মতুয়া-গুরুদের আবির্ভাব ইদানিং বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরকে পুরোপুরি হিন্দুদের কল্পিত সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুর অবতার রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ প্রমুখের উত্তরসূরি রূপে ব্যাখ্যা করেন এবং মতুয়াধর্ম কোনো আলাদা ধর্ম নয়, হিন্দুধর্মেরই অঙ্গীভূত বলে প্রচার করে থাকেন। এঁরা রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ ইত্যাদির জয়ধ্বনি দিয়ে, হরিচাঁদ ঠাকুরের পাশে তাদের ছবি রেখে ভক্তদের দিয়ে মহোৎসব করান, রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ ইত্যাদির লীলা বর্ণনা করে কীর্তন করান, এবং গুরুপূজা, গুরুপ্রণামী ও গুরুদক্ষিণা নিয়ে দীক্ষা দিয়ে মতুয়াভক্তকে শিষ্য করেন। মহোৎসবের নামে হাজার হাজার টাকা, এমনকি লক্ষাধিক টাকাও এভাবে তাঁরা লুট করে নিয়ে যান। এটাই তাঁদের একমাত্র জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছদ্মবেশী এইসব মতুয়া-গুরুদের মধ্যে অনেকে বৈদিকধর্মের তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকও আছেন। তাঁদের মদত দেন স্থানীয় শিক্ষিত ধূর্ত মতুয়াবেশধারী সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। মতুয়া মহলে দীক্ষা দেবার দোহাই হিসাবে এইসব গুরুরা হরিচাঁদের বাণীর অপব্যাখ্যা করে বলেন- “অদীক্ষিত, করিবে না তীর্থ পর্যটন। মুক্তি স্পৃহা শূন্য, নাই সাধন ভজন।।’’এর ব্যাখ্যা করেন- “দীক্ষা না নিয়ে কেউ তীর্থ-পর্যটনে যাবে না। যার মুক্তি স্পৃহা নেই, তার সাধন ভজনও হয় না। সুতরাং দীক্ষা নাও, তারপর তীর্থ করতে যাও। অন্তরে মুক্তির বাসনা নিয়ে সাধন-ভজনে এগিয়ে যাও। অনেক বিজ্ঞ পাঠক নিশ্চয়ই এ ব্যাখ্যা শুনে হাসবেন। কিন্তু সত্যি বলছি, এই প্রতিবেদক সাধারণ সহজ সরল ভক্ত মহলে ওইসব গুরুদের এই ব্যাখ্যা স্বকর্ণে শুনেছেন এবং ভক্তদের মধ্যে মতুয়ামতে দীক্ষা নেওয়ার প্রথাও বহুল প্রচারিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের স্থানীয় লোক তথা সহজ সরল আদিবাসীদেরও এইভাবে দীক্ষা দিয়ে চলেছেন। উপরে উদ্ধৃত লীলামৃতের বাণীটির এমন ব্যাখ্যা বাংলাদেশ তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক গুরু-গোঁসাইরাও করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা এটা লক্ষ করেন না যে, ওই গ্রন্থের অন্যত্র বলা হয়েছে- “বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র-মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে। ”(পৃঃ ৭০)
আবার হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতিভূ হিসাবে যিনি আজন্ম মতুয়াধর্ম প্রচার করে গিয়েছেন, সেই গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-
“দীক্ষা বৃথা, কর বৃথা তীর্থ পর্যটন।
মুক্তি বৃথা, কিবা কর সাধন ভজন\” (শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত, পৃঃ ১৪)
আবার-
“এক জাতি এক প্রাণ, সবে ডাকে হরিচান,
একই তরঙ্গে ভাসে একই সাগরে।
নাহি দেবদেবী পূজা, দীক্ষাহীন মহাতেজা,
একই মহামন্ত্রে বলে সবে জাগোরে।।”(ঐ, পৃঃ ৭০)
এ সম্পর্কে আরও উদাহরণ আছে। যথা-
“মন্ত্রতন্ত্র দীক্ষা নাই, পবিত্রতা রক্ষা চাই,
গৃহধর্মে সব পাই মানব জীবনে।
পবিত্রতা সত্য বাক্য, মনে যেবা করে ঐক্য,
হরি আছে তার পক্ষ সদা সর্বক্ষণে।।” (ঐ, পৃঃ ৪৮৪)
কিংবা
“দীক্ষা শিক্ষা কোন কিছু নাহি প্রয়োজন।
হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন।।” (ঐ, পৃঃ ৫৭৩)।
আবার মুক্তি প্রসঙ্গে লীলামৃতে আছে-
“মুক্তি শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যে যারা ভক্তি নাহি চিনে।
হরি নামে পাপ ক্ষয় তারা ইহা ভণে।
মুক্তিকে যে তুচ্ছ করে ভক্তি করে সার।
পুণ্যকে না দেয় স্হান পাপ কোন ছার।।” (শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত, পৃঃ ৪)
অর্থাৎ মতুয়ারা মুক্তিকে তুচ্ছ করে ভক্তিকে সার মনে করেন। তাই তাঁরা সাধন-ভজন করারও কোনো প্রয়োজন মনে করেন না।-[সুধীর রঞ্জন হালদার]
'নমঃশূদ্র' বলে কোন বর্ণ,সমাজ বা জনগোষ্ঠীর নাম সনাতন ধর্মের প্রামাণ্য ধর্ম পুস্তকে নাই।'নমঃশূদ্র' ব্যাখ্যা করলে তার অর্থ নিম্নপ্রকার হয়।নমো অথবা নমঃ শব্দের অর্থ প্রণাম অথবা অন্ন আর শূদ্র কথার অর্থ ধর্মীয় চেতনা এবং সামজিক কাণ্ডজ্ঞানহীন শ্রমজীবী মানুষ।প্রামাণ্য গ্রন্থে পাওয়া যায় "নমঃশূদ্র " জনসমাজ বল্লাল সেনের শাসনের পূর্বে এবং সময়কালে ছিল শ্রাস্ত্রজ্ঞ,উন্নত ব্রাহ্মণ শ্রেণী।বল্লাল সেনের পিতা এবং বল্লাল সেন ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভট্রপাদ সিংহ গিরি বল্লাল সেনকে বৌদ্ধ ধর্ম মত হতে শৈব বা শিব মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে সনাতন ধর্মে টেনে আনেন। রাজা হবার কারণে সনাতন ধর্মের বৈদিক ধ্যান ধারণা সব ছিন্ন ভিন্ন করে পোঁষা পুরোহিত শ্রেণীদের সাহায্যে সনাতন ধর্ম ও এই ধর্মের জনগোষ্ঠীর বারোটা বাজান।"হলায়ুধ এবং উমাপতি " নামে দুইজন ব্রাহ্মণ তাকে এই সমাজ ধংসের চক্রান্তে সাহায্য করে।বল্লাল সেনের অত্যাচারে এক অখন্ড আর্য জাতি শত শত জাতি,উপজাতিতে বিভক্ত হলো।আনন্দ ভট্র নামে একজন ব্রাহ্মণ লিখেছেন-"নিশ্চিতং জারজং সোহপি দৃষ্কর্ম মন্দ বিস্তথা"।"চন্ডাল ডোম কন্যাদৌ রতোহ সেযৌ সাধু পীড়কঃ।।" অর্থাৎ - বিজয় সেনের জারজ পুত্র বল্লাল সেন দৃষ্কর্ম পরায়ণ,সাধু পীড়ক,ডোম এবং চন্ডাল কন্যাতে আসক্ত।এই বল্লাল সেনের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন নমঃশূদ্রের পূর্ব পুরুষ তৎকালীন ব্রাহ্মণরা। শ্রাস্ত্র বিচারে বল্লাল সেনের পোঁষা পুরোহিতরা শোচনীয় ভাবে হেরে যায়।বল্লাল সেন বিজয়ী ব্রাহ্মণদের রাজ্যহারা এবং সমাজচ্যুত করেন। রাজ্য ও সমাজহারা এইসকল ব্রাহ্মণেরা বিল-নদ-নদী ও জঙ্গল এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।এই সকল ব্রাহ্মণদের বল্লাল "নমঃশূদ্র" ঘোষণা করেন।।তার ভাষায় "নমঃশূদ্র " অর্থ পরাজিত ব্রাহ্মণেরা "শূদ্র " তবে প্রণাম পাবার যোগ্য। বল্লাল সেনের দ্বারা কদর্য বিভাজনের ফলে সেই বিজয়ী ব্রাহ্মণের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে ভন্ডামী এবং হীন দোষযুক্ত এই নমঃশূদ্র নাম গ্রহণ করে নিজেরা প্রামাণ্য শ্রাস্ত্রের সামাজিক পরিচয় "আর্যজাতি" বা অমৃতের সন্তান বা ব্রাহ্মণজাতির পরিচয় প্রকাশ না করে দূর্বলতা যুক্ত মিথ্যা পরিচয় বহন করে চলেছে। প্রমাণ স্বরুপ বলা যায় ১৮৮২ ইং সালে তথাকথিত বর্ণবাদীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এক সরকারি আদেশ চন্ডাল নাম হতে নমঃশূদ্র নামকরণ করা হয়। পরিপত্রটি নিম্নরূপ -
That Namasudra must always be written and not Chandal for all person's of the said caste! That the Deputy Commissioner has ordered that any one who does not write Namasudra shall be remove from employ-Sd.w.c. Macpherson,Assistant commissioner sylhet 09/09/1882. অতীতের প্রমাণ মতে নমঃশূদ্র সমাজের সকল মানুষের পূর্ব পুরুষ শ্রাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল।আর বর্তমানে এই সমাজের মধ্যে যারা শ্রাস্ত্রালোচনা করেন,জ্ঞানী, ধর্মপ্রাণ,শিক্ষিত,সচেতন সকলেই সনাতন ধর্মের বিধানে ব্রাহ্মণ এবং কর্ম গুণে কেহ ক্ষত্রিয়,বৈশ্য এবং শূদ্র। "নমঃশূদ্র " নাম বল্লাল সেনের দেওয়া। এই নমঃশূদ্র নাম মনে প্রাণে সকলের ত্যাগ করা পরমধর্ম প কর্তব্য।
ধূর্ত ফন্ডিতগন ব্যঞ্জনবর্ণ স্বরবর্ণের সমবায়ে গঠিত যে বর্নাত্মক নাম যেমন, কৃষ্ণ কৃষ্ণ,কালী কালী,রাম রাম জপ করতে শিখিয়েছেন ভেবে দেখুন তো, 'ওঁ রাং রামায় নমঃ' এই মন্ত্রই যদি তারকব্রহ্ম নাম হয়, তাহলে ভগবান রাম ত ত্রেতাযুগে এসেছিলেন, সত্যযুগের লোকরা পরমেশ্বর কি নামে ডাকতো..? আপনার নাম যদি গদায় হয়, আপনি তো আর গুরুর কাছ তেকে "ওঁ গদায় নমঃ" মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে জপ করবেন না..? কাজেই শ্রীরামচন্দ্র নিশ্চয় গুরুর কাছ থেকে "রাং রামায় নমঃ" এই মন্ত্র নিয়ে জপ করতে বসে যান নি ! তাছাড়া ভগবান রামচন্দ্রের যিনি গুরু ছিলেন তিনি কোন্ তারকব্রহ্ম নামে ঈশ্বরকে ডাকতেন..?
ঋষি বৈশিষ্ঠ নাকি যোগবলে, জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে "রাম" এই নামকরণ করেছিলেন, তাহলে এই "রাম" নাম আবিষ্কারের পূর্ব্বেও তো রাজা দশরথ ও কৌশল্যা পরমেশ্বরকে ডাকতেন, সেটা কি নামে..?
তারপর পৌরাণিকদের কথামত, যে "রাম নাম" মুক্তি পথের তরণী হওয়ায় বহু সাধু ঋষি এই রাম নামের মহিমায় এত বই লিখে গেলেন, যার ফলে আপনারা আজও রাম নাম করতে করতে দরবিগলিত অশ্রু হ'ন, নিজেদের মা বাপের অন্তিম সময়ে তাঁদের কর্ন কুহরে উচ্চনাদে রাম নাম শুনিয়ে দিয়ে তাঁদের ভব সমুদ্রের মুক্তি-তরনীটি জুগিয়ে দেন একেবারে তাঁদের হাতের কাছে- পৌরাণিকদের অন্য দল এই রাম নাম কে মুক্তিপ্রদ নাম বলে স্বীকার করতে রাজী নন !
এক দল আবার ঢক্কানিনাদ সহ প্রচার করেছেন, "কৃষ্ণ" নামই একমাত্র অভয় অমৃত মুক্তিপ্রদ "প্রেমদ" মন্ত্র ! "ক্লীং কৃষ্ণায় গোবিন্দায় গোপীজনবল্লভায় স্বাহা" জে করলে বিষ্ণু দূতরা মরণকালে পুস্পকরথ সাজিয়ে এনে মৃত্যুপথ যাত্রীকে একেবারে গোলোকে নিয়ে যাবে,
স্থান হবে, "অপ্রাকৃত নিত্যলোক রসভূমি বৃন্দাবনে !!"
যে পরমানন্দময় মুক্তির অবস্থার কথা বেদ উপনিষদে বলা হয়েছে ঐ কৃষ্ণভক্ত সম্প্রদায় আবার এহেনমুক্তিকেই 'তুচ্ছ' বলেন। এঁরা মুক্তি কে বলেন "পিশাচী"; "যাবৎ ভুক্তিমুক্তিস্পৃহা পিশাচী হৃদি বর্ত্ততে,-যতক্ষণ হৃদয়ে ভুক্তি বা মুক্তিরূপ পিশাচী লাভের স্পৃহা থাকবে ততক্ষণ কৃষ্ণভক্তি জন্মাবে না" !! আচ্ছা, বিচার করে দেখুন তো, কৃষ্ণতো দ্বাপরযুগে এসেছিলেন, "কৃষ্ণ" এই কথাটাই যদি তাঁর 'নাম' হয় তাহ'লে সত্য ত্রেতার ভক্তরা তাঁকে কি "নামে" ডাকতেন..?
কৃষ্ণ নিশ্চয় সন্দীপন গুরুর কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন্ নি ! ঐ বৈষ্ণবদের দল আরও বলেন, রাম এবং কৃষ্ণে তত্ত্বতঃ ভেদ নাই, রসগত ভেদ আছে। তাহলে সত্য ত্রেতার প্রজ্ঞাবান ঋষিরা এই রসের ভিয়ান জানতেন না বুঝি..? তাঁরা এই 'রসের আস্বাদন" তেকে বঞ্চিত ছিলেন..?
এই রামভক্ত কৃষ্ণভক্তের দল ছাড়াও আরো সহস্র দল Patent Registered করা মুক্তিপ্রদ "নামের" ব্যবস্থা আছে। কেউ বলছেন-" ওঁ তারে তারে তত্তারে স্বাহা" এই জপলেই মুক্তি; কেউ " হ্রীং শ্রীং ক্রীং" কেউ "ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়",আরো কত কি..।
এরূপ আচরনকারী হিন্দুদের কখনো একজোট করা সম্ভব না যতক্ষন না তাঁরা নিজেদের প্রকৃত বীর আর্য সন্তান বলে জানতে ও মানতে পারছে....
আবৃত্তিস্তত্রাপ্যুত্তরোত্তরযোনিযোগাদ্বেয়ঃ।। সাংখ্যঃ ৩।৫২সরলার্থঃ যত উচ্চ জন্ম হউক না কেন তাহা জন্ম ও মৃত্যুর অধীন এবং তাহাকে স্থির রাখিবার জন্য কর্মরূপ আবৃত্তির প্রয়োজন যাহা ত্রিবিধ দুঃখের অধীন। যাহা আবৃত্তি সাপেক্ষ তাহা পরম পুরুযার্থ হইতে পারে না। সেই কারণ জন্মের নিবৃত্তি বা বন্ধন মোচনের দ্বারা মুক্তির উপায়ই পুরুষের শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ, অন্য সমস্ত পুরুষার্থ হেয় বা গৌণ। "সমানংজরামরণাদিজং দুঃখম্ " অর্থাৎ- যত প্রকার উচ্ছ জন্ম লাভ হউক না কেন সে সমস্তই জরামরণাদি দুঃখের অধীন সেই কারণ মুক্তির প্রয়োজন। "স হি সর্ববিৎসর্বকর্ত্তা" -ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান, এক রস ও অমূর্ত্ত বলিয়া সমস্তই তাঁহার অধীনে রাখিতে পারেন। তিনিই সৃষ্টির একমাত্র কর্ত্তা। জ্ঞানই কর্ত্তৃত্বের মূল। তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র নিরপেক্ষ কর্ত্তা। "ইদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা" -তিনিই সৃষ্টিকর্ত্তা, নিত্যমুক্ত, একরস। মুক্ত পুরুষ সূক্ষ্ম শরীর লইয়া মুক্তাবস্থায় ব্রহ্মানন্দে অবস্থান করেন, তিনি কখনোও ঈশ্বর হতে পারেন না..सहासनं अभिप्रेप्सुरुत्कृष्टस्यापकृष्टजः ।कट्यां कृताङ्को निर्वास्यः स्फिचं वास्यावकर्तयेत् ।।
মনুস্মৃতির প্রক্ষিপ্ত শ্লোক-৮/২৮১
টিপ্পণী-যে সাত ( ৮/২৭৯-২৮৫) শ্লোক নিম্নলিখিত কারণে প্রক্ষিপ্ত। ১-প্রসঙ্গ বিরোধ-( ক) মনু-২৮৬-২৮৮ শ্লোকে সকল বর্ণের জন্য সমভাব থেকে দন্ড-পরুষ্যের শাস্তি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু ২৭৯-২৮৩ স্লোকে শূদ্রের ( ব্রাহ্মণদের অপমান করার জন্য) আংশিক শাস্তির বিধান রয়েছে। ইহাকে যদি সত্য মনে করা হয়, তাহলে অন্যান্য বর্ণের জন্যও আলাদা আইন করা উচিত ছিল। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে এই শ্লোকগুলো শূদ্রের প্রতি পক্ষপাতমূলকভাবে লেখা হয়েছে। (খ) ২৮৫ তম শ্লোকে বৃক্ষ ধ্বংসের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে,
যা দন্ডপুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হওয়ার কারণে অসঙ্গতিপূর্ণ। ২- বিরোধ-এই শ্লোকগুলিতে বর্ণিত শাস্তি ব্যবস্থা মনুর বিশ্বাসের পরিপন্থী। এতদর্থ ৮/২৬৭-২৭২ শ্লোকের পর্যালোচনা দৃশ্যমান। ৩-শৈলী-বিরোধ-২৭৯তম শ্লোকের 'মনোর্নুশাসনম' শ্লোক থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মনুর নামে অন্য কেউ এই শ্লোকগুলি রচনা করেছে। আর এই শ্লোকগুলোর ধরন মনুর মতো গুরুতর নয়, বরং পক্ষপাত, কুসংস্কার ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। তাই এই শ্লোকগুলো প্রক্ষিপ্ত। -(ভাষ্য,পণ্ডিত আচার্য রাজবীর শাস্ত্রী)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ