চার্বাক সিদ্ধান্ত আলোচনা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

21 November, 2021

চার্বাক সিদ্ধান্ত আলোচনা

                                  

চার্বাক নামের উৎস

ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে বস্তুবাদী দর্শনটির নজির যত প্রাচীনই হোক-না কেন, এ মতবাদের চার্বাক নামকরণ সে তুলনায় অর্বাচীন। অষ্টম-নবম শতকের আগে দর্শন সাহিত্যে এ নামের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন চোখে পড়ে না। প্রাচীনেরা এ মতটিকে প্রধানত লোকায়ত নামেই উল্লেখ করেছেন। ওই অষ্টম-নবম শতক থেকেই বস্তুবাদী অর্থে লোকায়ত বা চার্বাক মতের সমালোচনায় বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় বিভিন্ন মতের দার্শনিকগণকে। এদের মধ্যে নবম শতকের ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্ট প্রধানতম। অন্যরা হলেন অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় শান্তরক্ষিত ও কমলশীল এবং জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী।

 .

লোকায়ত নামে চার্বাক মতের প্রাচীনতম অন্তর্ভুক্তির নিদর্শন হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য হলেও বস্তুবাদ অর্থে চার্বাক শব্দের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত। কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তাঁর গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের নামও উল্লেখ করেছেন। চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে এই পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের কথা আদৌ জানা যায় না।

 .

চার্বাক মতের প্রধানতম সমালোচক নবম শতকের ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত প্রতিনিধি জয়ন্ত ভট্ট। জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্য যেমন প্রগাঢ়, যুক্তি ও বিচার যেমন প্রখর, তেমনি তাঁর আশ্চর্য লেখার কায়দা বা রচনা কৌশলের বন্যায় যেন বিপক্ষমতকে একেবারে ভাসিয়ে নেবার মতো। স্বীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি তাঁর রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে অন্যতম বিপক্ষ মত খণ্ডনে চরম বস্তুবাদী মত বোঝাতে সুস্পষ্টভাবে চার্বাক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবং তার সঙ্গে রকমারি বিশেষণ যোগ করে মতটি নিয়ে তিনি হাসি-তামাশা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতেও পিছপা হননি। কোথাও তিনি চার্বাককে হাবাগোবা অর্থে ‘বরাক’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ’ উদ্ধৃতি দিয়ে, কোথাও বা চার্বাককে তুখোড় প্রতারক অর্থে ‘ধূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কোথাও ‘সুশিতিতরাঃ’ বিশেষণও ব্যবহার করেছেন। জয়ন্ত ভট্টের এরকম বিচিত্র বিশেষণ ব্যবহার থেকে ঐতিহাসিকেরা চার্বাকদের বিভিন্ন প্রাচীন গোষ্ঠির উপস্থিতির অনুমানও করে থাকেন। তবে একাধিক গোষ্ঠি থাকলেও জয়ন্ত ভট্টের লেখায় চার্বাক শব্দ চরম বস্তুবাদেরই নিদর্শক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

 .

খ্রীস্টিয় অষ্টম শতকে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ নামকরণেই বোঝা যায় সেকালের ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে জৈন মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই এর উদ্দেশ্য। সেকালের প্রখ্যাত ছটি দার্শনিক মতের অন্যতম ছিলো বস্তুবাদী লোকায়ত মত। হরিভদ্র কোথাও চার্বাক শব্দটি উল্লেখ না-করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে চার্বাক এবং লোকায়ত অভিন্ন। এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন রচনা করেন বিখ্যাত  ‘তর্করহস্যদীপিকা’ টীকাগ্রন্থটি। এটারও উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য দার্শনিক মত আরো বিশদভাবে বিচার করে জৈন মতই সবচাইতে সেরা এরূপ সিদ্ধান্ত করা। এই অন্যান্য মতের অন্যতম চরম বস্তুবাদেরও বিস্তৃত বিচার করা হয় এ গ্রন্থে এবং গুণরত্নের রচনায় এই বস্তুবাদ চার্বাক নামেই অভিহিত হয়েছে।

একইভাবে বেদব্যস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্র’-র প্রখ্যাত ভাষ্যকার রামানুজ একাদশ শতকে তাঁর রচিত ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে চার্বাক নামেই অভিহিত করেছেন।

 .

তবে বিভিন্ন দার্শনিক মতের পর্যালোচনা হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি হলো চতুর্দশ শতকের অদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনকার সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। অদ্বৈত বেদান্তই যে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মত- এটি প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই সেকালে প্রচলিত আরো পনেরোটি দার্শনিক মত বিচারমূলকভাবে খণ্ডন করার বিস্তৃত প্রয়াস এই গ্রন্থ। এ লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম যে মতটি খণ্ডন করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন তা হলো বস্তুবাদী দর্শন। এবং মাধবাচার্য তাকে চার্বাক নামেই উল্লেখ করেছেন। এজন্যেই তাঁর গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘চার্বাক-দর্শনম’।

 .

চার্বাক বলতে যে এক প্রখর বস্তুবাদী দর্শনই বোঝায়- এ ধারণাই হয়তো পরবর্তীকালের ভারতীয় সাহিত্যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এমন কি দার্শনিক সাহিত্য পেরিয়ে এই ধারণার প্রভাব যে নাট্যসাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণমিশ্র রচিত রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’। এ নাটকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতীক চরিত্রটির নাম ‘চার্বাক’।

 .

চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। ‘নয়তে চার্বী লোকায়তে’ এই কাশিকাবৃত্তিতে জানা যায় যে, লোকায়ত শাস্ত্রে চার্বী নামক আচার্য পদার্থের ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, বৃহষ্পতির শিষ্য চার্বাক নামে কোন একজন প্রাচীন ঋষি এই দর্শনের সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করেছেন। আবার কারো মতে চারু হচ্ছে বৃহষ্পতির নাম। তাঁর উপদেশরূপ বাক্যকে অনুসরণ করায় চার্বাক নাম হয়েছে। এছাড়াও চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে চার্বাক শব্দটির আরো দু’রকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টাও চোখে পড়ে। যেমন, প্রথমতঃ কারো মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) ধাতু থেকে চার্বাক শব্দটি নিষ্পন্ন। এই দর্শনে মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘খাও, পান করো ও আনন্দ করো’, খাওয়া-পান করাকে অত্যধিক জোর দেওয়ায় এই দর্শনকে চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয়তঃ কারো মতে ‘চারু বাক্’ থেকে চার্বাক। ‘চারু (সুন্দর, মিষ্ট) বাক্ (বচন, বাক্য) যার’ এই বিগ্রহে বহুব্রীহি সমাসে ‘চার্বাক’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। কেননা অদৃষ্ট অপেক্ষা দৃষ্ট সুখের জন্য বা দৃষ্ট দুঃখের নিবৃত্তির জন্য প্রাণিকূল সাধারণত প্রবৃত্ত হয়। স্বর্গসুখ প্রাপ্তির জন্য খুব কম ব্যক্তিই যজ্ঞাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। তেমনি নরকদুঃখ ভয়ে খুব কম লোকই পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়। সেকারণে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কারো কথা শুনে যা অনায়াসে চারুরূপে (=মধুরভাবে) গৃহীত হয় তা হচ্ছে লোকায়ত চার্বাক। প্রতিপক্ষের কটাক্ষ বা বিদ্রূপ থেকেই এই মানে তৈরির প্রবণতা লক্ষ্যণীয় বলে কারো কারো ধারণা। কেননা ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে কোনটাই টেকে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত।

 .

খ্রীস্টিয় সপ্তম বা তার পরবর্তীকালে ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনে প্রখর জড়বাদী মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ‘চার্বাক’ শব্দটি সুপরিচিতি লাভ করলেও প্রাচীন সাহিত্যে এ শব্দটি একেবারেই নিরব। বিশিষ্ট চিন্তাধারাকে স্বনামে পরিচিত করার উপযোগী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন চার্বাকের অস্তিত্বের সমর্থনে কোন তথ্যের একান্তই অভাব বলে চার্বাক নামটির উৎস নিয়ে একটা অনুন্মোচিত রহস্যের জট থেকেই যায়। তবে প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্মানুশাসন প্রসঙ্গে চার্বাক নামে এক রাক্ষসের উপাখ্যান আছে (মহাভারত : ১২/৩৮/২২-৩৬)। ‘সাক্ষ্য, শিখী এবং ত্রিদণ্ডী’ ব্রাহ্মণরূপী এ রাক্ষস চার্বাক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পরম শত্র“ দুর্যোধনের সখা এবং প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যমতের তীব্র সমালোচক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতকে আমরা বর্তমানে যে আকারে পাই তার রচনাকালের পূর্ব সীমা খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ এবং শেষ সীমা খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক বলে সাধারণত ধরে নেয়া হয়। আর মহাভারতের এই অংশের রচনাকাল আনুমানিক খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক। চার্বাক দর্শনের ইতিহাস বা চার্বাকের উৎস খুঁজতে গিয়ে আগ্রহী গবেষকদের দৃষ্টি মহাভারতের এই উপাখ্যানের দিকেই আকর্ষিত হয় স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এখানে জড়বাদ বা নাস্তিক্যবাদ সম্বন্ধে কোন কথা নেই। বরং যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় এই চার্বাকের স্বল্পস্থায়ী উপস্থিতি রাজা যুধিষ্ঠিরকে অপমান করতেই ব্যয়িত হয়েছে, যার পরিণামে সভায় ক্রমাগত ব্রাহ্মণদের রোষাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মহাভারতের উপাখ্যানটি এরকম-

‘পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে সহস্র সহস্র পুরবাসী-প্রজা দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া তথায় আগমন করিতে লাগিল। …ঐ সময় সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ পূর্বক অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না-করিয়াই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্বিতবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন পূর্বক কহিল,-

.

চার্ব্বাক উবাচ।

ইমে প্রাহুর্দ্বিজাঃ সর্ব্বে সমারোপ্য বচো ময়ি।

ধিগ্ভবন্তং কু-নৃপতিং জ্ঞাতিঘাতিনমস্তু বৈ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৬)

কিং তে রাজ্যেন কৌন্তেয় ! কৃত্বেমং জ্ঞাতিসঙ্ক্ষয়ম্ ।

ঘাতয়িত্বা গুরূংশ্চৈব মৃতং শ্রেয়ো ন জীবিতম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৭)

ইতি তে বৈ দ্বিজাঃ শ্র“ত্বা তস্য দুষ্টস্য রক্ষসঃ।

বিব্যথুশ্চু ক্রুশুশ্চৈব তস্য বাক্যপ্রধর্ষিতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৮)

ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে স চ রাজা যুধিষ্ঠিরঃ।

ব্রীড়িতাঃ পরমোদ্বিগ্নাস্তুষ্ণীমাসন্ বিশাংপতে!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৯)।

যুধিষ্ঠির উবাচ।

প্রসীদন্তু ভবন্তো মে প্রণতস্যাভিযাচতঃ।

প্রত্যাসন্নব্যসনিনং ন মাং ধিক্কর্ত্তুমর্হথ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩০)

ততো রাজন্ ! ব্রাহ্মণাস্তে সর্ব্ব এব বিশাংপতে!।

ঊচুর্নৈষ দ্বিজোহস্মাকং শ্রীরস্তু তব পার্থিব!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩১)

জজ্ঞুশ্চৈব মহাত্মানস্ততস্তং জ্ঞানচক্ষুষা।

ব্রাহ্মণা বেদবিদ্বাংসস্তপোভির্বিমলীকৃতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩২)।

ব্রাহ্মণা ঊচুঃ।

এষ দুর্য্যোধনসখা চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।

পরিব্রাজকরূপেণ হিতং তস্য চিকীর্ষতি।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৩)

ন বয়ং ব্রূম ধর্ম্মাত্মন্ ! ব্যেতু তে ভয়মীদৃশম্ ।

উপতিষ্ঠতু কল্যাণং ভবন্তং ভ্রাতৃভিঃ সহ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৪)

ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে হুঙ্কারৈঃ ক্রোধমূর্চ্ছিতাঃ।

নির্ভর্ৎসয়ন্তঃ শুচয়ো নিজঘ্নুঃ পাপরাক্ষসম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৫)

স পপাত বিনির্দগ্ধস্তেজসা ব্রহ্মবাদিনাম্ ।

মহেন্দ্রাশনিনির্দগ্ধঃ পাদপোহঙ্কুরবানিব।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৬)

পূজিতাশ্চ যযুর্বিপ্রা রাজানমভিনন্দ্য তম্ ।

রাজা চ হর্ষমাপেদে পাণ্ডবঃ সসুহৃজ্জনঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৭)

.

অর্থাৎ :

চার্ব্বাক বলিল- ‘পাণ্ডুনন্দন! এই ব্রাহ্মণেরা সকলে আমার উপরে বাক্য স্থাপিত করিয়া বলিতেছেন, (আমার মুখে বলিতেছেন)- ‘আপনি জ্ঞাতিহত্যাকারী ঘৃণিত রাজা; সুতরাং আপনাকে ধিক্ । ২৬।

কুন্তীনন্দন! এইরূপ জ্ঞাতি ক্ষয় করিয়া এবং গুরুজনদিগকে বধ করাইয়া, আপনার রাজ্যদ্বারা কি হইবে। আপনার এখন মৃত্যুই ভাল- জীবন নহে’। ২৭।

তখন ব্রাহ্মণেরা সকলেই সেই দুষ্ট রাক্ষসের এই প্রকার বাক্য শুনিয়া এবং তাহার পূর্ব্বোক্ত বাক্যে আক্রান্ত হইয়া ব্যথিত হইলেন ও আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ২৮।

তাহার পর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলে ও সেই রাজা যুধিষ্ঠির লজ্জিত ও বিশেষ উদ্বিগ্ন হইয়া, কিছুকাল নীরব থাকিলেন। ২৯।

তৎপরে যুধিষ্ঠির বলিলেন- ‘ব্রাহ্মণগণ! আমি অবনত হইয়া, আপনাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করিতেছি। আপনারা আমার উপরে প্রসন্ন হউন’। আমার মৃত্যু অতিনিকটবর্ত্তী; সুতরাং আমার উপরে ধিক্কার দেওয়া আপনাদের উচিত নহে’। ৩০।

তদনন্তর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলেই একযোগে বলিলেন- ‘রাজা ! এই ব্রাহ্মণটা আমাদের কেহই নহে। আপনি জীবন ধারণ করুন, আপনার রাজলক্ষ্মীও চিরস্থায়িনী হউক। ৩১।

তাহার পর বেদবিদ্বান্ ও তপোবলে নির্ম্মলচিত্ত সেই মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা জ্ঞানদৃষ্টিদ্বারা চার্ব্বাককে চিনিতে পারিলেন। ৩২।

ব্রাহ্মণেরা বলিলেন- ‘মহারাজ ! দুর্য্যোধনের সখা চার্ব্বাকনামক এই রাক্ষস পরিব্রাজকরূপে দুর্য্যোধনেরই হিতসাধন করিবার ইচ্ছা করিতেছে। ৩৩।

ধর্ম্মাত্মা ! আমরা এরূপ কথা বলি নাই। অতএব আপনার এইরূপ নিন্দার ভয় তিরোহিত হউক এবং ভ্রাতৃগণের সহিত আপনার মঙ্গল হউক। ৩৪।

তাহার পর সেই পবিত্র ব্রাহ্মণেরা সকলে ক্রোধে উত্তেজিত হইয়া, ভর্ৎসনা করিতে থাকিয়া, হুঙ্কারদ্বারা সেই পাপাত্মা রাক্ষসটাকে মারিয়া ফেলিলেন। ৩৫।

তখন ইন্দ্রের বজ্রদগ্ধ অঙ্কুরযুক্ত বৃক্ষের ন্যায় সেই রাক্ষসটা বেদবাদী ব্রাহ্মণগণের তেজে দগ্ধ হইয়া পতিত হইল। ৩৬।

তৎপরে সেই ব্রাহ্মণেরা বিশেষ সম্মানিত হইয়া, যুধিষ্ঠিরের অভিনন্দন করিয়া, যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন এবং যুধিষ্ঠিরও সুহৃজ্জনের সহিত আনন্দিত হইলেন। ৩৭।

 .

এমন এক দুরাত্মা পাপী রাক্ষসের নামের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনটিকে জুড়ে দিলে সাধারণ পাঠকের মনে দর্শনটির প্রতি সহজেই আতঙ্ক ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হবার কথা। এ কারণেই এই জড়বাদী দর্শনটিকে চার্বাক নামে উল্লেখ করার প্রথা গড়ে উঠেছিলো কিনা তা বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনার বিষয় হতেই পারে। তবে চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধের বলি করে উপাখ্যানটি এই ব্রাহ্মণবেশী দুর্যোধনসখার মধ্যে ব্রাহ্মণবিরোধী এক মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। আর এ ইঙ্গিতটাকে স্পষ্টতর করে তোলে মহাভারতেরই অন্তর্গত অন্য এক উপাখ্যান, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার প্রসাদপুষ্ট অপর এক চার্বাকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপাগত এই চার্বাকের অভিন্নতা প্রদর্শন করেন। (মহাভারত: ১২/৩৯/৩-১১) । উপাখ্যানটি এরকম-

বাসুদেব উবাচ।

ব্রাহ্মণাস্তাত ! লোকেহস্মিন্নর্চ্চনীয়াঃ সদা মম।

এতে ভূমিচরা দেবা বাগ্বিষাঃ সুপ্রসাদকাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/২)

পুরা কৃতযুগে রাজন্ ! চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।

তপস্তেপে মহাবাহো ! বদর্য্যাং বহুবার্ষিকম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৩)

বরেণ চ্ছন্দ্যমানশ্চ ব্রহ্মণা চ পুনঃ পুনঃ।

অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো বরয়ামাস ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৪)

দ্বিজাবমানাদন্যত্র প্রাসাদ্বরমনুত্তমম্ ।

অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো দদৌ তস্মৈ জগৎপতিঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৫)

স তু লব্ধবরঃ পাপো দেবানমিতবিক্রমঃ।

রাক্ষসস্তাপয়ামাস তীব্রকর্ম্মা মহাবলঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৬)

ততো দেবাঃ সমেতাশ্চ ব্রাহ্মাণমিদমব্রুবন্ ।

বধায় রক্ষসস্তস্য বলবিপ্রকৃতাস্তদা।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৭)

তানুবাচ ততো দেবো বিহিতস্তত্র বৈ ময়া।

যথাস্য ভবিতা মৃত্যুরচিরেণেতি ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৮)

রাজা দুর্য্যােধনো নাম সখাস্য ভবিতা নৃষু।

তস্য স্নেহাববদ্ধোহসৌ ব্রাহ্মণানবমংস্যতে।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৯)

তত্রৈনং রুষিতা বিপ্রা বিপ্রকারপ্রধর্ষিতাঃ।

ধক্ষ্যন্তি বাগ্বলাঃ পাপং ততো নাশং গমিষ্যতি।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১০)

স এষ নিহতঃ শেতে ব্রহ্মদণ্ডেন রাক্ষসঃ।

চার্ব্বাকো নৃপতিশ্রেষ্ঠ ! মা শুচো ভরতর্ষভ !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১১)।

 .

অর্থাৎ :

কৃষ্ণ বলিলেন- ‘মাননীয় রাজা ! এই জগতে ব্রাহ্মণেরা সর্ব্বদাই আমার পূজনীয়। কারণ, ইঁহারা পৃথিবীচারী দেবতাস্বরূপ এবং ইঁহাদের বাক্যই বিষ, আবার প্রসন্নতা উৎপাদন করাও সহজ। ২।

মহাবাহু রাজা ! পূর্ব্বকালে সত্যযুগে এই রাক্ষস চার্ব্বাক বদরিকাশ্রমে বহু-বৎসর যাবৎ তপস্যা করিয়াছিল। ৩।

ভরতনন্দন ! তাহার পর ব্রহ্মা আসিয়া বর লইবার জন্য বার বার অনুরোধ করিলে, চার্ব্বাক সমস্ত প্রাণী হইতেই নিজের অভয় বর প্রার্থনা করিয়াছিল। ৪।

তখন অপমানিত ব্রাহ্মণ ভিন্ন অপর সমস্ত প্রাণী হইতেই সর্ব্বোত্তম অভয় বর তাহাকে ব্রহ্মা দান করিয়াছিলেন। ৫।

তৎপরে অসাধারণ বিক্রমশালী, নিষ্ঠুর কার্য্যকারী, মহাবল ও পাপাত্মা চার্ব্বাক ব্রহ্মার নিকট সেই বর লাভ করিয়া, দেবগণকে সন্তপ্ত করিতে লাগিল। ৬।

তাহার পর একদা দেবতারা সেই চার্ব্বাক রাক্ষসের প্রভাবে নিপীড়িত হইয়া, ব্রহ্মার নিকটে যাইয়া, চার্ব্বাকের বধের জন্য এই কথাই বলিলেন। ৭।

ভরতনন্দন ! তদনন্তর ব্রহ্মা দেবগণকে বলিলেন- ‘যাহাতে অচিরকালমধ্যে চার্ব্বাক নিহত হয়, সে বিষয়ে আমি উপায় করিয়াছি। ৮।

মনুষ্যলোকে দুর্য্যোধননামে এক রাজা জন্মিবেন এবং তিনি চার্ব্বাকের সখা হইবেন। কালক্রমে এই চার্ব্বাক সেই দুর্য্যোধনের সৌহার্দ্দসূত্রে আবদ্ধ হইয়া, ব্রাহ্মণগণের অবমাননা করিবে। ৯।

তখন বাক্শক্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের অবজ্ঞায় ক্রুদ্ধ হইয়া, ব্রহ্মতেজেই পাপাত্মাকে দগ্ধ করিবেন; তাহাতেই চার্ব্বাক বিনষ্ট হইবে’। ১০।

ভরতশ্রেষ্ঠ রাজপ্রধান ! সেই চার্ব্বাক রাক্ষসই এই ব্রাহ্মণের তেজে বিনষ্ট হইয়া শয়ন করিয়াছে। অতএব আপনি ব্রহ্মহত্যা হইয়াছে বলিয়া অনুতাপ করিবেন না। ১১।

 .

যুধিষ্ঠিরের সভায় সমাগত চার্বাকের বিনাশের মূলে কার্যকর ব্রহ্মার অভিশাপ এবং ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার মাধ্যমে অভিশাপটিকে ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব স্বয়ং চার্বাকেরই। উপাখ্যানের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তকে দৃষ্টিপটে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট।

 .

চার্বাক নামে কোন ব্যক্তির কাহিনী মহাভারতের অন্যত্র বা অন্য কোন গ্রন্থেও আর দেখা যায় না। মহাভারতে চার্বাক নামের এই রাক্ষসের সামান্য উল্লেখ থেকে চার্বাক মতবাদের এরকম নামকরণের পক্ষে সুনিশ্চিত কোন যুক্তি বা সাক্ষ্য আদৌ আছে কিনা জানা নেই। তবে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে চার্বাক এখানে বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী দর্শনের এক মূর্ত রূপ। তাই বিরোধী প্রখর জড়বাদী মতের প্রতি বৈদিক সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের তীব্র বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ এমন চার্বাক নামকরণের মধ্যে দিয়ে ঘটে যাওয়া অসম্ভব না-ও হতে পারে।

ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনগুলির নিকট চার্বাকমত  এক জীবন্ত প্রহেলিকা। যুক্তিনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে অধ্যাত্ম বা অলৌকিকতার বিরুদ্ধে লৌকিক বাস্তবতার প্রচণ্ড সাঁড়াশি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিত যে-দর্শনমতের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলো তাকে অধ্যাত্মবাদীরা যে প্রাণপণে প্রতিহত করবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী! অধ্যাত্মবাদীদের এই প্রতিহতকরণ-প্রচেষ্টা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিলো তা অনুধাবন করা যায় চার্বাকদের বিরুদ্ধে তাঁদের ঘৃণা আর খেদোক্তি বা অভিশন্তাপের বাহুল্য দেখেও। প্রচলিত সাধারণ-জনমানসেও দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে বিরোধী কাউকে মনমতো শায়েস্তা করতে না পারলে অক্ষম যন্ত্রণায় শেষতক অভিশাপ দিয়েই সান্ত্বনা খোঁজে, ‘ধর্মই তোর বিচার করবে, তুই নরকবাসী হবি!’

এই নরকবাস আসলে কী? শান্ত্রে নরকের নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। বোঝাই যায় শাস্ত্রমতে নরক একরকমের নয়। কেবল ‘মনুস্মৃতি’তেই (মনুসংহিতা-৪/৮৮-৯০) একুশ রকম নরকের ফর্দ রয়েছে। ‘মনুস্মৃতি’র এই ফর্দ থেকেই বোঝা যায় সম্ভব-অসম্ভব রকমারি পার্থিব যন্ত্রণার বিবরণই নরক-কল্পনার মূল উপাদান। যেমন–

তামিস্রমন্ধতামিস্রং মহারৌরবরৌরবৌ।

নরকং কালসূত্রঞ্চ মহানরকমেব চ।। (মনু-৪/৮৮)

সঞ্জীবনং মহাবীচিং তপনং সম্প্রতাপনম্ ।

সংঘাতঞ্চ সকাকোলং কুড্মলং পূতিমৃত্তিকম্ ।। (মনু-৪/৮৯)

লোহশঙ্কুমৃজীষঞ্চ পন্থানং শাল্মলীং নদীম্ ।

অসিপত্রবনঞ্চৈব লোহদারকমেব চ।। (মনু-৪/৯০)

অর্থাৎ :

এই একুশ-রকমের নরকগুলি– তামিম্র (অন্ধকার), অন্ধতামিস্র (নিবিড় অন্ধকার), মহারৌরব (মহাকোলাহলপরিপূর্ণ), রৌরব (কোলাহলপরিপূর্ণ), কালসূত্র (যেখানে সকলরকম উপায়ে পীড়ন করা হয়), সঞ্জীবন (যেখানে বার বার বাঁচিয়ে বার বার মেরে ফেলা হয়), মহানরক (যেখানে অগ্নিপ্রভৃতির দ্বারা সন্তাপ দেওয়া হয়), মহাবীচি (মতান্তরে, অবীচি; যেখানে অত্যন্ত জলতরঙ্গ), তপন (আগুন প্রভৃতির দ্বারা দগ্ধ করা হয় যেখানে), সম্প্রতাপন (কুম্ভীপাক; যেখানে কুম্ভে নিক্ষেপ করা হয়), সংঘাত (যেখানে অত্যন্ত সংকীর্ণস্থানে বহু লোককে স্থাপন করা হয়), কাকোল (যেখানে কাকদের দ্বারা ভক্ষণ করানো হয়), কুড্মল (যেখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে পীড়ন দেওয়া হয়), পূতিমৃত্তিক (যেখানকার মাটি বিষ্ঠার গন্ধে পূর্ণ), লোহশঙ্কু (যেখানে সূচের দ্বারা ভেদন করানো হয়), ঋজীষ (যেখানে তপ্ত কড়াইতে নিক্ষেপ করা হয়), পন্থা (যেখানে বারংবার গমনাগমন করানো হয়), শাল্মলী (অন্যমতে, শাল্মল; যেখানে শাল্মলীর কাঁটার দ্বারা শরীরকে বিদ্ধ করানো হয়), নদী (বৈতরণী প্রভৃতি যে সব নদী দুর্গন্ধ-রুধির পূর্ণ, অস্থিপ্রভৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন, উষ্ণজলপরিপূর্ণ ও বেগবতী– তার উপর ভাসানো হয়), অসিপত্রবন (যেখানে তরবারীর তীক্ষ্ণাংশদ্বারা শরীর ছিন্নভিন্ন করা হয়) এবং লোহদারক (যেখানে লৌহশৃঙ্খলের দ্বারা বেঁধে রাখা হয়)। (মনসংহিতা-৪/৮৮-৯০) এই শ্লোক গুলি প্রক্ষিপ্ত।। চার্বাক মত এসব নিয়ে আলোচনা করে তাই দেওয়া হয়েছে।

तामिस्रं अन्धतामिस्रं महारौरवरौरवौ ।नरकं कालसूत्रं च महानरकं एव च ।।

এই (4.80-91) শ্লোকগুলি প্রক্ষিপ্ত - মনু সর্বজনীনভাবে বর্ণ ব্যবস্থার ভিত্তিকে কর্ম বলে বিবেচনা করেছেন, জন্ম নয়। বৈদিক মান্যতানাসারে দুঃখ কে নরক বলা হয়েছে।

স্বর্গ-নরক বিষয়ে👈 পড়ুন

কোন্ পাপে কার জন্য কোন্ নরকের নিবন্ধন ঘটে তাও নিশ্চয়ই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। আর টীকাকার কুল্লুকভট্টই বলছেন, রকমারি নরকের আরো বিস্তৃত বিবরণের জন্য ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় নরক-বর্ণনা নয়। তবে এতো রকমের নরকের একটি যে মহানরক, যেখানে সমস্ত রকম যন্ত্রণার আয়োজনই রাখা হয়েছে তা বোধ করি বোঝার বাকি নেই। এই মহানরকের উল্লেখ করা হচ্ছে এজন্যেই যে, প্রসিদ্ধ ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘ভামতি’ গ্রন্থে (ভামতি-৩/৩/৫৪) বলছেন–


‘এ-হেন মহানরকেই নাস্তিক চার্বাকের স্থান। অবশ্য সাধারণত মরবার পরে নরকে যাবার কথা। কিন্তু চার্বাকের অবস্থা তা নয়। মহানরকবাসের জন্যে তার মরবারও দরকার পড়ে না, জীবদ্দশাতেই ঐ নরকবাস। কেননা, চার্বকের এমনই মত যে তা মানলে মহানরকের যন্ত্রণা ছাড়া গত্যন্তর নেই।’



বাচস্পতির এই উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৪৩) থেকে। কিন্তু কী এমন মত যে তা মানলে জীবদ্দশাতেই এ-হেন যন্ত্রণা? দেবীপ্রসাদ-কৃত উদ্ধৃতিতে বাচস্পতি বলছেন–


‘চার্বাক প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণই মানে না। তাই তার অবস্থা জানোয়ারেরও বেহদ্দ। জানোয়ারেরাও হিত-প্রাপ্তি ও অহিত-পরিহারের ব্যাপারটা বোঝে, কিন্তু বুঝতে গেলে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন, জানোয়ারেরাও হিতপ্রাপ্তির জন্যে কোমল ঘাসের ক্ষেত্রে বিচরণ করে; অহিত পরিহারের জন্যে শুকনো কাঁটার জঙ্গল এড়িয়ে যায়। নিছক প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করে এজাতীয় ব্যবহার সম্ভব নয় : হিতপ্রাপ্তির ও অহিত-পরিহারের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির জন্যে অনুমানের উপর নির্ভরতা প্রয়োজন। কিন্তু চার্বাক অনুমান বলে কোনো প্রমাণই মানে না; পশুর ব্যবহারের মধ্যে যেটুকু অনুমানের আয়োজন তাও নয়। তাছাড়া, চার্বাকের পক্ষে তো বেবাক বোবা হয়ে থাকবার কথা, কেননা অপরকে কিছু বলতে গেলে শব্দ ব্যবহার প্রয়োজন এবং শব্দ প্রত্যক্ষ হলেও শব্দ থেকে শব্দযোগ্য পদার্থ অনুমানসাপেক্ষ। অতএব চার্বাক জন্মান্তরের কথা উড়িয়ে দিতে গেলেও ইহজন্মেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, নিশ্চেষ্ট এবং মূক অবস্থায় মহানরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য।’



ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বাচস্পতি মিশ্র যে যেনতেন লোক নন, দার্শনিক হিসেবে দিকপাল-বিশেষ, তা বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণই অবগত। নানা প্রসিদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় তাঁর গ্রন্থ প্রামাণ্য বলেই স্বীকৃত। কিন্তু বিদগ্ধ চিন্তাশীলও যখন চিন্তাচেতনার বালাই চুকিয়ে দিয়ে চার্বাককে এমন গাল দিতে উদ্যত হন তা নিশ্চয়ই হেলাফেলার বিষয় নয়। কিন্তু চার্বাকের নিন্দা– বিশেষত তার প্রত্যক্ষপরায়ণতার বিবরণ যে অতিরঞ্জিত এটুকু অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কেননা চার্বাকদের বিরুদ্ধে একটা প্রচলিত অভিযোগ এই যে সুখাদ্যের প্রতি চার্বাকের অত্যন্ত অভিরুচি। তাই কচি ঘাস দেখে ছাগলেও তার প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য যতটুকু অনুমান-পরায়ণতার পরিচয় দেয়, চার্বাকের মধ্যে তারও অভাব– এমনতর অসম্ভব উক্তি দার্শনিক প্রতিভা তো দূরের কথা, সামান্যতম সততারও পরিচায়ক নয় বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত। বিষয়গুলি স্পষ্টতর হওয়ার লক্ষ্যেই ভারতীয় দর্শনে চার্বাকী-সিদ্ধান্তের আলোচনায় আমরা অনুপ্রবিষ্ট হতে পারি। তবে এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা আবশ্যক যে, আলোচনার স্পষ্টতার নিরীখে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে আলোচিত চার্বাক সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট বিশেষ কিছু দৃষ্টান্তের পুনরোল্লেখ ঘটতে পারে প্রাসঙ্গিক বিবেচনার আলোকে।

প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ

।। ক।।  প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ।


চার্বাক দর্শন সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গ্রন্থে বিশেষত দর্শনের সঙ্কলন গ্রন্থগুলিতে চার্বাক নামের সঙ্গে প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। যেমন কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হয়েছে–


‘লোকায়তমেব শাস্ত্রং যত্র প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্…বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্।

তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্’। -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।

অর্থাৎ : লোকায়তশাস্ত্রমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। …বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।




বেদান্ত অনুসারী সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায় বলা হয়েছে–


‘প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদিতয়া অনুমানাদেরনঙ্গীকারেণ প্রামাণ্যাভাবাৎ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিত্ব হেতু অর্থাৎ একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলে, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলে দেহাতিরিক্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়।



‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদীদের দ্বারাও অদৃষ্ট কখনও দৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, বিশেষ কোন স্থানে বা কোন সময়ে দৃষ্ট হলেও এর অদৃষ্ট নামের সার্থকতা থাকে না। নিত্য অদৃষ্ট কোন বস্তুর সত্তাকে যদি আমরা অনুমোদন করি তাহলে ‘শশশৃঙ্গ’ বা অনুরূপ অসম্ভব পদার্থের অস্তিত্বকেও আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়। চার্বাকী বা লোকায়তিক এই মতবাদই বর্ণিত হয়েছে অদ্বৈতবেদান্তের প্রবর্তক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে–


‘প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।

অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।

‘ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্রুবতে কথম্ ।

নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।

অর্থাৎ :

লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে– এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।  যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।



নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাকের বর্ণনায় বলছেন–


তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী-১/২৬)।

অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।


‘সর্বমতসংগ্রহ’ গ্রন্থেও চার্বাকদেরকে বলা হয়েছে–


‘প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিনো’। (সর্বমতসংগ্রহ)

অর্থাৎ : কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী।



বলা যায়, ভারতীয় গোটা দর্শন সাহিত্যেই চার্বাকের প্রধান পরিচিতি প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে। তবে কি অন্যান্য দর্শনগুলি প্রত্যক্ষকে স্বীকার করেন না? অবশ্যই করেন। প্রমাণসমূহের অন্যতম হিসেবে ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্বীকৃতির উল্লেখ আছে সবকটি দর্শন-মতেই, ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে তার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।

লৌকিক মতে প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ জ্ঞানের দ্যোতক। কিন্তু দার্শনিক পরিভাষায় এর অর্থ পৃথক। আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের পর্যায়ে সাধারণত পাঁচটি ইন্দ্রিয় অন্তর্ভুক্ত। এগুলির কোনও একটির সাহায্যেই প্রত্যক্ষজ্ঞানের উদ্ভব হতে পারে। চক্ষু এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির অন্যতম হলেও কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক– এই চারটি ইন্দ্রিয়ের ভূমিকাও প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন অংশে কম নয়। এই ইন্দ্রিয় পাঁচটির প্রত্যেকটিই নিজ নিজ বিভাগে জ্ঞান আহরণের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। কোন বস্তু যখন বিশেষ কোন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসে তখন ইন্দ্রিয়টির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা বস্তুটি সম্বন্ধে বিশেষ ধরনের জ্ঞান লাভ করি। যেমন একটি ফুল সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে চক্ষু, নাসিকা এবং ত্বকেরই কেবল কার্যকারিতা দেখা যায়, অন্য ইন্দ্রিয়ের নয়। চোখ দিয়ে আমরা ফুলটিকে দেখি; নাকের সাহায্যে গন্ধ উপভোগ করি এবং ত্বক দিয়ে ফুলটিকে স্পর্শ করি। আবার গান শোনা বা সুখাদ্য ভোজন ইত্যাদি ব্যাপারে যথাক্রমে কর্ণ এবং জিহ্বার বৈশিষ্ট্য কাজ করে, অন্য ইন্দ্রিয় নয়। মনের ভূমিকা কোন কোন ক্ষেত্রে বাহ্য বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের মাধ্যম হিসেবে, আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র এক ইন্দ্রিয় রূপে। জ্ঞানেন্দ্রিয় হিসেবে মন আন্তর প্রত্যক্ষের কারণ হয়, অন্য ইন্দ্রিয়গুলির বা বাহ্য বস্তুনিচয়ের যেখানে কোন কার্যকরিতা নেই।


প্রমাণগুলির মধ্যে একমাত্র এই প্রত্যক্ষের সঙ্গেই যাঁরা চার্বাকের যোগ স্বীকার করেন তাঁদের মতে চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে সঞ্চয় এই ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথেই কেবল হওয়া সম্ভব। জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–


‘লোকায়তা বদন্ত্যেবং নাস্তি দেবো ন নির্বৃতিঃ।

ধর্মাধর্মৌন বিদ্যেতে ন ফলং পুণ্যপাপয়োঃ।।

এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮১)

অর্থাৎ : লোকায়তরা বলেন, দেবতা বলে কিছু নেই, মোক্ষ বলেও নয়। ধর্ম ও অধর্ম বলে কিছু হয় না, পুণ্য ও পাপের ফল বলেও নয়। যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক (অতএব সত্য)।



তার মানে, ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের বক্তব্য হলো, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যতটুকু জানা সম্ভব চার্বাকের জগৎ তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এভাবে বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও অনুরূপ একটি লোকায়ত বচনের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যেমন–


‘এতবানেব পুরুষো যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)

অর্থাৎ : যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক।



চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে চার্বাকেতর দার্শনিকদের সাধারণ মনোভাব এই ধারণারই অনুগামী বলে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে চার্বাকের পরিচিতিও সেই ধারণারই অনুসরণে গড়ে উঠেছে বা তৈরি করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারে একমাত্র বস্তুজগতের মালমসলাই সঞ্চিত হয়। প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম করার জন্য এই উপাদানের অতিরিক্ত অন্য কিছু চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে তার সঞ্চয় রাখতে পারে না, ফলে স্থূল বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করেই রূপায়িত হয়ে ওঠে চার্বাকের সম্পূর্ণ নিজস্ব বস্তুবাদী সিদ্ধান্ত।

কিন্তু সাধারণভাবে এই রূপে চার্বাকের পরিচিতি তৈরি করা হলেও ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে চার্বাকের সামগ্রিক রূপের প্রতিফলন এখানে হয়নি এবং কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবেও চার্বাককে সব ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা যায় না। ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে চার্বাক সম্প্রদায়ের শ্রেণীভেদ প্রসঙ্গে চার্বাকগোষ্ঠির মধ্যে বৈতণ্ডিক, ধূর্ত, সুশিক্ষিত ইত্যাদি একাধিক মতবাদের প্রচলনের উল্লেখ করা হয়েছে এবং চার্বাক সিদ্ধান্তের সামগ্রিক রূপের বিচারের জন্য এগুলির আলোচনা সহ বিভিন্ন দার্শনিকগোষ্ঠির মনোভাব বিশ্লেষণও  আবশ্যক বলেই মনে হয়।


.

চার্বাক প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টর বক্তব্য এবং তত্ত্বোপপ্লবসিংহ :

যদিও চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তভট্টর প্রকৃত বক্তব্য নির্ণয় করার বেশ সমস্যা রয়েছে, তবু এ প্রসঙ্গে চার্বাক সম্বন্ধে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্তভট্টর মন্তব্য উল্লেখ্য। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাক গোষ্ঠিকে সাধারণভাবে বিশেষিত করে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় সরাসরি বলেছেন–


তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।

অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।



শুধু এটুকু বললে সিদ্ধান্ত করা যেতো যে, তাঁর দৃষ্টিতে চার্বাকমতে প্রত্যক্ষাতিরিক্ত অনুমান বলে কোনো প্রমাণ সম্ভব নয়। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, এই ‘ন্যায়মঞ্জরী’রই অন্যত্র তিনি ভিন্ন ধরনের অপর এক মতবাদকে চার্বাক নামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং এই মতবাদের সমর্থক চার্বাকেরা তাঁর ভাষায় ‘ধূর্ত’ সংজ্ঞায় চিহ্নিত। যেমন–


‘চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্’। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।

অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো– এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।



জয়ন্তের বর্ণনায়, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে প্রমাণ এবং প্রমেয়ের সংখ্যা এবং লক্ষণের নিয়ম করা সম্ভব নয়। সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যই এঁদের পরিভাষায় ‘তত্ত্ব’ আখ্যা পেয়েছে এবং এই অর্থানুসারী তত্ত্বের ব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে এঁরা এমন অনেক প্রমিতির উদাহরণ দিয়েছেন যাদের উদ্ভব প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের মাধ্যমে হয় না। সহজভাবে বললে, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে কোন রকম প্রমাণেরই লক্ষণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়, মানে কোন রকম প্রমাণই সম্ভব নয়– ফলে প্রত্যক্ষও সংশয়াতীত নয়। তার মানে, এই মতটি যে অবশ্যই প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকদের মতাদর্শ নয়, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আবার এই একই ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেই জয়ন্ত ভট্ট আবার ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের সম্পর্কেও বলেন–


অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।

অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।



.

এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ইতঃপূর্বে উল্লেখকৃত মন্তব্যটি পুনরায় প্রণিধানযোগ্য–

‘জয়ন্তর স্বীয় সম্প্রদায়ের– অর্থাৎ ন্যায় সম্প্রদায়ের– দাবি এই যে প্রমাণ আসলে চার রকম। অতএব স্বমত সমর্থনে যে-দার্শনিকেরা প্রমাণের সংখ্যা চারের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন, জয়ন্তর পক্ষে তাঁদের মত খণ্ডনের প্রয়োজন বোধ করার কথা। কিন্তু কারা চারের চেয়ে বেশি প্রমাণ মানেন? জয়ন্ত বলছেন : প্রভাকর-পন্থী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ পাঁচ রকমের; কুমারিলভট্টর অনুগামী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ ছয় রকমের; কেউ-কেউ আবার বলেন, প্রমাণ আট রকমের; কিন্তু ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’রা বলেন, প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। কথাটার তাৎপর্য কি এই যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, নাকি, প্রমাণ বলেই কিছু নেই? -(ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।


মোটকথা, জয়ন্তভট্ট বর্ণিত চার্বাক-গোষ্ঠির সম্পূর্ণ চিত্রায়ণ কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ এ প্রসঙ্গে চার্বাক পক্ষের নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপিত করতে পারে এমন রচনার প্রকৃত অভাব। এ-প্রেক্ষিতে ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচিত জয়রাশি ভট্টর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ নামের গ্রন্থটির উল্লেখ করা যেতে পারে। তার মধ্যেই জয়ন্ত বর্ণিত ধূর্ত চার্বাকদের ছবি আবিষ্কার করা হয়তো সম্ভব হতে পারে। প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণের মর্যাদা দান সম্বন্ধে চার্বাক প্রসঙ্গে সাধারণ যে ধারণার প্রচলন করা হয়েছে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সাক্ষ্য তারও পরিপন্থী। এই গ্রন্থের গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্ট অন্য প্রমাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কার করতে আগ্রহী এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিও তাঁর কাছে প্রমেয়ের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ বিচারে আমরা যাকে ‘তত্ত্ব’ বলি বিভিন্ন প্রমাণগ্রাহ্য সেই তত্ত্বের অস্তিত্বকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলেছেন–


‘পৃথিব্যাদীনি তত্ত্বানি লোকে প্রসিদ্ধানি, তান্যপি বিচার্যমানানি ন ব্যবতিষ্ঠন্তে, কিং পুনরন্যানি’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)।

অর্থাৎ : সাধারণ লোকে যে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ এই পঞ্চভূতকে তত্ত্ব বলে স্বীকার করেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে দেখা যায় যে এরকম কোন প্রমেয় তত্ত্বেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। (মুক্ততর্জমা)



নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় জয়রাশি যে তত্ত্বকে উপজীব্য করেন, প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণসম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যের সঙ্গে তা একার্থক। বাস্তবিকপক্ষে জাগতিক বস্তুনিচয়ের সত্যাসত্য নির্ণয় করার মান, আমরা যেভাবেই ঠিক করি না কেন– কোন সময়েই তা ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না, এটা প্রদর্শন করাই তত্ত্বোপপ্লববাদীর উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য জয়রাশি তর্কের বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে একই সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখার সিদ্ধান্তে ত্রুটি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে–


‘কথং কথং তানি ন সন্তি? তদুচ্যতে সল্লক্ষণনিবন্ধনং মানব্যবস্থানং, মাননিবন্ধনা চ মেয়স্থিতিঃ, তদভাবে ন তথা সদ্ব্যবহারবিষয়ত্বং কথং…’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)

অর্থাৎ : প্রমাণের অস্তিত্ব সৎ লক্ষণের উপর নির্ভরশীল, আবার এই প্রমাণের মাধ্যমেই প্রমেয় বস্তুবিষয়ের ব্যবস্থাপনা। প্রমাণের লক্ষণে যদি ত্রুটি থাকে, তাহলে তাকে কখনই সৎ বলা চলে না এবং এই ত্রুটিপূর্ণ লক্ষণযুক্ত প্রমাণের অস্তিত্বও স্বীকৃত হতে পারে না। প্রমাণ অস্বীকৃত হলে প্রমাণের মাধ্যমে আমরা প্রমেয় যে বস্তু বা বিষয়ের ধারণা করি সেগুলিকেও অগ্রাহ্য করতে হয়।



এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, প্রমাণসম্বন্ধীয় নিয়মের বিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে চার্বাকদের প্রগতিবাদী মনোভাবের ঐক্য সূচক, যা দার্শনিক মতবাদ ছাড়াও আমাদের আচরণ বিধির প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম-বন্ধনকে শিথিল করার প্রয়াসে তৎপর। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি যে সুকঠোর বিধিনিয়মের ভারে ভারাক্রান্ত বৈদিক আচারের প্রভাব থেকে মুক্তির প্রচেষ্টার মধ্যেই চার্বাকী চিন্তার প্রথম উন্মেষ। আবির্ভাবের প্রাথমিক মুহূর্তে যে প্রগতিবাদী দৃষ্টি চার্বাকী মনে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিলো, উত্তর যুগের চার্বাকী চিন্তাতেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব লক্ষণীয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন বিভাগে প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়ম প্রসঙ্গে যে সূক্ষ্ম মতভেদ, চার্বাকী সমালোচনা তার মূলে আঘাত করেছে। এ-ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্টকেও কেউ কেউ হয়তো নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের অনুসরণ করে চার্বাকগোষ্ঠির অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছেন। শ্রদ্ধেয় লতিকা চট্টোপাধ্যায়ও এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন কিনা তা অস্পষ্ট। যদিও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিদ্বজ্জনদের মধ্যেই জয়রাশি ভট্টকে চার্বাকগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্তিকরণে তীব্র মতভেদ রয়েছে। সে যাক্, তবে জয়রাশির সঙ্গে ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে ধূর্ত সংজ্ঞায় অভিহিত চার্বাকগোষ্ঠির সম্পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে বলেই মনে হয়।


এ-প্রেক্ষিতে লতিকা চট্টোপাধ্যায় বলেন–

‘সংখ্যা ও লক্ষণের নিয়মে প্রমাণের শ্রেণীবিভাগে ব্রতী দার্শনিকদের বিরুদ্ধে চার্বাকদের যে ধরনের প্রতিবাদ ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে দেখা যায় তারই অনুরূপ প্রতিবাদে সোচ্চার চার্বাক জয়রাশি বৈয়াকরণকৃত শব্দের লক্ষণগত নিয়মের বিপক্ষে, তাঁর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। বৈয়াকরণেরা প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের দুর্লঙ্ঘ্য বন্ধনে শব্দকে আবদ্ধ রেখেছেন। ব্যাকরণের সূত্রগুলি তাঁদের মতে লক্ষণের পর্যায়ভুক্ত। এবং এই লক্ষণান্বিত শব্দসমূহকে তাঁরা ‘সাধু’ আখ্যায় ভূষিত করেন। এইভাবে সাধুত্বের ছাড়পত্র লাভে যে শব্দগুলি সক্ষম, একমাত্র সেগুলিই তাঁদের নির্দেশে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।’

‘চার্বাক জয়রাশির সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণা প্রসারিত হয়েছে বৈয়াকরণ নির্দেশিত বিশেষ লক্ষণযুক্ত সাধু শব্দের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ব্যাপারে। বৈয়াকরণদের মতে বিশেষ লক্ষণ দ্বারা যেগুলি নির্দেশিত হয় না, সেগুলি অসাধু শব্দ এবং এই অসাধু শব্দের প্রয়োগকে তাঁরা অনুমোদন করেন না। জয়রাশি অসাধু শব্দের প্রয়োগের ফলে সম্ভাব্য কয়েকটি দোষের উল্লেখ করে যুক্তির মাধ্যমে সব কটি দোষেরই অবাস্তবতা প্রতিপাদন করেছেন। আর উপসংহারে সাধু শব্দের সঙ্গে অসাধু শব্দেরও সমান সার্থকতা সম্বন্ধে নিজস্ব মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭০)


কিন্তু এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ জয়রাশি অবলম্বিত প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি কিরূপ? এ সম্বন্ধে একান্ত আগ্রহী পাঠকের ধারণা লাভের ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে বর্ণিত প্রত্যক্ষ প্রমাণসম্বন্ধীয় প্রারম্ভিক আলোচনার কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। এ-বিষয়ে লতিকা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৭০-৭২) ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করেছেন। আমরা এ-ক্ষেত্রে সংক্ষেপে তাঁর আলোচনা-রীতিই অনুসরণ করতে পারি।


আমরা জানি যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্জগতের সঙ্গে সরাসরি যোগের ফলে আমাদের যে জ্ঞান হয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণকে তার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন–


‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপনং জ্ঞানম্ অব্যোপদেশ্য অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়সূত্র: ১/১/৪)।

অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে যে অব্যাপদেশ্য (অশাব্দ), অব্যভিচারী  (অভ্রান্ত) এবং ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ।



সহজ কথায়, প্রত্যক্ষ বলতে সেই ধরনের জ্ঞান বোঝায় যা ইন্দ্রিয় এবং অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়। তবু ইন্দ্রিয় এবং অর্থ পরস্পর নিকটবর্তী হলেই যে প্রকৃত প্রত্যক্ষজ জ্ঞান সম্ভব হয় না তা বোঝাবার জন্য সূত্রকার ‘অব্যপদেশ্য’ বা অশাব্দ, ‘অব্যভিচারী’ বা অভ্রান্ত এবং ‘ব্যবসায়াত্মক’ বা নিশ্চয়াত্মক, এই কয়েকটি বিশেষণে এই জ্ঞানকে চিহ্নিত করেছেন।


প্রথম বিশেষণ ‘অব্যাপদেশ্য’ দ্বারা সংজ্ঞা, পরিচয় ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত বস্তুকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরিধি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। সম্মুখস্থ কোন ব্যক্তির আকৃতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সাক্ষাৎভাবে যে জ্ঞান আমাদের মনের গোচরীভূত হয় তাকে প্রত্যক্ষ বলা চলে। লোকটি সম্বন্ধে আমাদের পূর্ববর্তী জ্ঞানের সহযোগিতায় নাম ধাম ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত তার যে সম্পূর্ণ পরিচয় আমরা তখন লাভ করি তা প্রত্যক্ষ-বহির্ভূত।

সূত্রে ব্যবহৃত ‘অব্যভিচারী’ পদ মিথ্যা জ্ঞানকে প্রত্যক্ষের পরিসর থেকে অপসারিত করেছে। সূর্যকিরণে (মরীচিকায়) জলের বা রজ্জুতে সর্পের বোধ প্রকৃত প্রত্যক্ষ পদবাচ্য নয়।

আর ‘ব্যবসায়াত্মক’ শব্দের দ্বারা প্রকৃত বিচার বা অবধারণাকে জ্ঞানের একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যার অভাবে কেবল মাত্র অর্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষের ফলে জ্ঞানের উৎপত্তি সম্ভব নয়। চক্ষুর সন্নিকটে অসংখ্য বস্তু উপস্থাপিত হলেই যে তাদের সবগুলির প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় তা বলা চলে না। বস্তুগুলির মধ্যে বিশেষভাবে যেটি অবধারণায় আসে সেটিই প্রত্যক্ষপদবাচ্য। সেটি যদি ফুল হয় তাহলে জ্ঞাতা ব্যক্তির ধারণা জন্মে ‘এটি একটি ফুল’। ‘ব্যবসায়’ নামে অভিহিত এই বিশেষ ধারণা ন্যায়ের অভিমতে প্রকৃত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অপরিহার্য সোপান।


‘প্রত্যক্ষলক্ষণের বিচার প্রসঙ্গে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ প্রথমেই ন্যায়সূত্রবর্ণিত এই লক্ষণকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে এর সর্বাত্মক ত্রুটি প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছে। ন্যায়সূত্র-বর্ণিত ‘অব্যভিচারী’ পদ গ্রন্থমতে আরও বিস্তারের অপেক্ষা রাখে। অব্যভিচারিতা নানাভাবে হতে পারে– যে কারক বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই জ্ঞানের উৎপাদন তার অদুষ্টতা, জ্ঞানের পথে বাধার অস্তিত্বের অভাব অথবা প্রবৃত্তিসামর্থ্য। প্রথমটিকে অব্যভিচারিতার কারণ হিসাবে নির্দেশ করা সম্ভব নয়। কারণ চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের কুশলতার বিচার ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয় না, যে জন্য প্রত্যক্ষ এই বিচারের মাধ্যম হতে পারে না। এ ব্যাপারে অনুমানেরও অসার্থকতা একই সঙ্গে প্রতিপন্ন হয়, কারণ অনুমানের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষজ্ঞানেরই ভিত্তিতে। যে হেতু বা লিঙ্গ অনুমানের অপরিহার্য অঙ্গ, সেই লিঙ্গ এখানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উদ্ভূত জ্ঞান। ইন্দ্রিয়োত্থ জ্ঞানেরই সহায়তায় ইন্দ্রিয়ের অদুষ্টতা বিচার করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ প্রত্যক্ষজ্ঞানের অব্যভিচারিতা প্রমাণের চেষ্টা করলে ইতরেতরাশ্রয়দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।’

‘বাধারহিতত্ব এবং প্রবৃত্তিসামর্থ্য– অব্যভিচারী জ্ঞান উৎপাদনে এ দুটির মধ্যেও কোনটি যে প্রকৃত কারণ হতে পারে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়,– সম্ভাব্য নানা রকম দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটিকে বিচার করার পর এ সম্বন্ধে গ্রন্থকার তাঁর মন্তব্য করেন। মোট কথা, বিশেষ কোন বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞানে প্রত্যক্ষজ জ্ঞান প্রকৃতই বস্তুটির পরিচয় বহন করে কিনা স্থির করার প্রস্তুতি হিসাবে অব্যভিচারী জ্ঞানের বিভিন্ন কারণ আগে নির্ণয় করা প্রয়োজন, যেগুলির অনুপস্থিতিতে যথার্থ জ্ঞানের পর্যায়ে কোন জ্ঞান উন্নীত হতে পারে না। কিন্তু এই কারণগুলি নির্ণয়যোগ্য না হওয়ায় ‘অব্যভিচারী’ বিশেষণও কোন জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।’

‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে প্রত্যক্ষলক্ষণে ‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষ’ পদকে অন্তর্ভুক্ত করে নৈয়ায়িকেরা ‘অব্যভিচারী’ পদকে আরও অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। বাহ্য বস্তুর জ্ঞানে অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তু যদি ইন্দ্রিয়ের নিকটবর্তী হয় তাহলে আপনা থেকে জ্ঞানে ব্যভিচারিতা শঙ্কার নিবৃত্তি হয়। নৈয়ায়িকেরা এ ক্ষেত্রে স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন যে ইন্দ্রিয় অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকৃষ্ট হলেও বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত বস্তুজ্ঞানের পরিবর্তে ভ্রমের উৎপাদন হয়। যেমন সূর্যরশ্মিতে জলের প্রতীতি। এ যুক্তির বিপরীত পক্ষে গ্রন্থকারের যুক্তি এই যে উল্লিখিত নয়নেন্দ্রিয়ের যোগ হয় নিকটবর্তী সূর্যরশ্মির সঙ্গে; যে উদক বা জলের প্রতীতি এ ক্ষেত্রে হয়, সেই উদক নয়নের সন্নিকটে একেবারেই আসে না। কাজেই ন্যায়সূত্রবর্তী ‘অব্যভিচারী’ পদ এখানে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থকার ব্যভিচারী জ্ঞান বা ভ্রম সম্বন্ধে সুদীর্ঘ এক আলোচনার অবতারণা করেছেন। সূক্ষ্ম বিচারে কোন জ্ঞানই যে ‘অব্যভিচারী’ সংজ্ঞা লাভ করতে পারে না নানাভাবে তা দেখানো হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, লতিকা চট্টোপাধ্যায়)


অতএব, ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থের অভিমতে ন্যায়সূত্রে অন্তর্ভুক্ত ‘অব্যভিচারী’ পদটি সব দিক দিয়েই অসার্থক–


‘তস্মাৎ স্থিতমেতদ্ অব্যভিচারিপদমনর্থকম্’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১৭)

অর্থাৎ : তাই স্থির সিদ্ধান্ত যে, ‘অব্যভিচারী’ পদের ব্যবহার অর্থহীন। (মুক্ততর্জমা)



ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষ লক্ষণ সম্বন্ধে প্রযুক্ত অপর তিনটি পদের অসার্থকতাও ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে অনুরূপভাবেই অসার্থক প্রতিপন্ন করার প্রয়াস দেখা যায়। পরিশেষে গ্রন্থকার প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয় বা বাহ্য অর্থের যে কোন অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের অকার্যকারিতার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন।


ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখাতেও প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে নিজস্ব লক্ষণ আছে। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সমালোচনা থেকে এগুলিও বাদ যায়নি। দর্শনের সূক্ষ্ম তর্ককে উপজীব্য করায় তাতে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য এবং হেতুবাদের পূর্ণ প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও এই সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরস। তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কেননা, কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তার নমুনাস্বরূপ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবে ন্যায়দর্শনের উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়– সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে– অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে– উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।


দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, কিন্তু সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যাঁরা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তাঁরা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রিস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে যে ব্যাপক অস্পষ্টতা রয়েছে তা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি প্রয়োজন বিবেচনায় আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন–


‘মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস– এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।

তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার।

জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয়? সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য– বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’– সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)।


অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে অবশ্যই। যেহেতু চার্বাকমতের নিজস্ব রচনার প্রকৃত অভাব রয়েছে তাই কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ আলোচনা করলে চার্বাক দর্শনের ভিন্ন এক ধরনের পরিচয় আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। কিংবা চার্বাকদর্শনের রূপরেখা গঠনে গ্রন্থটি কোন কোন ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কেননা ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ক্ষেত্রে চার্বাকী ধারণার সাদৃশ্য থাকতে পারে।

চার্বাকেতর বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনায় প্রত্যক্ষনির্ভর বস্তুবাদী এক দর্শন হিসেবে চার্বাকের যে পরিচিতি, তা থেকে স্বভাবতই ধারণা হতে পারে যে চার্বাক সিদ্ধান্তে যে ইতিবাচক বক্তব্য আছে, যার কেন্দ্র হলো স্থূল বস্তুবাদ এবং এই বক্তব্যের বিপরীত সব কিছুই এই দর্শনের সমালোচনার বিষয়ীভূত। অনুমান প্রমাণের বিরোধিতায় চার্বাকপক্ষের তৎপরতার মূল এই ব্যাপারে, এবং একই কারণে চার্বাকেরা বাদ দিতে চান আত্মা, পরলোক ইত্যাদিকে– প্রত্যক্ষের মাপকাঠি দিয়ে যেগুলির বিচার চলে না। কিন্তু ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে যখন দেখা যায় যে চার্বাকদের প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কৃত করতে উন্মুখ এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিকেও প্রমেয়ের মর্যাদা দিতে আপত্তি তখন গ্রন্থ-রচয়িতার নির্দিষ্ট বক্তব্য সম্বন্ধে সংশয় জাগে।


ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিতণ্ডা প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছিলো। এই বিতণ্ডারই পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। কেননা, বৈতণ্ডিকের কাজ শুধুই অপরপক্ষের সমালোচনা। এই সমালোচনাতেই বৈতণ্ডিক তাঁর সমগ্র প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেন এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে অপরপক্ষের প্রতিপক্ষ যে স্বপক্ষ, সেই স্বপক্ষের মতামত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। সোজা কথায়, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক, যেখানে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে কেবল অপরের মত খণ্ডন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদী জগতের কোন তত্ত্বই মানেন না, কিন্তু নিজস্ব কোন তত্ত্বের প্রতিষ্টাও তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। অপরের বিচারের ত্রুটি প্রদর্শন করাই যে জয়রাশির মুখ্য উদ্দেশ্য, আলোচ্য গ্রন্থের পরস্পরবিরোধী কয়েকটি সিদ্ধান্ত থেকেও তা পরিস্ফুট হয় বলে লতিকা চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য। যেমন–

‘ন্যায়দর্শনের সমালোচনা প্রসঙ্গে জাতি বা সামান্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃতি জানিয়ে (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃপৃ:৪-৭) একই গ্রন্থে জয়রাশি ভট্ট বৌদ্ধদের বিচারে ত্রুটি প্রদর্শনকালে জাতির বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তি খণ্ডনে তৎপর হয়েছেন (ঐ, পৃপৃ:৪৬-৫১)। বৌদ্ধ ক্ষণিকসন্তানবাদীদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় গ্রন্থকারের প্রয়াস দেখে মনে হয় তিনি বুঝি আত্মবাদী দার্শনিকদেরই সগোত্র (ঐ, পৃ:৫৫)। কিন্তু পরক্ষণেই অধ্যাত্ম দর্শনে অনুসৃত অনুমান প্রমাণের সাহায্যে আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করার প্রয়াস থেকে বোঝা যায় (ঐ, পৃপৃ:৭৪-৮৩) যে ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া [তাঁর] লক্ষ্য নয়।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)


কারো কারো মতে এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদীরা চার্বাক-সম্প্রদায়েরই ভিন্ন একটি গোষ্ঠি। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে চার্বাকের এক বৃহৎ গোষ্ঠিই এই নেতিবাচক প্রবণতায় সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেনি এবং প্রত্যক্ষকে স্বীকৃতি দিয়ে সাধারণগ্রাহ্য এই প্রমাণের মাধ্যমে পাওয়া বস্তুজগৎকে তার বিষয়বস্তুর পরিসরে এনেছে। এই স্বাভাবিক ধারণারই প্রতিফলন দেখা যায় বস্তুবাদের সঙ্গে চার্বাকী মতবাদের একাত্মীকরণে। এ-প্রসঙ্গে লতিকা চট্টোপাধ্যায় মনে করেন–

‘কিন্তু চার্বাকের এই বস্তুবাদী প্রকাশকে তার নেতিবাচক প্রবণতারই অঙ্গবিশেষ হিসাবে দেখাটা বোধ হয় অযৌক্তিক নয়। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক মতকে বস্তুবাদের পরিবর্তে হেতুবাদের সঙ্গেই একাত্ম করা অধিকতর সমীচীন। এই হেতুবাদেরই দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী প্রকাশের মধ্যে একটির আশ্রয় বস্তুজগৎ, প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যার পরিচিতি। অপরটির প্রকাশ ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’তে রূপায়িত চার্বাকী ধারায়, বস্তুজগৎকে স্বীকৃতি দিতে না পারায় যা বাস্তববাদী দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত বৌদ্ধ এবং অদ্বৈত বেদান্তের সমপর্যায়ভুক্ত হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)

এ-প্রেক্ষিতে জৈন দার্শনিক বিদ্যানন্দীর ‘তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক’ গ্রন্থের বক্তব্যটি স্মর্তব্য–


‘সর্বথা শূন্যবাদিনস্তত্ত্বোপপ্লববাদিনো ব্রহ্মবাদিনো বা জাগ্রদুপলব্ধার্থক্রিয়ায়ং কিং ন বাধকপ্রত্যয়ঃ’। (তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক)

অর্থাৎ : শূন্যবাদী, তত্ত্বোপপ্লববাদী ও ব্রহ্মবাদী জাগ্রতোপলব্ধিজাত অর্থক্রিয়া বা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুজগতের সত্তাকে সত্য বলে স্বীকার করেন না। (মুক্ততর্জমা)



শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্য’ গ্রন্থেও এই তিনটি মতবাদ একই শ্রেণীর অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, এ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে চার্বাক প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে যে– ‘চার্বাকেরা কোন প্রমাণকে স্বীকার করেন না’–


‘সোহয়মপূর্বঃ প্রমাণাদিসত্তানভ্যুপগমাত্মা’। (খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ : পৃষ্ঠা ২৬)।



হেতুবাদ প্রসঙ্গেও ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনার চেষ্টা হয়েছে। অতএব, সে আলোচনা না বাড়িয়ে এটুকু বলা যায় যে, হেতুবাদের বিপরীতধর্মী দুটি অভিব্যক্তির মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষ যেখানে প্রামাণ্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত, প্রচলিত পরিভাষায় ‘চার্বাক’ সংজ্ঞা সেই দর্শনেরই পরিচয় বহন করে। প্রচলিত প্রত্যক্ষবাদী চার্বাক মতে তত্ত্বের বর্তমানতা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে লভ্য বস্তুজগতকে কেন্দ্র করে। এই বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মতে পাঁচ– ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা মাটি, অপ্ বা জল, তেজ বা আগুন, মরুৎ বা বাতাস এবং ব্যোম বা আকাশ। যেমন ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে–


‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)

অর্থাৎ : ক্ষিতি বা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ।



কিন্তু প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা এই মূল তত্ত্বের সংখ্যা চারে সীমিত রাখতে চান। ব্যোম বা আকাশকে তারা গ্রাহ্য করেন না যেমন–


‘পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি।

তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা।’ (বার্হস্পত্য-সূত্র)।

অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।


চার্বাকেতর দার্শনিকদের বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক-মতের পরিচয়ে এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন অদ্বৈত-বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্য তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে বলেছেন–


লোকায়তিকপক্ষে তু তত্ত্বং ভূতচতুষ্টয়ম্ ।

পৃথিব্যাপস্তথা তেজো বায়ুরিত্যেব নাপরম্ ।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১)।।

অর্থাৎ : লোকায়ত মতে চারটি ভূতকেই তত্ত্ব বলা হয়। উক্ত চারটি ভূত হলো যথাক্রমে পৃথিবী, জল, তেজ এবং বায়ু। অপর কোন ভূত এই মতে স্বীকৃত নয়।



মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকমতে তত্ত্বের উল্লেখ এবং একই লোকায়তিক মতের উপস্থাপনায় এ-প্রসঙ্গে যে লোকগাথাটি উল্লেখ করেছেন, তা হলো–


তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)

অর্থাৎ : এই চার্বাকমতে পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু– এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।

.

অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।

চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।

অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস– শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।


কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–


‘পৃথিব্যপ্ তেজোবায়বস্তত্ত্বানি’। (প্রবোধচন্দ্রোদয়)

অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।


জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে চতুর্ভূত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–


‘পৃথ্বী জলং তেজো বায়ুর্ভূত চতুষ্টয়ম্’…। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়)

অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু– এই চারটি ভূত স্বীকৃত।



এভাবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়তিক মতের বহু উল্লেখ করা যেতে পারে। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও সূত্রের মাধ্যমে চতুর্ভূত সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণার অভিব্যক্তি দেখা যায়–


‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি…’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৫৯)

অর্থাৎ : পৃথিবী বা মাটি, জল, তেজ বা আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।



চার্বাকেতর দর্শন-স্বীকৃত পঞ্চভূতের মধ্যে চার্বাক-মতে ব্যোম বা আকাশকে যে তত্ত্ব হিসেবে গ্রাহ্য করা হয় না তার একটাই কারণ, ব্যোম বা মহাশূন্যের জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে হয় না। প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের কাছে প্রত্যক্ষসিদ্ধ এই চারটি তত্ত্ব ছাড়া অন্য কিছু অনুমোদন লাভ করেনি। এই চার তত্ত্বের সমবায়ে দেহ, ইন্দ্রিয় এবং জাগতিক সব পদার্থের সৃষ্টি। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীল তাই এ-প্রসঙ্গে লোকায়তসূত্র উদ্ধৃত করে আরো বলেন–


‘তৎসমুদায়ে বিষয়েন্দ্রিয়সংজ্ঞা’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৬০)

অর্থাৎ : তার (চতুর্ভূতের) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।



বিভিন্ন প্রাণিদেহের উপাদানরূপেও মৌল এই চারটি তত্ত্বের নির্দেশ চার্বাক দর্শনে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বস্তুজগতের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অনুমোদিত চার্বাকী তত্ত্বের সংখ্যা ভারতের প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম হলেও, চার্বাক-দর্শনের ইতিহাসে এটা কাকতালীয় কিনা কে জানে, প্রাচীন গ্রিক চিন্তায়ও কিন্তু এর এক অনুলিপি দেখা যায়। যেমন–

(Plato) প্লেটো’র মতে– ‘there are four elements out of which the body is composed, earth and fire and water and air…’।

আর অ্যারিস্টটল বলেন– ‘Since the bodies of all animals, and likewise of all plants, are composed from the four elements, in some of them earth predominates, as in plants, in others, water, as in aquatic animals, and in others air of fire, as in pedestrious and winged animals.‘ -(‘plato Dictionary, p.74’ : সূত্র: লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)


অতএব, এই আলোচনা থেকে চার্বাক-মত প্রসঙ্গে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে, চার্বাকেরা অবশ্যই প্রত্যক্ষ-প্রমানবাদী। কিন্তু তাঁরা প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদী কিনা অর্থাৎ চার্বাকেরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন কিনা এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমাদেরকে প্রমাণবাদের অন্যতম অনুমান-প্রমাণের আলোচনায় প্রবিষ্ট হতে হবে।

প্রত্যক্ষ-অনুগামী অনুমান।


প্রত্যক্ষের পরেই প্রাধান্যের বিচারে ভারতীয় দর্শনে যে প্রমাণের অগ্রগামিতা সাধারণভাবে স্বীকার্য সেই অনুমানকেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তীব্রভাবে চার্বাকী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর অনুমান প্রমাণ হিসেবে যাঁদের দ্বারা পূর্ণভাবে অনুমোদিত, প্রতি-আক্রমণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরাও স্ব-স্ব মতবাদের ভিত্তিমূল দৃঢ় ও নিষ্কণ্টক করার মরিয়া প্রচেষ্টায় পশ্চাৎপদ হননি। অনুমান-প্রমাণকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দার্শনিকদের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে প্রবেশের আগে দর্শনের পরিভাষায় অনুমানের লক্ষণ সম্বন্ধে কিছুটা প্রাথমিক পরিচয় সেরে নেয়া দরকার।



মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষলক্ষণের বর্ণনার পর অনুমানকে প্রত্যক্ষ-আশ্রিত বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে–


‘অথ তৎ পূর্বকম্ অনুমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিই অনুমান।



অনুমান প্রত্যক্ষের মতো স্বনির্ভর প্রমাণ নয়। ‘অনু’ শব্দের অর্থ ‘পশ্চাৎ’ এবং ‘মান’ অর্থ জ্ঞান। তার মানে, প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের পর প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সংগৃহীত উপকরণগুলির সাহায্যে নতুন জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয় এই অনুমান প্রমাণ।

ন্যায়বর্ণিত অনুমানের গঠন বোঝাতে সবচেয়ে প্রচলিত দৃষ্টান্ত হলো–


‘পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ– যত্র যত্র ধূমোহস্তি তত্র তত্র অগ্নিঃ, যথা মহানসাদৌ।

অর্থাৎ : পর্বতে বহ্নি আছে যেহেতু পর্বতে আমরা ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করছি। কারণ যেখানে যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে। যেমন রান্নাঘরের চুল্লি।



তার মানে, পর্বতে ধূম বা ধোঁয়ার অস্তিত্ব থেকে বহ্নি বা আগুনের অস্তিত্ব জানা গেলো। আগুনের এই অস্তিত্ব জানলাম অনুমান করে। অনুমানের ভিত্তি এখানে ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে এক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ, যে সম্বন্ধের অভিব্যক্তি ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’ এই ভূয়োদর্শন-জনিত ধারণা। এ ধারণার উৎস আমাদের পুরাতন প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা, যথা– রান্নাঘর এবং অন্যান্য স্থানে ধোঁয়াকে সব সময়ে আগুনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে দেখা গেছে।

এই অনুমানে তিনটি পদ আছে– ধূম, অগ্নি, পর্বত। ভারতীয় ন্যায়ের পরিভাষায় এখানে–

‘ধূম’ হলো ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’ বা ‘সাধন’

‘অগ্নি’ হলো ‘সাধ্য’

‘পর্বত হলো ‘পক্ষ’।


ধোঁয়া দেখে আগুনের অস্তিত্ব আমরা অনুমান করি; কাজেই ধোঁয়া এখানে আমাদের অনুমানলব্ধ জ্ঞানের ‘হেতু’, ‘সাধন’ বা ‘লিঙ্গ’। হেতুর সাহায্য নিয়ে যা অনুমান করা হয়– এ ক্ষেত্রে আগুন– ন্যায়ের পরিভাষায় তার নাম ‘সাধ্য’। যে স্থানে বা অধিকরণে সাধ্যের অস্তিত্ব স্থির করা হয় তার নাম ‘পক্ষ’। উপরের উদাহরণে পক্ষের ভূমিকা পর্বতের। কিন্তু ধূম (হেতু) থেকে পর্বতে (পক্ষতে) অগ্নির (সাধ্যের) অনুমান করা গেলো কী করে? কেননা হেতুর (ধূমের) সঙ্গে সাধ্যর (অগ্নির) নিয়ত-সম্বন্ধ জানা আছে এবং তার কোনো ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম জানা নেই : যেখানেই ধূম সেখানেই আগুন, যেমন রান্নার চুল্লিতে; এবং জলাশয় প্রভৃতি অগ্নিহীন স্থানে ধূম কখনো দেখা যায় না। ‘সাধন’ বা ‘হেতু’র সঙ্গে ‘সাধ্য’র এই চিরকালীন বা নিয়ত এবং অব্যভিচারী সম্বন্ধকে ন্যায়ের ভাষায় বলা হয় ‘ব্যাপ্তি’ বা অবিনাভাব। ব্যাপ্তি হচ্ছে ব্যাভিচররহিত সম্বন্ধ। অতএব ‘ব্যাপ্তি’র ভিত্তিতেই অনুমান সম্ভব; ‘ব্যাপ্তি’ সম্ভব না-হলে অনুমানও অসম্ভব হবে।


অনুমানের ক্ষেত্রে ‘ব্যাপ্তি’র গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ অনুমানের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে এই ব্যাপ্তির জ্ঞানকেই নির্দেশ করা যেতে পারে। ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’– এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে ভিত্তি করে আমরা ‘পক্ষ’ বা পর্বতের সঙ্গে ‘সাধ্য’ বা আগুনের যোগ সাধন করি। ধোঁয়া এখানে ‘সাধ্য’ এবং ‘পক্ষ’ উভয়েরই সাধারণ ধর্ম বা ‘লিঙ্গ’। ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’র সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত থাকার জন্য ‘সাধ্য’র অপর নাম ‘লিঙ্গী’।


প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে পৌঁছানোর যে পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া তাকে বলে অনুমান। অনুমানকে প্রত্যক্ষপূর্বক বলা হয়েছে, কারণ অনুমানগত জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রত্যক্ষের উপর আমাদের নানাভাবে নির্ভর করতে হয়। দৃষ্টি ও অনুভূত নিয়মকে ভিত্তি করে কোন অদৃষ্ট ও অননুভূত বস্তুর সত্তাকে আমরা অনুমান করি। উদাহরণে ধোঁয়াকে প্রত্যক্ষ করে তবেই ধোঁয়ার কারণ হিসেবে আগুনের সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়। নির্ভুল অনুমানের ভিত্তি যে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের জ্ঞান, সেই ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের মূলেও আছে প্রত্যক্ষের কার্যকরিতা। অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধোঁয়া এবং আগুন বা সাধন এবং সাধ্যের একত্র অবস্থানকে প্রত্যক্ষ করে তবেই এই ব্যাপ্তিজ্ঞানের ধারণা সম্ভব। ন্যায়সূত্রের ব্যাখ্যাকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ তাই বলেন–


‘তৎপূর্ব্বকমিত্যনেন লিঙ্গলিঙ্গিনোঃ সম্বন্ধদর্শনং লিঙ্গদর্শনঞ্চাভিসম্বধ্যতে। (ন্যায়ভাষ্য-১/১/৫)

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিতে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান নির্ণীত হয় পূর্বে কোন স্থানে লিঙ্গ ও লিঙ্গীর সম্বন্ধদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার (স্মৃতির) মাধ্যমে। (মুক্ততর্জমা)



এ-প্রেক্ষিতে অনুমান প্রমাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের সেই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই প্রধানত চার্বাকেরা অনুমানের প্রামাণ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তিতেই রচিত অনুমান প্রমাণের বিশাল সৌধ, চার্বাকেতর গ্রন্থগুলির বিভিন্ন নজির থেকেই অনুমান হয়, চার্বাকপক্ষের বিচারে এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে অভ্রান্ততার ছাড়পত্র পেতে নিশ্চয়ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই প্রশ্নগুলির বিশ্লেষণমূলক সমাধানের মধ্যেই হয়তো সেই সিদ্ধান্তটাও নিহিত আছে যে, চার্বাকমত কি প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী অর্থাৎ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন, না কি তাঁরা প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী তথা প্রত্যক্ষ ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমানকেও প্রমাণ বলে স্বীকার করেন? এর সুরাহার জন্য নিরূপায় আমাদেরকে চার্বাকেতর দর্শন-সাহিত্যেরই আশ্রয় নিতে হবে।

মাধবাচার্য’র সর্বদর্শনসংগ্রহ ও চার্বাকের অনুমান খণ্ডন।


মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক-প্রস্থানে প্রমাণ সম্বন্ধে চার্বাকমত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–


‘প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদিতয়া অনুমানাদেরনঙ্গীকারেণ প্রামাণ্যাভাবাৎ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিত্ব হেতু অর্থাৎ একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলিয়া, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলিয়া দেহাতিরিক্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নহে।


তার মানে, মাধবাচার্য বলতে চান যে, চার্বাকরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে মানেন; অতএব তাঁদের মতে অনুমানের প্রামাণ্য নেই, বা সোজা কথায়, অনুমান বলে কোন প্রমাণ হয় না।



এক্ষেত্রে মাধবাচার্য চার্বাকদের অনুমান-বর্জনের বর্ণনায় তাঁদেরকে অত্যন্ত কূটতর্কপ্রবণ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে প্রসঙ্গক্রমে মাধবাচার্যের লেখার কায়দাটা সম্পর্কে বলে রাখা দরকার যে, বিপক্ষ-বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি এমনভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করেন যেন তিনি সাময়িকভাবে বিপক্ষ অবলম্বন করেছেন; অর্থাৎ তিনি নিজে যদি চার্বাক-মতানুগামী হতেন তাহলে কোন্ ধরনের বিচার করে ঐ বিপক্ষ সমর্থন করতেন যেন তারই পরিচয় দিয়েছেন। চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডনের বর্ণনায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মাধবাচার্য বলছেন–


‘তদেতদ্ মনোরাজ্য-বিজৃম্ভণম্ । ব্যাপ্তি-পক্ষধর্মতা-শালি হি লিঙ্গম্ গমকম্ অভ্যুপগতম্ অনুমান-প্রামাণ্য-বাদিভিঃ। ব্যাপ্তিশ্চ উভয়বিধোপাধি-বিধুরঃ সম্বন্ধঃ।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাকপ্রস্থান)

অর্থাৎ :

আপনার সেই এই কথাটি তো মনোরাজ্যের বিজৃম্ভণ। অনুমান-প্রামাণ্যবাদীগণ কর্তৃক ব্যাপ্তি ও পক্ষধর্মতা-বিশিষ্ট হেতুই গমক বা জ্ঞাপক (জ্ঞান-জনক) বলে স্বীকৃত হয়েছে। শঙ্কিত ও নিশ্চিত উপাধিদ্বয়-রহিত সামানাধিকরণ্য সম্বন্ধই ব্যাপ্তি।



এই জটিল দার্শনিক-ভাষা বোঝা সাধারণের কর্ম নয়। তবে এই কথাগুলোকে সহজবোধ্যভাবে বিশ্লেষণ করে বললে, মাধবাচার্য বলছেন, চার্বাক-মতে ‘ব্যাপ্তি’ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব, অতএব অনুমানও সম্ভব নয়। ‘ব্যাপ্তি’ অসম্ভব কেন? কেননা, ‘ব্যাপ্তি’ স্থাপনের জন্য সমস্ত ‘উপাধি’র সম্ভাবনা দূর করা দরকার। কিন্তু উপাধি মানে কী? মোটের উপর বলা যায় এক ধরনের শর্ত বা কন্ডিশন। যেমন– আগুন থাকলেই যদি ধোঁয়া থাকতো তাহলে তো তপ্ত লৌহপিণ্ডেও ধোঁয়া থাকার কথা! কিন্তু তপ্ত লৌহপিণ্ডে ধোঁয়া থাকে না। ভিজে কাঠ বা আর্দ্র জ্বালানিতে আগুন ধরালে ধোঁয়া থাকে, অতএব আর্দ্র জ্বালানি এই দৃষ্টান্তে হবে উপাধি বা শর্ত। মাধব আরো বলেছেন, চার্বাক মতে উপাধি আবার দু’রকম– ‘নিশ্চিত’ ও ‘শংকিত’। ভিজে কাঠ হলে উপাধিটি নিশ্চিত, কেননা তা আমাদের জানা আছে। কিন্তু এমন উপাধি তো থাকতে পারে যার খবর আমাদের জানা নেই। তাকে বলবো, শংকিত উপাধি। এই দু’রকম সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে দূর হলে পরই ‘হেতু’ এবং ‘সাধ্য’র নিয়ত-সহচার ও ব্যাভিচারের অভাব থেকে ব্যাপ্তি সুনিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত ও শংকিত সমস্ত রকম উপাধির সম্ভাবনা দূর করার কোনো উপায়ই সম্ভব নয়। অতএব, ব্যাপ্তিও সম্ভব নয়, এবং ব্যাপ্তি সম্ভব নয় বলেই অনুমানও অসম্ভব।


ব্যাপ্তি স্থাপন করা– বিশেষত নিশ্চিত ও শংকিত সমস্ত রকম উপাধির সম্ভাবনা দূর করে তা স্থাপনা করা– কেন একান্তই অসম্ভব, মাধবাচার্যের মতে চার্বাকরা নাকি তাই নিয়ে অনেক কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। বর্তমানে আমাদের পক্ষে তার জটিলতায় প্রবেশ করার সুযোগ নেই। তবে সাধারণ কৌতুহল মেটানোর জন্যে সংক্ষিপ্ত ধারণাটা হলো এরকম–

মাধবাচার্য বলেন, চার্বাক-মতে ব্যাপ্তিজ্ঞান দুটি পদার্থের ব্যতিক্রমহীন, শর্তহীন বা উপাধিহীন, সুনিশ্চিত, সার্বিক, সার্বত্রিক সাহচর্যের জ্ঞান। ‘ব্যাপ্তি’ অর্থাৎ সাধ্যের সঙ্গে সাধনের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধের জ্ঞানকে যদি আমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে লাভ করতে চাই তাহলে প্রয়োজন সাধ্যের সঙ্গে যুক্ত সাধনকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রত্যক্ষ করা। এভাবে প্রতিটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধের অবধারণের পথে প্রধান অন্তরায় হলো দেশ, কাল এবং স্বভাবের ব্যবধান। এইরূপ জ্ঞান প্রত্যক্ষসিদ্ধ হতে পারে না। প্রত্যক্ষের দ্বারা বর্তমানকালীন কোন বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকেই জানা যায়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় পদার্থকে প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায় না। দুটি পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান ঐ দুটি পদার্থের ত্রৈকালিক ও সম্ভাব্য যাবতীয় দৃষ্টান্তকে প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমেই সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যদি ধূম ও আগুনের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় ধূম ও আগুনকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ত্রৈকালিক যাবতীয় ধূম এবং আগুনকে পর্যবেক্ষণ করা হলে তবেই ধূম এবং আগুনের মধ্যে শর্তহীন নিশ্চিত সার্বিক সাহচর্যের জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু ত্রৈকালিক যাবতীয় ধূম ও আগুন প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না। যদিও বা ধরে নেওয়া হয় যে অতীত ও বর্তমানের যাবতীয় ধূম ও আগুনকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, তবুও ভবিষ্যতের ধূমকে আমরা কোনভাবেই প্রত্যক্ষ করতে পারি না। যাবতীয় ধূম ও আগুনের প্রত্যক্ষ ব্যতীত তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমহীন সম্বন্ধ জানাও সম্ভব নয়। সুতরাং দুটি পদার্থের ব্যাপ্তি ও ব্যতিক্রমহীন, শর্তহীন, সুনিশ্চিত, সার্বিক ও সার্বত্রিক সাহচর্যের জ্ঞান নিছক কল্পনামাত্র।


মাধবের মতে, চার্বাকদের আরও বক্তব্য হলো, অনুমান প্রমাণের অনুগামীগণ বলতে পারেন যে একটি অনুমানের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিজ্ঞান অপর একটি অনুমানের সাহায্যেই লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু একথাও গ্রহণযোগ্য নয়। একটি অনুমানের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিজ্ঞান যদি অপর একটি অনুমানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে ঐ অপর অনুমানের ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করার জন্য আবার একটি অনুমানের সাহায্য প্রয়োজন। এইভাবে অনবস্থা-দোষ অবশ্যম্ভাবী। তাছাড়া যদি অনুমানের সাহায্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান এবং ব্যাপ্তিজ্ঞানের সাহায্যে অনুমানকে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে অন্যোন্যাশ্রয়-দোষ দেখা দেয়। সুতরাং ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।


প্রমাণের অপর একটি মাধ্যম শব্দপ্রমাণ বা আপ্তবাক্যও যে চার্বাক-মতে ব্যাপ্তিজ্ঞানের কারণ নয়, মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’র বিবরণ থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে চার্বাকপক্ষ থেকে বৈশেষিক মতের উল্লেখ করা হয়েছে, যে মত অনুসারে আপ্তবাক্য অনুমানের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকারের ক্ষেত্রে আপ্তবাক্যের সাক্ষ্য সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি। আপ্ত বা বিশ্বস্ত ব্যক্তির বাক্যকে বলা হয় শব্দ-প্রমাণ। কিন্তু শব্দ পদজ্ঞান-নির্ভর। পদজ্ঞান বৃদ্ধ-ব্যবহার বা বয়স্ক ব্যক্তির শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে লব্ধ। পদজ্ঞান এককভাবে প্রত্যক্ষলব্ধ নয়। কয়েকটি ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করে পদজ্ঞান আমরা অনুমান করি। পদজ্ঞান আংশিকভাবে অনুমান নির্ভর। আপ্তবাক্যস্বরূপ এ জাতীয় উক্তিতে নির্ভরতা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন বাক্যের সঙ্গে অর্থের সার্বকালীন সঙ্গতি সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, অর্থাৎ, বাক্যের সঙ্গে অর্থের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূচক অপর একটি ব্যাপ্তিজ্ঞানের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া যায়। অতীত অভিজ্ঞতায় যাকে আপ্ত বলে জেনেছি সে যে বর্তমানেও আপ্ত থাকবে তার পক্ষেই বা প্রমাণ কী? কাজেই আপ্তবাক্যে নির্ভরতার সঙ্গে ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকায় ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে আপ্তবাক্য গণ্য হতে পারে না। এ-প্রেক্ষিতে মন্তব্য করা বোধকরি অসঙ্গত হবে না যে, অনুমানের আশ্রয় ব্যাপ্তিজ্ঞান আপ্তবাক্যের মাধ্যমে নির্ণয়যোগ্য নয়– চার্বাকদের এই উক্তি প্রকৃতপক্ষে অনুমানকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হলেও প্রমাণ হিসেবে আপ্তবাক্যের দুর্বলতারই ইঙ্গিত সূচিত করে।

এছাড়া উপমান বা অন্য কোন প্রমাণের দ্বারাও ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। শব্দ, উপমান বা অন্য কোন প্রমাণ নিজেই সিদ্ধ নয়। পূর্বশ্রুত সাদৃশ্য-জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞাতপূর্ব পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে যে জ্ঞান হয় তাকে বলে উপমিতি। সাদৃশ্যজ্ঞানও আংশিকভাবে অনুমান-নির্ভর। অনুমান অসিদ্ধ হওয়ায় শব্দ ও উপমান অসিদ্ধ হয়ে পড়ে। কোন অসিদ্ধ প্রমাণের সাহায্যে লব্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞান সিদ্ধ হতে পারে না।


এখানেই শেষ নয়, চার্বাক-মতানুসারে বলা হয়, বৌদ্ধগণ যে কার্য-কারণ ও তাদাত্ম্য সম্বন্ধের মাধ্যমে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ। কার্য-কারণ বা তাদাত্ম্য নিজেই নিঃসন্দিগ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সুতরাং তাদের সাহায্যে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কখনোই সার্থক হতে পারে না। বস্তুর স্বভাবের দ্বারাও ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। দহনক্রিয়া ও নিম্নগতি যথাক্রমে অগ্নি ও জলের স্বভাবধর্ম। প্রতিটি বস্তুর স্বভাবধর্ম যেহেতু অপরিবর্তনীয় সেহেতু অনেকে স্বভাবধর্মের মাধ্যমেও ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু চার্বাকগণ বস্তুর কোন অপরিবর্তনীয় স্থির স্বভাবধর্ম মানতে রাজী নন। তাঁদের বক্তব্য হলো, বস্তুর স্বভাবধর্ম ব্যক্তির অতীত অভিজ্ঞতার দ্বারা স্থির করা হয়। এই অভিজ্ঞতা কোন কিছুর ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে মাত্র, কোন স্থির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অগ্নির দাহিকাশক্তি ভবিষ্যতে অগ্নির দহন করার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে, কিন্তু প্রকৃতির পরিবর্তনে ভবিষ্যতে অগ্নির এই স্বভাব যে কখনও পরিবর্তিত হবে না– এমন তথ্য স্থির নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করে না।


বস্তুতপক্ষে দুটির পদার্থের মধ্যে শর্তহীন, নিঃসন্দিগ্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞান কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। যত বেশিসংখ্যক ক্ষেত্রই পরীক্ষা করা হোক না কেন দুটি পদার্থের সাহচর্য যে সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত তা কোনভাবেই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অনুমান ব্যাপ্তিজ্ঞান-সাপেক্ষ। ব্যাপ্তিজ্ঞান যেহেতু কোন প্রমাণের দ্বারাই লাভ করা সম্ভব নয় সেহেতু অনুমান অসিদ্ধ। অতএব চার্বাকদের সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ (প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্)।


অনুমান-প্রমাণে সমস্ত রকম শর্ত বা উপাধির সম্ভাবনা দূর করে ব্যাপ্তি স্থাপনা করা কেন একান্তই অসম্ভব, উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’কার মাধবাচার্যের মতে চার্বাকরা নাকি তাই নিয়ে অনেক কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। কিন্তু এখানে যদি বিপ্রতীপ-দৃষ্টিতে এরকম প্রশ্ন উত্থাপিত হয়– স্বয়ং মাধবাচার্যই চার্বাকদের মুখে এই রকম কঠিন ও জটিল যুক্তিজাল বসিয়ে দিয়ে উল্টো চার্বাকদেরকেই তিনি জটিল ও কঠিন যুক্তিবিশারদ আখ্যায় অতিশয়োক্তি করেছেন, তাহলে বাস্তব ইতিহাসের দিক থেকে তা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? প্রশ্নটা অবান্তর কিনা তা বিশ্লেষণ করতে হলে প্রসঙ্গত এখানে বলা যেতে পারে, চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডন হিসেবে মাধবাচার্য যে যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন তা অন্তত অনেকাংশে মাধবাচার্যের নিজের সম্প্রদায়-উদ্ভাবিত বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে–

‘মাধবাচার্য ছিলেন অদ্বৈত-বেদান্ত মতে অতি-নিষ্ঠ অনুগামী। অদ্বৈত-বেদান্ত মতে শ্রুতি (বা বেদান্ত) ছাড়া আর কোনো প্রমাণই সম্ভব নয়। তাই স্বয়ং শঙ্করাচার্য তাঁর ‘ব্রহ্ম-সূত্র’-ভাষ্যের ভূমিকাতেই ঘোষণা করেছেন যে সর্বপ্রকার প্রমাণ-প্রমেয় ব্যবহারের ভিত্তি বলতে আসলে অজ্ঞান বা অবিদ্যা। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে শ্রীহর্ষর কূটতর্কে পারদর্শিতা সুপ্রসিদ্ধ। এবং তিনি মাধবাচার্যের পূর্বেই অদ্বৈতমতকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য’ নামে গ্রন্থে সব রকম প্রমাণ খণ্ডনের আয়োজন করেছেন। শ্রীহর্ষ কূটতর্কে পারদর্শী ছিলেন বলেই সর্বপ্রকার প্রমাণ বলতে তাঁর কাছে বিশেষত অনুমান-প্রমাণ। শ্রীহর্ষের বইতে তাই অনুমান খণ্ডনের বিশদ আয়োজন। তার জন্যে যথেষ্ট যুক্তিতর্কও। যুক্তিতর্কগুলি খুবই বিদগ্ধ, সহজবোধ্য নয়। তারই জের টেনে শ্রীহর্ষর ব্যাখ্যাকারেরা তর্কজাল আরো জটিল করেছেন। এইসব বই থেকেই মাধবাচার্য অনুমান-খণ্ডনের অতি-বিদগ্ধ বিচার চয়ন করে চার্বাকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন কিনা, যোগ্যতর বিদ্বানরা তা অনুসন্ধান করতে পারেন। সে অনুসন্ধান হয়তো নিষ্ফল হবে না।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৪৬)


আগেই বলা হয়েছে, মাধবাচার্যের লেখার কায়দাটা এরকম যে, বিপক্ষ-বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি এমনভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করেন যেন তিনি সাময়িকভাবে বিপক্ষ অবলম্বন করেছেন; অর্থাৎ তিনি নিজে যদি চার্বাক-মতানুগামী হতেন তাহলে কোন্ ধরনের বিচার করে ঐ বিপক্ষ সমর্থন করতেন যেন তারই পরিচয় দিয়েছেন। চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডনের বর্ণনায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা তাঁর জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনকই হওয়ার কথা। কেননা, তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের প্রবক্তারাই অনুমান-খণ্ডনে বিশেষ পারদর্শিতার নজির দেখিয়েছেন। তা অনুসরণ করে অনুমান-খণ্ডনের অতি-বিদগ্ধ বর্ণনা রচনা করা সহজ ব্যাপার বলে দেবীপ্রসাদের অভিমত। যদিও মাধবাচার্য ঠিক এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন কিনা– এই প্রশ্ন নিয়ে অবশ্যই বিবাদের অবকাশ থাকতে পারে বলেও দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আদৌ চার্বাকরা মাধব-বর্ণিত এরকম জটিল ও কঠিন যুক্তিবিশারদ ছিলেন এই অতিশয়োক্তি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা চার্বাকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি থেকে বরং মনে হয়, তাঁরা কূট তার্কিকও ছিলেন না, আবার বাচস্পতি মিশ্রের আখ্যা অনুযায়ী একান্ত যুক্তিহীন অর্থে জানোয়ারেরও অধম ছিলেন না। তার বদলে হয়তো সাধারণ মানুষের বোধগম্য সাদামাটা যুক্তি দিয়ে সম্প্রদায়ান্তরের নানা মতামত নিয়ে হাসিতামাশা করেছেন। এই কিছু কিছু লোকগাথা মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেই লোকায়ত-মত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেমন–


‘পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি।

স্বপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে’।। (চার্বাকষষ্ঠি-৫০)।।

অর্থাৎ : জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে নিহত পশুর যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে যজ্ঞকারী যজমান কেন তার পিতাকে হত্যা করে না?

.

গচ্ছতামিহ জন্তৃ’নাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পনম্।

গেহস্থকৃতশ্রাদ্ধেন পথি তৃপ্তিরবারিতা।। (লোকায়তিকমত-সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।

অর্থাৎ : যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো।



যজ্ঞে নিহত পশু যদি সোজা স্বর্গে যায় তাহলে নিজের পিতাকে স্বর্গে পাঠানোর অমন সোজা পথ থেকে বঞ্চিত করা কেন? কিংবা, শ্রাদ্ধক্রিয়ায় পিণ্ড দান করলেই যদি মৃতের ভোজনরূপ ক্ষুধা নিবৃত্তি ঘটে তাহলে গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো আর পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না! হাসিতামাশা হলেও কথাগুলি যুক্তিহীন নয়, আবার শংকিত ও নিশ্চিত উপাধি বর্জন করে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করার অসম্ভাবনার মতো যুক্তিতর্কের কূটকচালও নয়। যেহেতু চার্বাকদের নিজস্ব মত ও বিতর্ক উপস্থাপন করে এমন গ্রন্থ প্রকৃতই অজ্ঞাত তাই স্থির সিদ্ধান্ত জানার উপায় নেই। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে অন্তত আপাতদৃষ্টিতে মাধবাচার্যের চার্বাক-বর্ণনায় বেশ কিছুটা অসংগতি চোখে পড়ে। একদিকে মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকের নামে প্রচলিত একটি প্রামাণিক লোকগাথা উদ্ধৃত করেন–


যাবদ্ জীবেৎ সুখং জীবেদ্ নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ।

ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।  -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।

অর্থাৎ : যতদিন বেঁচে আছ ততদিন সুখভোগ করে নাও। মরণ থেকে কারুরই রেহাই নেই। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?


এবং এই লোকগাথাটি উদ্ধৃত করে তিনি এরপর মন্তব্য করেছেন–


-ইতি লোকগাথামনুরুন্ধানা নীতিকামশাস্ত্রানুসারেণার্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ মন্যমানাঃ পারলৌকিকম্ অর্থম্ অপহ্নুবানাঃ চার্বাকমতম্ অনুবর্ত্তমানা এবানুভূয়ন্তে। অতএব তস্য চার্বাক-মতস্য লোকায়তম্ ইতি অন্বর্থম্ অপরং নামধেয়ম্ । -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।

অর্থাৎ : এই লোকগাথার অনুবর্তন করে, নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র অনুসারে অর্থ ও কামকে পুরুষার্থ মনে করে, পারলৌকিক স্বর্গ, দেবতা, পাপ ও পুণ্য প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ পদার্থ অগ্রাহ্য করে চার্বাকমতের অনুবর্তন করতে দেখা যায়। এজন্যে চার্বাক মতের অপর একটি সার্থক নাম লোকায়ত। প্রায় সমস্ত লোকে এই মতটি পরিব্যাপ্ত বলে তা লোকায়ত মত নামে প্রসিদ্ধ।



তার মানে, একদিকে তিনি বলছেন, চার্বাকেরই নামান্তর হিসেবে লোকায়ত শব্দটি বেশ জুৎসই, কেননা হাজার হোক এই দর্শন ইতর জনগণেরই দর্শন। তাদেরই মনে ধরবার মতো কথা। অন্যদিকে বলছেন চার্বাকেরা কঠিন ও জটিল কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। ‘কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায়, ইতর জনগণ তো শিক্ষাদীক্ষার সামান্য সুযোগ থেকেই বঞ্চিত। তাই এই ইতর জনগণই ‘নিশ্চিত’ ও ‘শংকিত’ উভয় প্রকার ‘উপাধি’ বর্জন করে ব্যাপ্তি নিশ্চয় নিয়ে অতি-বিশুদ্ধ আলোচনার অবতারণা করতে পারে– এ-হেন কথা কষ্টকল্পনার পক্ষেও দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে চার্বাকেরা যে সত্যিই অমন ফলাও করে অনুমান মাত্ররই অসারতা প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন, এ-হেন কথা কল্পনা করার কোনো কারণ নেই।’ দেবীপ্রসাদের এ-যুক্তি উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই।

আমরা পরে দেখবো, চার্বাকেরা একেবারে কোনো রকম অনুমানই মানতেন না।– এমন কি এজাতীয় কথা খুব জোর করে বলায় অনেক বড় বাধা আছে। বরং অন্যান্য নজির থেকে মনে হয়, আত্মা পরলোক ইত্যাদি একান্ত অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষ-গোচর বিষয়ে সাধারণ বা লৌকিক অনুমান মানবার ব্যাপারে তাঁদের মতে কোনো বাধা ছিলো না।

হরিভদ্র সূরি’র ষড়্দর্শনসমুচ্চয় ও চার্বাকের অনুমান-খণ্ডন 

চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডন বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যেই পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি যে মাধবাচার্যের বর্ণনা  সংশয়-সাপেক্ষ। অন্যান্য দার্শনিকদের রচনাতে তাই হয়তো চার্বাকের অনুমান-খণ্ডন সংক্রান্ত অমন বিস্তৃত, বিদগ্ধ ও যুক্তিকণ্টকিত আলোচনার পরিচয় পাওয়া যায় না। বরং তার বদলে, চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডনের উদ্দেশ্য এবং উপায়– উভয়েরই অনেকটা সাদামাটা ও সহজবোধ্য পরিচয় পাওয়া যায়।


অষ্টম শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক হরিভ্রদ্রসূরি তাঁর বিখ্যাত ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে চার্বাক-বর্ণনায় লোকায়তিক-মত প্রসঙ্গে (ইতঃপূর্বে আংশিক-উদ্ধৃত হয়েছে) বলেন–

‘লোকায়তা বদন্ত্যেবং নাস্তি দেবো ন নির্বৃতিঃ।
ধর্মাধর্মৌন বিদ্যেতে ন ফলং পুণ্যপাপয়োঃ।।
এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ।
ভদ্রে! বৃকপদং পশ্য যদ্বদন্তি বহুশ্রুতাঃ’।। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮১)
অর্থাৎ : লোকায়তরা বলেন, দেবতা বলে কিছু নেই, মোক্ষ বলেও নয়। ধর্ম ও অধর্ম বলে কিছু হয় না, পুণ্য ও পাপের ফল বলেও নয়। যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক (অতএব সত্য)। হে ভদ্রে! নেকড়ের পায়ের চিহ্ন দেখ এবং তা থেকে মহাপণ্ডিতেরাও কী বলেন (ভেবে দেখ)।


হরিভদ্রর গ্রন্থটি শ্লোকে লেখা। কিন্তু শ্লোকগুলি সহজ ও প্রাঞ্জল হলেও হরিভদ্রর রচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বলে এগুলির বিশদার্থ বোঝার জন্য তাঁর ব্যাখ্যাকার মণিভদ্র এবং গুণরত্নর লেখার উপর নির্ভর করতে হয়। সন্দেহ নেই যে প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের বস্তুবাদী লোকায়তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিবেচ্য করেই এ-শ্লোকটি রচিত হয়েছে। কিন্তু শেষোক্ত উক্তি– ‘ভদ্রে! বৃকপদং পশ্য যদ্বদন্তি বহুশ্রুতাঃ’ অর্থাৎ, ‘হে ভদ্রে! নেকড়ের পায়ের চিহ্ন দেখ এবং তা থেকে মহাপণ্ডিতেরাও কী বলেন (ভেবে দেখ)’– বেশ হেঁয়ালিপূর্ণ বলে মনে হয়। ব্যাখ্যাকার গুণরত্ন এই হেঁয়ালির তাৎপর্যটুকু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে বলছেন–

“এই বিষয়ে চার্বাক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি গল্প চালু আছে। জনৈক ব্যক্তি নাস্তিকমতের বিশেষ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছিলেন আস্তিকমতে বিশ্বাসী। লোকটি নানা যুক্তি দিয়ে স্ত্রীকে নিজমতের প্রতি টানবার চেষ্টা করেন। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে লোকটি এক মতলব আঁটলেন। গভীর রাতে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নগরের বাইরে গেলেন এবং বললেন, ‘এই নগরে তো অনুমান প্রভৃতি পরোক্ষ জ্ঞানের সমর্থক অনেক বড়বড় পণ্ডিত আছেন। কিন্তু তাঁদের বুদ্ধির দৌড় তোমাকে দেখাব।’ এই বলে নগরদ্বার থেকে শুরু করে চৌমাথা পর্যন্ত ধুলোর উপর নেকড়ের পায়ের ছাপ এঁকে ফিরলেন। পরদিন সকালে আস্তিক মহাপণ্ডিতেরা মিলিত হয়ে আলোচনা করতে লাগলেন : ‘নিশ্চয়ই নগরে নেকড়ে বাঘ এসেছিল, নইলে পায়ের ছাপ পড়ল কী করে?’ তখন তাদের দেখিয়ে নাস্তিক তাঁর স্ত্রীকে বললেন : ‘এঁরা আসল কথা না-জেনেও সবাই মিলে একই সিদ্ধান্ত করছেন। স্বর্গ ইত্যাদি বিষয়েও এঁরা একই রকম আচরণ করেন। নিজেদের মতের সমর্থনে কিঞ্চিৎ অনুমান বা আগম উল্লেখ করে স্বর্গ প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে সাধারণ লোককে ঠকান। সুতরাং এঁদের কথা স্বীকার করবার কোনো কারণ নেই।’ ফলে স্ত্রী স্বামীর মত মেনে নিলেন।”- (সূত্র: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৪৮)


গল্পটা মজাদার বটে। পাণ্ডিত্যের জাঁকজমক বা কূটযুক্তি অবতারণার কোনো প্রয়াস নেই, তবুও একরকম যেন পরীক্ষামূলকভাবে সরাসরি দেখিয়ে দেয়া গেলো যে মহাপণ্ডিতেরাও অনুমান, শাস্ত্র প্রভৃতির দোহাই দেখিয়ে অদৃষ্ট, আত্মা, পরলোক প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে যে-সব কথা বলেন তা আসলে অসার। দেবীপ্রসাদের মতে এ-জাতীয় গল্প চার্বাকদের মধ্যে চালু থাকার সম্ভাবনাও উপেক্ষা করা যায় না, কেননা গল্পটার সঙ্গে তাদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলির মূল প্রবণতার বেশ মিল আছে।

কিন্তু এমন বহুশ্রুত ব্যক্তিরাও অনুমান, আগম প্রভৃতির দোহাই দেখিয়ে প্রত্যক্ষগোচর ইহলোকের বদলে অপ্রত্যক্ষ পরলোকের প্রতি কেন সাধারণ লোককে মনোযোগী করতে চান? উত্তরে চার্বাকেরা কী বলবেন তা হরিভদ্রসূরি’র অপর ব্যাখ্যাকার মণিভদ্র মোটের উপর বিস্তৃতভাবেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে চার্বাক বলবেন–

‘তবু যে-সব বাচাল ব্যক্তিরা শুধু প্রত্যক্ষ জ্ঞানের স্বীকারে বিরত না হয়ে অনুমান, শাস্ত্র ইত্যাদির প্রমাণ দেখিয়ে বলেন যে, পুণ্য ও পাপের ফলে স্বর্গসুখ ও নরকদুঃখ ঘটে, তাদের উদ্দেশ্য (চার্বাক) বলছেন– ভদ্রে, নেকড়ের পায়ের ছাপ দেখ। (তাৎপর্য এই যে) জনৈক ব্যক্তির বউ নেকড়ের পায়ের ছাপ দেখবার কৌতুহল প্রকাশ করেছিল। ঐ ব্যক্তি ধুলোর উপর আঙুল দিয়ে নেকড়ের পায়ের ছাপ এঁকে বলল : ভদ্রে, বৃকপাদ দেখ। (বক্তব্য এই যে) যেমন ঐ ব্যক্তি তার মুগ্ধ পত্নীর বৃকপাদ দেখার আগ্রহ প্রকৃত বৃকপাদ না-দেখিয়ে শুধুমাত্র নিজের আঙুল দিয়ে আঁকা ছবি দেখিয়ে অপরকে প্রবঞ্চনা করতে পারে, তেমনি দক্ষ, কপট ধার্মিক ব্যক্তিরাও কিছু কিছু অনুমান, শাস্ত্র প্রভৃতির দোহাই দেখিয়ে সাধারণ লোকের মনে স্বর্গসুখ ইত্যাদির প্রলোভন জাগিয়ে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, গ্রাহ্য-ত্যাজ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংকটে ঠেলে দেয় এবং ধর্মের প্রতি অন্ধ মোহ সঞ্চার করে। পরমার্থতত্ত্ব-বেত্তা বলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা এইভাবেই (প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমান, শাস্ত্র, প্রভৃতি) প্রমাণের দোহাই দেখিয়ে থাকে।’- (সূত্র: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৪৯)


প্রাচীনকালের বস্তুবাদী হলেও চার্বাকদের এ-জাতীয় বক্তব্যের সঙ্গে আধুনিক বস্তুবাদীর বক্তব্যেও বেশ কিছুটা মিল সুযোগ আছে বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। তাছাড়া এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, জৈন দার্শনিকদের উক্তিগুলি থেকে মনে হয় চার্বাকদের বিশেষ আস্থা প্রত্যক্ষর উপর এবং তাঁরা এই অর্থেই অনুমান-প্রমাণের বিরোধী যে, অনুমানের দোহাই দিয়ে অনেকে অপ্রত্যক্ষ পরলোকাদির– তথা ধর্মাধর্ম ও পাপপুণ্যের– কথা বলে থাকে। এ-প্রেক্ষিতেই বোধকরি ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়ে’র ভাষ্যকার মণিভদ্র’র স্পষ্ট উক্তি–

‘এবম্ অমী অপি ধর্মছদ্মধূর্তাঃ পরবঞ্চনপ্রবণাঃ যৎকিংচিৎ অনুমানাদিদার্ঢ্যম্ আদর্শ্য ব্যর্থং মুগ্ধজনান্ স্বর্গাদিপ্রাপ্তিলভ্য ভোগাভোগপ্রলোভনয়া ভক্ষ্যাভক্ষ্যগম্যাগম্যহেয়োপাদেয়াদি সংকটে পাতয়ন্তি, মুগ্ধধার্মিককান্ধ্যম্ চ উৎপাদয়ন্তি।’
অর্থাৎ :
লোকায়তিকদের মতে প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা ধর্মপ্রবঞ্চনার প্রতিষেধক, কেননা অনুমান, আগম (শাস্ত্র) প্রভৃতির নজির দেখিয়ে পরবঞ্চনাপ্রবণ ধর্মছদ্মধূর্তেরা সাধারণ মানুষের মনে স্বর্গাদিপ্রাপ্তি ইত্যাদির প্রলোভন জাগিয়ে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, গ্রাহ্য-ত্যাজ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংকটে ঠেলে দেয় এবং ধর্ম সংক্রান্ত অন্ধ মোহের সঞ্চার করে, এই কারণেই প্রত্যক্ষ ছাড়া অন্য প্রমাণ স্বীকার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাপদ নয়।


তার মানে, আধ্যাত্মবাদী দর্শনের পেছনে লোকবঞ্চনার এক আয়োজন সক্রিয়। চার্বাক বিরোধী হয়েও মণিভদ্রের এই চমৎকার ব্যাখ্যাটি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তাই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, তিনি একাধারে একজন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী দার্শনিকও। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপটিও তাঁর উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং মণিভদ্রের এই ব্যাখ্যা স্বীকার্য হলে এটাও মানতে হবে যে, সেকালের লোকায়তিকেরাও দার্শনিক মতকে একেবারে নির্ভেজাল তত্ত্বজিজ্ঞাসার পরিচায়ক বলে মেনে নেননি। দার্শনিক মতের সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির এরকম যোগাযোগ তাঁদের চেতনারও অগোচর ছিলো না। চার্বাকদের নামে প্রচলিত প্রামাণিক লোকাগাথাগুলিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু চার্বাকেরা ঐকান্তিক অর্থে অনুমান-বিরোধী কিনা– সে-কথা জৈন দার্শনিকদের রচনায় স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়নি। অর্থাৎ পরলোকের প্রমাণে অনুমানের বিরোধিতা করলেও চার্বাক প্রত্যক্ষগোচর ইহলোক প্রসঙ্গেও অনুমান অগ্রাহ্য করতেন– এমন কোনো স্পষ্ট কথা হরিভদ্র ও তাঁর ব্যাখ্যাকারদের রচনায় পাওয়া যায় না বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন। পক্ষান্তরে, এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ আরো বলেন,–

‘ইহলোক-সর্বস্ব দার্শনিকের পক্ষে ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমান মানায় অন্তত কোনো অনিবার্য বাধা থাকার কথা নয়। অবশ্যই, নেকড়ের পায়ের ছাপ থেকে নেকড়ের আগমন ইহলৌকিক বিষয়েরই অনুমান। কিন্তু আলোচ্য উপাখ্যানে দৃষ্টান্তটির তাৎপর্য এই হতে পারে যে, যে-কোনো অনুমানের উপর নির্ভর করা নিরাপদ নয়। বস্তুতপক্ষে, আঙুলে আঁকা নেকড়ের পায়ের ছাপ সযত্নে পরীক্ষা করলে বোঝবার সম্ভাবনা থাকে, ওগুলি আসল নেকড়ের পায়ের ছাপ নয়; কিন্তু বিদগ্ধ ব্যক্তিরাও তা না-করে অসতর্কভাবে এবং হয়তো কিছুটা আতঙ্কের প্রভাবে তাড়াহুড়োয় নেকড়ের পায়ের ছাপের মতো চিহ্ন থেকেই ভেবে বসলেন যে, সত্যিই নেকড়ে এসেছিল। এ জাতীয় অসতর্ক অনুমানই স্বর্গ-নরক পাপ-পুণ্য ধর্ম-অধর্ম প্রভৃতি অনুমানের ভিত্তি। অবশ্যই জৈন লেখকদের উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে এই মন্তব্য নেই। তাঁদের উক্তিগুলির মূল কথা হলো, চার্বাক মতে অনুমান, শাস্ত্রবচন প্রভৃতির দোহাই দিয়ে প্রত্যক্ষগোচর বাস্তব পৃথিবীর বাস্তব সুখের প্রতি উদাসীন হয়ে কাল্পনিক পাপ-পুণ্য ও পরলোক প্রভৃতির কথায় কান দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়, কেননা অনুমান সব সময় নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু অনুমান কোনো সময়ই নির্ভরযোগ্য হতে পারে না– কিংবা অনুমানমাত্রই অসঙ্গত– এ-জাতীয় কোনো কথা হরিভদ্র, গুণরত্ন ও মণিভদ্র সরাসরি বলেন নি। তাঁরা যা বলেছেন তা থেকে শুধু এটুকুই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, অনুমান ও শাস্ত্রবচনের উপর নির্ভর করে পরলোকাদিতে বিশ্বাস একেবারেই কাজের কথা নয়। নেকড়ের পায়ের ছাপ সংক্রান্ত উপাখ্যান থেকে হয়তো আরো বোঝা যায়, চার্বাকমতে দৃষ্টান্ত-বিশেষে এমনকি সাধারণ লৌকিক অনুমানও ভ্রান্ত হতে পারে। কিন্তু তার তাৎপর্য এই হওয়া অনিবার্য নয় যে, অতএব অনুমানমাত্রই– এমনকি সবরকম লৌকিক অনুমানও– অগ্রাহ্য হতে বাধ্য। এই কথার পক্ষে এখানে একটি সহজ যুক্তি দেখানো যেতে পারে। কোনো উল্লেখযোগ্য দার্শনিক এমন কথা বলেননি যে চার্বাক প্রত্যক্ষ-প্রমাণ অস্বীকার করেন। কিন্তু লৌকিক বিষয়েই দৃষ্টান্ত-বিশেষে তো প্রত্যক্ষও ভ্রান্ত জ্ঞানের জনক হতে পারে : মরীচিকায় জলদর্শন, রজ্জুতে সর্পদর্শন প্রভৃতি ভ্রান্ত প্রত্যক্ষর নানান নমুনা তো ভারতীয় দর্শন-সাহিত্যে সুপ্রসিদ্ধ। অথচ ভ্রান্ত প্রত্যক্ষর নজির দেখিয়ে প্রত্যক্ষমাত্রকেই অস্বীকার করবার উপদেশ চার্বাকমত হিসাবে কোথাও পাওয়া যায় না। তেমনি, দৃষ্টান্ত-বিশেষে লৌকিক অনুমান ভ্রান্ত বলেই চার্বাকমতে সমস্ত লৌকিক অনুমানই ভ্রান্ত হতে বাধ্য– চার্বাকমতের এ-জাতীয় ব্যাখ্যা অন্তত হরিভদ্র প্রভৃতির অভিপ্রেত হতে বাধ্য নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০)

পুরন্দরের মত এবং শান্তরক্ষিত ও কমলশীল

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যের সূত্র ধরেই আলোচনাটা আগানো যেতে পারে। চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই যে প্রমাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, একথা প্রায় সকলেই বলেছেন। আর হরিভদ্র ও তাঁর ব্যাখ্যাকারেরা বিশদভাবে দেখাতে চেয়েছেন, এ-জাতীয় দাবির পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা বস্তুত কী। একদল ধূর্ত প্রবঞ্চক লোক অনুমান ও শাস্ত্রপ্রমাণের দোহাই দেখিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক প্রভৃতি কাল্পনিক বিষয়ে অন্ধ বিশ্বাস প্রচার করে তাদের ঠকাতে চায়। এ-জাতীয় কথার সঙ্গে লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলিরও সঙ্গতি সুস্পষ্ট। তাই চার্বাকমত প্রসঙ্গে এ-পর্যন্ত মোটের উপর সুনিশ্চিত হওয়া যেতেই পারে।


কিন্তু যে প্রশ্নটার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা আবশ্যক, তা হলো– একান্ত অপ্রত্যক্ষ ও অলৌকিক বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করলেও চার্বাক কি সমস্ত রকম অনুমান– এমনকি প্রত্যক্ষ-সাপেক্ষ লৌকিক বিষয়ে অনুমানও– অস্বীকার করতে চান?
মাধবাচার্যের বর্ণনাতেই আমরা দেখেছি তিনি বলেছেন, চার্বাক অনুমানমাত্ররই বিরোধী; কারণ ব্যাপ্তি ছাড়া অনুমান অসম্ভব, কিন্তু ব্যাপ্তি-নিশ্চয় কিছুতেই হওয়া সম্ভব হতে পারে না। আর বাচস্পতিমিশ্রের বর্ণনা মতে, এমনকি জন্তু-জানোয়ারের আচরণ থেকে অনুমান-পরায়ণতার যতটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, চার্বাক তাও মানেন না।

বাচস্পতির কথাটা যে অত্যুক্তির প্রকট নিদর্শন, স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলে তা হয়তো অনেকে স্বীকার করবেন। কিন্তু মাধবাচার্যের বর্ণনার বেলায় অন্য কথা। কেননা, উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পরবর্তীকালে অনেকেই এবং আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে প্রায় সকলেই মাধবাচার্যের কূটযুক্তিপূর্ণ বর্ণনাটুকু হুবহু মেনে নিয়েই চার্বাক-মতটিকে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন। আধুনিককালের প্রায় সবক’টি পাঠ্যগ্রন্থেই চার্বাক-মতের বর্ণনায় মাধবাচার্য-বর্ণিত চার্বাক-মতেরই অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় সকলেই ধরে নেন যে, চার্বাক-মতে অনুমানমাত্রই অপ্রমাণ, তা ইহলৌকিক বা পারলৌকিক যে-কোনো বিষয়েই হোক-না-কেন কোনো রকম অনুমানই চার্বাক-মতে সম্ভব নয়।

কিন্তু এ-হেন কথা স্বীকার করার বাধা আছে বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। কারণ–
‘প্রথমত, একেবারে ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অস্বীকার করলে সাধারণ-লোকব্যবহারই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ধোঁয়ো দেখে আগুন অনুমান অবান্তর হলে– বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখে বৃষ্টির সম্ভাবনা অনুমান করা অসঙ্গত হলে– মানুষের পক্ষে বাঁচাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। চার্বাকরা যদি সত্যি অমন বেকুব হতেন তাহলে তাঁদের মত খণ্ডন করবার জন্যে দিকপাল দার্শনিকদের পক্ষেও মাথা ঘামাবার দরকার পড়তো না।
দ্বিতীয়ত, আগেই বলেছি, লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি বিদগ্ধ প্রমাণবিদ্যা-সম্মত অনুমানরূপে ব্যক্ত না-হলেও বিচারে বোঝা যায় যে, এগুলি অবশ্যই একরকম অনুমান-নির্ভর। অনুমান সম্পূর্ণ নস্যাৎ হলে কী করে ঠাট্টা করেও বলা যায় : যজ্ঞে নিহত জীবের স্বর্গপ্রাপ্তি হলে যজ্ঞে নিহত স্বীয় পিতারও স্বর্গপ্রাপ্তি মানতে হবে? অনুমান একেবারে না-মানলে লোকগাথাটির মূল শ্লেষই ব্যর্থ হতে বাধ্য।’
‘এ-জাতীয় কথা একেবারে অবান্তর না-হলে স্বীকার করতে হবে যে চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হলেও লোকব্যবহার-প্রসিদ্ধ এবং প্রত্যক্ষসিদ্ধ ইহলৌকিক বিষয়েও অনুমানকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করার কথাটা অতিরঞ্জিত। চার্বাকমতে অবশ্যই অপ্রত্যক্ষ পরলোকাদি ব্যাপারে অনুমান স্বীকার্য নয়। কিন্তু লৌকিক ব্যবহারের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন এবং প্রত্যক্ষগোচর বিষয়েও অনুমান অস্বীকার করা চার্বাকের অভিপ্রেত মত হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫১)

চার্বাকদের নিজস্ব মত প্রকাশক গ্রন্থ বা সাহিত্য বিলুপ্তির অজ্ঞাত-অন্ধকারে পতিত ও দুর্লভ হওয়ায় উপরিউক্ত দাবি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক বিচারের উপরই প্রতিষ্ঠিত। তবুও আশার কথা হলো, দাবিটির পক্ষে কেবলমাত্র প্রাসঙ্গিক বিচারই এখানে একমাত্র সম্বল নয়। নানা দার্শনিক নানাভাবে পূর্বপক্ষ হিসেবে মতটি বর্ণনা করেছেন এবং সমস্ত পূর্বপক্ষ-বর্ণন সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য না-হলেও কোনো কোনো পূর্বপক্ষ-বর্ণনার মধ্যে এমন কথা স্পষ্টতই পাওয়া যায় যে, অলৌকিক বিষয়ে অনুমান না-মানলেও লোকপ্রসিদ্ধ এবং প্রত্যক্ষগোচর বিষয়ে অনুমান চার্বাক স্বীকার করতেন। তারই নমুনা পাওয়া যায় প্রখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের লেখা ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত।

কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তাঁর গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। তাঁদের এই পূর্বপক্ষ বর্ণনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের উল্লেখ। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের নাম আদৌ জানা না গেলেও অন্যান্য লেখকেরাও পুরন্দরকে ‘চার্বাকমতে গ্রন্থকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এজাতীয় উল্লেখ থেকে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানরাও পুরন্দরকে চার্বাকপন্থী বলেই ধরে নিয়েছেন।
শান্তরক্ষিতের লেখা ‘তত্ত্বসংগ্রহ’-র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় কমলশীল বলছেন–

‘পুরন্দরঃ তু আহ লোকপ্রসিদ্ধম্ অনুমানং চার্বাকৈঃ অপি ইষ্যতে এব, যৎ তু কৈশ্চিৎ লৌকিকং মার্গম্ অতিক্রম্য অনুমানম্ উচ্যতে তন্নিষিধ্যতে।’ (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)।
অর্থাৎ :
পুরন্দর কিন্তু বলেন চার্বাকও লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার করেন; তবে কেউ যদি লৌকিক পথ অতিক্রম করে কোনকিছু অনুমান করতে চান তাহলে চার্বাক তার নিষেধ করবেন বা স্বীকার করবেন না।


মাধবাচার্য প্রমুখের বণিত চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে চার্বাকমতের এই প্রবক্তা পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট, অনুমানমাত্রই– বা সব রকম অনুমানই– অস্বীকার করার দরকার নেই। লোকপ্রসিদ্ধ বা ইহলোক সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণত অনুমানের যে প্রয়োগ তার বিরুদ্ধে চার্বাকেরও কোন আপত্তি নেই। আপত্তিটা অন্যত্র। পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানের বিরুদ্ধে। লৌকিক পথ অতিক্রম করে পারলৌকিক বিষয়ে অনুমান অবশ্যই অচল ও অগ্রাহ্য।

কমলশীলের উপরিউক্ত মন্তব্য– এবং তারই সঙ্গে পুরন্দর প্রসঙ্গে জৈন লেখক বাদিদেব সূরির উক্তির সঙ্গতি রেখে– সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যে-ভাবে আধুনিক ভাষায় এই চার্বাকমত ব্যাখ্যা করেছেন, প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা হলো। দাশগুপ্ত বলছেন–

‘(আনুমানিক সপ্তম শতকের) চার্বাকমতানুগামী পুরন্দর নামে দার্শনিক প্রত্যক্ষসাপেক্ষ পার্থিব বা ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমানের উপযোগিতা স্বীকার করেন; কিন্তু প্রত্যক্ষাতীত লোকোত্তর বিষয়ে বা পরকাল ও কর্মফল প্রভৃতি বিষয়ে কোনো মত অনুমানের নজির দেখিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সাধারণ অভিজ্ঞতায় জানা ব্যবহারিক জীবনে অনুমানের প্রামাণ্য এবং অভিজ্ঞতাবহির্ভূত বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ে অনুমানের অনুপযোগিতা– এই দু-এর পার্থক্য প্রদর্শনের মূল যুক্তি হলো, দুটি বিষয়ের মধ্যে নিয়ত-সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত না-হলে অনুমান সম্ভব নয়; পরিভাষায় এই দুটিকে বলে ‘লিঙ্গ’ (যেমন ধূম) এবং ‘সাধ্য’ (যেমন বহ্নি)। (ধূম ও বহ্নির মধ্যে নিয়ত-সম্বন্ধ স্বীকৃত বলেই ধূম থেকে বহ্নির অনুমান হয়)। এ-জাতীয় নিয়ত-সম্বন্ধ স্থাপনের দুটি শর্ত। এক : বহু দৃষ্টান্তে উভয়কেই একত্রে দর্শন। যেমন বহু দৃষ্টান্তেই দেখা গেছে যে যেখানেই ধূম বর্তমান সেখানেই বহ্নি বর্তমান। দুই : বহু দৃষ্টান্তে একটির অভাবে অপরটিরও অভাব দর্শন। যেমন, বহু দৃষ্টান্তে দেখা গেছে বহ্নি-শূন্য স্থানে ধূম অবর্তমান। কিন্তু এই জাতীয় দ্বিবিধ পরিদর্শন পারলৌকিক বিষয়ে অসম্ভব, কেননা কোনো ক্ষেত্রেই পরলোক প্রত্যক্ষগোচর হতে পারে না। অতএব, পরলোকাদি বিষয়ে অনুমানও অসম্ভব। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে এজাতীয় দ্বিবিধ দৃষ্টান্ত দর্শনের সম্ভাবনা আছে। তাই প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে সাধারণ-স্বীকৃত অনুমানের উপযোগিতা মানা যায়।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৩)


ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যের নানা নজির অবজ্ঞা না-করলে পুরন্দর নামের দার্শনিককে নিশ্চয়ই চার্বাকমতের প্রবক্তা বলে স্বীকার করতে হবে। অতএব পুরন্দরের উপরিউক্ত বক্তব্য চার্বাকমত-সম্মত বলেও স্বীকার করা প্রয়োজন বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। তাহলে, চার্বাকরা কোনো রকম অনুমানই মানতেন না– এ-হেন দাবিকে অত্যুক্তি বলে সন্দেহ করারও কারণ আছে। বরং স্বীকার করা দরকার যে, চার্বাক-মতে পরলোকাদির অনুমান অসম্ভব হলেও প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার্য। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই কথা মানলে চার্বাক প্রসঙ্গে প্রচলিত অনেক কথাই কল্পিত বলে প্রমাণিত হবে।

চার্বাকমত-সম্পর্কে জয়ন্তভট্টর বক্তব্য প্রসঙ্গে

ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ-প্রমাণের আলোচনায় প্রখ্যাত নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের বক্তব্য প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। এবং এটাও বলা হয়েছে যে, চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তভট্টর প্রকৃত বক্তব্য নির্ণয় করার বেশ কিছুটা সমস্যা রয়েছে। কেননা তিনি তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের একেক স্থানে একেকবার চার্বাক প্রসঙ্গে একেক ধরনের পরস্পর অসঙ্গত বক্তব্য দিয়েছেন, যা থেকে চার্বাকমত প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ-প্রমাণ বিষয়ক কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন।


যেমন ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে তার পরম্পরাহীন বক্তব্যগুলি ছিলো–

‘তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।
.
‘চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্’। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।
অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো- এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।
.
‘অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।


বলা বাহুল্য, সাধারণ পাঠকের পক্ষে চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তর এই বিভিন্ন ধরনের বর্ণনার মধ্যে সংগতিসাধন সহজসাধ্য হবার কথা নয়। একই সঙ্গে কী করে বলা যায় যে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করতেন এবং তাঁরা কোনো প্রমাণই মানতেন না; প্রত্যক্ষও তাঁদের কাছে সংশয়াতীত নয়! এবং আবার এও বলেন যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’দের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। এই মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, না কি প্রমাণ বলেই কিছু নেই, জয়ন্তর উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে আসলে কিছু বোঝারই উপায় নেই।

তাছাড়া অনুমানের বিরোধিতা প্রসঙ্গেও চার্বাক পক্ষের উক্তি নিয়ে জয়ন্তভট্ট ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা অনেকটাই মাধবাচার্যের বর্ণনার অনুরূপ বলে মনে হয়। জয়ন্তভট্ট বলছেন, ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তি ভূয়োদর্শন, অর্থাৎ অসংখ্য ক্ষেত্রে সাধনকে সাধ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা। চার্বাকপন্থীরা বলেন যে এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুপ্রকৃতিও নিয়ত পরিবর্তনের অপেক্ষা রাখে। এই পরিবর্তনের পটভূমিকায় বিশেষ কোন ধর্ম বস্তুবিশেষের সঙ্গে সব অবস্থাতেই যুক্ত থাকতে বাধ্য, এটা আশা করা যায় না। কাজেই–

‘দেশকালদশাভেদবিচিত্রাত্মসু বস্তুষু অবিনাভাবনিয়মো ন শক্যা বস্তুমাহ চ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুপ্রকৃতির নিয়ত পরিবর্তনের কারণে ভূয়োদর্শনের মাধ্যমে লব্ধ বিশেষ দ্রব্য এবং ধর্মের পরস্পর উপাধিমুক্ত সম্বন্ধ বা অবিনাভাবের সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়া সম্ভব নয়। (মুক্ততর্জমা)


অসংখ্য ক্ষেত্রে সাধন এবং সাধ্যের একত্র অবস্থান যদিও দেখা যায়, তাহলেও এর থেকে আমরা চিরকালীন সত্য কোন ব্যাপ্তিজ্ঞানের আশা করতে পারি না; কারণ অতীতে যে অবিনাভাব দেখা গেছে, ভবিষ্যতে তার ব্যতিক্রম হবে না, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ‘ন্যায়মঞ্জরী’র উক্তিতে বলা হয়েছে যে,–

‘বিশ্বের সমস্ত বস্তু যদি কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষগোচরে আনা সম্ভব হতো তাহলে সেই ব্যক্তি তাঁর বিশেষ শক্তির সাহায্যে হয়তো বলতে পারতেন সাধন বা ধূম সাধ্য বা অগ্নির সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতই যুক্ত কিনা। কিন্তু এই ধরনের শক্তিমান ব্যক্তির পক্ষে অনুমান এবং অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞান– দুইই নিষ্প্রয়োজন’- (‘ন প্রত্যক্ষাকৃতা যাবৎ……এষামনুমানপ্রয়োজনম্’)।


সর্বশেষ বাক্যে জয়ন্তভট্টে শ্লেষটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। জয়ন্তভট্টর লেখার কায়দাটাই ওই রকম রকমারি শ্লেষ বা ঠাট্টা-তামাসায় ঠাসা। তবে বোঝাই যায়, নিয়ত ব্যাপ্তি-সম্বন্ধ সম্ভব নয় বলে চার্বাকরা কোন অনুমানকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না– এই ব্যাখ্যারই দীর্ঘ আয়োজন করা হয়েছে।
আবার ব্যাপ্তিজ্ঞানের সমর্থকদের মতে ধূমের অগ্নিব্যাপ্যতা প্রমাণ করতে হলে ধূমের সঙ্গে অগ্নির সহাবস্থানের প্রতিটি ঘটনা লক্ষ্য করার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন কেবল ‘ধূমত্ব’ এবং ‘অগ্নিত্ব’ এই দুটি সামান্যের মধ্যে কার্যকারণভাবে বিশ্বাস। ব্যাপ্তিগ্রহণ প্রকৃতপক্ষে ধূম ও অগ্নিসম্বন্ধীয় এই ‘সামান্য’কে কেন্দ্র করে। ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে জয়ন্তভট্টের আলোচনার মধ্যে ব্যাপ্তি শব্দের এই ধরনের অর্থ সূচিত হয়। তবে চার্বাকী ধারণায় কিন্তু এই সামান্যের কোন স্বীকৃতি নেই এবং ফলে সামান্যদ্বারক কার্যকারণভাবও এই দর্শন মতে অনিশ্চয়তার দোষে দুষ্ট– জয়ন্তের বর্ণনায় এসব দার্শনিক কূটযুক্তির ভিতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন আমাদের নেই। মোটের উপর জয়ন্তের বক্তব্য থেকে চার্বাক-মত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা চয়ন ব্যাপক সমস্যাপূর্ণ বলে মনে হয়।

‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ গ্রন্থে (ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-৩/৫,৬) উদয়নাচার্য বলেন,– চার্বাকী যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত মানুষ যদি প্রত্যক্ষ বহির্ভূত সব বস্তুকে অস্বীকৃতি দেয় তাহলে ব্যবহারিক জীবনে অগ্রসর হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। জয়ন্তভট্টও অনুরূপ মন্তব্যে তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে বলেন–

‘অনুমানাপলাপ তু প্রত্যক্ষাদপি দুর্লভা। লোকযাত্রেতি লোকাঃ স্যুর্লিখিতা ইব নিশ্চলাঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ বহির্ভূত সব অনুমানই যদি অপলাপ হয়, ব্যবহারিক জীবনে লোকযাত্রা নিশ্চল হতে আর বাকি কী।

এরপর চার্বাক মতবাদের খণ্ডনে জয়ন্তভট্ট তাঁর স্বভাবসুলভ বিদ্রূপাত্মক হেঁয়ালিপূর্ণ উক্তিতে বলেন,–

স্বামীর গৃহে অনুপস্থিতিকালে চার্বাক-পত্নী বিধবা হন, কারণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষের মাধ্যমে গৃহবহির্ভূত চার্বাকের বর্তমানতাকে স্বীকার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

উক্তিটি নিছক পরিহাসধর্মী হলেও ব্যবহারিক জীবনের গতিপথে বিশুদ্ধ চার্বাক-পন্থীরা যে ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন, এর মধ্যে তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই প্রশ্ন হলো, সত্যি কি চার্বাকেরা কোন ক্ষেত্রেই– সীমিত আকারে হলেও– অনুমানকে স্বীকার করতেন না?

কিন্তু জয়ন্তর-উক্ত ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ নিয়ে আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে বেশ একটু শোরগোল পড়ে যখন দেখা যায় একই গ্রন্থ ‘ন্যায়মঞ্জরী’র আরেক জায়গায় তিনি বলেন–

‘সুশিক্ষিততরাঃ প্রাহুঃ… যত্ত্বাত্মেশ্বরসর্বজ্ঞপরলোকাদিগোচরম্ । অনুমানং ন তস্যেষ্টং প্রামাণ্যং তত্ত্বদর্শিভিঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১১৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিততররা বলে থাকেন– অনুমান দু-রকম, উৎপন্ন-প্রতীতি এবং উৎপাদ্য-প্রতীতি। ধূম প্রভৃতি থেকে বহ্নি প্রভৃতির অনুমান কে অস্বীকার করে? এসব দ্বারা তার্কিক দ্বারা অক্ষত ব্যক্তিরাও সাধ্য-কে জানতে পারে। তবে আত্মা, সর্বজ্ঞ, ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদি বিষয়ে যে-অনুমানের কথা বলা হয় সেগুলির প্রামাণ্য তত্ত্বদর্শীরা স্বীকার করেন না। এইসব অনুমানের দ্বারা সোজা মানুষের অনুমেয় বিষয়ে জ্ঞান হয় না– অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মন দুষ্ট তার্কিকদের দ্বারা কুটিল হয়ে ওঠে।


একে তো ন্যায়শাস্ত্রের জটিল পরিভাষা, তার উপরে জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্যপূর্ণ শ্লেষ বা ঠাট্টা-তামাশায় ঠাসা বক্তব্যের তীর্যক কায়দা থেকে সহজ-সরল অর্থ উদ্ধার করা চাট্টিখানি কথা নয়। এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জয়ন্তর এ বক্তব্যকে আমাদের বোধগম্য করে সোজা ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন এভাবে–

‘জয়ন্ত বলছেন, সুশিক্ষিততরদের মতে প্রত্যক্ষগোচর ইহলোক বিষয়ে সাধারণ লোক যা অনুমান করে থাকে তা অবশ্যই স্বীকার্য : যেমন ধূম থেকে বহ্নির অনুমান। কিন্তু আত্মা, পরলোক প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে কূট তার্কিকেরা যে-সব অনুমান প্রদর্শন করেন তা শুধু তাঁদের কূটবুদ্ধিরই পরিচায়ক, স্বীকারযোগ্য অনুমান হতে পারে না।’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।


‘সুশিক্ষিততর’-দের মত হিসেবে জয়ন্ত এখানে যা বলেছেন তা অবশ্যই পুরন্দরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বক্তব্যের প্রকাশভঙ্গি যেরকমই হোক, মূল বক্তব্য আসলে একই। এবং পুরন্দর যে প্রকৃত চার্বাকপন্থীই ছিলেন এ বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে তার একাধিক নজির রয়েছে। কিন্তু, দেবীপ্রসাদের মন্তব্য অনুসারে–
‘সুশিক্ষিততর’ বিশেষণ দিয়ে জয়ন্ত যাঁদের কথা বলছেন তাঁরাও যে চার্বাকপন্থী ছিলেন– এ বিষয়ে কোথাও নিশ্চিত নজির নেই; অন্তত জয়ন্তর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে নয়। তাঁর আলোচ্য উক্তির আগে বা পরে কোথাওই চার্বাক বা লোকায়ত শব্দ চোখে পড়ে না। উক্তিটি অবশ্য পূর্বপক্ষ বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু পূর্বপক্ষ হিসাবে এখানে ঠিক কাকে বা কাদের বোঝা হবে? জয়ন্ত যেহেতু এখানে এমনকি আভাসে-ইংগিতেও চার্বাকের উল্লেখ করেননি সেইহেতু এখানেও পূর্বপক্ষ বলতে ঐ চার্বাকই– এমনতর কথা কল্পনা করা ভিত্তিহীন হবে। পক্ষান্তরে, মৃণালকান্তি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে (Indian Logic in Its Sources, pp-31 f.) স্পষ্টই দেখিয়েছেন যে, জয়ন্তর আলোচ্য পূর্বপক্ষ-বর্ণনাটির মধ্যে অনেকগুলি শ্লোক ভর্তৃহরির ‘বাক্যপদীয়’তেও পাওয়া যায়– একেবারে হুবহু একইভাবে পাওয়া যায়। ভর্তৃহরিকে চার্বাপন্থী মনে করার কারণ নেই। তাই শুধুমাত্র শ্লোকগুলির নজির থেকেই বলা যায় যে ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে এখানে জয়ন্ত যাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের সরাসরি চার্বাক বলে কল্পনা করা নিরাপদ নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৬)

আধুনিক বিদ্বানদের অনেকেই অতি-সারল্যের পরিচয় দিয়ে নির্বিবাদে ধরে নেন যে, জয়ন্তর লেখা থেকেই বোঝা যায়, চার্বাকদের দুটি সম্প্রদায় ছিলো। একটি হলো ধূর্ত চার্বাক এবং অপরটি হলো সুশিক্ষিত চার্বাক। তাঁরা আরো ধরে নেন যে, দুটির মধ্যে মূল প্রভেদ হলো, ধূর্ত চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোন প্রমাণ মানেননি; আর সুশিক্ষিত চার্বাকেরা অবশ্য তা ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ ও প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিষয়ে অনুমান-প্রমাণ মেনেছেন, শুধু অপ্রত্যক্ষ লোকোত্তর বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁদের এ-জাতীয় মতের পক্ষে একমাত্র নজির বলতে জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’। কেননা, জয়ন্ত চার্বাকদের বিশেষণ হিসেবে এক জায়গায় ‘ধূর্ত’ এবং অপর জায়গায় ‘সুশিক্ষিত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া ধরেই নেয়া হয় যে ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে জয়ন্ত যাঁদের উল্লেখ করেছেন তাঁরা ঐ সুশিক্ষিত চার্বাকই।
কিন্তু এই মত স্বীকার করায় অনেক বাধা আছে বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। তাঁর মতে,–

‘প্রথমত, বিদ্বেষমূলক বিশেষণ ব্যবহারে পটু জয়ন্ত একই গ্রন্থে চার্বাককে ‘বরাক’ বলেছেন। বরাক মানে বোকা-হাবা– ধূর্ত নয়। তাহলে কি এই নজির থেকেই চার্বাকদের আরো এক সম্প্রদায় কল্পনা করতে হবে? দ্বিতীয়ত, চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্ত যেখানে ‘ধূর্ত’ বিশেষণ ব্যবহার করেছেন, সেখানে চার্বাক বলতে যে-সর্বপ্রমাণ-বিরোধী দার্শনিকদের কথা বর্ণনা করেছেন তাঁরা কোনমতেই চার্বাকমতবাদী হতে পারেন না। এমনকি জয়ন্তর মতেও তা হওয়া কঠিন। কেননা একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, চার্বাকরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। তাই জয়ন্তর টীকাকার চক্রধর এখানে মতটির সমর্থক হিসাবে উদ্ভট বলে কোন এক ব্যক্তির কথা কল্পনা করতে বাধ্য হয়েছেন। তৃতীয়ত, ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে জয়ন্ত যাঁদের কথা বলেছেন তাঁরা যে কোনো এক সম্প্রদায়ের চার্বাকপন্থী– এ কথার পক্ষে কোনো নিশ্চিত নজির নেই।’

তাই চার্বাকদের বিষয়ে জয়ন্ত ভট্টের বিবিধ বিশেষণ প্রয়োগকে আদৌ কোন শ্রেণীভেদ হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা তাও সতর্ক বিবেচনার বিষয়। কেননা,– শ্লেষাত্মক বিশেষণ ব্যবহারপূর্ণ রচনাকৌশলে রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্ত ভট্ট ‘সুশিক্ষিত’ শব্দটিকে ব্যাঙ্গাত্মক অর্থেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়। এই শব্দটি শুধু চার্বাকদের বেলায়ই নয়, ন্যায়মঞ্জরীতে অন্যান্য দার্শনিকদের সমালোচনায়ও একইরকম ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন, একই গ্রন্থে (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১৬১) ঠাট্টা করে তিনি মীমাংসক প্রাভাকরদের সম্বন্ধে এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। আবার অন্যত্র (ন্যায়মঞ্জরী: ১/২৭৩) যে দার্শনিকেরা ‘সামান্য বা জাতি’ (Universal) মানেন না তাঁদেরও পরিহাস করে ‘সুশিক্ষিত’ বলেছেন। তাই জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ থেকে চার্বাকমতের শ্রেণীভেদ সম্বন্ধে কোনো সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন বলে বিদ্বান গবেষকদের অভিমত। ফলে পাণ্ডিত্য ও তর্কবিদ্যায় পারদর্শী ও সুপরিচিত চার্বাক গোষ্ঠির সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে সুশিক্ষিত শব্দের ব্যবহার অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। কিন্তু শুধু জয়ন্তর রচনার নজির দেখিয়ে চার্বাকদের ‘ধূর্ত’, ‘সুশিক্ষিত’ এসব নামের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের কল্পনা করা আদৌ সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়।

একইভাবে, জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ থেকে চার্বাকমত সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, বিশেষত চার্বাকেরা অনুমান মানতেন কিনা এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার চেষ্টা নিরাপদ নয়। অতএব এ-হেন কল্পনারও কোন সুযোগ নেই যে ধূর্ত চার্বাকেরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে মানতেন, কিন্তু সুশিক্ষিত চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমানকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন। বরং পুরন্দরের প্রামাণ্য উক্তি থেকে এটা মনে হয় যে, দ্বিতীয় কথাটিই চার্বাকপন্থীদের প্রকৃত অভিপ্রেত; অর্থাৎ তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ হলেও প্রত্যক্ষর অনুগামী অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করায় বাধা ছিলো না।

চার্বাক-মত প্রসঙ্গে কৌটিল্যর সাক্ষ্য

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র সাক্ষ্যে বার্হস্পত্য সম্পর্কে চমৎকার প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। চার্বাক বা প্রাচীনতর কালে লোকায়ত নামে খ্যাত দার্শনিক মতে অনুমানও যে প্রমাণ বলেই স্বীকৃত ছিলো– এ বিষয়ে মোক্ষম প্রমাণ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’।


এই গ্রন্থের প্রথম অধিকরণ ‘বিনয়াধিকারিকম্’ এর ‘বিদ্যাসমুদ্দেশ’ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যা ও তাদের সম্মন্ধে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধেয় আচার্যগণের মতভঙ্গি উদ্ধৃত করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেন–

[কৌটিল্যস্য স্বমতং চ।] আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ।
ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি মানবাঃ। ত্রয়ীবিশেষো হ্যান্বীক্ষিকীতি।
বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি।
দণ্ডনীতিরেকা বিদ্যেত্যৌশনসাঃ। তস্যাং হি সর্ববিদ্যারম্ভাঃ প্রতিবদ্ধা ইতি।
চতস্র এব বিদ্যা ইতি কৌটিল্যঃ। তাভির্ধর্মার্থৌ যদ্বিদ্যাত্তদ্বিদ্যানাং বিদ্যাত্বম্ ।। ১/২/১।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
অর্থাৎ :
কৌটিল্যের মতে, বিদ্যা চার প্রকারের, যথা– আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
মানব সম্প্রদায় অর্থাৎ মনু-শিষ্যগণ বলেন– ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি– বিদ্যা এই তিনপ্রকার। কারণ, আন্বীক্ষিকী (বা হেতুবিদ্যা) ত্রয়ীর অর্থবিচার করে বলে সেটি ত্রয়ীবিশেষ-মাত্র অর্থাৎ ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।
বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি– এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে, সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।
ঔশনস (উশনা-পুত্র শুক্রাচার্যের শিষ্য-) গণের মতে, দণ্ডনীতি বা অর্থশাস্ত্রই একমাত্র বিদ্যা, কারণ দণ্ডনীতিতেই অন্যান্য সমস্ত বিদ্যার আরম্ভ (অর্থাৎ কর্মনীতিপদ্ধতি এবং যোগক্ষেম) প্রতিষ্ঠিত আছে।
কিন্তু কৌটিল্যের মতে, (প্রথম উক্ত) চারটিই বিদ্যা। (এই চারটিকে বিদ্যা বলবার কারণ–) এই চারটির দ্বারাই ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার এবং অর্থ বা জাগতিক সকল প্রয়োজনবস্তু জানা যায় ; এবং এদের দ্বারা জানা যায় বলেই এদের ‘বিদ্যাত্ব’ সার্থক হয়েছে।


এবং এই বিদ্যাগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৌটিল্য আবার বলেন–

সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী।

ধর্মাধর্মৌ ত্রয্যাম্ । অর্থানর্থৌ বার্তায়াম্ । নয়াপনয়ৌ দণ্ডনীত্যাম্ । বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি, ব্যসনেহভ্যুদয়ে চ বুদ্ধিমবস্থাপয়তি, প্রজ্ঞাবাব্যক্রিয়াবৈশারদ্যং চ করোতি।

প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। ১/২/২।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
.
অর্থাৎ :
সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্রই উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত।
এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।
আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।


এখানে কৌটিল্যের মতে বিদ্যা চারটি হলেও উল্লিখিত শ্লোক অনুযায়ী কৌটিল্যবর্ণিত বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যার সংখ্যা দুই– দণ্ডনীতি এবং বার্তা। বেদ অথবা আন্বীক্ষিকীকে বার্হস্পত্যরা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তাঁরা বেদকে ‘লোকযাত্রাবিদ্’ বা লৌকিক ব্যবহারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ‘সংবরণ’ বা পোশাক বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বার্হস্পত্যদের অভিমত অনুসারে সে সময়ে বেদজ্ঞ বলে যাঁরা নিজেদের প্রচার করতেন তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ সব সময়ই বেদজ্ঞানের আবরণে গোপন থাকতো। তা থেকে অনুমিত হয় যে, ‘অর্থশাস্ত্রে’র সময়কালে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই বার্হস্পত্য মতবাদ বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। অনুরূপ বক্তব্য পরবর্তী অন্য দার্শনিকদের উক্তিতেও প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায়।

তাই, কৌটিল্যের এই বার্হস্পত্য মত বর্ণনার সাপেক্ষে পরবর্তীকালের সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের সাযুজ্য বিশ্লেষণ করতে একাদশ শতকের কৃষ্ণমিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকটিকে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা-উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই রূপক নাটকে বর্ণিত চার্বাক সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে–

‘দণ্ডনীতিরেব বিদ্যা। অত্রৈব বার্তান্তর্ভর্বিষ্যতি ধূর্ত প্রলাপস্ত্রয়ী।।’ (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৫)।
অর্থাৎ : চার্বাক মতে, দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা। বার্তা দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়ী বা বেদ ধূর্তদের প্রলাপ।

আবার অষ্টম শতকের প্রখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য লোকায়ত প্রসঙ্গে তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন–

কৃষিগোরক্ষবাণিজ্যদণ্ডনীত্যাদিভির্বুধঃ। দৃষ্টৈরেব সদোপায়ৈর্ভোগাননুভবেদ্ ভুবি।। ২/১৫।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : (লোকায়তরা) কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ইত্যাদি দৃষ্ট উপায়ের মাধ্যমে জাগতিক বস্তু উপভোগের পরামর্শ দেন।

অতএব, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-চার্বাক বা ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-লোকায়তের আদি রূপ হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত বর্ণিত বার্হস্পত্যের অনুমান করা অসঙ্গত নয়।

তবে বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনার দাবি রাখে। এ বিবেচনায় প্রথমে ‘অর্থশাস্ত্রে’ ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দার্থ আলোচনা করা যেতে পারে। কৌটিল্যের মতে (রাজার পক্ষে) শিক্ষণীয় বিদ্যা বলতে চার রকম– আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি। এর মধ্যে বার্তা ও দণ্ডনীতির অর্থ নিয়ে বিশেষ কোন হাঙ্গামা নেই। বার্তা মানে কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ইত্যাদি– এককথায় সেকালের অর্থনীতি। আর দণ্ডনীতি মানে রাজ্যশাসন বিদ্যা– মানে সেকালের পলিটিক্স বা রাজনীতি। আমাদের বিশ্লেষণের লক্ষ্য বাকি দুটি শব্দ– ত্রয়ী ও আন্বীক্ষিকী।

গবেষক জ্যাকবি ত্রয়ী শব্দের অর্থ করেছেন থিয়োলজি বা ধর্মতত্ত্ব। কিন্তু এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো, যে কোনো ধর্মতত্ত্বই ত্রয়ী নয়। প্রাচীন ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা অনুসারে অথর্ববেদকে বাদ দিয়ে শুধু ঋক্, সাম ও যজুর্বেদকে তিন বেদ বলে ধরা হতো। সেই প্রথা অনুসারে এখানেও ত্রয়ী বলতে তিন বেদ। অর্থাৎ, ত্রয়ী মানে ধর্মতত্ত্ব হলেও শুধু এই তিন বেদমূলক ধর্মতত্ত্ব বা এই তিন বেদের বিদ্যা। যদিও সেকালে পাল্টা ধর্মতত্ত্ব হিসেবে বিশেষত বৌদ্ধ ও জৈন মত সহজেই অনুমিত হতে পারলেও বেদবাদীরা তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাবেন এমন কল্পনা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু কৌটিল্য-বর্ণিত চার রকম বিদ্যার মধ্যে কৌটিল্য আন্বীক্ষিকী নামক বিদ্যাটির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। আন্বীক্ষিকী মানে কী? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যায়–

‘অন্বীক্ষা শব্দের অর্থ ‘পরবর্তী জ্ঞান’। অনু (অর্থাৎ পরবর্তী) + ঈক্ষা (বা জ্ঞান)। অনুমান শব্দটির অর্থও হুবহু একই : অনু (পরবর্তী) + মান (জ্ঞান)। অতএব ‘অন্বীক্ষা’ ও ‘অনুমান’ একই কথা, ভারতীয় পরিভাষায় যাকে বলে পর্যায়শব্দ। কিন্তু ‘পরবর্তী জ্ঞান’ বললে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে : কিসের পরবর্তী ? ভারতীয় ঐহিত্য অনুসারে ‘প্রত্যক্ষর পরবর্তী’। …মনে রাখা দরকার যে ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে ‘অনুমান’ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের অনুগামী– পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে কোনো প্রত্যক্ষ-জ্ঞান এবং তারই অনুসরণ করে অনুমান-জ্ঞান। কিংবা বলা যায়, অনুমানের একটি মূল শর্ত হলো পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষ। ভারতীয় দার্শনিকেরা একথা বলছেন কেন? পূর্ব-প্রত্যক্ষ বাদ দিয়ে অনুমান কেন সম্ভব নয়? একটা খুব সহজ দৃষ্টান্ত থেকে কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করা যাক। ধূম থেকে আমরা অগ্নি অনুমান করি। কী করে করি? কেননা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি (বা প্রত্যক্ষ করেছি) : যেখানে ধূম সেখানেই অগ্নি, যেমন রান্নার উনুনে। এ-জাতীয় পূর্বপ্রত্যক্ষ বাদ দিয়ে শুধু ধূম থেকে অগ্নির অনুমান সম্ভব নয়। তাই অন্বীক্ষা (অনু + ঈক্ষা) বা অনুমান (অনু + মান)। ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘ন্যায়সূত্র’তে বিষয়টি আরো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।…
তাহলে, ‘আন্বীক্ষিকী’র শব্দার্থ হলো ‘অনুমানবিদ্যা’– আজকাল চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ‘লজিক’। অবশ্য, কৌটিল্য এখানে বিশুদ্ধ অনুমানবিদ্যা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেননি ; তাঁর মতে ‘আন্বীক্ষিকী’ শুধু অনুমানবিদ্যা ছাড়াও অনুমান-মূলক দার্শনিক মতও। কেননা একই সঙ্গে তিনি বলেছেন– ‘আন্বীক্ষিকী’ বলতে তিনি এবং শুধুমাত্র তিন : সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত। এগুলি দার্শনিক মতের নাম। তাই এখানে ‘আন্বীক্ষিকী’ বলতে হেতুবিদ্যা বা অনুমানবিদ্যা ছাড়াও এমন দার্শনিক মতও বুঝতে হবে যার মূল ভিত্তি বলতে অনুমান বা অন্বীক্ষা। অর্থাৎ কৌটিল্য এখানে প্রকৃত অনুমান-ভিত্তিক– বা, চলতি কথায় হয়তো বলা যায়, যুক্তিমূলক– দার্শনিক মত হিসেবে শুধুমাত্র তিনটির উল্লেখ করেছেন। সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। তাঁর বিচারে আর কোনো দার্শনিক মতের যুক্তিবিদ্যা-ভিত্তির মর্যাদা নেই।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৯)।

.
উল্লেখ্য, আন্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত যে যোগের উল্লেখ রয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটা আসলে পতঞ্জলির (২৫০ খ্রিস্টাব্দ) যোগদর্শন নয়, মূলত ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে প্রাচীন যোগ বোঝানো হয়েছে। কীভাবে? কেননা, দার্শনিক মত হিসেবে পতঞ্জলির যোগ-দর্শন এবং সাংখ্য-দর্শনের মধ্যে মূল পার্থক্য শুধু এই যে, সাংখ্য-দর্শনে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই; কিন্তু পতঞ্জলি সাংখ্য-দর্শনের বাকি সব তত্ত্ব মেনে নিয়ে কোনোরকমে কেবল তার সঙ্গে ঈশ্বরকেও জুড়ে দিয়েছেন। এবং এ-কারণে পতঞ্জলির যোগদর্শন নামান্তরে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ (বা সাংখ্য + ঈশ্বর) নামেও খ্যাত। অতএব কৌটিল্যের বর্ণনায় যোগ নামে পতঞ্জলির যোগদর্শনকে বোঝানো সম্ভাবনা সুদূর-পরাহত। তাছাড়া দেবীপ্রসাদের ভাষ্যে জানা যায়, ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় সংশয়াতীতভাবে নির্ভরযোগ্য পণ্ডিত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রীর মতো মহাপণ্ডিতেরা মূল্যবান সাক্ষ্য ও যুক্তি প্রদর্শন করে নিশ্চিত করেছেন যে, পরবর্তীকালে যে-দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায়-বৈশেষিক নামে সনাক্ত করতে অভ্যস্ত, প্রাচীন কালে তাকেই ‘যোগ’ নামে অভিহিত করার প্রথা ছিলো। কৌটিল্যর রচনাতেও যোগ শব্দ এই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহৃত। অতএব সিদ্ধান্ত হয় যে, আন্বীক্ষিকী বা অনুমান-মূলক দর্শন বলতে শুধুমাত্র সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে যোগ, এবং লোকায়ত।

এ-প্রসঙ্গে আমাদের বর্তমান আলোচনার মূল যে লক্ষ্য– চার্বাক বা লোকায়ত মতে অনুমান-মাত্রই অগ্রাহ্য কিনা– ‘অর্থশাস্ত্র’র উক্তি থেকে এর চূড়ান্ত উত্তর অনুসন্ধান। সে-ক্ষেত্রে চরম উত্তরটি হলো, অনুমান-মাত্রই অগ্রাহ্য করা তো দূরের কথা, ‘অর্থশাস্ত্র’র মতে মাত্র তিনটি দর্শনমত অনুমান-মূলক বা আন্বীক্ষিকী বলে স্বীকার্য, তার মধ্যে একটি হলো লোকায়ত। অতএব লোকায়তিকেরা সব রকম অনুমানই অস্বীকার করেছেন– পরবর্তীকালের এ-জাতীয় কথার সঙ্গে প্রাচীন নজিরের মিল হয় না।

কিন্তু এ-প্রসঙ্গে আরেকটি কৌতুহলের বিষয় হলো, কৌটিল্য শুধুমাত্র তিনটি মতকে প্রকৃত দর্শনের মর্যাদা দিয়েছেন, তার মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন, পূর্ব-মীমাংসা এবং বেদান্তর মতো প্রভাবশালী দর্শনের উল্লেখ নেই কেন?
এ-প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত বিদ্বান গবেষক জ্যাকবির অনুমান হলো, কৌটিল্য বা চাণক্যের মতো প্রখ্যাত ব্রাহ্মণের পক্ষে বৌদ্ধ ও জৈন মতকে প্রকৃত দার্শনিক মতের মর্যাদা না দেবারই কথা। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে জ্যাকবির এই অনুমান সহজে মানা যায় না। কেননা ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ফলে কৌটিল্যর পক্ষে লোকায়তমতই সর্বপ্রথম অবজ্ঞা করার কথা এবং পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তর মতো প্রভাবশালী মতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাপ্রদর্শনই স্বাভাবিক। অতএব, জ্যাকবির মন্তব্য গ্রহণ না-করে বরং মনে করা যেতে পারে যে, কৌটিল্যের সময় বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রভাব তুলনায় সীমাবদ্ধ ছিলো; অন্তত প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে কৌটিল্যপূর্ব কোনো প্রখ্যাত বৌদ্ধ বা জৈন মতের সমর্থক ঐতিহাসিকভাবে আবির্ভূত হননি– কিংবা হলেও তাঁদের কথা কৌটিল্যের জানা ছিলো না। তবে কেবল ধারণাগত মতাদর্শ থেকে বৌদ্ধ ও জৈন মতকে যাঁরা দার্শনিক প্রস্থান হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ করেছেন ভারতীয় দর্শনেতিহাসে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে কৌটিল্যর সময়কালের পরেই। মহারাজ অশোকের পর– অর্থাৎ কৌটিল্যর পরে– নাগার্জুনের মতো বৌদ্ধ বা উমাস্বাতির মতো প্রখ্যাত জৈন দার্শনিকদের পরিচয় পাওয়া যায়।

কিন্তু কৌটিল্যের লেখায় পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তের উল্লেখ নেই কেন? পূর্বমীমাংসার আকরগ্রন্থ জৈমিনির ‘মীমাংসাসূত্র’ এবং বেদান্তর আকরগ্রন্থ বাদরায়ণের ‘ব্রহ্মসূত্র’র রচনাকাল সংক্রান্ত সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত সম্ভব না-হলেও ভারতীয় দর্শন-জগতে এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পূর্বমীমাংসা ও বেদান্ত দর্শন সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক (‘যোগ’) এবং লোকায়ত দর্শনের পূর্ববর্তী। অতএব দার্শনিক মত হিসেবে শুধু এই তিনটি উল্লেখ করেও কৌটিল্য কেন পূর্বমীমাংসা ও বেদান্ত সম্বন্ধে নীরব? প্রশ্নটি নিশ্চয়ই উপেক্ষা করার মতো নয়। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে, কৌটিল্যের পুরো উক্তির সঙ্গে পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তদর্শনের মূল দাবি মিলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন নয়। কেননা–
‘পূর্বমীমাংসকদের মূল দাবি কোনো স্বতন্ত্র বা স্বাধীন দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নয়। তার বদলে পূর্বমীমাংসা বেদেরই কর্মকাণ্ডের রূপায়ণ। তেমনি বেদান্তও কোনো স্বাধীন দার্শনিক মত নয় : বেদেরই জ্ঞানকাণ্ড বা উপনিষদ-উক্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়সাধন। অর্থাৎ, সংক্ষেপে, এই দুটি দর্শনের স্বীয় দাবিই হল, এগুলি বেদ ছাড়া আর কিছুই নয়– বেদেরই তাৎপর্য ব্যাখ্যা। অতএব, কৌটিল্য-উক্ত বিদ্যার তালিকায় ‘ত্রয়ী’ বা বেদ ছাড়াও দর্শন হিসাবে পূর্বমীমাংসা এবং বেদান্তের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন : উভয় দর্শনেরই সারাংশ ‘ত্রয়ী’-রই অন্তর্ভুক্ত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬১)

এখানে উল্লেখ্য, ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যের বর্ণনায় প্রাচীনকালের মতাদর্শগত একটা বিতর্কেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কৌটিল্যর স্বীয় মতে বিদ্যা বলতে চার রকম। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রাচীনেরা সকলেই এ-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত নন। এ প্রসঙ্গে তিনি মতান্তরগুলিও উল্লেখ করেছেন। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, মানব বা মনু-র অনুগামীদের মত বর্ণনায় কৌটিল্য বলছেন, মনুর অনুগামীদের মতে বিদ্যা বলতে শুধুমাত্র তিনটি– ত্রয়ী, দণ্ডনীতি এবং বার্তা; আন্বীক্ষিকীকে স্বতন্ত্র বিদ্যা বলে মানার কোনো কারণ নেই, কেননা তা ত্রয়ীবিশেষই বা ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।

তবে এখানে মনু নামে কৌটিল্য যাঁর উল্লেখ করেছেন তিনিই ‘মনুস্মৃতি’-কার কিনা– এ-বিষয়ে আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কিছু বিতর্ক রয়েছে। কারো কারো মতে, এখানে ‘মানব’ বা মনুর অনুগামী বলতে ‘মনুস্মৃতি’র অনুগামীদের বোঝা যুক্তিযুক্ত হবে না। কেননা, ‘মনুস্মৃতি’তে আন্বীক্ষিকী (বা নামান্তরে হেতুবিদ্যা, তর্কবিদ্যা) অবজ্ঞা করার উপদেশ নেই; বরং স্বীকৃতিই চোখে পড়ে। যেমন–

ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীং বিদ্যাদ্ দণ্ডনীতিঞ্চ শাশ্বতীম্ ।
আন্বীক্ষিকীঞ্চাত্মবিদ্যাং বার্তারম্ভাংশ্চ লোকতঃ।। (মনুসংহিতা-৭/৪৩)।
অর্থাৎ : রাজা ত্রিবেদবেত্তা দ্বিজাতিদের কাছ থেকে ঋগ্-যজুঃ-সাম এই বেদত্রয় আয়ত্ত করবেন। পরম্পরাগত দণ্ডনীতি অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র– যা চিরকাল বিদ্যমান আছে এমন রাজনীতিশাস্ত্র– রাজনীতিবিদ ব্যক্তিদের কাছে অধ্যয়ন করবেন। আন্বীক্ষিকী বা তর্কশাস্ত্র এবং আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং বার্তা অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যপশুপালনাদি জ্ঞান সেই সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের কাছে শিক্ষা করবেন।


কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, ‘মনুস্মৃতি’-তে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, শ্রুতি (বেদ) এবং স্মৃতি (ধর্মশাস্ত্র) চরম প্রমাণ; এমনকি কোনো দ্বিজও যদি হেতুশাস্ত্র অবলম্বন করে শ্রুতি-স্মৃতিতে কোনো সংশয় প্রকাশ করে তাহলে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাকে একেবারে দূর করে দেবেন। যেমন–

শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্রস্তু বৈ স্মৃতিঃ।
তে সর্বার্থেষ্বমীমাংস্যে তাভ্যাং ধর্মো হি নির্বভৌ।। (মনুসংহিতা-২/১০)।
অর্থাৎ : ‘বেদ’ বলতে ‘শ্রুতি’ বোঝায় এবং ‘ধর্মশাস্ত্রের’ নাম ‘স্মৃতি’। সকল বিষয়েই (অর্থাৎ সকল রকম বিধি-নিষেধের স্থানে) এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত, কারণ, শ্রুতি ও স্মৃতি থেকেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে।
.
যোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্ দ্বিজঃ।
স সাধুভি র্বহিষ্কার্যো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ।। (মনুসংহিতা-২/১১)।।
অর্থাৎ : যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে– তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় করে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক।


মনুর এই ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী? এমন মন্তব্য করা মনে হয় অস্বাভাবিক হবে না যে, হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধাই মনুর মতে বেদনিন্দা বা নাস্তিকতার উৎস। কেননা মনুর মতে হেতুশাস্ত্রের কাজ হলো শ্রুতি ও স্মৃতিকে বেদবিহিতরূপে প্রমাণ ও ব্যাখ্যা করা। এ হৈতুক যে বেদ-সমালোচক নয় বরং বেদ বা শ্রুতিকে প্রমাণ গণ্য করা হেতুবিদ, তা বোঝা যায় মনুর অন্য শ্লোকে–

ধর্মেণাধিগতো যৈস্তু বেদঃ সপরিবৃংহণঃ।
তে শিষ্টা ব্রাহ্মণা জ্ঞেয়াঃ শ্রুতিপ্রত্যক্ষহেতবঃ।। (মনুসংহিতা: ১২/১০৯)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্মচর্যাদি ধর্মযুক্ত হয়ে যাঁরা ‘সপরিবৃংহণ বেদ’ অর্থাৎ বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ইতিহাস ও পুরাণাদির দ্বারা পরিপুষ্ট বেদশাস্ত্র বিধিপূর্বক আয়ত্ত করেছেন সেই ব্রাহ্মণকে শিষ্ট বলে বুঝতে হবে; শ্রুতিই তাঁদের নিকট প্রত্যক্ষস্বরূপ এবং হেতুস্বরূপ অর্থাৎ অনুমানাদি অন্যান্য প্রমাণস্বরূপ।


আর হেতুশাস্ত্রকে যারা বেদ-বিরোধী বা বেদের সমালোচনায় নিযুক্ত করেন, মনু হয়তো বলতে চান যে ওই হৈতুকরাই হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান। সেইসব হৈতুকই মনুর মতে পরিত্যাজ্য। এ কারণেই মনুশান্ত্রে এই বেদবিরোধী তর্কমূলক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা উচ্চারিত হয়–

যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতাঃ।। (মনুসংহিতা-১২/৯৫)।।
অর্থাৎ : বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ-তর্কযুক্ত মতবাদসমূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে প্রেত্য বা নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিভাত হয় এবং সেগুলি তমোনিষ্ঠ বলে স্মৃত হয়ে থাকে।


তার মানে, শাস্ত্রবিশ্বাসে অবিচল থেকে শাস্ত্রকে হেতুস্বরূপ ব্যবহারে নিয়োজিত রাখাটাই মনুর মতে অনুমোদিত হেতুশাস্ত্র। তাকে অশ্রদ্ধা দেখানো চলে না। অশ্রদ্ধা দেখিয়ে হেতুশাস্ত্রকে যারা তার বিপরীতে ব্যবহার করেন তারা হচ্ছেন নিন্দিত হৈতুক, হেতুশাস্ত্রপরায়ণ বা তার্কিক।  কিন্তু কাদের মধ্যে এ-হেন হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা? এর ব্যাখ্যায় মেধাতিথি, কুল্লুকভট্ট প্রমুখ টীকাকার চার্বাক প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন। যেমন, মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথির মতে হৈতুক অর্থ হচ্ছে–

হৈতুকা নাস্তিকা নাস্তি পরলোকো, নাস্তি দত্তম্, নাস্তি হুতমিত্যেবং স্থিতপ্রজ্ঞাঃ।
অর্থাৎ : নাস্তিক অর্থাৎ যারা এই রকম দৃঢ়নিশ্চয় করে যে, পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, হোম করারও কোনও ফল নেই, তারাই হৈতুক।

আবার মনুসংহিতার অপর ভাষ্যকার কুল্লুকভট্টের মতে হৈতুক হলো–

হৈতুকা বেদবিরোধিতর্ক ব্যবহারিণঃ।
অর্থাৎ : হৈতুক হচ্ছে বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ।


চার্বাকেরা যে বেদনিন্দক নাস্তিক ছিলেন, একথা অবশ্যই সুবিদিত। কিন্তু কুল্লুকভট্টর বাখ্যা স্বীকার করলে মানতে হয়, তার আসল কারণ চার্বাকদের হেতুশাস্ত্র-পরায়ণতা। আর অবশ্যই অনুমানকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে হেতুশাস্ত্র-পরায়ণতার কথা ওঠে না। অতএব, দেবীপ্রসাদের মতে, মনু ও কুল্লুকের কথা মানলে– চার্বাকেরা ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অস্বীকার করেছেন– এজাতীয় মাধবাচার্য প্রভৃতির দাবির বিরুদ্ধে যায়।

অতএব, দেবীপ্রসাদ-প্রযুক্ত ‘মনুস্মৃতি’র এজাতীয় নজিরগুলি মনে রেখে ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যর বক্তব্যের বিশ্লেষণ করা যাক। কৌটিল্য বলছেন, তাঁর স্বীয় মতে (রাজার শিক্ষণীয়) বিদ্যা বলতে চার রকম হলেও ‘মানব’ বা মনুর অনুগামীরা তা মানেন না; তাঁদের মতে আন্বীক্ষিকীর কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই, তা ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে তাহলে কৌটিল্যের কথা এবং মনুর কথা কি এক হয়? কৌটিল্য আন্বীক্ষিকী বলতে স্বাধীন যুক্তিবিদ্যা বা তর্কবিদ্যার কথাই বলেছেন। কিন্তু ‘মনুস্মৃতি’র মতে কেবল আন্বীক্ষিকী অবশ্য পরিত্যাজ্য; শুধুমাত্র শাস্ত্রানুগামী– বা বেদান্ত অনুগামী– অর্থে আন্বীক্ষিকীর কিছুটা মূল্য আছে, কেননা তা আত্মবিদ্যা বা অধ্যাত্মবিদ্যা বোঝবার পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
এবং আন্বীক্ষিকী অর্থে কৌটিল্য শুধুমাত্র যে-তিনটি দার্শনিক মত স্বীকার করেছেন তার মধ্যে লোকায়ত বলতে যে পরবর্তীকালের নামান্তরে চার্বাক দর্শনই বোঝায়, ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য স্বীকার করলে তা বোধকরি অস্বীকার করা যায় না।

প্রমাণ প্রসঙ্গে চার্বাক-সিদ্ধান্ত

(১) প্রত্যক্ষ প্রসঙ্গে :

প্রমাণ বিষয়ক উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমাদের ধারণায় এটুকু স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকদর্শনের বর্ণনায় মাধবাচার্য প্রমুখ যদিও বলেছেন যে প্রমাণ হিসেবে চার্বাকেরা অনুমান প্রমাণ একেবারে বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন, তবু ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে একথা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, মাধবাচার্যের নিজের সম্প্রদায়ে (অর্থাৎ অদ্বৈত বেদান্তে) অবশ্যই সর্বপ্রমাণ বর্জনের– অতএব অনুমান বর্জনেরও– উপদেশ আছে। শঙ্করাচার্যের লেখা থেকে শ্রীহর্ষ ও তাঁর ব্যাখ্যাকারদের রচনায় সেকথা সুস্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এটাই হয়তো যৌক্তিক যে–
‘আসলে অনুমান খণ্ডনের প্রস্তাব মাধবাচার্য চার্বাকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের দার্শনিক মতকে খেলো প্রতিপন্ন করবার সহজ পথ বেছে নিয়েছেন : অনুমানই যদি কেউ না মানে তাহলে দর্শনের দরবারে তাকে কী করে স্থান দেওয়া যায়? প্রসঙ্গত, এ-জাতীয় যুক্তির জবাব দিয়েই শ্রীহর্ষ তাঁর প্রখ্যাত ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য’ বই শুরু করেছেন; অর্থাৎ তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে শূন্যবাদী এবং মায়াবাদীরা সব রকম প্রমাণ অগ্রাহ্য করেও শূন্যবাদ ও মায়াবাদ প্রচারের অধিকারী ছিলেন।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬৩)


কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনা অবশ্যই শূন্যবাদ বা মায়াবাদ নিয়ে নয়, প্রখর বস্তুবাদ নিয়ে– যে বস্তুবাদ লোকায়ত বা চার্বাক নামে ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ। এবং বিভিন্ন নজির থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে প্রকৃত চার্বাকমতে প্রত্যক্ষ অবশ্যই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ, প্রমাণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে সেরা। কিন্তু প্রত্যক্ষ-অনুগামী ইহলোক প্রসঙ্গেও অনুমানকে প্রমাণ বলে মানায় বাধা নেই। কেবল পরলোক, কর্মফল, আত্মা প্রভৃতি একান্ত অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান নিষ্ফল– কেননা একদল ধূর্ত এজাতীয় বিষয়ে অনুমান প্রমাণ দেখাবার চেষ্টা করে লোক ঠকাবার আয়োজন করে।

এই যদি চার্বাকদের প্রকৃত অভিপ্রেত মত হয় তাহলে সাধারণত মতটিকে অধ্যাত্মবাদীদের কর্তৃক যতটা খেলো করে প্রচার করার চেষ্টা চোখে পড়ে তা মূলতই বিরূপ-প্রচারের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, বিশেষত আমাদের দেশে শ্রুতি-স্মৃতির দোহাই পাড়ার প্রয়োজন এমনই প্রবল হয়েছিলো যে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের গুরুত্ব নেহাতই গৌণ বা অনেকাংশে অবান্তর বলেই বিবেচিত হবার আশঙ্কা দেখা গিয়েছিলো এবং এমন একটা ধারণা চালু হয়েছিলো যে আমাদের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যই বুঝি ঋষিদের ধ্যানলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অধ্যাত্মবিদ্যা– যার সঙ্গে চোখে দেখা মাটির পৃথিবীর বড় একটা সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃতি বিজ্ঞানের প্রথম ধাপই সম্ভব হয় না। অর্থাৎ বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষকে প্রমাণের জ্যেষ্ঠত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব না মেনে তা সম্ভবই নয়।

যেহেতু আমাদের আলোচনার নজিরগুলি ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যকে কেন্দ্র করে যুক্তিবিস্তৃত হচ্ছে, বিজ্ঞান-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেরকম নজির উপস্থাপন করা যায় কিনা দেখা যেতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ তাঁর ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৬৫) সুপ্রাচীন কালের শল্যবিদ্যর আকরগ্রন্থ ‘সুশ্রুত-সংহিতা’র নজির টেনে বলছেন, ‘সুশ্রুত-সংহিতা’-তেও প্রত্যক্ষজ্ঞানের প্রাধান্য প্রতিপাদন করা হয়েছে; এই কারণেই সুশ্রুত-মতে শবব্যবচ্ছেদ না করে প্রকৃত ভিষক্ হওয়া সম্ভব নয়। এ-প্রসঙ্গে তিনি ‘সুশ্রুত-সংহিতা’র প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন–

‘ত্বক্ পর্যন্ত সমস্ত দেহের যে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উক্ত হইয়াছে, শল্যজ্ঞান ব্যতিরেকে তাহার কোন অঙ্গ বর্ণন করিতে পারা যায় না। অতএব শল্যাপহর্তা যদি নিঃসংশয় (সন্দেহরহিত) জ্ঞান লাভের ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে একটি মৃতদেহকে শোধন করিয়া তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গসকল সম্যক্রূপে দর্শন করা তাঁহার কর্তব্য। যাহা প্রত্যক্ষদৃষ্ট হয় এবং যাহা শাস্ত্রে দেখা যায় তদুভয়ই উভয় বিষয়ে সহজে অধিকতর জ্ঞান বর্ধন করিয়া থাকে।।’
‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি দর্শনার্থে যেরূপ শব গৃহীত হইবে, তাহাই বলা যাইতেছে। শবটির যেন সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে, তাহা যেন বিষোপহত না হয়, দীর্ঘকাল ব্যাধিপীড়িত না হইয়া থাকে, শতবৎসর বয়স্কের দেহ না হয়। এনরূপ শবের অন্তঃপুরীষ নিষ্কাশিত করিয়া কোন নির্জন প্রদেশে তাহা একটি স্রোতহীন জলাশয়ে পচাইবে। মৎস্যাদিতে ভক্ষণ করিতে না পারে এবং অন্য কোথাও সরিয়া না যায়, এইজন্য এই জলাশয়ের জলের মধ্যে একটি মাচা বাঁধিয়া তাহার উপর ঐ শবকে রাখিতে হইবে, এবং মুঞ্জ বল্কল কুশ ও শণাদি রজ্জুর কোন রজ্জু-দ্বারা তাহার সর্বাবয়ব বেষ্টন করিয়া বাঁধিতে হইবে। সাতদিনের মধ্যেই উহা সম্যক পচিবে, তখন উহাকে তুলিয়া বেণারমূল, চুল, বাঁশের চেয়াড়ী বা কুঁচী দ্বারা ধীরে ধীরে ঘর্ষণ করিয়া ত্বগাদি সমস্তই অর্থাৎ যথোক্ত বাহ্যাভ্যন্তর অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ চক্ষু দ্বারা দর্শন করিবে।।’
…‘যিনি শবচ্ছেদ দ্বারা শরীরের বাহ্যাভ্যন্তর অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি সকল প্রত্যক্ষ করিয়াছেন এবং শাস্ত্রে তৎসমস্ত অবগত হইয়াছেন, তিনিই আয়ুর্বেদবিশারদ। প্রত্যক্ষদৃষ্ট এবং শাস্ত্রশ্রুত বিষয় দ্বারা সন্দেহ নিরাকরণপূর্বক তিনি চিকিৎসা করিয়া থাকেন।’- (দেবেন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর তর্জমা। শারীরস্থান, পঞ্চম অধ্যায়)


পাঠক হয়তো এখানে সরাসরি ব্যবহারিক জ্ঞানের উপদেশ দেখে ভাবতে পারেন যে দার্শনিক উপপত্তি কোথায়? কিন্তু উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রথা হিসেবেই প্রাচীন গ্রন্থগুলিতেও প্রাসঙ্গিক দর্শনালাপের খুব একটা কমতি দেখা যায় না কোথাও। এক্ষেত্রে আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থ– ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য়– প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের উপর চরম গুরুত্ব অর্পণের অজস্র নজির রয়েছে। তার দীর্ঘ তালিকায় না গিয়ে একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
আয়ুর্বেদ-মতে অন্বষ্ঠ নামের একজাতীয় ফল আমাশয় জাতীয় রোগের চিকিৎসায় বিশেষ ফলপ্রসূ, কেননা বহু দৃষ্টান্তেই দেখা গেছে যে তা খেলে কোষ্ঠ বদ্ধ হয়। আয়ুর্বেদ-মতে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতেই অন্বষ্ঠ জাতীয় ফলের এই উপযোগিতা স্বীকার্য। এবং প্রত্যক্ষের উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই একই ফলের বিপরীত গুণাগুণ হাজার যুক্তিতর্ক দিয়েও প্রমাণ করা অসম্ভব। তাই ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় বলা হয়েছে–

‘প্রত্যক্ষলক্ষণফলাঃ প্রসিদ্ধাঃ চ স্বভাবতঃ।
নৌষধীর্হেতুভির্বিদ্বান্ পরীক্ষেত কথঞ্চন।।
সহস্রেণাপি হেতুনাং ন অন্বষ্ঠাদির্বিরেচয়েৎ।
তস্মাত্তিষ্ঠেত্তু মতিমানাগমে ন তু হেতুষু।।’ (সুশ্রুতসংহিতা-১/৪১/২৩-২৪)
অর্থাৎ :
সংক্ষেপে, প্রত্যক্ষজ্ঞানলব্ধ বিষয়কে শুধুমাত্র হেতু বা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে যাওয়া বিদ্বানের লক্ষণ নয়। যেমন, সহস্র হেতু প্রয়োগ করেও প্রমাণ করা যাবে না যে অন্বষ্ঠ জাতীয় ফল বিরেচনের কারণ হতে পারে।


এখানে প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বলে তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, আয়ুর্বেদে যুক্তিতর্কের– এবং সাধারণভাবে অনুমানের– গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ‘চরক-সংহিতা’ গ্রন্থে অনুমান নিয়ে এতো দীর্ঘবিস্তৃত আলোচনা আছে যে, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে এমনকি ন্যায়দর্শনের উৎস-সন্ধনে শেষ পর্যন্ত এই আলোচনায় উপনীত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বক্তব্য যে অমূলক নয় তা আরেকটু পরেই আমরা দেখবো। তবে আয়ুর্বেদের অভিপ্রেত মত এই যে যুক্তিতর্ক এবং অনুমানের গুরুত্ব যতই হোক না কেন, তা প্রসিদ্ধ প্রত্যক্ষ-বিরুদ্ধ হলে বস্তুত অচল হয়ে যাবে। এবং এই দাবিও ন্যায়দর্শনের কথাই মনে করিয়ে দেয়, কেননা, ইতঃপূর্বেই আমরা দেখেছি, ‘ন্যায়-সূত্রে’র ভাষ্যে বাৎসায়নও দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ-বিরুদ্ধ অনুমানের মূল্য স্বীকার করা যায় না। সংক্ষেপে, ন্যায়দর্শনের মতোই আয়ুর্বেদ-মতেও প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ, প্রমাণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে বলে রাখা আবশ্যক, চার্বাক আলোচনায় এই আয়ুর্বেদকে টেনে আনার কারণ আর কিছু নয়, চার্বাকদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযানের একটা বড় হাতিয়ার হলো তাদের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা, এবং চার্বাকমতকে একেবারে খেলো প্রতিপন্ন করবার উৎসাহেই মনে হয় কথাটাকে বিকৃত করে বলা হয়েছে যে, চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ; এমনকি সাধারণ লোকব্যবহারসিদ্ধ অনুমানকেও প্রমাণের মর্যাদা দিতে চার্বাকেরা নারাজ। কিন্তু আমরা বিভিন্ন নজির থেকে অনুধাবন করতে পেরেছি, এই দ্বিতীয় কথাটি স্বীকার করা যায় না– অর্থাৎ, চার্বাকেরা একেবারে ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অগ্রাহ্য করেননি। চার্বাক-মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণ; তবুও প্রত্যক্ষ সাপেক্ষ বিষয়ে সাধারণ লৌকিক অনুমান মানায় তাঁদেরও আপত্তি ছিলো না। কিন্তু তা স্বীকার করলেও মানতে হবে, চার্বাকেরা অবশ্যই প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
অথচ চার্বাক-বিরোধীদের মন্তব্য হলো, চার্বাকদের এই প্রত্যক্ষ-বিহ্বলতা স্বাভাবিক এবং এর থেকেই বোঝা যায় মতটা আসলে অত্যন্ত অসার। ইন্দ্রিয়লব্ধ সুখভোগের প্রতিই যাদের অমন টান– যাদের মনের মতো কথা শুধু এই যে খাও-দাও-ফূর্তি করো– তারা প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া আর কীই বা মানতে পারে?–

‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে) যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?


এর উত্তরে অনেক আধুনিক বিদ্বান গবেষকই দেখার চেষ্টা করেছেন যে, পরলোকের কাল্পনিক সুখের আশায় ইহলোকের বাস্তব সুখের প্রতি বিরাগ চার্বাকমতে অবশ্যই বেকুবের কথা। প্রত্যক্ষলব্ধ ইহকালের কথা ছেড়ে অপ্রত্যক্ষ পরকালের কল্পনাও তাইই। তবু এই নজির থেকে– অর্থাৎ চার্বাকের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা থেকে– দার্শনিক মত হিসেবে নিকৃষ্টতা প্রতিপন্ন হয় না। বরং, চার্বাকের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা একদিক থেকে দার্শনিক উৎকর্ষেরই পরিচায়ক। কেননা, প্রত্যক্ষ-পরায়ণতাই প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ভিত্তি। এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদের কাল থেকে মধ্যযুগের রসায়নবিদ্যা পর্যন্ত প্রকৃতি-বিজ্ঞানের যতটুকু উৎকর্ষ তার মূলেও এই প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা। প্রত্যক্ষকেই প্রমাণজ্যেষ্ঠ বা প্রমাণশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার না করে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এদিক থেকে বলা যায়, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অন্যান্য দার্শনিক মতের তুলনায় চার্বাকমতই প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বিশেষ সহায়ক ছিলো। অতএব, চার্বাকমতের আলোচনায় ভারতীয় প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সাক্ষ্য অবান্তর নয়; পক্ষান্তরে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন।

.
(২) অনুমান প্রসঙ্গে :

প্রত্যক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলেও অবশ্যই নিছক প্রত্যক্ষ বা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করেও প্রকৃতি-বিজ্ঞান সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমানের উপরও নির্ভর করা প্রয়োজন। আয়ুর্বেদের গ্রন্থেই তার ভূরিভূরি নিদর্শন রয়েছে। ফলে অনুমানের আলোচনাও আছে। ইতঃপূর্বে আমরা অন্বীক্ষা বা অনুমান শব্দের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখেছি– অনু+ঈক্ষা হলো অন্বীক্ষা, বা অনু+মান হলো অনুমান। সহজ কথায়, পরবর্তী জ্ঞান– অর্থাৎ, অন্য কোনো জ্ঞানের অনুগামী জ্ঞান। কিন্তু কিসের পরবর্তী? প্রত্যক্ষ জ্ঞানের। মোদ্দা কথায়, কোনো পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষর উপর নির্ভরশীল আরেক রকম জ্ঞান হলো অনুমান। আয়ুর্বেদের আকর-গ্রন্থ ‘চরক-সংহিতা’য়ও কথাটা খুবই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে–

‘প্রত্যক্ষ-পূর্বং ত্রিবিধং ত্রিকালং চ অনুমীয়তে।
বহ্নিঃ নিগূঢ়ঃ ধূমেন মৈথুনং গর্ভদর্শনাৎ।।
এবং ব্যবস্যন্তী অুীতং বীজাৎ ফলম্ অনাগতম্ ।
দৃষ্টা বীজাৎ ফলং জাতম্ ইহ এব সদৃশং বুধৈঃ।।’ (চরকসংহিতা-১/১১/২১-২২)
অর্থাৎ :
যাহা প্রত্যক্ষপূর্ব, ত্রিবিধ এবং তিন কালেই অনুমেয় হয়, তাহাকে অনুমান বলে। অনুমান প্রত্যক্ষ-পূর্ব, অর্থাৎ পূর্বে যাহার প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে, তৎসম্বন্ধেই অনুমান করা যায়। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ের অনুমান কখনই হইতে পারে না। অনুমান তিন প্রকার বলাতে কারণ-অনুমান, কার্য-অনুমান ও সামান্যদৃষ্ট-অনুমান বুঝায়। অনুমানের গতি যে বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ– এই তিন কালেই হইয়া থাকে তৎপক্ষে দৃষ্টান্ত যথা : ধূম দ্বারা বর্তমান বহ্নির অনুমান, গর্ভ দেখিয়া অতীত মৈথুনের অনুমান হয় এবং বীজ দেখিয়া সেই বীজে একবার যেরূপ বৃক্ষ ফলিয়াছিল, এবারেও তৎসদৃশ ফল ফলিবেক, এইরূপ ভবিষ্যৎ অনুমান করা যায়। (কবিরাজ সতীশচন্দ্র শর্মা কবিভূষণের তর্জমা)।


এই শ্লোকের উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, ‘চরক-সংহিতা’য় ত্রিবিধ অনুমানের কথা বলা হয়েছে– বর্তমান ধূম দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান, বর্তমান গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান এবং বর্তমান বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান। কিন্তু এই তিন রকম অনুমানেরই মূল শর্ত হলো পূর্ব-প্রত্যক্ষ। এই কারণে অনুমান প্রসঙ্গে প্রথম কথাই হলো ‘প্রত্যক্ষ-পূর্ব’। প্রথমে প্রত্যক্ষ; এবং সেই প্রত্যক্ষের উপর নির্ভর করেই অনুমান। বলাই বাহুল্য, এই মতে অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান জ্ঞানের কোনো স্থান নেই; অতএব আত্মা, কর্মফল, পরকাল, পরলোক প্রভৃতি প্রসঙ্গে অনুমান অবান্তর হবে, কেননা এ-জাতীয় বিষয়ে কোনো পূর্ব-প্রত্যক্ষর সুযোগই নেই।

এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
‘অধুনালভ্য ‘চরক-সংহিতা’য় আত্মা, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা চোখে পড়ে। কিন্তু তার নজির থেকে আমাদের বর্তমান যুক্তি অগ্রাহ্য করা যায়।… আত্মা, পরলোক, প্রভৃতি আলোচনার সঙ্গে আয়ুর্বেদের প্রকৃত সারাংশের কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই। আসলে প্রকৃত চিকিৎসাবিদ্যার সমর্থনে আয়ুর্বেদ-বিদেরা গোমাংসাদি ভক্ষণ জাতীয় এমন অনেক কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ধর্মশাস্ত্রকারদের– অর্থাৎ সুপ্রাচীন আইনকর্তাদের– বিধান-বিরুদ্ধ। এই কারণে ধর্মশাস্ত্রকারেরা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিদ্যার তীব্র নিন্দা করেছেন। ফলে, আইনকর্তাদের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণের আশায় অধুনালভ্য ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় এমন অনেক আলোচনা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে যার সঙ্গে আয়ুর্বেদের সারাংশর প্রকৃত সম্পর্ক না থাকলেও অন্তত আপাতদৃষ্টিতে আয়ুর্বেদের উপর ধর্মশাস্ত্র আনুগত্যের এক রকম যেন মুখোশ পরানো যায়। কে বা কারা এই আয়োজন করেছিলেন তা আমাদের জানা নেই; শুধু এইটুকু জানা আছে যে দীর্ঘযুগ ধরে অনেকের হাত ঘুরে– অনেক অবান্তর কথা সংযোজিত হয়ে– ‘চরক-সংহিতা’ ও ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় বর্তমান সংস্করণ আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতএব পরবর্তী সংস্কারক ও সম্পাদকদের পক্ষে আত্মাদি বিষয়ে আলোচনা সংযোজনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মোট কথা, অনুমানের লক্ষণ ও তার ত্রিবিধ দৃষ্টান্ত থেকে যে-উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেই উক্তি অনুসারে একান্ত অপ্রত্যক্ষ আত্মা, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ে আয়ুর্বেদ-মতে অনুমানের সুযোগ নেই।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬৯)

আমরাও ইতঃপূর্বে দেখেছি, বহু প্রাসঙ্গিক নজির থেকে মনে করা যেতে পারে যে অনুমান প্রসঙ্গে চার্বাকদেরও আসল বক্তব্য মোটের উপর একই রকম হওয়া সম্ভব। প্রত্যক্ষ-অনুগামী লৌকিক বিষয়ে অনুমান চার্বাকেরাও অগ্রাহ্য করেন নি। অতএব এদিক থেকেও বলা যায়, বহু বিরূপ-প্রচারণা সত্ত্বেও চার্বাকমতকে একেবারে খেলো মনে করার কারণ নেই। পক্ষান্তরে ভারতীয় প্রকৃতিবিজ্ঞানের মূল ভিত্তির সঙ্গে চার্বাকমতের অন্তত অনেকাংশে আত্মীয়তা চোখে পড়ে।

এখানে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর সেই চিত্তাকর্ষক মন্তব্যটি স্মর্তব্য– ন্যায়-দর্শনের উৎস সন্ধানে আমাদের পক্ষে ‘চরক-সংহিতা’য় ফিরে যাবার সম্ভাবনা; অর্থাৎ আয়ুর্বেদ-এর আকরগ্রন্থে প্রমাণ প্রসঙ্গে যে আলোচনা আছে তাই কালক্রমে ন্যায়দর্শনের রূপ গ্রহণ করেছিলো। দাশগুপ্তের এই মন্তব্য সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য কিনা তা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এ-কথাটি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক যে, ‘ন্যায়সূত্র’-তে অনুমান প্রসঙ্গে প্রায় হুবহু একই কথা বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষর আলোচনার পরেই ‘ন্যায়সূত্র’কার বলছেন–

‘অথ তৎপূর্বকং ত্রিবিধমনুমানং পূর্ববৎ শেষবৎ সামান্যতোদৃষ্টঃ চ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।
অর্থাৎ : অনন্তর, অর্থাৎ প্রত্যক্ষনিরূপণের অনন্তর অনুমান (নিরূপণ করিতেছি)। তৎপূর্বক, অর্থাৎ প্রত্যক্ষবিশেষমূলক জ্ঞান অনুমান প্রমাণ ত্রিবিধ– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট।


ভারতীয় দর্শনের পরিভাষায় সূত্রটির ব্যাখ্যা অল্পবিস্তর কঠিন মনে হলেও মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ তাঁর ‘ন্যায়দর্শন’ গ্রন্থে সূত্রটির যথাসম্ভব প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।–  ‘ন্যায়সূত্র’র আলোচ্য সূত্রটির সরল অর্থ হলো, অনুমান বলতে বোঝায় ‘প্রত্যক্ষ-পূর্বক’। অর্থাৎ আগেকার কোনো প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল প্রমাণ, তা তিন রকম– পূর্ববৎ (অর্থাৎ বর্তমান কারণের প্রত্যক্ষ থেকে ভাবী কার্যর অনুমান; যেমন মেঘ দেখে অনুমান হয় বৃষ্টি হবে), শেষবৎ (অর্থাৎ কার্য থেকে কারণ অনুমান; যেমন নদীর জলস্ফীতি প্রভৃতি দেখে অনুমান হয় অতীতে বৃষ্টি হয়েছিলো), এবং সামান্যতোদৃষ্ট (যেমন কোনো বস্তুর স্থানান্তরপ্রাপ্তি থেকে তার গতি অনুমান; সূর্যের গতি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য হয়, কিন্তু আকাশে সূর্যের স্থানান্তরপ্রাপ্তি প্রত্যক্ষ করে অনুমান হয় তার গতি আছে)।

‘ন্যায়সূত্র’র সরল অর্থ অনুসারে অনুমান প্রমাণ প্রত্যক্ষ-নির্ভর। অর্থাৎ, আগে প্রত্যক্ষ এবং সেই প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করেই অনুমান। শেষ কথায় ফণিভূষণ যেমন বলেছেন, ‘প্রত্যক্ষের জ্ঞান ব্যতীত অনুমানের জ্ঞান হইতে পারে না। সুতরাং ঐ জ্ঞানদ্বয়ের কার্য-কারণ ভাব আছে।’- (ন্যায়দর্শন-১/১৩১)।
অনুমান প্রসঙ্গে এই কথাই যদি ন্যায়দর্শনের সারাংশ হয় তাহলে চার্বাকমতের সারাংশের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায় এবং কতোখানি? চার্বাক কোনো অর্থেই অনুমান মানতেন না– একথা চার্বাকদের বিরুদ্ধে বিকৃত-প্রচারণা হওয়াই স্বাভাবিক। বরং আমরা দেখেছি যে, প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার করা চার্বাকমতসম্মত হওয়াই স্বাভাবিক।

অতএব, বহু প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, প্রমাণ প্রসঙ্গে চার্বাকদের সিদ্ধান্ত হলো, চার্বাক-মতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে শ্রেষ্ঠ; পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষগোচর– বা প্রত্যক্ষ-অনুগামী– লৌকিক অনুমান স্বীকার করায় চার্বাকদের আপত্তি ছিলো না।

দেহাত্মবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদ

চার্বাকেতর দর্শন সম্প্রদায়গুলির পরবর্তীকালের প্রায় সকল দার্শনিকেরাই চার্বাকমত হিসেবে প্রচারিত প্রধানত দুটি দাবি খণ্ডন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এই প্রধান দুটি চার্বাক-মত হলো–
এক : প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অতএব অনুমানের কোনো প্রামাণ্য নেই।
দুই : দেহাত্মবাদ। অর্থাৎ দেহ ভিন্ন আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই। আত্মা বলে একান্তই যদি কোনো শব্দ ব্যবহার করতে হয় তাহলে এই দেহকেই আত্মা বলে মানতে হয়।

ইতোমধ্যে প্রথম দাবির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রাপ্ত যুক্তি-তথ্য অনুসারে দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে যে, প্রকৃত চার্বাকমতের সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক মতের এবং আয়ুর্বেদশাস্ত্রের আকরগ্রন্থ ‘চরক-সংহিতা’য় স্বীকৃত বিজ্ঞানের খুব একটা তফাৎ থাকে না। বরং চার্বাক-প্রতিপক্ষরা চার্বাকদের প্রত্যক্ষ-সংক্রান্ত আরোপিত যে-কোন দাবিকে প্রতিষ্ঠার যত চেষ্টাই করুন না কেন সেগুলিকে অতিরঞ্জিত বিকৃত-প্রয়াস বলেই মনে হয়। বর্তমান আলোচনা চার্বাক-সংক্রান্ত দ্বিতীয় দাবি দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে।


মূলত যে বৈশিষ্ট্য চার্বাক-দর্শনকে ভারতীয় অন্যান্য দর্শন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রেখেছে তাকে দেহাত্মবাদ বা ভূত-চৈতন্যবাদ সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়ে থাকে। চার্বাক-অনুমোদিত বস্তুজগতের উপাদান চার তত্ত্ব সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে কিছু আলোচনা হয়েছে এবং এই মৌল উপাদানের সংখ্যা সম্বন্ধে ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের স্বীকৃতির সঙ্গে চার্বাকী ধারণার পার্থক্যও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই তত্ত্বগুলি চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনে মহাভূত সংজ্ঞায় পরিচিত এবং অন্যান্য বহু তত্ত্ব বা বিষয়ের মধ্যে স্থূলতম হিসেবে পরিগণিত। ভারতীয় অন্যান্য দর্শনে অনুমোদিত তত্ত্বগুলির পরিচয় এবং সংখ্যা দর্শন ভেদে বিভিন্ন। চার্বাক দর্শনের বর্ণনা প্রসঙ্গে সেগুলির খুঁটিনাটি বিবরণের প্রয়োজন নেই। সে যাক, এই স্থূল বস্তুজগত ভারতীয় মতে মহাভূতের সমবায়ে গঠিত এবং এ বিষয়ে চার্বাক মতও ভারতীয় সাধারণ ধারণার সমধর্মী বলে হয়। তবে যেটুকু প্রভেদ তাতেই চার্বাকের সাথে অন্যান্য দর্শনগুলির সাথে বিশাল এক মৌলিক ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে। পঞ্চমহাভূত প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে–

‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ : ক্ষিতি বা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ।


‘বৈশেষিকের দৃষ্টিতে ক্ষিতি (মৃত্তিকা), অপ্ (জল), তেজ (আলোও উত্তাপের মূল উৎস), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচটি পঞ্চমহাভূত নামে প্রসিদ্ধ। পঞ্চমহাভূত বৈশেষিক মতে নয়টি দ্রব্যের অন্তর্গত। বৈশেষিক মতে দ্রব্য আর ইংরেজি ম্যাটার এক কথা নয়। ‘দ্রব্য’ শব্দটির অর্থ এর চেয়ে ব্যাপক। কারণ বৈশেষিক মতে আত্মা, মন, কাল এবং দিক দ্রব্যের অন্তর্গত। ‘দ্রব্য’ মানে ইংরেজিতে সাবস্ট্যান্স, অর্থাৎ যার কোনো না কোনো গুণ আছে। বৈশেষিক মতে দ্রব্যও আবার মূল ছয়টি পদার্থের (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সমবায় ও বিশেষ) অন্তর্গত। এখানে পদার্থ মানে ‘রিয়ালিটি’– মৌলিকতম বস্তু অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে। সেজন্য বৈশেষিক দর্শনকে ষট্পদার্থবাদী বলা হয়। নয়টি দ্রব্যের মধ্যে প্রথম চারটি (ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ) সূক্ষ্মতম বস্তুকণা (পরমাণু) দিয়ে গঠিত এবং বস্তুজগতের মূল উপাদান পরমাণু। এজন্য বৈশেষিক দর্শনকে পরমাণুবাদী বলা হয়।’– (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়,চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৭)।

কিন্তু চার্বাক মতে ক্ষিতি, অপ্ তেজ ও মরুৎ এই চারটিই হলো মূল বস্তু যা বিশ্বজগতের উপাদান।  যেমন–

তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : এই চার্বাকমতে পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু– এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।

বার্হস্পত্য-সূত্রেও বলা হয়েছে–

পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি। (বার্হস্পত্যসূত্র-১)
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু– এই চারটিই তত্ত্ব।


চার্বাক-স্বীকৃত এই চার মহাভূতের উপাদানে যে বস্তুজগতের সৃষ্টি, সেই জগতের জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সাক্ষাৎভাবে হওয়া সম্ভব এবং সেইজন্যই চার্বাক দর্শনে এই ভৌতিক জগতের অনুমোদন আছে। অন্যরা এই চার রকম ভূতপদার্থ ছাড়াও আকাশ নামে যে পঞ্চম এক ভূতপদার্থ স্বীকার করার প্রস্তাব করেছেন, কেন করেছেন, সে-কথা বেশ জটিল। সে-প্রসঙ্গ বর্তমান আলোচনার বিবেচ্য নয়। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, চার্বাকেরা আকাশ স্বীকার করেন না, কেননা আকাশের প্রত্যক্ষ হয় না এবং চার্বাকমতে যার প্রত্যক্ষ হয় না তা যথার্থ নয়।
আবার আকাশের জ্ঞান অনুমানের দ্বারা হয়ে থাকে। আমরা শব্দ শুনি। এই শব্দ গুণ বলে কোন দ্রব্যে অবশ্যই থাকবে। এই শব্দ পৃথিবী, জল, তেজের গুণ নয়, কেননা তাদের গুণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন। সেকারণে কোন কোন মতে, আকাশকে শব্দগুণের আশ্রয় দ্রব্য মনে করা হয়। কিন্তু চার্বাক সাধারণভাবে অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না বলে চার্বাকমতে আকাশের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

‘আকাশকে চার্বাকগণ ভূতবৈরল্যের অতিরিক্ত কিছু মনে করেন না। ‘ভূতবৈরল্যে’র অর্থ ভৌতিক কণার বিরলতা। এই কথার তাৎপর্য যেখানে ভৌতিক কণার ঘনীভাব হয় না সেখানে আকাশের প্রতীতি হয় না। আকাশ বিষয়ক দু’টি বস্তুর প্রতীতি হয়। ১. একটি ভৌতিক কণার অভাব, ২. অন্যটি তার বৈরল্য অর্থাৎ তার বিরলতা। প্রথম পক্ষটি সঙ্গত নয়, কেননা ভৌতিক কণার অভাব স্বীকার করা কোনভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। ফলে ভৌতিক কণার বিরলতা স্বীকার করতে হয়। চার্বাকগণের এক সম্প্রদায় অবশ্য অন্যান্য দার্শনিকের মত আকাশকে একটি বিশিষ্ট তত্ত্ব বলে স্বীকার করেন। কিন্তু পণ্ডিতেরা এই মতে আস্থাশীল নন। একারণে চার্বাকের নিজের বিশেষ মত হচ্ছে যে, মূল জগতে চারটি তত্ত্ব বর্তমান, পঞ্চম তত্ত্ব স্বীকার্য নয়। অনুরূপভাবে অন্য দার্শনিকদের স্বীকৃত দিক্, কাল, মন প্রভৃতি পদার্থের স্বতন্ত্র সত্তা চার্বাকগণ স্বীকার করেন না।’– (ড. বিশ্বরূপ সাহা, নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ, পৃষ্ঠা-১৭)।

একইভাবে চার্বাকেরা আত্মা মানেন না। উল্লেখ্য, যেকোন দার্শনিক আলোচনারই একটি উদ্দেশ্য ও  সামাজিক তাৎপর্য থাকে। চার্বাকমত আলোচনার ক্ষেত্রেও আমাদেরকে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্যের সঙ্গে চার্বাকের দার্শনিক চিন্তা সংগতিপূর্ণ। ঈশ্বর, বস্তুনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র চৈতন্য (আত্মা), পরলোক, জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, পারলৌকিক মুক্তি, স্বর্গসুখের আশ্বাস ইত্যাদি কল্পনাবাহুল্যের নিপীড়ন থেকে মানবচেতনাকে ভারমুক্ত করে মানবকেন্দ্রিক ধ্যানধারণা গড়ে তোলাই ছিলো চার্বাকমতের উদ্দেশ্য। অতএব, চার্বাকমতে নিছক ভূপদার্থ দিয়ে গড়া আমাদের দেহ ছাড়া আত্মা বলে আর কিছু মানবার কোনো কারণ নেই।

আমরা ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে অধ্যাত্ম দর্শনগুলিতে আত্মার ধারণা আমদানির ঔপনিষদিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু দর্শনক্ষেত্রে কেবল শ্রুতিপ্রমাণকে সম্বল করে দর্শনতত্ত্ব-প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যেকোন তত্ত্বের পক্ষে একটি দার্শনিক যুক্তির ভিত্তি রচনার প্রয়োজন হয়। আত্মা বা আত্মতত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী?
‘অন্যান্য বস্তুর মতো প্রাণীদেহও ভৌতিক উপাদানে গঠিত এবং সহজেই প্রত্যক্ষযোগ্য। কিন্তু প্রাণী সংজ্ঞায় ভৌতিক প্রাণীদেহ ছাড়া আরও কিছু অভিব্যক্ত হয়, যা প্রাণীজগতের অন্যতম মানুষ হিসাবে ‘আমি’ এই অনুভূতির মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই অনুভব করি। ‘আমি’ এই অনুভূতির বিকাশ সচেতনতা বা চৈতন্যের পটভূমিতে এবং এই সচেতন ‘আমি’কে কেন্দ্র করেই মানুষ বা যে কোন জীবের বৈশিষ্ট্য। এই সচেতন ‘আমি’র নানাভাবে বিচিত্র প্রকাশ দেহের মাধ্যমে, যার ফলে ভৌতিক উপাদানে গঠিত হয়েও জীবদেহ স্বকীয় বিশেষত্বে মণ্ডিত এবং অন্য নানা ভৌতিক বস্তুর সঙ্গে এর প্রভেদ সহজেই বোঝা যায়। এই সচেতন ‘আমি’র নিজস্ব রূপ হিসাবে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে ভৌতিক জীবদেহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক অপর একটি তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করেছে। জীবদেহে নিবদ্ধ এই তত্ত্বের নাম ভারতীয় দর্শনে জীবাত্মা, যা শুদ্ধ আত্মস্বরূপের এক বিশেষ বা সংসারদশায় আবদ্ধ রূপ। এই জীবাত্মা প্রাক্তন কর্মের ভোগ ক্ষয় করার জন্য বিশেষ এক ভৌতিক দেহের আশ্রয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং সেই বিশেষ দেহে যে ভোগ সম্ভব তা সম্পূর্ণ করার পর দেহ ত্যাগ করে চলে যায়। জীবাত্মার এই দেহত্যাগকে আমরা মৃত্যু সংজ্ঞায় অভিহিত করি। প্রাক্তন কর্মের সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই জীবাত্মাকে নূতন নূতন পরিবেশে ভিন্নজাতীয় ভোগের জন্য নূতন নূতন দেহ ধারণ করতে হয় এবং এইভাবে চলতে থাকে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমা।’– (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯০-৯১)।

ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন অনুসারে মৃত্যুর অর্থ জীবদেহের বিনাশ মাত্র, কিন্তু মৃত্যুর মাধ্যমে জীবদেহে অধিষ্ঠিত এই আত্মা বিনষ্ট হয় না। স্থূল দেহের একটি থেকে অপরটির উদ্দেশ্যে তার যাত্রার দীর্ঘ গতিপথে এক বিশেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি মাত্র। স্থূল শরীর থেকে বহির্গত এই আত্মার আশ্রয় তখন সূক্ষ্ম শরীর। উপনিষদীয় ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়া এই সূক্ষ্মশরীরের গঠন সম্পর্কে মতভেদও আছে। পঞ্চতন্মাত্র নামে অভিহিত পঞ্চভূতের সূক্ষ্মভাগ উত্তরকালের সাংখ্যমতে এই শরীরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা’য় বলা হয়েছে–

তন্মাত্রাণ্যবিশেষাস্তেভ্যো ভূতানি পঞ্চ পঞ্চভ্যঃ।
এতে স্মৃতা বিশেষাঃ শান্তা ঘোরাশ্চ মূঢ়াশ্চ।। (সাংখ্যকারিকা-৩৮)
সূক্ষ্মা মাতাপিতৃজাঃ সহ প্রভূতৈস্ত্রিধা বিশেষাঃ স্যুঃ।
সূক্ষ্মাস্তেষাং নিয়তা মাতাপিতৃজা নিবর্ত্তন্তে।। (সাংখ্যকারিকা-৩৯)
অর্থাৎ :
(শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ– এই পাঁচটি) তন্মাত্রকে অবিশেষ (বা সূক্ষ্মভূত) বলে। সেই পাঁচটি (তন্মাত্র) থেকে (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম– এই) পাঁচটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। এই পাঁচটি স্থূলভূত (সত্ত্ব-রজঃ-তমো-গুণাত্মক বলে এদের) সুঃখ, দুঃখ ও মোহ-স্বভাব বলা হয়। (সাংখ্যকারিকা-৩৮)।।   বিশেষ তিন প্রকার (যথা–) সূক্ষ্মশরীর, স্থূলশরীর ও পাঁচটি মহাভূত। এদের মধ্যে সূক্ষ্মশরীর প্রলয়কাল পর্যন্ত (আপেক্ষিক) নিত্য, স্থূলশরীর (কিছুদিন থেকে) নষ্ট হয়। (সাংখ্যকারিকা-৩৯)।।


কিন্তু প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যা ধরা পড়ে সেই পাঁচ বা চার স্থূল মহাভূতের যে এক্ষেত্রে কোনই অবদান নেই সে সম্বন্ধে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদীরা সকলে একমত। তাঁদের উপনিষদীয় ধারণা মতে, স্থূল শরীরের বন্ধন ছিন্ন হলেই জীবাত্মার মুক্তি হয় না; প্রাক্তন কর্মের সংস্কারের বশে সূক্ষ্ম দেহে সে আবদ্ধ থাকে তার নিজস্ব মন, বুদ্ধি এবং পূর্বজন্মার্জিত কর্মের সঞ্চয় ইত্যাদির সঙ্গে। এই সূক্ষ্মদেহধারী জীব (আত্মা) আবার নতুন পরিবেশে নতুন স্থূল দেহে তার আবাস রচনা করে। জীবাত্মার এই পথ-পরিক্রমার অবসান হয় মুক্তির মাধ্যমে যখন ছিন্নবন্ধন এই আত্মা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে শুদ্ধ আত্মস্বরূপে বিলীন হয়।

কিন্তু দেহাতিরিক্ত এই আত্মার অনুমোদন চার্বাক দর্শনে নেই। চার্বাকমতে মানুষের মৃত্যু তাই ‘দেহত্যাগ’ নয়, দেহাবসানের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ সত্তারই অবসান। যেমন–

‘তেষু বিনষ্টেসু সৎসু স্বয়ং বিনশ্যতি।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) দেহের সংগঠক সেই চারটি ভূত বিনষ্ট হলে সেই চৈতন্যও স্বয়ংই বিনষ্ট হয়।

এবং ‘চার্বাকষষ্ঠি’র লোকগাথায়ও বলা হয়েছে, যা মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তেও উদ্ধৃত হয়েছে–

‘ভস্মীভূতস্য ভূতস্য পুনরাগমনং কুতঃ।’- (চার্বাকষষ্ঠি-৩৩)
অর্থাৎ : ভস্মীভূত জীব বা দেহের পুনরাগমন কোন কারণেই হতে পারে না।


চার্বাকেরা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য মহাভূতের উপাদানে গঠিত দেহকেই আত্মা বলেন। যে সচেতন ‘আমি’কে কেন্দ্র করে আত্মস্বরূপের প্রকাশ, সেই ‘আমি’ চার্বাক মতে দেহের সঙ্গে অভিন্ন। যেমন–

‘তচ্চৈতন্য-বিশিষ্ট-দেহ এব আত্মা, দেহাতিরিক্তে আত্মনি প্রমাণাভাবাৎ।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) চৈতন্য-বিশিষ্ট দেহই আত্মা। দেহ-ভিন্ন আত্মাতে প্রমাণ নাই।
.
‘ভূতচতুষ্টয়ং চৈতন্যভূমিঃ’। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮৩)
অর্থাৎ : (লোকায়তমতে) চারটি ভূতই চৈতন্যের উৎস-ভূমি।


অধ্যাত্মবাদীদের দৃষ্টিতে সচেতন ‘আমি’র নিজস্ব রূপ হিসাবে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে ভৌতিক জীবদেহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক যে তত্ত্বকে ‘আত্মা’ বলে প্রচার করা হয়েছে, চার্বাকদের বর্ণনায় এই ‘আমি’ তার প্রকৃত অর্থে প্রকাশমান ‘আমি গৌরবর্ণ’ ‘আমি স্থূল’ ইত্যাদি বাক্যে, যেখানে দেহের বিভিন্ন গুণ ‘আমি’ সংজ্ঞায় অভিহিত আত্মাকে আরোপ করা হয়। এই ‘আমি’ শব্দই ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত ‘আমার দেহ’ ইত্যাদি বাক্যাংশে, যেখানে ‘আমি’ দেহ থেকে পৃথক। চার্বাক মত অনুসারে এই বাক্যাংশগুলি ঔপচারিক, অর্থাৎ ‘আমি’ এ-সব ক্ষেত্রে তার প্রকৃত অর্থে প্রযুক্ত হয় না। এ-প্রসঙ্গে মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ চার্বাকমত বর্ণনায় বলছেন–

‘অহং স্থূলঃ কৃশোহস্মীতি সামানাধিকরণ্যতঃ।
দেহ-স্থৌল্যাদি-যোগাচ্চ স এবাত্মা ন চাপরঃ।
মম দেহোহয়মিত্যুক্তিঃ সংভবেদৌপচারিকী।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) আমি স্থূল ও কৃশ হচ্ছি– এইরূপ সামানাধিকরণ্য বা অভেদের প্রত্যক্ষবশত এবং দেহে স্থূলতা কৃশতার সম্বন্ধবশত দেহই আত্মা বলে সিদ্ধ হয়। দেহের অতিরিক্ত অপর কোন আত্মার সিদ্ধি হয় না। কারণ তার প্রত্যক্ষ হয় না। যার প্রত্যক্ষ হয় না, তার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না। ‘আমার দেহ’ ইত্যাদি বাক্যাংশে উক্ত ‘আমি’ ঔপচারিক ব্যবহার-প্রযুক্ত।


শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে লোকায়ত মতের প্রতিভূ হিসেবে প্রাসঙ্গিক লোকগাথার উদ্ধৃতি রয়েছে–

‘স্থূলোহহং তরুণো বৃদ্ধো যুবেত্যাদিবিশেষণৈঃ।
বিশিষ্টো দেহ এবাত্মা ন ততোহন্যো বিলক্ষণঃ।।’- (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৬)।।
অর্থাৎ : আমি স্থূল, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ইত্যাদি বাক্যে স্থূল প্রভৃতি বিশেষণের দ্বারা দেহই বিশেষিত হয়ে থাকে। দেহ থেকে ভিন্ন অন্য কোন আত্মা নামক পদার্থ ঐ বিশেষণের বিশেষ্য হয় না।


এ-বিষয়টি আরো সহজভাবে বুঝতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য–
‘চলতি কথায় আমরা অবশ্য বলি “আমার দেহ”। অর্থাৎ, যেন “আমি” এক এবং দেহটি আলাদা কিছু। এবং “আমি” বা “আমার” বলতে যা উল্লেখ করছি– তাই-ই যেন ওই “দেহ”র মালিক। এ-হেন মালিক আত্মা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? চার্বাকমতে এ-হেন যুক্তি ধোপে টেকে না। “আমার দেহ” নেহাতই কথার কথা; ভারতীয় পরিভাষায় তাকে বলে উপচার। কিন্তু এ-হেন ঔপচারিক ব্যবহার থেকে “আমি” আর “দেহ”-র মধ্যে তফাৎ করতে যাওয়াটা অবান্তর হবে। কথার কথা হিসেবে তো অনেক সময় “রাহুর মাথা”-ও বলা হয়। তাই বলে কি স্বীকার করতে হবে যে “রাহু” এক, এবং তার “মাথা” বলতে অন্য কিছু। রাহুর কথা তো পুরাণকারদের কাছে শোনা এবং তাঁদেরই মতে, ওই মাথাই রাহুর সর্বস্ব; মাথাটির মালিক হিসেবে রাহু বলে স্বতন্ত্র কারুর কল্পনা একান্তই অবান্তর। তাই অত সহজে– কথার কথা-র নজির দেখিয়ে– দেহ ছাড়াও আত্মা বলে কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না, বা দেহাত্মবাদ খণ্ডন করা সম্ভব নয়। বরং, যাঁরা স্বতন্ত্র আত্মা মানেন তাঁদেরই বিপদে পড়ার ভয় আছে। যেমন, আমরা তো হামেশাই বলে থাকি, ‘আমি রোগা’, ‘আমি কালো’, ‘আমি ফর্সা’। এ-জাতীয় ক্ষেত্রে ‘আমি’ বলতে দেহ ছাড়া আর কি বোঝা যেতে পারে? কালোই বলুন আর ফর্সাই বলুন, রোগাই বলুন আর মোটাই বলুন– এ সবই দেহধর্ম বা দেহের গুণ। এ-জাতীয় দৃষ্টান্তেও আত্মাবাদীরা– অর্থাৎ, আত্মায় বিশ্বাসীরা– ‘আমি’ বলতে কি আত্মা বোঝাবেন? তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা তামাশার মতো শোনাবে : আত্মাটি মোটা বা রোগা, কালো বা ফর্সা– এ-জাতীয় কথা মানতে হবে।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৩)

এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ আরো বলেন যে, অবশ্যই লৌকিক ভাষা-ব্যবহারের নজির থেকে কোনো মতের দার্শনিক মূল্যায়ন হয় না। দেহাত্মবাদেরও নয়। তার প্রকৃত মূল্যায়নের জন্য দার্শনিক বিচারের অবতারণা প্রয়োজন। দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি মূলত চারটি বিষয়ের প্রস্তাব করেন–
১। দেহাত্মবাদের সমর্থনে চার্বাকদের পক্ষে কোন্ ধরনের নজির দেখানো সম্ভব?
২। দেহাত্মবাদ খণ্ডনে বিপক্ষ দার্শনিকরা কী যুক্তি প্রস্তাব করেন?
৩। এজাতীয় যুক্তি দিয়ে দেহাত্মবাদ কি সত্যিই নস্যাৎ হয়?
৪। সাধারণভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের প্রকৃত তাৎপর্য কী?

এই প্রস্তাবনা আলোচ্য বিষয়ের যথাযথ পর্যালোচনায় আমাদের সহায়ক হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাবটিই সবচেয়ে কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি চার্বাকমত পুনর্গঠন তথা রূপরেখা তৈরির পক্ষে আজকের দিনে আমাদের আসল সম্বল বলতে খুবই সামান্য। তাই ‘দেহাত্মবাদের সমর্থন’ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদই বলছেন, এক্ষেত্রে আমাদের আসল সম্বল বলতে–
‘অর্থশাস্ত্র’ জাতীয় প্রাচীন পুঁথিপত্রের নজির ছাড়া কিছু প্রামাণিক লোকগাথা এবং পূর্বপক্ষ হিসাবে বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু রচনা। কিন্তু পূর্বপক্ষ হিসাবে বর্ণনার উপর নির্বিচারে নির্ভর করা নিরাপদ নয়। খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বর্ণিত কোনো মত সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ না-হবারই সম্ভাবনা; পক্ষান্তরে কিছুটা কারসাজিই থাকতে পারে। অর্থাৎ, পূর্বপক্ষ বর্ণনায় এমন যুক্তি বা বিচার গুঁজে দেবার প্রবণতা অসম্ভব নয়, যার অন্তঃসারশূন্যতা দেখানো তুলনায় সহজ হয়। অবশ্যই ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায় পরস্পরকে খণ্ডন করতে চেয়েছে, অতএব পূর্বপক্ষ হিসেবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের উল্লেখও করেছে। তবে ন্যায়-বৈশেষিক, বেদান্ত, পূর্বমীমাংসা, জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কথা আলাদা; এগুলির সমর্থনে রচিত নানা গ্রন্থ বর্তমান। পূর্বপক্ষ হিসাবে এগুলির বর্ণনায় কারসাজির কোনো চেষ্টা থাকলেও তা সনাক্ত করা কঠিন নয়। কিন্তু চার্বাকদের নিজস্ব রচনা এককালে যে বর্তমান ছিল– সে-বিষয়ে মোটের উপর সুনিশ্চিত নজির থাকলেও, বাস্তব পরিস্থিতিটা এই যে, যে-কোনো কারণেই হোক-না-কেন, আজ তা বিলুপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সম্প্রতিকালে প্রকাশিত জয়রাশিভট্টর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বলে বইটি নিয়ে অবশ্যই বেশ কিছুটা শোরগোল পড়েছিল। কেননা এর সম্পাদকেরা মনে করেছিলেন প্রসিদ্ধ চার্বাক সম্প্রদায়ের গ্রন্থ না-হলেও কোনো-এক-কালে কোনো-এক-দেশে কোনো একরকম “সর্বপ্রমাণ-বিরোধী” চার্বাক সম্প্রদায় সম্ভবত বর্তমান ছিল; এই গ্রন্থে তারই মত বিবৃত হয়েছে। কিন্তু বইটা নিয়ে শোরগোল আজকাল প্রায়াংশেই স্তিমিত। অগ্রণী বিদ্বানদের বস্তুনিষ্ঠ বিচারে প্রমাণ হয়েছে চার্বাকমতের সঙ্গে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-র সম্পর্ক মোটের উপর কল্পিতই : বইটিতে আসলে একরকম চরম সংশয়বাদেরই পরিচয়– অনেকটা শ্রীহর্ষর ‘খন্ডনখন্ডখাদ্য’র মতোই, যদিও স্বয়ং শ্রীহর্ষ সর্বপ্রমাণ খণ্ডন করে অদ্বৈত-বেদান্ত দর্শনের সমর্থন করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার তাৎপর্য যাই হোক-না-কেন, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এই যে চার্বাকমতের সমর্থনে রচিত কোনো বই-এর অভাবে পূর্বপক্ষ হিসাবে বিরুদ্ধ দার্শনিকদের রচনায় কম-বেশি কারসাজি থাকলেও তা সনাক্ত করা সহজ নয়। এই প্রসঙ্গে আমাদের প্রধান অবলম্বন বলতে বোধহয় চার্বাকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি : আলোচ্য পূর্বপক্ষের সঙ্গে প্রামাণিক লোকগাথাগুলির যতটা সঙ্গতি অন্তত ততটা পর্যন্ত ওই পূর্বপক্ষ-বর্ণনার যাথার্থ্য স্বীকার করায় বাধা নেই। তাছাড়া আরো একটা ভাববার মতো কথা আছে : সমস্ত বিরুদ্ধ দার্শনিকদের রচনায় দেহাত্মবাদের সমর্থনে বর্ণিত যুক্তিতর্ক সমান নয়। নানা দার্শনিক দেহাত্মবাদের বর্ণনায় নানা রকম যুক্তিতর্কের– এমনকি রকমারি কূটতর্কের– অবতারণা করেছেন। এদিক থেকেও ভেবে দেখার সুযোগ আছে কোন্ যুক্তি চার্বাকদের প্রকৃত অভিপ্রায় হবার সম্ভাবনা আর কোন্ যুক্তি বিরুদ্ধ কল্পনায় অনুপ্রাণিত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৪)

এদিকে দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে প্রদত্ত গুটিকয় নমুনা-দৃষ্টান্ত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যে সচেতন ক্রিয়াকলাপ আত্মগত বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক, চার্বাকেরা তার উৎপত্তির ক্ষেত্র হিসেবে দেহকে নির্দেশ করে থাকেন। আত্মাকে দেহের গণ্ডির মধ্যে সীমিত রাখার মূলে কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ-অতিরিক্ত প্রমাণে চার্বাকদের স্বীকৃতি নেই; কারণ, যে আত্মা দেহতে আশ্রিত নয়, সেই বিদেহ চৈতন্য প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ধরা পড়ে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থাকার জন্য স্বপক্ষ সমর্থনে অবশ্য যুক্তির সহায়তায় পূর্বপক্ষ হিসেবে আসরে অবতীর্ণ হতে হয়েছে প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থে। কাজেই চার্বাকী নীতি বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমানের বিরোধী হলেও এবং স্থূল দেহের অতিরিক্ত আত্মাকে অস্বীকার করার মূল এই নীতিতে নিহিত থাকলেও চার্বাকপক্ষের আশ্রয় এক্ষেত্রে যুক্তিভিত্তিক অনুমান। আর চার্বাকেতর অধ্যাত্মবাদী মতবাদের প্রধান ভিত্তিই যেহেতু আত্মা বা আত্মতত্ত্ব, অতএব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই চার্বাকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে তাঁদের দ্বিধা করার কোন অবকাশ নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের বিভিন্ন শাখাও তাদের আত্ম-সম্বন্ধীয় ধারণার সমর্থনে যুক্তিকে বহুক্ষেত্রে টেনে এনেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিচারে তাঁদের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণার মূল আপ্তবাক্য। কাজেই অনুমানকে যখন তাঁরা প্রমাণের আসনে বসান, তখন তা সব সময়ে সহজগ্রাহ্য হয় না, এবং কষ্টকল্পিত তাঁদের এই যুক্তিগুলিতে প্রচুর ত্রুটিও থেকে যায় বলে আধুনিক বিদ্বানেরা মনে করেন। আর তর্কের আসরে নেমে বিরোধীপক্ষকে পরাভূত করার ক্ষেত্রে এই ত্রুটির সুযোগ নিতে চার্বাকেরা ইতস্ততঃ করবেন বলে মনে হয় না। কেননা, ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রমাণের জগৎ থেকে লৌকিক ব্যবহার-বহির্ভূত অনুমানকে বহিষ্কৃত করার মূলে যে ভাবনা চার্বাকদের মধ্যে সাধারণভাবে কার্যকরি তা হলে আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদির ধারণার ক্ষেত্রে অনুমানের কোন উপযোগিতা নেই। এইভাবে আত্মপ্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দর্শনের আসরে এক বিরাট তর্কযুদ্ধের সূচনা হয়। চার্বাকী দেহাত্মবাদের বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে এই তর্কযুদ্ধেরই আলোচনা; এবং বহুক্ষেত্রে তা নীরস হলেও বর্তমান প্রসঙ্গে এর প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।

‘এই তর্কযুদ্ধে চার্বাকের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে দুভাগে ভাগ করা যায়– প্রথম, স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাসী অধ্যাত্মদর্শনের বিভিন্ন শাখা; দ্বিতীয়, বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়, যাঁদের ধারণায় স্থায়ী আত্মার স্থান অধিকার করেছে সচেতন অনুভূতির পরস্পরাবদ্ধ প্রবাহ। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্য বা বিজ্ঞানকে দেহাতিরিক্ত মর্যাদা দিয়ে বৌদ্ধ দর্শন আত্মাবাদী দর্শনগুলির সঙ্গে একইভাবে চার্বাকী দেহাত্মবাদের বিরোধিতা করেছে এবং জন্মান্তরবাদ, কর্মফল, পরলোক ইত্যাদি বিষয়ের ধারণাতে এই দর্শন আত্মবাদী দর্শনগুলির সমগোত্রীয়। আত্মবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে চার্বাকী তর্কযুদ্ধের পরিচয় পাওয়া যায় সাংখ্য, ন্যায়, জৈন, বেদান্ত ইত্যাদি দর্শনের আচার্যদের রচিত পুস্তকে। বৌদ্ধ দার্শনিকদের সঙ্গে চার্বাকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিবরণ সংগৃহীত হয় প্রধানতঃ শান্তরক্ষিত এবং কমলশীল প্রণীত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে। বস্তুতঃ উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় চার্বাক দর্শন প্রসঙ্গে যে আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন, দেহাত্মবাদ সম্বন্ধীয় চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গীর রূপায়ণে তা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতে সমর্থ।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯৩)

এছাড়া, ‘জৈন দার্শনিক হরিভদ্রর ব্যাখ্যাকার– বিশেষত গুণরত্নে– দেহাত্মবাদ নিয়ে পাতার পর পাতা লিখেছেন; প্রভাচন্দ্র নামে অপর এক জৈন মহাতার্কিক তাঁর ‘ন্যায়কুমুদচন্দ্র’ এবং ‘প্রমেয়কমলমার্তণ্ড’ বলে বইতে দেহাত্মবাদের বিচারে বিস্তর বাগবিস্তার করেছেন। আরো অনেকেই করেছেন এবং তাঁদের রচনায় তর্কবিতর্কের মারপ্যাঁচ বোঝা সহজসাধ্য নয়। লোকায়তর অর্থ যদি হয় ‘লোকেষু আয়ত’ বা জনাসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত, তাহলে সহজেই সংশয় হবে, চার্বাক বা লোকায়তিকেরা সত্যিই অতশতর ধার ধারতেন কি না!’
‘কিন্তু শঙ্করের লেখা একেবারে অন্য রকম। এমন সহজ সরল ভাষায় তিনি লোকায়তিকদের দাবিটা বর্ণনা করেছেন যে, সাধারণ পাঠক অল্প আয়াসেই তা বুঝতে পারেন। আরো কথা আছে।… শঙ্করের দেহাত্মবাদ বর্ণনার সঙ্গে লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথারও অন্তত অনেকাংশেই মিল হয়। অবশ্যই এমন কথা জোর গলায় বলা যায় না যে শঙ্করের দেহাত্মবাদ বর্ণনায় একেবারেই কোনোরকম কারসাজি নেই। কিন্তু যদিই বা থাকে তাহলেও তিনি সেটা সহজ ভাষায় দেহাত্মবাদীদের বক্তব্যের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন যে তা সনাক্ত করা সহজসাধ্য নয়।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৫-৭৬)

। শঙ্করাচার্য-বর্ণিত চার্বাকী দেহাত্মবাদ।

অদ্বৈত-বেদান্তের প্রবর্তক শঙ্করাচার্যের নিজস্ব মতের সম্পূর্ণ বিপরীত বলতে ভারতীয় দর্শনে যদি কিছু থাকে তা হলো এই দেহাত্মবাদ। কেননা, চার্বাকমতে দেহই সত্য, আত্মা বলে কিছু নেই; অন্যদিকে শঙ্কর-মতে আত্মাই একমাত্র সত্য, তথাকথিত দেহ বলে বস্তুটি অজ্ঞানের ঘোরে সাময়িক কল্পনামাত্র। তবুও বিদ্বান গবেষকদের মতে শঙ্করের বর্ণনার আকর্ষণীয় দিকটি হলো, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে শঙ্করের মতো সহজ-সরল গদ্য রচনার নমুনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আলঙ্কারিকদের ভাষায়, শঙ্করের লেখা প্রসাদগুণে অুুলনীয়। অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করলে শঙ্করের বর্ণনায় সে-তুলনায়  কূটতর্কেল বিশেষ বালাই নেই, কেননা শঙ্কর যুক্তিতর্কেরই বড় একটা ধার ধারতেন না। তাঁর নিজের দাবি অনুসারে মায়াবাদ বা অদ্বৈত-বেদান্তের আসল খুঁটি হলো শাস্ত্র বা শ্রুতি-স্মৃতি। শ্রুতি-স্মৃতির উপর নির্ভর না করে স্বাধীন যুক্তিতর্কের প্রতি যে কোনো প্রবণতাই অজ্ঞানের কুহেলিকায় দিশেহারা হতে বাধ্য। তবে নেহাতই নিকৃষ্ট পরমত খণ্ডনের জন্য– বা পাঠক-সাধারণের মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে– যুক্তি-তর্কের গৌণ মূল্য থাকতে পারে। এই কারণে তিনি তুলনায় সীমিত অর্থে তর্কবিতর্কেরও পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তাঁর রচনায় দেহাত্মবাদের বর্ণনাও যেমন সহজ সরল, দেহাত্মবাদের খণ্ডনও তেমনি সাদামাটা।


শঙ্করাচার্য চার্বাকী দেহাত্মবাদ বর্ণনার ক্ষেত্রে অন্যান্য নানা অবান্তর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দেহাত্মবাদ নিয়ে যেটা প্রধান বিতর্ক সরাসরি তারই আলোচনা তুলেছেন। কিসের বিতর্ক? দেহাত্মবাদীর মতে দেহগঠনের মূল উপাদান বলতে আগুন, বাতাস, জল ও মাটি। ভূতপদার্থই। কিন্তু এই উপাদানগুলির মধ্যে কোথাও চেতনা বা চৈতন্যের পরিচয় নেই। এগুলির সবই নিছক অচেতন; জড়পদার্থ। অথচ, মানুষ প্রভৃতির দৃষ্টান্তে সুস্পষ্টভাবেই চেতনার পরিচয়। এবং এই চৈতন্যের সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণ হয় যে মানবাদির ক্ষেত্রে আত্মা বলে অতিরিক্ত কিছু মানা দরকার, কেননা আত্মাই চেতনপদার্থ বা চৈতন্যবিশিষ্ট। দেহাত্মবাদ নিয়ে অন্যান্য দার্শনিকেরাও যত তর্ক তুলুন না কেন, শেষ পর্যন্ত সবকিছুই এই চৈতন্য বা চেতনার নজিরটির উপর প্রতিষ্ঠিত। চার্বাকেরা এ বিষয়ে কী উত্তর দেবেন?

দেহাত্মবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় হিসেবে শঙ্কর বলছেন–

‘দেহমাত্রং চৈতন্যবিশিষ্টমাত্মেতি প্রাকৃতা জনা লোকায়তিকাশ্চ প্রতিপন্না’। (শাঙ্করভাষ্য-১/১/১)
অর্থাৎ : অশিক্ষিত বা ইতর জনগণ এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্য-বিশিষ্ট দেহমাত্রকে আত্মা বলে মনে করে।


তার মানে লোকায়তমতে চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। কিন্তু নিছক অচেতন বা জড় বস্তু দিয়ে গড়া এই দেহই কী করে চৈতন্যবিশিষ্ট বা চৈতন্যগুণযুক্ত হতে পারে? একই গ্রন্থের অন্যত্র শঙ্কর লোকায়তমতের বর্ণনায় এই প্রশ্নের তুলনায় বিশদ উত্তর দিয়েছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের স্বাধীন তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। শঙ্কর বলছেন–

‘অত্রৈকে দেহমাত্রাত্মদর্শিনো লোকায়তিকা…… তেভ্যশ্চৈতন্যং মদশক্তিবৎ বিজ্ঞানং …।’- (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫৩)
দেবীপ্রসাদ-কৃত তর্জমা :
‘লোকায়তিকেরা বলে আত্মা বলে কিছুই নেই; নিছক দেহকেই তারা আত্মা বলে বোঝে। তাদের মতে পৃথিবী বাহ্য ভূতবস্তুগুলিতে স্বতন্ত্রভাবে এবং এমনকি মিলিতভাবেও চৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু এই পৃথিবী প্রভৃতি ভূতবস্তুগুলিই শরীরাকারে পরিণত হলে তাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। অতএব জ্ঞান বা চৈতন্য (ভারতীয় পরিভাষায় ‘বিজ্ঞান’) মদশক্তির মতো। অর্থাৎ, মদ তৈরি করার জন্য কিণ্ব– খামির বা গাঁজ– প্রভৃতি বস্তু ব্যবহার করা হয়। এগুলির কোনটিতেই মদশক্তির পরিচয় নেই : সোজা কথায়, এগুলির কোনোটি খেলেই নেশা হয় না। কিন্তু এগুলি দিয়েই মদ তৈরি করলে– বা এগুলিই মদিরাকারে পরিণত হলে– তাতে মদশক্তির উদ্ভব হয় বা এগুলি দিয়ে তৈরি মদ গিললে নেশা হয়। এইভাবেই পৃথিবী প্রভৃতি বস্তুগুলিই দেহ আকারে পরিণত হলে– অর্থাৎ এগুলি থেকেই দেহ তৈরি হলে– সেই দেহে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। তাই ওরা– লোকায়তিকেরা– বলে মানুষ বলতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব স্বর্গগমন বা মোক্ষলাভে সমর্থ আত্মা নেহাতই কাল্পনিক। এমনতর কথা বলা যাবে না যে দেহের মধ্যে আত্মা বলে আলাদা কিছু আছে বলেই দেহে চৈতন্যের পরিচয়। লোকায়তমতে দেহই সচেতন, বা– আত্মা বলে কোনো কিছুর কথা যদি বলতেই চাও, তাহলে– ওই দেহকেই আত্মা বলো। এই মতের সমর্থনে সূত্র আছে : ‘শরীরে ভাবাৎ’। অর্থাৎ, যা বর্তমান থাকলে অপরকিছু বর্তমান থাকে, এবং যার অবর্তমানতায় সেই অপরকিছুও অবর্তমান হয়, সেই অপরকিছুকে তাই ধর্ম বলতে হবে। যেমন অগ্নির ধর্ম উষ্ণতা ও প্রকাশ : আগুন থাকলে তাপ ও আলো থাকে, আগুন না-থাকলে তাপ ও আলো থাকে না; অতএব তাপ ও আলো আগুনেরই ধর্ম। আত্মবাদীরা– অর্থাৎ যাঁরা দেহ ছাড়াও আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু মানতে চান, তাঁরা– প্রাণ, চৈতন্য, স্মৃতি প্রভৃতিকে ওই আত্মার ধর্ম বা গুণ বলে কল্পনা করেন। কিন্তু এসবই দেহতেই উপলব্ধ হয়, দেহ ছাড়া আর কোথাওই উপলব্ধ হয় না। তাই দেহ ছাড়া– বা দেহ-আত্মা বলে এমন কিছু মানা যায় না যার ধর্ম বা গুণ বলতে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি প্রভৃতিকে স্বীকার করার সুযোগ আছে। দেহের বর্তমানতায় বর্তমান এবং অবর্তমানতায় অবর্তমান বলে এগুলিকে দেহধর্ম বলেই মানতে হবে। এই অর্থে দেহই আত্মা।’ (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৬-৭৭)


সত্যি বলতে কি, দেহাত্মবাদের এরকম সাদামাটা প্রাঞ্জল বর্ণনা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে সত্যিই দুর্লভ। যদিও, এই প্রসঙ্গে লোকায়তিক সূত্র হিসেবে শঙ্কর ‘শরীরে ভাবাৎ’ বলে যে কথা উদ্ধৃত করেছেন তা তিনি কোথা থেকে পেলেন জানা নেই। তবে এটুকু বোঝা কঠিন নয় যে সূত্রটির তাৎপর্যের সঙ্গে দেহাত্মবাদের মিল হয়। চার্বাকদের লোকায়তসূত্র নামে প্রচলিত বার্হস্পত্যসূত্র, চার্বাকষষ্ঠি কিংবা প্রচলিত চার্বাকী লোকগাথাগুলিতে শঙ্কর-উদ্ধৃত সূত্রটি কোথাও দেখা যায় না। ‘যদি এমন হয় যে লোকায়তমতের প্রকৃত তাৎপর্য দার্শনিক পরিভাষায় বোঝাতে গিয়ে শঙ্কর এ-হেন একটি সূত্র নিজেই জুড়ে দিয়েছেন, তাহলে বলতেই হবে, শঙ্কর দেহাত্মবাদী চার্বাকদের হাতে কঠিন এক অন্ত্র তুলে দিয়েছে যা তাঁর নিজস্ব অদ্বৈতমতের জন্যেই নিজের বিপদ নিজে টেনে এনেছেন।‘

সে যাক্, শঙ্করের ভাষ্যে এখানে প্রধানত উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, অচেতন জড় মহাভূতের উপাদানে গঠিত দেহকে চৈতন্যের আবির্ভাবের ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকার করার সময় চার্বাকেরা স্বীয় ধারণার সম্ভাব্য অসঙ্গতি দূর করার প্রচেষ্টায় যে লোকায়তিক দৃষ্টান্তের আশ্রয় নিয়েছেন সেটি হলো– মদশক্তিবৎ।
সুরা বা মদের উপাদান হিসেবে যে বিশেষ ধরনের বৃক্ষনির্যাসের ব্যবহার, তা মূলতঃ মাদকতাবিহীন হলেও পরে তাতে মাদকশক্তির উদ্ভব হয় এবং সেটা সুরা বা মদে পরিণতি লাভ করে; অনুরূপভাবে স্থূল মহাভূত যদিও প্রকৃতিগতভাবে চৈতন্যবর্জিত, তাহলেও দেহরূপে পরিণত হবার পর এই স্থূলভূতে চৈতন্যের বিকাশ দেখা যায়। চার্বাকী দেহাত্মবাদ বর্ণনায় প্রায় সকল সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরাই এই মদশক্তির উপমা ব্যবহার করেছেন। জৈন দার্শনিক হরিভদ্রসূরি তাঁর ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ে’ বলেছেন–

‘মদশক্তিঃ সুরাঙ্গেভ্যো যদ্বৎ তদ্বৎ স্থিতম্ আত্মতা’। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮৪)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) মাদকতাবিহীন উপাদানের পরিণাম যেরূপ মদশক্তি, সেইরূপ স্থূলভূতের দেহরূপে পরিণত হবার পর চৈতন্যের বিকাশ হয়।


চার্বাকী দেহাত্মবাদে এই উপমা ব্যবহারের ইঙ্গিত বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়–

‘তস্মাদ্ভূতবিশেষেভ্যো যথা শুক্তসুরাদিকম, তেভ্য এব তথা জ্ঞানং জায়তে ব্যজ্যতেহথবা’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৫৮)
অর্থাৎ : (লোকায়তিকমতে) শুক্তসুরাদির মতোই চৈতন্যবর্জিত স্থূল মহাভূত দেহরূপে পরিণত হবার পর স্থূলভূতে জ্ঞান বা চৈতন্যের জন্ম হয়।

‘ন্যায়মঞ্জরী’তে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টও বলেন–

‘উক্তং চ, মদশক্তিবৎ বিজ্ঞানমিতি’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) তারা বলেন জ্ঞান বা চৈতন্য মদশক্তির মতো।


জয়ন্তভট্ট অবশ্য আরেকটু বিশদ করেই বলেছেন। লতিকা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৯৪) বলছেন–
‘ন্যায়মঞ্জরী’-তে চার্বাক ব্যবহৃত এই দৃষ্টান্তের বিবরণ এইভাবে দেওয়া হয়েছে– গুড়, পিষ্ট ইত্যাদি পদার্থ প্রাথমিক অবস্থায় মদশক্তিবিহীন হলেও সুরার আকারে পরিণত এই বস্তুগুলিতে বিশেষ এই মদশক্তির যে ভাবে প্রকাশ, ঠিক সেইভাবে আদিতে চৈতন্যবর্জিত মৃত্তিকাদি চতুর্ভূত শরীরাকারে রূপান্তরিত অবস্থায় চৈতন্যরূপ বিশেষ শক্তির দ্বারা যুক্ত হয়। এই বিশেষ শক্তির প্রকাশ ভূতাত্মক দেহে কিছুকাল থাকে, যে সময়ে স্মৃতি, অনুসন্ধান ইত্যাদি সচেতন ব্যবহারের অভিব্যক্তি এই দেহে দেখা যায়। কালবসানে ব্যাধি ইত্যাদির দ্বারা এই শক্তি বিনষ্ট হলে দেহ পুনরায় অচেতন রূপ পরিগ্রহ করে। (‘জ্ঞানাদি যোগস্তু ভূতানামেব পরিণাম বিশেষোপপাদিতশক্ত্যতিশয়জুষাং………ভবিষ্যন্তীতি’, ব্যাস, ২,৩)।’

তবে, নানা রকম উপকরণ মিশ্রিত তাম্বুল বা পানে যেমন উপকরণগুলির প্রত্যেকটির রঙ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রক্তবর্ণের উৎপত্তি, জড় মহাভূত থেকেও সেইভাবে ভিন্নধর্মী চৈতন্যের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা যায়– এধরনের উপমা-যুক্ত চার্বাকমতের প্রামাণিক একটি লোকায়তিক উদ্ধৃতি শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে রয়েছে–

‘জড়ভূতবিকারেষু চৈতন্যং যত্তু দৃশ্যতে।
তাম্বুলপূগচূর্ণানাং যোগাদ্রাগ ইবোত্থিতম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৭)।।
অর্থাৎ : (লোকায়তমতে) জড় ভূতের বিকাররূপ শরীরাদিতে যে চৈতন্য দৃষ্ট হয়, তা পান, সুপারি এবং চূণ সংযোগে রক্তিমার ন্যায়– সংযোগজন্য।


কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে চার্বাকী সাহিত্যে এই তাম্বুলপূগচূর্ণ-এর চেয়ে প্রথমটির অর্থাৎ মদশক্তিবৎ-এর প্রচলন বোধ হয় ব্যাপকতর, কারণ চার্বাক সিদ্ধান্তের আলোচনা বা সমালোচনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনার মধ্যে প্রচুর উল্লেখ রয়েছে– মদশক্তিবৎ। মদ্য প্রস্তুতের নানা উপকরণ। স্বতন্ত্র কিংবা মিলিত অবস্থায় (অর্থাৎ একসঙ্গে জড়ো করে দিলেও) এগুলির মধ্যে মদশক্তির বা নেশা ধরানোর সামর্থ্য থাকে না। অথচ, এগুলিই কোনো এক রকম ‘বিশেষ পরিণামে’র ফলে মদ তৈরি হলে সেই মদে নেশা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ‘বিশেষ পরিণাম’ শব্দটি অবশ্য শঙ্কর ব্যবহার করেননি। কিন্তু জয়ন্তভট্ট করেছেন এবং তা করে শঙ্করের অভীষ্ট বক্তব্য আরো প্রাঞ্জল করেছেন। কেননা, মদ তৈরির উপকরণগুলি যে-কোনো ভাবে একজায়গায় জড়ো করলেই মদ পাওয়া যায় না; অথচ এগুলিকেই কোনো এক বিশেষ পদ্ধতিতে পরিবর্তন করলে মদ তৈরি হয়। এই ঘটনার নজির দেখিয়ে লোকায়তিকেরাও বলবেন, আগুন, বাতাস, জল আর মাটি যেমন তেমন করে একত্র জড়ো করলেই চৈতন্যবিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয় না, কিন্তু এগুলিরই কোনো-এক-রকম বিশেষ পরিণামের ফলে প্রাণ-চেষ্টা-চৈতন্য-স্মৃতি বিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয়। এটিই চার্বাকী দেহাত্মবাদের মূল কথা; চার্বাকমতের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত প্রামাণিক লোকগাথাগুলি এই সাক্ষ্যই দেয়। এক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের সমর্থনে কয়েকটি প্রামাণিক লোকগাথার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের শুরুতেই– ‘চার্বাক-দর্শন’ নামে প্রথম পরিচ্ছেদেই– অনেকগুলি লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন, যা আমরা ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে উপস্থাপন করেছি। তার মধ্যে বর্তমান দেহাত্মবাদ আলোচনার পক্ষে বিশেষ প্রাসঙ্গিক কয়েকটি হলো–

‘অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।।
কিণ্ব-আদিভ্যঃ সমেতেভ্যঃ দ্রব্যেভ্যঃ মদশক্তিবৎ।
অহং স্থূলঃ কৃশঃ অস্মি ইতি সামানাধিকরণ্যতঃ।।
দেহঃ স্থৌল্য-আদি-যোগাৎ চ স এব আত্মা ন চ অপরঃ ।
মম দেহঃ অয়ম্ ইতি উক্তিঃ সম্ভবেৎ ঔপচারিকী ।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাকপ্রস্থান)
অর্থাৎ :
(লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস– শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।।  যেমন কিণ্ব প্রভৃতি বস্তুগুলি থেকেই উৎপন্ন হয় মদশক্তি। ‘আমি মোটা’, ‘আমি রোগা’– এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসলে বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্কই বর্তমান।।   ‘মোটা’ প্রভৃতি শব্দ দেহেরই বিশেষণ বলে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার কথা অবান্তর। ‘আমার দেহ’ জাতীয় কথা নেহাতই কথার কথা– যাকে বলে উপচার।।


এই প্রাসঙ্গিক লোকগাথাগুলির সহজ সরল বক্তব্য থেকেই চার্বাকী দেহাত্মবাদের প্রয়োজনীয় বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চার্বাকেতর আত্মবাদী দার্শনিকেরা এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবতারণা করে প্রকৃতপক্ষে স্বীয় পাণ্ডিত্য প্রদর্শনেরই অল্পবিস্তর প্রয়াস করেছেন বলে সন্দেহের অবকাশ আছে; কেননা এই প্রসঙ্গে তাঁরা এতরকম কূট বিচারের অবতারণা করেছেন যার তোয়াক্কা লোকায়তিকেরা সত্যিই করতেন বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে লোকায়তিকদের প্রামাণ্য লোকগাথাগুলি থেকে অনুমান হয়, তাঁরা সত্যিই অতশতর ধার ধারতেন না।

। মদশক্তির দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা।

মদশক্তির নজিরটা প্রকৃত চার্বাকমতের পরিচায়ক বলে স্বীকার করার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। এ-রকম নজির ব্যবহার করার মধ্যেই– বিশেষত প্রাচীন কালের পটভূমিতে– একটা বিজ্ঞান-সম্মত বাস্তব মনোভাবের পরিচয় খোঁজা অবান্তর হবে না বলে মনে হয়। মদ গিললে যে নেশা হয়, একথা অবশ্যই সকলের জানা। কিন্তু কেন হয়, তা দীর্ঘ যুগ ধরে দেশ-বিদেশের অনেকেরই জানা ছিলো না। তাই এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের নানারকম জল্পনা-কল্পনা চোখে পড়ে। সেসব জল্পনা-কল্পনার মূল কথা হলো, মদের মধ্যে বুঝি কোনো একরকম অপ্রাকৃত বা এমনকি অলৌকিক শক্তি আছে, যারই প্রভাবে মদ পেটে পড়লে মানুষ রকমারি অদ্ভূত আচরণ করে থাকে– চলতি কথায় যাকে আমরা বলি মাতলামি। এই জাতীয় বিশ্বাসের অনেক দৃষ্টান্ত হেস্টিংস্ সম্পাদিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজন অ্যান্ড এথিক্স’ (Encyclopaedia of Religion and Ethics, ed. Hastings)-এর ‘Drinks, Drinking’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে রয়েছে। নিবন্ধের দৃষ্টান্তগুলির বেশির ভাগই তুলনায় অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়ে থাকা মানুষদের বিশ্বাসের বিবরণ। এটাই স্বাভাবিক।


এ-প্রেক্ষিতে ঋগ্বেদের নজিরে প্রাচীন মানুষদের দেবতা-বিশ্বাসে ‘সোমরসে’র বিষয়টিও স্মরণ করা যেতে পারে। সোম নামে এক শ্রেণীর লতা ছিলো, যা পার্বত্য-অঞ্চলে জন্মাতো। বৈদিক কবিরা সোম-লতার পার্বত্য আবাস ও মর্ত্যে আগমন নিয়ে, সোম-লতা সংগ্রহ করা, জল দিয়ে ধোয়ে পাথরের সাহায্যে তা নিষ্কাশন করা, নিষ্কাশিত হরিৎবর্ণের রস ভেড়ার লোমের ছাঁকনীতে ছেঁকে কাঠের কলসে ভরা, তাকে দুধের সঙ্গে মেশানো, দেবতাদের উদ্দেশে তার আহুতি দেওয়া এবং অবশ্যই তা নিজেরা পান করা– ইত্যাদি বিষয়ে ঋগ্বেদে এমন অসম্ভব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, প্রক্রিয়াগুলির খুঁটিনাটি নিয়ে আদিম কল্পনার এমন জটিল জাল বুনেছেন যে বর্তমান সময়ে তার সমস্ত তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বোঝা হয়তো সম্ভব নয়। এই রসের একমাত্র গুণটি হলো তা মদশক্তি বা মাদকত্বে ভরপুর। এই সোমলতার কোনও সন্ধান এখন পাওয়া যায় না। সরস্বতী নদীর মতো তা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কেবল তার স্মৃতি এবং অশেষ গুণের কথা ঋগ্বেদের সূক্তগুলিতে রক্ষিত হয়ে আছে। এসব দৃষ্টান্তে নেশায় উন্মত্ত করা সোমকে কখনো অঢেল বলবীর্য দানকারী স্বর্গীয় মহিমা, কখনো হর্ষদায়ী দেবতা, কখনো অমরত্ব দানকারী অমৃত ইত্যাদি বিভিন্ন বিশ্বাস অঙ্কিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য বিষয়ক ভিন্ন অধ্যায়ে এই ‘সোম-দেবতা’ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্তসহ বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ভিন্নতর প্রেক্ষিতে–
‘আজকের দিনেও ইংরেজরা কড়া মদকে বলেন স্পিরিট বা ‘spirit’– অর্থাৎ, আক্ষরিক অর্থে ভূত বা প্রেতাত্মা জাতীয় কিছু। এই শব্দ ব্যবহার থেকেই সন্দেহ হয় যে এর পিছনে এক বিশ্বাস লুকোনো আছে : মদের বোতলের মধ্যে ভূত-প্রেত জাতীয় অলৌকিক কিছু বুঝি পোরা আছে; মদ গেলার ফলে তারই প্রভাবে মানুষ রকমারি তাণ্ডব বা তাজ্জব ব্যবহার করতে শুরু করে। ব্যাপারটা বানানো কথা নয়। জে. ডি. বার্নাল রচিত ‘ইতিহাসে বিজ্ঞান’ (J. D. Bernal, Science in History) বই দেখুন। দেখবেন, একদা য়ুরোপের বিজ্ঞানী মহলেও অন্তত ষোড়শ-সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এই রকম ধারণা চালু ছিল। নমুনা হিসেবে প্যারাসেল্সাস্ (Paracelsus : 1493-1541) নামে (বা আসলে ছদ্মনামে) রসায়নবিদের উল্লেখ করেছেন বার্নাল। তাঁর মতে, “The crucial process of chemistry, distillation, was essentially a process of capturing the invisible spirits that rose from a boiling liquid. That such spirits were indeed powerful was only too evident from the effect of drinking them.” (বার্নাল, পৃ-৩৯৯)।
অর্থাৎ, প্যারাসেল্সাস্-এর ধারণায় রসায়নবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মদ্য প্রস্তুতে বিশিষ্ট প্রক্রিয়াটি আসলে ফুটন্ত তরল পদার্থ থেকে অদৃশ্য প্রেত ধরবার এক রকম পদ্ধতি; এই প্রেতের শক্তিটা যে কতখানি তা মদ্যপানের ফলাফল থেকেই বস্তুত বোঝা যায়। এমনকি ভ্যান্ হেলমোস্ট (Van Helmost : 1577-1644) মনে করতেন মদ তৈরি করা বলে ব্যাপারটা আসলে শুঁড়িখানায় শুঁড়ির ভাঁট থেকে একরকম ভূত বা প্রেত ধরবার কৌশল।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮০)

উপরিউক্ত কথাগুলি বিবেচনায় রাখলে চার্বাকদের মদশক্তির দৃষ্টান্তটিরই একটা চিত্তাকর্ষক তাৎপর্য অবজ্ঞান ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কিণ্ব প্রভৃতি কতকগুলি নেহাতই জাগতিক বস্তুর কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ্য বলে একরকম নেহাতই জাগতিক জিনিস প্রস্তুত করা হয়, এবং তারি মধ্যে নেহাতই জাগতিক এক নতুন গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘আত্মা’ বলে দেহাতীত কোনো অলৌকিক বস্তুর অস্তিত্ব খণ্ডন করবার উদ্দেশ্য প্রযুক্ত বলে মদশক্তির এই নজিরটির মধ্যে অজাগতিক কোনো কিছুর কল্পনা অবশ্যই অবান্তর হবে। ঠিক কবে– কীভাবে– চার্বাকদের মাথায় এই মদশক্তির দৃষ্টান্ত এসেছিলো, তা আমাদের জানা নেই, জানবার উপায়ও নেই। জানতে পারলে হয়তো বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা বিকাশের ইতিহাসে কিছুটা নতুন আলোকপাতের সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, দেহ ছাড়া আত্মা বলে আলাদা কিছু মানবার বিরুদ্ধে– বা দেহাত্মবাদের সমর্থনে– তাঁরা এই মদশক্তির যে নজিরটি ব্যবহার করেছেন, নজিরটির স্বকীয় বৈজ্ঞানিক মূল্য তুচ্ছ নয়।

চার্বাকী দেহাত্মবাদে ‘মদশক্তিবৎ’-এর দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে আরেকটি বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য মনে হয়, যেখানে বলা হয়েছে–
‘চার্বাকের যুগে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের পদার্থবিজ্ঞান বা ভৌতবিজ্ঞান এবং রসায়ন শাস্ত্র জানা ছিল না। তবু তিনি প্রাণিদেহে চৈতন্য নামক গুণটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে উদাহরণটি দিয়েছেন তার মধ্যে কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাথমিক উন্মেষ প্রতিফলিত হয়েছে। চার্বাক উদাহরণ দিয়েছেন ‘মদশক্তিবৎ’মদের বিভিন্ন উপাদানগুলি বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত করে জ্বাল দিয়ে চোলাই করে মদ তৈরি করা হয়। পৃথকভাবে অবস্থান কালে মদের উপাদানগুলির মধ্যে পৃথক পৃথক ভাবে মাদকতা শক্তি থাকে না। কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় সমন্বিত হয়ে মদ নামক যে নূতন জিনিসটি উৎপাদন করে সেই বস্তুটির মধ্যেই মাদকতা শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এভাবে প্রাণিশরীরের মূল উপাদানগুলি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সমন্বিত হয়ে দেহ নামক নূতন বস্তুটি উৎপাদিত হলেই দেহের চৈতন্য গুণটির আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং এই দেহনিষ্ঠ গুণটি দেহছাড়া থাকতে পারে না। পৃথক একটি আত্মার কল্পনা অনাবশ্যক। চার্বাক আধুনিক যুগে জন্মগ্রহণ করলে মৌলিক পদার্থ ও যৌগিক পদার্থের পার্থক্য দেখিয়ে উদাহরণটি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। মদ না বলে অ্যালকোহল (C2H5OH) বলতে পারতেন, জল (H2O) বা গ্লুকোস (C6H12O6) থেকে উদাহরণ টানতে পারতেন। দেখাতে পারতেন যৌগিক পদার্থে প্রাকৃতিক নিয়মেই এমন সব নূতন গুণ বা আণবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় যা মৌলিক পদার্থে থাকে না। কিন্তু অত প্রাচীন যুগে একজন ভারতীয় দার্শনিক যে অসাধারণ বিজ্ঞানমুখী চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য ভারতীয় হিসেবে আমরা বিস্ময় ও গর্ব অনুভব করতে পারি।’– (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩২)

সে যাক্, আপাতত চার্বাকদের দেহাত্মবাদের দার্শনিক গুরুত্ব আরো কিছুটা খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কেননা, অন্যান্য বিদগ্ধ দার্শনিকেরাও এই মতটাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেননি। ফলে নিজেদের আত্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে যেন রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

। দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস।

এ-পর্যন্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য দার্শনিকেরা সবচেয়ে বড় যুক্তি হিসেবে চৈতন্যের নজির দেখাতে চেয়েছেন। আগুন, বাতাস, জল, মাটি– সবই অচেতন বা জড় বস্তু। দেহের উপাদান হিসেবে আর কিছু মানার সুযোগ নেই; অন্তত চার্বাকেরা আর কিছুই মানতে রাজি নন। কিন্তু এই জাতীয় নিছক জড় বা অচেতন বস্তু দিয়ে যা গড়া তাও তো সহজ সরল যুক্তিতে নেহাত অচেতনই হবার কথা। মানুষ তো আর তা নয়। আমাদের মধ্যে চৈতন্যর পরিচয় রয়েছে। তার ব্যাখ্যাটা কী হবে? কিংবা চৈতন্যর পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার জন্য দেহ ছাড়াও দেহস্থ চেতন আত্মা স্বীকার না করে উপায় কী?
উত্তরে চার্বাকেরা বলতে চান, উপায় আছে। বস্তুবিশেষ প্রস্তুতের উপাদানগুলিতে স্বতন্ত্র বা মিলিত অবস্থায় কোনো গুণ বা লক্ষণের পরিচয় না থাকলেও সেগুলিরই কোনো একরকম বিশেষ পরিবর্তনের ফলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ওই গুণ বা লক্ষণের উদ্ভব এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। নজির : মদশক্তি। যেমন মদের গুণ, চৈতন্যও তেমনি দেহেরই গুণ। মদ তৈরির কোনো উপকরণে মদশক্তির পরিচয় নেই। তেমনি দেহ গঠনের কোনো উপকরণেও চৈতন্যের পরিচয় নেই। উভয় ঘটনাই সমজাতীয়।


শুধু শঙ্করাচার্যের কথাই নয়, ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য প্রখ্যাত প্রতিনিধিদের লেখা থেকেও অনায়াসেই বোঝা যায়, দেহাত্মবাদ নিয়ে যত বিতর্ক তার মধ্যে মূল কথা বলতে একটাই। এর সঙ্গে অবশ্য অনেকে অনেক সময় অনেক রকম বাড়তি যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন– পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকমত বর্ণনা প্রসঙ্গেও করেছেন, খণ্ডন প্রসঙ্গেও। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,–
‘অত্যুক্তির অপবাদ না কুড়িয়েও বলা যায়, অনেকে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও যুক্তিকৌশলের উৎকর্ষ দেখাবার উৎসাহেই করেছেন বলে সন্দেহের অবকাশ আছে। কেননা, চার্বাকদের পক্ষে যে-ধরনের কূট তর্ক আদপেই তোলবার দরকার ছিলো না, স্বাভাবিকও নয়, এমনতর অনেক কথাই দেহাত্মবাদের বিচার প্রসঙ্গে অনেকের লেখায় চোখে পড়ে। উৎসাহী-পাঠকেরা তার নমুনা হিসেবে প্রভাচন্দ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল বা গুণরত্নের বিস্তৃত আলোচনা উলটে দেখতে পারেন। কিন্তু কথা হলো, চার্বাকপক্ষ থেকে দেহাত্মবাদের সমর্থনে যেটা সবচেয়ে মোক্ষম নজির বলে মনে করার পর্যাপ্ত কারণ আছে– অর্থাৎ ওই মদশক্তির নজির– তা বাস্তবিকই খণ্ডন করবার চেষ্টা কতটুকু সার্থক হয়েছে? এই নজির খণ্ডন করতে না-পারলে হাজারো রকম কূট তর্কের অবতারণা করলেও দেহাত্মবাদ কি সত্যিই খণ্ডন করা যায়?’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮২)

এক্ষেত্রে আমরা একান্তই আগ্রহী পাঠকের জ্ঞাতার্থে প্রথমে এ-ধরণের যুক্তি-তর্ক বিস্তারের কিছু সংক্ষিপ্ত নমুনা উপস্থাপন করতে পারি দার্শনিক-নজির সংরক্ষণের বাড়তি খেয়ালে। কেননা আমাদের ভুলে গেলে চলে না যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দেহ ও আত্মা বিষয়ক বিতর্কটাই আসলে সবচেয়ে মৌলিক প্রপঞ্চ এবং তার উপরেই মূলত স্ব-স্ব দর্শনগুলির অন্য সব তত্ত্ব উপস্থাপনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এই নমুনা উপস্থাপন শেষে, এরপর, চার্বাকী দেহাত্মবাদী সিদ্ধান্ত যাচাই ও পর্যালোচনা করে উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার একটা যৌক্তিক উপায় অন্বেষণ করে সে-মোতাবেক এগিয়ে যাবার প্রয়াস নেবো। উল্লেখ্য, দেহাত্মবাদ খণ্ডনে বিভিন্ন দার্শনিকদের যুক্তি বিস্তারের নমুনা চয়নে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রধানত লতিকা চট্টোপাধ্যায়ের ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে উপস্থাপিত রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

.
দেহাত্মবাদ খণ্ডনে তর্ক ও যুক্তি বিস্তার :
১.
সাংখ্যাচার্য বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ গ্রন্থে (সাভা-৩/২০, ২২) দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে চার্বাকপক্ষের মদশক্তিবৎ দৃষ্টান্তে ত্রুটি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে বাইরে প্রকাশ না পেলেও সূক্ষ্ম মাদকাশক্তি সুরার উপাদান হিসেবে বর্ণিত দ্রব্যগুলির মধ্যে বর্তমান থাকে এবং এই শক্তি সমষ্টিগতভাবে পরে মাদকতা উৎপাদনের কাজে সহায়তা করে। বিজ্ঞানভিক্ষুর সমালোচনা এক্ষেত্রে চার্বাকী দৃষ্টান্তকে কতোটা আঘাত করে সেটা বিবেচনার বিষয়, কারণ চার্বাকপক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর আসতে পারে যে সুরার উপাদানে বর্তমান অদৃশ্য মাদকশক্তির মতো জীবদেহের উপাদানেও আমরা প্রচ্ছন্ন চৈতন্যশক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি।
এ ধরনের চার্বাকী প্রত্যুত্তরের সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানভিক্ষুও পরিহার করতে পারেননি। কিন্তু যে যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তিনি একে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন, তাকে প্রকৃষ্ট যুক্তির পরিবর্তে পূর্ব-স্বীকৃত অধ্যাত্ববাদী ধারণার অনুকথনই বলা চলে। যুক্তি এখানে আবরণমাত্র। তিনি বলেন যে জীবদেহ সমষ্টিগতভাবে যে ভৌতিক উপাদানে গঠিত সেই উপাদানের সমষ্টির প্রত্যেক অবয়বে সূক্ষ্মভাবে চৈতন্যের উপস্থিতি অনুমান করলে বহুসংখ্যক চৈতন্যশক্তির অবস্থিতি স্বীকার করতে হয় এবং এতে যে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, সাংখ্য এবং সহযোগী অপর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত নিত্য এবং অখণ্ড চৈতন্যস্বরূপের কল্পনায় তা দূর হওয়া সম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে জীবদেহের উপাদানে ব্যষ্টিগতভাবে অদৃশ্য চৈতন্যশক্তির কল্পনা সমীচীন হয় না।

বিজ্ঞানভিক্ষু বলেন (সাভা-৫/১৩০), চৈতন্যকে যাঁরা দেহের গুণ বলেন আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁরা এ-ক্ষেত্রে ঘটের দৃষ্টান্তের অবতারণা করে দেখান যে জল আহরণ করা ইত্যাদি ঘটধর্ম ঘটের উপাদান মৃত্তিকাতে থাকে না। কিন্তু জীবদেহে সচেতনতার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ দৃষ্টান্ত একান্তই দুর্বল এবং এটা গ্রহণ করার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিজ্ঞানভিক্ষু বলেন যে ভৌতিক পদার্থে বিশেষ কোন গুণের সৃষ্টি সব সময়ে স্বজাতীয় কারণ গুণের সাহায্যে হয়। কাজেই উপাদান কারণে চৈতন্য না থাকলে দেহে চৈতন্যের উপস্থিতি অকল্পনীয়।

২.
চৈতন্য এবং দেহের মধ্যে কার্যকারণভাবের বিদ্যমানতা অস্বীকার করার সময় বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলও অনুরূপ যুক্তির অবতারণা করেছেন। তিনি তাঁর ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় বলছেন–

‘যত্র যদ্ভাবসিদ্ধৌ ন কিংচিৎ প্রমাণমস্তি ন তত্র তদ্ব্যবহারঃ প্রেক্ষাবতা কার্যঃ, যথা বহ্নৌ শীতব্যবহারঃ। নাস্তি চ বুদ্ধিদেহয়োঃ কার্যকারণভাবসিদ্ধৌ কিংচিৎ প্রমাণম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৫)
অর্থাৎ : বিশেষ কোন গুণের কোন বস্তুতে সদ্ভাবের পক্ষে কারণ না থাকলে বস্তুটিকে ঐ বিশেষ গুণের সঙ্গে কার্যকারণসম্বন্ধে আবদ্ধ করা যেতে পারে না, যে জন্য আগুনে আমরা শৈত্য আরোপ করতে পারি না। জ্ঞান এবং দেহের কার্যকারণভাব সিদ্ধির পক্ষে কোন প্রমাণ না থাকায় চার্বাক-অভিপ্রেত এই কার্যকারণভাবে পক্ষে কোন যুক্তি নেই।


এই প্রসঙ্গে ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’তে সাধারণভাবে কার্যকারণ সম্বন্ধ বিচারিত হয়েছে। কমলশীল বলেন–

‘যেষামুপলম্ভে সতি উপলব্ধি লক্ষণ প্রাপ্তম্ পূর্বমনুপলব্ধং সদ্ উপলভ্যতে ইত্যেবমাশ্রয়নীয়ম’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৫)
অর্থাৎ : কোন একটি বস্তুর বর্তমানতায় উপলব্ধি লক্ষণযুক্ত অথচ পূর্বে অনুপলব্ধ অপর একটি পদার্থ যদি উপলব্ধিগোচরে আসে, তাহলে প্রথম বস্তুটিকে দ্বিতীয়টির কারণ বলা যেতে পারে।


এই কার্যকারণতার বিচার অন্যভাবেও করা চলে। কমলশীল বলছেন, দুটি বস্তু বা ঘটনার তুলনামূলক পর্যালোচনায় যদি দেখা যায় যে প্রথমটির ভিতর দ্বিতীয়টির উৎপাদনের উপযোগী বিভিন্ন উপাদানের বর্তমানতা সত্ত্বেও বিশেষ একটি উপাদানের অভাবে দ্বিতীয়টির আবির্ভাব সম্ভব হয় না; সদ্ভাবে হয়, তাহলে–

‘সৎসু তদন্যেষু সমর্থেষু তদ্ধেতুষু যস্যৈকস্যাভাবে ন ভরতীত্যেবং আশ্রয়নীয়ম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৬)
অর্থাৎ : যে বিশেষ উপাদানের সদ্ভাবে দ্বিতীয়টির উৎপন্ন বা উপলব্ধি হয় তাকেই দ্বিতীয়টির কারণ হিসেবে নির্দেশ করা উচিত, অপরগুলিকে নয়।


যে কোন দুটি পদার্থের পারস্পরিক কার্যকারণভাবের সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য এই সদ্ভাব এবং অভাবগত উভয়বিধ মানেই প্রথমে বিচার করা প্রয়োজন। একমাত্র এই উপায়ের মাধ্যমেই কারণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে সেই উপাদানকে যার বিশেষ উপস্থিতি আলোচ্য কার্যগুণকে উৎপন্ন করেছে।
‘কমলশীলের মতে দেহকে মনোগত বিজ্ঞানের কারণ হিসাবে নির্দেশ করার ব্যাপারে এই উভয় প্রকার মানের প্রয়োগ সম্ভব নয়। সদ্ভাবগত মানে বিচারের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভ্রূণ অবস্থায় দেহের সঙ্গে মনের সম্বন্ধের বিষয়ে কিছু বলা অসম্ভব, কারণ ভ্রূণের মানসিক শক্তির বিকাশ হয় না। যে কোন বস্তু পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারে এই বিকাশের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অপর প্রাণীর মন কেউ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম নয়; কাজেই সে ক্ষেত্রেও দেহ এবং মনের কার্যকারণ সম্বন্ধের বিচার করা চলে না। অভাবগত মানের সম্ভাব্যতার বিপক্ষে বলা যেতে পারে যে শরীরের বিনাশের সঙ্গে একযোগে মনেরও বিলোপ হয় কিনা কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়, সে শরীর নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। মৃতদেহে গতিশীলতার অভাব থেকে মৃত ব্যক্তির মনোগত বিজ্ঞানের বিনাশ কল্পনা করা অসঙ্গত। কারণ, অপর কোন হেতুর অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে পরিহার করা চলে না, যা মৃত্যুর পরেও বর্তমান এই মানসিক বিজ্ঞানকে মৃতদেহে সচলতা সৃষ্টির পথে বাধা দেয়। কমলশীল এ ব্যাপারে বৌদ্ধ মত ঘোষণা করে বলেন যে মৃত্যুর পূর্বে প্রাণীদেহে অধিষ্ঠিত বিজ্ঞানের বর্তমানতা প্রাণীটির মৃত্যুর পরেও অনস্বীকার্য। কিন্তু এই বিজ্ঞানের অস্তিত্ব সত্ত্বেও মৃত প্রাণীর দেহে সচলতার অভাবের কারণ দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন যে মৃত্যুর পূর্বে ঐ বিশেষ দেহটিকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানগত বাসনা ও অবিদ্যার রূপায়ণের যে প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজনবোধ তখন লুপ্ত এবং সেইজন্যই দেহটিকে পরিচারিত করার ক্ষমতা বিজ্ঞানটির তখন আর থাকে না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯৭)

আমরা নিশ্চয়ই টের পেতে শুরু করেছি যে দেহাত্মবাদের দার্শনিক যুক্তিবিচার কোত্থেকে কোনদিকে বিস্তারিত হতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত এখানে দার্শনিক পরিভাষার ‘জ্ঞান’ শব্দটি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা রাখা আবশ্যক। ব্যবহারিক জগতে কোন বিষয় বা বস্তুকে জানার মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের প্রকাশ দেখা যায়। বহির্জগতের কোন বস্তুর বিশেষ রূপ যখন আমাদের অন্তর্লোকে প্রতিভাত হয়, তখন আমরা সেই বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন অনুসারে জ্ঞানের এই সব ব্যক্তিগত প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে নিত্যজ্ঞানস্বরূপ আত্ম-চৈতন্যের বিশেষ অভিব্যক্তি। বৌদ্ধরা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তাঁদের মতে ক্ষণিক বিজ্ঞানপ্রবাহ এই ব্যষ্টি জ্ঞানের আশ্রয়। কিন্তু এ বিষয়ে উভয় শ্রেণীর দার্শনিকেরাই একমত যে মনের এই সচেতন অভিব্যক্তিকে জড় দেহের সঙ্গে একাত্ম করা চলে না এবং এদের উৎপত্তির কেন্দ্র হিসেবে বাহ্যবস্তুনিরপেক্ষ চৈতন্যের বৃহত্তর প্রবাহকে নির্দেশ করা উচিত।

বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত এবং কমলশীল তাঁদের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে যখন লোকায়ত মত নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত তখন বৌদ্ধ পরিভাষা অনুসারে ‘জ্ঞান’ ‘মনোধী’ ‘মনোবুদ্ধি’ ইত্যাদি শব্দেরই তাঁরা ব্যবহার করেছেন ‘চৈতন্য’, ‘আত্মা’ ইত্যাদি শব্দের পরিবর্তে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা চার্বাক মতের বিবরণ দিয়েছেন কম্বলাশ্বতর নামে এক লোকায়তিকের মত উদ্ধৃত করে। এই মত অনুসারে–

‘কায়াদেব ততো জ্ঞানং প্রাণাপানাদ্যধিষ্ঠিতাৎ, যুক্তং জায়ত ইত্যেতং কম্বলাশ্বতরোদিতস’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৬৪)
অর্থাৎ : কম্বলাশ্বতর বলেন– প্রাণ, অপান ইত্যাদি বায়ুর দ্বারা অধিষ্ঠিত দেহ জ্ঞানের আশ্রয়।

কিন্তু, শান্তরক্ষিত বলেন, চার্বাক মতে জ্ঞানের একমাত্র প্রকাশ অর্থাবগতির মধ্যে। যেমন–

‘ন চার্থাবগতেরন্যদ্রূপং জ্ঞানস্য যুজ্যতে’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৬৬)
অর্থাৎ : অর্থাবগতি ছাড়া জ্ঞানের প্রকাশ সম্ভব নয়।


‘অর্থ’ এখানে বাহ্য বিষয়ের দ্যোতক এবং ‘অর্থাবগতি’ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাহ্য বস্তুর প্রকাশনাকে বোঝায়। চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্য বস্তুর রূপ আমাদের অবগতিতে আসে এবং সেই রূপ সম্বন্ধে আমরা জ্ঞান লাভ করি। অনুরূপভাবে কর্ণ ইত্যাদি অন্য ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে আমরা বাহ্য বিষয়ের শব্দ ইত্যাদি জ্ঞাত হই। চার্বাকমতে এই অর্থাবগতি যেখানে নেই জ্ঞানেরও সেখানে অভাব। সেইজন্য সুপ্তি বা মূর্ছা অবস্থাতে জ্ঞানের অস্তিত্ব লোকায়তরা স্বীকার করেন না। তাই, প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্থের প্রকাশনার মধ্যেই চার্বাকেরা জ্ঞানর সীমানা নির্দিষ্ট রাখেন বলে কমলশীলের মন্তব্য–

‘ইন্দ্রিয়ার্থবলোদ্ভূতং সর্বং বিজ্ঞানম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯২১)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) সকল জ্ঞানের উদ্ভব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্থের প্রকাশের মধ্যে।


এই মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে কমলশীল বলেন যে, আমাদের স্বপ্নাবস্থার জ্ঞানের উপযুক্ত কারণ চার্বাকী বিবরণে নির্ণীত হয়নি। স্বপ্নে আমরা যা দেখি ইন্দ্রিয় বা বাহ্য অর্থের উপস্থিতি ব্যতীতই তা আমাদের মনে প্রতিভাত হয়। স্বপ্নাবস্থার এই জ্ঞানকে মনোবিজ্ঞান বলা চলে। এই মনোবিজ্ঞান স্বনির্ভর এবং ইন্দ্রিয় অথবা বাহ্য বস্তুর কোন অপেক্ষা রাখে না। স্বপ্নে বা অন্য অবস্থায় এই স্বনির্ভর বিজ্ঞানের সুপরিস্ফুট অস্তিত্ব থেকে বিজ্ঞান কেবলমাত্র অর্থাবগতির মাধ্যমে প্রতিভাত– লোকায়তদের এই উক্তি নিরর্থক প্রমাণিত হয়।
কমলশীলের বিবরণী পাঠে বোঝা যায় যে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থাতে চিত্তের স্ববেদনানুপলম্ভ বা অনুপলব্ধিই চেতনার তৎকালীন অবর্তমানতার সিদ্ধান্তে চার্বাকদের উপনীত হতে সাহায্যে করেছে। স্বসংবেদনের অনুপলব্ধির মূলে আছে উদাহৃত অবস্থাগুলিতে সংবেদনার অস্তিত্বে নিশ্চয়তাবোধের অভাব। কমলশীলের মতে চিত্তের স্বসংবেদন সম্বন্ধে যে নিশ্চয়তাবোধের অভাব চার্বাকদের এই ধারণার ভিত্তি, সেই অভাবই প্রকৃতপক্ষে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় চিত্ত বা মনের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে।

শান্তরক্ষিত এবং কমলশীলের রচনায় এ প্রসঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনা রয়েছে যেখানে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য উত্তর এবং সেই উত্তরগুলিরও প্রত্যুত্তর লিপিবদ্ধ হয়েছে। চার্বাক পক্ষ থেকে বৌদ্ধমতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আপত্তি দেখানো হয় যে, জাগরিত অবস্থায় আমরা নিদ্রা বা মূর্ছাকালীন বিজ্ঞানকে যে স্মরণ করতে পারি না তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে নিদ্রাগত বা মূর্ছিত অবস্থায় বৌদ্ধস্বীকৃত বিজ্ঞানের সদ্ভাবের ধারণা ভ্রান্ত।
শান্তরক্ষিত উত্তরে বলেন যে অস্তিত্ব সত্ত্বেও জ্ঞানের অস্পষ্টতা এই অস্মরণের প্রকৃত কারণ। কমলশীল এ প্রসঙ্গে স্বপক্ষের বক্তব্য আরও বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত করেন। নিদ্রা বা মূর্ছাভঙ্গের পর মানুষের যে প্রথম বোধ হয় তার জনক বাহ্যবস্তুনিরপেক্ষ এই কারণ বিজ্ঞান, নিদ্রা বা মূর্ছা অবস্থাতেও যার অস্তিত্ব অব্যাহত ছিলো। পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মরণকালে স্মৃতির উদ্ভবের সময়েও এই কারণ বিজ্ঞানেরই কার্যকরিতা দেখা যায়। কমলশীল আরও বলেন যে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় এ ধরনের কোন বিজ্ঞানের যদি অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে ঐ অবস্থাগুলি মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত হতো।

কিন্তু লোকায়তবাদীরা এ প্রসঙ্গে বলতে চান যে উদাহৃত অবস্থাগুলিতে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব লুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু হয় না, কারণ জাগরণকালে আবার সম্পূর্ণ নতুন বিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়। উত্তরে ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’তে (পঞ্জিকা-১৯২৮-৩০) বলা হয়েছে যে, এভাবে নতুন বিজ্ঞানের উৎপত্তি স্বীকার করলে মানুষের মৃত্যু কোন রকমেই ব্যাখ্যা করা চলে না। কারণ নতুন বিজ্ঞানের উদ্রেকে যেখাবে মানুষের নিদ্রা বা মূর্ছা ভঙ্গ হয়, সেইভাবে তার মৃত অবস্থারও অবসান হতে পারে এবং এভাবে মৃত ব্যক্তির পক্ষে পুনরায় জীবিত হবার পথে কোন বাধা থাকে না। মোট কথা, চার্বাক মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে বৌদ্ধ দার্শনিকদ্বয় এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হন যে–

‘স্বতন্ত্রা মানসী বুদ্ধিশ্চক্ষুরাদ্যনপেক্ষণাৎ, স্বোপাদানবলেনৈব স্বপ্নাদাবিব বর্ততে’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৯২৯)
অর্থাৎ : সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানসী বুদ্ধি বা মনোগত বিজ্ঞান ইন্দ্রিয় অথবা বাহ্য বিষয়ের অপেক্ষা না রেখেই স্বীয় অস্তিত্বে বিরাজমান।


এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তাঁরা বাস্তবে অসম্ভব আকাশ-কুসুম ইত্যাদি ধারণার উদাহরণ দেন। কারণ, তাঁরা বলতে চান (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩১-২), এই জাতীয় জ্ঞানের আবির্ভাবের ঠিক পূর্ববর্তী ঘটনা হিসেবে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর যোগগুলিকে কখনোই নির্দেশ করা চলে না এবং চিত্তস্থিত পূর্ববর্তী এক ধারণার কার্যকরিতা সব সময়ে এই জ্ঞানে প্রভাব বিস্তার করে। সে ধারণার অনুপস্থিতিতে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সংযোগে কোনক্রমেই এ জ্ঞান সম্ভব হয় না।
দেহ যদি এই মনোবুদ্ধির উৎস হতো তাহলে দেহগত বৈকল্যের ফলে মানসিক বিজ্ঞানেরও বিকলতা দেখা যেতো। এ ছাড়াও হস্তী ইত্যাদি বৃহৎ শরীরধারী জীবের মানসিক ক্ষমতার কাছে ক্ষুদ্রতর অবয়ব বিশিষ্ট মানুষের মনের শক্তি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতো। কমলশীল এক্ষেত্রে যুক্তি দেখান যে, একটির পরিবর্তন বা তারতম্যের উপর অপরটির পরিবর্তন বা তারতম্য নির্ভরশীল না হলে প্রথমটিকে দ্বিতীয়টির কারণ বলা চলে না। স্বতন্ত্র মনোবিজ্ঞানের অস্তিত্বের বিরোধী চার্বাকেরা যদি ইন্দ্রিয়সমষ্টি যুক্ত দেহতেই কেবল মনের কারণতা আরোপ করেন, তাহলেও তাঁদের মত গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ, সে ক্ষেত্রে যে কোন ইন্দ্রিয়ের হানি হলেই মানসিক শক্তির বৈলক্ষণ্য দেখা দিতো। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এর বিপরতীত সাক্ষ্যই বহন করে। ফলে কমলশীল বৌদ্ধমতের সমর্থনে বলেন–

‘প্রসুপ্তিকারোগাদিনা কার্যেন্দ্রিয়াদীনামুপঘাতেহপি মনোধীর বিকৃতৈকাবিকলাং স্বসত্তামনুভবতী’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩৪)
অর্থাৎ : পক্ষাঘাত ইত্যাদি ব্যাধিতে কর্মেন্দ্রিয়গুলির সব রকম কার্যক্ষমতা বিনষ্ট হলেও মন তার পূর্ণ শক্তিতে সজীব থাকে।


আবার অনেক সময় শারীরিক অবস্থা সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকা সত্ত্বেও মানসিক প্রকৃতির অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য শারীরিক অবস্থা মানসিক ভাবকে কিছুটা প্রভাবান্বিত করে; কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে মনের বিনাশ শরীরের বিলোপের উপর নির্ভরশীল।

চার্বাকেরা হয়তো বলতে পারেন যে দেহ এবং মনোবিজ্ঞানের সহস্থিতি দেহকে এই বিজ্ঞানের কারণ হিসেবে চিন্তা করার একটি প্রধান কারণ। কিন্তু মনোবিজ্ঞান যেমন দেহের সঙ্গে সব সময়ে একত্র অবস্থান করে, দেহও সেইরকম মানসিক জ্ঞানের সঙ্গে সর্বদা একত্রবর্তী; কাজেই যে যুক্তির বলে দেহ মনের কারণ হিসেবে নির্দেশিত, সেই একই যুক্তির প্রভাবে মনোবিজ্ঞানও দেহের কারণরূপে বিবেচিত হতে পারে।
কমলশীলের মতে (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩৪), কেবলমাত্র সহস্থিতি থেকেই কার্যকারণতার বিচার অযৌক্তিক; কারণ, দুটি পদার্থের সহস্থিতিভাবের মূলে তৃতীয় অপর একটি পদার্থের উপস্থিতির সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা চলে না। কাজেই বিজ্ঞানের দেহমূলকতা সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণা বৌদ্ধ মতে গ্রহণযোগ্য নয় এবং দেহ বিনষ্ট হলেও এই বিজ্ঞানের লুপ্ত হবার কোন আশঙ্কা নেই বলে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা মনে করেন।

৩.
ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা অবশ্য চার্বাকী অভিমতকে প্রতিহত করার জন্যেই এক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা ‘মনোবুদ্ধি’ পদের পরিবর্তে ‘চৈতন্য’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। জীবদেহ যে জীব-চৈতন্যের উৎস তার সমর্থনে চার্বাকদের যুক্তি এঁরা প্রথমে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং পর স্বপক্ষীয় যুক্তির সাহায্যে এই চার্বাকী যুক্তি প্রতিরোধে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে এই আলোচনার পূর্বভাগে অদ্বৈত বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্মসূত্রভাষ্য’ বা ‘শাঙ্করভাষ্য’-এ শঙ্কর-বর্ণিত চার্বাকী দেহাত্মবাদের বর্ণনার কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

আচার্য শঙ্করের ভাষ্যগ্রন্থে (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫৩) এ প্রসঙ্গে চার্বাকপক্ষের যে যুক্তিগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে একটি যুক্তি অনুসারে চৈতন্য থেকে ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদি যে মনেবৃত্তিগুলির উদ্ভব, সেগুলি আমাদের শরীর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সব কাজে প্রেরণার উৎস হওয়ায়, চৈতন্যকে শরীরের ধর্ম বলে স্বীকার করা উচিত।
এ ব্যাপারে চার্বাকী অন্য একটি যুক্তির বিবরণও শঙ্করাচার্যের গ্রন্থে আছে। যুক্তিটি এই রকম– কোন বস্তু বর্তমান থাকলে যা দৃশ্য, কিন্তু বস্তুটি অবর্তমানে যা অদৃশ্য, তাকে ঐ বস্তুর ধর্ম বা গুণ বলে ধরে নিতে হয়। উষ্ণতা, দীপ্তি ইত্যাদিকে অগ্নিধর্ম বলা চলে এই যুক্তিরই অনুসরণে; কারণ, আগুনের উপস্থিতিতেই এদের বর্তমানতা, আগুন না থাকলে নয়। প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি ইত্যাদি সচেতনতার যে সব প্রকাশকে আত্মবাদী দার্শনিকেরা আত্মার ধর্ম বলে মনে করেন সেগুলি প্রকৃতপক্ষে দেহতেই বর্তমান এবং দেহের অনুপস্থিতিতে এদের কোন অস্তিত্ব থাকে না; কাজেই এগুলি দেহেরই ধর্ম, দেহব্যতিরিক্ত অন্য কিছুর নয়।

চার্বাকমত খণ্ডন করতে গিয়ে স্বভাবসুলভ সহজ-সরল যুক্তি বিস্তার করে শঙ্করাচার্য বলেন, কোন একটি বস্তুর বর্তমানতার সঙ্গে আর একটির উপস্থিতি জড়িত থাকতে দেখা গেলেই প্রথম বস্তুটিকে দ্বিতীয়টির কারণ হিসেবে নির্দেশ করা চলে না। কাজেই উপরের যুক্তির অনুসরণে সেই গুণগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধী গুণান্তর অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান থাকতে দেখা যায়। শ্যামবর্ণ ও রক্তবর্ণ এইভাবে দ্রব্যবর্তী পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি গুণ। প্রতিদ্বন্দ্বী এই উভয় গুণের এক দ্রব্যে একই সময় অবস্থান সম্ভব নয়। সেইজন্য কোন একটি গুণ দ্রব্য থেকে বিলীন হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর গুণের দ্রব্যে আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়– যেমন অগ্নিপাককে উপলক্ষ করে ঘটগত শ্যামবর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী রক্তবর্ণে রূপান্তর লাভ করে।
চৈতন্যকে কিন্তু দ্রব্যগত এই ধরনের গুণগুলির সঙ্গে সমপর্যায়ভুক্ত করা চলে না। কারণ, চৈতন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী এমন কোন গুণ দেখা যায় না যার সঙ্গে চৈতন্যের সহাবস্থান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে চৈতন্য শরীরের গুণ হলে বিনাশের পূর্ব পর্যন্ত শরীর অবশ্যই চৈতন্যযুক্ত থাকতো, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যের সঙ্গে এ ধারণার সঙ্গতি থাকে না। কাজেই চৈতন্যকে দেহের ধর্ম বলে স্বীকার করা চলে না।

অন্যান্য দার্শনিকদের মতো অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা শঙ্করাচার্য (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫) মরণোত্তর প্রাণীদেহে সচেতন অভিব্যক্তির অনুপস্থিতির সাক্ষ্য থেকে চৈতন্যের দেহধর্মতার প্রতিকূলে অভিমত প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে দেহ অবর্তমানে চৈতন্যের অভাব সম্বন্ধে চার্বাকী সিদ্ধান্তকেও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁর মতে রঙ, আকার ইত্যাদি দেহধর্মগুলি দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সকলের প্রত্যক্ষযোগ্য, কিন্তু চৈতন্য, স্মৃতি ইত্যাদি সকলের অনুভবগ্রাহ্য নয়। তা সত্ত্বেও প্রাণীর জীবিতকালে প্রাণীদেহে ঐগুলির উপস্থিতি সাধারণভাবে সকলের স্বীকৃত। দেহ ধ্বংস পাবার সঙ্গেই চৈতন্য ইত্যাদিও বিনষ্ট হয়– চার্বাকদের এ ধারণার মূলেও শঙ্করাচার্য প্রমাণের কোন সমর্থন পান না। চার্বাকী সিদ্ধান্তের অনুকূলে প্রমাণের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে শঙ্করাচার্য ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে অনুমোদিত শ্রুতিপ্রমাণের ভিত্তিতে আত্মা সম্বন্ধে স্বীয় অভিমতকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে দেহস্থিত এই চৈতন্যের বিনাশ নেই এবং এই চৈতন্যই আত্মা সংজ্ঞায় অভিধেয়। সাধারণত দেহের সঙ্গে যুক্ত অবস্থাতেই কেবল আত্মা আমাদের জ্ঞানের গোচরীভূত, কিন্তু এ থেকে দেহের বাইরে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করা চলে না।

চৈতন্য আর দেহ যে ভিন্ন ভিন্ন সত্তা তার সমর্থন করে শঙ্কর অন্যত্র বলেন যে, প্রাণী অঙ্গের সর্বত্রই চৈতন্যের ব্যাপ্তি দেখা যায়– হস্ত, পদ ইত্যাদি প্রাণীদেহের প্রত্যেকটি অবয়বই সচেতন। শরীর চৈতন্যের উৎপত্তিস্থল হলে শরীরের প্রতিটি অবয়ব স্বস্থানবর্তী চৈতন্যের জনক হতো এবং এর ফলে একই শরীরে বহু চৈতন্য সৃষ্টির প্রসঙ্গকে পরিহার করা সম্ভব হতো না। প্রতিদেহবর্তী প্রাণীর বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে কিন্তু চেতনার ঐক্য প্রকাশ পায় যার ফলে মানুষের এক বিশেষ অবয়ব, হস্ত, যে প্রেরণার বশবর্তী হয়ে খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করে, তার রসনা সেই প্রেরণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভোজনে প্রবৃত্ত হয়। প্রাণীদেহের প্রতিটি অঙ্গের এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ সঙ্গতিপূর্ণ কাজের ব্যাখ্যা এক দেহে বহু চৈতন্যের স্বীকৃতিতে সম্ভব নয়। শঙ্করের যুক্তিগুলির অনুরূপ যুক্তি ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ‘ন্যায়ভাষ্যে’ও বিশদভাবে রয়েছে।

৪.
এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেন যে,–

‘শরীরং শরীরাবয়বাশ্চ সর্ব্বে চেতনোৎপত্ত্যা ব্যাপ্তা ইতি ন ক্কচিদনুৎপত্তিশ্চেতনায়াঃ, শরীরবচ্ছরীরাবয়বাশ্চেতনা ইতি প্রাপ্তং চেতনবহুত্বং। তত্র যথা প্রতিশরীরং চেতনবহুত্বে সুখদুঃখজ্ঞানানাং ব্যবস্থা লিঙ্গং, এবমেকশরীরেহপি স্যাৎ? নতু ভবতি, তস্মান্ন শরীর গুণশ্চেতনেতি।’ (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৫০)
অর্থাৎ :
শরীর এবং শরীরের সমস্ত অবয়ব চৈতন্যের উৎপত্তি কর্তৃক ব্যাপ্ত; সুতরাং (শরীরের) কোন অবয়বে চৈতন্যের অনুৎপত্তি নাই, শরীরের ন্যায় শরীরের সমস্ত অবয়ব চেতন এ জন্য চেতনের বহুত্ব প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ শরীর ও ঐ শরীরের প্রত্যেক অবয়ব চেতন হইলে একই শরীরে বহু চেতন স্বীকার করিতে হয়। তাহা হইলে যেমন প্রতিশরীরে অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন শরীরে চেতনের বহুত্বে সুখ, দুঃখ ও জ্ঞানের ব্যবস্থা (নিয়ম) লিঙ্গ, অর্থাৎ অনুমাপক হয়, এইরূপ এক শরীরেও হউক? কিন্তু হয় না, অতএব চৈতন্য শরীরের গুণ নহে। (তর্জমা- ফণিভূষণ তর্কবাগীশ)


বাৎস্যায়নের মতে, বস্তুবিশেষের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক গুণকেই বস্তুটির স্বধর্ম বলে নির্দেশ করা চলে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি উষ্ণ কোন আধারস্থিত জলের সঙ্গে যুক্ত তরলতা এবং উষ্ণতা, এই গুণ দুটির উল্লেখ করেন। তাঁর মতে জলের স্বধর্ম প্রথমটি, দ্বিতীয়টি নয়; কারণ এই বিশেষ ক্ষেত্রে জলে উষ্ণতা দেখা গেলেও ভিন্ন আধারস্থিত জলে তা অদৃশ্য। ন্যায়ভাষ্যে বলা হয়েছে–

‘স্বগুণোহপ্স, দ্রবত্বমুপলভ্যতে, পরগুণশ্চোষ্ণতা। তেনাহয়ং সংশয়ঃ, কিং শরীরগুণশ্চেতনা শরীরে গৃহ্যতে? তথ দ্রব্যান্তরগুণ ইতি’। (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৬)
অর্থাৎ :
জলে স্বকীয় গুণ দ্রব্যত্ব উপলব্ধ হয়, পরের গুণ অর্থাৎ জলের অন্তর্গত অগ্নির গুণ উষ্ণতাও উপলব্ধ হয়। অতএব কি শরীরের গুণ চেতনা শরীরে উপলব্ধ হয়? অথবা দ্রব্যান্তরের গুণ চেতনা শরীরে উপলব্ধ হয়? এই সংশয় জন্মে।


তাঁর মতে, জলের সঙ্গে এইভাবে বহু ক্ষেত্রে যুক্ত হলেও উষ্ণতা প্রকৃতপক্ষে আগুনের স্বধর্ম। অনুরূপভাবে দেহের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে যুক্ত থাকার নিদর্শন থেকেই চৈতন্যের দেহধর্মতার অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হয় না। দৃষ্টান্তস্থিত উষ্ণতা যেমন জল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আগুনের ধর্ম, চৈতন্যকেও সেইরকম দেহ থেকে পৃথক আত্মার স্বভাব বলা চলে। শরীরের স্বধর্ম হিসেবে বাৎস্যায়ন কৃষ্ণ, গৌর ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দেহবর্ণের উল্লেখ করেন, যার অস্তিত্ব প্রাণীদেহে সব সময়েই থাকে, এমনকি মৃত প্রাণীর শরীরেও। আগুনের সঙ্গে উষ্ণতার একত্র বর্তমানতার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে চার্বাকেরা যখন দেহকে চৈতন্যের কারণ হিসেবে নির্দেশ করেন, তখন তাঁদের উপস্থাপিত দৃষ্টান্ত স্পষ্টতই ত্রুটিমুক্ত হয় না। উষ্ণতা এবং দীপ্তির সঙ্গে আগুনের যোগ সব সময় থাকে। এ থেকে বোঝা যায় যে এগুলি আগুনের স্বভাব, কারণ স্বভাব তার আশ্রয়কে কখনও পরিত্যাগ করে না। চৈতন্যের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক কিন্তু অনুরূপ নয়। চৈতন্য সব সময়ে দেহকে কেন্দ্র করেই বিকশিত এবং দেহ অবর্তমানে চৈতন্য অদৃশ্য– চার্বাকপক্ষের এ বক্তব্য অস্বীকার্য নয় বটে, কিন্তু মৃত্যু বা সংজ্ঞাহীনতার কবলিত অচেতন দেহের অস্তিত্বও সকলের কাছে সুপরিচিত। কাজেই উষ্ণতার সঙ্গে আগুনের স্বাভাবিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত চৈতন্যের সঙ্গে দেহের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। এ-প্রসঙ্গে ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বাৎস্যায়ন বলেন–

‘ন রূপাদিহীনং শরীরং গৃহ্যতে, চেতনাহীনন্তু গৃহ্যতে, যতোষ্ণতাহীনা আপঃ, তস্মান্ন শরীরগুণশ্চেতনেতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৭)
অর্থাৎ : রূপাদিশূন্য শরীর প্রত্যক্ষ হয় না। কিন্তু চেতনাশূন্য শরীর প্রত্যক্ষ হয়, যেমন উষ্ণতাশূন্য জল প্রত্যক্ষ হয়,– অতএব চেতনা শরীরের গুণ নহে।


চার্বাকদের সমালোচনা করার সময় চার্বাকী যুক্তির এই ত্রুটির উল্লেখ অনেকেই করেছেন। সাংখ্যাচার্য বিজ্ঞানভিক্ষুর (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য-৩/২১) মতে মৃত্যুর পরে এবং অন্য নানা অবস্থায় দেহের মধ্যে চৈতন্যের যে অভাব দেখা যায় তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে চৈতন্য দেহের স্বাভাবিক ধর্ম নয়।

এই মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে দেহাত্মবাদীদের পক্ষ থেকে যে ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে সে সম্বন্ধেও ন্যায়ভাষ্যে আলোচনা আছে। তাঁরা হয়তো বলতে পারেন যে প্রাণীদেহে চৈতন্যের মতো ঘটে যে শ্যাম রূপের প্রকাশ, সেই রূপও ঘটদেহে চিরকাল থাকে না। অগ্নিদগ্ধ ঘটে এই রূপ সম্পূর্ণ রূপে অন্তর্হিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রূপকে ঘটের উপাদানের ধর্ম বলতে কারও দ্বিধা নেই। অনুরূপভাবে চৈতন্যকেও ভৌতিক উপাদানে গঠিত জীবদেহের ধর্ম বলে স্বীকার করতে অসম্মত হওয়া উচিত নয়।
আপত্তির উত্তরদান প্রসঙ্গে বাৎস্যায়ন বলেন যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তটি এ ক্ষেত্রে সঠিক প্রযোজ্য নয়। ঘটের শ্যামতার যে বিলুপ্তি দেখা যায়, তা প্রকৃতপক্ষে অবস্থার রূপান্তর মাত্র। অগ্নিদগ্ধ ঘটে বর্ণের পরিবর্তন হয়– শ্যামবর্ণ রক্তবর্ণে পরিণতি লাভ করে। মৃত প্রাণীদেহে চৈতন্যের যেভাবে সম্পূর্ণ অবলোপ হয়, অগ্নিদগ্ধ ঘটদেহে শ্যামতার অবসান সেভাবে হয় না। এ ক্ষেত্রে বাৎস্যায়ন শরীরস্থিত চৈতন্যের সঙ্গে দ্রব্যগত শ্যামতা ইত্যাদি গুণের প্রভেদের বিষয় উল্লেখ করে বলেন–

‘নাত্যন্তং রূপোপরমো দ্রবস, শ্যামে রূপে নিবৃত্তে পাকজং গুণান্তরং রক্তং রূপ মুৎপদ্যতে। শরীরে তু চেতনামাত্রোপরমোহত্যন্তমিতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৮)
অর্থাৎ : দ্রব্যের আত্যন্তিক রূপাভাব হয় না, শ্যাম রূপ নষ্ট হলে পাকজন্য গুণান্তর রক্ত রূপ উৎপন্ন হয়। কিন্তু শরীরে চৈতন্যমাত্রের অত্যন্তাভাব হয়।


৫.
চার্বাকী ভূতচৈতন্যবাদের নিরসন প্রসঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের দার্শনিকেরা স্বসমর্থিত আত্ম-সম্বন্ধীয় মতবাদের অবতারণা করেছেন– দেহধারী জীবের মধ্যে সচেতনতার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যার ব্যাপারে স্বপক্ষীয় মতের উপযোগিতাই যে একমাত্র স্বীকার্য, তা ব্যক্ত করা এ ক্ষেত্রে তাঁদের অভিপ্রায়। নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’তেও এইভাবে চার্বাকী ধারণার বিপরীত অধ্যাত্মবাদী ধারণা উপস্থাপিত করা হয়েছে।
চার্বাকপক্ষের মতকে প্রতিহত করে স্বপক্ষীয় অভিমতকে এইভাবে উপস্থাপিত করার সময় জয়ন্তভট্ট ভূতচৈতন্যবাদের সমর্থনে চার্বাকী যুক্তির এক বিবরণ দিয়ে বলছেন–

‘ভূতেষ্বন্নপানাদ্যুপযোগপুষ্টেষু পাট্বী চেতনা ভবতি তদ্বিপর্যয়ে বিপর্যয়ঃ, ব্রাহ্মীঘৃতাদ্যুপযোগসংস্কৃতে চ কুমার শরীরে পটুপ্রজ্ঞতা জায়তে।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) বুদ্ধি বা চৈতন্যের বিকাশ শরীরের সম্যক পরিপুষ্টির উপর নির্ভরশীল। ভোজন, পান ইত্যাদির দ্বারা দেহ পুষ্ট থাকলেই চৈতন্যের সতেজ স্ফূর্তি দৃষ্ট হয়। ব্রাহ্মীঘৃত অথবা অন্য ঔষধাদি সেবনের ফলে বালকের মধ্যেও যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঞ্চার হতে দেখা যায়।


অপর পক্ষে অপুষ্ট শরীরে বুদ্ধি বা চৈতন্য সম্যক বিকশিত হতে পারে না। আবার দধি, আর্দ্র পরিবেশ ইত্যাদি ভৌতিক দ্রব্যের বিবিধ সংস্থান নানাবিধ কৃমি পতঙ্গাদির উৎপত্তির কারণ হয়। চার্বাকদের মতে ভৌতিক দ্রব্য থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি সমর্থনে এই কারণগুলিকে নিশ্চয়ই উপেক্ষা করা চলে না। ভৌতিক দেহকে চৈতন্যের উৎপত্তিস্থল হিসেবে গণ্য করার কারণ হিসেবে চার্বাকেরা শরীরের মাধ্যমে চৈতন্যলক্ষণযুক্ত ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদির আরম্ভ এবং নিবৃত্তির উল্লেখ করেন। শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে এবং ন্যায়সূত্র ও ন্যায়ভাষ্যেও ভূতচৈতন্যবাদীদের এই বক্তব্যের অন্তর্ভুক্তি আছে। জয়ন্তভট্ট শরীরের সঙ্গে চৈতন্যকে একাত্ম করার চার্বাকী এই প্রয়াসের বিরোধিতা করার সময় তাঁর স্বভাবসুলভ হেঁয়ালীপূর্ণ ভাষায়  শরীরের নিত্যপরিবর্তনশীলতার বিষয় উল্লেখ করে বলেন–

‘শরীরং চ বাল্যাদ্যবস্থাভেদেন ভিন্নমতন্তস্য নাশ্রয়ো ভবিতুমর্হতি সন্তানান্তরবদ্ যথা হি দেবদত্ত দৃষ্টেহর্থে যজ্ঞদত্তস্য ন স্মরণমেবং বাল শরীরাদ্যনুভূতে যুবশরীস্য তন্ন স্যাৎ।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : বাল্যদেহ, যৌবনের দেহ ও বৃদ্ধদেহ ভিন্ন ভিন্ন হলেও বাল্যকালের অভিজ্ঞতা যৌবনে এবং যৌবনের অভিজ্ঞতা বার্ধক্যকালে স্মরণ হয়। দেবদত্ত নামের ব্যক্তির দৃষ্ট অভিজ্ঞতা কি যজ্ঞদত্ত নামের অপর কেউ স্মরণ করতে পারে?


জয়ন্তভট্ট বলতে চেয়েছেন, জীবদেহ প্রতি পদে রূপান্তরিত হয়, শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য ইত্যাদি দশাভেদে। একের দৃষ্ট বিষয় যেমন অপরকে স্মরণ করতে দেখা যায় না এবং একের স্মৃতি বা অনুভবকে অপরের ইচ্ছার কারণ বলা চলে না সেই রকম ভূতচৈতন্যবাদকে স্বীকৃতি দিলে জীবদেহের কোন অবস্থায় প্রত্যক্ষীকৃত বিষয়ের স্মরণ সেই একই জীবের অন্য অবস্থায় ব্যাখ্যা করা যায় না এবং স্মৃত কোন বিষয় থেকেও পরবর্তী অবস্থার দেহে অভিব্যক্ত ইচ্ছাদিকে উৎপন্ন বলা চলে না। কাজেই প্রাণী চৈতন্যের যে ঐক্য পরম্পরাবদ্ধ অর্থবিজ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিভাত, শরীরের সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার মধ্যেও যা অভিন্ন এক জীবের পরিচিতি বহন করে, ভূতচৈতন্যবাদের সঙ্গে তার কোন সঙ্গতি নেই।

৬.
স্বতন্ত্র আত্মার ধারণায় বিশ্বাসী দার্শনিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে চার্বাকপক্ষ এতক্ষণ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, চৈতন্যধর্মী আত্মা এই চার্বাকদের মতে দেহের সঙ্গে অভিন্ন। কিন্তু এই শ্রেণীর চার্বাকেরা ছাড়াও–
‘আত্মগত ধারণার ভিত্তিতে আরও তিনটি পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত চার্বাকদের বর্ণনা সদানন্দের ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে পাওয়া যায় এবং… ‘বেদান্তসারে’র অভিমতে দৃষ্টিভঙ্গীর তারতম্য অনুযায়ী চার্বাকী বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্তর বিন্যাস আছে এবং এই স্তরের প্রকারভেদ অনুসারে চার্বাকেরা স্থূলতম বিষয় থেকে অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম বিষয় সম্বন্ধে ধারণায় সমর্থ, যদিও বেদান্ত-অভিপ্রেত সচ্চিদানন্দরূপী শুদ্ধ আত্মস্বরূপ এঁদের প্রত্যেকেরই অবগতির বহির্ভূত। এই বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত চার্বাকদের মধ্যে দেহাত্মবাদীরাই স্থূলতম ধারণার অংশীদার এবং বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনায় এই দেহাত্মবাদী বা ভূতচৈতন্যবাদীরাই উল্লিখিত হয়েছেন। জয়ন্তভট্ট তাঁর গ্রন্থে আত্মসম্বন্ধীয় আলোচনার প্রসঙ্গে ভূতচৈতন্যবাদ ছাড়াও ইন্দ্রিয় চৈতন্যবাদ এবং মনশ্চৈতন্যবাদ এই দু’ধরনের মতের উল্লেখ করেছেন। সদানন্দের বর্ণনায় ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির সঙ্গে যাঁরা আত্মাকে অভিন্ন বলে মনে করেন সেই চার্বাকদের ধারণা চিত্রিত হয়েছে। এই মতবাদগুলির কোনটাই অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের আত্মসম্বন্ধীয় ধারণার সমগোত্রীয় নয় এবং ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেও এই মতবাদগুলির বিরোধিতা করা হয়েছে।
জয়ন্তভট্ট তাঁর আলোচনায় ‘সুশিক্ষিত’ এই বিশেষণের মাধ্যমে আর এক শ্রেণীর চার্বাকদের পরিচিতি দিয়েছেন যাঁদের মতে আত্মা ‘প্রমাতৃতত্ত্ব’, স্থূল দেহ থেকে ভিন্ন। সচেতন ব্যবহারের সব কিছু এই আত্মা বা ‘প্রমাতৃতত্ত্বে’ এই শ্রেণীর চার্বাকেরা আরোপ করেন, কিন্তু এই আত্মার স্থায়িত্ব তাঁদের অভিমত অনুযায়ী শরীরের স্থায়িত্বকে অতিক্রম করে যেতে পারে না এবং দেহনাশের পর এই আত্মার বর্তমানতা এবং দেহান্তর পরিগ্রহ সুশিক্ষিত চার্বাকেরা স্বীকার করেন না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৫-৬)

জয়ন্তভট্ট বর্ণিত এই ‘সুশিক্ষিত’ চার্বাকেরা আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমণের বিরোধিতা করেছেন। ‘ন্যায়মঞ্জরী’র ভাষ্যানুযায়ী এঁরা বলেন–

‘যদি হ্যেবং ভবেত্তদিহ শরীরে শৈশবদশানুভূতপদার্থস্মরণবৎ অতীতজন্মানুভূতপদার্থ স্মরণমপি তস্য ভবেন্ন হি তস্য……তস্মাদুর্ধ্বং দেহান্নাস্ত্যেব প্রমাতা’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ :
আত্মা বা প্রমাতার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমণ সম্ভব হলে শৈশবে অনুভূত পদার্থের মতো জন্মান্তরে অনুভূত পদার্থেরও স্মরণে কোন বাধা থাকতো না এবং আমরা বিগত জন্মের ঘটনাগুলির স্মৃতিও অনায়াসেই বহন করতে সমর্থ হতাম। কিন্তু জন্মান্তরের ঘটনা স্মরণ করতে মানুষকে দেখা যায় না। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে শরীর নাশের পর শরীরস্থিত প্রমাতারও অস্তিত্বের লোপ হয়।


‘সুশিক্ষিত’ বিশেষণে ভূষিত চার্বাকেরা আত্মাকে দেহের সঙ্গে অভিন্ন বলে স্বীকার না করায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের বিচারে এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি দেহাত্মবাদী বৃহৎ গোষ্ঠির তুলনায় উন্নততর বলা হলেও এঁরা কিন্তু ভারতীয় অধ্যাত্মধারণার সম অংশীদার নন। কারণ তাঁদের অনুমোদিত প্রমাতৃতত্ত্ব দেহ থেকে পৃথক হয়েও দেহেরই সমকালীন বিনাশের কবলে পতিত হয়।
জয়ন্তভট্টের বিবরণীতে এই চার্বাকদের মতবাদে ত্রুটি দেখানো হয়েছে। নৈয়ায়িকেরা কার্যকারণভাবে বিশ্বাসী এবং জয়ন্তভট্টের মতে যে কোন সৎ বস্তুর বিনাশ কল্পনা করতে হলে বিনাশের মূলে নির্দিষ্ট কোন হেতুর আগে স্বীকৃতি হওয়া উচিত। কারণ–

‘ন চাস্তিত্বাবিনাভাবী ভাবানাং বিনাশঃ স্বাভাবিকঃ কিন্তু হেত্বন্তরনিমিত্তকঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : স্বাভাবিকভাবে যাকে সৎ বা বর্তমান বলে স্বীকার করা যায়, কারণ না থাকলে তাকে বিনষ্ট বলে ঘোষণা করা অযৌক্তিক।


নৈয়ায়িক আচার্য জয়ন্তভট্ট নানাভাবে বিচার করে দেখাতে চান যে আত্মার বিনাশের কোন কারণ আবিষ্কার করা সুকঠিন।
অনুমানের মাধ্যমে এই আত্মার বিনাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের অভিমত হলো আত্মা জড় দেহ থেকে পৃথক। কাজেই জড় বস্তুর ধর্ম আত্মাতে আরোপ করে আত্মার ধ্বংসের কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে না। জড় বস্তুনিচয় প্রধানত অবয়বী, অর্থাৎ বিভিন্ন অবয়ব বা অংশের সংযোগে এদের উৎপত্তি এবং এই অবয়বের বিনাশই এদের বিনাশের হেতু। এ ধরনের অবয়বের বিভাগ জড় বস্তু থেকে ভিন্ন আত্মাতে সম্ভব নয়। দ্রব্যাদির গুণ যেমন আশ্রয়দ্রব্যের বিনাশের সঙ্গে লুপ্ত হয়, আত্মার সেই ধরনের বিনাশও অনুমেয় নয়, কারণ আত্মাকে দ্রব্যবিশেষের গুণ বলা চলে না। কাজেই স্থূল দেহের ধ্বংসের সঙ্গে দেহাতিরিক্ত আত্মার বিলোপের কোন যোগ নেই এবং অন্য হেতু অবর্তমানে দেহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার সমকালীন এই আত্মার বিনাশের কল্পনা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
জয়ন্তর মতে দেহাতিরিক্ত এই আত্মার বিনাশ প্রত্যক্ষ প্রমাণেরও বিরোধী। আত্মার ধ্বংস কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষের গোচরে কখনো আসেনি, যদিও মৃত দেহটির ক্ষেত্রে এ জাতীয় অভিজ্ঞতা খুব সাধারণ, কারণ অগ্নিদাহ বা হিংস্র পশুর আক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে মৃতদেহকে প্রায়ই দেখা যায়।

পরিশেষে জয়ন্তভট্ট মন্তব্য করেন যে প্রত্যক্ষ এবং অনুমান, এই উভয়বিধ প্রমাণের যে কোনটিরই মাধ্যমে দেহনাশের সমকালীন আত্মার বিলোপের সপক্ষে ‘সুশিক্ষিত’ চার্বাকদের অভিমত গ্রাহ্য হতে পারে না। কাজেই ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে অনুমোদিত নিত্য প্রমাতা বা আত্মার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য ঘোষণা করে বলা হচ্ছে–

‘তস্মাদস্তি নিত্যঃ পরলোকে প্রমাতেতি’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : লোকে বা পরলোকে নিত্য প্রমাতা বা আত্মার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।


৭.
প্রকৃতপক্ষে চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের মৌল বিভেদ আত্মার অমরত্বের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রূপায়িত। আত্মার অমরত্বের ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত জন্মান্তরবাদ ও পরলোকতত্ত্ব। দেহাতীত যে আত্মা দেহনাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয় না একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব পুনরায় নতুন জন্মে এবং নতুন পরিবেশে ভিন্ন দেহের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা। কিন্তু আত্মার অমরত্বে বা অস্তিত্বে চার্বাকদের কোন সম্মতি নেই। জীবদেহে অভিব্যক্ত চৈতন্যে তাঁরা যে নশ্বরতার ছাপ দেন তা জন্মান্তরবাদের ধারণার সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় চার্বাকমত হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যে, চার্বাক মতে দেশান্তর, অবস্থান্তর বা কালান্তরকে পরলোক বলা যায়। চার্বাকমতের বর্ণনায় এ-প্রসঙ্গে একটি লোকায়ত বা বার্হস্পত্য সূত্রেরও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে–

পরলোকিনোহভাবাৎ পরলোকাভাবঃ। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৫৮)
অর্থাৎ : (চার্বাক মতে) যেহেতু পরলোক নাই, তাই পরলোকীও নাই।


এ ব্যাপারে চার্বাকদের সমালোচনায় তৎপর দার্শনিকেরা প্রত্যেকেই আত্মার ক্ষণস্থায়িত্ব বা অস্তিত্বহীনতা সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণার বিরোধিতা করেছেন আত্মার অমরত্ব এবং অবিনশ্বরত্ব সম্বন্ধে নিজ নিজ ধারণার বিবরণী দিয়ে।
চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনের অন্য গোষ্ঠির মতো বৌদ্ধদর্শনও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জন্মান্তরবাদের এই বৌদ্ধ ধারণাও স্বাভাবিকভাবে চার্বাকেরা স্বীকার করেন না এবং এই প্রসঙ্গে এই দুই গোষ্ঠির পারস্পরিক তর্কযুদ্ধের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে এবং কমলশীল-কৃত এই গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’র ব্যাখ্যাতে।

‘বৌদ্ধরা আত্মার পরিবর্তে অবিচ্ছিন্ন ‘বিজ্ঞান-সন্ততি’র অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেন এবং এই ‘বিজ্ঞান’ তাঁদের মতে দেহ, মন বা ইন্দ্রিয়– এগুলির কোনটার মাধ্যমেই উৎপন্ন হয় না। এই ‘বিজ্ঞান-সন্ততি’র অন্তর্ভুক্ত যে কোন বিজ্ঞানের জনক ঠিক তার পূর্ববর্তী অপর একটি ‘বিজ্ঞান’, ‘যে বিজ্ঞানে’র কারণরূপে নির্দেশ করা চলে অনুরূপ আর একটি ‘বিজ্ঞান’কে। এইভাবে প্রতিটি বিজ্ঞানের উৎস হিসেবে পূর্ববর্তী অপর বিজ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হলে শিশুমনের আদি বিজ্ঞানের কারণরূপেও কোন বিজ্ঞানের অস্তিত্বের ধারণা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ জন্মান্তরবাদের ভিত্তি এই ধারণাতে। বৌদ্ধরা শিশুমনের আদি চেতনার কারণ হিসেবে পূর্ববর্তী জন্মের অন্তিম বিজ্ঞানকে নির্দেশ করেন। এই উভয় বিজ্ঞান অচ্ছেদ্য কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ থেকে বিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখে। এইভাবেই গড়ে ওঠে প্রতিটি জন্মের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অপর জন্মগুলির অস্তিত্বের ধারণা।
পূর্ববর্তী জন্মের অন্তিম বিজ্ঞান একমাত্র তখনই পরবর্তী জীবনের বিজ্ঞানের উৎস হয় যথন তা রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি ধর্মের দ্বারা সম্পৃক্ত হয়। সম্পূর্ণভাবে বীতরাগ ব্যক্তি পুরাতন দেহের বন্ধন ছিন্ন হবার পর নূতন দেহের বন্ধনে পুনরায় আবদ্ধ হন না। অন্য মানুষের ক্ষেত্রে পূর্বতন জীবনের বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি মানসিক ধর্ম পরবর্তী জীবনে শিশুমনে সংক্রামিত হয়।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৮-৯)

কিন্তু চার্বাক মতে দেহই জ্ঞানের একমাত্র আশ্রয় এবং দেহনাশের সঙ্গে দেহাশ্রিত এই জ্ঞানেরও সম্পূর্ণ বিনাশ হয়। বৌদ্ধরা যখন পূর্বজন্মের মরণকালীন চিত্ত বা বিজ্ঞানকে পরবর্তী জন্মের প্রারম্ভিক বিজ্ঞানের কারণ বলেন– অথবা বর্তমান দৃশ্যমান দেহে যে সচেতনতার অভিব্যক্তি তার সঙ্গে অতীত কোন দেহের বিজ্ঞানের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধসূত্র আবিষ্কার করেন, তখন চার্বাকেরা তার মধ্যে যুক্তির কোন সমর্থন পান না। প্রথমত, পূর্বজন্মবর্তী যে দেহের অবসানকালে জাত বিজ্ঞানকে বৌদ্ধরা বর্তমান দেহের বিজ্ঞানের সঙ্গে কার্যকারণের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত করতে অভিলাষী, সেই দেহের অস্তিত্বই চার্বাক মতে নির্ভরযোগ্য প্রমাণের দ্বারা অসমর্থিত। তাছাড়া দুটি বিভিন্ন দেহবর্তী বিজ্ঞানকে একই বিজ্ঞান প্রবাহে অন্তর্ভুক্ত করার বৌদ্ধ প্রচেষ্টাতেও চার্বাকেরা ত্রুটি খুঁজে পান। ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’র পূর্বপক্ষীয় বর্ণনায় দেখা যায়, চার্বাকরা বলেন যে–

‘ন চৈকসন্তান বর্তিনোশ্চেতসো দেহান্তর সমাশ্রয়ণং যুক্তম্, গজবাজ্যাদিচিত্তবদেকসন্তান-সম্বন্ধিত্বহানি প্রসঙ্গাৎ’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৭০)
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন) ভিন্নদেহবর্তী গজ ও অশ্ব অথবা বরাহ ও মহিষের চিত্তকে আমরা কখনও একই বিজ্ঞানসন্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না, কারণ এক প্রবাহবর্তী চেতনার ভিন্নদেহ আশ্রয় করার ধারণা অযৌক্তিক।


অতএব, চার্বাকমতে, অনুরূপভবে ইহলোকবর্তী এবং পরলোকগত দেহ পরস্পর ভিন্ন হওয়ার ফলে সেই দেহান্তর্গত বিজ্ঞানগুলিকেও এক অভিন্ন প্রবাহভুক্ত করা চলে না।
এক্ষেত্রে বৌদ্ধরা হয়তো বলতে পারেন যে সদৃশ বস্তু থেকেই কেবল অপর সদৃশ বস্তুর আবির্ভাব সম্ভব, অসদৃশ বস্তু থেকে নয় এবং এইজন্যই আদি বিজ্ঞানের উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধান করতে হলে পূর্ববর্তী অপর বিজ্ঞানের অস্তিত্বের কল্পনা ব্যতীত গত্যন্তর নেই।
কিন্তু চার্বাকেরা বলবেন যে, এই যুক্তির অনুসরণে ধোঁয়ার কারণ হবার যোগ্যতা কেবল ধোঁয়ারই থাকে, আগুনের নয়। যদি বলা হয়, ধোঁয়া এবং আগুন উভয় বস্তুই ‘রূপরূপতা’ এই ধর্মে সদৃশ, অর্থাৎ দুটি বস্তুরই রূপ আছে, যা একটিকে অপরটির কারণ হবার যোগ্যতা দিয়েছে, তাহলে চার্বাক পক্ষ থেকেও ভূত এবং বিজ্ঞান উভয়েরই সদৃশ ধর্ম হিসেবে ‘স্বলক্ষণরূপতা’কে নির্দেশ করা চলে; অর্থাৎ দুটি বস্তু নিজস্ব লক্ষণযুক্ত রূপে প্রকাশমান এবং এই সদৃশ ধর্মের ভিত্তিতেই একটি অপরটির কারণ হিসেবে নির্দেশিত হতে পারে।
বৌদ্ধরা আপত্তি প্রসঙ্গে বলতে পারেন যে ভৌতিক পদার্থ বিজ্ঞানের মতোই স্বালক্ষণ্যে অবিচল থাকলেও ভৌতিক বস্তুতে বিজ্ঞানরূপতা নেই, যে কারণে বিজ্ঞানের উপাদান কারণ হবার যোগ্যতা ভৌতিক পদার্থে থাকতে পারে না। এর উত্তরে চার্বাকেরা বলতে পারেন যে, এ যুক্তি গ্রহণ করলে আগুনও ধূমের উপাদান কারণ হতে পারে না, কারণ আগুনের মধ্যে ধূমরূপতার অভাব। কাজেই আগুনকে যাঁরা ধোঁয়ার কারণ রূপে নির্দেশ করেন, ভূতসংঘাতকে বিজ্ঞানের জনক বলতে তাঁদের কোন বাধা থাকতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের তর্কযুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে সীমারেখা টানা যায় না এবং ভূতচৈতন্যবাদীদের সঙ্গে জন্মান্তরবাদের সমর্থকদের যে সংঘর্ষ ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রসারিত তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথম পক্ষের যোদ্ধারা বিজয়ীর সম্মান দাবি করেছেন, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পক্ষের তর্কবাণের আক্রমণে তাঁরা পরাভূত বলে মনে হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো, অন্যান্য বহু বিষয়ের মতো জন্মান্তরবাদও ভারতীয় দর্শনে যুক্তির পথ দিয়ে প্রবেশ করেনি।

৮.
জন্মান্তরবাদ ছাড়াও জন্মান্তরবাদের সঙ্গেই অচ্ছেদ্য বন্ধনসূত্রে আবন্ধ চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত অপর ধারণাটি হলো কর্মফলবাদ। এই কর্মফলবাদ ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অধ্যাত্মজীবনের স্তম্ভ স্বরূপ।
‘জন্ম থেকে জন্মান্তরে ভিন্ন ভিন্ন শরীরের মাধ্যমে জীবের যে ভোগবৈচিত্র্য তার কারণ হিসাবে ভারতের দর্শনে কর্মবৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জীবের প্রাক্তন কর্মের ক্ষয় একমাত্র ভোগের মাধ্যমেই হতে পারে, এবং এই ভোগের বিভিন্নতা ভারতীয় দার্শনিকদের মতে পূর্বকৃত কর্মের বৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। দেহধারী জীবের পক্ষেই কেবল এই বিচিত্র ভোগ সম্ভব এবং সেইজন্য ভোগের মাধ্যমে প্রাক্তন কর্মের সংস্কার ক্ষয় করার জন্য বিশেষ পরিবেশে বিশেষ শরীরে মানুষকে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করতে হয়। ভারতের অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা তাই শরীর সৃষ্টির উপাদান হিসাবে পঞ্চ মহাভূতকে স্বীকৃতি দিলেও এ ব্যাপারে মহাভূতের স্বতন্ত্র কারণতা অনুমোদন করেন না। তাঁদের মতে পঞ্চভূত থেকে জীবদেহের উৎপত্তির মূলে কার্যকরী জীবনের পূর্বকৃত কর্মের সংস্কারের প্রেরণা।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১১-২)।
এ-প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের দৃষ্টান্তে বলা হয়েছে–

‘পূর্ব্বকৃত-ফলানুবন্ধাৎ তদুৎপত্তিঃ’। (ন্যায়সূত্র-৩/২/৬০)
অর্থাৎ : পূর্বকৃত কর্মফলের (ধর্ম ও অধর্ম নামক অদৃষ্টের) সম্বন্ধপ্রযুক্ত সেই শরীরের উৎপত্তি হয় (অর্থাৎ শরীর-সৃষ্টি আত্মার কর্ম বা অদৃষ্ট-নিমিত্তক, এটাই তত্ত্ব)।


কিন্তু জন্মান্তরবাদে অবিশ্বাসী চার্বাকেরা স্বাভাবিক কারণেই জন্মান্তরবাদের সঙ্গে সমসূত্রে গাঁথা কর্মফলবাদকেও স্বীকৃতি দিতে অসম্মত। অধ্যাত্মবাদীরা যেখানে স্থূল ভূতের উপাদানে গঠিত বস্তুনিচয়কে তাত্ত্বিকক্রমে গৌণ মর্যাদা দেন, নাস্তিক চার্বাকদের বিবেচনায় সেখানে ভৌতিক স্থূল পদার্থের মুখ্য ভূমিকা জাগতিকক্রমে। এবং এই জড় ভূতের উপাদানে গঠিত দেহ থেকেই উৎপন্ন জাগতিক অপরাপর তত্ত্ব, মন, বুদ্ধি চৈতন্য ইত্যাদি। ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের মতে, ন্যায়সূত্রে নাস্তিকদের এই মনোভাব উল্লেখ করে বলা হয়েছে–

‘ভূতেব্যো মূর্ত্ত্যুপাদানবত্তদুপাদানম্’। (ন্যায়সূত্র-৩/২/৬১)
অর্থাৎ : (নাস্তিকমতে) ভূতবর্গ হতে (উৎপন্ন) মূর্তদ্রব্যের অর্থাৎ সাবয়ব বালুকা প্রভৃতি দ্রব্যের গ্রহণের ন্যায় তার (শরীরের) গ্রহণ হয়।


তার মানে, নাস্তিকেরা জীবদেহসৃষ্টিতে জীবের অনুষ্ঠিত প্রাক্তন কর্মের নিমিত্ততা স্বীকার করেন না। শর্করা, পাষাণ ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে যেভাবে নানা ধরনের মূর্তির নির্মাণ, প্রাণীদেহও তাঁদের মতে ঠিক সেই ভাবেই বিভিন্ন ভৌতিক উপাদানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে কর্মফলবাদের অন্তর্ভুক্তির মূলে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রেরণা, সে দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাকদর্শনে অনুপস্থিত। এ কারণেই আত্মা, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদির মতো এই কর্মফলবাদের ধারণাও চার্বাক মতবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।

কর্মফলের মতো মোক্ষও স্বাভাবিকভাবেই ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাকদের ধারণায় প্রবেশ লাভ করেনি। চার্বাক-মতে মৃত্যুর পর দেহের বিনাশকেই মোক্ষ সংজ্ঞায় অভিহিত করা যায়। চার্বাকেতর বিভিন্ন দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থে চার্বাকমতের বর্ণনায় এ-প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–

‘দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
‘দেহস্য নাশো মুক্তিঃ’। (সর্বদর্শন সংগ্রহ)
‘মরণেব চ মোক্ষঃ’। (সর্বমতসংগ্রহ)
নরকানুভবো বৈরিশস্ত্রব্যাধ্যাদ্যুপদ্রবঃ।
মোক্ষস্তু মরনং তচ্চ প্রাণবায়ুনিবর্তনম্ । (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১০)
অর্থাৎ :
(লোকায়তিক-চার্বাক মতে) দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।  দেহের নাশই মুক্তি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।  মরণেই মোক্ষ। (সর্বমতসংগ্রহ)।। শত্রুর অস্ত্র অথবা ব্যাধি প্রভৃতির উপদ্রবই নরকানুভব। মরণই মুক্তি এবং সেই মরণ হলো প্রাণবায়ুর চিরতরে বহির্গমন। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১০)।।


এছাড়া ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক ইত্যাদি সম্বন্ধীয় অপর কয়েকটি ধারণা ভারতীয় অধ্যাত্মধারণার আবশ্যিক অঙ্গ না হয়েও ভারতীয় জনমানসে বহুদিন থেকে স্থায়ী আসন অধিকার করে আছে। চার্বাক-মতে স্বর্গ, নরক ইত্যাদির ভোগ ইহজন্মেই হয়। যেমন–

‘স্বর্গনরকাবপি ন স্তঃ’। (সর্বমতসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) স্বর্গ বা নরক বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।

কিংবা–

ইহলোকাৎ পরো নান্যঃ স্বর্গোহস্তি নরকা ন চ।
শিবলোকাদয়ো মূঢ়ৈঃ কল্প্যন্তেহন্যৈঃ প্রতারকৈঃ।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৮।।
অর্থাৎ : (লোকায়তিক মতে) ইহলোক থেকে পৃথক স্বর্গ অথবা নরক নামক কোন স্থান নেই। মূর্খ এবং প্রতারকেরাই শিবলোকাদির কল্পনা করে থাকে।

এবং–

ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।
নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : স্বর্গ বলে কিছু নেই, অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল।


ফলে চার্বাকেরা দেশের রাজাকেই পরমেশ্বর আখ্যায় সংজ্ঞায়িত করেছেন–

‘অতএব কণ্টকাদি-জন্যং দুঃখমেব নরকঃ।
লোক-সিদ্ধ রাজা পরমেশ্বরঃ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) সুতরাং কণ্টকাদি জন্য দুঃখই নরক। লোকপ্রসিদ্ধ রাজই পরমেশ্বর।

কারণ, প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতিতে রাজা বহু ক্ষেত্রেই ঈশ্বর পদবাচ্য। এমনকি, মজার বিষয় হলো, ‘মনুস্মৃতি’তেও এই নজির বিরল নয়, যেমন–

‘বালোহপি নাবমন্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ।
মহতী দেবতা হ্যেষা নররূপেণ তিষ্ঠতি।।’ (মনুসংহিতা-৭/৮)
অর্থাৎ : রাজা বালক হলেও তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। কারণ, এই রাজা প্রকৃতপক্ষে একজন অসাধারণ দেবতা, ইনি মানুষের আকারে পৃথিবীতে অবস্থান করেন।

। চার্বাকী দেহাত্মবাদী সিদ্ধান্ত-খণ্ডন প্রয়াসের পর্যালোচনা।

চার্বাকী দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াসে চার্বাকেতর দার্শনিকদের উপরিউল্লিখিত যুক্তি বিস্তারের নমুনা থেকে শেষপর্যন্ত কী প্রমাণ হলো এবং সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের কতোটা বোধগম্য হয়েছে তা নিশ্চয় করে বলার সুযোগ নেই। তবে দেবীপ্রসাদের ভাষ্যানুযায়ী তাঁরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি ও যুক্তিকৌশলের উৎকর্ষ দেখাবার উৎসাহেই যুক্তি-বিস্তারণ যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাতে আসলেই সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় যে, চার্বাকদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে এ-ধরনের কূট তর্ক আদপেই তোলবার দরকার ছিলো কিনা। এমনতর অনেক কথাই যে দেহাত্মবাদের বিচার প্রসঙ্গে অনেকের লেখায় চোখে পড়েছে তা হয়তো পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু এতে করে চার্বাকদের পক্ষ থেকে দেহাত্মবাদের সমর্থনে ইতঃপূর্বে যে মদশক্তির উপমা ব্যবহার করা হয়েছে, বিপক্ষ দার্শনিকদের এতো কূটতর্কের অবতারণার পরও সেই দেহাত্মবাদ কি খণ্ডন করা সম্ভব হয়েছে?


বলাই বাহুল্য, মদ্য প্রস্তুতের উপাদানগুলির মধ্যে কোনোটি থেকেই– বা এগুলিকে যেন-তেন-প্রকারে এক জায়গায় জড়ো করলেই– মদ তৈরি হয় না; অর্থাৎ মদশক্তি বা মাদকতা জননের সামর্থ্য সম্ভব নয়। কিন্তু এগুলিরই কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ তৈরি হয় এবং তাতে মদশক্তি বলে এক অভূতপূর্ব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। যতোই উৎসাহ থাক, কথাটা উড়িয়ে দেওয়া আদৌ কি সম্ভব? বলা যায় একেবারেই অসম্ভব। এবং এই নজির মানতে বাধ্য হলে দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে মূল আপত্তিটা আর অত জোর গলায় তোলার সুযোগ থাকে না হয়তো; কেননা সে-আপত্তি বলতে তো এই যে, আগুন বাতাস জল প্রভৃতি দেহগঠনের উপাদানগুলি দিয়েই তৈরি নিছক দেহের মধ্যে চৈতন্য বলে গুণের পরিচয় সম্ভব নয়। এই কারণেই দেহবাসী চেতন আত্মা মানা দরকার। কিন্তু উপাদান-সামগ্রীতে যে-গুণের পরিচয় নেই সেগুলিরই বিশেষ পরিণামের ফলে ওই উপাদান-গঠিত বস্তুতেই অভূতপূর্ব গুণ– বর্তমান দৃষ্টান্তে চৈতন্য প্রভৃতি গুণ– আবির্ভূত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়। তার মানে, দেহগঠনের উপাদানগুলি স্বয়ং-অচেতন, শুধুমাত্র এই যুক্তি দিয়ে দেহাত্মবাদ খণ্ডন পর্যাপ্ত হতে পারে না।

‘তাই দেহাত্মবাদের বিচারে আমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন এই নয় যে এই প্রসঙ্গে কত দার্শনিক কতরকম কূট তর্কের নমুনা দেখিয়েছেন। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, চার্বাকমতের পক্ষে এই মূল নজিরটি অন্যান্যরা কতটা সার্থক ভাবে খণ্ডন করতে পেরেছেন?
যতদূর মনে হয়, দৃষ্টান্ত হিসাবে মদশক্তির এই দৃষ্টান্তটি নিয়ে বিপক্ষ দার্শনিকেরা খুব একটা তর্কাতর্কি তোলেননি। তার একটা কারণ এই হতে পারে যে দৃষ্টান্ত হিসাবে এটা উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়, হয়তো সম্ভবও নয়। তাছাড়া, তাঁরা হয়তো বলবেন, শুধুমাত্র একটা দৃষ্টান্তর নজির থেকে অত বড় একটা সিদ্ধান্ত– দেহাত্মবাদ– সুনিশ্চিত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নিরর্থক। তার মানে অবশ্য এই নয় যে দার্শনিক বিচারে দৃষ্টান্তর গুরুত্ব নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু নিছক কোনো দৃষ্টান্তর– বিশেষত এমন এক দৃষ্টান্তর যা মোটের উপর খুব প্রচলিত নয়, বরং তুলনায় দুর্লভ ক্ষেত্রেই পরিদৃষ্ট হয়– তার উপর ঐকান্তিক নির্ভরতা অতি-বড় অপ্রচলিত দার্শনিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে হয়তো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। যাই হোক এবং যে-কোনো কারণেই হোক, বিপক্ষ সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা মদশক্তির দৃষ্টান্ত নিয়ে তেমন কিছু তর্কাতর্কি করেননি। তার বদলে অন্যান্য অনেক যুক্তি দেখিয়ে দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস করেছেন।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮২-৩)

ইতোমধ্যেই আমরা তঁদের অনেকগুলি যুক্তিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি; যদিও তাঁদের সমস্ত যুক্তির কোনো তালিকা তৈরি করার সুযোগ নেই এবং তা সম্ভবও নয়। তার বদলে তাঁদের কয়েকটি প্রসিদ্ধ– এবং অন্তত আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ– যুক্তির বিচারই বর্তমান উদ্দেশ্যের পক্ষে পর্যাপ্ত হতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের আলোচনা রীতি অনুসরণ করা যেতে পারে, যা আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। দেহাত্মবাদ খণ্ডনে চার্বাকেতর দার্শনিকদের যুক্তি হিেেসব এখানে বোধকরি বিশেষত দুটির আলোচনা যথার্থ হবে।–

ক। দেহাত্মবাদের সমর্থনে চার্বাকেরা আগুন, বাতাস, জল প্রভৃতি স্বয়ং-অচেতন বা জড় ভূতবস্তুগুলির ‘বিশেষ পরিণাম’ হিসেবে যে-কথা বলতে চান তা আসলে বিচারের ধোপে টেকে না। বিশেষত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন এই কথাটি বেশ ফলাও করে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হলো, আর যে-যাই-বলে-বলুক, বিশেষত চার্বাকদের মুখে একথাটা একেবারেই শোভা পায় না।

খ। চৈতন্য প্রভৃতিকে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার ধর্ম বলে স্বীকার না-করে চার্বাকেরা যে-ভাবে নিছক দেহধর্ম বলে প্রতিপন্ন করতে চান তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো মৃতদেহের সাক্ষ্য। চৈতন্য প্রভৃতি যদি শুধুমাত্র দেহেরই গুণ বা লক্ষণ হতো তাহলে যতক্ষণ বা যেখানেই দেহ বর্তমান ততক্ষণ সেখানেই চৈতন্য প্রভৃতি থাকবার কথা। কিন্তু আসলে দেখা যায় যে দেহ থাকা সত্ত্বেও চৈতন্য নাও থাকতে পারে; তারই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত মৃতদেহ। ন্যায়বৈশেষিকের প্রথা অনুসারে জয়ন্তভট্ট যেমন তাঁর স্বভাবসুলভ হেঁয়ালিপূর্ণ বক্তব্যে খুব সাঁটে বলছেন–

‘শরীরং চৈতন্যশূন্যং, শরীরত্বাৎ মৃতশরীরবৎ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : শরীর আসলে চৈতন্যশূন্য, কেননা তা নিছক শরীর, যেমন কিনা মৃতশরীর।


শঙ্করাচার্য অবশ্য যুক্তিটা এরকম সাঁটে বলেননি; তাঁর স্বভাব সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মূলত একই যুক্তি। এবং অন্যান্য নানা দার্শনিকও এই যুক্তিকেই চলতি কথায় যাকে বলে ‘তুরুপের টেক্কা’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, অনেকের কাছেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনে এই যেন মোক্ষম প্রমাণ। এছাড়া স্মৃতির নজিরকেও দেহাত্মবাদ খণ্ডনে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের পক্ষ থেকে দেহাত্মবাদ খণ্ডনের নমুনা হিসেবে মূলত এই ক’টি প্রধান যুক্তিই পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে যে এ-ক’টির বলে দেহাত্মবাদ সত্যিই খণ্ডন হয় কিনা, কিংবা যা প্রায় একই কথা, দেহ ছাড়াও চৈতন্য-বিশিষ্ট আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু মানবার বাধ্যবাধকতা থাকে কিনা।

.
ক। ‘দেহাকারে পরিণাম’ নিছক ভূতবস্তু না বাড়তি কিছুর ফল?।

‘ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরা জানেন, মধ্যযুগ থেকে– কিংবা নাগার্জুনের কথা মনে রাখলে বোধহয় মানতে হবে প্রাচীন কাল থেকেই– এদেশে দার্শনকি দ্বন্দ্বের একটা কৌশল হিসেবে বিপক্ষকে একভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা ছিল। কী-ভাবে কোণ-ঠাসা করা? বিপক্ষের মত উল্লেখ করে প্রথমে দেখানো বিপক্ষের পক্ষেই ঠিক কী কী সম্ভাব্য অর্থে এই মত ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। তারপর দেখানো, এর মধ্যে কোনো অর্থই যুক্তিসহ নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৪)

দেহাত্মবাদ খণ্ডন প্রসঙ্গে গুণরত্ন এই রকম একটা দার্শনিক কায়দার পরিচয় দিয়েছেন। কীভাবে?
প্রথমত মনে রাখতে হবে, আগুন-বাতাস-জল-মাটি থেকেই চার্বাকমতে দেহ গঠিত হলেও চার্বাকেরা নিশ্চয়ই মানতে বাধ্য হবে যে ওই ভূতবস্তুগুলিকে যা-হোক-তা-হোক করে একজায়গায় জড়ো করে দিলেই তা থেকে দেহগঠন সম্ভব হবে না, যেমন মদ তৈরির উপকরণগুলি যে-কোনভাবে একত্র করলেই তা থেকে মদ তৈরি হয় না। চার্বাকদের এই বক্তব্যটা নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন এভাবে–

‘বিশেষ পরিণামের ফলে জড়পদার্থগুলিই কোনোরকম বিশেষ শক্তিসম্পন্ন হলে সেগুলিতেই জ্ঞান বা চৈতন্য উৎপন্ন হয়; যেমন গুড় পিষ্ট প্রভৃতিতে আগে মদশক্তির পরিচয় না-থাকলেও সেগুলিই সুরাকারে পরিণত হলে মদশক্তি লাভ করে। তেমনি ভূতবস্তুগুলি মাটি প্রভৃতি অবস্থায় অচেতন হলেও সেগুলিই ‘দেহাকারে পরিণত’ হলে চৈতন্যবিশিষ্ট হয়।’- (ন্যায়মঞ্জরী)


আগেই বলা হয়েছে, চার্বাকদের বক্তব্য যে মোটের উপর এইরকমই ছিলো তা প্রামাণিক লোকগাথা প্রভৃতি থেকেও স্বীকার করার যথেষ্ট কারণ আছে। অতএব, চার্বাকমতের একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে ‘দেহাকারে পরিণাম’ বলে কোনো একরকম পরিবর্তন স্বীকার না করে উপায় নেই।
এবং ঠিক এই কথাটি নিয়েই গুণরত্ন চার্বাকদের কোণঠাসা করতে চান। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘দেহাকারে’ বা ‘কায়াকারে’ পরিণাম না-মেনে চার্বাকদের গত্যন্তর নেই; কিন্তু চার্বাকরা কীভাবে তার ব্যাখ্যা করবে?

গুণরত্নর মতে, চার্বাকপক্ষ থেকে ঘটনাটার মাত্র তিনরকম ব্যাখ্যা সম্ভব, চতুর্থ কিছু থাকতে পারে না। এইভাবে দেহাত্মবাদীকে কোণঠাসা করে গুণরত্ন দেখাতে চান, তিনটির মধ্যে কোনোটিই চার্বাকমতে স্বীকৃত হতে পারে না। অর্থাৎ দেহাত্মবাদী একদিকে ‘কায়াকারে’ পরিণত হবার কথা বলতে বাধ্য, কিন্তু অপরদিকে স্বমত-সম্মত ভাবে ঘটনাটির কোনোরকম ব্যাখ্যাই দিতে পারেন না।
দেহাত্মবাদীর পক্ষে ‘কায়াকারে’ বা ‘দেহাকারে’ পরিণামের কারণ মোটের উপর তিনরকম হতে পারে–
এক : শুধুমাত্র পৃথিবী প্রভৃতি ভূতই তার কারণ।
দুই : ঘটনাটির আসল কারণ অন্য কিছু। দার্শনিক পরিভাষায় তাকে বলে ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি।
তিন : ব্যাপারটা অহেতুক, অর্থাৎ তার কোনো কারণই নেই।

প্রথমত, দেহাত্মবাদী নিশ্চয়ই বলতে পারে না যে শুধুমাত্র পৃথিবী প্রভৃতি ভূতবস্তুই কায়াকারে পরিণামের কারণ। কেননা, এই ভূতবস্তুগুলি তো সর্বত্রই বর্তমান এবং শুধুমাত্র এগুলিই যদি শরীররূপে পরিণত হবার পর্যাপ্ত কারণ হয় তাহলে তো সর্বত্রই কায়াকার ঘটবার কথা। তাহলে কি দেহাত্মবাদী বলবে, ভূতবস্তুগুলিই কায়াকারে পরিণত হবার কারণ হলেও এই পরিণতির জন্যে ‘সহকারি কারণ’ হিসেবে আরো কিছু মানা দরকার। যেমন, ধোঁয়ার আসল কারণ অবশ্যই আগুন; কিন্তু গনগনে লোহার পিণ্ডে আগুন থাকলেও ধোঁয়া থাকে না– তার জন্য ভেজা কাঠ জাতীয় সহকারী কারণ থাকা দরকার। কিন্তু ভূতবস্তুর পক্ষেও শরীর-আকারে পরিণত হবার জন্য কোনো রকম সহকারী কারণ কি মানা যায়?
গুণরত্ন বলছেন, সহকারী কারণের কথা আর যার মুখেই শোভা-পাক-না-কেন, অন্তত চার্বাকদের মুখে শোভা পায় না। কেননা তামাম দুনিয়ায় চার্বাকমতে এই ভূতবস্তুগুলি ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই সহকারী কারণ আর কোনো কিছু মানা চার্বাকের পক্ষে অসম্ভব, কিংবা, যা একই কথা, মানতে গেলে চার্বাকের পক্ষে নিজের মূল প্রতিপাদ্যই পরিহার করতে হবে। তথাকথিত ‘সহকারী কারণ’টিকে পৃথিবী প্রভৃতি ভূতপদার্থেরই বৈশিষ্ট্য বলে ব্যাখ্যা করতে গেলে কিন্তু আবার সর্বত্রই দেহাকারে পরিণাম হবার কথা। অতএব, সংক্ষেপে, গুণরত্নর বক্তব্য হলো : হয় ভূতবস্তুকেই একমাত্র সত্য বলে বক্তব্য ছাড়ো, না-হয় তো কায়াকারে পরিণামের কথা ছাড়ো।
আর, এতোশত ঝামেলা এড়াতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি বলতে চাও যে দেহাকারে পরিণাম সম্পূর্ণ অহেতুক– তার কোনো কারণই নেই– তাহলে একদিকে যেমন যখন-তখন যেখানে-সেখানে দেহাকারে পরিণতির সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে, অপরদিকে তেমনই কোথাওই এবং কখনোই তার সম্ভাবনা মানা যাবে না : কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া একটা ঘটনা যেমন যত্রতত্র ঘটতে পারে আবার তেমনি কোথাওই তা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। মোদ্দা কথা : কোনো ঘটনাকে অহেতুক বললে তা নিয়ে আর কোনো দার্শনিক আলোচনার সুযোগই থাকে না।

এটাকেই কূট-তর্ক বলে কিনা সে-প্রশ্ন না করেও বলা যায় গুণরত্নের যুক্তি-চাতুর্য অবশ্যই স্বীকার্য। ঐতিহাসিকভাবে চার্বাকেরা এজাতীয় যুক্তিবিন্যাসের সত্যিই কোনো জবাব দিতে পারতেন কিনা– বা এই রকম যুক্তির মারপ্যাচের সত্যিই বড় একটা পরোয়া করতেন কিনা– আমাদের পক্ষে মনে হয় আজ তা নিশ্চিতভাবে জানবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গুণরত্নের যুক্তিটা এমনই অমোঘ যে চার্বাকপক্ষ থেকে তার কোনো জবাবই হয় না। বরং খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চার্বাকপক্ষ সমর্থনে এহেন যুক্তির জবাব অসম্ভব নয়।
কী জবাব হতে পারে?

দেবীপ্রসাদ বলছেন– ‘একথায় অবশ্যই সন্দেহ নেই যে আগুন-বাতাস-জল-মাটিকে যেমন-তেমন-ভাবে একত্র করলেই ‘দেহাকারে পরিণাম’ সম্ভব নয়। এটুকু কথা যে চার্বাকেরা বুঝতেন না– তা কল্পনা করারও কোনো কারণ নেই। কেননা, চার্বাকদের বেকুব বলে প্রচার করার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এটুকু প্রত্যক্ষসিদ্ধ ঘটনা তাঁদের পক্ষে অবশ্যই বোঝবার কথা। অতএব গুণরত্ন-বর্ণিত প্রথম পক্ষটি চার্বাক-পক্ষ বলে কল্পনা করার কোনো কারণ নেই। তৃতীয় পক্ষটিও নয় : অর্থাৎ, ‘কায়াকারে পরিণাম’ হিসেবে বর্ণিত ব্যাপারটাকে নেহাতই অহেতুক বলে স্বীকার করে চার্বাকদের পক্ষে একেবারে হাল ছেড়ে দেবার সম্ভাবনাও সুদূর-পরাহত; তাহলে তো মতটা সমর্থন করার আর কোনো সুযোগই থাকে না। অর্থাৎ, গুণরত্নের যুক্তি-খণ্ডনে চার্বাকেরা সত্যিই কী বলতেন-না-বলতেন– আমাদের পক্ষে আজ তা নিশ্চিতভাবে জানবার মতো সুনিশ্চিত কোনো তথ্য না-থাকলেও অন্তত এটুকু অনুমান করার সুযোগ আছে যে, যে-তিনটি সম্ভবপর পক্ষ দেখিয়ে গুণরত্ন তাঁদের কোণঠাসা করতে গিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্তত দুটি চার্বাকপক্ষ থেকে মানবার কোনো কারণ নেই। তাহলে বাকি থাকে মাত্র আর একটি পক্ষ। দার্শনিক পরিভাষায় তা হলো ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৬)

এই ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’র ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। চার্বাকমতে প্রকৃত দার্শনিক তত্ত্ব বলতে মাত্র চতুর্ভূত। তামাম দুনিয়ায় এই চতুর্ভূত ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। কিন্তু এই চতুর্ভূতকে যেন-তেন-প্রকারে সমবেত বা একত্র করলেই তো আর দেহাকারে পরিণাম সম্ভব নয়। তাহলে দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যা হিসেবে আরো বাড়তি কিছু মানতে হবে। অর্থাৎ, চতুর্ভূত ছাড়াও আরো কোনো তত্ত্ব মানতে হবে। ওই বাড়তি কিছুকে ‘তত্ত্বান্তর’ বলা হবে।
তার মানে, গুণরত্ন বলতে চান, তোমার নিজের মতেই শুধুমাত্র যা তত্ত্ব বলে ঘোষণা করতে চাও– বা শুধুমাত্র সত্য বলে ঘোষণা করতে চাও– তোমার নিজের পক্ষ সমর্থনেই শুধুমাত্র তাকেই সত্য বলে মানা চলে না। তাছাড়াও আরো কিছু মানা দরকার। এবং এ-হেন বাড়তি কিছুকে যদি মানতে বাধ্য হও তাহলে নিজের মূল মতটা শোধরাতে রাজি হও। স্বীকার করো যে আগুন-বাতাস-জল-মাটি ছাড়াও আরো কোনো সত্য আছে– এ-হেন বাড়তি সত্য না-মানলে কোনো এক বিশেষ অবস্থায় কায়াকারে পরিণাম সম্ভব নয়– এ-হেন ঘটনার আর কী ব্যাখ্যা দেবে?

কিন্তু এইভাবে ‘তত্ত্বান্তর’– বা বাড়তি তত্ত্ব– মানতে বাধ্য হওয়াটা দার্শনিকের পক্ষে মারত্মক ব্যাপার– যাকে বলে হার স্বীকার করা। নিজেই যাকে শুধুমাত্র সত্য বলে ঘোষণা করছো তা ছাড়াও আরো কিছু সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য হও। সোজা কথায়, নিজের দর্শন থেকেই ইস্তফা দাও।
তাহলে কি দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চার্বাকেরা নিরুপায় হয়ে ‘শুধুমাত্র চতুর্ভূতই সত্য’ এই দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন? গুণরত্নের তর্ক-চাতুর্য মেনে নিয়েও উত্তরে বলা যায়, অন্তত এই সম্ভাবনা অনিবার্য নয়। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকার করতে বাধ্য না-হয়েও স্বমত-সম্মতভাবে চার্বাকদের পক্ষে দেহাকারে পরিণামের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
কী রকম ব্যাখ্যা?

এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলছেন– ‘আসলে তত্ত্বান্তরের প্রসঙ্গটা ওঠে কখন?
প্রথমে একটা সহজ দৃষ্টান্ত দেখা যাক। সকলেই মানবেন, ‘অগ্নি উষ্ণ’। কিন্তু একথা মানলেই সকলে কি ‘অগ্নি’ ছাড়াও ‘উষ্ণতা’– বা উষ্ণতার ব্যাখ্যায়– বাড়তি কোনো তত্ত্ব স্বীকার করতে বাধ্য? নিশ্চয়ই নয়। কেন নয়? কারণ, ‘উষ্ণতা’ অগ্নি-বহির্ভূত স্বতন্ত্র কিছু নয়। অগ্নির স্বভাবই হলো ‘উষ্ণ’। তাই উষ্ণতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অগ্নি ছাড়া বাড়তি কিছু মানতেই হবে– এ-হেন দাবি চলতি কথায় যাকে বলি এঁড়ে তর্ক। বাজে কথা।
তাহলে ‘স্বভাব’ বলে কোনো কিছু মানার একটা সুযোগ আছে। জল শীতল। কেন শীতল? জলের স্বভাবই তাই। কোনো দার্শনিক মুখে স্বীকার করুন-আর-নাই-করুন, ‘স্বভাব’ বলে একটা কিছু মানতেই হবে, এবং ‘স্বভাব’ বলে কিছু মানা মানেই ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি নয়। তত্ত্বান্তরের প্রসঙ্গ তাহলে ওঠে কখন? স্বমত-স্বীকৃত তত্ত্বর স্বভাব-বহির্ভূত কোনো কিছু মানলে। নইলে নয়।
এই কথা মনে রাখলে চার্বাকমতের সমর্থনে চতুর্ভূতেরই দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যার জন্যে তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি অনিবার্য নয়। চার্বাকপক্ষ থেকে অনায়াসেই বলা যায়, চতুর্ভূতের স্বভাবই হলো ‘পরিস্থিতি-বিশেষে তা দেহাকারে পরিণত হয়’। এখানে কোটেশন চিহ্ন ইচ্ছে করে ব্যবহার করছি, কেননা পুরো বক্তব্যটাকেই চতুর্ভূতের স্বভাব বলে বর্ণনা করতে চাই। কূট তার্কিক অবশ্যই আপত্তি তুলতে পারেন যে ‘পরিস্থিতি-বিশেষ’ বলে ব্যাপারটাকে আলাদা করে বুঝতে হবে; ওটাকে চতুর্ভূতের স্বভাবের মধ্যে গুঁজে দেওয়া চলবে না। এবং আলাদা করে ভাবলে তত্ত্বান্তরের স্বীকৃতি থেকে যায়। কিন্তু এ-হেন আপত্তিতে চার্বাকের পক্ষে বিচলিত হবার কারণ নেই। কেননা, পরিস্থিতি-বিশেষকে কেন আমরা আলাদা করে ভাবতে বাধ্য হবো? স্বভাব বলে ব্যাপারটা কখনো বা সরল আবার কখনো বা জটিল হতে পারে। ভারতীয় দর্শনে স্বভাব-এর ব্যাখ্যায় অনেকরকম প্রাকৃতিক নিদর্শন বা নমুনার কথা পড়েছি। নিম তেতো; খেজুর মিষ্টি। কিন্তু কেন? কেননা ওদের স্বভাবই ওই রকম। আধুনিক বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করুন। নিম কেন তেতো বা খেজুর কেন মিষ্টি– এজাতীয় প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই অল্প-বিস্তর দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেবেন। অত কথা অবশ্যই প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকদের জানা ছিল না, থাকবার কথাও নয়। কিন্তু তাঁরা যখন বলতেন, নিমের স্বভাবই তিক্ততা বা খেজুরের স্বভাবই মধুরতা তখন তাঁদের প্রকৃত বক্তব্যটুকু আজকের দিনে আমরা কী ভাবে বুঝবো? আধুনিক বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় পুরোটাই জটিল ব্যাপার। কিন্তু পুরোটাকে আলাদা-আলাদাভাবে ভেঙে বোঝাবার চেষ্টা নিরর্থক। পুরো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতিটি উপাদান ভেঙে এবং আলাদা-আলাদা ভাবে বুঝতে গেলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ‘স্বভাব’ বলে ধারণাটাও অর্থহীন হয়ে যাবার আশঙ্কা। চার্বাক-পক্ষ থেকেও এই কথা, চার্বাকদের বিপক্ষের পক্ষেও একই কথা। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অবহেলা করার কোনো প্রস্তাব আমাদের কাছে স্বীকৃত হতে পারে। অবশ্য সেইসঙ্গে একথাও মানা দরকার যে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বিতর্কটার বিচার প্রাচীন ভারতীয় চিন্তার সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ রাখা প্রাসঙ্গিক। যেমন ধরা যাক চতুর্ভূত-এর (বা পঞ্চভূত-এর) কথা : আগুন বাতাস জল মাটি (এবং তার সঙ্গে অনেকে আকাশ বলে পঞ্চম একটা ভূতপদার্থ জুড়েছেন)। চার্বাকমতে সত্য চতুর্ভূতই; অন্যান্য নানা দার্শনিকের মতেও ভূতপদার্থের তালিকা মোটামুটি একই রকম। অন্যান্যরা এই ভূত-পদার্থকেই একমাত্র সত্য বলে স্বীকার করতে রাজি না হলেও ভূতপদার্থ বলতে তাঁদের জ্ঞান-গম্মি ওই পর্যন্তই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আগুন বাতাস জল প্রভৃতির কতটুকু বা আজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে? শুধু প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের কথাই বা কেন? প্রাচীন গ্রীক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শনের বেলাতেও একই কথা। যুগের পর যুগ ধরে ভূতপদার্থের জ্ঞান বেড়েছে, ধারণাও বদলেছে। বিশ্বপ্রকৃতি প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এবং জ্ঞানের এই অগ্রগতির দৌড় আজ এমন প্রচণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও প্রাচীন দর্শনের আলোচনা নিছক অজ্ঞানের আবর্জনা বলে বর্জিত হয়নি, বা অন্তত তা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মানুষ আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে এবং কোনদিকে কীভাবে আগামীকাল তার অগ্রগতির পথ নির্ণীত হবে তা উপলব্ধির জন্যে অতীতকে আরো ভালো করে বোঝবার তাগিদ থেকে গিয়েছে। সোজা কথায়, অজ্ঞানের অপবাদ দিয়ে অতীতটাকে একেবারে মুছে ফেলা যায় না। তাহলে ইতিহাস বলে ব্যাপারটাই বরবাদ হবার আশঙ্কা।… ইতিহাসের চর্চা চলছে, চলবে। কেননা, অতীতের উপর থেকে পর্দা সরাতে পারলেই ভবিষ্যতের পথ নির্ণয় করার প্রয়াস তুলনায় নির্ভুল হয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৭-৯)

তার মানে, আধুনিক বিজ্ঞানের মানদণ্ডে বিচার করে প্রাচীন দর্শনকে একেবারে বাতিল করার প্রস্তাবটা যুক্তিযুক্ত হবে না। ফলে প্রাচীন দর্শনের বিতর্ক প্রসঙ্গে প্রাচীন যুগের দিকেই ফিরে তাকাতে হবে। সেক্ষেত্রে তাহলে প্রাচীন বিতর্কটার পুনর্বিচারে প্রাচীন কালের ধ্যান-ধারণার সাধারণ চৌহদ্দির কথা ভুলে গেলে চলবে না। সেই চৌহদ্দির মধ্যেই চার্বাকেরা দাবি করেছিলেন, ভূতপদার্থ থেকেই প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উদ্ভব। আধুনিক বিজ্ঞানীদের উচ্চাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা মনে রেখেও বোধ হয় বলা যায় প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উদ্ভব বা উৎপত্তি প্রসঙ্গে সমস্যার চরম সমাধান আমাদের পক্ষে এখনো অপেক্ষা-সাপেক্ষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা অন্তত বলা চলে যে, সে-সমাধানের আশায় আধুনিক বিজ্ঞান ভূতপদার্থ ছাড়াও আত্মা জাতীয় কিছুর প্রাচীন কল্পনা পুনরুজ্জীবনের তাগিদ বোধ করছে না। অবশ্য ভূতপদার্থের স্বরূপ নির্ণয়ে সেকালের সঙ্গে একালের আকাশ-পাতাল তফাৎ, আবার একালের সঙ্গে আগামীকালের পার্থক্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাও আন্দাজ করা সহজ নয়। এটাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রগতি।

কিন্তু সেই প্রসঙ্গেই একথা বলাও আবশ্যক যে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের যৎসামান্য সম্বল সত্ত্বেও চার্বাকেরা যেভাবে সমস্যাটার একটা সন্ধান খুঁজেছিলেন, আধুনিক জ্ঞানের মানদণ্ডে তার মূল্যায়ন অবশ্যই অবান্তর। কিন্তু তারই মধ্যে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের কোনো প্রতিশ্রুতি বা এমনকি কোনোরকম অস্পষ্ট আভাস ছিলো কিনা, এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই অবান্তর নয়। সে-আভাসের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, নিছক ভূতবস্তু থেকেই প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উৎপত্তি ব্যাখ্যার দিকেই আজকের বিজ্ঞানের ঝোঁক, ভূতবস্তু অতিরিক্ত কোনো আত্মার কথায় ফিরে আসবার দিকে নয়। এমনকি, দেবীপ্রসাদের মতে, একথাও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে এই উৎপত্তির ব্যাখ্যায় আধুনিক বিজ্ঞানেও এক অর্থে শেষ পর্যন্ত স্বভাববাদের উপরই নির্ভরতা। কেননা, স্বভাববাদের মূল কথাটা হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাকৃতিক নিয়ম বা স্বভাবকে বোঝবার ব্যাপারেও যে-অগ্রগতি, তার কথা ভুলে যাওয়াও কোনো কাজের কথা নয়; তুলনায় এই প্রসঙ্গে চার্বাকদের যেটুকু জ্ঞান তা একান্তই প্রাথমিক। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা এই যে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই মানুষ শুরু করতে বাধ্য। আধুনিক জ্ঞানের প্রকাণ্ড ইমারত রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। এবং এই ইমারত গড়ার ভিত্তিস্থাপনে যাঁরা প্রথম পদক্ষেপের পরিচয় দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিচারে তাঁদের অবদান অসীম।

‘অনুমান হয় ভূতপদার্থ থেকে চৈতন্য প্রভৃতির উৎপত্তি প্রসঙ্গে চার্বাকদের পক্ষ থেকে চরম কথা ‘স্বভাব’ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তর্কের খাতিরে এই স্বভাবের কথা চেপে গিয়ে ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’ বলে একটা গুরুগম্ভীর যুক্তির অবতারণা বস্তুনিষ্ঠ দার্শনিক বিচারের পরিচায়ক নয়। স্বভাব শব্দের একটা সংকীর্ণ অর্থ উদ্ভাবন করে বিপক্ষের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেবার চেষ্টাও চলবে না। যেমন ‘অগ্নির স্বভাব উষ্ণ’– শুধু এটুকু বলাই পর্যাপ্ত নয়। আরো বলা দরকার : ‘উষ্ণস্বভাব অগ্নির স্বভাবই এই যে অন্যান্য ভূতপদার্থের সঙ্গে নির্দিষ্ট নিয়মে মিলিত এবং পরিবর্তিত হয়ে তা কায়াকারে বা দেহরূপে পরিণত হয়।’ বাড়তি কথাটুকুকে ‘স্বভাব’ ছাড়াও অন্য কিছু বলে কল্পনা করে ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’-র অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯০)

এ-প্রসঙ্গে তাই মদশক্তির দৃষ্টান্তটা আবার উল্লেখ করা যেতে পারে, কেননা এক্ষেত্রেও কি গুণরত্নের মতো প্রখর তার্কিক ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’র অভিযোগ আনবেন? বা এজাতীয় অভিযোগ তোলবার কোনো সুযোগ আছে? শুষ্ক তর্কের খাতিরে হয়তো থাকতে পারে; কেননা মদ্য প্রস্তুতের উপাদানগুলি যেন-তেন-প্রকারে জড়ো করলেই মদ তৈরি হয় না। এগুলিরই একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ তৈরি হয়। কিন্তু এই বিশেষ পরিণাম স্বীকার করা মানেই বাড়তি তত্ত্বের স্বীকৃতি নয়; তা উপাদানগুলির স্বভাব। তার প্রমাণ, অন্য উপাদান দিয়ে মদ তৈরি করা যায় না; শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উপাদান– অতএব সেগুলির নির্দিষ্ট স্বভাব থেকেই মদ তৈরি হয়। ‘বিশেষ পরিণাম’টা তাই তত্ত্বান্তর নয়; উপাদান-সমূহের স্বভাবেরই অন্তর্ভুক্ত।

এখানে উল্লেখ্য, চার্বাকদর্শনের আরেকটি উপপাদ্য হলো ‘স্বভাববাদ’, যে-বিষয়ে আমরা পরে আলোকপাত করবো। তবে এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
‘স্বভাব’ বলে এই ধারণাটি প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সর্বসম্প্রদায়-স্বীকৃত কোনো ধারণা নয়। সম্প্রদায়-বিশেষে তা স্বীকৃত; সম্প্রদায়-বিশেষে সম্পূর্ণ অস্বীকৃত।… ‘স্বভাববাদ’-এর সমর্থক হিসাবে চার্বাকেরাই একমাত্র দার্শনিক হোন-আর-নাই-হোন অন্তত সবচেয়ে অগ্রণী দার্শনিক। পক্ষান্তরে ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা স্বভাববাদ খণ্ডনের সাধ্যমতো প্রয়াস করেছেন।
কেন করেছেন? কেননা, স্বভাববাদ মানায় দেহাত্মবাদ ছাড়াও অন্যান্য দার্শনিক বিপত্তির আশঙ্কা আছে। এমনকি তার ফলে অধ্যাত্মবাদের ভিত টলে যাবার ভয়। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এর একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও উপেক্ষণীয় নয়। বিজ্ঞানী-মহলে– বিশেষত চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের মূল প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে– স্বভাববাদ স্বীকৃত হয়েছে। এদিক থেকে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে চার্বাকমতের একরকম আত্মীয়তা অনুমানের অবকাশ আছে। অন্যান্য দিক থেকেও আছে। আগেও দেখেছি। পরে আরো দেখবো।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯১)

.
খ। মৃতদেহের নজির।

দেহাত্মবাদ খণ্ডনে ভারতীয় দর্শনে একাধিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মৃতদেহের নজির দেখিয়ে এই যুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছে। কিন্তু সহজ সরল ও সুখপাঠ্য হিসেবে সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে শঙ্করাচার্যের রচনা তুলনাহীন বলা চলে। তাই দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে প্রধানতম এই যুক্তিটি বোঝবার জন্য তাঁর লেখাই অনুসরণ করা সুবিধাজনক হবে। তবে যতো সহজ ভাষাতেই শঙ্কর এই যুক্তি প্রকাশ করুন না কেন, ‘ব্যতিরেক’, ‘অব্যতিরেক’ প্রভৃতি কিছু অতি-প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ তিনিও ব্যবহার করেছেন। তাই এ-জাতীয় পারিভাষিক শব্দের তাৎপর্য সাধ্যমতো অক্ষুণ্ন রেখে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনার অনুসরণে সাদামাটা ভাষায় দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে এই মূল যুক্তিটি উপস্থাপন ও পর্যালোচনা করা যায়।
প্রথমে, যুক্তিটা কী?

‘দেহ ছাড়া আত্মা বলে যদি আর কিছু না মানো তাহলে আত্মবাদীরা যে ধর্মগুলিকে আত্মধর্ম বলে স্বীকার করতে চান সেগুলিকেও আসলে দেহধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে। এজাতীয় ধর্ম বলতে শঙ্কর প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য ও স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। দেহাত্মবাদীরা এই ধর্মগুলিকেও নিছক দেহের ধর্ম বলে স্বীকার করতে বাধ্য; অন্য কিছুর ধর্ম বলে মানতে গেলে তো দেহাতিরিক্ত অন্য কিছু– অর্থাৎ আত্মা– মানতে হয়। কিন্তু শঙ্কর দেখাতে চান এগুলিকে নিছক দেহধর্ম বলে প্রমাণ করা অসম্ভব। আসলে আমাদের ক্ষেত্রে দু-রকম ধর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। একরকম হলো নিছক দেহের ধর্ম; আর একরকম ধর্মকে দেহ-অতিরিক্ত কিছুর (আত্মার) ধর্ম বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। তফাৎটা কীভাবে নির্ণয় করা হবে? যা নিছক দেহধর্ম তার লক্ষণ হবে দেহের বিদ্যমানতায় ধর্মটিরও বিদ্যমানতা : যতক্ষণ দেহ থাকবে ততক্ষণ ধর্মটিও থাকতে বাধ্য। যেমন, রূপ। দেহ বর্তমান অথচ তার রূপ অবর্তমান– এ-হেন কথা কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু দেহ বর্তমান হলেও যদি কোন ধর্ম অবর্তমান হয় তাহলে আর কীভাবে তাকে নিছক দেহেরই ধর্ম বলা যাবে? পক্ষান্তরে, এজাতীয় ধর্মকে দেহান্যধর্ম– বা দেহ ছাড়া অন্য কিছুর ধর্ম, অর্থাৎ আরো সহজ কথায়, আত্মার ধর্ম– বলে মানতে আমরা বাধ্য।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯২)

এই যুক্তি মনে রেখে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি ধর্মগুলির কথা বিচার করা যাক। যদি দেখা যায়, দেহ বর্তমান থাক সত্ত্বেও এই ধর্মগুলি অবর্তমান হয় তাহলে এগুলিকে কিছুতেই নিছক দেহধর্ম বলার সুযোগ থাকে না। অথচ বাস্তবে এই ব্যাপারই দেখা যায়– দেখা যায় দেহ আছে অথচ এই ধর্মগুলি নেই। কোথায় দেখা যায়? মৃতদেহের দৃষ্টান্তে। মৃতদেহও দেহ। তাই মৃতদেহেও নিছক দেহধর্ম বর্তমান। যেমন, রূপ– মৃতদেহ থেকে রূপ বলে ধর্মটি উবে যায় না। কিন্তু প্রাণ, চৈতন্য, চেষ্টা ইত্যাদি? অবশ্যই ভারতীয় দর্শনে বোকা-হাবা বলে চার্বাকদের রকমারি গালিগালাজ দেবার প্রথা ছিলো। কিন্তু তাই বলে কি এমনই হাবা যে ওরা বলবে, মৃতদেহেও প্রাণ, চৈতন্য ইত্যাদির পরিচয় আছে? চার্বাকদের অতি-বড় সমালোচকেরাও ওঁদের ঘাড়ে এরকম অসম্ভব কোনো কথা চাপিয়ে দেননি। মড়াটা যে প্রাণহীন, চৈতন্যহীন ইত্যাদি– এই ব্যাপারটা এমনই প্রকট যে চার্বাকের মতো আকাট বোকাও তা যেন স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু একথা স্বীকার করলে আরো স্বীকার করতেই হবে যে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি নিছক দেহধর্ম হতে পারে না। লাশটা তো রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কি প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি ধর্মের লেশমাত্র পরিচয় পাওয়া যায়? নিশ্চয়ই নয়। তা সত্ত্বেও কী করে চার্বাকেরা আত্মা বাদ দিয়ে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতিকে নিছক দেহধর্ম বলে কল্পনা করতে পারেন?

আপাত-দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চার্বাকদের বিরুদ্ধে এ যেন একেবারে মোক্ষম যুক্তি, যা থেকে চার্বাকপক্ষকে বাঁচানোর আর উপায় নেই। হয়তো এই কারণেই অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনের উৎসাহে মূলত এই যুক্তিই প্রয়োগ করেছেন। যদিও সকলের প্রকাশভঙ্গি সমান নয়– কারুর লেখা কঠিন, কারুর লেখা তুলনায় সহজ; কারুর লেখায় যুক্তির সঙ্গে আরো নানা কথা জুড়ে দিয়ে পুরো আলোচনা অনেক বেশি কঠিন-কঠোর করবার প্রয়াস, কারুর লেখায় সে-চেষ্টার পরিচয় তুলনায় কম। কিন্তু মূল যুক্তিটা একই।
এখানে আমাদের পক্ষে তাঁদের প্রতিটি উক্তি উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। আমরা ইতঃপূর্বেই তার কিছু নমুন দেখেছি। চার্বাকপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে খুচরো-খাচরা তর্ক-বিতর্ক তুলেও আলোচনা পল্লবিত করা যেতে পারে; কিন্তু সে-চেষ্টারও প্রয়োজন নেই। যেমন ধরা যাক, চার্বাকপক্ষ থেকে অনায়াসে বলা যেতে পারে, দেহ এবং মৃতদেহ এক নয়। নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক আত্মাবাদীর আচরণ থেকেই তার প্রকাশ পায়। কীভাবে? যে-গুরুজনকে আজ তিনি অতি ভক্তিভরে প্রণাম করেছেন তাঁরই মৃতদেহ আগামীকাল এমনই অপবিত্র হবে যে ছুঁলে স্নান করার বিধান। অতএব মৃতদেহর নজির দেখিয়ে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আত্মবাদীকেও নতুন করে ভাবতে হবে। কিংবা, চার্বাকপক্ষ থেইে তর্ক তুলে বলা যেতে পারে যে মৃতদেহের নজির থেকে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্তে বাধা আছে। যেমন নিছক দেহের একটা ধর্ম বা লক্ষণ হিসেবে শঙ্কর রূপ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দেহ এবং মৃতদেহের রূপ প্রভৃতি ধর্মও কি সর্বাংশে সমান?

কিন্তু এখানে এজাতীয় খুচরো যুক্তির তালিকা তৈরি করার দরকার নেই। কেননা, আবার দেহাত্মবাদের খণ্ডনে আত্মাবাদীরা এজাতীয় খুচরো কিন্তু পাল্টা যুক্তির পাল্টা ফর্দ তৈরি করতে পারেন। সে-সবের জটিলতায় ফাঁসলে আসল বিতর্কটা থেকে অল্পবিস্তর বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা। দেহাত্মবাদ-বিরোধী আত্মাবাদীদের চতুর উদ্দেশ্যটাও আসলে এখানেই। তাই, এ-জাতীয় আলোচনার না-তুলে এখানে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে বিতর্কটার সোজা ভাষায় পুনর্বিচারে প্রয়াস করা যায়।

দেহাত্মবাদের আলোচনায় আচার্য শঙ্কর দেহ এবং চৈতন্য প্রভৃতির মধ্যে ধর্ম-ধর্মী ভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষায় তাকে কারণ-কার্য সম্বন্ধেরই একটা নমুনা বলে ধরা যেতে পারে। এখানে পঞ্চভূতে গড়া দেহটি কারণ, এবং চৈতন্য প্রভৃতি ধর্ম তারই কার্য। একথা মানলে, ভেবে দেখতে হবে ভারতীয় প্রমাণ-বিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মূল পদ্ধতি কী এবং তা খণ্ডনেরই বা মূল শর্ত কী?

প্রমাণ-বিদ্যায় কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্ত বলতে দু’রকম– অন্বয় ও ব্যতিরেক–
এক। কারণ থাকলে কার্য থাকবে। যেমন, বহ্নি ধূমের কারণ হলে বহ্নি থাকলে ধূম থাকবে।
দুই। কারণ না থাকলে কার্য থাকে না। যেমন, বহ্নিশূন্য ধূমের অভাব।
প্রমাণ-বিদ্যার পরিভাষায়, প্রথমটিকে বলে ‘অন্বয়’, দ্বিতীয়টিকে বলে ‘ব্যতিরেক’। এবং কার্য-কারণ সম্বন্ধ খণ্ডনের প্রসিদ্ধ নিয়ম হলো, ‘অন্বয়’ এবং ‘ব্যতিরেক’ উভয়েরই গলদ দেখানো। সেক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের বিচারে দেহাত্মবাদীর পক্ষে ‘অন্বয়’ হবে– শরীর থাকলে চৈতন্য প্রভৃতি থাকবে। এবং ‘ব্যতিরেক’ হবে– শরীরের অভাবে চৈতন্য প্রভৃতিরও অভাব হবে।

কিন্তু মৃতদেহের নজির থেকে কতটুকু কথা প্রমাণ হয়? দেহাত্মবাদের পক্ষে শুধু ‘অন্বয়’টুকুর খণ্ডন– শরীর থাকলেও চৈতন্য প্রভৃতির অভাব হতে পারে। মৃতদেহের নজির দেখিয়ে আত্মাবাদীরা এটুকুই দেখাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, তাছাড়াও প্রমাণ-বিদ্যার অনিবার্য শর্ত হিসেবে ‘ব্যতিরেক’টিও খণ্ডন করা দরকার। অর্থাৎ, দেখানো দরকার যে শরীরের অবিদ্যমানতা সত্ত্বেও চৈতন্য প্রভৃতির পরিচয় সম্ভব। আত্মবাদী মহলে এই দ্বিতীয় কথাটি প্রমাণ করবার উৎসাহ বড় একটা চোখে পড়ে না। তার কারণ হয়তো এই যে তা প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়, বা অন্তত সহজবুদ্ধির কাছে গ্রাহ্য হওয়া কঠিন। দেহ নেই অথচ শুধু চৈতন্য আছে– এহেন ঘটনার নজির দেখানো তেমন সোজা নয়।
আত্মাবাদীদের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হবে যে দেহের মায়া কাটিয়ে আত্মা মোক্ষলাভ করলে চৈতন্য থাকে, কিন্তু শরীর থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে গেলো নয় কি? কেননা প্রত্যক্ষসিদ্ধ নজিরবিহীন মোক্ষলাভের কথাটা মেনে নিলেও– বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব আপাত-কল্পনায় স্বীকার করলেও– মুক্ত আত্মার অবস্থাটা আসলে কীরকম, এ-বিষয়ে আত্মবাদীদের মধ্যেও মতে মিল নেই। যেমন শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অনুসারে, মুক্ত আত্মা চৈতন্যস্বরূপ; কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা তা মানেন না। তাঁদের মতে মুক্ত আত্মার স্বরূপ জড়বস্তুর মতোই; তাতে চৈতন্যের কোন পরিচয় নেই। শুধুমাত্র দেহ, ইন্দ্রিয়, বিষয় বা বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযোগের ফলে আত্মাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়।

তার মানে, দেহের অনুপস্থিতিতেও চৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায়– এই দাবির পক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণ দেখাতে না-পারলে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার প্রথা অনুসারেই দেহাত্মবাদের খন্ডন সর্বাঙ্গীণ বা সম্পূর্ণ হয় না। মৃতদেহের নজির থেকে বড় জোর এটুকুই প্রমাণ হতে পারে যে দেহ বর্তমান থাকলেও চৈতন্যের অভাব সম্ভব। তার বেশি কিছু নয়। অতএব, দেবীপ্রসাদের ভাষ্য হলো–
‘জীবদেহ ও মৃতদেহকে দেহ অর্থে সম্পূর্ণ অভিন্ন বলে স্বীকার করলেও শুধুমাত্র তারই নজির থেকে দেহাত্মবাদের পূর্ণাঙ্গ খণ্ডন হয় না। অন্তত ভারতীয় ন্যায়বিদ্যার নিরিখে নয়। কিংবা, দাবাড়ে ভাষায়, শুধু মড়ার নজিরের চাল দিয়ে দেহাত্মবাদকে মাৎ করে দেওয়া সম্ভব নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৫)

এ প্রসঙ্গে তাই হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন–
‘যেহেতু চেতনা জীবদেহেরই একটা বিশেষ গুণ তাই দেহের সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার জন্ম ও মৃত্যু। এর অকাট্য অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ হল :
যে পর্যন্ত দেহ জীবিত থাকে সে পর্যন্ত চেতনা থাকে। মৃতদেহে কোনো চেতনার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা চেতনা বিশিষ্ট দেহ দেখতে পাই, চেতনাশূন্য দেহও দেখতে পাই। কিন্তু দেহহীন স্বাধীন চেতনা কোথাও কখনো দেখি না। এর দ্বারাই প্রমাণ হয় চেতন দেহেরই এক বিশেষ গুণ, চৈতন্যময় আত্মা নামক দেহবিযুক্ত কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নেই।
এই সিদ্ধান্তের জন্যই চার্বাক দর্শনকে বলা হয় ভূতচৈতন্যবাদী বা দেহাত্মবাদী দর্শন। এই মতবাদ স্বভাববাদেরই একটা অঙ্গ।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)

সাথে সাথে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় এই চার্বাক-সিদ্ধান্তের তাৎপর্যটাও উল্লেখ করে দিতে ভুলেন না যে–
‘চৈতন্য ভৌতিক প্রাণিদেহেরই একটি বিশেষ গুণ– এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তা হলে দেহব্যতিরিক্ত, দেহবহির্ভূত চৈতন্যময় আত্মা নামক কোনো স্বতন্ত্র অজর অমর পদার্থ নেই যে পদার্থটি জন্ম-জন্মান্তর পরিভ্রমণের পর, সংসার চক্রের বাইরে ঈশ্বরের দরবারে মুক্ত পুরুষ রূপে অবস্থান করে। স্বতন্ত্র আত্মা না থাকলে, জন্ম-জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, স্বর্গ নরক, পারলৌকিক মুক্তি, সৃষ্টিকর্তা ও মুক্তিদাতা ঈশ্বর সব কিছুই অনাবশ্যক বলে বাতিল হয়ে যায়।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)

.
গ। স্মৃতির নজির।

দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে আরো নানা যুক্তির মধ্যে আরেকটি যুক্তি তুলনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। তার একটা কারণ বোধহয় এই যে জয়ন্তভট্ট, উদয়নাচার্য প্রভৃতি মহানৈয়ায়িকেরা যুক্তিটির তুলনায় বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে তার্কিক হিসেবে এঁদের কোনোমতেই তুচ্ছ ভাবা যায় না। তাই এঁরা যে-যুক্তির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাও সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্যই এঁদের লেখা সহজপাঠ্য নয়; রচনার উৎকর্ষ সাধনে এঁরা যে-সব পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন তার পর্যাপ্ত সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের সহজে বোধগম্য হবার কথা নয়। তাই যুক্তিটির সহজ পরিচয়ের জন্য আমরা এক্ষেত্রেও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তা নিতে পারি।

ইতঃপূর্বে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের প্রাসঙ্গিক উক্তিটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। যুক্তিটির মূল কথা হলো স্মৃতির সাক্ষ্য। একথা না-মানার কোন কারণ নেই যে, বাল্যকালের অভিজ্ঞতা যৌবনে– এবং যৌবনের অভিজ্ঞতা বার্ধক্যকালে– স্মরণ হয়। কিন্তু বাল্যদেহ, যৌবনের দেহ ও বৃদ্ধদেহ অবশ্যই এক নয়। দেহ হিসেবে এগুলির মধ্যে এমনই মৌলিক পার্থক্য যে বরং এগুলির প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন দেহ বলে বিবেচিত হবার কথা। দ্বিতীয়ত, একের অভিজ্ঞতা অপরের পক্ষে স্মরণ করার প্রশ্ন ওঠে না– দেবদত্ত নামের ব্যক্তিটির অভিজ্ঞতা যজ্ঞদত্ত নামে অপর কেউ কি স্মরণ করতে পারে?
এই দুটি কথা মনে রাখলে স্বীকার করতেই হবে যে নিছক দেহকে স্মরণকর্তা বলে স্বীকার করা অসম্ভব। অথচ, স্মৃতি বলে ঘটনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে, স্মৃতির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হিসেবে মানতেই হবে যে স্মরণকর্তা অর্থে শুধু দেহকেই সত্য বলা সম্ভব নয়। দেহ ছাড়াও বাড়তি কিছু স্বীকার করতে হয়। সেই বাড়তি কিছুটিকে আত্মা বলে মানো। কেননা, দেহ নিত্য পরিবর্তনশীল হলেও আত্মা একই থাকে। বাল্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আত্মাও বদলাতে থাকে– এমনতর দাবি করা যাবে না।

অবশ্যই সাধারণভাবে আমরা এটা জানি যে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা নিত্য আত্মা বলে কিছু মানতেন না। তাঁদের মতবাদ তাই নৈরাত্ম্যবাদ বলে প্রসিদ্ধ। এই কারণে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নিত্য আত্মায় বিশ্বাসী নৈয়ায়িক প্রভৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ দার্শনিকদের ধুমাধূম তর্ক আছে। কিন্তু এখানে সে তর্ক বিচারের প্রয়োজন নেই। নিত্য আত্মা মানুন আর নাই মানুন– এবং নিত্য আত্মা অস্বীকার করেও স্মৃতির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কিনা, কিংবা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা স্মৃতির কী ব্যাখ্যা দিতেন– বর্তমান অবস্থায় সে-আলোচনায়ও বিক্ষিপ্ত হবার কারণ নেই। কেননা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা আর যাই হোন দেহাত্মবাদী ছিলেন না। কিন্তু চার্বাকী দেহাত্মবাদের আলোচনায় এই স্মৃতির সাক্ষ্য যে অন্তত দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড়ো অন্তরায়, এ কথাটুকু স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ, নিত্য আত্মা মানুন বা নাই মানুন, জয়ন্তভট্ট বা উদয়নাচার্য প্রভৃতির যুক্তি থেকে অন্তত আপাত দৃষ্টিতে এটুকু মনে হয় যে দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা একটা মোক্ষম নিদর্শন দেখিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন, চার্বাকেরা এ-তর্কের কী জবাব দেবেন?

সত্যি বলতে কী– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে– ‘প্রাচীনকালের সাধারণ পটভূমিতে এই তর্কের কোনো উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তার কারণ, স্মৃতি বলে ঘটনাটির পর্যাপ্ত কোনো ব্যাখ্যা প্রাচীনকালে ও এমনকি মধ্যযুগেও কারুর জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে এই তর্কের সম্মুখীন হয়ে চার্বাকপক্ষ থেকে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া বা দেহাত্মবাদ বর্জন করারও কারণ নেই।…
প্রাচীন দার্শনিকদের কাছে বিজ্ঞানের তথ্যসম্ভাব প্রত্যাশা করার অবশ্যই কোনো কারণ নেই। তবুও প্রাচীন দর্শনের বিচারে একটি প্রশ্ন অবান্তর হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিক থেকে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, কোনো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি– বা অন্তত কোনো অস্পষ্ট আভাস– খুঁজে পাওয়া যায় কি? যদি যায়, তাহলে স্বীকার করতে হবে অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় যার মধ্যে এই রকম ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ছিল তার অন্তত ঐতিহাসিক মূল্য উড়িয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৬)

তার মানে, প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অধুনালভ্য বৈজ্ঞানিক তথ্যের সম্পর্কের মধ্যেই জবাবটি নিহিত। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মৃতি বলে ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস শুধু আজকের ব্যাপার নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রয়াস চলেছে এবং এমনকি বিজ্ঞানীমহলেও এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ যুগ ধরে গবেষণার ফলে আজকের পরিস্থিতিটা অন্য রকম। স্মৃতির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া না-গেলেও অন্তত মোটের উপর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। যে-ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে তার পরিচয় দেবার সুযোগ এখানে নেই; কেননা ব্যাখ্যাটা সহজ-সরল মোটেই নয়, এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছোট করে উল্লেখ করবার চেষ্টা করাও নিষ্ফল। কিন্তু বর্তমান আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা হলো যে সে-গ্রন্থ মূলতই শরীরবিদ্যা বিষয়ের। অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে যেটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা তা হচ্ছে আজকের বিজ্ঞান স্মৃতির ব্যাখ্যায় যতটুকু সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেয়েছে তার মূলে শরীর বা দেহ প্রসঙ্গেই গভীরতর জ্ঞান। দেহকে বাদ দিয়ে নয়, বরং দেহকে আরো ভালো করে বুঝেই আজ স্মৃতির সন্তোষজনক ব্যাখ্যার দিকে অগ্রগতি।

তাহলে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোথায় আমরা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি পেতে পারি? দেহাত্মবাদের মধ্যে, না কি তার বিরুদ্ধমত আত্মবাদের মধ্যে? ঐতিহাসিকভাবে চার্বাকদের পক্ষে স্মৃতির রহস্য কতটুকু জানা ছিলো, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে লাভ নেই। সমস্যাটা নিয়ে তাঁরা একান্তই মাথা ঘামিয়েছিলেন কিনা, তাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবার কথা নয় যে তাঁদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই বিজ্ঞানের বীজ খুঁজে পাবার কথা– কারণ, বিজ্ঞান স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত।

স্বভাববাদ

ইতঃপূর্বে দেহাত্মবাদের আলোচনায় ‘স্বভাব’ বা ‘স্বভাববাদ’ বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হয়েছে। কোন প্রসঙ্গে? চার্বাকমতে আগুন বাতাস জল মাটি বলে চৈতন্যহীন ভূতবস্তুরই কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয়। কিন্তু কী করে হয়? আত্মপক্ষ সমর্থনে চার্বাক অবশ্যই দাবি করবেন এ জাতীয় বিশেষ পরিণামের ব্যাখ্যায় ভূতবস্তুগুলি ছাড়া আর কিছু মানার দরকার নেই, কেননা ভূতবস্তুগুলির ‘স্বভাব’ই ওই– অবস্থাবিশেষে তা দেহাকারে পরিণত হয়। কিন্তু, প্রশ্ন উঠবে, এইভাবে চার্বাকমত সমর্থন করার পক্ষে সত্যিই কি কোনো প্রমাণ আছে? কিংবা, যা একই কথা, চার্বাক কি বাস্তবিকই ‘স্বভাব’ বলে কিছু মানতেন?


শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে স্বভাববাদী চার্বাকদের অভিমতের এক বিবরণে বলা হয়েছে–

‘ন কল্প্যৌ সুখদুঃখাভ্যাং ধর্মাধর্মৌ পরৈরিহ।
স্বভাবেন সুখী দুঃখী জনোহন্যন্নৈব কারণম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৪)।।
‘শিখিনশ্চিত্রয়েৎ কো বা কোকিলান্ কঃ প্রকূজয়েৎ।
স্বভাবব্যতিরেকেণ বিদ্যতে নাত্র কারণম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৫)।।
অর্থাৎ :
(লোকায়তিক চার্বাকমতে) অপরবাদিগণ কর্তৃক সুখদুঃখরূপ হেতুর দ্বারা ধর্ম ও অধর্মের অনুমান করা অযৌক্তিক। স্বভাববশতই মানুষ সুখ এবং দুঃখ পেয়ে থাকে। এই বিষয়ে ধর্ম ও অধর্ম নামক কারণান্তরের অপেক্ষা নেই। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৪)।।  ময়ূরদের কে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করে দেয়? কোকিলদেরই বা কে কূজন করায়? বস্তুত স্বভাব ব্যতীত এক্ষেত্রে অন্য কোন কারণ নেই। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৫)।।


তার মানে, এই মত অনুসারে, শিখিপুচ্ছে নানা রঙের বৈচিত্র্য বা কোকিলের কণ্ঠে মধুর স্বরের সমাবেশ স্বাভাবিক যে নিয়মে হয়, মানুষের সুখ-দুঃখেও সেই নিয়মেরই প্রভাব দৃষ্ট হয়। এসবের কারণ হিসেবে ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদির কল্পনা অসঙ্গত। এই স্বাভাবিক নিয়মই হলো স্বভাব-নিয়ম; যাকে স্বভাববাদ বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যান্য চার্বাকী ধারণার মতো স্বভাববাদও ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখার সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। তবে এ আলোচনায় যাওয়ার আগে স্বভাববাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমাদের পক্ষে কিছু প্রাচীন নজির অনুসন্ধান করা আবশ্যক, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, চার্বাক বস্তুত স্বভাববাদী ছিলেন।

.
। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের নজির।

প্রসিদ্ধ দর্শন-গবেষক শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে বলেছেন, স্বভাববাদ সম্ভবত আদিতে স্বতন্ত্র মত হিসেবে ভারতের চিন্তাক্ষেত্রে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হয়েছিলো। চার্বাক মতের সঙ্গে এই মতের একীকরণ পরবর্তী পর্যায়ে বলে অনেকের ধারণা। শাস্ত্রী মহাশয়ের এই বক্তব্যের উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রাচীন নজির হিসেবে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’কেই লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিতে হয়। কেননা, ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে স্বভাববাদের সবচেয়ে পুরোনো নজির বলতে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’।

উপনিষদের নামটি অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কেননা দেবীপ্রসাদের মন্তব্য অনুসারে ‘শ্বেতাশ্বতর’ শব্দটির অর্থ সোজা কথায় ‘সাদা খচ্চর’। উপনিষদটির মধ্যেও ঋষি নিজেকে এই শ্বেতাশ্বতর নামেই উল্লেখ করেছেন–

‘তপঃপ্রভাবাৎ দেবপ্রসাদাচ্চ ব্রহ্ম হ শ্বেতাশ্বতরোহথ বিদ্বান্ ।
অত্যাশ্রমিভ্যঃ পরমং পবিত্রং প্রোবাচ সম্যগ্-ঋষিসঙ্থ-জুষ্টম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৬/২১)
অর্থাৎ :
শ্বেতাশ্বতর নামে এক বিদ্বান অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্বে জ্ঞানী তপস্যাবলে আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। কিন্তু কেবল তপস্যাবলেই নয়, দেবতার অনুগ্রহে ব্রহ্মজ্ঞ হয়েছিলেন। তারপর, তিনি সেই পরম-পবিত্র ঋষিগণ-সেবিত সেই সত্য ব্রহ্মজিজ্ঞাসু পূজনীয় আশ্রমিকদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন।


পরবর্তীকালের অধ্যাত্মবাদীদের কাছেও নামটা নিশ্চয়ই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তাই, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে–
‘শঙ্করানন্দ এর একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন : শ্বেত মানে বিশুদ্ধ এবং ঔপচারিক অর্থে অশ্ব মানে ইন্দ্রিয়। ‘বিশুদ্ধ ইন্দ্রিয়’ : কিন্তু মুস্কিল হলো, গ্রন্থ এবং তার প্রবক্তা ঋষিটির নাম শ্বেত-অশ্বতর এবং অশ্ব ও অশ্বতর এক নয়। একালে রাধাকৃষ্ণণও বুঝেছেন, ব্যাপারটা বেশ একটু গোলমেলে; ফলে নামটার নামে করেছেন, ‘সাদা খচ্চরের মালিক’। কিন্তু ব্যাকরণের পরোয়া করলে এমন মানে দাঁড় করানো কঠিন। এবং যদিই বা দাঁড় করানো যায় তাহলেও সাদা খচ্চরের মালিকানাটা এমন কিছু আহামরি ব্যাপার হবে না যে তা থেকে নিজের নাম এবং তাঁরই নামে প্রচলিত উপনিষদটির নামকরণ করে কেউ খুব একটা অধ্যাত্ম-গৌরব অনুভব করতে পারেন।
পক্ষান্তরে আমাদের ধারণা, নৃতত্ত্ববিদরা যাকে প্রাচীন ‘টোটেম বিশ্বাস’ বলেন, নামটার পিছনে তার কোনো ইংগিত থাকা অসম্ভব নয়; কেননা এহেন বিশ্বাসের মূল কথাই হলো গাছগাছড়া বা জন্তুজানোয়ার থেকে মানবদলের নামকরণ– দলের সবাই নিজেকে তারই বংশধর বলে কল্পনা করতো। টোটেম বিশ্বাস অবশ্যই আদিম সমাজের পরিচায়ক; কিন্তু বিশেষত আমাদের দেশে তার রেশ দীর্ঘযুগ ধরে টিকে থেকেছে। আজো আছে।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১০৮-৯)

তবে উপনিষদটির নামকরণের কারণ যাই হোক-না-কেন, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে গ্রন্থটির গুরুত্ব বড় কম নয়। কেননা এই উপনিষদেই, ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম বিশিষ্ট দার্শনিক মত হিসেবে ‘স্বভাব’ বা ‘স্বভাববাদে’র উল্লেখ পাওয়া যায়। উপনিষদটির প্রথম দুটি শ্লোকেই পাওয়া যায়, যদিও শ্লোক দুটির আক্ষরিক অর্থ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা– অতএব মতভেদ– আছে। কিন্তু অতশত সূক্ষ্ম বিচারে আমাদের আপাতত প্রয়োজন নেই; মোটকথা অর্থটাই যথেষ্ট। এখানে বলা হয়েছে–

‘ব্রহ্মবাদিনো বদন্তি–
‘কিং কারণং ব্রহ্ম, কুতঃ স্ম জাতা, জীবাম কেন, ক্ব চ সম্প্রতিষ্ঠাঃ।
অধিষ্ঠিতাঃ কেন সুখেতরেষু বর্তামহে ব্রহ্মবিদো ব্যবস্থাম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-১/১)
‘কালঃ স্বভাবো নিয়তির্যদৃচ্ছা ভূতানি যোনিঃ পুরুষ ইতি চিন্ত্যা।
সংযোগ এষাং ন ত্বাত্মভাবাৎ আত্মাহপি অনীশঃ সুখদুঃখহেতোঃ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-১/২)
অর্থাৎ :
পরম সত্য (উপনিষদের ভাষায় ব্রহ্ম) নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন উঠলো– পরম সত্য (বা ব্রহ্ম) আসলে কী? কী থেকে আমাদের জন্ম, কিসের উপর নির্ভর করে আমরা বাঁচি এবং শেষ পর্যন্ত কিসে ফিরে যাই? আমাদের সুখদুঃখের কারণ কী? (শ্বেতাশ্বতর-১/১)।।  কাল, বস্তুর স্বভাবধর্ম, নিয়তি (কারণ ও তার কার্য), যদৃচ্ছা (আকস্মিক ঘটনা), ভূতবস্তু, যোনি, পুরুষ (জীবাত্মা), এই সবের কোনও একটি কি জগতের কারণ? কোন একটি কারণ, না সব কটি কারণ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সৃষ্টি-কাজ সফল করেছে? এই সবগুলিকে একত্রিত করতে পারে জীবাত্মাই (পুরুষ); কিন্তু আবার সুখ-দুঃখের অধীন কোন জীবাত্মাই নিজের প্রভু অর্থাৎ স্বাধীন নয়। তাহলে এই যে সৃষ্টি-পরিণাম এর কারণ কী? (শ্বেতাশ্বতর-১/২)।।


শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দ্বিতীয় শ্লোক থেকে বোঝা যায় যে, প্রথম শ্লোকের প্রশ্নগুলি নিয়ে সেকালে রকমারি মত চালু ছিলো। তার তালিকাটাও খুব চিত্তাকর্ষক। একটা মতে, ‘কাল’ই পরম সত্য। অর্থাৎ, ‘কাল’ থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি; ‘কালে’ই সবকিছুর স্থিতি; ‘কালে’র মধ্যেই সব কিছু আবার বিলীন হয়। মতটাকে তাই ‘কালবাদ’ বলার প্রথা আছে। আধুনিক বিদ্বানরা বলছেন, ‘অথর্ববেদ’ থেকেই এই জাতীয় মতের পরিচয় পাওয়া যায় এবং এককালে একদল চিন্তাশীলের মধ্যে– বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহলে– মতটা বেশ চালু ছিলো।
দ্বিতীয় মতে, ‘স্বভাব’ই পরম সত্য। আমাদের উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিলয়ের মূলে এই ‘স্বভাব’ ছাড়া আর কিছু নেই। মতটাকে তাই ‘স্বভাববাদ’ বলা হয়।
তৃতীয় মতে, ‘ভূতবস্তু’ই পরম সত্য। মতটা অবশ্যই চার্বাকদের কথা মনে পড়িয়ে দেয়, কেননা প্রাচীনকালে আর কেউ নিছক ভূতবস্তুকে একমাত্র সত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
চতুর্থ ও পঞ্চম মতে, ‘নিয়তি’ এবং ‘যদৃচ্ছা’ (অর্থাৎ আকস্মিকত্বই বা কারণহীনতাই) পরম সত্য।

এর পর উপনিষদ্-এ ‘যোনি’ এবং ‘পুরুষ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শব্দ দুটি নিয়ে বিদ্বানদের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক আছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ে ভাষ্যে–
‘কেউ বলেন ‘কারণ’ অর্থে যোনি শব্দটাকে উপরিউক্ত মতগুলির সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে হবে। অপর মতে ‘যোনি’ বলতে স্বতন্ত্র মত উল্লিখিত। যোনি শব্দের আক্ষরিক অর্থ অবশ্যই নারীর জননাঙ্গ; সেদিক থেকে জন্ম বা উৎপত্তি-সূচক মনে করে কারণ অর্থে প্রয়োগ অসম্ভব নয়। অপরে বলেন, এখানে স্বতন্ত্র একটি কারণ অর্থে যোনি শব্দের প্রয়োগ। সে-অর্থ গ্রহণ করলে হয়তো তন্ত্রমতের কোনো আদিম সংস্করণের আভাস পাওয়া যেতে পারে। আবার কেউ বলছেন, স্বতন্ত্র পরম সত্য হিসেবে এখানে সাংখ্যমতের কোনো আদি-সংস্করণের নির্দেশ অসম্ভব নয়, কেননা সাংখ্যমতে যে ‘প্রকৃতি’ জগৎকারণ তা আদি-নারীরূপেই কল্পিত।’
‘এ-হেন ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে কিন্তু সাংখ্যদর্শনের আদিরূপ হিসেবে যার আভাস পাওয়া যায় তার সঙ্গে সাংখ্যদর্শনের পরবর্তী সংস্করণের মিল থাকে না। কেননা এই ‘যোনিবাদ’ অনুসারে নিছক প্রকৃতি বা প্রকৃতিমাত্রই জগৎকারণ, কেননা উপনিষদ্কার এখানে স্বতন্ত্রভাবে ‘পুরুষ’-এর কথা– বা ‘পুরুষবাদ’– উল্লেখ করেছেন। ‘ঋগ্বেদ’ থেকেই অবশ্য ‘পুরুষ’কে আদি কারণ বলে ঘোষণা করার প্রথা আমাদের জানা আছে (পুরুষসূক্ত), যদিও কিছু পরবর্তীকালে উপনিষদের চরম ভাববাদীরা বিশুদ্ধ আত্মা বা চিন্ময় পরব্রহ্মেরই প্রতিশব্দ হিসেবেও ‘পুরুষ’ শব্দ গ্রহণ করতে চেয়েছেন।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১০)

এই বিশুদ্ধ আত্মা বা চিন্ময় পরব্রহ্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘পুরুষ’ শব্দ গ্রহণের দৃষ্টান্ত হিসেবে যেমন ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ্’-এ আছে–

‘ইয়ং পৃথিবী সর্বেষাং ভূতানাং মধু, অসৌ পৃথিব্যৈ সর্বাণি ভূতানি মধু। যশ্চায়মাস্যাং পৃথিব্যাং তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুয়ুষো যশ্চায়মধ্যাত্বং শারীরস্তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুরুষোহয়মেব স যোহয়মাত্মা; ইদং অমৃতং, ইদং ব্রহ্মেদং সর্বম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৫/১)
অর্থাৎ :
এই পৃথিব্যাদি ভূতচতুষ্টয় সবার কাছে মধুস্বরূপ, মধুভাণ্ড বা মধুচক্র। আবার এই পৃথিবীর কাছেও, যা কিছু আছে, যত জীব আছে সবই মধুস্বরূপ। এই পৃথিবীতে যিনি তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ আছেন, এবং জীব শরীরের অভ্যন্তরে যে তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ আছেন– ইনিই তিনি। দুই-ই এক (মধু); যিনি হলেন এই এই আত্মা, এই অমৃত, এই ব্রহ্ম, এই সব কিছু।


কিন্তু এ-আলোচনা আমাদের পক্ষে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এ ‘যোনি’ ও ‘পুরুষ’ শব্দ ব্যবহারের পিছনে উপনিষদ্কারের বুদ্ধিস্থ আসলে কী ছিলো, সে-বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া সহজসাধ্য নয়। কিন্তু একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে আলোচ্য উপনিষদটির প্রতিপাদ্য বিষয় ঈশ্বরই প্রকৃত জগৎকারণ। যেমন–

‘স্বভাবমেকো কবয়ো বদন্তি কালং তথান্যে পরিমুহ্যমানাঃ।
দেবস্যৈষ মহিমা তু লোকে যেনেদং ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৬/১)
অর্থাৎ :
অনেক কবি বা দ্রষ্টার ধারণা, সৃষ্টির মূল কারণ হলো স্বভাব। বস্তুর স্বভাবধর্মই হলো সৃষ্টি করা, রূপ দেয়া। তাঁদের এ ধারণা ভুল।  আবার কারও মতে জগতের উৎপত্তি কাল থেকে, অর্থাৎ কালই জগৎনস্রষ্টা। এই ধারণাও ভুল। বস্তুত পরমেশ্বর পরমাত্মাই এই ব্রহ্মচক্র অর্থাৎ জগতের কারণ।


কিন্তু ঈশ্বরই প্রকৃত জগৎকারণ এই প্রতিপাদ্য-বিষয় ব্যাখ্যা করার আগে তাই সেকালে প্রচলিত কয়েকটি বিরুদ্ধ মত বর্জনার্থে অন্যান্য ধারণাগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। সেকালে মতগুলির বিশেষ প্রভাব না-মানলে এই উল্লেখের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ফলে অনুমান করা যায় যে, ওই সুদূর প্রাচীনকালেই মতগুলি বিশেষ প্রভাবশীল ছিলো।  এগুলির মধ্যে আমাদের আলোচনায় বিশেষ প্রাসঙ্গিক বলতে দুটি মত– ‘স্বভাববাদ’ ও ‘ভূতবাদ’।

.
। ভূতবাদ ও স্বভাববাদ।

‘ভূতবাদ’ বলতে চার্বাকমত– বা তারই খুব নিকটাত্মীয় কোনো প্রাচীন বস্তুবাদ– বলে গ্রহণ করায় বোধহয় বিশেষ কোন আপত্তির আশঙ্কা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘স্বভাববাদ’-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? স্বভাববাদ প্রসঙ্গে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর সাক্ষ্যই যদি এক্ষেত্রে একমাত্র সম্বল হতো তাহলে অবশ্য ভূতবাদ ও স্বভাববাদকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে মানতে বাধ্য হতে হতো, কেননা উপনিষদটিতে স্বতন্ত্রভাবে মত দুটির উল্লেখ রয়েছে। এ-জাতীয় পার্থক্য স্বীকার করলে স্বভাববাদকে চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে মনে করায় বাধা হয় বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, ভূতবাদই লোকায়ত বা চার্বাকমতের প্রাণবস্তু।

কিন্তু তুলনায় কিছু পরবর্তীকালের নজির থেকে অবধারিতভাবেই প্রমাণ হয় যে, ভূতবাদী চার্বাক স্বভাববাদীও ছিলেন; বস্তুত স্বভাববাদ না-মানলে চার্বাকের ভূতবাদ বা চরম বস্তুবাদ প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। এখানে উল্লেখ্য, উপনিষদে চার্বাক তো দূরের কথা লোকায়ত নামেরই কোন উল্লেখ নেই; কিন্তু প্রখর বস্তুবাদের বা ভূতবাদের বিস্তর নজির আছে। এই ভূতবাদের সঙ্গে স্বভাববাদের অনিবার্য আত্মীয়তার কথা ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এ উপলব্ধ হোক-আর-নাই-হোক, পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত হয়েছে। সম্ভবত তারই নজির মনে রেখে গোপীনাথ কবিরাজ মন্তব্য করেছেন–
‘মনে হয় চরম স্বভাববাদের প্রতিনিধি বলতে সুপ্রাচীন ভারতের একদল একেবারে স্বাধীন চিন্তাশীল ছিলেন; আদিতে এঁদেরই লোকায়ত বলে উল্লেখ করার প্রথা ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এঁরাই অনেক ব্যাপকভাবে চার্বাক নামে পরিচিত হন। তাঁদের মতের আদিরূপটির বৈশিষ্ট্য বলতে কট্টর বস্তুবাদ, অদৃষ্টে (অর্থাৎ কর্মফলে) অবিশ্বাস, আপসহীন যুক্তিবাদ– বা হয়তো বিতণ্ডাও।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১১)

বিতণ্ডা বলতে বোঝায় বৃথাতর্ক বা শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক। লোকায়তিকদের ঘাড়ে বিতণ্ডাবাদের অপবাদটা যে-উদ্দেশ্যে চাপানো হয়েছিলো তার যাথার্থ্য বড় জোর সংশয়-সাপেক্ষ। কিন্তু সে বিতর্ক না-তুলেও নিশ্চয়ই মন্তব্য করার সুযোগ আছে যে, ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর উক্তি সত্ত্বেও অন্তত কিছু দিনের মধ্যেই স্বভাববাদকে লোকায়ত বা চার্বাক বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। আর তাই হয়তো ‘মহাভারত’-এ সরাসরিই বলা হয়েছে–

‘স্বভাবং ভূতচিন্তকাঃ’। (মহাভারত)
অর্থাৎ : যাঁরা শুধু ভূতবস্তু বিষয়েই চিন্তা করেন (অর্থাৎ শুধু ভূতবস্তুকেই মানেন) তাঁরা স্বভাববাদী।


আর ‘বৃহৎ-সংহিতা’-র ব্যাখ্যায় ভট্ট উৎপল বলছেন– ‘অন্যেরা, অর্থাৎ লোকায়তিকেরা স্বভাবকেই জগৎকারণ বলে গ্রহণ করেন; স্বভাবের জন্যই বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি, স্বভাববশতই তার বিলোপ।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১২)। এবং ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তে চার্বাকমতের ব্যাখ্যায় মাধবাচার্য বলছেন–

ননু অদৃষ্টানিষ্টৌ জগদ্-বৈচিত্র্যম্ আকস্মিকং স্যাদিতি চেৎ? ন তদ্ ভদ্রম্, স্বভাবাদেব তদুপপত্তেঃ। তদুক্তম্–
‘অগ্নিরুষ্ণো জলং শীতং সমস্পর্শস্তথাহনিলঃ।
কেনেদং চিত্রিতং তস্মাৎ স্বভাবাৎ তদ্-ব্যবস্থিতিঃ।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
[চার্বাক দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠবে :] তোমরা যদি ‘অদৃষ্ট’ (অর্থাৎ পূর্বকর্মের ফল ধর্ম-অধর্ম) না মানো তাহলে পৃথিবীর এতো বৈচিত্র্য তো আকস্মিক (অর্থাৎ অকারণ) বলে স্বীকার করতে বাধ্য হবে। [চার্বাকেরা কিন্তু বলবেন], এমনতর কথা (বা আপত্তি) ঠিক নয়, [কেননা জগৎ-বৈচিত্র্যের] ব্যাখ্যার জন্য ‘স্বভাব’ স্বীকার করাই পর্যাপ্ত। [এই প্রসঙ্গে মাধব চার্বাকদের লোকগাথা উদ্ধৃত করেন]–
‘অগ্নি উষ্ণ, জল শীতল, বাতাস সমস্পর্শ অর্থাৎ অনুষ্ণ ও অশীত (গরমও নয়, ঠাণ্ডাও নয়)। এতো বৈচিত্র্য কার সৃষ্টি? (কারুরই নয়;) স্বভাবের জন্যই এগুলি ওই রকম।’


হরিভদ্রর লেখা ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ ব্যাখ্যায় জৈন দার্শনিক গুণরত্ন স্বভাববাদের আরো কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন এবং সেই প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি প্রামাণিক লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা স্বাধীন তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে–

‘স্বভাববাদীরা নিম্নোক্ত দাবি করবেন। স্বভাব বলতে বোঝায় বস্তুর স্বীয় বা স্বকীয় পরিণাম। স্বভাব-জন্যই সবকিছুর উৎপত্তি; যেমন, মৃত্তিকার পরিণাম ঘট, পট নয়। তেমনি তন্তু বা সুতো থেকে শুধু পটই তৈরি হয়। [শুধুমাত্র মাটি থেকেই ঘট তৈরি হয়, কাপড় বোনা যায় না; তেমনি শুধুমাত্র সুতো থেকেই কাপড় তৈরি হয়, ঘট হয় না। অতএব, মাটির স্বভাবই এমন এবং সুতোরও স্বভাবই এমন যে প্রথমটি থেকে শুধু ঘট এবং দ্বিতীয়টি থেকে শুধু পট তৈরি হয়; অন্যথা তো মটি থেকেও পট এবং সুতো থেকেও ঘট তৈরি হতে পারতো]। স্বভাব ছাড়া এজাতীয় পরিণাম-নিয়মের কোনো ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। অতএব, সবকিছুই স্বভাবের পরিণাম বলে মানতে হবে। [এ-বিষয়ে লোকগাথা আছে]–
কণ্টককে কে তীক্ষ্ণ করলো?
মৃগ-পক্ষীদের এত বৈচিত্র্যই বা কার সৃষ্টি?
এ সবই স্বভাব থেকে উৎপন্ন;
এগুলি কারুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরিণাম নয়।।
.
খেজুর গাছের কাঁটা তীক্ষ্ণ,
কোনোটা ঋজু, কোনোটা বাঁকা।
কিন্তু (গাছটার) ফল গোলাকার।
এসব আর কার সৃষ্টি– বলতে পারো?

‘অন্যান্য পরিণামের কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। এমনকি স্বভাব ছাড়া মুগডালও (মুদ্গ) সেদ্ধ হয় না। রান্নার পাত্র, চুল্লির আগুন, ফোটাবার সময় (কাল) প্রভৃতি সমস্ত আয়োজন-উপকরণ সত্ত্বেও কাঁকরের মুগডাল (‘কঙ্কদুকমুদ্গ’? ডালের মতো দেখতে কাঁকর) সেদ্ধ সম্ভব নয়। অতএব, যার অভাবে কিছুর উৎপত্তি হয় না এবং যার উপস্থিতিতে উৎপত্তি হয়– উভয় দিক থেকেই স্বভাবকেই কারণ বলে মানতে হবে। [অর্থাৎ, স্বভাবই কারণ; কেননা স্বভাব থাকলে ঘটনাটা ঘটে, না থাকলে ঘটে না : মুগডালের স্বভাবই এমন যে তা সিদ্ধ হয়; (ডালের মতো দেখতে) কাঁকরের স্বভাবই এমন যে তা সেদ্ধ হয় না।] অতএব, মুগডাল যে সেদ্ধ হয় তারও কারণ স্বভাব। তাই স্বীকার করতে হবে, সব ঘটনারই কারণ বলতে ‘স্বভাব’।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১২-৩)


তাহলে দেখা যাচ্ছে, অন্তত কালক্রমে লোকায়ত বা চার্বাকমতে স্বভাবই সব ঘটনার কারণ বলে স্বীকৃত। এককালে এই স্বভাবের ব্যাখ্যায় কিছু প্রামাণিক লোকগাথাও প্রচলিত ছিলো। এবং ঈশ্বরবাদ ছাড়াও কর্মফলবাদের পক্ষ থেকে নানা দার্শনিক স্বভাববাদ খণ্ডন করার সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন। তাঁদের এই খণ্ডন প্রচেষ্টা যে মূলত অদৃষ্ট অনুমান-ভিত্তিক কার্য-কারণ ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু চার্বাকেরা অদৃষ্ট অনুমান-ভিত্তিক কার্য-কারণ সম্বন্ধ স্বীকার করেন না।

। স্বভাববাদ খণ্ডন-প্রচেষ্টা।

স্বভাববাদ বিরোধীরা বলেন, দুটি ঘটনার একাধিক ক্ষেত্রে ক্রমিক সংঘটনের ব্যাপারে বিশ্লেষণ করলে উভয় ঘটনার আশ্রয় বস্তুগুরির অন্তর্নিহিত সামান্য ধর্মে অধিকাংশ সময়েই কার্যকারণভাবের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞানের জনক হিসেবে এই কার্যকারণভাবের উল্লেখ করা যেতে পারে।
কিন্তু কার্যকারণভাবে অবিশ্বাসী চার্বাকেরা মনে করেন যে দুটি ঘটনার একত্র যোগাযোগ নেহাতই অহেতুক এবং এ থেকে ভবিষ্যতেও অতীতের এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনুমান করা যায় না। কারণ, অতীতে দৃষ্ট হয়নি এবং সেইজন্য আমাদের কল্পনাতেও আসেনি এমন অনেক বিষয়ের উপস্থিতিতে হয়তো ভবিষ্যতে ঘটনাগুলির ক্রমিকতা নষ্ট হতে পারে।


অনেক সময় ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি বা রোগনিবৃত্তির জন্য রত্নধারণ, মন্ত্রপ্রয়োগ বা ঔষধ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। এতে অভীষ্টসিদ্ধি না হলে কেউ কি তা ব্যবহার করতো? কিন্তু চার্বাকদের মতে, কার্যকারণবাদীদের উপস্থাপিত এই দৃষ্টান্ত ত্রুটিপূর্ণ। কেননা, এ সবের মাধ্যমে অভীষ্টসিদ্ধি কোন কোন ক্ষেত্রে হলেও চার্বাকদের মতে এগুলির ব্যবহার এবং ফলপ্রাপ্তি, উভয়ের মধ্যে কার্যকারণ কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, অনেক সময় মণি, মন্ত্র বা ঔষধ প্রয়োগেও ফল পাওয়া যায় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলির ব্যবহার ছাড়াই উদ্দেশ্যসিদ্ধি হয়। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তে মাধবাচার্যের চার্বাকমত বর্ণনায় মণি, মন্ত্র বা ঔষদের প্রয়োগ এবং সেই প্রয়োগের ফলে আংশিক ক্ষেত্রে লব্ধ ফল– উভয়ের পরস্পর সম্বন্ধ চার্বাকী পরিভাষায় ‘যাদৃচ্ছিক’ আখ্যা পেয়েছে। যেমন–

‘ক্বচিৎ ফল-প্রতিলম্ভস্তু মণি-মন্ত্রৌষধাদিবদ্ যাদৃচ্ছিকঃ। অতঃ তৎ-সাধ্যম্ অদৃষ্টাদিকমপি নাস্তি।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : কখনো কোন স্থলে ফল প্রাপ্তি (বিষয় প্রাপ্তি) কিন্তু মণি, মন্ত্র ও ঔষধাদির ন্যায় যাদৃচ্ছিক। অতএব অনুমান সাধ্য অদৃষ্ট (পাপ ও পুণ্য) প্রভৃতিও নেই।


তার মানে, চার্বাক মত অনুসারে জগতের অন্য যে সমস্ত ঘটনাকে আপাতঃ দৃষ্টিতে কার্যকারণঘটিত বলে মনে হয়, অনুরূপ বিচারে সেগুলিও ‘যাদৃচ্ছিক’ প্রতিপন্ন হয়। তবে চার্বাকদের অভিমতে অগ্নির উষ্ণতা, জলের শৈত্য ইত্যাদি যেমন স্বাভাবিক এবং এই ধরনের কয়েকটি বিশেষ বস্তুর বিশেষ কোন গুণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মূলে কোন বস্তু বা ঘটনাকে যেমন কারণ হিসেবে নির্দেশ করা চলে না, সেইরকম জগতের বিভিন্ন ঘটনাবলী, মানুষের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন ইত্যাদিও স্বাভাবিকভাবেই হয়। ‘অদৃষ্ট’ ‘ধর্ম-অধর্ম’ ইত্যাদিকে জগতের বৈচিত্র্যের কারণ হিসেবে স্বীকার করার পক্ষে কোন যৌক্তিকতা নেই। এই স্বভাববাদ অনুসারে, শিখিপুচ্ছে নানা রঙের বৈচিত্র্য বা কোকিলের কণ্ঠে মধুর স্বরের সমাবেশ স্বাভাবিক যে নিয়মে হয়, মানুষের সুখ-দুঃখেও সেই নিয়মেরই প্রভাব দৃষ্ট হয়। এসবের কারণ হিসেবে ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদির কল্পনা অসঙ্গত। এই মতের সমর্থন শঙ্করের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকী প্রামাণিক লোকগাথার দৃষ্টান্তে ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি। এয়াড়াও ‘সর্বসিদ্ধান্তগ্রন্থে’ অন্য আরো প্রামাণিক লোকগাথা অনুযায়ী দেখা যায়, ‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদীদের দ্বারাও অদৃষ্ট কখনও দৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, আরো বলা হয়, বিশেষ কোন স্থানে বা কোন সময়ে দৃষ্ট হলেও এর অদৃষ্ট নামের সার্থকতা থাকে না। নিত্য অদৃষ্ট কোন বস্তুর সত্তাকে যদি আমরা অনুমোদন করি তাহলে ‘শশশৃঙ্গ’ বা অনুরূপ অসম্ভব পদার্থের অস্তিত্বকেও আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়। যেমন–

‘প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।
অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।
‘ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্র“বতে কথম্ ।
নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।
অর্থাৎ :
লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে– এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।  যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।


আমরা আগেই দেখেছি যে ‘অদৃষ্ট’ ‘ধর্ম-অধর্ম’ ইত্যাদি ধারণা ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনের অনুমোদিত কর্মফলবাদের আবশ্যিক অঙ্গ। কাজেই এই ধারণাগুলির বিরোধিতার মাধ্যমে কর্মফলবাদও যে প্রকারান্তরে অস্বীকৃতি লাভ করে তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু অধ্যাত্মবাদীরা স্বভাববাদকে এতো সহজে ছেড়ে দিতে রাজী নন। নৈয়ায়িকদেরকেও এই চার্বাকী ধারণার সমালোচনায় যথেষ্ট তৎপর হতে দেখা যায়। যেমন ‘ন্যায়সূত্রে’ পূর্বপক্ষীয় যুক্তিতে বলা হয়েছে–

‘অনিমিত্ততো ভাবোৎপত্তিঃ কণ্টকতৈক্ষ্ণ্যাদিদর্শনাৎ’। (ন্যায়সূত্র-৪/১/২২)
অর্থাৎ : (পূর্বপক্ষীয় যুক্তিতে) ভাববস্তুগুলির [অর্থাৎ, পৃথিবীতে বর্তমান বস্তুগুলির] নিমিত্তকারণ [অর্থাৎ, কর্তা অর্থে কারণ] নেই; কেননা কণ্টকের তৈক্ষ্ণ্য দর্শন [থেকেই তা বোঝা যায়]।


স্বভাববাদের প্রসিদ্ধ নজির ‘কণ্টকের তীক্ষ্ণতা’ থেকে বোঝাই যায়, এটা স্বভাববাদী চার্বাকী যুক্তি। যাঁর মতে উপাদান-কারণের ‘স্বভাব’ থেকেই সমস্ত জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি। ন্যায়সূত্রকার এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে আরো দুটি সূত্র রচনা করে একটি ‘প্রকরণ’– অর্থাৎ, সহজ কথায়, একটা আলোচনার স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিচয়– সম্পন্ন করেছেন। বাকি সূত্র দুটির তর্জমা হলো–

‘নিমিত্ত অন্য, নিমিত্তের প্রত্যাখ্যান অন্য; কিন্তু তাই বলেই নিমিত্ত প্রত্যাখ্যান হয় না।’ (ন্যায়সূত্র-৪/১/২৩)।।
‘[পূর্বসূত্রের এই যুক্তি] অসিদ্ধ; কেননা নিমিত্ত এবং অনিমিত্ত-র অর্থ সম্পূর্ণই আলাদা।’ (ন্যায়সূত্র-৪/১/২৪)।।


তার মানে কি ‘নিমিত্তকারণের অভাব’ স্বীকারও এক অর্থে তাকেই নিমিত্তকারণের স্থান দেওয়া? সূত্রগুলি এমনই সাঁটে লেখা যে আলোচনার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা সহজসাধ্য অবশ্যই নয়। তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তর্কটা জগতে বিদ্যমান বস্তুর বা ভাবপদার্থের ‘নিমিত্তকারণ’ নিয়ে। ‘নিমিত্তকারণ’ মানে কী? সোজা কথায় বললে, উপাদান-অতিরিক্ত কর্তাকে নিমিত্তকারণ বলে। যেমন ঘটের উপাদান মৃত্তিকা; কিন্তু শুধু মৃত্তিকা থাকলেই তো ঘট হয় না; তাছাড়াও কুম্ভকার বলে কারণ মানতে হবে। এই দৃষ্টান্তে কুম্ভকারই ঘটের নিমিত্তকারণ।
তাহলে, দেবীপ্রসাদের মতে, ‘ন্যায়সূত্র’র এই তিনটি সূত্রে আসল তর্কটা জাগতিক বস্তুগুলির কোনো নিমিত্তকারণ আছে কিনা– তাই নিয়ে। এগুলির উপাদান-কারণ তো সুবিদিত : ভারতীয় দর্শনে আগুন-বাতাস-জল-মাটি– এই চতুর্ভূত, কিন্তু অনেক সময় তার সঙ্গে ‘আকাশ’ ধরে পঞ্চভূতকে জগতের উপাদান-কারণ বলে স্বীকার করা হয়। অন্তত নৈয়ায়িকরা তা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এছাড়াও জাগতিক বস্তুর নিমিত্তকারণ হিসেবে স্বীকার করতে হবে, শুধু চতুর্ভূত বা পঞ্চভূতের ‘স্বভাব’ থেকেই সমস্ত জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি। অতএব আসল তর্ক হলো : স্বভাববাদ-বনাম-নিমিত্তকারণবাদ নিয়ে– যে নিমিত্তকারণ বলতে ঈশ্বর, অদৃষ্ট, প্রভৃতির উল্লেখ করা হয়।

ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন এই সূত্রগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমোক্ত ন্যায়সূত্রে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন স্বভাববাদের অনুরূপ যে চিন্তাধারার উল্লেখ পান জাগতিক ঘটনাসমূহের মূলে নিমিত্তের অবদান তাতে স্বীকৃত নয়। এই মতবাদ অনুসারে প্রকৃতির বিভিন্ন অভিব্যক্তি, যথা কণ্টকের তীক্ষ্ণতা, রঙের বৈচিত্র্য ইত্যাদি যেমন নিজেকে প্রকাশ করতে কারণের অপেক্ষা রাখে না, সেই রকম বিভিন্ন উপাদানের সমবায়ে গঠিত মানুষের দেহ প্রভৃতি বস্তু নিমিত্ত কারণ ব্যতিরেকেই স্বরূপে পরিণতি লাভ করে।
এই মতের আলোচনা প্রসঙ্গে ভাষ্যকার মন্তব্য করেন যে–

‘যতশ্চোৎপদ্যতে তন্নির্মিত্তম। অনিমিত্তস্য নিমিত্তত্বান্নার্নিমিত্তো ভাবোৎপত্তিরিতি’। (ন্যায়ভাষ্য-৪/১/২৩)
অর্থাৎ :
ভাবোৎপত্তির নিমিত্ত হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে অনিমিত্তকে; ফলে নিমিত্তকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে স্বভাববাদীরা অগ্রসর হয়েছেন নিমিত্তেরই সাহায্য নিয়ে, যদিও এই নিমিত্ত হিসেবে তাঁরা অনিমিত্তকে ব্যবহার করেছেন।

তার মানে, ন্যায়ভাষ্যকার বলতে চান, স্বভাববাদীরা এক্ষেত্রে যে ধারণাকে অস্বীকার করতে প্রবৃত্ত সেই বিশেষ ধারণাই এখানে তাঁদের অবলম্বন। তাঁদের এ ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অন্যদিকে আরেক নৈয়ায়িক উদ্যোতকর তাঁর ‘ন্যায়বার্তিক’ গ্রন্থে স্বভাববাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন– ‘নিমিত্তের অভাব কণ্টকাদি বিশেষ কয়েকটি বস্তুর ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য, না প্রতিটি বস্তুর ব্যাপারে এর প্রয়োগ স্বীকার্য? যদি কয়েকটি মাত্র বস্তুকে অনিমিত্ত মনে করা হয়, তাহলে অবশিষ্ট সব দ্রব্যের নিমিত্তমূলকতা প্রমাণিত হয়। অপর পক্ষে, প্রত্যেক বস্তু অনিমিত্ত– এ ধরনের স্বীকৃতিতে স্ববিরোধ দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। কারণ, স্বভাববাদের প্রচারকের এ-ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য অপরের মনে একটি বিশেষ ধারণা উৎপাদন করা। স্বভাববাদের সমর্থনে উৎপন্ন ধারণা নিমিত্তকে কেন্দ্র করেই সম্পাদিত। ফলে স্বভাববাদ এখানে ব্যাহত এবং কার্যের নিমিত্তমূলকতা শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য। কয়েকটি অংশের সমবায়ে গঠিত হবার ফলে কণ্টক প্রভৃতি দ্রব্য স্বরূপে পরিণতির জন্য কারণের অপেক্ষা রাখে– চার্বাক মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে ন্যায়বার্তিককার এই সিদ্ধান্তের অনুকূলে মন্তব্য প্রকাশ করেন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৫)

‘প্রকৃতপক্ষে, কার্যের উৎপত্তি বা ঘটনার সংঘটনের মূলে কারণের অস্তিত্বকে স্বীকার না করলে বিশেষ এক সময়ে কোন কার্য বা ঘটনা কেন উৎপন্ন বা সংঘটিত হয়, সব সময়ে হয় না– এ প্রশ্নের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। স্বভাববাদের এই মূলগত ত্রুটি স্বভাববাদ বিরোধীদের অস্ত্র হিসাবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এই মতবাদের আলোচনার সময় উদয়ন (ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-১/৫) বলেন যে কার্যের উৎপাদন কারণের উপর নির্ভরশীল হলে তবেই তার বিশেষ কোন সময়ে আবির্ভাবের যৌক্তিকতা থাকে এবং এই জন্যই কার্যের উৎপত্তির মূলে কারণকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ ও তার টীকাকে অনুসরণ করে এ সম্বন্ধে আরও বলা যায়– স্বভাব শব্দের অর্থ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য কার্যের কিংবা কারণের। প্রথম সম্ভাবনায় উৎপত্তির পূর্বে কার্যের এবং সেই সঙ্গে তার বৈশিষ্ট্যেরও অস্তিত্ব না থাকায় স্বভাবের মাধ্যমে কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে না। স্বভাবকে যদি কারণের অস্তিত্ব বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে স্বভাববাদের সমর্থকেরা প্রকারান্তরে কারণবাদকেই স্বীকৃতি দেন এবং স্বভাববাদের কোন স্বাধীন সত্তা থাকে না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৬)

এই ধরনের দার্শনিক কূট-যুক্তি ও তর্কের সমাহার আমরা ইতঃপূর্বে অন্যক্ষেত্রেও দেখেছি। অধ্যাত্মবাদের সমর্থকরা যে ভূতবাদের মতোই স্বভাববাদকেও কখনোই মেনে নিতে প্রস্তুত নন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু স্বভাববাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই একটা খটকা থেকে যায়। স্বভাববাদীরাও কি সব-অর্থে ‘নিমিত্তকারণ’ অস্বীকার করে পার পাবেন? ঈশ্বর, অদৃষ্ট প্রভৃতি আধ্যাত্মিক অর্থে ‘নিমিত্তকারণ’ বলে কিছু না মানলেও সাধারণভাবে ও সর্বত্র ‘নিমিত্তকারণ’-মাত্রই অস্বীকার করা অসম্ভব; চার্বাক যদি তা করে থাকেন তাহলে সেটা তাঁর দার্শনিক দুর্বলতারই পরিচায়ক হবে বলে দেবীপ্রসাদ প্রমুখ আধুনিককালের বিদ্বানদের অভিমত। মৃত্তিকাই ঘটের কারণ; কিন্তু এই কারণ বলতে ঐকান্তিক অর্থে ‘নিমিত্তকারণে’র নিষেধ করে শুধুমাত্র ‘স্বভাব’ মানাই পর্যাপ্ত হবে না। কেননা, নিছক স্বভাব ছাড়া নিমিত্তকারণ হিসেবে সবকিছু প্রত্যাখ্যান করলে তা মাটি থাকলেই ঘট হবার কথা। কিন্তু তা হয় না। নিমিত্তকারণ হিসেবে কুম্ভকারও মানতেই হবে। তন্তুর নিছক স্বভাবকেই বস্ত্রের পর্যাপ্ত কারণ বলা যায় না। কেননা সুতো থাকলেই কাপড় হয় না; সুতো থেকে কাপড় বোনবার জন্যে তাঁতী বলে নিমিত্তকারণও মানা দরকার। তবুও অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে এই নিমিত্তকারণও স্বভাব-নিরপেক্ষ নয়; পক্ষান্তরে স্বভাব-সাপেক্ষই। তা নাহলে তো মাটি থেকেই তাঁতী কাপড় বুনতে পারতো বা সুতো থেকেই কুমোর ঘট গড়তে পারতো।

চার্বাক প্রসঙ্গে আমাদের যেটুকু তথ্যের সম্বল তা থেকে অনুমানের সুযোগ নেই যে, এ-হেন পার্থিব অর্থে নিমিত্তকারণ বলে চার্বাক কিছু স্বীকার করতেন। যদি না করে থাকেন তাহলে তা প্রাচীন বস্তুবাদের একটা উল্লেখযোগ্য দুর্বলতারই পরিচায়ক হবে। আমরা বরং স্বভাববাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটির দিকে আলোকপাত করতে পারি। তিনি বলছেন–
‘সাধারণত, স্বভাব শব্দের ইংরেজি করা হয় ‘নেচার’। যে-কোনো জাগতিক ঘটনার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যায় তার জাগতিক কারণটুকুই পর্যাপ্ত। তার জন্যে অতি-প্রাকৃত বা প্রকৃতি-বহির্ভূত আর কিছু মানবার প্রশ্ন ওঠে না। ঈশ্বর নয়, অতীত কর্মের ফল হিসেবে ধর্মাধর্ম (বা পারিভাষিক অর্থে ‘অদৃষ্ট’)– এসব কিছুই নয়। আরো একটু ব্যাখ্যা করে বলবার সুযোগ দিলে হয়তো দাবি করা যেতে পারে যে, স্বভাব বলতে আমাদের প্রাচীন বস্তুবাদীরা ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বা অন্তত তারই খুব কাছাকাছি একটি ধারণা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতিবিজ্ঞানে আজকাল আমরা যাকে বলি ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বা ‘ল অব নেচার’। অবশ্যই সুপ্রাচীন কালের দার্শনিকদের কাছে থেকে এই ধারণার আধুনিক অর্থে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রত্যাশা করা ঐতিহাসিকভাবে অবাস্তব হবে। কিন্তু এই ধারণারই প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস স্বভাববাদের মধ্যে খোঁজবার চেষ্টা অত্যুক্তি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রাচীন ধ্যানধারণার মধ্যে আধুনিক– এবং অনেক সময় অতি-আধুনিক– বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনুসন্ধান অবশ্যই অচল। কখনো বা তার ফলে রকমারি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।… কিন্তু… প্রাচীন কালের চিন্তার মধ্যেও সেখানে যতটুকু বিজ্ঞান-চেতনার প্রতিশ্রুতি ছিল সেটুকুকেও সম্পূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। স্বভাববাদের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ম বা ‘ল অব্ নেচার’ একেবারে আধুনিক অর্থে অবশ্যই প্রত্যাশিত নয়; কিন্তু তারই যতটুকু প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস স্বভাববাদের মধ্যে অনুমিত হয় তাও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কোনো কাজের কথা নয়। বরং একরকম যেন পাল্টা ভুল। একটা ভুল– এবং তা যত বড় ভুলই হোক-না-কেন– সংশোধন করার জন্য পাল্টা-ভুলের পথ ধরা যুক্তিযুক্ত নয়। স্বভাববাদের বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা একেবারে অস্বীকার করা এই রকম একটা পাল্টা-ভুল বলেই মনে হয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৩-৪)

.
সে যাক্, তারপরেও ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে ‘স্বভাববাদ’ নিয়ে– ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃতই হোক– একধরনের বিভ্রান্তির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যেমন মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-এর উৎস নির্দেশ করে লতিকা চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন–
‘চার্বাক মত অনুসারে জগতের অন্য যে সমস্ত ঘটনাকে আপাতঃ দৃষ্টিতে কার্যকারণঘটিত বলে মনে হয়, অনুরূপ বিচারে সেগুলিও ‘যাদৃচ্ছিক’ প্রতিপন্ন হয়। চার্বাকদের অনুসৃত এই দৃষ্টিভঙ্গীরই পরিপ্রেক্ষিতে চার্বাক দর্শনের অপর সংজ্ঞা ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’ বা ‘স্বভাববাদ’।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৪)

সুস্পষ্টভাবেই, এই মন্তব্যে, ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’ ও ‘স্বভাববাদ’কে অনুরূপ বা অভিন্ন মত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সত্যি কি এই দুটি মত এক ও অভিন্ন? এ-বিষয়টিও নিশ্চয়ই আলোচনার দাবি রাখে। এবং বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার নজির হিসেবেও আলোচনাটি অবান্তর হবে না বলেই মনে হয়।

.
। স্বভাব ও যদৃচ্ছা।

শ্রদ্ধেয় দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১১৪) স্বভাববাদীদের মধ্যে দুটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেন– (১) যাঁরা স্বভাবকে কারণের স্বীকৃতি দেন এবং (২) যাঁরা কার্যকারণবাদের বিরোধী এবং মনে করেন যে জগতের সবকিছু ঘটনাই অহেতুক। দ্বিতীয় দলের স্বভাববাদীদের যাদৃচ্ছিক বলা হয়।
শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য স্বভাববাদীদের মতদ্বৈধ অনুযায়ী চার্বাকগোষ্ঠির মধ্যেও দুটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। যদিও এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তিনি কোন তথ্য সরবরাহ করেন না।

সম্ভবত, শাস্ত্রী মহাশয় এখানে ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’কে ‘স্বভাববাদ’ থেকে বিযুক্ত না করে তারই অংশ-বিশেষ বা ভিন্ন বিভাগ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সেকালের মতো একালের কোনো কোনো লেখকও বোধহয় ‘স্বভাববাদ’-কে– কিছুটা খেলো করবার উৎসাহেই কিনা কে-জানে– ‘যদৃচ্ছাবাদ’ বলে আর একটা প্রাচীন মতের সঙ্গে তার তাদাত্ম্য দেখাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ, এঁদের বিচারে ‘স্বভাববাদ’-ও যা, ‘যদৃচ্ছাবাদ’-ও তাই। যদৃচ্ছাবাদের মূল কথা কিন্তু কার্যকারণবাদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক ঘটনাবলী নেহাতই অহেতুক, অকারণ; অঘটনের সামিল। যদি সত্যিই তাই হয়, দেবীপ্রসাদের মতে, তাহলে প্রাকৃতিক ঘটনার কোনো কারণ খুঁজতে যাওয়া বেকুবির পরিচায়ক হবে। অর্থাৎ, যদৃচ্ছাবাদ সম্পূর্ণ অর্থে বিজ্ঞান-বিরোধী, কেননা বিজ্ঞানের একটা মূল উদ্দেশ্যই হলো, প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ অনুসন্ধান। নিউটন যদি ভাবতেন, ফলটা মাটির দিকে অকারণেই বা এমনিই পড়েছে– তাহলে আর এ নিয়ে তাঁর কোনো জিজ্ঞাসা জাগতো না। বিজ্ঞানও হতো না।

কিন্তু, এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ বলেন, স্বভাববাদকে এইভাবে ‘যদৃচ্ছাবাদে’র সঙ্গে অভিন্ন মনে করার পিছনে না আছে কোনো যুক্তি, না কোনো নির্ভরযোগ্য বা প্রামাণ্য তথ্য। ইতঃপূর্বে বর্তমান প্রসঙ্গে উদ্ধৃত ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর দৃষ্টান্ত থেকেও দেখা যায় যে, উপনিষদ্কার ‘স্বভাববাদ’ ও ‘যদৃচ্ছাবাদ’– এই দুটি মতকে সম্পূর্ণ পৃথক অর্থেই উল্লেখ করেছেন। তুলনায় পরবর্তীকালের নানা দার্শনিকও তাই-ই করেছেন। এঁদের প্রত্যেকের প্রতিটি উক্তি হয়তো এখানে উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই, দরকারও নেই। বর্তমান আলোচনার পক্ষে পর্যাপ্ত বিবেচনায় শুধু একটি নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। স্বভাববাদের সঙ্গে যদৃচ্ছাবাদের মূল পার্থক্য দেখাবার উদ্দেশ্যে জৈন দার্শনিক গুণরত্ন যদৃচ্ছাবাদের খুবই প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা স্বাধীন তর্জমায় তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম উদ্ধৃত করা যেতে পারে। গুণরত্ন বলছেন,–

‘যদৃচ্ছা বলতে বোঝায় কোনো রকম পূর্ব-পরিস্থিতি ছাড়াই ঘটনার ব্যাখ্যাপ্রয়াস। প্রশ্ন ওঠে : এ হেন মতবাদের সমর্থক বলতে কে বা কারা? উত্তর : কার্যকারণবাদকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে যাঁরা সব কিছুকেই একেবারে অকারণ বলে মনে করেন, তাঁরা। তাঁদের মূল যুক্তি হলো, কার্যকারণবাদ মানবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, কেননা তার পক্ষে কোনোরকম প্রমাণ নেই। যেমন, পদ্মবনেও শালুকফুল ফোটে, গোবরের গাদাতেও ফোটে। কিংবা, একটা অগ্নিকুণ্ড থেকে যেমন কোনো কিছুতে আগুন ধরানো যায়, তেমনি চকমকি পাথর ঠুকেও তা সম্ভব হয়। কিংবা, কলাগাছের গুঁড়ি থেকে নতুন কলাগাছ জন্মাতে পারে, আবার বীজ পুঁতেও কলাগাছ ফলানো সম্ভব। ধোঁয়ো থেকেও ধূম উৎপন্ন হয়, কাঠে অগ্নিসংযোগের ফলেও হয়। অতএব, কার্যকারণ বলে সম্বন্ধের কথাটা অলীক। মানতেই হবে, প্রাকৃতিক ঘটনাবলী নিছক অকারণ বা অহেতুক। প্রকৃত বিদ্বানেরা তাই তথাকথিত কার্যকারণ সম্বন্ধের দৃষ্টান্তগুলিকে কাকতালীয়র মতোই বিবেচনা করেন; অর্থাৎ কাক উঠে গেল, আর এদিকে গাছ থেকে তাল পড়ল, দুটো ঘটনার মধ্যে আসলে কোনো রকম সম্বন্ধ না-থাকলেও একটিকে অপরটির কারণ বলে কল্পনা করার সামিল।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৫)


তাহলে প্রশ্ন, আগুন কেন উষ্ণ? যদৃচ্ছাবাদী বলবেন, ব্যাপারটা নেহাতই অহেতুক; এর কোনো কারণ খোঁজাই বেকুবি। কাঁটা কেন তীক্ষ্ণ? তারও কোনো কারণ নেই। কারণ খুঁজতে যাওয়াই বেকুবি। তাই দেবীপ্রসাদ বলেন, এ-হেন মত মানলে আর-যাই-হোক, প্রকৃতি-বিজ্ঞান বলে কিছুই হতে পারে না। স্বভাববাদও নয়। কেননা, স্বভাববাদের মূল কথা হলো, প্রতিটি ঘটনারই পর্যাপ্ত কারণ থাকতে বাধ্য; কিন্তু সেই কারণের সন্ধানে প্রাকৃতিক বিষয় ছেড়ে অতি-প্রাকৃত বা প্রকৃতির অতীত কিছু খুঁজতে যাওয়া সম্পূর্ণ নিরর্থক। প্রাকৃতিক নিয়ম থেকেই প্রাকৃতিক ঘটনার পর্যাপ্ত কারণ পাওয়ার কথা।

দুটি মতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিয়ে আমাদের বর্তমান আলোচনা পল্লবিত করার প্রয়োজন হবে না। একালের অগ্রণী বিদ্বান গবেষকেরা তা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করাই বর্তমান উদ্দেশ্যের পক্ষে পর্যাপ্ত হবে বলে বিশ্বাস। অবশ্যই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা ব্যাখ্যামূলক স্বাধীন তর্জমায়। ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক্যের আলোচনা প্রসঙ্গে হিরিয়ান্না (Hiriyanna) মন্তব্য করেছেন–

‘কিন্তু এখানে তার মধ্যে দুটির (অর্থাৎ দুটি নাস্তিক্যমতের) পার্থক্য করা ভালো; কেননা ভারতীয় দর্শনের কয়েকটি বিষয় প্রসঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় তা কাজে লাগবে। তার মধ্যে একটি হলো ‘আপতনবাদ’ (accidentalism), দার্শনিক পরিভাষায় ‘যদৃচ্ছাবাদ’ বা ‘অনিমিত্তবাদ’। অপরটি হলো ‘প্রকৃতি-সর্বস্ববাদ’ (naturalism) বা ‘স্বভাববাদ’। ‘শ্বেতাশ্বতর’ উপনিষদ্-এ দুটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত হয়েছে, এবং পরবর্তী দার্শনিক গ্রন্থেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য স্বীকৃত (যেমন ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’-১/৫)। প্রথমটি অনুসারে বিশ্বপ্রকৃতি বিশৃঙ্খলার রাজ্য, তার মধ্যে যেটুকুবা নিয়মানুবর্তিতার পরিচয় পাওয়া যায় তা নেহাতই আকস্মিক ঘটনামাত্র। দ্বিতীয় মতে বিশ্বপ্রকৃতি স্বীয়স্বভাব-নিয়ন্ত্রিত (‘মহাভারত’-১২/২২২/২৭ : ‘স্বভাব-ভাবিনো ভাবান্’)। প্রথমটি কার্যকারণ-সম্বন্ধ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। দ্বিতীয়টি কার্যকারণভাবকে বিশ্বজনীন নিয়ম বলে মানে; কিন্তু এই মতে সমস্ত পরিবর্তন যে-বস্তুতে পরিদৃষ্ট হয় তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রতি বস্তুই অনুপম; এবং তার পুরো ইতিহাসটাই এই অনুপমতার দ্বারা পূর্বনিয়ন্ত্রিত। অতএব স্বভাববাদ অনুসারে যে-জগতে আমাদের বাস সেই জগৎ মোটেই নিয়মহীন নয়; কেবল সেই নিয়মের নিয়ন্তা বলতে প্রকৃতিবাহ্য কিছু কল্পনা করা চলবে না। জগৎ আত্ম-নিয়ন্ত্রিত; অনিয়ন্ত্রিত নয়। অতএব অন্য মতটির সঙ্গে এই মতের পার্থক্য হলো, এই মতে যাবতীয় ঘটনা অমোঘ নিয়মের অনুবর্তী; কিন্তু এই অমোঘ নিয়ম বস্তুস্বরূপেরই অন্তর্ভুক্ত– বাহ্য কোনো কর্তার আয়ত্তাধীন নয়। এ-বিষয়ে আমরা অন্ধ বলেই কল্পনা করি যে, প্রকৃতিতে নিয়ম বলে কিছু নেই বা আমরা স্বেচ্ছায় যা-খুশি করতে পারি। উভয় মতের মধ্যে মিল শুধু এইটুকুই যে উভয়ই জগৎনিয়ন্তা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি অস্বীকার করে। তাছাড়া, দুটি মতের কোনোটিই শাস্ত্রবচন বা ঈশ্বর-আস্নাত বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করে না। [ হিরিয়ান্না অবশ্য এখানে খানিকটা হাল্কাভাবেই চার্বাকমতের পিছনে যদৃচ্ছাবাদের প্রভাব কল্পনা করেছেন; কিন্তু আমরা ইতিপূর্বে সে-জাতীয় কল্পনা বর্জনের যুক্তি দেখিয়েছি। যাই হোক, তিনি আর যদৃচ্ছাবাদ নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেননি; পরন্তু একটু পরেই তিনি স্বভাববাদের সঙ্গেই লোকায়ত-মতের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। ]
‘এককালে স্বভাববাদ নিশ্চয়ই যথেষ্ট প্রচলিত ছিল, কেননা শঙ্কর (‘ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য’-১/১/২) প্রভৃতি পুরোনো কালের দার্শনিকদের রচনায় আমরা তার উল্লেখ পাই। ‘মহাভারত’-এর নানা প্রসঙ্গে মতটির পরিচয় আছে (মহাভারত-১২/১৭৯/২২২ ও ২২৪)। মতটি প্রসঙ্গে প্রথম লক্ষণীয় বিষয় হলো তার বস্তুতান্ত্রিকতা (positivistic character)। ‘অদৃষ্টবাদ’-এর বা প্রকৃতি-অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে স্বভাববাদের যে রকম বিরোধ সেই রকমই বিরোধ ‘উপনিষদ্’-এর অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে। মনে হয় ‘লোকায়ত’ (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোক সংক্রান্ত দর্শন) বলতে আদিতে স্বভাববাদের এই বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই বোঝাতো, যদিও পরবর্তী সাহিত্যে লোকায়ত শব্দটিই সাধারণভাবে প্রচলিত। মতটির আর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলতে দেহান্তরগামী আত্মার অস্বীকৃতি, যদিও অবশ্য এমন কথা অনুমানের সুযোগ আছে যে যতদিন দেহে প্রাণ বর্তমান ততদিন পর্যন্ত কোনো এক অর্থে আত্মার বর্তমানতা স্বীকার করায় স্বভাববাদের পক্ষে হয়তো বাধা ছিল না। কিন্তু মতটির সঙ্গে প্রধান বিরোধ বলতে অধ্যাত্মবাদেরই, কেননা অধ্যাত্মবাদের মূল কথাই হলো ভূত-অতিরিক্ত আত্মায় বিশ্বাস। যে-সব তথ্যের উপর নির্ভর করে আমাদের এই আলোচনা তার মধ্যে ‘মহাভারত’-এর একটি উক্তি হলো, ‘মৃত্যুতেই জীবের পরম পরিসমাপ্তি’। আসলে, স্বভাববাদের বিশেষ প্রবণতা বলতে প্রকৃতি-অতীত বস্তু অস্বীকারই। এইভাবে স্থায়ী আত্মা অস্বীকার করার ফলে সাধারণত কর্মফল বলতে যা বোঝায় তাও স্বভাববাদে অস্বীকৃত। বস্তুজগতের মূল উপাদান এক বা একাধিক– এবিষয়ে স্বভাববাদীর মত সম্বন্ধে আমাদের পক্ষে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়, কেননা মহাকাব্যে দু-রকম মতেরই ইংগিত পাওয়া যায়। যেমন, মহাকাব্যের এক জায়গায় উক্ত হয়েছে জীবদেহ অবশ্যই পঞ্চভূতের পরিণাম; অন্যত্র মোটের উপর একই কথা– স্বভাববাদীর মতে পঞ্চভূতই পরম সত্য। কিন্তু আবার প্রসঙ্গান্তরে উক্ত হয়েছে স্বভাববাদ অনুসারে জগৎ বৈচিত্র্যের মূলে একই বস্তু।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৬-৭)


প্রাচীন সাহিত্যে বিবিধ প্রসঙ্গে ছড়ানো স্বভাববাদ-সংক্রান্ত নানা মন্তব্যে নানা রকম ঝোঁক থাকার ফলে আমাদের কাছে আজ মতবাদটি প্রসঙ্গে অল্পবিস্তর অস্পষ্টতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবুও কিন্তু, দেবীপ্রসাদের মতে, দুটি কথা জোর দিয়ে বলার সুযোগ আছে।–
এক।। প্রাচীন লোকায়ত ও চার্বাকমতে জগৎ-বৈচিত্র্যের কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজা নিষ্ফল, কেননা স্বভাববাদের মধ্যেই তার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অবশ্য ভারতীয় দর্শনে লোকায়ত ছাড়া আর কোনো দর্শনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বভাববাদ স্বীকৃত কিনা– এ প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
দুই।। মতটি খুব প্রাচীন বলেই ভারতীয় দর্শনে এ সম্বন্ধে যে সব কথা পাওয়া যায় তারই উপর নির্ভর করে আধুনিক কোনো মতের সঙ্গে তার তুলনা হয়তো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। কিন্তু অত্যুক্তির আশঙ্কা এড়িয়েও বোধহয় দাবি করা যেতে পারে যে আধুনিক প্রকৃতি-বিজ্ঞানে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বলতে যা বোঝায় স্বভাববাদের মধ্যেই তার অন্তত প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস খোঁজা নিষ্ফল নয়।

এ-ব্যাপারে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই যে ভারতীয় দর্শনে অন্যতম প্রাচীন মত হিসেবে ‘স্বভাববাদ’ অবশ্যই চার্বাক-সম্মত। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে, ভারতীয় দর্শনে লোকায়ত ছাড়া আর কোনো দর্শনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই স্বভাববাদ স্বীকৃত কিনা?
এক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রাচীন সাহিত্যের দৃষ্টান্ত নজরে আসলে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছু কৌতুহল জেগে উঠে অবশ্যই। যেমন, দেবীপ্রসাদ দেখাচ্ছেন, ‘মহাভারত’-এর ব্যাখ্যায় (শান্তিপর্ব-২৩২/২১) নীলকণ্ঠ বলছেন–

‘স্বভাব ইতি পরিণামবাদিনাং সাংখ্যানাম্’। (মহাভারত-১২/২৩২/২১)
অর্থাৎ : পরিণামবাদী সাংখ্যমতে ‘স্বভাব’ স্বীকৃত।

আবার ‘সাংখ্যকারিকা’র ভাষ্যে গৌড়পাদও মন্তব্য করেছেন–

‘সাংখ্যানাং স্বভাবো নাম কশ্চিৎ কারণমস্তি’। (সাংখ্যকারিকাভাষ্য)
অর্থাৎ : সাংখ্যদর্শনের অনুগামীদের মতে ‘স্বভাব’ নামের একরকম কারণ আছে।


এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন– ‘হয়তো এজাতীয় নজিরের উপর নির্ভর করেই টি. ই. হিউম (T. E. Hume) ‘শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদ্’-এর তর্জমা প্রসঙ্গে স্বভাববাদকে সাংখ্যবাদীর মত বলে গ্রহণ করেছেন। তাঁর সমর্থনে শঙ্করাচার্যের উক্তি অনায়াসে উদ্ধৃত করা যায়। সাংখ্য-খণ্ডনে তিনি বারবার মতটিতে স্বভাববাদের উপর নির্ভরতা প্রদর্শন করেছেন।
এজাতীয় নজিরগুলির গুরুত্ব স্বীকার করলে অনুমানের সুযোগ থাকে, পরবর্তীকালে সাংখ্যদর্শনে ‘প্রকৃতি’ বা ‘প্রধান’ হিসেবে উল্লিখিত আদিম অচেতন কারণটির সঙ্গে ‘পুরুষ’ নামে এক চেতন তত্ত্ব সংযোজিত হলেও দর্শনটির আদিরূপে হয়তো তা ছিল না : অচেতন প্রধান থেকে স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই জগৎ-উৎপত্তি। এই কারণেই কি পরবর্তী সাংখ্যে ‘পুরুষ’ সংযোজিত হলেও তা ‘উদাসীন এবং অপ্রধানে’র চেয়ে বেশি মর্যাদা পাননি? যদি তাইই হয়, তাহলে সুখলালজী এবং সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আদি-সাংখ্যকেও কোনো একরকম প্রাচীন বস্তুবাদ বলে অনুমান করার সুযোগ আরো জোরদার হয়। জৈন দার্শনিক শীলাঙ্ক তো সরাসরি এই কথাই বলেছেন। সেদিক থেকে আরো বলা যেতে পারে, বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে চার্বাক বা লোকায়ত একান্তই নিঃসঙ্গ নয়। সম্ভাবনাটি নিয়ে বিদ্বানেরা আশা করি আরো গভীর বিবেচনা করতে সম্মত হবেন। প্রথাবিরুদ্ধ হলেও এবং প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী হলেও আদিসাংখ্য নিয়ে গবেষণার সুযোগটাই অস্বীকার করা মুক্ত মনের পরিচায়ক হবে না, বিশেষত ভারতীয় ঐতিহ্যেই যখন একথা স্বীকৃত যে সাংখ্যর আদিরূপ অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়েছে এবং তার ‘কণামাত্র’ আজ অবশিষ্ট।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১২০)

উল্লেখ্য, সাংখ্য-প্রবচন বা সাংখ্য-সূত্রের ভাষ্যের ভূমিকায় স্বয়ং বিজ্ঞানভিক্ষু বলেছিলেন–

‘কালার্কভক্ষিতং সাংখ্যশাস্ত্রং জ্ঞান-সুধাকরম্ ।
কলাবশিষ্টং ভূয়োহপি পুরয়িষ্যে বচোহমৃতৈঃ।।’- (সাংখ্যাপ্রবচনভাষ্য)
অর্থাৎ : সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যের গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কণামাত্রই অবশিষ্ট আছে; আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।


অনুমান করা হয়, বিজ্ঞানভিক্ষু যে-ভাবে তা পূরণ করেছিলেন ‘তার ফলে এ-দর্শন আর যাই হোক সাংখ্য-দর্শন থাকেনি– বেদান্তমতে বা অন্তত প্রায়-বেদান্তমতে পরিণত হয়েছিলো। কেননা, নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর দর্শনে পরিণত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; শেষ পর্যন্ত তিনি বেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের প্রায় সমস্ত মৌলিক প্রভেদই উড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন।’- (ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ, পৃষ্ঠা-২৩)। সম্ভবত পরবর্তীকালের অনুসারীদের মধ্যেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিলো।

চার্বাকী বস্তুবাদ

চার্বাক সিদ্ধান্তের আলোচনার সময় প্রথমেই আমাদের যে বিষয়টি মনে রাখা আবশ্যক তা হলো, চার্বাককে দেখা উচিত ভারতীয় একটি দর্শন হিসেবেই এবং এই চার্বাক দর্শনের সামগ্রিক চিত্রায়ণ ভারতীয় দর্শনের সাধারণ ধারার পরিপ্রেক্ষিতেই করা উচিত। সে বিবেচনায়, আমরা আগেই দেখেছি যে কেবল থিওরি বা মতবাদের মধ্যে ভারতের কোন দর্শনই আসলে সম্পূর্ণভাবে রূপায়িত নয়। আর তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দর্শনটি যে আকারে প্রতিভাত, দর্শনের সম্পূর্ণ রূপরেখার বিচারে তার আলোচনাও আবশ্যক বৈকি।


মতবাদের ক্ষেত্রে চার্বাক নাস্তিক, অর্থাৎ ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনকে কেন্দ্র করে যে মূল্যবোধ ভারতীয় ঐতিহ্যে বহুকাল ধরে সঞ্চিত, তার সমালোচনার ভিত্তিতে নেতিবাচক রূপে চার্বাকের প্রতিষ্ঠা। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই নাস্তিকতার রূপায়ণ কি সম্ভব? এই প্রশ্নটিকে ঘিরে ভারতীয় দার্শনিক গোষ্ঠীতে এই চার্বাকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ইতিবাচক বিশেষ কোন আচরণবিধির পটভূমিতে নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা চলে, এই আচরণবিধি ভারতের সনাতন ধারার পরিপন্থী হলেও। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘নাস্তিক’ শব্দ যদিও নেতিবাচক রূপই প্রকাশ করে, তবুও চার্বাক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাহচর্যের ফলে এই সংজ্ঞা ইতিবাচক কিছু অর্থের দ্যোতক অবশ্যই। এবং নাস্তিকদের এই ইতিবাচক রূপের প্রকাশ সনাতনগোষ্ঠীর বিরোধী কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে।

সনাতনপন্থী দার্শনিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে চার্বাকগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নামে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মত প্রচার করার প্রবণতা ইতঃপূর্বেই লক্ষ্য করেছি। সেক্ষেত্রে আমাদের বিচারে পুরন্দরপন্থী চার্বাকমতই যে আসলে দার্শনিক দৃষ্টিতে প্রকৃত চার্বাকমত হওয়ার যোগ্য– এবং হয়তো সেটাই ছিলো– তাও আমরা ঐতিহাসিক বিবেচনায় অনুসন্ধান ও রূপায়নের প্রচেষ্টা করেছি। এই চার্বাকগোষ্ঠীই হলো বস্তুবাদী চার্বাক। তবে– ‘এই চার্বাকদের পরিপূর্ণ আলেখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিকদের গ্রন্থে অদৃশ্য। কারণ এই দার্শনিকদের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে কেবল চার্বাকী হেতুবাদ, তর্কের সাহায্যে যা প্রতিপক্ষের ত্রুটি উন্মোচনে উন্মুখ। চার্বাকদের রীতিনীতি এবং আচরণবিধির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় দর্শনের সঙ্কলন গ্রন্থগুলিতে এবং সমসাময়িক অন্যান্য কিছু গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চার্বাকদের বিবরণী থেকে। প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিকেরা চার্বাকী আক্রমণের আঘাত থেকে নিজ নিজ মতবাদগুলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন– ফলে তাঁদের বর্ণনা হয়েছে পারস্পরিক তর্কযুদ্ধের এক বিবরণী। অন্যান্য ব্যাপারগুলিকে নিজেদের আলোচনার পরিসরে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করেননি। অন্যান্য গ্রন্থগুলিতে অবশ্য তর্কযুদ্ধের এ ছবি নেই, আছে কেবল চার্বাকী আচরণবিধির এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এই আচরণবিধির সমর্থনে চার্বাক পক্ষের যুক্তির কিছু বর্ণনা।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৪)

যেমন– ‘বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রে’র বর্ণনা অনুসারে (কামসূত্র-১/২/২৯/৩০) চার্বাকদের জগৎ প্রধানতঃ বর্তমানকে কেন্দ্র করে। বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্রে’র ‘সাধারণািধকরণম্’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ত্রিবর্গপ্রতিপত্তিঃ’-তে লোকায়তিক বর্ণনায় বলছেন–

‘নধর্ম্মাংশ্চরেৎ; এষ্যৎফলত্বাৎ, সাংশয়িকত্বাচ্চ।।
কো হ্যবালিশো হস্তগতং পরগতং কুর্য্যাৎ।।
বরমদ্য কপোতঃ শ্বো ময়ূরাৎ।।
বরং সংশয়িকান্নিষ্কাদসাংশয়িকঃ কার্যাপণঃ।–ইতি লৌকায়তিকাঃ।’-
(কামসূত্র-১/২/২১-২৪)।।
অর্থাৎ :
‘ধর্ম্মাচরণ করিবার প্রয়োজন নাই;– কারণ তাহার ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না এবং যজ্ঞাদি সাধিত হইলেও ফল হইবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহও আছে’। ২১।। ‘মূর্খ ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?’ ২২।। ‘আগামী কল্যকার ময়ূর লাভ অপেক্ষা অদ্যকার পারাবত লাভ মন্দের মধ্যে ভাল’। ২৩।। ‘সংশয়সঙ্কুল হেমশত লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহে এক কার্যাপণ লাভও মন্দের ভাল।– একই কথা লোকায়তিক নাস্তিকেরা বলিয়া থাকে’। ২৪।। (তর্জমা– গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর)।


‘যে বর্তমান সুনিশ্চিত তাকে উপেক্ষা করে সংশয়িত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে চার্বাকেরা অগ্রসর হতে চান না, ভবিষ্যৎ যদিও উজ্জ্বল সম্ভাবনার রঙে রঞ্জিত থাকে। এই গ্রন্থে বর্ণিত চার্বাকেরা পরবর্তী দিনে ময়ূর লাভের আশায় বর্তমান দিনে হস্তগত পারাবতকে উপেক্ষা করেন না এবং ভবিষ্যতে স্বর্ণমুদ্রার প্রতীক্ষায় থেকে বর্তমানের তাম্রমুদ্রাকে বিসর্জন দিতেও তাঁরা প্রস্তুত নন। তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টাকে বিতর্কিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে প্রসারিত করার পরিবর্তে বর্তমানে নিশ্চিতলভ্য বস্তুগুলির দিকে নিয়োজিত করতে তাঁদের আগ্রহ ‘কামসূত্রে’র বর্ণনায় সুপরিস্ফুট।’ – (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৪)

চার্বাকেরা বৈষয়িক এবং জাগতিক ভোগসুখে আকণ্ঠ নিমজ্জিত– এরকম অভিমতই বর্ণিত হয়েছে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে। এতে আরো বলা হয়েছে, এই ভোগকাঙ্ক্ষার চরিতার্থতাই তাঁদের জীবনে মূল লক্ষ্য। দুঃখবাদী অধ্যাত্মদর্শনের কোন প্রভাব চার্বাক দর্শনে নেই। চার্বাকমতে জগৎ ভোগসুখের সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল। এবং এই জাগতিক সুখকে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টায় চার্বাকেরা তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে আগ্রহী। বস্তুজগৎ তার মনোহারী রূপ নিয়ে সুখের আকর্ষণে মানুষকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে। অধ্যাত্মবাদীদের দাবি অনুসারে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে এই আকর্ষণকে দমন করার শিক্ষা আছে এবং এই বস্তুজগতের বিপরীতগামী পথই সেখানে চরম শান্তির পথ হিসেবে নির্দেশিত। মাধবের মতে, চার্বাকেরা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের পথিক। বিষয়রসে মগ্ন হয়ে তাঁরা তাঁদের উপভোগস্পৃহা চরিতার্থ করতে আগ্রহী। যেমন–

‘অঙ্গনাদ্যালিঙ্গনাদি-জন্য-সুখমেবঃ পুরুষার্থঃ। ন চাস্য দুঃখসম্ভিন্নতয়া পুরুষার্থত্বমেব নাস্তীতি মন্তব্যম্, অবর্জনীয়তয়া প্রাপ্তস্য দুঃখস্য পরিহারেণ সুখমাত্রস্যৈব ভোক্তব্যত্বাৎ।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
(চার্বাকেরা বলেন,) অঙ্গনার আলিঙ্গন, চুম্বন, মর্দন প্রভৃতি জন্য এবং কাম্য বিষয়ের প্রাপ্তিজন্য সুখই পুরুষার্থ। এই সুখ দুঃখ-সম্ভিন্ন অর্থাৎ দুঃখ-মিশ্রিত বলে পুরুষার্থই নয়, তা মনে করবেন না। কারণ অবর্জনীয়রূপে প্রাপ্ত দুঃখের পরিহারের দ্বারা সুখমাত্রই সকলের ভোক্তব্য হয়ে থাকে।


তার মানে, দুঃখের যে সংমিশ্রণ এই জাগতিক সুখে থাকে চার্বাকদের ভোগের পথে তা বাধার সৃষ্টি করে না। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র এই বিবরণীতে মাধবাচার্য চার্বাকদের কর্মোদ্যমের বিশেষ এক পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন যে, চার্বাকেরা জাগতিক সুখের উপভোগে প্রয়াসী বাধা বা বিপদের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। কণ্টকের উপস্থিতি তাঁদের পুষ্প আহরণ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করতে পারে না। চার্বাক মতে ধানে তুষ থাকে বলে ধানের ক্ষুধা নিবৃত্তির ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে ধান ফেলে দেবার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। মৎস্য ভোজনের সুখ যাঁরা আস্বাদন করতে চান তাঁদের প্রথমে কাঁটাযুক্ত মাছই সংগ্রহ করতে হয়। যে দুঃখ অপরিহার্য সুখের পথে অগ্রসর হতে গেলে তাকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা উচিত। শস্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় মানুষ মাটিতে বীজ বপন করে। রন্ধনকার্যে প্রবৃত্ত হবার মূলেও থাকে তার ভোজনে পরিতৃপ্তির আশা। কিছু কিছু আশঙ্কা অনেক সময় এই আশার সঙ্গি হয়, কতকগুলি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপরিহার্য অমঙ্গল মানুষের এ্ সুখ সম্ভাবনার পক্ষে বহু ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। পশুপাখি এবং কীট পতঙ্গের দ্বারা ভূমিতে উৎপাদিত শস্য বিনষ্ট হতে পারে। রন্ধনকর্তার সুখাদ্য ভোজনে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করার জন্য অনাহুত ভিক্ষুকের উপস্থিতির সম্ভাবনাকেও পরিহার করা চলে না। চার্বাকেরা কিন্তু এই দুঃখময় সম্ভাবনার ভয়ে ভীত হনা না এবং সুখ দুঃখময় জগতে চলার পথে দুঃখকে সব সময়ে উপেক্ষা করে সুখের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। এই মনোবৃত্তি যে প্রকৃতই চার্বাকমতই, তা বোঝাতে মাধবাচার্য কিছু প্রামাণিক লোকগাথাও উদ্ধৃত করেন–

‘ত্যাজ্যং  সুখং বিষয়জন্ম পুংসাং
দুঃখোপসৃষ্টমিতি মুর্খবিচারণৈষা।
ব্রীহীন্ জিহাসতি সিতোত্তমতণ্ডুলাঢ্যান্
কো নাম ভোস্তুষকণোপহিতান্ হিতার্থী।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন,) পুরুষের বিষয়ভোগজন্য সুখ যেহেতু দুঃখ মিশ্রিত সেহেতু তাকে পরিত্যাগ করতে হবে– এটা নেহাৎই মূর্খের বিচার। এমন হিতার্থী কে আছেন– যিনি তুষকণাযুক্ত বলে পরিষ্কার উত্তম তণ্ডুলপূর্ণ ধান্য পরিত্যাগ করেন?


ইহজগতে ভোগসুখকে উপেক্ষা করে কৃচ্ছ্রসাধন চার্বাকদের অভিপ্রেত নয়। সন্ন্যাস বা ত্যাগের পথ তাঁদের অনুমোদন লাভ করেনি। ত্রিদণ্ড, ভস্মের আবরণ ইত্যাদি সন্ন্যাসের উপকরণগুলি চার্বাকমতে বুদ্ধি বা পৌরুষহীন ব্যক্তির জীবিকার উপায়। এই বিবরণের সপক্ষে লোকগাথার উদ্ধৃতি রয়েছে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ ও শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে–

‘অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্ ।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১৪)।
অর্থাৎ : অগ্নিহোত্র, (ঋক, সাম ও যজু) তিন বেদ, ত্রিদণ্ডধারণ (সন্ন্যাস), ভস্মানুলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষহীন মানুষের জীবিকার্জনের উপায় বলে বৃহস্পতি মনে করেন।


চার্বাক সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থের বিবরণীতে চার্বাকেরা নিয়ম বন্ধন-বিহীন ইন্দ্রিয়-সুখপরায়ণ হিসেবেই অভিহিত হয়েছেন। এই গ্রন্থগুলির বর্ণনা থেকে মনে হয় যে ভোগের দুর্দম আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করার কোনো বাঁধন চার্বাক দর্শনে নেই এবং চার্বাকেরা তাঁদের কাজে ঔচিত্য বা নীতিবোধের প্রেরণায় চালিত হন না। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ উদ্ধৃত বিশেষ একটি শ্লোকে উল্লিখিত ঘৃতপায়ী চার্বাক সাধারণের কাছে সুপরিচিত–

‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক মতে,) যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে? 


এই চার্বাক সুখের রসের স্বাদে বঞ্চিত হতে অনিচ্ছুক। ঘৃতপানকে যদি তিনি এই লক্ষ্যে উপনীত হবার উপায় বিবেচনা করেন, তাহলে এই ঘৃতপানের ব্যয় বহন করার জন্য ঋণ করতেও তাঁর কুণ্ঠা নেই। চার্বাকমতের নামে এই বিশেষ শ্লোকটি অতি প্রচলিত। আবার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেরই ভিন্ন এক স্থানে এই শ্লোকটির অনুরূপ অপর একটি শ্লোক দেখা যায় লোকগাথা বা লোকপ্রবাদের পরিচিতি নিয়ে। যেমন–

‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেন্নান্তি মৃত্যোরগোচরঃ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : যতদিন বাঁচো সুখেই বাঁচো, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই। ভস্মীভূত দেহের পুনরাগমন কোনভাবেই হতে পারে না।


এমনকি জয়ন্তভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’তেও দ্বিতীয় শ্লোকটির কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে উদ্ধতি দেখা যায়। সেখানে ‘দেহস্য’ শব্দের পরিবর্তে ‘শান্তস্য’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে কেবল। এই শ্লোকে বর্ণিত চার্বাক সুখলিপ্সু সন্দেহ নেই, কিন্তু সুখের প্রয়োজনে নীতিবোধ বিসর্জন দেবার কোন ইঙ্গিত কি এই শ্লোকে আছে? দেহনাশের পরে আত্মার সত্তায় বিশ্বাসের অভাব এই শ্লোকে পরিস্ফুট, যে কারণে পারলৌকিক সুখকে কামনা না করে বর্তমান জীবনের সুখেই তাঁরা মগ্ন থাকতে চান।

চার্বাকদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে ধর্ম তাঁদের জীবনের লক্ষ্য নয়, অর্থ এবং কাম, বিশেষত কাম তাঁদের নিকট পুরুষার্থরূপে গণ্য। ভারতীয় অধ্যাত্ম চিন্তায় মনুষ্যজীবনের চারপ্রকার লক্ষ্য পুরুষার্থ-রূপে কথিত হয়, যথা– ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। কিন্তু চার্বাকেরা অর্থ ও কামের উপাসক।
মোক্ষ সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। মানুষের সব দুঃখের এবং সেই সঙ্গে জাগতিক ভোগসুখেরও একান্ত অবসান এই মোক্ষ বা মুক্তির মধ্যে। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে মোক্ষ চরম লক্ষ্য হিসেবে নির্দেশিত হলেও সাধারণ সংসারী মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা এই লক্ষ্যের পথে প্রসারিত নয়। সেজন্য সাধারণভাবে চতুর্বর্গ হিসেবে অভিহিত হলেও সাংসারিক মানুষের জীবনে পুরুষার্থ প্রধানত ত্রিবর্গাত্মক, অর্থাৎ– ধর্ম, অর্থ এবং কাম এই তিনটি বিভিন্ন লক্ষ্যের সমবায়ে গঠিত। ভারতীয় চিন্তায় ‘অর্থ’ শব্দটি ধনসম্পদের বাচক এবং ‘কাম’ শব্দটি ইন্দ্রিয়জ সুখের বাচক। সাংসারিক ভোগসুখ অর্থ ও কামের অন্তর্গত। সম্পূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে কিন্তু ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ কখনও নির্দেশিত হয়নি। অর্থ ও কাম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মের দ্বারা। এই ধর্মযুক্ত ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ ত্রিবর্গ আখ্যায় অভিহিত। (দ্রষ্টব্য : লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৭)

কিন্তু একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, ভারতীয় চিন্তাধারায় অর্থ এবং কামের পরিচর্যাকে কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যের বাইরে রাখা হয়নি। অর্থ এবং কামকে যথাক্রমে উপজীব্য করেও অর্থশাস্ত্র এবং কামশাস্ত্র সনাতনপন্থীদের সমালোচনার বিষয় হয়নি। কারণ হয়তো, ‘অর্থশাস্ত্র’কার কৌটিল্য এবং ‘কামসূত্রে’র রচয়িতা বাৎস্যায়ন ধর্মের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রে’ বলা হয়েছে–

‘ধর্মার্থকামেভ্যো নমঃ’। (কামসূত্র-১/১/১)
‘অন্যোহন্যানুবন্ধং পরম্পরানুপঘাতকং ত্রিবর্গং সেবেত’। (কামসূত্র-১/২/১)
অর্থাৎ : (মুক্ততর্জমা)
ধর্ম, অর্থ ও কামকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করো। (কামসূত্র-১/১/১)।।  এরা একে অন্যের অনুবন্ধ। কোনটি বর্জন না করে এই ত্রিবর্গের অনুসরণ করা কর্তব্য। (কামসূত্র-১/২/১)।।

এবং কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ বলা হয়েছে–

‘ধর্মার্থাবিরোধেন কামং সেবেত, ন নিঃসুখঃ স্যাত্ । সমং বা ত্রিবর্গমন্যোন্যানুবন্ধম্ । একো হ্যত্যাসেবিতো ধর্মার্থকামানামাত্মানমিতরৌ চ পীড়য়তি। অর্থ এব প্রধান ইতি কৌটিল্যঃ। অর্থমূলৌ হি ধর্মকামাবিতি।’ (অর্থশাস্ত্র-১/৭/২)
অর্থাৎ :
ধর্ম ও অর্থের সঙ্গে অবিরোধে তিনি (রাজা) কাম নামক তৃতীয় পুরুষার্থের সেবা করবেন, সম্পূর্ণ সুখবর্জিত ভাবে থাকবেন না। অথবা, তিনি পরস্পরসংসৃষ্ট ধর্ম, অর্থ ও কামরূপ ত্রিবর্গের সেবা সমানভাবে অর্থাৎ তুল্যমাত্রায় করবেন। কারণ, ধর্ম, অর্থ ও কাম (এই তিনটির মধ্যে) যে কোনও একটির অতিরিক্তভাবে সেবা (অনুষ্ঠান) করলে নিজের পক্ষে এবং অপর দুটির পক্ষেও (অর্থাৎ অর্থ ও কাম, ধর্ম ও কাম, বা ধর্ম ও অর্থ– এগুলির পক্ষে) তা পীড়াদায়ক হয়ে থাকে। কৌটিল্যের মতে (ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গের মধ্যে) অর্থ-ই প্রধান, কারণ, ধর্ম ও কাম– এই দুটির মূল-ও অর্থ (অর্থাৎ ধর্ম ও কামের অনুষ্ঠান অর্থের উপরই নির্ভর করে)।


বোঝা-ই যায়, ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘কামসূত্রে’ ধর্মের প্রতি আনুগত্য আছে– অর্থাৎ, নাস্তিকতার মনোভাব তাঁদের মধ্যে নেই। সেইজন্যই অর্থ এবং কামকে অবলম্বন করেও এঁদের বস্তুবাদ কখনও নিন্দিত হয়নি।

‘ধর্মবিরোধী হিসাবে চার্বাকী আচরণের পরিচিতি প্রধানতঃ সমালোচকদের বিবৃতির মাধ্যমেই আমাদের কাছে উপস্থাপিত। এ সম্বন্ধে চার্বাকপক্ষের নিজস্ব অভিমত আমাদের জানা নেই; তবে ধর্ম যদি সনাতন ধারার প্রতি আনুগত্যের দ্যোতক হয় তাহলে নিঃসন্দেহে চার্বাকী মনোভাব এই ধর্মের বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিকতার মধ্য দিয়ে চার্বাক মতবাদে যে বিদ্রোহী রূপের প্রকাশ, সাধারণ আচরণবিধির মানদণ্ড হিসাবে গৃহীত তথাকথিত ‘ধর্মে’র সঙ্গে তার কোন সামঞ্জস্য থাকতে পারে না। আর এই ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষায় চার্বাকেরা অসমর্থ বলেই চার্বাকী আচরণে সমালোচকেরা অনুসরণীয় সাধারণ মানের অভাব লক্ষ্য করেছেন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৮)

চার্বাকদের আচরণকে ধর্মের বিরোধী বলে অভিহিত করায় চার্বাকী নৈতিকমান যে সনাতনপন্থীদের নীতিগত মানদণ্ডের অনুকূল নয় সেটাই প্রকাশ পায়। সনাতনগোষ্ঠির অনভিপ্রেত যে কোন আচরণই বোধহয় এইভাবে ‘চার্বাক’ সংজ্ঞার সঙ্গে অভিন্ন সত্তায় নিজেকে একাত্ম করেছে।
মোট কথা, ভারতীয় সনাতনপন্থীদের বিচারে চার্বাকগোষ্ঠি চিরদিন অবজ্ঞেয় এবং সেইজন্য এই সম্প্রদায়ের আচরিত অধিকাংশ ক্রিয়াকলাপই তাঁদের কাছে দুর্নীতিপরায়ণতার পরিচায়ক বলে গণ্য হয়েছে। এই কারণেই চার্বাকদের বিরুদ্ধে যখন সনাতনপন্থীরা উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ করেন, সেই অভিযোগকেও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার আমাদের পক্ষে সঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়।

চার্বাকদের বিরুদ্ধে সনাতনপন্থী অধ্যাত্মবাদীদের অভিযোগের অন্ত নেই। তার প্রধান কারণই হয়তো চার্বাক ‘ধর্ম’ মানে না। এই ‘ধর্ম’ মানে কী? এই তথাকথিত ‘ধর্ম’ চার্বাকদের কাছে আসলে ‘শাস্ত্রশাসন’। কোন্ শাস্ত্র? ধর্মবাদীদের দৃষ্টিতে যা বেদবিহিত তাই শাস্ত্র। বৈদিক সংস্কৃতির প্রতিভূ এই শাস্ত্র তথা ‘বেদ’ সম্পর্কে চার্বাকদের মনোভাব কী তার যৎসামান্য কিছু ধারণা আমরা ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছি। কিন্তু চার্বাকী বস্তুবাদের আলোচনাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে এ-বিষয়ে আরো কিছু আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আলোচনাটা লক্ষ্যনিষ্ঠ হবে যদি বেদ প্রসঙ্গে চার্বাকদের মনোভাবের যথাযথ বিশ্লেষণটুকু করা সম্ভব হয়।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ