ব্রহ্ম বা ব্রহ্মন্ বলতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণাকে বোঝায়। এর অর্থ হল সৃষ্টির বস্তুগত, গুণগত, প্রামাণ্য ও অন্তিম কারণ। ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, চিরসত্য ও পরমানন্দ যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ। পরাবিদ্যায় ব্রহ্মের সংজ্ঞা হল চরাচরে অবস্থিত যাবতীয় বিচিত্র উপাদানের ধাত্রস্বরূপ একক মহাচৈতন্য।
ব্রহ্ম নির্গুণ [নিরুপাধিক], অদ্বয়, নির্বিশেষ, নিরাকার [নিরবয়ব] অপরিণামী, স্বপ্রকাশ, সর্বভূতান্তরাত্মা, অসীম এবং সচ্চিদানন্দ। বাক্য, মন এবং বুদ্ধির অতীত ব্রহ্ম একটি অনির্বচনীয় তত্ত্ব। ব্রহ্ম বুদ্ধিগত সকল প্রমাণের অগম্য। দেশ, কাল, জাতি, গুণ, কর্ম কার্য-কারণ সম্বন্ধগত ধারণা বা বুদ্ধিগত প্রকার, ব্যাপক কোন বিধেয় বা বিধেয়ক দ্বারা সাকার বিশেষ বস্তুকে জানা যায়। ব্রহ্ম নিরাকার বলিয়া বুদ্ধিগত সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
ব্রহ্মে সজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগতভেদ নাই। অবয়বী বস্তুর ইতর বিশেষ আছে, নানা স্বগত ভেদ আছে। ব্যক্তি এবং বস্তু নানা ভেদসমন্বিত। বিষয়ী এবং বিষয় জ্ঞানবিদ্যাগত অর্থে [Epistemologically] দ্বৈতভাবযুক্ত, তত্ত্ববিদ্যাগত অর্থে [Ontologically] এই দুইয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। এই অর্থে অদ্বয় বা অদ্বৈত। আত্মা কিংবা ব্রহ্ম অজ [জন্মহীন]। ব্রহ্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠজাতীয় কিংবা, সমজাতীয় ভিন্নতর কোন সত্তা নাই। সুতরাং ব্রহ্মে সজাতীয় কিংবা বিজাতীয় ভেদ নাই। যেমন, বৃহ্মের সঙ্গে বৃক্ষের কিংবা বৃক্ষের সঙ্গে প্রাণীর সজাতীয় এবং বিজাতীয় ভেদ আছে। বৃক্ষের নিজের অবয়বের মধ্যেও স্বগত ভেদ আছে। অঙ্গ-প্রতঙ্গ, পরিণাহ, শাখা-প্রশাখা, ফুল-ফল, মূল-পাতা প্রভৃতির মধ্যে বৃক্ষের নানা প্রকার স্বগত ভেদ থাকে। ব্রহ্মের দেহ নাই। ব্রহ্ম নিরাকার এবং নির্গুণ। ব্রহ্মে কোন প্রকার ভেদ নাই।
বৃহদাণ্যক, ছান্দোগ্য প্রভৃতি উপনিষদ সমূহে ব্রহ্ম সম্পর্কে নেতি নেতি বলা হইয়াছে। মাণ্ডুক্য উপনিষদে বলা হইয়াছে, ব্রহ্ম অন্তর্মুখী ও নয়, বহির্মুখী-ও নয়, ব্রহ্ম সমস্ত জ্ঞানের অতীত।
ব্রহ্ম শব্দটি বৈদিক সংস্কৃত। বেদে প্রাপ্ত বিভিন্ন দার্শনিক ধারণার অন্যতম হল ব্রহ্ম, এবং বিভিন্ন প্রারম্ভিক উপনিষদে এর বিস্তারিত আলোচনা আছে। উপনিষদের বিভিন্ন জায়গায় একে বলা হয়েছে সচ্চিদানন্দ, এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে অব্যয়, শাশ্বত ও পরম সত্য হিসেবে। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির শব্দশূল ‘বৃহ’। ‘বৃহ’ অর্থ ‘বৃধ’- বাড়িয়া চলা, বৃহৎ হওয়া। বৃহ+মন্=ব্রহ্ম। আদ্যোদাত্ত ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ক্লীবলিঙ্গ ‘ব্রহ্মন’ শব্দ হইতে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থঃ বৃহতের চেতনা বা শক্তি। ব্রহ্ম মূলত চেতনার বিষ্ফারণ। ব্রহ্মের চেতনায় স্ফুরিত হয় বাক্। ব্রহ্ম এবং বাক্ অভিন্ন। অন্তোদাত্ত ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি পুংলিঙ্গবাচক, অর্থ-‘ব্রহ্মবিৎ’ লাতিন ‘Verbum’ শব্দটির সঙ্গে শব্দমূলের বিচারে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের সাদৃশ্য আছে। ‘Verbum’ শব্দটির ইংরেজি রূপান্তর ‘Word’, সৃজনশীল শব্দ বা Logos। যে অর্থে ‘বাক’ অথবা শব্দ হইতে সৃষ্টি সম্ভব হইয়াছে। পরব্রহ্মের জীব এবং জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের প্রতি কোন প্রকার আকর্ষণ কিংবা অনুরাগ নাই।
অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম
অনাদিকাল ধরে প্রচলিত অবিদ্যার বা অজ্ঞানতার ফলস্বরূপ নানা প্রকার ভেদ প্রতীতি হয় বলে শঙ্করের অভিমত, যা থেকে উৎপন্ন হয় জন্ম, জরা, মৃত্যু ইত্যাদি সাংসারিক দুঃখসমূহ। এই সমস্ত দুঃখের জড়তাকে কাটানোর জন্য শুধুমাত্র ‘এক আত্মাই সত্য’ এই জ্ঞান প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এই আত্মার একত্ব বা ‘ব্রহ্ম-অদ্বৈত’ জ্ঞানের প্রতিপাদনকেই শঙ্কর তাঁর গ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন। তাই বিশুদ্ধ অদ্বৈবাদের প্রধান প্রবর্তক শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ। অতএব, এই মতে ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য।
ব্রহ্মের স্বরূপ :
‘বৃহ্’ ধাতুর উত্তর ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে ব্রহ্ম শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। বৃহ ধাতুর অর্থ হলো বড় বা ব্যাপক এবং মন্ প্রত্যয়ের অর্থ হলো অতিশয়। সুতরাং ধাতুগত অর্থে ব্রহ্ম হলেন, তিনিই, যাঁর থেকে অতিশয় ব্যাপক বা বৃহত্তম আর কিছুই নেই। ঋগ্বেদের পুরুষ-সূক্তের ‘পুরুষ’ ধারণার মধ্যে এই বৃহত্তম রূপেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণভাবে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। তাই শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘বৃহত্তমত্বাৎ ব্রহ্ম’, অর্থাৎ, যা বৃহত্তম তাই ব্রহ্ম। এবং নিরুক্তকারের মতে- ‘বর্হতি, বৃংহয়তি তদুচ্যতে পরং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ বা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সত্তাই ব্রহ্ম (নিরুক্ত)। আর ভামতীকার বাচস্পতিমিশ্র তাঁর ভামতী-টীকায় বলেছেন-
‘বৃহত্ত্বাদ্ বৃংহনত্ত্বাদ্ বা আত্মা ব্রহ্মেতি গীয়তে’।- (ভামতী)
অর্থাৎ : যা নিরতিশয় বৃহৎ কিংবা যা দেহাদির পরিণামঘটক আত্মাস্বরূপ, তাই ব্রহ্ম।
ব্রহ্মের এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে বোঝা যায় যে, ব্রহ্ম অনন্ত, অসীম, সর্বব্যাপী, পরিপূর্ণ, এক ও অদ্বয় সত্তা। এই অদ্বয় সত্তা একদিকে যেমন নিরাকার, নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিরবয়ব, অনির্বচনীয়, ভেদরহিত ও পরিণামরহিত, তেমনি অপরদিকে স্বপ্রকাশ, স্বয়ম্ভূ, সর্বগত, সর্বোচ্চ, সর্বব্যাপক ও সচ্চিদানন্দময়। শারীরকভাষ্যেও দেখা যায় শঙ্করাচার্য বলেছেন-
‘অস্তি তাবৎ, নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবং সর্ব্বজ্ঞং সর্ব্বশক্তিসমন্বিতং ব্রহ্ম ব্রহ্মশব্দস্য হি ব্যুৎপাদ্যমানস্য নিত্যশুদ্ধত্বাদয়োহর্থাঃ প্রতীয়ন্তে। বৃহতের্ধাতো অর্থানুগমাৎ। সর্ব্বস্যাত্মত্বাচ্চ ব্রহ্মাস্তিত্বসিদ্ধিঃ। সর্ব্বোহি আত্মাস্তিত্বং প্রত্যেতি। ন নাহমস্মীতি। যদিহি ন আত্মাস্তিত্বপ্রসিদ্ধিঃ স্যাৎ সর্ব্বোলোকোনাহহমস্মীতি প্রতীয়াৎ আত্মা চ ব্রহ্ম।’- (শাঙ্করভাষ্য : ব্রহ্মসূত্র-১)
অর্থাৎ :
সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিসমন্বিত, নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ ও নিত্যমুক্তস্বভাব ব্রহ্ম আছেন। কারণ, ব্রহ্ম শব্দটির যদি ব্যুৎপত্তি করা যায়, তাহলেও ঐ সব অর্থই পাওয়া যায়। ‘মহান্’ এই অর্থবোধক বৃহ ধাতু থেকেই তো ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, ব্রহ্ম- যেহেতু সকলেরই আত্মা, এ কারণে, সবার নিকট সর্বদা ব্রহ্মের অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ রয়েছে। সকলেই নিজের আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে থাকে। আমি নাই- এরকম জ্ঞান কখনও কারও হয় না। যদি এভাবে আমার অস্তিত্ব প্রসিদ্ধ না হতো- তাহলে সকলেই আমি নাই- এভাবে বুঝতো। আত্মাই তো ব্রহ্ম।
ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব। যেহেতু ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন নিত্য। যেহেতু কোন প্রকার দোষ বা মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করে না, সেহেতু তিনি হলেন শুদ্ধ। যেহেতু তিনি জড়বস্তু নন, সেহেতু তিনি হলেন বুদ্ধ বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। যেহেতু তাঁর কোন সীমা নেই, সেহেতু তিনি হলেন নিত্যমুক্ত। ব্রহ্মকে বলা হয়েছে অদ্বিতীয়, কারণ দ্বিতীয় কোন পদার্থ স্বীকার করলে অদ্বৈত হানি হয়। ব্রহ্মের কোন অংশও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে নির্বিশেষ। ব্রহ্ম হলেন অসীম। কারণ তার বাইরে কোন কিছু নেই। বিশ্বের যাবতীয় পদার্থ ব্রহ্মের মধ্যেই অবস্থিত। তাই বলা হয়েছে- ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম’। অর্থাৎ, এই বিশ্বে সবই ব্রহ্ম অথবা এই বিশ্বে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই।
ব্রহ্ম ভেদশূন্য :
শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম হলেন সকল প্রকার ভেদরহিত বা ভেদশূন্য। ভেদ বা পার্থক্য প্রধানত তিন প্রকার- স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদ। এক জাতীয় দুটি ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বজাতীয় ভেদ। যেমন, একটি মানুষের থেকে অপর একটি মানুষের ভেদ হলো স্বজাতীয় ভেদ। দুটি ভিন্ন জাতীয় ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে ভেদ তাকে বলে বিজাতীয় ভেদ। যেমন, একটা কুকুরের থেকে একটা গরুর ভেদ বিজাতীয় ভেদ। আবার একই বস্তু বা ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ বা অংশের মধ্যে যে ভেদ তাকে বলা হয় স্বগত ভেদ। যেমন একজন মানুষের হাত, পা, মুখ প্রভৃতির মধ্যে ভেদ হলো স্বগত ভেদ। ব্রহ্ম নির্বিশেষ মহাসামান্য হওয়ায় তিনি এই তিনপ্রকার ভেদরহিত।
যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, সেহেতু ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদরহিত। আবার যেহেতু ব্রহ্মের কোন অংশ নেই, সেহেতু ব্রহ্মের স্বগত ভেদও নেই। এই কারণে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে- ‘একম্ এব অদ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। এক্ষেত্রে ‘একম্’ বা এক শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও স্বগত ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। আবার ‘অদ্বিতীয়’ শব্দটির দ্বারা ব্রহ্মের বিজাতীয় ভেদশূন্যতা সূচিত হয়েছে। সুতরাং, ব্রহ্ম হলেন স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত ভেদশূন্য। তিনি সাংশ বা অংশযুক্ত নন, অপরপক্ষে তিনি অংশবিহীন। অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম একমাত্র সৎ ও নিরবয়ব সত্তা। একমাত্র ও নিরবয়ব সত্তার কোনপ্রকার ভেদের প্রশ্নই ওঠে না।
অদ্বৈত বেদান্তমতে ব্রহ্ম হলেন স্বরূপত নির্গুণ এবং নিরাকার। ব্রহ্ম নির্গুণ, কারণ তাঁকে কোন গুণ বা বিশেষণ দ্বারা ভূষিত করা যায় না। কোন পদার্থে বিশেষ প্রয়োগ করার অর্থ হলো তার মধ্যে ভেদরেখা টানা। যেমন, যদি বলা হয় ‘কলমটি লাল’, তাহলে এর দ্বারা বোঝানো হয় যে কলমটির লাল রং ছাড়া অন্য কোন রং নেই। অর্থাৎ, রং-এর দিক থেকে কলমটিকে এক বিশেষ গন্ডীর মধ্যে সীমিত করা হলো। তাছাড়া যেহেতু কলম এবং লাল রং এক নয়, সেহেতু কলম এবং লাল রং এর মধ্যে একটি ভেদ বা পার্থক্য টানা হলো। সুতরাং, যদি বিশেষ্যকে কোন গুণ বা বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট করা হয়, তাহলে বিশেষ্যটি সীমিত হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে একটা ভেদরেখা টানা হয়। যেহেতু ব্রহ্ম অসীম, সেহেতু তিনি নির্গুণ, স্বগুণ নন। কারণ ব্রহ্মকে স্বগুণ বললে তিনি সীমাযুক্ত হয়ে পড়েন।
ব্রহ্মের তটস্থ ও স্বরূপ লক্ষণ :
ভারতীয় দর্শনের রীতি অনুসারে ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ব্রহ্মের দু’প্রকার লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। একটি হলো তটস্থ লক্ষণ এবং অপরটি হলো স্বরূপ লক্ষণ। যে লক্ষণ কোন তত্ত্বের স্বরূপকে প্রকাশ করে, সেই লক্ষণকে বলা হয় স্বরূপ লক্ষণ। অপরদিকে যে লক্ষণ তত্ত্বের আপাত রূপকে প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় তটস্থ লক্ষণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন ব্যক্তি যখন রাজা হরিশ্চন্দ্রের অভিনয় করেন, তখনো ঐ ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় যা, তা হলো তার স্বরূপ লক্ষণ। কিন্তু অভিনয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরিচয় তার তটস্থ পরিচয়।
অতএব, ব্রহ্মের ক্ষেত্রে, যে লক্ষণ ব্রহ্মে আপাত থাকে, কিন্তু সর্বদা ব্রহ্মে থাকে না, তাই ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। ব্রহ্মের তটস্থ হলো- ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের কারণরূপ ঈশ্বর। অর্থাৎ, ব্রহ্ম জগতের সৃষ্টির কারণ, স্থিতির কারণ এবং লয়ের কারণ। এই লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়। কারণ, বেদান্ত দর্শন সর্বমুক্তিবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ, তাঁদের মতে কোন একটা সময় আসবে যখন সকল মানুষ মুক্তিলাভ করবে। এই অবস্থায় ব্রহ্মের সৃষ্টি করার কিছু থাকবে না। ব্রহ্ম যদি সৃষ্টিকর্তা না হন, তাহলে তিনি স্থিতি বা লয়ের কর্তাও হবেন না। সুতরাং, সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তৃত্ব ঐ অবস্থায় ব্রহ্মের থাকবে না। এ কারণে উক্ত লক্ষণটিকে ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ বলা হয়েছে।
ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- সচ্চিদানন্দস্বরূপ অর্থাৎ, ব্রহ্ম হলেন সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। সৎ শব্দের অর্থ হলো অস্তিত্ব, চিৎ শব্দের অর্থ হলো চৈতন্য বা জ্ঞান, এবং আনন্দ শব্দের অর্থ হলো ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে ঐশ্বরীক আনন্দের অনুভূতি। সৎ, চিৎ এবং আনন্দ কিন্তু ব্রহ্মের গুণ নয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মের সঙ্গে সৎ, চিৎ ও আনন্দের কোন বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্ক নেই। এগুলি হলো ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ, অর্থাৎ, এগুলির দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হয়। এই তিনটি পদের দ্বারা ব্রহ্মকে কখনোই বিশেষিত করা হচ্ছে না।
ব্রহ্ম সৎস্বরূপ বা অস্তিত্বস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অসৎ বা অস্তিত্বহীন নয়। এখানে সৎ বা অস্তিত্বের অর্থ হলো যা কোনদিন লয়প্রাপ্ত হয় না। সুতরাং, অসৎ বা অস্তিত্বহীনের ভিত্তি হলো সৎ। ব্রহ্ম কখনও অভাব পদার্থ হতে পারেন না। কারণ অভাব থেকে কখনও ভাবের উৎপত্তি হতে পারে না। সুতরাং, পরম সত্য বা ব্রহ্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
ব্রহ্ম চিৎ বা চৈতন্যস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম অচিৎ অর্থাৎ, জ্ঞানাভাব নন। ব্রহ্ম চৈতন্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। তিনি নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। সুতরাং, ব্রহ্ম বা চৈতন্য সর্বকালে প্রকাশিত।
এ প্রসঙ্গে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, চৈতন্য সব সময় প্রকাশিত হয় না। যেমন, মূর্চ্ছা ও নিদ্রাতে চৈতন্য প্রকাশিত হয় না। কারণ মূর্চ্ছা বা নিদ্রাভঙ্গের পর কোন ব্যক্তি মূর্চ্ছা বা নিদ্রিত অবস্থার কোন জ্ঞান পুনরুজ্জীবিত করতে পারে না।
কিন্তু অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। কারণ নিদ্রাভঙ্গের পর আমরা অনেক সময় বলি যে সুখনিদ্রা হয়েছিলো। এই স্মৃতি থেকে প্রমাণ হয় যে, নিদ্রা বা সুষুপ্তি প্রভৃতি অবস্থায় চৈতন্য থাকে। ব্রহ্মের প্রকাশ অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না। ঘট, পট ইত্যাদি অন্যান্য বিষয় প্রকাশিত হওয়ার জন্য চৈতন্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যিনি ‘চৈতন্যস্বরূপ’ তিনি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করেন না। যেমন সূর্যকে প্রদীপের সাহায্যে দেখার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং, ব্রহ্ম কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। তিনি জ্ঞানমাত্র।
ব্রহ্মকে আনন্দস্বরূপও বলা হয়েছে। যেহেতু ব্রহ্ম নিত্যতৃপ্ত, সেহেতু তিনি আনন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ- একথার অর্থ হলো ব্রহ্ম আনন্দাভাব বা দুঃখস্বভাব নন। ব্রহ্ম বা আত্মা যে আনন্দস্বরূপ, বেদান্তবাদীদের মতে তার একটা প্রমাণ হলো- নিদ্রিত অবস্থায় কোন বিষয়ের জ্ঞান থাকে না। তখন কেবলমাত্র আত্মা থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় আনন্দের কারণ হলো এই আত্মা বা ব্রহ্ম।
নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্ম :
অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্রহ্মকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করা যায়। পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রহ্ম হলেন সগুণ অর্থাৎ, গুণযুক্ত। ব্রহ্মকে যখন কোনরকম শক্তিসম্পন্ন নয় বা সকল গুণের উর্ধ্বে বলে আমরা ভাবি তখন ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। এই নির্গুণ ব্রহ্ম হলো পরমসত্তার আধিবিদ্যক রূপ। যদি পরমসত্তার কোন গুণ বা শক্তি থাকতো, তাহলে সেই সত্তা আনন্দ বা অসীম হতে পারতো না। ব্রহ্মের একটি নির্দিষ্ট গুণ আছে- একথা বললে স্বীকার করতে হবে যে, ব্রহ্মে সেই গুণের বিপরীত গুণটি নেই। তখন ব্রহ্ম একটি সীমিত সত্তায় পরিণত হবেন। একারণে অদ্বৈত বৈদান্তিকরা পারমার্থিক সত্তাকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলেছেন।
শ্রুতিতেও ব্রহ্মকে নির্গুণ হিসেবে দেখা হয়েছে। শ্রুতিতে আছে- ‘তদেজতি ও তন্নৈজতি তদ্দুরে তদবদন্তিকে’ অর্থাৎ, সে চলে আবার সে চলে না, সে দূরে আবার সে কাছে। এরূপ বাক্যের দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, ব্রহ্মে কোন নির্দিষ্ট গুণ নেই। কারণ পরস্পর বিপরীত গুণগুলি থাকার অর্থ হচ্ছে কোন গুণ না থাকা।
অদ্বৈতবেদান্ত মতানুসারে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যতক্ষণ আমাদের কাছে ব্রহ্ম একমাত্র সত্য- এই উপলব্ধি না হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী ব্রহ্মকে জগতের স্রষ্টা, পালক এবং সংহারক ঈশ্বররূপে ভাবা হয়। বেদান্ত এই সাধারণ ধারণার বিরোধিতা করে ঈশ্বরের ধারণাকে অবিদ্যাপ্রসূত বলে ঘোষণা করেছেন। বেদান্তমতে এই ঈশ্বর সগুণ ব্রহ্ম। এই সগুণ ব্রহ্মই মায়াশক্তির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর পূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। তিনি আমাদের উপাসনার বস্তু। তিনি দীনবন্ধু, করুণাসিন্ধু, জগৎপতি, অনাথের নাথ, ভক্তের ভগবান ইত্যাদি।
উপনিষদকে অনুসরণ করে শঙ্করাচার্য নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সগুণ ব্রহ্মের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে অপর ব্রহ্ম এবং নির্গুণ ব্রহ্মকে পর ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হলো ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ। অন্যদিকে নির্গুণ ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ অর্থাৎ, ব্রহ্ম স্বরূপত নির্গুণ। নির্গুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য ক্লীবলিঙ্গ এবং সগুণ ব্রহ্মকে বোঝানোর জন্য পুংলিঙ্গের ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘শান্তং নিরঞ্জনং নিষ্কলং ব্রহ্ম’ হলো নির্গুণ ব্রহ্মের বর্ণনা। অপরপক্ষে ‘যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ’ হলো সগুণ ব্রহ্মের বর্ণনা।
শঙ্করের মতে পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি, যাঁরা নির্গুণ ব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে জানেন। তাই যারা জগৎকে সত্য বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানী যারা জগৎকে অবভাস বলে মনে করেন তারা ব্রহ্মকে জগৎস্রষ্টা বলে মনে করেন না। বিজ্ঞ বা তত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে ব্রহ্ম বিশ্বাতীত। উপনিষদে ব্রহ্মকে বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত বলা হয়েছে। শঙ্করও বলেন যে ব্রহ্ম বিশ্বগত ও বিশ্বাতীত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অদ্বৈতবেদান্তে সগুণ ব্রহ্ম ও নির্গুণ ব্রহ্ম- দুটি ভিন্ন তত্ত্ব নয়। এই মতে ব্রহ্মের সগুণ ভাব তাঁর লীলা মাত্র। নির্গুণ ব্রহ্মই মায়ারূপ উপাধি গ্রহণ করে সগুণরূপে প্রতিভাত হন। সুতরাং, মায়াবিশিষ্ট ব্রহ্মকেই অদ্বৈতবেদান্তে ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়।
ব্রহ্মের উপলব্ধি :
ব্রহ্মকে কিভাবে উপলব্ধি করা যায় ? উত্তরে শঙ্করাচার্য বলেন- ‘ব্রহ্ম অবাঙমনসগোচর’ অর্থাৎ, ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অতীত। সুতরাং, বাক্য বা সাধারণ বুদ্ধির দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। কেবলমাত্র অপরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা যায়। শঙ্করাচার্যের মতে, ব্রহ্মের উপলব্ধিই হলো মুক্তি। এই মুক্তি কোন নতুন অবস্থাপ্রাপ্তি নয়। এটি হলো প্রাপ্তের প্রাপ্তি। জীবাত্মা নিত্যমুক্ত এবং জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার কোন ভেদ নেই। সুতরাং, ব্রহ্মকে জানার অর্থ হলো ‘ব্রহ্ম হওয়া’।
অজ্ঞ জীবের পক্ষে সব সময় সরাসরি পারমার্থিক শুদ্ধ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের কাছে প্রাথমিকভাবে জগৎই সৎরূপে প্রতীয়মান। ক্রমশ সে যখন এই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের কারণ আবিষ্কার করতে চায়, তখন সে এক সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে উপনীত। জড়বাদী মন তখন ঈশ্বরবাদী হয়ে ওঠে। তা হলো অবিদ্যাপ্রসূত ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঈশ্বরবাদী মনের কাছে ঈশ্বর ও জগৎ উভয়ই সত্য বলে প্রতিভাত হয়। এরপর ক্রমশ ঈশ্বরবাদী মন তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে অতিক্রম করে এক সর্বব্যাপী মহাসামান্য শুদ্ধ ব্রহ্মে উপস্থিত হয়। এই শুদ্ধ ব্রহ্মের উপলব্ধিতে জগৎ, ঈশ্বর ও জীব ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় এবং সেই পরম ব্রহ্মই একমাত্র সৎ ও সবকিছুর অধিষ্ঠানরূপে বিরাজ করে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ