দ্য গ্রেট কলকাতা কিলিংস - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 December, 2021

দ্য গ্রেট কলকাতা কিলিংস

 ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (Direct Action) এর ডাক দিয়েছিল যার ফলশ্রুতি হয় কলকাতাজুড়ে বীভৎস হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা ও হিন্দু গণহত্যা যা ইতিহাসে The Great Calcutta Killings নামে পরিচিত। তবে এই দাঙ্গা বা হিন্দু গণহত্যা আকস্মিক ছিল না এটি ছিল সুপরিকল্পিত এবং এবং এর পটভূমি অনেকদিন ধরেই রচিত হয়েছিল।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি ব্রিটিশ রাজের থেকে ভারতীয় নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে তিন সদস্যের মন্ত্রিসভা মিশন ভারতে প্রেরণ করেছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ভারতের গণপরিষদের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করার পরে এই ক্যাবিনেট মিশন ভারতের নতুন আধিপত্য এবং গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়। মুসলিম লীগের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে 'স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম' রাষ্ট্রের দাবিতে প্রাদেশিক স্তর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ‘'প্রদেশসমূহ’' নামে একটি নতুন স্তর তৈরি করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত ত্রিস্তরীয় পরিকাঠামোয় বলা হয়- কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং যোগাযোগের বিষয়গুলি পরিচালনা করবে এবং অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা প্রদেশ গুলিকে প্রেরণ করা হবে।


এক সময়ের কংগ্রেস সদস্য এবং বর্তমানে মুসলিম লীগের নেতা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলী হিসাবে ১৬ জুন ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তবে ১০ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহেরু বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেন যে, যদিও কংগ্রেস গণপরিষদে অংশ নিতে রাজি হয়েছে, তবে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে উপযুক্ত করতে সংশোধন করার অধিকার সংরক্ষণ করে। কেন্দ্রীয় সরকারে হিন্দু আধিপত্যের ভয়ে মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদরা জিন্নাহকে "তার পূর্বের অনমনীয় অবস্থান" ফিরিয়ে নিতে বলেন। জিন্নাহ ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে গণপরিষদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে জিন্নাহ বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই) নিজ বাড়িতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে মুসলিম লীগ "সংগ্রাম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে" এবং তারা "একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে"। তিনি আরও বলেন যে, মুসলমানদের যদি আলাদা পাকিস্তান না দেওয়া হয় তবে তারা ‘সরাসরি পদক্ষেপ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের" ডাক দেবে। সুনির্দিষ্ট হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, জিন্নাহ জবাব দিয়েছিলেন: "কংগ্রেসে যান এবং তাদের পরিকল্পনা জিজ্ঞাসা করুন। যখন তারা আপনাকে তাদের আস্থা নেবে আমি আপনাকে আমার আত্মবিশ্বাস দেখাবো। আপনারা আমাকে কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বলেছেন? আমরাও ঝামেলা করতে চলেছি।"


পরের দিন, জিন্নাহ ১৬ আগস্টকে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস" হিসাবে ঘোষণা করেন এবং কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি দেন- "আমরা যুদ্ধ চাই না। যদি আপনারা যুদ্ধ চান, তবে আমরাও যুদ্ধ করতে পিছুপা হবো না। আমাদের হয় বিভক্ত ভারত অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারত থাকবে।"


এইচ ভি হডসন তাঁর দ্য গ্রেট ডিভাইড বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "ওয়ার্কিং কমিটি ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে ১৬ আগস্টকে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। সেদিন, লীগের প্রস্তাব ব্যাখ্যা করতে সারাদেশে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা এবং মিছিলগুলি শেষ হয়ে গেল–যা স্পষ্টতই কেন্দ্রীয় লীগের নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল–সাধারণ এবং সীমাবদ্ধ ঝামেলা ছাড়া এক বিস্তৃত এবং করুণ ব্যতিক্রম ছাড়া...যা ঘটেছিল তা পূর্বে কোনোদিন ঘটেনি।

এই হত্যাযজ্ঞের ভয়বহতা সম্পর্কে লিওনার্ড মোসলে লেখেন-

মুসলিম লীগ বরাবর বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি করেই আসতো তাদের জন্মলগ্ন থেকে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল তাদের লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয় তাদের লড়াই হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই ধারা বজায় রেখেই ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ কুখ্যাত লাহোর প্রস্তাবে জিন্না বলেন,”ইসলাম ও হিন্দু তো শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয় সম্পূর্ণ বিপরীত জাতিসত্তা।… মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয় মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের মধ্যে আছে তাই অবশ্যই তাদের নিজেদের বাসভূমির অধিকার আছে।”


এরপর ১৯৪০ সালের ৬ ই এপ্রিল গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় লেখেন, “দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আছে বর্তমানে আমরা একটা যৌথ পরিবারের মধ্যে বসবাস করছি তাই এর কোন এক শরিক ভিন্ন হতে চাইতেই পারে।”

এইভাবে, প্রকারান্তরে গান্ধীজী পাকিস্তান প্রস্তাবে সমর্থন জানান। এতে জিন্না যারপরনাই খুশি হন কিন্তু জিন্না জানতেন মুখে কোনো কাজ হবে না, পাকিস্তান আদায় করতে হলে তাকে দেশের ভেতর অরাজকতা ও ভীতি তৈরি করতে হবে।


১৯৪৬ সালের প্রথম দিকে ব্রিটেন থেকে ক্যাবিনেট মিশন ভারতে আসে ভারতীয়দের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব নিয়ে। ক্যাবিনেট মিশন ১৬ ই মে তে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির কাছে। কিন্তু এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের কোন উল্লেখ ছিল না। উল্লেখ ছিল অখন্ড ভারত রাষ্ট্রের, তবে মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ এবং দেশীয় রাজন্যবর্গ রা একটি স্ব-শাসিত মন্ডলী গঠন করতে পারবে। এবং তারা ১৫ বছর পর চাইলে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারে। এই প্রস্তাব মুসলিম লীগ মেনে নিল কিন্তু পরবর্তীকালে ভারত খন্ডিত হতে পারে এরকম প্রস্তাব থাকায় কংগ্রেস এটি মেনে নেয়নি। এবং তারা এটিকে সংশোধনের আর্জি জানায় কিন্তু মুসলিম লীগ কোনরূপ সংশোধনে রাজি ছিল না। এ রকম জটিলতার মধ্যে মুসলিম লীগ ও পরে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে সম্মতি তুলে নেয়।

ক্যাবিনেট মিশনে সরাসরি পাকিস্তানের কোন উল্লেখ না থাকায় জিন্না সেটিকে যেনতেন প্রকারনে আদায় করতে উদ্যত হয়। বোম্বে শহরে ১৯৪৬ সালের ২৮ শে জুলাই মুসলিম লীগ অধিবেশনে জিন্না ১৬ ই আগস্টে সারা ভারত জুড়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়।


তিনি বলেন,”আমি নীতিকথার আলোচনায় যেতে চাই না, আমাদের হাতে বন্দুক আছে এবং তা ব্যবহার করতে প্রস্তুত।”


এরমধ্যে তৎকালীন অখন্ড বঙ্গপ্রদেশে প্রায় ৫৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা ছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই আইনসভাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম লীগের। অবিভক্ত বঙ্গ ছিল মুসলিম শাসনাধীনে থাকা ভারতের একমাত্র প্রদেশ। তাই বাংলায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বাস্তবায়িত করার সম্পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায় মুসলিম লীগ। তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি বাংলাজুড়ে হিন্দুদের কচুকাটা করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। ১৬ ই আগস্ট এর আগে ২৪টা পুলিশ হেডকোয়ার্টার এর মধ্যে ২২ টি তে মুসলিম পুলিশ কমিশনার কে দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে হিন্দুরা কোনভাবেই পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য না পায়। ৫ ই আগস্ট স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে সোহরাওয়ার্দী বলে,”হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয় যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় করা ছাড়া অন্য কোন প্রিয় কাজ নেই।” মুসলিম লীগ তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষিত বাহিনী মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড কে একত্রিত করতে থাকে, তাদের একটি সমাবেশে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, “মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে কারণ এই রমজান মাসেই জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ।”


প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ১১ ই আগস্ট বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগ নেতা নাজিমুদ্দিন আরও বলেন,”অসুবিধা সৃষ্টি করার ১০১ উপায় আমাদের জানা আছে, কেননা আমরা ও হিংসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বাংলার মুসলিম জনতা খুব ভালভাবেই জানে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কি! তাদেরকে নতুন করে কোনো ইঙ্গিত দেবার প্রয়োজন নেই।” এর সঙ্গেই কলকাতার তৎকালীন মুসলিম মেয়র ওসমান খান তরোয়াল হাতে জিন্নাহর ছবি সহ উর্দুতে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন যার বক্তব্য ছিল, “আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও, ওহে কাফের তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়।” এইভাবে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব মুসলিম জনগণকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত করতে থাকে। ১৬ ই আগস্টের এক সপ্তাহ আগে থেকে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম দোকানগুলোতে পাকিস্তান লিখে চিহ্নিত করা হচ্ছিল যাতে ভুল করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে মুসলিম দোকান লুট না হয়ে যায়। এছাড়া কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় রাজাবাজার, পার্কসার্কাস, ধর্মতলা, ক্যানেল ওয়েষ্ট রোড সহ বিভিন্ন জায়গায় লাঠি, ছোড়া, বন্দুক, তরোয়াল ভর্তি গাড়ি দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন জায়গায় কামারশালায় দেখা যায় মুসলমানরা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ধার দিয়ে রাখছিল। কলকাতার বিভিন্ন এলাকা বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে দেওয়া হয় যাতে সুষ্ঠুভাবে গণহত্যা চালানো যায়। এইভাবে প্রায় ১৮ দিন প্রস্তুতি নেওয়ার পর ১৫ ই আগস্ট মুসলিম লীগ সরকার ১৬ ই আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করে দেয় এবং বনধের ডাক দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে নিরাপদে এবং কোন অসুবিধা ছাড়াই মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করতে পারে এবং লুটপাট চালাতে পারে। এই বনধের সিদ্ধান্ত আসলে কি সবাই বুঝতে পারলেও একমাত্র হিন্দু মহাসভা ছাড়া এটির প্রতিবাদ কেউ করেনি উল্টে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকারান্তরে এই বনধ কে সমর্থন করে!


১৫ ই আগস্ট রাত জুড়ে নারায়ে তকবীর, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনি শোনা যেতে থাকে কলকাতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে। রাত্রিবেলায় বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে মুসলিম জনতাকে একত্রিত করতে থাকে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব যাতে সকালবেলায় ফজরের নামাজের পরেই বেরিয়ে পড়া যায় হিন্দু নিধনে।

১৬ ই আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলিম জনতার কলকাতাজুড়ে বীভৎস আক্রমণ। ভোরবেলা অন্যদিনের মত উত্তর কলকাতার এক দুগ্ধ ব্যবসায়ী প্রাতঃভ্রমণে বেরোলে তাঁকে খুন করা হয়। তিনি কলকাতার ৪৬ এর গনহত্যার প্রথম শিকার। এরপর সাড়ে ছয়টার দিকে মানিকতলা বাজার আক্রমণ করে মুসলিম জনতা। সাড়ে সাতটার দিকে বউবাজার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে শিয়ালদায় প্রচুর সংখ্যক মুসলমান লাঠি ও লোহার রড তরোয়াল সহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমায়েত হতে শুরু করে। এরপর দিকে দিকে খুন-জখম, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদি খবর আসতে শুরু করে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে। কিন্তু সেই দিন লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিজে বসেছিলেন হোসেন সোহরাওয়ার্দী যাতে পুলিশ চাইলেও কোন পদক্ষেপ না করতে পারে। এরপর টেরিটি বাজার, সিটি সিনেমা হল, রিপন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, মল্লিক বাজার, বড়তলা এরিয়াতে হিন্দুদের ধরে ধরে খুন ও ধর্ষণ করা শুরু হয় এবং বাড়ি ও দোকান লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ পুরোদমে চলতে থাকে।


এরইমধ্যে ময়দানে লাঠিসোটা এবং তরোয়াল, বন্দুক নিয়ে প্রায় ৫০,০০০ মুসলিম জনতা জমায়েত করে। যা তখনও পর্যন্ত ছিল সবচেয়ে বড় সমাবেশ। ময়দানে মঞ্চে উপবিষ্ট মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাসেম, এমএস ইস্পাহানি সঙ্গে তপশিলি মোর্চার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সমগ্র মুসলিম জনতা কে বলেন, “সেনা ও পুলিশ কে সংযত করা হয়েছে, ২৪ ঘন্টা সময় দিলাম যা করতে পারিস কর।”


ময়দানের সভা শেষ হতেই উন্মত্ত মুসলিম জনতা দলবদ্ধভাবে প্লান মাফিক আক্রমণ করে হিন্দু জনতা ও দোকানপাট এর উপর। ক্যানিং স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, কর্পোরেশন স্ট্রীট, ধর্মতলা স্ট্রীট মানিকতলা রোড, বিবেকানন্দ রোডে গণলুট চলে। বিখ্যাত দোকান কমলালয় স্টোর্স, ভারতকলা ভান্ডার, লক্ষী স্টোর্স লুট করা হয়। উত্তর ও মধ্য কলকাতার গড়পার, নারকেলডাঙ্গা ফুলবাগান, বেলেঘাটা,পার্কসার্কাস, কলুটোলা, চিৎপুর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়ি আক্রান্ত হয়। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস থেকে গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী,রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক থেকে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস এন মুখার্জি দের উপরে আক্রমণ করা হয়। ক্যানেল ওয়েস্ট স্ট্রীট, গ্যাস স্ট্রীট, বেলেঘাটা মেইন রোড, নারকেলডাঙ্গা মেইন রোড, পিয়ার্স লেন, মেটিয়াবুরুজের লিচুবাগান প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুদের নৃশংসভাবে হত্যা এবং নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের খবর আসতে থাকে। বেঙ্গল ক্লাব এবং কে সি বিশ্বাসের দোকানে লুটপাট চালাতে থাকে মুসলিম জনতা।


বিকেলে দেখা যায় ধর্মতলা স্ট্রিটে চাঁদনী চক বাজার সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে মুসলিম জনতার লুন্ঠনে, মির্জাপুর স্ট্রিট এবং আপার সার্কুলার রোড সশস্ত্র মুসলমানদের দ্বারা পরিপূর্ণ। বাটা সু কোম্পানি এবং সেন এন্ড ল এর দোকান পুরোপুরি লুণ্ঠিত। মার্কেট স্ট্রীট, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, মারকুইস স্ট্রিট, এলিয়ট রোডে হিন্দুদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয় এবং তাদের বাড়িঘর লুট করা হয়। চাঁদ দত্ত স্ট্রিটে গমের কল এবং লোয়ার সার্কুলার রোডে লক্ষীকান্ত দাস এর সাইকেল দোকান লুট করা হয় এবং অগ্নিসংযোগ ও সমস্ত কর্মীদের হত্যা করা হয়। এছাড়াও যে কত শত জায়গায় আক্রমণ হয়েছিল এবং কত শত মানুষ নিহত এবং কতশত মহিলা ধর্ষিত, গণধর্ষিত, অপহৃত হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব নেই। উপরের ঘটনাবলী শুধুমাত্র প্রথম দিন অর্থাৎ ১৬ ই আগস্ট এর। এরপর ১৭ ও ১৮ ই আগস্ট দুপুর পর্যন্ত মুসলিমরা বিনা বাধায় কলকাতার জায়গায় জায়গায় হিন্দুদের হত্যা বাড়িঘর লুন্ঠন মেয়েদের ধর্ষণ, অপহরণ করতে থাকে। দেড় দিন ধরে টানা নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনিতে ছেয়ে যায় কলকাতার আকাশ। কলকাতার প্রাক্তন ডিজি গোলক বিহারী মজুমদার দাঙ্গার বর্ণনায় তার বইতে লেখেন, “রাত এগারোটা বারোটা নাগাদ ওরা আবার আক্রমণ করল। দেখলাম একদল লোক তাদের হাতের ছোরা, তরোয়াল সহ নানা রকমের অস্ত্র। তারা চিৎকার করে বলছে আজ তো এক এক হিন্দু কো কুরবানি করেগা। সবচেয়ে বেশি ভয় দিদিকে নিয়ে কারণ হিন্দু মেয়েদের ওপর তাদের বরাবরের লোভ।” তিনি আরও বলেন, “আমাকে রাজাবাজারের উপর দিয়ে যেতে হত, একদিন দেখলাম গরু কেটে যেভাবে হোক এর সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে তেমনি ভাবে হাত পা কাটা নগ্ন হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে এসব ঝুলিয়ে রেখেছে।”


ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করেছিল মুসলিম জনতা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিলো তারা। হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে হিংস্র মুসলিম জনতা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য।


১৭ ই আগস্ট গার্ডেনরিচ টেক্সটাইল ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আব্দুল্লাহ ফারুকের নেতৃত্বে মেটিয়াবুরুজের কেশোরাম কটন মিলের কয়েক হাজার হিন্দু শ্রমিককে হত্যা করে মুসলিম জনতা এবং তাদের হুগলি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। পরে মাঝিরা বলতো মৃতদেহগুলি ফুলে-ফেঁপে এমন বীভৎস অবস্থা হয়েছিল যে মাঝ নদীতে নৌকা চালাতে গেলেও দাঁড় দিয়ে মৃতদেহ সরিয়ে সরিয়ে চলতে হচ্ছিল।


এরকম একতরফা মার খেতে খেতে বাঙ্গালী হিন্দুরা বুঝে যায় যে সরকার এবং পুলিশ কিছুই করবে না উল্টে তারাই হিন্দুদের গণহত্যাতে সাহায্য করছে। এবার তারা নিজেরাই মুসলিম আক্রমণ প্রতিরোধ করতে উদ্যত হয়। বাঙালি হিন্দুদের প্রাণ বাঁচাতে এবং হিন্দু রমণীগণকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন কলকাতার কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম গোপাল মুখার্জী যিনি পরিচিত গোপাল পাঁঠা নামে। তিনি এই ভয়াবহতা দেখে এক দিনের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি হিন্দু মুসলিম যুবককে নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুললেন। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং বন্দুক সংগ্রহ করতে থাকে এবং দাঙ্গাবাজ মুসলিমদের পাল্টা হত্যা করতে শুরু করে। কিন্তু এই প্রতিরোধ বাহিনীর প্রতি কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশও ছিল, ১.অস্ত্রহীন মুসলমানকে হত্যা করবে না। উল্টে যদি সে নিরাপত্তা চায় তাকে নিরাপত্তা প্রদান করবে। ২.মুসলমান পশুদের মত কোন মহিলা বা শিশুর গায়ে হাত দেবে না। কিন্তু অস্ত্রধারী মুসলমানকে ছাড়বেনা এবং একজন হিন্দু খুন হতে দেখলে ১০ জন মুসলমান কে খুন করবে।


এরইমধ্যে সোহরাওয়ার্দীর মেয়ের গানের শিক্ষক হরেন ঘোষ মুসলিম লীগের একটি ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেন। তিনি সোহরাওয়ার্দীর বাড়ি থেকে বিভিন্ন কাগজ এ দেখে বুঝতে পারেন যে মুসলিম লীগ হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, শিয়ালদহ স্টেশন ইত্যাদি বোম মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে। তিনি এই খবরটি গোপাল পাঁঠা কে অতিসত্বর প্রদান করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনী এই সমস্ত জায়গা থেকে মুসলিমদের সরিয়ে দিয়ে এলাকার দখল নিতে থাকে। এই কাজের জন্য হরেন ঘোষ কে হত্যা করে সোহরাওয়ার্দী। তার ছয় টুকরো দেহ পরে উদ্ধার হয়। গোপাল পাঁঠার পাশাপাশি তার গুরু বিজয় সিং নাহার গড়ে তোলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী। তাকে সাহায্য করেন কংগ্রেস নেতা ইন্দুভূষণ বিদ, দেবেন দে এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চ্যাটার্জী। সঙ্গে প্রতিরোধে এগিয়ে আসে হিন্দু মহাসভা। হিন্দুরা বিভিন্ন ক্লাব এবং আখড়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলে প্রত্যাঘাত শুরু করে। বাগবাজারের জাতীয় যুব সংঘ, বউবাজারের হিন্দু শক্তি সংঘ, দেশবন্ধু ব্যায়াম সমিতি, পার্কসার্কাস এর তরুণ ব্যায়াম সমিতি, আর্য বীর দল, এন্টালী ব্যায়াম সংঘ ইত্যাদি সমিতি এগিয়ে আসে প্রতিরোধে। শিয়ালদহর যুগল ঘোষ, ভানু বোস, বসু মিত্র, শ্যামবাজারের কালুর মত প্রচুর হিন্দু যুবকরা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে শুরু করে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ। মুসলিমরা হিন্দুদের একতরফাভাবে মারছিল যখন তখন চুপ করে বসে থাকা গান্ধীজী এবং নেহেরু এবার মুখ খোলে।গান্ধীজীর সাথে দেখা করে গোপাল পাঁঠা কে অস্ত্র ত্যাগ করতে বলা হয়! কিন্তু গোপাল পাঁঠা গর্জে ওঠেন এবং বলেন,”একটি পেরেকও যদি হিন্দু ভাইদের রক্ষা করে, নারীদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয় তাহলে আমি সেটাও সমর্পণ করবো না।”

ধীরে ধীরে কলকাতার আকাশে বাতাসে নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর ধ্বনির পরিবর্তে বন্দেমাতরম, জয় হিন্দ ধ্বনির তীব্রতা বাড়তে থাকে। নৃশংসতার জবাব দশগুণ নৃশংসতার মাধ্যমে দেওয়া হলে এবার ভয় পেতে শুরু করে মুসলিম দাঙ্গাকারীরা। হিন্দু বাহিনীর প্রতিরোধের তীব্রতায় মুসলিম লীগের বহু দাঙ্গাকারী নিহত হয়। বাঙ্গালী হিন্দু বাহিনীকে মুসলমানদের প্রতিরোধে সাহায্য করতে কলকাতা শহরে নামে বিহারী হিন্দু ও শিখ রা। এরকম সম্মিলিত প্রতিরোধ আশা করেনি মুসলিম লীগ। তাই শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে সোহরাওয়ার্দী রণে ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুসলিম দাঙ্গাকারীরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে দেখে মুসলিমদের বাঁচাতে অবশেষে কলকাতায় আর্মি নামান কলকাতার কসাই হোসেন সোহরাওয়ার্দী। অবশেষে ২২ শে আগস্ট কলকাতাতে দাঙ্গার পরিসমাপ্তি ঘটে।


দাঙ্গা শেষ হলে দেখা যায় শহরের অলিতে গলিতে মৃতদেহ স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে, হুগলি নদী জুড়ে ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। মনে করা হয় মুসলিম লীগের দ্বারা সংঘটিত এই দাঙ্গায় ১০,০০০ জন মারা যান, হাজারের বেশি রমনী ধর্ষিত হন এবং ১৫,০০০ এর বেশি মানুষ আহত হয়েছিলেন। তবে আসল সংখ্যা হয়তো এর থেকে অনেক গুন বেশী, অগুনতি মানুষ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। মুসলিম লীগের লুটপাটের ফলে হওয়া আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা ছিল অসম্ভব। শুধুমাত্র কমলালয় স্টোর্স থেকে লক্ষাধিক টাকার জিনিস লুট হয়েছিল তাহলে বুঝে দেখুন কি বিশাল অর্থ লুট করেছিল মুসলিম লীগ এর দ্বারা পরিচালিত মুসলিম জনতা।


এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে মুসলিম শাসনাধীনে হিন্দুদের অবস্থা কি পরিমান খারাপ হতে পারে! এই ঘটনার পরে সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস তাতে সমর্থন করলেও কমিউনিস্ট দল অবিশ্বাস্য ভাবে কলকাতা দাঙ্গার জন্য মুসলিম লীগ ব্যাতীত অন্য সবাইকে দায়ী করে মুসলিম লীগ সরকারের পাশে দাঁড়ায়!


কলকাতার এই দাঙ্গা থেকে প্রমাণ হয় বাঙ্গালী হিন্দু জাতি কাপুরুষের জাতি নয়। বাঙ্গালী হিন্দু আঘাত এলে প্রথমে ঘর গোছাতে সময় নেয় কিছুক্ষণ, শত্রু পিছু হটলে ভালো কিন্তু তারপরেও যদি শত্রু না শুধরায় তাহলে এতো প্রচন্ড পাল্টা আঘাত দেয় যে শত্রুপক্ষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তার প্রমাণ মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন মুসলিম ১৯৪৬ এ প্রচন্ডভাবে অনুধাবন করেছিল। এই ঘটনা থেকে বর্তমান প্রজন্মের হিন্দু বাঙ্গালীদের শিক্ষা নেওয়া এবং তাকে সর্বদা স্মরণে রাখা অবশ্য কর্তব্য। আমাদের আদর্শ গোপাল পাঁঠার দেখানো পথে আমাদের চলতে এবং তার পথেই শত্রুসংহার করতে হবে।

দ্য গ্রেট কলকাতা কিলিংস


তবে The Great Calcutta Killings বা হিন্দু গণহত্যার দায় শুধু মুসলিম লীগের নয়। মুসলিম লীগ অবশ্যই এই দাঙ্গার কারিগর কিন্তু কংগ্রেসের নেহেরু বা গান্ধীজী এর দায় এড়াতে পারেন না। যখন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হল তখন গান্ধী ও নেহেরু মৌনব্রত নিলেন উল্টে কোন ক্ষেত্রে মুসলিম লীগকে সুবিধা করে দিলেন! ১৬ ই আগস্ট বনধ ডাকার প্রেক্ষিতে নেহেরু হিন্দুদের বলেছিলেন,” যারা বনধ সমর্থন করেন না তারা যেন প্রতিদিনের মতোই হাট-বাজার অফিস করে। আর গান্ধীজী মুসলিম দাঙ্গাকারীদের প্রতিরোধ করার পরিবর্তে হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনীকে আমার অনুরোধ করে! দায় এড়াতে পারেন না কমিউনিস্টরাও কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি নির্লজ্জভাবে মুসলিম লীগ কে সমর্থন করেছেন এবং মুসলিম লীগের এই ন্যাক্কারজনক কাজ কে ঢাকার চেষ্টা করে গিয়েছে। তাই এই ঘটনা থেকে হিন্দু বাঙ্গালীকে মনে রাখতে হবে মুসলিম লীগ কে পরোক্ষভাবে কারা কারা সমর্থন জুগিয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সূচনা হয় ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই। সকল দশটার আগেই লালবাজারের পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছিল যে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, এবং পাথর ও ইটপাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি, ছুরিকাঘাতের খবর পাওয়া গেছে। সকল ১০টার আগেই সদর পুলিশ দপ্তর, লালবাজারে উত্তেজিত জনতার বিক্ষোভের খবর এসে পৌঁছায়। সকাল থেকেই জোরপূর্বক হিন্দুদের দোকানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং ঝগড়া, ছুরিকাঘাত, ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা আসতে থাকে। এই ঘটনাগুলো প্রধানত রাজাবাজার, কলাবাগান, কলেজ স্ট্রিট, হ্যারিসন রোড (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড), কলুটোলা এবং বড়বাজারের মতো শহরের উত্তর-কেন্দ্রীয় অংশগুলোতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই অঞ্চলগুলিতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং উন্নত ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানেও ছিল। সাম্প্রদায়িক এই উত্তেজনা পুরো শহর জুড়েই বর্তমান ছিল। লিগের সমাবেশটি ঠিক দুপুরে অক্টারলোনি মনুমেন্টের কাছে শুরু হয়। এই সমাবেশটি তখনকার 'বাংলার সর্বকালের বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ' হিসাবে বিবেচিত হয়। দুপুরের নামাজের পর দুপুর দুটোর দিকে সমাবেশ শুরু হয় এবং কলকাতার সমস্ত অঞ্চল থেকে মুসলমানদের মিছিল শুরু হয়। অংশগ্রহণকারীদের একটি বিশাল অংশ লোহার রড এবং লাঠি (বাঁশের লাঠি) দিয়ে সজ্জিত ছিল বলে জানা যায়। একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার রিপোর্টারের তথ্য অনুযায়ী ৩০,০০০ জন এবং কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শকের তথ্য অনুযায়ী ৫০০,০০০ জন সমাবেশে উপস্থিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। স্টার অফ ইন্ডিয়া রিপোর্টার এই সংখ্যাকে অসম্ভব ভাবে প্রায় এক লক্ষের উপরে রেখেছেন। প্রধান বক্তারা হলেন খাজা নাজিমউদ্দিন এবং মুখ্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। খাজা নাজিমুদ্দিন তার বক্তৃতায় প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণতা ও সংযমের কথা বললেও পরবর্তীতে প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিয়ে বলেন যে, সেদিন সকাল ১১ টা অবধি আহত সমস্ত ব্যক্তিই মুসলমান এবং মুসলিম সম্প্রদায় নাকি কেবল আত্মরক্ষায় প্রতিশোধ নিয়েছিল। কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখা সভায় একটি মাত্র শর্টহ্যান্ড সাংবাদিককে প্রেরণ করেছিল, ফলস্বরূপ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনও প্রতিলিপি উপলব্ধ নেই। তবে সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিযুক্ত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং প্রতিবেদক ফ্রেডেরিক বারোজ একটি বিবৃতিতে একমত হন (কলকাতা পুলিশ মোটেই কোনো রিপোর্ট করেনি)। প্রথমজনের বক্তব্য অনুযায়ী- তিনি [মুখ্যমন্ত্রী] লক্ষ রেখেছিলেন যাতে কোনো পুলিশ এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং ফ্রেডরিক বুরোসের মতে- "তিনি সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে সংযত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন"।[৩] যদিও পুলিশের ‘নীরব’ থাকার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আদেশ দেওয়া হয়নি। সুতরাং, সোহরাওয়ার্দী সমাবেশে যাই বলুন, উপস্থিত থাকা অশিক্ষিত দর্শকদের কাছে সেটা বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টির উন্মুক্ত আমন্ত্রণ বলে মনে হয়েছিল।[৩] শ্রোতাদের অনেকেই সমাবেশ শেষ হওয়ার পর ফেরার সময় হিন্দুদের উপর আক্রমণ করা এবং হিন্দুদের দোকান লুট করা শুরু করেছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও কলকাতায় হ্যারিসন রোডে লরি (ট্রাক)-এ করে আসা কট্টরপন্থী মুসলিম গুন্ডার দল ইটপাটকেল ও বোতল নিয়ে হিন্দু মালিকানাধীন দোকানে আক্রমণ করেছিল। আবুল কালাম আজাদ লিখেছে, সমগ্র কলকাতা শহরে যখন নারী পুরুষ খুন হচ্ছিল তখন পুলিশ ও মিলিটারি নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। 

সন্ধ্যে ৬টার সময় শহরের যেসব জায়গায় দাঙ্গা লাগে সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এই সকল অঞ্চল এবং প্রধান রাস্তাগুলো সুরক্ষিত রাখার জন্য রাত ৮টায় পুলিশি নজরদারি শুরু হয়, যার ফলে বস্তি এবং অন্যান্য অনুন্নত অঞ্চল গুলোতে পুলিশ মুক্ত করা হয়েছিল।

১৭ আগস্ট গার্ডেন রিচ টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি, সৈয়দ আবদুল্লাহ ফারুকী এবং কট্টরপন্থী মুসলিম গুন্ডা এলিয়ান মিস্ত্রি মেটিয়াব্রুজের লিচুবাগান এলাকার কসোরাম কটন মিলসের মিল চত্বরে একটি বিশাল সশস্ত্র দাঙ্গাহাঙ্গামাকারী দলের নেতৃত্ব দেন। মিল শ্রমিকরা, যাদের মধ্যে ওড়িয়াদের সংখ্যা বেশি ছিল, তারা মিল চত্বরেই থাকত। ২৫ আগস্ট বেঁচে যাওয়া চারজন ব্যক্তি ফারুকীর বিরুদ্ধে মেটিয়াব্রুজ থানায় অভিযোগ জানায়। ওড়িশা সরকারের একজন মন্ত্রী, বিশ্বনাথ দাস কসোরাম কটন মিলসের ওড়িয়া শ্রমিকদের হত্যার তদন্ত করতে লিচুবাগান অঞ্চলে এসেছিলেন। মেটিয়াব্রুজের এই হত্যাকাণ্ডে প্রায় ১০,০০০ বা তার বেশি মানুষ মারা যায় বলে কিছু সূত্র থেকে জানা যায়। অনেক লেখক দাবি করেন যে হিন্দুরা প্রাথমিক ভুক্তভোগী ছিলেন এবং অনেকের দাবি যে মুসলিম শ্রমিকরাও মারা গিয়েছিল।


১৭ আগস্ট হত্যার সবচেয়ে ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি ছিল। বিকেলের পর থেকে সৈন্যরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং রাত্রে সামরিক বাহিনী দ্বারা অঞ্চলসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। বস্তি এবং অন্যান্য অঞ্চল, যা তখনও সামরিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, সেখানে আইনশৃঙ্খলা এবং দাঙ্গা প্রতি ঘণ্টায় ঘন্টায় বাড়তে থাকে। ১৮ আগস্ট হিন্দুরা প্রতিরোধ শুরু করে। ১৮ আগস্ট সকালে বাস ও ট্যাক্সি ভর্তি শিখ এবং হিন্দুরা তরোয়াল, লোহার রড এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহযোগে প্রতিরোধ আক্রমণ শুরু করে।


এই সাম্প্রদায়িক সংঘাত প্রায় এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল। শেষ অবধি, ২১ আগস্ট বাংলাকে ভাইসরয়ের শাসনের অধীনে রাখা হয়। ভারতীয় এবং গোর্খাবাহিনীর চারটি ব্যাটালিয়নসহ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৫ টি ব্যাটালিয়ন শহরে নিয়োগ করা হয়েছিল। পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য থাকা সত্যেও কেন সৈন্যদের আরো আগে ডাকা হয়নি সেই বিষয়ে লর্ড ওয়াভেল পরবর্তীতে অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, পলাশীর যুদ্ধে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক লোকের মৃত্যু হয়েছে কলকাতার দাঙ্গায়।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে নোয়াখালী ও টিপ্পেরা জেলায় ঘটা গণহত্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের একটি কলঙ্কিত পরবর্তী ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়। কলকাতা দাঙ্গার খবর নোয়াখালী-টিপ্পার দাঙ্গাকে প্রভাবিত করেছিল। তবে হিংস্রতা কলকাতা দাঙ্গার চেয়ে প্রকৃতিতে আলাদা ছিল।


উত্তর নোয়াখালী জেলার রায়গঞ্জ থানার অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর গণহত্যা শুরু হয়।এই গণহত্যাকে "মুসলিম উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংগঠিত ক্রোধ" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের ঢেউ শীঘ্রই প্রতিবেশী থানার রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীর সন্দ্বীপ এবং ত্রিপুরা জেলার ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর, লাকসাম এবং চৌদ্দগ্রাম ছড়িয়ে পরে। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের জন্য হতাহতের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। তবে, সরকারি মতে, এই হত্যাকাণ্ডে ২০০-৩০০ জন মারা যায়। নোয়াখালীতে দাঙ্গা বন্ধ হওয়ার পরে, মুসলিম লীগ দাবি করেছিল যে এই সংঘর্ষে কেবল ৫০০ হিন্দু মারা গিয়েছিল, কিন্তু বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা মনে করেন যে ৫০,০০০ এরও বেশি হিন্দু নিহত হয়েছিল। কেউ কেউ দাবি করেন এর ফলে নোয়াখালীতে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিস টুকারের মতে, হিন্দু সংবাদমাধ্যম বিশৃঙ্খলার মারাত্মক অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করেছিল। তবে নিরপেক্ষ এবং ব্যাপকভাবে গৃহীত মতানুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০০-এর কাছাকাছি।


গভর্নর ফ্রেডেরিক বারোজের মতে, "জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রামগঞ্জ থানার একটি বাজারে লুটপাটই ঝামেলা শুরু হওয়ার তাত্ক্ষণিক ঘটনা ছিল।"সুরেন্দ্রনাথ বসু এবং হিন্দু মহাসভার বিশিষ্ট নেতা রাজেন্দ্রলাল রায় চৌধুরীর ব্যবসার জায়গায় হামলা হয়েছিল।

তথ্য সংগ্রহ : বেঙ্গল আউল 

১। ডা. কালিদাস বৈদ্য – বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব 

২। ড. জয়া চ্যাটার্জির বই– বাংলা ভাগ হল

৩। নারায়ন বন্দোপাধ্যয়– বিপ্লবের সন্ধানে

৪। শেখ মুজিবুর রহমান– অসমাপ্ত আত্মজীবনী 

৫। ভবতোষ দত্ত– আট দশক 

৬। আব্দুল গাফফার চৌধুরী– ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা

৭। গোপাল পাঁঠার সাক্ষাৎকার– https://tinyurl.com/872f93j8 

৮। বৃটিশ মিলিটারী রিপোর্ট– https://tinyurl.com/7eajvufx

৯। নিহার রঞ্জন চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার– https://tinyurl.com/59tfac4d

Mosley, Leonard (১৯৬০)। The Last Days Of The British Raj। পৃষ্ঠা ১

রায়, দেবজ্যোতি (২০০৫)। কেন উদ্বাস্তু হতে হল। বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র। পৃষ্ঠা ৩২।

Tunzelmann, Alex von (২০১২-১০-২৫)। Indian Summer: The Secret History of the End of an Empire (ইংরেজি ভাষায়)।

Sengupta, Debjani (২০০৬)। "A City Feeding on Itself: Testimonies and Histories of 'Direct Action' Day" (PDF)। Narula, Monica। Turbulence। Serai Reader। Volume 6। The Sarai Programme, Center for the Study of Developing Societies। পৃষ্ঠা 288–295।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ