অনুমান প্রমাণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 December, 2021

অনুমান প্রমাণ

 অনুমান প্রমাণ (Inference as instrument) বা অনুমিতি (Inferential knowledge)

.

ন্যায়মতে যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা চারপ্রকার। যথা- প্রত্যক্ষণ, অনুমিতি, উপমিতি ও শাব্দবোধ। সে অনুযায়ী যথার্থ জ্ঞান লাভের স্বীকৃত প্রণালী বা প্রমাণ হলো চারটি- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। অনুমান হলো দ্বিতীয় প্রমাণ।

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অনুমানের লক্ষণ দিয়েছেন-


‘অনুমিতিকরণম্ অনুমানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।

অর্থাৎ : অনুমিতি জ্ঞানের করণকে অনুমান বলে।


 .

‘অনুমান’ শব্দটি করণবাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয়সিদ্ধ হলে তার অর্থ হয় অনুমিতি জ্ঞানের করণ। কিন্তু ভাবার্থে ল্যুট্ প্রত্যয়সিদ্ধ হলে তার অর্থ হয় অনুমিতি জ্ঞান। মূলত ‘অনুমান’ শব্দটি জ্ঞান ও জ্ঞানের করণ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়।

‘অনু’ শব্দের অর্থ হলো পশ্চাৎ, আর ‘মান’ শব্দের অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ ‘অনুমান’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘পশ্চাৎ জ্ঞান’। ফলে সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। যেমন ধূমের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ করে বহ্নির অস্তিত্ব অনুমান করা। দূরের কোন পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে বলা হয় যে পর্বতটি বহ্নিবান। কারণ যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি, এটি আমাদের চূলা বা রান্নাঘরের পূর্ব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাই পর্বতে ধূমের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করে সেখানে বহ্নির অনুমান করি। এই অগ্নির জ্ঞান হলো অনুমানলব্ধ জ্ঞান। এই অনুমানের ভিত্তি হলো ধূম ও বহ্নির নিয়ত সম্বন্ধ সম্পর্কে আমাদের পূর্বে অর্জিত জ্ঞান। তাই অনুমান হলো পরোক্ষ জ্ঞান। কোনো একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষণ করে, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অপর একটি অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রক্রিয়াকে অনুমান বলে।

 .

অনুমিতির লক্ষণ

অনুমিতির লক্ষণ বোঝার আগে অনুমিতির ক্ষেত্রে সাধ্য, পক্ষ এবং হেতু– এই তিনটি বিষয় আমাদের জানা দরকার। অনুমিতিস্থলে আমরা যে বিষয়ের অনুমান করি তাকে বলা হয় সাধ্য। ন্যায়শাস্ত্রে সাধ্য ও লিঙ্গী শব্দ দুটি সমার্থক। যেখানে সাধ্য আছে বলে অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় পক্ষ। যার সাহায্যে পক্ষে সাধ্যের উপস্থিতি অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় হেতু। যেমন, ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ অর্থাৎ পর্বতটি বহ্নিমান কারণ ওখানে ধূম আছে- এই অনুমিতি স্থলে ‘পর্বত’ হলো পক্ষ। কারণ পর্বতে বহ্নি আছে- এরূপ অনুমান করা হয়। ‘বহ্নি’ হলো সাধ্য। কারণ পর্বত নামক পক্ষে বহ্নির অনুমান করা হয়। ‘ধূম’ হলো হেতু কারণ পক্ষ পর্বতে ধূমকে দেখে সাধ্য বহ্নির অনুমান করা হয়। ন্যায়দর্শনে হেতু, ধর্ম, সাধন, লিঙ্গ সমার্থক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। এবার আসা যাক অনুমিতির লক্ষণে।

মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্রে অনুমানের লক্ষণে বলেছেন-


‘অথ তৎ পূর্বকম্ অনুমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।

অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞানই অনুমান।

 .

উল্লেখ্য, এখানে ‘অনুমান’ শব্দটি অনুমিতি অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই অনুমিতির লক্ষণের পূর্বে মহর্ষি প্রত্যক্ষের লক্ষণ দিয়েছেন। তাই ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা প্রত্যজ্ঞানকে নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুমিতি প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অনুমিতিকে প্রত্যক্ষপূর্বক জ্ঞান বলা হলে অনুমিতির লক্ষণ ‘অব্যাপ্তি’ দোষে দুষ্ট হয় বলে অন্য নৈয়ায়িকদের অভিমত। তাঁদের মতে সমস্ত অনুমিতিই প্রত্যক্ষজন্য নয়। অনুমান বা শব্দ প্রমাণের দ্বারা কোন হেতুর জ্ঞান এবং তাতে কোন পদার্থের ব্যাপ্তি (নিয়ত-সম্বন্ধ) নিশ্চয় হলেও তার দ্বারা সেই পদার্থের অনুমিতি হয়। তাই ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’-এর বদলে ‘লিঙ্গ-পরামর্শ’-কেই ‘তৎ’ শব্দের দ্বারা নির্দেশ করা যুক্তিযুক্ত। এ লক্ষ্যে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অনমিতির লক্ষণ দিয়েছেন-

‘পরামর্শজন্যং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।

অর্থাৎ : পরামর্শ হতে উৎপন্ন যে জ্ঞান তাই অনুমিতি।

 .

কিন্তু পরামর্শ বা লিঙ্গ-পরামর্শ কাকে বলে তা না বুঝলে অনুমিতির এ লক্ষণ বোঝা যায় না। এজন্যে পরামর্শ জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অন্নংভট্ট আবার বলেন-

‘ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতা-জ্ঞানং পরামর্শঃ। (তর্কসংগ্রহ)।

অর্থাৎ : ব্যাপ্তিবিশিষ্ট পক্ষধর্মতাজ্ঞান হলো পরামর্শ।

 .

এর মানে দাঁড়ালো, পরামর্শ হলো একটি জটিল জ্ঞান যেখানে ব্যাপ্তিজ্ঞান বিশেষণের কাজ করে এবং পক্ষধর্মতাজ্ঞান (পক্ষে ধর্ম বা হেতুর জ্ঞান) বিশেষ্যের কাজ করে। এই বক্তব্য বুঝতে হলে আমাদের আগে ব্যাপ্তিজ্ঞান এবং পক্ষধর্মতাজ্ঞান কাকে বলে তা বোঝা প্রয়োজন।

 .

ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো ব্যাপ্তিবিষয়ক জ্ঞান। অর্থাৎ যে জ্ঞানের বিষয় ব্যাপ্তি তাই ব্যাপ্তিজ্ঞান। হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধকে বলে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ। ব্যাপ্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উদাহরণরূপে বলা হয়, ধূম থাকলেই বহ্নি থাকে। ধূমের সঙ্গে যখন বহ্নির সাহচর্য প্রত্যক্ষ করা হয়, তাদের উভয়কে সমান অধিকরণে (স্থানে) উপস্থিত থাকতে দেখা যায়, তখন বলা হয় তাদের মধ্যে সামানাধিকরণ্য আছে। এখানে ধূম (হেতু) এবং বহ্নির (সাধ্যের) সামানাধিকরণ্যই (নিয়ত-সম্বন্ধ) হলো ব্যাপ্তি।

 .

যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের সামানাধিকরণ্য আছে, সেই হেতুকে পক্ষে বর্তমান বলে জানা হলো পক্ষধর্মতা। যেমন, পর্বত প্রভৃতি পক্ষে হেতু ধূমকে প্রত্যক্ষ করলে পক্ষধর্মতা জ্ঞান জন্মায়। পক্ষধর্মতাকে যখন ব্যাপ্তিবিশিষ্ট বলে জানা যায় তখন তাকে বলা হয় পরামর্শ। ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’- এই অনুমিতির ক্ষেত্রে ‘যে ধূমের সঙ্গে বহ্নির ব্যাপ্তিসম্পর্ক আছে, পর্বতে দেখা ধূম হলো সেই ব্যাপ্তিবিশিষ্ট ধূম’। এবং এর ফলে ‘বহ্নিব্যাপ্যধূমবান এই পর্বত’- এই জ্ঞান হলো পরামর্শ। এখানে ‘বহ্নি’ হলো সাধ্য, ধূম হলো হেতু এবং পর্বত হলো পক্ষ। অর্থাৎ ন্যায়মতে, সাধ্যব্যাপ্যবিশিষ্ট হেতুমান পক্ষ- এটিই হলো পরামর্শ জ্ঞান।

 .

অনুমিতির ক্ষেত্রে প্রথমে পক্ষধর্মতাজ্ঞান, তারপর ব্যাপ্তিস্মরণ এবং তারপর পরামর্শের জ্ঞান জন্মায়। ন্যায়মতে বলা হয়, প্রত্যক্ষাদি যে কোন প্রমাণের দ্বারা লব্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞানাদি জন্য যে লিঙ্গ পরামর্শ হয় সেই লিঙ্গ পরামর্শের পরক্ষণেই অনুমিতি জন্মে। বিষয়টিকে বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন-

.

‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ বা ‘পর্বতে বহ্নি আছে যেহেতু পর্বতে আমরা ধূম প্রত্যক্ষ করছি’- এই অনুমিতিস্থলে ধূম হলো হেতু। হেতুর অপর নাম হলো লিঙ্গ। বহ্নি হলো সাধ্য এবং পর্বত হলো পক্ষ। এক্ষেত্রে পূর্বে কোন এক সময়ে রান্নাঘর প্রভৃতি স্থানে আমাদের ধূম ও বহ্নির সহচার দর্শন হয়েছিলো এবং বহ্নিশূন্য স্থানে ধূম না দেখতে পাবার জন্য ধূমের সাথে বহ্নির একটি ব্যাপ্তি-প্রত্যক্ষ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান জন্মায়। নৈয়ায়িক মতে এটিই হলো প্রথম লিঙ্গদর্শন (ব্যাপ্তিজ্ঞান)। পরে পর্বত প্রভৃতি স্থানে যখন আবার ধূম-দর্শন হয়, তখন ‘পর্বত ধূমবিশিষ্ট’ এরূপ প্রত্যক্ষ জন্মে। এই জ্ঞানের নাম পক্ষধর্মতাজ্ঞান। নৈয়ায়িক মতে এটি দ্বিতীয় লিঙ্গদর্শন। দ্বিতীয় লিঙ্গদর্শনের পর দৃষ্ট লিঙ্গ (ধূম) যে লিঙ্গী (বহ্নি)-ব্যাপ্য এরূপ ব্যাপ্তির স্মরণ হয়। এরই নাম ব্যাপ্তিস্মরণ। অর্থাৎ পূর্বে প্রথম লিঙ্গদর্শনে যে ব্যাপ্তিজ্ঞান হয়েছিলো এবং সেই জ্ঞান যে সংস্কার সৃষ্টি করেছিলো, সেই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘ধূম বহ্নিব্যাপ্য’ বা ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’ এরকম স্মরণ বা স্মৃতি উৎপন্ন হয়। নৈয়ায়িক মতে তা-ই ব্যাপ্তিস্মরণ। এই ব্যাপ্তিস্মরণের পরেই পর্বতে দৃষ্ট ধূম যে বহ্নিব্যাপ্য অর্থাৎ ‘বহ্নিশূন্য থাকে না এমন যে ধূম তা পর্বতে আছে’ এরূপ তৃতীয় লিঙ্গদর্শন হয়। এর নাম ব্যাপ্তিবিশিষ্টপক্ষধর্মতাজ্ঞান। এ জ্ঞানের আকার হলো ‘বহ্নিব্যাপ্যঃ ধূমবান পর্বতঃ’। এই তৃতীয় লিঙ্গদর্শনকেই বলা হয় লিঙ্গপরামর্শ বা কেবল পরামর্শ। এই পরামর্শ থেকে উৎপন্ন যে জ্ঞান (পর্বত বহ্নিযুক্ত), তাকেই ন্যায়দর্শনে অনুমিতি বলা হয়।

 .

এই পক্ষধর্মতাজ্ঞান বা লিঙ্গদর্শন, লিঙ্গ (হেতু) ও লিঙ্গীর (সাধ্য) ব্যাপ্তিসম্বন্ধের জ্ঞান এবং পরামর্শ থেকে অনুমিতি উৎপন্ন হয় বলে এগুলি সমস্তই অনুমিতির কারণ। কিন্তু সবগুলিই অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ নয়। প্রাচীন ন্যায়মতে করণের সংজ্ঞা বা লক্ষণ হলো-

‘ফলাযোগ-ব্যবচ্ছিন্নং কারণং করণম্’।

অর্থাৎ : যে কারণের অব্যবহিত পরে কার্যের উৎপত্তি হয় তাই করণ।

 .

এর মানে হলো চরম কারণ বা অন্তিম কারণই করণ। ফলে প্রাচীন ন্যায়মতে চরম কারণ লিঙ্গপরামর্শকেই অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ বলা হয়েছে। নব্য নৈয়ায়িক অন্নংভট্টও এক্ষেত্রে প্রাচীন ন্যায়সম্মত করণের লক্ষণ অনুসরণ করেছেন এই বলে যে- ‘পরামর্শজন্যং জ্ঞানম্ অনুমিতিঃ’। কিন্তু নব্যন্যায় মতে করণের লক্ষণ হলো-

‘ব্যাপারবৎ অসাধারণং কারণং করণম্’।

অর্থাৎ : যে অসাধারণ কারণ ব্যাপারবৎ, তাই করণ।

 .

এবং নব্যন্যায় মতে ব্যাপার বলতে বোঝানো হয়-

‘তজ্জন্যতে সতি তজ্জন্য জনকত্বং ব্যাপারত্বম্’।

অর্থাৎ : যা কারণের দ্বারা জন্য (উৎপন্ন) এবং কারণের দ্বারা জন্য কার্যের জনক তাই ব্যাপার।

 .

ফলে এই নব্যন্যায় মতে পরামর্শ বা লিঙ্গপরামর্শ অনুমিতির করণ বা অনুমান প্রমাণ নয়। নব্যন্যায় প্রণেতা গঙ্গেশ উপাধ্যায় তাঁর পরামর্শ গ্রন্থে ব্যাপ্তিজ্ঞান বা ব্যাপ্তিস্মরণকে অনুমিতির করণ এবং লিঙ্গপরামর্শকে সেই কারণের ব্যাপার বলেছেন। বিশ্বনাথ এই মতকেই সমর্থন করেছেন। তবে উদ্দ্যোতকর, অন্নংভট্ট, কেশব মিশ্র ও অনেকে পরামর্শকেই অনুমিতির করণ বলেছেন।

 .

কিন্তু পরামর্শ থেকে উৎপন্ন জ্ঞানকে অনুমিতি বললে অনুমিতির উক্ত লক্ষণে এক প্রকার অতিব্যাপ্তি দোষ দেখা দেয়। এটাকে বলা হয় সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে অনুমিতি লক্ষণের অতিব্যাপ্তি দোষ। তাহলে সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ কী ?

.

দূরস্থিত বা অস্পষ্ট আলোকে কোন পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে বস্তুটির বিশেষ ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের সংশয় হয়। অস্পষ্ট আলোকে কোন একটি দণ্ডায়মান বস্তু স্থাণু না মানুষ তা আমরা সঠিক বুঝতে পারি না। এই সংশয় নিরসনের জন্য বস্তুটির কাছে গিয়ে বস্তুটির হাত, পা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করে বস্তুটি যে একটি পুরুষ এই জ্ঞান আমাদের হয়। এইরূপ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্য হওয়ায় এবং ন্যায়মতে একই বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য জ্ঞানের সামগ্রির তুলনায় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সামগ্রী বলবান হওয়ায় এই জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলতে হয়। তাছাড়া এই জ্ঞানের অনন্তর জ্ঞাতা বস্তুটিকে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই মনে করেন, অনুমানের দ্বারা বস্তুটিকে জেনেছেন বলে মনে করেন না। এইরূপ প্রত্যক্ষের নাম হলো সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ।

 .

সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলেও তা পরামর্শের অনুগামী অর্থাৎ পরামর্শ জ্ঞানের থেকে উৎপন্ন। কারণ ‘এটি পুরুষ’ এই জ্ঞানের জন্য ‘এই বস্তুটি পুরুষত্ব ব্যাপ্যহস্তপদবিশিষ্ট’- এই পরামর্শ প্রয়োজন। অর্থাৎ ধূম বহ্নিব্যাপ্য হওয়ায় ‘এই পর্বতটি বহ্নিব্যাপ্তিবিশিষ্ট’- এরূপ জ্ঞানকে যেমন পরামর্শ বলা হয়, অনুরূপভাবে হস্তপদাদিও পুরুষত্বের ব্যাপ্যা হওয়ায় ‘এই বস্তুটি পুরুষত্বব্যাপ্য হস্তপদাদিবিশিষ্ট’- এইরূপ জ্ঞানকেও পরামর্শ বলতে হবে। সুতরাং পরামর্শজন্য জ্ঞানকে অনুমিতি বলা হলে সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষকেও অনুমিতি বলতে হয়। এইভাবে অনুমিতির প্রদত্ত লক্ষণের দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞান আক্রান্ত হওয়ায় অনুমিতির লক্ষণ অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়।

 .

এই অতিব্যাপ্তি দোষ দূরীকরণের জন্য নৈয়ায়িক দার্শনিকরা অনুমিতির লক্ষণে ‘পক্ষতা’ পদটি যোগ করে ‘পরামর্শজ্ঞান’ বলতে ‘পক্ষতা সহকৃত পরামর্শজ্ঞান’-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ কেবল পরামর্শের থেকে উৎপন্ন জ্ঞান অনুমিতি নয়। পক্ষতাযুক্ত পরামর্শের থেকে উৎপন্ন জ্ঞান হলো অনুমিতি। ‘পক্ষতা’ একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ হলো ‘ইচ্ছার অভাববিশিষ্ট সিদ্ধির অভাব’। ন্যায়দর্শনে বলা হয়েছে-

‘সিষাধয়িষাবিরহসহকৃতসিদ্ধ্যভাবঃ পক্ষতা’।

.

এক্ষেত্রে ‘সিষাধয়িষা’ পদের অর্থ সাধ্যকে অনুমান করার ইচ্ছা। সিদ্ধি পদের অর্থ ‘পক্ষে সাধ্য আছে’ এরূপ নিশ্চিত জ্ঞান। ন্যায়মতে বলা হয়, যেখানে জ্ঞাতার সিষাধয়িষা বা অনুমিতির ইচ্ছা আছে কিন্তু জ্ঞাতার সিদ্ধির অভাব আছে, যেখানে জ্ঞাতার সিষাধয়িষা বা অনুমিতির ইচ্ছা আছে কিন্তু জ্ঞাতার ঐ বিষয়ে সিদ্ধি (জ্ঞান) আছে এবং যেখানে জ্ঞাতার অনুমিতির ইচ্ছা নেই কিন্তু ঐ বিষয়ে জ্ঞাতার সিদ্ধির অভাব আছে- এই তিন ক্ষেত্রে পক্ষতা থাকে। কিন্তু যেখানে জ্ঞাতার অনুমিতির ইচ্ছা নেই এবং জ্ঞাতার ঐ বিষয়ে সিদ্ধি আছে, সেখানে পক্ষতা থাকে না। পক্ষতার অভাবে অনুমিতি হয় না। তাই সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে পরামর্শজ্ঞান থাকলেও পক্ষতা না থাকায় সংশয়োত্তর প্রত্যক্ষে অনুমিতি-লক্ষণের অতিব্যাপ্তির আশঙ্কা আর থাকে না।

 .

 অনুমানের অঙ্গ বা অবয়ব (The Constituents of Inference) 

ন্যায়দর্শনে অনুমানের অঙ্গ হিসেবে একাধিক অবয়ব ও পদ স্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যেক অনুমানে তিনটি পদ এবং অনুমানভেদে তিনটি বা পাঁচটি বাক্য থাকে। তিনটি পদ হলো- সাধ্য (Major Term), পক্ষ (Minor Term) এবং হেতু (Middle Term)।

যে বাক্যগুলির দ্বারা অনুমান গঠিত হয় সেই বাক্যগুলিকে অনুমানের অবয়ব বলা হয়।

 .

উল্লেখ্য যে, ন্যায়ের জ্ঞানতত্ত্বে পদার্থই জ্ঞানের বিষয়, এবং পদ সেই পদার্থের অভিধা। হেতুর সাহায্যে যে পদার্থকে অনুমান করা হয় তাকে সাধ্য বলে, এবং সেই পদার্থ বোধক পদের নাম সাধ্যপদ (Major Term)। যে আধার বা অধিকরণে সাধ্যকে অনুমান করা হয় তাকে বলে পক্ষ এবং সেই আধার বা অধিকরণপদকে পক্ষ বা পক্ষপদ (Minor Term) বলা হয়। আর যে পদার্থের সাহায্যে অনুমান করা হয় তাকে বলা হয় হেতু, সাধন বা লিঙ্গ এবং তার বোধক পদকে বলে হেতুপদ (Middle Term)। হেতু হলো মধ্যপদ। হেতুর মধ্যস্থতায় সাধ্য ও পক্ষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। আমরা পর্বতে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান করি তখন পর্বত হলো পক্ষ, ধূম হলো হেতু এবং বহ্নি হলো সাধ্য।

 .

পাশ্চাত্য তর্কবিজ্ঞানের নিরপেক্ষ বচনে অবশ্যই দুটি পদ ও একটি সংযোজক থাকে। ভারতীয় ন্যায়ের অবয়বের সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অবয়বে সংযোজকের কোন ভূমিকা নেই। আবার কেবলমাত্র একটি পদের দ্বারাই একটি অবয়ব গঠিত হতে পারে।

ভারতীয় ন্যায়ের প্রত্যেক অনুমানে কম পক্ষে তিনটি বচন (proposition) থাকবে। এই তিনটি বচন নিরপেক্ষ (categorical) হবে এবং এই বচন সদর্থক বা নঞর্থক- উভয়ই হতে পারে। অনুমিত বচনে পক্ষ হলো উদ্দেশ্য, সাধ্য হলো বিধেয়।

 .

প্রথম বচনে সাধ্য ও পক্ষের সম্বন্ধের কথা বলা হয়। এখানে সাধ্যকে পক্ষের বিধেয় করা হয়। যেমন- ‘পর্বত বহ্নিমান’। দ্বিতীয় বচনে পক্ষের সঙ্গে হেতুর সম্বন্ধের কথা বলা হয়, ‘কারণ পর্বত ধূমায়মান’। তৃতীয় বচনে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তির কথা বলা হয়, যেমন- ‘যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে’।

 .

নৈয়ায়িকদের মতে অনুমান দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। নিজের জন্য যে অনুমান করা হয় তাকে স্বার্থানুমান বলা হয়। স্বার্থানুমানে অনুমানটি যথাযথভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না। অনুমানের বা ন্যায়ের ন্যায়শাস্ত্রসম্মত রূপ প্রকাশ করাই হলো যথাযথভাবে ব্যক্ত করা।

যখন অপরের জন্য অনুমান করা হয় অর্থাৎ অপরের কাছে কোনো সত্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় তখন তাকে বলা হয় পরার্থানুমান। এক্ষেত্রে অনুমানকে যথাযথভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন আছে।

 .

ন্যায়মতে স্বার্থ ও পরার্থ ভেদে অনুমানের প্রকারভেদ অনুযায়ী ন্যায়ের অবয়বের সংখ্যারও ভেদ আছে। স্বার্থানুমানে থাকে তিনটি অবয়ব, কিন্তু পরার্থানুমানে থাকে পাঁচটি অবয়ব। পরার্থানুমানের এই পাঁচটি অবয়ব হলো- (১) প্রতিজ্ঞা, (২) হেতু, (৩) উদাহরণ, (৪) উপনয়, (৫) নিগমন। স্বার্থানুমানের ত্রি-অবয়ব পরার্থানুমানের এই পঞ্চ-অবয়বেরই প্রথম বা শেষ তিনটি অবয়ব। স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানের অবয়বগুলিকে যুক্তির আকারে নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে-

 .

পরার্থানুমান :

(১) পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)

(২) কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)

(৩) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- মহানস বা পাকশালা, কামারশালা ইত্যাদি (উদাহরণ)

(৪) পর্বতও ধূমায়মান (উপনয়)

(৫) সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)।

 .

স্বার্থানুমান :

(১) পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)

(২) কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)

(৩) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- মহানস ইত্যাদি (উদাহরণ)।

অথবা,

(১) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- পাকশালা ইত্যাদি (উদাহরণ)

(২) পর্বতও ধূমায়মান (উপনয়)

(৩) সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)।

.

পঞ্চ-অবয়ব সম্বন্ধে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্ অবয়বাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩২)

অর্থাৎ : প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন- এই পাঁচটি পঞ্চবাক্য অবয়ব।

 .

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে ‘ন্যায়’ নামক মহাবাক্যের পাঁচটি অবয়বের নাম সহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এবং তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকাগ্রন্থে প্রত্যেক অবয়বের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।

 .

প্রতিজ্ঞা : যে বাক্যে পক্ষ সাধ্যধর্মবিশিষ্ট বলা হয়, তাই প্রতিজ্ঞা (‘সাধ্যবত্তয়া পক্ষবচনং প্রতিজ্ঞা’)। প্রতিজ্ঞা হলো প্রতিপাদ্য বিষয় বা সাধ্য-জ্ঞাপক বিষয়। অর্থাৎ এই বিষয়টিকে প্রমাণ করতে হবে। যেমন, ‘পর্বত বহ্নিমান’ এরূপ প্রতিজ্ঞাবাক্যের দ্বারা আমরা জানতে পারি যে, পর্বতে বহ্নির অস্তিত্ব প্রমাণ করাই অনুমানকর্তার অভিপ্রায়। এক্ষেত্রে খোদ ন্যায়সূত্রেও বলা হয়েছে-  

‘সাধ্যনির্দ্দেশঃ প্রতিজ্ঞা’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৩)

অর্থাৎ : যথাবিভক্ত সেই পঞ্চাবয়বের মধ্যে ‘সাধ্য-নির্দেশ’ অর্থাৎ সাধনীয় ধর্মবিশিষ্ট ধর্মিমাত্রের বোধক বাক্য প্রতিজ্ঞা।

 .

হেতু : হেতুবাক্যে পঞ্চমী বিভক্তিযুক্ত পদের দ্বারা হেতু বা লিঙ্গের প্রতিপাদন করা হয় (‘পঞ্চম্যন্তং লিঙ্গপ্রতিপাদকং বচনং হেতুঃ’)। হেতু-জ্ঞাপক অবয়বের নাম হেতু। হেতু অবয়ব পক্ষপদের সঙ্গে হেতুপদের সম্বন্ধ ঘোষণা করে। হেতুই প্রতিজ্ঞার কারণ নির্দেশ করে। যার সাহায্যে পক্ষে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয় তাই হলো হেতু বা লিঙ্গ। আর ন্যায়সূত্রে হেতুর লক্ষণে বলা হয়েছে-  

‘উদাহরণসাধর্ম্ম্যাৎ সাধ্যসাধনং হেতুঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৪)

‘তথা বৈধর্ম্ম্যাৎ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৫)

অর্থাৎ :

উদাহরণ অর্থাৎ কেবল দৃষ্টান্তপদার্থের সাথে ধর্মপ্রযুক্ত অর্থাৎ কেবল দৃষ্টান্ত-পদার্থের সাথে সাধ্য ধর্মীর যা কেবল সমান ধর্ম, তাতে প্রযুক্ত সাধনীয় পদার্থের সাধনত্ববোধক বাক্যবিশেষ হচ্ছে হেতু (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৪)।  একইভাবে অর্থাৎ উদাহরণবিশেষের বৈধর্মপ্রযুক্ত ও সাধ্যসাধন অর্থাৎ যা সাধ্য ধর্মের সাধনত্ববোধক বাক্যবিশেষ তাই (বৈধর্ম্য) হেতু (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৫)।

 .

উদাহরণ : যে বাক্যে হেতুতে সাধ্যের বা সাধ্যাভাবে হেতুর অভাবের ব্যাপ্তির প্রতিপাদন করা হয়, তাকে উদাহরণ বাক্য বলা হয় (‘ব্যাপ্তি প্রতিপাদকং বচনম্ উদাহরণম্’)। পরিচিত দৃষ্টান্ত সহযোগে সাধ্যপদের সঙ্গে হেতুপদের সার্বিক সম্পর্ক জ্ঞাপক অবয়ব হলো উদাহরণ। অর্থাৎ বাক্যের প্রতিজ্ঞা এবং হেতুর মধ্যে যে ব্যাপ্তি সেটিকে পরিচিত দৃষ্টান্তের দ্বারা ব্যাপ্তি সম্বন্ধকে সমর্থন করা হয়। যেহেতু দৃষ্টান্ত সর্বজন স্বীকৃত সে জন্য দৃষ্টান্তে কোনো প্রকার মতভেদ থাকে না। আর ন্যায়সূত্রে উদাহরণের লক্ষণে বলা হয়েছে-  

‘সাধ্য-সাধর্ম্ম্যাত্তদ্ধর্ম্মভাবী দৃষ্টান্ত উদাহরণং’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৬)

‘তদ্বিপর্য্যয়াদ্বা বিপরীতং’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৭)

অর্থাৎ :

সাধ্য ধর্মীর সাথে সমানধর্মবত্তা-প্রযুক্ত সেই সাধ্য ধর্মীর ধর্মের (সাধ্য ধর্মের) ভাববিশিষ্ট পদার্থ দৃষ্টান্ত, সেই দৃষ্টান্তের বোধক বাক্য উদাহরণ (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৬)।  তদ্বিপর্য্যয় অর্থাৎ বিপরীত দৃষ্টান্তবোধক বাক্যবিশেষও (বৈধর্ম্য) উদাহরণ (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৭)।

 .

উপনয় : যে বাক্যে ব্যাপ্তিবিশিষ্টি হেতু বা লিঙ্গের প্রতিপাদন করা হয়, তাকে উপনয় বাক্য বলা হয় (‘ব্যাপ্তিবিশিষ্ট লিঙ্গ প্রতিপাদকং বচনম্ উপনয়ঃ’)। সাধ্যের সঙ্গে সার্বিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হেতুপদের ও পক্ষপদের সম্বন্ধজ্ঞাপক অবয়বই উপনয়। এই বাক্যে পক্ষে সাধ্যের ব্যাপ্তিবিশিষ্ট হেতুর প্রতিপাদন করা হয়। উপনয়ে সামান্য বচনটিকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আর উপনয়ের লক্ষণে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘উদাহরণাপেক্ষঃ তথেতি উপসংহারো ন তথেতি বা সাধ্যস্য উপনয়ঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৮)

অর্থাৎ : সাধ্য ধর্মীয় সম্বন্ধে উদাহরণানুসারী ‘তথা’ কিংবা ‘ন তথা’ এভাবে উপসংহার অর্থাৎ অনুরূপ হেতুবোধক বাক্য হচ্ছে উপনয়।

 .

নিগমন : যে বাক্যে ব্যাপ্তি ও পক্ষধর্মতাবিশিষ্ট হেতুর দ্বারা পক্ষে সাধ্য আছে তা প্রতিপাদিত হয়, তাকে নিগমন বাক্য বলা হয় [‘হেতু সাধ্যবত্তয়া (পক্ষ প্রতিপাদকং) বচনং নিগমনম্’]। নিগমন হলো সিদ্ধান্ত অবয়ব। পূর্ববর্তী বাক্যগুলির উপর নির্ভর করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তাকে নিগমন বলে। প্রতিজ্ঞার সঙ্গে নিগমনের পার্থক্য এই যে, প্রতিজ্ঞাতে যা অপ্রমাণিত, অথচ যা প্রমাণিত হতে চলেছে নিগমনে তা-ই প্রমাণিত। হেতু-অবয়বের সঙ্গে উপনয় অবয়বের পার্থক্য হলো, হেতু-অবয়বে যে হেতুপদের কথা বলা হয় সে হেতুপদের সঙ্গে সাধ্যের সম্বন্ধ আছে কিনা তা তখন অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু উপনয় অবয়বে যে হেতুপদের কথা বলা হয় সে হেতুপদের সঙ্গে সাধ্যের যে সার্বিক সম্বন্ধ আছে তা আমাদের জ্ঞাত। আর ন্যায়সূত্রে নিগমনের লক্ষণে বলা হয়েছে-  

‘হেত্বপদেশাৎ প্রতিজ্ঞায়াঃ পুনর্ব্বচনং নিগমনম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৩৯)

অর্থাৎ : হেতুবাক্যের কথনপূর্বক প্রতিজ্ঞাবাক্যের পুনঃ কথন হচ্ছে নিগমন।

 .

অবয়বসমষ্টি যখন যুক্তির আকারে প্রকাশিত হয় তখন তাকে ন্যায় বলে। স্বার্থানুমানকে ত্রি-অবয়বী ন্যায় এবং পরার্থানুমানকে পঞ্চাবয়বী ন্যায় বলা হয়। ভারতীয় ন্যায় অনুমানে অবরোহ অনুমান ও আরোহ অনুমান উভয়ের সমন্বয় করা হয়েছে। এতে আকারগত ও বস্তুগত উভয়বিধ সত্যতা প্রমাণ হয় বলে যুক্তিগুলির সত্যতা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়। এই প্রকার যুক্তি বাক্যের দ্বারা সমর্থিত হয়ে একটি অবশ্য-স্বীকার্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।

 .

ন্যায়সম্মত পঞ্চাবয়বী ন্যায় নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। যেমন, বাৎস্যায়নের ন্যায়ভাষ্যে অপরের নিকট বাক্য প্রয়োগের জন্য দশটি অবয়ব স্বীকার করেছেন এমন এক নৈয়ায়িক সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। সেই অবয়বগুলি হলো- জিজ্ঞাসা, সংশয়, শক্যপ্রাপ্তি, প্রয়োজন, সংশয়-অব্যুদাস এবং নৈয়ায়িক স্বীকৃত পাঁচটি অবয়ব। কিন্তু উক্ত মত খণ্ডন প্রসঙ্গে ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন বলেছেন যে, জিজ্ঞাসা প্রভৃতিকে ন্যায়ের অবয়ব বলা যায় না যেহেতু জিজ্ঞাসা প্রভৃতি ন্যায়বাক্যের অংশ নয়।

 .

সাংখ্য ও বৈশেষিক সম্প্রদায় পঞ্চাবয়বী ন্যায়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তবে মীমাংসা এবং বেদান্ত সম্প্রদায় মনে করেন ন্যায়সম্মত স্বার্থানুমানের ন্যায় প্রথম তিনটি অবয়ব অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ বা শেষের তিনটি অবয়ব অর্থাৎ উদাহরণ, উপনয় ও নিগমনের সাহায্যেই সকল প্রকার অনুমান সম্ভব হতে পারে। আবার জৈনমতে অনুমানের অবয়ব দুটি- প্রতিজ্ঞা ও হেতু। কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেন উদাহরণ ও উপনয় এই দুটি মাত্র অবয়বের সাহায্যেই অনুমান সম্ভব। এর অতিরিক্ত অবয়ব স্বীকার নিষ্প্রয়োজন ও নিরর্থক। কোন কোন মতে আবার নিগমন বাক্য প্রতিজ্ঞাবাক্যের পুনরুক্তিমাত্র। নৈয়ায়িকগণ অবশ্য তাঁদের স্বকীয় যুক্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, অনুমিত সত্যকে প্রতিপাদন করার জন্য পঞ্চ-অবয়বই একান্ত প্রয়োজন।

 .

অনুমানের ভিত্তি (The Grounds of Inference) 

অনুমান যার উপর নির্ভর করে সম্ভব হয় অর্থাৎ অনুমান করতে গেলে যে জিনিসের নিতান্তই প্রয়োজন তাকে বলা হয় অনুমানের ভিত্তি। অনুমানের লক্ষণে দেখা যায় যে, অনুমিতির ক্ষেত্রে পক্ষধর্মতাজ্ঞান (পক্ষে হেতুর প্রত্যক্ষ) এবং ব্যাপ্তিজ্ঞান (সাধ্য ও হেতুর ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্পর্কজ্ঞান) হলে পরামর্শ হয়, যাকে বলে ব্যাপ্তিবিশিষ্টপক্ষধর্মতাজ্ঞান। পরামর্শজ্ঞান থেকে অনুমিতি হয়। এ প্রেক্ষিতে নৈয়ায়িকগণ অনুমানের দু’প্রকার ভিত্তির কথা উল্লেখ করেছেন- মানস ও যৌক্তিক।

 .

মানস ভিত্তিকে বলা হয় পক্ষতা। পক্ষতা হলো ইচ্ছার অভাববিশিষ্ট সিদ্ধির অভাব। অর্থাৎ যেখানে সিদ্ধি বর্তমান এবং ইচ্ছা অনুপস্থিত সেখানে পক্ষতা থাকে না, ফলত অনুমান হয় না। উল্লেখ্য, সিদ্ধি বর্তমান মানে যেখানে সিদ্ধির অভাব নেই। তাই অনুমিতির ক্ষেত্রে সিদ্ধির অভাব বা ইচ্ছার অন্তত যে কোন একটি থাকলেই পক্ষতা থাকে, এবং অনুমান হয়।

 .

যৌক্তিক ভিত্তির নাম ব্যাপ্তি। ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো সাধ্য ও হেতুর ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্বন্ধজ্ঞান। এই জ্ঞান ব্যতীত কোন অনুমিতি সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ-

পর্বত বহ্নিমান, যেহেতু পর্বত ধূমায়মান এবং যেখানে ধূম আছে সেখানে বহ্নি আছে।

এই অনুমানে দেখা যাচ্ছে পর্বত (পক্ষ) ধূমায়মান যেখানে ধূম (হেতু) আছে সেখানে বহ্নি (সাধ্য) আছে। বহ্নি ও ধূমের মধ্যে ব্যতিক্রমহীন নিয়ত সম্পর্ক বিদ্যমান। হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে নিয়ত সম্পর্ক অথবা সার্বিক সম্বন্ধ (universal relation) তার নাম হলো ব্যাপ্তি। এই ব্যাপ্তি ন্যায় দর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 .

ব্যাপ্তির স্বরূপ ও ব্যাপ্তিজ্ঞান (The nature and definition of Vyapti)

ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো ব্যাপ্তিবিষয়ক জ্ঞান। ন্যায়মতে ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমানের ভিত্তিস্বরূপ। ব্যাপ্তি হলো একপ্রকার সম্বন্ধ বিশেষ। ব্যাপ্তি শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা। একটি বস্তু বা বিষয় আর একটি বস্তু বা বিষয়ে ব্যাপ্ত। যে বস্তুটি ব্যাপ্ত হয়, তাকে বলা হয় ব্যাপ্য এবং যার দ্বারা ব্যাপ্য হয়, তাকে বলা হয় ব্যাপক। হেতু ব্যাপ্য এবং সাধ্য ব্যাপক।

 .

অন্যভাবে বললে, একটি বস্তু যখন অপর একটি বস্তুর সঙ্গে সর্বত্র উপস্থিত থেকেও তদ্ভিন্ন অন্যত্র উপস্থিত থাকতে পারে, তখন সেই বস্তুকে বলা হয় ব্যাপক। কিন্তু একটি বস্তু যখন অপর একটি বস্তুর নিয়ত সহচর হয় এবং ঐ বস্তুর অনুপস্থিতিতে কোথাও থাকে না, তখন ঐ বস্তুকে ব্যাপ্য বলা হয়। যেমন বহ্নি থাকলেই সর্বক্ষেত্রে ধূম নাও থাকতে পারে, উদাহরণস্বরূপ বিদ্যুৎ, উত্তপ্ত লৌহপিণ্ড। কিন্তু যেখানে ধূম থাকে সেখানে বহ্নি থাকতে দেখা যায়, যেমন রান্নাঘর ইত্যাদি। অর্থাৎ বহ্নি বা আগুনের বিস্তৃতি বেশি বলে বহ্নি ব্যাপক, সে তুলনায় ধূমের বিস্তৃতি কম বলে ধূম ব্যাপ্য। এখানে ধূম বহ্নির দ্বারা ব্যাপ্য, এবং বহ্নি ধূমের ব্যাপক। এই ব্যাপ্য বা হেতু  ও সাধ্য বা ব্যাপকের মধ্যে যে সম্বন্ধ তাই হলো ব্যাপ্তি। তাই ব্যাপ্তিকে ব্যাপ্য-ব্যাপক সম্বন্ধও বলা হয়। বেশি জায়গা জুড়ে থাকা হলো ব্যাপকতা, আর অল্প জায়গা জুড়ে থাকা হলো ব্যাপ্যতা।

 .

নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তিকে দুইভাগে ভাগ করেছেন- সমব্যাপ্তি ও অসমব্যাপ্তি বা বিষমব্যাপ্তি।

ব্যাপ্য ও ব্যাপকের বিস্তৃতি যদি সমান হয় তাকে সমব্যাপ্তি বলে। অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের বিস্তৃতি সমান হলে উভয়ের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ হয় তা সমব্যাপ্তি। এইরূপ ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে যে কোন একটি থেকে অপরটিকে অনুমান করা যায়। যেমন মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন জীব। এখানে মানুষ ও বুদ্ধিসম্পন্ন জীব- দুটোরই বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা সমান। এভাবে কার্য ও কারণ, দ্রব্য ও গুণের মধ্যে যে ব্যাপ্তি তা হলো সমব্যাপ্তি।

অন্যদিকে ব্যাপ্য ও ব্যাপক অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের বিস্তৃতি যদি সমান না হয় তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সম্বন্ধকে বলা হয় অসমব্যাপ্তি বা বিষমব্যাপ্তি। যেমন ধূম ও বহ্নির বিস্তৃতি সমান না হওয়ায় যেখানে যেখানে ধূম থাকে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকলেও যেখানে যেখানে বহ্নি থাকে সেখানে সেখানে ধূম থাকে না। এরূপ ব্যাপ্তি বিষমব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত।

 .

ব্যাপ্তি ছাড়া অনুমান হয় না। যেমন, ‘যেখানে ধূম সেখানে অগ্নি’- এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞান থাকলে কোন ব্যক্তির দ্বারা পর্বতে(পক্ষ) ধূম (হেতু) প্রত্যক্ষ করে পর্বতে অগ্নির (সাধ্য) অনুমান করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ অনুমান স্থলে হেতুর (ধূম) দ্বারা পক্ষে (পর্বত) সাধ্যের (অগ্নি) জ্ঞান হয়। এই জ্ঞানই অনুমিতি।

তবে অনুমানকে যথার্থ হতে হলে প্রযুক্ত হেতুকে সৎ হতে হবে। আবার, হেতুকে সৎ হতে হলে হেতুকে ব্যাপ্তির একটি সম্বন্ধী হতে হবে। ন্যায়মতে ব্যাপ্তি হলো দুটি পদার্থের মধ্যে নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধ। অনুমানের ক্ষেত্রে এই দুটি পদার্থ হলো হেতু ও সাধ্য। হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে নিয়ত সাহচর্যের সম্বন্ধ তাই অনুমানের ভিত্তি। এই সম্বন্ধই ব্যাপ্তি। ন্যায়দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট ব্যাপ্তির লক্ষণ প্রসংগে বলেন-

‘যত্র যত্র ধূমঃ তত্র তত্র অগ্নিঃ ইতি সাহচর্য নিয়মঃ ব্যাপ্তিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।

অর্থাৎ : যেখানে যেখানে ধূম সেখানে সেখানেই অগ্নি- এই সাহচর্য নিয়মকেই ব্যাপ্তি বলা হয়।

 .

দুটি পদার্থ সহগামী হলেই তাদের সহচর বলা হয়। এই একসঙ্গে থাকাই সাহচর্য বা সহ-উপস্থিতি (co-existence)। সাহচর্য মানে সামানাধিকরণ্য বা সমান অধিকরণতাও বোঝায়। অর্থাৎ দুটি পদার্থ হেতু ও সাধ্য একই অধিকরণে থাকলে তাদের মধ্যে সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্য আছে বলা যায়। ব্যাপ্তি হলো হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়ম। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়ত বা অবশ্যম্ভাবিতা। অর্থাৎ যার কোন ব্যতিক্রম হয় না। অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্যই ব্যাপ্তি। ধূম থাকলে আগুন থাকবেই। এখানে হেতু ধূম, সাধ্য আগুন। এখন যদি আগুনকে হেতু ধরে সাধ্য হিসেবে ধূমের অনুমান করতে হয়, তাহলে যেখানে অগ্নি সেখানেই ধূম এই সাহচর্য নিয়ত সম্বন্ধ হবে না। কারণ ধূম ছাড়াও আগুনের অস্তিত্ব থাকতে পারে। তবে এই সাহচর্য নিয়ম শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেন-

‘হেতু সমানাধিকরণ অত্যন্তাভাব অপ্রতিযোগী সাধ্য সামানাধিকরণ্যং ব্যাপ্তিঃ’।

অর্থাৎ : হেতুর সমান অধিকরণে যে অত্যন্তাভাব থাকে, সেই অত্যন্তাভাবের অপ্রতিযোগী যে সাধ্য, তার সঙ্গে হেতুর সামানাধিকরণ্যই ব্যাপ্তি।

 .

যেমন, পর্বতে আগুন আছে যেহেতু পর্বতে ধূম আছে- এরূপ অনুমিতিস্থলে পর্বতে ধূমকে প্রত্যক্ষ করে আমরা যখন বহ্নির অনুমান করি, তখন সেই অনুমানে ধূম হলো হেতু এবং বহ্নি বা আগুন হলো সাধ্য এবং পর্বত হলো পক্ষ। ধূম হেতুর অধিকরণ হলো মহানস বা রান্নাঘর, গোষ্ঠ, চত্বর প্রভৃতি। এই সকল ধূমের অধিকরণে যে অত্যন্তাভাব থাকে ঐ অত্যন্তাভাব বহ্নির অত্যন্তাভাব হতে পারে না। (অত্যন্তাভাব মানে অত্যন্ত অভাব, অর্থাৎ অনুপস্থিত)। কোন পদার্থের অত্যন্তাভাবের উপস্থিতিতে সেই পদার্থের উপস্থিতি ঘটতে পারে না। অর্থাৎ বহ্নি হলো ধূমের অধিকরণে বর্তমান অত্যন্তাভাবের অপ্রতিযোগী। যার অভাব তাকে বলে প্রতিযোগী। যেমন, ঘটের অভাব হলো ঘাঁভাব। সুতরাং ঘটাভাবের প্রতিযোগী হলো ঘট। কাজেই সাধ্য আগুন এই অভাবের প্রতিযোগী না হওয়ায় তা অপ্রতিযোগী। অতএব, ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে হেতু ঘট পট ইত্যাদি অন্যান্য পদার্থের অত্যন্তাভাবের সমানাধিকরণ হলেও সাধ্যের অত্যন্তাভাবের সঙ্গে সমানাধিকরণ হয় না। ফলে এখানে হেতু ধুম এবং সাধ্য আগুনের সামানাধিকরণ্য বর্তমান। এই কারণে ধূম হেতু এবং বহ্নি সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি আছে বলা যাবে।

 .

তবে ন্যায়দর্শনে যে কোন সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্যের সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা যায় না। যে সাহচর্য ব্যতিক্রমহীন তাই নিয়ত সাহচর্য বা নিয়ত সামানাধিকরণ্য। এই সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্যই ব্যাপ্তি।  ধরা যাক্ ধূম থাকে পর্বত, চত্বর, গোষ্ঠ, মহানস বা রান্নাঘরে।  যেখনেই ধূম দেখি সেখানেই অগ্নির অস্তিত্ব দেখা যায়। অর্থাৎ আগুন ছাড়া ধূমের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। যেখানে আগুন নেই সেখানে ধূমও নেই। এখানে ধূম ও অগ্নির যে সাহচর্য, তার কোন ব্যতিক্রম নেই। ফলে যেখানে ধূম সেখানে অগ্নির সাহচর্য বা সামানাধিকরণ্য রয়েছে বলে তাদের সম্পর্ক ব্যাপ্তি সম্পর্ক।

 .

কিন্তু বহু অগ্নি আছে যেখানে যেখানে ধূম নেই। যেমন- বিদ্যুৎ, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড ইত্যাদি। আগুনে পুড়ে টকটকে লাল যে লৌহপিণ্ড তার মধ্যে ধূম নেই। কাজেই যেখানে অগ্নি সেখানেই ধূম আছে তা বলা চলে না। ফলে অগ্নির সাথে ধূমের ব্যাপ্তিসম্বন্ধ স্বীকার করা যায় না। কারণ অগ্নি ও ধূমের মধ্যে সামানাধিকরণ্য বা নিয়ত সাহচর্য নেই। তাই নৈয়ায়িকরা বলেন যে সাধারণত হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা হয়, কিন্তু যে-কোন সাহচর্যের সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তি বলা যায় না। ব্যাপ্তি সম্পর্ক হবে অনৌপাধিক অর্থাৎ উপাধিহীন। অগ্নির সাথে ধূমের যে সহচার সম্বন্ধ, তা একটি শর্ত বা উপাধির উপর নির্ভরশীল। সেই শর্তটি হলো আর্দ্র ইন্ধন বা ভেজা কাঠ। বস্তুত আর্দ্রতা না থাকলে অগ্নির সঙ্গে ধূম উপস্থিত থাকে না। কাজেই অগ্নি ও ধূমের সহচার সম্বন্ধ অনৌপাধিক বা শর্তহীন না হওয়ায় তা ব্যাপ্তি নয়। অপরপক্ষে ‘যেখানেই ধূম সেখানেই অগ্নি’- এক্ষেত্রে ধূমের সঙ্গে অগ্নির যে সহচার সম্পর্ক, তা উপাধিহীন (unconditional) হওয়ায় ব্যাপ্তি সম্পর্ক নামে পরিচিত। কাজেই ব্যাপ্তি হলো হেতু ও সাধ্যের সেই সহচার সম্বন্ধ যা অনৌপাধিক। যেহেতু এই সম্বন্ধ অনৌপাধিক সেহেতু এটি নিয়ত এবং অব্যভিচারী। অতএব হেতুর সঙ্গে সাধ্যের শর্তশূন্য বা অনৌপাধিক নিয়ত-সাহচর্যকেই ব্যাপ্তি বলা হয়। অর্থাৎ অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাপ্তি হলো দুটি পদের ব্যতিক্রমহীন (invariable), উপাধিহীন (unconditional) ও নিয়ত (universal) সহ-উপস্থিতি (co-existence)-এর সম্পর্ক।

 .

ব্যাপ্তিগ্রহ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায় (The ways of ascertaining vyapti)

অনুমানকে যাঁরা যথার্থ অনুভবের উৎস বলে স্বীকার করেন, ব্যাপ্তিজ্ঞানকে তাঁরা কোনো না কোনো ভাবে স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তির স্বরূপ নির্ণয়ের পর ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার উপায় নির্দেশ করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ব্যাপ্তিগ্রহ অর্থাৎ ব্যাপ্তির জ্ঞান কিভাবে হয় ? যেমন সকল ধূমযুক্ত বস্তু হয় বহ্নিযুক্ত- এরূপ সার্বিক বচনকে আমরা কিভাবে জানি ? এ প্রশ্নের উত্তর বিষয়ে বিভিন্ন দর্শনের মতভেদ দেখা যায়।

 .

প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী চার্বাক দার্শনিকরা ব্যাপ্তিজ্ঞানের সম্ভাব্যতাই স্বীকার করেন না। কারণ প্রত্যক্ষের দ্বারা সমস্ত ধূম এবং সমস্ত বহ্নির একত্র অবস্থান কখনোই জানা সম্ভব নয়। সুতরাং হেতু এবং সাধ্যের সাহচর্য বা ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায় না।

 .

আবার বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে তাদাত্ম্য নীতি (The principle of essential identity) ও তদুৎপত্তি নীতি (The principle of causality)-র ভিত্তিতে ব্যাপ্তির জ্ঞান হয়। তাদাত্ম্য অর্থ অভিন্নতা। দুটি জিনিস যদি স্বরূপগত এক হয় তাহলে ঐ দুটি জিনিসের মধ্যে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে বলে মনে করা হয়। যেমন শিংশপার সঙ্গে বৃক্ষের তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে। শিংশপা হলো একজাতীয় (শিশু) বৃক্ষ। সুতরাং বৃক্ষের সারধর্ম বৃক্ষত্ব যেমন অন্যান্য বৃক্ষে আছে, তেমনি শিংশপাতেও আছে। শিংশপাতে বৃক্ষত্ব না থাকলে শিংশপাত্বও থাকে না। তাদাত্ম্য সম্বন্ধ যাদের মধ্যে থাকে তাদের একটি থেকে অপরটিকে সহজেই অনুমান করা যায়।

 .

আর তদুৎপত্তি হলো কার্য-কারণ সম্বন্ধ। দুটি বস্তুর মধ্যে একটি যদি কারণ হয় এবং অপরটি যদি কার্য হয়, তাহলে তাদের মধ্যে একটি সার্বত্রিক সম্বন্ধ স্বীকার করতে হয়। সুতরাং যে দুটি বস্তুর মধ্যে কার্য-কারণ সম্বন্ধ থাকে, তাদের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ নির্ণয় করা যেতে পারে। বৌদ্ধমতে কার্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করা হয় পঞ্চকারণীর দ্বারা। সেগুলি হলো- (১) কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কারণের অনুপলব্ধি, (২) কারণের উপলব্ধি, (৩) কার্যের উপলব্ধি, (৪) কার্যের অনুপলব্ধি এবং (৫) কারণের অনুপলব্ধি। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা ধূম এবং বহ্নির কার্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়। সুতরাং ধূম এবং বহ্নির ব্যাপ্তি জ্ঞান নিশ্চিতভাবে জানা যায়।

 .

কিন্তু নৈয়ায়িক মতে তাদাত্ম্য ও তদুৎপত্তি বা কার্য-কারণ সম্বন্ধের থেকে ব্যাপ্তিজ্ঞান হতে পারে না। কারণ যেস্থলে হেতু এবং অনুমেয় বিষয়ের কার্য-কারণ সম্বন্ধ নেই অথবা তাদাত্ম্য সম্বন্ধ নেই, সেস্থলেও অনুমিতি হতে দেখা যায়। সেকারণে নৈয়ায়িকরা ব্যাপ্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বৌদ্ধমত গ্রহণ করেন নি।

 .

বৈদান্তিকরা অবাধিত (uncontradicted) অভিজ্ঞতার সাহায্যে দুটি বস্তুর সহচার দর্শনের মাধ্যমে ব্যাপ্তি নির্ণয় করেছে (ব্যাভিচারাদর্শনে সতি সহচারদর্শনম্)। দুটি বস্তুর একত্র উপস্থিতি (অন্বয়) দর্শন হলো সহচারদর্শন। অর্থাৎ বেদান্তমতে যেখানে হেতু সেখানে সাধ্যের উপস্থিতি দর্শন এবং এর ব্যতিক্রমের অদর্শনের মাধ্যমেই দুটি জিনিসের মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় সম্ভব।

নৈয়ায়িকরা বেদান্ত মতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করলেও তাঁরা ব্যাপ্তি নির্ণয়ের জন্য ছয়টি স্তরবিশিষ্ট একটি উপায় বা ছয়টি বিকল্প উপায়ের নির্দেশ করেছেন।  এই ছয়টি স্তর বা উপায় হলো- (১) অন্বয়, (২) ব্যতিরেক, (৩) ব্যভিচারাগ্রহ, (৪) উপাধিনিরাস, (৫) তর্ক ও (৬) সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ।

 .

(১) অন্বয় : দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই দুটি বস্তুর অন্বয় লক্ষ্য করতে হয়। সর্বদাই যদি দেখা যায় যে, একটি বস্তু যেখানে উপস্থিত হয়, সেখানে আর একটি বস্তুও উপস্থিত, তাহলে ঐ দুটি বস্তুর মধ্যে অন্বয় দর্শন হয়। যেখানে ধূম থাকে সেখানেই বহ্নি থাকে, তাই ধূম ও বহ্নির মধ্যে অন্বয় বোঝা যায়।

 .

(২) ব্যতিরেক : ব্যতিরেক পদ্ধতির দ্বারাও দুটি বস্তুর সাহচর্য দর্শন করা যায়। সর্বাদাই যদি দেখা যায় যে, একটি বস্তু অনুপস্থিত হলেই আর একটি বস্তু অনুপস্থিত হয়, তাহলে ঐ দুই বস্তুর সাহচর্য ব্যতিরেক প্রণালীর দ্বারা বোঝা যায়। যেখানে বহ্নি থাকে না সেখানে ধূম থাকে না- এরূপ ব্যতিকেক দৃষ্টান্তের দ্বারা ধূম ও বহ্নির সাহচর্য নির্ণয় করা যায়। উল্লেখ্য যে, ব্যতিরেক ব্যাপ্তিতে হেতুর অনুপস্থিতিতে সাধ্যের অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয় না, বরং সাধ্যের অনুপস্থিতিতে হেতুর অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয়। বহ্নির অনুপস্থিতিতে ধূমের অনুপস্থিতি থেকে বহ্নি দেখে ধূমের অনুমান করা যায় না, ধূম থেকে বহ্নির অনুমান করা যায়।

 .

(৩) ব্যভিচারাগ্রহ : অন্বয় ও ব্যতিরেক দুটিই সহচার প্রত্যক্ষ। অর্থাৎ অন্বয় সহচার হলো দুটি বস্তুর উপস্থিতি সংক্রান্ত ঐক্য, এবং ব্যতিরেক সহচার হলো দুটি বস্তুর অনুপস্থিতির ঐক্য। এই পুনঃ পুনঃ সহচারদর্শনকে ভূয়োদর্শনও বলা হয়। কিন্তু দুটি বস্তুর অন্বয় ও ব্যতিরেক দর্শন হলেই দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে- একথা বলা যায় না। অন্বয় ও ব্যতিরেক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে লব্ধ দুটি বস্তুর সাহচর্যের কোন ব্যতিক্রম আছে কিনা তাও বিচার করে দেখতে হবে। এই ধরনের ব্যতিক্রম বা বিরোধী দৃষ্টান্তের অভাবদর্শনই হলো ব্যভিচার দর্শন। কেননা নব্যনৈয়ায়িকদের মতে সহচারের ভূয়োদর্শন (বিস্তৃত অভিজ্ঞতা) ব্যাপ্তিজ্ঞানের জনক নয়। অর্থাৎ সহস্রবার সহচার দর্শন হলেও ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা দূর হয় না। অর্থাৎ বারবার ধূম ও বহ্নির সহচার দর্শন করলেও তাদের মধ্যে ব্যাপ্তিসম্বন্ধ আছে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সহচার দর্শন অর্থাৎ ‘যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি’ এরূপ ধূম ও অগ্নির সহচার দর্শন যদি একবার হয় তাহলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হবে যদি ব্যভিচার জ্ঞান না থাকে। ব্যভিচার জ্ঞান থাকলে পুনঃ পুনঃ সহচার দর্শন হলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হতে পারে না। নব্যনৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় ভূয়োদর্শন শব্দের অর্থ করেছেন- ‘ব্যভিচার জ্ঞান বিরহ সহকৃত সহচার জ্ঞান’। মানে, ভূয়োদর্শনকে অবশ্যই ব্যতিক্রমহীন হতে হবে। তাই অন্নংভট্টের মতে-

‘ব্যভিচার জ্ঞানবিরহ সহকৃত সহচারজ্ঞানস্য ব্যাপ্তিগ্রাহকত্বাৎ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।

অর্থাৎ : (দুটি বস্তুর) সাহচর্য বিষয়ে জ্ঞান এবং ব্যভিচার জ্ঞানের অভাব হতেই ব্যাপ্তিগ্রহ হয়।

 .

ব্যভিচার জ্ঞান ব্যাপ্তিজ্ঞান বা ব্যাপ্তিগ্রহের প্রতিবন্ধক। ব্যভিচারজ্ঞান দুভাবে ব্যাপ্তিজ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা করতে পারে। তাই ব্যভিচারজ্ঞান দু’প্রকার- (ক) ব্যভিচার নিশ্চয় ও (খ) ব্যভিচার সংশয়।

ব্যভিচারের নিশ্চয় বা প্রত্যক্ষ হলে ব্যাপ্তিজ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্যভিচারের সংশয় হলেও এরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, বহ্নির সহচারের পর যদি ব্যভিচার প্রত্যক্ষ হয় তাহলে যেমন ব্যাপ্তিগ্রহ হয় না, তেমনি ব্যভিচারের শঙ্কা থাকলেও ব্যাপ্তিগ্রহ হবে না। সুতরাং, যেখানে ধূম থাকে সেখানে বহ্নি থাকে কি না- এরকম কোন শঙ্কা বা সংশয় থাকলে ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’- এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না। ফলে ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের জন্য ব্যভিচার সংশয়ের নিবৃত্তি প্রয়োজন।

 .

(৪) উপাধিনিরাস : ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ উপাধিশূন্য বা শর্তহীন। তাই যে দুটি বস্তু বা সম্বন্ধীর মধ্যে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় তাদের মধ্যে কোন উপাধি আছে কিনা তা অনুসন্ধান করা দরকার হয় এবং যদি কোন উপাধি থাকে তবে উপাধিনিরাস প্রয়োজন। উপাধি নির্ধারণের প্রকৃষ্ট উপায় হলো ভূয়োদর্শন বা বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। ভূয়োদর্শন বা বিস্তৃত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে, ব্যাপ্তিজ্ঞাপক হেতু ও সাধ্যের মধ্যে কোন উপাধি বা শর্ত নেই।

 .

(৫) তর্ক : উপরিউক্ত উপায়ে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও কোন প্রতিবাদী ঐ ব্যাপ্তি সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করতে পারেন। প্রতিবাদীর এই সংশয় নিরাস করার জন্য নৈয়ায়িকরা ‘তর্ক’ নামক একটি যুক্তিপ্রণালীর কথা উল্লেখ করেন। তর্ক একপ্রকার পরোক্ষ যুক্তিপ্রণালী। এই যুক্তিপ্রণালীতে বাদীর বিরোধী সিদ্ধান্তকে খণ্ডনের মাধ্যমে বাদীর সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ‘যেখানে ধূম আছে সেখানেই বহ্নি আছে’- এরূপ ব্যাপ্তির বিরোধী সিদ্ধান্ত হলো ধূম বহ্নির ব্যভিচারী, মানে, কোন কোন স্থলে ধূম থাকলেও বহ্নি থাকে না অর্থাৎ বহ্নি ছাড়াও কোন কোন স্থলে ধূম থাকতে পারে। কিন্তু বাদীর সিদ্ধান্তের এই বিরোধী সিদ্ধান্ত দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বা সহচার দর্শন দ্বারা খণ্ডিত হয়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বহ্নি ছাড়া ধূম থাকে না। বহ্নি ছাড়া  যদি ধূম থাকতো, তাহলে ধূমপায়ীদের বহ্নিসংযোগের প্রয়োজন হতো না। ফলে বহ্নিশূন্য স্থানেও ধূম থাকবে। যেহেতু তা সম্ভব নয় অর্থাৎ প্রতিবাদীর সিদ্ধান্ত দৈনন্দিন ব্যবহারের দ্বারা খণ্ডিত হয়, তাই প্রতিবাদীর সিদ্ধান্ত খণ্ডিত হওয়ায় বাদীর সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এভাবে তর্কের দ্বারা প্রমাণ হয় যে ধূম ও বহ্নির মধ্যে ব্যাপ্তি আছে।

 .

(৬) সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ : ন্যায়সম্মত ব্যাপ্তি নির্ণয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ। সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ। যেমন আমরা পর্বত, পাকশালা প্রভৃতি কোন কোন ক্ষেত্রে ধূম ও বহ্নির ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু ব্যাপ্তি সম্বন্ধ সার্বজনীন। তাই আমাদের বলার উদ্দেশ্য এরকম হয় না যে, শুধু পর্বতীয় ধূমের সঙ্গে পর্বতীয় বহ্নির ব্যাপ্তি আছে বা পাকশালার ধূমের সঙ্গে পাকশালার বহ্নির ব্যাপ্তি আছে। সকল ধূমের সঙ্গে সকল বহ্নির ব্যাপ্তিই আমরা জানতে চাই। কিন্তু সকল ধূম ও সকল বহ্নির সঙ্গে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাধারণ বা লৌকিক সন্নিকর্ষ সম্ভব নয়। তা সমাধানকল্পেই ন্যায়দর্শনে সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষের দ্বারা সকল ধূম ও সকল বহ্নির ব্যাপ্তিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 .

এই সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে আমরা কোন একটি স্থানে ধূমকে প্রত্যক্ষ করার সময় ঐ ধূমের মাধ্যমে ধূমত্ব জাতিকে এবং ঐ ধূমত্ব জাতির মাধ্যমে সকল ধূমকে প্রত্যক্ষ করতে পারি। অনুরূপভাবে বহ্নিত্ব জাতির মাধ্যমে আমরা সকল বহ্নিকে প্রত্যক্ষ করতে পারি। ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের প্রত্যক্ষকালে ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের সম্বন্ধও আমাদের প্রত্যক্ষের বিষয় হয়। ধূমত্ব ও বহ্নিত্বের এই সম্বন্ধের সাহায্যে আমরা সামান্যত সকল ধূমের সঙ্গে সকল বহ্নির একটি সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ করি। এই প্রত্যক্ষ হয় এক ধরনের অলৌকিক প্রত্যক্ষ। এটাই সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ। এইভাবে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় করা যেতে পারে।

 .

অনুমানের শ্রেণীবিভাগ 

পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যায় অনুমানের দুটি মূল শ্রেণীবিভাগ রয়েছে- অবরোহ অনুমান (Deductive Inference) এবং আরোহ অনুমান (Inductive Inference)। অবরোহ অনুমানকে আবার দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- অমাধ্যম অনুমান (Immediate Inference) এবং মাধ্যম অনুমান (Mediate Inference)। কিন্তু ভারতীয় অনুমান পদ্ধতি অবরোহ ও আরোহ অনুমানের মিলিত প্রণালী।

ন্যায়দর্শনে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে বিভিন্ন নীতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তাঁদের মতে অনুমানের বিভিন্ন ধরনের তিন প্রকার শ্রেণীবিভাগ আছে। যথা- (ক) স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান; (খ) পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট; (গ) কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী।

 .

(ক) স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান :

অভিপ্রায়ের দিক থেকে নৈয়ায়িকগণ অনুমানকে স্বার্থ ও পরার্থ বলেছেন। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেছেন, অনুমান দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান (‘অনুমানং দ্বিবিধং স্বার্র্থং পরার্থং চ’)।

 .

স্বার্থ শব্দের অর্থ নিজের জন্য কৃত। স্বার্থানুমানের অর্থ হলো নিজের জন্য কৃত অনুমিতির করণ। ব্যক্তিগত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে যে অনুমান করা হয় তাকে স্বার্থানুমান বলা হয়। স্বার্থানুমান দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে বলা হয় স্বার্থানুমিতি। অর্থাৎ যে অনুমানের দ্বারা অনুমান-কর্তার নিজের সাধ্যবিষয়ক অনুমিতি হয় তাকে বলা হয় স্বার্থানুমিতি। এক্ষেত্রে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে একটি বাস্তব দৃষ্টান্তের সাহায্যে স্বার্থানুমিতির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন।

 .

পাকশালা বা বিভিন্নস্থানে ধূম ও বহ্নির মধ্যে নিয়ত সাহচর্য লক্ষ্য করে ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’ এরূপ ব্যাপ্তিজ্ঞানের পর কোন ব্যক্তি পর্বত থেকে ধূম নির্গত হতে দেখে ঐ পর্বতে বহ্নি আছে কিনা (১) তার অগ্নি বিষয়ে সংশয় হয়। তারপর (২) সে পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে (৩) তাঁর ধূম-বহ্নির ব্যাপ্তিসম্পর্কের কথা মনে পড়ে। এই ব্যাপ্তিস্মরণের পর (৪) তাঁর ‘পর্বত বহ্নিব্যাপ্য ধূমবিশিষ্ট’ বা ‘যে ধূম বহ্নির সঙ্গে ব্যাপ্তিবিশিষ্ট সেই ধূম এই পর্বতে আছে’- এরূপ পরামর্শজ্ঞান হয়। তখন (৫) সেই ব্যক্তির ‘পর্বত বহ্নিযুক্ত’ এরূপ জ্ঞান হয়।

 .

ন্যায়ের পরিভাষায় (১) প্রথমটি হলো সাধ্যসংশয়, (২) পক্ষধর্মতাজ্ঞান, (৩) ব্যাপ্তিস্মৃতি, (৪) পরামর্শ, (৫) অনুমিতি। এই অনুমিতি স্বার্থানুমিতি। এই অনুমিতির করণ স্বার্থানুমান। স্বার্থানুমানে অপরের উপলব্ধি বা জ্ঞানের জন্য অনুমান করা হচ্ছে না বলে অপরকে নিজ মত বোঝানোর জন্য অনুমানটিকে যথার্থভাবে লেখার বা বলার প্রয়োজন হয় না বা কোন বাক্য প্রয়োগ হয় না।

 .

অপরপক্ষে অন্যের কাছে কিছু প্রমাণ করার জন্য যে অনুমান করা হয় তাকে পরার্থানুমান বলা হয়। পরার্থানুমানের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে বলা হয় পরার্থানুমিতি। পরার্থানুমানে অপরের কাছে প্রমাণ করার জন্য অনুমান করা হয় বলে অনুমানটিকে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা প্রয়োজন হয়। অনুমিত বিষয়কে অন্যের কাছে প্রতিপাদন করতে হয় বলে নৈয়ায়িকগণ এই অনুমানকে পাঁচটি অবয়বের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, কোনো একটি উহ্য থাকলে চলবে না। পাঁচটি অবয়ব আছে বলে নৈয়ায়িক অনুমানকে ‘পঞ্চ-অবয়বী’ (five membered syllogism) বলা হয়। ইতঃপূর্বে ‘অনুমানের অবয়ব’ অনুচ্ছেদে বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে।

 .

(খ) পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট :

কার্যকারণ নীতিকে অবলম্বন করে মহর্ষি গৌতম ‘ন্যায়সূত্রে’ অনুমানের একপ্রকার বিভাগ উল্লেখ করেছেন। এই মতে অনুমান তিনপ্রকার। যথা- পূর্ববৎ, শেষবৎ এবং সামান্যতোদৃষ্ট। ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে-  

‘অথ তৎপূর্ব্বকং ত্রিবিধমনুমানং পূর্ব্ববচ্ছেষবৎ সামান্যতো দৃষ্টঞ্চ’।। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)

অর্থাৎ : অনন্তর প্রত্যক্ষবিশেষমূলক জ্ঞান- অনুমান-প্রমাণ ত্রিবিধ- পূর্ব্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট।

 .

পূর্ববৎ অনুমান : ন্যায়মতে পূর্ব শব্দের অর্থ হলো কারণ। অতএব, পূর্ববৎ অনুমান হলো কারণহেতুক অনুমান। অর্থাৎ, যে অনুমানে কারণকে প্রত্যক্ষ করে তার থেকে যখন অপ্রত্যক্ষ কার্যের কথা অনুমান করা হয় তখন তাকে পূর্ববৎ অনুমান বলা হয়। ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ন্যায়ভাষ্যে বলেছেন-  

‘পূর্ব্ব’দিতি–যত্র কারণেন কার্য্যমনুমীয়তে, যথা–মেঘোন্নত্যা ভবিষ্যতি বৃষ্টিরিতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)

অর্থাৎ : যে স্থলে কারণের দ্বারা কার্য অনুমিতি হয় অর্থাৎ কারণ বিশেষের জ্ঞানের দ্বারা তার ব্যাপক কার্যের অনুমিতি জন্মে, সে স্থলে অনুমানপ্রমাণ ‘পূর্ববৎ’ নামে কথিত হয়। যেমন মেঘের উন্নতি-বিশেষের দ্বারা অর্থাৎ তার প্রত্যক্ষ দ্বারা ‘বৃষ্টি হবে’ এরূপ অনুমিত হয়।

এক্ষেত্রে কারণবিশেষের জ্ঞানের সাহায্যে তার ব্যাপক কার্যবিশেষের অনুমিতি হয়। পূর্ব দৃষ্টান্ত বা পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অনুমান করা হয়। যেমন- আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখে আমরা অনুমান করি যে বৃষ্টি হবে। এখানে মেঘ হলো কারণ, বৃষ্টি হলো কার্য।

 .

শেষবৎ অনুমান : ন্যায়মতে ‘শেষ’ শব্দের অর্থ হলো কার্য। সুতরাং, শেষবৎ অনুমান হলো কার্যহেতুক অনুমান। অর্থাৎ, যে অনুমানে কার্যকে প্রত্যক্ষ করে অপ্রত্যক্ষ কারণকে অনুমান করা হয়, তাকে বলা হয় শেষবৎ অনুমান। ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বাৎস্যায়ন বলেছেন-  

‘শেষবাৎ’ তৎ,–যত্র কার্য্যণে কারণমনুময়ীতে, পূর্ব্বোদকবিপরীতমুদকং নদ্যাঃ পূর্ণত্বং শীঘ্রত্বঞ্চ দৃষ্টা স্রোতসোহনুমীয়তে ভূতা বৃষ্টিরিতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)

অর্থাৎ : যে স্থলে কার্যের দ্বারা কারণ অনুমিত হয় অর্থাৎ কার্যবিশেষের জ্ঞানের দ্বারা তার ব্যাপক করণের অনুমিতি জন্মে, তা অর্থাৎ সেই স্থলীয় অনুমান প্রমাণ ‘শেষবৎ’। যেমন নদীর পূর্বস্থিত জলের বিপরীত জলরূপ পূর্ণত্ব এবং স্রোতের তীব্রতা বা শীঘ্রত্ব দেখে ‘বৃষ্টি হয়েছে’ এরূপ অনুমিত হয়।

এক্ষেত্রে কার্যবিশেষের জ্ঞানের সাহায্যে তার ব্যাপক কারণ-বিশেষকে অনুমান করা হয়। যেমন- সকালবেলা মাটি ভেজা দেখে গতরাতের বৃষ্টির অনুমান করা হয়।

হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ তারই ভিত্তিতে অনুমানের এই শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে।

 .

সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান : আবার পূর্ব অভিজ্ঞতা ও সাদৃশ্যের ভিত্তিতে যে অনুমান করা হয় তাকে সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান বলা হয়। বাৎস্যায়নের ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘সামান্যতো দৃষ্টং’–ব্রজ্যাপূর্ব্বকমন্যত্র দৃষ্টস্যান্যত্র দর্শনমিতি তথাচাদিত্যস্য, তস্মাদস্ত্যপ্রত্যক্ষাপ্যাদিত্যস্য ব্রজ্যেতি।’ (ন্যায়ভাষ্য)

অর্থাৎ : ‘সামান্যতো দৃষ্ট’ অনুমান (যথা)–অন্যত্র দৃষ্ট দ্রব্যের অন্যত্র দর্শন ‘ব্রজ্যাপূর্বক’ অর্থাৎ সেই দ্রব্যের গতিক্রিয়াপ্রযুক্ত; সূর্যের অনুরূপ, অর্থাৎ প্রাতঃকালে এক স্থানে দৃষ্ট সূর্যের কালান্তরে অন্যত্র দর্শন হয়, অতএব অপ্রত্যক্ষ হলেও সূর্যের গতি আছে তা অনুমিত হয়।

এই অনুমানের ব্যাপ্তি কার্য-কারণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা এ অনুমানের হেতু ও সাধ্য কার্য-কারণ সম্বন্ধে সংবদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ- পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে গরু, মহিষের শিং আছে এবং তাদের খুরও দ্বিখণ্ডিত। অনুরূপভাবে শিংযুক্ত প্রাণী দেখে অনুমান করা হয় যে সেই প্রাণীর দ্বিখণ্ডিত খুর আছে।

 .

(গ) কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী :

ন্যায়মতে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিকে ভিত্তি করে অনুমানকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে- কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী এবং অন্বয়-ব্যতিরেকী।

 .

কেবলন্বয়ী : যে অনুমানের ব্যাপ্তি কেবলমাত্র অন্বয়ী পদ্ধতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সেই অনুমানকে বলা হয় কেবলান্বয়ী অনুমান। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কেবলান্বয়ী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘অন্বয়মাত্রব্যাপ্তিকং কেবলান্বয়ি’।

অর্থাৎ : যে হেতু (লিঙ্গ) কেবলমাত্র অন্বয়ব্যাপ্তিবিশিষ্ট তাকে কেবলান্বয়ী লিঙ্গ বলে।

 .

কেবলান্বয়ী অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের কেবল অন্বয় ব্যাপ্তি থাকে। যেখানে হেতু সেখানেই সাধ্য যখন অনুমান করা হয় তখন সেই অনুমানকে কেবলান্বয়ী অনুমান বলা হয়। এই অনুমানে কোন নঞর্থক বা ব্যতিরেকী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ-

সব ধূমায়মান বস্তুই বহ্নিমান

পর্বত ধূমায়মান

পর্বত বহ্নিমান।

 .

এই অনুমানে সাধ্য বাক্যটি একটি সার্বিক বাক্য, যে বাক্যে ‘বহ্নিমান’ এই বিধেয়টি সব ধূমায়মান বস্তু সম্পর্কেই স্বীকার করা হয়েছে। এমন কোনো ধূমায়মান বস্তু দেখা যায় না, যা বহ্নিমান নয়। এখানে কোনো ব্যতিরেকী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। একইভাবে-

সব জ্ঞেয় পদার্থই নামযুক্ত (অভিধেয়), যেমন- পট,

ঘট একটি জ্ঞেয় পদার্থ,

অতএব, ঘট নামযুক্ত।

 .

এখানে জ্ঞেয়ত্ব হেতু, অভিধেয়ত্ব সাধ্য এবং ঘট হলো পক্ষ। ন্যায়দর্শনে জ্ঞেয়ত্ব, বাচ্যত্ব, অভিধেয়ত্ব, প্রমেয়ত্ব প্রভৃতি ধর্মকে কেবলান্বয়ী ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এই ধর্মগুলি সকল পদার্থের মধ্যেই থাকে। এই কারণে উক্ত ধর্মগুলির একটিকে হেতু এবং অন্যটিকে সাধ্যরূপে গ্রহণ করে অনুমিতি করলে, সেগুলি হবে কেবলান্বয়ী অনুমিতি। তাই কোন পদার্থের ক্ষেত্রে ‘যেখানে যেখানে অভিধেয়ত্বের অভাব সেখানে সেখানে প্রমেয়ত্বের অভাব’ এরূপ ব্যতিরেকব্যাপ্তি সম্ভবই হয় না, যেহেতু এখানে সমর্থনসূচক দৃষ্টান্ত নেই।

 .

কেবল-ব্যতিরেকী : যে অনুমিতির সমর্থনে কেবলমাত্র ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, কিন্তু অন্বয় দৃষ্টান্ত যেখানে সম্ভব নয়, তাকে বলা হয় কেবল-ব্যতিরেকী অনুমান। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে কেবল-ব্যতিরেকী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘ব্যতিরেকব্যাপ্তিমাত্রকং কেবলব্যতিরেকি’।

অর্থাৎ : যে হেতু বা লিঙ্গ কেবল ব্যতিরেকব্যাপ্তি বিশিষ্ট তাকে কেবলব্যতিরেকী লিঙ্গ বলে।

 .

যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের অন্বয়ব্যাপ্তি সম্ভবই নয়, সাধ্যের অভাবের সঙ্গে হেতুর অভাবের ব্যাপ্তিই সম্ভব, সেই হেতু কেবলব্যতিরেকী হেতু। এই অনুমানে হেতু ও সাধ্যের অনুপস্থিতি বা অভাবের সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করেই সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ-

যা অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন নয় তা গন্ধবান নয়, যেমন- জল,

পৃথিবী গন্ধবান,

অতএব, পৃথিবী অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন।

 .

এই অনুমানের পক্ষ ‘পৃথিবী’, ‘গন্ধবত্ব’ হেতু এবং ‘অন্য ভূতদ্রব্য হতে ভিন্ন’ হচ্ছে সাধ্য। এ অনুমানের ‘গন্ধবত্ব’ হেতুটি কেবলব্যতিরেকী হেতু। কেননা, পৃথিবী গহৃবান কিন্তু পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোন পদার্থ গন্ধবান না হওয়ায় এই অনুমানের অন্বয় দৃষ্টান্ত (‘যা গন্ধবান তা অন্য ভূতদ্রব্য থেকে ভিন্ন’) সম্ভব নয়। তাই এরূপ অনুমানকে কেবল-ব্যতিরেকী অনুমান বলে। একইভাবে-

কোনো অবহ্নিমান বস্তুই নয় ধূমায়মান,

পর্বত হয় ধূমায়মান,

অতএব, পর্বত হয় বহ্নিমান।

 .

এই অনুমানে ব্যাপ্তি সম্পর্ক কেবলমাত্র ব্যতিরেকী দৃষ্টান্তের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ যেখানে হেতু নেই সেখানে সাধ্য নেই।

 .

অন্বয়-ব্যতিরেকী : যে অনুমানের সমর্থনে অন্বয় এবং ব্যতিরেক উভয়প্রকার ব্যাপ্তিই পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট অন্বয়ব্যতিরেকী লিঙ্গের লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘অন্বয়েন ব্যতিরেকেন চ ব্যাপ্তিমৎ অন্বয় ব্যতিরেকি’।

অর্থাৎ : যে লিঙ্গ অন্বয় এবং ব্যতিরেক ব্যাপ্তি বিশিষ্ট তাকে অন্বয়ব্যতিরেকী লিঙ্গ বলে।

 .

অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে ব্যাপ্তি সম্পর্ক অন্বয় ও ব্যতিরেকী এই দুই প্রকার দৃষ্টান্তের উপর নির্ভরশীল। যেখানেই হেতু সেখানেই সাধ্য এবং যেখানে হেতু নেই সেখানে সাধ্য নেই। এই অনুমানের আকারটি উদাহরণস্বরূপ-

যা ধূমবান তাই বহ্নিমান, যেমন- পাকশালা,

পর্বতটি ধূমবান,

অতএব, পর্বতটি বহ্নিমান।

এবং-

যা বহ্নিমান নয় তা ধূমবান নয়, যেমন-  হ্রদ,

পর্বতটি ধূমবান,

অতএব, পর্বতটি বহ্নিমান।

 .

অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে হেতুর সঙ্গে সাধ্যের অন্বয় ও ব্যতিরেকী এই উভয়প্রকার ব্যাপ্তি দেখা যায়। এখানে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে অন্বয় বা সহ-উপস্থিতি এবং ব্যতিরেক বা সহ-অনুপস্থিতি এই উভয় প্রকার সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। উপরিউক্ত অনুমানের অন্বয় দৃষ্টান্ত পাকশালা এবং ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত হ্রদ উভয়ই জ্ঞানের বিষয় হওয়ার যোগ্যতাবিশিষ্ট অর্থাৎ দৃষ্টান্ত হিসেবে তাদের জ্ঞান সম্ভব। তাই এই অনুমান হলো অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান।

 .

হেত্বাভাস (Fallacies in Inference) 

.

ভারতীয় চিন্তাবিদদের মতে অনুমানের বস্তুগত সত্যতা নির্ভর করে অনুমানে ব্যবহৃত হেতুর বস্তুগত সত্যতার উপর। ন্যায়মতে হেতু  সৎ বা যথার্থ ও  অসৎ বা অযথার্থ হতে পারে। তবে হেতু বলতে সব সময় যথার্থ হেতুকেই বোঝানো হয়। অযথার্থ হেতু প্রকৃতপক্ষে হেতুই নয়। অসৎ হেতুই হেত্বাভাস।  হেত্বাভাসের লক্ষণে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেছেন-  

‘হেতুলক্ষণাভাবাদহেতবো হেতুসামান্যাৎ হেতুবদাভাসমানাঃ’। (ন্যায়ভাষ্য)

অর্থাৎ : হেতুর সমস্ত লক্ষণ না থাকায় অহেতু অর্থাৎ প্রকৃত হেতু নয়, এবং হেতুর সামান্য বা সাদৃশ্য থাকায় হেতুর ন্যায় প্রকাশমান, এটাই ‘হেত্বাভাস’ শব্দের অর্থ।

সহজ কথায়, যে অনুমানে হেতুর আভাস মাত্র থাকে, অর্থাৎ আসলে যা আছে তা হেতু নয়, হেতুর মতো দেখায় মাত্র, সেই অনুমান ভ্রান্তিজনক এবং এই ভ্রান্তির নাম হেত্বাভাস। দোষযুক্ত হেতুকেই হেত্বাভাস বলে। ‘হেত্বাভাস’ শব্দটিতে দুটি শব্দ রয়েছে (হেতু+আভাস)। যথার্থ হেতু না হয়েও যা হেতু বলে প্রতীয়মান হয় (‘হেতুবদ্ আভাসন্তে’) তাই হেত্বাভাস বা ‘দুষ্ট হেতু’।

 .

ন্যায়মতে একটি প্রকৃত বা যথার্থ হেতুর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হলো- (১) সৎ হেতু পক্ষে থাকবে (পক্ষসত্ত্ব বা পক্ষধর্মতা), (২) সৎ হেতু সপক্ষে থাকবে (সপক্ষসত্ত্ব), (৩) সৎ হেতু বিপক্ষে থাকবে না (বিপক্ষাসত্ত্ব), (৪) অন্য কোন প্রমাণ সাধ্য ধর্মের অভাব সাধক হবে না (অবাধিতত্ত্ব), (৫) গৃহীত হেতুর তুল্য বলশালী কোন প্রতিপক্ষ হেতু থাকবে না (অসৎপ্রতিপক্ষত্ব)। কোন হেতুতে সৎ হেতুর এই পাঁচটি লক্ষণের যে কোন এশটির অভাব থাকলে ঐ হেতুকে বলা হয় অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস।

 .

সৎ হেতুর লক্ষণ পাঁচটি বলে হেতুর দোষও পাঁচ প্রকার এবং দোষযুক্ত হেতু বা হেত্বাভাসও পাঁচ প্রকার। এ প্রসঙ্গে যদিও ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-প্রকরণসম-সাধ্যসম-কালাতীতা হেত্বাভাসাঃ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৪/৪৫)

অর্থাৎ : এসব লক্ষণাক্রান্ত হেত্বাভাস পাঁচপ্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, প্রকরণসম, সাধ্যসম ও কালাতীত।

তবে এ বিষয়ে অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেন-

‘সব্যভিচার-বিরুদ্ধ-সৎপ্রতিপক্ষ-অসিদ্ধ-বাধিতাঃ পঞ্চ হেত্বাভাসাঃ’।

অর্থাৎ : অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস পাঁচ প্রকার- সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, সৎপ্রতিপক্ষ, অসিদ্ধ ও বাধিত।

 .

এ অনুযায়ী নৈয়ায়িকগণ পাঁচ রকমের হেত্বাভাস স্বীকার করে থাকেন। যথা- (ক) সব্যভিচার, (খ) বিরুদ্ধ, (গ) সৎ প্রতিপক্ষ, (ঘ) অসিদ্ধ, (ঙ) বাধিত। এই পাঁচ প্রকার হেত্বাভাসের আবার কোন কোনটির উপবিভাগ করা হয়েছে।

 .

হেত্বাভাসের প্রকারভেদে যাওয়ার আগে আমাদের আরেকটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আবশ্যক। অনুমানে এবং বিশেষভাবে হেত্বাভাসের আলোচনায় পক্ষ, সপক্ষ, বিপক্ষ- এই তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়।

 .

পক্ষ, সপক্ষ, বিপক্ষ : নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে এই তিনটির লক্ষণ ও উদাহরণ দিয়েছেন। তর্কসংগ্রহে পক্ষ-এর লক্ষণ দেয়া হয়েছে এভাবে-

‘সন্দিগ্ধ সাধ্যবান পক্ষঃ’।

অর্থাৎ : যে অধিকরণে সন্দিগ্ধ সাধ্য থাকে তাকে পক্ষ বলে।

 .

যেমন, ধূম থেকে পর্বতে বহ্নির অনুমান স্থলে পর্বত পক্ষ, ধূম হেতু এবং বহ্নি সাধ্য। ধূম থেকে পর্বতে বহ্নির এই অনুমান স্থলে ‘পর্বতে বহ্নি আছে কিনা’ এরূপ সন্দেহ থাকে। সাধ্য বিষয়ে সন্দেহ না থাকলে অনুমিতি হয় না বা ন্যায় প্রয়োগ হয় না। সাধ্যের সিদ্ধি অনুমিতির প্রতিবন্ধক। সাধ্য যদি নিশ্চিতভাবে জ্ঞাতই থাকে তাহলে অনুমিতি হয় না। অনুমিতির পূর্বে সাধ্য বিষয়ে সন্দেহ থাকলে ন্যায়বাক্যের প্রয়োগ হয়। এরূপ সন্দিগ্ধ সাধ্য যে অধিকরণে থাকে তাকে পক্ষ বলে।

তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট সপক্ষ-এর লক্ষণ দিয়েছেন এভাবে-

‘নিশ্চিত সাধ্যবান্ সপক্ষঃ’।

অর্থাৎ : যে অধিকরণে সাধ্যের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে থাকে, তাই সপক্ষ। 

 .

যেমন, যখন কোন ব্যক্তি পর্বতে ধূম দেখে বহ্নির অনুমান করে, তখন সেই অনুমানের পূর্বে ঐ ব্যক্তির মহানস বা পাকশালা, চত্বর, যজ্ঞশালা প্রভৃতি স্থানে ধূমের সাথে সাধ্য বহ্নির উপস্থিতি বিষয়ে পূর্ব প্রত্যক্ষ বা অভিজ্ঞতার কারণে (অন্বয়ব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে) নিশ্চিত জ্ঞান থাকে। তাই ‘পর্বত বহ্নিমান যেহেতু পর্বত ধূমায়মান’ এই অনুমান স্থলে পাকশালা প্রভৃতি সপক্ষ হয়।

.

আর বিপক্ষ-এর লক্ষণ দেখাতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেন-

‘নিশ্চিত সাধ্যাভাববান্ বিপক্ষঃ’।

অর্থাৎ : যে অধিকরণে সাধ্যের অভাব নিশ্চিতরূপে থাকে, তাই বিপক্ষ।

 .

যেমন, যখন কোন ব্যক্তি পর্বতে ধূম দেখে সেখানে বহ্নির অনুমান করে, তখন সেই অনুমানের পূর্বে ঐ ব্যক্তির জলহ্রদে ধূমের অভাবের সাথে সাধ্য বহ্নির অভাব বিষয়ে (ব্যতিরেকব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে) নিশ্চিত জ্ঞান থাকে। তাই উক্ত অনুমান স্থলে জলহ্রদ বিপক্ষ হয়।

 .

(ক) সব্যভিচার  বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস (Irregular middle) : 

সব্যভিচারী হেতু হলো ব্যভিচারযুক্ত হেতু। প্রকৃত হেতুর বিপক্ষাসত্ত্ব বৈশিষ্ট্যটি এই হেত্বাভাসের থাকে না। বিপক্ষাসত্ত্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সাধ্যের অভাবে হেতুর উপস্থিতি (আগুন নেই অথচ ধূম হচ্ছে ,তা) ঘটতে পারে না। কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম করে এই হেতু সমভাবে সপক্ষ সাধ্যে ও বিপক্ষ সাধ্যাভাবের সঙ্গেও উপস্থিত থাকে বলে এই হেতু ব্যভিচারযুক্ত। তাই তা সব্যভিচার হেত্বাভাস। যেহেতু, এই হেতু সাধ্যের সঙ্গে ঐকান্তিকভাবে (নিয়ত সাহচর্যে) থাকে না, সেহেতু এই হেতুকে অনৈকান্তিক হেতুও বলা হয়। তাই ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘অনৈকান্তিকঃ সব্যভিচারঃ’। (১/২/৪৬)

অর্থাৎ : হেতুরূপে গৃহীত যে পদার্থ প্রকৃত সাধ্যধর্মের সম্বন্ধে ঐকান্তিক নয়, তা সব্যভিচার হেত্বাভাস।

এবং অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-

‘সব্যভিচারঃ অনৈকান্তিকঃ’।

অর্থাৎ : যে হেতু অনৈকান্তিক অর্থাৎ ঐকান্তিক নয়, সেই হেতু সব্যভিচার হেত্বাভাস।

 .

যেমন, যদি কেউ অনুমান করে ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে স্পর্শগুণের অভাব আছে’ তাহলে ‘স্পর্শগুণ-অভাবত্ব’ হবে অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। কেননা ‘স্পর্শগুণাভাবত্ব’ হেতু যেমন আত্মায় আছে (ন্যায়মতে আত্মাকে নিত্যবস্তু স্বীকার করা হয়), আবার বিপক্ষ অনিত্য বস্তুতে যেমন জ্ঞানক্রিয়ায় আছে। অনৈকান্তিক হেতু হলো সেই হেতু যার সঙ্গে সাধ্যের নিয়ত সাহচর্য নাই। অর্থাৎ ঐ হেতুর সঙ্গে সাধ্যের ব্যাপ্তি নাই। ফলে ঐ হেতুর দ্বারা যথার্থ অনুমিতি হয় না। ঐ হেতু অনুমিতি প্রতিবন্ধক।

 .

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন- সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস তিনপ্রকার- সাধারণ, অসাধারণ, অনুপসংহারী।

 .

সাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সাধ্যাভাববৎবৃত্তিঃ সাধারণঃ অনৈকান্তিকঃ’।

অর্থাৎ : যে হেতু সাধ্যাভাবের অধিকরণে (বিপক্ষে) থাকে তাই সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।

 .

অন্যভাবে বললে, যে অনুমানে হেতুর ব্যাপকতা সাধ্যের ব্যাপকতার তুলনায় অধিক তাকে ‘সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস’ বলা হয়। যেমন, ‘পর্বত ধূমযুক্ত, যেহেতু পর্বত বহ্নিযুক্ত’- এই অনুমানে বহ্নি হেতুটি সাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। যেহেতু ‘বহ্নি’ হেতুটি পাকশালা প্রভৃতি সপক্ষে আছে, আবার জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডেও (বিপক্ষে) আছে। এখানে হেতু বহ্নির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে পক্ষ পর্বতে ধূমের অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় ‘বহ্নি’ হেতুটি পাকশালা প্রভৃতি (সপক্ষ) অধিকরণে ধূমের সাহচর্য প্রত্যক্ষ করা গেলেও জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড জাতীয় (বিপক্ষ) অধিরণে ধূমের অভাব (সাধ্যাভাব) প্রত্যক্ষ হয়েছে। অর্থাৎ জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে বহ্নি ও ধূমের নিয়ত সাহচর্য ব্যাপ্তি নেই। তাই বহ্নি থাকলেই ধূম থাকবে কথা নেই। এই অনুমানের হেতু বহ্নির বিস্তৃতি বা ব্যাপকতা সাধ্যের চেয়ে বেশি অর্থাৎ পাকশালা, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ড উভয়টিতেই বহ্নির উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু সাধ্য ধূমের উপস্থিতি কেবল পাকশালায় দেখা যায়, জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে নয়। ফলে হেতুর তুলনায় সাধ্যের ব্যাপকতা কম বলে এই অনুমানের হেতুটি সাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।

 .

একইভাবে আরেকটি উদাহরণ- ‘সমস্ত হাঁস বিজ্ঞ যেহেতু দ্বিপদ প্রাণী বিজ্ঞ’। এই অনুমানের সিদ্ধান্তে বস্তুগত সত্যতা নেই। কারণ দ্বিপদ প্রাণী বিজ্ঞ নয়। অতএব এই সিদ্ধান্ত ভ্রান্তিজনক। এখানে হেতু পদের (দ্বিপদ প্রাণীর) বিস্তৃতি সাধ্য পদের (বিজ্ঞ) বিস্তৃতি হতে বেশি। যেহেতু কেবল সপক্ষে না থেকে বিপক্ষেও থাকে, তাই হেতুটি সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস।

 .

অসাধারণ সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : অসাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাসে হেতু পদের ব্যাপকতা এতোই কম যে, হেতু কেবলমাত্র পক্ষ পদের মধ্যে একটি বিশেষ ধর্মরূপে উপস্থিত থাকে। কিন্তু সাধ্য পদে উপস্থিত থাকে না। এই অনুমানে হেতু সপক্ষ বা বিপক্ষ কোনোটিতেই থাকে না।  নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সর্বসপক্ষ-বিপক্ষ ব্যাপৃত্তঃ পক্ষমাত্রবৃত্তিঃ অসাধারণঃ’।

অর্থাৎ : যে হেতু সপক্ষ, বিপ্ক্ষ কোথাও থাকে না, কেবলমাত্র পক্ষে থাকে, তাই অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।

 .

উদাহরণস্বরূপ, ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে শব্দত্ব আছে’- এই অনুমানে শব্দ পক্ষ, নিত্য সাধ্য, শব্দত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘শব্দত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। কেননা, ‘শব্দত্ব’ হেতুটি সাধ্যের অধিকরণ যেমন, দিক্, কাল প্রভৃতি নিত্যবস্তুতে (সপক্ষে) কখনও থাকে না, আবার সাধ্যাভাবের অধিকরণ ঘট, পট প্রভৃতি কোন অনিত্যবস্তুতে (বিপক্ষে) কখনও থাকে না। ‘শব্দত্ব’ হেতুটি কেবলমাত্র থাকে শব্দে, যা আলোচ্য অনুমানে পক্ষ হয়েছে। তাই ‘শব্দত্ব’ হেতু ও ‘নিত্যত্ব’ সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি না থাকায় শব্দত্ব হেতু দ্বারা উল্লিখিত অনুমিতি হবে না। ফলে ‘শব্দত্ব’ হেতুটি অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। অসাধারণ সব্যভিচার হেতু সাধারণ সব্যভিচার হেতুর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। সাধারণ আর অসাধারণ অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের মধ্যে পার্থক্য হলো, সাধারণ অনৈকান্তিক হেতু সপক্ষে থাকে, আবার বিপক্ষেও থাকে, অন্যদিকে অসাধারণ অনৈকান্তিক হেতু সপক্ষ বা বিপক্ষ কোথাও থাকে না।

 .

অনুপসংহারী সব্যভিচার বা অনৈকান্তিক হেত্বাভাস : এই অনুমানে হেতু পদের ব্যাপকতা এতো বেশি যে,  সপক্ষ বা বিপক্ষ কোনরূপ দৃষ্টান্তের দ্বারা হেতুকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘অন্বয়ব্যতিরেক দৃষ্টান্তরহিতঃ অনুপসংহারী’।

অর্থাৎ : যে হেতুর সমর্থনসূচক অন্বয় ও ব্যতিরেক দৃষ্টান্ত নাই, সেই হেতু অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।

 .

উদাহরণস্বরূপ, ‘সবকিছু অনিত্য, যেহেতু তা জ্ঞেয়’- এই অনুমানে ‘সবকিছু’ পক্ষ, অনিত্য সাধ্য, জ্ঞেয়ত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতুটি এখানে অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘যেখানে যেখানে জ্ঞেয়ত্ব সেখানে সেখানে অনিত্যত্ব’ এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব নয় বলে ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতুটি হেত্বাভাস। কেননা আলোচ্য অনুমানে ‘সবকিছু’ (`Everything’) পক্ষ হওয়ায় সপক্ষে বা বিপক্ষে এরূপ ব্যাপ্তির সমন্বয়সূচক কোন অন্বয় (সদর্থক) বা ব্যতিরেক (নঞর্থক) দৃষ্টান্ত নাই যা ‘সবকিছু’র অন্তর্গত নয়। কোনরূপ দৃষ্টান্ত দ্বারা হেতুকে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যাপ্তি না থাকায় ‘জ্ঞেয়ত্ব’ হেতু থেকে আলোচ্য অনুমিতি হবে না। অনুপসংহারী অনৈকান্তিক হেতু ব্যাপ্তি-সংশয়-জ্ঞান দ্বারা ব্যাপ্তি জ্ঞানের প্রতিবন্ধক হয়ে অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়। এই হেতু দ্বারা পক্ষে হেতু ও সাধ্যের সম্বন্ধ বিষয়ে কোন সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত বা উপসংহার করা সম্ভব হয় না বলে এই হেতুটিকে ‘অনুপসংহারী’ বলা হয়।

 .

(খ) বিরুদ্ধ হেত্বাভাস (Contradictory middle) : 

যে হেতু পক্ষে সাধ্যকে প্রতিপাদন না করে সাধ্যের বিরুদ্ধকে প্রতিপাদন করে, তাকে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস বলে। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-  

‘সিদ্ধান্তম্ অভ্যুপেত্য তদ্বিরোধী বিরুদ্ধঃ’। (১/২/৪৭)

অর্থাৎ : সিদ্ধান্তরূপে কোন পদার্থ স্বীকার করে, তার বিরোধী পদার্থ অর্থাৎ যে পদার্থ স্বীকৃত সিদ্ধান্তের ব্যাঘাত্বক তা বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।

এবং নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বিরুদ্ধ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সাধ্যাভাবব্যাপ্তো হেতুঃ বিরুদ্ধঃ’।

অর্থাৎ : যে হেতুর সঙ্গে সাধ্যাভাবের ব্যাপ্তি আছে, সেই হেতু বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।

 .

ন্যায়মতে, অনুমান স্থলে হেতু ব্যাপ্য এবং সাধ্য ব্যাপক হলে হেতু থেকে সাধ্যের অনুমান সম্ভব হয়। কিন্তু যে হেতু সাধ্যের ব্যাপ্য না হয়ে সাধ্যের অভাবের ব্যাপ্য হয়, সেই হেতু বিরুদ্ধ হেত্বাভাস। যেমন, ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দের উৎপত্তি আছে’- এই অনুমানে শব্দ হলো পক্ষ, নিত্য সাধ্য, উৎপত্তিত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু উৎপত্তিত্ব হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। উৎপত্তিত্ব হেতু শব্দের নিত্যতাকে প্রতিপাদন না করে শব্দের অনিত্যতাকে প্রতিপাদন করে। অনিত্যতা নিত্যতার বিরুদ্ধ হওয়ায় উৎপত্তিত্ব হেতু এখানে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।

 .

যার উৎপত্তি আছে, তা অনিত্যই হয়। উৎপন্ন বস্তু নিত্য হয় না। তাই ‘যেখানে যেখানে উৎপত্তিত্ব আছে, সেখানে সেখানে নিত্যত্ব আছে’ এরূপ ব্যাপ্তি নাই। বরং ‘যেখানে যেখানে উৎপত্তিত্ব আছে, সেখানে সেখানে নিত্যতার অভাব আছে’ এরূপ ব্যাপ্তি দেখা যায়। তাই ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুর সঙ্গে ‘নিত্যত্ব’ সাধ্যের ব্যাপ্তি না থাকায় ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুর দ্বারা পক্ষ শব্দের নিত্যত্বের অনুমান হয় না বলে ‘উৎপত্তিত্ব’ হেতুটি এখানে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস। বিরুদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাপ্তি বিষয়ে যথার্থ জ্ঞানের উৎপত্তি প্রতিহত করে অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়।

সব্যভিচার ও বিরুদ্ধ হেতুর মধ্যে পার্থক্য হলো, সব্যভিচার হেত্বাভাসে সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে না, কিন্তু বিরুদ্ধ হেত্বাভাসে যে সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে হবে তার বিরুদ্ধ বচন প্রমাণ করে।

 .

(গ) সৎ প্রতিপক্ষ হেত্বাভাস (Fallacy of inferentialy contradicted middle) :

সৎ প্রতিপক্ষ অর্থ হলো যার প্রতিপক্ষ আছে। কোন একটি অনুমানের হেতু যে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, তারই বিরোধী আরেকটি হেতু অপর একটি অনুমানে সেই সাধ্যেরই অভাব প্রমাণ করে। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘যস্য সাধ্যাভাবসাধকং হেত্বন্তরং বিদ্যতে স সৎপ্রতিপক্ষঃ’।

অর্থাৎ : যে অনুমানে সাধ্যের সাধক হেতুর মত সাধ্যের অভাব সাধক অন্য হেতু বা প্রতিপক্ষ হেতু থাকে, সেই হেতু সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস।

 .

এই ‘সৎপ্রতিপক্ষ’ হেত্বাভাসকে মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্র গ্রন্থে ‘প্রকরণসম’ হেত্বাভাস বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ন্যায়সূত্রে প্রকরণসম হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘যস্মাৎ প্রকরণ চিন্তা স নির্ণয়ার্থম্ অপদিষ্ট প্রকরণসমঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৮)।

অর্থাৎ : যে পদার্থ প্রযুক্ত বাদীর সাধ্যধর্ম ও প্রতিবাদীর সাধ্যধর্ম কোন পক্ষেরই নির্ণয় না হওয়ায় বাদী ও প্রতিবাদীর প্রকরণ বিষয়ে চিন্তা বা সংশয় জন্মে, সেই পদার্থ যদি সাধ্যধর্ম নির্ণয়ের জন্য হেতুরূপে অপদিষ্ট বা প্রযুক্ত হয়, তাহলে সেই পদার্থ হবে ‘প্রকারণসম’ নামক হেত্বাভাস।

 .

অন্যান্য হেত্বাভাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি অনুমান উল্লেখ যথেষ্ট হলেও এই সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস ব্যাখ্যায় পাশাপাশি দু’টি অনুমান প্রয়োগ বা উল্লেখের প্রয়োজন হয়।

এক্ষেত্রে প্রথম অনুমানে ধরা যাক্ বাদী নিজ পক্ষ সমর্থনের জন্য বললেন- ‘শব্দ নিত্য, যেহেতু শব্দে শ্রাবণত্ব আছে, যেমন শব্দত্ব’।

দ্বিতীয় অনুমানে প্রতিবাদী তখন বললেন- ‘শব্দ অনিত্য, যেহেতু শব্দ উৎপত্তিশীল, যেমন ঘট’।

 .

বাদী ও প্রতিবাদীর নিজ নিজ পক্ষ ও তার অভাবরূপ প্রতিপক্ষই এস্থলে প্রকরণ। বাদীর শব্দের নিত্যত্ব এবং প্রতিবাদীর শব্দের অনিত্যত্ব এস্থলে প্রকরণ। এ দুটি অনুমানে দেখা যায় যে, বাদী প্রদত্ত প্রথম অনুমানের হেতু শ্রাবণত্ব প্রতিবাদী প্রদত্ত দ্বিতীয় অনুমানের হেতু উৎপত্তিশীলতার দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এস্থলে প্রতিবাদীর হেতুর প্রেক্ষিতে বাদীপ্রদত্ত হেতু সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস।

ন্যায়মতানুসারে বাদী ও প্রতিবাদীর অনুমান দুটি যথার্থ ব্যাপ্তি নির্ভর বলে দুটি অনুমানই বৈধ বলতে হয়। কিন্তু বাদীর নিত্যত্বসাধক শ্রাবণত্ব হেতু এবং প্রতিবাদীর অনিত্যত্বসাধক উৎপত্তিশীলত্ব হেতু পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক হয় বলে বাদী বা প্রতিবাদী কারও সাধ্যই সিদ্ধ হয় না।

 .

(ঘ) অসিদ্ধ হেত্বাভাস (Fallacy of unproved middle) :

অনুমিতি স্থলে হেতু সাধ্যের সিদ্ধি ঘটায়। তার জন্য পূর্বে ঐ হেতুর সিদ্ধি প্রয়োজন। যদি হেতু সাধ্যের মতোই অসিদ্ধ থাকে তাহলে হেতু সাধ্যকে সাধন করতে পারে না। এই ধরনের পূর্বাসিদ্ধ হেতুকে অসিদ্ধ হেত্বাভাস বলে। সাধ্যের মতো অসিদ্ধ বলে এই হেতুকে ‘সাধ্যসম’ হেত্বাভাসও বলা হয়। অসিদ্ধ হেত্বাভাসকে মহর্ষি গৌতম ন্যায়সূত্র গ্রন্থে ‘সাধ্যসম’ হেত্বাভাস নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি ন্যায়সূত্রে সাধ্যসম হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সাধ্য-অবিশিষ্ট সাধ্যত্বাৎসাধ্যসমঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৯)।

অর্থাৎ : যে হেতু সাধ্য পদার্থের মতোই অসিদ্ধ, সে হেতু সাধ্য পদার্থের তুল্য বলে তা সাধ্যসম হেত্বাভাস।

 .

উদাহরণস্বরূপ, ‘আকাশকুসুম সুগন্ধযুক্ত, যেহেতু তাতে কুসুমত্ব আছে’- এরূপ অনুমানে কুসুমত্ব হেতু নিজেই পক্ষ আকামকুসুমে অসিদ্ধ, কারণ আকাশকুসুম বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এই হেতুর দ্বারা সুগন্ধত্ব সাধ্য প্রতিপাদিত হয় না। তাই এই অনুমানটি অসিদ্ধ।

 .

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন, অসিদ্ধ হেত্বাভাস তিন প্রকার- (১) আশ্রয়াসিদ্ধ, (২) স্বরূপাসিদ্ধ এবং (৩) ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ।

 .

আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস : যে অনুমানের আশ্রয়টি বা পক্ষটি অসিদ্ধ, সেই অনুমানস্থলে যে হেতু প্রযুক্ত হয় তা প্রকৃত হেতু নয়, তা আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বা তর্কসংগ্রহদীপিকায় আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাসের কোন লক্ষণ দেননি, তবে দৃষ্টান্তের সাহায্যে আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-

‘গগনারবিন্দং সুরভি অরবিন্দত্বাৎ সরোজারবিন্দবৎ’।

অর্থাৎ : আকাশপদ্ম গন্ধযুক্ত, যেহেতু তা পদ্ম, যেমন জলজপদ্ম।

 .

এই অনুমানে ‘আকাশপদ্ম’ পক্ষ, গন্ধ সাধ্য, পদ্মত্ব হেতু। এখানে অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘পদ্মত্ব’ হেতুটি দোষযুক্ত। কারণ ন্যায়মতে সৎ হেতুর লক্ষণে বল হয় যে- ‘অনুমানস্থলে যা হেতু, তা অনুমানের পক্ষে থাকবে (পক্ষসত্ত্ব)’। কিন্তু আলোচ্য অনুমানের পক্ষ ‘আকাশপদ্ম’ অলীক বা অস্তিত্বহীন, ফলে ঐ পক্ষে ‘পদ্মত্ব’ হেতু থাকতে পারে না। আলোচ্য অনুমানে পক্ষ বা আশ্রয় আকাশপদ্ম অলীক বা অস্তিত্বহীন বলে আশ্রয়টি বা পক্ষটি অসিদ্ধ। তাই ‘পদ্মত্ব’ হেতুতে যে দোষ হয় তা আশ্রয়াসিদ্ধ এবং হেতুটি হয় আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস।

 .

স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস : অনুমানস্থলে যে হেতুর স্বরূপ অনুমানের পক্ষে থাকে না, সেই হেতু স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস। একটি বস্তুর স্বরূপ ঐ বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। তাই স্বরূপাসিদ্ধ হেতু হলো এমন হেতু যা পক্ষে থাকে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-

‘শব্দো গুণঃ চাক্ষুষত্বাৎ’।

অর্থাৎ : শব্দ গুণ, যেহেতু শব্দে চাক্ষুষত্ব আছে।

 .

এই অনুমানে শব্দ পক্ষ, গুণ সাধ্য, চাক্ষুষত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘চাক্ষুষত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘চাক্ষুষত্ব’ হেতুটি শব্দ পক্ষে বস্তুতই থাকে না। কেননা শব্দ শুনা যায় অর্থাৎ শব্দে শ্রাবণত্ব আছে, কিন্তু শব্দ দেখা যায় না অর্থাৎ চাক্ষুষত্ব নেই। এখানে পক্ষ শব্দ অলীক নয়, অস্তিত্বশীল। কিন্তু শব্দ রূপের মতো দেখা যায় না বলে চাক্ষুষত্ব হেতুটির সঙ্গে পক্ষ শব্দের সম্বন্ধ নাই। তাই চাক্ষুষত্ব হেতুটি পক্ষ শব্দে থাকে না। চাক্ষুষত্ব হেতুটি স্বরূপতই অসিদ্ধ বলে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়।

 .

ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস : ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেতু হলো সেই হেতু যার সাধ্যের সঙ্গে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রমাণিত হয়নি। কারণ ব্যাপ্তি সম্বন্ধ অন্য উপাধি বা শর্তের উপর নির্ভর করে। তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘সোপাধিকো হেতুঃ ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধঃ’।

অর্থাৎ : যে হেতু সোপাধিক অর্থাৎ উপাধিযুক্ত, তাই ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস।

 .

‘ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ’ এই সমাসবদ্ধ পদের অর্থ ‘যাতে ব্যাপ্যত্বের অভাব আছে’। অর্থাৎ ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হলো সেই হেতু যাতে সাধ্যের ব্যাপ্তি নাই। ফলে পরামর্শ সম্ভব হয় না। এভাবে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস অনুমিতির করণ পরামর্শের প্রতিবন্ধক হয়ে যথার্থ অনুমিতির প্রতিবন্ধক হয়। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন-

‘পর্বতো ধূমবান্ বহ্নিমত্ত্বাৎ’।

অর্থাৎ : পর্বত ধূমযুক্ত, যেহেতু তা বহ্নিযুক্ত।

 .

এ অনুমানস্থলে পর্বত পক্ষ, ধূম সাধ্য, বহ্নি হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি এখানে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস। কেননা ‘বহ্নিত্ব’ হেতুটি উপাধিযুক্ত (সোপাধিক)। এস্থলে উপাধি হলো ‘আর্দ্রেন্ধনসংযোগ’ অর্থাৎ ভেজা কাঠ জাতীয় আর্দ্র ইন্ধনযোগ্য বস্তুর উপস্থিতি। ন্যায়মতে, যা সাধ্যের ব্যাপক ও সাধন বা হেতুর অব্যাপক তাই উপাধি।

 .

সোজা কথায়, ‘যেখানে যেখানে বহ্নি সেখানে সেখানে ধূম’ এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব নয়, যেহেতু জ্বলন্ত লৌহপিণ্ডে বহ্নি থাকলেও ধূম নাই। বহ্নির সঙ্গে আর্দ্রেন্ধনের সংযোগ থাকলে ধূম থাকে, এরূপ ব্যাপ্তি সম্ভব। সুতরাং বহ্নি হেতু আর্দ্রেন্ধনসংযোগ উপাধিযুক্ত হলে সাধ্য ধূমের প্রতিপাদক হয়। তাই উপরিউক্ত অনুমানে বহ্নি হেতু সোপাধিক হওয়ায় তা ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস।

 .

(ঙ) বাধিত হেত্বাভাস (Non-inferentially contradicted middle) :

বাধিত হেত্বাভাস হলো সেই হেতু যা অন্য প্রমাণ বা যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। এই হেতু সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায় কিন্তু অন্য প্রমাণের দ্বারা সাধ্যের অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বাধিত হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘যস্য সাধ্যাভাবঃ প্রমাণাস্তরেণ নিশ্চিতঃ স বাধিতঃ’।

অর্থাৎ : যে অনুমানস্থলে পক্ষে সাধ্যের অভাব অন্য প্রমাণের দ্বারা নিশ্চিতরূপে জানা যায় সে স্থলে হেতুটি হয় বাধিত হেত্বাভাস।

 .

এক্ষেত্রে অন্নংভট্ট একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বাধিত হেত্বাভাস ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন-

‘বহ্নিঃ অনুষ্ণঃ দ্রব্যত্বাৎ’।

অর্থাৎ : বহ্নি অনুষ্ণ বা শীতল, যেহেতু বহ্নি দ্রব্য।

 .

এই অনুমানস্থলে বহ্নি পক্ষ, অনুষ্ণ সাধ্য, দ্রব্যত্ব হেতু। অনুমানটি দোষযুক্ত, যেহেতু দ্রব্যত্ব হেতুটি অসৎ হেতু বা হেত্বাভাস। এখানে দ্রব্যত্ব হেতুটি বাধিত হেত্বাভাস, কেননা এখানে হেতু ‘দ্রব্যত্ব’ বহ্নি বা অগ্নিতে অনুষ্ণতা বা শীতলতার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাইলেও স্পর্শ ইন্দ্রিয় বা স্পার্শন প্রত্যক্ষের দ্বারা বহ্নি পক্ষে অনুষ্ণ সাধ্যের অভাব অর্থাৎ উষ্ণত্বের প্রমাণ হয়ে যায়। তাই এখানে কোন হেতুর দ্বারাই বহ্নিতে অনুষ্ণত্ব প্রমাণিত হবে না।

 .

ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতম বাধিত হেত্বাভাসকে কালাতীত হেত্বাভাস বলেছেন। তিনি ন্যায়সূত্র গ্রন্থে কালাতীত হেত্বাভাসের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘কালাত্যয়-অপদিষ্টঃ কালাতীতঃ’। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৫০)।

অর্থাৎ : যে হেতু অনুমানে কালাত্যয়ে অপদিষ্ট (প্রযুক্ত) হয়, তাকে কালাতীত হেত্বাভাস বলে।

 .

এর তাৎপর্য হলো, যে কাল পর্যন্ত অনুমানের সাধ্যধর্ম বিষয়ে সংশয় থাকে, সেই কালপর্যন্ত ঐ ধর্মের অনুমানের জন্য হেতু প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু বলবৎ প্রমাণের দ্বারা সাধ্যের অভাবের নিশ্চয় জন্মালে কোন হেতুর দ্বারাই সেই সাধ্যের অনুমিতি হতে পারে না। কারণ সেই ধর্মের সংশয় ও অনুমিতি কাল অতীত হওয়ায় উক্ত ধর্মের অনুমিতির জন্য প্রযুক্ত যে কোন হেতুই ‘কালাতীত’ নামক হেত্বাভাস। একে ‘কালাত্যয়াপদিষ্ট’ হেত্বাভাসও বলে। পরবর্তী নৈয়ায়িকরা এরূপ হেতুকেই ‘বাধিত’ হেত্বাভাস বলেছেন।

 .

সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস বাধিত হেত্বাভাস থেকে পৃথক। কারণ সৎপ্রতিপক্ষের হেত্বাভাসে একটি অনুমান অপর একটি অনুমানের দ্বারা অযথার্থ বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু বাধিত হেত্বাভাসের একটি অনুমান প্রত্যক্ষের দ্বারা বা অনুমান নিরপেক্ষ জ্ঞানের দ্বারা অযথার্থ প্রমাণিত হয়।

.

‘ন্যায়মঞ্জরী’কার জয়ন্ত ভট্ট কালাতীত হেত্বাভাসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, অনুমানের ধর্মীতে প্রত্যক্ষ বা আগমের দ্বারা সাধ্যধর্মের অভাবনিশ্চয় না হওয়া পর্যন্তই সেই সাধ্যধর্মের সাধনের জন্য কোন হেতুর প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু সেই হেতুপ্রয়োগের কালাত্যয়ে অপদিষ্ট অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বা আগমের দ্বারা সাধ্যধর্মের অভাব নিশ্চয় হলে প্রযুক্ত হেতুই ‘কালাতীত’ নামক হেত্বাভাস। প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ ও আগমবিরুদ্ধ ন্যায়াভাস-স্থলীয় সমস্ত হেতুই তার উদাহরণ।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ