প্রত্যক্ষ প্রমাণ (Instrument of Perceptual Cognition) বা প্রত্যক্ষণ (Perception)
.
প্রত্যক্ষণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালী। ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্থান প্রথম ও প্রধান। কারণ প্রত্যক্ষ ভিন্ন কোন প্রমাণই ‘সিদ্ধ’ নয়। এ বিষয়ে সকল দর্শন সম্প্রদায়ই একমত যে প্রত্যক্ষই প্রধান প্রমাণ। আর প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন।
‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটি তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’-কে বোঝানো হয়। দ্বিতীয়ত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞানের করণকে (Instrumental cause) বোঝানো হয়। তৃতীয়ত, ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দ্বারা প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয় বা অর্থকে বোঝানো হয়। প্রত্যক্ষের লক্ষণ প্রসঙ্গে এই শব্দটিকে ‘প্রত্যক্ষজ্ঞান’ অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে।
.
অনুমান, উপমান এবং শব্দ পরোক্ষ প্রমাণ। এই প্রমাণত্রয় কোন না কোনভাবে প্রত্যক্ষ নির্ভর। ন্যায়মতে একটি বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন প্রমাণের সাহায্যে জানা যেতে পারে। অর্থাৎ যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় সেই বিষয়ের অনুমিতি, উপমিতি বা শাব্দবোধ হতে পারে। তবে ন্যায়মতে একই বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি প্রত্যক্ষের সম্ভাবনা থাকে তাহলে ঐ বিষয়ের প্রত্যক্ষজ্ঞানই সর্বাগ্রে উৎপন্ন হয়। আর একই বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-সামগ্রী অন্যান্য প্রমার কারণ-সামগ্রীর বাধকরূপে কাজ করে। সামগ্রী বলতে এখানে জ্ঞানের কারণ-সামগ্রীকে বোঝানো হয়েছে। সামগ্রী আবার সামান্য ও বিশেষ ভেদে দ্বিবিধ। জ্ঞানের সামান্যসামগ্রী সর্বজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিন্ন হলেও বিশেষ সামগ্রী জ্ঞানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিশেষকারণসামগ্রী তুলনামূলকভাবে প্রবলতর হওয়ায় ঐ সামগ্রী সেইক্ষণে অন্য জ্ঞানকে উৎপন্ন হতে দেয় না।
.
ভারতীয় দার্শনিকেরা প্রত্যক্ষ-এর উপর বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দার্শনিকরা প্রত্যক্ষ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাননি। কেননা, তাঁরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে বিতর্কবিহীন জ্ঞান বলে মনে করেন। দার্শনিক মিল (Mill)-এর মতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রশ্নের অতীত। বার্ট্রান্ড রাসেল (Russell)-এর মতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ।
.
৪.১ : প্রত্যক্ষের লক্ষণ
প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে সবাই একমত প্রকাশ করেন যে, বিষয় এবং ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উদ্ভব হয়।
মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-
‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপনং জ্ঞানম্ অব্যোপদেশ্য অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে যে অব্যাপদেশ্য (অশাব্দ), অব্যভিচারী (অভ্রান্ত) এবং ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ।
.
এখানে ‘অব্যপদেশ্য’ পদের দ্বারা শব্দের করণত্ব বহির্ভূত অর্থাৎ পূর্বজ্ঞাত শব্দের জ্ঞান থেকে উৎপন্ন নয়, ‘অব্যভিচারি’ পদের দ্বারা অভ্রান্ত এবং ‘ব্যবসায়াত্মক’ পদের দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অর্থ বা বিষয়ের সন্নিকর্ষ বা সংযোগের ফলে উৎপন্ন, অশাব্দ ও সুনিশ্চিত জ্ঞানই হলো প্রত্যক্ষজ্ঞান। মহর্ষির প্রত্যক্ষজ্ঞানের এই লক্ষণ যথার্থ প্রত্যক্ষজ্ঞানের লক্ষণ। বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘অব্যপদেশ্য’ ও ‘ব্যবসায়াত্মক’ শব্দ দুটিকে যথাক্রমে ‘নির্বিকল্পক’ ও ‘সবিকল্পক’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। জয়ন্ত ভট্ট, গঙ্গেশ উপাধ্যায়, বিশ্বানাথ, অন্নংভট্ট প্রভৃতি পরবর্তী নৈয়ায়িকেরা বাচস্পতির এই মত সমর্থন করেছেন।
তর্কসংগ্রহকার অন্নংভট্ট মহর্ষির প্রত্যক্ষলক্ষণ অনুসরণ করে বলেন-
‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্যম্ জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় ও অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন যে জ্ঞান তাই প্রত্যক্ষজ্ঞান।
.
মহর্ষি গোতমের ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎস্যায়ণ তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে বলেছেন-
‘অক্ষস্যাক্ষস্য প্রতিবিষয়ং বৃত্তিঃ প্রত্যক্ষং। বৃত্তিস্তু সন্নিকর্ষো জ্ঞানং বা।’ (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের স্ব স্ব বিষয়ে বৃত্তি অর্থাৎ ব্যাপার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বৃত্তি কিন্তু সন্নিকর্ষ ও জ্ঞান।
.
আবার বিশ্বনাথ তাঁর মুক্তাবলীতে প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-
‘ইন্দ্রিয়জন্যং জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’। (মুক্তাবলী)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানকে বলা হয় প্রত্যক্ষজ্ঞান।
.
বিশ্বনাথ, অন্নংভট্ট তথা অন্যান্য পরবর্তী নৈয়ায়িকগণ কেউই প্রত্যক্ষলক্ষণে ন্যায়সূত্রকারোক্ত ‘অব্যপদেশ্যম্’, ‘অব্যভিচারি’ ও ‘ব্যবসায়াত্মকম্’ এই তিনটি পদের উল্লেখ করেন নি। তবে তাঁরা যে মহর্ষির লক্ষণকেই অনুসরণ করে প্রত্যক্ষের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ নির্দেশ করেছেন সে কথা তাঁরা নিজেরাই ব্যক্ত করেছেন।
.
প্রত্যক্ষজ্ঞানে ইন্দ্রিয় ও অর্থের সন্নিকর্ষ গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দ্রিয় দু’প্রকার- বাহ্য এবং আন্তর। বাহ্য ইন্দ্রিয় পাঁচটি- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক। আর আন্তর ইন্দ্রিয় হলো মন। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ঘট, পট ইত্যাদি বাহ্য বিষয়ের এবং মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ ইত্যাদি আন্তর বিষয়ের জ্ঞান হয়। উল্লেখ্য, এই ছয়প্রকার ইন্দ্রিয় ন্যায়দর্শনে জ্ঞানেন্দ্রিয়রূপে স্বীকৃত। এছাড়াও অন্যান্য দর্শনে বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ এই পাঁচপ্রকার কর্মেন্দ্রিয় স্বীকার করা হয়। এই পাঁচটি শরীরের অবয়ববিশেষ। কিন্তু ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে কর্মেন্দ্রিয় স্বীকৃত নয়।
.
ন্যায়দর্শনে ‘ইন্দ্রিয়’ বলতে দেহের প্রত্যক্ষযোগ্য কোন অবয়বকে বোঝানো হয়নি। প্রত্যক্ষযোগ্য অবয়বের মধ্যে অপ্রত্যক্ষযোগ্য যে পদার্থ বা শক্তি বর্তমান থেকে জ্ঞানের করণ হয় তাকেই ‘ইন্দ্রিয়’ বলা হয়। যেমন চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ, কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা শ্রবণ প্রত্যক্ষণ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। ‘অর্থ’ শব্দের দ্বারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়ার মতো বিষয়কে বোঝানো হয়েছে। মনের কল্পনা বা অসৎ পদার্থকে ‘অর্থ’ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়নি। নৈয়ায়িকদের কাছে ‘অর্থ’ সবসময় কোন অস্তিত্বশীল প্রত্যক্ষযোগ্য পদার্থ। আবার প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের নির্দিষ্ট বিষয় আছে। এই কারণে যে-কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে-কোন বিষয়ের জ্ঞান হয় না। যেমন রূপ বা বর্ণ হলো চক্ষু ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়। অনুরূপভাবে শব্দ হলো শ্রবণেন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়। এছাড়া গমন প্রভৃতি ক্রিয়া এবং ঘটত্ব প্রভৃতি সামান্যকেও অর্থ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে।
.
‘সন্নিকর্ষ’ শব্দের অর্থ সম্বন্ধ। স্ব স্ব গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধই হলো সন্নিকর্ষ। ‘সংযোগ’ শব্দ দ্বারা এই সম্বন্ধকে ঠিক বোঝানো যায় না। কেননা বিভিন্ন ধরনের সন্নিকর্ষ রয়েছে, যার মধ্যে সংযোগ অন্যতম মাত্র। ন্যায়দর্শনে সন্নিকর্ষকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- লৌকিক ও অলৌকিক। লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয়প্রকার। যথা- সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায়, সংযুক্ত-সমবেত সমবায়, সমবায়, সমবেত-সমবায় এবং বিশেষণতা বা বিশেষ্যতা।
অপরপক্ষে অলৌকিক সন্নিকর্ষ তিনপ্রকার। যথা- সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ এবং যোগজ। প্রসঙ্গত, অন্নংভট্ট ‘সন্নিকর্ষ’ শব্দের দ্বারা কেবলমাত্র লৌকিক সন্নিকর্ষের উল্লেখ করেছেন।
.
ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণের বিরুদ্ধে নব্য নৈয়ায়িকরা দ্বিবিধ আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রথমত, উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ অনুমিতিতে ‘অতিব্যাপ্তি’ দোষদুষ্ট। দ্বিতীয়ত, উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে ‘অব্যাপ্তি’ দোষদুষ্ট।
.
তাঁদের মতে লক্ষ্যের অসাধারণ ধর্মকেই বলা হয় লক্ষণ। লক্ষণ লক্ষ্যে থেকেও যদি অলক্ষ্যে থাকে তাহলে লক্ষণটি অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়। নৈয়ায়িক মতে যথার্থ জ্ঞান চারপ্রকার। যথা- প্রত্যক্ষ, অনুমিতি, উপমিতি এবং শাব্দবোধ। প্রত্যক্ষের লক্ষণ যদি অনুমিতিতে চলে যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। নব্য নৈয়ায়িকরা বলেন যে, অনুমিতির ক্ষেত্রে মন হলো ইন্দ্রিয়। অনুমিতির বিষয় হলো অর্থ পদবাচ্য। অনুমিতির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সঙ্গে অলৌকিক জ্ঞানলক্ষণা সন্নিকর্ষ থাকে। এই কারণে অনুমিতিকেও ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন জ্ঞান বলা যায়। সুতরাং, প্রত্যক্ষের লক্ষণটি অনুমিতিতে অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হয়ে যাবে।
.
দ্বিতীয়ত, লক্ষণটি যদি লক্ষ্যের সর্বাংশে না থেকে একটি অংশে থাকে তাহলে লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষদুষ্ট হয়। নৈয়ায়িক মতে প্রত্যক্ষ দ্বিবিধ। যথা- জীবের প্রত্যক্ষ এবং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ। জীবের প্রত্যক্ষ হলো অনিত্য। অর্থাৎ এই প্রত্যক্ষের উৎপত্তি এবং বিনাশ আছে। কিন্তু নৈয়ায়িক মতে ঈশ্বরের কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হয় এবং সেই প্রত্যক্ষ হলো নিত্য। অর্থাৎ ঐ প্রত্যক্ষের উৎপত্তি নেই এবং বিনাশও নেই। ঈশ্বর সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন বলে আমরা জানি। কিন্তু ঈশ্বরের ইন্দ্রিয় স্বীকৃত নয়। তাই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষকে ‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্য’ বা ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন জ্ঞান বলা যায় না। সুতরাং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণ না থাকায় উক্ত প্রত্যক্ষের লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। মূলকথা, মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত প্রত্যক্ষলণে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অর্থাৎ, মহর্ষি গৌতমের প্রত্যক্ষের লক্ষণটি কেবলমাত্র জীবপ্রত্যক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
.
উক্ত অব্যাপ্তি দোষ পরিহারের জন্য নব্যনৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় প্রত্যক্ষের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘প্রত্যক্ষস্য সাক্ষাৎকারিত্বং লক্ষণম্’।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ হলো সাক্ষৎ প্রতীতি বা সাক্ষৎ জ্ঞান।
.
মানে এই জ্ঞান অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় উক্ত লক্ষণটিতে অব্যাপ্তির কোন আশঙ্কা নেই। সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ও ঈশ্বরের প্রত্যক্ষকে একই সঙ্গে লক্ষ্য করে গঙ্গেশ প্রত্যক্ষের একটি ভিন্ন লক্ষণ দিয়েছেন, যা বিশ্বনাথও ‘অথবা’ শব্দযোগে প্রত্যক্ষের এই বিকল্প লক্ষণটির উল্লেখ করেছেন-
‘জ্ঞানাকরণকম্ জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষম্’।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ হলো সেই জ্ঞান যাতে অন্য জ্ঞান করণ হয় না।
.
এই লক্ষণ অনুযায়ী যে জ্ঞানে কোন জ্ঞান করণ হয় না সেই জ্ঞানই প্রত্যক্ষজ্ঞান। অনুমিতির ক্ষেত্রে ‘ব্যাপ্তিজ্ঞান’, উপমিতির ক্ষেত্রে ‘সাদৃশ্যজ্ঞান’, শাব্দবোধের ক্ষেত্রে ‘পদজ্ঞান’ করণরূপে স্বীকৃত হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কোন জ্ঞান করণরূপে স্বীকৃত হয় না। প্রত্যক্ষের করণ হলো ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয় যেহেতু কোন জ্ঞান নয়, সেহেতু প্রত্যক্ষ হলো এমন জ্ঞান যার করণ কোন জ্ঞান নয়। তাই প্রত্যক্ষ হলো জ্ঞানাকরণক জ্ঞান।
.
উল্লেখ্য, ন্যায়সূত্রকার গৌতম এবং তর্কসংগ্রহকার অন্নংভট্ট প্রদত্ত লক্ষণের লক্ষ্য কেবলমাত্র জন্যপ্রত্যক্ষ। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ জন্যপ্রত্যক্ষ নয়। তাই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ মহর্ষি-প্রদত্ত লক্ষণের লক্ষ্যই নয়। কিন্তু গঙ্গেশ জন্যপ্রত্যক্ষ ও ঈশ্বরপ্রত্যক্ষ উভয় প্রকার প্রত্যক্ষকেই লক্ষ্য করে প্রত্যক্ষের লক্ষণ নির্দেশ করেছেন।
.
৪.২ : প্রত্যক্ষের শ্রেণীবিভাগ
ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষণকে নানাভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষণ প্রধানত দুই প্রকার- (১) লৌকিক (Ordinary) ও (২) অলৌকিক (Extraordinary)।
.
(১) লৌকিক প্রত্যক্ষণ (Ordinary Perception) :
বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষের মাধ্যমে যে প্রত্যক্ষ হয় তাকে বলা হয় লৌকিক প্রত্যক্ষণ।
লৌকিক প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার- বাহ্য (External) ও মানস (Internal)।
.
বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষকে বাহ্য প্রত্যক্ষণ বলে। বাহ্য ইন্দ্রিয় পাঁচটি- চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়, কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়, নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়, জিহ্বা বা স্বাদেন্দ্রিয়, ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয়। তাই বাহ্য প্রত্যক্ষণও পাঁচ রকমের হয়।
চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন বাইরের জগতের রূপ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ (Visual perception)।
কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন শব্দ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে শ্রবণ প্রত্যক্ষণ (Auditory perception)।
নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন গন্ধ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষণ (Olfactory perception)।
জিহ্বা বা স্বদেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন রস প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে স্বাদ প্রত্যক্ষণ (Gustony perception)।
ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যখন স্পর্শ প্রত্যক্ষ করি তাকে বলে স্পর্শন প্রত্যক্ষণ (Tectual perception)।
.
অপরপক্ষে মনের সঙ্গে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার যে সংযোগ ঘটে তাকে বলা হয় আন্তর বা মানস প্রত্যক্ষণ।
.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাঁচটি বাহ্য-ইন্দ্রিয় আবার পাঁচটি ভূত বা জড় উপাদানের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) দ্বারা গঠিত। ন্যায়মতে চক্ষু বা দর্শনেন্দ্রিয় তেজের দ্বারা গঠিত এবং তেজের ধর্ম হলো রূপ বা বর্ণ। এজন্য চক্ষু বর্ণ বা রূপ প্রত্যক্ষ করে। কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয় ব্যোম বা আকাশের দ্বারা গঠিত এবং ব্যোমের ধর্ম হলো শব্দ। তাই কর্ণ শব্দ প্রত্যক্ষ করে। নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয় ক্ষিতির দ্বারা গঠিত এবং ক্ষিতির ধর্ম হলো গন্ধ আঘ্রাণ করা। এজন্য নাসিকা গন্ধ আঘ্রাণ করে। জিহ্বা বা স্বাদেন্দ্রিয় অপের দ্বারা গঠিত এবং অপের ধর্ম হলো রস আস্বাদন করা। তাই জিহ্বা রস আস্বাদন করতে পারে। ত্বক বা স্পর্শেন্দ্রিয় মরুতের দ্বারা গঠিত এবং মরুতের ধর্ম হলো স্পর্শ। সেজন্য ত্বকের দ্বারা স্পার্শন প্রত্যক্ষ সম্ভব হয়। বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের মধ্যে এক একটি ইন্দ্রিয় একটি গুণই প্রত্যক্ষ করতে পারে। অর্থাৎ বাহ্য-ইন্দ্রিয়গুলি যে উপাদান দ্বারা গঠিত সেগুলির বিশেষ গুণ ও ধর্মকে এই ইন্দ্রিয়গুলি প্রত্যক্ষ করে।
.
কিন্তু অন্তরিন্দ্রিয় বা মন বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের মতো জড় উপাদানের দ্বারা গঠিত নয়। মন সুখ, দুঃখ, দ্বেষ, ইচ্ছা, প্রযত্ন, জ্ঞান প্রভৃতি আত্মার ধর্মগুলি প্রত্যক্ষ করে। মনের সাহায্য ছাড়া কোন বাহ্য ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। তাই মন হলো বাহ্য-ইন্দ্রিয়গুলির পরিচায়ক এবং মনে কাজ হলো সকল প্রকার জ্ঞানকে যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করা।
পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয় এবং একটি অন্তর ইন্দ্রিয়, এই ছয়টি ইন্দ্রিয়কে ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা এবং জৈন মতে একসাথে জ্ঞান-ইন্দ্রিয় বলা হয়।
.
ন্যায়দর্শনে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে লৌকিক প্রত্যক্ষণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Indeterminate Perception), সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Determinate Perception) ও প্রত্যক্ষভিজ্ঞা (Recognition)।
কিন্তু প্রত্যক্ষভিজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে বলে অনেক নৈয়ায়িক প্রত্যক্ষকে নির্বিকল্পক এবং সবিকল্পক- এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এ দুটি মূলত প্রত্যক্ষজ্ঞানের দুটি স্তরবিশেষ।
.
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Indeterminate Perception) : দর্শন পরিভাষায় বিকল্প শব্দের অর্থ হলো বিশেষণ। দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়া- এই পাঁচটি বিশেষণ ন্যায়দর্শনে ‘বিকল্প’ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ দর্শনে এই পাঁচটি বিশেষণকে একত্রে ‘পঞ্চকল্পনা’ বলা হয়। এই পঞ্চকল্পনামুক্ত জ্ঞানই হলো নির্বিকল্পক জ্ঞান। অর্থাৎ, যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হয় তাকে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘নির্বিকল্পক’ শব্দের অর্থ হলো বিশেষণ বর্জিত বস্তুর স্বরূপমাত্র জ্ঞান (বিকল্পকেভ্যঃ নির্মুক্তম্)। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো বস্তুর সহজ উপলব্ধি (Simple apprehension)। একটি ফুলের সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয় সংযোগ হয় তখন সেটাকে একটি ফুল বলেই জানি। যেমন একটি চাঁপা ফুলের যে হলুদ রঙ আছে, সুগন্ধ আছে এসব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করি না। সে জ্ঞান আসে পরের স্তরে। কেবল সহজ উপলব্ধিটুকু ছাড়া নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণে বস্তুর সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় না। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের স্বরূপ প্রকাশ করতে বলেছেন-
‘নিষ্প্রকারকম্ জ্ঞানম্ নির্বিকল্পকম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে জ্ঞানে কোন প্রকার বা বিশেষণ বিষয় হয় না, তাকে নির্বিকল্পক জ্ঞান বলে।
.
অতএব নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ, ক্রিয়া প্রভৃতি শূন্য বস্তুর স্বরূপমাত্র জ্ঞান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়াশূন্য বলতে নৈয়ায়িকরা নির্বিকল্পক জ্ঞানের দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়ার শূন্যতা না বুঝিয়ে নির্বিকল্পক জ্ঞানের বিষয়ের দ্রব্য, নাম, জাতি, গুণ ও ক্রিয়ার শূন্যতা বুঝিয়েছেন। একথা স্পষ্ট করতে তাই অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন- ‘বিশেষণ-বিশেষ্যসম্বন্ধানবগাহিজ্ঞানম্’।
যেহেতু নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় কোন ধর্মের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হয়ে জ্ঞানে ভাসমান হয় না, সেহেতু এই জ্ঞানকে ‘বিশেষণ-বিশেষ্যসম্বন্ধ-অনবগাহি জ্ঞান’ বলা হয়।
.
ন্যায়মতে নির্বিকল্পক জ্ঞানে পদার্থের ধর্ম পদার্থের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে জ্ঞানে ভাসমান হয় না। তাই নির্বিকল্পক জ্ঞানের বিষয়কে কোনভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেননা কোন বিষয়ের জ্ঞান ধর্মের দ্বারা অবচ্ছিন্ন না হলে তার জ্ঞান প্রকাশিত হয় না। ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় মহর্ষি গৌতমের উল্লেখিত ‘অব্যপদেশ’ পদটিকে বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘নির্বিকল্পক’ জ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ যে জ্ঞান পূর্বজ্ঞাত শব্দের জ্ঞান থেকে উৎপন্ন নয়। নব্য নৈয়ায়িক গঙ্গেশের মতে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো সম্পর্ক বিযুক্ত প্রত্যক্ষ। এই প্রত্যক্ষণ নাম, জাতি বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর সংযোগ থেকে মুক্ত। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র বস্তুটির সহজ উপলব্ধি বা সম্বন্ধহীন চেতনা হয়।
.
সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ (Determinate Perception) : যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কোন একটি বস্তুকে গুণযুক্ত হিসেবে প্রত্যক্ষ করা হয় তাকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। অর্থাৎ, সবিকল্পক প্রত্যক্ষে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের ন্যায় কেবলমাত্র একটি বস্তুর অস্তিত্বের জ্ঞান হয় না। এক্ষেত্রে বস্তুটির স্বরূপ বা প্রকৃতির জ্ঞান হয়। বিকল্প বা বিশেষণযুক্ত প্রত্যক্ষজ্ঞান হলো সবিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের পরিচয় দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট বলেন-
‘সপ্রকারকম্ জ্ঞানম্ সবিকল্পকম্’।
অর্থাৎ : যে জ্ঞান প্রকার বিশিষ্ট তাই সবিকল্পক।
.
সবিকল্পক প্রত্যক্ষণে আমরা বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করি। ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় মহর্ষি গৌতমের উল্লেখিত ‘ব্যবসায়াত্মক’ পদটিকে বাচস্পতি মিশ্র ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা গ্রন্থে ‘সবিকল্পক’ জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বস্তুর সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে তখন বস্তুর অস্তিত্ব, তার জাতি এবং বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে জ্ঞান হয়। একটি চাঁপা ফুলের সঙ্গে যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে, তখন আমরা বলি যে ‘এটি চাঁপা ফুল’। ফুলটির রঙ হলুদ, ফুলটি সুগন্ধযুক্ত এই জ্ঞান হচ্ছে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ। এখানে ‘এটি’ হলো বিশেষ্য এবং ‘ফুলত্ব’ হলো বিশেষণ। অর্থাৎ যে জ্ঞানে বিশেষ্য, বিশেষণ এবং বিশেষ্য-বিশেষণের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান হয়, তাই সবিকল্পক জ্ঞান।
.
তবে নৈয়ায়িকদের মতে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ হয় না। কারণ প্রথম স্তরে বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান না হলে সে বস্তুর জাতি, গুণ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয় না। সবিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয়কে ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা যায়।
.
নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষণের পার্থক্য :
প্রথমত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষের প্রাথমিক স্তর। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষের দ্বিতীয় স্তর।
দ্বিতীয়ত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ কোন বচনের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। অন্যদিকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষণকে বচনের দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
তৃতীয়ত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর হলেও স্ফূটজ্ঞান নয়। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষ ব্যবসায়াত্মক বা সুস্পষ্ট জ্ঞান।
চতুর্থত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকে অনুমানের দ্বারা জানা যায়। কিন্তু সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে অনুব্যবসায় রূপ মানস প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায়।
পঞ্চমত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ নাম, জাতি, গুণ অথবা বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ বর্জিত। অন্যদিকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষ নাম, জাতি, গুণ অথবা বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধযুক্ত।
ষষ্ঠত, নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র কোন বস্তুর অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ হয়, বস্তুটি কী তা জানা যায় না। সবিকল্পক প্রত্যক্ষে গুণ-সমন্বিত বস্তুকে জানা যায়।
.
ভারতীয় দর্শনে নৈয়ায়িকদের মতো সাংখ্য ও মীমাংসক দার্শনিকরা যথার্থ জ্ঞানের উৎস হিসেবে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক- উভয় প্রকার প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন। কিন্তু বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত মতে একমাত্র নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষই যথার্থ, সবিকল্পক প্রত্যক্ষ যথার্থ নয়। বস্তুত অদ্বৈত বেদান্তে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উভয়প্রকার প্রত্যক্ষের ভেদ স্বীকার করা হলেও, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একমাত্র নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকেই যথার্থ বলা হয়েছে। অন্যদিকে চার্বাক, জৈন এবং রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্ত মতে আমাদের সব প্রত্যক্ষই সবিকল্পক। বিশুদ্ধ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ রামানুজ স্বীকার করেন না। এই কারণে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষের পার্থক্যকে তিনি আপেক্ষিক বলেছেন।
.
প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition) : পূর্ব প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুকে পুনরায় প্রত্যক্ষ করে ‘এটি সেই’ এরূপ জ্ঞানকে প্রত্যভিজ্ঞা বলে। প্রত্যভিজ্ঞা এক প্রকার বিশেষ ধরনের সবিকল্পক প্রত্যক্ষজ্ঞান। এক্ষেত্রে বস্তুকে কেবলমাত্র জানা নয়, বস্তুকে পূর্বে থেকে জানা বস্তু বলে চিনতে পারা হলো প্রত্যভিজ্ঞা। পূর্বে জেনেছি এই জ্ঞানই হলো প্রত্যভিজ্ঞা। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ সম্ভব নয়, তেমনি সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ ছাড়া প্রত্যভিজ্ঞা সম্ভব নয়। এইরূপ জ্ঞানে স্মৃতি সহায়ক হলেও উৎপন্ন জ্ঞানটি স্মৃত্যাত্মক নয়, প্রত্যক্ষাত্মক। কারণ স্মৃতির ক্ষেত্রে বস্তু ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে উপস্থিত থাকে না। কিন্তু প্রত্যভিজ্ঞার ক্ষেত্রে বস্তু ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে উপস্থিত থাকে।
তবে নব্য মহানৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় নানা যুক্তির সাহায্যে প্রত্যভিজ্ঞা যে সবিকল্পক প্রত্যক্ষেরই অন্তর্গত, প্রত্যক্ষের তৃতীয় প্রকার নয়, তা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
.
(২) অলৌকিক প্রত্যক্ষণ (Extraordinary Perception) :
কিছু প্রত্যক্ষণে বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক সংযোগ বা লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় না, কিন্তু অসাধারণ উপায়ে প্রত্যক্ষণ হয়, তাকেই অলৌকিক প্রত্যক্ষণ বলা হয়। ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষের অতিরিক্ত সন্নিকর্ষকেই নৈয়ায়িকগণ অলৌকিক সন্নিকর্ষ বলেন (ন লৌকিকঃ অলৌকিকঃ)। অর্থাৎ অলৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন প্রত্যক্ষকে অলৌকিক প্রত্যক্ষ বলা হয়। অলৌকিক সন্নিকর্ষ তিনপ্রকার, যথা- সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষ, জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ এবং যোগজ সন্নিকর্ষ। অনুরূপভাবে অলৌকিক প্রত্যক্ষণও তিনপ্রকার- সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Perception of a Class), জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception) এবং যোগজ প্রত্যক্ষণ (Yogaja Perception)।
.
সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Perception of a Class) : ন্যায়মতে, কোন একটি ধূমের সঙ্গে চক্ষুর সংযোগ হলে ঐ ধূমের যেমন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়, তেমনি অন্য দেশ ও অন্য কালে স্থিত সব ধূমেরও চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু ঐ দেশান্তরীয়, কালন্তরীয় ধূমসমূহ এ স্থলে অনুপস্থিত বলে তাদের সঙ্গে চক্ষুর লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় না। তবুও চক্ষু সংযুক্ত ধূমের মতো অনুপস্থিত ধূমাদিরও প্রত্যক্ষ হয়। চক্ষুঃসংযোগ রূপ লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা চক্ষুর নিকটস্থ ধূমের প্রত্যক্ষের সময়ে অনুপস্থিত অন্যান্য ধূমেরও যে প্রত্যক্ষ হয়, তা হয় অলৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা।
.
সামান্য (Class) যে প্রত্যক্ষের লক্ষণ অথবা বিষয়, তাই সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ। এক্ষেত্রে লক্ষণ অর্থ স্বরূপ। ন্যায়মতে একটি বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষ হলে ঐ বস্তুতে আশ্রিত সমান্যধর্মেরও প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু ঐ সামান্যের আশ্রয়ের একটিমাত্র বস্তুর সঙ্গেই কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ সম্ভব হলেও ইন্দ্রিয় অ-সন্নিকৃষ্ট সকল বস্তুর প্রত্যক্ষ হয় সামান্যলক্ষণ সন্নিকর্ষের দ্বারা। অর্থাৎ কোনো একটি বস্তু বা ব্যক্তিকে দেখে তার সমগ্র জাতিকে প্রত্যক্ষ করাই সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষণ। যে ধর্ম বা গুণ একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত সব বস্তু বা ব্যক্তির প্রত্যেকের মধ্যে বিদ্যমান থাকে এবং এই বিশেষ গুণ বা ধর্মের উপস্থিতির জন্য জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করা সম্ভব হয় তাকেই সামান্য ধর্ম বলে। মনুষ্যত্ব মানব জাতির সামান্য ধর্ম। মনুষ্যত্ব মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বর্তমান। এই গুণ বা ধর্মটির জন্যই মানব জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করা হয়। মনুষ্যত্বের মাধ্যমে সকল মানুষকে প্রত্যক্ষ করাই হলো সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ।
.
ন্যায়মতে কোন একটি বস্তুর প্রত্যক্ষকালে বস্তুটির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যেমন একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয় তেমনি ঐ বস্তুর সামান্যধর্মের মাধ্যমে ঐ জাতীয় সকল বস্তুর সঙ্গে একটি অলৌকিক সন্নিকর্ষ হতে পারে। আমরা যখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ করি তখন ঐ ব্যক্তিটির সঙ্গে আমাদের চক্ষুরিন্দ্রিয়ের যেমন একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয়, তেমনি ঐ ব্যক্তিটির সামান্যধর্ম মনুষ্যত্বের সঙ্গেও আমাদের চক্ষুরিন্দ্রিয়ের একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয়। দ্রব্যের সামান্যধর্মের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সন্নিকর্ষকে নৈয়ায়িকরা সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ বলেন। এই সামান্যধর্ম প্রত্যক্ষের মাধ্যমে মনুষ্যত্ববিশিষ্ট সকল মানুষের সঙ্গে আমাদের একটি অলৌকিক সন্নিকর্ষ হয়। এই সন্নিকর্ষের ফলে সকল মানুষের সামান্যতঃ একটি অলৌকিক প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয়। তাই পরবর্তীকালে কোন মানুষ দেখলে আমাদের কখনও এরূপ সন্দেহ হয় না যে সন্নিকষ্ট জীব কি মানুষ ? সকল মানুষের সঙ্গে যেহেতু ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সম্বন্ধ হতে পারে না সেহেতু এই সন্নিকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন প্রত্যক্ষজ্ঞান সাধারণ বা লৌকিক হতে পারে না। এই প্রত্যক্ষ হলো অলৌকিক প্রত্যক্ষ। সামান্যধর্মের দ্বারা যেহেতু এইরূপ অলৌকিক প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় সেহেতু এই অলৌকিক প্রত্যক্ষের নাম সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ।
.
অতএব সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ অলৌকিক প্রত্যক্ষণ, কারণ এখানে বিষয়কে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা হয় না। যে রকম মনুষ্যত্ব এই ধর্মটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সকল লোকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হচ্ছে না। নৈয়ায়িকগণ সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের সাহায্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান, তমঃ, প্রাগভাব প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন বলে ন্যায়মতে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষকে স্বীকার করা হয়েছে। তবে নব্য-নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি অবশ্য স্বকীয় যুক্তিতে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করেছেন।
.
জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception) : সামান্যধর্মের দ্বারা যেমন একজাতীয় সকল বস্তুর একটি অলৌকিক প্রত্যক্ষ হয় তেমনি অনেক সময় পূর্বলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা আমাদের একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ হয়। যেহেতু বিষয়ের জ্ঞান এইরূপ প্রত্যক্ষের কারণ তাই এ ধরনের প্রত্যক্ষের নাম জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। জ্ঞানস্বরূপ সন্নিকর্ষই জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। এই জ্ঞান হলো স্মরণাত্মক জ্ঞান।
.
অন্যভাবে বললে, কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অন্য ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণ প্রত্যক্ষ করা হয় তখন তাকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন চক্ষু দ্বারা এক খণ্ড বরফ প্রত্যক্ষ করে বলা হলো যে বরফ ঠাণ্ডা। এক্ষেত্রে চক্ষু দ্বারা বরফের শীতলতা প্রত্যক্ষ করাই হলো জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ। জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষকে অলৌকিক প্রত্যক্ষ বলা হয় কারণ এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানটি এমন একটা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পাওয়া যায় যে ইন্দ্রিয়টি সাধারণত সেই জ্ঞান দিতে পারে না। যেমন চক্ষু কখনও বরফের শীতলতার জ্ঞান দিতে পারে না। বস্তুত জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ আমাদের পূর্বজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। পূর্বে আমরা যখন ত্বক বা স্পর্শ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জেনেছি যে বরফ ঠাণ্ডা, তার সঙ্গে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষও যুক্ত ছিলো। এর ফলে অতীতে বরফের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের সঙ্গে স্পর্শজাত প্রত্যক্ষের এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বর্তমানে বরফের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ তার স্পর্শন প্রত্যক্ষের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার ফলেই বরফের দিকে তাকিয়ে আমাদের বরফ ঠাণ্ডা বা শীতলতার জ্ঞান লাভ হয়।
.
উল্লেখ্য, ন্যায়মতে জ্ঞানমাত্রই জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে যে কোন ব্যক্তির যে কোন জ্ঞানের দ্বারা যে কোন বিষয়ের অলৌকিক প্রত্যক্ষের আপত্তি হবে। তাই নৈয়ায়িকেরা বলেন, ‘যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে বিষয়ের জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষ জন্য প্রত্যক্ষ হবে, সেই ইন্দ্রিয় সংযুক্ত মনঃসংযুক্ত আত্মাতে সমবেত সেই বিষয়ের জ্ঞানই সেই বিষয়ের প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ।’
.
ন্যায়দর্শনে একাধিক প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষকে স্বীকার করা হয়েছে। যেমন, ন্যায়মতে ভ্রমজ্ঞানকে ব্যাখ্যাই করা যায় না যদি জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষকে স্বীকার না করা হয়। যেমন, রজ্জুতে যখন সর্প ভ্রম হয় কিংবা শুক্তিতে রজত ভ্রম হয়, সেখানে নৈয়ায়িক মতানুসারে আমরা অন্য দেশস্থিত সর্পের এবং অন্য দেশস্থিত রজতের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করি। এটাই ন্যায়দর্শনে অন্যথাখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। এভাবে নৈয়ায়িকগণ জ্ঞানলক্ষণসন্নিকর্ষের দ্বারা প্রত্যভিজ্ঞা, অনুব্যবসায় বা মানসপ্রত্যক্ষণ, অভাব প্রভৃতির প্রত্যক্ষ প্রতিপাদন করেন।
.
যোগজ প্রত্যক্ষণ (Yogaja Perception) : নৈয়ায়িকরা যোগীদের একপ্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন। যোগ শব্দের অর্থ শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতিতে প্রতিপাদ্য যোগাভ্যাসজনিত ধর্মবিশেষ। যোগীরা স্বজ্ঞার (intuition) মাধ্যমে ভূত, ভবিষ্যৎ, প্রচ্ছন্ন ও অতি সূক্ষ্ম বিষয়ের যে প্রত্যক্ষ করে থাকেন তাকেই বলা হয় যোগজ প্রত্যক্ষণ। এই যোগজ প্রত্যক্ষণ অলৌকিক, যেহেতু এই জাতীয় প্রত্যক্ষে বিষয়ের সঙ্গে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোন লৌকিক সংযোগ থাকে না। এ ধরনের প্রত্যক্ষণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যোগজ প্রত্যক্ষণ দুই প্রকার। যথা- যুক্ত বা সিদ্ধযোগীর প্রত্যক্ষ এবং যুঞ্জান বা বিযুক্তযোগীর প্রত্যক্ষ। যুক্তযোগী সিদ্ধপুরুষ, তাই তাঁদের প্রত্যক্ষ নিত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত। যুঞ্জানযোগী পূর্ণসিদ্ধিপ্রাপ্ত নন, তাই তাঁদের প্রত্যক্ষ অনিত্য ও সাময়িক।
.
সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন যোগজ প্রত্যক্ষে বিশ্বাসী যেহেতু যোগজ প্রত্যক্ষ শ্রুতি প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মীমাংসা দর্শন ও মহানৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি যোগজ প্রত্যক্ষ স্বীকার করেননি।
.
৪.৩ : সন্নিকর্ষ
ন্যায়মতে, ইন্দ্রিয় ও অর্থ বা বিষয়ের সন্নিকর্ষ হতে উৎপন্ন জ্ঞানই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দের দ্বারা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন- এই ছ’টি ইন্দ্রিয়কে বোঝায়। ‘অর্থ’ শব্দ সৎ বা বাস্তব পদার্থকে (real entities) বোঝায়। ‘সন্নিকর্ষ’ শব্দ ইন্দ্রিয় ও অর্থের একপ্রকার বিশেষ সম্বন্ধকে বোঝায়। তাই অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের হেতু বলেছেন। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের এই সন্নিকর্ষ নানাবিধ। প্রথমত, তিন প্রকার অলৌকিক প্রত্যক্ষের জন্য ন্যায়মতে তিনপ্রকার অলৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়েছে। যথা- সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ। আবার লৌকিক প্রত্যক্ষ যেহেতু ছয়ভাবে হতে পারে তাই লৌকিক সন্নিকর্ষ ছয় প্রকার। ন্যায়মতে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় ছ’প্রকার বলে লৌকিক সন্নিকর্ষ ছ’প্রকার বলা হয়নি। লৌকিক প্রত্যক্ষের বিষয় ছ’প্রকার বলে লৌকিক সন্নিকর্ষকে ছ’প্রকার বলা হয়েছে। এটি ষড়বিধ সন্নিকর্ষবাদ নামে প্রাচীন ন্যায় সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ মত। প্রাচীন নৈয়ায়িক উদ্যোতকর এ মতের সমর্থক। ন্যায়মতে, আমাদের ভাব পদার্থ ও অভাব পদার্থের লৌকিক প্রত্যক্ষ হতে পারে। এই লৌকিক প্রত্যক্ষ সম্ভব হয় লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা।
.
নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে ছ’টি লৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করেছেন- (১) সংযোগ, (২) সংযুক্ত সমবায়, (৩) সংযুক্তসমবেত সমবায়, (৪) সমবায়, (৫) সমবেত সমবায়, (৬) বিশেষণ-বিশেষ্যভাব। অন্নংভট্ট প্রত্যক্ষ জ্ঞানের কারণ ছ’প্রকার সন্নিকর্ষের উল্লেখ প্রসঙ্গে ‘সন্নিকর্ষ’ বলতে মূলত লৌকিক সন্নিকর্ষকেই বুঝিয়েছেন।
(ক) দ্রব্য, (খ) কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দ্রব্যে স্থিত গুণ, কর্ম ও সামান্য বা জাতি, (গ) কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ ও কর্মে স্থিত জাতি, (ঘ) আকাশ নামক অতীন্দ্রিয় দ্রব্যের শব্দ নামক গুণ, (ঙ) শব্দ নামক গুণে স্থিত শব্দত্ব জাতি এবং (চ) অভাব পদার্থ-এর প্রত্যক্ষ উল্লিখিত ছ’টি লৌকিক সন্নিকর্ষের দ্বারা হয়ে থাকে। এই ছয় প্রকার লৌকিক সন্নিকর্ষ নিম্নরূপ।
.
(১) সংযোগ : দ্রব্যের প্রত্যক্ষ হয় সংযোগ সন্নিকর্ষের দ্বারা। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ের প্রত্যক্ষস্থলে যদি ইন্দ্রিয় এবং বিষয় উভয়ই দ্রব্য হয় তাহলে সেক্ষেত্রে সন্নিকর্ষটি হয় সংযোগ। কারণ ন্যায়মতে সংযোগ একটি গুণ পদার্থ এবং দুটি দ্রব্যের মধ্যে সম্বন্ধ হলো সংযোগ। যেমন- চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যখন ঘটের সম্বন্ধ হয়, তখন চক্ষু ইন্দ্রিয়ও দ্রব্য এবং ঘটও দ্রব্য হওয়ায় এক্ষেত্রে সন্নিকর্ষটি হলো সংযোগ-সন্নিকর্ষ।
.
(২) সংযুক্ত-সমবায় : ন্যায়মতে কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দ্রব্যের গুণ, কর্ম ও সামান্য বা জাতির প্রত্যক্ষ হয় সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষের দ্বারা। দ্রব্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হলেও দ্রব্যোস্থিত গুণ, ক্রিয়া বা জাতির প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হয় না। চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ঘটরূপের (colour of the jar) প্রত্যক্ষ সংযোগ-সন্নিকর্ষের দ্বারা হতে পারে না। চক্ষু ইন্দ্রিয় দ্রব্য, ঘটের রূপ একটি গুণ। এ দুটির মধ্যে সংযোগ-সন্নিকর্ষ হতে পারে না। গুণ সর্বদা দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধেই থাকে। ন্যায়মতে, চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ঘটরূপের প্রত্যক্ষে সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষ হয়। এক্ষেত্রে চক্ষুর সঙ্গে সংযুক্ত ঘটে রূপ সমবেত হয়। এটি পরম্পরা সম্বন্ধ (indirect relation)। আমরা যখন ঘটের রূপকে প্রত্যক্ষ করি, এক্ষেত্রে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ঘট সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত অর্থাৎ সংযুক্ত হয় এবং ঘটের সঙ্গে তার রূপের সম্বন্ধ হলো সমবায়। সুতরাং চক্ষুর সঙ্গে ঘটের রূপ-এর সম্বন্ধ হলো সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত সমবায় অর্থাৎ সংযুক্ত-সমবায়। অনুরূপভাবে ঘ্রাণ ও রসনার দ্বারা গন্ধ ও রসের প্রত্যক্ষেও সংযুক্ত-সমবায় সন্নিকর্ষই হয়।
.
(৩) সংযুক্তসমবেত সমবায় : ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ বা কর্মে অবস্থিত সামান্য বা জাতির প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য নৈয়ায়িকরা সংযুক্তসমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করেছেন। এই সন্নিকর্ষ তিনটি সম্বন্ধের উপর নির্ভরশীল- (০১) ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে দ্রব্যের সংযোগ, (০২) দ্রব্যের সঙ্গে গুণাদির সমবায় এবং (০৩) দ্রব্যে সমবেত গুণাদির সঙ্গে গুণাদিগত সামান্য বা জাতির সমবায়। যেমন- আমরা যখন একটা লাল গোলাপের দিকে তাকাই তখন আমরা যেমন গোলাপ দেখি, গোলাপের লাল রঙ দেখি, তেমনি লাল রঙের মধ্যে থাকে যে রক্তত্ব জাতি তাকেও প্রত্যক্ষ করি। চক্ষুর সঙ্গে গোলাপের রক্তবর্ণের সম্বন্ধ হলো সংযুক্ত-সমবায়। আবার রক্তবর্ণে রক্তত্ব জাতি সমবায় সম্বন্ধে থাকায় রক্তবর্ণে রক্তত্ব জাতি সমবেত বলা যায়। সুতরাং, চক্ষুর দ্বারা লাল গোলাপের রক্তত্ব জাতির প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ হলো সংযুক্ত-সমবেত সমবায়।
.
(৪) সমবায় : ন্যায়মতে আকাশ নামক অতীন্দ্রিয় দ্রব্যের শব্দ নামক গুণের প্রত্যক্ষকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করা হয়। শব্দের প্রত্যক্ষ হয় শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা। ন্যায়মতে কর্ণবিবরবর্তী আকাশকেই শ্রবণেন্দ্রিয় বলা হয়। আকাশ দ্রব্য এবং শব্দ হলো আকাশের গুণ। ন্যায়মতে দ্রব্য এবং গুণের সম্বন্ধ হলো সমবায়। সুতরাং, শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা শব্দের প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষ হলো সমবায় সন্নিকর্ষ।
.
প্রশ্ন হলো, কর্ণবিবরবর্তী আকাশ যদি শ্রবণেন্দ্রিয় হয় তাহলে ঐ শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা দূরে স্থিত শব্দের প্রত্যক্ষ হবে কিভাবে ? কারণ যেহেতু শব্দ গুণ পদার্থ সেহেতু শব্দ নিষ্ক্রিয়। যেহেতু শব্দ নিষ্ক্রিয় সেহেতু দূরে স্থিত শব্দের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হতে পারে না।
উক্ত পূর্বপক্ষের সমাধান প্রসঙ্গে নৈয়ায়িকরা বলেন যে দূরস্থিত শব্দের থেকে অন্য শব্দের উৎপত্তি হয়, তার থেকে আবার অন্য শব্দের উৎপত্তি হয়। এইভাবে শ্রবণেন্দ্রিয়-রূপ আকাশে উৎপন্ন শেষ শব্দের সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হওয়ার ফলে আমরা শব্দ প্রত্যক্ষ করি। এই যুক্তিটি বীচিতরঙ্গন্যায় নামে পরিচিত। কোন শান্ত জলাশয়ে যদি পাথর নিক্ষেপ করা হয় তাহলে সেখানে একটি তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এইরূপে তরঙ্গ পরম্পরার সৃষ্টি হওয়ার ফলে শেষ তরঙ্গটি এসে তটদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। অনুরূপভাবে শব্দ পরম্পরার শেষ শব্দটি শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ে উৎপন্ন হয়ে সমবায় সম্বন্ধে থাকে। সুতরাং, এই মতে বক্তার মুখে উৎপন্ন প্রথম শব্দটির সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ অর্থাৎ সন্নিকর্ষ হয় না।
.
পুনরায় প্রশ্ন হতে পারে যে, এক বক্তার মুখনিঃসৃত শব্দ একই সময়ে অনেক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেন কিভাবে ?
ন্যায়দর্শনে কদম্বমুকুলন্যায় অনুসরণ করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। যেমন কদম্ব ফুল বিকশিত হওয়ার সময় তার চারদিকে পাপড়ি উৎপন্ন হয়, সেরকমভাবে প্রথম শব্দ উৎপন্ন হওয়ার পরে তার সাহায্যে তার চারিদিকে অনেক শব্দ উৎপন্ন হয়। আবার এই শব্দগুলি প্রবাহক্রমে সকল শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৃথক পৃথক শব্দ উৎপন্ন করার ফলে ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ প্রত্যক্ষ করে থাকে।
.
(৫) সমবেত সমবায় : ন্যায়মতে শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা কেবল শব্দ (গুণ) প্রত্যক্ষ করি না, বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ শব্দের অনুগত ধর্ম শব্দত্ব জাতিও প্রত্যক্ষ করি। শব্দত্ব শব্দে সমবায় সম্বন্ধে থাকে এবং শব্দের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ সমবায় হওয়ায় শব্দত্বের সঙ্গে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হলো সমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ।
.
(৬) বিশেষণ-বিশেষ্যভাব : ন্যায়মতে ভাবপদার্থের মতো অভাবেরও প্রত্যক্ষ হয়। ন্যায়মতে অভাব একটি স্বতন্ত্র (অধিকরণ থেকে ভিন্ন) পদার্থ এবং অভাবের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই হয়। অভাবের গ্রাহক প্রমাণ হলো অনুপলব্ধি। অভাবের লক্ষণ বা সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘অথোপলম্ভ যোগ্যত্বে সত্যপ্যনুপলম্ভনম্ । অভাবাখ্যং প্রমাণম্ স্যাদভাবস্যাবোধকম্’। (মানমেয়োদয়)।
অর্থাৎ : যদি কোন বস্তু প্রত্যক্ষ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তার প্রত্যক্ষ না হয়, তাহলে সেই অপ্রত্যক্ষের দ্বারা বস্তুটির অভাবের জ্ঞান হয়। এরূপ অভাবের অববোধক প্রমাণ হলো অনুপলব্ধি বা অভাব।
.
অভাব প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যে সন্নিকর্ষ হয়, তাকে বলা হয় বিশেষণ-বিশেষ্যভাব। ভাব অর্থ সম্বন্ধ। অভাবকে কখনও বিশেষ্যরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়, আবার কখনও বিশেষণরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। অভাবকে যখন বিশেষ্যরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্ত-বিশেষ্যতা এবং অভাবকে যখন বিশেষণরূপে প্রত্যক্ষ করা হয় তখন সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্ত-বিশেষণতা।
.
ন্যায়মতে, সাধারণত অভাব যে অধিকরণে থাকে তার বিশেষণ হয়। ‘ভূতলটি ঘটাভাববিশিষ্ট’ এরূপ প্রত্যক্ষস্থলে ভূতল (অধিকরণ) হলো বিশেষ্য এবং ঘটাভাব হলো ভূতলের বিশেষণ। এক্ষেত্রে প্রথমে চক্ষুর সঙ্গে ভূতলের সংযোগ সন্নিকর্ষ হয়। ভূতলের বিশেষণ হলো ঘটাভাব। সুতরাং চক্ষুর সঙ্গে ঘটাভাবের সম্বন্ধ হলো সংযুক্ত-বিশেষণতা। এভাবে বিশেষণ-বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষের দ্বারা ভূতলে ঘটাভাবের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। বিশেষণ-বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষকে সংক্ষেপে ‘বিশেষণতা’ সন্নিকর্ষও বলা হয়।
কিন্তু ‘ভূতলে ঘটাভাব’ এরূপ প্রত্যক্ষস্থলে ঘটাভাব হলো বিশেষ্য আর ভূতল হলো বিশেষণ। চক্ষুর সঙ্গে ভূতলের সম্বন্ধ হলো সংযোগ। চক্ষুর সঙ্গে সংযোগ সম্বন্ধযুক্ত ভূতলে ঘটাভাব বিশেষ্যরূপ জ্ঞাত হয়। এজন্যে এই সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় সংযুক্তবিশেষ্যতা।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ