১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী বিকাল ৫.১৫মি. পরপর তিনটি গুলিতে বিদ্ধ হয়ে দিল্লীর বিড়লা ভবনের প্রাঙ্গণে যিনি লুটিয়ে পড়লেন, দুনিয়ার মানুষ তাকে জানত মহাত্মা গান্ধী নামে। সুদীর্ঘ ২৮ হাজার ৫ শত ৮৮ দিন (৭৮ বৎসর ৩ মাস ২৮ দিন) তিনি এই পৃথিবীর আলো ও বাতাসে প্রাণিত ছিলেন। নাম ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
গান্ধীরা বেনিয়া জাতিভুক্ত এবং মূলত ভুষিমাল দোকানদার। কিন্তু গান্ধীজীর ঠাকুর্দার পূর্ববর্তী তিন পুরুষ কাথিয়াবাড়ের বিভিন্ন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন। উত্তমচাঁদ গান্ধী ওরফে উটা গান্ধী ছিলেন মোহনদাসের পিতামহ। সম্ভবতঃ তিনি খুব নীতিপরায়ণ ছিলেন এবং সেই কারণে পোরবন্দরের দেওয়ান-এর পদ ছেড়ে তিনি চলে যান জুনাগড় নবাবের কাছে।
উত্তম চাঁদের দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে চার পুত্র সন্তান, দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে দুই পুত্র সন্তান। এই ছয় পুত্র সন্তানের পঞ্চম পুত্র সন্তানের নাম করমচাঁদ বা কাবা গান্ধী এবং ষষ্ঠ সন্তানের নাম তুলসী দাস গান্ধী। করমচাঁদ বা কাবা গান্ধী এবং তুলসীদাস দু’জনেই একের পর এক পোরবন্দরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। করমচাঁদ ছিলেন রাজস্থানিক কোর্ট-এর সদস্য। এখন আর ঐ সব সংস্থা নাই। তবে এগুলি প্রচন্ড প্রভাবশালী সংস্থা ছিল। গোষ্ঠী প্রধানদের সমস্যাগুলির মীমাংসা এই রাজস্থানিক কোর্ট করত। কাবা গান্ধী কিছুদিনের জন্য রাজকোটের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার পর ভাংকালের। তিনি রাজস্থান রাজ্যের পেনসনভোগী ছিলেন যখন মারা যান। কাবা গাদী চারটি বিয়ে করেন। প্রতিবারেই স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বিবাহ করেছেন। দ্বিতীয়া স্ত্রীর দুজন কন্যা সন্তান ছিল। তার সর্বশেষ এবং চতুর্থ পত্নী। পুতলীবাঈর এক কন্যা ও চার পুত্র ছিল। মোহনদাস ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। (গান্ধী তার পরিবারের কারোর বিষয়েই কিছু লিখেন নি। এমনকি যে দাদা বিলেত যাওয়া ও সংসার নির্বাহে সব থেকে বেশী সাহায্য করেছিলেন, নিজের বইতে তার নামও উল্লেখ করেন নি। মোহনদাস লিখেছেন যে, তার বাবা হয়ত একটি কামুক ছিলেন কারণ ৪০ বছর বয়সে তিনি চতুর্থ বিবাহ করেন।) গান্ধীজীর সৌভাগ্য যে তার বাবা তথাকথিত কামুক ছিলেন এবং ৪০ বছর বয়সে চতুর্থ বিবাহ করেছিলেন। অন্যথায় ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর মোহনদাস নামিত ব্যক্তিটির আবির্ভাব হত না। আমরা পেলাম যে গান্ধীর মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধের বড়ই অভাব ছিল। ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলতন। বিলাতে ব্যারিস্টারী পড়তে যাওয়ার জন্য তাঁর এক দাদা লক্ষ্মী দাস ১৩ হাজার টাকা দেন সে যুগে। আর খুড়তুতো ভাই ৫ হাজার টাকা ঋণ দেন। কোনও উল্লেখ নাই। তবুও তিনি নিজেকে খুব ধার্মিক বলতেন। ধার্মিক লোকেরা অকৃতজ্ঞ হয়- একথা ঠিক নয়। কেবলমাত্র অত্মপর স্বার্থন্বেষীরাই কারুর ঋণ স্বীকার করেন না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।) তবে পিতার প্রশংসায় গান্ধী লিখেছেন যে, তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। জাতভাইদের খুব ভালোবাসতেন, তাঁকেও সকলে ভালোবাসত। আর তিনি যে রাজ্যে রাজকর্মচারী সেই রাজ্যের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসাবে পরিবারে ও সমাজে করমচাঁদের সুনাম ছিল। তাঁর বাবা অর্থলিপ্স ছিলেন না। ফলে সন্তানদের জন্য তেমন কিছু সম্পত্তি রেখে যান নি। তাঁর বাবার পড়াশোনা তেমন কিছু ছিল না। (5th Gujrat Standard) বোধহয় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। ইতিহাস, ভুগোল কিছুই জানতেন না। ধর্মটর্ম সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না, তবে নিয়মিত মন্দিরে যেতেন ও ধর্মীয় কথকতা শুনতেন। এক ব্রাহ্মণ বন্ধুর পরামর্শে তিনি শেষ জীবনে গীতা পাঠ শুরু করেন। কিন্তু মোহনদাসের মা অতিশয় ধর্মপরায়ণা ছিলেন। ব্রত, উপবাস, চাতুমাস্য কিছুই বাদ দিতেন না। তার মায়ের সাধারণ জ্ঞান ছিল প্রখর। রাজ্যের সব খবরই তিনি রাখতেন।
গান্ধীর যখন ৭ বছর বয়স তখন (১৮৭৬) করমচাঁদ পোরবন্দর ছেড়ে রাজকোটে চলে আসেন। রাজস্থানিক কোর্ট-এর সদস্য হলেন। মোহনদাস সেখানে "একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে সুবারবান স্কুল তারপর হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন বয়স হয়ে গেছে ১২। তখন পর্যন্ত তিনি কখনও বাড়ীতে বা স্কুলে মিথ্যা কথা বলেন নি। ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে ঢুকতেন। স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বাড়ী চলে আসতেন। কারুর সাথে কোন বাক্যালাপ ছিল না। এই সময়ই সেই Kettle বানান নিয়ে গল্পটি তৈরি হয়। তিনি শিক্ষক মহাশয়ের ইংগিত সত্ত্বেও ইন্সপেকটারের কাছে ভাল হওয়ার লোভে কারুর খাতা দেখে ঠিক বানান লেখেন নি। তিনি কখনও নকল করার কৌশল শেখেন নি। (লক্ষ লক্ষ ছাত্র গান্ধীর সময় ছিলেন এখনও আছেন যারা নকল করেন নি কিন্তু তারা কেউ গান্ধী হয়নি। তবে গান্ধী হওয়ার জন্য যে কূটকৌশল প্রয়োজন হয়, লক্ষ লক্ষ নকল না করা ছাত্রদের তা ছিল না একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।)
গান্ধী স্কুলের পাঠ্য ব্যতীত আর কিছুই পড়তেন না। খেলাধুলা যা ছাত্র সুলভ, তাও করতেন না। বাইরের বই বলতে তার বাবার কেনা শ্রবণের পিতৃভক্তি নাটক বইটি তিনি পড়েছেন। আর এই সময় হরিশচন্দ্র নামে একটি যাত্রা দেখেছিলেন। তার মনে হত সকলে কেন হরিশচন্দ্রের মত সত্যপরায়ণ হয় না ? ইতিহাস বলছে মোহনদাস নিজ ক্ষেত্রেও সত্যপরায়ণ ছিলেন না। যতটা সত্যপরায়ণতা তার প্রয়োজনে লাগে তিনি ততটাই সত্যপরায়ণ ছিলেন। একথা ঐতিহাসিক ভাবে অসত্য যে মোহনদাস আজীবন সত্যপরায়ণ ছিলেন। তবে সত্য নিয়ে বাগাড়ম্বর তার প্রতিষ্ঠা তৈরিতে হয়ত কিছুটা সাহায্য করেছে। এই আত্মজীবনী লেখার আগেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসেছেন। ভারতের আসার আগে দ.আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ড যান গোখেলের সঙ্গে দেখা করতে। ঐ সময় তিনি সাড়ে চার মাস ইংল্যান্ডে ছিলেন। ঐ সাড়ে চার মাসের কোন কথা তার এই আত্মজীবনীতে বা অন্যত্র নাই। যিনি এত খুঁটিনাটি বিষয় আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন তিনি তার কোন আত্মীয়ের প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নি আর ঐ সাড়ে চার মাস তিনি লন্ডনে কী করছিলেন তা তিনি প্রকাশ করেন নি, তার কোন জীবনীকারও করেন নি।)
মোহনদাসের যখন ১৩ বছর বয়স অর্থাৎ ১৮৮২ সালে তার বিয়ে হয়। তখন তিনি প্রায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৮৮৭ তে অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি তার স্ত্রীকে সমবয়স্ক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কথাটি অসত্য। গান্ধীজীর স্ত্রী, গান্ধীর থেকে প্রায় আট মাসের বড়। ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর মোহনদাসের জন্ম এবং স্ত্রী কস্তুরীবাঈর জন্ম ঐ বছরই ফেব্রুয়ারীতে। কেউ কেউ লিখেছেন যে, কস্তুরীবাঈ এক বছরের বড় (ড. রাধাশ্যাম ব্রহ্মচারী), কেউ কেউ লিখেছেন ছয় মাসের বড় (রুদ্রপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। ১৩ বছর বয়সের মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য কিশোরদের আকর্ষণ করবেই। ফলে মোহনদাস স্কুল ছুটির পর আর খেলাধূলা করেনই বা কী করে? যখন তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন তখনই তিনি এক পুত্রের পিতা। সত্যবাদী মোহনদাস বিলাতে তিন বছর থাকাকালীন প্রথমে একথা কোথাও এবং কোন মহিলার কাছে প্রকাশ করেন নি।
মোহনদাস ও তার আর দুই ভাই (দাদা কর্শনদাস ও একজন খুড়তুতো ভাই) তিনজনের বিয়ে একই দিনে একই সঙ্গে হয়। তারা অবশ্য মোহনদাসের থেকে বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন। গান্ধী তার আত্মজীবনীতে একটি কথা খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, ....it was a habit with me to forget what I did not like, and to carry out in practice whatever I liked। বস্তুতঃ মোহনদাস সব ব্যাপারেই সারা জীবন ধরে এর প্রমাণ দিয়েছেন। যা তার বিরুদ্ধে যেত তাকে তিনি সমূলে উৎখাত করতেন আর যা তার পছন্দ ছিল নৈতিক-অনৈতিক যেকোন ভাবেই সম্পন্ন করতেন। - তা ভালো-মন্দ,
এই সূত্রে তার কর্তৃত্বপরায়ণতার লোভের দিকটাও লক্ষ্য করার মত। স্বামী হিসাবে বয়সে বড় স্ত্রীকে তিনি সব বিষয়ে বাধ্য করাতেন প্রয়োজনে বাড়ী থেকে দূর করে দেওয়ার মত কাজের ব্যাপারও গর্বের সঙ্গে করেছেন। স্ত্রী যদি মন্দিরে যেতে চাইতেন বা কোন বন্ধুর বাড়ি মোহনদাসের অনুমতি নেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। অন্যথায় পরস্পর বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যেত। নিজের উন্নতির স্বার্থে স্ত্রী-পুত্রের প্রতি এত নির্মম ব্যবহার আর কোন পিতা করেছেন কি-না জানা যায়নি। স্ত্রীকে ইনজেকশন নিতে দেন নি, ফলে তিনি মারা গেছেন। নিজে কিন্তু ইনজেকশন নিয়ে ও অপারেশন করিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তার অবহেলায় চার সন্তানের পড়াশোনা নষ্ট হয়েছে। একজনতো পিতার প্রতি রাগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। পাগলের মত রাস্তায় ঘুরেছেন – মৃত মাতাকে পর্যন্ত দেখতে পাননি দারোয়ান তাড়িয়ে দিয়েছে। বাকী তিন সন্তানের পড়াশোনাও তথৈবচ। কেউ কেউ বিলেত গিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে মোহনদাস তা করতে দেন নি। অথচ আমরা দেখব নিজে বিলেত যাওয়ার জন্য কত কান্ডই না করেছেন। মুসলমান পুত্রকে আবার হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনার জন্য যার সাহায্য নিয়েছেন, তার নিন্দা করতে তার বাধে নি। তার হত্যাকারীর প্রশংসা করেছেন।
যাইহোক,
বাড়ীতে উদ্ভিন্ন যৌবনা স্ত্রী থাকতে পড়াশোনায় মন বসানোর মত মন তার ছিল না, মেধাবী ছাত্র ছিলেন না। কখনও বাইরের বই পড়ার প্রশ্নই ছিল না। বার্ষিক পরীক্ষায় একবার ফেলও করলেন। তার দাদা কর্শন দাসও ফেল করলো। তিনি পড়া ছেড়ে দিলেন। ১৮৮৭ সালে ১৮ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করলেন থার্ড ডিভিশন-এ। ৬২৫ ছিল পূর্ণ নম্বর, মোহনদাস পেলেন ২৪৭ অর্থাৎ ৩৯.৫২ শতাংশ (ড. ব্রহ্মচারী ও রুদ্রপ্রসাদ চট্টেপাধ্যায় যথাক্রমে পৃ. ১৯ ও পৃ. ৫)। কিন্তু তার আত্মজীবনীতেও তিনি তা উল্লেখ করেন নি সত্যবাদী মোহনদাস। কারণ, যা তার অপছন্দের তা তিনি ভুলে যেতেন, যা করলে বা বললে নিজেকে মহান প্রতিপন্ন করা যায় তাই-ই তার পছন্দের ছিল। অবশ্য একথা লিখেছেন যে, my intelligence must have been sluggish and my memory raw. আমার বুদ্ধি নিশ্চয় কম ছিল এবং স্মৃতি শক্তি খারাপ। শ্রবণের পিতৃভক্তি ও হরিশচন্দ্র নাটক পড়েছেন ও দেখেছেন। বাড়ীতে বিশ্বেশ্বরের রাধা মহারাজের কাছে তুলসীদাসী রামায়ণ শুনেছেন, কথকের মুখে ভাগবত শুনেছেন। পিতার কিছু পার্সী ও মুসলমান বন্ধুদের কথাবার্তায় ঐ দুই ধর্ম বিষয়ে কিছু শুনেছেন। পরে বিলাতে থাকাকালীন বাইবেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। গীতা পড়েছেন বলে বলেছেন বটে কিন্তু কোন ভাষায় ? সংস্কৃত জানতেন না, ইংরাজীতে পড়তে পারেন। আত্মজীবনীর দু-জায়গায় গীতার দুটি শ্লোকের উল্লেখ আছে। ইংরাজীতে গীতার অনুবাদ প্রথম হয় ১৭৮৫ সালে, অনুবাদক চার্লস উইলকিন্স্। ১০০ বছর পরে আবার একটি অনুবাদ হয়। অনুবাদক এডুইন আরনল্ড্। তিনি কোনটি পড়েছেন, কোন ভাষায় পড়েছেন - ইত্যাদি কিছুই আত্মজীবনীতে নেই। আর মোহনদাস যেমন লোক উল্লেখ করবেন না, এটাও ভাবতে খটকা লাগে। আর গীতা পড়লে তিনি ঐ রকম আজগুবী অহিংসা তত্ত্ব ও সত্যতত্ব উল্লেখ করতেন না। গীতায় অহিংসাকে সত্যের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। আর সেই অহিংসা গান্ধী কথিত ক্লীব ও কাপুরুষের অহিংসা নয়। যাইহোক, তার পড়াশোনার গভীরতা ও সততা অন্ততঃ ভারতীয় শাস্ত্রসমূহ ও ইসলাম সম্পর্কে ছিল না এটি সুনিশ্চিত। তিনি রাসকিন ও টলস্টয়ের লেখা দুটি পুস্তকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। রাসকিন কৃত পুস্তকটির নাম Unto the Last এবং টলস্টয়ের The Kingdom of God l স্কুলে তার দাদা কর্শনদাসের ক্লাসের এক ছাত্র সেখ মহতাব (মুসলমান) এর সঙ্গে গান্ধী সখ্য ছিল। সে ছিল মোহনদাসের থেকে তিন বছরের বড়। ভারতবর্ষে ইংরাজ শাসকদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ভারতবাসীকে হীনমনা করে দেওয়া। অন্যথায় এই বিশাল দেশের অগণিত যোদ্ধা ও সুশিক্ষিত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব ছিল। মোহনদাসের জন্মের আগেই মেকলে, বেন্টিঙ্ক এবং উঙ মিলে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন ভাবে করেছিলেন যাতে এই হীনমন্যতা বেশ গভীরভাবে ভারতীয়দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহনদাস ছিলেন একান্ত ইংরাজভক্ত। সারা গুজরাটই এই হীনমন্যতার শিকার হয়েছিল। তাদের ধারণা হয়েছিল, ইংরাজদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য ভারতীয়দের মতই যে, হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানাবিধ ব্যবস্থা বন্দোবস্ত খুব খারাপ এবং ইংরাজরা খুবই উন্নত প্রজাতির মানুষ। মোহনদাসতো গভীরভাবে ইংরাজভক্ত ছিলেনই। সেখ মহতাব মোহনদাসকে বুঝিয়েছিলেন যে মাংসাশী হওয়ার জন্যই মুসলমানরা ভারতে জয়ী হয়ে রাজত্ব করেছিল। আর ইংরাজরাও মাংসাশী।
মোহনদাস ছিলেন স্বভাব ভীরু। সাহসী হওয়ার লক্ষ্যে মাংস খাওয়া ধরলেন মোহনদাস কর্শনদাস, মহতাব। তিনি নিজেই লিখেছেন - I was a coward, I used to be haunted by fear of thieves, ghosts and serpents. Darkness was a fever to me এক গুজরাট কবির একটি ছড়া খুব প্রচলিত ছিল – Behold the mighty English man He rules the Indian small, Because being a meat-eater He is five cubits tall.
মোহনদাস এতই প্রভাবিত হলেন যে, তিনি নিজেতো মাংস ধরলেনই আরও চাইলেন - সব ভারতবাসী মাংস খাওয়া আরম্ভ করলে ইংরাজদের হারাতে পারবে। মোহনদাস প্রভাবিত হতে ভালোবাসতেন। ইংরাজরা তার উপর এতই প্রভাব ফেলেছিল যে ইংরাজ শাসনকে তিনি ঈশ্বরের করুণা বলে মনে করতেন। পরে এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করব।
যাইহোক, মহতাবের অর্থে ও অনুপ্রেরণায় মোহনদাস মাংসাশী হলেন এবং বাড়ীতে বাবা, মা এবং স্ত্রীর কাছে দেদার মিথ্যা কথা বলে চললেন - প্রায় এক বছর এরকম চলল। পরে মহতাব -এর পক্ষেও অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হল না। সেই তের বছর বয়সে মোহনদাস ধুমপানও শুরু করেছিলেন। বৈষ্ণব যদি মাংস খেতে পারে, বিড়ি সিগারেট নয় কেন ?
রবীন্দ্রনাথ এর গোরাবোষ্টম বাবা, শুদ্ধ নিয়মমতে মুরগী পালন করে, গঙ্গাজলের যোগে তার কালিয়া রাঁধত। গোরাবোষ্টম বাবা টেরিটি বাজারের লোক। মোহনদাসের অন্যান্য পড়াশোনার মধ্যে তিনটি পুস্তকের উল্লেখ করতেই হয়। (১) হেনরী ডেভিড থরোর (১৮১৭-১৮৬২) লেখা কতকগুলি গ্রন্থ। থরো ছিলেন আমেরিকান কবি। ১৮৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসভায় Civil Disobedience কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। পরে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। (২) খ্যাতনামা লেখক রাসকিন (১৮১৯-১৯০০) এর লেখা Unto the Last, (৩) রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) লেখা The Kingdom of God. (ড. ব্রহ্মচারীর পুস্তকে পৃ. ৯-এ উল্লিখিত ড. অতুলচন্দ্র রায়ের পুস্তক থেকে)। মোহনদাসের পড়াশোনার পরিধি ছিল একান্ত সীমিতি। আর সেগুলির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তগুলি ছিল আরও উদ্ভট ও চূড়ান্ত ক্ষতিকারক।
আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রতিষ্ঠা তার পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিল। বৃটিশ শাসকরা তার উপর সম্পূর্ণ ভরসা করেছিল এবং তাকে মুখ রক্ষা করতেই হবে। বৃটিশদের সঙ্গে কী বোঝাপড়া হয়েছিল, ভারতে পৌঁছানোর আগে সাড়ে চারমাস বিলাতে তিনি কী করেছিলেন, গোখেল তাকে কেন ভারতীয় রাজনীতিতে মুখপত্র করতে চেয়েছিলেন তার আত্মজীবনীতে এ সবের কোন উল্লেখ নাই।
বিড়ি খাওয়া, মাংস খাওয়া, স্ত্রীসঙ্গের প্রতি লোলুপতা তিনি অক্লেশে স্বীকার করেছেন এগুলির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভারতের ইতিহাস ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নাই। মোহনদাসের আত্মজীবনীর কোন ঐতিহাসিক মূল্যও নাই। যে কোন মানুষ খুব উপরতলায় উঠে যাওয়ার পর তার ছোটবেলাকার গল্পগুলি বলে খুশী হন কারণ তিনি তার মধ্য দিয়েই নিজের প্রচারটা সেরে ফেলেন। ভাবটা হল- দেখ কী ছিলাম, কী হয়েছি। এবং এরকম হওয়ার পরও নিজের দোষগুলি স্বীকার করছি দেখ, আমি কত মহান। ১৯২৫ থেকে ১৯৪৭ সময়কালে তিনি আত্মজীবনী লেখেন নি। অন্যান্যরা তাঁর জীবনী লিখেছেন পছন্দমত।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা কোন স্বচ্ছ মানুষের কাজ হতে পারে না। দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে তিনি ১৯১৪ সালের ১৮ই জুলাই স্ত্রী কস্তুরীবাঈ ও ইহুদী বন্ধু কালেনবাখকে নিয়ে জাহাজে চাপেন। ঐ জাহাজ (এস. এস. কিনফাউন্স্ ক্যাল) লন্ডনে পৌঁছালো ১৯১৪, ৬ আগষ্ট। লন্ডন থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ১৯ ডিসেম্বর। প্রায় সাড়ে চার মাস তিনি লন্ডনে ছিলেন। তার আত্মজীবনীতে এই ১৩৪ দিনের কোন কার্য বিবরণীর উল্লেখ নাই। তিনি ভারতে পৌঁছালেন (বোম্বাই) ১৯১৫ সালের ৯ই ২১ বছর দক্ষিণ আফ্ৰিায় কাটিয়েছেন অথচ ওদেশের কোন কালো মানুষ তার বন্ধু ছিল না। জাহাজ থেকে নামার আগে গুজরাটি চাষীর পোষাক পরলেন। তারা ছিলেন বানিয়া সম্প্রদায়ের। কৃষক সম্প্রদায়ের নয়। তবু চাষীর পোষাক পরলেন, মাথায় গুজরাটি পাগড়ি। বোম্বাই বন্দরে নেমে প্রথম কাজটি হল- বোম্বাই প্রেসিডেন্সীয় গভর্নরকে চিঠি দিলেন যে তিনি তার নির্দেশ মেনে চলবেন। গান্ধী টুপি ব্যবহার করেন ১৯২০ সালে। কটি বস্তু আরও পরে মাদুরাইতে।
১৮৮৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ভাবনগরের শ্যামল দাস কলেজে ভর্তি হলেন। এপ্রিলের গরমে ভাবনগর ছেড়ে চলে এলেন পড়াশোনায় ইস্তফা। এই সময় তার এক বন্ধু তাকে বিলাত যাওয়ার স্বপ্ন দেখালেন। বন্ধুর নাম জয়শংকর দয়াশঙ্কর বুছ। ভাবনগর থেকে রাজকোেট এলেন। দাদা লক্ষ্মীদাস থাকতেন রাজকোটে। এখানে মাওজী নাকা দাভে- পারিবারিক বন্ধু ও পুরোহিত পরামর্শ দিলেন বিলেত যাওয়ার। ফিরে এসে দেশে কোন ভাল চাকরী পেতে পারবেন।
মোহনদাস বিলেত যাওয়ার জন্য প্রবল উৎসাহী হলেন। বাধা ছিল তিনটি -(১) অর্থ সংগ্রহ (পড়াশোনা সেরে আসতে তখনকার দিনেও ৩০-৪০ হাজার টাকা), (২) মায়ের সম্মতি, (৩) কালাপানি পেরালে জাত যাবার ভয়। তৃতীয় ব্যাপারটা মোহনদাস গুরুত্ব দিলেন না। দ্বিতীয় ব্যাপারটায় আধ্যাত্মিক শিক্ষক ও পারিবারিক বন্ধু বেচারজী স্বামী নামে জৈন সাধুর মধ্যস্থতায়, মোহনদাস মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, বিলাতে তিনি মদ মাংস ও নারী স্পর্শ করবেন না। (মোহনদাস পরে গর্ব করে বলেছিলেন যে মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন। বিলেতে তিনি বছরে তিনি মদ ও মাংস স্পর্শ করেন নি। নারী প্রসঙ্গে কিছু বলেন নি, তবে বিলেতে থাকাকালীন সত্যসেবী তিনি ঘুণাক্ষরেও একথা প্রকাশ করেন নি যে তিনি বিবাহিত এবং দেশে যুবতী স্ত্রী ও এক পুত্রকে রেখে এসেছেন।) প্রথম ব্যাপারটা ছিল অর্থ সংক্রান্ত। বড় ভাই লক্ষ্মীদাস কিছু টাকা ঋণ করে নিলেন মোহনদাসের জন্য, খুড়তুতো ভাই পরমানন্দ ৫ হাজার টাকা ঋণ দিলেন। জগমোহন দাস শ্যামল দাস নামে এক ব্যবসায়ী মোহনদাসকে কিছু ঋণ দিতে রাজী হলেন।
১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ১৯ বছর বয়সী মোহনদাস যুবতী স্ত্রী ও একপুত্রকে বাড়ীতে রেখে জুনাগড়ের বিখ্যাত উকিল এ্যম্বকরাই মজুমদারের সঙ্গে ক্লাইভ জাহাজে লন্ডন অভিমুখে যাত্রা করলেন। ১৮৮৮-র ২৮ অক্টোবর জাহাজ লন্ডনে পৌঁছালো।
ত্র্যম্বকরাই মজুমদার এবং এক সিন্ধ্রি মুসলমান আবদুল মজিদকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন ভিক্টোরিয়া হোটেলে। (আবদুল মজিদ-এর নামটা আত্মজীবনীতে নেই। সত্যবাদী মোহনদাস এটা গোপন করেছেন। আমিও মুসলমান শব্দটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ব্যবহার করলাম। দেশের স্কুলে মুসলমান ছাত্র- সেখ মহতাবের সঙ্গে মোহনদাসের উঠাবসা এবং মোহনদাসের উপর তার প্রভাব নিয়ে লিখেছি। এরপরও আমরা দেখব মুসলমান ব্যক্তিরা এই জৈনধর্মী-বৈষ্ণব মোহনদাসের জীবনে কী ভূমিকা পালন করেছেন এবং মোহনদাস তার ঋণ কীভাবে শোধ করেছেন। গান্ধী ও মুসলিম প্রসঙ্গে তা আলোচনা করব।)
মোহনদাস ম্যাট্রিক পাশ করার থার্ড ডিভিসনের সার্টিফিকেট নিয়ে লন্ডনে গেছিলেন, সেটি খুব কাজে এল না। ওখানে তাকে আবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে হল এবং তিনি অকৃতকার্য (fail) হলেন।
১৮৮৮-র নভেম্বর মাসে তিনি ইনার টেম্পলে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যারিস্টারী পাশ করার জন্য। ডিসেম্বরে ওখানকার প্রবেশিকায় অনুত্তীর্ণ হলেন। ছ'মাস ধরে খুব করে ল্যাটিন ভাষা পড়লেন। ছয়মাস পরে আবার পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ (pass) হলেন।
এদিকে লন্ডন শহর তাকে মুগ্ধ করেছে। রেভারেন্ড জোসেফ ডোক কে তিনি বলেছিলেন, 'ভারতের পরে পৃথিবীর অন্য কোনও স্থানে যদি আমাকে বাস করতে বলা হয়, তবে আমি লন্ডনে বাস করবো।' লন্ডন ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রদর্শনশালা, যাদুঘর, থিয়েটার, পার্ক, বাণিজ্যশালা ইত্যাদি মোহনদাসকে মুগ্ধ করল। এই লন্ডন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনায় কাতর গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বন্ধ করলেন। ইংরাজদের বিপদে ফেলতে চান না।
ভালোকথা, মোহনদাস ভারতে থাকতে কখনো খবর কাগজ পড়েননি। লন্ডনেই খবর কাগজ পড়া শুরু। মোহনদাস কখনও ভাবেন নি যে ইংল্যান্ডের এই চোখ ধাঁধানো সম্পদ অন্যান্য দেশকে, বিশেষ করে ভারতবর্ষকে শোষণ করেই। এই ১৯-২০ বছর বয়স পর্যন্ত মোহনদাসের পড়াশোনা ও মেধার মান এবং চিন্তার জগতের পরিধির একটা পরিচয় পাওয়া গেল।
মোহনদাস লন্ডনে বসবাসকারী চার ভারতীয়র সঙ্গে দেখা করার জন্য চারটি সুপারিশপত্র এনেছিলেন। এরা চারজন হলেন ডা. প্রাণজীবন মেহতা, দলপত্রাম শুক্লা, ক্রিকেট খেলোয়াড় রণজিৎ সিং এবং দাদাভাই নৌরজী। প্রাণজীবন এবং দলপত্রাম বিলাতে নিরামীষভোজী মোহনদাসের থাকার ব্যবস্থা করলেন একজনের বাড়ীতে পেয়িং গেস্ট হিসাবে। ডিমকে নিরামীি ধরে নিয়ে কিছুদিন ডিমও খেয়েছিলেন। মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞার কথা মনে করে। ডিম ছাড়লেন। কিন্তু তৃতীয় প্রতিজ্ঞাটি ঠিক ঠিক পালন করতে পেরেছেন কি না পরিষ্কার নয়। এক নবপরিচিতা মহিলা তার এক অল্পবয়স্কা সঙ্গিনীর সঙ্গে মোহনদাসের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মোহনদাস কিছুদিন ঐ মহিলার সঙ্গে অবিবাহিত পুরুষ হিসাবেই ঘনিষ্ঠ থাকলেন। পোর্টস মাউথে নিরামিশাষী সম্মেলনে (১৮৯০) গিয়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে তাস খেলতে খেলতে একটু অনঙ্গ বসে ডুব দিয়েছিলেন ইত্যাদি।
কিন্তু অন্য দুটি দিকে মোহনদাস নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন। চুলের বাহার, দামী দামী পোষাক, নাচ, বক্তৃতা, বেহালা, ফরাসী ভাষা ইত্যাদি। নিরামিষভোজী সংঘ বানালেন। নিরামিষ ভোজীদের পত্রিকায় লেখা দিলেন, কিছু আইনের বইও পড়লেন। মোহনদাস পাঠক্রমের বাইরে কিছু পড়াশোনার আগ্রহী ছিলেন না। তবু এই সময় তিনি এডুইন আর্নল্ডের গীতার অনুবাদটি পড়ে থাকতে পারেন। আলাপ হল ১৮৮৯তে বিখ্যাত থিয়োসফিস্ট মাদাম ব্লাভাটস্কি (১৮৩১-১৮৯১) ও অ্যানি বেসান্ত (১৮৪৭-১৯৩৩)-এর সঙ্গে। এই সময়ই প্রকাশিত হচ্ছিল ম্যাক্সমুলারের সেক্রেড বুক অফ দি ইস্ট গ্রন্থমালা।
দেশে এক হিন্দুকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে দেখেছিলেন। জেনেছিলেন যে, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সে কীভাবে হিন্দু ধর্মকে গালি দিত, দেখেছিলেন তার পোষাক ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তন। তাই খ্রিস্টান সম্পর্কে তার দুর্বলতা ছিল না। কিন্তু বিলাতে কয়েকজন খৃষ্টানের নিয়মিত অনুরোধে তিনি বাইবেল পড়তে শুরু করেছিলেন বটে তবে তা ঐ জেনেসিস অধ্যায় পর্যন্ত। খৃষ্টধর্ম প্রচারকের পাল্লায় পড়ে কেন্ট ও লন্ডনের গীর্জায় ধর্মেপিদেশও শুনেছেন। এই সময় তিনি আর একটি পুস্তক পড়েছিলেন টমাস কালহিলের লেখা হিরো অ্যান্ড হিরোওয়ারশিপ। নানাভাবে তার মাথায় গীতা, বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, মুশা সব তালগোল
পাকিয়ে গেল। ভারতে উদ্ভূত গীতা ও বুদ্ধর ধর্মের সঙ্গে সেমেটিক ধর্মত্রয় -ইহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম যে কখনও মিল খায় না, এটা বোঝার মত ইতিহাসজ্ঞান তার ছিল না। আর ধর্মেপিদেশের বৈপরীত্য বোঝার বড় মেধা ছিল কি-না তাও সংশয়ের। বিলেতে কয়েকবার বক্তৃতা দিতে উঠে নিতান্তই ছেলেমানুষী করলেন। ১টি বা ২টি বাক্যের বেশী বলতেই পারতেন না। আইন পরীক্ষা দিলেন। পাশও করলেন। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের ১০ জুন আহুত হলেন, আদালতে যোগ দেওয়ার জন্য। হাইকোর্টে নথীভূক্ত হলেন। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের ৫ জুলাই বোম্বাই বন্দরে অবতরণ করলেন ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যার মধ্যে দেশপ্রেমের ছিটো ফোঁটা নাই, আছে ইংরাজদের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা, নিরামিষ ভোজন ও খাদ্যাভাস নিয়ে নিজের কিছু ধ্যান ধারণা ও বাতিক। কোন বিষয়েই গভীর জ্ঞান ও ভাবনার লক্ষণ নাই।
দি ডেলিগেট পত্রিকার এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন- 'পরিশেষে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে বিলাতে তিন বছর অবস্থান কালে অনেক কাজ আমি করে উঠতে পারিনি, অনেক কাজ আমি করেছি যা না করলেও চলতো। এতৎ সত্ত্বেও একটি বিরাট সান্ত্বনা যে আমি ফিরে যাচ্ছি মদ ও মাংস না খেয়েই।' নারী সংসর্গের কথা উল্লেখ করতে কী ভুলে গেলেন ? (রুদ্রপ্রসাদ পৃ. ১৭)
গান্ধীজী তাঁর The Story of my experiments with Truth - যেটিকে তাঁর আত্মজীবনী বলা হয়, সেই পুস্তকে ২১ অধ্যায়ে বলেছেন যে, যখনই তিনি কোন বিপদে পড়েছেন আধ্যাত্মিক জীবনে বা আইন ব্যবসায়ে বা রাজনীতিতে, তখনই তিনি ঈশ্বরের সাহায্য পেয়েছেন, প্রসঙ্গটি এসেছিল পোর্টসমাউথে নিরামিষাষীদের সম্মেলনে গিয়ে তিনি এক মহিলার সঙ্গে যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তাই নিয়ে।
আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি যে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি গীতা, বুদ্ধ, মহম্মদ এবং যিশুর মৌল উপদেশ ইত্যাদি পড়েছেন। ব্লাভাটস্কি এবং অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে পরিচয় ইত্যাদি হয়েছে। গীতার সঙ্গে শৈল উপদেশের মিল দেখতে পেয়েছেন এক গালে চড় মারলে আর এক গাল বাড়িয়ে দিতে হবে ইত্যাদি। পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতিতে তিনি হিন্দু রমণীদের এই রকম উপদেশই দিয়েছেন যখন কোন মুসলমান তাকে ধর্ষণ করতে আসবে তখন সেই হিন্দু রমনীর কী করণীয় সেই প্রসঙ্গে। এ প্রসঙ্গ বিস্তারিত আলোচনা পরে করব। এখন শুধু এই টুকুই বক্তব্য যে গীতাতে এরকম পরামর্শ কোথায় তিনি পেয়েছেন ? তার আত্মজীবনীতে তিনি গীতার দুটি শ্লোকের ইংরাজি অনুবাদ ব্যবহার করেছেন। ঐ দুটিতেও এরকম কিছু নেই। আর গীতার ৭৪৫টি শ্লোকের মধ্যে অন্য কোথায় আছে তাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর অহিংসা তত্ব আলোচনার সময় আমরা দেখব হয় তিনি গীতা পড়েন নি, আর পড়ে থাকলে সামান্যও উপলব্ধি করতে পারেন নি।
বাইবেলের ওল্ড টেসটামেন্ট-এ প্রতিহিংসার কথা আছে। আর নিউ টেসটামেন্টের অর্ধেকেরও বেশী অংশ সুসমাচার মাত্র। সেগুলি যিশুর বক্তব্য নয়। সুসমাচারগুলির মধ্যেও কিছু কিছু বিরোধ দেখা যায়। মোহনদাস কী কী পড়েছেন তাঁর উল্লেখ করেছেন। যদিও তা অতিশয় সামানা। কিন্তু যা যা পড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলিও তিনি হজম করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। নিজের বুদ্ধিযুক্তি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন যে তাঁর স্মৃতি শক্তি ও বুদ্ধি খুব উচ্চমানের ছিল না।
মোহনদাস লিখেছেন তিনি আইন ব্যবসায়ে কত অসহায় ছিলেন। I had learnt nothing at all of Indian Law, I had not the slightest idea of Hindu Law, Mohamedan Law, I had not even learnt to draft a plaint and felt completely at sea. (পৃ. ৮৫, ১৫ অধ্যায়)
কারুর পরামর্শ শুনে তিনি দেখা করেছিলেন ফ্রেডারিক পিনকার্টের সঙ্গে দেশে ফেরার আগে। পিনকার্ট তার পড়াশোনার বহর জানতে চাইলেন। মোহনদাস তা জানালেন। পিনকার্ট হতাশ হলেন। বললেন, 'তোমার সাধারণ পড়াশোনা খুবই নগণ্য (meagre)। পৃথিবী সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নাই, এমনকি ভারতের ইতিহাস তুমি পড়নি। একজন ভারতীয়র ভারতের ইতিহাস জানা একান্ত আবশ্যক। অবশ্য এই ইতিহাস জানার জন্য আইন ব্যবসায়ের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু তোমার জ্ঞান থাকা দরকার ..... পিনকার্ট মোহনদাসকে কয়েকটি বই পড়ার পরামর্শ দিলেন। তবে মোহনদাস যে ভারতের ইতিহাস কিছুই জানতেন না এবং জানারও ইচ্ছা ছিল না তা গান্ধীজী হিসাবে বার বার প্রমাণ করেছেন।
ইংল্যান্ড থেকে বোম্বাই পৌঁছে মোহনদাস উঠলেন প্রাণজীবন মেহতার বাড়ীতে। লন্ডনে প্রাণজীবন মেহতার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল। মোহনদাসকে জানানো হল যে, তিনি লন্ডনে থাকাকালীনই তার মা পুতলীবাঈ গত হয়েছেন। প্রচণ্ড দুঃখ পেলেন মোহনদাস। কিন্তু ভেঙ্গে পড়লেন না। চোখের জলও ফেললেন না।দাদা লক্ষ্মীদাসের অনেক ভরসা মোহনদাসের উপর। তিনি রাজকোটে একজন বড় উকিলের জুনিয়ার। ভাই-এর শিক্ষার জন্য অনেক টাকা ঋণ করেছেন। ভাই-এর জন্য বাড়িতে প্রচলন করেছেন বিলাতী আদব কায়দা ও খাদ্য। বিলাতীয়ানা করতে গিয়ে খরচ অনেক বেড়ে গেল যেন সাদা হাতী পোষা হচ্ছে। এদিকে এক পয়সা রোজগার নাই। এই সময়টা মোহনদাস চাইলেন তার স্ত্রী লিখতে পড়তে শিখুক। কিন্তু তার কামুকতায় স্ত্রীর বিদ্যা শিক্ষা হল না।
কাথিয়াবাড়ে ওকালতি করার অনুমতি পেলেন কিন্তু সেখানে মামলা পাওয়া শক্ত। বন্ধুরা পরামর্শ দিল বোম্বাই হাইকোর্টে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। বোম্বাই হাইকোর্টে চলে গেলেন। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকলেন। কোর্টে মামলা শুনতে থাকলেন। শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও পড়তেন। কিন্তু মামলা এল না। শেষ পর্যন্ত মামলা হাতে এল। ফি তিরিশ টাকা। বিবাদী পক্ষের ব্যারিস্টার হিসাবে ফরিয়াদী পক্ষের সাক্ষীকে জেরা করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত পা কাঁপতে লাগল। ভিরমি গেলেন ব্যারিস্টার। শেষ পর্যন্ত মক্কেলকে তিরিশ টাকা ফেরৎ দিলেন। বোম্বাইর ওকালতী জীবনে একটি কাজই করেছিলেন পোরবন্দরের এক মুসলমানের একটি দরখাস্ত মুসাবিদা করে দিয়েছিলেন। দাদা লক্ষ্মীদাস ভাইকে আবার রাজকোটে ফিরিয়ে আনলেন। একটা অফিস করে দিলেন। মোহনদাসের কাজ হল মামলার কাগজপত্র তৈরি করা। এজলাসে দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টারী করতে হবে না। মাসে শ তিনেক টাকার মত আয় হতে থাকল।
এই সময় রাজকোটের পলিটিক্যাল এজেন্টের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাঁধল। ঐ এজেন্ট তার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় দাদার ব্যাপারে তিনি একটা তদ্বির করতে গেছিলেন। এজেন্ট তাকে অপমান করেন। ফিরোজ শাহ্ মেহতার পরামর্শে মোহনদাসকে সেই অপমান হজম করতে হয়। পলিটিক্যাল এজেন্টের পিয়ন মোহনদাসকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। বোম্বাই কোর্টে ভিরমি খাওয়ার পর তিনি আর কোর্টেই যাননি। এখন রাজকোর্টে এই ঘটনা ঘটল এত বড় অপমান তাকে হজম করতে হল। কারণ ফিরোজ শাহ মেহতা পরামর্শ দিলেন যে, জলে বাস করতে হলে, কুমীরের সঙ্গে লড়াই চলবে না। রাজকোর্টে থাকতে গেলে পলিটিক্যাল এজেন্ট-এর অপমান হজম করতে হবে।
গান্ধী ও খিলাফৎ আন্দোলন
১৯২০তে নাগপুরে কংগ্রেস সম্মেলন – শ্রদ্ধানন্দ সতর্ক করলেন গান্ধী অসহযোগিতার গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মহম্মদ আলি — অসহযোগ – চিত্তরঞ্জন দাস - শেষ অধ্যায় – মূল্যায়ন – মোপলা বিদ্রোহ সারাংশ - কথোপকথন পরিবর্তন - গান্ধী গ্রেপ্তার – গান্ধী ও স্বরাজ পার্টি - আর.এস.এ। গান্ধীর খাদ্য তালিকা – পোষাক এই সময়কার দাঙ্গা ও গান্ধী
(খিলাফৎ আন্দোলন ভারতে মুসলিম তুষ্টিকরণের প্রথম আন্দোলন -যার শতবর্ষপূর্তি হতে চলেছে। অর্থাৎ এই একশত বছর ধরে ভারতে রাজনীতির একটি বিরাট দিক – এই তুষ্টিকরণের রাজনীতি। গান্ধী এই তুষ্টিকরণের রাজনীতির স্রষ্টা। এই তুষ্টিকরণ রাজনীতি ভাঙ্গতে না পারলে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের (১৯৪৭) এই ৬৮ বছর পরেও ভারত এখানো বিশ্ব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পিছনের সারিতেই। ৬৮ বছরে এতটা অনগ্রগতি তুলনামূলক ভাবে অন্য দেশে হয়েছে কি-না সন্দেহ। অন্ততঃ চীন, জাপান বা পরিচিত অন্য কোন দেশতো এতটা অনগ্রগতিতে ভুগছে না। এই তুষ্টিকরণের রাজনীতি ভারতকে বিভক্ত করেছে। ভারত বিভাগের ক্ষেত্রেও গান্ধীজী দ্বিচারিতা করেছেন দেশের মানুষকে বলেছেন একরকম, মুসলিম লীগ আর ইংরাজদের বলেছেন অন্যরকম। ভারতে এত দাঙ্গার পিছনেও এই তুষ্টিকরণের রাজনীতি সক্রিয়, ভারত যে তার নিজের আত্মা বা চিতির উপর দাঁড়াতে পারছে না তার পেছনেও এই তুষ্টিকরণের রাজনীতি।
যে তুষ্টিকরণের রাজনীতি দেশকে এতটা ডুবিয়েছে এবং ডোবাচ্ছে - তার যে স্রষ্টা তাকেই আমরা ‘মহাত্মা' বানিয়ে বসে আছি। এই মিথ্যা ‘মহাত্মা' ভাবমূর্তি না ভাঙ্গতে পারলে আমরা তুষ্টিকরণের রাজনীতি ও সেই তুষ্টিকরণের ভিত্তিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না, পারবো না। এই ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থে সর্বতোভাবেই তুষ্টিকরণ। ভারত হিন্দুদের দেশ ভারতীয় সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতি, ভারত মানবতার পূজারী এখানে মানুষ মাত্রেই অমৃতের পুত্র ধরা হয়। ভারতেই একমাত্র জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সুখ ও নিরাময়তা কামনা করা হয়। এই তুষ্টিকরণ একধরণের সন্ত্রাসবাদেরও প্রবক্তা। তাই তুষ্টিকরণের স্থায়ী বিপদ ও বিনাশকারী শক্তির জনককে 'মহাত্মা' বলে আমরা যেমন প্রকৃত মহাত্মাদের ব্যঙ্গ করছি তেমনি একটি ভ্রান্ত ধারণায় দেশ পরিচালনা করছি। ফলে আমরা সর্বদাই অসুখে ভুগছি।)
একটি প্রশ্ন বারবারই আমাকে উত্যক্ত করে। সেটি হল ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গ আটকাতে পেরেছিলেন, Settled Fact কে Unsettle করেছিলেন মাত্র ৪২ বছর পরে তারা কেন ভারতভাগ আটকাতে পারলেন না। উত্তরে শুধু এইটুকুই মনে আসে যে- (১) বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনের নেতাদের যে গুণপণা, বলিষ্ঠতা, দূরদৃষ্টি ও স্বার্থত্যাগ ছিল, ১৯৪০-৪৭ এর নেতাদের তা ছিল না। (২) হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ভারতবর্ষে কোন কালেই ভাল ছিল না ঠিকই কিন্তু আলোচ্য সময়ে যে তুষ্টিকরণের রাজনীতি শুরু এবং চালু হয়েছিল ৪০-৪২ বছর আগে ১৯০৫ সালে তুষ্টিকরণের রাজনীতি প্রায় ছিল না।
ভারতের বর্তমান বিপর্যয়ের মূলে আছে এই তুষ্টিকরণের রাজনীতি। আমরা এটা স্বীকার করতে এবং বিশ্লেষণ করতে ভয় পাই ভোট এবং তদর্থে - ক্ষমতার কথা ভেবে। শাক্ দিয়ে মাছ ঢাকি। কাঁচের ফানুস যেমন মনে করে সে আলোর শিখাকে ঢেকে দিয়েছে। 'শরা ফানুস পন্ দারদ কি পিন্হান্ করদে অস্ত্’। তুষ্টিকরণের রাজনীতির প্রতিষ্ঠাতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং অস্ত্র খিলাফৎ আন্দোলন।
রাজনীতি ও ইতিহাসের বিচারে ভারত খিলাফৎ আন্দোলন একাত্ত অনাবশ্যক ছিল। মোহনদাস তার ক্ষমতা ও যশলোলুপতায় খিলাফৎ আন্দোলন প্রথমে কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের মাধ্যমে জনগণের উপর চাপিয়ে ছিলেন। গান্ধীর উপরওয়ালারা তখন গান্ধীকে একটা মজবুৎ স্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল চম্পারণ, খেড়া ও আহমেদাবাদের আন্দোলনের মাধ্যমে। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তার স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পাঞ্জাবে যে রক্তগঙ্গা বয়েছিল যার দায় একমাত্র মোহনদাসের কারণ তখনও তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্ব পাননি এবং এই সত্যাগ্রহ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ছিল না। গান্ধী তার সত্যাগ্রহ তত্ব নিয়ে ফাকা খেলেছিলেন। এত রক্ত, এত জীবন হানি, এত বর্বরতা তবু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করেন নি (একজন সৎ মানুষের পক্ষে যা করা স্বাভাবিক ছিল) এবং ইংরাজরাও তাকে কোনভাবে দোষী করেনি। বরং গ্রেপ্তার করে তার ভাবমূর্তি বাড়িয়ে ছিল সুকৌশলে।
খিলাফৎ-এর ইতিহাস : তুরস্কের সুলতান ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু বা খলিফা (Caliph)। ১৯১৮ খৃষ্টাব্দের শেষে খলিফা তার মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত সাম্রাজ্য খুইয়ে ছিলেন। এমনকি ইস্তাম্বুলের উপরও তার কর্তৃত্ব যেতে বসেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ছিল জামানীর পক্ষে বৃটিশদের বিরুদ্ধে। ভারতের মুসলমানরা খলিফার পক্ষে যেমন তেমনি ইংরাজদের পক্ষেও। তাদেরই খলিফা ইংরাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত দেখে ভারতীয় মুসলমানরা বেকায়দায় পড়ল। বৃটিশরা ভারতীয় মুসলমানদের এই পরিস্থিতি বিলক্ষণ অবগত ছিল। তাই ভারতীয় মুসলমানদের ইংরাজ আনুগত্য অবিচল রাখার লক্ষ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ১৯১৮ সালের ৫ জানুয়ারী ঘোষণা করলেন যে মিত্র পক্ষ (ইংরাজ পক্ষ) তুরস্ককে বঞ্চনা করবে না।
যুদ্ধ শেষ হতে দেখা গেল তুরস্কর হাতে কিছু নাই। তুরস্কের অধীনস্থ থ্রেস দেওয়া হল গ্রীসকে, তুরস্কর সাম্রাজ্যের এশীয় অংশ থাকল বৃটিশ এবং ফরাসীদের হাতে। তরুস্কের সুলতানের যাবতীয় কর্তৃত্ব খর্ব করা হল তাকে মিত্র শক্তি নিযুক্ত হাই মিশনারের কর্তৃত্বে থাকতে হল। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে ভারতীয় মুসলমানরা ভারতে আন্দোলন
সংগঠিত করেছিল যাতে বৃটেন, তুরস্ক সম্পর্কে তার নীতি পরিবর্তন করে।
একেই খিলাফৎ আন্দোলন বলে। গান্ধীর কিন্তু তুরস্ক সাম্রাজ্য বা খলিফার শাসন সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না। তিনি সম্ভবতঃ এটাও জানতেন না যে নতুন প্রজন্মের তুর্কীরা খলিফার কর্তৃত্বের অবসান চাইছিল। গান্ধীর এসবের জানারও দরকার ছিল না। তার দরকার ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্ব এবং সেই সুবাদে মুসলিম তুষ্টিকরণ। (ক্ষমতা লাভের জন্য সেই ট্রাডিশন ভারতে আজও চলছে।) তিনি বললেন যে, মুসলমানেদের দাবী যথার্থ (অর্থাৎ তুরস্ক-সুলতানের খলিফাত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে, তুরস্কবাসী পছন্দ করুক বা না করুক) গান্ধীর মধ্যে ভারতীয় মুসলমানরা আর এক খলিফাকে দেখতে পেল। গান্ধী আরও বললেন যে, হোমরুল-এর দাবীর মতই খিলাফৎ ও একই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দেখা গেল ১৯১৯ সালের ২৪ নভেম্বর দিল্লীতে যে খিলাফৎ সম্মেলন হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তার সভাপতি। সম্মেলনে গান্ধীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত হল যে তুরস্কর বিষয়ে বৃটিশ সরকার যদি মুসলমানদের মনোমত ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তারা বয়কট ও অসহযোগ আন্দোলন করবে। এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগের সম্মেলনেও সমর্থিত হল। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে অমৃতসরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলন। তার কিছুদিন আগেই খিলাফৎ আন্দোলনের দুই প্রধান নেতা মহম্মদ আলি ও সওকত্ আলি (আলি ভ্রাতৃদ্বয়) জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আলি ভাইদের গান্ধীর ভীষণ প্রয়োজন ছিল কারণ তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের অবিসংম্বাদিত নেতা। (মুসলমান নেতাদের তোয়াজ করা ও দলে টানার যে ট্রাডিশন গান্ধী তৈরি করেছিলেন তা আজও বলবান।) অমৃতসর কংগ্রেসে পাঞ্জাবে ইংরাজ বর্বরতা যা কয়েকমাস আগে এপ্রিলে ঘটেছে – কোন গুরুত্বই পেল না। গুরুত্ব পেল খিলাফৎ আন্দোলন এবং সেই আন্দোলন পরিচালিত হবে গান্ধীর দ্বারা। (এইভাবে গান্ধী পেলেন ক্ষমতা আর মুসলমানরা স্বাদ পেল তুষ্টিকরণের সুবিধার।)
এই কারণেই একথা বলছি যে, মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ (Pan Islamism) প্রতিষ্ঠা এর আগেও হয়েছিল, কিন্তু ফলবতী হয়নি। খিলাফৎ আন্দোলন আগেও শুরু হয়েছিল কিন্তু দাগ কাটতে পারেনি।
ইতিহাস বলছে - ঊনবিংশ শতাব্দীতে জামাল-উদ-দিন আল-আফগানী (১৮৩৯-৯৭) একজন উল্লেখ্য মুসলমান নেতা ছিলেন। ইউরোপীয় প্রভাব ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য তিনি মুসলমান দেশগুলিকে নিয়ে একটি খিলাফৎ (Caliphate) তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং একটি শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেই সাম্রাজ্যে ইউরোপীয় প্রভাব থাকবে না।
বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন যে, সেই জামালউদ্দিন আল আফগানী ১৮৮০ ৮১ সালে আফগানিস্থান থেকে ভারতে আসেন এবং ভারতের মুসলমান নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও গোপন বৈঠক করেন। তিনি কলকাতায় এসেছিলেন এবং নবাব আবদুল্লা লতিফ ও তাঁর পরিচিত কিছু শিক্ষিত মুসলমানের সঙ্গে যুক্ত হন। বিচারপতি আমীর আলী ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। ইসলাম সাম্রাজ্যবাদের বীজ সেই জামালুদ্দীনই ভারতে পুঁতে দিয়ে গেছিলেন। (Memoirs of my life and time B. C. Paul, Vol-I, P. - 417)
ইসলাম সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব যে পড়েছিল তা বোঝা যায় যখন মুসলমান নেতারা হান্টার কমিশনের কাছে দাবী করেছিলেন হিন্দু এবং মুসলমানদের - সম্পূর্ণ পৃথক প্রাথমিক শিক্ষা এবং শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসাবে দাবী করেছিলেন উর্দুভাষা যা বাংলার ৯৯ শতাংশ মুসলমান জানতই না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ১৯১১ সালে গোখেলের ৬০ জন হিন্দু ও ৪০ জন মুসলমান নেতাকে নিয়ে বৈঠক। মুসলিম অর্থে পালিত মোহনদাস সেই বৈঠকে বলেছিলেন যে, মুসলমানরা যা চায় হিন্দুদের তার সবকিছুই দিয়ে দেওয়া এবং উল্লসিত হওয়া উচিত। কিন্তু মোহনদাস-এর মত সমস্ত হিন্দুই মুসলমান অর্থে প্রতিপালিত নন। তাই তার কথায় গুরত্ব তখন ছিল না। কিন্তু সেই গুরুত্ব মোহনদাস এখন দিতে চাইলেন - খিলাফৎ আন্দোলনের মাধ্যমে। খিলাফতের সঙ্গে ভারতের কোন ধরণের সম্পর্কই থাকার কথা নয়। ভারত তখন বিদেশী শাসনাধীন, ভারতের কোন নিজস্ব সরকারও নাই। মোহনদাস বীজটি পাকাপাকিভাবে ঢোকালেন। একমাত্র উদ্দেশ্য মুসলমান শক্তি সঙ্গে রেখে নেতৃত্বে যাওয়া তাতে দেশের যা হয় হোক।
মোহনদাস কখনও ইতিহাস পড়েন নি। ভারতেরতো নয়ই। তিনি বলতেন - ইতিহাস পড়ব না, ইতিহাস তৈরি করব। ফলে হয়েছিল What is play to you, is death to us। ব্যাংদের যে শিশুরা খেলার ছলে ঢিল মারছিল, ব্যাং-এর প্রধান শিশুদের ঐ কথা বলেছিল যে তোমাদের কাছে ঢিল ছোঁড়া একটা খেলা হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে তা মৃত্যু। মুসলমানদের নিয়ে মোহনদাস এমন খেলা খেললেন যে দেশ ভেঙ্গে পাকিস্তান হল- আর হিন্দুস্তানে যে মুসলমানরা থেকে গেলেন তাদের তুষ্টিকরণ হিন্দুস্থানের রাজনীতিতে পরিণত হল। মোহনদাসের 'খেলা' ভারতবাসীর বিভাজনে পরিণতি পেল।
অমৃতসরে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেস সম্মেলনে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহে পাঞ্জাবে যে রক্তগঙ্গা বয়েছিল যে রক্ত তখনও শুকোয়নি, সেই বিষয়টি কোন গুরুত্বই পেল না। একমাত্র গুরুত্ব পড়ল খিলাফৎ আন্দোলনের উপর এবং নেতৃত্ব এল মোহনদাসের উপর।
১৯২০ সালের ১৯ জানুযারী মোহনদাসের নেতৃত্বে খিলাফতের স্বপক্ষে ভাইসরয়ের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হল। এ ব্যাপারে ভাইসরয়-এর কিছু করারই ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি তুরস্ক সম্পর্কে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল ভাইসরয়-এর তাতে কোন হাত ছিল না আর মিত্র শক্তি ভাইসরয়-এর পরামর্শে চলে না। ফলে ১৭ মার্চ ভাইসরয় যা বললেন তা খেলাফতীদের পক্ষে নিরাশাব্যাঞ্জক ছিল।
ঐ বছর মোহনদাস একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে অতঃপর মুসলমানদের অসহযোগ আন্দোলনে নামার পরামর্শ দিলেন। অর্থাৎ তুরস্কের খলিফা এবং তার খেলাফতি এখন জীবনমরণ সংগ্রাম। অথচ খোদ তুরস্কেই খলিফাপদ অবলুপ্ত হয়ে গেলেও মুসলমান দুনিয়ায় একটি পাতাও নড়ল না। কিন্তু মুসলিম পোষকতায় পালিত মোহনদাস ঐ ঋণ শোধ করতে দেখালেন যে মুসলমানদের থেকেও তার কাছে খেলাফৎ অধিক প্রেমের, অধিক মান্যতার। । প্রসঙ্গত বলি, মোহনদাস কোনকালে ইতিহাস পড়েন নি। তিনি জানতেনও না যে বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তৈরির আপ্রাণ হিন্দু প্রচেষ্টায় বাধা দিয়ে মুসলমানরা মুসলীম লীগ তৈরি করেছিল। তা সত্ত্বেও বঙ্গ -ভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দেলন শতভাগ সফল হয়েছিল এবং এই আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিলেন মুসলিম নেতৃত্ব। হিন্দু মুসলিম ঐক্য যে সম্ভব নয় তা প্রায় এক হাজার বছর আগে আলবিরুনী (৯৭৩-১০৪৮) বুঝেছিলেন। তিনি লিখেছেন - হিন্দুরা সমস্ত বিষয়ে আমাদের থেকে পৃথক। প্রথমত ভাষায় আলাদা। দ্বিতীয়ত ধর্ম বিষয়ে একেবারেই আলাদা। আমরা যা বিশ্বাস করি, তারা তা করে না। আবার তারা যা বিশ্বাস করে আমরা তা করি না। তৃতীয়ত, শিষ্টাচার, আদব কায়দা, পোষাক সমস্ত বিষয়েই বৈপরিত্য। যেন আমরা শয়তান সম্ভৃত এবং যা কিছু ভাল এবং উচিত আমরা তার বিপক্ষে।
(সূত্র ঃ Albirunis India. Sachon P-17-22 as quoted in যারা মুসলমান বলে গর্ব বোধ করেন – অমলেশ মিশ্র) (আলবিরুনী সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের সময় তার সঙ্গে ছিলেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার পুস্তক লিখেছেন।)
আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে যারা কোরাণ-শরিফ ও ৬ জনের সহী হাদিশের যে কোনও একটি পড়েছেন - তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের বিষয়টি কল্পনা করতে পারবেন না। শুধু হিন্দু কেন, মুসলিমদের সঙ্গে অন্য কারুরই ঐক্য সম্ভব নয়। ভারতের মনীষিরা এটা বুঝেছিলেন। তবে তারা কেউই ভারতবাসী হিসাবে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করতেন না। দেশের সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্ম সংস্কারে তাদের অসামান্য অবদান শুধুমাত্র ভারতকেই অলংকৃত করেনি, সারা বিশ্বে ভারতবর্ষকে একটি শ্রদ্ধার স্থানে বসিয়েছিল- রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম, কেশবচন্দ্র সেন, দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, রামকৃষ্ণ পরহমংস, বিবেকানন্দ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল - প্রমুখ যারা কখনও হিন্দু-মুসলমান পার্থক্য করেন নি, তাদের ঐক্যর কথাও বলেন নি। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য অনুধাবন করেছিলেন যে, ঐ ঐক্য সম্ভব নয়। এঁরা ছিলেন হিন্দু। তাই হিন্দু আদর্শ অনুযায়ী এরা শুধু মানবিকতার আদর্শই তুলে ধরেছিলেন। যে আদর্শ বলে প্রত্যেক মানুষ অমৃতের পুত্র এবং বসুধার সকলেই আমার কুটুম্ব। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনের জন্য যে সব প্রচেষ্টা হয়েছিল, মোহনদাস তার কিছুই জানতেন না। জানার কথাও নয় আর তা জানার দরকার তার ছিল না। তিনি চাইছিলেন মুসলমানদের ব্যবহার করতে আর মুসলমানরা চাইছিল মোহনদাসকে ব্যবহার করতে। মোহনদাস মুসলমানদের ব্যবহার করে। ক্ষমতায় গেলেন যেখান থেকে ভারতের বীরত্বকে ক্লীবত্বে পরিণত করা যায়। আর মুসলমানরা মোহনদাসকে ব্যবহার করে পাকিস্তান পেল আর হিন্দুস্থানে তুষ্টিকরণের রাজনীতির যাবতীয় সুবিধা ভোগ করল।
মোহনদাসের এটাও বোঝার ক্ষমতা ছিল না যে ইসলাম সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদ পরস্পর বিরোধী। ইসলাম সাম্রাজ্যবাদকে প্রশ্রয় দিলে জাতীয়তাবাদ মার খাবে, খেয়েছেও। ভারতের যে মানুষদের ভালমন্দ, হাসিকান্না ভারতের বাইরের তুরস্ক বা অন্য কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করে, তারা কখনও ভারত জাতীয়তার অংশ হতে পারে না। মুসলমান নেতারা নিজেরাও এটা স্বীকার করেছেন বলেছেন আমরা Super Nationalist |
তাই খিলাফৎ আন্দোলনের মধ্যেই যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপদ লুকিয়ে আছে মোহনদাসের সেটা না বোঝার খেসারৎ কোটি কোটি ভারতবাসীকে দিতে হয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য যে কোটি কোটি মানুষ ও তাদের দেশের স্বার্থ নষ্ট করে তাকে 'মহাত্মা' বলা তো একরকম ব্যঙ্গ বা উপহাস।
খেলাফৎ কমিটি : মোহনদাসের পরামর্শমত মুসলমান নেতৃত্ব অসহযোগ আন্দোলনে সম্মতি দিলেন, তারই পরামর্শ মত সর্বক্ষমতা সম্পন্ন একটি কমিটি হল। সেই কমিটিতে থাকলেন ৬ জন মুসলমান আর একজন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৯২০ সালের ১ আগষ্ট গান্ধী অসহযোগ শুরু করলেন কেবলমাত্র মুসলমানদের খেলাফতির জন্যই।
গান্ধীর নেতৃত্বের রাস্তা সম্পূর্ণ পরিস্কার হয়ে গেল লোকমান্য তিলকের মহাপ্রয়াণে। রাজনীতির এই ব্যাভিচার ও কপটাতা তাঁর মত নির্ভীক, স্বার্থত্যাগী দেশপ্রেমিকের পক্ষে সহ্য করা বোধ হয় সম্ভব হত না। তাই যেদিন অসহযোগ শুরু হল – সেই ১ আগষ্ট ১৯২০। সেই দিনই তাঁর লোকান্তর হল। মোহনদাসের রাস্তা পরিস্কার।
আর এক অনমনীয় ইংরাজ বিরোধী নেতা লালা লাজপৎ রাই এতদিন নজরবন্দী ছিলেন আমেরিকায়। তিনি ফিরলেন বটে তবে যা ঘটানোর গান্ধী তা আগেই ঘটিয়ে নিয়েছেন। গুজরাটের বেনিয়াদের স্বার্থ বুদ্ধির সুনাম আছে।
আরও একটি কপটতার বিষয় এই প্রসঙ্গে বলতে হয়। সেটি হল গান্ধীজী বলেছিলেন যে মুসলমানদের খিলাফতের হিন্দুরা যেমন তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তেমনি মুসলমানদেরও হিন্দুদের ধর্মবোধে সম্মান জানিয়ে গো হত্যা বন্ধ করতে হবে। তবে এগুলি শর্ত হিসাবে ধরা হবে না। হিন্দুরা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য খিলাফৎ প্রসঙ্গে গোহত্যা মুসলমানরা বন্ধ করুক না করুক। ইতিহাস বলছে গান্ধীর এই কথা মুসলমানদের সামান্যও প্রভাবিত করেনি। কারণ গোহত্যা আজও চলছে। তবে হিন্দুরা খিলাফতে যোগ দিয়েছিল।
হত্যাকান্ডের বিষয়টিও যুক্ত করা হক। গান্ধী আপত্তি করলেন। ওটা একটা স্থানীয় বিষয়, খেলাফতের মত বিশাল ওজনদার বিষয়ের সঙ্গে এই বিষয়টি জোড়া যায় না। গান্ধীজী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, অমৃতসর কংগ্রেসেই তিনি প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। I must regard my participation in Congress proceedings in Amritsar as my real কেউ কেউ বললেন যে, এই প্রসঙ্গে পাঞ্জাবের entrance to Congress politics. ১৯২০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর কলকাতায় কংগ্রেসের বিশাল অধিবেশন। লোকমান্য তিলকের প্রয়াণে সকলেই ব্যথিত। কলকাতা কংগ্রেসে গান্ধীজী যে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করলেন তার একনম্বরে আছে খিলাফৎ আর দু নম্বরে পাঞ্জাব। কংগ্রেসের প্রস্তাবে 'স্বরাজ’ এর কথা নাই। বিষয়টি নজরে পড়ল সি. ভিজিয়া রাঘবচারিয়ার। তার কথায় তখন 'স্বরাজ' কথাটা এল তিন নম্বরে।
যে 'স্বরাজ' মোহনদাসের কলমের ডগায় আসেনি, রাঘবাচারিয়ার কথায় তিন নম্বরে এসেছে, ভাষণে মোহনদাস বললেন ঠিকমত অসহযোগ চললে এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ আসবে। এই বাক্যটি তিনি জেনেশুনেই লোককে ভুল বুঝাতে বলেছিলেন এবং অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছিল। যে মানুষটি প্রস্তাবে ‘স্বরাজ’ শব্দটি উল্লেখ করতে ভুলে যান, বোঝাই যায় তিনি ঐ কথাটায় শোন গুরুত্বই দেন নি। অথচ মুখে বললেন এক বছরে স্বরাজ আসবে। ‘সত্য’ নাকি গান্ধীর ঈশ্বর।
এই মুসমলান সমর্থন নিশ্চিত হল আলী ভাইদের মুক্তি পাওয়ার পর। সম্রাট পঞ্চ জর্জ, মন্টেগু চেম্স্ফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী যে আইন তৈরি হয়েছিল। তাতে স্বাক্ষর করলেন ১৯১৯-এর ২৩ ডিসেম্বর। আইন লাগু হবে ১৯২১ থেকে। সম্রাট ঐ উপলক্ষ্যে রাজবন্দীদের মার্জনা করেন। সেই সূত্রে আলী ভাইরা ছাড়া পান। মোহনদাস তাদের পেয়ে ভারী খুশি। মুসলিম কর্তৃত্ব তার হাতে। তিনি এমন ধমকও দিলেন যে কংগ্রেস যদি অনুমোদন নাও করে তিনি একাই আন্দোলন করবেন। 'একা'র আন্দোলনের পরিণতি আমরা দেখেছি। দিল্লী, গুজরানওয়ালা, কসুর ও জালিয়ানাওয়ালাবাগে। কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে (৪ সেপ্টেম্বর) কংগ্রেস দখল করার পরিকল্পনা নিয়েই মোহনদাস এসেছিলেন। তার সঙ্গে ছিল ৩০০ খেলাফৎপন্থী ও প্রচুর টাকা। তিলক অনুপস্থিত, মতিলাল নেহেরু সভাপতি এবং চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিন চন্দ্র পাল ব্যতীত আর বড় নেতা নাই। মতিলালের সঙ্গে মুসলিম মোহনদাসের সম্পর্ক হঠাৎ বেশ ভাল দেখা গেল। ভিতরের ব্যাপার বাইরে এল না। ৫ সেপ্টেম্বর বিষয় নির্বাচনী
কমিটি গুলি মোল্লা-মৌলভীদের সাহায্যে মোহনদাস দখল করলেন। অধিবেশন শুরুর আগে পর্যন্ত মতিলাল, চিত্তরঞ্জন, জিন্না, বেসাত্ত, কেলকার এবং কস্তুরী আইয়ারদের অসহযোগে আপত্তি ছিল। মোহনদাসের খিলাফৎ আন্দোলনে আপত্তি করেছেন অনেকেই – যেমন রবীন্দ্রনাথ, কেলকার, এ্যান্ড্রুজ, রামস্বামী আইয়ার, বল্লভ ভাই প্যাটেল, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক এমনকি মোহনদাসের দক্ষিণ আফ্রিকার সৈনিক পোলক। পোলক মন্তব্য করেছিলেন মোহনদাস বিপজ্জনক, হাততালি লোভী, অজ্ঞান, সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন। মোহনদাস তখন সত্যিই আনন্দে উন্মাদ। তার আনন্দের শেষ নাই। মুসলমানদের সঙ্গে পেয়েছেন, কংগ্রেসে প্রাধান্য পেয়েছেন এবং ইংরাজদের উদ্বেগ কাটিয়েছেন যে, দেশের মানুষ আর জালিয়ানওয়ালাবাগ ও স্বরাজ নিয়ে কিছু করবে না। ইংরাজরা বিলক্ষণ জানত যে খেলাফৎ আন্দোলন-মুসলমান দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কহীন, মুসলমান দেশগুলিই খেলাফতের বিরুদ্ধে – এই আন্দোলন - একান্তভাবেই গান্ধীর সন্তান। গান্ধী যদি ঐ খেলনায় ব্যস্ত থাকতে চান, ইংরাজ শাসনের কোন সমস্যা নাই। কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে তা নাগপুরে সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদন করাতে হবে। অধিবেশন হচ্ছে নাগপুরে ১৯২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সভাপতি বিজয় রাঘবাচারিয়ার সভাপতিত্বে সম্মেলন। ইতিমধ্যেই গান্ধী আলি ভাইদের নিয়ে কখনও বা মতিলালকে নিয়ে সারা ভারত ঘুরে প্রচার করেছেন। (নিজের ভাবমূর্তি গড়তে প্রচারের উপর বরাবরই খুব গুরুত্ব দিয়েছেন মোহনদাস) নাগপুর সম্মেলনে প্রতিনিধি সংখ্যা দাঁড়ালো ১৪০০০। কলকাতার বিশেষ অধিবেশনের সিদ্ধান্তে চিত্তরঞ্জন দাস অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এক বিরাট প্রতিনিধিদল নিয়ে নাগপুর গেছিলেন। তিলকের সহযোগী খাপার্দে এবং জিন্নাও অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। (লক্ষ্য করুন, মুসলমান নেতা জিন্না খিলাফৎ আন্দোলনের বিরুদ্ধে কারণ
চলবে..>
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ