তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় খৃ. পূ. ১০০০ অব্দ থেকে ৫০০ খৃষ্টাব্দ
ইতিহাস : তক্ষশীলার অবস্থান ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে; যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে খুব কাছে। তক্ষশীলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৯ মিটার (১,৮০১ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। ভারতবর্ষের তক্ষশীলা ১৯৪৭ সালের পরে আর ভারত ভূখণ্ডে নাই। এই স্থান ১৯৪৭-এর ১৫ আগষ্টের পর থেকে পাকিস্তান নামক ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত। এবং সব ভারতবর্ষীয়ই অবগত যে পাকিস্থান নামিত ভূখণ্ডটিও এই সাল তারিখের পূর্বে ভারতবর্ষেরই অঙ্গ ছিল। ভারতে আগত এত সংখ্যক বিদেশীদের মধ্যে আরব ও সন্নিহিত ইসলাম দেশ থেকে আগত বিদেশী ইসলামীরা ভারতবর্ষের যে ক্ষতি করেছে, আর কোন বিদেশী শক্তি তা করতে পারেনি বা করেনি কারণ তারা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছিল। তবে ভারতের এই অঙ্গচ্ছেদ-এর জন্য কেবলমাত্র ইসলামীরা দায়ী বললে ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়। এই অঙ্গচ্ছেদ ব্যবস্থার জন্য তৎকালীন ভারতের সমস্ত প্রধান ব্যক্তিই যুক্ত ছিলেন। অঙ্গচ্ছেদ-এর বিরোধিতা তদানীন্তন নেতাদের কেউই করেননি। এমনকি নেতাদের নেতাও এই অঙ্গচ্ছেদ ব্যবস্থার শরীক ছিলেন।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় |
প্রাচীন ভারতের বিশ্ব বিদ্যালয়গুলির মধ্যে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রাচীনতম। শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে খৃ. পূ. সপ্তম শতাব্দী থেকে অতুলনীয় প্রশংসার অধিকারী হলেও কয়েক শতাব্দী আগেই সেই বীজ উপ্ত হয়েছিল।স্থানটির নাম -তক্ষ নাম থেকে এসেছে। তক্ষ ছিলেন ভরত-এর পুত্র। রামায়ণ সূত্রে জানা যায় যে, ভরত, গন্ধর্বদের পরাজিত করে দুটি প্রধান নগর স্থাপন করেন - পুত্র তক্ষকে তিনি তক্ষশীলায় এবং অপর পুত্র পুরুষকলাকে দেন পুস্কলাবত- যেটি গান্ধার রাজ্যে অবস্থিত ছিল। এইটি সেই স্থান যেখানে রাজা জনমেজয় পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্পসত্র বা সর্পযজ্ঞ করেছিলেন। এই স্থানটি অনেক গবেষণার পর নির্ণীত হয়েছে। প্লিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্থানটি সিন্ধু নদের পূর্ব দিকে ৫৫ মাইল দূরে অবস্থিত। কানিংহাম, অনেক স্তূপ, বিহার, মন্দির ইত্যাদি ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করে চিহ্নিত করেছেন যে, স্থানটি রাওলপিণ্ডি থেকে পশ্চিমে ২০ মাইল দূরে। প্রত্নতাত্বিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, নগরটি ছয়বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছিল। প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে তক্ষশীলা নামটিও পাওয়া গেছে। আরও নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে কালাকসরাই নামক স্থানের দক্ষিন-পূর্বে সাধারীর নামক স্থানের কাছে। এই স্থানটি কথিত কালাক সরাই থেকে এক মাইল দূরে।
পরিচালনা
এই প্রতিষ্ঠানে পরিচালনার কোন নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব বা অথরিটি ছিল না। যিনি যে বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন, তিনিই সর্বেসর্বা। কাকে পড়াবেন, কাকে পড়াবেন না, কীভাবে পড়াবেন, বিষয়টির পাঠক্রম কী হবে – সমস্তই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক বা শিক্ষকের এক্তিয়ার। আর কারুর মাথা ঘামানোর বা নাক গলানোর কোন সুযোগ ছিল না। ফলে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধও ছিল না।
এখানে কেবল কোনও বিষয়ের উচ্চশিক্ষাই দেওয়া হত। এবং শিক্ষকরা যে যে বিষয় পড়াতেন, তিনি সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। প্রত্যেক শিক্ষক নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। এবং সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যুক্ত - যাকে স্বায়ত্ত শাসন বলা যায়। ছাত্রদের প্রাত্যহিক রুটিনও তিনি স্থির করতেন। শিক্ষকের প্রতি নিঃসত আনুগত্য তথা আত্ম সমর্পন ছিল পাঠারম্ভের প্রথম শর্ত। শিক্ষকের গৃহই ছিল শিক্ষায়তন। যদি কোন ছাত্র সেই গৃহের সব কিছু মানিয়ে নিতে না পারে, শিক্ষক তাকে পড়া ছেড়ে চলে যেতে বলতেন। মনে হয়, তক্ষশীলায় বিভিন্ন বিষয়ের বহু বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন এবং এই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা নিজেদের বাড়িতেই, নিজেদের তৈরি করা নিয়মেই ছাত্র ও পাঠক্রম পরিচালনা করতেন। প্রথম দিকে নিশ্চয় বৌদ্ধ বিহার-এর মত কিছু গড়ে উঠেনি। (বলা যায় যে, স্থানটি বিশিষ্ট পণ্ডিতদের নিয়ে, এখন কমপ্লেক্স বলতে যা বুঝায় সেই ভাবে অধ্যাপক কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছিল – লেখক)। কোন বিশেষ বিষয়ে উচ্চশিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বহুদূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসত। যেমন পাটলিপুত্র থেকে জীবক চিকিৎসা শাস্ত্র শিখতে তক্ষশীলা গেছিলেন। এই অধ্যাপক কমপ্লেক্স-এর সমস্ত বিশেষজ্ঞদের যে বিশেষ বিষয়ে যে জ্ঞান, তার যোগফল বা সমষ্টিকেই তক্ষশীলাকে এত বিখ্যাত করেছিল।
সাধারণত কোন বিশেষ বিষয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য আট বছর সময় লাগত। তবে শিক্ষকের ইচ্ছায় – ছাত্রর গ্রহণ, ধারণ ও প্রয়োগ ক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রেখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এই কাল কমাতে বা বাড়াতে পারতেন। পাঠগ্রহণের এই আট বছর ছাত্রকে শিক্ষকের কাছেই থাকতে হত। শিক্ষা শেষে, কোন ডিপ্লোমা বা ডিগ্রী দেওয়ার রেওয়াজ বা ব্যবস্থা ছিল না। কোন সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠানও হত না। এই রকমই ভাবা হত যে জ্ঞান নিজেই নিজের পুরস্কার। সার্টিফিকেট, ডিপ্লেমা ইত্যাদি দিয়ে এবং সেই সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা দেখিয়ে জীবিকা অর্জনের প্রয়াস মানেই - জ্ঞানের অপবিত্রকরণ।
কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষা
তক্ষশীলায় যে কোন বিষয়েরই কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষা দেওয়ারই ব্যবস্থা ছিল। ধরে নেওয়া হত যে, সংশ্লিষ্ট ছাত্র প্রাথমিক শিক্ষা এবং তার পরের স্তরের শিক্ষা অন্য কোথাও গ্রহণ করে তবেই তক্ষশীলা এসেছে। তার অর্থ দাঁড়ায় এই এখানে ছাত্রদের ভর্তি হওয়ার বয়স ষোল থেকে কুড়ি বছর। পাঁচ বছর বয়সে যদি বিদ্যারম্ভ হয় তাহলে প্রাথমিকে চার বছর এবং তার পরের স্তরে আরও ছয় বছর। আশ্রমিক শিক্ষায় গেলে বারো বছর। তাহলে ছাত্রর বয়স দাঁড়ায় ১৭-১৮ বছর। অর্থাৎ ছাত্রের ভর্তির বয়স দাঁড়ায় প্রায় পনের ষোল বছর থেকে ১৭-১৮ বছর।
তক্ষশীলা ভারতের যে কোন স্থান থেকেই যথেষ্ট দূরবর্তী। পথ ঘাট যেমন দুর্গম তেমনি বিপদ সঙ্কুল। অভিভাবকরা যখন বাড়ির ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য তক্ষশীলা পাঠাতেন তখন যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েই পাঠাতেন। এতপথ অতিক্রম করে তক্ষশীলা পৌঁছাতে পারবে কি-না তাও তাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ ছিল। এরকম উল্লিখিত আছে যে বারাণসী, রাজগৃহ, মিথিলা, উজ্জয়িনী, কোশল, মধ্যদেশ, কুরুরাজ্য প্রভৃতি স্থান থেকে দল বেঁধে ছাত্ররা তক্ষশীলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করত। পড়াশোনা হয়ত তারা বিভিন্ন বিভাগে করবে কিন্তু দল বেঁধে যাওয়ার অর্থ ছিল অনেকটা নিরাপত্তা পাওয়া।
তক্ষশীলায় যে এতদূর দূরান্ত থেকে, এত ঝুঁকি নিয়ে ছাত্ররা আসত, তার একমাত্র কারণ ছিল উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল তক্ষশীলা এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা ছিলেন তক্ষশীলায়। ফলে তক্ষশীলা তদানীন্তন ভারতবর্ষের মেধা কেন্দ্র ও বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসাবে পরিগণিত ছিল। এমনকি অন্যান্য স্থানের শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশীলা কেন্দ্রের অনুমোদন চাইত।
পাঠক্রম
এত দীর্ঘকাল স্থায়ী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রম - এত কাল ধরে একই রকম থাকা সম্ভব নয়। সম্ভবত ছিলও না। তাছাড়া এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অনেক বিদেশী শক্তিও ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল। পাঠক্রমে তার প্রভাব পড়াও খুব স্বাভাবিক ছিল। এটাও স্বাভাবিক যে যাঁরা স্বভাবে জ্ঞান-পিপাসু, তারা নূতন কোন জ্ঞানের বিষয় পেলে, তা অধিগত করার চেষ্টা করবেন। আর তক্ষশীলাতে ছিল জ্ঞান ভিক্ষু ও জ্ঞানীদের কর্মভূমি।
যতদূর জানা গেছে, তক্ষশীলায় বহু বিষয়েরই শিক্ষাদান হত। প্রধানত শিক্ষা বিষয়গুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল – বেদ ও শিল্প। আরও সহজভাবে বলা যায় - সাহিত্য ও বিজ্ঞান। তবে এখানে কেবল ঋক, সাম এবং যজুর্বেদই পড়ানো হত। অথর্ববেদ কেন পাঠক্রমে ছিল না তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এর একটি কারণ এই রকম হতে পারে যে অথর্ববেদ ছিল অনেকটা সেকুলার ধর্ম নিরপেক্ষ তাছাড়া অথর্ববেদ-এর বিষয়বস্তুর অনেকটা শিক্ষা, শিক্ষার বিভিন্ন শেখানো কিন্তু অথর্ববেদকে ত্যাগ করা অসম্ভব ছিল কারণ মনুর মত পুরোহিতকে অথর্ববেদ বিশেষজ্ঞ হতে হত। বেদ পাঠ বলতে শুধু পাঠ বোঝাতো তা নয় অর্থবোধও বোঝাত। কারণ হিন্দু সংস্কৃতি যে এত হাজার ধরে প্রবহমান আছে, অর্থযুক্ত অবদান ব্যাখারও প্রয়োজন অন্যথায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার কথা উঠত না। এই সময়কালে বেদ জ্ঞানের ভিত্তিতে অনেক রচিত হয়েছিল। বেদ-এ শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে রচিত নিরুক্তকে এইরকম হয়েছে। যে অর্থ বুঝে বেদ পাঠ করে ভারবাহী পশুর মত। সে শুধু করছে, কিন্তু কী বহন করছে জানে না। করা হয় বেদপাঠের অঙ্গ হিসাবে ছয়টি শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিঘন্টু, ছন্দ জ্যোতিষও পড়ানো হত। একসময় শাস্ত্রও পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকতে বেদ-এর অর্থবোধে বেদাঙ্গর প্রয়োজন সুবিদিত।
শিল্প বিভাগ প্রসঙ্গ আলোচনায় উল্লেখ করতে হয় যে ১৮টি শিল্প বিদ্যা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দুই দিকেই শেখানো হত। তবে সেই ১৮টি শিল্প যে ঠিক কোনগুলি তা নির্দিষ্টভাবে গবেষণাকারীরা উল্লেখ করেন নি। কেউ কেউ বলেছেন যে এই শিল্পগুলি হল- আইন, সাত্ম্য, ন্যায়, বৈশেষিক, গণিত, চিকিৎসা, সঙ্গীত, পুরাণ, ইতিহাস, ধনুর্বেদ বা যুদ্ধ বিজ্ঞান, কাব্য। অপর কেউ কেউ বলেছেন, যে কতকগুলি বৃত্তি এবং কারিগরী বিদ্যাও শেখানো হত। যেমন- হিসাব শাস্ত্র, চাষ বা কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন ও পশু উৎপাদন, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, লোহা প্রভৃতি ধাতুর শিক্ষা, কাঠের কাজ, ভেষজ, শল্য চিকিৎসা, ধনুর্বিদ্যা, জ্যোতিষ, জ্যোতির্বিদ্যা, জাদু বিদ্যা, দৈব কথন, সাপ ধরা, গুপ্তধন আবিস্কার, নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন। বোঝাই যাচ্ছে ১৮টি শিল্প বলতে আক্ষরিক অর্থ বোঝাতো না।
ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রমে নতুন নূতন বিষয় নিশ্চয় সংযোজিত হত। ১৫০০ বছরের জীবনে এ সব ঘটনার প্রভাব তক্ষশীলাকে অবশ্যই বহন করতে হয়েছে।
খৃ. পৃ. ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য দেশীয়রা ভারত আক্রমণ করে। এর ফলে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপির স্থলে খরোষ্ঠি লিপি গ্রহণ করতে হয়। খৃ. পূ. দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইন্দো-ব্যাকট্রিয়ানরা তক্ষশীলা এলাকা দখল করে। এরা গ্রীক সংস্কৃতির মানুষ। ফলে কিছু পরিবর্তন নিশ্চয় হয়েছিল। জানা গেছে যে গ্রীক ভাষা শিক্ষার প্রবর্তন হয় এবং পাশাপাশি এলাকার অনেক মানুষই গ্ৰীক ভাষা বুঝত। শিক্ষকরাও উদার হৃদয় এবং জ্ঞান ভিক্ষু চরিত্রের হওয়ায় গ্রীকদের প্রবর্তিত কোন বিদ্যা শিখতে ও শিখাতে আপত্তি করেন নি।
খৃ. পৃ. প্রথম শতাব্দীতে স্কিথিয়ানরা আসে। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে আসে কুষাণরা। কিন্তু স্কিথিয়ান ও কুষাণদের নিজেদের দেওয়ার মত কোন শিক্ষা বা সংস্কৃতি ছিল না। ফলে শিক্ষা পাঠক্রমে কোন প্রভাব পড়েনি, পরিবর্তন ঘটেনি। পঞ্চম শতাব্দীতে হুণরা এল।
তক্ষশীলা এলাকায় হুণদের তান্ডবও হয়েছিল। পাঠক্রমে হুণদের কোন প্রভাব কি-না প্রভাব পড়েছিল, না। আরও কথা এই সময়েই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিঃশ্বাস পড়েছিল।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের মধ্যভাগে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম জন্ম ও লাভ করেছিল শতাব্দীতে। বুদ্ধের জন্মস্থান এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কেন্দ্র তক্ষশীলা থেকে বহুদূরে ছিল। তক্ষশীলা বৈদিক শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু ভারত থেকে বহু সংখ্যায় আসত তক্ষশীলায় ফলে একথা মনে আছে অন্ততঃ বৌদ্ধ ধর্মমতের প্রধান অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। আবার শতাব্দীতে বৌদ্ধদের মধ্যে মহাযান শাখা প্রাধান্য পায়। তক্ষশীলায় বৌদ্ধ শিক্ষার বিষয়টি হয়ত গুরুত্ব পেয়েছিল। ধর্ম প্রচার অথবা ধর্ম যুক্তিযুক্ত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ছিল বরং উল্টোটাও পারে বুদ্ধধর্মকে নাকচ করার জন্যই মতবাদ মনযোগ দিয়ে এবং পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করা হয়েছিল।
বিজ্ঞান বিষয়গুলির ক্ষেত্রে জ্ঞান যথেষ্ট বলে আদৌ গ্রহ্য হয়নি। তাত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানও বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রত্যেক তত্ব আলোচিত হওয়ার পর তা হাতেকলমে প্রয়োগ করা হত। কোন কোন নিজেদের প্রতিভা ক্ষমতার উপর ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনও ঝুকি নেওয়া হত না কারণ এই বিদ্যার সঙ্গে মানুষের জীবনমরণ যুক্ত যতদিন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারত, ততদিন শিক্ষকের অধীনেই থাকত। শিক্ষক নানাভাবে পরীক্ষা নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক হতে পারবে কি-না। তারপর ছাত্র ছাড়া পেত। এই প্রসঙ্গে জীবক এর কথা উল্লিখিত হয়েছে।
অর্থ ব্যবস্থা
শিক্ষকরা ছাত্রদের নিজেদের কাছে রাখতেন এবং বিনামূল্যেই খাওয়াতেন, পড়াতেন। সমাজ এই অনেকটাই বহন করত যেহেতু সমাজ শিক্ষকদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিল এবং তাদের ত্যাগ সপ্রশংস দৃষ্টিতে গ্রহণ করত। ছাত্ররা কোন অর্থ দিতে বাধ্য ছিল না -এবং তার জন্য তাদের অন্য চোখে দেখা হত না। পড়াশোনার জন্য টাকা দিতে হবে – এই ধারণাটাই নিন্দিত ছিল। অর্থের বিনিময়ে জ্ঞান বিতরণ হবে না। হিন্দু শাস্ত্রেও বলা হয়েছে যিনি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেবেন, মনু বলেছেন, তার সঙ্গে একাসনে যাবে না। বিষ্ণু শর্মা কথার না অহম্ শতে বিদ্যা বিক্রয়ং করোমি। একশত গ্রাম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমি বিদ্যা বিক্রয় করব না। অবশ্য অর্থের অভাবে খুব কষ্ট পেতে হত না। যা যা প্রয়োজন তার সবই পাওয়া যেত। উন্নত শিক্ষা, শিক্ষকের ত্যাগ ও জ্ঞান, ছাত্রদের জ্ঞান পিপাসা, অনেক ধনী ব্যক্তিকেই অনুপ্রাণিত করত স্বেচ্ছায় অর্থ দান করতে। কোন কোন ধনী অভিভাবক ও প্রচুর অর্থ দান করতেন হয় পুত্রের অধ্যয়নের শেষে বা প্রথমে। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে তার কোন প্রভাব পড়ত না। প্রয়োজনে তারা যতদিন দরকার ততদিনই শিক্ষকের কাছে থাকতেন। রাজারাও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অনেক অর্থ দিতেন, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও
নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ করতেন না। শিক্ষকদের কর্তৃত্বই শেষ কথা। ছাত্ররাও, রীতি অনুযায়ী অধ্যয়ন শেষে গুরু দক্ষিণা দিত। ছাতা, জুতো, উদ্ধাঙ্গের বস্তু। ব্যাপারটা ছিল শ্রদ্ধা নিবেদনের, অর্থ নিবেদনের নয়। প্রত্যেক ছাত্রেরই বিনাব্যায়ে অধ্যয়নের অধিকার ছিল।
সমাজ শিক্ষার গুরুত্ব এবং সমাজে শিক্ষিত যুবকের গুরুত্ব বেশ ভাল ভাবেই উপলব্ধি করত। অনেক সময় কোন রাজা তাঁর দেশ থেকে ছাত্রদল পাঠাতেন শিক্ষার জন্য এবং তাদের খরচ বাবদ অর্থ রাজকীয় অর্থ ভাণ্ডার থেকেই দেওয়া হত। আবার এও ঘটত যে দরিদ্র ছাত্র অধ্যয়ন শেষ করে রাজার কাছে গুরু দক্ষিণা দেওয়ার জন্য অর্থ ভিক্ষা করত এবং রাজাও তা নির্মল হৃদয়ে দিয়ে দিতেন। যে রাজা গুরু দক্ষিণা দেওয়ার জন্য দান দিতেন না, তিনি নিন্দিত হতেন। অযোধ্যার রাজা রঘু, সন্ন্যাস নেওয়ার পরও ১৪ কোটি টাকা মূল্যের অলংকার দান করেছিলেন কুৎসকে যে তার কাছে অর্থ ভিক্ষা করেছিল। বিভিন্ন যজ্ঞ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে শিক্ষককে অর্থ দান করা হত। এইভাবে বিনামূল্যে ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষার মর্যাদা ও শিক্ষা ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।
ছাত্র ভর্তি
যোগ্য ছাত্র পাওয়ার বিষয়ে শিক্ষকরা খুবই উন্মুখ ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি মন্ত্রে,
হে সৃষ্টিকর্তা, জল যেমন নিম্নমুখে প্রবাহিত হয়, মাসগুলি যেমন নিরন্তর প্রবাহিত হয়, সেভাবেই ব্রহ্মচারীরা আমার নিকট আগমন করুক। কিন্তু ছাত্র মানে যে কেউই নয় যোগ্যতা বিচার ছিল একটি গুরুতর পর্ব। ভর্তি হওয়ার জন্য কোন জাতি বিচার বা বর্ণ বিচার ছিল না। একমাত্র চণ্ডাল যাদে পঞ্চম বর্ণ বলা হত, তারাই ভর্তির সুযোগ পেত না। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন বাধ নিষেধ ছিল না। ছাত্রই স্থির করত সে কোন বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করবে। মোটামুটি নীতি ছিল-
জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যেই অধ্যয়ন - নলেজ ফল নলেজ'স সেক। তবে প্রাপ্ত জ্ঞা নিয়ে ব্যবসা করা চলবে না। এইভাবে লক্ষ্য করা যায় প্রতিষ্ঠান কতটা গণতান্ত্রিক ছিল। এ গণতন্ত্র রক্ষায় ছাত্রদের আর্থিক অবস্থা নির্বিচারে কিছু কিছু নিয়মকানুন তৈরি করা হয়েছিল যেগুলি ছাত্রদের পালন করা বাধ্যতামূলক।
যোগ্যতা থাকলে ছাত্রই শিক্ষকরা যোগ্য ছিলেন ছাত্রকে যথেষ্ট বাছ-বিচার করেই। গ্রহণ করতেন। ভর্তি হয়ে ছাত্র গেছে এমন উদাহরণ পাওয়া যায় যাদের যোগ্যতা থাকত তাদের ভর্তি হওয়ার কোন সমস্যাই ছিল ছাত্রদের সর্বনিম্ন যোগ্যতা ঈর্ষা হওয়া। স্পষ্টবাদী হওয়া আত্ম সংযমী হওয়া।
খ্যাতনামা ছাত্র
শিক্ষাকেন্দ্রে কোন ব্যক্তি কী রেখে গেছেন, কোন বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় একই ভাবে যায়নি সেই সর্বত্যাগী, সর্বস্ব শিক্ষকেদর নাম, যাঁরা বিখ্যাত ছাত্র তৈরি করেছিলেন। এমন কি জাতক যা বিশ্ব বিদ্যালয় সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছে, সেটিও বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেনি।
কথিত জানা তক্ষশীলার ছাত্র ছিলেন। আরও জানা যায় চাণক্য (কৌটিল্য) যিনি চন্দ্রগুপ্তকে উপযুক্ত পরামর্শ ও দর্শন করিয়ে ধনানন্দকে সরিয়ে মগধের রাজা পরে ভারতবর্ষের সম্রাট হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ ভারত পত্তন করে অমর হয়ে আছেন, সেই এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ভারতরাষ্ট্রের স্বপ্ন চাণক্যেরই যা রূপায়িত করতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুরু হয়েছিল তাঁকে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র (চাণক্য প্রণীত) আজও রাজ্য শাসনে ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি প্রণয়নে প্রাসঙ্গিক। যায় চিকিৎসক জীবকের তক্ষশীলার ছাত্র। নৃপতি বিম্বিসারের ফিসচুলা তিনি আরোগ্য তিনি মগধের রাজ হয়েছিলেন। তিনি এবং সঙ্ঘেরও চিকিসক ছিলেন। উজ্জয়িনীর প্রদ্যোৎ-এর জনডিস রোগ নিরাময় করেছিলেন। চিকিৎসক হিসাবেও অমর। এক ব্যবসায়ীর মাথায় শল্য চিকিৎসা ক্ষতস্থান থেকে দুইটি বের করেন। শল্য চিকিৎসিত স্থান সুনিপুণভাবে সেলাই করেন ঘা শুকানোর জন্য নিজের তৈরি মলম ব্যবহার করতে দেন। জড়িয়ে যাওয়া অন্ত্রকে শল্য চিকিৎসায় চোখের সামনে আনেন, জড়িয়ে যাওয়া অস্ত্রকে জটমুক্ত করে যথাস্থানে রেখে সেলাই ও প্রয়োগযোগ্য মলম দেন। তাঁর চিকিৎসার আরও অনেক কাহিনী অমর হয়ে আছে।
পরিসমাপ্তি
আগেই বলা হয়েছে যে, কুষণরা খৃষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতবর্ষের ঐ অংশের দখল পেয়েছিল জয় করে। কুষাণরা প্রায় দুইশত বছর মোটামুটি ২৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রভৃত্ব করেছিল। কিন্তু কুষাণরা যুদ্ধবাজ হলেও অনুন্নত সংস্কৃতির এবং শিক্ষায় একান্তই অনগ্রসর ছিল। শেষ আঘাত এসেছিল বর্বর হুণদের কাছ থেকে। পঞ্চম শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগে।
বিদেশীদের দখলের এলাকার মধ্যে থেকে একটি অনুন্নত সংস্কৃতির ও অনুন্নত শিক্ষার কবলে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিষ্প্রভ হতে শুরু করেছিল। সম্ভবত ছাত্র, অর্থ এবং শিক্ষক কোনটিই সহজলভ্য ছিল না। ধুকধুক করে জ্বলা এই প্রতিষ্ঠানটি হুণদের বর্বরাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
নারী শিক্ষা
একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে এই যুগে বা সময়কালে (৬০০ খৃ. পূ. পর্যন্ত) নারী শিক্ষারও কোন অবহেলা ছিল না, তাদের জন্যও ব্রহ্মচর্য ব্যবস্থা ছিল। ব্রহ্মচর্য ব্যবস্থার পরে তারা যখন গার্হস্থ ধর্মে প্রবেশ করত, শেখা অনুশাসনগুলি তাদেরও পালনীয় ছিল যাতে তারা একটি ভাল পরিবার এবং পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে পারে। শৃঙ্খলার শিক্ষা তাদের বাড়ীর বয়স্কদের মান্যতা দিতে শিখিয়েছিল। কষ্টের মধ্যেও সংসার জীবন শান্তিতে কাটানোর শিক্ষা তারা পেয়ে যেত।
তক্ষশীলার উল্লেখযোগ্য পণ্ডিতবর্গ
চাণক্য (অর্থনীতিবিদ)
পাণিনি (ব্যাকরণবিদ, অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণের রচয়িতা)
চরক (চিকিৎসক, চরক সংহিতা নামক আয়ুর্বেদ-গ্রন্থের রচয়িতা)
জীবক (শৈল্য চিকিৎসক, গৌতমবুদ্ধের চিকিৎসক)
অসম্পূর্ণ
তথ্যসূত্র
1. UNESCO World Heritage Site, 1980. Taxila: Multiple Locations. Retrieved 13 January 2007.
2. Windsor, Antonia (১৭ অক্টোবর ২০০৬)। "Out of the rubble"। The Guardian। London। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মে ২০১০।
3. UNESCO World Heritage Centre: Taxila
4. Scharfe, Hartmut (২০০২)। Education in Ancient India। Brill Academic Publishers। পৃষ্ঠা 141। আইএসবিএন 90-04-12556-6।
5. "History of Education", Encyclopædia Britannica, 2007.
6. Needham, Joseph (২০০৪)। Within the Four Seas: The Dialogue of East and West। Routledge। আইএসবিএন 0-415-36166-4।
"When the men of Alexander the Great came to Taxila in India in the fourth century BC they found a university there the like of which had not been seen in Greece, a university which taught the three Vedas and the eighteen accomplishments and was still existing when the Chinese pilgrim Fa-Hsien went there about AD 400."
7. Invasion of the Genes Genetic Heritage of India, By B. S. Ahloowalia. p81
8. Kosambi 1975:129
9. Kosambi, Damodar Dharmanand (১৯৭৫) [1956]। An Introduction to the Study of Indian History (Revised Second Edition সংস্করণ)। Bombay: Popular Prakashan। পৃষ্ঠা 126।
10. Britannica Online Encyclopedia, article:Taxila. "The great Indian epic Mahabharata was, according to tradition, first recited at Taxila at the great snake sacrifice of King Janamejaya, one of the heroes of the story."
11. Marshall 1975:81
12. A Record of Buddhistic Kingdoms, Being an Account by the Chinese Monk Fa-Hien of his Travels in India and Ceylon in Search of the Buddhist Books of Discipline, Chapter 11
13. J. W. McCrindle, The Invasion of India by Alexander the Great as Described by Arrian, Q. Curtius, Diodorus, Plutarch and Justin, Westminster, Constable, 1893, pp.343-344.
14. Frank Schaer, The Three Kings of Cologne, Heidelberg, Winter, 2000, Middle English Texts no.31, p.196.
15. ভারতের ইতিহাস। অতুলচন্দ্র রায়/প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
16. বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ