যত্ত্বা সূর্য স্বর্ভানুস্তমসাবিধ্যদাসুরঃ।
অক্ষেত্রবিদ্যথা মুগ্ধো ভুবনান্যদীধয়ুঃ।
"যত্ । ত্বা । সূর্য । স্বঽভানুঃ । তমসা । অবিধ্যত্ । আসুরঃ । অক্ষেত্রঽবিত্ । যথা । মুগ্ধঃ । ভুবনানি । অদীধয়ুঃ ।।"
পদার্থ— হে (সূর্য) সূর্য ! (যত্) যে (ত্বা) তোমার (স্বর্ভানুঃ) প্রকাশ দ্বারা প্রকাশিত [কিন্তু] (আসুরঃ) স্বয়ং প্রকাশহীন অর্থাৎ অন্যের দ্বারা প্রকাশিত [চন্দ্র] (তমসা) অন্ধকারময় ভাগ দ্বারা [তোমায়] (অবিধ্যত্) বেধ করে অর্থাৎ আবৃত করে তখন (ভুবনানি) অন্য সমস্ত লোকও অর্থাৎ নক্ষত্রাদি (অদীধয়ুঃ) এরূপ চমকিত হতে দেখা যায় (যথা) যার ফলে (অক্ষেত্রবিত্) অক্ষেত্রবিদ অর্থাৎ রেখাগণিত বা জ্যামিতি জ্ঞানে অজ্ঞ পুরুষ (মুগ্ধঃ) আশ্চর্য হয়ে যায়।
ভাবার্থ— চাঁদের নিজের আলো নেই,এটি সূর্যের দ্বারা আলোকিত হয়।কিন্তু যখন এই চাঁদ পরিভ্রমণরত অবস্থায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সেই সূর্যের সাথে একই রেখায় অবস্থান করে,তখন পৃথিবী থেকে দেখা যায় চাঁদ তার অন্ধকার পৃষ্ঠ দ্বারা সম্পূর্ণ সূর্যকেই আবৃত করে ফেলছে।এই সময়ে পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়।ফলে তখন পৃথিবী থেকে অসময়ে অন্যান্য নক্ষত্র সেগুলোও দৃশ্যমান হয়ে যায়।যারা জ্যোতির্বিদ্যা জ্ঞানশূন্য তারা এরূপ সূর্যগ্রহণের মূল কারণ জানতে না পেরে আশ্চর্য হয়ে যায়।অথচ সূর্যগ্রহণ হয় মূলত সেই সূর্যের আলোয় আলোকিত চাঁদেরই কারণে।
এখানে স্পষ্টত সূর্যগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।এই সূর্যগ্রহণের কারণ চন্দ্র,রাহু নয় সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে।আর [ঋগ্বেদ ১০/৮৫/৯] নির্দেশ করে যে সূর্য তাঁর কন্যা চন্দ্রকে আলো উপহারস্বরূপ প্রদান করে।
জ্যোতিষশাস্ত্র গ্রহলাঘব এর চন্দ্রগ্রহণাধিকার এর ৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে—
"সূর্যগ্রহণের সময় সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে চাঁদ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।যার ফলে সূর্যগ্রহণ সৃষ্টি হয়।অপরদিকে,সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে যখন পৃথিবী প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তখন চন্দ্রগ্রহণ সৃষ্টি হয়।"
(জ্যোতিষ শাস্ত্র– গ্রহলাঘব– চন্দ্রগ্রহণাধিকার– ৪)
আর্যভট্ট তাঁর আর্যভট্টীয় বই এর ৪র্থ অধ্যায় গোলপাদ এর ৩৭ নং সূত্রে উল্লেখ করেন—
"চন্দ্রোজলমর্কোগ্নির্মৃদভ্যুচ্ছয়াপি যা তমস্তদ্ধি।ছায়ায়াতি শশী সূর্য শশীনং মহতি চ ভুচ্ছায়া।।"
(আর্যভট্টীয়– ৪/৩৭)
অনুবাদ— চন্দ্র জলের,সূর্য অগ্নির,ধরণী মৃত্তিকার আর তার ছায়া অন্ধকার।চাঁদের ছায়া ঢেকে দেয় সূর্যকে আর ধরণীর বিরাট ছায়া ঢেকে দেয় চন্দ্রকে।
অর্থাৎ এই শ্লোক থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে যখন চাঁদ অবস্থান করে অর্থাৎ সূর্য,চাঁদ ও পৃথিবী যখন একই সরলরেখায় অবস্থান করে তখন সূর্যগ্রহণ হয় যেখানে চাঁদের ছায়া সূর্যকে আবৃত করে আবার সূর্য,পৃথিবী ও চাঁদ যখন একই সরলরেখায় অবস্থান করে তখন চন্দ্রগ্রহণ হয় যেখানে পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রকে আবৃত করে।
গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত আর্যভট্টের বিভিন্ন কাজ মূলত দুটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।এর মাঝে "আর্যভট্টীয়" একটি,যেটি উদ্ধার করা গিয়েছে।এটি রচিত চার খণ্ডে,মোট ১১৮টি স্তোত্রে।অন্য যে কাজটি সম্পর্কে জানা যায় সেটি হল "আর্য-সিদ্ধান্ত"।আর্য-সিদ্ধান্তের কোন পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে বরাহমিহির,ব্রহ্মগুপ্ত এবং প্রথম ভাস্করের কাজে এটির উল্লেখ মেলে।মাত্র ২৩ বছর বয়সে আর্যভট্ট এই "আর্যভট্টীয়" গ্রন্থটি সংকলন করেন।এর চারটি অধ্যায়– দশগীতিকা,গণিতপাদ,কালক্রিয়াপদ ও গোলপাদ।দশগীতিকা,কালক্রিয়া ও গোলপাদ অধ্যায়ে গোলীয় ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়াবলী রয়েছে।অন্যদিকে গণিতপাদে আছে পাটিগণিত,
বীজগণিত,সমতল ত্রিকোণমিতি,দ্বিঘাত সমীকরণ,
প্রথম n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার ঘাতবিশিষ্ট পদ সমূহের বর্গ ও ঘনের সমষ্টি এবং একটি সাইন অণুপাতের সারণি রয়েছ।তাছাড়া এই অধ্যায়ে সে সময়কার জনপ্রিয় জ্যোতিষচর্চার প্রয়োজনীয় ৩৩টি গাণিতিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে।গণিতপাদে আর্যভট্ট পাই– এর মান তথা বৃত্তের পরিধির সঙ্গে এর ব্যাসের মান ৩.১৪১৬ হিসাবে চিহ্নিত করেন।আর্যভট্টীয় বইটির গোলপাদ অংশে আর্যভট্ট উদাহরণের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন যে পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরে।তিনি পৃথিবীর আক্ষিক গতির হিসাবও করেছিলেন।সৌর জগতে গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি তার ভাষ্যে ছিল উপবৃত্তাকৃতির,এক বছর সময়কালের প্রায় সঠিক একটি পরিমাপ করেছিলেন,সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সঠিক কারণ এবং তার সময় নির্ধারণ করেছিলেন।আর্যভট্ট সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের পৌরাণিক ধারণার পরিবর্তে প্রকৃত কারণগুলো ব্যাখ্যা করে গেছেন।সেই সাথে তিনি সূর্য গ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল নির্ণয়ের পদ্ধতিও বের করেছিলেন।আর্যভট্ট বলেছিলেন যে চাঁদের আলো আসলে সূর্যের আলোর প্রতিফলনেরই ফলাফল।তিনি ছিলেন কুসংস্কারবিরোধী আর তাই তিনি তখনকার পৌরাণিকদের রোষানলে পড়েন।আর তাই তাঁর কর্ম তখন সাধারণ জনমানসে গৃহীত হয় নি।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ