রামকৃষ্ণের সাধনা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 February, 2022

রামকৃষ্ণের সাধনা

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়। রামকৃষ্ণ জীবনী সবিস্তারে জানতে গিয়ে ফ্রেডারিখ ম্যাক্সমুলার লক্ষ করেছেন রামকৃষ্ণ জীবনীতে অসত্য, অর্ধসত্য যেমন মিশে আছে, তেমনই ভক্তদের বিশেষত ইংরেজী জানা ভক্তদের দাক্ষিণ্যে যীশুখ্রীষ্টের জীবনীর কিছু ঘটনাও ঢুকে গেছে। কুমারী মাতার গর্ভে যিশুর জন্ম। রামকৃষ্ণ জন্মের ক্ষেত্রেও দেখা যায় পিতার কোন ভূমিকা নেই। শৈশবে গদাই নামে পরিচিত গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তাঁর ছিল সহজাত দক্ষতা। যদিও প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর আদৌ মনোযোগ ছিল না। সেযুগে ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তবে পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তার ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তার আগ্রহের অন্ত ছিল না।[Transformation of Ramakrishna। পৃষ্ঠা p.70] গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি অনায়াসে পারদর্শিতা অর্জন করেন।[Ramakrishna and His Disciples। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা p. 28] তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন গদাধর।[ "Râmakrishna's Life"। Râmakrishna his Life and Sayings। পৃষ্ঠা pp.33 Muller, Max (১৮৯৮)।] মাতৃভাষা বাংলায় তার অক্ষরজ্ঞান ছিল;[ Saradananda, Swami। The Great Master। পৃষ্ঠা p.59] কিন্তু সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।] পুরীর পথে কামারপুকুরে বিশ্রামরত সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্মীয় বিতর্ক মন দিয়ে শুনতেন গদাধর।

রামকৃষ্ণের সাধনা

গদাধর যখন কিশোর, তখন তার পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়। রামকুমার [ অগ্রজ / দাদা] কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন ["The Boyhood of Ramakrishna"। Ramakrishna and His Disciples। পৃষ্ঠা p.37]। ১৮৫৫ সালে কলকাতার অস্পৃশ্য কৈবর্ত সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন [Amiya P. Sen, "Sri Ramakrishna, the Kathamrita and the Calcutta middle Classes: an old problematic revisited" Postcolonial Studies, 9: 2 p 176]।

১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তার স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তার অবশিষ্ট জীবন [  Ramakrishna and his Disciples। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা pp. 55–57 ]। অনুমিত হয়, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন [Life of Sri Ramakrishna, Advaita Ashrama, Ninth Impression, December 1971, p. 44 ]। অন্য মতে, এই নামটি তার অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।

শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রথম কালীদর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিম্নরূপ,

রাণী রাসমণি ও তার জামাতা মথুরবাবু যদিও পরম স্নেহবশত তাকে তার ইচ্ছামতো পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও তারা মনে করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘ ব্রহ্মচর্যজনিত কোনও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মথুরবাবু তার জন্য বারবণিতার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু তাকে প্রলুব্ধ করার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয় [Ramakrishna and his Disciples। Advaita Ashrama। পৃষ্ঠা p. 66–70]। 

 ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া (৫ বছর) বালিকা সারদার সঙ্গে তার পৌরাণিক মতে বিবাহ সম্পন্ন হয়, শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বয়সের এই পার্থক্য উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজে কোনও অপ্রচলিত দৃষ্টান্ত ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের মে মাসের আগে তাদের আর সাক্ষাৎ হয়নি। এখানে উল্লেখ্য শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন স্ত্রী সঙ্গের ঘোরতর বিরোধী। তার কাছে নতুন কেউ এলে প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন বিয়ে হয়েছে কিনা। বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে তিনি হতাশ হয়ে "পড়তেন। এ অবস্থায় কি ভাবে স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে সাধন ভজন নিয়ে থাকা যায় তার পরামর্শ দিতেন। এমন কি স্ত্রীকে ছেড়েছুড়ে ভগবৎ ভজনায় জীবন কাটানোর ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারেন, এমন কথাও বলতেন।


সদ্য বিবাহিত শিষ্যকে তিনি বলছেন—"একদিন স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসিস-তাহাকে ও তোকে সেইরূপ করিয়া দিব। আর যদি সংসার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বর লাভ করিতে চাস, তা হইলে তাহাই করিয়া দিব।" (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৭৬৫)। অথবা মহেন্দ্র মাস্টারের সাথে কথোপকথন—'মণি (রামকৃষ্ণের প্রতি)—স্ত্রী যদি বলে, আমায় দেখছো না, আমি আত্মহত্যা করব। তাহলে কি হবে?" শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীর স্বরে)—“অমন স্ত্রী ত্যাগ করবে। যে ঈশ্বর পথে বিঘ্ন করে। আত্মহত্যাই করুক, আর যাই করুক "।' (কথামৃত, দ্বিতীয় ভাগ, পৃ-১১)।


ঠিক এই ঝামেলাতে ডুবে গিয়েই স্বামী ব্রমানন্দের স্ত্রী বিশ্বেশ্বরীদেবী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার স্বামী, স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে ফেলে রেখে শ্রীরামকৃষ্ণের কোলে শুয়ে দুধ খায়, ঘরে ফিরে আসার আর কোন আশাই নেই, তার পক্ষে আত্মহত্যাই বাঁচবার একমাত্র রাস্তা। তিনি মরে বেঁচেছেন। (ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা— ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, গৃ- ২০)।

কিন্তু আমরা ইতিহাসে নজর করলে দেখতে পাই, ভারতের অনেক মহান মুনিঋষিরা তাঁদের পত্নীদের সাথে থাকতেন।

বিবাহের পর শ্রীরামকৃষ্ণ—“বিয়ের পর ব্যাকুল হয়ে জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করেছিলুন, মা, আমার স্ত্রীর ভেতর থেকে কামভাব একেবারে দূর করে দে।” [শ্রীশ্রী মা সারদামনী দেবী-মানদাশঙ্কর দাশগুপ্ত, পৃ-২৩)।

শ্রীরামকৃষ্ণ চান ভগবান। কিন্তু সারদাদেবী তো তা চান না, তিনি চান সস্তান। মা'র প্রাণে সত্যই ছেলের জন্য একটা দুর্দমনীয় বাসনা ছিল। তিনি নিকুঞ্জদেবীর নিকট বলিয়াছেন, “ঠাকুর একদিন বলিলেন, ছেলে কি হবে? এই দেখছো সব মরছে। তা আমি বললাম সব কি যায়! আর রামদত্ত প্রভৃতিকে একদিন বললেন, দেখ, বড় ছেলে ছেলে করে। তোমরা একবার নহবতে যাও, আর বলে এসো আমরাই আপনার ছেলে।" মার এই উক্তি দুইটি হইতে বোঝা যায় ছেলের জন্য তাহার প্রাণে কি গভীর আকাঙ্ক্ষা জাগিত।' (ঐ, পৃষ্ঠা-৮৮)। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে বোঝাচ্ছেন 'তুমি একটি সন্তান চাইছ, কালে হাজার সন্তানের মা মা ডাক তোমাকে শুনতে হবে।" "মন্দিরে মূর্তি হয়ে যে পূজা নিচ্ছে, আমার পা টিপে সেবা করছেও সে।' সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণ জী পূজো করতেন সকলের কাছে বলতেন এ মানুষ নয়, সাক্ষাৎ ভগবতী, দেবী সরস্বতী রূপ লুকিয়ে এসেছে, আরো কত কি [ শ্রীশ্রী মায়ের পদপ্রান্তে, চতুর্থ খন্ড, পৃ-৯০৪] আমরা বৈদিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানি যে সরস্বতী কোন আলাদা দেবী নন, ঈশ্বরের এক নাম। "সরো বিবিধং জ্ঞানং বিদ্যতে যস্যাং চিতৌ সা সরস্বতী"- যাঁহার বিবিধ বিজ্ঞান অর্থাৎ শব্দার্থ প্রয়োগের যথাবৎ জ্ঞান হইয়া থাকে, সেই পরমেশ্বরের নাম "সরস্বতী" ।

শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি, ‘সারদা আসলে সরস্বতী জ্ঞান দিতে এসেছে' 'আমার কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, জগতের কল্যাণের জন্য বাকী কাজ ‘ও’ করবে।' ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলস্বরূপ জগজ্জননী রূপে সারদামণির দ্বিতীয় জন্ম। একবার সারদামণির ‘দৈব শরীর' প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব বলেন, “নবতে যিনি থাকেন, তার বুকের গড়ন মা জগধাত্রীর মতো, দোমেটে করে গড়া।” (সারদা-রামকৃষ্ণ, শ্রীদুর্গাপুরী দেবী, প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৩৬১ পৃ – ৩৩৭)। এটা তিনি জানলেন কীভাবে কে জানে।

রামকৃষ্ণের সাধনা
বিঃদ্রঃ [মহর্ষি অত্রি, মহর্ষি বশিষ্ঠ, অগস্ত্য মুনির মতো অনেক ঋষি বিবাহিত জীবন যাপন করে, স্ত্রীকে সঙ্গে রেখেই পরব্রহ্মবিদ্ হতে পরেছিলেন !! অপরদিকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পত্রাবলীতে বিবাহিত পুরুষদের (মাদ্রাজী) যোনিকীট বলেছেন.. ওনার গুরু গদাধর চট্টোপাধ্যায় তো কোন বিবাহিত ভক্ত দেখলে কষ্টে কাঁদতে থাকতেন]

আরও একজনকে রামকৃষ্ণদেব ভগবতী জ্ঞানে সকলকে পূজো করতে বলে গেছেন। তিনি হলেন সারদামণির সহচরি এবং তার নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রী, বালবিধবা এবং অনাথা লক্ষ্মীমণিদেবী। খুব একটা কেউ কেটা না হলেও তিনিও দিব্যি গুরু মা হয়েছিলেন। এবং নিশ্চিন্ত জীবন কটিয়েছেন। রামকৃষ্ণের অবর্তমানে লক্ষ্মীমণির ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা তিনি বেশ বুঝেছিলেন।

রামকৃষ্ণদেব বলতেন লক্ষ্মীর 'মা শীতলার' অংশে জন্ম। তাকে দু-তিন বার রামকৃষ্ণদেব পুজোও করেন। বিধবা হলেও তাকে মাছ খাইয়ে সকলকে বুঝিয়ে দেন মা শীতলার জন্য নির্দিষ্ট মৎস্য প্রসাদ লক্ষ্মীমণিরও প্রাপ্য। বলতেন, 'আর আসব না বললেই হল, কলমীর দল, টান মারলেই এসে হাজির হবি।' কাশীপুরে রামকৃষ্ণদেব লক্ষ্মীদিদিকে দুইবার শীতলা জ্ঞানে পুজো করেন। গিরিশচন্দ্রকে বলেন, “লক্ষ্মীকে মিস্টি টিস্টি একদিন যাইও, তাহলে মা শীতলাকে ভোগ দেওয়া হবে। ও তারই অংশ।” (ভক্তমালিকা—স্বামী গম্ভীরানন্দ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৬১, পৃ-৫০৬)। স্বয়ং মা শীতলাকে মাত্র একদিন মিস্টি খাইয়ে দায়িত্ব খালাস করে কোন্ পামর। পরবর্তীকালে লক্ষ্মীমণির কিছু শিষ্য জুটেছিল এবং তাদের দ্বারাই শেষ বয়সে তিনি পালিতা হয়েছিলেন। পুরীতে নিজের জন্য একটি বাড়িও করেছিলেন। (শারদীয়া উদ্বধোন, ১৪১৭, পৃষ্ঠা - ৬৯১)। ভাই শিবরামকে প্রতি মাসে কুড়ি-বাইশ টাকা পাঠাতেন। ভাই দক্ষিণেশ্বরে এলে পঞ্চাশ-ষাট টাকাও হাতে গুঁজে দিতেন। (শ্রী শ্রী লক্ষ্মীমণি দেবী—শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র সেনগুপ্ত, পৃ- ৬১, ২৬৭)।


সেই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণের পাশ্চাত্য গুণগ্রাহীদের অন্যতম ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের তদনীন্তুন অধ্যক্ষ ডক্টর ডব্লিউ ডব্লিউ হেস্টি। শ্রেণীকক্ষে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচিত দ্য এক্সকারসন কবিতাটিতে ব্যবহৃত "
ট্র্যান্স" শব্দটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, শব্দটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হলে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাওয়া আবশ্যক। তার এই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ দক্ষিণেশ্বরে যান। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।  প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রথম ইংরেজিতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন। ১৯৭৯ সালে থেইস্টিক কোয়ার্টারলি রিভিউ পত্রিকায় দ্য হিন্দু সেইন্ট নামে প্রকাশিত সেই জীবনী জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্স মুলার প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের দৃষ্টি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট করে। 
 রোম্যাঁ রোলাঁ, সুধীর কক্কর, নরসিংহ শীল, জেফরি কৃপাল, অ্যালান রোনাল্ড, ডক্টর জিন ওপেনশ, সোমনাথ ভট্টাচার্য, কেলি অ্যান রাব ও জে এস হলে প্রমুখ পণ্ডিতগণ এই সব ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য এই ব্যাখ্যা অনেকক্ষেত্রেই বিতর্কিত।

গদাধর ওরফে রামকৃষ্ণের সাধনা ['শ্রীম' অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রণীত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে তার ধর্মভাবনার মূল কথাগুলি লিপিবদ্ধ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের প্রধান গ্রন্থ এটিই।]

কালীর দর্শন ও কালীরূপে ব্রহ্মের উপাসনা / সাধনা / পূজা

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম ভাগ, পূর্বকথা ও বাল্যজীবন, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৬৫ অনুয়ায়ী আমরা দেখতে পাই রামকৃষ্ণ বাবু মাটির মূর্ত্তি কালীকে সাক্ষাৎ করেছিলেন।  পৌরানিক গল্প অনুযায়ী আমরা যে ৫১ টি পিঠস্থানের বর্ননা শুনি তা অনুযায়ী দক্ষিনেশ্বর কোন পিঠ নয়। ১৮৫৫ সালে কলকাতার অস্পৃশ্য কৈবর্ত সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করছিলেন। 

দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দির নির্মাণ ও জাগ্রতকরণের পেছনের ঘটনাঃ

মন্দির প্রতিষ্ঠাত্রী রাণীর‘জাত' এই ব্যাপারটিকে খুব গভীর ভাবে বুঝতে হবে, কারণ এই জাতপাত ব্যবস্থার মধ্যেই লুকিয়ে আছে রামকৃষ্ণায়ণের মূল গোপন সূত্রটি।

অনেকে ভ্রমবশতঃ রাণী রাসমণিকে মৎস্যজীবী কৈবর্ত বলে উল্লেখ করলেও তারা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন কৃষিজীবী মাহিষ্য। একদা উৎপীড়িত ধীবর সম্প্রদায়ের পক্ষ নিয়ে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কারণে অনেকে তাকে কৈবর্ত বলেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। মোদ্দা কথা রাণী জাতিতে শূদ্র। এবং সেই সময় উচ্চবর্ণের হিন্দুর তুলনায় শূদ্ররা অনুন্নত, এবং বরাবরই ঘৃণার পাত্র। কিন্তু আর পাঁচটা শূদ্রের সাথে রাণীর তুলনা করলে চলবে কেন। রাণী কি যে-সে লোক! বিশাল সম্পত্তির মালিক তিনি। আমার পকেটে কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি ঢুকে গেলে কাল থেকেই দেখব দুনিয়া বদলাতে শুরু করেছে। আর রাণীতো লাখ টাকের আওতায় পড়েন না, তিনি নিজেও হয়ত সবটা জানেন না কোথায় কত সম্পত্তি আছে। ছোটবেলা থেকেই রাণী ভীষণ উচ্চাভিলাষীও বটে। এহেন রাণীর পক্ষে দু'পয়সার ঘন্টা নাড়া বামুনের থেকে নিম্নস্তরের প্রাণী বলে নিজেকে ভেবে নেওয়াটা একটু কষ্টকরও বটে। কিন্তু নিরূপায়। সমাজের এই নিয়ম।

রাণীর পিতা হরেকৃষ্ণ দাস চাষবাস ছাড়াও ঘরামির কাজ করতেন। 'হারু ঘরামি' নামে তিনি গ্রামে পরিচিত ছিলেন। রাসমণির শ্বশুরমশাই প্রীতিরাম দাসের ছিল বাঁশের ব্যবসায়। এর থেকে তিনি এবং তার বংশধরগণ ‘মাড়' উপাধি লাভ করেন। রাণীর এক জামাইয়ের পারিবারিক উপাধি ছিল ‘আটা'। যাদের নামে সিঁথিতে ‘আটা পাড়া' বলে একটি অঞ্চল আজও আছে।

দেখা যাচ্ছে রাণীর পিতা বা শ্বশুরকূল এমন কিছু উপাধি লাভ করেছিল যার একটিও বংশের সম্মান একটুও বাড়ায় না। বরং এই ধরনের উপাধি কি করে চাপা দেওয়া যায় লোকে তারই চেষ্টা করে। কিন্তু চাপা দেব বললেই তো আর চাপা দেওয়া যায় না। যতই ধন দৌলত বিলাও না, আর ব্রাহ্মণ প্রণামি দাও না, তোমার নামের পিছে যে নিচু জাত লেগে রয়েছে সেই হতভাগা মোরগকে তাড়াবে কি করে। তোমার জমিদারীর খেয়েই বেঁচে আছি, তোমার দাসানুদাস প্রজা ভিন্ন কিছুই নই, তুমি ঘাড় ধাক্কা মেরে আজ তাড়ালে কাল থেকেই অন্নচিন্তা চমৎকারা, তথাপি আমি 'ভটচাজ বামুন', তুমি শুদ্রানি। তোমার ছোঁয়া লাগলেও আমার মুখের গ্রাস আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই পায়। এই ভয়ংকর সত্য রাণী খুব ভালভাবে বুঝতেন। কিন্তু কিচ্ছুটি করার নেই। সমাজের এ বিধান ভেঙ্গে ফেলা রাণীর কম্মো নয়। এই অভিশাপ থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাণীর মুক্তি লাভের উপায় একটিই—'জাতে ওঠা। শূদ্রের জাতে ওঠার উপায়ও একটিই—ঈশ্বর আনুকূল্য লাভ। ঈশ্বর আনুকূল্য লাভ হয় কিভাবে, না, মন্দির-মসজিদ নির্মাণ করে।


স্বামী রাজচন্দ্র দাস মন্দির নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন কিন্তু হয়ে ওঠেনি। রাণীও অনেক কিছু করেছেন কিন্তু মন্দির নির্মাণ এখনও হয়নি। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে মন্দির নির্মাণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সমস্যা রয়েছে সেখানে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে যে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে জাতে উঠতে হবে, জাত-পাতের অজুহাতে সেই মন্দিরই যদি ব্রাত্য থেকে যায়, লোক না ঢোকে, তখন কি হবে। পণ্ডশ্রম হবে না কি? অতএব উপায়। এরও উপায় একটা আছে। মন্দির নির্মাণের আগেই দেবতাকে জাগ্রত করে তুলতে হবে।মন্দিরই নেই তায় দেবতা জাগ্রত হন কিভাবে? উপায় আছে, তারও উপায় আছে। ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দিলে তিনি সব সমস্যার উপায় বাতলে দেন, আর এক্ষেত্রে একটি রাস্তা বেরবে না। তবে এর জন্য কোন ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দিতে হবে না। নিজে নিজেই মুশকিল আসান করা যায়। শুধু একটি স্বপ্নাদেশ।

এদেশে যুগ যুগ ধরে লোকে স্বপ্নাদেশ পেয়ে আসছে। হতদরিদ্র স্বপ্নাদেশ পায়, ভর, তুকতাক এসব হয়ে একটা যাহোক উপার্জনের রাস্তা তৈরি হয়। মধ্যবিত্ত খুব একটা স্বপ্ন-টপ্ন দেখে না। দেখলেও বড়জোর একটা নাকছাবি মা কালির নাক আলো করে। আসল স্বপ্ন দেখে রাজা-উজীর লোকেরা। ঘোড়ার ল্যাজে আতর মাখানো বা বিড়ালের বিয়ে দেওয়া যাদের ছেলেখেলা, স্বপ্ন দেখেও তারা। এইসব আমীরী স্বপ্ন থেকেই বড় বড় মন্দির গজিয়ে ওঠে, আরও বড় মন্দিরের জীর্ণ সংস্কার হয়ে যায়, বস্তি উচ্ছেদ হয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি। আরও কত কি যে হয় স্বপ্নদ্রষ্টারাই তা বলতে পারেন। আমি ভগবানের স্নেহের পাত্রও নই, দৈব স্বপ্নের দর্শকও নই। তা প্রয়োজন যখন আছেই রাণী একটি স্বপ্নাদেশ পেতেই পারেন। বিড়ালের বিয়ে দেবার মত খামখেয়ালী তিনি ছিলেন না ঠিকই কিন্তু স্বপ্নাদেশ পাবার মত আর্থিক সঙ্গতি তার যথেষ্টই ছিল। গঙ্গার বুকে বজরায় শুয়ে স্বপ্নাদেশ পেয়েও গেলেন, 'গঙ্গার পাড়েই মায়ের মন্দির নির্মাণ করতে হবে। স্থগিত হয়ে গেল কাশী-বিশ্বনাথ দর্শনের মানস। রাণী বাড়ি ফিরে গেলেন। দাস-দাসীর সংখ্যা কম নয়, তারা যখন রাণীর স্বপ্নাদেশের কথা জেনেছে রাষ্ট্র হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। প্রশ্ন হতে পারে রাণী দাস-দাসীদের দিয়ে তার স্বপ্নের কথা প্রচার করেছিলেন একথা বলল কে? কথা। আসলে হয় কি এই ধরনের শিখিয়ে পড়িয়ে হয় মনিব দৈব স্বপ্ন পেয়েছে। পরিচারকরা পাশে সব সময় থাকছে, মনিবের দরকার পরিচারককে প্রচারের প্রভাবিত করা। যাবে, ভাসতে পাঁচ হবে। প্রচারের না করেই বিলিয়ে দেওয়া হল। কারণ কি–না, মন্দির নির্মাণের দৈব আদেশ পেয়েছেন। দ্রব্যসামগ্রী সামান্য নয়। লোকের মনে প্রশ্ন জাগবেই এত দান-খয়রাত চলছে কেন?


সময় সময় স্বপ্ন কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তার একটা উদাহরণ এখানে দিচ্ছি—মুসলমানদের আক্রমণে বৃন্দাবনের ভেঙে গেছে। কিন্তু ভাঙলে চলে করে। গাদা পাণ্ডা পুরোহিতের বুজিরোজগারের জড়িয়ে একটা বসালে ভক্তরা যদি মেনে না নেয়। অতএব ভরসা দৈব স্বপ্ন। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত একটি স্বপ্ন ফেললেন নতুন বিগ্রহেই ঈশ্বর অধিষ্ঠান করবেন। ব্যস, সমস্যার সমাধান। পাঙা পুরোহিতও খুশী, স্বামী অভেদানন্দের পিতা প্রথম মারা যাবার অনেক দিন কেটে গেছে, হঠাৎ দৈব পেলেন ‘আবার বিয়ে করে ফেললেন আবার বিয়ে। কিন্তু দৈব আদেশ বোঝা খুব মুশকিল নয়। এবার লোক মারফৎ খবর নিতে লাগলেন গঙ্গার পাড়ে তেমন একটা জায়গার জন্য। দক্ষিণেশ্বরে হেষ্টি সাহেবের বাগানবাড়ি পাওয়া গেল। চুয়ান্ন বিঘা জমি প্রায় তেতাল্লিশ হাজার টাকায় খরিদ হল। মন্দির নির্মাণের কাজ প্রথম দফায় কারা নিয়েছিল জানা যায় না। হয়ত কোন দেশী কোম্পানী। কিন্তু তাদের কাজ বেশি দূর এগোয় নি। প্রবল বানে সব হবার ম্যাকিট্স এণ্ড ব্যরন কোম্পানীকে মন্দির পর্যন্ত নির্মাণ হলো। এর জন্য আরও প্রায় দশ লক্ষ টাকা ব্যয় হল। মন্দির হওয়া পর্যন্ত ব্রত ধারণ করেছেন। ত্রিসন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন ভোজন, মাটিতে শয়ন, পূজাপাঠ ইত্যাদি।

দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠার সময় এসে গেল। এক লক্ষের ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিমন্ত্রিত হয়েছেন। যাদের সরাসরি নিমন্ত্রণ করা যায় তাদের উদ্দেশ্যেও রাণী নিমন্ত্রণ জানিয়ে খোয়াতে কে-ই বা রাজী হবে ‘লীলাপ্রসঙ্গ কার সারদানন্দজী বলছেন ‘শূদ্র প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর পূজা করা দূরে যাউক সবংশজাত ব্রাহ্মণগণ ঐ কালে প্রণাম পর্যন্ত করিয়া ঐ সকল মূর্তির মর্যাদা রক্ষা করিতেন না। এবং রাণীর গুরুবংশীয়গণের ন্যায় ব্রয় বন্ধুদিগকে তাহারা শুদ্র মধ্যেই পরিগণিত করিতেন। সুতরাং যজন যাজন ক্ষম সদাচারী কোন ব্রাহ্মণই রাণীর দেবালয়ে পূজক পদে ব্রতী হইতে সহসা স্বীকৃত হইলেন না'। (পৃষ্ঠা-১৮৬)। দান-দক্ষিণা নেব, পেট পুরে খাব, ব্যস, চলে যাব। এই মোদ্দা কথা। শেষ সময়ে রাণী পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। দিকে দিকে খবর পাঠালেন যদি কেউ এমন কোন বিধান দেন যাতে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কিন্তু সব দিক থেকেই নেতিবাচক উত্তর আসতে লাগল। রাণী পূজকের জন্য বেতন ও পারিতোষিকের হার বাড়িয়ে দিয়ে ফল পেলেন। হঠাৎই এলো ঝামাপুকুর নিবাসী টোল পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক বিধান। যার দ্বারা রাণীর অন্নভোগ দেবার মনোরথ পূর্ণ হল।

উদার রাণী লক্ষাধিক ব্রাহ্মণের জন্য যা দান-দক্ষিণার ব্যবস্থা রেখেছিলেন (রেশমি বস্ত্র, উত্তরীয়, স্বর্ণ মুদ্রা) আজকের হিসাবে তা দশ বারো কোটির নিচে কিছুতেই হবে না। রাণী আর একটা খুব দামী জিনিস রেখেছিলেন যা আজ থাকলে মহা মহা রোগের ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞানীদের এত গবেষণার প্রয়োজনই পড়ত না। অতি সামান্য জিনিস, কৌটো ভরে লক্ষাধিক ব্রাহ্মণের 'পদধূলি'। এক কলা খেলেই যে কোন রোগ থেকে মুক্তি। রোগ সারাতে সারাতে কৌটোটি খালিও হয়ে যায়।


রামকুমার রাণী রাসমণির পূজকের আসনও গ্রহণ করেন। কামারপুকুর গ্রামে তার সামান্য আয়ে সংসার প্রতিপালনে অসমর্থ হয়ে ঝামাপুকুরে একটি টোল খুলেছিলেন রামকুমার। টোলে দু-চার জন ছাত্র আর যজমানী থেকে সামান্য আয়। রামকুমার যে দুরবস্থায় ছিলেন কলকাতায় এসেও সেই দুরবস্থাই রয়ে গেছে। এমত অবস্থায় যদি কোন ধনী ব্যক্তির মনোমত ব্যবস্থা দিয়ে তার আনুগত্য লাভ করা যায় তাতে মন্দ কি! আর সত্যিই এর ফলে রামকুমার যথেষ্টই লাভবান হয়েছিলেন। পুঁথিকার অক্ষয় কুমার সেন বলছেন—

অন্নভোগ হেতু ব্রতী হবে যে ব্রাহ্মণ।

 করিতে বলিল রাণী তার অন্বেষণ।।

 যত লবে মাহিয়ানা তত দিব তায়।

 তদুপরি মনোমত পাইবে বিদায়।।

 রাণীর বিদায় বড় ছোটখাট নয়।

 ক্ষুদ্র যেটি তবু পাঁচশত টাকা ব্যয়।। (পৃষ্ঠা-৪৩)

গরদ বসন অর্থ শ্রীরামকুমারে।

দান করিলেন রাণী অতি উচ্চ দরে।।

আর বড় ভট্টাচার্য আখ্যা দিয়া তায়।। 

সমাদরে রাখে রাণী শ্যামার সেবায়।। (পৃষ্ঠা ৪৫)


বেশ বোঝা যাচ্ছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেই রামকুমার সমগ্র ব্রাহ্মণ সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে রাণীর সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্রাহ্মণদের ক্ষমতার তুলনায় এক রাণীর ক্ষমতাই যে অনেক বেশী একথা রামকুমার বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। তাকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করা অথবা সমাজে এক ঘরে করা অত সহজ হবে না। যদিও, তাদের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণের নিমন্ত্রণ পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। এ নিয়ে রামকুমারের গর্বও কম ছিল না। তবুও পেটের দায় বড় দায়। রামকুমার ভাই গদাধরকে নিয়েই মন্দিরে বহাল রইলেন। ছোট জাতের মন্দিরে থাকতে গদাধরের তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু সেই পেটের দায় বড় দায়। শেষ পর্যন্ত থাকতেই হল।

শুধু ভাই গদাধর কেন, কলকাতায় তাদের গ্রামের যত জ্ঞাতিগুষ্টি ছিল সকলকেই তিনি মন্দিরের কাজে লাগিয়ে দিলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। রামকুমারের সু-বন্দোবস্ত হল। কিন্তু রাণী রাসমণির মনোবাশ্বা কি সত্যিই পূর্ণ হল? দেখা যাক এর পর কি ঘটছে।


স্বামী সারদানন্দ বলছেন—'ঠাকুর কখনো কখনো নিজ মুখে আমাদের ঐ সময়কার কথা এইরূপে বলিয়াছেন, “কৈবর্তের তন্ন খাইতে হইবে ভাবিয়া মনে তখন দারুণ কষ্ট উপস্থিত হইত। গরীব কাঙ্গালেরাও অনেকে তখন রাসমণির ঠাকুরবাড়িতে ঐজন্য খাইতে আসিত না। খাইবার লোক জুটিত না বলিয়া কতদিন প্রসাদী অন্ন গরুকে খাওয়াইতে এবং অবশিষ্ট গঙ্গায় ফেলিয়া দিতে হইয়াছে”।' (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-১১৬)। রাসমণির অভিলাষ পূর্ণ হল না। আজকের দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে তাকিয়ে কিন্তু সেই সময়টাকে ঠিক বোঝা যাবে না। হাজার হাজার মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ আজকের মন্দির আর দেড়শ বছর আগের সেই ফাঁকা জনমানবহীন মন্দির এক জিনিস নয়। এ যেন রাম চেয়ে বাঁদর লাভ। অনশনে থাকা কাঙ্গালদের ভাতের লোভ দেখিয়েও যেখানে আনা যায় না উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে সেদিকে ফিরেও তাকাবে না এ বলাই বাহুল্য।


কিন্তু রাণী রাসমণি তো এমন চাননি। তিনি চেয়েছিলেন আজকের দক্ষিণেশ্বর। যেখানে কাতারে কাতারে দর্শনার্থীর ভীড় লেগে থাকবে। সবাই রাণীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বলবে 'অতুল কীর্তি রাখল ভবে....।' এখানে বলতে পারেন রাণীর মত নিরভিমানী মহিলার নামে আত্মপ্রচারের অভিযোগ কেন? দেখুন, এ প্রসঙ্গে আমি বলি কি, ভক্তি কথা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার মনে প্রবল ঈশ্বরানুরাগ জেগেছে তা আপনি সারাদিন রাত পূজো-আচ্ছা, জপ-ধ্যান নিয়ে থাকুন না। তাতেও যদি কম মনে হয় তো নির্জন পাহাড়ে বনে চলে গেলেই হল। 'আপনার' ভক্তি শ্রবার সেটাই শ্রেষ্ঠ পরাকাষ্ঠা হয় না কি! তা না করে পাঁচজনের উদ্দেশ্যে মন্দির বানাবার আপনার দরকারটা কি। মন্দির বানানোর জন্য ঈশ্বর কি আপনার জন্য একটু বেশি পুন্ন্যি বরাদ্দ করবেন। মোদ্দা কথাটা এই মন্দির-মসজিদ বড়লোকেরা নির্মাণ করে নিজের নামে জয়ধ্বনি শোনবার জন্যই। রমা রলাঁ তার 'রামকৃষ্ণের জীবন' গ্রন্থে লিখেছেন—“সেখানে (ভারতবর্ষে) দেশের ধনী-মহাজনরা বিধাতার দরবারে সুযোগ-সুবিধা পাইবার প্রত্যাশায় দেবতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।” (প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১১, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-২০)।

যাক, ভগবান নিজে দাঁড়িয়ে রাণীকে স্বপ্নাদেশ দিলেন, আবার শূদ্রের ঘরে জন্ম দিয়ে তার অভিলাষ অপূর্ণ থাকার ব্যবস্থাও তিনিই করে রাখলেন। কি বিচিত্র লীলা মহামায়ার। তবে দু একটি নিন্দুক না থাকলে লীলা-পোষ্টাই কিন্তু জমত না। আচ্ছা, একটা কথা কি মনে হয় না, যেখানে লোকে জেনেছে রাণী এই মন্দির তৈরি করেছেন স্বয়ং ভগবানের আদেশেই। সেখানে তো লোকের মনে এই প্রশ্ন আসাই উচিতনয় এই মন্দির কোন জাতের তৈরি। ভগবানের আদেশে তৈরি মন্দির এটাই শেষ কথা। ভগবানের আদেশ উপেক্ষা করে, মন্দির দর্শন না করে, ভগবানের নেকনজরে পড়তে চায় কোন্ ভারতবাসী আমার জানা নেই। কিন্তু এখানে তাই ঘটছে।

আসলে সমাজের ধর্মীয় দিক পরিচালনা করে যে মাতব্বরেরা তারা যতক্ষণ না সবুজ সংকেত দিচ্ছে ততক্ষণ তো মন্দির উপেক্ষিত থাকবেই। কিন্তু কথা হচ্ছে ভগবানের স্বপ্নাদেশ অগ্রাহ্য তারা করছেন কি ভাবে? আসলে কি জানেন, এইসব মাতব্বরেরা নানা প্রয়োজনে নিজেরাও নানান দৈব স্বপ্ন দেখে থাকেন। তারা ভালই জানেন কে, কখন, কেন, দৈব স্বপ্ন দেখে। রাণী রাসমণিও কেন স্বপ্ন দেখছেন তারা ভালো ভাবেই জানেন। সেই জন্যই ও নিয়ে তাদের অত মাথাব্যথা নেই। আজ রাণীর মা কালী ঘেমেছেন, কাল মা কালী পা ভেঙেছেন, পরশু মা কালীর কিছু একটা হয়েছে এইসব নানা অজুহাতে একটা করে অনুষ্ঠান লাগাও, চব্য-চোষ্যের ব্যবস্থা করো, দান-দক্ষিণা হোক, আমরা আছি। নীচ জাতের সাথে এর থেকে বেশি মাখামাখি ভালো নয়।

এই তো গেল অবস্থা। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে রাণীর এত সাধের মন্দির শেষ পর্যন্ত কোন কাজেই এল না। নীচ কূলে জন্মানোর জন্য রাণী অনেক দুঃখ করলেন। কিন্তু তাতে আর হবে কি! রাণীর স্বপ্ন সার্থক হল না।

বিষম মরম খেদে রাসমণি বলে।

হে মা শ্যামা দিলে জন্ম হেন নীচ কুলে।। —রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃ-৪৩

কিন্তু সব আশা ছেড়ে দেবার পাত্র ছিলেন না মথুরমোহন বিশ্বাস। এবার তিনি আসরে নামলেন। তিনি দেখেছেন স্বপ্ন দেখে, টাকা ছড়িয়ে মন্দির সার্বজনীন করা গেল না। এমন একটা কিছু চাই যার টানে লোকে মন্দিরে আসবে। কিন্তু কি সেই জিনিস যার টানে লোকে মন্দিরে ভীড় করবে! মথুরবাবু অপেক্ষায় রইলেন। হয়ত কোন দিক থেকে সুযোগ আসবে।


'ছোট ভটচায’ গদাধর চট্টোপাধ্যায়। বয়সে নবীন। চেহারার মধ্যে একটা বেশ শান্ত সৌম্য আকর্ষণ আছে। মথুরবাবুর চোখে পড়ে গেল ছেলেটি। কিন্তু ছোট ভটচার্য নজরে এসেছে আরও অন্য একটি কারণে। তার ভক্তিশ্রদ্ধা দেখে মথুরবাবু অবাক হয়েছেন। পূজো করতে বসলে সময়ের হিসেব থাকে না। পূজো পদ্ধতিও রীতি বহির্ভূত, কিন্তু ভক্তিতে পরিপূর্ণ। এসবের মধ্যে একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার গদাধরের মধ্যে ছিলই। কিন্তু নজরে আসার আসল রহস্য অন্য জায়গায়। লীলাপ্রসঙ্গকার (রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা-১৯৯) বলছেন, 'ভগবৎ প্রেমে ঠাকুরকে ইতিপূর্বে মধ্যে মধ্যে ভাবাবিষ্ট হইতে দর্শন এবং কোন কোন বিষয় আদেশ প্রাপ্ত হইতে শ্রবণ করিয়াই মথুরবাবু...'। অর্থাৎ মথুরবাবু লক্ষ্য করেছেন ছেলেটি হঠাৎ হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। কিছু পরেই আবার স্বাভাবিক। রামচন্দ্র দত্ত (রামকৃষ্ণের জীবন বৃত্তান্ত, পৃষ্ঠা-৭৫) বলছেন, মথুরবাবু লক্ষ্য করেছেন ‘ছেলেটি ক্ষণে ক্ষণে মৃতপ্রায় পরক্ষণেই স্বাভাবিক'। এমন পড়ে পাওয়া সুযোগ হাতছাড়া হতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

নবীন বয়েস, ব্রক্ষ্মচারী প্রায়।

দরশনে মন-প্রাণ হয়ে যায়।।

মনে লয় তায় যদি কালীর সেবনে।

পুরীমধ্যে রাখা যায় অতি অল্প দিনে।

জাগরিত করিতে পারেন শ্যামা মায়ে।

এমন প্রতীত হয় তাহারে দেখিয়ে।।—পুঁথি, পৃ-৪৮

যেমন করে হোক এই ছেলেটিকে দিয়েই বাজি জিততে হবে। ছেলেটির বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়ে একে ভগবান যদি বানানো যায়। আর একবার যদি সাক্ষাৎ ভগবান বাঁধা পড়েন তাকে দেখার জন্য অন্তত কাতারে কাতারে লোক আসবেই আসবে। মথুরবাবু রাণী রাসমণিকে বলছেন, "অদ্ভূত পূজক পাইয়াছি, দেবী বোধ হয় শীঘ্রই জাগ্রতা হইয়া উঠিবেন”। (ঠাকুর রামকৃষ্ণ— ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৬৩)। মন্দিরের অন্যান্য কর্মচারীরা গদাধরের নামে অভিযোগ আনছে একে দিয়ে পূজোর কাজ হবে না, একে সরিয়ে দেওয়া হোক।' মথুরবাবু কিন্তু এসব শোনার মধ্যে নেই।তিনি ফরমান জারি করছেন কেউ যদি গদাধরকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয় তো তার মাথা কেটে উড়িয়ে দেওয়া হবে। স্বামী সারদানন্দ বলছেন, – কাজেই মথুর ঠাকুরের আচরণে বাধা না দিয়া কতনুর কী দাঁড়ায় তাহাই দেখিয়া যাইতে সংকল্প করিলেন এবং দেখিয়া শুনিয়া পরে যাহা যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হইবে তাহাই করিবেন, ইহাই স্থির করিলেন। বিষয়ী প্রভুর অধীনস্ত সামান্য কর্মচারীর উপর এইরূপ ব্যবহার কম ধৈর্য্যের পরিচায়ক নহে। (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃ-৪৫২)।

আসলে তিনি ছোট ভট্টচার্যকে বাড়তে দিচ্ছেন। যাকে ভগবান বানানো হবে তাকে। তো দমিয়ে রাখলে চলবে না। ডানা মেলে উড়তে দিতে হবে। তাকে নিজেকেই বুঝতে হবে আমি সত্যিই মানুষ নই, ভগবান। এরপরের ঘটনাবলী মোটামুটি ভাবে মথুর কেন্দ্রিক। মানে গদাধর পর্বের যা কিছু আলোচনা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এইসময় সবেতেই মথুরবাবু উপস্থিত। আসলে তিনি এই সময় চেষ্টা করছিলেন গদাধর যাতে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সে মানুষ নয়। মানুষের থেকে অনেক বেশি একটা কিছু।

একবার গদাধর মন্দিরের বারান্দায় পায়চারি করছেন। মথুরবাবু ততদিনে গদাধরকে ‘বাবা’ বানিয়ে ফেলেছেন। তিনি বললেন বাবা তুমি যখন পায়চারি করছিলে সামনে যাচ্ছ তো দেখছি তুমি শিব, পেছনে যাচ্ছ তো দেখছি মা কালী। এখানে আমার জিজ্ঞাস্য মথুরবাবুর মত একজন লোককে ভগবান কেন দেখা দেবেন? বেদ-পুরাণাদি বলছেন একমাত্র শুদ্ধ চিত্তেই ঈশ্বর দর্শন সম্ভব। সেখানে মথুরবাবুর মত একজন অর্থলোভী ব্যক্তি, যে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হয়েও পরের সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করে। জমি-জমা রক্ষার্থে মানুষ খুন করতেও যার দ্বিধা নেই। (লীলাপ্রসঙ্গ পৃ- ৪৫৭)। 'আর একবার সেজো-গিল্পী (জগদম্বা) বাবাকে বলেন, “বাবা, আমার সন্দেহ হয়, সেজোবাবু বোধহয় খারাপ জায়গায় যান। বাবা, আমি যেদিন বলবো, আপনি কি সেদিন সেজোবাবুর সঙ্গে যাবেন?” ঠাকুর বললেন, “বেশ, তা যাবো।” শেষে সেজো-গিন্নীর ইঙ্গিতে একদিন তিনি সেজোবাবুর সঙ্গে গাড়িতে করিয়া বাহির হইলেন। ফিরিয়া আসিলে সেজো-গিন্নী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, আপনারা কোথায় গেলেন, কি হোলো বলুন তো।” ঠাকুর বলিলেন, “দেখ গো—আমরা এক জায়গায় গেলুম। সেখানে সেজোবাবু আমাকে নীচে বসিয়ে রেখে ওপরে কোথায় চলে গেল। প্রায় আধঘণ্টা পরে এসে আমায় বল্লে, চলো বাবা।" সেজো-গিন্নী ঠিক অবস্থাটা বুঝিয়া লইলেন। মথুর কিন্তু এতো সাহসী যে, শ্রী ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া এমন স্থানে যাইতেও দ্বিধা বোধ করেন নাই। (শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ—মাসিক বসুমতি ১৩২৯-১৩৭৮, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার থেকে প্রকাশিত প্রথম সং-২০১২, পৃষ্ঠা-৪২৩)। ঠাকুরকে নীচে বসিয়ে রেখে উপরে বারবণিতার ঘরে ঢুকেছিলন। এহেন মথুরবাবুকে যদি ভগবান দেখা দিয়েই থাকেন তাহলে মানতে হবে বেদ-পুরাণ(ব্রাহ্মন গ্রন্থ)-উপনিষদ এবং দর্শনশাস্ত্র সব মিথ্যে।
যৎ প্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্রণীয়তে।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।।
[কেনোপনিষদ্ ১।৮]

📌যিনি প্রাণদ্বারা চালিত হন না কিন্তু যাঁহার দ্বারা প্রাণ গতিশীল হয়, সেই ব্রহ্মকেই জান এবং তাঁহারই উপাসনা কর; তাঁহা হইতে ভিন্ন বায়ুর উপাসনা করিও না। 

আবার 

ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্।
হৃদা মনীষা মনসাভিক্লৃপ্তো য এতদ্ বিদুরমৃতান্তে ভবন্তি।।[কঠোপনিষদ্ ২।৩।৯]-ঈশ্বরকে চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না

আসলে ওসব কিছু নয়, মথুরবাবু চাইছেন গদাধর যেন ভাবতে থাকে তাহলে সত্যিই কি আমি ভগবান?” এই ভাবনাটাই মথুরবাবুর কাজে আসবে। কারণ, যে ভগবান হবে তার নিজের মধ্যেই যদি তার ভগবানত্ব নিয়ে সংশয় থাকে তাহলেই মুশকিল। তাকে মনেপ্রাণে এই বোধ আনতে হবে সে মানুষ নয়।

একবার কথা প্রসঙ্গে মথুরবাবু গদাধরকে বলেন ভগবান যা নিয়ম করে দিয়েছেন সেই নিয়মে ভগবানকেও চলতে হয়। করুক দেখি সাদা ফুলের গাছে লাল ফুল। গদাধর বলেন যার নিয়ম ইচ্ছে হলে সে ভাগতেও পারে অন্য একটা নিয়ম বসিয়ে দিতেও পারে। পরের দিন গদাধর যখন শৌচের জন্য ঝাউতলার দিকে যাচ্ছেন একটি জবা গাছে দুটি ফেকড়িতে লাল সাদা দুটি জবাফুল ফুটে থাকতে দেখেন। আবার কোন জায়গায় কাহিনিটি একটু অন্য ভাবেও পাওয়া যায়। গদাধর মথুরবাবুর সাথে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে একটি জবা গাছের কাছে এসে দেখেন গাছে লাল সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। কাহিনি যে ভাবেই থাকুক আসল ঘটনা গদাধরকে বোঝানো দেখো তুমি বলেছ বলে ভগবান এক গাছে দুরকম ফুল ফুটিয়ে দিলেন। তুমি সাধারণ লোক নও'। ধারণা করা যায় মথুরবাবুই লাল জবার গাছে একটি সাদা জবা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে লাগিয়ে রাখেন। হতে পারে গাছটা গদাধরের শৌচে যাবার পথের ধারে। যাতে শৌচে যেতে গেলেই ফুল দুটি চোখে পড়ে। না হয় বাগানের কোন এক জায়গায়, ঘুরতে ঘুরতে মথুরবাবু যেখানে গদাধরকে নিয়ে পৌঁছে যান।

ঠিক এমনই একটি ঘটনা কিছু দিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রায় সকলেই পড়েছি। ঐ এক গাছে দুই ফুলের গল্প। কিছু এঁচোড়ে পক্ক কলেজ পড়ুয়ার জ্বালায় ঘুঁটি সেবার চিকে পৌঁছতে পারেনি। করিৎকর্মা গৃহস্বামী গনধোলাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে দরজায় তালা ঝুলিয়ে পালান।

অনেকে বলতে পারেন, কেন, ভগবানের লীলায় সব হয়। আর এই সামান্য ঘটনাটুকু ঘটতে পারে না? এখানে আগে বিচার করা দরকার ভগবান বা ঈশ্বরের স্বরূপ কেমন তাঁর কাজ কি। ঈশ্বর বিষয়ে ঈশ্বরীয় জ্ঞান বেদে বলা হয়েছে
ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অণুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা সব সত্যবিদ্যা এবং যা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায় সেসবের আদিমূল পরমেশ্বর।
মান্ডূক্যোপনিষদ্ [৩।১।৮]
-ঈশ্বরকে চক্ষু বা কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা দেখা সম্ভব নয়।।

[মান্ডূক্যোপনিষদ্ ১।১।৬]
-ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যপী, অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিত্য এবং সর্বভূতের কারন
ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হলেন সর্বব্যাপক। ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছু বস্তুকে তিনি আচ্ছাদন করে আছেন।(যর্জুবেদ0 অধ্যায় ৪০, মন্ত্র ১)। এইজন্য তিনি নিরাকার অর্থাৎ ঈশ্বর আকার বা ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট নন। কারণ,আকার ধারণকারী জীব, এক সময়ে, সব জায়গায় অবস্থান করতে পারে না।

সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাহত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।। ঋগ্বেদ ১০/৯০/১, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ ৩/১৪
অর্থাৎ সেই পূর্ণস্বরূপের অনন্ত মস্তক,অনন্ত নয়ন, অনন্ত চরণ।তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডকে সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করে এবং অতিক্রম করে,অসীমরূপে বিদ্যমান আছেন।

স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ- মস্নাবিরং শুদ্ধপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ- র্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
যর্জুবেদ: ৪০।৮
অন্বয়-সঃ(সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্(শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ(ক্রান্তদর্শী), মনীষী(সর্বজ্ঞ),পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান),স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ),[সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ(লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
ভাবার্থঃ- তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা, সর্বব্যাপী,জ্যোতির্ময় ও অশরীরী(অশরীর শব্দে পরমাত্মার লিঙ্গ শরীরের নিষেধ) ক্ষতরহিত,শিরাহীন, স্নায়ুহীন,(ক্ষতরহিত ও শিরাহীন শব্দে, স্থূল শরীরের নিষেধ), নির্মল (নির্মল শব্দে,কারণ শরীরের নিষেধ করা হল) ও অপাপবিদ্ধ।তিনি, সর্বদর্শী,সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান ও স্বয়ম্ভূ।পরমাত্না, চিরকাল ধরে, লোকের যথাযথ কর্মফল অনুসারে কর্তব্য বিধান করছেন।

একটা প্রশ্ন – ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মালেও রামকৃষ্ণদেব কি সত্যিই ব্রাহ্মণ ছিলেন? হেঁয়ালি নয় কিন্তু। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন তীব্র সাধনায় মত্ত। শুধু যে হিন্দু ধর্মেই সাধনা করে চলেছেন তা নয়, একে একে বেশ কয়েকটি ধর্মেই সাধনা করে ফেলেছেন এবং সব ধর্মেই তার ঈশ্বর দর্শন হয়েছে। রামকৃষ্ণদেবের এই যে চতুর্দিকে ঈশ্বর দর্শন অথবা যে ধর্ম নিয়েই সাধনা করছেন তাতেই ঈশ্বর দর্শন হয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটাকে রমী রলাঁ যে ভাবে দেখেছেন সেটুকু তুলে দিচ্ছি—'এ-গুলি ছিল সমস্ত দেবতাকে আত্মসাৎ করিবার অতৃপ্ত একটি লালসা—আবেগের তাড়নার উন্মত্ত, ভয়াল তরপাঘাতে দোলায়মান আত্মার প্রলাপ। (রামকৃষ্ণের জীবন, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-২১, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-২৮)। শ্রীরামকৃষ্ণের ভগবান দেখা সম্বন্ধে অন্য এক জায়গায় রমা রলাঁ মন্তব্য করেছেন—'যদি ঔদ্ধত্য মার্জনা করেন, তবে এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মত হইল, তিনি এরুপ কিছুই দেখেন নাই। কেবল দেবীর সর্বব্যাপী অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি 'সচেতন ছিলেন এবং ঐ মহাসমুদ্রকেই তিনি মায়ের নামে আহ্বান করেন। ছোট-খাট দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, তাহার অভিজ্ঞতা ছিল স্বপ্ন দর্শনের অনুরূপ।' (রামকৃষ্ণের জীবন, প্রথম সংস্করণ, , পৃ- ১৭, ২৫)। ভগবান তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ঠিকই। আসলে ভগবান ভগবান করে এমন ভগবানময় হয়ে উঠেছেন যে ইট কাঠ, বেড়াল কুকুরের মধ্যেও ঈশ্বর দর্শন করে ফেলছেন। আমি যেমন কালো চশমা পরে সব কিছু কালো দেখছি, তিনিও তেমনি ভগবানের চশমা পরে সব ভগবানময় দেখতেন।

মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আগের সূত্র ধরে আর একটি গল্প বলছি। মথুরবাবু ফিটন গাড়ীতে উয়ে রামকৃষ্ণদেবকে তার জানবাজারের বাড়িতে নিয়ে আসছেন। পথে এক সংকীর্তন দলের সাথে সাক্ষাৎ। গাড়ি কীর্ত্তন দলের সাথেই চলতে লাগল। রামকৃষ্ণদেবের খুব ইচ্ছা ঐ দলে যোগ দেন। পরের অংশ বই থেকে তুলে দিচ্ছি— রামকৃষ্ণদেব ভাবাবিষ্ট হইলেন, অমনি তাহার হৃদয় হইতে রজ্জুবৎ ঘনীভূত জ্যোতিঃ বাহির হইয়া সংকীর্তনের মধ্যে পড়িয়া তাহার অনুরূপ একটি মূর্তি ধারণ পূর্বক সেই দলের সঙ্গে নৃত্য করিতে লাগিল, আর কীৰ্ত্তনও খুব জমে গেল। এইরূপে সেই মূর্তি সেই কীর্তনে কিছুক্ষণ নৃত্য করিয়া পুনরায় তাহার দেহে আসিয়া প্রবেশ করিলে তৎপরে তাহার সহজাবস্থা আসিল।' (রামকৃষ্ণ চরিত— গুরুদাস বর্মণ, প্রথম ভাগ, প্রথম সংস্করণ, ১৩১৬ পৃষ্ঠা-৮৬)। কি সুন্দর গল্পই না ফেঁদেছিলেন মথুরবাবু। গাড়িতে রামকৃষ্ণদেব ভাবাবিষ্ট হয়ে বসে রইলেন, তার দেহ থেকে জ্যোতি বেরিয়ে আর একটা রামকৃষ্ণ শরীর ধারণ করে নেচে গেয়ে আবার তার শরীরে মিলিয়ে গেল। যুক্তি তর্ক বর্জিত মানুষ আমরা। জমিদার বাবু গল্প শোনাচ্ছেন অতএব গোগ্রাসে গেলো। হাঁসের ডিম খাচ্ছি না ঘোড়ার ডিম খাচ্ছি কে তার বিচার করে। আর একবারের ঘটনা। একইভাবে ফিটন গাড়ি দক্ষিণেশ্বর থেকে জানবাজারের দিকে চলেছে। পথে হঠাৎ ঠাকুরের ভাব। যেন তিনি সীতা, রাবণ তাকে হরণ করে নিয়ে চলেছে। পথে গাড়ির রাশ ছিড়ে ছিটকে পড়ে। সমাধি ভাঙলে রামকৃষ্ণদেব বলেন, জটায়ু আক্রমণ করেছিল, তাই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। (জীবন্মুক্তি সুখপ্রাপ্তি, পৃ-১৬৫)। এ বিবরণও শুধুমাত্র মথুরবাবুরই দেওয়া। এর আর অন্য কোন সাক্ষী নেই। এমন কি রামকৃষ্ণদেব ভক্তদের কাছে পুরানো দিনের এত গল্প করলেও এ গল্প তার কাছে কোনদিন। শোনা যায়নি।

যাক, গদাধর কিন্তু ভাবছে ছিলুম এক গণ্ডগ্রাম কামারপুকুরের 'গদাই'। আর কলকাতায় এসে স্বয়ং জমিদারবাবুকে এক গাছে দুই ফুল দেখিয়ে ছাড়লাম। রাণীনাকে থাবড়ে দিলুম, কিচ্ছুটি বললে না। সামনে হাঁটছি তো কালী, পেছনে গেলেই শিব। নিজে তো কিছু বুঝতে পারছি না। তবে স্বয়ং জমিদারবাবু যখন বলে বেড়াচ্ছেন কিছু একটা পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে।

মথুরবাবুর আদর যত্ন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তিনি গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেরোচ্ছেন। তার আবদার রাখতে নিরন্ন গ্রামবাসীকে পেট ভরে খাওয়াচ্ছেন। তাদের কাপড় বিতরণ করছেন। এখানে একটা কথা বলার আছে, গদাধরের নয় রাসমণির মন্দিরে অম্ল বস্ত্রের সংস্থান হয়ে গেছে। কিন্তু যে অনাহার ক্লিষ্ট লোকগুলিকে তিনি আজ খাবার ব্যবস্থা করে দিলেন কাল থেকে তারা খাবে কি? এদেরকে কুকুরের মত বাঁচিয়ে রাখা যদি বিধির বিধান হয় তো সে বিধি আমাদের কি উপকার করতে পারে।

সে সময় দক্ষিণেশ্বর মন্দির ছিল তীর্থ পর্যটনশীল সাধু সন্ন্যাসীদের দু-চার দিনের বিশ্রামস্থল। তারা দু'চার দিন থাকে, মন্দিরের অদ্ভূত পূজারীকে দেখে তার নামে নানা কথা শুনে অন্য সাধুদের কাছে তার কথা বলে। বিনে পয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তো আছেই সেই সঙ্গে উপরি পাওনা সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন। আস্তে আস্তে ভীড় বাড়তে লাগল। মথুরবাবু ঢালাও লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করলেন। সেই সঙ্গে অতিথি ব্রাহ্মণদের বাড়তি উপঢৌকন। পুঁথিকার মন্দিরের অতিথি সেবা নিয়ে লিখছেন—
যেমন অতিথিশালা ভাঙার তেমন।
ছত্রে খায় দিনে রেতে লোক অগণন।।
যেমন তেমন নয় যাহা ইচ্ছা যার।
ভক্তাভক্ত ছোটবড় নাহিক বিচার।।
আবাসে দ্বাদশ মাসে পর্ব ত্রয়োদশ।
অম্ল দান বস্ত্র দান দেশ জুড়ে যশ।॥
স্বর্ণ রৌপ্য পাত্র দেয় বিদায় ব্রাহ্মণে।
সম্বৎসর বারে বারে হিসাব বিহীনে।।
মূল্যবান পরিচ্ছদ গরদ বসন।
অকাতরে যারে তারে করে বিতরণ।। (পৃষ্ঠা-১৪৩)

-বোঝাই যাচ্ছে যেখানে গেলে অঢেল ভুরিভোজ আর দামী দামী ভেট পাওয়া যায়, এক আধ দিন নয় বারো মাসে তেরো পার্কা লাগিয়ে যখন তখন গিয়ে হাজির হলেই হলো। এমন কল্পতরুর নাচে কে না যেতে চাইবে। রাণীর মনের সাধ পূর্ণ হচ্ছে। এরই মধ্যে মথুরবাবু মাঝে মাঝে সভা সমিতি ডেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন তাদের পূজক ঠাকুরটি নেহাত সাধারণ ব্যক্তি নন। (রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-১২৬, লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫০৬)।

এই ভাবেই রাণী রাসমণির প্রয়োজনে, মথুরমোহন বিশ্বাসের বুদ্ধিমত্তায় গণ্ডগ্রাম কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায় ভগবান রামকৃষ্ণদেব'-এ পরিণত হলেন। অবশ্য মথুরবাবুর উদ্দেশ্য সফল হবার পেছনে আরও অনেকগুলো 'ফ্যাক্টর' কাজ করেছিল। যথা সময়ে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাবেখন। মন্দির এখন লোকে লোকারণ্য। কেউ আর বলছে না ‘শূদ্রের' মন্দির। রাতারাতি মন্দির হয়ে উঠেছে মহা জাগ্রত। সাক্ষাৎ ভগবান অবতার বেশে মন্দিরে পুজো করছেন। রাবণ কুম্ভকর্ণের মতো দশ হাজার বছর তপস্যা করার দরকার নেই, হাতের কাছেই দক্ষিণেশ্বর মন্দির, গিয়ে পৌঁছলেই ভগবৎ দর্শন। এমন সোনার সুযোগ হাতছাড়া হতে দেওয়া যায়। না। হাজার বছরে ভগবান অবতার বেশে এক-আধবার আসেন কি আসেন না। এ সুযোগ কেউ হেলা-ফেলা করে?

অবতার রূপী শ্রীরামকৃষ্ণ উত্থানে সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছে তার এই ব্যাধি। যা কিনা জনমানসে রামকৃষ্ণদেবের ‘ভাব সমাধি' নামে খ্যাত। রমা রলাঁ বলেছেন ইউরোপ হইলে তাহার নিস্তার ছিল না। অবিলম্বে ওই শিশুকে মানসিক চিকিৎসার কড়া কানুনের কবলে কোন উন্মাদ আশ্রমে পাঠানো হইত।' (রামকৃষ্ণের জীবন, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৯, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৮)।
বলেছেন, এর ফলে এক অসাধারণ শিল্পী সত্তার ইতিও ঘটে যেত। আমরা আগে দেখেছি শ্রীরামকৃষ্ণের এই ব্যাধি কাজে লাগিয়ে রাণী রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাস তাদের মন্দির সার্বজনীন করতে কত বড় বাজি খেলে গেছেন।

আমরা আগে দেখেছি শ্রীরামকৃষ্ণের এই ব্যাধি কাজে লাগিয়ে রাণী রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাস তাদের মন্দির সার্বজনীন করতে কত বড় বাজি খেলে গেছেন। এবার আমরা আলোচনা করব তার এই ভাব সমাধি বা ভাবাবেশ আসলে কি। ধর্মবিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত আমরা আগেই পেয়ে গেছি। বস্তুবিজ্ঞান কি বলে দেখাই যাক না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পিসী রামশীলাদেবীর উপর মাঝে মাঝে মা শীতলার ভাবাবেশ দেখা দিত। একবার ভাই ক্ষুদিরামের বাড়ি বেড়াতে এসে সেখানেই তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। রামকৃষ্ণদেব সে বার তাকে খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেন এবং পরে বলেছিলেন, “পিসীর ঘাড়ে যে আছে সে যদি আমার ঘাড়ে চাপে তো বেশ হয়।” (লীলাপ্রসা, পৃষ্ঠা ১২৫)। রামকৃষ্ণদেবের দিদি কাত্যায়নীর হত ভূতের আবেশ। (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা ১০৬)। এই ভূতটিকে মুক্ত করতেই ক্ষুদিরামের গয়া গমন, স্বপ্ন দর্শন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ লাভ। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণদেবের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে সেই একই ভাবাবেশ। এমন কি রামকৃষ্ণদেবের ভাইয়ের মেয়ে লক্ষ্মীমণিদেবীর মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি একই রোগের লক্ষণ। তিনিও গুরুমা হয়েছিলেন। তার এক ভক্ত শিষ্য রাস্তা থেকে একটি গান। শুনে আসে। লক্ষ্মীদেবী সেই গানটি জানেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় তিনি গানটি গাইতে থাকেন। গাইতে গাইতে এতই ভাব বিভোর হয়ে পড়েন যে হাত পা আড়ষ্ট হয়ে বাহাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অন্যান্য ভক্তরা মিলে তাকে বিছানায় শুইয়ে কানে কৃষ্ণ নাম শোনাতে থাবেন। প্রায় দু-তিনদিন এই অবস্থায় পড়েছিলেন। (শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ ভ্রাতুষ্পুত্রী শ্রীশ্রী লক্ষ্মীমণিদেবী—শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা-২৫৬-৫৭)। এর পরবর্তী অংশ গুরুমার ভাব সমাধি নিয়ে ভক্তদের ঈশ্বরীয় ব্যাখ্যা। সে সব আমাদের দরকার নেই। সারদামণির মন্ত্র। শিষ্য স্বামী ভূমানন্দের বয়ানেও দেখছি—'সাধন-ভজনকালে লক্ষ্মীদিদির দেবদেবী দর্শন এবং ভাবসমাধি হোত।' (শ্রী শ্রী মায়ের জীবন-কথা, পৃষ্ঠা ২৩৪)। আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি পিতার বংশের দিক থেকেই এদের এই আবিষ্ট হবার রোগটা আসছে।
এই ভাবাবিষ্ট হবার পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, বদমায়েশী। ভাবাবেশ হয়েছে প্রচার করে ভর-টর হয়ে বেশ দুপয়সা কামিয়ে নেওয়া। যেমনটি হয় স্বপ্নাদেশের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়, হিষ্টিরিয়া, স্নায়বিক বিকার জনিত এক ভয়ংকর রোগ। সময় মতো চিকিৎসা হলে সেরে যেতে পারে অথবা নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। কিন্তু ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে অন্য সব রোগের মতো বেড়েই যাবে। রামকৃষ্ণদেবেরও ঠিক তাই হয়েছিল। ছয় সাত বছর বয়সে শম্ভু কুমোরকে গান শোনাতে গিয়ে যখন তার মধ্যে প্রথম হিষ্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় তখন থেকেই চিকিৎসা তেমন হয় নি। পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে এসে দীর্ঘ বারো বছর ধরে সাধনার নামে শরীরের উপর তিনি যে অত্যাচার করেন তার ক্ষত তাকে সারা জীবন বইতে হয়। শরীর এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তিনি আর কোনদিন নিজের পায়ে ভর দিয়ে দু পা হাঁটতে পারতেন না। যেখানেই যেতেন ভক্তদের কাঁধে ভর দিয়েই যেতে হত।
পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই তিনি বারে বারে ভাবসমাধি নামক হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। যখন কম্প হইত, তখন পাঁচ জনে ধরিয়া রাখিতে পারিত না।' (জীবনবৃত্তাত্ত—রামচন্দ্র দত্ত, চতুর্থ সংস্করণ, পৃ-২৬)। আবার এই রোগ একজনের দেখাদেখি আর একজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ারও একটা প্রবণতা আছে। একে বলা যায় গণহিষ্টিরিয়া। এমনও দেখা গেছে কোন এক গ্রামে একটি মেয়ে হঠাৎ করেই নিজেকে মা কালী বলে ভাবতে শুরু করেছে। সেটা হজম হতে না হতেই দেখা গেল আর একটি মেয়ে একই রকম আচরণ করছে। তারপরে আবার আর একজন, আবারও আর একজন। হঠাৎ হলটা কি এদের। সবাই মিলে একসঙ্গে একই রকম ভাবছে কেন? সমীক্ষক সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন আসলে এরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বন্ধু। হয়তো সবাই মিলে ঠাকুর দেবতা নিয়ে গল্পগুজব করতে গিয়ে, অথবা মন্দিরে ঠাকুর দেখতে গিয়ে মা কালীর উদ্দীপনা লাভ করেছে। পরে এই নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল্পনার রাজ্যে প্রত্যেকেই এক একজন মা কালী হয়ে উঠেছে। আর একটা উপমা দিচ্ছি। রামকৃষ্ণদেব ভক্ত সঙ্গে কীৰ্ত্তনে মেতে উঠেছেন। স্বয়ং রামকৃষ্ণ ভাবে ডগমগ, সমবেত প্রলয় নৃত্য চাপে মেদিনী কম্পমান। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবের ঘোরে নেচে চলেছেন। ভাব দেখে নাচতে নাচতেই এক ভক্ত আর এক ভক্তের গায়ে ঢলে পড়ল। তার দেখাদেখি আর একজন। একজন হো হো করে হাসছে। কেউ বা ভ্যা ভ্যাঁ করে কাঁদছে। (রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-৩৪৯, জীবন বৃত্তান্ত পৃষ্ঠা-১৭৭-৭৮)। এই হল গণহিষ্টিরিয়া। তবে এই ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাময়িক উদ্দীপনা কেটে গেলে রোগের বিকারও কেটে যায়। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব তো সাময়িক রোগী নন। তার রোগ এসেছে বংশগতির হাত ধরে। অর্থাৎ 'জীন’ বাহিত। সে তো অত সহজে যাবার নয়। আর সেই কারণেই শ্রীরামকৃষ্ণ মহা ভাবসমাধির সাধক।
একমাত্র শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ ঠিকমতো চিনতে পেরেছিলেন। তিনি বলতেন "রামকৃষ্ণের ভাবসমাধি স্নায়ুবিকার প্রসূত রোগ বিশেষ"। (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫৪৬)। ভক্ত মারফৎ এই কথা শ্রীরামকৃষ্ণের কানে এসে পৌঁছলে কথাটা তিনি মোটেই সহজ ভাবে নেননি। পরে শিবনাথ শাস্ত্রীর সাথে দেখা হলে তাকে বেশ দুকথা শুনিয়ে ছাড়েন। দক্ষিণেশ্বরে যে ঘরে রামকৃষ্ণদেব থাকতেন ঘরটি ছিল স্যাঁতস্যাঁতে, অস্বাস্থ্যকর, হাওয়া বাতাস চলাচলের অনুপযুক্ত। সুস্থ লোকই বেশিদিন সেখানে থাকলে সমাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আর তিনি তো হাজারো রোগের রুগী। ভাবসমাধি তো তার হবেই। শুনি সাধকেরা সমাধির মাধ্যমে ভগবানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কিন্তু যিনি নিজেই সাক্ষাৎ ভগবান, তিনি সমাধির মধ্যে কোন ভগবানের সাথে যুক্ত হতেন ? বিখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার রামকৃষ্ণদেবের ভাবাবেশ দেখে অবাক হয়েছিলেন। ডাক্তারবাবু রামকৃষ্ণদেবের সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তার কাছে সুযোগ পেলেই আসা যাওয়া করতেন। এটা ধারণা করাই যায় তিনি রামকৃষ্ণদেবের ভাবাবেশই দেখেছিলেন, তার পারিবারিক ইতিহাস সেভাবে জানতেন না। যদি জানতেন এর পিসীর হয় শীতলার আবেশ, এনার হয় ভবতারিণীর আবেশ, বোনের হয় ভূতের আবেশ, ভাইঝির হয় কালীর আবেশ, বংশের পূর্বতন লোকেদের মধ্যে আরও কত আবেশ হত আমার জানা নেই, এত আবেশ দেখলে রামকৃষ্ণদের সম্বন্ধেও ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপসন কিন্তু পাল্টে যেতে পারত। সুচিকিৎসার পরামর্শই তিনি দিতেন।

জাতপাত বিষয়ে রামকৃষ্ণের কি ধরনের জ্ঞান ছিলো তার বিবরনঃ-

রামকৃষ্ণদেবের নিচু জাত উদ্ধারের নমুনা -------দেখলে দেখা যায় তিনি আসলে মনুষ্য যে এক জাতি তা জানতেন না। বর্ণবিভাজন বা বর্ণব্যবস্থা কে তিনি ও অঙ্গের ন্যায় বর্ণপ্রথা ভেবে নিয়েছিলেন। এই মিথ্যা জাতিভেদ হিন্দুদের বিভাজন করে দর্বল করে দিয়েছে। আসলে মহাভারতের সময় থেকে এই বর্ণাশ্রম বিশেয ভাবে প্রচলন হয়ে যায় যা পরে পরে অজ্ঞতার কারনে বর্ণাশ্রম জাতিপ্রথা বা জাতি ভেদে পরিনত হয়েছে রঘুনাথের মতো পশু ব্রাহ্মণদের প্রচার ও প্রসার।
রামকৃষ্ণদেব বলিতেন ," জন্মগত দ্বিজাতি (উঁচু জাত) নহে , এমন ভক্ত মুখে পরব্রহ্ম বাচক প্রণব উচ্চারণ শুনিলেই কে যেন কানে ছুঁচ ফুটিয়ে দেয়।" তাই কোন কায়স্থ ভক্তকে কহেন, " নামী কিনা ভগবান সঙ্গে অভেদ এমন যে, তার নাম জপ করলে সর্বার্থ সিদ্ধ হয় , তখন প্রণবটা না বল্লে আর তোমার ধর্ম হবে না "?' (শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত, পৃষ্ঠা - ১৩৭)।
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল ঐ গ্রন্থের অন্যত্র বলছেন ,' আর একদিন ঠাকুর কহেন ," শূদ্র মুখে প্রণব উচ্চারণ শুনলে কানে যেন ছুঁচ ফুটিয়ে দেয় ; ভগবানের অসংখ্য নামের একটিতে রতি হলে সর্বার্থ সিদ্ধি হয়। তখন প্রণব উচ্চারণের কি আবশ্যিক" ?' (ঐ, পৃ - ৩৩৪)। দেখুন ঠাকুর কি বলছেন , জন্মসূত্রে যে উচ্চবর্ণ নয় তার মুখে প্রণব মন্ত্র তিনি শুনতে চান না।
একটি পুরনো দিনের ঘটনা -- বৃন্দাবন ভ্ৰমন প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, " বৃন্দাবনে গিয়ে আর আমার ফিরে আসতে ইচ্ছে হল না। গঙ্গামার কাছে থাকবার কথা হলো। সব ঠিকঠাক। এদিকে আমার বিছানা হবে, ওদিকে গঙ্গামার বিছানা হবে, আর কলকাতায় যাব না, কৈবর্তের ভাত কতদিন খাব ?"( কথামৃত , রিফ্লেক্ট , অখন্ড সং . পৃ - ৩৩৬)। এরপর আছে মাতৃভক্তি , মায়ের টানে কলকাতায় ফিরে আসা।
কিন্তু ফিরলেই তো হবে না, আমরা তার মনের কথাটা শুনে নিয়েছি। কে এক গঙ্গামা, যাকে তিনি চিনেছেন দু দিন আগে, মথুরবাবুর এত দিনের আতিথেয়তা জাতপাতের জোয়ারে মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি বৃন্দাবনেই থেকে যাবেন। নীচু জাত উদ্ধার তো হলো না।

বর্ণাশ্রমঃ কি তা সংক্ষেপে দেখে নিই। গুন কর্ম স্বভাব অনুযায়ী এই বর্ণ-ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণঃ বেদ পড়া, পড়ানো বা বুদ্ধি জ্ঞান দ্বারা সমাজ সেবা করা
ক্ষত্রিয়ঃ দেশ রক্ষা
বৈশ্যঃ কৃষি কাজ, ব্যবসা
শূদ্রঃ সমাজ সেবা social worker

পূর্বে অর্থাৎ মহাভারতের পূর্বে সকলে ব্রাহ্মণ ছিল [মহাভারত শান্তি পর্ব ১৮৮।১০] মনুষ্য উৎপত্তি সময় থেকে জন্ম গত সকলে ব্রাহ্মণ সেই সময় থেকে ধিরে ধিরে যারা রজগুনেনে, কাম ভোগ প্রিয় তীক্ষ স্বভাব, ক্রোধী সাহসী তারা ক্ষত্রিয়। যে সকল ব্রাহ্মণ হিংসুক, লোভী মিথ্যাবাদী তাঁরা বৈশ্য, এই ভাবে ক্রমে ক্রমে ব্রাহ্মন্যত্বের গুন হারিয়ে যারা সকল প্রকার কাজে ইচ্ছুক হলো শৌচাদি মানতো না সব কিছু খেতে শুরু করলো তাঁরাই শূদ্র হলো [ব্রহ্মান্ডপুরাণ ৮।১৪৯]। ধিরে ধিরে আমরা জন্মগত সকলে শূদ্রে পরিনত হলাম, শূদ্র অর্থাৎ মূর্খ জ্ঞানহীন । শাস্ত্র মতে পূর্ণবিদ্যান ধার্মিকদের ব্রাহ্মণ বলা হয়, সেই দিক দিয়ে গদাধর কি ছিলেন পাঠকগন বিচার করবেন।

একদিন ভক্ত সঙ্গে খাওয়া দাওয়া প্রসঙ্গ চলছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—“আমার কামার বাড়ির দাল খেতে ইচ্ছে ছিল; ছেলেবেলা থেকে কামাররা বলতো বামুনেরা কি রাঁধতে জানে? তাই (ধনীর বাড়ি) খেলুম, কিন্তু, কামারে কামারে গন্ধ”। (সকলের হাস্য)। (কথামৃত—শ্রীম, দ্বিতীয় ভাগ, একাদশ সংস্করণ - ১৩৮৮, পৃ- ১৩২)। ধনীর প্রতি শ্রবা ভক্তির ঘাটতি তার ছিল না। মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐ জাতপাতের আচার। ছোট্টবেলা থেকে যার কোলে পিঠে বড় হয়েছেন, প্রাপ্ত বয়সে ব্রাহ্মণত্তের অভিমানে তার খাবারেই 'কামারে কামারে গন্ধ পাচ্ছেন। আসলে তিনি ছোট জাতের হাতে খাওয়া ব্যাপারটাকেই মেনে নিতে পারেননি। তার ভক্তমণ্ডলীও একথা শুনে হেসে ফুটিফাটা। (নিশ্চয়ই শুধু ব্রাহ্মণরাই হবে)। পাঠকের কাছে জিজ্ঞাসা আমরা তাহলে কোন্ সময়টাকে ধরব, শৈশবের ভিক্ষা মা', নাকি প্রাপ্ত বয়সের 'কামারে কামারে গন্ধ'। জমিদার মণি মল্লিকের বাড়ি খেতে গিয়েও তার অভিমত একই রকম—"মণি মল্লিকের (বরানগর) বাগানে ব্যাঞ্জন রান্না খেলুম, কিন্তু কেমন একটা ঘেন্না হল।" (কথামৃত—শ্রীম, দ্বিতীয় ভাগ, পৃ-১৩২।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে। কাতারে কাতারে ব্রাহ্মণের মধ্যে রামকৃষ্ণদেবও আছেন। সকলে খাওয়া দাওয়া করছেন। এমনকি দাদা রামকুমার পর্যন্ত। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব সে খাবার স্পর্শ করলেন না। বাইরে থেকে চিড়ে মুড়কি কিনে তাই খেয়ে ঝামাপুকুর নিবাসে চলে এলেন। রাণী রাসমণি নীচজাতীয়া মহিলা। তার মন্দিরের অন্ন গ্রহণ করে জাত খোয়াতে রাজী নন ভগবান রামকৃষ্ণদেব।

তিনি ঝামাপুকুরেই রয়ে গেলেন দাদার অপেক্ষায়। কিন্তু দাদা যে ফেরেই না। রামকুমার বুঝে গেছেন তার যা আর্থিক অবস্থা এই মন্দির ছেড়ে চলে আসা নেহাত মূৰ্খামো ছাড়া কিছুই নয়। তিনি ফিরলেন না। এইভাবে পুরো সপ্তাহ কেটে গেল। রামকৃষ্ণদেব আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। দক্ষিণেশ্বরে এসে হাজির হলেন। এবং অবশ্যম্ভাবী দাদার সাথে বাতবিতণ্ডা শুরু হল। পৈতে নেবার সময় ধনীকে ভিক্ষা মা হতে বলায় রামকুমার যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাদের পিতা কখনও নীচ জাতের সাথে গা মাখামাখি করেন নি। রামকৃষ্ণও যেন ওপথে পা না দেয়।' আজ শ্রীরামকৃষ্ণও দাদার কাছে একই যুক্তি তুলে ধরলেন।

যুক্তি যেমনই হোক না কেন, এ যে রামকুমারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। যুক্তি তক্কো কি পেট ভরাবে। শেষ পর্যন্ত ‘ধর্ম পত্রানুষ্ঠান' রূপ সরল উপায় অবলম্বন করা হল। এ এক অনেকটা হেড-টেল করার মত ব্যাপার। টসে রামকুমারের জিত হল। জানিনা কয়েনটা 'শোলে'র কয়েন ছিল কিনা। কারণ রামকুমারের জেতাটা ছিল ভাইয়ের জেদ বজায় রাখার থেকে অনেক বেশি জরুরি।

রামকৃষ্ণদেব বুঝে গেছেন রামকুমার আর ফিরছেন না। ঝামাপুকুরের টোলটিও গেল। এবার তিনি যাবেন কোথায়। সে রাত দক্ষিণেশ্বরেই থেকে গেলেন। রামকুমারও তাকে পথে আনার একটু সময় পেয়ে গেলেন। "দেবালয়, গঙ্গা জলে রান্না, তাহার উপরে শ্রী শ্রী জগদম্বাকে নিবেদন করা হইয়াছে, এ ভোজনে কোন দোষ হইবে না”। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব মানছেন না। এসবের মধ্যে ব্রাহ্মণত্বের সমূহ ক্ষতি, এ তিনি দিব্য চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন।

এবার রামকুমার তার শেষ অস্ত্রটি নিক্ষেপ করছেন। এ অস্ত্র যদি ব্যর্থ হয় শ্রীরামকৃষ্ণকে নিশ্চিত কামারপুকুরে ফিরে যেতে হবে। কোথায় পড়ে থাকবে দক্ষিণেশ্বর মন্দির আর কোথায়ই বা অবতার রামকৃষ্ণদেব। রামকুমার বললেন “তবে সিধা লইয়া পঞ্চবটী তলে গঙ্গা গর্ভে স্বহস্তে রখন করিয়া ভোজন কর; গঙ্গা গর্ভে অবস্থিত সকল বস্তুই পবিত্র, একথা মান তো?”

উপরের সমস্ত বিবরণই লীলাপ্রসঙ্গ ১৯০-৯১-৯২ পাতা থেকে নেওয়া। পড়ে মিলিয়ে নিতে পারেন।

বলরাম মন্দিরে অন্ন গ্রহণ করেন জানিয়া, কোন ভক্ত তাদের শালগ্রাম শিলার অন্ন ভোগ দিয়া তাহাকে সেবা করিবার প্রস্তাব করিলে ঠাকুর কহেন—“তোমার তো কুল প্রথা নয়, কেবল আমাকে ভাত খাওয়াবার অভিলাষ, আবার তোমার দেখাদেখি অন্য ভক্তরাও এইরূপ করবে। তাহলে আমি সকল শূদ্র ভক্ত বাড়িতেই ভাত খেয়ে বেড়াই”।" এই হল লীলামৃতের বর্ণনা। এই বর্ণনাটি 'প্রেমানন্দ—ওঁকারেশ্বরানন্দ, দ্বিতীয় ভাগ, প্রথম সংস্করণ ১৩৫৩ পৃ. ১৯-১০১' থেকেও পাওয়া যাবে। সেখানে আরও দেখা যাবে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর বীর ভক্ত গিরীশ ঘোষের বাড়িতে অন্ন গ্রহণেও অস্বীকার করেন। তাকে
পরিষ্কার বলে দেন, তুমি তো ব্রাহ্মণ নও, আর তোমার বাড়িতে কোন ঠাকুরের অন্নভোগও নেই। অতএব তোমার ভাতের থালায় আমিও নেই। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, 'শ্রী রামকৃষ্ণ সকল অহং ভাব ত্যাগ করিয়াছিলেন, কিন্তু তথাপি “আমি ব্রাহ্মণ" এই বোধ তাহার ছিল।' রামকৃষ্ণদেব বলতেন, "ভগবানকে দেখার পর আর জাতির অভিমান থাকে না, তখন শিশুর মতো অবস্থা হয়। শিশুর যেমন জাতের অভিমান নাই, তত্ত্ব স্রষ্টারও তেমনি জাতির অভিমান লোপ পায়।" (ভক্ত মনোমোহন—–উদ্বোধন, পৃ-৪৫)। আমরা দেখছি মৃত্যুর পূর্বেও ঠাকুরের জাতের অভিমান অতি প্রবল। তাহলে ঠাকুর ঠিক কোন্ সময় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছিলেন, মৃত্যুর আগে না পরে। ব্রাহ্মণদের নীচু জাতের ছোঁয়া না খাওয়া প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ 'মদীয় আচার্যদেব' প্রবন্ধে তার মত ব্যক্ত করেছেন এই ভাবে, যদিও সব কুসংস্কারের মত এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তিনি দেন নি, এটি খাঁটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা — তাহারা বরং উপবাস করিয়া থাকিবে, তথাপি তাহাদের স্বজাতির ক্ষুদ্র গণ্ডীর বহির্ভূত কোন ব্যক্তির হাতে খাইবে না। এইরূপ স্বাতা-প্রিয় হইলেও তাহাদের ঐকান্তিকতা ও অসাধারণ নিষ্ঠা আছে। নিষ্ঠাবান হিন্দুদের ভিতর অনেক সময় এইরূপ প্রবল বিশ্বাস ও ধর্মভাব দেখা যায়, কারণ সত্যের প্রতি গভীর বিশ্বাস হইতেই তাহাদের নিষ্ঠা আসিয়াছে।' (স্বামীজীর বাণী ও রচনা, অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা (৩৮৪)। নিজে শূদ্র হয়েও বীর কেশরী স্বামী বিবেকানন্দ দেখছি প্রথাটিকে দিব্যি হজম করে নিয়েছেন। শ্রী শ্রী ঠাকুর ব্রাহ্মণেতর বর্ণের হাতে ভাতটা মাত্র সচরাচর খাইতেন না। কিন্তু কখনও কখনও এই নিয়মের ব্যতিক্রম করিয়াছেন। যেমন পূজাপাদ স্বামীজী রখন করিলেও সেই অন্ন খাইয়াছেন এবং 'সর্ব্বং ব্রম' এই কথা প্রত্যক্ষ করিয়া কাশালীদের উদিষ্ট খাইয়া পবিত্র জ্ঞানে মস্তকে হস্ত স্পর্শ করিয়াছেন।' (স্বামী সারদানন্দের "পত্রমালা", দ্বিতীয় সংস্করণ, পত্র সংখ্যা "তিন", পৃষ্ঠা ১৪৩। এর প্রভাব আমরা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনেও পড়তে দেখি , স্বামী বিবেকানন্দ নিজে শূদ্র হয়েও বলে গেছেন “বামুনের ছেলের নীচ জাতের ছোঁয়া না খাওয়াই ভালো।” (স্বামীজির বাণী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃ- ১৫৩)। রামকৃষ্ণদেবের অনান্য শিষ্যরাও জাতিভেদ প্রথা রক্ষার্থে সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। মুচি আমার ভাই, চামার আমার ভাই, ব্রাহ্মণ আমার ভাই, এতসব ভাই ভাই শুনে ভেবে বসবেন না যেন স্বামীজী জাতপাত উৎখাত করতে এত ভাইয়ের ডাক দিয়েছেন। একেবারেই না। জাতপাত যেমন আছে তেমনই থাকুক, ওসব নিয়ে নাড়াচাড়া করার পক্ষপাতী কখনই তিনি ছিলেন না। সিস্টার নিবেদিতার বক্তব্য অনুযায়ী জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করে তিনি জীবনে একটি বাক্যও খরচ করেন নি। বরং এই কু-প্রথার প্রয়োজনীয়তা এবং গুণাবলী নিয়ে গণ্ডা গণ্ডা মন্তব্য করে গেছেন। (স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি—নিবেদিতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৫৩, অনুবাদক-স্বামী মাধবানন্দ, পৃ- ২৯১)।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও তন্ত্রসাধনা [১৮৬১ সাল-১৮৬৩]-Muller, Max (১৮৯৮)। "Râmakrishna's Life"। Râmakrishna his Life and Sayings। পৃষ্ঠা pp.43–44 অথবা রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড ১৯৯-২০৬ পৃষ্ঠা

রামকৃষ্ণের সাধনা
তন্ত্রসাধনা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড একাদশ অধ্যায় পৃষ্ঠাঃ১৯৭ /  পিডিএফ পৃঃ২৩১

যিনি বেদবিৎ শুদ্ধচেতা কামজয়ী ব্রহ্মবিদ্গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনিই গুরুপদবাচ্য তিনিই শ্রেষ্ঠাচার্য, অনভিজ্ঞ গুরুর দ্বারা উপদিষ্ট হলে আত্মাকে সম্যকরূপে জানা যায় না। জ্ঞানের দ্বারাই জীবের মোক্ষলাভ হয়, জ্ঞানই পরাৎপর (পরমাত্মা)। অতএব যিনি এই পরম জ্ঞানদানে অসমর্থ সেই গুরুকে ত্যাগ করায় কোনও দোষ নেই। যার কাছে সত্য ও অমৃতের সন্ধান পাওয়া যাবে না তাকে অবিলম্বে ত্যাগ করা উচিৎ। ভন্ড গুরুদের জন্যই যুগ যুগ ধরে সত্যধর্ম্ম হয়েছে পদদলিত, সম্প্রদায়ের পর সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রচনা করে চলেছে নানা মনগড়া পুস্তক। তন্ত্র সাধনা একটা কুপথ এবং বিপথ !! ভৈরবী ব্রাহ্মনী দ্বারা প্ররোচিত হয়ে গদাধর চট্টোপাধ্যায় তন্ত্র সাধনার নামে নানা জঘন্য ক্রিয়া কলাপ করেছিলেন [স্বামী সারদানন্দের "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ" দ্বিতীয় খন্ড]। রামকৃষ্ণের জীবনে ভৈরবী-ব্রাহ্মণী-সমাগম [শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ১৮৭ / পিডিএফ পৃঃ২২৩]
গাদাধর তন্ত্রসাধানা কিরূপে করেছিলেন কিংবা তিনি তা দ্বারা সত্য কি ঈশ্বর লাভ করেছিলেন বিচার করার আগে দেখা দরকার তন্ত্র সাধনা আসলে কি এবং সত্য কি এটা কোন সাধনার পথ ? ঈশ্বরীর জ্ঞান বেদ ও শাস্ত্রগ্রন্থে এসব বিষয়ে কি বলা হয়েছে ও তন্ত্র সাধনা কি। 
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর অমর গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশ অনুযায়ী মহাভারতের যুদ্ধের হাজার বছর পূর্ব্ব হতে ঋষি মুনি থাকা সত্ত্বেও আলস্য, প্রমাদ এবং ঈর্ষ্যা-দ্বেষের অঙ্কুর উৎপন্ন হয়ে তা ক্রমশ বর্দ্ধিত হতে থাকে। যখন জনসাধারণ  মেষপালকবৎ মিথ্যা গুরু ও শিষ্যদিগের বশীভূত হলো, তখন তারা প্রমাদ ও বিষয়াসক্তিতে নিমগ্ন হয়ে গেল। তাহাদের বিদ্যা-বল-বুদ্ধি-পরাক্রম এবং শৌর্য-বীৰ্য্যাদি যাবতীয় শুভগুণ নষ্ট হয়ে গেল। অতঃপর তারা বিষয়াসক্ত হইয়া গোপনে মদ্য-মাংস সেবন করতে আরম্ভ করে। তাহাদেরই মধ্যে ৰামমার্গী আবির্ভূত হয়ে, “শিব উবাচ”, “পার্ববত্যুবাচ” এবং “ভৈরব উৰাচ”, ইত্যাদি লিখে তন্ত্রগ্রন্থ রচনা করে এবং তন্মধ্যে
এই সকল বিচিত্র লীলা-খেলা সন্নিবিষ্ট করিল—

মাং মাংসং চ মীনং চ মুদ্রা মৈথুনমেব চ।
এতে পঞ্চ মকারাঃ স্ন্যুম্মোক্ষদা হি যুগে যুগে ॥ (কালীতন্ত্ৰাদিতে)।

এই সকল গণ্ডমূর্খ পুশুর লীলা খেলা দেখুন! এই বামমার্গিগণ বেদবিরুদ্ধ মহাপাপজনক কাৰ্যগুলিকে উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে করিল। তারা মদ্য, মাংস, মীন অর্থাৎ মৎস্য, মুদ্রা (পুরী, কচুরী, বৃহৎ রুটি প্রভৃতির চর্ব্বণ, যোনি, পাত্রাধার মুদ্রা ) এবং পঞ্চম মৈথুন অবলম্বন করে সকল পুরুষকে শিব এবং সকল স্ত্রীকে পাৰ্ব্বতীতুল্য মনে করে—

অহং ভৈরবস্তুং ভৈরবী হ্যাবয়োরস্ত সঙ্গমঃ।

যে কোনও স্ত্রী অথবা পুরুষ হউক না কেন, এই অর্থশূন্য বচন পাঠ করে সমাগম করা বামমার্গিগণ দোষজনক মনে করে না। যে সকল হীনচরিত্রা স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিতে নাই, তাহাদিগকে ইহার। অতি পবিত্র মনে করে। শাস্ত্রে রজস্বলা স্ত্রীলোকের স্পর্শ নিষিদ্ধ। বামমার্গিগণ তাহাকেও অতি পবিত্র মনে করে। অন্যেরা যাতে কিছু বুঝতে না পারে তাই এরা মদ্যের নাম 'তীর্থ", মাংসের নাম "শুদ্ধি" ও "পুস্প", মৎসের নাম "তৃতীয়া" ও জল তুম্বিকা, মৈথুনের নাম "পঞ্চমী" রেখেছে। এরা নিজেদের "কৌল", "আর্দ্রবীর", "শাম্ভব" এবং "গণ" প্রভৃতি রেখেছে। যারা বামমার্গী নয় তাদের নাম এরা "কন্টক" "বিমুখ" এবং "শুস্কপশু" প্রভৃতি রেখেছে। বামমার্গী অর্থাৎ যারা স্ত্রীলোক নিয়ে ব্যাভিচার করে তারা। এরা নিত্য নতুন ভন্ডামি ও ভ্রষ্টাচার করার জন্য দেবীগীতা, দেবীভাগবতী ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করে।
এদের সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ ব্যক্তি সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে—

হালাং পিবতি দীক্ষিতন্য মন্দিরে সুপ্তো নিশায়াং
গণিকাগৃহেষু। বিরাজতে কৌলবচক্ৰবৰ্ত্তী ॥

যে ব্যক্তি দীক্ষিত অর্থাৎ শৌভিকের গৃহে গিয়ে বোতলের পর বোতল মদ পান করে, বেশ্যালয়ে গিয়ে তাহার সহিত কুকৰ্ম্ম করে শয়ন করে এবং নির্লজ্জ ও নিঃশঙ্কভাবে এই সকল কর্ম্ম করে, সে বামমাগীদিগের মধ্যে চক্রবর্ত্তী রাজার ন্যায় সর্ব্বোপরি সম্মান প্রাপ্ত হয়।
অর্থাৎ যে সর্বাপেক্ষা অধিক কুকৰ্ম্মী সেই তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যে সৎকর্ম্ম করে এবং কুকর্ম্ম হইতে ভীত হয়, সেই নিকৃষ্ট। কারণ:

পাশবদ্ধো ভবেজ্জীব: পাশমুক্তঃ সদা শিবঃ ॥ [ জ্ঞানসঙ্কলিনী তন্ত্র, শ্লোক ৪৩ ]

তন্ত্রে এইরূপ কথিত আছে যে, যে ব্যক্তি লোকলজ্জা, শাস্ত্ৰলজ্জা, কুললজ্জা এবং দেশলজ্জা প্রভৃতি পাশে বন্ধ থাকে সেই জীব এবং যে নির্লজ্জ হইয়া কুকর্ম্ম করে সেই সদাশিববামমার্গিগণ বলে যে, বেদ, শাস্ত্র পুরাণ (ব্রাহ্মণ গ্রন্থ) সামান্য গণিকাতুল্য। কিন্তু তাহাদের শাস্তবী মুদ্রা গুপ্ত কুলবধূ সদৃশ। এই কারণে ইহারা বেদবিরুদ্ধ মত স্থাপন করেছে। পরে তাহাদের মত বিশেষরূপে প্রচারিত হলে তাহারা ধূর্ত্ততার সহিত বেদের নামেও বামমার্গের লীলা-খেলা ক্রমে ক্রমে প্রচলিত করে।
মুনিঋষিদের গ্রন্থে নানাবিধ বচন প্রক্ষিপ্ত করে এবং নিজেদের নামে গ্রন্থ রচনা করে, গোমেধ ও অশ্বমেধ নামক যজ্ঞ করাতে আরম্ভ করে। এই সকল পশু কে হত্যা করে হোম করিলে যজমান এবং পশু স্বর্গলাভ করে, এরূপ তাঁরা ঘোষণা করতে থাকে।
বিঃদ্রঃ 
রাষ্ট্রং বা অশ্বমেধঃ।।[শতপথ ব্রহ্মণ ১৩।১।৬।৩]
অন্ন হি গৌঃ।। [শতপথ ৪।৩।১।২৫]
অগ্নির্বা অশ্বঃ। আজ্যং মেধঃ।।[শতপথ ব্রহ্মণ]- অশ্ব গবাদি পশু এবং মনুষ্য বধ করে হোম করবার কথা কোথাও নাই। কেবল বামমার্গীদের গ্রন্থেই এরূপ অনর্থ লেখা আছে। মন্ত্র শব্দ বিশেষ, মন্ত্রের অর্থ এই নয় যে পশুকে বধ করে হোম দিতে হবে।

যাক্, আসল প্রশ্নে আসা যাক্। অনেকে বলেন, রামকৃষ্ণের মত লোক যখন তন্ত্রমতের সাধনা করে গেছেন, তখন এও নিশ্চয়ই একটা পথ ! কিন্তু আমার মতে 'যত বড় লোকেরাই ঐ পথের সাধনা করুন না কেন ওটা কুপথ এবং বিপথ !!
 সত্য বটে, ভৈরবী ব্রাহ্মনী দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, ‘এক পূর্ণযৌবনা বিবস্ত্রা নারীর কোলে বসা', 'কুকুর শেয়ালের এঁটো খওয়া' 'শবের পরে মৎস্য রান্না খাওয়া' 'গলিত আম-মহামাংস (নরমাংস ভক্ষণ' এবং 'একজন ভৈরবীকে পাঁচসিকা পয়সা দিয়া বীরভাবের সাধন, 'যোনিমন্থন' ইত্যাদি তন্ত্রসাধনার নামে নানা জঘন্য ক্রিয়া কলাপ রামকৃষ্ণ করেছিলেন [ স্বামী সারদানন্দের 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ" দ্বিতীয় খণ্ড, ২০৪-২০৫ পৃষ্ঠা / পিডিএফ ২৩৯ পৃঃ দ্রষ্টব্য ], তাই বলে তাঁর জ্ঞানের অপরিপক্ক অবস্থার ঐ সকল নির্ব্বোধ আচরণ কোন প্রকারেই শ্রেয়োলাভের পথ হয়ে যাবে না। যদি ‘রামকৃষ্ণের মত লোক বলে গেছেন’ প্রমাণ হয়, তেমনি মহর্ষি দয়ানন্দের মত লোকের নাম করে বলতে পারি, তিনি ঐ জঘণ্য তন্ত্রমত খণ্ডন করে গেছেন। মহর্ষি দয়ানন্দজী সারা ভারতের পণ্ডিত এবং সাধু সমাজকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করে মূর্তিপূজা যে মিথ্যা এবং বেদ বহির্ভুত, তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। তোমাদের ঐ 'যুগাবতার' তখন ত সাহসই করেন নি ঐ বেদজ্ঞ দিগ্বিজয়ী মহর্ষির সঙ্গে বাক্যালাপ করতে।
রামকৃষ্ণের সাধনা
“আর একদিন দেখি, ব্রাহ্মণী শবের খর্পরে মৎস্য রাঁধিয়া শ্রীশ্রীজগদম্বার তর্পণ করিল এবং আমাকেও ঐরূপ করাইয়া উহা গ্রহণ করিতে বলিল। তাহার আদেশে তাহাই করিলাম, মনে কোনরূপ ঘৃণার উদয় হইল না। “কিন্তু যেদিন সে (ব্রাহ্মণী) গণিত আম-মহামাংস-খণ্ড আনিয়া তর্পণাস্তে উহা জিহ্বাদ্বারা স্পর্শ করিতে বলিল, সে দিন ঘৃণায় বিচলিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘তা কি কখন করা যায়?' গুনিয়া সে বলিল, 
‘সে কি বাবা, এই দেখ আমি করিতেছি!'—
বলিয়াই সে উহা নিজ মুখে গ্রহণ করিয়া 'ঘৃণা করিতে নাই’ বলিয়া পুনরায় উহার কিয়দংশ আমার সম্মুখে ধারণ করিল। তাহাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া শ্রীজগদম্বার প্রচণ্ড চণ্ডিকা-মূর্তির উদ্দীপনা হইয়া গেল এবং 'মা' 'মা' বলিতে বলিতে ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম! তখন ব্রাহ্মণী উহা মুখে প্রদান করিলেও ঘৃণার উদয় হইল না [রামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড পৃঃ ২০৫ / পিডিএফ ২৩৯ পৃঃ]।
রামকৃষ্ণের সাধনা 
[রামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড পৃঃ ২০৬ / পিডিএফ ২৪০ পৃঃ]।


নির্ম্মল চৈতন্য দেশের অধিপতি ঈশ্বর দর্শন লাভের জন্য পঞ্চ কোষের আবরণ ভেদ করে, পিও ব্রহ্মাণ্ডের অতীত ভূমি, রামকৃষ্ণের কথা মত কোন “হালদার পুকুরের পাড়” নয় যে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব্ব পশ্চিম ঈশান অগ্নি নৈঋত বায়ু -যে কোন দিক বা কোন দিয়ে চলে যাওয়া যাবে !!!


হঠযোগ
কালীবাড়ী-প্রতিষ্ঠার কথা জানাজানি হইবার পরে গঙ্গাসাগর ও ৺জগন্নাথ-দর্শনপ্রয়াসী পথিক-সাধুকুল ঐ তীর্থদ্বয়ে যাইবার কালে কয়েক দিনের জন্য শ্রদ্ধাসম্পন্না রাণীর আতিথ্য গ্রহণ করিয়া দক্ষিণেশ্বর ঠাকুর ৰাটীতে বিশ্রাম করিয়া যাইতে আরম্ভ করেন ঠাকুর বলিতেন ঐরূপে অনেক সাধক ও সিদ্ধপুরুষেরা এখানে পদার্পণ করিয়াছেন। ইহাদিগের কাহারও নিকট হইতে উপদিষ্ট হইয়া ঠাকুর এইকালে প্রাণায়ামাদি হঠযোগের ক্রিয়াসকল অভ্যাস করিতেন বলিয়া বোধ হয়। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে-
‘যমনিয়মাসন-প্রাণায়ামপ্রত্যাহারধারণাধ্যানসমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি’- (যোগসূত্র : ২/২৯)
অর্থাৎ : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ।
 .
যোগের এই অষ্টাঙ্গ যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে চিত্তের মলিনতা নষ্ট হয় এবং জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পায়।
হঠযোগের একটা অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ (Astanga Yoga)। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি- (১) যম (Yama), (২) নিয়ম (Niyama), (৩) আসন (Asana), (৪) প্রাণায়াম (Pranayama), (৫) প্রত্যাহার (Pratyahara), (৬) ধারণা (Dharana), (৭) ধ্যান (Dhyana) ও (৮) সমাধি (Samadhi)। 
পাঠকগন বিচার করবেন ওনার জীবানাচার দেখে তিনি সত্য প্রণায়ামাদি করেছিলেন কিনা।


বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধনা  [১৮৬৪ সালে]

চান করে উঠে রোদে দাঁড়িয়ে তিনি মেয়েদের মত চুল শুকোতেন। (শ্রী রামকৃষ্ণ অন্ত্যলীলা, স্বামী প্রভানন্দ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১-১০)। মনে মনে কল্পনা করতেন আবার যদি জন্ম গ্রহণ করেন তবে যেন ব্রাহ্মণের ঘরে সুন্দরী, সুকেশী, বালবিধবা কন্যা হয়ে জন্মান। বাকী জীবনটা একমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে ভজনা করে কাটিয়ে দিবেন। (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-২১৩)। বলতেন, 'প্রকৃতিভাবে পুরুষকে (ঈশ্বরকে) আলিঙ্গন চুম্বন করতে ইচ্ছে হয়।' (অন্ত্যলীলা, প্রথম খণ্ড, পৃ-৬৫)।


একবার যুবক স্বামী অভেদানন্দকে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—“তোর ভ্রু-দুটি, চোখ ও কপাল দেখে শ্রীকৃষ্ণের মুখের উদ্দীপনা হয় ও আমার ভিতর রাধার ভাব জেগে ওঠে কেন বল দেখি?” (স্বামী অভেদানন্দ, প্রকাশক স্বামী আদ্যানন্দ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২১)। লক্ষ্য করে দেখবেন রামকৃষ্ণের মধ্যে সব সময় মা কালী, শ্রী রাধিকা এই রকম কোন নারী চরিত্রের ভাবই ফুটে উঠছে। শিব ঠাকুর, নারায়ণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এরা যেন তার বিপরীত চরিত্র।

একবার আরতি হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ কাপড় পরে মথুরবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে চামর করছেন। মথুরবাবু তাঁকে চিনতে পারেননি। স্ত্রী জগদম্বা বলেন— ' তা হইতেই পারে। মেয়েদের মতো কাপড়চোপড় পরিলে বাবাকে পুরুষ বলিয়া মনেই হয় না।' (লীলা প্রসঙ্গ, পৃ – ৪৬৭)। স্ত্রী ভক্তরা বলেন—“ঠাকুরকে আমাদের পুরুষ বলিয়াই অনেক সময় মনে হইত না; মনে হইত যেন আমাদেরই একজন। সেজন্য পুরুষের নিকট আমাদের যেমন লজ্জা সংকোচ আসে ঠাকুরের নিকটে তাহার কিছুই আসিত না।” (ঠাকুর রামকৃষ্ণ—ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৫১৫)। বেশ বোঝা যাচ্ছে রামকৃষ্ণদেবের স্বভাবে একটা মেয়েলি লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। কিছু হরমোন ক্ষরণের অসাম্য থেকে এই ধরনের বিপরীত লক্ষণ ফুটে উঠতে পারে। এজন্য তার কিছু করারও থাকে না।

বৃন্দাবনে গঙ্গা মাইয়া রামকৃষ্ণদেবকে দেখে কি ভেবেছিলেন লক্ষ্য করুন— “ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি ইনি দর্শন মাত্রেই ধরিতে পারিয়াছিলেন ঠাকুরের শরীরে শ্রীমতী রাধিকার ন্যায় মহাভাবের প্রকাশ, এবং সেজন্য ইনি ঠাকুরকে শ্রীমতী রাধিকাই স্বয়ং অবতীর্ণ ভাবিয়া ‘দুলালী' বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন।” (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা ৫৬৮)। রামকৃষ্ণদেবকে দেখে শিব, কৃষ্ণ, নারায়ণ ইত্যাদি কোন পুরুষ চরিত্র তার মনে না এসে রাধিকার ছবি ফুটে উঠল কেন?


রমা রলাঁও বলেছেন “আর সেই সঙ্গে ছিল নারী সুলভ একটি মাধুর্য, যাহা তাহার মধ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।” (রামকৃষ্ণের জীবন, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৬, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৬)। অথবা—"সম্ভবত মেয়েরা তাহার মধ্যে নারী সুলভ কোন বস্তু প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তিনি কৃষ্ণ ও গোপীদের কাহিনী কিংবদন্তীর মধ্যে আবাল্য লালিত হওয়ায় একটি নারী সুলভ প্রকৃতিও তাহার অধিগত হইয়া গিয়াছিল।" (ঐ, পৃষ্ঠা-১০, ১৯)।


শ্রীরামকৃষ্ণের এই নারী সুলভ আচরণের প্রমাণ জীবনী গ্রন্থগুলির যত্রতত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। নিজেকে নারী ভাবার মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। আরও অন্য দিক থেকেও তাকে লক্ষ্য করার আছে। যখন তখন উলঙ্গ হয়ে পড়ার প্রবণতা তার ছিল। শুধু নিজে একা নয়, অল্প বয়সী কোন ভক্তকে নির্জনে পেলে তাকেও তিনি উলঙ্গ করিয়ে দিতেন। যুক্তি দেখাতেন সাধন কালে শরীরে মনে কোন বন্ধন রাখতে নেই [রামকৃষ্ণকে যেরূপে দেখিয়াছি-স্বামী চেতনানন্দ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৭২]। স্বামী তুরীয়ানন্দ তখন সবে রামকৃষ্ণদেবের কাছে এসেছেন। একদিন রামকৃষ্ণদেব তাকে জিজ্ঞাসা করছেন “কিরে, ন্যাংটা হয়ে ধ্যান করিস তো?” “আজ্ঞা হ্যাঁ”। “কেমন বোধ হয়?” ইত্যাদি। (রামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি—স্বামী চেতনানন্দ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৭২)। 

তোতাপুরী ও বৈদান্তিক সাধনা [১৮৬৪ সালে]

দক্ষিণেশ্বরে এসে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন তোতাপুরী নামে এক সিদ্ধ যোগী। অভিনেতা তুলসি চক্রবর্তী (পরশপাথর) এবং শ্রীমৎ তোতাপুরি, মাত্র এই দুজন ‘কিমিয়া’ বিদ্যায় সিন্ধিলাভ করেছিলেন এবং তামাকে সোনায় পরিণত করতে পারতেন। (ঠাকুর রামকৃষ্ণ ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৩১)। প্রধানত তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন গুরু। যদিও সোনা তৈরির কারিকুরিটুকু তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে শেখাননি। চেপে গেছিলেন। শিব, দুর্গা, কালী এসবে বিশ্বাস নেই, এক নিরাকারবাদী সন্ন্যাসী। শ্রীরামকৃষ্ণের হাততালি দিয়ে হরি সঙ্গীত শুনে কটাক্ষ করে বলেন “কি হাত ঠুকে ঠুকে চাপাটি বানিয়ে চলেছ!' এহেন তোতাপুরীকে রামকৃষ্ণদেব শ্যামা ভক্তি জাগাবার বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয় নি।

একবার তোতাপুরী বিষম পেটের গণ্ডগোলে কাহিল। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। বিফল হয়ে একদিন রামকৃষ্ণদেবকে বলছেন—

কহিল তাহারে কত করিয়া মিনতি।

 কেমনে আরোগ্য হই করহ যুকতি।।

দয়া করি প্রভুদেব উত্তরিলা তায়।

আরোগ্য যদ্যপি কর প্রণাম শ্যামায়।। (রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-১০৫)

 এর পরের ঘটনা বুঝে নেওয়া সহজ। তোতাপুরী মন্দিরে গিয়ে শ্যামা মাকে প্রণাম করছেন, তার রোগ সেরে যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখান থেকে আমরা কি পেলাম, যে লোকটা শ্রীরামকৃষ্ণের শ্যামা মাকে মানে না তাকে তিনি তার শ্যামার পথে নিয়ে আসার জন্য সবিশেষ চেষ্টা করছেন। সকলে যে মানবেই এমন কোনো কথা নেই, তবু তিনি চেষ্টা করছেন যদি সে মেনে নেয়।


খ্রিস্টমতে সাধনা [১৮৭৩ সালে]

 শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে রমা রলাঁ মন্তব্য করে গেছেন। বলেছেন, 'রামকৃষ্ণের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যেন হাজার বছরের প্রাচীন কোন গীর্জায় বসে আছেন।

খ্রীষ্টানরা যেমন বলে না। সব ধর্মই সত্য, সব ধর্ম মতই মুক্তির পথ, তবে কথা একটা আছে বটে, যীশু ছাড়া গতি নেই।' রামকৃষ্ণদেবের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটছে। ‘সব মতই সত্য কিন্তু আমার শ্যামা কালী এবং অদ্বৈতবাদ ছাড়া গতি নেই।'


তিনি তার শ্যামা মার প্রতি কি ভীষণ অনুরক্ত তার কয়েকটি নমুনা রামকৃষ্ণ পুঁথি থেকে তুলে দিচ্ছি—


নানান সাধনে নানা মূর্তি আরাধনা।

সাধনান্তে সেই নাম শ্যামা শ্যামা শ্যামা।।

বুঝিতেন শ্যামা মায় সকলের সার।

যাবতীয় মুরতির শ্যামাই আধার।।

শ্যামা তুষ্টে সব তুষ্ট তবে সিদ্ধ কাজ।

সর্ব ঘটে এক শ্যামা করেন বিরাজ।। 

"শ্যামা সুপ্রসন্না অগ্রে না হইলে পরে।

 নার ফেলিয়া জীব দাঁড় টেনে মরে।।


-শ্যামা মার প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তি শ্রদ্ধা এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যেখান থেকে 'যত মত তত পথ' পালন করাটাই অসম্ভব। কেশব চন্দ্র সেনের ক্ষেত্রে কি ঘটছে লক্ষ্য করুন


প্রায় অধিকাংশে বলিতেন ভগবান।

শ্রীমন্দিরে কর অগ্রে মায়েরে প্রণাম।।

সেই আব্বা শ্রীকেশবে মাল লক্ষণ।

ভক্তি ভরে বন্দীবারে মায়ের চরণ।।

শুনিয়া কেশব কন অতি ধীরে ধীরে।

মনপ্রাণ সমর্পণ করেছি পিতারে।।

ভাব বুঝি প্রভুদেব করিলা উত্তর।

কহ কার খেয়ে মাই পৃষ্ঠ কলেবর।।

যদি মাতৃ পয়োধরে হেন কান্তি কায়।

বল তবে কেন নাহি মানিবে শ্যামায়।।

মা ধরিয়া বাপে চিনে জগজনে জানা।

বুদ্ধিমান তুমি তবু কি হেতু বুঝ না।। (পুঁথি, পৃষ্ঠা-২৪০)

কেশব সেনকে শ্যামার প্রতি অনুরক্ত করে তোলার জন্য কি আকুল প্রচেষ্টা দেখুন রামকৃষ্ণদেবের মধ্যে। কেশব সেনও মস্ত সাধক। কিন্তু রামকৃষ্ণদেবের কথায় পরিষ্কার তুমি যে মতেরই সাধক হও না কেন শ্যামা মা ছাড়া মুক্তি নেই।' 'যত মত তত পথ' খুঁজে পাচ্ছেন? আমি পাচ্ছি না। তারপর বলছেন— দর্পণ স্বরূপা শক্তি সহায় না হলে। ব্রহ্মতত্ত্ব ব্রহ্মজ্ঞান কখনো না মিলে।। যে পথ দিয়েই যাও না কেন শক্তি সহায় না হলে’, মানে শ্যামা মা সহায় না হলে ব্ৰহ্মজ্ঞান 'গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল'। এখনও কেশব মানছেন না। তাই আবার বলছেন— 

বৃহতী যেমন তিনি তেমতি করুণা।

ব্রহ্মময়ী মা বলিয়া তাহারে ডাক না।। 

এত কাল পিতা বলি কি কাজ করিলে।

এইবার ডাক তুমি ব্রমময়ী বলে।। 

এতদিন অন্য মতে চলে কি ফল পেলে। শ্যামা মাকে ধর, তিনিই পারানির কড়ি। 'যত মত তত পথ' স্রেফ কথার কথা। তিনি বুঝতেন এক শ্যামা সত্য, সকলকে বোঝাতেনও ওই শ্যামা সত্য। অন্যগুলো মিথ্যে একথা বলতেন না বটে, তবে যীশু ছাড়া গতি নেই' এটাও বুঝিয়ে দিতেন।

ইসলামে দীক্ষা লাভ

যাক্‌, আমরা আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সে সময় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নানা জায়গা থেকে সাধু, সন্ন্যাসী, ফকিরের দল এসে ডেরা বাধত। খাওয়া পরার চিন্তা নেই, এমন শাস্ত্র নির্জন পরিবেশ তাদের সাধন ভজনের জন্যও বেশ প্রশস্ত। ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী ফকিরেরা দক্ষিণেশ্বরে এসে নিশ্চিত্ত মনে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেত। রামকৃষ্ণদেবেরও চলছিল তখন বিভিন্ন ধর্মে সাধন শিক্ষা। কয়েকদিন গীর্জায় গেলেন, খ্রীষ্টধর্ম সাধনা করলেন। (যদিও এর জন্য তিনি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন নি)। কিছুদিন ভৈরবীর কাছে তন্ত্র সাধনা হল। তোতাপুরীর কাছে নিরাকারের সাধন, সেও সাঙ্গ হল।


সে সময় দক্ষিণেশ্বরে এসে ডেরা বেঁধেছেন গোবিন্দ রায় নামে এক সুফীপন্থী ইসলাম দরবেশ। রামকৃষ্ণের ইচ্ছে গোবিন্দ রায়ের [সুফী] কাছে দীক্ষা নিয়ে ইসলাম ধর্ম সাধনা করবেন। 'যে চিন্তা, সেই কাজ। ঠাকুর গোবিন্দকে নিজ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন এবং যথাবিধি দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ইসলাম ধর্ম (রিলিজিওন) সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন।'  (লীলাপ্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা-৩১০, লীলামৃত, পৃষ্ঠা-৭১, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ চরিত – গুরুদাস বর্মণ, পৃষ্ঠা-৮০, জীবন বৃত্তান্ত— রামচন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা-৫৪, রামকৃষ্ণ পুঁথি, পৃষ্ঠা-১১৯)। এখানে উল্লেখ্য ইসলাম কোন ধর্ম নয় এটা দ্বীন বা মত [কোরআন ৩।১৯]।লীলাপ্রসঙ্গ এখানে ব্যবহার করা হল। রামকৃষ্ণদেবের সব জীবনী গ্রন্থেই এই ঘটনার উল্লেখ পাবেন। তবে 'কথামৃতে' এই ধরনের অনেক ঘটনারই উল্লেখ নেই। আসলে কথামৃত ঠিক জীবনী গ্রন্থ নয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গ করেছেন। এই পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে তিনি যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তার নোট বইতে ঠিক সেইটুকুই লিপিবন্ধ করে গেছেন। পরে সেই নোট বই থেকেই মহাগ্রন্থ 'কথামৃত' রচনা করেছেন। এই ধরনের রচনাকে বলে 'অ্যানাস'। রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পরেও যেহেতু শ্রীম তার গুরুভাইদের সাথে অনেক দিন কাটিয়েছেন, তাই ১৮৮৬ সালের পরের বহু | ঘটনাও কথামৃতে ঠাই পেয়েছে। কিন্তু এ বইতে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম, বেড়ে ওঠা, ইত্যাদি নানা ঘটনার তেমন কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই তার সাধনকালীন সময়ের ঘটনাবলীও। সে সব জানতে গেলে অন্যান্য প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ থেকেই জানতে হবে। এবং সব জীবনীকারই একটা কথা খুব নিশ্চিত ভাবে প্রয়োগ করেছেন, তা হল 'যথাবিধি দীক্ষা গ্রহণ।


যথাবিধি দীক্ষা গ্রহণ বললে আমরা নিশ্চয়ই বুঝবো হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে গেলে যে সব প্রথা পালন করতে হয়, এক্ষেত্রে সে সব সুচারু রূপেই পালন করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে রামকৃষ্ণদেব হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। আসলে বিচার্য যে ইসলামে দীক্ষার কোন ব্যবস্তা বা নাম গন্ধ নেই যাই হোক ছোটবেলায় ব্রাহ্মণ ছিলেন ঠিকই, দীক্ষা গ্রহণের পর তা কিন্তু তিনি নন। এরপরে তিন চার দিনের সাধন ঘোর কেটে যাবার পর তিনি অবশ্য তার পুরানো কালী মন্দিরেই ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাতে তো তিনি হিন্দু হলেন না। আমরা তো কত মুসলমানকেই দেখেছি বাঙালী হিন্দু পাড়ায় থাকে, বাংলা স্কুলে পড়াশুনো করে, আদব কায়দায়ও হিন্দুর মত হয়ে গেছে, তা বলে কি তারা হিন্দু হয়ে গেল। সে মুসলমান মুসলমানই থাকবে। একটি মুসলমান ছেলেকে চিনি, যার সব ভাইরা বাঙলা স্কুলে পড়াশুনো করেছে, ওঠাবসা হিন্দুদের সাথে। সরস্বতী পূজায় প্রসাদী ফল কাটে, অলি দেয়, সব কিছুই হিন্দুদের মত । তা বলে সে কখনই বলে না আমি হিন্দু। সব সময়ই বলে 'আমি খাঁটি মুসলমান'। মুসলমান থেকে হিন্দু হতে গেলে সেই 'যথাবিধি' নিয়মকানুন অনুষ্ঠান করেই আসতে হবে। সেই সঙ্গে আছে 'প্রায়শ্চিত্ত'। কাউকে যদি বলপূর্বক বিধর্মী বানানো হয় তবে তার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে প্রায়শ্চিত্ত না করলেও চলে। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম অবশ্য পালনীয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন—“যাহারা ইচ্ছাপূর্বক ধর্মাত্তর গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু এখন হিন্দু সমাজে ফিরিয়া আসিতে চায়, তাহাদের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত ক্রিয়া আবশ্যক, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।” (বাণী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮৪)। আমরা আর্যসমাজেও দেখি শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে মুসলমানদের পুনঃ হিন্দু বা আর্য করার জন্য কিছু আচার আচরন ও কোটে গিয়ে affidavit ও করতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ তো সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাকে এখন হিন্দু হতে গেলে নিশ্চিত ভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না কি! কিন্তু তা তো তিনি করেন নি। তাহলে উপায়? তিনি যতই অন্যের জাত বিচার করুন না কেন, তিনি নিজে কিন্তু ব্রাহ্মণও নন, হিন্দুও নন, খাঁটি বাঙালি মুসলমান।

কেউ বা বলতে পারেন রামকৃষ্ণদেব একজন সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর আবার জাত কি? খুব ভালো কথা, তাহলে কি আমরা মেনে নেব গীর্জায় যে পাদ্রী সাহেবরা রয়েছেন তারা খ্রীষ্টান নন। মসজিদে যে ইমাম সাহেব বসে আছেন তিনি মুসলমান নন! মঠ মন্দিরে যে সন্ন্যাসীরা রয়েছেন তারা হিন্দু নন !

রামকৃষ্ণের সাধনা

রামকৃষ্ণ (গদাধর) মুসলমান ধর্ম সাধনার সময়, 
"গোমাংস ভক্ষণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, মুসলমানের হাতে খেয়েছেন"
-[শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ইসলাম, খ্রীষ্ট ও হিন্দু কোন ধর্মের নাম নয়। তবুও প্রচলিত ভাষ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো সকল রিলিজিওন বা সম্প্রদায়ের নাম। ধর্ম্ম একমাত্র সনাতন যা সত্য বৈদিক।  
‘শ্রীমা সারদাদেবী' গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দ কি লিখছেন একবার দেখা যাক— 'কোঠারের পোষ্ট মাস্টার দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ঘটনাচক্রে যৌবনে খ্রীষ্টধর্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। অধুনা তিনি বিশেষ অনুতপ্ত ও স্বধর্মে ফিরিয়া আসিতে বিশেষ ব্যগ্র হইয়া সকলের নিকট পরামর্শ চাহিতে লাগিলেন। ক্রমে ভক্তদের মুখে শ্রীমা ঐ কথা শুনিয়া বিধান দিলেন যে, “সরস্বতী পূজার পূর্বদিন দেবেন্দ্রবাবু রামবাবুদের গৃহদেবতা রাধাশ্যাম চাঁদজীর সম্মুখে প্রায়শ্চিত্ত সমাপণাস্তে গায়ত্রী ও যজ্ঞোপবীত গ্রহণ করিলেই পুনঃ ব্রাহ্মণত্বে প্রতিষ্ঠিত হইবেন”।' (সপ্তম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-২৬১)। স্বামী ভূমানন্দের ‘শ্রীশ্রী মায়ের জীবন কথা’ গ্রন্থে প্রায়শ্চিত্তের কথা নেই। শুধু শুদ্ধিক্রিয়ার উল্লেখই আছে। (২য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০৪)।

এরপর দেবেন্দ্রনাথের শুদ্ধিক্রিয়া, গায়ত্রী মন্ত্র, যজ্ঞোপবীত ধারণ ইত্যাদি আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সারদাদেবীও স্বেচ্ছায় ধর্মত্যাগীকে প্রায়শ্চিত্ত অথবা শুদ্ধিক্রিয়া করিয়েই হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করছেন। তবে রামকৃষ্ণেদেবের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না কেন? নিশ্চয়ই হওয়া উচিত। তা যদি তিনি না করে থাকেন, ইসলাম ধর্মে দীক্ষা যখন নিয়েই ফেলেছেন, নিশ্চিত ভাবেই তিনি ধর্মান্তরিত। ওপাড়ার রহিম চাচা বেদ পাঠ করলেই যেমন হিন্দু হচ্ছেন না, শ্রীরামকৃষ্ণও তেমনই কালী কালী করে হিন্দু হবেন না। অবশ্য স্বীকার করে নেবার প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

মনুস্মৃতি ২।২৮ অনুযায়ী স্বাধ্যায়, যোজ্ঞ-হোম, বেদ পাঠ, পঞ্চমহাযোগ্য যারা করে তারা ব্রহ্মনত্ত্ব প্রাপ্ত হন।

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। রামকৃষ্ণের মনে এমন প্রবল ভাব আসিল যে, তিনি তৎক্ষণাৎ গঙ্গাতীরে যে স্থানে সকলে মল মুত্রাদি পরিত্যাগ করিয়া থাকে, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া তথা হইতে সদ্য তক্ত মল মুক্তিকাবৎ ব্যবহার করিলেন। এমন কি জিহ্বা দ্বারা উহা স্পর্শ করিতেও তাহার ঘৃণার উদ্রেক হয় নাই। তাহার মুখে শুনিয়াছি, যখন তিনি বিষ্ঠায় জিহ্বা সংলগ্ন করিয়াছিলেন, তখন কোন প্রকার দুর্গন্ধ অনুভব করেন নাই।' (জীবন বৃত্তান্ত—শ্রীরামচন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা-১৯)। এ সবই সাধনা নামক পরীক্ষার অঙ্গ । তিনি নানা সময় সেইসব পরীক্ষায় বসেছেন মাত্র। 


 যতমত তত পথ কি সঠিক পথ ? 👈পডুন

এক ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে সারদামণি বলছেন—“তোমাদের গুরু অদ্বৈতবাদী তাই তোমরাও নিশ্চয়ই তাই।” (শ্রীশ্রী মায়ের পদপ্রান্তে—স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, চতুর্থ মুদ্রণ, পৃষ্ঠা-৭৪৭)। কেউ যদি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়, তার কাছে তার নিজের সমাজটিই শ্রেষ্ঠজ্ঞান হয়। এটাই স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা। স্বামী শিবানন্দ এক ভক্তকে চিঠি লিখছেন—“রামকৃষ্ণ সূর্য ভারতে উদিত হইয়াছেন; তাহার কিরণ বিবেকানন্দ পশ্চিম গগনে বহন করিয়া লইয়া গিয়াছেন। সেদিকও পরিষ্কার হইতে আরম্ভ করিয়াছে। প্রভুর সর্বগ্রাসী বেদাস্ত এবার সমগ্র জগৎকে গ্রাস করিতে প্রস্তুত।' দেখাই যাচ্ছে সকলেই একটি বিশেষ মতের সমর্থক। ইহুদী ধর্মে কি বলা আছে সে মানবে কেন?


মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে এক দ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী যোগ দিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ তখন মায়াবতীতে। তিনি সকলকে নিবিড় ভাবে বোঝালেন এই অদ্বৈত আশ্রমে দ্বৈতবাদ না থাকাটাই শ্রেয়। উক্ত সন্ন্যাসী নিজের দ্বৈতভাব লইয়া ওরুপ স্থানে থাকা উচিৎ কি না শ্রী শ্রী মাতাঠাকুরাণীকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, “শ্রী গুরুদেব নিজে অদ্বৈতময় ছিলেন ও অদ্বৈতভাব প্রচার কর্ডেন। তুমি তবে ঐ ভাব গ্রহণ কৰ্ত্তে 'কিন্তু' কচ্চ কেন বাবা? তার সব শিষ্যই যে অদ্বৈতবাদী।” (স্বামী বিবেকানন্দ জীবন চরিত-প্রমথনাথ বসু, চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সং, পৃষ্ঠা-১০০১-২)। ইহুদী মত্‌ ঈশ্বর লাভের পথ একদম ভুল কথা।

একবার স্বামী অখণ্ডানন্দ নবদ্বীপ ঘুরতে গেছেন। নবদ্বীপের বিখ্যাত ‘পাকা টোল' এ ঘুরতে গিয়ে অধ্যক্ষ রাজকৃষ্ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয়ের সাথে বাক্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তারা দ্বৈতবাদী। অতএব তাদের মতে দ্বৈতবাদই ঠিক। স্বামীজী অদ্বৈতবাদী, তার কাছে অদ্বৈতবাদ ছাড়া জীবন বৃথা। অতএব—“তিনি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দোহাই দিয়া দ্বৈতবাদের পক্ষে অনেক কথা বলিলেন। আমিও অদ্বৈতবাদের পক্ষে অনেক কথা বলিলাম।” (স্মৃতিকথা—স্বামী অখণ্ডানন্দ, পৃষ্ঠা-২০৫)। যে যার মতকে সঠিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবেই। তবে আর যত মত তত পথ কেন।


এক বার গাজীপুরে স্বামী বিজ্ঞানানন্দের কাছে ঘুরতে আসেন স্বামী অভেদানন্দ। সে সময় গাজীপুরে এক বিখ্যাত দ্বৈতবাদী পণ্ডিত থাকতেন। বিজ্ঞানানন্দের ইচ্ছা স্বামী অভেদানন্দকে দিয়ে দ্বৈতবাদী পণ্ডিতকে পরাস্ত করে বুঝিয়ে ছাড়বেন দ্বৈতবাদ নয় অদ্বৈতবাদই সেরা। দীর্ঘ তর্কাতর্কির পর পণ্ডিতজী মানতে বাধ্য হলেন অদ্বৈতবাদই গুড, বেটার, বেষ্ট। (প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিপটে স্বামী বিজ্ঞানানন্দ-উদ্বোধন, পৃষ্ঠা - ২১৮-১৯)।


স্বামী বিবেকানন্দ বহু বার বলেছেন 'অদ্বৈতবাদই একমাত্র সঠিক ধর্মমত।' তাহলে দ্বৈতবাদ, বিশিষ্ঠাদ্বৈতবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, সাকারবাদ, নিরাকারবাদ আরও কত কি বাদ আছে আমার জানা নেই, সে সব কি ভুল? আর নিজেরটা ছাড়া অন্যগুলো ভুলই যদি হয় তবে আর মুখে মুখে ‘যত মত তত পথ'-কেন? স্বামীজী বলেছেন 'বেদান্তের অদ্বৈতবাদ পেয়ে খ্রীষ্টানরা বর্তে গেছে।' বর্তে গেছে কি অন্য কিছু হয়ে গেছে সে গবেষণার বিষয়। আমি শুধু বলতে চাই তারা যে বাইবেল-খ্রীষ্টধর্ম মেনে চলেছে সে সব কি ঠিক পথ নয়। স্বামীজী—“বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র যতটা বেদের সহিত মেলে ততটা গ্রাহ্য, কিন্তু যেখানে না মেলে, সেখানটা মানিবার প্রয়োজন নাই। কোরাণ সম্বন্ধেও ঐ কথা।” (ভারতে বিবেকানন্দ, পৃষ্ঠা-৩৯৫)। আর ওনার গুরু বলেছেন যত মত তত পথ !!

রামকৃষ্ণের উত্থানের কারণঃ


রাণী রাসমণি পর্বে মথুর বাবুর চেষ্টায় শ্রীরামকৃষ্ণ উত্থানের একটি কারণ বর্ণনা করেছিলাম। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ 'ফ্যাক্টর' এখন আলোচনা করব। এই ফ্যাক্টরটি সম্পূর্ণ ভাবে সামাজিক। ঠিক সেই সময়কার সামাজিক পরিস্থিতি। বহু গ্রন্থেই এই বিষয়ে আলোচনা দেখতে পাই। সব বর্ণনাই সে সময়কার সামাজিক পরিস্থিতি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে। তার মধ্যে থেকে আমার পছন্দ মতো ‘শ্রীশ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতি-কথা'—শ্রী চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়-এর বর্ণনা এখানে ব্যবহার করলাম। (দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৯-২২)। তিনি 'রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব' পর্বে যা লিখেছেন হুবহু তা তুলে দিলাম—


'আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, ধর্ম ও রাষ্ট্র জগতের দিক হইতে তাহাকে সন্ধিক্ষণ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তখন সবে মাত্র কোম্পানী রাজ্যের অবসান ঘটিয়াছে। সিপাহী বিদ্রোহের পরে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া ভারতের জনগণ পাশ্চাত্র্য শিক্ষা দীক্ষা ও আদর্শের সম্মুখীন হইয়াছে। ভারতের যা কিছু কৃষ্টি, সভ্যতা, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য ভাব ধারার কষ্টি পাথরে যাচাই হইতে চলিয়াছে। সে-হেন যুগ সন্ধিক্ষণে নানা আদর্শের সংঘাতে ও নানা আন্দোলনের মাঝে বাংলার তথা ভারতের হিন্দু সমাজ লক্ষ্য হারা হইতে বসিয়াছিল।


তৎকালীন চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের অধিকাংশেরই মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়াছিল—তাহারা যে পথে চলিয়াছেন, যে ধারায় জীবন যাপন করিতেছেন, তাহাতে ঐহিক ও পারলৌকিক সার্থকতা আছে কি-না। তাহাতে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য সফল হইতে পারে কি না। চিস্তাশীল ব্যক্তিগণের দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে বিভিন্নতা থাকায় তাহারা ঐ একই প্রশ্নের সমাধানে বিভিন্ন পথের নির্দেশ দিলেন। কেহ কেহ বলিলেন, সমাজ তরণীখানিকে ভারতীয় আদর্শ বন্দর হইতে নোঙর মুক্ত করা হউক; কেহ কেহ বলিলেন পাশ্চাত্ত্য আদর্শ ও ভাবধারার মধ্যে যেগুলি ভালো ও গ্রহণীয় তাহাই ভারতীয় সমাজের মধ্যে প্রচলিত করা হউক; আবার কেহ কেহ নির্দেশ দিলেন, যা কিছু পাশ্চাত্ত্য তাহাই ত্যাজ্য এবং যা কিছু ভারতীয় তাহাই রক্ষণীয়। এইরূপ নানা লোকের নানা মতে ও বিভিন্ন বিধানে সমাজের ক্ষীণ প্রাণশক্তির ওপর নানা অত্যাচার আরম্ভ হইয়া গেল। সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে ব্যাধি মুক্ত করিতে, কিন্তু একই কালে সমাজ দেহের ওপর সকলের চিকিৎসা বিধান চালু হওয়ায় সমাজের ব্যাধি দূর হওয়া দূরে থাকুক, তাহাতে অধিকতর জটিলতা আসিয়া উপস্থিত হইল। 

তৎকালীন চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের বিধানের ফলে সমাজ স্তরে তিনটি বিভিন্ন দল, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথ হইয়াছিল। এক দল প্রাচীন নিথর সমাজকেই প্রাণবস্তু বলিয়া চালু করিবার চেষ্টা করিলেন; তাহারা পুরাণবাদকে আঁকড়াইয়া রহিলেন, অদৃষ্টকে জীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামক বলিয়া রাষ্ট্র ও ধর্ম বিপর্যয়ে আপনাদের পুরুষকার হীন অনুদ্যমকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন। পারলৌকিক সুখ ভোগকে তাহারা কবিত্বনয় করিয়া সাধারণের সমক্ষে ধরিলেন এবং ইহলৌকিক দুঃখ দুর্দশা গুলিকে পরীক্ষার মানদণ্ড হিসাবে গণ্য করিয়া তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিতে উপদেশ দিলেন। তাহারা সামাজিক বিধিগুলির অপেক্ষা নিষেধ গুলির উপর জোর দিতে চাহিলেন। এবং যে কেহ নিষেধাত্মক কর্মগুলির সম্পাদনে দুঃসাহস দেখাইলেন তাহাদিগকে সমাজ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়া শাস্তি প্রদান করিলেন।


তৎকালীন প্রচলিত কৌলিন্য ও ছুতমার্গকে তাহারা ধর্মের অঙ্গ করিয়া তুলিলেন এবং দেশাচারে লোকাচারে (কুসংস্কার প্রচলিত থাকিলেও) রক্ষণশীল হওয়াকেই গৌরবের ও পৌরুষের বিষয় বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন। এই দলের মধ্যে তৎকালে শাস্ত্র পাণ্ডিত্যই প্রশংসনীয় হইয়া উঠিয়াছিল এবং আড়ম্বর ও গড্ডলিকাই সম্মানজনক স্থান পাইয়াছিল। তাহাদেরই দূরদৃষ্টির অভাবে দলের মধ্যে ভাঙন ধরিয়াছিল। এবং সেই ভাঙনে অপর দুটি দল নিজেদের পুষ্ট করিয়া লইতেছিল।


অপর দুটি দলের মধ্যে একটি ছিল পাশ্চাত্ত্য আদর্শ মুগ্ধ শিক্ষিত সমাজ। এই দলে অধিকাংশ ব্যক্তিই হিন্দুয়ানীতে বিশ্বাস হারাইয়া ছিলেন। তাহাদের ধারণায় ভারতীয় যা কিছু তাহাই নিকৃষ্ট, আর পাশ্চাত্র্য যা কিছু তাহাই সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তাহারা বৈজ্ঞানিক জড়বাদকে গ্রহণ করিয়া পার্থিব ভোগবাদকে জীবনের কাম্য জ্ঞান করিতেন। ভোগ পরিপন্থী ত্যাগ ও সন্ন্যাসবাদকে অশ্রদ্ধেয় গণ্য করিয়া আচারহীন উচ্ছৃঙ্খল তৃপ্তিকে তাহারা পরমারাধ্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। ঐহিক সার্থকতাই তাহাদের নিকট শ্রেষ্ঠ সাধনা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিল।


তৃতীয় দলটি পাশ্চাত্ত্য আদর্শ মুগ্ধ হইলেও সনাতন হিন্দু ভাব ধারাতে আস্থাহীন হন নাই, যদিও প্রচলিত হিন্দু ধর্মের উপর তাহাদের শ্রদ্ধা ছিল না। তাহারা চাহিয়াছিলেন প্রচলিত হিন্দু ধর্ম ও অনুষ্ঠানগুলির সংস্কার এবং এই অপরাধে তাহারা সমাজচ্যুত হইয়াছিল। তৎকালীন হিন্দু সমাজ যাহাদের বর্জনের নির্দেশ দিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে যাহারা অন্তরে বৈদিক ও ঔপনিষদিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন, তাহারা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সমাজ স্থাপন করিয়া সনাতন হিন্দু আদর্শের প্রতি সাধারণকে সচেতন করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন। তাহাদেরই প্রচারের ফলে সমাজের মধ্যে বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় দলের প্রচারে সমাজে অনাচার ও বিশৃঙ্খলা আসিয়াছিল, কিন্তু এই তৃতীয় দলের প্রচারে সমাজের মধ্যে বিপ্লব মাথা তুলিয়াছিল। এ-হেন সঙ্কটকালে সকলেই একজন সুচতুর কাণ্ডারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়াছিলেন। যিনি তৎকালীন জীর্ণ সমাজ নৌকাকে বাক্‌বিতণ্ডার ঝড় হইতে বাঁচাইয়া, সংকীর্ণতা মলিন অভিমান তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত হইতে রক্ষা করিয়া, মোহসমুদ্রের অগাধ গভীরতা হইতে উদ্ধার করিয়া, ভারতীয় আদর্শ ধারার ও জীবন বিধানের সনাতন আলোক স্তম্ভকে দেখাইয়া দিতে পারেন; যিনি ভগ্ন তরীকে সংস্কার মার্জিত করিয়া পুনরায় ব্রহ্মসাগরগামী করিয়া তুলিতে পারিবেন; যাহার স্পর্শে মুমূর্ষু সমাজ নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হইয়া ধীরে সুস্থে সরল ও প্রাণবত্ত হইয়া উঠিতে পারিবে, সে-হেন কাণ্ডারী কে? তৎকালীন অনেকেই জানিতে বা অনুমান করিতে পারেন নাই যে, তিনি আসিয়াছেন।'


সব মিলিয়ে সে সময় সমাজে এক চরম অসহিষ্ণু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। যুব সমাজ যা কিছু পৌরাণিক, প্রগতি বিরোধী সমস্ত কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদকে জীবনে অঙ্গীভূত করতে চাইছিল। আর এক দিকে ছিল সমাজের মূল অংশ, প্রাচীন পন্থী, সনাতন পন্থীর দল। যারা অষ্টপ্রহর নামগান, হরিকীর্তন, তিথি নক্ষত্র নিয়ে জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু এই নব যুবক দল যেন তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এরা পাশ্চাত্র শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে আছে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার গুরুপাক ভোজনের কিছু বদহজমও। এদেরকে রুখতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সেই প্রাচীন ভারতবর্ষ। যেখানে মুনি ঋষিরা গাছ তলে বসে পাঁচ হাজার বছর ধরে কঠোর তপস্যায় রত। সন্ধ্যা হলেই তুলসী তলে পিদিম জ্বালার ধূম পড়ে যাবে। পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে দেখতে হবে কোন কাজটা কখন করলে ফলবতী হবে। এই যুব সম্প্রদায়ের পাল্লায় পড়ে সে সব সনাতনী প্রথা যেন লোপ পেতে বসেছে। দেশটা রসাতলে গেল। বিদেশী শত্রুর হাত থেকে কে দেশ বাঁচায় তা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই, এই সনাতনী প্রথা বিরোধী যুবক দলকে রুখতে হবে। চাই হাতিয়ার। এমন কোন হাতিয়ার যা সামনে রেখে ধর্ম রাজ্যের সেই ছেঁড়া পতাকাটা আবার উড়িয়ে দেওয়া যায়। আর ঠিক এই আবহবর্তেই শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন। মথুর বাবুর প্রচারে লোকের মুখে মুখে ফিরছে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাথে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে এই ভাবে বলা যায় --

গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে।

 এক মহা সাধক এসেছেন দক্ষিণেশ্বর ধামে।

তিনি পথে ঘাটে পড়ে ‘মা মা’ করে কাঁদছেন। এই সজ্ঞান, এই অজ্ঞান। ঈষৎ তোতলা, বচনে অপরিশীলিত, অথচ কথার মধ্যে এমন এক মোহিনী শক্তি আছে যা উপেক্ষা করে। কার সাধ্য। তার ধর্ম বাণী শোনার জন্য আপামর শিক্ষিত অশিক্ষিত জনসাধারণ দক্ষিণেশ্বরে জড় হতে লাগল। এই সেই প্রাচীন ভারত, যাকে ফিরে পেতে চেয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাচীন পন্থী ভারতবাসী। যাকে খোঁজা হচ্ছিল তাকে পাওয়া গেল, যাকে পাওয়া যাচ্ছিল সে হারিয়ে গেল।

স্বামী সারদানন্দ তার বাল্যকাল সম্বন্ধে বলছেন—'আমাদের বাল্য জীবনটা বাংলা দেশে ভাঁটার মত হইয়াছিল। অর্থাৎ সেই সময় পুরাতন বাংলা শেষ হইয়া যাইতেছিল, একেবারে কাদা পাঁক জমিয়াছিল এবং নতুন বাংলা আসিবার উপক্রম করিতেছিল, ঠিক এই দুইয়ের মধ্যস্থলে আমাদের বাল্য জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল।'-(রামকষ্ণ পুঁথি, পৃ- ৬০১)


স্বামী সারদানন্দের বাল্যকাল মানে ঠিক শ্রীরামকৃষ্ণের উত্থানের সময়। ঠিক যে সময় পুরাতন বাংলা শেষ হয়ে নতুন বাংলা জেগে উঠছে। কিন্তু বাংলা তো জাগল না। জাগলেন ধর্মের খোলকৰ্ত্তাল বাজিয়ে, কীৰ্ত্তন গাইতে গাইতে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব। এই রকম টালমাটাল সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণের উত্থান। উত্থান না বলে বলা উচিত তাকে খুঁজে বার করা হল, দোদুল্যমান সমাজের চিত্ত স্থিতিশীল করার জন্য। কিন্তু কি পেলাম আমরা এই উত্থানের মধ্যে দিয়ে? রমা রলার মাঝে মাঝে রামকৃষ্ণের ভাব দেখে সংশয় হচ্ছে তিনি এ যুগে আছেন, না হাজার বছরের প্রাচীন কোন গীর্জায় বসে আছেন। (রামকৃষ্ণের জীবন, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা-২৪)। আমাদের পাওনাও এইটুকুই। হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া।


শ্রীরামকৃষ্ণের উত্থানে এক ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন অত্যন্ত সহায়ক রূপে দেখা দিয়েছিল। হয়তো ঐ ভবঘুরে মহিলা ভবঘুরে সাধু সন্ন্যাসীদের কাছে খবর পেয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে জীবন্ত ভগবান বাস করছেন। 'যাও একবার গিয়ে দেখে এসো, সেই সঙ্গে কিছু দিনের থাকা খাওয়ার নিশ্চিত্তি। এই ভৈরবী অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী মহিলা। তিনি নিজেকে নিজেই মা মনসা বলে ভাবেন। তার আশা ধরাধামে একটি অবতার উত্থানে তার যদি কিছু হাত থাকে! এতকাল বিস্তর জপতপ নিয়ে কাটিয়েছেন। এখন ইচ্ছা যদি একটি অবতারের জন্ম দিতে পারেন তো তোফা হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট বয় তৈরি করলে যেমন মাস্টারমশাইয়ের গ্রেড বেড়ে যায়, সে রকম আর কি।

লেখা বাকী আছে

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ