ঈশ্বর সাকার অথবা নিরাকার ? - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 January, 2022

ঈশ্বর সাকার অথবা নিরাকার ?

 ঈশ্বর নিরাকার। যাহা সাকার অর্থাৎ শরীরবিশিষ্ট তাহা ঈশ্বর নয়। কারণ তাহা হইলে তিনি পরিমিত শক্তিসম্পন্ন, দেশ-কাল-বস্তুসমূহে পরিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ছেদন-ভেদন, শীতোষ্ণ ও জ্বরপীড়াদিযুক্ত হইতেন। তাঁহাতে জীবের গুণ ব্যতীত ঈশ্বরের গুণ থাকিত না। যেমন আমরা সাকার অর্থাৎ শরীরধারী বলিয়া অনু-পরমানু-ত্রসরেণু এবং প্রকৃতিকে স্ববশে আনিতে পারিনা, সেইরূপ স্থুলদেহধারী পরমেশ্বরও সূক্ষ পদার্থ সমূহ হইতে স্থুল জগৎ নির্ম্মাণ করিতে পারেন না। কোন পদার্থের সংযোগে ঈশ্বর গঠিত নন তাই তিনি অবশ্যয় নিরাকার। পরমেশ্বরের ভৌতিক ইন্দ্রিয় গোলক ও হস্ত-পদাদি অবয়ব নাই কিন্তু তিনি তাঁহার অনন্ত শক্তি, বল এবং পরাক্রম দ্বারা যে সকল কার্য্য করেন, তাহা জীব ও প্রকৃতি দ্বারা কখনও হইতে পারে না। তিনি প্রকৃতি অপেক্ষাও সূক্ষ এবং প্রকৃতির মধ্যে ব্যাপক বলিয়া প্রকৃতিকে জগদাকার দান করেন। পরমেশ্বর উপাদান কারণ নন তিনি নিমিত্ত কারণ।

প্রকৃতি ও পরমাণু যাহা স্থুল তাহা জগতের উপাদান কারণ। ঐ সকল সর্ব্বদা নিরাকার নহে কিন্তু পরমেশ্বরের তুলনায় স্থুল এবং অন্য কার্য্য অপেক্ষা সূক্ষ্ম। পরমেশ্বর কারণ ব্যাতিত কার্য্য করিতে পারেন না। কারণ যাহার অভাব আছে, অর্থাৎ যাহা বর্ত্তমান নহে, তাহার ভাব অর্থাৎ বর্ত্তমান হওয়া সর্ব্বথা অসম্ভব। 

ঈশ্বর সাকার অথবা নিরাকার ?


যেমন যদি কেহ গল্পচ্ছলে বলে, "আমি বন্ধার পুত্র-কন্যার বিবাহ দেখিয়াছি, তহারা নরশৃঙ্গের ধনু এবং আকাশ-কুসুমের মালা ধারণ করিয়াছিল, এবং মৃগতৃষ্ণিকার জলে স্নান ও গন্ধর্ব্বনগরে বাস করিত, সেই স্থানে বিনা মেঘেদ বৃষ্টি এবং মৃত্তিকা ব্যতীত সব অন্নাদি উৎপন্ন হইত"। এই সকল যেমন অসম্ভব, সেইরূপ কারণ ব্যতীত কার্য্যোৎপত্তিও অসম্ভব। আবার কেঃ যদি বলে আমি মাতা পিতা ব্যতিত এমনিই হইয়াছি, আমার মুখে জিহ্বা নাই কিন্তু কথা বলিতেছি; গর্তে সর্পাদি ছিল না এখন নির্গত হইয়াছে। এইরূপ অসম্ভব কতা, প্রমত্ত গীত অর্থাৎ পাগলের প্রলাপ মাত্র। 

মূলে মূলাভাবাদমূলং মূলম্ [সাংখ্য সূ০ ১।৬৭]-মূলের মূল অর্থাৎ কারণের কারন হয় না। যাহা কেবল কারণরূপই, তাহা কাহারও কার্য্য হয় না। যাহা কাহারও কারণ এবং কাহারও কার্য্য হয়, তাহা স্বতন্ত্র পদার্থ। যেমন পৃথিবী গৃহাদির কারণ এবং জলাদির কার্য্য। কিন্তু আদি কারণ প্রকৃতি অনাদি।

যাহা সকল কার্য্যের কারণ, তাহার কারণ নাই। কেননা, কোন কার্য্যের আরম্ভের পূর্ব্বে তিনটি কারণ অবশ্যই থাকে। যেমন বস্ত্র নির্ম্মাণের পূর্ব্বে তন্তুবায়, তূলার সূত্র ও নালিকা প্রভৃতি বর্ত্তমান থাকে বলিয়া বস্ত্রনির্ম্মিত হয়,

সেইরূপ জগতুৎপত্তির পূর্ব্বে পরমেশ্বর, প্রকৃতি, কাল এবং আকাশ ছিল বলিয়া এবং জীব অনাদি বলিয়া এই জগতের উৎপত্তি হইয়া থাকে। এই সকলের মধ্যে একটি না থাকিলে জগৎও হইত না।

এখন প্রশ্ন হতে পারে শূন্যই একমাত্র পদার্থ, সৃষ্টির পূর্বে শূন্য ছিল এবং অন্তেও শূন্য থাকিবে। কারণ, যাহা ভাব অর্থাৎ বর্ত্তমান পদার্থ, তাহার অভাব হইয়া শূন্যে পরিণত হইবে।

 ইহার উত্তর আকাশ, অদৃশ্য অবকাশ এবং বিন্দুকেও শূtgন্য বলে। শূন্য জড় পদার্থ। এই শূন্যের মধ্যে সমস্ত পদার্থ অদৃশ্য থাকে। যেমন একটি বিন্দু হইতে রেখা, রেখাসমূহ হইতে বর্ত্তুলাকার হইয়া থাকে, সেইরূপ ঈশ্বরের রচনানুসারে ভূমি এবং পর্ব্বতাদি সৃষ্ট হয়। পুনশ্চ শূন্যের জ্ঞাতা শূন্য নহে-[সাখ্য ১।৪৪।১]। যাহা হিতে কোন পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহাই তাহার নিমিত্ত। কন্টক বৃক্ষ ব্যতীত কন্টক উৎপন্ন হয় না কেন [সাখ্য ১।৪৪।৪] ? 

"ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন নহে" যেমন কুযুক্তি দেখান তেমন অনেক পন্ডিতগণ যুক্তি দেখান যেহেতু সকল পদার্থই উৎপত্তি ও বিনাশশীল , সুতরাং সব অনিত্য কিন্তু তাহারা অবগত নন সকলের নিত্যতা নিত্য হইলে সকল অনিত্য হইতে পারেনা। ব্রহ্ম আর জগৎ এক হতে পারে না।


ঈশ্বর সাকার নয় কেন ? 

ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে একটা নয় — অনেক দোষ । ভেবে দেখুন - ঈশ্বরের লক্ষণ তিঁনি "সচ্চিদানন্দ" (অথর্ব: ১০/৭/১) । "সচ্চিদানন্দ" শব্দে তিনটি পদ আছে । যথা - "সৎ" - "চিৎ" এবং "আনন্দ" । 

যজুর্বেদে শব্দ এসেছে "তস্মাৎ যজ্ঞাৎ" [যজু০ ৩১।৭]-সৎ অর্থাৎ যাঁহার কদাপি নাশ হয় না, চিৎ> যিনি সদা জ্ঞান স্বরূপ, যাঁহার কদাপি লেশমাত্র অজ্ঞান নাই। আনন্দ যিনি সদা সুখস্বরূপ ও সকলের সুখদাতা।

"সৎ" হল - ভূত , ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান । তিন কালেই যে একরস হয়ে বিদ্যমান থাকে । আর এক কথায় বলা হয় , যাতে কোনও প্রকার পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়,তাকে বলা হয় "সৎ"।

যে জ্ঞান যুক্ত সে "চিৎ"। 

আর ত্রিকালে যাতে দুঃখের অত্যন্ত অভাব সে ‘আনন্দ’ ।

ঈশ্বর এই কারণেই হলেন "সচ্চিদানন্দ" (যজুর্বেদ ৩২।১১)

তাই ঈশ্বরে কখনও কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব না । তাঁর জ্ঞান কখনও নষ্ট হয় না , আর তাতে কখনও দুঃখও ব্যাপ্ত হয় না । কিন্তু জগতে যত সাকার পদার্থ দৃষ্ট হয় সেই সমস্ত পদার্থে পরিবর্তন দেখা যায় । তাই তারা ‘সৎ' নয় , কেবলমাত্র “চিৎ" হল নিরাকার । তাই আত্মা এবং পরমাত্মা উভয়কেই "চিৎ" বলা হয় । কোনও সাকার বা দেহধারী দুঃখের হাত হতে রক্ষা পেতে পারে না , ত্রিকালে তাতে ‘ আনন্দ'ও থাকতে পারে না । তাই এখানে ঈশ্বরকে সাকার মানলে তিঁনি আনন্দ স্বরূপ হতে পারবেন না ।

তাই ঈশ্বর সাকার হলে তাঁকে দোষ স্পর্শ করবে -

প্রথম দোষ —

শীত , গ্রীষ্ম , ক্ষুধা , তৃষ্ণা , ভয় , রােগ শােক , বৃদ্ধত্ব , মৃত্যু প্রভৃতি প্রত্যেক সাকার বা দেহধারীকে গ্রাস করে দুঃখ দেয় ।

কিন্তু ঈশ্বর সর্বদা এই সমস্ত হতে পৃথক্‌ । অতএব ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে তাঁকে দোষ স্পর্শ করবে , সে অবস্থায় ঈশ্বর ‘ সচ্চিদানন্দ ’ এবং নির্বিকার হতে পারবেন না ।

কেননা প্রত্যেক সাকার পদার্থে জন্ম , বৃদ্ধি , ক্ষয় , জরা , মৃত্যু প্রভৃতি বিকার দোষ থাকে ।

দ্বিতীয় দোষ —

 ঈশ্বরকে সাকার স্বীকার করলে তিনি সর্বব্যাপক ’ হতে পারবেন না । কেননা প্রত্যেক সাকার পদার্থ একদেশী অর্থাৎ একস্থানে স্থিতিশীল ।

তৃতীয় দোষ —

ঈশ্বর ‘অনাদি’ ও ‘ অনন্ত হতে পারবেন না । কেননা , প্রত্যেক ‘সাকার’ বা ‘অবয়বী’ বা ‘'দেহধারী’ উৎপন্ন হয়ে থাকে । যে বস্তুর আরম্ভ আছে অর্থাৎ সে সাদি । এ অবস্থায় ঈশ্বরে অনাদিত্ব গুণের অভাব হবে । অর্থাৎ ঈশ্বর অনাদি হতে পারবেন না ; অনন্তও হতে পারবেন না ।

যার আদি আছে , তার অন্তও অবশ্যই আছে । যার উৎপত্তি আছে , তার বিনাশও আছে । যে নদীর এক পাড় থাকে ; তার অপর পাড়ও থাকে ।

চতুর্থ দোষ —

ঈশ্বরে সর্বজ্ঞত্ব গুণের অভাব হবে । কেননা , যদি ঈশ্বরকে সর্বজ্ঞ স্বীকার করা যায় , তাহলে ঈশ্বর সাকার হওয়ায় এক দেশে অবস্থিতির কারণে তার পক্ষে সর্বত্র বিদ্যমান থাকা সম্ভব হবে না । যদি ঈশ্বর সর্বত্র না থাকেন তাহলে তাঁর মধ্যে সব স্থানের জ্ঞান থাকাও সম্ভব হবে না , তার জ্ঞান এক স্থানেরই হবে । ঈশ্বর যে দেশে বা যে স্থানে থাকবেন তাঁর সেই দেশের বা স্থানের জ্ঞানই হবে । 

পরিনাম - ঈশ্বর অন্তর্যামীও হতে পারবেন না ।

পঞ্চ দোষ —

ঈশ্বরে নিত্যত্ব গুণের অভাব হবে । অর্থাৎ ঈশ্বর অনিত্য হয়ে যাবেন । সেই পদার্থকেই নিত্য বলা হয় , যার অস্তিত্ব থাকবে , অথচ তার কোনও কারণ থাকবে  না 

ঈশ্বরের নাম হিরণ্যগর্ভ

হিরণ্য শব্দে জ্যোতি ও বিজ্ঞান বুঝায়, এজন্য যাঁহার গর্ভ অর্থাৎ স্বরূপ ও সামর্থ মধ্যে জ্যোতি অর্থাৎ অমৃত বা মোক্ষ বিদ্যমান অথবা জ্যোতি অর্থাৎ প্রকাশ স্বরূপ সূর্য্যাদি লোক যাঁহার গর্ভে স্থিত রহিয়াছে; কিংবা জ্যোতি অর্থাৎ জীবাত্মা যাঁহার গর্ভে অর্থাৎ সামর্থ্য মধ্যে রহিয়াছে;
অথবা হিরণ্য শব্দে যশঃ, সৎকীর্ত্তি ও ধন্যবার বুঝায়; এজন্য যশ ও সৎকীর্ত্ত্যাদি যাঁহার স্বরূপে বিদ্যমান রহিয়াছে; অথবা জ্যোতি বা ইন্দ্র অর্থাৎ সূর্য্য, বায়ু ও অগ্নি যাঁহার সামর্থ্য মধ্যে অবস্থান করে, এরূপ পরমেশ্বর / হিরণ্যগর্ভ হতে বেদ জ্ঞান প্রকাশিত হয়েছে [বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.১০]
হিরণ্যগর্ভ [শতপথ ব্রাহ্মন ৬।৭, ১৪।৭, ১০।৪, নিরুক্ত ১২।২৫]

অথর্ব০ ১।৩২।৩৩
যোভূতংচভব্যংচসৰ্ব্বংযশ্চাধিতিষ্ঠতি।
স্ব ১ বর্জ্যচকেবলং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায়ব্রহ্মণেনমঃ ॥
-( যো ভূতং চ ) যে পরমেশ্বর ভূতং অর্থাৎ অতীতকালে যাহা ব্যতীত হইয়া গিয়াছে, চশব্দে যাহা বর্ত্তমান কালে বিদ্যমান রহিয়াছে, এবং (ভব্যং চ ) এবং যাহা ভবিষ্যতে হইবে অর্থাৎ যে কাল বা সময় পরে আসিবে, এই তিন কালের সমস্ত পদার্থ বা ঘটনার ব্যবহার যিনি যথাবৎ জ্ঞাত আছেন। ( সৰ্ব্বং যশ্চাবিতিষ্ঠতি ) যিনি সমস্ত জগতের বিষয় বিজ্ঞান বলে জ্ঞাত আছেন। যিনি এই জগতের সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়কৰ্ত্তা এবং যিনি সংসারের সমগ্র পদার্থের অধিষ্ঠাতা ও স্বামী স্বরূপ। ( স্ব ১ বর্জ্য চ কেবলম্ ) যিনি স্বয়ং --সুখ বা আনন্দ স্বরূপ। যিনি মুক্তি ও ব্যবহারিক অর্থাৎ পারমার্থিক ও সাংসারিক উভয় প্রকারের সুখ প্রদাতা। (তস্মৈ জ্যৈষ্ঠায় ব্ৰহ্মণে নমঃ) সেই সৰ্ব্ব জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ সামর্থ যুক্ত ব্রহ্ম যাহাকে পরমাত্মা বলা যায়, তাহাকে অত্যন্ত সপ্রেম হৃদয়ে আমরা নমস্কার করি। এই পরমাত্মা সর্ব্ব সময়ে বিরাজমান আছেন, যাঁহার লেশমাত্রও দুঃখোদয় হয় না। এইরূপ আনন্দ ঘন পরমেশ্বর আমার নমস্কার প্রাপ্ত হউন।।

ঋগ্বেদ ১'ম অষ্টক ২য় অধ্যায় ৭তম বর্গের ৫নং মন্ত্রে পরমেশ্বর কে "বিষ্ণোঃ" অর্থাৎ অর্থাৎ ব্যাপক পরমেশ্বরকে যজুর্বেদ ৮।৩৬ নং মন্ত্রে "ষোড়শী" বলা হয়েছে। ষোড়শী অর্থাৎ ষোড়শ কলা বা ষোড়শ পদার্থ যা ঈশ্বর ব্যাপ্তিতে অবস্থান করে। যোড়শ কলা;যথা- ঈক্ষণ বা যথার্থ বিচার, প্রাণ যাহা সমস্ত বিশ্বকে ধারণ করে আছে, শ্রদ্ধা বা সত্য বিষয়ে বিশ্বাস, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাহ্যেন্দ্রিয়, মন অর্থাৎ জ্ঞান, অন্ন, বীর্য্য (বল ও পরাক্রম), তপ অর্থাৎ ধর্ম্মানুষ্ঠানরূপ সত্যাচার, মন্ত্র বা বেদবিদ্যা, কর্ম্ম বা চেষ্টা এবং নাম অর্থাৎ দৃষ্ট ও অদৃষ্ট পদার্থের সজ্ঞা। এ বিষয়ে প্রশ্নোপনিষদের ষষ্ঠ প্রশ্নে লেখা আছে।

অনেকে ৩৩কোটি দেবতার পূজার কথা বলিয়া থাকে কিন্তু
নিরুক্ত ৭।৪ এ প্রমাণ আছে, যে ব্যবহারিক দেবতার (৩৩ কোটী দেবতা) কদাপি উপাসনা করা কর্ত্তব্য নহে, পরন্তু এক পরমেশ্বরেরই পূজা বা উপাসনা করা উচিত। মানুষের ব্যবহারিক কার্য্য সিদ্ধি হয় বলিয়া ইহাদের দেবতা বলা হয়। মানুষ্যের পক্ষে একমাত্র উপাস্য দেবতা সেই পরব্রহ্মই।
ব্যবহারিক ৩৩ প্রকার দেবতা ["ত্রয়স্ত্রিংশ" অথর্ব্ববেদ০ কাং ১০ প্রপা ২৩ অনু ৪ মং ২৩-২৭] - যথা অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, এক ইন্দ্র এবং এক প্রজাপতি। ইহার মধ্যে অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দৌঃ, চন্দ্রমা ও নক্ষত্র এই অষ্ট প্রকার পদার্থকে বসু বলা যায়। ইহাদিগকে বসু বলিবার কারণ এই, যে সমস্ত পদার্থ উপরোক্ত অষ্ট পদার্থের মধ্যে বা ব্যাপকতায় বসতি করে, অর্থাৎ স্থিত থাকে; অর্থাৎ ইহারাই সকল প্রকার পদার্থের নিবাসস্থান।
শরীরস্থিত দশপ্রাণ অর্থাৎ প্রান, অপান, ব্যান, সমান, উদান, নাগ, ক্বকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা, এই একাদশ পদার্থকেই একাদশ রুদ্র বলা যায়। ইহাদিগকে রুদ্র সংজ্ঞা দিবার কারণ এই যে উপরোজ, দশপ্রাণ ও জীবাত্মা, যখন স্কুল শরীর পরিত্যাগ করে, তখনই লোকের মৃত্যু উপস্থিত হইয়া থাকে, এবং তৎকালে উত্তলোকের আত্মীয় ও সম্বন্ধীগণ তাহার ( বিয়োগ ) জন্য কোন বা ক্রন্দন করিয়া থাকেন ; অর্থাৎ উপরোক্ত একাদশ পদার্থ শরীর হইতে বহির্গত হইবার সময়, সকলকে রোদন বা ক্রন্দন করায় বলিয়াই, ইহাদিগকে রুদ্র বলা যায়; ( কারণ রুদ্র শব্দের অর্থ রোদন করায় যে )। এইরূপে ছাদশ মাসকেই দ্বাদশ আদিত্য বলা যায়, যেহেতু এই দ্বাদশ মাস রূপী (কাল) জগতের সমস্ত পদার্থের আদান অর্থাৎ আয়ু গ্রহণ করিয়া আসিতেছে। বিদ্যুৎকেই ইন্দ্র বলে, যেহেতু বৈদ্যুতিক বিদ্যাই ঐশ্বর্য্যোপার্জ্জনের মুখ্য হেতু স্বরূপ। যজ্ঞকে এই জন্য প্রজাপতি বলা যায়, যে ইহা দ্বারা বায়ু ও বৃষ্টির জলের শুদ্ধি হইয়া থাকে; (এই শুদ্ধি হেতু উত্তম অন্নাদি উৎপন্ন হয় ), যদ্দ্বারা প্রজার পালন হইয়া থাকে। তৎপরে পশুদিগকেও যজ্ঞ [শ০ ১৪।৫] সংজ্ঞা দিবার কারণ এই, যে ইহাদিগের দ্বারাও প্রজার জীবন ( ধারণ) হয়, (অর্থাৎ পশুদিগের দ্বারাও, প্রজাগণ অনেক প্রকার উপকার প্রাপ্ত হইয়া জীবন ধারণ করিতে সমর্থ হয়েন )। এইরূপে উপরোক্ত ৩৩টা পদার্থ প্রত্যেকে নিজ নিজ দিব্যগুণ হেতু, তেত্রিশ দেবতা নামে অভিহিত হয়। পুনশ্চ: স্থান, নাম ও জন্ম, এই তিন পদার্থকেও, নিরুত্তের মতে ত্রয়োদেবা বলা যায়। এইরূপে অন্ন ও প্রাণ, এই দুইটীকেও দৌ দেবা বলে। সূত্রাত্মা (রূপী) বায়ু বাহা সমগ্র জগতে পরিপূর্ণ রূপে বিরাজমান থাকিয়া সকল পদার্থের ধারণ ও বৃদ্ধি করে, তাহাকে অধ্যর্থ দেব বলা যায়।
পূর্বক্ত ৩৩ প্রকার দেবতা সকল এক পরমেশ্বরেরই প্রকাশ দ্বারা প্রকাশিত হইয়া থাকে; এবং  পরমেশ্বররূপি দেব, স্বয়ং স্বপ্রকাশ বলেই সদা প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছেন, এজন্য তিনিই একমাত্র সকলের পূজ্য দেবতা। 

এ বিষয়ের প্রমাণ যথা; –(স ব্রহ্ম শ০ব্রা০ ১৪।৫) অর্থাৎ যিনি সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা, সৰ্ব্ব শক্তিমান, সকলের ইষ্টদেব, সকলের উপাসনার যোগ্য, সকলের ধারণকারী বা ধারকস্বরূপ, সৰ্ব্বব্যাপক এবং সকলের কারণ স্বরূপ, যাহার আদি অন্ত নাই, যিনি সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, যাহার কদাপি জন্ম হয় না, যিনি কদাপি অন্যায় করেন না, ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত বেদাদি (সত্য) শাস্ত্রের প্রতিপাদিত (পরমাত্মাকেই), ইষ্টদেব বলিয়া জ্ঞান করা কর্তব্য। যেজন -উপরোক্ত পরমাত্মাকে পরিত্যাগ করিয়া, অন্য পদার্থকে ইষ্টস্বরূপে স্বীকার করে, তাহাকে অনাৰ্য্য অর্থাৎ আনাড়ী বলিয়া জ্ঞান করিবে। (আত্মেত্য) আর্য্যগণের ইতিহাস্বরূপ শতপথ ব্রাহ্মণগ্রন্থে লিখিত আছে, যে পরমেশ্বর, যিনি সকল পদার্থের আত্মাস্বরূপ, তাঁহাকেই সকল মনুষ্যের উপাসনা করা কর্তব্য। যদি কেহ এরূপ (কুতর্ক) করেন, যে পরমাত্মা ব্যতীত অপর বস্তুতেও, ঈশ্বর বুদ্ধি করিয়া প্রেম ও ভক্তি করা আবশ্যক, তবে তাহাকে বলা উচিত, যে তিনি (এরূপ করিলে) সদা দুঃখী হইয়া রোদন করিবেন, যেহেতু যেজন পরমাত্মার উপাসনা করেন, তিনি সদা পরমানন্দে মগ্ন থাকেন; পরস্ত যেজন অনায় পদার্থে ঈশ্বর বুদ্ধি করিয়া তাহার উপাসনা করেন, তিনি কিছুই ( ভাল মন্দ ) জানিতে পারেন না; এবং তজ্জন্যই তিনি বিদ্বানদিগের সম্মুখে, পশু অর্থাৎ গর্দভের ন্যায় গণ্য হইয়া থাকেন। অতএব নিশ্চয় জানিবেন, যে আর্য্যগণ সদাকাল হইতে এক পরমাত্মারই উপাসনা করিয়া আসিতেছেন।
আবার দেখুন দিবু ধাতুর দশপ্রকার অর্থ নিম্নে লিখিত হইতেছে, যথ। :- ১ম ক্রীড়া অর্থাৎ খেলা করা, ২য় বিজিগীবা অর্থাৎ শত্রুগণকে পরাজয় করিবার ইচ্ছা করা, ৩য় ব্যবহার, যাহা দুই প্রকার, যথা বাহ ও অন্তর, ৪র্থ নিদ্রা, ৫ম মদ; এই পাঁচ প্রকার অর্থ মুখ্যরূপে ব্যবহারিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়; যেহেতু (ভৌতিক) অন্নাদি পদার্থ সকল ব্যবহার সিদ্ধিরই হেতু হইয়া থাকে। পরন্তু ইহাতেও পরমেশ্বরের সর্ব্বথা ত্যাগ হয় না; যেহেতু উপরোক্ত ব্যবহারিক দেব সকলও, সেই পরমাত্মার ব্যাপ্তি ও রচনা বলেই দিব্য গুণযুক্ত হইয়াছে। এইরূপে স্থাতি (অথাৎ প্রকাশ করা), স্তুতি (বা গুণকীৰ্ত্তন করা), মোদ (বা প্রসন্নতা), কান্তি (বা শোভা), এবং গতি (যাহা জ্ঞান গমন ও প্রাপ্তি অর্থপ্রকাশ করে), ইত্যাদিরূপ “দিবু” ধাতুর অপর যে পাঁচপ্রকার অর্থ আছে, তাহা, মুখ্যরূপে পরমেশ্বরে বৰ্ত্তিয়া থাকে। যেহেতু পরমেশ্বর ব্যতীত অন্যান্য পদার্থে, যে পরিমাণে উপরোক্ত দিব্য গুণ বর্তমান থাকে, সেই সেই পদার্থের সেই পরিমাণেই দেবত্ব বা দেবভার গ্রহণ করা যায়; এবং এক পরমেশ্বরের সর্ব্বশক্তিমত্বাদিরূপ অনস্তগুণ বর্তমান আছে বলিয়াই, তিনিই একমাত্র পূজ্য দেবতা হয়েন। অথর্ব্ববেদ কাং১০ প্রপাঠক ২৩ অনুচ্ছেদ ৪ মন্ত্র নং ৩৮ (মহদ্যক্ষং)- যিনি সর্ব্বাপেক্ষা শ্রষ্ঠ, বৃহৎ তিনিই পূজ্য।।

অপরের সৎকার (সন্মান) ও প্রিয়াচরণ অর্থাৎ তদনুযদয়ী অনুকূল কার্য্য করাকে পূজা বলা যায়। এই পূজার সাধন সকলেরই করা কর্তব্য। অতএব অগ্নি আদি পদার্থের অর্থ যে যে পরিমাণে দিব্যগুণ, ক্রিয়াসিন্ধি, ও উপকার লওয়ার সম্ভব আছে, সেই সেই পরিমাণে উক্ত পদার্থ সকলের দেবত্ব স্বীকার করায় কোন রূপ ক্ষতি নাই । আর বেদশাস্ত্রে যে যে স্থানে উপাসনা রূপ ব্যবহার বিষয় গ্রহণ করা হইয়াছে, তথায়, এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই গৃহীত হইয়াছেন।

উপরোক্ত দেবতা বিষয়ে দুইপ্রকার ভেদ আছে, যথা— প্রথম মূর্তিমান ও দ্বিতীয় অমূৰ্ত্তিমান। মাতা পিতা আচার্য্য ও অতিথি এই চারিজন (সাক্ষাৎ ) মূর্তিমান দেবতা স্বরূপ। পরমাত্মা অমূর্তিমান দেবতা ; অর্থাৎ পরমাত্মার কোন প্রকার মুর্ত্তি বা ভৌতিক শরীর অথবা ইন্দ্রিয়াদি নাই।
উপরোক্ত পাচটী সাক্ষাৎ দেবতার, মানবমাত্রেরই সৎকার পূজা ও উপাসনা করা কর্ত্তব্য। পূর্বোক্ত মাতা পিতাদি চারিজন শরীরী, ও পরমাত্মা অশরীরী দেবতা হয়েন।
এইরূপে অষ্ট বসুরূপ দেবতাদিগের মধ্যে, অগ্নি, পৃথিবী, আদিত্য, চন্দ্রমা ও নক্ষত্র এই পাচটী মূৰ্ত্তিমান দেব; ও একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, মন, অন্তরিক্ষ, বায়ু দ্যৌ এবং মন্ত্র, ইহারা অমুর্তিমান দেবতা। এইরূপে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, বিদ্যুৎ ও বিধিযজ্ঞ, ইহারা মূর্তিমান ও অমূর্তিমান ( উভয় প্রকারেরই) দেবতা হইয়া থাকে ।

যজুর্বেদ ৩২।১১ [পরীত্য ভূতানি পরীত্য লোকান্ পরীত্য সর্ব্বাঃ প্রদিশোদিশশ্চ..] (পরীত্য ভূঃ) পরমেশ্বর আকাশাদি সমস্ত ভূত সকলে তথা সূর্য্যাদি সমস্ত লোকে ব্যপ্তস্বরূপে বিরাজমান হরিয়াছেন। এখানে বলা হয়েছে (পরীত্য সর্ব্বা) পরমেশ্বর বৃহৎ হইতে বৃহৎ এবং অনু হইতেঔ অণুরূপী পরমানু আদি সমস্ত পদার্থেই ব্যাপকতায় স্থিত।
আবার এই মন্ত্রে শব্দ এসেছে "ঋতস্যা" অর্থাৎ যিনি নিজ সামর্থ্যেরও আত্মা স্বরূপ অর্থাৎ যিনি নিজ সামর্থ নিজে জ্ঞাত আছেন।

সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্ব্বে সংজানানা উপাসতে ॥ ঋ০ অ৮ অ ৮ ব. ৪৯ মং• ২ ।
–(সংগচ্ছব ) অর্থাৎ পরমেশ্বর বলিতেছেন, দেখ আমি সকলের জন্য উপদেশ করিতেছি যে হে মনুষ্যগণ ! তোমরা পক্ষপাত রহিত, ন্যায় ও সত্যাচরণযুক্ত যে ধর্ম্ম তাহাই গ্রহণ কর। ইহার বিপরীত কদাপি আচরণ করিও না.; পরস্ক উহারই প্রাপ্তির জন্য বিরোধ পরিত্যাগ পূর্ব্বক পরস্পর সম্মতিযুক্ত হও, চন্দ্বারা তোমাদিগের শ্রেষ্ঠ সুখ দিন দিন বৃদ্ধি হউক এবং কোন প্রকারের ছঃখাহম্ভব না হউক। (সংবদধ্বং) তোমরা বিরুদ্ধ বাদ (বিতণ্ডা) পরিত্যাগ পূর্ব্বক অর্থাৎ পরস্পর প্রীতি সহকারে, পঠন পাঠন ও প্রশ্নোত্তর বিধানে সংবাদে রত হও, যারা তোমাদিগের (মধ্যে) সত্যবিদ্যা নিত্য নিত্য বৃদ্ধি প্রাপ্ত হউক। (সংবো মনাংসি জানতাম্) তোমরা আপন আপন যথার্থ জ্ঞানকে নিত্যপ্রতি বৃদ্ধি করিতে থাক, যদ্বারা তোমাদিগের মন প্রকাশযুক্ত হইয়া সদা তোমাদিগের পুরুষার্থ বা ধর্ম্মযুক্ত পুরুষকারকে বৃদ্ধি করুক; এবং এইরূপে তোমরা জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া নিত্যাননে স্থিত বা মগ্ন থাক। তোমাদিগের (সঙ্গা) ধৰ্ম্মেরই সেবা করা কর্তব্য, অধর্ম্মের সেবা করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। ( দেবাভাগং য.) যেরূণ পক্ষপাত রহিত ধর্ম্মাত্মা বিঘানপুরুষেরা বেষোক্ত রীত্যনুসারে সত্যধর্ম্মের আচরণ করেন, তদ্রূপ তোমরাও আচরণ কর, অর্থাৎ করিবে।

"স্তুতি " গুণজ্ঞান, গুণকীর্ত্তন এবং গুণ শোনার নাম স্তুতি। স্তুতির ফলে ঈশ্বর প্রীতি জন্মে ইত্যাদি।
“প্রার্থনা”—যে জ্ঞান-বিজ্ঞানাদি নিজের শক্তির অতীত, কিন্তু ঈশ্বরের সাথে যোগবশতঃ প্রাপ্ত হওয়া যায়, ঈশ্বরের নিকট তা যাজ্ঞা করাকে প্রার্থনা বলে; ফলঃ অহঙ্কার মুক্ত হওয়া।
“উপাসনা" — ঈশ্বরের গুণ-কর্ম্ম-স্বভাবের ন্যায় নিজের গুণ-কৰ্ম্ম-স্বভাব পবিত্র করা এবং ঈশ্বর সবব্যাপক, আমি তাঁহার নিকটে আছি এবং তিনি আমার নিকটে আছেন, এইরূপ জ্ঞানসহকারে যোগাভ্যাস দ্বারা ঈশ্বর সাক্ষাৎকার করার নাম উপাসনা। উপাসনার ফল জ্ঞানোন্নতি, নিরভিমানতা, উৎসাহ ও সাহায্য ইত্যাদি লাভ হয়। উপাসনা দ্বারা পরম ব্রহ্মের সহিত মিলন ঘটে এবং তাহার সাক্ষাৎকার লাভ হয়।
 সগুণ ও নির্গুণ “স্তুতি প্রার্থনা উপাসনা" - পরমেশ্বরে যে সকল গুণ বিদ্যমান তাঁহাকে সে সকল গুণবিশিষ্ট এবং যে সকল গুণের অভাব, সে সকল গুণরহিত জানিয়া প্রশংসা করাকে যথাক্রমে সগুণ ও নির্গুণ স্তুতি বলে। শুভগুণ গ্রহণ এবং দোষবর্জনার্থ পরমাত্মার সহায়তা প্রার্থনা করাকে যথাক্রমে সগুণ ও নির্গুণ প্রার্থনা বলে। 
পরমেশ্বর সর্ববগুণময় এবং সর্ব্বদোষরহিত জানিয়া নিজ আত্মাকে তাঁহাড়ে এবং তাঁচার আজ্ঞায় সমর্পণ করাকে সগুণ এবং নির্গুণ উপাসনা বলে।
“যজ্ঞ”—বিদ্বান্‌দিগের প্রতি সমুচিত সম্মান প্রদর্শন, শিল্পকার্য্যে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার উপযোগ, বিদ্যাদান, শুভগুণবৃদ্ধি এবং অগ্নিহোত্রানুষ্ঠানকে যজ্ঞ বলে। অগ্নিহোত্র দ্বারা বায়ু, বৃষ্টি, জল এবং ওষুধি পবিত্র হয়।
দেবপুজা—বিদ্যানদের, মাতা, পিতা, আচার্য্য, অতিথি, ন্যায়বান রাজা, ধর্মাত্মা, পতিব্রতা স্ত্রী এবং স্ত্রীব্রত পতি—ইহাদের সম্মানকে দেবপূজা এবং তাহার বিপরীত আচরণকে অদেব পূজা বলা হয়। পাষাণ-নির্ম্মিত জড়মূর্ত্তি সর্ব্বদা অপূজ্য।।
(ঈশ্বর-স্তুতি ) – সেই পরমাত্মা সর্ববত্র ব্যাপক, ক্ষিপ্রকর্ম্মা এবং অনন্ত বলশালী। তিনি শুদ্ধ, সকলের অন্তর্যামী, সর্ব্বোপরি বিরাজমান, সনাতন এবং স্বয়ংসিদ্ধ। পরমেশ্বর সনাতন বিভাদ্বারা বেদপ্রকাশ করিয়া তাঁহার সনাতন ও অনাদি জীবরূপী প্রজাদিগকে তাহার অর্থবোধ করাইয়া থাকেন। এইরূপ ( গুণ কীৰ্ত্তনকে ) সগুণ স্তুতি বলে। অর্থাৎ পরমেশ্বরের এই সকল গুণবিশিষ্ট স্তুতি সগুণ। (অকার) অর্থাৎ পরমেশ্বর কখনও শরীর ধারণ অথবা জন্মগ্রহণ করেন না। তাঁহার ছিত্র নাই। তিনি নাড়ী প্রভৃতির বন্ধনেও বন্ধ হন না। তিনি কখনও পাপাচরণ করেন না। তাঁহাতে ক্লেশ, দুঃখ ও অজ্ঞান কখনও সম্ভব হয় না। এই সকল রাগ ও দ্বেষাদি হইতে পৃথক্ জানিয়া ঈশ্বরের স্তুতি করার নাম নির্গুণ স্তুতি। ইহার ফল এই যে পরমেশ্বরের গুণ-কৰ্ম্ম-স্বভাব অনুযায়ী নিজ গুণ-কর্ম্ম-স্বভাব গঠিত হয়। অর্থাৎ পরমেশ্বর যেমন ন্যায়কারী, নিজেও সেইরূপ ন্যায়কারী হইবে। কিন্তু, যিনি কেবল ভাঁড়ের ন্যায় পরমেশ্বরের গুণ কীৰ্ত্তন করিতে থাকেন, কিন্তু নিজ চরিত্র সংশোধন করেন না তাঁহার স্তুতি নিষ্ফল।

প্রর্থনার উদাঃ
যজু০ ৩২।১৪ 
যাং মেধাং দেবগণাঃ পিতরশ্চোপাসতে।
তয়া মমদ্য মেধয়াহগ্নে মেধাবিনং কুরু স্বাহা।।
-হে অগ্নে! অর্থাৎ জ্যোতিঃস্বরূপ পরমেশ্বর ! বিদ্বান, জ্ঞানী এবং যোগীরা যে বুদ্ধির উপাসনা করেন, আপনি কৃপা করিয়া বর্তমান সময়ে আমাকে সেই বুদ্ধি প্রদান করুন ॥ 

অথবা যজুর্বেদ ১৯।৯
-আপনি জ্যোতিঃস্বরূপ, কৃপা করিয়া আমাকেও জ্যোতিঃ প্রদান করুন। আপনি অনন্ত পরাক্রমশালী, অতএব কৃপাকটাক্ষপাতে আমাকেও পূর্ণ পরাক্রম প্রদান করুন। আপনি অনন্ত বলশালী, অতএব আমাকেও বলশালী করুন । আপনি অনন্ত সামর্থ্যবান্, অতএব আমাকেও সামর্থ্যবান করুন।

উপাসনা শব্দের অর্থ সমীপস্থ হওয়া। অষ্টাঙ্গ যোগদ্বারা পরমাত্মার সমীপন্থ হইবার এবং তাঁহাকে সর্বব্যাপী ও সর্বান্তর্যামীরূপে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য যাবতীয় কৰ্ত্তব্য কর্ম্ম করা উচিত। অর্থাৎ :

তত্রাঽহিংসা সত্যাস্তেয় ব্রহ্মচর্য্যাপরিগ্রহা যমাঃ ॥-যোগদর্শন সাধনপাদে ॥ সৃ. ৩০॥ 

ইত্যাদি পাঞ্জল যোগশাস্ত্রের সূত্র। যিনি উপাসনা আরম্ভ করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি কাহারও সহিত বৈরভাব রাখিবেন না। সর্ববদা সকলের প্রতি প্রীতি সম্পন্ন হইবেন। সত্য বলিবেন, কখনও মিথ্যা বলিবেন না। চুরি করিবেন না। সত্য আচরণ করিবেন। জিতেন্দ্রিয় হইবেন, লম্পট হইবেন না। নিরহঙ্কার হইবেন, কখনও গর্ব্ব করিবেন না। একত্রে এই পঞ্চবিধ যম উপাসনা যোগের প্রথম অঙ্গ।

শৌচ সন্তোষ তপঃ স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ ॥

যোগস্- সাধনপাদে । সু ৬২ ॥

রাগ-দ্বেষ পরিত্যাগ করিয়া অন্তরে এবং জলাদির দ্বারা বাহিরে পবিত্র থাকিবে। ধর্ম্মানুসারে পুরুষার্থ করিলে লাভে সন্তুষ্ট অথবা হানিতে অসন্তুষ্ট হইবে না। আল্য পরিত্যাগ করিয়া সর্ববদা প্রফুল্লচিত্তে পুরুষকার করিতে থাকিবে। সুখ-দুঃখ সহ্য করিয়া সর্ববরা ধর্ম্মেরই অনুষ্ঠান করিবে। কখনও অধর্ম্মানুষ্ঠান করিবেনা। সর্বদা সত্য শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করিবে ও করাইবে। সৎপুরুষদিগের সঙ্গ করিবে। প্রতিনিয়ত পরমাত্মার “ওম্” এই নামের অর্থ মনন পূর্ববক জপ করিবে। নিজ আত্মাকে পরমেশ্বরের আজ্ঞানুকূল করিয়া (তাহাতেই ) সমর্পণ করিবে।
জীবের পক্ষে পরমেশ্বরের নিত্য উপাসনা করা কর্ত্তব্য অর্থাৎ উপাসনা কালে সকল মানুষ্যই যেন তাঁহাতেই (সেই পরমাত্মায়) মত স্থির করেন [ঋগ্বেদ ৪।৪।২৪।১] যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো] মন স্থির করেন এবং যাহারা ঈশ্বরের উপাসক অত্যন্ত মেধাবী, বিদ্যান ব্যাক্তি, যোগীগণ সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বপ্রকার বিদ্যাযুক্ত পরমেশ্বরের মধ্যে অর্থাৎ তাঁহাতে আপনার মনকে যথাযোগ্য বা সম্যক প্রকারে যুক্ত বা স্থির (চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি) করেন।

 ঈশ্বরস্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা মন্ত্র
ওতম্ বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব।
যদভদ্রন্তন্ন আসুব।।-[যজুঃ৩০।৩]
-🟢হে সকল সৃষ্টির রচয়িতা পরমেশ্বর! আমাদের সব দূর্গুণ দূর করিয়া যাহা কিছু কল্যাণকর তাহাই দান করুন।।
ওতম্ হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ত্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।-[যজুঃ১৩।৪]
🔵যে পরমাত্মা গর্ভে জ্যোতিষ্ক মন্ডল ধারণ করিয়া আছেন, যিনি এই সৃষ্টির উৎপত্তির পূর্ব হইতেই বিদ্যমান আছেন এবং
যিনি এই উৎপন্ন জগতের সর্ববিদিত স্বামী, তাঁহারই আশ্রয়ে পৃথ্বীলোক ও দ্যুলোক স্থিত রহিয়াছে। আমরা সেই সুখ স্বরূপ সৃষ্টিকর্ত্তা পরমাত্মাতে আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ।
যস্যচ্ছায়াহমৃতং যস্য মৃতুঃ কস্মৈ দেবায হবিষা বিধেম।।-[যজুঃ২৫।১৩]
🟣যিনি আত্মবল ও দেববলের দাতা, যাঁহার শাসনকে বিদ্বানেরা প্রশংসা করেন, যাঁহার আশ্রয়ই অমৃত ও যাঁহার বিয়োগই মৃত্যু, আমরা সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ যঃ প্রাণতো নিমিষতো মহিত্বৈক ইদ্রাজা জগতো বভূব।
য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুস্পদঃ কস্মৈ দেবায হবিষা বিধেমঃ।।-[যজুঃ২৩।৩]
🟠যিনি স্বীয় মহিমায় প্রাণী ও অপ্রাণী জগতের একমাত্র রাজা এবং সব দ্বিপদ ও চতুস্পদ প্রাণীর উপর শাসন করিতেছেন, আমরা সকলে সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ যেন দ্রৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢ়া যেন স্বঃ স্তুভিতং যেন নাকঃ।
যো অন্তরিক্ষে রজসো বিমানঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ।।-[যজুঃ৩২।৬]
🟡যাঁহার দ্বারা আকাশ উজ্জ্বল ও পৃথিবী স্বীয় কক্ষপথে দৃঢ় হইয়া আছে, যিনি আকাশে সব লোক লোকান্তকে নির্মাণ করিয়াছেন, আমরা সেই সুখস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা পরমাত্মায় আত্মসমর্পণ করিয়া স্তুতি ও উপাসনা করিতেছি।।
ও৩ম্ প্রজাপতে ন ত্বদেতান্যন্যো বিশ্বা জাতানি পরি তা বভুব।
যৎকামাস্তে জুহুমস্তন্নো অস্তু বয়ং স্যাম পতযো রযীণাম্।।-[ঋগ্বেদঃ১০।১২১।১০]
🔴হে প্রজাপতি পরমাত্মন্ ! তুমি ছাড়া এই সব উৎপন্ন জড় চেতনাদি পদার্থের উপর অন্য কাহারও রাজ্য নাই। আমরা তোমাকে যে ইচ্ছা করিয়া প্রার্থনা করিতেছি, আমাদের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হউক। আমরা সকলে যেন পার্থিব ও অপার্থিব ধনৈশ্বর্য্যের অধিপতি হইতে পারি।।
ও৩ম্ স নো বন্ধুর্জনিতা স বিধাতা ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা।
যত্র দেবা অমৃতমানশানাস্ততীযে ধামান্নধ্যৈরযন্ত।।-[যজুঃ৩২।১০]
🟢সেই পরমাত্মা আমাদের জন্মদাতা, পালক, পোষক ও বন্ধু। তিনি সব লোক লোকান্তকে জানেন। মুক্ত পুরুষেরা মুক্তিকালে অমৃত সুখের আস্বাদন করিয়া তাঁহার আশ্রয়েই বিচরণ করেন।।
ও৩ম্ অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্ বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো ভূষিষ্ঠান্তে নম উক্তিং বিধেমঃ।।-[যজুঃ৪০।১৬]
🟠হে সর্বপ্রকাশক পরমাত্মন্ ! তুমি আমাদিগকে ঐশ্বর্ষ্যলাভের জন্য সুপথে চালনা কর। তুমি সব শুভ কর্মের জ্ঞাতা। তুমি আমাদের নিন্দনীয় পাপরাশি নষ্ট করিয়া দাও। আমরা বারংবার তোমাকে নমস্কার করিতেছি।।
🙏ইতি ঈশ্বর স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা মন্ত্র🙏


অষ্টবিধ প্রমানঃ

১ প্রত্যক্ষ, ২ অনুমান, ৩ উপমান, ৪ শব্দ, ৫ ঐতিহ্য, ৬ অথাপত্তি, ৭ সম্ভব, ও ৮ অভাব; এই প্রকার ভেদে আমি ৮ প্রকার দর্শন স্বীকার করিয়া থাকি। (ইন্দ্রিয়াথ•) ইহাদের মধ্যে চক্ষু আদি ইন্দ্রিয় এবং রূপ আদি বিষয়ের সম্বন্ধ হইতে, যে সত্যজ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহাকে প্রত্যক্ষ বলা যায় । যেমন দুর হইতে দেখিলে সন্দেহ হয়, যে উহা মনুষ্য বা অপর কিছু, কিন্তু পরে তাহার সমীপস্থ হইলেই নিশ্চয় হইয়া যায় যে ইহা মম্ৰষ্যই বটে, অপর কিছু নহে, ইত্যাদি বিষয় প্রত্যক্ষের উদাহরণ স্বরূপ জানিবে। ১॥ (অথতৎপু০) কোন পদার্থের (আংশিক) চিহ্নমাত্র দেখিলেই, (সেই বা অপর) পদার্থের যে জ্ঞান হয়, তাহাকেই অনুমান বলে; যেমন কোন ব্যক্তির পুত্রকে দেখিলে জ্ঞাত হওয়া যায় যে ইহার মাতা পিতাদি আছেন বা অবশ্য ছিলেন ইত্যাদি অনুমান বিষয়ের উদাহরণ রূপ জানিবে । ২ ॥ (প্রসিদ্ধ ) তৃতীয় উপমান, যদ্দ্বারা কোন বস্তুর তুলাধর্ম্ম দেখিয়া, সম-ধর্ম্মযুক্তের যে জ্ঞান হয় তাহাকে উপমান বলে ; যেমন কোন ব্যক্তি কাহাকেও বলিল—যেরূপ এই দেবদত্তকে দেখিতেছ, সেই প্রকার সেই যজ্ঞদত্তকেও জানিবে, এবং উহার নিকট যাইয়া এই কার্য্য করাইয়া লও; এই প্রকারের তুল্য ধর্ম্ম হইতে যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে উপমান বলা যায়৷৩৷ (আপ্তোপ.) চতুর্থ টি শব্দ প্রমাণ, যাহা প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অর্থের নিশ্চয় করাইয়া দেয়; যেমন জ্ঞান হইতে মোঙ্গ হয়, এইরূপ আপ্তোদেশ, শব্দ প্রমাণের উদাহরণ স্বরূপ জানিবে । ৪ ॥ (ঐতিহং) সত্যবাদী বিদ্বান কর্তৃক কথিত ব| লিখিত উপদেশের নাম ইতিহাস, যেমন দেব ও অসুর যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত তৎপর হইয়াছিলেন, এই, (বা এইরূপ) যে সমস্ত ইতিহাস ঐতরেয় শতপথ ব্রাহ্মণাদি সত্য গ্রন্থে লিখিত আছে, তাহাই গ্রহণীয় হইয়া থাকে। অন্য অসত্য গ্রন্থের বাক্যাদি প্রমাণীর নহে, এবং ইহাই (ঐতিহ্যরূপ) পঞ্চম প্ৰমাণ ॥৫॥ বণ্ঠ প্ৰমাণ (অর্থাপত্তিঃ), অর্থাৎ কোন বাক্য শ্রবণ করিয়া, তাহা হইতেই বিরুদ্ধ অর্থ বুঝিয়া লওয়া; যথা কোন ব্যক্তি বলিল, যে মেঘ হইতেই বৃষ্টি হয়। এই কথা শুনিয়াই অপরে জ্ঞাত হইলেন, যে বিনা মেঘে কদাপি বৃষ্টি হইতে পারে না; এবম্বিধ প্রমাণ হইতে যে জ্ঞান জন্মে, তাহাকে অৰ্থাপত্তি কহে। ৬ ॥ সপ্তম (সম্ভবঃ), যেমন কোন ব্যক্তি কাহাকেও বলিল, যে মাত৷ পিত। হইতে সন্তানের উৎপত্তি হইয়া থাকে, এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি তাহা স্বীকার করিল যে, হাঁ, একথা সম্ভব বটে ; পরন্তু যদি কেহ এইরূপ কহে, যে রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের শ্মশ্রুর কেশ (গোক), আকাশে চাবি ক্রোশ পর্যন্ত উর্দ্ধে অবস্থিত করিত, এবং উহা (১৬) ষোড়শ ক্রোশ পর্যাপ্ত দীর্ঘ বা প্রশ্নেও তদ্রূপ ছিল; তবে এইরূপ বাক্যগুলিকে (সব্বথা) মিথ্যা বলিয়া বুঝিতে হইবে ; যেহেতু এরূপ ঘটনা অবস্থা, কখন সম্ভব হইতে পারে না। ৭ ॥ অষ্টম প্রমাণ (অভাবঃ), যেমন কোন ব্যক্তি কাহাকেও বলিল যে “তুমি ঘট আনয়ন কর” এবং যখন সে ঘট আনয়ন করিতে গিয়া তথায় ঘট পাইল না, তখন অপর যেখানে ঘট ছিল, তথা হইতে লইয়া আসিল। ৮ ॥

ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেওয়া তো সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে আপনি ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করবেন?

উত্তরঃ প্রমাণ অর্থ হচ্ছে স্বচ্ছ জ্ঞান যা ইন্দ্রিয় অঙ্গগুলো হতে প্রাপ্ত উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় । কিন্তু লক্ষ করুন ইন্দ্রিয় অঙ্গ গুলো শুধ মাত্র গুণ সুমহকে ধারণ করতে পারে ঐ সকল গুণের কারণ বা হেতুকে নয় । উদারহন স্বরূপ, যখন আপনি এই লেখাটি পড়ছেন তখন কিন্তু আপনি আমার অস্তিত্বকে ধারণ করতে পারছেন না, কিন্তু কতগুলি সাংকেতিক চিহ্ন, বর্ন, বা ছবি যা কম্পিউটার স্ক্রিনে আসছে যা আপনি অর্থপূর্ন জ্ঞানে রূপান্তরিত করছেন । তারপরে আপনি এই সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন যে এই লেখাটির কোন লেখক আছে এবং এই লেখকের অস্তিত্বের প্রমাণ আপনার কাছে আছে বলে আপনি দাবী করেন । সুতরাং এটা হচ্ছে একটি পরোক্ষ প্রমাণ যদি প্রত্যক্ষ ভাবেই প্রতীয়মান হয় । ঠিক একই ভাবে এই সমস্ত সৃষ্টি যা আমরা এর বৈশিষ্ট্য দ্বারা পর্যবেক্ষন করি আমাদের ইন্দ্রিয় অঙ্গসমূহ মধ্য দিয়ে তা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে ।
যখন প্রত্যক্ষভাবে একটি সত্ত্বার সাথে একটি সংবেদনশীল তথ্যের যোগসূত্র ঘটাতে পারবেন তখন আপনি দাবী করতে পারবেন যে আপনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে । উদাহরণ স্বরূপ, যখন আপনি আম খাবেন তখন আপনি এর মিষ্ট গুণকে উপলব্ধি করতে পারেন এবং যে আমটি খেয়েছিলেন তার সাথে এই মিষ্ট গুণটিকে সংশ্লিষ্ট করতে পারছেন । এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে আপনি "প্রত্যক্ষ প্রমাণ" কে শুধু মাত্র সংশ্লিষ্ট করতে পারছেন নির্ধারিত কোন ইন্দ্রিয় অঙ্গ দিয়ে যা আপনি ব্যবহার করেছিলেন ঐ গুণটিকে পর্যবেক্ষন করার জন্য । অর্থাৎ আমের এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ আপনি কর্ণ ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে পাবেন না । এটা কেবল জিহ্বা, নাসিকা ও চক্ষু দ্বারাই সম্ভব । ঠিক তেমনি বাস্তবে আমরা "পরোক্ষ প্রমাণ" গুলিও পাই যদিও আমরা এগুলোকে "প্রত্যক্ষ প্রমাণ" বলে থাকি ।
যেহেতু ঈশ্বর হচ্ছেন সবচেয়ে সুক্ষ অতীন্দ্রি়য় সত্ত্বা সেহেতু ঈশ্বরের "প্রত্যক্ষ প্রমাণ" আমাদের এই অসুক্ষ অশিষ্ট সীমিত শক্তির ইন্দ্রিয় অঙ্গ যেমন নাক, কান, চোখ, জিহ্বা, চর্ম দ্বারা সম্ভব নয় । যেমন আমরা অতি পারমানবিক কণাকে এমনকি অনেক শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে পারি না, আমরা শ্রবণাতীত শব্দ (Ultrasonic Sound ) শুনতে পারি না, আমরা স্বরন্ত্র একটি অণুর স্পর্শ অনুভব করতে পারি না । অর্থাৎ ঈশ্বরকে এই দুর্বল ও অসুক্ষ ইন্দ্রিয় অঙ্গ দ্বারা প্রমাণিত করা যাবে না ঠিক যেমন আমকে কর্ণ দ্বারা অথবা অতি পারমানবিক কণাকে কোন ইন্দ্রিয় অঙ্গ দিয়ে ইন্দ্রগ্রাহ্য করা যাবে না ।
একমাত্র ইন্দ্র যা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করতে পারে তা হলে মন । যখন মন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত এবং সকল ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদান (যেমন চিন্তা যা সর্বদা জাগ্রত থাকে) থেকে মুক্ত এবং ঈশ্বরের সকল গুণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান যা অধ্যায়ন ও চর্চার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, তাহলেই বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দিয়েই প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যাবে যেমন করে ঐ আমকে এর স্বাদ দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছিল । এটাই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য যা একজন যোগী করার চেষ্টা করেন মন নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন । এই পদ্ধতি গুলোর মধ্যে রয়েছে অহিংসা, সত্য সন্ধান, পর দুঃখকাতরতা, সকলের জন্য পরমসুখ সন্ধান, উন্নত নৈতিক চরিত্র, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, মানুষের মাঝে একতা ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
এভাবে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রমাণের ইঙ্গিত পাই । যখন আমরা চুরি, প্রতারণা, পাশবিকতার মতো কোন ভুল কাজ করি তখন আমরা ভয়,ভীতি, লজ্জা, সন্দেহ ইত্যাদি আকারের আমরা ভেতরকার ক্ষীন কণ্ঠস্বর শুনতে পাই । আর যখনই আমরা কোন মঙ্গল সূচক কাজ করি যেমন কাউকে সাহায্য করা, কোন শিশুকে আর্শীবাদ করা ইত্যাদি, তখনও আমরা ভেতরকার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাই ভয়শূন্য, আত্মতৃপ্তি, প্রত্যয়ী ও পরম সুখবোধ আকারে ।
এই ভেতরের কণ্ঠস্বরটি আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে । আমরা প্রায়শই এর শ্রাব্যতাকে কমিয়ে চুপ করে রাখার চেষ্টা করি আমাদের চারপাশে উচ্চ শব্দের DJ Music এর মত নির্বোধ প্রবণতার মাধ্যমে । কিন্তু তখন আমরা সবাই কোন এক সময়ে ভেতরের কণ্ঠস্বরকে আরও উচ্চ শব্দে শুনতে পাই যখন এই সব কিছু তুলনামূলকভাবে নিঃশ্চুপ ।
যখন আত্মা নিজেকে সকল মানসিক বিশৃঙ্খলা থেকে নিজেকে শুদ্ধ করে এবং ঐ DJ ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে তখন আত্মা নিজেই নিজেকে ও ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে প্রামানিক হয় । এভাবে আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় মাধ্যমে পরিষ্কার ভাবে ঈশ্বরকে জানতে পারি ।
বিপ্রতিষেধাচ্চ ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৫(বিপ্রতিষেধাত্-চ) বিরোধের নিষেধ বিপ্রতিষেধ বলা হয়। বৈদিক ঈশ্বর থেকে ধর্ম বিরোধী ঈশ্বর অর্থাৎ সাকার ঈশ্বরের নিষেধ করা যায়-যেমন অজ একপাত্ ( যজু০ ৩৪/৫৩)=ঈশ্বর অজন্মা অকায়মব্রণমস্নাবিরম্ ( যজু০ ৪০/৮)=ঈশ্বর অকায়=শরীররহিত অপাণিপাদো ( শ্বেতা ৩/১৯) পরমাত্মার হস্ত-পদ হয় না, অতঃ জগতের কর্তা ঈশ্বর উৎপত্তি হতে রহিত তথা শরীর ইন্দ্রিয়ো এবং আকার হতে রহিত, এই সূত্রে সিদ্ধ হয়।

ঊর্জা ও বলের মতো গুণ কোনো সাকার পদার্থের মধ্যে হয় না। এই সংসারে সাকার পদার্থের মধ্যে যেসব বল বা ঊর্জা দেখা যায়, তা আসলে সেই সাকার পদার্থের ভিতর বিদ্যমান অন্য নিরাকার পদার্থেরই হয়। বিভিন্ন বিশাল বা লঘু যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যুৎ, যা নিরাকারই হয়, আদির বল বিদ্যমান থাকে। প্রাণীদের শরীরের মধ্যে চেতন জীবাত্মারও বল কাজ করে। নিরাকার বিদ্যুৎ আদি পদার্থের মধ্যে চেতন পরম তত্ত্ব ঈশ্বরের বল কাজ করে, এটা আমি পূর্বেই বলেছি। যে ঈশ্বর তত্ত্ব প্রত্যেক সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাদের বল ও ঊর্জা প্রদান করছে, সেটা কেবল নিরাকারই হতে পারে, সাকার কখনও নয়।

য়জুর্বেদ বলছে -
ইশাবাস্যমিদ্ঁ সর্বম্ য়ত্কিঞ্চ জগত্যাম্ জগত্"
(য়জু০ ৪০|১)
অর্থাৎ - সেই ঈশ্বর এই সম্পূর্ণ জগতের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাকে আচ্ছাদিত করে আছেন। এইভাবে সেই ঈশ্বর সর্বব্যাপক সিদ্ধ হল। সেটা একদেশী কখনও হতে পারবে না।

আমরা জানি যে আমাদের সৃষ্টিতে বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রায় দুই অরব গ্যালাক্সিকে দেখেছে বা অনুভব করেছে। আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যেই প্রায় দুই অরব তারা আছে। বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত দেখা ব্রহ্মাণ্ডের ত্রিজ্যা 10^26 m -কে মানে। দুই গ্যালাক্সির মাঝে কয়েক অরব-খরব কিলোমিটার ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো লোক হয় না, তবুও সম্পূর্ণ রিক্ত স্থানের মধ্যে সূক্ষ্ম হাইড্রোজেন গ্যাস অত্যন্ত বিরল অবস্থায় ভরা থাকে। তারমধ্যেও Vaccum Energy ভরা থাকে। সারাংশ এই হল যে, এত বড়ো ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নিতান্ত রিক্ত স্থান কোথাও নেই। এরমধ্যে আমাদের সূর্যের থেকে কয়েক কোটি গুণ বড়ো তারাও বিদ্যমান আছে, তাই সূক্ষ্ম লেপ্টন, কোয়ার্ক এবং কোয়ান্টাস্ বিদ্যমান আছে। এছাড়াও এদের থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণ, ছন্দ ও মনতত্ত্বাদি পদার্থ বিদ্যমান আছে। এইসব স্থূল ও সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে গতি ও বলের বিদ্যামানতা আছে। সবার মধ্যে সৃজন ও বিনাশের খেলা হচ্ছে। এই কারণে যেখানে-যেখানে এই খেলা চলছে, সেখানে-সেখানে ঈশ্বর তত্ত্বও বিদ্যমান হওয়া উচিত। এর মানে হল, ঈশ্বর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে তথা স্থূল থেকে স্থূলতম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এই কারণে কঠ উপনিষদের ঋষি বলেছেন -
"অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্"
(কঠ০ উপ০ ২|২০)
অর্থাৎ - সেই পরমাত্মা হলেন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম আর মহান থেকে মহান্। এই কারণে তিনি হচ্ছেন সর্বব্যাপক।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ