ঈশ্বরের অবতার - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 February, 2022

ঈশ্বরের অবতার

পৌরাণিক হিন্দুরা শ্রী রামচন্দ্র জি এবং শ্রী কৃষ্ণ জিকে ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করেন।  হিন্দুদের কোথাও দশটি আবার কোথাও চব্বিশটি অবতার ধরা হয়। শ্রী রামচন্দ্র জিকে বারো কলার অবতার এবং শ্রী কৃষ্ণকে ষোল কলার অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অবশিষ্ট অবতারগুলিতে, বিভিন্ন কলার অবতার বিবেচনা করা হয়।

ঈশ্বরের অবতার

আজকের কিছু শিক্ষিত পণ্ডিত এই অবতার থেকে বিবর্তন প্রমাণ করেন। তারা বলেন, কচ্ছপ, মৎস, বরাহ, নরসিংহ ইত্যাদি অবতার বিবর্তনের বিভিন্ন শ্রেণী। অর্থাৎ ডারউইন যেভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা বলেছেন ঈশ্বরের অবতারদের মধ্যেও একই ধরনের বিকাশ পাওয়া যায়। অবতার সাধনে যে যুক্তিগুলো দেওয়া হয় তা থেকে জানা যায় যে ঈশ্বরের অবতার সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সুনির্দিষ্ট নয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কোন না কোন উপায়ে অবতারের নীতি সঠিক হোক বা না হোক তা প্রমাণ করা।

'অব' অপসর্গ এবং 'তু' থেকে 'অবতার' শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ 'নামা' বা নেমে আসা। ঈশ্বর অবতার মানে নিরাকার ঈশ্বর দেহে অবতরণ করেন অর্থাৎ দেহ ধারণ করেন। 

এ সম্বন্ধে মূলতঃ সাতটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়-

(১) ঈশ্বর কেমন ?

(২) ঈশ্বরের গুণাবলী কি পরিবর্তন হয় ?

(৩) এই গুণগুলো মাথায় রেখে অবতারের আবশ্যকতা কী ?

(৪) অবতার হওয়া কি সম্ভব ?

(৫) রাম জী ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কী বিশেষ গুণ পাওয়া যায় যাঁরা ভগবানের অবতার বলে বিবেচিত হন, যার কারণে তাঁদেরকে মানুষ নয়, ভগবান মনে করা উচিত।

(৬) মানুষের জীবনে ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের প্রভাব কী?

(৭) বেদে কি রাম, কৃষ্ণ প্রভৃতি অবতারের বর্ণনা আছে? 

এখন আমরা এই সমস্ত প্রশ্ন যথাক্রমে বিবেচনা করব, দেখুন

(১) ঈশ্বর কেমনঃ

যারা অবতারবাদে বিশ্বাস করেন তাঁরা সকলেই জানেন ও মানেন, ঈশ্বর সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। সূর্য, চন্দ্র গ্রহাদির মতো, বড় বস্তু থেকে ক্ষুদ্রতম পদার্থের সৃষ্টিকর্ত্তা, স্থিতি কর্ত্তা ও প্রলয় কর্ত্তা।

দেখুন ব্যাসজী বেদান্ত দর্শনে বলেছেন-

"জন্মাদ্যস্য যতঃ."-(বেদান্ত দর্শন ১-১-২)

অর্থাৎ, ঈশ্বর হলেন যিনি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ধ্বংস করেন। এটি দেখায় যে ঈশ্বর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম, অর্থাৎ নিরাকার। যদি তা সূক্ষ্ম না হয়, তবে কীভাবে সূক্ষ্ম জিনিসের মধ্যে সূক্ষ্মতম জিনিস তৈরি করেন ? একটি মোটা জিনিস একটি পাতলা জিনিস করতে পারে না. কুড়াল দিয়ে সোনা ও রূপার সূক্ষ্ম অলঙ্কার তৈরি করা যায় না। গয়না যত সূক্ষ্ম, এটি তৈরি করতে আরও সূক্ষ্ম সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। সূক্ষ্ম বস্তু স্থূল বস্তুতে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু স্থূল বস্তু সূক্ষ্ম বস্তুতে প্রবেশ করতে পারে না।

সাংখ্য দর্শন ৬।৬৪ ["অহংকারকর্ত্রধীনাকার্য্যসিন্ধির্নেশ্বরাধীনাপ্রমাণাভাবাৎ"] পরমেশ্বর সর্ব্বব্যাপক ও সর্বজ্ঞ তিনি সমস্ত রচনা সৃষ্টি করে জীবের মধ্যে দ্রষ্টা ও সক্ষীরূপে থেকে যথাযত ফল প্রদান করেন।পরমেশ্বরের নাম "নিরঞ্জন" কারন [অঞ্জনং ব্যক্তির্ম্লক্ষণং কুকাম ইন্দ্রিয়ৈঃ প্রাপ্তিশ্চেত্যস্মাদ্যো নির্গতঃ পৃথগ্ভূতঃ স নিরঞ্জনঃ]- যিনি ব্যক্তি অর্থাৎ আকৃতি,ম্লেচ্ছাচার, দুষ্টকামনা এবং চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের বিষয়-পথ হতে পৃথক।

ঈশ্বরের কাজ দেখুন, তিনি মূল প্রকৃতির মধ্যে বিকার উৎপন্ন করে সম্পূর্ন ব্রহ্মান্ড রচনা করেছেন। পৃথিবীতে কত সূক্ষ্ম ! পিঁপড়ার চেয়ে অনেক গুণ ছোট প্রাণী আছে। তার শরীরে শত শত অঙ্গ রয়েছে। আমরা দূরবীন দিয়েও তাদের দেখতে পারি না। এসবের স্রষ্টা এবং যিনি এগুলোকে স্থির রাখেন তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম অর্থাৎ নিরাকার ও সর্বব্যাপী হওয়া উচিত। ক্ষুদ্রতম পরমাণুর মধ্যেও ঈশ্বর থাকেন। ফুলের রং আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন।

প্রজাপতির ডানা কত রঙিন ? ময়ূরের পালক কত সুন্দর ? কাজটা কতটা জ্ঞানপূর্বক বুদ্ধিমত্তার ? তিনি অনু, পরমানু ও মহৎতত্ত্ব ও মনসত্ত্বতের মধ্যে থেকে তাঁর কার্য করেন। একমাত্র নিরাকার এবং সর্বব্যাপী ঈশ্বরই এই সকল কার্য করতে সক্ষম। ঈশ্বর সত্য, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়, করুণাময়, অজাত, তিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ, অসীম, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত, অতুলনীয়, সর্বশক্তিমান, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী, সর্বব্যাপী, অমর, অমর, নির্ভীক, চিরন্তন, পবিত্র এবং স্রষ্টা। সব সত্যবিদ্যা এবং যা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায় সেসবের আদিমূল পরমেশ্বর। তাঁকে চক্ষুদ্বারা দেখা যায় না [কঠ. ২।৩।৯]। সর্ব্বশক্তিমান না হলে তিনি কিভাবে সমগ্র ব্রহ্মান্ড নির্মান করতেন ? 

২) ঈশ্বরের গুণাবলী কি পরিবর্তন হয় ?

এখানে ঈশ্বরের কিছু গুণাবলী বর্ণনা করা হল। এই সকল গুণের কি পরিবর্ত্তন হওয়া সম্ভব ? তিনি কি নিরাকার থেকে সাকার হতে পারেন ? তিনি কি সর্ব্বব্যাপক থেকে একদেশীয় হতে পারেন ? পৃথিবীর সব জিনিসই পরিবর্তনশীল এবং তাদের পরিবর্তনের প্রধান কারণ হল ঈশ্বর। কখনো কখনো মনুষ্যও ঈশ্বরের নিয়ম অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন করে থাকে। ঠিক যেমন সে কাঠের টেবিল তৈরি করে, কিন্তু ঈশ্বর পরিবর্তনযোগ্য জিনিস নয়। ঈশ্বরও যদি বদল হন, তাহলে ঈশ্বরে নির্বলতা প্রকাশ পাবে। পরিবর্তনশীল সবকিছুই নির্বল হয়, এবং কোন কিছুর সংযোগে তৈরী হয়। যদি ঈশ্বেরর গুণাবলীর পরিবর্তন হয় তিনি আর ঈশ্বর থাকবেন না এবং সংসারের কাজ চলবে কিভাবে ? যদি নিরাকার থেকে ঈশ্বর সাকার হন, তবে তার মধ্যে স্থূলতা আসবে। স্থূলতা আসার সাথে সাথে তাঁর সর্বব্যাপকতা বিনষ্ট হয়ে যাবে কারণ তিনি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম পদার্থে পরিব্যাপ্ত থাকতে পারবেন না। ব্যাপক না হওয়ায় জ্ঞানও নষ্ট হয়ে যাবে, তা কখনো সম্বব নয়। এইজন্য ঈশ্বর কখনো পরিবর্তন হন না বা হবেন না। তিনি একান্ত স্বরূপ, তাঁহার স্বরূপে অন্য পদার্থ সংযুক্ত নয় দুষ্টদের পরিত্যাগ করেন এবং করান তাই তিনি "রাহু" নামে পরিচিত।

আচ্ছা আমি প্রশ্ন করি যে, ঈশ্বরের পরিবর্তনের কারণ কি স্বয়ং ঈশ্বর নাকি অন্য কেউ ? যদি ঈশ্বর নিজেই তাঁর পরিবর্তনের কারণ হন তবে তার দোষ, ত্রুটি বা অপূর্ণতা থাকবে। পূর্ণ দ্রব্য কখনই পরিবর্তন হবে না। যদি তিনি পূর্ণ তো তিনি পূর্ণ থাকবেন। তিনি কি পূর্ণ থেকে অপূর্ণ হবেন ?ব্রহ্ম সর্বদা পূর্ণ থাকবেন ? কখনো তিনি পরিবর্ত্তন হবেন না [ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং ...যজু০৫।১১ ] . অতএব প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং ঈশ্বরের মধ্যে এমন কোন ত্রুটি নেই যার দ্বারা তিনি পরিবর্তন হতে পারেন বা হবেন।তাহলে কি ঈশ্বর ছাড়া অন্য কেউ ঈশ্বরের পরিবর্তনের কারণ ? না !! কারণ শুধুমাত্র একটি জিনিস অন্যকে পরিবর্তন করতে পারে যা তার চেয়ে শক্তিশালী। ঈশ্বরের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই। তাই তাঁকে কোন কিছুই পরিবর্ত্তন করতে পারবে না।

কিছু লোক মনে করে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারে না সর্বশক্তিমান যিনি হবেন তিনি পরিবর্ত্তন হবেন না। পরিবর্তন শক্তির লক্ষণ নয়, দুর্বলতার লক্ষণ। শক্তিশালী পদার্ত নির্বল বস্তু প্রতিস্থাপন করে। ঈশ্বর অন্যান্য বস্তুর পরিবর্তন করেন। তিনি নিজেই এক রস, অবিচ্ছিন্ন, অপরিবর্তনীয় এবং সম্পূর্ণ। যে বস্তুটি পরিবর্তিত হয় তা পরিবর্ত্তিত হয়ে নিজে আরো ভাল হয় অথবা আরো খারাপ হয়ে যায়। ঈশ্বর এতই ভালো যে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না যে উন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে আছে সে কেন পরিবর্ত্তন হবে। তার আর কী উন্নতি হবে! খারাপ হওয়া প্রশ্নই ওঠে না। খালি পাত্র ভর্তি করা যাবে, ভর্ত্তি পাত্র আর কি করে ভরবে ? "সর্ব্বাঃ শক্তয়ো বিদ্যন্তে যস্মিন্ স সর্ব্বয়ক্তিমানীশ্বরঃ"। ঈশ্বর স্বকার্য্য সাধনের জন্য অন্যের সহায়তা গ্রহণ করেন না, এবং নিজ সামর্থ্য দ্বারা স্বকামনা পুরণ করিতে সমর্থ তাই তাঁকে "সর্ব্বশক্তিমান্" বলা হয়। যাঁর গুণ-কর্ম্ম-স্বভাব এবং সত্য ব্যবহার সর্ব্বাপেক্ষা মহান্ তাঁকে শ্রেষ্ঠ বলে, শ্রেষ্ঠদের মধ্যে যিনি অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ তাঁকেই পরমেশ্বর বলে..তাঁর সদৃশ কেহ হয় না এবং হবেও না।


৩-রূপ পরিবর্তন না করে ঈশ্বর অবতীর্ণ হতে পারেন না 

আমরা উপরে পড়েছি যে ঈশ্বর রূপ পরিবর্তন করেন না। যে কারণে সে অবতারও নিতে পারে না। ভগবানের তিনটি কাজ অর্থাৎ সৃষ্টি করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং ধ্বংস করা, রূপ পরিবর্তন না করেই করতে পারে এবং চলছে। তাই ঈশ্বরের জন্মের কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু লোক বলে যে ঈশ্বর দুষ্টদের বধ করতে এবং সেরাদের সুখ দেওয়ার জন্য অবতার হন। তাকে জিজ্ঞাসা করুন যে তিনি জন্ম না নিয়ে দুষ্টকে হত্যা করতে এবং সেরাকে সুখ দেওয়ার মতো শক্তিশালী নন কিনা।

সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি বানানোর চেয়ে কংস ও রাবণকে বধ করা কি কঠিন ছিল ? কংস ও রাবণ কে, কে বানিয়েছে [বানিয়েছে অর্থাৎ কর্ম্মানুসারে শরীর] ? ঈশ্বর কি তাদের সৃষ্টি করেননি ? যখন তাদের তৈরি করতে অবতারের প্রয়োজন নেই, তখন তাদের ধ্বংস করার জন্য অবতার হওয়ার কি প্রয়োজন ? যেখানে বানানোর চেয়ে ধ্বংস সহজ। আপনি একটি ঘড়ি বানাতে পারবেন না কিন্তু আপনি এটি ভেঙে দিতে পারেন। তাহলে বলুন আজকাল কি ঈশ্বর দুষ্টকে ধ্বংস করেন না ? যদি এমন হতো তাহলে আজ সব দুষ্কৃতীরা অমর হয়ে যেত। সকল জীব ঈশ্বরের কর্ম্মফল ব্যবস্থার মধ্যেই থাকে।

কেউ কেউ বলেন ঈশ্বর ভক্তদের হাতে থাকেন, ভগবান ভক্তদের যে রূপে দর্শন দিতে চান সেই রূপে দর্শন দেন। এটি তাঁদের একটি বিশাল ভুল। ঈশ্বরের নিয়মের অনুকূল চলাই প্রকৃত ভক্তি, ভগবানের উদ্দেশে নেচে নেচে আকাঙ্ক্ষা করা ভক্তি নয়। সেবক হল সেই যে প্রভুর আদেশ অনুসরণ করে, এটা নয় যে প্রভু তাকে অনুসরণ করুক। তাই ঈশ্বরের অবতার বা রূপ পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।


৪- ঈশ্বর কি অবতার হতে পারেন না ?

ঈশ্বর অবতার হতে পারেন বলা তাকে অপমান করা। ঈশ্বরের অবতার হয় না [যজু০ ৩২।৩]। ঈশ্বর কৌশল্যা বা দেবকীর গর্ভের আগে উপস্থিত ছিলেন, কারণ তিনি সর্বব্যাপী এবং সর্বদাই বিস্তৃত। অতঃপর তিনি গর্ভে এসেছেন, গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছেন ইত্যাদি বলা সবই অলীক বা বিভ্রান্তিকর। বেদান্ত দর্শন ২।২।৩৯ ঈশ্বরের জন্ম অসম্ভব বলে তাঁর কোন কর্ত্তা নেই। 

কিছু লোক মনে করে যে এমন কিছু নেই যা ঈশ্বর করতে পারেন না। তিনি সর্বশক্তিমান। কিন্তু, তারা জানে না যে অনেক কিছু করাই দুর্বলতা, শক্তি নয়। আমি বলি যে "ঈশ্বর দুর্বল হতে পারে না। ঈশ্বর অন্যায় করতে পারেন না. ঈশ্বর নিজের মতন অন্য কোন ঈশ্বরকে বানাতে পারেন না। ঈশ্বর যখন রাম ও কৃষ্ণের দেহে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখন সেই দেহের বাইরে অন্য জায়গায় কে তৈরি বা নষ্ট করত ? 

৫- রাম ও কৃষ্ণ কি ঈশ্বরের অবতার ছিলেন?

শ্রীরাম চন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি মহাপুরুষ অবশ্যই ছিলেন। তার ছিল অসাধারণ কৌশল এবং আশ্চর্য ক্ষমতা। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কোন জিনিস নেই যা তাদের ঈশ্বর বলে প্রমাণ করতে পারে। ঈশ্বর যোল কলার নির্মাতা তিনি ভোক্তা নন, শ্রীরাম চন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের মত মহাপুরুষ এই ষোল কলার বিভিন্ন কলায় পারদর্শী ছিলেন। যোগ দর্শনে বলা আছেঃ ক্লেশ কর্ম বিপাকাশয়ৈরপরব্রষ্টঃ পুরুষ বিশ্বঃ ঈশ্বরঃ অর্থাৎ ঈশ্বরে দুঃখ ও কর্মের ফল ভোগ করা উচিত নয়। রাম ও কৃষ্ণের জীবনে ভালো করে দেখলে পাওয়া যায় ধার্মিকতা, বীরত্ব ইত্যাদি। কিন্তু, তিনি কখনো ঈশ্বরের ন্যায় কোন কিছু সৃষ্টি করেননি। অন্যান্য পুরুষদের মতো তিনিও খাবার খেতেন, জল পান করতেন, ঘুমাতেন, পড়াশোনা করতেন, বিয়ে করতেন, যুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করতেন।

এই সমস্ত নিদর্শন মানুষের, ঈশ্বরের নয়। তিনি সীতা হারানোর শোক প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে ঈশ্বর হওয়ার কি আছে? কেউ কেউ বলেন তিনি ঈশ্বর, কিন্তু মনুষ্য লীলা করতেন। এটাও একটা ভুল ধারনা। ঈশ্বর কি মানুষের বিনোদনের জন্য অবতারণা করেন ? মনুষ্য লীলা করার জন্য মানুষ তো আছে। জগতের সকল মানুষই লীলা করে এবং যখন আপনি মুখে বলেন যে, সেই মানুষরা লীলা করতেন, তখন আপনি বিশ্বাস করেন যে, সেই মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের কোনো গুণ তাদের মধ্যে পাওয়া যায়না, তাহলে তিনি কিভাবে ঈশ্বর হলেন?

কেউ কেউ রামচন্দ্রের উপর খুশি হয়ে চাঁদের কাছে খেলনা চেয়ে, ঠুমক ঠুমক করে হাঁটা, তীর-ধনুক নিয়ে, শ্রী কৃষ্ণের মাখন চুরি, বাঁশি বাজানো ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে ভক্তি দেখায় এবং মনে করে যে এটা ঈশ্বরের পূজা ও ঈশ্বরের স্তোত্র..উপাসনা হচ্ছে।

খ্রিস্টান লোকেরাও যীশু সম্পর্কে অনুরূপ জিনিস বিশ্বাস করে যেমন ক্রুশবিদ্ধকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এই মূর্খদের ভাবা উচিত, এগুলো সবই সাধারণ মানুষের কাজ। এসবের মধ্যে ঈশ্বরত্বের কি এমন গুন আছে ? সব শিশু ঠুমক দিয়ে হাঁটে, কিছু চালাক ছেলে আছে মাখন চুরি করে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ না মাখন চোর না তিনি বাঁশী বাজক। এবং ক্রুশবিদ্ধ শুধুমাত্র মানুষের অনুভূত হয় ঈশ্বরের জন্য নয়। তাই তাদের ঈশ্বরত্ব কোনোভাবেই প্রমাণিত নয়।


৬- অবতারে বিশ্বাস মানবজীবনে প্রভাব

রাম কৃষ্ণ প্রভৃতিকে ঈশ্বর হিসাবে বিবেচনা করা হিন্দু সম্প্রদায়ের আচার-আচরণে খারাপ প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, তারা ঈশ্বরের পূজা না করে মূর্তিপূজারী হয়েছে। শুধুমাত্র রাম-রাম, সীতা-রাম, রাধাকৃষ্ণের জপকে ঈশ্বরের পূজা, উপাসনা বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয়ত তাঁরা রাম জী ও শ্রীকৃষ্ণের জীবন অনুকরণ করেন না। তারা বোঝে যে রাম কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার বা ঈশ্বর ছিলেন, আমরা সাধারণ মানুষ তার মতো আচরণ করতে পারি না। এই কারণেই হিন্দু ক্রমাগত অবক্ষয়ের দিকে পতিত হচ্ছে। হিন্দুরা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোন প্রতিকার না নিয়েই ঈশ্বরের অবতারের জন্য অপেক্ষা করে। তারা বোঝে যে কখন ঈশ্বর অবতার হয়ে আসবেন। তিনি তাঁদের দুঃখ, কষ্ট দূর করবেন। তারা বিশ্বাস করতে পারে না যে তারা কঠোর পরিশ্রম করলেও ঈশ্বর তাদের সাহায্য করতে পারেন। কেউ কেউ অবতারের জন্য চোখ বন্ধ করে বসে আছেন অর্থাৎ অকারণে অপেক্ষা করছেন। যদি তারা বিশ্বাস করে যে শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণ জী মানুষ হয়ে, এমন ভাল কাজ করেছেন, তবে তাদের নিজেরাই উন্নতির জন্য প্রস্তুত হতেন, অন্যের জন্য অকারন অপেক্ষা করতেন না। 

৭- বেদে কি রাম ও কৃষ্ণের বর্ণনা আছে?

এখন প্রশ্ন হল শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের অবতার বেদে বর্ণিত আছে কি না ? রাম ও কৃষ্ণ প্রভৃতি শব্দ যে বেদে বহু স্থানে আবির্ভূত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের অবতারের কোন বর্ণনা নেই। কিভাবে থাকবে ? বা কেন থাকবে ? ত্রেতায় রাম এবং দ্বাপরের শেষে কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। বেদ মহাবিশ্বের আদি থেকে এসেছে, যার উপর শত শত চতুরযুগী অতিক্রান্ত হয়েছে। রাম ও কৃষ্ণের প্রপিতামহ ও প্রপিতামহরাও বেদ পড়তেন এবং বিশ্বাস করতেন। আমরা বেদ ভালো করে অধ্যয়ন করলে দেখি বেদে কোন মনুষ্যের নাম নেই।

বেদের কোথাও দশরথের পুত্র রামচন্দ্র বা বাসুদেবের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনের বর্ণনা নেই। যারা শুধু নাম শব্দ দেখেই লাফায় যে অবতার বেদ দ্বারা প্রমাণিত, তারা নিজেকে এবং অন্যকেও প্রতারিত করেন। তাদের জানা উচিত যে দশরথ এবং বাসুদেব তাদের পুত্রদের জন্য নতুন নাম তৈরি করেননি। কিন্তু তারা সেই জনপ্রিয় শব্দগুলোকে আজকের বাবা-মায়ের মতোই গ্রহণ করেছে। মোহন নামটি অনেক পুরনো এবং এর অর্থ হল 'লোভনীয়' বা 'মন্ত্রমুগ্ধকর'। এখন যদি কারো নাম মোহন হয় এবং সে কোনো প্রাচীন ধনভান্ডারে বা বইতে মোহনের নাম দেখে এবং বলতে থাকে যে, আমার নামে অমুক বইয়ের বর্ণনা আছে, তাহলে সেটা হবে তার বোকামি। রাম ও কৃষ্ণ প্রভৃতি নামের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পৃথিবীতে সংস্কৃত ভাষার শব্দে যার নাম আছে, তার নাম বেদে কোনো না কোনো রূপে অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে বেদে সেই মানুষটিকে বর্ণনা করা যায় না।


বেদের কোন মন্ত্র থেকে অযোধ্যার রাজা দশরথের গৃহে ভগবান অবতারণা করেছিলেন এবং তাঁর নাম রাম ছিল বলে পাওয়া যায় না। তিনি জনক কন্যা সীতাকে বিয়ে করেন এবং রাবণকে হত্যা করেন। এমনকি সায়নাচার্যের মতো প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় ভাষ্যকাররাও তা মেনে নেননি। হ্যাঁ, বর্তমান সময়ের কিছু পণ্ডিত অবতার প্রমাণের জন্য কিছু মন্ত্র পাঠ করেন, কিন্তু তারা সফলতা পায়নি। এখানে আমরা একটি মন্ত্র দিই যাতে রামের নাম এসেছে।

भ॒द्रो भ॒द्रया॒ सच॑मान॒ आगा॒त्स्वसा॑रं जा॒रो अ॒भ्ये॑ति प॒श्चात् ।

सु॒प्र॒के॒तैर्द्युभि॑र॒ग्निर्वि॒तिष्ठ॒न्रुश॑द्भि॒र्वर्णै॑र॒भि रा॒मम॑स्थात् ॥[ঋগ্বেদ০ ১০।৩।৩]

এখানে 'রাম' শব্দটি এসেছে। সায়ণাচার্য এর অর্থ করেছেন "রাম কৃষ্ণ শর্বর তমঃ"-অর্থাৎ রাম রাত্রের অন্ধকার কে বলে। আর্য পন্ডিত ব্রহ্মমুনি জী নিঘন্টু  ১।৯ ও নিরুক্ত ১১।৩২ দ্বারা একই অর্থ করেছেন।এর থেকে বোঝা যায় সায়ণের সময়েও কেউ মানতো না বেদে ঈশ্বরের অবতার আছে। এটা সম্ভব শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বে লোক রাজা অর্থে ঈশ্বর ব্যবহার করতো, ঈশ্বর অর্থে রাজাও হয় ও পরমাত্মাও।

প্রশ্ন: ঈশ্বর শব্দটি কখনই একা রাজা অর্থে আসে না। শুধু ভিতরে আসে। উত্তরঃ এটা ভুল। আপনি পড়েননি, আমরা প্রমাণ দিচ্ছি।

অপি ত্বমিশ্বরম্ প্রাপ্য কামবৃত্তিম্ নিরুকুশম্।

ন বিনাশ্যেত পুরী লঙ্কা ত্বয়া সহ মারাক্ষসা।

এটি বাল্মীকি রামায়ণের একটি শ্লোক।মরীচ রাবনকে বলেন এমন না হয় যে স্বৈরাচারী এবং কামবৃত রাজা দের পেয়ে রাবন সহ লঙ্কা ও সকল রাক্ষস কূলের বিনাশ না হয়ে যায়। আরো দেখুন

ঈশ্বরস্য বিশতানাম বিলোক্য নিখিলাপুরী।

 কুশল্লো অন্বেষণস্য হনায়ুক্তো দৌতম কর্মাণি।-[ভট্টীকাব্য় সর্গ শ্লোক ১১৫]

অর্থাৎ, হনুমান জি বলেন, নিশাচরদের অধিপতি রাবণের সমস্ত পুরী দেখেই আমি সীতার সন্ধানে দূতের কাজে নিযুক্ত হয়েছি।

এই দুই শ্লোকে সমাস না থেকেও ঈশ্বর শব্দটি শুধুরাজার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। । সম্ববতঃ প্রথমে রামকেও কিছু জায়গায় ঈশ্বর শব্দে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তারপর ভুলবশত মানুষ রামকেই ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছে।

প্রকৃতপক্ষে রাম ও কৃষ্ণ উভয়েই ঈশ্বরের ভক্ত ছিলেন। তাঁদের সান্ধ্য আচারের বর্ণনাও আছে, দেখুন গোস্বামী তুলসীদাস জির রামায়ণেরও অযোধ্যা কাণ্ডে অনেক জায়গায় বর্ণনা , যখন রাম ও লক্ষ্মণ সন্ধ্যা করেছিলেন।

চল সন্ধ্যায় যাই ভাই।

আর কর রঘুবর সন্ধ্যায়।

যদি রামচন্দ্র জী ও শ্রীকৃষ্ণ জী ঈশ্বরের অবতার অথবা নিজে ঈশ্বর তাহলে ওনাদের সন্ধ্যা করার আবশ্যকতা কি ? সন্ধ্যা হলে কার সন্ধ্যা উপাসনা করতেন ? কেউ কি তার নিজের সন্ধ্যা বা উপাসনা করতে পারেন ? এটি একটি ভুল. যদি রাম সন্ধ্যা করেন, তবে তিনি কি নিজে অবতার হওয়ার চিন্তাও করেননি, নাকি ভুলে গেছেন ? এসকল বালকের চিন্তা।

মহাভারতঃ শান্তিপর্বঃ অধ্যায়ঃ১৫২ শ্লোক ৭

"তত উণ্থায় দাশার্হঃ স্নাতঃ প্রাঞ্জলিরচ্যুতঃ। জপ্ত্বা গুহ্যং মহাবাহুরগ্নীনাশ্রিত্য তস্থিবান্।।"-শ্রীকৃষ্ণ বেদমাতা গায়ত্রী মহামন্ত্র এর মাধ্যমে উপাসনা তথা সন্ধ্যা করতেন।

ঈশ্বর নিজে নিজের সন্ধ্যাউপাসনা কেন করবেন ? পেছন থেকে লোকজন তাঁদের সম্পর্কে অনেক মিথ্যা কথা রটিয়েছেন। তারা তাদের মূর্তি তৈরি করে পূজা করে এবং তাদের নৈবেদ্য থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। তাঁদের কথা এটা লজ্জার বিষয় যে ঈশ্বর অবতার হন না। পিঁপড়া, হাতি, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি মানুষ সবই জীবের অবতার, কারণ জীবাত্মা নির্বল তাদের কাজের জন্য একটি শরীর প্রয়োজন। জীবাত্মা ততদিন অবতার নেয় যতদিন না তাঁর মুক্তি অবস্থা হয়। জীবের কর্ম যত নীচ হয়, কর্ম্মফল অনুসারে অবতার তত নীচ হয়। কারণ অবতারের অর্থঃ অবতরণ হওয়া বা নীচে পড়া ও নামা, যখন অভৌতিক চেতন আত্মা জড় দেহে অবতরণ করে, তখন তাকে আত্মার অবতার বলা হয়। কিন্তু আত্মার এই অবতার উপাসনার যোগ্য নয়। উপাসনার যোগ্য একমাত্র ঈশ্বর। যিনি নিরাকার, নির্বিকার এবং অজন্মা তাঁরই উপাসনা করা উচিত। যিনি সর্ব্বব্যাপক বলে সব জগতের পদার্থ সমূহকে সংযুক্ত করেন, যিনি বিদ্বানদিগের পূজ্য এবং যিনি ব্রহ্মা হতে সকল ঋষিমুনিদের পূজ্য ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন সেই পরমেশ্বরের পূজা অর্থাৎ সৎকার ও উপাসনা করা উচিৎ। রাম এবং কৃষ্ণকে ঐতিহাসিক মহাপুরুষ হিসাবে বিবেচনা করে, তাদের জীবন কাহিনী পড়ুন এবং তাদের অনুশীলন অনুসরণ করুন। কিন্তু ঈশ্বরের জায়গায় তার মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করবেন না কারণ ঈশ্বরের জায়গায় অন্যের পূজা করা পাপ ও মূর্খতা। 

বিপ্রতিষেধাচ্চ ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৫(বিপ্রতিষেধাত্-চ) বিরোধের নিষেধ বিপ্রতিষেধ বলা হয়। বৈদিক ঈশ্বর থেকে ধর্ম বিরোধী ঈশ্বর অর্থাৎ সাকার ঈশ্বরের নিষেধ করা যায়- যেমন অজ একপাত্ ( যজু০ ৩৪/ ৫৩) = ঈশ্বর অজন্মা অকায়মব্রণমস্নাবিরম্ ( যজু০ ৪০/৮)=ঈশ্বর অকায়=শরীররহিত অপাণিপাদো ( শ্বেতা ৩/১৯) পরমাত্মার হস্ত-পদ হয় না, অতঃ জগতের কর্তা ঈশ্বর উৎপত্তি হতে রহিত তথা শরীর ইন্দ্রিয়ো এবং আকার হতে রহিত, এই সূত্রে সিদ্ধ হয়।

ও৩ম্ শম্  

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ