ত্রিতাপ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 February, 2022

ত্রিতাপ

 আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই ত্রিবিধ দুঃখ; ত্রিতাপ। মহর্ষি কপিলদেব এই দর্শনের প্রণেতা। ইনি কহেন যে ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তিই অত্যন্ত পুরুষার্থ।

সাংখ্যদর্শনের মতে দুঃখ ত্রিবিধ,-আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, ও আধিদৈবিক। যে দুঃখের কারণ আত্মা । তাহার নাম আধ্যাত্মিক দুঃখ। ইহা দুই প্রকার শারীর ও মানস। পীড়াদিসমুখ দুঃখের নাম শারীরিক দুঃখ । উন্মাদ, শোক প্রভূতি মানসিক দুঃখ। যে ব্যক্তি দুঃখ (डाश करन, उड़िम अश्रव्र खैौद खरु cए | ছঃখের কারণ, তাহার নাম আধিভৌতিক দুঃখ । ব্যাঘ্রাদিদংশন বা চোরের উপদ্রব এই সমুদয় আধিভৌতিক দুঃখ । দৈব যে দুঃখের কারণ তাহার নাম আধিদৈবিক দুঃখ। দাহশীতাছখ্য দুঃখের নাম আধি দৈবিক দুঃখ। যদ্যপি সর্ব্বপ্রকার দুঃখই । প্রকৃতপ্রস্তাবে মানস অর্থাৎ মনের দ্বারা । অনুভূত, তথাপি সাংখ্যের কারণভেদে দুঃখের বিভিন্নত। বর্ণন করিয়াছেন। অতীত ও বর্তমান দুঃখ যখন উৎপন্ন হইয়াছে তখন অবশ্যই নিবৃত্ত হইবে। অতএব সাংখ্যদর্শনের মতে বর্তমান ও অতীত দুঃখের নিবারণার্থ চেষ্টা করিবার প্রয়োজন নাই, কেবল ভবিষ্যৎ দুঃখই সাংখ্যদিগের বিবেচনার বিষয়। কি প্রকারে ভবিধাতে কোন প্রকার দুঃখ ভোগ করিতে না হয় ।

 ত্রিবিধ দুঃখ যথা,—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দ্বিবিধ—শারীর ও মানস। আধিভৌতিক দুঃখ মনুষ্য, পশু, পক্ষী ও স্থাবরাদি ভূত পদার্থ হইতে উৎপন্ন হয়। আধিদৈবিক দুঃখ যক্ষ রাক্ষসাদি দেবযোনির আবেশ নিবন্ধন উৎপন্ন হয়। দেবতাদের দ্বারা সংঘটিত যে দুঃখ। ভূমিকম্প, ঝড়, প্রবল বৃষ্টি, বন্যা, প্রচণ্ড গরম, কনকনে ঠাণ্ডা, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদিজনিত দুঃখ। আধিদৈবিক = দৈব বা প্রাকৃতিক ...


 জগতে আসিয়াই লোক এই ত্রিবিধ দুঃখের অধীন হইয়া পড়ে। পুরুষকার অবলম্বন করিলে কখন কখন কোনও প্রকার দুঃখের ক্ষণিক অবসান হয় বটে, কিন্তু তাহাকে পুরুষার্থ বা মোক্ষ বলা যাইতে পারে না। এই দুঃখ সমূহের চিরাবসান অর্থাৎ তাহাদিগের পুনরুৎপত্তির কারণ পর্য্যন্ত নাশ করাই পুরুষার্থ। প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তির কারণ। কিন্তু এই বিবেক-জ্ঞান লাভ করিতে হইলে পুরুষ ও প্রকৃতির স্বরূপ ও কার্য্য এবং জগৎ কি ও তাহার কারণ কি ইত্যাদি জানিতে হইবে। এই নিমিত্ত সাংখ্যকার পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের অবতারণা করিয়া সমস্ত বিষয় বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।

ত্রিবিধ দুঃখ

 পরিদৃশ্যমান জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে আমরা জড় ও চৈতন্য এই দুই পদার্থ দেখিতে পাই। চৈতন্য পদার্থ পুরুষ এবং জড় পদার্থ প্রকৃতি নামে অভিহিত হয়। এই দুই পদার্থই অনাদি, কিন্তু উভয়ে ভিন্নধর্ম্মী। সাংখ্যমতে পুরুষ বহু, কিন্তু কোনওপ্রকার প্রমাণ দ্বারা ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন সিদ্ধাস্ত করা যায় না। প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ব; মহৎ হইতে অহঙ্কার; অহঙ্কারের সাত্বিক অংশ হইতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন এবং পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়, এবং অহঙ্কারের তামস ভাব হইতে পঞ্চ তন্মাত্রা —শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—এবং তাহা হইতে পঞ্চ মহাভূত যথা, ক্ষিতি, জল, তেজ বায়ু ও আকাশ—সৃষ্ট হয়।

পূর্ব্বোক্ত চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বের তিনটি প্রকার-ভেদ আছে, যথা, (১) প্রকৃতি, (২) প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন, (৩) এবং বিকৃতি। প্রকৃতি শব্দে কারণ বুঝায়। মূলা প্রকৃতি ত্রয়োবিংশতি তত্ত্বের কারণ অথচ নিজে কাহারও কার্য্য নহে, অতএব ইহা কেবলই কারণ ভাবাপন্ন। কিন্তু মহত্তত্ব প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন অথচ অহঙ্কারের কারণ, অতএব ইহা প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয় ভাবাপন্ন। আবার যে সমস্ত তত্ত্ব হইতে অপর কোনও প্রকার তত্ত্ব উদ্ভূত হইতেছে না তাহারা কেবলই বিকৃতি ভাবাপন্ন।


 কিন্তু পুরুষতত্ত্ব প্রকৃতি বা বিকৃতি ভাবাপন্ন নহে। পুরুষ কোনও কারণ হইতে উদ্ভূত হয় নাই এবং পুরুষ হইতে কোনও কিছু উদ্ভূত হয় না। প্রকৃতির সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ আছে; কিন্তু পুরুষ নির্গুণ। প্রকৃতির রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টি, সত্ত্বদ্বারা স্থিতি ও তমঃ দ্বারা প্রলয় হইয়া থাকে। সৃষ্টি শব্দের অর্থ আবির্ভাব এবং প্রলয় শব্দের অর্থ তিরোভাব। প্রকৃতির স্থুল ক্রিয়া দ্বারা যখন জগৎ স্থুল-রুপ ধারণ কবে তখনই ইহার আবির্ভাব এবং যখন প্রকৃতির সূক্ষ্মক্রিয়া দ্বারা জগৎ সূক্ষ্মভাবাপন্ন হয় তখনই ইহার তিরোভাব। বস্তুতঃ ইহার একেবারেই ধ্বংস নাই।


 প্রকৃতিতে সৃষ্টির প্রবৃত্তি ও ভোগের উপাদান আছে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি ও ভোগ হইয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃতিই ভোক্ত্রী ও কর্ত্রী; পুরুষ ভোক্তাও নহেন কর্ত্তাও নহেন। পুরুষ প্রকৃতিতে আসক্ত হইয়া কর্ম্মীরূপে প্রতীয়-মান হয়েন।

ত্রিবিধ দুঃখ


“অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহং ইতি মন্যতে।”

 অহঙ্কার বিমূঢ় ভাবই দুঃখের কারণ। অতএব পুরুষ যখনবিদ্যা আশ্রয় পূর্ব্বক অহং তত্ত্বের উপরে উঠিয়া স্বরূপে অবস্থিত হয়েন তখন প্রকৃতির তিনগুণের সাম্যাবস্থা হয়।


 প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেক জ্ঞান সম্বন্ধে আরও কিছু স্পষ্ট করিয়া লিখিত হইতেছে। পুরুষ যদিও নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয় এবং নির্গুণ, তথাপি অদৃষ্টবশতঃ অহঙ্কারকে আশ্রয় করিয়া নিজের দুঃখের বীজ নিজে রোপন করেন। কর্ম্মফল হইতে অদৃষ্টের উৎপত্তি। দর্শনকারগণ বলেন যে কর্ম্মের প্রথম নাই কারণ সৃষ্টি অনাদি, অতএব পুরুষের অদৃষ্টও অনাদি। কিন্তু অনাদি হইলেও সাংখ্যমতে কর্ম্মফল সান্ত। জ্ঞান কর্ম্মফলের ধ্বংস করিতে পারে। কর্ম্মফলের ধ্বংস হইলেই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ নষ্ট হইবে। তাহা হইলেই মুক্তি। এক্ষণে এই প্রকৃতি পুরুষের সংযোগ ধ্বংসকারী জ্ঞান কি? “নিজ স্বরূপ বোধ।” প্রকৃতিই সমস্ত ভোগের আধার ও বোধক, নিজে সমস্ত ভোগ হইতে পৃথক, এইরূপ জ্ঞান দ্বারা নিজের স্বরূপ বুঝিতে পারিলে আর কর্ম্মফলে বাধ্য হইতে হয় না।

দুঃখের অনুভূতি হলো মানবজীবনের সবচাইতে তীব্র ও কষ্টকর অনুভূতি। মূলত জীবন মানেই অসংখ্য দুঃখের সমষ্টি। এই দুঃখানুভূতির আবির্ভাবও ঘটেছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। তাই চিরকালই প্রাণীমাত্রেই এই দুঃখকে জয় বা অতিক্রম করে সুখলাভের উপায় অনুসন্ধান করেছে। এবং এই অনুসন্ধিৎসা থেকেই ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাধারারও উৎপত্তি হয়েছে। সাংখ্যশাস্ত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা’র প্রথম কারিকাটিই এই দুঃখ–কেন্দ্রিক–


দুঃখত্রয়াভিঘাতাজ্জিজ্ঞাসা তদপঘাতকে হেতৌ।


দৃষ্টে সাহপার্থা চেন্নৈকান্তাত্যন্ততোহভাবাৎ।। (সাংখ্যকারিকা–১)


অর্থাৎ : ত্রিবিধ দুঃখের অভিঘাতের ফলে তার (অর্থাৎ সেই ত্রিবিধ দুঃখের) নিবৃত্তির (সাংখ্যশাস্ত্রীয়) উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসার উদয় হয়। লৌকিক উপায়ে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয় না বলে (দুঃখ নিবৃত্তির) সেই (সাংখ্যশাস্ত্রীয়) উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসা ব্যর্থ হয় না।

সহজ কথায় কারিকাকারের মতে জন্ম থেকেই জীবকুল নানা ধরনের দুঃখতাপে দগ্ধ হয়। শুধু যে বিচিত্র দৈহিক জরা ও যন্ত্রণাই ভোগ করে তাই নয়। যুদ্ধ, মহামারী, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। শুধু লৌকিক উপায়ে সমস্ত দুঃখের স্থায়ী নিবৃত্তি বা পরিত্রাণ সম্ভব হয় না বলে সাংখ্যশাস্ত্রে এই সব ধরনের দুঃখের আত্যন্তিক বা পূর্ণ বিনাশের উপায় বলা হয়েছে।


উল্লেখ্য, সাংখ্যকারিকায় দুঃখকে ত্রিবিধ অর্থাৎ তিন প্রকার বলা হলেও এর ব্যাখ্যা সাংখ্যকারিকায় পাওয়া যায় না। সাংখ্য শাস্ত্রকারদের মতে এই ত্রিবিধ দুঃখ বলতে এখানে দুঃখের সংখ্যা তিন– একথা বলা হয় নি। কারণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ। এই তিন কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ ঈশ্বরকৃষ্ণের মতে তিন প্রকার– এটাই বক্তব্য। কিন্তু কারিকায় এই তিন প্রকার দুঃখও চিহ্নিত না থাকায় বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে–


‘দুঃখানাং ত্রয়ং দুঃখত্রয়ং।

 তৎ খলু আধ্যাত্মিকং আধিভৌতিকং আধিদৈবিকং চঃ।

’ (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)


অর্থাৎ : দুঃখসমূহের ত্রয় দুঃখত্রয় বা ত্রিবিধ দুঃখ। এই ত্রিবিধ দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক।


সাংখ্যশাস্ত্র অনুসারে আন্তর উপায়ে অর্থাৎ শরীরের ভেতর থেকে উৎপন্ন রোগ জরাদি বা কাক্সিক্ষত বিষয়ের অপ্রাপ্তি হেতু মানসিক দুঃখ–তাপসমূহ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। এই আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই প্রকার– শারীর ও মানস। বাত, পিত্ত ও শ্লেষ্মার তারতম্যের ফলে শারীর দুঃখ জন্মে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং কাক্সিক্ষত বিষয় না পাওয়ার ফলে মানস দুঃখ জন্মে।


অন্যদিকে আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখ হলো বাহ্য উপায়ে সাধ্য অর্থাৎ শরীরের বাইরের কোন কারণ থেকে উৎপন্ন দুঃখ। মানুষ, পশু–পক্ষী, সরীসৃপ ও স্থাবর উৎস থেকে উৎপন্ন যে দুঃখ, তা হলো আধিভৌতিক দুঃখ। আর মহামারী, ভূমিকম্প, যক্ষ, রাক্ষস, বিনায়ক প্রভৃতি দৈব বা গ্রহাদির সংস্থান থেকে উৎপন্ন যে দুঃখ, তাই আধিদৈবিক দুঃখ।


জন্ম থেকেই জীব এই দুঃখত্রয়ের ত্রিতাপ জ্বালায় জর্জরিত। এই ত্রিতাপ দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তিই তার চরম লক্ষ্য বা পরম পুরুষার্থ। প্রশ্ন হলো, এই দুঃখ নিবৃত্তির উপায় কী ?

দুঃখ নিবৃত্তির উপায়:


দুঃখের অভিভব বা নিবারণ সম্ভব এবং তিন প্রকার দুঃখের নিবারণের তিন প্রকার উপায় আছে। যথা– (১) দৃষ্টবৎ বা লৌকিক উপায়, (২) আনুশ্রবিক উপায় তথা বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ এবং (৩) সাংখ্যশাস্ত্রবিহিত উপায়– তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান।


(১) দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্টবৎ বা লৌকিক উপায়: :


দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্ট বা লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য। তিন প্রকার দুঃখের অভিভব বা নিবৃত্তির তিন প্রকার দৃষ্ট উপায় রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বলেন–


‘সন্তি চোপায়াঃ শতশঃ শারীরদুঃখপ্রতীকারায়েষৎকরাঃ সুকরা ভিষজাং বরৈরুপদিষ্টাঃ। মানসস্যাপি সন্তাপস্য প্রতীকারায় মনোজ্ঞস্ত্রী -পানভোজনবিলেপনঃ বস্ত্রালঙ্কারাদিবিষয়প্রাপ্তিরুপায়ঃ সুকরঃ। এবমাধি -ভৌতিকস্য দুঃখস্যাপি নীতিশাস্ত্রাভ্যাস কুশলতানিরত্যয়স্থানাধ্যসনাদিঃ প্রতীকারহেতুরীষৎকরঃ। তথাধিদৈবিকস্যাপি দুঃখস্য মণিমন্ত্রৌষধাদ্য উপযোগঃ সুকরঃ প্রতীকারোপায় ইতি।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)


অর্থাৎ:


(আধ্যাত্মিক) শারীর দুঃখ নিবারণের জন্য শত শত সহজ উপায় আছে, যেমন বৈদ্যদের (অর্থাৎ আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের) দ্বারা উপদিষ্ট ভেষজাদি সেবন। (আধ্যাত্মিক) মানস দুঃখ নিবৃত্তির জন্য মনোজ্ঞ স্ত্রী (অথবা পুরুষ), পানীয়, সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি (অনেক) সহজলভ্য ভোগ্য বিষয় রয়েছে। এইরূপ আধিভৌতিক দুঃখ নিরাকরণের জন্য নীতিশাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বাস ইত্যাদি বিবিধ সহজ উপায় আছে। অনুরূপভাবে আধিদৈবিক দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সহজলভ্য মণি, মন্ত্র, ঔষধাদির ব্যবহাররূপ অনেক সহজ উপায় আছে।


দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্ট বা লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য হলেও দৃষ্ট উপায়ে দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব হয় না, অর্থাৎ সকল দুঃখের চিরনিবৃত্তি হয় না।


(২) দুঃখ নিবৃত্তির আনুশ্রবিক উপায় তথা বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ :


এটা মূলত মীমাংসকগণের দুঃখ নিবৃত্তির অনুসৃত উপায়। অনেক মুহূর্ত, প্রহর, দিন, রাত্রি, মাস এবং বৎসরাদি কাল যাবৎ অনুষ্ঠিতব্য বৈদিক জ্যোতিষ্ঠোমাদি কর্মকলাপ, তথা যাগযজ্ঞানুষ্ঠান দুঃখত্রয়কে নিবৃত্ত করতে সমর্থ। এর ফল স্বর্গলাভ। শ্র“তির ভাষ্য অনুযায়ী স্বর্গকামী ব্যক্তি যজ্ঞ করবেন। যে সুখ দুঃখের সঙ্গে মিশ্রিত নয়, যে সুখ পরে দুঃখের দ্বারা অভিভূত হয় না এবং যে সুখ ইচ্ছামাত্র উপস্থিত হয়, সেই সুখকে স্বর্গ বলে।


এই আনুশ্রবিক উপায়ের বিরোধিতা করে সাংখ্যাচার্য তথা বাচস্পতি মিশ্র বলেন–


‘আনুশ্রবিকোহপি কর্ম্মকলাপো দৃষ্টেন তূল্যো বর্ত্ততে ইতি। ঐকান্তিকাত্যন্তিকদুঃখত্রয়ঃ প্রতীকারানুপায়ত্বস্যোভয়ত্রাপি তুল্যত্বাৎ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)


অর্থাৎ : আনুশ্রবিক (তথা বেদবিহিত) যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ দৃষ্ট উপায়ের মতোই হয়ে থাকে। একান্ত ও অত্যন্তভাবে দুঃখের নিবৃত্তি করতে পারে না বলে দৃষ্ট ও আনুশ্রবিক উভয়েই সমান।


আনুশ্রবিক উপায়ে কেন দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না, তার কারণ হিসেবে সাংখ্যাচার্যরা বলেন আনুশ্রবিক উপায় অবিশুদ্ধ, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত। এটা অবিশুদ্ধ কেননা সোমাদি যাগে পশু–বীজাদি বধ করা হয়। এক্ষেত্রে ‘কোন জীবকে হিংসা করবে না’– এই সামান্য বা সাধারণ শাস্ত্রবাক্য ‘অগ্নিসোম যজ্ঞে বলি দেবে’– এই বিশেষ শাস্ত্রবাক্যের দ্বারা বাধিত হয়। যদিও এই হিংসা (সাধারণভাবে) পুরুষের পাপ জন্মালেও যজ্ঞের উপকার করে।


অন্যদিকে পঞ্চশিখাচার্য–এর মতে– ‘যাগাদিক্রিয়া স্বল্পসঙ্কর, সপরিহার ও সপ্রত্যবমর্ষ’।


জ্যোতিষ্টোমাদি যাগ থেকে উৎপন্ন প্রধান অপূর্বের সঙ্গে যজ্ঞে কৃত পশুহিংসা–জাত দুঃখের হেতু–রূপ অল্প পরিমাণ পাপের যোগ থাকে বলে তাকে স্বল্পসংকর বলে।


এই যজ্ঞে কৃত পশুহিংসা–জাত পাপ প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা কিছু পরিমাণে দূর করা যায় বলে তা সপরিহার।


আবার ভুল করে যদি যজ্ঞে কৃত পশুহিংসা জনিত পাপ নাশের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা না হয় তাহলে যজ্ঞের প্রধান কর্মফল স্বর্গ ভোগের সময় যজ্ঞে–কৃত পশুহিংসা জনিত পাপের ফল দুঃখ ভোগ হয়। তবু সেই পাপ থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয়, তাকে সহজেই সহ্য করা যায়। সহিষ্ণুতার সঙ্গে বর্তমান বলে আনুশ্রবিক উপায়ে সাধ্য সুখকে সপ্রত্যবমর্ষ বলে।


 .


এছাড়া যজ্ঞের ফল স্বর্গাদির ক্ষয় আছে– এটা লক্ষণার দ্বারা বোঝায়। যেহেতু স্বর্গ জন্য–পদার্থ অর্থাৎ যজ্ঞাদির ফলে স্বর্গ উৎপন্ন হয় বলে ভাবরূপ কার্য করে, সেহেতু অনুমিত হয় যে স্বর্গের ক্ষয় আছে।


আবার যজ্ঞের ফল স্বর্গাদির অতিশয় আছে– এটাও লক্ষণার দ্বারা বোঝায়। যেহেতু জ্যোতিষ্টোমাদি যাগ কেবল স্বর্গ লাভের উপায়, কিন্তু বাজপেয়াদি যাগ স্বর্গের আধিপত্য লাভের উপায়– তাই এদের মধ্যে অতিশয় আছে। কেননা পরের অধিক সম্পদ দেখে স্বল্প সম্পদের অধিকারী পুরুষ যেমন দুঃখ পায়, তেমনি স্বর্গাধিপতির অধিক সম্পদ দেখে সাধারণ স্বর্গবাসীরাও দুঃখ পায়, তা যুক্তিযুক্ত।


আনুশ্রবিক উপায় দৃষ্ট উপায়ের মতো সহজসাধ্য না হলেও বহু জন্ম যাবৎ অনুষ্ঠিতব্য কষ্টসাধ্য তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান থেকে সহজসাধ্য। সাংখ্যাচার্যদের মতে, শুধু কর্মের দ্বারা দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ সম্ভব নয়। যজ্ঞাদি ক্রিয়াকাণ্ড দ্বারা সাময়িকভাবে স্বর্গাদিসুখলাভ হতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা দুঃখের আত্যন্তিক নির্বত্তি হতে পারে না। সাংখ্যমতে স্বর্গাদিসুখভোগ জীবের পুনর্বন্ধন সূচিত করে, আত্যন্তিক নিবৃত্তি সূচিত করে না।


 

(৩) সাংখ্য শাস্ত্রবিহিত উপায়– তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান:


সাংখ্যমতে লৌকিক বা বৈদিক কোন প্রকার কর্মের দ্বারাই জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে না। জ্ঞানের দ্বারাই জীব দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি লাভ করতে পারে। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা পুরুষের স্বরূপ অনুধাবনের মাধ্যমেই দুঃখের হাত থেকে জীবের চিরনির্বত্তি লাভ হতে পারে। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর এই ভেদজ্ঞানই সাংখ্য দর্শনে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান বলে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ ‘সাংখ্যকারিকা’র দ্বিতীয় কারিকায় বলেন–


‘দৃষ্টবদানুশ্রবিকঃ স হ্যবিশুদ্ধিক্ষয়াতিশয়যুক্তঃ।


তদ্বিপরীতঃ শ্রেয়ান্ ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২)


অর্থাৎ : বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়েল মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান–ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।

ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ– এই ত্রিবিধ তত্ত্বের বিভেদ জ্ঞান হলে দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব হয়। দুঃখের ঐকান্তিক নিবৃত্তি হলো দুঃখের অবশ্য নিবৃত্তি এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হলো নিবৃত্ত দুঃখের পুনরায় উৎপত্তি না হওয়া। তবে তত্ত্বজ্ঞান অর্জন অনেক জন্মব্যাপী অভ্যাসপরম্পরা–রূপ আয়াসসাধ্য হওয়ায় তা অতি দুষ্কর।


ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ববেদ ২/১৩/৪

  ह्यश्मा॑न॒मा ति॒ष्ठाश्मा॑ भवतु ते त॒नूः। कृ॒ण्वन्तु॒ विश्वे॑ दे॒वा आयु॑ष्टे श॒रदः॑ श॒तम् ॥ ত্রহ্যশ্মানমা তিষ্ঠাশ্মা ভবতুতে তনূঃ। কৃণ্বন্তু...

Post Top Ad

ধন্যবাদ