গর্ভাধান (সংস্কৃত: गर्भाधान ) (অর্থ: জরায়ুতে শুক্র স্থাপন) হিন্দুধর্মের ষোড়শ সংস্কারের অংশ।
পরিহন্ত বি ধারয় যোনিং গর্ভায় ধাতবে।
মর্যাদে পুত্রমা ধেহি তং ত্বমা গময়াগমে।। -অথর্ববেদ ৬/৮১/২
পদার্থঃ- (পরিহন্ত) হে শক্তির আশ্রয়দাতা পুরুষ! (গর্ভায় ধাতবে) গর্ভের পুষ্টির জন্য (যোনিম্) স্ত্রী যোনিকে (বি ধারয়) বিশেষ রূপে রক্ষা কর, (মর্যাদে) হে মর্যাদাযুক্ত পত্নী! (পুত্রম্) গর্ভস্থ সন্তানকে (আ ধেহি) বিশ্বাস রূপে পুষ্ট কর (ত্বম্) তুমি (তম্) সেই সন্তানকে (আগমে) যোগ্য সময়ে (আ গময়) উৎপন্ন কর ।
বঙ্গানুবাদঃ- হে শক্তিধর পুরুষ! গর্ভের পুষ্টির জন্য স্ত্রী যোনিকে বিশেষরূপে রক্ষা কর। হে মর্যাদাময়ী পত্নী! গর্ভস্থ সন্তানকে বিশেষ ভাবে পুষ্ট কর। তুমি সেই সন্তানকে উপযুক্ত সময়ে প্রসব কর।
‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বগুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।।”
(ছান্দোঃ উপ০=অ০৭। খ ২৬।২।।)
=ইহা ছান্দোগ্যের বচন অর্থাৎ মদ্যমাংসাদি রহিত ঘৃত, দুগ্ধাদি এবং তণ্ডুল, গোধূম ইত্যাদি শুদ্ধাহার করিলে অন্তঃকরণের শুদ্ধি বুদ্ধি, বল, পুরুষকার ও আরোগ্য লাভ হয়। এইজন্য পূর্ণ যুবাবস্থায় বিবাহ করিবে। এইরূপ বিধি অনুসারে প্রেমপূর্বক গর্ভাধান করিলে সন্তান ও কুল উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করিবে।
শরীরের উন্নতি বা অবনতি সম্বন্ধে বৈদ্যক শাস্ত্রে যেরূপ বিধি,সেরূপ অন্য কোথাও নাই। কোন্ কোন্ বয়সে কোন্ কোন্ ধাতু কী কী প্রকারে কাঁচা বা পাকা হয়, বৃদ্ধি পায় বা ক্ষয় হয়-এসব বিষয় বৈদ্যক শাস্ত্রে লিখিত আছে। এজন্য গর্ভাধান সংস্কারাদি করিতে বৈদ্যক শাস্ত্রের আশ্রয় লওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এক্ষণে দেখুন-সমগ্র বিদ্বনমণ্ডলী যে বৈদ্যশ্রেষ্ঠ সুশ্রুতকারের প্রামাণিকতা স্বীকার করিয়া থাকেন, তিনি বিবাহ গর্ভাদানের কাল সম্বন্ধে লিখিতেছেন যে -
বিবাহোচিত কাল -
পঞ্চবিংশে ততো বর্ষে পুমান্নারী তু ষোড়শে।
সমত্বাগতবীয়ৌ তৌ জানীয়াৎ কুশলোভিষক্।।-সুশ্ৰুতে। সূত্রস্থানে। অধ্যায় ৩৫।১০।
=এই সময় কন্যার ন্যূনতম বয়স ১৬ (ষোল) বৎসর ও পুরুষের ন্যূনতম বয়স ২৫ (পঁচিশ) বৎসর অবশ্যই হইবে। ২৫ (পঁচিশ) বৎসর বয়সে পুরুষের শরীরে যেরূপ সামর্থ্য জন্মে, ১৬ (ষোল) বৎসর বয়সে কন্যার শরীরে সেইরূপ সামর্থ্য জন্মে। এই কারণে বৈদ্যগণ (আয়ুর্বেদজ্ঞমণ্ডলী) পূর্বোক্ত বয়সে উভয়কে সমবীর্য অর্থাৎ সম-সামর্থ্যবান্ বলিয়া জানেন।
ঊনষোড়শবর্ষায়ামপ্রাপ্তঃ পঞ্চবিংশতিম্। য়দ্যাধত্তে পুমান্ গর্ভং কুক্ষিস্থঃ স বিপদ্যতে।।
জাতো বা ন চিরং জীবেজ্জীবেদ্বা দুর্বলেন্দ্রিয়ঃ । তন্মাদত্যন্তবালায়াং গর্ভাধানং ন কারয়েৎ।।
সুশ্রুতে। সূত্রস্থানে। অ১০।৪৭ -৪৮
=২৫ (পঁচিশ) বৎসরের কম বয়সের পুরুষ যদি ১৬ (ষোল) বৎসরের কম বয়সের স্ত্রীতে গর্ভাধান করে, তবে গর্ভ উদরেই বিপন্ন হয়।।
সন্তান জন্মিলেও অধিক দিন জীবিত থাকে না। জীবিত থাকিলেও তাহার শরীর ও ইন্দ্রিয় অত্যন্ত দুর্বল হইয়া থাকে। সুতরাং অল্প বয়সের বালিকা অর্থাৎ ১৬ (ষোল) বৎসরের কম বয়সের স্ত্রীতে কখনও গর্ভাধান করিবে না।
সুশ্ৰুতে ইহাও লিখিত আছে-
চতস্রোৎবস্থাঃ শরীরস্য বৃদ্ধিয়ৌবনং সম্পূর্ণতা কিঞ্চিৎ পরিহানিশ্চেতি। আষোড়শাবৃদ্ধিরা চতুর্বিংশতেয়ৌবনমাচত্বারিং শতঃ সম্পূর্ণতা ততঃ কিঞ্চিৎ পরিহাণিশ্চেতি।। ·
অর্থ :-
ষোল বৎসরের পরে মনুষ্যের শরীরে সর্ব ধাতুর বৃদ্ধি, পঁচিশ বৎসর হইতে যুবাবস্থার আরম্ভ, চল্লিশ বৎসরে যুবাবস্থার পূর্ণতা অর্থাৎ সর্ব ধাতু পূর্ণভাবে পুষ্ট হয় এবং তাহার পরে ধাতুবীর্যের কিছু কিছু ক্ষয় হইতে থাকে । ৪০ (চল্লিশ) বৎসরে সব অবয়ব পূর্ণ হইয়া যায়। পরে পানাহারে যে ধাতুবীর্য উৎপন্ন হয়, তাহা কিছু কিছু ক্ষীণ হইতে থাকে। ইহা দ্বারা এই সিদ্ধ হয় যে, শীঘ্রই বিবাহ দিতে হইলে কন্যার বয়স অন্ততঃ ১৬ (ষোল) এবং পুরুষের বয়স অন্ততঃ ২৫ (পঁচিশ) বৎসর অবশ্যই হওয়া উচিত। কন্যার বয়স ২০ (কুড়ি) বৎসর পর্যন্ত এবং পুরুষের ৪০ (চল্লিশ) বৎসর পর্যন্ত-মধ্যম অবস্থা এবং কন্যার বয়স ২৪ (চব্বিশ) বৎসর পর্যন্ত এবং পুরুষের বয়স ৪৮ (আটচল্লিশ) বৎসর পর্যন্ত উত্তম অবস্থা। যাঁহারা দীর্ঘায়ু, সুশীল, বুদ্ধিমান, বলবান, পরাক্রমশালী, বিদ্বান্ সন্ততি লাভ করিয়া বংশের উন্নতি কামনা করেন, তাঁহারা যেন কখনও ১৬ (ষোল) বৎসরের পূর্বে কন্যার এবং ২৫ (পঁচিশ) বৎসরের পূর্বে পুত্রের বিবাহ না দেন। ইহাই সব সংস্কারের মধ্যে প্রকৃত সংস্কার, সব সৌভাগ্যের মধ্যে প্রকৃত সৌভাগ্য ও সব উন্নতির মধ্যে প্রকৃত উন্নতি বিধায়ক কর্ম। এই বয়সোচিত ব্রহ্মচর্য পালন দ্বারা আপন পুত্রকন্যাগণের বিদ্যা ও সুশিক্ষা দানের ব্যবস্থা করিবে, ইহাতে সুসন্তান লাভ হইবে।
ঋতুদান কাল:
ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরতস্সদা।
পর্ব বর্জং ব্ৰজেচ্চৈনাং তদ্ ব্রতো রতিকাম্যয়া।।১।
ঋতুঃ স্বাভাবিকঃ স্ত্রীণাং রাত্রয়ঃ ষোড়শ স্মৃতাঃ ।
চতুর্ভিরিতরৈঃ সার্দ্ধমহোভিঃ সৰিগর্হিতৈঃ।।২।
তাসামাদ্যাশ্চতস্রস্ত নিন্দিতৈকাদশী চ য়া।
ত্রয়োদশী চ শেষাস্ত প্রশস্তা দশ রাত্রয়ঃ।।৩।
যুগ্মাসু পুত্রা জায়ন্তে স্ত্রিয়োऽয়ুগ্মাসু রাত্রিষু।
তস্মাদ্যুগ্মাসু পুত্রার্থী সংবিশেদার্ভবে স্ত্রিয়ম্।।৪।
পুমান্ পুংসোৎধিকে শুক্রে স্ত্রী ভবত্যধিকে স্ত্রিয়াঃ।
সমে পুমান্ পুংস্রিয়ৌ বা ক্ষীণেল্পে চ বিপর্যয়ঃ।।৫।
নিন্দ্যাস্বষ্টাসু চান্যাসু স্ত্রিয়ো রাত্রিষু বৰ্জয়ন্ ।
ব্রহ্মচায়ের ভবতি যত্র তত্রাশ্রমে বসন্।।৬।
(মনুস্মৃতি অ৩। শ্লোক ৪৫-৫০।।)
অর্থ :- মনু আদি মহর্ষিগণ ঋতুদানের সময় এইভাবে নির্ধারণ করিয়াছেন –
পুরুষ ঋতুকালেই স্ত্রী সমাগম করিবে এবং আপন স্ত্রী ব্যতীত পরস্ত্রী সর্বদা পরিত্যাগ করিবে। সেইরূপ স্ত্রীও নিজের বিবাহিত স্বামী ব্যতীত পরপুরুষ হইতে সর্বদাই পৃথক্ থাকিবে। যেরূপ পতিব্রতা স্ত্রী স্বীয় বিবাহিত স্বামী ব্যতীত কখনও পরপুরুষের সঙ্গ করিবে না, সেইরূপ স্ত্রী ব্রত পুরুষও স্বীয় বিবাহিত স্ত্রীতেই প্রসন্ন থাকিবে। ঋতুদানের সময় পুরুষ পর্ব অর্থাৎ ১৬ (ষোল) দিনের মধ্যে যদি পুর্ণিমা, অমাবস্যা, চতুর্দশী বা অষ্টমী পড়ে, তাহা হইলে ঐ তিথিগুলি পরিত্যাগ করিবে। এইসব তিথিতে স্ত্রী পুরুষ কখনও রতিক্রিয়া করিবে না। ১।
নারীর স্বাভাবিক ঋতুকাল ১৬ (মোল) রাত্রি অর্থাৎ রজোদর্শনের দিন হইতে পরবর্তী ১৬ (ষোল) দিন পর্যন্ত ঋতুর সময়। ইহার মধ্যে প্রথম চারি রাত্রি অর্থাৎ যেদিন রজস্বলা হইবে, সেই দিন হইতে চারি দিন নিন্দিত অর্থাৎ নিষিদ্ধ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ রাত্রিতে পুরুষ স্ত্রীকে কখনও স্পর্শ করিবে না এবং স্ত্রীও পুরুষের সংস্পর্শে আসিবে না। রজস্বলা স্ত্রীর ছোঁওয়া জলও পান করিবে না। রজস্বলা স্ত্রী কোন কাজকর্মও করিবে না, কেবল নির্জনে বসিয়া থাকিবে। এই চারি রাত্রিতে সমাগম করা নিরর্থক ও মহারোগোৎপাদক। যেমন ফোঁড়া হইতে পুঁজ বা রক্ত বাহির হয়, স্ত্রীর শরীর হইতে সেইরূপ রজঃ অর্থাৎ এক প্রকার বিকৃত ঊষ্ণ রক্ত নির্গত হইতে থাকে।।২।।
ঋতুদান সম্বন্ধে যেরূপ প্রথম চারি রাত্রি নিন্দিত অর্থাৎ নিষিদ্ধ, সেইরূপ একাদশ এবং ত্রয়োদশ রাত্রিও নিন্দিত অর্থাৎ নিষিদ্ধ। অবশিষ্ট রহিল দশ রাত্রি, এগুলি ঋতুদানের পক্ষে প্রশস্ত।।৩।।
পুত্রকামী ব্যক্তি ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ, চতুর্দশ ও ষোড়শ- এই ছয় রাত্রি ঋতুদানের পক্ষে উৎকৃষ্ট বলিয়া জানিবে, পরন্ত উল্লিখিত রাত্রিগুলি উত্তরোত্তর অর্থাৎ ৬ অপেক্ষা ৮.৮ অপেক্ষা ১০, ১০ অপেক্ষা ১২ ইত্যাদি ক্রমে শ্রেষ্ঠ। কন্যা লাভ করিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি পঞ্চম, সপ্তম, নবম ও পঞ্চদশ—এই চারি রাত্রি উৎকৃষ্ট বলিয়া জানিবে। পুত্রার্থী যুগ্ম রাত্রিতে ঋতুদান করিবে।।৪।।
পুরুষের বীর্য অধিক হইলে পুত্র, স্ত্রীর রজঃ অধিক হইলে কন্যা এবং রজোবীর্য সমান হইলে নপুংসক পুরুষ বা বন্ধ্যা স্ত্রী জন্মে। পুরুষের বীর্য অল্প বা ক্ষীণ হইলেও গর্ভপাত হইবে।।৫।।
পূর্বনিষিদ্ধ যে ৮ (আট) রাত্রির কথা বলা হইয়াছে, যে ব্যক্তি ঐ নিষিদ্ধ ৮ (আট) রাত্রি স্ত্রীসঙ্গ পরিত্যাগ করে, সে গৃহাশ্রমে থাকিয়াও ব্রহ্মচারী নামে অভিহিত হয়।।৬৷৷
মাতৃমান্ পিতৃমানাচার্য্যবান্ পুরুষো বেদ'৷'
(শতপথ ব্রাহ্মণ তথা ছাউ০৬ (১৪)
ইহা শতপথ ব্রাহ্মণের বচন। বস্তুতঃ তিন উত্তম শিক্ষক অর্থাৎ প্রথমে মাতা, দ্বিতীয় পিতা এবং তৃতীয় আচার্য্য লাভ করিয়াই মানুষ জ্ঞানবান হয়।
যে সন্তানের মাতা ও পিতা ধার্মিক ও বিদ্বান, তাহার কুল ধন্য। সে সন্তান ভাগ্যবান। সন্তান মাতার নিকট হইতে যেরূপ উপদেশ ও উপকার লাভ করে অন্য কাহারও নিকট সেইরূপ লাভ করে না। মাতা সন্তানকে যেমন স্নেহ করেন ও তাহার হিত কামনা করেন, সেইরূপ অন্য কেহই করে না।
এই কারণে (মাতৃমান) অর্থাৎ ‘প্রশস্তা ধার্মিকী বিদূষী মাতা বিদ্যতে য়স্য স মাতৃমান্' বলা হইয়াছে।
যে মাতা গৰ্ভাধান হইতে সন্তানদের সম্পূর্ণ বিদ্যালাভ না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে সুশীলতার শিক্ষা দিয়া থাকেন, তিনি ধন্য।
মাতা এবং পিতার পক্ষে গর্ভাধানের পূর্বে, তৎকালে এবং তদন্তর মাদক দ্রব্য, মদ্য, দুর্গন্ধযুক্ত, রুক্ষ ও বুদ্ধিনাশক দ্রব্য পরিত্যাগ করিয়া, যাহাতে শান্তি, আরোগ্য, বল, বুদ্ধি, পরাক্রম এবং সুশীলতার দ্বারা সভ্যতা প্রাপ্ত হওয়া যায় এইরূপ ঘৃত, দুগ্ধ, মিষ্ট অন্নপানাদি উৎকৃষ্ট পদার্থ সেবন করিবে, যাহাতে রজোবীর্য দোষ রহিত হইয়া অত্যুত্তম গুণ লাভে সমর্থ হয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ