বস্ত্ররাশির আবির্ভাবের ঘটনাটিকে লোক রঞ্জক কাহিনীতে পরিণত করতে ও শ্রীকৃষ্ণজীকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বানাতে পরে কল্পিত ও যোজিত হয়েছে। প্রমাণ সাইজের মহাভারতে ৬৮/৪১-৪৬ শ্লোকে আছে যে পরিধেয় বস্ত্র আকর্ষণ করলে দ্রৌপদী শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন, কৃষ্ণ জী অদৃশ্যভাবে এসে বস্ত্র অন্তহীন করে দিলেন। কিন্তু ধর্মের প্রভাবে বস্ত্র অন্তহীন হল, দুঃশাসন টেনে টেনে শেষ করতে না পেরে বসে পরল..ইত্যাদি
মহাভারত সভাপর্বের ৬৭.. ৭২ অধ্যায় বিচার বুদ্ধি জাগ্রত রেখে পাঠ করলে মনে হয় যে শ্রীকৃষ্ণ জীর দ্বারা বস্ত্ররাশির আবির্ভাবের কথা মূল কাহিনীর অংশ নয়, পরে যোজিত। প্রতিকামী যখন দুর্যোধনের আদেশে দ্রৌপদীকে সভায় আনতে গেল, তখন দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করে এসে জানাতে বললেন যে যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজেকে পণ করেছিলেন না প্রথমে দ্রৌপদীকে পণ করেছিলেন। জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য এই যে যুধিষ্ঠিব যদি প্রথমে নিজেকে পণ বেখে হেরে গিয়ে দাস হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর দ্রৌপদীকে পণ রাখবার অধিকার নাই। প্রতিকামী প্রশ্ন জানালে দুর্যোধন বললেন, দ্রৌপদী সভায় এসে নিজেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করুন। প্রতিকামী ফিরে গিয়ে দ্রৌপদীকে সে কথা জানালে দ্রৌপদী বললেন, পৃথিবীতে ধর্মপালন সর্বদা শ্রেষ্ঠ, কৌরবগণ যেন অধর্মাচরণ না করেন, তুমি গিয়ে সভাসদগণকে জিজ্ঞাসা কর, ধর্মতঃ আমার কি করা উচিত। প্রতিকামী সভায় এসে সেই প্রশ্ন জানালে সভাসদগণ কোন উত্তর দিতে সাহস করল না। দুর্যোধন পুনরায় প্রতিকামীকে বললেন, দ্রৌপদী সভায় এসে নিজে প্রশ্ন করুন। প্রতিকামী ইতস্ততঃ করলে দুর্যোধন দুঃশাসনকে বললেন, তুমি গিয়ে দ্রৌপদীকে সভায় আন।
দুঃশাসনকে দেখে দ্রৌপদী কুরুবৃদ্ধাদের কাছে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করলেন, ইতিমধ্যে দুঃশাসন তাঁকে কেশ ধরে সভায় টেনে নিয়ে গেল। দ্রৌপদী দুঃশাসনকে তিরস্কার করলেন, ভীষ্মাদি কুরুবৃদ্ধদিগকে কুলবধূর অপমান উপেক্ষা করা হেতু গঞ্জনা দিলেন, এবং যুধিষ্টিরাদির প্রতি রোষকষারিত নেত্রে তাকালেন। ইতিমধ্যে দুঃশাসন তাকে দাসী বলে উপহাস করল, কর্ণ ও শকুনি দুঃশাসনের উক্তি সমর্থন করলো। ভীষ্ম বললেন, দ্রৌপদী ধর্মতঃ জিতা কি অজিতা সেটি অতি সূক্ষ্ম প্রশ্ন, উত্তর দেওয়া কঠিন।
টানাটানিতে দ্রৌপদীর উত্তরাঙ্গ হতে বস্ত্র খসে পড়েছিল। তাকে সেই অবস্থায় দেখে ভীম বলে উঠলেন, আমি মনে করি যে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রেখে অধর্ম করেছেন, যে হাত দিয়ে তিনি দ্রৌপদীকে পণ করেছেন, সেই -হাত আমি জ্বালিয়ে দেব,
সহদেব, আগুন নিয়ে এস। অর্জুন ভীমকে শান্ত করলেন। বিকর্ণ বললেন, আমি মনে করি যে দ্রৌপদী ধৰ্মত জিতা হন নাই। কর্ণ তাকে তিরস্কার করে বললেন, দুঃশাসন, তুমি পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীর বস্ত্র কেডে নাও। পাণ্ডবগণ নিজেদের বস্ত্র ও উত্তরীয় ছেড়ে দিলেন।
দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে আকর্ষণ করতে আরম্ভ করলো। সেই সময় কৃষ্ণজীর প্রভাবে যদি বস্ত্র অন্তহীন হয়ে দ্রৌপদীর মান রক্ষা করে থাকে ও দুঃশাসন বন্ধ টানতে টাতে শেষ করতে না পেরে বসে পড়ে থাকে, তাহলে সভাসদগণ দ্রৌপদীর জয়ধ্বনি করবে, দুঃশাসনাদিকে নিন্দা করবে, নির্ভয়ে মতামত ব্যক্ত করবে এই আশা করা যায় এবং ব্যাপার জেনে ধৃতরাষ্ট্র তখনই দ্রৌপদীকে বরদান করে পাণ্ডবদের দাসত্ব মুক্ত করবেন তাই স্বাভাবিক হ’ত।
কিন্তু যদিও ৬৮, ৬৯ শ্লোকে আছে যে অদ্ভুত ব্যাপার দেখে উপস্থিত রাজগণ দ্রৌপদীর প্রশংসা ও দুঃশাসনের নিন্দা করলেন, কিন্তু তা অত্যন্ত ক্ষীণভাবে বলা, তার স্বাভাবিক পরিণত্তির উল্লেখ নাই। আছে যে ভীম প্রতিজ্ঞা করলেন যে দুঃশাসনের বক্ষশোণিত পান করবে, এবং বিদুর জী বললেন যে দ্রৌপদী প্রশ্ন তুলে অনাথার মত ক্রন্দন করছে, তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া বর্তব্য, সেই সঙ্গে সুধন্বা-বিরোচন উপাখ্যান শোনালেন, যার প্রতিপাদ্য নীতি হল যে নিজের বা পুত্রের জীবনসংশয় হলেও প্রশ্নের সত্য উত্তর দেওয়া কর্তব্য। কিন্তু সভাসদগণ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল -না, কর্ণ দুঃশানকে বললেন, দাসী দ্রৌপদীকে সভা হতে নিয়ে যাও, দুঃশাসন -আবার দ্রৌপদীকে টান দিল, দ্রৌপদী তাকে থামতে বলে মাটিতে পড়ে আবার -প্রশ্ন করলেন, তিনি ধর্মতঃ জিতা কি অজিতা। ভীষ্ম আবার বললেন যে প্রশ্নটিতে ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব জড়িত, সহসা উত্তর দেওয়া যায় না। তারপর -দুর্যোধন, ভীম, কর্ণ কিছু কিছু কথা বললেন, দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ভীম “অর্জুন নকুল সহদেব তোমার আদেশের প্রতীক্ষা করছে, তুমি বল দ্রৌপদী ধৰ্মতঃ জিতা কি অজিতা। এই বলে তিনি নিজ উরু থেকে কাপড় সবিয়ে দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে নিজের উরু দেখালেন। ভীম তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে যুদ্ধে দুর্বোধনের উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করলেন।
বিদুর বললেন, এবার কুরুবংশের অমঙ্গলের সূচনা হল। দুর্যোধন আবার বললেন, ভীম অর্জুন নকুল সহদেব এরা বলুক যে যুধিষ্টির তাদের প্রভু নহেন, তাহলে দ্রৌপদী মুক্তি পাবে। অর্জুন বললেন, দ্যুতকালে প্রথমে যুধিষ্টির আমাদের প্রভু ছিলেন, কিন্তু নিজে জিত হয়ে ইনি আর কার প্রভু থাকতে পারেন !!?
তখন নানা অমঙ্গল চিহ্ন প্রকাশ পেল, বিদুর ও যুধিষ্ঠির অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সে কথা জানালে ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে বর দিয়ে পাণ্ডবদের দাসত্বমুক্ত করলেন ও রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। এই বিববণের মধ্যে এই অসঙ্গতি আছে যে অলৌকিক ভাবে বস্ত্ররাশির আবির্ভাব হলে তখন সভাসদগণ মৃদুস্বরে দ্রৌপদীর প্রশংসা ও দুঃশাসনের নিন্দা করবেন না, অলৌকিক ব্যাপার দেখে সভা উত্তেজনায় ফেটে পড়বে, দ্রৌপদীর ও ধর্মের জয় এত উচ্চস্বরে ঘোষিত হবে যে তখন দ্রৌপদী জিতা বা অজিতা সে প্রশ্ন অবাস্তব হয়ে যাবে, বিদুর সভাসদদের নিকট একটি উপাখ্যান বলে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বলবেন না। এবং কর্ণও তখন বলবেন না যে দাসীকে অন্যত্র নিয়ে যাও। দ্রৌপদীও আবার মাটিতে পড়ে বলবেন না, তিনি ধর্মতঃ জিতা বা অজিতা তা সভাসদগণ বলুন। ভীষের দুঃশাসনের বক্ষের শোণিত পানের প্রতিজ্ঞা এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব নয় — অনুদ্যুত পর্বে আছে যে পাণ্ডবগণ শেষ পণে হেরে যখন বনবাসে চলেছেন, তখন দুঃশাসন পান্ডবদের গরু গরু বলে নেচে নেচে উপহাস করছিল, তখন ভীম দুঃশাসনের বক্ষশোণিত পানের প্রতিজ্ঞা করেন, সেখানেই সে প্রতিজ্ঞা সমীচীন; একটি প্রতিজ্ঞা দুর করার কোন কারণ নাই।
সুসঙ্গত আখ্যান পাওয়া যায় ৬৮ অধ্যায়ের ৪০ শ্লোকের পরেই ৬৯ অধ্যায় পাঠ করলে দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র টানতে আরম্ভ করলে দ্রৌপদী বললেন, থাম দুর্বৃত্ত, আমি আগে কুরুবৃদ্ধদের অভিবাদন করে আমার প্রশ্নের উত্তর জেনে নিই। অর্থাৎ ৬৮ / ৪০-৯০ শ্লোক সম্পূর্ণ বাদ দিলে তাহলেই ৬৯-৭১ অধ্যায়ের বিবৃতি স্বাভাবিক হয়। দ্রৌপদী যোগিরাজ কৃষ্ণের কাছে সখিত্বের মর্যাদা পেয়েছিলেন, ধর্মের পথেও চিরকাল চলে ধর্মের প্রসাদ লাভ করেছেন, বিন্ব দ্যূতসভায় তিনি নিজের বুদ্ধিতে, নিজের স্থৈর্ষপ্রভাবে— তিনি ধর্মতঃ জিতা কিনা সেই প্রশ্ন তুলে এবং বস্ত্র টান পড়লে ভূমিশষ্যা গ্রহণ করে—নিজেকে বস্ত্রহরণের অসন্মান থেকে রক্ষা করেছিলেন..
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ