প্রায় কয়েক বছর ধরে ফেসবুক আদি নানান সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বাণী খুবই প্রচার হতে দেখি মহাভারতের শ্লোক হিসেবে যে, অহিংসা পরমো ধর্মঃ ধর্ম হিংসা তথৈব চ অর্থাৎ অহিংসা পরম ধর্ম কিন্তু ধর্ম রক্ষার্থে হিংসা করাও ধর্ম। তারা এটাও বলে থাকে যে গান্ধী শুধু শিখিয়েছে অহিংসা পরম ধর্ম কিন্তু পরের বাক্যটা তিনি প্রকাশ করেনি।
যে সকল সনাতনী বন্ধুরা এই বাণীটি মহাভারতের শ্লোক হিসেবে প্রচার করে থাকে তাদের জেনে রাখা উচিত যে এই শ্লোক মহাভারতে কোথাও নেই অর্থাৎ যারা এই অহিংসা পরমো ধর্মঃ ধর্ম হিংসা তথৈব চ শ্লোকটি মহাভারতের বলে থাকে তারা না জেনে মিথ্যাচার করে মাত্র। এই শ্লোকটি পুরো একসাথে নয় পুরো মহাভারতের সার বলা যেতে পারে ,বনপর্ব ১৯৮,২০৭ ও শান্তি পর্ব গীতা ৬:৪০ দেখুন। ধর্মের জন্য হিংসা করা সঠিক কি বেঠিক এই বিষয়ে শেষে আলোচনা করা হবে। আসুন এখন দেখে নেওয়া যাক অহিংসা পরম ধর্ম বিষয়ে মহাভারত থেকে কিছু শ্লোক__
অহিংসা পরমো ধর্ম স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ।
সত্যে কত্বা প্রতিষ্ঠাং তু প্রবর্তন্তে প্রবৃত্তয়ঃ।।৭৪।।
অহিংসা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং যা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সত্য আচরণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ সকল কার্য আরম্ভ করেন।
[মহাভারত, বনপর্ব/ অধ্যায়- ২০৭/ ৭৪। গীতাপ্রেস]
অহিংসা সর্বভূতেভ্যঃ সংবিভাগশ্চ ভাগশঃ।
দমস্ত্যাগো ধৃতিঃ সত্যং ভবত্যবভৃথায় তে।।১৮।।
সমস্ত প্রাণীর প্রতি অহিংসা ভাব রাখা, সকলে যথাযোগ্য ভাগ অর্পণ করা, ইন্দ্রিয় সংযম, ত্যাগ, ধৈর্য এবং সত্য এই সকল গুণ অবভৃত স্নানের তুল্য ফলদানকারী।।
[মহাভারত, অনুশাসনপর্ব/ অধ্যায়- ৬০/ ১৮। গীতাপ্রেস]
অহিংসা পরমো ধর্মস্তথাহিংসা পরং তপঃ।
অহিংসা পরমং সত্যং য়তো ধর্ম প্রবর্ততে।।২৩।।
অহিংসা পরম ধর্ম, অহিংসা পরম তপ এবং অহিংসা পরম সত্য, কেননা এর মাধ্যমে ধর্মের প্রবৃত্তি হয়ে থাকে।।
[মহাভারত, অনুশাসনপর্ব/ অধ্যায়-১১৫/ ২৩। গীতাপ্রেস]
এখন অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে ধর্ম রক্ষার্থে হিংসা করা কি ঠিক ? উত্তর হবে না। ধর্ম রক্ষা করাকে হিংসা বলা উচিত নয়, আমরা সনাতনীরা প্রায় সকলেই জানি যে পরম পিতা পরমাত্মাকে ন্যায়কারী বলা হয়ে থাকে। তিনি ধর্মাত্মাদের সুফল দান করেন এবং দুষ্টদের দণ্ড দেন যা ঈশ্বরের ন্যায় ব্যবস্থা। তিনি দুষ্টদের দমন করেন বলে ঈশ্বর কি হিংসা করে ? আদালতে জর্জ যখন দুষ্টদের শাস্তি দেন তখন তিনি ন্যায়কারী হন নাকি হিংসাকারী হন ? অবশ্যই ন্যায়কারী, তাই এখানে ন্যায় আর হিংসা কে এক করা উচিত নয়।
ঋষি পতঞ্জলি যোগ দর্শন লিখেছেন, যোগের অষ্টাঙ্গের মধ্যে একটি হল য়ম্। য়ম্ কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার মধ্যে একটি হল অহিংসা। ঋষি ব্যাসদেব যোগদর্শনের টীকায় অহিংসা পরিভাষায় যা লিখেছেন তার অর্থ হিসেবে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন- সর্ব সময়ে শরীর বচন মন দ্বারা সর্বপ্রকারে সকল প্রাণীর সাথে বৈরভাব ত্যাগ করে প্রীতিপূর্বক ব্যবহার করাই হল অহিংসা। অহিংসার পরিভাষা এমন কোথাও লেখা নাই যে, কেউ অন্যায় করলে তা চুপচাপ সহ্য করতে হবে। অধার্মিকের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে হিংসা বলেনা বরং ন্যায় ব্যবস্থা বলে, ঋষি মনু বলেছেন-, ধর্ম এব হতো হন্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধর্ম কে নাশ করে, ধর্ম তাকেই বিনাশ করে [মনুস্মৃতি ৮/১৫] ধর্ম কে রক্ষা করার জন্য হিংসা নয় বরং ধর্ম কে পালন করতে হবে।
ঋষি মনু ধর্মের দশটি লক্ষণ বলেছেন তার মধ্যে যার মধ্যে একটি হলো সত্য অর্থাৎ একজন ধার্মিক হতে গেলে সত্য কে ধারণ করতেই হবে মন বাণী কর্ম দ্বারা। উদারহণ স্বরূপ- একজন সৎ ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে কিছু নিকৃষ্ট ব্যক্তি খুন করার জন্য ধাওয়া করেছে। সেই ধর্মাত্মা ব্যক্তিটি আপনার কাছে এসে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। আপনি সেই ব্যক্তিকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন। তারপর সেই নিকৃষ্ট ব্যক্তি গুলো আপনার কাছে এসে বললো আপনি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন কিনা ? তখন আপনি কি করবেন ? ধর্মের লক্ষণ তো সত্য কে ধারণ করা, তাহলে আপনি কি বলবেন সেই ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে আপনি নিজের বাড়িতে রেখেছেন ? আপনি যদি সত্যিই ধর্ম অনুকূল আচরণকারী হন তাহলে আপনি তাদেরকে অবশ্যই মিথ্যা কথা বলবেন, যাতে সেই ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সত্য বলা যেমন ধর্ম ঠিক তেমনি মিথ্যা বলাও ধর্ম। আপনি ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য যে মিথ্যা কথা বললেন সেটা মিথ্যা নয় বরং ন্যায় কার্য। ভারতের কথিত জাতির পিতা গান্ধী অহিংসা বিষয়ে কাকে কি শিখিয়ে গেছেন তার উপর ধর্ম শাস্ত্র নির্ভর করে না, তিনি কোনো ঋষি নন আর না কোনো ধর্মাত্মা। অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞ লোকের কথিত ধর্ম জ্ঞান আদি দ্বারা ধর্ম কে জানা সম্ভব নয়। ঋষি মনু বলেছেন তর্ক দ্বারা অনুসন্ধান করা ব্যক্তিরাই ধর্মের তত্ত্বকে জানতে পারেন, ইতর নয়। ঋষি য়াস্ক তর্ক কে ঋষি বলেছেন, অতএব বলা যায় যে ধর্মের লক্ষণ সমূহকে ধারণ করে তার্কিক, যুক্তিবাদী হলে আপনি ধর্ম কে জানতে সক্ষম হবেন অন্যথা নয়।
🙏বিক্রম বর্মন
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ