গীতা ১০/২১ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

14 August, 2022

গীতা ১০/২১ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ


গীতা ১০/২১ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ
গীতার ১০/২১ শ্লোকটি নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন। তার মধ্যে মূল দুটি বিষয়ে লিখার চেষ্টা করবো, প্রথমে শ্লোকার্থ দেখে নিই-
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্ৰাণামহং শশী ৷৷-গীতা১০।২১৷৷
পদপাঠ : আদিত্যানাম্ । অহম্ । বিষ্ণুঃ । জ্যোতিষাম্ । রবিঃ । অংশুমান্ । মরীচিঃ । মরুতাম্ । অস্মি । নক্ষত্রাণাম্ । অহম্ । শশী ৷৷
পদার্থ : (আদিত্যানাম্) দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে (অহম্ বিষ্ণুঃ) আমি বিষ্ণু (জ্যোতিষাম্ রবিঃ) জ্যোতিষ্মান পদার্থের মধ্যে কিরণমালী সূর্য (মরুতাম্) বায়ুর মধ্যে (মরীচিঃ) মরীচি নামক বায়ু (নক্ষত্রাণাম্) নক্ষত্রের মধ্যে (অহম্ শশী) আমি চন্দ্রমা ৷৷
সরলার্থ : দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্মান পদার্থের মধ্যে কিরণমালী সূর্য, বায়ুর মধ্যে মরীচি নামক বায়ু নক্ষত্রের মধ্যে আমি চন্দ্রমা ৷৷ [৪৯ প্রকার বায়ুর মধ্যে মরীচি নামক বায়ুকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে "মরীচয়ো বিস্ফুলিঙ্গাঃ" ১/৪৫]
১. বৃহদারণ্যক-৩/৯/২ শ্লোকে দ্বাদশ আদিত্য দেবের উল্লেখ রয়েছে ৩/৯/৫ শ্লোকেই বলা হয়েছে সংবৎসরের ১২ মাস'ই সেই দ্বাদশ আদিত্য। এর মধ্যে বিষ্ণু নাম তো নেই তাহলে শ্রীকৃষ্ণ আদিত্যের মধ্যে বিষ্ণু বললেন কেন?
সমাধান : বৈদিক ভাষায় কিংবা সংস্কৃত ভাষায় আদিত্য বলতে কেবল মাস বুঝায়না। আদিত্য বলতে সূর্য্যকেও বুঝায় "সূর্যমাদিতেয়ম্ (ঋগ্বেদ-১০/৮৮/১১)অর্থাৎ সূর্য্যই আদিত্য"।
মহাভারতে অদিতির পুত্র দ্বাদশ আদিত্যেরও উল্লেখ রয়েছে "অদিত্যাং দ্বাদশাদিত্যাঃ সম্ভূতা" (ম০ আদি০ ৬৫/১৪) সেই দ্বাদশ আদিত্য হলো -
ধাতা মিত্রোর্যমা শক্রো বরুণস্ত্বংশ এব চ।
ভগো বিবস্বান পূষা চ সবিতা দশামস্তথা॥
একাদশস্তথা ত্বষ্টা দ্বাদশো বিষ্ণুরুচ্যতে।
জঘন্যজস্তু সর্বেষামাদিত্যানাং গুণাধিকঃ॥
(মহাভারত, আদিপর্ব-৬৫/১৫-১৬)
অনুবাদ : ধাতা, মিত্র, অর্যমা, ইন্দ্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান্, পূষা, দশম সবিতা, একাদশ নং ত্বষ্টা এবং দ্বাদশ নং বিষ্ণু বলা হয়। দি সকল আদিত্যের মধ্যে বিষ্ণু কনিষ্ঠ ; কিন্তু গুণ দ্বারা সব হইতে উত্তম।
গীতা-১০/৩৫ শ্লোকেই মাস বিভূতি বলা হয়েছে- "মাসানাং মার্গশীর্ষোऽহং" এবং উক্ত-১০/২১ শ্লোকেই সূর্য্যের উল্লেখ করা হয়েছে "জ্যোতিষাম্ রবিঃ" তাই এক্ষেত্রে আদিত্য শব্দ দ্বারা দ্বাদশ আদিত্য কিংবা সূর্য্য বুঝায়নি বরং অন্য কোন অর্থেই বলা হয়েছে বুঝা যায়। অন্য অর্থ হলো - অদিতির পুত্রগণের মধ্যে উত্তম গুণে গুণান্বিত "বিষ্ণু"। বিভিন্ন ভাষ্যকারের মত এই "বিষ্ণুর" কথনই বলা হয়েছে। "বিভূতির" ব্যাখ্যানুসারেও এটির গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
২. নক্ষত্র তো তাকেই বলা হয় যার নিজস্ব আলো আছে। আমরা জানি চন্দ্রমার নিজস্ব আলো নেই, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ নক্ষত্রের মধ্যে আমি চন্দ্রমা বললেন কেন?
সমাধান : বিভিন্ন আধুনিক ভাষা দ্বারা বৈদিক ভাষা কিংবা সংস্কৃত ভাষার ঠিক ভুল বিচার করা একপ্রকার মূঢ়তা। যেরূপ আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে 'অণু' বিভাজ্য কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় [মহাভারত, অনুশাসনপর্ব,১৪৫ অধ্যায় (গীতাপ্রেস. পৃষ্ঠা- ৬০১৪)] অবিভাজ্য মূল প্রকৃতিতে অণু বলা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় 'অণু' শব্দ দ্বারা কেবল মূল প্রকৃতিই বুঝায় না ক্ষেত্রবিশেষে অণু বিভাজ্য পদার্থকেও বুঝায়। যেমন "গৌ" শব্দ দ্বারা সূর্যও বুঝায় আবার রশ্মিও বুঝায় (নিরুক্ত-২/৬), ক্ষেত্র বিশেষে নির্দিষ্ট অর্থ গ্রহণ করা হয়। সেরূপ নক্ষত্র শব্দ দ্বারাও বিবিধার্থ নক্ষত্র বুঝায়। যেমন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা হয়েছে -
"তানি বা এতানি সপ্তবিংশতিঃ নক্ষত্রাণি"
(শতপথব্রাহ্মণ-১০/৫/৪/৫)
অর্থাৎ এখানে ২৭টি নক্ষত্রের কথা বলা হয়েছে, যা কিনা চন্দ্রপথের বিভাগ। নামগুলো হলো-
অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্য, আশ্লেষা, মঘা,পূর্বাফল্গুনী, উত্তর ফল্গুনী, হস্ত, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা,পূর্ব ভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ, রেবতী এই হলো ২৭ নক্ষত্র 'অভিজিত্' নামেও ২৮ নং নক্ষত্র মানা হয়ে থাকে। (অথর্ববেদ-১৯ কাণ্ডের নক্ষত্র সূক্তে (৭) এই নামগুলো পাওয়া যায়) উক্ত পথপরিক্রমা করে বিধায় 'চন্দ্রমাকে লৌকিক ভাষায় নক্ষত্রেস বা নক্ষত্রস্বামীও বলা হয়ে থাকে'। (বৈদিক বিজ্ঞান, পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্মা কাব্যতীর্থ) অনেক উপনক্ষত্রাদির উল্লেখও পাওয়া যায় ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদিতে।
নক্ষত্র বিষয়ে - 'শ্রী মহাত্মা নারায়ণ স্বামী' তৈত্তিরীয় উপনিষদ-প্রথমবল্লী শিক্ষাধ্যায়ের তৃতীয় অনুবাকের ব্যাখ্যায় লিখেছন-
"সমষ্টিরূপে জগত্ দুইভাগে বিভক্ত। একপ্রকার নক্ষত্র স্বয়ং প্রকাশময় নয় কিন্তু অন্য হইতে প্রকাশ (আলো) গ্রহণ করে থাকে। এরূপ সকল নক্ষত্রের এক নাম পৃথিবী। অন্য আরেক প্রকার নক্ষত্র স্বয়ংপ্রকাশক, এই সকল নক্ষত্রের এক সমষ্টি নাম দ্যো"।
ঋষি দয়ানন্দও বেদ ভাষ্যে সূর্য এবং চন্দ্র উভয়কেই নক্ষত্র বলেছেন - ঋক্ষাঃ = সূর্যচন্দ্রনক্ষত্রাদিলোকাঃ [ঋক্ষাস্ত্রিভিরিতি নক্ষত্রাণাম্ (নিরুক্ত-৩/২০)] ঋগ্বেদ-১/২৪/১০
চন্দ্রমা সূর্য্যের আলোয় আলোয় আলোকিত হয় এই বিষয়ে বেদাদি শাস্ত্রে অসংখ্য তথ্য রয়েছে যেমন -
অত্রাহ গোরমন্বত নাম ত্বষ্টু রপীচ্যম্।
ইত্থা চন্দ্রসো গৃহে॥ (ঋগ্বেদ-১/৮৪/১৫)
অনুবাদ: গমনশীল চন্দ্রলোকে সূর্য্যের উজ্জ্বল জ্যোতি প্রতিফলিত হয়- এরূপ মানা হয় ।
আদিত্যেন চন্দ্রমা (দীপ্যতে)।
(শতপথব্রাহ্মণ-১০/৬/২/১১)
অর্থাৎ আদিত্য (সূর্য) দ্বারা চন্দ্রমা দীপ্ত হয়।
"আদিত্যতো দীপ্তির্ভবতি" নিরুক্ত-২/৬
অর্থাৎ সূর্য্যের কিরণ চন্দ্রমাকে প্রকাশিত বা দীপ্ত করে।
ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকায় "প্রকাশ্যপ্রকাশকবিষয়ঃ" নামে একটি অধ্যায়ই লিখেছেন। সেখানে তিনিও প্রমাণ করেছেন সূর্য্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত হয়।
এমনটা নয় যে শ্রীকৃষ্ণ এইসকল বেদাদি শাস্ত্রজ্ঞ ছিলনা। মহাভারতে বলা হয়েছে-
"বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানং বলং চাভ্যধিকং তথা" সভাপর্ব-৩৮/১৯
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বেদ-বেদাঙ্গ বিজ্ঞানের জ্ঞান তো ছিলই, বলশালীও অধিক ছিল।
অত: শ্লোকটিকে যদি ভালোভাবে বিচারশীল দৃষ্টিতে দেখি,তাহলে বুঝা যায় যে- দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে এক আদিত্য বিষ্ণুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন, মরুৎগণ কিংবা বায়ুর মধ্য থেকে একপ্রকার বায়ুর নাম উদ্ধৃত করেছেন, নিজস্ব আলো আছে এরূপ কিরণমালী পদার্থের মধ্য থেকে সূর্যের নাম বলা হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী কথন দ্বারা বুঝা যায় যে নিজস্ব আলো নেই এরূপ নক্ষত্রের মধ্য থেকে একটি নক্ষত্র চন্দ্রমার কথা বলা হয়েছে। মহাভারত সভাপর্বেও পিতামহ ভীষ্ম একটি শ্লোক বলেছেন -
"নক্ষত্রাণাং মুখং চন্দ্র আদিত্যস্তেজসাং মুখম্" সভাপর্ব-৩৮/২৮
অর্থাৎ নক্ষত্রের মধ্যে চন্দ্রমা তেজোময়/দীপ্তিময় পদার্থের মধ্যে সূর্য।
এই শ্লোকটিও এটাই ইঙ্গিত করে যে সূর্য নিজস্ব আলো আছে এরূপ পদার্থ আর নিজস্ব আলো নেই এরূপ নক্ষত্র হলো চন্দ্রমা।
পুরো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই ঈশ্বরের বিভূতি, তাই গীতায় বলা হয়েছে-
"নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে" (গীতা-১০/১৯)
অর্থাৎ আমার বিভূতি বিস্তারের অন্ত নেই (অর্থাৎ পরমাত্মার বিভূতি অনন্ত)
সেই অনন্ত বিভূতি থেকে কিছুমাত্র গীতায় বলা হয়েছে।

ভ্রান্তিনিবারকঃ প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ