শঙ্করাচার্য রচনাবলী - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

14 August, 2022

শঙ্করাচার্য রচনাবলী

শঙ্করাচার্য রচনাবলী

ভারতের ধর্ম, দর্শন এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আচার্য শঙ্কর ছিলেন কোহিনুর স্বরূপ কোহিনুরই বা বলি কেন, তিনি ততোধিক। কোহিনুর বহুবার লুণ্ঠিত হয়েছে, তুর্কী-মোগল ইংরেজ অনেকের কাছেই হস্তান্তরিত হয়েছে বারবার, তাতে আমাদের স্থায়ী কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু যদি শঙ্করাচার্যের মূল একখানি গ্রন্থও চিরতরে অপহৃত বা নষ্ট হত তাহলে দেশের যে ক্ষতি হত তা অপূরণীয়। ১৫০/২০০ টির পরিবর্তে মাত্র ৩০টি গ্রহকে তার প্রকৃত রচনা বলায় আপনি ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন, কিন্তু মাত্র ৩২ বৎসর আয়ুষ্কালের মধ্যে ৩৫ খানা কালজয়ী গ্রন্থ লেখাও কি কম কথা ? আমার মতে তিনি যদি কেবল ব্র শারীরিক ভাষা লিখে যেতেন, অন্য কোন বই লেখার সুযোগ তাঁর নাও হত তাহলেও তিনি মৃত্যুি কীর্তির অধিকারী হতেন।

শঙ্করাচার্য রচনাবলী

প্রাচীনকাল হতে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন ভাষায় ভাষা, প্রকরণ গ্রন্থ এবং স্তোত্রাদি মিলিয়ে প্রায় ২০০ খানা গ্রন্থ শঙ্করের নামে প্রচলিত আছে। তার মধ্যে ব্রহ্মসূত্রের উপর বিখ্যাত শারীরক ভাষা, ঈশ-কঠ মুন্ডুক ঐতরেয় ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদের উপর রচিত উপাদেয় ভাষারাজি, 

গৌড়পাদকৃত মাণ্ডুক্যকারিকার ভাষ্য, বিষ্ণুসহস্রনাম ভাষা, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য, মণ্ডলব্রাহ্মণোপনিষদের উপর রাজযোগ ভাষ্য, বিবেকচূড়ামণি, সর্ববেদান্তসিদ্ধান্তসংগ্রহ,উপদেশসহস্ৰী, অদ্বৈতানুভূতিঃ, অনাবর্তী বিহন প্রকরণম্, মঠান্নায়া, মোহমুদ্গর নির্বাণদশক, আত্মবোধাঃ, অদ্বৈতপঞ্চক, কেবলোহম গুর্বষ্টকম্, দক্ষিণামূর্তিস্তোত্রম্, পরাপূজা, নির্গুনমানসপূজা, প্রবোধসুধাকর, স্বাত্ম প্রকাশিকা, প্রশ্নোত্তর মালিকা, মণিরত্নমালা, বিজ্ঞান-নৌকা (স্বরূপানুসন্ধানম্), ব্রহ্মজ্ঞানাবলীমালা, ব্রহ্মানুচিন্তনম্ এবং নির্বাণষটকম্ প্রভৃতি গ্রহ যে আদি শঙ্করাচার্যের রচিত এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই। নিশ্চিত প্রমাণের ভিত্তিতে পণ্ডিতরা সকলেই এ বিষয়ে একমত। কিন্তু আপনার উল্লেখিত ভবানষ্টিক, গঙ্গাষ্টক, গণেশাটক, শিবস্তুতি, দুর্গপরাধভঞ্জনস্তোত্র প্রভৃতি প্রায় ৭৫ খানি স্তবস্তুতি গ্রহ সহ শঙ্করের নামাঙ্কিত আরও কয়েকটি ভাষা ও উপদেশ গ্রন্থ সম্বন্ধে আমার মনে ঘোরত্তর সংশয় আছে। নিম্নলিখিত প্রমাণ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে শঙ্করের নামে প্রচলিত অনেক পুস্তকই প্রকৃত পক্ষে অন্য লোকের দ্বারা রচিত হয়ে তাঁর নামে আরোপিত হয়ে আসছেঃ-

(ক) উদাহরণস্বরূপ প্রথমেই জ্ঞানগাশতক এবং বোধসারা' নামক দুইখানি প্রন্থের কথাই ধরা যাক। ১২৯২ সালে জনৈক অন্নদাপ্রসাদ বসু ঐ দুখানি পুস্তক কলিকাতা হতে প্রকাশ করেন। রচনার লালিতা, রস এবং উপাদেয়তা লক্ষ্য করে তিনি ভুলক্রমে এইগুলিকে স্বয়ং শঙ্করাচার্যের লেখা বলে প্রচার করেন। কিন্তু পরে পণ্ডিতরা আবিষ্কার করেন যে বিখ্যাত সংস্কৃত কাব্যকার এবং দার্শনিক বিশ্বশ্বর্য নরহরি নামক জনৈক দক্ষিণী ব্রাহ্মণ ঐ বই দুখানির লেখক। প্রকৃত তথ্য হল, অন্নদাপ্রসাদ বসু নরহরি রচিত বোধসাবঃ হতে ২৫০টি শ্লোক সঙ্কলন করেছিলেন মাত্র। নরহরি বাংলা ১২২০ সালে বোধসারা রচনা করেন এবং তাঁর প্রিয় শিষ্য দিবাকর ১২২৩ সালে (১৭৩৮ শকাব্দে) তার টাকা রচনা করেন। তারা কেউ শঙ্করাচার্যের নাম উল্লেখ করেন নি। জ্ঞানগঙ্গাশতক এবং বোধসারা এর গ্রন্থকার যে শঙ্করাচার্য নন তার একটি বড় প্রমাণ ঐ বই দুটিতে শঙ্কর। প্রবর্তিত সন্ন্যাস ধর্মের বিধি ও চিহ্নাদি ধারণের নিন্দা আছে। তাছাড় গ্রন্থমধো ষোড়শ শতাব্দীতে আবির্ভূত


মধুসূদন সরস্বতীর বহু উদ্ধৃতিই প্রমাণ করে যে বইটি শঙ্করাচার্যের রচনা নয়। (খ) কালা পরাধ ভঞ্জন স্তোত্রটিও শঙ্করের রচিত নয়। কারণ, জোরটি গুপ্তার্ণব তাদের । যিনি তন্ত্রমত খণ্ডন করে তার উচ্ছেদ সাধন ঘটিয়েছিলেন এবং যার জন্য বহু স্থানে তাঁর তান্ত্রিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটেছিল, এমন কি একসময় একজন কাপালিকের হাতে তাঁর প্রাণ যাওয়ারও উপক্রম ঘটেছিল, সেই শঙ্কর কোন তান্ত্রিক ভাবধারামণ্ডিত স্তোত্র রচনা করবেন বলে মনে হয় না।


(গ) আচার্যের নামে প্রচারিত দুর্গাপরাধজন স্তোত্রটি সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। একথা সবাই জানেন, পণ্ডিতমহলেও একথা স্বীকৃত সত্য যে আচার্য শঙ্কর ৭৮৮ খু ৮২০ মৃস্টাব্দ অর্থাৎ ৩২ বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এমতাবস্থায় স্তোত্রটিকে শঙ্কর রচিত বলে স্বীকার করলে তিনি ৮৫ বৎসর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে মানতে হবে। কারণ ঐ স্তোত্রের মধ্যে রচয়িতা স্বীকারোক্তি করেছেন না দুর্গে। অন্য দেবতা পরিত্যাগ করে পঁচাশি বৎসর বা তদধিক কাল পর্যন্ত তোমারই সেবা করে এলাম। এখন তুমি যদি আমার রূপা না কর, তাহলে আমি আর কার শরণ নিবা পরিত্যক্তা দেবা বিবিধবিধিসেবাকুলওয়া ময়া পঞ্চশীতেরধিকমপনীতে তু বয়সি। অপীদানীং মাতস্তর যদি কৃপা নাপি ভরিতা নিরালম্বো লম্বোদর- জননি কং যামি শরণম ।


(ঘ) আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন আমাদের এই বাংলাদেশেও একজন শঙ্করাচার্য ছিলেন। লণ্ডনে ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে রক্ষিত 'তারারহস্যবৃত্তিকা' নামে একখানি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। নেপাল দরবার লাইব্রেরীতেও ঐ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি রয়েছে। ঐ প্রতিলিপির তারিখ লক্ষ্মণসংবং ৫১১ (১৬৩০ খৃঃ)। গ্রন্থের পুষ্পিকায় লেখক আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি বাঙালী এবং কোল। তাঁর পিতার নাম কমলাকর, পিতামহের নাম লম্বোদর (Descriptive Catalougue of Sanskrit Miss in India Office Libary 4/2603)। এই গৌড়ীয় শঙ্করাচার্য রচিত 'মৃত্যুঞ্জয় পূজা', 'প্রপঞ্চসার' এবং 'সৌন্দর্যলহরী' প্রভৃতি গ্রন্থ বৈদান্তিক চূড়ামণি জ্ঞান-শুরু শঙ্করের নামে অবলীলাক্রমে প্রচলিত হয়ে আসছে।


(ঙ) প্রকৃতপক্ষে শঙ্কর জীর রচিত নয় অথচ তাঁর নামে প্রচলিত হয়ে আসছে এমন গ্রহগুলিকে তাঁর মূল রচনার সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে বিচার করলেই যে কোন নিরপেক্ষ পাঠকের চোখে উভয় শ্রেণীর গ্রন্থের মধ্যে ভাষাগত ও ভাবগত অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। যেমন শ্বেতাশ্বতর ও নুসিংহতাপনীয় উপনিষদের তথাকথিত শঙ্করভাষা। ঐ দুটি ভাষ্যের লেখক পৌরাণিক প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেছেন। 

কিন্তু আদি শঙ্করাচার্যের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তিনি তাঁর লেখার মধ্যে উপনিষদ্ প্রমাণকেই প্রধান্য দিয়েছেন। এ ছাড়া ঐ দুখানি ভাষ্যে ব্যাকরণ অশুদ্ধিও রয়েছে। এতেই বুঝা যায় যে, ঐ দুটি ভাষ্যের ব্যাখ্যাতা আর যিনিই হোন, তিনি কদাপি আদি শঙ্করাচার্য নন।  শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ভাষ্যের একস্থানে গৌড়পাদের একটি কারিকার (৩/৫৫) উল্লেখ এইভাবে করা “তথা চ শুকশিষ্যো গৌড়পাদাচার্যঃ' অর্থাৎ তকের শিষ্য কোন এক গৌড়পাপাচার্য ইত্যাদি। শঙ্করাচার্যের মত মহাজ্ঞানী শিষ্যের আচার-বিরুদ্ধ এইরকম লঘু ভাষায় লঘু চালে নিজ পরমগুরুর নাম স্মরণ করবেন - একথা বিশ্বাস করা ক


(চ) কেনোপনিষদের পদভাষ্য এবং বাকাভাষাও শঙ্করের নামে প্রচলিত। কিন্তু যে কোন অনুসন্ধানী পাঠক একটু খুঁটিয়ে বিচার করলেই দেখতে পাবেন এই উভয় ভাষ্যের কোন কোন আশে মূলের ব্যাখ্যা পরস্পর ভিন এবং বিপরীত। মূল ন/১/২ এর পাঠ পদভাষ্য মতে নাহয় কিন্তু বাক্যাভাষ্য মতে 'নাই'। লেখক একজন হলে বিশেষতা শঙ্করের মত মহাপণ্ডিত এর রচয়িতা হলে এই ধরণের ভারগত ও ভাষাগত ভুল কখনও সম্ভব নয় (ছ) সম্প্রতি বর্তমান ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বানী মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ প্রণীত ভারতীয় সাধনার ধারা' নামে একখানি অমূল্য গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই বই-এ তিনি দেখিয়েছেন যে, মাণ্ডুক্য উপনিষদের ভাষাও আদি শঙ্করের নয়। এর দুটি মঙ্গল শ্লোক অত্যন্ত নিকৃষ্ট ভাষায় রচিত। দ্বিতীয় শ্লোকে ত পরিষ্কার ছন্দোভঙ্গের দোষ। শ্রোকের প্রথম তিন পঙক্তি মন্দাক্রান্তা এবং চতুর্থ পঙক্তি জন্তুরা ছন্দে লিখিত। অস্তিম তিন শ্লোকে ব্যাকরণগত অশুদ্ধিও বর্তমান। এই সব মারাত্মক ত্রুটি কি শঙ্করাচার্যের লেখার সম্ভবপর।

সম্ভব যে নয় তা বিচারশীল লোকমাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য। তবুও যে নানা অবৈদিক মতবাদে কন্টকিত (কোন কোন ক্ষেত্রে শঙ্করের জীবন দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবধারায় পরিপূর্ণ) গ্রন্থও অবলীলাক্রমে তাঁর নামে কিভাবে চলে আসছে, তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের দেশের দুই একটি বিশিষ্ট প্রাচীন রীতি এবং বিচিত্র মানসিকতাকেই দায়ী করতে হয়। সাম্প্রদায়িক স্বার্থ এবং অতিভক্তির জলাভূমিতেই এই রীতি ও মানসিকতার জন্ম। স্বরচিত গ্রন্থের গৌরব বৃদ্ধির জন্য অনেকেই আমাদের দেশে নিজ নাম গোপন করে প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ মহাত্মা ও মনীষীর নামে গ্রন্থরচনা করে গেছেন। অনেকে আবার নিজ মতবাদকে জনপ্রিয় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রসিদ্ধ আকরগ্রন্থের মধ্যে স্বরচিত অনেক শ্লোকও সুকৌশলে প্রক্ষেপ (Interpolation) করেছেন। পরবর্তীকালে অনেক গবেষক পণ্ডিতের চোখে এ রহস্য ধরাও পড়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে অভিসন্ধিপরায়ণ লোকেরা বিশেষতঃ নানা মঠ মিশনের মোহান্ত মহারাজের দল এইরকম অপকার্য করে এসেছেন। এখানে কিছু ঘটনার উল্লেখ করছি। যেমন রামের দুর্গাপূজা প্রসঙ্গ। রাম দুর্গাপূজা করেন নি, মূল বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপূজার উল্লেখ নাই। রাজসাহী জেলার অন্তর্গত তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ যা পঞ্চদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করেন। তাঁর সভাপণ্ডিত ও পুরোহিত পণ্ডিত রমেশ চন্দ্র শাস্ত্রীই দুর্গাপূজার পদ্ধতি ও মন্ত্রাদি রচনা করে রাজাকে দিয়ে পূজা করান। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের লেখা 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' নামক বই-এ এই প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে এবং রাজা কংসনারাযণের সাক্ষাৎ বংশধর, কাশীস্থ ভারতীয় ধর্ম মহানণ্ডলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক রাজা শশিশেখরেশ্বর রায়ও প্রাচীন দলিল ও কাগজপত্র দৃষ্টে এই তথ্য সমর্থন করেছেন। কিন্তু রাজার সভাকবি কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের নামে এই মহাপূজা আরোপ করার পর থেকে সারাদেশে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে গেল। এখন আবালবৃদ্ধবনিতা বিশ্বাস করেন যে বাম দুর্গাপূজা করেছিলেন এবং মহামুনি বাল্মীকিই যেন ঐ পূজাপদ্ধতির প্রবর্তক।


বুদ্ধদেবের কথা ভেবে দেখুন যে বুদ্ধদেবের প্রতিষ্ঠিত ধর্মের মূল মন্ত্রই ছিল ক্ষমা, প্রেম, মুদিতা, করুণা ও অহিংসা, যে বুদ্ধদের ঈশ্বর সম্বন্ধে সারাজীবন নীরব থেকেছেন, মূর্তিপূজা ও বহিরাচারকে যিনি অসার ও নিরর্থক বলেছেন, তন্হা অর্থাৎ তৃষ্ণা দূর করে নির্বাণলাভই ছিল যাঁর ধর্মে পরম পুরুষার্থ, সেই অমিতাভ বুদ্ধের মৃত্যুর পর কি দেখা গেল? দেখা গেল, তথাগতের ধর্ম কতকগুলো ভ্রষ্টাচারী ভিক্ষু ভিক্ষুণীর পোক তান্ত্রিক পূজাপাঠ এবং গুহা ক্রিয়াকৌশলে পরিণত হয়ে গেল। একদিকে যেমন তা মহাযান, হীনযান, বজ্রযান প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হল, অন্যদিকে তেমনি তা দণ্ডেশ্বরী, বক্রেশ্বরী, চক্রেশ্বরী প্রভৃতি বহুতর দেবদেবীর অনুষ্ঠানসর্বস্ব পূজাপদ্ধতিতে হল পর্যবসিত। যেহেতু বৌদ্ধধর্মের কোন কোন সম্প্রদায়ে ঐ সব অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে, এজন্য কি কেউ বলবেন যে বুদ্ধদেব ঐ সব মূর্তিপূজা এবং তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ


আমি বলতে চাই যে রাম ও বুদ্ধদেবের মত নির্বিশেষে ব্রহ্মবাদী শঙ্করাচার্যের নামে নানা দেবদেবীর আরাধনা এবং তদনুকূল স্তোত্রমহ্রাদি প্রচলনের মূলেও ঐ একই মনোবৃত্তি বর্তমান। প্রক্ষেপের ভূত ভারতের ধর্মজগতে অনেক অঘটন ঘটিয়েছে, অনেক অনাচারেরই জন্ম দিয়েছে। এই ভৌতিক উপদ্রব থেকে ব্যাসদেব এমন কি স্বয়ং ভূতনাথও রক্ষা পাননি। বোম্বাই এর ক্ষেমরাজ কোম্পানী দেবনাগরী অক্ষরে একখানি পুরাণ প্রকাশ করেছেন। নাম করা হয়েছে। বইটিতে আছে - ভবিষ্যপুরাণ। অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থের মত এটিও ব্যাসদেবের রচিত বলে অপপ্রচার মহাদেবেন লোকার্থে ভবিষ্যৎ রচিত শুভ' লোকহিতের জন্য মহাদেবই যেন বইখানির প্রণেতা। লক্ষা করুন, এখানে লেখক এক ঢিলে দুই পাখী মারার আশ্চর্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। শিব ও ব্যাসদেব দুজনকেই জড়িয়েছেন। দুইজনের পুণ্য নামকে যথেচ্ছভাবে অপব্যবহার করেছেন। ভাবখানা এই বইটি originally মহাদেবের দ্বারা লিখিত হলেও এই অধরম ধরাধামে ব্যাসদেবই তার প্রকাশক। শিবের উক্তিতে কলিকাতারও উল্লেখ করা হয়েছে 'কলিকাতা পুরী রম্যা প্রসিদ্ধা মহীতলো (৪)। শান্তিপুরেরও নাম বাদ যায়নি। "গঙ্গামুলে শাস্তিপুরং রচিতং তেন ধামতা"। "তেন' অর্থাৎ রাজা শাস্তিবনা গঙ্গাতীরে শাস্তিপুর নগর নির্মাণ করলেন আর তাঁর পুত্র নদীবর্মা গৌড়দেশে গড়ে তুললেন "নদীহা' অর্থাৎ নদীয়া চকার নগরীং রম্যাং নদীহাং গৌড়রাষ্ট্রভাব (শ্লোক ২৫) শিব একে ত্রিনয়ন তায় ত্রিকালদর্শী। কাজেই মতলবী গ্রন্থকার তাঁর মুখ দিয়ে রামানন্দ, শ্রীধরস্বামী ও তাঁর নীতার টাকা, জয়দেব পদ্মাবর্তী এবং গীতগোবিন্দ, চৈতন্য-শঙ্কর-রামানুজ, কবীর নানক-নিত্যানন্দ, বিশ্বমঙ্গল, তুলসীদাস সকলের কথাই বলিয়েছেন। স্থান-কাল-পাত্র, সমীচীনতা-অসমীচীনতা কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই।


ভবিষ্য পুরাণের শিব শুধু অসাধারণ ভবিষ্যৎ-সৃষ্টিরই অধিকারী নন, হিন্দু, অহিন্দু সকলের প্রতিই তাঁর সমান করুণা। শুধু হিন্দুর কথাই তিনি বলেন, মুসলমান বা ইংরেজদের কথা বলবেন না, এমন ত আর হয় না। তাই তিনি পৃথ্বীরাজের প্রতিমূর্তির গলায় সংযুক্তার মালাদান এবং জয়চন্দ্র পৃথ্বীরাজের যুদ্ধপর্ব কর্ণনার পরেই কুতুবুদ্দিন সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন। পৈশাচঃ কুতুবুদ্দিন!" | ইংরাজদের বেলায় শিবকে একটু গদগদ দেখা যায়। তাঁর মতে ইংরাজরা বড় ভাল লোক। তারা ঈশ্বরের পুত্র যীশুর মতাবলম্বী, বাণিজ্যের জন্যই তারা এদেশে এসেছে “ঈশ-পুত্ৰ-মতে সংস্থা তেষাং হৃদয়মুক্তমন। তাদের কে রাজা এবং সে রাজার সিংহাসন কোথায় সে সব কথাও পঞ্চানন পঞ্চমুখে ব্যক্ত করেছে বিকটে পশ্চিমে দ্বীপে তৎপত্নী বিকটাবর্তী'


বিকট অর্থাৎ অতি দুর্গম পশ্চিম দ্বীপে রাজার পত্নী বিকটারর্তী অর্থাৎ রাণী ভিক্টোরিয়া। তিনি বর্তমানে আটজন কৌসলী অর্থাৎ কাউন্সিলারের সাহায্যে রাজ্যশাসন করছেন। "অষ্ট কৌশলমার্গেণ রাজ্যমত্র চকার হ। একেই বলে কলি-কৌতুক।


সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হলেই তা যেমন শাস্ত্র হয় না, তেমনি শিব উবাচ, 'ব্যাস-উবাচ বলে নিজেদের সংস্কার বিশ্বাস এবং মতবাদ প্রচারের প্রয়াসও কখনও মান্য ও প্রামাণ্য বলে গ্রাহ্য হতে পারে না। শঙ্করাচার্যের গীতে বসে কেউ ফরমান জারী করলেও না।


ভবিষ্যপুরাণের শিব ও ব্যাসের উক্তিতে যেমন কৌতুক সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনি কৌতুক সৃষ্টি করা হয়েছে সাক্ষাৎ বেদান্ত মূর্তি আচার্য শঙ্করকে নিয়ে। ভবিষ্যপুরাণের শুদ্ধ ও সরল সংস্কৃত ভাষার কোন ব্যাকরণ গত দোষ নাই। তাই তা যেমন শিব ও ব্যাসের রচনা বলে চালাতে কোন অসুবিধা নাই, তেমনি লালিতামণ্ডিত ছন্দোবদ্ধ সংস্কৃতে নানা শ্লোক ও স্তোত্রমন্ত্রাদি রচনা করে শঙ্করের নামে প্রচার করলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাও সহজে ধরার উপায় নাই। সূক্ষ্ম মনন ও বিচারের আলো ফেলে শঙ্করের নামাঙ্কিত কোন কোন গ্রন্থে তার জীবন-দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত তত্ত্ব সুকৌশলে পরিবেশন করে সম্প্রদায়ীরা তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থবুদ্ধি চরিতার্থ করেছে, ক্যাজনই বা তা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে বলুন। তাই অগণিত মানুষ আজও সহজিয়া ভক্তিবশে আচার্যের নামাঙ্কিত প্রতিটি রচনাকেই তারই মূল রচনা বলে মনে করেন। যিনি ছিলেন জ্ঞানগঙ্গার নব ভগীরথ, অদ্বৈতবাদের মহান উপখাতা, বার অভেদ দৃষ্টিতে সর্বত্র সর্ব বস্তুতে অদ্বয় ব্রহ্মের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু ভাসত না, তাঁর পক্ষে 'দেবী। সুরেশ্বরী ভগবতে গঙ্গে' বলে ভৌম গঙ্গার স্তবস্তুতি এবং বাহ্যিক পূজারাধনামূলক মন্ত্রাদি রচনা সম্ভব কিনা তা একবারও কেউ বিচার করে দেখে না। যিনি স্বরচিত 'আত্মপূজা' বা পরাপুজাতে ব্রহ্মযজ্ঞের ভাব এবং নির্গুণমানসপূজা'তে বাহ্যিক পূজাঙ্গ ষোড়শোপচারাদির নিগূঢ় তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করে কিভাবে দিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে নির্গুণের ধ্যান করতে হয়, তা স্বার্থহীন ভাষায় বিশদভাবে বুঝিয়ে গেলেন, তারাই প্রতিষ্ঠিত মাঠের মঠচার্যরা তবু কেন যে পূর্ণাগিরি শারদাদেবী, প্রভৃতির জড়োপসানার ঠাঁট সাড়ম্বরে বজায় রেখেছেন, তা আমার বুদ্ধির অগনা। ঐ সমস্ত মূর্তির পূজা যে তাঁর অন্তর্ধানের পর শিষ্য প্রশিষ্যদের দ্বারাই প্রচলিত হয় নি। তার কি কোন নিশ্চিত প্রমাণ আছে ?

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ