ধর্ম অর্থ কাম আর মোক্ষ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 September, 2022

ধর্ম অর্থ কাম আর মোক্ষ

 ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ হল আর্যদের সভ্যতার আধারশিলা। এরমধ্যে মানুষের সেই সমস্ত অভিলাষা অন্তর্ভূত হয়ে যায় যার উল্লেখ বেদমন্ত্র সংগ্রহের আদির মধ্যে করা হয়েছে, কারণ মানুষের শরীরের মধ্যে আবশ্যকতার ইচ্ছাকারী চারটি স্থানই রয়েছে আর এই চারটি পদার্থ তার পূর্তি করে দেয়। ভগবান্ মনু তাঁর এক শ্লোকে বলেছেন যে -

অদ্ভির্গাত্রাণি শুদ্ধ্যন্তি মনঃ সত্যেন শুদ্ধ্যতি।
বিদ্যাতপোভ্যাম্ ভূতাত্মা বুদ্ধির্জ্ঞানেন শুদ্ধ্যতি।।
(মনুস্মৃতি ৫|১০৯)
অর্থাৎ - শরীর আর শরীরের অঙ্গ জল দ্বারা শুদ্ধ -- নির্মল হয়ে যায়, মন সত্য সংকল্প, সত্যভাষণ আর সত্যাচরণ দ্বারা শুদ্ধ হয়ে যায়, জীবাত্মা বিদ্যাপ্রাপ্তি আর ধর্মপালন রূপ তপ দ্বারা, তথা বুদ্ধি অধিকাধিক সত্যজ্ঞানের অর্জন দ্বারা শুদ্ধ বা নির্মল হয়ে যায়।
এই শ্লোকটিতে শরীর, মন, বুদ্ধি আর আত্মার গণনা ভিন্ন-ভিন্ন করা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই চারটি যেখানে জল আদি ভিন্ন-ভিন্ন চার পদার্থ দ্বারা শুদ্ধ হচ্ছে, সেখানে এই শরীরাদি চার অঙ্গকে ভিন্ন-ভিন্ন চার পদার্থের আবশ্যকতাও দেখাচ্ছে। এই চার আবশ্যক পদার্থই হল ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ।
ধর্ম অর্থ কাম আর মোক্ষ

শরীর পোষণের জন্য অর্থের, মন সন্তুষ্টির জন্য কামের, বুদ্ধির জন্য ধর্মের আর আত্মার শান্তির জন্য মোক্ষের আবশ্যকতা রয়েছে, কারণ ভোজনাদি (অর্থ) রহিত শরীর অকেজো হয়ে যায়, কাম (স্ত্রী) রহিত মন অকেজো হয়ে যায়, মোক্ষ (অমরতা) রহিত আত্মা অকেজো হয়ে যায় আর ধর্ম (সত্য আর ন্যায়) রহিত বুদ্ধি অকেজো হয়ে যায়। অর্থ আর শরীরের, কাম আর মনের তথা মোক্ষ আর আত্মার সম্বন্ধ তো প্রত্যক্ষই রয়েছে, এরমধ্যে কারও কোনো শঙ্কা হবে না, কিন্তু ধর্ম আর বুদ্ধির সম্বন্ধকে শুনে লোকে বলতে পারে যে এটা ঠিক নয়, কারণ সংসারে ধর্মকে বুদ্ধির সঙ্গ হতে দেখা যায় না, কিন্তু আমি যে বৈদিক ধর্মের কথা বলছি তার দশা এরকমটা নয়। বৈদিক ধর্ম হল বুদ্ধিপূর্বক, এর কারণ হল এটাই যে বৈদিক ধর্ম বেদের দ্বারা স্থির করা হয়েছে আর বেদ হল "বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদে" - এর অনুসারে বুদ্ধিপূর্বক, এইজন্য এই ধর্মে সেসব শঙ্কা হওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কথা হল যে, বুদ্ধির সম্বন্ধ হল জ্ঞানের সঙ্গে, যেভাবে-যেভাবে জ্ঞানের বৃদ্ধি হতে থাকে সেভাবেই বুদ্ধির বিকাশ হতে থাকে, এইজন্য বুদ্ধি আর জ্ঞান হচ্ছে একই বস্তুর দুটি বিভাগ। যেভাবে বুদ্ধি আর জ্ঞান একই বস্তুর দুটি বিভাগ ঠিক সেইভাবে ধর্ম আর জ্ঞানও একই বস্তুর দুটি বিভাগ, কারণ দেখা যায় যে যেভাবে - যেভাবে জ্ঞানের বৃদ্ধি হতে থাকে সেভাবে - সেভাবে ধর্মেরও বৃদ্ধি হতে থাকে। ধর্মের মধ্যে যতই জ্ঞানাংশ হবে আর জ্ঞানের মধ্যে যতই ধর্মাংশ হবে বুদ্ধিতে ততই স্থিরতা হবে। এইরূপ সিদ্ধান্তের উপর পৌঁছেই ইউরোপের প্রসিদ্ধ বিদ্বান্ হক্সলে বলেছেন যে, "সত্য বিজ্ঞান আর সত্য ধর্ম হল দুটি যমজ ভাই। এদের মধ্যে যদি একটিকে অপরটির থেকে আলাদা করা হয় তবে উভয়েরই মৃত্যু হয়ে যাবে। বিজ্ঞানের মধ্যে যতই অধিক ধার্মিকতা হবে, ততই অধিক তার উন্নতি হবে। বিজ্ঞানের অভ্যাস করার সময় মনের ধার্মিক বৃত্তি যতই অধিক হবে বিজ্ঞানবিষয়ক অনুসন্ধান ততই অধিক গভীর হবে আর তার আধার যতই অধিক দৃঢ় হবে ধর্মের বিকাশও ততই অধিক হবে। তত্ত্ববেত্তাগণ আজ পর্যন্ত যেসব বড়ো-বড়ো কাজ করেছেন সেগুলোকে কেবল তাদের বুদ্ধিবৈভবেরই ফল ভাবা উচিত নয়, কারণ তাদের ধার্মিক বৃত্তিই হল এসবের মধ্যে অধিক কারণীভূত" (হর্বর্ট স্পেন্সর রচিত "এজুকেশন" নামক গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত)। এইজন্য ধর্মের সঙ্গে জ্ঞানের আর জ্ঞানের সঙ্গে বুদ্ধির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যেভাবে ধর্মের সঙ্গে বুদ্ধির সম্বন্ধ রয়েছে, সেইভাবে অর্থের সঙ্গে শরীরের, কামের সঙ্গে মনের আর মোক্ষের সঙ্গে আত্মারও সম্বন্ধ রয়েছে। এই ধর্ম, অর্থ, কামাদির মধ্যেই মানুষের জীবন, রতি, মান, জ্ঞান, ন্যায় আর পরলোক আদির সমস্ত কামনাগুলোর সমাবেশ হয়ে যায়, অর্থাৎ জীবনের অভিলাষা অর্থতে, স্ত্রী-পুত্রাদি কামতে, মান -- জ্ঞান আর ন্যায় ধর্মতে আর পরলোকের কামনা মোক্ষতে সমাবেশ হয়ে যায়, অর্থাৎ সমস্ত এষণাগুলোর সমাবেশ ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষের মধ্যে হয়ে যায় আর এই চার পদার্থ একে-অপরের আধার-আধেয় হয়ে যায়। যেভাবে অর্থ অর্থাৎ ভোজন বস্ত্রাদি ছাড়া শরীরের স্থিতি থাকবে না আর না কাম অর্থাৎ রতি ছাড়া শরীর উৎপন্ন হতে পারবে আর না শরীর আর শরীর-নির্বাহ ছাড়া মোক্ষসাধন হতে পারবে, সেইভাবে বিনা মোক্ষসাধন -- বিনা মোক্ষমার্গ - নির্ধারণ করে অর্থ আর কামের সহায়তাও পাওয়া যাবে না, কারণ অর্থ আর কামের সমস্ত পদার্থ প্রায়শঃ মানুষ, পশু আর উদ্ভিদ থেকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এসবই হল জীব আর তারা নিজেদের কর্মফল ভোগ করছে। এদেরও উদ্ধার তখনই হওয়া সম্ভব যখন এরা কর্মফল ভোগ করে মানুষের শরীরে আসবে আর এখানে মোক্ষের মার্গ খুলতে পারবে, এইজন্য মোক্ষের সত্য কামনা দ্বারাই অর্থ আর কামের অর্থাৎ মানুষ, পশু আর উদ্ভিদের সহায়তা পাওয়া সম্ভব। মোক্ষের সত্য কামনাকে ছাড়া অর্থ আর কামের উচিত প্রয়োগ হওয়া সম্ভবই নয় আর বিনা উচিত প্রয়োগে অর্থী স্বার্থী হয়ে যাবে আর কামনাকারী কামী হয়ে যাবে তথা স্বার্থী আর কামী মিলে সমাজকে নষ্ট করে দিবে। এইজন্য বলা হয়েছে যে, মোক্ষ দ্বারা অর্থ আর কামের সহায়তা মিলে, কিন্তু প্রশ্ন হল এটা যে, অর্থ-কাম দ্বারা মোক্ষকে আর মোক্ষ দ্বারা অর্থ-কামকে পরস্পর উচিত সহায়তা দেওয়ার মতো নিয়ম কোনটি? এর উত্তর স্পষ্ট যে অর্থ, কাম আর মোক্ষের মধ্যে সামঞ্জস্য উৎপন্নকারী হল ধর্ম। ধর্মপূর্বক মোক্ষসাধনের দ্বারা অর্থ আর কামের উচিত ব্যবস্থা হয়ে যাবে আর ধর্মপূর্বক অর্থ - কামকে গ্রহণ করলে মোক্ষ সুলভ হয়ে যাবে। এইভাবে এই চার পদার্থ একে-অপরের সহায়ক হয়ে যাবে। যদিও এই চার পদার্থ পরস্পর একে-অপরের সহায়ক আর নিজের-নিজের কাজের মধ্যে এই চারটি বড়ো মহত্বের, কিন্তু চারটির মধ্যে মোক্ষই হল সবার থেকে উপরে। মোক্ষের মহত্তার কারণ হল মৃত্যুর দুঃখ থেকে বেঁচে যাওয়া। মানুষের সমস্ত অভিলাষাগুলোর মধ্যে দীর্ঘাতিদীর্ঘ জীবনের অভিলাষাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষ জীবনের তুলনায় অর্থ, কাম, মান, ন্যায় আর জ্ঞানের পরোয়া করে না। একথার প্রমাণ মৃত্যুর সময়েই পাওয়া যায়, এইজন্য যেই সাধন দ্বারা মৃত্যুর ভয় সর্বদার জন্য দূর হয়ে যাবে -- যাকে প্রাপ্ত করলে পরে মৃত্যুর কারণরূপ এই জন্মেরই অভাব হয়ে যাবে -- কে সেই মোক্ষের সমতা করতে পারে? এটাই হল কারণ যে আর্যরা নিজের সভ্যতাকে মোক্ষপ্রাপ্তির উচ্চ আদর্শে স্থির করেছে আর কেবল ধর্মপূর্বক প্রাপ্ত অর্থ আর কামকেই তার সহায়ক মেনেছে, ধর্ম বিরুদ্ধকে নয়। ধর্মপূর্বক অর্থ আর কামকে গ্রহণ করে মোক্ষ প্রাপ্ত করার জন্যই আর্যদের নিজেদের জীবন ধার্মিক বানানোর শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, এইজন্য তারা ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে শুরু করে সন্ন্যাস পর্যন্ত সন্ধোপাসন, প্রাণায়াম আর য়োগাভ্যাস দ্বারা নিজেদের জীবনকে মোক্ষাভিমুখী বানিয়ে তোলে।

••• মোক্ষের প্রাধান্য •••
মোক্ষপ্রাপ্তির মার্গে চলা ব্যক্তির দুটি বিষয়ের আবশ্যকতা হয় -- প্রথমটি হল সৃষ্টি উৎপত্তির কারণকে জানা আর কারণের কারণ ঈশ্বরকে প্রাপ্ত করা, দ্বিতীয়টি হল সৃষ্টির প্রয়োগ করার বিধিকে বুঝে নেওয়া। সৃষ্টির কারণ আর ঈশ্বর প্রাপ্তির উপায়ের জ্ঞান দ্বারা সৃষ্টি, প্রলয়, জীব, ঈশ্বর, কর্ম, কর্মফল আর ঈশ্বর ও জীবের সংযোগ তথা তাদের প্রাপ্তি আদির রহস্য খুলে যায় আর সৃষ্টির প্রয়োগ করার বিধির জ্ঞান দ্বারা অর্থ আর কামের উপভোগের তাৎপর্য বুঝতে সুবিধা হয় তথা উভয়ের মৌলিক জ্ঞান আর উচিত ব্যবহার দ্বারা মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। অর্থ আর কামের চক্র থেকে মুক্তির নাম হল মোক্ষ, কিন্তু বিনা এই দুইয়ের চক্রে পড়ে মোক্ষও হয় না। এরকম অবস্থায় ধর্মের সাহায্য নিয়েই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য উৎপন্ন করা যেতে পারে, কারণ সকলের অর্থের আবশ্যকতা রয়েছে। ভোজন, বস্ত্র, গৃহ আর গৃহস্থীকে ছাড়া কারও নির্বাহই হবে না। এইসব পদার্থ সংসার (সৃষ্টি) থেকেই নিতে হয়। ঠিক একইভাবে সকলের কামেরও আবশ্যকতা রয়েছে। সকল মানুষেরই ইচ্ছা স্ত্রী, পুত্র, শোভা, শৃঙ্গার আর সাজ-সজ্জার। এসব পদার্থও সৃষ্টি থেকেই নেওয়া হয়, অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি বা সমাজকে যা কিছুর আবশ্যকতা হয় সেসব সংসার থেকেই (সৃষ্টি থেকেই) নেওয়া হয়, এইজন্য যতক্ষণ পর্যন্ত না সংসারের কারণের জ্ঞান না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কাজের যথার্থ প্রয়োগ হওয়া সম্ভবই হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা জ্ঞাতই হবে না যে আমাদের এই সৃষ্টি থেকে -- এই সংসার থেকে কি-কি, কত-কত, কখন-কখন আর কোন-কোন প্রকারের গ্রহণ করা উচিত, এইজন্য আর্যরা সর্বপ্রথম সংসারের কারণের খোঁজ করেছে। এখানে আমি অর্থ আর কামের দেওয়া সৃষ্টির কারণের বর্ণনা করবো আর দেখাবো যে সেই কারণ থেকে উৎপন্ন কার্যই অর্থ আর কামরূপে সংসারে বিদ্যমান রয়েছে, অতঃ এর উচিত প্রয়োগ করেই মোক্ষ প্রাপ্ত করা উচিত।
কারণ দ্বারাই কার্য হয় আর কারণই কার্যের মধ্যে অবতরিত হয়ে অনেক প্রকারের নিয়মে পরিবর্তিত হয়ে যায়, এইজন্য যখন কার্য হতে কারণের অনুসন্ধান করা হয় তখন কার্যের নিয়মেরই নিরীক্ষণ করা হয়। আমাদেরকে সৃষ্টির কারণকে জানতে হবে, অতএব আমাদের উচিত যে আমরাও যেন এই কার্যরূপ সৃষ্টির কারণের অনুসন্ধান করি।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ