ন্যায় দর্শন ১/১/২ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 September, 2022

ন্যায় দর্শন ১/১/২

 

দুঃখজন্মপ্রবৃত্তি দোষমিথ্যাজ্ঞানা নামুত্তরোত্তরাপায়ে তদনন্তরাপায়াদপবর্গঃ

অর্থাৎ - মিথ্যা জ্ঞান থেকে দোষ, দোষ থেকে প্রবৃত্তি, প্রবৃত্তি থেকে জন্ম আর জন্ম থেকে দুঃখ হল। জন্মের নিরোধ করলে দুঃখের নাশ হয়ে যায় আর মোক্ষ হয়ে যায়। বলার তাৎপর্য হল যে দুঃখের অত্যন্তাভাব করার জন্য জন্ম অর্থাৎ শরীরের অত্যন্তাভাব করা উচিত, শরীরের অত্যন্তাভাবের জন্য প্রবৃত্তির অভাব হতে হবে, প্রবৃত্তির অভাবের জন্য দোষের অভাব হতে হবে আর দোষের অভাবের জন্য মিথ্যাজ্ঞানের অভাব হতে হবে, অর্থাৎ মিথ্যা জ্ঞানের অভাব দ্বারাই পূর্ব-পূর্বের বিঘ্নতা দূর হতে পারে, এইজন্য সবার আগে মিথ্যা জ্ঞান দূর করার অবশ্যতা রয়েছে, কারণ মিথ্যা জ্ঞানই হল মোক্ষের সবার থেকে বড়ো বাধক। মিথ্যা জ্ঞানের নাশ সত্য জ্ঞান দ্বারাই হতে পারে। সত্য জ্ঞানের দ্বিতীয় পারিভাষিক নাম হল বস্তুর যথার্থ পরিচয়। যদি সংসারের যথার্থ পরিচয় হয়ে যায় মানুষের, যদি সংসারের কারণ-কার্যের বোধ তার হয়ে যায়, আর যদি মানুষ এটা বুঝতে সক্ষম হয়ে যায় যে সমস্ত দুঃখের আর পাপের মূল কেবল মানুষের এই শরীর তাহলে তার মন থেকে সংসারের মমতার দোষের গভীর ছাপ মুছে যাবে আর তার সাংসারিক প্রবৃত্তির মধ্যে বিবেক উৎপন্ন হবে। মোক্ষপ্রকরণে এই বিবেকের নাম হল জ্ঞান, তবে স্মরণে রাখতে হবে যে কেবল এতটুকু জ্ঞান আর বিবেক উৎপন্ন হলেই মানুষ মুক্ত হয়ে যায় না। যারা কেবল জ্ঞান দ্বারা মোক্ষকে মানে, তারা এটা বোঝে না যে এই ধরনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে কেবল বুঝে যাওয়া মাত্রই পূর্বকৃত কর্মের নাশ কিভাবে হতে পারে! কখনও কোনো বিজ্ঞানবেত্তা অপরাধের দণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছে কি? কক্ষনো না। মনু ভগবানের দণ্ডবিধানের মধ্যে তো ব্রাহ্মণ আর রাজাকে সর্ব সাধারণের দণ্ড থেকেও অনেক অধিক দণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। এইজন্য জ্ঞান উৎপন্ন হয়ে গেলেও আর বিবেক উৎপন্ন হয়ে গেলে পরেও যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর উৎপন্নকারী পূর্বকর্মের নাশ না হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত দুঃখের অত্যন্তাভাব হবে না, কিন্তু কর্মের নাশ বিনা কর্ম ভোগ করে হতে পারে না। কর্মের নাশ বিনা কর্মফল ভোগ করে হতে পারে না এটা ঠিক, তবে আমরা এটা অবশ্যই দেখি যে কর্মফলের ভোগ ক্ষীণ হতে পারে, কারণ কর্মফলের ভোগের সিদ্ধান্ত কর্মের লঘুতা-গুরুতার উপরে অবলম্বিত।
যে কর্মটি গুরু হয় তার ফল আগে আসে আর যেটি লঘু হয় তার ফল পরে আসে। যেভাবে জলের মধ্যে ফেলা একটি ছোটো পাথর ছোট্ট তরঙ্গ উৎপন্ন করে কিন্তু তারপরের ফেলা বড়ো পাথরটি ছোট্ট তরঙ্গকে মিলিয়ে বড়ো ঢেউ উৎপন্ন করে দেয়, সেইভাবে ছোটো কর্মফল বড়ো কর্মফলের সামনে চাপা পরে যায় আর বড়ো কর্মফল আগে হয়ে যায়। একই দিনে আগে-পরে করা লঘু-গুরু কর্মের পরিণাম আগে-পরে হওয়া দেখা যায়। প্রাতঃকালের দেওয়া দানের কীর্তি আটটার সময় হওয়া চুরির সামনে চাপা পরে যায় আর আটটার সময় হওয়া চুরির অপরাধ দশটার সময় হওয়া রাজার প্রাণরক্ষার সামনে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, এইজন্য খারাপ কর্মফলকে চাপানোর সবথেকে উত্তম উপায় হল এটাই যে নিঃস্বার্থভাবে লোকসেবা আদি বড়ো কর্ম করা। যজ্ঞ, দান আর ইষ্টাপূর্তকে করে স্কুল, হাসপাতাল, গোশালা আর ধর্মশালা নির্মাণ করে অথবা ধর্ম, দেশ আর জাতির সেবার জন্য সবদিক থেকে কষ্টকে সহ্য করে যেসব লোকজন লোককল্যাণের নিমিত্ত অনেক প্রকারের বড়ো কর্ম করে তাদের এই সুকৃত কর্ম পাপ ভোগের আগে হয়ে যায় আর পরবর্তী জন্মগ্রহণে বাঁধা উৎপন্ন করে আর তাই সব প্রকারের দুঃখ থেকে বেঁচে যায়।
ন্যায় দর্শন ১/১/২

বলার তাৎপর্য হল এটাই যে এই দুঃখদায়ী শরীর তখনই পাওয়া যায় যখন মানুষ অন্য কাউকে দুঃখ দেয়, কিন্তু যে কখনও কাউকে দুঃখ দেয়নি কেবল সবাইকে সুখই দিয়েছে, সে এই দুঃখদায়ী শরীর আর সংসারে কেন আসবে? এইজন্য দুঃখের অত্যন্তাভাবের জন্য উত্তম কর্মের আবশ্যকতা রয়েছে, কিন্তু যারা বলে যে কেবল কর্ম দ্বারাই মোক্ষ হয়, তারাও ভুল করছে। যদি গীতার কর্ময়োগের অনুসারে কর্ম করলেই মোক্ষ হয়ে যেত তাহলে কর্ময়োগের উপদেশকর্তা স্বয়ং কৃষ্ণই কেন বলেছেন যে "বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি" অর্থাৎ আমার অনেক জন্ম হয়েছে। এতে তো এটাই জ্ঞাত হচ্ছে যে তিনিও মুক্ত হননি। যদি এটাও মানা হয় যে ভগবান্ কৃষ্ণের উপর এই নিয়ম প্রযোজ্য হয় না তাহলে সেই অর্জুনেরই দশা দেখা উচিত যাকে কর্ময়োগের উপদেশ করা হয় আর যিনি সেই কর্ময়োগের অনুসারে যুদ্ধ করেন। মহাভারতের মধ্যেও লেখা রয়েছে যে মৃত্যুর পরে নরক যন্ত্রণায় তিনিও চিৎকার করছিলেন আর সেই যন্ত্রণা থেকে যুধিষ্ঠির বাঁচিয়ে ছিলেন যাঁকে কখনও কর্ময়োগের উপদেশই দেওয়া হয়নি। বলার তাৎপর্য হল যে কেবলমাত্র কর্ম দ্বারাই মোক্ষ হতে পারে না।
এখন বাকি রইলো উপাসনা। যারা বলে যে এটাই মোক্ষের সাধন, তারাও ভুল করছে। যেভাবে কেবল জ্ঞান আর কেবল কর্ম মোক্ষ সাধনের জন্য অসমর্থ, কিন্তু মোক্ষ সাধনের এক-একটি অঙ্গকে পূরণ করে সেইভাবে উপাসনাও করে। উপাসনাও একাই মোক্ষ প্রাপ্ত করতে পারবে না, কারণ উপাসনার দ্বারা শরীরের অত্যন্তাভাব হবে না, তবে সেটি মোক্ষের এক অঙ্গের পূর্তি করবে। যেভাবে জ্ঞানের দ্বারা বিবেক উৎপন্ন হয় আর কর্ম দ্বারা শরীরের অত্যন্তাভাব হয়ে যায় ঠিক সেইভাবে উপাসনা দ্বারা পরমাত্মার প্রাপ্তি হয়ে যায়, কারণ জ্ঞান, কর্ম আর উপাসনার মধ্যে এক উপাসনাই হল এরকম যা পরমাত্মাকে অন্তঃকরণের মধ্যে আবির্ভূত করাতে পারে। যেসময় মানুষ জ্ঞান দ্বারা বিবেক আর বৈরাগ্য উৎপন্ন করে মানুষ ছোটো-বড়ো সৎকর্মকে করে সমাধিতে পৌঁছে যায় আর স্থিরচিত্ত হয়ে যায় সেই সময় উপাসনার দ্বারাই সে পরমাত্মাকে আত্মার মধ্যে প্রকট হওয়ার প্রার্থনা করে। যদি উপাসনা দ্বারা দ্রবীভূত হয়ে পরমেশ্বর দর্শন না দেন তাহলে মানুষ জ্ঞান আর কর্ম দ্বারা কিছুই করতে পারবে না। যেভাবে চোখের মধ্যে পরে থাকা ধুলি কণাকে চোখ দেখতে পারে না সেইভাবে আত্মার মধ্যে ঢুকে থাকা পরমাত্মাকে বোঝা যায় না, কিন্তু যেভাবে চোখের কণা তার ঝিকমিকি দ্বারা চোখকে তার অনুভব স্বয়ং করিয়ে দেয়, সেইভাবে সমাধিস্থ শান্ত আত্মার মধ্যে নিত্য ব্যাপ্ত পরমেশ্বরও নিজের প্রেরণা দ্বারা নিজের অনুভব করিয়ে দেন। পরমাত্মার এই অনুভবই হল জীবনমুক্তি আর মোক্ষের প্রবল প্রমাণ। যতক্ষণ পর্যন্ত না পরমেশ্বরের অনুভব হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মোক্ষের মধ্যে সন্দেহই ভাবা উচিত, কিন্তু এই অনুভব উপরিউক্ত জ্ঞান, কর্ম আর উপাসনার মিশ্রিত প্রচেষ্টা দ্বারাই প্রাপ্ত হতে পারে, এইজন্য মোক্ষের না কেবল জ্ঞান, না কেবল কর্ম আর না কেবল উপাসনা, কিন্তু তিনটির মিশ্রণ যা আর্যদের বর্ণাশ্রমধর্মের মধ্যে ভরপুর রয়েছে। উপনিষদ্ বলছে -
আচার্য়কুলাদ্বেদমধীত্য য়থাবিধানম্ গুরোঃ
কর্ম্মাতিশেষেণাভিসমাবৃত্য কুটুম্বে শুচৌ দেশে
স্বাধ্যায়মধীয়ানো ধার্মিকান্বিদধদাত্মনি সর্বেন্দ্রিয়াণি
সম্প্রতিষ্ঠাপ্যাহিম্সন্সর্বভূতান্যন্যত্র তীর্থেভ্যঃ স
খল্বেবম্ বর্তয়ন্যাবদায়ুষম্ ব্রহ্মলোকমভিসম্পদ্যতে।
ন চ পুনরাবর্ত্ততে। ন চ পুনরাবর্ত্ততে।।
(ছান্দোগ্য উপ০ ৮|১৫|১)
অর্থাৎ - আচার্যকূল থেকে বেদাধ্যায়ন করে, গুরুকে দক্ষিণা দিয়ে, সমাবর্তন হওয়ার পর গৃহে এসে, স্বাধ্যায়রত থেকে আর ধার্মিক বিদ্বানদের সৎসঙ্গ দ্বারা, সকল ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে, অহিংসা ও বুদ্ধির দ্বারা সকল প্রাণীদের উপর দৃষ্টি রেখে আর পূর্ণ আয়ু পর্যন্ত এই ধরনের ব্যবহার করা বিদ্বানই ব্রহ্মলোক (মোক্ষ) -কে প্রাপ্ত করে, যেখান থেকে সে ফিরে আসে না, আসে না।
এটাই হল আর্য সভ্যতানুসারে মোক্ষ প্রাপ্ত করার মার্গ। এই মার্গের মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্ঞান, কর্ম আর উপাসনার মিশ্রণ পাওয়া যায়। এইজন্য এটা হল মোক্ষ প্রাপ্ত করার উপায় আর এটাই হল মোক্ষের স্বরূপ, স্থান আর উপায়ের কিছুটা দিগ্দর্শন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ