মূল বাল্মীকি রামায়ণে রামচন্দ্র জী দুর্গাপূজা করেন নি ! দুর্গাপুজার নামে আজকাল কলিকৌতুক আর মূর্তির প্রদর্শনীর খেলা চলে, তার মূলে কোন সত্য নেই।
বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, কালিকা পুরাণ, দেবী ভাগবত ইত্যাদি অর্ব্বাচীন গ্রন্থে তান্ত্রিক ভক্তরা দুর্গার মহিমা বাড়ানোর জন্য রচনা করেছিলেন-আর তারই উপর ভিত্তি করে কৃত্তিবাস জী তাঁর রামায়ণে এই পূজার উল্লেখ করে গেছেন। রামচন্দ্র জী ভারতবাসীর প্রাণপুরুষ, আদর্শ পুরুষ। তাঁকে দিয়ে পূজা করার কাহিনী রটাতে পারলেই বিনা বিচারে সবাই দেবী পূজা করবে, এই জন্যই তাঁরা এ সব করেছিলেন।
এই ভাবে, ভারতবর্ষে যখন শাক্তদের প্রাধান্য ছিল, তখন তারা পদ্মপুরাণ, দেবী ভাগবত, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, কালিকা পুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ রচনা করে নানা অলৌকিক আধ্যাত্মিকা বর্ণনা করে গেছেন, যাতে দেবীর প্রতিই সাধারণ মানুষের পরিপূর্ণ বিশ্বাস জন্মে। সাধারণ অজ্ঞলোক ছাপার অক্ষরে যা দেখে, তাই ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করে; তা যদি আবার দেবভাষা সংস্কৃতে রচিত হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই! সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য, যে পরিমাণ সত্যানুসন্ধিৎসা, গবেষণা এবং অধ্যবসায়ের দরকার, সাধারণ মানুষের তা নেই। সেইজন্য যখন যেটি সমাজের পণ্ডিত ব্যক্তিরা চালু করে গেছেন, আবার তা যদি তৎকালীন রাজা মহারাজা দ্বারা সমন্বিত হয়, তাহলে সবাই সেই প্রথা বা আচারকেই অনুসরণ করে চলে। যে সময় রাম রাজা হয়েছিলেন, সে সময় ঐ সব পুরাণ-উপকথার অস্তিত্বও ছিল না অজ্ঞলোকদের মধ্যে বিশ্বাস উৎপাদনের জন্ম এক সম্প্রদায়ের পণ্ডিত ব্যক্তিরা 'ব্যাসোবাচ’ 'শিবোবাচ' ইত্যাদি বাক্য দিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করে যে যার ইষ্টের প্রাধান্ত স্থাপন করে গেছেন। রাম যেহেতু সকলের বরেণ্য পুরুষ, এ জন্য শক্তিরা রাম জীকে দিয়ে দুর্গাপূজা করার কাহিণী উদ্বোধন করে সমাজে চালু করে গেছেন।
বিচার করে দেখুন, রাম যদি দুর্গাপুজা করে থাকতেন, তাহলে বাল্মীকির চেয়ে সে সম্বন্ধে আর কে তা ভাল জানবেন ? রামচন্দ্র জীর দুর্গাপূজার গল্পটি কৃত্তিবাসজীর কৃর্ত্তি তিনি এই গল্পটির সংয়োজনা করেছেন।
রামের দুর্গাপূজার গল্পটিও এই ধরণের একটি সংযোজনা মাত্র। বাল্মীকি রামায়ণ পড়লেই বুঝতে পারবেন, যখন লঙ্কাযুদ্ধ শুরু হয় তখন আশ্বিন কার্তিক মাস, শরৎকাল শেষ হয়ে গেছে। বালীবধের পর রাম সুগ্রীবকে বলছেন_______ "এখন চার মাস বর্ষাকাল (আষাঢ় হতে আশ্বিন ), এখন যুদ্ধোদ্যোগের সময় নয় ; কার্ত্তিক মাস পড়লে রাবণ বধের আয়োজন করবে, এখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন কর" ।
"প্রবৃতাঃ সৌম! চত্বারো মাসাঃ বার্ষিক সজ্ঞকাঃ।
নারমুদ্যোগ সময়ঃ প্রবিশ ত্বাং পুরীং শুভাম্।” (কিষ্কিদ্ধাকান্ড)
___কাজেই সাড়ম্বরে দুর্গাপূজায় পরবর্তীকালে মেতে উঠবার সুযোগ দেওয়ার জন্য শরৎকালে রামের শারদীয়া দুর্গাপুজার অবকাশ কোথায়?
তাও আবার লঙ্কাতে, রাবণ বধের সময় ? লঙ্কাতে, ওর যাওয়ার পূর্ব্বেই তো আশ্বিন মাসটি গত হয়েছিল! সীতার অন্বেষণ করতে করতেই আশ্বিন মাস বহু পূর্ব্বেই যে গত হয়ে গিয়েছিল তা সীতান্বেষণরত হতাশ বানর পুরুষদের কথাতেই বোঝা যায়—
“বরমাশ্বযুদ্ধে মাসি কাল সংখ্যা ব্যবস্থিতা,
প্রস্থিতাঃ সোহপিচা তীত কিমতঃ কার্যমুত্তরম্।। (কিষ্কিন্ধাকাণ্ড)
তবুও যদি কেউ কৃত্তিবাসের বর্ণনাকে প্রামাণ্য ধরে, তাঁর বর্ণিত রামের দুর্গাপুজাকে সত্য বলে ধরে নিয়ে একটা Spiritual importance দেয়,
তাহলে ঐ কৃত্তিবাসী রামায়ণেরই ঘটনাগুলি পারম্পর্যক্রমে বিচার করলেই দেখতে পাবেন,আশ্বিন মাসের শারদীয়া দুর্গোৎসবের মূল ভিত্তি টিকবে না।
'রাম আশ্বিন মাসে এই দুর্গাপূজা করেছিলেন' বলে যে দুর্গাপুজার নামে আজকাল কলিকৌতুক আর মূর্তির প্রদর্শনীর খেলা চলে, তার মূলে কোন সত্য নেই।
দুর্গাপূজা বাঙ্গালীর সৃষ্টি, খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজসাহীতে হাহেরপুরের ভূঞ্যা রাজা ছিলেন কংসনারায়ণ খাঁ ["বঙ্গভাষা ও সাহিত্য", ডঃ দীনেশ সেন]। তিনি যজ্ঞ করতে মনস্থ করায় তাঁর পুরোহিত এবং শ্রেষ্ঠ সভাপণ্ডিত, (নাটোরস্থ বাসুদেবপুর গ্রামের) পণ্ডিত রমেশ চন্দ্র শাস্ত্রী জী যজ্ঞের (অশ্বমেধ) অনুরূপ এক মহা আড়ম্বরময় মহাপূজার ব্যবস্থা, মন্ত্রাদি পদ্ধতির নিয়মাদি রচনা করে ছিলেন তাই প্রথম দুর্গাপূজা ছিলো। এই পূজা রাজা খংসনারায়ণ খাঁ তখনকার দিনে প্রায় আট লক্ষ টাকা ব্যায় করে করেছিলেন। মহাকবি কৃত্তিবাস জী ছিলেন এই ভূঞ্যারাজা কংসনারাণেরই সভাকবি।
মহাভারতে ভীষ্মপর্বের তেইশ অধ্যায়ে গীতা আরম্ভের পূ্র্বেই সম্প্রদায়ীরা নিজেদের স্বার্থে মুনিঋষির নাম করে দুর্গাস্তব ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
পল্লীতে পল্লীতে, শহরে গলিতে হাজার হাজার টাকার চাঁদা তুলে জর মূর্ত্তিপূজার মাধ্যমে আনন্দময়ীর আহ্বানের প্রহসন চলছে। বেদে উপনিষদে ভদ্রা,দুর্গা,উমা শক্তি প্রভৃতি যে নাম পাওয়া যায় তা একই পরমাত্মা বাচক অর্থে ব্রহ্ম বিদ্যাপ্রকাশিকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পৌরাণিক গ্রন্থকারেরা এই সকল অংশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে
কালী, তারা, দুর্গা, যোড়শী বগলামুখী ইত্যাদি এক একটা স্বতন্ত্র দেবী বানিয়ে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র মূর্ত্তিপূজার প্রচলন করে গেছেন। দেবী বলতে পৃথক কোন ঠাকুর নয়, পরমেশ্বররের নামই দেবী। পরমেশ্বরেরে নাম তিনলিঙ্গেই আছে, যথা-"ব্রহ্মচিতিরীশ্বরশ্চেতি"; যখন ঈশ্বরের বিশেষণ তখন "দেব" আর যখন চিতির বিশেষণ হ'বে তখন "দেবী"।
বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণ থেকে প্রমাণ গুলো দেখুনঃ-
পূর্বোহয়ং বার্ষিকো মাসঃ শ্রাবণঃ সলিলাগমঃ।
প্রবৃত্তাঃ সৌম্য চত্বারো,মাসা বার্ষিকসংজ্ঞিতাঃ। ১৪
নায়মুদযোগসময়ঃ,প্রবিশ ত্বং পুরীং শুভাম্।।
অস্মিন্ বৎস্যাম্যহং সৌম্য পর্বতে সহলক্ষ্মণঃ।।১৫
ইয়ং গিরিগুহা রম্যা বিশালা যুক্তমারুতা।
প্রভূতসলিলা সৌম্য প্রভূতকমলোৎপলা।।১৬
কার্তিকে সমনুপ্রাপ্তে ত্বং রাবণবধে যতঃ
এষ ন সময়ঃ সৌম্য!প্রবিশ ত্বং স্বমালয়ম্।
অভিষিচ্যস্ব রাজ্যে চ সুহৃদঃ সম্প্রহর্ষয়।।১৭
বাল্মীকি রামায়ণম্ কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড ষড়্ বিংশঃ সর্গঃ শ্লোক ১৪,১৫,১৬,১৭
___অর্থঃ (বালী বধের পর, রাম জী সুগ্ৰীবকে বলছেন) জল বর্ষণের,চারমাস'কে বর্ষাকাল বলা হয়।এখন বর্ষার মাস শ্রাবণ মাস চলছে। ১৪
সৌম্য!! এখন আমাদের সীতা উদ্ধারের জন্য উদ্যোগের সময় নয়। সুতরাং,তুমি এখন পুরীতে প্রবেশ কর, আমিও লক্ষ্মণের সঙ্গে এই পর্বতে বাস করি।এই পর্বত-গুহা প্রশস্ত ও সুন্দর,এখানে বায়ুর চলাচল হয়।
এই স্থানের কাছাকাছি প্রচুর জল বিশিষ্ট অনেক পদ্মফুল শোভিত জলাশয় আছে। [১৫,১৬]
সৌম্য! বর্ষা শেষ হলে কার্তিক মাসে রাবণ বধের জন্য তুমি উদ্যোগী হবে,এখন তার সময় নয়। সুতরাং,এখন তুমি নিজের গৃহে যাও ও রাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে,সুহৃদদেরকে আনন্দিত কর। [১৭]
অর্থাৎ ,যখন রাম যুদ্ধের উদ্যোগ আরম্ভ করবেন, তখন,কার্তিক মাস, শরৎকাল শেষ হয়ে গেছে!!!
তাহলে,শরৎকালে রাম যখন যুদ্ধযাত্রাই করেননি, তখন শরৎকালে, অকালবোধন হল কিভাবে?!!
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ