ঈশ্বর নিরাকার নাকি সাকার ? - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

25 October, 2022

ঈশ্বর নিরাকার নাকি সাকার ?

 • শাস্ত্রার্থ আরম্ভ •

🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
(১) ত্রয়ম্বকম্ য়জামহে... (য়জুর্বেদ) (২) প্রজাপতিশ্চরতি... গর্ভে অন্তরজায়মানো বহুধা বিজায়তে... তথা (৩) য়স্য পৃথিবী শরীরম্... ইত্যাদি।।
Note : এখানে কেবল প্রমাণই ছাপা পাওয়া গেছে, সম্পূর্ণ পাঠ পাওয়া যায়নি, অতঃ প্রমাণই উদ্ধৃত করতে হল, সম্পূর্ণ বার্তা ও পাঠ হলে ভালো হতো। (সম্পাদক)
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এই মন্ত্রগুলোকে যদি মনোযোগ দিয়ে পড়া যায় তাহলে কোনো নিষ্পক্ষ বিদ্বানও এই মন্ত্রগুলো থেকে সাকারবাদকে সিদ্ধ করতে পারবে না, "প্রজাপতিশ্চরতি..." মন্ত্রের মধ্যে তো প্রভুকে স্পষ্ট রূপেই "অজায়মানঃ" (যে জন্ম নেয় না) বলা হয়েছে। মহিধর আদিও এরকমই ব্যাখ্যা করেছে। "ত্রয়ম্বকম্ য়জামহে..." এর ত্রিনেত্রধারী অর্থ কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় না আর পৃথিবী আদির শরীর বা সূর্য চন্দ্রের চক্ষুতুল্য বলা তো ঈশ্বরের সাকারবাদকে সিদ্ধ করে না। এটা তো পরমাত্মার সর্বব্যাপকতা, রচনা, চাতুর্থ তথা মহত্বকেই সিদ্ধ করছে।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
যারা মূর্তি পূজা করে না কেবল নিরাকারের ভক্তি চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে করে তাদের গীতার মধ্যে "মিথ্যাচার" বলা হয়েছে। দেখুন -
কর্মেন্দ্রিয়াণি সম্য়ম্য য় আস্তে মনসা স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ।।
(গীতাঃ ৩|৬)
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
বিদ্বানের কর্তব্য হল যে, সে সত্য অর্থকে জনসাধারণের মধ্যে প্রকাশ ও শিক্ষার প্রসার করবে, কিন্তু যার কাজই হল যে সারাজীবন যেমনটা করেই হোক জনতাকে মূর্খ বানিয়ে স্বার্থ-সাধন করতে থাকা উচিত, তো সে গীতাকে পরম পবিত্র মেনেও তার কিভাবে সত্যার্থ করতে পারবে?
এই শ্লোকটির ব্যাখ্যাও লোকজনের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য উল্টোই করা হয়েছে। এই শ্লোকটির অর্থ এক সামান্য সংস্কৃতজ্ঞও জানতে পারবে তা সত্ত্বেও এখানে জেনেশুনে অনর্থ করা হয়েছে। এরকম আত্ম হননকারীর কি কখনও ভালো গতি হতে পারে? এরকম ব্যক্তি - অসূর্য়া নাম তে লোকাঃ...য়ে কে চাত্মহনো জনাঃ।" (য়জুর্বেদ) বেদমন্ত্রের অনুসারে নরকগামী হয়। গীতার শ্লোকে তো তাকে মিথ্যাচার বলা হয়েছে, যে ইন্দ্রিয়ের সংযম করে তো বসেছে কিন্তু মন নিয়ন্ত্রণে নেই, তারফলে এদিক-সেদিক গতি করতে থাকে। বলুন এরমধ্যে নিরাকার ব্রহ্মের সন্ধ্যাতে বসে থাকা উপাসকের উপহাস কোথায় আছে? এর বিপরীত গীতাই অবতারবাদী মূর্তিপূজকদের মূঢ় (মূর্খ) বলে ধিক্কার করছে, যথা -
অবজানন্তি মাম্ মূঢ়া মানুষীম্ তনু মাশ্রিতম্।।
(গীতাঃ ৯|১১)
অর্থাৎ - পরমেশ্বরের স্বরূপকে না জেনে সে মূর্খ ব্যক্তি ভগবানের অপমান করে, যে ভগবানকে শরীরধারী ভেবে পূজো করে। আর উপাসনার সত্য পদ্ধতির নির্দেশ করে গীতার মধ্যে লেখা আছে -
সর্বদ্বারাণি সম্য়ম্য মনোহৃদি নিরুধ্য চ
(গীতাঃ ৮|১২)
তথা -
ওমিত্যেকাক্ষরম্ ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মামনুস্মরন্।।
(গীতাঃ ৮|১৩)
অর্থাৎ - নেত্র আদি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে ব্রহ্ম বিষয় দিয়ে থামিয়ে রেখে, মনকে হৃদয়স্থ, জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলন কেন্দ্রের মধ্যে পরমাত্মার ভক্তিতে লাগিয়ে "ও৩ম্" শব্দের উচ্চারণ করার সঙ্গে পরমেশ্বরের ধ্যান করবে।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
পরমেশ্বর সর্বব্যাপক, একথা আর্য সমাজও মানে, সুতরাং মূর্তির মধ্যেও পরমেশ্বর আছে তাহলে তার উপাসনার খণ্ডন কেন করছেন?
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এটা তো সত্য যে, পরমেশ্বর সর্বব্যাপক হওয়ার দরুণ পরমেশ্বর মূর্তির মধ্যেও আছে, কিন্তু উপাসনার স্থান সেটাই হতে পারে যেখানে উপাসক তথা উপাস্যের সান্নিধ্য হয়ে থাকে। কারণ মূর্তির মধ্যে উপাস্য তো আছে কিন্তু উপাসক নেই, সুতরাং মূর্তি উপাসনার স্থান হতে পারে না। পরমাত্মা তো সর্বত্র ব্যাপক, তাঁর সঙ্গে মিলন জীবাত্মার নিবাস স্থান হৃদয়ের মধ্যেই হতে পারে, কারণ হৃদয়ের মধ্যেই উপাসকের সান্নিধ্য নিজের উপাস্য দ্বারা সম্ভব।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
স্বামী দয়ানন্দজী যদিও অনেক স্থানে মূর্তি পূজার খণ্ডন করেছেন, কিন্তু নিজের পুস্তক আর্যাভিবিনয়ের মধ্যে মূর্তি পূজাকে মেনেছেন। এটার পুষ্টি -
বায়বা য়াহি দর্শতেমে সোমা অরঙ্কৃতাঃ
(ঋগ্বেদঃ ১|১|৩|১)
এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা দ্বারা মূর্তি পূজা সিদ্ধ হচ্ছে, দেখুন - হে অনন্তবল পরেশ বায়ো দর্শনীয়! আমরা অল্প শক্তি দিয়ে সোমবল্ল্যাদি ঔষধির উত্তম রস সম্পাদন করেছি আর যা কিছু আমাদের শ্রেষ্ঠ পদার্থ আছে তা আপনার জন্য অলঙ্কৃত অর্থাৎ উত্তম রীতিতে আমরা বানিয়েছি আর সেসব আপনাকে সমর্পণ করা হয়েছে, তাকে আপনি স্বীকার করুন। (সর্বাত্মা দিয়ে পান করো) এই ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে, সোম আদির রস পরমাত্মা পান করেন। আর এই পান ক্রিয়া বিনা মুখ আদি শরীরাবয়বে হতে পারে না, সুতরাং পরমেশ্বরের অবতার ও মূর্তিপূজা স্বামী দয়ানন্দজীর অনুসারেও সিদ্ধ হচ্ছে।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
ভাই আমার, পূর্ব পক্ষী শাস্ত্রার্থের মধ্যে অনেকবার এই মন্ত্র ব্যাখ্যাকে প্রস্তুত করেছে, কিন্তু তারা স্বামী দয়ানন্দের ভাষা শৈলীকে না বুঝে জনসাধারণের মধ্যে ভ্রান্তি তৈরি করার সাহস মাত্রই করছে। আসলে এই মন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়ে এই ভাব কখনও বের হয় না, এর নিম্ন লিখিত কারণ আছে -
(১) এই ব্যাখ্যার মধ্যে লেখা আছে - "সর্বাত্মা দিয়ে পান করো" কখনও কি সর্বাত্মা দিয়ে পান করা সম্ভব? যদি পান করাই অর্থ মানা হয় তাহলে পান করা তো মুখ দিয়ে হয়, সুতরাং ধাত্বর্থকে অনেকার্থক মেনে এখানে "পান করো" এর অর্থ স্বীকার করা হবে আর এটাও ভক্তের উৎকৃষ্ট দশার সূচক যে, যা দিয়ে ভক্ত নিজের সমস্ত কর্মকে নিরপেক্ষ হয়ে ঈশ্বরার্পণ করতে থাকে।
(২) মহর্ষির ভাষাকে বোঝার জন্য তৎকালীন পরিস্থিতিকেও বোঝা উচিত। মহর্ষির সময়ে হিন্দি ভাষার এই স্বরূপ কোথায় ছিল? যাকে আমরা আজকাল ব্যবহার করি। মহর্ষি তো সংস্কৃতের আশ্রয় করে হিন্দি ভাষা লেখেন তাই মহর্ষির ভাষার মধ্যে বিধি, অগ্নি, বায়ু ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ সংস্কৃতের অনুসারেই হয়েছে, যেরকম সংস্কারের বিধি লেখা হয়, "অগ্নি জ্বলে" ইত্যাদি। যদি কোনো ব্যক্তি পূর্বোক্ত বাক্যকে আধুনিক হিন্দির আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা বলার সাহস করে তাহলে এটা তার মহা ভ্রান্তিই হবে।
একইভাবে স্বামীজীর ভাষার মধ্যে প্রেরণার্থক ক্রিয়াকে অপ্রেরণার্থক ক্রিয়ার মতোও প্রয়োগ করা হয়েছে। যেরকম ঈশ্বর স্তুতি প্রার্থনোপাসনার মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে মহর্ষি লিখেছেন - "যে (ভদ্রম্) কল্যাণ কারক, গুণ, কর্ম, স্বভাব আর পদার্থ আছে সেসব আমায় প্রাপ্ত করুন" যেমন এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে "করুন" এর অভিপ্রায় "করান" হবে, অন্যথা মন্ত্রার্থ সংগতি লাগবে না। সেভাবেই পূর্বোক্ত মন্ত্র ব্যাখ্যাতেও "পান করো" এর অর্থ "পান করান" হবে। মহর্ষির এই ভাষার প্রবাহকে না বুঝেই পূর্বপক্ষী মহর্ষির উপর মিথ্যা আক্ষেপ করেছে।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
স্বামী দয়ানন্দজী সংস্কার বিধির চূড়াকর্ম সংস্কারে "শিবো নামাসি..."(য়জুঃ ৩|৬৩) মন্ত্রের বিনিয়োগ করেছেন। এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা এক আর্য সমাজের মহান পণ্ডিত শ্রী রামগোপালজী বিদ্যালঙ্কার করেছেন যে - হে উস্তরে! তোমার নমস্কার হোক "। ইত্যাদি, যদি আর্য সমাজী জড় উস্তরের পূজা করতে পারে তাহলে তাদের মূর্তিপূজাতে আপত্তি কেন আছে?
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
আর্য সমাজ বেদকে স্বতঃ প্রমাণ নিভ্রন্তি জ্ঞান মানে। তাতে লেখা ঋষিদেরই ব্যাখ্যাকে প্রামাণিক মানে। তাই পণ্ডিত রামগোপালজীর মন্ত্র ব্যাখ্যা আমাদের জন্য প্রমাণ নয়। এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা মহর্ষি দয়ানন্দ এইভাবে করেছেন যারমধ্যে জড় উস্তরের থেকে লেশমাত্রও প্রার্থনা করা হয়নি। অতঃ জড় পূজক পৌরাণিকদের আর্যসমাজের উপর করা আক্ষেপ নিরাধার। মহর্ষির ব্যাখ্যা দেখুন -
"হে (রুদ্র) ঈশ্বর! বা উপদেশক! আপনি (স্বাধিতিঃ) অমর হওয়াতে বজ্রময় (অসি) হন আর যে (তে) আপনার (শিবঃ) মঙ্গল স্বরূপ জ্ঞানময় বিজ্ঞানদাতা (নাম) রয়েছে, তাই আপনি আমার (পিতা) পালক হন (তো) আপনাকে (নমঃ অস্তু) নমস্কার হোক"।
আর যদি মন্ত্র বিনিয়োগকে দেখেও মন্ত্রার্থ করা হয়, তাহলেও জড় পূজা সিদ্ধ হবে না। যে ব্যক্তি বেদের কাব্যময়ী ভাষা হতে অনভিজ্ঞ, সে উল্টোপাল্টা অর্থ করে আর্য সমাজের উপর আক্ষেপ করে তো তাকে প্রমত্ত প্রলাপই ভাবা উচিত। কারণ সে লৌকিক ব্যবহার হতেও অনভিজ্ঞ। আমি নগরে গিয়ে প্রতিদিন এই ব্যবহার দেখি যে রিক্সাচালককে রিক্সা শব্দের দ্বারাই ডাকা হয় আর রিক্সাচালক এসে যায়। সাহিত্যের মধ্যেও - "মঞ্চাঃ ক্রোশন্তি" বাক্য দ্বারা মাচায় বসে থাকা ব্যক্তির আক্রোশের অর্থই নেওয়া হয়। সেইরকম চূড়াকর্মের মধ্যে উস্তরে থেকে অভিপ্রায় উস্তরা ধারণকারী নাপিতের নিকটই প্রার্থনা করা হয়। তুমি এইদিকের কর্মে অতি দক্ষ, তুমি এই বালকের ক্ষৌর কর্ম খুবই ধ্যানপূর্বক করো, আমি তোমার অন্নাদি দিয়ে সৎকার করছি ইত্যাদি।
Note: এইভাবে মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত মন্ত্র ব্যাখ্যা দ্বারা জড় পূজার সর্বদা নিরাকরণ করার পরেও পূর্বপক্ষী বারংবার একই কথা আবৃত্তি করতে থাকে, যা শ্রোতাদের উপরে খুবই খারাপ প্রভাব পড়েছিল, আর পণ্ডিত প্রেমাচার্যজীর উদ্দেশ্যে এটা বলতে শোনা যায় যে এটা কিরকম বিদ্বান? এটা তো কিছুই পারে না।

🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
সাকার এবং নিরাকার হল পরমাত্মার দুটি রূপ। এরমধ্যে আরও একটি প্রমাণ দেখুন -
দ্বেবাব ব্রহ্মণোম্ রূপে মূর্ত্তম্চৈবামূর্ত্তম্ চ
অর্থাৎ - ব্রহ্মের রূপ হল দুটি মূর্ত্ত - সাকার আর অমূর্ত্ত - নিরাকার। এইজন্য মূর্তিপূজা বেদক্ত।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এটাও সরল সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে প্রতারণামূলক প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম তো এই প্রমাণ এইজন্য সত্য নয় কারণ যখন প্রথমেই নিশ্চয় করা হয়েছিল যে - নিজের নিজের পক্ষে বেদেরই প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু এটা বৃহদারণ্যকোপনিষদের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে আর এটারও ব্যাখ্যার প্রকরণকে সম্পূর্ণভাবে তিলাঞ্জলি দিয়ে করা হয়েছে। এখানে প্রকরণটি পরমাত্মার নয়। দেখুন -
দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্ত্তঞ্চৈবামূর্ত্তঞ্চ...।।
তদেতন্মূর্ত্তম্ য়দন্যদ্বায়োশ্চান্তরিক্ষাচ্চ...।।
অথামূর্ত্তম্ বায়ুশ্চান্তরিক্ষম্...।।
(বৃহদারণ্যকোপনিষদঃ অধ্যায় ২ ব্রাহ্মণ ৩ কণ্ডিকা ১-৩)
এখানে প্রকরণের অনুসারে জগতের বর্ণনা আছে। এই জগৎ হল পঞ্চ ভৌতিক। আর এই পঞ্চভূতের মধ্যেও ক্রম এই হল যে - যার থেকে যেটি সূক্ষ্ম, তার গুণ স্থুলের মধ্যে আসে। দৃশ্য পদার্থের মধ্যে রূপ-গুণটি অগ্নির আছে, সেটা তার স্থূল জল ও পৃথিবীর মধ্যেও আছে তাই রূপ গুণকারী হওয়ার জন্য অগ্নি, জল ও পৃথিবী হল মূর্ত্তরূপ, আর আকাশ, বায়ু হল অমূর্ত্ত। এই বাক্যটিকে ঈশ্বরের সাকার রূপের পুষ্টির জন্য বললে পরে সর্বদাই অসঙ্গত হওয়ার জন্য মিথ্যা হবে।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
বেদের মধ্যে পরমেশ্বরের সাকার বর্ণনা অনেক স্থানে করা আছে, তবুও বেদোক্ত কথাকে যদি আর্য সমাজ অস্বীকার করে তাহলে আমি তাদের কি বলবো? দেখুন বেদের মধ্যে একটি মন্ত্র আছে -
মুখায় তে পশুপতে য়ানি চক্ষূম্ষি তে ভব।
ত্বচে রূপায় সম্দৃশে প্রতীচীনায় তে নমঃ।।
(অথর্বঃ ১১|২|৫)
এই মন্ত্রের মধ্যে পরমেশ্বরের সাকার রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ ত্রিনেত্রধারী পশুপতি শিবজীর মুখকে নমস্কার করা হয়েছে।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এই মন্ত্রটিরও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কারণ এই মন্ত্রটির যে দেবতা সেই দেবতার অন্য মন্ত্রগুলোর মধ্যে একটি মন্ত্রে "ভবাশর্বৌ" - "ভূতপতী" - "পশুপতী" (অথর্বঃ ১১|২|১) দ্বিবচনান্তের প্রয়োগ পাওয়া যায়, যার দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে লোকের মধ্যে শিবের বাচক "ভব, শর্ব" শব্দ বেদের মধ্যে একটি শিবের জন্য নয়। আর (অথর্বঃ ১১|২|৩) মন্ত্রের মধ্যে "সহস্রাক্ষায়" পদ ত্রিনেত্রধারী শিবজীর খণ্ডন করছে, আর সর্বব্যাপক প্রভু কখনও দুঃখী হন না। তিনি তো সর্বদা আনন্দস্বরূপ, কিন্তু এই সূক্তেরই (এই মন্ত্রের) মধ্যেই "ক্রন্দায়" পদ রুদ্রের জন্য এসেছে, যার দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে এই বিশেষণটি রুদ্রের নয়। বরং ভক্ত নিজের ক্রন্দন (দুঃখজনক) কাজ থেকে নিবৃত্তির জন্য রুদ্র (ঈশ্বরের) নিকট প্রার্থনা করছে। পূর্বপক্ষীর দ্বারা উদ্ধৃত মন্ত্রটির সঠিক অর্থ এইরকম হবে -
"হে (পশুপতে) সমস্ত দৃশ্যমান প্রাণীদের রক্ষক! (ভব) হে সমস্ত সুখের উৎপাদক পরমেশ্বর! আমাদের যে (য়ানি চম্ক্ষূষি) জ্ঞানের সাধন আছে তার জন্য (ত্বচে) আমাদের ত্বচার জন্য (রূপায়) সৌন্দর্যের জন্য (সম্দৃশে) ভালো স্বাস্থ্যের জন্য (প্রতীচীনায়) আমাদের পশ্চাৎ অর্থাৎ পরোক্ষের মধ্যেও রক্ষা করার জন্য আর (মুখায়) মুখ তুল্য বিদ্বান ব্রাহ্মণদের রক্ষার জন্য (তে নমঃ) আপনাকে নমস্কার করছি।"
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
শতপথের মধ্যে মাটি দিয়ে মহাবীরের মূর্তি নির্মাণের বিধান করা আছে, যার দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে মূর্তিপূজা করাটা শাস্ত্রোক্ত।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
শতপথ ব্রাহ্মণের মধ্যে মহাবীর নামক যজ্ঞের পাত্র মাটি দিয়ে নির্মাণ লেখা আছে, সেটা পরমেশ্বরের মূর্তির না।
Note: প্রতিপক্ষী এর কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল বারংবার এটাই বলতে থাকে যে - এটা কোন যজ্ঞের পাত্র? স্বামী দয়ানন্দ সংস্কারবিধির মধ্যে যজ্ঞ পাত্রের বিবরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে কোনটা মহাবীর পাত্র? আদি। তবে এটা মুখ্য বিষয় থেকে পলায়নই ছিল, যাতে যজ্ঞ পাত্রের নির্মাণের কথা নিয়ে পরমেশ্বরের মূর্তির ভ্রান্তি ছড়ানো যায়।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
স্বামী দয়ানন্দজীও কোমরের মেরুদণ্ডের হাড্ডির মধ্যে ধ্যান লাগানোর কথা বলেছেন। এই মাংস রুধির যুক্ত হাঁড়ের মধ্যে ধ্যান লাগানোর চেয়ে তো আমাদের মূর্তি পূজাই অনেক ভালো। কারণ এই দুটোই হল জড়, সুতরাং যারা স্বয়ং জড়ের পূজা করছে তাদের অন্য মূর্তি পূজকদের খণ্ডন করার কোনো অধিকার নেই।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এখানে পূর্বপক্ষী প্রতারণা করারই সাহস করেছে। "দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা" (য়োগদর্শন) এই সূত্রের অনুসারে য়োগ সাধনকারী সাধককে ধ্যান আর সমাধির পূর্বে ধারণা করতে হয়। আর এই ধারণা শরীরের ভিতর যথা নাভি, মস্তক, নাসিকা, হৃদয় আদি স্থানের মধ্যেই করা হয়, শরীরের বাইরের নয়। আর ধারণার অভ্যাস পরিপক্ক (দক্ষ) হয়ে গেলে ধ্যায় - পরমেশ্বরের মধ্যে নির্বিষয় হয়ে মগ্ন হওয়াকে ধ্যান বলে, অতঃ ধারণাকেই ধ্যান বলা সর্বদা অল্পজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিজনক হবে।
যদি পূর্বপক্ষী এটাই মনে করে যে মেরুদণ্ডের হাঁড়ের মধ্যে ধারণা করাই হল জড় পূজা, তাহলে প্রথম তো একথা সর্বদা অব্যবহারিক হবে যে, কোনো ব্যক্তি নিজের মেরুদণ্ডের হাঁড়কে দেখতে পারে, আর যখন ভক্ত এরকম কখনও করতে পারে না তাহলে এটার এরকম সঙ্গতি লাগানো প্রসঙ্গ বিরুদ্ধ হবে। ইন্দ্রিয়কে বাহ্য বিষয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের অন্তর্গত কোনো স্থানের উপরই মনকে একাগ্র করার কথা য়োগদর্শনকার বলেছেন। স্বামী দয়ানন্দও সেই কথা লিখেছেন। অতঃ স্বামীজীর লেখা থেকে মূর্তিপূজা কখনও সিদ্ধ হবে না।
🔵 শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী শাস্ত্রী -
আপনি আমার কোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেন নি। "ন তস্য প্রতিমা অস্তি..." এর মধ্যে স্পষ্ট লেখা আছে যে মূর্তি পূজা বেদোক্ত, অন্য প্রশ্নও আমার যেমনটা তেমন আছে। আগে তার উত্তর দেওয়ার কৃপা করুন।
🟠 শ্রী পণ্ডিত ওমপ্রকাশজী শাস্ত্রী -
এটা তো সত্য যে - "প্রতিমা" শব্দকে মূর্তি ছাড়া ভিন্ন তোলার বা মাপার সাধনকেও (গ্রাম, কিলোগ্রাম আদি) প্রতিমা বলে, যথা "প্রতিমীয়তে য়থা সা প্রতিমা" অর্থাৎ প্রমাণ বা পরিমাণ যা দিয়ে করা যায় তাকে প্রতিমা বলে, তাই ভগবান্ মনু "প্রতিমানাম্ চ ভদেকঃ" বলে তোলা আদির সাধনের মধ্যে ত্রুটিকারককে দণ্ড দেওয়ার বিধান করেছেন। কিন্তু অনেকার্থক শব্দ প্রসঙ্গের মধ্যে এসে অনেকার্থক হয় না। "ন তস্য প্রতিমাऽঅস্তি... (য়জুঃ ৩২|৩) মন্ত্রটির দেবতা হল "পরমাত্মা", অতএব ঈশ্বর বিষয়ক ব্যাখ্যারই সঙ্গতি হচ্ছে। মহর্ষি কৃত এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা দেখুন -
(তস্য) পরমেশ্বরস্য (প্রতিমা) প্রতিমীয়তে য়থা
তত্পরিমাপকম্ সদৃশম্ তোলন সাধনম্
প্রতিকৃতিশকৃতির্বা (ন অস্তি) ন বর্ত্ততে"।
অর্থাৎ - সেই পরমেশ্বরের প্রতিমা অর্থাৎ মাপার, তার আকৃতি অথবা সদৃশ প্রতিকৃত - মূর্তি নেই। (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য) অতঃ প্রতিপক্ষী বিদ্বান মহর্ষির ব্যাখ্যা বলে এই মন্ত্রটির বিষয়ে যে ভ্রান্ত বিচার রেখেছেন, সেটা ভ্রান্তিমূলক অসঙ্গত আর মিথ্যা।
•উপসংহার•
🟤 শ্রী পণ্ডিত রাজবীরজী শাস্ত্রী -
শাস্ত্রার্থের উপরিউক্ত কতিপয় সমস্মরণ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রতিপক্ষী বিদ্বান শ্রী পণ্ডিত প্রেমাচার্যজী নিজের পক্ষের পোষণে বৈদিক প্রমাণের অভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে সেইসব পুরোনো অচল অসঙ্গত, মিথ্যা এবং অবৈদিক কথাকেই বারংবার নিজের স্বভাবানুসার বলতে থাকেন, যার ফলে শ্রোতাদের উপর ভালো প্রভাব আর কি পড়বে বরং লোকের মুখে এটাই বলতে শোনা যায় যে, - যে ব্যক্তি বেদের নামে মিথ্যা প্রমাণ দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কেবল ভ্রান্তি তৈরি করে সে কি বিদ্বান হওয়ার যোগ্য?
মূর্তি পূজা বা ঈশ্বরের সাকারবাদ একটি অতীব বিবাদাস্পদ বিষয় আস্তিকদের মধ্যে আছে কিন্তু যদি বেদ শাস্ত্রের প্রমাণের উপর গম্ভীরতার সঙ্গে বিচার করা হয় তাহলে সাকারবাদ স্বতঃ ধরাশাহী হয়ে যায়। উপাসনার প্রসিদ্ধ এবং সর্বমান্য য়োগ শাস্ত্রকার উপাসনার ক্ষেত্রে সবথেকে বড়ো বাধা অবিদ্যাকে মেনেছেন। আর অবিদ্যার স্বরূপকে স্পষ্ট করে লিখেছেন - যে ব্যক্তি অনিত্য পদার্থের মধ্যে নিত্য বুদ্ধি তথা অনাত্মা - জড় বস্তুর মধ্যে চেতন বুদ্ধি রাখে, সে অবিদ্যা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারবে না, তথা ঈশ্বর ভক্তির পাত্রও হয়ে উঠতে পারবে না, অতঃ জড় মূর্তির মধ্যে ঈশ্বরের ভাবনা করা সবথেকে বড়ো অবিদ্যা হবে।
ঈশ্বর উপাসনার ক্ষেত্রে মূর্তি পূজার ধারণাটি ঈশ্বরের যথার্থ স্বরূপকে না বুঝতে পারার কারণে ছড়িয়েছে, য়জুর্বেদের (৪০|৮) মধ্যে ঈশ্বরের স্বরূপের উপর বিচার করা হয়েছে। যথা - "স পর্য়গাত্"- সেই ঈশ্বর সর্বত্র ব্যাপক। "অকায়ম্"- সেই ঈশ্বর স্থূল, সূক্ষ্ম তথা কারণ শরীর হতে রহিত। "অব্রণম্"- সেই পরমাত্মা অচ্ছেদ্য, অবিকারী সত্তা। "অস্নাবিরম্"- সেই পরমাত্মা জীবাত্মার মতো নস-নাড়ির বন্ধনে কখনও আসে না। "শুদ্ধম্"- অবিদ্যা আদি দোষে গ্রস্থ না হওয়ার কারণে সর্বদা পবিত্র। "মনীষী"- তিনি সমস্ত জীবের মনোবৃত্তিকেও জানেন। "স্বয়ম্ভূ"- তাঁর কোনো কারণ নেই, যা অনাদি স্বরূপ অর্থাৎ সেই ঈশ্বর জন্ম-মরণ তথা বৃদ্ধি-ক্ষয় হতে রহিত, ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিচার করে মহর্ষি ব্যাসজী য়োগ ভাষ্যতে ঈশ্বরকে "সদৈব মক্তঃ" বলেছেন। অবতারবাদী তাদের সাকার ঈশ্বরকে সদা মুক্ত বলতে পারবে?
এর বিপরীত যেটা নিরাকার থেকে সাকার তথা সাকার থেকে পুনঃ নিরাকার হবে, সেটা বিকারী হওয়ার কারণে নিত্য হতে পারবে না। সংসারের মধ্যে যত পদার্থ নিরাকার আছে তাদের মধ্যে কোনোটির মূর্তি আজ পর্যন্ত কেউ বানাতে পারেনি। জীবাত্মা, বায়ু, আকাশও নিরাকার, আজ পর্যন্ত কেউ কি এদের মূর্তি দেখেছে? যদি না দেখে থাকে তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের মূর্তি কিভাবে হওয়া সম্ভব? আর বর্তমানে যেসব ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি বা পূজা করা হয়, সেই সবগুলোর আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের। যার ফলে ঈশ্বরকে বহুরূপী (চতুর্ভুজ, অষ্টভূজ, চতুর্মুখ আদি) বানিয়ে ফেলেছে। আর মানুষের মতো ঈশ্বরকে শিব, বিষ্ণু, মহেশ আদি রূপ বানিয়ে তাঁর ভক্তদের মধ্যে ঘৃণা, বৈমনস্য, ঈর্ষার বীজ বপন করছে। অতঃ মূর্তিপূজা মানবোন্নতির জন্য এক অভিশাপই সিদ্ধ হচ্ছে।
যথার্থ স্থিতি হল - উপাসনার যে ফল যা উপাস্যকের গুণকে ধারণ করে তদনুরূপ হওয়া। ঈশ্বর ভক্তির ক্ষেত্রে এই কাজ তো চিরকালীন তপস্যা ও সাধনা দ্বারাই হওয়া সম্ভব। কিন্তু আজকের ভৌক্তিকবাদী মানব তো ঈশ্বরকেও মানবিকরণ করে দিয়েছে, ঈশ্বরকেও নিজেদের সমান জন্ম-মরণ, বৃদ্ধি-ক্ষয়, ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণা, শীত-উষ্ণ আদি দ্বন্দ্ব দ্বারা গ্রস্ত করে দিয়েছে। এটা এক মহান আশ্চর্য এবং উপাসনার থেকে বিপরীত গতির সূচক হয়ে গেছে।।

অনুবাদকঃ আশীষ আর্য

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ