তর্পণ শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত 'তৃপ্' (অর্থাৎ সন্তুষ্ট করা) থেকে। পৌরাণিক মতে দেবতা, ঋষি ও মৃত পূর্বপুরুষদের (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) উদ্দেশ্যে জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিকে তর্পণ বলা হয়। বংশের যে সকল পিতৃপুরুষ পরলোক গমন করেছেন, তাঁদের প্রীতির উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক স-তিল জল (তিল মেশানো জল) দান করে সাধারণত পুত্রসন্তানেরা পিতৃতর্পণ করে থাকেন। এভাবে তর্পণ করাকে আবার তিল তর্পণও বলে।
বাস্তবে ‘পিতৃযজ্ঞ’ অর্থাৎ যাঁহারা দেব অর্থাৎ বিদ্বান্ ঋষি, যাঁহারা অধ্যাপনা করেন এবং পিতব অর্থাৎ মাতা, পিতা, বুদ্ধ, জ্ঞানী এবং পরম যোগী—ইহাদের সেবা করা। ‘পিতৃযজ্ঞ' দ্বিবিধ—প্রথম শ্রাদ্ধ দ্বিতীয় তর্পণ। শ্রাদ্ধ অর্থাৎ ‘শ্র’ সত্যের নাম, শ্র সত্যং দধাতি য়য়া ক্রিয়য়া সা শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধয়া য়ৎ ক্রিয়তে তচ্ছ্রাদ্ধম্। যে ক্রিয়া দ্বারা সত্য গ্রহণ করা যায় তাহাকে ‘শ্রদ্ধা’ বলে এবং শ্রদ্ধা পূর্বক যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহার নাম ‘শ্রাদ্ধ’। আর ‘তৃপ্যন্তি তৰ্পয়ন্তি য়েন পিতৃণ তত্তর্পণম' যে যে সকল কর্মের দ্বারা বিদ্যমানমাতা-পিতা প্রভৃতি পিতৃগণ তৃপ্ত অর্থাৎ প্রসন্ন হন, এবং যে সকল ক্রিয়ার দ্বারা তাঁহাদিগকে প্রসন্ন করা যায় তাহার নাম 'তর্পণ'। কিন্তু তাহা জীবিত ব্যক্তিদের জন্য, মৃতদের জন্য নহে। অথ দেবতর্পণম্ ওম্ ব্রহ্মাদয়ো দেবাস্তুপ্যস্তাম্। ব্রহ্মাদিদেবপত্ন্যস্তূপ্যস্তাম্। ব্রহ্মাদিদেবসুতাপ্যন্তাম্। ব্রহ্মাদিদেবগণস্তূপ্যস্তাম্॥ ইতি দেব তৰ্পণম্ ॥
'বিদ্বাß সো হি দেবাঃ' ইহা শতপথ ব্রাহ্মণের বচন (৩।৭।৩১০) বিদ্বানদিগকেই ‘দেব’বলে। যাঁহারা সাঙ্গোপাঙ্গ চারিবেদ জানেন, তাঁহাদেরও নাম ‘ব্রহ্মা’। যাঁহারা তাঁহাদের অপেক্ষা অল্প বিদ্যাভ্যাস করেন, তাঁহাদের নাম 'দেব' অর্থাৎ ‘বিদ্বান’॥ বিদ্বান ব্যক্তিদের সদৃশ বিদুষী স্ত্রী তাঁহাদের নাম ‘ব্রাহ্মণী’ এবং ‘দেবী’। তাঁহাদের সদৃশ পুত্র ও শিষ্য তথা তৎসদৃশগণ অর্থাৎ সেবক; তাঁহাদের সকলের সেবা করার নাম ‘শ্রাদ্ধ’ও ‘তর্পণ'। ওম্ মরীচ্যাদয় ঋষয়স্তূপ্যন্তাম্। মরীচ্যাদ্যূষিপত্ন্যস্ত প্যন্তাম্। অথৰ্ষিতর্পণম মরীচ্যাদ্যষিসুতা স্তূপ্যন্তাম্। মরীচ্যাদৃষিগণাস্ত্রপ্যন্তাম ৷৷ —ইতিঋষিতৰ্পণম্ ৷
যাঁহারা ব্রহ্মার প্রপৌত্র মরীচির ন্যায় বিদ্বান্ হইয়া অধ্যাপনা করেন এবং তৎসদৃশ তাঁহাদের পুত্র ও শিষ্য এবং তৎসদৃশ সেবকদিগকে সেবা ও সম্মান করার নাম ‘ঋষি তৰ্পণ’।
অথ পিতৃতর্পণম্
ওম্ সোমসদঃ পিতরস্তুপ্যন্তাম্। অগ্নিস্বাত্তাঃ পিতরস্তূপ্যন্তাম্। বহিষদঃ পিতরস্তু পাস্তাম। সোমপাঃ পিতরস্তুপ্যন্তাম্। হবির্ভুজঃ পিতরস্ত্র প্যন্তাম্। আজ্যপাঃ পিতরস্তূপ্যন্তাম্। (সুকালিনঃ পিতরস্তুপ্যন্তাম্) য়মাদিভ্যো নমঃ য়মাদীংস্তপয়ামি। পিত্রে স্বধা নমঃ পিতরং তপয়ামি । পিতামহায় স্বধা নমঃ পিতামহং তপয়ামি। (প্রপিতামহায় স্বধা নমঃ প্রনিতামহং তপয়ামি।) মাত্রে স্বধা নমো মাতরং তপয়ামি (প্রপিতামহ্যৈ স্বধা নমঃ প্রপিতামহীং তর্পয়ামি।) পিতামহৈ স্বধা নমঃ পিতামহীং তপয়ামি। স্বপত্যৈ স্বধা নমঃ স্বপত্নীং তর্পয়ামি। সম্বন্ধিভ্যঃ স্বধা নমঃ সম্বন্ধিনস্ত পয়ামি। সগোত্রেভ্যঃ স্বধা নমঃ সগোত্ৰাংস্তপয়ামি ৷৷ ইতি পিতৃতর্পণম্ ৷৷
য়ে সোমে জগদীশ্বরে পদার্থবিদ্যায়াং চ সীদন্তি তে সোমসদঃ' যাঁহারা পরমাত্মা এবং পদার্থবিদ্যা বিষয়ে নিপুণ তাহারা ‘সোমসদ’। য়ৈরগ্নেবিদ্যুতো বিদ্যা গৃহীতা তে অগ্নিস্বাত্তাঃ’যাঁহারা অগ্নি অর্থাৎ বিদ্যুৎ প্রভৃতি পদার্থের জ্ঞাতা তাহারা ‘অগ্নিম্বাত্ত’। ‘য়ে বহির্ষি উত্তমে ব্যবহারে সীদন্তি তে বহিদঃ’, যাঁহারা উত্তম বিদ্যাবুদ্ধিযুক্ত ব্যবহারে নিযুক্ত থাকেন, তাঁহারা ‘বহিষদ্’।‘য়ে সোমমৈশ্বর্য়মোষধীরসং বা পান্তি পিবন্তি বা তে সোমপাঃ’, যাঁহারা ঐশ্বর্য্যের রক্ষাকর্তা এবং মহৌষধি রসপান দ্বারা রোগরহিত তথাঅপরের ঐশ্বর্যের রক্ষক যাঁহারা ঔষধ প্রদান করিয়া অন্যকে রোগমুক্ত করেন তাঁহারা 'সোমপাঃ'। 'য়ে হবিহোতুমত্তুমহং ভুঞ্জতে ভোজয়ন্তি বা তেহর্বিভুজঃ', যাঁহারা মাদক পদার্থ এবং হিংসাকারক দ্রব্য পরিত্যাগ করিয়া ভোজন করেন তাঁহারা ‘হর্বিভুজঃ'। 'য় আজ্যাং তুং প্রাপ্তং বা যোগ্যং রক্ষন্তি বা পিবন্তি তে আজ্যপাঃ', যাঁহারা জ্ঞাতব্য বস্তুর রক্ষক এবং যাঁহারা ঘৃত-দুগ্ধাদি সেবন করেন তাঁহারা 'আজ্যপা'। 'শোভনঃ কালো বিদ্যুতে য়েষাং তে সুকালিনঃ' উৎকৃষ্ট ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা যাঁহাদের সময় সুখময়, তাঁহারা “সুকালিন। `য়ে দুষ্টান য়চ্ছন্তি নিগৃহুন্তি তে য়মাঃ ন্যায়াধীশাঃ”, যাঁহারা দুষ্টজনের দণ্ডদাতা এবং শ্রেষ্ঠজনের পালনকর্তা এবং যাঁহারা ন্যায়াকারী তাঁহারা ‘য়ম'।
'য় পাতি স পিতা' যিনি সন্তানগণের অন্নদাতা ও যিনি স্নেহের সহিত তাঁহাদিগকে রক্ষা করেন অথবা যিনি জন্মদাতা ‘পিতা”। “পিতুঃ পিতা পিতামহঃ, পিতামহস্য পিতা প্রপিতামহঃ যিনি পিতার পিতা তিনি ‘পিতামহ’ যিনি পিতামহের পিতা তিনি ‘প্রপিতামহ'। ‘য়া মানয়তি সা মাতা’ যিনি অন্ন এবং আদর যত্ন সহকারে সন্তানদের মান্য করেন তিনি। ‘মাতা’। য়া পিতুমাতা সা পিতামহী, পিতামহস্য মাতা, ‘প্রপিতামহী’, যিনি পিতার মাতা তিনি ‘পিতামহী’ এবং যিনি পিতামহের মাতা তিনি ‘প্রপিতামহী’। নিজের স্ত্রী, ভগ্নী, আত্মীয়, সগোত্র এবং অপর কোন ভদ্রপুরুষ বা বৃদ্ধ—তাঁহাদের সকলকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত উত্তম অন্ন, বস্ত্র এবং সুন্দর যান প্রভৃতি প্রদান করিয়া সম্যকরূপে তাঁহাদের পরিতৃপ্ত করা, অর্থাৎ যে সকল কার্য্য দ্বারা তাঁহাদের আত্মা তৃপ্ত হয় ও শরীর সুস্থ থাকে, সেই সকল কার্য্য করিয়া প্রীতির সহিত তাঁহাদের সেবা করাকে ‘শ্রাদ্ধ' এবং ‘তপণ’ বলে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ